বিল্টুর দিকে তাকাতেই, ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। যত্তসব অকম্মার কলাগাছ কোথাকার! অগত্যা নিধিরাম নিজের হাতেই কাগজ কলম তুলে নিয়েছে। দু’চার মিনিট বিশাল ভাবনাচিন্তা করে খসখস কিংবা খচখচ করে কিছু একটা লিখে— ‘এই নে ধর দেখি”, বলে মনোজের হাতে গুঁজে দিল।
মনোজ যথাস্থানে রেখে দিয়ে বলল, ‘জানোই তো দাদা আমি কিন্তু যাকে বলে এক্কেবারে ক-অক্ষর গোমাংস, মানে যদ দেখিতং তদ লিখিতং। যশ খ্যাতি সব তোমার। এবার এসো তোমরা। আমার এখন অনেক কাজ। শনিবার সকালে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ করে নিয়ে চলে যেও দয়া করে তা হলেই হবে।’ আর কথা না বাড়িয়ে ওরা দু’জনে বেরিয়ে পড়ল।
—বিল্টু তুই আর আমার সঙ্গে গিয়ে কী করবি বল। বাড়ি ফিরে যা। আমাকে আজ অনেকের কাছে যেতে হবে বুঝলি। অন্তত সেদিন মিটিংয়ে যারা এসেছিল। মনে হয় সারাদিনটাই লেগে যাবে। আর হ্যাঁ শোন, আগামীকাল বিকেল চারটে নাগাদ আমার বাড়ি চলে আসিস কেমন।
বিল্টু মাথামুণ্ডু তেমন বুঝতে না পেরে, মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “ঠিক আছে যাও।”
তারপর যে যার পথে পা বাড়াল।
বিল্টু পরেরদিন চারটের অনেক আগেই নিদুদার বাড়িতে হাজির। বাড়িতে অনেকগুলো ঘর। তার মধ্যে দু’তিনটে তালা বন্ধই পড়ে থাকে সারা বছর। তারই একটাতে নিদুদাকে হাঁকডাক করে পাওয়া গেল। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ঝাড়পোছটা আজই করা হয়েছে। একটা কাঠের পুরোনো শোকেস দু’তিনটে টেবিল আর খানকয়েক চেয়ার পাতা আছে। শোকেস টেবিলে বেশ কিছু উত্তরীয় আর স্মারক সাজানো।
বিল্টুকে দেখেই বলল, ‘আর বলিস না, কাল থেকে যা চলছে! ওদের সবাইকে জনে জনে খবর দিয়ে ফিরতে ফিরতেই সন্ধে সাতটা।’
—বুঝলাম না দাদা।
—আরে বাবা, এখানে মানে আমার বাড়ির পাশে আমাদের বারোয়ারি দুর্গা মণ্ডপের গ্রিল দিয়ে ঘেরা হলঘরের মতোন বিশাল শেডটা দেখলি না, পঞ্চাশ-ষাটটার মতোন চেয়ার পাতা আছে। আজ ওখানেই একটা মিটিং কল করেছি, সেদিন যারা এসেছিল তাদের সবাইকে নিয়ে। তারা প্রত্যেকেই তাদের পাওয়া কিছু না কিছু স্মারক ও উত্তরীয় নিয়ে আসবে। সেগুলো সব তাদের নামে নামে আমার এই ঘরে আলাদা আলাদা ভাবে রাখা থাকবে।
—কেন গো? তারা এখানে রাখতে আসবে কেন?
—আসবে আসবে। একটু সবুর কর। ঠিক সময় মতোন জানতে পারবি। চল দেখি বাকিরা আসার আগে তুই আর আমি একটু চা পান করে আসি।
—আচ্ছা নিদুদা সেদিন কী যেন বললে চালতা বাগানের কোথায় কী একটা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে, ঠিক বুঝলাম না। —ওটা না বোঝার আছেটা কী শুনি? মাথা মোটা কোথাকার! কিছুই বুঝতে পারে না, সব বলে দিতে হবে। যত্তসব গাড়ল এসে জুটেছে আমার কাছেই একসে এক।
—বেশ বেশ… এবার বলো তো কেসটা কী?
—আরে, শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠানে একই খাট-বিছানা, উপচার, ব্যবস্থাপনা, পুরোহিত, লোকজন কোনও কিছুই পালটায় না। আজ একজনের আত্মার শান্তি হল তো ওই একই জায়গায় একই উপচারাদি দিয়ে কাল আর একজনের শ্রাদ্ধশান্তি হচ্ছে। এবার বুঝলি?
