পৃথা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১২টা বাজে। মিহির এখনও এসে পৌঁছল না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল পৃথা। কিছুক্ষণ আগে পৃথা যখন মিহিরকে ফোন করেছিল, তখন উত্তর পেয়েছিল, দিস নাম্বার ইজ নট রিচেব্ল। এত দেরি তো করে না মিহির! আজ যে কী হল! কোনও দুর্ঘটনায় পড়েনি তো? নট রিচেব্ল কেন বলছে? চিন্তায় পড়ে যায় পৃথা।
শুধু খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথার। খুব ঘাবড়ে যায় সে। কারণ, এই শহরটা তার কাছে নতুন। সে প্রায় কাউকেই চেনে না। কার সাহায্য নেবে ভেবে ঠিক করতে পারছে না। বাপের বাড়ির শহর কলকাতা হলে, সে এতক্ষণে দুচারজনকে ডেকে নিয়ে সাহায্য চাইত।
আসলে, মিহিরের সঙ্গে বিয়ে হওযার পর দিল্লি চলে আসে পৃথা। একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে সেল্স এগ্জিকিউটিভ হিসাবে কাজ করে মিহির। তা প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল মিহির এবং পৃথা দিল্লিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ওরা এখনও মা-বাবা হয়নি। বিয়ের পর ওরা এখনও গোল্ডেন টাইম পাস করছে। এবার হয়তো দুই থেকে তিনজন হওযার প্ল্যান করবে।
অফিস কলিগ ছাড়াও, মিহিরের অনেক বন্ধু আছে দিল্লিতে। তাদের সঙ্গে সন্ধেবেলা আড্ডাও মারে মিহির। কিন্তু দেরি হলে ফোন করে জানিয়ে দেয়। আজ যে কী হল… ভাবতে থাকে পৃথা।
অনেক সময় অবশ্য অফিস-এ বস্-এর সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে দেরি হয়। আর দেরি হলেই এসে নানা অজুহাত দেবে। কখনও বলবে, বস্ আমাকে একটা জরুরি কাজ করতে দিলেন অফিস ছুটির সময়। কোনও দিন হয়তো বলবে, আজ বস্-এর সঙ্গে কফি শপ-এ গিয়ে কফি খেতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
মিহিরের কাজের প্রতি একাগ্রতা এবং অনেস্টির জন্য যে, মিহিরকে কিছুটা বেশি গুরুত্ব দেন ওর বস্, এটা জানে পৃথা। শুধু এটুকুই নয়, মিহিরের বস্-এর সম্পর্কে পৃথা জেনে গেছে আরও অনেক কিছু। মেয়েদের নিয়ে শপিং-এ যাওইয়া, ককটেল পার্টিতে যাওয়া, এসবও যে-বেশ পছন্দ করেন মিহিরের বস্, এসবও পৃথা জেনেছে মিহিরের মাধ্যমে। আসলে পৃথা এবং মিহির স্বামী-স্ত্রী হলেও, বন্ধুর মতো। তাই মিহির মজা করে পৃথাকে অনেকবার-ই বলেছে, পৃথা, তুমি তো একদিন শপিং-এ যেতে পারো আমার স্যার-এর সঙ্গে, তাহলে আমার ভালো প্রোমোশন হতো। এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মোটর বাইকের শব্দ শুনতে পেল পৃথা। ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজার আইহোল-এ চোখ রাখতেই পৃথা দেখতে পেল, মিহির এসে গেছে। এবার নিশ্চিন্ত হল সে এবং দরজা খুলে দাঁড়াল।
মোটরবাইক রেখে মিহির ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পৃথা-র উদ্দেশ্যে বলল, খুব কাজের চাপ ছিল, ফোন করতে পারিনি, সরি। খুব খিদে পেয়েছে, খাবার রেডি করো, ফ্রেশ হয়ে আসছি।
ডিনার-এর সময় মিহির পৃথাকে জানাল, কাল আমাদের মুম্বই অফিস থেকে কয়েকজন স্টাফ আসবে। বস্-কে নিয়ে সবাই শপিং-এ যাবে। বাড়ির বউদের জন্য শাড়ি কিনবে সবাই। আমরা কেউ শাড়ি চিনি না। প্লিজ, তুমি একটু আমাদের সঙ্গে যাবে শপিং-এ?
মিহিরের কথা শুনে পৃথা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এতগুলো পুরুষ মানুষের সঙ্গে একা যেতে ওর মন চাইছে না। আবার ভাবল যে, মিহির অবশ্য সঙ্গে থাকবে। তাই, কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে হ্যাঁ বলে দিল পৃথা।
পরের দিন বিকেল পাঁচটার সময় ফোন এল মিহিরের। পৃথা তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। ঠিক তিরিশ মিনিট বাদে আমরা তোমাকে গাড়িতে তুলব।
পৃথা রেডি হয়ে ব্যাগটা নেবে, এমন সময় ডোরবেল বাজল।
দরজা খুলল পৃথা।
আসুন স্যার ভেতরে, বলেই মিহির ড্রইং-রুম-এ এনে বসাল অভিজিৎবাবুকে।
পৃথা একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। মিহির ওর দিকে ঘুরে বলল, কাম হিযার পৃথা, আলাপ করিয়ে দিই আমার বস্ মিস্টার চ্যাটার্জী। আর স্যার, ও পৃথা, আমার স্ত্রী।
পৃথা এবং মিস্টার চ্যাটার্জী দুজনেই নমস্কার বিনিময় করলেন। হঠাৎ পৃথা-র কেমন যেন চেনা মনে হল ভদ্রলোককে। মিস্টার চ্যাটার্জীও পৃথাকে দেখে কেমন যেন চমকে গেলেন। তাঁরও যেন খুব চেনা মনে হল পৃথাকে। এভাবেই কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। তারপর মিস্টার চ্যাটার্জীই পৃথাকে প্রশ্ন করলেন, আরে তুমি সেই পৃথা না…? হাসপাতালে আলাপ হয়েছিল। মনে আছে, তোমার বাবা আর আমার বাবা একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন? হাসপাতালের ওয়েটিংরুম-এ আলাপ হয়েছিল আমাদের। একই দিনে আমাদের দুজনেরই বাবা মারা গিয়েছিলেন!
পৃথা-র সব মনে পড়ে যায়। কিন্তু সেও তো প্রায় দশ বছর আগের কথা। পৃথা এবার মিস্টার চ্যাটার্জীর উদ্দেশ্যে বলে, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনি তো অভিজিৎ তাই না?
এগ্জ্যাক্টলি। তোমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো দেখছি, এখনও আমার নামটা মনে রেখেছ?
পৃথা এবং মিস্টার চ্যাটার্জী পরস্পরের চেনা দেখে বেশ খুশি হল মিহির। এবার সে সত্যিই ভাবতে শুরু করল, বস্ তার প্রতি এবার আরও সদয় হবেন এবং ওর প্রোমোশনও হবে।
আরও দু-চারটে বাক্য বিনিময়ের পর, ওরা তিনজনে গাড়িতে উঠল। ড্রাইভিং সিটে ছিলেন মিস্টার চ্যাটার্জী। তাঁর পাশে বসেছিল মিহির এবং পৃথা বসেছিল পিছনের সিটে। তারা তিনজনই তিন রকম ভাবনায় ডুবে ছিল। মিহির ভাবছিল, পৃথা এবং তার বস্-এর মধ্যে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক ঠিক কতটা এগিয়েছিল? আর পৃথা ভাবছিল সেই ফেলে আসা দিনগুলির কথা।
অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাসপাতালে যখন আলাপ হয়েছিল, তখন সে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি, ভালো ছবি আঁকত সে। একটা বড়ো আঁকার স্কুলে ভর্তিও হয়েছিল। ওখানে আবার দেখা হয়ে গিয়েছিল অভিজিতের সঙ্গে। অভিজিৎ যেমন ভালো ছবি আঁকত, তেমনই ভদ্র এবং বিনয়ী ছিল। তাই, অভিজিতের প্রতি একটা বাড়তি আকর্ষণ ছিল পৃথার কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেনি। হয়তো অভিজিত্ও পছন্দ করত পৃথাকে কিন্তু সেও মুখ ফুটে কখনও বলতে পারেনি। তাই আজ দশ বছর পর আবার দেখা হয়ে যেতেই পৃথা একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। আবার পরক্ষণেই ভাবতে থাকে, তার দুর্বল হওযা উচিত নয়। কারণ, তার বিবাহিত জীবন সুখের। মিহির ভালো ছেলে। বন্ধুর মতো। তাই সে পুরোনো দিনের সব কথা মিহিরকে সময় মতো বলবে ঠিক করে।
আবার অভিজিৎ ভাবতে থাকেন, আঁকার স্কুলেও যে পৃথার সঙ্গে অনেকগুলি দিন পাশাপাশি কাটিয়েছেন, তা তো মিহিরের সামনে বলা গেল না। যাইহোক, এর মধ্যে পৃথা আবার ভাবতে থাকে, মিহির তার বস্ অভিজিতের সম্পর্কে যেমনটা বলেছে অর্থাৎ, অভিজিৎ ভালো কিন্তু মহিলাদের সঙ্গে শপিং করতে ভালোবাসেন, ককটেল পার্টি-তে যান, এসব যেন মেলাতে পারছে না পৃথা। কারণ সে জানে অভিজিৎ অত্যন্ত নম্র ভদ্র একজন মানুষ, যে-মেয়েদের চোখের দিকে সরাসরি তাকাতও না। গাড়িতে বসে এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পৃথা মৌনতা ভেঙে প্রশ্ন করে অভিজিৎকে, ছবি আঁকা এখনও জারি আছে তো?
ওটা তো আমার প্রাণ। একদিন মিহিরকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসো, সব দেখতে পাবে। তবে, আগের মতো রেগুলার আর আঁকা হয় না।
এসবের মধ্যে মিহির হঠাৎ বলে উঠল, স্যার, আমরা তো শপিংমল পিছনে ফেলে এসেছি।
মিহিরের কথা শুনে গাড়ির ব্রেক কষলেন অভিজিৎ। তারপর বললেন, নো প্রবলেম। বরং ভালোই হল। এখানে গাড়িটা ভালো ভাবে, নিশ্চিন্তে পার্ক করা যাবে। শপিংমল-এর পার্কিং খুব বাজে, বেরোতে সময় লেগে যায়। আর এইটুকু তো রাস্তা। আমি আর পৃথা হেঁটে মল-এর দিকে এগোচ্ছি। তুমি গাড়িটা পার্ক করে এসো।
মিহির গাড়ি পার্ক করতে চলে গেল বস্-এর কথামতো। আর অভিজিৎ এবং পৃথা পাশপাপাশি হাঁটতে শুরু করল। এমন সময় হঠাৎই অভিজিতের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোনে কথা যখন শেষ হল, তখন ওরা পৌঁছে গেছে শপিং মল চত্বরে। কথা শেষ করে অভিজিৎ জানালেন পৃথাকে, মুম্বই থেকে আসা আমাদের কলিগরা আর শপিং করতে আসতে পারবে না, কাজে আটকে গেছে। চলো পৃথা, মিহির না আসা পর্যন্ত ওই সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসি।
এক সময় অভিজিৎ ক্রাশ ছিল পৃথার, তবুও আজ এতদিন পর অভিজিতের পাশে বসতে কেমন যেন একটু বাধো বাধো লাগছে তার। কারণ, সে এখন মিহিরের স্ত্রী, সুখের দাম্পত্য। অবশ্য এসব ভাবনার মধ্যেও সে কখন যেন বসে পড়েছে অভিজিতের পাশে।
কয়েক সেকেন্ড দুজনে চুপচাপ বসে থাকার পর মুখ খুললেন অভিজিৎ, পৃথা, দেখা যখন হয়ে গেল এত বছর পর, আমার জীবনের কিছু না-বলা কথা শেয়ার করতে চাই তোমার সঙ্গে। আজ না বললে আর কোনও দিন হয়তো বলাই হবে না।
অভিজিতের কথা শুনে পৃথা একটু ঘাবড়ে যায়। আজ এতদিন বাদে অভিজিতের মনের কথা শোনার পর সে যদি নতুন করে অভিজিতের প্রতি কোনও টান অনুভব করে, তাহলে তো মিহিরের সঙ্গে তার মনের দূরত্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু অভিজিতের কথা না শুনেও তো উপায় নেই, আফটার অল তিনি তো মিহিরের বস্। বস্ রেগে গেলে কর্মক্ষেত্রে মিহিরের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে যদি মিহির এসে পড়ে? এমনই কিছু ভাবনা যখন ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথার মনে, ঠিক তখনই আবার অভিজিতের ফোনটা বেজে উঠল।
ফোনে কথা বলার পর অভিজিৎ পৃথাকে জানালেন, মিহিরের ফোন। আমাদের এক কলিগের-এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে পার্কিং এরিযায়, তাই মিহিরের আসতে একটু সময় লাগবে জানাল।
মিহিরের দূরভাষ বার্তার পর অভিজিৎ এবং পৃথা দুজনেই হয়তো একটু নিশ্চিন্ত বোধ করল। তারপর অভিজিৎ পৃথা-কে বলতে শুরু করলেন, জানো পৃথা, চার বছর আগে আমি বিয়ে করেছিলাম। আমার স্ত্রীর নাম ছিল বিদিশা। খুব সুন্দরী ছিল। আমি খুব ভালোবাসতাম তাকে।
বিদিশা একা থাকত। বলেছিল, ওর মা-বাবা মারা গেছেন। টিউশন করে নিজের এবং ভাইবোনের লেখাপড়া-সহ সমস্ত দায়িত্ব বহন করত বলেই, শুনেছিলাম ওর থেকে। আমাদের এক ক্লাইয়েনট-এর অফিস-এ কাজ পেয়েছিল পরে। ওখানেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। ওর দুঃখ-কষ্টের কাহিনি শুনিয়েছিল আলাপ পরিচয়ের পরে। বিয়ের আগে প্রায়ই আমাকে বলত, অভিজিৎ, আই লভ ইউ ফ্রম দ্যা কোর অফ মাই হার্ট। শুধু তাই নয়, বিদিশা আমাকে বলেছিল, এত খেটে, কষ্ট করে আর আমি পারছি না, বিয়ে করে তুমি আমার কষ্ট লাঘব করো প্লিজ। ওর এই কথা শোনার পর আমি আর দেরি করিনি, ওকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলাম।
বিয়ের আগে বিদিশার সঙ্গে পরিণয়-পর্বে আমার বন্ধুস্থানীয় দুতিনজন আমাকে বলেছিল, বিদিশা ভালো মেয়ে নয়, সরে যাও ওর থেকে। কিন্তু তখন আমি কারওর কথা শুনিনি। কারণ, বিদিশাকে খুব বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পরই ধীরে ধীরে ওর আসল রূপ দেখাতে শুরু করে দিল। প্রায় দিনই নতুন নতুন পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করে গভীর রাতে মাতাল হয়ে ফিরত। বিরক্ত হয়ে যখন আমি প্রতিবাদ করতে শুরু করলাম, তখন বিদিশা জানিয়েছিল, ওটা ওর পার্সোনাল লাইফ, তাই যা-ইচ্ছে করবে। অবস্থা এক সময় এতটাই চরমে উঠেছিল যে, প্রায় দিনই হাত তুলত আমার গায়ে।
পৃথা অবাক হয়ে শুনে চলেছে তার পুরোনো বন্ধু কিংবা বলা যায় এক সময়ের ভালোলাগা মানুষটার দুঃখের কাহিনি। আর অভিজিৎ বলে চলেছিল, বিয়ের মাস পাঁচেক পর একদিন হঠাৎ বিদিশা জানাল, সে মুক্তি চায়, উড়তে চায় বাঁধনহারা হয়ে। আমার কোনও অসম্পূর্ণতা কিংবা অন্যায় না থেকেও, শুধু সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, চাহিদা মতো আমার থেকে মোটা টাকা নিয়ে ডিভোর্স দিয়েছিল বিদিশা। পরে জেনেছিলাম, আমি একা নই, আমার আগে প্রতারিত হয়েছিল আরও দুজন। আমি ছিলাম বিদিশার থার্ড হাজব্যান্ড।
এবার একটু থামলেন অভিজিৎ। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আমি একা ছিলাম একাই হয়ে গেলাম। নেশায় ডুবিয়ে রাখলাম নিজেকে। সিগারেট আর মদ আমার বন্ধু হয়ে উঠল। মনটা শূন্যতা আর হাহাকারে ভরে গেল। কখন যেন আমি আমূল বদলে গেলাম। মেয়েরা সুযোগ নিতে শুরু করল। শূন্যতা কাটানোর জন্য আমি মেয়েদের সঙ্গে ক্লাব-এ, বার-এ, পার্টিতে গিয়ে আকণ্ঠ মদ গিলতে শুরু করলাম আর নেশা চড়ে গেলে আমার গাড়ির ড্রাইভার-এর হাত ধরে বাড়ি এসে শুয়ে পড়তাম। মেয়েরা দু-একজন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইত কিন্তু বিদিশার মুখটা ভেসে উঠলেই আমায রাগ চড়ে যেত। সব মেয়ে সমান নয় জেনেও, কেমন যেন বিদিশার মতো মনে হতো সবাইকে। কাউকে টাচ করার ইচ্ছেও এখন হয় না আমার। শুধু একরাশ ঘৃণা জমে আছে মনের মধ্যে। কিন্তু তোমার মুখোমুখি হতেই আমি কেমন যেন সেই পুরোনো আমি-কে ফিরে পেলাম। তোমার আর মিহিরের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে ভালো লাগছে। কত বিশ্বাসে ভরা তোমাদের দাম্পত্য! এমনই থেকো তোমরা চিরকাল। আজ তোমাদের দেখে কেন জানি না শুধরে যেতে ইচ্ছে করছে, নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
পৃথার হঠাৎ চোখ পড়ে অভিজিতের চোখে। তার চোখ তখন জলে টইটুম্বুর। অভিজিতের ওই অবস্থা দেখে পৃথা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। মনের একটা স্তর বলছে, অভিজিতের মাথাটা ধরে নিজের কাঁধে রাখতে, আবার মনের অন্য স্তর মনে করিয়ে দিচ্ছে, সে মিহিরের বিশ্বাস, মিহিরের ভালোবাসা, মিহিরের স্ত্রী। তাই পৃথা আবেগ কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে যা ঘটেছে তা খুব বেদনাদায়ক। আমার খুব খারাপ লাগছে তোমার জন্য। কিন্তু এখন কী-ই বা করতে পারি আমি? বড়োজোর তোমার ভালো বন্ধু হতে পারি। তোমার যখন মন চাইবে ফোন করবে নির্দ্বিধায়। মিহির আমার হাজব্যান্ড হলেও, খুব ভালো বন্ধু। ওকে আমি সময় মতো সব বুঝিয়ে বলব। আমি নিশ্চিত, মিহির আমাকে সাপোর্ট করবে। আশাকরি, অফিসে তুমি ওর বস্ হলেও, বাইরে মিহির তোমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠবে। প্লিজ তুমি অবসর সময়ে আঁকায় মনোনিবেশ করো আবার। তোমার দুঃখ-যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলো ক্যানভাসে, প্লিজ…।
অসহ্য গরমের পর ঝেঁপে বৃষ্টি নামলে শরীরে এবং মনে যে-শান্তি আসে, পৃথার কথা শুনে অভিজিতেরও সেই অনুভতি হল হঠাৎ। এমন সময় আবার মিহিরের ফোন। ফোনটা রিসিভ করে মিহিরের কথা শোনার পর অভিজিৎ জানালেন, না, আমরা শপিং করিনি। মুম্বইয়ে কলিগরা কাজে আটকে গেছে, শপিং-এ আসতে পারবে না জানিয়েছে। আমরা তোমার জন্য মল-এর বাইরে বেঞ্চ-এ অপেক্ষা করছি। তুমি গাড়ি নিয়ে এসো।
এক সন্ধেবেলা মিহির বাড়ি ঢুকল হাসিমুখে। একটা প্রিন্টেড পেপার পৃথা-র হাতে দিয়ে বলল, দ্যাখো এটা, আমার প্রোমোশন লেটার।
পৃথা প্রোমোশনাল লেটারটি খুলে এক ঝলক দেখে বলল, বাহ্, দারুণ ব্যাপার, কনগ্র্যাচুলেশন্স।
স্যালারিও বেড়েছে অনেকটাই, বলেই পৃথাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মিহির।
পৃথা বলল, রেস্তেরাঁয় খাওয়াতে হবে কিন্তু।
চলো আজই যাব। রেডি হয়ে নাও। জানাল মিহির।
সত্যিই সেদিন পৃথাকে নিয়ে গিয়ে একটা বড়ো রেস্তোরাঁয় ডিনার করিয়েছিল মিহির। আর সেদিনের শপিং মল-এর বাইরের বেঞ্চে বসে যে-জীবনকাহিনি শুনেছিল অভিজিতের থেকে, রাতে মিহিরের পাশে শুয়ে সবটাই জানিয়েছিল পৃথা। সব শুনে মিহির বলল, স্যার-এর জীবনে যা ঘটেছে তা সত্যিই বেদনাদাযক। কিন্তু কী আশ্চর্য, স্যার-এর জীবনে যে-এত বড়ো ঝড় বয়ে গেছে, তা আমরা অফিসে এতটুকুও টের পাইনি। তাই, সব শুনে যেন অবিশ্বাস্য লাগছে।
এটাই সত্যি। তাই, তোমাদের বস্ মহিলাদের সঙ্গে ককটেল পার্টিতে গেলেও, একটা চাপা ঘৃণার ভাব রয়েছে মহিলাদের প্রতি। কারণ, সব মেয়েকে দেখে এখন তাঁর, স্ত্রী বিদিশার মতো প্রতারক মনে হয়। আমি পুরোনো বন্ধু বলেই হয়তো তাঁর ধারণা কিছুটা হলেও বদলাতে পেরেছি। কথাগুলো মিহিরকে জানাল পৃথা।
একটু থামার পর পৃথা মিহিরকে বলল, একটা কথা বলব?
হ্যাঁ, বলো…
যদি তুমি অনুমতি দাও তো আমি তোমার বস্-এর সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে কিছু কথা বলব, মানুষটা বড়ো একলা। আমি কথা বললে তোমার খারাপ লাগবে না তো?
পৃথার কথার উত্তরে মিহির জানাল, দ্যাখো, তুমি আমার স্ত্রী। আমরা ভালো বন্ধুও পরস্পরের। আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস এবং ভালোবাসা রয়েছে। তোমার উদ্যোগে যদি আমার বস্-এর জীবনে কোনও পরিবর্তন আসে, তাহলে আমার ভালো লাগবে। বন্ধু হিসাবে তোমাকে ভরসা করে তিনি যখন সবকিছু জানিয়েছেন, তাই তুমি যদি দশটা কথা বলে কাউন্সেলিং করো, তাহলে আমি কেন মন খারাপ করব? এতে আমার পূর্ণ সম্মতি রইল।
মিহির তার প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা রাখার জন্য খুব ভালো লাগল পৃথার এবং আবার নতুন করে বুঝতে পারল, তাদের দাম্পত্য সত্যিই সুখের।
এক ছুটির দিনে সকালে মিহির এবং পৃথা দুজনে পরিকল্পনামাফিক পৌঁছে যায় অভিজিতের ফ্ল্যাটে। দরজা খুলে অভিজিৎ প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় ওদের দেখে। তোমরা হঠাৎ!
সারপ্রাইজ ভিজিট। ভেতরে আসতে বলবে না? হাসতে হাসতে জানাল পৃথা।
উত্তরে অভিজিৎ জানালেন, তোমরা এসেছ দেখে খুবই ভালো লাগছে। আসলে ঘরে সব অগোছালো তো…। আচ্ছা, এসো তোমরা ভেতরে।
ঘরে ঢুকে পৃথা দেখল, বসার ঘরের সোফার উপর মদের বোতল, গেলাস, ছাইদানি সব ছড়ানো রয়েছে। অভিজিৎ কিছুটা লজ্জা পেয়ে গিয়ে সবকিছু অন্য ঘরে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং ওদের সোফায় বসার ব্যবস্থা করে দেন।
স্যার, আমি একটু আসছি, গাড়িটা লক করতে ভুলে গেছি বলে ছুতো করে সরে যায় মিহির। আসলে পৃথার সঙ্গে এই পরিকল্পনা করে রেখেছিল মিহির। যাতে ওর বস্ নিরিবিলিতে পৃথার সঙ্গে দুটো মনের কথা বলে হালকা হতে পারেন নির্দ্বিধায়।
কী খাবে চা নাকি কফি? প্রশ্ন করল অভিজিৎ।
একটু আগেই আমরা চা খেয়ে বেরিয়েছি। বরং ব্যস্ত না হয়ে তুমি বসো একটু কথা বলি। জানাল পৃথা।
অভিজিৎ একটা চেযার টেনে বসল পৃথার সামনে। তারপর পৃথা বলতে শুরু করল, তোমার আঁকার নেশাটাকে বাড়াও অভিজিৎ। আমি খুব খুশি হব যদি তুমি আগের মতো রং তুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকো।
খুব বিষাদ মাখা কণ্ঠে অভিজিৎ জানাল, এখন আর ধৈর্য রাখতে পারি না আঁকতে গিয়ে।
কিন্তু জীবনটা তো আর সাদা-কালো করে রাখতে পারো না তুমি। ভুলে যাও কী ঘটেছে। যে-তোমায় ঠকিয়েছে, তাকে জিততে দিও না। তুমি এভাবে দিন কাটালে আদতে বিদিশা-ই জিতে যাবে। জীবনের রং ছড়িয়ে দাও তোমার ক্যানভাসে। এমন আরও অনেক প্রেরণামূলক কথা বলে অভিজিতের আরও ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল পৃথা।
এরপর মাঝেমধ্যে পৃথা ফোনে কথা বলত অভিজিতের সঙ্গে। একদিন মিহির এবং পৃথা একটা পেইন্টিং এগ্জিবিশন-এ নিয়ে যায় অভিজিৎকে। আর ওই প্রদর্শনীতে গিয়ে মন ভালো হয়ে যায় অভিজিতের এবং তিনি যেন নতুন ভাবে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেন মনে। এরপর অবসর সময়ে রং-তুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে শুরু করেন অভিজিৎ।
সময় বয়ে চলে। এভাবেই মিহির এবং পৃথার সঙ্গে অভিজিতের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। কিন্তু হঠাৎই মুম্বই ট্রান্সফার হয়ে যান অভিজিৎ। স্বাভাবিক ভাবে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায় তাদের মধ্যে। এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ একটা চিঠি এল কুরিযার-এ। খামের উপর মিহির এবং পৃথা-র নাম লেখা।
চিঠি খুলে ওরা দেখল, অভিজিতের চিঠি। তাতে লেখা,
প্রিয মিহির ও পৃথা,
দূরভাষে এই খুশির খবরটা দিতে ইচ্ছে হল না, তাই চিঠিতে জানাচ্ছি। এটা রেখে দিও যত্নে। তোমাদের প্রতি এ আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার। তোমাদের প্রেরণায আমি নতুন জীবন পেয়েছি। সবাই যে বিদিশা নয়, তার প্রমাণ পেয়েছি আমি। তোমাদের প্রেরণায় আমি জীবনে নতুন করে পেয়েছি সাগরিকাকে। ও ছবি আঁকে আমার মতো। আমরা বিয়ে করব আগামী সপ্তাহে। আর ওই বিয়ের রিশেপশন-এ আমাদের একটা যৌথ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন থাকবে। উদ্বোধক হিসাবে চাই তোমাদের দুজনকে। আমি ফ্লাইট টিকিট পাঠিয়ে দেব। আসতে হবে দুজনকেই।
অভিজিৎ ও সাগরিকা।
চিঠিটা পড়ার পর মিহির এবং পৃথা দুজনে আনন্দে জড়িয়ে ধরল পরস্পরকে। তারপর মিহির বলল, পৃথা তুমি জিতে গেছ। তোমার উদ্যোগ সফল। সত্যিই গর্ব হচ্ছে তোমার জন্য।
সেদিন আনন্দে আবার ওরা ডিনার করেছিল বাইরে রেস্তোরাঁয়।