গ্যাসে পাউরুটি সেঁকতে সেঁকতে স্ত্রী অনসূয়ার কথাই ভাবছিল দেবল। পনেরো দিন হল বাপের বাড়ি গিয়েছে অনু, আর এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কটা মাস কীভাবে কাটাবে জানা নেই দেবলের।

মা হতে চলেছে অনু। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে মাত্র তিনবারই যেতে পেরেছে সে। দেবলকে একা রেখে যেতে কিছুতেই মন চায় না অনুর। এবার দেবলই একপ্রকার জোর করে অনুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে। ওখানে থাকলে অনুর ঠিকমতো দেখাশোনা হবে। অফিস থেকে দেবলের ফেরার কোনও ঠিক থাকে না। এতক্ষণ এই অবস্থায় অনুকে বাড়িতে একা রাখতে দেবলের মন সায় দেয়নি। তাছাড়া ডাক্তারের কথামতো এইসময় একটু বিশেষ যত্নেরও প্রয়োজন  অনুর।

যথারীতি রোজকার মতো ডিম-পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই, দেবল অফিস পেঁছোল। লাঞ্চটা আজকাল বাইরেই সারে। অনু থাকতে টিফিন প্যাক করে ব্যাগে ভরে দিত। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়ি যখন ফিরল দেবল, নিজেকে অসম্ভব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। জিরিয়ে নিতে সোফায় এসে বসল। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল ফোনের একনাগাড়ে বেজে চলা ক্রিং ক্রিং শব্দে। অনুর ফোন। তাড়াতাড়ি উঠে বসল হ্যালো।

এত দেরি হল ফোন ধরতে? নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলে? এক কাজ করো বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নাও। বাড়িতে কিছু আর করতে হবে না, চিন্তিত লাগল অনুকে।

অনু ফোন ছেড়ে দিলে হাতমুখ ধুয়ে দেবল ফ্রেশ হয়ে নিল। সবে ফোনটা নিয়ে খাবারের অর্ডার দিতে যাবে, কলিংবেলটা বেজে উঠল। মনে মনে বিরক্ত হল, এই সময় কে আবার এল?

দরজা খুলতেই দেখল তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সি একটি তরুণী দরজায় দাঁড়িয়ে ফরসা, বেশ সুন্দরী। এক মুখ হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণায়।

আপনি?

আমি মিতা, আপনাদের ঠিক উপরের ফ্লোরেই থাকি।

কিন্তু আপনাকে তো আমি কোনও দিন…

দেবলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতা বলে উঠল, হ্যাঁ, আপনি আমাকে চেনেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। অনুর হাজব্যান্ড আপনি। অনু ডেলিভারির জন্য বাপের বাড়ি গেছে।

মিতার কথা শুনতে শুনতে একটা কথাই দেবলের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, ওদের সম্পর্কে মহিলা এত কথা কী করে জানলেন? এছাড়াও একই বিল্ডিং-এ থেকেও কী করে দেবল মহিলাকে চেনে না?

এত চিন্তা করতে হবে না। মাত্র একমাস আগেই এখানে শিফট হয়েছি আমি। কিছুই খবর রাখেন না দেখছি। আগে যারা থাকত তাদের জায়গায় এসেছি। অবশ্য আপনি সকালে অফিস বেরিয়ে যান, ফেরেন দেখি সেই সন্ধেবেলায়। আর আমাকে কী বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভিতরে আসতে বলবেন না?

