ফ্লাড রিলিফ ক্যাম্প-এর বাইরে লাইনটা ক্রমশ একটা অজগরের মতো এঁকে বেঁকে বৃহৎ আকার নিল। প্রায় ল্যাজের দিকে দাঁড়িয়ে রাবিয়া বারবার উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিল, সেই ভাগ্যবান লোকটিকে, যে একদম মুখের দিকে দাঁড়িয়ে। ক্যাম্প-এ মুহুর্মুহু ঘোষণা শুনে সকলেই ছুটে এসেছে, চিঁড়ে-গুড়, ত্রিপল, ওষুধ সংগ্রহের আশায়। তিন দিনের অঝোর বৃষ্টিতে, নদীনালা খালবিল মিশে গিয়ে একেবারে নারকীয় অবস্থা হয়েছে তাদের বস্তির। ঝুপড়িগুলো বেশিরভাগই ভেসে গেছে। ভেসে গেছে গরু-বাছুর মানুষ, কুকুর। এই অবস্থায় সরকারি সাহায্যই একমাত্র কুটো, যা আঁকড়ে বাঁচার প্রাণপণ এই চেষ্টা।

নাঃ শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এখনও সরেনি। মানে তার প্রাপ্য চিঁড়ে-গুড় দেওয়া এখনও শুরু হয়নি। সে সরলে পরের জন পাবে, তারপর তার পরের জন– এভাবে কখন কপাল খুলবে রাবিয়ার, সে জানে না।

অসমের গোলাঘাটের আপাত শান্তশিষ্ট নদী ধানসিঁড়িকে, এসময় বড়ো অচেনা লাগে রাবিয়ার। এরকম তাণ্ডব সে আগে দেখেছে কয়েকবার। তবে এবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেন কিছুটা বেশি। কত মানুষের তিল তিল করে জমানো খড়কুটো যেন নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে গেল রাক্ষুসী। তাদের চালাঘরটার চিহ্নমাত্র আর নেই। দশ বছরের ভাই আজিমের যক্ষের ধন খেলনাগুলোও ভেসে গেছে জলের তোড়ে। বেচারা ওগুলো বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা করেছিল, একটা ভাঙা টিনের বাক্স জোগাড় করে। কিন্তু ঈশ্বর অলক্ষ্যে থেকে হেসেছিলেন। বাস্তবের রূঢ় রূপটা দেখাবেন বলেই প্রায় শিকড় থেকে উপড়ে দিলেন তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটা।

রাবিয়া এই কুড়ি বছর বয়সে কী না দেখতে বাধ্য হল! সত্যি বলতে কী সৌভাগ্য কী তা বোঝার কখনও সুযোগই হয়নি তার। আজ এই ছিন্নমূল অবস্থায়, রিলিফ ক্যাম্প-এর লাইনে দাঁড়িয়ে তার সেই দুর্ভাগ্যের কথাই ভাবছিল রাবিয়া।

মা আর ভাই আজিমকে সে কাছেই একটা অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে রেখে এসেছে। ত্রাণ শিবির থেকে সরকারি সাহায্য, কাপড় জামা, খাবার যা পাবে নিয়ে যাবে ওদের জন্য। এখানে পরিবারের লোকসংখ্যা অনুযায়ী কম্বল, চাদর, পাউরুটি, বিস্কুট, চিঁড়ে, গুড় বিতরণ করা হবে।

আজিম যখন বছর দুয়েকের, তখনই আব্বার মৃত্যু হয়। তিনিও কত লড়াই লড়েছেন। শান্তিতে দুমুঠো খাবারের জন্য না জানি কত যন্ত্রণা সয়েছেন। এক ফালি জমিতে চাষ করে চারজনের পেট ভরাতে তাঁর নাভিশ্বাস উঠত। কখনও রাজনীতির ছল চাতুরির শিকার হয়েছেন, কখনও দুর্বৃত্তের কাছে ঠকেছেন। কখনও প্রকৃতি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দিয়েছে খরা কিংবা বন্যা। এত প্রতিকূলতার মধ্যে যে একটু সমবেদনা জানিয়েছে, তাকেই ঈশ্বর মেনেছেন।

জন্মানোর পর থেকেই দুর্ভাগ্যকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আছে রাবিয়া। এ যেন এক অন্তহীন জেহাদ। কেন এই লড়াই, কেন বেঁচে থাকার এই সংঘর্ষ? কিছুতেই বুঝতে পারে না রাবিয়া।

এক ছটাক জমি ছিল আব্বার। তাতেই ফসল বোনা। লকলকে ধানগাছগুলো সোনালি ধানে ভরে না যাওয়া অবধি সে জমিতে কত যত্নআত্তি। আব্বা বলতেন, ‘ভূমি হল আমাদের মা। মা সারাবছর অন্ন জোগায়, আর তার সেবা যত্ন করব না?’ আম্মা-ও কত কষ্ট করে তাঁর বয়ে আনা ফসল, টিপে টিপে খরচ করতেন, যাতে কেউ অভুক্ত না থাকে, অথচ বেশি খেয়ে ফেলে ভাঁড়াড়ে টান না পড়ে। মা প্রথমেই সরিয়ে রাখত বীজধানটা, যাতে খিদের জ্বালায় সেগুলোও না চলে যায় বুভুক্ষু পেটে।

এত কষ্টের মধ্যেও আম্মা-আব্বার কারও প্রতি কোনও অভিযোগ ছিল না। না গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতি, না সরকারের প্রতি। মুসলমান হওয়ার সুবাদে, মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করত যে, কখনও যেন তারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত না হয়। কিন্তু এত সাবধানতা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হল না।

২০১২-র সেই অভিশপ্ত দিনটা আজও ভুলতে পারেনি রাবিয়া। রোজকার মতো আব্বা গিয়েছিলেন জমিতে। মাথায় সবসময় তার অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেত, কিন্তু বিদ্রোহ করে ওঠা মনটাকে সংযত রাখতেন। তিনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? কেন এসেছেন? কবে থেকে আছেন? কতদিন থাকবেন? এমন নানা প্রশ্নে জর্জরিত হতে হতেও বাবা হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। বোড়ো ,অহমিয়া অর্থাত এখানকার ভূমিপুত্রদের আপত্তি ছিল, এই রাজ্যে বহিরাগতরা থাকবে কেন? তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা যা-ই থাকুক না কেন, মোটের ওপর তাদের অন্নের ভাগীদার তারা চায় না।

আব্বা আর খেত থেকে ফিরলেন না। সেই থেকে অন্ন সংস্থান করাটাই সমস্যা হয়ে গেল রাবিয়াদের পরিবারের। একদিকে খিদে, প্রাণভয়, অন্যদিকে জমি বেদখল হওয়ার চিন্তা। রুজিরুটি,অসুখ-বিসুখ, দেশ থেকে বহিষ্কারের ভয়– এহেন অন্তহীন অন্ধকার। রাবিয়ার যেটুকু পড়াশোনা, সেটা বাড়িতেই হয়েছে আব্বার কাছে।

আম্মা-কে দেখত পাগলের মতো আঁতিপাঁতি করে কাগজের একটা টুকরো খুঁজতে। কখনও টিনের আলমারিতে, কখনও ট্রাংকে, বিছানার চাদরের নীচে– ওই প্রমাণপত্র যা আইনসিদ্ধ করবে তার পরিচয়। আব্বা চলে যাওয়ার পর আম্মা আরও অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। কোথায় সেই কাগজ যা প্রমাণ করে দেবে তার পূর্বপুরুষরা ১৯৪২ সালের আগে থেকেই অসমে বসবাস করছেন। কিন্তু খুঁজে পেলেন না। যা ছিল, সবই হারিয়ে গেছে কালে কালে। রাবিয়া কী ভাবেই বা সাহায্য করতে পারত। তার তখন সবে চোদ্দো বছর বয়স। আম্মা আর ভাই-কে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছিল কাজের সন্ধানে।

কখনও কোনও বাড়িতে, কখনও রাস্তার হোটেলে বা দোকানে– যখন যেখানে কাজ মিলেছে, রাবিয়া তা করেছে। আম্মাও বসে থাকেনি। রান্নার কাজ করেছে লোকের বাড়িতে। জীবন কোনওরকমে কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠত অহমিয়া ও বহিরাগত বসবাসকারীদের মধ্যেকার বিবাদ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় অসমের এই নদী কূলবর্তী এলাকাগুলোর জন্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই এখানকার মানুষদের জীবনযাপন। গোলাঘাটের বাইরের পৃথিবীটাকে কখনও দেখেনি রাবিয়া। এই শহর এই ধানসিঁড়ি নদী– সবই তার তুলনায় অনেক বড়ো মনে হয়। বাইরের পৃথিবীটা যে এর ঠিক কতগুনে বড়ো তা সে আন্দাজও করতে পারে না।

এসব ভাবতে ভাবতে লাইনটা এগোচ্ছিল। হঠাৎ পেছনের মহিলার কাছে একটা গুঁতো খেয়ে সে সচকিত হয়ে ওঠে। এবার তার পালা, ত্রাণশিবিরের সাহায্য পাওয়ার। হঠাৎই চোখ গেল একজন বাবু সামনে টেবিল পেতে বসে আছেন। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘কার্ড বের করো, যেটা এনআরসি’র আইডেন্টিটি কার্ড হিসাবে দেওয়া হয়েছে।’

–‘কোন কার্ড’? রাবিয়া থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে।

– আরে বাবা এনআরসি, ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন-এর পরিচয়পত্র। ওটা দেখাও। না হলে ত্রাণের সরঞ্জাম পাবে না,’ বাবু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। ‘যাদের কার্ড আছে, আগে তারা পাবে।’

অপ্রস্তুত অবস্থা খানিক কাটিয়ে নিয়ে রাবিয়া বলে, ‘আজ্ঞে দ্বিতীয় দফার দরখাস্ত জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনও তো সবার নাম ওঠেনি খাতায়। দয়া করে জিনিসগুলো দিন। আমি অনেকক্ষণ ধরে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেছি। আমার আম্মা আর ছোটো ভাইটা ক্যাম্প-এ অপেক্ষায় আছে।’

এদিকে রাবিয়ার ত্রাণ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে এরকম বচসা তৈরি হয়েছে দেখে, লাইনের পেছন দিকে দাঁড়ানো কার্ডধারী শরণার্থীরা চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করেছে। তারা বারবার রাবিয়া-কে লাইন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য হল্লা করতে থাকে। কিন্তু রাবিয়ার জন্য এ যেন জীবন-মরণ সমস্যা। দুটো মানুষ না খেয়ে তার অপেক্ষায় বসে আছে। এখন কিছুতেই খালি হাতে এখান থেকে তার যাওয়া চলে না। দুপাট্টার খুঁটে করে সে কপালের ঘামটা মুছে নেয়। কোমরটা ভালো ভাবে বেঁধে নেয়, লাইনের ধাক্বাধাক্বি সামলাতে। এখন সে বুঝতে পারছে মানুষের স্বার্থে তৈরি হওয়া আইন আসলে কার্যক্ষেত্রে অনেকরকম অসুবিধেও তৈরি করে।

বাবুর পেছনে দাঁড়িয়েছিল ২৭-২৮ বছরের এক অহমিয়া যুবক। রাবিয়া দেখেছে অনেকেই তাকে নীরদ বলে সম্বোধন করছে। এবার সেই নীরদ-ই এগিয়ে এল রাবিয়াকে সাহায্য করতে। সে রাবিয়াকে বলে, ‘আপনি আমার সঙ্গে আসুন, বড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিচ্ছি। ওনাকে বলুন আপনার সমস্যার কথা। যদি তাতে কিছু সুরাহা হয়।’

রাবিয়া ভিড় ঠেলে কোনওরকমে ক্যাম্প-এর মধ্যে প্রবেশ করল। এবার সে সুঠাম চেহারার নীরদকে ভালো ভাবে দেখল। অনেক ছদ্মবেশী মানুষ সে দেখেছে এই জীবনে, যারা উপকার করতে এসে অন্য কিছু সুযোগ নিতে চায়। নীরদ-কে দেখে কিন্তু সেরকম মনে হয় না।

নীরদ-ও খুঁটিয়ে দেখছিল রাবিয়াকে। রোগা পাতলা, পানপাতার মতো মুখের মেয়েটির সুর্মা পরা চোখদুটি ভারি মায়াময়। চাইলেও চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না ওই মায়া-চোখ দুটি থেকে। রাবিয়ার চোখে-মুখে করুণ মিনতি তার নজর এড়াল না। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে নীরদ বলল, ‘জিনিসপত্র বন্টনের দায়িত্ব আমার উপরেই আছে। আমি এদিককার কাজ সেরে, বিকেলের দিকে তোমাদের শিবিরে গিয়ে জিনিসগুলো দিয়ে আসব। তুমি তোমার নাম বলে যাও।’

রাবিয়া নাম তো বলে দিল, কিন্তু মনে মনে অপরাধবোধ হল এই ভেবে যে, কাজটা সে অন্যায়ই করল। নীরদ যে একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ, সেটা রাবিয়া প্রথম দেখাতেই বুঝেছে। তার ফরসা গায়ের রং, পোশাক আশাক সাধারণ হলেও, ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ার মতো।

নীরদ আপৎকালীন সহায়তা বিভাগের সরকারি কর্মচারী। চাকরি, টাকা, নিয়ম, রেজিস্টার, সরকারি প্রমাণপত্র– এসবের বাইরে তার একটা মানবিক মন আছে। আর সেইজন্যই বিপদে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানোটা তার সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছিল। কিছু কিছু সময় আইনের ফাঁসে তার সাহায্য করার সুযোগ আটকে গেলেও, সে কোনও না কোনও রাস্তা বের করে ফেলত পাশে দাঁড়াবার।নীরদ রাবিয়াকে বলল, ‘এখন যদি তোমায় এখান থেকে মালপত্র দিয়ে দিই, ন্যাশনাল রেজিস্টারে নাম তোলা নিয়ে বিরাট ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে। কারণ তোমাদের কাছে প্রয়োজনীয় পরিচয়পত্র নেই।’

‘কী করি বলুন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ওই পরিচয়হীন চল্লিশ লক্ষ মানুষের দলে আমরাও আছি। সরকারি খাতায় আমাদের নাম নেই। আব্বা নেই। বাঁচার ফিকির করব নাকি নাম দাখিল করার জন্য ঘুরে বেড়াব,’ রাবিয়া বলে।

নীরদ সমস্যাটা বোঝে। একটু ভেবে নিয়ে বলে, ‘বেশ, দেখছি কী করা যায়। তোমরা ওই সরকারি স্কুলের শরণার্থী শিবিরে রয়েছ না? আমি কাজ শেষ করে সন্ধেবেলায় ৬টা নাগাদ যাব ওখানে। জিনিসগুলোও নিয়ে যাব, তুমি চিন্তা কোরো না।’

শিবিরে ফিরেও ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না রাবিয়ার। বারবার সে চৌরাস্তার মুখে বড়ো বাড়িটার উপরে লাগানো ঘড়িটার দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু সত্যি সত্যিই সন্ধে নামার একটু পরেই নীরদ, দুটো কম্বল আর কিছু খাবারদাবার নিয়ে রাবিয়াদের শরণার্থী শিবিরে এসে উপস্থিত হল। আম্মি কৃতজ্ঞতায় কী করবেন ভেবে পাচ্ছিল না। নিজের তুলে রাখা একটা পরিষ্কার শাড়ি চটের উপর বিছিয়ে নীরদকে বসতে দিল। রাবিয়ার মুখে পুরোটা শুনে যেন নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। রাবিয়াও এক আধবার চোখ তুলে দেখছিল এই দেবদূতকে। নীরদের মনের ভাষা যে সে সবটা পড়তে পারছিল তা নয়, কিন্তু কেবল তার মনে হচ্ছিল ধানসিঁড়ির এই বন্যা যেন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় রচনা করে দিল।

শরণার্থী শিবিরে রোজ কিছু কিছু খাবার বিতরণ করা হতো ঠিকই। কিন্তু ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস্-এ যাদের নাম ছিল না, তাদের সরকারি সাহায্য পাওয়ার কোনও রাস্তা ছিল না। এ বিষয়ে স্থানীয় লোকেরাও সহযোগিতা করতে রাজি ছিল না। নীরদ সেই খাবার প্রায় রোজই লুকিয়ে এনে দিত রাবিয়াদের।

বাসভূমির রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, প্রতিশোধের আগুন, নিরাপত্তাহীনতা, অসহায়তা এসবই দেখে এসেছে রাবিয়া। তার সুদিনের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। নীরদ এলে রাবিয়া তার আম্মি ও আজিম যেন নিশ্চিন্ততার নিঃশ্বাস নেয়। না হলে সেই প্রতিদিন ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা।

রাবিয়া নীরদকে অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু কেন যেন রাজ্যের মৌনতা তাকে ঘিরে ধরে। আর যতবেশি মৌন সে হয়ে যায়, তার অন্তর তত সরব। তার মনের জমিতে এক ফালি সবুজ ঘাসজমি যেন সে টের পায় আজকাল, যেখানে বিশ্রাম নিতে আসে নীরদ। কল্পনায় নীরদের কোলে মাথা রেখে যেন শুয়ে থাকে। নীরদ যেন ধানসিঁড়ির জলের মতো কত কথা বলে যায় রাবিয়ার কানে। কিন্তু সেসব কথা তো কেবল রাবিয়াই শুনতে পায়। নীরদ কি জানে রাবিয়ার মনের এই ঘাসজমির কথা?

এই অসমের মাটি তার বড়ো আপন। তার ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ি সত্ত্বেও রাবিয়া নিজেকে কিছুতেই বহিরাগত ভাবতে পারে না। নীরদ এই ক’টা মাসে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছে তাকে, যেভাবে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছে তার পরিবারকে– সে কী করে নিজেকে তার অনাআত্মীয় ভাববে! আজ বিকেলে নীরদ আসবে তাদের একটি ভাড়া বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখার জন্য। রাবিয়া টুকিটাকি জিনিসগুলো গুছিয়ে পোঁটলা বাঁধতে থাকে। একটা কাগজের টুকরোয় সে কিছু লিখে রেখেছে। আজ সে সেটা নীরদকে দেবে।

নীরদ তার সাইকেল নিয়ে বিকেলবেলা আসতেই, রাবিয়া কাগজের টুকরোটা নীরদের আঙুলের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ে। নীরদ কাগজটাখোলে। তাতে রাবিয়া লিখেছে, ‘আমার জন্ম অসমে, তাই আমি অসমের মেয়ে। তুমি অসমের ছেলে। আমরা দুজনেই যদি এই অসমের মাটিকে একইরকম ভাবে ভালোবাসি– তবে তোমার আমার মধ্যে তফাত কোথায়? তফাত যদি না থাকে, তাহলে একবার আমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলো।’

নীরদ কাগজটার উলটো পিঠে লিখে দেয় ‘আমি কাল তোমার আম্মির সঙ্গে কথা বলব।’

রাবিয়াকে কলে জল ভরতে দেখে সে চিঠিটা তার হাতে দিয়ে সাইকেল নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। তার ভেতরেও কী যেন একটা হচ্ছিল, সে নিজেকে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝেছে রাবিয়া তার মন জুড়ে রয়েছে।

চিঠিটা পেয়ে রাবিয়া প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না, নীরদ একথা কেন লিখল। তবে কি সে বিবাহিত? নাকি রাবিয়া মুসলমান বলে সে মুখ ফিরিয়ে নিল? রাবিয়া নিজেকে অসমিয়া বলায়, সে কি রেগে গেল?

এসব ভাবনা ক্রমাগত বুকে চেপে বসতে লাগল রাবিয়ার। রাতে সে কিছুই প্রায় খেল না। আজিমকে একটু বকাবকিও করে ফেলল। তারপর সিদ্ধান্ত নিল আর নীরদের সাহায্য নেবে না। এখান থেকে চলে যাওয়াই তাদের জন্য শ্রেয়। সে আম্মাকে বোঝাল নিজেরাই কিছু ব্যবস্থা করার জন্য এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত। আম্মা কিছু একটা বুঝলেন হয়তো। কিন্তু মেয়েকে বললেন, ‘দিনকাল ভালো নয় রাবিয়া। এখানে তাও মাথার উপর একটা ছাদ আছে। এই আশ্রয় ছেড়ে বেরোনো নিরাপদ নয়। প্রাণ চলে যেতে পারে। আজিম তো নিছকই শিশু। সে কী ভাবে পারবে সব সামলাতে।’

রাবিয়া আর কথা বাড়াল না। সারারাত আর ঘুম এল না। ভোরের দিকে কখন যেন দুচোখের পাতা লেগে গেছিল। জলের লাইন দিতে হবে বলে আম্মি তার ঘুম ভাঙালেন।

এর খানিক পরে, খাবারদাবার সমেত নীরদ এল। আম্মির সামনে বসে পড়ল। আড়চোখে একবার রাবিয়াকে দেখে নিয়ে, আম্মির হাতদুটো ধরে বলল, ‘রাবিয়ার জন্য আপনাদের পরিবারকে খুব আপন মনে করি আমি। আপনারাও আশাকরি আমায় পর ভাবেন না। তাই আমি বলতে এসেছি আপনারা সকলে মিলে আমার সঙ্গে গুয়াহাটি চলুন। ওখানে রাবিয়াকে আমি একটা এনজিও’র কাজ জুটিয়ে দেব। আজিমকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেব। আপনার জন্যও সেলাই বা অন্য কোনও হাতের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি যাতেকিছু রোজগার হয়। আর থাকা নিয়েও আপনারা চিন্তা করবেন না। গুয়াহাটিতে আমাদের নিজস্ব বাড়ি আছে। দেখবেন আপনাদের কোনও অসুবিধাই হবে না।’

রাবিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নীরদের দিকে। সে কখনও ঈশ্বরকে দেখেনি। কিন্তু নীরদ-কে আজকে তার ঈশ্বর বলেই মনে হল। আম্মি দুহাত দিয়ে নীরদের মুখটা চেপে ধরে, তার চোখে জল। বলে, ‘তুমি যা বলবে তা-ই করব বাবা। আমার ছেলের চেয়ে বেশি তুমি।’ আজিম কী বুঝল কে জানে, তবে সে নীরদের গায়ের কাছে এসে বসল।

এর কিছুদিন পরই সত্যি সত্যিই ওরা সকলে নীরদের সঙ্গে গুয়াহাটি চলে এল। নীরদের বাড়ির লাগোয়া আউটহাউস এখন ওদের আস্তানা। এরকম পরিচ্ছন্ন ঘর-বাথরুম রাবিয়া অনেকদিন দেখেনি। শরণার্থী শিবিরে দুঃস্বপ্নের মতো দিনগুলো কাটানোর পর– এরকম একটা স্বর্গ তার জন্য অপেক্ষা করেছিল, সে ভাবতে পারেনি।

কথা রেখেছিল নীরদ। রাবিয়ার এনজিও-তে চাকরি, আজিমের জন্য স্কুল, আম্মির জন্য টেলারিং শপ-এ দর্জির কাজ– সবই সে করে দিল। আর কীই বা চাইতে পারত রাবিয়া, তার এই ‘মসীহা’-র থেকে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও মাথার উপর খাঁড়ার মতো ঝুলে রইল ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস্-এর বিষয়টা। এতও সহজ ছিল না

সুখে-শান্তিতে জীবন কাটানো।

মাসখানেক যেতে না যেতেই নীরদের মা তিনসুকিয়ায় তাঁর বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। বাড়িতে এরকম অযাচিত অতিথিদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে দেখে তিনি বেশ অবাক। কৗতূহল চাপতে না পেরে, নিজেই দেখা করতে এলেন রাবিয়ার মায়ের সঙ্গে। এসেই প্রায় তোপের গোলার মতো কয়েকটি প্রশ্ন দেগে দিলেন। ‘নীরদ তো পরিষ্কার করে কিছুই বলল না, কিন্তু আপনারা কারা? আপনাদের জাতধর্মই বা কী? নীরদ বাড়ি ভাড়ার কথা কিছু বলেছে কি? আপনারা থাকবেনই বা কতদিন?’

রাবিয়া অপ্রস্তুত। কোনও উত্তর জোগাচ্ছে না তার মুখে। শেষে আম্মিই হাতজোড় করে বলল, ‘দিদি নীরদ আমাদের ছেলের মতো। বন্যায় আমাদের ঘরবাড়ি সব ভেসে গেছে। তাই ও আমাদের এখানে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা একটু সামলে নিয়েই এখান থেকে চলে যাব।’

‘ছেলেটা আমার বরাবরই ওরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন, বুঝলেন তো! ঘর জ্বালানি পর ভালানি। যাইহোক, আপনারা যত তাড়াতাড়ি পারেন নিজেদের ব্যবস্থা দেখুন।’

নীরদের মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর অপমানে রাবিয়ার মুখটা লাল হয়ে উঠল। পরিচয়পত্র না থাকাটা বুকে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। ঘাটা-আঘাটায় এভাবে কতদিন তারা ঘুরবে! কত প্রজন্ম ধরে এই মাটিতেই বসবাস করে এখন নিজেদের অনুপ্রবেশকারী, রিফিউজি মনে হতে শুরু করেছে। সরকারি খাতায় তাদের নাম নেই, অতএব তারা বহিরাগত। এই সত্যটা লুকিয়ে কতদিন তারা নিরাপদে বাঁচতে পারবে?

নীরদকে রাবিয়া দোষ দিতে পারে না। সে আশ্রয় দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাকেও কাজেকম্মে দীর্ঘ দীর্ঘ দিন শহরের বাইরে থাকতে হয়। সারাক্ষণ তাদের সুরক্ষা দেওয়া নীরদের পক্ষেও কি সম্ভব! তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে সে দেখছে, সেটার ব্যাপারে কাউকেই সে কিছু জানায়নি। সন্ধ্যা হলেই রান্নাঘরের জানলার পাশে কেউ একটা এসে দাঁড়ায়। সে আগেও দু-একবার টের পেয়েছে। সে বেরিয়ে দেখতে গেলেই ছায়ামূর্তিটা পেছনের ঝোপঝাড়ে মিলিয়ে যায়।

পরের সপ্তাহে নীরদ বাড়ি ফিরলে, রাবিয়া ভাবে তাকে সব কথা খুলে বলবে। তার মায়ের কথা, ছায়ামূর্তির কথা। কিন্তু কী ভেবে গুটিয়ে যায়। নীরদ তো এখনও মুখ ফুটে বলেনি যে, সে রাবিয়াকে নিয়ে কী ভাবে? কী তাদের সম্পর্ক? আর সে চায় না, তার একটা ভুলের জন্য আম্মি আর আজিমের জীবনটাকে অনিশ্চয়তার সামনে দাঁড় করাতে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর সে ঠিক করল তাদের অপমানের কথাটা যদি না-ও জানায়, অন্তত ছায়ামূর্তিরূপী ওই আগুন্তুকের ব্যাপারটা নীরদের কাছে গোপন করবে না। সে ঠিক করে,  মা-কে এসব জানতে দেবে না৷ তাই নীরদকে সব খুলে বলবে বলে সে  কাছেই একটা জঙ্গুলে জায়গায় নীরদের সঙ্গে দেখা করল।

নীরদ সব শোনার পর নিশ্চিত হয়ে গেল, যে আসে সে রাবিয়ার জন্যই আসে। একা অসহায় যুবতিকে দেখে কোনও মানুষরূপী পশু ওৎ পেতে থাকে রাতের অন্ধকারে। নীরদের মধ্যে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধল। এই আশ্রয়হীন পরিবারটা তার কথায় ভরসা করে তার সঙ্গে এখানে চলে এসেছে। সে কি সত্যিই রাবিয়ার যথাযথ দায়িত্ব নিতে পারবে তো ! সে নিজের বিবেকের কাছে কী জবাব দেবে, রাবিয়ার ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলে? সে রাবিয়াকে জিগ্যেস করে, ‘রাবিয়া তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? তাকে বিয়ে করতে চাও? তুমি আমায় নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করে বলতে পারো সব কথা।’

রাবিয়ার চোখ সহসা জ্বলে ওঠে। সে মনে মনে যাকে এতটা ভালোবাসে সে খবরও রাখে না, তার প্রতি রাবিয়ার অনুভূতিটা কেমন! সে নিজেকে সংযত করতে পারে না। বলে, ‘কাকে বিশ্বাস করব, তোমায়? যে এতদিনেও আমার মন বুঝল না। আমি তোমাকে মনে মনে কবে থেকে আমার করে বসে আছি, আর তুমি জানতে চাইছ…’। সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। নীরদের বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে রাবিয়া। নীরদও যেন এরকমই একটা স্পর্শের অপেক্ষায় এতদিন নিজেকে বেঁধে রেখেছিল। আজ অনুভূতির বাঁধ ভেঙে গেল। দুজনে আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় কতক্ষণ রইল খেয়াল নেই। একসময় রাবিয়া-কে আলগোছে ধরে তার মুখটা দুহাতের পাতায় নিয়ে, নীরদ বলে, ‘বিয়ে করবে আমায় রাবিয়া?’

রাবিয়ার মুখে অনিশ্চয়তার রেখা স্পষ্ট। সে বলে, ‘কী করে করব আমরা বিয়ে? তুমি পারবে? আমার না হয় আম্মা আর আজিম ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন? সমাজ?’

–‘তুমি আমায় ভালোবাসো তো রাবিয়া?’

–‘এ কথা কি আর বলার দরকার নীরদ?’

–‘তাহলে চিন্তা কোরো না। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না।’ আমি জানি সমাজকে, আমার পরিবারকে রাজি করানো খুব কঠিন কাজ। কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। সূর্য নেমে আসছে। আর এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়।’ একথা বলতে বলতে রাবিয়ার হাত ধরে সে এগোতে যাবে, পেছনে থেকে কোনও এক আততায়ী একটা ভারী কিছু দিয়ে তাকে জখম করে, রাবিয়ার মুখ চেপে ধরে জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা নীরদ, জানতেও পারল না, কী সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল রাবিয়ার।

শত দুর্ভাগ্যের মধ্যেও আজ রাবিয়ার হয়তো কিছু ভালো কাজের মূল্য প্রাপ্য হল। জঙ্গলের মধ্যে ভারী বুটের শব্দ পেল রাবিয়া। আততায়ীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির মধ্যে একটু সুযোগ পেতেই সে চিৎকার করে উঠল সাহায্যের জন্য। পুলিশের টহলদারি চলছিল ক’দিন ধরেই একটা রাজনৈতিক খুন-কে কেন্দ্র করে। জঙ্গলের মধ্যে থেকে মহিলাকণ্ঠের চিৎকার পেয়েই পুলিশের লোকেরা টর্চ নিয়ে ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। বিপদ বুঝে দুষ্কৃতি পালাল।

রাবিয়াকে পুলিশ উদ্ধার করল। নীরদ ও রাবিয়া মিলে থানায় গেল এফআইআর করতে। কিন্তু হায় রে ভাগ্য, জিজ্ঞাসাবাদ করতেই জানা গেল রাবিয়ার কোনও নথিপত্র নেই। প্রমাণ নেই নাগরিকত্বের। এসআই হাত উলটে দিয়ে বললেন, ‘যে এদেশের নাগরিক কিনা তা-ই জানি না, তার কীসের রিপোর্ট, কীসের কী। যান তো মশাই সময় নষ্ট করবেন না।’

কপালের পাশটা দিয়ে তখনও রক্ত বেরোচ্ছে নীরদের। সে রাবিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসে থানা থেকে। রাগে অপমানে তার মুখটা তখনও লাল হয়ে আছে। ফেরার পথে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আর দেরি করা যাবে না। রাবিয়াকে বলে, ‘চলো রাবিয়া, আমরা রেজিস্ট্রি করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি আর তোমার জীবনটা এভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রাখতে পারি না।’

স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী দুজনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাড়িতে আপাতত ব্যাপারটা গোপন-ই রাখবে ঠিক করে নীরদ। সময় মতো দুজনে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে পৌঁছোয়। কিন্তু সেখানেও একই গোলযোগ। সঠিক পরিচয়পত্র না থাকার কারণে এ বিয়ে আইনত সিদ্ধ করা যাবে না।

তার ভাগ্য কী উপহাস করছে ভাবে রাবিয়া। আস্তে আস্তে সব রাস্তাই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার সামনে। সেদিন রাতে বাড়িতে তার মায়ের সঙ্গে জোর অশান্তি হল নীরদের। কিছুতেই তিনি এই চালচুলোহীন বেজাতের মেয়েকে মেনে নেবেন না বউ হিসাবে। নীরদের বাবা মারা যাওয়ার পর তিনিই এবাড়ির কর্তৃ। তাঁরই হুকুম চলবে এ বাড়িতে। পরিবারের মানসম্মান রাখতে তিনি ছেলেকে ত্যাজ্য করতেও রাজি।

ভোর রাতে নীরদ এসে ডাকে রাবিয়াকে। বলে, ‘তৈরি হয়ে নাও রাবিয়া। আম্মি আর আজিমকেও বলো, রেডি হয়ে নিতে। আমরা সবাই ডিব্রুগড় যাব। ওখানে আমরা আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধবকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করব। কোনও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের দরকার নেই। প্রয়োজন নেই সরকারি শীলমোহরের। আমি যথেষ্ট দায়িত্ববান একজন পুরুষ। আমি কথা দিচ্ছি ভালো রাখব তোমাকে।’

গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে রাবিয়ার। কিন্তু সে বিশ্বাস করে নীরদকে। সূর্য উঠতে তখনও কিছু দেরি। কিন্তু পুবের আকাশে লালচে ছোপ। চারজন মানুষ নতুন সম্ভাবনার দিকে পা বাড়ায়। ডিব্রুগড়গামী ট্রেনে জানলার দিকে বাইরে তাকিয়ে রাবিয়া দেখে, একটা লাল টকটকে সূর্য উঠছে। প্রকৃতি তার পরিচয় জানতে চায় না। প্রকৃতির কাছে তার একমাত্র পরিচয়, সে মানুষ।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...