‘সুন্দরবন ইজ দ্য মোস্ট বিউটিফুল প্লেস ইন দ্য বেঙ্গল বাট সুন্দরবন ইজ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস ইন বেঙ্গল টু’- এই লাইনটা কোনও এক বইতে পড়েছিল ডরোথি, কলেজে পড়ার সময়। ডরোথি বিশ্বাস, পাথরপ্রতিমার মেয়ে। সেই ছোটো থেকে জল, জঙ্গল, জীব-জন্তু জগতের সঙ্গে মনুষ্যসমাজের ঘোলাটে ক্ষীণ সহাবস্থান দেখে বড়ো হয়েছে সে। ২০১৬ সালে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট সার্ভিস’-এ যোগ দেওয়া। এখন চিকুরি ফরেস্ট অফিসে পোস্টিং, ফরেস্ট রেঞ্জার হিসেবে।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ভুটভুটি বোটটা খুব নিচু হয়ে, দু-পাশে মাতলা নদীর কালচে জলে অলৌকিক সৌন্দর্যের মাদুর বুনছে। ডরোথি চোখের উপর লং রেঞ্জ বাইনোকুলারটা চাপিয়ে দেখে নেয় চারিপাশ। দুদিকের উঁচু জায়গাগুলোতে কাঁকড়া, গরান, গেওয়া, হেতাল গাছের জঙ্গল। সেখান থেকে জমি ঢালু হয়ে নেমে এসেছে নদীর পাড় অবধি। এখন অমাবস্যার মরা কোটাল চলছে। তাই দু- পাশের চর নোনা জলে ডুবে গেছে। না হলে অন্যসময় জায়গাগুলো থকথকে পা ডোবানো কাদায় ভরে যায়। জোয়ারের জল সরে গেলে কাঁকড়া গাছের শ্বাসমূলগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে জেগে ওঠে শক্ত ভোঁতা ছুরির আগার মতো।

অ্যালট নম্বর ১২০, ১২১, গৌরচক গ্রাম৷ এখানেই আজ ভোররাতে ঘটনাটা ঘটেছে। ঝাঁসি মণ্ডল নামের এক গ্রাম্য গৃহবধূকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছে আজমলমারীর জঙ্গলে। সেই কেসেই স্পট ভিজিটে যাচ্ছে ডরোথি, সঙ্গে দু’জন ফরেস্ট গার্ড। এদের মধ্যে একজন অরূপ মণ্ডল, খুবই অভিজ্ঞ। বহুবছর হয়ে গেল এই জঙ্গলে। এদিককার জঙ্গলে গাছের পাতা, খাল-জলার গতিপ্রকৃতি, বাঘের মুভমেন্ট খুব ভালো ভাবে চেনে সে।

মাস চারেক আগে গত ফেব্রুয়ারিতে শ’দুয়েক চিতল হরিণ ছাড়া হয়েছিল এদিককার জঙ্গলে, বাঘের খাবারের অভাব মেটাতে। কিন্তু এদিকটায় এখন পোচিং-এর খবর খুব পাওয়া যায়। বোটে করে এসে পোচাররা জঙ্গলে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকে গুলি চালিয়ে হরিণ মারে। সেইজন্যই লোকালয়ে বাঘ হানা দিচ্ছে খুব। হঠাৎ বর্ষা এসে যাওয়ায় বাঁধের গায়ের নাইলন ফেন্সিংয়ের কাজ পুরোটা শেষ করা যায়নি। সেইখান থেকেই বনমামাদের আবির্ভাব হচ্ছে।

পশ্চিমদিক থেকে জলীয় বাষ্পের একটা ঘূর্ণি এসে সজোরে ধাক্কা দিল বোটটার গায়ে। ভুরভুর করে ভেসে আসা জোলো বাতাস সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা ডরোথির সারা গায়ে সোঁদা গন্ধের আলেখ্য এঁকে দিল যেন। ডেকের অন্য পাশটাতে ডান হাতে ট্রাংকুইলাইজারটাকে ধরে বিশেষ কায়দায় বাঁ-হাতে বিড়ি ধরিয়েছে অরূপ। বিশেষ কায়দায় কারণ মুখটা তাঁর বাঁ-দিকে বেঁকে গেছে। একবার জঙ্গলে প্যাডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে ওর উপর টাইগার অ্যাটাক হয়েছিল। বাঘের থাবায় মুখ আর মাথা চুরমার হয়ে যায় অরূপের। প্রায় মাসখানেকের যমে মানুষে টানাটানির পর, বনবিবির দয়ায় ঘরে ফেরে অরূপ।

এখনও সেই গল্প শুনলে গায়ে কাঁটা দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের নতুনদের। তবু অরূপ হার মানেনি। চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে সরকারি পেনশনে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার বদলে, জঙ্গলে ফিরে এসেছে। আসলে এই বিবস্ত্র জঙ্গল আর তার মধ্যবর্তী বিচিত্র জীবজগৎই এখনও ওর জীবন-আসক্তির মূল কারণ। এই সুন্দরবন আসলে কাদের? দক্ষিণরায়, হিংস্র শ্বাপদ, শঙ্খচূড়, কালাচ, রাজগোখরার মতো বিষধর সরীসৃপ, সদা ক্ষুধার্ত কুম্ভীরকুল, চিতল হরিণ, রং-বেরঙের পাখি যেমন মৌটুসি, পাপিয়া কিংবা মদন টাক, বক, লাজুক সুন্দরী হাঁস এদের? নাকি জঙ্গলের একদম গা ঘেঁষে মূর্তিমান মরীচিকার মতো বসবাস করা নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ, নির্ভার, ছায়াচ্ছন্ন জনপদগুলোর? এ প্রশ্ন চিরন্তন স্বাভাবিক।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার “ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী সুন্দরবনের মোট ১০২টি বদ্বীপের মধ্যে ৫৪টিতে জনবসতি আছে বাকি ৪৮টিতে আছে সংরক্ষিত অরণ্য। তবু অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ, এ জঙ্গল মা বনবিবি আর দক্ষিণরায়ের। দক্ষিণরায় এ জঙ্গলের অঘোষিত নরখাদক রাজা। তার সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ-বিবাদ বনবিবির। বনবিবির উপাখ্যানে পাওয়া যায়—

‘আঠারো ভাটির মাঝে আমি সবার মা

মা বলি ডাকিলে কারও বিপদ থাকে না।

বিপদে পড়ি যেবা মা বলি ডাকিবে

কভু তারে হিংসা না করিবে।’

আসলে জঙ্গলের রাজার সঙ্গে জলের শাসক কুমিরের বিবাদী আখ্যান, লোকশ্রুতি হয়ে ভেসে বেড়ায় লোকসাহিত্যের শর্বরী অন্তঃসলিলায়। আজও জঙ্গলে মাছ, কাঁকড়া শিকারে যাওয়া কিংবা মধু সংগ্রহে যাওয়া প্রতিটি জেলে কিংবা মউলিরা বিশ্বাস করে, বনে যাওয়ার আগে মা বনবিবির পুজো দিলে বিপন্ন সময়ে মা তাদের নিজের সন্তানের মতো আগলান।

বর্ষার মেঘের সঙ্গে ফন্দি করে অস্বাভাবিক রকমের একটা আলো-আঁধারির মায়াজাল, বিকট ফ্যাটফ্যাটে ফণা তুলে আকাশটাকে প্রায় পুরোটা ঢেকে ফেলেছে। মাকি নদীর মুখটায় এসে ফরেস্ট বোটটা ডানদিকে বাঁক নিল। আর কিছুদূর এগোলেই খালটা সরু হয়ে ‘পান্তামারি খাল’ শুরু। এই ধরনের খাল বা জলাগুলোতে মাছ, কাঁকড়ার পরিমাণ থাকে অনেক বেশি। খয়রা মাছের টোপ দিয়ে এখানে জেলেরা বড়শিতে কানমাগুর, সোনাবোগো কিংবা কাঁকড়া শিকার করে। অথবা ভাটার জলে হাতজালে শিকার করে ঢাকা চিংড়ির ঝাঁক।

দু-ধারে নিদ্রিত ঘন হেতাল পাতার জঙ্গল। হেতাল পাতার হলুদ সবুজ রঙের অস্পষ্ট আবছায়ায় গা মিশিয়ে, অশরীরী ধূমকেতুর মতো ওত পেতে বসে থাকে বাঘ। জঙ্গল ভিতর দিকে খুব ঘন, সূর্যের আলো মাটি ছোঁয় না। শিকার করার সময় বাঘ বিড়ালের মতো দু-পায়ের মাঝে শরীরটা ভাঁজ করে ছোটো হয়ে যায়। তারপর হাড় হিম করা একটা ক্ষমাহীন হুংকার ছুঁড়ে, চারপায়ে প্রচণ্ড লাফ দেয়। মানুষের টুটি কামড়ে ধরে, তীক্ষ্ণ দুটো শ্বদন্ত দিয়ে গলার নলি ফুটো করে দেয়। সঙ্গে বাঘের দুই পার্টির carnassial teeth কাজ করে কাঁচির মতো।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...