স্বর্ণযুগের জনপ্রিয় বাংলা ছবিগুলি দেখতে খুব পছন্দ করেন কাকলি। তার সেই ভালোলাগা এখন সংক্রামিত হয়েছে বউমা পল্লবীর মধ্যে। সে-ও এখন শাশুড়ির সঙ্গে বসে পুরোনো ছবিগুলি দেখে ল্যাপটপ-এ, ইউটিউব-কে মাধ্যম করে।

গতকাল শাশুড়ি-বউমা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত পলাতক দেখেছে। তাই আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে পল্লবীর। ফলে, দ্রুত স্নান সেরে, মুখে অল্প খাবার তুলে নিয়ে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিয়েছে সে।

অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে পল্লবী কাকলির উদ্দেশ্যে বলে, বাই মা, আমি বেরোচ্ছি। দুপুরে খাবার খাওয়ার আগে ঠিক মতো ওষুধ খেয়ে নিও কিন্তু।

পল্লবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই টিফিন বক্স নিয়ে ছুটে এসে কাকলি বললেন, এক মিনিট দাঁড়িয়ে যা পল্লবী। এই নে ধর, আজও টিফিন নিতে ভুলে যাচ্ছিলি। বলেই খাবারের ব্যাগটা পল্লবীর হাতে দিলেন।

তাড়াহুড়োয় আজও ভুলে গিয়েছিলাম মা। যাক ক্যান্টিনের ওই অখাদ্য খাবার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচলাম। লভ ইউ মা।

অফিসে পৌঁছে ফোন করিস কিন্তু। মনে করিয়ে দেন কাকলি। আর পল্লবী এগোতে গিয়ে আবার পিছন ফিরে জানায়, মা, মনে আছে তো? পাঁচটার সময় রেডি থেকো। আমি চলে আসব। বাই।

কাকলির সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানো দেখে নিয়ে দ্রুত অফিসের পথে পা বাড়ায় পল্লবী।

কী ব্যাপার মা, তোমার বউমার সঙ্গে ইশারায় কী কথা হচ্ছিল? মুচকি হেসে বিপুল প্রশ্ন করে কাকলিকে।

মেয়েদের সব ব্যাপারে এত নাক গলাতে নেই ছেলেদের। যা, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়। উত্তর দেন কাকলি।

মায়ের কথা শুনে বাবার দিকে তাকিয়ে বিপুল হেসে বলল, দেখো বাবা,শাশুড়ি-বউমার গোপন আঁতাত চলছে।

ছেলের কথা শুনে অজিতেশও হেসে ফেললেন। বেচারা বিপুল বউ আর মায়ের মধ্যে ইশারায় হওয়া কথার রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পেরে, বিফল মনে রওনা দিল অফিসের পথে।

দুকাপ চা এনে কাকলি বসলেন অজিতেশের পাশে। তখনও অজিতেশের মুখে হাসি দেখে কাকলি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, এত হাসছ কেন?

তোমরাও পারো বটে। শাশুড়ি-বউমা মিলে কী প্ল্যান করছ, ছেলেকে বলে দিলেই পারতে। বেচারা কৌতুহল নিয়ে অফিসে গেল। বলেই জোরে জোরে হাসতে শুরু করলেন অজিতেশ। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বললেন, তবে তোমাদের বন্ডিং দেখে আমার খুব ভালো লাগে, খুব আনন্দ হয়। আমার মা তো তোমাকে শুধু শাসন করেছে। শয্যাশায়ী হওয়ার আগে কোনও দিন বুঝতে চায়নি তার প্রতি তোমার অবদানের কথা। যাক, তবু মারা যাওয়ার আগে তোমাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিয়েছিল ভাগ্যিস, নয়তো শুধু দুঃখ-স্মৃতি নিয়ে থাকতে হতো তোমাকে।

আসলে কী জানো, আজকাল খুব ভয় হয় আমার। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি ইমোশনাল। দিনকয়েক আগে খবরের কাগজে পড়লাম, শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, কোলের শিশুসমেত এক তরুণী বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে শাশুড়ি, শ্বশুর, স্বামী সবাইকে।

অজিতেশের কথা শুনে কাকলি বলেন, মেয়েটির শাশুড়ির অপরাধে বিনা কারণে হয়তো আইনি ঝামেলায় পড়বে ওর স্বামী, শ্বশুর। এতদিন হয়তো মা আর বউয়ের ঝগড়ার মাঝে অসহায় বোধ করত ছেলেটি। সত্যিই এসব মর্মান্তিক ঘটনা।

তুমি ঠিকই বলেছ কাকলি। এক পরিবেশে বড়ো হয়ে বিয়ে পর যখন অন্য পরিবেশে এসে এতগুলো লোককে মানিয়ে চলতে হয় একজন মেয়েকে, তা যে কত কঠিন কাজ সেটাই বুঝতে চান না অনেকে। সবার মন জুগিয়ে চলতে পারবে কিনা, খুশি করতে পারবে কিনা, ভালোবাসা পাবে কিনা, এসব ভয় কাজ করে মেয়েটির মধ্যে।

সেই ভয় কাটানোর দাযিত্ব নেয় কজন? অথচ, ভালোবাসা পেলে পরের বাড়ির মেয়েটিও সম্মান করতে শিখবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে। তা ছাড়া তাকেও তো বিবাহিত জীবনের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, হেসেখেলে বেড়াতে দিতে হবে। তা না করে অনেকে বিয়ে পরের দিন থেকেই মেয়েটির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে দেয়। এমন ভাবে ফাই ফরমাশ খাটাতে শুরু করে দেয় যে, মেয়েটি আর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের আপন ভাবতে পারে না, প্রথম থেকেই ওর মনে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামলেন অজিতেশ।

আর অজিতেশের কথার রেশ ধরে কাকলি বলতে শুরু করলেন, শুধু কি তাই? অনেক ছেলের মা ভাবতে শুরু করে দেন যে, বিয়ের পর ছেলে ওদের ভুলে যাবে, বউয়ের কথায় উঠবে-বসবে, ছেলে পর হয়ে যাবে। তা ভাবনা যদি এমনই হয়, তাহলে ছেলের বিয়ে দেওয়া কেন বাপু! রাখো না নিজের আঁচলে বেঁধে। সত্যি, কারও কারও কী বিচিত্র মানসিকতা! মা যদি ভুল করে, ছেলে যদি তখন মাকে শাসন করে, তখন মা ভাবতে থাকেন, সব বউমা শিখিযে দিয়েছে। ফলে, যা হওয়ার তাই হয়। এসব অযৌক্তিক মিথ্যে দোষারোপ সহ্য করতে করতে ধৈ্যের বাঁধ ভাঙে তারও, সেও আর সম্মান দেখাতে পারে না গুরুজনদের।

অথচ, শাশুড়ি যদি মুর্খের মতো এসব চিন্তা না করে বউমাকে নিজের মেয়ের মতো ভাবে, তাকেও যদি সংসারের কিছু বিষযে আলোচনা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সেও আর নিজেকে পর ভাববে না, ভালোবাসায ভরিয়ে দেবে।

কাকলির কথা শুনে অজিতেশ বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, আজ আবার সেই অসহাযতার মুহূর্তগুলি কাকলির মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। তাই তাঁরও মনে পড়ে গেল, মায়ের দ্বারা কাকলির নিপীড়িত হওয়ার দিনগুলি। প্রায়ই তাঁর মা দুর্ব্যবহার করতেন কাকলির সঙ্গে। পান থেকে চুন খসলেই ধমকানো, গালিগালাজ, এমনকী কাকলির গালে থাপ্পড় মারতেও ছাড়েননি তিনি। সব মুখ বুঝে সহ্য করত কাকলি।

কিন্তু যখন তার মা-বাবা তুলে গালিগালাজ দিতেন, কাকলি আর নিজেকে সামলাতে পারত না, জবাব দিত। অনেকবার মাকে বুঝিযে কোনও লাভ হয়নি। শুধু তিনি যখন চলতে অক্ষম হয়ে পড়েন, বউমার সেবা নেওয়া ছাড়া আর অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না, তখন একপ্রকার নিরুপায় ভাবেই কদর করতেন কাকলির।

এসব ভাবতে ভাবতেই কাকলির মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন অজিতেশ। তাই কাকলির মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলেন। বললেন, তোমার বউমা কিন্তু লাকি। ভালো শাশুড়ি পেয়েছে।

আমি তো আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, আমার ছেলের বউকে আমি নিজের মেয়ে মতো আদর-ভালোবাসা দেব। তাই শুধু দায়িত্ব, কতর্ব্য-ই নয়, পল্লবীকে আমি স্বাধীনতাও দিয়েছি, অধিকারও দিয়েছি মেয়ের মতোই।

এই দ্যাখো, কথায় কথায় বড্ড দেরি হয়ে গেল। কত কাজ পড়ে আছে। আমি যাই।

হ্যাঁ, সে যাও কাজ করতে, কিন্তু শাশুড়ি-বউমার প্রোগ্রাম-টা কী, তা অন্তত আমাকে তো বলো… হাসতে হাসতে কৌতুহল নিবারণের চেষ্টা করলেন অজিতেশ।

ধরে নাও আজ শাশুড়ি-বউমা মিলে সিনেমা দেখতে যাব।আর রাতের রান্নার দায়িত্ব তোমাদের বাপ ছেলের। বলেই মুচকি হাসলেন কাকলি।

কোন ছবি?

আরে, ওই তো, বিদ্যা বালনের কী একটা সিনেমা এসেছে না… তুমহারি সুলু না কী যেন নাম…

ও বুঝলাম। তাই রাতের খাবার বাপ-ছেলেকেই বানাতে বলছ তাই তো?

একটা দিন তো অন্তত রান্না থেকে আমাদের বিশ্রাম দাও।

চলো, তাই হোক। কিন্তু আর এক কাপ চা এখন খাওয়াতে হবে। বলেই হাসতে লাগলেন অজিতেশ।

এভাবেই হাসিতে, খুশিতে চলতে থাকে ভট্টাচার্য দম্পতির প্রৌঢ়-দাম্পত্য। হবে না-ই বা কেন? এত ভালো বউমা পেয়েছেন ওঁরা। পল্লবী, ভট্টাচার্য পরিবারের চার বছরের সদস্য। এই চার বছরে শাশুড়ি-বউমার চিৎকার চ্যাঁচামেচি কিংবা ঝগড়া কেউ শোনেনি। আত্মীয-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশীর লোকেরা ওদের শাশুড়ি-বউমার এমন মিলমিশ দেখে আশ্চর্য হন।

বিপুলের সঙ্গে পল্লবীর আলাপ হয়েছিল কর্মসূত্রে। দুজনে ভিন্ন সংস্থায কাজ করলেও, দুই সংস্থার প্রযোজনায় হওয়া এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল ওদের। আসলে, বিপুল খুব ভালো গান গায় আর পল্লবী খুব ভালো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করে। এসব ওদের বাড়তি গুণ। অফিসের যে-কোনও অনুষ্ঠানে তাই ওদের অংশগ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিয়ের আগে পল্লবী একটা বিষয় নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। শাশুড়ি শব্দটাতেই আতঙ্ক ছিল। পল্লবীর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে,

শাশুড়ি-বউমা মানেই সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আসলে, মা এবং ঠাকুমার মধ্যে দিনরাত ঝগড়া দেখতে দেখতেই বড়ো হয়েছে পল্লবী। ওর বয়স যত বেড়েছে, মা-ঠাকুমার লড়াই ততই জোরদার হয়েছে। কারও অন্যায় দেখে অন্য পক্ষের সমর্থনে যতবারই কিছু বলতে গেছেন পল্লবীর বাবা, ততবারই তিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন। কখনও এমনও হয়েছে যে, পল্লবীর মা-ঠাকুমার অত্যাচারে, ওর বাবা বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও একা একা বেড়াতে চলে যেতেন, মন ভালো করার জন্য।

অবশ্য শুধু নিজের মা-ঠাকুমার ঝগড়াই নয়, প্রতিবেশী শাশুড়ি-বউমার ঝগড়ার কথাও কানে আসত পল্লবীর। এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে, এক রাতের সেই ঘটনা! প্রতিবেশী এক বউ, শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। পাড়ার অনেকে বলেছিল, শাশুড়িই নাকি কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল বউটাকে। তারপর তো থানা, পুলিশ, হাঙ্গামা… উফ্ কী ভয়ানক ছিল সেই ঘটনা! বউটির বাপের বাড়ির লোক প্রচুর ঝামেলা করেছিল কিন্তু আদালতে শাশুড়ির অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। আসলে এসব দেখে শুনেই বড়ো হয়েছে পল্লবী। তাই তার মনে শাশুড়ি-ভীতি ছিল প্রবল।

তাই বিয়ের আগে এই শাশুড়ি-ভীতির কথা সে বিশদে জানিয়েছিল বিপুলকে। আর সব শুনে হাসতে হাসতে বিপুল বলেছিল, এখনও সময় আছে, ভেবে নাও, বিয়ে পর্যন্ত আর এগোবে কিনা সম্পর্কটাকে।

কিন্তু পল্লবী তখন বিপুলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তাই মজা করে বলেছিল, তেমন হলে শাশুড়িকে ছেড়ে দেব কিন্তু তোমাকে নয়।

বিপুল অবশ্য পরে পল্লবীকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, দেখবে আমার বাড়ি গেলে তোমার শাশুড়ি-ভীতি কেটে যাবে। কারণ, আমার মা চান না, আমার ঠাকুরমার মতো ঝগড়ুটে শাশুড়ি হতে।

এভাবেই পল্লবীর মন থেকে শাশুড়ি-ভীতি কাটানোর চেষ্টা করেছিল বিপুল। কিন্তু বিয়ের পরের দিন নিজের বাড়ি ছাড়ার আগে, বিদায়ী মুহূর্তে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছিল পল্লবী। কারণ, ওর মা চুপিচুপি বলেছিলেন, শাশুড়ির থেকে সাবধানে থাকিস। টাকাপয়সা সব নিজের হাতে রাখবি, হাতছাড়া করবি না। বরকে বেশি মা মা করার সুযোগ দিবি না। আর মনে রাখবি, শাশুড়ি কখনও নিজের মায়ের মতো হয় না।

পল্লবী যখন শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিল, তখন ঘাবড়ে গিয়েছিল শাশুড়িকে দেখে। স্বাস্থ্যবতী, ভারী গলা, চলন-বলন প্রভৃতি দেখে পল্লবীর মনে হয়েছিল, ওর আশঙ্কাই ঠিক হবে। আর-দশজন অত্যাচারিত বউয়ের থেকে আলাদা কিছু ঘটবে না তার ক্ষেত্রে। কিন্তু বিয়ের দিন দশেক পর পল্লবী বুঝেছিল,

অন্যদের মতো শাশুড়ি নয় বিপুলের মা। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতি, মিশুকে এবং এক আদর্শ মাতৃগুণের অধিকারী। মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল পল্লবীর। আবেগে যখন তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল, কাকলি তখন পরম স্নেহে বুকে জড়িযে ধরে বলেছিলেন, কাঁদিস না, তোকে আমি পেটে না ধরলেও, মেয়ের থেকে কম কিছু আদর পাবি না।

এভাবেই ভালো শাশুড়ি হওয়ার প্রয়াস জারি রেখেছিলেন কাকলি। পল্লবী যদি কোনও ভুলও করে ফেলত, কাকলি মায়ের মতো পরম স্নেহে শিখিযে দিতেন। ভাত, ম্যাগি, ওমলেট ছাড়া আর কিছুই বানাতে পারত না পল্লবী। কিন্তু এখন সে অনেক রান্না জানে। এই অবদানও কাকলির। ছেলে বিপুল যদি কোনও কারণে পল্লবীর উপর চোটপাট করে, তাহলে কাকলি পল্লবীর পক্ষ নিয়ে বিপুলকেই বকাঝকা করেন। এর ফলে কাকলির প্রতি আরও সম্মান বেড়ে যায় পল্লবীর। তার হৃদয়ে নিজের মায়ের থেকেও বড়ো জায়গায় বসায় শাশুড়িকে।

তারা দুজনে শপিং করে, সিনেমা দেখে, বেড়াতে যায়, রেস্তোরাঁয় খায়, বাড়িতে পার্টিও করে। শাশুড়ির প্রসাধন সামগ্রী থেকে পোশাক সবই কিনে দেয় পল্লবী। আর বউমার পছন্দের জিনিস কিনে এনে তাকে উপহার দিতে ছাড়েন না কাকলি।

যে-প্রকাশনা সংস্থায সম্পাদনার কাজ করে পল্লবী, সেই সংস্থার সহকর্মীদের অনেকেই এখন জেনে গেছেন, তার শাশুড়ির অভাবনীয় গুণের কথা। অবশ্য শুধু সহকর্মীরাই নয়, সংস্থার এমডি-র কানেও পেঁছে গিয়েছিল পল্লবীর শাশুড়ির মহানুভবতার কাহিনি।

 

একবার ওড়িশার এক অঞ্চলে স্বামী, শ্বশুর এবং শাশুড়ির সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল পল্লবী। জঙ্গলে ঘুরে-বেড়িযে আনন্দ করার পর, সন্ধে নাগাদ যখন তারা হোটেলে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিল, তখন আচমকাই পল্লবীর পায়ে ছোবল মারে এক বিষধর সাপ। অনেক চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি অ্যান্টিভেনাম জোগাড় করতে পারেনি তারা। অবশেষে যখন অ্যান্টিভেনাম দিয়ে কোনও রকমে পল্লবীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল, ততক্ষণে ওর দুটি কিডনিই প্রায় ড্যামেজ হয়ে গেছে। পল্লবীর মা-বাবা কিডনি দিতে চাইলেও, নানারকম সমস্যার কারণে তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেন কাকলি। পল্লবীর বি-পজিটিভ ব্লাড-গ্রুপ-এর সঙ্গে কাকলির ব্লাড গ্রুপ অদ্ভুত ভাবে মিলেও যায়। তাই, একটা কিডনি ডোনেট করে পল্লবীর প্রাণ বাঁচান ওর শাশুড়িই।

শাশুড়ি-বউমার এই অভাবনীয় ভালোবাসার কাহিনি পল্লবী নিজে মলাটবন্দি করেছে তার সংস্থার এমডি-র নির্দেশে। ‘দৃষ্টান্ত’ শিরোনামের সেই বইয়ের আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন আজ সন্ধ্যায়।

যে-হাসপাতালে পল্লবীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, সেই হাসপাতালই বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানটির মুখ্য স্পনসর। শাশুড়ি ছাড়া আর কাউকে আগে থেকে খবরটা জানায়নি পল্লবী। বর এবং শ্বশুরকে সন্ধেটা ফাঁকা রাখার কথা শুধু ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল সে।

কথামতো অফিস থেকে ফিরে স্বামী, শ্বশুর এবং শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে বাইপাস অঞ্চলে অবস্থিত এক পাঁচতারা হোটেলে পৌঁছে গিয়েছিল পল্লবী।

হোটেলের অনুষ্ঠান কক্ষে ঢুকেই চমকে যায় বিপুল। এত বড়ো একটা ব্যাপার কেন পল্লবী আগে জানায়নি, ভেবে একটু রাগ হয় তার। কিন্তু তার মায়ের প্রতি পল্লবীর এই সম্মান প্রদর্শনের অভিনব উদ্যোগ দেখে গর্বে বুক ভরে যায়। বিপুলের বাবা অজিতেশেরও একই অবস্থা। লোক সমাগম না থাকলে তিনি হয়তো তখনই পল্লবীর মাথায় হাত রেখে বাহবা দিতেন।

অনুষ্ঠানটি নিজের নামে উৎসর্গ হতে দেখে কাকলিও বেশ লজ্জা পেয়ে যান। আবার, তাঁর প্রতি পল্লবীর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের উদ্যোগ দেখে, তাঁর মনটাও ভরে যায় আনন্দে।

সবাই মিলে রাতের খাওয়া সেরে যখন গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিল, পল্লবী তখন তার ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে শাশুড়ির কোলে। আর পরম স্নেহে পল্লবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন কাকলি। বাইপাসের বড়ো রাস্তা ধরে গড়িয়ামুখী গাড়িটা ছুটে চলেছে আপন গতিতে। আর সেই গাড়িতে থাকা পল্লবী, বিপুল, অজিতেশ এবং কাকলির কানে তখন শুধু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের উচ্ছ্বসিত করতালি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...