মোবাইল ফোনটার তীব্র আওয়াজে, ঘুমটা ভেঙে গেল শ্রীরাধার। কোনও রকমে চোখ খুলে জানলার বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল সে। না, এখনও খুব দেরি হয়ে যাযনি। কাঁচা একটা আলোর রেখা ঘরের মেঝেতে প্রবেশ করে, গ্রিলের জ্যামিতিক ছাযা আলপনার সৃষ্টি করেছে। সুজিতও উঠে বসেছে বিছানায়।
শ্রীরাধা ফোনটা ধরতে গিয়ে মোবাইলে দেখল পৌনে ছটা বাজে।
হ্যালো
শ্রীরাধা মিত্র বলছেন?
হ্যাঁ, কে কথা বলছেন?
আমি কানপুর আইআইটির হোস্টেল থেকে বলছি।
হ্যাঁ বলুন, কী ব্যাপার?
প্রশান্ত বসু আপনার কে হয়?
ভাই। কেন? কী হয়েছে প্রশান্তর? উদ্বেগটা লুকোতে পারে না শ্রীরাধা। সুজিতও কিছু বুঝতে না পেরে অধৈর্য হয়ে তাকিযে আছে তার দিকে, অনেক প্রশ্ন নিয়ে। এবার একটু থেমে ওপারের কণ্ঠস্বর একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল,
আজ সকালে ঘরে ঢুকে দেখি উনি সুইসাইড করেছেন।
সে কি!
প্রায় চিৎকার করে ওঠে শ্রীরাধা। ফোনটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তার অবস্থা দেখে সুজিত ফোনটা কেড়ে নিয়ে বাকি কথা শোনে। তারপর বলে,
ঠিক আছে, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাওয়ার চেষ্টা করছি।
ডুকরে ডুকরে কাঁদতে শুরু করে শ্রীরাধা। তাদের ৯ বছরের ছেলে জিৎ-ও উঠে বসেছে মাযের কান্না শুনে। ঘুম ভেঙেই এরকম একটা দৃশ্য দেখে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেছে সে। শ্রীরাধার পিঠটা কান্নায ফুলে ফুলে উঠছে। সুজিত তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
সত্যি বলতে কী, এই ঘটনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না শ্রীরাধা। প্রশান্ত তার নিজের ভাই নয কিন্তু নিজের ভাইযের চেয়ে বেশি আপন। বহরমপুরে তার বাপের বাড়ির সরকারি কোযার্টারে পাশাপাশি থাকত তারা। প্রশান্তর মা স্বামীহারা হওয়ার কারণে স্বামীর চাকরিটা পেয়েছিলেন। ওই কোযার্টারেই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। শ্রীরাধার কোনও ভাই-বোন ছিল না। প্রশান্তকেই ছোটো থেকে ভাইফোঁটা দেওয়া, রাখি পরানো, পুজোয জামাকাপড় দেওয়া এসব চলত। দুই বাড়ির মধ্যে অন্তরঙ্গতা এমন ছিল যে, কেউ বলে না দিলে বোঝা সম্ভব ছিল না, এরা পরস্পরের প্রতিবেশী। নিকট আত্মীযের মতোই ছিল এই পারিবারিক সম্পর্ক।
প্রশান্ত তার চেয়ে প্রায় আট বছরের ছোটো হলেও, শ্রীরাধা তার সঙ্গে খেলাধুলো করেই বড়ো হয়েছে। ছোটো থেকেই পড়াশোনায় দারুণ ভালো প্রশান্ত। ক্লাসে কখনও দ্বিতীয হয়নি। শ্রীরাধা নিজে অত ভালো ছাত্রী না হলেও, ভাই-কে নিয়ে তার গর্বের শেষ ছিল না। ভাইয়ের পাওয়া মেডেল নিয়ে সারা স্কুলে ঘুরে বেড়াত প্রশান্তর কৃতিত্ব তুলে ধরার জন্য।
বিয়ে হয়ে কানপুরে চলে আসার পরও, ভাইযের জন্য ভীষণ মন কাঁদত শ্রীরাধার। ঈশ্বর হয়তো সেই কষ্টের কথা ভেবেই ভীষণই মেধাবী ছাত্র প্রশান্তকে একটা সুবর্ণ সুযোগ করে দিলেন। অল ইন্ডিয়া জয়েন্ট-এ দারুণ রেজাল্ট করল প্রশান্ত এবং আইআইটি কানপুরে ইঞ্জিনিযারিং পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল।
দিনটা আজও মনে আছে। খবরটা পাওয়া মাত্র, শ্রীরাধা ফ্ল্যাটের সকলকে মিষ্টি খাইযে এসেছিল। ভর্তি হওয়া ইত্যাদির প্রক্রিযা চলাকালীন প্রশান্ত আর তার মা রুবিমাসি, শ্রীরাধার ফ্ল্যাটে এসে কদিন ছিলেন। শ্রীরাধা অনেকবার বলেছিল প্রশান্তকে, হোস্টেল-এ ঘর নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু শ্রীরাধার ছোটো ফ্ল্যাটে অসুবিধা হবে ভেবে, কিছুতেই রাজি হয়নি প্রশান্ত। তবে ছুটিছাটা পেলেই সে চলে আসত তার রাধাদিদির কাছে। দুজনে জমিযে আড্ডা দেওয়া, সিনেমা দেখা এসবও বহুবার হয়েছে।
আজ খবরটা পাওয়ার পর কিছুতেই যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না শ্রীরাধা। এত ব্রিলিযান্ট একটা ছেলে, কেন নিল এরকম সিদ্ধান্ত! কী ছিল তার মনে? কেন একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি শ্রীরাধা! চোখের জল বাধা মানছে না। রুবিমাসিকে কীভাবে খবরটা দেবে, সেটাও ভেবে পাচ্ছে না। দিশাহারা অবস্থাটা কীভাবে সামলাবে যখন বুঝতে পারছে না, তখন সুজিত ধীর স্বরে বলল,
রাধা ওঠো তৈরি হয়ে নাও। আমাদের তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছনো দরকার।
সম্বিত ফিরল শ্রীরাধার। সত্যিই তো এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। তাকে শক্ত হতেই হবে। অনেকগুলো কাজ বাকি। বডি পুলিশ নিয়ে যাবে মযনাতদন্তের জন্য। হোস্টেল থেকে প্রশান্তর জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হবে। ঘর ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিছু ফর্মালিটিজ আছে। খাতায-কলমে তারাই প্রশান্তর লোকাল গার্জেন। কিন্তু সবচেয়ে আগে ফোন করা দরকার রুবিমাসিকে। তারপর ফোন করা দরকার আরও একজন-কে। সুমনা। প্রশান্তর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা একমাত্র শ্রীরাধাই জানত। কে জানে, খবরটা শুনে কী অবস্থা হবে মেয়েটার। একটু নিজেকে সামলে নিয়ে রুবিমাসির নম্বরটা ডাযাল করে শ্রীরাধা।
আধঘন্টা পর হোস্টেল-এ পৌঁছে দেখে ভিড়ে ভিড়াক্কার। সহপাঠী, শিক্ষক সকলেই জমাযেত হয়েছেন সেখানে। প্রশান্তর বডিটা শোযানো আছে হোস্টেল-এর বড়ো দালানটায। শ্রীরাধা আর সুজিতকে দেখে এগিয়ে এলেন মেট্রন। বললেন প্রশান্তর খাটের উপর একটা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। লেখা তার মৃত্যুর জন্য কেউ দাযী নয। সে স্বেচ্ছায এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কথাগুলো শুনতে শুনতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শ্রীরাধা। প্রশান্ত শুযে আছে মাটিতে। চোখ বোজা, কেউ বলবে না দেখে যে তার দেহে আর প্রাণ নেই। শ্রীরাধাকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সুজিত। শ্রীরাধা বসে পড়ে মেঝেতে। জ্ঞান হারায। পুলিশ, পোস্টমর্টেম, জিজ্ঞাসাবাদ এই পর্বগুলো সুজিতই সামলায। রুবিমাসির কাছে এই মর্মান্তিক খবর পেঁছোনোর পর, তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে দাহকর্ম সুজিতকেই সারতে হয়।
দিন দুযেক পরের কথা, রুবিমাসি আজ কানপুর পৌঁছবেন। সকালে উঠেই সুজিত স্টেশনে গেছে তাঁকে আনতে। শ্রীরাধা খাবার টেবিলে বসে ভাবছে, কীভাবে ফেস করবে রুবিমাসিকে। এই ঘটনা যে তাঁরও কল্পনার অতীত। জিৎ একটা খেলনা রেলগাড়ি নিয়ে সারা ঘরে হুটোপাটি করছিল। ঠাস করে তার গালে একটা চড় লাগিয়ে দেয শ্রীরাধা। কোনও কিছুই তার ভালো লাগছে না যেন। চোখের সামনে খালি ভাসছে প্রশান্তর মুখটা। কী ভেবেছিল প্রশান্ত, গলায ফাঁস লাগানোর ঠিক আগের মুহূর্তটায? কেন সে একটিবার তার রাধাদিদি-কে ফোন করল না, চরম সিদ্ধান্তটা নেওয়ার আগে?
ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল কলিংবেল-এর আওয়াজে। রুবিমাসি এসে ঢুকলেন সুজিতের হাত ধরে। এই দুটো দিনে যেন আরও অনেকটা বযস বেড়ে গেছে তাঁর। মনের উপর দিযে যে-ঝড় বযে গেছে, তার ছাপ স্পষ্ট তাঁর চেহারায। শ্রীরাধা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। রুবিমাসিকে জড়িযে ধরতেই দুজনে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। রুবিমাসিকে জোর করে আটকে রেখেছে শ্রীরাধা। রুবিমাসির প্রেশার ফল করেছিল দিন দুযেক আগে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেন না। শুধু জানলার বাইরে তাকিযে থাকেন শূন্য দৃষ্টি মেলে। জিৎ অনেকবার বায়না ধরেছে তাঁর কাছে গল্প শোনার। কিন্তু রুবিমাসি যেন আর সেই আগের মানুষটা নেই। ক্রমশ যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছেন। প্রশান্তর হোস্টেল থেকে আসা জিনিসগুলো জড়িযে ধরে মাঝেমধ্যেই কাঁদেন, তারপর আবার কেমন যেন গুম মেরে যান।
একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খায় শ্রীরাধাকে। কেন সে আরও একটু সজাগ হয়নি তার ভাইযের ব্যাপারে? গত দুসপ্তাহ প্রশান্ত আসেনি তার কাছে? কেন শ্রীরাধা নিজে চলে যাযনি হোস্টেল-এ তার সঙ্গে দেখা করতে? জিতের পরীক্ষার মতো তুচ্ছ কারণ তাকে কেন আটকে রাখল! যদি সে একবার জানতে পারত প্রশান্তর মনের কথা, তাহলে হয়তো রোকা যেত এই মর্মান্তিক ঘটনা।
আজ সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুজিত অফিস বেরোনোর পর, তাড়াতাড়ি করে সব রান্নাবান্না সেরেছে। তার পরিকল্পনা আছে, দুপুরে রুবিমাসি আর জিৎ-কে খাইযে ঘুমোতে বলে, সে একবার সুমনার সঙ্গে দেখা করে আসবে। দশটা দিন হয়ে গেল, মেযেটা কীভাবে এই শোক সামলাচ্ছে কে জানে। কে বলতে পারে, হয়তো সুমনা বলতে পারবে প্রশান্তর আত্মহত্যার আসল কারণ।
একটা কফি শপে ঢুকে জানলার পাশে চেযারে গা এলিয়ে বসল শ্রীরাধা। মোবাইলে সুমনার সঙ্গে কথা হয়েছে। সে অটোতে আসছে। এসে পড়বে মিনিট পাঁচেকের ভেতর। এই অবসরে নিজেকে একটু গুছিযে নেওয়ার চেষ্টা করে শ্রীরাধা। ওযেটারকে দুটো ক্যাপিচিনো আর কিছু কুকিজ-এর অর্ডার দিযে জানলার বাইরে তাকাতেই দেখে সুমনা আসছে। কটা দিনে আরও যেন শীর্ণ হয়ে গেছে সে। একটু অন্যমনস্কও হয়ে গেছে। অনেকটা সময় নিল রাস্তা পার হতে। তারপর কফি শপের কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে এসে শ্রীরাধার উলটো দিকের চেযারটা টেনে বসল।
মুখ নীচু করে টেবিলে আঙুল দিযে আঁকিবুঁকি কাটতে লাগল সুমনা। শ্রীরাধাও কিছুতেই কথা শুরু করতে পারছিল না। সুমনার হাতটা চেপে ধরতেই সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
কী সব হয়ে গেল বলতো সুমনা!
কথাটা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে শ্রীরাধার। সুমনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও ভাষা নেই। কফি দিতে আসা ওযেটার একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি কাপগুলো আর কুকিজ-এর প্লেটটা নামিযে রেখে চলে গেল।
সুমনা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। শ্রীরাধা কফিতে চুমুক দিযে বলল, সুমনা, কী হয়েছিল ওর তুই কিছু জানিস?
না রাধাদিদি। কিন্তু ও খুব বদলে যাচ্ছে এটুকু বুঝেছিলাম। ও খুব মেধাবী ছিল একথা সত্যি, না হলে এত ভালো প্রতিষ্ঠানে কী আর চান্স পায! কিন্তু ব্যাপারটা হল, এখানে ওর চেয়ে মেধাবী ছাত্র রয়েছে। একথা ও আমায মাঝেমধ্যে বলত। ওর কীসের ইনসিকিউরিটি আমি বুঝতে পারতাম না। ইদানীং বড্ড ডিপ্রেসড থাকত। দু-একজনের থেকে শুনেছি, মাঝেমধ্যে নাকি বুজিং করত। এক দুবার কোকেন-ও নিয়েছে।
কথাগুলো বলে আবার ফোঁপাতে লাগল সুমনা। একটু সামলে নিয়ে বলল, ইদানীং আমাকেও অ্যাভয়েড করছিল গো দিদি। আমি কতবার জানতে চাইলাম ক্যাম্পাসিং-এ কী হল, কিছুতেই বলল না আমায়। অথচ তুমি তো জানো রাধাদিদি, ও একটা ভালো চাকরি পেলে আমরা বিয়ে করব ভেবেছিলাম। সব এলোমেলো করে চলে গেল ও।
সুমনাকে জড়িযে ধরে একটু সামলানোর চেষ্টা করে শ্রীরাধা। সত্যি বলতে কী, প্রশান্তর এভাবে চলে যাওয়াটা ওরা দুজনের কেউই অ্যাকসেপ্ট করতে পারছিল না। পারবেও না কোনওদিন।
আরও দিন দশেক কেটে গেছে। না, অনেক চেষ্টা করেও সুমনার থেকে শোনা কথাগুলো রুবিমাসিকে বলতে পারেনি শ্রীরাধা। রুবিমাসি আগের চেয়ে খানিকটা শোক সামলালেও, এখনও হঠাৎ হঠাৎ কীরকম যেন লস্ট হয়ে থাকেন।
সেদিনও এভাবেই বসেছিলেন। জিৎ এসে সমানে বাযনা করছে, দিদুন আমার সঙ্গে একটু লুডো খেলো না দিদুন। প্লিজ খেলো না।
দুদুবার জিৎ-কে সরিযে দিয়ে, শেষে একটু বাধ্য হয়ে নিমরাজি হলেন রুবিমাসি।
যা আমার চশমাটা নিয়ে আয়।
জিৎ পরম উৎসাহিত হয়ে চশমা আর লুডোর ঘুঁটি নিয়ে চলে এল বারান্দায। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হল সাপ-লুডো খেলা। দিদুনের লাল ঘুঁটি একবার সাপের মুখে পড়ে, তো জিতের নীল একবার ধরাশাযী। শ্রীরাধা ডাস্টিং করতে করতে আড়চোখে ওদের খেলা দেখতে দেখতে মুখ টিপে হাসে। এভাবেই খেলা এগোতে এগোতে একসময় জিতের ঘুঁটি ৯৯-এর ঘরে পৌঁছে, একটা বিরাট সাপের মুখে পড়ল। এমন দীর্ঘ সেই সাপ যে, তার লেজের শেষটা এসে পৌঁছেছে ৩-এর ঘরে। জিৎ অমনি কান্না জুড়ে দিল, না না আমি আবার চাল দেব। আমি সাপের মুখে পড়ব না…
রুবিমাসি তাকে দৃঢ় ভাবে বললে্ন, না, তোমার ঘুঁটিকে নীচে নামতেই হবে। আমি ওটা হতে দেব না।
শুরুতে বিষযটাকে আমল দেযনি শ্রীরাধা কিন্তু রুবিমাসি ওরকম অস্বাভাবিক জেদই-বা করছেন কেন একটা ৯ বছরের বাচ্চার সঙ্গে সেটা কিছুতেই মাথায ঢুকল না তার। শেষে জিৎ কান্না শুরু করেছে দেখে, শ্রীরাধা বাধ্য হয়ে বলল,
ওকে আবার চাল দিতে দিন না মাসি। বাচ্চার জেদ, শুধু শুধু কান্নাকাটি করছে।
এবার বেশ জোরের সঙ্গে বলে ওঠেন রুবিমাসি, না রাধা। ওকে বুঝতে হবে হারের মানে। জীবন মানে তো শুধু জেতা নয। হেরে যাওয়াও।
কিন্তু মাসি ও তো একটা শিশু। এই বয়সেই…
আমায ভুল বুঝো না রাধা। আমার ছেলে স্কুলে কখনও দ্বিতীয হয়নি, সেটা তুমি জানো। কিন্তু ও কেন আত্মহত্যা করল তুমি জানো?
এবার চমকানোর পালা শ্রীরাধার। সে অবাক চোখে তাকিযে আছে রুবিমাসির দিকে। রুবিমাসি সরাসরি তাকিযে আছেন তার চোখে। রুবিমাসির চোখ দিযে জল গড়িয়ে পড়ছে। গলাটা কেঁপে যাচ্ছে কথা বলতে গিয়ে, রাধা, ও আমায় মারা যাওয়ার একদিন আগে একটা মেইল করেছিল। লিখেছিল, আমি হেরে যাচ্ছি মা। ক্যাম্পাসিং-এ ভালো কোনও কোম্পানিতে চাকরি হয়নি আমার। অথচ এখানে অনেকেই অনেক ভালো ভালো জব অফার পেল।
চোখ মুছলেন রুবিমাসি। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, রাধা ও হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারছিল না। কারণ ছোটো থেকে আমি কখনও ওকে হারতে দিইনি। ও ওর বাবা আর আমার সঙ্গে সাপ-লুডো খেলতে বসলে, ওকে আমরা জিতিয়ে দিতাম। সব কিছুতে জিতে যাওয়ার সুবিধা ও পেয়েছে। কিন্তু হারতে কেমন লাগে ওকে শেখাইনি। আজ তাই মাশুল দিতে হল আমায় রাধা। আঁচলে মুখচাপা দেন রুবিমাসি।
শ্রীরাধা তাঁর পিঠে হাত রাখে। সে বুঝতে পেরেছে খেলার মধ্যে দিযে সঠিক শিক্ষাটাই জিৎ-কে দিতে চাইছিলেন রুবিমাসি।
সাপ-লুডোর মই বেয়ে প্রশান্তর উত্থানটাও সে চোখের সামনে দেখেছে। কিন্তু প্রথম একটা সাপের মুখে পড়ার ক্রাইসিস সামলাতে পারল না প্রশান্ত। সে হেরে গেল। পালিয়ে গেল এই জীবন থেকে। নেশার কবলে পড়ে আর ও হেরে যেতে চাইছিল না বলেই, হয়তো এই চরম পথটা বেছে নিল।
জিৎও কিছুটা থতমত। খেলাটা যে শেষ হয়ে গেছে সে বুঝতে পেরেছে। নতুন করে বোর্ড সাজাচ্ছেন রুবিমাসি। এবার সবুজ ঘুঁটি নিয়ে শ্রীরাধাও খেলায় যোগ দিল।