৫০ বছরেরর ঊধের্ব বা তার বেশি বয়সি মহিলাদের মধ্যে কি স্তন ক্যানসারের প্রবণতা বেশি?
- সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ৫০ বছর বয়সি কোনও মহিলারও একজন তরুণীর মতোই তাঁর শরীরে স্তন ক্যানসার দেখা দেওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। বয়স্ক মহিলাদের কী কারণে স্তন ক্যানসার হতে পারে, কী ধরনের রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করে, সে সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা গিয়েছে। এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলির জন্যই স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ে।
এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে কিছু বলা সম্ভব কি?
- সাধারণত একজন মহিলা কোন বয়সে রজঃস্বলা হচ্ছেন এবং কোন বয়সে তাঁর মেনোপজ হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে তাঁর স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি। যেসব মহিলা ১২ বছর বয়স হওয়ার আগেই রজঃস্বলা হন এবং ৫৫ বছর বয়স হওয়ার পর যাঁদের মেনোপজ হয়– তাঁদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সামান্য বেশি। কারণ, নারী হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের উপস্থিতি এর ফলে শরীরে বেশিদিন থেকে যায়, যা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও, বয়সজনিত অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তনও স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে মহিলাদের স্তনের তন্তুর গঠন পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলেও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা কি বয়সভেদে আলাদা?
- বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় থেরাপি কম্বিনেশেন সংখ্যায় কম হয়। ফলে চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যেসব সাইড এফেক্ট বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, তা অনেক সময় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। যদি কোনও বয়স্ক মহিলার স্তন ক্যানসার অ্যাডভান্সড স্টেজে বা প্রাথমিক চিকিৎসার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রে কেমোথেরাপিই যথাযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি। যদিও অল্পবয়সিদের তুলনায় বয়স্কদের শরীরে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হবে। রোগীর শরীর এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতখানি গ্রহণ করতে পারছে এবং তাঁর দৈনন্দিন জীবনে তার কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তার ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হয়।
বয়স্ক মহিলাদের স্তন ক্যানসারের জন্য কী ধরনের শারীরিক পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং হওয়া উচিত?
- ৪০ বছরের বেশি বয়সি মহিলাদের সব সময়ই স্তন ক্যানসারের জন্য শারীরিক পরীক্ষা হওয়া উচিত। পরীক্ষা দুভাবে হতে পারে। বাড়িতেই কোনও মহিলা নিজের স্তন পরীক্ষা করতে পারেন। একে হোম সি্্ক্রনিং বলা হয়। আবার চিকিৎসক ও নার্সরা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষা করতে পারেন। একে বলা হয় ক্লিনিক্যাল সি্্ক্রনিং। পারিবারিক ইতিহাস ও ঝুঁকির বিষয়টি খতিয়ে দেখে চিকিৎসকরা ৫০ বছরের বেশি বয়সি মহিলাদের প্রতি দুই থেকে তিন বছর অন্তর ম্যামোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
কী ধরনের শারীরিক উপসর্গ ও লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত?
- স্তন ক্যানসার বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় স্তনে নতুন লাম্প বা মাংসপিণ্ডের উপস্থিতি। এই মাংসপিণ্ড শক্ত হতে পারে, ব্যথা নাও থাকতে পারে। আবার মাংসপিণ্ড তুলনায় নরম ও গোলাকার হতে পারে, তাতে ব্যথাও হতে পারে। এছাড়াও স্তন ক্যানসারের অন্যান্য লক্ষণগুলি হল স্তনের একাংশ বা গোটা স্তনই ফুলে যাওয়া (এমনকী, যদি কোনও মাংসপিণ্ডের অস্তিত্ব আলাদা করে বোঝা না-ও যায়), চামড়ায় জ্বালাযন্ত্রণা এবং চামড়া কুঁচকে যাওয়া (কমলালেবুর খোসার মতো), স্তন ও স্তনবৃন্তে ব্যথা, স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া, বৃন্ত লালচে হয়ে যাওয়া এবং তা থেকে রস নিঃসৃত হওয়া। মহিলাদের উচিত নিয়মিত স্তন পরীক্ষা করা এবং কোনও ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কী ভাবে কমাতে পারেন মহিলারা?
- স্তন ক্যানসার প্রতিরােধের নির্দিষ্ট কোনও পথ নেই। তবে একটু সতর্ক থাকলে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। যেমন, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ বন্ধ করতে হবে, শারীরিক ভাবে সক্ষম থাকতে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে হবে, স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার খেতে হবে। যেসব মহিলা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর বেশ কিছু মাস পর্যন্ত দুগ্ধপান করান, তাঁদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কম। যাঁরা একেবারেই দুধ পান করান না সন্তানকে, তাঁদের ঝুঁকি তুলনায় বেশি।
স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং বা চিকিৎসা শুরুর আগে, মহিলাদের কী কী বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার?
- ৬০ বা তার বেশি বয়সি মহিলাদের স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা পদ্ধতি অন্যদের তুলনায় জটিলতর হয়। সুতরাং, আগে থেকেই রোগিণীকে এই চিকিৎসা ও স্ক্রিনিংয়ের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। তা ছাড়াও চিকিৎসার খরচ ও ঝুঁকি সম্পর্কে তাঁদের অবগত করা উচিত। চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং রোগিণীদের জীবনযাত্রায় তার প্রভাব সম্পর্কেও তাঁদের সচেতন করা উচিত। যেসব বয়স্ক মহিলা স্ক্রিনিং করানোর কথা ভাবছেন বা যাঁদের কিছু দিন আগে স্তন ক্যানসার ধরা পড়েছে, তাঁদের নিম্নলিখিত বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত-
- সম্পূর্ণ শারীরিক অবস্থা (রোগিণীর শরীরে অন্যান্য উপসর্গ, তাঁর পৗষ্টিক ও মানসিক অবস্থা)
- রোগিণীর অবস্থা ও জীবনের মেয়াদ যাচাই করা
- স্ক্রিনিং ও চিকিৎসার সম্ভাব্য সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে রোগিণীকে অবগত করা
- জীবন ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে ব্যক্তিগত বাছাই– অর্থাৎ রোগিণী কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত চিকিৎসা চান নাকি আগ্রাসী চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করতে চান। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেহে নতুন করে ক্যানসার ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যায় ।
তরুণীদের তুলনায় বয়স্ক মহিলাদের চিকিৎসার ফলাফল ভালো নাকি খারাপ হতে পারে?
- বিষয়টি ব্যক্তিনির্ভর। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বদল, বয়স্ক নারীদের চিকিৎসা সফল হতে ও তাঁদের জীবনের মেয়াদ বাড়াতে সাহায্য করছে। গবেষণা বলছে, যদিও ৬০ বছর বয়সের পর মহিলাদের স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, তবু ওই বয়সে মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।
আপনি কেন মনে করেন, বয়স্ক মহিলাদের স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনার প্রতি বেশি নজর দেওয়া উচিত?
- আমরা সকলেই জানি, বয়স্কদের শরীরে নানা ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তার সঙ্গে যদি স্তন ক্যানসার যোগ হয়, তা হলে চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়ে। আরোগ্যের সম্ভাবনাও কমে যায়। সে জন্যই বয়স্ক মহিলাদের সচেতন করা উচিত, যে-কোনও বয়সেই স্তন ক্যানসার হতে পারে এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিহ্নিত করা দরকার। এ জন্য নিয়মিত সি্্ক্রনিং ও রিস্ক ফ্যাক্টর সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। এর ফলে সময় থাকতে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় ও চিকিৎসা সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে।
বর্তমানে ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের চেয়েও স্তন ক্যানসারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যদিও কমবয়সি মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসার বেড়ে যাওয়া নিয়ে মাথাব্যথা দেখা দিয়েছে, তবু বয়স্ক মহিলাদেরও এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, কোনও নতুন ওষুধ বাজারে এলে বা চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলে বয়স্ক বা বৃদ্ধাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা গবেষণামূলক পরীক্ষার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। ভারতে এত বেশি সংখ্যক বয়স্ক মহিলার শরীরে স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা দেখা যায় যে, প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা পদ্ধতি খতিয়ে দেখে এবং তাতে উল্লেখযাগ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে তাঁদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা দরকার।