দুর্গার কথা মতো শুভায়ু নিমপাতা দাঁতে কেটে চিনি মুখে দিয়ে বারান্দার এককোণে গিয়ে কুশাসন পেতে বসল। শুভায়ু একটু আগে ভাবছিল শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরার পর শ্মশানযাত্রীদের মুখে কে একটু চিনি জল দেবে। কে তাদের যত্ন করে দাওয়ায় বসাবে। দিদিটাও যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তার কোনও চিন্তা ছিল না।
বাসুলডাঙ্গা গ্রামে দিদির যখন বিয়ে হয়, তখন সে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ছাত্র। বাবা বেশ ধুমধাম করেই দিদির বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কপাল পুড়ল। ছেলেপুলে না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে লাগল। শুধু তার খাওয়া বন্ধ নয়, বাঁজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ বলে শাশুড়ির অকথ্য গঞ্জনাও চলতে লাগল।
শ্বশুরবাড়ির অনাচার আর অবহেলা পেয়ে দিদি যখন মনের দুঃখে বাপের বাড়ি ফিরে এল, তখন শুভায়ু দেখল দিদি নয়, যেন তার কঙ্কালসার দেহটা ফিরে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বছর খানেক বেঁচেছিল। তারপর একদিন দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সব দুঃখ আঁচলে বেঁধে পরপারে পাড়ি দিয়েছিল।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির নিন্দেমন্দ করলেও বাসুলডাঙা গ্রামের লোকজন দিদিকে দেবীর আসনে বসিয়েছিল। তারা এখনও বলে সতীলক্ষ্মী এরকম মেয়ে আর হয় না। গ্রামের কারও বিপদ-আপদ হলে দিদি যেন তখন দশভুজা হয়ে তাদের সেবা করত। সাধে কি আর বাসুলডাঙা গ্রামের লোকেরা তাকে দেবী বলে। আজ মায়ের শব দাহ করে এসে শুভায়ুর দিদির কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে।
—এই চা-টুকু খেয়ে নাও। শরীরের ধকলটা একটু কমবে, বলে দুর্গা চায়ের প্লেটটা শুভায়ুর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে উঠোনে নেমে গেল।
দুর্গা যে কখন স্টোভ ধরিয়ে চা করেছে, কখন শ্মশানযাত্রীদের হাতে মিষ্টি তুলে দিয়েছে— শুভায়ু জানতেই পারেনি। জানতে পারল তখন, যখন সে দেখল শ্মশানবন্ধুরা একে একে যে-যার বাড়ি চলে গেছে। শুধু বারান্দার একধারে শোভন হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চায়ের কাপে সে চুমুক দেয়নি। তার বিষণ্ণ চোখের দৃষ্টি এখন উঠোনে উড়ে এসে বসা শালিখ পাখির দিকে, না কাপ-ডিশ ধোয়ায় ব্যস্ত দুর্গার পদতলে, বোঝা মুশকিল।