শেষ পর্যন্ত সোনাগাছিতেই যাবে অলকানন্দা। তার তাড়না এখন বিপদসীমা ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠা নদীর মতো ভয়ংকর। সেই জলের তোড় এখন অলকানন্দাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলতে চাইছে সোনাগাছিতে। তারপর অলকানন্দা সেরে নেবে তার আসল কাজ। চকার সঙ্গে হবে তার শেষ বোঝাপড়া। একটা তুমুল হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে সে। জামার কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাবে থানায়। সবাই দেখুক গোবরডাঙার চ্যাটার্জিপাড়ার, লালবাড়ির ছোটোবউয়ের আসল মূর্তি।
অফিসে গিয়ে কদিনই সুস্থির মতো কাজে মন দিতে পারছে না অলকানন্দা। ভেতরে ভেতরে একটা ছটফটানি ভাব লেগেই আছে। সেটা খেয়াল করেছে কস্তুরী। কস্তুরীর পাশের টেবিল অলকানন্দার।
কী হল তোর?
কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।
ঘুমোতে পারিসনি? কীসের অস্বস্তি? কী ব্যাপার রে তোর? কদিন ধরে লক্ষ্য করছি, কী হয়েছে?
অলকানন্দা এড়িয়ে যেতে গিয়ে, গেল না। বলল, তোকে বলে তো কোনও সুরাহা হবে না। খুবই বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা বরদাস্ত করতে পারছি না। আবার মন থেকে ঝেড়েও ফেলতে পারছি না।
সব শুনে কস্তুরী একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জলের গেলাস হাতে তুলে বলল, তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। এসব তো খুবই বস্তাপচা ঘটনা। তুই এতে ফালতু মাথা গলাচ্ছিস। চিরকালই তো এসব হচ্ছে। তুই ভেবেও বা করবিটা কী?
আমি সোনাগাছিতে যাব।
জলের গেলাসে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল কস্তুরী। বেমক্কা বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। ধরা গলায় বলল, তুই কোনও সাইকায়াট্রিস্ট-কে দেখা অলোকা। আমার ধারণা, তোর মাথাটা হ্যাং মোডে চলে গেছে। ডোন্ট বি সিলি অলোকা। মাটিতে পা রেখে চল। বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর। ডোন্ট টেক এনি হুইমজিক্যাল ডিসিশন লাইক দিস। এই ধরনের ছেলেমানুষি জেদের কথা তোর মুখে মানায় না। কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে ও-পাড়ায় পা দেয় নাকি? তোর বাড়িতে ক’বছর রান্না করেছে, তো কী হয়েছে? এসব কথা কেউ স্বীকার করে নাকি? লজ্জায় চেপে গেছে।
সেই লজ্জাটাই তো ওকে দিতে চাই আমি। আবার ঠাটের কথার বহর কী! চাকরি পেয়েছি।
তোকে কি এই যুদ্ধে জিততেই হবে? একটা নোংরা ব্যাপার ঘাঁটতে গিয়ে তোকেও যে নর্দমায় নামতে হবে, তা ভেবে দেখেছিস?
ওসব আমি বুঝি না। আমি সোনাগাছিতে যাবই আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি।
আমি যাব! তুই আমাকে নিয়ে যাওয়ার আর জায়গা পেলি না? শেষ পর্যন্ত ওই নরকে? কোনও লোচ্ছা তোর বা আমার হাত ধরে টান দিলে, আই মিন টু সে দ্যাট, তুই বা আমি ফিজিক্যালি হ্যরাসড হলে মুখ দেখাতে পারব?
ওসব ভয় দেখিয়ে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবি না। আমি যাবই। আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি। আমাকে যেতেই হবে।
সে নয় গেলি। আমিও সঙ্গে গেলাম। কিন্তু তুই তোর হাবিকে বলতে পারবি? সাহসে কুলোবে তোর?
ও জানে কেসটা। ও-ই বলেছে আমাকে।
কী বলেছে? বলেছে, ওহ, শিয়োর। ইউ মাস্ট গো টু সোনাগাছি? তাই বলেছে?
না, তা নয়। সোমা যে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে, খবরটা সুজয়ই আমাকে দিয়েছে। কে নাকি সোমাকে সোনাগাছিতে দেখেছে, এই তো গত বৃহস্পতিবারেই।
রাতে অলকানন্দা শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। সুজয় ওর স্টাডিরুমে ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে বসেছিল। সুজয়ের জন্য জলের গেলাস নিয়ে গজগজ করতে করতে ঢুকল অলকানন্দা। বলল, বেশি রাত কোরো না। আমাকে সাতসকালে উঠতে হবে। সোমা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই দুম করে কাজ ছেড়ে দিল।
সুজয় তখনই বলল কথাটা। প্রথমটা তেমন খেয়াল করেনি অলকানন্দা। বলল, কী বললে?
