পত্রমিতালি

মাস ছয়েক হল সাতপাকে বাঁধা পড়েছে অরিত্রি। সবে সবে এমএ কমপ্লিট করেছে, তারপরেই সম্বন্ধ করে বিয়ে। বরানগরের সাহা বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্র ঋদ্ধির সঙ্গে। অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে গিয়েই ঋদ্ধির বাবা-মায়ের চোখে পড়ে যায় অরিত্রি। পড়বে না-ই বা কেন, ফরসা, টিকোলো নাক, টানাটানা চোখ, যাকে বলে একেবারে প্রকৃত সুন্দরী। ব্যস তারপরেই পাকাদেখা, আর চারহাত এক করা।

অরিত্রির নতুন পরিবার বলতে ঋদ্ধি, শ্বশুর-শাশুড়ি আর সমবয়সি এক দেওর। ভীষণ ফিচেল। হবি বলতে সময় পেলেই শার্লক হোমস্-এর বই নিয়ে বসে পড়া। কেমন যেন সন্দেহপ্রবণ। সবেতেই নাকি রহস্যের গন্ধ পায় সে। আর একজন বিবাহিত ননদ। সাংসারিক কিছু সমস্যার জন্য ইদানীং বাপের বাড়িতেই থাকছে। তবে ভীষণ মিষ্টি স্বভাবের। যাই হোক অরিত্রি এগুলো বেশ এনজয়ই করে। এযুগের মেয়ে হলেও নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি অরিত্রির একেবারেই পছন্দের নয়। বরং বরাবরই সংযুক্ত পরিবারের প্রতিই তার ঝোঁক বেশি। সে তার পছন্দ মতোই পরিবার পেয়েছে বটে। সারাদিন কাজ বলতে শাশুড়ির হাতেহাতে টুকটাক কিছু। আরও একটি ব্যাপারে অরিত্রি বেশ প্রাচীনপন্থী। এই ফেসবুক, টুইটারের যুগেও সে পত্রমিতালিতেই আস্থাশীল।

সেদিনও বেলা এগারোটা নাগাদ শাশুড়ি আর দেওরের সঙ্গে বসার ঘরে গল্প করছিল অরিত্রি। শ্বশুর ধৃতিমান আর স্বামী ঋদ্ধি তখন অফিসে। সেই সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। সোহম-ই দরজা খোলার জন্য উঠে গেল। খানিক পরে একটা গোলাপিরঙা খাম নাকে দিয়ে শুঁকতে শুঁকতে ঘরে ঢুকল। খামটা অরিত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও বউমণি তোমার চিঠি।’ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।

মুহুর্তেই অরিত্রির মুখচোখের রঙই বদলে গেল। একপ্রকার লাফিয়ে উঠেই সোহমের হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিল সে। নিজের ঘরের দিকে যাবার উপক্রম করতেই শাশুড়ি বিমলাদেবী প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কার চিঠি বউমা?’

‘আমার বন্ধুর’ কোনওমতে জবাব দিয়েই নিজের ঘরের দিকে চলে গেল অরিত্রি।

বউমণির হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গেল সোহম। এমনিতে তো অষ্টমঙ্গলার দিন-দুয়েক পর থেকেই চিঠি আসা শুরু হয়েছে। তবে সোহমের মারফত এই প্রথম। মনে মনে ভাবতে থাকল, এমন কার চিঠি যে হাতে পাওয়া মাত্রই বউমণির মুখে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে গেল? অমন ভাবে ছিনিয়েই বা নিল কেন? তার উপর খামের ওই সুগন্ধী! আরও যেন উসকে দিল সোহমের সন্দেহপ্রবণতাকে।

ভাবনায় বাধ সাধলেন বিমলাদেবী। চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁরে সোহম আজও দিদির কোনও ফোন বা চিঠিপত্তর কিছু এল না নারে?’

‘মা এব্যাপারে আমাদেরও তো কোনও তৎপরতা নেই বলো। আমরাও যেমন ভাবছি ওদিক থেকে কোনও সাড়া পেলে আমরা এগোব, তেমন ওরাও হয়তো সেটাই ভাবছে। তাছাড়া ওরা দিদিকে যেভাবে হেনস্থা করেছে, তাতে করে ওর আর ওবাড়িতে না যাওয়াই ভালো। ও এখানেই থাক।’ কথা বলতে বলতেই কানে ভেসে এল রবীন্দ্রসংগীত। সম্ভবত বউমণির ঘর থেকেই। ‘দ্যাখ সংসার থাকলে একটু-আধটু অশান্তি হয় বটে। পরে সব ঠিকও হয়ে যায়। তাছাড়া মা-বাবা যেমনই হোক জামাই তো আমাদের খুব ভালো। লজ্জায় হয়তো ফোন করতে পারছে না। চিঠি পাঠালেও তো পাঠাতে পারে। আচ্ছা বউমা তো মাঝেমধ্যেই পোস্ট অফিসে যায়, না? তা ওকে বললেই তো একটু খোঁজ নিতে পারে।’

‘তোমার বউমা তো তার বন্ধুকে চিঠি দিতে যায়। ননদের কথা ভাবার কি তার সময় আছে? এই দ্যাখো না পনেরো দিনের মাথায় দু-বার চিঠি এল বউমণির। সেদিন তো নিজেই নিল। আর আজ… সেই একই গোলাপি খামে সুগন্ধী দেওয়া চিঠি।’ সোহম বেশ গম্ভীর ভাবেই বলল।

‘বউমার এই চিঠির কথা ঋদ্ধি জানে? নিশ্চয়ই জানে।’ আশঙ্কা প্রকাশ করেও নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি। এমনিতে অরিত্রিকে নিয়ে অভিযোগের জায়গাই ছিল না বিমলাদেবীর। দেখতে যেমন, তেমনই মিষ্টি ব্যবহারও। সকলকে যত্ন করে খাওয়ানো, কেউ কষ্ট পেলে তা লাঘব করার চেষ্টা, একেবারে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল ওর। তবু মা তো। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এমনিই মেয়েকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় আছেন, তার উপর এখন আবার ছেলে। সোহমের কথাগুলো বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল বিমলাদেবীকে।

‘ঠিকানাটা দেখলি? কোথা থেকে এল চিঠিটা?’

সোহম কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল, ‘আমি কী করে জানব, বউমণির পেন ফ্রেন্ড। কাজেই ওটা বউমণিই জানবে।’

‘পেন ফ্রেন্ড’ আবার কী জিনিস রে?’ ভুরু কোঁচকালেন বিমলাদেবী।

‘মা তুমিও না! কী করে বোঝাই বলো তো? মানে পত্রমিত্র।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, এবার বুঝতে পেরেছি। ঋদ্ধি যখন ছোটো ছিল, তখন বাচ্চাদের পত্রিকা থেকে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ও তাদের চিঠি লিখে পাঠাত।’

‘মা, তুমি না খুব সহজ সরল। তোমাকে বোকা বানানো খুব সোজা। মানুষ বছরের পর বছর একসঙ্গে স্কুলে পড়ার পর সেইসব বন্ধুদের একটা সময় পর ভুলে যায়, আর এ তো কোন পত্রমিত্র। বউমণির মতো নিয়মিত পত্রমিত্র-র চিঠি আসতে কখনও দেখিনি।’

সোহমের কোথাও বেরোনোর ছিল বোধহয়। বন্ধু ডাকতে হনহন করে বেরিয়ে গেল। বিমলাদেবী খানিকক্ষণ সেখানেই বসে রইলেন। হয়তো কিছু ভাবছিলেন। তারপর গতানুগতিক ভাবে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ঋদ্ধি আবার খিদে সহ্য করতে পারে না। খিদের সময় খাবার না পেলে ওর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। তাই বিকাল বিকাল জলখাবার বানাতে শুরু করে দেন বিমলাদেবী। সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে, ‘ওহ্, অরিত্রি তোমার দাদা ফোন করেছিল। তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমাকে কল করেছিল। কাল রমামাসি নাকি কে যেন আসবে ওবাড়িতে। তাই আমাদের যাওয়ার জন্য বলছিল। আমার তো সময় হবে না, তুমি ঘুরে এসো।’

‘ঠিক আছে। তুমি গেলে ভালো হতো। কিন্তু সময় না পেলে আর কী করা যাবে। সময় করে আমিই একবার দেখা করে আসব।’

পরদিন ঋদ্ধি অফিস যাবার পর অরিত্রি পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রমামাসি অরিত্রির ছোটোমাসির বড়োজা। ছোটোমাসি মারা গেলেও ওনার জায়ের সঙ্গে অরিত্রির মায়ের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। একেবারে মায়ের পেটের বোনের মতো। অসুস্থ থাকায় অরিত্রির বিয়েতে আসতে পারেননি। তাই আসার সময় আদরের অরিত্রির জন্য একছড়া সোনার মালা আর কানের দুল এনেছেন। সেটা পেয়ে অরিত্রি একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।

রমামাসির সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় সকলে গল্পে মশগুল হয়ে গেল। গল্পের মাঝে হঠাৎই অরিত্রির মা বিভাদেবীর কিছু মনে পড়ে যাওয়াতে ‘একটু আসছি’ বলে ভিতর ঘরে গেলেন। খানিক পরে একটা খাম হাতে করে নিয়ে এসে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নে অরি, পরশুদিন এটা এসেছিল। বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি।’ সেই গোলাপিরঙা খাম দেখে একপ্রকার মায়ের হাত থেকে কেড়েই নিল অরিত্রি।

‘কার কার্ড রে?’ অরিত্রির নেওয়ার ভঙ্গিমা দেখে প্রশ্ন করে বসল বউদি অনিন্দিতা।

‘কেন তুমি আমার পত্রমিত্র-র কথা জানো না? নতুন নাকি?’

‘বাবা, তোরা যে কীভাবে না দেখেশুনে একজন অচেনা লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাস কে জানে। এইভাবে আবার…’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যায় অনিন্দিতা। মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় তার। কোনও এক অশনিসংকেতের আভাসে মুহূর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার।

‘হ্যাঁরে ওবাড়িতে এইরকম কোনও চিঠি যায় না তো?’ শঙ্কা প্রকাশ করে অনিন্দিতা।

‘কেন, না যাওয়ার কী আছে?’

‘তোর এই পত্রমিত্রের কথা ঋদ্ধি জানে?’

‘নাহ্। আর জানলেই বা কী হবে? আমি তো কোনও অন্যায় করছি না।’ সহজ ভাবে উত্তর দেয় অরিত্রি।

‘ভুলে যাস না অরি, তুই এখন বিবাহিত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভীষণ স্পর্শকাতর। সামান্য থেকে সামান্য জিনিসও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই এমন কিছু করিস না, যেটাতে ওর বা ওর বাড়ির লোকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। ছেলেমানুষি ছাড়, এসব চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া বন্ধ কর।’ অরিত্রিকে বোঝানোর চেষ্টা করে অনিন্দিতা।

‘বউদি তুমি ভালো করেই জানো আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া আর অন্য কোনও সম্পর্ক নেই। এই সামান্য একটা কারণে আমার আর ঋদ্ধির সম্পর্কে ফাটল ধরবে, ঋদ্ধি আমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। সরি বউদি, তোমার এই অ্যাডভাইস-টা মানতে পারলাম না।’

গল্প আর কথার মাঝে বিকাল গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে। বাড়িতে ফেরারও তাড়া ছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মাসির দেওয়া উপহারগুলো সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেল অরিত্রি।

দেখতে দেখতে আরও দুটো মাস কেটে গেল। শীত গড়িয়ে গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এইরকমই এক গ্রীষ্মের দুপুরে অরিত্রি স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখল ঋদ্ধি মুখটা ভার করে বসে রয়েছে। তার দিকে ফিরেও দেখছে না। অথচ অন্যান্য দিন ভিজে চুলে অরিত্রিকে দেখে ঋদ্ধির যে কী হয় কে জানে। নিজেকে একদম কন্ট্রোল করতে পারে না। অরিত্রি নানা অছিলায় তাকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করে। ইচ্ছে করেই বুক থেকে আঁচলটা খসিয়ে দেয় সে। কিন্তু কিছুতেই কোনও লাভ হচ্ছে না দেখে চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে, ‘আজ কী হয়েছে তোমার? এত নির্লিপ্ত কেন?’

অরিত্রির গলার আওয়াজ শুনে ঘাড়টা ফিরিয়ে ঋদ্ধি বউয়ের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল, ‘তোমার চিঠি’। ঋদ্ধির কপালে অসন্তোষের ভাঁজ স্পষ্ট।

‘আমার চিঠি!’ চিঠির দিকে চোখ যেতেই আনন্দে হাসতে হাসতে খামটা খুলতে খুলতে বলল, ‘আরে এটা তো সুরজের চিঠি।’ বলেই চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে দিতে প্রশ্ন করল, ‘সুরজ কে? এর কথা তো আগে কখনও বলোনি!’

‘আমার পত্রমিত্র। ভীষণ ভালো। ওর গুণের তুলনা হয় না।’ পড়তে পড়তেই জবাব দিল অরিত্রি। তারপর আবার চিঠির মধ্যে ডুবে গেল। পরে আয়নার সামনে বসে গুনগুন করে গাইতে থাকল। ঋদ্ধি আড়চোখে অরিত্রিকে পরখ করছিল। পরপুরুষের প্রতি স্ত্রীর প্রীতি কোন পুরুষই বা মেনে নিতে পারে? রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনওমতে নিজেকে সংযত করে বেশ দৃঢ় ভাবেই বলল, ‘আজ খাবারদাবার পাওয়া যাবে নাকি?’

‘খাবার তো রেডিই আছে,’ বলে রান্নাঘরে চলে গেল সে। স্ত্রীর এত খুশির কারণ কী? ওই চিঠিতে কী এমন লেখা রয়েছে? কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে অরিত্রি যাওয়া মাত্রই আলমারি থেকে চিঠিটা বার করে পড়তে শুরু করল ঋদ্ধি। হিমাচল প্রদেশের কোনও এক গ্রাম থেকে চিঠিটা এসেছে। প্রতিটি ভাষায় রয়েছে পর্বতীয় সংস্কৃতির ছাপ। অরিত্রিকে সপরিবারে ওখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে সুরজ। নতুন বছরে কার্ড পাঠাবার জন্য অরিত্রিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, সঙ্গে ওর কিছু প্রশ্নের উত্তরও। চিঠির ভাষা আর লেখনী সত্যিই তারিফযোগ্য।

অরিত্রি খাবার দেওয়ার পর একে একে সকলে এসে টেবিলে খেতে বসে গেছে। ঋদ্ধি খেতে বসলেও খাওয়ায় বিন্দুমাত্র মন নেই তার। কেমন যেন উদাস। সোহম শুরু থেকেই দাদাকে খেয়াল করছিল। কারণ এই খাম আসার সাক্ষী সে নিজেও, তাই হয়তো দাদার কষ্টটা ও ফিল করছিল। মনে মনে বউমণিকে দূষতে ছাড়েনি সে।

দাদার মন ঘোরাতে মটর পনিরের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাদা এটা তো খেলেই না। দারুণ টেস্ট, খেয়ে দ্যাখো।’

‘না না দিস না। পেটটা ভারভার লাগছে।’ বলে টেবিল থেকে উঠে চলে গেল ঋদ্ধি।

দাদার অবস্থা দেখে সোহম মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিল এবার কোনও চিঠি এলে সে তার বউমণিকে না দিয়ে দাদা ঋদ্ধির হাতেই তুলে দেবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই রহস্য ভেদ করতেই হবে।

সোহমের পরিকল্পনা অনুযায়ী দিন পনেরো পরে সেই শুভক্ষণ উপস্থিত হল। বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবে বলে বেরোচ্ছে, এমন সময় গেটের মুখে ডাকপিয়োন হরিদার সঙ্গে দেখা। দাদার অফিসের একটা চিঠির সাথে সাথে বউমণির সেই গোলাপিরঙা খাম পকেটস্থ করে বেরিয়ে গেল সোহম।

সিনেমা, খাওয়াদাওয়া সেরে সোহম যখন ফিরল তখন ঋদ্ধিও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গেছে। বউমণি রান্নাঘরে আর মা বারান্দায় বসে বসে রেডিয়োতে পুরোনো দিনের গান শুনতে ব্যস্ত। সেই সুযোগে সোজা দাদার কাছে গিয়ে, ‘দাদা, এগুলো নাও। এটা বোধহয় তোমার অফিসের, আর এটা বউমণির। দুপুরে বেরোনোর সময় রাস্তাতেই হরিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।’

‘ওহ্, ঠিক আছে। টেবিলে রেখে যা। আমি দেখে নেব।’ সোহম যাওয়ার পর অফিসের চিঠিটা নিজের কাছে রাখল। অরিত্রির-টা ওর বালিশের নীচে।

ডিনার সেরে অরিত্রি যখন শুতে এল তখন ঋদ্ধি তার চিঠির কথা তাকে জানাল, সঙ্গে এও জানাল সেটা তার বালিশের নীচে রয়েছে।’

‘আমার চিঠি এই সময়?’ অরিত্রি বেশ আশ্চর্য হয়েই কথাগুলি বলে বসল।

‘ওটা দুপুরেই এসেছে। ছোটোন নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন দিয়ে গেল।’ ঋদ্ধির মুখের দিকে তাকাল অরিত্রি। ‘সুরজ-এর চিঠি তাই তো?’ তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল সে।

‘হ্যাঁ, তুমি কেমন করে জানলে?’ হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করল অরি।

‘খাম দেখে। তা, যে আমার বউয়ের মনের এত কাছে, সেই মহাশয়ের সম্পর্কে আমারও তো জানার অধিকার রয়েছে নাকি?’ বিছানায় বসে পড়ল ঋদ্ধি।

‘অবশ্যই রয়েছে। সুরজের সম্পর্কে তোমাকে কী বলব, ঠিক ভাষা খুঁজে পাই না। আমারই সমবয়সি হবে। যেমন সুন্দর তেমনি ব্যক্তিত্ব, আকর্ষকও বটে। ভীষণ ভালো লেখে। মনে হয় পড়তেই থাকি। আর ওর চোখ দুটো…’ বলতে বলতে থেমে যায় অরি। বোধহয় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এমনটা মনে হয় ঋদ্ধির। সন্দেহ আর ঈর্ষায় জ্বলে যেতে থাকে সে। তারপর আর মুখ খোলেনি ঋদ্ধি। পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে সে। অরিত্রি একবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সাড়া দেয়নি ঋদ্ধি। সেও পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

এই কদিনে ঘর সংসারের কোনও পরিবর্তন না হলেও, ঋদ্ধির আচার-ব্যবহারে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে। দেরি করে বাড়ি ফেরে। অরিত্রি না খেয়ে বসে থাকলেও ‘বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি’ বলে হাত-পা ধুয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।

বিমলাদেবী আর সোহমও ঋদ্ধির এই আকস্মিক পরিবর্তনে চিন্তান্বিত হয়ে উঠেছিল। চোখের সামনে ছেলেটা সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে চলেছে। বাড়িতে কারওর সঙ্গে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলছে না। চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

একদিন সন্ধ্যাবেলা কোনও কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে ঋদ্ধি। ফেরা থেকেই ঘর থেকে এক পা বেরোয়নি। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সিগারেটে টান দিয়েই চলেছে। একটা শেষ হলে আরেকটা। সামনে টিভি চালিয়ে বসেছে, কিন্তু একবারের জন্যও সেদিকে তাকিয়ে দেখছে না। যেন অন্য কোনও জগতে রয়েছে।

চোখের সামনে এসব আর দেখতে পারছিল না অরিত্রি। রাগে হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল সে, ‘কী হয়েছে তোমার? আমাকে খোলসা করে বলোতো। আমাকে দেখলে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ কেন? বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি। আমি কি এতটাই অবহেলার পাত্রী? নাকি আমাকে আর পছন্দ হচ্ছে না তোমার?’

টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করল না ঋদ্ধি। তাই দেখে রাগে গা জ্বালা করে উঠল অরিত্রির। কিন্তু তাতেও স্বামীর কোনওরম তাপোত্তাপ নেই দেখে একটু নরম হয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘কী এত ভাবো তুমি? কারণটা আমাকে বলা যায় না? আগে তো এত সিগারেট খেতে না। কী এমন হল বলো না?’ চোখ ছলছল করে উঠল অরিত্রির।

‘তুমি আগেও যেমন সুন্দর ছিলে, এখনও তেমনি সুন্দর আছ। বরং আমিই তোমার যোগ্য নই। সুরজের মতো আমি সুন্দরও নই, অত সুন্দর কথাও বলতে পারি না, আর আকর্ষকও নই।’ কথাগুলো কানে গিয়ে লাগল অরিত্রির।

‘এসব কী বলছ তুমি?’

‘ঠিকই বলছি। তোমাকে আমি আর বেশিদিন ধরে রাখব না। যাতে খুব তাড়াতাড়ি পাকাপাকি ভাবে সুরজের কাছে যেতে পারো, সেই ব্যবস্থাই করছি।’ ঠান্ডা মেজাজে জবাব দিল ঋদ্ধি।

‘তুমি কী পাগল হলে? এসব কী আবোল-তাবোল বকছ তুমি?’ বলেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল অরিত্রি। সে ভালোমতোই বুঝে গিয়েছিল ঋদ্ধির মনে সন্দেহ বাসা বেঁধেছে। সহজে এটা যাওয়ারও নয়।

‘তুমি যেটা মুখ ফুটে বলতে পারোনি, আমি সেই সত্যিটা-ই বলছি। প্লিজ আমাকে ভালোবাসার নাটকটা এবার বন্ধ করো।’ কঠোরভাবেই ঋদ্ধি কথাগুলো বলে গেল।

‘এমন করে কেন বলছ। সুরজ শুধুই আমার পত্রমিত্র। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না। শুধু শুধু সন্দেহ করছ।’ দু-গাল দিয়ে জল বয়ে নেমে এল অরিত্রির।

‘তুমি যতই সাফাই দাও না কেন, আমি জানি তোমাদের সম্পর্কটা কী। স্ত্রীকে পরপুরুষে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছে, এটা কোন স্বামী মেনে নেবে।’ একই ভঙ্গিমায় বলে যাচ্ছিল ঋদ্ধি।

‘তুমি পড়ে দ্যাখো, এগুলো প্রেমপত্র নয়।’ দৌড়ে আলমারি থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিল অরিত্রি।

কিন্তু ঋদ্ধির সেই এক গোঁ। অরিত্রির কোনও কথাই সে শুনবে না। ‘ওগুলো নিজের ভবিষ্যতের জন্য রেখে দাও।’ বলেই চিঠিগুলো অরিত্রির মুখের উপর ছুড়ে মারল।

‘তুমি জানো না ঋদ্ধি, আমাদের সম্পর্ক এই কাগজের চিঠিপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমাকে কী করে বোঝাব।’

‘বোঝানোর আর আছেটা কী? কী বোঝাবে আমাকে? ধরা পড়ে গেছ অরি। এত বোকা ভেব না আমাকে।’ রাগে বিছানা থেকে বালিশটা নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ঋদ্ধি।

কাঁদতে কাঁদতে অরিত্রি আওড়ে যেতে থাকল, ‘তুমি ভুল বুঝছ। ফোটো ছাড়া আমি তাকে কোনওদিন দেখিনি পর্যন্ত, বন্ধুত্ব ছাড়া কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের। প্লিজ ট্রাস্ট মি।’ অরিত্রির পৌনঃপুনিক কাতর স্বীকারোক্তি ঋদ্ধির কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা কে জানে। অনেক রাত পর্যন্ত ওই ভাবেই বসে রইল অরিত্রি। ভোরের দিকে গা এলিয়ে দিল বিছানায়।

পরদিন সাততাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় ঋদ্ধির। অরিত্রি তখনও অবচেতন ভাবে ঘুমিয়ে রয়েছে। প্রায় সাতটা নাগাদ বাড়ির ল্যান্ড ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই কোনওরকমে হাত-পা মুখ ধুয়েই ছোটে রান্নাঘরের দিকে। ব্রেকফাস্ট রেডি করে আনতে আনতেই বেরিয়ে যায় ঋদ্ধি। প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অরিত্রি। ছেলেকে বেরিয়ে যেতে দেখে, ‘কী হল বউমা?’ প্রশ্ন করেন বিমলাদেবী।

‘কিছু না মা।’ লোকানোর চেষ্টা করে অরিত্রি।

‘বাবু না খেয়েই চলে গেল?’

‘তাড়া ছিল তাই…’

‘এত কীসের তাড়া, যে না খেয়ে চলে যেতে হল। বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি তোমাদের দুজনের কিছু একটা হয়েছে। যাই হোক ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ভেবে দেখো’ বলে অন্যত্র চলে গেলেন বিমলাদেবী।

সেইদিন ঋদ্ধি বাড়ি ফিরলও বেশ রাত করে। সকলে অপেক্ষা করছিল তার জন্য।

ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে এল, তখন বিমলাদেবী ছেলেকে পাশে বসিয়ে একপ্রকার চেপে ধরলেন, ‘হ্যাঁরে বাবু আগে তো অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি করতিস না। কদিন ধরে কী হচ্ছে, রোজই দেরি করছিস, ঠিক করে খাচ্ছিস না।’

‘মা, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। তাই দেরি হচ্ছে।’

‘কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে তুই ভালো নেই।’ ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিমলাদেবী।

‘না-না মা। সেরকম কিছু নয়।’ হাসার চেষ্টা করল ঋদ্ধি।

‘জানিস বাবু তুই তো তাড়াহুড়োতে না খেয়ে চলে গেলি। তারপর থেকে মেয়েটা সারাটা দিন কিচ্ছুটি মুখে দিল না।’

‘পতিব্রতা নারীদের মতো?’ কথার মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তীর্যক উক্তি করল সোহম। ছোটোছেলের রসিকতার জন্য বিমলাদেবী তাকে বকাও দিলেন। ওদিকে অরিত্রি লক্ষ্য করল শাশুড়ি বলার পর থেকেই ঋদ্ধি আড়চোখে তাকেই দেখে যাচ্ছে। ভালো করে খাচ্ছে না দেখে এবার শাশুড়িই ছেলেকে খাওয়াতে উদ্যোগী হলেন। হাতে খানিকটা ভাতের দলা তুলে ছেলের মুখে দিতে দিতে বললেন ‘তোর মনে আছে বাবু, ছোটোবেলায় তুই একটা গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতিস। বামুন আর পাঁঠার গল্প। সেই যে বলি দেবে বলে বামুন হাট থেকে একটা স্বাস্থ্যবান পাঁঠা কিনে ফিরছিল। ফেরার পথে একদল দুষ্টু লোক বামুনকে বোকা বানিয়ে পাঁঠা নিয়ে কেটে খাবে বলে তাকে বলল, ‘এমা পুরুতমশাই আপনি একটু কুকুর ঘাড়ে করে কোথায় চললেন?’ বামুন তো একপ্রকার তাদের গালমন্দ করে ভাগিয়ে দিলেন। ‘অন্ধ মুখপোড়ার দল কিছুই কি তোদের চোখে পড়ে না?’

ঋদ্ধি ছেলেমানুষের মতো গল্প শুনতে শুনতে ভাত মুখে পুরতে থাকে। বিমলাদেবী গল্পের জাল বুনতে থাকেন। তারপর আরেকদল ছেলে একই উদ্দেশ্যে বলে, ‘ও পুরুতমশাই এই গাধাটাকে ঘাড়ে নিয়ে কোথায় চললেন?’ এই শুনে পুরোহিত তাদের এই মারে তো সেই মারে। কিন্তু তৃতীয়বার একই উদ্দেশ্যে একদল চাষী যখন বলে ওঠে ‘ও ঠাকুরমশাই ব্রাহ্মণ হয়ে আপনি শেষে কিনা একটা মরা বাছুর ঘাড়ে নিয়ে চললেন’। এবার পুরুতমশাই তাদের কথায় বিশ্বাস করে ওখানেই পাঁঠাটাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। এই গল্পের নীতিবাক্যটা মনে আছে বাবু? সত্যতা যাচাই করে তবেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত। চল উঠে পড় খাওয়া শেষ তোর।’

ঋদ্ধি যেন ঘোর ভেঙে উঠে পড়ল। পরিবেশ হালকা করার জন্য এবার বিমলাদেবী বললেন, ‘তাহলে আজকে একটা সায়গলের গান হয়ে যাক, কী বলিস বাবু।’

অন্যমনস্ক থাকায় হঠাৎই মায়ের কথা শুনে চমকে উঠল ঋদ্ধি। কোনওমতে জবাব দিল, ‘ঠিক আছে।’

ডিনার সেরে ওঠার পর হালকা করে সায়গলের গান চালিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই ঋদ্ধির। হয়তো মানসিক অশান্তিও এর একটা কারণ। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই বিছানায় থাকা বিয়ের অ্যালবামগুলো নজরে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই হাত চলে গেল অ্যালবামগুলোর দিকে। বিছানায় বসে অ্যালবামগুলো হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে ওলটাতে পালটাতে থাকল সে। বিয়ের সেইসব সুখের মুহূর্তগুলো ভেসে উঠল চোখের সামনে। সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমেষে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল।

সমস্ত কাজ গুছিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা স্বামীর পাশে গিয়ে বসল অরিত্রি। ‘বিশ্বাস করো আমার মনে কোনও পাপ নেই। হ্যাঁ পত্রমিত্র-র ব্যাপারটা আমি আগাগোড়াই সহজভাবে নিয়ে এসেছি। এটা নিয়ে কোনওদিন গভীর ভাবে ভাবিইনি। এটাই আমার সব থেকে বড়ো ভুল। প্রতিটি ক্ষণে যার মাসুল গুনছি আমি।’

ঋদ্ধি অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। অরিত্রি বলে চলেছিল তার কথা। ‘আজ সারাদিন ভেবেছি, এই সামান্য একটা ভুলের জন্য আমার সংসারটা আজ ভাঙতে বসেছে। আমার ভালোবাসা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ঠিক করেছি এই কাগজের সম্পর্ক আমি আজই শেষ করব’ বলে সমস্ত চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল অরিত্রি। তারপর একটু এগিয়ে ঋদ্ধির গা ঘেঁষে বসে তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘আমি শুধু তোমার… শুধু তোমার। ভুল বুঝে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ। একটা মুহূর্ত তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি।’

বারবার মায়ের বলা গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। অরিত্রির কথা শুনে জমে থাকা সব অভিমান গলে জল হয়ে গেল ঋদ্ধির। চোখ ছলছল করছিল তার। অরিত্রির হাত দুটো নিজের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে, ‘তুমি জানো না অরি এই কয়েকদিনে তোমার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। প্রতিটি মুহূর্তে ছটফট করেছি। সুরজের প্রতি তোমার অ্যাটেনশন, কথায় কথায় ওর প্রশংসা, মেনে নিতে পারছিলাম না। সুরজের নাম শুনলেও কেমন একটা আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল আমাকে।’ খানিক চুপ করে যায় ঋদ্ধি। অরি-র হাতদুটো আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘জানো ছোটোন যখন তোমার চিঠিটা লুকিয়ে আমাকে দিতে এল, তখন লজ্জায় ওর চোখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারিনি। শুধু মনে হয়েছে ওরা তোমাকে কত ছোটো নজরে দেখছে। তোমার চরিত্র নিয়ে… বিশ্বাস করো তোমাকে কেউ ছোটো করুক সে আমি চাইনি।’ মাথা হেঁট করে নেয় ঋদ্ধি।

স্বামীকে কাছে টেনে নেয় অরিত্রি। ‘দুঃস্বপ্ন ভেবে সব ভুলে যাও। দেখো আমরা খুব সুখী হব।’ একে-অপরের খুব অন্তরঙ্গ হয়ে আসে ওরা। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। তখনও দুজনের চোখে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে সুদূর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছে।

 

রুনার আকাশ

এক

আমার ঠাকুরদার নাম হরিহর। হরিহর গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের বাড়িতে ঠাকুরদার কোনও ছবি নেই। কেন নেই কে জানে! সে আমলেও তো ভালো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি তোলা হতো।

এইসব প্রশ্ন রুনা আমাকে করে। রুনা মানে আমার মাস তিনেকের বিয়ে করা নতুন বউ। ঠাকুমার কাছে শুনেছি দেশের বাড়ি তৈরির সময় টাটা স্টিলের লোহার বিম, এক মাইল রাস্তা ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন গাঙ্গুলিমশাই। এসব কথা রুনা অবাক হয়ে শোনে। গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে,

– তুমি পারো?

– আমি? অবাক না হয়ে পারি না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সদ্য বিয়ে করা বউকে অবাক হয়ে দেখা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি!

সেই শুরু। এরপর থেকে গাঙ্গুলিমশাই থেকেই গেলেন। আমার আর রুনার মধ্যে ছোট্ট হাইফেনের মতো। আমাদের শয়নে, স্বপনে, আহারে, বিহারে এবং সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যেও।

একটা উদাহরণ দিলে সহজবোধ্য হবে ব্যাপারটা। নাইট শো’তে সিনেমায় গেছি আমরা দুজন। এলাকার প্রেস্টিজিয়াস এসি হল ‘মৌলি’তে। রুনার হাতে আমার হাত। আর স্বাধীনতা পেলে কী করতে পারে আমার হাত সে ভালোমতো জানা আছে। রুনাও সম্ভবত তেমনই কোনও প্রত্যাশায় কাঁপছে ভিতরে ভিতরে। স্ক্রিনে তখন ভালোই চলছে ‘মিস লাভলি’র নীরব অভিসার। আমাদেরও। হলের অন্ধকার ও নৈঃশব্দ্যে। হঠাৎ এক দৃশ্যে এক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ। ওই যেমন হয় আরকি, নায়ক কি নায়িকার দাদু বা অন্য কেউ। বুঝতে পারলাম ছটফটিয়ে উঠল রুনা।

হাতের মধ্যে ধরে থাকা ওর হাত না ছেড়েই জিজ্ঞেস করলাম,

– কী হল রুনা?

আর কিছু বলবার দরকার ছিল না। কানের পাশেই ফিসফিসিয়ে উঠল রুনা

– দাদু থাকলে খুব ভালো হতো, না গো!

বিশ্বসংসার তখন লুপ্ত আমার সামনে। স্ক্রিন ডাহা ফাঁকা। গান-গল্প বিষ লাগছে সব। নায়ক-নায়িকার চূড়ান্ত প্রেমও কেমন অভব্য লাগছে পর্দায়। অথচ ঠিক আমার পাশেই সেই মুখ, ঠোঁট আর পহলগাঁওয়ের পথের পাশের কাশ্মীরি আপেলের মতো টুকটুকে গাল। ওই গালে ঠোঁট ছোঁয়ানো যায় শুধু। হাত তোলা কক্ষনো নয়।

বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর ঘরে চার দেয়ালের নির্জনে রুনাকে একেবারে নিজের করে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– আচ্ছা রুন, দাদুর কথাটা এবার থেকে একটু কম বলা যায় না কি?

রাতে বিছানায় উঠে আসবার আগে কন্ঠার কাছটায়, চোখের তলায় ক্রিম ঘষে রুনা। ফরাসি ক্রিম। ওরিগন। দশ মিলি সাড়ে সাতশো টাকা। ওর মাসির বাড়ি থেকে দিয়েছে। মামুলি প্রাইভেট ফার্মের কর্মচারী, আমার এসব সাধ্যের বাইরে।

ঠিক এই একটি কারণে রুনার বাবা শুভ্রজ্যোতিবাবুর, মেয়ের পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও আমার নামের পাশে বিরাট এক ঢ্যারা মেরে দিতে প্রথমে একটুও দ্বিধা হয়নি। বড়ো চাটার্ড ফার্ম ‘মুখার্জি অ্যান্ড সরকার’-এর সিনিয়র পার্টনার মুখার্জি সাহেবের ছোটো মেয়ে রুনা। কীভাবে যে কলেজ সোশ্যালে আমার গলায় ‘রামধনু মন’ শুনে মজল, উঁহু শুধু মজল না গলা পর্যন্ত ডুবল, সেটাই এক রহস্য। আমার কাছে। মুখার্জি সাহেবের কাছে তো বটেই।

সেই রুনা এবং আশ্চর্য এক মায়াবী সুগন্ধ এখন উড়ে বেড়াচ্ছে আমার মুখের আশপাশে। ওর গলায় মুখার্জি দম্পতির দেওয়া পার্ল-এর হার লকেটসমেত। দোল খাচ্ছে আমার চোখের সামনে। আলতো করে জিভ দিয়ে সেই লকেট স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে ফেলি। তবুও সেই অবস্থায়ই জিজ্ঞেস করি,

– কী হল, কিছু বললে না যে?

আমার নাকে নিজের নাক দিয়ে ঘষতে ঘষতে রুনা হাসল। ঘরের আলোআঁধারিতে সেই সংক্রামক হাসি কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে কোনও পুরুষকে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। যুগ যুগ ধরে শুধু তথ্যই আহরিত হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে– আর কিছু নয়। বাস্তবে সেই অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারাই শুধু জানে।

– আচ্ছা, তুমি কেমন মানুষ গো! যে-মানুষটার কোনও ছবিই নেই বাড়িতে, তাকে তোমার এত হিংসে কেন? আমাকে নিজের শরীরের নীচে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে দখলদারিত্ব দেখিয়ে বলল রুনা।

এই সুমধুর সময়ে, যখন নাইটির পাতলা আড়াল ছাড়া রুনার পাখির মতো হালকা নরম শরীরটা সম্পূর্ণ আমারই অধিকারে এবং সেই শরীরের সর্বত্র চলে বেড়াচ্ছে আমার চঞ্চল হাত, তখন এসব কথা জিজ্ঞেস করে কোন মূর্খ? তবু একবার প্রায় জড়িয়ে আসা গলায় বলবার চেষ্টা করলাম,

– উঁ…উঁ… হিংসের কথা উঠছে কেন?

– ন্– না– এসব কথা থাক এখন। বুকের উপর অহংকারী মরালীর মতো শরীর ছেড়ে রাখা রুনা, ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিল। অগত্যা আমাকে চুপ করতেই হল।

দুই

রমেনের বাবা জীবনকাকু মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার। শুধু কমিশনার বললে ভুল হবে। রীতিমতো বাঘ আর গরুকেএকঘাটে জল খাওয়ানোর এলেমধারী বলতে যা বোঝায় জীবন রায় ঠিক তাই-ই।

ওঁকে বাদ দিয়ে মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান দিনে অন্ধকার দেখেন আর রাতে চোখে তারাবাজি। সেই জীবনকাকু আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির আঠাশ নম্বর ওয়ার্ডের। এই ওয়ার্ডেই আবার এলাকার সবচেয়ে বড়ো মার্কেটিং কমপ্লেক্স ‘উত্তরায়ণ’। কেন ‘উত্তরায়ণ’ কেন ‘দক্ষিণায়ন’ নয় এসব জটিল কথার জবাব কাকুকে জিজ্ঞেস করলে সুন্দর দাঁতের প্রদর্শনী দেখান। তারপর হাত একটু কাত করেন উপর দিকে। অর্থাৎ চেয়ারম্যান জানতে পারেন কিংবা আর একটু উপরের, সব চেয়ারম্যানের লর্ড স্বয়ং ভগবান।

এই মানুষটির ছেলে রমেন আমার বন্ধু। সেই পাঠশালার দিনগুলো থেকে। তারপর সেন্ট জন্স এইচ এস স্কুল হয়ে কলেজ পর্যন্ত। সেই রমেন। রমেন রায়। তার ফুলশয্যা। আটশো থেকে হাজার লোকের অ্যারেঞ্জমেন্ট। মিছিলের মতো একদল ঢুকছে ‘কুশন্ডিকা’ লজে আর একদল বেরিয়ে আসছে। বাজারের যত কসাই আর মাছওয়ালাদের দেখলাম। সবাই বেশ ওদের স্বাভাবিক ড্রেস লুঙ্গি, গেঞ্জি আর রক্তমাংস মাখা ফতুয়া ছাড়াই সেজেগুজে এসেছে। অনেকের চোখে আবার সুরমা টানাও দেখলাম।

রুনা আর আমিও এসেছি খুব সেজেগুজে। হালকা নীল ফুলস্লিভ ব্র্যান্ডেড শার্ট পরেছি। ‘আবু জানি’র এই শার্ট শীতের তত্ত্বে দিয়ে পাঠিয়েছেন আমার শাশুড়ি মা। এসব কি গরিব জামাইকে কিছু শেখানোর জন্য? কে জানে? পরবার জন্য শার্ট এসেছে পরেছি। তার সঙ্গে মানানসই ট্রাউজার। কোটের বাটনহোল-এ লালগোলাপ সামান্য মাথা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে আমার স্বাতন্ত্র্য।

আর রুনা যা সেজেছে আজ দেবতারাও মনে হচ্ছে স্বর্গের ব্যালকনিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে দেখছেন ওকে। বাঙ্গালোর সিল্ক-এর উপর বিয়েবাড়ির আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে যেন। রামধনু-রঙা চোলি, ঠিক ব্যাকলেস নয় আবার তা বলাও যায়। অদ্ভুত এক রঙিন কাটাকুটি খেলায় মেতেছে পিঠের দিকটা।

নিজের বউকে এইসব সময়েই অন্য কারওর বলে মনে হয়। গলা থেকে অনায়াসে ঝুলছে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া মুক্তোর হার। কানে ম্যাচিং দুল। যেন ইশারায় ডাক পাঠাচ্ছে, ‘আয় আয় ছুঁয়ে যা’। হাতে সুগন্ধি ডোকরা প্রিন্টেড রুমাল। দেখেশুনে কার ফুলশয্যা হচ্ছে আমার না রমেনের বোঝা দায়।

কাজের বাড়িতে জীবনকাকু কারওর কোনও অসুবিধার জায়গাই রাখেননি। আদর-আপ্যায়ন, কফি, পকোড়া এবং অবশ্যই মাটনের সঙ্গে বিবিধ মাছের প্রিপারেশন (ইলিশ, চিংড়ি আর ভেটকি)।  খাওয়াদাওয়া শেষ করে সকলে ধন্য ধন্য করতে করতে বেরিয়ে আসছে। ঘড়িতে রাত বারোটা। খাওয়াদাওয়ার পর সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে রমেন আর পর্ণাকে ঘরে ঢুকিয়ে তবে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আমাদেরও ছুটি।

এত রাতে আবার বাড়ি ফেরা কেন রমেনদের বাড়ির সকলেই সেকথা জিজ্ঞেস করছিল। রুনা হেসে সকলকে বিদায় জানাল। হাসলে যে ওকে এত সুন্দর লাগে একান্নতম বার সেই সত্যটা আবিষ্কার করলাম একেবারে ওর পাশে দাঁড়িয়ে।

রমেনের বাবা ঘাড় ফিরিয়ে কাকে যেন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে বললেন আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য। তারপর কাজের বাড়িতে যা হয়। আরও গুরুতর কোনও কাজের তাড়ায় আমাদেরটা অনায়াসে হারিয়ে গেল।

অগত্যা শুধু আমরা দুজনে রাস্তায় নেমে এলাম। পিছন ফিরে একবার আলোয় ঝলমলে লজটার দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা জাহাজের মতো মনে হল। টাইটানিক নাকি রে বাবা! মজা পেলাম খুব। বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম রমেনের উদ্দেশে আমাদের যৌথ শুভেচ্ছাবাণী– ভাস রমেন, ভেসে যা ওই অথৈ সমুদ্রে!

সামনের দিকে রাস্তা পড়ে আছে রাস্তারই মতো শুনসান। অনুষ্ঠান বাড়ির গাড়িগুলো তীরবেগে ছুটে চলে যাবার পরই রাস্তা আবারও শুনসান। একটু তফাতে তফাতে হ্যালোজেন ল্যাম্পের আলো অন্ধকারের পরিধি কমিয়েছে কেবল। আলো আর অন্ধকারের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলতে খেলতে কখন যে বেশ খানিকটা ফাঁকা রাস্তা ফেলে এগিয়ে এসেছি আমরা দুজনে একটুও বুঝতে পারিনি।

এমন ফাঁকা রাস্তায় আমার রুন-কে একলা পাবার আনন্দে মন গুনগুনিয়ে উঠল। চট করে ওর পাশে গিয়ে ডানহাত দিয়ে বেড় দিয়ে নিলাম ওর মোম আর মেদ দিয়ে তৈরি মসৃণ কোমরটাকে। নীচু হয়ে সেই কোমরে সবে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছি, এমন সময় যেন পায়ের আওয়াজ পেলাম পিছনে।

চমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। কেউ কোথাও নেই। রাস্তা যেই কে সেই। একেবারে ফাঁকা। কেবল দূরে দূরে একটি দুটি কুকুর। সন্দেহজনক চোখে দেখছে আমাদের। উপযুক্ত পরিচালকের হাতে পড়লে এই সিন মারকাটারি হয়ে উঠতে পারে। এই স্তব্ধতা, এই নির্জন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ধোঁয়া ধোঁয়া আচ্ছন্নতা। তার সঙ্গে বিমূঢ় নায়ক-নায়িকা। ফ্যানটাস্টিক!

মাথার মধ্যে কোনও প্রতিবর্তী সংকেত পাবার আগেই রুনার ভয়ার্ত গলা শুনতে পেলাম,

– একটা লোক!

স্বর্গ থেকে যেন পতন হল আমার,

– কই– কোথায়?

– পিছনে। বলতে বলতে আমার শরীরে সেঁধিয়ে এল রুনা। আহ্ রুন, আমার রুনি! ওকে শক্ত করে এক হাতে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে পিছনে তাকালাম। কোনও তারতম্য নেই। নির্জন রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টের আলো শুষে নিচ্ছে নিঃশব্দে।

– ধুস্ – ভুল দেখেছ। বিয়েবাড়িরই কেউ হবে হয়তো।

রুনাকে সাহস দিতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল আমার। এত রাতে বেমক্বা রাস্তায় নেমে পড়বার কী খেসারত দিতে হবে কে জানে। কোনও অটো কিংবা অন্য যানবাহনও তো নজরে পড়ছে না। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো!

যাই হোক, এই পরিস্থিতি থেকে তো বেরোনোর চেষ্টা করতেই হবে। সঙ্গে আবার রুনাও রয়েছে। আমার যা হবার হোক। কিন্তু রুন– আমার রুন যেন নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে। কপালে বিন্ বিন্ করে ঘাম ফুটছে টের পেলাম।

আমার এমন প্রায়-অপ্সরা বউয়ের স্পর্শও নিশ্চিন্ত করতে পারল না একটুও। একবার মনে হল পায়ের আওয়াজ পেলাম পাশেই। চমকে তাকালাম। কেউ না। কিছু না। অথচ নিশ্চিতভাবেই পায়ের শব্দ। নির্ঘাত বদ মতলবেই লুকিয়েচুরিয়ে কেউ আসছে পিছু পিছু।

চিন্তাটা মাথায় আসতেই কেঁপে উঠলাম। মনে মনে খুব ধমকাতে লাগলাম নিজেকে। কেন যে অনুষ্ঠান বাড়ির বাইরে ওদেরই বাড়ির দু’চারজন ছোকরা যারা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রাস্তার অগুনতি সুন্দরীদের ঝাড়ি করছিল ফ্রাঙ্কো নিরো কি চার্লস ব্রনসন স্টাইলে, তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এলাম না। আপশোশ হচ্ছিল খুব। রুনার সুগন্ধি কানের লতির পাশে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললাম,

– আর দেরি নয়। এবার দৌড় দিতে হবে।

রুনা হয়তো বলতও কিছু কিন্তু আমার হাতে বাঁধা পড়েছে ওর হাত। কুসুমকোমল যাকে বলে। সেই হাতে টান পড়ল। শুরু হল আমাদের সম্মিলিত দৌড়। রেডি-স্টেডি-গো।

পাশে পড়ে রইল ‘কমলা স্টোর্স’, ‘হিরন্ময় জুয়েলারি হাউস’। ঘাড় ফিরিয়ে আবার কাউকে দেখতে হবে, এখন আর এমন ভয় করি না। শক্ত করে রুনার হাত ধরে কাছে টানলাম ওকে। বললাম,

– এলাকায় এসে গেছি। আর কোনও ভয় নেই।

আস্তে আস্তে দুই পরাজিত সৈনিকের মতো বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। পিছনে আর কোনও পায়ের শব্দ নেই। ওই তো সামনে হলুদ গেটওয়ালা অনিরুদ্ধ সিনহার বাড়ি। সিনহাদা’র পরই আমাদের সাতাশ’এর দুই, চণ্ডীতলা রোড-এর আস্তানা। বারান্দার আলো এখান থেকেও নজরে পড়ে বেশ।

তিন

রাতের ব্যাপারটাকে মনে মনে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না। তা নইলে রুনাকে কি আর অমন করে কাছে পেতাম কোনওদিন। একেবারে সর্বস্ব নিয়ে কাছে আসা বোধহয় একেই বলে।

ভোর সত্যিই যে কত মনোরম হতে পারে এমন ঘোরতর কোনও রাত না কাটলে তা বোঝা যেত না। রাতে ঘরের তালা খুলে কখন ঢুকলাম, কখন অনুষ্ঠানবাড়ির পোশাক ছেড়ে আবার বিছানার পোশাকে ফিরলাম এসব এই ভোরে আর মনে করতে ইচ্ছা হল না।

শেষরাতে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙেছে এটুকুই শুধু মনে করতে পারলাম। রুনার মোবাইলে সুন্দর সুরেলা আওয়াজ। হাত বাড়াতে ইচ্ছা করছিল না বলে ধরিনি। তার থেকে ঘুমন্ত রুনার কবিতার মতো ঠোঁটদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশি ভালো লাগছিল।

বসে বসে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, আবার ক্রিং ক্রিং… এবার ল্যান্ডলাইনে।

হাত গেল। রুনারই পছন্দ করা প্রিয়দর্শিনী রিসিভার উঠে এল হাতে। কোনও কথা না বলে শুধু ‘শুনলাম’ বলাই ভালো।

– হ্যালো রুনা, আমি আকাশ।

কেবল ‘হুঁ’ দিয়ে গেলাম। কে আকাশ, কী বৃত্তান্ত সেসব কথা এই ভোরের রাজেন্দ্রাণী উঠে জানাবে আমায়।

অফিস বেরোবার সময় শুধু আমার রুনের স্বপ্নালু চোখ দুটিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম,

– আকাশের ফোন এসেছিল।

– ওমা, সত্যি! কখন গো?

এত উচ্ছ্বাস ঝ’রে পড়ল রুনার গলায় যে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না,

– কে আকাশ?

– সেকি তুমি আকাশকে চেনো না! রুনার চোখ গোল হয়ে গেল। যেন আকাশ রবিশংকরজি কিংবা রোনাল্ডো যে তাকে চিনতেই হবে। আরও হয়তো কথা বলতাম কিন্তু হাতের ঘড়ি এক মারাত্মক যন্ত্র। ঘাড় ধাক্বা দিয়ে অফিসে তাড়িয়ে নিয়ে গেল আমায়। বিয়ের পর এই কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবার দুপুরে আর বাড়িতে ফোন করলাম না।

সন্ধের একটু পরে অটো থেকে নেমে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতেই শুনতে পেলাম ড্রইংরুম থেকে ভেসে আসা রুনার হাসির শব্দ।

পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ালাম। সোফায় বসা রুনা তাকাল। অত্যন্ত রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে এলিয়ে বসে আছে সোফায়। শরীরের আঁচল নামক বস্তুটি অজান্তে কিংবা স্বজ্ঞানেই কখন প’ড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেয়। আর সেই শরীরের প্রখর তাপে দগ্ধ হয়ে চলেছে রুনার পায়ের কাছে ভক্তের মতো বসে থাকা এক ঝাঁকড়া চুলের ছোকরা। গায়ে অসংখ্য তারা আঁকা ‘গোয়া’ লেখা টি-শার্ট আর পরনে ডেনিম।

আমাকে দেখে হই হই করে উঠল রুনা,

– দ্যাখো কে এসেছে! আরে এ-ই তো আকাশ। আকাশ ঘোষদস্তিদার। ফেমাস আর্টিস্ট। আসলে, ঠাকুরদার একটা ছবি আঁকানোর ব্যাপারে –

ছোকরা কথার মধ্যেই তার মুগ্ধ চোখদুটি আমার দিকে ফেরাল। আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না। পর্দা ছেড়ে সিঁড়িতে বেশ কয়েকধাপ উঠে গেলাম তাড়াতাড়ি।

‘গাঙ্গুলিমশাই’-এর ছবি যে আঁকা হবেই, সেটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হল না আর।

 

ছুটি

হঠাৎ গোঁ ধরেছিল ছেলেটা। কাল থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু, কিন্তু কিছুতেই পড়তে বসবে না। বিকেলে খেতে খেতে নিনজা হাতোড়ি, ছোটা ভীম, বেনটেন রোজকার মতো কালও অনুমোদন করা হয়েছে। খাওয়ার ছলে বেশ খানিকক্ষণ টিভি দেখতে থাকে এমনিতেই। কিন্তু কাল ওকে বোকাবাক্সের সামনে থেকে নড়ানোই যাচ্ছিল না। লিটারেচারের কী বিরাট সিলেবাস। অত প্রশ্নোত্তর, শব্দার্থ, ইডিয়ামস, কবিতা, বানান– তিথি নিজেও মনে রাখতে পারত কিনা সন্দেহ। আর রন্তির ভ্রূক্ষেপ নেই। দশ পূর্ণ হল। ক্লাস ফাইভে উঠবে। ছেলের নিজেরও তো গরজ থাকবে। তা নয়। মা চামচে মেখে গিলিয়ে না দিলে এক বর্ণ পড়বে না। আধাখ্যাঁচড়া প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষার আগের দিন নিশ্চিন্তে কার্টুনে ডুবেছিল।

অনেকক্ষণ বোঝানোর পর পিঠে একটা চাপড় বসায় তিথি। এমন দুর্বিনীত ছেলে, মাকেই উলটে আক্রমণ করে। তবে রে? ছেলেকে এলোপাতাড়ি মেরে ধরে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যায় মা। যার জন্য নিজের প্রিয় ধারাবাহিক ছেড়ে দিচ্ছে, তার একটু হুঁশ থাকবে না? উলটে মাকে মার? ভাগ্যিস শাশুড়ি ওই সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন না।

মার খেয়ে রন্তি আরও গোঁয়াড় হয়ে উঠল। এমন বিশ্রী জেদ, আদর করে ভুলিয়েও গলানো গেল না। বাবা অফিস থেকে ফিরেছে ছেলের জন্য বেনটেন কমিক্স আর এক প্যাকেট হিমায়িত চিকেন কাটলেট নিয়ে। কী আক্বেল। পড়ানোর বেলা গোল্লা, পরীক্ষার আগে এমন বিনোদনের বই কেউ কেনে? সাধারণত যেদিন এই ধরনের খাদ্য আসে, সেদিনই ভেজে উদ্বোধন করা হয়। ছেলে বই নিয়ে সদ্য বসেছে, আর দেরিও হয়ে গেছে। তাই বলল, ‘আজ থাক, কাল ভালো করে পরীক্ষা দাও। কাল ভেজে দেব। আর পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে যা চাইবে তাই দেব। সোনা বাবা আমার, পোয়েমদুটো লিখে দেখাও তো। ওগুলো থেকে ফিল ইন দি ব্ল্যাঙ্কস আসবে না? কমা ফুলস্টপ, সেমিকোলন সব ভালো করে দেখে নাও।’

‘কোলন আর ড্যাশও আছে। টু আ বাটারফ্লাই আমার মুখস্থ।’ অসন্তুষ্ট গলায় গজগজ করল রন্তি। তারপর দুটো মাঝারি কবিতা লিখতেই সাড়ে ন’টা বাজিয়ে দিল। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রশ্নোত্তর ঝালানো বাকি। তাছাড়া সাহিত্যের টেক্স্ট থেকেও ব্যাকরণের প্রশ্ন আসে। সবই করিয়েছে তিথি একবার করে। কিন্তু পরীক্ষার আগে না দেখলে? ছেলের ঠাকুমা বলেন, ‘ও সব পারবে’। বাবা বলে, ‘বাদ দাও’।

অগত্যা জেনারেল লি’র অধিনায়কত্বে খ্যাঁদা-নেকো জাপানিদের তাকেশি’স কাসল অভিযান দেখতে দেখতে খাবার টেবিলের বদলে সেন্টার টেবিলে ডিমের ঝোল ভাত মেখে রন্তিকে গিলিয়ে দিল। খাওয়ার ব্যাপারে রন্তিকে সাধতে হয় না। কিন্তু আজ একে মার-বকুনি, তার ওপর আলু-পটল দিয়ে ডিমের ডালনা। মুখে মুখে প্রশ্নোত্তর ধরতে গিয়ে দেখল ছেলে হাঁ করে হাড়গোড় গুঁড়োনো খেলার একশো সাতান্নতম রিপিট টেলিকাস্ট আর ভাত গিলছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না একটাও। চুলের মুঠি ধরে একবার নাড়া দিয়ে থালা হাতে উঠে গেল তিথি। ‘ব্রাশ করে সোজা বিছানায় যা। আইদার টেক্স্ট বুক, কিংবা ঘুম। কমিকস্ খুলতে দেখলে ছিঁড়ে ফেলব।’

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত গোঁজ মারা ভাবটা কমেনি। ঠাকুমার রসিকতায় জবাব দিল না। মা মেরেছে তাই বাবার আদরে ভুলবে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে বালিস ভিজিয়েছে। তিথি রান্নাঘর, টেবিল ফ্রিজ, কোলাপ্সিব্ল গেটে তালা, বসার ঘরের আলো-পাখা, রাতের গা ধোয়া ইত্যাদি সেরে এসে দেখে বাপ নাক ডাকাচ্ছে। ছেলে বাবার ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তিথি আর মনোময় দুজনেই লম্বা দোহারা। ছেলেটার এখন থেকেই কী সুন্দর সুঠাম দেহ। মায়ের চোখ ডাইনির চোখ। নিজেকে শাসন করল তিথি।

‘মায়ের সঙ্গে কি অমন করতে আছে সোনা? আমার কষ্ট হয় না তোকে মারতে? এত বড়ো হয়েছিস এটুকু বুঝবি না? অয়না দ্যাখ তোর চেয়ে ছোটো হয়েও কেমন ভালো রেজাল্ট করে। মাথায় কি তোরও বুদ্ধি কম? পরীক্ষার পর কত আনন্দ করব। বাবা বিরিয়ানি রাঁধবে। একদিন বাইরেও খেয়ে আসব। সোনা বাবা আমার…।’ ছেলের পাশে শুয়ে তার গুঁজে রাখা অভিমানী মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিতে চাইল। ডান পা-টা নিজের পেটের ওপর চাপাতে চাইল। রন্তি ঘুমের মধ্যেও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল না। কাঠ হয়ে থাকল। এগারো বছরের ছেলের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠে না মা। ছেলের ঘাড়ে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুয়ে পড়ল। তার স্কুলেও পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু।

একজনের অফিস, একজনের স্কুল ও সংসার। পাশের ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি। তাঁর জায়গাও বেশি লাগে, আর রন্তিও মাকে ছেড়ে ঠাকুমার কাছে শোবে না। রাতে ঘুমের ঘোরে ছেলে এখান সেখান হাত-পা ছুড়লে অস্বস্তি লাগে। কিন্তু উপায় কী? স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত আড়াল নেই। তাগিদও নেই। তেরো বছর তো হল। ছেলেই মা-বাবার অগ্রাধিকার। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। শেষ হতে দু সপ্তাহ।

দশ বছরে কয়েকটা টিকার বুস্টার ডোজ আছে। দীর্ঘদিন সর্দিকাশিতে ভোগায় সেগুলো দেওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সর্দির প্রেসক্রিপশন হাতে ফিরতে হচ্ছিল। এমনিতেই তিনখানা টিকা একদিনে দেবেন না। দশ বছর বয়স থাকতে মেয়েকে সুস্থ অবস্থায় পাবে তো? সর্দিকাশি, পেট ইত্যাদি মোটামুটি ঠিক আছে দেখে পরীক্ষার আগের দিনই ডাক্তার সান্যালের কাছে ঘুরে এল শ্রেয়সী। আসার পথে রাই বায়না ধরল ফুচকা খাবে। মাথা খারাপ? পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। রাত্রে বাড়িতে ফ্রায়েড রাইস, মাংসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েকে ভোলাতে চাইল। রাই তবু ঘ্যানঘ্যান করে, ‘বেশি নয়, মোটে চারটে ফুচকা মা। কিছু হবে না। তুমি ওষুধ কিনে বাড়ি চলো।’

‘পাঁচ টাকার ফুচকার খেসারত একশো টাকার ওষুধের কোর্স, সেই সঙ্গে অরুচি? না বললাম না? কাল বাদে পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। একেই আজ এটা কাল ওটা করে ভুগিস। রাতে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন করব বললাম তো। এখন বরং একটা আইসক্রিম খা। আসতে আসতে চেটে খাবি, গলায় ঠান্ডা না লাগিয়ে।’

আইসক্রিম যতই প্রিয় হোক, ফুচকার গন্ধে নাকে মুখে জল এলে আইসক্রিম কি তার বিকল্প হতে পারে? নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়ল রাই। ওপারে দোকান। মা মেয়ে রাস্তা পার হতেই একটা ফাঁকা অটো হাঁকতে হাঁকতে পাশে দাঁড়াল। লাইনে না দাঁড়িয়েই বাহন পেয়ে যাওয়ায় শ্রেয়সী আর আইসক্রিমের দোকানে না ঢুকে সোজা অটোয় চড়ে পড়ল মেয়ের হাতে ধরে।

‘তুমি মিথ্যেবাদী।’

মাথায় চড়াক করে রক্ত উঠলেও শান্ত হয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘তোমায় কি আইসক্রিম, চকোলেট দিই না? কিন্তু আইসক্রিম খেলে আধ ঘন্টা অটোর লাইনে দাঁড়াতে হতো। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসাটা জরুরি নয় এই সময়? আচ্ছা বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি বাড়ি ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবে। এখন বাড়ি গিয়ে দুধ ফিনিশ করলে কিন্তু।’

তরুণকে ফোন করল শ্রেয়সী। তরুণের ফিরতে রাত হবে। সে দোকানের কর্মচারী শান্তনুর হাতে পাঠিয়ে দেবে। শান্তনু কোনও কাজে গিয়ে ফেঁসে গেছে। তরুণ ফিরল রাত দশটায়। এতক্ষণ বকুনি সহ ঘ্যানঘ্যান করতে করতে পড়ছিল রাই। রাতে বাবাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে আর নতুন করে হতাশা প্রকাশ করল না। ফুচকার বদলে আইসক্রিম, তাও না দুধ-বোর্নভিটা। এখন রুটি তরকারি। মা ফ্রায়েড রাইস করতে পারেনি। রান্নার মাসিরও তাড়া ছিল। গতকালের একটু পনির উদ্বৃত্ত ছিল। তাই দিয়ে শান্ত হয়ে মায়ের হাতের রুটি খেয়ে নিল রাই ডিজনিতে হাসির ধারাবাহিক দেখতে দেখতে। রাতে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখে মুখে প্রশ্নোত্তরও ঝালিয়ে নিল। হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কাল করবে তো মা? সব পরীক্ষা শেষে দাদা-বউদির বিরিয়ানি আনবে বাবা?’

‘নিশ্চয়ই’। কে জানে, মেয়ে মনে মনে মা-বাবাকে মিথ্যেবাদী বলল কি না।

মেয়েটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। সেভেন হল। এর মধ্যেই বাবার কানের পোকা খেয়ে ট্যাব আদায় করেছে। মাকে দিদি নম্বর ওয়ানে গিয়ে প্রাইজ জিতে আসার অনুপ্রেরণা দিয়ে কাজ হয়নি। নিজেই বাড়ি থেকে ইন্টারনেটে মায়ের আর নিজের অনলাইন আবেদন জমা করেছে। বছর ঘুরতে চলল। কতদিন আর দরকারি জিনিস অনিশ্চিত ইভেন্টের হাতে ফেলে রাখা যায়?

পড়াশুনো কী করছে দেখাতে চায় না। সারাক্ষণ কম্পিউটারে নেট খুলে খানাতল্লাশি চালায়। নাকি পড়াশুনো হচ্ছে। অত অত মোটা বইয়ের পাহাড় থাকতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর ইন্টারনেট থেকে বাড়তি কী এমন তথ্য জানার থাকতে পারে? তিনটে টিউশনি। নেট-এ খোঁজাখুঁজি। তাও ফলাফল ভালো থেকে ক্রমশ মাঝারি হয়ে যাচ্ছে। কিছু বললে যা মূর্তি ধারণ করে। মাকে তো পাত্তাই দেয় না। বাবাকে একটু মানে। আবার আবদারের বেলায়ও বাবা। কিন্তু এই বয়স থেকে একা একা নেটে থাকা মা-বাবা কেউই অনুমোদন করে না। পৃথিবীর কদর্যতম দৃশ্যটাও কয়েকটা মাউস ক্লিকের অপেক্ষায় সাইবার দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। নারী-পুরুষের ভালোবাসার মাধুর্য বোঝার আগেই যদি চরমতম বিকৃতি আর বীভৎসতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় তাহলে রুচি, মানসিকতা কেমন দাঁড়াবে? অবশ্য তেমন কিছু ব্রাউজিং-এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু গাদা গাদা চ্যাট। পড়ার বই খুলে রেখে ট্যাব হাতে চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে গপ্পো।

বাধ্য হয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে সাত্যকী বারো বছরের মেয়ের গায়ে হাত তুলল। এগালে-ওগালে এলোপাতাড়ি। মল্লিকা ঝাঁপিয়ে পড়ে থামাতে এলে তার গায়েও দু-একটা পড়ল। পরীক্ষার আগে কেউ এভাবে মেরে মনমেজাজ খারাপ করে দেয়? নিজে যখন বুঝবে না, বোঝাতে হবে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে। এভাবে বাপের মার খেলে আত্মসম্মানে লাগবে না? এখনকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সব কিছুতে হস্তক্ষেপের অধিকারটা মেনে নেয় না। একদিকে আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু রাগলে নিজের চূড়ান্ত ক্ষতি করে ফেলে, ভালোবাসার মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে দুবার ভাববে না। মল্লিকা সাত্যকীকে ঠেলে সরাতে গেল, ‘ছাড়ো। ওকে বুঝিয়ে বললেই শুনবে’।

‘বাবাকে লেলিয়ে দিয়ে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। আমার বইখাতা খুলে স্পাইং করো না তুমি?’

সদ্য কিশোরী কন্যার এই মন্তব্যে মা দিশাহারা হয়ে গেল। বাবা তো অফিস থেকে ফিরে প্রায়দিন দেখে মেয়ে টিউশনি থেকেই ফেরেনি। মা-ই মেয়ের খাতা বই দেখে যতটা সম্ভব পড়াশুনোর খবর নিয়ে নেয়। পারিজাতের সেটাও অপছন্দ? মায়ের গোয়েন্দাগিরি মনে হয়? মায়ের স্নেহ-চিন্তাকে চরবৃত্তি মনে হলে সে মেয়ের মুখে ঠাটিয়ে চড়ই মারা উচিত। কিন্তু তাহলে মোবাইলের সেল্ফিতে যে কেষ্টঠাকুরের ছবি আছে, তার সম্পর্কে জানা যাবে না, জানা যাবে না এমন আরও অনেক কিছুই। প্রশ্ন করলে হয়তো শুনতে হবে, মোবাইল ব্যক্তিগত বস্তু। তেরো বছরের নাবালিকা তার মাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে আড়াল করবে? এখনও বিছানার চাদরে, পোশাকে দাগ লাগলে কেচে দিতে হয়। মেয়ের সঙ্গে কি মারামারি করবে? মরিয়া হয়ে বলল, ‘পরীক্ষাগুলো তো উৎরোতে হবে পুপু। বন্ধুবান্ধব, আনন্দ-ফুর্তি তো আছেই।’

‘কিচ্ছু নেই। ঘাড় গুঁজে পড়ে পড়ে চোখে পাওয়ার আর ঘাড়ে পিঠে ব্যথা বাড়ানো ছাড়া আমাদের জীবনে কোনওটাই সিকিওরড নয়। পরীক্ষা তো দেব আমি। পড়ার ফাঁকে একটু রিল্যাক্স করলে এত গায়ে জ্বালা তোমাদের?’

সন্দীপন পড়াশোনায় মনোযোগী। মনোযোগ আর আগ্রহ আরও অনেক বিষয়ে। ভালো আঁকে, ফুটবল খেলে। ওদের সেকশনে নতুন আগত একটি মেয়ে গত বছর থেকেই সন্দীপনকে হটিয়ে প্রথম হচ্ছে। নিশ্চয়ই প্রিন্সিপাল বা টিচারদের সঙ্গে চেনাজানা আছে। এদিকে ছেলের নামে অন্য ছাত্রদের, বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকরা নিয়মিত নালিশ জানায়। সন্দীপন ওদের মারে, ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, বেণি ধরে, কানের রিং ধরে টানে। হিংসা! সব হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। ভালো ফল করে কিনা। তাই যুক্তি করে ওকে পিছিয়ে দেওয়া। হলে একটা নতুন স্টুডেন্ট, তাও আবার মেয়ে, কালো শিকলি চেহারা কখনও ফার্স্ট হয়? ছেলেরা তো হাতেপায়ে দুরন্ত হবেই। দাদু আদর করে নাম রেখেছেন গুন্ডা। গুন্ডার অধীনে আবার স্কুলে একটা দলও আছে। ইচ্ছা করেই ছেলেকে বেশি বয়েসে পড়াচ্ছে সঙ্গীতা। বার্থ সার্টিফিকেটের বয়স বারো দেখালেও সন্দীপন আসলে চোদ্দ বছরের। ওর সঙ্গে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো পারবে কেন? কী পড়াশুনোয়, কী খেলাধুলোয়। ছেলেকে শেখানো আছে, ‘মার খেয়ে ফিরবি না, মেরে আসবি’।

কেন করবে না। সকলেই এগিয়ে যেতে চায়। তোমার সামনে যারা আছে দরকারে তাদের মাড়িয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তোমায় কেউ একচুল জায়গা ছেড়ে দেবে? যারা পেরে ওঠে না, তারাই নালিশ করে। তা বলে ছেলে কি হাত-পা গুটিয়ে থাকবে? মারামারির ভয় যখন, তোদের মেয়েদের গার্লস স্কুলে পড়ালেই পারতিস। অত বড়ো খেলার মাঠ দেখে রাত থাকতে লাইন দিয়ে খুকিদের ভর্তি করিয়েছিস। এখানেও গুন্ডার নামে নালিশ। সে নাকি খেলার ক্লাসে মেয়েদের ইচ্ছা করে মেরে ফেলে দেয়। সঙ্গীতা মাঝে সাঝে স্কুলে গিয়ে দেখেছে, খেলার পিরিয়ডে ছেলেরা স্যারের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেট বল খেলে। মেয়েরা গজালি করে, নয় রুমাল চোর খেলে, নয় তো স্রেফ বসে বা পায়চারি করে কাটায়। ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট চাইলেও নাকি দিতে চায় না গেমস্ টিচার, দিলেও ছেলেরা কেড়ে নেয়। মেয়েরা খেলেই না তো মার কখন খাবে? আমার ছেলে কি খেলা ফেলে তোদের মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করে?

ওই শুঁটকি অরিত্রিকে এবার বিট করতেই হবে। গুন্ডার চাইতে দু’বছর ছোটো হয়েও অমন রেজাল্ট এমনকী অংকেও? তা খাতায় কলমে কম দেখিয়েও মা পুত্রের বয়সের সুবিধাটা মনে মনে স্বীকার না করে পারে না। ছেলে আজকাল কম্পিউটারে ইন্টারনেট খুলে জোর পড়াশুনো শুরু করেছে। কী পড়ে দেখাতে চায় না। ছেলের বাবা চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকে। মা নিয়ম করে ছেলেকে কোচিং ক্লাসে নিয়ে যায়। শুধু ক্লাসে নয়, আইসিএসসিতেও স্কুল থেকে ফার্স্ট হতে হবে।

কাল থেকে যুদ্ধ, মানে পরীক্ষা শুরু। গুন্ডা সকাল বেলা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। দুপুর দুটো বাজতে চলল, এখনও পাত্তা নেই। প্রথমে অর্ণবের বাড়ি, তারপর এর বাড়ি ওর বাড়ি ফোনাফুনি। সোয়া দুটোয় সিঁদুর মুখে বাড়ি ফিরে মায়ের কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে চায় না। একবার ঝেঁজে বলল, ‘এই জন্যই মোবাইল চাই। বাড়িবাড়ি ফোন করতে হতো না তোমায়।’ ক্লাস সেভেনের ছেলে মোবাইল নিয়ে ঘুরবে? স্কুলেও তো অনুমতি দেবে না। আবার আসল বয়সটা মনে পড়ল। মায়ের কথায় উদ্ধত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক খোঁচাখুঁচিতে বলল, ‘তোমায় বলে কী হবে? তুমি তো না-ই বলবে।’ এখন থেকে এমন কী চাই যা মাকে বলা যাবে না? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু সে খেয়াল আছে? পড়াশুনোয় ভালো বলেই ও অনেক বদমায়েশি করে পার পেয়ে যায়। এবার রেজাল্ট খারাপ হলে আর ছাড় দেওয়া যাবে না।

সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদে নির্বিকার থেকে রাতে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘একটা স্পোর্টস্ সাইকেল দেখেছি। চল্লিশ হাজার পড়বে। আইসিএসসি দেখিও না। এই পরীক্ষার পরই চাই।’

সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই এই। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলে তো হেলিকপ্টার চাইবে। এর চেয়ে অরিত্রি, মেঘা, তিতিক্ষাদের পেটানোর অনুমতি চাইলে দেওয়াটা অনেক সহজ হতো। এই প্রথম ছেলেকে অচেনা লাগল মায়ের, ভয়ও হল। মাথা নাড়ল শুধু, যার মানে হ্যাঁ ও হতে পারে, নাও হতে পারে। পরীক্ষাটা তো উৎরোক। দর কষাকষি পরে।

স্নেহা শান্ত মেয়ে। অঙ্কে একটু দুঃখ আছে। কিন্তু বেয়াড়া নয়। পড়ালে খুব একটা আপত্তি করে না, অঙ্ক ছাড়া। একটু আদুরি আহ্লাদী প্রকৃতির। রোজ নিয়ম করে মা আর বাবার কাছে চটকাই মটকাই খাবে। সান্তাক্লজের রহস্য জানার পরও সান্তার কাছে উপহার চাই। গত বছর জন্মদিন পালন হয়নি ঘটা করে। এবার পরীক্ষার ঠিক পর জন্মদিন। মানে জন্মদিনের ঠিক আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীসোনা হয়ে ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে বার্থ ডে সেলিব্রেশনটাও জমকালো করে করতে হবে। এইটুকু বায়না রাখাই যায়। বেচারার সব প্রিয় খেলনা খুড়তুতো ভাই এসে ভেঙে দিয়ে যায়। ভাইকে বড্ড ভালোবাসে। তাকে কিছু বলতে পারে না, পাছে কাকিমা আর নিয়ে না আসে। সে চলে গেলে মায়ের কোলে কিংবা বাবার বুকে মুখ গুঁজে হাপুসনয়নে কাঁদে।

বহুদিনের শখ আইপডের। বন্ধুদের আছে। ওকে বস্তুটা ঠাম্মা, দিদা, মাসি না মা-বাবা কে দেবে ঠিক না হওয়ায় এখনও পায়নি। এবার জন্মদিনে সেটাই দাবি। অঙ্কিতা নিজে বড়ো সিস্টেমেই গান শুনতে ভালোবাসে। অমন স্বার্থপরের মতো কানে গুজি গুঁজে অনেক কথা কানে না ঢুকিয়ে গান শোনা তার পোষায় না। তবে ধুমধাড়াক্বা গান পরিত্রাহি বাজলে মনে হয়, যার যেমন রুচি তেমন গান হেডফোনেই শোনা ভালো।

পরীক্ষা শুরুর কদিন আগেই মাসিমণি তার আদরের বোনঝিকে একটা আইপড দিয়ে গেল। অনেকগুলো নতুন গান লোড করা আছে। ব্যস! সারাদিন মারমার গান শোনা। এখন কি গান নিয়ে মেতে থাকার সময়? পড়াশুনোর বারোটা বাজবে জানালে মাসি বলবে, ‘আমার ইচ্ছে দিয়েছি। তোদের পছন্দ না হলে ডাস্টবিনে ফেলে দে।’

বুঝিয়েসুঝিয়ে যন্ত্রটা পরীক্ষা পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় চালান করা গেলেও জন্মদিনের জন্য তাহলে নতুন কিছু চাই। নতুন মানে ট্যাব। টিভি রিয়ালিটি শোতে কাউকে ট্যাব জিততে দেখলেই এমন হাততালি দেয়, যেন পুরস্কারটা সেই জিতেছে। এমনিতে অঙ্কিতার অ্যানড্রয়েড মোবাইল অঙ্কিতার চেয়ে স্নেহাই ভালো চেনে। ক্লাস ফোর তো কী? এখনকার বাচ্চারা মায়ের পেটে থাকতে কম্পিউটার নাড়াঘাটা করতে শিখে আসে। অঙ্কে ভয় থাকলেও, কম্পিউটারের ঘাঁতঘোঁত ফাইলের অবস্থান খুঁজে বার করতে ওস্তাদ। মাকে কাজ করতে দেখে নিজে নিজে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাতে শিখে ফেলেছে। মোবাইলে গান আর গেম ডাউনলোড তো হাতের ময়লা। সে তো ট্যাব চাইতেই পারে। কিন্তু বাড়িতে তিনজন মানুষের জন্য পাঁচটা সিম এটা ওটা অফার পরখ করতে গিয়ে জমে গেছে। প্রীতমের তাই বাচ্চার হাতে এখন থেকে নেট সমৃদ্ধ ট্যাবলেট তুলে দেওয়ার ইচ্ছা নেই। বলে, ‘যা করার পিসিতে করো। আর একদম নেট খুলবে না। আমি বা মা পাসওয়ার্ড দিয়ে মেশিন ওপেন না করা পর্যন্ত ওয়েট করবে। আমি এত বছর সিস্টেমস্-এ আছি, এখনও পর্যন্ত আমিই একটা ল্যাপটপ কিনলাম না, আর পাকু-মার ট্যাব চাই।’

মৌমিতা সদ্য চাকরির আনন্দে বলে ফেলল, ‘ডোন্ট ওরি। আই উইল টেক কেয়ার অব দ্যাট।’

সোজা প্রীতমের প্রেস্টিজে ছ্যাঁকা। সে কি নিজের মেয়েকে কিনে দিতে পারে না? এই বয়স থেকে এত বিলাসিতা ঠিক মনে করে না বলেই তো আপত্তি করছে। প্রিয় শ্যালিকাকে দেখলে হাসা বন্ধ। মৌমিতাও দমবার পাত্রী নয়। ‘কেন, হিয়া আমার কেউ নয়? মাসি হিসাবে আমার কোনও শখ থাকতে পারে না? অধিকার নেই? আমি আনন্দ করে কিনে দেওয়া মানেই প্রীতমদাকে ছোটো করা? তোরা আমাকে পুজোয় টাকা দিস না? আমার বিয়েতে দামি গয়না দিসনি? তোদের বিয়ের সময় আমি তো স্টুডেন্ট ছিলাম। কী দিয়েছি? আজ আমার আনন্দে যদি কারও মুখ গোমড়া হয়, তাহলে আমি আর এ বাড়ি আসব না। হিয়ার জন্মদিনেও নয়…’

আচ্ছা মুশকিল! অঙ্কিতা বরকে বোঝায়, না বোনকে। বড়োদের মান হানাহানিতে হিয়া অর্থাৎ স্নেহা বেচারা বোমকে গেছে। মায়ের কানে কানে বলল, ‘মাসিকে বলো, আমার ট্যাব চাই না। শুধু এগ্জামের পর আমরা, মাসি-মেসো সবাই মিলে আইনক্সে একটা থ্রিডি দেখব, নয়তো সিটি সেন্টার টুতে সেভেন ডি। আর সবাই মিলে বাইরে খাব। আর আমার বার্থডেতে মাসি সকাল থেকে এসে থাকবে।’

মৌমিতা শুনতে পেয়ে ঝুঁকে বোনঝিকে হামি খেয়ে বলল, ‘আমার তরফ থেকে ডান। তোর বাবা ছুটি না নিলেও আমি কিন্তু আমার নতুন চাকরিতেও একদিন ছুটি নিয়ে হিয়া সোনার সঙ্গে কাটাব, ক্যারাম খেলব। আর ওটা আমাদের সিক্রেট। রাইট?’

নিজের হাতে খেতে পারে না। মা খাওয়ালেও ন্যাকরচ্যাকর। কিন্তু কাল থেকে যে পরীক্ষা শুরু। লক্ষ্মী মেয়ের মতো টিভি না দেখেই খেয়ে দাঁত মেজে শুয়ে পড়ল। শোবার ঘর থেকে একটু পরে ডাকল, ‘মা তোমাদের হয়েছে? তুমি ছাড়া ঘুম আসে না মা।’

একটা টাটা সুমোয় গাদাগাদি করে চোদ্দজন বাচ্চা। সবাই বাচ্চা নয়। সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ আকারে বড়ো মানুষই বলা যায়। মাঝেমাঝে এইসব গাড়ির পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে ধরপাকড় ওঠে। আবার সব মিটমাট হয়ে যায়। গরজ বড়ো বালাই। গাড়ি বন্ধ থাকলে গাড়িওয়ালাদেরও ক্ষতি, ছাত্রছাত্রী পক্ষেরও ক্ষতি। ধেড়েগুলো কুচোকাচাদের ওপর দাদাগিরি দিদিগিরি ফলায়, ঝগড়া থামায়, আবার বাধায়ও। কিন্তু পরীক্ষার কদিন বেশির ভাগই স্কুল যাবার পথে বই মুখে নিবিষ্ট। আজকের মতো ছুটি। বাড়ি ফেরার পালা। কালকের দিনটা পার করতে পারলেই ক্লাস ফাইভের কেল্লা ফতে। সিক্স, সেভেন আর এইট শেষ হতে আরও পাঁচ দিন। রোজ পরীক্ষা নয়, মধ্যে বিরাম আছে। কারো দুটো কারও তিনটে পরীক্ষা বাকি। ক্ষুদেগুলো কাল পরীক্ষার পর কী করবে তার জোর আলোচনা চালাচ্ছে। বড়োগুলো তাদের কাউকে কাউকে খ্যাপাচ্ছে। হই হই করতে করতে চলেছে টায়েটায়ে ভর্তি যান। গাড়ির চালকও যোগ দিয়েছে গুলতানিতে। এই গাড়িকাকু ওদের সবার খুব প্রিয়। না খেতে পারা টিফিন উদ্ধার করে সাহায্য করে। আবার যাদের যেদিন পরীক্ষার ইতি, সেদিন তাদের চকোলেট খাওয়ায়। বড়োগুলোর পরীক্ষা শেষ হতে দেরি থাকলেও চ্যাঁচাচ্ছে, ‘আমরাও আছি কিন্তু মোহিতকাকু। নো পার্শিয়ালিটি। কালকেই সবাইকে খাইয়ে দাও। শেষের দিন আমরা ফিস্ট করব। ওফ্ তোমাকে কখন থেকে গান লাগাতে বলছি না? আর ওই সামনের গদ্ধড় বাসটাকে ওভারটেক করতে পারছ না? পুরো রাস্তাটা আগলে চলছে।’

‘…ক্যাঁ…চ্’! বড়ো রাস্তার এক পাশটা খাওয়া। এক্সপ্রেসওয়ে কে বলবে? গদ্ধড় বাসটাকে কাটাতে গিয়ে পাশ থেকে একটা দৈত্যাকার লরির সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি। কাছাকাছি লোকালয় ছিল না। দেরিতে লোক পৌঁছোল। গাড়ির হেল্পারটি লাফিয়ে পালাতে পেরেছে, গুরুতর আহত। চালক ঘটনাস্থলেই শেষ। পকেটে তার আজও লজেন্স আছে। ফুচকা, আইসক্রিম, বিরিয়ানি, সাইকেল, ট্যাব, জন্মদিন সান্তাক্লসের ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো দুমড়ে দলা পাকিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল।

 

প্রতিজ্ঞা

জীবনের চল্লিশটা বছর পেরিয়ে এসেছি। কত ওঠা-পড়া দেখেছি। এখন আর কোনওকিছুই মনকে সেভাবে ছুঁয়ে যায় না। দিন আসে দিন বয়ে যায়। ঝরা, শুষ্ক গাছের মতো কেবলই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। জানান দেওয়া যে, এপৃথিবীতে আমিও আছি, আমারও অস্তিত্ব রয়েছে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ, একাকী জীবন যেন আরও গ্রাস করে ফেলেছে আমাকে। নিজেকে খানিক গুটিয়েও ফেলেছি আমি। তাই ভিড়ভাট্টা, হইহুল্লোড় একটু এড়িয়েই চলি।

স্বাতীলেখা। বন্ধু বলা যায় কী না জানি না, একমাত্র ও-ই একটু জোর খাটায় আমার উপর। মাঝেমধ্যে আসে আমার ফ্ল্যাটে। কখনও কখনও ওর কাছেই মনের দু-এক কথা প্রকাশ করে ফেলি। আজ ওর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। শ-দুয়েক লোক নিমন্ত্রণ করেছে। আমার যাওয়া নিয়ে ভীষণ নাছোড়। কাজেই আর না করতে পারলাম না।

আটটা নাগাদ যখন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছোলাম তখন আমন্ত্রিতদের বেশ কয়েকজন এসে গেছে। আমাকে দেখামাত্রই টেনে নিয়ে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিল স্বাতী। আমার পরিচয় দিতেই তাদের মধ্যে এক অপরিচিত মহিলা কেমন যেন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলে উঠল, ‘ওহ্, তাহলে আপনিই সেই ঋত্বিকা।’

একজন অচেনা-অজানা মহিলার মুখে নিজের নামটা এভাবে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওনাকে ভালো করে দেখলাম। ‘না এর আগে কখনও দেখিনি। তাহলে? উনি কি আমাকে চেনেন? নাকি স্বাতী আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে? কিন্তু এমন কী বলেছে যে, মহিলা এভাবে রিঅ্যাক্ট করলেন!’ ভাবতে ভাবতে বোকার মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন মনে হল, না জানা দরকার, ততক্ষণে উনি সেখান থেকে কয়েক পা এগিয়ে সোফায় বসে পড়েছেন। হাতে কফি। ওনাকে লক্ষ্য করে আমিও সেদিকেই এগিয়ে গেলাম।

ওনার নামটাও ঠিক করে মনে পড়ছিল না। স্বাতী পরিচয় করানোর সময় কী যেন বলেছিল একটা? মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না।

বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে শুরু করব, আমি কিছু বলার আগে উনিই বলে উঠলেন, ‘জানতাম আপনি আসবেন। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম। চলুন বারান্দায় গিয়ে বসি।’ আমাকে ওনার দিকে এগোতে দেখেই হয়তো উনি বুঝে গিয়েছিলেন তীর লক্ষ্যভেদ করেছে। যেটা আমার চোখেমুখেও প্রকাশ পাচ্ছিল।

অদ্ভুতভাবে দুজনের কারওর ঠোঁটের কোণায় হাসির লেশমাত্র ছিল না। প্রথম সাক্ষাতেই যে কারও প্রতি কারওর এতটা তিক্ততা থাকতে পারে, সেটাই আমার বিশ্বাসযোগ্যতার বাইরে। সত্যিই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও আমাকে জানতেই হবে আমার প্রতি মহিলার এত বিদ্বেষ কেন? কী করেছি আমি! বারান্দায় রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম দুজনে।

সব অতিথি আসতে শুরু করেছে। ওয়েটারগুলো স্ন্যাক্স আর ড্রিংক্স সার্ভ করছে। খাওয়ার এখন অনেক দেরি। স্বাতীও আমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত। এখানে উপস্থিত সকলকে সেভাবে চিনিও না। কাজেই ডিসটার্ব করারও কেউ নেই।

খুব ভদ্রভাবে, বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘মাফ করবেন, আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। এর আগে কি আমাদের কখনও দেখা হয়েছে?’

‘নাহ্। সেই সৌভগ্য এর আগে না হলেও আপনাকে আমি ভালো করেই চিনি।’ এখনও সেই রুঢ় গলাতেই উত্তর দিলেন মহিলা। মনে হল গলায় যেন কাঁটা বিঁধে গেছে। কেমন যেন একটা ইরিটেশন হচ্ছিল। দেখা হওয়া পর্যন্ত মহিলার খোঁচা দেওয়া ব্যবহার আর নিতে পারছিলাম না। একটু উগ্রভাবেই বলে বসলাম, ‘আপনার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।’

‘না ম্যাডাম, একটুও না। আমরা মুখোমুখি না হলেও একে-অপরকে খুব ভালো করেই চিনি।’

হতভম্বের মতো ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শত চেষ্টা করেও স্মৃতি সঙ্গ দিল না। মিনিট খানেক চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার স্বামী ঈপ্সিত-কে নিশ্চয়ই চেনেন, নাকি তাও বলবেন…।’

ঈপ্সিতের নাম শোনামাত্রই মাথায় কে যেন হাতুড়ির ঘা দিল। কিন্তু ওই কষ্টের জায়গাটা তো আমি বহু আগেই কাটিয়ে উঠেছি। প্রায় পনেরো বছর ওই মানুষটার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। আর আজ এত বছর পরে মহিলা সেই সম্পর্কে রসদ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হায় ভগবান! আমার প্রতি ওনার তিক্ততার বহিঃপ্রকাশ সেই কারণেই। অনেকদিন পর এই নামটা শুনে প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি মনের আয়নায় ভেসে বেড়াতে থাকল।

আমারই অফিস কলিগ ছিল ঈপ্সিত। বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সব মহিলারাই ওর সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করত। যাকে বলে একেবারে টল, ডার্ক আর হ্যান্ডসাম। সবথেকে বড়ো কথা ছিল ওর মিষ্টি ব্যবহার আর ওর কথাবার্তা, সময়ে-অসময়ে, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, যার কারণে ডিরেক্টর থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্টের সমস্ত লোক ভীষণ ভালোবাসত ওকে। সকলের মাঝে কখন যে আমি ওর পছন্দের পাত্রী হয়ে উঠেছিলাম, সত্যিই জানি না।

এদিকে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই আমাকে পাত্রস্থ করার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টা মা-বাবার ছিলই। ইতিমধ্যে এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের খোঁজ পাওয়া গেল। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সুদর্শন, উচ্চ আয়, বাড়ি-গাড়ি– এমন পাত্র কী আর হাতছাড়া করা চলে। তড়িঘড়ি বিয়ের দিনটাও ঠিক হয়ে গেল।

বিয়ের কথা শুনে সবাই খুশি হয়ে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। কেবলমাত্র ঈপ্সিত ছাড়া। খবরটা শুনে ও যে একেবারেই খুশি হয়নি তা ওর বডিল্যাঙ্গোয়েজে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ জানানোর সময় কী যেন অস্ফুটে বলল। শুনে যেটুকু বোধগম্য হল, ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিলেই চলছিল না?’

সেইদিন প্রথম বুঝেছিলাম, ঈপ্সিত কেন আমার এত খেয়াল রাখত। আমাকে চিন্তিত দেখলে ও-ও কেন চিন্তান্বিত হয়ে পড়ত। সহকর্মীদের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা, অফিস পলিটিক্স– সব কিছু থেকে আগলে রাখত আমাকে। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দিনদুয়েক মনটা একটু খচখচ করলেও, পরে বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে হাজারো ব্যস্ততায় সব ভুলেও গেলাম। তারপর তো একমাস ছুটিতে। বিয়ে, হনিমুন, সব কিছু নতুন নতুন। নতুন এক নেশায় কীভাবে যে দিনগুলো কেটে গেল টেরই পেলাম না।

প্রথম যেদিন অফিস জয়েন করলাম, সেদিন একেবারে হইচই পড়ে গেল। যারা বিয়েতে যেতে পারেনি, তারা সবাই এক-এক করে এসে দুঃখপ্রকাশ করে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। আর কয়েকটি কৌতুহলী কান নাছোড়বান্দা হয়ে রইল, আদ্যোপান্ত শোনার জন্য। কিন্তু ঈপ্সিত এল না।

এতদিন নির্দ্বিধায় ওর সাথে কত বকবক করেছি, কিন্তু এখন ওর কাছে যেতেও কেমন যেন সংকোচ হল। ওর টেবিলের দিকে দু-পা বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে এলাম। সত্যি বলতে কী ওর কাছে গিয়ে আমি ওর কষ্ট বাড়াতে চাই না। এখন আমার একটা সংসার আছে।

সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। আর সেখানে তৃতীয় ব্যক্তির কোনও জায়গা নেই। সেই সময় নতুন সংসার, নতুন সম্পর্কই আমার কাছে সবচেয়ে দামি। কিন্তু আন্দাজ করতে পারতাম তখনও ঈপ্সিতের মনজুড়ে আমি এবং শুধুই আমি। ওর আচার-ব্যবহার প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিত ওর মনের কথা। তখন সবকিছু জেনেও না-জানার ভান করে থাকতাম। আর করারই বা কী ছিল। ভেবেছিলাম সময়, পরিস্থিতি মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়, ঈস্পিতও একদিন সব ভুলে যাবে।

দিন সাতেক পরে ও-ই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘চলো, আমরা পরস্পরের জীবনসঙ্গী না হতে পারি, অন্তত আগের মতো বন্ধু তো হতেই পারি।’ সেদিন আমিই মেনে নিতে পারিনি। মন যেন সায় দেয়নি কিছুতেই– সবকিছু জানার পরেও আবার আগের মতো বন্ধুত্ব! একেবারেই সম্ভব নয়।

ওদিকে দিনের পর দিন ছেলেকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দেখে বাড়ির লোকেরা একপ্রকার জোর করেই ঈপ্সিতের বিয়ে দিয়ে দিল। ওর বিয়ের কার্ড হাতে পেয়ে সবথেকে খুশি বোধহয় আমিই হয়েছিলাম। কারণ ওর এই অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে হয়তো আমিই দায়ী ছিলাম। ভীষণ গিলটি ফিলিং হতো। মনে মনে আশ্বস্ত হলাম।

কিন্তু কথায় বলে না– কপালে নেই কো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী। কপালে আমারও সুখ সইল না। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই একদিন মাঝরাতে আবিষ্কার করলাম কার যেন ফিসফিসানি আওয়াজ। পাশে প্রতুল নেই। মনে হল আমারই ঘর সংলগ্ন বারান্দা থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখি বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে প্রতুল কাকে যেন ফোনে ফিসফিসিয়ে বলছে, ‘প্লিজ আগে আমার কথাটা তো শোনো, তারপর না হয়…’। কথা শেষ হওয়ার আগেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামে প্রতুল। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, বাড়িতে কী বলতাম, যে আমি একজন পুরুষকে ভালোবাসি, ওর সাথেই আমি আমার সারাটা জীবন কাটাতে চাই! সেটা কি সবাই মেনে নিত?’

এক ঝটকায় যেন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল। এসব কী বলছে প্রতুল! চোখের সামনেটা হঠাৎই যেন ঝাপসা বোধ হল। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে সরে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলাম, ‘না, এর শিকড় পর্যন্ত আমাকে পৌঁছোতেই হবে। মন শক্ত করতেই হবে। দিনের পর দিন কেউ আমার বিশ্বাসে আঘাত হানবে, তা তো মেনে নেওয়া যায় না।’

যাইহোক, তখনও প্রতুল তার প্রেমিকের মান ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। ‘একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো, আমাদের সমাজ তো এখনও এত দরাজ হয়নি যে সমকাম ব্যাপারটাকে মেনে নেবে। সমাজে থাকতে গেলে সমাজের কিছু রীতি তো মেনে চলতেই হবে। তাছাড়া তুমিও খুব ভালো করেই জানো, আমার যা কিছু ভালোলাগা, আনন্দ সব তোমার সঙ্গেই জড়িয়ে। তোমার সাথে যে-সুখ পাই ঋত্বিকার সঙ্গে সেই সুখ কোথায়? এমনকী চরম মুহূর্তেও…।’

আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে প্রতুলও চুপচাপ এসে শুয়ে পড়েছিল। সারারাত তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। কিন্তু সেদিন ওকে কিছু বুঝতে দিইনি। একবার মনে হয়েছিল, সরাসরি প্রশ্ন করি, কেন আমাকে এভাবে ঠকাল। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয়েছে, যে ছেলে সমাজে নিজের সত্যিটা ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারে, সেখানে নিজের মান বাঁচাতে একটা প্রাণ নিতেও হাত কাঁপবে না তার। একপ্রকার ভয়েই চুপ থাকলাম সেই রাতটা। পরের দিন কাকভোরে পালিয়ে গেলাম বাবার কাছে। সেখান থেকেই ডিভোর্স ফাইল। ডির্ভোসটাও মিউচুয়াল ভাবেই হয়েছিল। পাছে যদি ওনার কু-কীর্তির কথা লোকে জেনে ফেলে সেই ভয়েই সাত-তাড়াতাড়ি সম্পর্কের ইতি টানা গেল।

জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। এই এক মাসের মানসিক টানাপোড়েন অনেক পরিণত করে তুলেছিল আমাকে। কাজেই ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিলাম, এজন্মে আর ওপথ (বিয়ে) মাড়াব না। এখন আমার সংসার বলতে মা-বাবা-আমি। অতএব সবকিছু ভুলতে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে।

এসব খবর তো আর চেপে থাকে না। অফিসে জানাজানি হওয়া মাত্রই কানাঘুষো শুরু। হাজারো সহানুভূতি, আশ্বাস আর ব্যঙ্গের মাঝে মর্মাহত একজোড়া চোখ সর্বদা যেন খুঁজে বেড়ায় আমাকে। ওই চোখের দিকে তাকালে হয়তো পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ব, সেই ভয় থেকেই ঈপ্সিতকে এড়িয়ে চলতে থাকি। বারংবারই ও চেষ্টা করেছে আমার দুঃখ ভাগ করে নিতে। সর্বক্ষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে উপেক্ষা করে গেছি। ওর আর আমার মাঝে থাকা সুক্ষ্ম প্রাচীর কোনওদিনই ভেদ করতে চাইনি। আমার সীমা সম্পর্কে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। নিজের সংসার সুখের হয়নি বলে ওর সংসারের দিকে হাত বাড়ানোর মতিভ্রম কোনওদিনই হয়নি। কিন্তু ঈপ্সিতকে বোঝায় কে! নিজের সাংসারিক চিন্তা ছেড়ে ও সর্বদা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাতেই জড়িয়ে থাকে।

তখন কিন্তু আমি চাইলে একাকীত্ব কাটাতে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই পারতাম। শুধু মাত্র সামনে বসা এই অচেনা মহিলার কথা ভেবেই সেদিন আমি এগোইনি। আমি চাইনি আমার মতো উনিও কষ্টের সম্মুখীন হোন। অথচ এই মহিলাই আমাকে দোষী মনে করে বসে আছেন। জানি কোনও মহিলাই তার স্বামীকে অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। কিন্তু আমি তো তা নই। তাহলে এত ঘৃণা কেন? বরং সেদিন এই অপরিচিত মহিলার কারণেই ঈপ্সিতকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, আমাদের দুজনের পথ আলাদা। কাজেই ভবিষ্যতে আমাকে সে যেন আর বিরক্ত না করে। তাহলেই আমি খুশি হব।

একই অফিসে কাজ করে অপরিচিতের মতো থাকাটাও তো সম্ভব নয়। আমাকে দেওয়া কথা রাখতে ঈপ্সিত চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ এত বছর পর ঈপ্সিতের নাম শুনে মনটা কেমন যেন হু-হু করে উঠল। অনুভব করলাম আজও মনের কোণে কোথায় যেন লুকিয়ে বসে রয়েছে। এই মহিলাও তো পনেরোটা বছর ধরে ঘৃণার সাথেই আমাকে মনে রেখেছে। তাহলে ঈপ্সিতও কি…?

কিন্তু আজ এত বছর পরে এসবের অর্থ কী? তাও আবার এই বয়সে! সবকিছু অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছি। আমার এই মহিলার জন্য খারাপই লাগছিল, আমার কারণেই এত বছর ধরে ভয়ে ভয়ে থেকে এসেছেন, এই বুঝি ওনার সংসার ভেঙে গেল! ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘দেখুন, কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। বহু বছর হয়ে গেল আমাদের দেখাসাক্ষাৎ নেই। ইভেন আপনারা যে কোথায় থাকেন আমি সেটাও জানি না।’

‘আমার কোনও কিছু অজানা নেই। একদিন নেশায় বুঁদ হয়ে ঈপ্সিত আমাকে সবকিছু বলে ফেলেছে।’

‘বিশ্বাস করুন, একজন অফিস কলিগের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত, আমরাও ঠিক তেমনই ছিলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।’ বুঝতে পারছিলাম না কী প্রমাণ দিলে ওনার সন্দেহ দূর হবে।

‘সেটাই তো জানতে চাই, কেন এরকম একজন মানুষের থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে থেকেছ? কীভাবে পারলে তুমি? ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে তো সবাই মুখিয়ে থাকত।’ বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল ঈপ্সিতর অর্ধাঙ্গিনী।

‘কিন্তু আমি তো শুধুমাত্র তোমার জন্য…’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার জন্য… আমার জন্য তুমি ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকেছ? এত বছরে একবারও জানার চেষ্টা করেছ তোমার এই সিদ্ধান্তে আমি কী পেয়েছি? আমার কী লাভ হয়েছে।’ দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল মেয়েটার।

বুঝতে পারছিলাম না ও কী চায়। ওর স্বামী ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তবুও এত অভিযোগ। এরই মাঝে খেয়াল হল অভিমানই হোক বা অভিযোগ কখন যে দুজনেই আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছি, বুঝতে পারিনি। শ্যামলারঙা পানপাতা মুখের মেয়েটির নামটা এখন হঠাৎ করে মনে পড়ল আমার। আলো। হ্যাঁ, বিয়ের কার্ডে ওই নামই দেখেছিলাম।

‘কোনওদিন ওই মানুষটার কথা ভেবেছ যাকে তুমি নিজের করে নাওনি, আর আমারও হতে দাওনি।’ চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিল আলো।

‘কী বলছ, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

‘আমাদের মাঝে সবসময় তুমি থেকেছ। ঈপ্সিতের ভালোবাসার আর আমার ঘৃণার পাত্রী হয়ে।’

‘কীভাবে বললে বিশ্বাস করবে, আমি তোমাদের মাঝে আসতে চাইনি। তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ তোমাদের বিয়ের আগেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।’ সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

প্রত্যুত্তরে বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল আলো। ‘আমি বললাম না, আমি সব জানি। শুধু তোমার কাছে একটাই প্রশ্ন, ঈপ্সিত কী এমন চেয়েছিল তোমার থেকে। শুধু একটু বন্ধুত্বই তো। কীসের এত অহঙ্কার তোমার? তোমার জন্য একটা মানুষ তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাটা দিন নেশায় ডুবে থাকে মানুষটা।’

‘কী?’ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। বিস্ময়ের পর বিস্ময়। সত্যি বলতে কী ভাবতে অবাকই হচ্ছিলাম, যে মানুষটাকে বিশ্বাস করে সংসার বাঁধলাম, আর যাকে কোনও সুযোগই দিলাম না, দুটো মানুষের মধ্যে কতটা ফারাক। একজনের থেকে উপেক্ষা পেয়েছি, আর একজন পাগলের মতো ভালোবেসেছে অথচ বদলে সে আমার থেকে নির্লিপ্তি ছাড়া কিছুই পায়নি।

ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। খানিক পরে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে ধরা গলায় বলে উঠলাম, ‘তুমি কেন বাধা দাওনি?’

‘কেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছ!’

আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। মনে মনে ভাবছিলাম, এ কী পাগল? এই মহিলা আমাকে ঘৃণা করে কারণ, আমি ওর বরের বন্ধুত্ব অ্যাকসেপ্ট করিনি। ভাবনায় বাধ সাধল আলো। ‘দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে না কেন?’

শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল, ‘প্লিজ স্টপ। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি জবাবদিহি করতে বাধ্যও নই।’ সবকিছু জেনেশুনে এমনভাবে বলে বসল যেন বিয়েটা কোনও খেলা। ভাগ্যের পরিহাস দ্যাখো যার থেকে ভালোবাসা চেয়েছিলাম, সে অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষিত আর যে আমাকে ভালোবাসল সেও ততদিনে অন্য কারওর হয়ে গেছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হাউহাউ করে কেঁদে উঠলাম।

আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা স্বাতীর পার্টিতে এসেছি। ততক্ষণে সমস্ত অতিথিরাই চলে এসেছে।

আমাকে কাঁদতে দেখে আলো কিছুটা ইতস্তত বোধ করল। তখন গলার স্বর নামিয়ে খানিক বোঝানোর ভঙ্গিমায় আলো বলতে থাকে ‘পৃথিবীতে এত লোকের ভিড়ে একজন মানুষকে কেন ভালো লাগে জানো? জানো না তো? এরকম কত প্রশ্নের উত্তরই তো জানা নেই আমাদের? না হয় ঈপ্সিত আর তোমার সম্পর্কটা কী সেটাও একটা প্রশ্ন হয়েই থাকত!’

‘ঈপ্সিতের বউ হয়ে তুমি একথা বলছ?’

‘কেন? নিজের ঘর-সংসার, স্বামীর কথা ভাবাটা কী অন্যায়? প্রয়োজনে আমি ডিভোর্সও দিয়ে দিতাম। তিনটে মানুষ সারাজীবন কষ্ট পাওয়ার থেকে অন্তত দুটে মানুষতো সুখি হতো।’

আলোর কথা শুনে মনে হল, কত বড়ো হূদয় ওর। স্বামীর খুশির জন্য নিজের খুশিও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ও। সব বাঁধ যেন মুহূর্তে কে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। এতদিন পর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সেই ভালোবাসা গাল বেয়ে বয়ে যেতে থাকল। চোখ মুছতে মুছতে বোকার মতো বলেই বসলাম, ‘এতই যদি ভালোবাসত, ফিরে এলো না কেন আমার কাছে?’

‘কীভাবে ফিরত? তুমি-ই তো সব পথ বেঁধে রেখে দিয়েছিলে। প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলে যেন কোনওদিনও ও তোমার পথে না আসে।’

‘উহ্, শুধুমাত্র একটা প্রতিজ্ঞা রাখতে সারাজীবন–’ আর কোনও শব্দ বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে। আজ অনুভব করতে পারছি ঈপ্সিত আমার, সত্যিই আমার। ওকে দেখার অদম্য ইচ্ছে, জানার ইচ্ছে ও কি এখনও আমাকে এতটাই ভালোবাসে? আমাকে নিজের করে পেতে চায়? বোধহয় এখন আর…। ভালোবাসার জন্য তো মানুষ কত কী করে! এতো সামান্য একটা প্রতিজ্ঞা। সেটা ভাঙা গেল না? ছুটে এসে বলা গেল না ‘ঋত্বিকা আমি তোমাকেই ভালোবাসি। শুধু তোমাকে…’

 

ভুঁইফোঁড়

তাইদাদা, ও নিতাইদাদা, আজও তুমি কাজে বের হবে না গো?

অনেক ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে জবাব আসে– বললাম তো না। আর এভাবে রোজ রোজ ডাকাডাকি করবি না।

নিতাই-য়ের যেন ধনুকভাঙা পণ। টলাতে পারে কার সাধ্যি! নিতাই-য়ের মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। বাঁশের বেড়া। মাটি গোবরে লেপা। মেঝে দাওয়া টানটান। শান বাঁধানো মেঝেকেও হার মানায়। উঠোনের এক পাশে ধানের গোলা। আর একপাশে ছোট্ট ঢেঁকিঘর। মাঝখানে মাটির বেদিতে তুলসী গাছ। অনেকটা দূরে বাড়ির এক্বেবারে পেছনে গোয়াল ঘর। হাঁস মুরগির খোঁয়াড়। সীমানা, বাঁশের কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ।

কিছুদিন আগেও এই বাড়ি, উঠোন, ঢেঁকিঘর, গোয়ালঘর– সব কিছুর মধ্যে ছুটোছুটি করে বেড়াত মনোরমা। নিতাই-য়ের বউ। তখন নিতাই-য়ের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। আর বুক ভরা ছিল স্বাদ-আহ্লাদ আর ভালোবাসা। কিন্তু এখন? সব শুকিয়ে, পোড়া কাঠ। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘন্টা দুই। তারপর মাইল দেড়েক হাঁটা। গ্রামের পথ ধুলোয় ভরা। চলাচলের পথে হাঁটু অবধি ধুলোর মোজা। খাটো ধুতিতেও বসে যায় ধুলোর পাড়। এ’ভাবেই পুজোর মরশুমে অন্তত হপ্তায় একদিন বাড়ি আসত নিতাই এবং তার বাপ-ঠাকুরদা। কিন্তু বছর পাঁচেক হ’ল নিতাই আর…। এখন সে কলকাতায় যায় না, বাড়ির বাইরেও বেশি বেরোয় না। বাড়িতেই থাকে। আগে কয়েকজন মিলে শোভাবাজারের ভিতর দিকে মাটির বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সে সব পাট এখন চুকে-বুকে গেছে।

এই মুহূর্তে সংসার চলেছে শামুকের গতিতে। নিতাই-ও নির্বিকার। জুটলে খায়। না জুটলে খায় না। বৃদ্ধা মা, কোটরাগত চোখদুটো তুলে ছেলেকে দেখে আর ভাবে– হায় রে কী ছেলে, কী হয়ে গেল! অমন শক্তসামর্থ্য ছেলে আমার, সুতোর মতো পাকিয়ে গেল গা। কী কুক্ষণে ওর কাঁধে সংসারটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম…। হায় হায় রে…। প্রতিদিনই এভাবে বুক চাপড়ে বিলাপ করে মা।

চোখ বুজলে এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। ভয়ে শিউরে ওঠে নিতাই। নিতাই মণ্ডল। সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই আর তার দশপুরুষের কাজে হাত দেয় না। একসময় তাদের এই কাজে খুব নামডাক ছিল। মূর্তি গড়ার কাজ। তখন এদের তৈরি মাটির প্রতিমা বিভিন্ন বড়ো বড়ো প্যান্ডেলে শোভা পেত। যেমন বাগবাজার, শোভাবাজার, কুমোরটুলি– এসব জায়গায়। কিন্তু সেবারের সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যে যা বলে, এক কান দিয়ে শুনে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। পরিবার পরিজনের পীড়াপীড়িও গ্রাহ্য করে না।

এদিকে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এই অবস্থাতেও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে থাকে। এখন বেশীরভাগ দিনই তাদের উপোস করে বা অর্ধাহারে কাটে। বৃদ্ধা মা, বিধবা বউদি, তার ছেলেপুলে– এসব নিয়ে নিতাই-য়ের সংসার। নিতাই এই বিরাট কর্মযজ্ঞের একমাত্র হোতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কারও কান্নাকাটিতেই তার মন ভেজে না। সে যেন ‘পিছে বেঁধেছে কুলো আর কানে গুঁজেছে তুলো’। এক্বেবারে নীরেট এক পাথর।

নিতাই-য়ের সব স্পষ্ট মনে পড়ে। এই তো সেদিনের কথা। দিনের আলো পশ্চিমে যখন ঢলে পড়ে, তখন ঢেঁকিঘরে চলে আলোছায়ার খেলা। সে সময় দু’হাত ওপরে বাঁশের আড় ধরা। এক পা ঢেঁকিতে আর এক পা মাটিতে রেখে ধানের পাড় দেয় মনো। আর ঢেঁকিতে ধান তোলানামা করে বিন্তিখুড়ি। নিতাই-য়ের মা, কোনও এক কালে তাঁর পুরো নাম ছিল বিনোদিনী মণ্ডল। বয়স যত বাড়ছে ততই গ্রামের লোকদের মুখে মুখে বিনোদিনী একসময়, বিন্তিখুড়ি হয়ে ওঠে। বিন্তিখুড়ির একটাই সন্তান। এই নিতাই। টিয়েরঙের শাড়ি আর কপালে বড়ো সিঁদুরের টিপে বেশ দেখাত মনোরমাকে।

অনেক সাধ করে পাঁচ-সাতটা গ্রাম খুঁজে পেতে মনোকেই মনে ধরল বিন্তিখুড়ির। দাবিদাওয়া ছিল না। কিন্তু যেটা ছিল তা হ’ল লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। গুনে গুনে চব্বিশটা মেয়ে বাতিল করে, মনোরমাকে নিয়ে এল ঘরে। নিতাই-য়ের কোনও মতামত ছিল না। মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। মায়ের সায়ে সায় মিলিয়ে দিব্যি ছিল নিতাই। ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। এখন মা-ই তার সব। কোনওভাবেই মাকে কষ্ট দিতে চায় না সে। বাড়িতে মা ছেলে ছাড়াও আছে জ্যাঠতুতো দাদার বিধবা স্ত্রী, তার ছেলেমেয়ে নিয়ে। মোট পাঁচ-পাঁচটা সদস্য। সংসারে একটু টানাটানি থাকলেও ছিল না তেমন কোনও অভাব অভিযোগ। তখনকার সময়ে হেসেখেলে দিনগুলো কেটে যেত।

এভাবে বছর তিনেক কাটতে না কাটতেই একটা বড়ো অভাব বিন্তিখুড়িকে অস্থির করে তুলল। নাতিনাতনির অভাব। বিন্তিখুড়ি নানা জনের সঙ্গে নানা কথা বলে এ ব্যাপারে। এই তো সেদিন চড়া সুরে বিন্তিখুড়ির পাশের দুটো বাড়ির পরে ষষ্ঠীপদ ঘোষের বউকে বলে– দ্যাখো বউমা, ছেলেপুলে ছাড়া সংসার আবার সংসার নাকি! এমন সংসারে কখনও লক্ষ্মীশ্রী থাকে?

– অমন করে বলছেন কেন খুড়িমা, সবে তো বছর তিনেক বিয়ে হয়েছে। সময় হলে নিশ্চয়ই হবে।

আপনমনেই বিড়বিড় করে বিন্তিখুড়ি– পরে হলে তো চলবে না। সময় যে ফুরিয়ে এল। আমাকে তো দেখে যেতে হবে। নাতিনাতনির মুখ দেখার বড়ো সাধ আমার। না দেখতে পেলে ওপারে গিয়েও শান্তি পাব নে। দেখি কী করা যায়! এখন তো আমাকেই হাল ধরতে হবে।

শুরু হ’ল বিন্তিখুড়ির প্রচেষ্টা। অমাবস্যা পূর্ণিমা একাদশী মেনে মেনে ঝাড়ফুঁক তাবিজ কবজ। মাঝে মধ্যে আবার মাসের শেষ অমাবস্যায় মাঝরাতে চৌরাস্তার মোড়ে কালো দিঘির জলে স্নান করিয়ে ভেজা কাপড়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সাধুবাবার ভেষজ ওষুধ সেবন, মাদুলি ধারণ– এসবও চলে।

মনো খুব মিষ্টি মেয়ে। শাশুড়িমা যা করান তা-ই করে। কিন্তু নিতাই-য়ের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এ’ভাবে চলতে চলতে গড়িয়ে গেল আরও দু-দুটো বছর। পাঁচ বছরের মাথায় বিন্তিখুড়ি তো দিশাহারা! কী করলে কী হবে মালুম পায় না! এক রাতে নিতাইকে ডেকে বলে– খোকা এক কাজ কর, তুই তো কামকাজে কলকাতা যাস, এবার সঙ্গে করে বউমাকেও নিয়ে যা। ওখানকার ডাক্তার দেখিয়ে আনবি।

– কেন মা, তোমার জড়িবুটি, মাদুলি, তাবিজ-কবজে আস্থা চলে গেল?

– না রে বাবা, কে বলতে পারে কীসে কী হয়?

অগত্যা মনোরমাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। কিছুদিন পিসির বাড়ি রাখে। চিকিৎসা চলে। এমনকী দুটো দিন সরকারি হাসপাতালেও থাকতে হয়। ছোট্ট একটা কাটাছেঁড়াও নাকি হয়। অবশেষে গ্রামে ফেরে।

এসবের পর বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই…। আজও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দিনটা। কাজ সেরে নিতাই সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ ঠেলে ঢোকার সময় শুনতে পায়, মনোর কলকল করে কথা। আর খিল খিল করা হাসি। বুকটা যেন জুড়িয়ে যেত। মা, বউ-তে খুব মিল। কত কথাই না হতো। মনোরমা দূরের গ্রামের নয়। পাশের কলাবতী গ্রামের মেয়ে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ি-বউ একসঙ্গে কলাবতী গ্রামে বেড়াতে যেত। নিতাই বাড়ি ফিরলেই মনো যেখানেই থাকত ছুটে আসত। জল গামছা এগিয়ে দিয়ে একডালা মুড়ি বাতাসা নিয়ে উঠোনে মাদুর পেতে বসত। তারপর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতে করতে কত কথা! এক সপ্তাহ না তো, মনে হতো যেন একবছর বাদে নিতাই বাড়ি এসেছে।

অন্ধকার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাত ভোর হয়। কোনও রাতে বেশিক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। কালের নিয়মে বা কালের স্রোতে একসময় মনোরমার স্মৃতিও ধুয়েমুছে সাফ হয়। কিন্তু…! নাহ্, আর ভাবতে পারে না। বুকটা ব্যথায় যন্ত্রণা করে। মাথাটা খালি হয়ে যায়।

হঠাৎ এক রাতে ভেতর ঘর থেকে মার গোঙানি কানে আসে। অনেকক্ষণ ধরে। একটানা। অগত্যা উঠতেই হয় নিতাইকে।

পায়ে পায়ে কাছে যায়। খাটো গলায় বলে– কী হয়েছে মা? কোনও সাড়া নেই। মাঝে মাঝে শুধু খকখক কাশির শব্দ। হ্যারিকেনের সলতে বাড়িয়ে, কপালে হাত রাখতেই চমকে ওঠে– এত তাপ! এ যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! এমন গভীর রাতে ডাক্তার – ওষুধ কোথায় পাব! তাছাড়া পয়সা! একটা সিকি পয়সাও নেই বাড়িতে। তাড়াতাড়ি জল ন্যাকড়া ভিজিয়ে জলপট্টি দেওয়া শুরু করে। প্রায় তিন দিন যাবৎ কলমি শাক সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। যতক্ষণ পুকুরে শাক আছে, ততক্ষণ না খেয়ে মরতে হবে না– গজ গজ করতে করতে বউদি বলছিল। একসময় ওর দিকে চোখ রেখে, ঝাঁঝিয়ে ওঠে বউদি– এমন মদ্দা মানুষ থাকাও যা, না থাকাও তা। আচমকা কাশতে কাশতে মায়ের গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসে। খুব ভয় পায় নিতাই। মা-ও কি তবে মনোরমার মতো…! শীর্ণ মায়ের জীর্ণ শরীরটা মুহূর্তে অতীত ভোলায়। রুগ্ন মায়ের কপালে হাত রেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে– না, আর নয়। এভাবে মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে না সে। কিছু একটা করতেই হবে।

এভাবে বসে বসে দুঃখ করলে, যারা গেছে, তারা তো ফিরে আসবে না। না আসবে মনোরমা, আর না আসবে…। পাশের ঘর থেকে বউদিকে ডেকে দিয়ে, রাতেই বেরিয়ে পড়ে নিতাই। যেতে যেতে বউদির চড়া সুর কানে আসে– ক্ষয়রোগ গো ক্ষয়রোগ। ভালোমন্দ না খাতি খাতি এই রোগ দেহে বাসা বাঁধে।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রথম এতদিনের চেষ্টায় নিতাই ধীরে ধীরে মূর্তি গড়ায় হাত দেয়। পুজো প্রায় এসে গেছে। বর্ষাও তেমন হয়নি। কেমন যেন গুমোট চারদিকটা। এবারের অকাল কালবোশেখিতে নিতাইয়ের ঘরের চালার কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। তাই এবারের প্রথম সামান্য বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে এক হাঁটু জল। তাই নিতাইকে যেভাবেই হোক ঘরের চালাটা সারাতে হবে। আগে মায়ের চিকিৎসা, না আগে ঘর সারানো– কোনটা আগে করবে? ভেবে পায় না। দুটো চাপ মাথায় নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায় কাজে। মনে মনে ভাবে নিতাই, আগে মা। তারপর সব। এখন তো তার নিজের বলতে, একান্ত আপন বলতে, আছে কেবলমাত্র মা।

প্রায় রাতেই সে আসে। বিশেষত শেষ রাতে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে গলা জড়িয়ে, খিল খিল করে হেসে বলে– বাবা, ও বাবা, এই যে আমি। এই তো তোমার কাছে। এ মা দেখতে পায় না! বাবা আমাকে ছোঁও তো দেখি, ইস্ ছুঁতে পারে না। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে নিতাই। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কাকে যেন ছুঁতে চায়। কয়েক সেকেন্ড বাদে ধাতস্ত হয়। তখন শুধুই বুক চাপড়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যেদিন মুন্নি এল তার কোলে, সেদিন-ই মনোরমা ফাঁকি দিল। মুন্নিকে পেয়ে মনোর দুঃখ ভুলে ছিল নিতাই। মুন্নির কচি কলাপাতার মতো, নরম মোলায়েম মনের স্পর্শে, দেহের ছোঁয়ায় একটু একটু করে নিতাই-য়ের দগ্ধ মনের ক্ষতে প্রলেপ পড়ে। নিতাই অতীত ভবিষ্যৎকে ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে।

মেয়ে তো নয়, যেন এক ডানা কাটা পরি। গরিবের ঘর আলো করে মা লক্ষ্মী যেন স্বয়ং এসেছেন। একটু বড়ো হতে না হতেই রূপের ছটায় চারদিক আলোকিত। সাত পেরোতেই ভ্রমরকালো ডাগর চোখদুটো তুলে বাবাকে শাসন করে– এত দেরি হয় কেন বাবা? আরও তাড়াতাড়ি আসতে পার না? কাজে বেরোলে তুমি আমায় ভুলে যাও, তাই না বাবা?

– ওরে মা, থাম থাম। সবে তো এলাম, এখনও হাত-পাও ধুইনি। এরই মধ্যে তোর একসঙ্গে এত প্রশ্নের উত্তর দিই কী করে বলতো? ঠাম্মা ছুটে এসে বলে

– আয় দিদিভাই, আমার কাছে আয়। বাবা হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিক, তারপর তোর সব কথা শুনবে। কেমন? আয় না দিদিভাই, আয়…। ঠাম্মা যত জোর করে মুন্নির তত জেদ বাড়ে।

– না আমার কথার জবাব না দিয়ে বাবা কোথাও যাবে না।

অগত্যা নিতাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতকাহন শুনিয়ে তবে নিজের কাজে যেতে হয়। দিন দিন নিতাই অনেক বেশি বাড়িতে আসে। এমনকী পুজোর মরশুমেও একদিনের বদলে হপ্তায় দু’তিনদিন করে বাড়ি আসে। এ নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। কিন্তু নিতাই-য়ের স্পষ্ট জবাব– ওরে তোরা বুঝবি না, আমার ছোট্ট মা-টা যে সারাক্ষণ আমার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে।

সারাটা দিন মুন্নি গোটা পাড়ায় খেলে বেড়ায়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এর-তার বাড়ি ঘোরাঘুরি করে। গাঁয়ের সব্বাই ওকে খুব ভালোবাসে। যার বাড়ি যা কিছু হোক, বিয়ে পৈতে পুজোআচ্চা ইত্যাদি, মুন্নি থাকা চাই-ই চাই-ই। মুন্নি না এলেও জোর করে ধরে আনে সবাই। নইলে সব আনন্দই যে মাটি। দু’গালে টোল ফেলে, গলা ছেড়ে খিলখিল করা মুন্নির হাসি, গাঁয়ের ঘরে ঘরে উলুধবনি শঙ্খধবনির চেয়েও বেশি পয়া, বেশি আদরণীয়।

প্রতি রাতে মুন্নি ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে, কল কল করে সারাটা দিনের গল্প বলে। কত জ্যাঠা, কাকা, মাসি, পিসির বাড়ি আজকে গিয়েছে। কতজন, কুলের আচার, আমের মোরোব্বা খাইয়েছে, বিল্টু, নেপু, তিন্নি ওদের সঙ্গে চু কিত কিত খেলতে খেলতে কতবার পড়ে গেছে। কতবার ডাংগুলিতে বল্টু পিন্টুকে হারিয়েছে– নানান দস্যিপনার গল্প ঠাম্মাকে শুনতে হয়। ঠাম্মারও মন ভরে ওঠে। একসময় বকবক করতে করতে মুন্নি ঘুমিয়ে পড়ে। তখন মুন্নিকে দু’হাতে জড়িয়ে, আদরে সোহাগে ভরিয়ে তোলে ঠাম্মা। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। নাতনি বলে কোনও ক্ষোভ নেই বিন্তিখুড়ির। বরং বেশ গর্ব। অমন রূপ ক’জন পায়! মনে মনে ভাবে– দু’হাত তুলে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলে, এ যে দেবে ধর্মে তুষ্ট হওয়ার ফল গো। মেয়ের শখ তার বহুদিনের। নিজের তো ছিল না। এমনকী তাদের বংশেও মেয়ের সংখ্যা খুব কম। অবশেষে মুন্নি এল। তার ষোলোকলা সাধও পূর্ণ হল।

গরিবের ঘরে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব। কিন্তু ঘাটতি নেই ভালোবাসার। তাই সবার অফুরন্ত আদর ভালোবাসায় তিল তিল করে বেড়ে উঠছিল মুন্নি। গোলগাল ফরসা টুকটুকে মেয়েটা ঘরে বাইরে সবার মন কেড়ে নিয়েছে। নিতাই-য়ের ছিল নয়নের মণি। বাঁচার একমাত্র প্রেরণা। অন্ধের যষ্টি।

সূর্য ডুবে যেতেই হালকা অন্ধকার নামে চারধারে। বছর আটেকের মুন্নি। তখনও উঠোনে এক্বাদোক্বা খেলছিল। হঠাৎ জেঠির ডাক– খুকি ও খুকি যা তো মা, গোয়াল ঘরের ধোঁয়াটা দিয়ে আয় তো মা। তোর ঠাকুমার আবার জ্বর এসেছে। দেখি গিয়ে কী করা যায়!

– যাই জেঠি, বলতে বলতে মুন্নি লাফাতে লাফাতে আসে। ধোঁয়াটা নিয়ে গোয়ালঘরের দিকে যায়। সেটাই বোধ হয়…।

নিতাই মণ্ডলের গোয়ালঘর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। মুন্নি মাঝে মাঝেই গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে আসে। ওটা ষষ্ঠীপদ জানে। কিছুদিন যাবৎ তার মাথায় একটা মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে। নাদুসনুদুস মেয়েটার দিকে চোখ পড়লেই ষষ্ঠীপদর বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। দুশ্চরিত্র, লম্পট ষষ্ঠীপদ তক্বে তক্বেই ছিল। সুযোগের অপেক্ষায়। গোয়ালঘরের সামনে যেতেই মুন্নি একটা খসখস শব্দ শুনতে পায়। ঘুরে তাকায়। কিন্তু কারুকে নজরে পড়ে না। তাই সে অনায়াসে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। তখনও পাশের বাড়ির রামতনুদাদা গরু নিয়ে ফেরেনি। আজ হাটবার। তাই হাট সেরে রামতনুদাদার গরু নিয়ে ফিরতে আজ বেশ দেরি হবে। আগে ওদের অনেক গরু ছিল, এখন একটাই গরু। সে-ই দেখাশোনা করে। কিন্তু রামতনুদাদা যে এখনও ফেরেনি, মুন্নি তা জানত না।

রামতনুদাদার সঙ্গে মুন্নির খুব বন্ধুত্ব। অসম বয়সের বন্ধুত্ব। কিন্তু মাঝখানে কোনও ফাটল ছিল না। এতটাই গভীর ছিল যে, একদিন তাকে না দেখলে মুন্নি অস্থির হয়ে উঠত। ঠাম্মা ছাড়া আর যে মুন্নির বকম বকম ধৈর্যসহকারে শুনত, সে হল একমাত্র রামতনুদাদা। কিন্তু আজ যে হাটবার, সেটা মুন্নির মাথা থেকে বেমালুম উড়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগেই শিয়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীপদটা। সব দিক আটঘাট বেঁধে। আজই সুবর্ণ সুযোগ। নিঃশব্দে সে মুন্নির দিকে এগিয়ে আসে। নেকড়ে যেন মাংসের গন্ধ পেয়েছে। লোকটার বয়স বছর পঞ্চাশ। শক্তসমর্থ্য শরীর। খালি গা। খাটো ধুতি। চুপিচুপি তাকে ঢুকতে দেখে বছর আটেকের মুন্নি বিস্ময়ে হতবাক। কোনওমতে টেনে টেনে বলে– জ্যাঠা তুমি এখানে! হাতে ধরা কেরোসিনের কুপিটা, সামনে এনে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।

এক ফুঁ-য়ে কুপিটা নিভিয়ে দিয়ে ষষ্ঠীপদ মেয়েটার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে কষে। তারপর পাঁজাকোলা করে খড়ের গাদার ওপর শুইয়ে দেয়। নেকড়ের হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচি মেয়েটার ওপর। লালসায় এক্বেবারে পশু হয়ে ওঠে মুন্নির ষষ্ঠীজ্যাঠা। একটানে খুলে ফেলে মুন্নির বেশবাস। সেই উন্মাদ নরপশু ফুলের মতো ছোট্ট মুন্নির অচৈতন্য দেহটার ওপর একবার নয় বারবার চালায় হিংস্র তাণ্ডব। নিষ্পাপ ফুলটিকে এক্বেবারে দলে পিষে নারকীয় খেলা শেষ করে।

মুন্নির জেঠি বার দুই খুকি খুকি করে ডেকে, মনে মনে ভাবে পাশের ঘরে তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলছে বোধ হয়। সে-ও নিশ্চিন্তে পুজোর ঘরে বসে যায়। নিতাই তখন বাড়ি ছিল না। সে গিয়েছিল কলকাতায়। বাড়িতে শুধু জেঠি, আর বিছানায় মুন্নির ঠাম্মা।

ঘন্টা দুই পর রামতনু যখন গরু নিয়ে গোয়ালঘরে আসে, তখন খুব ক্ষীণ কণ্ঠে গোঙানি কানে আসে। হাতের কাজ ফেলে, কোঁচর থেকে দেশলাই বের করে জ্বালায়। রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া অচৈতন্য মুন্নিকে দেখে চমকে ওঠে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে পাড়ার সবাইকে ডেকে নিয়ে, ভ্যান ঠিক করে মুন্নিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয়। কিন্তু এসব করতে করতে বেশ সময় লেগে যায়। সেই সময়টুকু দিতে পারে না ছোট্ট মুন্নি। অনেকক্ষণ রক্তক্ষরণ হতে হতে অসাড় হয়ে পড়ে মেয়েটা… পথেই মুন্নি…। একসময় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিভে যায় ওর জীবনপ্রদীপ।

ছোট্ট প্রাণ-পাখিটা চিরতরে ছটফট করতে করতে খাঁচা ছাড়ার আগে, কোনওমতে ক্লান্তস্বরে ঠাম্মাকে বলে যায়– কমলিদিদির বাবা, জ্যা…। আর বলতে পারে না সে।

শহর থেকে ফিরে প্রবল আক্রোশে দপ করে জ্বলে ওঠে নিতাই। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কাঁপতে কাঁপতে বলে– আজই আমি কুপিয়ে শয়তানটার মুণ্ডু নামিয়ে দেব। শালা! কোথায় যায় দেখছি! তাতে আমার যা শাস্তি হয় হবে। ছিঃ ছিঃ নিজের নাতনির থেকে ছোটো, ওইটুকু এক দুধের শিশু! ছুটে যায় নিতাই। হাত থেকে শহরে কেনা মুন্নির লাল কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা, রঙিন টিপ, লাল ছোট্ট ফ্রকটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়।

মুন্নি মারা যাবে এটা বোধহয় ষষ্ঠীপদ ভাবতে পারেনি। তাই চমকে ওঠে! নিতাই আসার আগেই বেগতিক দেখে চটপট গ্রাম ছাড়ে ষষ্ঠীপদ।

একসময় নিতাই জ্ঞান হারায়। দিন তিনেক পর নিতাই-য়ের হুঁশ আসে। কথায় কথায় গ্রামের ছেলে গৌরাঙ্গ, মহাদেবকে বলে– শয়তান ষষ্ঠীটাকে খুঁজে পাসনি এখনও?

ওরা কাঁচুমাচু মুখে মাথা নাড়ে। নিতাই আবার চিৎকার করে ওঠে– শয়তান লম্পট ষষ্ঠীটা যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ঠিক ধরতে পারবই পারব। আর ধরতে পারলেই চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে, এক্বেবারে টুঁটি চেপে মেরে ফেলব। শোন আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ হল সোনার দেশ। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি এমন লম্পটের জন্ম দিতে পারে না। এই সোনার গাঁয়ের আলো বাতাসে ওরকম জানোয়ারের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। ও একটা ভুঁইফোঁড় লম্পট জানোয়ার– বলতে বলতে পাগলের মতো নিজের মাথার চুল টানতে থাকে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে। নীচের চোয়াল দাঁত দিয়ে চেপে কী সব বিড়বিড় করে।

আজন্ম চেনা গৌরাঙ্গ, মহাদেব, মদনের মতো গাঁয়ের ছেলেরা ক্রোধে উন্মত্ত, রক্তচক্ষু, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য নিতাইকে যেন সেই মুহূর্তে চিনতে পারে না। তারপর থেকে বেশ ক’টা বছর অচেনা নিতাই ভয়ংকর মূর্তিতে খুঁজে বেড়ায় ষষ্ঠীকে। কিন্তু কোথাও পায় না। শয়তান ষষ্ঠীটা জানে, সময় সব ক্ষতের প্রলেপ দেয়। তাই সে ঘাপটি মেরে থাকে। মনে মনে ভাবে একসময় না একসময় নিতাইকে হাল ছাড়তে হবে।

কিন্তু নিতাই-য়ের বুকে ক্রমশ তুষের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে জ্বলবে… শুধু একটু বারুদের অপেক্ষা। নিতাই মুন্নিকে হারিয়ে উন্মাদের মতো থানা-পুলিশ করতেও ছাড়েনি। সব্বাই শুধু ওকে আশ্বস্ত করছে একদিন না একদিন এর শাস্তি হবেই হবে। জানোয়ার ষষ্ঠীটা জানোয়ারের সাজা-ই পাবে।

এ মুহূর্তে প্রতিমা প্রায় শেষের দিকে। মায়ের জন্যই নিতাই-য়ের মূর্তি গড়ায় হাত। কয়েকদিন আগে খড়ের ওপর পড়েছে মাটির প্রলেপ। পাশের বাড়ির গৌরাঙ্গ সেদিন কথায় কথায় বলে– হ্যাঁগো নিতাইদাদা, তোমার প্রতিমা তো এবার শেষের দিকে, তাই না গো? গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে নিতাই বলে– নারে এখনও অনেক দেরি। কত কিছু বাদ আছে।

– তা এবার-ই প্রথম বাড়িতে মূর্তি গড়ছ, তাই তো?

– হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস। প্রতিবার তো কলকাতাতে-ই…।

এ ভাবেই কাটে আরও কিছুকাল। ক’দিন বাদেই পুজো, প্রতিমা প্রায় শেষ। প্রতিমার মুখের আদল যে দেখে, সে-ই কেমন যেন আঁতকে ওঠে। নিতাই-য়ের তুলি ধরা হাতটা থমকে যায়। নিজে নিজেই বলে– এ কী! এ কার মুখ!

সেদিন গৌরাঙ্গ হঠাৎ বলে ওঠে– নিতাইদাদা, এ তুমি কার মুখ আঁকলে গো? বড়ো চেনা চেনা যে। সকালের উজ্জ্বল আলোয় গাঁয়ের অনেকেই সেখানে জড়ো হয়। নিতাই-ও চমকে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকায়। সবার ফিসফিস কথাবার্তা কানে যায়। গৌরাঙ্গ আবার বলে ওঠে– এ যে আমাদের মুন্নি গো! আচমকা ঘুরে তাকায় নিতাই। হাত থেকে তুলিটা পড়ে যায়। সারা শরীরে শিহরণ জাগে! কাঁপতে কাঁপতে বলে– দাঁড়া অসুরটাকে একটু অদলবদল করে দিই। ধীরে ধীরে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে শয়তান ষষ্ঠীটাকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের আড়ালে এ কার মুখ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। গাঁয়ের সব্বাই দেখে নিতাই-য়ের চোখে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন।

ধীরে ধীরে সেই আগুনের ছোঁয়ায় সমবেত জনতা জ্বলে ওঠে। আর সেই সম্মিলিত দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা ভস্মীভূত করে, শয়তান লম্পট ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীটার মতো আরও অনেক অনেক অনেক…।

ছলনা

অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বারান্দায়। তারপর চা-সহযোগে একটু জলখাবার খাওয়ার পর, ফুরফুরে বাতাসে আরামকেদারায় গা এলিয়ে দেওয়া নিত্য অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে আকাশের। একফালি বারান্দা থেকে যে প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ দেখা সম্ভব, তা বোধকরি নতুন বাড়িতে শিফট না করলে বোধগম্য হতো না তাঁর। দখিনা বাতাস আর মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রকৃতি সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়েমুছে কখন যে তাঁর চোখে আচ্ছন্নের ভাব এনে দেয়, তিনি নিজেও বুঝতে পারতেন না। সেদিনও একটু তন্দ্রাভাব এসেছে কী আসেনি, পাশের বাড়ি থেকে এক নারীকন্ঠ ও জনৈক পুরুষের তুমুল চিৎকার-চ্যাঁচামেচি কানে এল। বেশ কিছুক্ষণ স্থির থাকার পরেও এই মহাভারতের অবসান নেই বুঝে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘রমা, দ্যাখো তো এত হাঙ্গামা কীসের!’

কাজের মেয়ে পারুলের পেছনে খিটখিট করা রমার স্বভাব। তাকে দিয়ে ঘর মোছাতে মোছাতে এটা সেটা গজগজ করছিল রমা। আকাশের দেওয়া এই বাড়তি কাজে সে তেমন উৎসাহ পেল বলে মনে হল না। দিল্লির দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল আকাশের। শ্বশুরবাড়ির জ্বালায়, একটু শান্তির খোঁজে দিল্লি থেকে তার কলকাতা চলে আসা। অনেক ছোটাছুটির পর তবেই এই ট্রান্সফার। দিল্লিতে তো সর্বদা রমার বাড়ির লোকের আনাগোনা। অফিস যাওয়ার আগে, ফেরার পরে কেবলই কথাবার্তা আর হুল্লোড়। নিরিবিলি বলে যেন কিছুই ছিল না সংসারে।

পঁয়ত্রিশ বর্ষীয় আকাশ বরাবরই একটু রিজার্ভ প্রকৃতির। তেমন হইহল্লা কোনওদিনই পছন্দ করেন না  বরং একান্তে থাকতেই ভালোবাসেন। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকের জ্বালায় জীবনটা তাঁর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। লোকে বোধহয় ঠিকই বলে– মনের শান্তি, বড়ো শান্তি।

ভাবনায় বাধা পড়ে রমার গলার আওয়াজে। কিছুক্ষণ পর কাজের ঝিকে বিদায় করে রমা এসে দাঁড়ায় আকাশের সামনে। তীর্যক হাসি হাসতে হাসতে বলে, ‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে পতিদেব। কয়েকদিন ধরে বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। শুনলে খুব খুশি হবে। পাশের বাড়িতে আমার পাতানো বোন মালারা ভাড়া এসেছে। দুবছর আগেই ওর বিয়ে হয়েছে।’

কথাটা শোনামাত্রই আকাশের মুখ একেবারে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। শুধু একটা অস্পষ্ট আওয়াজ রমার কানে এল, ‘এখানেও?’

রমা বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলল, ‘আরে শোনো শোনো, এইটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে? শালি বলে কথা। তাও আবার তোমার একমাত্র শাশুড়ির বান্ধবীর মেয়ে। তখন না হয় কাজের জন্য শালির বিয়েতে যেতে পারোনি, এখন তো বাড়িতে ডেকে আতিথেয়তা করতেই হবে।’

আর সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না আকাশের। বউয়ের কথার মাঝখানে কথা কেটে একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘ওহ্, তাহলে অমন নির্লজ্জের মতো ঝগড়াটা তারাই করছিল, তাই তো?’

বড়ো বড়ো চোখ করে স্বামীর দিকে তাকায় রমা, ‘সহানুভূতি না দেখাতে পারো, অন্তত তাদের নিয়ে পরিহাস কোরো না। কার যে কখন কেমন সময় আসে, কে বলতে পারে!’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমা। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করে, ‘দুজনেই ভালো চাকরি করত। মালার কল সেন্টারের চাকরিটা ছাড়তে হল নাইট শিফ্টের কারণে। আর তার কয়েকদিন পরেই সৌরভ যে-কোম্পানিতে চাকরি করত, সেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানিটাও বিনা নোটিশে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। তাও প্রায় দুমাস হয়ে গেল। সংসার খরচ, ঘরভাড়া– কী করে যে সংসারটা চলবে! তাই আপাতত হাজার কুড়ি টাকা দেব…।’

টাকার কথা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় আকাশের।

‘আমার থেকে অনুমতি না নিয়েই যাকে-তাকে…।’

‘যাকে-তাকে কাকে বলছ। আফটার অল আমার মাসির মেয়ে।’

মেজাজ চড়েই ছিল আকাশের। ‘মাসির মেয়ে, মাসি! তবু যদি জানতাম নিজের কেউ। বলা নেই কওয়া নেই, উনি একেবারে কথা দিয়ে চলে এলেন। আমাদের গাছ আছে নাড়া দেব, আর তুই টাকা নিয়ে চলে আসবি। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটলে তবে দুটো পয়সা পাওয়া যায় বুঝেছ।’ কথাগুলি বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যান আকাশ। দরজার সামনেই অত্যন্ত সুন্দর, আকর্ষক এক মহিলা এবং একজন পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মতো হাইটের সুপুরুষ। বোকার মতো মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন আকাশ। চিরকালই মহিলাদের উপর একটা আলাদা টান ছিল তাঁর। তাও আবার এমন আকর্ষণীয়া সুন্দরী।

ঠিক তখনই রমা বেশ উঁচু স্বরে বলে ওঠে, ‘আয়, আয় মালা। সৌরভ এসো। আরে দাঁড়িয়ে গেলি কেন তোরা।’

নিজের শান্ত জীবনে দুই আগন্তুকের অতর্কিত প্রবেশ সত্ত্বেও আর কিছু বলতে পারলেন না আকাশ। খানিক আলাপচারিতা আর চা-জলখাবার খাওয়ার পর দিদিকে আলাদা ঘরে নিয়ে যায় মালা, ‘দিদি টাকাটা!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ আনছি।’ বলেই কুড়ি হাজার টাকা আলমারি থেকে বার করে মালার হাতে ধরিয়ে দেয় রমা।

টাকা হাতে পাওয়া মাত্রই খুশি মনে কপোতকপোতী গেট থেকে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা চারেক আর দুজনের টিকিটি পাওয়া গেল না। রাতে ফিরে, ফের রমার বাড়িতে হাজির দুজনে। মালা ঘরে ঢুকেই সোফায় গা এলিয়ে বলে, ‘রমাদি ডিনারটা কিন্তু এখানেই সারব। আর রান্না করার মতো শক্তি নেই আমার। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে।’

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি তোরা দুজন?’ প্রশ্ন করে রমা।

‘বেশিরভাগ সময়টাই তো চলে গেল পার্লারে।’ চমকে ওঠে রমা। মালা কোনও দিকে না তাকিয়ে কলকলিয়ে ওঠে, ‘পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, ফেসিয়াল, হেয়ার কাটিং।’

‘তুই তো এমনিই সুন্দর। তাহলে এসবের কী দরকার ছিল বলতো? খামোকা এই সময়ে কতগুলো টাকা নষ্ট হল।’ বিমর্ষতার ভাব ঝরে পড়ছিল রমার স্বরে।

‘কতগুলো আর কোথায়, মোটে পনেরোশো টাকাই তো লেগেছে।’ নিজের এলো চুলগুলো নাড়তে নাড়তে মালা কেমন অকপটে বলে গেল, ‘মেনটেন না করলে কী আর সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় রমাদি। নিজের দিকেই দ্যাখো না, এমন চাঁদপানা মুখটার কী অবস্থা করে রেখেছ। ভাই, হয় পয়সা বাঁচাও, না-হয় রূপ… টাকা তো হাতের ময়লা, আজ আছে কাল নেই।’

আকাশের সহ্যশক্তির বাঁধ প্রায় ভাঙতেই বসেছিল। নিজেকে কিছুটা সংযত করে তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে ফেললেন, ‘সৌরভ কি তাহলে মেন্স স্যালন-এ গিয়েছিল নাকি?’

‘আরে না না। ওর এত সময় কোথায় যে ও পার্লারে যাবে। রাজ্যের বিল জমা দিতে দিতেই তো ওর সময় চলে গেল, ঘরের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল। না হলে হয়তো ও-ও…।’

শিউরে ওঠে রমা, ‘তাহলে তো অনেকটাই গেল!’

‘হ্যাঁ, বেশিরভাগটাই। এখনও দুধের বিল বাকি আছে। সঙ্গে নিত্যদিনের খরচাপাতি।’

মনে মনে আকাশ বলতে থাকেন, ‘পকেটে কড়ি নেই, অথচ ফুটানি দ্যাখো, যেন একেবারে জমিদারের ব্যাটা।’

স্বামীর চোখমুখ দেখামাত্রই ঘাবড়ে যায় রমা। ‘মালা তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তোরা বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

মালা আর সৌরভ যাওয়া মাত্রই আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়লেন আকাশ, ‘কোথাও যাবে না তুমি। লাটসাহেব সব একেবারে। দু-পয়সা উপায় করার মুরোদ নেই, অথচ ঠাটবাট দ্যাখো। ভগবান একটু সুখশান্তি আর আমার কপালে লেখেনি। সেই কথায় বলে না, তুমি যাবে বঙ্গে, তোমার কপাল যাবে সঙ্গে।’ গজগজ করতে থাকেন আকাশ।

খাটোগলায় রমা বলার চেষ্টা করে ‘না না ওটা ধার হিসাবে নিয়েছে…’ কিন্তু তাতে আরও রেগে ওঠে আকাশ।

প্রায় মাস-দুয়েক হতে চলল আকাশ আর রমা বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে এসেছে। আস্তে আস্তে পাড়াপড়শির সাথে পরিচিতি বেড়েছে। সেখান থেকেই খবর পাওয়া। মালা-সৌরভ আশেপাশের অনেক লোকের থেকেই টাকাপয়সা ধার করে বসে আছে। যখন তাদের হাতে টাকা থাকে তখন মনে হয় এরা একে অপরের জন্যই তৈরি। আর পকেট ফাঁকা হলেই দুজনের চ্যাঁচামেচির জ্বালায় পাড়ায় কাকপক্ষীও বসতে সাহস দেখায় না।

এমনভাবেই কেটে গেল আরও ছটা মাস। ততদিনে পাড়াপড়শিরাও এই জুটির স্বভাব সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তাই তারাও ধার দেওয়ার ঝাঁপি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। ওদিকে ছ’মাসের ভাড়াও বাকি পড়ে গেছে। বাড়িওয়ালা রোজই আসে আর খালি হাতে ফিরে যায়। ক্রোধের বশে একদিন বাড়িওয়ালা সৌরভকে না পেয়ে ঘরের সমস্ত মালপত্র তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। মালার সঙ্গে বাড়িওয়ালার তুমুল বচসা বেধে যায়। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না।

ঘটনাচক্রে সেদিন সৌরভ কোনও কাজে কলকাতার বাইরে ছিল। তার ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত। ওদিকে রমাও সেদিন পাড়ার এক মহিলার সঙ্গে পরিচিত কারওর বাড়িতে ঠাকুরের নামগান শুনতে গেছে। তারও বাড়ি ফিরতে রাত গড়াবে। এমতবস্থায় আস্তানা হিসাবে কেবলমাত্র তার রমাদির গেটকেই বেছে নেয় মালা।

রোজের অশান্তির কারণে কলকাতার প্রতিও মোহভঙ্গ হতে বসেছিল আকাশের। সেই জন্যই অন্যত্র বদলির জন্য কোম্পানিতে আবেদনপত্র জমাও দিয়েছিল। কিন্তু ওই ভাগ্য। অফিস থেকে ফিরে গেটের দরজাটা খুলতে যাবে কী, সামনে আলুথালু ভাবে বসে মালা। মালাকে দেখামাত্রই হকচকিয়ে ওঠেন আকাশ। খানিক পরে ধাতস্ত হয়ে মালাকে ঘরে বসার জন্য বলেন। ঘরে ঢোকামাত্রই জামাইবাবুকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মালা। সৌরভ আর মালার প্রতি তিতিবিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও মালাকে সরিয়ে দিতে পারেন না আকাশ। মালার শরীরের মদির স্পর্শে আকাশের শরীরে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে যায়। মালার গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর ঘন চুলের আবর্তে আরও আকর্ষিত হতে থাকেন আকাশ। হূৎস্পন্দন বাড়ার সাথে সাথে কেঁপে ওঠে শরীরও। কয়েক মুহূর্তের লাবণ্যে বশীভূত হয়ে যান তিনি। সেইসময় হঠাৎই বেজে ওঠে আকাশের ফোনটা। সম্বিত ফেরে আকাশের। এ-কী করতে বসেছিল সে! সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরিয়ে দেন মালাকে। পাশের সোফায় বসায় তাকে। ‘শান্ত হও। যাই হোক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

চোখ মুছতে মুছতে মালা জবাব দেয়, ‘ঠিক হওয়ার জন্য টাকাই তো আমাদের কাছে নেই। নাহলে কী আর বাড়িওয়ালা জোর করে এভাবে তুলে দেয়। কী করে সব ঠিক হবে?’

‘ঠিক আছে দেখছি কী করতে পারি। তুমি একটু বোসো, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমি আসছি।’ বলে পকেট থেকে এটিএম কার্ডটা বার করে গাড়ি নিয়ে চলে যান আকাশ।

মিনিট সাতেক পরে ফিরে ছয় মাসের বাড়ি ভাড়া বাবদ মালার হাতে হাজার তিরিশেক টাকা দিতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে মালা। কায়দা করে শাড়ির আঁচলটা খসিয়ে দিয়ে আকাশের একদম কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘থ্যাংক ইউ আকাশদা, থ্যাংক ইউ।’

জুতো খোলার জন্য সোফায় বসা আকাশের চোখ আটকে যায় যৌবনে ভরা মালার সুডৌল স্তন যুগলের উপর। মুখ থেকে কোনও কথা সরে না তার। কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

সেদিনের পর থেকে মালা-সৌরভের প্রতি আকাশের ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। এই পরিবর্তনটা যে রমার চোখে পড়েনি, তা নয়। অবাক যেমন হয়েছে, খুশিও হয়েছে তার দ্বিগুণ। মনে মনে ভেবেছে, যাক রোজকার ঝঞ্ঝাট থেকে তো অন্তত মুক্তি পাওয়া গেল। আকাশ রমাকে বলব বলব করে মালাকে টাকা দেওয়ার কথাটা শেষ পর্যন্ত আর বলে উঠতে পারেননি।

ওদিকে মালাও বুঝে গিয়েছিল আকাশ ক্রমশ তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাকে নিজের মোহজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করল সে।

সহজসরল রমা যখনই কোনও কাজে বাইরে যায়, এমনকী বাপের বাড়ি গেলেও সংসারের দায়িত্ব মালার উপরেই দিয়ে নিশ্চিত থাকে সে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় মালা। বিভিন্ন অছিলায় নিজের রূপযৌবনকে হাতিয়ার করে আকাশের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করা। আজ এটা চাই, কাল সেটা চাই– তৎপর আকাশও মোহের বশে উড়িয়ে যায় টাকা। বাদ যায়নি রমাও। তার কাছ থেকেও কুমিরের কান্না কেঁদে টাকা হাতাতে থাকে মালা।

সহজসরল স্বভাবের অনুরাগী স্বামীর, হঠাৎই তার প্রতি উদাসীন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিল না রমা। খটকা একটা লাগছিলই। কিন্তু কোথায় যে এর গোড়া, অনেক চিন্তাভাবনার পরেও সেটা কোনওভাবেই অনুসন্ধান করতে পারল না রমা।

কেবলমাত্র পয়সার জন্যই মালার যত ছলাকলা। আকাশের প্রতি বিন্দুমাত্রও দায়বদ্ধতা ছিল না তার। একদিন রমার অনুপস্থিতিতে সংযম হারিয়ে আকাশ মালাকে বিছানায় টেনে নেয়। সব বাধা পেরিয়ে মালার শরীরী সান্নিধ্য পেতে চায় একান্তভাবে। বাধ সাধে মালা। রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘ভেবেছেনটা কি টাকা দিচ্ছেন বলে কি নিজেকে উৎসর্গ করব আপনার কাছে? এতটা সহজলভ্য বস্তু বোধহয় আমি নই। আরে আপনার মতো বোকা লোকেরও তো অভাব নেই পৃথিবীতে, শরীরের একটু হালকা স্পর্শ পেলেন কী না পেলেন সবকিছু লোটাতে শুরু করলেন। যাক অনেক হয়েছে, হাজার কুড়ি ছাড়ুন তো।’

হতবাক আকাশ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। মালা বলতে থাকে, ‘ছাড়ুন, ছাড়ুন, নয়তো আপনার আসল চেহারাটা আর কারওর জানতে বাকি থাকবে না।’ বাঁচার জন্য মানুষ কী না করে, অগত্যা মালাকে দিতেই হয় সেই টাকা। এইভাবেই মালার লোভ আরও বেড়ে চলে।

কলশির জলও গড়াতে গড়াতে একদিন শেষ হয়ে যায়। রমা আর আকাশের সংসারেও অভাবের ছাপ পড়তে শুরু করে। তাই একদিন বাধ্য হয়েই মালাকে দেওয়া পাওনা টাকার কিছুটাও যদি মালার মায়ের থেকে পাওয়া যায়, সেই আশায় অনুভামাসিকে ফোন করে রমা। কিন্তু তিনি বলেন, ‘ছোটোবোনকে কটা টাকা দিয়েছিস বলে সেটাও চাইছিস। এত নীচ তোকে কখনও ভাবিনি।’

পরে রমা তার মাকে সব কথা জানালে, তিনিও ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মেয়ের উপরে, ‘মালা যে দিনের পর দিন তোর সরলতার সুযোগ নিয়ে এভাবে টাকা নিচ্ছে কই আগে বলিসনি তো? সবকিছু খুইয়ে দিয়ে এখন বলছিস। অনুভা আর ওর পরিবারের ওই দোষের জন্য আমরা ওদের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ছেদ করে দিয়েছি।’

এতদিনে বাপের বাড়ির লোকেদের থেকে মোহভঙ্গ হয়েছে রমার। ওদিকে মালার প্রতিও ঘেন্না জন্মে গিয়েছিল আকাশের মনে। তৎসত্ত্বেও তিনি না পারছিলেন রমাকে সত্যিটা বলতে, না পারছিলেন মালার দিনদিন বেড়ে যাওয়া চাহিদা মেটাতে। সংসারের চাপ আর মালার চাহিদায় আকাশ রীতিমতো নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন। রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল তাঁর। অন্যত্র বদলির জন্য আবেদন জমা দিয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি।

এরই মাঝে মালা আবার কলসেন্টারে জয়েন করেছে। সৌরভও একপ্রকার চাপে পড়েই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেছে। পাড়াপড়শির কাছে প্রচুর দেনা, তারাও তো আর ছেড়ে কথা বলছে না। সেই চাপেই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু উপায় তেমন বিশেষ নয়। বরং খরচা অনেক বেশি।

দিন পনেরো এভাবে চলার পর হঠাৎই একদিন মালা উধাও হয়ে গেল। অফিসে গিয়ে আর ফেরেনি। পুলিশ এদিক-সেদিক খুঁজলেও কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র এটুকুই খবর পাওয়া গিয়েছিল মালা সেইদিন কলসেন্টার যায়ইনি। সৌরভ পাগলের মতো খুঁজে বেড়াল তাকে। তারপর একদিন সেও নিরুদ্দেশ।

ঠিক তখনই মালার মা অনুভাদেবী, আকাশ আর রমার বিরূদ্ধে রিপোর্ট দায়ের করলেন। তাদের নিখোঁজের পিছনে নাকি রমা আর আকাশের-ই হাত রয়েছে। পাড়াপড়শির হস্তক্ষেপ এবং উপরমহলের কিছু বন্ধুর জন্য জেলে যেতে হয়নি তাদের। বড়ো বাঁচা বেঁচেছে তারা।

মাসদুয়েক পর হঠাৎই একদিন দেরাদুন থেকে ট্রান্সফার লেটার এসে উপস্থিত হল। এই পরিবেশে দুজনেই বেশ হাঁফিয়ে উঠেছিল তাই পাকাপাকি ভাবে দেরাদুনে সেটল করার আগে একবার সেখানে তদারকি করতে ও কয়েকদিন ছুটি কাটাতে রমাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল আকাশ।

প্রথমদিনটা অফিসেই কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন টুরিস্ট বাসে চড়ে পুরো শহর ঘোরার পালা। সেইমতো সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া। যেতে যেতে পথের মাঝে শুটিং হচ্ছে দেখে গাড়ি থামিয়ে সকলে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল। কোনও এক হিন্দি ছবির নাচের শুটিং চলছিল। নায়ক-নায়িকার পিছনে বেশ কয়েকজন রংবেরঙের পোশাক পরে তালে তালে নাচছে।

আচমকা রমা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ওটা মালা না?’

আকাশেরও বিন্দুমাত্র চিনতে অসুবিধা হল না। মালাকে দেখে রমা আকাশকে বলল, ‘এবার অনুভামাসির হাতে ওকে তুলে দিয়ে আমাদের বদনাম ঘোচাব। একবার যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ার প্রশ্নই নেই।’

রমার কথায় ঘোর আপত্তি তোলে আকাশ। বলে, ‘খবরদার, একবার যখন এই ধান্দাবাজগুলোর হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি তখন আর এসবের মধ্যে ঢুকতে যেও না। ফালতু ফালতু জল ঘোলা করে লাভ কী। চলো ফিরে যাই।’

কিন্তু রমাকে বোঝাবে কে? তার মাথায় জেদ চেপে বসেছে, এই কলঙ্ক থেকে তাদের মুক্তি পেতেই হবে। তাই স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে, শুটিং শেষ হওয়ার পরেই মালার পিছু পিছু একটা ট্যাক্সি নিয়ে পিছনে ধাওয়া করল। একটি নিম্নবিত্ত পাড়ায় একখানা অপরিসর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল মালা। অপ্রত্যাশিত ভাবে আকাশ আর রমাকে দেখে, মালা এমন ভান করল যেন তাদের কোনওদিন দেখেইনি। রীতিমতো চিনতে অস্বীকার করল তাদের। সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় রমার। রাগে চিৎকার করে ওঠে, ‘তুই এখানে আয়েশে আছিস, আর তোর মা তোর কারণে আমাদের দুজনকে জেলে পাঠাবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত প্রায় সেরেই ফেলেছিল। তোকে নাকি আমরা গায়েব করেছি। এখুনি আমাদের সাথে চল। তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাব তোকে।’

একটা কথাও বলল না মালা। কোনও সদুত্তর না পেয়ে রাগের বশে মালার গালে একটি সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে রমা বলে, ‘যে তার নিজের স্বামীর হতে পারেনি, সে অন্যের কী হবে! তুই এখানে আনন্দে বেলেল্লাপনা করছিস, আর তোর বর সৌরভ পাগলের মতো খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে তোকে। ভগবান জানে সে এখন কোথায়।’ হ্যাঁচকা টানে মালাকে ঘর থেকে বাইরে আনার উপক্রম করতেই, মালা রীতিমতো জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’

আওয়াজ শুনে আশপাশের বেশ কয়েকজন লোক জড়ো হতেই ঘাবড়ে গিয়ে রমা, মালার হাত ছেড়ে দিল। সেখানকার গতিক ভালো নয় বুঝে আকাশ একপ্রকার জোর করেই রমাকে টেনে নিয়ে ট্যাক্সিতে এনে বসালেন।

খানিক যাওয়ার পরেই আকাশ বলে উঠলেন, ‘আমাদের এখানে কোনও গন্ডগোল না পাকিয়ে ওদের ঠিকানাটা কলকাতার পাওনাদারদের দিয়ে দিলেই হতো, তারাই যা করার করত।’ আকাশের কথাতে সম্মতি জানাতে গিয়ে হঠাৎই রমার মনে পড়ে গেল, তাইতো ঠিকানাটাও তো ঠিক করে দেখা হল না। গাড়ি থামিয়ে রমা বলে, ‘তুমি গাড়িতেই থাকো। আমি লুকিয়ে জেনে আসছি।’

জায়গাটায় ফেরত আসতেই, রমা হকচকিয়ে গেল। গলায় জয়ের উল্লাস নিয়ে মালা বলছে, ‘কি মা, কেমন অ্যাক্টিংটা করলাম বলোতো? রমাদিকে একেবারে আউট করে দিলাম কেমন। দ্বিতীয়বার আর এখানে আসার ভুলটা করবে না।’

অনুভাদেবীও মেয়ের কাজে খুশি হয়ে শাবাশ শাবাশ করতে লাগলেন।

‘মানছি বাবা মানছি। তুই তো আচ্ছা আচ্ছা নায়িকাদেরও কাত করে দিবি রে! কী দারুণ অভিনয়টাই না করলি। তোর হিরোইন হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না দেখিস।’

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মালার বর সৌরভও মালার তারিফ না করে পারল না।

সবকিছু দেখে হতবাক রমা, বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। নতুন করে আর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না তার। গাড়িতে ফিরে স্বামীকে সমস্ত বৃত্তান্ত শোনাতে শোনাতে কেঁদে ফেলল সে, ‘আমরা ঠকে গেছি আকাশ, একেবারে ঠকে গেছি। সবাই প্লান মাফিকই টাকা হাতানোর এই ফাঁদটা পেতেছিল। আমাদের সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মালা-সৌরভ দিনের পর দিন ছলনা করে গেছে। ছলনা।’

 

প্রস্তাব

অফিসের মহিলা কলিগদের থেকে সৌহার্দ্য একটু ডিসটেন্স রেখেই চলে। অফিসিয়াল কথাবার্তা ছাড়া তেমনভাবে কারওর সাথে মেশে না। এর পিছনে যে কোনও কারণ রয়েছে, তেমনটা নয় বা তাকে দেখতে-শুনতে খারাপ তেমনও নয় বরং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সুন্দর, হ্যান্ডসাম, মিষ্টি স্বভাবের। হাইটও তেমনি, প্রায় ছ ফুট। গায়ের রং শ্যামলা– মেয়েরা ঠিক যেমনটা চায় আর কি। তাকে দেখলে যে-কোনও মহিলার হূদয়ে কম্পন অনুভূত হবে, এমনটা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু হয় না– অনেকেই নিজের মতো করে ভেবে নেয়, সৌহার্দ্যও অফিসের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনকে এক করতে চায় না। তাই ছুটির পর এক মুহূর্তও ওয়েস্ট না করে সোজা বাইক ছুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। তবে মাঝেমধ্যে কাজের জন্য আটকেও পড়তে হয়। এরকমই একদিন একটা প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য শ্রেয়া আর তাকে ছুটির পরেও থেকে যেতে হল। প্রেজেন্টেশন জমা করতে করতে রাত প্রায় সোয়া দশটা হয়ে গেল। যাবার সময় বসের ফরমায়েশ, ‘সৌহার্দ্য, শ্রেয়ার ফেরার ব্যাপারটা একটু দেখে নিও।’

‘ওকে স্যার। আপনি না বললেও এত রাতে ওনাকে…।’

‘আরে না না। আমাকে নিয়ে এত ভাববেন না। আমার সঙ্গে স্কুটি রয়েছে। আমি চলে যেতে পারব,’ কথার মাঝেই বলে বসে শ্রেয়া।

পার্কিং জোনে শ্রেয়ার স্কুটি স্টার্ট করার বিফল চেষ্টা দেখে, সৌহার্দ্য বলে– ‘স্টার্ট যখন নিচ্ছেই না, ওটা এখানে ছেড়ে যান। কাল মেকানিক ডেকে দেখিয়ে নেবেন। চেষ্টা করলে স্টার্ট হয়তো নিয়ে নেবে, কিন্তু মাঝপথে যদি আবার বিগড়োয় প্রবলেমে পড়বেন।’

‘ঠিক বলেছেন। বরং সৌরভকে বলি পিক করে নিতে।’ ব্যাগ থেকে ফোন বার করতে করতে কথাটা শেষ করে শ্রেয়া, ‘আশা করি মিনিট পনেরোর মধ্যে ও চলে আসবে।’

‘কিন্তু ততক্ষণ এখানে দাঁড়ানোটাও তো নিরাপদ নয়। তার চেয়ে বরং আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।’

‘কিন্তু আমার বাড়ি তো আপনার বাড়ির ঠিক উলটো পথে, শুধু শুধু আবার অতটা পথ…’ বলতে বলতে থেমে যায় শ্রেয়া।

‘আপনাকে বিপদের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়ার মতো পাত্র তো আমি নই, আশা করি এতক্ষণে সেটা বুঝে গেছেন। তাছাড়া বসের হুকুম বলে কথা। না মানলে কী আর চলে বলুন? তাই বলছি দেরি না করে গাড়িতে বসে পড়ুন।’ ঈষৎ মজা করেই বলে সৌহার্দ্য।

শ্রেয়া আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যায় তারা।

‘চলুন, ভিতরে চলুন।’ বলতে বলতে কলিংবেলটা বাজায় শ্রেয়া।

‘অন্য আর এক দিন, শ্রেয়া।’ বলে গাড়িটা ঘোরাতে যাবে এমন সময় শ্রেয়ার মা উমাদেবী আর যমজ ভাই সৌরভ বেরিয়ে আসে। ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়াতে হয় সৌহার্দ্যকে।

মা-ভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় শ্রেয়া।

‘তা বাবা কষ্ট করে এতদূর যখন মেয়েটাকে ছাড়তে এলেই… অন্তত একটু চা যদি…’

‘শুধু চা কেন আন্টি অন্য একদিন পাত পেড়ে খেয়ে যাব’খন। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাবা-মা না খেয়ে বসে থাকবেন।’

এমন সময় ভিতর থেকে কাঁপা গলায় শ্রেয়ার বাবা নীরেন্দ্রবাবুর আওয়াজ ভেসে আসে, ‘শ্রেয়া বাড়ি ফিরেছিস? সঙ্গে কে? ভিতরে আসতে বল।’

‘আসলে বাবার কাল থেকে আর্থ্রাইটিসের ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে-চলতেও পারছেন না। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা লোকজন খুব ভালোবাসেন। যদি একবার দেখা করে যেতেন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চলুন ওনার সাথে আলাপ করে আসি।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘরে ঢুকে যায়।

ঘরে ঢুকেই নীরেন্দ্রবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সৌহার্দ্য। ‘আরে বোসো বোসো। এখন আর এসব কেউ মানে নাকি। তা বুঝেছ বাবা কাল থেকে বাতের ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে। পা বাড়াতে গেলেই একেবারে বাবা-মা সকলকে টেনে আনতে হচ্ছে।’ বলে খানিক থেমে যান, তারপর আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেখেছ কাণ্ড, নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার নামটাও তো জিজ্ঞেস করা হয়নি! তোমার নাম যেন কী?’

‘সৌহার্দ্য।’

‘মানে অন্তরঙ্গ। বাহ্ বেশ মিষ্টি নাম তো।’ বলেই উমাদেবীকে ডাকতে শুরু করেন। ‘উমা, উমা। বলি ছেলেটাকে কিছু খেতে তো দেবে নাকি। সারাদিন খেটে মুখটা একেবারে আমসি হয়ে গেছে।’ ভাবটা এমন যেন কতদিনের পরিচিত। অবশ্য মানুষটাই এইরকম। নীরেন্দ্রবাবুর ডাকাডাকিতে উমাদেবী ইতস্ততবোধ করতে থাকেন।

‘না না আঙ্কল, আন্টি বলেছিলেন। আমিই না বলেছি। রাত হয়েছে তো।’

‘বলি বিয়ে করেছ?’

‘আজ্ঞে!’

‘বিয়ে করেছ কি?’

‘না-না।’

‘ব্যাচেলার। তাহলে আবার দেরি কিসের হে। না খেয়ে তোমার যাওয়া হবে না।’

‘আসলে বাবা চিন্তা করবেন তো তাই।’

‘বাবা খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

মুচকি হেসে সম্মতি জানায় সৌহার্দ্য।

‘জানিয়ে দাও। আজ তুমি খেয়েদেয়ে ফিরবে।’ বেগতিক দেখে বাড়িতে জানাতেই হয় সৌহার্দ্যকে।

খেতে বসে এদিক-ওদিকের নানারকম কথা চলতে থাকে। আড্ডা বেশ জমে ওঠে।

‘কাল ম্যাচটা দেখলেন?’ প্রশ্ন করে সৌরভ।

কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই নীরেন্দ্রবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘ওই তোর এক দোষ বাবু, শুধু খেলা আর খেলা। তার চেয়ে বরং খবরটা শোন কাজে দেবে।’

‘সত্যি বাবা পারো বটে। খেলার নাম শুনলেই তোমার যে কী হয়!’ শুরু হয়ে যায় বাপ-ছেলের কথা কাটাকাটি।

‘তোমাদেরও বলিহারি যাই, ছেলেটা একদিন এসেছে কোথায় ওর সাথে চারটে কথা বলবে তা নয়, বাপ-ছেলে মিলে শুরু করে দিলে। ছাড়ো ওদের কথা। তুমি তোমার কথা বলো, বাবা।’ উমাদেবী পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করেন।

‘আমার কথা। আলাদা করে কী বলব! পরিবার বলতে বাবা-মা আর আমি। বাবা-মা দুজনেই ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক ছিলেন। বেশ কয়েকদিন হল রিটায়ার করেছেন। এখন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং চালাচ্ছেন।’

‘তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভীষণ ভালো লাগল বাবা। সময় পেলেই চলে এসো।’

‘আরে আসবেই তো। কী হে, এই সেকেলে বুড়োটার সাথে মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসবে তো?’

‘অবশ্যই আঙ্কল। তবে আজ উঠতে হবে। অনেক রাত হল। ওহ্… আঙ্কল আপনার বাতের ব্যথার জন্য একটা ওষুধ পাঠিয়ে দেব, ব্যবহার করে দেখবেন।’

দিন পাঁচেক পরেই শ্রেয়ার হাত দিয়ে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছিল সৌহার্দ্য। সঙ্গে একটা কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে ব্যবহারবিধি লিখে পাঠিয়েছিল সে।

তারপর আরও দিন দশেক কেটে গেছে। শ্রেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তেমন না এগোলেও নীরেন্দ্রবাবু আর উমাদেবীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে সৌহার্দ্য। সময় পেলেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একে-অপরকে ফোন করে খবর নেওয়া। কিছু স্পেশাল রান্না করলেই উমাদেবী নয় তো নীরেন্দ্রবাবুর ফোন। শ্রেয়ার হাত দিয়ে খাবারও পাঠিয়েছে বার দুয়েক। ওনাদের এই আন্তরিকতা সৌহার্দ্য-র মনকেও ছুঁয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে বেশ এনজয়ই করে।

একদিন সৌহার্দ্য সবেমাত্র লাঞ্চবক্স নিয়ে বসেছে, ঠিক সেই সময়েই নীরেন্দ্রবাবুর ফোন, ‘বলি ব্যাপার কী হে! বুড়োটার খবর কী শুধু ফোন মার়ফত-ই নেবে নাকি দর্শনও দেবে?’

‘না না আঙ্কল, কী বলছেন, সময় পেলেই চলে যাব।’

‘না না ওসব সময়-টময় বুঝি না বাপু। তুমি বরং রবিবার দিনই চলে এসো। জমিয়ে আড্ডাও দেওয়া যাবে আর একসাথে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। তোমার মাসিমা কী সব হায়দরাবাদি বিরিয়ানি বানাবে। তোমার খুব ভালো লাগবে।’

‘বিরিয়ানি, ওয়াও। বাবা – আমি দুজনেই ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু রবিবার তো হবে না আঙ্কল। ওই একটা দিনই তো বাড়ির সকলে একসঙ্গে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়।’

‘তাহলে, বাবা-মাকেও সঙ্গে নিয়ে চলে এসো। ওনার ফোন নম্বর দাও। আমি নিজে ওনাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাব। ওই দ্যাখো তোমার মাসিমাও বলছে আসার জন্য।’

‘আরে না-না আঙ্কল, অত ফর্মালিটির প্রয়োজন নেই, বাবাকে আমি বললেই হবে। মা হয়তো আসতে পারবে না। ওই দিন মায়ের, মাসির বাড়ি যাবার কথা।’

‘ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইল।’

কথামতো রবিবার সন্ধেবেলা সৌহার্দ্য তার বাবা অসীমবাবুকে নিয়ে শ্রেয়াদের বাড়িতে উপস্থিত হল। বাবা-ছেলের হূদ্যতা সত্যিই প্রভাবিত করার মতো। হাসিঠাট্টা, আলাপচারিতার পর, খাওয়ার টেবিলে উমাদেবীর রান্নার তারিফ না করে পারলেন না অসীমবাবুও।

‘বাহ্ দিদিভাই। লাজবাব। বিশ্বাস করুন বহু বড়ো বড়ো রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। কিন্তু এই স্বাদ…জাস্ট অতুলনীয়! তবে হ্যাঁ আপনি যেমন বিরিয়ানিতে এক্সপার্ট, আমার গিন্নি তেমনি হিংয়ের কচুরি। না খেলে বুঝবেন না।’ তারিফের বহরে খানিক কুন্ঠাবোধ করেন উমাদেবী।

‘সামনের রবিবার আমাদের ওখানে চলে আসুন। গীতার সঙ্গে আলাপও হয়ে যাবে আর ছুটিটা উপভোগও করা যাবে। কী বলিস বাবা?’

‘আরে হ্যাঁ সে আর বলতে। চলে আসুন সামনের রবিবার। সৌরভ ওইদিন কোনও কাজ রাখিস না কিন্তু। শ্রেয়া, আঙ্কল-আন্টির সঙ্গে তুমিও আসছ কিন্তু।’ শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে সৌহার্দ্য।

ঠোটের কোণায় ঈষৎ হাসি খেলে যায় শ্রেয়ার। মুখের দু-পাশ রাঙা হয়ে ওঠে। মাথা নীচু করে সম্মতি প্রকাশ করে সে।

পরের রবিবার শ্রেয়া, সৌরভ বাবা-মায়ের সঙ্গে টাইম মতোই পৌঁছে যায় সৌহার্দ্য-দের বাড়িতে। গীতাদেবীও বাপ-ছেলের মতোই মিশুকে। সহজ সরল। কাজেই দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। গীতাদেবীর সঙ্গে উমাদেবীও কিচেনে ওনার হাতে হাতে খানিক সামলে নিলেন। খাওয়ার সময়তেও খাবার পরিবেশন করার ব্যাপারেও হেল্প করলেন। অসীমবাবুও খাতিরে কোনও ত্রুটি রাখেননি। যাবার সময় বরং সকলে মিলে বারবার অনুরোধ করেছে আবার আসার জন্য। ‘নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু তার আগে গীতাদিকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে।’ প্রত্যুত্তরে উমাদেবী বললেন।

‘আপনি না বললেও আমি আমার মিসেসকে নিয়ে আসতাম আপনাদের বাড়িতে। কি বলো গিন্নি?’ গীতাদেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন অসীমবাবু।

পরের দিন অফিসে শ্রেয়ার মোবাইলে একটা এসএমএস। প্রেরক সৌহার্দ্য। দু-চার কথায় লেখা রয়েছে– অফিসের পরে ওয়েট কোরো। কথা আছে।

শ্রেয়া বেশ অবাকই হয়েছিল। চোখের সামনেই তো রয়েছে মানুষটা, তাহলে কী এমন কথা যে এখানে বলা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল শ্রেয়াকে। তারপর থেকে কাজে মন বসাতে পারেনি একটুও।

অফিসের পরে গেটের সামনে এগোতেই সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে হাজির।

‘বোসো।’ সৌহার্দ্যের হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমি বলাতে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে শ্রেয়া। ভাবার শক্তি যেন কে ছিনিয়ে নিয়েছে। সম্বিত ফেরে সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বরে, ‘কী হল বোসো।’

‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ বসছি। কোথায় যাব? আ…আপনি যে বললেন কথা…’ মাঝখানেই থামিয়ে দেয় সৌহার্দ্য, ‘কেন বিশ্বাস নেই আমার উপর?’

‘এবাবা আমি এভাবে বলতে চাইনি’, হঠাৎ এই পরিবর্তনে হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া।

‘তাহলে?’ আর একটাও কথা বলে না শ্রেয়া। গাড়ি ছুটতে থাকে। মিনিট পনেরো পরে একটা রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করায় সৌহার্দ্য। ভিতরে টেবিল আগে থেকেই বুক করা ছিল। সেখানে গিয়ে খাবারের অর্ডার দেয় সে।

‘দ্যাখো আমি ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে পারি না। স্পষ্টই বলছি, বাবা-মা কাল তোমাদের বাড়িতে যাবেন আমাদের বিয়ের কথা বলতে।’ কথা সরে না শ্রেয়ার। কেবল শুনতে থাকে। এতটাও আশা করেনি শ্রেয়া। বলে যায় সৌহার্দ্য। ‘তুমিও খুব ভালো করে জানো যে তোমার বাবা-মা এই বিয়েতে অমত করবেন না। তবে তোমার হ্যাঁ বলার আগে, আমার মনে হয় তোমাকে কিছু কথা জানানো উচিত। অবশ্যই আমার পরিবারের কথা। আমার জীবনে আমার বাবার স্থান সবার উপরে। আমার জন্য ওনার অবদান ভোলার নয়। সত্যিই আমি ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনি আমার জন্মদাতা নন। আমার জন্মের কয়েকমাস পরেই আমার বাবা মারা যান।

মা যে-কলেজে পড়াতেন বাবাও সেই কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সঙ্গে মামার বন্ধুও। মামার সূত্রে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে আসতেন আর আমার সঙ্গে আমার মতো করেই মিশতেন, খেলা করতেন। সেই সময় বাড়িতে মায়ের আবার বিয়ে দেওয়ার কথা চলছে। উনি আমাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে শুনেই মামাকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘তাহলে সৌহার্দ্যর কী হবে? নতুন মানুষটি সৌহার্দ্যকে মেনে নেবে এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারে? এই সব সম্পর্কে সবসময়ই একটা রিস্ক থেকে যায়। সৌহার্দ্যর ব্যাপারে আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তোদের যদি অমত না থাকে আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবন ওকে বুঝতেই দেব না যে, আমার সঙ্গে ওর রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই।’ বলতে বলতে চোখে জল ভরে আসে সৌহার্দ্যর। বাবার প্রতি তার আবেগ একটু বেশিই।

সামলাতে সৌহার্দ্যের হাতটা চেপে ধরে শ্রেয়া। নিজেকে সামলে নেয় সৌহার্দ্য। অপলক দৃষ্টিতে শ্রেয়ার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার বলতে শুরু করে সে।

‘মামার বাড়ি থেকে মেনে নিলেও বাবার বাড়িতে মানে ঠাকুরদা ব্যাপারটা একেবারেই ভালো চোখে নেননি। শুধুমাত্র আমার জন্য সেদিন বাবা নিজের বাবা-মা, বিশাল সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছিল। এখানেই শেষ নয়, সেইসময় বাবা আইএএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরীক্ষার সময়তেই এমারজেন্সি পিরিয়ডে মায়ের ইউটেরাসের অপারেশন করাতে হল। মায়ের বেড রেস্ট। বাবা পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি, কেরিয়ার ভুলে আমার আর মায়ের দেখাশোনা করে গেছে।’

সৌহার্দ্য আবেগতাড়িত হয়ে বলে যাচ্ছিল। বাবার প্রতি তার অসীম ভালোবাসা প্রতিটা কথায় ঝরে পড়ছিল।

‘এটা বললেও বোধহয় ভুল হবে না যে বাবা নিজের সর্বস্ব আমার উপর সমর্পিত করে দিয়েছিল। এখন বাবাকে বাকি জীবনটা সুখে রাখাই হল আমার একমাত্র কর্তব্য। আমার বউকেও এটা মেনে চলতে হবে। দায়িত্বটা আমার বউয়ের উপরও বর্তাবে। জানি শ্রেয়া, শুধুই পরিবারের লোকজনই নয়, আমরাও একে-অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। হয়তো বা ভালোও বেসে ফেলেছি। তবুও হ্যাঁ বলার আগে ভালো করে ভেবে নাও। সারাজীবন তোমাকে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানে বাবা-মাকে নিয়েই থাকতে হবে।’ উত্তরের আশায় বসে থাকে সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্যর হাতটা আর একটু জোরে চেপে ধরে শ্রেয়া। বলে, ‘মেসোমশাই আর মাসিমার মতো সহূদয় মানুষের সঙ্গে থাকতে আমার কেন কারওরই কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হলেও কথা দিচ্ছি কোনওদিন কোনওরকম অভিযোগ করব না তোমাকে।’

শুনে খানিক আশ্বস্ত বোধ করে সৌহার্দ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর শ্রেয়ার হাতটা মুঠোর মধ্যে ভরে নেয়।

‘বিশ্বাস করো আমি জানতাম তুমি পারবে।’

মাস দেড়েক পরে চার-হাত এক হয়ে গেল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী এক অফিসে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করতে পারে না। সেই কারণে চাকরি ছাড়তে দ্বিধাবোধ করেনি শ্রেয়া। মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর শ্বশুর-শাশুড়ির কোচিং সেন্টারে যোগ দিয়েছিল সে। ধীরে ধীরে অসীমবাবুর বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রেয়া। কাজের সূত্রে দিনের বেশিরভাগ সময়টা একসঙ্গে কাটানোর জন্য শ্বশুর-বউমার সম্পর্কটা আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। অসীমবাবু স্নেহও করতেন তেমনভাবেই।

‘ভাগ্যিস অফিসের দায়িত্বটা নিয়েছিলে শ্রেয়া। সারাদিন কোচিং ক্লাস করানোর পর আর পেরে উঠছিলাম না।’ শ্রেয়া মমতা অনুভব করে শ্বশুরের প্রতি।

‘ঠিক আছে বাবা, নতুন অফিসে জয়েন করলেও তোমার এই অফিসের কাজগুলো ছুটির দিনে বসে আমিই করে দেব।’

‘খানিক স্বস্তি পেলাম। সত্যিই আর পারছি না, হাঁফিয়ে উঠছি। আর কতদিন পারব তাও জানি না। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ নিজের কাছেই নিজে হেরে যাচ্ছি।’ শ্বশুরের কথাগুলো কেমন আর্তনাদের মতো মনে হল শ্রেয়ার।

অবাক হয়ে শ্রেয়া বলে, ‘কী বলছ বাবা! মনের সাথে যুদ্ধ মানে!’

‘সৌহার্দ্য বা গীতাকে একথা বলা যায় না। তাছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে ওরা আমাকে বার করতে পারবে না।’

‘তাহলে কে পারবে?’

‘তুমি, কেবলমাত্র তুমি।’ অসীমবাবুর চোখেমুখে তখন বিমর্ষতার স্পষ্ট ছাপ।

‘আমি! আমি কীভাবে?’ প্রহেলিকার থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না শ্রেয়া।

‘আমার করুণ কাহিনি শুনবে?’

‘অবশ্যই। আমায় বলে যদি একটু হালকা হতে পারো, তা বলো না বাবা।’

‘এখানে নয়, চলো একটু খোলা হাওয়ায় বেরোই।’

দারোয়ানকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে একটা বিশাল জমিদারবাড়ির সামনে থামল গাড়িটা।

‘এই বাড়িটা দেখছ। এটা আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে। গীতা আর আমার বিয়েটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমাদের বিয়ের পর বাবা একটাই শর্ত রেখেছিলেন, এই বিশাল সম্পত্তির মালিক শুধুমাত্র তার রক্তের সম্পর্কের নাতি বা নাতনি অর্থাৎ আমার নিজের সন্তানই পাবে। সৌহার্দ্য নয়। সৌহার্দ্যের জন্যই তো গীতাকে বিয়ে করা, আর বাবা বলে কিনা সে-ই…। রক্ত চড়ে গেল মাথায়, ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। এমনিতেই গীতার গর্ভাশয়ে ফ্রাইব্রয়েডের সমস্যা ছিলই, হাতিয়ার করলাম সেটাকেই। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে গীতার জরায়ুটাই শরীর থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। তারপর আর কখনও এ-বাড়ির পথ মাড়াইনি।’ মিনিট খানেক স্থির হয়ে বসে রইলেন অসীমবাবু।

‘তারপর? তারপর কী হল?’

‘মাস আষ্টেক হল বাবা মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে উনি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, ওনার দাহ-সংস্কার যেন আমার হাতেই হয়। সেইমতো ডেকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সমস্ত সম্পত্তি আমার নামেই করে গেছেন, কারণ তিনি কখনও চাননি জায়গা-জমি-টাকাপয়সা বংশের বাইরে অন্য কারওর কাছে যাক। সঙ্গে রেখে গেছেন একটা চিঠিও। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই আত্মগ্লানিতে তিল তিল করে মরছি।’

‘কেন, কী এমন লেখা ছিল সেই চিঠিতে?’

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন অসীমবাবু। তারপর বলতে শুরু করেন ‘ওনার বংশ নিঃশেষ করার জন্য কেবলমাত্র আমিই দায়ী, এমন অভিযোগের পাশাপাশি একটা তীব্র আর্তি… ‘পারলে নিজের বংশজকে পৃথিবীতে নিয়ে এস। বংশরক্ষা কোরো নইলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না। বেঁচে থাকতে তো বাবার ইচ্ছের দাম দিলে না, অন্তত মারা যাওয়ার পর যদি বাবাকে একটু সম্মান দাও।’

অসীমবাবুর সারা মুখে একটা ভেঙে পড়া বিষণ্ণতার ছাপ।

‘তারপর থেকেই অনুশোচনায় ভুগছি। কোথাও একটা মনে হচ্ছে, বাবার কথাটা বোধহয় কিছুটা হলেও সত্যি। যদি আমার আর একটা সন্তান এই পৃথিবীতে আসত তাতে তো সৌহার্দ্য-র প্রতি ভালোবাসা কমে যেত না। ছেলে বা মেয়ে যাই হতো দুজনে একসাথে বড়ো হতো। এতে আমার বাবাও শান্তি পেতেন আর বংশরক্ষাও হতো। এখন ভাবি সেদিন অতটা কঠিন সিদ্ধান্ত না নিলেই পারতাম। অন্তত একটা বাচ্চার পরেও তো গীতার অপারেশনটা করাতে পারতাম।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অসীমবাবু।

‘আমি তোমার ফিলিংসটা বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু এখন সবই তো হাতের বাইরে।’

‘না, একটা রাস্তা এখনও আছে, তুমি, একমাত্র তুমি আমায় সাহায্য করলে এখনও সম্ভব শ্রেয়া। অবশ্যই যদি তুমি চাও।’

‘এক্ষেত্রে আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শ্রেয়া।

শ্রেয়ার হাতটা চেপে ধরে অসীমবাবু। ‘কেউ জানতে পারবে না শ্রেয়া। সবাই জানবে সৌহার্দ্য-র সন্তান। শুধু তুমি আর আমি…’ তড়িতাহত হয়ে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় শ্রেয়া। শ্বশুরের কথা শুনে আঁতকে ওঠে সে।

বউমার প্রতিক্রিয়া দেখে অসীমবাবু বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘না-না শ্রেয়া তুমি ভুল বুঝছ। আমি কোনওরকম অশ্লীল বা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বলছি না তোমাকে! স্পার্ম ট্রান্সপ্ল্যান্ট মানে আইভিএফ-এর কথা তো নিশ্চয়ই তুমি শুনে থাকবে। প্লিজ শ্রেয়া যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়াও, তাহলে আমিও শান্তি পাই, আর বাবার আত্মাও খানিক স্বস্তি পায়।’

পরমপূজ্য শ্বশুরের আত্মতুষ্টির কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে পড়ে শ্রেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে, এমন জঘন্য কথাটা বলল কীভাবে বাবা? একবারও বাধল না! ছিঃ ছিঃ ছেলের বউয়ের সম্পর্কে এমনটা ভাবতে পারে কোনও শ্বশুর? সৌহার্দ্য-র বিশ্বাস, ভালোবাসার এই দাম দিল মানুষটা! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সৌহার্দ্যর কাছে কখনও এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না আর বিশ্বাস করলেও এই আঘাত সহ্য করতে পারবে না। পায়ের নীচ থেকে যেন অযাচিত ভাবে খানিকটা মাটি সরে গেছে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে অভিশপ্ত সেই বাড়ি থেকে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে আসে শ্রেয়া। কোথায় যাবে সে, কাকে বলবে, তার এই লজ্জাকর পরিস্থিতির কথা। সৌহার্দ্যও কী করে করতে পারবে তার এই দুঃস্বপ্নের অবসান?

 

আশ্বাস

বড়োজামাই বিজয়ের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে আত্মীয়-পরিজন মোটামুটি সবাই ওয়াকিবহাল। প্রতিপত্তির পাশাপাশি বদমেজাজের কারণে সমাজে তার একটা নামডাক ছিলই। মানুষকে হেয় করা, ছোটো নজরে দেখা, সবসময় কেমন যেন একটা দাম্ভিক আচরণ। বিশেষত শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ছোটো করতে পারলে সে যেন একটু বেশিই মজা পায়। শ্বশুরবাড়ির যে-কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে তার একটা গোল বাধানো চাই-ই-চাই।

সেসব এড়াতেই পিসিশাশুড়ি মুগ্ধা, ছেলের বিয়ের একমাস আগেই বিয়ের কার্ডের সঙ্গে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। শুধুমাত্র তাই নয় বহুবার ফোনও করেছিলেন, কিন্তু সংযোগবশত জামাই বাড়িতে না থাকায় ভাইঝি স্নেহা আর নাতি-নাতনির সঙ্গেই কথা হয়েছে প্রত্যেকবার। ব্যক্তিগত ভাবে জামাই বিজয়ের সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠেনি মুগ্ধার।

বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আবারও ফোন করেন মুগ্ধা। এইবার ফোনটা বিজয় নিজেই ধরেছিল। কোনও কিছু শোনার আগেই পিসিশাশুড়ির গলা পেয়েই খোঁচা মারল, ‘এখন আপনি বিয়েতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করছেন, যখন বিয়ের আর মাত্র চার-পাঁচ দিন বাকি। কী ভেবেছেন, আমরা কি অনাহুত? ভাইঝিকে বললেই দায়িত্ব শেষ। ভাবলেন কী করে আপনাদের বাড়ির মেয়েকে বললেই আমরা হ্যাংলার মতো চলে যাব। জামাইয়ের কদর যারা করতে পারে না, তাদের সাথে আমরা সম্পর্কও রাখতে চাই না।’ বলেই ফোনটা রেখে দেয় বিজয়।

জামাইকে তোষামোদ করার নানানরকম চেষ্টা করেন মুগ্ধা। কিন্তু কেউ যদি বুঝতে না চায় তাকে বোঝানো খুব কঠিন। শেষ পর্যন্ত বিজয় তার স্বভাবসিদ্ধ আচরণের কারণে শালার বিয়েতে নিজেও অনুপস্থিত থেকেছে, স্নেহাকেও পাঠায়নি।

একমাত্র ভাইঝি, ভাইঝি-জামাই না আসায় বিয়েবাড়িতে বেশ চর্চা হয়েছে। সবকিছু শুনেও না শোনার ভান করতে হয়েছে মুগ্ধাকে। কখনও বা স্নেহার অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কাটাতে হয়েছে। শুধু বা তাকেই বলা কেন, মুগ্ধার দাদা প্রতাপবাবুকেও জামাইয়ের এই ব্যবহারের জন্য কম লজ্জিত হতে হয়নি।

বাবার মৃত্যুর পর দু’হাজার টাকা নিয়ে ফল্স পাড়ের বিজনেসে নেমেছিল বিজয়। আর আজ সে-ই শহরের সব থেকে বড়ো কাপড়ের ব্যবসায়ী। দিনের পর দিন যত উপার্জন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে অভিমান আর টাকা কামানোর দম্ভ। আর সেই দম্ভে চাপা পড়েছে সম্পর্কের রসায়ন।

উপহার পেতে কে-না ভালোবাসে। তাই বলে সেই পাওনাটা তার অধিকার ধরে নেওয়াটাও একেবারে যুক্তি সঙ্গত নয়। ঐশ্বর্যশালী, প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকার পরেও শ্বশুরবাড়ির থেকে পাওয়ার আশা বরাবরই বিজয়ের ছিলই। নিয়মমতো পূজাপার্বণ, উৎসব, ষষ্ঠীতে তত্ত্ব না পেলেই মুখ ব্যাজার। জামাইকে আমন্ত্রণ করে থালার চারপাশে বারো-চোদ্দো বাটি না সাজিয়ে দিলে কি জামাই আপ্যায়ন সম্ভব? অথচ কথাতেই আছে, কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য পাত্র হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু দম্ভের কারণে বিজয় বোধহয় সে-সব ভুলতে বসেছিল।

তার এই দুর্ব্যবহারের জন্য স্নেহার বাবা প্রতাপবাবুও একপ্রকার মেয়ের বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতাপবাবুর স্ত্রী রমাই নিয়ম মেনে, ফলটি, মুলোটি, মিষ্টিটি নিয়ে হাজির হতেন মেয়ের বাড়িতে। তাতেও কম গঞ্জনার মুখোমুখি হতে হতো না তাঁকে। তাঁর সামনেই প্যাকেট থেকে এক-একটা জিনিস বার করে প্রত্যেকটিতে কিছু না কিছু খুঁত বার করে অপমান করা। যার জন্য বিজয়ের মায়ের পেটের ভাইরাও আজ তার থেকে বিচ্ছিন্ন। তার উপর গোদের উপর বিষফোড়ার মতো নিত্যদিনের তার সুরাপান।

ছোটো থেকেই স্নেহা ভীষণ সহজ-সরল এবং শান্ত প্রকৃতির। কোনওদিন সাত চড়ে রা নেই তার। কাজেই স্বামীর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সৎসাহসও তার ছিল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ বুজে কেবলই স্বামীর কঠোর অনুশাসন মেনে চলা। সেই কারণেই বিজয় আরও পেয়ে বসেছে। নিত্যদিন নেশা করে বাড়ি ফেরা। চ্যাঁচামেচি করা। কিছু বোঝাতে গেলে চিরাচরিত সেই এক ডায়লগ ‘নিজের পয়সায় খাই, তোমার বাবার টাকায় খাই না। তোমার বাবার তো ডেকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোরও ক্ষমতা নেই। নিজের পয়সায় খাচ্ছি তাও সহ্য হচ্ছে না তোমার।’

কোনও বিতর্কে যায় না স্নেহা। অভয়ের বিয়েতে যেতে না পারার জন্য স্নেহার মনটা ক’দিন ধরে ভালো নেই। অভয় স্নেহার থেকে বছর দশেকের ছোটো হলে কী হবে, ভাইবোনের দারুণ বন্ধুত্ব। কত সুখ-দুঃখের কথা হতো তাদের। বিয়ের পর সম্পর্কগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে।

কিছুদিন পরে এক বিয়েবাড়িতে হঠাৎই দেখা পিসির সঙ্গে। লজ্জায় অভয়ের বউয়ের কথা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারেনি স্নেহা। আর করবেটাই বা কী করে, বিয়ের মিষ্টি নিয়ে যা কান্ড ঘটল! মুগ্ধা, অভয়কে দিয়ে বাচ্চাদের জন্য বিয়ের মিষ্টি পাঠিয়েছিল, সে মিষ্টিও তো অভয়ের সামনেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল বিজয়। মাথা নত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল অভয়। তারপর দু-তরফ থেকেই ফোন বন্ধ।

এতকিছুর পরেও ভাইঝির উপর বিন্দুমাত্র রাগ নেই মুগ্ধার। স্নেহার সমস্যাটা সে বোঝে। বরং ভাইঝির জন্য চিন্তাই হয় তার। যে মেয়ে বলতে গেলে, একপ্রকার তার কাছে মানুষ, ভাগ্যের পরিহাসে সুখে-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানোরও অধিকার নেই তাদের। জোর করে কারও সংসারে নাকগলানোটাও ঠিক নয়। যদিও এর আগে স্নেহার বড়দা, বিজয়কে বোঝানোর নানারকম প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার স্বভাব সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

মুগ্ধা মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। মন নিয়েই তার যত কারবার। কাজেই পুরুষদের দম্ভ আর অহং সম্পর্কে তার ধারণাটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু তার থেকে বেশি চিন্তার কারণ বিজয়ের নেশার প্রতি আসক্তি। যেটা মুগ্ধাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল।

দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলেও এদিক-ওদিক থেকে কিছু খবর তো কানে আসেই। তারপর সেগুলোকেই বাড়িয়ে-চাড়িয়ে রং লাগিয়ে যা হয় আর কী! মুগ্ধা সেগুলো সহজভাবে নিলেও, বিজয় তো একেবারে বিপরীত। লোকের মুখে শোনামাত্রই নিরীহ স্নেহার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ‘তোমার পিসি নিজেকে কী মনে করেন? ওনাকে বলো আমাদের চিন্তা ছেড়ে দিতে। বেশি পড়াশোনা শিখে কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি। শোনো ওসব পড়াশোনা-টড়াশোনা দিয়ে কিছু হয় না বুঝেছ, লোক টাকা চেনে, টাকা। আমার মতো উপায় করে দেখাক তো, তাহলে জানব।’ ব্যস তারপর ঝগড়ার বাহানায় আরও কয়েক পেগ চড়িয়ে নেয় বিজয়। দিন এভাবেই গড়িয়ে যায়।

অশান্তির কারণে আত্মীয়দের কারও সামনে ভাইঝির প্রসঙ্গে কিছু বলাও ছেড়ে দিয়েছিল মুগ্ধা। সারাটা দিন অধ্যাপনা নিয়েই ব্যস্ত থাকত। তার উপর মুম্বইতে অভয়ের ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য বাড়িতেও বেশ কিছুটা সময় দিতে হচ্ছিল তাকে। পরের মাসের মধ্যে আবার নতুন বউকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

বছর গড়াতে না গড়াতে হঠাৎ একদিন খবর এল বিজয়ের নাকি ওরাল ক্যানসার ডিটেক্টেড হয়েছে। ব্যস পরিবারের উপর একেবারে বজ্রাঘাত পড়ার মতো অবস্থা হল। যতই বদমেজাজি, দাম্ভিক হোক না কেন, বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের এমন মারনরোগ, তাদের বেশ বিচলিত করে তুলেছিল। ক্যানসারের প্রথম স্টেজ।

ডাক্তাররাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করার কথা বলেছেন। স্নেহার বাচ্চাগুলোও ছোটো ছোটো, আর স্নেহা এমনিই একটু দুর্বল প্রকৃতির। কোনওদিনই নিজের সিদ্ধান্তে চলেনি, বরাবরই অন্যের মুখাপেক্ষী। সুতরাং তার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও অসম্ভব। পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। টাকাপয়সার অভাব না থাকলেও কোথায় চিকিৎসা করাবে, কোথায় গেলে সমুচিত হবে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না তার। বিজয়ের দুই ভাইও কর্তব্য পালন করতে শুধুমাত্র একদিন চোখের দেখা দেখে গেছে মাত্র, বাড়তি কোনও দায়িত্ব তারাও নিতে রাজি নয়। স্নেহার ননদও কোনওদিনই দাদার প্রতি যত্নশীল নয়। তার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘যেটা ভালো মনে হয় করো। আমরা এ ব্যাপারে কোনও মতামত পোষণ করতে চাই না। দাদাকে তো চিনি, ভালো করতে গিয়ে যদি কিছু একটা… থাক ভাই আমাদের এর মধ্যে জড়িয়ো না।’

যত মত তত পথ। কেউ আয়ুর্বেদের উপর জোর দিতে বলে তো কেউ অ্যালোপ্যাথি বা হোমিওপ্যাথির। কেউ কেউ তো আবার এটা বলতেও ছাড়ে না যে, ‘এখনও পর্যন্ত তো এই রোগে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তিকে বেঁচে ফিরতে দেখিনি’, তো কেউ বলে, ‘এরোগের কোনও চিকিৎসাই নেই। সুতরাং এখন সবই ভগবানের ইচ্ছা।’

সবাই গা-বাঁচিয়ে চললেও স্নেহার বাবা-মা দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বোন মুগ্ধার কাছে। না মুগ্ধা ফেরায়নি বরং সেও মুখিয়ে ছিল। আদতে মুগ্ধা চাইছিল কেউ অন্তত একবার আসুক। তাই প্রতাপবাবু কোনও কিছু বলার আগেই মুগ্ধা বলে ওঠে, ‘দাদা তুমি তো জানোই অভয়ের মুম্বইতে ট্রান্সফার হয়েছে। মাস তিনেক হল টাটা মেমোরিয়ালে জয়েনও করেছে। যেভাবেই হোক বিজয়কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মুম্বই পাঠাও। বাকি, যা ব্যবস্থা করার অভয়ই করে নেবে।’

ডাক্তার ভাগনের জন্য মামার এমনিই গর্বের অন্ত ছিল না। ভাগনে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বলে কথা। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভাগনের কাছে জামাইকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটা সংশয় থেকেই গেল। আসলে দুই পরিবারের মধ্যে ভীষণ মিষ্টিমধুর সম্পর্ক কিনা!

ক্যানসারের মতো মারণরোগের মৃত্যুভয়ও টলাতে পারেনি বিজয়কে। সেও হার মেনেছে তার দম্ভের কাছে। তাই বোধহয়, রিপোর্ট হাতে পাওয়া মাত্রই বিকৃত হেসে বউকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, ‘খবরদার স্নেহা, আমার রোগের ব্যাপারে তোমার পিসি যেন কিচ্ছুটি জানতে না পারে। এমনিতেই ছেলে এখন বড়ো ডাক্তার হয়েছে। টাটা মেমোরিয়ালে চাকরি করছে। অহংকারে তেনাদের এখন মাটিতে পা পড়ে না। তার উপর তাদের অতিবড়ো শত্রু মরতে বসেছে শুনলে খুব খুশিই হবে।’

স্নেহা জবাব দিতে গিয়েও পরিস্থিতির কথা ভেবে চুপ করে যায়।

এভাবেই কেটে যায় আরও দুটো দিন। জামাইয়ের মানা-না মানার ব্যাপারে প্রতাপবাবুর একটা দ্বিধা ছিলই। বোঝাতে গেলে যদি উলটো ভাবে নেয়, তাহলেই তো বাড়ি মাথায় করে ফেলবে। এই অবস্থায় বেশি উত্তেজনাও শরীরের পক্ষে হানিকারক। ভাবতে থাকে প্রতাপবাবু।

ওদিকে দুদিন পরেও কোনও খবর না পেয়ে তৃতীয় দিনের দিন মুগ্ধা নিজেই প্রতাপবাবুকে ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘দাদা কিছু ঠিক হল। বিজয় মুম্বই কবে যাচ্ছে?’

‘কী যে করি, বিজয়ের সঙ্গে কথা বলতেই ভয় করছে। এক বলব আর অন্য মানে করে বসবে। তুই তো ওর স্বভাব জানিস, পারলে হাওয়া বাতাসের সঙ্গেও যুদ্ধ করে।’ মেয়ের কথা ভেবে চোখে জল আসেঞ্জপ্রতাপবাবুর। অসহায়ের মতো বসে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। দাদার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধার মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, যে ভাবেই হোক, একটা উপায় বার করতেই হবে। দিন চারেকের জন্য বাড়ি ফিরেছিল অভয়। চিন্তামগ্ন মাকে দেখে, ‘কী হল মা চুপচাপ কেন? জামাইবাবু মুম্বই যেতে রাজি হয়নি তাই তো?’ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করেন মুগ্ধা।

‘মা, তুমি তো নিজেই মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। তুমি তো জানোই কিছু মানুষ আছে যারা কোনও অবস্থাতেই মাথা নোয়াতে পছন্দ করেন না। জামাইবাবু সেল্ফমেড লোক। নিজের ক্ষমতায় এতো বড়ো একটা বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। একটু অহংকারী এই যা। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি।’

‘কিন্তু তুই?’ প্রশ্ন করে মুগ্ধা।

‘আরে ধুর! তুমি আমার জন্য হেজিটেট কোরো না তো। আমাদের মতো ডাক্তারদের রোজ কত ভুরিভুরি কথা শুনতে হয় জানো? কোনও পেশেন্টকে বাঁচাতে না পারলেই গালিগালাজ হজম করতে হয়। আবার রুগি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে কেউ কেউ মাথায় করে নাচে। আমাদের পেশাটাই এরকম! তার উপর উনি তো নিজের জামাইবাবু। স্নেহাদির বর। দিদির অসময়ে তার ছোটোভাই পাশে থাকবে না তো কে থাকবে?’ অভয়ের কথা শুনে আশ্বস্তবোধ করেন মুগ্ধা।

পরদিন দুপুরের মধ্যে দিদির বাড়িতে হাজির হয় অভয়। দিদিকে দেখে এমন হাবভাব করে যেন সবকিছু আগের মতোই নর্ম্যাল। ঘরে ঢুকে বসামাত্রই ডাক্তারসুলভ ভঙ্গিতে স্নেহাকে জামাইবাবুর সমস্ত রিপোর্ট আনার জন্য বলে। রিপোর্ট দেখার পর ফোনে সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চলল শলাপরামর্শ। তারপর সোজা জামাইবাবুর ঘরে ঢুকে প্রায় যুদ্ধের কম্যাণ্ডারের মতো করে বলে, ‘ব্যস অনেক হয়েছে। কাল সকালের ফ্লাইটে আপনি আমার সঙ্গে মুম্বই যাচ্ছেন। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়ে গেছে। পরশুদিন আবশ্যক যা যা পরীক্ষানিরীক্ষা হওয়ার হবে, তারপরেই চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে।’

বিজয়ের ক্রোধ তখনও বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয়নি। বরং যাদের সাথে এরকম তিক্ত সম্পর্ক, তাদের এত আদিখ্যেতায় রাগে তার গা জ্বালা করতে শুরু করেছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা সময়ে তো শালাবাবুর উদ্দেশ্যে বলেই ফেলল, ‘জানি, জানি, অনেক বড়ো ডাক্তার হয়ে গেছিস। আমার চিকিৎসাও করবি। কিন্তু তোর বিয়েতে পিসি যা ব্যবহার করেছে সেটা কোনওদিনও…’

জামাইবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, ‘হ্যাঁ, জানি, আমার বিয়েতে মা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে নিমন্ত্রণ করতে আসতে পারেনি। বোঝেনই তো বাবা আর পেরে ওঠে না। আর মায়ের একার পক্ষে সব জায়গায় ছোটাছুটি করাটা প্রায় অসম্ভব। আর আমি নিমন্ত্রণ করতে এলেও তো হতো না বলুন। এসব আপনি বুঝবেন না তো কে বুঝবে বলুন তো। ঠিক আছে ছোটোর বিয়েতে আমি নিজে এসে আপনাকে নিয়ে যাব।’ কথার মারপ্যাঁচে অভয়, বিজয়ের মনের গ্লানি কিছুটা হলেও দূর করতে পারল। পরিস্থিতি আরও হালকা করতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিদিকে দেখে, ‘কী রে চা-টাও দিবি না নাকি বলতো?’ ভাইয়ের এই সকল প্রচেষ্টায় স্নেহা কিছুটা হলেও সোয়াস্তি অনুভব করল।

পরদিন ভোররাতের ফ্লাইটে রওনা দিল তারা। প্রথমদিন ডাক্তারি পর্যবেক্ষণে পরীক্ষানিরীক্ষা সমস্ত কিছু চলল। দ্বিতীয় দিনে অপারেশন। ততক্ষণে প্রতাপবাবু আর মুগ্ধা দুই ভাইবোনেই, টাটা মেমোরিয়ালে পৌঁছে গেছে। সিনিয়র ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এবং অভয়ের সহযোগিতায় অপারেশন সাক্সেসফুল। চার-পাঁচ দিন পর থেকেই লিকুইড জাতীয় খাবার দেওয়া হল বিজয়কে। তারপর আর সাত দিন অবজার্ভ করার পর ছুটি দিয়ে দেওয়া হল তাকে।

ছুটির দিন বিজয়, পিসিকে সামনে পেয়ে পিসির হাত দুটো ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, ‘পিসিমা ওই দিন না-জানি কত বাজে কথা বলেছি আপনাকে। তারপরেও আপনারা। প্লিজ পিসিমা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’

সঙ্গে সঙ্গে জামাইয়ের হাত দুটো ধরে নেয় মুগ্ধা। বলে, ‘এটা কী করছ বাবা! তুমি যে আমাদের কত আদরের, কত কাছের তা কী বলার অপেক্ষা রাখে। ভুলটা আমারই হয়েছিল বাবা, আমারই উচিত ছিল গিয়ে বলা।’

‘পিসিমা, আর লজ্জা দেবেন না। এখনও তো ও বাড়িতে একটা বিয়ে বাকি আছে। দেখবেন ছোটোর বিয়েতে নিমন্ত্রণের পরোয়া না করেই আমি চলে আসব। শালাবাবুর বিয়েতে সব দায়িত্ব আমার।’

অপারেশন করার পর বিজয়ের মুখটা সামান্য একটু বেঁকে গেছে। দাঁত তুলে দেওয়ার পর কথাগুলোও কিছুটা জড়িয়ে যাচ্ছে, তৎসত্ত্বেও বিজয়ের মন থেকে বলা জড়ানো কথাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি মুগ্ধার।

ভরসা জোগাতে জামাইয়ের কাঁধে হাত রেখে মুগ্ধা শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল, ‘সম্পর্ক এত ঠুনকো নয় যে, দুটো কথাতে সেটা ভেঙ্গে যাবে। মন থেকে সমস্ত রাগ, দম্ভ মুছে ফেলো। দেখবে ভালো আছ। আমরা সবাই সবসময় তোমার সঙ্গেই আছি।

বিদায়

অনুভা কাগজ পড়তে পড়তে রিমার মুখের দিকে তাকালেন। একমাত্র মেয়ে। অরূপ এবং অনুভা বহু আদরে নিজেদের একমাত্র সন্তানকে বড়ো করে তুলেছেন। কোথাও কিছু ফাঁক রাখেননি। শহরের নামি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে এখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। রিমার এখন বয়স মাত্র উনিশ বছর। অথচ অনুভা আশ্চর্য হয়ে যান রিমার সাহস এবং কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বলেই ফেলেন, ‘এটা তুই কী বলছিস রিমা?’

‘হ্যাঁ মা, আমি অনেক ভেবেচিন্তেই ডিসিশন নিয়েছি। কলেজের ওই একঘেয়েমি ক্লাস আর পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না। ঠিক করেছি অভিনেত্রী হব।’

অনুভার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া এক্সপ্রেশন রিমার চোখ এড়ায় না, ‘এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? অনেকদিন ধরেই খোঁজখবর নিচ্ছিলাম শুধু তোমাদের আগে জানাইনি। অনন্যাকে চেনো তো? আমার সঙ্গে কলেজে পড়ে। নামটা লেখানো মাত্র, ক্লাস করে না। টিভির পর্দায় এখন ও বেশ পরিচিত মুখ। ওই আমাকে মুম্বইয়ের এক এজেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ফোনে কয়েকবার ওই এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাকে মুম্বই গিয়ে থাকতে হবে, তবেই অডিশনের সুযোগ ও করিয়ে দেবে। তার আগে অবশ্য খানিকটা গ্রুমিংয়েরও দরকার আছে।’

অনুভা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের মুখের দিকে। এই সেদিনের সেই ছোট্ট রিমা নিজের মধ্যে এত তেজ আনল কীভাবে, সেটা অনুভা ভেবে পেলেন না। তবুও মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে ছাড়লেন না, ‘এতদূর একা গিয়ে থাকবি কিন্তু ওখানে কাউকেও তো তুই চিনিস না। আর ওই এজেন্টকেও তো সামনাসামনি কখনও দেখিসনি। ওর উপর আমরা ভরসা করব কী করে? এছাড়া তোর বাবাকেও তো সব খুলে বলতে হবে। উনি মত দেবেন বলে মনে হয় না।’

‘আমি মুম্বই যাব ঠিক করে নিয়েছি’, রিমার কণ্ঠস্বর কঠোর শোনায়, ‘তোমরা আমাকে ভরসা করবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার। যেমন করেই হোক অভিনয়ের জগতে আমাকে খ্যাতি পেতেই হবে, তবেই তো আমি টাকা রোজগার করতে পারব। টাকা এবং খ্যাতি, এই দুটোই আমার স্বপ্ন।’

অরূপ বাড়িতে আসতে অনুভা মেয়ের ইচ্ছের কথা স্বামীর কাছে জানান। অরূপ সব শুনে বুঝতে পারেন মেয়ে যখন জেদ ধরেছে ওকে আটকাবার আর কোনও উপায় নেই। অনুভাকে শান্ত করতে বলেন, ‘আমার মত যদি শোনো অনুভা, তাহলে মেয়েকে আটকাবার চেষ্টা কোরো না। রিমা বড়ো হয়েছে। আইনের চোখে ও এখন অ্যাডাল্ট। সুতরাং আমরা আটকাবার চেষ্টা করলে ও যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। তার চেয়ে বরং ওর ইচ্ছেটাকে মেনে নিলে সম্পর্কটা টিকে থাকবে। আর ওর ভালোমন্দের দায়টা তো আমাদেরই। তবে একটা কথা, ওর কাছ থেকে এজেন্টের নম্বরটা নিয়ে রেখো, আমি একবার লোকটার সঙ্গে কথা বলে ওকে যাচাই করে নিতে চাই।’ অনুভা চুপ করে থেকেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন।

খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি হতে মেয়েকে সরাসরি অরূপ ধরলেন, ‘হ্যাঁরে, তোর মায়ের কাছে শুনলাম তুই নাকি মুম্বই যেতে চাস অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য। ভালো কথা। আশা করি এই পেশার ভালোমন্দ সবকিছু জানার পরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। এই পেশায় যেমন অর্থ, খ্যাতি আছে তেমনি একাকিত্ব, অবসাদও আছে। খ্যাতি ধরে রাখা কিন্তু কঠিন কাজ। তুই কি প্রস্তুত এই কঠিন পথে পা ফেলতে? ভেবে দ্যাখ কিন্তু।’

‘বাবা, আমি সবকিছু জেনেই অভিনেত্রী হতে যাচ্ছি। আমি জানি আমি সফল হবই।’

ট্রেন ছুটে চলেছে টিনসেল টাউনের দিকে। বাতানুকূল কামরার চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয় রিমা। মনে মনেই বলে, ‘চারপাশে শুধু মানুষের ভিড়। আজ আমি এই ভিড়েরই একটা

অংশমাত্র। এই লোকের ভিড়ে এদের সকলের মতো আজ আমি হারিয়ে গেছি, কেউ আমাকে চেনে না। আমার নামও কেউ জানে না। অথচ একটা এমন দিন আসবে যেদিন লোকের মুখে মুখে আমার নাম ঘুরবে। এক দেখায় লোকে আমাকে চিনে ফেলবে।’ চারপাশের ভিড় অগ্রাহ্য করেই রিমার মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।

রিমার চোখের সামনে মুম্বইয়া এজেন্টটার মুখ ভেসে ওঠে। আরব সাগরে খড়কুটোর মতো ওই এজেন্টটিই তো ভরসা। রিমার পোর্টফোলিও দেখে ও চার-পাঁচটা টিভি ধারাবাহিকের প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে কথা বলেছে। ওর জোরাজুরিতেই মুম্বইতে এসে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া, কারণ এজেন্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে শহরে এসে না থাকলে অডিশনের সুবিধা ও করিয়ে দিতে পারবে না। তবে অডিশন দিলে নাকি কোথাও না কোথাও রিমার চান্স হয়েই যাবে এই আশ্বাস এজেন্ট দিয়েছে।

মুম্বইতে পা দিয়েই প্রথমে রিমা এজেন্টকে ফোন করে। ওরই পাঠানো গাড়িতে বান্দ্রার অফিসে গিয়ে এজেন্টের সঙ্গে দেখা করে। এজেন্টই রিমাকে নিয়ে যায় অফিসের কাছাকাছি একটি লোকালিটিতে যেখানে সস্তায় পিজি থাকার ব্যবস্থা রিমার জন্য করা হয়েছে। একটা ঘরে চারজন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনটে অলরেডি দখল করেছে তিনটি অবাঙালি মেয়ে, চতুর্থজন হল রিমা।

ঘরের দশা দেখে রিমা খানিকটা দমে যায়। এজেন্টটা প্রবাসী বাঙালি তাই রিমার ধারণা ছিল বাঙালিদের সুবিধা অসুবিধাটা অন্তত লোকটা বুঝবে। এরকম একটা ঘর ঠিক করে রাখবে ও, রিমা ভাবতে পারেনি।

সংযত হয়ে রিমা প্রশ্ন করে, ‘আপনি তো অনেক বড়ো বড়ো কথা বলেছিলেন, এরকম একটা ঘর পছন্দ করলেন কীভাবে?’

‘ডোন্ট বি সিলি রিমা। এরকম ঘর না তো কি জুহুর বাংলোতে থাকবে! ভালো ঘর মানে ভালো টাকা। স্টার হতে পারলে তবেই তোমার হাতে টাকা আসবে আর এর জন্য তোমাকে প্রচুর পরিশ্রমও করতে হবে। এসব কথা এখন ছাড়ো। কাল তোমার জন্য একটা অডিশনের ব্যবস্থা করে রেখেছি। সকালে ঠিক দশটার সময় এই ঠিকানায় পৌঁছে যেও’, বলে রিমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিল এজেন্ট।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে রিমা সময়ের আগেই নির্দেশিত ঠিকানায় পৌঁছে গেল। নতুন জায়গা, অচেনা লোকজন রিমাকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলছিল। অডিশনের জন্য লম্বা লাইন। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অবশেষে ডাক এল। তখন প্রায় তিনটের ঘরে ঘড়ির কাঁটা। রিমার বেহাল অবস্থা। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্তিতে সারা শরীর ঝিম মেরে গেছে। তবুও নিজেকে কিছুটা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার উপযুক্ত করে নিয়ে ভিতরে পৌঁছল রিমা। যে-লাইনগুলো ক্যামেরার সামনে বলার জন্য দেওয়া হয়েছিল সেগুলো মনে মনে ঝালিয়ে নিল। ভিতরে ঢুকে সামান্য কথাবার্তার পর সোজা ক্যামেরার সামনে ওকে দাঁড়াতে বলা হল। মুহূর্তে সব কিছু যেন গুলিয়ে গেল রিমার। যে লাইনগুলো ওকে বলার জন্যে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সব গুলিয়ে তাল পাকিয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না। স্বাভাবিক ভাবেই অডিশন-এ পাশ করতে পারল না রিমা।

টানা তিনমাস একটাও অডিশন রিমা উতরোতে পারল না। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই কেমন জানি সব গোল পাকিয়ে যেত, চেহারায় এক্সপ্রেশন কিছুতেই ফোটাতে পারত না। সঙ্গের টাকাপয়সাও শেষ হবার জোগাড় হল। রিমার রুমমেটদেরও সেই একই অবস্থা। রুপোলি পর্দার মোহ সবাইকে এই মায়া নগরীতে টেনে এনেছিল ঠিকই কিন্তু বাস্তবে কাজ জোগাড় করা অতটাও সহজ ছিল না।

ক্যামেরার সামনে স্বাভাবিক না হতে পারাই যে তার ব্যর্থতার কারণ সেটা রিমা বুঝতে পারছিল। এজেন্টের অভিজ্ঞ চোখও সেটা বুঝতে পেরে রিমাকে প্রথমে মডেলিং-এ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।

এজেন্টের কথামতো রিমা ওয়াডালায় একটি মডেলিং এজেন্সিতে এসে উপস্থিত হল। সেখানেও মেয়েদের ভিড়। অপেক্ষা করতে করতে রিমা লক্ষ্য করছিল ওই এজেন্সিরই একটি ছেলে, মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাপ নিচ্ছে আর জোরে জোরে অন্য একটি ছেলেকে মেয়েদের নামের সঙ্গে সঙ্গে মাপগুলো বলছে। অন্যজন কাগজে সেগুলো লিখে নিচ্ছে। রিমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির মাপ নেওয়ার সময় ছেলেটি অশালীন ভাবে মেয়েটির নিতম্বে চাপ দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আসলি হ্যায়?’ রিমার এসমস্তই অত্যন্ত কুরুচিকর মনে হলেও মনে মনে ভাবল আগুনে পুড়েই খাঁটি সোনা হওয়া যায়।

ধীরে ধীরে এই ধরনের কালচারে রিমা অভ্যস্ত হয়ে উঠল। ক্যামেরার সামনে জড়ত্ব কাটাতে শুরু করল। ছোটোখাটো বিজ্ঞাপনের কাজ আসতে লাগল সেইসঙ্গে টাকা পয়সার অভাবও মিটে গেল। মুম্বইতে থাকাটাই যেখানে অসম্ভব মনে হচ্ছিল, সেটাই রিমার কাছে এখন সম্ভব মনে হল।

রিমার চোখে এমন একটা জেদ ছিল এবং রিমার চেহারার বৈশিষ্ট্য দেখে রিমার এজেন্ট বুঝে গিয়েছিল, মেয়েটি এই ইন্ডাস্ট্রিতে হারার জন্য আসেনি। ইতিমধ্যে টিভি ধারাবাহিকের আর-একটি অডিশনের জন্য সে রিমাকে পাঠাল। এবার আর রিমাকে অসফল হতে হল না। ধারাবাহিকে একটি পার্শ্বচরিত্রে রিমা নির্বাচিত হল। পার্শ্বচরিত্র হলেও গল্পে চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রথম রিমার মনে হতো, অফিসে কাজ করছে ও। পরিশ্রম, সময়ে পৌছনো সবই করতে হচ্ছে উলটে শনি-রবিবারেও কোনও ছুটি নেই। জ্বর, শরীর খারাপ হলেও ওষুধ খাও আর কাজে এসো। কিন্তু আস্তে আস্তে ধারাবাহিকের টিআরপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিমার করা চরিত্রটাও দর্শকদের কাছে পর্দার পরিচিতি মুখ হয়ে দাঁড়াল। রিমার বাড়িওলাও ওর সঙ্গে আগের থেকে অনেক মার্জিত ভাবে কথা বলা শুরু করল। বাড়িওলার টিনএজার ছেলেটিও মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের নিয়ে রিমার কাছে পৌঁছে যেত সেলফি তোলার অজুহাতে।

রিমাও ব্যাপারটা উপভোগ করতে আরম্ভ করল এবং ওর এজেন্টও ওকে সাবধান করল, ‘রিমা, এখন তুমি একজন সেলিব্রিটি। হুটহাট করে যে-কোনও পোশাকে দোকান-বাজার চলে যাওয়া তোমাকে এখন মানায় না। দরকার পড়লে অনলাইনে অর্ডার করো।’

ইতিমধ্যে অভিনয়ের ব্যস্ততা রিমাকে নিজের মা-বাবার থেকেও অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও কাজের প্রেশারে ফোনে কথাবার্তাও একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করলে অনুভা স্বামীর সঙ্গে মুম্বই কিছুদিনের জন্য ঘুরে যেতেন। তাতেও বিশেষ লাভ হতো না কারণ বাড়িতে রিমাকে কতটুকুই বা তাঁরা পেতেন! কিন্তু মেয়ে সম্পর্কে কানাঘুষো কলকাতায় বসেও তাঁদের কানে আসতে থাকত। এবারে তাই অনুভা ঠিক করেই এসেছিলেন মেয়ের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলবেন।

‘হ্যাঁরে রিমা, খবরের কাগজগুলোতে তোর সঙ্গে ওই ছেলেটার নাম জড়িয়ে রোজই কিছু না কিছু ছাপা হচ্ছে। কী ব্যাপার বল তো! তোর এখন বয়স অল্প। এই ধরনের খবর যদি বেরোতে থাকে কাগজে তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার। আমি জানি ওরা যা পারে কাগজে ছেপে দেয়। কারও বদনাম হলে ওদের কি?’

‘ওই নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না’, অল্প কথায় উত্তর সারলেও রিমা এই বিষয়টা নিয়ে খুবই সচেতন। অভিনয় জগতে প্রায় দুই বছর কাটাবার পর রিমা এখন অনেক বেশি পরিপক্ব। ওর সহঅভিনেতা সিদ্ধার্থকে রিমা প্রথম থেকেই খুব পছন্দ করে। কাজের খাতিরে দুজনকে প্রায়শই সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হতো। রিমার চোখের ভালোলাগা, সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায় এবং গসিপ ছড়িয়ে পড়ে। সিদ্ধার্থও জেনে ফেলে রিমার হূদয়ের দুর্বলতা।

পঁয়ত্রিশ বছর উত্তীর্ণ সিদ্ধার্থ সময় নষ্ট না করেই রিমাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। সিদ্ধার্থর সঙ্গে একা থাকার এই সুযোগ রিমারও ছেড়ে দিতে মন চায় না। তারপর থেকেই কখনও কফি শপে, ডিস্কোয় অথবা কারও পার্টিতে শুটিং-এর পর দুজনে একসাথে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দুজনের এই মেলামেশা চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মিডিয়ার কাছে।

সেদিনটা, প্রাণ থাকতে রিমা কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সিদ্ধার্থর সঙ্গে ডেটে বেরিয়েছিল রিমা। পাঁচতারা হোটেলে টেবিল বুক করে রেখেছিল সিদ্ধার্থ। ডিস্কোতে নাচতে নাচতে রিমা বুঝতে পারেনি কখন ভিড় থেকে সরে গিয়ে সামান্য আলোআঁধারইতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। সিদ্ধার্থর শক্ত বাহু তার কোমর বেষ্টন করে তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে এক করে নিয়েছে। কিছু বলা বা বোঝার আগেই সিদ্ধার্থের তপ্ত চুম্বন এসে পড়ে রিমার নরম ঠোঁটের উপর। একবার নয় বারবার। মিনিট, সেকেন্ড সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রিমা। ভালো খারাপ সব মুছে যায় মন থেকে। সেই রাতটা হোটেলেরই একটা রুমে এক শয্যায় কাটে রিমা আর সিদ্ধার্থর। নিজেকে উজাড় করে তুলে দেয় সিদ্ধার্থের চাহিদার আগুনে।

এরপর আর লুকোচুরি, রাখঢাক কিছুই রাখেনি রিমা। প্রকাশ্যে হাতে হাত দিয়ে দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছে, ভিড়ের মধ্যেই সিদ্ধার্থর গলা জড়িয়ে ধরে উষ্ণ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। মিডিয়াও চুপ করে থাকেনি। ছবির পাশাপাশি ফলাও করে রিমা, সিদ্ধার্থর সম্পর্কের রঙিন বর্ণনা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে কার্পণ্য দেখায়নি। ফলে দুজনের সম্পর্কের কথা সাধারণ লোকের মুখে মুখে ফিরেছে এমনকী অভিনয় জগতের সহশিল্পীরা ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেও ছাড়েনি।

আজ রিমা তাই মায়ের প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে গেল যদিও ওর মনে হল মায়ের চিন্তাটা অমূলক নয়।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে এজেন্টের ফোন দেখে রিমা একটু অবাকই হল। এত রাতে প্রয়োজন ছাড়া ও কথা বলে না তবুও ফোন তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘রিমা, টিভিতে সন্ধে সাতটার স্লটে যে ধারাবাহিকটা চলছে তার লিড অ্যাক্ট্রেস প্রেগনেন্ট। আর কয়েকদিনই ও কাজ করবে। তুমি ওর জায়গায় কাজ করতে রাজি থাকলে আমি ডাইরেক্টরের সঙ্গে কথা বলব তোমার জন্য।’

‘হ্যাঁ, কথা বলুন আমি কাজ করব’, পরপর কাজের অফার আসাতে রিমা খুশি হয়, মনে মনে অহংকারও বোধ করে।

সকালে শুটিং-এর কাজ না থাকাতে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে রিমা। ফোনটা বাজতেই আলস্য ভরে ফোনটা কানে নেয়। ‘আজকের খবরের কাগজটা পড়েছো রিমা?’ ঈশানীর গলার আওয়াজ শুনে একটু অবাক হয়ে যায়। দুটো ধারাবাহিকে একসঙ্গে কাজ করেছে ঠিকই কিন্তু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। সামনাসামনি দেখা হলে হাই…হ্যালো। ব্যস ওই পর্যন্তই দৌড়।

‘না, এখনও পড়া হয়নি। নতুন একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সঙ্গে সাতটার স্লটে যে ধারাবাহিকটা চলছে তার লিড অ্যাক্ট্রেস হওয়ার একটা অফার পেয়েছি।’

‘সে কী! ওটাতেই তো যে লিড রোলে এখন করছে সে আসলে সিদ্ধার্থের গার্লফ্রেন্ড। ওর সন্তানেরই মেয়েটি মা হতে চলেছে। আসছে সপ্তাহেই ওরা দুজন বিয়ে করছে। আমি ভাবলাম তুমি আর সিদ্ধার্থ এত ভালো বন্ধু, তুমি নিশ্চই এই আনন্দের খবর আগেই পেয়ে থাকবে।’

ঈশানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিমা ফোনটা নামিয়ে রাখে। সত্যিই কি সিদ্ধার্থ তার সঙ্গে এমনটা করতে পারে? ঈশানীরই বা কী স্বার্থ থাকতে পারে মিথ্যা কথা বলায়। এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক সিদ্ধার্থ, মেনে নিতে রিমার কষ্ট হয়। বসে থাকতে পারে না রিমা। হাত-পা মনে হয় যেন অবশ হয়ে আসছে। শুয়ে পড়ে বিছানায়। অনুভা, অরূপ কেউই পারেন না ওকে তুলে খাওয়াতে।

সন্ধের সময় রিমার এজেন্ট, রিমার খোঁজে বাড়িতে এসে পৌঁছোয়। অনুভা ওকে রিমার ঘরের দোরগোড়ায় ছেড়ে দিয়ে অন্য ঘরে চলে যান। কারণ উনি ভালো করেই জানেন বাড়ির লোকের সামনে কাজের কথাবার্তা রিমা একেবারেই পছন্দ করে না।

‘কী ব্যাপার রিমা? সকাল থেকে তোমার ফোন ট্রাই করছি, ধরছ না কেন?’ বলতে বলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এজেন্ট। রিমার বিশ্রস্ত অবস্থা দেখে মুহূর্তেই বুঝতে পারে সিদ্ধার্থর খবর আগেই এসে পৌঁছেছে রিমার কানে।

রিমাকে উঠিয়ে বসায়। রিমা সামলে নিতে একটু সময় নেয়। ওকে সহজ করার জন্য বলে, ‘এত আপসেট হওয়ার কী আছে? এই ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকে।’

‘রিয়েলি? সত্যিই আপনার মনে হয় আমার আপসেট হওয়া উচিত নয়?’

‘দ্যাখো রিমা, যা হয়ে গেছে ভুলে যাও। চামড়া মোটা না করলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকতে পারবে না। টিভির জগৎটাই আলাদা। রাতারাতি খ্যাতি, প্রতিপত্তি… কাল পর্যন্ত তুমি সকলের অজানা ছিলে আর আজ ঘরে ঘরে তোমায় নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। তোমার কাছে অর্থ আছে, খ্যাতি আছে, জনপ্রিয়তার স্বাদ সবেই পেতে শুরু করেছ। আর তোমার বয়সটাই বা কী? এখনও বহুদিন তোমাকে কাজ করতে হবে। সুতরাং এবার নিজের একটু যত্ন নাও। যত তোমার নামডাক হবে ততই তুমি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে এবং এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। আবেগে ভেসে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া তোমার অনুচিত। নিজেকে শক্ত করো। প্রেমে বিহ্বল হয়ে পড়ার মতো ফালতু সময় তোমার এখন নেই।’ এজেন্ট রিমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই একইরকম হয় না। রিমা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সিদ্ধার্থ তাকে এভাবে ধোঁকা দেবে। এজেন্টের হাজার বোঝানো সত্ত্বেও রিমা বুঝতে পারছিল কাজে ঠিকমতো মন বসাতে পারছে না। হাতের মুঠোয় আসা ধারাবাহিকের লিড রোলটাও এই করে রিমার হাতছাড়া হয়ে গেল। মেলামেশা করাও বন্ধ করে দিয়েছিল রিমা। যে-ধারাবাহিকটায় ও কাজ করছিল তার কাজও প্রায় শেষ হওয়ার মুখে ছিল। হাতে কাজ না থাকলেও টিভির অভিনেত্রী হিসেবে তাকে নিজের ঠাটবাট বজায় রেখেই চলতে হচ্ছিল। হাতের জমানো টাকাও প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় রিমা নিজের এজেন্টকে গিয়ে ধরে। মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিল রিমা, হাতে যা কাজ পাবে তাতেই রাজি হয়ে যাবে। এজেন্টের চেষ্টায় একটা রিয়ালিটি শো-তে কাজ করার সুযোগ হয়ে যায়। কাজটা পেয়ে রিমা খুশিও হয় কারণ সেটার পুরো শুট্-টাই বিদেশে হওয়ার কথা ছিল ফলে এই বাহানায় বিদেশ যাওয়ারও সুযোগ হয়ে যায় রিমার।

শো-তে গিয়ে রিমার আলাপ হয় রঞ্জনের সঙ্গে। রঞ্জন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিল মুম্বইতে মডেলিং করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু আশা সফল হয়নি। কাজের জন্য যখন হয়রান হয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তখনই হঠাৎ করে এই শো-টার কাজ হাতে পায় রঞ্জন। বিদেশে একা থাকার কষ্টটাও লাঘব হয়ে যায় রিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর।

রিমার অবস্থাটাও খানিকটা রঞ্জনের মতোই হয়। ভালোবাসায় একবার অসফল হওয়ার পর রঞ্জনকেই আঁকড়ে ধরে রিমা। কয়েক মাস বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে দেশে ফেরার পথে বিমানেই রঞ্জন রিমাকে প্রোপোজ করে, ‘রিমা তোমাকে আমি আমার পাশে পেতে চাই সারা জীবন। তোমাকে ভালোবাসি।’

রিমাকে মুখে ‘হ্যাঁ’ বলতে হয় না, ওর চোখে-মুখে উপচে পড়া আনন্দই রঞ্জনকে তার প্রত্যাশিত উত্তর দিয়ে দেয়।

দুজনে ঠিক করে মুম্বই ফিরে তারা একসঙ্গে থাকবে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। কথামতোই শোতে পাওয়া পুরো টাকা দুজনে একত্রিত করে এবং রঞ্জনের নামে লোন অ্যাপ্লাই করা হয় নতুন ফ্ল্যাট কেনা হবে বলে। রঞ্জন পরিষ্কার রিমাকে লোন নিয়ে মাথা ঘামাতে বারণ করে দিল, ‘তোমাকে টাকার লোন নিয়ে ভাবতে হবে না। প্রতি মাসে মাসে আমি ঠিক শোধ করতে থাকব টাকা। কিন্তু ফ্ল্যাটটা সাজাবার দায়িত্ব তোমার। ওই ব্যাপারে আমি কোনও কথা বলব না।’ রঞ্জনের দায়িত্ববোধ রিমার সব চিন্তা দূর করে দেয়। মনে শান্তি অনুভব করে রিমা।

মুম্বইতে এসেই রিমা নিজের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে রঞ্জনের কাজের জন্য। এজেন্টের সাহায্যে পরপর কাজও আসতে থাকে রঞ্জনের কাছে। নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওঠে দুজনে। কাজ থেকে কিছুদিনের বিরতি নিয়ে রিমা ব্যস্ত হয়ে যায় নতুন ফ্ল্যাট সাজাতে। আশেপাশের প্রতিবেশীদের কাছে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়েই ওরা লিভ ইন শুরু করে। দিনগুলো কাটতে থাকে স্বপ্নের মতো আর রাতের আঁধারে দুজনে ভাসতে থাকে উষ্ণ ভালোবাসায়। নরম বিছানা ছুঁয়ে পড়ে থাকা দুটো তপ্ত শরীর তৃপ্ত হওয়ার বাসনায় ভুলে যায় সমাজ, বাস্তব জগতটার কথা। বিয়ে শব্দটা অনাহূত অতিথির মতোই ওদের মনের গভীরে প্রবেশ করার পথ পায় না।

হুঁশ ফেরে যখন রিমা নিজের শরীরে নতুন একটি প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে। কী পরিচয়ে বড়ো করবে সন্তানকে? এতো তার ভালোবাসার সন্তান, তবুও রিমা চিন্তা করে, সমাজ কি রিমার মনের কথা বুঝবে?

রাতে রঞ্জন বাড়ি ফিরলে, বিছানায় শুয়ে রঞ্জনের হাতটা রিমা নিজের পেটের উপর টেনে আনে। মুহূর্তে রঞ্জন বুঝে যায় ইঙ্গিতটা। তার সন্তান রিমার গর্ভে। আনন্দে রিমার নরম শরীরটা নিজের শরীরের উপর টেনে নেয় রঞ্জন। চুম্বনে ভরিয়ে দেয় রিমাকে।

‘আমাদের বিয়েটা এবার করে নেওয়া উচিত রঞ্জন’, অতিকষ্টে রঞ্জনের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রিমা বলে।

‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমিও তাড়াতাড়ি সব অনুষ্ঠান করে নিতে চাই। সকালেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা করব। এই মাসের মধ্যেই শুভদিন দেখে…।’

দশ-বারো দিন স্বপ্নে ভেসে কাটার পর একদিন হঠাৎই বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বরটা বেজে ওঠে। সাধারণত প্রয়োজনে সকলেই মোবাইল ব্যবহার করায় এই ফোনটার উপস্থিতি রিমা প্রায় ভুলতেই বসেছিল। বাজতেই চমকে ওঠে রিমা। উঠে এসে ফোনটা তুলে নেয় হাতে, ‘হ্যালো!’ মন দিয়ে শোনে ওপাশের মহিলা কণ্ঠস্বর কী বলতে চায়, তারপর আবার বলে, ‘কিন্তু রঞ্জন তো এখন বাড়ি নেই। আপনি কে বলছেন বলুন, ও এলে আমি ওকে বলে দেব।’

কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আমি ওর পুরোনো বান্ধবী। ওর সঙ্গে দেখা করে সারপ্রাইজ দিতে চাই। যদি ঠিকানাটা দেন খুব ভালো হয়।’

রিমা ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা দিয়ে দেয় সামান্য ইতস্তত করে।

সন্ধের অন্ধকার ঘনাতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। রিমা দরজা খুলতেই অচেনা একটি মেয়ে ঘরে এসে ঢোকে রিমাকে একপ্রকার ঠেলে দিয়েই। রঞ্জনকে দেখেই মেয়েটি রঞ্জনের গালে সপাটে একটি চড় কষিয়ে দেয়, ‘তোমার সাহস কোথা থেকে হয় যে আমাকে বিট্রে করে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছ। ভুলো না তোমার বাবা আমার ড্যাডের আন্ডারে কাজ করে। ড্যাডের একটা কথায় যদি তোমার বাবার চাকরি যায় তাহলে তোমার অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারছ? একটা রাস্তার মেয়ের জন্য আমায় চিট করার স্বপ্ন যদি দেখে থাকো, তাহলে আমিও তোমার এবং তোমার এই গার্লফ্রেন্ডের কি দুর্দশা করব তুমি ভাবতেও পারবে না।’

এই ঘটনা রিমার জীবন থেকে সমস্ত আনন্দ ছিনিয়ে নিয়ে ওর জোড়া লাগা হূদয়টাকে আবার দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত করে তোলে। রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেও পরিষ্কার জবাব পায় না। দুজনে একসঙ্গে থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। রঞ্জনের ব্যবহারে স্পষ্ট হতে থাকে রিমার প্রতি তার উদাসীনতা। রাগের মাথায় গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না রঞ্জন।

গর্ভাবস্থায় এই মানসিক স্থিতি ধীরে ধীরে রিমাকে ডুবিয়ে দেয় অবসাদে। নিজেকে অসহায় মনে করা শুরু করে রিমা। তার মনে হতে থাকে, কী লাভ এই সৌন্দর্যের? সারা পৃথিবীতে কারও কাছ থেকেই তো এতটুকু ভালোবাসা সে পেল না। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পর আর কী ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব? অর্থ এবং খ্যাতির জন্য রিমা বাড়ি ছেড়েছিল, কিন্তু মানুষের চাহিদার কি কোনও শেষ আছে? এরপর জীবনে প্রেমকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল রিমা। সেটাও যখন পুরোপুরি পেয়ে গেছে মনে করতে শুরু করেছিল রিমা– রঞ্জনের সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল– স্বপ্ন দেখার অপরাধ করেছিল, তখনই সব শেষ হয়ে গেল।

খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে ছাপা খবরটা অনুভার দৃষ্টি এড়াল না, ‘টিভির পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী রিমার মৃতদেহ উদ্ধার তাঁর নিজের ফ্ল্যাট থেকে। সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বিস্তারিত খবর তিন-এর পাতায়।’

 

লাইটহাউস

সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি চোখের উপর টেনে নিল কুমকুম। সে তার চোখের জল, এমনকী সমুদ্রকেও দেখাতে চায় না। ঢেউগুলো তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল, পরমুহূর্তেই আবার একটা ঢেউ। তার মনে হল, অনুপম তাকে এইটাই দেখাতে এনেছে। একটা ঢেউয়ের ব্যর্থতা, পরবর্তী ঢেউয়ের নাছোড় উদ্যম। এভাবেই তাকে বাঁচতে শিখতে হবে।

এত ভেবেও সে ফোনটা না করে পারল না।

‘কি করছিস বেটা?’

ওপারে উত্তজিত গলায় মিষ্টি বলল, ‘মা, পায়েস করছি। জাস্ট ইমাজিন। লাইফে প্রথম। তোমার জামাইয়ের জন্মদিন তো। একটু পরে তোমায় সঙ্গে কথা বলছি। দুধটা নাকি ননস্টপ নেড়ে যেতে হবে, ও বলে গেল।’

কুমকুম দেখতে পেল তার মেয়ে হাতা দিয়ে সমানে দুধ নেড়ে যাচ্ছে। সে বলল, ‘রজত বেরিয়ে গেছে? কী বানিয়ে দিলি? তুই ব্রেকফাস্ট করেছিস বেটা?’

‘ওঃ মা, ছোলে চাউল, ছোলে চাউল। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।’ ব্যস্ত গলায় ফোন ছেড়ে দেয় মিষ্টি।

আবার সেই অবিশ্রান্ত ঢেউ। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে হবে না। এখুনি পরের স্পটে যেতে হবে। তারপর আর একটা স্পট, তারপরও একটা। অনুপম আক্ষরিক অর্থেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে তাদের। দাদাভাই, দিদিভাই তো অনেক স্পটে নামছেই না ভয়ে।

‘না রে, তোরা যা। আমরা এখানেই বসি। ওই তো চায়ের দোকান একটা। দেখি লাল চা পাওয়া যায় কিনা।’ এইসব বলে কাটিয়ে দিচ্ছে।

কুমকুম পারছে না ওরকম। সে কোথাও হাঁটু ব্যথা, বুক ধড়ফড়ের অজুহাতে নামতে না চাইলে অনুপম হই হই করে উঠছে, ‘আরে তোমার জন্যেই তো আসা। নইলে আমি তো অফিস টুরে তিন বছর আগেই…।’

সবাই ভাবছে কুমকুমকে ভোলানোর জন্যেই এই ভ্রমণের ললিপপ ধরিয়ে দিয়েছে অনুপম। অথচ ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়।

দাদাভাই আর দিদিভাই যাচ্ছিল চোখ দেখাতে চেন্নাই। ফেরার পথে ওদের ইচ্ছে আরাকু ঘুরে আসে। দক্ষিণের এইটুকু বাকি আছে ওদের। ফেরার পথে দমদমে ওদের ফ্ল্যাটে কয়েকদিন থেকে শিলিগুড়ি ফিরবে। অনেক আগে থেকেই ঠিকঠাক এসব। টিকিটও কাটা। হঠাৎ এক রাতে দাদাভাইয়ের ফোন। ‘তোরাও চল ভাইজাগ, আমরা চেন্নাই থেকে চলে আসব। পাশাপাশি দুটো ডাবল রুম বুক করে ফেল।’

অনুপম ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিল। টিকিট পাওয়া অসম্ভব, কুমকুম আজকাল কোথাও বেরোতেই চায় না, মিষ্টিদের আসার কথা সামনে। দাদাভাইয়ের জোরের কাছে কোনও আপত্তিই টেকেনি।

যাদের জোরাজুরিতে এখানে আসা, তারা অনেক জায়গা স্রেফ গাড়িতে বসেই দেখে নিচ্ছে। কুমকুমের মন ভালো করার পাশাপাশি অনুপম আর কুমকুমকে খানিকক্ষণ একলা ছেড়ে দেওয়ার এক কৌতুকও কি কাজ করছে না ওদের মধ্যে?

অথচ অনুপম এখন তার ধারেকাছেও নেই। খটখটে রোদ্দুরে, শুনসান ইরাডা বিচে সে একরকম একাই দাঁড়িয়ে, অনুপম সেই কোথায় পাহাড় ঘেঁষে বড়ো বড়ো পাথর টপকে টপকে চলেছে। ওখানে নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া আছে। থাক, কুমকুম যাবে না। ওই পাথর সে টপকাতে পারবে না। তাছাড়া কাঁকড়ার জ্বালা সে কি কম বুঝছে? বুকের মধ্যেটা সবসময় জ্বলে যাচ্ছে। মিষ্টিকে ছেড়ে থাকতে এত কষ্ট হবে আগে বুঝতে পারেনি তো।

সানগ্লাসটা খোলে কুমকুম। একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। চোখ মোছে। এই এত বড়ো একটা তটে সে প্রায় একা– যেমন একা ওই আকাশ, দুপুরের পড়ন্ত রোদ। অনুপম দূরে যেতে যেতে একটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে গেছে। এত ছোট্ট, যেন আঙুল দিয়ে মুছে ফেলা যায়।

কুমকুমের মনে পড়ল তার কাঁধের ব্যাগে একটা বায়নোকুলার আছে, বার করলেই হয়। এটা মিষ্টির খুব আদরের জিনিস। বাবার কাছে বায়না করে আদায় করেছিল। অনুপম তাই বলে বায়নোকুলার নয়, বায়নাকুলার। এত প্রিয়, তবু নিয়ে যায়নি মিষ্টি যাবার সময়। এখন আরও কত নতুন মডেল বেরিয়েছে। কত পাওয়ারফুল। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। মিষ্টি কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট ছিল। মেয়েটা কখনও সাধ্যাতীত জিনিসের বায়না করেনি। জানত, বাবার মাপা রোজগার। মা কত হিসেব করে চলে।

সেবার পুজোয় কত দ্বিধা করে একটা আনারকলি চুড়িদার চাইল। তাও অর্ধেক টাকা নিজের জমানো ফান্ড থেকে দিল। সেই সাধের চুড়িদারও নিয়ে যায়নি মেয়ে।

‘আরে এখানে থাক। আমি আসব তো মাঝে মাঝে। এসে থাকব। তখন কি সব বয়ে বয়ে আনব? নাকি ভাবছ একেবারে বিদায় করে দিচ্ছ?’

কত দূরে বিয়ে হল, তাও বায়না ধরেনি কাছে দাও বলে। হয়তো দিল্লি বলেই করেনি। বছর আটেক তো ওখানেই কেটেছে। এখানেই বরং ওর ভালো লাগত না। দমদমের ঘিঞ্জি রাস্তা, নোংরা, জ্যাম কোনওদিনই মানিয়ে নিতে পারেনি।

যতই চেনা জায়গা হোক, তবু কুমকুমের বুক কাঁপে। কী যে সব হচ্ছে। সেদিন বাসের মধ্যে ২০-২১ বছরের মেয়েটা, মিষ্টিরই বয়সি…! বায়নোকুলার চোখে লাগায় কুমকুম। অনুপমকে খোঁজে। কোথায় অনুপম? তার কোনও চিহ্ন নেই। সে খানিকটা আনমনে সমুদ্র, আকাশ, নারকেলের সারি দেখে যায়। হঠাৎ তার বায়নোকুলার থমকে যায় একটা বিন্দুতে। এই ইরাডা বিচে সে তাহলে একা নয়। ওই তো গোলাপি ফ্রক পরা দস্যি মেয়েটা দৌড়োচ্ছে, পেছন পেছন ছুটছে তার মা। মোটাসোটা চেহারার, সে দৌড়ে বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। কুমকুমের চোখে হাসি খেলে যায়।

ওই তো দশ-পনেরো বছর আগের কুমকুম। সে অমনিই মোটা চিরকাল, আর মিষ্টি বরাবরই রোগা-পাতলা। তার খুব কৌতুহল, বিয়ের জল মিষ্টির গায়ে লাগে কিনা। রজতরা প্রবাসী বাঙালি, ভিলাইয়ের। ওদের খাবার ধরনটাও অবাঙালিদের মতো হয়ে গেছে। ছোলে, রাজমা, কালি ডাল, পনির মশলা। গাদাগুচ্ছের ঘি আর প্যাকেটের মশলা ঢাললেই রান্না হয়ে গেল। মাছ প্রায় খেতেই পায় না মেয়েটা। রজত রুই ছাড়া মাছ চেনেও না কিছু। তাতেও মেয়ের কোনও অভিযোগ নেই। যখনই ফোন করে কুমকুম, তখনই মেয়ে ওইসব আগড়ম-বাগড়ম রাঁধছে। কী রেঁধেছে যেন বলল সকালে, ‘ছোলে চাউল!’ ইস্! পারশের ঝাল খেতে কি যে ভালোবাসত!

দাদাভাই আর দিদিভাই তাদের সঙ্গেই ফিরবে। কুমকুম ভালো করেই জানে, ফেরার পথে ট্যাক্সি থেকে বাজারমোড়েই নেমে যাবে অনুপম, একরাশ বাজার করে ফিরবে। এমন নয় যে এখানে এসে তারা দক্ষিণী তেঁতুলগোলা খাবার খেয়েছে। বাঙালি হোটেল, ভাত-মাছ চলেছে দুবেলাই। কিন্তু ওই যে– বাই। আর আনবেও সেই মিষ্টির প্রিয় মাছগুলোই, পারশে, পমফ্রেট, ভেটকি– সেগুলো ধুতে ধুতে, হলুদ মাখাতে মাখাতে, তেলে ছাড়তে ছাড়তে খানিকটা কেঁদে নেবে কুমকুম। দুপুরে একা ঘরে খেতে বসে সে মাছ কিছুতেই মুখে তুলতে পারবে না, শুধু নাড়াচাড়া করবে। দুপুরে তো একবার ফোন করবেই মিষ্টি। খেয়ে উঠতে উঠতে আসবেই ওর ফোন।

‘খেয়েছ তো? নাকি শুধু কেঁদেছ?’

‘খেয়েছি রে বেটা খেয়েছি। আজ সব তোর ফেভারিট ডিশ। কলমি শাক, পোস্ত আর পারশের ঝাল।’

‘পারশে! সরষে দিয়ে করেছ তো?’ প্রায় লাফিয়ে ওঠে মিষ্টি। এত কষ্ট হয় তখন। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

‘জানো মা, আমি কী খেলাম?’ শোনার কোনও উৎসাহ থাকে না কুমকুমের। সেই তো ঘি জবজবে ডাল, নয় পনির, বড়ো জোর আন্ডা কারি। রাতে ধরাবাঁধা চিকেন। তবে মঙ্গলবার বাধ্যতামূলক নিরামিষ। ওখানে গিয়ে হনুমানের পুজো ধরেছে মিষ্টি, পাশের ফ্ল্যাটের একটা মেয়ের দেখাদেখি। হনুমানচালিশা না পড়ে মেয়ে জল খায় না। ভাবো! মাছ তো পনেরো দিনে একবার আসে, তাও রুই। কুমকুম তবু ক্ষীণ গলায় জিগ্যেস করে, ‘কী খেলি বেটা?’

‘ভাপা ইলিশ।’

‘ভাপা ইলিশ!’ চমকে ওঠে কুমকুম। কে আনল আর কেই বা রাঁধল!

‘তুমি ভাবছ রজত ইলিশ কিনেছে? চিনলে তো। ওই যে পাশের ফ্ল্যাটে শম্পা আছে না, ওরা খুব মাছ খায় মা। আর কি মুশকিল জানো, প্রায় দুপুরেই আমাকে দিয়ে যাবে। আমি ওকে একদিন ভালো করে খাওয়াব ভাবছি।’

‘খাওয়াস।’

‘জানো মা, ও আসা থেকে একদিনও বাপের বাড়ি যায়নি। তিন বছর! জাস্ট ভাবো। খুব কাঁদে জানো মা। মাকে ছেড়ে থাকেনি তো কখনও। একটা ভাই আছে। ক্লাস এইটে পড়ে।’

কুমকুম অস্ফুটে বলে ‘আমার যে তাও নেই বেটা। আমি কি নিয়ে থাকি বলত?’

রোজ দুপুরেই এভাবে ভাতে অনেকখানি অশ্রু মিশে যায়। ওখানে মিষ্টি কেমন থাকে, সত্যি কেমন আছে কে জানে। যা চাপা মেয়ে। সারাক্ষণই অন্যদের কথা বলে যায়। রজতের কথা, শম্পার কথা। আর কি উত্তেজিত গলা, যেন কি দারুণ একটা খবর দিচ্ছে মাকে।

কুমকুমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। মিষ্টি আসলে এখনও ছেলেমানুষই থেকে গেছে। সাত তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটা না দিলে যেন চলত না। অনুপমের যত বাড়াবাড়ি। কি, না ইন্টারনেটে ম্যাচিং, একেবারে রাজযোটক।

ইন্টারনেট কি ঠিকুজিকুষ্ঠি– এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই কুমকুমের। সে শুধু চেয়েছিল মেয়েটা কাছাকাছি থাক। একটাই তো সন্তান। একদম বাড়ির পাশে চায়নি। দু-তিন ঘন্টায় পৌঁছে গিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে আবার ফিরে আসা যাবে– এমনটা হলে কি ক্ষতি হতো! তা নয়, একেবারে দিল্লি! কথায় বলে, ‘কোনওকালে নেই ষষ্টীপুজো, একেবারে দশভুজো!’

অবশ্য দিল্লি একেবারে অচেনা জায়গা নয় তাদের, বছর আষ্টেক ছিল তারা ওখানে, আর্মি কোয়ার্টারে। মিষ্টি তো ওখানেই বড়ো হল। স্কুলে পড়ল বছর চারেক। যদিও কুমকুম কলকাতায় ফেরার জন্যে ছটফট করত। অনুপমদের বাড়িটাকে কেন্দ্র করে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকলে সেই বৃত্তের পরিসীমার মধ্যেই তার সব আত্মজন– বাপের বাড়ি, দিদি, বোন, দুই ননদ। অনুপমের অবশ্য সেরকম টান ছিল না ফেরার। ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। হস্টেলে মানুষ। অল্প বয়সেই মিলিটারিতে ঢুকেছে। লোকটার যেন কোনও শেকড় নেই। নইলে একমাত্র মেয়েকে কেউ অতদূরে বিয়ে দেয়? রজতকে নাকি আবার কানাডায় পাঠাবে অফিস থেকে। মিষ্টিকে না নিয়ে কি ও যাবে? আর একবার ওখানে গেলে কেউ ফেরে না, জানে কুমকুম। এই তো তার মাসতুতো দাদা, বাবুলদা, তার ছেলে-বউ মন্ট্রিয়েল-এ চলে গেল। যাবার সময় বলল, দু’বছরের বন্ড, শেষ হলেই চলে আসবে। তারপর কত দু’বছর কেটে গেল। ফিরল না। এমনকী বাবুলদা যখন চলে গেল, তখনও আসতে পারল না। এল তিনমাস পরে শীতে। ওদের আর এ দেশের সামার সহ্য হয় না। তার মিষ্টিও যদি… বুকটা ধড়াস করে ওঠে কুমকুমের।

ধুৎ! কত বাড়িয়ে ভেবে ফেলছে সে। অনুপম বলে ফালতু চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিতে। তার হার্ট একটু কমজোরি। ইদানীং একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। গ্যাসের ব্যথা ভেবে এতদিন পাত্তা দেয়নি সে। এবার ভাবছে ফিরে গিয়ে কার্ডিওলজিস্ট দেখাবে। দিদিদের পাড়ায় বসে ডা. মনোজিৎ জানা। দেবতুল্য ডাক্তার।

বায়নোকুলারটা আবার চোখে লাগিয়ে চমকে ওঠে কুমকুম। একি! বাচ্চা মেয়েটা যে ক্রমশ জলে নেমে যাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই বেটা, বেটা, যায় না, ঢেউ টেনে নিয়ে যাবে।’

মা ছাড়া অন্য কারও স্বরে থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা। দুটো বিনুনি, চুলে বার্বি ক্লিপ, গোলাপি রিবনে ওকে অবিকল প্রজাপতির মতো দেখায়। অনুপম এই প্রজাপতিটাকে না দেখে লাল কাঁকড়ার খোঁজে গেছে। পারেও বাবা!

সে আবার বলে ‘এসো বেটা, চকোলেট দেব, এসো।’ মিষ্টির জন্যে ব্যাগে চকোলেট রাখার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে কুমকুমের। এই সব জার্নিতে চকোলেট খুব কাজে দেয়। আরাকু ভ্যালির ওই লম্বা রাস্তায় চকোলেট খেয়ে খেয়েই তো সে খিদে সামলেছে। বুকের ব্যথাটার জন্যে সে বোরা কেভ-এ নামেনি। দাদাভাই, দিদিভাই তো নয়ই। অতগুলো সিঁড়ি ভাঙা ওদের পক্ষে অসম্ভব। ওরা দুজনে কফি খেল আর সে বসে বসে চকোলেট। দাদাভাই কিনে দিয়েছিলেন কফি চকোলেটের অনেকগুলো স্ল্যাব আরাকু থেকে। তারই একটা বার করে মেয়েটাকে দেখাল কুমকুম। চকোলেটের টানেই হোক কিংবা অচেনা মানুষের আকর্ষণে– মেয়েটা ছুটে ছুটে তীরের দিকে আসছিল। ওর মা-ও এসে পড়ল থপথপ করে। ‘দেখছেন তো? এই মেয়ে নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় বলুন?’

কুমকুম হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মেয়েটা এসে ততক্ষণে ওর বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

‘তুমি ব্যাগে চকোলেট রাখো কার জন্যে?’ কুমকুমের আবার চোখে জল আসছিল। সেটা সামলে সে চকোলেটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যে বেটা।’

‘মা দ্যাখো, আন্টি আমাকে বেটা বলছে!’

‘আপনারা ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে থাকেন বুঝি?’

কুমকুম জবাব দেবার আগেই অনুপম ডাকল ‘চলে এসো, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।’

অনুপম কখন লাল কাঁকড়া ছেড়ে এদিকে চলে এসেছে খেয়াল করেনি কুমকুম। দেখতে পেয়ে সে বলল ‘এদিকে শোনো না। দ্যাখো এই নান্হি পরিটাকে। ছোটোবেলায় মিষ্টি ঠিক এইরকম ছিল না?’

অনুপম রুক্ষস্বরে বলল ‘চলে এসো, এরপর লাইটহাউস বন্ধ হয়ে যাবে।’

কুমকুম অপ্রস্তুত হেসে বলল ‘চলি ভাই, এই ড্রাইভারগুলো সব ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসে। চলি রে বেটা।’ মেয়েটার গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না কুমকুম। বালির ওপর দিয়ে ওর দ্রুত হাঁটার চেষ্টা দেখে ফ্যাকাশে হাসল মা। মেয়ে তার হাত টেনে বলল ‘রান। আমাদেরও তো লাইটহাউস চড়তে হবে।’

কুমকুমের মুড অফ হয়ে গেছিল। অনুপমটা মাঝে মাঝে এত অভদ্র হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছিল দাদাভাই, দিদিভাইয়ের সঙ্গে বসে থাকতে। কিন্তু অনুপম তাকে বসতে দিলে তো? লাইটহাউস নাকি বন্ধ হয়ে যাবে।

কুমকুমের বুকে আবার ব্যথা করছিল। সে আর কিছু বলল না। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বহু কষ্টে ওপরে উঠে সে অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেল। সমুদ্রটা কি অপূর্ব লাগছে এখান থেকে! পড়ন্ত আলোর আভা জলের ওপর। কিন্তু কি হাওয়া, বাব্বা! তার মতো মোটা মানুষকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হয়। ভয়ে সে বসে পড়ল রেলিং ধরে। বসে বসে আরও ভালো লাগছিল সব কিছু। এই প্রথম বেড়ানোটা সে এনজয় করছিল। মিষ্টির কথা মনে পড়ে কোনও কষ্ট হচ্ছিল না তার। মনে হচ্ছিল, সব মানুষেরই মাঝে মাঝে এতটা উঁচু থেকে পৃথিবীটাকে দেখা দরকার। দু-তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল ওপাশে। মেয়েটা তার সাদা ওড়না ধরে আছে। ওড়নাটা পতপত করে উড়ছে, ছেলেটা ছবি তুলছে। কুমকুম কৌতুকের সঙ্গে দেখছিল। এমন সময় একটা দুষ্টু-দুষ্টু মুখ লাইটহাউসের দরজা দিয়ে উঁকি দিল।

‘আন্টি!’

কুমকুমের বুক ধড়াস করে উঠল ‘বেটা! তুই একা এসেছিস?’

মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ে লাফাতে লাফাতে বলল ‘মা উঠতেই পারছে না। যা মোটা! তোমার থেকেও মোটা!’

কুমকুম ভয় পেয়ে বলল ‘বসে পড় বেটা, তুই যা রোগা, হাওয়ায় উড়ে যাবি!’

মেয়েটা কোনও কথাই শোনার পাত্রী নয়। সে পুরোটা ঘুরে দেখবে। নীচ থেকে ওর মা’র কাতর গলা শোনা গেল।

‘একটু দেখবেন প্লিজ মেয়েটাকে। আমি হাফ উঠে আর উঠতে পারছি না।’

অনুপম এক মনে ছবি তুলছিল। হঠাৎ সে ঘুরে মেয়েটার হাত চেপে ধরল। কুমকুমের বুক ঢিপঢিপ করছিল। আবার না কড়া কড়া কথা বলে অনুপম। অনুপমের হাতে বন্দি মেয়েটা ছটফট করছিল যেন দৈত্যের হাতের মুঠোয় একটা পাখি। হঠাৎ অনুপম হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ল। এখন ওর আর বাচ্চাটার মাথা সমান সমান। মেয়েটা অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। কুমকুম শুনল অনুপম বলছে ‘লাইটহাউস কাকে বলে জানিস?’

‘ওই যে আলো দেখায়।’

‘কাদের?’

‘শিপগুলো যখন নাইটে কিছু দেখতে পায় না।’

‘দেখবি, লাইটহাউস কী করে কাজ করে?’

অমনি মেয়েটার চোখ চকচক করে উঠল। সে কুমকুমের দিকে চেয়ে হাসল। জয়ের হাসি। তারপর অনুপমের হাত ধরে দরজা গলে কলকব্জা বুঝতে গেল। কুমকুমের দু’পা টনটন করছিল। সে দু’পা ছড়িয়ে বসল। মেয়েটার ওড়না উড়ে গেছে। সেই নিয়ে কি ভীষণ হাসাহাসি ওদের। অচেনা ভাষা, তবু ওদের কথাগুলো ছুঁতে পারছিল কুমকুম। দূরে তখন সূর্য ডুবছে। তবু চারপাশে যথেষ্ট আলো।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব