প্রতীক্ষাপ্রান্তর

অসীম টুরে গেছে পাঁচ দিনের জন্য, তিতির কলেজে। কারেন্টও নেই। একা বাড়িতে লম্বা দুপুরটা কাটতে চাইছিল না। আজকের কাগজটা নিয়ে বিছানায় গড়াচ্ছিল নন্দিনী। এ পাতা থেকে ও পাতায় এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই চোখটা পার্সোনাল কলামে আটকে গেল। ডান দিকের কোণে একদম তলার দিকে ছোটো ছোটো কয়েকটা অক্ষর। আলাদা করে সেইভাবে চোখে পড়ার কথাই নয়। তবু পড়ল। হয়তো পড়ার ছিল বলেই। ‘জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন অফ হ্যাপি নুক, জোরহাট– পাসড অ্যাওয়ে পিসফুলি, অ্যাট হার রেসিডেন্স। ফিউনারেল মাস অন’…

জেনিফার ম্যাকলেন? জোরহাটের জেনিফার ম্যাকলেন? এই নামে অনেকদিন আগে একজনকে চিনত না নন্দিনী? হ্যাপি নুকের জেনিফার ম্যাকলেন বলতে তো একজনের কথাই মনে পড়ে। মিস ম্যাকলেন তাহলে এতদিনে মারা গেলেন। কে দিল নোটিসটি? চার্চ থেকেই হবে নিশ্চয়ই। নন্দিনী অন্যমনস্কভাবে হাতের কাগজটা ভাঁজ করে। আশ্চর্য, একেবারে ভুলেই গিয়েছিল মহিলার কথা।

অসীমের পোস্টিং তখন ছিল অসমের জোরহাটে। জোরহাট টাউন থেকে একটু দূরে কিছুটা ভেতরের দিকে ছিল ওদের বাড়িটা। বেশ নির্জনই ছিল পাড়াটা সেই সময়। প্রচুর জায়গা, বাগান, ফলের গাছ-টাছ নিয়ে এক একটা বাড়ি। এরকমই একটা বাড়ির একতলাটা অসীমের অফিস থেকে তাদের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।

কলকাতায় ও রকম বাড়ি স্বপ্নের অতীত। বিরাট বড়ো বড়ো চারখানা ঘর, আলো ভরা বাথরুম, বাদশাহি রান্নাঘর, সঙ্গে আলাদা প্যান্ট্রি, চারদিক ঘুরিয়ে কাঠের জাফরি ঝোলানো টানা বারান্দা, মানে এককথায় এলাহি ব্যাপার। কিন্তু এত বড়ো বাড়িতে সারাদিন একা একা কাটাতে নন্দিনীর দম বন্ধ হয়ে আসত। তাদের মানিকতলার বাড়িও যথেষ্ট বড়ো। কিন্তু সেখানে ছিল কাকা-কাকি, জ্যেঠা-জেঠি তুতো ভাইবোন সবাইকে নিয়ে বিশাল যৌথ পরিবার। চেষ্টা করলেও ওবাড়িতে একা থাকা যেত না।

সেই হট্টমালার দেশ থেকে বিয়ে হয়ে এসে পড়ল এই ভূতবাংলোয়। ঘর মোছা, বাসন মাজার জন্য একজন আর কাপড়চোপড় কাচার জন্য একজন, এই দু’জন স্থানীয় আদিবাসী কাজের মেয়ে ছিল, কিন্তু সারাদিনের জন্য নয়। সকাল সকাল এসে দশটার মধ্যে সব কাজ সেরে তারা চলে যেত। কতটুকুই বা কাজ থাকত দুজনের সংসারে। তাদের ওদিককার ভাষাও নন্দিনী সবটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারত না। ফলে সঙ্গী হিসেবে তারা খুব একটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি।

তিতির হয়নি তখনও। অসীম অফিসে বেরিয়ে গেলে এত বড়ো বাড়িতে একলা নন্দিনী। শূন্যতা যেন বিশাল হাঁ করে তাকে গিলে খেতে এগিয়ে আসত। উপরতলায় কোনও ভাড়াটেও ছিল না যে গল্প করে সময় কাটাবে। পাড়াটাও এত চুপচাপ। লোকজন বাস করে বলে বোঝাই মুশকিল। কলকাতার শোরগোলের একেবারে বিপরীত। কী করে যে দিনগুলো কাটত এখন ভাবলেও অবাক লাগে। তখনই কোনও এক সময় মিস ম্যাকলেনের সঙ্গে নন্দিনীর পরিচয়।

নন্দিনীদের বাড়িটার ঠিক পাশেই একটা একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটো বাড়ি ছিল। রংচটা, ধুলোটে। চওড়া কাঠের গেটের রং এককালে হয়তো সাদাই ছিল, বা অন্য কিছুও হতে পারে, বলা মুশকিল, কারণ বহুদিনের অযত্নে অবহেলায় সেটা একটা অবর্ণনীয় শেড ধরে নিয়েছিল। কার্নিশে যেখানে সেখানে বেয়াড়া বট অশ্বত্থের চারার যথেচ্ছ জবরদখল অভিযান। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় বৃষ্টি গড়ানো শ্যাওলাটে সবুজ দাগ। গেটের পাশে বহু বছরের ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া ফলকে কষ্ট করে পড়া যায় ‘হ্যাপি নুক’। বাগান হয়তো কোনওকালে একটা ছিল, নন্দিনীর চোখে যেটা পড়েছিল তাকে বাগানের অপভ্রংশও বলা চলে না।

এই বাড়িতেই থাকতেন জেনিফার ম্যাকলেন। একাই। কাজের লোকটোকও কেউ ছিল না। অন্তত নন্দিনী তো কোনওদিন কাউকে থাকতেও দেখেনি, আসতে যেতেও দেখেনি। সঙ্গী বলতে একটি বৃদ্ধ পমেরিয়ান কুকুর। এত দিন পরে হঠাৎ তার নামটাও আজ নন্দিনীর মনে পড়ে গেল। পিক্সি। তাকে নিয়ে রোজ সকাল-বিকেল হাঁটতে বেরোতেন। চুপচাপ মাথা নীচু করে কোনও দিকে না তাকিয়ে একটু ঝুঁকে হেঁটে যেতেন, আবার ওই ভাবেই বাড়ি ফিরে আসতেন। যতদিন নন্দিনী ছিল ওখানে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ওই রুটিনে কোনওদিন ছেদ পড়তে দেখেনি।

মিস ম্যাকলেনের মতো নিরুত্তাপ মানুষ নন্দিনী আজ পর্যন্ত আর দ্বিতীয় একজন দেখল না। কোনও মানুষ যে তার চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে এতটাই নিরাসক্ত হতে পারে ভাবা যায় না। কারমেল কনভেন্টে ইংরেজি পড়াতেন। শোনা কথা, ছাত্রীরা নাকি আড়ালে বলত ‘আইসবার্গ’। স্বভাবের জন্য না চেহারার জন্য সেটা জানা যায়নি। তবে দুদিক থেকেই নামটা মানানসই।

রোগাপাতলা ছোটোখাটো চেহারা। গায়ের রং পুরোনো খবরের কাগজের মতো। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখ। পাতলা ফ্যাকাশে ঠোঁট। ফ্যাকাশে সবজেটে চোখের মণি। ফ্যাকাশে বাদামি চুল। চিরটাকাল পরনে হালকা রঙের ছাঁটকাটহীন ঢোল্লা হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ফ্রক। সব মিলিয়ে একজন ফ্যাকাশে মানুষ। কেউ ডেকে কথা বললে উত্তরে বাধ্য হয়ে ভদ্রতাসূচক দু-চারটে কথা যা বলার বলতেন, নইলে চুপচাপ। গলার আওয়াজও চেহারার মতোই নিষ্প্রভ, নিরুত্তেজ। কোনও ওঠাপড়া নেই। স্কুল, বাড়ি আর পিক্সির মধ্যেই ওঁর জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতি রবিবার অবশ্য নিয়ম করে চার্চে যেতেন। আর প্রতি মাসে দিন দুয়েক বাড়ি তালা বন্ধ রেখে সম্ভবত গৃহস্থালির টুকটাক কেনাকাটার জন্য টাউনেও যেতেন। কারণ এবং গন্তব্যস্থলটা লোকের ধরে নেওয়া। কোনওটাই কারও সঠিক জানা ছিল না, কারণ উনিও কোনওদিন কাউকে ডেকে বলেননি, আর ওঁর কাছে কোনওদিন কেউ জানতেও চায়নি। কাকেই বা বলবেন, কেই বা জানতে চাইবে। কুকুরটি ছাড়া তো তিন কুলে কোথাও কেউ ছিলও না। অন্তত আছে বলে কেউ জানত না। উনি যে দিনগুলো বাড়ির বাইরে থাকতেন সেই কটা দিনের জন্য পিক্সি চার্চের ফাদার অ্যান্টনির কাছে থাকতে যেত।

নন্দিনী বলতে গেলে সেধেই আলাপ করেছিল। ওঁর বাড়িতেও গিয়েছিল কয়েকবার। উনি অবশ্য বিশেষ আসতেন না। দেখা হলে বেড়ার পাশে বা গেটের ওধারে দাঁড়িয়েই সামান্য দুচারটে সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে যেতেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে স্পষ্টই অনীহা ছিল। তবে পরের দিকে মাঝেমধ্যে কেক বা বিস্কিট গোছের কিছু ভালোমন্দ বানালে ডাক দিতেন। নন্দিনী খেয়েও আসত, নিয়েও আসত। জিজ্ঞাসা করে করে শিখেও নিয়েছিল ওঁর কাছ থেকে নানারকম।

একদিন, শুধু একদিনই মিস জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেনকে অন্যরকম দেখেছিল নন্দিনী। একটা পুরো দিন।

সেদিন সকালে একটু বেলার দিকে মিস ম্যাকলেনের গেটের লেটারবক্সে পিওন চিঠি ফেলে গিয়েছিল একটা। নন্দিনী নিজের শোবার ঘরে কী যেন করছিল। জানালা দিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে মনে মনে একটু অবাকই হয়েছিল। এতদিনের মধ্যে কোনও দিনও ওবাড়িতে কোনও চিঠিপত্র আসতে দেখেনি সে। পিক্সির ডাকাডাকির আওয়াজ পেয়েই আসলে তার চোখ বাইরের দিকে গিয়েছিল। সে বেচারাও পিওন নামক খাকি পোশাকধারী অপরিচিত জীবটিকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পাহারাদারির সহজাত সারমেয় প্রবৃত্তি পালনের তাগিদে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরে মিস ম্যাকলেনের ভাবভঙ্গি দেখে নন্দিনীর অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল যেন। পিক্সির চিৎকারে উনিও বেরিয়ে এসেছিলেন। পিওন চলে যেতে যেতে হাতের ইশারা করে বুঝিয়ে দিল চিঠি দিয়ে গেছে। উনি খানিকক্ষণ যেন কিছু না বুঝে পিওনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলেন। তারপরে পায়ে পায়ে গেটের দিকে এগোলেন।

নন্দিনী ঘটনাটা কী ঘটছে দেখার জন্য জানালার পাশ থেকে সরেনি, ওখান থেকেই তাকিয়ে ছিল। মিস ম্যাকলেন লেটারবক্স থেকে চিঠিটা বার করে একটু হতবুদ্ধি ভাবে প্রথমটা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাদামি কাগজের খামটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে উলটেপালটে দেখছিলেন, বোঝার চেষ্টাই করছিলেন হয়তো তাঁকে কে চিঠি লিখতে পারে। তারপরে ওখানে দাঁড়িয়েই খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলেন। নন্দিনী আশ্চর্য হয়ে দেখল চিঠিটা পড়তে পড়তেই ওঁর হাবভাব কেমন যেন পালটে গেল। দূর থেকেও সে বুঝতে পারছিল মহিলা থরথর করে কাঁপছেন। হাত বাড়িয়ে একবার গেটটা ধরারও চেষ্টা করলেন। নন্দিনীর ভয় হচ্ছিল উনি পড়ে-টড়ে না যান। হয়তো কোনও খারাপ খবর আছে চিঠিতে। তারপরে আরও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল উনি ওদের বাড়ির দিকেই আসছেন।

মিস ম্যাকলেন বেল বাজানোর আগেই নন্দিনী বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন উনি। মুখচোখ যেন কেমন কেমন। নাকের তলায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। কিছু না বলে অকস্মাৎ নন্দিনীর দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন। নন্দিনীও কিছু না বুঝেই ওঁর হাত থেকে ওটা নিয়ে নিল। পড়তে ইশারা করছিলেন মিস ম্যাকলেন। তখনও কথা বলতে পারছিলেন না। নন্দিনী আগে ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসাল। তাড়াতাড়ি এক গ্লাস খাবার জল এনে দিল। উনি এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলেন। তারপরে কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়ে সোফার পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। নন্দিনী নজর ফেরাল হাতে ধরা চিঠিটার দিকে।

চিঠিটা লিখেছেন কোনও এক ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। ইংরেজিতে লেখা চিঠির বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়–

‘ডিয়ার জেনিফার,

আশা করি ভালোই আছ। তোমার জন্য সুখবর আছে একটা। তুমি হয়তো জেনে খুশি হবে যে ফ্র্যাংকলিনের মধ্যে আজকাল আগের থেকে অনেক বেশি উন্নতি দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ওর ঘরে রাখা তোমার ছবিটা দেখে তোমাকে চিনতে পেরেছিল। কাল নিজে থেকেই বলল, জেনি খুব ভালো চকোলেট কেক বানায়। আমার মনে হচ্ছে নতুন ওষুধটায় বোধহয় কাজ হচ্ছে।

যে জন্য তোমাকে চিঠিটা লেখা। আমি ভাবছিলাম এ মাসে তুমি না এসে যদি আমিই ফ্র্যাংকলিনকে নিয়ে তোমার কাছে যাই তাহলে কেমন হয়? একটা চেঞ্জও হবে ওর। তাই এই বৃহস্পতিবার বিকেলে তোমার বাড়ি আসছি আমরা। তৈরি থেকো।’ তারপরে আবার পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন– ‘খুব বেশি কিছু আশা কোরো না। এই রিঅ্যাকশনগুলো প্রায়ই খুব একটা পার্মানেন্ট হয় না। তবুও লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট।’

বৃহস্পতিবার? বৃহস্পতিবার তো আজকেই। কিন্তু কে এই ডাক্তার বড়ুয়া? যে ফ্র্যাংকলিনের কথা চিঠিতে আছে সে-ই বা কে? আর এই চিঠি পেয়ে মিস ম্যাকলেনেরই বা অমন অবস্থা কেন হল? নন্দিনী সত্যি কিছুই বুঝতে পারে না। এ প্রহেলিকার উত্তর একমাত্র মিস ম্যাকলেনই জানেন। ধাঁধায় পড়ে সে মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায়। আর অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন কেমন অদ্ভুত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেনও, আবার নেইও। ওঁর ওই ফ্যাকাশে সবুজ চোখের দৃষ্টি যেন নন্দিনীকে ভেদ করে, এ ঘর ছাড়িয়ে কোথায় কতদূরে উধাও হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে একটি দুটি করে কথা বলতে আরম্ভ করেন জেনিফার ম্যাকলেন। তারপরে বাঁধভাঙা বন্যার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক দিনের অনেক জমে থাকা কথা। গলার আওয়াজ থরথর করে কাঁপে। আর নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে এক আশ্চর্য কাহিনি। যাকে কাহিনি না বলে রূপকথা বলাই বোধহয় উচিত।

আসাম চা বাগিচার দেশ। আর চা বাগিচা মানেই প্ল্যান্টার। প্রথম দিকে খাঁটি সাহেবরাই বাগান চালাত। পরে আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। সে জায়গায় আসতে শুরু করে দেশি সাহেবরা। এ কাহিনির যখন শুরু তখন সবে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিছু কিছু বাগানে দু-একজন সাদাচামড়া সাহেব তখনও ছিল। তাদেরই একজন রঙালি টি এস্টেটের ছোটো সাহেব প্যাট্রিক ম্যাকলেন। প্যাডি সাহেব। প্যাডি সাহেবকে সবাই চিনত দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ তার দিলদরিয়া স্বভাব। গায়ের রংটা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত ঠিকই, তা নইলে এদেশের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশায় সে, সাহেব আর নেটিভের কোনও ফারাকই রাখত না। কত প্ল্যান্টারদের কত অত্যাচারের কাহিনি সে সময় বাগানের কুলি কামিনদের মুখে মুখে ফিরত, কিন্তু প্যাডি সাহেব সম্বন্ধে কেউ কোনওদিনও অমন কথা ভাবতেও পারত না।

আর দু-নম্বর কারণ তার মা-মরা একমাত্র মেয়ে জেনি মেমসাহেব। জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন। বলতে গেলে সেটাই তখন সাহেবকে চেনার প্রধান কারণ। বিশেষ করে উঠতি যুবকদের মধ্যে। পাহাড়ি ঝরনার মতো চঞ্চল, পরিদের মতো সুন্দর উনিশ বছরের জেনি মেমসাহেবকে দেখলে অতি বড়ো গোমড়ামুখোদেরও মন ভালো হয়ে যায়। সেই সময় আশপাশের ছোটোবড়ো যত গার্ডেনের সব ইয়ং ম্যানদের জীবনের একটাই লক্ষ্য, কে জেনিকে একটু খুশি করতে পারে। পিকনিক, টি-পার্টি, ক্রিসমাস ড্যান্স– সবের মধ্যমণি জেনি ম্যাকলেন। মিস স্টুয়ার্ট, মিস ব্রাউনদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। জেনির সঙ্গে একটা ড্যান্স মানে জীবন সার্থক। জেনি কারও দিকে চেয়ে একটু হাসলে সে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ভাবতে একটুও দ্বিধা করে না।

জেনি কাউকে নিরাশ করে না। কিন্তু কাউকে আশাও দেয় না। আজ ব্রিজ পার্টিতে ডিকি রবার্টসনকে পার্টনার করলে পরের দিন নাচের ফ্লোরে তার সঙ্গী হয় জেরি উইলিয়ামস। কেউ তার কাছে বিশেষ নয়। সবাই তার ভালো বন্ধু, ব্যাস।

বিশেষ তার একজনই। সেই ছেলেবেলা থেকেই। ফ্র্যাংকি। তখন ছিল শুধুই ফ্র্যাংকি। বড়ো হয়ে হল টগবগে তরুণ আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন। প্যাডি সাহেবের বন্ধু ফ্রেডি ক্লিফটনের একমাত্র ছেলে। খাঁটি সাহেব ছিল না অবশ্য সে।

ফ্রেডি ক্লিফটন এদেশে আসার আগে ছিল বার্মায়। আজকাল যে দেশের নাম হয়েছে মায়ানমার। ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডি ক্লিফটন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই বার্মারই এক সুন্দরী মেয়েকে। ফ্র্যাংকি ছিল তাদের ভালোবাসার ফসল। মিশ্র রক্তের সন্তান।

তাতে অবশ্য বাগানের কারও কিছু আসত যেত না। ওখানে অনেকেরই জন্মের ইতিহাস ফ্র্যাংকির মতোই। তাও তো তার মা, পাতা তোলা কামিন ছিল না। যথেষ্ট শিক্ষিত, ধনী ঘরের মেয়ে ছিল তার মা। কেবল বিজাতীয়, বিধর্মীকে বিয়ে করার অপরাধে সে মেয়ের পরিবার তাকে ত্যাগ করে।

ফ্র্যাংকির যখন বারো বছর বয়স তখন তার মা বাবা দুজনেই এক সাংঘাতিক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। এ-দেশে তার আর কেউ ছিল না। বহু দূর আয়ারল্যান্ডে, কখনও-না-দেখা তার এক কাকা ছিল বটে, সে ভাইপোকে নিয়ে যেতে চাইছিল না। ঝুটঝামেলায় না গিয়ে প্যাডি সাহেব ফিউনারেল হয়ে যাবার পর সটান ফ্র্যাংকিকে নিজের কাছে রঙালিতে নিয়ে চলে এসেছিল। জেনির বয়স তখন আট। সেই থেকে জেনি আর ফ্র্যাংকি একসঙ্গেই বড়ো হয়েছে।

দশ বছর বয়স থেকেই জেনি জানত সে ফ্র্যাংকির। কী করে জানত জানে না। কিন্তু জানত। ফ্র্যাংকিও যেমন জানত জেনি তার। একমাত্র তার। তারা দুজন একে-অপরের জন্যই তৈরি। আর কেউ কখনও তাদের মধ্যে আসবে না, আসতে পারে না। এই ধ্রুব সত্যিটা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেই জেনি দশ থেকে উনিশ হয়েছে, ফ্র্যাংকি হয়েছে তেইশ।

‘হি ওয়াজ সাচ আ হ্যান্ডসাম ডেভিল য়ু নো। অ্যান্ড ডেয়ারিং। আর্মি জয়েন করল। ইউনিফর্ম পরে আমার সামনে দাঁড়াত। নানডিনি, বিলিভ মি, আমি মেল্ট করে যেতাম। আমাকে পেছনে বসিয়ে স্পিডে মোটরবাইক চালাত, ভাবতে পারবে না। আই থট মাইসেল্ফ দ্য লাকিয়েস্ট গার্ল অ্যালাইভ।’

নন্দিনী রূপকথা শুনছে। এই মিস ম্যাকলেনকে সে দেখেনি কোনওদিন। মিস ম্যাকলেনের গলায় উনিশের জেনি কথা বলে চলে। গলার আওয়াজ আর কাঁপছে না এখন। সেই কণ্ঠস্বরের সম্মোহনী ওঠাপড়া নন্দিনীকে আবিষ্ট করে ফেলে। রূপকথার নায়িকা স্মৃতিমগ্ন হয়ে নিজের কাহিনি শোনাতে থাকে।

‘সেদিন সানডে ছিল, জানো। আমাদের ফর্মাল এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। ফ্র্যাংকি আমাকে আংটি পরাল। আমি পরালাম ফ্র্যাংকিকে। চার্চে বিয়ের নোটিস পড়ল। তিন মাস পরে আমাদের বিয়ে। উই ওয়্যার সো হ্যাপি দ্যাট ডে।’ হালকা হাসির রেখা জেনিফার ম্যাকলেনের ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

নন্দিনী অবাক বিস্ময়ে মিস ম্যাকলেনের দিকে চেয়ে দেখতে থাকে। তার চোখের সামনে মধ্য চল্লিশের বর্ণহীন মিস ম্যাকলেন আস্তে আস্তে খোলস ঝরিয়ে আদ্যন্ত জেনি হয়ে ওঠে। পুরোনো কাগজের মতো গালে গোলাপি রক্তোচ্ছ্বাস, চোখে পান্নার দ্যুতি।

গুনগুন করে কত দিনের কথা বলে যান মিস ম্যাকলেন। আর নন্দিনীর চোখের সামনে আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে রঙালি টি এস্টেট, জেনি মেমসাহেব আর সুদর্শন, ডাকাবুকো

ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

আর তার পরে সেই রাতের কথা। জেনি আর প্যাডি সাহেবের সঙ্গে ডিনার সেরে ইউনিটে ফিরছিল ক্যাপ্টেন ক্লিফটন। ঠিক কী যে সে রাতে হয়েছিল কেউই জানে না, কিন্তু পরের দিন সকালে রাস্তার পাশে দোমড়ানো মোচড়ানো মোটরবাইকটা ও তার থেকে অনেকটা দূরে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটনের রক্তাক্ত অচৈতন্য শরীরটা দেখেছিল ভোরের পথচলতি বাগানশ্রমিকরা। খুব সম্ভবত কোনও মাতাল লরির ধাক্বায় বাইক শুদ্ধু রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়েছিল ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

‘ওরাই ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পকেটে ডায়ারি ছিল, তাতে আমার ছবি, ঠিকানা ছিল। হাসপাতাল থেকে আমাদের খবর দেয়।’

মাথায় সাংঘাতিক আঘাত লেগেছিল ফ্র্যাংকির। বাঁচার আশাই ছিল না। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ দিন কোমায় অচেতন ছিল সে। তারপরে জ্ঞান যখন ফিরল তখন ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন নিজের নামটুকুও মনে করতে পারে না আর। হাসপাতালের বিছানায় ফ্র্যাংকি তখন শুধুই স্মৃতিহীন, ভাষাহীন এক মানবশরীর মাত্র।

প্যাডি সাহেব অনেক করেছে তখন। মিলিটারির ডাক্তার ছাড়াও আরও বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখিয়েছে। সবারই এক কথা। আশা ছাড়লে চলবে না। সময়, সময়ই করতে পারে যা করবার। ফ্র্যাংকির খুব ভালো বন্ধু ছিল ডাক্তার বড়ুয়া। সে-ও তাই বলে গেছে অহর্নিশ। ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো।

ধৈর্য ধরেছে জেনি। প্যাডি সাহেবের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেছে একদিন, কিন্তু জেনির ভরসা ভাঙেনি। প্যাডি সাহেব অনেক বুঝিয়েছে মেয়েকে, মন পালটাবার অনেক চেষ্টা করেছে, তারপরে একদিন বোধহয় মনের দুঃখেই ফট করে মাথার শিরা ছিঁড়ে ওপরে চলে গেছে।

এই হ্যাপি নুক বাড়িটা অনেকদিন আগে কিনেছিল প্যাডি সাহেব। কখনও কোনও দরকারে বাগান থেকে টাউনে এসে রাত হয়ে গেলে এখানেই থেকে যেত। সাহেব মারা যাবার পর জেনিরও বাগানের পাট চুকে গিয়েছিল। সেই তখন থেকেই জেনি এখানে। সেও আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। এখান থেকে মাসে মাসে হাসপাতাল যেতেও সুবিধে। ধৈর্য ধরে থাকতে থাকতে ফ্র্যাংকির মুখে ধীরে ধীরে একটা দুটো কথা ফুটল। আর দিনে দিনে কখন যেন রঙালির চুলবুলি জেনি মেমসাহেব আস্তে আস্তে সব রং ঝরিয়ে ফ্যাকাশে মিস ম্যাকলেন হয়ে গেল।

সেই ফ্র্যাংকি আজ ডাক্তার বড়ুয়ার সঙ্গে আসছে, জেনির বাড়িতে।

‘তুমি বিকেলে একটু থাকবে আমার সঙ্গে, নানডিনি, প্লিজ? আয়্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। ফ্র্যাংকি এতদিন পরে আসছে আমায় মিট করতে।’ নন্দিনী খুব অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মতো টুকটুকে গোলাপি হয়ে যাচ্ছেন।

বিকেলে মিস ম্যাকলেনকে চেনা যাচ্ছিল না। ঘন সবুজ সিল্কের একটা অপূর্ব ফ্রক পরেছেন। পুরোনো কাটের জামা, কিন্তু কী যে সুন্দর মানিয়েছে ওঁকে। ঝলমল করছেন যেন। নন্দিনী কখনও লক্ষ্যই করেনি, মিস ম্যাকলেনের হাত পায়ের পাতা কী অদ্ভুত সুন্দর। ঝিনুকের মতো পাতলা, শাঁখের মতো মসৃণ। লম্বা আঙুলের ডগায় বাদাম শেপের হালকা গোলাপি নখ। চোখ মুখ চেপে রাখা উত্তেজনার আঁচে গনগন করছে। এই অপরূপা মিস ম্যাকলেন কোথায় ছিলেন এতদিন? নন্দিনী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে ছটফট করে বেড়াচ্ছিলেন জেনিফার। বারবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। লজ্জাও পাচ্ছিলেন, নন্দিনী তাঁর অস্থিরতা বুঝতে পারছে বলে। টেবিলে একটা ট্রে আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন। চায়ের যাবতীয় সরঞ্জাম, আর একটা বড়ো প্লেটে নিজের হাতে তৈরি চকোলেট কেক। এত উত্তেজনার মধ্যেও কখন যেন ঠিক সময় করে বানিয়ে ফেলেছেন।

গাড়ির শব্দটা একই সঙ্গে দুজনের কানেই আসে। নন্দিনী মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায় একঝলক। যেখানে ছিলেন সেখানেই একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন উনি। মুখ থেকে সব রক্ত নেমে গিয়ে বরফের মতো সাদা দেখাচ্ছে। এক হাত দিয়ে অন্য হাতটা এত জোরে আঁকড়ে ধরেছেন যে আঙুলের গাঁটগুলো চামড়ার নীচে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বন্ধ দরজাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন জেনিফার। নন্দিনীই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খোলে।

দুজন মানুষ। একজনকে স্পষ্টই বোঝা যায় এদিককার অধিবাসী বলে। খুব সম্ভব ইনিই ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। এক হাত দিয়ে আরেকটি মানুষের কাঁধ জড়িয়ে রেখেছেন। সে মানুষটি এক বিশাল বৃক্ষের বাজ পড়া শুকনো কাণ্ড। ঝুঁকে পড়া লম্বা শরীর, পোড়া তামাটে গায়ের রং। নীল হাওয়াই শার্ট তার গায়ে ঢলঢল করছে। গাল ভাঙা, চোখের কোলে গভীর ক্লান্তি। কানের দু-পাশে কিছু পিঙ্গলে সাদায় মেশানো চুল। বাকি মাথা ফাঁকা। বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব। পঞ্চাশও হতে পারে, পঁচাত্তরও হতে পারে। পিঠে ডাক্তার বড়ুয়ার হাতের চাপ অনুসরণ করে পা ঘষে ঘষে সে এগিয়ে আসতে থাকে নন্দিনীর দিকে।

‘হ্যালো জেনি।’ নন্দিনী ডাক্তার বড়ুয়ার কথায় সচেতন হয়ে পিছনে তাকায়। কখন যেন মিস ম্যাকলেন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ‘আমরা এসে গেছি।’

কথার জবাব দেন না জেনিফার। তাঁর দৃষ্টি শুধু দ্বিতীয় মানুষটির দিকে। ডাক্তার বড়ুয়া তার পিঠে চাপ দেন। ‘চিনতে পারছ ফ্র্যাংক? তোমার জেনিকে?’

ফ্র্যাংক নীরব থাকে। চোখে কোনও ভাষাই ফোটে না। মিস ম্যাকলেন নিজের হাতদুটো শক্ত করে মুঠি করেন। মুখ একবার লাল একবার সাদা হয়। নন্দিনীর ভেতরে কী একটা ভাঙতে থাকে, ভেঙে ভেঙে যায়।

ডাক্তার বড়ুয়া আস্তে আস্তে ফ্র্যাংককে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসান। সামনে টেবিলে মিস ম্যাকলেনের সাজানো ট্রে।

‘দেখছ ফ্র্যাংক, চকোলেট কেক। তুমি তো ভালোবাসো। দ্যাখো, জেনি নিজে বানিয়েছে, তোমার জন্য।’

ফ্র্যাংকি দুহাতে দুটো কেকের টুকরো তুলে নেয়। বাচ্চাদের মতো একবার এ-হাত একবার ও-হাত থেকে কামড়ায়। থুতনিতে গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়া কেক মাখামাখি হয়ে যায়। শব্দ করে চিবোয় ফ্র্যাংকি। অথচ কী আশ্চর্য, মুখে কোনও অভিব্যক্তি ফোটে না।

‘আর এক পিস কেক নেবে ফ্র্যাংকি?’ জেনিফার খুব নরম গলায় বলে।

ফ্রাংকি কোনও উত্তর দেয় না। শুনতে পেল কী না তাও বোঝা যায় না। তাকিয়ে থাকে সোজা নির্বিকার। ফাঁকা দৃষ্টি জেনিফারকে ভেদ করে চলে যায়। তার হাতে মুখে আইসিঙের ক্রিম আর কেকের গুঁড়ো লেগে থাকে। সে বুঝতেও পারে না, বসে থাকে স্থির। জেনিফার ফ্রাংকির সোফার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। অসীম মমতায় পরিষ্কার নরম ন্যাপকিন দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দেয়, হাত মুছিয়ে দেয়।

গোধূলির রং আস্তে আস্তে সন্ধ্যায় পালটে যেতে থাকে। আগে থেকে সাজিয়ে রাখা ট্রে-র কাপ ভর্তি চায়ে সর পড়ে যায়। ঘরের কোণায় কোণায় অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। টেবিলবাতিটা জ্বেলে দেয় নন্দিনী।

জেনিফার ফ্র্যাংকির দুটি হাত মুঠিতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেই থাকে। হাতদুটি অল্প অল্প কাঁপে, পাতলা দুটি ঠোঁট কত কিছু বলতে চেয়ে থিরথির করে। কিন্তু কোনও কথাই বেরোয় না। বোধহীন, ভাষাহীন ফ্রাংকির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে চোখের পলকও বুঝি পড়ে না তার।

ঘরের মধ্যে ক্রমশ ভারী হয়ে জমতে থাকা একরাশ নৈঃশব্দ্য নন্দিনীকে চেয়ারে গেঁথে রাখে। নড়াচড়া করলেই যেন কী একটা ঘটে যাবে। সে শুধু দুচোখ মেলে এই ট্র্যাজিক মূকাভিনয় দেখতেই থাকে। গলার কাছে কী যে ভীষণ কষ্ট শক্ত হয়ে ডেলা পাকায়, সে জোর করে করে গিলে গিলে সেই ডেলাকে নীচে পাঠায়। কতক্ষণ যেন কেটে যায় এমনি করেই।

ডাক্তার বড়ুয়াই শেষে উঠে দাঁড়ান। শব্দ করে গলা পরিষ্কার করেন। ‘সরি জেনিফার।’ নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ পরে ওঁর কথাটা যেন ভীষণই জোরে বেজে ওঠে মনে হয়। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। গলা নামিয়ে আবার বলেন, ‘এবার যেতে হবে আমাদের।’

ডাক্তারের গলার আওয়াজে ঘোর ভাঙে জেনিফারের। ‘ফ্র্যাংকি আমার কাছে থাকতে পারে না? প্লিজ ডাক্তার? ও তো অনেক ভালো আছে আগের থেকে। ওকে তো এখন তোমরা এখানেই রাখতে পারো।’ জেনিফারের কণ্ঠস্বরে একরাশ আকুল আর্তি। অসহায় আশা ভরা দুটি চোখ ডাক্তার বড়ুয়ার দিকে চেয়ে থাকে।

জ্বলন্ত টেবিলবাতিটার চারপাশে একটা মথ অবিশ্রাম পাক খাচ্ছিল। ডাক্তার বড়ুয়া সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ এমন ভাবে চুপ করে থাকেন যেন কানেই যায়নি। তারপর চোখ না সরিয়েই খুব নরম গলায় বলেন, ‘এইরকম সোবার কোয়ায়েট মোমেন্টগুলো ফ্র্যাংকির লাইফে খুবই রেয়ার, জেনিফার। তুমি পারবে না। পারবে না ম্যানেজ করতে তুমি। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হবে…’ জেনিফারের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ না করেই থেমে যান ডাক্তার।

এতক্ষণে বাঁধ ভাঙে। কী অসহ্য এক আক্ষেপে জেনির মুখ দুমড়ে দুমড়ে যায়। শব্দহীন কান্নায় বিকৃত মুখ দু-হাতে ঢেকে ফেলে সে। কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে শরীরটা। ডাক্তার বড়ুয়া আর নন্দিনী দুজনেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। গতে বাঁধা সান্ত্বনাবাক্য এখানে এত অর্থহীন।

অস্বস্তি কাটানোর জন্য নন্দিনী চায়ের সরঞ্জামগুলো সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ডাক্তার বড়ুয়া ফ্র্যাংকির দিকে তাকান। এ ঘরের চারজন মানুষের মধ্যে একমাত্র ফ্র্যাংকিরই কোনও বিকার নেই।

গেটের বাইরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়ানো গাড়িটা এই সময়ে একবার জোরে হর্ন বাজায়। চমকে তাকিয়ে নন্দিনী এতক্ষণে দেখতে পায় গাড়িটার গায়ে বড়ো বড়ো সাদা অক্ষরে লেখা ‘সেন্ট জর্জেস অ্যাসাইলাম’।

পরের দিন সকালেও মিস ম্যাকলেনকে দেখেছিল নন্দিনী। রোজকার মতোই হালকা রঙের হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ঢোল্লা ফ্রক পরে পিক্সিকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মাথা নীচু, চোখ রাস্তার দিকে। বর্ণহীন, নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাশে এক প্রৌঢ়া।

টিউব লাইটটা হঠাৎ দপদপ করে জ্বলে উঠে নন্দিনীর চোখটা ধাঁধিয়ে দিল। যাক, এতক্ষণে কারেন্ট এল তাহলে। বাবা, পাঁচটা বাজে। তিতিরের কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এল। সবিতা বিকেলের কাজ করতে এসে যাবে আর একটু পরেই। নন্দিনী দ্রুত হাতে খোলা চুল গোছাতে গোছাতে বিছানা থেকে নামে। আলস্যমন্থর স্মৃতিমেদুর দুপুরের ভার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এবার আবার সংসারের অভ্যস্ত ছন্দ তার আপাদমস্তক অধিকার করে নিতে শুরু করে।

মিস ম্যাকলেনের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া কাগজটা দলামোচড়া হয়ে খাটের উপরেই পড়ে থাকে।

 

রূপান্তর

আজ থেকে প্রায় আট মাস আগে বিয়ের দিন মৃন্ময়ীদেবীর সঙ্গে ঐশীর প্রথম দেখা। মৃন্ময়ীদেবী শতদ্রুর পিসিমা। থাকেন মেদিনীপুরে। বিয়ের শতব্যস্ততায় তখন ওনার সঙ্গে ঠিকমতো পরিচয় ঘটেনি ঐশীর। আজ আট মাস পর ওনার পদধূলি পড়তে চলেছে এ-বাড়িতে। থাকবেনও প্রায় মাসখানেক। খবরটা পাওয়া মাত্রই বাড়িতে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল।

ওনার দাপুটে স্বভাব সম্পর্কে কমবেশি শ্বশুর, শাশুড়ি, বরের কাছে গল্প শুনেছে সে। যদিও কিয়দংশ তারও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিয়ের সময়তেই পুরোহিতের ভুল মন্ত্রোচ্চারণে একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়েছিলেন, পুরোহিতকে এই মারতে যান তো সেই মারতে যান… তারপর ঐশীর বাবা আর মৃন্ময়ীদেবীর ছোটোভাই রমাকান্তবাবুর মধ্যস্থতায় তিনি খানিক শান্ত হয়েছিলেন।

সেই কোন ছোটোবয়সে তিনি বিধবা হয়ে বাবার ভিটেতে গিয়ে উঠেছিলেন। এখনও ওই ভিটেই যক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। বাবা সংস্কৃতের টোল চালাতেন, ফলে মেয়েও তাতে বেশ চৌকশ। বাবা গত হয়েছেন, ছোটোভাই তো পড়াশোনা চলাকালীন-ই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তারপর আর ওমুখো হননি। কালেভদ্রে বেড়াতে বা প্রয়োজনে গেছেন কখনও সখনও। গ্রামের ওই প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দা বলতে বড়োভাই, ভাই বউ, আর তিনি। ভাইয়ের এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়িতে। আর এক ছেলে ছিল বটে, তবে সে আর বেঁচে নেই। বছর সাতেক আগে বিনা নোটিশে দু-দিনের জ্বরে সব শেষ। সেই থেকেই বড়োভাই শয্যাশায়ী। বিঘের পর বিঘে জমিজমা, চাষবাস সবই এখন মৃন্ময়ীদেবীর রক্ষণাবেক্ষণে।

ছুটির দিন। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে ঐশী। রোজই তো সেই ১০টা – ৬টার ডিউটি। সকালে উঠে কাকচান সেরে কোনওরকমে নাকেমুখে গুঁজে ছোটা। একদিন এর অন্যথা হলে বেশ ভালোই লাগে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আজ সোয়া নটা বেজে গেছে তার। তারপর বাড়তি মেদ ঝরাতে ট্রেড মিলে মিনিট কুড়ি হাঁটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনেই একটু স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ে আর কী! হাঁটতে হাঁটতেই কানে এল এক প্রৌঢ়ার গলা। এ গলা সে আগেও কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায়?… উৎসাহবশত বসার ঘরে আসতেই দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, শতদ্রু সবাই মিলে সেই পিসিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দীপ্তিময়ের সেই টানা চোখ। বয়সের কারণে ত্বকে খানিক শিথিল ভাব এলেও, এককালে যে অপরূপা সুন্দরী ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমনি লম্বা দীর্ঘকায়া তেমনি রংও যেন ফেটে পড়ছে। হাঁ করে তাকিয়েছিল ঐশী। হুঁশ ফিরল তাঁর রাশভারী গলার আওয়াজে। ভারী গলায় তিনি কাদের যেন দুষছেন। ‘বেআদব সব ছেলেপুলে। একটু শিক্ষেদীক্ষে নেই গো, বড়োদের সম্মান পর্যন্ত করতে জানেনে সব। সক্বাল না হতে হতে বেহায়াদের মতো হাত ধরাধরি করে… ছি ছি ছি…।’

পিসিশাশুড়ির কথায় হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। দু-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন পিসিমা?’

এই নাকি তাঁর নাতবউ! পরনে ট্রাউজার আর ঢলা গেঞ্জি। ঘেমে নেয়ে একাকার। দেখেই মৃন্ময়ীদেবীর চক্ষু চড়কগাছ।

‘থাক থাক। আর প্রণাম করতে হবে না।’ বলেই কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলি বেলা তো কম হল না, এখনও নাওয়া-খাওয়া হয়নি বুঝি?’

‘না আসলে একটু ব্যায়াম করছিলাম। আপনার আওয়াজ শুনে চলে এলাম। এবার…’

‘তা বেশ করেছ, এবার নেয়ে এসো দিকি।’

‘যাচ্ছি পিসিমা। তার আগে আপনার পছন্দের এককাপ চা বানিয়ে আনি। মার কাছ থেকে শিখেছি দেড় চামচ চিনি আর কড়া লিকার, তাইতো?’ বলেই হাসল ঐশী।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই চা বসা, আমি আসছি।’ সুমিত্রাদেবী বউমাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হন না। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই গলা ভারী করে ভাজের দিকে তাকিয়ে, ‘ও তুমিও বুঝি এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে শহুরে আদবকায়দা রপ্ত করেছ। ম্লেচ্ছদের মতো নাওয়া-ধোওয়া না করেই রান্নাঘরে ঢুকছ?’

‘না-না দিদি একদমই তা নয়। আমিই চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’ বলেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।

‘আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার আছে পিসিমা, আমি চটপট স্নান সেরে আসছি’, বলেই পিসিমাকে একবার জড়িয়ে ধরে ঐশী ছুটে পালাল স্নানঘরের দিকে।

‘কী মেয়েরে বাপু! বাপের বাড়ি থেকে কি কোনও রীতিনীতিই শিখে আসেনি? তা রমা তোরাও তো দেখছি আশকারা দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছিস। সংসারের আচার-ব্যবহার কিছু শেখা, নয়তো পরে তোদেরই ভুগতে হবে এই বলে দিচ্ছি।’ চা-আসা পর্যন্ত রমাকান্তবাবু আর শতদ্রুর এইভাবেই ক্লাস নিতে থাকলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবীর বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা দুজনের কারওরই ছিল না। দিদির কথার প্রেক্ষিতে রমাকান্তবাবু শুধু এটুকুই বললেন, ‘তুমি যখন এসেই গেছ, তুমিই ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিও। আচ্ছা দিদি তুমি বোসো, আমি একবার বাজারটা ঘুরে আসছি’, বলে উঠতে যাবেন এমন সময় সুমিত্রাকে দেখে, ‘ওই তো সুমিত্রা এসে গেছে। তুমি চা খাও, আমি এক্ষুনি আসছি’, বলেই রমাকান্তবাবু বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শতদ্রুও পিসিমার ব্যাগ-পত্র গেস্টরুমে রাখার বাহানায় ঘর থেকে সরে পড়ল। অগত্যা সুমিত্রাদেবী-ই বসে রইলেন ননদের উপদেশাবলি শোনার জন্য।

সন্ধেবেলা সকলে একসঙ্গে বসে চা-জলখাবার খেতে খেতে নানান আলোচনা চলছে। গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। গ্রামের নগেনখুড়ো থেকে শীতের নলেন গুড়– কোনওকিছুই বাদ নেই। খাওয়াদাওয়ার কথা উঠতেই ঐশী হঠাৎই হাহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবা মনে আছে চিন্নাস্বামী আর তার পরিবারের কথা, সেই দিল্লি যাওয়ার সময় ট্রেনে?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না! চিন্নাস্বামীর হাতির মতো চেহারার ছেলেটিকে বলে কিনা দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। একদম নাকি খায় না। অথচ ট্রেন ছাড়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত মুখ থেমে থাকেনি তার। বোধহয় দশজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।’ বলেই শ্বশুর, বউ মিলে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকল।

হাসিতে রাশ টানলেন পিসিমা। ‘আহ্ ঐশী একটু আস্তে। ভুলে যেও না এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে কেউ তোমার বন্ধু নয়।’

কেউ কিছু বলার আগেই ঐশী অকপটভাবে বলে বসল, ‘মা-বাবার থেকে বড়ো বন্ধু আবার কেউ হয় নাকি পিসিমা? বাপি ছিল আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু আর এখানে বাবা-মা। কী বলো বাবা?’

উত্তর দেওয়া দূরস্থান, ঐশীর কথাতেই বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে শ্বাস ফুলে উঠল রমাকান্তবাবুর। এই বুঝি দিদি ঝাঁপিয়ে পড়ল বেচারির উপর। হলও তাই।

‘বড়োদের মুখে মুখে কথা বলাটা মোটেই শোভনীয় নয় ঐশী। তাদের সম্মান করতে না পারো, অন্তত অনাদর কোরো না।’ বেচারিকে এমন ধমক দিলেন যে বাড়ির সকলের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

ঐশী জিভ কাটল, ‘ছি ছি পিসিমা, এমন বলবেন না। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, আসলে দোষটা আমার বাপির। আপনার সঙ্গে যখন আমার বাপির দেখা হবে, আপনি খুব করে শাসন করে দেবেন তো। ওনার অপত্যস্নেহেই আমি বিগড়ে গেছি। ছোটো থেকে উনি-ই আমাকে শিখিয়েছেন, সবকিছু বন্ধুর মতো ওনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে। সেই অভ্যাসটাই থেকে গেছে। এখানেও তাই বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভুলেই যাই যে উনি আমার শ্বশুরমশাই। ওনার সামনে বেশি কথা বলা সাজে না আমার।’ কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। ঐশীর মাথা নীচু করার ভঙ্গি দেখে শ্বশুর, শাশুড়ি, শতদ্রু – সকলেই হেসে ফেলল।

‘এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে তোমাদেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।’ সকলকে হাসতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবী আসার পর থেকে এ-বাড়িতে বেশ একটা অদ্ভুতরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ওনার কাজই যেন ঐশীর দোষত্রুটি খুঁজে বার করা। তারপর তাকে ভৎসনা করা। বাড়ির অন্য সদস্যরা তাঁর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালেই মুখ ব্যাজার করে সেই একই সাবধানবাণীর পুনরাবৃত্তি, ‘প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে মেয়েটাকে।’

দিন দশেক এইভাবেই কেটে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মায়াপুর থেকে খবর এল সুমিত্রাদেবীর ছোটোকাকা মারা গেছেন। দাহ হওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখতে হলে এখুনি রওনা দিতে হবে। তখুনি শতদ্রু বাবা-মাকে নিয়ে গাড়িতে রওনা দিল মায়াপুরের উদ্দেশে। ফিরতে ফিরতে কাল সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়িতে এখন ঐশী আর পিসিমা।

ভাই-ভাজ-ভাইপো রওনা দেওয়ার ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ ওনার মনে হল সময়টা ভালো যাচ্ছে না, তাই একবার মন্দিরে ঘুরে আসা দরকার। ফিরে আর কিছু খেলেনও না। ঐশী বারবার অনুরোধ করাতে জানালেন, ভোগ খেয়ে ফিরেছেন।

বিকেল থেকেই পিসি বারবার বাথরুম যাওয়া-আসা করছেন। সন্ধ্যার পর সেই আনাগোনার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে যোগ হল বমি। ঠিক করে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই ওনার। সন্ধে গড়িয়ে রাত হতে চলল। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়াবাড়ি হলে ঐশীর একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে এনে পিসিমাকে নিয়ে সোজা চলে গেল ডাক্তারখানায়।

চেম্বারে বেশ ভিড়। সকলেই অপেক্ষা করছেন তাদের পালা কখন আসবে। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করলে পিসির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না ভেবে, সোজা পিসিমাকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেল ঐশী। পাশ থেকে অপেক্ষারত অন্যান্য পেশেন্টদের বাড়ির লোকের দু-এক কথা কানে গেল বটে, ‘এভাবে হয় না, সিরিয়াল অনুযায়ী দেখাতে হয়। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। আমরাও তো রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছি।’

তাদের দিকে না তাকিয়েই ঐশী জবাব দিল, ‘নিয়ম-ই সিরিয়াস পেশেন্টদের আগে চেক-আপ করা।’ বলে পিসিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সে। ডাক্তারবাবু পেশেন্ট-এর অবস্থা দেখে আর দ্বিমত করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে চেক-আপ করে প্রয়োজনানুযায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধপত্র লিখে দিলেন।

বাড়িতে ফেরার পর প্রেসক্রিপশন মাফিক তিনটে ট্যাবলেট খাওয়ানোর পরে খানিক স্বস্তি পেলেন মৃন্ময়ীদেবী। ওআরএস জলে গুলে বারেবারে একটু একটু করে পিসিমাকে খাওয়াতে থাকল ঐশী। ঘন্টা দুয়েক পর অবস্থার খানিক উন্নতি হলে মৃন্ময়ীদেবী ঐশীর দিকে তাকালেন, ‘যদি রাতবিরেতে আবার বাড়াবাড়ি হয় তাহলে…’ মৃন্ময়ীদেবীর চোখেমুখে তখন চিন্তার ভাঁজ।

‘আমি তো আছি। আপনি চিন্তা করছেন কেন? কিছু হবে না। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন’, বলে পিসিমার মাথায় হাত বোলাতে থাকল ঐশী। বউমার আত্মবিশ্বাসে মৃন্ময়ীদেবীর সমস্ত টেনশন দূর হয়ে গেল। শিশুর মতো ঐশীর কোলের কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি।

মায়াপুর থেকে ফোন এলে তাদেরও সকলকে ভরসা দিল ঐশী, ‘চিন্তার কিছু নেই, এদিকটা আমি সামলে নেব।’

রাত্রে মৃন্ময়ীদেবী যতবারই চোখ খুলেছেন, বিছানার পাশে ঐশীকে পেয়েছেন। সারারাত জেগে মেয়েটা সেবা করেছে পিসিশাশুড়ির। মাঝে মাঝে চামচে করে নুন-চিনির জল দিয়েছে, খেতে না চাইলে ধমক দিয়েও খাইয়েছে। রাত দেড়টা নাগাদ ওনার শরীরটা বোধকরি আবার গুলিয়ে উঠেছিল, সামলাতে না পেরে বিছানাতেই কাপড়েচোপড়ে বমি করে ফেলেছিলেন তিনি। অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন তিনি। পিসিমাকে ইতস্তত বোধ করতে দেখে ঐশী সামান্য হাসে, ‘কেন এত সংকোচ করছেন। ঠিক আছে হয়ে গেছে। বরং উঠে গিয়ে ভালোই হয়েছে, এইবার একটু হালকা বোধ করবেন।’

এক এক করে ওনার কাপড় ছাড়ানো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা পরিষ্কার করা, ফ্রেশ কাপড় পরানো, বিছানার চাদর বদলানো সব হাসিমুখে সেরে ফেলল ঐশী। তারপর ওনার মাথায় এমন ভাবে হাত বুলিয়ে দিল যে মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল সাতটায় মৃন্ময়ীদেবী ঘুম ভাঙতে দেখলেন ঐশী তার মাথার পাশে বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা কাত হয়ে গেছে। স্নেহের হাত মাথায় রাখতেই চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে উঠল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো পিসিমা? শরীর কেমন? আর বমি হয়নি তো?’ যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে এক বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে, সেই অস্বস্তিতে একসঙ্গে প্রশ্ন করে ফেলল ঐশী।

‘ওরে থাম থাম, আমি একদম ঠিক আছি। শেষবার বমি হওয়াতে শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। এখন আর কোনও কষ্ট নেই। দ্যাখ একদম ফিট। আমার কথা ছাড়, তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল, এবার আরাম করগে যা তো। একটু ঘুমিয়ে নে। সারারাত ঠায় মাথার সামনে বসে ছিলি। আমি সব দেখেছি।’

‘আগে স্নান সেরে তোমার জন্য কিছু খাবার বানাই, তারপর না হয়…’

‘না না তোকে কিছু করতে হবে না। আমি সব করে নেব। তুই ঘুমুতে যা দিখি।’

‘কিন্তু’,

ঐশীকে থামিয়ে দিয়ে মৃন্ময়ীদেবী আদেশ দেবার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিন্তু-টিন্তু কিছু নয়, তোকে বলছি না তুই শুতে যা।’

এই এক রাতেই ঐশী আর মৃন্ময়ীদেবীর সম্পর্ক এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্নেহপরবশ হয়ে ঐশী যে কখন তার পিসিমার কাছে তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে, তা বোধকরি তিনিও টের পাননি। সত্যিই সময়ই পারে সবকিছু বদলাতে।

আদেশ অমান্য না করে পিসিমার খাটেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল ঐশী। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বউমাকে ওভাবে শুতে দেখে একখানা চাদর চাপিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

ঐশীর উঠতে উঠতে মৃন্ময়ীদেবীর ভাত-ডাল-আলু-পোস্ত সমস্ত কিছু কমপ্লিট। দুপুরে দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে দেদার গল্পে মেতেছে।

‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে কি? যদি দাও তা হলে বলি। আসলে তুমি আসার পর থেকেই প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।’

‘ভণিতা না করে কী বলবি বল দিকি?’

‘না দ্যাখো, আমরা প্রতিমাসে পার্লার ঘুরে আসছি, কত কত টাকা গচ্ছা দিয়ে আসছি, তবুও ত্বকে কোনও উজ্জ্বলতা নেই। আর তোমার এই বয়সেও এত গ্ল্যামার, রহস্যটা কী বলোতো?’ হাসতে হাসতে বলল ঐশী।

ঐশীর কানটা ধরে বলেন, ‘পিসিশাশুড়ির পিছনে লাগা হচ্ছে অ্যাঁ? ওরে মুখপুড়ি আমাদের সময় ওসব পার্লার ফার্লার ছিল না বটে, কিন্তু মা ঘষে ঘষে সর-বেসন মাখাতেন, বুঝলি।’

‘সত্যি বলছি তোমাকে দেখলে কেউ বলবেই না যে, তুমি বাবার থেকেও বড়ো। কী সুন্দর দেখতে তোমায়।’ মুগ্ধ চোখে তাকায় ঐশী।

‘নে আর আমড়াগাছি করতে হবে না।’ বলে মৃন্ময়ীদেবীও তার কৃত্রিম গাম্ভীর্য ভেঙে হেসে ফেললেন।

মায়াপুর থেকে ফেরার পর দুজনকে পাশাপাশি বসে এভাবে হাসিঠাট্টা করতে দেখে সকলেই হতবাক। পরিবেশ হালকা বুঝে রমাকান্তবাবু তো বলেই বসলেন, ‘একি রে বাবা, কোনও ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়লাম না তো? নয়তো এমন মিরাকেল – ভাবাই যায় না!’

পাশে বসে থাকা বউমার গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘দ্যাখ রমা তুই আর তাচ্ছিল্য করিসনি বাপু। এমনিই আমি মরমে মরে আছি। আমার সত্যিই চিনতে ভুল হয়েছিল রে – এ যে একেবারে খাঁটি হিরে।’ বলেই চিবুকে একটু হাত বুলিয়ে বলেন, ‘জানিস কাল সারারাত ঠায় মেয়েটা মাথার কাছে বসে সেবা করেছে আমার। খাব না বলেছি বলে ধমক পর্যন্ত দিয়েছে। ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার জন্য ডাক্তারখানায় কম রাগারাগি করেনি, ডাক্তারও বাধ্য হয়েছে আমাকে দেখতে। খুব বুঝেছি তোরা কেন এই পাগলিটাকে এত ভালোবাসিস।’ বলতে বলতে চোখের কোণায় জল ভরে আসে মৃন্ময়ীদেবীর। ‘মেয়েটাকে তো অকথা-কুকথা কম বলিনি, হাসিমুখে সব সয়েছে। আজকালকার দিনে এমন বউ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের রে। সত্যিই ভাগ্যের!’ আবেগবিহ্বল হয়ে চোখ মুছলেন পিসিমা। মৃন্ময়ীর এই রূপান্তরে সকলেই বেশ হতবাক। পাষাণের ভেতরেও যে এত টলটলে জলের এক হ্রদ ছিল তা কে জানত!

 

শয়তানের মুখোশ

‘বাবা এ বাবা দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

‘দেখছিস মাপ লিচ্ছি তবু কানের গড়াটায় সেই ঘ্যেনের ঘ্যেনের কচ্চিস। টুকু দাঁড়া ন, মাপটা লিয়েলি।’

‘বাবা এ বাবা…’ এবার ঘুমটা ভেঙে যায় দুলালের। এখন ঘরময় অন্ধকার, দাঁত বিছিয়ে খিলখিল করে হাসছে। বিছানা থেকে উঠে লাইটটা জ্বালায় দুলাল। অন্ধকারের দাঁতগুলো যে যার মতো ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঘামে শরীরটা ভিজে গেছে দুলালের। মাটির কলশি থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে ঢক-ঢক শব্দে জলটা গিলে নেয় দুলাল। বাতাসি আলুথালু শরীর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বাতাসির চুপসে যাওয়া বুকদুটো বেরিয়ে পড়েছে বাতাসের খোঁজে। বালিশের তলা থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাইটা নিয়ে একটা বিড়ি ধরায় দুলাল। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটা আরও গুমোট হয়। দুলালের কানে স্বপ্নে শোনা কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে…

১)

ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি থেকেই কাজের চাপ বাড়তে থাকে দুলালের। এই দুটো মাস নিঃশ্বাসটাও গুনে-গুনে নিতে হয় ওকে। বাতাসি কাজে তেমন পটু না হলেও দুলালকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মুখোশগুলোকে সময় মতো রোদে দেওয়া, পরিমাণমতো রোদ পাওয়ার পর সেগুলোকে তুলে ঘরে রাখা। দোকানে দোকানে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসা। সময় মতো অর্ডারের মাল দোকানে দিয়ে আসা। বাতাসি না থাকলে দুলালের একার পক্ষে সবদিক সামলানো সম্ভব হতো না।

পুরুলিয়ার মাহাত পাড়ায় গিয়ে দুলাল মাহাতোর নাম বললে যে কেউ ওর ঘরটা দেখিয়ে দিতে পারবে। রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে দুলাল। সেবছর দুর্গা পূজার সময় বাথানির মাঠে মরা মহিষ বানিয়ে শকুন নামিয়ে দিয়েছিল দুলাল। সেদিনের পর থেকে ছেলেবুড়ো সবাই ওকে এক নামে চেনে। তবে দুলাল মাটির কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ছৌনাচের মুখোশ বানাতেই ও বেশি ভালোবাসে। সারা বছর ধরেই মুখোশ বানাতে হয় ওকে। দুর্গা পূজার আগের কটা মাস খুব কাজের চাপ পড়ে যায়। নানান জায়গা থেকে অর্ডার আসে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও দুলাল সকাল সকাল নিজের কাজ নিয়ে বসেছিল। আপন মনে রং করছিল একটা মুখোশ। বাতাসি মুখোশের সাইজ অনুযায়ী পেপার কাটছিল দুলালের পাশে বসেই। ঠিক এমন সময় একটা লোক ঢুকল ঘরের ভেতর। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। কাঁচাপাকা চুল, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। পরনে আলখাল্লা ধরনের একটা পাঞ্জাবি। দুলাল কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল লোকটাকে, তারপর বলল, ‘পূজার আগে আর লতুন অডার লিব লাই।’ লোকটা কিছুই বলল না। হাসি মুখে তাকিয়ে রইল একটা মুখোশের দিকে। কথাটা বলার পর দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো কিছু বলবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুলাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের মুখশ চাই?’

