সুবর্ণরেখার তীরে (শেষ পর্ব)

সকলেই হতবাক। কেউ আগে থেকে মুখ খুলতে রাজি নয়। আজকের দিনে এমন কথা কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে তা বাড়ির সদস্যরা কেউ ভাবতেই পারছিল না। অসম্ভব অবাস্তব ঠেকছিল কথাটা। ভাবলেশহীন হয়ে সবাই শিবনাথের দিকে এক দৃষ্টে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। চোখে-মুখের অভিব্যক্তি দেখে প্রতীতি হচ্ছিল যেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নিষেধ। যদিও বা কেউ দিতে চায় তাহলে হয়তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে আসবেন এই ধরিত্রীর বুকে বাধা দেওয়ার অছিলায়।

শিবনাথ ক্রমশ‍ই অধৈর্য হয়ে উঠছিল। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে— তোমরা সকলে চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো।

—আজকে ওদের বাড়িতে কাজ। মা এগিয়ে এসে জবাবদিহি করেন।

—কাজ? কীসের কাজ? শিবনাথের মনে অপার কৌতূহল।

—চিঠিতে তোকে সবকিছু বিস্তারিত ভাবে জানানো হয়েছিল। ছোটো বোন কৃষ্ণা বলে ওঠে, তুই পাসনি আমাদের লেখা সেই চিঠি?

—না, সম্প্রতি আমি তোমাদের একটিও চিঠি পাইনি। যেটা পেয়েছিলাম তা প্রায় বাইশ-পঁচিশ দিন আগের। তাতে বিশেষ কোনও সংবাদ ছিল না। গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে শিবনাথের স্পষ্ট জবাব।

—অতনু আর নেই আমাদের মধ্যে। ও মারা গিয়েছে। অগত্যা কৃষ্ণা বলতে বাধ্য হয় আজ ওর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

—অতনু মারা গিয়েছে? এইসব কি বলছিস তুই? শিবনাথের মনে ঘোর অবিশ্বাস।

কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র মনে হয়েছিল যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শিবনাথের বোধগম্য হচ্ছিল না। অবিশ্বাস্য লাগছিল। বোধহয় এর চেয়ে অবাক হওয়ার মতো দুঃসংবাদ সংসারে আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। অতনুর মুখচ্ছবিটা জ্বলজ্বল করে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয় অন্ধকার কোনও প্রেক্ষাগৃহে বসে সে ছায়াছবি দেখছে। একমনে সে তখন অতনুর কথাই চিন্তা করতে থাকে। নিথর নিস্পন্দ জড়বৎ হয়ে শিবনাথ কেবলই ভাবতে থাকে কিছুক্ষণ আগের দেখা অতনুর কথা। অতনুর আসল পরিচয়টা কী তাহলে— সে ছায়া না কায়া? কিছুক্ষণ আগেও সে অতনুর মুখোমুখি বসে গল্প করে এসেছে। কথাচ্ছলে রাঁচির কত অজানা তথ্য সে জানতে পেরেছে। এগুলো কী সব অলীক? একে একে অতনুর মুখে বলা কথাগুলো স্মরণ করে সে রোমন্থন করতে থাকে। রহস্য তবু রহস্যই থেকে যায়। মৃত্যুর কূলকিনারা খুঁজে পায় না শিবনাথ।

আরও কিছু তথ্য আবিষ্কারের দুর্বার আশায় সে সকলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে— হঠাৎ এসব হল কী করে?

এবার বাড়ির লোকদের হয়ে জবাবদিহি করেন মা। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো ছিল রে। একটা ক্রমবর্ধমান অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওকে অকালে প্রাণ হারাতে হল। পাড়ার বন্ধুর পান দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ও যখন গল্প করছিল ঠিক সেই সময় কয়েকটা অবাঙালি আদিবাসী গুন্ডা এসে রাস্তার পারের দোকানগুলো থেকে ভয় দেখিয়ে হপ্তা আদায় করছিল। ওটা নাকি ছিল ওদের রুজি রোজগারের একমাত্র পথ এবং অনেক বছর ধরেই নাকি চলছিল। লেখা নেই, পড়া নেই চাকু হাতে সবাইকে ভয় দেখিয়ে গুণ্ডামি করেই ওদের দিন কাটে। প্রাণের ভয়ে দোকানদারেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহে কিছু টাকা ওদের হাতে তুলে দিত। ব্যাপারটা অতনুর জানা ছিল না হয়তো বা জানলেও সেদিন ও সহ্য করতে পারেনি। দোকানদারের হয়ে ও ওদের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারপর যা হওয়ার ছিল না, তাই ঘটে গিয়েছিল। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার মিনিট পনেরোর মধ্যে ছেলেটা রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার উপরে লুটিয়ে পড়েছিল। আজ ওর মৃত্যুতে পাড়াশুদ্ধু লোক কাঁদছে। ওর নামে একটি স্মৃতিসংঘ খোলা হয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, অঘটনের ঠিক আগের দিন ও আমাদের বাড়িতে এসে তোর খবর নিয়ে গিয়েছিল। পুজোতে তুই আসবি জেনে খুব খুশি হয়েছিল।

বিস্ময়ের ঘোর তবু কাটে না শিবনাথের। হাজার প্রশ্নের ভিড়ে সময় পায় না নিজের কথা ভাববার। তারপর একটু প্রকৃতস্থ হলে শিবনাথ বলে— কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, ওর সাথে আমার একটু আগেই দেখা হয়েছে। আমরা দু’জনে একসাথে গল্প করতে করতে এলাম। তারপর আদ্যোপান্ত যা ঘটেছিল সকলকে জানাল সেই কথা। এবার অবাক হওয়ার পালা বাড়ির সদস্যদের। আনুপূর্বিক সবকিছু বলা হয়ে গেলে পরে গ্রাস করে নিস্তব্ধতা।

হঠাৎ এক সময় মা বলে ওঠেন— তুই আসছিস জেনে ও যে মনে মনে খুব খুশিই হয়েছিল এটা পরিষ্কার হয়ে গেল। তোকে দেখা দিয়ে গেল।

শিবনাথ জানায়— ও নিজের মুখে স্বীকার করেছিল যে, ওর দিনলিপি লেখার অভ্যেস ছিল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওর মুখে বলা কথাটা ডায়ারির পাতায় আদৌ কোথাও লেখা আছে কিনা— ‘মৃত্যুর পরে আমার পার্থিব শরীর যেন এই সুবর্ণরেখার তীরেই সৎকার করা হয়।”

—যাক ওর শেষ ইচ্ছেটা আর অপূর্ণ থাকেনি। কৃষ্ণা আরও বলে, ও যা চেয়েছিল সেটাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সুবর্ণরেখার তীরেই ওকে দাহ করা হয়েছে।

মা তারপর শিবনাথকে সাবধান করতে গিয়ে বলেন— আজকে ওদের বাড়িতে কাজ। বাড়ির মানুষদের মন মেজাজ কারওরই বিশেষ ভালো নয়। যা জানার পরে এক সময় জেনে নিস সময় সুযোগ করে। অন্তত আজকে এই ব্যাপারে ওদের বিরক্ত করিস না যেন। দিনলিপির কথাটা পরে উত্থাপন করলেও চলবে। তুই তো আছিস ক’টা দিন এখানে। সুতরাং দু’দিন দেরি হয়ে গেলে কোনও ক্ষতি হবে না। বেদ অশুদ্ধ হবে না, আর যাই হোক। এটা মা হয়ে তোর কাছে আমার একান্ত অনুরোধ।

একটা ঘরে ফেরার গল্প (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অর্জুন কে চুপ হয়ে যেতে সাঞ্ঝা আবার প্রশ্ন করল, ‘কেন স্কুল থেকে পালালে?’

