অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে যাব, ঠিক এমন সময় শীলা সেই মর্মঘাতী সংবাদটি ফের একবার মনে করিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার মনে আছে তো, আজ সন্ধেয় কিন্তু বিমলবাবুর ছেলের রিসেপশন। আমাদের যেতে হবে। আমি একটু পরে বের হব ভাবছি। একটা প্রেজেন্টেশন তো কিনতে হবে! তোমার দ্বারা যদি একটা কোনও সংসারের কাজ হয়।’

শীলার চিরকালীন অভিযোগের কোনও জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে তো অনেক দূরে কোন একটা জায়গায় যেন, তাই না? আমি তো ভুলেই গেছিলাম!’

শীলা মুখঝামটা দিয়ে বলল, ‘ভুলবে যে, সে তো জানি। বিনা পয়সায় সেক্রেটারি পেয়েছ যে! তোমার সব কথা মনে করে রাখবে।’

আমি তার চিবুক ধরে মিনমিন করে বললাম, ‘কেন এত রাগ করো?’

সে এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘থামো। আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। আজকাল সব কথাই তুমি ভুলে যাচ্ছো। কী ব্যাপার বলো তো? নতুন করে কারও প্রেমে পড়েছ নাকি?

জিভ কেটে বলি, ‘ছিছি! কী যে যা-তা কথাবার্তা বলো তুমি ইদানীং! মুখে যেন কিছু আর আটকায় না। অফিসে তো যেতে হয় না, যন্ত্রণাটা বুঝবে কী? কাজের যেন কোনও শেষ নেই। কাজের লোক কম, কিন্তু কাজ গাদা-গাদা। দম ফেলার ফুরসত নেই। যাক গে, বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমার মোবাইল ফোনে একবার ফোন করে মনে করিয়ে দিয়ো। আমি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ব–!’

বলে আমি দরজার দিকে পা বাড়াতে গেছি, শীলা পিছন থেকে আমার জামার হাতা টেনে ধরল। বিরক্ত মুখে তাকিয়ে দেখি, তার চোখমুখ বিস্ফারিত। বলল, ‘কী বললে? পাঁচটা? অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে তোমার এক ঘণ্টা সময় লাগে। তারপর তৈরি হতে কম করে আধঘণ্টা। তারপর কখন অত দূরে পৌঁছোব গো? আবার ফিরতে তো হবে, নাকি! ওসব জানি না, তুমি পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে।’

শেষ বাক্যটায় শীলা এমন সুকৌশলে আদুরে অভিমান মেশাল যে ‘না’ করতে পারলাম না। বললাম, ‘আচ্ছা, চেষ্টা করব।’

ঠিক বেরোনোর মুখে শীলার সঙ্গে কথার মারপ্যাঁচে জড়িয়ে যাওয়ায় অফিসে পৗঁছোতে স্বভাবতই দেরি হয়ে গেল বেশ একটু। ব্যস্তসমস্ত হয়ে অফিসে ঢুকে বরং বেশ চমকে গেলাম। সন্দেহের বশে কবজি উলটে হাতঘড়িটা দেখলাম। এই সময়ের মধ্যে গোটা ফ্লোরটাই নানা কিসিমের কর্মীদের কার্যকলাপে ভরে থাকে। অথচ আজ এক অদ্ভুত শান্ত নীরবতা বিরাজ করছে। কম্পিউটারের কী বোর্ডগুলিতে আঙুলের মার্চপাস্ট নেই। ফাইলগুলি স্কুলের বাধ্য মনিটরের মতো অবাধ্য পাতাগুলিকে সযত্নে সামলে রেখেছে। ফ্যানগুলোর অধিকাংশই বন্ধ আছে বলে, খটখট শব্দটাও বাজি ফোটার মতো কর্ণপটাহে এসে আঘাত করছে না। সবটাই যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

নিজের কেবিনে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে, ঢকঢক করে এক গ্লাস জল পুরোটা খেয়ে নিলাম। ইতিউতি তাকাচ্ছি, হঠাৎ তমাল এল। তমাল এই অফিসের একনিষ্ঠ অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাকে ছাড়া একটিও ফাইল এঅফিসে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

প্রত্যেকদিনের মতোই সে এসে জানতে চাইল, ‘চা খাবেন তো সুবীরদা?’

রোজই খাই। তবু সে রোজই জানতে চাইবে। বারণ করলে বলবে, জিজ্ঞেস করাটা তার দায়িত্ব। উপরন্তু, এঅফিসে তাকে ডাকাডাকির লোক অনেক, কিন্তু তার কথা বলার সুযোগ কম।এই সুযোগে সে একটু খেজুরে আলাপ করে নেয় আর কি!

