স্বপ্ন

কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলো কোনওক্রমে আজও আশ্চর্য ভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তারই একটি ঘরে থাকে শিবু। তার অন্যদিকে জানালা বরাবর থাকে ভাড়াটে সীমা, তার বাবা-মা আর ঠাকুমা। সীমাদের ঘরের এ পাশের জানালাটা খোলা হয় না, পাছে বাইরের লোকের কাছে ঘরের দারিদ্র্যটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। বড্ড মুশকিল হয় গরমে। বুড়ো আমগাছটা যদিও বা একটু-আধটু হাওয়া দেয়, সেটাও বন্ধ। মাঝে মাঝে সীমার মনে হয় এ জীবন থেকে মুক্তি বোধহয় আর নেই। কয়েকটা টিউশন সম্বল করে এবং বাবার পেনশনে চলে চারজনের সংসার। স্বপ্ন দেখা তো সে কবেই ছেড়ে দিয়েছে। সীমা ভাবে গরিবের আবার স্বপ্ন কী? সকালে একমুঠো জুটলেও বিকেলে জুটবে কিনা সন্দেহ।

রাতের বেলায় শিবু মাঝে মাঝে জানালাটা একটু ফাঁক করে দেখে, সীমা বাড়ির ছাদে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভীষণ ইচ্ছে হয় সীমার মুখে একটুকরো হাসি দেখতে। হাসির রাস্তা দিয়ে সীমার আর যাতায়াত কোথায়? কবে যে একটু হেসেছে তা-ও মনে পড়ে না।

আজ গরম বড্ড বেশি। সীমার বাবা হাতপাখা করতে করতে বলেন, ‘সীমা এক গ্লাস জল দে তো মা।’

সীমা জলের গ্লাস হাতে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বড্ড গরম লাগছে তাই না বাবা?”

পরমেশবাবু বলেন, ‘ও কিছু নয়। গরমে গরম তো হবেই।’

সীমা মনে মনে ভাবে যে করেই হোক এবার একটা পাখা কিনতেই হবে।

টিউশন সেরে ফেরার পথে শিবুর ইলেকট্রিক দোকানে ঢুকে পড়ে সীমা। ওকে দেখে শিবুর বুকের ভিতরে বসন্তের হাওয়া বয়ে যায়।

সে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু লাগবে?’

সীমা বলে, ‘একটা পাখার জন্য এসেছিলাম।’

শিবু তাকে কয়েক রকমের পাখা এনে দেখায়। সংকোচের সঙ্গে সীমা বলে, ‘চারটে কিস্তিতে পয়সা দিলে চলবে?’

শিবু বলে, ‘চারটে কেন ছ’টা কিস্তিতে দিলেও চলবে।’

সাদা রঙের একটা পাখা পছন্দ করে সেটা নিয়ে বাড়ির পথে বাড়ায় সীমা। মনের মধ্যে বাবার খুশিভরা মুখটা ফুটে ওঠে। পাখা হাতে মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে সীমার মা রীতিমতো চিৎকার করে ওঠেন, ‘আরে এটা কী করেছিস, পরের মাসে খাব কী?’

সীমা শান্ত কণ্ঠে বলে, “তুমি একটুও চিন্তা কোরো না মা, এর পয়সা কিস্তিতে দিলেই চলবে।’

বাবা মাকে ধমক দিয়ে বলেন ‘চুপ করো তো, মেয়েটা কত শখ করে পাখাটা বয়ে নিয়ে এল আগে সেটা দ্যাখো।’

মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান। মনে মনে চিন্তা করেন নিজের জীবনে তো কোনও সাধ আহ্লাদ পূরণ হল না। মেয়েটার ইচ্ছে অন্তত পূরণ হোক। ভগবান আর কত কষ্ট দেবেন কে জানে।

পরদিন টিউশন থেকে ফিরে সীমা জানালার দিকে তাকিয়ে অবাক। মা সেখানে তার পুরোনো শাড়ি কেটে পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমগাছের হাওয়ায় পর্দাটা একটু একটু করে দুলছে। এক অজানা আনন্দের ঢেউ সীমার মনের বারান্দায় লুটোপুটি খেতে থাকে। মনে হয়, হয়তো আবারও স্বপ্ন দেখা যায়।

চোখ টেপা মেয়ে ( পর্ব ১)

প্রফুল্ল সেন কলোনি থেকে বেরিয়ে ক্যাবে বসে কেতকী ঘোষণা করে দিলেন, এই মেয়ে আমি ঘরে তুলব না। আমার মুখের দিকে যেভাবে ও সোজাসুজি তাকাল তাতে মনে হল ও আমাকে পারলে গিলে খায়।

অবিনাশবাবু হেসে বললেন, “কেন ও তো তোমাকে মাসিমা বলে ডাকল। তুমি ওকে আমাদের রান্নাবান্না শিখিয়ে দেবে বললে… আমার তো মনে হল খুব ইন্টেলিজেন্ট মেয়েটা আর সোজাসুজি কথা বলে।’

—অত স্পষ্ট বক্তা মেয়ের দরকার নেই বাপু আমার। চ্যাপটা মুখ, জোড়াভুরু, ছোটো ছোটো চোখ। দশ জনের সামনে দাঁড় করানো যাবে না ওকে। আমার শুভমিতাকেই পছন্দ, স্পষ্ট বলে দিলুম।

অবিনাশবাবু তাকালেন ছেলের দিকে। ‘কী রে খোকা, তুই কী ভাবছিস?”

অরিত্র যা ভাবছিল তা মা-বাবাকে কী করে বলবে ও? মেয়েটা যে ওকে চোখ টিপে দিয়েছে সেটা আর কেউ না দেখুক, ওতো দেখে নিয়েছে। বহুদিন আগে শোনা কুমার শানু আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গাওয়া সেই হিন্দি ছবির গানের কলিটাই মনে মনে ভাঁজছিল অরিত্র – ‘আঁখ মারে, ও লেড়কি আঁখ মারে/ দিল ধড়কায়ে, বিচ সড়ক মে নখরে দিখায়ে উয়ো সারে/ হো করকে ইশারে ও লেড়কি আঁখ মারে’।

গাজিয়াবাদের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট-এ কর্পোরেট ফাইন্যান্সিং পড়ায় অরিত্র। আইআইটি, আইআইএম-এর প্রোডাক্ট অরিত্র দাশগুপ্ত লম্বা, সুদর্শন, মৃদুভাষী, কর্তব্যনিষ্ঠ, উনত্রিশ বছরের যুবক। বছরে আঠাশ লাখ টাকার প্যাকেজ, পাণিপ্রার্থী যুবক, তার বাড়ির সামনে তো মেয়েদের লাইন লেগে যাবারই কথা! কিন্তু অরিত্র আঠারো ঘণ্টা ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে এমন মেয়ে ঘরে আনতে চায় না। ও চায় এমন একটি ঘরোয়া মেয়ে যে নিজের শিক্ষার মর্যাদা দিতে দিনে কয়েক ঘন্টার জন্য ছোটোখাটো কোনও কাজ করুক ক্ষতি নেই কিন্তু ঘরেই বেশির ভাগ সময় থাকবে।

বড়ো কোম্পানিতে উচ্চ শিক্ষিতা যেসব মেয়েরা কাজ করে, তারা নিজের কেরিয়ার খারাপ করে হাউজওয়াইফ হতে রাজি নয়। কাজেই দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই-এ কর্মরতা হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিতা বিবাহযোগ্যা মেয়েদের প্রলোভন এড়িয়ে দক্ষিণ কলকাতার গলি খুঁজিতে মেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে অরিত্র।

গুড ফ্রাইডের ছুটির সঙ্গে শনি আর রবিবারের ছুটি মিলিয়ে তিনটে দিন হাতে পেয়ে, প্লেনে করে বাবা-মাকে নিয়ে কলকাতা ছুটে এসেছে অরিত্র। যে-তিনটি মেয়েকে ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট ঘেঁটে কেতকী আর অবিনাশ আগে থেকেই শর্ট লিস্ট করে রেখেছিলেন, তাদের মধ্যেই একটি মেয়েকে পছন্দ করে যাবেন ওঁরা। থাকার ব্যবস্থা সল্টলেক সেক্টর ফাইভে ওদের ইন্সটিটিউট-এর গেস্ট হাউসেই করে নিয়েছে অরিত্র।

শুক্রবার বিকেলে বেলেঘাটায় একটি মেয়ে দেখে শনিবার বাকি দুটো মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন অবিনাশ। বেলেঘাটার মেয়েটি দেখতে সুশ্রী, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে এমএসসি করেছে, একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ায় সে। কেতকীর মেয়েটিকে একরকম পছন্দ হয়ে গিয়েছে। দিল্লিতে এলে ওকে কোনও স্কুলে ঢুকিয়ে দিতে পারবে অরিত্র। ওর নামটাও পছন্দ হয়েছে কেতকীর— শুভমিতা।

পরের দিন সকালে বাগুইআটির বর্ণালিকে দেখতে গেল ওরা। মেয়েটি বড্ড রোগা, চোখে চশমা, দমদম পার্কের কোনও এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। কথাবার্তা খুব গুছিয়ে বলতে পারে মেয়েটি যেটা ভালো শিক্ষিকা হবার জন্য প্রয়োজন। ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও খুব ভালো, বাবা কাকা দাদারা সবাই স্কুল কলেজে পড়ান অথবা সরকারি চাকরি করেন। রংটাও বেশ ফরসা ছিল বর্ণালির, কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে ওকে ঘরে তুলতে ইচ্ছুক নন কেতকী। ছেলেপুলে যদি মায়ের মতো রোগা পটকা হয় তবে বাবা-মার আজীবন ভোগান্তি।

                                                                                                                                      চলবে….

এমএনসি-র প্রেম (দ্বিতীয় পর্ব)

জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, অবনীবাবু এইচআর হেড, মিস্টার বিনয় রাজদান-কে ডেকে পাঠান। মিস্টার রাজদান অবনীবাবুর কেবিনে এসে প্রবেশ করলে, অবনীবাবু বলা শুরু করেন— আচ্ছা, মিস্টার রাজদান, যদি কোনও কর্মচারীকে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়, তবে কত তাড়াতাড়ি আপনি তাঁকে বের করতে পারবেন আমাকে বলতে পারেন?

রাজদান— স্যার, দু’-তিন ঘণ্টা লাগবে সব ফর্মালিটি পুরো করতে। তবে তেমন আপৎকালীন অবস্থায় পাঁচ মিনিটেও বের করা যেতে পারে।

অবনীবাবু— আগামীকাল প্রয়োজন হতে পারে। তবে এ খবরটা যেন কেউ জানতে না পারে আগে থেকে।

রাজদান— ওকে, তাই হবে স্যার।

অবনীবাবু— আচ্ছা, স্নেহা গুপ্তা-কে আপনি চেনেন? মেয়েটি কাজেকর্মে কেমন?

রাজদান— স্যার, ভালোই কাজ করছিল, তবে কিছুদিন ধরে ওর প্রোজেক্ট ম্যানেজার বলছে যে, মেয়েটা যেন কেমন উদাস হয়ে গেছে।

অবনীবাবু— কোনও প্রেমে-ট্রেমে পড়েনি তো? ওর কোনও প্রেমিক থাকলে তার থেকেই জেনে নিন না ব্যাপারটা কী? কারণ মেয়েটা আগে কাজের জন্য অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। এমন একজন কর্মচারীর কাউন্সেলিং তো খুবই প্রয়োজন, তাই না? আপনি গিয়ে ওকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিন দেখি, আমাকে কিছু বলে কিনা। চেষ্টা করেই দেখি।

রাজদান বেরিয়ে গেলে অবনীবাবু ভাবতে থাকেন, কীভাবে কথা শুরু করবেন স্নেহার সঙ্গে। কারণ ওর মেজাজ ও হাবভাব দেখে খুবই হতাশ লাগছে আজকাল। নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে যা ও আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। দেখা যাক কী করা যায়।

স্নেহা গুপ্তা এসে অবনীবাবুর কেবিনে ঢোকে। অবনীবাবু স্নেহাকে বসতে বলে, ফোনে দু’টো চায়ের অর্ডার দেন। অবনীবাবুই প্রথম শুরু করেন—

—আচ্ছা, স্নেহা কেমন আছো বলো?

—ঠিক আছি স্যার।

—না, মোটেই তুমি ঠিক নেই। কয়েকদিন ধরেই দেখছি তুমি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো। কোনও সমস্যা হলে আমাকে অনায়াসেই বলতে পারো। এর আগেও তুমি দেখেছ অনেকের ক্ষেত্রেই আমি সমস্যার সমাধানে সাহায্য করেছি।

–না স্যার, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।

—বলেই দ্যাখো না, পারি কিনা? আরে বাবা, আমার চুলগুলো তো এমনি পাকেনি? তুমি আমাকে বলতে পারো। সমস্যার সমাধান আমার কাছে না থাকলে আমি তোমাকে সোজাসুজি বলে দেব।

—স্যার, এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। তবুও আপনি যখন জানতে চাইছেন বলছি, যেহেতু আমি আপনাকে অন্য চোখে দেখি। তবে কারও সঙ্গে এই কথাগুলো শেয়ার করবেন না প্লিজ।

—ঠিক আছে, বলো।

—স্যার, আমি সংক্ষেপে আপনাকে বলছি। আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসতাম কলেজ জীবনে। ওর সঙ্গে ঘর বাঁধব বলে ঠিকও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি এই শহরে চলে আসার পর ওর সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ কমতে থাকে। এর পর ও আমেরিকাতে অন সাইটে চলে যায়। সেখান থেকে মাঝে মাঝে কথাবার্তা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে তা কমে আসতে থাকে। যাকে ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ বলে আর কী। এই কোম্পানিতে এসে রোহন বলে একটি ছেলের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব বেড়ে যায়। একদিন সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকি। দু’জনে বিয়ে করব বলে ঠিক করি। কিন্তু আমাদের ভাগ্য মনে হয় সেটা মেনে নিল না। রোহনের বদলি হয়ে গেল বেঙ্গালুরু। এই ক্ষেত্রেও প্রায় তাই হচ্ছিল, দেখা শোনা কম হওয়ায় দূরত্বটা একটু বাড়ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরাই ঠিক করলাম আর দেরি নয়। বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলব। আমাদের দু’বাড়ির মধ্যে কথাও প্রায় পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। পাকাদেখার কয়েকদিন আগে আমি ভেবে দেখলাম আমার আগের প্রেমিকের সম্পর্কে রোহনকে সব খুলে বলা উচিত এবং সব কথা ওকে বললাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, ও সে সব কথা শুনে পিছিয়ে গেল! বলল – তোমার মনে হয় আগের জনকেই বিয়ে করা ঠিক হবে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! এটাকে আমার সরলতা বলব না বোকামি বুঝতে পারলাম না। এর পরে বহু চেষ্টা করেও যখন রোহনকে রাজি করাতে পারলাম না, তখন ফিরে গেলাম আবার ওই আগের প্রেমিকের কাছে অর্থাৎ অভিজিৎ-এর কাছে।

মাঙ্কি ক্যাপ (১ম পর্ব)

শীত এলেই সবার নজরে পড়ে মাঙ্কি ক্যাপটির উপর। প্রথমে ইমনের দাদু এক্স বিপ্লবী স্বদেশ হালদারের। একসময় চুটিয়ে স্বদেশি করেছেন। সার্থক তাঁর নাম আর কাম। মাথায় গান্ধি ক্যাপ। মনে হতো তিনিই মহাত্মা। স্বাধীনতার পরও টুপি মাথায়। গান্ধি যেন তাঁর তেলা নি-কেশ মাথায় চেপে বসেছে। পাড়ার উঠতি ছেলেছোকরার কাছে তিনি টুপিদাদু। কিন্তু দাদুরও বয়স বাড়ছে। সঙ্গে জাঁকিয়ে পড়ছে শীত। গান্ধি টাক মাথা সামলালেও কান আর নাকের ফুটোয় গোঁজ মারা তার কম্মো নয়। ফলত হিমেল হাওয়ার দাপটে ইমনের টুপি দাদু একেবারে কুপোকাত। গলায় ঘর্ঘর, নাকে সরসর আর কানের ভিতর কড়কড় অনবরত বেজেই চলেছে। তবু দাদু টুপি খুলবেন না। ডাক্তার সনাতন হাজরা ইমনের মাকে উপদেশ দিলেন— এমনটা কখনওই বরদাস্ত করা যাবে না। আরে বাবা বয়স তো হচ্ছে নাকি? কত চলছে?

ইমনের মা আঙুলের কড় গুনে বলেন— আশি ছুঁই ছুঁই।

ডাক্তার হাজরা চমকে উঠে বলেন— এই ভয়ংকর শীতে এখনও হাফ নেকেড ফকির হয়ে থাকতে চান। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—বাবা তো সচিনের মতো সেঞ্চুরির পাহাড় গড়বেন বলে শপথ করেছেন।

—বলবেন, ওসব গান্ধিগিরি চলবে না। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভিমরতি। নিউমোনিয়ায় একেবারে টেসে যাবে।

—তাহলে উপায় ডাক্তারবাবু?

—হনুমান ডট কমের যুগ। ছবিতে দেখেছেন বিশুর ছেলেটা মাথায় কী পরে আছে? ইমনের মা মাথা নাড়ে।

ডাক্তার হাজরা বিজ্ঞের মতো বলেন— আইসল্যান্ডে ওসব গান্ধি-টান্ধি এক্কেবারে অচল। হনুমানই পারে ওরকম রাবণের মতো ভয়ংকর প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে।

—তার মানে, আপনি বলছেন মাঙ্কি ক্যাপ।

—গান্ধির বদলে হনুমান। ঠিক ধরেছেন।

—কিন্তু হনুমান টুপি যদি মাথায় না পরতে চান? আমার শ্বশুরমশাইয়ের যা জেদ।

ডাক্তার হাজরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে কিসব চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতহাস্যে বললেন— কুছ পরোয়া নেই। যে রোগের যেমন ওষুধ।

ইমনের মা বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন— সেটা আবার কী?

—কথা না শুনলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।

—আপনি কী করবেন?

—ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে গান্ধি খুলিয়ে হনুমান পরিয়ে দেব।

—কতক্ষণ লাগবে?

—মাত্র সাড়ে সতেরো মিনিট।

—বলেন কী টুপি পরানো এত সোজা? এত তাড়াতাড়ি?

—আমার নাম…।

ইমনের মা সামান্য রসিকতা করে বলে— মুন্না ভাই এমবিবিএস। তাই না?