চায়ের দোকানের অনুপকে নিধিরাম বলল, “এই অনু, একটাকে দু’টো।’
অনুপ দু’জনকে হাফ কাপ করে চা ধরিয়ে দিল। জিজ্ঞাসা করল, “বিস্কুট?’
—না দরকার নেই। কীরে বিল্টু?
—লাগবে না।
চা খেয়ে ফেরার সময় বিল্টুকে শেডটা ভালো করে দেখাল। নিধি শুধু দু’টো পুরোনো টেবিল চেয়ারগুলোর সামনে রেখে তার উপর সাদা কাপড় বিছিয়ে দিয়েছে।
—বুঝলি বিল্টু, এবার থেকে এই অঞ্চলের সমস্ত সাহিত্যসভা, আলোচনা, সংবর্ধনা— যা কিছু সব এখানেই হবে বুঝলি। পুরো হল ভাড়াটা বেঁচে যাবে। আর চেয়ার তো এই মণ্ডপেই থাকে, টেবিল আমার বাড়ির। শুধু ইলেকট্রিক আর মাইক ভাড়াটা দিলেই হবে।
এখন যাদের আসার কথা তারা একে একে জমতে শুরু করেছে। তাদের থেকে স্মারক উত্তরীয় নিয়ে নাম লিখে নিধিরাম ঘরে রেখে দিচ্ছে তাদেরকে দেখিয়ে। তারপর মণ্ডপে চেয়ার গ্রহণ। মোটামুটি সবাই হাজির যখন সাড়ে চারটে নাগাদ সাহিত্যসভা, আলোচনা পদ্ধতি, নিয়ম-রীতি, সংবর্ধনা কীভাবে কী হবে না হবে ঠিক হল। মানে প্রতি মাসে এক একটা লিটল ম্যাাগের নামে একটা করে সাহিত্যসভা, আলোচনা, কবিতা পাঠ হবে। সঙ্গে থাকবে গুণীজন সংবর্ধনা।
প্রয়োজন হলে বিশেষ আলোচনাসভা করার অবকাশও থাকছে। সবাই খুব খুশি এমন একটা প্রায় চিরস্থায়ী ব্যবস্থায়। খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। আর প্রত্যেক সভায় নতুন নতুন লেখক কবিদেরকে সংবর্ধনা দেওয়া আবশ্যিক থাকছে। সঙ্গে পুরোনো কবি, লেখক, সম্পাদকও দু’তিনজন থাকলেও থাকতে পারেন।
অনুপ, কেটলি ভরতি চা নিয়ে এসে কাপে সার্ভ করে গেল। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সভা শেষ। সবাই চলে গেলে নিধিরাম বিল্টুকে নিয়ে টেবিল দু’টো আর সাদা কাপড়টাকে বাড়ি নিয়ে গেল। দুর্গামণ্ডপ শুনশান আবার যে কে সেই!
—বুঝলি বিল্টু, আপাতত আমার কাজ শেষ আজকের মতোন। এবার একটু গড়িয়ে নিতে হবে। আজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে একটা সলিড ঘুম দিতে হবে। তুই পরশু মানে রোববার দশটা নাগাদ চলে আয়। অ্যাডভেঞ্চারে বেরোব। এখন বাড়ি যা।
পরের দিন মানে শনিবার সকাল সকাল রেডি হয়ে নিধিরাম দশটা নাগাদ মনোজের দোকানে হাজির। মনোজ নিধিরামের হাতে লেখা ম্যাটারের কাগজ আর একটা ফ্লেক্স খুলে দেখিয়ে বলল, “ভালো করে দেখেশুনে নাও সব ঠিকঠাক আছে কিনা। নইলে পরে আবার খুঁত বের করবে।’
নিধিরাম দেখে নিল মন দিয়ে। বলল, “ঠিকই তো লাগছে এখন। তবে তোর কাজ তো। এখানে দেখলাম ঠিকঠাক, আবার বাড়ি গিয়ে হয়তো দেখব ভুলভাল।’ বলে নিজেই হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। যাইহোক, বিল মিটিয়ে বারোটা ফ্লেক্স হাতে নিয়ে “আসি রে বলে’, দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল নিধিরাম।
একে একে অন্য জনাসাতেক সম্পাদকের বাড়ি গিয়ে এক একটা করে ফ্লেক্স দিয়ে বলেছে, এটাকে পাড়ার কোনও একটা স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে ডিসপ্লে করে দেবেন। এটা আমাদের বিজ্ঞাপনের কাজ করবে, বুঝলেন কিনা। সব শেষে দালাল মিত্তিরের বাড়ি। সেখানে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ভালোমতো একটা ভাতঘুম দিয়ে সন্ধে হব হব সময়ে ‘মন চল নিজ নিকেতনে”।
রোববার সকালে নিধিরাম তার রাস্তামুখী বাড়ির বারান্দা থেকে একটা ফ্লেক্স টাঙিয়ে দিল। বেলা ন’টা নাগাদ পাড়ার ছেলে কবচ এল তার অটো নিয়ে। ‘নিদুদা ও নিদুদা কই গো কোথায় গেলে? আমি এসে গেছি।’ নিধিরাম অলক্ষ্যে থেকে আওয়াজ ছাড়ল— ‘একটু দাঁড়া, আসছি এখন।”
মিনিট পাঁচেক পর একটা ফ্লেক্স কবচের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা অটোর পিছনে ভালো করে জড়িয়ে বেঁধেছেদে দে দেখি। দেখিস হাওয়ায় না আবার উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর মাইকটা টেস্ট করে এনেছিস তো?’
—হ্যাঁ দাদা, কোনও চিন্তা কোরো না। আমার কাজে কোনও গাফিলতি পেয়েছ কখনও। এতদিন তো তোমার কাজ করছি। আমার এককথা— যেমন কথা তেমন কাজ। কোনওরকম খেলাপ পাবে না কখনও। আমি গ্যারান্টি দিয়ে কাজ করি। আর দেব নাই বা কেন, তোমরা যখন যথাযোগ্য মূল্য দাও!
—ঠিক আছে বাবা, তোকে জিজ্ঞাসা করাটাই আমার ঘাট হয়েছে।
ততক্ষণে বিল্টু এসে হাজির। নিধিরাম বলল— এই বিল্টু ফ্লেক্সের লেখাটা ভালো করে পড়ে মুখস্থ করে নে। একটু পরে বেরোব আমরা এই অটোটায়। মাইকিংটা কিন্তু তুই করবি। কারণ ওটা তুই ভালো পারিস। বিল্ট মক টেস্টিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু শব্দ করেই পড়ে নিচ্ছে, “শিল্পাঞ্চলের সমস্ত লিটল ম্যাগের একটি সম্মিলিত প্রয়াশ (পড়ুন প্রয়াস) একচ্ছত্র সাহিত্য আকাদেমির উদ্যোগে এখন থেকে প্রতি মাশের (পড়ুন মাসের) শেষ রবিবারে মালপাড়ার দুর্গামণ্ডপে সাহিত্যসভা, কবিতা পাঠ, আলোচনা এবং পত্রিকা ও গ্রন্থ প্রকাশসহ নামমাত্র সহযোগিতায় গুণীজনদের সুলভ সংস্করণের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনাদের সহৃদয় উপস্থিতি ও সক্রিয় সহযোগিতা একান্ত কাম্য। সহযোগিতায় ইচ্ছুকেরা সত্বর যোগাযোগ করুন। যোগাযোগ, দালাল মিত্তির, মুঠোফোন- ৯৮৭৬…. ১০ শুনুন শুনুন শুনুন…।’
এটা মুখস্থ করতে করতেই বিল্টু বেশ চার্জড হয়ে গেল। আর যেন তর সয় না। দশটা বাজতেই বিল্টু নিধিরামকে পাশে বসিয়ে মাইক ফুঁকতে শুরু করল। আপাতত প্রথম বলে এই মাসটা পর পর দিন চারেক। পরবর্তীতে মাসে একদিন। তারপর প্রচারটা একবার পেয়ে গেলে, তখন আর মাইকিং করার দরকার হবে বলে মনে হয় না। আজ একবেলা মাইকিং করে বেলা দু’টো নাগাদ বিল্টুকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে নিধিরাম বলল, “বিল্টু কাল দু’টোর সময় রেডি থাকিস, তোকে তুলে নেব!” তারপর নিজের বাড়ি ফিরেছে। কবচকে বলল, “তাহলে আগামীকাল দেড়টার সময় চলে আসিস।”
—ঠিক আছে দাদা।
কবচ হাত পাততেই নিধি একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বলল, কাজ চুকেবুকে গেলে ফাইনাল হিসাবটা একদিন করে নেওয়া যাবে বুঝলি।
—নিশ্চয়। তা আর বলতে।
পরপর দিন কয়েক শিল্পাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রচার চলল। কিন্তু দালাল মিত্তিরের কাছে থেকে এখনও কারও যোগাযোগের খবর আসছে না। নিধিরাম ভেবে ভেবে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়ল। দিন দশেক পর প্রথম একজনের খবর এল— তরুণ কবি শুক্রাচার্য ভট্টোপাধ্যায়, যে তার নাম নথিভুক্ত করিয়েছে।





