‘সে কী মশাই আপনি এখনও একটাও সম্মাননা পাননি! ছোটো বড়ো কোনও অ্যাওয়ার্ড? তাও না?’ প্রশান্ত এমন করে কথাগুলো বলল, কিছুতেই যেন তার মুখের রেখাগুলো থেকে, অশ্রদ্ধার ভাবটা লুকোনো গেল না। বর্ষীয়ান মানুষ অমূল্যবাবু। কিছু না হোক বয়োঃজ্যেষ্ঠ হিসেবে তো তাঁর একটা সম্মান প্রাপ্য হয়! অপমানটা কোনও রকমে গিলে ফেলে মুখে একটু হাসির ভাব এনে অমূল্যবাবু বলার চেষ্টা করলেন ‘না’। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। তাই মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

‘অ! তা আমার কিন্তু আপনাদের আশীর্বাদে ২৮টা হল,’ বেশ গদগদ শোনাল প্রশান্তর গলা।

বছর ৪৮ বয়স হবে প্রশান্তর। খুব বেশি দিন লেখালেখি করছে বলেও জানা নেই অমূল্যবাবুর। তিনি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন প্রশান্তর মুখের দিকে। কী যেন ছিল সেই তাকানোয়, প্রশান্ত বেশিক্ষণ তাঁর চোখে চোখ রাখতে পারল না। মাথা নীচু করে মুখে একটা অহংকারী ভাব রেখে বলল, ‘সাহিত্যকর্ম তো আর যে-কেউ পারে না দাদা। এটা আপনার মতো পোড় খাওয়া লেখকরাই বুঝবেন। আচ্ছা চলি, ফেরার সময় একবার বাজারটা ঘুরে যাব। পা চালিয়ে এগোই৷’ কথাটা বলে প্রশান্ত ভিড়ে মিশে যায়।

অমূল্যবাবুর বয়স আটষট্টি। একটা স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পর থেকে একটু বেশিই সাবধানী হয়ে পড়েছেন। একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে। স্ত্রীকে নিয়ে বোলপুরের বাড়িতে থাকেন অমূল্যবাবু। সাদামাটা একটা সরকারি চাকরি করতেন। লোন নিয়ে তখন বাড়িটা বানিয়ে ফেলেছিলেন বলে আজ নিশ্চিন্তে অবসর জীবন কাটাতে পারেন। লেখালিখির একটা বাতিক আছে।

‘বাতিক’! এমনটাই বলেন সুরমা,তাঁর স্ত্রী। সেই কারণেই তেমন অ্যাম্বিশাস হতে পারেননি অমূল্যবাবু। কোনও দিন বিরাট লেখক হয়ে দেশের নানা প্রান্তে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়বে, এমনও ভাবেননি। কিন্তু যে-টুকু যা লেখালেখি করছেন, তা এই বোলপুরের সাহিত্য সভা-টভায় বেশ প্রশংসিত হয়েছে। প্রতি শুক্রবার সন্ধেবেলা এখানকার একটি পাঠাগারে সাহিত্যচর্চার আসর বসে। তাঁর মতো যাঁরা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা আসেন। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, নতুন লেখা পাঠ এসব নিয়ে দিব্যি সময়টা কেটে যায়। সেখানেই প্রশান্তর সঙ্গে আলাপ। খুব যে আহামরি কিছু লেখে তেমন নয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই এতগুলো সম্মানলাভ, ব্যাপারটা আজ একটু হলেও ভাবিয়েছে অমূল্যবাবুকে।

গোলাপ গাছগুলোয় বারবার পোকা লেগে যাচ্ছে। মালিকে সঙ্গে নিয়ে তাই আজ সকাল থেকেই বাগান পরিচর্যায় মেতেছেন সুরমা। সাবানজল গুলে বাড়িতেই তৈরি করেছেন কীটনাশক। ভালো করে সেটা স্প্রে করছেন গাছে। মালি খুপরি নিয়ে মাটি খোঁচাচ্ছে।

অমূল্যবাবুর কাগজ পড়ায় আজ তেমন মন নেই। সকালে দেওয়া চা-টাও পুরোটা খাননি। দুটো মাছি সমানে কাপের গায়ে আটকে থাকা চিনির উপর উড়ে উড়ে বসছে। সেদিকেও তেমন লক্ষ্য নেই অমূল্যবাবুর।বাড়ির গেটের বাইরে খোলা রাস্তা, তারও পরে বটগাছ আর ফণীমনসার ঝোপের ওধারে তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত।

ছেলে বছর দুয়েক হল একটা কম্পিউটার কিনে দিয়ে গেছে। ব্যবহারটাও মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছেন অমূল্যবাবু। ওটাতেই টাইপ করেন এখন। কিন্তু তিনি ভাবছেন অন্য কথা। প্রশান্ত কথায় কথায় যা বলছিল, সেই ভাবনাটাই তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এইসব সম্মান জ্ঞাপনের আমন্ত্রণগুলো প্রশান্ত মেইল-এ পায়। এরকম মেইল তো তাঁর কাছেও আসে বটে। কিন্তু ছেলে বলে প্রচুর স্প্যাম মেইল জমে মেইল বক্স-এ। তাই কয়েক মাস ছাড়া ছাড়াই জাংক মেইল খালি করে দেন অমূল্যবাবু।

আজ কী মনে করে চেয়ার থেকে উঠে সোজা কম্পিউটারের ঘরে চলে এলেন। মেইল বক্স খুলে বেশ কিছু পুরোনো মেইল হাতড়াতে শুরু করলেন। হ্যাঁ, এই তো গোটা পাঁচেক এই ধরনের সাহিত্যসভার আমন্ত্রণী মেইল খুঁজেও পেলেন, যেগুলো অনাদরে ফেলে রেখেছিলেন এতদিন। নিজ মুখে স্বীকার না করলেও, অমূল্যবাবু টের পাচ্ছিলেন তাঁর মধ্যে একটা ইচ্ছার সঞ্চার হচ্ছে। একটা সবুজ গিরগিটি যেন মনের মধ্যে পুরস্কার পাওয়ার ইচ্ছা হয়ে প্রবেশ করেছে। রং বদলে এখন কমলা দেখাচ্ছে গিরগিটিটাকে। ইচ্ছাটা প্রবল হতে হতে ক্রমশ লোভ হয়ে উঠছে। সম্মানলাভের লোভ, অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার লোভ। পরক্ষণেই গিরগিটিটা বাদামি রং নিচ্ছে। এবার তিনি হিংসা টের পাচ্ছেন মনের ভেতর। তাঁর হাঁটুর বয়সি প্রশান্ত সেও এত কম বয়সে এতগুলো সংস্থা থেকে সম্মান পেয়ে গেল! আর তিনি? কী লাভ এই লেখালেখির, যা তাঁকে জনপরিচিতি দেয় না? চারটে পদক, দুটো মানপত্র এটুকুও যদি এই বয়সে পৌঁছে না থাকে তাঁর, তবে কীসের লেখক তিনি!

একবার ঝট করে টেবিলের একপাশে স্তূপ করে রাখা, তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিগুলির উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নেন অমূল্যবাবু। এই সব সাহিত্যকীর্তি তো একদিনে হয়নি। তাঁর বহু পরিশ্রমলব্ধ এই লেখাগুলি, বহু বছরের ফসল। সমাদর পাওয়ার অধিকার ওই পুঁচকে ছোঁড়ার যদি থাকে, তবে তাঁরও আছে। তিনি দিব্যি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন, সাহিত্য সভায় তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে এগিয়ে আসছেন কোনও এক গণ্যমান্য ব্যক্তি। মাইকে অ্যানাউন্স করা হচ্ছে অমূল্যভূষণ চক্রবর্তীর নাম, থালায় ফুল আর মানপত্র নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে একটি কমবয়সি মেয়ে৷সলজ্জ অথচ গুণমুগ্ধতার ভাব তরুণীটির চোখেমুখে।

ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন অমূল্যবাবু। বিভিন্ন তারিখে আসা ওই পাঁচটি মেইল-এর একটি তিনি ক্লিক করেন। বর্ধমান-এর একটি প্রকাশনীর সহযোগিতায় জনৈক সাহিত্য-অনুরাগী একটি সংস্থা, সম্মান জ্ঞাপনের এই অনুষ্ঠান আয়োজন করবে মাসদুয়েকের মধ্যেই। চিঠিতে লেখা আছে—

‘মাননীয় মহাশয়,

আমাদের বহুল পরিচিত সাহিত্য সংস্থাটি আপনাকে শ্রেষ্ঠ লেখক হিসাবে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আপনি তা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক থাকলে, দয়া করে আপনার পাসপোর্ট সাইজ রঙিন ছবি, সম্পূর্ণ পরিচয়পত্র, সাহিত্যক্ষেত্রে উত্তরণের বৃত্তান্ত ও ১৫০০ টাকার মানিঅর্ডার বা নিম্নোক্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-এ রেজিস্ট্রেশন হেতু জমা দিন। একটি ফর্ম, এই মেইল-এর সঙ্গে যুক্ত করা হল। দয়া করে সেটি পূরণ করে  পাঠিয়ে দিন আমাদের দফতরে৷’

চিঠিটা বারদুয়েক পড়লেন অমূল্যবাবু। কিন্তু শেষ তারিখ পার হয়ে গেছে দেখে একটু বিমর্ষ হলেন।এরপর এক এক করে বাকি মেইলগুলিও খুলে পড়লেন অমূল্যবাবু। বয়ান প্রায় একইরকম। রেজিস্ট্রেশন ফি-এর অঙ্কটায় যা কিঞ্চিত্ তারতম্য। একটি মেইল-এ দেওয়া ফোন নম্বরে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। এই পত্রটিতে অবশ্য গল্প-উপন্যাস নয়, কবি হিসাবে সম্মান জ্ঞাপনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পুরস্কারের লোভটা এবার বেশ জাঁকিয়ে বসছে অমূল্যবাবুর মনে।

মালদা ইংলিশবাজারের একটি ঠিকানা দেওয়া রয়েছে এই মেইল-এ। সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন করতেই ওপাশ থেকে একটি গম্ভীর গলা ফোন ধরল।

‘হ্যাঁ বলুন’

‘বলছিলাম কি এটা কি বাগদেবী সাহিত্য মন্দির?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

‘না,আপনারা যে মেইল পাঠিয়েছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম। ইয়ে মানে আমি পুরস্কৃত হতে ইচ্ছুক, আর কী৷’

‘বেশ তো, ফর্ম ভরে টাকা পাঠিয়ে দিন। সব বলা আছে তো মেইল-এ’।

‘না মানে বলছি, যে-তারিখ দেওয়া আছে, আমার পূরণ করা ফর্ম পৌঁছোতে পৌঁছোতে তো তারিখ পার হয়ে যাবে তাহলে’?

‘আরে ওসব চিন্তা আপনি করবেন না। ফর্মটা মেইল-এ পাঠিয়ে দিন। সই-এর ব্যাপারটা আমরা ম্যানেজ করে নেব। আপনি টাকাটা খালি অ্যাকাউন্ট-এ ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন’।

‘সেকি! আপনারা আমার সাহিত্য একটু পড়ে দেখবেন না, মানে কয়েকটি প্রকাশিত লেখার কপি ইত্যাদি পাঠাব ভাবছিলাম…’

‘ওসব কী হবে! আরে আপনাকে আমাদের কমিটি নির্বাচন করে মেইল পাঠিয়েছে, মানেই তো বোঝা যাচ্ছে আমরা আপনার গুণগ্রাহী’!

এবার বেশ একটু নড়েচড়ে বসলেন অমূল্যবাবু, সত্যিই তো এরা বেশ কদর করেছে তাঁর প্রতিভার। এবার আরও একটু সাহস সঞ্চয় করে বলেন, ‘আচ্ছা ওই সাহিত্য ক্ষেত্রে উত্তরণের বিষয়ে কী লিখব বলুন তো’?

মানে আসলে আমার লেখা কিছু জাযগায় ছাপাও যেমন হয়েছে, বাতিলও হয়েছে এটাও সত্যি। মানে আপনার কাছে আর কী লুকোব। সব লেখককেই এই উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, নয় কী’?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো বটেই, সে তো বটেই’। ওপারের কণ্ঠস্বরে একটু যেন তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করলেন অমূল্যবাবু। যেন ফোনটা রাখতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু বয়স বাড়া বোধহয় একেই বলে। অল্প কথায় আজকাল আর সারতে পারেন না অমূল্যবাবু। অনেক অনেক কথা কোথা থেকে যেন এসে পড়ে গলার কাছে, আর আসা মাত্র মুখ দিয়ে বেরোতেও চায়। সুরমাও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ওঠেন, বলেন, ‘যা বলবে একটু সংক্ষেপে বলো না বাপু, আমার ঢের কাজ পড়ে আছে’।

ফোনটা সহজে ছাড়তে চান না অমূল্যবাবু। সব খোঁজখবর নেওয়া দরকার ভালো করে। যতই হোক প্রথমবার অ্যাপ্লাই করছেন পুরস্কারের জন্য। বললেন, ‘না আসলে আমি সারাজীবন সত্ ভাবেই লেখালেখি করেছি আর কী! লিটল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপলে ওরা সদস্য হওয়ার চাঁদার বিল ধরিযে দেয়। বইটাও কিনতে হয়। আর কাগজে বেরোলেও সেটা পত্রিকা অফিস ফ্রি-তে দেয় না আজকাল। লেখা বেরোল কিনা চেক করার জন্য, পাড়ার খবরের কাগজওলাকে কাগজটা দেখতে দিতে বললে সেও খিঁচিয়ে ওঠে, পাঁচ টাকা দিয়ে একটা কাগজ কিনতে পারেন না? রোজ এসে জ্বালান। কিন্তু আপনি বলুন দাদা, রোজ রোজ কত কাগজ আর পত্র-পত্রিকা কিনব, আমি তো একটা রিটায়ার্ড মানুষ,’ বলেই খ্যা খ্যা করে একটু জোরেই হাসলেন অমূল্যবাবু।

ওপারের কণ্ঠস্বর এবার বেশ বিরক্ত। বলে, ‘আর কী জানতে চান একটু তাড়াতাড়ি বলুন। আর টাকাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যাকাউন্ট-এ..’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। না আসলে প্রথমবার তো, তাই একটু নার্ভাস লাগছে আর কী! আর বলবেন না, পত্র-পত্রিকার সম্পাদকরাও আজকাল লেখা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন। বলে লেখা অমনোনীত হলে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। প্রতিলিপি রেখে লেখা পাঠান। বারবার ফোন করে লেখার ব্যাপারে খোঁজ নেবেন না। পত্রিকার গ্রাহক হয়েছেন? ও গ্রাহক হননি? তাহলে আর লেখা পাঠাবেন না…। বুঝলেন তো! এইসব চললে কী সাহিত্যচর্চার মতো জিনিস চালিয়ে যাওয়া যায়? তবে আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। এত বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে গেছি আমার সাহিত্যকর্ম। আমার গল্পের সংখ্যা ২০০-র বেশি, আর উপন্যাসের সংখ্যা ৩১। তবে সত্যি বলতে কী, কবিতা তেমন একটা লিখিনি’।

‘সে আমরা ম্যানেজ করে নেব। আপনি আসুন না,’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন। ওপারের ব্যক্তি।

একটু যেন মনক্ষুণ্ণ হলেন অমূল্যবাবু। তাছাড়া কবি হিসাবে সম্মান গ্রহণ করায় একটা মিথ্যাচার থাকবে তাঁর ক্ষেত্রে। সে অর্থে তো কবি তিনি নন, সাহিত্যিক বটে! তাই অন্য একটি মেইল খুলে ফেললেন।

এটা খোদ কলকাতার একটি ঠিকানা থেকে এসেছে। ‘চারণিক’ নামক এই সংস্থাটির রেজিস্ট্রেশন ফিজ একটু বেশি, ২০০০ টাকা। ফোন নম্বর দেওয়া আছে দেখে, কিন্তু কিন্তু করে ডায়াল করেই ফেললেন অমূল্যবাবু।

কলকাতার বিজয়গড়ের নিরঞ্জন সদনে আগামী মাসেই হবে এই সংবর্ধনা ও সম্মান জ্ঞাপন অনুষ্ঠান। স্পনসরশিপও নাকি রয়েছে এই সংস্থার। খুবই প্রেস্টিজিযাস সম্মান, এমনটাই বললেন চারণিক-এর পক্ষ থেকে জনৈক ব্যক্তি। ফোনে আরও যা যা জানবার একে একে প্রশ্ন করে ফেললেন অমূল্যবাবু। সব শেষে আমতা আমতা করে একটু অপ্রিয়-কথন করে ফেললেন।

‘আচ্ছা ইয়ে বলছিলাম যে, আপনাদের ওই রেজিস্ট্রেশন ফিজটা একটু বেশি নয় কী! মানে, আসলে অনেকগুলো টাকা তো…’

‘অনেক টাকা! কী বলছেন। ওটুকু তো লাগবেই। খোদ কলকাতার নামি সংস্থা থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবেন, প্রচার হবে, আর ওটুকু খরচ করবেন না? সম্মানপত্র বানানো, সংস্থার তরফে ব্যানার পোস্টার, হলভাড়া, সংস্থার স্মৃতিস্মারক, পুষ্পস্তবক এসবের খরচা নেই? কী বলছেন মশাই?’

ফোনের ওপারের ব্যক্তি প্রায় ধমকের মতো করে কথাগুলো বলে থামলেন। সত্যি বলতে কী, একটু যেন ঘাবড়েই গেলেন অমূল্যবাবু। তারপর পরিস্থিতিটা ম্যানেজ করার জন্য সুর আরও মোলায়েম করে বললেন, ‘তাও তো বটে! আচ্ছা বেশ বেশ। আমি কালই টাকাটা আপনাদের অ্যাকাউন্ট-এ ফেলার ব্যবস্থা করছি’।

‘বেশ, আর আগামী ১৬ আগস্ট সোজা চলে আসবেন আমাদের নিরঞ্জন সদনে। সকাল ১১-টার ভেতর পেঁছে যাবেন কিন্তু’।

ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটা শিহরণ হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। কম্পিউটারে ফর্ম পূরণ করে মেইল বন্ধ করলেন অমূল্যবাবু। কম্পিউটার শাট ডাউন করতে করতে দু’কলি গানও গুনগুনিয়ে উঠলেন।

সুরমা ঘরে ঢুকে স্বামীর খোশমেজাজ দেখে একটু অবাকই হলেন।

‘কী ব্যাপার বলো তো? চান করার কথা মনেই নেই তোমার। বলি আজ কি চান খাওয়া হবে না?’

‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও গিন্নি। এত দিনে তোমার স্বামীর প্রতিভাকে কুর্নিশ করার একটা সুযোগ পেতে চলেছ তুমি’।

‘সে আবার কী? মাথাটা কি বিগড়োল তোমার?’

‘আরে না গো না। কলকাতার একটি নামি সংস্থা আমায় সম্মানিত করবে আগামী ১৬ আগস্ট। ওদের অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে’।

খুশিতে চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সুরমার। বরাবরই স্বামীর এই সাহিত্যগুণকে তিনি আপদ হিসাবেই জ্ঞান করে এসেছেন। কী হবে এসব ছাইপাঁশ লিখে, এমন বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন। স্বামী গরবে গরবিনী হয়ে আজ তিনি বেশ ডগমগ হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘এ তো দারুণ খবর গো! দাঁড়াও আজ রাতেই খোকা ফোন করলে দিতে হবে খবরটা। হ্যাঁ গো তোমায কি তাহলে কলকাতা যেতে হবে নাকি?’

‘নিশ্চয়ই হবে। অত বড়ো সভায দাঁড়িয়ে সম্মান গ্রহণ করব, সেকি মুখের কথা! ওরা আমার লেখাগুলো নিশ্চয়ই সব খুঁটিয়ে পড়েছে, বুঝলে গিন্নি। আজ আমার সাহিত্যচর্চা সত্যিই সফল হল মনে হচ্ছে’। উত্তেজিত শোনায় সুরমার কণ্ঠও। বলেন,

‘হ্যাঁ গো তোমার জন্য তবে কালই বেরিয়ে একটা ভালো পাঞ্জাবি কিনে আনব। আর সঙ্গে ছেলের দেওয়া ওই ফরাসডাঙার ধুতিটাই পোরো না হয় ওইদিন’।

‘উফঃ, এখন থেকে এত উত্তেজিত হোয়ো না। একগাদা খরচ করে বোসো না’।

‘না না, ওসব শুনব না। অত বড়ো সাহিত্য সম্মান নিতে যাচ্ছো, তা কি একটা এলেবেলে পোশাক পরে গেলে ভালো দেখায়!’

সেই কাক ভোরে আজ বাড়ি থেকে বেরিযেছেন অমূল্যবাবু। দু’বার লোকাল বদলে হাওড়ায় এসে নেমেছেন। সুরমা শোনেননি। সুন্দর একটা চিকন কাজ করা সাদা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছেন। পাঞ্জাবি, ধুতি আর পাম্প শু পরে বেশ দেখাচ্ছে অমূল্যবাবুকে। সেই বিয়ের দিনটির মতো। উত্তেজনা একটা ভেতরে ভেতরে বেশ টের পাচ্ছেন তিনি। দেরি হয়ে যাবে ভেবে, স্টেশনে একটু চা-বিস্কুট খেয়ে চড়ে বসেছেন বিজয়গড়ের মিনিতে। না হোক বার তিনেক কন্ডাক্টরকে বলেছেন ঠিক জায়গায় নামিয়ে দেওয়ার কথা। পাশে বসা তরুণীকে দু’বার জিজ্ঞেস করেছেন ক’টা বাজে।

বাস থেকে নামার সময় অল্প একটু মাথাটা ঘুরে গেল। আসলে এত ধকল অভ্যাস নেই তো। সামলে নিয়ে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে হাঁটা দিলেন নিরঞ্জন সদনের দিকে। গিয়ে বুঝলেন সময়ের একটু আগেই পৌঁছে গেছেন তিনি।

মূল অনুষ্ঠান শুরু বেলা ১টা থেকে। ঘড়িতে সবে পৌনে এগারোটা। উনি অত দূর থেকে আসবেন জেনেই হয়তো উদ্যোক্তাদের তরফে ওই ভদ্রলোক, ফোনে তাঁকে ১১টায় আসতে বলেছিলেন। হলের বাইরে ডেকরেটরের লোকজন ইলেক্ট্রিশিয়ান আর উদ্যোক্তাদের কয়েকজন ঘোরাফেরা করছে। জোর তোড়জোড় চলছে ভেতরে।

অমূল্যবাবু এগিয়ে গিয়ে একজনকে নিজের পরিচয় দিলেন। চারণিক গোষ্ঠীরই কেউ হবেন হয়তো। তিনি তেমন উত্সাহ না দেখিয়ে একটা চেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বসতে বলে, আবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ডেকরেটরের একজন এগিয়ে এসে তাঁকে চেয়ারে বেফালতু বসে থাকতে দেখে বললেন, ‘দাদা ধরুন তো ব্যানারটা, টাঙিয়ে দিই গেটে’।

আরও কিছুক্ষণ এটা সেটা টুকটাক ফাইফরমাশে সময় কেটে গেল অমূল্যবাবুর। তিনি অবিশ্যি কিছু মনে করেননি। এরা এত বড়ো একটা উদ্যোগ নিয়েছে, এটুকু সাহায্য না হয় তিনি করলেনই!

এক এক করে লোক আসতে শুরু করল এরপর। একটু কান পেতে গল্পগাছা শুনে অমূল্যবাবু বুঝতে পারলেন, তাঁরই মতো আরও অনেকে এসেছে সম্মান গ্রহণ করতে। জায়গাটা লোকের হাঁকডাক আর গালগল্পে বেশ জমজমাট হয়ে উঠতে লাগল। এদিকে অনেকগুলো ফুলের তোড়া নিয়ে একটি সাগরেদকে সঙ্গে করে একজন লম্বা চেহারার লোক প্রবেশ করল। সাগরেদটিকে ফুলগুলো যথাস্থানে রাখতে বলে, সে এবার এগিয়ে এল অমূল্যবাবুর দিকে।

‘আপনি অমূল্যভষণ চক্রবর্তী তো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ’।

‘বুঝেছি, আপনার সঙ্গেই ফোনে কথা হয়েছিল আমার। ছবি পাঠিয়ে ছিলেন তো, তাই চিনতে অসুবিধা হল না। চলুন ভিতরে বসবেন আসুন’। এই প্রথম অমূল্যবাবুর বেশ ভালো লাগল, কেউ অন্তত তাঁকে আলাদা ভাবে স্বাগত জানাল।

হলের ভিতরে তখন অনেকেই দর্শকাসনে জায়গা দখল করতে ব্যস্ত। ভদ্রলোকের থেকে অমূল্যবাবু জানতে পারলেন, তাঁরই মতো মোট ৫০ জন লেখককে সম্মান জ্ঞাপন করা হবে আজ। তিনি ওই পঞ্চাশজনের তালিকায় রয়েছেন সেটা শুনে খুশি হবেন নাকি হবেন না, বুঝতে গিয়ে সব কেমন গুলিয়ে গেল অমূল্যবাবুর। কিন্তু ওসব ভাবার তখন সময় নেই। সবাই জায়গা দখল করছে। তিনি এই বেলা একটা সিটে বসে না পড়লে, পুরো অনুষ্ঠানটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। হল বেশ ভরে উঠেছে ইতিমধ্যেই। এত সাহিত্য গুণমুগ্ধ রয়েছে এ শহরে, ভেবে বেশ ভালো লাগতে শুরু করল অমূল্যবাবুর।

উদ্যোক্তারা সবাইকে চা পরিবেশন করল। কিন্তু এবার বেশ খিদে পেয়েছে। একবার ভাবলেন বেরিয়ে কিছু খেয়ে আসবেন। কিন্তু জায়গা যদি দখল হয়ে যায়, এই ভয়ে বেরোলেন না তিনি। চা দিয়ে খিদেটা মেরে দেওয়ার চেষ্টা করলেন অমূল্যবাবু। স্টেজ সাজানো হয়ে গেছে। লম্বা একটা টেবিলের ওপারে দশটা চেয়ার। সাদা ঝালর লাগানো টেবিল ক্লথ আর টেবিলের উপর ফুল ও জলের বোতল সাজানো।

ঘোষক উঠে এবার একে একে সংস্থার সভাপতি-সহ অন্যান্য সম্মানীয় অতিথিদের স্টেজে ডেকে নিলেন। প্রধান অতিথি এই অঞ্চলের কাউন্সিলর। তাঁর জন্যই অপেক্ষা। তিনি এসে পড়লেই সভার কাজ শুরু হবে, এও বললেন ঘোষক। সেইমতো শুরু হল উদ্বোধনী সংগীত। দু’তিনটি বাচ্চা মেয়ে মিলে ‘ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা’ গাইল। অমূল্যবাবু মাথা নেড়ে নেড়ে শুনলেন ওই গান। ছেলেবেলায় ইস্কুলে এই গান তাঁর প্রার্থনা সংগীত ছিল।

সভা শুরু হয়ে গেছে প্রায় আধঘন্টা হল। অতিথিদের পুষ্পস্তবক দিয়ে অ্যাপায়নের পর, প্রত্যেকের বক্তব্য রাখা শুরু হল। আশপাশের সবাই এবার উশখুশ করা শুরু করল। কতক্ষণে এই বক্তব্য রাখা শেষ হবে কে জানে! এতজন বসে আছেন মঞ্চে! এসব মিটলে তবে ৫০ জনের সংবর্ধনা। শেষ হতে হতে তো বিকেল গড়িয়ে যাবে মনে হয়। এর মধ্যেই প্রধান অতিথির আগমন! তিনিও আপ্যায়িত হলেন পুষ্প ও উত্তরীয় দিয়ে৷ চারণিক প্রসঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বক্তব্যও রাখলেন।

মাথাটা বেশ টিপটিপ করছে অমূল্যবাবুর। একটু যেন দমটা বন্ধ বন্ধ লাগছে। তিনি অস্বস্তি অনুভব করছেন, এটা বোধহয় পাশের লোকটি বুঝতে পেরেছিল। একটি জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জল খাবেন?’

অমূল্যবাবু বোতলটা নিয়ে বেশ খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি অনুভব করলেন। এই ভদ্রলোক তাঁর চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেকের ছোটোই হবেন। তিনিও এসেছেন সম্মান গ্রহণ করতে।

সব কিছুরই যেমন শেষ আছে, স্টেজের অভ্যাগতরাও একসময় মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। এবার পুরষ্কার প্রদানের পালা। একটি করে মেমেন্টো, সংস্থার ব্যাজ ও একটি গোলাপ ফুল– প্রতিটি লেখককে এভাবেই বরণ করে নেওয়া হবে ও সম্মান জানানো হবে, বললেন ঘোষক। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে তিনটে।

দীর্ঘ নামের তালিকা নিয়ে এবার নাম ডাকা শুরু করলেন ঘোষক। দর্শকাসনে যেন হইচই পড়ে গেল। তারপর রীতিমতো হুড়োহুড়ি। লেখকপ্রতি দেড় মিনিট সময় বরাদ্দ হল। একজনের নাম ডাকতে না ডাকতে অন্যজন মঞ্চে উঠে পড়ছে, একজনের স্মারক অন্যজনের হাতে চলে যাচ্ছে। ধাক্কাধাক্কি, হইচই, একজন তো ডায়াস-এ ওঠার সময় পড়েই গেলেন।

এত কম সময়ের মধ্যে যে সম্মানজ্ঞাপন হয়ে যাবে, ভাবেননি অমূল্যবাবু। কোনও রকমে নিজের স্মারকটা বুকে চেপে বসে পড়লেন একটি চেয়ারে। সুরমা আসার আগে বলে দিয়েছিলেন, একটা ছবি তুলে এনো মোবাইলে কিন্তু সে সবের অবকাশ কোথায়!জানা গেল বিকেল চারটে অবধি হল বুকিং আছে। নিমেষের মধ্যে ৫০জনকে সম্মান জ্ঞাপন করা হয়ে গেল উদ্যোক্তাদের।

ঘোষক এবার স্পনসর-এর গুণকীর্তন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন সারছেন। তাঁর শেষ কথাগুলো আর কানে ঢুকছিল না অমূল্যবাবুর। বুকের বাঁ দিকটায় প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। এতটাই তীব্র ব্যথাটা যে, জোরে কাউকে ডাকতেই পারছেন না তিনি। চারপাশের কলরোল আর মাইকের শব্দে চাপা পড়ে গেল তাঁর ক্ষীণকণ্ঠ।

আর সামলাতে পারলেন না, চেয়ার থেকে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেলেন অমূল্যবাবু। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা হইহই শুরু হল তাঁকে ঘিরে। সবাই এগিয়ে এসেছে, কী হল, কী হল করে। কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলেন অমূল্যবাবু। চোখ বন্ধ। কে একটা পাশ থেকে বলে উঠল, ‘গ্যাস থেকে হয়েছে মনে হয়, চোখে জলের ঝাপটা দে’। কেউ একজন বলল, ‘স্ট্রোক নয়তো? মুখের একটা দিক কেমন বেঁকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে!’ আর-একজন কেউ আতঙ্কের গলায় বলল, ‘ওরে ডাক্তার ডাক। একটা স্ট্রেচারের ব্যবস্থা কর’।

চৈতন্য ক্রমশ লোপ পাচ্ছে অমূল্যবাবুর। খুব আবছা ভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠছে সুরমা আর খোকার মুখ। তিনি যেন তলিয়ে যাচ্ছেন জলের নীচে। মাইকে কারা যেন বারবার ঘোষণা করছে তাঁর নাম। করতালি, আর জলের শব্দের ভেতর থেকে আবারও কানে এল, ‘উফঃ কতবার বলেছি এইসব বুড়োগুলোকে ডেকে আনবে না সম্মান দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, নাও এবার ভোগো!’

কে একটা রাগত স্বরে বলল, ‘এসব চিটিংবাজির ব্যাবসা। পুরস্কার দেওয়ার লোভে টাকা নিয়েছে প্রত্যেকের থেকে’। এবার শুরু হয়ে গেল জোর বচসা। ‘আরে টাকা দিয়েছেন বলেই তো সম্মান পেলেন, আবার অত কথা কীসের?’ দুপক্ষই লড়ে যাচ্ছে। কে একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেছে, বুড়োটাকে শিগগির তোল’।

সবাই ধরাধরি করে এবার স্ট্রেচারে তুলল অমূল্যবাবুকে। চোখ খুলে শেষবারের মতো তাকানোর চেষ্টা করলেন অমূল্যবাবু। পারলেন না। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছেন জলের অতলে, গভীরে, আরও আরও গভীরে। হাতে ধরা স্মারকটা মুঠো আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। গোলাপটা তখনও সতেজ। শেষ সম্মানটা জানাতে সেটা রয়ে গেল তাঁর বুকের উপর।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...