হাতের তলা থেকে সকালের খবরের কাগজের গোছাটা সে টেবিলে আমার চোখের সামনে রাখে। আমি খুব অবাক হওয়া গলায় প্রশ্ন করি, ‘তমাল, গোটা অফিসটা আজ এত ফাঁকা লাগছে কেন ভাই? সকলে গণছুটি নিল নাকি?’

তমাল কথা না বলে, খবরের কাগজের একটা খবরে আঙুল রেখে দেখাল। শিরোনামে লেখা হয়েছে, শহরে আজ নাকি রেকর্ড সংখ্যক বিয়ে হচ্ছে। কারণ শাস্ত্রমতে এমন শুভদিন নাকি আর হয় না। শহরের বড়ো বড়ো বিয়েবাড়িগুলো তো অনেক আগে থেকেই বুকড। যারা বিয়েবাড়ি পায়নি, তারা রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে শামিয়ানা খাটিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে লেগে পড়েছে। সব মিলিয়ে গোটা শহরে আজ উৎসবের আমেজ। অফিসে হাজিরা মাত্রাতিরিক্ত কম হবে অনুমান করে, অনেক কর্তৃপক্ষ অফিসে ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে আগেভাগে। সরকার চিন্তিত এই ভেবে যে, যত মানুষ সন্ধেবেলা পথে নামবে, তাদের যাতয়াতের জন্য এত বাস কোথায় পাওয়া যাবে! শহরের ট্র্যাফিক পুলিশরা চিন্তিত, নিশ্চিত যানজট ছাড়ানো, ঘোরালো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী নাকি মন্ত্রী ও অফিসারদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। রাজ্যে বন্যা হলে যেরকম বৈঠক হয়। সকলেই একমত, শহরের বুকে এরকম পরিস্থিতি নাকি এর আগে কস্মিনকালেও ঘটেনি।

ওরে বাবা! খবরের কাগজটা দ্রুত ভাঁজ করে শূন্য দৃষ্টিতে তমালের দিকে তাকালাম। আমাকে বিহ্বল দেখেও সে দেঁতো হেসে বলল, ‘কাগজে লিখেছে, শহরে আজ দশহাজার বিয়ে হচ্ছে। যাদের কোনওদিন বিয়ে হবে বলে কেউ ভাবেনি, যারা কনফার্মড ব্যাচেলর, তাদেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সুবীরদা। আগামী দুবছর আর কোনও বিয়ে হবে কিনা, সেই ভেবে বাড়িওলা, ক্যাটারার, ডেকোরেটরদের মাথায় হাত। আজ আমারও নেমন্তন্ন আছে। টুনির মাকে আসবার সময় বলে এলাম, বিকেলে সেজেগুজে তৈরি থেকো–!’

এইসময় ‘সুবীর তুমি এসেছ?’ বলেএগিয়ে এল শ্যামল মুখোটি। সে আমাদের এই কোম্পানির ম্যানেজার। প্রায় ফাঁকা অফিসে আমাকে দেখে তার যেন হালে পানি পাওয়া অবস্থা। আমার উলটোদিকের চেয়ারটা টেনে বসে শ্যামলদা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী কাণ্ড!’ ‘কী কাণ্ড’–শব্দবদ্ধটা শ্যামল মুখোটির একটা অভ্যাস। নিজের পিতৃবিয়োগের সংবাদটিও তিনি অফিসে ‘কী কাণ্ড’ সহযোগে পেশ করেছিলেন, বেশ মনে আছে।

শ্যামলদা গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, ‘দ-শ-হাজার বিয়ে? ভাবতে পারো ভায়া? কী কাণ্ড! আমার হয়েছে বিপদ। আদ্ধেক বলেকয়ে ছুটি নিয়েছে। বাকিদের বেশিরভাগ না জানিয়ে ডুব মেরেছে। আর যে-গুটিকয় দয়া করে এসেছে, আমায় ধন্য করতে, তারাও বলছে লাঞ্চের পরে তাদের ছেড়ে দিতে হবে। বলো দেখি, কী কাণ্ড! আরে এটা অফিস, না থেটার?’

শ্যামল মুখোটি উত্তেজনায় হাত পাকিয়ে টেবিলে ঘুসি মারল। মেরে নিজেই মুখ বেঁকিয়ে ফেলল ব্যথায়।

তমাল তখনও যায়নি। সব শুনে পাশ থেকে ফোড়ন কাটল, ‘সেই দলে তো আপনিও পড়েন শ্যামলবাবু!’

