জীবনশৈলীর বদল ঘটলে, খাদ্যাভ্যাসও বদলায়। কেউ হয়তো ঠিক সময়ে সঠিক খাবার খাওয়ার সময় পান না, কেউ আবার মশলাদার মুখরোচক খাবার খেতে অভ্যস্ত। এরফলে শুরু হয় হজমের গণ্ডগোল। আর দীর্ঘদিন যদি হজমের গণ্ডগোল হতে থাকে, তাহলে তার পরিণতিতে হতে পারে গলস্টোন– যা কিনা বিপদবহুল। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন ডা. মহেশ গোয়েঙ্কা।

গলব্লাডার এবং গলস্টোন বিষয়টি ঠিক কী?

মানুষের শরীরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল গলব্লাডার। মাত্র ৩ ইঞ্চি লম্বা এক অরগান যা আপনার লিভারের ঠিক নীচে থাকে আর লিভারে তৈরি হওয়া পিত্তকে স্টোর করে। ‘বাইল’কে ‘গল’ও বলা হয় যার থেকে এই অরগানের নামকরণ হয়েছে। পিত্তের কাজ হল চর্বিকে হজম (ইমস্লিফিকেশন) করা। তাই আপনি যখনই মুখরোচক খাবার খান, তখন তৈলাক্ত পদার্থ (ফ্যাট) হজম করে উপযোগী জ্বালানির রূপ দেওয়ার কাজ গল ব্লাডার করে থাকে। আপনার পেটে আর আপনার অন্ত্রে যখনই হজম প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন গল ব্লাডার ‘বাইল ডাক্ট’ নামের একটি নল থেকে আপনার ছোটো অন্ত্রে বাইল পাঠায়, যাতে ফ্যাটের ইমস্লিফিকেশন হতে পারে।

কিন্তু গল ব্লাডার বা বাইল ডাক্টে ‘পাথর’ থাকলে, বাইল ডাক্টে বাইলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় যা এই প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। বাইল ডাক্টের পাথরকে ‘কোলেডোকোলাইথিয়াসিস’ বলা হয়। গলস্টোন (পাথর) হওয়ার কারণে বাইলের কিছু পদার্থ শক্ত হয়ে যায়। কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, গল ব্লাডারে পাথরের পনেরো শতাংশ রোগীর, বাইল ডাক্টেও পাথর হয়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কেবল একটি পাথর হয়, আবার অনেক রোগীর ক্ষেত্রে একাধিক পাথর হতে পারে। পাথর বালুর দানার মতো খুব ছোটো বা লেবু বা গলফ বলের মতো বড়ো হতে পারে।

কী কারণে হয় গলস্টোন?

বেশির ভাগ গল স্টোন কোলেস্টেরল থেকে হয়ে থাকে। সেই কারণে ডাক্তার মনে করে স্থূলতা, মধুমেহ, খাবারে বেশি ফ্যাট আর ফাইবার কম থাকা এবং শরীর কম সক্রিয় থাকলে তা গল ব্লাডারের সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানায়। অন্য এক ধরনের গলস্টোন বিলুরুবিন থেকে তৈরি হয়, যা বস্তুত লিভার  দ্বারা ব্লাড সেল নষ্ট হওয়ার সময় তৈরি হওয়া পিগমেন্ট। লিভার সিরোসিসের রোগীর যদি রক্তের কোনও অসুখ বা বিলিয়রি ট্র্যাকে সংক্রমণ হয়, তাহলে লিভারে বিলুরুবিন অনেক বেশি তৈরি হওয়ার আর গল ব্লাডারে এর পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে পাথর তৈরি হওয়া শুরু হয়।

পাথর হওয়ার বিপদ মহিলাদের মধ্যে বেশি থাকে। যদি পরিবারে আগে থেকেই কারও পাথর থাকে, তার ওজন দ্রুত কমতে থাকে। এস্ট্রোজেন যুক্ত (কেবল মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) ওষুধ বা ট্যাবলেট যদি নেন আর তার বয়স ৪০ এর বেশি যদি হয়, তবে পাথর হওয়ার বিপদ বেড়ে যায়।

পাথর হওয়ার সাধারণ লক্ষণগুলি কী কী?

  •  পেটের ওপরে ডানদিকে হঠাৎ ব্যথা
  •  স্তনের হাড় (ব্রেস্টবোন)-এর নীচে পেটের মাঝখানে হঠাৎ ব্যাথা
  • কোমরের ব্যথা, ঘাড়ের (শোল্ডার ব্লেড) মাঝের অংশে ব্যথা
  •  ডান কাঁধে ব্যথা, এই ব্যথা কয়েক মিনিটের জন্য হতে পারে বা কয়েক ঘন্টা ধরে সমস্যায় ফেলতে পারে।

অন্য লক্ষণগুলি হল–

  •  বমি
  •  মাথা ঘোরা
  •  ধূসর রঙের মল

গলস্টোন হলে কী কী সমস্যা দেখা দেয়?

পাথর হয়ে থাকলেও সবক্ষেত্রে স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয় না। কিন্তু এই সব সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে যেমন–

  •  কোলেসিস্টাইটিস ছ এটি গল ব্লাডার ফুলে যাওয়ার সমস্যা, যা গল ব্লাডারের গলায় পাথর আটকে গেলে হয়। এর ফলে রোগীর খুব ব্যথা বা জ্বর হতে পারে।
  •  বাইল ডাক্টে ব্লকেজ ছ যদি পাথরের ফলে বাইলকে লিভার হয়ে অন্ত্রে নিয়ে যাওয়ার ডাক্ট ব্লক হয়ে যায়, তবে সংক্রমণ এবং জন্ডিস (চোখ এবং ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া কারণ বিলুরুবিন জমতে থাকে) হতে পারে।
  •  প্যানক্রিয়াটাইটিস ছ যদি পাথর প্যানক্রিয়াটিক ডাক্ট (প্যানক্রিয়াসকে কমন বাইল ডাক্ট-এর সঙ্গে যুক্ত করার নল)-কে ব্লক করে দেয়, তবে এ থেকে পাথরের সবচেয়ে বিপজ্জনক অসুখের মধ্যে অন্যতম, প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এর ফলে প্যানক্রিয়াস ফুলে যায় এবং খুব ব্যথা হয় আর প্রায়ই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার হয়। প্যানক্রিয়াটাইটিস কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হতে পারে।
  •  গল ব্লাডারের ক্যান্সার ছ যদিও এই ক্যন্সারের বেশি প্রকোপ নেই কিন্তু যদি কারও পাথরের সমস্যা থেকে থাকে, তবে তার গল ব্লাডারের ক্যান্সার হওয়ার বিপদ থাকে

এই রোগের নিরাময় কীভাবে সম্ভব?

ল্যাব টেস্ট আর ইমেজিং টেস্ট থেকে পাথর সম্পর্কে জানা হয়। ইমেজিং টেস্ট থেকে ডাক্তারদের পক্ষে গল ব্লাডার, বাইল ডাক্ট আর এসবের সঙ্গে যুক্ত অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পরীক্ষা প্রক্রিয়া সহজ হয়, যাতে পাথর সম্পর্কে জানা যায়। আজ ডাক্তারদের কাছে ইমেজিং-এর অনেক বিকল্প আছে যেমন–

  •  আল্ট্রা সাউন্ডঃ  এটি পাথর সম্পর্কে জানার অন্যতম ভালো পদ্ধতি। আল্ট্রা সাউন্ড মেশিন সাউন্ড ওয়েভের সহায়তায় অঙ্গের ইমেজ তৈরি করে আর এটাও দেখায় যে সেই অংশে পাথর আছে কি না। এতে রোগীর কোনও কষ্ট হয় না। এটি গর্ভবতী মহিলা সহ সকলের জন্য সুরক্ষিত।
  •  কম্পিউটেড টোমাগ্রাফি (সিটি) স্ক্যানঃ  এতে এক্সরে আর কম্পিউটার টেকনোলজির সামঞ্জস্যে গল ব্লাডার, বাইল ডাক্ট আর প্যানক্রিয়াসের ইমেজ তৈরি করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই প্রযুক্তি খুব কার্যকর নয় আর কিছু কিছু পাথর এতে ধরা পড়ে না।
  •  ম্যাগনেটিক রেসোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই)ঃ  এই মেশিন এক্সরে-এর পরিবর্তে রেডিও ওয়েভস আর শক্তিশালী চুম্বকের সহায়তায় অঙ্গের সুক্ষ্ম ছবি তৈরি করে আর সমস্ত স্থানে পাথরের বিষয়ে জানার কার্যকরী পরীক্ষা।
  •  এইচআইডিএ স্ক্যানঃ  একে কোলেসাইন্টিগ্রাফিও বলা হয়। এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীরের ভেতরে খুব অল্পমাত্রায় সুরক্ষিত রেডিও অ্যাক্টিভ মেটিরিয়াল ইঞ্জেক্ট করা হয় আর একটি বিশেষ ক্যামেরার সহায়তায় এর ওপর দৃষ্টি রাখা হয়, যাতে গল ব্লাডারে যদি কিছু অস্বাভাবিক থাকে বা বাইল ডাক্ট ব্লক হয়, তার ছবি সামনে দেখা যায়।
  •  এন্ডোস্কোইক রেট্রোগ্রেড কোলেজিয়োপ্যাংক্রিয়েটোগ্রাফি (ইআরসিপি)ঃ  এই পরীক্ষা উররোক্ত অন্যান্য পরীক্ষার চেয়ে বেশি ইনভেসিভ হয়ে থাকে। এতে রোগীর মুখে একটি লম্বা নমনীয় টিউব প্রবেশ করান হয়, যা গলা হয়ে পেট এবং অন্ত্র পর্যন্ত যায়। এই প্রক্রিয়ায় পাথর দেখা এবং বের করাও যায়।

গলস্টোন-এর কোনও নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে কি?

‘কোলেজিয়োস্কোপি’র জন্য উপলব্ধ নতুন প্রযুক্তিতে একটি ইআরসিপি (ওপরে তথ্য দেওয়া হয়েছে) থেকে ডাক্ট-এর ভেতর পাথর দেখা এবং নষ্ট করা সম্ভব হয়েছে। আগে বাইল ডাক্ট দেখার জন্য এন্ডোস্কোপি টুলস ব্যবহার করা হতো, যা তাদের রোগীর মুখের ভেতরে প্রবেশ করাতে হতো, সেইসঙ্গে এক্সরে-র ব্যবহার করতে হতো, যাতে পাথর কোথায় আছে তা সঠিক ভাবে জানা যায়। আজকের আধুনিক টুলসের ফলে এক্সরে-র প্রয়োজন নেই আর ডাক্তার আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট এবং ছোটো ক্যামেরার সহায়তায় গল ব্লাডারের পাথর সোজা দেখতে পারেন। এতে ডাক্তাররা পাথরের সঠিক অবস্থান জানতে পারেন আর সঠিক চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি পাথরের সেই সব ঘটনায় সাহায্য করে, যেখানে চিকিৎসা কঠিন।

পাথর অন্য অঙ্গে, যেমন কিডনিতে হলে ডাক্তার শরীরের বাইরে থেকে শক ওয়েভ দিয়ে পাথর ভেঙ্গে ফেলতে পারেন। কিন্তু এই পদ্ধতি গল ব্লাডারের পাথরের কঠিন জায়গায় হওয়ার দরুন খুব কার্যকর নয়। তবে এই সমস্যারও সমাধান এসে গেছে। আজ ডাক্তার লেজারের সহায়তায় পাথর সনাক্ত করে, সঙ্গে সঙ্গে বের করতেও পারেন। এই সার্জারি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে ন্যূনতম সার্জারির প্রক্রিয়া। রোগীর কষ্ট কম হয়, কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনের আনন্দ নিতে পারেন।

——-

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...