সুজয় ল্যাপটপেই ঘাড় গুঁজে রেখে ফের বলল, তোমার সোমার প্রামোশন হয়েছে। সে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে।
কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। ইটস ট্রু অ্যাজ ডে লাইট। নাও সোমা ইজ আ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট অফ সোনাগাছি।
সোমা সোনাগাছিতে…!
ইয়েস, ঘর নিয়েছে। নাও সি ইজ আ কনফার্মড হোর। ওহ, আই অ্যাম সরি। দিজ ভোকাবুলারিজ আর আনকনস্টিটিউশনাল নাউ-এ-ডেজ। আজকাল ওদের ডেজিগনেশন হয়েছে। দে আর কলড সেক্স ওয়ার্কার্স। আই মিন যৌনকর্মী। ডোন্ট সে হোর, প্রস্টিটিউট অ্যান্ড সো অন…
কী নিষ্ঠুরের মতো বলছ এসব? একটুও মুখে বাধছে না তোমার?
লিসন মাই ডিয়ার, ইন দিস কেস, আম সিম্পলি হেল্পলেস। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি আ পেটি সিমপ্যাথাইজার লাইক ইউ, ইউ নো। আই হেট অল দিস ডার্টি থিংগস। যাও, শুতে যাও। আমাকে কাজ করতে দাও।
অলকানন্দা আর দাঁড়ায়নি। সুজযের স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে সোফার ওপর গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে। অলকানন্দা মনে মনে দুয়ে দুয়ে চার করে নেয়। নিজের সঙ্গেই কথা বলে ওঠে সে, ও তাই সোমা আমার রান্নার কাজটা ছেড়ে দিল!
দোলের পরের দিনই সোমা এসেছিল। বলল, বউদি, খুব খারাপ খবর। তোমার বাড়ির কাজ আমি আর করতে পারব না গো। শুনে অলকানন্দার মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেল। বলল, ইযার্কি করিস না সোমা। তুই ছাড়া আমি অচল, তুই জানিস। আমার অফিস মাথায় উঠবে, তুই না এলে।
সে তো জানি বউদি। কিন্তু, কলকাতায় আমি একটা বড়ো কাজ পেয়েছি। অনেক টাকা মাইনে!
তুই কি আমাকে মাইনে বাড়াতে বলছিস? তা অত ঘুরিয়ে নাক ধরার কী আছে? সোজা কথা বল না। দেব বাড়িয়ে জানি তোর বরের চিকিত্সার খরচ অনেক। আমি তো সবাইকে বলি, সোমা ওর বরকে নিয়ে কী লড়াইটাই না লড়ছে! এমনিতেই তোকে আমি অনেক বেশিই টাকা দিই। আরও বাড়িয়ে দেব। তবু তোকে ছাড়া আমার চলবে না সোমা।
না বউদি, চাকরিটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। ওর ওষুধের পেছনে কত খরচ, তা তো জানো। তিনবাড়ির রান্নার কাজে যা পাই ফুটকড়াই হয়ে যায়। সংসার চলে না। এবার মনে হয় একটু সুখের মুখ দেখব।
কী চাকরি তোর?
উঁ
উঁ না টুঁ। বলছি কাজটা কী?
ওই একটা কাজ। সে বলার মতো কিছু নয়। লেখাপড়া জানি না। অফিসের কাজ আর কে দেবে আমায়?