এবার উত্তর দিল লোকটা, ‘আমি মুখোশ কিনতে আসিনি।’

‘তাহলে কী জন্যে আইচেন?’ জিজ্ঞেস করল দুলাল।

‘এমনি।’

লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না দুলাল। আর কথা না বাড়িয়ে বাতাসিকে চোখের ইশারায় ঘরের ভেতর ঢুকতে বলে, আবার নিজের কাজে মন দিল। বাতাসি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দুলালের দিকে। তারপর চুপচাপ ঘরের ভেতরে চলে গেল। হাতে ধরে থাকা মুখোশটায় রং দেওয়া হলে দুলাল তাকিয়ে দেখে লোকটা নেই। কখন বেরিয়ে গেছে। লোকটার মতিগতি বোধগম্য হল না দুলালের। এমন তো কত লোকেই আসে-যায় ওসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার সময় হয় না দুলালের। আজকের এই লোকটাকে দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগল ওর।

হাতের রং করা মুখোশটাকে উঠোনের রোদে নামাতে গিয়ে দুলাল খেয়াল করল সদর দরজার কোণায় একটা প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেটটা কুড়িয়ে থমকে গেল দুলাল। একবান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট রাখা আছে প্যাকেটটার ভেতর। বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল দুলালের। কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো লোকটা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল কয়েকবার। কোনও উত্তর পেল না। একবার ভাবল প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে লোকাল থানায় দিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত সাহস হল না দুলালের। পুলিশের চক্বরে পড়লে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রেখে দিল একটা মুখোশের ভেতর। যদি লোকটা আবার আসে তাহলে ওকে ফিরিয়ে দেবে…

২)

নানান কাজের চাপে টাকার প্যাকেটটার কথা মাথাতেই ছিল না দুলালের। মনে পড়ল মুখোশটা বিক্রি করতে গিয়ে। মুখোশটা হাতে নিয়েও টাঙিয়েই রেখে দিল দেয়ালে। বেশ কিছুদিন হল পূজা পেরিয়ে গেছে। এখন কাজের তেমন চাপ নেই বললে চলে। দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো আবার কিছু দিনের ভেতর কোনও কুপ্রস্তাব নিয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা সেই যে গেল আজও এল না। প্যাকেটটার কথা দুলাল বাতাসিকেও বলেনি। দুলাল জানে বাতাসি টাকার গন্ধ পেলে সেটা শেষ না করে শান্তিতে বসবে না।

দিন দিন কাজের পরিমাণ যতই কমছিল ততই বেশি মনে পড়ছিল টাকার প্যাকেটটার কথা। শেষ পর্যন্ত দুলাল যখন নিশ্চিত হল লোকটা আর আসবে না তখন হাত দিল টাকার প্যাকেটটায়। ওই টাকা খরচা করে ঘরের চাল-ডাল যেমন এল, ঠিক তেমন ভাবেই মুখোশের রং তুলিও এল। বিনা পরিশ্রমের টাকা খরচা করতে বিশেষ সময় লাগল না। মাস দুয়েকের ভেতরেই দুলাল শেষ করে ফেলল টাকাগুলো। টাকাটা শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আবার হাজির হল লোকটা। লোকটা যে আবার কোনও দিন আসতে পারে সেটা কল্পনা করেও দেখেনি দুলাল। লোকটাকে দেখামাত্রই দুলাল মনে মনে ঠিক করে নিল লোকটা টাকার কথা বললে টাকাটার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা টাকার কোনও কথাই বলল না। সেদিন যেমন নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই বেরিয়ে গেল আজকেও। তবে আজকে আর কোনও টাকা রেখে গেল না লোকটা।

এবার বেশ চিন্তায় পড়ল দুলাল। কে এই লোকটা? কেন আসে ওর কাছে? কী করাতে চায় ওকে দিয়ে? নিজেই নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে দুলাল। কিন্তু উত্তরগুলো কিছুতেই ধরা দিল না ওর হাতে। শেষ পর্যন্ত বাতাসিকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল দুলাল। ওর একার পক্ষে আর চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তবে বাতাসিকে বলেও বিশেষ কিছুই লাভ হল না দুলালের। বাতাসি এমন কোনও পথ বলতে পারল না যে পথে ভাবলে মানসিক শান্তি পায় দুলাল।

৩)

আজকে আর রাতজেগে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না দুলালের। বেশ কিছুদিন হল শরীরটাও সাথ দিচ্ছে না ওর। বাতাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা ভাঙল আবার সেই স্বপ্নটা দেখে। অনেক চেষ্টা করেও আর ঘুম এল না ওর। শেষ পর্যন্ত ঘরের কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল ওকে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বসল ঘরের বারান্দায়। আজকে আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা মুখোশগুলো। ঘরের পিছন দিকের বাঁশ বাগান থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। এমন রাত মানুষের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। দুলালের ভেতরটাও আপন খেয়ালে গুনগুন করে ওঠে,

‘আইজ চাঁদ চইল্যেছে আকাশ গায়ে জোছনা বিছ্যায়ে

আইজ বুকের ভেতর প্রেমের খেলা দুবুক লাচ্যাইয়ে।

তুই ঘর ভিতরে ঘুমাই আছিস আমি বেকার বাজাই বাঁশি

আর কবে বুঝবি লো তুই আমি কীসের লাইগ্যে আসি?’

দুলাল গানটা থামিয়ে দিতেই দরজার বাইরে থেকে গানের পরের লাইন দুটো ভেসে আসে,

‘ওলো সখী তুই উঠার আগেই ভোর হইয়্যে যায় পাছে

আয়-না-গো তুই বাতাস হইয়্যে আমার বুকের কাছে।’

গানের শেষ দুটো লাইন শুনে দুলাল অবাক হয়ে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কে এই গান গায়? এই গান তো দুলালের বানানো গান। এই গান অন্য কারুর জানার কথা নয়। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা খুলল দুলাল। দরজাটা খুলেই দেখল সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দুলাল পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটা হাসছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করল দুলাল, ‘এতো রাইত্যে কী জন্যে আইচেন?’

‘একটা মুখোশ চাই আমার।’

‘না আমি আপনারে কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসতে থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ভয়ংকর শোনায় সেই হাসির শব্দ। দুলাল নিজের কান দুটোকে প্রাণপণে চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আমি দিব লাই মুখশ। কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসি মুখেই বলে, ‘মুখোশটা বানিয়ে ফ্যাল্। ওই মুখোশটা তোকে বানাতেই হবে।’ কথাগুলো বলেই লোকটা স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুলাল কান দুটোকে চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে কপাট কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে আর দেখা যায় না। বাতাসি দুলালকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে কপাট বন্ধ করে দেয়।

৪)

পরের দিন সকাল সকাল বাতাসি কয়েকটা মুখোশ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ে। এই মুখোশগুলো রমেন গাঙ্গুলি অর্ডার দিয়েছিল। মুখোশগুলো কলকাতায় যাবে। আজকে বাজারে আরও একটা কাজ আছে বাতাসির। দুটো কাজ সেরেই ও ফিরবে। বাতাসি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ভাঙা আলমারিটা থেকে দুলাল একটা মুখোশ বের করে আনে। আজ অনেক বছর পর দুলাল আবার বের করেছে মুখোশটা। সেদিন সারারাত কাজ করেও মুখোশটা শেষ করতে পারেনি দুলাল। সেই রাতের পর আর হাত দেওয়া হয়নি মুখোশটায়। আজকে যে ভাবেই হোক মুখোশটার অসমাপ্ত কাজটা ওকে শেষ করতে হবে। গতকাল রাতেই দুলাল বুঝতে পেরেছিল লোকটা কোন মুখোশটা নিতে চায়। আজ থেকে সাত বছর আগে একজন লোক এসেছিল দুলালের কাছে। একটা শয়তানের মুখোশ বানাতে বলেছিল দুলালকে। কাজটা নিয়েছিল দুলাল। কিন্তু শেষ আর করতে পারেনি।

মুখোশটায় রং করতে করতে দুলাল শুনতে পায়, ‘বাবা এ দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

মাঝে মাঝে রং তুলি ফেলে কান দুটোকে চাপা দেয় দুলাল। কয়েক মিনিট পর কান ছেড়ে আবার কাজে মন দেয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এভাবে চলার পর মুখোশটার কাজ শেষ হয়। একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় দুলালের ভেতর। এর আগে কোনও মুখোশ বানিয়ে এতটা আনন্দ হয়নি ওর। যেমন বানাতে চেয়েছিল অবিকল তেমনই মুখোশ বানিয়েছে দুলাল।

মুখোশটা দুহাতে নিয়ে দুলাল ওটাই ভাবছিল কতক্ষণে লোকটা আসে। ও এলেই ওর হাতে মুখোশটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করবে ওকে। মুখোশটা কমপ্লিট হওয়ার পর সেই লোকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসি মুখে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, ‘হয়েছে?’

‘হইচ্যে। কিন্তু এই মুখশটা লিয়ে যাবার পর আর আসা চইলব্যেক লাই আমার বাড়ি।’ দুলাল বলে।

লোকটা কোনও কথা না বলে মুচকি হেসে দুলালের কাছে এগিয়ে আসে। দুলাল শক্ত করে ধরে রাখে মুখোশটা। কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে দূরের থেকেই মুখোশটা দেখায় লোকটাকে। লোকটার পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারে দুলাল।

লোকটা হাসি মুখে অস্ফুট সুরে বলে, ‘শয়তানের মুখোশ।’

যখন বাতাসি ঘরে ঢোকে তখনও দুলাল লোকটার সঙ্গে গল্প করছে। আজকে বাতাসির সঙ্গে আরও একজন এসেছে।

পুলিশ?

না পুলিশ নয়, মনের ডাক্তার। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুবিমল সরকার। ডাক্তারকে বাতাসি আঙুল বাড়িয়ে দেখায় দুলাল কেমন ভাবে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প করছে। শুধু তাই নয় দুলাল গল্প করছে সম্পূর্ণ দুরকম ভাবে। একটা ওর নিজের ভাষা। অন্যটা শহরের। বাতাসি দুলালের কাছে যেতে চাইলে সুবিমল বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ওকে মুখোশটা দিতে দাও।’

দুলালের কল্পনায় তৈরি লোকটা যখন কথা দেয় ও আর আসবে না, তখন দুলাল মুখোশটা শূন্যে তুলে ধরে। তারপর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বাতাসি আর সুবিমল সরকার মিলে দুলালকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে। সুবিমল বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই। আশা করি আজকের পর আর এই সমস্যা হবে না। তবে ওই মুখোশটা যেন ওর চোখে আর না পড়ে। পারলে ওটাকে পুড়িয়ে দিও।’

৫)

বাতাসি উঠোনে গিয়ে মুখোশটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। অবিকল নিজের মুখোশ বানিয়েছে দুলাল। কাঁচাপাকা চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। মুখোশ হাতে নিয়ে বাতাসি ডাক্তারের সামনে তুলে ধরে। মুখোশটাকে দেখার পর কয়েক মিনিট চিন্তা করে সুবিমল। কোনও একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সুবিমল বাতাসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা দুলাল নিজের মুখোশ বানাল কেন? তোমার কী মনে হয়?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতাসি বলে, ‘যেদিন রাইত্যে আমাদের ছেল্যাডারে সাপে কাইট্যে ছিল সেদিন একটা লোক আছিল একটা অডার লিয়ে। একটা শয়তানের মুখশের অডার। সেই অডারের কাইজটাই রাইত্যের বেলায় কচ্চিল দুলাল। আমি ঘুমোচ্চিলাম। তাতাই আমাকেও তুইল্যেছিল, উঠি লাই। উয়ার বাপও কাইজ ছ্যাইড়ে উঠে লাই। যখন জাইনত্যে পাইল্লম তাতাইকে সাপে কাইট্যাছে, তখন সব শেষ। সেদিন থ্যেইক্যেই তাতাই-এর বাপ ক্যেমন যেন হইয়ে গেছ্যে।’

‘আচ্ছা সেদিন তুমি টাকার বান্ডিলটা কোথায় রেখেছিলে?’

‘ওই কপাট কুনট্যায়।’ আঙুল বাড়িয়ে দেখায় বাতাসি।

‘দুলাল টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রেখেছিল বলতে পারবে?’

‘একটা মুখশের ভিতর‍্। দাঁড়ান লিয়ে আসচি।’

বাতাসি মুখোশটা নিয়ে এসে সুবিমলের হাতে দেয়। সুবিমল মুখোশটা বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর বলে, ‘আচ্ছা এই মুখোশটার ভেতর আরেকটা ছোট্ট মুখোশ কেন আছে?’

এবার চুপ করে যায় বাতাসি। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা পু্রোনো ব্যথাটা চোখের পাতা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাতাসিকে চুপ করে থাকতে দেখে সু্বিমল বলে, ‘আমাকে মুখোশ রাখার ঘরটায় একবার নিয়ে চলুন।’

না বলতে পারে না বাতাসি। মুখোশ ঘরে নিয়ে আসে সুবিমল ডাক্তারকে। ঘরটায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় ডাক্তার। সারা ঘরটা জুড়ে কয়েক’শ মুখোশ রাখা আছে। দেব-দেবীদের মুখোশ থেকে শুরু করে পশু-পাখি কিছুই বাদ নেই। কিন্তু একটা দেয়াল জুড়ে ঝুলছে অদ্ভুত কিছু মুখোশ। প্রতিটা মুখোশের ভেতর একটা করে ছোটো মুখোশ আছে। একটা মুখোশ হাতে নিয়ে ভেতরের ছোটো মুখোশটাকে বের করার চেষ্টা করে ডাক্তার। পারে না। বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটো মুখোশটাকে এমন ভাবেই ঢোকানো আছে যে, দুটোকে আলাদা করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সুবিমল অবাক চোখে বাতাসিকে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেন বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটোটাকে লুকিয়ে রেখেছে দুলাল?’

শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বাতাসি বলে, ‘তাতাইকে সাপে কামড়্যায় নায়, ডাক্তারবাবু।’

‘তাহলে?’

‘সাত বছর আগে সেদিন যে লোকটা আইছিল, সে বইল্যেছিল…’

‘শয়তানের মুখোশ বানাতে। তারপর?’

‘মুখশটা মাপে ঠিক হচ্যিল লাই। তাতাই-এর বাপ তাই তাতাইকে মুখশটা পরাই মাপটা ঠিক করত্যে গ্যেইছিল…’ কান্নায় বাতাসির কথাগুলো ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেতরের কান্নাটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে বাতাসি বলে, ‘তাতাই বারবার বইল্যেছিল, দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। উয়ার বাপ কথাগুল্যান কানেই নিল লাই। আর খুলত্যে পারে নাই মুখশটা। মাছের মতো ছটপট্যাই ছটপট্যাই মইরে ছিল তাতাই…’ নিজেকে আটকাতে পারে না বাতাসি। সাত বছর ধরে জমিয়ে রাখা চোখের জল আজ আর কোনও বাধা মানতে চাইছে না।

সুবিমল একটা মুখোশকে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। পারে না। প্রতিটা কাগজের মুখোশের ভেতর টিনের পাত দেওয়া আছে। সুবিমল খেয়াল করে দেখে সব মুখোশগুলোর গঠন এক নয়। অধিকাংশ মুখোশের পিছন দিকটায় কিছু নেই, ফাঁকা। গোটা কুড়ি-পঁচিশ মুখোশ আছে যেগুলোর পিছনটাও সুন্দর ভাবে বানানো। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই কুড়ি-পঁচিশটা মুখোশ শয়তানের মুখোশ।

সুবিমল সরকার আগে তো একজন মানুষ, পরে ডাক্তার। ওর বাড়িতেও বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে আছে। তাই ওর পক্ষে দুলাল কিংবা বাতাসির যন্ত্রণার জায়গাটা বোঝা কঠিন নয়। এতক্ষণে সুবিমল বুঝতে পারে, কেন দুলাল শয়তানের মুখোশে নিজের রূপ এঁকেছে। কেন শয়তানের মুখোশের ভেতর একটা করে ছোট্ট মুখোশ ঢোকানো রয়েছে।

দুলাল এখনও অচেতন ভাবে বিছানায় পড়ে আছে। সুবিমল দুলালের নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। না নিঃশ্বাস স্বাভাবিক। এখন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে না দুলাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুবিমল বাতাসিকে বলে, ‘চিন্তা কোরো না। দুলাল ওই বাজে স্বপ্নটা বা ওই লোকটাকে আর কখনওই দেখবে না। তবে হাঁ জ্ঞান ফেরার পর যদি কাঁদে তো ওকে মন খুলে কাঁদতে দিও।’ কথাটা বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েও আবার একবার ফিরে আসে সুবিমল, ‘আরেকটা কথা। শয়তানের ওই মুখোশটা, যেটা দুলালের নিজের মুখের আকৃতি, সেটা যেন আর দুলালের চোখে না পড়ে। ওটাকে দূরে কোথাও পুড়িয়ে দিও কিংবা মাটি চাপা দিয়ে দিও।’

সুবিমল চলে যাওয়ার পর বাতাসি দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে দুলালের মুখটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর মুখোশটা নিয়ে বাড়ির পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কোনওদিন দুলালের চোখে পড়বে না শয়তানের মুখোশটা।

 

ভিওয়ানির রহস্য

শ্যামলের জীবনটা যেন কেমন একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে টিউশন করে আর কতদিন চলবে! এসব ভাবতে ভাবতে একদিন দিল্লিতে একটা ইন্টারভিউ পেয়ে গেল। দিল্লির কনটপ্লেস-এ ইন্টারভিউতে সিলেক্টও হয়ে গেল। জানতে পারল, চাকরিটা হরিয়ানার ভিওয়ানিতে। প্রথমে ভেবেছিল যাবে না। পরে ভেবে দেখল, ঘুরেই আসা যাক না। নতুন একটা জায়গা দেখেই আসা যাক। ভালো না লাগলে ফিরে আসবে নিজের রাজ্যে।

বাবা-মা ও বন্ধুদের উৎসাহে বেরিয়ে পড়ল ভিওয়ানির উদ্দেশে। প্রথমে ট্রেনে করে দিল্লি পৌঁছোল, সেখান থেকে বাসে করে নানারকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ভিওয়ানিতে নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে অনেক সময় লেগে গেল। ওখানে পৌঁছে তার নামে অ্যালট করা কোয়ার্টারও পেয়ে গেল। কোয়ার্টার-এ জিনিসপত্র রেখে দেখল ঘড়িতে চারটে বেজে গেছে। দুপুরের খাওয়া অবশ্য পথে একটা ধাবাতেই করে নিয়েছিল।

অনেক দূরের জার্নি বলে বাসওয়ালারা মাঝপথে এক জায়গায় বাস থামিয়ে বলেছিল, যাদের খিদে পেয়েছে তারা এই ধাবাতেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতে পারেন। তবে সময় মাত্র ১৫ মিনিট দেওয়া হবে। তার মধ্যে খেয়ে বাসে এসে বসতে হবে। শ্যামলও সে সুযোগ ছাড়েনি। কারণ বুঝতে পেরেছিল এখন না খেলে ওখানে গিয়ে আজ লাঞ্চ কপালে নাও জুটতে পারে, তাই খাওয়াটা সেরে নিয়েছিল। তবে সে যা খাওয়া তা অন্য সময় হলে হয়তো ফ্রিতেও খেতে চাইত না। তবুও কোনও উপায় নেই ভেবে খেতেই হল!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল এবার আশেপাশে একটু ঘুরে দেখে আসা যাক। রাতের খাবারটা কোথায় খাবে ইত্যাদি। কারণ কোম্পানি থেকে থাকার জায়গাটা ফ্রি দিয়েছিল কিন্তু ভেতরে রান্নার কোনও জায়গা ছিল না। তাছাড়া সোমবার থেকে জয়েনিং বলে রোববারে এসে পৌঁছোবার ফলে, অফিসের থেকে খোঁজও নেওয়া যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়ল। ভাবল ফেরার পথে রাতের খাবারটাও খেয়ে ফিরবে।

কোয়ার্টার থেকে বেরোবার সময় একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, তাদের এই জায়গা থেকে শহর একটু দূরেই, তাই রিকশাতেই যাওয়া ভালো। দেরি না করে একটা রিকশা নিয়ে শহরে পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখল সেখানে বেশকিছু দোকানপাট আছে ঠিকই কিন্তু সে হিসেবে এটাকে শহর বললে একটু অপমানই করা হবে মনে হয়।

হঠাৎ নজরে পড়ল একটা দোকানে কুলফি মালাই বিক্রি হচ্ছে। লোভ সামলাতে না পেরে ঢুকে পড়ল সেখানে। কুলফিটা খেয়ে দাম দিতে গিয়ে দেখল যে, অতদূরের রিকশা ভাড়া নিয়েছে মাত্র দশ টাকা আর কুলফি নিল চল্লিশ টাকা। বেশ বুঝতে পারছিল ইচ্ছে থাকলেও এ শখ রোজ পূরণ করা যাবে না। এরপর অনেক দোকান-বাজার ঘুরে খাবারের দোকানের খোঁজে এগোতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন লোকালয়ে গলিতে ঢুকে পড়েছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা বিকট চিৎকারে প্রায় আত্মারাম খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। পরক্ষণেই দেখল কতকগুলো মযূর এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে যাচ্ছে আর ওই অদ্ভুত বিকট চিৎকার করছে। সন্ধে হয়ে গেছে তাই তারাও ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসায়।

মনে মনে ভাবল, ঈশ্বরের কী অদ্ভুত সৃষ্টি! মযূর দেখতে এত সুন্দর কিন্তু তার আওয়াজ যে এত কর্কশ, তা না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। একসাথে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা মযূর ডেকে ওঠাতে শ্যামল প্রথমটা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের বিকট আওয়াজ সে কখনও শোনেনি। যখন সে খাবার হোটেলে গিয়ে পৌঁছোল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।

হোটেলে গিয়ে শুনল আজ স্পেশাল ডিশ হল, ক্ষীর। শুনেই জিভ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছিল শ্যামলের। মনটা আনন্দে ডগমগ করে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থাযী হল না। এই ক্ষীর খাওয়ার অভিজ্ঞতা সে কখনও-ই ভুলবে না!

ক্ষীর খেয়ে বুঝতে পারল যে, এখানে দুধের পায়েসকে ক্ষীর বলা হয়। আর সেটা দুধের পায়েসও বলা চলে না। সেটা একেবারে দুধ-ভাত ছাড়া আর কিছু নয়। প্রথম দিনই এমন ক্ষীর খাওয়াতে এখানে বাইরে খাওয়ার উৎসাহটা একটু কমে গেল।

সেখান থেকে কোয়ার্টারে ফেরার সময় থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। কোয়ার্টারে যখন ফিরে এল তখন বৃষ্টির গতিও অনেক বেড়ে গেছে। বৃষ্টির শাব্দিক অনুভূতিটা বরাবরই তার কাছে বেশ আনন্দময় কিন্তু আজ যেন কেমন একটা গা শিরশির করা ব্যাপার আছে বলে মনে হচ্ছে। এমনিতেই শীত পড়তে শুরু করেছে। শীতকে আরও জমিয়ে তুলতে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সুতরাং গা শিরশির করাটাই স্বাভাবিক।

ঘরে দুটো জানলা। আজ যেন কেন দুটো জানলাই বন্ধ করতে ইচ্ছে হচ্ছে শ্যামলের। দুমিনিটের ভেতরেই জানলা দুটো বন্ধ করে এসে চেয়ারে বসতেই, বারান্দার দিকের জানলাতে হঠাৎ খট করে শব্দ হল। চমকে উঠল শ্যামল। বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ওখানে তালাও নিজে লাগিয়ে এসেছে। তাই সেখানে কেউ ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকী তালাটা সে বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল। নিজের তালা-ই লাগিয়েছে।

মোটা কাঠের জানলা। এমনিতেই এখন বন্ধ। তাই বৃষ্টির দিনে এমন জোরে খট করে শব্দ করাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। শ্যামলকে বেশি ভাবতে সময় দিল না ওপাশের কেউ। আবার খট করে শব্দ হল। শ্যামল ভাবতে লাগল, যেহেতু বারান্দাটা পুরো গ্রিল দিয়ে ঘেরা ও তালা দেওয়া, তাই গ্রিল পেরিয়ে আসা কারও-র পক্ষে সম্ভব নয়। এই দুর্ভেদ্য সুরক্ষা ভেদ করে জানলায় এসে ধাক্কা মারার কথা নয়।

শ্যামল চেঁচিয়ে উঠল কে… কে ওখানে? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। জানলায় আবার খট করে আওয়াজ হল। শব্দটা ক্রমশ যেন বাড়তে শুরু করল।

( ২ )

একে তো শীতের রাত, তার ওপর এই জায়গায় সে একেবারে নতুন। ভাবল এখানে সে নতুন, কেউ হয়তো ভয় দেখানোর জন্য এসব করছে। বিছানায় শুয়ে পড়ল কিন্তু শুয়ে ঘুম আসছিল না। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছিল। বিছানায় শুয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেল সে।

অন্যদিকের জানলাটায় কেউ ধাক্কা দিলে সে অন্তত বুঝতে পারত যে, এই বৃষ্টির দিনে হয়তো কোনও আগন্তুক বাইরে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু গ্রিল দিয়ে ঘেরা এই জানলাটায় কেউ ধাক্কা দেবে কি করে! কিছুতেই এ কথাটা তার মাথায় ঢুকছিল না। তাছাড়া শোওয়ার আগে তালা দিয়ে বন্ধ করে এসেছে। এসব আবোল তাবোল চিন্তা করতে করতে তার সব কিছুই যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।

জানলাটায় ধাক্কাটা এবার থেমে থেমে আসছে। অনবরত ধাক্কা দিয়ে মানুষ যেমন ক্লান্ত হয়ে যায়, মনে হচ্ছে ওপাশের কেউ তেমনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসলে ওপাশে কি কেউ আছে, না পুরোটাই তার মনের ভুল! হয়তো শুধু বৃষ্টিই হচ্ছে, আসলে হয়তো জানলায় কোনও ধাক্কার শব্দ হচ্ছে না। পুরোটাই তার মনের ভুল নয়তো!

শ্যামল এগিয়ে যায় জানলার দিকে, কান খাড়া করে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু একি, সত্যিই তো মনে হচ্ছে কেউ কয়েক সেকেন্ড পর পর একই তালে ঠক ঠক করে চলেছে। এবার তার মনে হতে লাগল হয়তো মনের ভুলে সে গ্রিলের তালাটাই লাগাতে ভুলে গেছে আর সেই সুযোগ নিয়ে কেউ হয়তো ঢুকে পড়েছে বারান্দায়। কিন্তু এত রাতে কে হতে পারে? তবে কি চোর! আর চোর হলে সে জানলায় কেন ধাক্কা দেবে। চোর হলে তো নিঃশব্দে আসবে। জানিয়ে আসবে কেন!

শ্যামলের মাথায় নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। কেউ কি তাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব করছে? নাকি কোনও বোবা লোক বিপদে পড়ে জানলায় খট খট আওয়াজ করছে? নাকি অন্য কোনও প্রাণী? মনে পড়ে যায়, একবার তার বাড়িতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভাম-বিড়াল ঢুকে গিয়েছিল বারান্দায়। সেরকম কিছু নয়তো?

প্রথমে ভেবেছিল দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখবে। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল না এত রাতে এই অজানা জায়গায় সেটা হয়তো ঠিক হবে না। এসব নানা অজানা আশঙ্কায় শ্যামল অনুভব করল, ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কোনও চোর-ডাকাত নয়তো!

চিৎকার করে সে কি লোকজন জড়ো করবে? এবার সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, কে ওখানে? কিন্তু কোনও উত্তর এল না। এত রাতে জানলার শব্দ এবং নিজের ধারণা সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাবে নিশ্চিত হতে পারল না বলেই, চিৎকার করতে তার ভীত-সন্ত্রস্ত সত্ত্বা বারণ করে দিল।

( ৩ )

এবার মনে হল বৃষ্টির তালে তালে কেউ যেন নাচছে আর তার পায়ে নূপুর ও হাতের চুড়ির আওয়াজ যেন তালে তালে বাজছে। এতে শ্যামলের মাথার ভেতরে কেমন যেন এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে লাগল। ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না। সত্যিই কি কেউ বাইরে নাচছে, না এসব তার মনের ভুল!

এমনিতে শ্যামল খুব একটা ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। এর আগে পাড়ায় কেউ মারা গেলে অনেক গভীর রাতেও তাকে নিয়ে দাহ করে এসেছে। সামাজিক পরোপকারে তার জুড়ি নেই। জানলার শব্দটাও থেমে গেছে নূপুরের ও হাতের চুড়ির আওয়াজের সাথে সাথে। তার মনে হচ্ছে কেউ নাচছে তার বারান্দায়, ঠিক জানলার পাশে। মাথাটা কেমন যেন বন বন করে ঘুরছে মনে হচ্ছে।

কল্পনায় সে দেখতে পেল রাজা-বাদশাদের হারেমখানার কোনও নর্তকী যেন সুযোগ পেয়ে আজ এই বারান্দায় এসে তার আসর বসিয়েছে। খালি তফাত হল, ঘরভর্তি শ্রোতা নেই। শ্রোতা শুধু একজন। আর সেটা হল সে নিজে।

ঘরের আলোটা জ্বলছে। শ্যামল আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ নিজের মুখ দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। আয়নায় এক নারীমূর্তি। এ কী করে সম্ভব। পেছন ফিরে দেখল, জানলার কপাট কখন খুলে গেছে বুঝতেই পারেনি। মনে হল কোনও এক নারী মূর্তি যেন জানলা থেকে সরে গেল। অন্য জানলাটা কিন্তু বন্ধই রয়েছে। নিমেষেই ঘোর কেটে যায়। বুঝতে পারে, সে ঠিকই শুনেছে এবং দেখেছেও ঠিকই। আবার সেই নারী মূর্তি যেন তার জানলা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর আর তার কিছুই মনে নেই।

( ৪ )

যখন জেগে উঠল তখন বুঝতে পারল, সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তখনও বারান্দার দিকের জানলাটা হাট করে খোলা। অথচ অন্যদিকের জানলাটা এখনও বন্ধই রয়েছে। রাতের ঘটনাটা তাহলে কি শুধুই তার মনের ভুল নাকি সত্যি!

গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে করতেই আবার যেন কেমন একটা ভয় এসে বাসা বাঁধছিল। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। তাই মনেও একটু সাহস পেল। বাইরে থেকে কিছু লোকের কোলাহলও এসে কানে পৌঁছোল।

শ্যামল ধীর পায়ে বারান্দায় পা রাখল। দেখল গ্রিলের গেটে যে-তালাটা গতকাল রাতে লাগিয়েছিল সেটা এখনও বন্ধই আছে। এটা দেখে ভাবল, তাহলে গতকালের ঘটনাটা হয়তো মনের ভুল হতে পারে। কিন্তু তার এই ধারণা বেশিক্ষণ স্থাযী হল না, নিমেষেই বদলে গেল। বারান্দায় কিছু পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখল একটা গলার চেন ও একটা লকেট পড়ে আছে।

এগুলো দেখার পর শ্যামলের মন থেকে অনেকটাই বিভ্রান্তি কেটে গেল। কারণ সে নিশ্চিত যে গতকাল কেউ এখানে এসেছিল। তবে ওই লকেট ও গলার চেনটা তোলার সাহস তার হল না। কেউ যে এসেছিল তার প্রমাণ তার সামনে হাজির রয়েছে। ভাবল ব্যাপারটা প্রতিবেশীদের কাউকে জানালে হয়তো কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দেখল পাশের কোয়ার্টারের সামনে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে কী সব যেন আলোচনা করছে।

( ৫ )

সেখানে পৌঁছে যা শুনল তা শুনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল শ্যামল। শুনল গতকাল পাশের বাড়ির মেয়েটি বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। আর আশেপাশের অনেক বাড়িতেই ওর উপস্থিতি অনুভব করেছে প্রতিবেশীরা। প্রায় একই রকম ভাবে যেরকম শ্যামল অনুভব করেছে।

প্রতিবেশীদের আলোচনার বিষয়ে একটা কথা সবাই বলছিল যে, গতকাল রাতে তাদের বাড়িতে কেউ এসেছিল। কিন্তু শ্যামল লক্ষ্য করল সবাই অনেক কথা বললেও তাদের বাড়িতে কেউ গলার চেন ও লকেট পেয়েছে বলে বলল না। ব্যাপারটা ভেবেই রাতের সেই অনুভূতি যেন আবার শীতল হয়ে নেমে গেল শ্যামলের মেরুদণ্ড বেয়ে। ভয়ে ভাবনায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করল শ্যামল।

শ্যামলের খালি মনে হতে লাগল, আবার যদি রহস্যমযী সেই মেয়েটি রাতে তার কাছ থেকে ফেলে যাওয়া লকেট ও চেনটা ফেরত চাইতে আসে, তখন কী হবে?

 

দিতি-ও বাঁচতে চায়

হাতে ধরা ব্লাড স্যাম্পল-এর শিশি দুটো আর রিকুইজিশন স্লিপটা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের কোলাপ্সিবল গেটের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দেয় নীলাদ্রি। ও পাশে থাকা ভদ্রলোক স্যাম্পল জমা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে জানিয়ে দিল, ‘ঘন্টা খানেক পরে আসুন’।

কাল সকাল আটটায় দিতির অপারেশন। অত সকালে ব্লাড জোগাড় করা যাবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। খামোকা টেনশন না পুষে, অমিতকে নিয়ে নীলাদ্রি তাই আগের দিন-ই এসেছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। ব্লাড স্যাম্পল জমা দিয়ে এখন খানিকটা রিলিভড্। এলোমেলো চুল বাঁ হাতে ঠিক করতে করতে, সিগারেটের লম্বা টানের ধোঁয়ার সাথে, টেনশন হালকা করে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় নীলাদ্রি।

‘টেস্ট করতে, গ্রুপ মেলাতে এটুকু সময় তো লাগবেই। এক ঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বা করবি কী! চল একটু হেঁটে হেদুয়ায় গিয়ে বসি’– অমিত ঘুরে, সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। অমিতের সঙ্গে পা মিলিয়ে নীলাদ্রিও মানিকতলা মোড় পেরিয়ে হেদুয়ার দিকে এগিয়ে চলে। রবিবারের শান্ত বিকেলে বড়ো রাস্তাগুলো যেন ক্লান্ত বিবশ হয়ে শুয়ে আছে। এই ফাঁকা শান্ত রাস্তাঘাট হঠাৎ করে নীলাদ্রিকে দিতি-র কথা মনে করিয়ে দেয়। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর অনেকবার দিতিকেও এরকমই বিবশ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে নীলাদ্রি। অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোর কাটে না তখনও, আধো ঘুমে আচ্ছন্ন। হসপিটালে দিতিকে দেখতে অনেকেই আসে। জানতে চায় কেমন আছে সে। কিছুক্ষণ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে যায় তারা। কিন্তু দিতি কিছুই বুঝতে পারে না। জানতে পারে না কারা কারা এসেছিল ওকে দেখতে। কাটাছেঁড়া – অপারেশন – ব্যান্ডেজ – ড্রেসিং – ভয় – টেনশন সবগুলো মিলে যায় অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোরে। হসপিটালের ধবধবে সাদা বেডে, ফ্যাকাশে দিতি তখন ঘোরের মধ্যে শুয়ে।

নীলাদ্রিকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে, অমিত বলে, ‘কী ভাবছিস? গ্রুপ মিলিয়ে ব্লাড পাওয়া যাবে কিনা! চিন্তার কিছু নেই, এখানে না পাওয়া গেলে পিপলস্-এ যাব, সেখানে না পাওয়া গেলে লায়ন্স এ…’, হঠাৎ থেমে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা দিতির ব্লাড গ্রুপ কী জানিস?’

‘জানি ‘বি’ পজিটিভ।’

‘তোর?’

‘বি পজিটিভ।’

‘আমারও। তাহলে তো চিন্তার কিছু নেই। কোথাও না পাওয়া গেলে আমরা তো আছিই।’

অমিত যেন সত্যিই চিন্তামুক্ত হল। নীলাদ্রিও অমিতের কথায় ভরসা পায়। রক্ত চাই– রক্ত। এক বোতল, দু বোতল, তিন… চার। নেই শুনলেই মাথায় হাত। পৃথিবীতে এই একটা জিনিসের জন্য মানুষকে মানুষের উপরই নির্ভর করতে হয়। যার কোনও বিকল্প নেই। টাকা পয়সায় যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।

পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, সন্ত্রাস, হিংসা– রক্ত হোলির এক বিভৎস উৎসব, কত রক্তের অপচয়। অথচ এই রক্তের জন্য, জীবনের জন্য কত না কাতর চাহিদা আর উৎকণ্ঠার অপেক্ষা। কিছু মানুষ আছে এখনও, যারা মানুষের জন্য ভাবে, চায় সব মানুষ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুক এই সুন্দর পৃথিবীতে। তারাই তো অকৃপণ হয়ে দান করে দেহের লাল তরল অংশ– অমূল্য ধন ‘রক্ত’।

যেদিন লাল মারুতি চেপে পাঁচ-ছ’ জন এসে মালঞ্চ সিনেমা হলের সামনে সত্যকেই প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে রেখে গেল। সেদিন রক্তে ভেজা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নীলাদ্রি, রাজনৈতিক ধিক্বার সভায় কোনও একজন নেতার মুখে শুনেছিল, ‘এসব বরদাস্ত করা হবে না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিশোধ হবেই। রক্তের বদলে রক্ত চাই। আরও রক্ত।’

হঠাৎই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল নীলাদ্রির। নিজের মনে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, ওই যারা সত্যকে মেরে রাস্তায় রক্ত ছিটিয়ে গেল বা যে নেতারা রক্তের বদলে রক্ত চাইছিল, ওরা কি কখনও কাউকে রক্ত দেয়? তাহলে এত রক্ত আসে কোথা থেকে? যারা দেয় তারা নিশ্চয়ই দেওয়া-নেওয়ার হিসাব করে না। রক্তের বদলে রক্ত চাই বলে না।’

‘তুই কখনও ব্লাড ডোনেট করেছিস?’ নীলাদ্রির প্রশ্নে অমিত খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়, ‘না, দিইনি। অফিসে একবার হেল্থ চেক-আপ ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করিয়েছি।’

‘আমি দু-একবার ব্লাড দিয়েছি, কিন্তু দিতি দিত– বছর বছর, ক্লাবের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে। ব্লাড নেওয়ার জন্য কার্ডগুলো তো ক্লাব থেকেই আনলাম।’

হাঁটতে হাঁটতে হেদুয়ার কাছে এসে বাঁদিকের বড়ো বিল্ডিংটার দিকে আঙুল তুলে অমিত নীলাদ্রিকে বলে, ‘এই স্কটিশে ভারতবর্ষের দু-দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি পড়াশুনা করেছেন, যারা পৃথিবীর কাছে ভারতবর্ষকে নতুন করে পরিচিত করেছেন, গর্বের আসনে বসিয়েছেন। বলতো কে সেই দুজন?’

নীলাদ্রির মাথাটা যেন ফাঁকা ডিব্বা, সব ভুলে বসে আছে। অমিতের মুখের দিকে বোকা বোকা ভাবে তাকিয়ে থাকে।

‘স্বামী বিবেকানন্দ আর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।’

উত্তর না দিতে পারায় নীলাদ্রি লজ্জাবোধ করে। ‘সরি! এটা বলা উচিত ছিল।’

কথা বলতে বলতে ওরা হেদুয়ায় ঢুকে পড়েছে। নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে নেয়, এক ঘন্টা হতে কত দেরি আছে।

‘দিতিটা কি বল তো! সব কিছু ভুলে, নিজের গায়ে আগুন লাগাল ও! মৃত্যুকে এত কাছের মনে হল? কী দুঃসাহস!’

অমিতের কথায় নীলাদ্রি চকিতে ফিরে দাঁড়ায়– ‘না রে, মৃত্যুর কাছে এসে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা যে কত প্রকট হয়ে ওঠে, দিতিকে তখন দেখলে বুঝতিস। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য আকুল হয়ে ওঠে মানুষ– আমি দেখেছি।’

সুইমিং পুলের রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি আর অমিত। সামনেই ডাইভ দেওয়ার জন্য ঢালাই করা জায়গাটা, যার একাংশ ঝুলে আছে পুলের মধ্যে। সেখানে বসে একজন অল্পবয়সি বউ আপন মনে শাড়িতে অ্যাপ্লিকের কাজ করছে। বোধহয় স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। বাদ দেওয়া টুকরো কাপড়গুলোর কিছু কিছু হাওয়ায় উড়তে উড়তে সুইমিং পুলের জলে এসে পড়ছে। ওই টুকরোগুলো উড়ে গিয়ে জলে পড়ছে কিনা বা জল নোংরা করছে কিনা সে ভাবনা নেই– স্বার্থপরের মতো বউটি নিজের কাজে মগ্ন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা বা মৃত্যুর জন্য দুঃসাহসী প্রয়াস। কোনও ক্ষেত্রেই বোধহয় মানুষ ভাবে না অন্যের কথা।

নীলাদ্রি আর অমিত পার্কের এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কের এক পাশে গোল হয়ে বসে আছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। পাশের কলেজ হোস্টেল থেকেই বোধহয় এসেছে ওরা। কোনও বিশেষ আলোচনা বা পরিকল্পনায় তারা মশগুল। এরকম সুশৃঙ্খল ভাবে ওদের বসে থাকতে দেখে নীলাদ্রির বেশ ভালো লাগে। চারিদিকের অশালীন গুলতানি, ছন্নছাড়া অসহিষ্ণু চেনা সমাজ থেকে পৃথক ভালো কিছু দেখে মনটাও যেন শান্তি পায়। নীলাদ্রি মনে মনে ভাবে, এদের মতো মানুষেরাই নিশ্চয়ই মানুষের জন্য রক্ত দেয়।

একটু এগিয়ে এসে গাছতলায় সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটায় এসে বসে নীলাদ্রি-অমিত। আগে থেকেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন ওখানে। পরিপাটি পোশাক, পাট ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কেয়ারি করে চুল আঁচড়ানো, গলাবন্ধ ফুল হাতা সোয়েটার পরা।

সামনে দিয়ে অন্য একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে ধরা বন্ধ ছাতায় ভর দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন। তার উদ্দেশ্যে পাশে বসা ভদ্রলোক হাঁক ছাড়েন, ‘দাদা কত হল?’

ভদ্রলোক কানে কম শোনেন, থেমে, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী বললেন, কীসে বদহজম হল?’

‘না না, বয়স কত হল?’

‘এই তো একানব্বই। শয়ে পড়তে এখনও নয় নয় করে ন’টা বছর বাকি।’

‘তা প্রায় টেনে এনেছেন। আমার তো একাশি, আমার থেকে পুরো দশ বছর এগিয়ে। আমরা কি আর পারব, আপনার মতো?’

মৃদু হেসে ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘যা ঠান্ডা পড়েছে।’

পাশের ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘দেখুন কী হয়?’

নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে, অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘এখনও আধ ঘন্টা।’

অন্য একজন ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক পাশে এসে বসলেন। তার পায়ের কেডস্টিও ধবধবে সাদা। আগের সেই ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করতে করতে প্রশ্ন করেন, ‘ক পাক হল?’

নস্যির কৌটো বের করার সময় পকেটে রাখা খুচরো পয়সাগুলো ঝনঝন করে বেজে ওঠে।

‘এই তো সবে এক পাক দিয়ে এসে বসলাম।’

নস্যি নিয়ে পরিষ্কার রুমাল দিয়ে নাক, হাত মুছে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসেন।

‘ঘোষবাবুকে দেখলেন? এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ্যই আছেন। একানব্বই চলছে!’

‘ভাইপোদের কাছে থাকেন। ভালো চাকরি করতেন, ভালো পেনশন। বিয়ে থা তো করেননি। সাংসারিক চিন্তাভাবনা নেই। সুস্থ থাকারই কথা।

‘আপনার কত চলছে?’

‘ক’দিন আগে সত্তর পার হলাম।’

‘আমার থেকে তো অনেক ছোটো। যান সন্ধে হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি আরও দু-চার পাক ঘুরে আসুন। ভালো করে বাঁচতে হবে। কত কী আরও দেখবার আছে।’

‘না না, আর দেখবার ইচ্ছে নেই। ঘরে-বাইরে যা চলছে। তাড়াতাড়ি গেলেই বাঁচি।’

‘মানুষ হয়ে এসেছেন, অত তাড়াতাড়ি করে লাভ কী? যতদিন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা যায় সেটাই ভালো। মরলে পরে কে যে কী হবে কে জানে!’

‘ওই দেখুন বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের প্রোগ্রাম সেট করছে, আর আমরা রক্তচোষারা বসে আছি শুধু সময়ের অপেক্ষায়।’ একটু থামেন। ‘আচ্ছা, মানুষের জন্য কোনওদিন রক্ত দিয়েছেন?’

সংক্ষিপ্ত উত্তর– ‘না’।

ভদ্রলোক তবুও থামেন না, ‘সে কি কথা।’ মানুষইতো কেবল মানুষের জন্য রক্ত দিতে পারে। জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ওরা কিন্তু পারে না। একবার চেষ্টা করে দেখুন না।’

‘আমাদের চেষ্টার দিন তো শেষ। আমাদের রক্ত সব শুকিয়ে গেছে। না হলে এত অনাচার, এই খারাপ সময়ে একটুও গরম হয় না কেন রক্ত?’ নীলাদ্রি-অমিতের দিকে ফিরে বলে, ‘এখন চেষ্টা করবে এরা। চারিদিকে লড়াই। অনেক অনেক রক্তের দরকার।’ বেঞ্চ থেকে উঠে ভদ্রলোক এগিয়ে যান। পাশের ভদ্রলোক অমিতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যাই যাই করছে। ওসব মিথ্যে মুখোশ। মরতে কেউ-ই চায় না। মরতেই যদি চায় তাহলে প্রতিদিন পার্কে এসে পাঁচ পাক ঘুরছে কেন? বাঁচতে চায় বলেই তো শরীরটাকে সতেজ রাখার চেষ্টা। রক্ত ফুরিয়ে গেলে দেখবে রক্ত চাইবে। এক বোতল, দু বোতল, তিন বোতল…।’

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ায়।

অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘মিনিট দশেক।’

বেঞ্চ ছেড়ে অমিতও উঠে দাঁড়ায়। পাশের ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমাদের দুজনেরই বি পজিটিভ। কখনও রক্ত লাগলে বলবেন।’

পার্কের রাস্তা– মানিকতলা মোড়– সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক, পায়ে পায়ে শেষ হয় নীলাদ্রি অমিতের রাস্তা।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ব্লাড কালেক্ট করে হসপিটালের ফ্রিজে সেই ব্লাড ঢুকিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নীলাদ্রি অমিতকে নিয়ে দিতির কেবিনের দরজা খুলে দাঁড়ায়, দরজা খোলার হালকা শব্দে দিতি ঘুরে তাকায় ওদের দিকে।

দিতির চোখে-মুখে আবার একবার দেখতে পায় বেঁচে থাকার আকুল আগ্রহ – ‘ব্লাড পেয়েছ?’

 

স্নেহ

অর্ক মায়ের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ও জানে মা অনেকদিন ধরেই মাসিকে ফোনে চেষ্টা করছে কিন্তু মাসিকে কিছুতেই ফোনে ধরা যাচ্ছে না। আর মাসির খবর কয়েকদিন না পেলেই মায়ের কী অবস্থা হয় আন্দাজ করে নিয়েই অর্ক বলে, ‘মাসির চিন্তা করা বন্ধ করো এবার। মা, তুমি খুব ভালো করেই জানো মাসি ভালো আছে বলেই এখন তোমার ফোনও ধরছে না, তোমাকে একটা ফোন করারও প্রয়োজন মনে করছে না। কোনও প্রবলেম হলে কাঁদতে কাঁদতে আগে তোমাকেই ফোন করত।’

সুচরিতা অর্কর কথার কোনও প্রত্যুত্তর দিতে পারে না শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নেয়। আজকালকার ছেলে, ইমোশন খুব কম, তবে জীবনের উঁচু-নীচু পথটাকে অনেক ভালো ভাবে বোঝে, চেনে ওরা। তবে সেটা সুচরিতার কাছে কষ্টের নয়, গর্বের।

সুচরিতা বোঝে আজকের দিনে ওর নিজের ভালোমানুষি স্বভাবটাকে নিয়ে লোকেরা হাসিঠাট্টাই করবে, আড়ালে সকলে নিরেট, বুদ্ধিহীন বলবে। অথচ সত্যিই তো ছোটোবেলায় এত বুদ্ধি ছিলটাই বা কোথায় যে এক-দু’বার সাক্ষাতেই কাউকে বুঝে ফেলবে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়ো হওয়ার কারণে, বড়োদের মধ্যে সুচরিতার থাকার সুযোগ হয়নি। পরিবারের অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গেই মিলেমিশে মানুষ হয়েছে। বড়োরা কীভাবে ঘরসংসার সামলাচ্ছেন সেটা ঘুণাক্ষরেও সুচরিতা কখনও বুঝতে পারেনি। অথচ এখন তিন-চার সদস্যের পরিবারে বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে কিন্তু সবদিকেই তাদের তীক্ষ্ণ  নজর। কারও সঙ্গে দুটো কথা বলেই ওরা বুঝে ফেলে মানুষটা কেমন।

‘আজই আমি মাসিকে দোকানে শপিং করতে দেখেছি। হয়তো অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। মাসির সঙ্গে আরও দুজন ছিল। ওদের সকলের হাতেই অনেকগুলো করে ব্যাগ ছিল।’

‘তোর সঙ্গে কোনও কথা হয়েছে?’

‘না, আমি ফুটপাথে একটা দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। মাসিকে একটা দোকান থেকে বেরিয়ে আর একটা দোকানে ঢুকতে দেখলাম।’

‘তুই তো ভুলও দেখে থাকতে পারিস।’

‘কেন, আমি কি অন্ধ, নাকি চোখে কম দেখি যে মাসিকে দেখে চিনতে পারব না?’

‘তাহলে কথা বললি না কেন?’

‘বাব্বা! মাসি হেসে গড়িয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আমাকে দেখতেই পায়নি। দিব্যি খোশমেজাজে ছিল… আর যেই তুমি ফোন করো অমনি মাসির কান্নাকাটি আরম্ভ হয়ে যায় যেন ওর চেয়ে দুঃখী সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর একটাও নেই। মাসির যখন ভালো সময় যায় তখন কই, তোমাকে তো বলতে আসে না অথচ যেই সামান্য প্রবলেমের আঁচ পায় ওমনি তোমার কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মা, মাসির চিন্তা করা ছাড়ো। ফোন আসেনি মানে ধরে নাও মাসি বহাল তবিয়তে আছে।’

সুচরিতা শাসনের ভঙ্গিতে অর্কর দিকে চোখ ফেরায়। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে কারণ সুপর্ণার নামে আরও দুটো বাজে কথা অর্কর মুখ থেকে শুনতে সুচরিতার ভালো লাগছিল না। অথচ মনে মনে সুচরিতা ভালো করেই জানে অর্কর প্রতিটা কথা সত্যি। ও ঠিকঠাকই চিনেছে নিজের মাসিকে। সুপর্ণার এটা বরাবরের স্বভাব। সাধারণ সমস্যাকে বাড়িয়ে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না অথচ কোনও আনন্দের খবর থাকলে এমনভাবে সকলের কাছে চেপে যাবে যে অন্য লোকে মনে করবে দুঃখ ছাড়া মেয়েটার জীবনে সুখশান্তি একেবারেই নেই।

সুপর্ণাকে যতবার সুচরিতা এটা নিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে প্রত্যেকবারই ওর একটাই উত্তর শুনে এসেছে, ‘তুই জানিস না দিদি, আমার ভালো কেউ সহ্য করতে পারে না। সকলে আমাকে হিংসা করে। ভালো কিছু আমার জীবনে ঘটলে অন্যের নজর লেগে যায়, তাই কাউকে আমি কিছু জানতে দিই না।’

সুচরিতা আশ্চর্য হয় সুপর্ণার কথা শুনে। আশ্চর্য, নিজের দিদিকেও বলা যায় না। তার মানে কি সুপর্ণা বলতে চায় ছোটো বোনকে দিদি হিংসা করছে? অথচ দিনরাত সুচরিতার একটাই চিন্তা, ছোটো বোনটা কীভাবে ভালো থাকবে? কী করে ওকে আরও সাহায্য করা যাবে?

সুচরিতার মনে পড়ল, এই তো কয়েকদিন আগেই সুপর্ণা কাজের মেয়েটার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল কিছু টাকা চাই লিখে। সংসার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সুচরিতা সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখে দুর্দিনের কথা মাথায় রেখে। ভেবেছিল বোন এলে ওখান থেকেই কিছু টাকা সুপর্ণাকে দিয়ে দেবে। ও ভালো করেই জানে ওই টাকা সুপর্ণা কবে ফেরত দেবে কোনও ঠিক নেই। আদৌ দেবে কিনা সেটাও অজানা।

এই ভাবেই দুই বোন মানুষ হয়েছে। দশ বছরের ছোটো সুপর্ণা। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মা-বাবার কাছে সমানে শুনে এসেছে, ছোটো বোনের সব দায়িত্বই সুচরিতার। বোনকে চোখে চোখে রাখা, সঙ্গে করে স্কুল নিয়ে যাওয়া, টিফিন খেয়েছে কিনা দেখা, বোনকে আগলে আগলে রাখা সবই করেছে সুচরিতা। বিয়ের পরেও এর অন্যথা হয়নি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরেও সুপর্ণার দায়িত্ব সুচরিতার ঘাড়েই এসে পড়েছে। সুচরিতা নিজেই বুঝতে পারেনি কবে থেকে ও বড়ো দিদির খোলস ত্যাগ করে সুপর্ণার মা হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই নিয়ে সুচরিতার স্বামী এবং ছেলে প্রচুর হাসিঠাট্টাও করেছে, কিন্তু সুচরিতা কখনও প্রতিবাদ করেনি।

‘সুচি, তুমি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালোমানুষ। নিজের বোনকে ভালোবাসো ক্ষতি নেই কিন্তু এতটা স্বার্থপরও ওকে করে তুলো না যে ওর নিজের চরিত্রই একদিন ওর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মা-বাবাও শক্ত হাতে সন্তানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তাকে শাসন করে কিন্তু তাই বলে কি তারা তাদের সন্তানের শত্রু? তাহলে তুমি কেন সুপর্ণার সব দোষ ঢাকবার চেষ্টা করো?’

‘আমি ওকে কী বলব? ও নিজে পড়াশোনা করেছে, ব্যাংকে চাকরি করে। ও বাচ্চা মেয়ে নয় যে ওকে বোঝাব। সবারই স্বভাবের কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে।’

‘যদি আলাদা আলাদা স্বভাবের কথাই বলো তাহলে ওকে ওর স্বভাব নিয়েই থাকতে দাও। ওর নিজের স্বভাবের জন্য যা কিছু সমস্যা সেটা সুপর্ণার একার, সেটা সমাধানের দায়িত্বও ওর উপরে কেন ছেড়ে দিচ্ছ না? সেখানে তুমি কেন ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? আমার আপত্তিটা এখানেই।’

শেখরের কথাটা ফেলতে পারে না সুচরিতা কারণ সুচরিতা জানে শেখর সত্যি বলছে। কিন্তু মনকে কীভাবে বোঝাবে সুচরিতা। বোনের প্রতি গভীর মমতাবোধ সবসময় সুচরিতাকে দুর্বল করে তোলে। এই যে সুপর্ণা টাকা চেয়েছে সেটা শেখরকে এখনও বলতে পারেনি সুচরিতা। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে নিজের জমানো টাকা থেকেই সুপর্ণাকে কুড়ি হাজার টাকা এখন দিয়ে দেবে। কিন্তু কেনই বা এই টাকার দরকার সুপর্ণার, নিজের মনকেই সুচরিতা প্রশ্ন করে। সুপর্ণা ব্যাংকে চাকরি করে, মাইনেও খারাপ নয়। তাহলে? আর কতদিন সুপর্ণাকে এইভাবে সাহায্য করে যেতে হবে? মনে মনে বিরক্ত হয় সুচরিতা। কেন ও সুপর্ণার মুখের উপর ‘না’ বলতে পারে না? বেশ বুঝতে পারে সুচরিতা, সুপর্ণা ওর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ওকে ব্যবহার করছে।

শেখর বহুবার সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে সুপর্ণা ওকে নিজের কাজ গুছোবার জন্য খালি ব্যবহার করছে। সুপর্ণার এই স্বভাবের জন্য সুচরিতা অনেকটাই দায়ী। বোনের অন্যায় কোনওদিন সুচরিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি উপরন্তু সকলের সামনে ঢাকবারই চেষ্টা করেছে। এমন অনেক সম্পর্ক রয়েছে যেগুলো ছাড়া জীবন এগোতে চায় না অথচ সম্পর্কগুলো শুধু ব্যথাই দেয়। দেওয়ার ইচ্ছেটা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। আর পিছন ফিরে কিছুতেই তাকানো যায় না। অথচ যে পাচ্ছে, তার কিছুতেই আর আশ মেটে না। গোগ্রাসে সারা পৃথিবীটাকে যেন গিলে খেতে চায়।

সুপর্ণার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। অথচ নিজেকে বদলাবার কোনও চেষ্টা নেই ওর। সুচরিতা ভাবে, সুপর্ণা কখনও কি বদলাবে? হয়তো না। অথচ ওর জন্য সুচরিতার সংসারে মাঝেমধ্যেই অশান্তির ঝড় বয়ে যায়। আশকারা তো সুচরিতাই দিয়েছে। যখন তখন এসে কেঁদে পড়া, টাকা ধার চাওয়া, সুচরিতার জীবনে নাক গলানো এগুলো সুপর্ণার অভ্যাস হয়ে গেছে। সন্তানকে শাসন করা যায়, গায়ে হাতও তোলা যায়। কিন্তু একটা বয়সের পরে কেউ কথা শুনবে কি শুনবে না সেটা পুরোটাই তার মানসিকতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু সব জেনেশুনে চুপচাপ বসে থাকাটাও বোকামি। গায়ে হাত তুলে শাসন করা না-ই বা গেল কিন্তু শাসনের ভঙ্গিতে হাত তো তোলাই যেতে পারে, শরীরে না ঠেকালেই হল।

সুচরিতাও মনে মনে দৃঢ় হল, এভাবে আর সুপর্ণার অন্যায়গুলোতে সায় দেওয়া যায় না। বিকেলে সুপর্ণার বাড়ির রাস্তা ধরল। শেখরের ফিরতে রাত হবে, অতএব অর্কই মা-কে অটোতে উঠিয়ে দিল। গলির মুখটাতে অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল সুচরিতা। সুপর্ণাকে অগ্রিম কিছু জানায়নি ফোন করে যা এতদিন করে এসেছে ও। ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল বাজায় সুচরিতা। অল্প অপেক্ষার পরই দরজা খুলে দাঁড়ায় সুপর্ণা। দিদিকে হঠাৎ সামনে দেখে সুপর্ণার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, ‘দিদি তুই?’

সুচরিতার পেছনে আরও কেউ আছে কিনা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে সুপর্ণা শুকনো গলায় আবার জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি তুই? একটা ফোন করিসনি কেন?’

‘ভাবলাম তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব, তাই চলে এলাম। ভিতরে আসতে বলবি না… নাকি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব?’

সুপর্ণাকে পাশ কাটিয়েই সুচরিতা বসার ঘরে পা দেয়। সোফাতে সুপর্ণার কোনও সহকর্মী বসে আছে দেখে সুচরিতা থমকায়। ঘরে চোখ বুলোতেই চোখে পড়ে কার্পেটের উপর কাগজ পেতে হোটেল থেকে আনানো খাবার রাখা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্লেটে খাবার নিয়ে গুছিয়ে সুপর্ণাকে কোনওদিন খেতে দেখেনি সুচরিতা। এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে সুপর্ণার। সুচরিতার চোখ পড়ে সোফায় বসা ভদ্রলোকের হাতেও হোটেলেরই খাবারের একটা বাক্স ধরা। চামচে করে সরাসরি বাক্স থেকেই খাওয়া হচ্ছিল সেটা বুঝতে ভুল হয় না। একটু লজ্জা অনুভব করে। সুপর্ণা নিজে এভাবে খায় ঠিক আছে তাই বলে অতিথির বেলাতেও একই নিয়ম?

সোফায় এসে বসে সুচরিতা। ওর মনে হয়, ভদ্রলোক যেন ওকে দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছেন। ব্যবহারটা কেমন যেন অসহজ মনে হয়।

সুপর্ণা ঘরে এসে বসতেই সুচরিতা চোখ ফেরায় ওর দিকে, ‘নিজেরই তো বোনের বাড়ি… শুধু শুধু ফোন করতে ইচ্ছে করল না। বসে বসে হঠাৎ মনে হল অনেকদিন ফোনে তোর সঙ্গে কথা হয়নি, তোকে দেখিনি। ব্যস চলে এলাম অটো ধরে। তুই কেমন আছিস? তোর কোথাও বেরোনোর নেই তো এখন?’

সুচরিতার মনে হয় সুপর্ণাকে একটু শুকনো লাগছে দেখতে। পাশের ভদ্রলোকটিও কেন জানি না উশখুশ করতে থাকেন। দু’জনকে দেখেই সুচরিতার মনে হয় যেন ওদের জীবনে একটা সাংঘাতিক অঘটন ঘটে গেছে।

‘কী হয়েছে, তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

সুচরিতা জিজ্ঞেস না করে পারে না।

‘হ্যাঁ, মাঝে একটু শরীরটা খারাপ হয়েছিল। দিদি, ইনি ব্যাংকে আমার সহকর্মী। নাম সৃজিত। আমার শরীর খারাপের খবর শুনে আমাকে দেখতে এসেছেন।’

সুচরিতা স্পষ্ট বুঝতে পারে সুপর্ণা মিথ্যা কথা বলছে। ওর নিজের করা প্রশ্নটাই সুপর্ণার মুখে উত্তর জুগিয়েছে এটা কাউকে এসে বলে দেওয়ার দরকার নেই। সুচরিতা শরীর খারাপের প্রশ্নটা না তুললে হয়তো সুপর্ণার ঠোঁটে সদুত্তর কিছু জুটত না।

ছোটো থেকে সুপর্ণাকে দেখছে তাই ওকে বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না সুচরিতার। প্রত্যেকটা গতিবিধি ওর চেনা। অনেকটা বয়সের পার্থক্য দুই বোনের মধ্যে। সুচরিতার জন্মের পর দশ বছর পর্যন্ত ওর মা-বাবা দ্বিতীয় সন্তানের কথা চিন্তাতেও আনেননি। সুচরিতার নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে এবং ওর বারো মাস অসুস্থ থাকার কারণে বাড়ির বড়োরা ওদের পরামর্শ দেন দ্বিতীয় সন্তানের জন্য। কারণ বাড়িতে আর সকলেরই দুটি করে সন্তান ছিল। সুচরিতা একা হওয়ার কারণে খেলার কোনও সঙ্গী ছিল না ফলে ও ধীরে ধীরে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠছিল। সুচরিতার এই সমস্যার একমাত্র সমাধানের রাস্তা ছিল বাড়িতে ভাই কিংবা একটা বোন হওয়া।

ভাই, বোন হওয়ার আগে থেকেই সুচরিতার মা-বাবা ওকে বোঝাতে শুরু করেন বাড়িতে নতুন অতিথি এলে সুচরিতার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সত্যি সত্যিই সুপর্ণার জন্মের পর সুচরিতার শৈশব হারিয়ে গেল সুপর্ণার প্রতি কর্তব্য পালনে। সকলে এসে একটাই কথা সুচরিতাকে বলে গেল, ‘তুই বড়ো দিদি, দশ বছরের বড়ো। তোকে বোনের দায়িত্ব নিতে হবে বই-কি।’ ব্যস সুচরিতাও, বোনের কীসে ভালো, তাতেই নিজেকে সমর্পণ করে দিল। দশ বছরের মেয়েটার ঘাড়ে সুপর্ণা নামের দায়িত্ব বেশ শিকড় গেড়ে বসল।

‘সুচি, তুমি ওর মা নও… তোমারা তো একই মায়ের পেটের বোন, তাহলে তুমি এত কেন চিন্তা করো ওকে নিয়ে?’ কতবার শেখর সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু সুচরিতার অবচেতনে গভীরভাবে ওর মা-বাবা এটাই রোপণ করে দিয়েছিলেন যে সুচরিতার প্রয়োজনেই সুপর্ণাকে সংসারে নিয়ে আসা হয়েছে। ছোটোবেলার কোনও কথা সুচরিতা ভোলেনি। একসঙ্গে যখন খেতে বসত, তখন হঠাৎ যদি সুপর্ণা বিছানা ভিজিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ত অথবা খিদের জ্বালায় কান্নাকাটি জুড়ে দিত, খাবার ফেলে রেখে সুচরিতাকেই দৌড়োতে হতো। এখন সুচরিতার মাঝেমধ্যেই মনে হয় ওই কাজগুলো সত্যিই কি ওর করার কথা ছিল? ওগুলো তো মা-বাবার দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল। বোনকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তারা সুচরিতার কাছে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন? সুচরিতার জীবনে যে সঙ্গীর অভাব ছিল সেটার অভাব পূরণ করে তারা কি সুচরিতার উপকার করতে চেয়েছিলেন? এই ভার আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সুচরিতা বয়ে চলেছে। এখন বড়ো ক্লান্ত বোধ করে সুচরিতা। মা-বাবার প্রতি এই কর্তব্যের থেকে কবে মুক্তি পাবে সুচরিতা? সুপর্ণার ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ে বর্তমানে ফিরে আসে সুচরিতা–

‘এই দিদি, কী ভাবছিস তুই? কোনও কথা বলছিস না কেন?’

সোফায় পড়ে থাকা প্যাকেটগুলোর উপর চোখ চলে যায় সুচরিতার। শহরের নামি কয়েকটা দোকানের নাম লেখা প্যাকেটগুলোয়। অর্ক সত্যি কথাই বলেছিল, বুঝতে পারে সুচরিতা। শরীর খারাপটা বাহানা মাত্র, আসলে সুপর্ণা ঘোরা-বেড়ানো, মার্কেটিং নিয়েই ব্যস্ত ছিল। দিদির একটা খোঁজ নেওয়া দরকার, সেটা ওর মনেও আসেনি।

সুচরিতা লক্ষ্য করে দুটো, তিনটে পোশাক ইতিউতি চেয়ারের উপর পড়ে রয়েছে। দেখে তো নতুনই মনে হচ্ছে। হয়তো সুপর্ণা পরে পরে দেখছিল আর নয়তো পরে দেখাচ্ছিল!

হঠাৎই সুচরিতার মনে হয়, তাহলে কি বসে থাকা পুরুষটির সঙ্গে সুপর্ণার কোনও গভীর সম্পর্ক রয়েছে নয়তো কোনও বাইরের পুরুষের উপস্থিতিতে সুপর্ণা পোশাক বদলাবার মতো নির্লজ্জ আচরণ করে কী করে?

‘তোর কি জ্বর হয়েছিল? ক্লাইমেট বদলাচ্ছে… চারদিকে ভাইরাল চলছে, একটু সাবধানে থাকতে পারিস তো’, এই বলে সুচরিতা চেয়ার থেকে জামাকাপড়গুলো উঠিয়ে একটা জায়গায় জড়ো করে। ঠিক সেই মুহূর্তে সোফায় বসা ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘আচ্ছা সুপর্ণা আমি এখন বেরোচ্ছি।’

‘আপনি উঠছেন কেন, বসুন না… খাবারটা তো এখনও শেষ হল না। সুপর্ণা, তুইও এসে এখানে একটু বস না,’ সুচরিতার গলার স্বরে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে ওরা দু’জনেই চমকে সুচরিতার দিকে তাকায়।

ভদ্রলোক কোনও কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়ান। সুপর্ণাকে দেখেও একটু আনমনা মনে হয় সুচরিতার।

‘অসুস্থ ছিলি যদি তাহলে হোটেলের খাবারগুলো খাচ্ছিস কেন?’ না চাইতেও সুচরিতার চোখ চলে যায় পড়ে থাকা খাবারের কৌটোতে। তেলের মধ্যে মাংসের টুকরোগুলো ভাসছে, একটা কোনও সবজি আর রুমালি রুটি পড়ে রয়েছে। ‘তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল, তাই আর আসার আগে তোকে ফোন করিনি। আমার কিছু টাকার দরকার… অর্কর একটা কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য। তোর কাছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো পাই।’

মুহূর্তেই সুপর্ণার মুখের চেহারা বদলে যায়, বিবর্ণ রং ধারণ করে। কারণটা সুচরিতা জানে তাই আবার জানার চেষ্টা করে না। সুপর্ণাকে টাকা দিয়ে এই প্রথম টাকা ফেরত চাইল সুচরিতা। সুপর্ণাও টাকা নিয়ে কোনওদিন ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সুচরিতা খুব খুঁটিয়ে সুপর্ণার চোখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে কারণ ও বুঝতে পেরেছিল এখানে এসে সুপর্ণার সন্ধেটা মাটি করে দিয়েছে।

আপশোশ হয় সুচরিতার। একই মা-বাবার সন্তান হয়েও দুই বোনের চরিত্র কতখানি আলাদা। একই বাড়ির পরিবেশ কীভাবে দুজনের রক্তে আলাদা প্রভাব ফেলল?

‘আমার কাছে টাকা কোথায়?’ সুপর্ণা অস্ফুটে বলে।

‘কেন? একলা ফ্ল্যাটে থাকিস। তোর স্বামী আর ছেলে দুজনেই অন্য শহরে রয়েছে। তোর পুরো খরচা ভাস্কর পাঠায়। তোর নিজের মাইনের পুরোটা যায় কোথায়? নিজের জন্য একটা পয়সাও তো খরচ করিস না।’

সুপর্ণা অবাক হয়ে যায় দিদির কথা শুনে। সবসময় ওর হয়েই সুচরিতা মুখ খুলেছে তাহলে আজ হঠাৎ দিদি বিপক্ষে কী করে চলে গেল। অথচ সুচরিতা সবসময়েই চেয়েছে সুপর্ণা বিপথে না যাক। প্রতিদিন ভেবেছে, সুপর্ণা এবার নিজেকে বদলাবে। ওর স্বামী, ছেলে সকলেই ওর আচরণে বিরক্ত। সুচরিতারও বাড়ির কেউ সুপর্ণাকে পছন্দ করে না। একমাত্র ওই ঢাল হয়ে সুপর্ণাকে আগলেছে। সেই ঢাল-ই আজ তির হয়ে সুপর্ণাকে আঘাত করতে উদ্যত।

‘একটু একটু করে সংসার থেকে বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছি… অর্কর ভর্তির জন্য অনেকগুলো টাকা লাগবে এটা তো তুই জানতিস। আমাকে সাহায্য করতে হবে না কিন্তু আমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দে। আমার তাতেই কাজ মিটে যাবে,’ উঠে দাঁড়ায় সুচরিতা।

সুপর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছিল কাটলেও এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়বে না। মরা মানুষের মতো ফ্যাকাসে চেহারা হয়েছে ওর। ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সুচরিতা এতটা মুখরা হয়ে উঠতে পারে, এতটা নির্দয় ভাবে সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলতে পারে। সুপর্ণার স্ন্দুর সন্ধের শেষটার যে এমন পরিণাম হতে পারে, সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।

‘দ্যাখ না দিদি, ভাস্কর কিছুই বুঝতে চায় না…’

ভাস্করকে খুব ভালো করেই জানে সুচরিতা। সুপর্ণা বরাবরই স্বামীকে ডমিনেট করে এসেছে। নিজের ইচ্ছে ওর উপর চাপাতে চাপাতে ভাস্করের জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। ছেলেটাকেও কোনওদিন আদর করে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। বাড়ির বাইরেই সময় কাটিয়েছে বেশি। তাই চাকরির বদলি হওয়াতে ভাস্কর যে খুশিই হয়েছিল সেটা সুচরিতার অজানা নয়। চাকরির দোহাই দিয়ে সুপর্ণা ওদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করে। আর এই সুপর্ণাকে এতদিন, এতবছর ধরে সুচরিতা সকলের চোখের আড়ালে স্নেহ মমতা দিয়ে সিঞ্চন করে এসেছে। আজ আপশোশ হয় সুচরিতার।

দম আটকে আসতে থাকে ওর, সুপর্ণার ফ্ল্যাটের ভিতরে। একটা নেগেটিভ এনার্জি সুচরিতাকে সদর দরজার দিকে ধাক্বা মারতে থাকে। নিজের বোনের প্রতি এই ধরনের মনোভাব কোনওদিন সুচরিতা আগে ফিল করেনি। নিজেই ও সবথেকে বেশি দোষী। ঘৃণা হতে থাকে নিজের উপরেই সুচরিতার।

‘দিদি আর একটু বস না।’

‘না সুপর্ণা… আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর সঙ্গে আমার এইটুকুই কাজ ছিল’, বলে সুপর্ণার হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে সুচরিতা বাইরে বেরিয়ে আসে। বাধভাঙা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে সুচরিতার দুই গাল বেয়ে। কী যেন আশায় একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে, ফেলে আসা বাড়িটার দিকে। ওকে পেছন থেকে ডাকার মতো একটা মানুষের মুখও চোখে পড়ে না। গভীর শ্বাস নেয় সুচরিতা। এই তো বেশ ভালো হল। টাকা ফেরত পাবার আশা কম তবে ‘দিদি কিছু টাকা দে’ বলে হাত বাড়ানো সুপর্ণাকে আর দেখতে হবে না। হঠাৎই সুচরিতা বুঝতে পারে ঘাড়ের ভারী বোঝাটা কখন যেন হালকা হয়ে গেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অটো ধরতে এগিয়ে যায় সুচরিতা।

আই অ্যাম নট ভার্জিন

মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই শ্রীতমা ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে। প্রায় মরার মতো ঘুমোচ্ছিল। কাল অনেকটা ধকল গিয়েছে। অ্যালার্ম না দিলে হয়তো উঠতেই পারত না। কাল রাত্রে পার্টি করতে অত দূর যাওয়া উচিত হয়নি। ফিরতে ফিরতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিল। আজ সকালে অডিশন আছে। মোনালিসাটা ছাড়ল না, জোর করে নিয়ে গেল। ওর বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি, যেতেই হবে। লং ড্রাইভে যাবে কোলাঘাট, ওখানে শের-এ-পাঞ্জাব-এ খানাপিনা, পার্টি হবে।

মোনালিসা, শ্রীতমা স্কুল-জীবন থেকে বন্ধু। এক সঙ্গে কলেজেও পড়েছে। মোনালিসা ব্যাংকে চাকরি করে, এখন কলকাতায় পোস্টিং। খাওয়াদাওয়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ না থাকলেও, লং ড্রাইভে যাওয়ার লোভটা ছাড়তে পারল না শ্রীতমা। এটা ওর খুব পছন্দের। কখনও কখনও কার বুক করে একলাই বেরিয়ে পড়ে লং ড্রাইভে। মাঝে মাঝে শ্রীতমা স্বপ্ন দেখে লং ড্রাইভে এক অনন্ত যাত্রায় চলেছে সে। কখনও গন্তব্যে পৌঁছোতে পারে কখনও বা পৌঁছানোর আগেই ঘুম ভেঙে যায়।

লং ড্রাইভ শেষে বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র কিনারে সে একা। ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় থাকে অন্য কারও। যাকে সে চেনে না, জানে না, দেখেনি কখনও। আলস্য ঝেড়ে উঠতে উঠতে কাল রাত্রির পার্টির মজাগুলো মনে পড়ে খুশির রেখা দেখা দেয় শ্রীতমার মুখে।

মোনালিসার বয়ফ্রেন্ড ঈশান ইঞ্জিনিয়র, আইআইএম থেকে এমবিএ করেছে। মাইক্রোসফট-এ বড়ো পোস্টে চাকরি করে। স্মার্ট, হাসিখুশি ছেলে। কাল মজা করে বলছিল, আগে দেখা হলে সে শ্রীতমাকেই প্রোপোজ করত। ঈশানের কথা শুনে মোনালিসা একপ্রস্থ পিটিয়ে নেয় তাকে।

পার্টিতে ঈশানের বন্ধু সূর্য ছিল সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়রিং আর এমবিএ ঈশানের সঙ্গে করেছে, এখন সিঙ্গাপুরে বড়ো মাইনের চাকরি করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। বন্ধুর বার্থডে পার্টি তো মিস করা যায় না কোনও ভাবেই! চারজনে মিলে বেশ এনজয় করেছে কাল। পার্টি শেষে ফেরবার পথে সূর্য‌ শ্রীতমাকে প্রোপোজ করে। মোনালিসা উস্কায়, হ্যাঁ করে দে।

শ্রীতমা হেসে উড়িয়ে দেয়, এটা লালজল পানের আফটার এফেক্ট। দেখবে সকাল হলেই ঘোর কেটে যাবে।

সূর্য‌ শ্রীতমার হাতে হাত রেখে বলে, নো বেবি, ইটস রিয়েল।

বাঁকা হেসে শ্রীতমা হাতের উপর থেকে  সূর্য‌র  হাত নামিয়ে দেয়। বিভিন্ন পার্টিতে এমন ঘটনা অনেক বার ফেস করেছে সে, এমন কথা অনেকবার শুনেছে। পরের দিন তারাও ভুলে যায়, শ্রীতমাও আর মনে করার চেষ্টা করে না।

কাল রাত্রে সকলের সঙ্গে সেও অল্প ড্রিংক করেছিল। তবুও ঘুম ভেঙে সকালে সূর্য‌র মুখটা, সূর্য‌র কথাগুলো কেন যে মনে পড়ে গেল! গত রাত্রির স্মৃতি ঠেলে সরিয়ে রেখে বেড থেকে নেমে আসে শ্রীতমা।

বাথরুম থেকে একেবারে স্নান সেরে বেরোয় সে। সকাল নটা থেকে অডিশন। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে ইন্ডাকশন অ্যাভেনে চাপায় গরম করার জন্য। বেডরুমে এসে ওয়ার্ডরব থেকে নতুন কেনা ওয়েস্টার্ন ড্রেসটা বের করে পরে, হালকা প্রসাধন করে।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে দেখে নেয় নিজেকে। পাঁচ পাঁচ হাইটে, চৌত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ ফিগারটা বেশ মোহময়ী লাগছে এই নতুন ওয়েস্টার্ন ড্রেসটায়। শরীরে চেপে বসা ড্রেসটা স্পষ্ট করে রেখেছে শরীরের বিভিন্ন কার্ভ। চনমনে সেক্সি-সেক্সি ফিল হচ্ছে ভিতর থেকে।

কিচেনে গিয়ে গরম দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেয়ে বেরোনের জন্য রেডি হয় শ্রীতমা। ড্রেসের সঙ্গে মানানসই সিলভার কালারের পেনসিল হিল শু-টা টেনে নিয়ে সোফায় বসে পা গলিয়ে উঠে এসে আরও একবার নিজেকে দেখে নেয় ড্রেসিং টেবিলে। এখন সে আরও দীর্ঘাঙ্গী, পাঁচ ফুট পাঁচ নয়।

পোশাকের সঙ্গে মানানসই আগে থেকে বের করে রাখা হাত ব্যাগটা তুলে নেয়। চেন খুলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সারফেস স্যানিটাইজার স্প্রে ব্যাগে ঢোকায়। নিজে পরে নেয় ডিজাইনার মাস্ক। মোবাইল অ্যাপে ক্যাব বুক করে ফ্ল্যাটের দরজা লক করে, নীচে নামার জন্য লিফ্ট-এ চড়ে শ্রীতমা।

নাকতলায় গলির মধ্যে পাঁচতলা বিল্ডিংটার, তিনতলার ওয়ান বিএইচকে এই ফ্ল্যাটে শ্রীতমা আছে বছর দেড়েক হবে। যখন প্রথম ছবির কাজ শুরু হল, তখন থেকে। ফ্ল্যাটের সামনের সরু রাস্তায় ক্যাব ঢোকে না, সেজন্য ভাড়াটা একটু কম। কাছেই বড়ো রাস্তা, অসুবিধা হয় না । এগিয়ে এসে বড়ো রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, এই যা।

প্রথম ছবিতে সে লিড রোল করেছিল। ছবিটা ভালো বিজনেস করেছিল। তার অভিনয়ে প্রশংসাও হয়েছিল। এর পর পরই দ্বিতীয় ছবিটার অফার পেল। ভালো রেমুনারেশনে কন্ট্যাক্ট হয়েছে। প্যান্ডেমিকের জন্য এখন শুটিং বন্ধ আছে, অসুবিধাটা সেখানেই। ফ্ল্যাটের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, নিজের খাওয়াদাওয়া ও অন্য সব খরচা তো আর বন্ধ নেই। সেজন্য অন্য কাজের ব্যাপারে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

সকাল সকাল একগাদা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকেছে। লিফটে নামতে নামতে মেসেজগুলো দেখে নেয় শ্রীতমা। এতক্ষণ দেখার সময় পায়নি। চেনাজানা লোকজনের গুড মর্নিং মেসেজে ভরা। অচেনা একটা নাম্বার থেকেও মেসেজ এসেছে, সঙ্গে রেড হার্ট লাভ সিম্বল। শ্রীতমা হাসে, কোন পাগলের কাজ কে জানে!

লিফট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বড়ো রাস্তার দিকে এগোয়। অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভারের ফোন ঢুকছে। শ্রীতমা ফোন ধরে বলে, মেন রোডে কালী মন্দিরের সামনে থাকছি। কতক্ষণে আসছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। শ্রীতমা আবার মোবাইলটায় চোখ রাখে। ভাবতে থাকে, অচেনা নাম্বার থেকে কে মেসেজ পাঠাল।

বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াতে লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে শ্রীতমাকে। ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নেয়। ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াতে দরজা খুলে সারফেস স্যানিটাইজার ক্যাবের ভিতরে স্প্রে করে উঠে বসে। শ্রীতমাকে স্প্রে করতে দেখে ড্রাইভার বলে, ম্যাম, আমি এখনই গাড়ি বের করেছি। ভালো করে স্যানিটাইজ করে এনেছি। ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরও তো প্রাণের মায়া আছে! সারাদিনে কত রকমের প্যাসেঞ্জার চড়ছে।

শ্রীতমা হুম বলে চুপ করে যায়। ব্যাগ পাশে রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসে। অডিশনের জন্য কনসেন্ট্রেট করার চেষ্টা করে। একটু এগোতে না এগোতে ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে। রিচা ফোন করছে। ওর প্রথম ফিলম লাভ মি-তে সেকেন্ড লিড ছিল রিচা।

গুড মর্নিং। কী করছিস বল।

আর কী! বসে আছি। তোর খবর বল।

আমিও বসেই ছিলাম। এই ক’দিন হল একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করছি। লিড রোল। ভালো পেমেন্ট করছে। একটু আধটু বোল্ড সিন আছে, এই যা। এমনিতে ইউনিটটা ভালো, সব লোকজনও বেশ ভালো। একটু থেমে রিচা বলে, তুই ওয়েব সিরিজ করবি?

এখনও ভাবিনি। ফিলমের শুট শিগগিরি শুরু হবে বলছে। দেখি, ফিলমের শুট শুরু হয়ে গেলে তো আর হবে না। না হলে হয়তো…

বলিস। বড়ো প্ল্যাটফর্মে এদের একটা নতুন প্রোজেক্ট আসছে। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।

শ্রীতমা মিষ্টি করে বলে, থ্যাংকস।

রিচার ফোনে অন্য একটা ফোন ঢুকছে। একটা ইম্পট্যান্ট ফোন আসছেরে। পরে ফোন করছি, বলে রিচা ফোন কাটে।

শ্রীতমা সময় দেখে। এখনও মিনিট চল্লিশ হাতে আছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে নিউটাউন। আজ ওখানেই অডিশন। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে শ্রীতমা।

শুরুর দিন থেকে ফিলম কেরিয়ারের আজ পর্যন্ত জার্নিটা ভেসে ওঠে শ্রীতমার মনে। পরিস্থিতির চাপে সে যে এক অনিশ্চিত পথে চলতে শুরু করেছিল বছর কয়েক আগে, তা কি আর এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে!

শ্রীতমা সবে মাত্র গ্র‌্যাজুয়েন শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে, সে সময় বাবা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন। আগে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি। ছোটো ভাইটা এইচএস পড়ছে। বাবা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী ছিলেন। একটা নিজস্ব বাড়ি বানিয়ে রেখে গিয়েছেন, এইটাই ভরসার। মাথার উপর একটা ছাদ আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সামান্য পেনশন পান। জমানো টাকা বলতে তেমন কিছু নেই। সে টাকায় সংসার চালিয়ে দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা চালানো খুবই কঠিন। তখন থেকেই কোনও ভাবে ইনকাম করার চিন্তাটা শ্রীতমার মাথায় চেপে বসে।

পাঁচ ফুট পাঁচ-এর দীঘল শরীর, সুন্দর মুখশ্রী আর নজর কাড়া ফিগারের জন্য রাস্তায়, এলাকার ছেলেদের চোখ সব সময় তার উপর পড়ে থাকত। বান্ধবীরাও তার রূপের প্রশংসা করত। সে নাকি বাংলা ফিলম ইন্ডাস্ট্রির নায়িকার আকাল মেটাতে সক্ষম। ছোটোবেলা থেকে শ্রীতমা নাচ শিখেছে আর বড়ো হয়ে কলেজে পড়ার সময় থেকে দুর্গাপুরের নামি নাটকের গ্রুপে নিয়মিত অভিনয় করছে। কলকাতাতেও বেশ কয়েকটা শো করে গিয়েছে। তাই শ্রীতমার মনেও আশা জাগে, হয়তো সত্যিই সে পারবে!

তখন মাস্টার্স-এর ফার্স্ট ইয়ার। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে নিজের ফটো আর রেজিউমে মেল করে পাঠায় শ্রীতমা। কলকাতার একটা নামি শপিং মলের হোর্ডিং-এর জন্য মডেল চেয়ে বিজ্ঞাপন ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে অ্যাড এজেন্সি থেকে রিপ্লাই পেল, সে শর্ট লিস্টেড হয়েছে। ফাইনাল সিলেকশনের জন্য কলকাতায় এসে অডিশন দিতে হবে। সিলেক্ট হয়েছিল। সেই শুরু।

অ্যাড এজেন্সির মালিক সার্থকদার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। সার্থকদার রেফারেন্সে প্রায় প্রতি মাসে একটা দুটো মডেল শুট-এর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে যেত। পেমেন্টও খারাপ নয়। আসা যাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে আট-দশ হাজার টাকা। সংসারের, নিজের আর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ অনেকটাই মিটে যেত সে টাকায়। এমন করেই দুই আড়াই বছর চলে গেল। মাস্টার্সের ফাইনালের আগে মাস কয়েক ব্রেক দিয়েছিল, পরীক্ষাটা ঠিকমতো দেওয়ার জন্য।

মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরনোর আগেই একদিন সার্থকদার ফোন, এবার পাকাপাকি ভাবে কলকাতাতে চলে এসো।

শ্রীতমা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, কেন, কী হল আবার?

কেন আবার কি! তুমি ফিলমের হিরোইন হচ্ছো। আমাদের হাউস থেকে একটা ফিলম প্রোডিউস করছি। আর সেটাতে তোমাকে ছাড়া আর কাকে নিই বলো? তোমার অপোজিটে টলিউডের হট হিরো কাজ করবে। নামটা বলছি না। ওটা এখন সারপ্রাইজ হিসাবেই থাক।

শ্রীতমা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সামনে থাকলে হয়তো সার্থককে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিত। ফোনেই থ্যাংক ইউ সো মাচ বলে একটা চুমু ছুড়ে দেয়।

সে এবার টলিউডের নায়িকা হবে। যে টলিউডে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, সন্ধ্যা রায়, মহুয়া রায় চৌধুরী, ঋতুপর্ণা, শতাব্দী, ইন্দ্রাণী, এই সময়ে মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তী, শুভশ্রী কাজ করছে, সেই টলিউডে তার নামটাও নায়িকা হিসাবে যুক্ত হয়ে যাবে। উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রীতমা ঘরময় নেচে বেড়ায়। সার্থকদার কাছে সে চিরঋণী হয়ে গেল।

সত্যিই এখন আর দুর্গাপুর থেকে যাওয়া আসা করে কাজ করা যাবে না। মডেলিং শুট-এর সময় এক দুদিনের কাজ থাকত। কোনও ভাবে ম্যানেজ হয়ে যেত। সিনেমা, সিরিয়ালে তো তা সম্ভব নয়। কখন কল টাইম দেবে কে জানে। কলকাতায় সেটেল করার কথা শুনেই মা ঝামেলা করতে শুরু করেছে, এবার একেবারে গোল্লায় যাবে, বিয়ে টিয়ে আর হবে না।

শ্রীতমাও থামে না, না হোক বিয়ে তাই বলে তো সে তার কেরিয়ার নষ্ট করবে না। এমন সুযোগ কজন পায়?

চেনাজানা ব্রোকারের মাধ্যমে সার্থক-ই ফ্ল্যাটটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আর অ্যাডভান্স রেন্ট পেমেন্টটাও। ডেবিউ ফিলম হলেও ভালোই পেমেন্ট করেছিল সার্থকদা। হয়তো তাকে বিশেষ পছন্দ করত বলেই।

ফিলমের অফারটা পেয়ে যেন স্বপ্নের দুনিয়াটা শ্রীতমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বেশ কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে দিয়ে কাটল। মহরত থেকে শুরু করে শুটিং এর প্রতিটা দিন, বিদেশে গানের শুটিং, প্রিমিয়ার শো, প্রেস মিট অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে দিল শ্রীতমাকে। বাস্তব যেন পিছনে ফেলে আসা অতীত। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন গ্ল্যামারের জগত্টাই এখন আসল শ্রীতমার কাছে।

প্রথম ছবির ঘোরটা কাটতে না কাটতে দ্বিতীয় ছবির অফারটা পেয়ে গেল প্রভাসদার রেফারেন্সে। প্রথম ছবির ডিওপি প্রভাসদার সঙ্গে শ্রীতমার সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল মরিশাসে।  গানের শুট করতে গিয়ে সার্থকদার অনুপস্থিতে তখন প্রভাসদাই শ্রীতমার ফ্রেন্ড, ফিলজফার, গাইড।

কীভাবে লাইট নিলে, কেমন লুক দিলে ফিলমে তাকে আরও সুন্দর দেখাবে, আলাদা করে সে সব টিপ্স দিত প্রভাসদা। আর নিজের হাতে ক্যামেরার কারসাজি তো করতই। ভবিষ্যতে কীভাবে ক্যারেক্টার বুঝে ফিলম সাইন করবে, সে সব অ্যাডভাইস দিত। এত কিছুর পর কিছু প্রত্যাশা তো থেকেই যায়! ইউনিটের লোকের মুখে রং মাখানো গসিপ হয়তো সার্থকের কানেও পৌঁছেছিল।

প্রভাসদার রেফারেন্সে অন্য হাউসের ফিলমে কাজ শুরু করার পর থেকে সার্থকদা শ্রীতমার ফোন ধরাই বন্ধ করে দিল। শ্রীতমা অফিসে দেখা করতে গেলেও দেখা করেনি। মিটিং-এ বিজি আছে বলে অ্যাভয়েড করেছে। রিসেপসনিস্টকে দিয়ে সে রকমই বলেছিল। এসব হওয়ার পর থেকে শ্রীতমার মনটাও কয়েকদিন বেশ খারাপ ছিল। নতুন লোকজনের সঙ্গে নতুন কাজ শুরু করার পর থেকে মনটাও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

শ্রীতমা শিখে গিয়েছে ফিলম ইন্ডাস্ট্রিতে সম্পর্ক ভাঙা-গড়ায় মনখারাপ করতে নেই। কিন্তু হঠাৎ করে শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সব দিক থেকে মুশকিল হয়ে গিয়েছে। সবে মাত্র একটা ফিলম রিলিজ করেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে সে রকম চেনাজানা পরিচিতি হয়ে ওঠেনি এখনও, যে ডেকে ডেকে কাজ দেবে। এখনও ফ্রেশ ফেস বা স্ট্রাগলিং অ্যাক্ট্রেস বলা যায়।

জমানো টাকা খরচ করতে করতে প্রায় শেষ। শুধু তো নিজের খরচা নয়, বাড়ির জন্যও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। ভাইটা কলেজে পড়ছে তার পড়াশুনার খরচও আছে। ফিলমের শুটিং শুরু হয়নি। এখন শুধু মডেল শুট, ওয়েব সিরিজ আর সিরিয়ালের শুটিং হচ্ছে। তাও অনেক বাধা নিষেধ মেনে।

শ্রীতমার পরিচিত ইন্ডাস্ট্রির মেয়েরা, যারা বিভিন্ন ছোটোখাটো প্রোজেক্টে কাজ করত, অ্যালবাম, শর্ট ফিলম-এ অ্যাক্টিং করত, তাদের অনেকেই আজকাল ওয়েব সিরিজের কাজ করছে শুনেছে। ভালো পেমেন্ট কিন্তু ওয়েব সিরিজগুলোর সবই প্রায় অ্যাডাল্ট কন্টেন্টে ভরপুর।

হাজার লোকের সামনে নিজের নগ্ন শরীর দেখিয়ে উপার্জনে তার ঘোর আপত্তি। আর বাড়ির লোকজন সে এমন কিছু করছে জানতে পারলে একেবারে অনর্থ হয়ে যাবে! এমনিতেই দুর্গাপুর ছেড়ে যখন থেকে কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে, তখন থেকেই বাড়ির সঙ্গে ঝামেলা। শ্রীতমা বোঝাতে পারে না ফিলমের কাজ আসা-যাওয়া করে হয় না, কলকাতায় একটা থাকার জায়গার দরকার।

এই সময় কিছু অ্যাডের কাজ বা মডেল শুট-এর কাজ পেলে ভালো হতো। কিন্তু সার্থকদার সঙ্গে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অ্যাড বা মডেলিং-এর কাজ সে তেমন আর পায়নি। সব জায়গাতেই তো সেটিং আর কমপ্রোমাইজের গল্প। ফিলমে লিড রোল করার পর একদম ছোটোখাটো অ্যাডে কাজ করাটা ঠিক হবে না। তার স্ট্যাটাসে সেটা মানাবে না। বড়ো কোনও ব্র‌্যান্ডের অ্যাড হলে ঠিক আছে। কিন্তু সেরকম যোগাযোগ এখনও হয়নি।

প্রভাসদা বলেছে এমএনসি কোম্পানির একটা নামি ব্র‌্যান্ডের অ্যাড করার কথা চলছে। সেটা হলে শ্রীতমাকে সেখানে প্লেস করবে। বিগ বাজেট, ভালো পেমেন্ট পাবে। সেও কবে হবে কে জানে! কিছু তো একটা করতে হবে। না হলে চলবে কী করে। আজকের অডিশনের খবরটা পেয়েছে পরিচিত এক প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদার কাছ থেকে।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় নটা বেজে গেল। তাড়াহুড়ো করে পৌঁছে দেখে বিভিন্ন বয়সের অনেক ছেলে মেয়ের ভিড়। শ’খানেক তো হবেই। বড়ো প্রোডাকশন হাউস, অফিসটাও বড়ো। বিভিন্ন চ্যানেলে এদের অনেকগুলো সিরিয়াল চলছে। বাংলার এক নম্বর পপুলার চ্যানেলে নতুন একটা পিরিয়ড ড্রামা শুরু হচ্ছে তার জন্য অডিশন। অনেকগুলো ফিমেল ক্যারেক্টারের প্রয়োজন। পনেরো-কুড়িটা তো লিড ক্যারেক্টারই আছে। শ্রীতমা নাম রেজিস্টার করিয়ে অপেক্ষা করে।

প্রভাসের ফোন ঢোকে, হ্যালো, কোথায় আছো? কী করছ? মেসেজেরও রিপ্লাই দিলে না!

পরে ফোন করছি, বলে শ্রীতমা ফোন কেটে দেয়। শ্রীতমা জানে এই কেয়ারিং-এর আড়ালে আসলে নজরদারি করছে প্রভাসদা। ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি ওকে। শুনে হয় নানান নেগেটিভ কথা বলত, নয়তো সঙ্গে চলে আসত। কাজের জায়গায় লেজুড় নিয়ে ঘোরা একদমই পছন্দ নয় শ্রীতমার।

এখানে আসা মেয়েদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশিরভাগই শহরতলীর কোনও না কোনও জায়গা থেকে এসেছে। সঙ্গে মা বা অন্য কোনও অভিভাবক। চেহারা পোশাকআশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সকলেই প্রায় মধ্যবিত্ত ঘরেরই মেয়ে, শুরুর দিনের তারই মতো। সে যেমন কিছু ইনকাম করে সংসারে সাহায্য করবে বলে মডেলিং-এর পথ বেয়ে অভিনয় জগতে ঢুকে পড়েছিল। হয়তো এদের অনেকেই সে রকম পরিস্থিতির মধ্যেই বড়ো বড়ো স্বপ্ন সাজিয়ে এসেছে আজকের অডিশনে। আজকের পর এদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো ভবিষ্যৎ জীবন বদলে যাবে। আবার অনেকেরই স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। হয়তো এই অডিশনের গণ্ডি পার হতে মেনে নেবে অনেক কিছু।

যার কাছে শ্রীতমা অডিশনের জন্য নাম লেখাল সে তাকে চিনতে পারেনি। মনে মনে একটু অভিমান-ই হয় তার। তার একটা ফিলম রিলিজ হয়েছে। শহর জুড়ে হোর্ডিং পড়েছিল তবুও…। শ্রীতমা একপাশে সরে এসে বসার জন্য সাজিয়ে রাখা একটা চেয়ার টেনে বসে।

এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছে, ভিতরে ঢুকে অডিশন দিয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রত্যেকের ভিন্ন অভিব্যক্তি চোখ মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। কেউ ঘেমে নেয়ে অস্থির। ঘটনার আকস্মিকতায় কারও মুখে কালো মেঘের ছায়া। কেউ বা ফিরছে দুষ্টু হাসি মেখে শরীরী ভঙ্গিতে হরিণী চপলতা নিয়ে। উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে পোশাকে প্রসাধনে শ্রীতমাই শ্রেষ্ঠ বলা যেতে পারে।

অপেক্ষায় থাকা মেয়েদের অনেকেই ঘুরে ফিরে শ্রীতমাকে দেখছে। ওরা ওর সাজ পোশাক, ওর সৌন্দর্য দেখছে নাকি ওদের মধ্যে কেউ কেউ ওকে রিকগনাইজ করতে পেরেছে লাভ মি ফিলমের নায়িকা হিসাবে। একটু প্রাউড ফিল করে।

শ্রীতমা নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার জন্য মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি শুরু করে। ফেসবুক পেজ ঘুরে ফিরে দেখে অস্থির সময়টুকু কাটানোর জন্য। ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। কেমন যেন সাফোকেটেড লাগছে শ্রীতমার। নিজেকে ভ্যালুলেস, ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো ফিলমের হিরোইন। সিরিয়ালের একটা ক্যারেক্টার পাওয়ার জন্য এভাবে এতক্ষণ বসে থাকতে হবে! ভাবে প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদাকে ফোন করে একটু ঝাড় দেবে, এ কোথায় আসতে বললে? এখানে তো দেখছি গরু ছাগল সব সমান। আলাদা কোনও ট্রিটমেন্টই নেই। আগে জানলে আসতাম না। আবার পরক্ষণেই ভাবে, রাজুদার কি আর দোষ। হেল্পিং মাইন্ড নিয়ে তো খবরটা দিয়েছে।

শ্রীতমা ভাবে এত এত মেয়ের এত কাজের অভাব! এত অর্থের অভাব, তবেই না! হলগুলো খোলা থাকলে সে সিরিয়ালে নাম না লিখিয়ে আবার মঞ্চের নাটকে ফিরে যেত। কিন্তু সমস্যাটা তো সেই অর্থের। অর্থের জন্যই আজ মেয়েগুলো ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের নামে সফট পর্ন করছে। হয়তো পর্দায় যা দেখানো হচ্ছে পর্দার পিছনে করতে হচ্ছে তার থেকেও বেশি।

অনেকটা সময় অভিনয় অভিনয় করে কাটিয়ে দেওয়ার পর এখন আর ফেরবার জায়গা নেই। মনে প্রাণে বাঁধা পড়ে গিয়েছে এখানে। শুধু বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরা। অভিনয়ের জায়গাটা দিন দিন ছোটো হয়ে আসছে। শরীর প্রদর্শনই এখন মুখ্য অভিনয়। সরকারই তো ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এমন সব কনটেন্ট সকলের হাতের মধ্যে পৌঁছে দিতে। পছন্দ মতো অ্যাপ ডাউনলোড করে সাবস্ক্রাইব করো। তারপর মোবাইলে হাত ছোঁয়ালেই কত না ওয়েব সিরিজ, শর্ট ফিলম। গুলে যাও ঘোলা দুনিয়ায়!

বসে বসে উলটোপালটা ভাবতে ভাবতে শ্রীতমা শুনতে পেল তার নাম ডাকছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে সপ্রতিভ ভাবে এগিয়ে রিসেপসনিস্ট-এর সামনে যেতে, সে দেখিয়ে দিল কোন ঘরে যেতে হবে। পারমিশন নিয়ে শ্রীতমা অডিশন রুমে ঢোকে। সুন্দর করে সাজানো অফিসরুমের একটা ওয়ালে লাগানো ডিসপ্লে বোর্ডে এদের হাউসের পপুলার সিরিয়ালগুলোর বিভিন্ন ফোটো লাগানো আছে। ফলস সিলিং-এ লাগানো ডিজাইনার এলইডি লাইটগুলো ঘরের মধ্যে একটা মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এ পরিবেশ যেন সম্মোহিত করার জন্য।

বড়ো এগজিকিউটিভ টেবিলের ও পাশে কাঁচাপাকা চুলের সুদর্শন যে-ভদ্রলোক বসে, উনি দেবাদিত্য বোস। সিরিয়ালের নামি পরিচালক। টেবিলের পাশে বসা অন্য জন হাউসের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার।

শ্রীতমাকে ওরা বসতে বলে। ঘরে ঢোকা থেকে বসা পর্যন্ত ওদের নজর শ্রীতমার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী কী করেছে, এখন কী করছে রুটিন প্রশ্ন করে। নানা রকম হ্যাজানো প্রশ্ন কথাবার্তা শুরু করে। শ্রীতমা ভাবে নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে ওকে, তাই এতটা সময় নিচ্ছে।

মাথা গরম করা প্রশ্নটা হঠাৎ উড়ে আসে।

আর ইউ ভার্জিন?

শ্রীতমা নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের সব রক্ত মাথায় চড়ে ধাক্কা দিচ্ছে। বার্স্ট করে শ্রীতমা…হাউ ডেয়ার ইউ আস্ক মি সাচ রাবিশ?

ওরা থতমতো খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। শ্রীতমার চিৎকার বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে।

শ্রীতমা আরও রেগে টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে, চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়, নো। আই অ্যাম নট দ্যাট। আই অ্যাম নট ভার্জিন।

প্রোডাকশন কন্ট্রোলার কোনও মতে বলে সরি, আপনাকে সিলেক্ট করতে পারলাম না।

ইয়োর সিলেকশন! মাই ফুট। সজোরে দরজা খুলে গট গট করে বেরিয়ে যায় শ্রীতমা। অডিশন রুমের দরজাটা নিস্তব্ধতা ভেঙে সশব্দে বন্ধ হয়। শ্রীতমার সদর্পে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাইরে উপস্থিত সকলে।

বাড়ি ফিরে হাতব্যাগ, জুতো, জামা এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোফায় হতাশ শরীর এলিয়ে দেয় শ্রীতমা। সকালে লাভ মেসেজ করা সেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন কল আসছে। শ্রীতমা ফোন ধরে খিঁচিয়ে ওঠে, কে রে বো…দা সকাল থেকে ডিস্টার্ব করছিস?

সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। আমি সূর্য‌। পরশু সিঙ্গাপুর ফিরে যাচ্ছি। তার আগে কি একবার দেখা করা যায়?

শ্রীতমা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। এর মধ্যে প্রভাসদার ফোন ঢুকছে।

শ্রীতমা রিকল করতে থাকে প্রথম কবে সে ভার্জিনিটি লুজ করেছিল কার সঙ্গে! তারপর… তারপর…

সে কি সূর্য‌কে, প্রভাসদাকে বলে দেবে, আই অ্যাম নট ভার্জিন। তারপরেও কি প্রভাসদা তাকে কাজ খুঁজে দেবে! আগের মতো গাইড করবে? তার পরেও কি সূর্য‌ তাকে বলবে, বেবি আই লাভ ইউ?

শ্রীতমা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। কে জানে অন্য প্রান্তে সূর্য‌ বা প্রভাসদা উত্তরের অপেক্ষায় এখনও লাইনে আছে কিনা!

কয়েদি

আজকাল শব্দটা সারা দিনরাত মাথার ভিতর বাজতে থাকে। ধুপ ধুপ ধুপ… আওয়াজটা ঘুমের মধ্যেও শুনতে পায় সরতাজ। রাত যত গভীর হয়, চারপাশের ক্রমবর্ধমান নৈঃশব্দের সাথে সাথে শব্দটার তীব্রতাও বাড়তে থাকে। মাথার ভিতরকার স্নায়ুগুলি যেন সব জট পাকিয়ে গেছে, মুক্তির আশায় প্রাণপণ টানছে, ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে মাথার খুলি ভেদ করে। একটা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে সরতাজ। একটা ঘোরতর বিস্ফোরণ প্রয়োজন, যেটা তার নামের জায়গায় সেঁটে থাকা নম্বরটাকে ধ্বংস করে দেবে।

সরতাজ সিং, গাঁও সুলহানি, জেলা ফিরোজপুর, পঞ্জাব প্রদেশ। শব্দবন্ধগুলো মনে হয় যেন গত জন্মের কোনও বিস্মৃতপ্রায় অতীতের ছায়া। এখন সরতাজ শুধুই কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ। দিনের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা জেলের কমিউনিটি কিচেনের রাবণের চিতার মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে পাহাড়প্রমাণ ডেকচিতে ডাল সবজির জাউ রাঁধে সরতাজ। গনগনে ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে সরতাজ সিং-এর। সেই ধোঁয়ার ভিতরে কখনও কখনও একটা চেনা মুখ ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়।

বড়ো আবছা সে মুখ, এখন আর মনে পড়ে না স্পষ্ট। শুধু সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে ঝিকিয়ে ওঠা নাকছাবিটা স্পষ্ট দেখতে পায় সরতাজ। লম্বা ভারী হাতাটা ডালের ভিতর চালাতে চালাতে মাথার ভিতরটা প্রাণপণে হাতড়াতে থাকে সে। দরদর করে লবণাক্ত ঘাম গড়ায় তার মাথা, গলা, বুক, পিঠ বেয়ে জিভে ঠেকে নোনতা স্বাদ। সরতাজ এলোমেলো হয়ে জড়িয়ে যাওয়া স্মৃতির তন্ত্রী ঘেঁটে চলে। কবে কোথায় পথের কোন বাঁকে দেখা হয়েছিল সেই চেনা মুখের সাথে, কিছুতেই মনে পড়ে না।

এগারো বছর কম সময় নয়। সরতাজ সিং এগারোটা বছর এই জেলের উঁচু দেয়ালের ও-প্রান্তের পৃথিবীকে দেখেনি। আজকাল আর মনে পড়ে না বাইরের পৃথিবীর কথা। মাথার ভিতরে সব যেন ধোঁয়াটে লাগে। বেশি ভাবতে গেলে মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়। দীর্ঘদিন ধরে জেলের ভেতরে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চলেছে তার উপরে।

জেলের ডাক্তারসাহেব বলেছেন, সরতাজ সিং-এর মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্মৃতিশক্তির উপর ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশার অস্বচ্ছ আবরণ। আজকাল মাঝে মাঝে বুকের বাঁ দিকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তখন। বয়স বাড়ছে সরতাজ সিং-এর। তার পাহাড়ের মতো বিশাল দেহটা দেখে নতুন কয়েদিরা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকায়, পুরোনোরা মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে মাথা নাড়ে। আহা, এই সরতাজ সিং-এর নামে একদিন গোটা ফিরোজপুর জেলা কাঁপত। কত যে খুন জখম তোলাবাজির কেস ছিল তার নামে, সে হিসাব বোধ করি সে নিজেও রাখত না। ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল সকলেই সমীহ করে চলত এই সরতাজ সিংকে।

সরতাজ সিং-এর কোনও দলের দরকার হতো না, দলেদের দরকার হতো তাকে। সে নিজেই ছিল একটা প্রতিষ্ঠান। সেসবও দিন ছিল, যখন সরতাজ সিং ছিল ফিরোজপুরের মুকুটহীন সম্রাট।

আজ আর সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। সরতাজ সিং-এর সিংহের কেশরের মতো দাড়িতে পাক ধরেছে। কালোর মাঝে মাঝে রূপোলি রেখা ভেসে উঠেছে। তার সেই আগেকার রুক্ষ কঠোর দৃষ্টি আজকাল কেমন যেন ক্লান্ত, করুণ দেখায়। কখনও কোনও অলস বিকেলে জেলের হেঁশেলের বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বিড়বিড় করে চলে সরতাজ। কী যে বলে, কাকে দোষারোপ করে কে জানে!

নিজের হাতের তালু উলটেপালটে দেখে। কী যেন খুঁজে চলে খাঁজে কড়া পড়া দুই হাতের রেখায়। কখনও আবার গলা ছেড়ে গান ধরে পঞ্জাবের মাটির সুরে। অন্য কয়েদিরা আসা যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়ায় কিছু মুহূর্তের জন্য। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সেই গান কান পেতে শোনেন আরেকজন, তিনি জেলর গগনজিত কপূর। মাথার ভিতরে সেই সুর গুমরে মরে তাঁরও। সরতাজ সিং-এর গান শুনে তিনিও ফিরে যান তাঁর ফেলে আসা অতীতে।

ভাতিন্ডা থেকে ফিরোজপুরে বদলি হয়ে এসে সরতাজ সিং-এর নাম কানে আসতে দেরি হয়নি গগনজিত কপূরের। তাঁকে এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জলে বাস করে কুমীরের সাথে শত্রুতা চলে না। সরতাজ সিংকে ভয় পায় না, এমন লোক ফিরোজপুরে নেই। সুতরাং নবাগত অফিসারকে যে সরতাজকে ভয় হোক বা সমীহ, কিছু একটা করতেই হবে তা তো বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

গগনজিত কপূরও শুরু শুরুতে সরতাজ সিংকে সমঝে চলার চেষ্টাই করেছিলেন। দেশি কাট্টা, ম্যাগাজিনের অবৈধ চোরাচালানের বিশাল রমরমা ব্যাবসা ছিল সরতাজ সিং-এর। পুলিশ, প্রশাসন সবাই ছিল তার হাতের মুঠোয়। ভোটের আগে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, দুই দলের ফান্ডেই সরতাজ সিং-এর অনুদান জমা হতো। সাথে তাদের হাতে হাতে ঘুরত সরতাজ সিং-এর কারখানায় তৈরি দেশি অস্ত্র। দুই হাতে জলের মতো টাকা ছড়াত সরতাজ। নেতা মন্ত্রীরাও ছিল তার কৃপাধন্য। সরতাজ সিং-এর হাত যার মাথার উপর, গদিও তারই খাতে বরাদ্দ হতো।

কিন্তু দিন কারও একরকম যায় না। কোন ছিদ্রপথে সরতাজ সিং-এর ইস্পাত-দৃঢ় হৃদয়ে ভিতর এক চিলতে তুলতুলে নরম দুর্বলতা গোপনে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছিল, তা সে বোধ করি নিজেও জানতে পারেনি। নইলে সরতাজ সিং-এর কি নারীর অভাব? এতদিন যারা তার বিছানা গরম করেছে, তারা তো সরতাজ সিং-এর সামান্য ইশারার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। প্রেম ভালোবাসার মতো দুর্বলতা তার ছিল না কোনও দিন। আর ঠিক সেই কারণেই সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তারপর একদিন সব ওলোট পালট হয়ে গেল হঠাৎই। সরতাজ সিং প্রেমে পড়ল।

গগনজিত কপূর উঠে গিয়ে খোলা জানলার সামনে দাঁড়ালেন। বাইরে আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। বৃষ্টির ছাঁট সূচের মতন এসে বিঁধছে তাঁর চোখেমুখে। তবু জানলাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না। সরতাজ সিং আজ আবার গাইছে। বুকের ভিতরকার কোন চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা তীব্র যন্ত্রণা গলে গলে মিশছে সেই সুরে। জেলখানার উঁচু প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে সেই সুর, অনুরণিত হচ্ছে এক সুতীব্র হাহাকার। গগনজিত বেশ শব্দ করে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। ঠিক যতটা জোরে শব্দ হলে সংগীতের শব্দ ভেঙে চুরে যায়, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করলেন তিনি। বুকের ভিতরটা তোলপাড় করছে। চেয়ারে বসে দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরলেন জেলরসাহেব।

চাঁদনি মেয়েটা চাঁদের মতোই সুন্দর ছিল। সহজ সরল পঞ্জাবি মেয়ের মদ-মাতাল হাড়বজ্জাত বাপটা মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। মেয়ের বিয়ে দিয়ে কিছু আদায় উশুল করে নেবার ধান্দায় ছিল বুড়ো। অন্তত এমন চটকদার মেয়ের পরিবর্তে কয়েক মাসের মতো পাঁইটের ব্যবস্থা তো হয়ে যেত।

বস্তিতে লুকোনো চোরাই মালের রেড করতে গিয়ে চাঁদনির দেখা পেয়েছিলেন গগনজিত কপূর। কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি স্থির হয়েছিল মেয়েটার মুখে। অভিজ্ঞ দৃষ্টি বুলিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন, একে দিয়ে তাঁর কাজ হবে। এই মেয়ে হবে তাঁর টোপ। সরতাজ সিংকে বঁড়শিতে গাঁথতে পারলে প্রোমোশন তাঁর পাকা, কেউ আটকাতে পারবে না। শুধু প্রোমোশনের লোভ নয়, সরতাজ সিং-এর মতন সাক্ষাৎ শয়তানকে শিক্ষা দেওয়ার একটা সুতীব্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছিল তাঁকে।

পুলিশের উর্দি গায়ে চাপিয়ে শয়তানটাকে সেলাম ঠোকার অসহায়তা আর সহ্য হচ্ছিল না। চাঁদনির বাপটাকে টোপ গেলাতে অসুবিধে হয়নি। টাকা আর মদের বোতল পেয়ে বুড়ো খুশি মনে কন্যেকে জবাই হতে পাঠিয়েছিল। চাঁদনি বুড়ো বাপের হাতে পায়ে ধরেছিল, বুড়োটা দুবার হ্যাট হ্যাট করে লাথি মেরে টলতে টলতে গুনগুন করে গান ধরে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল সেদিন। একবারের জন্যও ফিরে তাকায়নি মেয়ের দিকে।

সরতাজ সিং-এর মতো পাক্কা খেলুড়েও চাল চিনতে ভুল করেছিল। চাঁদনিকে নিজে হাতে করে ট্রেনিং দিয়েছিলেন গগনজিত কপূর। একটা সোজা সরল বস্তির মেয়েকে ঘষে মেজে পুলিশের চর হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু কপূরসাহেব সেই অসাধ্যই সাধন করেছিলেন। সরতাজ সিংকে প্রেমের জালে জড়িয়ে তার সব গোপন খবর তুলে দিতে হবে পুলিশের হাতে। খুব অল্প সময়ে সব শিখে নিয়েছিল চাঁদনি, হয়ে উঠেছিল পুলিশের শিক্ষিত চর। সে তখনও জানত না, কোন কাজের জন্য তৈরি করা হচ্ছে তাকে। নির্মোহ, বীতস্পৃহ মন নিয়ে খুব অল্প সময়ে মধ্যে সব শিখে নিয়েছিল চাঁদনি।

সময় থেমে থাকে না। সরতাজ সিং-এর দিকে চাঁদনিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা নাটকের দরকার ছিল, সেটাও মসৃণ ভাবে উতরে গেছিল। মাঝরাত্তিরে কোনও অনাথিনী যদি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে পালিয়ে সরতাজ সিং-এর আশ্রয় ভিক্ষা করে, সর্বশক্তিমান সরতাজ কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? সরতাজ সেই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারেনি, ত্রস্ত চড়ুই পাখির মতো তিরতির করে প্রাণভয়ে কাঁপতে থাকা মেযেটা শুধুই অভিনয় করছে। কিংবা হয়তো সত্যিই সে অভিনয় করছিল না। সরতাজ সিং-এর মতো ভয়ংকর মানুষের হাতে নিজেকে তুলে দেওয়ার মুহূর্তে নরম মেযেটা হয়তো সত্যিই শঙ্কা, লজ্জায় কেঁপে উঠেছিল।

হায় মোহ! মোহের কারাগার থেকে নিজেকে রক্ষা করা কি আর এতই সহজ? ইতিহাস সাক্ষী, এই রিপুর কারণে বারবার রক্তক্ষয় হয়েছে, বদলে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র। দুটি মানুষের বুকেও মোহের প্লাবন উত্তাল হয়ে উঠছিল সেই দিনগুলোয়। ভযংকর সরতাজ, কুখ্যাত সমাজবিরোধী সরতাজ, যার ভয়ে সারা ফিরোজপুর কাঁপে, শিশুর মতো হৃদয়ে আশ্রয় খুঁজে চলেছিল আরেকটি হৃদয়ে একটা সাধারণ মেয়ের প্রতি অন্ধ মোহ ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছিল তাকে। আর আরেকজন, যিনি নিজের হাতে চাঁদনিকে তুলে দিয়েছিলেন শয়তানের হাতে, তাঁরও বুকের ভিতর যে কী ভীষণ ঝড় চলছিল, তা সেদিন আর কেউ জানতে পারেনি।

একদিকে চাঁদনির প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ, অপরদিকে তাঁর কর্তব্য, প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয় করছিল তাঁকে। কখনও মনে হতো, থাক আর দরকার নেই, ফিরিয়ে নিয়ে আসি তাকে। আবার মনে হতো আর তো মাত্র কটা দিন। চাঁদনি তার দায়িত্ব সুচারুরূপেই পালন করে চলেছে। গত দুই মাসে সরতাজের একখানা বড়ো কনসাইনমেন্ট ধরা পড়েছে। আরও কিছু মালপত্র উদ্ধার হয়েছে সীমান্তের গ্রামগুলি থেকে। সরতাজ সিং-এর ব্যাবসায় একটা বড়োসড়ো ধাক্কা দেওয়া গেছে। এইখান থেকে ফিরে আসা যায় না।

হায়, যদি সেদিন তিনি ফিরিয়ে আনতেন চাঁদনিকে। গত এগারো বছর ধরে এই প্রশ্নটাই নিজেকে বারবার করেছেন গগনজিত কপূর। কেন? কীসের পেছনে ছুটছিলেন তিনি? কী পেতে চেয়েছিলেন? সরতাজ সিং-এর মতন পাষণ্ডের দিকে সব জেনেশুনে কেন ঠেলে দিয়েছিলেন চাঁদনিকে? আর চাঁদনি? তাকে তো তিনি নিজের হাতে দক্ষ চর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। নিজের হাতে যত্ন করে শিখিয়েছিলেন চরবৃত্তির প্রথম আবশ্যিক পাঠ, একজন সুদক্ষ চরের হৃদয় থাকতে নেই। প্রেম, দয়া-মায়ার মতন হৃদয়াবেগের কোনও জায়গা নেই সেই কাজে। সে কী করে এত বড়ো ভুল করল? বোকা মেয়েটা কী করে সরতাজ সিং-এর মতো একটা পাষণ্ডের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল?

এরকমই ভাবেন গগনজিত কপূর, ভাবতে ও বিশ্বাস করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। হয়তো নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার এই চেষ্টাটাই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন গত এগারোটা বছর ধরে। ভেবে শান্তি পান যে, চাঁদনি সত্যিই ভালোবাসেনি সরতাজকে। শুধু ক্ষণিকের জন্য আত্মবিস্মৃত হয়েছিল। সরতাজ ওকে মিথ্যে প্রেমের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করেছিল, বোকা মেয়েটা একটা ভুল করেছিল। নইলে সরতাজের প্রেমে পড়তে পারে না সে। চাঁদনি শুধু তাঁর, গগনজিত কপূরের। নিষ্ফল আক্রোশে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন গগনজিত।

চাঁদনির তরফ থেকে সবরকম খবরের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছিল। নরম কোমল মেযেটা নাগিনির মতো ফোঁস করে মাথা তুলেছিল। তেজোদৃপ্ত স্বরে গগনজিত কপূরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জানিয়েছিল, আর কোনও ভাবেই সরতাজের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করা যাবে না। সরতাজকে সে ভালোবাসে।

ভালোবাসে! এত বড়ো কথা? চাঁদনি সরতাজ সিংকে ভালোবাসে? একটা সমাজবিরোধী, দাগি অপরাধী, সাক্ষাৎ শয়তানের দূত, চাঁদনি নাকি ভালোবাসে তাকে! সারা শরীরের রক্ত প্রবল বেগে মস্তিষ্কের দিকে ছুটতে থাকে গগনজিত কপূরের। প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠেন তিনি। চাঁদনিকে যে-নরক থেকে তুলে এনেছিলেন তিনি, সেখানকারই যোগ্য সে। নইলে স্বেচ্ছায় কেউ সরতাজ সিং-এর কণ্ঠলগ্না হতে চায়?

ছি ছি, একটা নরকের কীট, সে কি না দংশন করবে গগনজিত সিং-এর বাগানের ফুলকে! সেই মুহূর্তে তিনি ভুলে যান, তিনি নিজেই তো সেই উদ্দেশ্যে চাঁদনিকে পাঠিয়েছিলেন সরতাজ সিং-এর কাছে। ভুলে যান, তখন চাঁদনি তাঁর কাছে ছিল শুধু তাঁর উদ্দেশ্যপূরণের, উপরে ওঠার সিঁড়ি। নিস্ফল আক্রোশে নিজের হাত কামড়াতে থাকেন গগনজিত কপূর।

সরতাজ সিং তার জীবনে মেয়েমানুষ কম দেখেনি। তবে এতদিন নারীদেহ তার কাছে শুধুই ছিল ভোগের উপকরণ, রাত শেষ হলে উচ্ছিষ্টের মতন যাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা যায়। কিন্তু চাঁদনি মেযেটা অন্যরকম। আজকাল সরতাজের একটা সুস্থ জীবন পেতে খুব ইচ্ছে করে। একটা সুখী গৃহকোণ, চাঁদনিকে নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনের প্রতি বড়ো লোভ হয় সরতাজের। প্রথমবার কোনও নারীকে তার শুধু শরীর নয়, আস্ত একটা মানুষ বলে মনে হয়। যার নরম চোখে চোখ রেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা জীবন।

চাঁদনিকে নিয়ে এই ফিরোজপুর, এই অপরাধের জগৎ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে সরতাজ। এখানে থাকলে তার অপরাধ, তার কলঙ্কিত অতীত, তার পিছু ছাড়বে না। চাঁদনিও তাই চায়। অর্থের অভাব নেই তার। দুজনে মিলে নতুন কোনও জায়গায় তাদের সুখের নীড় গড়ে তুলবে। ভাবতে ভাবতে তৃপ্তিতে সরতাজ সিং-এর ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়। বক্ষলগ্না প্রেয়সীর কপালে চুমু খায় স্নেহভরে।

 

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। দীর্ঘ জ্যৈষ্ঠদিনের শেষের এই বৈকালিক বর্ষণ শীতলতার পরশ বুলিয়ে গেছে তাপদগ্ধ মৃত্তিকার বুকে। কিন্তু দীর্ঘ এগারো বছর ধরে যে-প্রচণ্ড দাহ চলছে গগনজিত কপূরের বুকের ভিতর, তা নিভবে কোন শান্তিজলে?

সন্ধ্যা নেমেছে। সরতাজ সিং-এর গান থেমে গেছে কখন। কয়েদিদের নম্বর মিলিয়ে একে একে সেল-এ ঢোকানো হচ্ছে। সেদিনও এমনই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা ছিল। দিন শেষে আজকের মতোই বৃষ্টি হয়েছিল সেদিনও। গোটা ফিরোজপুর শহরটা সেদিন সেজেছে আলোর মালায়। সরতাজ সিং-এর বিয়ে বলে কথা, উত্সবই হবে বই কি।

পুলিশ চৌকির নিঃসঙ্গ কেবিনে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে চলেছিলেন গগনজিত কপূর। আহ্, অপেক্ষার প্রহর কী দীর্ঘ! আজ চাঁদনি ফিরে আসবে, বিয়েবাড়ির আলো নিভে যাবে, বাজনা থেমে যাবে। সরতাজ সিং-এর মোহজাল ছিন্ন করে চাঁদনি ছুটে আসবে গগনজিতের কাছে, তাঁর বাহুডোরে ধরা দেবে তাঁর প্রেয়সী।

এতক্ষণে তো সরতাজ সিং-এর কাছে খবর পৌঁছে যাওয়ার কথা। যাকে ভালোবেসে সরতাজ সিং জীবনসঙ্গী বানাতে চলেছে, সে শুধুমাত্র একজন পুলিশের চর। আগাগোড়াই মিথ্যে দিয়ে সাজানো, পুরোটাই তার অভিনয়। নিজের মনেই একা বসে মিটিমিটি হাসতে থাকেন কপূরসাহেব।

জলদি চলুন স্যার, সরতাজ সিং তার হবু স্ত্রীকে বিয়ে মণ্ডপ থেকে তুলে টানতে টানতে জিপে বসিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে। মেয়েটাকে কিছু করে না ফেলে।

খবরটা পেয়ে পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছিল গগনজিত কপূরের। প্রাণপণ দ্রুতগতিতে গাড়ি ছুটিয়েছিলেন তিনি। তবু দেরি হয়ে গেছিল, খুব দেরি হয়ে গেছিল সেদিন। গিয়ে কী দেখেছিলেন তিনি? চাঁদনির রক্তাক্ত নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। সরতাজ সিং একটা ভারী কাঠের বাটাম দিয়ে তার গায়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে, ভোঁতা শব্দ হচ্ছে, ধুপ ধুপ ধুপ…।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সরতাজ সিং-এর চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আট দশজন সেপাই মিলেও ধরে রাখতে পারছিল না তাকে। পাগলের মতো চিত্কার করে চলেছিল সরতাজ সিং, কেন? কেন? কেন? সেই চিত্কার কপূরসাহেবের কানে সেদিন হাহাকারের মতো শোনাচ্ছিল। দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছিলেন তিনি।

এগারো বছর কেটে গেছে। ফিরোজপুর ছেড়ে আর যাওয়া হয়নি গগনজিত সিং-এর। ওপরতলায় সমস্ত যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে এই জেলেই রয়ে গেছেন তিনি। পদটা হয়তো জেলার কিন্তু তিনি নিজে জানেন, সরতাজের মতন তিনিও কয়েদি এখানে! চাঁদনি এক অদৃশ্য সম্পর্কে বেঁধে দিয়ে গেছে তাঁদের দুজনকে। এই তাঁদের শাস্তি। সরতাজকে ঘৃণা করেন তিনি, প্রবল ঘৃণা। আর সেই ঘৃণাই এগারো বছর ধরে চাঁদনিকে বাঁচিয়ে রেখেছে গগনজিত কপূরের বুকের ভিতর।

স্যারজি, জলদি আসুন, জেলের নিরাপত্তারক্ষীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন জেলরসাহেব। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তার দিকে।

কী হয়েছে?

স্যার, কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ…, বলে থেমে যায় নিরাপত্তারক্ষী।

কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ, সরতাজ সিং, গাঁও সুলহানি, জেলা ফিরোজপুর, পঞ্জাব, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে জেলের হেঁশেলের বারান্দায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। যেন অনেকদিন পরে স্মৃতির আস্তর সরিয়ে দেখা মিলেছে সেই নাকছাবি ঝিকিয়ে ওঠা নরম মুখের। সরতাজ সিং-এর চোখের দৃষ্টি আজ স্থির, শান্ত। সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি মিলেছে এতদিনে।

মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন জেলর গগনজিত কপূর, নিস্পন্দ নিশ্চল। জেলের দেয়ালগুলো যেন কাছে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, ঘিরে ধরছে তাঁকে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন গগনজিত। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু বাতাস চাই তাঁর, একটু বাতাস…

ক্যানভাস

দুচোখের পাতা অর্ধেক খুলতে না খুলতেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল সাত সকালের সোনালি রোদের ছটা। বিছানার পাশের জানলার ভারী পর্দাগুলো সরানো। এ নিশ্চয়ই অয়নের কাজ। এত বারণ করি তবুও শুনবে না। আমাকে বিরক্ত করে যে ও কী আনন্দ পায় কে জানে! এত রাগারাগি, চ্যাঁচামেচি কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না। সবসময় ওই এক ভালোমানুষের ভাবমূর্তি, অসহ্য!

ওকে যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। কী ধাতুতে গড়া! কম তো অত্যাচার করি না। বিয়ের আগেই জানিয়েছিলাম আমার আর রূপমের খোলামেলা সম্পর্কের কথা। যাতে ও এই বিয়েতে রাজি না হয়। কিন্তু কোথায় কী! আমার কোনও কথারই কোনও ফল হয়নি। তিন মাস হয়ে গেল বিয়ে, এখনও ওকে ছুঁতে পর্যন্ত দিইনি আমার শরীর। তবুও সে একই রকম নিরুত্তাপ! আমার মেজাজ, অহেতুক ঝগড়াঝাঁটি, জিনিসপত্র ভাঙা সব সহ্য করছে নিঃশব্দে।

বাবা যেদিন আমার বিয়ের ভাবনার কথা প্রথম বলেছিল পিকলুদাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব করেছিল তার শান্তশিষ্ট সহকর্মী অয়নের নাম। সব দেখে শুনে বাবা-মা একবারে রাজি হয়ে যায়। আমার আপত্তির পরোয়া কেউ করেনি। রূপমও তখন ছিল না আমার কাছে। দিন কাটাচ্ছিল কলকাতার কোনও এক রিহ্যাবে।

সন্ধে নামলেই অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে থাকি আজকাল। আকাশের অগুনতি তারাদের ভিড়ে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। আজও বেতের হেলানো চেয়ারটায় বসে একমনে ভাবছিলাম রূপমের কথা। আজ প্রায় ছমাস হতে চলল, দেখা হয়নি আমাদের। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানি না আমি।

কী করছিস এখানে? তারা গুনছিস? পেছন থেকে চুপি চুপি বলল ঝুম্পাদি, আমার পিসতুতো দিদি।

আরে, তুমি কখন এলে? পিকলুদা আসেনি?

এসেছে। ওই তো ড্রযিংরুমে আছে অয়নের সঙ্গে। কিন্তু গুনগুন একি চেহারা হয়েছে তোর? ফ্যাকাশে চোখমুখ, এলোমেলো চুল!

ধুস! ছাড়ো তো। সাজগোজটা কোনও কালেই আমার দ্বারা ঠিক হয় না।

সে আমি জানি। তাই বলে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো হয়ে থাকবি। অয়ন কী ভাবে বলতো? আহত স্বরে বললাম, অয়ন কী ভাবে! আচ্ছা, আমার ভাবনার পরোয়া কেউ কখনও করেছে ঝুম্পাদি? তোমরা তো জানতে যে রূপমকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তবুও জোর করে, রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে বাড়ির সকলে মিলে আমাকে ঝুলিয়ে দিলে অয়ন পুরকায়স্থ নামক এক নিপাট ভদ্রলোকের গলায়!

তুই একটা আস্ত পাগল রে গুনগুন! এখনও ওই বদমেজাজি, নেশাখোর ছেলেটার কথা ভাবছিস? নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, আর অয়নকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

তোমরা জানো না, রিহ্যাবে যাবার আগে রূপমকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ওর জন্যে অপেক্ষা করব। কথা না রাখতে পারার জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছি আমি প্রতিটা দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে। আমার জীবনে আর কোনও রং অবশিষ্ট নেই গো ঝুম্পাদি। স্রেফ পড়ে আছি একটা ফাঁকা ক্যানভাসের মতো।

আমার সামনে এসে দাঁড়াল ঝুম্পাদি। বলল, এখন কথা খেলাপির জন্যে কষ্ট পাচ্ছিস আর রূপমকে বিয়ে করলে অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতিই রে বোকা মেয়ে।

 

( ২ )

ড্রাইভিং সিটে বসে আছে পিকলুদা। পাশে অয়ন। পেছনে আমি আর ঝুম্পাদি।

জায়গার নামটা যেন কী?

ওই তো শামুকতলা থেকে কিছুটা দূরে। গ্রামের নাম একটা বলেছিল বটে রঞ্জন কিন্তু সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের পৈতৃক বাড়ি ওখানে। ঝুম্পাদির প্রশ্নের উত্তরে বলল পিকলুদা।

দেখেছিস এই একজন মানুষ! কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি ঠিক মতো না জেনেই রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি। বলি জায়গাটার নামটা তো শুনবে খেয়াল করে। তাহলে গুগল ম্যাপে একটু সার্চ করে দেখতাম। গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বলে উঠল ঝুম্পাদি।

পিকলুদাও দমবার পাত্র নয়। আরে রাখো তো তোমার গুগল ম্যাপ-ট্যাপ। বিরাট টেক স্যাভি হয়েছে আজকাল! শামুকতলা বাজারে পৌঁছে ফোন করতে বলেছে রঞ্জন। ওখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ও। তারপর নিয়ে যাবে গন্তব্যে। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কলকাতায় রেখে অনেকদিন বাদে দেশের বাড়িতে এসেছে রঞ্জন, আমার ইউনিভার্সিটির রুমমেট। সেদিন ফোনে আমন্ত্রণ জানাল ওদের গ্রামের বাড়িতে দু-একটা দিন সপরিবারে কাটিয়ে যাবার। এই উইক-এন্ডে তিনদিন পরপর ছুটি আছে। তাই লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কম খরচে ছোটোখাটো একটা আউটিং হয়ে যাবে। ঠিক কিনা বল, গুনগুন?

জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে পিকলুদার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। ঝুম্পাদিরা নিঃসন্তান। তাই ঘোরাফেরা, হইচই করেই চেষ্টা করে নিজেদের জীবনের শূন্যতাটাকে ভরিয়ে রাখতে। আজকাল ওদের সঙ্গী হয়েছি আমি আর অয়ন। আমাদের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা অন্ধকার নদীটাকে আলোয় ভরাতে চায় ওরা।

 

( ৩ )

একটু দূরেই ভুটান পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নাম না জানা পাহাড়ি ঝোরা। ধারে কাছে ঘরবাড়ি বিশেষ নেই। নৈঃশব্দের ভিড়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটা। চারপাশে কত রকমের ফুলের গাছ। নিকোনো উঠোন। গ্রামের বাড়ি হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রুচির ছাপ স্পষ্ট।

সন্ধের মুখে দোতলার ঘরে চলছিল গল্পগুজব। রঞ্জনদা দামি স্কচের বোতল খুলে বসেছেন। ওঁকে সঙ্গ দিচ্ছে পিকলুদা আর অয়ন। রাঁধুনি সোমরাজ প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে কুচো চিংড়ির পকোড়া আর ফ্রায়েড কাজু। কফির কাপ হাতে আমি আর ঝুম্পাদি নির্বাক দর্শক। কথায় কথায় রঞ্জনদা বলছিলেন অকৃতদার বিরাজকাকু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওনার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন, তাই বহুদিন ওনারা গ্রামছাড়া। পনেরো বছর আগে হঠাৎ বিরাজকাকু ফিরে আসে এখানে। বাবা গত হয়েছেন। মা অথর্ব। অকূল সমুদ্রে খাবি খাচ্ছি একলা আমি। বিরাজকাকুকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। সব দাযিত্ব ওঁর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেলাম কলকাতা, রুজিরুটির টানে। বিরাজকাকু না থাকলে সব সাত ভূতে খেত এতদিনে। শিল্পী মানুষ তো, তাই খুব শৌখিন। যত্ন করে আগলে রেখেছে আমার পৈত্রিক ভিটেমাটি, জমিজিরেত।

রঞ্জনদার একটু টিপসি লাগতে শুরু করেছে সবে। মাঝে মাঝেই বাঁক বদলাচ্ছে কথার স্রোত। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একমাথা কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক।

আরে বিরাজকাকু আসুন আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তাঁকে দেখে বলে উঠল পিকলুদা।

অয়ন-এর সঙ্গে তো পরিচয় হয়েছে। এই আমার মিসেস ঝুম্পা আর ওটি আমার শ্যালিকা গুনগুন।

আমার দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক কেমন যেন চমকে উঠলেন। অবাক চোখে দেখছিলেন আমাকে। সেই দৃষ্টিতে যে কী ছিল বলে বোঝানো যাবে না। রাগ? দুঃখ? ভয়? আনন্দ? নাকি অন্য কিছু? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার! ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অয়নকে বললাম আচ্ছা বিরাজকাকু ওভাবে কেন দেখছিলেন আমাকে?

কী জানি! রঞ্জনদা বলছিলেন উনি একটু আপনভোলা গোছের মানুষ।

আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ওঁর চোখ দুটো মনে পড়লেই কাঁটা দিচ্ছে গায়ে কে জানে আবার মাথাটাথা খারাপ কী না? এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় একা থাকেন। বেশ সন্দেহ হচ্ছে।

একটা অভয় দেবার হাসি হেসে অয়ন বলল অত ভেবো না। আমি, মানে আমরা সকলে আছি তো। কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। মোটা চাদরটা আমার গায়ে টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল অয়ন।

 

( ৪ )

ঘুমের ওষুধ ছাড়া আজকাল ঘুম আসে না সহজে। কিন্তু কাল রাতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ওষুধ খাবার কথাটা। তবুও অনেকদিন পর নিখাদ শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি আমি। হয়তো এই শান্ত পরিবেশে এসে অস্থির মনটাও বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা অয়নের দিকে। শিশুর মতো সারল্য ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।

ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। হালকা মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সূর্য। সকাল সকাল বৃষ্টিস্নান সেরে আরও বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে গাছগাছালি। কখনও কখনও মেঘছেঁড়া রোদ এসে পড়ছে তাদের গায়ে। ভেজা শরীরে রোদের আদর মেখে ঝিকমিক করে উঠছে বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলো। পরক্ষণেই কোথা থেকে এক টুকরো মেঘ এসে বিষাদের পর্দা টেনে দিচ্ছে সেই সোহাগি আলোর প্রবাহপথে।

রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে একটা ঘরের কাছে এসে থেমে গেল পা দুটো। দরজাটা হাট করে খোলা। জানলা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে একটা ক্যানভাসের ওপর। দেখি হাতে রঙের প্যালেট আর পয়েন্টেড তুলি নিয়ে বিরাজকাকু একমনে তাকিয়ে আছেন ফাঁকা ক্যানভাসটার দিকে। শুনেছিলাম সব শিল্পীর কাছেই তাঁর সৃষ্টি নিছক কাজ নয়, সাধনা। হয়তো বিরাজকাকু সে রকমই কোনও সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন। মনে মনে সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন কিছু। একটু পরেই যা তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠবে এই শূন্য ক্যানভাসের ওপর। পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন বিরাজকাকু। সেই একই রকম দুর্বোধ্য চাহনি।

 

আলিপুরদুয়ার জেলার এই অঞ্চলে অনেক জনজাতির মানুষের বাস। এদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন একটা সময়। তাই গ্রামের মাঝে তৈরি হয়েছে একটা বড়োসড়ো প্রটেস্টান্ট গির্জা। দুপুর দুপুর চার্চ, সিমেট্রি ঘুরে আমরা সবে ফিরেছি। এমন সময় সোমরাজ এসে বলল কাকাবাবু সেই সকাল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া কিছুই করেননি। আপনারা একবার ডাকবেন? শরীরটরির ঠিক আছে কিনা দেখবেন একটু?

সেকি! বিরাজকাকু তো কখনও এমন করেন না। শঙ্কিত গালায় বললেন রঞ্জনদা।

বিস্তর হাঁকডাকের পর অবশেষে খুলল দরজা। এদিক ওদিক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে দেখে বিরাজকাকুর চোখ স্থির হল আমার চোখের দিকে। একটা অস্বস্তি ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে। একটু একটু করে আমার কাছে এগিয়ে আসছিলেন বিরাজকাকু। বাড়তে থাকা হৃদকম্পটা টের পাচ্ছিলাম ভালো ভাবে। নিজের অজান্তেই কখন যেন শক্ত করে ধরে ফেলেছি আমার পাশে দাঁড়ানো অয়নের হাতটা।

কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? সেই যে আমাকে ম্যারেজ রেজিস্ট্যারের অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে বলেছিলে, মনে পড়ে? তুমি আর এলে না তো! কত খুঁজেছি তোমায়। বন্ধু, পড়শিরা বলল, তোমার বাড়ির লোকেরা নাকি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে বিয়ে হবে তোমার। সত্যিই হয়েছিল? জানো, সব ছেড়ে এসেছি আমি। সেই শহর, পুরোনো রাস্তা, গলি, চৌমাথা যা কিছু তোমার কথা মনে করাত, স…ব।

খড়খড়ে গলায় বলা কথাগুলো শুনে আমার সারা শরীরটা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমার সামনে বিরাজকাকু নয় রূপম দাঁড়িয়ে আছে। আজ যদি সে ফিরে আসে তবে এভাবেই অভিযোগের তিরে বিদ্ধ করবে আমাকে। কাঁপুনিটা যত বাড়ছিল, তত শক্ত করে ধরছিলাম অয়নের হাতটা। সকলেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিহ্বল ভাবে কথা বলছেন শুধু বিরাজকাকু, তুমি প্রায়ই অভিযোগ করতে আমি কত কিছু আঁকি কিন্তু কখনও তোমার ছবি আঁকি না। বিশ্বাস করো, তুমি চলে যাবার পর আমি আর অন্য কিছু আঁকতে পারিনি। রং তুলির আঁচড়ে শুধু ধরে রাখতে চেয়েছি তোমাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার। দিনের পর দিন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে। এতদিন ধরে যে-ব্যর্থতার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তার থেকে আজ হয়তো মুক্তি পাব আমি। সেই চোখ, সেই মায়াভরা দৃষ্টি… সব অতীত আমার সম্মুখে। আমি পারব এবার। দেখে নিও ঠিক পারব তোমার ছবি আঁকতে। এসো আরফিন, বসো এখানে।

রঞ্জনদা অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, ও আরফিন নয়, গুনগুন। অয়নের স্ত্রী।

বিরাজকাকু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তুই জানিস না রঞ্জন, ডিব্রুগড়ে আমাদের বাড়ির পাশে থাকত ওরা। আরফিন, আমার আরফিন।

আবার আরফিন! বললাম না ওর নাম…

জানি না হঠাৎ অয়নের কী হল। রঞ্জনদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ছেড়ে দিন রঞ্জনদা, এসব বুঝবেন না বিরাজকাকু। দেখছেন না একটা ঘোরের মধ্যে আছেন উনি, বন্দি হয়ে আছেন ভালোবাসার মায়াজালে। আরফিন এখনও ভীষণ ভাবে জীবন্ত ওনার অনুভবে। তাকে ফিরে পাবার ইচ্ছে এতটাই প্রবল যে বাদামি চোখ আর বড়ো বড়ো আঁখিপল্লবের গুনগুন ওনার কাছে ধরা দিচ্ছে আরফিন হিসেবে। সেদিনের আরফিন আর আজকের গুনগুনের মধ্যে যে পনেরোটা বছরের ফারাক, সে খেয়াল ওনার নেই। একটা ইলিউশনকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন উনি। আসুন না আমরা বাঁচতে দিই ওনাকে।

বিরাজকাকুর দিকে মুখ ফিরিয়ে অয়ন বলল, হ্যাঁ আরফিন, ও আপনারই আরফিন। আঁকুন বিরাজকাকু। ঘুমিয়ে থাকা শিল্পীমনকে জাগিয়ে তুলুন আবার। শূন্য ক্যানভাস ভরে উঠুক রঙে রঙে।

বিরাজকাকু মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছেন আমাকে। আর আমি, অয়নকে। কোথা থেকে একটা হালকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল আমাদের। ভেতরের কাঁপুনিটা থেমে গিয়েছে কখন যেন। অয়নের বাম হাতটা কিন্তু এখনও রয়েছে আমার ডান হাতের ভেতর, নির্বিকারে উষ্ণতা বিনিময় করছে তারা একে অপরের সঙ্গে।

 

নিজভূমে পরবাসী

ঊর্মিলা হন্তদন্ত হয়ে ক্যাব-এ উঠে পড়ল। তার কপালে, চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাজারও বিরক্তি মুখে মেখে প্রাণেলও উঠে পড়ল একই গাড়িতে। মে মাসের সূর্যের প্রখর তেজে চারিদিক ঝলসে যাচ্ছে। প্রাণেল সিটে বসেই রুক্ষ্ম ঝলসানো গলায় ঊর্মিলাকে বলল, কি যে করো সারাদিন! ছেলেটার দিকে নজর দিতে পারো না। ও দিন দিন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। ভালো স্কুলে প্রচুর টাকা দিয়ে অ্যাডমিশন করা নয়, ছেলে গোল্লায় গেলে গার্জিয়ান মিটিং-এ অপমান হজম করা।

ঊর্মিলা নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। প্রাণেলের কথার প্রত্যুত্তর দেবার প্রয়োজন সে বোধ করল না। ঊর্মিলার কাছ থেকে কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে প্রাণেল গলার স্বর চড়িয়ে বলল, কী হল! কথা বলছ না কেন! নিজের ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি বলে ঠিক মানতে পারছ না।

ঊর্মিলা আর চুপ করে থাকতে পারল না। প্রাণেলের চোখে চোখ রেখে বেশ ভারী গলায় সে বলল, আমি সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি বুঝি চাকরি ফেলে! আমার না হয় মা হিসাবে অনেক ত্রুটি আছে, একথা আমি মেনেই নিলাম। তুমি বাবা হয়ে কোন কর্তব্যটি পালন করো শুনি? একটা কম্পিউটার সেন্টারে পাঁচ ঘন্টার পার্ট টাইম জব করে বাড়িতে বসে আয় করো। যে-টাকা ইনকাম করো তাতে ডাল-ভাতের খরচা হয় না। আজ আমি প্রাইভেট ব্যাংক-এ জব করছি বলে সংসারের চাকা গড়গড়িয়ে চলছে।

প্রাণেল বলল, ও তুমিই যেন পৃথিবীতে একা মহিলা যে ইনকাম করে সংসার চালাচ্ছ! এখন সব মহিলাই রোজগার করে স্বামীদের হেল্প করার জন্য, তাতে হয়েছে কি!

ঊর্মিলা বলল, বাহ্ চমৎকার! দুহাতে রোজগার করে সংসারের জন্য উপার্জন করব আবার কথাও শুনব! প্রাণেল বলল, কথা শুধু শুনছ কি! সে হতাশ গলায় বলল, আমি সংসারের জন্য খুব বেশি টাকা আনতে পারি না বলে, প্রায় রোজই খোঁটা শুনতে হয়। ক্যাব এসে পড়ল তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ঊর্মিলা আর প্রাণেল দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।

ঊর্মিলা বলল, প্রাণেল, তোমাকে যখন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, তখন সকলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। বিয়ের পর সতেরো বছর সংসারের জন্য ঘরে বাইরে লড়াই করছি। এতদিন পর তোমার সঙ্গে লড়াই করতে ভালো লাগে না। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি আগেই হেরে বসে আছি। বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল। আর আমি পারছি না।

প্রাণেল নিশ্চুপ থেকে একটু হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঊর্মিলা বলল, সামনের বছর ছেলে মাধ্যমিক দেবে। তার যদি নিজে থেকে পড়াশোনার কোনও আগ্রহ না থাকে তাহলে আমার বা তোমার কী দোষ! সারাক্ষণ ওই কম্পিউটার অথবা মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকে ঋক। দ্যাখো ওই করে চোখটা খারাপ হবে। আর বাদবাকি অঙ্গে জং ধরে যাবে অল্প বয়সে। কত বলি একটু খেলাধুলা কর বাইরে বেরিয়ে কিন্তু কে কার কথা শোনে! কী যে মোহ লাগিয়ে দেয় আধুনিক যন্ত্রগুলো, কে জানে! যন্ত্রগুলো দিনরাত ছেলেমেয়েদের শৈশব-কৈশোরকে অযথা নির্দয় ভাবে নিষ্পেষণ করতে থাকে। ভাগ্যিস আমাদের সময়ে এসব ছিল না। এত মন-মগজ ঘুরিয়ে দেওয়ার জিনিস থাকলে পরীক্ষায় পাশটুকু হতো না। আজকাল বাচ্চারা এত অল্প বয়সে হাতের নাগালে সবকিছু পেয়ে যায় যে, তাদের ভালোমন্দ বোধটুকু তৈরি হওয়ার সময় পায় না।

প্রাণেল ঊর্মিলার কথা ভ্রূক্ষেপ না করে ঘরে জামা ছাড়তে ছাড়তে বিরক্তিভরে বলল, যা গরম পড়েছে আর পারা যাচ্ছে না। যতদিন যাচ্ছে গরম বাড়ছে। কথা বলতে বলতে ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে খেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আহ! কী যে তেষ্টা পেয়েছিল!

ঊর্মিলা প্রাণেলের উপর স্বাভাবিক অধিকারবশত উগ্র গলায় বলল, রোদ থেকে ফিরে ওই বরফ ঠান্ডা জল খাওয়ার মজা বুঝবে। একে তো আরামপ্রিয় শরীর। দিনের পর দিন শরীর অতিরিক্ত আরাম পেয়ে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কথায় বলে না, যত্নের ধানে পোকা লাগে তোমারও হয়েছে তাই।

প্রাণেল হাওয়ায় ওড়া হাসি হেসে বলল, তোমার এই চোখ মুখ লাল করা শাসনটা আমার খুব ভালো লাগে, তাই শরীরের উপর নির্বিচারে নির্যাতন করি। তুমি কি এখন বেরোবে?

ঊর্মিলা বলল, আর ভালো লেগে কাজ নেই। ভালো লাগতে লাগতে ভালোলাগা একসময় তলানিতে দাঁড়াবে, তখন মন্দলাগার ভিড়ে ভালোলাগাকে আলাদা করতে পারবে না। ঋকের স্কুলে গার্জিয়ান মিটিংয়ে জন্য ছুটি নিয়েছি তো আজ। কথা শেষ করেই সে রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

প্রাণেল দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটে বেজে গেছে। সময়গুলো কেমন ঝড়ের বেগে বয়ে গেল। পার হয়ে গেল ঊর্মিলার সঙ্গে তার দীর্ঘ সতেরো বছর। ঋকও হু হু করে বড়ো হয়ে গেল। ঊর্মিলার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের বয়সও বাড়ল। চব্বিশ বছরের সেই ঊর্মিলাই আজ বয়সের হাত ধরে চল্লিশের দোরগোড়ায় এসে উপনীত হয়েছে। প্রাণেলকে ভালোবেসে চব্বিশ বছরে বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে ঊর্মিলা।

সবে সে তখন এমবিএ করে ব্যাংক-এ চাকরি পেয়েছে। তারপর দু-একটা ব্যাংক পরিবর্তন করেছে সে, জব লাইফে আত্মতুষ্টির জন্য। সে যাই হোক সংসারের বোঝার ভার প্রাণেলের চেয়ে তার ঘাড়েই পড়েছে বেশি। সেই চাপেই বোধ হয় চব্বিশ বছরের ছেলেমানুষি আবেগ সব বিদায় নিতে শুরু করেছে নীরবে। ঊর্মিলা তা নিজেও বুঝতে পারেনি হয়তো। ঘরে বাইরে একা হাতে সবটুকু সামলাতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই।

ঊর্মিলার যখন বিয়ে হয় সত্যিই সে তখন সুন্দরী। সাদা কাগজের মতো গায়ে রং। মেদহীন ছিপছিপে চেহারা। মাঝারি উচ্চতা। দেবী প্রতিমার মতো একঢাল ঘন ঢেউখেলানো চুল পিঠ পর‌্যন্ত বিস্তৃত। মুখশ্রীটি পানপাতার মতো। ঝিনুকের খোলের মতো চোখে বাদামি তারা। সে রূপের ঝলকানি কমে এসেছে। গায়ের রং আর উচ্চতা ছাড়া সবকিছুরই পরিবর্তন হয়েছে।

মেদহীন চেহারা কিছু অপ্রয়োজনীয় চর্বি এসে দখল করেছে। মুখের মধ্যে হাজার ক্লান্তি দিনের শেষে জমা হয়েছে। বাদামি তারার চোখ দুটো উজ্জ্বলতা হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে। ঢেউখেলানো চুলে ঢেউয়ে গতি কমে আসায় বব ছাঁট হয়েছে। প্রাণেলের অবশ্য ঢেউয়ে গতি কমা পিঠ পর্যন্ত চুলই পছন্দের ছিল।

ঊর্মিলা প্রথমদিকে প্রাণেলের পছন্দের গুরুত্ব দিয়েছিল। পরে চাকরির উন্নতিতে সে কর্পোরেট দেখনদারিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। সে নিয়ে প্রাণেলও খুব বিরোধিতা করেনি। সে শুধু হাসতে হাসতে বলেছিল, চুলের উপর এভাবে রাগ দেখাতে পারলে! একটুও কষ্ট হল না তোমার! আমার সারা জীবনের শান্তির ঘুম গেল। যে-ঘ্রাণে আমি ঘুমোই, আবার নতুন সকালে জেগে উঠি সেটার উপর এতটা জুলুম না করলেও পারতে।

ঊর্মিলা সেদিন খুব হেসে বলেছিল, তুমি আমার রাগ তো পছন্দ করো। তোমার মনে হয় রাগটা মেয়েদের অলংকারের মতো। তোমার উপরে তো সবসময় রাগ করতে পারি না। আর রাগ করলেও স্থায়ীত্ব কম। তাই চুলের উপর চিরস্থায়ী রাগ বর্তালাম।

ঊর্মিলার পায়ের শব্দে অতীত সরে গিয়ে বর্তমান এসে পড়ল প্রাণেলের সামনে। প্রাণেল বলল, কী করছিলে এতক্ষণ রান্নাঘরে! আমি কখন থেকে সোফায় বসে আছি চায়ের প্রতীক্ষায়। ঋক এখনও বাড়ি ফেরেনি? ঊর্মিলা ম্যাক্সিতে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, তোমার ছেলের খাবার ব্যবস্থা করলাম। ঋক এখুনি ফিরবে। সাড়ে চারটে বাজছে। চাউমিন রেডি করে ক্যাসারোলে ভরে রাখলাম। একটু সরে বসো, ফ্যানের তলায় এমন বসেছ হাওয়া পাই না আমি। প্রাণেল একটু নড়েচড়ে বসল ঊর্মিলার কথায়।

ঋক হন্তদন্ত হয়ে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এমন ভাবে ঘরে ঢুকল যে, দেখে মনে হল সে রাজ্য জয় করে ফিরেছে। প্রাণেলের নিজের ছেলেকে আজ বড়ো অচেনা লাগে। ঋকও আজকাল প্রাণেলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলে। প্রাণেল ভাবে মাঝেমাঝে বাবা-মার সঙ্গেও এত মেপে কথা বলা যায়! তবু এ যুগের ছেলেমেযো বোধ হয় প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতে চায় না।

ঋক আগে অবশ্য এরকম ছিল না। সে বরাবর হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল স্বভাবের ছিল। মা হলেও ঊর্মিলার সঙ্গে তার যথেষ্ট সখ্যতা ছিল। প্রাণেল শাসন করলেও সে শাসন ভালোবাসা মিশ্রিত ছিল বলে, তা ঋকের মনে কখনও অপমান বোধ তৈরি করতে পারেনি। তার সুকুমার মুখটা দেখলে প্রাণেলের পুত্রস্নেহ বিগলিত হতো। ঊর্মিলার মতো দেখতে হওয়ায় সকলেই বলাবলি করত, ঋক জন্ম থেকেই মায়ের রূপ পেয়েছে। মাতৃমুখী পুত্র নাকি খুব সুখী হয় ইত্যাদি। এখন সেই ঊর্মিলাই হয়তো ছেলেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ঊর্মিলার সঙ্গেও কথাবার্তা যে খুব বেশি হয়, তা নয়।

ঋক যেন গত চার বছরে নিজেকে কেঁচোর মতো বাবা-মার থেকে গুটিয়ে নিল। ঊর্মিলার খুব কষ্ট হয় ছেলের এই স্বভাবে। প্রিয়জনের পরিবর্তনকে সে কখনও-ই মানতে পারে না। সে প্রাণেলের হোক বা ঋকের। মুখ ফুটে কিছু না বললেও আড়ালে চোখের জল ফেলে। কতবার প্রাণেল তা লক্ষ্য করেছে। প্রাণেলের কোনও পরিবর্তিত আচরণে খারাপ লাগলে এক আধবার নীচু গলায় বলত, সকলেই পরিস্থিতির সঙ্গে পালটাচ্ছে। আমি নিজের লোকদের কাছে অপরিচিত হয়ে উঠতে পারছি না বলে এত কষ্ট। আমিও যেদিন তোমাদের কাছে অচেনা হয়ে যাব, সেদিন তোমাদেরও আমাকে মেলাতে অসুবিধে হবে।

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ঊর্মিলা একটু হলেও আজ শিখেছে। বাধ্য হয়ে আবেগের কিছু অংশ তাকে কাটছাঁট করতে হয়েছে। তাই প্রাণেল সংসারের খুব বেশি দাযিত্ব না নিলেও সে নিশ্চুপ থাকে। ঋকের খারাপ ব্যবহারের কোনও জবাব সে দেবার প্রয়োজন মনে করে না। ঊর্মিলা নির্দ্বিধায় নিজের কাজ করে যাওয়াটাকেই লক্ষ্য মনে করে। সব ভুলে প্রতিদিনের মতো ছেলের জন্য সে যত্ন সহকারে খাবার বানিয়ে রেখেছে।

ঋক বেশ বিরক্তি ভরা গলায় বলল, আমার চাউমিন করেছ?

ঊর্মিলা শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ করেছি। তুই যেদিন যা খেতে চেয়েছিস কোনদিন তোকে দেওয়া হয়নি! আমি আমার সাধ্যমতো তা করে দিয়েছি।

ঋক ঝাঁঝালো গলায় বলল, থামো কত দাও আমার জানা আছে! ছোটোলোকের মতো আগের সপ্তাহে টানা মুড়ি খেয়েছি। ডিসগাস্টিং।

ঊর্মিলা এবার একটু চড়া সুরে বলল, আগের সপ্তাহে আমার অফিসে কাজের চাপ ছিল তুই জানতিস। আর মুড়ি বুঝি ছোটোলোকের খাবার!

ঋক বলল, একদম তাই। মা, তুমি শুধু দুহাতে রোজগার করেই গেলে, স্ট্যাটাস মেনটেন করতে শিখলে না। তোমরা বাবা সত্যিই পারো।

ঊর্মিলা ছেলের এ কথার প্রত্যুত্তর দেবার প্রয়োজন না মনে করে বলল, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। ডাইনিং টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তোকে খাবার দিয়ে বাবাকে চা করে দেব।

ঋক বাথরুম যেতে যেতে বলল, মা, তুমি না অতিরিক্ত কথা বলো। আমি কি জানতে চেয়েছি বাবার জন্য তুমি কী করবে! আমার খাবার টেবিলে রেখে দাও। আমি খেয়ে নেব। আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি! ঋক বাথরুমে চলে গেল।

ঊর্মিলা ঋকের জন্য খাবার ঠিক করে চায়ে জল বসাল। সে ভাবল সত্যিই ঋক বাচ্চা ছেলে নয়, অনেক বড়ো হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল ছুটির দিনে ঋককে খাবার টেবিলে সঙ্গ দেবে। কিন্তু তার সব ইচ্ছা হাওয়ায় বুদবুদের মতো নিমেষে মিলিয়ে গেল।

চা হয়ে গেছে। ঊর্মিলা চায়ে কাপ হাতে নিয়ে প্রাণেলের কাছে গিয়ে বলল, ধরো। প্রাণেল বলল, তুমি খাবে না! ঊর্মিলা বলল, খাব। রান্নাঘর থেকে কাপটা নিয়ে আসি। প্রাণেল শশব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি বসো। আমি এনে দিচ্ছি। ঘেমে নেয়ে গেছ পুরো।

প্রাণেলের প্রায়ই ইচ্ছে করে ভালো রোজগার করে ঊর্মিলাকে বিশ্রাম দিতে। ঊর্মিলাকে দেখে তার বুকটা চিনচিন করে ওঠে। বড়োলোক বাবার খোলস ছেড়ে কতদিন আগে ঊর্মিলা তার কাছে চলে এসেছে। তার কাছে আসার পর থেকেই সংসারের হাড়িকাঠে ঊর্মিলা নিজেকে বলি দিয়েছে। ভালোবেসে কী পেয়েছে ঊর্মিলা তা কোনওদিন হিসাব করেনি প্রাণেল। সে হিসাব করেনি বলেই মাঝেমধ্যে কারণে-অকারণে নিজের মেজাজকে জাহির করতে গিয়ে নিদারুণ আঘাত দিয়ে ফেলেছে ঊর্মিলাকে। তার কাজের জন্য পরে সে অনুতপ্তও হয়েছে।

ঊর্মিলার হাতে চা তুলে দিয়ে প্রাণেল বলল, ঋক খেয়েছে?

ঊর্মিলা কী যেন চিন্তা করছিল। সে হকচকিয়ে বলে উঠল, খেয়ে নেবে হাত মুখ ধুয়ে আমি রেডি করে রেখেছি।

প্রাণেল একটু তিক্ততার সঙ্গে বলল, কখন বাথরুম ঢুকেছে। এখনও বেরোবার নাম নেই। কী যে করে ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুমে, আমার মাথায় ঢোকে না। প্রাণেলের কথা শেষ হতেই বাইরে প্লেটের শব্দ হল। ঋক খেতে বসেছে।

চা শেষ হয়ে আসা প্রায় শূন্য কাপ হাতে নিয়ে ঊর্মিলা জানলার কাছে এল। বাড়ির বাইরে বড়ো রাস্তায় গাড়িগুলো সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও জ্বলে উঠল। ঊর্মিলার বুকের ভিতর একরাশ অপরিমেয় শূন্যতা। প্রাণেল তার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করুক না কেন, তা ক্ষণস্থায়ী। ঊর্মিলা এটা ভালো ভাবে জানে দিনের শেষে প্রাণেলের শেষ আশ্রয় সে-ই। প্রাণেল সেই নিরাপদ আশ্রয় হারাতে চায় না। ঋক তো ঊর্মিলার নিজের রক্ত। রক্ত কি শরীর ছাড়া আশ্রয় পায়! যদি না পায় তাহলে ঋক কেন ঊর্মিলার কাছে দিন দিন অপরিচিত হয়ে উঠছে! ঊর্মিলা নিজের সন্তানকে আশ্রয় দেবার পরিবর্তে কি তার কাছে আশ্রয় খুঁজছে! নিজের সন্তান ঋক স্ট্যাটাস মেনটেন শেখায় তাকে।

ঊর্মিলা স্ট্যাটাস মানে যতটুকু বোঝে তা হল তার সামাজিক পদমর‌্যাদা। সে সেটা অনেক বছর আগে তার শিক্ষক-বাবার কাছ থেকে অজান্তেই শিখে ফেলেছে। সৎ পথে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকাকেই বরাবর গুরুত্ব দিয়েছে ঊর্মিলা। আজকালকার ছেলেমেয়ে হয়তো একেই মিডল ক্লাস মেন্টালিটি বলে বিদ্রুপ করে। ঋক যে-স্ট্যাটসের কথা বলে, সেটা কী বস্তু ঊর্মিলার জানা নেই।

বাবা-মার কাছ থেকে সন্তানকে বোধ হয় অনায়াসে পৃথক করতে পারে এই স্ট্যাটাস। বহু কষ্টে উপার্জিত বাবা-মার অর্থ, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ, হোটেল, সিনেমা হল অথবা শপিংমলে নির্দ্বিধায় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে খরচা করাকে স্ট্যাটাস বলে। তাই খাবারের বিভাজনও ঋকের কাছে ছোটোলোক-বড়োলোক দিয়ে হয়। বড়োলোকি ছাঁচে নিজেকে ফেলে ঋক। সেই ছাঁচে ঊর্মিলাকে ফেলতে পারছে না বলেই কি এত দূরত্ব!

ঊর্মিলা ভাবে ঋকের মতো ছেলেরা কি কোনও দিন ঘাম ঝরিয়ে সংসারের সবার জন্য পরিশ্রম করতে পারবে! শেষ জীবনে ঋকের মধ্যে কি আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে সে! আশ্রয়হীন হয়ে যাবার ভয় কি তাকে প্রতিনিয়ত সাপের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে! বুঝতে পারে না সে। হয়তো বুঝতেও চায় না। শুধু মাতৃত্বের দাবি নিয়ে বারবার সে করাঘাত করে ঋকের দরজায়। তার উদ্ভ্রান্ত মন ছুটে চলে সন্তান পিপাসায়। নিজের রক্তের মায়া যে কী, তা ঋক কবে বুঝবে! এই চার বছরে কি একবারও তার মনে হয়েছে মা ঊর্মিলার কথা? দূরের নিস্তেজ আলোর মতো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে না তো সম্পর্কগুলো? এসব ভাবতে ভাবতে ঊর্মিলা শূন্যতার বুকে একটা নিরাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

প্রাণেল ঊর্মিলার কাঁধে আলতো হাত রেখে বলল, কী হয়েছে ঊর্মি! কখন থেকে খালি চায়ে কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো এক ভাবে। বলো কী হয়েছে। ঋক কিছু বলেছে তোমায়?

ঊর্মিলার ভালো লাগল অনেকদিন পর প্রাণেলের মুখ থেকে ঊর্মি ডাকটা শুনে। বিয়ে প্রথম তিন বছর এই নামটা যেন অজ্ঞাত শৃঙ্খলে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল। যাইহোক সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সে শৃঙ্খল ক্রমশ শিথিল হয়েছে।

ঊর্মিলা সব গোপন করে, হাসির মতো হাসি না এনে ঠোঁট একটু চওড়া করে বলল, কিছু হয়নি। আর ঋক কী বলবে আমাকে।

প্রাণেল যেমনই মানুষ হোক না কেন, কেউ ঊর্মিলার মুখের উপর কথা বলেছে শুনলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ভীষণরকম প্রতিক্রিয়া হয়। সব শুনলে সে ঋককে বকবে। হয়তো ঋকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবে না। ঋকের ইদানীং অপমানবোধটাও সাংঘাতিক তৈরি হয়েছে।

প্রাণেল ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, তোমায় কিছু না বললেই ভালো। গুণী ছেলে বোধ হয় এখন নিজের ঘরে ঢুকেছেন। তাকে বলো গিয়ে আজ গার্জিয়ান মিটিং-এ কী কী শুনতে হয়েছে আমাদের।

ঊর্মিলা বলল, ঋককে বলব বইকি! তুমি মাথা গরম করছ কেন! আমি যাচ্ছি। ঊর্মিলা ঘর থেকে বিরক্তির সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

ঋকের ঘরে গিয়ে ঊর্মিলা দেখল ঋক মোবাইলে গেম খেলছে। ঊর্মিলা ঘরে পা দিতেই সে তিক্ততার সঙ্গে বলল, তুমি এ সময়ে আমার ঘরে! কিছু দরকার আছে?

ঊর্মিলার মুখটা কেমন ম্লান হয়ে গেল ঋকের কথায়। দাঁতে দাঁত চেপে মুখটা কঠিন করে ঊর্মিলা বলল, আমি তোর ঘরে আসতে পারি না নাকি! দরকার আছে বলেই আরও তোর কাছে আসার প্রয়োজন হয়েছে।

ঋক গেমটায় হেরে গেছে এমন মুখ করে বলল, অফ কোর্স আসতে পারো। কিন্তু ডিসিপ্লিন মেনে নক করা উচিত ছিল। কী দরকার সেটা সরাসরি বলো ভমিকা না করে। ঊর্মিলার রুচিতে আঘাত লাগছিল ঋকের সঙ্গে কথা বলতে। তার মনে হচ্ছিল মা হিসাবে ঠাস করে গালে একটা থাপ্পড় কষাতে। নিজের মেজাজ সামলে নিয়ে সে বলল, তোর স্কুলে আজ গার্জিয়ান মিটিং ছিল। সেখানে কী হল তুই একবারও জানার প্রয়োজন মনে করলি না বলে আমি আগ বাড়িয়ে জানানোর কথা ভাবলাম।

ঋক একটু থতমত খেয়ে বলল, আমি ওসব শুনে কী করব! স্কুলে গার্জিয়ান মিটিং ছিল যেতে বলেছিলাম তোমাদের। গেছ তোমরা আর-পাঁচটা গার্জিয়ানের মতো। ব্যস মিটে গেছে। স্কুলের সমস্যা বাড়িতে আনছ কেন!

ঊর্মিলা উঁচু গলায় বলল, শুনতে হবে ঋক। তুই অন্যায় করলে হাজারবার শুনতে হবে। তুই কী মেটার কথা বলছিস! তোদের স্কুলের হেডমাস্টার তমালবাবু বলেছেন যে, তুই তোদের জুনিয়ার ব্যাচের মীনা নামে একটি মেয়েকে প্রায়ই টিজ করিস। গত সপ্তাহে তোর ব্যাগ থেকে তোর বন্ধু রণিতের টাকা পাওয়া গেছে। তমালবাবু বললেন যে, তুই চোরের খাতায় নাম লিখিয়েছিস। আর উনি যা তোর পড়াশোনার নমুনা বললেন, তা শুনে আমার নিজের লজ্জা লাগছিল। তুই প্রায় দিনই ক্লাস অফ করে বাইরে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে যাস কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। এগুলো কি সত্যি ঋক, আমি জানতে চাই। তোর বাবা ভীষণ আপসেট।

ঋক পুলিশের হাতে ধরা পড়া চোরের মতো ভয় পেয়ে বলল, মা, তুমি নিজের ছেলেকে কি বিশ্বাস করো না! ওই শালা হারামি তমালবাবু কী বলল তার কথা শুনে নাচছ!

ঊর্মিলা আর সহ্য করতে পারল না। ঋকের গালে গায়ে জোরে ঘৃণার সঙ্গে থাপ্পড় মেরে বলল, চুপ। একদম চুপ। ছি ছি, কী মুখের ভাষা শিক্ষক সম্পর্কে! আমাকে তুই শিক্ষা দিস স্ট্যাটাসের। তোকে ছেলে বলে পরিচয় দিতে কষ্ট হয় আমার। পড়াশোনা বাদই দিলাম। তাই বলে মেয়েদের টিজ করবি, চুরি করবি! পড়াশোনা সবার দ্বারা হয় না ভদ্র স্বভাব-আচরণটা তো তৈরি করতে হয়।

ঊর্মিলা আর ঋকের চিতকার তিরের ফলার মতো প্রাণেলের কানে বিঁধছিল। সে থাকতে না পেরে ঋকের ঘরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গেল। অনেকদিন পর ঊর্মিলার চোখ মুখ লাল করা রাগি চেহারাটা সে দেখতে পেল। ঋক তখন বিড়বিড় করে রাগে গজরাচ্ছে।

ক্ষুব্ধ গলায় ঋক বলল, ছেলে বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছে না করে দিও না। একদম অপমান করবে না আমাকে। সারাদিন তো চাকরির নাম করে উড়ে উড়ে বেড়াও। নিজের ছেলের সঙ্গে এরকম আচরণ কোন ভদ্রতায় পড়ে? দুপয়সা কামাচ্ছ বলে তোমার খুব দেমাক। আমি তোমার ওই পয়সায় ইয়ে করি বুঝলে। আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছ কোন সাহসে!

ঊর্মিলা তীব্র কঠিন গলায় বলল, সন্তান বেপথে গেলে তাকে শাসন করতে মায়ের সাহস লাগে না, মাতৃত্বের অধিকার থাকলেই চলে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের জন্য টাকা আনাটা তোর উড়ে বেড়ানো মনে হতে পারে। এত ফুটানি করিস মা দুপয়সা ইনকাম করে তাই। তুই পাঁচটাকা ইনকাম করে তবে আমার টাকায় ইয়ে করিস। আমার টাকার দেমাক যদি হয়ে থাকে সেটা রক্ত, ঘাম ঝরিয়ে উপার্জিত। তোর মতো চুরি চামারির পয়সা বা হাত পেতে অন্যের কাছ থেকে নেওয়া নয়।

প্রাণেল এই প্রথমবার ঊর্মিলার চেহারার ও মনের ভাঁজে ভাঁজে ঋকের জন্য ঘৃণা, অভিমান দেখল। ঋকের এই চার বছরের পরিবর্তিত পর্বে সে বহু অন্যায় করেছে। অকথা-কুকথা ঊর্মিলাকে বলেছে। ঊর্মিলা বোবার মতো নিশ্চুপ থেকেছে। সে বিনা প্রতিবাদে সব মেনে নিয়েছে। তার মনের ভিতরের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট মাঝেমধ্যে উগরেছে প্রাণেলের কাছে। কিন্তু সে ঋকের সঙ্গে কোনও তর্ক-বিতর্ক করেনি। এতদিনের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট আগ্নেয়গিরির লাভার মতো স্ফুরিত হতে লাগল।

ঋকের ঊর্মিলাকে অপমান করাটা প্রাণেল ভালো চোখে নিল না। প্রাণেল ঊর্মিলার পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠে ঋককে বলল, তোর মাথার ঠিক আছে তো! কী যা তা কথা বলছিস মাকে। ছোটোলোকের বাড়ির মতো ঝগড়া করছিস।

ঋক প্রাণেলকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, এই তুমি তোমার ঘরে যাও তো। তুমি প্রথম থেকে ছিলে না তাই জানো না কিছু। মা সামান্য একটা স্কুলের গার্জিয়ান মিটিং নিয়ে তিলকে তাল করছে।

প্রাণেল শান্ত গলায় ঋককে বলল, তুই তোর মায়ের সঙ্গে হাজার খারাপ ব্যবহার করলেও আজও তোকে নিয়ে কেউ কোনও খারাপ কথা বললে তোর মায়ের খারাপ লাগে। আফটার অল তোরই মা তো।

ঊর্মিলা তখনও খাটের হাতল ধরে রাগে গজর গজর করছিল। বিমর্ষ মুখে সে যেন নিজেকেই দোষারোপ করছিল। হঠাৎ ক্ষিপ্ত গলায় সে প্রাণেলের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি কিছু বোলো না ছেলেকে। ওর আর কিছু হবার নেই। শুধু শুধু তুমি ছেলের কাছে অপমানিত হও আমি স্ত্রী হিসাবে তা মেনে নেব না। যে নিজের ভালোমন্দ নিজে বুঝতে চায় না তাকে বোঝাবার কোনও দরকার নেই।

ঋক ঊর্মিলার কথায় খ্যাপা কুকুরের মতো ক্ষেপে উঠল। তার দুটো চোখ আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠল। সে রুক্ষ্ম স্বরে ঊর্মিলাকে বলল, বাবার আবার মান-অপমান বোধ! তোমার টাকায় খেয়েপরে আমাকে জ্ঞান দিতে আসে। আমি তো সবাইকে অপমান করি। আমি বিন্দুমাত্র ব্যবহার জানি না। আর বাবা যখন কথায় কথায় তোমাকে অপমান করে, তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তখন তোমার কিছু লাগে না বলো! অ্যাকচুয়ালি বাবা একটা মেরুদণ্ডহীন লোক। আত্মসম্মান বলে কোনও কিছু আছে নাকি বাবার?

ঋকের কথা শুনে প্রাণেল ভিতর থেকে খোলা ছাতা বন্ধ হওয়ার মতো দমে গেল এই ভেবে যে, ঊর্মিলার মতো স্ত্রীকেও সে অপমান করে। ঋকের মতোই সেও তো ঊর্মিলাকে প্রতিপদে আঘাত করে। সে ভাবল ঋকের কথাগুলো তো খুব ভুল নয়।

প্রাণেলের অপমানটা ঊর্মিলা হজম করতে পারল না। সে ঋকের গালে সপাটে চড় মেরে বলল, তোর এত অধঃপতন হয়েছে ঋক! তুই তোর বাবাকে অপমান করছিস। ছোটো করছিস। নিজেও ছোটো হচ্ছিস। বাবা না হয় মেরুদণ্ডহীন। আমার রোজগারের টাকায় খায়-পরে। তার কোনও মুরোদ নেই। তোর তো মেরুদণ্ড আছে। তোর মুরোদটা দ্যাখা। আমি মা হয়ে সেটা দেখি।

প্রাণেলের বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল সন্তানের মুখ থেকে অযোগ্যতার কথা শুনে। এখুনি বুঝি সাপের খোলস ছাড়ার মতো তার বাইরের আবরণ খসে গিয়ে ভিতরের দুর্বলতাগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। ঋকের মুখ থেকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়বে এই দুর্ভাবনা, এই শঙ্কার তাড়া খেয়ে সে ঊর্মিলাকে বলল, চলো ও ঘরে। মাথা ঠান্ডা করো। গায়ে হাত তুললে সমস্যার সমাধান হবে না। আর তুমিও ঊর্মি, ঋকের মতো বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি। চলো, বেরিয়ে এসো ঘর থেকে। প্রাণেল ঊর্মিলার হাত ধরে ঋকের ঘরের বাইরে নিয়ে চলে এল।

ঋকও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবার পাত্র নয়। সে মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে নেমেছে। যুদ্ধে জয়ীর মতো গলা হাঁকিয়ে সে বলল, আরে যাও যাও। বউয়ে প্রতি দরদ উথলে উঠছে একেবারে। আমার কী মুরোদ আছে না আছে দেখাব তোমাদের। আমাকে চড় মারলে তো তার ফল ভালো হবে না, বলে দিলাম।

ঋকের ঘরের মধ্যে চিৎকার করে বলা কথাগুলো প্রাণেল আর ঊর্মিলার কানে গেল। ঊর্মিলা হতাশ ভাবে বলল, ঋক এতটা বেপরোয়া, এতটা নির্দয় হয়ে গেল! প্রাণেল নীরব হয়ে রইল। নীরবতা ভেঙে তার মতামতের অপেক্ষা ঊর্মিলা করে না।

ঊর্মিলা জোর করায় প্রাণেল রাতের খাবার খেল। ঊর্মিলার খাওয়ায় রুচি ছিল না। মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর ঋক সেই যে দরজা বন্ধ করেছে, আর খোলেনি। মা তাকে ডাকতে গেলে ঘরের ভিতর থেকেই সে জানিয়েছে খিদে নেই। রাতের বিছানায় শুতে গিয়ে নানা রকম দুর্ভাবনা ঊর্মিলাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে। ঘুম আসে না সহজে। প্রাণেলকেও মাঝেমাঝেই অচেনা লাগে তার। প্রাণেল নিরলস ভঙ্গিতে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অকারণ ঘন ঘন সিগারেট খায়।

ঊর্মিলা একবার দুহাত বাড়িয়ে ডাকে প্রাণেলকে, কী হল! রাতদুপুরে এত সিগারেট খাচ্ছ কেন! শোবে এসো।

প্রাণেল হতাশার সুরে বলল, আচ্ছা ঊর্মি, আমি মেরুদন্ডহীন লোক বলো! এই যে সিগারেট টানছি সেটার খরচাও তোমাকে জোগাতে হয়। এমন লোককে ভালোবেসে আপশোশ হয় না তোমার?

ঊর্মিলার মন মেজাজ একদম ভালো ছিল না। তাই প্রাণেলের কথাগুলো এড়িয়ে বলল, শুতে এসো। তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না জানো। তবু দূরে দাঁড়িয়ে আছ। কাছে এসো আমার। প্রাণেল বলল, তুমি শোও। আমি বাথরুম থেকে আসছি হাত মুখ ধুয়ে

ঊর্মিলা কথা বাড়াল না। সারা পৃথিবী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঊর্মিলার মনে হল কেবল সেই জেগে আছে একাকী। সে নিজেও জানে প্রাণেল ঘুম পাড়ালেও আজ তার ঘুম আসবে না। পরক্ষণেই ঋকের চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কী করছে ঋক এখন! ছেলেটা কি ঘুমিয়ে পড়ল! সারারাত কি না খেয়ে থাকবে ছেলেটা! আগে একদম খিদে সহ্য করতে পারত না ঋক। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো অভ্যাসের চরিত্র বদলাল। ঊর্মিলার বুকটা কোনও এক অজ্ঞাত ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। ঋকের গায়ে এই প্রথমবার হাত তুলল সে। তবু তার মনে হল সন্তানকে আঘাত করা মানে নিজেকে আঘাত করা। ঋক কি আদৌ বুঝবে সেকথা!

নানা দুর্ভাবনাকে প্রশ্রয় আশ্রয় দিয়ে ঊর্মিলা শোবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। তার কপালে চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঘুম তার আজ হবে না। বাইরে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা জলের গেলাস থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে একটা হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর অনেক সংশয় নিয়ে ঊর্মিলা ঋকের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজাটা বোধ হয় শোওয়ার আগে ভেজিয়ে রেখেছিল ঋক। ঊর্মিলা হাত দিয়ে ঠেলতেই ক্যাঁচ করে একটা মৃদু শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ঘরটার দখল নিয়েছে একটা থমথমে অন্ধকার।

ঊর্মিলা আপন মনেই বলল, নাইট বাল্বটাও জ্বালেনি ঋক। কী যে করে না ছেলেটা। একদম এই দিকটা বাবার মতো হয়েছে। নাইট বাল্ব জ্বালতেই অন্ধকার সরে গিয়ে স্নিগ্ধ আলোয় ভরে উঠল ঘর। বাল্বের পরিমিত আলোয় দেখল, এলোমেলো বিছানায় ঋক অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমাচ্ছে। ঋকের ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা ভেবে স্মিত হাসল। তারপর তার স্নেহের হাতটা বেশ কিছুক্ষণ ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিল। ঋকও ঘুমের ঘোরে স্নেহের স্পর্শ পেয়ে নড়েচড়ে উঠল। ঊর্মিলা তার কপালে একটা স্নেহচুম্বন করে ঘরের দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

ঊর্মিলা বাইরে এসে দেখল প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। মিশমিশে কালো আকাশ ভেদ করে মেঘ তীব্র ভাবে গর্জন করছে। ঊর্মিলা বাইরের দরজা জানালা বন্ধ করতে করতে হাঁক পাড়ল, প্রাণেল, একবার বাইরে এসো। প্রচণ্ড মেঘ করেছে। ঝড় উঠেছে। ঊর্মিলা তার নিজের ডাকের কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে বিরক্তিভরে বলল, আমার পোড়া কপাল! লোকটা বোধ হয় কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছে। দরজা জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ছাঁটের জলে কিছুটা ভিজে গেল ঊর্মিলা। ভিজে জামাকাপড় বদলে ফেলে শোবার ঘরে ঢুকল সে।

ঊর্মিলা ঘরে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে এমন সময় দেখল, প্রাণেল বিছানায় নেই। শোবার ঘরে প্রাণেল আসেনি। ঝড় বৃষ্টির রাতে ঊর্মিলা উচ্চস্বরে প্রাণেলের নাম ধরে চিৎকার করল। কিন্তু কোনও লাভ হল না। সারা বাড়ির দমবন্ধ করা নীরবতা তাকে হাঙরের মতো গিলতে চাইল। সে ঊর্ধশ্বাসে বাথরুমে গেল। সেখানেও গিয়ে সে দেখল প্রাণেল নেই। রান্নাঘরের দরজা, ছাদের দরজা সব বন্ধ। সংশয়পূর্ণ গলায় ঊর্মিলা নিজেই বলে উঠল, কোথায় গেল প্রাণেল! ঋকের ঘরে তো যাবার কথা নয়। আমি তো ঋকের ঘরে এতক্ষণ ছিলাম।

ঊর্মিলার এবার নজরে পড়ল উত্তরে রান্নাঘরের পাশে গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমের মৃদু আলোর রেখা ভেজানো দরজা ভেদ করে বাইরে আসছে। ঊর্মিলা হাঁপ ছেড়ে বলল, শোবার ঘরে আমি বিরক্ত করব ভেবে গেস্টরুমে লোকটা ঘুমানো বাদ দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কী লোক বাবা। দেখাচ্ছি মজা।

ঊর্মিলা একরাশ অভিযোগ মাথায় নিয়ে গেস্টরুমের ভেজানো দরজা সজোরে ঠেলে বলল, কী ব্যাপার এত রাতে এ ঘরে! কথা শেষ করেই ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ঊর্মিলার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। নাইট বাল্বের মৃদু আলোয় যা দেখল তাতে তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ঋক, কোথায় তুই! আমার এ কি সর্বনাশ হল! কান্নায় জড়িয়ে এল ঊর্মিলার গলা। সেই সময় ঋক বোধ হয় বাথরুম গিয়েছিল। সে ঘুম চোখে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।

মায়ের তীব্র আর্তনাদ শুনে ছুটে এসে বলল, রাত দুটো বেজে গেছে। এত রাতে চিৎকার করছ কেন! ঊর্মিলা গেস্টরুমের সামনে বসেছিল। অশ্রুভেজা দু’চোখে ধরা গলায় প্রাণেলের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, দ্যাখ ওদিকে তাকিয়ে ঋকের ঘুমের ঘোর কেটে গিয়েছিল। সে ঊর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, বাবা! প্রাণেলের নিথর দেহটা সিলিং ফ্যানের তলায় ঝুলছে। প্রাণেলের গলায় প্যাঁচানো রয়েছে ঊর্মিলার একটা শাড়ি। গত বছর পুজোর সময় প্রাণেল নিজের হাতে গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে ঊর্মিলার জন্য কিনে এনেছিল।

ঋক ঊর্মিলাকে বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। মনে মনে ঋক ভাবল, সন্ধ্যায় বাবাকে খুব অপমান করেছে। এই সবকিছুর জন্য ঋক যেন নিজেকে দায়ী করল। তারপর সে গলা ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। ঋক ঘরের টিউব লাইট জ্বেলে মাকে ছেড়ে ঘরের খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খাটের কাছে যেতেই বাবার হাতে লেখা বালিশের উপর একটি খোলা চিঠি ঋকের নজরে পড়ল। ঋক চিঠিটা হাতে তুলে বলল, মা, এই দ্যাখো বাবা চিঠি লিখে রেখেছে এখানে।

ঊর্মিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কী লিখেছে লোকটা! নিশ্চয়ই অনেক অভিযোগ করে গেছে আমার বিরুদ্ধে। ঊর্মিলার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণবাযু কে যেন ভিতর থেকে শুষে নিচ্ছে। ঋক চিঠিটা পড়তে শুরু করল। চিঠিতে লেখা কথাগুলো ছিল—

প্রিয় ঊর্মি,

তোমার বিরুদ্ধে কোনও রাগ অভিমান অভিযোগ আমার কোনও দিনই ছিল না। আজও নেই। আমার মেরুদণ্ডহীনতা আমার অপদার্থতার জন্য আমি নিজেই দায়ী। তোমার উপর সব ভার চাপিয়ে আমি বোঝা বাড়িয়ে চলেছিলাম। তুমি এ জীবনে যা দিয়ে আমাকে, তা হয়তো আমার কোনও জন্মের পুণ্যের ফল। তোমার মতো স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবু কারণে-অকারণে কত আঘাত কত কষ্ট দিয়েছি তোমায়। সেকথা সব ভাবলে আমার নিজের উপর ঘৃণা হয়। ঋকের উপর তুমি এত অভিমান কোরো না। ছেলেটা হাজার হলেও এই মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ বাপটার ছেলে বলে, তোমাকে না বুঝে আঘাত দেয়। যেদিন ছেলেটা বুঝবে হয়তো আমারই মতো অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হবে। আমার ঋক যখন একদিন বাবা হবে তখন হয়তো বুঝবে বাবার মর্ম। ওকে তুমি আমার মতো নয়, তোমার মতো তৈরি কোরো, যাতে ওর ছেলেমেয়ে কোনও দিন ওর মেরুদণ্ডহীনতা অপদার্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে না পারে। আমি তো সে ভাবে ভালো স্বামী, ভালো বাবা হয়ে উঠতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা কোরো। তোমাকে মুক্তি দিলাম ঊর্মি। আর একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। চন্দ্রকোণায় আমার ভাগের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির কুড়ি লাখ টাকায় তোমার আর ঋকের নামে একটা এলআইসি করে ছিলাম। ঋকের জন্য আমার অনেক আশীর্বাদ রইল। ওকে তুমি মানুষ কোরো। তোমরা ভালো থেকো।

চিঠি পড়া শেষ করে ঋক ঊর্মিলার কাছে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, মা, বাবার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। বাবা আমার কাছ থেকে পাওয়া অপমান সহ্য করতে পারেনি। আমাকে তুমি শাস্তি দাও।

ঊর্মিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, শাস্তি আমি দেবার কে! ওই লোকটা দেখছিস না আমাদের শাস্তি দিয়ে চলে গেল। সব ব্যথা বুকে নিয়ে আমার ভার কমিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। যাবার আগে তোকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে গেছে। নিজেকে অপরাধী ভাবিস না। আমার কাছে শাস্তি ভিক্ষে করার চেয়ে তোর বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ কর। তুই মানুষের মতো মানুষ হলে তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে। কথা বলতে বলতে ঊর্মিলার গলা থমকে গেল। মনে হল একটা বোবা কান্না মণ্ড পাকিয়ে গলাকে আড়ষ্ট করে দিল।

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। দেয়াল ঘড়িতে সাড়ে চারটে বেজে গেছে। ঝড় বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। নীল আকাশ থেকে স্নিগ্ধ নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভোরের দুচারটে দূরপাল্লার ট্রেন অজানা পথে হুইসেল বাজিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে। পাড়ার অলিতেগলিতে কিছু কুকুর তারস্বরে ডেকে উঠল।

স্বামী প্রাণেলকে ছাড়া নতুন একটা সকাল আসছে ঊর্মিলার জীবনে। বাবা ছাড়া ঋকের নতুন অধ্যায়ে সূচনা হবে। এ যেন ঋকের পুনর্জন্ম। ঊর্মিলা ছেলেকে বুকে আঁকড়ে জলভরা দুচোখে অস্পষ্ট ভাবে হয়তো উপলব্ধি করল দূরের অনাগত দিনগুলি।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব