সন্তান গর্ভাবস্থায় থাকাকালীনই মা-বাবা তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দেন। তার পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিত্ব কীভাবে গড়ে তোলা যায় তার প্ল্যানিং শুরু করে তাকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার একটা ছক কষে ফেলেন তারা। সুতরাং শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার পালন-পোষণ এবং তাকে সু-অভ্যাস ও ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত করাবার জন্য অভিভাবকেরা উঠেপড়ে লেগে যান।

বাচ্চার গ্রোয়িং এজ-টাতে যদি দেখা যায়, মা-বাবা বা খুব নিকট আত্মীয়-স্বজন অতিরিক্ত অন্য বাইরের লোকের উপস্থিতিতে বাচ্চা ঠিক সহজ হতে পারছে না অথবা ভয় পাচ্ছে তাহলে অনেক সময় ভবিষ্যতে গিয়ে দেখা যায় যে, বাচ্চাটি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই লাজুক অথবা তার অন্তর্মুখী পার্সোনালিটি রয়েছে। এই দুটোই বাচ্চার সম্পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ইন্ট্রোভার্ট সমস্যা-টা কিন্তু দুর্লভ নয়। দেখা যায় প্রায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষই অন্তর্মুখী। অনেক সময় বংশানুক্রমিক এই সমস্যাটা চলতে থাকে। ভবিষ্যতে গিয়ে বাচ্চা ইন্ট্রোভার্ট হবে কীনা এটার সংকেত পাওয়া যায় তার বেড়ে ওঠার সময় থেকেই।

পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রতি অত্যধিক সংবেদনশীলতা এবং সহজ হতে না পারা : খুব বেশি আলোতে, খুব চ্যাঁচামেচিতে অথবা অপরিচিত ব্যক্তির সান্নিধ্যে বাচ্চা যদি কাঁদতে থাকে, হাত-পা ছুড়ে জেদ দেখাতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে বড়ো হয়ে সে লাজুক প্রকৃতির হতে পারে বা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকার একটা প্রবণতা জন্মাতে পারে আর নয়তো অন্তর্মুখীও হয়ে উঠতে পারে। শিশুর মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া নজরে এলে প্রথম প্রথম আলো কম করে, চ্যাঁচামেচি থেকে শিশুকে দূরে রেখে তাকে সুরক্ষিত পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করুন। তারপর ধীরে ধীরে সুরক্ষিত পরিবেশ থেকে তাকে সরিয়ে এনে, স্বাভাবিক জীবনশৈলীর স্রোতে মিশতে অনুপ্রেরিত করুন

জিজ্ঞাসা, আশঙ্কা ও ভয় : আশেপাশে নতুন জিনিস দেখে সব বাচ্চার মনেই সেটা নিয়ে প্রশ্ন উদয় হয়। এই বাচ্চাদের প্রতিক্রিয়া অন্যদের থেকে একটু আলাদা হয়। তারাও প্রশ্ন করে ঠিকই কিন্তু কোনও অনাবশ্যক কারণবশত ভীত এবং আশঙ্কিত হয়ে পড়ে। দূর থেকে দেখেই মনের মধ্যে সেটা নিয়ে একটা চিন্তার জগত্ তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা কাছে গিয়ে দেখা অথবা সেই পরিবেশে, নিজে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করে। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার এটা একটা লক্ষণ।

অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া : কোনও কোনও বাচ্চা খুব স্বাভাবিক অপ্রত্যাশিত কোনও শব্দ, চ্যাঁচানোর শব্দ বা অনেকের একসঙ্গে চ্যাঁচামেচির শব্দে চমকে ওঠে, অসহজ বোধ করে। নতুন বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে বা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারা বা বিলম্ব হওয়ার লক্ষণও বাচ্চার মধ্যে দেখা যেতে পারে। এই ধরনের পরিবেশে বাচ্চা যদি ছটপট করতে থাকে, ঘাবড়ে যায়, কিছুতেই অ্যাডজাস্ট করতে না-চায় বা খুশি হওয়ার বদলে উদাসীনতায় ঘিরে থাকে তাহলে বাচ্চাটির ইন্ট্রোভার্ট হয়ে বড়ো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে

সময়ের আগে বাচ্চার জন্ম হলে : সময়ের আগেই যদি বাচ্চা মায়ের গর্ভ থেকে বাইরে আসে তাহলে দেখা গেছে বাচ্চার অন্তর্মুখী হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং অভিভাবকদের প্রথম থেকে সতর্ক হওয়া জরুরি এবং বাচ্চাকে সামাজিক হওয়ার জন্য(সোশ্যালাইজ) উৎসাহ এবং প্রেরণা দেওয়া বাঞ্ছনীয়

একটা জিনিস বা খেলনা নিয়ে ব্যস্ত থাকা : কোনও বাচ্চা যদি একটা কোনও জিনিস বা খেলনা নিয়ে সারাক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখে তাহলে তার অন্তর্মুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরা ওই বিশেষ জিনিস বা খেলনা নিয়ে মনের মধ্যে একটা কল্পনার জগত্ তৈরি করে নেয় সেটাই তাদের মনোরঞ্জন করে। এই ক্ষেত্রে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের বাচ্চাটির বেশি করে খেয়াল রাখা দরকার। বাচ্চাটির নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা তাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য, তাকে উৎসাহিত করা উচিত। অন্যথায় বাচ্চাটির ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

 

আরও পড়ুন

 

ইন্ট্রোভার্ট এবং লাজুকের মধ্যে পার্থক্য

অন্তর্মুখী ব্যক্তি একাকী থাকতে ভালোবাসে, অপরে তার সম্পর্কে কী ভাবল সেটা নিয়ে চিন্তা করে না। লাজুক বাচ্চা বা ব্যক্তি একাকিত্ব পছন্দ করে না কিন্তু চট করে কারও সঙ্গে মিশতেও ভয় পায় বা এড়িয়ে চলে। উদাহরণ হিসেবে মাইক্রোসফট-এর ফাউন্ডার বিল গেটস-এর নাম বলতে হয়, যিনি ইন্ট্রোভার্ট হিসেবে পরিচিত কিন্তু লাজুক নন।

লাজুক স্বভাব রোধ করা সম্ভব : অন্যের সাহায্য নিয়ে বা থেরাপির সাহায্যে লাজুক স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু অন্তর্মুখী ব্যক্তিকে বহির্মুখী করে তোলার প্রচেষ্টায় অনেক সময় ব্যক্তিটি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তার আত্মসম্মানে লাগে। এরা অনেক সময় যে-কোনও সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বহির্মুখী করে তুলতে পারে না

মানসিক দুর্বলতা : ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি মানসিক ভাবে দুর্বল হয়। নিজেদের সম্মান হানি হয়েছে বুঝতে পারলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়

 

জরুরি টিপস

বাচ্চা যদি অন্তর্মুখী হয় এবং তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে তাহলে এই টিপস আপনার কাজে আসবে।

  • যারা ইন্ট্রোভার্ট তারা কী করবে বা কী করবে না সেটা ঠিক করতে পারে না। তাই অভিভাবকদের উচিত নানা রকম পরিস্থিতির মধ্যে কী পার্থক্য বাচ্চাকে শেখানো। ধীরে ধীরে বাচ্চা সঠিক দিশা খুঁজে পাবে
  • বাচ্চা যদি কোনও পরিবেশে বা কোনও ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা করতে অসুবিধা বোধ করে তাহলে তাকে কাছে বসিয়ে আদর করে, কারণ জানার চেষ্টা করুন। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেবেন না যে, বাচ্চা অন্তর্মুখী তাই ওরকম ব্যবহার করছে। আপনার এই চিন্তাধারা বাচ্চার সামগ্রিক বিকাশে বাধা হয়ে উঠতে পারে
  • অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই অন্তর্মুখী বাচ্চারা তাদের নিজস্ব প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। অভিভাবকদের কাজ হচ্ছে সেই প্রতিভার সঙ্গে বাচ্চাকে পরিচিত করানো
  • অন্তর্মুখী বাচ্চা অন্য বাচ্চাদের মতো বাড়ির বাইরে গিয়ে খেলাধুলো করতে পছন্দ নাও করতে পারে। এর মানে ও খেলতে ভালোবাসে না, এমন নয় বরং বলা যেতে পারে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে ওর মধ্যে দ্বিধা রয়েছে। দ্বিধা কাটাবার জন্যে বাড়িতেই বাচ্চার সঙ্গে আউটডোর গেমস খেলুন। ধীরে ধীরে বাচ্চাকে বোঝান আউটডোর গেম খেলতে তখনই ভালো লাগবে যখন সে বাইরে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে টিম বানিয়ে খেলবে
  • এই ধরনের বাচ্চাদের কিছুটা স্বাধীনতা দিতে হবে। সব সময় ওদের প্রোটেক্টর হয়ে থাকলে চলবে না। ওরা যে-কাজটা করতে পারছে না আগ বাড়িয়ে নিজে করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এর ফলে ওদের মনে হতে পারে, কোনও কাজ করতে ওরা অক্ষম।

খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটি বাচ্চা স্বভাবে এবং শারীরিক ক্ষমতায় একে অপরের থেকে আলাদা। সুতরাং বাচ্চার ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন করেই আপনি আপনার বাচ্চার ভবিষ্যতের ভিত মজবুত করতে পারবেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...