একটি বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেল। শাশুড়ি বউমা-কে নিজের চশমা খুঁজে না পেয়ে, কোথায় আছে জিজ্ঞেস করাতে বউমার তির্যক উত্তর, ‘জায়গায় কোনওদিন ঠিক করে রাখো না, তারপর সারাদিন বকবক করে মাথা খাও।’
পরক্ষণেই বউমা যখন নিজের ছেলেকে জিজ্ঞেস করছে যে, সে নিজের টিফিনবক্স স্কুলব্যাগে ভরে নিয়েছে কিনা, ছেলে মা-কে উত্তর দিচ্ছে, ‘কেন বকবক করছ, আমি ঢুকিয়ে নিয়েছি তো।’
ছেলের উত্তর শুনে মা রেগে যায় এবং ছেলেকে সজোরে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে বলে, ‘স্কুলে আজকাল এইভাবে বড়োদের সঙ্গে ব্যবহার করা শিখে আসছিস।’ ছেলে নিজের স্কুলব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে মা-কে উত্তর দেয়, ‘এটা আমি স্কুল থেকে নয় বরং তোমার থেকেই এক্ষুনি শিখেছি। এরপর মায়ের আর কিছু বলার থাকে না।
বিজ্ঞাপনটির বিষয়টি আবারও আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাচ্চারা যা দেখে তাই তারা শেখে। বাচ্চার মধ্যে কোনও পাপবোধ কাজ করে না। নিষ্পাপ ও সরল হয় তাদের মন। বড়োদের অনুসরণ এবং অনুকরণ করার প্রবৃত্তি থাকে ওদের। বাড়িতে বড়োদের প্রতি মা-বাবার ব্যবহার বাচ্চা ঠিকই লক্ষ্য করে এবং বড়ো হয়ে সেই একই আচরণ করে নিজের মা-বাবার প্রতি। এমনকী নিজের বয়স্ক আত্মীয়স্বজন অথবা পাড়া-প্রতিবেশীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় তার আচরণ বিন্দুমাত্র বদলাচ্ছে না।
এমনও হয় অনেক সময়, নিজের মা-বাবার সঙ্গে স্ত্রীয়ের খারাপ ব্যবহার চোখে দেখেও অনেক স্বামী চুপ করে থাকেন। কিন্তু তাদেরই সন্তানের স্ত্রী যদি পরবর্তীকালে নিজের স্বামীকে, নিজের মা-বাবা বা আত্মীয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখে তাহলে সে কখনওই সেটা সহ্য করবে না এবং ঘটনাক্রম বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াও অসম্ভব নয়। সুতরাং সন্তানের সামনে নিজেরাই আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠুন যাতে ভবিষ্যতে নিজের সন্তানের ব্যবহার সংসারে ঝগড়া-ঝামেলা অশান্তির প্রধান কারণ না হয়ে ওঠে।
সম্পর্কে ভেদাভেদ রাখবেন না – অনেক পরিবারেই দেখা যায় সংসারের কর্ত্রী কেনাকাটা করার সময় নিজের বাপেরবাড়ির জন্য দামি জিনিস কিনছে অথচ শ্বশুরবাড়িতে কাউকে কিছু দিতে হলে সস্তা, ফুটপাথের জিনিস দিয়েই কর্তব্য পালন করছে। এতে সেই বাড়ির সন্তানরাও ওই একই জিনিস শিখছে। জেঠু, কাকু, পিসিদের যেমন তেমন দিলেই হল কিন্তু মামা, মাসিদের দিতে হলে দেখেশুনে দামি জিনিসটাই দেওয়া দরকার।
স্বামীর বিশ্বাস ভাঙবেন না – বিয়ের পর সব স্বামীরাই চান তার স্ত্রী শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুক, তাদের সম্মান করুক। স্ত্রীয়েরও এটা দায়িত্ব স্বামীর বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা। শুধু স্বামীকেই নয়, স্বামীর পরিবারের সকলকেই যেমন ভালোবাসা উচিত তেমনি তাদের প্রতি কর্তব্যেও অবহেলা করা উচিত নয়।
বিশ্বাসের বুনিয়াদের উপর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকে থাকে। নিজের চেষ্টায় সেটা আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা সবসময় চালিয়ে যাওয়া দরকার।
আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠুন – ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফে ঠাকুমা-ঠাকুরদার ছবি না দেখে চার বছরের অয়ন বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, দাদু ঠাম্মা আমাদের ফ্যামিলি নয়?’ বাবার ছোট্ট উত্তর ‘না শুনে সরল মনে ওই শিশু বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে আমি বড়ো হয়ে গেলে তোমরাও আর আমার ফ্যামিলি থাকবে না?’
ছোট্ট অয়নের প্রশ্নে ওর বাবা-মায়ের ভুল ভাঙে। এটা খুব স্পষ্ট, বাচ্চা আজ যা দেখছে শিখছে কাল বড়ো হয়ে সে আপনাদের সঙ্গে ওই একই আচরণ করবে। সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেরাই বাচ্চার কাছে আদর্শ হয়ে উঠুন। এমন না হয় ভবিষ্যতে নিজের সন্তান আপনাকেই সহ্য করতে পারছে না।
দায়িত্ববোধ থাকা জরুরি – অনেকসময় দেখা যায় নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য, বাড়ির ছেলে বাবা-মাকে আর্থিক সাহায্য করতে চায় কিন্তু তার স্ত্রী এতে রাজি হয় না। শুরু হয় অশান্তি, ফলে লুকিয়ে
মা-বাবাকে অর্থ সাহায্য করতে হয় সেই ছেলেটিকে। উচিত হচ্ছে শ্বশুরবাড়িতে যদি কোনও আর্থিক সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের জীবনসঙ্গিনী হয়ে উঠতে হবে এবং স্বামীকে সবরকম সাহায্য করতে পারলে তবেই মনের শান্তি খুঁজে পাবেন। এটি শুধু স্ত্রী নয়, স্বামীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্ত্রীয়ের মা-বাবার দায়িত্ব নেওয়াও স্বামীর কর্তব্য।
নিন্দে করবেন না – সকলের সামনে অপরের নিন্দে বা শ্বশুরবাড়ির নিন্দে বা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা কখনও উচিত নয় কারণ বড়োদের মুখে অন্যান্যদের সম্পর্কে খারাপ কথা শুনতে থাকলে, বাচ্চার মনেও তাদের প্রতি খারাপ এবং ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হবে। এছাড়া বাপের বাড়ি অথবা শ্বশুরবাড়ি যে-কোনও একটার নিন্দে অপর জায়গায় করাও উচিত নয়। এতে দু-পক্ষের সম্পর্কও ভালো থাকবে।
স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই দায়িত্ব পরস্পরের বাড়ির সদস্যদের যথেষ্ট সম্মান দেওয়া এবং তাদের দেখাশোনা করা, খবরাখবর রাখা। কোনও বাড়ির সমস্যা হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা দরকার। অনেক সময় দেখা যায় বিয়ের পরেও অনেক মেয়েকে নিজের বাপের বাড়ির দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ি থেকে অথবা স্বামীর কাছ থেকে অযথা বাধা আসা কিন্তু উচিত নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে এই দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলে পরের প্রজন্ম এই শিক্ষাই গ্রহণ করবে যে, সকলেই তার আপন। দাদু-দিদা বা ঠাকুরমা-ঠাকুরদার মধ্যে সূক্ষ্ম দেয়াল তুলে দেওয়ার প্রয়াস সে করবে না।
একথা সত্যি যে চারটে বাসন এক জায়গায় থাকলে ঘষাঘষিতে আওয়াজ হবেই কিন্তু সেটা সামলে রাখাটা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। বাচ্চার ভবিষ্যৎ সুখের করে তুলতে চাইলে এবং নিজের সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গেলে আবশ্যক হল, বাচ্চার সামনে এমন কোনও উদাহরণ প্রস্তুত করবেন না, যাতে বাচ্চা সেটা মনে রেখে নিজের ভবিষ্যতের জন্যও বিষবৃক্ষ রোপণ করে।