‘কী আমি পড়ি? মানে কী?’

‘মানে, আপনারও ছুটি চাই লাঞ্চের পর। বউদিকে ফোনে বলছিলেন, তৈরি হয়ে থাকতে, শুনিনি ভাবছেন? ফিসফিস করে বললেই কি সব কথা চাপা দেওয়া যায়?’

শ্যামলদা খেপে গিয়ে বলল, ‘দূর হ। দূর হ হতচ্ছাড়া। শ্যামল মুখোটির পিছনে লাগতে এসেছে? জানে না–!’

তমাল মুচকি হেসে পালাল।

শ্যামল মুখোটি গলা বাড়িয়ে চাপা স্বরে শুধোল, ‘কী কাণ্ড! কী করি বলুন তো মশাই? ম্যানেজমেন্ট কাগজেকলমে ছুটি দেবে না। এদিকে সকলেরই নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার আছে। সেনসিটিভ ইস্যু। কাউকে বাধা দেওয়াও যাবে না। আপনারও আছে নাকি? নিমন্ত্রণ?’

শীলার সকালবেলার হুমকি মনে পড়ে গেল। আঁতকে উঠে বললাম, ‘আছে বইকী! আমাকেও, মানে একটু তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে শ্যামলদা–!’

‘আরে ছিছি, এটা কোনও কথা হল নাকি একটা?’ শ্যামল মুখোটি বিগলিত ভঙ্গিতে বলে, ‘সবাই যাচ্ছে, আমি-আপনিও যাচ্ছি। ম্যানেজমেন্টকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবে। আমার ছেলেটা ছোটোবেলায় কী দুষ্টু আর দুরন্ত ছিল জানেন? কিন্তু ওই, …বুঝিয়ে বললে, কী কাণ্ড, একেবারে শান্ত!’

‘কিন্তু শ্যামলদা, একটা সন্দেহ কিন্তু আমার রয়েই যাচ্ছে!’– রহস্যভেদীর দৃষ্টিতে চোখ সরু করে বললাম।

‘কী সন্দেহ, সুবীরবাবু?’

‘এই যে বিয়েবাড়ি যাবে বলে অফিস ফাঁকা করে সকলে চলে যাচ্ছে, ঞ্জরা সবাই কি বিয়েবাড়িই যাচ্ছে? নাকি একদিন এই ছুতোয় একটা ছুটি নিয়ে নিচ্ছে?’

শ্যামল মুখোটি খপ করে আমার হাতটা ধরে বলল, ‘আপনি আমার মনের কথাটা বলেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে কাউকে আপনি সন্দেহ করতে পারবেন না। দশ হাজার বিয়ে। তার মানে প্রত্যেক বিয়েতে যদি গড়ে তিনশো ইন্টু দশ হাজার। ভাবতে পারছি না মশাই। এত লোক আছে শহরে?’

‘তা কেন!

এক-একজনের দু-তিনটে করে নিমন্ত্রণও থাকতে পারে’, বিজ্ঞের মতো বললাম।

শ্যামল মুখোটি বলল, ‘আপনারও তো বিকেলে নিমন্ত্রণ!’

‘হ্যাঁ! আমাকেও বের হতে হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, যেতে ইচ্ছে করছে না শ্যামলদা। বউ বলছে যেতে। তাই যাব। নাহলে তো গৃহশান্তি নষ্ট হবে।’

‘কী কাণ্ড! যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না কেন? বউদির বাপের বাড়ি যাবেন তো! তাহলে তো স্পেশাল আদর… মানে ইয়ে আদর কথাটা কিএকটু স্ল্যাং হল? তাহলে সমাদর… স্পেশাল সমাদর পাবেন!’– শ্যামলদা চোখ টিপে রসিকতা করে।

‘আরে না, শ্বশুরবাড়ির অনুষ্ঠান এটা নয়। আমাদের উপরের ফ্ল্যাটে বিমলবাবু থাকেন। ওরই ছেলের বিয়ে। বরযাত্রী যেতেই হবে, খুব করে ধরেছে। আর সে বিয়ে কোথায় হচ্ছে জানেন?’

শ্যামলদা দুপাশে ঘাড় নাড়ে।

‘আমিও জানি না দাদা। তবে শুনেছি কমপক্ষে দু-ঘণ্টা লাগবে শুধু সেখানে পৗঁছোতে!’

