কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলো কোনওক্রমে আজও আশ্চর্য ভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তারই একটি ঘরে থাকে শিবু। তার অন্যদিকে জানালা বরাবর থাকে ভাড়াটে সীমা, তার বাবা-মা আর ঠাকুমা। সীমাদের ঘরের এ পাশের জানালাটা খোলা হয় না, পাছে বাইরের লোকের কাছে ঘরের দারিদ্র্যটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। বড্ড মুশকিল হয় গরমে। বুড়ো আমগাছটা যদিও বা একটু-আধটু হাওয়া দেয়, সেটাও বন্ধ। মাঝে মাঝে সীমার মনে হয় এ জীবন থেকে মুক্তি বোধহয় আর নেই। কয়েকটা টিউশন সম্বল করে এবং বাবার পেনশনে চলে চারজনের সংসার। স্বপ্ন দেখা তো সে কবেই ছেড়ে দিয়েছে। সীমা ভাবে গরিবের আবার স্বপ্ন কী? সকালে একমুঠো জুটলেও বিকেলে জুটবে কিনা সন্দেহ।
রাতের বেলায় শিবু মাঝে মাঝে জানালাটা একটু ফাঁক করে দেখে, সীমা বাড়ির ছাদে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভীষণ ইচ্ছে হয় সীমার মুখে একটুকরো হাসি দেখতে। হাসির রাস্তা দিয়ে সীমার আর যাতায়াত কোথায়? কবে যে একটু হেসেছে তা-ও মনে পড়ে না।
আজ গরম বড্ড বেশি। সীমার বাবা হাতপাখা করতে করতে বলেন, ‘সীমা এক গ্লাস জল দে তো মা।'
সীমা জলের গ্লাস হাতে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বড্ড গরম লাগছে তাই না বাবা?”
পরমেশবাবু বলেন, ‘ও কিছু নয়। গরমে গরম তো হবেই।'
সীমা মনে মনে ভাবে যে করেই হোক এবার একটা পাখা কিনতেই হবে।
টিউশন সেরে ফেরার পথে শিবুর ইলেকট্রিক দোকানে ঢুকে পড়ে সীমা। ওকে দেখে শিবুর বুকের ভিতরে বসন্তের হাওয়া বয়ে যায়।
সে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু লাগবে?’
সীমা বলে, ‘একটা পাখার জন্য এসেছিলাম।'
শিবু তাকে কয়েক রকমের পাখা এনে দেখায়। সংকোচের সঙ্গে সীমা বলে, ‘চারটে কিস্তিতে পয়সা দিলে চলবে?’
শিবু বলে, ‘চারটে কেন ছ'টা কিস্তিতে দিলেও চলবে।'
সাদা রঙের একটা পাখা পছন্দ করে সেটা নিয়ে বাড়ির পথে বাড়ায় সীমা। মনের মধ্যে বাবার খুশিভরা মুখটা ফুটে ওঠে। পাখা হাতে মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে সীমার মা রীতিমতো চিৎকার করে ওঠেন, 'আরে এটা কী করেছিস, পরের মাসে খাব কী?'