ওহ! সরি, প্লিজ ভিতরে আসুন। দেবল মিতাকে বসার ঘরে সোফায় এনে বসায়।

সারাক্ষণ বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে না আপনার? বড়ো শহরের এই এক অসুবিধা। অন্যান্য সুবিধা তো প্রচুর আছে কিন্তু জায়গা অত্যন্ত সীমিত আর লোকগুলোও বড়ো স্বার্থপর। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অপরের জন্য কোনও সময় নেই।

মিতার কথা শুনে দেবল হেসে ফেলে।

আরে আমি আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। কথায় কথায় সেটা দিতেই ভুলে গেছি, বলে মিতা হাতে রাখা কাপড় ঢাকা থালাটা সোফার সামনেই টেবিলে নামিয়ে রাখল।

খাবার দেখে অস্বস্তি বোধ করছিল দেবল। কিন্তু কিছু বলার আগেই মিতা বলে উঠল, আমি জানি আপনি বলবেন এসবের কী দরকার ছিল? আরে আমি নিজের জন্য খাবার বানাচ্ছিলাম ভাবলাম, আপনারটাও বানিয়ে নিই।

মিতাকে হাসতে দেখে দেবলও মুখে হাসি টেনে আনে।

কথায় কথায় দেবল জানতে পারে, মিতা লখনউ-এর মেয়ে ওর স্বামী দুবাইতে ব্যাবসা করেন। এতদিন ওখানেই ছিল মিতা কিন্তু নিজে কিছু করবে ভেবে দেশে ফিরে আসে। এখানে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত সে।

ঠিক আছে আজ চলি। বাসনের চিন্তা করবেন না। সকালে এসে আমি নিয়ে যাব। মিতা চলে গেল। দেবল একদৃষ্টে মিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুব দিল।

সকালে বাসন নেওয়ার অছিলায় গরম গরম আলুর পরোটা আর এক বাটি দই জোর করে ধরিয়ে দিয়ে গেল দেবলের হাতে। দেবল প্রতিবাদ করলে, মিতা বলল, দেবলকে দেখে ওর মৃত দাদা অক্ষয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সুতরাং দেবল কিছুই আর বলে উঠতে পারে না।

 

এরপর থেকে রোজই কিছু না কিছু খাবার বানিয়ে দিয়ে যেতে আরম্ভ করে মিতা। অনু কিছু ভুল না ভেবে বসে, এই ভেবে বলব না বলব না করেও, শেষমেশ সবকিছু খুলে বলে দেবল।

সব শুনে অনু বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে, আমার এখানে চলে আসার আগেই ভদ্রমহিলা ওখানে শিফট করেন। অল্পবিস্তর আলাপ হয়েছিল। যাক বাড়ির তৈরি খাবার পাচ্ছ, আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু দেখো ওই খাওয়া অবধি, ওর থেকে বেশি কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না। নিজের রসিকতায় অনু নিজেই হেসে ওঠে।

কখনও পোলাও-মাংস তো কখনও লুচি-তরকারি আবার কখনও সাদামাটা ঘরোয়া খাবার রোজই কিছু না কিছু দেবলের কাছে আনা আরম্ভ করল মিতা। কিছু বললেই বলে, আপনার জন্য আমারও তো খাওয়া হচ্ছে।

এত কিছু খেয়ে ফিট থাকেন কী করে বলুন তো? জিজ্ঞেস করেই বসে দেবল।

কেন, রোজ হাঁটা এবং জিম দুটোই করি নিয়ম করে।

বাঃ, তাহলে চলুন কাল থেকে আমিও আপনাকে সঙ্গ দেব, দেবল বলে।

উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মিতা। এরপর রোজই সকালে দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে যেত আর সন্ধেবেলায় জিম যাওয়াটা ওদের রুটিন হয়ে দাঁড়াল।

ধীরে ধীরে মিতা আর দেবলের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল। বিশ্বাস থেকে মিতার উপর একটা নির্ভরতা গড়ে উঠল। কথায় কথায় একদিন আগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা শেয়ার করছিল দেবল, খেয়াল করল মিতা কিছুটা উদাস। কারণ জিজ্ঞেস করতে দেবল জানতে পারল, ডাক্তাররা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, মিতা কোনও দিনও মা হতে পারবে না। তবে ওদের স্বামী-স্ত্রীর ইচ্ছে কোনও অনাথ শিশুকে নিয়ে এসে মানুষ করা। এটা জানার পর মিতার প্রতি দেবলের মনে সম্মানের জায়গাটা আরও বেড়েছে।

সেদিন বিকেল থেকেই বৃষ্টি। আকাশ কালো করে শুধু মেঘের গর্জন। ছুটির দিন। অনুর কথা খুব মনে হচ্ছিল দেবলের। ও যদি বাড়িতে থাকত এই বৃষ্টির মরশুমে ছুটত গরম গরম পকোড়া ভাজতে। থালা ভরে দেবলের সামনে এনে রেখে দিত। নিজের হাত পুড়িয়ে পকোড়া ভাজতে মন চাইল না দেবলের। বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্যে  বুঁদ হয়ে রইল।

ফোনটা বাজতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল। মিতার ফোন, পকোড়া বানাচ্ছি। চলে আসুন আমার ফ্ল্যাটে।

যাক বাঁচা গেল। সত্যিই খুব পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি এখনই আসছি, বলে দেবল ফোন ছেড়ে দিল।

মিতার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতেই সঙ্গে সঙ্গে প্লেট ভর্তি করে পকোড়া হাজির। দেবলকে বসিয়ে মিতা পকোড়ার সঙ্গে গরম গরম চা বানিয়ে আনল। চা আর পকোড়ার সঙ্গে ওদের আড্ডাও বেশ জমে উঠল।

হঠাৎ-ই খেয়াল হল বাইরে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে।, আড্ডা মারতে মারতে খেয়ালই হয়নি। উঠব উঠব করেও কিছুতেই ওঠা হয়ে উঠছিল না। মাথাটাও কেমন জানি ঘুরছে বলেই মনে হল দেবলের। মিতা জোর করল, ডিনার খেয়ে যেতে হবে। বারণ করা সত্ত্বেও কথা কানে তুলল না মিতা। রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

হেঁটে একটু হাত-পাগুলো ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল দেবলের। সেই কখন থেকে এক ভাবে সোফায় বসে আছে। উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা জোরে ঘুরে গেল দেবলের। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল। জ্ঞান হারিয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়ল দেবল।

খানিক পরে মিতা এসে ঘরে ঢুকল। দেবলের ওই অবস্থা দেখে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। কোনও ভাবে টানতে টানতে দেবলের বেহুঁশ শরীরটাকে শোবার ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখল মিতা। যে-কোনও পুরুষমানুষের হুঁশ উড়ে যাওয়ার মতোই রূপ। ঘরের আলো নিভিয়ে দেবলের পাশে এসে শুয়ে পড়ল মিতা।

 

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই লক্ষ্য করল দেবল, মিতার নগ্ন শরীরটাকে ও বাহুবন্ধনে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। এ কী করে সম্ভব? চমকে উঠে বসল দেবল। ঘটনাস্রোত মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু সব অন্ধকার।

ততক্ষণে মিতাও উঠে বসেছে। চাদর দিয়ে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। দেবলের বিস্ফারিত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর দুই চোখ। দেবলের দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার? এর আগে কখনও এভাবে জবরদস্তি করোনি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কাল রাতে তোমার শরীরের জোরের সঙ্গে আমি পেরে উঠিনি।

লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারল না দেবল। নিজের প্রতি নিজেরই ঘেন্না হল। যে ওকে দাদার আসনে বসিয়েছিল, তাকেই ও নিজের বাসনার শিকার করল। এই ভুল ও কী করে করল? যে কিনা কোনও দিন অন্য মহিলাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। ভুল করে ফেলেছে, কী করেই বা সেটা শুধরানো যায়?

দেবলের ইচ্ছে হচ্ছিল ফোন করে মিতার কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু সাহসে কুলোল না। মিতা ফোন করা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। দেবলের ভয় করতে লাগল, মিতা যদি ওর উপর ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে অনু আর সমাজের সামনে কী করে সে মুখ দেখাবে? ফোনে অনুর সঙ্গে রোজই কথা হতো দেবলের কিন্তু এই ঘটনার কথা দেবল কিছুতেই অনুকে বলতে পারল না।

 

একদিন হঠাৎ নিজে থেকেই মিতা এসে হাজির হল দেবলের কাছে। দেবল ওকে দেখেই আমতা আমতা করে বলে উঠল, মিতা আমিই তোমার কাছে আসতাম ক্ষমা চাইতে।

কীসের ক্ষমা দেবল? সেদিনের ঘটনায় না তোমার দোষ ছিল আর না আমার। ঘটনাটা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে। দুর্ঘটনা ভুলে যেতে পারলেই ভালো। আমি মন থেকে ওটা মুছে ফেলেছি।

মিতার কথা শুনে দেবলের মধ্যে যেন প্রাণ এল। মনে হল, সত্যিই মিতার মতো মেয়ে হয় না!

দেবল, আমি একটা অন্য কাজে তোমার কাছে এসেছি। হঠাৎ আমার কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে এত টাকা আমার কাছে নেই। আমি তাড়াতাড়িই তোমাকে টাকাটা ফিরিয়ে দেব, বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মিতা দেবলের দিকে তাকাল।

কত টাকা?

পঞ্চাশ হাজার। টাকা এসে গেলেই আমি তোমার টাকা ফিরিয়ে দেব, দেবলের চোখে চোখ রাখে মিতা।

দোষী দোষ ঢাকতে কী না করে? যখন-তখন প্রযোজনের জন্য বাড়িতে চল্লিশ হাজার মতো রেখেই দেয় দেবল। সেই টাকাটাই বার করে এনে মিতার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমার কাছে চল্লিশ হাজারই আছে মিতা। টাকাটা দিয়ে দেবলের মনে হল, কিছুটা হলেও ওর অপরাধের বোঝা হালকা হয়েছে।

 

সেই শুরু। এরপর থেকে মাঝেমাঝেই মিতা কখনও দশ-বিশ হাজার টাকা দেবলের কাছে চাইতে শুরু করল। দিয়ে দিত দেবল, কিন্তু কত দিন? কুবেরের ধন নেই ওর কাছে! সুতরাং একদিন দেবলকে না বলতেই হল মিতার মুখের উপর। মিতাও চুপ করে থাকল না।

না শোনার অভ্যাস নেই মিতার। ফোঁস করে উঠল। তুমি কী ভেবেছ দেবল? ওই রাতের ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি? সেদিন তুমি যা কিছু করেছ তার সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। দেখতে চাও? বলে নিজের ফোনে রেকর্ড করা পুরো ভিডিও-টা তুলে ধরল দেবলের সামনে। ভিডিও-তে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে দেবল মিতার সঙ্গে জবরদস্তি করার চেষ্টা করছে আর মিতা ওর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সবকিছু দেখে ঘেমে উঠল দেবল।

কী বলো দেবল? ভিডিও-টা নিয়ে পুলিশের কাছে যাব, না সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল করে দেব? ভালোই হবে, অনুও দেখবে তোমার আসল রূপ, বাঁকা হাসি হেসে বলে মিতা।

শিউরে ওঠে দেবল। যে ওকে দাদা বলে মেনেছিল তার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার? ভাবতে পারেনি দেবল। সে মিতাকে কারণটা সরাসরি জিজ্ঞাসা করে। উত্তরও পায়।

একটা বড়ো বাড়ি দেখেছি। পঞ্চাশ লাখ দাম বলছে। তোমাকে দিতে হবে টাকাটা। একবারে নয়, কিছু কিছু করে দিলেই চলবে কিন্তু দিতে তো তোমাকে হবেই। নয়তো আমি কী করতে পারি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, শ্লেষের ভঙ্গিতে বলে মিতা।

খুব ভালো করেই বুঝেছে দেবল, ওর সঙ্গে আলাপ করাটা মিতার একটা কৌশল ছিল। অনুর কথাগুলো মনে পড়ল, কাউকে ভালো করে না জেনেশুনে ভরসা কোরো না। এটা যে কত বড়ো সত্যি আজ টের পাচ্ছে দেবল।

অনু ডেলিভেরির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে শুনেই দেবল কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কানপুর রওনা হল। অনুর বাপের বাড়ি ওখানেই। কিন্তু দেবল পৌঁছনোর আগেই অনু ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং হাসপাতালে পৌঁছে নিজের সন্তানকে দেখে গত কয়েক মাসের দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে স্ত্রী আর নবজাত সন্তানকে নিয়ে মেতে উঠল দেবল। এদিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসছিল। অনুর ইচ্ছে ছিল দেবলের সঙ্গেই ফিরে যায় কলকাতায়। কিন্তু ডাক্তারের কথামতো আরও একমাস কানপুরে মা-বাবার কাছে থেকে যেতে বাধ্য হল অনু। দেবল ফিরে এল একাই।

আবার সেই মিতার মুখোমুখি হওয়া। সেই টাকার জন্য চাপ। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয়। দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল দেবলের। পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও রাস্তা দেখতে পেল না সে।

এক মাস বাদেই অনু ফিরে এল সন্তানকে নিয়ে এসে অবাক হল দেবলের ব্যবহারে। যে-সন্তানকে নিয়ে এতদিন এত স্বপ্ন দেখেছে দেবল, সেই সন্তানকে কোলে নেওয়া তো দূরে থাক, তার একটু কান্নায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগল দেবল। নতুন খেলনা কিনে আনার কথা বললে রেগে উঠত বলত, বাজে খরচ করা বন্ধ করো অনু।

শুধু এটুকুই নয়, অনুর থেকেও দূরে দূরে থাকতে আরম্ভ করল দেবল। অনু কাছে আসার চেষ্টা করলে, অন্য ঘরে চলে যাওয়াটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল।

 

সেদিন দেবলের ছুটি। রোজকার থেকে একটু ধীরে ধীরেই বাড়ির কাজ সারছিল অনু। দেবের মোবাইলটা অনেক্ষণ থেকে বাজছে। এত সকালে কোথায় গেল দেব? এদিক ওদিক চাইল অনু। নাঃ আশেপাশে কোথাও নেই। বাধ্য হয়ে হাত মুছে মোবাইলটা ধরল। হ্যালো বলার আগেই ওধার থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল, দুদিন ধরে সমানে ফোন করছি, ফোন ধরছ না কেন? দ্যাখো আমাকে রাগিয়ে দিও না। তাহলে আমি বাধ্য হব ভিডিও-টা ভাইরাল করে দিতে। তখন তোমার অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছ একবার? আমার এখুনি পনেরো লাখ টাকা চাই। আর যখনই টাকার কথা বলব, এসে দিয়ে যেও। আর আজ রাত্রে একবার ফ্ল্যাটে এসো আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, হঠাৎই ফোনটা কেটে গেল।

অনুর পায়ে তলার মাটি সরে গেল। মহিলা কে? দেবলের কাছে কেন টাকা চাইছে? কোন ভিডিও ভাইরাল করার ভয় দেখাচ্ছে? রাত্রিতে কেন দেবলকে ফ্ল্যাটে ডাকল? এরকম নানা প্রশ্ন এসে অনুর মাথায় ভিড় করতে শুরু করল। ইচ্ছে হল সঙ্গে সঙ্গে দেবলের মুখোমুখি হতে কিন্তু আটকাল নিজেকে। আগে ব্যাপারটা বুঝতে হবে, ঘটনার শুরুটা জানতে হবে, তবেই কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব।

দেবল বাইরে থেকে ফিরলে, আজ অনেক দিন পর ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল অনু। সত্যি কত রোগা হয়ে গেছে। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। অনু নিজেকেই দোষারোপ করল, কেন লোকটার দিকে এতদিন ভালো করে তাকায়নি? কী এমন দুঃখ বুকে চেপে বসে আছে, যেটা ওকেও বলতে পারেনি দেবল?

দেব? অনেকটা সাহস বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে অনু তাকাল দেবলের দিকে। আমাকেও বলবে না, তোমার কী হয়েছে? আমরা তো কথা দিয়েছিলাম, কেউ কাউকে কোনও কথা লুকোব না। তাহলে এত বড়ো ঘটনা তুমি কী করে লুকিয়ে রাখলে?

ছ্যাঁত করে উঠল দেবলের বুকটা। অনু কি তাহলে সব জেনে গেল? সবকিছু অনুর কাছে খুলে বলার জন্য দেবলের মনটা উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোল না।

বলো না দেব, কে ওই মহিলা, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য তোমাকে বাড়ির বাইরে যেতে হয়? আজ তুমি না থাকাতে আমি ফোন ধরেছিলাম। যতক্ষণ তুমি না বলবে আমাকে, আমি কী করে জানব কেন তোমাকে মহিলা বিরক্ত করছেন? প্লিজ আমাকে খুলে বলো, হয়তো তাহলে তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারব।

অনুর কথায় দেবের চোখ জলে ভরে এল। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না দেবল। কী কী ঘটনা ওর সঙ্গে ঘটেছে সব খুলে বলল দেবল।

এত কিছু হয়ে গেছে, তুমি আমাকে জানাওনি? কীসের ভয় ছিল তোমার, যে আমি তোমাকে ভুল বুঝব? আমি তোমার স্ত্রী, এতদিনে তুমি আমাকে এটুকুই চিনেছ? তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমি, একটু তো ভরসা করতে পারতে আমাকে। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। আমি তোমাকে ঠিক এই চোরাবালি থেকে টেনে বার করবই।

সারাটা দিন ধরে ভাবল অনু। রাতে খেতে বসে মনে মনে ঠিক করে রাখা প্ল্যানটা জানাল দেবলকে।

সত্যিই অনু, তুমি যেটা করবে ভাবছ সেটা আদৌ কি হওয়া সম্ভব? তুমি জানো না ওই মহিলা কতখানি চালাক, শঙ্কিত চোখে প্রশ্নটা করে দেবল।

অবশ্যই হবে দেব তবে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেবলের হাতে হাত রেখে ওকে ভরসা দেয় অনু।

প্ল্যান অনুযায়ী অনু, মিতার সঙ্গে বেশি করে মিশতে আরম্ভ করল, যাতে বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়। যখন অনু বুঝল মিতা এখন ওকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে তখন ও শেষ চালটা দিল।

আজ ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। হয়তো দেরি হবে ফিরতে, দেবল ফিরলে তুমি বাড়ির চাবিটা দিয়ে দিও আর পারলে কিছু খাইয়ে দিও, নয়তো বেচারা খিদে পেটে নিয়ে বসে থাকবে। হাত জোড় করে বলে অনু। মিতার মনে হয় আকাশের চাঁদ আপনিই এসে ওর হাতে ধরা দিয়েছে।

আরে হাত জোড় কেন করছ অনু। চাবি দিয়ে দেব আর তোমার বরকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। চিন্তা কোরো না।

মিতাকে হাসতে দেখে গা জ্বলে উঠল অনুর। মনে মনে বলল অনু, হেসে নাও এখন যত খুশি। তুমি আমার দেবকে কাঁদিয়েছ মিতা, আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।

অফিস থেকে ফিরে নিজের বাড়িতে মিতাকে দেখে দেবল অবাক হবার ভান করল। মিতা তুমি আমার বাড়ির ভিতর, কী করছ?

তোমার অনু আমার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়ে গেছে দেবল। রহস্যময় হাসিতে মুখ ভরে উঠল মিতার। চাবির গোছাটাকে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে দেবলের খুব কাছে ঘেঁষে এল মিতা।

প্লিজ বন্ধ করো তোমার ফালতু নাটক। কেন করছ তুমি এরকম আমার সঙ্গে? তুমিই বলেছিলে আমার মধ্যে তুমি তোমার দাদাকে দেখতে পাও। তাহলে আমার সঙ্গে এসব করতে তোমার লজ্জা করে না?

ইচ্ছে করেই দেবল আবার ওই একই প্রসঙ্গ টেনে আনল। সেদিন তোমার ফ্ল্যাটে আমাকে প্ল্যান করেই ডেকেছিলে, তাই না? চা-পকোড়ার নাম করে নেশার ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলে চায়ের মধ্যে? ধর্ষণ আমি করিনি, তুমি করেছিলে আমাকে। বলো আমি মিথ্যা বলছি?

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছ। পুরোটাই আমার প্ল্যান ছিল। নেশার ওষুধ খাইয়ে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে তোমার জামাকাপড় নিজের হাতে খুলে তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ, আমিই তোমাকে ধর্ষণ করি। কিন্তু একথা তুমি কী করে প্রমাণ করবে দেবলবাবু? ভিডিও-তে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই সত্যি বলে সবাই ধরবে। যেদিন তোমাকে আমি বড়ো গাড়িটা করে যেতে দেখেছিলাম, সেদিনই ঠিক করে নিই, তোমাকে কোনও ভাবে ফাঁসাতে হবে। সত্যিই বলছি দেবল, এই দেশলাই বাক্সর মতো ফ্ল্যাটে দম আটকে আসছে। বড়ো বাড়ি, গাড়ি হবে। চাকরবাকর থাকবে আর পর্যাপ্ত শারীরিক সুখ, দেবে তো আমাকে দেবল?

আচ্ছা এইসব এইজন্যই তুমি করেছ যাতে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পার?

হ্যাঁ দেবল। পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাকে দিয়ে দাও, তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়। তুমি তো টাকা দিতে ঝামেলা করছ।

আর আমি যদি টাকা না দিই?

তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। চেঁচিয়ে ওঠে মিতা। অনু যে বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছে এবং ও পুলিশ নিয়ে এসেছে ভাবতেও পারেনি মিতা।

 

এবার তুই আমাদের হাত থেকে রেহাই পাবি না। অনেক ঘোল খাইয়েছিস। হঠাৎই মহিলা পুলিশ দেখে ঘাবড়ে যায় মিতা।

দেবল কিছু বলে ওঠার আগেই মিতা নকল অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বলে ওঠে, অফিসার এই লোকটা আমাকে ধর্ষণ করেছে আর এখন ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। বলছে ওর কথা না শুনলে ওর কাছে রেকর্ড করে রাখা ভিডিও ভাইরাল করে দেবে।

কোন ভিডিও-টা? যেটা উনি নন, তুই বানিয়েছিস? তোকে খুব ভালোমতন চিনি, বলে মহিলা পুলিশটি অনুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মহিলা এক নম্বরের ঠগ, জোচ্চোর। বহু লোককে এভাবে ঠকিয়েছে। অনেক দিন ধরেই পুলিশ একে খুঁজছিল। এর আসল নাম মিতা নয়, সোনম।

মিতার ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ লাখ লাখ টাকা আর অনেকগুলো ভিডিও উদ্ধার করল। মিতাকে এবং ভিডিওগুলো পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনুদের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় মিতার চাহনি একটাই কথা দেবলকে বলে গেল, তোমাকে আমি ছাড়ব না।

থ্যাংকস অনু। তুমি যদি শেষ চালটা না চালতে তাহলে যে আমার কী হতো জানা নেই। হয়তো চোরাবালি-ই গ্রাস করত আমাকে। দেব অনুকে নিজের কাছে টেনে নিল। অনুও সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে দেবের হাতে সঁপে দিল।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...