—ধ্যাৎ, কী যে বলেন। আমার নাম সনাতন হাজরা। রোগীদের টুপি পরানোই আমার কাজ। বিফলে মূল্য ফেরত।

ইমনের মা বিড়বিড় করে বলে— মুন্নার বদলে সনাতন। গান্ধির বদলে হনুমান। দুয়ে দুয়ে চার।   ভালোই মিলেছে।

ডাক্তার হাজরার চেম্বার পর্যটন করে ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপের স্বাদ টের পেয়েছেন এখন হাড়ে হাড়ে। তাঁর মুখে দিনরাত হনুমান চালিশা। হনুমান ভক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। টুপির এত গুণ, আগে জানা ছিল না। শীত এলেই তিনি বাহুবলী হয়ে যান। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে যখন সবাই লেপের ভিতর জবুথবু, ঘুম আর ভাঙতেই চায় না, তখন ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে স্বপ্নবীথি পার্কের ভিতর তিন রাউন্ড মর্নিং-ওয়াক সেরে অবলীলায় বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর সোজা ইমনের বাবার ঘরে ঢুকে এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলেন— যা আর দেরি করিস না। পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। ইমনের বাবার মুখে বিরক্তির সুর— আঃ আমাকে আবার টুপি পরাতে এলে কেন? দাদু নাছোড়বান্দা। টুপি পরানোয় তিনি জেনারেশন ধরে অভ্যস্ত করাবেনই। সবশেষে যে ইমনের পালা, তা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সে জানে লেপের তলায় ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকলেও রেহাই নেই। দাদু ইমনের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন – শোন মহিম, মাঙ্কি ক্যাপ পরে শীতের সকালে মর্নিং ওয়াকের মজাই আলাদা। ইমনের বাবা যেন তার দাদুর কথা শুনতেই পায় না। লেপের ভিতর শামুক হয়ে থাকতে চায়। দাদু তবু ছাড়ে না ইমনের বাবাকে। বলেন— কিরে উঠবি নাকি বউমাকে বলব গায়ে জল ঢেলে দিতে। ইমনের বাবা মুখ বিকৃত করে বলে— আঃ কি জ্বালাতন! শান্তিমতো ঘুমোতেও দেবে না নাকি?

—ব্যাটা কুম্ভকৰ্ণ। এত ঘুম আসে কী করে? রাতে ঘুমোসনি? হঠাৎ দাদু বাজখাই গলায় ইমনের মাকে চিৎকার করে ডেকে বলেন— বউমা, মহিম কি রাতে ঘুমায় না? তোমরা করো কী? মা আমতা আমতা করে বলে— আপনার গুণধর ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমি পই পই করে বলি, যা ঠান্ডা পড়েছে তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর…। দাদু মাকে সমর্থন করে বলেন— ইউ আর রাইট বউমা। বাট মহিম…।

—সাত তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর ঢুকলে ওর নাকি জ্বর আসে।

—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জ্বর?

—মানে গরম হয়ে গেলে আর ঘুম আসে না। —কই আমি তো এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না।

—আপনি গুরুজন। আপনাকে কি সব খুলে বলা যায়?

—তুমি কাছে থাকো না?

—আমি থাকলে জ্বর আরও বাড়ে।

—সে কি কথা! কেমন ব্যাধি?

—আপনার ছেলেই ভালো বলতে পারবে।

—ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

—আপনার ছেলে না যেতে চাইলে আমি কি আর করতে পারি?

—আঃ বউমা হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার হাতেই ওর কলকব্জা।

—শীত এলেই ও এরকম বিগড়ে যায়। মেশিন ঠিক থাকে না।

—না না এতো ভালো কথা নয়। এর একটা আশু বিহিত প্রয়োজন।

—দেখুন চেষ্টা করে। আপনার মধ্যস্থতায় যদি কাজ হয়। আমি তো অলরেডি ফেড-আপ।

এইবার দাদু ইমনের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন— কী’রে বউমা যা বলছে সত্যি?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— হুম।

—রাতে ঘুমোস না?

—হুম।

—বউমার কথা শুনিস না?

—হুম।

—কী তখন থেকে হুম হুম করছিস?

—আঃ বিরক্ত কোরো না তো। লেট মি হ্যাভ এ সাউন্ড স্লিপ।

—রাতে না ঘুমিয়ে সকালে কেন ঘুমোচ্ছিস মহিম?

—ক’দিন ধরে অফিসের কিছু জরুরি ফাইল রাতে দেখতে হচ্ছে। তাই শুতে দেরি হচ্ছে। আর কোনও গল্প নেই।

ইমনের মার দিকে তাকিয়ে দাদু বলেন— ও তাই বল। আমরা তো অন্য কিছু সন্দেহ করছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন -ওরে বাবা সাতটা বেজে গেল। নে আর দেরি না করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপটা চাপিয়ে পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। দেখবি মন-মেজাজ একেবারে ঝরঝরে হয়ে যাবে।

ইমনের বাবার সেই এক বিরক্তিকর জবাব— আজ টুপি না পরলেই নয়?

— টুপি না পরলে ইউ মাস্ট ক্যাচ কাফ্ অ্যান্ড কোল্ড। আজকের টেম্পারেচার কত জানিস? অলমোস্ট এইট ডিগ্রি। ‘জয় হনুমান’ বলে বেরিয়ে পড়।

—আজ আমি টুপি পরব না।

—ছেলেমানুষি করিস না মহিম। টুপি তোকে পরতেই হবে।

—কিছুতেই না।

—অবাধ্য হোস না। তুই ভালো করেই জানিস। আমি এক সময় স্বদেশি করেছি। কতজন গোরাকে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলেছি। গান্ধি ছেড়ে এখন আমি হনু হয়েছি। আমার এখন মহাবলী শক্তি।

হঠাৎ ‘জয় বজরংবলী’ বলে একলাফে ইমনের টুপিদাদু তার বাবাকে চ্যাংদোলা করে তুলে বাইরে এনে ফেলে। তারপর মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ পরিয়ে বলেন— মহিম তুই এখনও আমার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু রে।

(২)

সেদিনটাও ছিল এমনই এক ভয়ংকর শীতের সকাল। হনুমান টুপি মাথায় ইমনের বাবা বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে তখন পড়ত বাবা। সঙ্গে চাকরির পরীক্ষা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বডি ফিট। বাইসেপস, ট্রাইসেপস, সিক্স প্যাকস সবই তার স্বাস্থ্যবান শরীরে সুসজ্জিত ও সুশোভিত। কিন্তু শীতকাল এলেই কেমন জবুথবু হয়ে যায় ইমনের বাবা। সামান্য ঠান্ডা যেন সহ্য হয় না। হাঁচি একবার শুরু হলে তিন কুড়িতে গিয়ে থামত। নাকের ট্যাপ কলে প্যাঁচ বিকল। অনবরত জল পড়েই চলেছে। ইমনের ঠাম্মা বুকে গরম তেল মালিশ করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলত— যা মর্নিং ওয়াকটা সেরে আয়। তোর বাবা আগেই বেরিয়েছে। আমি গরম জল চাপাচ্ছি। চা খেয়ে বাজারে যাবি। ইমনের বাবা ঠাম্মার কথা শিরোধার্য করে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

আড়াই রাউন্ড মারার পর হঠাৎ ইমনের বাবার বোধোদয় হয় কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। একেই ভয়ংকর ঠান্ডা। তার উপর পার্ক প্রায় জনমানবশূন্য। যে দু-চারজন সিনিয়র সিটিজেন হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করছিল তারাও একবার কোনওক্রমে রাউন্ড মেরেই সটকেছে। কেবল ইমনের নির্ভীক স্বাস্থ্যবান বাবা একা শীতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

পিছনে না তাকিয়েই জোরে পা চালায় তার বাবা। ভাবে, নির্ঘাৎ কোনও চোর-ডাকাত। তার পকেটে বাজারের টাকা। আঙুলে জন্মদিনের সোনার আংটি। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। সব কেড়ে নিলে, খুলে নিলে তার যাবতীয় বীরত্ব ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। ওর হাতে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে।

এরকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পিছু-নেওয়া আগন্তুকের সঙ্গে ছোটাছুটি লুকোচুরি খেলার পর অকস্মাৎ এক মেয়েলি কন্ঠস্বরে ইমনের বাবার সম্বিৎ ফেরে। তার বাবা শুনতে পায়— প্লিজ হেল্প মি…. আর পারছি না… ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি… আমাকে বাঁচান।

মেয়েলি কেসে তার বাবা কোনওদিনই পাশ করতে পারেনি। বরাবরই শূন্য পেয়েছে মেয়ে পটানোর পরীক্ষায়। অথচ কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুরা ক্যান্টিনে বাথরুমে-সিঁড়িতে- ব্যালকনিতে— যত্রতত্র নির্ভয়ে টুকলি করে পাশ করে যাচ্ছে। ইমনের বাবার কানে ফের সেই করুণ আর্ত কন্ঠস্বর — আমাকে বাঁচান… আমি জমে যাচ্ছি… মরে যাচ্ছি। ইমনের বাবা মনে মনে ভাবে— কেসটা জন্ডিস নয় তো? বাঁচাতে গিয়ে যদি ফেঁসে যায়? মেয়েরা সব পারে। ইমনের বাবা তবু সাহস সঞ্চয় করে ‘জয় বজরং বলী’ বলে একলাফে মেয়েটির সম্মুখীন হয়— আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান বলুন তো? মেয়েটি তার কথার জবাব না দিয়ে ইমনের বাবার মুখের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বাবা থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে বলে— কী মেয়েরে বাবা, কথা নেই বার্তা নেই। প্রথম সাক্ষাতেই মুখ দেখাচ্ছে। এরপর না জানি কী করতে বলবে। এদিকে মেয়েটি প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রায় বাকরুদ্ধ। আঙুল দেখিয়ে কোনওক্রমে বলে — টুপি। ইমনের বাবা চমকে উঠে বলে— টুপি কেন?

—বাইটিং কোল্ড। বুঝিনি বাইরে এতটা ঠান্ডা। টুপি না জড়ালে কানের যন্ত্রণায়…।

—কিন্তু আমার টুপি আপনাকে জড়ালে আমার হাঁচি, কাশি, নাকের জল…।

—আপনি কি চান না একটা অসহায় মেয়েকে এই নিষ্ঠুর আবহাওয়া থেকে বাঁচাতে, উদ্ধার করতে। আপনি সু-পুরুষ স্বাস্থ্যবান। আপনি নিশ্চয়ই চান না চোখের সামনে অসহায় মেয়েটি শীতের প্রচন্ড কামড়ে ফালাফালা হোক। ইমনের বাবার মনে হল, কে যেন তার জামা-প্যান্ট-মাফলার-সোয়েটার-হনুমান টুপি সব খুলে নিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেহে এক বালতি জল ঢেলে দিল।

মাথার মাঙ্কি ক্যাপটা একটানে খুলে ইমনের বাবা মেয়েটির মাথায় পরিয়ে দিল। উষ্ণতা পেয়ে মেয়েটি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। কিন্তু টুপি খসিয়ে হাড়-কামড়ানো কনকনে শীতে ইমনের বাবা টানা এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছিল। মেয়েটি এর মধ্যে বার কয়েক এসে তার বাবাকে উষ্ণ করে দিয়ে গেছে। এরপর তার বাবার চাকরি, তার বাবার বিয়ে সবই সম্ভব হয়েছে মেয়েটির চিরস্থায়ী সঙ্গলাভ এবং ভালোবাসার হাতের-গরম স্পর্শে। মাঙ্কি ক্যাপের আড়ালে সুজাতা সরকার নামের সেই মেয়েটি এইভাবেই ইমনের বাবার অর্ধাঙ্গিনি এবং ইমনের গর্ভধারিণীরূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

ফোরম্যানের টেবিল

সুরের ঝরনাধারায় মন ভরিয়ে দিয়ে দেয়ালঘড়ি জানিয়ে দিল সাড়ে চারটে বাজে। ফাইলে ডুবে থাকা পল্লব, মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। কুশলের আসার সময় হল। স্টোরের চাবি জমা দিয়ে সে ক্লাসরুমের জানলা-দরজা বন্ধ করবে তারপর ওয়ার্কশপের গেটে তালা লাগাবার মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে পল্লব, রওনা দেবে ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ি সুঠাম আবাসন-এর দিকে।

আর মাত্র ষোলোটা মাস বাকি। তারপর এই চেয়ার-টেবিল এইসব ফাইলপত্রের ভার ইন্সট্রাকটর নবীনকে সমর্পণ করে তার ছুটি। ফোরম্যানের ভূমিকায় সমস্ত কর্তব্য পালন করলেও তাকে ফোরম্যান করা হয়নি। এই ঝঞ্ঝাট সামলানোর দায় আর তার থাকবে না। শুনতে হবে না প্রিন্সিপাল বলরাম বোসের অসূয়াযুক্ত কটূক্তি- টেবিলের ফাইলে ডুবে করোটা কী! তুমি তো বসে বসে কবিতা-গল্প লিখে লিখে পাঠাও তারপর প্রিন্টেড কপি এনে অফিস স্টাফদের পড়িয়ে বাহবা কুড়োবার চেষ্টা করো। বেতনের টাকাটা তো গুনে গুনে নাও অথচ কাজের কাজ কিছুই হয় না!

অবশ্য এই কটূক্তিতেই থেমে থাকেননি তিনি। তাঁর টেবিলের সমকোণে ছিল বহুদিনের পুরোনো ফোরম্যানের টেবিল, সেটিও ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরা ওই বলরাম বোসের সমর্থনে দখল করে নিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগেই। তবে সেই যুদ্ধে জিতে মাথা উঁচু করে সে যে বিদায় নিতে পারছে, এইটুকুই তার চাকুরি জীবনের সবচেয়ে বড়ো অ্যাচিভমেন্ট।

তার স্ত্রী সঞ্চারি বলেছিল, তোমার নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে অস্ত্র করে লড়াই করছ তুমি! অভিমন্যুর মতো তোমায় সপ্তরথী ঘিরে ধরলেও তুমি তাদের হারিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসতে পারবে। একদিন তারাই হাতে হাত মেলাতে ছুটে আসবে, মিলিয়ে নিও! সেই ঘটনাই ঘটে চলছে এই সময়, কেউ এসে আবার তার বুক পকেটে গোলাপও গুঁজে দিয়েছে।

ডক্টর বি সি সেন ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। হিজলপুরের কুড়ি বিঘা জমিতে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে ষাটের দশকের শুরুতেই তিনি তৈরি করেছিলেন এই ব্রাইট বয়েজ আকাদেমি। আবার পঠন-পাঠনের সঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনাও তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তখন কারিগরি প্রশিক্ষণও খুব প্রযোজন হয়ে পড়েছিল। তাই ওই একই জমিতে সরকারি অনুমোদনক্রমে ব্রাইট বয়েজ টেকনিক্যাল সেকশন গড়ে উঠেছিল। কুড়িজন ছাত্রের প্রশিক্ষণের জন্য ফোরম্যান, ইন্সট্রাকটর-সহ দশজন স্টাফ নিয়োগের অনুমতি মিলেছিল সেই সময়ে। চালু হয়েছিল একবছরের ফিটিং-কার্পেন্টরি কম্বাইন্ড কোর্স।

পল্লব যখন ইন্সট্রাকটর পোস্টে ইন্টারভিউ কাম টেকনিক্যাল স্কিল টেস্টে ডাক পেয়ে আসে, তখন তার প্রতিযোগী ছিল ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরার ভাই শ্রীনাথ হাজরা। ছিল আরও বারোজন প্রতিযোগী। অবশেষে শেষ হাসি হেসেছিল পল্লব। শ্রীনাথ হাজরা দাঁড়াতেই পারেনি, ক্লিন বোল্ড হয়ে ফিরে গিয়েছিল। তাই পল্লবকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না ভূতনাথ। গোটা ব্রাইট বয়েজ আকাদেমির বেশ কিছু স্টাফের মন ক্রমে ক্রমে বিষিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

পঁচিশ বছর আগে যখন পল্লব ইন্সট্রাকটরের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল, তখন ফোরম্যান ছিলেন শিরীষ বোস। ভদ্রলোক ছিলেন অকৃতদার, হাসিখুশি অথচ সেই মানুষটা যে ভয়ানক সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এ ভোগেন এই বছর সেপ্টেম্বরের টিচার্স ডে পালনের আগে পর্যন্ত পল্লব বুঝতেই পারেনি। ততদিনে যাদের সঙ্গে তার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তারা সবাই তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। তাদেরই অনুরোধে সেই বছর টিচার্স ডে উপলক্ষে পল্লব প্রথম কবিতা পাঠের সুযোগ পায় আর তারপরই শিরীষ বোসের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে।

তখন চাকরির সবেমাত্র এক বছর পূর্ণ হয়েছে, আরও এক বছর পার হলে তার প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হবে। তবেই স্থাযী পদে নিযুক্ত হবে সে। টেকনিক্যাল সেকশনের ফিটিং-শপের সামনে একটি ছ’ফুট বাই বারোফুটের টেবিলে পুরো ব্রাইট বয়েজ আকাদেমির মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এক নামি শিল্পী। মিড-ডে মিলের ঘর, খেলার মাঠ, ছোটো ছোটো জলাশয়, কারিগরি প্রশিক্ষণ ভবন, বিদ্যালয় ভবন, লাইব্রেরি– সব মিলিয়ে আকাদেমির পুরো চিত্রটা সেই টেবিলে উপস্থিত ছিল। তখন অবশ্য মিড-ডে মিল রুম না বলে টিফিন রুম বলা হতো।

শিক্ষক দিবস পার হওয়ার দু’-তিনদিন পর একদিন ফোরম্যান বোস বলে বসলেন, শোনো পল্লব, এই টেবিলের নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে ড্রিল করা আছে, যেমন ধরো টিফিন রুম, প্লে-গ্রাউন্ড, স্কুল বিল্ডিং এইসব আর কী! প্রত্যেক ড্রিলড হোলের মধ্যে তার গলিয়ে হোল্ডার পরিয়ে পুরো টেবিলটার নীচে ইলেকট্রিক ওয়্যারিং কমপ্লিট করে রাখবে তুমি, বুঝেছো নিশ্চয়ই?

পল্লবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ইলেকট্রিক সার্কিট সম্বন্ধে সে অভিজ্ঞ নয় তাই বলল, সে কী! আমি তো মেকানিক্যাল গ্রুপের, ওয়্যারিং করিনি কখনও! আমাদের তো একজন ইলেকট্রিশিয়ান আছেনই, আমি বরং তাঁকে সাহায্য করব। নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল পল্লব।

—টুনি-বাল্ব, সুইচ-বোর্ড সে লাগাবে, ফিনিশিং টাচ দেবে সে। ইনিশিয়াল ওয়্যারিং কমপ্লিট করবে তুমি।

—কিন্তু আমার থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলোও তো রয়েছে!

—তার বাইরে অনেক সময় পাও তুমি! অফ পিরিয়ডে কবিতা না লিখে কাজ করে দেখাও দেখি! তারপর রীতিমতো হুমকির সুরে বলেছিলেন, এখনও প্রবেশন পিরিয়ড কাটতে গোটা একটা বছর বাকি, জানো তো নিশ্চয়ই!