শ্যামল মুখোটি অবশ্য আর কথা বাড়াতে চাইল না। ভেবেছিল আমার কাঁধে বন্দুক রেখে, অফিসটাকে খোলা রেখে ম্যানেজমেন্টকে খুশি করবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় বেশ দমে গেছেন ভদ্রলোক। মনে মনে একচোট হেসে নিয়ে আমি কাজে মন দিলাম।

বিকেলে ঠিক পাঁচটায় জামার পকেটে ফোনটা নড়েচড়ে উঠল। শীলা তাগাদা দিল, ‘কই গো, কখন বের হবে!’

বললাম, ‘এই তো এক্ষুনি…!’

তমালও কেবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সুবীরদা, গোটা অফিস খালি হয়ে গেছে। এখন আপনি এগোলে, আমিও বের হতে পারি।’

বললাম, ‘হ্যাঁ, এই তো হয়ে গেছে…!’

যৌথ তাগাদায় শেষপর্যন্ত ফাইলপত্র বন্ধ করে উঠতেই হল। গুনগুন করে একট সুর ভাঁজতে ভাঁজতে অফিসের বাইরে এসে স্কুটারে সওয়ার হলাম। ফেরার সময় রোজই ট্র্যাফিক জ্যামে আটকাতে হয়। অফিস থেকে বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু পৌঁছোতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়।

অথচ আজ এই পড়ন্ত বিকেলে রাস্তাঘাট আশ্চর্যরকম ফাঁকা। বোধহয় সকলেই বাড়িতে বসে নিজেদের সন্ধ্যার প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত করছে। হয়তো একটু পরেই সুন্দর ও সুন্দরীরা শহর জুড়ে ক্যাটওয়াকে বেরোবেন।

বাড়ি গিয়ে দেখলাম শীলা খুব ব্যস্ত। এককাপ চা আর বিস্কুটের গোটা কৌটোটাই আমার সামনে ধপ করে বসিয়ে হুড়মুড়িয়ে চলে যেতে যেতে বলল, ‘ঝট করে তৈরি হয়ে নাও। সোসাইটির সকলেই কিন্তু একসঙ্গে যাবে বলে ঠিক করেছে। সময়ের মধ্যে বের হতে হবে–!’

আমি শেষতম বার মরিয়া গলায় বলি, ‘শীলা, যাওয়াটা সত্যিই কি খুব জরুরি? তুমি তো জানো ভিড় আমার ভালো লাগে না!’

‘অবশ্যই জরুরি,’ শীলা আড়াল থেকে জবাব দেয়, ‘একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকি, দুবেলা দেখা হয়– যাব না? তা ছাড়া উমাদি, মানে বিমলবাবুর বউ আমাদের কিটি পার্টি গ্রুপের মেম্বার! না গেলে আস্ত রাখবে?’

‘দুর! এত ভয় পাও কেন?’– আমি মিহি হেসে বললাম, ‘বলে দিলেই হবে, আমি অসুস্থ ছিলাম। ওরা কি সেটা সরেজমিনে দেখতে পুলিশকুকুর পাঠাবে নাকি?’

‘ভয় কে পাচ্ছে?’ শীলা এবার অন্তরাল থেকে মুখ বাড়াল। বলা ভালো, মুখোশ বাড়াল। সারা মুখে নানা রঙের কী সব মেখেছে, দেখাচ্ছে ঠিক টিভি সিরিয়ালের খল চরিত্রের মতো। সহসা শীলাকে চিনতে না পেরে আঁ-আঁ করে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম। তারপর চেনা গলা শুনে ধাতস্থ হলাম।

শীলা বলল, ‘ভয় কে পাচ্ছে? উমাদি বড্ড বড়ো বড়ো কথা বলে। আমরা কিটি পার্টির বাকি মেম্বাররা ঠিক করেছি, বিয়েতে গিয়ে চারদিকে কড়া নজর রাখব। সেইজন্যেই যাওয়াটা জরুরি। বুঝলে?’

নিজেকে সশব্দে সোফায় ছুড়ে ফেলে জানতে চাইলাম, ‘ছেলেমেয়ে তাহলে একাই থাকবে বাড়িতে? শুধু আমরা দুজন যাব?’

শীলা কোনও উত্তর দিল না। তবে মৌনং সম্মতি লক্ষণম্।

অন্তরাল থেকে শীলা এরপর লাজুক মুখে যখন সামনে এসে দাঁড়াল, সত্যিই চোখ ফেরাতে পারলাম না। এই রূপ ও কোথায় লুকিয়ে রাখে অন্য আর পাঁচটা সাধারণ দিনে? যখন মুখ ঝামটা দেয়, গলগল করে ঘামতে ঘামতে ব্যাগে ভরে দেয় আমার লাঞ্চ বক্স, তখন সৌন্দর্যের এই ব্যাখ্যাতীত বিচ্ছুরণ ও কী দিয়ে ঢেকে রাখে?