—যার বাপ-মা নেই, সে তো অনাথ। অনাথের আবার ঘর কীসের! পরিবার কীসের! বাপ-মায়ের পদবি, নিজের নাম থেকে মুছে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছোলাম এই হাওড়া স্টেশনে। সাথে ছিল আমার স্কুলের বইপত্র ভর্তি একটা স্কুলব্যাগ। রাতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে একা একা বসে, সেই বইগুলো পড়তাম। খিধে পেলে এর ওর কাছ থেকে খাবার চাইতাম। কেউ কেউ কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কেউ আবার দয়া পরবেশ হয়ে আধ-খাওয়া খাবার ছুড়ে দিত। ধীরে ধীরে রেল পুলিশ থেকে শুরু করে, অনেক নিত্যযাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকদের নজরে পড়লাম আমি। আসা যাওয়ার পথে, তাদের অনেকেই যেচে এসে আমার সাথে কথা বলতেন। পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দিয়ে, বড়ো হয়ে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, তার জন্য উৎসাহ দিতেন তাঁরা। এইরকমই একজনের অনুপ্রেরণায়, উদ্যোগে ন্যাশনাল ওপেন স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। মাঝেমধ্যে হাওড়া স্টেশনে কোনও গণ্ডগোল হলে, পুলিশের তাড়া খেয়ে, কলকাতার দিকে পালিয়ে যেতাম। তখন কোনওদিন ধর্মতলায় মেট্রো-সিনেমার নীচে, কোনওদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সামনের ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটাতাম। এইরকম ভাবে চলতে চলতে একদিন মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে গেলাম। ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। বড়ো এক সরকারি অফিসারের পরামর্শে কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারের চাকরির পরীক্ষায় বসলাম। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কলকাতার এক অফিসে অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হলাম। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে মন চায়নি কোনওদিন। গত তিন বছর ধরে, এদেরকে নিয়েই আছি এইখানে। আমাকে নিয়ে মোট একুশজনের বাস এখানে। তুমি থাকতে চাইলে, আমরা বাইশজন হব…!

ওর পোষ্যদের সারাদিনের দায়িত্ব শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝা’র উপরে চাপিয়ে দিয়ে, এর পরে আরও বছর তিনেক বেশ নিশ্চিন্তে কলকাতায় তার অফিস-কাছারির কাজ সামাল দিয়েছে অর্জুন। রোজ সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে ফিরে এসে হ্যাজাক জ্বেলে পোষ্যদের নিয়ে যথারীতি রাতস্কুল চালিয়েছে সে। ইত্যবসরে শ্রাবণী যেমন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে, সাঞ্ঝাও মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিল্টু আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। কিন্তু অর্জুনের মাথায় ঘুরছে, আরও অনেক বড়ো পরিকল্পনা। গত এক বছরে অফিসের বড়ো কর্তাদের কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছে সে— রাঁচি শহরে তার ‘বদলি’ প্রার্থনা করে।

নতুন বছরের শুরু থেকেই শ্রাবণী, সাঞ্ঝা ও অর্জুন— তিনজনের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে; বিল্টুকে দিয়ে যে করেই হোক মাধ্যমিকে ভালো ফল করাতেই হবে। সেই দিনটা ছিল, বিল্টুর মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। বিল্টুকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে, অর্জুন অফিসে ঢুকতেই, বড়োকর্তা অর্জুনের হাতে ওর বহু-প্রার্থিত ‘রাঁচি-বদলির’ অর্ডারটা ধরিয়ে দিলেন।

অগত্যা রাঁচি যাওয়ার আগে, শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝার উপর তার পোষ্যদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, অর্জুন ওদেরকে জানাল, ‘সামনে আমাদের অনেক বড়ো দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এখন সবার আগে আমাকে রাঁচিতে গিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। তারপরে আমার সব পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ করতে পারলেই, এখানে ফিরে এসে তোদের সবাইকে নিয়ে রাঁচি চলে যাব। ততদিন তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই রাত-স্কুল চালানোর সব দায়িত্ব তোদের উপরেই রইল।”

এর প্রায় বছর খানেক বাদে, একদিন ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পার মন্দিরে ছিন্নমস্তা দর্শন সেরে, অর্জুনের কলকাতা অফিসের প্রাক্তন বড়োকর্তা অম্বরীশবাবু ট্রেকারে করে, রামগড় সদর মোড়ে এসে নামলেন। সেখান থেকে ট্রেকার পালটে রাঁচি যেতে হবে। ট্রেকার স্ট্যান্ডে পৌঁছে, রাঁচি যাওয়ার একটা ট্রেকারে উঠে বসতেই, অম্বরীশবাবুর সাথে অর্জুনের দেখা হয়ে গেল।

অর্জুনই প্রথমে কথা বলল, ‘স্যার, আপনি এখানে?’

—এই তো কাল এসেছি এখানে। রাজরাপ্পা গিয়েছিলাম; ছিন্নমস্তা দর্শনে। আজ রাতেই রাঁচি থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরব। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? তোমার তো এখন রাঁচিতে থাকার কথা, অম্বরীশবাবু জানতে চাইলেন অর্জুনের কাছে। অর্জুন এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, তার পাশে বসা দুই মহিলার সাথে অম্বরীশবাবু’র পরিচয় করিয়ে দিল।

—এদের কথা আপনাকে আমি আগে অনেকবার বলেছি; আজ এদের সাথে দেখা হয়ে গেল আপনার। এর নাম শ্রাবণী, আর এ হচ্ছে সেই সাঞ্ঝা। আপনি তো জানেন, ও ভুটকি গ্রামের মেয়ে। সেই ভুটকি গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে, সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল চালু করেছি। সেটা এখন সাঞ্ঝাই চালায়। আশপাশের গ্রাম থেকে আপাতত জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী পাওয়া গিয়েছে। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে সকলের। সাঞ্ঝাকে ফিরে পেয়ে, শুধু ওর পরিবার নয়, গোটা মহকুমার মানুষ উল্লসিত, গর্বিত। বিডিও, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে জেলা শাসক পর্যন্ত, সকলেই সাঞ্ঝার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে, ওর এই কৃতিত্বকে সাধুবাদ জানিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

অর্জুনের কথা শুনে অম্বরীশবাবু’র চোখেমুখে খুশির ঝলক। অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “বাঃ! এ তো দারুণ খবর! তবে এ তো গেল সাঞ্ঝার কথা। শ্রাবণী কী করছে এখন?”

—এই রামগড়ে আপাতত একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, অনাথ শিশুদের সেখানে রেখে, তাদের পড়াশোনার একটা বন্দোবস্ত করেছি। তবে আমি আমার অফিস সামলে, ওদের দেখাশোনা করার জন্য কতটুকুই বা আর সময় পাই! অনাথ আশ্রমের সবটা শ্রাবণী’ই দেখাশোনা করে।

—আর তোমার হাওড়া স্টেশনের পোষ্যদের কী খবর? তাদেরকে তুমি রামগড়ে নিয়ে এসেছ না-কি!

—না, না! ওরা ওদের জায়গাতেই আছে। প্রতি শনি-রবিবার দুটো দিন হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পোষ্যদের কাছে ছুটতে হয় আমাকে। সারা সপ্তাহ ধরে বিল্টুই ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলায়। তবে সম্প্রতি ও আবার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগামী বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে সে। ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে, ওদের সবাইকে রামগড়েই নিয়ে আসার কথা ভাবছি। কিন্তু এতজনকে রাখতে গেলে, নিজেদের একটা বড়ো বাড়ি হলে ভালো হয়।

কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অর্জুন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আবার কথায় ফিরে আসে সে, ‘এই দেখুন, কথা বলতে বলতে আসল লোকের সাথেই তো আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছি। এ হচ্ছে, আমাদের সেই শান্তা। ও এখন এখানকার স্থানীয় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে পড়ছে। এই রামগড়ের আশ্রমে, শ্রাবণীর হেফাজতেই থাকে ও। শান্তা এখনও একই রকমের শান্ত। তবে ও শুধু আমাকে জানিয়েছে যে, ও বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায়।’ শান্তাকে আদর করতে করতে অম্বরীশবাবুর সঙ্গে শান্তারও পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলল না অর্জুন।

সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে, অম্বরীশবাবু অর্জুনের কাছে জানতে চাইলেন, “কিন্তু এই ছুটির দিনের সকালে, এমন সদলবলে তুমি কি হাওড়ায় চললে না-কি?’

না, না, এই সপ্তাহে আমার আর হাওড়া যাওয়া হচ্ছে না। তবে আমার বদলে এই সপ্তাহে শ্রাবণী হাওড়া যাচ্ছে আজ। দু’দিন থেকে, পরশু দিন ফিরে আসবে ও।

অর্জুন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, অম্বরীশবাবু ফিরে জানতে চাইলেন, “তাহলে তুমি চললে কোথায়!”

—সম্প্রতি দাদু’র সাথে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই জানলাম, ইদানীং দাদুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দাদুকে আমার বর্তমান কর্মকাণ্ডের কথা সব জানিয়েছি!

—সব! অম্বরীশবাবু’র গলায় এবার অন্য রকমের সুর!

—হ্যাঁ, সব! তাই দাদুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে, দীর্ঘদিন বাদে আজই প্রথম ঘরে ফিরতে চলেছি আমি। অম্বরীশ চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলতে বলতে মুচকি হেসে এবার সাঞ্ঝার দিকে একবার তাকাল অর্জুন!

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৬ পর্ব)

৬ পর্ব

তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে, অর্জুনের ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স’-এর কোনও হদিশ করতে পারল’ না নিখিল। প্ল্যাটফর্মের দোকানদার থেকে শুরু করে, রেলের বিভিন্ন কর্মচারীদের কাছে অর্জুনের খোঁজ করার পরে, সবার কাছ থেকে একই কথা জানতে পারল নিখিল, ‘অর্জুন সরকারি চাকরি করে। কলকাতায় ওর অফিস। সারাদিন সেখানকার কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার পরে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে অর্জুন। ওখানেই রাতে ওর পোষ্যরা আসবে, ওদের অর্জুন স্যারের কাছে পড়াশোনা করতে। তারপরে পড়াশোনা শেষ হলে, পোষ্যদের খাইয়ে দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, ওই স্টেশন চত্বরেই যেদিন যেখানে মর্জি, সেখানে বিছানা পেতে রাত কাটিয়ে দেয় অর্জুন।”

পরদিন সকালে নিখিল অফিসে পৌঁছে, বড়োকর্তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। গতকাল সন্ধ্যায় সংগ্রহ করা, অর্জুন স্যার সংক্রান্ত সবিশেষ তথ্য বড়োকর্তাকে জানাতে জানাতে চোখের কোণে আঙুল ছোঁয়াল নিখিল। ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স বলে কোথাও কোনও ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই স্যার। তবে আপনার ফাইলে যা তথ্য রয়েছে, তার কোনওটাই অসত্য নয়। কোনও অনাথ ছেলে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জীবন কাটিয়ে, মাস্টার্স ডিগ্রি করে, সরকারি অফিসের অফিসার হতে পারেন, তা আমাদের অর্জুন-স্যারকে না দেখলে কোনওদিন বিশ্বাসই করতে পারতাম না। শুধু তাই নয়; সারাদিন এই অফিসে এইভাবে নিজেকে উজাড় করে পরিশ্রম করার পরে, রাতে আবার ওই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফিরে গিয়ে, বহু অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসান। তারপরে তাদের রাতের খাবার খাইয়ে, ওদের সাথেই প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে, পরদিন আবার যে-কেউ এইভাবে অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারে; তা অর্জুন স্যারকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। অর্জুন স্যার আমাদের ভগবান!” দু’-হাত কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে অম্বরীশ চ্যাটার্জীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল নিখিল।

ওদিকে পরপর পাঁচদিন অফিস কামাই হওয়ার পরে, নিখিল যেদিন অর্জুনের খোঁজে হাওড়া স্টেশনে এসেছিল, সেদিনই সকালে শ্রাবণীকে সঙ্গে নিয়ে, এস আই জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন গিয়েছিল হাসপাতালেই। সাঞ্ঝাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে, সন্ধ্যার পরে যথারীতি হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, সাঞ্ঝাকে নিয়ে ফিরে এল অর্জুন। হাওড়া স্টেশন চত্বরে পা রাখতেই, রেল পুলিশের লোকজন, প্ল্যাটফর্মের স্টলমালিকরা থেকে শুরু করে, তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওর পোষ্যরা সকলেই এসে অর্জুনকে জানাল, ‘আজ তোমার অফিস থেকে তোমার খোঁজে একজন লোক এসেছিলেন। তোমার বাড়ি, ঘরদোর সম্বন্ধে খোঁজ করছিলেন তিনি।’

একথা শোনার পরে অর্জুনের কাছে সাঞ্ঝা জানতে চাইল, ‘আপনার ঘর এখান থেকে কতদূর?”

সাঞ্ঝার কথায় মুচকি হেসে অর্জুন জানাল, ‘এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া গোডাউনের পাঁচিল ঘেঁষেই আমাদের সবার ঘরবাড়ি। আমাদের সবার মানে, আমাদের এই ক’জন অনাথের।’

—কিন্তু সবাই যে বলছে, আপনি অফিসে চাকরি করেন! তাহলে কাছাকাছি কোথাও আপনার বাড়িঘর আছে নিশ্চয়ই।

—সে ছিল একসময়। রাঁচি স্টেশনের দক্ষিণদিকের রেল কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আমরা মানে মা-বাবা, দাদু ও ঠাকুমা। আমার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। দিল্লির একটা নামকরা হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে রাঁচি আসতেন। হঠাৎ করে কী একটা গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে গেলেন তিনি।

—তারপর… অর্জুন কথা বলতে বলতে একটু থামতেই, ফিরে জানতে চাইল সাঞ্ঝা।

—তারপর আর কী! আমার মা ছিলেন রাঁচির একটা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা। মা যে স্কুলে পড়াতেন, আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মা নেই। বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে দাদুকে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। এর পরে আমার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ল দাদুর উপরে। দাদু আমাকে রোজ স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।

অর্জুন বলতে লাগল, ‘স্কুলে গেলেই সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই আমার কাছে আমার মা-বাবা’র সম্বন্ধে জানতে চাইত। দিনের পর দিন সেটা আমার কাছে ভীষণ অসহনীয় লাগতে লাগল। একদিন স্কুল থেকে আমিও পালালাম!’

ক্রমশ…

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৫ পর্ব)

জঙ্গল থেকে ঘাস-পাতা সংগ্রহ করে, ওই ঘরের মেঝেতে পেতে তার উপরে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হয়। গ্রামের প্রান্তের ওই স্থান চারিদিক থেকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সারারাত ভয়ে-যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকতে হয়, একেকটা দশ-এগারো বছরের শিশুকন্যাকে। ওই পাঁচ-ছ’টা দিন ওদেরকে এতই অস্পৃশ্য মনে করে সবাই যে, পরিবারের কোনও লোক, কোনও খোঁজ নিতেও আসে না তাদের। ওই জঙ্গলঘেঁষা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই ঘরের ধারেকাছে কোথাও কোনও জলের সংস্থানও নেই। নিজেকে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করার কোনও উপায় পর্যন্ত নেই। ওদের গ্রামের মেয়েরা অনেকে ওই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণেই মারা যায় সেখানে।

ওর মা-ঠাকুমাকেও ছোটো থেকে দেখেছে সাঞ্ঝা— প্রতিমাসে ওই পাঁচ-ছ’টা দিন বাড়ি ছেড়ে, ছোটো বাচ্চাদের ঘরে ফেলে রেখে, গ্রামের প্রান্তের ওই ঘরে দিন কাটাতে চলে যেতে। বছর তিনেক আগে সাঞ্ঝা’র মাকে এইরকমই একরাতে ভাল্লুকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে মায়ের সাথে আর কোনওদিন দেখা হয়নি সাঞ্ঝার।

সাঞ্ঝার বাবা ঝরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করে। মা মারা যাওয়ার পরে বাবা আর কোনওদিন বাড়িতে ফেরেনি। দাদু-ঠাকুমার কাছে মানুষ হচ্ছিল সাঞ্ঝা। পড়াশোনা করার জন্য ওদের তুটকি গ্রাম থেকে বিশ কিলোমিটার দূরের মাঞ্চুগঞ্জের স্কুলে বছরের পর বছর আসা যাওয়া করে, দশ ক্লাস পাশ করে, এগারো ক্লাস পেরিয়ে বারো ক্লাসে উঠেছে সাঞ্ঝা। তাই সাঞ্ঝা ভাবে, অন্যায় অবিচারে ভরা এই সামাজিক কু-প্রথাকে যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে আর পড়াশোনা করে আমার লাভটা কী! এই গ্রাম ছেড়ে, জেলা ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে পালাতে না পারলে, আমার অবস্থাও একদিন আমার মায়ের মতনই হবে।

পাঁচদিনের প্রথম দিনটা এইসব ভাবতে ভাবতে অতিবাহিত হয়ে যায়। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাউকোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সাঞ্ঝা। বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, সাঞ্ঝা এসে পৌঁছোয় গোধিয়ার সতেরো মাইল বাসরাস্তার উপরে। একটা কয়লা বোঝাই লরিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করায় সাঞ্ঝা। লরি থেকে একটা লোক নেমে এসে, ও কোথায় যেতে চায়, জানতে চাইলে তাকে ওই অঞ্চল ছেড়ে ওর পালানোর ইচ্ছার কথা, কারণ সহ সবিশেষে জানানোর পরেই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সাঞ্জা জ্ঞান হারায়। মাঝরাতে সাঞ্ঝা নিজেকে আবিষ্কার করে, একটা চলন্ত ট্রেনের টয়লেটের মেঝেতে পড়ে আছে। তারপর সাঞ্ঝা আর কিছু জানাতে পারে না অর্জুনকে!

পরপর ক’দিন এই ভাবে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আর হাসপাতালে যাতায়াতের ফলে, অফিসমুখো আর হতে পারেনি অর্জুন। আজ প্রায় বছর চারেক হল, ডালহৌসি পাড়ার কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের এক দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে অর্জুন। ঝড় হোক, জল হোক, হাজার দুর্যোগেও অর্জুনের গরহাজিরা কারও চোখে পড়েনি কোনওদিন। এহেন অর্জুন বিনা কোনও সংবাদে, এইভাবে যে কোথাও উধাও হয়ে যেতে পারে, তা বুঝে উঠতে পারেন না তার অফিস কর্তা অম্বরীশ চ্যাটার্জী।

গত চার-পাঁচদিন ধরে অর্জুনকে যতবারই মোবাইল ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন উনি, ততবারই হয় ‘নো আনসার’, নয় তো জানতে পেরেছেন অর্জুনের ফোনটা রয়েছে ‘পরিষেবা সীমার বাইরে’। অর্জুনের চাকরির নিয়োগপত্র ও জয়েনিং লেটার সম্বলিত ফাইলটা বের করে বারকয়েক চোখ বোলালেন অম্বরীশ। সব জায়গাতেই ওর স্থায়ী ঠিকানা লেখা রয়েছে, ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড রেসিডেন্স, প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেইশ, হাওড়া স্টেশন’। নামের জায়গায় লেখা শুধু ‘অর্জুন’; পদবির কোনও উল্লেখ নেই কোথাও। মা- বাবার নামের পাশে লেখা, ‘নট-অ্যাপ্লিকেবল’; বন্ধনীর মধ্যে লেখা ‘অরফ্যান’। শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লেখা রয়েছে, “ইতিহাসে এমএ’।

অম্বরীশবাবু ফাইল থেকে অর্জুনের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে, তা অফিস পিওন নিখিলের হাতে দিয়ে, ওকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, একবার অর্জুনের খোঁজে যেতে বললেন। নিখিল যথারীতি বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। লঞ্চে নদী পেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল সে।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৪ পর্ব)

৪ পর্ব

আরও ঘণ্টা-দুয়েক মাথার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরে, অর্জুনরা দেখল, মেয়েটা চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে, খোট্টা ভাষায় অর্জুন মেয়েটার কাছে জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?” —সাঞ্ঝা, সাঞ্ঝা ওঁরাও!

—ঘর কোথায় তোমার?

—ভুটকি গ্রাম; তহসিল মাণ্ডু; জিলা রামগড়।

—এখানে এসেছ কেন? ট্রেনেই বা চড়েছিলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দিতে পারল না সাঞ্ঝা। আবার চোখ বুজল সে। এস আই জয়ন্ত ঘোষ এবার রোগীর বেডের পাশের বসার টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অর্জুনকে বলল, “এবার আমাকে ফিরতে হবে অর্জুন। আমার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ফিরে রিপোর্ট করতে হবে অফিসে। তবে এ তো মনে হচ্ছে, তোমার ঝাড়খণ্ডেরই লোক। যেসব জায়গার নাম বলছে ও, তার কিছু কি চিনতে পারলে তুমি?”

এস আই সাহেবের প্রশ্নের জবাবে অর্জুন জানাল, ‘হ্যাঁ, ভুটকি হচ্ছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রামগড় জেলার উত্তর প্রান্তের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। রাঁচি থেকে পঁচাশি কিলোমিটার, আর রামগড় সদর শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম ‘ভুটকি’। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হচ্ছে মাণ্ডু। তাও প্রায় বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে নিকটবর্তী বাস রাস্তা হচ্ছে একশো নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে অবস্থিত গোধিয়া সতেরো মাইল; ভুটকি থেকে যার দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। ভুটকির উত্তর এবং পশ্চিম দিক হাজারিবাগের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা— সেই প্রত্যন্ত ভুটকি থেকে মেয়েটা রাঁচি এল কী করে! আর সেই সুদূর রাঁচি থেকে এই হাওড়া স্টেশনেই বা ও এল কী উদ্দেশ্যে!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অর্জুন আবার জানাল, আপনি এখন ফিরে যান ঘোষদা। আমি আরও একটু থেকে দেখি; যদি কিছু জানতে পারি ওর সম্বন্ধে। তবে ফিরে গিয়ে আপনি যদি একটা কাজ করে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়। হাওড়া স্টেশনে ফিরে, আপনার কাজকর্ম সেরে, একটু তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আমার পোষ্যগুলোকে বলবেন, হ্যাজাকটা জ্বেলে নিয়ে ওরা যেন পড়তে বসে যায়। সামনেই ওদের পরীক্ষা। কাল ঝড়-বৃষ্টির দরুন পড়াশোনাটা হয়নি ঠিকমতো। আজকে যেন ওরা পড়াশোনাটা শুরু করে দেয়। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফিরে গিয়ে জানতে চাইব—কে কী পড়ল! আর বিল্টুকে একটু আলাদা করে ডেকে বলে দেবেন, কোনও কারণে আমার ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে ও যেন সবাইকে ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়।”

সন্ধ্যার পরে সাঞ্ঝা চোখ মেললে, ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অর্জুন আবার জানতে চাইল, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমাকে এখানে এই হাওড়া স্টেশনে কে নিয়ে এসেছে?”

—কেউ না, আমি একাই এসেছি! কিন্তু আমি এখন কোথায়? অর্জুনের কাছে চোখ বুজেই জানতে চায় সাঞ্ঝা।

—তুমি রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলে। সেখান থেকে তোমাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি ভুটকি থেকে রাঁচিতেই বা এসেছিলে কেন? আবার ট্রেনে করে হাওড়াতেই বা এলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না সাঞ্ঝা। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দু’-হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে, নিজের বুকফাটা যন্ত্রণার কথা সব উজাড় করে দেয় সে। ওর ভুটকি গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা, মনের দরজা খুলে, সব বাইরে বের করে আনে সাঞ্ঝা।

সাঞ্ঝার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার তুটকি গ্রামে। তার পুরো নাম সাঞ্ঝা ওঁরাও। ছোটোবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। স্কুলের এগারো ক্লাস পাশ করে এখন সে বারো ক্লাসে পড়ে। ওদের গ্রামের ছাউপদি প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই ওর ঘর ছাড়া। এটা শুধু ওর গ্রামের প্রথা নয়; এটা গোটা গ্রামীণ ঝাড়খণ্ডের দুঃসহ এক প্রথা। এই প্রথার শিকার হয়ে, সেই দশ-এগারো বছর বয়স থেকে প্রতিমাসে ঋতুস্রাবকালীন পাঁচ-ছয়দিন ওর গ্রামের বাড়ি-ঘর ছেড়ে, গ্রামের বাইরে একটা চালা ঘরের মধ্যে গিয়ে থাকতে হয় ওকে। এ যন্ত্রণা শুধু সাঞ্ঝার নয়। ওখানকার আপামর সব মহিলাদের এই প্রথা মেনে চলতে হয়। সেই ঘরের না আছে কোনও দরজা, না আছে কোনও জানলা।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৩ পর্ব)

৩ পর্ব

আজ সকালে বেড-রোল গুটিয়ে তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন টয়লেটের বিপরীত দেয়ালে তালাবন্ধ ঢাউস কাঠের বাক্সটা খুলে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে, টয়লেটের দিকে তাকাতেই অর্জুন বুঝতে পারল, তখনও পর্যন্ত টয়লেট একরকম ফাঁকাই রয়েছে বলা চলে। তার মানে ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা বাজলে কি হবে, এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে পারেনি। প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে, বাইরে বেরোতেই অর্জুনের চোখে পড়ল — বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস এসে দাঁড়িয়ে আছে। জামা-প্যান্ট-জুতো গলিয়ে, পিঠব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, ধীর পায়ে অর্জুন চোদ্দো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এস্ক্যালেটরের দিকে পা বাড়াল। তার পুষ্যিগুলোকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, রোজকার মতন টিফিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে, স্কুলমুখো রওনা করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

সারারাত ধরে দুর্যোগ-ক্লিষ্ট, অনিশ্চিত যাত্রার শেষে, ক্লান্ত আচ্ছন্ন শরীরে মালপত্র টানাটানি করে প্যাসেঞ্জাররা সব ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম পার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে অর্জুন খেয়াল করল, জিআরপি’র লোকজন ধরাধরি করে কাউকে যেন ওই ট্রেনের সাধারণ কামরা থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে, প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে অনেকে চলার পথে সেদিকে অগ্রসর হয়ে, উকিঝুঁকিও মারছে। অর্জুনও কৌতূহল দমন করতে না পেরে সেদিকেই পা বাড়াল।

ভিড় ঠেলে কাছাকাছি পৌঁছোতেই, এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে— একটা মেয়ে পাশ ফিরে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। তার জামা-প্যান্ট রক্তে ভেজা; যা দেখে ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ কেউ মন্তব্য করছে, ‘চল চল, পাগলি-টাগলি হবে’। আবার কেউ বলছে, “না না, রেপ কেস! চল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ঝামেলা বাড়ানো।’ অর্জুন কাছে গিয়ে, জিআরপি’র একজন এসআই-কে দেখে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে এর?”

—কী যে হয়েছে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। সারারাত সাধারণ কামরার টয়লেটের মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিল। প্যাসেঞ্জাররা নাকি রাত থেকেই ওকে এইরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে ওই টয়লেটের মধ্যে। ঝামেলা এড়াতে কেউ আর কোনও সাড়াশব্দ করেনি। অনেকে বলছে, রেপ-কেস হতে পারে। কিন্তু জ্ঞান না ফিরলে, কিছুই জানা যাচ্ছে না— জিআরপি’র এসআই জয়ন্ত ঘোষ মেয়েটির রক্তে ভেজা জামা-প্যান্টের দিকে ইঙ্গিত করে, অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

এই স্টেশন চত্বরে রেল পুলিশের সব লোকজনই অর্জুনকে খুব ভালো করে চেনে। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে তাই এসআই-এর উদ্দেশ্যে বলল, ‘অবস্থা কিন্তু খুব একটা ভালো ঠেকছে না। এক্ষুনি একে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।’ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই, পাশেই বিল্টুকে দেখতে পেল অর্জুন। বিল্টুর হাতে ওর দলবলের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করার জন্য দু’শো টাকা দিয়ে বলল, “তুই সবার টিফিনের বন্দোবস্ত করে, সকলকে স্কুলে পাঠিয়ে দিবি ঠিকমতো। আমি একে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তুই চট করে কুলিদের থেকে একটা হ্যান্ড ব্যারো নিয়ে আয়।”

এরপরে এসআই জয়ন্ত ঘোষ আর অর্জুন দু’জনে মিলে মেয়েটাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে এল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটার অবস্থা দেখে, ওকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে নিয়ে, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন প্রভৃতি প্রক্রিয়া চালু করে দিল। মেয়েটার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন ওয়ার্ডের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দুপুরের পরে, ক্ষণিকের জন্য মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার জানালেন, ‘মেয়েটি শারীরিক ভাবে অসম্ভব রকমের দুর্বল। মনে হয় চার-পাঁচদিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষীণ স্বরে কিছু হয়তো বলছে, যদিও তার বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সামান্য সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরলেও, আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। দেখুন, আবার জ্ঞান ফিরলে, ওর কাছ থেকে যদি কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন! পরীক্ষায় ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনও তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। তবে মেয়েটি ঋতুকালীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ভালো করে জ্ঞান না ফিরলে, বেশি জোর জবরদস্তি করে কিছু জানার চেষ্টা করা উচিত নয়।’

ক্রমশ…

 

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (২-পর্ব)

২ পর্ব

পড়শিদের চিৎকার আর আলোচনা শুনে শ্রাবণী জানতে পেরেছিল, ওর জ্ঞাতিরা তার মা-বাবাকে মেরে ওদের জায়গা জমি হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। দিন দু’য়েক বাদে গাঁয়েরই এক পিসে ওকে বুঝিয়েছিল, এভাবে পথে পথে কেঁদে বেড়ালে, না আর বাপ-মাকে খুঁজে পাবি; না জোটাতে পারবি পেটের ভাত। তার চেয়ে আমার সাথে চল, কলকাতার একটা অনাথ আশ্রমে ভর্তি করিয়ে দেব’খন। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই যেমন একটা পাবি; দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে দু’অক্ষর লেখাপড়াও শিখতে পারবি। পথে পথে ভিক্ষে করে আর বেড়াতে হবে না তোকে।

কিন্তু হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরে, সেই পিসেকে আর খুঁজে পায়নি শ্রাবণী। পরে জিআরপি’র এক পুলিশ অফিসার কাকুর কাছ থেকে শ্রাবণী জেনেছিল, ওটা তোর পিসে না ছাই! ওটা শিশু পাচার চক্রের একটা দালাল। তোকে বেচে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে, তোকে ফেলে রেখে এখান থেকে পিঠটান দিয়েছে।

হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে, পূর্বপ্রান্তের রাস্তার ওপারে একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে, সেইদিন দুপুরে মাছ-ভাত খাইয়ে, রেল-পুলিশের অফিসার শ্রাবণীকে ওই ভাতের হোটেলে রেখে দিয়ে, চলে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আপাতত তুই এখানেই থাক, টুকটাক ফাই-ফরমায়েশ খেটে দিবি। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যেমন পেয়ে যাবি, তেমনই মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইও হয়ে গেল তোর। কিন্তু হোটেল মালিক কথায় কথায় যেমন ধমক-ধামক আর তার সাথে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিত, তা মোটেও পছন্দ হতো না শ্রাবণীর।

একদিন ভোর হওয়ার আগে হোটেল থেকে পালিয়ে, প্রথম মেদিনীপুর লোকাল ধরে, সোজা খড়গপুর স্টেশনে গিয়ে নেমে পড়েছিল সে। সেখানে কিছুদিন ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ করে একদিন রেল পুলিশের তাড়া খেয়ে, বছর দুয়েক বাদে আবার হাওড়া স্টেশনে ফিরে আসে সে। তারপর থেকে রোজ সারাদিন ধরে এ ট্রেন ও ট্রেন ভিক্ষে করে বেড়ানোর শেষে, রাতে ফিরে আসত এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে শুয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত শ্রাবণী।

আর রোজ সন্ধ্যায় অর্জুনের পাশে বসে, কোলে চেপে, সবচেয়ে ছোটো যে মেয়েটা স্লেট-পেন্সিল নিয়ে, সবে অক্ষরজ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত; তার নাম শান্তা। শান্তার জন্ম এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই। সেও এক প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির রাতে। জন্ম দেওয়ার পরে, ওকে ফেলে রেখে ওর মা-টা যে কোথায় চলে গিয়েছিল, তা কে জানে! মা-কে ছাড়া অতটুকু শিশু এতটুকু টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি কোনওদিন। ছোটো থেকেই সে এতই শান্ত ছিল যে, অর্জুনই ওর নাম দিয়েছিল— শান্তা!

এদের সঙ্গে অর্জুন দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হলেও, এদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা বানাতে সক্ষম হয়েছে সে; তাও প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। এদের বেশির ভাগই আগে প্ল্যাটফর্মে বসে, ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে ভিক্ষে করে বেড়াত। সুযোগ পেলে যাত্রীদের মালপত্র থেকে হাতসাফাই করে, দু’-চার টাকা কামিয়ে নিতেও সিদ্ধহস্ত ছিল এরা।

অর্জুন বুঝেছিল, এদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পেট চালানোর একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারলে আর নিয়মিত ভাবে পড়াশোনার জগতে ব্যস্ত করে রাখতে পারলে, তবেই এদের এই অসৎ উপার্জনের থেকে বিরত রেখে, একটা সুস্থ জীবনের আলো দেখানো সম্ভব। তাই সকাল হতেই কোনওদিন লুচি-তরকারি, কোনওদিন কেক, কোনওদিন কলা-পাউরুটি ধরিয়ে দিয়ে, সকলকে আজকাল টিকিয়াপাড়ার রেল লাইনের ধারের স্কুলে পাঠিয়ে দেয় অর্জুন। সেখানে প্রাপ্ত মিড-ডে মিলের সুবাদে দুপুরের খাওয়াটাও জুটে যায় রোজ। রাতে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের ধারে বসে ঘন্টা দুয়েকের পড়াশোনার পরে, একুশজনের এই দলটা চলে যায় হাওড়া স্টেশনের বাইরে নদীর ধারের ভাতের হোটেলে নৈশভোজ সারতে। তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে, ওই গোডাউনের পাঁচিলের ধারেই সবাইকে শুইয়ে দেওয়ার পরে, রাতের এই ক’ঘন্টার জন্য অর্জুনের সারাদিনের সব ব্যস্ততার অবসান।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (১-পর্ব)

সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে যেতে, আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে অর্জুনের। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে, কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল সাতটা বাজে। এইসময় টয়লেটে ঢুকতে গেলে, লম্বা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। রোজ সাধারণত ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে টয়লেটে ঢুকে, একেবারে প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে নেয় অর্জুন। এর থেকে বেশি দেরি হয়ে গেলেই, হাওড়া স্টেশনের তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এই টয়লেটে সহজে ঢোকার সুযোগ পাওয়াটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে।

দূরপাল্লার ট্রেনগুলো ভোরবেলায় ঠিক এই সময় থেকেই একের পর এক ঢুকতে শুরু করে হাওড়া স্টেশনে। যেসব প্যাসেঞ্জারদের ট্রেন থেকে নেমে, ট্রেন পালটাতে হয়, তারা এইসময় টয়লেটে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সবাই। এদের পিছনে লাইন দিতে হলে, সেদিনকার মতো সব কাজ যে মাথায় উঠবে, তা খুব ভালো করে জানে অর্জুন।

অর্জুন মনে মনে ভাবে, আজকের এই গণ্ডগোলের মূলে হচ্ছে গতকাল রাতের কালবৈশাখীর ঝড়। গতকাল রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়ে, কয়েক দফায় যে ভীষণ বেগে এবছরের প্রথম কালবৈশাখীর ঝড় আছড়ে পড়েছিল, তাতেই তো সমস্ত রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ওই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গী ছিল অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব যখন থামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে।

হাজার হাজার প্যাসেঞ্জার অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তারা কেউ লোকাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবে, কেউ আবার বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরবে বলে হাজির হয়েছে হাওড়া স্টেশনে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, সবার সে এক নিদারুণ অসহায় অবস্থা! সেই ঝড়-বৃষ্টির পর থেকে সারারাত, না আর কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢুকেছে; না কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে বেরোতে পেরেছে।

গতকাল রাতে ঝড় যখন উঠল, অর্জুন তখন ওর দলবল নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের কোল ঘেঁষে বসেছিল। ওর দলবল বলতে এক পাঁচ বছর বয়সি থেকে শুরু করে, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কয়েক জন কিশোর-কিশোরী মিলিয়ে জনা বিশেকের একটা দল। এদের সবাইকে এককথায় ‘অনাথ’ বলা চলে। কিন্তু অর্জুন তা মানতে রাজি নয়। অর্জুন বলে, ‘এরা সবাই আমার পরিবারের!” রোজ সন্ধ্যায়, মাঝখানে একটা হ্যাজাক জ্বেলে বসে অর্জুন। তাকে ঘিরে গোল করে বসে থাকে বাকি সকলে। অর্জুন ওদের গুরু। গুরুর কাছে পাঠ নিতে, সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই যে যেখানে থাকুক না কেন, সকলেই এসে হাজির হয় হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই গোডাউন লাগোয়া পাঁচিলের গোড়ায়।

ওদের প্রত্যেককে একটা করে পিঠব্যাগ কিনে দিয়েছে অর্জুন। সঙ্গে দিয়েছে বই, খাতা, কলম, পোশাক; যার যেমন প্রয়োজন। পড়াশোনার স্তরও একেক জনের একেকরকম। সবচেয়ে বড়ো যে ছেলেটি, তার নাম বিল্টু; বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওর ব্যাগে রয়েছে ক্লাস সিক্সের বইপত্র। বিল্টু কীভাবে এই হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তা অর্জুন অনেকবার বিল্টুর কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিল্টু কিছুতেই তার জবাব দিতে পারে না। শুধু ওর কথাবার্তা থেকে অর্জুন বুঝতে পারে— ও কোনও সাঁওতাল মা-বাবার সন্তান। বিল্টুর পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও, ভিতটা খুব দুর্বল হওয়ায়, অর্জুন ওকে গত দু’বছর আগে ক্লাস ফোরের স্তর থেকে সব বইপত্র কিনে দিয়ে, তালিম দিতে শুরু করেছিল। বয়স অনুপাতে অনেকটা পিছন থেকে শুরু করলেও, বিল্টুর অধ্যাবসায় যথার্থভাবেই ওকে ক্লাস সিক্স স্তর পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।

আর বিল্টুর সমবয়সি যে-মেয়েটি, সে হল শ্রাবণী। আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। শ্রাবণীর মা-বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত। ওর কতই বা আর বয়স হবে তখন; বছর এগারো হবে। মেদিনীপুর জেলার শ্যামচকে ওদের বাড়ি ছিল। একরাতে ঘুমের মধ্যেই শ্রাবণী টের পায়, ওদের গ্রামের সেই খড়ের চালের ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী একরাশ ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। মালপত্র বের করতে গিয়ে, চালচাপা পড়ে ঘরের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে ওর মা-বাবা মারা গিয়েছিল সেদিন।

ক্রমশ…

 

ভুলের মাশুল (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

নেগেটিভিটিতে ভরপুর জীবন তারক সিং-এর। ভালো চিন্তা কিছু নেই, সর্বক্ষণ দুঃখী ভাব। তার শরীরের কলকবজা বিকলের কাহিনি, প্রায় প্রত্যহ এদের শুনতে হয়। কেষ্ট দাস ঠিক তার উলটো। সর্বসময় প্রাণচঞ্চল তেজি ঘোড়া। একেবারে টগবগ করে ফুটছে। তবে মুখে কোনও লাগাম নেই। ‘অমিতসাব, পাক্কা দো’দিন মেরা টয়লেট নেহি হুয়া।’ বললেন তারক সিং। অমিতবাবু কিছু বললেন না, তিনি নিজেই বেশ ক’দিন ধরে নড়বড়ে। মুখ খুললেন কেষ্ট দাস।

—কোনটা বন্ধ, হিসি না হাগু?

—নেহি, ও তো কর রাহা, লেকিন হা…

—পিছনে বাতি দিন, সেরেফ বাতি।

—দূর মশাই, কী যে বলেন! হেসে ফেলেছেন অমিত সেন।

—কেন, লজ্জার কী আছে দাদা! ছেলেবেলায় আমরা সবাই তো…, হো হো করে হাসছেন দু’জনে। তারক সিং-ও গাঁদাল পাতা গেলা মুখ করে হাসতে বাধ্য হলেন। এইসব করে যখন অমিতবাবু ফ্ল্যাটে ফিরলেন নীচের পাম্পের ঘরের সামনে বেশ কয়েকজন আবাসিকের জটলা। আষাঢ়ে মেঘের ইঙ্গিত পেলেন অমিতবাবু। চারতলার গঙ্গাগোবিন্দবাবু, তিনতলার ভিনেশ জোশি, দোতালার অটল সাঁপুই, ডাঃ নিতিশ মিত্র— সবাই আছেন। কেমন যেন ভিলেন ভিলেন গন্ধ খুঁজছে সবাই তাঁর শরীর থেকে।

অটল সাঁপুই কিছুদিন আগে ছানি কাটিয়ে এসেছেন। চোখের দৃষ্টি বেড়ে গেছে, তিনি কাছে এসে খুব একেবারে গোয়েন্দা কায়দায় মাপতে লাগলেন অমিতবাবুকে। অমিতবাবু বুঝতে পারলেন না, কী খুঁজছেন রিভলবার না রক্তমাখা ছোরা! আসরে প্রথম এগিয়ে এলেন ভিনেশজি।

—আপনি কী করলেন মিঃ সেন? ওয়াটার পাম্প একদম খারাপ করিয়ে দিলেন। অমিতবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না, শুধু সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

গঙ্গাগোবিন্দ মণ্ডল সংক্ষেপে যা বললেন তার সারমর্ম হল, ‘সকালে অমিতবাবু পাম্প চালিয়ে চলে গেসলেন। আবাসিকরা কেউ তা জানতেন না। দীর্ঘক্ষণ চলায় পাম্পের মোটর পুড়ে গেছে। সারাই করতে অনেক টাকার ধাক্কা।’

নিতিশ মিত্র প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, “তিনি এই বাবাদ এক কানাকড়িও দেবেন না।’ অমিতবাবুর মনে হল অন্য সকলে নির্বাক থেকে নিতিশবাবুর মতেই মত দিলেন। আর এখানে দাঁড়ালেন না তিনি। তিনতলায় তাঁর নিজের ফ্ল্যাটের বেল বাজালেন। কাজের লোক বুলি দরজা খুলল। এখানেও সন্দেহের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। এক গেলাস জল খেয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিলেন। হঠাৎ হাত থেকে কে যেন টেনে নিল কাগজটা। স্ত্রী, বিমলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে চেক বই।

স্ত্রীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। থমথমে মুখ। ভয় পেলেন অমিতবাবু, কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলেন। মুখ খুললেন বিমলা। পাম্পটা ঠিক করতে প্রায় বারো হাজার টাকা লাগবে। আমি কল মিস্ত্রী রাজু-কে খবর দিয়েছি। ও একটু বাদে এসে চেক নিয়ে যাবে। কোনওরকম ভূমিকা না করে চেকবইটা সামনে রেখে চলে গেল বিমলা।

আমিতবাবু বুঝতে পারলেন এই বাড়ির বারোটা ফ্ল্যাটেই তিনি এখন খলনায়ক! শুধু জানতে পারলেন না, খবরটা চেন্নাই-তে ছেলে অত্রি অবধি পৌঁছেছে কিনা! যাই হোক, নিজের ভুলের মাশুল চোকাতে বারো হাজার টাকার একটা চেক লিখে টেবিলের উপর কলম চাপা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বিমলাদেবী দেখলেন কিন্তু বাধা দিলেন না। লোকটার মনেপ্রাণে আজ একটু মুক্ত হাওয়ার দরকার।

 

ভুলের মাশুল (২-পর্ব)

(পর্ব-২)

টেকো ওসি রামদাস টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে কথোপকথন শুরু করলেন।

—কী মশাই একেবারে রসের ভাণ্ডার হয়ে বসে রয়েছেন যে!

—হে, হে, তা যা বলেছেন, রস ছাড়া তো জীবন অচল। পৃথিবী তো রসেরই ভাণ্ডার। ফলের রস, তালের রস, আখের রস, খেজুর রস, রসগোল্লার রস…।

—থামুন, এইবার আমি আপনার দুটো রসগোল্লার রস বার করব!

ঘাড় নাড়লেন মোহিত দাস। অমিত সেন এবং আশেপাশের বাড়ির দু-চারজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

—মনিকা কে? একেবারে বাজখাঁই গলায় খেঁকিয়ে উঠলেন পাঁচতলা থানার ওসি। নামটা শোনার পর মোহিত দাসের চেহারায় কোনও ভাবগতিক লক্ষ্য করা গেল না। সেটা দেখে আরও সুর চড়ালেন ওসি।

—স্পিক আউট, স্পিক আউট, টেল মি হু ইজ মনিকা। কিন্তু যাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, সে ফ্যালফ্যাল করে শুধু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এইবার রামদাসবাবু পুলিশি বিক্রম দেখাতে তার হাতের লাঠিটা মোহিতবাবুর চিবুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘মনিকা, মাই ডার্লিং, শালা আপনার পিছনে এই লাঠি …!’ মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “স্যরি, ভেরি স্যরি, আসলে…।’ অন্য ছন্দে ফিরলেন তিনি।

মোহিতবাবুর আয়াকে আলাদা করে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, অয়ন দাসের বাড়ির পজিশন ইত্যাদি দেখে ফিরে গেলেন ওসি রামদাস মণ্ডল। যাওয়ার সময় তার সনাক্তকরণ রিপোর্টও প্রকাশ করে গেলেন। এটা বয়সজনিত মানসিক দুর্বলতা। জীবনের চলার পথে এসব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

অমিতবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে উত্তর করলেন ওসি, ‘ভুল তো মানুষ মাত্রই করে, মিঃ সেন, না কি?’ বাদী পক্ষের অয়ন দাস নীচে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে এ ব্যাপারে আর বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দিয়ে আসল নাটকের মঞ্চ ছেড়ে জিপে উঠলেন ওসি।

মোহিতবাবুর সেই ঘটনা অনেক রজনী অতিক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমিতবাবুর এইরকম ভুল মাঝে মাঝেই কেন হয়, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। ওসি রামদাসের কথা মতো মোহিতবাবুর সঙ্গে তুলনা করতে থকেন তিনি। কিন্তু অমিতবাবুর তো করোনা হয়নি। তাহলে? অমিতবাবুর স্ত্রী বিমলাও স্বামীর নানাবিধ অস্বাভাবিক ব্যবহারে নাজেহাল হয়ে যান। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি নিরুপায়।

আজকের ঘটনাটাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটাপথে ভগবানদাস পার্কে প্রত্যেকদিন সকালে একেবারে নিয়ম করে প্রাতভ্রমণে বেরোন অমিত সেন। সকালে টয়লেটে গিয়ে দেখেন জল নেই। তার মানে, মিউনিসিপালিটির কলের জল গতকাল রাতে আসেনি। এখন একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ জল। অমিতবাবু চাবি নিয়ে একতলায় পাম্প ঘরে সুইচটা অন করে হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের পেল্লাই ট্যাঙ্ক ভরতে প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। ততক্ষণে তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু ঘটনাটা যে এরকম ঘেঁটে বর্ণপরিচয়ের সব অক্ষর ধারণ করবে তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাহলে কি তার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। তিনি কি অ্যালজাইমার রোগের শিকার! আজকাল কিছুই বুঝতে পারেন না অমিতবাবু। সেদিন মোহিবাবুর বাড়িতে এসে কেমন যেন একটা উপলব্ধি হল।

ভগবানদাস পার্কে দু-পাক চক্কর মেরে নিত্যদিনের মতো পার্কের বাঁধানো পাথরের বেঞ্চে বসে কপালভাতি প্রাণায়ম করছিলেন অমিত। কেষ্ট দাস আর তারক সিং এসে পাশে বসে পড়ল। কপালভাতি চটকে গেল। বিহারের ছাপরা থেকে কলকাতায় এসে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে তারক সিং।

ক্রমশ…

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব