মানস বোস, কেউ বলে মানসা, কেউ বা আরও ভালোবেসে মা মনসা। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির রোগা চেহারার লোকটি জেলা অফিসের একটি দফতরের বড়োবাবু।
বছর ছাপ্পান্নর ভদ্রলোকটি ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস বাদ দিলে, বাকি সময় হাফশার্ট আর চটি পায়ে অফিসে আসেন। বাকি মাসে পাম শু, ফুল শার্ট আর হাফ সোয়েটার। মাথার বাঁ দিকে সিঁথে, চুল এক্কেবারে পেতে ছড়ানো।
আটটা একত্রিশের লোকাল ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরাতে উঠলেই, সবাই যে-যার খুশিমতো ডেকে ঠাট্টা ইযার্কি আরম্ভ করে। মানস বোস রাগেন না, বা রাগলেও প্রকাশ করেন না। বেশির ভাগ দিনেই ট্রেনে বসার জায়গাটা রাখা থাকে, না পেলে দাঁড়িয়ে চলে যান। কারও-র সাথে কোনও রকম বিরোধে সচরাচর যান না। কম কথা বলেন, হাসেন কম, আসা-যাওয়ার মাঝে এই টুকটাক যা কথাবার্তা এই নিয়ে চলে মানস বোসের নিত্যযাত্রা।
শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিন বাদে মানসবাবুর প্রতিদিনের কাজকর্মও এক্কেবারে নিয়মমাফিক। ঘুম থেকে ওঠেন সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে। নিজের হাতের তৈরি এক কাপ চা পান করে একটু হেঁটে যোগব্যায়াম করে বাড়ি ফেরা। তারপর ভাতের জল চাপিয়ে স্নান সেরে রান্নার কাজ আরম্ভ করেন।
মানসবাবু সকাল সাড়ে সাতটায় ভাত খেয়ে পৌনে আটটার বাস ধরেন। বাস থেকে নেমে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে বা কোনও দিন অফিসের গাড়িতে অফিস পৌঁছন।
সকালে বউয়ের সাথে কথা বলা মানে আলু পটলের নাম গোত্র অথবা একমাত্র মেয়ে কলেজ বা টিউশন বা হাত খরচের টাকা নেওয়া সম্পর্কিত। কোনও দিন বউয়ের মনটা বাগান বাগান থাকলে বা সকালে ভালো ভাবে পেট পরিষ্কার হয়ে গেলে, আরও দু-একটা কথা বলেন তার মধ্যে বেশির ভাগটাই নিজের বাপের বাড়ি নিয়ে।
মানসবাবুর মেয়ে কলেজে পড়ে, গড়ন রোগা হলেও মায়ের মতো গায়ে রং-টা ফরসা। এখনকার চালচলন সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন। নিয়মিত বিউটি পার্লার যায়, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিনেমা-টিনেমা তো আছেই। এখনও পর্যন্ত কোনও বিশেষ বন্ধু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে জানা না গেলেও, মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার গায়ে হুল ফোটাতে বেশ পটু হয়ে গেছে। মায়ের আশীর্বাদে এই দক্ষতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাধ্যমিক পাশ করেই মোবাইলের জন্য তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মানসবাবুকে হারিয়ে নিজেকে মায়ের যোগ্য কন্যা হিসাবে প্রমাণও করে দিয়েছে।
মানসবাবুও কোনও আঠারো ইঞ্চির কপাল নিয়ে জন্মাননি। তাঁর বউও পৃথিবীর সেই একমাত্র ব্যতিক্রমী ভদ্রমহিলা হবেন, যিনি সব কিছু ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে একমাত্র নিজের স্বামীর স্বার্থটাই দেখবেন। অন্তত মানসবাবু কোনও দিন স্বপ্নেও একথা ভাবেননি! বউএর পাশে দাঁড়ালে তাঁকে আরও নিরীহ অসহায় লাগে।
সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে মানসবাবু যখন বাড়ি ফেরেন, বউ তখন টিভির সাথে মধুর সহবাসে ব্যস্ত থাকেন। পেমেন্টের দিন বা অন্য কিছু বিশেষ দরকারের দিনে এক কাপ চায়ের সাথে কিছু খাবার মানসবাবুর মুখের সামনে পৌঁছে দেন। আর না হলে বলেন, চা করা আছে, গরম করে নাও, অথবা গিলে নাও।
এই বিশ বছরের বৈবাহিক জাঁতাযন্ত্রে বউএর রাগ, মন খারাপের রূপ, রং, গন্ধ, স্পর্শগুলো খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছেন। যেমন যেদিন নিজে দরজা খুলে হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা টেনে নেন, তার মানে আবহাওয়াটা বাগান বাগান। তা না হলে মেঘ জমেছে। সেদিন কোনও কথা না বলে চুপচাপ জামাকাপড় ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে নিজের চা গরম করে নেন। মুড়ির কৌটো থেকে মুড়ি বের করে চায়ে চুমুকের সাথে মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, রুটি হয়ে গেছে? উত্তরটাও সেদিনের আবহাওয়ার মতোই আসে।
সন্ধের থেকে রাতটা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। একটা শীতল জড়বস্তুর পাশে শুয়ে নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অন্তত মানসবাবুর নিজের সেই রকমই মনে হয়। তবুও কোনও কোনও দিন শরীর হালুম হালুম করে ওঠে। পাশে শুয়ে থাকা শীতল যন্ত্রটাকে নিজের দিকে টেনে নিতে গেলে স্পিকার বেজে ওঠে, সেই কয়েকটা বুলি, লজ্জা লাগে না, মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। বা মরণ! কখনও আদিখ্যেতা!
মানসবাবুর জেগে ওঠা রঙে আলকাতরা মিশে যায়। জেগে যাওয়া শরীর নুয়ে পড়ে, জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কোনও কোনও দিন শরীর বাগ মানে না। জেগে উঠে, বিছানা নড়ে। পাশের শীতল যন্ত্রের স্পিকারে শোনা যায, বাথরুমে যাও। তার পরেই ফুলস্টপ।
মানসবাবুর মেয়ে খুব ব্যস্ত। সকালে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ঘুম থেকে ওঠে। ফেরার সময় বেশির ভাগ দিনেই ব্যস্ত থাকে নিজের কাজে। কী কাজ, মানসবাবু জিজ্ঞেস করেন না। করলেও উত্তর আসে, তোমাকে বলে কী করব? কিছু বুঝবে কি? সেই তো সেকেলেই রয়ে গেলে। মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুল ফোটায়। মানসবাবুর ব্যথা লাগলেও কিছু বলা যায় না। বউ মেয়ে সাঁড়াশি আক্রমণে বেচারা বোসবাবুর যা অবস্থা, তা বর্ণনা করতে গেলে দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।
মানসবাবুর অফিসটাও খুব অদ্ভুত। সকাল থেকে দুপুর হয়ে বিকাল শুধু কিছু ফাইল আর লেখা। না হয় পেপার পড়া। ডিপার্টমেন্টের না আছে কোনও ঘুসের ব্যবস্থা, না আছে কোনও মহিলা কর্মচারী। আগে দুএকজন যা ছিল ফাঁক-তোল, ভাঁজ-খাঁজ দেখা যেত। কিন্তু কয়েক বছর আগে অন্য জায়গায় বদলির পরে শুধু ফাঁকা মরুভূমি।
তবে খুব ভালো লাগার জায়গা হল ট্রেনের কামরা। যদিও তিনি খুব একটা সক্রিয় যাত্রী নন। এমনকী তাঁকে নিয়ে ইয়ার্কিতে ফাজলামিও বেশি হয়। তাও অন্য কেউ কিছু বললে শোনেন, অন্যের ইয়ার্কিতে মন পুলকিত হয়ে ওঠে। তাঁদের নজনের নিত্যযাত্রীর দলে কোনও মহিলা সঙ্গী নেই। বোসবাবু ছাড়া বাকি সবাই কম-বেশি নেশা করেন, খিস্তিখাস্তাও চলে। মহিলা নিত্যযাত্রী থাকলে অসুবিধা হয়।
এমনি যাত্রীদের সেরকম পাত্তা দেওয়া না হলেও, মহিলা যাত্রীদের আড় চোখে দেখে নেওয়া হয়। বোসবাবুও এই রস নেওয়া থেকে বাদ যান না। বিশুদা এলে খুব ভালো লাগে, তিনদিন আসেন বিশুদা। ওষুধ সাপ্লাই করেন, জামার বাঁ দিকের পকেট থেকে প্যাড বের করে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, কপাতা? সঙ্গে একটা দামি মোবাইল থাকে। নিজের কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মোবাইলটা বেশির ভাগ দিনেই বোসবাবুকে দিয়ে দিলে, তিনি ওটাকে আড়ালে নিয়ে চলে যান। একমনে দেখেন, আর শরীরের ঘুম ভাঙান। অনেকেই এই ব্যাপারটা দেখে টিপ্পনি কাটে, তবে তাতে বোসবাবুর কোনও কিছু এসে যায় না, হেসে উড়িয়ে দেন।
নজনের নিত্যযাত্রীদের প্রায় সবাই বযস্কদের জায়গা ছেড়ে বসতে দেন। আর জায়গা ছাড়েন ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যাত্রীদের। শুধু কম বয়সী মহিলা, কলেজ পড়ুয়াদের বসতে জায়গা ছাড়েন না। তবে সেদিন এর ব্যতিক্রম ঘটল এবং ঘটালেন সেই মানস বোস।
লোকাল ট্রেনে সেদিন অস্বাভাবিক রকমের ভিড়। দেওঘরের কোনও এক আশ্রমের উৎসবের জন্য ট্রেনের সব কামরা তাদের দখলে। ট্রেনে ওঠার আগে এই খবরটা পেলেও কোনও এক্সপ্রেস ট্রেন না থাকার কারণে সবাইকে লোকালেই উঠতে হয়। উঠতেই পিছনের থেকে কেউ একজন বলে উঠল, কাকা, আজ মাছিও গলবে না। বোসবাবু তাকে কোনও উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে এগিয়ে যান।
অন্যদিনে যে-সিটে তিনজন বসে থাকে আজ সেখানেই পাঁচজন। বোসবাবু কোনও রকমে একটা জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেনাজানা কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে লাগলেন। মাথা নাড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানালেন। কেউ আবার তাঁকে দেখে বলে উঠল, বোসদা আমাদের এদিকে আসুন, গল্প করা যাবে।
না ভাই, আজ যে এখানে দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছি এটাই অনেক।
কেউ আবার বলে উঠল, কি রে মানসা, কোনও এক্সপ্রেস পেলি না? ভিড়ে মরতে এলি, না মারাতে?
বোসবাবু এবারেও হেসে উত্তর দেন, উৎসব চলছে তো তাই এত ভিড়।
নিত্যযাত্রীদের অনেকেই সেদিন পেপার বা পলিথিন পেতে দরজার সামনে বসেছিল। বোসবাবুর একবার এভাবে বসতে গিয়ে প্যান্ট ফেটে গেছিল! সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। সারাটা দিন ভগবানকে গালাগালের সাথে, জামা দিয়ে ফাটা জায়গা ঢাকতে হয়েছিল। তবে এইদিন মানসবাবুর ভাগ্যটা হয়তো একটু প্রসন্ন ছিল। পরের স্টেশনে একটা জায়গা পেয়ে গেলেন। গোটা সিট না হলেও এই বাজারে সেই সিটের যে কী মহিমা, তা আর বোঝাতে হবে না। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে শুনলেন, বোসদা আজ একটা লটারি কেটে নিন।
বোসবাবু কিছু না বলে হালকা হাসলেন। বুঝতে পারলেন নজর লেগে গেল, হলও তাই। এক স্টপেজ যেতে না যেতেই একটা মেয়ের গলা কানে এল, কাকু কাইন্ডলি আমাকে একটু বসতে দেবেন, পায়ে খুব ব্যথা করছে, আজ আমার পরীক্ষা আছে। বোসবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। তাঁর মেয়ের মতোই বয়স, একটু বড়োও হতে পারে। জিন্স-এর প্যান্ট আর কুর্তি পরে আছে। গায়ে রং-টা চাপা হলেও মুখটা বেশ ভালো। কোনও ছেলে হলে এতক্ষণ জবাব না দিয়ে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন। সেই জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বোসো, তবে জায়গাটা খুব কম। মেয়েটি বোসবাবুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে, থ্যাংক ইউ বলে বসেই হাতে থাকা একটা খাতাতে চোখ ডুবিয়ে দিল।
বোসবাবু আবার আগের জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আড়চোখে মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন। দুএকজন চেনা নিত্যযাত্রী দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি চোখের ইশারাতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটি বলে উঠল, কাকু তোমার ব্যাগটা দাও, আমি ধরছি। বোসবাবু, না, ঠিক আছে বললেও মেয়েটি মানসবাবুর হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় কেড়ে নিজের কোলে নিয়ে তার ওপর খাতা রেখে পড়তে আরম্ভ করল।
হাতের ভার কমলেও বোসবাবু আর মেয়েটির কুর্তির কোনও ভাঁজ দেখতে পেলেন না। তবে সারাদিন মনটা বেশ বাগান বাগান হয়ে থাকল। অলিগলি থেকে ট্রেনের মেয়েটার ভেসে ওঠা মুখটা শরীরটাকেও নাড়িয়ে দিচ্ছিল। কাজ করবার সময় গুনগুন গান আঙুলগুলোর মধ্যে একটা অনুঘটকের কাজ করছিল। এমনকী বাড়ি গিয়ে বউয়ের মুখ ঝামটা শুনেও সেরকম কোনও প্রতিক্রিযা হয়নি।
বাড়ি ফিরে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে অথবা হাওয়ার সাথে মিশিয়ে নিজের গাওয়া দু-এক কলি গান গাওয়ার মধ্যেও মেয়েটি চলে আসে। রাতে শুয়ে ঘুম আসেনি। বন্ধ চোখের সামনে সেই মুখ মনে শরীরে এক অদ্ভুত তৃপ্তি এনে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য বউয়ের ভয়ে বাথরুম চলে যেতে হল।
তার পরের দিনও সেই একই রকমের ভিড় ঠেলে কিছুটা ট্রেনের ভিতরে গিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই, আগের দিনের মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখে একটু রাগই হল। নিশ্চয়ই আবার কারওর পি… মেরে জায়গা করে নিয়েছে। কিছু না বলে একটু ইতস্তত করে আরও ভেতরের দিকে যাওয়ার পরেই পিছনের দিক থেকে শুনলেন, ও কাকু, আমি এখানে, দেখতে পাওনি?
বোসবাবু আর না এগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, না, মানে দেখতে পাইনি।
বুঝেছি, আর বলতে হবে না। না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলে।
মানসবাবুর মাথাতে আর কোনও জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা এল না। আমতা আমতা করে বললেন, তুমি পড়ছিলে তো তাই।
কই আজ তো আমি পড়িনি।
পরীক্ষা শেষ?
কাল একটা ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা ছিল।
তারপরে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাকু, আজ তুমি বোসো।
না না ঠিক আছে। আমরা তো প্রতিদিন জায়গা পাই না। দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে।
পাশে বসে থাকা আর একজন যাত্রী বললেন, আপনি বসুন, আমি পরেরটাতেই নেমে যাব।
মেয়েটির পাশে কুঁকড়ে বসতেই মেয়েটি বলে উঠল, ও কাকু, তুমি ওরকম জড়ভূতের মতো বসে আছো কেন? বি কমফর্টেবল।
না না, আমি ঠিক আছি।
দূর কিছু ঠিক নেই।
মানসবাবু মেয়েটির দিকে আরও একটু সরে বসলেন।
আজও আগের দিনের মতোই জিন্স আর টপ পরেই এসেছে। ডান কাঁধের সাথে বোসবাবুর বাঁ কাঁধ লেগে আছে, কনুইটা বুকের কাছাকাছি।
পিছন থেকে নিত্যযাত্রী ভোম্বল বলে উঠল, বোসদা লটারি কিনেছিলেন? আজ মিলিয়ে নেবেন, ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গেছেন। শুধু বউদিকে একটু সাইজে আনতে হবে।
ওষুধের বিশুদা বলে উঠল, নতুন ডাউনলোড করেছি দেখবেন নাকি? দেব ওখানে। বোসবাবু কিছু সময় মেয়েটির কাছে বসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, তুমি এখানে বোসো, আমি একটু বন্ধুদের কাছে যাই, ওরা আবার কী ভাববে।
ওরা তোমার লেগপুল করছে?
না না। আসলে প্রতিদিন একসাথে যাই তো, তাই একটু মজা করছে।
কথাগুলো শেষ করেই জায়গাটা ছেড়ে পিছনের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু নিত্যযাত্রীদের কাছে রীতিমতো টোন টিটকিরি সহ্য করতে হল। সেটা অবশ্য প্রতিদিনই হয়। তবে সেদিন এতটাই মাত্রা ছাড়াল যে, বোসবাবু তাদের থেকে পাশে সরে দরজার সামনে একাই দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাওয়া আসছিল, মনটাও ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন যেন অস্থির। সব সময় ইয়ার্কিও ভালো লাগে না।
কাকু বসবে না তুমি? কথাটা শুনে ঘাড়টা ঘোরাতেই দেখলেন আবার সেই মেয়েটি, এক্কেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বোসবাবু একটু কঠিন ভাবে বললেন, কী ব্যাপার তুমি উঠে এলে?
তুমি বসবে না?
তুমি বোসো।
মেয়েটি আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে নিজের জায়গাতে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর মানসবাবুর মনটা হু হু করে উঠল। মেয়েটিকে এরকম ভাবে না বললেই হতো। বেচারি শুধুমাত্র বসতে বলবার জন্য এসেছিল।
মেয়েটির কাছে গিয়ে ওকে সরিয়ে নিজের বসবার ব্যবস্থা করলেন। কিছু সময় পরে মেয়েটি, বোসবাবু কোথায় কাজ করতে যান থেকে আরম্ভ করে, বাড়িতে কে কে আছে, সব জেনে নিল।
মানসবাবুও জানলেন ওর নাম অনুশ্রী। এবার নিত্যযাত্রীরা কেউ কিছু বললেও, বোসবাবু কাউকে কোনও পাত্তা দিলেন না। সারাটা রাস্তা অনুশ্রীর সাথে গল্প করে যেতে লাগলেন।
ট্রেন থেকে নেমেই অনুশ্রী বলে, কাকু তোমার অফিস তো কাছেই, পরের ট্রেনে তো আসতে পারো। দশটার মধ্যে ঢুকে যাবে।
ট্রেনের কামরাতে থাকবার সময় অনুশ্রীর কথাটা সেরকম ভাবে না শুনলেও, অফিসের রাস্তায় হাঁটবার সময় কথাগুলো কানের কাছে গুন গুন করতে আরম্ভ করল। সত্যিই তো পরের ট্রেনটাতেও আসা যায়! বাড়িতে আরও আধ ঘন্টা বেশি সময় পাওয়া যাবে। আর একটু বেশি সময় ঘুমানো যাবে। ট্রেনেও শুধুমাত্র অনুশ্রী। তাছাড়া অফিসে তাড়াতাড়ি এসেই বা কী করবেন, সেই তো বসে বসে পেপার পড়া। না হয়, এর ওর সাথে গল্প করা। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।
অনুশ্রীর মোবাইলে ফোন করতেই সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে উত্তর আসে,
বলো কাকু…
ক্লাসে?
না, এই তো নামলাম।
শোনো কাল থেকে পরের ট্রেনেই আসব।
বেশ কাকু তাই হবে। পিছনের থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠবে, আমি জায়গা রাখব।
পরের দিন থেকেই মানসবাবু সব কিছু আধঘন্টা পরে করতে আরম্ভ করলেন। সেই ঘুম থেকে ওঠা থেকে আরম্ভ করে বাস ধরা পর্যন্ত সব কিছু আধ ঘন্টা পিছিয়ে গেল। বাকি সব কিছু একই ভাবে চললেও আরেকটা বড়ো পরিবর্তন বউয়ের চোখে পড়ল। অফিসে যাওয়ার সময় এই প্রথম জামা ইন করে পরতে আরম্ভ করলেন, সঙ্গে জুতো। এমনকী মেয়ের বডি স্প্রে-র গন্ধও জামার ঘামের গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। বউ সব কিছু দেখেও কিছু বললেন না। কিন্তু মাস দেড় পরে স্বামীর সাজ বেড়ে উঠতে দেখে, একদিন মানসবাবু বেরিয়ে গেলে, মেয়ের সাথে আলোচনা করলেন, হ্যাঁ রে তোর বাবার হল কী? এত চকচকে পোশাক, উড়ো উড়ো ভাব, বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়ল নাকি?
মেয়ে সব কিছু দেখে শুনে, মাকে চিন্তা করতে বারণ করলেও নিজের কাছে অস্বস্তি গোপন থাকল না। ট্রেনে কিন্তু বোসবাবুর যাতাযাতের মজা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। পরের ট্রেনটা তুলনামূলক ফাঁকা আসে। অনুশ্রীও প্রতিদিন বোসবাবুর জন্য জায়গা রেখে দেয়। সারাটা রাস্তা দুজনে গল্প করতে করতে চলে যান। শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিনে মন খারাপ লাগে। অনুশ্রীকে ফোন করেন।
বিশুদা কথা প্রসঙ্গে মোবাইলে আরও নতুন কিছু আনার খবর দেয়। মানসবাবু উত্তরে শুধু হাসেন। কিন্তু ট্রেন বা কার সঙ্গে কোন কামরাতে উঠলেন, সে সম্পর্কে কোনও কথাই বলেন না। রাতে ফিরে একা বসে প্রায়ই গুনগুন করে গান করেন। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি। বউ ঘুমিয়ে থাকা বোসবাবুকে দেখে বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু বুঝতে না পেরে পরের দিন বোসবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরে, আবার মেয়ের সাথে আলোচনা করতে বসেন।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে মানসবাবু অবাক হয়ে যান। বেল বাজাতেই বউ তাড়াতাড়ি এসে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে চেযার টেনে বসতে দেন। হাত মুখ ধোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছে চা তৈরি করে দেন। মেয়ে ডিম পাঁউরুটি তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মানসবাবুর খাওয়ার আগে অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকেন।
বিবাহবার্ষিকী, দু-একটা পূজাপার্বণ আর মেয়ের জন্মদিন ছাড়া, অফিস থেকে ফিরে এরকম জলখাবার আর কোনও দিন হয় কিনা মনে করতে পারলেন না। তাই অত খাবার দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি কোনও অনুষ্ঠান আছে? কোনও পুজো-টুজো!
না না, অনুষ্ঠান কেন থাকবে? রোজ ওই এক মুড়ি। তাই মাম্পি বলল, ডিম পাঁউরুটি করবে। এই টিফিনটা শুধুমাত্র একদিনের জন্যেই নয়। এরপর অফিস থেকে ফিরলেই বিভিন্ন রকমের টিফিন নিয়ে মা, মেয়ে হাজির থাকত।
এখন রাতে শুয়ে বউ নিজের থেকে নিজের দিকে টেনে, বিয়ের প্রথম কয়েক বছরের সেই সব দিনের কথা আলোচনা করে। তারপর মাঝে মাঝেই জানলাতে মুখ রেখে মাম্পি ঘুমিয়ে গেছে কিনা দেখে নিয়ে নিজেদের ঘরের দরজার ছিটকিনিটা তুলে দেয়। বোসবাবুর এখন ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়। তবে অসুবিধা হয় না, হেঁটে এলেই হাতে রেডি চা পেয়ে যান।
এখন আর আনাজ কাটতে বসতে হয় না, ভাতের জলও চাপাতে হয় না। সব কাজ মা আর মেয়ে মিলেই সামলে দেয়। বোসবাবু ট্রেনে যাওয়ার সময় অনুশ্রীর সাথে সব কিছুর আলোচনা করেন, তবে পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারেন না। অনুশ্রীও কিছু বলে না।
একদিন প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজে উঠতে উঠতে পুরোনো নিত্যযাত্রীদের দলের তপন ফোন করে, কী ব্যাপার বোসদা, আমাদের ছেড়ে নতুন বান্ধবী পাতিয়েছেন শুনলাম! বউদি সব জানে তো? গা পিত্তি জ্বলে উঠল। কাছে থাকলে টেনে দুথাপ্পড় কষাতেন।
বেশ জোর গলাতেই উত্তর দিলেন, সে খবরে তোমার কী দরকার? বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।
ট্রেন আসতে মিনিট দশ দেরি হল। পিছনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠলেন। অনুশ্রী বাঁ দিকটাতে বসে। বোসবাবু বাঁ দিক দেখলেন, ডান দিক দেখলেন, কই নেই তো! সামনে উঠল নাকি? চলন্ত ট্রেনের ভিতর হেঁটে সেই কামরার সামনের দিকে এলেন। না নেই। ভালো লাগছে না। মোবাইলের কন্ট্যাক্ট-এ গিয়ে অনুশ্রীকে ডায়াল করলেন। কী আশ্চর্য! ফোন বন্ধ! তাহলে? একটা জায়গাতে বসলেন বোসবাবু, কিন্তু অনুশ্রী কই? আসেনি, নাকি সামনের দিকে উঠল? এরপর কি পুরো ট্রেনটা দেখতে হবে? শরীরে একটা অস্বস্তি আরম্ভ হল। না আর বসা যাবে না।
অফিসেও সেদিন কোনও কাজ করা তো দূর, ভালো করে বসে থাকতেই পারলেন না। একটা চাপা কষ্ট তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। বাড়িতে সেই এক অবস্থা। পরের দিন একটু আগে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগের ট্রেনে অনুশ্রীর কলেজে পৌঁছলেন। বহু কষ্ট করে ভিতরে গিয়ে ডিপার্টমেন্টও পৌঁছোলেন। কিন্তু নাম বলতে কেউই বুঝতে পারল না। একজন তো বলেই দিলেন, অনুশ্রী নামে এই ডিপার্টমেন্ট-এ কেউ নেই।
কলেজের রাস্তা ধরে অফিসের রাস্তায় আর যেতে ইচ্ছে করল না। কী রকম একটা লাগছে! তার মানে আগামীকাল থেকে সেই জীবন! সেই ট্রেন? সেই বউ মেয়ে?
কলেজের রাস্তার পাশে থাকা বেঞ্চে বসলেন। কত হাজার হাজার কমবয়সী ছেলে-মেয়ে কলেজে ঢুকছে। বোসবাবু তাদের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকলেন।
হঠাৎ দুকানে ও কাকু… ডাক শুনে একটু চমকে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে আরম্ভ করলেন। না মানুষটা ধারে কাছে নেই!