একটা ঘরে ফেরার গল্প (৩ পর্ব)

৩ পর্ব

আজ সকালে বেড-রোল গুটিয়ে তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন টয়লেটের বিপরীত দেয়ালে তালাবন্ধ ঢাউস কাঠের বাক্সটা খুলে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে, টয়লেটের দিকে তাকাতেই অর্জুন বুঝতে পারল, তখনও পর্যন্ত টয়লেট একরকম ফাঁকাই রয়েছে বলা চলে। তার মানে ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা বাজলে কি হবে, এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে পারেনি। প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে, বাইরে বেরোতেই অর্জুনের চোখে পড়ল — বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস এসে দাঁড়িয়ে আছে। জামা-প্যান্ট-জুতো গলিয়ে, পিঠব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, ধীর পায়ে অর্জুন চোদ্দো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এস্ক্যালেটরের দিকে পা বাড়াল। তার পুষ্যিগুলোকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, রোজকার মতন টিফিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে, স্কুলমুখো রওনা করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

সারারাত ধরে দুর্যোগ-ক্লিষ্ট, অনিশ্চিত যাত্রার শেষে, ক্লান্ত আচ্ছন্ন শরীরে মালপত্র টানাটানি করে প্যাসেঞ্জাররা সব ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম পার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে অর্জুন খেয়াল করল, জিআরপি’র লোকজন ধরাধরি করে কাউকে যেন ওই ট্রেনের সাধারণ কামরা থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে, প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে অনেকে চলার পথে সেদিকে অগ্রসর হয়ে, উকিঝুঁকিও মারছে। অর্জুনও কৌতূহল দমন করতে না পেরে সেদিকেই পা বাড়াল।

ভিড় ঠেলে কাছাকাছি পৌঁছোতেই, এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে— একটা মেয়ে পাশ ফিরে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। তার জামা-প্যান্ট রক্তে ভেজা; যা দেখে ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ কেউ মন্তব্য করছে, ‘চল চল, পাগলি-টাগলি হবে’। আবার কেউ বলছে, “না না, রেপ কেস! চল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ঝামেলা বাড়ানো।’ অর্জুন কাছে গিয়ে, জিআরপি’র একজন এসআই-কে দেখে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে এর?”

—কী যে হয়েছে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। সারারাত সাধারণ কামরার টয়লেটের মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিল। প্যাসেঞ্জাররা নাকি রাত থেকেই ওকে এইরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে ওই টয়লেটের মধ্যে। ঝামেলা এড়াতে কেউ আর কোনও সাড়াশব্দ করেনি। অনেকে বলছে, রেপ-কেস হতে পারে। কিন্তু জ্ঞান না ফিরলে, কিছুই জানা যাচ্ছে না— জিআরপি’র এসআই জয়ন্ত ঘোষ মেয়েটির রক্তে ভেজা জামা-প্যান্টের দিকে ইঙ্গিত করে, অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

এই স্টেশন চত্বরে রেল পুলিশের সব লোকজনই অর্জুনকে খুব ভালো করে চেনে। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে তাই এসআই-এর উদ্দেশ্যে বলল, ‘অবস্থা কিন্তু খুব একটা ভালো ঠেকছে না। এক্ষুনি একে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।’ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই, পাশেই বিল্টুকে দেখতে পেল অর্জুন। বিল্টুর হাতে ওর দলবলের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করার জন্য দু’শো টাকা দিয়ে বলল, “তুই সবার টিফিনের বন্দোবস্ত করে, সকলকে স্কুলে পাঠিয়ে দিবি ঠিকমতো। আমি একে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তুই চট করে কুলিদের থেকে একটা হ্যান্ড ব্যারো নিয়ে আয়।”

এরপরে এসআই জয়ন্ত ঘোষ আর অর্জুন দু’জনে মিলে মেয়েটাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে এল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটার অবস্থা দেখে, ওকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে নিয়ে, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন প্রভৃতি প্রক্রিয়া চালু করে দিল। মেয়েটার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন ওয়ার্ডের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দুপুরের পরে, ক্ষণিকের জন্য মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার জানালেন, ‘মেয়েটি শারীরিক ভাবে অসম্ভব রকমের দুর্বল। মনে হয় চার-পাঁচদিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষীণ স্বরে কিছু হয়তো বলছে, যদিও তার বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সামান্য সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরলেও, আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। দেখুন, আবার জ্ঞান ফিরলে, ওর কাছ থেকে যদি কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন! পরীক্ষায় ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনও তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। তবে মেয়েটি ঋতুকালীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ভালো করে জ্ঞান না ফিরলে, বেশি জোর জবরদস্তি করে কিছু জানার চেষ্টা করা উচিত নয়।’

ক্রমশ…

 

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (২-পর্ব)

২ পর্ব

পড়শিদের চিৎকার আর আলোচনা শুনে শ্রাবণী জানতে পেরেছিল, ওর জ্ঞাতিরা তার মা-বাবাকে মেরে ওদের জায়গা জমি হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। দিন দু’য়েক বাদে গাঁয়েরই এক পিসে ওকে বুঝিয়েছিল, এভাবে পথে পথে কেঁদে বেড়ালে, না আর বাপ-মাকে খুঁজে পাবি; না জোটাতে পারবি পেটের ভাত। তার চেয়ে আমার সাথে চল, কলকাতার একটা অনাথ আশ্রমে ভর্তি করিয়ে দেব’খন। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই যেমন একটা পাবি; দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে দু’অক্ষর লেখাপড়াও শিখতে পারবি। পথে পথে ভিক্ষে করে আর বেড়াতে হবে না তোকে।

কিন্তু হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরে, সেই পিসেকে আর খুঁজে পায়নি শ্রাবণী। পরে জিআরপি’র এক পুলিশ অফিসার কাকুর কাছ থেকে শ্রাবণী জেনেছিল, ওটা তোর পিসে না ছাই! ওটা শিশু পাচার চক্রের একটা দালাল। তোকে বেচে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে, তোকে ফেলে রেখে এখান থেকে পিঠটান দিয়েছে।

হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে, পূর্বপ্রান্তের রাস্তার ওপারে একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে, সেইদিন দুপুরে মাছ-ভাত খাইয়ে, রেল-পুলিশের অফিসার শ্রাবণীকে ওই ভাতের হোটেলে রেখে দিয়ে, চলে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আপাতত তুই এখানেই থাক, টুকটাক ফাই-ফরমায়েশ খেটে দিবি। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যেমন পেয়ে যাবি, তেমনই মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইও হয়ে গেল তোর। কিন্তু হোটেল মালিক কথায় কথায় যেমন ধমক-ধামক আর তার সাথে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিত, তা মোটেও পছন্দ হতো না শ্রাবণীর।

একদিন ভোর হওয়ার আগে হোটেল থেকে পালিয়ে, প্রথম মেদিনীপুর লোকাল ধরে, সোজা খড়গপুর স্টেশনে গিয়ে নেমে পড়েছিল সে। সেখানে কিছুদিন ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ করে একদিন রেল পুলিশের তাড়া খেয়ে, বছর দুয়েক বাদে আবার হাওড়া স্টেশনে ফিরে আসে সে। তারপর থেকে রোজ সারাদিন ধরে এ ট্রেন ও ট্রেন ভিক্ষে করে বেড়ানোর শেষে, রাতে ফিরে আসত এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে শুয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত শ্রাবণী।

আর রোজ সন্ধ্যায় অর্জুনের পাশে বসে, কোলে চেপে, সবচেয়ে ছোটো যে মেয়েটা স্লেট-পেন্সিল নিয়ে, সবে অক্ষরজ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত; তার নাম শান্তা। শান্তার জন্ম এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই। সেও এক প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির রাতে। জন্ম দেওয়ার পরে, ওকে ফেলে রেখে ওর মা-টা যে কোথায় চলে গিয়েছিল, তা কে জানে! মা-কে ছাড়া অতটুকু শিশু এতটুকু টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি কোনওদিন। ছোটো থেকেই সে এতই শান্ত ছিল যে, অর্জুনই ওর নাম দিয়েছিল— শান্তা!

এদের সঙ্গে অর্জুন দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হলেও, এদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা বানাতে সক্ষম হয়েছে সে; তাও প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। এদের বেশির ভাগই আগে প্ল্যাটফর্মে বসে, ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে ভিক্ষে করে বেড়াত। সুযোগ পেলে যাত্রীদের মালপত্র থেকে হাতসাফাই করে, দু’-চার টাকা কামিয়ে নিতেও সিদ্ধহস্ত ছিল এরা।

অর্জুন বুঝেছিল, এদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পেট চালানোর একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারলে আর নিয়মিত ভাবে পড়াশোনার জগতে ব্যস্ত করে রাখতে পারলে, তবেই এদের এই অসৎ উপার্জনের থেকে বিরত রেখে, একটা সুস্থ জীবনের আলো দেখানো সম্ভব। তাই সকাল হতেই কোনওদিন লুচি-তরকারি, কোনওদিন কেক, কোনওদিন কলা-পাউরুটি ধরিয়ে দিয়ে, সকলকে আজকাল টিকিয়াপাড়ার রেল লাইনের ধারের স্কুলে পাঠিয়ে দেয় অর্জুন। সেখানে প্রাপ্ত মিড-ডে মিলের সুবাদে দুপুরের খাওয়াটাও জুটে যায় রোজ। রাতে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের ধারে বসে ঘন্টা দুয়েকের পড়াশোনার পরে, একুশজনের এই দলটা চলে যায় হাওড়া স্টেশনের বাইরে নদীর ধারের ভাতের হোটেলে নৈশভোজ সারতে। তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে, ওই গোডাউনের পাঁচিলের ধারেই সবাইকে শুইয়ে দেওয়ার পরে, রাতের এই ক’ঘন্টার জন্য অর্জুনের সারাদিনের সব ব্যস্ততার অবসান।

ক্রমশ…

 

ভুলের মাশুল (১-পর্ব)

এখন সকাল। রোদ্দুরের তেজটা সেরকম বোধ হচ্ছে না। প্রিন্সেপ ঘাটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছেন অমিত সেন। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজ করার সুবাদে আগে এখানে কতবার এসেছেন। এখন আর সেরকম ভাবে আসা হয় না। ঘাটের চারপাশজুড়ে আকাশ কমলা হওয়ার দৃশ্যটা কতদিন দেখেননি তিনি! চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে প্রায় সবাইকে নিজের কাজে বেরুতে হবে। সে তাড়া অমিত সেনের নেই। আজ তাঁর একটু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার দরকার ছিল। তাই সটান চক্র রেলে চেপে এখানে এসেছেন।

আজ আবার ঘটনাটা ঘটল। এই নিয়ে কতবার যে হল আর মনে করতে পারছেন না অমিত সেন। কিছুদিন আগে বাসে উঠে মনে পড়ল দরজাটা লক করা হয়নি। মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাড়ির সামনে এসে দেখেন তার ধারণা ভুল। দরজা বন্ধ। ব্যাংক-এ পাশবই আপ ডেট করতে গিয়ে দেখেন পাশবইটা সঙ্গে আনা হয়নি। এসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেরটা একেবারে সাংঘাতিক ভুল। কথায় বলে ভুলের মাশুল। কড়ায় গণ্ডায় একেবারে বারো হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। এরপর চলবে জলকষ্ট। তাঁদের চার-পাঁচটা বাড়ির পরে থাকেন মোহিত দাস। তিনি কিছুদিন করোনা রোগের শিকার হয়েছিলেন। যমে-মানুষে টানাটানি করে বাড়ি এলেন কিন্তু ব্রেন-এর অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উলটোপালটা বকেন। মোহিতবাবু-র একমাত্র মেয়ে বিদেশে। আয়া-নির্ভর জীবন। আয়ার চড়-চাপট খেয়ে জীবন কাটে। সেই মোহিত দাসের বাড়িতে কিছুদিন আগে পুলিশ এল। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় থাকার সুবাদে মোহিত দাসের সঙ্গে অমিত সেনের ভালোই সখ্যতা আছে। আজকাল অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। অভিযোগ মারাত্মক। মহিলার শ্লীলতাহানি।

আশেপাশের বাড়ি থেকে গুঞ্জন উঠল, তাহলে কি আয়ার সঙ্গে! এই বয়েসে! ছিঃ ছিঃ ইত্যাদি। পরের ঘরের কুৎসা পেয়ে যে যত পারে বেলুন ফোলাতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এইসব ঘটনাকে মোহিতবাবুর সাময়িক যৌন উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আখ্যায়িত করল। অমিতবাবুর এইসব ন্যাস্টি কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগল না। তিনি নিজে মোহিতবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ব্যাপারটা অন্য। এক্কেবারে রোমান্টিক।

অয়ন দাস তাঁর স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে মোহিতবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে চুরি করতে চোরেদের এখানে খুব মজা। এখন অবশ্য এসব ঘটনা শোনা যায় না। তবে উঁকি ঝুঁকি মারলে প্রতিবেশীর বেডরুমে চোখ পৌঁছে যায়। সেই চোখই হয়েছে ভিলেন।

মোহিতবাবু নাকি প্রায়শই অয়নবাবুর বাড়িতে উকিঝুঁকি মারেন। মনিকাকে নাম ধরে ডাকেন। বয়সে বড়ো, তাছাড়া ভুলো মনের মানুষ এইসব ভেবে অয়ন বা মনিকা খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু শেষ কয়দিন মোহিবাবুর মাথার ব্যামো একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রায়ই কলতলায় যাওয়ার সময় জানলার ফাঁক দিয়ে ‘মনিকা, মনিকা’ বলে হাঁক পেড়ে চলে যান। এতেও ঠিক ছিল। তিন দিন আগে দু’তিনবার, ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’ সুর ভেঁজেছেন। ব্যস আর যায় কোথায়! রাহুল দেব বর্মনের এই কীর্তিকে একেবারে খাটো করে দেখতে রাজি নন তারা। একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বেন। তাই সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অয়ন-রা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। পুলিশ যদি বুড়োকে একটু আচ্ছা করে কড়কে দেয়।

পাঁচতলা থানার ওসি রামদাস মণ্ডল একজন রসিক এবং সমপরিমাণ বদমেজাজি ব্যক্তি। নিজে মাঝেমধ্যে পাড়ার গজিয়ে ওঠা শখের থিয়েটারে ছোটোখাটো পার্ট করে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন। খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করেন বলে পুলিশমহলে বেশ ওজনদার। রামদাস ওসি যখন মোহিত বাবুর কাঁটাপুকুরের বাড়িতে এলেন, তখন অমিতবাবু একটু অবাকই হলেন। সিনেমার শুটিং-এর মতো ক্যামেরার পরিবর্তে হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে চোখের সামনে এনে বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে মোহিত বাবুকে মাপতে লাগলেন। হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। তার কথা শুনে মোহিতবাবু দেঁতো হাসি হাসলেন। অমিতবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ক্রমশ…

 

 

জোড়া শালিক (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

একবার সুশীলা এবং সুনীল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছে। সুনীলের বাইকের পিছনে সুশীলা বসল। হঠাৎ করে ব্যাংকের দরজার বাইরে পেয়ারা গাছেতে জোড়া শালিকের একটি ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য শালিকটাও কাঁই কাঁই করে উঠল। সুনীল তখন সবে বাইক স্টার্ট দিয়েছে। গাছটা ওদের ঠিক ডান পাশে। ভালো করে দেখার জন্য সুশীলা ‘রুকিয়ে জি’ বলে লাফিয়ে নেমে পড়ল বাইক থেকে। কান হেলমেটে ঢাকা থাকাতে সুনীল কিছুই শুনতে পায়নি। বাইক ব্যাংকের পরিসর থেকে বেরিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল।

জোড়া শালিকে মাথা ঠোকা শেষ হলে সুশীলা সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখল সুনীল ও বাইক দুটোই ধারে কাছে নেই। এদিকে অনেকটা যাওয়ার পর সুনীল অনুভব করল পিছনটা বেশ হালকা লাগছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে বউ নেই। দুশ্চিন্তায় বাইক ঘোরাল ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকে পৌঁছে অবাক, সুশীলা সেখানে নেই! সুনীলের সঙ্গে আসবে বলে সুশীলা ফোনটাও আনেনি। কী করবে ভাবছে, এমন সময়, গেটের বাইরে বসে থাকা মুচিটা বলল, ‘সাব কিসিকো ঢুঁঢ রহা হ্যায় ক্যায়া?’

সুনীল বলল, ‘মেরি পত্নি কুছ দের পহলে এহি থি, কহা চল দি পতা নহি, ফোন ভি নহি হ্যায় উনকি পাস।’

—এক মেডামজি থোড়া পরিশান দিখ রহি থি। ও তো পয়দল চল দিয়ে।

সুনীল আর্তস্বরে বলল, “কিধার চল দিয়ে, দেখা আপনে?’

—জি সাহাব বাঁয়ে তরফ গয়ি, জবাব দিল মুচি।

এবার প্রমাদ গুনল সুনীল, উলটো দিকে হাঁটা দিয়েছে সুশীলা। বাইক ঘোরাল ডান দিকে। কিছুটা এগোতেই দেখা পেল সুশীলার। ও হেঁটেই বাড়ি যাবে, কিছুতেই সুনীলের বাইকে চড়বে না। অনেকবার সরি বলার পরেও মানতে নারাজ। অগত্যা সুনীল বলল, ‘মগর হামারা ঘর দুসরা তরফ হ্যায়, রাস্তাপে খো যাওগি।’ এবার ভয় পেয়ে গেল সুশীলা, ফিরে এসে বাইকে বসল।

এহেন সুশীলাদেবীর ঝোলা বারান্দার সামনে কবিতাদেবীর বারান্দা। কবিতাদেবী এবং ওনার স্বামী দুবেজি ধার্মিক প্রকৃতির। দুবেজি সকালবেলায় স্নান করে সূর্য প্রণাম করেন। এরকম একদিন, দুবেজি যখন সূর্য প্রণাম সারছেন, সেই সময় এক জোড়া শালিক কচর কচর করতে করতে দুবেজির বারান্দার মাথার উপর কার্নিশে এসে বসল। জোড়া শালিকের কচকচানি শুনে সুশীলা দৌড়ে এসে দরজা খুলে জোড়া শালিক সকাল সকাল দেখে আনন্দে আত্মহারা। ভাবাবেগে পরের পর ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল।

ভগবান বন্দনায় মত্ত দুবেজি পরপর চুমু ছুড়ে দেওয়ার আওয়াজ শুনে চোখ খুলে দেখেন, সুশীলা দেবী চোখ বুজে ক্রমাগত চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন তার দিকে। বয়সে অনেকটা ছোটো সুশীলা ওনার থেকে। দুবেজির স্ত্রী রীতিমতো দাপুটে। ভগবানবন্দনা অসম্পূর্ণ রেখে বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে ভিতরে চলে গেলেন দুবেজি! সংবিৎ ফিরে এল সুশীলার, এবার খেয়াল হল তির ভুল জায়গায় বিঁধেছে!

চুমুর আওতায় শালিক ছাড়া দুবেজিও ছিলেন। শালিক-চুম্মা দুবেজি-চুম্মাতে পরিণত হয়েছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম। দুবেজিও চাচা নিজের প্রাণ বাঁচা, ঝুল বারান্দায় আসাই বন্ধ করে দিলেন। সুশীলা অনুশোচনায় দগ্ধ। এ কি কাণ্ড হল! ছেলে বড়ো হয়ে গেছে, পাঁচকান হলে আর রক্ষে নেই। বাধ্য হয়ে স্বামী সুনীলকে বলল কিছু একটা করতে।

সুনীল সাফ জানাল, ‘হামসে কুঁছো না হতোই। ই তোহার লাফরা, হম না পরবু।’

এমত অবস্থায় একদিন নীচে মন্দিরে যেতে গিয়ে সামনে পেলেন দুবেজি পত্নি কবিতাজিকে। হিম্মত করে বলেই ফেললেন সমস্ত ঘটনা। সব শুনে কবিতাজি বললেন, ‘ছোড়িয়ে আপ ময়না কো দিয়ে, ক্যায়া দুবেজি কো দিয়ে — ম্যায় ক্যায়া জানু। ঔরতকো সমাহালকে রহনা চাহিয়ে। হমলোগ হ্যায় সজ্জন ব্রাহ্মণ।’ বলে গটগট করে চলে গেলেন কবিতা।

সুশীলার মাথায় হাত— এবার বোধহয় পাড়ায় ঢিঢি পড়তে আর খুব বেশি দেরি হবে না!

 

দুর্গা (পর্ব – ১)

দুর্গার কথা মতো শুভায়ু নিমপাতা দাঁতে কেটে চিনি মুখে দিয়ে বারান্দার এককোণে গিয়ে কুশাসন পেতে বসল। শুভায়ু একটু আগে ভাবছিল শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরার পর শ্মশানযাত্রীদের মুখে কে একটু চিনি জল দেবে। কে তাদের যত্ন করে দাওয়ায় বসাবে। দিদিটাও যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তার কোনও চিন্তা ছিল না।

বাসুলডাঙ্গা গ্রামে দিদির যখন বিয়ে হয়, তখন সে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ছাত্র। বাবা বেশ ধুমধাম করেই দিদির বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কপাল পুড়ল। ছেলেপুলে না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে লাগল। শুধু তার খাওয়া বন্ধ নয়, বাঁজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ বলে শাশুড়ির অকথ্য গঞ্জনাও চলতে লাগল।

শ্বশুরবাড়ির অনাচার আর অবহেলা পেয়ে দিদি যখন মনের দুঃখে বাপের বাড়ি ফিরে এল, তখন শুভায়ু দেখল দিদি নয়, যেন তার কঙ্কালসার দেহটা ফিরে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বছর খানেক বেঁচেছিল। তারপর একদিন দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সব দুঃখ আঁচলে বেঁধে পরপারে পাড়ি দিয়েছিল।

শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির নিন্দেমন্দ করলেও বাসুলডাঙা গ্রামের লোকজন দিদিকে দেবীর আসনে বসিয়েছিল। তারা এখনও বলে সতীলক্ষ্মী এরকম মেয়ে আর হয় না। গ্রামের কারও বিপদ-আপদ হলে দিদি যেন তখন দশভুজা হয়ে তাদের সেবা করত। সাধে কি আর বাসুলডাঙা গ্রামের লোকেরা তাকে দেবী বলে। আজ মায়ের শব দাহ করে এসে শুভায়ুর দিদির কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে।

—এই চা-টুকু খেয়ে নাও। শরীরের ধকলটা একটু কমবে, বলে দুর্গা চায়ের প্লেটটা শুভায়ুর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে উঠোনে নেমে গেল।

দুর্গা যে কখন স্টোভ ধরিয়ে চা করেছে, কখন শ্মশানযাত্রীদের হাতে মিষ্টি তুলে দিয়েছে— শুভায়ু জানতেই পারেনি। জানতে পারল তখন, যখন সে দেখল শ্মশানবন্ধুরা একে একে যে-যার বাড়ি চলে গেছে। শুধু বারান্দার একধারে শোভন হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চায়ের কাপে সে চুমুক দেয়নি। তার বিষণ্ণ চোখের দৃষ্টি এখন উঠোনে উড়ে এসে বসা শালিখ পাখির দিকে, না কাপ-ডিশ ধোয়ায় ব্যস্ত দুর্গার পদতলে, বোঝা মুশকিল।

একটু পর দুর্গা হাতের কাজ সেরে এসে বলল, ‘কী হল শোভনদা চা যে জুড়িয়ে গেল।’

শোভন তাড়াতাড়ি এক চুমুকে চা-টুকু খেয়ে দুর্গার উদ্দেশে বলল, “তুমি শুভায়ুর জন্য হবিষ্যির ব্যবস্থা করো। আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি।’

দুর্গা বলল, “দিদিকে বোলো সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। আমি একটু পরেই যাচ্ছি।

—আসি রে, বলে শোভন, শুভায়ুর উদ্দেশে হাত নেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

—চা-টা খেয়ে নাও। চা খেলে মাসিমার আত্মা মোটেও কষ্ট পাবে না। বলে দরজার কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল দুর্গা। শুভায়ু চোখ তুলে দেখল, দুর্গার কথা বলার ধরন, তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, এমনকী কাজলকালো টানা চোখের দৃষ্টিটাও ঠিক সাত বছর আগেকার মতো। যা কিছু পরিবর্তন ওর হয়েছে, তা হল কপালের সিঁদুর আর তার পলা বাঁধানো শাঁখা – যাকে বলে এয়োস্ত্রীর চিহ্ন। শোকের দিনেও দুর্গার চিবুকের তিলটার দিকে তাকিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর পুষে রাখা পুরোনো ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। পৃথিবীর কোনও ওষুধেই এ ক্ষত সারবে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে ঠিক পেসমেকারের মতো।

—কী হল, চা খেলে না? দুর্গার সেই পিয়ানোর সুর বেজে ওঠা কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল। যে-কণ্ঠস্বর শুনলে এখনও একরাশ কান্না গুমরে গুমরে ওঠে শুভায়ুর পোড়খাওয়া বুকের মধ্যে। এর জন্য দায়ী তার বন্ধু শোভন।

ক্রমশ…

 

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-২)

পর্ব ২

বড়োবাবু বুঝতে পারলেই চিৎকার করে, ‘দূর হ, এখন আর কাজ হবে না, হয় সব খসিয়ে আয়, না হলে ভাগ।’ ফুলমণিদের সবেই জ্বালা। এমনিতেই মাসে মাসে আরেকটা জ্বালা আসে, কয়েকটা দিন পেটে ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, সারাটা শরীরে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই ম্যাদা মেরে যায়। তখন কাজ করতে হাঁপ ধরে, মাঝে মাঝেই আড়াল খুঁজতে হয়।

কথাগুলো তাঁবুতে প্রথম দিকে টুনটুনির মা বলেছিল, সেই সঙ্গে বড়োবাবুর থেকে সাবধানে থাকতে বলে। ফুলমণি নিজেও বড়োবাবুর চোখে সব সময়ের খিদে দেখছে। ফুলমণিরা শাড়ি বা সালোয়ার যাই পরুক তার উপর একটা জামাও পরে। তাও কাজ করবার ফাঁকে জামা সরে যায়, পোশাকের বাঁধন আলগা হয়, বড়োবাবু তখনই শকুন হয়ে ওঠে।

ফুলমণি নিজেও দেখেছে, গোবরার বউ কয়েকদিন আগে তার কোলের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। বড়োবাবু মুখে একটা বিড়ি ভরে চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছিল মায়ের আদর, ভালোবাসা। গোবরার বউয়ের সেদিন কোনও উপায় ছিল না।

টুনটুনিও কাজ করত। কাজ করবার সময়েই বিয়ে হল, এখন কোনও নজর নাই। একবার টুনটুনি আর ফুলমণির একই সময়ে রক্তপাত আরম্ভ হল। টুনটুনি বয়সে অনেক ছোটো ছিল, তাও মেয়ে তো। কাজ করবার মাঝে বারবার আড়াল খুঁজতে গেলে বড়োবাবু ঝাঁঝি মেরে ওঠেন, ‘তুরা গেদে কামচোর, একটু ঝাঁট দিচ্ছিস আর পালাচ্ছিস।’

—উয়ারা এমনি পালাচ্ছে নাকি গো। তোমার ঘরে বিটিছিলা নাই! জানো না, কি বটে?

সেদিন অবশ্য বড়োবাবু সবার মাঝে হেসে উঠেছিল, ‘তুদের আবার লজ্জা?’

খেপে উঠেছিল টুনটুনির মা, ‘কেন গো বাবু, তুমার ঘরের মেয়েদের শরীর-ট শরীর, লাজলজ্জা সব তুমাদের, আমাদের নাই।’

—তুর কিন্তু খুব কথা হয়েছে। লাথ মেরে তাড়িয়ে দিলে বুঝবি।

আর কোনও কথা বলেনি টুনটুনির মা। সেদিনই রাতে রান্না করবার সময় ফুলমণিদের মাঝে বসে কথাগুলো বলে। ফুলমণি কোনও দিন তার মাকে কাঁদতে দেখেনি। চরম কষ্টের দিনেও শুকনো চোখে খেটে গেছে। গোবর কুড়িয়েছে, ঘুঁটে দিয়েছে, সেই ঘুঁটে মাথায় করে বিক্রি করেছে, রাতে বরের হাতে মার খেয়েছে, মারামারি করেছে, চিল্লিয়েছে। টুনটুনির মাকে কাঁদতে না দেখলেও চোখমুখে একটা চাপা ভয় দেখতে পেয়েছে।

ফুলমণি লম্ফের আলোটা একটু বাড়ায়। ভাতের মধ্যে কয়েকটা আলু আর দুটো ডিম ফেলে দেয়। আর বেশি কিছু করতে ভালো লাগছে না। লোকটার মুখে আবার খারাপ কিছু রোচে না, খিস্তি করে, মারতে যায়। আগে লোকটা এমন ছিল না। যে-রাতে বড়ো তাঁবুতে ফুলমণির পাশে মোটা বউয়ের বরটা ফুলমণির শরীর ছুঁয়ে নিজের আমিত্ব ফলাতে গেছিল তারপরের দিন সকালে উঠেই হারু লোকাটাকে খুব পেটায়। বড়োবাবুর কাছে খবর চলে যায়।

মোটাবউ ও তার বর দু’জনেই বড়োবাবুর পেয়ারের লোক ছিল। সবাই জানত নিজের শরীরের গন্ধ শুঁকিয়ে মোটা বউ বড়োবাবুর হকের মেয়েমানুষ হয়ে উঠেছে। সারাদিন কোনও কাজ না করে বসে থাকলেও তাকে কিছু বলে না, বরং ফুরসত পেলেই দু’জনে গল্প করে। বড়োবাবু একটা ক্লাব ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকে। মোটাবউ সকালে রাতে সেখানে রান্না করতে যায়।

—রান্না করে হাতি, ও যায় ধান্দা করতে। কথাগুলো হাবুলের বউ একদিন বলে।

ফুলমণি তখন এই কাজে নতুন এসেছে। কথা বললেও খুব বেশি মাখামাখি করে না। পরের দিনের ঝামেলার জন্যে দু’জনেরই কাজ চলে যেত, পোঁটলা গুটিয়ে চলে যেতে হতো। কিন্তু বড়োবাবুর হাত পা ধরে সে যাত্রায় কোনওরকমে কাজটা বাঁচলেও অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়, বড়োবাবুও সেখানে যাবে। হারু ও ফুলমণিকে আবার নিজেদের খরচে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নতুন জায়গায় যেতে হয়।

হারুর বাবাও রাস্তা তৈরি করবার কাজ করত। ছোটো বয়সে মা মারা যাবার পর হারুও বাবার সাথে ছোটো থেকেই এই রাস্তা তৈরি করবার কাজে ঢুকে যায়। দু’জনের রোজগারে ভালোই চলছিল। বাবা ফুলমণির সাথে বিয়ের দেখাশোনাটাও করে গেছিল, তারপর হারুর বিয়ের আগেই একদিন রাস্তা তৈরি করবার সময় রোলার গাড়ির নীচে পড়ে এক্কেবারে মাটির সাথে মিশে যায়। কয়েক বছর সব চুপচাপ থাকবার পরেই ফুলমণির বাড়ি থেকে আবার হারুর সাথে যোগাযোগ করে, তাদের বিয়ে হয়। কন্ট্রাকটর কিছু টাকা দিয়েছিল, সেই টাকাতেই বিয়ের খরচ মেটে।

বিয়ে হলেও সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। হারুর তো বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ। গ্রামে বাবার একটা ঘর থাকলেও সেখানে আর কেউ থাকে না। হারুর জীবনও এই তাঁবুর ভেতরেই কাটতে আরম্ভ হয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করা বউ তো আর সেভাবে থাকবে না। কথাগুলো তার তাঁবুর বাকি লোকদের সাথে আলোচনা করলে তারা বেশ মজা করেই বলে, “আরে বাবা, তুই বিয়ে করবি এটা তো ভালো কথা। এখানে অনেকেই বউ নিয়েই থাকে। তোরা যখন থাকবি আমরা না হয় চোখদুটো বন্ধ করে রাখব।”

হারু হেসে ওঠে। তাদের বিয়ে হয়, কন্ট্রাকটর কয়েকদিন ছুটিও দেয়, ফুলমণির বাড়িতেই তাদের ফুলশয্যা হয়। কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও বসে বসে কেউ আজীবন মুখে ভাত দেবে না। হারু ফুলমণি দু’জনই কাজে ঢুকে যায়। কাজ বলে কাজ— পিচ গরম, রাস্তা খোঁড়া, ধুলো বালি পরিষ্কার করা, পাথর বিছিয়ে সমান করা, দু’পায়ে চিকচিকি বেঁধে পিচ ফেলা, বালি দেওয়া, কাজের আর শেষ নাই।

ফুলমণির প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। বিয়ের কয়েকদিন পর হারু কোনও পিচের রাস্তার উপর দিয়ে যাবার সময় বলে উঠত, “এই দ্যাখ এই রাস্তাটা আমরা করেছি।’ তারপরেই রাস্তা তৈরি করবার গল্প করত। তখন ফুলমণি অবাক হয়ে শুনলেও কাজ করতে এসে বোঝে, সব গল্প গল্প হয় না!

ক্রমশ…

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-১)

তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে ফুলমণি আকাশের দিকে চোখ রেখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এই দিকটাতে আলো নেই, চারদিকের অন্ধকার মেঘের জন্যে আরও গুমোট, তাঁবুর ভিতরেও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পাশে মেয়েদের তাঁবুটাতেও রান্না চেপেছে, কারওর মোবাইলে গান বাজছে। ছেলেদের তাঁবুতে এই সময় এক-দু’জন বাদে কেউ থাকে না, ওরা রান্না করে না, মেয়েদের তাঁবুতেই রান্না করা হয় — সবাই তো বউ-বর বা মা-ছেলে।

মেয়েদের একটা তাঁবু, আর ছেলেদের আলাদা একটা। শুধু ফুলমণিরাই আলাদা থাকে। তাঁবুটা ওদের টাকাতেই তৈরি করা। ফুলমণি দেখে একটু দূরের চায়ের দোকানটা এখনও খোলা আছে। বেশ কয়েকবার ওই দোকানে পাউরুটি কিনতে গেছে। ঘরের মানুষটার মতিগতি সব সময় ভালো থাকে না। মাঝে মাঝে ফুলমণির মনে হয় সকাল আর রাতে দু’জন আলাদা লোকের সাথে ঘর করে! পেটে জল পড়লেই হয়ে গেল, কতদিন ভাতের হাঁড়ি উলটে দিয়েছে, তখনই দোকানে খাবার কিনতে যেতে হয়।

চায়ের দোকানটাতে গিয়ে অনেকবার কথাও বলেছে। দেখে খুব মায়া হয়! লোকটার বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়ে কেউ দ্যাখে না। বউটাও অসুস্থ। দোকানের পিছনেই একটা ছোটো জায়গায় ওরা দু’জন থাকে। বউটা ওখানেই শুয়ে থাকে। ফুলমণি একবার দোকানের লোকটাকে, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করেছিল।

লোকটা কেমন ভাবে বলে উঠেছিল, ‘আর কী হয়েছে! বেঁচে আছে এই…’

বউটা চোখ ঘুরিয়ে ফুলমণিকে দেখেছিল। তারপর থেকে ফুলমণি দোকানে গেলেই বউটাকে দেখে। বুঝতে পারে ভালো ঘরের মেয়ে, রোগে ভুগলেও গায়ের রং এখনও বেশ চকচকে। কয়েকদিন আগে দোকানিটা অন্য আরেকজন খদ্দেরকে বলছিল, “আর ক’দিন থাকতে দেবে কে জানে? শুনলাম সেন গুমটির কাছে সব দোকান ভেঙে দিয়েছে, আমাদের এদিকটাও ভাঙবে।” ফুলমণি কথাগুলো শুনে নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দোকান ভেঙে দেবে, কেন?’

লোকটা ফুলমণির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘এই যে তোমরা রাস্তা তৈরি করছ।’

মনটা খারাপ হয়ে যায়, কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না! হারুকে বললেই এক্ষুনি খেঁকিয়ে উঠবে। সে নিজে এই কয়েক বছরে অনেক জায়গায় রাস্তা তৈরি করতে গেছে। দেখেওছে কীভাবে রাস্তা তৈরি করবার আগে কত জায়গার দু’দিকের ঘরবাড়ি দোকানঘর ভেঙে দেয়। এখানেও প্রথম দিকে কয়েকটা দোকানঘর ভেঙেছিল।

ফুলমণির এসব দেখে কষ্ট হয়, একবার ঝড়ে ওদের নিজেদের গোয়ালঘর ভেঙে গেছিল। দু’টো গরু সারাটা রাত ভিজেছিল। এদিকেও রাস্তা একদিকে তৈরি হয়, আরেক দিকে গাড়ি চলে। রাস্তা হয়ে গেলে এখন আবার পাথর বসায়, একটা কী যেন নাম আছে। ফুলমণিদের অবশ্য তখন ডাকে না।

একটু আগেই ও পুকুরে স্নান করে এসেছে। পুকুরটা একটু দূরে, তাও সন্ধেবেলাতেও সবাই মিলে স্নান করতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হয় না। প্রতিদিন দু’বার করে স্নান করবার জন্যে প্রথম দিকে ঠান্ডা লাগত। এখন সবকিছু কেমন যেন সয়ে গেছে।

—কি রে ফুলু, আজ কী করবি, আটা খাবি, নাকি ভাত চাপাবি?

—আটা খেতে লারি, গলা দিয়ে নামতেই খুঁজে না, গেল হপ্তাতে কয়েকদিন আটা খেয়িছিলম, হাগা আর বাগাতে লারি, ক’টা ভাতই ভালো, তুমি কী করছ?

—আমার তো একার কথাতে কিছু হবেক নাই, সবাই রুটি সেঁকছে। ভাত কালকের লগে, পান্তা করবেক।

কথাগুলো বলে লোকটি এগিয়ে গেলেও পিছন থেকে ফুলমণি ডাকে, ‘ও, খুড়ো, বড়োবাবুর কী খবর, এখনও টাকা দিলেক নাই।’ খুড়ো একটা শ্বাস ছাড়ে। হাওয়ার শব্দ ফুলমণির কান দিয়ে মাথার ভেতরে পৌঁছে যায়।

—সেই তো, গেল হপ্তা থেকে পাঁয়তারা কষছে। হারু কই?

—সাঁঝের ব্যালা কুথাকে থাকে?

খুড়ো আর কথা না বলে একপা একপা করে নিজের তাঁবুর দিকে যায়। খুড়োর বয়স হয়েছে, এখন একটু বেশি কাজ করলেই হাঁপায়। কয়েকদিন আগেও মাটি কুপাত, মাথায় করে গরম পিচ মেশাত, পাথর ফেলত। এখন শুধু রোলার গাড়িটার সামনে ভিজে বস্তা ধরে আর বাকি টুকটাক কিছু কাজ করে।

ফুলমণি খুড়োর সাথে কথা শেষ করেই নিজের তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। এইবেলা ভাতটা করে নিলে অনেকটাই ফের কাটে। ফুলমণিরা আগে একটা তাঁবুতেই থাকত, তখন এই ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে ছিল না। মরদগুলো সারাটা দিন জানোয়ারের মতো খাটত। কাজ শেষ হলে কয়েকজন পিচ গলানোর কাজ করলেও বাকিরা চলে যেত। রাত বাড়লে টলতে টলতে তাঁবুতে ফিরত। যারা পিচ গলাত তারাও যে গিলত না সেটা নয়, তাও ওদের সব কিছু বাঁচিয়ে করতে হতো।

এই দলে কম বয়সি মেয়েছেলেগুলোও মদ মারে। না হলে ওদের শরীর কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে যায়, তারা কেউ বাইরে যায় না। ফুলমণি প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখত। টানা পাঁচদিন কাজের পর একদিন ছুটি থাকত, সেদিনের জন্যে তারা টাকা না পেলেও সবাই সন্ধেবেলা তাঁবুর ভেতরে বসে যেত, সামনের কোনও দোকানে ঝাল ঝাল করে চপ বা অন্যকিছু ভাজাত তারপর…

ফুলমণির লোকটার অবশ্য এইসব পোষাত না। দোকানে না গেলে তার নেশা জমত না। ফুলমণিরও খুব সাধ হতো, ছুটির বেলায় সবার সাথে বসে একটু মজা করবে। কিন্তু সেই সময় পেটে শত্রু চলে আসত। এটাই ফুলমণির সব থেকে অসুবিধার। শত্রু আসত, কয়েকটা মাস পেটেই বড়ো হতো, তারপর পেটের ভেতরেই মরে যেত। ফুলমণির সেই সময় খুব রক্তপাত হতো। কয়েকদিন তাঁবুর ভেতরেই শুয়ে থাকতে হতো। কাজ করতে পারত না। এটাই ঝামেলার, শত্রু এলে আর ভালো কাজ হয় না।

ক্রমশ…

 

 

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (শেষ পর্ব)

সামন্তকের মুখের সবকটা বাতি নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। কোনও রকমে আমতা আমতা করে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি এসবের কিছুই জানতাম না।”

জানার কথাও নয়। আপনার কাকুর মতো ক্রিমিনালরা সকলকে অন্ধকারে রেখেই নিজেদের কাজ হাসিল করেন। রাগ-অভিমান এসবের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন এখন মাসিমণি। তাই সবকিছু জেনেও আপনার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানালেন না আর। শুধু এই টাকাটা দিলেন, রোগশয্যায় থাকা গুরুর প্রতি একজন শিষ্যার দক্ষিণা হিসেবে।

তন্দ্রার এগিয়ে দেওয়া খামটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়ে নিল স্যমন্তক। মুখে বলল, ‘আপনি না বললে এসব কথা হয়তো জানাই হতো না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমার।’

—মাসিমণি এই কথাগুলো কাউকে বলেন না। আপনাকেও হয়তো বলতেন না। কিন্তু আমি দিনের পর দিন একজন মানুষকে কষ্ট পেতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই না পেরে বলে দিলাম। দয়া করে স্নেহাংশু সরকারকে এই বাড়ির ঠিকানা জানাবেন না।

আর আমি? আমাকেও কি আসতে বারণ করছেন আপনি? তন্দ্রার চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল স্যমন্তক।

ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি লেগে আছে তার। গলার স্বরটাও কেমন যেন আবেগমাখা! নিরুত্তর তন্দ্রা তাকিয়ে আছে অপলক। দমকা হাওয়ায় মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে অজস্র হলুদ রঙের ফুল।

প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে লাস্ট বাসটা ধরল স্যমন্তক। ভাগ্যক্রমে একদম শেষের জানালার ধারের সিটটা পেয়ে গেল বসার জন্যে। ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল একটা। বাসটা চলতে শুরু করেছে। জানলা দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা জোলো বাতাস। পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে মুখটা সামান্য খুলল। একবার চোখ বুলিয়ে নিল কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোটগুলোর ওপর। হাজার দশেক আছে মনে হয়। আপাতত চলে যাবে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল স্নেহাংশু সরকারকে। পরলোকে যাবার আগে একটা মোক্ষম পয়সা কামানোর উপায় বাতলে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

স্যমন্তককে মধুরিমার কাছে যাবার কথা বলেই চোখ বুজেছিলেন স্নেহাংশু। কী একটা ভেবে স্যমন্তকও লুফে নিয়েছিল কাকুর অন্তিম ইচ্ছেটা। ভগ্যিস নিয়েছিল। ব্যাবসাপাতির এই মন্দার বাজারে এখন মাঝে মাঝেই তাঁর নাম করে বেশ কিছু মালকড়ি হাতানো যাবে ভালো মানুষ মধুরিমার কাছ থেকে।

স্যমন্তকের জীবনে মেঘ না চাইতেই জল হিসেবে এসেছেন মধুরিমা, একসময়ের নামজাদা গায়িকা। অনেক টাকার মালিক। বছর বছর রয়্যালটি হিসেবেই ব্যাংক-এ জমে গাদা গাদা টাকা। স্নেহাংশুর সঙ্গে মধুরিমার আইনত বিচ্ছেদ হয়নি। তাই হিসেব মতো স্যমন্তকই এখন তাঁর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধিকারি।

এতদিন মৃত মেয়েকে শিখণ্ডী বানিয়ে টাকা নিয়ে এসেছেন স্নেহাংশু। এবার পালা স্যমন্তকের। ফুসফুসের জটিল রোগে ধুঁকে ধুঁকে ইহলোক ত্যাগ করা কাকুর মিথ্যে অসুখের ফিরিস্তি দিয়ে যতদিন পারা যায় টানবে আর এর মধ্যে যদি পটিয়ে ফেলতে পারে মধুরিমার পালিত কন্যা তন্দ্রাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তন্দ্রার বিহ্বল চাহনি আশা জাগাচ্ছে স্যমন্তকের মনে। তার ফেলা টোপটা বোধহয় বৃথা যায়নি। আইসিইউতে চলে যাওয়া বাবার ব্যাবসাটাকে এবার একটু একটু করে সারিয়ে তুলবে সে। সাদা খামটায় আলতো করে চুমু খেয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল স্যমন্তক।

বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে। হু হু হাওয়া এসে ঝাপটা মারছে মুখে। প্রসন্ন চিত্তে সিটের ব্যাকরেস্টে শরীর এলিয়ে দিয়েছে স্যমন্তক। মধুরিমার বিক্রি হওয়া বাংলোর দাম, বর্তমান বাড়ির ভ্যালুয়েশন, বছর বছর জমতে থাকা গানের রয়্যালটি এসবের একটা আনুমানিক হিসেব মনে মনে কষে চলেছে সে।

আধো ঘুম আধো চেতনার ঘোরেই চোখের সামনে একবার ভেসে উঠছে অনেক অনেক টাকা আর একবার তন্দ্রার মুখ। হঠাৎ পথ চলতে চলতে কোনও দামি জিনিস কুড়িয়ে পেলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমনই একটা খুশি চলকে উঠছে স্যমন্তকের মনে।

জীবনের এবড়োখেবড়ো পথে চলতে চলতে সেও যেন আচমকাই একটা স্বপ্ন কুড়িয়ে পেয়েছে। জোর করে চোখ বুজে থাকে স্যমন্তক ফিরে ফিরে দেখতে চায় স্বপ্নটাকে…।

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ৪)

পুরোনো কথা শোনার আগ্রহ স্যমন্তকের তেমন ছিল না। অস্থিরতা বাড়ছিল। সাড়ে চারটের বাসটা না ধরতে পারলে কেস খেতে হবে। তাই ব্যস্ত হয়ে বলল, “এবার আমায় উঠতে হবে ছোটোমা। সাড়ে চারটেতে লাস্ট বাস।’

—হ্যাঁ, তাই তো। গল্পে গল্পে সময়ের খেয়াল ছিল না। তোমাকে এ্যদ্দিন বাদে দেখে সমস্ত পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। তুমি আর একটু বসো, কেমন। তন্দ্রা একবারটি ভেতরে আয় তো।

যাবার আগে স্যমন্তকের মাথায় হাত রেখে মধুরিমা আরও একবার উচ্চারণ করলেন ওম শান্তি। স্যমন্তকও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল তার ছোটোমাকে। তন্দ্রা মধুরিমাকে অনুসরণ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর আবার ফিরেও এল কয়েক মিনিটের মধ্যে। হাতে একটা সাদা খাম।

—চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।

কথাটা বলেই চলে গেল দরজার দিকে। পায়ে গলিয়ে নিল চামড়ার জুতো। তারপর স্যমন্তককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে। কয়েক মিনিট চুপচাপ হাঁটার পর স্যমন্তক বলল, ‘আপনি যে আমার সঙ্গে এসেছেন সে কথা ছোটোমা জানেন?”

—নাহ। উনি এখন মেডিটেশনে বসেছেন। কোনও দিকে মন দেবেন না। তাই চলে এলাম আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে। —যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন করব?

—করুন।

—কাকু না হয় অন্যায় করেছেন ছোটোমার সঙ্গে। কিন্তু মিতিন? সে তো তাঁর সন্তান। তাহলে মিতিনের প্রতি এতটা উদাসীন কীভাবে হয়ে গেলেন ছোটোমা? বিষয়টা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকল।

ধীর গতিতে হাঁটছিল ওরা। এবার থেমে গেল তন্দ্রা। পথে লোকজন বিশেষ নেই। সকালে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ এখনও মেঘলা। রাস্তার পাশের রাধাচূড়া গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে স্যমন্তকের দিকে তাকাল সে। বলল, “আপনি আপনার কাকু আর ছোটোমা সম্পর্কে কতটা জানেন স্যমন্তক?’

—না মানে তেমন কিছুই আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বললাম না আপনাকে কাকু সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাকু ফিরে আসায় একটু আধটু জেনেছি। ইতস্তত করে উত্তর দিল স্যমন্তক।

—একটু আধটু নয়, আপনি আসলে কিছুই জানেন না। আপনার কাকু মানে স্নেহাংশু সরকার আপনাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে থাকা শুরু করেছিলেন মিতিনকে নিয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি হানা দিতেন মাসিমণির বাসায় আর নানা বাহানায় টাকা নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় টাকা চাওয়ার কারণটা হতো মিতিন। মাসিমণি অনেক খোঁজখবর করে তার আস্তানার হদিশ বের করেছিল দু’একবার কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা পাওয়া যেত না কারওর। প্রত্যেকবার টাকা নিয়ে যাবার পর নিজের ঠিকানা বদলাতেন স্নেহাংশু। আত্মীয়স্বজনদের মুখে শুনেছি মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্যে পাগলের মতো করতেন মাসিমণি। কিন্তু আপনার কাকু কোনওদিনও সে সুযোগ দেননি মাসিমণিকে। শুধু দিনের পর দিন হাত পেতে টাকাই নিয়ে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন মাসিমণি। কমিয়ে দিয়েছিলেন গান গাওয়া।

—এসব কথা তো আমি…

—এখানেই শেষ নয় স্যমন্তক। গল্প আরও আছে। মাসিমণির সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম হাওড়ায় এক কনসার্টে। সেখানে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় পাপিয়ামাসির সঙ্গে। পাপিয়ামাসি মাসিমণির ছোটোবেলার সঙ্গী। একসঙ্গে গান শিখতেন স্নেহাংশু সরকারের কাছে। তিনি কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের নার্স। তাঁর মুখ থেকেই মাসিমণি শুনেছিলেন সেই চরম সত্যিটা যেটা দিনের পর দিন আপনার কাকু লুকিয়ে রেখেছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে।

—চরম সত্যি? সেটা কী ?

ভ্রূ কুঁচকে তন্দ্রার দিকে তাকাল স্যমন্তক। বুজে আসা গলায় তন্দ্রা যে-কথাটা বলল সেটা শোনার জন্যে একটুও প্রস্তুত ছিল না স্যমন্তক।

—মিতিন আর বেঁচে নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার পরপরই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় মিতিন। পাপিয়ামাসিদের হাসপাতালেই ভর্তি ছিল সে। আপনার কাকু বানিয়ে বানিয়ে মাসিমণির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রচুর গল্প বলেছিলেন পাপিয়ামাসিকে। তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটা। অথচ স্নেহাংশু সরকার দিনের পর দিন সেই মৃত মেয়ের নাম করে টাকা নিয়ে আসছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে। আজও আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই একই কারণে। মিতিনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই গান গাওয়া ছেড়ে দেন মাসিমণি। শান্তির খোঁজে পা বাড়ান আধ্যাত্মিকতার পথে। পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে আশ্রয় নেন এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায়। চলে যেতে চেয়েছিলেন। স্নেহাংশুর ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু টাকার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সেখানেও পৌঁছে গিয়েছে ওই ঠগবাজ লোকটা। নিজে আসতে না পারলেও পাঠিয়ে দিয়েছে আপনাকে।

(চলবে)

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ২)

স্যমন্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ঘরের প্রতিটা জিনিস। বোঝার চেষ্টা করছিল ঠিক কোন গাঙে আজকাল তরী ভাসিয়েছেন মধুরিমা। একসময়ে খ্যাতির শীর্ষে থাকা গায়িকার এহেন স্বেচ্ছা নির্বাসন অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মঞ্চ সংগীতের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তারপর হঠাৎই একদিন উবে গেলেন কপূরের মতো। মানুষের মন থেকেও আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকলেন মধুরিমা সরকার নামের সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিণী। তাঁর ফেলে যাওয়া আসন ভরাট করতে এগিয়ে এল একঝাঁক নতুন মুখ। এখনও কিছু রসিক শ্রোতার সংগ্রহ খুঁজলে মধুরিমার অনেক কালজয়ী গানের হদিশ পাওয়া যাবে।

মধুরিমা সরকারের নাগাল পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে স্যমন্তককেও। পুরোনো বাড়িতে ঢুঁ মেরেছে বার কতক। ফোন নম্বরও বদল হয়েছে। বহু চেষ্টার পর অবশেষে জানতে পেরেছে মধুরিমার বর্তমান ঠিকানার সন্ধান। ধরতে পেরেছে ফোনে। আর আজ বহুপ্রতীক্ষিত সেই সাক্ষাতের সময় উপস্থিত। স্যমন্তকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল ক্রমশ। মনের ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল অস্থিরতা। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকলেন। সাদা পোশাক পরিহিতা মধুরিমা। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল। মুখে আলতো বলিরেখার আভাস।

স্যমন্তকের দিকে প্রসন্ন মুখে চেয়ে বললেন, ‘কত বড়ো হয়ে গিয়েছ বুম্বা! বহু বছর বাদে তোমায় দেখলাম। ওম শান্তি!”

গভীর বিস্ময়ে স্যমন্তক দেখছে মধুরিমাকে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘ছোটোমা!”

স্যমন্তকের বয়স যখন নয় কী দশ বছর তখন তার কাকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মধুরিমার। তাঁর গানের স্কুলের সবথেকে ভালো ছাত্রীটির প্রেমে পড়েছিলেন স্নেহাংশু। বিয়ে করেছিলেন সকলের অমতে বয়সে অনেক ছোটো মধুরিমাকে। স্নেহাংশুর বাড়ির লোকেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলেন সম্পর্কটা। কিন্তু বেঁকে বসলেন মধুরিমার পরিবারের লোকজন। বাপেরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল তাঁর।

প্রথম প্রথম সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। নতুন কাকিমার ভীষণ ন্যাওটা ছিল স্যমন্তক। ডাকত ছোটোমা বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল পরিস্থিতি। গানের জগতে মধুরিমার পরিচিতি বেড়ে যাচ্ছিল দিন কে দিন। অপরদিকে হীনম্মন্যতা গ্রাস করছিল স্নেহাংশুকে। গুরুর কাছে ছাত্রীর উন্নতি সুখের হলেও একজন স্বামীর কাছে তাঁর স্ত্রীর বাড়তে থাকা উচ্চতা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। যত দিন এগোতে লাগল তত গরিমা বাড়তে লাগল মধুরিমার।

মুগ্ধ শ্রোতার দল ঘিরে থাকত তাঁকে। রেগে যেতেন স্নেহাংশু। ভেবেছিলেন সন্তান এলে হয়তো ভাটা পড়বে মধুরিমার সংগীত চর্চায়। কিন্তু দেখা গেল মিতিনের জন্মের পর দ্বিগুন উৎসাহে গান গাইছেন তিনি। একের পর এক আসছে কনসার্ট, সিনেমায় প্লে-ব্যাকের প্রস্তাব। ঈর্ষার বশে স্নেহাংশু বন্ধ করলেন গান শেখানো। ঝাঁপ পড়ল স্কুলের।

নেশার প্রতি আসক্ত হচ্ছিলেন স্নেহাংশু। মধুরিমার ওপর বাড়তে থাকা ক্রোধ তাঁকে ঠেলে দিচ্ছিল অন্ধকারের দিকে। সে সময় স্যমন্তক নেহাতই শিশু। অতশত বুঝত না কিছু। তবুও বেশ মনে পড়ে, প্রায় রোজ রাতেই ঝামেলা করতেন স্নেহাংশু। কিন্তু কোনও দিন সে তার প্রত্যুত্তরে রা কাড়তে শোনেনি মধুরিমাকে। নিত্য অশান্তিতে বিরক্ত হয়ে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মধুরিমা।

স্যমন্তকের মনে আছে সেই দিনটার কথা। তার ছোটোমার মাথায় আঘাত করেছিলেন কাকু। রক্ত ঝরছিল সেখান থেকে। কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন মধুরিমা। ছোট্ট মিতিনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্নেহাংশুর তীব্র বিরোধিতায় একরত্তি মেয়েটাকে না নিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরিবারের সকলে হতভম্ব হয়ে দেখেছিল সব ঘটনা। মধুরিমা চলে যাবার মাস খানেক পর মিতিনকে নিয়ে গৃহত্যাগ করেন স্নেহাংশুও। ছিঁড়ে যায় মধুরিমার সঙ্গে স্যমন্তকের যোগাযোগের শেষ সুতোটাও। আজ আঠারো বছর পর আবার মুখোমুখি বুম্বা আর তার ছোটোমা।

(চলবে)

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব