ঠাকুমার ডায়ারি (শেষ পর্ব)

ঠাকুমার শেষ কাজকর্মের ঝামেলায় এই ক’দিন আর পূজারিনি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেনি। শ্রাদ্ধশান্তির পর একদিন ইউনিভার্সিটি গিয়ে দেখা হল অরুনাংশুর সঙ্গে। ঘরের টুকটাক খবরাখবর নেওয়ার পর বলল, ‘পরের রবিবার বিকেলে একটু নন্দনে যেতে পারবি?’

পূজারিনি জানত অরুনাংশু লেখালেখি করে, মাঝেমাঝে নানা জায়গায় নানারকম সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যায়৷ বলল, “ওসব অনুষ্ঠানে তুই-ই যা, আমার সময় নেই।”

—আরে চল না, সারপ্রাইজ আছে।

—কী সারপ্রাইজ?’ পূজারিনি অবাক চোখে চাইল।

—সেটা হলে গিয়েই দেখতে পাবি, এখন বলব না।

রোববার বিকেলে বাংলা আকাদেমিতে গিয়ে পূজারিনি দেখল— হলভর্তি মানুষের ভিড়। মঞ্চে বিশিষ্ট অতিথিরা বসে আছেন। পিছনে টাঙানো একটি নামি প্রকাশনার ব্যানার। আর সামনের টেবিলে বইয়ের পাহাড়। কিছুক্ষণ পরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, উদ্‌বাধনী সংগীত ও বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের সঙ্গে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান।

দু’টি প্রবন্ধের বই প্রকাশের পর সঞ্চালিকা বললেন— এবার এমন একজন লেখিকার বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে যিনি দুর্ভাগ্যবশত আর আমাদের মাঝে নেই। যাঁর সৃষ্টিশীল মন সংসারের বন্ধন ও প্রতিকূলতার মধ্যে বন্দি হয়েও হারিয়ে যায়নি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যার কলম ছিল সচল, অপ্রতিরোধ্য। জীবনের ছোটোছোটো উপলব্ধি, আবেগ, আর বাস্তব ও কল্পজগতের টানাপোড়েন তিনি সাবলীল ভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর ডায়ারির পাতায়। তাঁর লেখার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই প্রথিতযশা সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর ছায়া। তাঁর ডায়ারির পাতা থেকে তুলে আনা সেই মণিমুক্তাগুলি পুস্তক আকারে প্রকাশ করতে পেরে আমরা গর্বিত। এ ব্যাপারে উদীয়মান কবি অরুণাংশু সামন্তর উদ্যোগ বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। তার জন্যেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল নির্মলা দেবীর সৃষ্টিকে। বইটি প্রকাশের জন্য এবার মঞ্চে ডেকে নেব কবি অরুণাংশু সামন্ত এবং দর্শকাসনে আসীন নির্মলা দেবীর নাতনি পূজারিনি চৌধুরীকে। প্রকাশিত হচ্ছে নির্মলা দেবীর ‘উপলব্ধি”।

সঞ্চালিকার মুখে হঠাৎ ঠাকুমা আর নিজের নাম শুনে পূজারিনি চমকে উঠল। ‘চল আমাদেরকে ডাকছে” বলে অরুণাংশু পূজারিনির হাত ধরে উঠে গেল মঞ্চে। পূজারিনির মাথায় কিছুই ঢুকছিল না, সম্মোহিতের মতো অনুসরণ করল অরুণাংশুকে।

বইপ্রকাশ শেষ হতে হলের বাইরে গিয়ে পূজারিনি জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই এসব কবে কীভাবে করলি? কখনও কিছু বলিসনি তো?”

—তোর বোধহয় মনে আছে একদিন একটা কাজে আমি তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখনই কথায় কথায় আমি কবিতা লিখি শুনে ঠাকুমা আমাকে বলেছিলেন তাঁর নিজেরও লেখালেখির অভ্যাসের কথা। আমি সেগুলো দেখার জেদ করতে উনি চুপিচুপি আমাকে আর একদিন যেতে বলেছিলেন যেদিন তুই বাড়িতে থাকবি না। সেইমতো কয়েকদিন পরে আমি আর একদিন গেলে উনি বাক্স থেকে তাঁর পুরোনো ডায়ারিগুলো আর কিছু ছিঁড়ে যাওয়া লেখার খাতা বের করে দেখিয়েছিলেন। লেখাগুলো দেখে আমি অবাক হয়ে যাই এবং একপ্রকার জোর করেই সেগুলো নিয়ে আসি। তবে উনি বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন এসব কথা কাউকে না বলি, এমনকী তোকেও না। তাই তোকে কিছু জানাইনি।

পূজারিনির মনে উঠল একই সাথে অভিমান ও বিস্ময়ের তুফান। অস্ফুটে বলল, “ওইটুকু সময়ের মধ্যে তুই ঠাকুমাকে একেবারে বশ করে ফেললি? ঠাকুমা তোকে এত ভালোবেসে ফেলল? দিয়ে দিল তার যত্ন করে রাখা প্রিয় ডায়ারিগুলো?”

—হ্যাঁ দেবিজি’, অরুণাংশুর মুখে দুষ্টুমির হাসি। শুধু কি তাই? ঠাকুমা তাঁর আরও একটি প্রিয় জিনিস আমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, করতে চেয়েছিলেন প্রায়শ্চিত্ত।

পূজারিনি তো আরও অবাক, ‘কী জিনিস? আর প্রায়শ্চিত্ত কীসের?”

—কথায় কথায় ঠাকুমা যখন জানতে পারল আমি ঘাটালের সুবিমল সামন্তর নাতি, তখন ভারী গলায় বলেছিলেন, তোর দাদুকে তো কিছু দিতে পারিনি, প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ আমার নাতনিকে তোকে দিলাম। ওকে তুই গ্রহণ করিস।

পূজারিনির মনে পড়ে গেল ঠাকুমার ডায়ারির লেখাগুলো। তাহলে সে যা ভেবেছিল সেটাই ঠিক? মনটা কড়কড় করে উঠল ‘সতিন’-এর জন্যে। আজীবন কত না অপূর্ণ সাধ, অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে বাঁচতে হয়েছে তাকে।

—কী রে, কী ভাবছিস এত?

—কিছু না! চল বাড়ি যাই, বলে পূজারিনি হাতটা বাড়িয়ে দিল অরুণাংশুর দিকে।

ঠাকুমার ডায়ারি (পর্ব ২)

মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল পূজারিনির। ফটোটা বুকে চেপে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল, ‘সতিনকে ছেড়ে কেন পালিয়ে গেলি এত তাড়াতাড়ি? আমি এখন কী করব?”

নির্বাক ছবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ পূজারিনির মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগে বলা ঠাকুমার একটা কথা— আমি যখন থাকব না আমার ডায়ারিগুলো পড়িস, আমাকে খুঁজে পাবি ডায়ারির পাতায়। মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের কথা। ঠাকুমা প্রতিদিন শোবার আগে বসত ডায়ারি লিখতে। দাদু যখন বেঁচে ছিল কতবার এই নিয়ে তার ঠাট্টা তামাশা শুনতে হয়েছে ঠাকুমাকে।

দাদু যখন বলত— কাজের মধ্যে তো সারাদিন লুড়ি টানা হেঁশেল থেকে শোবার ঘর আর শোবার ঘর থেকে হেঁশেল। কী এত লেখো ওই ডায়ারিতে ?

ঠাকুমা অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিত— কথা কইছি নিজের সঙ্গে।

—কী এত কথা বলত ঠাকুমা নিজের সঙ্গে? কী এত লিখেছে ডায়ারিতে?

দেয়ালের তাকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল এ বছরের ডায়ারিটা। পেড়ে নিয়ে এসে খুলে দেখল দিন চারেক আগে পর্যন্ত লেখা। বিছানায় বসে ডায়ারিটা পড়তে শুরু করল পূজারিনি।

দেখল ডায়ারির পাতায় পাতায় ঝরে পড়েছে পরলোকগত স্বামীর নানারকম স্মৃতির টুকরো টুকরো কথা। বেঁচে থাকার অনাগ্রহের কথা। আর ভগবানের কাছে তাকে তাড়াতাড়ি ডেকে নেওয়ার আকুতি। পড়তে পড়তে হঠাৎ পূজারিনির নজরে এল পাতাভর্তি একটু অন্যরকম লেখা। ভালো করে পড়তে শুরু করল।

‘মনটা মাঝেমাঝে গুমরে গুমরে ওঠে, কী একটা অস্বস্তি বুকের উপরে পাষাণ হয়ে চেপে বসে, নড়তে চড়তে পারি না। যুগান্ত সঞ্চিত না-বলা কথাগুলো বুকের মধ্যে এমন ভাবে চেপে বসে আছে যে, মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই জগদ্দল পাষাণ বুকে নিয়ে মরেও শান্তি পাব না। সারাটা জীবন মুখে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কুলুপ এঁটে দিয়ে মনের কথাগুলো চেপে না রাখলে আজ সেগুলো এত ভারী হয়ে উঠত না। জীবনে কত লোককে কত কিছু বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারিনি। পারিনি গৃহশিক্ষক সুজিত স্যারকে- তাকে আমার অপছন্দের কথা, বলতে পারিনি স্কুলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঈর্ষায় স্কুলের বান্ধবী নীরার অঙ্ক বইটা পরীক্ষার আগে আমারই সরিয়ে দেওয়ার কথা, বলতে পারিনি ভুল বোঝাবুঝির কারণে দূরে সরে যাওয়া ভাইপোকে আমার অন্তর থেকে তাকে ভালোবাসার কথা, বলার সুযোগ হয়নি রাগে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেওয়া কাজের ছেলেটাকে আমার অনুশোচনার কথা— এমনি আরও কত কথা। আর কলেজের সেই মুখচোরা পড়াশোনায় ভালো ছেলে সুবিমল? তাকেও বলতে পারিনি সেদিন তাকে আঘাত দিয়ে যা যা বলেছিলাম কোনওটাই আমার মনের কথা ছিল না, মন আসলে চেয়েছিল ঠিক উলটোটা। আজ মনে হয় মনের কথাগুলো সবাইকে সময়মতো খুলে বলে দিলেই ভালো হতো। তাতে হয়তো সাময়িক কষ্ট পেতাম! হয়তো বা জীবনটাও বইত অন্য খাতে! কিন্তু আজ শেষের বেলায় এইরকম আপশোশের বোঝা বইতে হতো না।’

ঠাকুমার লেখাগুলো গোগ্রাসে গিলছিল পূজারিনি। ভাবতে লাগল ঠাকুমা এত কথা চেপে রেখেছিল বুকের মধ্যে? আর কে এই সুবিমল? সেকি ঠাকুমার সঙ্গে মেদিনীপুরে কলেজে পড়ত? সত্যিই কি ঠাকুমা তাকে পছন্দ করত নাকি?

পাতা ওলটাতে ওলটাতে পূজারিনি থমকে গেল আর একটা পাতায়। ঠাকুমা লিখেছে, ‘আজ বড্ড মনে পড়ছে একটা মুখ, যে মনে সাহস জোগাত। বলত সাহস করে জীবনে এগিয়ে চলতে, অন্তরের সুপ্ত ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করতে। বয়সে সামান্য বড়ো ছোটোকাকু ছিল আমার বন্ধুর মতো। দু’জনে একসঙ্গে খেলাধুলা মারামারি করে বড়ো হয়েছিলাম। কখনও ভয়ে নিজের কোনও ইচ্ছের কথা বাবা-মাকে না বলতে পারলে সে বলত — কেন এত ভাবিস কে কী ভাববে তাই নিয়ে? কেন এত সংকোচ, কেন এত ভয়? লোকে কী বলবে, ঘরের লোক কী বলবে তাই ভেবে কখনও নিজেকে গুটিয়ে রাখবি না। মন যা চায় তা বলে দিবি। যা ভালো লাগে তাই করবি। এই ভাবে চুপ করে সবকিছু মেনে নিলে লোকের ফাঁপা প্রশংসা ছাড়া জীবনে সত্যিকার সুখ পাবি না কোনওদিন। কিন্তু কাকুর শত উৎসাহেও আমি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারিনি। পারিনি ঘরের মানমর্যাদার কথা না ভেবে নিজের ইচ্ছেমতো চলতে। পারিনি লোকনিন্দার ভয় ঝেড়ে ফেলে নাচগানের চর্চা চালিয়ে যেতে। পারিনি শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বাঁকা কথার খোঁচা অগ্রাহ্য করে লেখালেখি করতে। কেবলি চিন্তা করেছি লোকের কথা, তারা কী ভাববে, তারা কী বলবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি লোকের কথা ভাবতে গিয়ে সারা জীবন কেবল নিজেকেই বঞ্চনা করেছি, প্রতারণা করেছি নিজের সঙ্গে। সত্যিকার সুখের স্বাদ পাইনি জীবনে।”

অবাক হল পূজারিনি। ঠাকুমার ছোটোকাকু এত উদার মনের মানুষ ছিল? দু’একবার ঠাকুমার মুখে শুনেছে তার এক কাকা কলেজে পড়তে পড়তে মেতে উঠেছিল ষাটের দশকের বিপ্লবী আন্দোলনে, তারপর কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল কেউ জানে না। আরও অবাক হল ঠাকুমার নাচগান আর লেখালেখির নেশার কথা জেনে। ছোটোবেলা থেকে কখনও তো ঠাকুমাকে এসব করতে দেখেনি! কিন্তু লেখালেখি করলে তো সবকিছু যত্ন করেই কোথাও রাখবে, ফেলবে না। অমনি ঠাকুমার খাটের নীচ থেকে টিনের পুরোনো তোরঙ্গটা টেনে বের করল। খুলে দেখে কয়েকটা পুরোনো শাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। এমনকী পুরোনো ডায়ারিগুলোও নেই। নিরাশ হল পূজারিনি। কোথায় গেল সব? তবে কি ঠাকুমা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল, নাকি দাদুর ভয়ে সব নষ্ট করে ফেলেছে?

(চলবে)

ঠাকুমার ডায়ারি (পর্ব ১)

ঠাকুমাকে শ্মশানে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ গুম মেরে বারান্দায় বসে রইল পূজারিনি। মনে হচ্ছিল যেন অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে সে, বেঁচে থেকেও যেন নেই, এই ঘর, এই সংসার কেবল ছায়াময় অবয়ব মাত্র। কয়েকদিন আগেও যে-মানুষটা তার সঙ্গে কথা বলেছে, আজ সে হয়ে গেছে বিদেহী। কাল যে বর্তমান ছিল, আজ সে অতীত। কাল যার উপস্থিতি ছিল গোটা বাড়িটা জুড়ে, আজ সে কেবলই স্মৃতি।

বাবা আর ভাই পাড়ার লোকেদের সঙ্গে গেছে শেষ যাত্রায়, ঘরে সে আর মা ছাড়া কেউ নেই, নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে গোটা বাড়িটাকে। আস্তে আস্তে উঠে ঠাকুমার ঘরে গেল পূজারিনি। অপলকে তাকিয়ে রইল টেবিলে রাখা গত বছর তার জন্মদিনে ঠাকুমার সঙ্গে তোলা ফটোটার দিকে। ঠাকুমা তাকে পায়েস খাইয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হল যেন এখুনি ঠাকুমা উঠে এসে নিত্যদিনের মতো তার ‘সতিন’-এর সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা শুরু করবে! মনে পড়ে যাচ্ছিল কত কথা৷

একদিন সন্ধ্যাহ্নিক সেরে চা খেয়ে বিছানায় বসে মাতৃশক্তি পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল নির্মলা। খানিক পরে হঠাৎ চমকে উঠল কানের কাছে কারও ডাকে, ‘টুকি!” মুখ ঘুরিয়ে দেখে পূজারিনি, যথারীতি চুপিচুপি এসে পাশে বসেছে।

কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘দুষ্টু মেয়ে, এত বড়ো হলি এখনও তোর সেই ছোটোবেলার স্বভাব গেল না। খালি পিছন থেকে কানের কাছে ডেকে চমকে দেওয়া।”

—এ স্বভাব মরলেও যাবে না বুড়ি, তুই যে আমার সতিন। বলে দু’হাত দিয়ে ঠাকুরমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে মুখ ঘষতে লাগল।

—ছাড় বাবা, উলটে পড়ে হাত-পা ভাঙব যে, বলে নির্মলা তাকে যতই ছাড়াবার চেষ্টা করে ততই নাতনির বাহুপাশ শক্ত হয়৷ অবশেষে পত্রিকাটা রেখে দিয়ে মুখে চুমু খেয়ে একটু আদর করতে তবে মেয়ে ছাড়ে।

—সতিনকে ছেড়ে দু’দিন পরে তো ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবি শ্বশুরবাড়ি, তখন তো ভুলেও আমার কথা মনে পড়বে না।

—চিন্তা করিস না, যেখানেই যাব সতিনকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। বুঝলি বুড়ি?

—আর বাজে কথা বলিসনি ছুঁড়ি। মনে যখন প্রেমের রং ধরবে তখন আর কারও কথা মনেই থাকবে না।

—ধুস, কী যে বলিস না তুই?’ লজ্জারাঙা পূজারিনি ঠাকুমার কোলে মুখ লুকাল। আর নির্মলা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল তার মাথায়।

এইরকমই ছিল ঠাকুমা-নাতনির নিত্যদিনের রুটিন। ছোটোবেলা থেকে ঠাকুমাই তার সব— তার কাছে খাওয়া, তার কাছে শোওয়া, যত অভাব অভিযোগ সব ঠাকুমার কাছে। স্কুল মাস্টারনি মায়ের বকুনি আর রাগি মেজাজ তাকে আরও বেশি। করে ঠেলে দিয়েছিল ঠাকুমার দিকে। দাদু যখন তাকে ‘নতুন বউ’ বলে ঠাট্টা করত, আর ঠাকুমা তাকে ‘সতিন’ বলে কপট রাগ দেখাত, সেও অর্থ না বুঝে ‘আমি তোমার সতিন, আমি তোমার সতিন’ বলে ঠাকুমাকে রাগাবার চেষ্টা করত। সেই থেকে তার সতিন ডাকটাই রয়ে গিয়েছিল, হাসিঠাট্টার সময় সতিন বলে রাগাত পরস্পরকে। ছোটোবেলা থেকেই সে ঠাকুমাকে তুই বলে ডাকত, যেটা বড়ো হয়েও আর পরিবর্তন হয়নি।

(চলবে)

দ্বিতীয় পুরুষ (শেষ পর্ব)

কেউ বলছে ডাক্তার ডাকতে, কেউ বা হাসপাতালের কথা। অঙ্গিরা জোর করে উঠে বসে বারণ করল সবাইকে। জানাল সে সম্পূর্ণ ঠিক আছে। কিন্তু নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে কী স্বপ্ন দেখছে! সে মৃত না জীবিত। এতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েও কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই শরীরে! তার তো এতক্ষণে এই চরাচর ছেড়ে দেওয়ার কথা। তাহলে কী! ওষুধের মধ্যেই কোনও কারসাজি! রঙ্গন তার প্রখর বুদ্ধি দিয়ে হারিয়ে দিল অঙ্গিরার অবধারিত মৃত্যুকে। কিন্তু রঙ্গনের কী হল! এবার সেই ভেবে উতলা হয়ে উঠল অঙ্গিরার মন। সে তো আর মোবাইলের যুগ নয়, দৌড়ে গেল ল্যান্ড লাইনের দিকে। হাত কাঁপছে, ডায়াল করতে পারছে না, আঙুল জড়িয়ে যাচ্ছে। অবশেষে লাগল রঙ্গনদের বাড়ির নম্বর। জানা গেল বেশ কিছুক্ষণ আগেই রঙ্গন নাকি হিমাচল ঘুরতে যাচ্ছে বলে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল অঙ্গিরার। কিছুদিন পর ওষুধের শিশির ভেতর সাদা গুঁড়ো পরীক্ষা করে জানা গেল, সেগুলো অতি সাধারণ ক্যালশিয়ামের বড়ি ছিল। ভালোবাসা আরও গভীরে নোঙর ফেলল অঙ্গিরার ডুবোপাহাড়ের ভেতরে।

এরপর রঙ্গনদের পরিবার আরও বছর দুই ছিল ওই পাড়ায়। ততদিন পর্যন্ত এক দিনের জন্যেও ফেরেনি নিখোঁজ রঙ্গন। রঙ্গনদের পরিবার এই পাড়া ছেড়ে চলে যাবার আগে এক অদ্ভুত খবর এল তাদের বাড়ি। দেরাদুনের কাছে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় একটি দলা পাকানো দেহ পাওয়া গেছে। চেনার কোনও উপায় নেই। পাশের পড়ে থাকা টিকিটের সূত্র ধরে আন্দাজ করা হচ্ছে এটা নাকি রঙ্গন মিত্র। রেলওয়ে জিআরপি এরকমই খবর দিল। পাড়ার দু’একজনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটল রঙ্গনের পরিবার। শোনা যায় ওখানেই নাকি দাহ করে এসেছিল সেই অশনাক্ত রঙ্গনকে। তারপর বাড়ি ফিরে রঙ্গনের শ্রাদ্ধ শান্তি-ও হল। চিরকালের মতো অঙ্গিরার জীবনের একটা রঙিন অধ্যায় সাদা হয়ে গেল।

নিয়মভঙ্গের দিন অঙ্গিরা শেষবারের মতো গিয়েছিল ওদের বাড়ি। যে রঙ্গনের গলায় মালা দেওয়ার কথা ছিল ওর, তার কাচের ফ্রেমেবন্দি হাসিভরা মুখচ্ছবিতে মালা দিয়ে এল। আজ ওটাতো একটা জড় পদার্থ। তার আর কোনও হেলদোল নেই। হা ঈশ্বর! অঙ্গিরা মনে মনে ভাবল, যখন যাত্রীভরা নৌকাডুবি হয়, তখন যারা বেঁচে যায়, তারা ভাবে ঈশ্বর অপার করুণাময়, অথচ যারা ডুবে মরছে তারা ঠিক তখনই বুঝতে পারে ঈশ্বর আসলে কত নির্মম।

তারপর ওর বাবা-মায়েরাও চলে গেল এই পাড়া ছেড়ে। বলেও যায়নি কাউকে। আসলে একমাত্র ছেলে চলে যাওয়ায়, পুরোনো স্মৃতিকে আর টেনে নিয়ে যেতে চাইল না তারা। পুরোনো যোগাযোগ থাকা মানেই সেইসব ফেলে আসা দিনের অপ্রিয় স্মৃতির রোমন্থন। যেটা তারা একেবারেই চাইল না। তাই পাড়ায় আর কেউ জানেও না ওদের খবর।

এদিকে একবার আত্মহত্যার হাত থেকে বরাতজোরে বেঁচে যাওয়ায় ভীষণ চোখে চোখে রাখা শুরু হল অঙ্গিরাকে। বিশেষ করে ওর মা এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতেন না অঙ্গিরাকে। শুরু হল ওর মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা। কিছুদিনের মধ্যেই রাজি করিয়ে মোটামুটি মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বসিয়ে দেওয়া হল বিয়ের পিঁড়িতে। চার হাত এক হয়ে গেল পুলকের সাথে। সংসারের সুখের অভ্যাসে অনেক তলানিতে চলে গেল ফেলে আসা স্মৃতি। বিয়ের দু’বছরের মাথায় কোলে এল মেয়ে। সংসার ভরে উঠল অপত্য স্নেহে। দায়িত্ব কর্তব্যের পুরু ধুলো পড়ে গেল কিশোরীবেলার সেই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ওপর। অঙ্গিরার মন থেকে অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গেল রঙ্গনের গল্প।

তারপর হঠাৎ এই আজকের সকাল। মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, এই রঙ্গন মিত্র কি সেই রঙ্গন? নাকি একই নামের কোনও আলাদা মানুষ। মনের গভীরে আবার একটা নিস্তব্ধ আলোড়ন হচ্ছে। যার ঢেউ’র কোনও বহিঃপ্রকাশ বাইরের চেহারায় নেই। কিন্তু এখন উপায়! কীভাবে যোগাযোগ করা যায় রঙ্গনের সাথে? একবার পত্রিকা অফিসে কি ফোন করা উচিত হবে? দোটানায় অঙ্গিরা। তবু মন মানছে না। শেষমেশ নিজেকে আর দমন করে রাখতে পারল না। ফোন করেই ফেলল পত্রিকা অফিসে।

—হ্যালো…?

—আমি অঙ্গিরা বসু বলছি, আচ্ছা গত রবিবার আপনাদের কাগজে যে-গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর লেখক রঙ্গন মিত্রের ফোন নম্বরটা কি পাওয়া যাবে?

—না, মাপ করবেন। লেখকের অনুমতি ছাড়া তো তার ফোন নম্বর কাউকে দেওয়া তো সম্ভব নয়।

—তাহলে কি কোনওভাবেই ওনার সাথে যোগাযোগ করা যাবে না?

—আপনি একটা কাজ করতে পারেন, আপনার ফোন নম্বরটা আমাকে দিন, আমি রঙ্গনবাবুকে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করব। এইটুকু করতে পারি বড়োজোর।

—অসংখ্য ধন্যবাদ।

এরপর প্রায় দিন সাতেক কেটে গেল। অঙ্গিরা হতাশ হয়ে পড়ল। ধরেই নিল যে, রঙ্গন সত্যি সত্যিই আর এই দুনিয়াতে নেই। তার মানে ওটা আসলে রঙ্গনেরই মৃতদেহ ছিল। মনের কোণে যেটুকু দোলাচলের নিষ্পাপ কুঁড়ি টিকেছিল, সেটাও ঝরে গেল। ধরেই নিল, এই রঙ্গন মিত্র আলাদা এক মানুষ। দোল এসে গেল। পুলকের সেদিন ছুটি। অঙ্গিরাদের ফ্ল্যাটে হই হই করে রং খেলা হচ্ছে। কাউকে চেনা যাচ্ছে না। সবাই রং মেখে অন্য চেহারা। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল অঙ্গিরার। মেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘মা তোমার ফোন।’ দৌড়ে গেল অঙ্গিরা।

—হ্যালো…?

ওপার থেকে এক গুরুগম্ভীর পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে এল। অবিকল সেই বহু বছর আগে শোনা বড়ো চেনা অঙ্গিরার এই কন্ঠস্বর। ঝলমলিয়ে উঠল অঙ্গিরা, গলা কেঁপে উঠল, এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, ‘কেমন আছো? এতদিন কোথায় ছিলে? আমি অঙ্গিরা!”

—পত্রিকা অফিস থেকে আপনার নম্বরটা দিল। আপনি নাকি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন, তাই ফোন করলাম! আমি তো ঠিক আপনাকে চিনতে পারলাম না! কে আপনি?

চুপ করে গেল অঙ্গিরা। ভেজা গলায় বলে উঠল, ‘মাপ করবেন। আমার বোধহয় কিছু একটা ভুল হয়েছিল। নমস্কার।”

ফোন কেটে গেল। এতদিন অঙ্গিরা মরিয়া ডুবেছিল, এবার ডুবিয়া মরিল রঙ্গনের স্মৃতিতে।

দ্বিতীয় পুরুষ (পর্ব ২)

তারপর আর কিছু মনে নেই অঙ্গিরার। তবে বেশ কিছুক্ষণ অঙ্গিরাকে পাওয়া যায়নি। চারদিকে সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিল। শেষে নির্জন দুপুরে রেশন দোকানের পাশে একটা কানা গলিতে অঙ্গিরার শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল। অচৈতন্য। কষের ওপর গড়িয়ে পড়া শুকনো রক্তের দাগ। সারা গায়ে শেয়াল শকুনের ছিঁড়ে খাওয়ার চিহ্ন। খবর দিয়েছিল, ওদেরই পরিচিত এক দুধাওয়ালা। দেখে চিনতে পেরেছিল অঙ্গিরাকে। বহুকষ্টে রঙ্গনের জন্য সযত্নে তুলে রাখা তার অরক্ষিত যমুনা এক লহমার ভুলে তছনছ হয়ে গেল। মাসখানেক লেগে গেল প্রায় অঙ্গিরার সুস্থ হতে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। শরীরের ক্ষত মেরামত হলেও, মনের ভেতরের গভীর দাগ কেউ মুছে দিতে পারল না। মনস্তত্ববিদের সহায়তা নিতে হল।

মানসিক স্বাস্থ্য কিছুটা ঠিক হবার পর একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অঙ্গিরা। সেটা কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটা সে নিজেই জানে। কিন্তু বাকিদের কাছে, বিশেষ করে বড়ো অবাক ঠেকল রঙ্গনের কাছে। ক্রমশ সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইল রঙ্গনের কাছ থেকে। কথার জালে রঙ্গন অনেক বোঝাতে চাইত কিন্তু ফল খুব একটা কিছু হল না। অঙ্গিরা তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাইল রঙ্গনের নাম। তার জীবনের সেইসব স্বপ্নের দিনগুলোর গভীর দাগ আবছা করে দিল তার জীবন থেকে। নিজেকে মনে করতে লাগল অপবিত্র। তার নিজের শরীরটাই মনে হতে লাগল, তার কাছে পাপের বোঝা। সেই পাপী শরীর মনকে অনেক দূরে সরিয়ে নিল এতদিনের লালিত পবিত্র সম্পর্ক থেকে। এদিকে রঙ্গন তো নাছোড়বান্দা। সে প্রাণের বিনিময়ে হলেও, যে করেই হোক পেতে চায় তার প্রাণাধিক অঙ্গিরাকে।

তবে অঙ্গিরার বাড়ির পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো হয়ে উঠল। বিনা দোষে অঙ্গিরার শরীরে এক গাঢ় কলঙ্কের দাগ এঁকে দিয়েছিল সমাজ। তাই বাড়ি থেকে চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে সামাজিক লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পেতে। সবাই তো আর খারাপ হয় না। এগিয়ে এল এক সহৃদয় পরিবার। ছেলেটিও বেশ ভালো। ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মী। বড়ো অমায়িক ব্যবহার। পুলক সব জেনেও রাজি হয়ে গেল অঙ্গিরাকে বিয়ে করতে। অঙ্গিরার বাড়ি থেকে ক্রমশ চাপ বাড়তে লাগল বিয়ের। বেঁকে বসল অঙ্গিরা। অবশ্য রঙ্গনকে বিয়ে করতে চাইলে, অঙ্গিরার বাড়ির লোকের কোনও আপত্তি নেই।

রঙ্গনের-ও অমতের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রঙ্গন প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল বোঝানোর। কিন্তু অঙ্গিরা কোনওমতেই রঙ্গন বা অন্য কাউকেই বিয়ে করতে রাজি হল না। কিছুতেই না। তবু ওর বাড়ির লোক এক প্রকার বাধ্য হয়েই শুরু করল বিয়ের তোড়জোড়। অঙ্গিরা হাপুস নয়নে আত্মসমর্পণ করল রঙ্গনের বুকে। যেভাবেই হোক এই উভয়সঙ্কট থেকে উদ্ধার করে দিতেই হবে তাকে।

বহুরকম আলোচনাতেও কোনও সমাধান সূত্র বেরোল না। অগত্যা আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথই খোলা থাকল না তাদের। অঙ্গিরা নিজের জীবন শেষ করে দিতে রাজি হলেও রঙ্গনকে সে কিছুতেই মরতে দিতে চায় না। এদিকে অঙ্গিরা নিজেকে শেষ করে দিলে, রঙ্গনের পক্ষে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থহীন।

অবশেষে আলোচনার ঝড় থেমে যাওয়ার পর দু’জনেই এক নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ ওদের জীবনে খোলা নেই। পরিকল্পনা শুরু হল। যেদিন স্থির হল তার মোটামুটি এক সপ্তাহ পরেই অঙ্গিরার বিয়ে। রঙ্গন অঙ্গিরাকে সবচেয়ে কষ্টহীন মৃত্যুর পথ দেখাল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরঘুমে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ।

উতলা হয়ে উঠল অঙ্গিরা। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে উঠল, “আর তুমি?”

শান্ত গলায় উত্তর দিল রঙ্গন, ‘তুমি যেদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে, দেখবে আমি তোমার পাশেই আছি। মৃত্যুর পরে তুমি যেখানেই যাও, দেখবে আমি তার আগেই সেখানে গিয়ে তোমার জায়গা করে রেখেছি আমার পাশেই। তুমি নিশ্চিন্তে মৃত্যুবরণ করতে পারো। আমি নিজে তোমায় ওষুধ এনে দেব।”

নিশ্চুপ হয়ে গেল অঙ্গিরা। অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রঙ্গনের দিকে। সুখের দিন পার হয় দৌড়ে, দুঃখের দিন খুঁড়িয়ে। চোখের পলকে যেন কেটে গেল মাঝের ক’টা দিন। এসে গেল সেই মহা অশুভ সময়। রঙ্গন গোপনে এসে অঙ্গিরাকে দিয়ে গেল সেই শিশিভরা মৃত্যুবাণ। হাত থেকে ওষুধটা নেবার সময় হাতে হাত লাগল দু’জনের। শেষ স্পর্শ। দু’জনের অপলক দৃষ্টি। আঙুলে আঙুল ছাড়তে চাইছে না। প্রবাহিত হচ্ছে এক অনাদি অনন্ত ভালোবাসার স্রোত। চোখ ভিজে উঠছে দু’জনের। মনের বিরুদ্ধে জোর করেই বিদায় নিল রঙ্গন। ওষুধের শিশি নিয়ে ঘরের দরজায় খিল দিল অঙ্গিরা।

এরপরেই ঘটনা মোড় নিল এক অপ্রত্যাশিত বাঁকে। পুরো ওষুধের শিশি গলায় ঢেলে দিল অঙ্গিরা। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে যেন ওষুধের শিশির লেবেলটা। টেবিলে রেখে দিল শিশিটা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে অঙ্গিরার। জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা ব্যর্থ করে ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল খেয়াল নেই অঙ্গিরার। হঠাৎ ভীষণ চিৎকারে ঘুম ভাঙল। দরজায় সজোরে ধাক্কার আওয়াজ। ভেঙে পড়ার জোগাড়। ধড়মড়িয়ে উঠল অঙ্গিরা। বাধ্য হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। সবাই দৌড়ে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই দেখে টেবিলের ওপর ঘুমের ওষুধের শিশি। পুরোটাই ফাঁকা। ধরাধরি করে বাকিরা শুইয়ে দিল অঙ্গিরাকে।

(চলবে)

ছায়ামূর্তি (পর্ব ২)

জানো, যখন সাদা টেরিকটের পাঞ্জাবি পরে গলায় ফুলের মালা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন নিজেকে দেখে মনে হয়েছিল আমি মানুষটা দেখতে খারাপ নই। যদিও আজন্ম রোগা বলে আমার একটা দুঃখ আছে। কিন্তু যাই বলো বাপু আমার চোখ নাক মুখ মোটেই খারাপ নয়। এই, তুমি হাসছ নিজেকে সুন্দর বলছি বলে? নিজেকে সুন্দর সবাই ভাবে। যে, কুৎসিত কদাকার চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছে সেও নিজেকে সুন্দর ভাবে।

জানো, রোগা চেহারা নিয়েও আমি দুটো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছিলাম। যদিও ওরা কেউ আমায় ভালোবাসেনি। শুধুই দুঃখ দিয়েছে। আমার সঙ্গে ওরা ভালোবাসার খেলা খেলেছে। দশ বছর আগে আমি ভীষণ বোকা ছিলাম। তখন পাড়ার কোনও মেয়ে কাছে এসে একটু হেসে কথা বললেই ভাবতাম, বুঝি সে আমায় ভীষণ ভালোবাসে। আমি পাগলের মতো একটু ভালোবাসা পাবার জন্য ছুটে গেছি। পরক্ষণেই সহস্র দুঃখ নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে। ভালোবাসার পেছনে ছুটে যখন আমি পরিশ্রান্ত হয়েছি তখনই বুঝতে পেরেছি ওটা ভালোবাসা নয়, মরীচিকা।

যাক, যা বলছিলাম। আমাদের নিয়ম, বিয়ে করতে যাবার আগে মা-বাবা ও গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে হয়। মা আমার মাথায় দুর্বা দিয়ে যখন আশীর্বাদ করছিলেন, তখন আমি তাঁর চোখে জল দেখেছিলাম। মার চোখে জল দেখে সেদিন মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল। আচ্ছা, ছেলেরা বিয়ে করতে গেলে সব মায়েরাই কি কাঁদে? মনে হয়, মা ভাবছিলেন আমি পর হয়ে গেলাম।

তোমার মামা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। আমি যখন বরের সাজে গাড়িতে গিয়ে বসলাম তখন শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে পৃথিবী তোলপাড়। তিন বন্ধু আর ছোটো বোন অপুর বর আমার সঙ্গে ছিল। ঠিক সাড়ে ছটায় আমাদের গাড়ি ছাড়ল। উঃ সে কী আনন্দ। বালি ব্রিজ পার হয়ে বিটি রোডে আসতেই গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। আমরা সবাই মনমরা হয়ে গেছিলাম। অবশ্য সেদিন রাত একটা পর্যন্ত বিয়ের লগ্ন ছিল।

আমার বন্ধুরা গাড়ি থেকে নেমে চায়ের সন্ধানে গেল। বাইরে তখন বেশ ঠান্ডা পড়েছে। চিত্তবাবু আর ড্রাইভার বনেট তুলে গাড়ি ঠিক করতে লেগে গেছেন। একটু পর শম্ভু আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এল। আমার হাতে চায়ের কাপটা ঠকঠক করে কাঁপছিল। বিয়ের সময় যত এগিয়ে আসছিল আমার টেনশন তত বাড়ছিল। চিত্তবাবু ড্রাইভারের সিটে বসলেন। ওঁর হাতে যেন জাদু ছিল। গাড়িটাকে তিনি পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতোই ছুটিয়ে নিয়ে চললেন। তোমাদের বাড়ির সামনে যখন আমাদের গাড়ি পৌঁছোল, তখন অসংখ্য লোক ছুটে এল আমাকে দেখার জন্য। বিশ্বাস করো, আমার সে সময় ভয় করছিল। আবার ভালোও লাগছিল। আমার মনে হয়েছিল সেদিন আমি পৃথিবীর সম্রাট। তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এসে যখন আমাকে সদর ঘরে নিয়ে বসালেন তখন আনন্দে আমার চোখে জল এসেছিল। এত যত্ন এত আদর আমি আগে কখনও পাইনি।

বরযাত্রীরা রিজার্ভ বাসে আমার আগেই এসেছিল। রাত এগারোটায় ওরা খেতে চলে গেল। কথা ছিল বিয়ে সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বরযাত্রীরা কেউ যাবে না। ওরা কথা রেখেছিল।

আমি যখন লাল সাটিনের চাদর বিছানো বিছানায় বসে ভেলভেটের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে নিজেকে পৃথিবীর সম্রাট ভাবছি, ঠিক তখনই একটি সুন্দর মেয়ে এসে আমাকে একটা গোলাপফুল দিয়ে বলল, “জামাইবাবু এটা আমার উপহার।’

আমি ফুলটা নিয়ে বলেছিলাম, ‘ধন্যবাদ।’

লাল গোলাপের সুগন্ধে আমার বুকের ভেতর জমে থাকা নীল দুঃখগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। তখন ভুলেই গেছিলাম আমি দীপারুণ মিত্র বেসরকারি অফিসের বেতনভুক কর্মচারী।

মরমি, আমার কথাগুলো শুনতে তোমার ভালো লাগছে? তুমি বিরক্তবোধ করছ না তো? বলতে ভুলেই গেছি তোমার জন্য আজ আমি একটা পিওর সিল্ক শাড়ি কিনে এনেছি। শাড়ির প্যাকেটটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখেছি। রং-টা সবুজ। তোমার তো সবুজ রং ভীষণ ভালো লাগে। এই শাড়িটা পরে এসো না। দেখি তোমাকে কেমন মানায়। ওহো, এখন তো লোডশেডিং। আলো এলে শাড়িটা পরবে কিন্তু। আচ্ছা কত দাম নিয়েছে বলো তো? কি, একহাজার টাকা? তোমার তাহলে কোনও আইডিয়া নেই। ওই শাড়িটার দাম তিনহাজার আটশো টাকা। আলো জ্বললে তোমাকে আমি ক্যাশমেমো দেখাব। তাহালে বিশ্বাস হবে তো?

এই জানো, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন বলে অফিসের বন্ধুদের মাংসের চপ খাইয়েছি। ওরা ভীষণ খুশি হয়েছে। তোমার জন্যও এনেছি। তোমার জন্য রজনীগন্ধা ফুল এনেছি। রজনীগন্ধা তো তোমার প্রিয় ফুল। আর একটু রাত হোক ফুলদানিতে ফুলগুলো রেখে দিও কেমন?

ছায়ামূর্তি (পর্ব ১)

মরমি, আমার মাথাটা একটু টিপে দেবে? আজ অফিসে কাজের চাপ ছিল, একগাদা ফাইল দেখতে হয়েছে। এ বছরেই প্রমোশন হওয়ার কথা। একটু বেতাল হলেই সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর প্রমোশন বন্ধ হওয়া মানেই আমার সুখের ঘরে আগুন। কারণ টাকাই তো সমস্ত সুখের কারণ। টাকা না থাকলে জীবন বৃথা! এ পৃথিবী বিষময়।

জানো, প্রমোশন হলে আমার প্রায় পাঁচ হাজার টাকা মাইনে বেড়ে যাবে। প্রমোশনটা হলেই তোমাকে আমি একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেব, যা তোমার বহুদিনের শখ। বিয়ের পর তোমাকে আমি কোনও উপহার দিইনি। এমনকী ফুলশয্যার রাতে তোমাকে একটা সোনার আংটি উপহার দিতে পারিনি। সে জন্য তুমি আমাকে অনেক দিন খোঁটা দিয়েছ। নিজের এই অর্থনৈতিক অক্ষমতার জন্য মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। ভেবেছি যার একটা সোনার আংটি কিনে দেবার ক্ষমতা নেই তার বিয়ে করাটাই উচিত হয়নি।

এবার প্রমোশনটা হলেই তোমার মনের অনেকগুলো সাধ আমি মিটিয়ে দেব। আজ লোডশেডিং-এর জন্য ঘরের লাইটটাও গেছে। মোমবাতির আলোয় তোমার মুখটা যেন রাতের এক গোছা রজনীগন্ধা।

এখন ভীষণ ভালো লাগছে, তুমি মাথা টিপে দিলে আমার কোনও মানসিক বা দৈহিক যন্ত্রণা বলতে কিছু থাকে না। এই জানো, এখন মনে হচ্ছে তুমি আমার মা। আমার অসুখ করলে মা ঠিক তোমার মতোই সেবা করতেন। মা মারা যাওয়ার পর তুমিই তার বিকল্প হয়েছ। আচ্ছা তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন? শরীর খারাপ নয়তো?

তোমার বিয়ের দিনের কথা মনে আছে? আমার কিন্তু সব মনে আছে। আসলে ওই দিনটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন মনে থাকবে। তোমাকে কিন্তু আমার মা প্রথম থেকেই ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। কথায় বলে কুপুত্র যদিও হয় কুমাতা কখনও নয়। আমি মাকে সুখী করতে পারিনি কিন্তু মা আমাকে সুখী করেছেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন তোমাকে পেলে আমার জীবন সুখের হবে। আমার মতো সুখী বোধহয় পৃথিবীতে কেউ নেই। কিংবা হয়তো আছে, আমার জানা নেই।

বিয়ের দিনে আমি হয়েছিলাম একদিন কা বাদশা। আমাকে নিয়েই তো উৎসব। দধিমঙ্গলের সময় আমি বুঝেছিলাম আমার নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল। শুনলে অবাক হবে, আমি কিন্তু সেদিন উপোস করে থাকতে পারিনি। দুপুরবেলা লুকিয়ে দোকানে গিয়ে কষা আলুর দম আর পাঁউরুটি খেয়েছিলাম। অবশ্য সে জন্য আমি মা কালীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম। জানি না তিনি আমায় ক্ষমা করেছেন কিনা। যখন বউদি আমাকে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজাচ্ছিল তখন তোমার কথাই শুধু বার বার ভাবছিলাম। আচ্ছা, তুমি যখন কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে লাল বেনারসী পরে বসেছিলে তখন তোমার কী মনে হয়েছিল? আহা লজ্জা কীসের, বলো না। কী বললে ? তখন তোমার ভয় করছিল? খুবই স্বাভাবিক। বিয়ের দিনে সব মেয়েরই ভয় করে। তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান মিটে গেলেই তোমরা হয়ে যাও রণচণ্ডী। এই রণচণ্ডী বললাম বলে তুমি রাগ করলে ? মাইরি তোমাকে একটু রাগাবার জন্যই কথাটা বললাম। আসলে রাগলে তোমাকে খুবই সুন্দর দেখায়।

এখন যদিও লোডশেডিং, তবু অন্ধকারে তোমার রাগ রাগ মুখটা আমি মনের আলো জ্বেলে ঠিক দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা আর তোমাকে রণচণ্ডী বলব না। এই তোমার পা ধরছি, হল তো? কে বলছে, আমি তোমার পায়ে হাত দিলে তোমার পাপ হয়? ভক্ত প্রতিমার পায়ে হাত দিলে কি প্রতিমার পাপ হয়? তুমিই তো আমার প্রাণ-প্রতিমা। আমার প্রাণেশ্বরী। লোকের বিশ্বাস গঙ্গায় স্নান করলে যেমন সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়, ঠিক সেইরকম আমার বিশ্বাস তোমার পায়ে হাত দিলে আমার সব পাপ নিঃশেষ হয়ে যায়। আমার মনে হয়, গত জন্মে হয়তো এককণা পুণ্য সঞ্চয় করেছিলাম, আর সেই পুণ্যের ফলেই তোমাকে এ জীবনে স্ত্রী রূপে কাছে পেয়েছি। এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। এই সবুজ জর্জেট শাড়িটা আজও পরেছ দেখছি। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখতে গেছিলাম তখন এই শাড়িটা পরেই তো তুমি আমার সামনে এসে বসেছিলে। হাঁটু মুড়ে বসলেও তোমার আলতা পরা ফরসা পা দু’খানি কিন্তু আমার নজর এড়ায়নি। জলপাথর বসানো নাক ছাবিটায় তোমাকে বেশ মানিয়েছিল। এখনও মনে আছে তুমি উঠে চলে যাবার পরও আমি হ্যাংলার মতো বারবার পাশের ঘরটার দিকে তাকিয়েছিলাম। আর কারও জীবনে ঘটেছে কিনা জানি না, মেয়ে দেখতে গিয়ে মন দিয়ে ফেলা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে।

(চলবে)

অবিশ্বাস্য (শেষ পর্ব)

থার্ড ডিগ্রির কথা শুনেই তান্ত্রিক যেন কেমন হকচকিয়ে গেল। মনে হল থার্ড ডিগ্রি কী সেটা ভালো ভাবে ও জানে। রাতের অন্ধকারে কথাটা শুনেই বুঝে গেল যে এই অফিসার সম্ভবত এনকাউন্টারের কথা বলছে। তাই হাতজোড় করে গড়গড় করে সব বলে গেল।

সন্দীপের ভাই ছোটোবেলায় যে এলাকায় কিডন্যাপ হয়েছিল সেখানকার কিডন্যাপারদের লিস্ট নিয়ে রাম সিংকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছোল সেই এলাকায়। ফোনে ওই এলাকার এসএইচও-র সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে পৌঁছে গেল সেখানকার থানায়। কিন্তু কথা বলে যা জানতে পারল তাতে একটু হতাশ হল। কারণ সে সময়ে যারা এসব কাজ করত তারা নাকি সবাই এখন জেলে, নয়তো মারা গেছে। তবে বেশ কিছু বাচ্চাকে ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ এবং তাদের ওই এলাকার একটা অনাথ আশ্রমে দিয়েছিল। বর্তমানে সেই অনাথ আশ্রমও উঠে গেছে।

সন্দীপ এসএইচও-কে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ওই অনাথ আশ্রমের কেউ কি এখনও বেঁচে আছে?’

—আছে। ওই আশ্রমের মালিক এখনও বেঁচে আছেন তবে অনেক বয়েস হয়েছে। বিছানায় প্রায় শয্যাশায়ী। তবে আজকাল যেহেতু দিল্লি পুলিশ সিনিয়র সিটিজেন স্কিমের জন্য সিনিয়র সিটিজেনদের সাথে যোগাযোগ রাখে, তাই আমরাও ওনার সাথে যোগাযোগ রাখি। আমি আপনাকে ওনার ফোন নম্বর দিতে পারি। আপনি গিয়ে একবার কথা বলে দেখতে পারেন।

সন্দীপ ফোন করে রাম সিং-কে সাথে নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে পৌঁছে গেল। ভদ্রলোকের নাম ধীমান দত্ত। গিয়ে দেখল, ভদ্রলোক বিছানায় শুয়ে আছেন অসুস্থতার জন্য। সন্দীপকে দেখে কোনওরকমে উঠে বসলেন। সন্দীপ, ধীমানবাবুকে ভাইয়ের কিডন্যাপ হওয়ার কথা সব খুলে বললেন। বললেন- – আমার ভাইয়ের নাম ছিল সৌরভ। আমার ভাই যখন কিডন্যাপ হয় তখন ও নিজের নামটা কোনওরকমে বলতে পারত।

—কী নাম বললেন! সৌরভ। আমার এখানে দু’জন সৌরভ ছিল। দু’জনই এখন দিল্লি পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার। আপনি আগামীকাল বিকেলে আমার এখানে আসুন। দু’জনের মধ্যে একজন আগামীকাল বিকেল ৫টায় আমার সাথে দেখা করতে আসবে। ও প্রতি সপ্তাহেই আমার সাথে দেখা করতে আসে। তখনই সামনাসামনি দেখে নেবেন যে সে-ই আপনার ভাই কিনা। আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব জানি না। ওনার সাথে না দেখা করা পর্যন্ত আজ রাতে আমার ঘুম হবে না জানেন। সন্দীপ বাড়ি ফিরে আসে। পরের দিন ছুটি নেবে, তার দরখাস্তও করে দিল সে।

পরের দিন সকাল থেকে ওর সময়টা যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। মা-বাবাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে কিছু জানায়নি। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে জানাবেই বা কী করে! এই লাইনে অনেক কথাই সে গোপন রেখেছে বাড়ির লোকেদের কাছে। পুলিশের চাকরির এই একটা জিনিস। অনেক কথাই গোপন রাখতে হয়। সকাল থেকে তার খবরের কাগজটা পর্যন্ত দেখা হয়নি, টিভির নিউজটাও শোনা হয়নি।

বিকেলে ধীমানবাবুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় সন্দীপের বাবা বললেন- -কোথায় চললি খোকা? আজ তো ছুটি নিয়েছিস বললি, তাহলে কোথায় বেরোচ্ছিস?

—একজনের সাথে দেখা করতে যাব। তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। বলেই সন্দীপ বেরিয়ে পড়ল৷

ধীমানবাবুর বাড়ির সামনে পৌঁছোতেই দেখল ধীমানবাবুর বাড়িতে অনেক লোকের ভিড়। কোনওরকমে ভিড় ঠেলে ভেতরে পৌঁছে গেল। দেখল ধীমানবাবুর কোলে শায়িত এক পুলিশ অফিসারের মৃতদেহ। ধীমানবাবু স্থবির হয়ে বসে আছেন। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

জিজ্ঞাসা করে জানলেন মৃত পুলিশ অফিসার ধীমানবাবুর ছেলে, নাম সৌরভ। গতকাল রাতে একটি এনকাউন্টারে মারা গেছে। একথা শুনেই সন্দীপের মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল। মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। সামনেই রাখা একটি বেঞ্চে মাথায় হাত রেখে বসে পড়ল। অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বেরিয়ে এল। অনেক আশা নিয়ে সে এসেছিল কিন্তু এভাবে ভাইয়ের পরিণতি দেখতে হবে সে কখনওই ভাবতে পারেনি। মুখ তুলে সাহস করে মৃতদেহের দিকে তাকাতেও পারছে না সে।

অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে এসেছিল যে আজ ভাইয়ের সাথে দেখা হবে এবং তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মা, বাবাকে অবাক করে দেবে। এই মুহূর্তে সে কিছুই ভাবতে পারছে না। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। এমন সময় তার পিঠে একটা হাতের স্পর্শে একটু সোজা হয়ে বসল। পেছনে ফিরে দেখল ধীমানবাবুর হাত তার পিঠের ওপরে। বললেন, ‘সন্দীপবাবু, আপনার ভাই সৌরভ আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে বাড়ি নিয়ে যাবেন না!”

—তাহলে ওখানে কার দেহ শায়িত আছে?

—ওর নামও সৌরভ৷ কিন্তু ওর নাম সৌরভ কুমার।

আপনার ভাইয়ের নাকের কাছে একটা কাটা দাগ আছে বলেছিলেন না, যেটা ছোটোবেলায় পড়ে গিয়ে চোট লেগে হয়েছিল এবং তার দাগটা এখনও মেলায়নি, এই দেখুন।

সন্দীপ এতদিন বাদে ভাই সৌরভকে কাছে পেয়ে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। দু’ হাতে জড়িয়ে ধরল ভাইকে। তার দু’-চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।

অবিশ্বাস্য (পর্ব ২)

এভাবেই তিনদিন কেটে গেল। তৃতীয় দিনে একজন ইনফরমার খবর দিল যে সে একজনকে সাদা কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় রোজ রাতে ওই বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছে। ওই ছায়ামূর্তিটা পাশের ওই জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ভয়ে সে আর তাকে ফলো করতে পারেনি জঙ্গলের ভিতর পর্যন্ত। সন্দীপ আর দেরি না করে দলবল নিয়ে গিয়ে হাজির হল ওই জঙ্গলটার ভেতরে। দিনের আলোতে অনেক খোঁজার পর দেখল জঙ্গলের এক জায়গায় একটা ঢিবির মতো এবং তার ওপরে কিছু তাজা ফুল। মনে হল কেউ আজই রেখে গেছে। ঢিবিটা দেখে মনে হচ্ছে সদ্য খোঁড়া হয়েছে।

সন্দীপের আদেশে ওই ঢিবিটাকে খোঁড়া হল। খুঁড়ে নজরে এল কাগজে মোড়া কিছু একটা। সেটা খুলতেই চারিদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। সন্দীপ আর সহ্য করতে পারছিল না। বুঝতে পারল ওটা ওই শিশুটিরই হৃৎপিণ্ড। পচন ধরেছে। সন্দীপ রামসিং- কে ওটাকে পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়ে দিতে বলেই জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এল। এ দৃশ্য তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না। থানায় ফিরে সব অনুগত অফিসারদের ডেকে রাতের কর্মসূচীর কথা জানিয়ে দিল।

—দেখুন, যেহেতু এটা খুনের কেস, তাই সকলে নিজেদের আর্মস নিয়ে থাকবেন স্পটে। তবে আমি না বললে গুলি চালাবেন না। যদি জীবন বাঁচাতে গুলি চালাতে হয়, তবে পায়ে গুলি করবেন। আমি হত্যাকারীকে জীবিত ধরতে চাই। কারণ এই গ্রুপের সাথে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা আমাকে জানতে হবে। এই কেসটা সলভ না করতে পারলে জানবেন আপনাদের অনেকেই এই থানা থেকে বদলি হয়ে যাবেন। শুধু তাই নয় মিডিয়াও আমাদের ছেড়ে দেবে না। তাই বি সিরিয়াস।

রাম সিং বলল— “ঠিক বলেছেন স্যার। আমরা আপনার সাথে থাকব। আমি নিশ্চিত হত্যাকারী আমাদের হাতে ধরা পড়বেই।”

নিজের দলের সবাইকে নিয়ে ছদ্মবেশে রাতের বেলা ওই জায়গায় গিয়ে দূরে দূরে পজিশন নিয়ে পাহারা দিতে লাগল। রাত প্রায় ১টা নাগাদ দেখা গেল সাদা কাপড় পরা এক ছায়ামূর্তি ওই ঢিবির কাছে এগিয়ে এসে দু’-হাত ভরে কিছু ফুল ওই ঢিবির ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর আর কিছু ভাবার আগেই সন্দীপ দৌড়ে গিয়ে তার সাদা কাপড়টা সরিয়ে দিতেই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল! ভাবল এ কী করে সম্ভব! দেখল শিশুটির মা তার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে। তাকে ধরে নিয়ে আসা হল থানায়।

সন্দীপ নিজের রাগ অনেক কষ্টে সংযত করে বলল— ‘তুমি নিজের শিশুটিকে কেন মারলে? সত্যি না বললে আমি কিন্তু তোমার মতো এমন মহিলার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করব না।”

—আমি ও আমার পরিবার বাচ্চাদের নিয়ে দারিদ্রের জ্বালায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। একদিন এক তান্ত্রিকের কাছে যাই। ওই তান্ত্রিকই বলেছিল যে, আমরা যদি আমাদের একটি শিশুকে বলি দিতে পারি, তবেই আমাদের অবস্থা ফিরবে।

—তুমি আমাদের ওই তান্ত্রিকের ডেরায় নিয়ে চলো।

এরপর সন্দীপ ওই তান্ত্রিকের ডেরায় গিয়ে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। সন্দীপ মনে মনে ভাবে এই তান্ত্রিকের সাথে নিশ্চয়ই দিল্লির অনেক ক্রিমিনালের যোগাযোগ আছে। এর থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তাই বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিল— আজ বাড়ি যেতে দেরি হতে পারে। এমনকী না-ও যেতে পারে। বিশেষ কাজে আটকে গেছে। রাম সিং-কেও বলল বাড়িতে জানিয়ে দিতে।

এরপর তান্ত্রিককে নিয়ে এল একটা আলাদা ঘরে। সেখানে রাম সিং আর সন্দীপ ছাড়া কেউ নেই। সন্দীপ তান্ত্রিককে জেরা শুরু করল। তান্ত্রিক হঠাৎ ঝোলার থেকে একটা লাট্টু বের করে ঘোরাতে লাগল। রাম সিং বাঘের মতো থাবা দিয়ে লাট্টুটা তুলে নিল। বলল— সাহেব, আমি লোকের মুখে শুনেছি যে এই তান্ত্রিক নাকি লাটু ঘুরিয়ে সামনের লোকেদের সম্মোহিত করে দেয়। ও হয়তো আমাদেরও তাই করতে চাইছিল। তাই আমি আটকে দিলাম। একথা শুনে সন্দীপের রাগটা আরও বেড়ে গেল।

তান্ত্রিককে বলল, সোজাসুজি আমার সব প্রশ্নের জবাব দেবে নাকি থার্ড ডিগ্রি শুরু করব? এখানে চ্যাঁচালেও কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। সোজাসুজি বলো — তুমি দিল্লির কিডন্যাপার গ্যাংদের কাকে কাকে চেনো।

—রাম সিং, মনে হয় সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আমার রুলারটা আর থার্ড ডিগ্রির যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এসো। আমি আজ একটু হাতটা ঝালিয়ে নিতে চাই। এদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। বাকিটা আমি দেখে নেব রাতের অন্ধকারে।

(চলবে)

অবিশ্বাস্য (পর্ব ১)

সন্দীপ ব্যানার্জী ছোটোবেলা থেকেই দিল্লিতে মানুষ। বাবা দিল্লিতে এসেছিলেন কলকাতা থেকে চাকরি নিয়ে। তারপর দিল্লিতেই থেকে যান। মা-ও দিল্লিতে এসে চাকরি করতেন একটা স্কুলে। সন্দীপের জন্মের পর থেকেই ওকে ভালো স্কুলে পড়ানো হয়েছে। সন্দীপ পড়াশোনাতে খুব ভালো। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই সন্দীপের পুলিশে চাকরি করার একটা প্রবল ইচ্ছে ছিল।

আসলে সন্দীপের আর এক ভাই ছিল কিন্তু ছোটোবেলায় হঠাৎ তাকে একদিন কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর থেকে সেই ভাইয়ের আর কোনও খোঁজ তারা পায়নি। সন্দীপের মা, সাধনাদেবীও কেঁদে কেঁদে কঙ্কালসার হয়ে গেছেন। সন্দীপের খুব ইচ্ছে ছিল যে, পুলিশের বড়ো পোস্টে তাকে চাকরি পেতেই হবে। এবং একদিন সেই ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার রহস্য ঠিক উদ্ধার করবে।

সন্দীপের সেই ইচ্ছে একদিন সাফল্যের মুখ দেখল। সন্দীপ সরাসরি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে পুলিশের চাকরিটাও পেয়ে গেল। চাকরি জীবনেও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল বহু কেস ঘাঁটতে ঘাঁটতে কিন্তু তবুও যেন মনে শান্তি ফিরে আসেনি। সন্দীপের এই পরিশ্রমের জন্য পুলিশ মহলে বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। পুলিশ পদকও পেয়েছে।

সন্দীপ কিছুদিন আগেই নতুন দিল্লির কালকাজি থানার স্টেশন হাউস অফিসার হিসেবে ট্র্যান্সফার হয়ে এসেছে। জায়গাটা চিনতে ও বুঝতে একটু সময় লাগবে। হঠাৎ একদিন সকালে রাম সিং কনস্টেবল এসে খবর দিল কালকাজি বস্তিতে একটা মার্ডার হয়েছে। সন্দীপ আর দেরি না করে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হল। যে-দৃশ্য দেখল তা সন্দীপকে রীতিমতো নাড়া দিয়ে দিল। দেখল আড়াই বছরের একটি শিশুর মৃতদেহ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাম সিং- কে বলল কাপড়টা তুলে মুখটা দেখাতে। সে দৃশ্যটা আরও মর্মান্তিক।

পুলিশের চাকরিতে বহু মৃতদেহ দেখেছে কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে কখনও পড়তে হয়নি। দেখল শিশুটির বুক চিরে কে বা কারা হৃৎপিণ্ডটা বের করে নিয়ে গেছে। সন্দীপ এ দৃশ্যটা আর সহ্য করতে না পেরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। রাম সিং-কে বলল বডিটা পোস্টমর্টমে পাঠাতে। শিশুটির মা-বাবাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল যে, গতকাল রাতে তারা যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন কে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে তা তারা কেউ জানে না।

কয়েকদিন আগেই ওরা এই নতুন ঠিকানার ঘরে উঠে এসেছে। এরা কম টাকায় বস্তিতে এই ঘরটা পেয়েছে। এতে দরজার ছিটকিনিটাও নেই। ছিটকিনিটা ভাঙা, তাই রাতে ঘর খোলাই ছিল। এ নিয়ে তারা কখনও মাথা ঘামায়নি। ভেবেছিল ঘরে তো কিছুই নেই তাই কী আর চুরি হবে!

সন্দীপ থানায় ফিরে এসে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইল। কীভাবে এগোবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। বস্তির আশেপাশে সিসিটিভি-র ফুটেজ ও মা-বাবার মোবাইল থেকেও কিছু খুঁজে না পেয়ে ওই এলাকার ইনফরমারদের ডেকে সবাইকে পালা করে আক্রান্ত বাড়িটার ওপর নজর রাখতে বলল। সারা বস্তিতে খুঁজেও কোনও সিসিটিভি পাওয়া গেল না।

রাম সিং বলল— “স্যার, এদের সবার ঘরে টিভি আছে কিন্তু সিসিটিভি কেউ লাগায়নি কারণ এখানে ওটার প্রয়োজন হবে না বলেই ওদের ধারণা।’

সন্দীপের বার বার নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। যে করে হোক এই কেসটার আসামিকে খুঁজে বের করতে হবে। না হলে মনে শান্তি পাচ্ছে না। মিডিয়া এই খবরটাকে বেশ ফলাও করে প্রকাশ করবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। থানায় বলে দিল মিডিয়াকে কেউ যেন কোনও ইন্টারভিউ না দেয়। থানার অফিসারদের সবাইকে বলে দিল সবাই যেন নিজেদের সোর্স লাগিয়ে খবর জোগাড় করে আনে। যে করেই হোক হত্যাকারীর খোঁজ তার চাই। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে তাকে হার স্বীকার করতে হয়েছে। আজও সে হারতে চায় না। ওই এলাকায় যত ক্রিমিনাল ছিল সবার ফাইল খুলে বসে গেল। অফিসারদের বলল, ওই সব ক্রিমিনালদের থেকে খোঁজ নিতে। এখানে আবার বিভিন্ন দল আছে গুণ্ডাদের। সবার থেকেই খবর নিতে হবে।

(চলবে)

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব