সম্বন্ধ বিভ্রাট

আজকাল ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে মানুষ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। যারা নিজেরা ঠিক করে নিচ্ছে, সেই ছেলেমেয়েদের গল্প এখানে নয়। এখানে তাদের নিয়ে গল্প যারা সুবোধ ছেলে বা মেয়েটির মতো পাত্রী বা পাত্র নির্বাচনের দায় বাবা-মার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

সম্বন্ধ আনা এবং বিয়ে করিয়ে দেওয়া কাজটি বড়োই কঠিন। সফল হলেও একটা কিন্তু লোক লাগিয়েই দেবে। আর বিফল হলে তার গুষ্টির তুষ্টি একদিন দু’দিন নয়, দীর্ঘদিন চলবে। আজকাল এই কাজটা কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা হাতে নিয়েছে। তাতে হতাশ হয়ে ফিরে আসার লাইন অবশ্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আগেকার দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে পাত্রের বাড়ির থেকে দল বেঁধে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। এটা ছিল এক সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব। মনে যাই থাকুক না কেন ভাবটা থাকত- – মশাই আপনার ঘাড়ের বোঝা কমাতে এলাম, নির্ভর করছে আপনার কৃতকর্মের উপর। তাতে ছেলের বাবা-মা ছাড়া থাকত পরিবারের বা বন্ধুবর্গের মধ্যের একজন বিচক্ষণ ব্যাক্তি।

গুষ্টিশুদ্ধ নিয়ে এসেও নীতিবাগীশ পাত্রপক্ষের বয়ঃজ্যেষ্ঠর কড়া নির্দেশ আসত— কন্যা পছন্দ না হলে সেই বাড়ির অন্ন ধ্বংস করা অনুচিত হবে। কিন্তু এটা ভুলে যেত পাড়ার মিষ্টির দোকানদার, মিষ্টি আর ফেরত নেবে না। সব ক্ষেত্রে এই আদেশ অবশ্য কার্যকারী হতো না। বিশেষ করে খাদ্যরসিক পেটমোটা পিসেমশাই যদি থাকতেন।

মেয়ে পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে, সবচেয়ে আগে বদলে যেত পাত্রীর বাবার শারীরিক ভঙ্গিভাবটা, খুব সস্তায় ভালো মাল ছেড়ে দেওয়া ব্যাপারীর মতন।

আমার মা যেচে পড়ে অনেক সমাজসেবা করতেন। প্রায়ই আবেগমথিত হয়ে পরোপকারিকতার ভূত মাথায় চাগাড় দিত। পাড়ার এক অতি ফোঁড়ে লোক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে যেতেন, আর তার খেসারত দিতেন ওনার স্ত্রী। বেচারিকে প্রচুর টিউশন পড়িয়ে কোনওমতে সংসারের হাল ধরতে হতো। ঘরে চার চারটি অবিবাহিত মেয়ে। খুব নিরীহ এক পুরোহিতমশাই আসেন তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য বড়ো মেয়েটিকে নির্বাচন করতে। সমাজসেবার অঙ্গ হিসেবে আমার মা সম্বন্ধটা এনেছিলেন।

মাড়োয়ারিদের বাড়িতে জজমানি করে পুরোহিতমশাই ভালোই উপার্জন করেন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিজের সাদামাটা পাকা বাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। পত্নি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। ছেলেকে কাপড়ের দোকান খুলে দিয়েছেন বেহালা চৌরাস্তায়। মেয়েটি ক্লাস সিক্সের বেড়াও ডিঙোতে পারেনি। দেখতেও সাদামাটা, তবে মনটা খুব ভালো। এর আগে অনেক সম্বন্ধ এসেছে ও গেছে। এহেন পাত্রীকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করার পর পুরোহিতমশাই যারপরনাই বিপদের সামনে পড়লেন।

পাত্রীর বাবা হঠাৎ করে তাঁকে ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেন। বেচারা পুরোহিত তখন সবে পাত্রী নির্বাচন করে রসগোল্লার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। রসগোল্লা হাতে নিয়ে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাত্রীর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি করলেন, ‘আপনি কী কন বুঝি না আমি।’ আমার মাতৃদেবী দেখলেন হাতে পাওয়া সাফল্য ছিটকে গেল বলে! সাকসেস রেট নীচে চলে যাবে… ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি সামলে দিয়ে ডিল পাকা করলেন।

আমার এক পিসি ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে ছেলের উপর রাগ করে উঠে এসেছিলেন এই বলে, “তুই এক কাজ কর একটা বরমালা এনে এখনই পরিয়ে দে, আমি চললাম।’

ভাইটি খুব অল্প বয়সে চাকরি নিয়ে বাইরে যায়, হাত পুড়িয়ে খায়। বেচারার আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল না। না পারত সন্ধ্যাবেলার পার্টিতে বসতে। চাকরি পাওয়ার আট বছর বাদে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ভাইটির মা দু’বছর ধরে ছত্রিশটি পাত্রী দেখেছেন, আর সব ক’টা না করার অকাট্য যুক্তি দিয়ে সম্বন্ধ বানচাল করেছেন।

এই প্রথম ভাইটি নিজে গেছিল দেখতে। পাত্রী দেখতে ভালো, বাড়িঘর ভালো, পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। আট মাস বাদে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। আর এইখানেতেই বাঁধল মুশকিল।

মা বললেন, ‘পরীক্ষাটা দিয়ে পাস করে নিক, তারপরে পাকা কথা হবে।’ ছেলে দেখল সমূহ বিপদ, আবার একটা অজুহাত মা পেয়ে গেছে।

ছেলের মাসি মেয়ে দেখতে এসে ছেলেকে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, “শোনো বাবু, যদি সারাজীবন ব্যাচেলর না থাকতে চাও, নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও।’

বাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘পরীক্ষা হতে এখন অনেক দেরি। বিয়ের পর অনেক সময় পাবে।’ ব্যস, এতেই আগুনে ঘি পড়ল।

—আমি থাকতে এত বড়ো কথা। তোর বিয়ে তুই কর, বলে আমার পিসি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান। বিয়ে সেই পাত্রীর সাথেই হয়েছিল এবং একমাসের মধ্যে। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে মা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেন।

এবার শোনাই আমার এক মাসতুতো শ্যালিকার মুখ থেকে শোনা গল্প। মাসতুতো শ্যালিকার ছিল এক বিধবা পিসিমা। পিসিমা এক ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হন। জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা একাই সামলে ছেলেকে মানুষ করেন। ছেলে বিখ্যাত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। যাদবপুরে কচুরিপানা ভর্তি জমি রাত জেগে জবরদখল করে তার উপর বাড়ি তুলেছেন পিসিমা। সেই জায়গা এখন উঠতি বনেদি পাড়া, আর সেই টালির চালের বাড়ি এখন তিন তলা আলিশান অট্টালিকা। পিসিমা কর্পোরেশন স্কুলে চাকরি করেন। এইমত অবস্থায় উপযুক্ত পাত্রর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন পিসিমা।