তবে কী? টিভি সিরিয়ালে অ্যাকটিং করবি? ওই চকা তোর মাথায় এসব ভূত চাপিয়েেছে না? আমি তোকে বলেছি না, ওসব লাইন তোর মতো মেয়ের জন্য নয়। তোর রূপের চটক আছে। কিন্তু, খুঁটির জোর আছে কি? চিল-শকুনে ছিঁড়ে খাবে তোকে, তখন কেঁদে কূল পাবি না। ওই চকার পাল্লায পড়িস না। ওটা একটা আস্ত ক্রিমিনাল। মওকা পেলে ও তোকে আরব-এ চালান করে দেবে।
সোমা বলল, না বউদি, চকাকে ওপর থেকে দেখে আম্মো তাই ভাবতাম। ও আমাকে দিদি ডেকেছে।
অলকানন্দার আন্দাজে ঢিল ছোড়াটা তাহলে লাগসই হয়েছে। রিভলভিং স্টেজ-ড্রামার মতো বাঁই করে এক চক্করে ঘুরে গেল যেন মঞ্চটা। একটা ঘাগু উকিল আর ঝানু গোয়েন্দার মতো দ্বৈত চরিত্রে ঢুকে পড়ে অলকানন্দা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বলে, তাহলে চকাই তোর মাথাটা খেয়েছে। দ্যাখ সোমা, দুনিয়াটার কিছুই দেখিসনি তুই। জানিসও না কিছুই। চকার মতো ক্রিমিনালদের কাছে মা-বোন বলে কিছু নেই রে। ওটা একটা আস্ত তোলাবাজ। ওরা শুধু চেনে টাকা আর চেনে মদ আর মেয়েমানুষ। তোকে দিদি বলল, আর তুই অমনি গলে গেলি?
চকা আজ পোজ্জন্ত আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যাভার করেনি।
করেনি তোকে বাগে পায়নি, তাই করেনি। এবার পাবে।
কেন? এবার পাবে কেন?
ওই যে কৃতজ্ঞতা। তুই তো আর অকৃতজ্ঞ হতে পারবি না। তোকে অনেক টাকার কাজ জোগাড় করে দিল। তার প্রতিদান যখন চাইবে, তখন বুঝবি। যাই হোক, চাকরিটা কী? মানে কী কাজ?
সোমা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কে যেন ওর গলা টিপে ধরল। তার চোখ, চিবুক শক্ত দেখাল। বলল, ওই একটা ছোটোখাটো কাজ আর কী। বলার মতো তেমন কিছু না। চলি। আর দাঁড়ায়নি সোমা।
বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই অলকানন্দা হাতব্যাগটাকে ছুঁড়ে দিল সোফায়। বাথরুমে ঢুকে গেল সোজা। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে শরীর ও মনকে স্থির করার অনুশীলন চালাল। সোমার এই পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে গা গুলিয়ে ওঠে তার। বেসিনের কাছে ছুটে গিয়ে ওয়াক তুলতে থাকে। খানিক ধাতস্থ হওয়ার পর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। ঘাড়ে ও পিঠে জল দেয়। হ্যাঙার থেকে তোয়ালেটাকে একটানে নামিয়ে এনে, বিছানায় শরীর গড়িয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে পড়ে থাকে। যেন চোখ খুলতেও ভয়। ছেলেবেলায় রাক্ষস-খোক্ষসের স্বপ্ন দেখার পর ভয়ে আতঙ্কে যেমন চোখ খুলতে পারত না ঠিক তেমন। ঠিক সেই আতঙ্ক গিলে রেখেছে অলকানন্দাকে। যেন জেগে শুয়ে চোখ বুজে থাকলে মনে হবে, সে সোমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। গোটাটাই স্বপ্ন। চোখ খুলে বাস্তবে ফিরতে চায় না সে।
ওভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে অলকানন্দা টের পায়, ওর ভেতরে স্মৃতির জলভরা বোতলটা কখন কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তাই নীচের অচেতন স্তরের খড়িমাটির গুঁড়োর মতো থিতিয়ে পড়া স্মৃতিগুলো গড়িয়ে অবচেতন স্তর টপকে এল। এল একেবারে অলকানন্দার চেতন স্তরে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে সে। তার মন বলে ওঠে, ও, তাই! তাই সোনাগাছির প্রতি তার এমন দুর্বার আকর্ষণ? এই সেই সোনাগাছি। ওহ! এ তো সেই প্রত্যভিজ্ঞা! সেই প্রত্যভিজ্ঞাই এতকাল পরে ঘুরে ফিরে অলকানন্দার সামনে এসে হাজির।
অলকানন্দা কলেজে সাইকোলজি পড়েছে। জেনেছে প্রত্যভিজ্ঞার কথা। আগের দেখা ও শোনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া। এই যে-সোনাগাছি তাকে মাতিয়ে তুলেছে, তার মূলে তো শুধু সোমা নয়! রয়েছে আরও একজন। সে অলকানন্দার মাসতুতো দিদি মান্তুদি। অনেক বছর আগে মান্তুদি গেছিল সোনাগাছিতে। মান্তুদির বর প্রায় রাতেই বাড়ি ফিরত না। পাড়ার অভিজিত্দাই গোয়েন্দাগিরি করে, সুমনদার সুলুক সন্ধান এনে দিল মান্তুদিকে। অভিজিত্দার সঙ্গে সোনাগাছিতে গিয়ে হানা দিল মান্তুদি। এক রূপসী মহিলার ঘর থেকে মান্তুদি ওর বরকে, জামার কলার ধরে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তায় এনে, মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। আর ফেরেনি।
সে আজ থেকে বছর কুড়ি আগের কথা। তখন অলকানন্দার বয়স বড়োজোর বারো-তোরো হবে। তাই বাড়ির বড়োরা ছোটোদের কানকে আড়াল করে ফিসফাস, কানাঘুষো চালাত। তখনই সোনাগাছি শব্দটা ছিটকে এসেছিল অলকানন্দার কানে। পরে সব ঘটনাই শুনেছে, জেনেছে। প্রায় এক যুগ আগের সেই পারিবারিক বিপর্যয়, মান্তুদির সেই সোনাগাছি অভিযানের কথা স্রেফ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। আজ এতকাল পরে সোমার কদর্য পরিণতিতে অলকানন্দার অন্তরিন্দ্রিয়ে অচেতন স্তরে, মজে যাওয়া সেই স্মৃতি উঠে এল চেতনায়। আখেরে মান্তুদিই হল তার অ্যাকচুয়াল ইন্সপিরেশন। এই মুহূর্তে মান্তুদিই তার মনের জোর একশোগুন বাড়িয়ে দিল যেন।
রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারল না অলকানন্দা। যত রাত বেড়েছে, ততই রোখ বেড়েছে তার। কেবলই মনে হতে থাকে, ওই লোচ্ছা চকা যেন ওকে হারিয়ে দিল শেষটায়। চকাকে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে স্বস্তি নেই। এত দূর স্পর্ধা! একটা মেয়ে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাকে ওই নরকে টেনে নিয়ে যায় কী করে? আগে সোমার গালে চড় কষিয়ে ওর দেমাক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তারপর সে একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই ছাড়বে।
পার্টি-পলিটিক্স যতদূর যেতে হয় যাবে অলকানন্দা।
পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে অলকানন্দা গেল চকাদের ঠেকে। একদল ছেলেছোকরা বসে গুলতানি করছিল একটা চা দোকানে। চকা এসে দাঁড়াল অলকানন্দার সামনে। মোবাইল ফোনে তর্জনী চালাতে চালাতেই বলল, আপনি এখানে? কী ব্যাপার বলুন তো?
অলকানন্দা বলল, সোমাকে তুমি এই পথে নামালে কেন?
কে সোমা?
তুমি ভালোই জানো কোন সোমা। ও আমাদের বাড়িতে রান্নার কাজ করত।
অ… সোমাদি। তাকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেছি কেন? তাই তো? তা সে কি কারও কোলের মেয়ে আমি কি তাকে কারও কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গেছি? এমন গিলাবিলা বলেন না, শুনলে শালা সাত পেগের নেশা ছুটে যায়। নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে হাটে গেল ঘোষ, সবাই বলে, হাই রোডেরই দোষ। সোমা তো নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। সব জেনে তাপ্পর কথা বলুন। মাস খানেক ধরে সোমা আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে পড়েছিল। শুধু বলেছে, ছেলেকে ইশকুলে ভত্তি করাবে। ওর অনেক টাকা দরকার। বলল, ও কারও দয়া নেবে না। বলল, চকা আমি রোজগার করতে চাই। যেমন করেই হোক, নিজের রোজগার। ওর স্বামীর তো প্যারলিসিস। শুনে আমার মায়া হল। তাই আমি ওকে…
চকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলকানন্দা বলল, তাই তুমি ওকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেলে? বাঃ চমত্কার সোমা যে-ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবে, দুদিন বাদে ছেলে বড়ো হয়ে যখন মায়ের আসল পরিচয়টা জানবে, তখন?
চকা আঙুলের টোকায় সিগারেটটাকে ঘরের এক কোণে ছুড়ে দিয়ে বলল, দেখুন বউদি, ছোটোমুখে একটা বড়ো কথা বলি, মায়ের পরিচয় শুধুই মা। আপনারা পিথিবির কটা মাকে দেখেছেন?
তোমার কাছে জ্ঞানের কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে সোমার সোনাগাছির ঠিকানাটা একটু বলবে?
কেন? আপনি যাবেন নাকি সেখানে?
নিশ্চয়ই যাব।
বিন্দাস বলেছেন মাইরি। আপনার কলিজায় কুলোবে?
আমি ভয় পাই না।
তাওলে যান, আপনি গেলে সিনটা জমে যাবে। অবোসসো আপনি একা গেলে ওর ঠেক খুঁজে পাবেন না। সে অনেক গোলমেলে গলতা। কিন্তু, আপনি কেন যাবেন সেখানে সেটা বলবেন? মানে আপনার আসলি কাহানি?
কাহিনি আবার কী? ও আমায় বলেছে চাকরি পেয়েছে নাকি। আমি গিয়ে ওই মিথ্যেবাদীর গালে একটা ঠাস করে চড় মারব। তারপর তোমার সঙ্গে হবে আমার আসল বোঝাপড়া।
চমকাচ্ছেন? আমাকে? আপনি মেয়েছেলে, তাই চেপে গেলাম। ঠিক আছে, কবে যেতে চান, চলুন আমি নিয়ে যাব।
আমি কালই যেতে চাই। কিন্তু তুমি আগে থেকে সোমাকে কিছু জানাতে পারবে না।
সে ঠিক আছে। একটা সবুজ পাত্তি ছাড়তে হবে। মাগনা হবে না।
মানে! কত পাঁচশো?
চকা মাথা ঝাঁকিয়ে তার সম্মতি বুঝিয়ে দেয়।
অলকানন্দা বলে, ঠিক আছে দেব।
রাতে তুলকালাম ঝড় উঠল। অলকানন্দার প্রস্তাব শুনে সুজয়, সিংহের গর্জন তুলে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দিল। এমন বিশ্রী একগুঁয়েমি, জেদের কথা শুনে সুজয় ঝাঁঝিয়ে উঠে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল অলকানন্দার গালে। ব্যস, আর কোনও পরোয়া নেই। কোনও বাধা নেই আর। সুজয়ের চড় অলকানন্দার সোনাগাছির পাসপোর্ট পাকা করে দিল। তার সোনাগাছি অভিযানের আসন্ন সাফল্যের রোমাঞ্চ, সুজয়ের চড়ের গ্লানি মুহূর্তে মুছে দিল। আর কথা বাড়তে দেয়নি অলকানন্দা। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সুজয় বারবার অনুতাপ, অনুকম্পা জানাতে এলেও, মুখ তোলেনি সে।
সারারাত এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে অলকানন্দা। অনেক রাত পর্যন্ত সুজয় আত্মপক্ষ সমর্থনে গজগজ করতে থাকে। একসময় অলকানন্দা টের পায়, তার সিংহমার্কা স্বামী নাকের গর্জন তুলছে। অলকানন্দা টুঁ শব্দেরও টুঁটি টিপে নেমে আসে বিছানা থেকে। ওদের তিনতলার ঝুলবারান্দায় একটু একটু করে রাতের আয়ু ফুরিয়ে আসতে থাকে।
খুব ভোরে আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে সুজয় দেখল অলকানন্দা নেই। ওর বালিশের এক কোণে একটা ভাঁজ করা এ ফোর পেপার। তাতে লেখা, আজ অফিস ছুটির পর সোনাগাছি যাচ্ছি। তার পরের গন্তব্য আমার জানা নেই।
অফিস ছুটির পর অলকানন্দা ভূত দেখে চমকে ওঠে। অফিসের গেটের মুখে সুজয় দাঁড়িয়ে অলকানন্দাকে দেখে এগিয়ে এল। বলল, চলো আমিও যাব। পেছন থেকে কস্তুরী বলল, অলকা, তাহলে আমি আর যাচ্ছি না। অলকানন্দা মাথা নেড়ে হাত তুলে গুডবাই বোঝাল।
ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে চকার দাঁড়ানোর কথা। দূর থেকে চকাকে দেখা গেল। ফর্সা লম্বা মেয়ে পটানো চেহারা। নীল জিন্স-এর ওপর একটা ডার্ক টি-শার্ট। বলিউডের হিরোর স্টাইলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অলকানন্দা বলল, ওই যে ওই ছেলেটা। চকার গা ঘেঁষেই ট্যাক্সি দাঁড়াল। অলকানন্দা মুখ বাড়িয়ে বলল, উঠে এসো চকা, সামনে বসো। ট্যাক্সি ছুটছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে। চকা ড্রাইভারের কপালের কাছে ঝোলানো আয়নায় কেঁপে কেঁপে যাওয়া লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছিল।
ট্যাক্সি থেকে নেমে চকা বলল, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে। চকাকে অনুসরণ করে চলল অলকানন্দা আর সুজয়। বুক কাঁপছিল অলকানন্দার। এটাই তাহলে সোনাগাছি! আসলে পৃথিবীর এই আদিম পেশার ওপর অনেকদিনের চাপা কৌতূহল তার। সোমাই যেন হাত ধরে নিয়ে এল অলকানন্দাকে। তার অজানা ও অদেখাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সোমাই। রাস্তার দুধারের বাড়ির সামনে সব অসভ্য সাজগোজ করা রোজগেরে মেয়ে। এরাই বেশ্যা, বারবনিতা, বারাঙ্গনা আরও কত নাম এদের। এখন শুধুই যৌনকর্মী।
একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন ফেরে চকা। বলে, এই বাড়িটাই, চলে আসুন। বাড়িটার একবারে গর্ভস্থলে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।
অলকানন্দা বলল, বাব্বা, কত ভেতরে গো চকা।
চকা বলল, আসুন না। আরও একটু ভেতরে। সুজয় নাকে-মুখে সাদা রুমাল চেপে হাঁটছিল। অলকানন্দার বুকে ভূমিকম্পের ধকল। গলা শুকিয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে বলল, চকা তুমি সোমাকে কিছু জানাওনি তো।
না কিছু বলিনি। আপনাদের দেখে ও বমকে যাবে।
অলকানন্দা চাপা গলায় বলল, লজ্জাও পাবে। অবশ্য এখনও যদি ওর লজ্জা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে।
চকা বলল, এখানে ওসব লজ্জাফজ্জা চলে না। বলতে বলতে একটা ঘরে ঢুকে গেল চকা। পেছন ফিরে বলল, আসুন ভেতরে চলে আসুন। ঘরের ভেতরে ঝলমল করছে আলো। ঘরে ঢুকেই একেবারে সোমার মুখোমুখি অলকানন্দা।
সোমা ছুটে এসে অলকানন্দার হাত চেপে ধরল। বলল, দাদা-বউদি, তোমরা এখানে! চকা নিয়ে এল বুঝি? খুব ভালো করেছ এসেছ। আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।
অলকানন্দার কথা বলার শক্তি নেই। চকা বলল, এটা এই বাড়ির কিচেন। দুবেলা পনেরো-পনেরো তিরিশটার মতো পাত পড়ে এখানে। দুজন জোগাড়েকে নিয়ে সোমা একাই সামলায় এই কিচেন। মাস মাইনে পনেরো হাজার।
সোমা বলল, তোমরা বসো বউদি, আমি তোমাদের চা করে দিই।
অলকানন্দার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। কিচেন থেকে বেরিয়ে বাইরের ছোট্ট প্যাসেজে একটা চেয়ারে স্থবিরের মতো বসে পড়ল অলকানন্দা। সুজয় পাশে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দাঁড়াল।
চকা এসে বলল, এবার বলুন বউদি, আমার সঙ্গে কী বোঝাপড়া করবেন।
অলকানন্দার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হাতের রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছে নিয়ে বলল, আমাকে আর লজ্জা দিও না।
ঠিক তখনই চকার মধ্যে জেগে উঠল মাস্তান চকা। মাস্তানির ঢঙেই সে বলল, বউদি, সোমাকে এই সোনাগাছিতে কে দেখেছে বলুন তো? মানে সেই ডবল ভদ্দলোকটি কে?
সুজয় এবার তাড়া লাগাল। বলল, ওসব কথা পরে হবে। আমরা এখন ফিরব।
অলকানন্দার বুকের ভেতরে ভূমিকম্পে ধস নামছিল। সুজয় বলল, চলো, একটু হেঁটে এসো। ওই মোড় থেকে ট্যাক্সি নেব।
অলকানন্দা হাঁটছিল সুজয়ের পেছন পেছন। দূরত্ব সামান্য হলেও ব্যবধান ছিল। একটা লোক সুজয়কে দেখে সালাম সাব বলল। প্রায় মাঝবয়সি লোকটার পরনে চেক লুঙ্গি, কালো স্যান্ডো গেঞ্জি, গলায় চৌকো তাবিজ। অলকানন্দাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল লোকটা।
অলকানন্দা এবার পা চালিয়ে সুজয়ের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বলল, লোকটাকে তুমি চেনো নাকি?
কথাটা সুজয়ের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। অদূরে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সি দেখে সুজয়, ট্যাক্সি বলে চেঁচিয়ে উঠল।