অস্ফুটে, সেই আগের মতো, প্রেমিক-প্রেমিক গলায় বলে উঠলাম, ‘অপূর্ব দেখাচ্ছে। আজ বিয়েবাড়িতে সকলের নজর তোমার দিকে ঘুরে যাবে মনে হচ্ছে। বিয়ের কনেও পাত্তা পাবে না।’

শীলা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ছাড়ো। আদিখ্যেতা!’

বিমলবাবু একটি বেশ বড়োসড়ো মাপের বাসের বন্দোবস্ত করেছেন। শীলা জানলার পাশের একটি সিট পেয়ে গেল। আমিও গুটিগুটি পায়ে তার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। ভালোই হল। অনেকদিন দুজনে মিলে এরকম সান্ধ্যভ্রমণ হয় না। আলো ঝলমলে শহরটার মধ্য দিয়ে হাওয়া আর যানজট কেটে এগিয়ে যেতে থাকল আমাদের বাসটা।

শীলাকে খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কি সত্যিই মনে হয়, আজ শহরে দশহাজার বিয়ে হচ্ছে?’

শীলা পালটা জবাব দিল, ‘এমনভাবে জিজ্ঞেস করছ যেন আমি পুরোহিত বা রাশিবিজ্ঞানী! আমি কী করে জানব?’

তার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, ‘আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, একটু বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। খুব বেশি হলে ৩-৪ হাজার বিয়ে হচ্ছে হয়তো! দশ হাজার কি মুখের কথা?’

বাসের মধ্যে তারস্বরে রেডিয়ো চলছে। আজ সন্ধেয় সবাই রাস্তার যানজট নিয়ে চিন্তিত। থেকেথেকেই ট্র্যাফিকের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে – ‘অমুক রাস্তা ধরে যাবেন না। তমুক রাস্তা এখন এড়ানোই ভালো।– ইত্যাদি। যান-ঝঞ্ঝাটে বিরক্ত ড্রাইভার নিজের মনেই গরগর করে উঠলেন, ‘স্টুডিয়োয় বসেএসব কথা বলা খুব সোজা। রাস্তায় নেমে দ্যাখ একবার!’

চালক যেন দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছেন বেচারা ঘোষকদের। তখনই পাশের একটি গাড়ি থেকে চালক মুখ বের করে আমাদের গাড়ির চালককে প্রায় হুমকির সুরে বললেন, ‘দাদা গাড়িটা একটু পিছনে নিয়ে যান তো! সাইড দিয়ে বেরিয়ে যাব। রেডিয়োয় বলছে, মোড়ে বহুত জ্যাম! রাস্তা ‘আটকা!’

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাসের যাত্রীরাও হইহই করে উঠলেন চালকের উদ্দেশ্যে, ‘দাদু, ঘুরিয়ে নিন, গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। অন্য রাস্তা ধরে চলুন!’ অবস্থার চাপে সকলের শরিফ মেজাজেই উচ্চণ্ড হয়ে গেছে।

চালকও খেপে গিয়ে বললেন, ‘কী বলছেন? ঞ্জই গাড়িগুলো ঞ্জলোমেলো লেনে ঢুকে গিয়ে, জ্যামটাকে আরও পাকিয়ে তুলবে, ঞ্জটা বুঝতে পারছেন না?’

চালক এরপর এমনকি প্রস্তাব দিলেন সুবেশ যাত্রীদের মধ্যে কাউকে স্টিয়ারিং-এ এসে বসতে। তাতে মোক্ষম কাজ হল। হইহইটা স্তিমিত হয়ে গেল। তবে, শীলা তখনও ফিসফিস করে খুব উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘লোকটা এমন বিশ্রীভাবে গাড়ি চালাচ্ছে কেন বলো তো? কখন পৌঁছোবে, কে জানে! আর, কী গরম পড়েছে, তাই না!’

‘হ্যাঁ, খুব গরম পড়েছে। তোমার মেক-আপ তো গলতে শুরু করেছে!’

আমার মন্তব্য শীলার অন্তরাত্মা পর্যন্ত উষ্ণ করে তোলে। মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘যাও, যাও, তোমাকে দেখতে হবে না।’ বলে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যাবলি দেখতে থাকে।

 

ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে আসতে আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল। বাস থেকে যখন নামা হল, প্রত্যেকের পোশাক ঘামে গায়ের সঙ্গে লেপটে বসেছে। বাস থেকে ছোটো ছোটো মেয়েরা রাংতায় মোড়া গোলাপফুল হাতে তুলে দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। মৃদু ভলিউমে সানাই বাজছে। নানারকম পারফিউমের গন্ধ হাওয়ায় কোলাকুলি করছে। অনেক পুরোনো ঞ্জকটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যেতে মনটা খুশি হয়ে উঠল। লাজুক চোখে শীলার দিকে তাকালাম। সে অবশ্য ততক্ষণে অ্যাপার্টমেন্টের অন্যান্য লাবণ্যময়ীদের দলে ভিড়ে গেছে।

পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস গুপ্ত যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘আরে শীলা, কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে! বাঃ, গলার নেকলেসটাও তো দারুণ। কবে বানালে গো?’

শীলার নেকলেসটা দু-আঙুলে অল্প তুলে ধরে মিসেস গুপ্ত নিশ্চয়ই তার দামটাও মেপে নিতে চাইলেন।

পাশ থেকে মিসেস দত্ত-ও ঝুঁকে পড়লেন, ‘সত্যি তো!’

দেখতে দেখতে নেকলেসের উপর ঝুঁকে পড়া মাথার সংখ্যা বাড়তে থাকল। ক্রমশ শীলাই হারিয়ে গেল ওকে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে। ক্ষুণ্ণ মনে সেটাই দেখতে থাকি। এক-এর বি-এর অর্ণব মজুমদার আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। সকালে প্রায় একই সময়ে আমরা অফিসের উদ্দেশ্যে বের হই। তখন দেখা আর কথা হয় অল্পস্বল্প। তাইতেই সে আমাকে বন্ধু ঠাউরে নিয়েছে। দিব্যি কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আরে সুবীরদা! এখানে এই মহিলাদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছ? ওদিকে চলো। ছেলেদের আলাদা আড্ডা বসেছে ও ঘরে। তোমাকে সবাই ডাকছে।’ অগত্যা অর্ণবের সঙ্গে মিঃ দত্ত, মিঃ গুপ্ত এবং মিঃ দত্তগুপ্তদের আড্ডায়এসে ভিড়লাম।

মিঃ দত্ত চারপাশে তাকিয়ে, তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে বললেন, ‘ভাই, বিমলবাবু কিন্তু বেশ সরেস বেয়াইবাড়ি জুটিয়েছেন, যাই বলুন। যথেষ্ট খরচাপাতি করেছে। মনও খুবও ভালো। বন্দোবস্ত দেখেছেন?’

অর্ণব বলল, ‘আপনিও যেমন দত্তদা! ভিতরের কথা বলছি, আমার কাছে শুনুন। বিমলবাবুকে জোটাতে হয়নি, পাত্র নিজেই জুটিয়েছেন। এই মেয়েটার সঙ্গে বিমলবাবুর ছেলেকে আমি অনেকদিন দেখেছি লাভার্স পার্কের ওখানে!’

মিঃ দত্তগুপ্ত মুখটা বড়ো করে হাঁ করে বললেন, ‘তুমি ওখানে কী করতে গেছিলে হে?’

অর্ণব থমকে গিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, ‘আরে কী আশ্চর্য! পার্কের কাছেই তো আমার অফিস!’

মিঃ দত্তগুপ্ত চোখ মটকে বললেন, ‘অফিসটাও বেছে বেছে খুব ভালো জায়গায় জুটিয়েছ দেখছি!’

মিঃ দত্ত তাকে থামিয়ে দিয়ে বললন, ‘আহা ওকে বলতেই দিন না! ঝেড়ে কাশো দেখি অর্ণব। পরচর্চা বেশ ভালোই লাগে। একথা বউদের আবার যেন বোলো না!’

অর্ণব গলা নামিয়ে বলল, ‘দুজনে একই কলেজে, একই ক্লাসে পড়ত।’

তারপরই অর্ণবের চোখ পড়ল আমার দিকে। সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘সুবীরদা মিটমিট করে হাসছে। কী সুবীরদা, হাসছেন যে বড়ো!’

আমি গলাটা কেশে সাফ করে নিয়ে বললাম, ‘আমি ভাবছিলাম, সবই যখন ঠিকঠাক হয়েই ছিল, তখন এত খরচা করার দরকার কী ছিল! এত বড়ো বাড়ি ভাড়া নেওয়া, এত এলাহি খাওয়াদাওয়ার আয়োজন, সাজগোজ, গয়নাগাটি– এসব ফালতু খরচ না?’

‘আসলে কী জানেন সুবীরবাবু’, দত্তগুপ্ত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘মেয়েপক্ষের টাকাপয়সার কোনও অন্ত নেই। বিরাট সমুদ্র থেকে

দু-এক ঘটি জল তুলে নিলে সমুদ্রের কি কোনও ক্ষতি হয়?’

আমি ক্ষুণ্ণ মুখে বললাম, ‘তা বলেই কি জলের মতো পয়সা খরচ করা উচিত?’

হাতা ধরা ঠান্ডাপানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে অন্য এক কোণ থেকে তেতলার মনোজ ঘোষ কথা বলে উঠল এবার, ‘এই সুবীরবাবুটা না,… কেমন যেন… বেশ মজা করছিলুম! দিল মুডটা খারাপ করে!’

আমি খানিকক্ষণ ব্যাজার মুখ করে বসে রইলাম। তারপর গুটিগুটি পায়ে সরে এলাম মশগুল ভিড় থেকে।

নিমন্ত্রিতদের ভিড়টা ক্রমশ বাড়ছে। অনেকটা ঘুরে শেষপর্যন্ত শীলাকে পাওয়া গেল। ফুচকার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মহানন্দে মুখে পুরছে। কাছে গিয়ে কানেকানে বলি, ‘রাত হচ্ছে।এবার খেয়ে নিলে হয় না? বাস কখন ছাড়বে জানি না। দেরি হলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব। তুমি কী বলো?’

শীলা এমন চোখে তাকাল, মনে হল যেন, আমি গর্হিত কথা বলে ফেলেছি। বলল, ‘এত তাড়ার কী আছে? এখনও কেউ চলে গেছে কি?’

‘না, বলছিলাম কি, সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে তো! অফিসে। তারপর এই ভয়ানক যানজট পার হওয়া। বাড়ি পৌঁছোতেও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।’

‘বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না তো!এসে থেকে খালি খাই-খাই আর যাই-যাই!’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘বেশ, তাহলে আমি ওই সোফাটায় বসে আছি কেমন? তোমাদের খাওয়ার সময় হলে ডেকো–!

মুখ না ফিরিয়েই শীলা বলল, ‘আচ্ছা!’

ঘরের একমাত্র নিরালা কোণে রাখা আছে সোফাটা। নরম তুলতুলে গদি। ধুপ করে শরীরটাকে তাতে ফেলতেই আধশোয়া হতে ইচ্ছে হল। আর, আধশোয়া হতেই চোখদুটো যেন বন্ধ হয়ে এল আপনিই।

কতক্ষণ কেটেছে জানি না, হঠাৎ কারও প্রবল ধাক্বায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। স্থান এবং কালের বোধ সহসা মাথায় খেলল না। চোখ কচলে নিয়ে দেখি মিস গুপ্ত দাঁত বের করে হাসছেন।

‘কী ব্যাপার, অ্যাঁ, সুবীরবাবু? কোথায় আনন্দ করবেন, তা না, ঘুমোচ্ছেন! ক’টাকা খসেছে প্রেজেন্টেশনে?’

‘জানি না তো। শীলা কিনেছে।’

‘সেটাও জানেন না? কী লোক মশাই আপনি, অ্যাঁ? যাই হোক, টাকাটা তো উশুল করে নেবেন নাকি? ফুচকা প্রায় শেষ হতে চলল, চাটের অবস্থাও তথৈবচ, জিলিপিওলা তো অনেকক্ষণ হল উঠেই গেছে। আপনি মশাই স্রেফ ঘুমিয়ে এই এতগুলো মিস করলেন।’

গুপ্তবাবু আমার হাত ধরে টেনে তুললেন। না হলে নরম গদির গর্ভ থেকে নিজেকে টেনে তোলা প্রায় অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। গুপ্তবাবু বললেন, ‘দেখুন, দেখুন, বিমলবাবু কেমন নাচছেন!’

সত্যিই, বিরাট হলঘরেরএকটা পাশে তারস্বরে লাউডস্পিকার চালিয়ে নিমন্ত্রিতরা নাচছে। বিমলবাবু বাতের রোগী। পা নাড়াতে পারছেন না। কেবল কোমরের উপর থেকে ল্যাগব্যাগ করছে।

কিন্তু সেদিকে মন দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার নেই। আমার চোখ শীলাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল।

শীলাকে দেখতে পেয়ে করুণ মুখে তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতঘড়িটা তুলে দেখালাম! মিসেস দাস কুলকুল করে বলে উঠলেন, ‘শীলা তোর বর কেন বারবার মেয়েদের পাড়ায় চলে আসছে বল তো?’

নম্রভাবে বললাম, ‘দাসবউদি, কাল সকালে অফিস আছে কিনা! সারা রাত না ঘুমোলে কাজ করব কী করে? দয়া করে শীলাকে আপনারা যাওয়ার অনুমতি দিলে আমি প্রাণে বেঁচে যাই!’

‘কী ছেলেমানুষি করছ বলো তো? সবাই তো ফিরবে নাকি? সবারই তো অফিস আছে!’– শীলা যথারীতি ঝাঁঝিয়ে উঠল।

অতএব আমি ব্যর্থমনোরথ হয়ে সোফার শরণ নিলাম। এবার কোনওদিকে না তাকিয়ে লম্বা হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মেঘ ডেকে বৃষ্টি আসার মতো, নাক ডেকে ঘুম এল। ঘুম ভাঙল শীলার ধাক্বায়। কৌতূহলী মজা পাওয়া মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে অস্বস্তির গলায় সে বলল, ‘তুমি কী গো! দিব্যি ঘুমিয়ে নিলে? চলো, সবাই খেতে যাচ্ছে!’

কবজি উলটে দেখলাম রাত একটা বেজে গেছে।

খাওয়াদাওয়ার পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করল ঢিমে তালে। বিয়েবাড়ি আসার সময়কার উৎসাহ সকলের মধ্যেই নির্বাপিত। বাসের মধ্যে শ্মশানের শান্তি। থেকে থেকে মৃদু নাসিকাগর্জনও কানে আসতে লাগল।

বাড়ির দরজা খুলে দিল, দশ বছরের ঋজু। আমাদের বড়ো ছেলে। মুন্নির বয়স আট চলছে। সে তার ঘরে যথারীতি ঘুমোচ্ছে।

ঋজু খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘এত রাত হল ফিরতে? কাল অফিসটফিস যেতে হবে না, নাকি?’

বড়ো করে একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবলাম, কে বলে পুরুষ হলেই সে স্বাধীন হয়? শৈশবে পিতামাতা, যৌবনে স্ত্রী, পড়ন্ত যৌবনে পুত্রকন্যারা অভিভাবকের চেয়ারটায়একবার না একবার ঠিকই বসে যায়।

হেসে বললাম, ‘কীসের ছুটি রে? গুচ্ছের কাজ রেখেএসেছি।এখন শুলে আর দুপুরের আগে ঘুম ভাঙবে না। তাই ভাবছি, একটু কফি করে খাব।’

বাড়িতে ফিরেই শীলা বদলে গেছে। এখন তার মেক-আপ ঘরোয়া। চিনতে অসুবিধা হয় না। যত্নবতী  স্ত্রীর মতোই বলল, ‘তুমি বোসো আমি করে আনছি। তারপর মর্নিং ওয়াকে বের হব।’

আমরা পুরো পরিবার প্রত্যেকদিন সকালে অ্যাপার্টমেন্টের সামনের পার্কে প্রাতর্ভ্রমণ করতে যাই।

মিষ্টিমিষ্টি মন ভালো করা হাওয়া দিচ্ছে। দুটো-চারটে নাম না জানা ছোটো রঙিন পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-ওখানে। জীবন কত সুন্দর। যেন প্রকৃতির মধ্যে মিশে আছে। সেখানে কোনও দেখানেপনা নেই। মেক-আপ নেই। গয়না নেই। পরচর্চা নেই।

শীলাকে বললাম, ‘মানুষের দেখানেপনা এসবের কাছে কত তুচ্ছ মনে হয়, তাই না? একে অন্যের আড়ালে কথা বলাও কত গৌণ লাগে!’

শীলা বলল, ‘যা বলেছ! কাল আমার একদম ভালো লাগেনি!’

আমি বললাম, ‘আমারও।’

গোটা পার্কটা এখনও সাদা কুয়াশায় ঢেকে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম জনহীন পার্কে আমরা বোধহয় একাই। কুয়াশা কেটে এগোতেএকে একে সকলের সঙ্গেই দেখা হতে থাকল। মিঃ দত্ত, মিঃ গুপ্ত, মিঃ ঘোষ, মিঃ দত্তগুপ্ত, মিসেস দাস– সকলেই মেক-আপ তুলে, আঙরাখা খুলে রেখে এসেছেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...