ততক্ষণে কারণটা প্রাঞ্জল হয়ে গেছে পল্লবের কাছে। সে বুঝতে পারল টিচার্স ডে উপলক্ষে তার কবিতার প্রশংসার পুরস্কার হিসেবে, তার জন্য এই বংশদণ্ডের ব্যবস্থা করেছেন বোস। শাস্তি হিসেবে টেবিলের তলায় ঢুকে মশার কামড় খাওয়ানোটাকেই উপযুক্ত মনে করেছিলেন তিনি।

স্টোরকিপার মনোজ দাসকে পল্লব মনাদা নামেই ডাকত। ওয়্যারিং-এর প্রাক্কালে স্টোর থেকে এনে হ্যামার, স্ক্রু-ড্রাইভার, সোল্ডারিং আয়রন এসব টেবিলের নীচে সাপ্লাই দিত সে। চটাস-পটাস শব্দে মশা মারতে মারতে বাধ্য হয়ে ওয়্যারিং-এর কাজ করতে হতো পল্লবকে। একদিন তার মনাদা ফাঁকা পেয়ে বলল, এসব বাঁজা লোকেদের নিজেদেরই ঠিক নেই আবার অন্যের বিচার করে!

—মানে! কৌতূহলের দৃষ্টিতে পল্লব তাকিয়েছিল তার মনাদা-র দিকে।

—মানে বুঝলে না তো! এই যে চাকরি পেয়ে বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে-থা সেরে ফেললে বোসের চোখ টাটাবে না!

—কিন্তু ফোরম্যান উনি! মোটা মাইনের চাকরি করেন, বিয়ে করেননি কেন?

—আরে বাঁজা তো!

—সে আবার কী! মেয়েদের ছেলেমেয়ে না হলেই তো বাঁজা বলে!

—দূর কিছুই জানো না তুমি! ছেলেদেরও দোষ থাকলে ছেলেপুলে হয় না। মেয়েরা এদের বিয়ে করে সুখী হয় না। ডিভোর্স হয়ে যায়, দ্যাখোনি! ওই বোসেরও সেই দোষ আছে। ও হল গিয়ে বাঁজা ব্যাটাছেলে! তাই ভয়ে বিয়ে করেনি।

যে-চার বছর শিরীষ বোস ছিলেন, তাকে খুব জ্বালাতন করেছিলেন। ডক্টর স্নেলের সূত্র উদ্ধৃত করে একটা দৃষ্টিশক্তির চার্ট বানিয়েছিল পল্লব। শিরীষ বোস সেটিকে দেখেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, সূত্র ধরে চার্ট হয়! এই লেখাপড়া শিখেছ!

তিনি তাঁর ইচ্ছামতো চার্ট-পোস্টার লাগাতেন ওয়ার্কশপের বিভিন্ন জায়গায়। তাঁর রিটায়ারমেন্টের পর পল্লব যখন দায়িত্ব নিল, সেও বোসের লাগানো সমস্ত কিছু দূর করে দিয়ে নিজের মতো করে শপফ্লোরের দেয়াল সাজিয়ে তুলল।

শিরীষ বোস বিদায় নিলেও ভূতনাথ হাজরার হাতে তখনও বেশ কিছুকাল সময় ছিল। নতুন প্রিন্সিপাল হলেন বলরাম বোস। ভূতনাথ তাঁর কান ভারী করা শুরু করে দিলেন।

এদিকে আর এক বিপত্তি শুরু হল। ফিটিং-কার্পেন্টরির এক বছরের কম্বাইন্ড কোর্সটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস থেকে শুরু করে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আর মান্যতা দিতে অস্বীকার করল। প্লেসমেন্ট অফিসার চঞ্চল তালুকদার দেখলেন ভারি মজা! তিনি প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দিলেন— এই কোর্সের কোনও ভ্যালিডিটি নেই। খোলনলচে বদলাতে হবে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ভোকেশনাল ট্রেনিং বা এনসিভিটি-র অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন কোর্স চালু না হলে, এই কোর্স চালিয়ে কোনও লাভ হবে না। ছেলেরা চাকরি পাবে না। আমারও কিছু করার নেই।

চাকরির সুযোগ কমে যেতেই ছাত্রের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করল। কুড়ি থেকে কমে কমে চার-পাঁচজনে এসে ঠেকল। চতুর্দিকে সমালোচনার ঝড় উঠতে লাগল। অবশ্য আড়ালে ছিল ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরার উসকানি। চার-পাঁচজন ছাত্রের জন্য দশজন স্টাফ। নড়ে-চড়ে বসল রাজ্য-প্রশাসন। মিড-ডে মিল থেকে শুরু করে সবরকম সুযোগ-সুবিধে কমতে শুরু করল। ছাত্রদের সঙ্গেও ঠাট্টা-তামাশা শুরু হল। তাদের নাম দেওয়া হল কম্বাইন্ড। স্কুলে প্রার্থনার সময় অতি উৎসাহী এক শিক্ষক বলে ফেললেন, কেউ আছো কম্বাইন্ড?

তিনজন ছাত্র সেদিন উপস্থিত ছিল। তারা হাত তুলতেই হেসে তিনি বললেন, এই তো কম্বাইন্ড আছে এখনও, একেবারে নিল হয়ে যায়নি!

মিড-ডে মিল খেতে গিয়ে একটি ছাত্র দু’-হাতা ভাত বেশি চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, কী করতে এই মরা কোর্সটা করতে যে আসিস তোরা, বুঝি না! নে খেয়েদেয়ে বছরটা কাটিয়ে দে। তারপর তো সেই বাড়িতেই বসে থাকবি।

যে-নদী হারিয়ে পথ চলিতে না পারে… দশম শ্রেণিতে পড়া সেই ভাবসম্প্রসারণটাই মনে পড়ে যায় পল্লবের। কলকাতার সল্টলেকের কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে যোগাযোগ শুরু করে পল্লব। তখন অবশ্য নতুন প্রিন্সিপাল বলরাম বোস সাহায্য করেছিলেন তাকে, কিন্তু সেটির পিছনে ছিল তাঁর নিজের স্বার্থ। সেখানে যাতায়াত করতে করতেই নতুন একটা দু’বছরের কোর্স তৈরি করে ফেলে সে। সেখানকার এক অফিসারই এই কোর্সের নাম দেন ফিটিং-কাম মেশিনিং কম্বাইন্ড কোর্স।

ভূতনাথ হাজরা অতসব বোঝেন না, ডিসট্যান্স- এ এমএ করে অনেক তৈলমর্দন করে ভাইস-প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। তিনি অন্যদের উসকানি দিতে লাগলেন ওই পল্লববাবুর ছোটাছুটিই সার, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। মনে মনে প্ল্যান করতে লাগলেন কীভাবে পল্লবকে নাস্তানাবুদ করা যায়।

দীর্ঘ বৈঠকের পরও কোর্সটি তখনও পাস হয়নি। সরকারি ফিতের ফাঁস সহজে আলগা হয় না, একথা ভূতনাথও জানতেন। তিনি তলে তলে চঞ্চল তালুকদারকে হাত করলেন। বললেন, এই যে বসে-শুয়ে গান গেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কোর্স চালু হয়ে গেলে, সব নষ্ট হয়ে যাবে। ছুটোছুটি করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, যদি সত্যি সত্যিই এনসিভিটি-র নতুন কোর্স চালু হয়ে যায়! তাই পল্লব বিশ্বাসের কনফিডেন্স লেভেল মানে আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ডটাই যদি ভেঙে দিতে পারি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

—এক্ষুনি রাজি। কী করতে হবে বলুন তো দেখি! বলে ওঠেন চঞ্চল তালুকদার।

—কিচ্ছুই নয়, শুধু আমার সঙ্গে থাকুন। যেমনটি বলব ঠিক তেমনটাই করবেন, ব্যস তাহলেই কেল্লা ফতে! বলে ক্রূর হাসি হাসলেন ভূতনাথ।

সেদিন টিফিনের পর নবীন তখন ক্লাস নিচ্ছে, অফিস রুমে বসে কাজ সারছিল পল্লব। হই-হই রবে সেই ঘরে এসে ঢুকে পড়লেন ভূতনাথ হাজরা, চঞ্চল তালুকদার আর দু’জন কার্পেন্টার। পল্লবের টেবিলকে পাস কাটিয়ে তার টেবিলের সমকোণে থাকা ফোরম্যানের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একজন কার্পেন্টারের উদ্দেশ্যে ভূতনাথ বললেন, দ্যাখো তো, এই টেবিলটাকে কেটেকুটে নতুন একটা টেবিল বানিয়ে দিতে হবে। পারবে তো? আমার নতুন কম্পিউটার বসবে এই টেবিলেই… হয়ে যাবে নিশ্চয়ই!

পল্লব লাফিয়ে উঠল, এসবের মানে কী? আমার ঘর থেকে টেবিল নিয়ে যাবেন কেন?

—আর ঘর! সেকশনটাই উঠে যাবে আজ নয় কাল! প্রিন্সিপালকে জানিয়ে এসেছি, চাইলে ফোন করে যাচাই করে নিন। ভূতনাথ হাজরার কণ্ঠে উষ্মা ফুটে উঠল।

চোখের সামনে দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা ফাইল-পত্র ফেলে ছড়িয়ে ওরা টেবিলটাকে বলির পাঁঠার মতো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল। মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল পল্লবের। নাহ্ এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতেই হবে! তবে সেটা ঠান্ডা মাথায়, তাড়াহুড়ো একদম নয়। পল্লব শপথ নিল এর শেষ দেখেই সে ছাড়বে!

সল্টলেক অফিসের তিনজন টপ ক্লাস অফিসারই পল্লবের কাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার এই হার না মানা লড়াই-এর অংশীদার হলেন তাঁরাও। জানালেন তার তৈরি দু’বছরের কোর্সটিকে চেন্নাই অফিস ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু অন্তত আরও একটি কোর্স না হলে নতুন আইটিআই চালু হবে কীভাবে?

পল্লবের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। তাদের আকাদেমির এয়ার কন্ডিশনড কম্পিউটার রুমটিকে তো মাল্টিপল ওয়ার্কিংয়ে লাগানো যায়! ওই রুমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর এক বছরের কোর্সটি চালু করলে আরও দশজন ছাত্র যোগ দিতে পারে। আর নতুন আইটিআই তৈরির পথের বাধাও দূর হয়।

কম্পিউটার রুম নিজের দখলে রেখে মেন কম্পিউটার-এ পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে রাখতেন ভূতনাথ হাজরা। এবার সেই অনধিকার চর্চা বন্ধ করার সুযোগ স্বযং এসে উপস্থিত হয়েছে। ভূতনাথ তার অফিসের টেবিল কেড়ে নিয়েছেন, এবার তাঁর দখলে থাকা কম্পিউটার রুমটাই কেড়ে নেবে সে!

যথাসময়ে ইন্সপেকশন টিম এসে পুরো ওয়ার্কশপ ঘুরে ঘুরে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে সবুজ সঙ্কেত দিতেই, প্রিন্সিপাল বলরাম বোস পুরো ওয়ান এইট্টি ডিগ্রি ঘুরে পল্লবের পাশে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। কারণ স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি ততক্ষণে পল্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন।

দু’-দুটি কোর্স নিয়ে নতুন প্রাইভেট আইটিআই-এর উন্মেষ ঘটল। নামি একটি দৈনিকের পক্ষ থেকে দু’জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী এসে ছবি তুলে সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেন।

সাংবাদিক পল্লবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘নতুন আইটিআই-এ আপনার অনুপ্রেরণার মূল উৎস কী?’

নিজের অজান্তেই পল্লব উত্তর দিয়েছিল— ফোরম্যানের টেবিল।

সখী

যে-গন্ধটা আসছে, সেটা খুব খারাপ গন্ধ। ঠাকুরের আসনের জুঁই-চন্দনের গন্ধ ছাপিয়েও এই গন্ধটা আসে। এই গন্ধে এখনও লোভ হয়। ইলিশ মাছের গন্ধ। মরণ! ইলিশ মাছ হচ্ছে আজ।

ছত্রিশ বছর ধরে ইলিশ খাচ্ছেন না তারাসুন্দরী। উনি গত হয়েছেন ছত্রিশ বছর হ’ল। কোনও মাছই তো খাচ্ছিলেন না, নিউমোনিয়া হবার পর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, ডাক্তার বলল চিকেন সুপ খেতে হবে। তারাসুন্দরী বলেছিলেন, ছি-ছি-ছি, মুরগির ঝোল? বিধবার মুখেও আনতে নেইকো। ডাক্তার বলেছিল, তবে শিঙিমাছের ঝোল খান। সেটাও খেতে চাননি, বলেছিলেন, এসব খেতে পারব না, আঁশটে গন্ধ লাগবে, এতদিন ওসব খাইনি, বমি হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছিল, বমি হবে না। হলে আমি আছি।

কই, আঁশটে গন্ধ লাগেনি তো, ভালোই লেগেছিল বেশ। মাছগুলো ঝোলের ভিতরে চটকে মিশিয়ে দিয়েছিল, বেশ বুঝতে পারছিলেন তারাসুন্দরী। কিন্তু ভালো লাগাটা কাউকে বুঝতে দেননি। দিতে নেই। চামচে করে সুপ খাইয়ে দিচ্ছিল ছেলে বউ, আর প্রতিবার মুখ বিকৃত করেছেন।

তারপরও, জ্বরজারি হলে একটু শিঙিমাছের সুপ খেয়েছেন। নাতনিটা বলেছে নিয়মভঙ্গ যখন হয়েই গেছে ঠাম্মা, রোজই একটু মাছ খাও। শরীর ঠিক থাকবে। একশো বছর টেনে দেবে।

একশো বছর টেনে দেবে কথাটা যে একটা খোঁচা মারা কথা এটা কি বোঝেন না তারাসুন্দরী? বেশ বোঝেন। বাড়ি সারাইয়ের সময় রাজমিস্ত্রিকে বড়ো বউমা বলেছে, ওটা শুনেছেন তারাসুন্দরী, শুনে ফেলেছেন– বাড়ি ভেঙে যাবে, খসে পড়ে যাবে, উনি থাকবেন। উনি মানে কে, সে কি বুঝতে অসুবিধা হয়? মাছ আর খান না। জ্বরজারি হলেও না।

ইলিশ হচ্ছে। গন্ধটা ম’ ম’ করছে। উনি খুব ইলিশ আনতেন। দু’ হাতে দুটো ঝুলিয়ে আনতেন বর্ষার দিনে। তখন তো মাছ কাটিয়ে আনত না আজকালকার মতো, নিজে মাছ কাটতেন। কালোজিরে কাঁচালংকার পাতলা ঝোল– কাঁচা কুমড়ো দিয়ে, সরষেবাটা আর সরষের তেল মাখিয়ে, কাঁচালংকা চিরে দিয়ে টিফিনবাটিতে ভাতের হাঁড়িতে রেখে দিয়ে ভাপা, নারকেলবাটা দিয়ে লাউপাতায় মুড়ে… কত কী…। ওনার শ্রাদ্ধে ছেলেরা ইলিশ খাইয়েছিল– উনি ভালোবাসতেন বলে। তারাসুন্দরী মরে গেলে ওর মৎস্যমুখীতেও হয়তো ইলিশ করবে ছেলেরা। আত্মা কি স্বাদ পায়?

কে জানে?

বলহরি শব্দ শুনলেন যেন তারাসুন্দরী। তখন বারান্দায় ছিলেন। কানের ছিপিটা চেপে ধরলেন। বলহরি। ইলিশ মাছের গন্ধের ভিতরে একটা মরণ চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। মালতী বলল, দত্ত-বাড়ির দিদিমা চলে গেলেন। তারাসুন্দরী বললেন– একটু জোরেই, বউমারা যেন শুনতে পায়– এমন দিন আমার কবে আসবে রে মালতী?

মালতী বলল, অমন কথা বোলো না দিদিমা। আমার খুব রাগ ধরে যায়…।

তারাসুন্দরী বললেন, নিরুপমাও চলে গেল। আমার চেয়ে কত ছোটো। ও ঠাকুর, আমাকেও তুলে নাও। জোরেই বললেন, ভগবান শুনতে পান বা না পান, বউমারা যেন শুনতে পায়।

()

এই বাড়িটাকে দারোগা-বাড়ি বলেই সবাই জানে। তারাসুন্দরীর স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের দারোগা। পাড়ায় ছিল খুব প্রতিপত্তি। পাড়ার ক্লাবটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারাসুন্দরীর স্বামী শ্রীকান্ত মজুমদার। পাড়ার যে-বারোয়ারি দুর্গাপূজার হীরকজয়ন্তী না কী যেন হচ্ছে এবছর, ৬০ বছর, এই পুজোটাও শুরু করেছিলেন শ্রীকান্ত দারোগা। নবোদয় সঙেঘর ক্লাব ঘরে শ্রীকান্ত মজুমদারের ছবি আছে। বাড়িতে যে-ছবিটা আছে, তার চেয়েও যত্নে আছে। মালা পড়ে। নেতাজি, গান্ধিজিদের সঙ্গে এক লাইনেই নাকি ছবিটা আছে। এক ডাকাতের কাছ থেকে বেলেঘাটা খালপাড়ের কাছে ছ’কাঠা জমি সস্তায় কিনে নিয়েছিলেন শ্রীকান্ত দারোগা। তিনতলা বাড়ি। প্রতি তলায় পাঁচ-ছ’টা করে ঘর। একতলায় দুটো ঘর রেখে বাকি ঘর ভাড়া দেওয়া আছে।

দোতলায় বড়ো ছেলে, তিনতলায় ছোটো ছেলে। মেয়েরা কেউ এলে তিনতলায় থাকে। ওদের আলাদা ঘর রাখা আছে। মূল রান্নাবান্না দোতলাতেই, যদিও ছেলেদের আলাদা আলাদা ছোটো কিচেন আছে। বন্ধুবান্ধব এলে বা শ্বশুরবাড়ির কেউ এলে ওখানে টুকটাক ‘স্পেশাল’ হয়। ছেলেরা আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে কিন্তু এ বাড়ি ছাড়েনি। ছাড়বে কেন? যতটা ছড়িয়ে থাকা যায়। দুটো নারকেলগাছও আছে, পেয়ারাগাছ, কাঁঠালগাছ। পাখিটাখি আসে। নীচের জমিতে শেড করে গাড়িও রেখেছে। প্রোমোটাররা প্রস্তাব দিয়েছে। এখন জমির দাম আগুন। দুই ছেলেই প্রোমোটারদের জমিটা প্রোমোটিং করার পক্ষে, এ নিয়ে কারওর মতবিরোধ নেই। মতভেদটা হ’ল মা কোথায় থাকবেন। সুতরাং মা যতদিন আছেন, ততদিন মুলতুবি। কিন্তু উনি যাচ্ছেন না তো। বয়েস তো হয়েছে। বয়সের কূলকিনারা নেই। কী করে থাকবে, তারাসুন্দরীর তো কোনও বার্থ সার্টিফিকেট নেই, অ্যাডমিট কার্ডও নেই। জন্ম সালটা কী করে জানা যাবে? তবে শ্রীকান্ত মজুমদারের পেনশনের বইতে তারাসুন্দরীর বয়েস লেখা আছে, হিসেব করলে দাঁড়ায় ৯৭ বছর চলছে। সুগার নেই, প্রেশার নেই, কিডনির গন্ডগোল নেই, চোখেও মোটামুটি দেখতে পান। কানে কম শুনছিলেন, হিয়ারিং এড দেওয়া হয়েছে। হাঁটতে চলতে একটু অসুবিধে, ধরে ধরে হাঁটাতে হয়, স্নান করার পর গা মুছিয়ে দিতে হয়, কাপড়টা পরিয়ে দিতে হয়। কিছুতেই ম্যাক্সি পরবেন না, বলেন শুধু সেমিজ পরে চলা যায়? লজ্জা করে না বুঝি? এইজন্য আয়া রাখা আছে। বেলা দশটা নাগাদ আসে, স্নান করিয়ে গা মুছিয়ে, চুল আঁচড়ে দেয়, দুপুরের খাবারটা দিয়ে যায়। নিজে হাতেই খেতে পারেন এখনও তারাসুন্দরী। এখন যে-আয়াটি আছে, গত সাত বছর ধরে, মালতী, দুপুরবেলা গা, হাত-পা টিপে দেয়, সন্ধেবেলা টিভি খুলে সিরিয়াল দেখায়, তারাসুন্দরী সিরিয়ালের ঘটনাগুলির খেই হারিয়ে ফেললে মালতী ধরিয়ে দেয়– ওই তো ও হ’ল রাশির ছোটো বোন, বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, ওর বরটা খুব পাজি, আবার ফিরে এসেছে…। ওই চাপ দাড়িওলা ছোঁড়াটা কে, আর্য? জিজ্ঞাসা করলে বলে চিনতে পারছ না দিদিমা? ওই-যে গো, মেজোবউটা ওর বিয়ের গয়নাগুলো সব তুলে দিয়েছিল যাকে, ওর সোয়ামিকে কিচ্ছুটি বলেনি। ওই লোকটা দুপুর দুপুর আসত… ও হ’ল গে মেজোবউটার… ইয়ে…।

মেজোবউয়ের নাং? বুঝেছি।

নাং শব্দটা শুনে মালতী তারাসুন্দরীর গায়ে ছোট্ট করে একটা কনুই খোঁচা দেয়।

যা গল্পগাছা হয়, মালতীর সঙ্গেই তো হয়।

বুচুর বাবার না ইয়া বড়ো গোঁফ ছিল, আর নস্যি নিত। গোঁফে নস্যি লেগে থাকত। আমার নাকের কাছে ওর গোঁফ গেলে হাঁচি হতো আমার। রাতের বেলা হেঁচে ফেলতুম, কী লজ্জা, কী লজ্জা…। আজকাল ওসব ল্যাটা নেই। ব্যাটাছেলেরা কেউ মোটা গোঁফও রাখে না, নস্যিও নেয় না।

বুচুর বাবা না বডিজ কিনে আনল। বলল, এটা পরবে, মেমরা পরে, বডি ঠিক থাকবে। আমি তো পরতেই পারিনে, আমাদের কালে তো ওসব ছিল না। বড়োজোর সেমিজ। উনি বললেন, এই দ্যাখো পিছনে টেপা বোতাম আছে। উনি বললেন, পরিয়ে দেব নাকি? কী লজ্জা

কী লজ্জা।

মালতীর তো বাড় বেড়ে গিয়েছিল, বলে– দাদু কী করে জানল ওসব কী করে পরতে হয়?

তারাসুন্দরীও কনুই দিয়ে খোঁচা মারে মালতীর গায়ে। হাসে, গোলাপি আভার মাড়ি ঝলকে ওঠে। বলে, সে কথা তো ভাবিনি তখন, ভাবতাম দারোগারা সব জানে। তবে ব্যাটাছেলে বলে কতা। পুরুষজাতি ভোমরা জাতি। ফুলে ফুলে মধু খায়। কে জানে ওর দু’একটা নাং ছিল কিনা? হ্যাঁরে, তোর সোয়ামির ওসব নেই তো? মালতী বলে, আরে ধুস, আমার সোয়ামি তো ঠুঁটো জগন্নাথ। হাত কই যে ওসব করবে?

সে কী রে, হাত নেই? দু’হাতই নেই?

দুটো না, একটা হাত নেই। বোমা বাঁধতে গিয়ে বাস্ট করে একটা হাত কনুই থেকে খুলে গেল।

জেনেশুনে বিয়ে দিল তোকে ওর সঙ্গে?

না, সে তো বিয়ের পর। বিয়ের আগে কলের মিস্তিরি ছিল। এখন কী করবে ও? এক হাতে কী হয় বলো? ঠোঙাও বানানো যায় না। মস্তানি তো করত না যে, হাতকাটা ভজন বলে এখনও কাজকম্ম করবে, তোলা তুলবে।

মস্তানি করত না তো বোমা বাঁধতে গেল কেন?

টাকার লোভে গো দিদিমা। পেটো বাঁধার কাজটা জানত। কী করে শিখেছিল কে জানে? ইলিকশনের আগে ওকে ধরে নিয়ে গেল। ব্যস, হয়ে গেল। এখন কী করবে বলো, তরিতরকারি বেচতে গেলেও তো দুটো হাত লাগে। পাল্লা ধরতে হয়।

এখন কী করে?

কী আর করবে, গাঁজার পুরিয়া বেচত, পুলিশ ধরল। মাসে মাসে টাকা দিতে বলল, বলল পোষাবেনে। এখন রাতের বেলা বাজার পাহারা দেয়, রাতে ঘুরে ঘুরে পিরিপ পিরিপ বাঁশি বাজায়। ক’পয়সাই বা পায়। তুমি ভালো থাকো গো দিদিমা, যেন রাতে তোমার কাছে না থাকতে হয়। বাড়িতে মেয়েটা আছে, একা ফেলে রাখতে পারব না।

এসব কথাবার্তা অনেক আগেকার। তারাসুন্দরী মালতীর মনের কথা জানে। মালতীও তারাসুন্দরীর। যখন ওর স্বামী ভজন হাতকাটা ভজা হয়ে ফিরে এল, তারপর মালতী বুদ্ধি করে হাসপাতালে গিয়ে নাড়ি কাটিয়ে এসেছিল, যেন আর বাচ্চা না হয়।

মালতীর মেয়ের বয়স তখন সাত, ছেলেটা পাঁচ। ছেলেটাও নেই। পাগলা কুকুর কামড়েছিল রাস্তায়। ও এখন মেয়ে অন্ত। ফ্রিজ থেকে চকোলেট চুরি করে মালতীকে দিয়েছে কত দিন– তোর মেয়েকে দিস। বড়োবউমা বুঝেছিল হয়তো, নইলে হঠাৎ একদিন বড়োর ঘরের ছোটো নাতনিটা ইয়া বড়ো একটা ক্যাডবেরি নিয়ে এসে কেন বলবে নাও ঠাম্মা, তুমি চকোলেট খেতে ভালোবাসো, এটা খেয়ো, মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছিল– ঠিক দেখেছিলেন তারাসুন্দরী। চকোলেট নেব বেশ করব– মনে মনে বলেছিলেন তারা। চাইলে কি মেয়েটাকে দিবি তোরা? বলবি আদেখলেপনা। চকোলেট খেতে পারি না? নিজের টাকায় খাব। কতগুলো করে পেনশন পাই। স্বামীর চাকরির পেনশন। যখন বিছানায় ছিলেন উনি, বলেছিলেন তো, যা টাকা রেখে গেলুম, তোমার কোনও কষ্ট হবে না। তা ছাড়া পেনশনের টাকা যা পাবে, হেসেখেলে দিব্যি চলে যাবে। ওরম অলক্ষুণে কথা বোলো না– মুখ চাপা দিয়েছিলেন তারাসুন্দরী। ক্যানসার ছিল কিনা, উনি তো জানতেন। বলেছিলেন কোনও কষ্ট কোরো না, মাথার চুল ফেলো না, মাছ খেয়ো, কোনও দোষ নেই। জীবনমরণ তো ভগবানের হাতে। ওনাকে নিয়েছেন, আমাকে নিচ্ছেন না তো আমি কী করব?

কত টাকা পেনশন পান তারাসুন্দরী জানেন না।

ছেলেরা বলত সই করো, করে দিতেন। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তখন একটু একটু লেখাপড়া জানতেন। উনিই চিঠি লেখা শিখিয়েছিলেন, বই এনে দিতেন সতীর পতি, আজব কুটুম৷ রতিবিলাস ও দাম্পত্যলীলা বইটা এনে বলেছিলেন, চুপি চুপি পড়বে। যখন বদলি হয়ে মালদা গেলেন, কত চিঠি লিখেছেন তারাসুন্দরী। ইতি তোমার আদরিণী তারা, ইতি তোমার বিরহিণী তারা, ইতি তোমার প্রেম কাঙালিনি তারা। এখন আর সই করতে পারেন না। হাত কাঁপে। বেশ কিছুদিন হল টিপসই দেন। কতবার জিগ্যেস করেছেন, হ্যাঁরে, আমার পেনশন এখন কত রে? ওরা ঠিক মতো বলে না। কখনও বলে তোমার আয়ার খরচ মোটামুটি হয়ে যায়। কখনও বলে তা দিয়ে তোমার কী হবে? তোমার যা লাগবে বোলো, পেনশনের টাকা আর কত, ছেলেরা আছি কী করতে?

কিন্তু তারাসুন্দরী জানেন ওঁর পেনশন ভালোই। টিভিতেও পেনশন বাড়ার কথা শুনেছেন। একটা সিরিয়ালেও একজন বিধবার মুখে বলতে শুনেছেন– তোমাদের খাই না পরি? নিরামিষ খেতে কত লাগে? তোমাদের ওই মুখে মাখার লোশনের মধ্যে জেনো, আমার পেনশনের টাকাও আছে।

যখন ছোটো নাতনি চুকচুকি ক্যাডবেরিটা এনে তারাসুন্দরীর হাতে দিয়েছিল, নাও ঠাম্মা, চকোলেট ভালোবাসো, খেয়ো…। তারাসুন্দরীও শুনিয়ে দিয়েছিলেন– ফ্রিজ থেকে নিয়েছিলাম তো একটা, খেতে সাধ হয়েছিল। দিস, মাঝে মাঝে দিবি, কেমন? দু’এক বার দিয়েছে তারপর। একবার দু’জনে মিলে ভেঙে খেয়েছে। চকোলেট রস লালা দু’জনের মুখের ভিতরে। ওরা হেসেছিল হিহি, হিহি, শিশুদের মতো। সেদিন টিভিতে গান হচ্ছিল পরান, না ছাইড়া যাইও রে…। মালতী বলেছিল, তুই ছাইড়া গেলে পরান চকোলেট দিমু কারে…? হিহি, হিহি। মালতী ক’দিন আগে রাস্তার আলুকাবলি নিয়ে এল। একটা একটা করে কাঠি দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিল তারাসুন্দরীকে। তারা বলছিলেন এটা দিল চুকচুকি, এটা দিল ফুলটুসি, এটা দিল বাবুই…।

এরা ওঁর নাতি-নাতনিরা।

তারাসুন্দরীর প্রথম দুটো সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তারপর বড়োছেলে। ছোটোবেলায় ওর কান ফুঁড়ে দিয়েছিল তারাসুন্দরীর শাশুড়ি, যেন নজর না লাগে। পাঁচ আনায় বেচেও দিয়েছিল কাকে যেন, তাই বড়োছেলের নাম পাঁচকড়ি।

সবাই পাঁচুবাবু বলে ডাকে। পঁচাত্তরের উপর বয়স। ওর সন্তান হয়েছিল বেশি বয়সে। তারপর দুই মেয়ের পর ছেলে। ছোটোছেলে প্রফেসর। এই সবে রিটায়ার করল। ওদের ঘরেই সব চুকচুকি-ফুলটুসি-বাবুই-পুঁচকুরা। ওদের সঙ্গে আর কথাবার্তা তেমন হয় না।

রাত করে খেতে আসে ওরা, অত রাত অবধি জেগে থাকেন না তারাসুন্দরী। আগে খাওয়ার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন।বলতেন, পাঁচুকে আর একটু ছ্যাঁচড়া দাও বউমা, চুকচুকি ফুলটুসিদের বলতেন, এত কম খেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি যে…। এখনও পয়লা বোশেখে বাটির উপর জল ঢেলে বাঁহাতের কেড়ো আঙুলে জল কেটে কেটে ফাঁড়া কাটান তারাসুন্দরী– যা কেটে যা পাঁচুর ফাঁড়া, যা কেটে যা নাড়ুর ফাঁড়া, যা কেটে যা বড়োবউমার ফাঁড়া…।

গন্ধটা আসছে, ইলিশ মাছের। জোরে শ্বাস টানলেন তারাসুন্দরী। তারপর বললেন– মালতী… দরজাটা বন্ধ কর।

()

এক রোববার সকালে নবোদয় সংঘ থেকে কয়েকজন ছেলেছোকরা দারোগা-বাড়িতে এল। বলল, এবছরের পুজোটা একটু ধুমধাম করে হবে। হীরক জয়ন্তী হচ্ছে।

সাংসারিক কথাবার্তা বড়োছেলে খুব একটা বলে না। ছোটোছেলে নাড়ুই বলে। ভালো নাম মানবেন্দ্র। বলল সে না হয় চাঁদাটা একটু বাড়িয়ে দেব এবার…।

ক্লাবের ছেলেরা বলল, না, চাঁদা নয়, সে জন্য আসিনি। আমরা এবার আপনাদের মা-কে সংবর্ধনা দেব। এ পাড়ায় তো উনিই সর্বজ্যেষ্ঠ। আপনাদের বাবা এই ক্লাব এবং দুর্গাপূজা পত্তন করেছিলেন। উনি নেই, ওঁর সহধর্মিণীকেই আমরা সংবর্ধনা দেব। উদ্বোধনটাও ওনাকে দিয়ে করাব ভাবছিলাম, কিন্তু অনেকে বলল, হীরক জয়ন্তী বলে কথা, সিনেমা আর্টিস্ট আনতে। কুহু-কেকা-কে রাজি করিয়েছি, সোর্স বেরুল, পঞ্চাশ হাজারে হয়ে যাবে।

কুহু-কেকা কারা?

কুহু-কেকা জানেন না? দুই বোন। নাচও করে। ধ্যাত্তেরিকা, খুকুমণি, মুচুমুচু এসব সিনেমায় অভিনয় করেছে। সিরিয়ালও করে। কুহু-কেকার সঙ্গে দিদিমার ছবি তুলে ক্লাব ঘরে রেখে দেব।

কিন্তু মা যাবেন কী করে? ওঁর তো শরীর ভালো নেই…। ছোটোছেলে বলে।

ভালোই তো আছে। বারান্দায় তো দেখি ওনাকে। বসে থাকেন।

সে নয় বসেন, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবেন না, তোমাদের স্টেজেও ওঠা সম্ভব নয়…।

ওসব আমাদের উপর ছেড়ে দিন। একদম স্ট্রেচারে শুইয়ে সিধে স্টেজে নিয়ে বসিয়ে দেব। আপনারা শুধু ভালো দেখে একটা গরদের শাড়ি পরিয়ে রাখবেন, ব্যস। আর যদি দুটো একটা কথা বলতে পারেন তবে তো আরও ভালো।

আরে ধুর, একশো বছর বয়েস হ’তে চলল এখন। বক্তৃতা-টক্তৃতা দিতে পারে নাকি?

দিদিমা খালি বলবেন তোমাদের সব্বাইকে আশীর্বাদ করি… ব্যস। তা হলেই হবে। আরে এই পাড়ায় পুরোনো লোক বলতে এখন কজনই বা আছে? সব তো উটকো লোকে ভরে গেল। দারোগা-বাড়ি, রায় ভিলা, নস্করদের বাড়ি… ব্যস। রায় ভিলা তো এবার প্রোমোটিং হবে শুনছি। হ্যাঁ, বলে রাখি, আপনাদের বাড়িটা যদি প্রোমোটিং করেন, আগে আমাকে বলবেন কিন্তু,… ক্লাবের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বলল।

না, এসব ভাবছি না… অন্তত মা যতদিন আছেন…।

আরে, দিদিমা আর ক’দিন। আগেভাগেই ঠিক করতে হয়। কাগজপত্রগুলো দিয়ে রাখতে পারেন। কিছুটা অ্যাডভান্সও দিয়ে রাখতে পারি…।

অন্য একজন, সম্ভবত সেক্রেটারি বলল, অ্যাই দিলীপ, তোকে নিয়ে পারা যায় না। কী জন্য এসেছিস? বাড়িটার বায়না নিতে নাকি দিদিমার জন্য?

দিলীপ নামের ছেলেটি বলল, ওই আর কী। দিদিমার কথা হতে হতেই তো দিদিমার বাড়িটার কথা এল। থাকগে দিদিমার সংবর্ধনা, ফাইনাল তো?

ছোটোছেলে বলে, মা কে সংবর্ধনা দিচ্ছ বলে গাদাখানেক চাঁদা চেয়ে বোসো না আবার।

জিভ কাটে ছেলেটা। বলে, কী যে বলেন। মাছের তেলে মাছ ভাজব ভাবছেন কেন? মিটিং-এ পাস হয়েছে এটা। আপনারা যদি বলেন, কথার কথা বলছি, এক পয়সাও চাঁদা দেব না, তা হলেও দিদিমাকে সংবর্ধনা দেব। দিদিমার মাথায় মুকুট পরাব, গায়ে চাদর পরাব। আর নস্কর বাড়ির ভুজঙ্গ নস্কর দিদিমা সম্পর্কে বলবেন। উনি দারোগাদাদুর বাড়ি আসতেন, বলছিলেন আমাদের। দিদিমা তালের বড়া ভাজতেন, পাড়ার সবাই সেই তালের বড়া খেতে আসতেন, অষ্টমীর খিচুড়িও নাকি নিজে হাতে রান্না করতেন– ওইসব বলবেন, আর আপনাদের ফ্যামিলির কেউ ওঁর সম্পর্কে দু’চার কথা বলবেন। আমাদের উদ্বোধন কিন্তু পঞ্চমীর দিন হবে। আর হ্যাঁ, একটা কথা, জরুরি কথা। আপনাদের ফ্যামিলির কেউ যদি দিদিমা সম্পর্কে বলেন, তখন কায়দা করে একটা লাইন ঢুকিয়ে দেবেন– যে উনি রামগোপাল জাদু মলম ব্যবহার করতেন। যে-কোনও ফোঁড়া, পোড়া, কাটাছেঁড়ায় অব্যর্থ। ওরাই আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা স্পনসর করছে কিনা…।

(৪)

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সকাল থেকে জেল্লা দেওয়া জরি-রোদ্দুর। সকাল থেকেই ঢাক বাজছে। মালতী সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিয়েছে তারাসুন্দরীকে। বিকেলে ফাংশন।

ছোটোছেলে এল ঘরে। বলল মা, একটা বক্তৃতা দিতে হবে তো, কী বলবে ঠিক করেছ?

কী বলব বলে দে না বাবা…।

বোলো দুনিয়ায় কত কী দেখলে। এত কিছু দেখতে পেলে, টিভি, মোবাইল, মেয়েরা সব বিদ্বান হচ্ছে, এসব কথা বোলো, আর এ বাড়িতে ছেলেদের কাছে ভালোই আছো, এটাও বোলো… ভালো আছো তো, না কী?

হ্যাঁ বাবা, খুব ভালো আছি।

সেটা বোলো। আর বোলো সবার ভালো হোক, সবাই ভালো থাকো, এই আর কী।

ছোটোছেলে মানবেন্দ্রবাবু তো প্রফেসর, ইকোনমিক্স পড়ান। প্রবন্ধ লেখেন। খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।

বাড়িতে আজ অতিথি। বিয়ে হয়ে যাওয়া নাতনি এসেছে ওর বর নিয়ে, মেয়ের ঘরের নাতিটাও নাতবউ নিয়ে এসেছে সংবর্ধনা দেখবে বলে। দুপুরে ইলিশ মাছের গন্ধ, আবার।সারা ঘরে। উঃ অসহ্য। দোর দিয়ে দে মালতী।

বন্ধ দোর ঠেলে নাতি আসে, নাতনি আসে, বলে, কার মতো সাজবে? ঐশ্বরিয়া রাই, নাকি বিদ্যা বালন? অন্য কেউ বলে– না, না, দিদিমাদের যুগে ছিল নার্গিস, মধুবালা…।

তারাসুন্দরীর বেশ ভালো লাগছে। এতদিন বাঁচা হল বলেই তো এসব দেখা হচ্ছে। স্টেজে উঠে এই বয়সে মাইকে বলা… বাপরে…। বুক একটু ধুকপুক করছে নাকি? না-না, ও কিছু না।

মালতী সুন্দর করে গরদের শাড়ি পরিয়ে দিল, মুখে ক্রিম ঘষে দিল। নাতনিগুলো দেখতে এল। একজন ফেস পাউডারের পাফ ঘষে দিল। একজন ভ্রূ আঁকার পেনসিল দিয়ে ভ্রূ এঁকে দিল, কেউ একজন লিপস্টিক বাগিয়ে ধরতেই তারাসুন্দরী সদ্য আঁকা ভ্রূ কুঁচকে

বললেন, আমাকে সং সাজাবি নাকি, সং? কী পেয়েছিস? আমি দারোগার বউ।

ওমনি কোরাস হিহি। একটুখানি দেবই দেব।

হালকা করে, হালকা করে।

স্ট্রেচার নয়, চেয়ারে বসিয়েই নামানো গেল। প্যান্ডেল পর্যন্ত গাড়িতে, তারপর চেয়ারে বসিয়ে মঞ্চে। তারাসুন্দরী কানের ছিপিটা ভালো করে চেপে ধরলেন।

হাততালি হ’ল। কুহু-কেকাও এল, আরও অনেক বেশি জোরে হাততালি, অনেকক্ষণ ধরে। কুহু-কেকা নীচু হয়ে তারাসুন্দরীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, এবার আরও অনেক বেশিক্ষণ ধরে হাততালি হল।

ক্লাব সম্পাদক তাঁর ভাষণে কুহু-কেকার উপস্থিতির জন্য গৌরব প্রকাশ করলেন।

এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকান্ত মজুমদার, ভীম নস্কর, লালবিহারী রায় এদের স্মরণ করা হল এবং এ পল্লীর সবচেয়ে প্রবীণা মহিলা, যিনি এই অঞ্চলটির অভিভাবিকা, ছাতার মতো, বটগাছের মতো, তাঁকে সংবর্ধনা দিতে পেরে ধন্য। এবং সত্যিসত্যি মাথায় একটা মুকুট পরিয়ে দেওয়া হল। দেখে মনে হচ্ছে রুপোর। বিশ্বসুন্দরীদের এরকম পরানো হয়। পরিয়ে দিল কুহু, চাদর পরাল কেকা। ভুজঙ্গ নস্কর আসতে পারেননি, অসুস্থ, তাই তারাসুন্দরী সম্পর্কে বলতে বলা হল মানবেন্দ্র মজুমদারকে।

মানবেন্দ্রবাবু তাঁর ভাষণে, ভারতে ষাটোর্দ্ধ জনসংখ্যা কত? শতকরা হার, প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং শেষকালে মা মানেই ভরসা, মায়েরা থাকা মানে শ্বাশ্বত মূল্যবোধগুলি বেঁচে থাকা এই বলে বক্তৃতা শেষ করলেন। জাদু মলম বলতে ভুলে গেলেন।

এবারে তারাসুন্দরীর মুখের সামনে মাইক ধরা হ’ল। উনি প্রথমেই হাসলেন, হাসির শব্দ শুনল সবাই। বললেন খুব আনন্দ হচ্ছে বাবা। ক্লাবের সেক্রেটরি বলল– নিজের কথা কিছু বলুন। কী খেতে ভালোবাসেন, কী করে সময় কাটান, কাটা ফোঁড়া ব্যথা হলে রাম গোপালের জাদু মলম ব্যবহার করেন ওই সব বলুন।

তারাসুন্দরী বললেন, আমি কী বলব বাবা, এসব মালতী বলবে।

মালতী… এই মালতী, একবার আয় না মা…।

মালতী সেজেগুজেই এসেছিল, যতটা সম্ভব। কী আতান্তরে পড়ল ও।

এবার কুহু নিজে মাইক নিয়ে ডাকল– মালতী নামে কে আছেন, স্টেজে চলে আসুন।

মালতী গেল। স্টেজের উপর। মাথা চুলকোচ্ছে। সামনে মাইক। কুহু বলল, বলো মালতীদি, বলো।

মালতী জানে প্রথমে কী বলতে হয়। বলল, আপনাদের সবাইকে নমস্কার। আমি দিদিমার দেখাশুনো করি। আমার স্বামীর হাত নেই। নেতাদের ভোটে জেতাতে গিয়ে হাত চলে গেছে। এই দিদিমা সেই হাত দিয়েছে। হাত মানে তো দুটো ভাত। মানুষ বাঁচালেই মানুষ বাঁচে। একা একা বাঁচা যায় নাকো। দিদিমা বেঁচে আছে বলেই আমি স্বামী, মেয়ে নিয়ে বেঁচে আছি। মেয়েটা এলেবেন কেলাশে পড়ছে। দিদিমা বেঁচে থাকলে বিএ পাশ করাব। দিদিমা কী খায় কী বলব। নিরমিষ্যি খায়…। আর কিছু মাথায় আসছে না। খুব আস্তে করে বলেই ফেলল, আর নিজের কামনা, বাসনা…। সবাই শুনতে পেল না। শব্দটা জড়ানো ছিল।

()

বাড়ির সবাই ফাংশন দেখবে। কুহু-কেকা একটু নাচবে। তারপর আরও আছে। ব্যান্ডের গান।

ওরা সবাই ফাংশন দেখবে। তারাসুন্দরীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হ’ল। মালতীও গেল সঙ্গে। বাড়িতে শুধু মালতী আর তারাসুন্দরী। ওরা কেউ ফিরলে মালতী ওর ঘরে যাবে।

তারাসুন্দরী বললেন, তুই সবচেয়ে ভালো বলেছিস মালতী। একদম মনের কথা। আমার ছেলেটা যে কী বলল কিছুই বুঝতে পারলুম নে।

মালতী ঘর ছেড়ে বাইরে যায়। রান্নাঘরে ঢোকে।

প্লেটে করে এক টুকরো ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দরজাটা বন্ধ করে। অনেকটা বাতাস টেনে নেয় বুকে, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, দিদিমা ইলিশ, আজ উৎসবের দিন। এটা

তোমার জন্য।

তারাসুন্দরী বলেন ওমা, কী অলুক্ষুণে কথা। বলিস কী। আমি এসব খাই নাকি?

মালতী বলে– অলুক্ষুণে কথা কেন? দারোগাদাদু তো বলেই গেছিলেন মাছ খেয়ো। আমাকে বলেছ তো সে কথা। কেউ দেখবে না। আমি কাঁটা বেছে খাইয়ে দিয়ে পেলেট পরিষ্কার করে দেব। কেউ জানবে না। শুধু তুমি আর আমি।

তারাসুন্দরী মাছের টুকরোটার দিকে চেয়ে থাকেন। সোনালি বরণ। বলেন ভয় করছে।

কীসের ভয় দিদিমা?

জানি না।

ধুর। খাও তো, এটাই তোমার

সংবর্ধনা। হাঁ করো।

তারাসুন্দরী বলেন, তা হলে ওনার মুখে ছুঁইয়ে পেসাদি করে দে।

দেয়ালে গোঁফওলা একটা লোক।তারাসুন্দরীর গোলাপি মাড়ি পদ্ম হয়ে ফুটে ওঠে।

ছুটি

হঠাৎ গোঁ ধরেছিল ছেলেটা। কাল থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু, কিন্তু কিছুতেই পড়তে বসবে না। বিকেলে খেতে খেতে নিনজা হাতোড়ি, ছোটা ভীম, বেনটেন রোজকার মতো কালও অনুমোদন করা হয়েছে। খাওয়ার ছলে বেশ খানিকক্ষণ টিভি দেখতে থাকে এমনিতেই। কিন্তু কাল ওকে বোকাবাক্সের সামনে থেকে নড়ানোই যাচ্ছিল না। লিটারেচারের কী বিরাট সিলেবাস। অত প্রশ্নোত্তর, শব্দার্থ, ইডিয়ামস, কবিতা, বানান– তিথি নিজেও মনে রাখতে পারত কিনা সন্দেহ। আর রন্তির ভ্রূক্ষেপ নেই। দশ পূর্ণ হল। ক্লাস ফাইভে উঠবে। ছেলের নিজেরও তো গরজ থাকবে। তা নয়। মা চামচে মেখে গিলিয়ে না দিলে এক বর্ণ পড়বে না। আধাখ্যাঁচড়া প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষার আগের দিন নিশ্চিন্তে কার্টুনে ডুবেছিল।

অনেকক্ষণ বোঝানোর পর পিঠে একটা চাপড় বসায় তিথি। এমন দুর্বিনীত ছেলে, মাকেই উলটে আক্রমণ করে। তবে রে? ছেলেকে এলোপাতাড়ি মেরে ধরে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যায় মা। যার জন্য নিজের প্রিয় ধারাবাহিক ছেড়ে দিচ্ছে, তার একটু হুঁশ থাকবে না? উলটে মাকে মার? ভাগ্যিস শাশুড়ি ওই সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন না।

মার খেয়ে রন্তি আরও গোঁয়াড় হয়ে উঠল। এমন বিশ্রী জেদ, আদর করে ভুলিয়েও গলানো গেল না। বাবা অফিস থেকে ফিরেছে ছেলের জন্য বেনটেন কমিক্স আর এক প্যাকেট হিমায়িত চিকেন কাটলেট নিয়ে। কী আক্বেল। পড়ানোর বেলা গোল্লা, পরীক্ষার আগে এমন বিনোদনের বই কেউ কেনে? সাধারণত যেদিন এই ধরনের খাদ্য আসে, সেদিনই ভেজে উদ্বোধন করা হয়। ছেলে বই নিয়ে সদ্য বসেছে, আর দেরিও হয়ে গেছে। তাই বলল, ‘আজ থাক, কাল ভালো করে পরীক্ষা দাও। কাল ভেজে দেব। আর পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে যা চাইবে তাই দেব। সোনা বাবা আমার, পোয়েমদুটো লিখে দেখাও তো। ওগুলো থেকে ফিল ইন দি ব্ল্যাঙ্কস আসবে না? কমা ফুলস্টপ, সেমিকোলন সব ভালো করে দেখে নাও।’

‘কোলন আর ড্যাশও আছে। টু আ বাটারফ্লাই আমার মুখস্থ।’ অসন্তুষ্ট গলায় গজগজ করল রন্তি। তারপর দুটো মাঝারি কবিতা লিখতেই সাড়ে ন’টা বাজিয়ে দিল। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রশ্নোত্তর ঝালানো বাকি। তাছাড়া সাহিত্যের টেক্স্ট থেকেও ব্যাকরণের প্রশ্ন আসে। সবই করিয়েছে তিথি একবার করে। কিন্তু পরীক্ষার আগে না দেখলে? ছেলের ঠাকুমা বলেন, ‘ও সব পারবে’। বাবা বলে, ‘বাদ দাও’।

অগত্যা জেনারেল লি’র অধিনায়কত্বে খ্যাঁদা-নেকো জাপানিদের তাকেশি’স কাসল অভিযান দেখতে দেখতে খাবার টেবিলের বদলে সেন্টার টেবিলে ডিমের ঝোল ভাত মেখে রন্তিকে গিলিয়ে দিল। খাওয়ার ব্যাপারে রন্তিকে সাধতে হয় না। কিন্তু আজ একে মার-বকুনি, তার ওপর আলু-পটল দিয়ে ডিমের ডালনা। মুখে মুখে প্রশ্নোত্তর ধরতে গিয়ে দেখল ছেলে হাঁ করে হাড়গোড় গুঁড়োনো খেলার একশো সাতান্নতম রিপিট টেলিকাস্ট আর ভাত গিলছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না একটাও। চুলের মুঠি ধরে একবার নাড়া দিয়ে থালা হাতে উঠে গেল তিথি। ‘ব্রাশ করে সোজা বিছানায় যা। আইদার টেক্স্ট বুক, কিংবা ঘুম। কমিকস্ খুলতে দেখলে ছিঁড়ে ফেলব।’

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত গোঁজ মারা ভাবটা কমেনি। ঠাকুমার রসিকতায় জবাব দিল না। মা মেরেছে তাই বাবার আদরে ভুলবে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে বালিস ভিজিয়েছে। তিথি রান্নাঘর, টেবিল ফ্রিজ, কোলাপ্সিব্ল গেটে তালা, বসার ঘরের আলো-পাখা, রাতের গা ধোয়া ইত্যাদি সেরে এসে দেখে বাপ নাক ডাকাচ্ছে। ছেলে বাবার ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তিথি আর মনোময় দুজনেই লম্বা দোহারা। ছেলেটার এখন থেকেই কী সুন্দর সুঠাম দেহ। মায়ের চোখ ডাইনির চোখ। নিজেকে শাসন করল তিথি।

‘মায়ের সঙ্গে কি অমন করতে আছে সোনা? আমার কষ্ট হয় না তোকে মারতে? এত বড়ো হয়েছিস এটুকু বুঝবি না? অয়না দ্যাখ তোর চেয়ে ছোটো হয়েও কেমন ভালো রেজাল্ট করে। মাথায় কি তোরও বুদ্ধি কম? পরীক্ষার পর কত আনন্দ করব। বাবা বিরিয়ানি রাঁধবে। একদিন বাইরেও খেয়ে আসব। সোনা বাবা আমার…।’ ছেলের পাশে শুয়ে তার গুঁজে রাখা অভিমানী মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিতে চাইল। ডান পা-টা নিজের পেটের ওপর চাপাতে চাইল। রন্তি ঘুমের মধ্যেও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল না। কাঠ হয়ে থাকল। এগারো বছরের ছেলের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠে না মা। ছেলের ঘাড়ে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুয়ে পড়ল। তার স্কুলেও পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু।

একজনের অফিস, একজনের স্কুল ও সংসার। পাশের ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি। তাঁর জায়গাও বেশি লাগে, আর রন্তিও মাকে ছেড়ে ঠাকুমার কাছে শোবে না। রাতে ঘুমের ঘোরে ছেলে এখান সেখান হাত-পা ছুড়লে অস্বস্তি লাগে। কিন্তু উপায় কী? স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত আড়াল নেই। তাগিদও নেই। তেরো বছর তো হল। ছেলেই মা-বাবার অগ্রাধিকার। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। শেষ হতে দু সপ্তাহ।

দশ বছরে কয়েকটা টিকার বুস্টার ডোজ আছে। দীর্ঘদিন সর্দিকাশিতে ভোগায় সেগুলো দেওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সর্দির প্রেসক্রিপশন হাতে ফিরতে হচ্ছিল। এমনিতেই তিনখানা টিকা একদিনে দেবেন না। দশ বছর বয়স থাকতে মেয়েকে সুস্থ অবস্থায় পাবে তো? সর্দিকাশি, পেট ইত্যাদি মোটামুটি ঠিক আছে দেখে পরীক্ষার আগের দিনই ডাক্তার সান্যালের কাছে ঘুরে এল শ্রেয়সী। আসার পথে রাই বায়না ধরল ফুচকা খাবে। মাথা খারাপ? পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। রাত্রে বাড়িতে ফ্রায়েড রাইস, মাংসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েকে ভোলাতে চাইল। রাই তবু ঘ্যানঘ্যান করে, ‘বেশি নয়, মোটে চারটে ফুচকা মা। কিছু হবে না। তুমি ওষুধ কিনে বাড়ি চলো।’

‘পাঁচ টাকার ফুচকার খেসারত একশো টাকার ওষুধের কোর্স, সেই সঙ্গে অরুচি? না বললাম না? কাল বাদে পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। একেই আজ এটা কাল ওটা করে ভুগিস। রাতে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন করব বললাম তো। এখন বরং একটা আইসক্রিম খা। আসতে আসতে চেটে খাবি, গলায় ঠান্ডা না লাগিয়ে।’

আইসক্রিম যতই প্রিয় হোক, ফুচকার গন্ধে নাকে মুখে জল এলে আইসক্রিম কি তার বিকল্প হতে পারে? নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়ল রাই। ওপারে দোকান। মা মেয়ে রাস্তা পার হতেই একটা ফাঁকা অটো হাঁকতে হাঁকতে পাশে দাঁড়াল। লাইনে না দাঁড়িয়েই বাহন পেয়ে যাওয়ায় শ্রেয়সী আর আইসক্রিমের দোকানে না ঢুকে সোজা অটোয় চড়ে পড়ল মেয়ের হাতে ধরে।

‘তুমি মিথ্যেবাদী।’

মাথায় চড়াক করে রক্ত উঠলেও শান্ত হয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘তোমায় কি আইসক্রিম, চকোলেট দিই না? কিন্তু আইসক্রিম খেলে আধ ঘন্টা অটোর লাইনে দাঁড়াতে হতো। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসাটা জরুরি নয় এই সময়? আচ্ছা বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি বাড়ি ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবে। এখন বাড়ি গিয়ে দুধ ফিনিশ করলে কিন্তু।’

তরুণকে ফোন করল শ্রেয়সী। তরুণের ফিরতে রাত হবে। সে দোকানের কর্মচারী শান্তনুর হাতে পাঠিয়ে দেবে। শান্তনু কোনও কাজে গিয়ে ফেঁসে গেছে। তরুণ ফিরল রাত দশটায়। এতক্ষণ বকুনি সহ ঘ্যানঘ্যান করতে করতে পড়ছিল রাই। রাতে বাবাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে আর নতুন করে হতাশা প্রকাশ করল না। ফুচকার বদলে আইসক্রিম, তাও না দুধ-বোর্নভিটা। এখন রুটি তরকারি। মা ফ্রায়েড রাইস করতে পারেনি। রান্নার মাসিরও তাড়া ছিল। গতকালের একটু পনির উদ্বৃত্ত ছিল। তাই দিয়ে শান্ত হয়ে মায়ের হাতের রুটি খেয়ে নিল রাই ডিজনিতে হাসির ধারাবাহিক দেখতে দেখতে। রাতে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখে মুখে প্রশ্নোত্তরও ঝালিয়ে নিল। হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কাল করবে তো মা? সব পরীক্ষা শেষে দাদা-বউদির বিরিয়ানি আনবে বাবা?’

‘নিশ্চয়ই’। কে জানে, মেয়ে মনে মনে মা-বাবাকে মিথ্যেবাদী বলল কি না।

মেয়েটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। সেভেন হল। এর মধ্যেই বাবার কানের পোকা খেয়ে ট্যাব আদায় করেছে। মাকে দিদি নম্বর ওয়ানে গিয়ে প্রাইজ জিতে আসার অনুপ্রেরণা দিয়ে কাজ হয়নি। নিজেই বাড়ি থেকে ইন্টারনেটে মায়ের আর নিজের অনলাইন আবেদন জমা করেছে। বছর ঘুরতে চলল। কতদিন আর দরকারি জিনিস অনিশ্চিত ইভেন্টের হাতে ফেলে রাখা যায়?

পড়াশুনো কী করছে দেখাতে চায় না। সারাক্ষণ কম্পিউটারে নেট খুলে খানাতল্লাশি চালায়। নাকি পড়াশুনো হচ্ছে। অত অত মোটা বইয়ের পাহাড় থাকতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর ইন্টারনেট থেকে বাড়তি কী এমন তথ্য জানার থাকতে পারে? তিনটে টিউশনি। নেট-এ খোঁজাখুঁজি। তাও ফলাফল ভালো থেকে ক্রমশ মাঝারি হয়ে যাচ্ছে। কিছু বললে যা মূর্তি ধারণ করে। মাকে তো পাত্তাই দেয় না। বাবাকে একটু মানে। আবার আবদারের বেলায়ও বাবা। কিন্তু এই বয়স থেকে একা একা নেটে থাকা মা-বাবা কেউই অনুমোদন করে না। পৃথিবীর কদর্যতম দৃশ্যটাও কয়েকটা মাউস ক্লিকের অপেক্ষায় সাইবার দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। নারী-পুরুষের ভালোবাসার মাধুর্য বোঝার আগেই যদি চরমতম বিকৃতি আর বীভৎসতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় তাহলে রুচি, মানসিকতা কেমন দাঁড়াবে? অবশ্য তেমন কিছু ব্রাউজিং-এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু গাদা গাদা চ্যাট। পড়ার বই খুলে রেখে ট্যাব হাতে চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে গপ্পো।

বাধ্য হয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে সাত্যকী বারো বছরের মেয়ের গায়ে হাত তুলল। এগালে-ওগালে এলোপাতাড়ি। মল্লিকা ঝাঁপিয়ে পড়ে থামাতে এলে তার গায়েও দু-একটা পড়ল। পরীক্ষার আগে কেউ এভাবে মেরে মনমেজাজ খারাপ করে দেয়? নিজে যখন বুঝবে না, বোঝাতে হবে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে। এভাবে বাপের মার খেলে আত্মসম্মানে লাগবে না? এখনকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সব কিছুতে হস্তক্ষেপের অধিকারটা মেনে নেয় না। একদিকে আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু রাগলে নিজের চূড়ান্ত ক্ষতি করে ফেলে, ভালোবাসার মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে দুবার ভাববে না। মল্লিকা সাত্যকীকে ঠেলে সরাতে গেল, ‘ছাড়ো। ওকে বুঝিয়ে বললেই শুনবে’।

‘বাবাকে লেলিয়ে দিয়ে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। আমার বইখাতা খুলে স্পাইং করো না তুমি?’

সদ্য কিশোরী কন্যার এই মন্তব্যে মা দিশাহারা হয়ে গেল। বাবা তো অফিস থেকে ফিরে প্রায়দিন দেখে মেয়ে টিউশনি থেকেই ফেরেনি। মা-ই মেয়ের খাতা বই দেখে যতটা সম্ভব পড়াশুনোর খবর নিয়ে নেয়। পারিজাতের সেটাও অপছন্দ? মায়ের গোয়েন্দাগিরি মনে হয়? মায়ের স্নেহ-চিন্তাকে চরবৃত্তি মনে হলে সে মেয়ের মুখে ঠাটিয়ে চড়ই মারা উচিত। কিন্তু তাহলে মোবাইলের সেল্ফিতে যে কেষ্টঠাকুরের ছবি আছে, তার সম্পর্কে জানা যাবে না, জানা যাবে না এমন আরও অনেক কিছুই। প্রশ্ন করলে হয়তো শুনতে হবে, মোবাইল ব্যক্তিগত বস্তু। তেরো বছরের নাবালিকা তার মাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে আড়াল করবে? এখনও বিছানার চাদরে, পোশাকে দাগ লাগলে কেচে দিতে হয়। মেয়ের সঙ্গে কি মারামারি করবে? মরিয়া হয়ে বলল, ‘পরীক্ষাগুলো তো উৎরোতে হবে পুপু। বন্ধুবান্ধব, আনন্দ-ফুর্তি তো আছেই।’

‘কিচ্ছু নেই। ঘাড় গুঁজে পড়ে পড়ে চোখে পাওয়ার আর ঘাড়ে পিঠে ব্যথা বাড়ানো ছাড়া আমাদের জীবনে কোনওটাই সিকিওরড নয়। পরীক্ষা তো দেব আমি। পড়ার ফাঁকে একটু রিল্যাক্স করলে এত গায়ে জ্বালা তোমাদের?’

সন্দীপন পড়াশোনায় মনোযোগী। মনোযোগ আর আগ্রহ আরও অনেক বিষয়ে। ভালো আঁকে, ফুটবল খেলে। ওদের সেকশনে নতুন আগত একটি মেয়ে গত বছর থেকেই সন্দীপনকে হটিয়ে প্রথম হচ্ছে। নিশ্চয়ই প্রিন্সিপাল বা টিচারদের সঙ্গে চেনাজানা আছে। এদিকে ছেলের নামে অন্য ছাত্রদের, বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকরা নিয়মিত নালিশ জানায়। সন্দীপন ওদের মারে, ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, বেণি ধরে, কানের রিং ধরে টানে। হিংসা! সব হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। ভালো ফল করে কিনা। তাই যুক্তি করে ওকে পিছিয়ে দেওয়া। হলে একটা নতুন স্টুডেন্ট, তাও আবার মেয়ে, কালো শিকলি চেহারা কখনও ফার্স্ট হয়? ছেলেরা তো হাতেপায়ে দুরন্ত হবেই। দাদু আদর করে নাম রেখেছেন গুন্ডা। গুন্ডার অধীনে আবার স্কুলে একটা দলও আছে। ইচ্ছা করেই ছেলেকে বেশি বয়েসে পড়াচ্ছে সঙ্গীতা। বার্থ সার্টিফিকেটের বয়স বারো দেখালেও সন্দীপন আসলে চোদ্দ বছরের। ওর সঙ্গে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো পারবে কেন? কী পড়াশুনোয়, কী খেলাধুলোয়। ছেলেকে শেখানো আছে, ‘মার খেয়ে ফিরবি না, মেরে আসবি’।

কেন করবে না। সকলেই এগিয়ে যেতে চায়। তোমার সামনে যারা আছে দরকারে তাদের মাড়িয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তোমায় কেউ একচুল জায়গা ছেড়ে দেবে? যারা পেরে ওঠে না, তারাই নালিশ করে। তা বলে ছেলে কি হাত-পা গুটিয়ে থাকবে? মারামারির ভয় যখন, তোদের মেয়েদের গার্লস স্কুলে পড়ালেই পারতিস। অত বড়ো খেলার মাঠ দেখে রাত থাকতে লাইন দিয়ে খুকিদের ভর্তি করিয়েছিস। এখানেও গুন্ডার নামে নালিশ। সে নাকি খেলার ক্লাসে মেয়েদের ইচ্ছা করে মেরে ফেলে দেয়। সঙ্গীতা মাঝে সাঝে স্কুলে গিয়ে দেখেছে, খেলার পিরিয়ডে ছেলেরা স্যারের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেট বল খেলে। মেয়েরা গজালি করে, নয় রুমাল চোর খেলে, নয় তো স্রেফ বসে বা পায়চারি করে কাটায়। ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট চাইলেও নাকি দিতে চায় না গেমস্ টিচার, দিলেও ছেলেরা কেড়ে নেয়। মেয়েরা খেলেই না তো মার কখন খাবে? আমার ছেলে কি খেলা ফেলে তোদের মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করে?

ওই শুঁটকি অরিত্রিকে এবার বিট করতেই হবে। গুন্ডার চাইতে দু’বছর ছোটো হয়েও অমন রেজাল্ট এমনকী অংকেও? তা খাতায় কলমে কম দেখিয়েও মা পুত্রের বয়সের সুবিধাটা মনে মনে স্বীকার না করে পারে না। ছেলে আজকাল কম্পিউটারে ইন্টারনেট খুলে জোর পড়াশুনো শুরু করেছে। কী পড়ে দেখাতে চায় না। ছেলের বাবা চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকে। মা নিয়ম করে ছেলেকে কোচিং ক্লাসে নিয়ে যায়। শুধু ক্লাসে নয়, আইসিএসসিতেও স্কুল থেকে ফার্স্ট হতে হবে।

কাল থেকে যুদ্ধ, মানে পরীক্ষা শুরু। গুন্ডা সকাল বেলা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। দুপুর দুটো বাজতে চলল, এখনও পাত্তা নেই। প্রথমে অর্ণবের বাড়ি, তারপর এর বাড়ি ওর বাড়ি ফোনাফুনি। সোয়া দুটোয় সিঁদুর মুখে বাড়ি ফিরে মায়ের কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে চায় না। একবার ঝেঁজে বলল, ‘এই জন্যই মোবাইল চাই। বাড়িবাড়ি ফোন করতে হতো না তোমায়।’ ক্লাস সেভেনের ছেলে মোবাইল নিয়ে ঘুরবে? স্কুলেও তো অনুমতি দেবে না। আবার আসল বয়সটা মনে পড়ল। মায়ের কথায় উদ্ধত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক খোঁচাখুঁচিতে বলল, ‘তোমায় বলে কী হবে? তুমি তো না-ই বলবে।’ এখন থেকে এমন কী চাই যা মাকে বলা যাবে না? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু সে খেয়াল আছে? পড়াশুনোয় ভালো বলেই ও অনেক বদমায়েশি করে পার পেয়ে যায়। এবার রেজাল্ট খারাপ হলে আর ছাড় দেওয়া যাবে না।

সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদে নির্বিকার থেকে রাতে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘একটা স্পোর্টস্ সাইকেল দেখেছি। চল্লিশ হাজার পড়বে। আইসিএসসি দেখিও না। এই পরীক্ষার পরই চাই।’

সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই এই। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলে তো হেলিকপ্টার চাইবে। এর চেয়ে অরিত্রি, মেঘা, তিতিক্ষাদের পেটানোর অনুমতি চাইলে দেওয়াটা অনেক সহজ হতো। এই প্রথম ছেলেকে অচেনা লাগল মায়ের, ভয়ও হল। মাথা নাড়ল শুধু, যার মানে হ্যাঁ ও হতে পারে, নাও হতে পারে। পরীক্ষাটা তো উৎরোক। দর কষাকষি পরে।

স্নেহা শান্ত মেয়ে। অঙ্কে একটু দুঃখ আছে। কিন্তু বেয়াড়া নয়। পড়ালে খুব একটা আপত্তি করে না, অঙ্ক ছাড়া। একটু আদুরি আহ্লাদী প্রকৃতির। রোজ নিয়ম করে মা আর বাবার কাছে চটকাই মটকাই খাবে। সান্তাক্লজের রহস্য জানার পরও সান্তার কাছে উপহার চাই। গত বছর জন্মদিন পালন হয়নি ঘটা করে। এবার পরীক্ষার ঠিক পর জন্মদিন। মানে জন্মদিনের ঠিক আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীসোনা হয়ে ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে বার্থ ডে সেলিব্রেশনটাও জমকালো করে করতে হবে। এইটুকু বায়না রাখাই যায়। বেচারার সব প্রিয় খেলনা খুড়তুতো ভাই এসে ভেঙে দিয়ে যায়। ভাইকে বড্ড ভালোবাসে। তাকে কিছু বলতে পারে না, পাছে কাকিমা আর নিয়ে না আসে। সে চলে গেলে মায়ের কোলে কিংবা বাবার বুকে মুখ গুঁজে হাপুসনয়নে কাঁদে।

বহুদিনের শখ আইপডের। বন্ধুদের আছে। ওকে বস্তুটা ঠাম্মা, দিদা, মাসি না মা-বাবা কে দেবে ঠিক না হওয়ায় এখনও পায়নি। এবার জন্মদিনে সেটাই দাবি। অঙ্কিতা নিজে বড়ো সিস্টেমেই গান শুনতে ভালোবাসে। অমন স্বার্থপরের মতো কানে গুজি গুঁজে অনেক কথা কানে না ঢুকিয়ে গান শোনা তার পোষায় না। তবে ধুমধাড়াক্বা গান পরিত্রাহি বাজলে মনে হয়, যার যেমন রুচি তেমন গান হেডফোনেই শোনা ভালো।

পরীক্ষা শুরুর কদিন আগেই মাসিমণি তার আদরের বোনঝিকে একটা আইপড দিয়ে গেল। অনেকগুলো নতুন গান লোড করা আছে। ব্যস! সারাদিন মারমার গান শোনা। এখন কি গান নিয়ে মেতে থাকার সময়? পড়াশুনোর বারোটা বাজবে জানালে মাসি বলবে, ‘আমার ইচ্ছে দিয়েছি। তোদের পছন্দ না হলে ডাস্টবিনে ফেলে দে।’

বুঝিয়েসুঝিয়ে যন্ত্রটা পরীক্ষা পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় চালান করা গেলেও জন্মদিনের জন্য তাহলে নতুন কিছু চাই। নতুন মানে ট্যাব। টিভি রিয়ালিটি শোতে কাউকে ট্যাব জিততে দেখলেই এমন হাততালি দেয়, যেন পুরস্কারটা সেই জিতেছে। এমনিতে অঙ্কিতার অ্যানড্রয়েড মোবাইল অঙ্কিতার চেয়ে স্নেহাই ভালো চেনে। ক্লাস ফোর তো কী? এখনকার বাচ্চারা মায়ের পেটে থাকতে কম্পিউটার নাড়াঘাটা করতে শিখে আসে। অঙ্কে ভয় থাকলেও, কম্পিউটারের ঘাঁতঘোঁত ফাইলের অবস্থান খুঁজে বার করতে ওস্তাদ। মাকে কাজ করতে দেখে নিজে নিজে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাতে শিখে ফেলেছে। মোবাইলে গান আর গেম ডাউনলোড তো হাতের ময়লা। সে তো ট্যাব চাইতেই পারে। কিন্তু বাড়িতে তিনজন মানুষের জন্য পাঁচটা সিম এটা ওটা অফার পরখ করতে গিয়ে জমে গেছে। প্রীতমের তাই বাচ্চার হাতে এখন থেকে নেট সমৃদ্ধ ট্যাবলেট তুলে দেওয়ার ইচ্ছা নেই। বলে, ‘যা করার পিসিতে করো। আর একদম নেট খুলবে না। আমি বা মা পাসওয়ার্ড দিয়ে মেশিন ওপেন না করা পর্যন্ত ওয়েট করবে। আমি এত বছর সিস্টেমস্-এ আছি, এখনও পর্যন্ত আমিই একটা ল্যাপটপ কিনলাম না, আর পাকু-মার ট্যাব চাই।’

মৌমিতা সদ্য চাকরির আনন্দে বলে ফেলল, ‘ডোন্ট ওরি। আই উইল টেক কেয়ার অব দ্যাট।’

সোজা প্রীতমের প্রেস্টিজে ছ্যাঁকা। সে কি নিজের মেয়েকে কিনে দিতে পারে না? এই বয়স থেকে এত বিলাসিতা ঠিক মনে করে না বলেই তো আপত্তি করছে। প্রিয় শ্যালিকাকে দেখলে হাসা বন্ধ। মৌমিতাও দমবার পাত্রী নয়। ‘কেন, হিয়া আমার কেউ নয়? মাসি হিসাবে আমার কোনও শখ থাকতে পারে না? অধিকার নেই? আমি আনন্দ করে কিনে দেওয়া মানেই প্রীতমদাকে ছোটো করা? তোরা আমাকে পুজোয় টাকা দিস না? আমার বিয়েতে দামি গয়না দিসনি? তোদের বিয়ের সময় আমি তো স্টুডেন্ট ছিলাম। কী দিয়েছি? আজ আমার আনন্দে যদি কারও মুখ গোমড়া হয়, তাহলে আমি আর এ বাড়ি আসব না। হিয়ার জন্মদিনেও নয়…’

আচ্ছা মুশকিল! অঙ্কিতা বরকে বোঝায়, না বোনকে। বড়োদের মান হানাহানিতে হিয়া অর্থাৎ স্নেহা বেচারা বোমকে গেছে। মায়ের কানে কানে বলল, ‘মাসিকে বলো, আমার ট্যাব চাই না। শুধু এগ্জামের পর আমরা, মাসি-মেসো সবাই মিলে আইনক্সে একটা থ্রিডি দেখব, নয়তো সিটি সেন্টার টুতে সেভেন ডি। আর সবাই মিলে বাইরে খাব। আর আমার বার্থডেতে মাসি সকাল থেকে এসে থাকবে।’

মৌমিতা শুনতে পেয়ে ঝুঁকে বোনঝিকে হামি খেয়ে বলল, ‘আমার তরফ থেকে ডান। তোর বাবা ছুটি না নিলেও আমি কিন্তু আমার নতুন চাকরিতেও একদিন ছুটি নিয়ে হিয়া সোনার সঙ্গে কাটাব, ক্যারাম খেলব। আর ওটা আমাদের সিক্রেট। রাইট?’

নিজের হাতে খেতে পারে না। মা খাওয়ালেও ন্যাকরচ্যাকর। কিন্তু কাল থেকে যে পরীক্ষা শুরু। লক্ষ্মী মেয়ের মতো টিভি না দেখেই খেয়ে দাঁত মেজে শুয়ে পড়ল। শোবার ঘর থেকে একটু পরে ডাকল, ‘মা তোমাদের হয়েছে? তুমি ছাড়া ঘুম আসে না মা।’

একটা টাটা সুমোয় গাদাগাদি করে চোদ্দজন বাচ্চা। সবাই বাচ্চা নয়। সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ আকারে বড়ো মানুষই বলা যায়। মাঝেমাঝে এইসব গাড়ির পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে ধরপাকড় ওঠে। আবার সব মিটমাট হয়ে যায়। গরজ বড়ো বালাই। গাড়ি বন্ধ থাকলে গাড়িওয়ালাদেরও ক্ষতি, ছাত্রছাত্রী পক্ষেরও ক্ষতি। ধেড়েগুলো কুচোকাচাদের ওপর দাদাগিরি দিদিগিরি ফলায়, ঝগড়া থামায়, আবার বাধায়ও। কিন্তু পরীক্ষার কদিন বেশির ভাগই স্কুল যাবার পথে বই মুখে নিবিষ্ট। আজকের মতো ছুটি। বাড়ি ফেরার পালা। কালকের দিনটা পার করতে পারলেই ক্লাস ফাইভের কেল্লা ফতে। সিক্স, সেভেন আর এইট শেষ হতে আরও পাঁচ দিন। রোজ পরীক্ষা নয়, মধ্যে বিরাম আছে। কারো দুটো কারও তিনটে পরীক্ষা বাকি। ক্ষুদেগুলো কাল পরীক্ষার পর কী করবে তার জোর আলোচনা চালাচ্ছে। বড়োগুলো তাদের কাউকে কাউকে খ্যাপাচ্ছে। হই হই করতে করতে চলেছে টায়েটায়ে ভর্তি যান। গাড়ির চালকও যোগ দিয়েছে গুলতানিতে। এই গাড়িকাকু ওদের সবার খুব প্রিয়। না খেতে পারা টিফিন উদ্ধার করে সাহায্য করে। আবার যাদের যেদিন পরীক্ষার ইতি, সেদিন তাদের চকোলেট খাওয়ায়। বড়োগুলোর পরীক্ষা শেষ হতে দেরি থাকলেও চ্যাঁচাচ্ছে, ‘আমরাও আছি কিন্তু মোহিতকাকু। নো পার্শিয়ালিটি। কালকেই সবাইকে খাইয়ে দাও। শেষের দিন আমরা ফিস্ট করব। ওফ্ তোমাকে কখন থেকে গান লাগাতে বলছি না? আর ওই সামনের গদ্ধড় বাসটাকে ওভারটেক করতে পারছ না? পুরো রাস্তাটা আগলে চলছে।’

‘…ক্যাঁ…চ্’! বড়ো রাস্তার এক পাশটা খাওয়া। এক্সপ্রেসওয়ে কে বলবে? গদ্ধড় বাসটাকে কাটাতে গিয়ে পাশ থেকে একটা দৈত্যাকার লরির সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি। কাছাকাছি লোকালয় ছিল না। দেরিতে লোক পৌঁছোল। গাড়ির হেল্পারটি লাফিয়ে পালাতে পেরেছে, গুরুতর আহত। চালক ঘটনাস্থলেই শেষ। পকেটে তার আজও লজেন্স আছে। ফুচকা, আইসক্রিম, বিরিয়ানি, সাইকেল, ট্যাব, জন্মদিন সান্তাক্লসের ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো দুমড়ে দলা পাকিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল।

 

ফিরে এসো পিউ

‘তোর একটা কবিতায় দেখলাম লিখেছিস, ‘সাদা তালের মতো তুলতুলে। তুই দেখেছিস কোনও সাদা তাল?’

‘না, মানে…’ তো তো করতে থাকে পথিক।

‘তোকে বলেছি না, যা দেখিসনি তা নিয়ে লিখবি না, ভুল লিখবি…’

একমুখ ধোঁয়া হতভম্ব পথিকের মুখের উপর দিয়ে আকাশে ছুড়ে দেয় লেনাদি। বয় কাট চুল, টিকালো নাক, ধারালো মুখ, সাদা শার্ট আর নীল ফেডেড জিন্স পরা লেনাদি, কলেজের মারকাটারি সুন্দরীদের মধ্যে একজন।

‘দেখিসনি তো…?’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে লেনাদি বলল, ‘আমি দেখাব তোকে…।’ বলেই স্কুটিতে চড়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল কলেজ থেকে।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পথিক!

একদিন এতটা লাজুক ছিল সে, মুখে ভালোবাসার কথাও কাউকে বলতে পারেনি। তখন ইলেভেন চলছে। সে এক নভেম্বরের সকালবেলা। পিউ টিউশানি যাচ্ছে। পথিক পিছু পিছু হাঁটছে। আর তার বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি। হাতে রাখা চিরকুট ঘামে ভিজছে। নির্জন জায়গার অপেক্ষায়।

ফলো করে কিছুটা যাবার পর পিউ বুঝতে পারে পথিক ওকে অনুসরণ করছে। ও ঘুরে দাঁড়ায়।

‘কী রে পথিক, তুই এই রাস্তায়…কোথায় যাবি?’

‘তোর সাথে একটা কথা ছিল…’

‘ওহ, হ্যাঁ, বল…’

চিঠিটা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দেয় পথিক। ‘এটা একটু পড়ে দ্যাখ।’

পথিক মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল দুরুদুরু বুকে। এভাবে আগে কেউ কাউকে প্রোপোজ করেছে কি না তার জানা নেই। চিঠিতে লেখা ছিল ‘আই লভ ইউ, পিউ’ ব্যস, এতটুকুই।

‘তুই এই কথাটা তো আমাকে মুখেও বলতে পারতিস…’

প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পর স্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল পিউ।

ওদিকে তখন পথিকের বুকে অবিরাম হাতুড়ি পেটা চলেছে। তার পরের শব্দগুলো শোনার জন্য।

‘দ্যাখ, আমি তোকে বন্ধুর মতো দেখি। তোর সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো থাকলেই ভালো!’

হিমালয়ের চূড়া থেকে কোন অতল খাদের গভীরে যেন তলিয়ে যেতে লাগল পথিক। শরীর যেন ভারশূন্য পালকের মতো ভাসছে। যে-কোনও দিকেই উড়ে চলে যেতে পারে। শহরের সব শব্দ, সব কোলাহল যেন তার কানের তিন ফুট দূরে এসে থমকে গেছে। আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না পথিক। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে, জানে না। আবার সম্বিত ফেরে পিউ-এর কথায়। ‘সরি, কিছু মনে করিস না। টিউশনির দেরি হচ্ছে, চলি…’

চলে গেছিল পিউ। আর তখনই মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল পথিক। নাহ, পিউ আর পিছন ফিরে তাকায়নি। মেয়েরা সত্যিই কখনও পিছন ফিরে তাকায় না…

‘কী রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অত কী ভাবছিস?’ দূর থেকে হাঁক দেয় সঞ্জয়দা ‘ইউনিয়ন রুমে আয়, কথা আছে।’

লেনাদির আহ্বানে মশগুল থাকা পথিক চমকে ওঠে। লেনাদির সাথে পথিকের পরিচয়ও ইউনিয়ন রুমেই। তখন ওরা সদ্য ঢুকেছে। ফ্রেশারস ওয়েলকাম হয়নি তখনও।

দুই

কলেজ শুরুর প্রথম দিনই পিউকে দেখেছিল পথিক। ও উইমেন্স এ ভর্তি না হয়ে বিবেকানন্দে ভর্তি হয়েছে, জেনে ভিতরে ভিতরে খুশিই হয়েছিল। তবে পিউ কে সিগারেট খেতে দেখে খুব অবাক হয়েছিল।

 

কলেজে গিয়ে তার মনে হয়েছিল পুকুর থেকে যেন সমুদ্রে এসে পৗঁছেছে। গার্জেনদের চোখ রাঙানি নেই, মাস্টারমশাইদের শাসন নেই। হঠাৎ এতটা স্বাধীনতা পেয়ে গিয়ে বেশ মজাই লাগছিল পথিকের।

 

পথিক ভেবেছিল পড়াশোনার সাথে হালকা করে থাকবে ছাত্র রাজনীতিতে। আর সবাই যেমন থাকে। কিন্তু ইউনিয়ন রুমের মোহ ক্রমশ বাড়তে থাকে তার কাছেও। কারণ পিউও সেখানে যাতায়াত শুরু করেছে ততদিনে। স্কুলের রাজনীতি-নির্বোধ ছেলেগুলো এখানে এসে কীভাবে তুখোড় নেতা হয়ে ওঠে, সে দেখতে থাকে চোখের সামনে।

 

সঞ্জয়দা তখন নতুন ব্যাচকে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করতে উন্মুখ। কলেজ শুরুর দু’একদিনের মধ্যেই ফাঁকা ক্লাসগুলোয় গিয়ে শুরু করল রুম মিটিং। তারপর ইউনিয়ন রুমে নিরন্তর দীক্ষাদান তো আছেই।

 

‘শোন, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ারে অলরেডি আমাদের তৈরি ছেলেরা আছে। সে নিয়ে চিন্তা নেই। এই যে ফ্রেশ মাইন্ডগুলো স্কুল পেরিয়ে কলেজে এল, এদের মাথায় কোনও পলিটিক্যাল থট নেই। অন্য কেউ চষে দেবার আগে রাজনীতির বীজটা আমাদের পুঁতে দিতে হবে। দেখতে হবে আমাদের ছেড়ে কেউ অন্যদিকে চলে না যায়…’

 

সিগারেট ধরিয়ে নিজের মার্ক করা চেয়ারে বসে ধোঁয়া ছাড়ল সঞ্জয়দা। বাকিরা উলটো দিকের সারি সারি চেয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা। কয়েকজন নীচে পাতা ম্যাট্রেসের উপর গোল হয়ে বসে ওয়াল ম্যাগাজিনের ছবি অাঁকছে।

 

‘আয় লেনা…আয়…এই এদের একটু ক্লাস নিচ্ছিলাম।’

 

লেনা নাম্নি ফরসা, লম্বা, সুন্দরী, জিন্স পরিহিত সঞ্জয়দার সহপাঠিনী কমরেড ইউনিয়ন রুমে ঢুকল। তার সাথে পাঁচটা মেয়ে। সব ফাস্ট ইয়ারের। যাদের মধ্যে পিউ একজন।

 

তাদের দেখিয়ে বলল, ‘এই যে আমার লেডি ব্রিগেড… কী বলছিলি বল, এরাও শুনুক…’

 

‘তোমাদের ক’জনের উপরেই আমরা ভরসা করছি। তোমাদের যে যার নিজের নিজের ক্লাসকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাছাড়াও সার্বিক ভাবে কলেজে পার্টির স্বার্থটা দেখতে হবে।’ সিগারেটে টান দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যথেষ্ট পজ দিয়ে কথাগুলো আমাদের সবার দিকে ছুড়ে দিল সঞ্জয়দা।

 

ম্যাগাজিনের কাজ করতে থাকা সেকেন্ড ইয়ারের একজন পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরাল। দু’টান দিয়েই পাশের জনকে ধরিয়ে দিল। তারপর এল ফার্স্ট ইয়ারের হাতে। দু’একজন টান দিয়েই কেশে ফেলল। বাকিরা তাই দেখে হাসতে লাগল।

 

দীপাঞ্জন তার কানে কানে বলল, ওটা সিগারেট নয় শালা, ব্যাগড়া ভরা আছে। তাই দু’টান করে দিচ্ছে…’

 

পথিক তখনও ‘ব্যাগড়া’ মানে শোনেনি। পরে জানল গাঁজা ভরা আছে। কলেজের গেটেই ছাত্রদের জন্য নাকি গাঁজা ভরা সিগারেট বিক্রি করা হয়। ছাত্ররা তো আর ক্যাম্পাসে কলকে মুখে দিয়ে গাঁজা টানতে পারে না!

 

কথা শেষ করে সঞ্জয়দা আর লেনাদি ভিতরের কেবিনে গিয়ে বসল। বাইরের ঘরে নতুন পুরোনো ইউনিয়নপন্থী ছাত্র ছাত্রীরা গল্প, গান, কবিতায় মশগুল হয়ে গেল।

 

পথিক যেন সেদিন নতুন করে মানুষ চিনল। মানুষ যে এত ক্যালকুলেশন করে অন্য মানুষের সঙ্গে মেশে, তা ওর অজানা ছিল। কমরেডদের কথা বলা, গল্প করার পিছনেও যে পার্টি তথা সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার তাগিদ থাকে, সে তখনই জানতে পারল।

 

পথিক বারবার পিউয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। পিউয়ের কোনও হেলদোল নেই। ও কী অনায়াসে তার এতদিনের সহপাঠী, তার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত ছেলেটাকে অগ্রাহ্য করছে! মেয়েরা পারেও বটে!

 

তিন

 

পথিকের কাছে কলেজ আর ইউনিয়ন রুমের আকর্ষণটাই ছিল পিউয়ের জন্য। সারাক্ষণ ক্লাসে মন বসত না। শুধু বসে বসে ওর কথা ভাবত। আর ক্যান্টিন, ইউনিয়ন রুম, লাইব্রেরি, কলেজের মাঠ, শালজঙ্গল যেখানেই ওর দেখা পেত পথিকের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যেত।

 

দু’এক বার সামান্য দলবদ্ধ হাই হ্যালো ছাড়া অন্য কথাই বলেনি আজ পর্যন্ত। বর্ধমান শহরের অন্য আর পাঁচটা অচেনা মেয়ের মতোই শীতল সম্পর্কটা। কিন্তু কেন হবে? নিজেকে প্রশ্ন করে পথিক, কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। ওর সাথে ছ’টা বছর একসাথে পড়ার কোনও রেখাপাতই নেই! পথিকও নাছোড়…। সে নিজেকে বলে এর শেষ দেখবই…কী এমন রহস্য আছে, যে বন্ধু বন্ধুই রয়ে যাবে? প্রেমিক হতে পারবে না!

 

সেদিন ওদের কবিতা পত্রিকার নতুন সংখ্যাটা ইউনিয়ন রুমে কয়েকজন বন্ধুকে দিচ্ছিল পথিক। লেনাদি বলল, ‘পথিক তুই নাকি ‘ভূমি’তে, লিখিস!’

 

‘ওই আর কি…’ মৃদু হেসে জবাব দেয় পথিক।

 

পত্রিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে তার প্রেমের কবিতাটা দেখে বলল, ‘ও! এটা তোর লেখা…?’

 

পথিক ঘাড় নাড়ে।

 

পড়া শেষ করে তার দিকে চেয়ে হাসে লেনাদি। সিগারেটে টান মেরে বলে, ‘উমম্….কী লিখেছিস যেন… ‘তারপর লঘু অথচ গম্ভীর পদক্ষেপে হেঁটে চলে গেলে তুমিয একবারও পিছন ফিরে তাকালে নায সত্যি, মেয়েরা কখনও পিছন ফিরে তাকায় না…!’

 

‘তুই মেয়েদের কী জানিস? অ্যাঁ? এর আগে কটা প্রেম করেছিস? আর এখন তোর কটা গার্লফ্রেন্ড আছে, বল শুনি….’ তর্জনি আর মধ্যমার মাঝে চেপে ধরা সিগারেট নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে লেনাদি।

 

‘এর আগে একটাও প্রেম করেনি’, বলল দীপাঞ্জন।

 

‘আর একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই বেচারির’, যোগ করেছিল গণেশ।

 

‘একটাই সরু লাইন করতে গেছিল, মেয়েটি প্রথম দিনই ভাই না বন্ধু কী একটা বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল।’ হি হি করে হাসে আলতাফ।

 

‘হুম… তোর ক্লাস নিতে হবে রোজ। না হলে মেয়েদেরকে না জেনেই প্রেমের কবিতা লিখতে যাবি, দিয়ে হোঁচট খাবি। আই মিন, ভুলভাল লিখবি। কাল থেকে অফ পিরিয়ডে আমার কাছে আসবি, রোজ আধঘন্টা করে মেয়েরা কী করে, কী চায় তোকে শেখাব…’

 

‘হা হা হি হি…।’ লেনাদির সাথে সবাই যোগ দেয় হাসিতে।

 

ইউনিয়ন রুমে সেদিন অনেকক্ষণ ধরে গান, কবিতা, গল্প হল। পিউ কী রকম একটা গম্ভীর হয়ে বসে রইল। সঞ্জয়দা তার সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন আমাদের চোখে একটু পর পর মাখিয়ে দিতে থাকল।

 

‘শোন, শোন… হো চি মিন বলেছিলেন, ‘পোয়েট্রি মাস্ট বি ক্ল্যাড ইন স্টিল। আ পোয়েট শুড নো হাউ টু ফাইট।’ তোদের ওই শান্তনু রায় এর ছেলে ভোলানো কবিতায় শুধু ‘আমি-তুমি’… এই তো…? এর বাইরে খেটে খাওয়া মানুষের কথা কোথায়! যত বোগাস কবিতা সব!’

 

‘আরে কী বলছ? জানো তুমি লোকটার কী বিশাল ফ্যান

 

ফলোয়িং?’

 

‘রাখ তোর ফ্যান। আগে ভাতের কথা ভাব, তারপর ফ্যান নিয়ে ভাববি। আমার সব ভালো করে পড়া আছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক বলতে উনি বোঝেন প্রেম, অবৈধ প্রেম, ভাই বোনে প্রেম…তোরাও তাই গিলছিস, আর নিজেরাও তেমন লিখছিস…’

 

সেদিন ইউনিয়ন রুম থেকে বেরিয়ে একা একা হাঁটছে পথিক। দ্রুত পা চালিয়ে পাশাপাশি এল পিউ। ‘তুই খবরদার লেনাদির কাছে যাবি না। ফরসা কচি ছেলেদের খুব পছন্দ করে ডাইনিটা। আর ব্যাগে সবসময় কন্ডোম নিয়ে ঘোরে…’ দাঁড়ায় না পিউ, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়।

 

চার

 

‘কী, আমার কাছে ক্লাস করতে এলি না তো?’ সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল লেনাদি।

 

দিন পনেরো পর বাইক শেডের সামনে মুখোমুখি দেখা। ইউনিয়ন রুমে এর মধ্যে বারকতক দেখা হলেও কিছু বলেনি লেনাদি। পথিক সেদিনের কথাটাকে ঠাট্টাই ভেবেছিল।

 

তাই কী উত্তর দেবে পখিক ভাবছিল।

 

‘না, মানে…’ তো তো করতে থাকে ঊনিশ বছরের পথিক।

 

‘তোকে বলেছি না, যা দেখিসনি তা নিয়ে লিখবি না, ভুল লিখবি…। আমার কাছে আসিস, দেখাব…’ বলে স্কুটিতে চড়ে সাঁ করে চলে যায় লেনাদি।

 

সাতপাঁচ ভাবছিল পথিক। সত্যি-মিথ্যা, রোমাঞ্চ, পিউয়ে-র সাবধানবাণী…। তার মাঝে হাঁক দিয়ে গেল সঞ্জয়দা। তবু ইউনিয়ন রুমে গেল না পথিক।

 

পাঁচ মিনিট পর তার মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল। ন্তুপ্প ২ প্পম্ভ ব্জপ্প ্ত্রব্ধ ন্সন্ধ্রুন্ন্স্ত্র, ্ত্রন্দ্রব্ধব্জ ন্ধ্রচ্ঞন্দ্র ু ন্ধ্রব্জ, ঢঅচ্ঞচ্ঞ ব্দন্ধ্রভ্র ব্ভ ভ্রন্ধ্রব্ধ হ্মব্জপ্সপ্পব্দস্তু.

 

বুক ধড়ফড় করতে থাকে পথিকের। ও মাঠের ঘাসে বসে পড়ে। পা কাঁপছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ নেই এখন। ঘাসের উপর পিঠ এলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। উত্তেজনায় তার নিঃশ্বাস ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে, বুঝতে পারে পথিক। সে কলেজের আনাড়ি ছোকরা। সদ্যাগত, তাকে ‘সাদা তাল’ দেখতে আমন্ত্রণ করছে কলেজের হার্টথ্রব ইউনিয়ন নেত্রী থার্ড ইয়ারের লেনাদি! নিষিদ্ধ ফলের আকর্যণ পথিককে চুম্বকের মতো টানতে থাকে।

 

আবার মনে পড়ে পিউয়ে-র কথা। ভীষণ রাগ হয় পিউয়ে-র উপর। মনে হয় কেন শুনবে সে ওর কথা? সবাই কত হাসি গল্প করে তাদের বান্ধবীদের সাথে। ফোন করে, মেসেজ করে। ঘুরতে যায়… আরও কত কী… সে কেন বঞ্চিত থাকবে এই সুখ থেকে…

 

এক অপ্রতিরোধ্য রোমাঞ্চ তাড়িয়ে নিয়ে যায় পথিককে। কলেজের খেলার মাঠ, শাল জঙ্গল ছাড়িয়ে, বাজারের শেষে ছাতার দিঘির পাড়ে ছোট্ট অতিথিনিবাস, ক্ষণিকা। হাফ প্যান্ট আর ফিনফিনে গেঞ্জিতে অপেক্ষা করছিল লেনাদি…

 

সেদিন লেনাদি আরও অনেক কিছু দেখিয়েছিল। এক প্রকার হাতে ধরে শিখিয়েছিল শরীরের কোন ভাঁজে লুকিয়ে আছে কতটা সুখ, দুগ্ধফেননিভ ফর্সা নরম তাল তাল মাংসের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে পথিকের প্রথমবারের জন্য মনে হয়েছিল জীবনটা সত্যিই সুন্দর…।

 

লেনাদি আলস্য জড়ানো চোখে বিড়বিড় করছিল, ‘হোয়াই ইউ পিপল ডোন্ট ডু ইট ফর আওয়ারস!

 

পাঁচ

 

সেদিন মাথায় একটা কবিতা ঘুর ঘুর করছিল পথিকের। একটা অফ পিরিয়ড পেতেই ও ভাবল কবিতাটা নামিয়ে ফেলতে হবে। সাদা কাগজ আর পেন তার পকেটেই থাকে। বই খাতা ক্লাস রুমে রেখে ও হাঁটতে লাগল। খেলার মাঠ, শাল জঙ্গল পেরোলে কলেজের পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারেই ছোট্ট ক্যানেল। কুলকুল জলের শব্দ। দূরে তাকালে দেখা যায় ছাতার দিঘির বিস্তৃত জলরাশি। ভিতরের দিকের প্রাচীরের গায়ে একজায়গায় পুরানো ইট ঢিবি হয়ে আছে। তাতে পা দিয়ে অনায়াসে সীমানা প্রাচীরের উপর বসে সৗন্দর্যে বিভোর হয়ে কবিতার কথা ভাবা যায়। জায়গাটা খুব পছন্দ পথিকের। সেদিকেই হাঁটছিল ও। হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর খুক খুক কাশির শব্দে থমকে দাঁড়াল সে। পিউ আর কেমিস্ট্রির রুষা। রুষার হাতে একটা কল্কে, যা থেকে দু’জনেই একবার করে টান মারছে। পথিককে দেখে পিউ ডাকে, ‘এই গুড বয়, শোন শোন, এদিকে আয়, একা একা কোথায় যাচ্ছিস? তোর সখীরা কই?’

 

পথিক বুঝতে পারে পিউয়ে-র নেশা হয়ে গেছে। এই কারণে ও সব ক্লাস করে না আজকাল।

 

‘তোরা কল্কে নিয়ে…’

 

‘সিগারেটে পুরে হয় না রে মাইরি। গাঁজা খেলে কল্কেতে ফেলেই খাওয়া উচিত…উঁহ…কী স্বাদ । মাইরি! দু’টান মেরে দ্যাখ…’

 

‘আমি গাঁজা খাই না, নট ইভন বিড়ি, সিগারেট, চা…’

 

‘চা খাস না… হি হি… চা খায় না…দুধ তো খাস…’

 

‘না, তাও খাই না।’ নাকের পাটা ফুলিয়ে জবাব দেয় পথিক।

 

‘অলে বাবা… কচি ছেলে দুদুও খায় না…।’ হঠাৎ তড়াক করে রুষার গায়ের হেলান ছেড়ে উঠে বসে পিউ। ‘সেদিন তাহলে লেনাদির ঘরে গিয়ে কী খেয়ে এলি?’

 

পিউ আর রুষা দুজনেই হাসতে থাকে হো হো করে।

 

চমকে ওঠে পথিক। তার লেনাদির ঘরে গোপন অভিসারের কথা এরা জানল কী করে!

 

‘শালা ভাবছিস চুপি চুপি করে গেলাম, এরা জানল কী করে?

 

হা-হা-হা… এমন অভিসারের কথা এই মফস্সলে চাপা থাকে না সোনা…। গেছিলি তো একা একা…পায়ে হেঁটে। আসার সময় যে স্কুটিতে চড়ে একেবারে কলেজের গেট পর্যন্ত চলে এলি…হি হি… কচি ছেলেটার খিদে পেয়েছে রে রুষা, একটু দুদু খাওয়া…’

 

মাথা ঘুরতে থাকে পথিকের। সময়টা বড়ো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তার সাথে তাল রেখে হাঁটতে পারে না সে… ছোট্ট থেকেই দেখেছে তার শিক্ষক বাবা সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। তাদের ঘরে রুশ দেশের বাংলা পত্র-পত্রিকা, বই-সাহিত্য ছিল ঠাসা। সেগুলো ছোটো থেকে গোগ্রাসে গিলেছে সে। তাদের মতাদর্শের অনুসারী এই অঙ্গরাজ্যের হাত ধরে সারা দেশে একদিন সমাজতন্ত্র আসবে এমন স্বপ্ন ছিল বাবার, যা ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এখন ভোটে জিতে ক্ষমতায় টিকে থাকাই আসল। কলেজগুলোতেও ভোটে জেতার জন্য কী সুবিশাল আয়োজন! বাবা যে কমিউন গড়ার গল্প শোনাতেন তা আজ প্রলাপ বা বিলাপের মতন শোনায়…

 

‘উরুর তিলটা দেখেছিস… লেনাদির উরুর সেই বিখ্যাত তিল…’

 

‘বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো চমকে ওঠে পথিক। লেনাদির ডান দিকের ফরসা উরুর মাঝ বরাবর কপালের বড়ো টিপের সাইজের একটা ঘোর কালো তিল…সেদিন হাত বুলিয়ে দেখেছিল সে…’

 

তার কান গরম হতে থাকে…কী করে সম্ভব…

 

‘তুইও যেমন… শালা একটা প্রসের সাথে শুতে গেছিস…গোটা কলেজ জানে ওর সারা শরীরের কোথায় ক’টা তিল আছে…’ ভক ভক করে গাঁজার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে রুষা।

 

মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা কবিতাটা কোথায় চলে যায়… শাল জঙ্গলের মধ্যে ধপ করে বসে পড়ে পথিক।

 

ছয়

 

পরদিন তার কবিতা আশ্রমে যাবার পথে পিউকে একা বসে থাকত দেখল পথিক। খেলার মাঠের শেষে। শাল জঙ্গলের শুরুতেই। টান মারার জন্য জাস্ট আড়াল নেওয়া আর কি!

 

‘আসতে পারিস। কোনও পরিশ্রম করাব না… নেশালু কণ্ঠে বলে পিউ।’

 

বিনা বাক্যব্যয়ে পাশে গিয়ে বসে পথিক। বুঝতে পারে আগে থেকেই টান দিচ্ছে পিউ। তাই ক্লাসে যায়নি।

 

‘তোদের তো ভালোই হল…’ জড়ানো গলায় বলে পিউ।

 

‘কেন?’

 

‘শুনিসনি?

 

‘না তো, কী?’

 

‘তোদের কিছু ক্যান্ডিডেট পারচেজ করতে চাইছে বিপ্লব বাবুদের দল। দু’হাতের উপর পিঠ হেলিয়ে বিড়বিড় করে পিউ।

 

এরকম কথা আগে একবার শুনেছিল পথিক।।

 

‘সেজন্য নমিনেশন জমা দেবার পরই তোদের গাড়ি করে নিয়ে চলে যাওয়া হবে মাইথনের একটা হোটেলে। চারবেলা খাওয়া,

 

মউজ-মস্তি। তোদের পাহারায় থাকবে সঞ্জয়দা, লেনাদি। কটা দিন লেনাদির কাছাকাছি থাকবি…’

 

‘বেশ করব থাকব।’ রাগ দেখিয়ে বলে পথিক। ‘আমারও একটা গার্ল ফ্রেন্ড-এর দরকার আছে…’

 

‘মাই গড, লেনাদি তোর গার্ল ফ্রেন্ড! থার্ড ইয়ারে তিনবছর ড্রপ… পার্টির নির্দেশে ও আর সঞ্জয়দা কলেজ দেখছে। ছাত্র না থাকলে ‘বহিরাগত’ হয়ে যাবে, তাই…’

 

‘হোক ছ’বছরের বড়ো, তবু তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে পারব আমি।’

 

রাগ দেখিয়ে বলে পথিক। পিউ-র প্রত্যাখানের জ্বালা মেটাতে। কিন্তু সে জানে আর তার লেনাদিকে চুমু খাওয়া হবে না। চারদিন আগেই সে দেখেছে সেকেন্ড ইয়ারের লম্বা বীরুকে। স্কুটি চড়ে লেনাদির সাথে ক্ষণিকায় যেতে। তখনই সে বুঝতে পারে, কেন ক’দিন ধরে কাছাকাছি ঘুর ঘুর করলেও তাকে আর ডাকছে না লেনাদি, তার সফেন সমুদ্রের জোয়ারের জলে নামতে। এদিকে জীবনের প্রথম নারী সঙ্গমের পর পথিকের তখন পাগলের মতো অবস্থা। চোখ বুজলেই সফেন সমুদ্র… কালো টিপের মতো তিল। তাল তাল নরম মাংসের মধ্যে স্বর্গের সমস্ত সুখ। অথচ লেনাদি কী নিস্পাপ ভাবে কবিতার কথা, ইউনিয়ন ভোটের কথা, সমাজবাদের কথা আওড়ে যায়! যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি কোনওদিন! লেনাকে জানার ইচ্ছা তাকে পাগল করে দিয়েছিল। সেই ইচ্ছাই তাকে জানিয়েছে কলেজের লেকচারার জাহিরবাবুর ভাড়া বাড়িতে প্রায়ই রাত কাটায় সে। আর কলেজের লালটুস দেখতে জুনিয়র, সিনিয়র অনেকেই চেনে তার শরীরের ঘাত প্রতিঘাত, চড়াই উতরাই। সেদিনের জড়নো গলায় বলা কথাটার মানে এদ্দিনে বুঝতে পারে পথিক, ‘হোয়াই ইউ পিপল ডোন্ট ডু ইট ফর আওয়ারস!’

 

লেনাদি এক পুরুষে তৃ৫ হবার মতো মেয়েই নয়। তবে তার এই আবিষ্কার সে পিউ-র কাছে চেপে যায়।

 

‘খা শালা, কত চুমু খাবি পিসিমাকে, ফ্রি তে খেয়ে নে…হা-হা-হা-হা, হাসির দমকে কাশতে থাকে পিউ।

 

‘হাসির কী হল?’ জিজ্ঞেস করে পথিক।

 

‘আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। মুখে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে না পারা সেই ছেলেটার কথা…. একটা চিরকুট কাগজ নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছিল…’

 

হঠাৎ ধবক করে জ্বলে ওঠে যেন পিউর চোখ। কিড়মিড় করে দাঁত। পথিকের বুকের কাছের জামা খামচে ধরে বলে ওঠে, ‘ক্যান ইউ ব্রিং দ্যাট গাই ব্যাক টু মি…?’

 

‘ছাড়…বোতাম ছিঁড়ে যাবে…’

 

‘পারবি না বল? জানতাম…’ শিথিল হয়ে যায় পিউ এর হাত।

 

একটা সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালায় পিউ। টান দিতে দিতে বলে, ‘ডু ইউ নো, হু ইজ মাই ফার্স্ট ক্রাশ?’

 

পথিক কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

 

‘ইউ… ব্লাডি শিলি ইউ… পথিক রায়… মাই ক্লোজ কম্পিটিটর ইন দ্য ক্লাস। বাট দেয়ার ইন দ্য ভিলেজ ইজ নো অ্যাটমোস্ফিয়ার ফর আওয়ার লাভ। নাইদার ইউ কুড টেল মি এনিথিং, নর আই…’

 

শূন্যে ক’বার ধোঁয়া ছাড়ে পিউ।

 

‘তখন রাতদিন পড়ছি জয়েন্টের জন্য। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব।

 

যে-স্যারের কাছে টিউশন নিতাম… বায়োলজির সুনীল স্যার…তাঁর ছেলে উদ্দী৫ তখন ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ি আসত… জয়েন্ট অ্যাস্পিরান্ট আমাদের কাছেও তখন হিরো। ওই শালা আমাকে বলেছিল রাতে ঘুম পেলে সিগারেট খাবে…। সেই থেকে…’

 

পথিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিউয়ে-র দিকে।

 

‘আর কী বোকা ছিলাম আমি! ওর বাবা মা দু’জনেই টিচার। ফাঁকা বাড়িতে একদিন ডাকল। আমিও গেলাম গাইডেন্স-এর লোভে। বাঁধভাঙা ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল একটা সতেরো বছরের মেয়ে। টোটালি আন প্রিপেয়ার্ড অবস্থায় একটা আন প্রোটেক্টেড সেক্স। সব মিটে গেলে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। ও তখন ডেট-ফেট কী সব হিসেব করে বলল আমার সেফ পিরিয়ড চলছে… ওরিড হবার কিছু নেই। তারপরও ওর ডাকে সাড়া দিয়ে পাঁচবার মিলিত হয়েছি। তবে প্রত্যেকবার উইথ প্রোটেকশন। কিন্তু দেড়মাসের মাথায় আমি বুঝতে পারলাম আই ওজ মিসিং মাই পিরিয়ড…’

 

‘ওই টার্মিনেশনের জন্য অ্যারেঞ্জ করেছিল একটা নার্সিংহোমে। তারপর কুড়ি দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। মা-কে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলেছি। আর তারপর থেকেই ওর সুইচ অফ। সারাদিন শুধু অঝোরে কেঁদেছি। এমন সময় একটা মেয়ের মনের অবস্থা কী হয়… সেসময় কাকে পাশে দরকার হয়…। তোর ওই ‘মেয়েরা যেমন হয়’ কবিতা পড়ে বোঝা যাবে না কোনওদিনও, রাস্কেল…’

 

হঠাৎ কেঁদে ফেলে পিউ। আই ওয়াজ টোটালি ডিভাস্টেটেড। অ্যাট দ্যাট টাইম ইউ কেম টু টেল মি ‘আই লাভ ইউ’। ইট ওয়াজ আ লেট কল, পথিক…’

 

‘স্যারের কাছে একদিন সব বলে কান্নায় ভেঙে পড়ি। স্ত্বান্নার জন্য তাঁর হাতের স্পর্শ মাথা থেকে নেমে ক্রমশ আমার সারা শরীর ঘুরতে শুরু করে… ছেলের সাথে শুয়েছি শুনেই ওঁর চাউনি কেমন যেন বদলে গেল। ভাবছিলাম… সেদিন ওই বাস্টার্ডের মুখে থুতু ছিটিয়ে বেরিয়ে আসি। জয়েন্টের স্বপ্ন ফিনিশড…’

 

‘যে-ছেলেটা মুখে বলতে পারে না ‘আই লভ ইউ’, তার হাতে একটা অ্যাবরশন হওয়া মেয়েকে তুলে দিতে মন চায়নি সেদিন। তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।’

 

‘কিন্তু সে যদি আজও চায়?’ পিউয়ে-র একটা হাত খপ করে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রশ্ন করে পথিক। ‘সেও তো একটা ভুল তোরই মতো করে বসেছে? তোকে একজন পুরুষ ব্যবহার করেছিল, আমাকে একজন নারী। যে-দুটোর কোনওটার মধ্যে ভালোবাসা ছিল না…’

 

‘তোকে ফিরিয়ে দিয়ে কতরাত কেঁদেছি জানিস, রাস্কেল…।’ তারপর ডিপ্রেশন শুরু হয়। বন্ধুদের কাছ থেকে মদ গাঁজা সব খাওয়া আস্তে আস্তে শিখে যাই।’

 

‘এখনও কি ফিরে আসা যায় না?’

 

‘কে ফেরাবে তারে… সব স্বপ্ন লুঠিত হয়ে গেছে যার, সবার অগোচেরে…’

 

‘আছে একজন।’

 

‘সে ইউনিয়নের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত।’

 

‘ছেড়ে দেবে সে ইউনিয়ন।’

 

‘বেট?’

 

‘বেট।’

 

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে পিউ।

 

পিউয়ে-র হাতে ধরা রুমাল নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয় পথিক। নির্জন চরাচরে দু’জন মানব মানবী দু’জনকে নতুন করে দেখতে থাকে। চার চোখের মুগ্ধতায় তখন ভর করে হাঁটতে থাকে ভাষাহীন শব্দেরা। অনেক না বলা কথা যেন বলা হয়ে যায় মুহর্তে। একে অপরকে পরম আশ্লেষে বুকে জড়িয়ে ধরে ওরা। পিউ-র কাঁধে পথিক-এর মাথা। তার হাতে ধরা রুমালে একটা মৗমাছি এসে বসে। পথিক ফিসফিস করে বলে, ‘পিউ তোর রুমালে মৗমাছি…’

 

পিউ নেশা ধরানো গলায় প্রশ্নের স্বরে আওয়াজ দেয়, ‘উমমম…’

 

পথিক পিউ এর কানের কাছে মাথা রেখে অস্ফুটে বলতে থাকে,

 

‘দুহাতে কোনও কাজ ছিল না, দুটোই মারকুটে

 

দুহাত ভরে সেলাই এলো নাইন-টেনে উঠে

 

এহাতে এল রান্নাঘর, ওটায় তানপুরা

 

হাতের কথা জেনেও গেল দাদার বন্ধুরা

 

দুহাতে আজ ভরা সেলাই, আঙুলে সুতো কাঁচি

 

টেবিল ক্লথে ভ্রমর এলো, রুমালে মৗমাছি…’

 

আরও গভীর ভাবে পথিককে চোখ বুজে জড়িয়ে ধরল পিউ। শালের পাতায় পাতায় তখন লুটোপুটি খাচ্ছে শীতের রোদ। দূরে কোথাও একটা সুখপাখি ডেকে উঠল। তিনবার।

(কবিতার ঋণছ ‘সেলাই খাতার নকশা’ –শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব