সুন্দরবনে সাসপেন্স (পর্ব-০১)

‘সুন্দরবন ইজ দ্য মোস্ট বিউটিফুল প্লেস ইন দ্য বেঙ্গল বাট সুন্দরবন ইজ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস ইন বেঙ্গল টু’- এই লাইনটা কোনও এক বইতে পড়েছিল ডরোথি, কলেজে পড়ার সময়। ডরোথি বিশ্বাস, পাথরপ্রতিমার মেয়ে। সেই ছোটো থেকে জল, জঙ্গল, জীব-জন্তু জগতের সঙ্গে মনুষ্যসমাজের ঘোলাটে ক্ষীণ সহাবস্থান দেখে বড়ো হয়েছে সে। ২০১৬ সালে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট সার্ভিস’-এ যোগ দেওয়া। এখন চিকুরি ফরেস্ট অফিসে পোস্টিং, ফরেস্ট রেঞ্জার হিসেবে।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ভুটভুটি বোটটা খুব নিচু হয়ে, দু-পাশে মাতলা নদীর কালচে জলে অলৌকিক সৌন্দর্যের মাদুর বুনছে। ডরোথি চোখের উপর লং রেঞ্জ বাইনোকুলারটা চাপিয়ে দেখে নেয় চারিপাশ। দুদিকের উঁচু জায়গাগুলোতে কাঁকড়া, গরান, গেওয়া, হেতাল গাছের জঙ্গল। সেখান থেকে জমি ঢালু হয়ে নেমে এসেছে নদীর পাড় অবধি। এখন অমাবস্যার মরা কোটাল চলছে। তাই দু- পাশের চর নোনা জলে ডুবে গেছে। না হলে অন্যসময় জায়গাগুলো থকথকে পা ডোবানো কাদায় ভরে যায়। জোয়ারের জল সরে গেলে কাঁকড়া গাছের শ্বাসমূলগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে জেগে ওঠে শক্ত ভোঁতা ছুরির আগার মতো।

অ্যালট নম্বর ১২০, ১২১, গৌরচক গ্রাম৷ এখানেই আজ ভোররাতে ঘটনাটা ঘটেছে। ঝাঁসি মণ্ডল নামের এক গ্রাম্য গৃহবধূকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছে আজমলমারীর জঙ্গলে। সেই কেসেই স্পট ভিজিটে যাচ্ছে ডরোথি, সঙ্গে দু’জন ফরেস্ট গার্ড। এদের মধ্যে একজন অরূপ মণ্ডল, খুবই অভিজ্ঞ। বহুবছর হয়ে গেল এই জঙ্গলে। এদিককার জঙ্গলে গাছের পাতা, খাল-জলার গতিপ্রকৃতি, বাঘের মুভমেন্ট খুব ভালো ভাবে চেনে সে।

মাস চারেক আগে গত ফেব্রুয়ারিতে শ’দুয়েক চিতল হরিণ ছাড়া হয়েছিল এদিককার জঙ্গলে, বাঘের খাবারের অভাব মেটাতে। কিন্তু এদিকটায় এখন পোচিং-এর খবর খুব পাওয়া যায়। বোটে করে এসে পোচাররা জঙ্গলে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকে গুলি চালিয়ে হরিণ মারে। সেইজন্যই লোকালয়ে বাঘ হানা দিচ্ছে খুব। হঠাৎ বর্ষা এসে যাওয়ায় বাঁধের গায়ের নাইলন ফেন্সিংয়ের কাজ পুরোটা শেষ করা যায়নি। সেইখান থেকেই বনমামাদের আবির্ভাব হচ্ছে।

পশ্চিমদিক থেকে জলীয় বাষ্পের একটা ঘূর্ণি এসে সজোরে ধাক্কা দিল বোটটার গায়ে। ভুরভুর করে ভেসে আসা জোলো বাতাস সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা ডরোথির সারা গায়ে সোঁদা গন্ধের আলেখ্য এঁকে দিল যেন। ডেকের অন্য পাশটাতে ডান হাতে ট্রাংকুইলাইজারটাকে ধরে বিশেষ কায়দায় বাঁ-হাতে বিড়ি ধরিয়েছে অরূপ। বিশেষ কায়দায় কারণ মুখটা তাঁর বাঁ-দিকে বেঁকে গেছে। একবার জঙ্গলে প্যাডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে ওর উপর টাইগার অ্যাটাক হয়েছিল। বাঘের থাবায় মুখ আর মাথা চুরমার হয়ে যায় অরূপের। প্রায় মাসখানেকের যমে মানুষে টানাটানির পর, বনবিবির দয়ায় ঘরে ফেরে অরূপ।

এখনও সেই গল্প শুনলে গায়ে কাঁটা দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের নতুনদের। তবু অরূপ হার মানেনি। চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে সরকারি পেনশনে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার বদলে, জঙ্গলে ফিরে এসেছে। আসলে এই বিবস্ত্র জঙ্গল আর তার মধ্যবর্তী বিচিত্র জীবজগৎই এখনও ওর জীবন-আসক্তির মূল কারণ। এই সুন্দরবন আসলে কাদের? দক্ষিণরায়, হিংস্র শ্বাপদ, শঙ্খচূড়, কালাচ, রাজগোখরার মতো বিষধর সরীসৃপ, সদা ক্ষুধার্ত কুম্ভীরকুল, চিতল হরিণ, রং-বেরঙের পাখি যেমন মৌটুসি, পাপিয়া কিংবা মদন টাক, বক, লাজুক সুন্দরী হাঁস এদের? নাকি জঙ্গলের একদম গা ঘেঁষে মূর্তিমান মরীচিকার মতো বসবাস করা নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ, নির্ভার, ছায়াচ্ছন্ন জনপদগুলোর? এ প্রশ্ন চিরন্তন স্বাভাবিক।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার “ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী সুন্দরবনের মোট ১০২টি বদ্বীপের মধ্যে ৫৪টিতে জনবসতি আছে বাকি ৪৮টিতে আছে সংরক্ষিত অরণ্য। তবু অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ, এ জঙ্গল মা বনবিবি আর দক্ষিণরায়ের। দক্ষিণরায় এ জঙ্গলের অঘোষিত নরখাদক রাজা। তার সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ-বিবাদ বনবিবির। বনবিবির উপাখ্যানে পাওয়া যায়—

‘আঠারো ভাটির মাঝে আমি সবার মা

মা বলি ডাকিলে কারও বিপদ থাকে না।

বিপদে পড়ি যেবা মা বলি ডাকিবে

কভু তারে হিংসা না করিবে।’

আসলে জঙ্গলের রাজার সঙ্গে জলের শাসক কুমিরের বিবাদী আখ্যান, লোকশ্রুতি হয়ে ভেসে বেড়ায় লোকসাহিত্যের শর্বরী অন্তঃসলিলায়। আজও জঙ্গলে মাছ, কাঁকড়া শিকারে যাওয়া কিংবা মধু সংগ্রহে যাওয়া প্রতিটি জেলে কিংবা মউলিরা বিশ্বাস করে, বনে যাওয়ার আগে মা বনবিবির পুজো দিলে বিপন্ন সময়ে মা তাদের নিজের সন্তানের মতো আগলান।

বর্ষার মেঘের সঙ্গে ফন্দি করে অস্বাভাবিক রকমের একটা আলো-আঁধারির মায়াজাল, বিকট ফ্যাটফ্যাটে ফণা তুলে আকাশটাকে প্রায় পুরোটা ঢেকে ফেলেছে। মাকি নদীর মুখটায় এসে ফরেস্ট বোটটা ডানদিকে বাঁক নিল। আর কিছুদূর এগোলেই খালটা সরু হয়ে ‘পান্তামারি খাল’ শুরু। এই ধরনের খাল বা জলাগুলোতে মাছ, কাঁকড়ার পরিমাণ থাকে অনেক বেশি। খয়রা মাছের টোপ দিয়ে এখানে জেলেরা বড়শিতে কানমাগুর, সোনাবোগো কিংবা কাঁকড়া শিকার করে। অথবা ভাটার জলে হাতজালে শিকার করে ঢাকা চিংড়ির ঝাঁক।

দু-ধারে নিদ্রিত ঘন হেতাল পাতার জঙ্গল। হেতাল পাতার হলুদ সবুজ রঙের অস্পষ্ট আবছায়ায় গা মিশিয়ে, অশরীরী ধূমকেতুর মতো ওত পেতে বসে থাকে বাঘ। জঙ্গল ভিতর দিকে খুব ঘন, সূর্যের আলো মাটি ছোঁয় না। শিকার করার সময় বাঘ বিড়ালের মতো দু-পায়ের মাঝে শরীরটা ভাঁজ করে ছোটো হয়ে যায়। তারপর হাড় হিম করা একটা ক্ষমাহীন হুংকার ছুঁড়ে, চারপায়ে প্রচণ্ড লাফ দেয়। মানুষের টুটি কামড়ে ধরে, তীক্ষ্ণ দুটো শ্বদন্ত দিয়ে গলার নলি ফুটো করে দেয়। সঙ্গে বাঘের দুই পার্টির carnassial teeth কাজ করে কাঁচির মতো।

কুড়ি হাজার সাতশোর জন্য (শেষ পর্ব)

সুমন এখান থেকে মুক্তি চায়। এখানে আকাশের গায়ে কথারা দানা বাঁধে না। এখানে এসে কবিতার দল তাকে ছেড়ে গিয়েছে। কিন্তু পালাবার পথ নেই। আজকাল কিছু ভালো লাগে না। গত কয়েকদিন পিয়ালির মিলনের ডাক উপেক্ষা করছে সুমন। বারবার গায়ের জোরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে পিয়ালিকে। এইভাবে সে আর মিলিত হবে না। এমন পরিস্থিতিতে এখানকার মেয়েরা প্রশাসনকে জানাতে পারে। তখন কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হয় পুরুষটির। কিন্তু সুমন ভালোবাসা চায়। ভালোবাসাবিহীন যৌনতায় লাভ নেই। অবশ্য পিয়ালি কাউকে কিছু জানায়নি।

সেদিন মেডিটেশনের সময় একটা ঘটনা ঘটল। তখন পিয়ালি বাড়ি ছিল না। হঠাৎ বহুদূর থেকে একটা ডাক শুনতে পেল সুমন।

—সুমন শুনতে পাচ্ছিস?

ওই গলা শুনেই সুমন আনন্দে লাফিয়ে উঠল। এই কণ্ঠস্বর তার কাকার। মানসিক তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে।

—শুনতে পাচ্ছি কাকা।

—শোন সেদিন আমার একটা ভুলে তুই ব্ল্যাক হোলে পড়ে গিয়েছিলি। অকস্মাৎ ইউনিভার্সাল বোসন পার্টিকলের ভাইব্রেশনের কম্পাঙ্ক বদলে গিয়েছিল। তাই ব্ল্যাক হোল খুলে যায়। তখন তুই ঘরে থাকলে তোর কিছু হত না। আমি অনেক কষ্ট করে মানসিক তরঙ্গ দিয়ে তোকে খুঁজে বের করেছি।

—মা কেমন আছে কাকা?

—ও কথা পরে হবে। শোন ওখানকার হিসেবে আজ থেকে সাতদিন পর আবার ব্ল্যাক হোল খুলবে। এনার্জি ইমপাল্স রিডারের রিডিং সেই কথাই বলছে। তৈরি থাকিস। ওটাই তোর ফিরে আসার রাস্তা।

সেদিন অকস্মাৎ কী হয়ে গেল সুমনের ভিতর। তার ভিতরে তখন কত সুখ। পিয়ালি বাড়ি ফিরেছিল তাড়াতাড়ি। তবে সুমনের কাছে আসেনি। সেদিন সুমন নিজেই পিয়ালিকে আক্রমণ করল। পিছন থেকে অকস্মাৎ ওর বুকে হাত রাখল সুমন। হঠাৎ এমন আক্রমণে হকচকিয়ে গেল মেয়েটি। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। পুরুষ এমন ভাবে বলিষ্ঠ হাতে আক্রমণ করবে এ পিয়ালি ভাবতেও পারে না।

—এই, পিয়ালির প্রথম শিৎকার।

সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তখন সুমনের হাতে। মিলন কাকে বলে পিয়ালিকে শেখাল সুমন। প্রথমবার অনাবিল সুখে ভেসে গেল ওরা।

পরদিন প্রশাসন থেকে মেয়েরা এসেছিল। এখনও সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। পিয়ালি পুরুষ বদলাবে কিনা জানতে চাইল ওরা। কুড়ি হাজার সাতশো তার পুরুষটাকে বদলাতে রাজি হল না। তারপরের দিনক’টা সুমনের কাটল বড়ো আনন্দে। এই ক’দিন পুরুষসুলভ স্বাভাবিকতায় ও নিজেই এগিয়ে গেছে। নীরব আত্মসমর্পণ করেছে মেয়েটা। গুঙিয়েছে, সুমনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। চুমু খেয়েছে তীব্র আশ্লেষে। ফেরার আনন্দে তখন সুমন মশগুল।

পাঁচদিন পর পিয়ালি জানাল, যুদ্ধ বাধতে চলেছে। তাকে যুদ্ধে যেতে হবে। সে মারা গেলে সুমন অন্য কোনও মেয়ের কাছে জায়গা পাবে। সুমন জানে পিয়ালি না থাকলেও তার কিছু না। ব্ল্যাক হোল খুলে গেলেই সে ফিরবে পৃথিবীতে। সেখানে স্থানকালের হিসেব আলাদা।

দু-দিন পর যুদ্ধ শুরু হল। লেগেছে পাশের দেশের সঙ্গে। তারা অযাচিত ভাবে হানা দিয়েছে এদেশের সীমানার ভিতর। তারা এদের জমি কেড়ে নিতে চায়।

এখানকার দেশগুলো খুব ছোটো ছোটো। প্রাচীন পৃথিবীর মতো। এখানকার সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, দেশ ছোটো হলে শাসন করতে সুবিধা হয়।

যুদ্ধের দিন সীমান্তে একটা বড়ো ময়দানে মুখোমুখি দাঁড়াল দুই দল। দুই দল উলঙ্গ মেয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে। এক তরফে আক্রমণকারী হানাদার মেয়েদের দল। অপর দিকে এদিকের মেয়েরা।

দু-পক্ষের সেনা জমায়েত বেশ বড়ো। এখানে খালি হাতে যুদ্ধ হয়। তাই দূর থেকে যুদ্ধ দেখা যায়। ময়দান থেকে নিরাপদ দূরত্বে একটি ঢিবির উপর গিয়ে দাঁড়াল সুমন। তার মতো এখানকার আরও অনেক ছেলে যুদ্ধ দেখতে এসেছে। জুল জুল চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। তাদের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। তাদের অনেকেরই ঘরের মেয়েরা রয়েছে ময়দানে।

এক সময় উভয় তরফ থেকে বিউগলের মতো বাজনা বাজল। যুদ্ধ শুরু। প্রথমে উভয় তরফ থেকেই শুধু প্রথম সারির মেয়েরা পরস্পরের মুখোমুখি হল। একের বিরুদ্ধে এক লড়াই। অপরপক্ষ যথেষ্ট মল্লযুদ্ধ পটু এবং শক্তিশালী। এইপক্ষের সবক’টা মেয়েকে ওরা মেরে ফেলল। এবার উভয় তরফের দ্বিতীয় সারির পালা। কিন্তু সেই লড়াইতেও এইপক্ষের মেয়েরা দাঁড়াতে পারল না। ওরা সবাইকে মেরে ফেলল। এবার গেল তৃতীয় সারি। পিয়ালি নামল ময়দানে। মনের মধ্যে কেমন একটা উৎকণ্ঠা অনুভব করল সুমন। এই প্রথমবার। অন্য ছেলেরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর আবার এইপক্ষের মৃত্যুমিছিল শুরু হল। সুমন খেয়াল করল পিয়ালিকেও কোণঠাসা করে ফেলেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। একটি ঢিবির কাছে নিয়ে গেছে পিয়ালিকে। আর হয়তো কিছুক্ষণ। মেয়েটি নিশ্চিত মেরে ফেলবে পিয়ালিকে।

ঠিক তখনই একটা আবছা কণ্ঠ। সুমনের কাকা। ‘সুমন তাড়াতাড়ি। ব্ল্যাক হোল খুলছে। এনার্জি ভাইব্রেশনের কম্পাঙ্ক বদলাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ব্ল্যাক হোলে ঢুকে পড়।”

আশ্চর্য হয়ে নিজের থেকে কয়েক হাত দূরে, একটা কালো গহ্বরকে খুলে যেতে দেখল সুমন। এই সুযোগ। ওদিকে পিয়ালি ততক্ষণে ধরাশায়ী হয়েছে মাটিতে। হঠাৎ মনের ভিতর কেমন যেন ঝটকা দিল সুমনের। বুকে যেন কীসের ঝড় উঠল! মনের ভিতর ও কীসের অনুরণন! সুমন লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল ওদের দু’জনের মাঝখানে। পিয়ালির প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য কমান্ডো ট্রেনিং নেওয়া সুমনের একটা আঘাত যথেষ্ট। সুমনের একটা ঘুষিতে ঘুরে পড়ে গেল মেয়েটি। আর উঠল না।

এই আশ্চর্য ঘটনায় চমকে গিয়েছিল যুদ্ধরত মেয়েরা। যুদ্ধ থামিয়ে তারা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল এইদিকে। ঘোর কাটিয়ে অপরপক্ষের দু’জন মেয়ে তেড়ে এল এইদিকে। তবে সুমনের পরের আঘাতে ওদের একজন ধরাশায়ী হতেই অপরজন পালাল। এই দৃশ্য দেখে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের মধ্যে কী হল কে জানে! তারা রে রে করে ময়দানের দিকে ছুটে আসতে লাগল। অপরপক্ষের মেয়েদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া তখন শুরু হয়ে গেছে।

তখনই আবার কাকার গলা। ‘সুমন আর তিরিশ সেকেন্ড বাকি। কুইক।”

পিয়ালিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েই ব্ল্যাক হোলে ঝাঁপ দিল সুমন। এখানে কে আর আছে মেয়েটার। কুড়ি হাজার সাতশোর ঠোঁটে তখন মৃদু হাসি। চোখের কোলে দুটো টলটলে মুক্তো। এই জীবনে প্রথমবার। আজ থেকে আকাশের গায়ে আবার কথারা দানা বাঁধবে।

কুড়ি হাজার সাতশোর জন্য (পর্ব-০১)

কতকাল হল আকাশের গায়ে কোনও কথা দানা বাঁধছে না। এই আবছায়া সন্ধ্যাটাকে বড়ো অপরিচিত মনে হচ্ছে সুমনের। সে এখন যেখানে বসে আছে সেখান থেকে রান্নাঘরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আধুনিক এই ফ্ল্যাটের রান্নাঘর দরজাবিহীন। তাই যিনি রান্না করছেন তাঁর পিছনটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সুমন। ছেড়ে দেওয়া কালো চুল মহিলার কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার সরু কোমর, গায়ের রং, ঈষৎ মেদবহুল নিটোল স্বাস্থ্য— থেকে থেকে সুমনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ভদ্রমহিলাকে সুমন ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। সে এখন এখানে কী করছে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। আসল কথা সম্ভবত আকাশের গায়ে কোনও কথা দানা বাঁধছে না!

যে আরামদায়ক সোফাটায় সুমন বসেছিল, সেখান থেকে ব্যালকনিটা দেখা যায় না। সুমন সোফা ছেড়ে ব্যালকনিতে এল। এখান থেকে শহরটার বহুদূর দেখা যায়। তার মনে হল, এই শহরটাকে সে বহুবার দেখেছে। কিন্তু তবুও সে এই শহরটাকে চিনতে পারছে না। আকাশ থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তার এক ফোঁটাও সুমনের গায়ে লাগছে না। বহুতল ফ্ল্যাটের নিরাপদ আশ্রয়ে বৃষ্টি ঢুকতে পারে না।

কয়েকদিন ধরেই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে সুমন। সে বুঝতে পারছে সে আছে। কিন্তু কোথায় আছে, সেখানে সে এল কেমন করে, সেটা তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। তার যতটুকু মনে পড়ছে শেষবার সে ছিল তার শোবার ঘরে। দেয়াল ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছ’টা বেজেছিল। রিস্ট ওয়াচে তারিখ ছিল পাঁচ আগস্ট দু’হাজার তিরিশ।

ব্যালকনি থেকে আবার সোফায় ফিরে এল সুমন। আবার তার চোখ গেল রান্নাঘরের দিকে। ওখানে যে মহিলা কাজ করছিল সে ততক্ষণে সুমনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা থালা। থালার উপর কোনও খাবার রয়েছে। এতক্ষণে মহিলাটিকে ভালো করে লক্ষ্য করল সুমন। মহিলা না বলে একে মেয়ে বলাই ভালো। খুব বেশি হলে বছর বাইশ-তেইশের হবে মেয়েটি। সে একদৃষ্টে সুমনের দিকে তাকিয়েছিল। মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। সুমন চোখ ফেরাতে পারছিল না। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে সুমন চমকে উঠল। মেয়েটির শরীরে কোনও পোশাক নেই। বদলে তার শরীরের উপর রয়েছে স্বচ্ছ আলোর একটা আস্তরণ। বলতে গেলে মেয়েটি সম্পূর্ণ নিরাভরণ। সুমন নিজের দিকেও এবার খেয়াল করল। ওই একইরকম আলোর আস্তরণ রয়েছে তার শরীরেও। বলতে গেলে এই মেয়েটির সামনে সুমন নিজেও সম্পূর্ণ নিরাভরণ ভাবে রয়েছে।

মেয়েটি ধীরে ধীরে সুমনের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর থালাটা ধরিয়ে দিল ওর হাতে। থালার উপর থকথকে সবুজ জেলির মতো কিছু একটা রয়েছে। মেয়েটি ওকে ইশারায় খেয়ে নিতে বলল। এবার সুমনের মনে হল তার খিদে পেয়েছে। অনেকটা বাঁধাকপির তরকারির মতো খেতে খাবারটা। তবে সুস্বাদু। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল সুমন। অনেকটা দিয়েছিল মেয়েটা। পেট ভরে গেল সুমনের। আরেকটা থালা হাতে নিয়ে সুমনের পাশে বসেই খেল মেয়েটা।

খাওয়ার পাট চুকে গেলে, নিজের শরীরের উপরের আলোর আস্তরণটা আঙুলের একটা অদ্ভুত কায়দা করে সরিয়ে দিল মেয়েটা। সম্পূর্ণ নিরাভরণ হয়ে এগিয়ে এল সুমনের দিকে। তবে ও সুমনকে স্পর্শ করল না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে বসে রইল। হঠাৎ সুমনের মনে হল তার কানে কানে কেউ কিছু বলছে। পরিষ্কার বাংলায়। কণ্ঠটা কোনও মহিলার।

—স্বাগতম, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?

আশ্চর্য হলেও সুমন কথাটার উত্তর দিল।

—পাচ্ছি।

আবার ওপাশের অদৃশ্য কণ্ঠ কথা বলে উঠল, “মুখে বলার দরকার নেই। যা বলার মনে মনে বলুন। আমি সব শুনতে পাব৷’

—কীভাবে?

—কারণ আমরা কথা বলছি স্নায়ু তরঙ্গের মাধ্যমে। যেটা মূলত একটা ইলেকট্রো কেমিক্যাল ইমপালস। আমার মস্তিষ্কের নিউরো ট্রান্সমিটার থেকে সেটা বেরোচ্ছে। তারপর আপনার ঘরের ক্যাচার কাম কনভার্টার সেটাকে ক্যাচ করছে। তারপর সেটাকে এনক্রিপটেড করে বাংলায় কনভার্ট করে আপনার ব্রেনে পাঠাচ্ছে। সেটা ক্যাচ করছে আপনার রিসেপ্টর নার্ভ। আর আপনি স্পষ্ট বাংলায় আমার কথা শুনছেন। উলটো দিকে আমিও নিজের ভাষায় আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি একই ভাবে।

—আমি কোথায়?

—আপনি এই মুহূর্তে রয়েছেন আমাদের গ্রহে। এটা আপনাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় দুই আলোকবর্ষ দূরে।

—এখানে আমি এলাম কী করে?

—আপনি এখানে এসেছেন ছায়াপথের মাধ্যমে। যা নিয়ে আপনার কাকা বহুদিন গবেষণা করেছেন। আরও শুনতে চান?

—নিশ্চয়ই।

—আপনার কাকার সূত্র ধরেই বলি। পৃথিবীর প্রতিটি পথ আর ছায়াপথ পাশাপাশি যায়। কিন্তু দুটোর মাত্রা আলাদা। আর সেই মাত্রা হল সময়। ছায়াপথকে সাধারণ ভাবে সময়ের মাপকাঠিতে বাঁধা যায় না। তার সময়ের মাত্রা অন্যরকম। এই সময়ের মাত্রার পার্থক্যের জন্য ছায়াপথ সবার অগোচরে থেকে যায়। কিন্তু মহাজাগতিক বিস্ফোরণের ফলে এক এক সময় তৈরি হয় ব্ল্যাক হোল। ওই ব্ল্যাক হোলের ভিতর দিয়ে ছায়াপথে আসা যায়। তবে এটা একটা দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনাই আপনার সঙ্গে ঘটেছে। আপনি ভুলবশত ব্ল্যাক হোলে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ছায়াপথ ধরে আমাদের এখানে চলে এসেছেন।

—আমার কাকার কথা আপনারা জানলেন কীভাবে?

—মেন্টাল ইলেকট্রো কেমিক্যাল সিগন্যাল সিস্টেমের মাধ্যমে। এটি সবচেয়ে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা। যাকে আপনারা মন বলেন। এর মাধ্যমে খুব দ্রুত যোগাযোগ করা যায়।

সুমনের আর কোনও কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন আজগুবি আর ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিল। সে চুপ করে গেল। তাকে চুপ করে যেতে দেখে অদৃশ্য মহিলা কণ্ঠ আবার কথা বলল।

—আপনার সামনে যে মেয়েটা বসে আছে, ওর নম্বর কুড়ি হাজার সাতশো। এখানে কারও-র নাম হয় না। লটারিতে ও আপনাকে পেয়েছে। আপনার কাজ ওর সঙ্গে থাকা, ঘরের কাজ করা আর ওর সঙ্গে রতিক্রিয়া করা। আপনাদের লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন। অদৃশ্য কণ্ঠ থেমে গেল। ঠিক তখনই আর একটি নারীকণ্ঠ কানে গেল সুমনের।

—আমি কুড়ি হাজার সাতশো বলছি। এখন আমাদের মিলনের সময়।

এরপর কিছুটা জোর করেই সুমনের সঙ্গে মিলিত হল মেয়েটি। সুমনের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কিছুটা বাধ্য হয়ে ওর ইচ্ছায় সায় দিতে হল। তবে ভীষণ যান্ত্রিক মিলন। তৃপ্তি পেল না সুমন। ওদিকে কুড়ি হাজার সাতশোর চোখ মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না।

গারদ (পর্ব-০২)

এমনিতে ঘরটাতে একটা তক্তা ও আরেক পাশে একটা কম্পিউটার ছাড়া আর কিছু নেই। গৌতম তক্তাতে বসতে একটু ইতস্তত করল। ভদ্রলোক বলে উঠলেন ‘বসুন কোনও ব্যাপার না।’ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কলিগের সঙ্গে আগে কেউ দেখা করতে এসেছিল কি, জানেন কিছু?’

—কে আসবে? বাড়িতে বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ নেই। মায়েরও শুনেছি হাঁটুর অপারেশন হয়েছে।

—তাহলে আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, ওনার বাড়ি থেকে আপনাকেই দেখাশোনা করবার দায়িত্ব দিয়েছে। আসলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কাউকে জেলে দেখা করবার অনুমতি দেয় না। আপনি এই স্লিপটার একটা ফটো তুলে রেখে দেবেন। সব সময় তো আমি এখানে থাকব না। অন্য কেউ থাকলে এই স্লিপের ছবিটা দেখিয়ে বলতে পারবেন।’ ভদ্রলোক একটা স্লিপ লিখতে লিখতেই কথাগুলো বলছিলেন। লেখা থামিয়ে গৌতমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওনার আধার বা ভোটার কার্ড কিছু আছে?’

—না, আমি তো খবর পেয়েই স্কুল থেকে সোজা চলে এলাম। ইনফ্যাক্ট আমি এখনও পর্যন্ত ওর বাড়িতে যাইনি। ভদ্রলোক আর কোনও কথা বাড়ালেন না। স্লিপটা গৌতমের হাতে দেবার সময় বললেন, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার বলুন, বাড়িতে কেউ নেই আর এদিকে…’

—কেউ নেই তা নয়, নিজের দাদা আছে, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের একটা অর্গানাইজেশনে কাজ করেন।

—তাহলে…

এবারের গ্রীষ্মের ছুটিটা কেমন যেন হঠাৎ করে পড়ে গেল। স্কুলের কিছু কাগজপত্রে সই করবার প্রয়োজন থাকায় হেডস্যার অরুণবাবু একদিন সকালে সবাইকে একটা জায়গায় ডেকে পাঠালেন। সেখানেই তাঁর মুখে গৌতম প্রথম সঞ্জীবের অ্যারেস্ট হবার ঘটনাটা শোনে। গৌতমের সঙ্গে উপস্থিত বাকি শিক্ষক বা শিক্ষিকারাও অবাক হয়ে যান। পুলিশ নাকি রাত দুটোর সময় সঞ্জীবের বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে তাকে অ্যারেস্ট করে।

সঞ্জীবের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাবার পর তার দাদা নিজের শালির সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে দেয়। বিয়ের পরে জানতে পারে দাদার শালির মাথার কিছু গোলমাল আছে। দাদা ও বউদি সব কিছু জেনেও বিষয়টা লুকিয়ে যায়। বিয়ের পর জানাজানি হতেই অশান্তি আরম্ভ হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টা কোর্ট-কাছারি পর্যন্ত চলে যায়।

শোনা যায় সঞ্জীবের বাবা তার দাদার চাকরির সময় বেশ কিছু টাকা ঘুষ হিসাবে দিয়েছিলেন। সঞ্জীবকে দেন তাদের বসত বাড়িটা। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়েটাতেও অশান্তি হলে সঞ্জীবের দাদা সেই বাড়িরও ভাগ চায়। ইতিমধ্যে আরও কিছু ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয়, সঞ্জীবের এই বউও আত্মহত্যা করে। বউয়ের ভাই, যে-আবার সঞ্জীবদের দুই ভাইয়েরই শালা, সঞ্জীবের নামে পুলিশে অভিযোগ করেন। তার বোন মারা যাবার সময় সঞ্জীবের নামেই দোষ দিয়ে যায়। যাকে কোর্টের ভাষাতে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি বা ডাইং ডিক্লারেশন বলে।

পুলিশ রাত দুটোর সময় সঞ্জীবের বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে বেশ কয়েকদিন পুলিশ কাস্টডিতে রেখে তারপর আদালতে চালান করে। আদালত জামিন দেয়নি, তাই জেল হেপাজত।

কথাগুলো হেডস্যার অরুণবাবু প্রায় একশ্বাসে বলেন। শোনবার পরে গৌতমদের কেউই কোনও উত্তর দিতে পারেনি। এমনিতে সঞ্জীবের সঙ্গে গৌতমের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। কোনওদিন কোনওরকম ঝগড়া ঝামেলা না হলেও বিভিন্ন কারণে সঞ্জীবকে তার পছন্দ ছিল না। পরে অবশ্য নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছে, ‘সব মানুষ সবাইকে পছন্দ করে না, করতে পারে না। আমাকেও অনেকে পছন্দ করে না।’ কিন্তু স্বপ্নেও কোনওদিন সঞ্জীবের কোনও ক্ষতি চায়নি। এমনকী সেদিন হেডস্যারের মুখে কথাগুলো শুনে সঞ্জীব ও তার মায়ের জন্যে খুব খারাপ লেগেছে।

একভাবে কথাগুলো শুনে সেই ঘরে থাকা ভদ্রলোকটিও বেশ অবাক হয়ে গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘এমনও হয় বলুন, নিজের মায়ের পেটের ভাই…”। তারপর একটা বড়ো শ্বাস ছেড়ে কিছু সময়ের জন্যে চুপ করে যান। কিছু পরে বলেন, “আপনি দেখা করে আসুন। আমাকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে, এক্ষুণি গাড়ি আসবে। আসলে স্টাফ কম থাকলে যা হয়। আপনি কিছু খাবারও নিয়ে যেতে পারেন।’

—না কিছু আনা হয়নি। আসলে এখানে বাইরে থেকে খাবার দিতে দেয় কিনা সেটাও জানতাম না। কোনওদিন তো আসতে হয়নি।

গৌতম আর কথা না বাড়িয়ে স্লিপটা নিয়ে জেলখানার বড়ো গেটটার সামনে যায়। স্লিপটা জমা দেয়। একজন রোগা মতোন ভদ্রলোক স্লিপটা হাতে নিয়েই বলে উঠলেন, “এবার সেই একটার পর দেখা হবে, এখন লাঞ্চ চলছে।’

গৌতম ঘড়ি দেখে। বারোটা পনেরো বাজে, তার মানে এখনও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করবার পরে দেখা করবার সুযোগ পাবে। গৌতমের বাড়িও এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। স্কুলের পোশাকটা ছেড়ে আসবে তারও কোনও উপায় নেই। সংশোধনাগারের ভিতরে সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। একটা বড়ো লোহার গেটের এদিকে সবাই অপেক্ষা করে। কোথাও একবার শুনেছিল কিছু কিছু সংশোধানাগারে বড়ো বাগান থাকে। ভিতরের মানুষজন সেই বাগান দেখাশোনা করে। এখানে অবশ্য গৌতমের কিছু চোখে পড়েনি। কিছু সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। কয়েকটা নোটিশ টাঙানো আছে। জামিনের পর কীভাবে ছাড়ানো যাবে, কী কী কাগজ জমা করতে হবে তার একটা তালিকা দেখল।

গেটের এদিকে বসবার কোনও ব্যবস্থা নেই। যারা দেখা করতে এসেছেন তাদের অনেকেই মাটিতে বসে আছেন। গৌতম তাদের সবাইকে একবার দেখে নিল। কয়েকজনের হাতে বড়ো ব্যাগ আছে। সেই বয়স্ক ভদ্রলোক ও তার সঙ্গে আসা বাচ্চাগুলোর দিকেও চোখ গেল। একজন মাটিতেই বসে নিজের মনে খেলে যাচ্ছে, আরেকজন তার মায়ের কোলে আছে। এরা নির্বিকার থাকলেও বড়ো দু’জনের চোখমুখ এক্কেবারে অন্ধকার। তাদেরকে খুব অসহায় লাগল। বয়স্ক ভদ্রলোকের ব্যাগ থেকে একটা মেরি বিস্কুটের প্যাকেট উঁকি দিচ্ছে। তার বয়সি অথবা একটু ছোটো আরও দু’জনকে দেখল। তাদের একজনের হাতেও একটা থলি আছে।

(ক্রমশ…)

উইপোকা (শেষ পর্ব)

সুলগ্না ক্ষণিকের জন্য শিশির কাকার মুখটা মনে করে বলল – ‘একজনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার আছে। শাস্তি দেওয়ার আছে।’ সুনীতা কপাল সংকুচিত করে বললেন, ‘উচিত শিক্ষা! শাস্তি! তুই কী বলছিস কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না।’

সুলগ্না বলল, ‘একজন আমার ক্ষতি করেছে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আমাকে মলেস্ট করেছে। আমার সারা শরীর তার নোংরা হাতে স্পর্শ করেছে। এতদিন মুখ বুজে সহ্য করেছি। আর নয়।’

সুনীতা বললেন, ‘কী বলছিস তুই? তোর মাথার ঠিক আছে!’

সুলগ্না বলল, ‘হ্যাঁ মা, আমি ঠিকই বলছি। একবর্ণ মিথ্যে বলছি না।’ সুনীতা বললেন, “যে তোর এত বড়ো সর্বনাশ করল কে সে? বল মা।’

সুলগ্না আর্দ্র গলায় বলল, ‘মা, বাবার বন্ধু শিশির কাকা।’

সুনীতা চমকে উঠে বললেন, ‘শিশিরদা! তুই আমাকে বলিসনি তো আগে!’

সুলগ্না বলল, ‘বাবার দুর্ঘটনার সময় তুমি প্রায়ই বাবার সঙ্গে হসপিটালে থাকতে একথা শিশির কাকা আমার মুখ থেকে শুনেছিল। বাড়িতে তুমি আর বাবা না থাকার সুযোগে শিশির কাকা একদিন সন্ধ্যায় আমাকে জোর করে শারীরিক নির্যাতন করে। ভয় দেখিয়ে খারাপ আচরণ করে আমার সঙ্গে। দিদি কিছুটা হয়তো জানে। কিন্তু ও তো অসহায়। আমি মুখ খুলব বলে শিশির কাকা আমায় ভয় দেখায় যে, সে গ্রামের সকলকে জানিয়ে দেবে আমি কতটা নোংরা। শিশির কাকা ভয় দেখায় এই বলে যে, গ্রামের সকলে আমাদের একঘরে করে দেবে। আমি তখন অনেকটা ছোটো ছিলাম। ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি। কিন্তু দশ বছর কেটে যাওয়ার পরও ওই লোকটার নোংরা চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে। আজ সকালে টোটো থেকে নেমে আসার সময় নোংরা ইঙ্গিত করছিল। অর্পণের সঙ্গে সংসার বাঁধার আগে ওই লোকটাকে উচিত শিক্ষা দিতে চাই।’

সুনীতা বললেন, ‘জানোয়ারটা ওই কারণে সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার কাছে তোর খোঁজ নিচ্ছিল। আমি বুঝতেই পারিনি।” সুনীতা সুলগ্নাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুই এত বড়ো একটা ঘটনা কী করে আমার থেকে লুকিয়ে রাখলি! মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতার ফল ওকে ভোগ করতেই হবে।’ সুলগ্নার কানে কানে কী যেন বললেন সুনীতা। তারপর দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে শুয়ে পড়লেন।

পাঁচদিন সুলগ্নার গতানুগতিক ভাবেই বাবা-মা-দিদির সঙ্গে কেটে গেল। পাঁচদিন পর সুলগ্না পাড়ার দোকানে কিছু জিনিস কিনতে গেল। সেখানে পাড়ার এক কাকিমার সঙ্গে সুলগ্নার দেখা হতেই তার বাড়ির খবরাখবর নিতে শুরু করল। কথায় কথায় সুলগ্না সজোরেই বলল, ‘মায়ের শরীর ভালো নেই। আজ বিকেলে বাবাকে নিয়ে মা-ও ডাক্তার দেখাতে যাবে।’ অদূরে চায়ের দোকানে বসে শিশির কাকার কানে গেল সুলগ্নার কথাগুলো। তার মুখের লালায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকা গুটখা ফেলে উঠে দাঁড়াল।

শিশির কাকা সুলগ্নার পা অনুসরণ করতে করতে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়াল। সে সুলগ্নাকে জোর গলায় ডাকল— ‘এই শোন৷’ সুলগ্না হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে গেল। সে বলল, ‘পিছু ডাকলে কেন?’

শিশির কাকা সুলগ্নার কানের কাছে মুখ এনে বলল— ‘তোকে পিছু ডাকব না তো কাকে ডাকব। তুই তো আমার পিছুটান। তোর জন্যে আমি মরেও শান্তি পাব না রে। আজ বিকালে তোর বাপ-মা চলে গেলে সদর দরজাটা খুলে রাখিস। তোকে অনেকদিন ভালো করে দেখিনি। তোর পরিপুষ্ট ডগডগে গতরটা বহুদিন দেখিনি। এখন তো শহুরে জলে গতরে চিকনাই ধরেছে।’

সুলগ্না বলল, ‘ছি! ছি!’

শিশির কাকা বলল, ‘ছি ছি করিস না। যদি দরজা না খোলা দেখি তাহলে কী করব তোর নিশ্চয়ই মনে আছে। গ্রামের মানুষ তোকে দেখলে ছি ছি করবে। কথাটা মাথায় রাখিস।’

বিকালে সুলগ্নার বাবাকে বাড়ি থেকে বার করা হল। সুনীতাও সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে। এমন সময় সদর দরজায় মৃদু আওয়াজ হল। শিশির কাকা এল। সে ঘরগুলো চারদিক চেয়ে দেখল একটি ঘরে সুলগ্নার দিদি হুইল চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। সে ক্রূর হাসি হেসে সুলগ্নার কাছে এসে বলল— ‘বাগান খালি, আমিই মালি। ‘

সুলগ্না বলল— ‘কাকা, তুমি এসব বন্ধ করো। আমাকে মুক্তি দাও।’

শিশির কাকা সুলগ্নার পিঠে কাঁধে হাত বুলিয়ে বলল – ‘খোলাই হল না কিছু, বন্ধ করব কী রে! মুক্তি আমি মরলেই পেয়ে যাবি।’ সে হাসতে হাসতে সুলগ্নার গায়ের ওড়নাটা টান মেরে ফেলে দিল। সুলগ্নাকে জাপটে ধরে বলল – “তোকে না আমার খুব খেতে ইচ্ছে করে। খিদে পেয়েছে রে।’

সুলগ্না জোরে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও কাকা। দোহাই তোমার।’

শিশির কাকা বলল— ‘বহুদিন পর বাঘ হরিণ শিকার করলে কি ছেড়ে দেয় পাগলি!’

সুলগ্না সজোরে বলল— ‘ভালো হবে না কিন্তু কাকা৷’

শিশির কাকা ঠেলে সুলগ্নাকে বিছানায় ফেলে বলল— ‘ভালো হবে না খারাপ হবে সেটা দেখছি।’ সুলগ্না শিশির কাকার হাত থেকে বেরোবার প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, “ছেড়ে দাও আমাকে।’

সুনীতা সজোরে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বলল, ‘শিশিরদা, ছেড়ে দিন আমার মেয়েকে। আপনি যা অন্যায় করেছেন আমার মেয়ের সঙ্গে তার উপযুক্ত সাজা আপনি পাবেন। মানুষের মতো দেখতে হলেই সে মানুষ হয়ে যায় না। আপনার মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই।’ সুনীতাকে দেখে শিশির কাকার হাত আলগা হতেই সুলগ্না তার মায়ের পিছনে এসে দাঁড়াল।

শিশির কাকা বলল— ‘কী প্রমাণ আছে আমি তোর মেয়ের সঙ্গে অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি যদি সকলকে ডেকে বলি ওই তোর শহুরে ফেরত মেয়ে আমাকে ডেকেছিল শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য।’

সুনীতা শিশির কাকার গালে একটা সজোরে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘আর একটা নোংরা কথা আমার মেয়ের নামে নয়। আর প্রমাণ আমি দেব। এই দ্যাখো, তুমি যা যা একটু আগে আমার মেয়ের সঙ্গে করেছ, তার পুরো ভিডিও আমি জানালার বাইরে থেকে এই ফোনে তুলে রেখেছি। পুলিস এলেই হাতে তুলে দেব।’

শিশির কাকা সুনীতাকে রক্তচক্ষু বার করে বলল – ‘তবে রে শালি। দে ফোন দে।’

সদর দরজা ঠেলে স্থানীয় পুলিস অফিসার তার দলবল সহ বাড়িতে প্রবেশ করলেন। সুনীতা বললেন— ‘স্যার, আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম। নিয়ে যান এই শিশির দাস-কে। আমার মেয়েকে ভয় দেখিয়ে তার অনেক ক্ষতি করেছে। আমার মেয়ের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করার ভিডিও এই ফোনে আছে।’

শিশির কাকা হুমকি দিয়ে বলল – ‘তোদের মা-মেয়ে কাউকেই আমি ছাড়ব না। এর প্রতিশোধ আমি নেবই।’

সুলগ্না বলল, ‘আগে তো জেলের ঘানি টেনে এসো, তারপরে প্রতিশোধের কথা ভাববে।’

অফিসার তার দলবলকে বললেন, ‘এই লোকটাকে গাড়িতে তোলো। আর আপনারা কাল সকালে থানায় একবার দেখা করবেন।’

শিশির দাস-কে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল পুলিস। পূর্ণিমার গোলাকার চাঁদের আলো সুনীতার বাড়িকে তখন যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সুনীতার বুকে সুলগ্না একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল— ‘মা।’ সুনীতা মেয়ের কপালে সোহাগ চুমু খেয়ে মৃদু হাসলেন।

সুবর্ণরেখার তীরে (শেষ পর্ব)

সকলেই হতবাক। কেউ আগে থেকে মুখ খুলতে রাজি নয়। আজকের দিনে এমন কথা কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে তা বাড়ির সদস্যরা কেউ ভাবতেই পারছিল না। অসম্ভব অবাস্তব ঠেকছিল কথাটা। ভাবলেশহীন হয়ে সবাই শিবনাথের দিকে এক দৃষ্টে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। চোখে-মুখের অভিব্যক্তি দেখে প্রতীতি হচ্ছিল যেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নিষেধ। যদিও বা কেউ দিতে চায় তাহলে হয়তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে আসবেন এই ধরিত্রীর বুকে বাধা দেওয়ার অছিলায়।

শিবনাথ ক্রমশ‍ই অধৈর্য হয়ে উঠছিল। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে— তোমরা সকলে চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো।

—আজকে ওদের বাড়িতে কাজ। মা এগিয়ে এসে জবাবদিহি করেন।

—কাজ? কীসের কাজ? শিবনাথের মনে অপার কৌতূহল।

—চিঠিতে তোকে সবকিছু বিস্তারিত ভাবে জানানো হয়েছিল। ছোটো বোন কৃষ্ণা বলে ওঠে, তুই পাসনি আমাদের লেখা সেই চিঠি?

—না, সম্প্রতি আমি তোমাদের একটিও চিঠি পাইনি। যেটা পেয়েছিলাম তা প্রায় বাইশ-পঁচিশ দিন আগের। তাতে বিশেষ কোনও সংবাদ ছিল না। গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে শিবনাথের স্পষ্ট জবাব।

—অতনু আর নেই আমাদের মধ্যে। ও মারা গিয়েছে। অগত্যা কৃষ্ণা বলতে বাধ্য হয় আজ ওর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

—অতনু মারা গিয়েছে? এইসব কি বলছিস তুই? শিবনাথের মনে ঘোর অবিশ্বাস।

কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র মনে হয়েছিল যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শিবনাথের বোধগম্য হচ্ছিল না। অবিশ্বাস্য লাগছিল। বোধহয় এর চেয়ে অবাক হওয়ার মতো দুঃসংবাদ সংসারে আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। অতনুর মুখচ্ছবিটা জ্বলজ্বল করে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয় অন্ধকার কোনও প্রেক্ষাগৃহে বসে সে ছায়াছবি দেখছে। একমনে সে তখন অতনুর কথাই চিন্তা করতে থাকে। নিথর নিস্পন্দ জড়বৎ হয়ে শিবনাথ কেবলই ভাবতে থাকে কিছুক্ষণ আগের দেখা অতনুর কথা। অতনুর আসল পরিচয়টা কী তাহলে— সে ছায়া না কায়া? কিছুক্ষণ আগেও সে অতনুর মুখোমুখি বসে গল্প করে এসেছে। কথাচ্ছলে রাঁচির কত অজানা তথ্য সে জানতে পেরেছে। এগুলো কী সব অলীক? একে একে অতনুর মুখে বলা কথাগুলো স্মরণ করে সে রোমন্থন করতে থাকে। রহস্য তবু রহস্যই থেকে যায়। মৃত্যুর কূলকিনারা খুঁজে পায় না শিবনাথ।

আরও কিছু তথ্য আবিষ্কারের দুর্বার আশায় সে সকলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে— হঠাৎ এসব হল কী করে?

এবার বাড়ির লোকদের হয়ে জবাবদিহি করেন মা। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো ছিল রে। একটা ক্রমবর্ধমান অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওকে অকালে প্রাণ হারাতে হল। পাড়ার বন্ধুর পান দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ও যখন গল্প করছিল ঠিক সেই সময় কয়েকটা অবাঙালি আদিবাসী গুন্ডা এসে রাস্তার পারের দোকানগুলো থেকে ভয় দেখিয়ে হপ্তা আদায় করছিল। ওটা নাকি ছিল ওদের রুজি রোজগারের একমাত্র পথ এবং অনেক বছর ধরেই নাকি চলছিল। লেখা নেই, পড়া নেই চাকু হাতে সবাইকে ভয় দেখিয়ে গুণ্ডামি করেই ওদের দিন কাটে। প্রাণের ভয়ে দোকানদারেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহে কিছু টাকা ওদের হাতে তুলে দিত। ব্যাপারটা অতনুর জানা ছিল না হয়তো বা জানলেও সেদিন ও সহ্য করতে পারেনি। দোকানদারের হয়ে ও ওদের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারপর যা হওয়ার ছিল না, তাই ঘটে গিয়েছিল। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার মিনিট পনেরোর মধ্যে ছেলেটা রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার উপরে লুটিয়ে পড়েছিল। আজ ওর মৃত্যুতে পাড়াশুদ্ধু লোক কাঁদছে। ওর নামে একটি স্মৃতিসংঘ খোলা হয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, অঘটনের ঠিক আগের দিন ও আমাদের বাড়িতে এসে তোর খবর নিয়ে গিয়েছিল। পুজোতে তুই আসবি জেনে খুব খুশি হয়েছিল।

বিস্ময়ের ঘোর তবু কাটে না শিবনাথের। হাজার প্রশ্নের ভিড়ে সময় পায় না নিজের কথা ভাববার। তারপর একটু প্রকৃতস্থ হলে শিবনাথ বলে— কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, ওর সাথে আমার একটু আগেই দেখা হয়েছে। আমরা দু’জনে একসাথে গল্প করতে করতে এলাম। তারপর আদ্যোপান্ত যা ঘটেছিল সকলকে জানাল সেই কথা। এবার অবাক হওয়ার পালা বাড়ির সদস্যদের। আনুপূর্বিক সবকিছু বলা হয়ে গেলে পরে গ্রাস করে নিস্তব্ধতা।

হঠাৎ এক সময় মা বলে ওঠেন— তুই আসছিস জেনে ও যে মনে মনে খুব খুশিই হয়েছিল এটা পরিষ্কার হয়ে গেল। তোকে দেখা দিয়ে গেল।

শিবনাথ জানায়— ও নিজের মুখে স্বীকার করেছিল যে, ওর দিনলিপি লেখার অভ্যেস ছিল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওর মুখে বলা কথাটা ডায়ারির পাতায় আদৌ কোথাও লেখা আছে কিনা— ‘মৃত্যুর পরে আমার পার্থিব শরীর যেন এই সুবর্ণরেখার তীরেই সৎকার করা হয়।”

—যাক ওর শেষ ইচ্ছেটা আর অপূর্ণ থাকেনি। কৃষ্ণা আরও বলে, ও যা চেয়েছিল সেটাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সুবর্ণরেখার তীরেই ওকে দাহ করা হয়েছে।

মা তারপর শিবনাথকে সাবধান করতে গিয়ে বলেন— আজকে ওদের বাড়িতে কাজ। বাড়ির মানুষদের মন মেজাজ কারওরই বিশেষ ভালো নয়। যা জানার পরে এক সময় জেনে নিস সময় সুযোগ করে। অন্তত আজকে এই ব্যাপারে ওদের বিরক্ত করিস না যেন। দিনলিপির কথাটা পরে উত্থাপন করলেও চলবে। তুই তো আছিস ক’টা দিন এখানে। সুতরাং দু’দিন দেরি হয়ে গেলে কোনও ক্ষতি হবে না। বেদ অশুদ্ধ হবে না, আর যাই হোক। এটা মা হয়ে তোর কাছে আমার একান্ত অনুরোধ।

একটা ঘরে ফেরার গল্প (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অর্জুন কে চুপ হয়ে যেতে সাঞ্ঝা আবার প্রশ্ন করল, ‘কেন স্কুল থেকে পালালে?’

—যার বাপ-মা নেই, সে তো অনাথ। অনাথের আবার ঘর কীসের! পরিবার কীসের! বাপ-মায়ের পদবি, নিজের নাম থেকে মুছে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছোলাম এই হাওড়া স্টেশনে। সাথে ছিল আমার স্কুলের বইপত্র ভর্তি একটা স্কুলব্যাগ। রাতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে একা একা বসে, সেই বইগুলো পড়তাম। খিধে পেলে এর ওর কাছ থেকে খাবার চাইতাম। কেউ কেউ কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কেউ আবার দয়া পরবেশ হয়ে আধ-খাওয়া খাবার ছুড়ে দিত। ধীরে ধীরে রেল পুলিশ থেকে শুরু করে, অনেক নিত্যযাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকদের নজরে পড়লাম আমি। আসা যাওয়ার পথে, তাদের অনেকেই যেচে এসে আমার সাথে কথা বলতেন। পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দিয়ে, বড়ো হয়ে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, তার জন্য উৎসাহ দিতেন তাঁরা। এইরকমই একজনের অনুপ্রেরণায়, উদ্যোগে ন্যাশনাল ওপেন স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। মাঝেমধ্যে হাওড়া স্টেশনে কোনও গণ্ডগোল হলে, পুলিশের তাড়া খেয়ে, কলকাতার দিকে পালিয়ে যেতাম। তখন কোনওদিন ধর্মতলায় মেট্রো-সিনেমার নীচে, কোনওদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সামনের ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটাতাম। এইরকম ভাবে চলতে চলতে একদিন মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে গেলাম। ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। বড়ো এক সরকারি অফিসারের পরামর্শে কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারের চাকরির পরীক্ষায় বসলাম। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কলকাতার এক অফিসে অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হলাম। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে মন চায়নি কোনওদিন। গত তিন বছর ধরে, এদেরকে নিয়েই আছি এইখানে। আমাকে নিয়ে মোট একুশজনের বাস এখানে। তুমি থাকতে চাইলে, আমরা বাইশজন হব…!

ওর পোষ্যদের সারাদিনের দায়িত্ব শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝা’র উপরে চাপিয়ে দিয়ে, এর পরে আরও বছর তিনেক বেশ নিশ্চিন্তে কলকাতায় তার অফিস-কাছারির কাজ সামাল দিয়েছে অর্জুন। রোজ সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে ফিরে এসে হ্যাজাক জ্বেলে পোষ্যদের নিয়ে যথারীতি রাতস্কুল চালিয়েছে সে। ইত্যবসরে শ্রাবণী যেমন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে, সাঞ্ঝাও মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিল্টু আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। কিন্তু অর্জুনের মাথায় ঘুরছে, আরও অনেক বড়ো পরিকল্পনা। গত এক বছরে অফিসের বড়ো কর্তাদের কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছে সে— রাঁচি শহরে তার ‘বদলি’ প্রার্থনা করে।

নতুন বছরের শুরু থেকেই শ্রাবণী, সাঞ্ঝা ও অর্জুন— তিনজনের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে; বিল্টুকে দিয়ে যে করেই হোক মাধ্যমিকে ভালো ফল করাতেই হবে। সেই দিনটা ছিল, বিল্টুর মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। বিল্টুকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে, অর্জুন অফিসে ঢুকতেই, বড়োকর্তা অর্জুনের হাতে ওর বহু-প্রার্থিত ‘রাঁচি-বদলির’ অর্ডারটা ধরিয়ে দিলেন।

অগত্যা রাঁচি যাওয়ার আগে, শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝার উপর তার পোষ্যদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, অর্জুন ওদেরকে জানাল, ‘সামনে আমাদের অনেক বড়ো দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এখন সবার আগে আমাকে রাঁচিতে গিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। তারপরে আমার সব পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ করতে পারলেই, এখানে ফিরে এসে তোদের সবাইকে নিয়ে রাঁচি চলে যাব। ততদিন তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই রাত-স্কুল চালানোর সব দায়িত্ব তোদের উপরেই রইল।”

এর প্রায় বছর খানেক বাদে, একদিন ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পার মন্দিরে ছিন্নমস্তা দর্শন সেরে, অর্জুনের কলকাতা অফিসের প্রাক্তন বড়োকর্তা অম্বরীশবাবু ট্রেকারে করে, রামগড় সদর মোড়ে এসে নামলেন। সেখান থেকে ট্রেকার পালটে রাঁচি যেতে হবে। ট্রেকার স্ট্যান্ডে পৌঁছে, রাঁচি যাওয়ার একটা ট্রেকারে উঠে বসতেই, অম্বরীশবাবুর সাথে অর্জুনের দেখা হয়ে গেল।

অর্জুনই প্রথমে কথা বলল, ‘স্যার, আপনি এখানে?’

—এই তো কাল এসেছি এখানে। রাজরাপ্পা গিয়েছিলাম; ছিন্নমস্তা দর্শনে। আজ রাতেই রাঁচি থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরব। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? তোমার তো এখন রাঁচিতে থাকার কথা, অম্বরীশবাবু জানতে চাইলেন অর্জুনের কাছে। অর্জুন এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, তার পাশে বসা দুই মহিলার সাথে অম্বরীশবাবু’র পরিচয় করিয়ে দিল।

—এদের কথা আপনাকে আমি আগে অনেকবার বলেছি; আজ এদের সাথে দেখা হয়ে গেল আপনার। এর নাম শ্রাবণী, আর এ হচ্ছে সেই সাঞ্ঝা। আপনি তো জানেন, ও ভুটকি গ্রামের মেয়ে। সেই ভুটকি গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে, সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল চালু করেছি। সেটা এখন সাঞ্ঝাই চালায়। আশপাশের গ্রাম থেকে আপাতত জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী পাওয়া গিয়েছে। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে সকলের। সাঞ্ঝাকে ফিরে পেয়ে, শুধু ওর পরিবার নয়, গোটা মহকুমার মানুষ উল্লসিত, গর্বিত। বিডিও, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে জেলা শাসক পর্যন্ত, সকলেই সাঞ্ঝার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে, ওর এই কৃতিত্বকে সাধুবাদ জানিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

অর্জুনের কথা শুনে অম্বরীশবাবু’র চোখেমুখে খুশির ঝলক। অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “বাঃ! এ তো দারুণ খবর! তবে এ তো গেল সাঞ্ঝার কথা। শ্রাবণী কী করছে এখন?”

—এই রামগড়ে আপাতত একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, অনাথ শিশুদের সেখানে রেখে, তাদের পড়াশোনার একটা বন্দোবস্ত করেছি। তবে আমি আমার অফিস সামলে, ওদের দেখাশোনা করার জন্য কতটুকুই বা আর সময় পাই! অনাথ আশ্রমের সবটা শ্রাবণী’ই দেখাশোনা করে।

—আর তোমার হাওড়া স্টেশনের পোষ্যদের কী খবর? তাদেরকে তুমি রামগড়ে নিয়ে এসেছ না-কি!

—না, না! ওরা ওদের জায়গাতেই আছে। প্রতি শনি-রবিবার দুটো দিন হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পোষ্যদের কাছে ছুটতে হয় আমাকে। সারা সপ্তাহ ধরে বিল্টুই ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলায়। তবে সম্প্রতি ও আবার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগামী বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে সে। ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে, ওদের সবাইকে রামগড়েই নিয়ে আসার কথা ভাবছি। কিন্তু এতজনকে রাখতে গেলে, নিজেদের একটা বড়ো বাড়ি হলে ভালো হয়।

কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অর্জুন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আবার কথায় ফিরে আসে সে, ‘এই দেখুন, কথা বলতে বলতে আসল লোকের সাথেই তো আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছি। এ হচ্ছে, আমাদের সেই শান্তা। ও এখন এখানকার স্থানীয় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে পড়ছে। এই রামগড়ের আশ্রমে, শ্রাবণীর হেফাজতেই থাকে ও। শান্তা এখনও একই রকমের শান্ত। তবে ও শুধু আমাকে জানিয়েছে যে, ও বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায়।’ শান্তাকে আদর করতে করতে অম্বরীশবাবুর সঙ্গে শান্তারও পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলল না অর্জুন।

সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে, অম্বরীশবাবু অর্জুনের কাছে জানতে চাইলেন, “কিন্তু এই ছুটির দিনের সকালে, এমন সদলবলে তুমি কি হাওড়ায় চললে না-কি?’

না, না, এই সপ্তাহে আমার আর হাওড়া যাওয়া হচ্ছে না। তবে আমার বদলে এই সপ্তাহে শ্রাবণী হাওড়া যাচ্ছে আজ। দু’দিন থেকে, পরশু দিন ফিরে আসবে ও।

অর্জুন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, অম্বরীশবাবু ফিরে জানতে চাইলেন, “তাহলে তুমি চললে কোথায়!”

—সম্প্রতি দাদু’র সাথে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই জানলাম, ইদানীং দাদুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দাদুকে আমার বর্তমান কর্মকাণ্ডের কথা সব জানিয়েছি!

—সব! অম্বরীশবাবু’র গলায় এবার অন্য রকমের সুর!

—হ্যাঁ, সব! তাই দাদুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে, দীর্ঘদিন বাদে আজই প্রথম ঘরে ফিরতে চলেছি আমি। অম্বরীশ চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলতে বলতে মুচকি হেসে এবার সাঞ্ঝার দিকে একবার তাকাল অর্জুন!

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৬ পর্ব)

৬ পর্ব

তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে, অর্জুনের ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স’-এর কোনও হদিশ করতে পারল’ না নিখিল। প্ল্যাটফর্মের দোকানদার থেকে শুরু করে, রেলের বিভিন্ন কর্মচারীদের কাছে অর্জুনের খোঁজ করার পরে, সবার কাছ থেকে একই কথা জানতে পারল নিখিল, ‘অর্জুন সরকারি চাকরি করে। কলকাতায় ওর অফিস। সারাদিন সেখানকার কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার পরে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে অর্জুন। ওখানেই রাতে ওর পোষ্যরা আসবে, ওদের অর্জুন স্যারের কাছে পড়াশোনা করতে। তারপরে পড়াশোনা শেষ হলে, পোষ্যদের খাইয়ে দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, ওই স্টেশন চত্বরেই যেদিন যেখানে মর্জি, সেখানে বিছানা পেতে রাত কাটিয়ে দেয় অর্জুন।”

পরদিন সকালে নিখিল অফিসে পৌঁছে, বড়োকর্তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। গতকাল সন্ধ্যায় সংগ্রহ করা, অর্জুন স্যার সংক্রান্ত সবিশেষ তথ্য বড়োকর্তাকে জানাতে জানাতে চোখের কোণে আঙুল ছোঁয়াল নিখিল। ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স বলে কোথাও কোনও ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই স্যার। তবে আপনার ফাইলে যা তথ্য রয়েছে, তার কোনওটাই অসত্য নয়। কোনও অনাথ ছেলে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জীবন কাটিয়ে, মাস্টার্স ডিগ্রি করে, সরকারি অফিসের অফিসার হতে পারেন, তা আমাদের অর্জুন-স্যারকে না দেখলে কোনওদিন বিশ্বাসই করতে পারতাম না। শুধু তাই নয়; সারাদিন এই অফিসে এইভাবে নিজেকে উজাড় করে পরিশ্রম করার পরে, রাতে আবার ওই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফিরে গিয়ে, বহু অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসান। তারপরে তাদের রাতের খাবার খাইয়ে, ওদের সাথেই প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে, পরদিন আবার যে-কেউ এইভাবে অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারে; তা অর্জুন স্যারকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। অর্জুন স্যার আমাদের ভগবান!” দু’-হাত কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে অম্বরীশ চ্যাটার্জীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল নিখিল।

ওদিকে পরপর পাঁচদিন অফিস কামাই হওয়ার পরে, নিখিল যেদিন অর্জুনের খোঁজে হাওড়া স্টেশনে এসেছিল, সেদিনই সকালে শ্রাবণীকে সঙ্গে নিয়ে, এস আই জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন গিয়েছিল হাসপাতালেই। সাঞ্ঝাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে, সন্ধ্যার পরে যথারীতি হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, সাঞ্ঝাকে নিয়ে ফিরে এল অর্জুন। হাওড়া স্টেশন চত্বরে পা রাখতেই, রেল পুলিশের লোকজন, প্ল্যাটফর্মের স্টলমালিকরা থেকে শুরু করে, তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওর পোষ্যরা সকলেই এসে অর্জুনকে জানাল, ‘আজ তোমার অফিস থেকে তোমার খোঁজে একজন লোক এসেছিলেন। তোমার বাড়ি, ঘরদোর সম্বন্ধে খোঁজ করছিলেন তিনি।’

একথা শোনার পরে অর্জুনের কাছে সাঞ্ঝা জানতে চাইল, ‘আপনার ঘর এখান থেকে কতদূর?”

সাঞ্ঝার কথায় মুচকি হেসে অর্জুন জানাল, ‘এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া গোডাউনের পাঁচিল ঘেঁষেই আমাদের সবার ঘরবাড়ি। আমাদের সবার মানে, আমাদের এই ক’জন অনাথের।’

—কিন্তু সবাই যে বলছে, আপনি অফিসে চাকরি করেন! তাহলে কাছাকাছি কোথাও আপনার বাড়িঘর আছে নিশ্চয়ই।

—সে ছিল একসময়। রাঁচি স্টেশনের দক্ষিণদিকের রেল কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আমরা মানে মা-বাবা, দাদু ও ঠাকুমা। আমার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। দিল্লির একটা নামকরা হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে রাঁচি আসতেন। হঠাৎ করে কী একটা গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে গেলেন তিনি।

—তারপর… অর্জুন কথা বলতে বলতে একটু থামতেই, ফিরে জানতে চাইল সাঞ্ঝা।

—তারপর আর কী! আমার মা ছিলেন রাঁচির একটা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা। মা যে স্কুলে পড়াতেন, আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মা নেই। বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে দাদুকে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। এর পরে আমার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ল দাদুর উপরে। দাদু আমাকে রোজ স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।

অর্জুন বলতে লাগল, ‘স্কুলে গেলেই সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই আমার কাছে আমার মা-বাবা’র সম্বন্ধে জানতে চাইত। দিনের পর দিন সেটা আমার কাছে ভীষণ অসহনীয় লাগতে লাগল। একদিন স্কুল থেকে আমিও পালালাম!’

ক্রমশ…

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৫ পর্ব)

জঙ্গল থেকে ঘাস-পাতা সংগ্রহ করে, ওই ঘরের মেঝেতে পেতে তার উপরে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হয়। গ্রামের প্রান্তের ওই স্থান চারিদিক থেকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সারারাত ভয়ে-যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকতে হয়, একেকটা দশ-এগারো বছরের শিশুকন্যাকে। ওই পাঁচ-ছ’টা দিন ওদেরকে এতই অস্পৃশ্য মনে করে সবাই যে, পরিবারের কোনও লোক, কোনও খোঁজ নিতেও আসে না তাদের। ওই জঙ্গলঘেঁষা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই ঘরের ধারেকাছে কোথাও কোনও জলের সংস্থানও নেই। নিজেকে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করার কোনও উপায় পর্যন্ত নেই। ওদের গ্রামের মেয়েরা অনেকে ওই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণেই মারা যায় সেখানে।

ওর মা-ঠাকুমাকেও ছোটো থেকে দেখেছে সাঞ্ঝা— প্রতিমাসে ওই পাঁচ-ছ’টা দিন বাড়ি ছেড়ে, ছোটো বাচ্চাদের ঘরে ফেলে রেখে, গ্রামের প্রান্তের ওই ঘরে দিন কাটাতে চলে যেতে। বছর তিনেক আগে সাঞ্ঝা’র মাকে এইরকমই একরাতে ভাল্লুকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে মায়ের সাথে আর কোনওদিন দেখা হয়নি সাঞ্ঝার।

সাঞ্ঝার বাবা ঝরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করে। মা মারা যাওয়ার পরে বাবা আর কোনওদিন বাড়িতে ফেরেনি। দাদু-ঠাকুমার কাছে মানুষ হচ্ছিল সাঞ্ঝা। পড়াশোনা করার জন্য ওদের তুটকি গ্রাম থেকে বিশ কিলোমিটার দূরের মাঞ্চুগঞ্জের স্কুলে বছরের পর বছর আসা যাওয়া করে, দশ ক্লাস পাশ করে, এগারো ক্লাস পেরিয়ে বারো ক্লাসে উঠেছে সাঞ্ঝা। তাই সাঞ্ঝা ভাবে, অন্যায় অবিচারে ভরা এই সামাজিক কু-প্রথাকে যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে আর পড়াশোনা করে আমার লাভটা কী! এই গ্রাম ছেড়ে, জেলা ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে পালাতে না পারলে, আমার অবস্থাও একদিন আমার মায়ের মতনই হবে।

পাঁচদিনের প্রথম দিনটা এইসব ভাবতে ভাবতে অতিবাহিত হয়ে যায়। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাউকোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সাঞ্ঝা। বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, সাঞ্ঝা এসে পৌঁছোয় গোধিয়ার সতেরো মাইল বাসরাস্তার উপরে। একটা কয়লা বোঝাই লরিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করায় সাঞ্ঝা। লরি থেকে একটা লোক নেমে এসে, ও কোথায় যেতে চায়, জানতে চাইলে তাকে ওই অঞ্চল ছেড়ে ওর পালানোর ইচ্ছার কথা, কারণ সহ সবিশেষে জানানোর পরেই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সাঞ্জা জ্ঞান হারায়। মাঝরাতে সাঞ্ঝা নিজেকে আবিষ্কার করে, একটা চলন্ত ট্রেনের টয়লেটের মেঝেতে পড়ে আছে। তারপর সাঞ্ঝা আর কিছু জানাতে পারে না অর্জুনকে!

পরপর ক’দিন এই ভাবে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আর হাসপাতালে যাতায়াতের ফলে, অফিসমুখো আর হতে পারেনি অর্জুন। আজ প্রায় বছর চারেক হল, ডালহৌসি পাড়ার কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের এক দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে অর্জুন। ঝড় হোক, জল হোক, হাজার দুর্যোগেও অর্জুনের গরহাজিরা কারও চোখে পড়েনি কোনওদিন। এহেন অর্জুন বিনা কোনও সংবাদে, এইভাবে যে কোথাও উধাও হয়ে যেতে পারে, তা বুঝে উঠতে পারেন না তার অফিস কর্তা অম্বরীশ চ্যাটার্জী।

গত চার-পাঁচদিন ধরে অর্জুনকে যতবারই মোবাইল ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন উনি, ততবারই হয় ‘নো আনসার’, নয় তো জানতে পেরেছেন অর্জুনের ফোনটা রয়েছে ‘পরিষেবা সীমার বাইরে’। অর্জুনের চাকরির নিয়োগপত্র ও জয়েনিং লেটার সম্বলিত ফাইলটা বের করে বারকয়েক চোখ বোলালেন অম্বরীশ। সব জায়গাতেই ওর স্থায়ী ঠিকানা লেখা রয়েছে, ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড রেসিডেন্স, প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেইশ, হাওড়া স্টেশন’। নামের জায়গায় লেখা শুধু ‘অর্জুন’; পদবির কোনও উল্লেখ নেই কোথাও। মা- বাবার নামের পাশে লেখা, ‘নট-অ্যাপ্লিকেবল’; বন্ধনীর মধ্যে লেখা ‘অরফ্যান’। শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লেখা রয়েছে, “ইতিহাসে এমএ’।

অম্বরীশবাবু ফাইল থেকে অর্জুনের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে, তা অফিস পিওন নিখিলের হাতে দিয়ে, ওকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, একবার অর্জুনের খোঁজে যেতে বললেন। নিখিল যথারীতি বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। লঞ্চে নদী পেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল সে।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৪ পর্ব)

৪ পর্ব

আরও ঘণ্টা-দুয়েক মাথার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরে, অর্জুনরা দেখল, মেয়েটা চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে, খোট্টা ভাষায় অর্জুন মেয়েটার কাছে জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?” —সাঞ্ঝা, সাঞ্ঝা ওঁরাও!

—ঘর কোথায় তোমার?

—ভুটকি গ্রাম; তহসিল মাণ্ডু; জিলা রামগড়।

—এখানে এসেছ কেন? ট্রেনেই বা চড়েছিলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দিতে পারল না সাঞ্ঝা। আবার চোখ বুজল সে। এস আই জয়ন্ত ঘোষ এবার রোগীর বেডের পাশের বসার টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অর্জুনকে বলল, “এবার আমাকে ফিরতে হবে অর্জুন। আমার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ফিরে রিপোর্ট করতে হবে অফিসে। তবে এ তো মনে হচ্ছে, তোমার ঝাড়খণ্ডেরই লোক। যেসব জায়গার নাম বলছে ও, তার কিছু কি চিনতে পারলে তুমি?”

এস আই সাহেবের প্রশ্নের জবাবে অর্জুন জানাল, ‘হ্যাঁ, ভুটকি হচ্ছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রামগড় জেলার উত্তর প্রান্তের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। রাঁচি থেকে পঁচাশি কিলোমিটার, আর রামগড় সদর শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম ‘ভুটকি’। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হচ্ছে মাণ্ডু। তাও প্রায় বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে নিকটবর্তী বাস রাস্তা হচ্ছে একশো নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে অবস্থিত গোধিয়া সতেরো মাইল; ভুটকি থেকে যার দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। ভুটকির উত্তর এবং পশ্চিম দিক হাজারিবাগের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা— সেই প্রত্যন্ত ভুটকি থেকে মেয়েটা রাঁচি এল কী করে! আর সেই সুদূর রাঁচি থেকে এই হাওড়া স্টেশনেই বা ও এল কী উদ্দেশ্যে!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অর্জুন আবার জানাল, আপনি এখন ফিরে যান ঘোষদা। আমি আরও একটু থেকে দেখি; যদি কিছু জানতে পারি ওর সম্বন্ধে। তবে ফিরে গিয়ে আপনি যদি একটা কাজ করে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়। হাওড়া স্টেশনে ফিরে, আপনার কাজকর্ম সেরে, একটু তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আমার পোষ্যগুলোকে বলবেন, হ্যাজাকটা জ্বেলে নিয়ে ওরা যেন পড়তে বসে যায়। সামনেই ওদের পরীক্ষা। কাল ঝড়-বৃষ্টির দরুন পড়াশোনাটা হয়নি ঠিকমতো। আজকে যেন ওরা পড়াশোনাটা শুরু করে দেয়। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফিরে গিয়ে জানতে চাইব—কে কী পড়ল! আর বিল্টুকে একটু আলাদা করে ডেকে বলে দেবেন, কোনও কারণে আমার ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে ও যেন সবাইকে ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়।”

সন্ধ্যার পরে সাঞ্ঝা চোখ মেললে, ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অর্জুন আবার জানতে চাইল, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমাকে এখানে এই হাওড়া স্টেশনে কে নিয়ে এসেছে?”

—কেউ না, আমি একাই এসেছি! কিন্তু আমি এখন কোথায়? অর্জুনের কাছে চোখ বুজেই জানতে চায় সাঞ্ঝা।

—তুমি রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলে। সেখান থেকে তোমাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি ভুটকি থেকে রাঁচিতেই বা এসেছিলে কেন? আবার ট্রেনে করে হাওড়াতেই বা এলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না সাঞ্ঝা। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দু’-হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে, নিজের বুকফাটা যন্ত্রণার কথা সব উজাড় করে দেয় সে। ওর ভুটকি গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা, মনের দরজা খুলে, সব বাইরে বের করে আনে সাঞ্ঝা।

সাঞ্ঝার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার তুটকি গ্রামে। তার পুরো নাম সাঞ্ঝা ওঁরাও। ছোটোবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। স্কুলের এগারো ক্লাস পাশ করে এখন সে বারো ক্লাসে পড়ে। ওদের গ্রামের ছাউপদি প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই ওর ঘর ছাড়া। এটা শুধু ওর গ্রামের প্রথা নয়; এটা গোটা গ্রামীণ ঝাড়খণ্ডের দুঃসহ এক প্রথা। এই প্রথার শিকার হয়ে, সেই দশ-এগারো বছর বয়স থেকে প্রতিমাসে ঋতুস্রাবকালীন পাঁচ-ছয়দিন ওর গ্রামের বাড়ি-ঘর ছেড়ে, গ্রামের বাইরে একটা চালা ঘরের মধ্যে গিয়ে থাকতে হয় ওকে। এ যন্ত্রণা শুধু সাঞ্ঝার নয়। ওখানকার আপামর সব মহিলাদের এই প্রথা মেনে চলতে হয়। সেই ঘরের না আছে কোনও দরজা, না আছে কোনও জানলা।

ক্রমশ…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব