সার্কাসের দুর্গা

লোহার জালের বেড়াটা আট-দশ ফুট মতো হবে। এইটুকু ডিঙোনো কোনও ব্যাপার নয়। এখনও হাত-পা নিশপিশ করে। ঝুলন্ত গাছের ডাল দেখলে এই আটষট্টি বছর বয়সেও ওরাংওটাং হ’তে ইচ্ছে করে কৃষ্ণলাল বোসের। রেললাইন দেখলে দুপাশে দুহাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে একটা লাইনের উপর দিয়ে ব্যালান্সের খেলা দেখাতে দেখাতে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হলেও আজকাল উপায় থাকে না। প্রথমত রেললাইন পাওয়া যায় না, দ্বিতীয়ত পাবলিক এই স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের মর্যাদা দেয় না।

কিছুদিন আগেই তো কলকাতার বাবুঘাটে চক্ররেলের লাইনের উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে একবার একটু পড়ে গেলেন, রেলের পাথরে হাত-পা ছড়েও গেল। পাঁচ পাবলিক এল, ধরে তুলল, আর বলল – এই বুড়ো বয়সে এমন কম্ম করতে গেলেন কেন মশাই? মাথাটা ঠিক আছে তো? কেউ বলল– পাগলদের দেখে বোঝা যায় না, পাগল নানারকম হয়। ভদ্র পোশাকেরও পাগল হতে পারে। কৃষ্ণলাল কী করে বোঝাবেন ওদের, ওর রক্তের মধ্যে সার্কাস মিশে আছে, সার্কাস। ট্রাপিজ, টানটান তার, এক চাকার সাইকেল। বয়ে যাওয়া রেল লাইন মানে দিগন্ত বিস্তারিত ব্যালান্সের খেলা।

এই লোকগুলোকে কি তখন বলা যেত– মাননীয়গণ, আমি উড়ন্ত মানুষের খেলা দেখাচ্ছি। এই সরু লোহার রেললাইন হ’ল একটা রানওয়ে। দু-হাত ছড়িয়ে দিলাম আমার দু-দিকে, ঈগলের মতো, ঈগল কেন, এরোপ্লেনের মতো। শো…শো…শো… মিউজিক, বিউগল, ট্রাম্পেট, ডানদিকে বাঁদিকে দু-টো জোকার, ওরাও ওড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে, আমি প্রফেসর কেএল বোস। এবারে শোঁ করে আকাশে উড়ব। মানে লাফ দিয়ে ধরে নেব ঝুলন্ত দোলনা। দিস ইজ গ্রেট প্যারাডাইস সার্কাস। পড়ে যাবার পর গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তো আর বলা যায় না, আমিই ছিলাম প্রোপ্রাইটার অফ গ্রেট প্যারাডাইস সার্কাস। বাংলা-বিহার-ওড়িশা দাপিয়ে শো করেছি এককালে। অসমে, ত্রিপুরায়। মানুষ অপেক্ষা করে বসে থাকত প্রফেসর বোসের সার্কাস কবে আসবে। উড়ন্ত চাকির খেলা অথবা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র, অভিমন্যুর যুদ্ধ অথবা তির আর ঢালের খেলা… চারিদিক থেকে তির মারা হচ্ছে আর সার্কাসম্যান ঢাল দিয়ে তির ঠেকাচ্ছে। মহিষাসুরমর্দিনীও ছিল। বিজয় মাহাতো ছিল অসুর। ও ছৌ নাচ জানত। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে শো করতে গিয়ে ওকে পাওয়া গিয়েছিল। কী দারুণ ডিগবাজি খেত। দলের লোকেরা বলত মিস্টার তিড়িং। আর দেবী দুর্গা করত দুগ্গি। ওর ভালো নাম কিন্তু দুর্গা-ই। গোল মুখের মেয়ে। দুগ্গি ছিল তিড়িং-এর বউ।

বিজয় মাহাতোর ছৌ নাচ দেখে যখন সার্কাসে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল কৃষ্ণলাল, বিজয় বলেছিল– আমার বিহা করা পরিবার আছে, আমি সার্কাসে গেলে উ মেয়াটা থাকবে কী করে? কৃষ্ণলাল বলেছিল বউকেও নিয়ে এসো। তাঁবুতে অনেক কাজ আছে। কাজ তো ছিলই। রান্না ঘরে কাজ ছিল, পাখিদের দানা খাওয়ানো, ঘোড়ার ঘাস কাটা, কত কী। পরে দেখা গেল দুগ্গি নাচতেও পারে। দুগ্গি ঝুমুর নাচত। ওর শরীরটা খুব আঁট ছিল। চিতাবাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্গার কথা মনে হয় কৃষ্ণলালের। লম্বা গড়ন, সরু কোমর, টানা চোখ, ভরাট বুক। দলের লোকেরা বলত কালোবাবু একটা ডাঁসা মেয়েছেলে আমদানি করেছে গো…।

কৃষ্ণলাল বোস মানে তো কেএলবি। তিনি কেলোবাবু বলেই খ্যাতিমান হলেন। রংটা কালোই, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা, চওড়া কাঁধ। ভদ্রঘরের ছেলে। বাবা ছিলেন সাহেবি অফিসের বড়োবাবু। শীতকালে ধুতির উপর কোট চড়াতেন। সে সময় মুড়ি চিঁড়ে দুধকলার যুগে মাখন পাউরুটি জ্যাম জেলিতে ব্রেকফাস্ট হতো। বউবাজারের বক্সিং ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণলালের জিমনাস্টিক আর জাগলিং-এ উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। নানা ধরনের জাগলিং-এ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। বলের খেলা, বোতলের খেলা, আস্তে আস্তে ধারালো ছুরির খেলা, নানারকম ব্যালান্সের খেলা…। বিএ পাশটাও করে ফেললেন। ওর বাবা চেয়েছিল সাহেবকে বলে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবেন, কিন্তু কৃষ্ণলাল বলল চাকরি করব না, জাগলিং করব। গ্রেট এশিয়ান সার্কাসে ঢুকে পড়লেন। তারপর নিজেই সার্কাসের দল করে ফেললেন। সে অনেক কথা, অন্য ইতিহাস।

আসলে সার্কাস ছিল কৃষ্ণলালের রক্তে। ওর পিতামহ ছিলেন প্রিয়নাথ বোস। গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালির নিজস্ব সার্কাস। সাহেবদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ঝামাপুকুরের প্রিয়নাথ বোস কলকাতার ময়দানে হই হই করে সার্কাস দেখালেন ১৯১১ সালে, কিছু দিন আগেই বাঙালির বাচ্চারা খালি পায়ে ফুটবল খেলে সাহেবদের ইস্টইয়র্ক দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে নিয়েছিল। মোহনবাগান ক্লাব। আর প্রিয়নাথ বোসের বেঙ্গল সার্কাস বাঙালির ছেলেদের নিয়ে সার্কাস করিয়ে দেখিয়ে দিল বাঙালির ছেলেরা বাঘ নিয়েও খেলতে পারে। হ্যাঁ, সত্যেন দত্তর কবিতাটা ময়দানে প্রমাণ করে দিল, ‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি’। প্রিয়নাথ বোসের বেঙ্গল সার্কাসকে বলা হতো প্রফেসর বোসের সার্কাস।

প্রিয়নাথ বোস গোয়ালিয়রে খেলা দেখাতে গিয়ে গোয়ালিয়রের রাজার কাছ থেকে এক জোড়া বাঘ উপহার পেয়েছিলেন তার কিছুদিন আগেই। বাঘ দুটোর নাম রেখেছিলেন লক্ষ্মী আর নারায়ণ। লক্ষ্মী-নারায়ণকে কী করে ট্রেনিং দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ সেটা কৃষ্ণলাল জানেন না, তবে বাবার কাছে শুনেছেন বাঘের গায়ে হাত বুলিয়ে বাঘকে ঘুম পাড়াতেন প্রিয়নাথ। বাঘদের গল্প শোনাতেন, গান শোনাতেন। কী গান? কৃষ্ণলাল কল্পনা করেছেন বাঘের সামনে মাথা দুলিয়ে ওর পিতামহ গাইছেন, ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো…’। নাকি ঝিঁঝিট আড়া তেতালাতে – ‘নয়নের মায়াজালে সই মজালে আমারে’। বাঘের পিঠে চেপে সার্কাসের এরিনায় আসতেন প্রফেসর বোস– দু-হাতে সাতখানা বল লোফালুফি করতে করতে। বাঘের মুখে হাত ঢুকিয়ে দিলে লকলকে জিভ দিয়ে হাত চেটে দিত বাঘ। এই সার্কাসেই যোগ দিয়েছিলেন ভীম ভবানী। ভীম ভবানী শুয়ে পড়লে, বুকের উপর তক্তা চাপিয়ে দেয়া হতো একটা, সেই তক্তার উপর দিয়ে হাতি চলে যেত। ভীম ভবানী উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করত। সেই হাততালি, বহুযুগ আগেকার মানুষের আনন্দ-বিস্ময় মাখানো হাততালির শব্দ এই কৃষ্ণলাল ওরফে কালোবাবুও শুনেছেন তার নিজের সার্কাসে।

প্রিয়নাথ বোস মারা গেলেন ১৯২০ সালে। সার্কাসের দলটাও ভেঙে গেল। প্রিয়নাথের পুত্র, মানে কৃষ্ণলালের বাবা তখন বালক মাত্র। কৃষ্ণলালের বাবা সার্কাসে ছিলেন না, আগেই বলেছি, সাহেবি অফিসে চাকরি করেছেন, কিন্তু গর্ব ছিল। বাঙালির সার্কাস ছিল বাঙালির মাথা তুলে দাঁড়ানো অহংকার। রক্তের গভীরে গোপনে বেঁচে থাকা সার্কাসকে জাগিয়ে তুলেছিলেন– এই কালোবাবু। রায়বেশে নাচের দল থেকে টেনে এনেছিলেন নকুল বাগদিকে, রণপায়ের খেলা দেখাত। ডুয়ার্সের চা বাগানে অবিরাম সাইকেল চালানোর আসর থেকে জোগাড় করেছিলেন বাচ্চু গুরুংকে, আর ওখানেই কৃষ্ণলাল পেয়ে গিয়েছিল একটি চিতাবাঘকে। হ্যাঁ, সারা গায়ে ছিট ছিট ছবি আঁকা চিতাবাঘ। চিতাবাঘটা ছিল কালোবাবুর প্যারাডাইস সার্কাসের সম্পদ। ওর পিতামহের মতো বাঘের পিঠে চেপে সার্কাসের এরিনায় প্রবেশ করতে পারেননি কালোবাবু কিন্তু চিতাবাঘের পিঠে চেপে ঢুকেছেন, যার অন্য নাম লেপার্ড।

কালোবাবু নারী শরীরের রহস্য কিছুটা জানেন, শরীরের কোন জায়গায় কী ধরনের স্পর্শ দিলে শরীর তার কী উত্তর দেবে কালোবাবু বোঝেন, কিন্তু আরও বেশি বোঝেন জানোয়ারের শরীর। কুকুরের মতো বাঘও লেজ নাড়ায়। জানতে হয় কী ধরনের স্পর্শে লেজ নড়ে উঠবে। কী ধরনের স্পর্শে বাঘ হুংকার দেবে, সেটাও জানেন। চিতাবাঘ তো বাঘই। এরিনায় নামছেন কালোবাবু, চিতার পিঠে চেপে। চিতা হুংকার দিল, আর বেজে উঠল ট্রাম্পেট, বিউগল…।

লোহার খাঁচাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কৃষ্ণলাল। নতুন রং হয়েছে খাঁচার লোহায়। একটা গন্ধ আসছে। এখন রোদ্দুরটাও বেশ কড়া। দলের সবাই মূর্তিনদী দেখতে গেছে। কৃষ্ণলাল যাননি। উনি একাই এসেছেন এখানে। এক ঘন্টার উপর দাঁড়িয়ে আছেন। যদি মধুবালা আসে, একবারটি দেখা দেয়। এটা খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী সুরক্ষা কেন্দ্র।

কৃষ্ণলালের প্যারাডাইস সার্কাসটাও ভেঙে গেছে বহুদিন হয়ে গেল। ওর বাবা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন, মিত্র বংশের মেয়ে। সে বিয়েও ভেঙে গেছে সার্কাসটা ভাঙার আগেই। ভাঙবেই তো। কে-না ভালোবাসা চায়। চিতাবাঘটাও চেয়েছিল। একটা মেয়ে বাঘকে যদি বউয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে কোনও পুরুষ– সহ্য হয়? কেবল মধুবালা আর মধুবালা। চিতাবাঘিনির নাম রাখা হয়েছে মধুবালা– আদিখ্যেতা নয়? কৃষ্ণলালের বউ তো এমনই ভেবেছিল। তা ছাড়া বাড়িতে তো থাকতই না। প্যারাডাইস সার্কাস নিয়ে ঘুরে বেড়াত বাইরে বাইরে। নেশাও করত। সার্কাসের দলে মেয়েরাও তো ছিল। এক ঝুমুর নাচা মেয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টির গল্পও কানে এসেছিল কৃষ্ণলালের স্ত্রীর। কৃষ্ণলালের স্ত্রী অন্নপূর্ণা চেয়েছিল সার্কাস-টার্কাস অনেক হয়েছে। টাকাপয়সা যা আছে তা দিয়ে কিছু একটা ব্যাবসাপাতি করে এবার সংসারে থিতু হোন কৃষ্ণলাল। ছেলেটাও বড়ো হয়েছে। কৃষ্ণলাল স্ত্রী-র কথায় কান দেননি। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন– হয় তোমার মধুবালা নয় আমি। কৃষ্ণলাল মধুবালাকেই বেছেছিলেন। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন মধুবালা তোমার ভড়ং। তোমার আসল আঠা হ’ল দুর্গা নামের ওই নাচুনে মেয়েটা। সংসারটা ভাঙল। ভাঙা বউটাও পৃথিবীতে নেই আর। ছেলেটা লেখাপড়া শিখেছে। ভালো চাকরিবাকরি করে। বাপকে ফেলে দেয়নি ও। মনে রেখেছে। বিয়ে-থা করেছে। ওর মামার বাড়ির ন্যাওটা। কলেজের লেখাপড়া তো ওর মামার বাড়িতে থেকেই করেছে।

প্যারাডাইস সার্কাসটা তেমন কোনও বড়ো সার্কাস দল ছিল না। তত বড়ো করতে পারেনি। বিরাট তাঁবু ফেলে, কাগজে বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনওদিনই শো করতে পারেনি কেএল বোস। জেলা শহরগুলিতেই শো করেছে। যেমন সিউড়ি, দুবরাজপুর, বসিরহাট, রায়গঞ্জ, বীরপাড়া, মালবাজার…। সবাই বলত কালোবাবুর সার্কাস। হ্যান্ডবিল বিলি হতো, জোকার রামদাস চোঙা ফুঁকে বলে বেড়াত– প্লাস্টিক গার্ল অঙ্গ বেঁকাবে যেখানে খুশি, বাঁদর সাইকেল চালাবে, দক্ষযজ্ঞ আর সীতার দেহত্যাগ, মহিষাসুরমর্দিনী…।

মহিষাসুরমর্দিনী খেলার অসুর তিড়িং মানে বিজয় মাহাতো, ছৌ নাচের অসুরের মুখোশ পরে কী ডিগবাজিটাই না দিত। আহা। দুগ্গি, মানে দুর্গা হাতে ত্রিশূল নিয়ে নাচত। ওর খ্যামটা নাচটাও ফ্যালনা নয়। সারা অঙ্গের কাজ আছে। নাচতে নাচতে, ত্রিশূল দোলাতে দোলাতে মুখ দিয়ে আগুন বের করত। মুখ দিয়ে আগুন বের করার খেলাটা শিখতে হয়েছিল মুখে কেরোসিন রেখে। শেষ কালে তিড়িং-এর কাঁধের উপর পা তুলে দিত দুগ্গি, ত্রিশূল বুকে বিঁধিয়ে দিত, উপর থেকে রঙিন কাগজের কুচি ঝরে পড়ত, যেন পুষ্পবৃষ্টি। তারপর তুমুল হাততালির মধ্যে দুগ্গি তিড়িং এর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলত, ইনি আমার স্বামী। গায়ে পা দিয়েছি বলে পেন্নাম করে নিলাম। তারপর আর এক প্রস্থ হাততালি।

আবার দক্ষযজ্ঞ খেলায় মহাদেব সেজে ডিগবাজি খেত তিড়িং, লম্বা করে লাফ মারত, আর কৃষ্ণলাল নিজে পাগড়িতে ময়ূরের পালক গুঁজে চাকতির জাগলিং দেখাত, যেন সুদর্শন চক্র ছোড়া হচ্ছে। এই ভাবে সার্কাসের সাহেবিয়ানাকে দেশি, লৌকিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন কৃষ্ণলাল। মহিষাসুরমর্দিনী খেলাটা একেবারে অন্য মাত্রা পেয়ে গেল যখন সার্কাসে বাঘটা এল। শ্রী শ্রী দুর্গা হলেন সিংহবাহনা। উত্তর ভারতের কোথাও কোথাও ব্যাঘ্রবাহনা দুর্গাও দেখা গেছে। পটচিত্রে আছে, মন্দিরেও। আমাদের দুগ্গি চিতাটার পিঠে করেই ঢুকত এরিনায়। চিতার গলায় পরানো থাকত পাটের ঝালর। সিংহের কেশর যেমন থাকে।

বেশ অদ্ভুত ভাবে চিতাটাকে পাওয়া গিয়েছিল। ডুয়ার্সের মালবাজারে সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল। চা-বাগানের কুলি-কামিনরা সারা বছর কোনও আমোদ আহ্লাদ পায় না। ওরা দলে দলে ভিড় জমাত সার্কাসে। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে হাতির পাল যেমন নেমে আসত, মাঝে মাঝে চলে আসত চিতাও। চিতাবাঘ এসে গোয়ালের গরুটা, বাছুরটা, ছাগলটা, হাঁস, মুরগি, ভেড়াকে মেরে টেনে নিয়ে যেত। গাঁয়ের লোকজন সার্কাস দেখতে এলে চিতাদের সুবিধে হতো। গাঁয়ে লোক কম থাকত বলে গেরস্ত ঘরের পালিত পশু শিকার করতে সুবিধে হতো। মানুষজন চিতাকে বাগে পেলে ছেড়ে দেবে কেন? চিতার দেখা পেলে তিরধনুক, কোদাল-কুড়ুল, শাবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। কখনও মেরেই ফেলত। একবার হ’ল কি, সার্কাস চলার সময় খবর এল চিতা বেরিয়েছে। শুনে সার্কাস ছেড়ে অনেকে চলে গেল। বাইরে হইচই হট্টগোল। সার্কাস বন্ধ করেনি কৃষ্ণলাল। দশটা লোক থাকলেও শো চলবে। বাইরে পটকা বাজির শব্দ। শো শেষ হ’ল। শোনা গেল একটা চিতা একটা ছাগলছানাকে খেয়ে ফেলেছে। ওর গায়ে তির লেগেছে, হেঁসো-কোদালের কোপও পড়েছে। কিন্তু পালিয়েছে।

আরও রাত্তিরে জলত্যাগ করার জন্য তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে কৃষ্ণলাল দেখতে পেলেন, আধা চাঁদের আলোছায়ায় তাঁবুর পিছনের জারুল গাছটার তলায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে একটা জানোয়ার। টর্চের আলো পড়ল। চিতা…! রক্তমাখা। নিজের গায়ের রক্ত চেটে পরিষ্কার করছে ও। লেজের দিকে মুখ দিচ্ছে বার বার। লেজের শেষ দিকটা নেই। যেন কুড়ুলের ঘায়ে খাবলে নেওয়া। চিতার চোখে টর্চের আলো পড়লে কৃষ্ণলাল দেখেন ওর চোখে ভিক্ষা লেগে আছে। জীবন ভিক্ষা চাইছে চিতাবাঘটা। এক মগ জল সামনে রাখে। জলটা চেটে খায়। কৃষ্ণলালের দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। একটা চেন এনে গলায় পরায়। চিতা প্রতিবাদ করে না। জীবনের বিনিময়ে শিকল মেনে নেয়।

জীবন বড়ো না শিকল… এই প্রশ্নের উত্তর আজও কালোবাবুর কাছে পরিষ্কার নয়। জীবন বড়ো রহস্যময়, আর শিকলও। কে কখন কী ভাবে শিকল পরে তা বোঝা যায় না। আর শেকল প্রায়শই অদৃশ্যই থাকে।

কৃষ্ণলাল জানতেন গাঁয়ের মানুষ যদি খোঁজ পায়, সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকে চিতাটাকে খুঁচিয়ে মারবে। তাই প্রথমেই চিতাটার মুখে একটা জাল পরিয়ে দিলেন, যাতে আওয়াজ করতে না পারে। গর্জন-ই হ’ল নির্দেশক। চিতাটার লেজের কিছুটা নেই। টাঙ্গি জাতীয় কিছুর আঘাতে লেজের শেষ অংশ খোয়া গেছে। রক্ত ঝরছে। ভালো করে পট্টি বেঁধে দেয় কৃষ্ণলাল। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়… ঘাড়ের কাছটায়। ছিন্ন হয়ে যাওয়া লেজটা নড়ে ওঠে। সেদিন রাতের খাবারে ছিল মুরগি। দু-টুকরো নিয়ে আসে কৃষ্ণলাল। চিতার মুখের জালিটা খুলে ওর মুখের সামনে ধরে। দু-বার গন্ধ শোঁকে চিতা। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রান্না মাংস ওর অচেনা। হলুদ-লংকা-গরম মশলা দেওয়া মাংস কি কখনও খেয়েছে নাকি সে?

কিন্তু খিদে সব পারে। অনর্থ ঘটাতে পারে খিদে, আর এটা তো সামান্য খাওয়া।

ওদের সার্কাসে আগে শুধু ছাগল আর বাঁদর ছিল। চিতা ঢুকল। সে তো বহুদিন আগেকার কথা।

এই খাঁচাটার সামনে কৃষ্ণলাল। গতকাল দেখতে পেয়েছিলেন একটা মাংস ভক্ষণরত চিতা। খাবার সময় এই প্রজাতি লেজটা একটু বেঁকিয়ে রাখে। এই চিতাটার লেজের শেষদিকটা ছিল না। কিন্তু

মাংস দ্রুত শেষ করে ভিতরে চলে যায় সে। আর দেখেনি। তাই আজ আবার এখানে, অপেক্ষা। এখনও আসেনি সে…

বেশ কিছুক্ষণ খাঁচার বাইরে অপেক্ষার পর বাঘটির দেখা পেলেন কৃষ্ণলাল। কয়েকবার পায়চারি করার পর ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে গেল। ঠিকই দেখেছিলেন গতকাল। লেজের শেষের দিকটা নেই। জোরে চিৎকার করলেন কৃষ্ণলাল– মধুবালা কাম হিয়ার। কই এল না তো…।

এই খয়েরবাড়ির বন্যপ্রাণী সুরক্ষা কেন্দ্রে সার্কাস থেকে ছিনিয়ে আনা বাঘ, চিতা, হাতিদের রেখে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন সার্কাসে থাকা বনের পশুদের ফের বনের ভিতরে ছেড়ে দিলে ওরা বেশিদিন বাঁচে না। কারণ বন্দিদশায় ওরা শিকার ভুলে যায়। খাবারের জোগান থাকে না, জোগাড়ও হয় না। তাই খাঁচাঘেরা বনে ছেড়ে রাখা হয়। এই খাঁচা, চিড়িয়াখানার খাঁচার মতো ছোটো নয়। প্রাকৃতিক বনের অনেকটা জায়গা লোহার জালে ঘিরে তার ভিতরে পশুদের ছেড়ে দেওয়া হয়। চিতাদের জন্য আলাদা অঞ্চল, বাঘেদের আলাদা, হাতিদের আলাদা। ঘেরা জায়গায় ঘাস জঙ্গল থাকে, ঝোপঝাড় থাকে, থাকে বড়ো গাছও। খরগোশ, শুয়োর-ও ছাড়া থাকে। যদি পারে বাঘেরা টুকটাক শিকার ধরে। নইলে সময়মতো খাবার তো আছেই। বেলা একটা নাগাদ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মাংস রেখে দেওয়া হয়। সেই যে একটা আইন হ’ল না, মানেকা গান্ধির সময়ে– সার্কাসে জন্তু-জানোয়ারের খেলা বেআইনি করে দিল, কেন? জন্তুদের কষ্ট হয়। তারপর থেকেই সার্কাসে জানোয়ারের খেলা দেখানো বন্ধ হতে লাগল। কালোবাবুর সার্কাসটা সেরকম বড়ো মাপের ছিল না, তাই বেশ কিছুদিন দেখাতে পেরেছিল। পানামা, অলিম্পিক, ইম্পিরিয়াল এসব সার্কাস থেকে আগেই হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওর প্যারাডাইস সার্কাসের মধুবালাকে ওরা নিয়ে গেল আরও পরে। তা-ও আঠারো বছর হয়ে গেল। আর আঠারো বছর, মানে দেড় যুগ পরে মধুবালার সঙ্গে দেখা।

এই আঠারো বছরে কত কী হয়ে গেল। দু-তিন রকম সরকার হ’ল, মঙ্গল গ্রহে মানুষ গেল, ব্যাটাছেলেরা অপারেশন করে মেয়ে হল, প্যারাডাইস সার্কাস ভেঙে গেল, বিয়ে করা স্ত্রী মরে গেল, তার নিজের ক্যান্সার ধরা পড়ল।

হ্যাঁ। কালো রঙের বাহ্য হচ্ছিল, জ্বর, শেষ অবধি ধরা পড়ল ক্যান্সার। ছেলেকে জানিয়েছিল। ছেলে মুম্বই নিয়ে গিয়েছিল। অপারেশন হয়েছে, কেমো থেরাপি। মাত্র দু’বছর আগেকার কথা। এর আগে একা একাই থাকতেন কৃষ্ণলাল। হ্যারিসন রোডের একটা মেস-এ। সম্পদ বলতে একটা অ্যালবাম। ওখানে প্যারাডাইস সার্কাসের নানারকম ছবি। দক্ষযজ্ঞ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, মহিষাসুরমর্দিনী…। যে টাকাটা সার্কাসের কল্যাণে জমিয়েছিলেন, তা থেকে যা ব্যাংকের সুদ পেতেন, তাতেই কোনওরকমে চলে যাচ্ছিল। অসুখটাই বিপত্তি বাধাল। ছেলেকে জানাতে বাধ্য হলেন কৃষ্ণলাল। ছেলে চিকিৎসা করিয়ে দিল। খরচাপাতি কী লেগেছে কৃষ্ণলালের জানা নেই। হতে পারে চিকিৎসার খরচ অফিস থেকেই পেয়েছে। ওর সার্টিফিকেটে বাপের নাম তো কৃষ্ণলাল বোসই লেখা আছে। এরপর ছেলে বলেছে মেস-এ থেকে কোনও কাজ নেই। একটা বৃদ্ধাশ্রম ঠিক করে দিয়েছে। চন্দননগরে গঙ্গার ধারে। মাসিক খরচটা ওর সুদের টাকাতেই হয়ে যায়, তবে এককালীন একটা মোটা টাকা জমা রাখতে হয়েছিল। সেটা ছেলেই দিয়েছে। মরে গেলে ফেরত পেয়ে যাবে। মরে যাওয়াটা খুব বেশি দূরে নেই। ও জানে যখন-তখন ফিরে আসতে পারে রোগটা, শরীরের অন্য কোথাও, অন্য কোনও খানে। বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটা জানে। ওরাও বলে দিয়েছে– এখন ভালো আছে, থাকা যাবে, কিন্তু রোগব্যাধি বাড়লে এখানে রাখা যাবে না। তবে লোকটাকে ফিরিয়ে দিলে জমা রাখা টাকাও ফিরিয়ে দেবে।

বৃদ্ধাশ্রমটা ভালোই। আলো হাওয়া খেলা করে। গঙ্গাটা দেখা যায়। বোর্ডাররা গল্প করে। সার্কাসের গল্প বলেন কৃষ্ণলাল। বৃদ্ধরা গল্প শোনে। মাঝে মাঝে বলে– আবার একটু সার্কাস হয়ে যাক-না প্রফেসর বোস।

এই বৃদ্ধাশ্রম মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন করে। একবার পুরী নিয়ে গিয়েছিল। এবার ডুয়ার্স। আশ্বিনের মাঝামাঝি। জঙ্গলে সদ্যস্নান সেরে আসা শ্যামলি। নদীজল কলকল, কাশফুল দুলছে। এই ডুয়ার্স পরিক্রমার মধ্যেই ছিল খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণশালা দর্শন। গতকাল এসে এক ঝলক চিতাটিকে দেখে মনে হয়েছিল এই সেই মধুবালা। তাই আজ আবার। অন্যরা অন্যত্র বেড়াতে গেছে। গেস্টহাউসে ফিরে আসবে বিকেলে। শরীর খারাপের নাম করে গেস্টহাউসেই রয়ে গিয়েছিলেন, তারপর হাঁটি হাঁটি করে আবার এখানে। মধুবালার টানে।

সেই রাত্রের কথা মনে পড়ে। রক্তমাখা জবুথবু চিতাবাঘটি। সারা গায়ে কী সুন্দর ছোপছোপ। বড়ো কাঠের বাক্সে ঢোকানো হ’ল। উপরে চাপা দেওয়া। গোপনে রাখা। স্থানীয় মানুষদের চোখের আড়ালে রাখা। জানতে পারলে পিটিয়ে মেরে দিত। বাক্সের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই গাঁক-গাঁক করে উঠছিল। যন্ত্রণার কাতরানির শব্দের সঙ্গে ক্ষোভ মেশানো ছিল, ক্রোধও।

মালবাজারের পাট গুটিয়ে এরপর অসমের বড়পেটা। ওর জন্য খাঁচা বানানো হ’ল। খাঁচায় খাবার দেওয়া হল। খাঁচার ভিতরে আস্ফালন। কৃষ্ণলাল ওকে সোনামনি ডেকেছে, এমন দুষ্টুমি করে না সোনা বলেছে, খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে ওর পিতামহের মতো গানও শুনিয়েছে, ‘এক পলকের একটু দেখা– আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?’ খাঁচার ভিতরে থেকে ও হালুম করেছে, গাঁক-গাঁক করেছে। মধুবালার জন্য একটুকরো লেজও গড়িয়ে দিয়েছিল। সার্কাসে যখন আসত, নকল লেজের টুকরোটা জোড়া দিয়ে দিত। কৃষ্ণলাল তো ট্রেনিং জানে না, অন্য সার্কাস থেকে একজন ট্রেনার আনিয়েছে। সেই ট্রেনার বলেছিল– এই চিতার বয়স একবছরও হয়নি। শিশু চিতা। কৃষ্ণলাল ওর নাম রেখেছিল মধুবালা।

ট্রেনার বলেছিল– এদের ঠিক মতো খাবার দিতে নেই। ক্ষুধার্ত রাখতে হয়। ক্ষুধার্তদেরই বশে রাখা যায়। হালুম করলেই চাবুক। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। হুকুম পালন করলেই খাবার দেওয়া হবে। এটাই নিয়ম। এটাই ফর্মুলা।

এভাবেই পোষ মেনেছিল মধুবালা। বশ্য থাকার বিনিময়ে খাদ্য। তারপর ক্রমশ বনের চিতাবাঘ মানুষের নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। চাবুককে ভয় পেতে শিখল। নখ গুটিয়ে নিল থাবার ভিতর। নখ গোটানো থাবায় হ্যান্ডশেক শিখল। পিঠে চাপলেন প্রফেসর বোস। গলায় পাটের কেশর চাপল, সং সাজল বনের চিতা। সিংহের অভিনয় করল। প্যারাডাইস সার্কাসের নামযশ হল। মাইকে ফোঁকা হতে লাগল ‘চিতাবাঘের আশ্চর্য খেলা’।

খাঁচার লোহার বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণলাল, মানে প্রফেসর বোস হেঁকে চলেছেন মধুবালা… হ্যালো মধুবালা, মাই ডার্লিং… কাম হিয়ার… কাম হিয়ার।

এবং কী আশ্চর্য। মধুবালা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। ওর অবশিষ্ট লেজটুকু নড়ে উঠল। খাঁচার ওধারে মধুবালা। হ্যাঁ, মধুবালাই তো। চিতাও কি মনে রাখে? বেড়ার ওধারে মধুবালা। ও কি এখন প্রৌঢ়া? ওর চোখ চিকচিক করছে কেন? জল? চোখে জল?

এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি।

মাঝে লোহার খাঁচা।

কেমন আছিস রে মধুবালা?

মধুবালা একবার তাকায়। প্রফেসর বোসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়।

মধুবালা একটা আওয়াজ করে… গররর…।

প্রফেসর বোঝেন– তুমি ভালো আছো তো বোস?

প্রফেসর বলেন– কী করে ভালো থাকব বল। তোকেও ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল, বাঁদর, কাকাতুয়াকেও নিয়ে গেল, তিড়িংটাও মরে গেল ঝপ করে, বড্ড মদ খেত। দলের আর রইল কী? মহিষাসুরমর্দিনীর আইটেমটাই বন্ধ হয়ে গেল। দলটাই উঠে গেল। দুর্গা, মানে দুগ্গি রে, ও বলল– এবার আমার কী হবে। কেউ তো আমার রইল না। আমার একটা উপায় করেন। ওকে কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় দিলাম। অন্যরা কেউ কেউ অন্য সার্কাসে চলে গেল। আমিও এখন তোর মতোই একটা বৃদ্ধাশ্রমে। তুই নিশ্চই এখানে আমার সার্কাসের চাইতে ভালো আছিস। কত গাছ। মাথার উপর আকাশ। ছোটো খাঁচার ভিতরে তো থাকতে হয় না আর। তোর মুক্তি হয়েছে। আমারও মুক্তি হয়ে যাবে মধুবালা। ক্যান্সার। এখন ঠিকই আছি, তবে আবার চলে আসতে পারে। খুব ভালো হল, যাবার আগে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আবার।

মধুবালা পিছন ফিরল। চলে যাচ্ছে কেন? ও কি চিনতে পারেনি তবে? আবার ডাকল, পুরোনো কায়দায়। হুকুম যেমন। কাম হিয়ার। কাম হিয়ার মধুবালা।

মধুবালা ফিরে এল। হুকুমের শব্দ মনে রেখেছে ও। দাঁড়িয়েছে।

প্রফেসর সত্যি সত্যি গান গায়। ‘আরও ভালো হতো। যদি তুমি আর আমি, পাশাপাশি বসে কাটিয়ে দিতাম যদি কিছুটা সময়…’।

এবার জঙ্গলের কেয়ারটেকার হাঁক দেয়। হাতে বস্তা। ও বেড়ার ওধারে। হু…উ..ই, হুক, হুক।

একটা পাথরের উপর মাংসখন্ড ফেলে দেয়।

গানের চেয়ে খাদ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এই জ্ঞানে মধুবালা খাদ্যের দিকেই মুখ ফেরায়।

কৃষ্ণলাল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। দূর থেকে মধুবালার খাওয়া দেখে। খাওয়া শেষ হলে কৃষ্ণলাল আবার ডাকে। হুকুমের স্বরেই ডাকে। কেয়ারটেকারটি এগিয়ে আসে। বলে, চ্যাঁচামেচি করছেন কেন! কৃষ্ণলাল বলে এই বাঘটি আমার পুরোনো বন্ধু। বহুদিনের চেনা।

কেয়ারটেকার বলে, যত পাগলের কারবার। চলে যান এক্ষুনি। জঙ্গলে জোরে কথা বলা বারণ। ওই দেখুন বোর্ড।

বোর্ডে লেখা– জঙ্গলের শান্তি ও নীরবতা বজায় রাখুন।

কৃষ্ণলাল গুটিগুটি পায়ে চলে যায়। গেট পেরিয়ে, ছায়াছায়া পথে এবার পিচ রাস্তায়। এখানে কয়েকটা হোটেল। আর মিনিট পনেরো হেঁটে গেলেই গেস্টহাউস। কৃষ্ণলাল ভবেন এখানকার একটা হোটেলেই খেয়ে নেবেন। তৃপ্তি হোটেল। আজকের স্পেশাল বোরালি মাছ। ডুয়ার্সে শো করতে এলে এই মাছ খেয়েছেন কত।

ডুয়ার্সের নদীগুলোতেই এই মাছ পাওয়া যায়। হোটেলে ঢুকতেই বাঁদিকে একটা বাঁশের মাচা। সেই মাচায় শুয়ে আছে এক মহিলা। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। মুখটা চেনা-চেনা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন কৃষ্ণলাল। বেজে ওঠে বেসুরো ট্রাম্পেট। দুর্গা? দুর্গাই তো। দুগ্গি। কৃষ্ণলাল চেঁচিয়ে ওঠেন। দুগ্গি, তুই?

দুর্গা চোখ খোলে। অপলক কিছুক্ষণ। ঠোঁট নড়ে ওঠে। হাল্কা শব্দে শোনে– পফেছর…।

পাশের কাশফুল ঝোপ নড়ে ওঠে। একটা নাম না জানা পাখির ডাক। কী আশ্চর্য। এখানে দুর্গা। এখানেই মধুবালা। কী করে হয়। পৃথিবী কী বিচিত্র। কোণায় কোণায় কত রহস্য কত সুখ পড়ে থাকে।

কৃষ্ণলাল বলেন– দুর্গা, তুই কি করে এখানে?

দুর্গা কিছু বলার চেষ্টা করে হয়তো, ঠোঁট নড়ে। কথা আসে না। তৃষ্ণা এগোয়, জল এগোয় না। হোটেল মালিক হাফপ্যান্ট আর জঙ্গলছাপ গেঞ্জি পরা। বলে– চেনেন এই মাসিকে?

কৃষ্ণলাল বলেন– খুব চিনি। এখানে কি করে ইনি?

হোটেল মালিক যা বলে তার সার কথা হল– এই মহিলা এই হোটেলে বাসন মাজা, তরকারি কোটা, ধোয়াধুয়ির কাজ করছে ওর বাবার আমল থেকে। টুকটাক রান্নাও। জঙ্গল থেকে ঢেঁকিশাক কুড়িয়ে আনতে গিয়ে পাথরে পা পিছলে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসে। জ্ঞান আসে, কিন্তু অঙ্গ পড়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। হাসপাতালে দেখিয়েছে। আলিপুরদুয়ারে। ওরা বলেছে শিরদাঁড়ায় চোট লেগেছে। অপারেশন দরকার। কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। কে নিয়ে যাবে কলকাতায়! এতদিনের পুরোনো মাসি। ফেলেও দেওয়া যায় না। শুয়েই থাকে।

কৃষ্ণলাল ওর পাশে বসে। নিজের কথা বলে।

এই দুগ্গিই দুঃখের কথা বলত প্রফেসরকে। বলত ওর স্বামী মদ খায়, মদটাই ওর আসল আনন্দ। বলত স্বামীর সোহাগ পায় না। বলত ও বাঁজা। বলত ও আদর চায়। কৃষ্ণলাল সেটাও দিয়েছিল।

কৃষ্ণলাল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মধুবালার কথা বলে। বলে কী আশ্চর্য, এত কাছে তোমরা দু’জনে থাকো, অথচ তোমাদের দেখা হয়নি। দুগ্গির মুখে হাসির রেখা আঁকা হয়ে যায়। ওর ঠোঁট নড়ে। প্রফেসর ঠিক বুঝতে পারছে ও বলছে, ওসব জায়গায় তো টুরিস্ট বাবুরা যায়। আমি কী করতে যাব?

প্রফেসর বলে– দেখবি দুগ্গি, দেখতে যাবি তোর মধুবালাকে? আবার চড়বি নাকি ওর পিঠে? ওর মুখে শিউলি ফোটে। কাশফুল নড়ে। আকাশে সাদা মেঘ ডানা মেলে।

দুগ্গিকে একটা ভ্যান রিকশায় শুইয়ে দেয়। পাশে প্রফেসর। মনে মনে বলে দুগ্গি, তোকে এই অবস্থায় ফেলে আমি চলে যেতে পারি? এখান থেকেও নয়, পৃথিবী থেকেও নয়। এখন আমার মরে যাওয়া চলবে না। ক্যান্সারের নিকুচি করেছে। তোকে কলকাতা নিয়ে যাব।

তার আগে ওই পুরোনো বন্ধুর কাছে।

সেই লোহার বেড়ার কাছে ভ্যান রিকশা থামে। কৃষ্ণলাল প্রফেসর বোস হয়ে হাঁকেন– মধুবালা… কাম, কাম হিয়ার। ইউ সি হু ইজ শি। কাম অন, কাম অন…। মধুবালা গুটি গুটি পায়ে বেড়ার কাছাকাছি চলে আসে। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। চিতার গায়ে বিকেলের সোনা রোদ। দুগ্গি পাশ ফেরে। মধুবালাকে চিনতে পারে যেন। ওর মুখে শিউলি-কাশফুল-সাদা মেঘ মেশানো শরৎ। মধুবালা শব্দ করে। বলে, চিনতে পারছ দিদি? বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীরা ধরনির বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধবনি। দুগ্গি কনুইয়ে ঠেস দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। প্রফেসর বাড়িয়ে দেয় হাত। দুগ্গি বসে। পিঠে হাত দিয়ে রাখে প্রফেসর। দুগ্গি ক্রমশ দুর্গা হয়ে যায়। লোহার খাঁচা আঁকড়ে ধরে দু’হাতের আঙুলে। প্রফেসর কোমর ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। দুর্গা বেড়া ধরে এক’পা – দু’পা। মধুবালা গররগরর করে বলে হ্যাঁ-হ্যাঁ, এভাবেই। সার্কাস দেখাচ্ছে দুর্গা। আবার। হয়। ভালোবাসায় হয়। বেজে উঠল ট্রাম্পেট, বিউগল। বাজল। ‘বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন…’

 

আজ শালুকের জন্মদিন

সুবোধের যখন ঘুম ভাঙল পৃথিবীর গা থেকে কুয়াশার সর এতটুকু কাটেনি। যেন কয়েক লাখ টনের এসি ফুলদমে চলছে। পুরো কনকনে ঠান্ডা চারদিকে। পুরোনো সরষের তেলের গন্ধে ম-ম করা লেপটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আর এক চোট ঘুমের ব্যবস্থা করতে যাবে হঠাৎই মনে হল কাল রাতে ছেলেটার গায়ে চাদর ঢাকা দেওয়া হয়েছিল? আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় গতকাল রাতের কথা মনে করতে চেষ্টা করল। রাত্রে ছেলেকে খাওয়ানো তারপর এঁটো বাসন তুলে…। কম্বলটা কি শেষপর্যন্ত জড়িয়ে দিয়েছিল? …যতদিন যাচ্ছে মাথাটার বারোটা যেন বেজে যাচ্ছে। আগে কত মনে থাকত! বড়ো বড়ো হিসেব সব গড়গড় করে বলে ফেলতে পারত, এখন সব গেছে, এই এক বছরে মাথাটা যেন অন্য লোকের হয়ে গেছে!

দু’-একবার এপাশ-ওপাশ করে নরম গরম বিছানার মায়া ছেড়েছুড়ে উঠে পড়ল সুবোধ। লেপ ছাড়তেই ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরল শীত। ঘরের টিউব জ্বালল। পাশের চৌকিতে নীলিমা ঘুমোচ্ছে। আপাদমস্তক লেপে ঢাকা। ও কী করে যে মুখ ঢেকে ঘুমোয় সে এক বিস্ময়। তিপ্পান্ন বছরের সুবোধ কোনওকালেই চাদর বা লেপে মুখ ঢেকে ঘুমোতে পারে না। দম আটকে আসে। নীলিমা ঠিক উলটো স্বভাবের। ছেলেটার স্বভাবও ঠিক তাই। পুরো মুড়ি দিয়ে তারপরে ঘুমোয়।

ঘরের এককোণে লালুয়া চটের পাপোশের ওপর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছিল, সুবোধকে উঠতে দেখে এখন পিটপিট করে দেখছে। তিন বছর বয়স হয়ে গেল মদ্দা কুকুরটার। শালুক, মানে সুবোধের ছেলেই নর্দমা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল কুকুরটাকে। লালচে হলুদ কুকুরটার তখন এই লিকলিকে চেহারা। নর্দমায় পড়ে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। বড়ো কুকুরের কামড়ে পিঠের অনেকটা ছালও উঠে গেছিল। সেই কুকুরবাচ্চাকে রীতিমতো সেবা শুশ্রূষা করে পুরো ফিট করে তুলেছিল শালুক। তারপর যা হয়, কুকুরটা আর গেল না এই বাড়ি ছেড়ে। নীলিমা মাঝে মাঝে ছেলের ওপর রাগ করে বলত বাড়িটা পুরো চিড়িয়াখানা করে ফেললি! কুকুর, খরগোশ, পায়রা, এরপর বন থেকে বাঘ ভাল্লুক নিয়েও পোষ, আমাদের মেরে খাক তবে তোর শান্তি হবে।

মায়ের কথা শুনে হাসত শালুক। খুব হাসত, আর হাসলে এত সুন্দর লাগে… সুবোধ তো নিজের ছেলের রূপ নিয়ে খুব ডাঁটে থাকে, এখনও। ওর বন্ধুদের গ্রুপে এমন সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা আর একজনেরও নেই। হোক না সুবোধ গরিব মানুষ, হোক না দুইবেলা ইস্তিরি ঘষে সুবোধের সংসার চলে কিন্তু এমন সুন্দর দেখতে ছেলে পাড়ায় কটা আছে? ছিলও না থাকবেও না।

ঘুমচোখে পা ঘষে ঘষে শালুকের কাছে এল সুবোধ। ছেলের দিকে তাকাল। ইসসস যা ভয় পেয়েছিল ঠিক তাই… আহা রে! পুরো রাতটা ঠান্ডার মধ্যে ছেলেটা… নিজের কপালটায় চটাস চটাস করে দুটো থাপ্পড় মারল সুবোধ। তারপর নিজের তোবড়ানো গালের ওপর বিজিবিজি পাকা দাড়িগুলোয় নিজের কেঠো আঙুলগুলো কয়েকবার বুলিয়ে নিল। নিজের পিছনেই লাথি মারতে ইচ্ছে করছে সুবোধের। শালা বাপ হয়েছে ও! নিজের ছেলের এইটুকু খোয়ালও রাখতে পারে না!

আলনা থেকে একটানে নীল রঙের শালটা নামাল। এটা শালুকের বড্ড প্রিয়। শালুক তাকিয়ে রয়েছে বাবার দিকে। সুবোধ নিজের ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারল না, বড়ো অপরাধী লাগছে নিজেকে। ক্ষমা কর বাবা, একেবারে ভুল হয়ে গেছে, জানিসই তো তোর বাপটা চিরকালের অপদার্থ! এই ঠান্ডায় আবার সর্দি হলে মাথা যন্ত্রণাটা বাড়বে তোর। সব জানি তাও যে কী করে ভুলে গেলাম। বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে শালটা দিয়ে ভালো করে নিজের উনিশ বছরের ছেলে শালুকের মাথা কান ভালো করে মাফলারের মতো পেঁচিয়ে দিল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল সুবোধের। তারপর শালুকের নাকের ডগায় গালে হাত ঠেকাল। ইসস একেবারে ঠান্ডায় হিম হয়ে আছে ছেলেটা।

খুব ঠান্ডা লেগেছে না রে বাবা?

না বাবা আমার ঠান্ডা লাগেনি। বলল শালুক।

একবার তো ডাকবি আমাকে! আমার না হয় বয়স হচ্ছে আজকাল সবই কেমন যেন ভুলে যাই, আর তোর মা… তো ঘরে থেকেও নেই, কোনও কিছুতেই খেয়াল নেই শালীর। ছেলেটা সারা রাত এই যম ঠান্ডায়… একটা চাদর যে অন্তত গায়ে চাপিয়ে দেবে সেটাও মনে রাখে না। কতবার করে তোর মাকে বলেছিলাম, তোকে… কেউ শুনল না, তোর মাও না, তুইও না। এবার নে, ঠান্ডায় জমে বসে থাক। আমার কী! বলতে বলতেই বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠে নিজের বিছানার দিকে যাচ্ছিল সুবোধ। আবার ফিরে এল। শালুকের গালে হাত রেখে বলল রাগ করিস না মনা। বকলাম তোকে।

না বাবা রাগ করিনি আমি, তুমি শুতে যাও। আমার শীত করছে না।

মাথায় ব্যথা করছে না তো?

না করছে না।

আচ্ছা। কাল বেলায় আমাকে একবার মনে করাস। একটু সরষের তেল গরম করে ভালো করে মালিশ করে তারপর চান করাব তোকে। ঠান্ডা যদি লেগেও থাকে সব পালাবে। আর কাল মনে আছে তো? কী দিন?

হ্যাঁ বাবা মনে আছে। বলে সামান্য হাসল শালুক।

এত সুন্দর করে কী করে যে হাসে ছেলেটা! দেখলে সব মন খারাপ হুশ হয়ে যায়। একটা দারুণ জিনিস এনেছি তোর জন্য। দেখবি খুব পছন্দ হবে তোর।

কী জিনিস বাবা?

উহুঁ আজ না কাল দেখিস। তোর মায়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে। বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল সুবোধ। আর শালুক তাকিয়ে থাকল কুয়াশার পাতলা পাতলা পর্দা ঢাকা ভোরের দিকে।

**

রবিবারটা সকলেরই ছুটি থাকে। প্রবুদ্ধ, সোনাল, অরিন্দম, নির্মাল্য একটু বেলা হলে চলে আসে সুবোধকাকুর দোকানে। ওরা সকলেই শালুকের বন্ধু। আগে যখন শালুক নিয়মিত দোকানে বসত তখনও আসত ওরা, এখন শালুক আর বসে না, তবু আসে। সুবোধের ইস্তিরি ঘরের ঠিক পাশেই শালুকের দোকান। পান, বিড়ি, সিগারেট, লজেন্স আরও টুকিটাকি জিনিস বিক্রির দোকান। সুবোধই দোকানটা করে দিয়েছিল ছেলেকে। টুয়েলভ পাশ করার পর আর পড়াশোনা করতে চাইছিল না শালুক। কোনওকালেই পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না ওর। ছোটোবেলা থেকেই যার পায়রা ওড়ানোর শখ তার মনও আকাশেই ওড়ে। পড়ার বইয়ে আর বসতে চায় না। ক্লাস এইট পাশ সুবোধ ছেলেকে পণ্ডিত বানানোর কোনওদিনই স্বপ্ন দেখেনি। আর নীলিমাও তাই। আর শালুকের সেই মাথা যন্ত্রণার রোগটাও ছিল সাংঘাতিক। যখন তখন আসত। আর নিজেই ওষুধ খেত।

এইচএস পাশ করার পর বন্ধুরা যখন কলেজে ভর্তি হল তখন ছেলেকে নিজের ঘরেরই সামনে দোকান করে দিল সুবোধ। পাড়ার দোকান। মোটামুটি যেমন চলার তেমনই চলে। ছেলে ছোকরাদের ভিড়। ছেলের রূপের গর্বে গর্বিত সুবোধ শুধু শালুকের মুখের দিকে তাকাত আর ভাবত এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা ছেলেটা পেল কী করে! এমন রং, ব্যাকব্রাশ করা এমন ঘন কালো চুল, সুন্দর নাক, ছুঁচলো চিবুক, পাতলা ঠোঁট, চোখের পাতাগুলো এত বড়োবড়ো। এমন চেহারা নিয়ে যেন কোনও বাজে মেয়ের খপ্পরে না পড়ে তাই নিয়েও অহরহ দুশ্চিন্তা সুবোধের। নীলিমা হাসত আর বলত, তোমার ওই পানবিড়িওলা ছেলেকে কোনও মেয়েই বিয়ে করবে না দেখো।

এহ্ বললেই হল! দেখো রাজকন্যাকে নিয়ে আসব বউমা করে।

কতযুগ আগের যেন সেইসব কথা। সুবোধ নিজের ইস্তিরি ঘরে দাঁড়িয়ে উনুনে লোহার ইস্তিরি গরম করে। তারওপর চাদর ঢাকা চওড়া টেবিলে খদ্দেরদের দিয়ে যাওয়া জামা, প্যান্ট, শাড়ি, সালোয়ার, ধুতি, পাঞ্জাবি একের পর এক ডলে যেতে থাকে। যত মনে পড়তে থাকে তত চাপ বাড়তে থাকে ইস্তিরির হাতলে।

সব ছুটির মতো আজও একটু বেলা হতেই প্রবুদ্ধ নির্মাল্যরা এসে পড়ল। আগে শালুক যখন দোকানে বসত তখন আড্ডাটা জমত দারুণ। কিন্তু ও যেদিন থেকে আর বসতে পারে না বন্ধুরা ভেবেছিল আর এই দোকানে কেউ অন্তত ছুটির দিনের সকালে আসবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি সুবোধকাকুর জন্য। ওদের সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিরকালের হাফ খ্যাপাটে লোকটা বলে এসেছিল হ্যাঁ রে তোরা কেমন বন্ধু। এতকাল একসঙ্গে রইলি আর যেই শালুক দোকানে বসতে পারবে না অমনি আসা ছেড়ে দিলি! তোরা না আসলে, ওর মনটা কেমন খারাপ লাগবে বল তো! আরে ওর হয়ে দোকান আমি খুলব। তোদের হাতজোড় করছি অন্তত ছুটির দিনগুলোয় ছেলেটার পাশে গিয়ে একটু বসে আগের মতো গল্পটল্প করিস।

প্রবুদ্ধরা বলতে চেয়েছিল কাকু বিশ্বাস করুন শালুককে ওইভাবে দেখতে আমাদের খুব কষ্ট লাগে… খুব! সেইজন্য ইচ্ছে হলেও ওর পাশে গিয়ে বসতে আর ইচ্ছে করে না। কিন্তু বলতে পারেনি কেউ। লোকটা আরও কষ্ট পাবে তাহলে। তাই ‘আচ্ছা কাকু আমরা আবার যাব ছুটির দিনে।’ কিন্তু কেউ যায়নি। যেতে পারেনি।

তার কিছুদিন পর নীলিমা গেছিল ওদের বাড়িতে। তোরা একটু ছুটির দিনগুলোয় পারলে যাস বাবা নইলে মানুষটাকে বাঁচাতে পারব না। জানিসই তো…

আচ্ছা কাকিমা যাব। আর না গিয়ে থাকতে পারেনি বন্ধুরা।

তারপর থেকে প্রতি ছুটির দিনে সেই আগের মতোই শালুককে ঘিরে সকাল সন্ধে গল্প করে ওরা। আর পাশের ঘরে ইস্তিরি চালাতে চালাতে সুবোধ কান খাড়া করে শুধু শোনে তার একমাত্র ছেলে শালুক, পাড়ার সবথেকে সুন্দর ছেলে শালুক কী গল্প করছে, কতটা হাসছে।

বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছোল চার বন্ধু। গিয়ে দেখে তখন সুবোধকাকু হই হই করে শালুককে তেল মাখাচ্ছে। মাথায় মুখে কানে গলায় বুকে…

কী করছেন কাকু?

এই দেখ না তোদের বন্ধুর অবস্থা। ঠান্ডায় গালের চামড়া কেমন ফেটে গেছে। আজ এমন জম্পেশ করে তেল মাখাব সব ফাটাফুটি ভ্যানিশ হয়ে যাবে। আয় আয় দেখবি কেমন ফেটেছে দেখ বলে ওদেরকে কাছে ডাকল সুবোধ। চারজনেই এগিয়ে এসে মুখ ঝোঁকাল শালুকের মুখের সামনে। শালুক খুব হাসছে। কিছু বলছে না। বন্ধুরা দেখল শালুকের দুই গালে খুব সরু সরু ফাটা দাগ।

হ্যাঁ কাকু।

বল তো জন্মদিনের দিন এমন থাকলে মানায়? বোস তোরা, গল্প কর। আমি চানটা করিয়ে দিই ওকে।

গল্প আর কী করবে? প্রবুদ্ধ শালুকের দিকে তাকিয়ে বলল হ্যাপি বার্থ ডে শালুক। আজ সন্ধেবেলা সবাই আসছি। খুব আনন্দ হবে সবাই মিলে।

হ্যাঁ সন্ধের মধ্যে চলে আসিস সবাই। কাজ করতে করতে উত্তর দিল সুবোধ। তারপর বলল, তোরা এক কাজ কর তো। ঘরের ভেতর দেখ একটা হ্যালোজেন আছে আর সাউন্ড বক্স। কালকেই নিয়ে এসেছি। হ্যালোজেনটা বারান্দায় বেঁধে ফেল আর বক্সটা ফিট করে তোদের যা ইচ্ছে গান শোন, হই হই কর অমন চুপ করে বসে আছিস কেন বন্ধুর জন্মদিনে?

আচ্ছা কাকু করছি। উঠল চারজনে একরকম জোর করেই। শালুক সব দেখছে আর হাসছে। বন্ধুরা হ্যালোজেন লাইট বাঁধল, সাউন্ড বক্স ফিট করল আবার তার মাঝে শালুকের দোকানে যেসব খদ্দের টুকিটাকি জিনিস কিনতে এল তাদেরও জিনিস দিল। আর ওদিকে সুবোধ পুরো দুই বালতি জলে শালুককে স্নান করিয়ে নতুন গামছা দিয়ে ভালো করে মোছাল। তারপর শালুকের কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা দিয়ে প্রবুদ্ধদের জিজ্ঞাসা করল বল এবার কেমন লাগছে তোদের বন্ধুকে।

খুব সুন্দর কাকু।

দেখবি রাত্রে তোদের বন্ধুর জন্য যা একখানা জিনিস এনেছি না। কাল রাতেও বলেছি তোদের বন্ধুকে। খুব দেখতে চাইছিল আমি দেখাইনি। একবারে রাতে দেখাব।

হ্যাঁ কাকু সেই ভালো।

তোরা বোস আমি পায়রাগুলোকে উড়িয়ে দিই একবার।

চার বন্ধু চুপ করে দেখল সুবোধকাকু ঘরের পিছনের মাচায় উঠে পায়রার খোপগুলো খুলছে। কত রকমের যে পায়রা রয়েছে শালুকের। গোলা, লককা, গিরিবাজ, চিলা। এইসব নাম শালুকের কাছ থেকেই জানা ওদের। একেক পায়রা একেক রকম স্পেশাল। কারও পেখম ময়ূরের মতো কেউ আকাশে উড়তে উড়তে দারুণ ভল্ট খায়। হাততালি আর বিশেষ রকমের সিটি দিয়ে পায়রা ওড়াত শালুক। খুব নেশা ছিল পায়রা ওড়ানোর। কম্পিটিশনে নামও দিত। ওর একজোড়া গিরিবাজ পায়রা রয়েছে সে দুটোর দারুণ ওড়ার দম। সকালে উড়িয়ে দিলে সন্ধে হয়ে গেলেও নামতে চায় না। শালুক যেখানেই খবর পেত কেউ ভালো জাতের পায়রা বেচতে চাইছে অমনি সাইকেল চালিয়ে ছুটত সেখানে, কিনে আনত সেটা। শালুকের কাছেই সোনালরা শুনেছিল অনেক সময় অন্য কোথাকার পায়রাকেও নিজের পায়রাদের দিয়ে ভুলিয়ে পোষ মানিয়ে ফেলা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে পায়রা ওড়াতে এতটুকু ক্লান্তি ছিল না শালুকের। খুব আনন্দ পেলে বলেই ফেলত একেক সময়, এর পরের জন্মে মাইরি পায়রা হয়ে জন্মাব, আর শুধু উড়ব।

সেই ছেলেটাই এখন সারাদিন চুপচাপ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে।

আজ পায়রাগুলোকেও খুব ভালো দানা খাওয়াব বুঝলি। আর শোন তোরা শুধু চারজনেই আসিস না। তোদের গ্রুপের যত বন্ধু আছে সকলকে তো আমি চিনি না, প্রত্যেককে নিয়ে আসিস কিন্তু। খাবারের কোনও অভাব হবে না। বুঝলি?

আচ্ছা কাকু।

গোটা বেলাটা শালুকের সামনে কাটিয়ে দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় সোনাল বলল, আমার একটুও আসতে ইচ্ছে করছে না।

আমারও না। কিন্তু আসিস নইলে কাকু…

হ্যাঁ আসব।

আর কাকে বলবি?

অয়ন, মারুফ আর অর্পণকে বলা যেতে পারে।

দ্যাখ।

আচ্ছা ফোনে বলে নেব।

***

সন্ধেবেলা থেকে হ্যালোজেনের চড়া আলো সুবোধকাকুর বারান্দায় কিছুটা রাস্তায়। সঙ্গে বক্সে গান, শালুকের বন্ধুদের গল্প। যতটা না আনন্দ আসছিল তার থেকে একটু বেশিই দেখাতে হচ্ছিল ওদের। চুপ করে গেলেই সুবোধকাকু এসে বলছিল কী রে চুপ করে বসে আছিস কেন? গানবাজনা কর। ওই দেখ তোদের বন্ধু কেমন হাসছে আজ এতদিন পর তোদের সকলকে পেয়ে। আর ড্রেসটা কেমন পরিয়েছি বল?

হ্যাঁ কাকু খুব সুন্দর হয়েছে, প্রশংসাটা করতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেছিল শালুকের বন্ধুদের। আজ বন্ধুরা মিলে শালুককে উপহার দিয়েছে একটা ধপধপে সাদা খরগোশ ছানা।

সুবোধ বলেছে ঘরে তো একটা রয়েছে, আবার আর একটা আনলি কেন?

আর একটাও থাকুক কাকু।

আচ্ছা থাক।

নীলিমা শালুকের বন্ধুদের জন্য লুচি ছোলার ডাল, খাসির মাংস রান্না করছে। রান্না করতে করতে বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছে তার। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

কেমন ফিটিং হয়েছে বল জ্যাকেটটা? খুব অহংকারের হাসি নিয়ে ছেলের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করল সুবোধ। একটা নীল রঙের জ্যাকেট শালুককে আজ পরিয়েছে ওর বাবা। সুন্দর দেখতে।

খুব সুন্দর হয়েছে কাকু।

দ্যাখ দ্যাখ তোদের বন্ধুর কী হাসি দ্যাখ? বলে এমনভাবে শালুকের গাল টিপে দিল সুবোধ যেন এখনও ও ক্লাস টু-তে পড়ে। অবশ্য চিরকালই সুবোধের এমন স্বভাব। ছেলে যে বড়ো হয়েছে তা যেন খেয়ালই পড়ে না। এই বছর দেড়েক আগেও শালুক যখন এইচএস পরীক্ষা দিচ্ছে সুবোধ ওকে নিজের সাইকেলের হ্যান্ডেলে বসিয়ে স্কুল নিয়ে যাওয়া আসা করেছে, ওকে একা সাইকেল চালাতে দেয়নি। এত বেশি ছেলে ছেলে… আসলে নীলিমা বোঝে, বিয়ের ন’বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ওর পেটে কেউ আসছে না, ডাক্তার ওষুধ পির মন্দির সব করতে করতে হয়রান তখন আচমকাই একদিন ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। শালুক এল। সে যে কী আনন্দ সুবোধের। বড্ড শখ ছিল একটা বাচ্চার। শালুককে পেয়ে যেন মানুষটা এক পৃথিবী আনন্দে ভরে উঠেছিল। সারাক্ষণ শুধু ছেলে আর ছেলে। নীলিমা মা হয়েও যা করে উঠতে পারত না সুবোধ যেন সেটুকুও করে ফেলত। গোটা জীবনটাই শুধু শালুকে ভরা হয়ে উঠেছিল সুবোধের।

পথচলতি মানুষরা যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে দেখল ব্যাপারটা কী ঘটছে। যারা পাড়ার পরিচিত তারা বুঝল যারা অপরিচিত তারা কিছু না বুঝেই কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে কিছুই না বুঝে আবার হাঁটা লাগাল।

আজ শালুক তোদের সঙ্গেই খাবে।

হ্যাঁ কাকু। আমরা আজ একসঙ্গে খাব।

শালুকের জন্য আজ নতুন থালা বাটি গ্লাস। তাতে লুচি মাংস ছোলার ডাল পায়েস। শালুক আজ যেন বেশি হাসছে। বন্ধুদের সঙ্গে কত খুশিতে খাচ্ছে শালুক। কতদিন পর আবার গুছিয়ে খাচ্ছে…। বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে অবশ হয়ে দেখছিল সুবোধ। নীল রঙের জ্যাকেটটা পরে কী সুন্দর লাগছে! ওর বন্ধুদের মধ্যে সেরা।

অনেক রাত। পৃথিবীর সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ বুজে অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই চোখ মেলল নীলিমা। আজ তারও ঘুম আসছে না। একেক সময় মনে হয় বুক ফাটিয়ে কাঁদতে, কিন্তু তাহলে ওই মানুষটাকে আর বাঁচানো যাবে না। পাশ ফিরে নাইটল্যাম্পের আবছা আলোয় দেখল ঘরে সুবোধ নেই। নীলিমা জানে লোকটা কোথায় গেছে। লেপের ওম ছেড়ে উঠল। বারান্দার ভেজানো দরজাটা অল্প ফাঁক করে দেখল এক ভেঙেচুরে যাওয়া বাবা অন্ধকারে তার ছেলের সামনে বসে আছে। তার গায়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে আর বলছে তুই খুশি হয়েছিস তো বাবা? আমি কত করে মিস্তিরিকে বলেছিলাম শুধু বুক পর্যন্ত কেন বানাচ্ছ? পুরোটা চাই আমার ছেলে নইলে নড়াচড়া করতে পারবে না। কেউ শুনল না। জ্যাকেটটা তোকে বড়ো সুন্দর লাগছে… তোর হাতদুটো থাকলে আরও কত ভালো লাগত বল তো? কেউ শুনল না!…

উনিশ বছরের ছেলের শ্বেত পাথরের মূর্তির মাথায় গালে বুকে বার বার হাত বোলাচ্ছিল সুবোধ আর বলে চলেছিল তোর মাথায় ব্যথাটা আর নেই তো সোনা? ব্যথা হলে আমাকে এবার আগেই বলিস আর চুপ করে থাকিস না সোনা… আর নেই তো?

শালুক হাসছে। ওর বুকের পর থেকে যে চৌকো থামের মতো পাথরের পিলার তার অনেকটা পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে জন্মদিনে বাবার পরানো জ্যাকেট। ওই কাপড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে পাথরের ফলকে কালো রঙে লেখা একটা ছোটো লাইন। শালুক মজুমদার। জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৯৭।

প্রেম-অপ্রেম

তারুণ্যে ভরপুর সেগুনগাছগুলো অল্প বাতাসেই বেশ মাথা নাড়ায়। মেন রোডের ধারে বাড়ি বলে দূষণের ছাপ বাড়ির গায়ে পড়েছে। সেগুনগাছগুলোর পাতার উপরেও। কর্পোরেশনের জল ইদানীং মানে কয়েক বছর হল চালু হয়েছে। সে জল নিতে হলে ছ’খানা গাছের মাঝবরাবর হেঁটে যেতে হয়। গাছগুলোর শিকড় এখনও পোক্ত নয়। মোটে পোক্ত নয়, বলতে গেলে কচি-ই। পাথুরে শক্তমাটি ভেদ করে মাটির গভীরে যেতে সময় চাই। অথচ কর্পোরেশনের জল এখন ঘরে ঘরে। দু’দিন পর পর রাস্তা ফুটো করে পাইপ বসে যায়। ঘরে পাইপ ঢোকা মানে আর রাস্তার কলে লাইন দিতে হয় না।

মনোজিৎ ভেবেছিল ওসব ঝামেলায় যাবে না। কুয়ো আছে। ভাবনা কী? গ্রুপ ডি-তে চাকরি করেও রিটায়ারের সময় দেদার টাকা এসেছে হাতে। তো, এত টাকা কি সব ভবিষ্যতের ভাঁড়ে জমা হবে। বর্তমান যদি হাঁপায়, ভবিষ্যৎ আসবে কী করে? সবকালেই টাকার খেলা চলে। ছেলে কুণাল বুদ্ধি দেয় বাপকে। মাধ্যমিক পাস কুণালের মাথায় বুদ্ধি গজগজ। কুয়ো এখন সমাজে অচল। পরিশ্রুত জল না খেলে সোসাইটিতে মান থাকে না। সোসাইটি এখানে পায়েল। কুণালের ধ্যান-জ্ঞান। সুতরাং বাড়িতে কর্পোরেশনের জল এল। দুটো সেগুনের মাঝবরাবর পাইপ ঢুকে গেল। মনোজিৎ স্নেহভরে সেগুনদের দ্যাখে। একদিন এরা মহীরুহ হবে। এত বড়ো বড়ো পাতা। চমৎকার বাতাস দেবে। জল এসেও স্বস্তি হয়েছে। ছেলেটা খুশি। মনোজিতের হাতে এখনও প্রচুর পয়সা।

শ্যালক বিবস্বান এসেছে জলপাইগুড়ির আদরপাড়া থেকে। এসেছে চকচকে অল্টো চেপে। গাড়ির হর্নে অ্যাম্বুলেন্সের ধামাকা। দেখেশুনে কুণালের মাথা খারাপ। মাতুলের প্রশ্রয় মিশে গেল এর সঙ্গে। জামাইবাবুকে আড়ালে ডেকে নিল বিবস্বান। সানগ্লাস খুলে পকেটে ঢোকাচ্ছে ও। দেখে খাপে ঢাকা ছুরি ভেবে চমকে উঠেছিল মনোজিৎ। দিনকাল ভালো নয়। স্বজনকেও ভয় হয়। হাতে পয়সা এসেছে কিনা!

‘বুদ্ধি খরচা করো মনোজিৎদা। সঙ্গে টাকাও। ভবিষ্যৎ তোমার ছেলে। ভয় কী?’ বিবস্বানের ধূর্ত চোখে বদবুদ্ধির পটাকা ফোটে। শ্যালককে খুব একটা বিশ্বাস করে না মনোজিৎ। নিজের লোককেই ভয় বেশি। কারণ, ঘরের খবর সে-ই জানে বেশি, দুর্বলতার সুযোগও সে-ই নেবে বেশি। ইদানীং কুণালের মন উড়ু উড়ু। পকেটে দামি মোবাইল। দামি বাইক। অ্যান্টি ড্যানড্রফ শ্যাম্পুর চুলে হাইলাইট। হাসি-কাশি সবই চেঞ্জ হয়ে গেছে ছেলের। মামার দেখাদেখি এখন আবার অল্টো না চায়।

জামাইকে আনমনা হতে দেখে সাবধান হল বিবস্বান। মেপে পা ফেলতে হবে। বিবস্বানের পরিচিত মানে সুপরিচিত সোমেশ দাসের মেয়েকে ছেলের বউ করে মনোজিতের ঘরে ঢোকাতে হবে। এ কাজটা পারলে সোমেশের কাউন্সিলার ভাই দীপেন দাসের নেকনজর পাবে বিবস্বান। নজরটা ঠিকঠাক পেলে ঠিকেদারির ব্যাবসা জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। সেই ক্ষীরে কিশমিশ আর এলাচের গন্ধ। লোকবলঅলা সংসারে অর্থবল না থাকায় কাজু-টাজু অনেক দূরের বস্তু ছিল। ইদানীং অবস্থা পালটেছে। তাই মাঝেসাজে রূপশ্রী সিনেমা হলের পাশের মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে ছানা আনে ছেলেদের জন্য। আপেল আনে বিধান মার্কেট থেকে। তাও শালা দাম কম নাকি?

‘ছেলেকে কিছু তো করে দিতে হবে। মার্কেট প্লেসে একটা স্টেশনারি দোকান দিয়ে দিই?’ মনোজিৎ শ্যালকের চতুর পরামর্শ চায়। শ্যালকটাকে খুব বিশ্বাস করে না মনোজিৎ। বিবস্বান এত টাকা পায় কোথায়? জাল নোট-ফোটের কারবার করে না তো!

‘তুমি জানো মনোজিৎদা, মার্কেট প্লেসে অ্যাডভান্স কত দিতে হয়? বাড়ির সামনের সেগুন কেটে ফ্যালো। দোকান লাগিয়ে দাও। ফাইন।’

‘সেগুন?’ অবাক হয় মনোজিৎ, ‘ওতো সবে বাড়ছে। শিকড় নড়বড়ে। কেটে কী লাভ? তাছাড়া শেকড় মাটির ভেতরে যাবে, তবেই শক্ত হবে। পোক্ত হবে!’ মনোজিৎ বিড়বিড় করে।

‘ধুর! মাটি শক্ত হয়ে উঠেছে। শেকড় বেশি গভীরে যাবে কী করে? আর মাটি কোথায়? সবই পাথর।’ বিবস্বান শব্দ না করে হাসতে থাকে– ‘পড়াশোনা ছেড়ে না দিলে ও একদিন অফিসার হতে পারত। স্টেশনারি দোকান ওকে মানায় না! এসটিডি বুথ খুলে দাও। সঙ্গে ফিল্মের সিডি, মিউজিক সিডি, মোবাইলের হ্যান্ডসেট… খুব চলবে।’ বিবস্বান সন্তর্পণে মূল ঘটনার দিকে এগোয়– ‘এখন শিলিগুড়ি জমে উঠেছে। নানা ধরনের লোক ভিড় জমাচ্ছে এখানে। আরে জামাইবাবু, তুমি তো পারলে না! ছেলেকে টাকা ধরতে শেখাও। এরপর বিয়ে আছে, ভালো মেয়ে চাই, তাই না? কচি সেগুনই বেচে দাও। শেকড়বাকড় বেশি গভীরে না যাওয়াই ভালো, বুঝলে?’

শ্যালকের ইঙ্গিতমতো শোরুম খুলে দিয়েছে মনোজিৎ। ‘দোকান’ শব্দটা পছন্দ নয় কুণালের। আসলে ইদানীং, অনেক কিছুই ঠিকঠাক বোধগম্য হচ্ছে না। শিলিগুড়ির জল বাতাসে কীরকম একটা গন্ধ ভাসছে। শপিং মল, বিগবাজার, সিনেম্যাক্সে বিদেশি ছবি…। সানি আর বাসব সেদিন কোন হোটেলে নাকি ফ্যাশন শো দেখতে গেছিল। একটা মডেল নাকি দীপিকার মতো দেখতে। দীপিকা পাড়ুকোন। পায়েলও তো দীপিকার মতো দেখতে। ওরও খুব মডেলিং-এর শখ। লোকাল কেবল চ্যানেলে অ্যাংকারিং করে। পরিচিত মুখগুলো কী করে যেন ক্যামেরার মুখ হয়ে উঠেছে। মাথাটা পাগল পাগল ঠেকে কুণালের। অনেক টাকা চাই। ইদানীং পায়েল বড্ড উড়ু উড়ু করছে!

বিবস্বান জানতো এমনটাই হয়ে থাকে। সময়টা বড্ড উদ্ভ্রান্ত। বয়সটাও। কী করবে কেন করবে বুঝতে পারছে না এরা। হঠাৎ করে মোটা টাকা হাতে এসে যাওয়ায় টলমল করছে দিদির পরিবার। বর্ধমান রোডে বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়ে গেল ভাগ্নেকে। সেখানে বসে জীবনের মূল অর্থ, অর্থ বিনা অনর্থ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান দিল বিবস্বান মামা। বিরিয়ানির পাশাপাশি মামার কথা গিলছিল ভাগ্নে। শেষে তুরুপের তাস বের করল বিবস্বান– ‘বিয়ে কর। একটা বিয়ে তোকে করতে হবে।’

‘সে তো করব। আগে দাঁড়িয়ে নিই!’ কুণাল মৌরি চিবুচ্ছিল।

‘কবে? বুথ আর সিডির শোরুম তাড়াতাড়ি দাঁড়াতে দেবে? টাকা চটপট ধরতে চাইলে ডিসিশনও চটপট নিবি। দু’হাত ভরে পাবি, এমন একটা বিয়ে চাই। সঙ্গে পাওয়ারফুল শ্বশুর।’

কুণাল ভাবছিল পায়েলের কথা। পায়েল কোনওদিন কি মডেল হতে পারবে? ওর বাবা প্রাইমারি স্কুলের রিটায়ার্ড মাস্টারমশাই। কখনও তোবড়ানো স্কুটি চেপে নিউ সিনেমার পেছনে শেষবেলায় ঝড়তি পড়তির বাজার করে। লোকটা কুণালকে কতটা সাপোর্ট দেবে? কিন্তু পায়েল? দীপিকার মতো টোল ফেলে হাসে। পায়েলকে ছেড়ে দেবে? দিয়ে? টাকার বান্ডিল নিয়ে কে আর আসবে কুণালকে শাদি করতে?

‘আমার উপর ছেড়ে দে! তোর মত আছে মানে বাড়িতে সানাই বাজল বলে। রাজ ক্যাটারারকে রেডি থাকতে বলিস।’ হাসতে থাকে বিবস্বান। কুণাল কিন্তু কিন্তু করে– ‘আমার একটা রিলেশন আছে। এখন… পয়সা নেই তাদের। কী করা উচিত?’ কুণাল মোবাইল ফোনে পায়েলের হাসিমুখ দ্যাখে– দেখতে ফাইন। দারুণ নাচে। হিন্দি ডান্স। ‘ধুর! বলে দে শোরুম চলছে না! বাবার হাতে টাকা এসেছে সেকথা বলেছিস নাকি? খবরদার! শোন্, প্রেম করবি টাকার সঙ্গে। বাকি সব ফালতু। জীবনে টাকা থাকলে সব থাকে কুণাল, টাকা নেই মানে, তুমি ফালতু।’

‘বাবার হাতে টাকা কোথায়? আমার শোরুম, জলের লাইন, ফ্রিজ, কুলার, ডাইনিং টেবিল, মায়ের সোনার বালা, জামাইবাবুর জন্য সোনার চেন, দিদির ঝুমকো… মেঝেতে টাইলস…! কম লাগল?’ কুণাল হতাশ– ‘রিটায়ার করতে করতেই টাকা হাওয়া।’

‘শোন, তাহলে এখনই তোর টাকার দরকার। প্রথম কাজ হল প্রেমিকাকে ছেঁটে দে!’

প্রায় চমকেই উঠল কুণাল। কত সহজে বলে ফেলল মামা কথাটা। কী ভাববে পায়েল? সম্পর্কটা টেনে চলেছিল কুণালই। অথচ এখন ও-ই পিছিয়ে যাচ্ছে! অথচ কাজটা করতে হবে! মামা ভুল বলেনি কিছু! পায়েলও নাচতে চায়। বিখ্যাত হতে চায়। বিয়ে করতে চায় না। তবু… একটা প্রেম প্রেম ব্যাপার তো ছিল। কিন্তু মামা যা বলে, তা ঠিকই!

বিকেলে হুক্বাবারের পরের গলিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেখানো কথা উগরে দেয় কুণাল। অবাক চোখে ওকে দেখল পায়েল। অবশ্য খুশিই হল। কত রঙিন দুনিয়ার হাতছানি চারধারে। রিয়ালিটি শো-এ একটা সুযোগ করে দেবে সুরযদা। এখন কেউ কুণালের সঙ্গে প্রেম করে?

পায়েলকে ছেঁটে দিয়ে ফিরে আসতে আসতে শাহরুখের দেবদাসের ডায়লগ বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মনেই করতে পারল না। সময়মতো কিচ্ছু মনে পড়ে না। অথচ মনটা খারাপ খারাপ লাগছে যেন। পাঁচদিন পরে কাউন্সিলারের ভাইয়ের মেয়েকে দেখতে গেল ও। মনোজিৎ চুপচাপ মুখবন্ধ করে চশমা পরে বসে আছে। বড়োলোকের উচ্চ মাধ্যমিক পাস মেয়ের জন্য কুণাল কেন? কুণাল কি কিছু আন্দাজও করতে পারে না! মেয়েটাই বা রাজি হল কেন কুণালকে বিয়ে করতে? বাবার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না কুণাল। পারে না বলেই সারা বিকেল সেভকে গিয়ে কাটাল একা একা। সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরছিল স্পোর্টিং ক্লাবের পাশ দিয়ে। পাত্রীর বাবা সোমেশ দাসের মুখোমুখি হয়ে পড়ল। হাসিমুখে পথ আটকাল দাস– ‘কোতায় যাওয়া হচ্চে?’ কুণাল দেখল সোমেশ দাসের হাতে গাড়ির চাবি। আই-টেন গাড়ি। এইসব গাড়ির স্বপ্ন কতদিন ধরেই দেখছে কুণাল!

‘চলো। আজ অঙ্কিতার বার্থ ডে। তোমারই প্রেজেন্ট থাকার কথা আজ।’ ‘কিন্তু’ কুণাল তো তো করে। বার্থডে মানে গিফটের প্রশ্ন আসছে। সোমেশ দাস টিপটিপে হাসিমুখে সমাধানের রাস্তা বাতলায়– ‘জীবনে হাজারবার অঙ্কিতা মানে তোমার ওয়াইফের বার্থডে আসবে। অনেক সময় পাবে গিফট্ দেওয়ার। নাউ, লেটস্ গো!’

যাব কি যাব না ভেবে ভেবে কুল পায় না কুণাল। মামা বিবস্বান বিবেকের মতো পাশে থাকে ভাগ্নের– ‘টাকা না থাকলে কেউ পাত্তা দেয় না!’

মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কুণাল। আমি ঠাকুর হাবলা গোবলা। যা করাও তাই করি– ভাব নিয়ে সোমেশ দাসের গাড়ির পেছন ধরল ওর বাইক। হাজার বছর ধরে জন্মদিন উপভোগ করার মতো ভাগ্যবতী এক আয়ুষ্মতীর একটি জন্মদিনকে সমৃদ্ধ করতে ছুটছিল ও। এখন পায়েল অতীতমাত্র। সামনে অন্য নারী যার হাত ধরে কুণাল ছুটবে। চারধারে টাকা উড়বে। সব টাকা ধরবে কুণাল। হাত ভরে টাকা তুলবে ঘরে। পাঁচজনের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবে। খাওয়াদাওয়ার জম্পেশ ব্যবস্থা ছিল। সোমেশের মেল মারফত আমন্ত্রণ জুটেছে বিবস্বান আর মনোজিতের। তেতলার ব্যালকনিতে অঙ্কিতার সঙ্গে বসে প্রাক-অনুরাগপর্ব সেরে নিচ্ছিল কুণাল। ওদিকে বিবস্বান ব্যাবসায়িক কথাবার্তা পাকা করে নিচ্ছিল। ‘দাদাকে বলে মোটা ঠিকেদারি দিতে হবে। নির্ভেজাল জামাই দিচ্ছি! সোনার চাকা। গড়গড় ছুটবে। ঝলক দেখবেন কেবল!’

সোমেশ টিপটিপ হাসে, ‘আমিও কম দিচ্ছি না। জামাইকে তুলব। সঙ্গে তার মামাকেও!’

তেরিয়া মেজাজ সামলেও অস্ত্র দেখাতে বাধ্য হল বিবস্বান, ‘তুলব মানে? তুলছি তো আমি! তোমার মেয়ের দুটো কেচ্ছা হজম করেছি! থার্ড হ্যান্ড মাল! নার্সিংহোমে গেছিল যেন কবে?’ নীচু স্বর বিবস্বানের। ব্যাবসার কথা! চ্যাঁচাতে নেই।

সুশৃঙ্খল ভাবে আলোচনাচক্র শেষ হল একসময়। জামাইবাবুকে নিয়ে অল্টোতে উঠে বসে বিবস্বান।

‘সব ঠিক আছে তো মনোজিৎদা? পাত্রী… বাবা… মা… বাড়িঘর…’

‘হ্যাঁ! লোক ভালো!’ মনোজিৎ বিজ্ঞের ভান করে। এছাড়া উপায় কি! দিনকাল হুড়মুড় করে পালটাচ্ছে। তার জীবনের সঙ্গে তার ছেলের জীবনের কত পার্থক্য। পাত্রী দেখা নিয়ে কত রোমাঞ্চ ছিল সেই সময়ে। সেই রোমাঞ্চ বিবাহিত জীবনেও শাল-সেগুনের শেকড়ের মতো গেড়ে বসত। এখনও ইচ্ছে করলে বউ-এর লাজুক মুখটা মনে করতে পারে। প্রথমদিন দেখা হওয়ার সেই লাজুক মুখ। অথচ কুণালের কোনও মানসিক বৈকল্য নেই। তবে ছেলের পেছনে ভারীসারি শ্বশুর থাকলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা নেই। কিন্তু ভরসাই বা কি? মেয়েটা কেমন হবে…! তাছাড়া, সারা বাড়ি জুড়ে বড্ড বদ টাকার গল্প!

একটু আগে হবু শ্বশুরের গাড়ির পেছনে চলছিল, এবার মামার গাড়ির পেছনে চলছে কুণালের বাইক। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। আরাম হওয়ার কথা। কুণালের শীত করছিল। নিজেকে গরম রাখতে ছোটে ও। দেখে মনে হচ্ছে বাইকটা গাড়িটাকে ছুঁতে চাইছে। খুব শিগগির ওরও গাড়ি হবে। বাকি সব ক্রমান্বয়ে আসবে। প্রাপ্তির হাজার সম্ভাবনার মধ্যেও এমন শূন্যতা কেন চারধারে! বোধহয় থমকে গেছিল কুণাল। বিবস্বানের মুখ গাড়ির জানলায়– ‘কী হল? তাড়াতাড়ি আয়! কাল আবার কীসের বনধ্! অনেক কাজ! আয়।’

সেই অমোঘ আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারে না কুণাল। কার্গোর ছ’টা পকেটের একটা থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে। সামনে নতুন জীবন। গতস্য শোচনা নাস্তি। পায়েলের ছবিটা ডিলিট করতে করতে বিড়বিড় করে কুণাল, ‘ধুর! প্রেম করে কী লাভ? বেকার সময় নষ্ট। শ্বশুর বড়লোক হলে তবু কথা ছিল। না হলে কী লাভ?’

এলওভিই লাভ এখন হিসেবের দাঁড়িপাল্লায়। কিস্যু করার নেই কুণালদের। এখন শাল-সেগুনের শেকড় পোক্ত হওয়ার সময় পায় না। রোমাঞ্চ টোমাঞ্চ সেইরকম। পালটে যাচ্ছে পরিবেশ। পালটে যাচ্ছে মানুষ। চারধারে জাল জুয়াচুরি। কোথায় পৌঁছোতে চায় মানুষ, তারা নিজেও জানে না! সময়টা বড্ড উদ্ভ্রান্ত। ঠিকই ধরেছে বিবস্বান। মাটি শক্ত হয়ে উঠেছে। শেকড় এখন আর বেশি গভীরে যায় না। অল্পেই শুকিয়ে যায়।

প্রতীক্ষাপ্রান্তর

অসীম টুরে গেছে পাঁচ দিনের জন্য, তিতির কলেজে। কারেন্টও নেই। একা বাড়িতে লম্বা দুপুরটা কাটতে চাইছিল না। আজকের কাগজটা নিয়ে বিছানায় গড়াচ্ছিল নন্দিনী। এ পাতা থেকে ও পাতায় এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই চোখটা পার্সোনাল কলামে আটকে গেল। ডান দিকের কোণে একদম তলার দিকে ছোটো ছোটো কয়েকটা অক্ষর। আলাদা করে সেইভাবে চোখে পড়ার কথাই নয়। তবু পড়ল। হয়তো পড়ার ছিল বলেই। ‘জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন অফ হ্যাপি নুক, জোরহাট– পাসড অ্যাওয়ে পিসফুলি, অ্যাট হার রেসিডেন্স। ফিউনারেল মাস অন’…

জেনিফার ম্যাকলেন? জোরহাটের জেনিফার ম্যাকলেন? এই নামে অনেকদিন আগে একজনকে চিনত না নন্দিনী? হ্যাপি নুকের জেনিফার ম্যাকলেন বলতে তো একজনের কথাই মনে পড়ে। মিস ম্যাকলেন তাহলে এতদিনে মারা গেলেন। কে দিল নোটিসটি? চার্চ থেকেই হবে নিশ্চয়ই। নন্দিনী অন্যমনস্কভাবে হাতের কাগজটা ভাঁজ করে। আশ্চর্য, একেবারে ভুলেই গিয়েছিল মহিলার কথা।

অসীমের পোস্টিং তখন ছিল অসমের জোরহাটে। জোরহাট টাউন থেকে একটু দূরে কিছুটা ভেতরের দিকে ছিল ওদের বাড়িটা। বেশ নির্জনই ছিল পাড়াটা সেই সময়। প্রচুর জায়গা, বাগান, ফলের গাছ-টাছ নিয়ে এক একটা বাড়ি। এরকমই একটা বাড়ির একতলাটা অসীমের অফিস থেকে তাদের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।

কলকাতায় ও রকম বাড়ি স্বপ্নের অতীত। বিরাট বড়ো বড়ো চারখানা ঘর, আলো ভরা বাথরুম, বাদশাহি রান্নাঘর, সঙ্গে আলাদা প্যান্ট্রি, চারদিক ঘুরিয়ে কাঠের জাফরি ঝোলানো টানা বারান্দা, মানে এককথায় এলাহি ব্যাপার। কিন্তু এত বড়ো বাড়িতে সারাদিন একা একা কাটাতে নন্দিনীর দম বন্ধ হয়ে আসত। তাদের মানিকতলার বাড়িও যথেষ্ট বড়ো। কিন্তু সেখানে ছিল কাকা-কাকি, জ্যেঠা-জেঠি তুতো ভাইবোন সবাইকে নিয়ে বিশাল যৌথ পরিবার। চেষ্টা করলেও ওবাড়িতে একা থাকা যেত না।

সেই হট্টমালার দেশ থেকে বিয়ে হয়ে এসে পড়ল এই ভূতবাংলোয়। ঘর মোছা, বাসন মাজার জন্য একজন আর কাপড়চোপড় কাচার জন্য একজন, এই দু’জন স্থানীয় আদিবাসী কাজের মেয়ে ছিল, কিন্তু সারাদিনের জন্য নয়। সকাল সকাল এসে দশটার মধ্যে সব কাজ সেরে তারা চলে যেত। কতটুকুই বা কাজ থাকত দুজনের সংসারে। তাদের ওদিককার ভাষাও নন্দিনী সবটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারত না। ফলে সঙ্গী হিসেবে তারা খুব একটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি।

তিতির হয়নি তখনও। অসীম অফিসে বেরিয়ে গেলে এত বড়ো বাড়িতে একলা নন্দিনী। শূন্যতা যেন বিশাল হাঁ করে তাকে গিলে খেতে এগিয়ে আসত। উপরতলায় কোনও ভাড়াটেও ছিল না যে গল্প করে সময় কাটাবে। পাড়াটাও এত চুপচাপ। লোকজন বাস করে বলে বোঝাই মুশকিল। কলকাতার শোরগোলের একেবারে বিপরীত। কী করে যে দিনগুলো কাটত এখন ভাবলেও অবাক লাগে। তখনই কোনও এক সময় মিস ম্যাকলেনের সঙ্গে নন্দিনীর পরিচয়।

নন্দিনীদের বাড়িটার ঠিক পাশেই একটা একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটো বাড়ি ছিল। রংচটা, ধুলোটে। চওড়া কাঠের গেটের রং এককালে হয়তো সাদাই ছিল, বা অন্য কিছুও হতে পারে, বলা মুশকিল, কারণ বহুদিনের অযত্নে অবহেলায় সেটা একটা অবর্ণনীয় শেড ধরে নিয়েছিল। কার্নিশে যেখানে সেখানে বেয়াড়া বট অশ্বত্থের চারার যথেচ্ছ জবরদখল অভিযান। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় বৃষ্টি গড়ানো শ্যাওলাটে সবুজ দাগ। গেটের পাশে বহু বছরের ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া ফলকে কষ্ট করে পড়া যায় ‘হ্যাপি নুক’। বাগান হয়তো কোনওকালে একটা ছিল, নন্দিনীর চোখে যেটা পড়েছিল তাকে বাগানের অপভ্রংশও বলা চলে না।

এই বাড়িতেই থাকতেন জেনিফার ম্যাকলেন। একাই। কাজের লোকটোকও কেউ ছিল না। অন্তত নন্দিনী তো কোনওদিন কাউকে থাকতেও দেখেনি, আসতে যেতেও দেখেনি। সঙ্গী বলতে একটি বৃদ্ধ পমেরিয়ান কুকুর। এত দিন পরে হঠাৎ তার নামটাও আজ নন্দিনীর মনে পড়ে গেল। পিক্সি। তাকে নিয়ে রোজ সকাল-বিকেল হাঁটতে বেরোতেন। চুপচাপ মাথা নীচু করে কোনও দিকে না তাকিয়ে একটু ঝুঁকে হেঁটে যেতেন, আবার ওই ভাবেই বাড়ি ফিরে আসতেন। যতদিন নন্দিনী ছিল ওখানে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ওই রুটিনে কোনওদিন ছেদ পড়তে দেখেনি।

মিস ম্যাকলেনের মতো নিরুত্তাপ মানুষ নন্দিনী আজ পর্যন্ত আর দ্বিতীয় একজন দেখল না। কোনও মানুষ যে তার চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে এতটাই নিরাসক্ত হতে পারে ভাবা যায় না। কারমেল কনভেন্টে ইংরেজি পড়াতেন। শোনা কথা, ছাত্রীরা নাকি আড়ালে বলত ‘আইসবার্গ’। স্বভাবের জন্য না চেহারার জন্য সেটা জানা যায়নি। তবে দুদিক থেকেই নামটা মানানসই।

রোগাপাতলা ছোটোখাটো চেহারা। গায়ের রং পুরোনো খবরের কাগজের মতো। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখ। পাতলা ফ্যাকাশে ঠোঁট। ফ্যাকাশে সবজেটে চোখের মণি। ফ্যাকাশে বাদামি চুল। চিরটাকাল পরনে হালকা রঙের ছাঁটকাটহীন ঢোল্লা হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ফ্রক। সব মিলিয়ে একজন ফ্যাকাশে মানুষ। কেউ ডেকে কথা বললে উত্তরে বাধ্য হয়ে ভদ্রতাসূচক দু-চারটে কথা যা বলার বলতেন, নইলে চুপচাপ। গলার আওয়াজও চেহারার মতোই নিষ্প্রভ, নিরুত্তেজ। কোনও ওঠাপড়া নেই। স্কুল, বাড়ি আর পিক্সির মধ্যেই ওঁর জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতি রবিবার অবশ্য নিয়ম করে চার্চে যেতেন। আর প্রতি মাসে দিন দুয়েক বাড়ি তালা বন্ধ রেখে সম্ভবত গৃহস্থালির টুকটাক কেনাকাটার জন্য টাউনেও যেতেন। কারণ এবং গন্তব্যস্থলটা লোকের ধরে নেওয়া। কোনওটাই কারও সঠিক জানা ছিল না, কারণ উনিও কোনওদিন কাউকে ডেকে বলেননি, আর ওঁর কাছে কোনওদিন কেউ জানতেও চায়নি। কাকেই বা বলবেন, কেই বা জানতে চাইবে। কুকুরটি ছাড়া তো তিন কুলে কোথাও কেউ ছিলও না। অন্তত আছে বলে কেউ জানত না। উনি যে দিনগুলো বাড়ির বাইরে থাকতেন সেই কটা দিনের জন্য পিক্সি চার্চের ফাদার অ্যান্টনির কাছে থাকতে যেত।

নন্দিনী বলতে গেলে সেধেই আলাপ করেছিল। ওঁর বাড়িতেও গিয়েছিল কয়েকবার। উনি অবশ্য বিশেষ আসতেন না। দেখা হলে বেড়ার পাশে বা গেটের ওধারে দাঁড়িয়েই সামান্য দুচারটে সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে যেতেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে স্পষ্টই অনীহা ছিল। তবে পরের দিকে মাঝেমধ্যে কেক বা বিস্কিট গোছের কিছু ভালোমন্দ বানালে ডাক দিতেন। নন্দিনী খেয়েও আসত, নিয়েও আসত। জিজ্ঞাসা করে করে শিখেও নিয়েছিল ওঁর কাছ থেকে নানারকম।

একদিন, শুধু একদিনই মিস জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেনকে অন্যরকম দেখেছিল নন্দিনী। একটা পুরো দিন।

সেদিন সকালে একটু বেলার দিকে মিস ম্যাকলেনের গেটের লেটারবক্সে পিওন চিঠি ফেলে গিয়েছিল একটা। নন্দিনী নিজের শোবার ঘরে কী যেন করছিল। জানালা দিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে মনে মনে একটু অবাকই হয়েছিল। এতদিনের মধ্যে কোনও দিনও ওবাড়িতে কোনও চিঠিপত্র আসতে দেখেনি সে। পিক্সির ডাকাডাকির আওয়াজ পেয়েই আসলে তার চোখ বাইরের দিকে গিয়েছিল। সে বেচারাও পিওন নামক খাকি পোশাকধারী অপরিচিত জীবটিকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পাহারাদারির সহজাত সারমেয় প্রবৃত্তি পালনের তাগিদে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরে মিস ম্যাকলেনের ভাবভঙ্গি দেখে নন্দিনীর অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল যেন। পিক্সির চিৎকারে উনিও বেরিয়ে এসেছিলেন। পিওন চলে যেতে যেতে হাতের ইশারা করে বুঝিয়ে দিল চিঠি দিয়ে গেছে। উনি খানিকক্ষণ যেন কিছু না বুঝে পিওনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলেন। তারপরে পায়ে পায়ে গেটের দিকে এগোলেন।

নন্দিনী ঘটনাটা কী ঘটছে দেখার জন্য জানালার পাশ থেকে সরেনি, ওখান থেকেই তাকিয়ে ছিল। মিস ম্যাকলেন লেটারবক্স থেকে চিঠিটা বার করে একটু হতবুদ্ধি ভাবে প্রথমটা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাদামি কাগজের খামটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে উলটেপালটে দেখছিলেন, বোঝার চেষ্টাই করছিলেন হয়তো তাঁকে কে চিঠি লিখতে পারে। তারপরে ওখানে দাঁড়িয়েই খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলেন। নন্দিনী আশ্চর্য হয়ে দেখল চিঠিটা পড়তে পড়তেই ওঁর হাবভাব কেমন যেন পালটে গেল। দূর থেকেও সে বুঝতে পারছিল মহিলা থরথর করে কাঁপছেন। হাত বাড়িয়ে একবার গেটটা ধরারও চেষ্টা করলেন। নন্দিনীর ভয় হচ্ছিল উনি পড়ে-টড়ে না যান। হয়তো কোনও খারাপ খবর আছে চিঠিতে। তারপরে আরও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল উনি ওদের বাড়ির দিকেই আসছেন।

মিস ম্যাকলেন বেল বাজানোর আগেই নন্দিনী বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন উনি। মুখচোখ যেন কেমন কেমন। নাকের তলায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। কিছু না বলে অকস্মাৎ নন্দিনীর দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন। নন্দিনীও কিছু না বুঝেই ওঁর হাত থেকে ওটা নিয়ে নিল। পড়তে ইশারা করছিলেন মিস ম্যাকলেন। তখনও কথা বলতে পারছিলেন না। নন্দিনী আগে ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসাল। তাড়াতাড়ি এক গ্লাস খাবার জল এনে দিল। উনি এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলেন। তারপরে কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়ে সোফার পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। নন্দিনী নজর ফেরাল হাতে ধরা চিঠিটার দিকে।

চিঠিটা লিখেছেন কোনও এক ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। ইংরেজিতে লেখা চিঠির বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়–

‘ডিয়ার জেনিফার,

আশা করি ভালোই আছ। তোমার জন্য সুখবর আছে একটা। তুমি হয়তো জেনে খুশি হবে যে ফ্র্যাংকলিনের মধ্যে আজকাল আগের থেকে অনেক বেশি উন্নতি দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ওর ঘরে রাখা তোমার ছবিটা দেখে তোমাকে চিনতে পেরেছিল। কাল নিজে থেকেই বলল, জেনি খুব ভালো চকোলেট কেক বানায়। আমার মনে হচ্ছে নতুন ওষুধটায় বোধহয় কাজ হচ্ছে।

যে জন্য তোমাকে চিঠিটা লেখা। আমি ভাবছিলাম এ মাসে তুমি না এসে যদি আমিই ফ্র্যাংকলিনকে নিয়ে তোমার কাছে যাই তাহলে কেমন হয়? একটা চেঞ্জও হবে ওর। তাই এই বৃহস্পতিবার বিকেলে তোমার বাড়ি আসছি আমরা। তৈরি থেকো।’ তারপরে আবার পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন– ‘খুব বেশি কিছু আশা কোরো না। এই রিঅ্যাকশনগুলো প্রায়ই খুব একটা পার্মানেন্ট হয় না। তবুও লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট।’

বৃহস্পতিবার? বৃহস্পতিবার তো আজকেই। কিন্তু কে এই ডাক্তার বড়ুয়া? যে ফ্র্যাংকলিনের কথা চিঠিতে আছে সে-ই বা কে? আর এই চিঠি পেয়ে মিস ম্যাকলেনেরই বা অমন অবস্থা কেন হল? নন্দিনী সত্যি কিছুই বুঝতে পারে না। এ প্রহেলিকার উত্তর একমাত্র মিস ম্যাকলেনই জানেন। ধাঁধায় পড়ে সে মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায়। আর অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন কেমন অদ্ভুত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেনও, আবার নেইও। ওঁর ওই ফ্যাকাশে সবুজ চোখের দৃষ্টি যেন নন্দিনীকে ভেদ করে, এ ঘর ছাড়িয়ে কোথায় কতদূরে উধাও হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে একটি দুটি করে কথা বলতে আরম্ভ করেন জেনিফার ম্যাকলেন। তারপরে বাঁধভাঙা বন্যার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক দিনের অনেক জমে থাকা কথা। গলার আওয়াজ থরথর করে কাঁপে। আর নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে এক আশ্চর্য কাহিনি। যাকে কাহিনি না বলে রূপকথা বলাই বোধহয় উচিত।

আসাম চা বাগিচার দেশ। আর চা বাগিচা মানেই প্ল্যান্টার। প্রথম দিকে খাঁটি সাহেবরাই বাগান চালাত। পরে আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। সে জায়গায় আসতে শুরু করে দেশি সাহেবরা। এ কাহিনির যখন শুরু তখন সবে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিছু কিছু বাগানে দু-একজন সাদাচামড়া সাহেব তখনও ছিল। তাদেরই একজন রঙালি টি এস্টেটের ছোটো সাহেব প্যাট্রিক ম্যাকলেন। প্যাডি সাহেব। প্যাডি সাহেবকে সবাই চিনত দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ তার দিলদরিয়া স্বভাব। গায়ের রংটা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত ঠিকই, তা নইলে এদেশের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশায় সে, সাহেব আর নেটিভের কোনও ফারাকই রাখত না। কত প্ল্যান্টারদের কত অত্যাচারের কাহিনি সে সময় বাগানের কুলি কামিনদের মুখে মুখে ফিরত, কিন্তু প্যাডি সাহেব সম্বন্ধে কেউ কোনওদিনও অমন কথা ভাবতেও পারত না।

আর দু-নম্বর কারণ তার মা-মরা একমাত্র মেয়ে জেনি মেমসাহেব। জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন। বলতে গেলে সেটাই তখন সাহেবকে চেনার প্রধান কারণ। বিশেষ করে উঠতি যুবকদের মধ্যে। পাহাড়ি ঝরনার মতো চঞ্চল, পরিদের মতো সুন্দর উনিশ বছরের জেনি মেমসাহেবকে দেখলে অতি বড়ো গোমড়ামুখোদেরও মন ভালো হয়ে যায়। সেই সময় আশপাশের ছোটোবড়ো যত গার্ডেনের সব ইয়ং ম্যানদের জীবনের একটাই লক্ষ্য, কে জেনিকে একটু খুশি করতে পারে। পিকনিক, টি-পার্টি, ক্রিসমাস ড্যান্স– সবের মধ্যমণি জেনি ম্যাকলেন। মিস স্টুয়ার্ট, মিস ব্রাউনদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। জেনির সঙ্গে একটা ড্যান্স মানে জীবন সার্থক। জেনি কারও দিকে চেয়ে একটু হাসলে সে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ভাবতে একটুও দ্বিধা করে না।

জেনি কাউকে নিরাশ করে না। কিন্তু কাউকে আশাও দেয় না। আজ ব্রিজ পার্টিতে ডিকি রবার্টসনকে পার্টনার করলে পরের দিন নাচের ফ্লোরে তার সঙ্গী হয় জেরি উইলিয়ামস। কেউ তার কাছে বিশেষ নয়। সবাই তার ভালো বন্ধু, ব্যাস।

বিশেষ তার একজনই। সেই ছেলেবেলা থেকেই। ফ্র্যাংকি। তখন ছিল শুধুই ফ্র্যাংকি। বড়ো হয়ে হল টগবগে তরুণ আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন। প্যাডি সাহেবের বন্ধু ফ্রেডি ক্লিফটনের একমাত্র ছেলে। খাঁটি সাহেব ছিল না অবশ্য সে।

ফ্রেডি ক্লিফটন এদেশে আসার আগে ছিল বার্মায়। আজকাল যে দেশের নাম হয়েছে মায়ানমার। ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডি ক্লিফটন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই বার্মারই এক সুন্দরী মেয়েকে। ফ্র্যাংকি ছিল তাদের ভালোবাসার ফসল। মিশ্র রক্তের সন্তান।

তাতে অবশ্য বাগানের কারও কিছু আসত যেত না। ওখানে অনেকেরই জন্মের ইতিহাস ফ্র্যাংকির মতোই। তাও তো তার মা, পাতা তোলা কামিন ছিল না। যথেষ্ট শিক্ষিত, ধনী ঘরের মেয়ে ছিল তার মা। কেবল বিজাতীয়, বিধর্মীকে বিয়ে করার অপরাধে সে মেয়ের পরিবার তাকে ত্যাগ করে।

ফ্র্যাংকির যখন বারো বছর বয়স তখন তার মা বাবা দুজনেই এক সাংঘাতিক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। এ-দেশে তার আর কেউ ছিল না। বহু দূর আয়ারল্যান্ডে, কখনও-না-দেখা তার এক কাকা ছিল বটে, সে ভাইপোকে নিয়ে যেতে চাইছিল না। ঝুটঝামেলায় না গিয়ে প্যাডি সাহেব ফিউনারেল হয়ে যাবার পর সটান ফ্র্যাংকিকে নিজের কাছে রঙালিতে নিয়ে চলে এসেছিল। জেনির বয়স তখন আট। সেই থেকে জেনি আর ফ্র্যাংকি একসঙ্গেই বড়ো হয়েছে।

দশ বছর বয়স থেকেই জেনি জানত সে ফ্র্যাংকির। কী করে জানত জানে না। কিন্তু জানত। ফ্র্যাংকিও যেমন জানত জেনি তার। একমাত্র তার। তারা দুজন একে-অপরের জন্যই তৈরি। আর কেউ কখনও তাদের মধ্যে আসবে না, আসতে পারে না। এই ধ্রুব সত্যিটা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেই জেনি দশ থেকে উনিশ হয়েছে, ফ্র্যাংকি হয়েছে তেইশ।

‘হি ওয়াজ সাচ আ হ্যান্ডসাম ডেভিল য়ু নো। অ্যান্ড ডেয়ারিং। আর্মি জয়েন করল। ইউনিফর্ম পরে আমার সামনে দাঁড়াত। নানডিনি, বিলিভ মি, আমি মেল্ট করে যেতাম। আমাকে পেছনে বসিয়ে স্পিডে মোটরবাইক চালাত, ভাবতে পারবে না। আই থট মাইসেল্ফ দ্য লাকিয়েস্ট গার্ল অ্যালাইভ।’

নন্দিনী রূপকথা শুনছে। এই মিস ম্যাকলেনকে সে দেখেনি কোনওদিন। মিস ম্যাকলেনের গলায় উনিশের জেনি কথা বলে চলে। গলার আওয়াজ আর কাঁপছে না এখন। সেই কণ্ঠস্বরের সম্মোহনী ওঠাপড়া নন্দিনীকে আবিষ্ট করে ফেলে। রূপকথার নায়িকা স্মৃতিমগ্ন হয়ে নিজের কাহিনি শোনাতে থাকে।

‘সেদিন সানডে ছিল, জানো। আমাদের ফর্মাল এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। ফ্র্যাংকি আমাকে আংটি পরাল। আমি পরালাম ফ্র্যাংকিকে। চার্চে বিয়ের নোটিস পড়ল। তিন মাস পরে আমাদের বিয়ে। উই ওয়্যার সো হ্যাপি দ্যাট ডে।’ হালকা হাসির রেখা জেনিফার ম্যাকলেনের ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

নন্দিনী অবাক বিস্ময়ে মিস ম্যাকলেনের দিকে চেয়ে দেখতে থাকে। তার চোখের সামনে মধ্য চল্লিশের বর্ণহীন মিস ম্যাকলেন আস্তে আস্তে খোলস ঝরিয়ে আদ্যন্ত জেনি হয়ে ওঠে। পুরোনো কাগজের মতো গালে গোলাপি রক্তোচ্ছ্বাস, চোখে পান্নার দ্যুতি।

গুনগুন করে কত দিনের কথা বলে যান মিস ম্যাকলেন। আর নন্দিনীর চোখের সামনে আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে রঙালি টি এস্টেট, জেনি মেমসাহেব আর সুদর্শন, ডাকাবুকো

ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

আর তার পরে সেই রাতের কথা। জেনি আর প্যাডি সাহেবের সঙ্গে ডিনার সেরে ইউনিটে ফিরছিল ক্যাপ্টেন ক্লিফটন। ঠিক কী যে সে রাতে হয়েছিল কেউই জানে না, কিন্তু পরের দিন সকালে রাস্তার পাশে দোমড়ানো মোচড়ানো মোটরবাইকটা ও তার থেকে অনেকটা দূরে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটনের রক্তাক্ত অচৈতন্য শরীরটা দেখেছিল ভোরের পথচলতি বাগানশ্রমিকরা। খুব সম্ভবত কোনও মাতাল লরির ধাক্বায় বাইক শুদ্ধু রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়েছিল ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

‘ওরাই ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পকেটে ডায়ারি ছিল, তাতে আমার ছবি, ঠিকানা ছিল। হাসপাতাল থেকে আমাদের খবর দেয়।’

মাথায় সাংঘাতিক আঘাত লেগেছিল ফ্র্যাংকির। বাঁচার আশাই ছিল না। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ দিন কোমায় অচেতন ছিল সে। তারপরে জ্ঞান যখন ফিরল তখন ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন নিজের নামটুকুও মনে করতে পারে না আর। হাসপাতালের বিছানায় ফ্র্যাংকি তখন শুধুই স্মৃতিহীন, ভাষাহীন এক মানবশরীর মাত্র।

প্যাডি সাহেব অনেক করেছে তখন। মিলিটারির ডাক্তার ছাড়াও আরও বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখিয়েছে। সবারই এক কথা। আশা ছাড়লে চলবে না। সময়, সময়ই করতে পারে যা করবার। ফ্র্যাংকির খুব ভালো বন্ধু ছিল ডাক্তার বড়ুয়া। সে-ও তাই বলে গেছে অহর্নিশ। ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো।

ধৈর্য ধরেছে জেনি। প্যাডি সাহেবের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেছে একদিন, কিন্তু জেনির ভরসা ভাঙেনি। প্যাডি সাহেব অনেক বুঝিয়েছে মেয়েকে, মন পালটাবার অনেক চেষ্টা করেছে, তারপরে একদিন বোধহয় মনের দুঃখেই ফট করে মাথার শিরা ছিঁড়ে ওপরে চলে গেছে।

এই হ্যাপি নুক বাড়িটা অনেকদিন আগে কিনেছিল প্যাডি সাহেব। কখনও কোনও দরকারে বাগান থেকে টাউনে এসে রাত হয়ে গেলে এখানেই থেকে যেত। সাহেব মারা যাবার পর জেনিরও বাগানের পাট চুকে গিয়েছিল। সেই তখন থেকেই জেনি এখানে। সেও আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। এখান থেকে মাসে মাসে হাসপাতাল যেতেও সুবিধে। ধৈর্য ধরে থাকতে থাকতে ফ্র্যাংকির মুখে ধীরে ধীরে একটা দুটো কথা ফুটল। আর দিনে দিনে কখন যেন রঙালির চুলবুলি জেনি মেমসাহেব আস্তে আস্তে সব রং ঝরিয়ে ফ্যাকাশে মিস ম্যাকলেন হয়ে গেল।

সেই ফ্র্যাংকি আজ ডাক্তার বড়ুয়ার সঙ্গে আসছে, জেনির বাড়িতে।

‘তুমি বিকেলে একটু থাকবে আমার সঙ্গে, নানডিনি, প্লিজ? আয়্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। ফ্র্যাংকি এতদিন পরে আসছে আমায় মিট করতে।’ নন্দিনী খুব অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মতো টুকটুকে গোলাপি হয়ে যাচ্ছেন।

বিকেলে মিস ম্যাকলেনকে চেনা যাচ্ছিল না। ঘন সবুজ সিল্কের একটা অপূর্ব ফ্রক পরেছেন। পুরোনো কাটের জামা, কিন্তু কী যে সুন্দর মানিয়েছে ওঁকে। ঝলমল করছেন যেন। নন্দিনী কখনও লক্ষ্যই করেনি, মিস ম্যাকলেনের হাত পায়ের পাতা কী অদ্ভুত সুন্দর। ঝিনুকের মতো পাতলা, শাঁখের মতো মসৃণ। লম্বা আঙুলের ডগায় বাদাম শেপের হালকা গোলাপি নখ। চোখ মুখ চেপে রাখা উত্তেজনার আঁচে গনগন করছে। এই অপরূপা মিস ম্যাকলেন কোথায় ছিলেন এতদিন? নন্দিনী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে ছটফট করে বেড়াচ্ছিলেন জেনিফার। বারবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। লজ্জাও পাচ্ছিলেন, নন্দিনী তাঁর অস্থিরতা বুঝতে পারছে বলে। টেবিলে একটা ট্রে আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন। চায়ের যাবতীয় সরঞ্জাম, আর একটা বড়ো প্লেটে নিজের হাতে তৈরি চকোলেট কেক। এত উত্তেজনার মধ্যেও কখন যেন ঠিক সময় করে বানিয়ে ফেলেছেন।

গাড়ির শব্দটা একই সঙ্গে দুজনের কানেই আসে। নন্দিনী মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায় একঝলক। যেখানে ছিলেন সেখানেই একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন উনি। মুখ থেকে সব রক্ত নেমে গিয়ে বরফের মতো সাদা দেখাচ্ছে। এক হাত দিয়ে অন্য হাতটা এত জোরে আঁকড়ে ধরেছেন যে আঙুলের গাঁটগুলো চামড়ার নীচে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বন্ধ দরজাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন জেনিফার। নন্দিনীই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খোলে।

দুজন মানুষ। একজনকে স্পষ্টই বোঝা যায় এদিককার অধিবাসী বলে। খুব সম্ভব ইনিই ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। এক হাত দিয়ে আরেকটি মানুষের কাঁধ জড়িয়ে রেখেছেন। সে মানুষটি এক বিশাল বৃক্ষের বাজ পড়া শুকনো কাণ্ড। ঝুঁকে পড়া লম্বা শরীর, পোড়া তামাটে গায়ের রং। নীল হাওয়াই শার্ট তার গায়ে ঢলঢল করছে। গাল ভাঙা, চোখের কোলে গভীর ক্লান্তি। কানের দু-পাশে কিছু পিঙ্গলে সাদায় মেশানো চুল। বাকি মাথা ফাঁকা। বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব। পঞ্চাশও হতে পারে, পঁচাত্তরও হতে পারে। পিঠে ডাক্তার বড়ুয়ার হাতের চাপ অনুসরণ করে পা ঘষে ঘষে সে এগিয়ে আসতে থাকে নন্দিনীর দিকে।

‘হ্যালো জেনি।’ নন্দিনী ডাক্তার বড়ুয়ার কথায় সচেতন হয়ে পিছনে তাকায়। কখন যেন মিস ম্যাকলেন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ‘আমরা এসে গেছি।’

কথার জবাব দেন না জেনিফার। তাঁর দৃষ্টি শুধু দ্বিতীয় মানুষটির দিকে। ডাক্তার বড়ুয়া তার পিঠে চাপ দেন। ‘চিনতে পারছ ফ্র্যাংক? তোমার জেনিকে?’

ফ্র্যাংক নীরব থাকে। চোখে কোনও ভাষাই ফোটে না। মিস ম্যাকলেন নিজের হাতদুটো শক্ত করে মুঠি করেন। মুখ একবার লাল একবার সাদা হয়। নন্দিনীর ভেতরে কী একটা ভাঙতে থাকে, ভেঙে ভেঙে যায়।

ডাক্তার বড়ুয়া আস্তে আস্তে ফ্র্যাংককে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসান। সামনে টেবিলে মিস ম্যাকলেনের সাজানো ট্রে।

‘দেখছ ফ্র্যাংক, চকোলেট কেক। তুমি তো ভালোবাসো। দ্যাখো, জেনি নিজে বানিয়েছে, তোমার জন্য।’

ফ্র্যাংকি দুহাতে দুটো কেকের টুকরো তুলে নেয়। বাচ্চাদের মতো একবার এ-হাত একবার ও-হাত থেকে কামড়ায়। থুতনিতে গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়া কেক মাখামাখি হয়ে যায়। শব্দ করে চিবোয় ফ্র্যাংকি। অথচ কী আশ্চর্য, মুখে কোনও অভিব্যক্তি ফোটে না।

‘আর এক পিস কেক নেবে ফ্র্যাংকি?’ জেনিফার খুব নরম গলায় বলে।

ফ্রাংকি কোনও উত্তর দেয় না। শুনতে পেল কী না তাও বোঝা যায় না। তাকিয়ে থাকে সোজা নির্বিকার। ফাঁকা দৃষ্টি জেনিফারকে ভেদ করে চলে যায়। তার হাতে মুখে আইসিঙের ক্রিম আর কেকের গুঁড়ো লেগে থাকে। সে বুঝতেও পারে না, বসে থাকে স্থির। জেনিফার ফ্রাংকির সোফার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। অসীম মমতায় পরিষ্কার নরম ন্যাপকিন দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দেয়, হাত মুছিয়ে দেয়।

গোধূলির রং আস্তে আস্তে সন্ধ্যায় পালটে যেতে থাকে। আগে থেকে সাজিয়ে রাখা ট্রে-র কাপ ভর্তি চায়ে সর পড়ে যায়। ঘরের কোণায় কোণায় অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। টেবিলবাতিটা জ্বেলে দেয় নন্দিনী।

জেনিফার ফ্র্যাংকির দুটি হাত মুঠিতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেই থাকে। হাতদুটি অল্প অল্প কাঁপে, পাতলা দুটি ঠোঁট কত কিছু বলতে চেয়ে থিরথির করে। কিন্তু কোনও কথাই বেরোয় না। বোধহীন, ভাষাহীন ফ্রাংকির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে চোখের পলকও বুঝি পড়ে না তার।

ঘরের মধ্যে ক্রমশ ভারী হয়ে জমতে থাকা একরাশ নৈঃশব্দ্য নন্দিনীকে চেয়ারে গেঁথে রাখে। নড়াচড়া করলেই যেন কী একটা ঘটে যাবে। সে শুধু দুচোখ মেলে এই ট্র্যাজিক মূকাভিনয় দেখতেই থাকে। গলার কাছে কী যে ভীষণ কষ্ট শক্ত হয়ে ডেলা পাকায়, সে জোর করে করে গিলে গিলে সেই ডেলাকে নীচে পাঠায়। কতক্ষণ যেন কেটে যায় এমনি করেই।

ডাক্তার বড়ুয়াই শেষে উঠে দাঁড়ান। শব্দ করে গলা পরিষ্কার করেন। ‘সরি জেনিফার।’ নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ পরে ওঁর কথাটা যেন ভীষণই জোরে বেজে ওঠে মনে হয়। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। গলা নামিয়ে আবার বলেন, ‘এবার যেতে হবে আমাদের।’

ডাক্তারের গলার আওয়াজে ঘোর ভাঙে জেনিফারের। ‘ফ্র্যাংকি আমার কাছে থাকতে পারে না? প্লিজ ডাক্তার? ও তো অনেক ভালো আছে আগের থেকে। ওকে তো এখন তোমরা এখানেই রাখতে পারো।’ জেনিফারের কণ্ঠস্বরে একরাশ আকুল আর্তি। অসহায় আশা ভরা দুটি চোখ ডাক্তার বড়ুয়ার দিকে চেয়ে থাকে।

জ্বলন্ত টেবিলবাতিটার চারপাশে একটা মথ অবিশ্রাম পাক খাচ্ছিল। ডাক্তার বড়ুয়া সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ এমন ভাবে চুপ করে থাকেন যেন কানেই যায়নি। তারপর চোখ না সরিয়েই খুব নরম গলায় বলেন, ‘এইরকম সোবার কোয়ায়েট মোমেন্টগুলো ফ্র্যাংকির লাইফে খুবই রেয়ার, জেনিফার। তুমি পারবে না। পারবে না ম্যানেজ করতে তুমি। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হবে…’ জেনিফারের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ না করেই থেমে যান ডাক্তার।

এতক্ষণে বাঁধ ভাঙে। কী অসহ্য এক আক্ষেপে জেনির মুখ দুমড়ে দুমড়ে যায়। শব্দহীন কান্নায় বিকৃত মুখ দু-হাতে ঢেকে ফেলে সে। কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে শরীরটা। ডাক্তার বড়ুয়া আর নন্দিনী দুজনেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। গতে বাঁধা সান্ত্বনাবাক্য এখানে এত অর্থহীন।

অস্বস্তি কাটানোর জন্য নন্দিনী চায়ের সরঞ্জামগুলো সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ডাক্তার বড়ুয়া ফ্র্যাংকির দিকে তাকান। এ ঘরের চারজন মানুষের মধ্যে একমাত্র ফ্র্যাংকিরই কোনও বিকার নেই।

গেটের বাইরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়ানো গাড়িটা এই সময়ে একবার জোরে হর্ন বাজায়। চমকে তাকিয়ে নন্দিনী এতক্ষণে দেখতে পায় গাড়িটার গায়ে বড়ো বড়ো সাদা অক্ষরে লেখা ‘সেন্ট জর্জেস অ্যাসাইলাম’।

পরের দিন সকালেও মিস ম্যাকলেনকে দেখেছিল নন্দিনী। রোজকার মতোই হালকা রঙের হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ঢোল্লা ফ্রক পরে পিক্সিকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মাথা নীচু, চোখ রাস্তার দিকে। বর্ণহীন, নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাশে এক প্রৌঢ়া।

টিউব লাইটটা হঠাৎ দপদপ করে জ্বলে উঠে নন্দিনীর চোখটা ধাঁধিয়ে দিল। যাক, এতক্ষণে কারেন্ট এল তাহলে। বাবা, পাঁচটা বাজে। তিতিরের কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এল। সবিতা বিকেলের কাজ করতে এসে যাবে আর একটু পরেই। নন্দিনী দ্রুত হাতে খোলা চুল গোছাতে গোছাতে বিছানা থেকে নামে। আলস্যমন্থর স্মৃতিমেদুর দুপুরের ভার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এবার আবার সংসারের অভ্যস্ত ছন্দ তার আপাদমস্তক অধিকার করে নিতে শুরু করে।

মিস ম্যাকলেনের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া কাগজটা দলামোচড়া হয়ে খাটের উপরেই পড়ে থাকে।

 

রূপান্তর

আজ থেকে প্রায় আট মাস আগে বিয়ের দিন মৃন্ময়ীদেবীর সঙ্গে ঐশীর প্রথম দেখা। মৃন্ময়ীদেবী শতদ্রুর পিসিমা। থাকেন মেদিনীপুরে। বিয়ের শতব্যস্ততায় তখন ওনার সঙ্গে ঠিকমতো পরিচয় ঘটেনি ঐশীর। আজ আট মাস পর ওনার পদধূলি পড়তে চলেছে এ-বাড়িতে। থাকবেনও প্রায় মাসখানেক। খবরটা পাওয়া মাত্রই বাড়িতে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল।

ওনার দাপুটে স্বভাব সম্পর্কে কমবেশি শ্বশুর, শাশুড়ি, বরের কাছে গল্প শুনেছে সে। যদিও কিয়দংশ তারও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিয়ের সময়তেই পুরোহিতের ভুল মন্ত্রোচ্চারণে একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়েছিলেন, পুরোহিতকে এই মারতে যান তো সেই মারতে যান… তারপর ঐশীর বাবা আর মৃন্ময়ীদেবীর ছোটোভাই রমাকান্তবাবুর মধ্যস্থতায় তিনি খানিক শান্ত হয়েছিলেন।

সেই কোন ছোটোবয়সে তিনি বিধবা হয়ে বাবার ভিটেতে গিয়ে উঠেছিলেন। এখনও ওই ভিটেই যক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। বাবা সংস্কৃতের টোল চালাতেন, ফলে মেয়েও তাতে বেশ চৌকশ। বাবা গত হয়েছেন, ছোটোভাই তো পড়াশোনা চলাকালীন-ই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তারপর আর ওমুখো হননি। কালেভদ্রে বেড়াতে বা প্রয়োজনে গেছেন কখনও সখনও। গ্রামের ওই প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দা বলতে বড়োভাই, ভাই বউ, আর তিনি। ভাইয়ের এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়িতে। আর এক ছেলে ছিল বটে, তবে সে আর বেঁচে নেই। বছর সাতেক আগে বিনা নোটিশে দু-দিনের জ্বরে সব শেষ। সেই থেকেই বড়োভাই শয্যাশায়ী। বিঘের পর বিঘে জমিজমা, চাষবাস সবই এখন মৃন্ময়ীদেবীর রক্ষণাবেক্ষণে।

ছুটির দিন। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে ঐশী। রোজই তো সেই ১০টা – ৬টার ডিউটি। সকালে উঠে কাকচান সেরে কোনওরকমে নাকেমুখে গুঁজে ছোটা। একদিন এর অন্যথা হলে বেশ ভালোই লাগে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আজ সোয়া নটা বেজে গেছে তার। তারপর বাড়তি মেদ ঝরাতে ট্রেড মিলে মিনিট কুড়ি হাঁটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনেই একটু স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ে আর কী! হাঁটতে হাঁটতেই কানে এল এক প্রৌঢ়ার গলা। এ গলা সে আগেও কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায়?… উৎসাহবশত বসার ঘরে আসতেই দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, শতদ্রু সবাই মিলে সেই পিসিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দীপ্তিময়ের সেই টানা চোখ। বয়সের কারণে ত্বকে খানিক শিথিল ভাব এলেও, এককালে যে অপরূপা সুন্দরী ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমনি লম্বা দীর্ঘকায়া তেমনি রংও যেন ফেটে পড়ছে। হাঁ করে তাকিয়েছিল ঐশী। হুঁশ ফিরল তাঁর রাশভারী গলার আওয়াজে। ভারী গলায় তিনি কাদের যেন দুষছেন। ‘বেআদব সব ছেলেপুলে। একটু শিক্ষেদীক্ষে নেই গো, বড়োদের সম্মান পর্যন্ত করতে জানেনে সব। সক্বাল না হতে হতে বেহায়াদের মতো হাত ধরাধরি করে… ছি ছি ছি…।’

পিসিশাশুড়ির কথায় হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। দু-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন পিসিমা?’

এই নাকি তাঁর নাতবউ! পরনে ট্রাউজার আর ঢলা গেঞ্জি। ঘেমে নেয়ে একাকার। দেখেই মৃন্ময়ীদেবীর চক্ষু চড়কগাছ।

‘থাক থাক। আর প্রণাম করতে হবে না।’ বলেই কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলি বেলা তো কম হল না, এখনও নাওয়া-খাওয়া হয়নি বুঝি?’

‘না আসলে একটু ব্যায়াম করছিলাম। আপনার আওয়াজ শুনে চলে এলাম। এবার…’

‘তা বেশ করেছ, এবার নেয়ে এসো দিকি।’

‘যাচ্ছি পিসিমা। তার আগে আপনার পছন্দের এককাপ চা বানিয়ে আনি। মার কাছ থেকে শিখেছি দেড় চামচ চিনি আর কড়া লিকার, তাইতো?’ বলেই হাসল ঐশী।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই চা বসা, আমি আসছি।’ সুমিত্রাদেবী বউমাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হন না। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই গলা ভারী করে ভাজের দিকে তাকিয়ে, ‘ও তুমিও বুঝি এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে শহুরে আদবকায়দা রপ্ত করেছ। ম্লেচ্ছদের মতো নাওয়া-ধোওয়া না করেই রান্নাঘরে ঢুকছ?’

‘না-না দিদি একদমই তা নয়। আমিই চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’ বলেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।

‘আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার আছে পিসিমা, আমি চটপট স্নান সেরে আসছি’, বলেই পিসিমাকে একবার জড়িয়ে ধরে ঐশী ছুটে পালাল স্নানঘরের দিকে।

‘কী মেয়েরে বাপু! বাপের বাড়ি থেকে কি কোনও রীতিনীতিই শিখে আসেনি? তা রমা তোরাও তো দেখছি আশকারা দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছিস। সংসারের আচার-ব্যবহার কিছু শেখা, নয়তো পরে তোদেরই ভুগতে হবে এই বলে দিচ্ছি।’ চা-আসা পর্যন্ত রমাকান্তবাবু আর শতদ্রুর এইভাবেই ক্লাস নিতে থাকলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবীর বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা দুজনের কারওরই ছিল না। দিদির কথার প্রেক্ষিতে রমাকান্তবাবু শুধু এটুকুই বললেন, ‘তুমি যখন এসেই গেছ, তুমিই ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিও। আচ্ছা দিদি তুমি বোসো, আমি একবার বাজারটা ঘুরে আসছি’, বলে উঠতে যাবেন এমন সময় সুমিত্রাকে দেখে, ‘ওই তো সুমিত্রা এসে গেছে। তুমি চা খাও, আমি এক্ষুনি আসছি’, বলেই রমাকান্তবাবু বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শতদ্রুও পিসিমার ব্যাগ-পত্র গেস্টরুমে রাখার বাহানায় ঘর থেকে সরে পড়ল। অগত্যা সুমিত্রাদেবী-ই বসে রইলেন ননদের উপদেশাবলি শোনার জন্য।

সন্ধেবেলা সকলে একসঙ্গে বসে চা-জলখাবার খেতে খেতে নানান আলোচনা চলছে। গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। গ্রামের নগেনখুড়ো থেকে শীতের নলেন গুড়– কোনওকিছুই বাদ নেই। খাওয়াদাওয়ার কথা উঠতেই ঐশী হঠাৎই হাহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবা মনে আছে চিন্নাস্বামী আর তার পরিবারের কথা, সেই দিল্লি যাওয়ার সময় ট্রেনে?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না! চিন্নাস্বামীর হাতির মতো চেহারার ছেলেটিকে বলে কিনা দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। একদম নাকি খায় না। অথচ ট্রেন ছাড়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত মুখ থেমে থাকেনি তার। বোধহয় দশজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।’ বলেই শ্বশুর, বউ মিলে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকল।

হাসিতে রাশ টানলেন পিসিমা। ‘আহ্ ঐশী একটু আস্তে। ভুলে যেও না এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে কেউ তোমার বন্ধু নয়।’

কেউ কিছু বলার আগেই ঐশী অকপটভাবে বলে বসল, ‘মা-বাবার থেকে বড়ো বন্ধু আবার কেউ হয় নাকি পিসিমা? বাপি ছিল আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু আর এখানে বাবা-মা। কী বলো বাবা?’

উত্তর দেওয়া দূরস্থান, ঐশীর কথাতেই বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে শ্বাস ফুলে উঠল রমাকান্তবাবুর। এই বুঝি দিদি ঝাঁপিয়ে পড়ল বেচারির উপর। হলও তাই।

‘বড়োদের মুখে মুখে কথা বলাটা মোটেই শোভনীয় নয় ঐশী। তাদের সম্মান করতে না পারো, অন্তত অনাদর কোরো না।’ বেচারিকে এমন ধমক দিলেন যে বাড়ির সকলের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

ঐশী জিভ কাটল, ‘ছি ছি পিসিমা, এমন বলবেন না। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, আসলে দোষটা আমার বাপির। আপনার সঙ্গে যখন আমার বাপির দেখা হবে, আপনি খুব করে শাসন করে দেবেন তো। ওনার অপত্যস্নেহেই আমি বিগড়ে গেছি। ছোটো থেকে উনি-ই আমাকে শিখিয়েছেন, সবকিছু বন্ধুর মতো ওনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে। সেই অভ্যাসটাই থেকে গেছে। এখানেও তাই বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভুলেই যাই যে উনি আমার শ্বশুরমশাই। ওনার সামনে বেশি কথা বলা সাজে না আমার।’ কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। ঐশীর মাথা নীচু করার ভঙ্গি দেখে শ্বশুর, শাশুড়ি, শতদ্রু – সকলেই হেসে ফেলল।

‘এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে তোমাদেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।’ সকলকে হাসতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবী আসার পর থেকে এ-বাড়িতে বেশ একটা অদ্ভুতরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ওনার কাজই যেন ঐশীর দোষত্রুটি খুঁজে বার করা। তারপর তাকে ভৎসনা করা। বাড়ির অন্য সদস্যরা তাঁর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালেই মুখ ব্যাজার করে সেই একই সাবধানবাণীর পুনরাবৃত্তি, ‘প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে মেয়েটাকে।’

দিন দশেক এইভাবেই কেটে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মায়াপুর থেকে খবর এল সুমিত্রাদেবীর ছোটোকাকা মারা গেছেন। দাহ হওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখতে হলে এখুনি রওনা দিতে হবে। তখুনি শতদ্রু বাবা-মাকে নিয়ে গাড়িতে রওনা দিল মায়াপুরের উদ্দেশে। ফিরতে ফিরতে কাল সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়িতে এখন ঐশী আর পিসিমা।

ভাই-ভাজ-ভাইপো রওনা দেওয়ার ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ ওনার মনে হল সময়টা ভালো যাচ্ছে না, তাই একবার মন্দিরে ঘুরে আসা দরকার। ফিরে আর কিছু খেলেনও না। ঐশী বারবার অনুরোধ করাতে জানালেন, ভোগ খেয়ে ফিরেছেন।

বিকেল থেকেই পিসি বারবার বাথরুম যাওয়া-আসা করছেন। সন্ধ্যার পর সেই আনাগোনার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে যোগ হল বমি। ঠিক করে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই ওনার। সন্ধে গড়িয়ে রাত হতে চলল। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়াবাড়ি হলে ঐশীর একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে এনে পিসিমাকে নিয়ে সোজা চলে গেল ডাক্তারখানায়।

চেম্বারে বেশ ভিড়। সকলেই অপেক্ষা করছেন তাদের পালা কখন আসবে। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করলে পিসির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না ভেবে, সোজা পিসিমাকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেল ঐশী। পাশ থেকে অপেক্ষারত অন্যান্য পেশেন্টদের বাড়ির লোকের দু-এক কথা কানে গেল বটে, ‘এভাবে হয় না, সিরিয়াল অনুযায়ী দেখাতে হয়। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। আমরাও তো রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছি।’

তাদের দিকে না তাকিয়েই ঐশী জবাব দিল, ‘নিয়ম-ই সিরিয়াস পেশেন্টদের আগে চেক-আপ করা।’ বলে পিসিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সে। ডাক্তারবাবু পেশেন্ট-এর অবস্থা দেখে আর দ্বিমত করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে চেক-আপ করে প্রয়োজনানুযায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধপত্র লিখে দিলেন।

বাড়িতে ফেরার পর প্রেসক্রিপশন মাফিক তিনটে ট্যাবলেট খাওয়ানোর পরে খানিক স্বস্তি পেলেন মৃন্ময়ীদেবী। ওআরএস জলে গুলে বারেবারে একটু একটু করে পিসিমাকে খাওয়াতে থাকল ঐশী। ঘন্টা দুয়েক পর অবস্থার খানিক উন্নতি হলে মৃন্ময়ীদেবী ঐশীর দিকে তাকালেন, ‘যদি রাতবিরেতে আবার বাড়াবাড়ি হয় তাহলে…’ মৃন্ময়ীদেবীর চোখেমুখে তখন চিন্তার ভাঁজ।

‘আমি তো আছি। আপনি চিন্তা করছেন কেন? কিছু হবে না। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন’, বলে পিসিমার মাথায় হাত বোলাতে থাকল ঐশী। বউমার আত্মবিশ্বাসে মৃন্ময়ীদেবীর সমস্ত টেনশন দূর হয়ে গেল। শিশুর মতো ঐশীর কোলের কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি।

মায়াপুর থেকে ফোন এলে তাদেরও সকলকে ভরসা দিল ঐশী, ‘চিন্তার কিছু নেই, এদিকটা আমি সামলে নেব।’

রাত্রে মৃন্ময়ীদেবী যতবারই চোখ খুলেছেন, বিছানার পাশে ঐশীকে পেয়েছেন। সারারাত জেগে মেয়েটা সেবা করেছে পিসিশাশুড়ির। মাঝে মাঝে চামচে করে নুন-চিনির জল দিয়েছে, খেতে না চাইলে ধমক দিয়েও খাইয়েছে। রাত দেড়টা নাগাদ ওনার শরীরটা বোধকরি আবার গুলিয়ে উঠেছিল, সামলাতে না পেরে বিছানাতেই কাপড়েচোপড়ে বমি করে ফেলেছিলেন তিনি। অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন তিনি। পিসিমাকে ইতস্তত বোধ করতে দেখে ঐশী সামান্য হাসে, ‘কেন এত সংকোচ করছেন। ঠিক আছে হয়ে গেছে। বরং উঠে গিয়ে ভালোই হয়েছে, এইবার একটু হালকা বোধ করবেন।’

এক এক করে ওনার কাপড় ছাড়ানো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা পরিষ্কার করা, ফ্রেশ কাপড় পরানো, বিছানার চাদর বদলানো সব হাসিমুখে সেরে ফেলল ঐশী। তারপর ওনার মাথায় এমন ভাবে হাত বুলিয়ে দিল যে মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল সাতটায় মৃন্ময়ীদেবী ঘুম ভাঙতে দেখলেন ঐশী তার মাথার পাশে বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা কাত হয়ে গেছে। স্নেহের হাত মাথায় রাখতেই চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে উঠল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো পিসিমা? শরীর কেমন? আর বমি হয়নি তো?’ যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে এক বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে, সেই অস্বস্তিতে একসঙ্গে প্রশ্ন করে ফেলল ঐশী।

‘ওরে থাম থাম, আমি একদম ঠিক আছি। শেষবার বমি হওয়াতে শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। এখন আর কোনও কষ্ট নেই। দ্যাখ একদম ফিট। আমার কথা ছাড়, তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল, এবার আরাম করগে যা তো। একটু ঘুমিয়ে নে। সারারাত ঠায় মাথার সামনে বসে ছিলি। আমি সব দেখেছি।’

‘আগে স্নান সেরে তোমার জন্য কিছু খাবার বানাই, তারপর না হয়…’

‘না না তোকে কিছু করতে হবে না। আমি সব করে নেব। তুই ঘুমুতে যা দিখি।’

‘কিন্তু’,

ঐশীকে থামিয়ে দিয়ে মৃন্ময়ীদেবী আদেশ দেবার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিন্তু-টিন্তু কিছু নয়, তোকে বলছি না তুই শুতে যা।’

এই এক রাতেই ঐশী আর মৃন্ময়ীদেবীর সম্পর্ক এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্নেহপরবশ হয়ে ঐশী যে কখন তার পিসিমার কাছে তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে, তা বোধকরি তিনিও টের পাননি। সত্যিই সময়ই পারে সবকিছু বদলাতে।

আদেশ অমান্য না করে পিসিমার খাটেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল ঐশী। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বউমাকে ওভাবে শুতে দেখে একখানা চাদর চাপিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

ঐশীর উঠতে উঠতে মৃন্ময়ীদেবীর ভাত-ডাল-আলু-পোস্ত সমস্ত কিছু কমপ্লিট। দুপুরে দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে দেদার গল্পে মেতেছে।

‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে কি? যদি দাও তা হলে বলি। আসলে তুমি আসার পর থেকেই প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।’

‘ভণিতা না করে কী বলবি বল দিকি?’

‘না দ্যাখো, আমরা প্রতিমাসে পার্লার ঘুরে আসছি, কত কত টাকা গচ্ছা দিয়ে আসছি, তবুও ত্বকে কোনও উজ্জ্বলতা নেই। আর তোমার এই বয়সেও এত গ্ল্যামার, রহস্যটা কী বলোতো?’ হাসতে হাসতে বলল ঐশী।

ঐশীর কানটা ধরে বলেন, ‘পিসিশাশুড়ির পিছনে লাগা হচ্ছে অ্যাঁ? ওরে মুখপুড়ি আমাদের সময় ওসব পার্লার ফার্লার ছিল না বটে, কিন্তু মা ঘষে ঘষে সর-বেসন মাখাতেন, বুঝলি।’

‘সত্যি বলছি তোমাকে দেখলে কেউ বলবেই না যে, তুমি বাবার থেকেও বড়ো। কী সুন্দর দেখতে তোমায়।’ মুগ্ধ চোখে তাকায় ঐশী।

‘নে আর আমড়াগাছি করতে হবে না।’ বলে মৃন্ময়ীদেবীও তার কৃত্রিম গাম্ভীর্য ভেঙে হেসে ফেললেন।

মায়াপুর থেকে ফেরার পর দুজনকে পাশাপাশি বসে এভাবে হাসিঠাট্টা করতে দেখে সকলেই হতবাক। পরিবেশ হালকা বুঝে রমাকান্তবাবু তো বলেই বসলেন, ‘একি রে বাবা, কোনও ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়লাম না তো? নয়তো এমন মিরাকেল – ভাবাই যায় না!’

পাশে বসে থাকা বউমার গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘দ্যাখ রমা তুই আর তাচ্ছিল্য করিসনি বাপু। এমনিই আমি মরমে মরে আছি। আমার সত্যিই চিনতে ভুল হয়েছিল রে – এ যে একেবারে খাঁটি হিরে।’ বলেই চিবুকে একটু হাত বুলিয়ে বলেন, ‘জানিস কাল সারারাত ঠায় মেয়েটা মাথার কাছে বসে সেবা করেছে আমার। খাব না বলেছি বলে ধমক পর্যন্ত দিয়েছে। ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার জন্য ডাক্তারখানায় কম রাগারাগি করেনি, ডাক্তারও বাধ্য হয়েছে আমাকে দেখতে। খুব বুঝেছি তোরা কেন এই পাগলিটাকে এত ভালোবাসিস।’ বলতে বলতে চোখের কোণায় জল ভরে আসে মৃন্ময়ীদেবীর। ‘মেয়েটাকে তো অকথা-কুকথা কম বলিনি, হাসিমুখে সব সয়েছে। আজকালকার দিনে এমন বউ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের রে। সত্যিই ভাগ্যের!’ আবেগবিহ্বল হয়ে চোখ মুছলেন পিসিমা। মৃন্ময়ীর এই রূপান্তরে সকলেই বেশ হতবাক। পাষাণের ভেতরেও যে এত টলটলে জলের এক হ্রদ ছিল তা কে জানত!

 

শয়তানের মুখোশ

‘বাবা এ বাবা দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

‘দেখছিস মাপ লিচ্ছি তবু কানের গড়াটায় সেই ঘ্যেনের ঘ্যেনের কচ্চিস। টুকু দাঁড়া ন, মাপটা লিয়েলি।’

‘বাবা এ বাবা…’ এবার ঘুমটা ভেঙে যায় দুলালের। এখন ঘরময় অন্ধকার, দাঁত বিছিয়ে খিলখিল করে হাসছে। বিছানা থেকে উঠে লাইটটা জ্বালায় দুলাল। অন্ধকারের দাঁতগুলো যে যার মতো ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঘামে শরীরটা ভিজে গেছে দুলালের। মাটির কলশি থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে ঢক-ঢক শব্দে জলটা গিলে নেয় দুলাল। বাতাসি আলুথালু শরীর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বাতাসির চুপসে যাওয়া বুকদুটো বেরিয়ে পড়েছে বাতাসের খোঁজে। বালিশের তলা থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাইটা নিয়ে একটা বিড়ি ধরায় দুলাল। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটা আরও গুমোট হয়। দুলালের কানে স্বপ্নে শোনা কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে…

১)

ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি থেকেই কাজের চাপ বাড়তে থাকে দুলালের। এই দুটো মাস নিঃশ্বাসটাও গুনে-গুনে নিতে হয় ওকে। বাতাসি কাজে তেমন পটু না হলেও দুলালকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মুখোশগুলোকে সময় মতো রোদে দেওয়া, পরিমাণমতো রোদ পাওয়ার পর সেগুলোকে তুলে ঘরে রাখা। দোকানে দোকানে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসা। সময় মতো অর্ডারের মাল দোকানে দিয়ে আসা। বাতাসি না থাকলে দুলালের একার পক্ষে সবদিক সামলানো সম্ভব হতো না।

পুরুলিয়ার মাহাত পাড়ায় গিয়ে দুলাল মাহাতোর নাম বললে যে কেউ ওর ঘরটা দেখিয়ে দিতে পারবে। রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে দুলাল। সেবছর দুর্গা পূজার সময় বাথানির মাঠে মরা মহিষ বানিয়ে শকুন নামিয়ে দিয়েছিল দুলাল। সেদিনের পর থেকে ছেলেবুড়ো সবাই ওকে এক নামে চেনে। তবে দুলাল মাটির কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ছৌনাচের মুখোশ বানাতেই ও বেশি ভালোবাসে। সারা বছর ধরেই মুখোশ বানাতে হয় ওকে। দুর্গা পূজার আগের কটা মাস খুব কাজের চাপ পড়ে যায়। নানান জায়গা থেকে অর্ডার আসে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও দুলাল সকাল সকাল নিজের কাজ নিয়ে বসেছিল। আপন মনে রং করছিল একটা মুখোশ। বাতাসি মুখোশের সাইজ অনুযায়ী পেপার কাটছিল দুলালের পাশে বসেই। ঠিক এমন সময় একটা লোক ঢুকল ঘরের ভেতর। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। কাঁচাপাকা চুল, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। পরনে আলখাল্লা ধরনের একটা পাঞ্জাবি। দুলাল কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল লোকটাকে, তারপর বলল, ‘পূজার আগে আর লতুন অডার লিব লাই।’ লোকটা কিছুই বলল না। হাসি মুখে তাকিয়ে রইল একটা মুখোশের দিকে। কথাটা বলার পর দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো কিছু বলবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুলাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের মুখশ চাই?’

এবার উত্তর দিল লোকটা, ‘আমি মুখোশ কিনতে আসিনি।’

‘তাহলে কী জন্যে আইচেন?’ জিজ্ঞেস করল দুলাল।

‘এমনি।’

লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না দুলাল। আর কথা না বাড়িয়ে বাতাসিকে চোখের ইশারায় ঘরের ভেতর ঢুকতে বলে, আবার নিজের কাজে মন দিল। বাতাসি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দুলালের দিকে। তারপর চুপচাপ ঘরের ভেতরে চলে গেল। হাতে ধরে থাকা মুখোশটায় রং দেওয়া হলে দুলাল তাকিয়ে দেখে লোকটা নেই। কখন বেরিয়ে গেছে। লোকটার মতিগতি বোধগম্য হল না দুলালের। এমন তো কত লোকেই আসে-যায় ওসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার সময় হয় না দুলালের। আজকের এই লোকটাকে দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগল ওর।

হাতের রং করা মুখোশটাকে উঠোনের রোদে নামাতে গিয়ে দুলাল খেয়াল করল সদর দরজার কোণায় একটা প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেটটা কুড়িয়ে থমকে গেল দুলাল। একবান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট রাখা আছে প্যাকেটটার ভেতর। বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল দুলালের। কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো লোকটা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল কয়েকবার। কোনও উত্তর পেল না। একবার ভাবল প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে লোকাল থানায় দিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত সাহস হল না দুলালের। পুলিশের চক্বরে পড়লে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রেখে দিল একটা মুখোশের ভেতর। যদি লোকটা আবার আসে তাহলে ওকে ফিরিয়ে দেবে…

২)

নানান কাজের চাপে টাকার প্যাকেটটার কথা মাথাতেই ছিল না দুলালের। মনে পড়ল মুখোশটা বিক্রি করতে গিয়ে। মুখোশটা হাতে নিয়েও টাঙিয়েই রেখে দিল দেয়ালে। বেশ কিছুদিন হল পূজা পেরিয়ে গেছে। এখন কাজের তেমন চাপ নেই বললে চলে। দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো আবার কিছু দিনের ভেতর কোনও কুপ্রস্তাব নিয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা সেই যে গেল আজও এল না। প্যাকেটটার কথা দুলাল বাতাসিকেও বলেনি। দুলাল জানে বাতাসি টাকার গন্ধ পেলে সেটা শেষ না করে শান্তিতে বসবে না।

দিন দিন কাজের পরিমাণ যতই কমছিল ততই বেশি মনে পড়ছিল টাকার প্যাকেটটার কথা। শেষ পর্যন্ত দুলাল যখন নিশ্চিত হল লোকটা আর আসবে না তখন হাত দিল টাকার প্যাকেটটায়। ওই টাকা খরচা করে ঘরের চাল-ডাল যেমন এল, ঠিক তেমন ভাবেই মুখোশের রং তুলিও এল। বিনা পরিশ্রমের টাকা খরচা করতে বিশেষ সময় লাগল না। মাস দুয়েকের ভেতরেই দুলাল শেষ করে ফেলল টাকাগুলো। টাকাটা শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আবার হাজির হল লোকটা। লোকটা যে আবার কোনও দিন আসতে পারে সেটা কল্পনা করেও দেখেনি দুলাল। লোকটাকে দেখামাত্রই দুলাল মনে মনে ঠিক করে নিল লোকটা টাকার কথা বললে টাকাটার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা টাকার কোনও কথাই বলল না। সেদিন যেমন নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই বেরিয়ে গেল আজকেও। তবে আজকে আর কোনও টাকা রেখে গেল না লোকটা।

এবার বেশ চিন্তায় পড়ল দুলাল। কে এই লোকটা? কেন আসে ওর কাছে? কী করাতে চায় ওকে দিয়ে? নিজেই নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে দুলাল। কিন্তু উত্তরগুলো কিছুতেই ধরা দিল না ওর হাতে। শেষ পর্যন্ত বাতাসিকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল দুলাল। ওর একার পক্ষে আর চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তবে বাতাসিকে বলেও বিশেষ কিছুই লাভ হল না দুলালের। বাতাসি এমন কোনও পথ বলতে পারল না যে পথে ভাবলে মানসিক শান্তি পায় দুলাল।

৩)

আজকে আর রাতজেগে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না দুলালের। বেশ কিছুদিন হল শরীরটাও সাথ দিচ্ছে না ওর। বাতাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা ভাঙল আবার সেই স্বপ্নটা দেখে। অনেক চেষ্টা করেও আর ঘুম এল না ওর। শেষ পর্যন্ত ঘরের কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল ওকে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বসল ঘরের বারান্দায়। আজকে আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা মুখোশগুলো। ঘরের পিছন দিকের বাঁশ বাগান থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। এমন রাত মানুষের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। দুলালের ভেতরটাও আপন খেয়ালে গুনগুন করে ওঠে,

‘আইজ চাঁদ চইল্যেছে আকাশ গায়ে জোছনা বিছ্যায়ে

আইজ বুকের ভেতর প্রেমের খেলা দুবুক লাচ্যাইয়ে।

তুই ঘর ভিতরে ঘুমাই আছিস আমি বেকার বাজাই বাঁশি

আর কবে বুঝবি লো তুই আমি কীসের লাইগ্যে আসি?’

দুলাল গানটা থামিয়ে দিতেই দরজার বাইরে থেকে গানের পরের লাইন দুটো ভেসে আসে,

‘ওলো সখী তুই উঠার আগেই ভোর হইয়্যে যায় পাছে

আয়-না-গো তুই বাতাস হইয়্যে আমার বুকের কাছে।’

গানের শেষ দুটো লাইন শুনে দুলাল অবাক হয়ে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কে এই গান গায়? এই গান তো দুলালের বানানো গান। এই গান অন্য কারুর জানার কথা নয়। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা খুলল দুলাল। দরজাটা খুলেই দেখল সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দুলাল পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটা হাসছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করল দুলাল, ‘এতো রাইত্যে কী জন্যে আইচেন?’

‘একটা মুখোশ চাই আমার।’

‘না আমি আপনারে কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসতে থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ভয়ংকর শোনায় সেই হাসির শব্দ। দুলাল নিজের কান দুটোকে প্রাণপণে চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আমি দিব লাই মুখশ। কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসি মুখেই বলে, ‘মুখোশটা বানিয়ে ফ্যাল্। ওই মুখোশটা তোকে বানাতেই হবে।’ কথাগুলো বলেই লোকটা স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুলাল কান দুটোকে চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে কপাট কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে আর দেখা যায় না। বাতাসি দুলালকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে কপাট বন্ধ করে দেয়।

৪)

পরের দিন সকাল সকাল বাতাসি কয়েকটা মুখোশ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ে। এই মুখোশগুলো রমেন গাঙ্গুলি অর্ডার দিয়েছিল। মুখোশগুলো কলকাতায় যাবে। আজকে বাজারে আরও একটা কাজ আছে বাতাসির। দুটো কাজ সেরেই ও ফিরবে। বাতাসি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ভাঙা আলমারিটা থেকে দুলাল একটা মুখোশ বের করে আনে। আজ অনেক বছর পর দুলাল আবার বের করেছে মুখোশটা। সেদিন সারারাত কাজ করেও মুখোশটা শেষ করতে পারেনি দুলাল। সেই রাতের পর আর হাত দেওয়া হয়নি মুখোশটায়। আজকে যে ভাবেই হোক মুখোশটার অসমাপ্ত কাজটা ওকে শেষ করতে হবে। গতকাল রাতেই দুলাল বুঝতে পেরেছিল লোকটা কোন মুখোশটা নিতে চায়। আজ থেকে সাত বছর আগে একজন লোক এসেছিল দুলালের কাছে। একটা শয়তানের মুখোশ বানাতে বলেছিল দুলালকে। কাজটা নিয়েছিল দুলাল। কিন্তু শেষ আর করতে পারেনি।

মুখোশটায় রং করতে করতে দুলাল শুনতে পায়, ‘বাবা এ দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

মাঝে মাঝে রং তুলি ফেলে কান দুটোকে চাপা দেয় দুলাল। কয়েক মিনিট পর কান ছেড়ে আবার কাজে মন দেয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এভাবে চলার পর মুখোশটার কাজ শেষ হয়। একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় দুলালের ভেতর। এর আগে কোনও মুখোশ বানিয়ে এতটা আনন্দ হয়নি ওর। যেমন বানাতে চেয়েছিল অবিকল তেমনই মুখোশ বানিয়েছে দুলাল।

মুখোশটা দুহাতে নিয়ে দুলাল ওটাই ভাবছিল কতক্ষণে লোকটা আসে। ও এলেই ওর হাতে মুখোশটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করবে ওকে। মুখোশটা কমপ্লিট হওয়ার পর সেই লোকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসি মুখে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, ‘হয়েছে?’

‘হইচ্যে। কিন্তু এই মুখশটা লিয়ে যাবার পর আর আসা চইলব্যেক লাই আমার বাড়ি।’ দুলাল বলে।

লোকটা কোনও কথা না বলে মুচকি হেসে দুলালের কাছে এগিয়ে আসে। দুলাল শক্ত করে ধরে রাখে মুখোশটা। কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে দূরের থেকেই মুখোশটা দেখায় লোকটাকে। লোকটার পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারে দুলাল।

লোকটা হাসি মুখে অস্ফুট সুরে বলে, ‘শয়তানের মুখোশ।’

যখন বাতাসি ঘরে ঢোকে তখনও দুলাল লোকটার সঙ্গে গল্প করছে। আজকে বাতাসির সঙ্গে আরও একজন এসেছে।

পুলিশ?

না পুলিশ নয়, মনের ডাক্তার। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুবিমল সরকার। ডাক্তারকে বাতাসি আঙুল বাড়িয়ে দেখায় দুলাল কেমন ভাবে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প করছে। শুধু তাই নয় দুলাল গল্প করছে সম্পূর্ণ দুরকম ভাবে। একটা ওর নিজের ভাষা। অন্যটা শহরের। বাতাসি দুলালের কাছে যেতে চাইলে সুবিমল বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ওকে মুখোশটা দিতে দাও।’

দুলালের কল্পনায় তৈরি লোকটা যখন কথা দেয় ও আর আসবে না, তখন দুলাল মুখোশটা শূন্যে তুলে ধরে। তারপর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বাতাসি আর সুবিমল সরকার মিলে দুলালকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে। সুবিমল বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই। আশা করি আজকের পর আর এই সমস্যা হবে না। তবে ওই মুখোশটা যেন ওর চোখে আর না পড়ে। পারলে ওটাকে পুড়িয়ে দিও।’

৫)

বাতাসি উঠোনে গিয়ে মুখোশটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। অবিকল নিজের মুখোশ বানিয়েছে দুলাল। কাঁচাপাকা চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। মুখোশ হাতে নিয়ে বাতাসি ডাক্তারের সামনে তুলে ধরে। মুখোশটাকে দেখার পর কয়েক মিনিট চিন্তা করে সুবিমল। কোনও একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সুবিমল বাতাসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা দুলাল নিজের মুখোশ বানাল কেন? তোমার কী মনে হয়?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতাসি বলে, ‘যেদিন রাইত্যে আমাদের ছেল্যাডারে সাপে কাইট্যে ছিল সেদিন একটা লোক আছিল একটা অডার লিয়ে। একটা শয়তানের মুখশের অডার। সেই অডারের কাইজটাই রাইত্যের বেলায় কচ্চিল দুলাল। আমি ঘুমোচ্চিলাম। তাতাই আমাকেও তুইল্যেছিল, উঠি লাই। উয়ার বাপও কাইজ ছ্যাইড়ে উঠে লাই। যখন জাইনত্যে পাইল্লম তাতাইকে সাপে কাইট্যাছে, তখন সব শেষ। সেদিন থ্যেইক্যেই তাতাই-এর বাপ ক্যেমন যেন হইয়ে গেছ্যে।’

‘আচ্ছা সেদিন তুমি টাকার বান্ডিলটা কোথায় রেখেছিলে?’

‘ওই কপাট কুনট্যায়।’ আঙুল বাড়িয়ে দেখায় বাতাসি।

‘দুলাল টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রেখেছিল বলতে পারবে?’

‘একটা মুখশের ভিতর‍্। দাঁড়ান লিয়ে আসচি।’

বাতাসি মুখোশটা নিয়ে এসে সুবিমলের হাতে দেয়। সুবিমল মুখোশটা বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর বলে, ‘আচ্ছা এই মুখোশটার ভেতর আরেকটা ছোট্ট মুখোশ কেন আছে?’

এবার চুপ করে যায় বাতাসি। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা পু্রোনো ব্যথাটা চোখের পাতা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাতাসিকে চুপ করে থাকতে দেখে সু্বিমল বলে, ‘আমাকে মুখোশ রাখার ঘরটায় একবার নিয়ে চলুন।’

না বলতে পারে না বাতাসি। মুখোশ ঘরে নিয়ে আসে সুবিমল ডাক্তারকে। ঘরটায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় ডাক্তার। সারা ঘরটা জুড়ে কয়েক’শ মুখোশ রাখা আছে। দেব-দেবীদের মুখোশ থেকে শুরু করে পশু-পাখি কিছুই বাদ নেই। কিন্তু একটা দেয়াল জুড়ে ঝুলছে অদ্ভুত কিছু মুখোশ। প্রতিটা মুখোশের ভেতর একটা করে ছোটো মুখোশ আছে। একটা মুখোশ হাতে নিয়ে ভেতরের ছোটো মুখোশটাকে বের করার চেষ্টা করে ডাক্তার। পারে না। বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটো মুখোশটাকে এমন ভাবেই ঢোকানো আছে যে, দুটোকে আলাদা করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সুবিমল অবাক চোখে বাতাসিকে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেন বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটোটাকে লুকিয়ে রেখেছে দুলাল?’

শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বাতাসি বলে, ‘তাতাইকে সাপে কামড়্যায় নায়, ডাক্তারবাবু।’

‘তাহলে?’

‘সাত বছর আগে সেদিন যে লোকটা আইছিল, সে বইল্যেছিল…’

‘শয়তানের মুখোশ বানাতে। তারপর?’

‘মুখশটা মাপে ঠিক হচ্যিল লাই। তাতাই-এর বাপ তাই তাতাইকে মুখশটা পরাই মাপটা ঠিক করত্যে গ্যেইছিল…’ কান্নায় বাতাসির কথাগুলো ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেতরের কান্নাটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে বাতাসি বলে, ‘তাতাই বারবার বইল্যেছিল, দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। উয়ার বাপ কথাগুল্যান কানেই নিল লাই। আর খুলত্যে পারে নাই মুখশটা। মাছের মতো ছটপট্যাই ছটপট্যাই মইরে ছিল তাতাই…’ নিজেকে আটকাতে পারে না বাতাসি। সাত বছর ধরে জমিয়ে রাখা চোখের জল আজ আর কোনও বাধা মানতে চাইছে না।

সুবিমল একটা মুখোশকে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। পারে না। প্রতিটা কাগজের মুখোশের ভেতর টিনের পাত দেওয়া আছে। সুবিমল খেয়াল করে দেখে সব মুখোশগুলোর গঠন এক নয়। অধিকাংশ মুখোশের পিছন দিকটায় কিছু নেই, ফাঁকা। গোটা কুড়ি-পঁচিশ মুখোশ আছে যেগুলোর পিছনটাও সুন্দর ভাবে বানানো। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই কুড়ি-পঁচিশটা মুখোশ শয়তানের মুখোশ।

সুবিমল সরকার আগে তো একজন মানুষ, পরে ডাক্তার। ওর বাড়িতেও বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে আছে। তাই ওর পক্ষে দুলাল কিংবা বাতাসির যন্ত্রণার জায়গাটা বোঝা কঠিন নয়। এতক্ষণে সুবিমল বুঝতে পারে, কেন দুলাল শয়তানের মুখোশে নিজের রূপ এঁকেছে। কেন শয়তানের মুখোশের ভেতর একটা করে ছোট্ট মুখোশ ঢোকানো রয়েছে।

দুলাল এখনও অচেতন ভাবে বিছানায় পড়ে আছে। সুবিমল দুলালের নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। না নিঃশ্বাস স্বাভাবিক। এখন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে না দুলাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুবিমল বাতাসিকে বলে, ‘চিন্তা কোরো না। দুলাল ওই বাজে স্বপ্নটা বা ওই লোকটাকে আর কখনওই দেখবে না। তবে হাঁ জ্ঞান ফেরার পর যদি কাঁদে তো ওকে মন খুলে কাঁদতে দিও।’ কথাটা বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েও আবার একবার ফিরে আসে সুবিমল, ‘আরেকটা কথা। শয়তানের ওই মুখোশটা, যেটা দুলালের নিজের মুখের আকৃতি, সেটা যেন আর দুলালের চোখে না পড়ে। ওটাকে দূরে কোথাও পুড়িয়ে দিও কিংবা মাটি চাপা দিয়ে দিও।’

সুবিমল চলে যাওয়ার পর বাতাসি দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে দুলালের মুখটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর মুখোশটা নিয়ে বাড়ির পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কোনওদিন দুলালের চোখে পড়বে না শয়তানের মুখোশটা।

 

ভিওয়ানির রহস্য

শ্যামলের জীবনটা যেন কেমন একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে টিউশন করে আর কতদিন চলবে! এসব ভাবতে ভাবতে একদিন দিল্লিতে একটা ইন্টারভিউ পেয়ে গেল। দিল্লির কনটপ্লেস-এ ইন্টারভিউতে সিলেক্টও হয়ে গেল। জানতে পারল, চাকরিটা হরিয়ানার ভিওয়ানিতে। প্রথমে ভেবেছিল যাবে না। পরে ভেবে দেখল, ঘুরেই আসা যাক না। নতুন একটা জায়গা দেখেই আসা যাক। ভালো না লাগলে ফিরে আসবে নিজের রাজ্যে।

বাবা-মা ও বন্ধুদের উৎসাহে বেরিয়ে পড়ল ভিওয়ানির উদ্দেশে। প্রথমে ট্রেনে করে দিল্লি পৌঁছোল, সেখান থেকে বাসে করে নানারকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ভিওয়ানিতে নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে অনেক সময় লেগে গেল। ওখানে পৌঁছে তার নামে অ্যালট করা কোয়ার্টারও পেয়ে গেল। কোয়ার্টার-এ জিনিসপত্র রেখে দেখল ঘড়িতে চারটে বেজে গেছে। দুপুরের খাওয়া অবশ্য পথে একটা ধাবাতেই করে নিয়েছিল।

অনেক দূরের জার্নি বলে বাসওয়ালারা মাঝপথে এক জায়গায় বাস থামিয়ে বলেছিল, যাদের খিদে পেয়েছে তারা এই ধাবাতেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতে পারেন। তবে সময় মাত্র ১৫ মিনিট দেওয়া হবে। তার মধ্যে খেয়ে বাসে এসে বসতে হবে। শ্যামলও সে সুযোগ ছাড়েনি। কারণ বুঝতে পেরেছিল এখন না খেলে ওখানে গিয়ে আজ লাঞ্চ কপালে নাও জুটতে পারে, তাই খাওয়াটা সেরে নিয়েছিল। তবে সে যা খাওয়া তা অন্য সময় হলে হয়তো ফ্রিতেও খেতে চাইত না। তবুও কোনও উপায় নেই ভেবে খেতেই হল!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল এবার আশেপাশে একটু ঘুরে দেখে আসা যাক। রাতের খাবারটা কোথায় খাবে ইত্যাদি। কারণ কোম্পানি থেকে থাকার জায়গাটা ফ্রি দিয়েছিল কিন্তু ভেতরে রান্নার কোনও জায়গা ছিল না। তাছাড়া সোমবার থেকে জয়েনিং বলে রোববারে এসে পৌঁছোবার ফলে, অফিসের থেকে খোঁজও নেওয়া যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়ল। ভাবল ফেরার পথে রাতের খাবারটাও খেয়ে ফিরবে।

কোয়ার্টার থেকে বেরোবার সময় একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, তাদের এই জায়গা থেকে শহর একটু দূরেই, তাই রিকশাতেই যাওয়া ভালো। দেরি না করে একটা রিকশা নিয়ে শহরে পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখল সেখানে বেশকিছু দোকানপাট আছে ঠিকই কিন্তু সে হিসেবে এটাকে শহর বললে একটু অপমানই করা হবে মনে হয়।

হঠাৎ নজরে পড়ল একটা দোকানে কুলফি মালাই বিক্রি হচ্ছে। লোভ সামলাতে না পেরে ঢুকে পড়ল সেখানে। কুলফিটা খেয়ে দাম দিতে গিয়ে দেখল যে, অতদূরের রিকশা ভাড়া নিয়েছে মাত্র দশ টাকা আর কুলফি নিল চল্লিশ টাকা। বেশ বুঝতে পারছিল ইচ্ছে থাকলেও এ শখ রোজ পূরণ করা যাবে না। এরপর অনেক দোকান-বাজার ঘুরে খাবারের দোকানের খোঁজে এগোতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন লোকালয়ে গলিতে ঢুকে পড়েছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা বিকট চিৎকারে প্রায় আত্মারাম খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। পরক্ষণেই দেখল কতকগুলো মযূর এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে যাচ্ছে আর ওই অদ্ভুত বিকট চিৎকার করছে। সন্ধে হয়ে গেছে তাই তারাও ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসায়।

মনে মনে ভাবল, ঈশ্বরের কী অদ্ভুত সৃষ্টি! মযূর দেখতে এত সুন্দর কিন্তু তার আওয়াজ যে এত কর্কশ, তা না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। একসাথে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা মযূর ডেকে ওঠাতে শ্যামল প্রথমটা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের বিকট আওয়াজ সে কখনও শোনেনি। যখন সে খাবার হোটেলে গিয়ে পৌঁছোল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।

হোটেলে গিয়ে শুনল আজ স্পেশাল ডিশ হল, ক্ষীর। শুনেই জিভ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছিল শ্যামলের। মনটা আনন্দে ডগমগ করে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থাযী হল না। এই ক্ষীর খাওয়ার অভিজ্ঞতা সে কখনও-ই ভুলবে না!

ক্ষীর খেয়ে বুঝতে পারল যে, এখানে দুধের পায়েসকে ক্ষীর বলা হয়। আর সেটা দুধের পায়েসও বলা চলে না। সেটা একেবারে দুধ-ভাত ছাড়া আর কিছু নয়। প্রথম দিনই এমন ক্ষীর খাওয়াতে এখানে বাইরে খাওয়ার উৎসাহটা একটু কমে গেল।

সেখান থেকে কোয়ার্টারে ফেরার সময় থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। কোয়ার্টারে যখন ফিরে এল তখন বৃষ্টির গতিও অনেক বেড়ে গেছে। বৃষ্টির শাব্দিক অনুভূতিটা বরাবরই তার কাছে বেশ আনন্দময় কিন্তু আজ যেন কেমন একটা গা শিরশির করা ব্যাপার আছে বলে মনে হচ্ছে। এমনিতেই শীত পড়তে শুরু করেছে। শীতকে আরও জমিয়ে তুলতে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সুতরাং গা শিরশির করাটাই স্বাভাবিক।

ঘরে দুটো জানলা। আজ যেন কেন দুটো জানলাই বন্ধ করতে ইচ্ছে হচ্ছে শ্যামলের। দুমিনিটের ভেতরেই জানলা দুটো বন্ধ করে এসে চেয়ারে বসতেই, বারান্দার দিকের জানলাতে হঠাৎ খট করে শব্দ হল। চমকে উঠল শ্যামল। বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ওখানে তালাও নিজে লাগিয়ে এসেছে। তাই সেখানে কেউ ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকী তালাটা সে বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল। নিজের তালা-ই লাগিয়েছে।

মোটা কাঠের জানলা। এমনিতেই এখন বন্ধ। তাই বৃষ্টির দিনে এমন জোরে খট করে শব্দ করাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। শ্যামলকে বেশি ভাবতে সময় দিল না ওপাশের কেউ। আবার খট করে শব্দ হল। শ্যামল ভাবতে লাগল, যেহেতু বারান্দাটা পুরো গ্রিল দিয়ে ঘেরা ও তালা দেওয়া, তাই গ্রিল পেরিয়ে আসা কারও-র পক্ষে সম্ভব নয়। এই দুর্ভেদ্য সুরক্ষা ভেদ করে জানলায় এসে ধাক্কা মারার কথা নয়।

শ্যামল চেঁচিয়ে উঠল কে… কে ওখানে? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। জানলায় আবার খট করে আওয়াজ হল। শব্দটা ক্রমশ যেন বাড়তে শুরু করল।

( ২ )

একে তো শীতের রাত, তার ওপর এই জায়গায় সে একেবারে নতুন। ভাবল এখানে সে নতুন, কেউ হয়তো ভয় দেখানোর জন্য এসব করছে। বিছানায় শুয়ে পড়ল কিন্তু শুয়ে ঘুম আসছিল না। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছিল। বিছানায় শুয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেল সে।

অন্যদিকের জানলাটায় কেউ ধাক্কা দিলে সে অন্তত বুঝতে পারত যে, এই বৃষ্টির দিনে হয়তো কোনও আগন্তুক বাইরে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু গ্রিল দিয়ে ঘেরা এই জানলাটায় কেউ ধাক্কা দেবে কি করে! কিছুতেই এ কথাটা তার মাথায় ঢুকছিল না। তাছাড়া শোওয়ার আগে তালা দিয়ে বন্ধ করে এসেছে। এসব আবোল তাবোল চিন্তা করতে করতে তার সব কিছুই যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।

জানলাটায় ধাক্কাটা এবার থেমে থেমে আসছে। অনবরত ধাক্কা দিয়ে মানুষ যেমন ক্লান্ত হয়ে যায়, মনে হচ্ছে ওপাশের কেউ তেমনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসলে ওপাশে কি কেউ আছে, না পুরোটাই তার মনের ভুল! হয়তো শুধু বৃষ্টিই হচ্ছে, আসলে হয়তো জানলায় কোনও ধাক্কার শব্দ হচ্ছে না। পুরোটাই তার মনের ভুল নয়তো!

শ্যামল এগিয়ে যায় জানলার দিকে, কান খাড়া করে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু একি, সত্যিই তো মনে হচ্ছে কেউ কয়েক সেকেন্ড পর পর একই তালে ঠক ঠক করে চলেছে। এবার তার মনে হতে লাগল হয়তো মনের ভুলে সে গ্রিলের তালাটাই লাগাতে ভুলে গেছে আর সেই সুযোগ নিয়ে কেউ হয়তো ঢুকে পড়েছে বারান্দায়। কিন্তু এত রাতে কে হতে পারে? তবে কি চোর! আর চোর হলে সে জানলায় কেন ধাক্কা দেবে। চোর হলে তো নিঃশব্দে আসবে। জানিয়ে আসবে কেন!

শ্যামলের মাথায় নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। কেউ কি তাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব করছে? নাকি কোনও বোবা লোক বিপদে পড়ে জানলায় খট খট আওয়াজ করছে? নাকি অন্য কোনও প্রাণী? মনে পড়ে যায়, একবার তার বাড়িতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভাম-বিড়াল ঢুকে গিয়েছিল বারান্দায়। সেরকম কিছু নয়তো?

প্রথমে ভেবেছিল দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখবে। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল না এত রাতে এই অজানা জায়গায় সেটা হয়তো ঠিক হবে না। এসব নানা অজানা আশঙ্কায় শ্যামল অনুভব করল, ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কোনও চোর-ডাকাত নয়তো!

চিৎকার করে সে কি লোকজন জড়ো করবে? এবার সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, কে ওখানে? কিন্তু কোনও উত্তর এল না। এত রাতে জানলার শব্দ এবং নিজের ধারণা সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাবে নিশ্চিত হতে পারল না বলেই, চিৎকার করতে তার ভীত-সন্ত্রস্ত সত্ত্বা বারণ করে দিল।

( ৩ )

এবার মনে হল বৃষ্টির তালে তালে কেউ যেন নাচছে আর তার পায়ে নূপুর ও হাতের চুড়ির আওয়াজ যেন তালে তালে বাজছে। এতে শ্যামলের মাথার ভেতরে কেমন যেন এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে লাগল। ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না। সত্যিই কি কেউ বাইরে নাচছে, না এসব তার মনের ভুল!

এমনিতে শ্যামল খুব একটা ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। এর আগে পাড়ায় কেউ মারা গেলে অনেক গভীর রাতেও তাকে নিয়ে দাহ করে এসেছে। সামাজিক পরোপকারে তার জুড়ি নেই। জানলার শব্দটাও থেমে গেছে নূপুরের ও হাতের চুড়ির আওয়াজের সাথে সাথে। তার মনে হচ্ছে কেউ নাচছে তার বারান্দায়, ঠিক জানলার পাশে। মাথাটা কেমন যেন বন বন করে ঘুরছে মনে হচ্ছে।

কল্পনায় সে দেখতে পেল রাজা-বাদশাদের হারেমখানার কোনও নর্তকী যেন সুযোগ পেয়ে আজ এই বারান্দায় এসে তার আসর বসিয়েছে। খালি তফাত হল, ঘরভর্তি শ্রোতা নেই। শ্রোতা শুধু একজন। আর সেটা হল সে নিজে।

ঘরের আলোটা জ্বলছে। শ্যামল আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ নিজের মুখ দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। আয়নায় এক নারীমূর্তি। এ কী করে সম্ভব। পেছন ফিরে দেখল, জানলার কপাট কখন খুলে গেছে বুঝতেই পারেনি। মনে হল কোনও এক নারী মূর্তি যেন জানলা থেকে সরে গেল। অন্য জানলাটা কিন্তু বন্ধই রয়েছে। নিমেষেই ঘোর কেটে যায়। বুঝতে পারে, সে ঠিকই শুনেছে এবং দেখেছেও ঠিকই। আবার সেই নারী মূর্তি যেন তার জানলা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর আর তার কিছুই মনে নেই।

( ৪ )

যখন জেগে উঠল তখন বুঝতে পারল, সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তখনও বারান্দার দিকের জানলাটা হাট করে খোলা। অথচ অন্যদিকের জানলাটা এখনও বন্ধই রয়েছে। রাতের ঘটনাটা তাহলে কি শুধুই তার মনের ভুল নাকি সত্যি!

গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে করতেই আবার যেন কেমন একটা ভয় এসে বাসা বাঁধছিল। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। তাই মনেও একটু সাহস পেল। বাইরে থেকে কিছু লোকের কোলাহলও এসে কানে পৌঁছোল।

শ্যামল ধীর পায়ে বারান্দায় পা রাখল। দেখল গ্রিলের গেটে যে-তালাটা গতকাল রাতে লাগিয়েছিল সেটা এখনও বন্ধই আছে। এটা দেখে ভাবল, তাহলে গতকালের ঘটনাটা হয়তো মনের ভুল হতে পারে। কিন্তু তার এই ধারণা বেশিক্ষণ স্থাযী হল না, নিমেষেই বদলে গেল। বারান্দায় কিছু পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখল একটা গলার চেন ও একটা লকেট পড়ে আছে।

এগুলো দেখার পর শ্যামলের মন থেকে অনেকটাই বিভ্রান্তি কেটে গেল। কারণ সে নিশ্চিত যে গতকাল কেউ এখানে এসেছিল। তবে ওই লকেট ও গলার চেনটা তোলার সাহস তার হল না। কেউ যে এসেছিল তার প্রমাণ তার সামনে হাজির রয়েছে। ভাবল ব্যাপারটা প্রতিবেশীদের কাউকে জানালে হয়তো কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দেখল পাশের কোয়ার্টারের সামনে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে কী সব যেন আলোচনা করছে।

( ৫ )

সেখানে পৌঁছে যা শুনল তা শুনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল শ্যামল। শুনল গতকাল পাশের বাড়ির মেয়েটি বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। আর আশেপাশের অনেক বাড়িতেই ওর উপস্থিতি অনুভব করেছে প্রতিবেশীরা। প্রায় একই রকম ভাবে যেরকম শ্যামল অনুভব করেছে।

প্রতিবেশীদের আলোচনার বিষয়ে একটা কথা সবাই বলছিল যে, গতকাল রাতে তাদের বাড়িতে কেউ এসেছিল। কিন্তু শ্যামল লক্ষ্য করল সবাই অনেক কথা বললেও তাদের বাড়িতে কেউ গলার চেন ও লকেট পেয়েছে বলে বলল না। ব্যাপারটা ভেবেই রাতের সেই অনুভূতি যেন আবার শীতল হয়ে নেমে গেল শ্যামলের মেরুদণ্ড বেয়ে। ভয়ে ভাবনায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করল শ্যামল।

শ্যামলের খালি মনে হতে লাগল, আবার যদি রহস্যমযী সেই মেয়েটি রাতে তার কাছ থেকে ফেলে যাওয়া লকেট ও চেনটা ফেরত চাইতে আসে, তখন কী হবে?

 

দিতি-ও বাঁচতে চায়

হাতে ধরা ব্লাড স্যাম্পল-এর শিশি দুটো আর রিকুইজিশন স্লিপটা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের কোলাপ্সিবল গেটের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দেয় নীলাদ্রি। ও পাশে থাকা ভদ্রলোক স্যাম্পল জমা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে জানিয়ে দিল, ‘ঘন্টা খানেক পরে আসুন’।

কাল সকাল আটটায় দিতির অপারেশন। অত সকালে ব্লাড জোগাড় করা যাবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। খামোকা টেনশন না পুষে, অমিতকে নিয়ে নীলাদ্রি তাই আগের দিন-ই এসেছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। ব্লাড স্যাম্পল জমা দিয়ে এখন খানিকটা রিলিভড্। এলোমেলো চুল বাঁ হাতে ঠিক করতে করতে, সিগারেটের লম্বা টানের ধোঁয়ার সাথে, টেনশন হালকা করে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় নীলাদ্রি।

‘টেস্ট করতে, গ্রুপ মেলাতে এটুকু সময় তো লাগবেই। এক ঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বা করবি কী! চল একটু হেঁটে হেদুয়ায় গিয়ে বসি’– অমিত ঘুরে, সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। অমিতের সঙ্গে পা মিলিয়ে নীলাদ্রিও মানিকতলা মোড় পেরিয়ে হেদুয়ার দিকে এগিয়ে চলে। রবিবারের শান্ত বিকেলে বড়ো রাস্তাগুলো যেন ক্লান্ত বিবশ হয়ে শুয়ে আছে। এই ফাঁকা শান্ত রাস্তাঘাট হঠাৎ করে নীলাদ্রিকে দিতি-র কথা মনে করিয়ে দেয়। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর অনেকবার দিতিকেও এরকমই বিবশ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে নীলাদ্রি। অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোর কাটে না তখনও, আধো ঘুমে আচ্ছন্ন। হসপিটালে দিতিকে দেখতে অনেকেই আসে। জানতে চায় কেমন আছে সে। কিছুক্ষণ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে যায় তারা। কিন্তু দিতি কিছুই বুঝতে পারে না। জানতে পারে না কারা কারা এসেছিল ওকে দেখতে। কাটাছেঁড়া – অপারেশন – ব্যান্ডেজ – ড্রেসিং – ভয় – টেনশন সবগুলো মিলে যায় অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোরে। হসপিটালের ধবধবে সাদা বেডে, ফ্যাকাশে দিতি তখন ঘোরের মধ্যে শুয়ে।

নীলাদ্রিকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে, অমিত বলে, ‘কী ভাবছিস? গ্রুপ মিলিয়ে ব্লাড পাওয়া যাবে কিনা! চিন্তার কিছু নেই, এখানে না পাওয়া গেলে পিপলস্-এ যাব, সেখানে না পাওয়া গেলে লায়ন্স এ…’, হঠাৎ থেমে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা দিতির ব্লাড গ্রুপ কী জানিস?’

‘জানি ‘বি’ পজিটিভ।’

‘তোর?’

‘বি পজিটিভ।’

‘আমারও। তাহলে তো চিন্তার কিছু নেই। কোথাও না পাওয়া গেলে আমরা তো আছিই।’

অমিত যেন সত্যিই চিন্তামুক্ত হল। নীলাদ্রিও অমিতের কথায় ভরসা পায়। রক্ত চাই– রক্ত। এক বোতল, দু বোতল, তিন… চার। নেই শুনলেই মাথায় হাত। পৃথিবীতে এই একটা জিনিসের জন্য মানুষকে মানুষের উপরই নির্ভর করতে হয়। যার কোনও বিকল্প নেই। টাকা পয়সায় যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।

পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, সন্ত্রাস, হিংসা– রক্ত হোলির এক বিভৎস উৎসব, কত রক্তের অপচয়। অথচ এই রক্তের জন্য, জীবনের জন্য কত না কাতর চাহিদা আর উৎকণ্ঠার অপেক্ষা। কিছু মানুষ আছে এখনও, যারা মানুষের জন্য ভাবে, চায় সব মানুষ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুক এই সুন্দর পৃথিবীতে। তারাই তো অকৃপণ হয়ে দান করে দেহের লাল তরল অংশ– অমূল্য ধন ‘রক্ত’।

যেদিন লাল মারুতি চেপে পাঁচ-ছ’ জন এসে মালঞ্চ সিনেমা হলের সামনে সত্যকেই প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে রেখে গেল। সেদিন রক্তে ভেজা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নীলাদ্রি, রাজনৈতিক ধিক্বার সভায় কোনও একজন নেতার মুখে শুনেছিল, ‘এসব বরদাস্ত করা হবে না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিশোধ হবেই। রক্তের বদলে রক্ত চাই। আরও রক্ত।’

হঠাৎই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল নীলাদ্রির। নিজের মনে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, ওই যারা সত্যকে মেরে রাস্তায় রক্ত ছিটিয়ে গেল বা যে নেতারা রক্তের বদলে রক্ত চাইছিল, ওরা কি কখনও কাউকে রক্ত দেয়? তাহলে এত রক্ত আসে কোথা থেকে? যারা দেয় তারা নিশ্চয়ই দেওয়া-নেওয়ার হিসাব করে না। রক্তের বদলে রক্ত চাই বলে না।’

‘তুই কখনও ব্লাড ডোনেট করেছিস?’ নীলাদ্রির প্রশ্নে অমিত খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়, ‘না, দিইনি। অফিসে একবার হেল্থ চেক-আপ ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করিয়েছি।’

‘আমি দু-একবার ব্লাড দিয়েছি, কিন্তু দিতি দিত– বছর বছর, ক্লাবের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে। ব্লাড নেওয়ার জন্য কার্ডগুলো তো ক্লাব থেকেই আনলাম।’

হাঁটতে হাঁটতে হেদুয়ার কাছে এসে বাঁদিকের বড়ো বিল্ডিংটার দিকে আঙুল তুলে অমিত নীলাদ্রিকে বলে, ‘এই স্কটিশে ভারতবর্ষের দু-দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি পড়াশুনা করেছেন, যারা পৃথিবীর কাছে ভারতবর্ষকে নতুন করে পরিচিত করেছেন, গর্বের আসনে বসিয়েছেন। বলতো কে সেই দুজন?’

নীলাদ্রির মাথাটা যেন ফাঁকা ডিব্বা, সব ভুলে বসে আছে। অমিতের মুখের দিকে বোকা বোকা ভাবে তাকিয়ে থাকে।

‘স্বামী বিবেকানন্দ আর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।’

উত্তর না দিতে পারায় নীলাদ্রি লজ্জাবোধ করে। ‘সরি! এটা বলা উচিত ছিল।’

কথা বলতে বলতে ওরা হেদুয়ায় ঢুকে পড়েছে। নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে নেয়, এক ঘন্টা হতে কত দেরি আছে।

‘দিতিটা কি বল তো! সব কিছু ভুলে, নিজের গায়ে আগুন লাগাল ও! মৃত্যুকে এত কাছের মনে হল? কী দুঃসাহস!’

অমিতের কথায় নীলাদ্রি চকিতে ফিরে দাঁড়ায়– ‘না রে, মৃত্যুর কাছে এসে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা যে কত প্রকট হয়ে ওঠে, দিতিকে তখন দেখলে বুঝতিস। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য আকুল হয়ে ওঠে মানুষ– আমি দেখেছি।’

সুইমিং পুলের রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি আর অমিত। সামনেই ডাইভ দেওয়ার জন্য ঢালাই করা জায়গাটা, যার একাংশ ঝুলে আছে পুলের মধ্যে। সেখানে বসে একজন অল্পবয়সি বউ আপন মনে শাড়িতে অ্যাপ্লিকের কাজ করছে। বোধহয় স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। বাদ দেওয়া টুকরো কাপড়গুলোর কিছু কিছু হাওয়ায় উড়তে উড়তে সুইমিং পুলের জলে এসে পড়ছে। ওই টুকরোগুলো উড়ে গিয়ে জলে পড়ছে কিনা বা জল নোংরা করছে কিনা সে ভাবনা নেই– স্বার্থপরের মতো বউটি নিজের কাজে মগ্ন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা বা মৃত্যুর জন্য দুঃসাহসী প্রয়াস। কোনও ক্ষেত্রেই বোধহয় মানুষ ভাবে না অন্যের কথা।

নীলাদ্রি আর অমিত পার্কের এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কের এক পাশে গোল হয়ে বসে আছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। পাশের কলেজ হোস্টেল থেকেই বোধহয় এসেছে ওরা। কোনও বিশেষ আলোচনা বা পরিকল্পনায় তারা মশগুল। এরকম সুশৃঙ্খল ভাবে ওদের বসে থাকতে দেখে নীলাদ্রির বেশ ভালো লাগে। চারিদিকের অশালীন গুলতানি, ছন্নছাড়া অসহিষ্ণু চেনা সমাজ থেকে পৃথক ভালো কিছু দেখে মনটাও যেন শান্তি পায়। নীলাদ্রি মনে মনে ভাবে, এদের মতো মানুষেরাই নিশ্চয়ই মানুষের জন্য রক্ত দেয়।

একটু এগিয়ে এসে গাছতলায় সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটায় এসে বসে নীলাদ্রি-অমিত। আগে থেকেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন ওখানে। পরিপাটি পোশাক, পাট ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কেয়ারি করে চুল আঁচড়ানো, গলাবন্ধ ফুল হাতা সোয়েটার পরা।

সামনে দিয়ে অন্য একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে ধরা বন্ধ ছাতায় ভর দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন। তার উদ্দেশ্যে পাশে বসা ভদ্রলোক হাঁক ছাড়েন, ‘দাদা কত হল?’

ভদ্রলোক কানে কম শোনেন, থেমে, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী বললেন, কীসে বদহজম হল?’

‘না না, বয়স কত হল?’

‘এই তো একানব্বই। শয়ে পড়তে এখনও নয় নয় করে ন’টা বছর বাকি।’

‘তা প্রায় টেনে এনেছেন। আমার তো একাশি, আমার থেকে পুরো দশ বছর এগিয়ে। আমরা কি আর পারব, আপনার মতো?’

মৃদু হেসে ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘যা ঠান্ডা পড়েছে।’

পাশের ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘দেখুন কী হয়?’

নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে, অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘এখনও আধ ঘন্টা।’

অন্য একজন ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক পাশে এসে বসলেন। তার পায়ের কেডস্টিও ধবধবে সাদা। আগের সেই ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করতে করতে প্রশ্ন করেন, ‘ক পাক হল?’

নস্যির কৌটো বের করার সময় পকেটে রাখা খুচরো পয়সাগুলো ঝনঝন করে বেজে ওঠে।

‘এই তো সবে এক পাক দিয়ে এসে বসলাম।’

নস্যি নিয়ে পরিষ্কার রুমাল দিয়ে নাক, হাত মুছে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসেন।

‘ঘোষবাবুকে দেখলেন? এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ্যই আছেন। একানব্বই চলছে!’

‘ভাইপোদের কাছে থাকেন। ভালো চাকরি করতেন, ভালো পেনশন। বিয়ে থা তো করেননি। সাংসারিক চিন্তাভাবনা নেই। সুস্থ থাকারই কথা।

‘আপনার কত চলছে?’

‘ক’দিন আগে সত্তর পার হলাম।’

‘আমার থেকে তো অনেক ছোটো। যান সন্ধে হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি আরও দু-চার পাক ঘুরে আসুন। ভালো করে বাঁচতে হবে। কত কী আরও দেখবার আছে।’

‘না না, আর দেখবার ইচ্ছে নেই। ঘরে-বাইরে যা চলছে। তাড়াতাড়ি গেলেই বাঁচি।’

‘মানুষ হয়ে এসেছেন, অত তাড়াতাড়ি করে লাভ কী? যতদিন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা যায় সেটাই ভালো। মরলে পরে কে যে কী হবে কে জানে!’

‘ওই দেখুন বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের প্রোগ্রাম সেট করছে, আর আমরা রক্তচোষারা বসে আছি শুধু সময়ের অপেক্ষায়।’ একটু থামেন। ‘আচ্ছা, মানুষের জন্য কোনওদিন রক্ত দিয়েছেন?’

সংক্ষিপ্ত উত্তর– ‘না’।

ভদ্রলোক তবুও থামেন না, ‘সে কি কথা।’ মানুষইতো কেবল মানুষের জন্য রক্ত দিতে পারে। জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ওরা কিন্তু পারে না। একবার চেষ্টা করে দেখুন না।’

‘আমাদের চেষ্টার দিন তো শেষ। আমাদের রক্ত সব শুকিয়ে গেছে। না হলে এত অনাচার, এই খারাপ সময়ে একটুও গরম হয় না কেন রক্ত?’ নীলাদ্রি-অমিতের দিকে ফিরে বলে, ‘এখন চেষ্টা করবে এরা। চারিদিকে লড়াই। অনেক অনেক রক্তের দরকার।’ বেঞ্চ থেকে উঠে ভদ্রলোক এগিয়ে যান। পাশের ভদ্রলোক অমিতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যাই যাই করছে। ওসব মিথ্যে মুখোশ। মরতে কেউ-ই চায় না। মরতেই যদি চায় তাহলে প্রতিদিন পার্কে এসে পাঁচ পাক ঘুরছে কেন? বাঁচতে চায় বলেই তো শরীরটাকে সতেজ রাখার চেষ্টা। রক্ত ফুরিয়ে গেলে দেখবে রক্ত চাইবে। এক বোতল, দু বোতল, তিন বোতল…।’

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ায়।

অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘মিনিট দশেক।’

বেঞ্চ ছেড়ে অমিতও উঠে দাঁড়ায়। পাশের ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমাদের দুজনেরই বি পজিটিভ। কখনও রক্ত লাগলে বলবেন।’

পার্কের রাস্তা– মানিকতলা মোড়– সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক, পায়ে পায়ে শেষ হয় নীলাদ্রি অমিতের রাস্তা।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ব্লাড কালেক্ট করে হসপিটালের ফ্রিজে সেই ব্লাড ঢুকিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নীলাদ্রি অমিতকে নিয়ে দিতির কেবিনের দরজা খুলে দাঁড়ায়, দরজা খোলার হালকা শব্দে দিতি ঘুরে তাকায় ওদের দিকে।

দিতির চোখে-মুখে আবার একবার দেখতে পায় বেঁচে থাকার আকুল আগ্রহ – ‘ব্লাড পেয়েছ?’

 

স্নেহ

অর্ক মায়ের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ও জানে মা অনেকদিন ধরেই মাসিকে ফোনে চেষ্টা করছে কিন্তু মাসিকে কিছুতেই ফোনে ধরা যাচ্ছে না। আর মাসির খবর কয়েকদিন না পেলেই মায়ের কী অবস্থা হয় আন্দাজ করে নিয়েই অর্ক বলে, ‘মাসির চিন্তা করা বন্ধ করো এবার। মা, তুমি খুব ভালো করেই জানো মাসি ভালো আছে বলেই এখন তোমার ফোনও ধরছে না, তোমাকে একটা ফোন করারও প্রয়োজন মনে করছে না। কোনও প্রবলেম হলে কাঁদতে কাঁদতে আগে তোমাকেই ফোন করত।’

সুচরিতা অর্কর কথার কোনও প্রত্যুত্তর দিতে পারে না শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নেয়। আজকালকার ছেলে, ইমোশন খুব কম, তবে জীবনের উঁচু-নীচু পথটাকে অনেক ভালো ভাবে বোঝে, চেনে ওরা। তবে সেটা সুচরিতার কাছে কষ্টের নয়, গর্বের।

সুচরিতা বোঝে আজকের দিনে ওর নিজের ভালোমানুষি স্বভাবটাকে নিয়ে লোকেরা হাসিঠাট্টাই করবে, আড়ালে সকলে নিরেট, বুদ্ধিহীন বলবে। অথচ সত্যিই তো ছোটোবেলায় এত বুদ্ধি ছিলটাই বা কোথায় যে এক-দু’বার সাক্ষাতেই কাউকে বুঝে ফেলবে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়ো হওয়ার কারণে, বড়োদের মধ্যে সুচরিতার থাকার সুযোগ হয়নি। পরিবারের অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গেই মিলেমিশে মানুষ হয়েছে। বড়োরা কীভাবে ঘরসংসার সামলাচ্ছেন সেটা ঘুণাক্ষরেও সুচরিতা কখনও বুঝতে পারেনি। অথচ এখন তিন-চার সদস্যের পরিবারে বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে কিন্তু সবদিকেই তাদের তীক্ষ্ণ  নজর। কারও সঙ্গে দুটো কথা বলেই ওরা বুঝে ফেলে মানুষটা কেমন।

‘আজই আমি মাসিকে দোকানে শপিং করতে দেখেছি। হয়তো অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। মাসির সঙ্গে আরও দুজন ছিল। ওদের সকলের হাতেই অনেকগুলো করে ব্যাগ ছিল।’

‘তোর সঙ্গে কোনও কথা হয়েছে?’

‘না, আমি ফুটপাথে একটা দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। মাসিকে একটা দোকান থেকে বেরিয়ে আর একটা দোকানে ঢুকতে দেখলাম।’

‘তুই তো ভুলও দেখে থাকতে পারিস।’

‘কেন, আমি কি অন্ধ, নাকি চোখে কম দেখি যে মাসিকে দেখে চিনতে পারব না?’

‘তাহলে কথা বললি না কেন?’

‘বাব্বা! মাসি হেসে গড়িয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আমাকে দেখতেই পায়নি। দিব্যি খোশমেজাজে ছিল… আর যেই তুমি ফোন করো অমনি মাসির কান্নাকাটি আরম্ভ হয়ে যায় যেন ওর চেয়ে দুঃখী সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর একটাও নেই। মাসির যখন ভালো সময় যায় তখন কই, তোমাকে তো বলতে আসে না অথচ যেই সামান্য প্রবলেমের আঁচ পায় ওমনি তোমার কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মা, মাসির চিন্তা করা ছাড়ো। ফোন আসেনি মানে ধরে নাও মাসি বহাল তবিয়তে আছে।’

সুচরিতা শাসনের ভঙ্গিতে অর্কর দিকে চোখ ফেরায়। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে কারণ সুপর্ণার নামে আরও দুটো বাজে কথা অর্কর মুখ থেকে শুনতে সুচরিতার ভালো লাগছিল না। অথচ মনে মনে সুচরিতা ভালো করেই জানে অর্কর প্রতিটা কথা সত্যি। ও ঠিকঠাকই চিনেছে নিজের মাসিকে। সুপর্ণার এটা বরাবরের স্বভাব। সাধারণ সমস্যাকে বাড়িয়ে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না অথচ কোনও আনন্দের খবর থাকলে এমনভাবে সকলের কাছে চেপে যাবে যে অন্য লোকে মনে করবে দুঃখ ছাড়া মেয়েটার জীবনে সুখশান্তি একেবারেই নেই।

সুপর্ণাকে যতবার সুচরিতা এটা নিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে প্রত্যেকবারই ওর একটাই উত্তর শুনে এসেছে, ‘তুই জানিস না দিদি, আমার ভালো কেউ সহ্য করতে পারে না। সকলে আমাকে হিংসা করে। ভালো কিছু আমার জীবনে ঘটলে অন্যের নজর লেগে যায়, তাই কাউকে আমি কিছু জানতে দিই না।’

সুচরিতা আশ্চর্য হয় সুপর্ণার কথা শুনে। আশ্চর্য, নিজের দিদিকেও বলা যায় না। তার মানে কি সুপর্ণা বলতে চায় ছোটো বোনকে দিদি হিংসা করছে? অথচ দিনরাত সুচরিতার একটাই চিন্তা, ছোটো বোনটা কীভাবে ভালো থাকবে? কী করে ওকে আরও সাহায্য করা যাবে?

সুচরিতার মনে পড়ল, এই তো কয়েকদিন আগেই সুপর্ণা কাজের মেয়েটার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল কিছু টাকা চাই লিখে। সংসার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সুচরিতা সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখে দুর্দিনের কথা মাথায় রেখে। ভেবেছিল বোন এলে ওখান থেকেই কিছু টাকা সুপর্ণাকে দিয়ে দেবে। ও ভালো করেই জানে ওই টাকা সুপর্ণা কবে ফেরত দেবে কোনও ঠিক নেই। আদৌ দেবে কিনা সেটাও অজানা।

এই ভাবেই দুই বোন মানুষ হয়েছে। দশ বছরের ছোটো সুপর্ণা। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মা-বাবার কাছে সমানে শুনে এসেছে, ছোটো বোনের সব দায়িত্বই সুচরিতার। বোনকে চোখে চোখে রাখা, সঙ্গে করে স্কুল নিয়ে যাওয়া, টিফিন খেয়েছে কিনা দেখা, বোনকে আগলে আগলে রাখা সবই করেছে সুচরিতা। বিয়ের পরেও এর অন্যথা হয়নি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরেও সুপর্ণার দায়িত্ব সুচরিতার ঘাড়েই এসে পড়েছে। সুচরিতা নিজেই বুঝতে পারেনি কবে থেকে ও বড়ো দিদির খোলস ত্যাগ করে সুপর্ণার মা হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই নিয়ে সুচরিতার স্বামী এবং ছেলে প্রচুর হাসিঠাট্টাও করেছে, কিন্তু সুচরিতা কখনও প্রতিবাদ করেনি।

‘সুচি, তুমি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালোমানুষ। নিজের বোনকে ভালোবাসো ক্ষতি নেই কিন্তু এতটা স্বার্থপরও ওকে করে তুলো না যে ওর নিজের চরিত্রই একদিন ওর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মা-বাবাও শক্ত হাতে সন্তানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তাকে শাসন করে কিন্তু তাই বলে কি তারা তাদের সন্তানের শত্রু? তাহলে তুমি কেন সুপর্ণার সব দোষ ঢাকবার চেষ্টা করো?’

‘আমি ওকে কী বলব? ও নিজে পড়াশোনা করেছে, ব্যাংকে চাকরি করে। ও বাচ্চা মেয়ে নয় যে ওকে বোঝাব। সবারই স্বভাবের কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে।’

‘যদি আলাদা আলাদা স্বভাবের কথাই বলো তাহলে ওকে ওর স্বভাব নিয়েই থাকতে দাও। ওর নিজের স্বভাবের জন্য যা কিছু সমস্যা সেটা সুপর্ণার একার, সেটা সমাধানের দায়িত্বও ওর উপরে কেন ছেড়ে দিচ্ছ না? সেখানে তুমি কেন ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? আমার আপত্তিটা এখানেই।’

শেখরের কথাটা ফেলতে পারে না সুচরিতা কারণ সুচরিতা জানে শেখর সত্যি বলছে। কিন্তু মনকে কীভাবে বোঝাবে সুচরিতা। বোনের প্রতি গভীর মমতাবোধ সবসময় সুচরিতাকে দুর্বল করে তোলে। এই যে সুপর্ণা টাকা চেয়েছে সেটা শেখরকে এখনও বলতে পারেনি সুচরিতা। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে নিজের জমানো টাকা থেকেই সুপর্ণাকে কুড়ি হাজার টাকা এখন দিয়ে দেবে। কিন্তু কেনই বা এই টাকার দরকার সুপর্ণার, নিজের মনকেই সুচরিতা প্রশ্ন করে। সুপর্ণা ব্যাংকে চাকরি করে, মাইনেও খারাপ নয়। তাহলে? আর কতদিন সুপর্ণাকে এইভাবে সাহায্য করে যেতে হবে? মনে মনে বিরক্ত হয় সুচরিতা। কেন ও সুপর্ণার মুখের উপর ‘না’ বলতে পারে না? বেশ বুঝতে পারে সুচরিতা, সুপর্ণা ওর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ওকে ব্যবহার করছে।

শেখর বহুবার সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে সুপর্ণা ওকে নিজের কাজ গুছোবার জন্য খালি ব্যবহার করছে। সুপর্ণার এই স্বভাবের জন্য সুচরিতা অনেকটাই দায়ী। বোনের অন্যায় কোনওদিন সুচরিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি উপরন্তু সকলের সামনে ঢাকবারই চেষ্টা করেছে। এমন অনেক সম্পর্ক রয়েছে যেগুলো ছাড়া জীবন এগোতে চায় না অথচ সম্পর্কগুলো শুধু ব্যথাই দেয়। দেওয়ার ইচ্ছেটা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। আর পিছন ফিরে কিছুতেই তাকানো যায় না। অথচ যে পাচ্ছে, তার কিছুতেই আর আশ মেটে না। গোগ্রাসে সারা পৃথিবীটাকে যেন গিলে খেতে চায়।

সুপর্ণার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। অথচ নিজেকে বদলাবার কোনও চেষ্টা নেই ওর। সুচরিতা ভাবে, সুপর্ণা কখনও কি বদলাবে? হয়তো না। অথচ ওর জন্য সুচরিতার সংসারে মাঝেমধ্যেই অশান্তির ঝড় বয়ে যায়। আশকারা তো সুচরিতাই দিয়েছে। যখন তখন এসে কেঁদে পড়া, টাকা ধার চাওয়া, সুচরিতার জীবনে নাক গলানো এগুলো সুপর্ণার অভ্যাস হয়ে গেছে। সন্তানকে শাসন করা যায়, গায়ে হাতও তোলা যায়। কিন্তু একটা বয়সের পরে কেউ কথা শুনবে কি শুনবে না সেটা পুরোটাই তার মানসিকতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু সব জেনেশুনে চুপচাপ বসে থাকাটাও বোকামি। গায়ে হাত তুলে শাসন করা না-ই বা গেল কিন্তু শাসনের ভঙ্গিতে হাত তো তোলাই যেতে পারে, শরীরে না ঠেকালেই হল।

সুচরিতাও মনে মনে দৃঢ় হল, এভাবে আর সুপর্ণার অন্যায়গুলোতে সায় দেওয়া যায় না। বিকেলে সুপর্ণার বাড়ির রাস্তা ধরল। শেখরের ফিরতে রাত হবে, অতএব অর্কই মা-কে অটোতে উঠিয়ে দিল। গলির মুখটাতে অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল সুচরিতা। সুপর্ণাকে অগ্রিম কিছু জানায়নি ফোন করে যা এতদিন করে এসেছে ও। ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল বাজায় সুচরিতা। অল্প অপেক্ষার পরই দরজা খুলে দাঁড়ায় সুপর্ণা। দিদিকে হঠাৎ সামনে দেখে সুপর্ণার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, ‘দিদি তুই?’

সুচরিতার পেছনে আরও কেউ আছে কিনা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে সুপর্ণা শুকনো গলায় আবার জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি তুই? একটা ফোন করিসনি কেন?’

‘ভাবলাম তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব, তাই চলে এলাম। ভিতরে আসতে বলবি না… নাকি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব?’

সুপর্ণাকে পাশ কাটিয়েই সুচরিতা বসার ঘরে পা দেয়। সোফাতে সুপর্ণার কোনও সহকর্মী বসে আছে দেখে সুচরিতা থমকায়। ঘরে চোখ বুলোতেই চোখে পড়ে কার্পেটের উপর কাগজ পেতে হোটেল থেকে আনানো খাবার রাখা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্লেটে খাবার নিয়ে গুছিয়ে সুপর্ণাকে কোনওদিন খেতে দেখেনি সুচরিতা। এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে সুপর্ণার। সুচরিতার চোখ পড়ে সোফায় বসা ভদ্রলোকের হাতেও হোটেলেরই খাবারের একটা বাক্স ধরা। চামচে করে সরাসরি বাক্স থেকেই খাওয়া হচ্ছিল সেটা বুঝতে ভুল হয় না। একটু লজ্জা অনুভব করে। সুপর্ণা নিজে এভাবে খায় ঠিক আছে তাই বলে অতিথির বেলাতেও একই নিয়ম?

সোফায় এসে বসে সুচরিতা। ওর মনে হয়, ভদ্রলোক যেন ওকে দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছেন। ব্যবহারটা কেমন যেন অসহজ মনে হয়।

সুপর্ণা ঘরে এসে বসতেই সুচরিতা চোখ ফেরায় ওর দিকে, ‘নিজেরই তো বোনের বাড়ি… শুধু শুধু ফোন করতে ইচ্ছে করল না। বসে বসে হঠাৎ মনে হল অনেকদিন ফোনে তোর সঙ্গে কথা হয়নি, তোকে দেখিনি। ব্যস চলে এলাম অটো ধরে। তুই কেমন আছিস? তোর কোথাও বেরোনোর নেই তো এখন?’

সুচরিতার মনে হয় সুপর্ণাকে একটু শুকনো লাগছে দেখতে। পাশের ভদ্রলোকটিও কেন জানি না উশখুশ করতে থাকেন। দু’জনকে দেখেই সুচরিতার মনে হয় যেন ওদের জীবনে একটা সাংঘাতিক অঘটন ঘটে গেছে।

‘কী হয়েছে, তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

সুচরিতা জিজ্ঞেস না করে পারে না।

‘হ্যাঁ, মাঝে একটু শরীরটা খারাপ হয়েছিল। দিদি, ইনি ব্যাংকে আমার সহকর্মী। নাম সৃজিত। আমার শরীর খারাপের খবর শুনে আমাকে দেখতে এসেছেন।’

সুচরিতা স্পষ্ট বুঝতে পারে সুপর্ণা মিথ্যা কথা বলছে। ওর নিজের করা প্রশ্নটাই সুপর্ণার মুখে উত্তর জুগিয়েছে এটা কাউকে এসে বলে দেওয়ার দরকার নেই। সুচরিতা শরীর খারাপের প্রশ্নটা না তুললে হয়তো সুপর্ণার ঠোঁটে সদুত্তর কিছু জুটত না।

ছোটো থেকে সুপর্ণাকে দেখছে তাই ওকে বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না সুচরিতার। প্রত্যেকটা গতিবিধি ওর চেনা। অনেকটা বয়সের পার্থক্য দুই বোনের মধ্যে। সুচরিতার জন্মের পর দশ বছর পর্যন্ত ওর মা-বাবা দ্বিতীয় সন্তানের কথা চিন্তাতেও আনেননি। সুচরিতার নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে এবং ওর বারো মাস অসুস্থ থাকার কারণে বাড়ির বড়োরা ওদের পরামর্শ দেন দ্বিতীয় সন্তানের জন্য। কারণ বাড়িতে আর সকলেরই দুটি করে সন্তান ছিল। সুচরিতা একা হওয়ার কারণে খেলার কোনও সঙ্গী ছিল না ফলে ও ধীরে ধীরে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠছিল। সুচরিতার এই সমস্যার একমাত্র সমাধানের রাস্তা ছিল বাড়িতে ভাই কিংবা একটা বোন হওয়া।

ভাই, বোন হওয়ার আগে থেকেই সুচরিতার মা-বাবা ওকে বোঝাতে শুরু করেন বাড়িতে নতুন অতিথি এলে সুচরিতার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সত্যি সত্যিই সুপর্ণার জন্মের পর সুচরিতার শৈশব হারিয়ে গেল সুপর্ণার প্রতি কর্তব্য পালনে। সকলে এসে একটাই কথা সুচরিতাকে বলে গেল, ‘তুই বড়ো দিদি, দশ বছরের বড়ো। তোকে বোনের দায়িত্ব নিতে হবে বই-কি।’ ব্যস সুচরিতাও, বোনের কীসে ভালো, তাতেই নিজেকে সমর্পণ করে দিল। দশ বছরের মেয়েটার ঘাড়ে সুপর্ণা নামের দায়িত্ব বেশ শিকড় গেড়ে বসল।

‘সুচি, তুমি ওর মা নও… তোমারা তো একই মায়ের পেটের বোন, তাহলে তুমি এত কেন চিন্তা করো ওকে নিয়ে?’ কতবার শেখর সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু সুচরিতার অবচেতনে গভীরভাবে ওর মা-বাবা এটাই রোপণ করে দিয়েছিলেন যে সুচরিতার প্রয়োজনেই সুপর্ণাকে সংসারে নিয়ে আসা হয়েছে। ছোটোবেলার কোনও কথা সুচরিতা ভোলেনি। একসঙ্গে যখন খেতে বসত, তখন হঠাৎ যদি সুপর্ণা বিছানা ভিজিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ত অথবা খিদের জ্বালায় কান্নাকাটি জুড়ে দিত, খাবার ফেলে রেখে সুচরিতাকেই দৌড়োতে হতো। এখন সুচরিতার মাঝেমধ্যেই মনে হয় ওই কাজগুলো সত্যিই কি ওর করার কথা ছিল? ওগুলো তো মা-বাবার দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল। বোনকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তারা সুচরিতার কাছে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন? সুচরিতার জীবনে যে সঙ্গীর অভাব ছিল সেটার অভাব পূরণ করে তারা কি সুচরিতার উপকার করতে চেয়েছিলেন? এই ভার আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সুচরিতা বয়ে চলেছে। এখন বড়ো ক্লান্ত বোধ করে সুচরিতা। মা-বাবার প্রতি এই কর্তব্যের থেকে কবে মুক্তি পাবে সুচরিতা? সুপর্ণার ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ে বর্তমানে ফিরে আসে সুচরিতা–

‘এই দিদি, কী ভাবছিস তুই? কোনও কথা বলছিস না কেন?’

সোফায় পড়ে থাকা প্যাকেটগুলোর উপর চোখ চলে যায় সুচরিতার। শহরের নামি কয়েকটা দোকানের নাম লেখা প্যাকেটগুলোয়। অর্ক সত্যি কথাই বলেছিল, বুঝতে পারে সুচরিতা। শরীর খারাপটা বাহানা মাত্র, আসলে সুপর্ণা ঘোরা-বেড়ানো, মার্কেটিং নিয়েই ব্যস্ত ছিল। দিদির একটা খোঁজ নেওয়া দরকার, সেটা ওর মনেও আসেনি।

সুচরিতা লক্ষ্য করে দুটো, তিনটে পোশাক ইতিউতি চেয়ারের উপর পড়ে রয়েছে। দেখে তো নতুনই মনে হচ্ছে। হয়তো সুপর্ণা পরে পরে দেখছিল আর নয়তো পরে দেখাচ্ছিল!

হঠাৎই সুচরিতার মনে হয়, তাহলে কি বসে থাকা পুরুষটির সঙ্গে সুপর্ণার কোনও গভীর সম্পর্ক রয়েছে নয়তো কোনও বাইরের পুরুষের উপস্থিতিতে সুপর্ণা পোশাক বদলাবার মতো নির্লজ্জ আচরণ করে কী করে?

‘তোর কি জ্বর হয়েছিল? ক্লাইমেট বদলাচ্ছে… চারদিকে ভাইরাল চলছে, একটু সাবধানে থাকতে পারিস তো’, এই বলে সুচরিতা চেয়ার থেকে জামাকাপড়গুলো উঠিয়ে একটা জায়গায় জড়ো করে। ঠিক সেই মুহূর্তে সোফায় বসা ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘আচ্ছা সুপর্ণা আমি এখন বেরোচ্ছি।’

‘আপনি উঠছেন কেন, বসুন না… খাবারটা তো এখনও শেষ হল না। সুপর্ণা, তুইও এসে এখানে একটু বস না,’ সুচরিতার গলার স্বরে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে ওরা দু’জনেই চমকে সুচরিতার দিকে তাকায়।

ভদ্রলোক কোনও কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়ান। সুপর্ণাকে দেখেও একটু আনমনা মনে হয় সুচরিতার।

‘অসুস্থ ছিলি যদি তাহলে হোটেলের খাবারগুলো খাচ্ছিস কেন?’ না চাইতেও সুচরিতার চোখ চলে যায় পড়ে থাকা খাবারের কৌটোতে। তেলের মধ্যে মাংসের টুকরোগুলো ভাসছে, একটা কোনও সবজি আর রুমালি রুটি পড়ে রয়েছে। ‘তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল, তাই আর আসার আগে তোকে ফোন করিনি। আমার কিছু টাকার দরকার… অর্কর একটা কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য। তোর কাছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো পাই।’

মুহূর্তেই সুপর্ণার মুখের চেহারা বদলে যায়, বিবর্ণ রং ধারণ করে। কারণটা সুচরিতা জানে তাই আবার জানার চেষ্টা করে না। সুপর্ণাকে টাকা দিয়ে এই প্রথম টাকা ফেরত চাইল সুচরিতা। সুপর্ণাও টাকা নিয়ে কোনওদিন ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সুচরিতা খুব খুঁটিয়ে সুপর্ণার চোখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে কারণ ও বুঝতে পেরেছিল এখানে এসে সুপর্ণার সন্ধেটা মাটি করে দিয়েছে।

আপশোশ হয় সুচরিতার। একই মা-বাবার সন্তান হয়েও দুই বোনের চরিত্র কতখানি আলাদা। একই বাড়ির পরিবেশ কীভাবে দুজনের রক্তে আলাদা প্রভাব ফেলল?

‘আমার কাছে টাকা কোথায়?’ সুপর্ণা অস্ফুটে বলে।

‘কেন? একলা ফ্ল্যাটে থাকিস। তোর স্বামী আর ছেলে দুজনেই অন্য শহরে রয়েছে। তোর পুরো খরচা ভাস্কর পাঠায়। তোর নিজের মাইনের পুরোটা যায় কোথায়? নিজের জন্য একটা পয়সাও তো খরচ করিস না।’

সুপর্ণা অবাক হয়ে যায় দিদির কথা শুনে। সবসময় ওর হয়েই সুচরিতা মুখ খুলেছে তাহলে আজ হঠাৎ দিদি বিপক্ষে কী করে চলে গেল। অথচ সুচরিতা সবসময়েই চেয়েছে সুপর্ণা বিপথে না যাক। প্রতিদিন ভেবেছে, সুপর্ণা এবার নিজেকে বদলাবে। ওর স্বামী, ছেলে সকলেই ওর আচরণে বিরক্ত। সুচরিতারও বাড়ির কেউ সুপর্ণাকে পছন্দ করে না। একমাত্র ওই ঢাল হয়ে সুপর্ণাকে আগলেছে। সেই ঢাল-ই আজ তির হয়ে সুপর্ণাকে আঘাত করতে উদ্যত।

‘একটু একটু করে সংসার থেকে বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছি… অর্কর ভর্তির জন্য অনেকগুলো টাকা লাগবে এটা তো তুই জানতিস। আমাকে সাহায্য করতে হবে না কিন্তু আমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দে। আমার তাতেই কাজ মিটে যাবে,’ উঠে দাঁড়ায় সুচরিতা।

সুপর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছিল কাটলেও এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়বে না। মরা মানুষের মতো ফ্যাকাসে চেহারা হয়েছে ওর। ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সুচরিতা এতটা মুখরা হয়ে উঠতে পারে, এতটা নির্দয় ভাবে সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলতে পারে। সুপর্ণার স্ন্দুর সন্ধের শেষটার যে এমন পরিণাম হতে পারে, সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।

‘দ্যাখ না দিদি, ভাস্কর কিছুই বুঝতে চায় না…’

ভাস্করকে খুব ভালো করেই জানে সুচরিতা। সুপর্ণা বরাবরই স্বামীকে ডমিনেট করে এসেছে। নিজের ইচ্ছে ওর উপর চাপাতে চাপাতে ভাস্করের জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। ছেলেটাকেও কোনওদিন আদর করে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। বাড়ির বাইরেই সময় কাটিয়েছে বেশি। তাই চাকরির বদলি হওয়াতে ভাস্কর যে খুশিই হয়েছিল সেটা সুচরিতার অজানা নয়। চাকরির দোহাই দিয়ে সুপর্ণা ওদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করে। আর এই সুপর্ণাকে এতদিন, এতবছর ধরে সুচরিতা সকলের চোখের আড়ালে স্নেহ মমতা দিয়ে সিঞ্চন করে এসেছে। আজ আপশোশ হয় সুচরিতার।

দম আটকে আসতে থাকে ওর, সুপর্ণার ফ্ল্যাটের ভিতরে। একটা নেগেটিভ এনার্জি সুচরিতাকে সদর দরজার দিকে ধাক্বা মারতে থাকে। নিজের বোনের প্রতি এই ধরনের মনোভাব কোনওদিন সুচরিতা আগে ফিল করেনি। নিজেই ও সবথেকে বেশি দোষী। ঘৃণা হতে থাকে নিজের উপরেই সুচরিতার।

‘দিদি আর একটু বস না।’

‘না সুপর্ণা… আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর সঙ্গে আমার এইটুকুই কাজ ছিল’, বলে সুপর্ণার হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে সুচরিতা বাইরে বেরিয়ে আসে। বাধভাঙা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে সুচরিতার দুই গাল বেয়ে। কী যেন আশায় একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে, ফেলে আসা বাড়িটার দিকে। ওকে পেছন থেকে ডাকার মতো একটা মানুষের মুখও চোখে পড়ে না। গভীর শ্বাস নেয় সুচরিতা। এই তো বেশ ভালো হল। টাকা ফেরত পাবার আশা কম তবে ‘দিদি কিছু টাকা দে’ বলে হাত বাড়ানো সুপর্ণাকে আর দেখতে হবে না। হঠাৎই সুচরিতা বুঝতে পারে ঘাড়ের ভারী বোঝাটা কখন যেন হালকা হয়ে গেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অটো ধরতে এগিয়ে যায় সুচরিতা।

আই অ্যাম নট ভার্জিন

মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই শ্রীতমা ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে। প্রায় মরার মতো ঘুমোচ্ছিল। কাল অনেকটা ধকল গিয়েছে। অ্যালার্ম না দিলে হয়তো উঠতেই পারত না। কাল রাত্রে পার্টি করতে অত দূর যাওয়া উচিত হয়নি। ফিরতে ফিরতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিল। আজ সকালে অডিশন আছে। মোনালিসাটা ছাড়ল না, জোর করে নিয়ে গেল। ওর বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি, যেতেই হবে। লং ড্রাইভে যাবে কোলাঘাট, ওখানে শের-এ-পাঞ্জাব-এ খানাপিনা, পার্টি হবে।

মোনালিসা, শ্রীতমা স্কুল-জীবন থেকে বন্ধু। এক সঙ্গে কলেজেও পড়েছে। মোনালিসা ব্যাংকে চাকরি করে, এখন কলকাতায় পোস্টিং। খাওয়াদাওয়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ না থাকলেও, লং ড্রাইভে যাওয়ার লোভটা ছাড়তে পারল না শ্রীতমা। এটা ওর খুব পছন্দের। কখনও কখনও কার বুক করে একলাই বেরিয়ে পড়ে লং ড্রাইভে। মাঝে মাঝে শ্রীতমা স্বপ্ন দেখে লং ড্রাইভে এক অনন্ত যাত্রায় চলেছে সে। কখনও গন্তব্যে পৌঁছোতে পারে কখনও বা পৌঁছানোর আগেই ঘুম ভেঙে যায়।

লং ড্রাইভ শেষে বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র কিনারে সে একা। ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় থাকে অন্য কারও। যাকে সে চেনে না, জানে না, দেখেনি কখনও। আলস্য ঝেড়ে উঠতে উঠতে কাল রাত্রির পার্টির মজাগুলো মনে পড়ে খুশির রেখা দেখা দেয় শ্রীতমার মুখে।

মোনালিসার বয়ফ্রেন্ড ঈশান ইঞ্জিনিয়র, আইআইএম থেকে এমবিএ করেছে। মাইক্রোসফট-এ বড়ো পোস্টে চাকরি করে। স্মার্ট, হাসিখুশি ছেলে। কাল মজা করে বলছিল, আগে দেখা হলে সে শ্রীতমাকেই প্রোপোজ করত। ঈশানের কথা শুনে মোনালিসা একপ্রস্থ পিটিয়ে নেয় তাকে।

পার্টিতে ঈশানের বন্ধু সূর্য ছিল সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়রিং আর এমবিএ ঈশানের সঙ্গে করেছে, এখন সিঙ্গাপুরে বড়ো মাইনের চাকরি করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। বন্ধুর বার্থডে পার্টি তো মিস করা যায় না কোনও ভাবেই! চারজনে মিলে বেশ এনজয় করেছে কাল। পার্টি শেষে ফেরবার পথে সূর্য‌ শ্রীতমাকে প্রোপোজ করে। মোনালিসা উস্কায়, হ্যাঁ করে দে।

শ্রীতমা হেসে উড়িয়ে দেয়, এটা লালজল পানের আফটার এফেক্ট। দেখবে সকাল হলেই ঘোর কেটে যাবে।

সূর্য‌ শ্রীতমার হাতে হাত রেখে বলে, নো বেবি, ইটস রিয়েল।

বাঁকা হেসে শ্রীতমা হাতের উপর থেকে  সূর্য‌র  হাত নামিয়ে দেয়। বিভিন্ন পার্টিতে এমন ঘটনা অনেক বার ফেস করেছে সে, এমন কথা অনেকবার শুনেছে। পরের দিন তারাও ভুলে যায়, শ্রীতমাও আর মনে করার চেষ্টা করে না।

কাল রাত্রে সকলের সঙ্গে সেও অল্প ড্রিংক করেছিল। তবুও ঘুম ভেঙে সকালে সূর্য‌র মুখটা, সূর্য‌র কথাগুলো কেন যে মনে পড়ে গেল! গত রাত্রির স্মৃতি ঠেলে সরিয়ে রেখে বেড থেকে নেমে আসে শ্রীতমা।

বাথরুম থেকে একেবারে স্নান সেরে বেরোয় সে। সকাল নটা থেকে অডিশন। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে ইন্ডাকশন অ্যাভেনে চাপায় গরম করার জন্য। বেডরুমে এসে ওয়ার্ডরব থেকে নতুন কেনা ওয়েস্টার্ন ড্রেসটা বের করে পরে, হালকা প্রসাধন করে।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে দেখে নেয় নিজেকে। পাঁচ পাঁচ হাইটে, চৌত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ ফিগারটা বেশ মোহময়ী লাগছে এই নতুন ওয়েস্টার্ন ড্রেসটায়। শরীরে চেপে বসা ড্রেসটা স্পষ্ট করে রেখেছে শরীরের বিভিন্ন কার্ভ। চনমনে সেক্সি-সেক্সি ফিল হচ্ছে ভিতর থেকে।

কিচেনে গিয়ে গরম দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেয়ে বেরোনের জন্য রেডি হয় শ্রীতমা। ড্রেসের সঙ্গে মানানসই সিলভার কালারের পেনসিল হিল শু-টা টেনে নিয়ে সোফায় বসে পা গলিয়ে উঠে এসে আরও একবার নিজেকে দেখে নেয় ড্রেসিং টেবিলে। এখন সে আরও দীর্ঘাঙ্গী, পাঁচ ফুট পাঁচ নয়।

পোশাকের সঙ্গে মানানসই আগে থেকে বের করে রাখা হাত ব্যাগটা তুলে নেয়। চেন খুলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সারফেস স্যানিটাইজার স্প্রে ব্যাগে ঢোকায়। নিজে পরে নেয় ডিজাইনার মাস্ক। মোবাইল অ্যাপে ক্যাব বুক করে ফ্ল্যাটের দরজা লক করে, নীচে নামার জন্য লিফ্ট-এ চড়ে শ্রীতমা।

নাকতলায় গলির মধ্যে পাঁচতলা বিল্ডিংটার, তিনতলার ওয়ান বিএইচকে এই ফ্ল্যাটে শ্রীতমা আছে বছর দেড়েক হবে। যখন প্রথম ছবির কাজ শুরু হল, তখন থেকে। ফ্ল্যাটের সামনের সরু রাস্তায় ক্যাব ঢোকে না, সেজন্য ভাড়াটা একটু কম। কাছেই বড়ো রাস্তা, অসুবিধা হয় না । এগিয়ে এসে বড়ো রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, এই যা।

প্রথম ছবিতে সে লিড রোল করেছিল। ছবিটা ভালো বিজনেস করেছিল। তার অভিনয়ে প্রশংসাও হয়েছিল। এর পর পরই দ্বিতীয় ছবিটার অফার পেল। ভালো রেমুনারেশনে কন্ট্যাক্ট হয়েছে। প্যান্ডেমিকের জন্য এখন শুটিং বন্ধ আছে, অসুবিধাটা সেখানেই। ফ্ল্যাটের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, নিজের খাওয়াদাওয়া ও অন্য সব খরচা তো আর বন্ধ নেই। সেজন্য অন্য কাজের ব্যাপারে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

সকাল সকাল একগাদা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকেছে। লিফটে নামতে নামতে মেসেজগুলো দেখে নেয় শ্রীতমা। এতক্ষণ দেখার সময় পায়নি। চেনাজানা লোকজনের গুড মর্নিং মেসেজে ভরা। অচেনা একটা নাম্বার থেকেও মেসেজ এসেছে, সঙ্গে রেড হার্ট লাভ সিম্বল। শ্রীতমা হাসে, কোন পাগলের কাজ কে জানে!

লিফট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বড়ো রাস্তার দিকে এগোয়। অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভারের ফোন ঢুকছে। শ্রীতমা ফোন ধরে বলে, মেন রোডে কালী মন্দিরের সামনে থাকছি। কতক্ষণে আসছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। শ্রীতমা আবার মোবাইলটায় চোখ রাখে। ভাবতে থাকে, অচেনা নাম্বার থেকে কে মেসেজ পাঠাল।

বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াতে লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে শ্রীতমাকে। ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নেয়। ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াতে দরজা খুলে সারফেস স্যানিটাইজার ক্যাবের ভিতরে স্প্রে করে উঠে বসে। শ্রীতমাকে স্প্রে করতে দেখে ড্রাইভার বলে, ম্যাম, আমি এখনই গাড়ি বের করেছি। ভালো করে স্যানিটাইজ করে এনেছি। ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরও তো প্রাণের মায়া আছে! সারাদিনে কত রকমের প্যাসেঞ্জার চড়ছে।

শ্রীতমা হুম বলে চুপ করে যায়। ব্যাগ পাশে রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসে। অডিশনের জন্য কনসেন্ট্রেট করার চেষ্টা করে। একটু এগোতে না এগোতে ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে। রিচা ফোন করছে। ওর প্রথম ফিলম লাভ মি-তে সেকেন্ড লিড ছিল রিচা।

গুড মর্নিং। কী করছিস বল।

আর কী! বসে আছি। তোর খবর বল।

আমিও বসেই ছিলাম। এই ক’দিন হল একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করছি। লিড রোল। ভালো পেমেন্ট করছে। একটু আধটু বোল্ড সিন আছে, এই যা। এমনিতে ইউনিটটা ভালো, সব লোকজনও বেশ ভালো। একটু থেমে রিচা বলে, তুই ওয়েব সিরিজ করবি?

এখনও ভাবিনি। ফিলমের শুট শিগগিরি শুরু হবে বলছে। দেখি, ফিলমের শুট শুরু হয়ে গেলে তো আর হবে না। না হলে হয়তো…

বলিস। বড়ো প্ল্যাটফর্মে এদের একটা নতুন প্রোজেক্ট আসছে। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।

শ্রীতমা মিষ্টি করে বলে, থ্যাংকস।

রিচার ফোনে অন্য একটা ফোন ঢুকছে। একটা ইম্পট্যান্ট ফোন আসছেরে। পরে ফোন করছি, বলে রিচা ফোন কাটে।

শ্রীতমা সময় দেখে। এখনও মিনিট চল্লিশ হাতে আছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে নিউটাউন। আজ ওখানেই অডিশন। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে শ্রীতমা।

শুরুর দিন থেকে ফিলম কেরিয়ারের আজ পর্যন্ত জার্নিটা ভেসে ওঠে শ্রীতমার মনে। পরিস্থিতির চাপে সে যে এক অনিশ্চিত পথে চলতে শুরু করেছিল বছর কয়েক আগে, তা কি আর এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে!

শ্রীতমা সবে মাত্র গ্র‌্যাজুয়েন শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে, সে সময় বাবা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন। আগে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি। ছোটো ভাইটা এইচএস পড়ছে। বাবা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী ছিলেন। একটা নিজস্ব বাড়ি বানিয়ে রেখে গিয়েছেন, এইটাই ভরসার। মাথার উপর একটা ছাদ আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সামান্য পেনশন পান। জমানো টাকা বলতে তেমন কিছু নেই। সে টাকায় সংসার চালিয়ে দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা চালানো খুবই কঠিন। তখন থেকেই কোনও ভাবে ইনকাম করার চিন্তাটা শ্রীতমার মাথায় চেপে বসে।

পাঁচ ফুট পাঁচ-এর দীঘল শরীর, সুন্দর মুখশ্রী আর নজর কাড়া ফিগারের জন্য রাস্তায়, এলাকার ছেলেদের চোখ সব সময় তার উপর পড়ে থাকত। বান্ধবীরাও তার রূপের প্রশংসা করত। সে নাকি বাংলা ফিলম ইন্ডাস্ট্রির নায়িকার আকাল মেটাতে সক্ষম। ছোটোবেলা থেকে শ্রীতমা নাচ শিখেছে আর বড়ো হয়ে কলেজে পড়ার সময় থেকে দুর্গাপুরের নামি নাটকের গ্রুপে নিয়মিত অভিনয় করছে। কলকাতাতেও বেশ কয়েকটা শো করে গিয়েছে। তাই শ্রীতমার মনেও আশা জাগে, হয়তো সত্যিই সে পারবে!

তখন মাস্টার্স-এর ফার্স্ট ইয়ার। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে নিজের ফটো আর রেজিউমে মেল করে পাঠায় শ্রীতমা। কলকাতার একটা নামি শপিং মলের হোর্ডিং-এর জন্য মডেল চেয়ে বিজ্ঞাপন ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে অ্যাড এজেন্সি থেকে রিপ্লাই পেল, সে শর্ট লিস্টেড হয়েছে। ফাইনাল সিলেকশনের জন্য কলকাতায় এসে অডিশন দিতে হবে। সিলেক্ট হয়েছিল। সেই শুরু।

অ্যাড এজেন্সির মালিক সার্থকদার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। সার্থকদার রেফারেন্সে প্রায় প্রতি মাসে একটা দুটো মডেল শুট-এর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে যেত। পেমেন্টও খারাপ নয়। আসা যাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে আট-দশ হাজার টাকা। সংসারের, নিজের আর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ অনেকটাই মিটে যেত সে টাকায়। এমন করেই দুই আড়াই বছর চলে গেল। মাস্টার্সের ফাইনালের আগে মাস কয়েক ব্রেক দিয়েছিল, পরীক্ষাটা ঠিকমতো দেওয়ার জন্য।

মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরনোর আগেই একদিন সার্থকদার ফোন, এবার পাকাপাকি ভাবে কলকাতাতে চলে এসো।

শ্রীতমা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, কেন, কী হল আবার?

কেন আবার কি! তুমি ফিলমের হিরোইন হচ্ছো। আমাদের হাউস থেকে একটা ফিলম প্রোডিউস করছি। আর সেটাতে তোমাকে ছাড়া আর কাকে নিই বলো? তোমার অপোজিটে টলিউডের হট হিরো কাজ করবে। নামটা বলছি না। ওটা এখন সারপ্রাইজ হিসাবেই থাক।

শ্রীতমা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সামনে থাকলে হয়তো সার্থককে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিত। ফোনেই থ্যাংক ইউ সো মাচ বলে একটা চুমু ছুড়ে দেয়।

সে এবার টলিউডের নায়িকা হবে। যে টলিউডে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, সন্ধ্যা রায়, মহুয়া রায় চৌধুরী, ঋতুপর্ণা, শতাব্দী, ইন্দ্রাণী, এই সময়ে মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তী, শুভশ্রী কাজ করছে, সেই টলিউডে তার নামটাও নায়িকা হিসাবে যুক্ত হয়ে যাবে। উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রীতমা ঘরময় নেচে বেড়ায়। সার্থকদার কাছে সে চিরঋণী হয়ে গেল।

সত্যিই এখন আর দুর্গাপুর থেকে যাওয়া আসা করে কাজ করা যাবে না। মডেলিং শুট-এর সময় এক দুদিনের কাজ থাকত। কোনও ভাবে ম্যানেজ হয়ে যেত। সিনেমা, সিরিয়ালে তো তা সম্ভব নয়। কখন কল টাইম দেবে কে জানে। কলকাতায় সেটেল করার কথা শুনেই মা ঝামেলা করতে শুরু করেছে, এবার একেবারে গোল্লায় যাবে, বিয়ে টিয়ে আর হবে না।

শ্রীতমাও থামে না, না হোক বিয়ে তাই বলে তো সে তার কেরিয়ার নষ্ট করবে না। এমন সুযোগ কজন পায়?

চেনাজানা ব্রোকারের মাধ্যমে সার্থক-ই ফ্ল্যাটটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আর অ্যাডভান্স রেন্ট পেমেন্টটাও। ডেবিউ ফিলম হলেও ভালোই পেমেন্ট করেছিল সার্থকদা। হয়তো তাকে বিশেষ পছন্দ করত বলেই।

ফিলমের অফারটা পেয়ে যেন স্বপ্নের দুনিয়াটা শ্রীতমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বেশ কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে দিয়ে কাটল। মহরত থেকে শুরু করে শুটিং এর প্রতিটা দিন, বিদেশে গানের শুটিং, প্রিমিয়ার শো, প্রেস মিট অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে দিল শ্রীতমাকে। বাস্তব যেন পিছনে ফেলে আসা অতীত। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন গ্ল্যামারের জগত্টাই এখন আসল শ্রীতমার কাছে।

প্রথম ছবির ঘোরটা কাটতে না কাটতে দ্বিতীয় ছবির অফারটা পেয়ে গেল প্রভাসদার রেফারেন্সে। প্রথম ছবির ডিওপি প্রভাসদার সঙ্গে শ্রীতমার সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল মরিশাসে।  গানের শুট করতে গিয়ে সার্থকদার অনুপস্থিতে তখন প্রভাসদাই শ্রীতমার ফ্রেন্ড, ফিলজফার, গাইড।

কীভাবে লাইট নিলে, কেমন লুক দিলে ফিলমে তাকে আরও সুন্দর দেখাবে, আলাদা করে সে সব টিপ্স দিত প্রভাসদা। আর নিজের হাতে ক্যামেরার কারসাজি তো করতই। ভবিষ্যতে কীভাবে ক্যারেক্টার বুঝে ফিলম সাইন করবে, সে সব অ্যাডভাইস দিত। এত কিছুর পর কিছু প্রত্যাশা তো থেকেই যায়! ইউনিটের লোকের মুখে রং মাখানো গসিপ হয়তো সার্থকের কানেও পৌঁছেছিল।

প্রভাসদার রেফারেন্সে অন্য হাউসের ফিলমে কাজ শুরু করার পর থেকে সার্থকদা শ্রীতমার ফোন ধরাই বন্ধ করে দিল। শ্রীতমা অফিসে দেখা করতে গেলেও দেখা করেনি। মিটিং-এ বিজি আছে বলে অ্যাভয়েড করেছে। রিসেপসনিস্টকে দিয়ে সে রকমই বলেছিল। এসব হওয়ার পর থেকে শ্রীতমার মনটাও কয়েকদিন বেশ খারাপ ছিল। নতুন লোকজনের সঙ্গে নতুন কাজ শুরু করার পর থেকে মনটাও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

শ্রীতমা শিখে গিয়েছে ফিলম ইন্ডাস্ট্রিতে সম্পর্ক ভাঙা-গড়ায় মনখারাপ করতে নেই। কিন্তু হঠাৎ করে শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সব দিক থেকে মুশকিল হয়ে গিয়েছে। সবে মাত্র একটা ফিলম রিলিজ করেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে সে রকম চেনাজানা পরিচিতি হয়ে ওঠেনি এখনও, যে ডেকে ডেকে কাজ দেবে। এখনও ফ্রেশ ফেস বা স্ট্রাগলিং অ্যাক্ট্রেস বলা যায়।

জমানো টাকা খরচ করতে করতে প্রায় শেষ। শুধু তো নিজের খরচা নয়, বাড়ির জন্যও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। ভাইটা কলেজে পড়ছে তার পড়াশুনার খরচও আছে। ফিলমের শুটিং শুরু হয়নি। এখন শুধু মডেল শুট, ওয়েব সিরিজ আর সিরিয়ালের শুটিং হচ্ছে। তাও অনেক বাধা নিষেধ মেনে।

শ্রীতমার পরিচিত ইন্ডাস্ট্রির মেয়েরা, যারা বিভিন্ন ছোটোখাটো প্রোজেক্টে কাজ করত, অ্যালবাম, শর্ট ফিলম-এ অ্যাক্টিং করত, তাদের অনেকেই আজকাল ওয়েব সিরিজের কাজ করছে শুনেছে। ভালো পেমেন্ট কিন্তু ওয়েব সিরিজগুলোর সবই প্রায় অ্যাডাল্ট কন্টেন্টে ভরপুর।

হাজার লোকের সামনে নিজের নগ্ন শরীর দেখিয়ে উপার্জনে তার ঘোর আপত্তি। আর বাড়ির লোকজন সে এমন কিছু করছে জানতে পারলে একেবারে অনর্থ হয়ে যাবে! এমনিতেই দুর্গাপুর ছেড়ে যখন থেকে কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে, তখন থেকেই বাড়ির সঙ্গে ঝামেলা। শ্রীতমা বোঝাতে পারে না ফিলমের কাজ আসা-যাওয়া করে হয় না, কলকাতায় একটা থাকার জায়গার দরকার।

এই সময় কিছু অ্যাডের কাজ বা মডেল শুট-এর কাজ পেলে ভালো হতো। কিন্তু সার্থকদার সঙ্গে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অ্যাড বা মডেলিং-এর কাজ সে তেমন আর পায়নি। সব জায়গাতেই তো সেটিং আর কমপ্রোমাইজের গল্প। ফিলমে লিড রোল করার পর একদম ছোটোখাটো অ্যাডে কাজ করাটা ঠিক হবে না। তার স্ট্যাটাসে সেটা মানাবে না। বড়ো কোনও ব্র‌্যান্ডের অ্যাড হলে ঠিক আছে। কিন্তু সেরকম যোগাযোগ এখনও হয়নি।

প্রভাসদা বলেছে এমএনসি কোম্পানির একটা নামি ব্র‌্যান্ডের অ্যাড করার কথা চলছে। সেটা হলে শ্রীতমাকে সেখানে প্লেস করবে। বিগ বাজেট, ভালো পেমেন্ট পাবে। সেও কবে হবে কে জানে! কিছু তো একটা করতে হবে। না হলে চলবে কী করে। আজকের অডিশনের খবরটা পেয়েছে পরিচিত এক প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদার কাছ থেকে।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় নটা বেজে গেল। তাড়াহুড়ো করে পৌঁছে দেখে বিভিন্ন বয়সের অনেক ছেলে মেয়ের ভিড়। শ’খানেক তো হবেই। বড়ো প্রোডাকশন হাউস, অফিসটাও বড়ো। বিভিন্ন চ্যানেলে এদের অনেকগুলো সিরিয়াল চলছে। বাংলার এক নম্বর পপুলার চ্যানেলে নতুন একটা পিরিয়ড ড্রামা শুরু হচ্ছে তার জন্য অডিশন। অনেকগুলো ফিমেল ক্যারেক্টারের প্রয়োজন। পনেরো-কুড়িটা তো লিড ক্যারেক্টারই আছে। শ্রীতমা নাম রেজিস্টার করিয়ে অপেক্ষা করে।

প্রভাসের ফোন ঢোকে, হ্যালো, কোথায় আছো? কী করছ? মেসেজেরও রিপ্লাই দিলে না!

পরে ফোন করছি, বলে শ্রীতমা ফোন কেটে দেয়। শ্রীতমা জানে এই কেয়ারিং-এর আড়ালে আসলে নজরদারি করছে প্রভাসদা। ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি ওকে। শুনে হয় নানান নেগেটিভ কথা বলত, নয়তো সঙ্গে চলে আসত। কাজের জায়গায় লেজুড় নিয়ে ঘোরা একদমই পছন্দ নয় শ্রীতমার।

এখানে আসা মেয়েদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশিরভাগই শহরতলীর কোনও না কোনও জায়গা থেকে এসেছে। সঙ্গে মা বা অন্য কোনও অভিভাবক। চেহারা পোশাকআশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সকলেই প্রায় মধ্যবিত্ত ঘরেরই মেয়ে, শুরুর দিনের তারই মতো। সে যেমন কিছু ইনকাম করে সংসারে সাহায্য করবে বলে মডেলিং-এর পথ বেয়ে অভিনয় জগতে ঢুকে পড়েছিল। হয়তো এদের অনেকেই সে রকম পরিস্থিতির মধ্যেই বড়ো বড়ো স্বপ্ন সাজিয়ে এসেছে আজকের অডিশনে। আজকের পর এদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো ভবিষ্যৎ জীবন বদলে যাবে। আবার অনেকেরই স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। হয়তো এই অডিশনের গণ্ডি পার হতে মেনে নেবে অনেক কিছু।

যার কাছে শ্রীতমা অডিশনের জন্য নাম লেখাল সে তাকে চিনতে পারেনি। মনে মনে একটু অভিমান-ই হয় তার। তার একটা ফিলম রিলিজ হয়েছে। শহর জুড়ে হোর্ডিং পড়েছিল তবুও…। শ্রীতমা একপাশে সরে এসে বসার জন্য সাজিয়ে রাখা একটা চেয়ার টেনে বসে।

এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছে, ভিতরে ঢুকে অডিশন দিয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রত্যেকের ভিন্ন অভিব্যক্তি চোখ মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। কেউ ঘেমে নেয়ে অস্থির। ঘটনার আকস্মিকতায় কারও মুখে কালো মেঘের ছায়া। কেউ বা ফিরছে দুষ্টু হাসি মেখে শরীরী ভঙ্গিতে হরিণী চপলতা নিয়ে। উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে পোশাকে প্রসাধনে শ্রীতমাই শ্রেষ্ঠ বলা যেতে পারে।

অপেক্ষায় থাকা মেয়েদের অনেকেই ঘুরে ফিরে শ্রীতমাকে দেখছে। ওরা ওর সাজ পোশাক, ওর সৌন্দর্য দেখছে নাকি ওদের মধ্যে কেউ কেউ ওকে রিকগনাইজ করতে পেরেছে লাভ মি ফিলমের নায়িকা হিসাবে। একটু প্রাউড ফিল করে।

শ্রীতমা নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার জন্য মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি শুরু করে। ফেসবুক পেজ ঘুরে ফিরে দেখে অস্থির সময়টুকু কাটানোর জন্য। ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। কেমন যেন সাফোকেটেড লাগছে শ্রীতমার। নিজেকে ভ্যালুলেস, ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো ফিলমের হিরোইন। সিরিয়ালের একটা ক্যারেক্টার পাওয়ার জন্য এভাবে এতক্ষণ বসে থাকতে হবে! ভাবে প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদাকে ফোন করে একটু ঝাড় দেবে, এ কোথায় আসতে বললে? এখানে তো দেখছি গরু ছাগল সব সমান। আলাদা কোনও ট্রিটমেন্টই নেই। আগে জানলে আসতাম না। আবার পরক্ষণেই ভাবে, রাজুদার কি আর দোষ। হেল্পিং মাইন্ড নিয়ে তো খবরটা দিয়েছে।

শ্রীতমা ভাবে এত এত মেয়ের এত কাজের অভাব! এত অর্থের অভাব, তবেই না! হলগুলো খোলা থাকলে সে সিরিয়ালে নাম না লিখিয়ে আবার মঞ্চের নাটকে ফিরে যেত। কিন্তু সমস্যাটা তো সেই অর্থের। অর্থের জন্যই আজ মেয়েগুলো ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের নামে সফট পর্ন করছে। হয়তো পর্দায় যা দেখানো হচ্ছে পর্দার পিছনে করতে হচ্ছে তার থেকেও বেশি।

অনেকটা সময় অভিনয় অভিনয় করে কাটিয়ে দেওয়ার পর এখন আর ফেরবার জায়গা নেই। মনে প্রাণে বাঁধা পড়ে গিয়েছে এখানে। শুধু বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরা। অভিনয়ের জায়গাটা দিন দিন ছোটো হয়ে আসছে। শরীর প্রদর্শনই এখন মুখ্য অভিনয়। সরকারই তো ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এমন সব কনটেন্ট সকলের হাতের মধ্যে পৌঁছে দিতে। পছন্দ মতো অ্যাপ ডাউনলোড করে সাবস্ক্রাইব করো। তারপর মোবাইলে হাত ছোঁয়ালেই কত না ওয়েব সিরিজ, শর্ট ফিলম। গুলে যাও ঘোলা দুনিয়ায়!

বসে বসে উলটোপালটা ভাবতে ভাবতে শ্রীতমা শুনতে পেল তার নাম ডাকছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে সপ্রতিভ ভাবে এগিয়ে রিসেপসনিস্ট-এর সামনে যেতে, সে দেখিয়ে দিল কোন ঘরে যেতে হবে। পারমিশন নিয়ে শ্রীতমা অডিশন রুমে ঢোকে। সুন্দর করে সাজানো অফিসরুমের একটা ওয়ালে লাগানো ডিসপ্লে বোর্ডে এদের হাউসের পপুলার সিরিয়ালগুলোর বিভিন্ন ফোটো লাগানো আছে। ফলস সিলিং-এ লাগানো ডিজাইনার এলইডি লাইটগুলো ঘরের মধ্যে একটা মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এ পরিবেশ যেন সম্মোহিত করার জন্য।

বড়ো এগজিকিউটিভ টেবিলের ও পাশে কাঁচাপাকা চুলের সুদর্শন যে-ভদ্রলোক বসে, উনি দেবাদিত্য বোস। সিরিয়ালের নামি পরিচালক। টেবিলের পাশে বসা অন্য জন হাউসের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার।

শ্রীতমাকে ওরা বসতে বলে। ঘরে ঢোকা থেকে বসা পর্যন্ত ওদের নজর শ্রীতমার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী কী করেছে, এখন কী করছে রুটিন প্রশ্ন করে। নানা রকম হ্যাজানো প্রশ্ন কথাবার্তা শুরু করে। শ্রীতমা ভাবে নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে ওকে, তাই এতটা সময় নিচ্ছে।

মাথা গরম করা প্রশ্নটা হঠাৎ উড়ে আসে।

আর ইউ ভার্জিন?

শ্রীতমা নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের সব রক্ত মাথায় চড়ে ধাক্কা দিচ্ছে। বার্স্ট করে শ্রীতমা…হাউ ডেয়ার ইউ আস্ক মি সাচ রাবিশ?

ওরা থতমতো খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। শ্রীতমার চিৎকার বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে।

শ্রীতমা আরও রেগে টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে, চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়, নো। আই অ্যাম নট দ্যাট। আই অ্যাম নট ভার্জিন।

প্রোডাকশন কন্ট্রোলার কোনও মতে বলে সরি, আপনাকে সিলেক্ট করতে পারলাম না।

ইয়োর সিলেকশন! মাই ফুট। সজোরে দরজা খুলে গট গট করে বেরিয়ে যায় শ্রীতমা। অডিশন রুমের দরজাটা নিস্তব্ধতা ভেঙে সশব্দে বন্ধ হয়। শ্রীতমার সদর্পে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাইরে উপস্থিত সকলে।

বাড়ি ফিরে হাতব্যাগ, জুতো, জামা এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোফায় হতাশ শরীর এলিয়ে দেয় শ্রীতমা। সকালে লাভ মেসেজ করা সেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন কল আসছে। শ্রীতমা ফোন ধরে খিঁচিয়ে ওঠে, কে রে বো…দা সকাল থেকে ডিস্টার্ব করছিস?

সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। আমি সূর্য‌। পরশু সিঙ্গাপুর ফিরে যাচ্ছি। তার আগে কি একবার দেখা করা যায়?

শ্রীতমা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। এর মধ্যে প্রভাসদার ফোন ঢুকছে।

শ্রীতমা রিকল করতে থাকে প্রথম কবে সে ভার্জিনিটি লুজ করেছিল কার সঙ্গে! তারপর… তারপর…

সে কি সূর্য‌কে, প্রভাসদাকে বলে দেবে, আই অ্যাম নট ভার্জিন। তারপরেও কি প্রভাসদা তাকে কাজ খুঁজে দেবে! আগের মতো গাইড করবে? তার পরেও কি সূর্য‌ তাকে বলবে, বেবি আই লাভ ইউ?

শ্রীতমা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। কে জানে অন্য প্রান্তে সূর্য‌ বা প্রভাসদা উত্তরের অপেক্ষায় এখনও লাইনে আছে কিনা!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব