যখন বাড়ি ঢুকল বেশ রাত হয়ে গেছে। মনটা আজকে খুশিতে ভরে রয়েছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে রুমনাকে যে, রুমনা বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না। খালি সমীরের মুখটা মনের পর্দায় বারবার ভেসে উঠছে। প্রথম যেদিন আলাপ হয় সমীরের সঙ্গে ওকে দেখা মাত্রই, বিদ্যুৎ বয়ে গিয়েছিল সারা শরীরে।

সমীর ইউনির্ভাসিটি-তে এমটেক-এর ফাইনাল ইযারের ছাত্র আর রুমনা ফাইন আর্টস-এর। প্রথম দেখাতেই প্রেম। একে অপরকে ছাড়া জীবন, নিরর্থক মনে হতো। রোজ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানো চাই-ই। অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করত ওদের মধ্যে। রুমনার সৌন্দর্য‌্য আর মধুর স্বভাব সমীরকে আচ্ছন্ন করে রাখত। প্রেমের বহমান স্রোতে দুজনেই গা ভাসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। এভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। খোলা আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতোই স্বাধীন ছিল ওরা। কিন্তু হঠাৎই মেঘমুক্ত আকাশে কালো মেঘের আভাস রুমনাকে আশঙ্কিত করে তুলল।

একদিন স্নান করার সময় আয়নায় নজরে এল পিঠে একটা সাদা দাগ। আগে এই দাগটা কখনও দেখেনি। মুহূর্তে বিচলিত হয়ে উঠল রুমনা। এটা যদি তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সে অসুন্দর হয়ে যাবে। তখন বেঁচে থাকার কোনও অর্থই থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গে সমীরের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার স্বপ্নের জগৎ মুহূর্তে কাচের মতো ভেঙে পড়ল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল সে, চোখে আতঙ্ক স্পষ্ট! মা, আমার পিঠে দ্যাখোতো, এটা কীসের সাদা দাগ? শম্পা মেয়ের পিঠে সাদা দাগ দেখে নিজেও ঘাবড়ে গেলেন।

কথায় কথায় শম্পা এক বান্ধবীর কাছ থেকে একজন সাধুর ঠিকানা জোগাড় করে সেখানেই মেয়েকে নিয়ে যাওযা মনস্থ করলেন। সেই সাধু নাকি এরকম হাজারো রোগ মন্ত্র বলে সারিয়ে দিতে পারেন। রুমানাকেও জানালেন সাধুর কথা, আমি তোকে ওই সাধুর কাছে নিয়ে যাব ঠিক করেছি। আমার বান্ধবীর ভাইয়ের মেয়েরও এই রকম দাগ হয়েছিল শরীরে। তিন-চারবার বাবার কাছে, নিয়ে যাওয়ার পর দাগ সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে।

মায়ের কথা রুমনা বিশ্বাস করতে পারল না।তন্ত্র-মন্ত্র-তে কোনওদিনই তার বিশ্বাস নেই। তাই মায়ের মুখে এই কথা শুনে একটু আশ্চর্য হল। জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি পড়াশোনা জানা একজন মহিলা হয়ে এরকম কথা কী করে বলছ? এই সব সাধু-রা ধর্ম এবং বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে মানুষকে ঠকায়।

শম্পা মেয়ের কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না বরং উলটে একটু রাগ দেখিয়ে উত্তর দিলেন, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এটাই সমস্যা। তোরা নিজেদের ছাড়া অন্য কিছু আর ভাবিস-ই না। রুমি এই যে মন্ত্র-তন্ত্র, এরও শক্তি কিন্তু বিশাল, একে অবহেলা করিস না। আমার সঙ্গে তোকে যেতেই হবে, তুই বিশ্বাস করিস আর না-ই করিস।

অগত্যা রুমনা মায়ের সঙ্গে ওই সাধুবাবার কাছে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। মা-মেয়ে যখন পৌঁছল তখন বেশ ভিড় জমা হয়েছে ওখানে। সকলেই কোনও না কোনও সমস্যা নিয়ে এসেছে। খানিকক্ষণ পরেই কালো বস্ত্রে সর্বাঙ্গ ঢেকে জটাধারী এক বাবা প্রবেশ করলেন। কপালে জ্বলজ্বল করছে লাল টিকা। পিছনে সাত-আটজন শিষ্য। আসন গ্রহণ করতেই এক একজন করে যারা সমস্যা নিয়ে এসেছেন, তারা সামনে গিয়ে বসে সমস্যা খুলে বলা শুরু করলেন। অদ্ভুত ভঙ্গিমায়ে বাবা তাদের চিকিৎসা শুরু করলেন।

একজন মহিলা পেটে পাথরের সমস্যা নিয়ে বাবার সামনে বসে ছিলেন। রুমনার চোখের সামনে বাবা কিছু মন্ত্র পড়ে মহিলার পেটে তাঁর মুখ স্পর্শ করলেন। খনিকক্ষণ ওভাবে থাকার পর একটা পাথর সত্যি সত্যি মুখ দিয়ে বার করে আনলেন বাবা। রুমনার এবার ভয় করতে শুরু হল। ওর যখন বাবার সামনে যাওয়ার সুযোগ হল রুমনা ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেল। বাবা রুমনার শরীরের এই দাগের উপর একটা মযূরের পালক বোলাতে আরম্ভ করলেন। মুখেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর বাবা মৌনতা ভেঙে বলে উঠলেন, এই দাগ সহজে যাবার নয়। কোনও অজানা শক্তির প্রকোপ এটা। এর জন্য অন্য কোনও বড়ো ব্যবস্থা করতে হবে।

বলুন বাবা কী করলে এই দাগ সারবে? আমরা সবকিছু করতে রাজি আছি, শ্রদ্ধার সঙ্গে উত্তর দিলেন শম্পা।

সাধুবাবা রুমনার হাতে একটা লাল কাপড়ের পুঁটুলি দিয়ে বললেন, শোন, এই কাপড়ের পুঁটুলিটা রোজ নিজের বালিশের তলায় রেখে শুবি। আর প্রতি শনিবার একটা যে-কোনও কালো কুকুরকে একটি করে অমৃত্তি খাওযাবি।

শম্পা মাথা নেড়ে মেনে নিল এই আদেশ। একটি পাত্রে রাখা পানীয় বাবা রুমনার হাতে দিয়ে বললেন, নে, এটা অমৃত, খেয়ে নে। এবার পিছন দিকে যে-কুঁড়েঘরটা রয়েছে সেখানে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর।

রুমনার সঙ্গে সঙ্গে শম্পাও কুটিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই বাবা বললেন, উঁহু, তুই না… তুই, এখানেই থাক। তোর মেয়েকে একলাই ওখানে যেতে হবে।

এই বদ্ধ পরিবেশে রুমনা হাঁপিয়ে উঠছিল, তার উপর সাধুর কারসাজি যতই দেখছিল ভয়টা চেপে বসছিল বুকের ভিতর। ওকে ওই কুটিরে যেতে হবে শুনেই একটা চোরা টেনশন তাকে উদ্বেল করল। সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। শক্ত করে মায়ের হাতটা চেপে ধরে সে সোজা ওই ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এল।

মুহূর্তের আকস্মিকতায় শম্পাও কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। সম্বিত ফিরতেই শুনলেন বাবার সাগরেদরা চিৎকার করে বলছেন, আরে দাঁড়া, তোরা দাঁড়া, কোথায় যাচ্ছিস?

হাঁটার গতি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা। হাঁপাতে হাঁপাতে রুমনা বলল, আমার কাউকে দেখাবার কোনও দরকার নেই। ভণ্ড সাধু-সন্ন্যাসীতে আমার কোনও দিনই বিশ্বাস ছিল না, তোমার জন্য এখানে আসতে হল। শিগগিরি বাড়ি চলো মা।

রুমনার বাবা যখন পুরো ঘটনাটা শুনলেন, স্ত্রীয়ের উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন, শম্পা, তুমি কোন যুগে বাস করছ? এইসব বাবাজী, ওঝা আসলে বুজরুকের দল। ব্যাবসা ফেঁদে বসেছে। তুমি জানো না, দৈবশক্তির প্রভাব বলে এরা মানুষকে বোকা বানায়। রুমিকে একা পেয়ে বদমায়েসটা কী করত কোনও ধারণা আছে তোমার? খুব অন্যায় করেছ রুমিকে ওখানে নিয়ে গিয়ে, কাল আমি রুমিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

পরের দিন রুমনার বাবা ওকে স্কিন স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার রুমনাকে পরীক্ষা করে জানালেন, লিউকোডার্মার জাস্ট প্রথম স্টেজ। ঘাবড়াবার কিছু নেই। এখনই চিকিৎসা শুরু করে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। রোগীকে যদি আনতে দেরি করে ফেলতেন তাহলে হয়তো পরিণাম খারাপ হতে পারত।

ডাক্তারের কথামতো রুমনা চিকিৎসা করানো শুরু করে দিল। কিন্তু মাথার মধ্যে একটা চিন্তা সবসময় ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করল। সমীর এখনও ওর এই অসুখটার কথা কিছুই জানে না। কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি রুমনা। সমীর হয়তো জানতে পারলে ওকে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু না বলে বিয়ে করলেও পরে তো ও ঠিকই জানতে পারবে। তখন? কল্পনা করেই শিউরে ওঠে রুমনা। শত চেষ্টা করেও মন থেকে সমীরের চিন্তাটা কিছুতেই সরাতে পারে না সে। মন এক কথা বলে, মস্তিষ্ক সেটা কিছুতেই মানতে চায় না। দুটোই যেন রুমনার নিয়ন্ত্রণে নেই। সমীরকে হারাবার ভয়ে সত্যিটা চেপে রাখার চেষ্টা যেন রুমনার মধ্যে দিন দিন আরও জোরালো হয়ে উঠতে লাগল।এরকম চিন্তা করার জন্য রুমনার মন ওকে ধিক্কার দিত। কিন্তু তাতেও রুমনা সত্যিটা বলার জন্য কিছুতেই নিজেকে তৈরি করতে পারত না। ও খুব ভালো করেই বুঝত সমীরকে সাদা দাগের ব্যাপারটা না জানানো মানে ওকে ঠকানো। বিয়ের মতো পবিত্র এবং মধুর একটা সম্পর্কের ভিতটাই হল বিশ্বাস আর ভালোবাসা। সেটাই যদি না থাকে তাহলে ওদের বিয়ে কীসের ভিত্তিতে টিকে থাকবে? এই একই চিন্তায় ভিতরে ভিতরে গুমরে ক্ষয়ে যেতে লাগল রুমনা। হঠাৎই একদিন নিজের মন শক্ত করল, ঠিক করল সমীর যাই বলুক না কেন, সত্যিটা ওকে জানাতেই হবে।

সেদিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ। দুপুর নাগাদ সমীরের ফোন এল, রুমনা, বিকেলে কী করছ? একটা নতুন রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়েছি, যাবে নাকি আজ?

সমীরের গলার আগ্রহ উপলব্ধি করে রুমনা তত্ক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল, ঠিক আছে, যেখানে অপেক্ষা করো সেখানেই থেকো। আমি পৌঁছে যাব।

ওরা দুজনে রেস্তোরাঁর একটা কোনা বেছে নিয়ে চেযার টেনে বসল। রঙিন আলোর মাযাবী খেলায় স্বপ্নাচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে রেস্তোরাঁর ভিতরে।

আজ সমীর, রুমনা-কে বিয়ের প্রস্তাব দেবে ঠিক করেই এসেছিল। ক্যাম্পাসের সুবাদে ভালো একটা চাকরি পেয়েছে সে। ছমাস বাদে জয়েনিং। মনে মনে আউড়ে নিচ্ছিল কী ভাবে শুরু করবে, তার আগেই রুমনা হঠাৎ বলল, সমীর, আমার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।

রুমনার মনে হল হৃৎপিণ্ডের আওযাজটা সে নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছে। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওযার জন্য রুমনা আজ তৈরি হয়ে এসেছে। সমীরের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রুমনা জানাল তার শরীরের সাদা দাগটার কথা।

সমীরের চোখের গভীরে চোখ রাখল রুমনা। সেখানে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই। কোনও ঘেন্না, বিতষ্ণা, কিছু ফুটে উঠল না সমীরের চোখে। বরং রুমনার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিল সমীর, রুমনা তোমার যাই হয়ে থাকুক না কেন, আমি সবসময় তোমার সঙ্গে আছি। তুমি আমার বাঁচার প্রেরণা। আমাকে বিয়ে করবে রুমনা?

অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রুমনার গাল বেয়ে প্রচণ্ড ঝড়ের পরে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে ওঠে, রুমনার মনটাও তেমনি প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। মনের সমস্ত শঙ্কা মুহূর্তে দূর করে দিয়েছিল সমীর।

 

রাত গভীর হয়েছে, তবুও অতীতের স্মৃতিগুলো রুমনার মনে এসে ভিড় জমাচ্ছে। নিজের অজান্তেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে রুমনা।

রুমি, এই রুমি ওঠ। অনেক বেলা হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটি যাবি না। মায়ের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসে রুমনা। মুহূর্তে গত সন্ধের সব ঘটনা মনে পড়ে যায় তার। একটা অদ্ভুত শান্তির পরিবেশ যেন ওকে ঘিরে রেখেছে। সে মায়ের হাতটা ধরে বলল, মা, প্লিজ আমার কাছে বসো না একটু।

রুমনা শম্পার কোলে মাথা রেখে বিছানায় এলিয়ে দিল শরীরটা। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। নিরবতা ভেঙে রুমনাই বলল, মা, তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই।

শম্পা রুমনার চুলে সস্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, কী বলবি বল না।

মা, তোমার সঙ্গে তো সমীরের আলাপ আছে। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা বিয়ে করতে চাই।

রুমি এটা তো খুবই ভালো খবর। সমীরকে আমারও খুব পছন্দ। কিন্তু ও কি তোর অসুখটা সম্পর্কে জানে? শম্পার গলায় অনিশ্চয়তা ফুটে উঠে!

হ্যাঁ মা, আমি ওকে সব বলেছি।

রুমনার মা-বাবা সম্বন্ধ পাকাপাকি করার জন্য সমীরের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করলেন। সকলের সম্মতিতে ওদের বিয়ে দিনও স্থির হয়ে গেল। ওদের ভালোবাসা পরিণতি পেল বিয়ের পবিত্র বন্ধনে।

ফুলশয্যার রাতে রুমনা নববধূর সাজে সমীরের জন্য অপেক্ষা করছিল। চারিপাশে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব, হইচই। এত ভিড়ের মধ্যেও রুমনার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল শুধু একটি মানুষকেই। সব কাজ সেরে সমীর যখন ঘরে এল তখন বেশ রাত হয়েছে।

সমীর দরজা বন্ধ করে রুমনার সামনে এসে বসল। মুহূর্তে রুমনা নিজেকে সঁপে দিল সমীরের আলিঙ্গনে। এভাবেই কাটে কিছুটা সময়। রুমনাই প্রথম কথা বলল, সমীর আমি সত্যিই ভাবিনি, ওই সাদা দাগটা হওযা সত্ত্বেও তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইবে।

সমীর রুমনার ঠোঁটে আঙুল রাখল ওকে চুপ করাবার জন্য। মৃদু হেসে বলল, একটা সম্পর্কে বিশ্বাসটাই সব নয়। পারস্পরিক বোঝাপড়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা সামান্য দাগ কি সত্যিই তোমার আমার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে? রুমনা মনে রেখো তুমিই আমার জীবন। তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই নই।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...