পিসিমার আপন বলতে দাদা, বউদি আর ভাইঝি। যেখানেই পিসিমা পাত্রী দেখতে যান, সাথে যান দাদা, বউদি ও ভাইঝি। জীবন যুদ্ধে প্রচুর লড়াই করে পিসিমার রসবোধ কমে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব এসে গেছিল। মেয়ে দেখা হয়েছে, মেয়ে পছন্দও হয়েছে। ঠিক হল এবার ছেলে এসে দেখলেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৬ পর্ব)

৬ পর্ব

তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে, অর্জুনের ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স’-এর কোনও হদিশ করতে পারল’ না নিখিল। প্ল্যাটফর্মের দোকানদার থেকে শুরু করে, রেলের বিভিন্ন কর্মচারীদের কাছে অর্জুনের খোঁজ করার পরে, সবার কাছ থেকে একই কথা জানতে পারল নিখিল, ‘অর্জুন সরকারি চাকরি করে। কলকাতায় ওর অফিস। সারাদিন সেখানকার কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার পরে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে অর্জুন। ওখানেই রাতে ওর পোষ্যরা আসবে, ওদের অর্জুন স্যারের কাছে পড়াশোনা করতে। তারপরে পড়াশোনা শেষ হলে, পোষ্যদের খাইয়ে দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, ওই স্টেশন চত্বরেই যেদিন যেখানে মর্জি, সেখানে বিছানা পেতে রাত কাটিয়ে দেয় অর্জুন।”

পরদিন সকালে নিখিল অফিসে পৌঁছে, বড়োকর্তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। গতকাল সন্ধ্যায় সংগ্রহ করা, অর্জুন স্যার সংক্রান্ত সবিশেষ তথ্য বড়োকর্তাকে জানাতে জানাতে চোখের কোণে আঙুল ছোঁয়াল নিখিল। ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স বলে কোথাও কোনও ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই স্যার। তবে আপনার ফাইলে যা তথ্য রয়েছে, তার কোনওটাই অসত্য নয়। কোনও অনাথ ছেলে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জীবন কাটিয়ে, মাস্টার্স ডিগ্রি করে, সরকারি অফিসের অফিসার হতে পারেন, তা আমাদের অর্জুন-স্যারকে না দেখলে কোনওদিন বিশ্বাসই করতে পারতাম না। শুধু তাই নয়; সারাদিন এই অফিসে এইভাবে নিজেকে উজাড় করে পরিশ্রম করার পরে, রাতে আবার ওই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফিরে গিয়ে, বহু অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসান। তারপরে তাদের রাতের খাবার খাইয়ে, ওদের সাথেই প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে, পরদিন আবার যে-কেউ এইভাবে অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারে; তা অর্জুন স্যারকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। অর্জুন স্যার আমাদের ভগবান!” দু’-হাত কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে অম্বরীশ চ্যাটার্জীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল নিখিল।

ওদিকে পরপর পাঁচদিন অফিস কামাই হওয়ার পরে, নিখিল যেদিন অর্জুনের খোঁজে হাওড়া স্টেশনে এসেছিল, সেদিনই সকালে শ্রাবণীকে সঙ্গে নিয়ে, এস আই জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন গিয়েছিল হাসপাতালেই। সাঞ্ঝাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে, সন্ধ্যার পরে যথারীতি হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, সাঞ্ঝাকে নিয়ে ফিরে এল অর্জুন। হাওড়া স্টেশন চত্বরে পা রাখতেই, রেল পুলিশের লোকজন, প্ল্যাটফর্মের স্টলমালিকরা থেকে শুরু করে, তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওর পোষ্যরা সকলেই এসে অর্জুনকে জানাল, ‘আজ তোমার অফিস থেকে তোমার খোঁজে একজন লোক এসেছিলেন। তোমার বাড়ি, ঘরদোর সম্বন্ধে খোঁজ করছিলেন তিনি।’

একথা শোনার পরে অর্জুনের কাছে সাঞ্ঝা জানতে চাইল, ‘আপনার ঘর এখান থেকে কতদূর?”

সাঞ্ঝার কথায় মুচকি হেসে অর্জুন জানাল, ‘এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া গোডাউনের পাঁচিল ঘেঁষেই আমাদের সবার ঘরবাড়ি। আমাদের সবার মানে, আমাদের এই ক’জন অনাথের।’

—কিন্তু সবাই যে বলছে, আপনি অফিসে চাকরি করেন! তাহলে কাছাকাছি কোথাও আপনার বাড়িঘর আছে নিশ্চয়ই।

—সে ছিল একসময়। রাঁচি স্টেশনের দক্ষিণদিকের রেল কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আমরা মানে মা-বাবা, দাদু ও ঠাকুমা। আমার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। দিল্লির একটা নামকরা হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে রাঁচি আসতেন। হঠাৎ করে কী একটা গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে গেলেন তিনি।

—তারপর… অর্জুন কথা বলতে বলতে একটু থামতেই, ফিরে জানতে চাইল সাঞ্ঝা।

—তারপর আর কী! আমার মা ছিলেন রাঁচির একটা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা। মা যে স্কুলে পড়াতেন, আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মা নেই। বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে দাদুকে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। এর পরে আমার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ল দাদুর উপরে। দাদু আমাকে রোজ স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।

অর্জুন বলতে লাগল, ‘স্কুলে গেলেই সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই আমার কাছে আমার মা-বাবা’র সম্বন্ধে জানতে চাইত। দিনের পর দিন সেটা আমার কাছে ভীষণ অসহনীয় লাগতে লাগল। একদিন স্কুল থেকে আমিও পালালাম!’

ক্রমশ…

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৫ পর্ব)

জঙ্গল থেকে ঘাস-পাতা সংগ্রহ করে, ওই ঘরের মেঝেতে পেতে তার উপরে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হয়। গ্রামের প্রান্তের ওই স্থান চারিদিক থেকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সারারাত ভয়ে-যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকতে হয়, একেকটা দশ-এগারো বছরের শিশুকন্যাকে। ওই পাঁচ-ছ’টা দিন ওদেরকে এতই অস্পৃশ্য মনে করে সবাই যে, পরিবারের কোনও লোক, কোনও খোঁজ নিতেও আসে না তাদের। ওই জঙ্গলঘেঁষা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই ঘরের ধারেকাছে কোথাও কোনও জলের সংস্থানও নেই। নিজেকে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করার কোনও উপায় পর্যন্ত নেই। ওদের গ্রামের মেয়েরা অনেকে ওই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণেই মারা যায় সেখানে।

ওর মা-ঠাকুমাকেও ছোটো থেকে দেখেছে সাঞ্ঝা— প্রতিমাসে ওই পাঁচ-ছ’টা দিন বাড়ি ছেড়ে, ছোটো বাচ্চাদের ঘরে ফেলে রেখে, গ্রামের প্রান্তের ওই ঘরে দিন কাটাতে চলে যেতে। বছর তিনেক আগে সাঞ্ঝা’র মাকে এইরকমই একরাতে ভাল্লুকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে মায়ের সাথে আর কোনওদিন দেখা হয়নি সাঞ্ঝার।

সাঞ্ঝার বাবা ঝরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করে। মা মারা যাওয়ার পরে বাবা আর কোনওদিন বাড়িতে ফেরেনি। দাদু-ঠাকুমার কাছে মানুষ হচ্ছিল সাঞ্ঝা। পড়াশোনা করার জন্য ওদের তুটকি গ্রাম থেকে বিশ কিলোমিটার দূরের মাঞ্চুগঞ্জের স্কুলে বছরের পর বছর আসা যাওয়া করে, দশ ক্লাস পাশ করে, এগারো ক্লাস পেরিয়ে বারো ক্লাসে উঠেছে সাঞ্ঝা। তাই সাঞ্ঝা ভাবে, অন্যায় অবিচারে ভরা এই সামাজিক কু-প্রথাকে যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে আর পড়াশোনা করে আমার লাভটা কী! এই গ্রাম ছেড়ে, জেলা ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে পালাতে না পারলে, আমার অবস্থাও একদিন আমার মায়ের মতনই হবে।

পাঁচদিনের প্রথম দিনটা এইসব ভাবতে ভাবতে অতিবাহিত হয়ে যায়। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাউকোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সাঞ্ঝা। বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, সাঞ্ঝা এসে পৌঁছোয় গোধিয়ার সতেরো মাইল বাসরাস্তার উপরে। একটা কয়লা বোঝাই লরিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করায় সাঞ্ঝা। লরি থেকে একটা লোক নেমে এসে, ও কোথায় যেতে চায়, জানতে চাইলে তাকে ওই অঞ্চল ছেড়ে ওর পালানোর ইচ্ছার কথা, কারণ সহ সবিশেষে জানানোর পরেই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সাঞ্জা জ্ঞান হারায়। মাঝরাতে সাঞ্ঝা নিজেকে আবিষ্কার করে, একটা চলন্ত ট্রেনের টয়লেটের মেঝেতে পড়ে আছে। তারপর সাঞ্ঝা আর কিছু জানাতে পারে না অর্জুনকে!

পরপর ক’দিন এই ভাবে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আর হাসপাতালে যাতায়াতের ফলে, অফিসমুখো আর হতে পারেনি অর্জুন। আজ প্রায় বছর চারেক হল, ডালহৌসি পাড়ার কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের এক দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে অর্জুন। ঝড় হোক, জল হোক, হাজার দুর্যোগেও অর্জুনের গরহাজিরা কারও চোখে পড়েনি কোনওদিন। এহেন অর্জুন বিনা কোনও সংবাদে, এইভাবে যে কোথাও উধাও হয়ে যেতে পারে, তা বুঝে উঠতে পারেন না তার অফিস কর্তা অম্বরীশ চ্যাটার্জী।

গত চার-পাঁচদিন ধরে অর্জুনকে যতবারই মোবাইল ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন উনি, ততবারই হয় ‘নো আনসার’, নয় তো জানতে পেরেছেন অর্জুনের ফোনটা রয়েছে ‘পরিষেবা সীমার বাইরে’। অর্জুনের চাকরির নিয়োগপত্র ও জয়েনিং লেটার সম্বলিত ফাইলটা বের করে বারকয়েক চোখ বোলালেন অম্বরীশ। সব জায়গাতেই ওর স্থায়ী ঠিকানা লেখা রয়েছে, ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড রেসিডেন্স, প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেইশ, হাওড়া স্টেশন’। নামের জায়গায় লেখা শুধু ‘অর্জুন’; পদবির কোনও উল্লেখ নেই কোথাও। মা- বাবার নামের পাশে লেখা, ‘নট-অ্যাপ্লিকেবল’; বন্ধনীর মধ্যে লেখা ‘অরফ্যান’। শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লেখা রয়েছে, “ইতিহাসে এমএ’।

অম্বরীশবাবু ফাইল থেকে অর্জুনের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে, তা অফিস পিওন নিখিলের হাতে দিয়ে, ওকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, একবার অর্জুনের খোঁজে যেতে বললেন। নিখিল যথারীতি বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। লঞ্চে নদী পেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল সে।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৪ পর্ব)

৪ পর্ব

আরও ঘণ্টা-দুয়েক মাথার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরে, অর্জুনরা দেখল, মেয়েটা চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে, খোট্টা ভাষায় অর্জুন মেয়েটার কাছে জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?” —সাঞ্ঝা, সাঞ্ঝা ওঁরাও!

—ঘর কোথায় তোমার?

—ভুটকি গ্রাম; তহসিল মাণ্ডু; জিলা রামগড়।

—এখানে এসেছ কেন? ট্রেনেই বা চড়েছিলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দিতে পারল না সাঞ্ঝা। আবার চোখ বুজল সে। এস আই জয়ন্ত ঘোষ এবার রোগীর বেডের পাশের বসার টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অর্জুনকে বলল, “এবার আমাকে ফিরতে হবে অর্জুন। আমার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ফিরে রিপোর্ট করতে হবে অফিসে। তবে এ তো মনে হচ্ছে, তোমার ঝাড়খণ্ডেরই লোক। যেসব জায়গার নাম বলছে ও, তার কিছু কি চিনতে পারলে তুমি?”

এস আই সাহেবের প্রশ্নের জবাবে অর্জুন জানাল, ‘হ্যাঁ, ভুটকি হচ্ছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রামগড় জেলার উত্তর প্রান্তের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। রাঁচি থেকে পঁচাশি কিলোমিটার, আর রামগড় সদর শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম ‘ভুটকি’। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হচ্ছে মাণ্ডু। তাও প্রায় বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে নিকটবর্তী বাস রাস্তা হচ্ছে একশো নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে অবস্থিত গোধিয়া সতেরো মাইল; ভুটকি থেকে যার দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। ভুটকির উত্তর এবং পশ্চিম দিক হাজারিবাগের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা— সেই প্রত্যন্ত ভুটকি থেকে মেয়েটা রাঁচি এল কী করে! আর সেই সুদূর রাঁচি থেকে এই হাওড়া স্টেশনেই বা ও এল কী উদ্দেশ্যে!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অর্জুন আবার জানাল, আপনি এখন ফিরে যান ঘোষদা। আমি আরও একটু থেকে দেখি; যদি কিছু জানতে পারি ওর সম্বন্ধে। তবে ফিরে গিয়ে আপনি যদি একটা কাজ করে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়। হাওড়া স্টেশনে ফিরে, আপনার কাজকর্ম সেরে, একটু তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আমার পোষ্যগুলোকে বলবেন, হ্যাজাকটা জ্বেলে নিয়ে ওরা যেন পড়তে বসে যায়। সামনেই ওদের পরীক্ষা। কাল ঝড়-বৃষ্টির দরুন পড়াশোনাটা হয়নি ঠিকমতো। আজকে যেন ওরা পড়াশোনাটা শুরু করে দেয়। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফিরে গিয়ে জানতে চাইব—কে কী পড়ল! আর বিল্টুকে একটু আলাদা করে ডেকে বলে দেবেন, কোনও কারণে আমার ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে ও যেন সবাইকে ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়।”

সন্ধ্যার পরে সাঞ্ঝা চোখ মেললে, ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অর্জুন আবার জানতে চাইল, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমাকে এখানে এই হাওড়া স্টেশনে কে নিয়ে এসেছে?”

—কেউ না, আমি একাই এসেছি! কিন্তু আমি এখন কোথায়? অর্জুনের কাছে চোখ বুজেই জানতে চায় সাঞ্ঝা।

—তুমি রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলে। সেখান থেকে তোমাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি ভুটকি থেকে রাঁচিতেই বা এসেছিলে কেন? আবার ট্রেনে করে হাওড়াতেই বা এলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না সাঞ্ঝা। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দু’-হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে, নিজের বুকফাটা যন্ত্রণার কথা সব উজাড় করে দেয় সে। ওর ভুটকি গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা, মনের দরজা খুলে, সব বাইরে বের করে আনে সাঞ্ঝা।

সাঞ্ঝার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার তুটকি গ্রামে। তার পুরো নাম সাঞ্ঝা ওঁরাও। ছোটোবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। স্কুলের এগারো ক্লাস পাশ করে এখন সে বারো ক্লাসে পড়ে। ওদের গ্রামের ছাউপদি প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই ওর ঘর ছাড়া। এটা শুধু ওর গ্রামের প্রথা নয়; এটা গোটা গ্রামীণ ঝাড়খণ্ডের দুঃসহ এক প্রথা। এই প্রথার শিকার হয়ে, সেই দশ-এগারো বছর বয়স থেকে প্রতিমাসে ঋতুস্রাবকালীন পাঁচ-ছয়দিন ওর গ্রামের বাড়ি-ঘর ছেড়ে, গ্রামের বাইরে একটা চালা ঘরের মধ্যে গিয়ে থাকতে হয় ওকে। এ যন্ত্রণা শুধু সাঞ্ঝার নয়। ওখানকার আপামর সব মহিলাদের এই প্রথা মেনে চলতে হয়। সেই ঘরের না আছে কোনও দরজা, না আছে কোনও জানলা।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৩ পর্ব)

৩ পর্ব

আজ সকালে বেড-রোল গুটিয়ে তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন টয়লেটের বিপরীত দেয়ালে তালাবন্ধ ঢাউস কাঠের বাক্সটা খুলে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে, টয়লেটের দিকে তাকাতেই অর্জুন বুঝতে পারল, তখনও পর্যন্ত টয়লেট একরকম ফাঁকাই রয়েছে বলা চলে। তার মানে ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা বাজলে কি হবে, এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে পারেনি। প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে, বাইরে বেরোতেই অর্জুনের চোখে পড়ল — বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস এসে দাঁড়িয়ে আছে। জামা-প্যান্ট-জুতো গলিয়ে, পিঠব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, ধীর পায়ে অর্জুন চোদ্দো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এস্ক্যালেটরের দিকে পা বাড়াল। তার পুষ্যিগুলোকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, রোজকার মতন টিফিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে, স্কুলমুখো রওনা করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

সারারাত ধরে দুর্যোগ-ক্লিষ্ট, অনিশ্চিত যাত্রার শেষে, ক্লান্ত আচ্ছন্ন শরীরে মালপত্র টানাটানি করে প্যাসেঞ্জাররা সব ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম পার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে অর্জুন খেয়াল করল, জিআরপি’র লোকজন ধরাধরি করে কাউকে যেন ওই ট্রেনের সাধারণ কামরা থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে, প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে অনেকে চলার পথে সেদিকে অগ্রসর হয়ে, উকিঝুঁকিও মারছে। অর্জুনও কৌতূহল দমন করতে না পেরে সেদিকেই পা বাড়াল।

ভিড় ঠেলে কাছাকাছি পৌঁছোতেই, এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে— একটা মেয়ে পাশ ফিরে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। তার জামা-প্যান্ট রক্তে ভেজা; যা দেখে ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ কেউ মন্তব্য করছে, ‘চল চল, পাগলি-টাগলি হবে’। আবার কেউ বলছে, “না না, রেপ কেস! চল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ঝামেলা বাড়ানো।’ অর্জুন কাছে গিয়ে, জিআরপি’র একজন এসআই-কে দেখে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে এর?”

—কী যে হয়েছে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। সারারাত সাধারণ কামরার টয়লেটের মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিল। প্যাসেঞ্জাররা নাকি রাত থেকেই ওকে এইরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে ওই টয়লেটের মধ্যে। ঝামেলা এড়াতে কেউ আর কোনও সাড়াশব্দ করেনি। অনেকে বলছে, রেপ-কেস হতে পারে। কিন্তু জ্ঞান না ফিরলে, কিছুই জানা যাচ্ছে না— জিআরপি’র এসআই জয়ন্ত ঘোষ মেয়েটির রক্তে ভেজা জামা-প্যান্টের দিকে ইঙ্গিত করে, অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

এই স্টেশন চত্বরে রেল পুলিশের সব লোকজনই অর্জুনকে খুব ভালো করে চেনে। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে তাই এসআই-এর উদ্দেশ্যে বলল, ‘অবস্থা কিন্তু খুব একটা ভালো ঠেকছে না। এক্ষুনি একে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।’ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই, পাশেই বিল্টুকে দেখতে পেল অর্জুন। বিল্টুর হাতে ওর দলবলের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করার জন্য দু’শো টাকা দিয়ে বলল, “তুই সবার টিফিনের বন্দোবস্ত করে, সকলকে স্কুলে পাঠিয়ে দিবি ঠিকমতো। আমি একে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তুই চট করে কুলিদের থেকে একটা হ্যান্ড ব্যারো নিয়ে আয়।”

এরপরে এসআই জয়ন্ত ঘোষ আর অর্জুন দু’জনে মিলে মেয়েটাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে এল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটার অবস্থা দেখে, ওকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে নিয়ে, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন প্রভৃতি প্রক্রিয়া চালু করে দিল। মেয়েটার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন ওয়ার্ডের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দুপুরের পরে, ক্ষণিকের জন্য মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার জানালেন, ‘মেয়েটি শারীরিক ভাবে অসম্ভব রকমের দুর্বল। মনে হয় চার-পাঁচদিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষীণ স্বরে কিছু হয়তো বলছে, যদিও তার বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সামান্য সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরলেও, আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। দেখুন, আবার জ্ঞান ফিরলে, ওর কাছ থেকে যদি কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন! পরীক্ষায় ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনও তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। তবে মেয়েটি ঋতুকালীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ভালো করে জ্ঞান না ফিরলে, বেশি জোর জবরদস্তি করে কিছু জানার চেষ্টা করা উচিত নয়।’

ক্রমশ…

 

 

ভুলের মাশুল (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

নেগেটিভিটিতে ভরপুর জীবন তারক সিং-এর। ভালো চিন্তা কিছু নেই, সর্বক্ষণ দুঃখী ভাব। তার শরীরের কলকবজা বিকলের কাহিনি, প্রায় প্রত্যহ এদের শুনতে হয়। কেষ্ট দাস ঠিক তার উলটো। সর্বসময় প্রাণচঞ্চল তেজি ঘোড়া। একেবারে টগবগ করে ফুটছে। তবে মুখে কোনও লাগাম নেই। ‘অমিতসাব, পাক্কা দো’দিন মেরা টয়লেট নেহি হুয়া।’ বললেন তারক সিং। অমিতবাবু কিছু বললেন না, তিনি নিজেই বেশ ক’দিন ধরে নড়বড়ে। মুখ খুললেন কেষ্ট দাস।

—কোনটা বন্ধ, হিসি না হাগু?

—নেহি, ও তো কর রাহা, লেকিন হা…

—পিছনে বাতি দিন, সেরেফ বাতি।

—দূর মশাই, কী যে বলেন! হেসে ফেলেছেন অমিত সেন।

—কেন, লজ্জার কী আছে দাদা! ছেলেবেলায় আমরা সবাই তো…, হো হো করে হাসছেন দু’জনে। তারক সিং-ও গাঁদাল পাতা গেলা মুখ করে হাসতে বাধ্য হলেন। এইসব করে যখন অমিতবাবু ফ্ল্যাটে ফিরলেন নীচের পাম্পের ঘরের সামনে বেশ কয়েকজন আবাসিকের জটলা। আষাঢ়ে মেঘের ইঙ্গিত পেলেন অমিতবাবু। চারতলার গঙ্গাগোবিন্দবাবু, তিনতলার ভিনেশ জোশি, দোতালার অটল সাঁপুই, ডাঃ নিতিশ মিত্র— সবাই আছেন। কেমন যেন ভিলেন ভিলেন গন্ধ খুঁজছে সবাই তাঁর শরীর থেকে।

অটল সাঁপুই কিছুদিন আগে ছানি কাটিয়ে এসেছেন। চোখের দৃষ্টি বেড়ে গেছে, তিনি কাছে এসে খুব একেবারে গোয়েন্দা কায়দায় মাপতে লাগলেন অমিতবাবুকে। অমিতবাবু বুঝতে পারলেন না, কী খুঁজছেন রিভলবার না রক্তমাখা ছোরা! আসরে প্রথম এগিয়ে এলেন ভিনেশজি।

—আপনি কী করলেন মিঃ সেন? ওয়াটার পাম্প একদম খারাপ করিয়ে দিলেন। অমিতবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না, শুধু সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

গঙ্গাগোবিন্দ মণ্ডল সংক্ষেপে যা বললেন তার সারমর্ম হল, ‘সকালে অমিতবাবু পাম্প চালিয়ে চলে গেসলেন। আবাসিকরা কেউ তা জানতেন না। দীর্ঘক্ষণ চলায় পাম্পের মোটর পুড়ে গেছে। সারাই করতে অনেক টাকার ধাক্কা।’

নিতিশ মিত্র প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, “তিনি এই বাবাদ এক কানাকড়িও দেবেন না।’ অমিতবাবুর মনে হল অন্য সকলে নির্বাক থেকে নিতিশবাবুর মতেই মত দিলেন। আর এখানে দাঁড়ালেন না তিনি। তিনতলায় তাঁর নিজের ফ্ল্যাটের বেল বাজালেন। কাজের লোক বুলি দরজা খুলল। এখানেও সন্দেহের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। এক গেলাস জল খেয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিলেন। হঠাৎ হাত থেকে কে যেন টেনে নিল কাগজটা। স্ত্রী, বিমলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে চেক বই।

স্ত্রীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। থমথমে মুখ। ভয় পেলেন অমিতবাবু, কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলেন। মুখ খুললেন বিমলা। পাম্পটা ঠিক করতে প্রায় বারো হাজার টাকা লাগবে। আমি কল মিস্ত্রী রাজু-কে খবর দিয়েছি। ও একটু বাদে এসে চেক নিয়ে যাবে। কোনওরকম ভূমিকা না করে চেকবইটা সামনে রেখে চলে গেল বিমলা।

আমিতবাবু বুঝতে পারলেন এই বাড়ির বারোটা ফ্ল্যাটেই তিনি এখন খলনায়ক! শুধু জানতে পারলেন না, খবরটা চেন্নাই-তে ছেলে অত্রি অবধি পৌঁছেছে কিনা! যাই হোক, নিজের ভুলের মাশুল চোকাতে বারো হাজার টাকার একটা চেক লিখে টেবিলের উপর কলম চাপা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বিমলাদেবী দেখলেন কিন্তু বাধা দিলেন না। লোকটার মনেপ্রাণে আজ একটু মুক্ত হাওয়ার দরকার।

 

ভুলের মাশুল (১-পর্ব)

এখন সকাল। রোদ্দুরের তেজটা সেরকম বোধ হচ্ছে না। প্রিন্সেপ ঘাটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছেন অমিত সেন। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজ করার সুবাদে আগে এখানে কতবার এসেছেন। এখন আর সেরকম ভাবে আসা হয় না। ঘাটের চারপাশজুড়ে আকাশ কমলা হওয়ার দৃশ্যটা কতদিন দেখেননি তিনি! চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে প্রায় সবাইকে নিজের কাজে বেরুতে হবে। সে তাড়া অমিত সেনের নেই। আজ তাঁর একটু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার দরকার ছিল। তাই সটান চক্র রেলে চেপে এখানে এসেছেন।

আজ আবার ঘটনাটা ঘটল। এই নিয়ে কতবার যে হল আর মনে করতে পারছেন না অমিত সেন। কিছুদিন আগে বাসে উঠে মনে পড়ল দরজাটা লক করা হয়নি। মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাড়ির সামনে এসে দেখেন তার ধারণা ভুল। দরজা বন্ধ। ব্যাংক-এ পাশবই আপ ডেট করতে গিয়ে দেখেন পাশবইটা সঙ্গে আনা হয়নি। এসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেরটা একেবারে সাংঘাতিক ভুল। কথায় বলে ভুলের মাশুল। কড়ায় গণ্ডায় একেবারে বারো হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। এরপর চলবে জলকষ্ট। তাঁদের চার-পাঁচটা বাড়ির পরে থাকেন মোহিত দাস। তিনি কিছুদিন করোনা রোগের শিকার হয়েছিলেন। যমে-মানুষে টানাটানি করে বাড়ি এলেন কিন্তু ব্রেন-এর অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উলটোপালটা বকেন। মোহিতবাবু-র একমাত্র মেয়ে বিদেশে। আয়া-নির্ভর জীবন। আয়ার চড়-চাপট খেয়ে জীবন কাটে। সেই মোহিত দাসের বাড়িতে কিছুদিন আগে পুলিশ এল। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় থাকার সুবাদে মোহিত দাসের সঙ্গে অমিত সেনের ভালোই সখ্যতা আছে। আজকাল অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। অভিযোগ মারাত্মক। মহিলার শ্লীলতাহানি।

আশেপাশের বাড়ি থেকে গুঞ্জন উঠল, তাহলে কি আয়ার সঙ্গে! এই বয়েসে! ছিঃ ছিঃ ইত্যাদি। পরের ঘরের কুৎসা পেয়ে যে যত পারে বেলুন ফোলাতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এইসব ঘটনাকে মোহিতবাবুর সাময়িক যৌন উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আখ্যায়িত করল। অমিতবাবুর এইসব ন্যাস্টি কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগল না। তিনি নিজে মোহিতবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ব্যাপারটা অন্য। এক্কেবারে রোমান্টিক।

অয়ন দাস তাঁর স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে মোহিতবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে চুরি করতে চোরেদের এখানে খুব মজা। এখন অবশ্য এসব ঘটনা শোনা যায় না। তবে উঁকি ঝুঁকি মারলে প্রতিবেশীর বেডরুমে চোখ পৌঁছে যায়। সেই চোখই হয়েছে ভিলেন।

মোহিতবাবু নাকি প্রায়শই অয়নবাবুর বাড়িতে উকিঝুঁকি মারেন। মনিকাকে নাম ধরে ডাকেন। বয়সে বড়ো, তাছাড়া ভুলো মনের মানুষ এইসব ভেবে অয়ন বা মনিকা খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু শেষ কয়দিন মোহিবাবুর মাথার ব্যামো একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রায়ই কলতলায় যাওয়ার সময় জানলার ফাঁক দিয়ে ‘মনিকা, মনিকা’ বলে হাঁক পেড়ে চলে যান। এতেও ঠিক ছিল। তিন দিন আগে দু’তিনবার, ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’ সুর ভেঁজেছেন। ব্যস আর যায় কোথায়! রাহুল দেব বর্মনের এই কীর্তিকে একেবারে খাটো করে দেখতে রাজি নন তারা। একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বেন। তাই সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অয়ন-রা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। পুলিশ যদি বুড়োকে একটু আচ্ছা করে কড়কে দেয়।

পাঁচতলা থানার ওসি রামদাস মণ্ডল একজন রসিক এবং সমপরিমাণ বদমেজাজি ব্যক্তি। নিজে মাঝেমধ্যে পাড়ার গজিয়ে ওঠা শখের থিয়েটারে ছোটোখাটো পার্ট করে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন। খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করেন বলে পুলিশমহলে বেশ ওজনদার। রামদাস ওসি যখন মোহিত বাবুর কাঁটাপুকুরের বাড়িতে এলেন, তখন অমিতবাবু একটু অবাকই হলেন। সিনেমার শুটিং-এর মতো ক্যামেরার পরিবর্তে হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে চোখের সামনে এনে বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে মোহিত বাবুকে মাপতে লাগলেন। হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। তার কথা শুনে মোহিতবাবু দেঁতো হাসি হাসলেন। অমিতবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ক্রমশ…

 

 

দুর্গা (পর্ব- ২)

পর্ব – ২

আসলে শোভনের জন্যই শুভায়ুর, দুর্গার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তা না হলে তার জানাই হতো না জয়নগর গ্রামে এরকম একটি সুন্দরী রমণী রত্ন আছে। পাওয়া হতো না প্রেমের রূপ-রস-গন্ধ। তার বেশ মনে আছে, অভাবের জন্য যখন তাদের সংসার অচল হয়ে পড়েছিল, তখন শোভন জয়নগরে তার দাদার শ্বশুরবাড়িতে পাঁচশো টাকার একটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিল। সে সময় অভাবের সংসারে টিউশনি করে পাওয়া পাঁচশো টাকার মূল্য ছিল অনেক।

শুভায়ু যখন দুর্গার ছোটো ভাই রাজুকে পড়াতে যেত, তখন সে দেখত ছলছুতো করে দুর্গা পড়ার ঘরে হঠাৎ ঢুকে তার উপস্থিতি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিত। কখনও ছাত্র পড়ানোয় ব্যস্ত শুভায়ুর কানের কাছে আলতো স্বরে বেজে উঠত রঙিন কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আবার কখনও কোনও মুহূর্তে ভেসে আসত শাড়ির খসখস শব্দ। যদি কখনও পড়ার ঘরে স্নো পাউডারের গন্ধ ঘ্রাণে ভেসে আসত, শুভায়ু বুঝতে পারত দুর্গা এসে ঘরে ঢুকেছে। সে এক অপূর্ব অনুভূতি ঘিরে থাকত শুভায়ুকে সারাক্ষণ।

সে সময় শুভায়ুকে যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল। পড়াতে এসে যদি কোনও দিন দুর্গার উপস্থিতি টের না পেত, মনটা তখন ভীষণ খারাপ লাগত। অথচ তখনও তার ছাত্রের দিদির মুখটা দেখা হয়নি। সে যেমন মাথা নীচু করে শোভনের দাদার শ্বশুড়বাড়ি পড়াতে আসত, তেমনি পড়ানো শেষ হলে মাথা নীচু করেই চলে যেত। শুধু একদিন সে যখন তাকে চা দিতে এসেছিল, সেদিন শুভায়ু সাহস করে চশমার ফাঁক দিয়ে তার পদ্মফুলের মতো আলতা পরা ফরসা পা দু’খানা দেখেছিল। তাইতেই সে মজে গিয়েছিল। তারপর থেকে দুর্গার মুখটা দেখার জন্য সে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।

একদিন দুর্গা সে সুযোগ করে দিল। সে দিন কী কারণে যেন ঘরে ঢুকেছিল। ‘উরি বাবারে বলে হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠতেই শুভায়ু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “কী হয়েছে?”

—দেখুন না, আরশোলা। বলে দুর্গা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়েছিল।

শুভায়ু দেখল তার সামনে যেন কুমোরটুলির রাখাল পালের দুর্গা প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে দিন কি তিথি ছিল তা মনে নেই। শুধু মনে আছে দুর্গার পরনে ছিল জরিপাড় বসানো লাল ছাপা তাঁতের শাড়ি, কানের লতিতে ছিল সোনার রিং, গলায় ছিল কালো পুঁতি দিয়ে গড়া মঙ্গলসূত্র হার, আর নাকে ছিল ডালিমের দানার মতো লালপাথর সেট করা নাকছাবি। যতদূর মনে পড়ে, কপালের মাঝখানে কুমকুমের একটা ছোটো টিপও ছিল।

আজও মনে আছে, দুর্গার সেই অপরূপ মোহিনী রূপ দেখে শুভায়ু ফস করে বলে ফেলেছিল, ‘দুর্গা নামটা তোমার সার্থক!’

সে কথা শুনে দুর্গার মেক-আপ করা মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল। শুভায়ুর স্পষ্ট মনে আছে, দুর্গা তাকে জিভ ভেংচে ছুটে পালাতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল।

শুভায়ু পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে কোনও দ্বিধা না করে তার হাত ধরে তুলে বলেছিল, ‘খুব লেগেছে বুঝি?’ দুর্গার সুন্দর মুখটা তখন ঘামতেলের মতো চকচক করছিল। সে যখন মাথা নেড়ে তার ভ্রমরকালো চঞ্চল চোখের দৃষ্টি দিয়ে শুভায়ুকে মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন করে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল, তখন শুভায়ুর বুকে হাজার খুশির ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছোটোবেলা থেকে যত দুঃখ যন্ত্রণা তার মনে জমা হয়েছিল, তা যেন দুর্গার এক পলকের সম্মোহনী দৃষ্টিতে সেই মুহূর্তে গলে জল হয়ে গিয়েছিল।

তার পর পরম লগ্ন এল সেই দিন, যে-দিন পড়াতে গিয়ে দুর্গা তার প্রেমপত্রে কোনও ভনিতা না করেই জানিয়ে দিয়েছিল তার মনের গোপন কথা… ‘তোমাকে ভালোবাসি। এর চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে আর কিছু নেই। ভালোবাসা যদি কোনও পাপ না হয়, যদি অন্যায় না হয়, তাহলে অন্তত একটা চিঠি লিখে আমাকে জানিও। তোমার চরণে শত কোটি প্রণাম জানিয়ে চিঠি এখানেই শেষ করছি।’

— ইতি দুর্গা।

ক্রমশ…

দুর্গা (পর্ব – ১)

দুর্গার কথা মতো শুভায়ু নিমপাতা দাঁতে কেটে চিনি মুখে দিয়ে বারান্দার এককোণে গিয়ে কুশাসন পেতে বসল। শুভায়ু একটু আগে ভাবছিল শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরার পর শ্মশানযাত্রীদের মুখে কে একটু চিনি জল দেবে। কে তাদের যত্ন করে দাওয়ায় বসাবে। দিদিটাও যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তার কোনও চিন্তা ছিল না।

বাসুলডাঙ্গা গ্রামে দিদির যখন বিয়ে হয়, তখন সে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ছাত্র। বাবা বেশ ধুমধাম করেই দিদির বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কপাল পুড়ল। ছেলেপুলে না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে লাগল। শুধু তার খাওয়া বন্ধ নয়, বাঁজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ বলে শাশুড়ির অকথ্য গঞ্জনাও চলতে লাগল।

শ্বশুরবাড়ির অনাচার আর অবহেলা পেয়ে দিদি যখন মনের দুঃখে বাপের বাড়ি ফিরে এল, তখন শুভায়ু দেখল দিদি নয়, যেন তার কঙ্কালসার দেহটা ফিরে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বছর খানেক বেঁচেছিল। তারপর একদিন দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সব দুঃখ আঁচলে বেঁধে পরপারে পাড়ি দিয়েছিল।

শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির নিন্দেমন্দ করলেও বাসুলডাঙা গ্রামের লোকজন দিদিকে দেবীর আসনে বসিয়েছিল। তারা এখনও বলে সতীলক্ষ্মী এরকম মেয়ে আর হয় না। গ্রামের কারও বিপদ-আপদ হলে দিদি যেন তখন দশভুজা হয়ে তাদের সেবা করত। সাধে কি আর বাসুলডাঙা গ্রামের লোকেরা তাকে দেবী বলে। আজ মায়ের শব দাহ করে এসে শুভায়ুর দিদির কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে।

—এই চা-টুকু খেয়ে নাও। শরীরের ধকলটা একটু কমবে, বলে দুর্গা চায়ের প্লেটটা শুভায়ুর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে উঠোনে নেমে গেল।

দুর্গা যে কখন স্টোভ ধরিয়ে চা করেছে, কখন শ্মশানযাত্রীদের হাতে মিষ্টি তুলে দিয়েছে— শুভায়ু জানতেই পারেনি। জানতে পারল তখন, যখন সে দেখল শ্মশানবন্ধুরা একে একে যে-যার বাড়ি চলে গেছে। শুধু বারান্দার একধারে শোভন হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চায়ের কাপে সে চুমুক দেয়নি। তার বিষণ্ণ চোখের দৃষ্টি এখন উঠোনে উড়ে এসে বসা শালিখ পাখির দিকে, না কাপ-ডিশ ধোয়ায় ব্যস্ত দুর্গার পদতলে, বোঝা মুশকিল।

একটু পর দুর্গা হাতের কাজ সেরে এসে বলল, ‘কী হল শোভনদা চা যে জুড়িয়ে গেল।’

শোভন তাড়াতাড়ি এক চুমুকে চা-টুকু খেয়ে দুর্গার উদ্দেশে বলল, “তুমি শুভায়ুর জন্য হবিষ্যির ব্যবস্থা করো। আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি।’

দুর্গা বলল, “দিদিকে বোলো সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। আমি একটু পরেই যাচ্ছি।

—আসি রে, বলে শোভন, শুভায়ুর উদ্দেশে হাত নেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

—চা-টা খেয়ে নাও। চা খেলে মাসিমার আত্মা মোটেও কষ্ট পাবে না। বলে দরজার কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল দুর্গা। শুভায়ু চোখ তুলে দেখল, দুর্গার কথা বলার ধরন, তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, এমনকী কাজলকালো টানা চোখের দৃষ্টিটাও ঠিক সাত বছর আগেকার মতো। যা কিছু পরিবর্তন ওর হয়েছে, তা হল কপালের সিঁদুর আর তার পলা বাঁধানো শাঁখা – যাকে বলে এয়োস্ত্রীর চিহ্ন। শোকের দিনেও দুর্গার চিবুকের তিলটার দিকে তাকিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর পুষে রাখা পুরোনো ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। পৃথিবীর কোনও ওষুধেই এ ক্ষত সারবে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে ঠিক পেসমেকারের মতো।

—কী হল, চা খেলে না? দুর্গার সেই পিয়ানোর সুর বেজে ওঠা কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল। যে-কণ্ঠস্বর শুনলে এখনও একরাশ কান্না গুমরে গুমরে ওঠে শুভায়ুর পোড়খাওয়া বুকের মধ্যে। এর জন্য দায়ী তার বন্ধু শোভন।

ক্রমশ…

 

সমর্পিতা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

দিন দশেক ভালোই কাটল অন্বেষা আর শুভর। পুরীতে জগন্নাথ দর্শন, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, চিল্কা সঙ্গে সমুদ্রস্নান। চিন্তা, টেনশন থেকে একেবারে দূরে। পুরী থেকে ঘুরে আসার পরে ওদের একদিন নিমন্ত্রণ করলাম বাড়িতে। মা বিভিন্ন পদ রেঁধেছে ওদের জন্য। ওদের বিয়ের পর থেকে খেতেও বলা হয়নি একদিনও। তাই ওদের পছন্দমতো মাছ-মাংস নিয়ে এসেছিলাম। কেন জানি না, ওরা ভালো আছে দেখে আমার মনটাও ভীষণ ভালো হয়ে গেছে। হয়তো আমি একটা অপরাধবোধে ভুগছিলাম। হাজার হোক আমার হাত ধরেই তো ওদের আলাপ। কথা ছিল অন্বেষা আগে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে, আর শুভ অফিস ফেরত।

সেইমতো অন্বেষা আসার মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল শুভ। তখন মা আমি আর অন্বেষা জমিয়ে গল্প করছি। শুভ আসতেই মা ওর জন্য চা বানাতে চলে গেল। মা ভিতর ঘরে চলে যাওয়ার পরেই একগাল হেসে বলল, ‘শোন শোন দারুণ খবর আছে। আজ অফিসে রেজিগনেশন জমা দিলাম!’

আঁৎকে ওঠে অন্বেষা, কী বলছ কী? পাগল-টাগল হলে নাকি। এটাকে তুমি দারুণ খবর বলছ?’

‘আরে আগে পুরো কথাটা তো শোনো,’ বলে শুভ।

আমিও বলে উঠলাম, ‘শুনবে আবার কী? কী শুনবে? আজকের বার্তা-র মতো হাউস তুই ছেড়ে দিলি! পাবি আর এরকম চাকরি?’

‘পাব আবার কী, পেয়ে বসে আছি বুঝেছিস।’ জোর গলায় বলে উঠল শুভজিৎ।

অন্বেষা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুভর দিকে। বলে, ‘মানে?’

‘মানে একটা নতুন ডেইলি থেকে দারুণ অফার পেয়েছি। আজকের বার্তায় যা পাচ্ছি তার ডাবল দিতে রাজি হয়েছেন পত্রিকার মালিক। তবে কাজের সূত্রে মাঝেমাঝে বাইরে যেতে হতে পারে। আর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট-ই মুম্বইয়ের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। প্রায় মাস খানেকের ধাক্কা।

‘মাস খানেক!’ অজানা আশঙ্কায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে অন্বেষার কপালে। বিস্মিত হয়ে আমিও বলে বসলাম, ‘এতদিন? অন্বেষার কী হবে?’

হাসতে হাসতে শুভ জবাব দেয়, ‘আরে কটা তো দিন, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। না হয় কিছুদিন বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে আসবে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কভার করার সুযোগ তো সবসময় আসে না, তাই হাতছাড়া করতে চাইছি না।’

মুম্বই যাওয়ার পর প্রায় সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। এর মধ্যে হাতেগুনে চার-পাঁচবারই কথা হয়েছে ওদের। ফোন করলেই কাজের চাপ আর ব্যস্ততা, নানান কারণ দেখিয়ে ফোন কেটে দেয় শুভ। এই ভাবেই কেটে যায় বাকি কটা দিন। কাজ সেরে ফিরে আসে শুভজিৎ।

একদিন অফিস যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখা শুভজিতের সঙ্গে। উদভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করছে। গালভরা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল। চাউনিটাও যেন কেমন ছন্নছাড়া। জিজ্ঞাসা করলাম, “কীরে, ফিরে তো কোনও খবরই দিলি না। কাটল কেমন, আজ অফিস নেই?’

উত্তর না দিয়েই হাঁটা দিল শুভজিৎ। পরে জানলাম, চাকরিটা আর নেই। মদ তো ছিলই, মুম্বইতে এ-কদিন থেকেই জুয়ার নেশাটাও চেপে বসেছে। প্রচুর ধারদেনা করে ফেলেছে। অফিসের দেওয়া লাখ-খানেক টাকার ক্যামেরা বিক্রি করে সেই দেনা মেটায়। যার কারণে চাকরিটাও খুইয়ে বসেছে। সম্পাদক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ক্যামেরার দাম না মেটালে থানায় অভিযোগ করবেন। এমনকী অন্য সংবাদপত্রে যাতে শুভজিৎ কাজ না পায়, সে বন্দোবস্তও করবেন তিনি।

সঞ্চয় বলে কিছুই ছিল না শুভজিতের। বরাবরই দেখনদারির ব্যাপার ছির ওর মধ্যে। হাই-প্রোফাইল স্ট্যাটাস মেনটেন করতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই বেশি হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত অন্বেষা নিজের গয়না বিক্রি করে ও বন্ধুদের থেকে ধার করে শুভজিৎকে বাঁচায়। অথচ এ নিয়ে প্রচুর কটাক্ষ শুনতে হয়েছে অন্বেষাকে। টাকা কোথা থেকে এল, সে নিয়েও নোংরা ইঙ্গিত করেছে শুভজিৎ বহুবার।

অন্বেষার হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও বদলায়নি শুভজিৎ। কোনও কাজকর্ম করত না। সারাদিন মদের ঠেক আর জুয়ার আড্ডাতেই কাটাত। পয়সার টান পড়লেই মারমুখী হয়ে উঠত। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় গুমরে মরত অন্বেষা। হাসিখুশি মেয়েটাকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে খারাপ লাগত। ক্যানটিনে খেতে খেতে একদিন ওই-ই বলল, ‘ভানুদা আর পারছি না। এরচেয়ে মৃত্যুই ভালো। মারধর তো রয়েইছে, এখন কথায় কথায় চরিত্র নিয়েও টানাটানি করে। একজন মেয়ের কাছে স্বামীই সব। সে-ই যদি চরিত্র নিয়ে বাজে ইঙ্গিত করে, অপমান করে, এইভাবে বাঁচা যায় না!’

সান্ত্বনার ভাষা আমার জানা ছিল না। শুধু বললাম, ‘মনকে শক্ত কর। শুভকে বরং কোনও রি-হ্যাব সেন্টারে নিয়ে যা। কিছুদিন থাকুক, দ্যাখ না কী হয়। এখন তো অনেকেই ওভাবে নেশার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে।’

একপ্রকার জোর করেই আমরা রি-হ্যাব সেন্টারে ভর্তি করলাম শুভজিৎকে। মাস চারেক থাকার পর অনেকটা সুস্থ হতে বাড়ি আনা হল। দিন দশেক বিশ্রাম নিয়ে স্টুডিয়োর বিজনেস আবার শুরু করল। টুকটাক কাজও পাচ্ছিল। তারপর পূর্ব পরিচিত এক বন্ধুর হাত ধরে মেগাস্টার সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়ের ফোটোগ্রাফির অর্ডার। হারানো রাজ্যপাট ফিরে পেয়ে আবার আগের মেজাজ ফিরে এসেছে শুভজিতের।

এর মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্ট। বেশ কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি। প্রাণে বাঁচলেও চিরকালের মতো হারাতে হল দুটো হাতই। চালকের পাশেই বসেছিল শুভ। পিছন থেকে লরি ধাক্কা মারতেই কীভাবে যেন শুভর হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইলে ঢুকে যায়। তারপর দু-তিন বার পাল্টি খেয়েছে গাড়িটা। হাতের একটা হাড়ও আর আস্ত ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাত দুটো কেটে বাদ দেয় ডাক্তাররা।

কষ্ট পেতে পেতে মেয়েটা বোধহয় পাথর হয়ে গেছে। আজ আর কিছুই ওর মনকে ছোঁয় না। এই ঘটনা ওকে আরও শক্ত করেছে। খুব ইচ্ছে হল বলি, অন্বেষা তুই ডিভোর্স নিয়ে নতুন করে জীবনটা শুরু কর। কিন্তু ওর হাতদুটো ধরে কিছু বলার আগেই ও-ই বলে, “চিন্তা কোরো না ভানুদা। আজ থেকে তোমার বন্ধুর সব দায়িত্ব আমার। আমার বাকি জীবনটা তোমার বন্ধুকেই সমর্পণ করলাম।’

অজান্তে কখন যে দু-চোখ দিয়ে জল নেমে এসেছে বুঝতেই পারিনি।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব