গত দু’দিন হল ম্যাঙ্গালোর এসেছি। কাল উদিপি দেখতেই সারাটা দিন কেটেছে। সঙ্গে দেখেছি মালপে আর কৌপের মতো অল্প চেনা অসাধারণ সব সৈকত। আজ ভেবেছি মন ভরে দেখব ম্যাঙ্গালোর। সকালে স্নানপর্ব মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল সন্নিকটে একটি রেস্টুরেন্টে সারলাম প্রাতরাশ। এবার একটা অটো ভাড়া করে শহর দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম।
বন্দর নগরী ম্যাঙ্গালোর বেশ বড়োসড়ো আধুনিক শহর। ভৌগোলিক ভাবে এর অবস্থান আরবসাগরের তীরে নেত্রবতী ও গুরুপুর নদীর সঙ্গমে। মধ্যযুগে ইবনবতুতা ঘুরে গেছেন এ শহর থেকে। দীর্ঘ দিন পর্তুগীজদের দখলে থাকা এ শহরের সঙ্গে কেরালার অনেকটাই সাদৃশ্য রয়েছে। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলি ম্যাঙ্গালোর অধিকার করে মহীশূর রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত করেন। এ শহরে টিপুর সঙ্গেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপুর মৃত্যুর পর ইংরেজরা এই শহরের দখল নেয়। সব যুগের স্মৃতি ও স্মারক ম্যাঙ্গালোরকে উপভোগ্য পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এটাই ভারতের কাজু, কফি ও মশলা রফতানির মুখ্য ঘাঁটি। শহরের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে উঁচুনীচু পাহাড়। পথঘাটে অনেক বাঁক, নানাদিকে চলে গেছে সংকীর্ণ গলিপথ। সমুদ্র ছাড়াও এখানে রয়েছে অনেক মন্দির, মসজিদ ও গির্জা।
মন্দির দর্শনের মধ্যে দিয়ে সকালটা শুরু হল। গাড়ি নিয়ে প্রথমেই চলে এলাম কাদরি মঞ্জুনাথ মন্দিরে। বাসস্ট্যান্ড থেকে চার কিমি দূরে এর অবস্থান। এই মন্দির নির্মিত হয় একাদশ শতকে। গাড়ি থেকে নেমে চললাম বিগ্রহ দর্শনে। এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে সুবিশাল অঙ্গন। প্রবেশ সম্মুখে উঠে গেছে সিঁড়ি, যেটা পেরিয়ে তোরণদ্বার ছুঁয়ে প্রবেশ করলাম সুপ্রশস্ত সেই অঙ্গনে। মূল মন্দির ছাড়া এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, অনেক দেবদেবীর মন্দির।
প্রথমেই ঢুকলাম নবগ্রহ মন্দিরে। পাশেই গণেশ মন্দির৷ একই চত্বরের মধ্যে রয়েছে শনি, সূর্য ও অন্যান্য মন্দিরশ্রেণী। পাশেই আচ্ছাদিত এক প্ল্যাটফর্মের উপর রুপোর রথ। অনেকটা ঘুরে আবার মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। কেরলের লাল টালির ধাঁচের এই মন্দির চূড়া অবশ্য শ্বেতশুভ্র। এখানেই রয়েছে ব্রোঞ্জের প্ল্যাটফর্মের উপবিষ্ট লোকেশ্বর শিব। পাশেই অবস্থান করছে মঞ্জুরী মূর্তি। লোক সমাগম দেখেই উপলব্ধি হয়, কত জনপ্রিয় এই মন্দির।
মন্দিরের ভিতরে তখন বড়ো মেশিনের সাহায্যে ধোয়া-ধুয়ির কাজ চলছে। মন্দিরের সম্মুখে খাড়াই সিঁড়ির সারি। উঠেছে কাদরি পাহাড়ে। সিঁড়িতে পা দিতেই চোখ চলে যায় মন্দির সম্মুখে আকাশচুম্বী দীপস্তম্ভ-এর দিকে। একপাশে রয়েছে পবিত্র জলাশয়। মন্দির লাগোয়া সাতটি জলে চর্মরোগের নিরাময় হয় বলে ভক্তদের বিশ্বাস। কাছেই রয়েছে পান্ডবগুহা ও যোগীমঠ। আরও কয়েকধাপ এগিয়ে গেলেই নজরে পড়ে, পাহাড়ি চত্বরে সুন্দর করে সাজানো পার্ক। অন্য পাশে রয়েছে ছোট্ট চিড়িয়াখানা। ফেরার পথে চত্বরের মূল ফটকের কাছে শিবের মূর্তিটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
গাড়ি এবার চলে আসে মঙ্গলা দেবীর মন্দির সম্মুখে। মূল রাস্তার ধারেই এই মন্দির। বেশ খোলামেলা পরিবেশ। আড়ম্বরহীন মন্দির সম্মুখে এক প্রকাণ্ড অশ্বত্থগাছ। সেই গাছটি ঘিরেই ভক্তদের জটলা। দশম শতাব্দীতে এক রাজকন্যার স্মৃতিরক্ষার্থে নাকি এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। শোনা যায়, এই দেবীর নাম অনুসারেই শহরের নাম হয় ম্যাঙ্গালোর।
এবার গাড়ি এগিয়ে চলে, হাল আমলের তৈরি গোরক্ষনাথ মন্দির দর্শনে। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনার্দন পূজারীর অর্থ আনুকূল্যে এই মন্দির নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। মন্দির গাত্রের সুচারু সৗন্দর্য দেখে সত্যিই চোখ আটকে যায়। মন্দির কমপ্লেক্স জুড়ে যেন অভিনবত্বের আতিশয্য। মোজাইক চত্বরে প্রবেশ করেই দেখে নিই পরপর মন্দিরগুলি। রয়েছে বজরংবলী, শনি, সাঁইবাবা, কার্তিকস্বামী ইত্যাদি মন্দির। ফুল, বেলপাতা, কর্পূর, ধূপ, ধুনোর মিলিত চির-চেনা গন্ধটা নাকে আসে।মূল গোরক্ষনাথ শিব মন্দিরে তখন আরতি চলছে। বক্সে বাজছে আধ্যাত্ম সংগীত। সংগীতের তালটা যেন শরীরেও ভর করে। ফেরার পথে লক্ষ্য করি, মূল ফটকের কারুকার্যও দেখার মতো। শুনলাম, মন্দির জুড়ে দশেরাতে বিরাট উৎসবের আয়োজন করা হয়।
গাড়ি এবার দৌড়োল এক নতুন মন্দির দর্শনে।সম্প্রতি এই সূর্যনারায়ণ মন্দির পুণ্যার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে এই মন্দিরের মূল বিগ্রহ সূর্যদেব। আধুনিক শিল্পীদের হাতে গড়া এই মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য অসাধারণ। খোঁজ নিয়ে জানলাম, পশ্চিমবঙ্গের বহু শিল্পীই এই মন্দিরে কাজ করেছেন। কেরলীয় ধাঁচে তৈরি এই নতুন মন্দিরের ভক্তসমাগম এর মধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে।
ম্যাঙ্গলোরকে বোধহয় মন্দির নগরী বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। তাই এবার গাড়ি ছোটে অন্য এক মন্দির অভিমুখে। এবারের আকর্ষণ সোমেশ্বর শিব মন্দির। মন্দির লাগোয়া দুর্দান্ত এক সৈকত। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি, সামনে ছোটো-খাটো এক টিলা। টিলাশীর্ষে রয়েছে সোমেশ্বর শিব মন্দির। খাড়াই সিঁড়িপথটা উঠেছে মন্দির অবধি। মন্দির লাগোয়া গাছগাছালির ছায়াঘন পরিবেশ। পুণ্যার্থীর সমাগমও যথেষ্ট। ভক্তদের লম্বা লাইনটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে সামনে এগিয়েছে।
সিঁড়ির সম্মুখভাগ দিয়ে অন্য একটা পথ পৌঁছেছে টিলার শীর্ষে। লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলি টিলার মাথায়। উপরে উঠতেই চোখাচোখি হয়ে যায় আরবসাগরের সঙ্গে। সামনেই ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে সোমেশ্বর সি-বিচ। এখানে বিশ্রামের জন্য আছে আচ্ছাদিত কংক্রিটের প্লাটফর্ম। তাতে কয়েকটা চেয়ার পাতা। তার সম্মুখে বোল্ডার বিছানো পাহাড়ি প্রাকৃতিক পরিসর। সামনের ফ্রেম জুড়ে সফেদ ফেনিল জলরাশির জলছবি। ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে বোল্ডার সর্বস্ব পাহাড়ের দেয়ালে। যতদূর চোখ যায় আদিগন্ত বিস্তৃত নীল-নীলিমার উদ্দাম লহরির খেলা। অশান্ত লোনা হাওয়ায় মন ভালো করা ষোলো আনা তৃপ্তি। জায়গাটা এতটাই নয়নাভিরাম আর নিরিবিলি যে, মনে হয় জীবনের শতব্যস্ততা থেকে মুক্তির ঠিকানা পেয়ে গেছি।
একটু এগোতেই দেখি, পাহাড়ের গা বেয়ে লাল রেলিংয়ের সিঁড়ি। নেমে গেছে সোজা সি-বিচে। শুনসান সি-বিচে লোকজন হাতে গোনা। বিচ জুড়ে আবার ঝাউয়ের বিন্যাস। উপলখন্ডের উপর উথালি-পাথালি ঢেউ অবলোকন করি অনেকক্ষণ ধরে। সমুদ্রের মাদকতার স্বাদ নিতে গিয়ে, সময় অনেকটাই চলে যায়। দুপুরের নিয়মের শাসনে সোমেশ্বর শিবমন্দির বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বিগ্রহ দর্শন আর হয়ে ওঠে না। মন্দির চত্বরটা ঘোরাঘুরি করে, আবার গাড়িতে গিয়ে উঠি।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর পৌঁছোই এখানকার বিখ্যাত উল্লাল-সি-বিচে। গাড়ি থেকে নামতেই হাতছানি দেয় বিস্তৃত সোনালি বালুর দূর্দান্ত এক সৈকত। সামনে বালিয়াড়ির বিস্তৃতিটা কিছুটা উঁচু হয়ে সোজা নেমে গেছে সি-লেভেলে। এখানকার সৈকতের বিস্তৃতি খানিকটা সরলরেখায়। সৈকত জুড়ে সারি-সারি জেলে নৌকার সারি। সমুদ্রের দিকে মুখ করে চুম্বক শলাকার মতো শুয়ে আছে । রোদে শুকোচ্ছে মাছ ধরার জাল। সেই সঙ্গে টোটাল পরিবেশটা জুড়ে আছে একটা আঁশটে গন্ধ। আর বালিয়াড়ির পিছনে সবুজের নিবিড় সন্নিবেশ। সৈকত জুড়ে সীমাহীন ঢেউয়ের মস্তানি। রোদ থাকলেও বাতাসে একটা শীতল অনুভূতি। দু’একজন স্নানার্থী চোখে পড়ছে। তবে উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে এখানে স্নান করার ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো।
সমুদ্রকে বাঁদিকে রেখে বালুজমি ধরে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাই। কিছুটা দূরেই শুরু হয়েছে জেলেদের পাড়া। বালিয়াড়ি জুড়ে কিছু অস্থায়ী দোকানপাট। সেই সব দোকানে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা-মিঠে আম। আছে আনারসের মতো কাটা ফলও। বিকেলে এখানে স্থানীয় মানুষজনদের ভিড় হয় ভালোই।
সমুদ্র সৈকতের অদূরেই রয়েছে এক দরগা। চলে এলাম সেই সৈয়দ মহম্মদ শরীফুল মাদানী দরগায়। দরগা ও সংলগ্ন মূল ফটকের নান্দনিক সৗন্দর্য অসাধারণ। দরগা লাগোয়া প্রসস্ত চত্বর দেখেই বুঝে যাই এখানে একসঙ্গে বহু ধর্মপ্রাণ মানুষজন নামাজ পড়তে পারেন। মহিলাদের প্রবেশের ক্ষেত্রেও কোনও বাধা নেই দেখলাম। ফেরার পথে রেল স্টেশনের সন্নিকটে দেখে নিলাম মিলাগ্রেস চার্চ। শোনা যায় বিশপ থমাস এই রোমান ক্যাথালিক চার্চটি তৈরি করান। বিকালে গিয়েছিলাম পানাম্বুর সৈকতে। সাগর তীরে সূর্যাস্ত দেখে হোটেলে ফিরলেও, অনেক স্পটই এ যাত্রায় আর দেখা হল না।
কীভাবে যাবেন – কলকাতা থেকে সরাসরি ম্যাঙ্গালোর পৌঁছোতে ধরুন সাঁতরাগাছি ম্যাঙ্গালোর সাপ্তাহিক বিবেক এক্সপ্রেস। অন্যথায় চেন্নাই, বেঙ্গালুরু অথবা মহীশূর থেকেও ম্যাঙ্গালোরের ট্রেন মিলবে। চেন্নাই থেকে পাবেন চেন্নাই ম্যাঙ্গালোর সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস। বেঙ্গালুরু বা মহীশূর থেকে পাবেন যশোবন্তপুর-কুন্নুর এক্সপ্রেস এবং যশোবন্তপুর-কারওয়ার এক্সপ্রেস। মাদিকেরি থেকে ১৩৬ কিমি দূরে ম্যাঙ্গালোর। মাদিকেরি ঘুরে ম্যাঙ্গালোর গেলে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়াই সুবিধা। অন্যথায় এই পথে সরকারি বাস মিলবে অহরহ।