‘বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভির মতো চরে
পরান্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে…’
তখন মনসুন সবে সরকারি ভাবে এসে পড়েছে। কোথাও কোথাও বর্ষার প্রকৃতি আরও সবুজ, আরও সজীব। তেমনই একটি অঞ্চল পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। অফবিট জায়গার খোঁজে তাই প্রথমেই মনে এল মেঘমালাইয়ের নাম। তামিল ছবি ‘রাভানন’-এর অনেকখানি অংশ শুট করা হয়েছিল এই মেঘমালাইয়ে। তাই রুট ম্যাপ ঠিক করে নিয়ে চেন্নাই পৌঁছে, থেনি যাওয়ার রাতের বাসে চড়ে বসলাম।
নৈশসফরের পুরোটাই কাটল অঝোর ধারার বৃষ্টিকে সঙ্গী করে। বর্ষায় যারা রোমান্টিকতা অনুভব করেন– মেঘমালাই তাদের শূন্য হাতে ফেরায় না বলেই শুনেছিলাম। রাত ৯টায় বাস ছাড়ার পর সেই যে ঘুমিয়েছি, ভোর বেলায় ডিন্ডিগুল পৌঁছে ঘুম ভাঙল। এখান থেকে ঠিক ঘন্টাখানেকের দূরত্ব থেনি। বৃষ্টি থেমে তখন মিহি একটা রোদের রেখা উঁকি মারছে আকাশে।
সকাল সাড়ে সাতটায় থেনি পৌঁছোতেই দেখি অগ্রিম বুক করা ক্যাব ড্রাইভার হাজির। প্রথম ডেস্টিনেশন চিন্না সুরুলি ফলস-এর উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু হল। এই ফলসটির অন্য নাম মেঘমালাই ফলস। ঘন্টা দুয়েকের দূরত্ব। দুপাশে আশানুরূপ সবুজের সমারোহ মন ভালো করে দিল। ছোটো ছোটো গ্রাম দুপাশে ফেলে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি পাইথন পিচ-রাস্তা ধরে।
গাড়ি থামল ঝরনার বেশ কিছু আগে। জঙ্গুলে পথ পেরিয়ে একটু এগোলেই হবে ঝরনার সঙ্গে মোলাকাত। কয়েকটি রেলিং বাঁধানো সিড়ির ধাপ পেরিয়ে সম্মুখের প্যানোরামায় উন্মুক্ত হল ঝরনাটি। বর্ষার জলে টইটুম্বুর। মন সম্পূর্ণ রিফ্রেশড্। এবার এগোলাম মেঘমালাইয়ের পথে। পথে সাধারণ ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে আরও ঘন্টা দুয়েক পরে পৌঁছোলাম মেঘমালাইয়ের নিরালা নিসর্গের কোলে। যেমন ভেবেছিলাম জায়গাটা তার চেয়েও সুন্দর। বছরে প্রায় ১০ মাসই এখানে বৃষ্টি হয়। উপচানো সবুজ, ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া আর অজস্র পাখির ডাক নিয়ে মেঘমালাই, প্রথম দেখার প্রেমের মতো।
বস্তুত মেঘমালাই একটি দক্ষিণ ভারতীয় গ্রাম, যার সমস্ত পথ জুড়েই চা বাগিচার পরিপাটি বিন্যাস। আ হিল স্টেশন উইথ টি প্ল্যান্টেশন বললে এক কথায় বুঝিয়ে দেওয়া যায় এর চরিত্র। বিকেল ৪-টে বাজতে না বাজতেই তাই হিমেল আমেজ চেপে ধরে। মেঘের খেলা অবিরাম চলতে থাকে বাগিচার প্রান্ত ছুঁয়ে। সেই মেঘের কিনারেই আমাদের টি-এস্টেট কটেজ। পথেই পড়ল একটা ড্যাম ও সংলগ্ন ইন্সপেকশন বাংলো। সামান্য চা-বিরতি সেরে একটু এগোতেই চোখে পড়ে বিরাট এক হ্রদ। সে এক অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ। এর অদূরে মানালর অঞ্চলে আমাদের নির্দিষ্ট কটেজ।
পুরো রাস্তাটাই যেন পিকচার পোস্টকার্ড-এর সমতুল্য। পাহাড়ের ব্যাকড্রপ, একেবেঁকে চলা এই প্রকাণ্ড হ্রদ আর মেঘের খেলা। মেঘমালাই জুড়ে প্রায় ৬টি ড্যাম-এ ঘেরা এই হ্রদ।
কটেজে পৌঁছোনোর আগে শেষ বিকেলে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। আমাদের জন্য সুস্বাদু রান্না তৈরিই ছিল। বৃষ্টি নামতে ক্যাম্প ফায়ার-এর আয়োজনও হল। পরদিন সকালে উঠে থিরুথল একটি ওয়াটার ফলস দেখতে যাওয়ার প্ল্যান হল। ম্যাগি খেয়ে শুরু হল যাত্রা। এ ঝরনাটিও অপূর্ব। ফেরার পথে চা কারখানা ও মহারাজা মেট্টু ভিউ পয়েন্ট দেখাতে ভুলল না আমাদের গাড়ির চালক। ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখলাম চরাচর জুড়ে চা-বাগিচার চোখ জুড়োনো বিস্তার। কুয়াশা আর মেঘের স্তরে এক অদ্ভুত রহস্যময়তার চাদর জড়ানো প্রকৃতি।
ফেরার পথে আরও একটা গন্তব্য স্থির হল ইরাভাঙ্গালার ড্যাম। এই স্পটটা মিস করলে সত্যিই মেঘমালাইয়ের সৗন্দর্য অদেখাই থেকে যেত। সবুজ কার্পেটে মোড়া ল্যান্ডস্কেপ-এর সঙ্গে সঙ্গত করছে এই নীল জলাধার। এমন কোলাহলহীন প্রকৃতির বাসরে গেলে, শহুরে জীবনে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। একটা উইকএন্ড যেন যথেষ্ট মনে হয় না।
কটেজে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল গরম ইডলি ও সম্বর। প্রতিটি রান্নাই অনবদ্য। সারাদিন বই পড়ে, পাখির ডাক শুনেই কাটিয়ে দেওয়া যায় মেঘমালাইতে। বলতে ভুলেছি, ভোর বেলা ছোট্ট একটা ফরেস্ট ট্রেল সেরে আসুন ভালপারাইতে। কপালে থাকলে হাতির হার্ড-এর দেখা মিলবে। যারা আরও দুটো দিন সময় নিয়ে যেতে চান, সুরুলি ছাড়াও কুম্বাক্বরাই, সথুপরাই ফলসগুলিও দেখে নিন। মাত্র ৪টি থাকার জায়গা রয়েছে মেঘমালাইতে। দুটি টি-এস্টেট কটেজ উডব্রায়ার গ্রুপ-এর তত্ত্বাবধানে। স্যান্ড রিভার ও ক্লাউড মাউন্টেন। একটা পঞ্চায়েত গেস্ট হাউস, অন্যটি ইন্সপেকশন বাংলো।