সৌন্দর্যের পূজারি কে নয়? সৌন্দর্য-কে ধরে রাখতে সকলেই নানাপ্রকার প্রচেষ্টা করে থাকেন। সৌন্দর্যের মূল উৎস কিন্তু মানুষের অন্তর আত্মা। ভিতরের সৌন্দর্যই প্রস্ফুটিত হয়ে মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে।  আত্মার সৌন্দর্য কখনওই নষ্ট হওয়ার নয় কিন্তু মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যের উপর প্রভাব পড়ে বয়স, পরিবেশ, আবহাওয়া, দূষণ ইত্যাদির। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল রাখতে হয় ডায়েট-এরও। বিশেষ যত্ন নিতে হয় ত্বক, চুল, মুখের। হাত-পায়ের সৌন্দর্যও কিন্তু অবহেলা করার নয়।

ত্বকের যত্ন

সৌন্দর্য বজায় রাখতে ত্বকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রমণ, কেমিক্যালস, ধুলোমাটি, দূষণ ইত্যাদির প্রভাবে ত্বক রুক্ষ প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ত্বককে হাইড্রেট করতে প্রচুর পরিমাণে জল খান। এছাড়াও রয়েছে ত্বকের সঙ্গে যুক্ত কিছু সমস্যা এবং তার সমাধান।

(১)   ট্যানিং – সূর্যের রশ্মি-তে রয়েছে আল্ট্রা-ভায়োলেট-রে যা ত্বককে প্রাণহীন করে তোলে। বেশিক্ষণ রোদে থাকলে ত্বকে ট্যান-এর সমস্যা হয়ে থাকে। এই সমস্যা রোধ করতে রোদে বেরোবার আগে কমপক্ষে ২০ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রীন অবশ্যই লাগান। যদি রোদে আপনাকে বেশিক্ষণ থাকতে হয় তাহলে ৩ ঘন্টা অন্তর একবার করে সানস্ক্রীন লাগান। সুইমিং করার আগেও সানস্ক্রীন অবশ্যই লাগাবেন, তাতে ত্বকে ট্যানিং হবে না। এছাড়াও রোদচশমা, ছাতা, টুপি অবশ্যই ব্যবহার করুন যাতে ত্বক সুরক্ষিত থাকে।

(২)   টাইট পোশাক থেকে সংক্রমণ – ফ্যাশনের চক্বরে পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে ফ্যাশনেবল পোশাক পরতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে এমন টাইট পোশাক পরিধান হিসেবে তারা বেছে নেন যেটা ত্বকের সঙ্গে টাইট হয়ে লেগে থাকে। ফলে ত্বক নিঃশ্বাস নিতে পারে না, ত্বকে দাগ পড়ে যায়, এমনকী অনেকসময় ত্বকে পোশাক কেটে বসে যায়। ত্বকে চুলকানির সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের মতো গরমের দেশে ত্বকে ঘাম জমে সংক্রমণ হওয়ার ভয় বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে অথবা রোজ রোজ টাইট পোশাক পরলে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতাও বেড়ে যায়। গরমের মরশুমে সুতির ঢিলাঢালা বা কমফর্টেবল পোশাক নির্বাচন করাই বুদ্ধিমানের। এরই মধ্যে ফ্যাশনেবল পোশাকও পেয়ে যাবেন। এছাড়া অন্যসময় স্কিন ফ্রেন্ডলি, হালকা, আরামদায়ক পোশাকই বাছুন।

(৩)    রুক্ষ, প্রাণহীন ত্বক – শরীরের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে দরকার পর্যাপ্ত জল খাওয়া। জলের অভাবে ত্বকে বলিরেখা পড়ে যায় এবং ত্বক রুক্ষ হয়ে পড়ে। ত্বক ফেটে ফেটে যায় এবং ওই জায়গায় ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস বাসা বাঁধে। এই সমস্যা রোধ করতে দিনে অন্তত ২ থেকে ৩ লিটার জল খাওয়া আবশ্যক। স্নানের পর ময়েশ্চারাইজার লাগানো জরুরি। ত্বক বেশি রুক্ষ হলে ৩-৪ ঘন্টায় ত্বক ময়েশ্চারাইজ করুন। ত্বক মোলায়েম রাখতে নারকেল তেলও লাগাতে পারেন।

(৪)    ব্রণ, মেচেতা, হরমোনাল চেঞ্জেস – এর কারণে সাধারণত ব্রণ, মেচেতা ইত্যাদি হয়ে থাকে। কিন্তু এছাড়াও অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, মুখে তাপ লাগা, অবসাদগ্রস্ত হয়ে থাকা, ত্বকে বারবার হাত দেওয়া ইত্যাদি কারণেও ব্রণ, ছুলি, মেচেতা ইত্যাদির সমস্যা বাড়তে পারে। বারবার সাবান দিয়ে মুখ ধুলে ব্রণ বা মুখের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার সঙ্গে সঙ্গে অবসাদ থেকেও দূরে থাকুন। ত্বকে বারবার হাত লাগাবেন না। সমস্যা বেড়ে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।

(৫)   ত্বকের হলদেটে ভাব বেড়ে যাওয়া – অতিরিক্ত ধূমপান করলে বয়সের আগেই ত্বক ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলে এবং বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ত্বকের উপরের পরতে থাকা শিরা-উপশিরাগুলি আকারে কুঁকড়ে যায় ফলে রক্ত চলাচল ঠিকমতো হতে পারে না। ত্বকে হলুদ ভাব প্রকট হয়ে ওঠে। এছাড়াও ত্বকের অক্সিজেন প্রবাহ এবং পুষ্টিকর তত্ত্বের উপরেও প্রভাব ফেলে। বেশি ধূমপান করলে ঠোঁট এবং চোখের নীচেও কালি পড়ে। ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে তোলে। এই সমস্যার একটাই সমাধান হল ধূমপান পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া।

(৬)    স্কিন ইরিটেশন – জীবাণু, তেল, নোংরা ও মৃত কোশ দূর করতে নিয়মিত ভাবে মুখ পরিষ্কার করা জরুরি। স্ক্রাবিং বেশি করলে ত্বকে ইরিটেশন হতে পারে ফলে ত্বকে রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অনেকেই জোর দিয়ে রগড়ে স্ক্রাব বা ফেস ওয়াশ করে থাকেন যেটা করা অনুচিত। জেন্টল স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টস ব্যবহার করা উচিত। হালকা গরম জল এবং মাইল্ড ক্নিঞ্জার দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলা উচিত। সার্কুলার মোশনে আঙুল দিয়ে মুখে মাসাজ করুন। সাবান বা সাবানের ফেনা ত্বকে যাতে এতটুকুও লেগে না থাকে তারজন্য মুখ ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ঘষে ঘষে মুখ না মুছে তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে মুখের জল মুছে ফেলুন।

চুলের যত্ন

কেশ বা চুল, সৌন্দর্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। সুতরাং চুল পড়া বা চুলের যে-কোনও সমস্যায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, বিশেষ করে মেয়েরা। নানা কারণে চুল পড়তে পারে যেমন হরমোনাল ইমব্যালেন্স, পুষ্টির অভাব, থাইরয়েডের সমস্যা, গর্ভনিরোধক ওষুধের অতিরিক্ত সেবন, স্ট্রেস, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, বিভিন্ন কেশসজ্জার প্রোডাক্ট ব্যবহার করা এবং জিনগত সমস্যা ও মেডিকেল কন্ডিশন-এর কারণে।

চুল পড়ার সমস্যায় ঘরোয়া সমাধান

১)       শ্যাম্পু – আপনার মাথার ত্বকের (স্ক্যাল্প) ধরন বুঝে তবেই শ্যাম্পু বাছবেন। স্ক্যাল্পের উপর নির্ভর করেই কতবার চুল ওয়াশ করবেন ডিসাইড করুন। ড্রাই স্ক্যাল্পের ক্ষেত্রে বেশিবার চুল ধুলে চুলপড়া বেড়ে যাবে আবার সপ্তাহে অন্তত ৩ বার অয়েলি হেয়ার ধোয়া প্রয়োজন। এটাও শিওর হয়ে নেওয়া দরকার আপনার শ্যাম্পুতে সালফেট, প্যারাবেন এবং সিলিকন-এর মতো কেমিক্যাল যেন না থাকে

২)       কন্ডিশনার – কন্ডিশনার-এ থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড ড্যামেজড হেয়ার রিপেয়ার করে চুল রাখে মজবুত এবং মসৃণ

৩)      উপযুক্ত ডায়েট এবং এক্সারসাইজ – চুলের জন্য প্রয়োজন সঠিক পুষ্টির, বিশেষ করে প্রোটিন এবং আইরনের। ব্যালেন্সড ডায়েটের সঙ্গে যোগ ব্যায়াম এবং মেডিটেশন চুলপড়া কমাতে সাহয্য করবে

৪)       কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট – চুলের স্ট্রেটনিং, পার্মিং, কালারিং ইত্যাদি চুলের যথেষ্ট ক্ষতি করে। এছাড়া ব্লো ড্রায়ার, কার্লিং রড বিশেষ করে ভেজা চুলে ব্যবহার করলে এগুলি চুলকে ভঙ্গুর করে তোলে। ব্যবহার যদি করতেই হয় শুরু করুন ফর্টিফায়িং লিভ ইন কন্ডিশনার দিয়ে এবং শেষ করুন প্রোটেক্টিভ স্প্রে প্রয়োগ করে

৫)       অয়েলিং – সপ্তাহে ১ বার চুলে অয়েল মাসাজ করুন এবং ২ ঘন্টা রেখে মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। এতে ব্লাড সার্কুলেশন বাড়বে এবং চুলের গোড়ায় পুষ্টি পৌঁছোবে। চুলপড়া রোধ করতে কেমিক্যাল-যুক্ত প্রোডাক্ট চুলে ব্যবহার না করে, ন্যাচারাল হোমমেড রেসিপি চুলে ব্যবহার করা ভালো

৬)      এগ মাস্ক – ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে ১ টেবিলচামচ অলিভ অয়েল এবং মধু মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে চুলের গোড়া থেকে আগা অবধি লাগান। ২০ মিনিট পর মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন

৭)       যষ্টিমধুর শিকড় – একের চার চামচ কেসরের সঙ্গে এক টেবিলচামচ যষ্টিমধুর শিকড় পিষে এক কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নিন। সারা মাথায় লাগিয়ে সারারাত রেখে দিন। সকালে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দু’বার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করুন

8)       নারকেল তেল – নারকেল দুধের সঙ্গে ১ চা-চামচ করে গোলমরিচগুঁড়ো এবং পেষা মেথিদানা মিশিয়ে স্ক্যাল্প ও চুলে লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে নিন

৫)       গ্রিন টি – গরমজলে গ্রিন টি-র ২-৩ টি প্যাকেট ভিজিয়ে রাখুন। জল ঠান্ডা হলে সেটি মাথায় ঢেলে ধীরে ধীরে স্ক্যাল্প মাসাজ করুন। ১ ঘন্টা পর পরিষ্কার জলে চুল ধুয়ে ফেলুন

৬)      বিটরুটের জুস – ভিটামিন সি ও বি৬, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম-এ ভরপুর, চুলের হেলদি গ্রোথের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। বিটরুটের ৭-৮ টি পাতা গরমজলে ফুটিয়ে ৫-৬ টি হেনা পাতার সঙ্গে পিষে স্ক্যাল্পে লাগান। ১৫-২০ মিনিট বাদে হালকা গরম জলে মাথা ধুয়ে ফেলুন

৭)       মেথি আমলকী – সারা রাত মেথিদানা জলে ভিজিয়ে রেখে পেস্ট বানিয়ে নিন। সেটি স্ক্যাল্পে লাগিয়ে আধঘন্টা রাখুন ও পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এক মাসে, সপ্তাহে দু’বার করে এই পদ্ধতি মেনে চললে চুল পড়া কমে যাবে এবং চুল সজীবতা ফিরে পাবে

৮)         আমলকী পাউডার -লেবুর রসের সঙ্গে মিশিয়ে স্ক্যাল্প ও চুলে লাগান এবং শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন যাতে চুল শুকিয়ে না যায়। ১ ঘন্টা রেখে জল দিয়ে মাথা পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন

৯)       পেঁয়াজের রস – এতে রয়েছে অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল প্রপার্টিজ যা স্ক্যাল্পে সংক্রমণ হতে দেয় না এবং এতে থাকা সালফার, ব্লাড সার্কুলেশন বাড়িয়ে চুলের গ্রোথ উন্নত করে এবং চুলপড়াও বন্ধ করে

১০)     অ্যালোভেরা – অ্যালোভেরার পাল্প বার করে স্ক্যাল্পে লাগিয়ে ঘন্টাখানেক রেখে দিন। নর্মাল জল দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিন-চারবার এই পদ্ধতি ট্রাই করতে পারেন

১১)     টক দই মধু – একটি পাত্রে ২ চা-চামচ টক দই মিশিয়ে নিন একটি লেবুর রস এবং ১ চামচ মধুর সঙ্গে। মিশ্রণটি স্ক্যাল্প এবং চুলের গোড়ায় লাগিয়ে আধ ঘন্টা রেখে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে একবার এটি ট্রাই করতে পারেন

 

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...