স্বীকারোক্তি

ডা. চ্যাটার্জি বললেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার সবসময় হয় না?

টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও, অর্পণের চোখ মোটেও ডা. চ্যাটার্জির উপর ছিল না। বরং তার দৃষ্টি ছিল ঘরের দেয়াল ঘড়ি, মানুষের ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি, একটা ক্যালেন্ডার বা ওর রিভলভিং-এর একটু উপরে একটা এসির উপর। জায়গাটা চেম্বার আর কর্পোরেট অফিসের এক মিশ্রণ মনে হচ্ছিল।

মুখ ফিরিয়ে এবার বলল, একেবারেই না। হয়তো মনের কোথাও থাকে অনুভূতিটা। কিন্তু তীব্র ভাবে জেগে ওঠে, যখন ও আমার কাছাকাছি থাকে। যেমন ধরুন, খাবার টেবিলে। আমার কাছাকাছি বসে খাচ্ছে বা আমার বাইকে। বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

আর কোথাও? টেবিলের উপর দুটো কনুই তুলে, হাতের উপর কায়দা করে নিজের চিবুক রাখলেন ডা. চ্যাটার্জি। ফরসা মুখ আর হালফ্যাশনের চশমায় মুখে আগ্রহের রেখা।

না, সবচেয়ে বেশি হয়, গলা এক স্কেল নামিয়ে বলল অর্পণ, যখন আমরা বিছানা শেয়ার করি।

তখন কোনও সমস্যা? মানে, প্রসেসটা চলার সময় আপনার কোনও অনুভূতি?

ঘরে কেউ নেই। তাও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ডা. চ্যাটার্জির চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভাসা সুরে বলল, প্রবলেম মানে, ব্যাপারটার মধ্যে যেন একশো শতাংশ থাকতে পারি না। একটা নতুন বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আর সে জন্যেই তো আপনার কাছে…

আসলে, কাউন্সেলিং-এর পরিভাষায় এটাও এক ধরনের ডবল পার্সোনালিটি। এই স্টেজটাকে আমরা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির মধ্যে রাখলেও, আমরা বুঝি নর্মাল আর অ্যাবনর্মাল-এর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব, ডা. চ্যাটার্জির কাউন্সেলিং সত্তা জেগে উঠেছে।

অর্পণের মনে হচ্ছিল, উনি একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন এগোনোর। মন বলছিল, আরও প্রশ্ন ভেসে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তর তো দিতেই হবে। না হলে সমাধান মিলবে কেমন করে।

আসলে, সত্যিটা এটাই। আবার বলতে শুরু করেছেন উনি, আমরা যতই বলি, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার তা কিন্তু নয়। কিছু স্মৃতি অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি থাকলেও, ভীষণ সতেজ থাকে। মানে, আমরা ভিতর থেকে, অবচেতন মনে তার থেকে ডিট্যাচড্ হতে চাই না।

চেম্বারের ভেতরের নিস্তব্ধ হিম পরশে আর ডা. চ্যাটার্জির নরম সাহচর্যে ইতিমধ্যেই অশান্ত ভাবটা কমতে শুরু করেছিল। স্বস্তি নেমে আসছিল। অর্ণব অফিস কলিগ হলেও ইনটিমেট ফ্রেন্ড। ডা. সৌম্যশেখর চ্যাটার্জির নাম সাজেস্ট করে বলেছিল, ওনাকে সব বলতে পারবি। ওনার সমাধান একেবারেই অফবিট। পেশাদারিত্বর সঙ্গে গোপনীয়তাও দারুণ বজায় রাখেন। জাস্ট চেক করে দেখতে এসেছিল। নির্ভরতাটা তৈরি হচ্ছে। শ্রদ্ধা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সমাধান আছে নিশ্চই?

অবশ্যই আছে। আই গ্যারান্টি। বন্ধুর মতো, নিজের মতো করে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে এই টেকনিকটাকে আমরা বলি, ফ্রি অ্যাসোসিয়েন অবাধ অনুষঙ্গ। এতে আপনি অনেকটা হালকা বোধ করবেন। আর সমাধানটা অনেক মাইনর ব্যাপার। জাস্ট একটা উপসংহার টানার মতো।

থমকাল অর্পণ। এখনও পর্যন্ত ডা. চ্যাটার্জির সঙ্গে এই অ্যাপযে্টমেন্টের বেশ কয়েটা ধাপে প্রথমে থেমে, তারপর এগোতে হয়েছে। সুতো ছাড়ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে। সমস্যা নিয়ে একজন কাউন্সেলর-এর পরামর্শ নিতে আসা। লাজুক ভাব আর হাসির মোটামুটি ব্যালেন্স যেমন অফিসে করে, সেরকম ভাবে বলল, আসলে, এ রকম অ্যাফেয়ার তো আজকের যুগে সবারই একটা-দুটো থাকে। পাসিং অ্যাফেয়ারের মতো। তা পেরিয়ে সবাই চলেও যায়। বিবাহিত জীবন শুরুও হয়ে যায় জমাটি ভাবে। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগেরই কাহিনি অনেকটা এ রকমই।

একদম ঠিক বলেছেন। তবে ঘটনার রেখাপাত সবার মনে একরকম ভাবে হয় না। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মনের আলাদা আলাদা স্তর।

অর্পণকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র আর শিক্ষিত মনে হয় বলেই কি শুরু থেকেই ডা. চ্যাটার্জি এতটা টেকনিক্যাল স্বর বজায় রাখছেন? হতেও পারে। বেশ কিছুটা বাতাস বুকে ভরে নিয়ে অর্পণ বলল, যে-সমাধান আপনি দেবেন, তাতে কি মনের ভারি ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে কি আর রেজাল্ট পাবেন, মি. মিত্র? কিন্তু রেজাল্ট আসে। আর সে চেঞ্জ আপনি বুঝতে পারবেন আপনা থেকেই।

ফিল-গুড ভাবটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতেও পারছে অর্পণ। প্রথমে ভেবেছিল, কোনও জ্যোতিষের কাছে যাবে। টিভি খুললেই তিন মিনিটে কালসর্পদোষ, ব্যাংদোষ, টিকটিকিদোষ কাটানো হয়। স্ক্রিনের নীচের ফোন নাম্বারে ফোন করলেই এদের চেম্বারে। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য এদের হাতের মুঠোয়। জ্যোতিষির ডিগ্রিতে সব এক একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আর ত্রিকালজ্ঞ। অর্ণবকে বলতেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, কাউকে বলিস না, অ্যাড এজেন্সিতে এই পদে চাকরি করিস। বিজ্ঞাপন এখন তোকেই টুপি পরাচ্ছে! ভাবতে পারি না।

তখন আর কথা এগোয়নি। এখন মনে হচ্ছে অর্ণবের কথা শুনে একদম ঠিক করেছে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বলল, ওকে। কিন্তু সলিউশনটা কী?

কিছু না। ছোট্ট একটা কনফেশন।

কনফেশন! কার কাছে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে অর্পণের।

হেসে ফেলেছেন ডা. চ্যাটার্জি। নট সো ফাস্ট। কারও-র কাছে না। নিজের কাছে। কেউ থাকবেও না।

মানে?

খুব সহজ মি. মিত্র। নিজের ভেতরে যদি কোনও পাপবোধ থেকেও থাকে, তা খুঁড়ে, তুলে ফেলে দিন স্ট্রেট…

সেটাই তো বলছি। মানে…

দেখুন, আপনি নিশ্চয় চার্চে কনফেশন বক্স দেখেছেন।

হুঁ….

উলটো প্রান্তে একজন পাদরি বসে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাজ হল শুধু শুনে যাওয়া। অনেকেই বলে, তা করে তারা রিলিফ পেয়েছে।

তাহলে কি চার্চে, বিভ্রান্ত লাগছে অর্পণের।

না, না। আসলে নিজের ভেতরের কথাগুলো আপনি কোনও দিন কাউকে পুরোটা বলেননি। সেটাই নিজে এবার একটা কাগজে পুরো লিখে ফেলুন।

এক মিনিট। আপনাকে তো…

সরি, মি. মিত্র, আমাকেও আপনি পুরোটা বলেননি। ইনফ্যাক্ট বলতে পারছেন না। তাই বলছি, লিখে ফেলুন পুরোটা।

হ্যাঁ, তারপর?

সিম্পল। কোনও ভরা পূর্ণিমার রাতে, যখন কেউ দেখছে না সেটাকেই কুচিয়ে টুকরো করে চোখের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। এ টুকুই। দেখবেন, অনেকটা রিলিভড হয়ে যাবেন।

সত্যি কি এটা হতে পারে? এর কোনও সাযে্নটিফিক জাস্টিফিকেশনই তো নেই।

সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের সব সলিউশন, বিজ্ঞান মেনে হয় না মি. মিত্র। একবার ট্রাই করুন শুধু। ডা. চ্যাটার্জি হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়েছেন। টলে যাওয়া বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অর্পণ, কিন্তু মুন লাইটই কেন?

মুন ইজ আ লাভ সিম্বল। চাঁদের আলোর একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার আছে।

ওকে, কবে করতে বলছেন এটা? কাল বাদ পরশুই কিন্তু পূর্ণিমা আছে। মোবাইল খুলে বং ক্যালেন্ডার-এ ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে অর্পণ।

দুচোখ বুজে কী যেন ভাবলেন ডা. চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, পরে করতে গেলে আবার বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা। কামিং ডেটটাই কাজে লাগান।

একটা কথা, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল অর্পণ, বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা বেশ সিক্রেট। এটা নিশ্চয়ই ডিসক্লোজ হবে না কোনও ভাবেই?

শুনুন মি. মিত্র, কোনও কাউন্সেলরই এক জন পেশেন্ট-এর কেস হিস্ট্রি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

থ্যাংক ইউ। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনে অর্পণ।

 

তোফা দুপুরের ঘুমের পরও আলিস্যি ভাবটা ছেড়ে যাচ্ছিল না। রোববার মানেই শেষ তিন মাসে পাতলা খাসির মাংসের ঝোল আর ভাত। শেষ পাতে একটু টক দই। ঘুম ঘুম ভাবটা খাবার টেবিলেই ফিল করে অর্পণ। নতুন ফ্ল্যাট-এর ইএমআই-এর সময় যত এগিয়ে গেছে, তত বেশি করে এই অলস ভাবটা ঘিরে ধরেছে। উত্তরপাড়ায় জিটি রোড গঙ্গার কোল ঘেঁসে এই ফ্ল্যাট। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল। সে সময় ওর বয়স আঠাশ। কোম্পানি চেঞ্জ করে বহুজাতিকে যোগদান করে, ডিজাইনার হিসেবে তখনই ঈর্ষণীয় পে-স্কেলে চলে গিয়েছিল। আর এখন তো উন্নতির চরমসীমায়।

অ্যাড-এর ফিল্ডে অর্পণ মিত্রকে সমস্ত ক্লাযে্নট এক ডাকে চেনে। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন না করে স্পেশালাইজড কোর্স করতে গোঘাট থেকে সোজা কলকাতায়। একেবারে রেসিডেন্সিয়াল। দুবছর পর ক্যাম্পাস থেকেই একটা মোটামুটি কোম্পানিতে। দেশের বাড়িতে আর ফিরলই না। বছর তিনেক গড়িয়াতে দুজনের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকা। গোঘাটে দাদার সংসারে বাবা-মা থাকলেও, বেশ কয়েবার কাটিয়ে গেছে এখানে।

ঘরে ঢুকে বক্স খাটের পাশের ড্রয়ারের উপরে বিকেলের চা রাখল ঐশিকি। এই তিনমাসে দুপুরে অন্তত ছুটির দিনে তাকে ঘুমোতে দেখেনি অর্পণ। প্রচণ্ড হেলথ কনশাস বলেই কি ঘুমোয় না! তিন মাসের নব বিবাহিত জীবনে, এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। চায়ের গন্ধের সঙ্গে ঐশিকির লম্বা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও মিশে যাচ্ছে। একটা ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলেও এখনই কাছে টানাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

সদ্য ঘুমিয়ে উঠেছে। বাসি গন্ধ, মাথা চাড়া দিল যেন। উঠে বসে চা বিছানায় নিল। খোলা ব্যালকনিতে চলে গেছে ঐশিকি। এ সময়টায় ওর বাড়ি থেকে মা বা বাবা কেউ একজন ফোন করে। চোখ সরিয়ে রাখল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পুরুষ্ট গোঁফে আর একটু বেড়ে ওঠা ভুঁড়িতে, সুখের ঝলক নাকি স্বামী হয়ে ওঠার আদল প্রকাশ পাচ্ছে!

চা খেয়ে আলিস্যি ভাবটা যাচ্ছে না। আজ রাতে কী করবে ভাবতেই বুকে শান্তির হাওয়া। একটা বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া।

চা শেষ করে চিত হয়ে শুল অর্পণ। স্যান্ডো গেঞ্জিটা উঠে গেছিল। নামিয়ে নিল পাজামার উপর ঠিক ঠাক। সুখের উড়ানকে সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছে। এমনকী সুদেষ্ণার সঙ্গে কাটানো সময়ে তো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল বা কলেজে কারও-র সঙ্গে ক্রাশ হয়নি। প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটে যখন এসে বলেছিল, রীতিমতো মুখ টিপে হাসাহাসি হয়েছিল। হোস্টেলে অলক বলেছিল, তোরা মফস্সল বা একটু ভিতর দিকের ছেলেরা কেমন যেন একটু বাড়তি চাপা প্রকৃতির হোস। গ্রাম শব্দটা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া।

ভ্রূ কুঁচকে অর্পণ বলেছিল, আর তোরা সিটির লোকেরা সত্যি কথা বলে যে ডিক্সনারিতে কিছু হয়, তা বোধহয় বিশ্বাসই করিস না।

অলক চোখ গোল্লা করে বলেছিল, তুই কিন্তু অন্যরকম। আগ লাগা দেগা তু।

তো আগুনই লেগেছিল। সে আগুন যে কী কী পোড়ায়, বুঝতে সময় লাগেনি। ইনফরমাল কমিউনিকেশনের চতুর্থ ক্লাসেই চোখ গেছিল অর্পণের। হ্যাঁ, তবে উপরের ঠোঁটের এক সেমি উপরের তিলটায়। পাশের ডেস্কে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছিল বলে অলক এক সময়ে ফিসফিসিয়ে বলেও ছিল, পুরো ম্যাডোনা তো রে। ঠোঁটে হাসি চলে এসেছিল।

ক্লাস শেষ করেই সিনেমাটোগ্রাফিক বিস্ফোরণ। তবে ম্যাডোনা না, সুচিত্রা সেন টাইপ। এগিয়ে এসে একেবারে মিসাইল, সোজাসুজি কারও-র সম্পর্কে কিছু বলতে না পারাটা হিপোক্রেসি। বুঝতে পারছিস?

ঠোঁটে হাসিটা রেখে বলে উঠেছিল অর্পণ, ফ্যাকাল্টির সামনে তোর তিল নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগত?

বাঃ! স্মার্টনেসের তো অভাব নেই।

অভাব কেন হবে। আশির দশকের কেবলু বাংলা সিনেমার নায়ক আর কোথায় পাবি এখন!

সুদেষ্ণা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলেও, অলক পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিল, তেরা হোগা গুরু।

সত্যিই হয়েছিল এবং এগিয়ে গিয়েছিল একটু দ্রুত গতিতে। প্রথম প্রেম আর তার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে লেকের ধার সুদেষ্ণার সঙ্গে সে সম্পর্ক এগিয়েছিল চোখের পলকে। সিনেমার হলে একই ফাউন্টেনে চুমুক, লাইব্রেরিতে স্টাডিনোট লোড করা বা গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটা হু হু করে কেটে গেছিল দিনগুলো। একই গতিতে শেষ হয়েছিল কোর্সের বছর দুটোও।

অর্পণের মনে হয়েছিল ছেদ পড়তে এবার বাধ্য, কারণ সুদেষ্ণা বর্ধমানে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা বলছিল। ঠিক সেই সময় অর্পণের হঠাৎ চাকরি। আর সুদেষ্ণার আবার একটা স্পেশাল কোর্সে ভর্তি হওয়া।

 

চব্বিশে চাকরি কি অর্পণকে বেপরোয়া করে দিয়েছিল? ছুটির দিনে নতুন কেনা বাইকে বোম্বে হাই রোড ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া বা বাইকে রাতের কলকাতা আবিষ্কার ওর আর সুদেষ্ণার। এ ছাড়াও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ভাড়ার ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

অফিসিয়ালি দাঁড়ি টানলাম, এই জাতীয় কথা কোনও দিন ওরা পরস্পরকে বলে, সম্পর্ক থেকে বেরোয়নি। কেউ কোনও দিন কাউকে পরে ফোন করে বা দেখা করে কৈফিয়তও চায়নি। সেটা সম্পর্কের চোরাটানের মৃত্যু হতে পারে বা, দুজনের ইগো ফ্যাক্টর হতে পারে। এমনকী নিজের তরফে ঠিক কী, সেটাও নিশ্চিত করে অর্পণ বলতে পারে না। মনের গভীরে স্মৃতি থেকে যাওয়াতেই কি কোথাও পাপবোধ! প্রথম কয়েক মাস ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকেও মনে হতো, একবার যোগাযোগ করলে কেমন হয়। তারপর একদিন সেখানেও ধাক্কা।

ছোটোখাটো মনোমালিন্য ওদের মধ্যে হলেও তা দীর্ঘস্থাযী হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজ করে নিত সুদেষ্ণাই। তাই কোনও দিন সেভাবে ওর মুখ গম্ভীর দেখেনি। স্পেশাল কোর্স শেষের ঠিক একমাস পর এলগিন রোডের এক ক্যাফেতে রবিবারের দুপুরে হাজির হয়ে দেখতে পেয়েছিল গম্ভীর মুখ। বাইরেও আকাশের মুখ ভার। অসাধারণ সুন্দর মিউজিকের সঙ্গতেও দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ হয়েছিল নিঃশব্দে।

এই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউটা ক্র‌্যাক করতে পারলাম না। অথচ পোস্টিং কলকাতাতে ছিল, আর প্যাকেজও ছিল অ্যাট্রাকটিভ। সুদেষ্ণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নীচের ঠোঁট।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল অর্পণ, তো?

তো কিছুই নয়। দিল্লিতে একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা ইন্টারেস্টেড। এক সেকেন্ড থেমে সুদেষ্ণা যোগ করেছিল, আমিও।

সোজা হয়ে বসেছিল অর্পণ, ভালো খবর। কিন্তু কলকাতাতে আরও দুএকটা ট্রাই করলে হতো না?

ইনস্টিটিউটে শর্মা স্যার বলছিলেন, দিল্লির অফারটা নিয়ে নেওয়া উচিত। ওদের নাকি প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনিং স্টাইলটা গোটা ইন্ডিয়ায় খুব খাচ্ছে। আর আহমেদাবাদ আইআইএম-এর দুজন প্রাক্তন মিলে অফিসটা খোলায়, শেখার স্কোপটা বেশি হবে।

অন্যমনস্ক হয়ে খালি কফি কাপটা একবার নাড়াচাড়া করে অর্পণ বলেছিল, ও, তাহলে তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস।

এভাবে ভাবছিস কেন, যে-কোনও অবস্থাতেই কলকাতা ফিরে আসতে পারি। আরও অনেক বেটার এক্সপেরিযে্ন্স নিয়ে। অফিসের দুদুটো অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে চলতে থাকায় রাতের ফোন ছাড়া সে সপ্তাহে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বর্ধমানে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সুদেষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে ওর বাবা-মা ছাড়তে এসেছিল। আগে থেকে কোনও পরিচয় না থাকায় সামনে যেতে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।

দিল্লিতে সেটলড হয়ে ফোনে বেশ কয়েবার কথা হয়েছিল। সে ফোনও কমে আসছিল তিন-চার মাস পর। তারপর দুদুটো নম্বর অস্তিত্বহীন।

শোক করেনি অর্পণ। নিজের প্রেমের নির্লিপ্তিতে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভাবার এত সময় ছিল না। নিজের কেরিয়ার গ্রাফ রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। কোম্পানি চেঞ্জ করে সাধারণ বেসরকারি অফিসে চাকরি থেকে অনেকগুনে বেশি রোজগার মোটেও মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। দুবছরের মাথায় ফ্ল্যাট নিয়ে পরের ছবছর শুধু তার ইএমআই গুনে গেছে নিঃশব্দে।

১৮ লাখের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে উঠে এসে প্রথম প্রথম উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারির যুদ্ধটা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ভালো লাগত। রাতে ফ্ল্যাটে একা থাকার পীড়া যে-একেবারেই দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু ক্লান্তি খুব দ্রুত ঘুমের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলত।

এ রকম অবস্থাতে ছটা বছর কেটেছিল অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। নতুন করে কারও-র সঙ্গে জড়ানোর সময় ছিল না। ছুটির দিনে বাজার, গোছগাছ, রান্নার লোককে বুঝিয়ে দেওয়া আর বাকি সময়টা ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ডিজাইন। গোঘাট থেকে বউদি আর মায়ের অনবরত ফোন ভেসে আসছিল।

বিয়ের প্রস্তাবে খুব বেশি চমকায়নি। হিসেব কষে দেখেছিল ফ্ল্যাটের ঋণশোধে বাকি আর সাত বছর। ইনক্রিমেন্ট স্টেডি রেটে বাড়ছে। জিডিপির লোয়ার গ্রোথের দাঁত ওদের ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শরীর-মন একযোগে বলে উঠেছিল বিয়ের এটাই সঠিক সময়। আর তা ছাড়া এতগুলো বছর অন্য কারও-রও তো মনে পড়েনি। সুতরাং দায়ের প্রশ্ন আসছে না বোধহয়। আর নিশ্চিত সমাধান তো এবার হাতের কাছেই।

চন্দননগরে ঐশিকিদের বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখা। মোটামুটি খবর নেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারফেক্ট চয়েস। বাংলায় অনার্স গ্র‌্যাজুয়েট। তবুও বাইরে দুতিনবার মিট করে নিয়েছিল। লম্বা চুল, হাইট, রং-এ জোরদার লাগলেও, সুদেষ্ণার সঙ্গে তুলনায় যায়নি। চন্দননগর ষ্ট্র‌্যান্ডেই রবিবারের এক সন্ধেতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঐশিকীকে, ওর অতীত জীবনের কথা। কোনও পাস্ট অ্যাফেয়ার, এ বিয়েতে রাজি কিনা, ছোটো ছোটো প্রশ্নে জানার চেষ্টা করেছিল।

ঐশিকির সোজা-সাপটা সরল উত্তরে কিছুতেই নিজের অতীতকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পারেনি। বিয়ের পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও নিষ্কলঙ্ক ঐশিকীর আচরণে, নিজের অতীতকে বার বার গিলতে হয়েছে। একটা অ্যাফেয়ার কী করে অপরাধবোধে পরিণত হয়, ভেবে বের করতে পারেনি। অগত্যা ছুটে যাওয়া ডা. চ্যাটার্জির কাছে।

 

ঘুমানোর ভান করেই শুয়েছিল। একটা হালকা উত্তেজনা তো বটেই, দুপুরে ভালো রকম ঘুমের জন্যও ঘুম আসতে চাইছিল না। কাল খুব সকালে উঠে প্রোজেক্টের একটা কাজ ছকে নিতে হবে বলেছিল। তাই ঐশিকি আজ আর কোনও উষ্ণতা চায়নি। ভীষণ কম্প্রোমাইজিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মেয়ে। সম্পর্কের সতেজতা আর স্নিগ্ধতা দুটোই সমান ভাবে মেনটেইন করতে পারে। এভাবেই তিন মাস অর্পণকে যেন অদৃশ্য হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

মধ্য কুড়িতে সম্পর্ক উন্মাদনা খোঁজে হয়তো, মধ্য তিরিশে স্থিতাবস্থা। সংসারের বৃত্তে এ ভাবেই বোধহয় ঢুকে পড়তে হয়। আজকের রাতের পর নিশ্চই পুরোপুরি ঢুকে পড়বে। সন্ধেবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঐশিকির চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। বিশেষত ছুটির দিনে। মনে হয়েছিল রাতই সঠিক সময়।

রোজের মতো আজও ঐশিকি টয়লেটে উঠল। এসি অফ করল। মিনিট চারেক সময় ব্যয় করে টয়লেটে ও। এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এক মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়ল অর্পণ। ভাগ্যিস অ্যাটাচড্ বাথ নয়। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল। টয়লেটের আলো জ্বলছে, জলও পড়ছে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিজের ল্যাপটপে কম্পোজ করেছিল প্রায় তিন পাতার কনফেশন। প্রিন্ট আউটও বের করে রেখেছিল। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলল। সামনে চাঁদের আলোয় ভরা গঙ্গা। দ্রুত হাওয়ায় বড়ো মায়াবী এ চরাচর। টুকরোগুলো হাত থেকে ছোড়ার আগের মুহূর্তেই, স্থির হতে হয়।

পাশের ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে আসে প্রায় একই রকম কাগজের টুকরো। অসংখ্য। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের জানালা থেকে সরে যায় ঐশিকির মুখ। হাতের ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোকে এবার ছেড়ে দেয় অর্পণ। দুটো স্বীকারোক্তি প্রায় একইরকম হয়ে মিলেমিশে প্রবল হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মিশে যায়। যেমন করে বসন্তের হাওয়া আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছিল…

 

বেহায়া

অফিসের জন্য তৈরি হয়ে অনন্যা বাইরের ঘরে এসে দেখল, শাশুড়ি-মা বসে শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করছেন। অনন্যা এসেই সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরে অফিস যাওয়ার অনুমতি চেয়ে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বাই বলে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল। অজয়ের বাবা অনিরুদ্ধবাবু খুবই ভালোবাসেন অনন্যাকে।

সুগন্ধা বললেন, অনন্যা, আজ কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। অজয়ের পিসিমা আসবেন সন্ধেবেলা।

মা, তাড়াতাড়ি আসা তো মুশকিল। অফিস থেকে পাঁচটায় বেরোলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা তো বাজবেই। এসে দেখা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। বলে নিজেই জোর করে হাসি টেনে আনে মুখে। আর তাছাড়া পিসিমা তো আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন না। নিজের গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।

খানিক আগেই স্বামী অজয় ঘরে ঢুকেছে, অনন্যা খেয়াল করেনি। অজয়ে গলার আওয়াজে ওর দিকে দৃষ্টি পড়ল অনন্যার। ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে হাসতেই অজয় বলল, বাজে কথা বোলো না অনন্যা। ঠিক সময় চলে এসো।

হাসতে হাসতেই অনন্যা বেরিয়ে গেল।

মায়ে গম্ভীর মুখ দেখে অজয় সুগন্ধাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? মুড খারাপ?

না, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে অজয় বাবার দিকে তাকাল। অনিরুদ্ধবাবু ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। ইশারায় কথা বলে বাবা ছেলে দুজনের মুখেই চাপা হাসি ফুটে উঠল।

অজয় অফিস চলে গেলে অনিরুদ্ধবাবু নিজের স্ত্রীকে বললেন, আমি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চেষ্টা করব, দিদি আসার আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু তুমি এত কেন চুপচাপ?

স্বামী প্রশ্ন করতেই রাগে ফেটে পড়লেন সুগন্ধা। চুপ করে থাকব না তো আর কী করব? আর কত অ্যাডজাস্ট করব? সকাল থেকে ওইরকম বেহায়া ছেলের বউকে দেখে এমনিতেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

বেহায়া? অনন্যা? একথা কেন বলছ?

হাবভাব দেখছ তো, একে দেখে এ বাড়ির বউ বলে মনে হয়? সবসময় ঠাট্টা, ইয়ার্কি, সাজগোজ তারপর এই প্রাইভেট চাকরি! আর কথাবার্তার তো কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কত ভেবেছিলাম বাড়ির বউ নম্র, ভদ্র হবে, মা-বাবার দেওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থাকবে। কিন্তু না, যাই বলি না কেন এমন উত্তর দেবে যে, তারপর আর কিছু বলা চলে না। সব কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অথচ আমাদের মেয়ে অপর্ণাকে দেখো, শ্বশুরবাড়ির সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শাশুড়ি যা বলছেন তাই মাথা নীচু করে মেনে নিচ্ছে। আর আমাদের অজয় এমন একটা বেহায়া মেয়েে এনে আমাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে তার কাঁধে হাত রাখলেন, এখনই এত অধৈর্য্য হয়ে পড়ছ কেন? মাত্র চারমাস হয়েছে অনন্যা এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি ওর কোনও রকম ছবি মনের মধ্যে এঁকে ফেলো না। তুমিও তো পড়াশোনা করেছ, তুমিও যথেষ্ট মডার্ন। এই কদিন অনন্যাকে দেখেই তুমি ওর নামকরণ করে ফেলেছ বেহায়া! এটা ঠিক নয় সুগন্ধা। অজয় যথেষ্ট দাযিত্ববান ছেলে। ও অনন্যাকে যখন নিজের বউ হিসেবে স্বীকার করেছে, তখন নিশ্চই সে অনন্যার গুণ দেখেই ঘরে এনেছে।

হ্যাঁ, গুণ তো আছে বটেই। সেই জন্যই তো অজয়কে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। অনন্যা যা বলে তাতেই সায় দেয় অজয়। ও সাজগোজ আর বউয়ে রূপ দেখে এমন মজেছে যে, অনন্যা যাই করুন না কেন তাতে তার সাত খুন মাপ হয়ে যায়। আমিই শুধু ওর কোনও গুণ দেখতে পাই না কেন কে জানে!

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীয়ের রাগ দেখে হেসে ফেলেন। একটু রসিকতা করার ইচ্ছা সামলাতে পারেন না। সুগন্ধা কখনও কোনও শাশুড়িকে দেখেছ ছেলের বউয়ে গুণ এত সহজে মেনে নিতে? তোমার তো কত গুণ ছিল কিন্তু তোমার শাশুড়ি কোনও দিন সেটা স্বীকার করেছেন?

এত রাগের মধ্যেও স্বামীর কথা শুনে সুগন্ধা হেসে ফেলেন।

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, ঠিক আছে, আমি এখন বেরোচ্ছি। রাগ কোরো না, বিশ্রাম নাও। দিদি এলে তুমিও ব্যস্ত হয়ে পড়বে, এই বলে অনিরুদ্ধবাবু বেরিয়ে যান।

সুগন্ধা বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের লোককে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে দুপুরে একটু ফ্রি হয়ে সবে শুতে যাবেন, ফোনটা বেজে উঠল। বড়ো ননদের ফোন যিনি সন্ধেবেলায় ওঁদের বাড়ি আসছেন থাকতে।

সুগন্ধা, আমি ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ তোমাদের বাড়ি পৌঁছে যাব। ততক্ষণে আমাদের বউমাও নিশ্চয় বাড়ি এসে যাবে? বিয়ের সময়ে ওর সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারিনি।

হ্যাঁ দিদি, অনন্যা বলেছে ও চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ফিরতে, বলে ফোন নামিয়ে রাখেন সুগন্ধা। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সুগন্ধা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। সন্ধেবেলায় অনেক কাজ আছে। কিন্তু শুয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। নানা চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করে। তিন বছর আলাপের পর মাত্র চারমাস আগে অজয় আর অনন্যার বিয়ে হয়েছে। অনন্যার মা-বাবা দুজনেই প্রফেসর। বেঙ্গালুরুতে অনন্যা বড়ো হয়েছে। সুন্দরী, মডার্ন, সুশিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে

অজয় অনন্যাকে পছন্দ করে, এটাই সুগন্ধার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সন্তনের খুশিতে, সংসারের আনন্দেই সুগন্ধা পরিপূর্ণ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অনন্যার সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার পরেই একটাই শব্দ দিনরাত ওনার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করল, বেহায়া।

সুগন্ধা ভালোমতোই জানেন, অনন্যা অজয়কে চোখে হারায়। অনন্যার অফিস বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। যার ফলে অজয়ে আগে ওকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় আর ফেরেও অজয় ফেরার অনেকটা পরে।

কলকাতায় অফিস যাতায়াত করাটা একটা সমস্যা কিন্তু অনন্যা বাড়ি এসেই চটপট জামাকাপড় বদলে, ফ্রেশ হয়ে সকলের সঙ্গে বসে গল্প করতে শুরু করে দেয়। কোথাও ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও থাকে না ওর চেহারায়। সুগন্ধা অবাক হয়ে যান যত ওকে দেখেন। বাড়িতে এমন ভাবে থাকে, দেখে যে কেউ ভাববে ও বাড়ির মেয়ে নতুন বিয়ে হয়ে আসা বউ নয়।

রান্নাবান্নার কোনও শখ নেই অনন্যার। একদিন সুগন্ধা খুব আদর করেই অনন্যাকে বলেছিলেন, অনন্যা, ছুটির দিনগুলোতে একটু একটু করে রান্নাটা শিখে নাও।

কেন মা? ঝট করে অনন্যা বলে ফেলে।

রান্নার জন্য লোক আছে ঠিকই কিন্তু একটু আধটু রান্না তো সকলেরই শিখে নেওয়া উচিত।

সে কাজ চালাবার মতো রান্না আমি করে নিতে পারব। ওটাতেই এখন কাজ চলবে। পরে কখনও শিখে নেব, বলেই অনন্যা শাশুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে।

মা রান্নাঘরে ঢুকতে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি একবার হ্ঁযা বলো, এখুনি একজন ফুল টাইম রান্নার লোকের ব্যবস্থা করছি। তোমারও একটু বিশ্রাম হবে। আমি তো বলি তুমি সবসময়ে জন্য একটা লোক রেখেই নাও।

বাড়ির ভিতর সবসময় কাজের লোক ঘোরাফেরা করবে ভেবেই সুগন্ধা মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তখনকার মতো অনন্যাকে চুপ করানোর জন্য বলেন, ঠিক আছে, যখন ইচ্ছে হবে শিখে নিও। এখন লোকের আমার কোনও প্রযোজন নেই। প্রমিলা সব কাজই তো করে দিচ্ছে।

অনন্যা আর সুগন্ধার কথোপকথন যখন হচ্ছিল তখন অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবা আর ছেলে, দুজনের কথা শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিলেন।

আজ সুগন্ধা অনিরুদ্ধবাবুকে একা পেয়ে অনন্যার বিরুদ্ধে জমে থাকা রাগ উগরে দিলেন, নিজের চোখেই দেখছ বাড়ির কোনও কাজ করতে চায় না। যখনই কিছু শেখার কথা বলি অমনি গলা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে যে, রাগও করতে পারি না।

স্ত্রীয়ে নালিশ শুনে হেসে ফেলেন অনিরুদ্ধবাবু, তুমি কতটা শাশুড়ি হিসেবে রাগ দেখাতে পারো আমার খুব জানা আছে।

সন্ধেবেলায় উমাদিদি আসার আগেই অনিরুদ্ধবাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, যাতে সুগন্ধার মনে ক্ষোভ না তৈরি হয়।

চা-জলখাবার খেতে খেতে উমা অনন্যা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। কেমন বউ হয়েছে? শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে কিনা? অফিসে এতটা সময় কাটায়, তাহলে বাড়ির কাজ করে কখন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

উত্তরটা অনিরুদ্ধবাবুই দিলেন, আমাদের সেবার কীসের দরকার! আমরা কি কেউ অসুস্থ? অনন্যা খুব ভালো মেয়ে দিদি। দাযিত্ব নিয়ে সব কাজ করে।

অনন্যার কথা ওঠাতে সুগন্ধার মুখের উপর কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। উমার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সবই নজর করল। মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন উমা। অনিরুদ্ধর থেকে বেশ অনেকটাই বড়ো উমা। মা-বাবার মৃতু্যর পর ভাই-বোনের সম্পর্ক আরও অনেক বেশি মজবুত হয়েছে। সম্পর্কের মান দুজনেই রক্ষা করে চলেছেন।

বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন উমা। এখন বয়ে হওয়ায় আরও বেশি পূজাপাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সেকেলে

আচার-বিচার মেনে চলেন। কোনও এক মহারাজ-এর কাছে দীক্ষিত। কাশীধামে থাকেন মহারাজ। দেশের যেখানেই মহারাজের প্রবচন থাকে, উমা ঠিক কিছু একটা করে

চার-পাঁচদিনের জন্য সেখানে পৌঁছে যান।

কলকাতার রাজারহাটে এবার মহারাজের শিবির অনুষ্ঠিত হয়। সেটার জন্যই উমার রাঁচি থেকে কলকাতায় আসা। ওঁরা বসে গল্প করতে করতেই অজয় আর অনন্যাও অফিস থেকে চলে এল। পিসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অনন্যা নিজের ঘরে চলে এল ফ্রেশ হবে বলে। ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে ডিনার করতে করতে সকলে আড্ডায় মেতে উঠল। অন্যান্য সময়ে মতো অনন্যাও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। অনন্যার এই ব্যবহার উমার চোখে অতিরিক্ত স্পর্ধার বলেই মনে হতে লাগল।

এরপর শুরু হল নাগরিকতা বিল নিয়ে আলোচনা। অনন্যা তো সোজাসুজি জানিয়ে দিল এই বিল সে সমর্থন করে না। অথচ উমা নিজের বাড়িতে স্বামীকে এই বিলের সমর্থনে সবসময় কথা বলে আসতে শুনেছেন। অনন্যার কথাবার্তায় উমার খালি মনে হতে লাগল, অনন্যা একপ্রকার তার স্বামীকেই অপমান করছে। প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল উমার। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান স্বল্প হওয়াতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

অনন্যা অনিরুদ্ধবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে চলছিল, বাবা আমাদের অফিসে আমার কিছু সহকর্মী এই বিলের বিরোধিতা করে একটা মিছিল বার করার প্ল্যান করছে। আমার এতে পুরো সমর্থন রয়েছে।

উমা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ইচ্ছে করে অনন্যাকে থামাবার জন্য বলে উঠলেন, আমি ভাবছিলাম এবার মহারাজের শিবিরে যাওয়ার সময় সুগন্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ওখানে দুটো দিন থেকেও নেবে আর মহারাজের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। কী বউমা, তোমার শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে ওই দুটো দিন সংসার সামলে নিতে পারবে তো?

কিন্তু পিসিমা, মা তো শিবিরে যাবেন না।

সুগন্ধা হতচকিত হয়ে পড়েন। এই বেহায়া মেয়েটা বলে কী? আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাব না, সেটা ও ঠিক করবে? উমাও অনন্যার কথা শুনে যেন শক খেলেন। দুদিন হল বাড়িতে এসেছে, এর মধ্যেই ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস পাচ্ছে মেযো? একটু গম্ভীর হয়ে উমা বললেন, মহারাজের কাছে দু’দণ্ড বসে ওনার কথা যে-শোনে, তার জীবনে কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকে না।

পিসিমার কথায় রসিকতা করার ইচ্ছেটাকে কিছুতেই দমাতে পারল না অনন্যা। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, সে কী পিসিমা, তাহলে আপনার মহারাজের জন্য দেখছি, ডাক্তারদের ক্লিনিকগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে! সাবধান হতে বলবেন মহারাজকে, নাসা থেকে ওনাকে তুলে নিয়ে না চলে যায়, হা হা হা বলে হাসিতে ফেটে পড়ে অনন্যা।

খুব গম্ভীর দেখায় উমাকে। বলেন, বউমা, আমার মনে হয় আধ্যাত্মিক বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সেজেগুজে অফিসে যাওয়া এক ব্যাপার আর আধ্যাত্মিক চেতনা অন্য জিনিস।

পিসিমার কঠোর স্বর শুনে অনন্যা ভিতরে ভিতরে একটু মুষড়ে পড়লেও, স্বভাবসুলভ কৌতুকের বশেই বলে ফেলল, পিসিমা সত্যিই আধ্যাত্মিক আলাপ-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

অনন্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার উমা সুগন্ধাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তাহলে তুমি যাবে তো সুগন্ধা?

সুগন্ধার কাছে বাড়ির শান্তি সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু ননদের মুখের উপর কিছু বলার সাহস কোনও দিনই তাঁর হয়নি। আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, আমি মনে হয় যেতে পারব না দিদি। বেশিক্ষণ বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় আজকাল। পায়ে ব্যথাটা খুব বেড়েছে।

উমার মুখের উপর অসন্তোষের ছায়া এসে মিলিয়ে গেল। অজয়ও বলে উঠল, হ্যাঁ মা, তোমার তো ওখানে একেবারেই যাওয়া উচিত নয়। পিসি, তুমি বরং একাই ঘুরে এসো।

রাতে সবাই ঘরে শুতে চলে গেলে উমা, সুগন্ধার সঙ্গে সোফায় এসে বসলেন, সুগন্ধা তোমার ছেলের বউ তো দেখছি খুব স্মার্ট। ফটফট করে মুখের উপর কথা বলে।

সুগন্ধা কী বলবেন ভেবে পান না। চুপ করে থাকেন।

তোমাকে সাবধান করছি সুগন্ধা, ওকে এত বেশি বাড়তে দিও না। লাগাম নিজের হাতে রাখো।

হেসে ফেলেন সুগন্ধা। দিদি ও বাড়ির বউ। ঘোড়া হলে না হয় লাগাম কষে ধরতাম। সুগন্ধা বরাবরই শান্তিপ্রিয়। অশান্তি কোনও দিনই ওনার পছন্দ নয়।

সুগন্ধাকে চুপ থাকতে দেখে উমাই আবার মুখ খুললেন, এ যেরকম মেয়ে দেখলাম বাড়ির কাউকে ও পরোযা করে না বলেই মনে হয়। সবসময় সেজেগুজে, মেক-আপ করে রয়েছে। বড়োদের সামনে মুখ বন্ধ করে থাকার সভ্যতাটুকুও ওর জানা নেই। এইসব মেযো স্বামীকে ভালো মতন আঁচলে বেঁধে রাখতে জানে। দেখো তোমার সংসারে ভাঙন না ধরায়।

ছেলের বউকে কীভাবে রাখা উচিত, এ বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার সুগন্ধার কাছে উজাড় করে দিয়ে উমা পরের দিন সকালে মহারাজের শিবিরে চলে গেলেন। ওখান থেকেই উমা নিজের বাড়ি চলে যাবেন এটাই প্রথম থেকে স্থির ছিল।

পিসিমা চলে যেতে অজয় অনন্যাকে বলল, তুমি তো পিসির সামনে প্রচুর কথা বলছিলে দেখলাম। এত কথা মা কোনও দিন বলতে সাহস করেননি।

মা যত ভালোমানুষ না অজয়, সেরকম ভালোমানুষ হয়ে আজকের দুনিয়ায় কোনও কাজ করা যায় না। মাঝেমধ্যে বলতেও হয়। শান্ত এবং গম্ভীর স্বরে কথাগুলো অনন্যা বলতেই, সুগন্ধা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দেখলেন অনন্যাকে। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি অনন্যা। ওর চেহারায় সবসময় একটা তরতাজা ভাব, মুখে প্রশান্তি এবং যথেষ্ট সুন্দরী সে।

অপর্ণা, অজয়ে থেকে চার বছরের বড়ো। শ্বশুরবাড়ি বরোদায়। বছরে একবার আসে

মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছেলেকে আনে।

স্বামী সুজয় সবসময় আসতে পারে না। ভাই অজয়ে বিয়ে সময় মাত্র পাঁচদিনের জন্য আসতে পেরেছিল। তাই ছেলের স্কুলের ছুটি পড়তেই, এবার কুড়ি দিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে অপর্ণা হাজির হল বাপের বাড়িতে। বাড়তি আগ্রহ, অনন্যার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করার। সুজয় আসতে পারেনি অফিসে জরুরি কাজ থাকার জন্য। এমনিতে অপর্ণা খুবই স্বামীর অনুগামী। কিন্তু একলা বাপের বাড়ি আসায় বেশ একটা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।

অনন্যার সঙ্গে জমেও গেল খুব অপর্ণার। সুগন্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলেন অপর্ণার সঙ্গে বেশি করে, সময় কাটাবার জন্য অনন্যা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল।

দুদিন যেতে না যেতেই অনন্যা একদিন অপর্ণাকে বলল, এ কী দিদি, আজকাল ম্যাচিং গয়না পরে সাজগোজ করে থাকার যুগ। আর তোমার গলায়, হাতে লাল-কালো সুতোয় খালি মাদুলি পরা! এসব কোথা থেকে জোগাড় করেছ?

অপর্ণা আমতা আমতা করে উত্তর দিল, আমার শাশুড়ি-মা সারাদিন মন্দির, দেবতা, বাবাজি, পুরোহিতদের নিয়ে থাকেন। বাড়িতে কিছু একটা হলেই, একটা মাদুলি নিয়ে পরের দিনই উপস্থিত হন। আমাকে এরকম দেখছ, তাহলে সুজয়কে দেখে কী বলবে? সারা শরীরে এই মাদুলি। এভাবেই ওকে অফিস করতে হয়। ওর অফিসে নিশ্চই ওকে নিয়ে ওর কলিগরা হাসাহাসি করে।

অনন্যা এবার জোরে হেসে উঠল, দিদি, সুজয়দার অফিসে যদি আমার মতো মেয়ে থাকে, তাহলে তো নিশ্চই সুজয়দাকে নিয়ে হাসবেই।

অনন্যার কথা বলার ভঙ্গিতে অপর্ণাও হেসে উঠল। অনন্যা এটা কিন্তু খুব খারাপ। নন্দাইকে নিয়ে এরকম রসিকতা তাও আবার ননদেরই সামনে!

সন্ধেবেলা শপিং-এ যাওয়ার কথা ছিল। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, দিদি তুমি শাড়ি আর সু্য়ট ছাড়া আর কিছু পরো না? যেমন ধরো ওযে্টার্ন ড্রেস?

না, অনন্যা। আমার শাশুড়ির শাড়িই পছন্দ।

তুমি তো তোমার পছন্দের কথাও ওনাকে জানাতে পারো। এখন তো সবাই সবরকমের পোশাক পরছে।

অপর্ণাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে অনন্যা।

বাইরের ঘরে বসে অপর্ণা এবং অনন্যার সব কথাই সুগন্ধা শুনতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল বেহায়া মেযোর এতদূর স্পর্ধা যে, নিজের নন্দাইকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে একটুও আটকায় না। আবার ভিতরে ভিতরে খুশিও হচ্ছিলেন নিজের মেয়ে অপর্ণার প্রতি অনন্যার ভালোবাসা দেখে। মেয়ে আগেও যতবার এসেছে এতটা আনন্দে ওকে কখনও থাকতে দেখেননি সুগন্ধা।

অপর্ণা আসার চার-পাঁচদিন পরেই হঠাৎ সুগন্ধার ভাই ফোন করে জানাল, ওনার ছেলে রাতুল তার ফ্যামিলির সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে আসছে। ফোন আসার পর থেকে সুগন্ধা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় যখন খবরটা শুনলেন তখন ওদের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক মনে হলেও অনন্যা, শাশুড়ি এবং ননদের মুখের উপর লক্ষ্য করে কালো মেঘের ঘনঘটা।

সারাদিনই অপর্ণা কারও সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা না বলে নিজের ঘরেই বন্ধ থাকল। হাসিখুশি মেযো হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। অপর্ণার ছেলে খুবই শান্ত, ও নিজের মতো অাঁকা, বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাকে বিরক্ত করার কথা ওর মনেও হয় না।

পরের দিন অনিরুদ্ধবাবু আর অজয় অফিস চলে গেলে, অনন্যা খেয়াল করল সুগন্ধার ঘরে অপর্ণা। নীচু স্বরে দুজনে কিছু কথা বলছে। অপর্ণার ছেলে বসে টিভি দেখছে। অনন্যা, শাশুড়ির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এতদিনে এই বাড়িটা, বাড়ির লোকজনগুলো বড়ো আপন হয়ে উঠেছে তার। ও জানতে চাইছিল, কেন ওদের দুজনের মুখে অমাবস্যার ছায়া পড়েছে, মামার ছেলে রাতুলের নাম শুনে।

অপর্ণার গলা শুনতে পেল, মা, আমি কালই বরোদায় ফিরে যাচ্ছি। টিকিটের ব্যবস্থা এখুনি অজয়কে বললেই করে দেবে।

না অপু, এত কষ্ট করে এই তো এলি, এরই মধ্যে…

মা আমি রাতুলের মুখও দেখতে চাই না।

কিন্তু রাতুল তো ফ্যামিলির সঙ্গে আসছে, তুই চিন্তা করিস না। ইগনোর করিস।

মা, তুমি সবসময় এই একই কথা বলো, ইগনোর কর। আমি কিছুতেই ওর মুখ দেখতে পারব না।

বাইরে দাঁড়িয়ে অনন্যা বুঝে ফেলে, কিছু একটা রহস্য আছে। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে। অপর্ণাকে বলে, দিদি তুমি কেন এখান থেকে যাবে? এটা তোমার বাপের বাড়ি, মানে তোমারও নিজের বাড়ি। তোমরা আমার আপন। তোমার কষ্ট মানে আমারও কষ্ট। আমাকে আপন ভেবে নিজের কষ্টের কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না?

অপর্ণা জড়িয়ে ধরে অনন্যাকে, নিশ্চই শেয়ার করব। এতদিনে তুইও আমার বড়ো আপন হয়ে উঠেছিস। রাতুল আমার মামার ছেলে। অত্যন্ত অভদ্র, রুঢ় এবং চরিত্রহীন। আমার বিয়ে কিছুদিন আগে এখানে এসেছিল এবং আমাকে একদিন একা পেয়ে আমার শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে। আমি চ্ঁযাচাতে এবং থাপ্পড় মারাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। অথচ ওকে কিছু বলার বদলে মা আমাকেই চুপ থাকতে বলে, ইগনোর করতে বলে। আমার বিয়েে আসেনি। এতদিন পর যখন আসছে, আমি ওর মুখও দেখতে চাই না।

অনন্যা ননদের হাত চেপে ধরে, তোমাকে ওর মুখ দেখতে হবে না দিদি।

কিন্তু ও তো আসছে!

সুগন্ধা চুপ করে ছিলেন। অনন্যা বলে, মা তুমি শুধু নও, অনেক মা-ই এমন করেন। মেয়েেই চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু বাড়ির সাপোর্ট না পেলে এই ক্ষত আরও গভীর হয়ে ওঠে মেয়েের মনে। সেদিন দিদির কাছে শোনার পর, রাতুলের গালে চারটে থাপ্পড় মেরে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তাহলে দিদিকে আজ চলে যাওয়ার কথা বলতে হতো না। যাই হোক, যা হওয়ার ছিল হয়েছে। দিদি তুমি একদম চিন্তা কোরো না। এছাড়াও দেখছি, যে যখন খুশি কলকাতায় মানে এখানে চলে আসছে। ফলে মা-কে একগাদা কাজ করতে হয়। মা মুখে কিছু বলেন না কিন্তু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমিও অফিসে থাকি। ইচ্ছে করলেও কোনও সাহায্য করতে পারি না। দিদিকে তো আমি কোনও ভাবেই কষ্টে থাকতে দেব না। বলেই অনন্যা তত্ক্ষণাৎ অজয়কে ফোন করল।

অজয়, প্লিজ একটা কাজ করতে হবে। মামাকে ফোন করে বলো, যে-হঠাৎই আমরা বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি। মা কিছু জানত না। তুমি সারপ্রাইজ দেবে বলে আগে থেকে টিকিট কেটে, কাউকে জানাওনি।

অজয়ে উত্তর কেউ শুনতে না পেলেও অনন্যার মুখ হাসিতে ভরে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, এখুনি ফোনটা করো। বলে ফোন কেটে দিল।

অপর্ণার মুখের উপর থেকে চিন্তার ছায়া কেটে গিয়ে হাসিতে মুখ ঝলমল করে উঠল। সুগন্ধার মুখে হাসি ফুটতেই অনন্যা সুগন্ধার কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, মা, এইসব করতে হয়। ভালোমানুষ হয়ে কাজ চলবে না। আমার মতো স্পষ্টবক্তা এখনকার দিনে দরকার। অজয় তোমার ভালোমানুষির অনেক গল্প শুনিয়েছে। কিন্তু আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি এসে গেছি।

এমন ভাবে কথাগুলো বলল অনন্যা, সুগন্ধা আর অপর্ণা জোরে হেসে উঠলেন।

সুগন্ধা অনন্যার চুলে বিলি কাটতেই ঝট করে অনন্যা উঠে বসল, আমার চুলে এখন হাত দেওয়া যাবে না মা, সবে স্ট্রেটনিং করিয়েছি।

সুগন্ধা হেসে হাত সরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধার ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলেন উমার ফোন। ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

উমা মহারাজের সম্পর্কে দু-চার কথা বলেই অনন্যার প্রসঙ্গে চলে এলেন, কী সুগন্ধা তোমার বেহায়া বউটার কী খবর?

দিদি, ওই বেহায়া বউটাই আমার মনের পুরো জায়গাটা জুড়ে বসে গেছে। আরও অন্য কিছু কথা বলে সুগন্ধা ফোন রেখে আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর কথায় উমাদি যথেষ্ট আশ্চর‌্য হয়েছেন।

ঘরে আসতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করল, পিসি কী বললেন?

কিছু না। ওই আমরা সবাই কেমন আছি।

কেন মা, জিজ্ঞেস করলেন না, বেহায়া মেযো নতুন কী খেল দেখাচ্ছে?

সুগন্ধা শক খেলেন, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ একথা বলছ কেন?

হেসে গড়িয়ে পড়ল অনন্যা। মা চিন্তা কোরো না। আমার খুব ভালো লেগেছে এই নামটা। আজকে দিদি আর তোমার কথা যেমন কানে এসেছিল, সেরকমই ওইদিনও পিসিমা আর তোমার কথাগুলো কানে গিয়েছিল। তোমাকে বললাম না, ভালোমানুষির যুগ শেষ। এখন চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়। কিন্তু এটা সত্যি আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। বলে সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরল অনন্যা।

অপর্ণা লক্ষ্য করছিল। হেসে বলল, মা, এটা কী হচ্ছে?

সরি সরি রে বাবা, বলে সুগন্ধা নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের কান ধরতেই তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠল। অনন্যা মিছিমিছি কলার তোলার ভান করে বলল, দেখলে তো, এই বেহায়া মেযে শাশুড়িকেও কান ধরিয়ে ছাড়ল।

তিনজনেরই মিষ্টি হাসিতে ঘরের ভিতরটা আনন্দে ভরে উঠল।

সংঘাত

সুখে থাকতে গেলে একজন মানুষের কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়? মানুষের উপর বিশ্বাসের? সম্পর্কের উপর আস্থার? সহানুভূতির? নাকি, অনেক অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে সুখ, যেরকম বলে থাকেন অনেকে। জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার রসদ, গলা ফাটিয়ে নিজের অধিকার ঘোষণা করার অধিকার– সুখে থাকার জন্য এইরকম কত বিষয়েরই না দরকার পড়ে!

কিন্তু সবসময় কি এই সবকিছু খুব সহজে মেলে? সহজে পাওয়ার রাস্তায় কত না বাধা। মানুষের রিপু বড়ো পরশ্রীকাতর। সে বড়ো হিংসুক। বড়ো লালসা তার! চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রতারণা, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, ছল– ইত্যাকার হাজাররকম প্রকাশ সেই লালসার। এই কি তবে মানুষের নসিব? মানুষ একটু সুখে থাকবে, তাতে আর একজন মানুষের খুব কি কিছু আসে-যায়, যদি না সেই সুখ অন্য কারও বঞ্চনার মাধ্যমে এসে না থাকে? যুক্তি বলে, যায় না। বুদ্ধি বলে, অবশ্যই যায়।

তাড়াহুড়ো করে স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে এই সব কথাই মনে মনে ভাবছিল সুজাতা। রোজ সকালে ঠিক এভাবেই অত্যন্ত ব্যস্ত পা ফেলে তাকে স্টেশনে আসতে হয়। অফিসযাত্রীদের ভিড়টা এসময়েই সবচেয়ে বেশি থাকে। পা মাড়িয়ে, কনুই দিয়ে সহযাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে মানুষের চলমান শরীরগুলো উন্মত্তের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কারওর অন্য কোনও দিকে হুঁশ নেই। মানুষ কি ধীরে ধীরে উন্মাদ বা পাশবিক হয়ে যাচ্ছে? কে জানে!

পিছন থেকে এসে একটা লোক সুজাতার পা মাড়িয়ে চলে যেতেই সে চাপা গুঙিয়ে উঠল। লোকটি বোধহয় একটু ভদ্রগোছের। সুজাতার গোঙানি শুনে অন্তত পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে গেল, ‘দুঃখিত’! হায়, দুঃখ প্রকাশে যদি শরীরের ব্যথা কিছুমাত্রাতেও কমত! যদিও ব্যথার দিকে পিছু ফিরে তাকানোর সময় সুজাতারও নেই। ভোরে বাড়িতে একটা ব্যাচ পড়তে আসে। তাদের পড়িয়ে উঠতে বেলা চড়ে যায়। অন্যান্য দিন যদিও সে কিছুটা সমবেদনামূলক ছাড় পায়, কিন্তু সেটি হওয়ার জো নেই আজ। স্কুলপরিদর্শনে সরকারের অফিসারেরা আসছেন। ছাত্রছাত্রীদের কালকেই সে পইপই করে বলে দিয়েছিল যাতে আজ কেউ কামাই না করে। সরকারি বাবুরা যদি দেখেন স্কুলে পড়াশুনা ভালো হচ্ছে, ছেলেমেয়েদর মধ্যে পড়ার এবং বাবা-মায়েদের মধ্যে তাদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা রয়েছে, তাহলে স্কুলের জন্য বাড়তি কিছু অনুদান চাইবার মুখটা থাকে।

কিন্তু এত সহজে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কিছুতেই। শেষমুহূর্তে ছেলেমেয়েগুলো যেন না ডোবায়।

মালতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভূগোলের দিদিমণি সুজাতা। মালতীপুর জায়গাটা খুব বড়ো হয়তো নয়, তবে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এ অঞ্চলে ধান খুব ভালো হয়। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান রিকশায় চেপে সুজাতা যখন স্কুলের দিকে যায়, রাস্তার দুধারে হলুদ হয়ে যাওয়া ধানগাছগুলি হাওয়ায় মাথা দোলাতে থাকে। মাটিতে বীজ পোঁতা থেকে, কচি সবুজ ধানগাছগুলির বেড়ে ওঠা, তারপরে সেগুলির সোনালি হতে থাকার প্রতিটি দৃশ্য এখন তার চেনা। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এত বর্ধিষ্ণু গ্রামেও বিকাশের লক্ষণগুলি তেমন স্পষ্ট নয়। টিউবওয়েলে ঠিকমতো জল ওঠে না, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা নামমাত্র। কে বলবে, এখানেও বছর-বছর ভোটের হাওয়া বয়। নেতাদের গরম বক্তৃতায় তেতে ওঠে সমাজজীবন। ভোট হয়ে যায়। উন্নয়নও ঝিমিয়ে পড়ে। জীবন চলতে থাকে সেই একইরকম শম্বুকগতিতে। তাই এখানে চাকরি করতে আসার ইচ্ছে থাকে না সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও। সুজাতাই কি পোস্টিংটা পেয়ে খুব খুশি হতে পেরেছিল?

তার অবশ্য অন্য সমস্যাও কিছু ছিল। তবে সবকিছুর উপরে, এখানে বদলি হয়ে আসতেও তার মন চায়নি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, কোনওরকম সামাজিক সুযোগসুবিধাহীন জায়গায় পঙ্গু হয়ে থাকার চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে?

তার উপর রাতুল এখনও যথেষ্ট ছোটো। শ্বশুর-শাশুড়িও বৃদ্ধ হয়েছেন। তবু যদি মনোময় কলকাতায় চাকরি করত, একটা কথা ছিল। তাকেও তো বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দিয়েছে।

সুজাতা তাই বাস্তবিক খুবই আতান্তরে পড়ছিল। অনুরোধে যদি কিছু হয়, সেই ভেবে সত্যপ্রিয় মজুমদারের কাছে পৗঁছেও গিয়েছিল একদিন। টাকমাথা, মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। সারাদিন পান চিবোচ্ছেন। দেখলেই মনে হয় ধুরন্ধর, ভোগী মানুষ। সব শুনে বাঁকা হেসে বললেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনি কি মনে করেন অসুবিধা আপনার একার? কিন্তু তাই বলে, লোকে শহর ছেড়ে নড়বে না, এরকম হলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষার হালটা কী দাঁড়াবে ভাবতে পারছেন?’

সুজাতা এরপরও তার নাচার অবস্থাটা আর একটু বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেছিল। সত্যপ্রিয়বাবু থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কত্তা তো ভালো পোস্টেই আছেন, তাই তো? তা আপনার আর টাকাপয়সার কী দরকার? অসুবিধা হলে ছেড়ে দিন না। আমরাও তো সেটাই চাই। আপনার পুরোনো লোকেরা সব বাস্তুঘুঘু হয়ে গেছেন। চাকরির বাজারের যা অবস্থা তাতে নতুন টিচার অনেক কম মাইনেয় পাওয়া যাবে।’

জিভটা মুহূর্তে তেতো হয়ে গিয়েছিল লোকটার চাঁচাছোলা বক্তব্য শুনে। কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সত্যপ্রিয়র চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল সুজাতা। সত্যিই তো, প্যানেলে এখনও শতসহস্র যুবক-যুবতি অপেক্ষা করছে চাকরি পাওয়ার জন্য। একটা জায়গা খালি হওয়ার খবর পেলেই তদ্বিরের ধুম পড়ে যায় বলে শোনা যায়। যার যেখানে যত প্রভাবশালী খুঁটি আছে, তাদের ব্যবহার করার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। কপালের শিকে তো এক-আধজনেরই ছেঁড়ে। আর সত্যপ্রিয় মজুমদারের মতো লোকেরা দিব্যি মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে যান।

তাকে ম্লানমুখে চেম্বারের বাইরে বের হতে দেখে রামকুমার দাঁড়িয়ে পড়ে। বগলে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে সে কোথাও যাচ্ছিল। সুজাতাকে দেখে গলায় খানিকটা শ্লেষ এনে কথা শুরু করে।

‘কী? হল না বুঝি?’– মুখে একফালি হাসি ঝুলিয়ে রাখল রামকুমার, যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে।

ম্লান হাসল সুজাতা, যার মানে, না।

রামকুমার বলল, ‘আপনাদের কিছু হবেও না। কেন হবে? এত বছর ধরে চাকরি করছেন, এখনও সরকারি কর্তারা কীসে তুষ্ট সেটা ধরতে পারলেন না?’

রামকুমার খুব অর্থবহ দৃষ্টিতে সুজাতার দিকে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ে গেল সহকর্মী তপতীর কথা। সাধারণ গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে তপতী। কিন্তু মেয়েটির বাস্তববোধ দেখার মতো। সুজাতাদের বয়সি হলেও তপতী তাদের থেকে বেশ খানিকটা পরিণত। বছরকয়েক শহরের জল পেটে পড়তেই, তপতী গ্রাম ছেড়ে এসে এখানেই একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট কিনে জমিয়ে বসল। বিয়ে-থা করেনি। গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এল।

সেই তপতীর আবার গ্রামে পোস্টিং হতে সে বেঁকে বসল। সুজাতাদের কাছে বলল, ‘এই অর্ডার আমি পালটে তবে ছাড়ব।’ বাস্তবে ঘটলও তাই। তপতীর বদলে অন্য কোন শিক্ষকের ঘাড়ে বদলির কোপটা পড়ল, তা অবশ্য সুজাতা জনে না। তপতী হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জানতে হবে, কোন পুরুষের কী চাহিদা! লোকটা বোকা ছিল বুঝলি! খুব বেশি আপস করতে হল না। বাঁ হাতের মুঠোয় আদর করে কিছু ছাপানো কাগজ গুঁজে দিতেই গলে গেল!’

আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তপতী বলল, ‘তুই চাইলে লোকটার সঙ্গে আমি একবার কথা বলে দেখতে পারি। খুব বেশি কম্প্রোমাইজ না করে যদি হয়ে যায় ক্ষতি কী? আর একটু-আধটু কম্প্রোমাইজ করলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় বল তো? পৃথিবীর প্রত্যেককে আপস করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে. কেউ কম করছে, কেউ বেশি। এত সতীপনা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে আজীবন!’

তপতীর চাপা গলায় বলা কথাগুলো কানে যেন গরম সিসের মতেই ঢুকল সুজাতার। সে মরে গেলেও পারবে না তপতীর মতো করে ভাবতে। কঠিন গলায় বলল, ‘না, তার দরকার হবে না!’ তক্ষুনি তার চোখের সামনে মনোময়ের সহজ ঋজু চাহনিটা ভেসে উঠেছিল।

আজকাল পনেরো দিনে একবার বাড়িতে আসার সুযোগ পায় মনোময়। আর তাই নিয়ে তার খেদের অন্ত নেই। যে দু-একদিন বাড়িতে থাকে মনোময়, সুজাতার ইচ্ছে করে না তাকে ছেড়ে দূরে যেতে। এটা শুধু প্রেমের জন্য নয়। নির্ভরতার জন্য, বলা যেতে পারে। মনোময় একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে। সকাল-সন্ধে কাজের মাসি এসে তার জন্য রান্না করে চাপাঢাকা দিয়ে রেখে চলে যায়। অধিকাংশ দিন সেই ঠান্ডা খাবারই গিলতে হয় তাকে। সুজাতার বুকটা ভেঙে যায় এসব কথা শুনে। মনোময় বোঝে। তাই আজকাল ক্লিষ্ট হাসি ঠোঁটে টেনে এনে বলে, সে ভালো আছে।

সুজাতা এখন দিব্যি বোঝে, সেই ভালো থাকার মানে কী! সকালের ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে ঘণ্টাদেড়েক যাত্রার পর, কম করে দু-কিলোমিটার হাঁটা। তবে পৌঁছোনো যায় স্কুলে। সেদিন অংকের বিনোদবাবু বলছিলেন, ‘আপনি একটা সাইকেল কিনে নিন মিসেস মিত্র। এখানে একটু খোঁজখবর নিলে পুরোনোও পেয়ে যেতে পারেন। স্টেশন থেকে স্কুলে আসবেন, আবার ফেরার সময় স্টেশনে রেখে বাড়ি চলে যাবেন।’

সুজাতাও দেখেছে, গ্রামের রাস্তায় মেয়েরা এখানে সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন্তু সুজাতার বড়ো সংকোচ হয়।

ইংরেজির বিনতা মিস বলেছিলেন, ‘একটা কথা তোকে বলে রাখি সুজাতা। আমাদের গ্রামটা আর আগের মতো নেই বুঝলি? পাশের গ্রামে পলিটিক্যাল মারামারি নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই খুনজখম হয় বলে শুনি। তার ছোঁয়াচ এ গ্রামেও লাগছে। কাজেই সাবধানে রাস্তা চলবি । তুই নতুন লোক। কখনও রাত করে ফিরবি না।’

বিনোদবাবু বললেন, ‘শুধু পলিটিক্যাল বলছেন কেন? আমাদের স্কুলের কতগুলো মেয়ে গত দু-তিন বছরে উধাও হয়ে গেছে কেউ খোঁজ রেখেছে? সব নারীপাচারের ব্যাপার, বুঝলেন মিসেস মিত্র! কেউ দেখার নেই!’

বিনোদবাবু খেদের সঙ্গে জিভে শব্দ করলেন। ভয়ে শিউরে উঠছিল সুজাতা। সব শুনে মনোময়ও কম উদ্বিগ্ন হল না। বলল, ‘তোমার ছুটিছাটা জমা নেই? কোনওমতে ওসব নিয়ে এ বছরটা কাটিয়ে দাও সুজাতা। সামনের বছর দেখি, কাউকে ধরেকরে কিছু করা যায় কিনা!’

বিছানায় শুয়ে থাকা মনোময়ের শরীরের উপর নিজেকে হিঁচড়ে তুলে এনে সুজাতা বলল, ‘আর ততদিনে আমার যদি একটা কিছু হয়ে যায়? তুমি এত দূরে থাকো, তুমি তো খবরও পাবে না! আমার খুব ভয় করে।’

মনোময় বলল, ‘ভয়ের কী? তুমি একা অত দূরে চাকরি করতে যাও? আরও অনেকে ওই স্টেশনে বা কাছাকাছি স্টেশনে নামে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে। তোমরা দল বেঁধে যাওয়া-আসা কোরো। দেখবে কোনও বিপদ থাকবে না।’

মুখে এ কথা বলে সুজাতার মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করলেও মনোময়ের গলায় যেন জোর নেই। সুজাতাও হয়তো সেটা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছুই করার নেই, মনে করে চুপ করে রইল দুজনেই।

দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেতকে সাক্ষী রেখে ট্রেনটা ছুটছে। সুজাতাদের স্কুলের হেডমাস্টার অভ্রনীল দত্ত, বিপ্লবী মানুষ। একসময় নাকি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু রাজনীতির ক্লেদটা নিজের চোখের সামনে দেখার পরেই এক মুহূর্ত আর থাকেননি তার মধ্যে। ইদানীং বেশ হালছাড়া হতাশ গলাতেই কথাবার্তা বলে থাকেন। একদিন স্টাফরুমে সুজাতাকে ঝুঁকির কথা বলতে শুনে, নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘খুব বেশি ভেবো না এসব নিয়ে সুজাতা। পৃথিবীটা এরকম-ই। এভাবেই চলবে। তুমি আর আমি কিছু ভাবলেই যে সেটা হয়ে যাবে, এমন নয়। আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি, আমার কিংবা তোমার মতে কিছুই হওয়ার নয়।’

তারপর থেকে প্রবীণ এই শিক্ষকের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেল সুজাতার।

মানুষের সত্ত্বা সবসময়ই দ্বৈত। যে-অভ্রনীল অন্য সময় সুজাতাকে স্ত্বান্না দেন, সেই তিনিই কোনও কোনওদিন চরম বিরক্তিতে বলে ওঠেন, ‘ভেবে দ্যাখো একবার, সরকারি যোজনাগুলিকে গ্রামীণ জনতার কাছে পৗঁছে দেবে কে? না আমরা। পোলিয়ো ড্রপস খাওয়ানোর প্রচার কে করবে? আমরাই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের বোঝাবে, গ্রামীণ মানুষের মনে গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ ঘটাবে, সাক্ষরতা অভিযান চালাবে, বিনে পয়সার বই বন্টন করবে, বাচ্চারা স্কুলে না এলে বাড়ি থেকে টেনে আনবে, সরকারি কর্তারা এলে জলপানির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, আমরা!’

হেডমাস্টারমশাইয়ের কথাটা যে কত দূর সত্যি, তা আজ হাড়ে-হাড়ে টের পেল সুজাতা। দশটা বাজতে না বাজতে স্কুলের সামনে এসে হাজির হয়েছে ধুলোমাখা দুটো গাড়ি। ঝটপট দরজা খুলে চার-পাঁচজন মানুষ নেমে এলেন। ততক্ষণে তাদের দেখতে গ্রামের কৗতূহলী মানুষজন ভিড় করেছে। আজ স্কুলে অ্যাটেনডেন্স একশো শতাংশ। এর পুরো কৃতিত্বটাই অবশ্য স্কুলের অশিক্ষক কর্মীদের। অভ্রনীলের একটা বড়ো চিন্তা তাতে দূর হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সুজাতারাও।

সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতার নাম জয়ন্ত গুহ। ক্লাসগুলো খুব কম সময়ে পরিদর্শন করে ফিরে এলেন স্টাফরুমে। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসলেন সরকারি প্রতিনিধিরা। তাদের ফেরার তাড়া আছে। ফলে একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে তারা রাজি নন।

জয়ন্ত গুহ গম্ভীর চোখে হেডমাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের কথাও শুনি–!’

খুকখুক করে একটু কেশে নিলেন অভ্রনীল। তারপর বললেন, ‘আমাদের স্কুলবাড়িটার অবস্থাটা তো নিজের চোখেই দেখলেন স্যার। আমাদের এ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে অনেকবার বলেছি। কাজ হয়নি। আরও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, স্কুলে যে-টিউবওয়েলটা আছে, তাতে জল ওঠে না ঠিকমতো। বাচ্চারা জল খেতে পারছে না। স্কুলের মূল দরজাটা চুরি হয়ে গেছে। সকালবেলা এসে আমরা দেখতে পাই অবলা জীবের বিষ্ঠায় ভরে আছে ক্লাসঘর। পরিষ্কার না করলে ভদ্রভাবে বসা পর্যন্ত যাবে না। কে পরিষ্কার করবে? এখানে তো  কোনও সাফাইকর্মীও নেই!’

অভ্রনীল হাঁফিয়ে উঠলেন সমস্যার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে। জয়ন্ত গুহরা নিশ্চয়ই সব জায়গাতে গিয়েই এমন ফিরিস্তি শুনতে অভ্যস্ত। তাই, তার মুখেচোখে কোনও ভাবান্তর ধরা পড়ল না। কেবল বললেন, ‘সমস্যা কোথায় নেই অভ্রনীলবাবু? এই তো, আমরা শহর থেকে আসছিলাম। আসার পথে গাড়ির টায়ার গেল ফেটে। এটা সমস্যা নয়?’

জয়ন্ত গুহের রসিকতায় তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা হেসে উঠলেন।

জয়ন্ত তাদের থামিয়ে বললেন, ‘যাক সে কথা। ঘটনা হচ্ছে, অভ্রনীলবাবু, আমি আপনাদের কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে আসিনি। স্কুলের ডেভেলপমেন্টের জন্য পঞ্চায়েতের কাছে সরকারি টাকাপয়সা আছে। এত দূর থেকে আমরা তো আর সবটা দেখে উঠতে পারি না! আপনাকেই প্রধানের সঙ্গে বসে সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিতে হবে। তবে একটা কথা, মিড-ডে মিলের ব্যাপারে সরকার কিন্তু এখন খুবই কড়া। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাজেই ওই প্রকল্পটা যাতে ঠিকভাবে চলে সেটা দেখবেন।

‘মিড-ডে-মিল?’ অভ্রনীল আঁতকে ওঠেন, ‘সত্যি বলতে কী জয়ন্তবাবু, সপ্তাহে তিনদিনের বেশি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না হয় না। বাসনপত্র নেই। জ্বালানি কেনার টাকা পাওয়া যায় না। আপনারা কেবল আমাদেরই দোষ দেখেন!’

অভ্রনীল রেগে উঠতে গিয়েও উলটোদিকে বসে থাকা সুজাতার ভয়ার্ত মুখচোখ দেখে চুপ করে যান। সরকারি লোকেদের কাছে কোন বিষয়গুলি তুলে ধরা হবে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মিটিংয়ে মিড-ডে মিলের বিষয়ে প্রবলভাবে সরব হয়েছিলেন অভ্রনীল। তার বক্তব্য ছিল, একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক এইবার। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাচ্চারা মিড-ডে মিলের মতো সরকারি প্রকল্প থেক বঞ্চিত হবে, আর সব দোষটা এসে পড়বে শিক্ষকদের উপর– এটা চলতে পারে না।

তখনই অজানা আতঙ্কে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিল সুজাতার। মরিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘এমন চরম মনোভাব নেওয়া ঠিক হবে না স্যার। আপনি মোটরসাইকেলে গ্রামের মধ্য দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করেন। কেউ যদি আপনাকে একা পেয়ে অপহরণ করে, তাহলে? আপনি আছেন বলেই আমরা জোর পাই।’

‘তা বলে কি চুপ করে থাকব দিনের পর দিন?’ অভ্রনীল রেগে গিয়েছিলেন সেদিনও। তারপর নিজেকে সামলে, শান্ত গলায় বললেন, ‘মনে রেখো, এটা আমার গ্রাম। আমার মাতৃভূমি। আমার কিছু অধিকার আছে। পাঁচটা মানুষ আমায় সম্মান করে। সবকিছু এত সহজ হবে না।’

ভূগোলের দিদিমণি চিত্রা সমর্থন করেছিল সুজাতাকে। বলল, ‘আমার মনে হয় সুজাতা ঠিক কথাই বলেছে স্যার। আপনি না হয় এখানকার ভূমিপুত্র। আমরা তো তা নই। সকালবেলা সংসার গুছিয়ে রেখে শহর থেকে এখানে আসি চাকরি করতে। কাজেই, আমার মনে হয় কৗশল নিয়ে চলাই সমীচীন হবে।’

অভ্রনীল খানিকটা থমকে গেলেন শিক্ষিকাদের প্রত্যুত্তরে। শেষে নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘কৗশল কাকে বলে, আপনারাই বলে দিন আমায়। প্রধানের কাছে মিড-ডে মিলের টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী আসে। সেগুলো ঠিকমতো দেওয়া হয় না। আংশিক দেওয়া হয়। হেডমাস্টারের আলাদা ঘর আছে। কিন্তু প্রথমত সেটি জরাজীর্ণ, বসার অযোগ্য, উপরন্তু পঞ্চায়েত মেম্বারের বাড়ির পশুখাদ্য সব ওখানেই থাকে, আপনারা জানেন। স্কুলবাড়িটা ভেঙে পড়ছে, কারওর নজর আছে সেদিকে? সরকারি লোকজন তো দেখেশুনে আমাদেরই দোষ দেবেন। বলবেন, আপনারাই ঠিকভাবে যত্ন নেননি। শাস্তিও দিতে পারেন তারা। তখন কোন কৌশলটা কাজে লাগবে বলুন তো!’

সুজাতা আর কোনও কথা বলেনি। চিত্রাও চুপ করেই ছিল। কারণ ওরা সকলেই জানত, অভ্রনীল যতই গলা ফাটান, সে কেবল অরণ্যেরোদন ছাড়া অন্য কিছু হবে না। এই গ্রামে প্রধানের প্রতিপত্তি সীমাহীন। সামনে অবশ্যই একটা ভদ্রতার আড়াল আছে। কিন্তু বাস্তবে যে তার ভয়ংকর লোকলস্করের সঙ্গে ওঠাবসা, এ কথাও গ্রামে সকলে জানে। তাই কেউ মুখ খোলে না। কে জানে, কোন কথায় আবার কোন সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে!

অভ্রনীলের অভিযোগ লোকটি নতমস্তকে শুনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যাবে– এটাই তো ঘটেছে বারবার।

সরকারি প্রতিনিধিরা আসার আগেরদিন অভ্রনীল নিজেই স্কুল বসার আগে একজন মজুরকে ডেকে এনে গোটা স্কুল সাফ করালেন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। সুজাতা অবশ্য বলছিল, সে-ও অর্ধেক খরচ দেবে। স্কুল সাফ করা কি একা হেডমাস্টারের দায়িত্ব?

অভ্রনীল রাজি হননি। গলা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘গতকাল রাতে নিজেকে অনেক বোঝালাম সুজাতা। কিন্তু মন সায় দিল না আপসে। বাস্তব পরিস্থিতি যা, তাকেই সামনে না এনে উপায় নেই সুজাতা। কাউকে আড়াল করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।’

সুজাতা চুপ করে রইল। এক অদ্ভুত মানসিক দোলাচল তাকে ক্রমাগত পীড়িত করছে।

অভ্রনীল ফের বললেন, ‘ভয় পাচ্ছ?’

সুজাতা ক্লিষ্ট হেসে জবাব দিল, ‘একটু।’

অভ্রনীল বললেন, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না, দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই, মরব না’– শুনেছ তো এই রবীন্দ্রসংগীতটা? তাহলে? সমস্যার প্রতিকার তো একদিন কাউকে না কাউকে করতেই হবে। তাহলে আমরাই বা নই কেন? এখনই বা নয় কেন?’

জয়ন্ত গুহ পোড়খাওয়া আমলা। ফুঁসে উঠলেন, ‘দোষের ভাগি তো আপনাকেও হতে হবে অভ্রনীলবাবু। এই স্কুল দেখাশোনার দায়িত্ব সরকার আপনার উপর সঁপেছে। ইস, কী অবস্থা করেছেন স্কুলটার! চোখে দেখা যায় না!’

অভ্রনীল ম্লান হেসে বললেন, ‘কেন কিছু হয়নি, সবই আপনাকে বলেছি স্যার। তারপরও…!’

জয়ন্ত গুহর পাশে বসে থাকা অন্য অফিসারটি এবার মুখ খুললেন, ‘ঞ্জসব বাহানা না হয় না-ই শোনালেন! আমরা সবকিছুই জানি। গ্রামের বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসা শিক্ষক স্কুলেই আসেন না। কেবল মাইনে নেন। আমরা এও জানি, সেই মাইনে থেকে সামান্য টাকা গ্রামেরই কোনও বেকার যুবককে দিয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষকতার কাজটা করিয়ে নেন।’

জয়ন্ত গুহ হাসেন, ‘যা হোক, এটুকু দায়িত্ববোধ তো তাদের আছে, কী বলো সরকার! এটুকু অন্তত বোঝে যে, স্কুলটা খুলতে হবে।’

সরকার বলে যেতে থাকেন, ‘আমরা জানি, এ স্কুলেও সেই ঘটনা ঘটে। প্রধানসাহেব আমাদের সবই জানিয়েছেন। লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ হবে না অভ্রনীলবাবু।’

অভ্রনীল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে। বলতে গেলেন, তার স্কুলে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তিনি গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এইসময় বিনোদবাবু এসে তার কানে কিছু যেন বললেন। মিটিং ছেড়ে বাইরে এলেন অভ্রনীল। গ্রামের প্রধান অরূপ মাইতি এসেছেন। মুখে বিগলিত হাসি। দেখেই মনটা বিষিয়ে উঠল অভ্রনীলের। ভ্রূদুটো কুঁচকে গেল।

প্রধান বললেন, ‘মাস্টারমশাই, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’

অভ্রনীল প্রমাদ গুনলেন।

প্রধান বললেন, ‘শহর থেকে বাবুদের যে-দলটা এসেছে, তারা আজ এখানেই থাকবেন। কাল এখান থেকেই অন্য জায়গায় স্কুল পরিদর্শনে যাবেন। ওদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়।’

অভ্রনীল বললেন, ‘পঞ্চায়েত করুক। আমায় বলছেন কেন?’

প্রধান বললেন, ‘সে তো করবই। কিন্তু, আপনার স্কুলের দুই দিদিমণিরও বাড়ি যাওয়া চলবে না। বাবুদের একটু যত্নআত্যি…!’

প্রধানের কথা শেষ করতে দিলেন না অভ্রনীল। বলে উঠলেন, ‘ওরা অনেক দূর থেকে আসেন। সংসার, ছোটো বাচ্চা আছে। ওদেরকে তো ছাড়তেই হবে ভাই!’

‘ছাড়তেই হবে, মানে?’ প্রধানের গলা চড়ে যায়, ‘ঞ্জই স্কুলে চাকরি করতে হলে ওদের যে এটুকু করতেই হবে মাস্টারমশাই!’

অভ্রনীলের যে কী হয়ে গেল, হঠাৎই হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন প্রধানের গালে। অরূপ মাইতির টকটকে গায়ের রং ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। তাকে কিছু বলতেও হল না। তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভ্রনীলের উপর।

তার পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য অবশ্য প্রস্তত ছিল না সুজাতা। সমস্ত ক্লাসঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছেলেমেয়েদের দল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুষ্কৃতীদের উপর। আর অভ্রনীল দূর থেকে চ্যাচাঁচ্ছেন, ‘ওরে ছেড়ে দে। মারের পালটা মার নয়।…’ কিন্তু তার দুচোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।

ভাঙা বনেদ

সুমির সঙ্গে অতনুর পরিচয় হয় একটি আর্ট গ্যালারিতে। পাঁচ মিনিটের আলাপেই দু’জনের মধ্যে বিজনেস কার্ড-এর আদানপ্রদানও সারা হয়ে যায়।

অতনুকে নিজের বিজনেস কার্ড-টা ধরাতে ধরাতে সুমি বলল, ‘এটা আমার কার্ড। এখানে আমার স্টুডিওর নামটা আর ঠিকানাটা দেওয়া আছে। আমার নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে। ওখানেই আমার সব পেইন্টিং-এর ছবি রয়েছে এবং দামও দেওয়া আছে।’ কার্ডে দেওয়া লিংক-টাতে আঙুল রেখে সুমি অতনুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল।

‘হ্যাঁ, ভালোই হল। আমি আপনার সব পেইন্টিংগুলো দেখতে চাই। দেখা হলে টেক্সট ম্যাসেজ করে আপনাকে ফিডব্যাকটা জানিয়ে দেব। এমনিতে প্রায় শহরের কোনও আর্ট এগ্জিবিশন আমি দেখতে বাদ রাখি না, কিন্তু আপনার মতো শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার সুযোগ কখনও হয়নি। আপনার প্রত্যেকটা ছবির যেন কোনও না কোনও বক্তব্য আছে। স্টাইলাইজড্ ফর্ম হলেও তা ভীষণভাবে মৌলিক। কার্ডটাতে চোখ বোলাতে বোলাতে অতনু সুমিকে নিজের বক্তব্য জানাল।

‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। স্টে ইন টাচ।’ সুমি হেসে উত্তর দিল। এই ছোট্ট আলাপে সুমির মনে হল, অতনুর মতো তার শিল্পের এত বড়ো অনুরাগী সারা পৃথিবীতে আর নেই।

পাঁচ মিনিটের বেশি অতনুর সঙ্গে কথা হয়নি কিন্তু গ্যালারিতে সুমির চোখ সর্বক্ষণ অতনুর দিকেই নিবদ্ধ রইল। অতনুর আকর্ষণ সুমি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছিল না। যতক্ষণ অতনু গ্যালারিতে রইল সুমির প্রত্যেকটা ছবি সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং ছোট্ট একটা নোটবুকে অতনুকে কিছু লিখে রাখতেও দেখল। ছেলেটি শিল্পের কদর করতে জানে, এই একটা কথাই অতনুর হাবভাবে সুমির মনে হল।

এই ঘটনার পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অতনু সুমিকে কন্ট্যাক্ট করার যেমন চেষ্টা করেনি সুমিও অতনুর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি।

এই ক’মাসের মধ্যে ওয়েবসাইট থেকে সুমির মাত্র দুটো তিনটে ছবিই বিক্রি হয়েছে। সুমি নানা ভাবে নিজের ছবির প্রচার চালাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। চেনা-অচেনা সুমি পরোয়া করেনি। নিজের ওয়েবসাইটের লিংক সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুমির একটাই লক্ষ্য– পেইন্টিংয়ের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজের জন্য একটা জায়গা বানানো। মানসিক এই চাহিদা পূর্ণ করার লক্ষ্যে সুমি অতনুকেও একটা মেসেজ করে, ‘আপনি যদি আজকে ফ্রি থাকেন তাহলে একসঙ্গে কফি খাওয়া যেতে পারে।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে অতনুর ‘ফ্রি আছি’ শব্দটা সুমিকে দ্বিধার মধ্যেই ফেলে দেয়। পাঁচ মিনিটের আলাপের পর দীর্ঘ ছ’মাসের বিরতি। আর আজ এতদিন পর সুমি নিজের দরকারে একটা মেসেজ পাঠাতেই সঙ্গে সঙ্গে কফি খাওয়ার জন্য আসতে রাজি! একটু অস্বাভাবিক নয় কি? সুমি, অতনুর হ্যাঁ-এর উত্তরে আর কিছু লিখল না মেসেজে।

‘পৃথিবী-টাই বড়ো অদ্ভুত’, মনে মনে বলল সুমি। ঘটনাটা মনের এক কোণায় সরিয়ে রেখে নিজের আসন্ন আর্ট এগ্জিবিশন নিয়ে সুমি মেতে উঠল।

হঠাৎই কাজের মধ্যে একদিন সুমির কাছে অতনুর ফোন এল, ‘হ্যালো সুমি, সেদিন আপনি কফি খাওয়ার জন্য ডাকলেও যে-কোনও কারণেই হোক প্ল্যান-টা ম্যাচিওর করেনি। চলুন একটা দিন ঠিক করে কফি শপ্-এ দু’জনে বসা যাক।’

‘কিন্তু আপনি আমাকে চেনেন না আর আমাদের পরিচয় মাত্র পাঁচ মিনিটের। দু’জন একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না প্রায়। সুতরাং একসঙ্গে বসে কফি খাওয়ার কোনও মানে নেই। আমি আমার কাজের জন্যই আপনাকে আগে মেসেজ করেছিলাম। এর অর্থ এটা ধরে নেবেন না যে, আমি আপনার সঙ্গে বে-ফালতু টাইম পাস করতে আগ্রহী,’ সুমির নিজেরই নিজেকে বড্ড রুড মনে হয়।

‘সুমি, আপনার আর্ট, আপনার শিল্পকলা আমাকে আকর্ষণ করে। আপনার শিল্পের গভীরতায় আমি মুগ্ধ। আপনার ছবিকে মাধ্যম করে আপনাকে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। এতে আপনার প্রতি আমার সম্মান দিনে দিনে বেড়েছে। একদিন দেখবেন আপনার সৃষ্টি আপনাকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেবে। প্রতিটি খবরের কাগজে আপনাকে নিয়ে লেখা বেরোবে। এই জার্নিটায় আমি কি আপনার একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু হতে পারি না?’

নিজের প্রশংসা কার না ভালো লাগে? অতনুর কথাগুলোর প্রভাব পড়তে শুরু করে সুমির উপরে। অতনুর প্রশংসা বাক্যের সম্মোহনী শক্তি সুমিকে আকর্ষণ করতে থাকে অতনুর দিকে। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুমি অতনুর সঙ্গে কথা বলতে থাকে। মনের সুপ্ত বাসনাগুলো শিকড় মেলতে শুরু করে।

‘সুমি, তোমার সঙ্গে যত মিশছি, কথা বলছি, তোমার প্রতি সম্মান আমার ততো বাড়ছে। সারা পৃথিবীর মানুষ একত্র হলেও তোমার প্রতি আমার এই মনোভাব কখনও ভাঙতে পারবে না। কতদিন হয়ে গেল, তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছি, অথচ এখনও একসঙ্গে বসে আমাদের কফি খাওয়া হল না,..’ প্রথম আড়ষ্টতা কাটিয়ে, অতনু এবার অনেকটা স্পষ্টবাক।

সুমির সব প্রতিরোধের দেয়াল মুহূর্তে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায় দিনই অতনুর সঙ্গে সুমির দেখা হতে থাকে। সামান্য পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। সুমি জানতে পারে অতনু বিবাহিত। ওর তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। ওর স্ত্রী মীনাক্ষী কলেজে ইতিহাসের প্রফেসর। অতনু নিজে কোনও কাজ করে না।

‘আমার কাজ করার দরকারটা কী? আমার বাবা বিধায়ক ছিলেন, সারাজীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। আমিও বিধায়কের টিকিটের জন্য দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি। আশা করছি এবার টিকিট পেয়েই যাব। হাজার-দু’হাজার টাকার চাকরি আমার জন্য নয়,’ গর্বের সঙ্গে অতনু সুমিকে বলে।

‘চাকরিতে যখন তোমার এতই ঘেন্না তাহলে মীনাক্ষীর মতো চাকুরিরতাকে কেন বিয়ে করেছ?’ সুমি জিজ্ঞাসা না করে পারে না।

‘মীনাক্ষীকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু ওর ওই এক জেদ, চাকরি কিছুতেই ছাড়বে না। অথচ বিয়ের আগে ও আর ওর পরিবারের লোকেরা প্রমিস করেছিল বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেবে। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মীনাক্ষী এতটা বদলে যাবে বুঝতে পারিনি। চাকরি ছাড়তে কিছুতেই রাজি হল না। আসলে ওর কোনও ধারণাই নেই বিধায়কের বাড়ির বউয়ের চাল-চলন কীরকম হওয়া উচিত।’ আত্মগর্বে এবং অহংকারে অতনুর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে।

অতনুর উত্তর শুনে সুমির মাথায় শঙ্কার ঘন মেঘ ঘনিয়ে আসে। সুমির কাছে সংকেত আসে, ভুল মানুষের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু অতনুর প্রশংসা আর ওর বিধায়ক বাবার পরিচিতির বিশাল পরিধির মাঝে থাকতে পারলে সুমির লাভ বই ক্ষতি নেই– এই বোধটাই সুমিকে নিজের মনের বিপদের ঘণ্টাটাকে উপেক্ষা করেই অতনুকে আঁকড়ে ধরতে চায়।

একদিন কফি শপে কফি খেতে খেতে অতনু সুমিকে বলে, ‘মন্দিরের মূর্তির মতো আমি মনে মনে তোমাকে পুজো করি। আমি তোমাকে যা-যা বলি শুধু শুনে যেও তুমি, মনের মধ্যে রেখো না তাহলে কষ্ট পাবে। তবে এটাও ঠিক, আমি বিবাহিত, তোমার হাত ধরে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘আমি জানি তুমি বিবাহিত। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আমি কোনও আশা রাখি না। কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না যখন আমরা দু’জনেই জানি আমরা এই পথে বেশিদূর এগোতে পারব না, তখন মিছিমিছি এই ভাবে দেখা করার কী লাভ?’ সুমি জিজ্ঞেস করে।

‘তোমার প্রতিভা-কে সম্মান করি। তোমাকে সাফল্যের চূড়ায় দেখতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই আশা করি না। শুধু ভালো বন্ধু হিসেবে তোমাকে সাফল্য পেতে সাহায্য করতে চাই। আসছে বছর থাইল্যান্ডে ফাইন আর্টস-এর একটা বড়ো প্রদর্শনী আছে। সেখানে যোগদান করার সব ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে ললিত কলা অ্যাকাদেমি স্কলারশিপও পাইয়ে দেব। আমার বাবার বড়োবড়ো কনট্যাক্টস আছে। সুতরাং তোমার জন্য এইটুকু করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। তোমার দুটো-চারটে ইন্টারন্যাশনাল প্রদর্শনী হয়ে গেলেই দেখবে তুমি বিখ্যাত হয়ে উঠেছ।’

অতনুর কথা শুনে সুমি উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সুমির মনে হল ও বিখ্যাত হতে পারুক চাই না পারুক, অতনুর মতো মানুষ তার প্রশংসা করছে, এর চেয়ে বড়ো পাওয়া আর কী হতে পারে?

রোজই নানা ছুতোয় অতনু আর সুমির দেখা হওয়া শুরু হল। সুমি বুঝতে পারল তার প্রতি অতনুর ব্যবহারটা শুধু বন্ধুত্বে আটকে নেই। অতনু আরও কিছু চাইছে ওর কাছে। আগে দেখা হলেই পেইন্টিং সম্পর্কে আলোচনা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে অতনুর কথার ধরন বদলাচ্ছে লক্ষ্য করল সুমি –

‘একটা জিনিস চাইব তোমার কাছে?’

‘কী?’

‘আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে চাই।’

‘একদমই না। এরকম ভুলভাল ইচ্ছা না হওয়াই ভালো।’

‘প্লিজ, শুধু একবার। জানো আমার কী মনে হয়?’

‘কি?’

‘মনে হয় তোমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সময়কে বরাবরের মতো থামিয়ে দিই। সময় নেই, অসময় নেই, চোখ খুলে বন্ধ করে সবসময় তুমিই আমার সমস্ত মন জুড়ে থাকো।’

সুমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মুখে সে যতই বলুক, তার মন-ও তো এটাই চাইছিল। তার শুভবুদ্ধি তাকে সাবধান করা সত্ত্বেও সুমি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই অতনুর বুকে নিজেকে সঁপে দেয়।

সর্প কুণ্ডলীর মতো অতনুর দুটো বাহু সুমিকে জড়িয়ে ধরে। সুমির মনে হয় কোনও গভীর অতল থেকে ভেসে আসছে অতনুর গলার স্বর, ‘সুমি আমি তোমাকে উচ্চতার শিখরে দেখতে চাই…’

সম্বিত ফেরে সুমির। নিজেকে অতনুর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে অতনুকে অনুরোধ করে, ‘প্লিজ এবার আমাকে বাড়ি যেতে দাও। কাল সন্ধের মধ্যে আমাকে আরও দুটো পেইন্টিং শেষ করতে হবে।’

‘ঠিক আছে, যাও ছেড়ে দিলাম… কিন্তু প্রমিস করো কাল-পরশুর মধ্যে আবার দেখা করবে। এই সপ্তাহের শেষে তোমার সম্পর্কে বাবার সঙ্গে কথা বলব। ললিত কলা অ্যাকাডেমির স্কলারশিপটা নিয়ে তাড়াতাড়ি এগোনো দরকার।’

দু’দিন বাদেই অতনু আর সুমি ওদের পছন্দের কফি শপে মুখোমুখি হল। আগের দিনের প্রচণ্ড বৃষ্টির পর সকালের নরম রোদ্দুরে গা ভাসাতে ইচ্ছে করছিল সুমির। অতনুর ফোনটাও এসেছিল সময় বুঝে। রেস্তোরাঁর নিমন্ত্রণটা সুমি তখনই পেয়েছিল। ভাবার জন্যে এক মুহূর্তও নষ্ট করেনি। কফি খেতে খেতে অতনু বলল, ‘চলো পাশের পার্কটাতে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। আজ দিনটা বেশ ভালো। কাল বৃষ্টি হওয়াতে গরম নেই বললেই চলে।’

পার্কের বেঞ্চিতে পিঠ এলিয়ে দিয়ে অতনু সহজ হবার চেষ্টা করে। ‘সুমি আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। একথা আমরা দুজনেই আর অস্বীকার করতে পারি না। মনের বন্ধন যেখানে আছে, সেখানে শরীরকে শাসন করতে চাইছ কেন?’

সুমি চুপ থাকতে পারল না। উত্তর দিল, ‘তুমি ঠিক কী বলতে বা বোঝাতে চাইছ অতনু?’ যদিও অতনুর ইচ্ছা দিনের মতোই পরিষ্কার ছিল সুমির কাছে তবুও না বোঝারই ভান করল সুমি।

আমার এই ইচ্ছে নতুন তো কিছু নয় সুমি। তুমি জানোই যে আমি বিবাহিত এবং শহরে বাবার একটা সম্মান আছে সুতরাং এই সম্পর্কটাকে কোনও পরিণতি দেওয়া হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তোমার সঙ্গে যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে আরও কিছু পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?’

কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই অতনু সুমিকে টেনে নিয়ে একটা মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সুমি টের পেল অতনুর তপ্ত নিঃশ্বাস ওর মুখের উপর এসে পড়ছে। তার নিজের ঠোঁটের উপর অতনুর ঠোঁট এসে প্রতিরোধের সব ক্ষমতা সুমির লুপ্ত করে দিল। সমস্ত শরীরময় অতনুকে অনুভব করছিল সুমি অথচ কোনও প্রতিরোধ কাজ করছিল না।

নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সুমি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুদিন ধরে নিজের আঁকা আর অতনুকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে ফ্ল্যাটটা অগোছালো হয়েই পড়ে আছে। আজ পরিষ্কার না করলেই নয়। সুমির মা-বাবা নিজেদের পৈত্রিক বাড়িতেই থাকেন শহরের উত্তর অংশে নিজের অন্য ভাইদের সঙ্গে। মেয়ের কাজের সুবিধার জন্য ছোট্ট ফ্ল্যাটটা সুমির বাবাই সুমিকে কিনে দিয়েছেন।

ফ্ল্যাটটা গোছগাছ করে সুমি বিছানায় এসে বসল। আজ অনেক দিন বাদে নিজের বিবেকের সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ ঘটল সুমির। পার্কে সময় কাটিয়ে অতনুই নিজের গাড়িতে সুমিকে ফ্ল্যাটে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল। অবধারিত ভাবে দুটো প্রাপ্ত বয়স্ক শরীর ডুবে গিয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল, পূর্ণতার লক্ষ্যে। অতনুর সঙ্গে তার এই সম্পর্কটার কী নাম দেওয়া যেতে পারে? সুমি ভালো করেই জানে অতনুর সঙ্গে যে রাস্তায় সে পা বাড়িয়েছে তাতে কিছু পাবার আশা নেই বরং চারিদিকে ধূ ধূ করছে প্রান্তর। মুখ লুকোবার কোনও জায়গা নেই। কী করবে সুমি ভেবে স্থির করতে পারে না। সব জেনেশুনে অতনুকে বেছে নেওয়াটা কি সুমির নিয়তি না দুর্বলতা– মনে হতে থাকে সুমির।

অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা সুমির মস্তিষ্কে ভিড় করে আসে। প্রায় দুই বছর হতে চলল সুমি আর অতনুর বন্ধুত্বের। সত্যিই কি অতনু ওকে একজন বড়ো শিল্পী ভাবে? আদৌ কি ওর জন্য অতনুর মনে কোনও সম্মান আছে? অতনু কি সত্যিই কোনওদিন একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? মুখে যা-ই বলুক, কাজে সেটা সফল হতে এখনও দেখেনি সুমি। এই দুই বছরে সুমির জন্য ও কী চেষ্টা করেছে? কিছুই তো না।

প্রশ্নের বোঝা মাথায় নিয়েই সুমি ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। পরের দিনও সুমির, ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখতে ইচ্ছে করে না। রাত্রের প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে সুমির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এমন নয়তো উচ্চাশাকাঙক্ষী হতে গিয়ে অতনুর কামনার একটা মাধ্যম হয়ে উঠছে সে? উত্তর জোগায় না। এই দু’বছরে সুমি অতনুকে নিয়ে এতটাই মেতে ছিল যে সুমির অন্য বন্ধুরা ওর থেকে দূরে সরে গেছে। ফ্ল্যাটে একা বসে বসে সুমির পুরোনো স্মৃতি, ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়তে থাকে। শেষমেশ সব গ্লানি, অপরাধের বোঝা ঝেড়ে ফেলে সুমি, বান্ধবী শ্রেয়ার বাড়ি যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।

‘অনেক দিন পর সুমি, কী ব্যাপার? কোথায় ছিলি এতদিন? তোর কোনও খবরই কারও কাছে ছিল না? শ্রেয়ার বাড়ির দরজাতেই সুমিকে দেখে শ্রেয়ার মা এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলি করে গেলেন। সামান্য হাসি টেনে ঘরের ভিতরে ঢুকতেই সুমিকে উনি জড়িয়ে ধরলেন। ওনার আন্তরিকতা সুমির চোখের পাতা ভিজিয়ে তুলল।

‘মাসিমা, কয়েকটা বড়ো পেইন্টিং প্রোজেক্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই সময় করে উঠতে পারিনি। তবে একটা দিনও এমন যায়নি, যখন আপনাদের কথা আমার মনে পড়েনি,’ রুমাল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেয় সুমি।

‘চল, ভালোই হল সুমি। এতদিন পরে হলেও তো এসেছিস। কী খাবি? শরবত নাকি গরম কিছু? হাত ধরে সুমিকে সোফায় বসাতে বসাতে শ্রেয়ার মা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কিছু খাব না মাসিমা, শুধু বলুন শ্রেয়া কোথায়… ওকে তো কোথাও দেখছি না।

‘এতদিন পর এসেছিস, কিছু তো খেতেই হবে। আর ততক্ষণে শ্রেয়াও চলে আসবে। ওর আজকে একটা বড়ো অনুষ্ঠানে সেতার বাজাবার প্রোগ্রাম আছে। প্রোগ্রামটা নিয়ে ও খুব আশাবাদী। কয়েক মাস ধরে এটা নিয়েই লেগে ছিল,’ মেয়ের প্রতিভার উপর গভীর আস্থা ফুটে ওঠে শ্রেয়ার মা-র স্বরে।

‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এত বড়ো একটা সুযোগ পেয়েছে আর আমি কিছুই জানি না,’ ভাবতে ভাবতে গ্লানিতে সুমির মন ভরে ওঠে।

গল্প করতে করতে কখন এক ঘণ্টা কেটে গেছে সুমি টের পায়নি। কলিংবেলের আওয়াজে দু’জনের ঘোর ভাঙে। শ্রেয়ার মা দরজা খুলতেই ঝড়ের গতিতে শ্রেয়া ঘরে ঢুকে মা-কে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়ার চোখমুখ উৎসাহ, উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করছে।

‘মা, মা… আজ আমার প্রোগ্রাম দারুণ হয়েছে। জানো অনুষ্ঠান চলাকালীন কী হয়েছে?’ খুশি উপচে ওঠে ওর চোখে-মুখে। মা-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, ‘মা, আজকে প্রোগ্রামে এখানকার একজন এমএলএ, পরিবারের সঙ্গে এসেছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। জানো ওদের আমার বাজনার হাত এত ভালো লেগেছে যে ওনার ছেলে অনুষ্ঠানের শেষে আলাদা করে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ছেলেটি আমাকে বলে যে, আমার বাজনার হাত নাকি এতটাই ভালো যে একদিন আমি রবিশঙ্করের মতোই নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ছেলেটি ওর বাবার সঙ্গেও কথা বলবে, যদি কোনও স্কলারশিপের ব্যবস্থা আমার জন্য করা যায়।

কথা শেষ করতেই শ্রেয়ার দৃষ্টি পড়ল সুমির উপর। আনন্দে লাফিয়ে উঠে, সুমিকে জড়িয়ে ধরল শ্রেয়া। অনেক কষ্টে সুমি মনের ভাবটা মুখে প্রকাশ হতে দিল না। কিন্তু তার বিশ্বাসের বনেদটা ক্রমশ ভেঙে চৌচির হতে থাকল, অতনুর স্বরূপটা জানতে পেরে। শ্রেয়া কিছু বলার আগেই সুমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, খালি মনে হচ্ছিল কতক্ষণে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরবে। শুধু সুমির মনে তোলপাড় হচ্ছিল, অতনুর সঙ্গে ওর দুই বছরের সম্পর্কে এটাই কি তার প্রাপ্য?

‘শ্রেয়া, প্লিজ আজকে আমাকে বাড়ি যেতে দে। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। একটু বিশ্রাম করলে মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে যাবে। আর এক দিন আসব তোর কাছে। জমিয়ে গল্প করব সেদিন দু’জনে,’ কোনওমতে সুমি বলে।

‘ঠিক আছে, তোর মুখটা কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। বিশ্রাম নিলেই মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। তোকে আমি আটকাব না, সাবধানে যেতে পারবি তো?’ শ্রেয়ার চোখে-মুখে সুমির জন্য চিন্তা ফুটে ওঠে।

রাতের শহরে স্ট্রিট লাইটগুলোর আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাসের বদলে ট্যাক্সি নিয়েছে সুমি। পিঠটা ট্যাক্সির সিটে এলিয়ে দিয়েছে, তবু যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। উঠেই ড্রাইভারকে গন্তব্য জানিয়ে গুছিয়ে বসেছে ও। চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দুই বছরের ছায়া ছায়া অন্ধকার হারিয়ে গেছে। অতনুর ব্যক্তিত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কামুক পুরুষটাই ক্রমশ সুমির চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। যে নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে, কলেজের প্রফেসর হওয়া সত্ত্বেও নিকৃষ্ট মনে করতে পারে, তার কাছ থেকে অন্য নারীরা সম্মানের আশা রাখবে কী করে? এই ধরনের লোক কারও প্রতিভার কদর করতেই পারে না। সুমির মনে হল যেটুকু নামডাক ওর হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই। অতনুর কোনও অবদান সেখানে নেই।

সুমি আর অতনুর পরিচয়ের শুরুটাই ভুল ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যতগুলি অধ্যায় ওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ভ্রান্তি আরও বেড়েছে, সম্পর্কের ধাপগুলিতে মলিনতা আশ্রয় পেয়েছে। মনের আয়না কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় সুমি, অতনুকে চিনতে ভুল করেছিল, কিন্তু কুয়াশা সরতেই চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে তার কাছে। অতনু এসেইছিল সুমিকে টেনে অন্ধকারের অতলে নিয়ে যেতে, উচ্চতার শিখরে নয়। এরপরেও যদি সম্পর্ক এগোতে থাকে তাহলে তা আরও ঘৃণ্যতর হয়ে উঠবে। সুতরাং এখানেই তা শেষ করা দরকার। সুমির পাড়া কাছাকাছি এসে পড়েছে। খুব ঠান্ডা মাথায় ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে সুমি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করল। মনে মনে অতনুর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে এখন সে নিশ্চিত। মোবাইল অন করে অতনুর ফোন নম্বরটা ব্লক করে দিল সুমি। জীবনটা এবার নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে।

 

বডিগার্ড

উন কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে টাটানগর থেকে হাওড়া ফিরছিল প্রকাশ। তার এমআর-এর চাকরি। আগের দু-দিনে সব ডক্টর্স চেম্বার ভিজিট করা হয়নি। শনি-রবিতে প্রায় সব চেম্বারে রোগীর এত লাইন থাকে যে,পাঁচ মিনিট ডেমনস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য এক দেড় ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই আজ সকালেও তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ঘন্টা চারেক টাটানগরে টো টো করে ঘুরতে হল। অভ্যাস অনুযায়ী সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ারও সময় মেলেনি। ট্রেনে চেপে ব্যাগটা কোনও মতে বাংকে তুলে প্রকাশ দৈনিকটা খুলে বসেছে। তারপর দু’ঘন্টা ধরে আর তার হুঁশ ছিল না। কাগজের ষোলো-সতেরো পাতা যখন প্রায় মুড়ো ল্যাজা করে পুরোপুরি পড়া হল, তখন ট্রেন ঝাড়গ্রামে ঢোকার আগে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে।

ঘড়ি দেখে বিরক্ত হল প্রকাশ, কুরলা এক্সপ্রেস টানা দুঘন্টা টাটায় লেট ছিল, আর এখন তিন ছুঁই ছুঁই। কত রাত করে যে হাওড়া ঢুকবে, ভগবানেরও অজানা। ওঠার পরে এতটা সময় পার করে দিয়ে, এই প্রথম কামরার অভ্যন্তরে চোখ বুলোবার ফুরসত পায় প্রকাশ। লম্বা সিটে তাকে নিয়ে চার চার আটজন, ওপাশে জানালার ধারে সিঙ্গল সিটে আরও দু’জন। সকলেই দেহাতি, মলিন পোশাক। এদের কেউ খড়গপুরের এপারে যাবে বলে মনে হয় না। তাতে অবশ্য প্রকাশের কিছুই হেলদোল নেই। যেন আগুনের পরশমণি প্রাণে জাগিয়ে বসে আছে।

প্রায় দু’বছর ধরে মাসে দু’তিনবার ট্রেনে জার্নি করা খাওয়া-শোয়ার মতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কথা বলার মতো সঙ্গীর দরকার হয় না। অনেকে বলে খালি ট্রেনে চোর-ডাকাতের উৎপাত হয়, প্রকাশ আমল দেয় না। সেই কবিতার লাইনটা মনে পড়ে, ‘হঠাৎ আলো দেখবে যখন, ভাববে কী বিষম এই কান্ডখানা।’ হঠাৎ আলো মানে আরপিএফ জওয়ানদের লাঠির গুঁতো আর গুলির খোঁচা। তবে কুরলা নিয়ম করে লেট করে ঠিকই, কিন্তু ভিড় কমে গেলে কামরায় চুরি ছিনতাই হয়, এই গাড়ির বেলায় এমন বদনাম শোনেনি। নিজেও তো এল গেল এবার নিয়ে সাত-আটবার।

ফালতু কথা আর না ভেবে প্রকাশ ঝাড়গ্রাম প্ল্যাটফর্মে চোখ বোলাতে থাকে। সকালে ইস্পাত এক্সপ্রেসে আসার সময় দেখেছে, স্টেশন লোকের ভিড়ে জমজমাট আছে। এখন শুনশান। ঝাঁকড়া গাছগুলোয় কিচিরমিচির করে পাখিরা আসর জমিয়ে রেখেছে। তিন নম্বর, মানে লুপ লাইনে গাড়ি থেমেছে। হয়তো, এখানেও খানিক লেট করানো হবে। বিরক্ত মুখ কামরার ভেতরে ফেরাতে গিয়েই চোখ পড়ল ভদ্রমহিলার দিকে। এখান থেকেই উঠলেন। হাতে ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগ, জলের বোতল। উলটোদিকের সিটে বসতে চাইতেই দুই দেহাতি বুড়ো নিজেদের মধ্যে ছ’ইঞ্চি জায়গা খালি করে দিল। ভদ্রমহিলা বেশ দ্বিধায় পড়েছেন, প্রকাশ দেখেই বুঝতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনি বরং এই জানলার ধারে এসে বসুন, আমি ওপাশে চলে যাচ্ছি।

– থাক না, একটু বাদে খড়গপুরে অনেকে নেমে যাবে মনে হয়। তখন ভালো করে বসব।

– আরে বসুন। আমি টাটা থেকে জানালার ধারে এলাম।

ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ালেন না। বসতে গিয়ে প্রকাশকে একটা অনুরোধ করলেন– আমার এই ব্যাগটা যদি বাঙ্কের একটু ভিতর দিকে তুলে দেন। বেঁটে চেহারার মানুষকে এই সাহায্যটা প্রতিবারই কারও না কারও কাছে চাইতে হয়।

প্রকাশ হেসে ফেলল। ‘বেঁটে’ শুনে ভদ্রমহিলাকে প্রথম ভালো করে দেখল। তখনই মনে হল, আগে কোথাও দেখেছে।

এইমাত্র জানালা ছেড়েছে, এইবার গায়ে পড়ে ‘মনে হচ্ছে আগে কোথাও যেন দেখেছি আপনাকে’ বলাটা নাটকের মতো হয়ে যাবে। মহিলা সুন্দরী হলেও বিবাহিতা, বয়সে ওর সমান কিংবা খানিক বড়োও হতে পারেন। বাড়তি মনোযোগ দেবার তেমন কোনও কারণ নেই। তাই প্রশ্নটা ঢোঁক গিলে মনোযোগ দিয়ে বাঙ্কে ব্যাগ ওঠাল প্রকাশ। দুই বুড়োর মাঝখানে আলগোছে বসতেই ট্রেন নড়ে উঠল।

বাঁশতলা এবং সারদিয়া স্টেশন পার হয়ে খেমাশুলিতে গাড়ি আবার ঘটাং করে থেমে গেল। তখনই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পিলপিল করে উঠতে থাকে আদিবাসী মহিলারা। মিনিট দুই তিনেকের মধ্যে লোকাল ট্রেনের চেহারা নিল কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাস। দুই সিটের মধ্যে এত লোক ঢুকেছে যে, নড়াচড়া করাই দায় হল। কুরলা এক্সপ্রেসে এতবার ফিরেছে প্রকাশ, এরকম ঘটনা আগে কখনও চোখে পড়েনি। মনে করে দেখল, স্টপেজই নেই লো-লেভেল স্টেশন খেমাশুলিতে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল চমকে মোড়া বিস্ময়– এত লোক এই জঙ্গল দেশে কোথা থেকে এল?

– কপালে সিঁদুর লেপা দেখে বুঝতে পারছেন না, এরা গুপ্তমণির পুজো দিতে গিয়েছিল। আজ হয়তো কোনও বিশেষ উৎসব আছে। হাইওয়েতে বাস বন্ধও হতে পারে। জানলার ধারে ভদ্রমহিলা বললেন।

অনেকক্ষণ পরে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল প্রকাশ। ভিড়ের মধ্যে মুখটুকুই শুধু দেখতে পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল, সবার কপালে টিপ তো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু গুপ্তমণি আবার কে?

– তিনি আমাদের দুর্গা বা কালীর মতো এই এলাকার আদিবাসীদের প্রিয় এক দেবী। সবাই বলে খুব জাগ্রত। হাইওয়ে দিয়ে বাসে গেলে দেখতেন, যাত্রী থেকে ড্রাইভার কন্ডাক্টর, সকলে মন্দির পার হওয়ার সময় নমস্কার করে পয়সা ছুড়ে দেয়। সেই পয়সা কুড়োতে মন্দিরের পনেরো কুড়ি জন লোক সবসময় ছুটে বেড়ায়।

প্রকাশ এমন বিচিত্র দেবীস্থানের মাহাত্ম্যের কথা শুনে মজা পায়। উপরন্তু অবাক ভাব চাপতে না পেরে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করে– আপনি এখানকার অনেক কিছুই জানেন দেখছি!

– এটা জানার মতো কোনও বিষয় নয়। ঝাড়গ্রামে আমার প্রায় আঠারো উনিশ মাস মানে দেড় বছরেরও বেশি চাকরি হয়ে গেল। উইকেন্ডে ফিরে যাই। এই ট্রেন প্রায় দিনই লেট করে। তখন বাস ধরে খড়গপুর বা গিরি ময়দান যেতে হয় লোকাল ট্রেন ধরার জন্য। সেই বাসেই দেখেছি গুপ্তমণির মন্দির।

প্রকাশ কথা ঘোরায়– আপনার চাকরি ঝাড়গ্রামে, রাজ কলেজে নাকি?

– বাঃ, আপনিও তো দেখছি অনেক কিছু জানেন। রাজ কলেজের নাম বলে দিলেন। তবে, আমি স্কুলে পড়াই, রানি বিনোদ মঞ্জরী।

– এ নামটাও শুনেছি মনে হচ্ছে। মেয়েদের স্কুল। বোধহয় সরকারি।

– ঝাড়গ্রাম তো দেখছি, আপনার নখদর্পনে। অথচ গুপ্তমণির নাম শোনেননি?

– আসলে, আমার এক মেসোমশাই বেশ কয়েক বছর আগে রাজ কলেজে পড়াতেন। সরকারি কলেজ তো, হুগলি মহসিন থেকে দু-বছরের জন্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছি। বলে রাখি, আমার সেই মেসোমশাইয়ের নাম জগৎ লাহা।

– তাই বলুন।

– এখনও রাজবাড়ি, জঙ্গলমহল, চিলকিগড় আর ডুলুং নদীর কথা ভালোই মনে আছে। মেসোমশাই যে জায়গাটায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন সেখানকার নাম রঘুনাথপুর না রঘুনাথগঞ্জ কী যেন।

এবার ভদ্রমহিলার অবাক হওয়ার পালা। বললেন– আপনার স্মৃতি দেখছি একেবারে টাটকা রয়েছে। আমিও রঘুনাথপুরে থাকি, স্টেশনের কাছেই।

ভিড়ের চাপে, বাচ্চাদের তারস্বরে কান্না আর বায়নায় একসময় কথা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে শেষ বিকেলের সোনা হলুদ আলো মেখে খড়গপুর স্টেশনে ঢুকল ডাউন কুরলা এক্সপ্রেস।

কামরা খালি করে প্রায় সবাই নেমে গেল। প্রকাশদের খোপে সে এবং ভদ্রমহিলা ছাড়া উলটোদিকের জানালার ধারের লোকদুটো শুধু বসে রইল। ভদ্রমহিলার মুখোমুখি জানালায় সরে গেল প্রকাশ। দেখতে চেষ্টা করল, প্ল্যাটফর্মে কোনও কফিওয়ালা দেখা যাচ্ছে কি না। তখনই এদের খোপে ফাঁকা সিটের দখল নিল জনা পাঁচেক লোক। হাবভাব দেখে ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে মনে হচ্ছে। ধুপধাপ বসেই কোনও কথা না বলে সিগারেট ধরাল। মুহূর্তে ধোঁয়ায় খোপটা নরক গুলজার করে তুলল। প্রকাশ দেখল, উলটোদিকে ভদ্রমহিলা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করছেন। বিরক্ত মুখে ও লোকগুলোর দিকে ফিরল। বলল– কম্পার্টমেন্টের ভিতরে এভাবে স্মোক করছেন কেন? জানেন না, এটা নিষিদ্ধ? দরজায় দাঁড়িয়ে শেষ করে আসুন।

লোকগুলো উঠে যাওয়ার কোনও গরজ দেখায় না। যেন কথা শুনতেই পায়নি। প্রকাশ আবার তাই গলার জোর আরেকটু বাড়িয়ে বলে– আপনাদের বলছি, সিগারেটগুলো দরজায় গিয়ে ফিনিশ করে আসুন। আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে।

এইবার দলের একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল– বেশি বকবেন না তো। রোজই আমরা এই ট্রেনে যাই।

এইবার প্রকাশের রাগ বেড়ে যায়। উঁচু গলায় বলে কী বলতে চান আপনারা, রোজ এক ট্রেনে গেলে কি আইন ভাঙার অধিকার জন্মায়?

– আইন আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখাবেন। জানালায় বসেছেন, খানিকক্ষণ এখন নাকে রুমাল চাপা দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখুন। সিগারেট একসময় নিজেই ফুরিয়ে যাবে।

রাগে লাল হয়ে উঠল প্রকাশ। কোনওরকম সিভিক সেন্স নেই এদের। একবার ভাবে, টিটিই-র কাছে কমপ্লেন করা যেতে পারে। কিন্তু এটা ভেস্টিবিউল কম্পার্টমেন্ট নয়, টিটিই-কে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, তার ঠিক নেই। কমপ্লেন করেও কোনও ফল হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে প্রকাশের। যাতায়াতের পথে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকজন তো কম দেখল না। তাই প্রকাশ একবার ভাবল, তর্ক চালিয়ে যাবে। তাতে পরের রাউন্ডে সিগারেট ধরানোর আগে লোকগুলো অন্তত দ্বিতীয়বার ভাববে। শেষ পর্যন্ত উলটোদিকে বসা সদ্য পরিচিতার অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ভদ্রমহিলাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার আবার মনে হল, খুব চেনা। স্মৃতি হাতড়ে বিরক্তি আর সময় কাটাতে থাকল প্রকাশ। সংবিৎ ফিরল মেচেদা পৌঁছে, জানালার কাছে ‘গরম চপ-সিঙাড়া’ ওয়ালার বাজ পড়ার মতো হাঁক শুনে। কামরার ভেতরে তখন টিমটিমে আলো জ্বলে উঠেছে। পাশের লোকগুলো যথারীতি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাঁটুতে হাঁটুতে তোয়ালে পেতে তাস খেলার আসরে মেতে উঠেছে। অকারণে তর্ক জুড়ে কামরা ফাটাচ্ছে। সামনে ভদ্রমহিলা যথারীতি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে রয়েছেন, দৃষ্টি প্রকাশের দিকে। এক পলকে দেখল ও, তার চোখেও কেমন অবাক করা ভাব। এ চোখের ভুল, ভেবে প্রকাশ দৃষ্টি ফেরাল মেচেদার ভিড়ের দিকে।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই বাইরের ঝুপসি অন্ধকার ধেয়ে এল। ভিতরে পরিবেশ এতই বিরক্তিকর যে, বাইরের সে অন্ধকার রাজ্যে চোখ সওয়াবার চেষ্টা করতে থাকে প্রকাশ। গাড়ি এবারে বেশ গতি নিয়েছে। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের সেতু পার হওয়ার পর ও আবার ভাবতে শুরু করে, সামনে বসা ভদ্রমহিলাকে ও কোথায় দেখতে পেয়েছে আগে। এমন সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। হয়তো টয়লেটে যাবেন। তাসখেলা লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন– তোয়ালেটা একটু সরিয়ে নিন, আমি বাইরে যাব। খেলা থেকে চোখ না সরিয়ে একজন কড়া গলায় জবাব দেয়– এখন গোটানো যাবে না। সিটে গিয়ে বসুন। সাঁতরাগাছি ঢুকলে খেলা শেষ হবে।

– তা কেন? আমাকে যেতে দিন।

তাসুড়ের গলা এবার আরও চড়ল– বাইরে যাওয়ার এত তাড়া থাকলে জানালার ধারে বসেন কেন? নিজের বাড়ির সব সুবিধা তো ট্রেনে মেলে না।

একে ভদ্রমহিলা, তায় তার ওপর মানসিক জবরদস্তি। মনে হচ্ছিল প্রকাশের, ভদ্রমহিলার বাথরুমে যাওয়ার কথা শুনে তাঁর মন এবং শরীরকে মানসিক ভাবে ভিসুয়ালাইজ করছিল তারা।

আরেকজন চোখ নাচিয়ে বলল– আমি ঘোড়াঘাটা যাচ্ছি। এই তো ঘোড়াঘাটা চলে এল বলে। আর বড়োজোর ঘন্টা খানেকের মামলা। মেয়েরা তো ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুম চেপে রাখতে পারে।

সংকোচে বাক্রুদ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলা বসে পড়লেন। এতক্ষণ প্রকাশ চুপচাপই ছিল। মন বসাতে চেষ্টা করছিল বাইরের অন্ধকারে। এবারে তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। উঠে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে বলল– খেলা বন্ধ করুন এবার।

লোকগুলো কথা শোনার পাত্র নয়। ওর চেয়েও এক কাঠি বেশি রাগ দেখিয়ে একজন বলল– আপনি তখন থেকে ফালতু বকে চলেছেন কেন বলুন তো। সব প্রসঙ্গের মধ্যে ঢুকছেন! যার বাথরুম যাওয়ার দরকার ছিল তিনি তো চুপচাপ বসে রয়েছেন।

– নোংরা কথা বলবেন না। মহিলাদের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলতে জানেন না আপনারা?

– আমরা জানি না, আর আপনি দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলেন। এই তো শোধবোধ হয়ে গেল। এবারে তবে থামুন।

নিজেকে প্রকাশ আর সামলে রাখতে পারল না। কলার চেপে ধরল সবচেয়ে উঁচু গলার লোকটার। তখন বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকাশের উপর– ছাড় শালা। রাজার চালে যাবি তো এসিতে চাপতে পারতিস। মেয়েরা সেখানে সারাদিন বার্থ আর বাথরুম করে কাটালেও কেউ কিছু বলবে না।

সিঙ্গল সিটে বসা লোকদুটোর দিকে ফিরে মরিয়া ভাবে প্রকাশ বলে– শুনুন আপনারা। আবার নোংরা কথা বলছে। এরা মহিলাদের সম্মান করে না। আপনারা চুপ করে থাকবেন?

প্রকাশের আশা বৃথা। গ্রাম্য লোকদুটো এদিকেই তাকিয়ে বসেছিল, কথা শুনে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে জানালার দিকে ঘুরে বসল। পাশের খুপরি থেকে কয়েকটা উৎসুক মুখ উঁকি দিল। তাদের একজন তাসপার্টির নেতাকে জিজ্ঞাসা করে– কীসের ঝামেলা, মজুমদারবাবু? হাত লাগাতে হবে নাকি?

– আরে না দাদা, একজন অসভ্য লোক সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ভাট বকেই যাচ্ছে। আমরা চেপে বসিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে মহিলা থাকলে সবাই তো একটু বীরত্ব দেখাতে চায়। প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয়ে গেল নিজের অসহায়তা অনুভব করে। নোংরা লোকগুলো দলে ভারী। এদেশে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক ক্রমেই কমে আসছে। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিজের সিটে বসে পড়ল প্রকাশ। ও এবং সামনের মহিলা, দু’জনের দৃষ্টি মাটির দিকে। তাসুড়েরা কিন্তু নির্বিকার, তাসের চাল নিয়ে আবার তুমুল তর্কে ফিরে গেল। একটু বাদে খুপরির ভিতরের অস্বাভাবিক গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করে প্রকাশ– আপনি যাবেন কোথায়?

– চন্দননগর।

– আজ অনেক রাত্রি হয়ে যাবে হাওড়া ঢুকতে। ন’টা আটান্নোর মেন লাইন বর্ধমানটা পাওয়া যাবে কি না কে জানে।

– আপনি কি ওদিকেই?

– হ্যাঁ, কিন্তু আপনার অনেক আগে নামব, কোন্নগর।

মৌড়িগ্রামে কুরলা ঢুকছে। আউটার সিগনাল লাল হয়ে থাকায় থেমে গিয়ে ঘন ঘন হুটার বাজাচ্ছে। এইবার তাসপার্টির আসর গোটানোর তাড়া লাগল। তোয়ালে ভাঁজ করতে করতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল– আমি ভাবলাম লোকটা নিজের লোকের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, এখন দেখছি অচেনা।

আরেকজন হেসে গড়িয়ে গিয়ে বলল– মজুমদার, মেয়েদের মতো ন্যাকামি কোরো না। তুমিও বয়সকালে পরিচিত মহিলার কাছে এমনই হিরো সাজতে চাইতে।

– তা হতে পারে, কিন্তু মালটাকে কোন্নগরে আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

– ফি হপ্তায় আটটা দশটা করে ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠছে আর কত উটকো লোক রোজ থাকতে আসছে। কোন্নগরের বনেদি লোক বলে কি সবাই তোমার চেনা হবে?

– তা একরকম ঠিকই বলছ। আমরাই এখন কোন্নগরে কোণঠাসা।

ওরা ভাব এমন করছিল যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু প্রকাশ ও ভদ্রমহিলা দুজনের কানেই যাতে পৌঁছোয়, ততটাই জোরে বলছিল।

মহিলা আবার সংকুচিত হলেন। তাসের আসর গোটানো হতেই টয়লেটের দিকে চলে গেলেন। প্রকাশ একটুক্ষণ আগে যে লোকটার জামার কলার চেপে ধরেছিল, সে এই সুযোগে ওর দিকে ফিরল। গলায় দারুণ ঘৃণা ঝরিয়ে বলল– ঝামেলা পাকানো ধাতে নেই বলে আজ ছাড় পেয়ে গেলে। অন্য কারও গায়ে হাত দিলে মেরে শুইয়ে দিত। আমিও কোন্নগরে থাকি, তিনপুরুষের বাস। মুখটা ভালো করে চিনে রাখো।

বিরক্ত প্রকাশ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা যে-দিকে গিয়েছেন তার উলটোদিকের টয়লেটের পথে পা বাড়াল।

শেষবার প্রতিদিনের নিয়মমতো ট্রেনটা মার খেল টিকিয়াপাড়া ইয়ার্ডে। হাওড়া ঢুকল দশটা বাজার পর। তাসপার্টি শেষবার প্রকাশের দিকে আগুনের মতো দৃষ্টি হেনে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। বাংক থেকে নিজের ও ভদ্রমহিলার ব্যাগ নামাতে নামাতে বলল প্রকাশ– চলুন, একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে দশটা সতেরোর ব্যান্ডেল লোকালটা মনে হয় পেয়ে যাব। কোন্নগর পর্যন্ত একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। তারপরেও ট্রেনে ভালো ভিড় থাকে। ভয় পাবেন না।

ভাগ্যক্রমে ব্যান্ডেল লোকালে পাশাপাশি দুটো সিট পাওয়া গেল। ট্রেন ছাড়ল। মাত্রই কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে কোন্নগর। প্রকাশ ‘এবার আসি’ বলে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল ভিড় ঠেলে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে বলে। কোন্নগরে ট্রেন ঢোকার মুখে ভদ্রমহিলা গলা তুলে জানতে চাইলেন– এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, আপনার নাম কী ভাই?

পিছনে প্রবল ঠেলা খেতে খেতে প্রকাশ কোনওমতে জবাব দিল– প্রকাশ সেনগুপ্ত, আপনার?

উত্তর শোনার আগেই এক ধাক্বায় প্লাটফর্মে। প্রকাশ ট্রেনের জানালায় হাত নাড়তে যেতেই ভদ্রমহিলা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এলেন জানালার সামনে। বললেন– প্রকাশ আমি তোমার পারমিতা দিদি। ঝাড়গ্রাম থেকে মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি। এইমাত্র চিনতে পারলাম। আর কোনও কথা হওয়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ব্যান্ডেল লোকাল। প্লাটফর্মে হতবাক প্রকাশ। সেও এইমাত্র চিনতে পেরেছে পারমিতা দিদিকে। চেনার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হারিয়ে যাওয়া।

দুঃখিত প্রকাশ মনে মনে ফিরে গেল চব্বিশ পচিঁশ বছর আগে। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে। তখন ওরা ভাড়াবাড়িতে ঢাকুরিয়ায়। স্কুল বাসে গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে স্কুলে যাতায়াত করত ও। বড়ো ছেলেরা বাসের জানালা আর প্যাসেজের দিকের সিট সবসময় আগলে রাখত, ওকে কিছুতেই মাঝখানে ছাড়া বসতে দিত না। দুজনের মাঝখানে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে স্কুলে যাওয়া যেন অলিখিত নিত্যনৈমিত্তিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওঠা নামার সময় তাড়াহুড়ো করলেও দাদারা টেনে ধরে আটকে, অকারণে চড়চাপড় লাগাত। বাসের কাকুদের কাছে দু-একবার কাঁদো কাঁদো হয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। বাসযাত্রার ভয়ে ‘কাল স্কুলে যাব না’ একসময় নিত্যনৈমিত্তিক বোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকাশের। রোজ শুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ আর সকালে ঘুম থেকে চোখ ছাড়ানোর পর একপ্রস্থ।

সমস্যাটা কী, তা জানতে বাবা-মা বারদুয়েক স্কুলের আন্টির সঙ্গে দেখাও করে এলেন। স্কুল থেকে কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ না পেয়ে তারাও দিশাহারা হয়ে পড়লেন। ঠিক সেই সময় একদিন স্কুলবাসে যেতে পাদানিতে উঠতে আরম্ভ করে ডাকাবুকো পারমিতা দিদি। প্রকাশ যখন ক্লাস ওয়ান, পারমিতা তখন সিক্স। ওদের স্টপ থেকে দুটো কালো সাপের মতো লম্বা বিনুনি ঝুলিয়ে উঠত। ছোট্ট প্রকাশের ওপর বড়োদের অত্যাচারের কথা শুনে দু-তিনদিন পরেই কাছে ডেকে নিল। জানালার সিট ছেড়ে সেখানে বসতে দিল। বড়ো ছেলেদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে দিল– আজ থেকে রোজ তুই আমার পাশের সিটেই বসবি। কেউ মেরে তুলে দিতে এলে আমাকে বলবি, তাকে উচিত সাজা দেব। এরপর থেকে অনেকদিন ধরে প্রকাশকে আগলে আগলে রাখত পারমিতা দিদি। এর জন্য দাদাদের সঙ্গে ঝগড়াও করত। একসময় তাই বাসের সকলে পারমিতা দিদিকে ‘প্রকাশের বডিগার্ড’ বলে ডাকতে শুরু করে।

অভিভাবক মহলেও নামটা ছড়িয়েছিল। প্রকাশের বাবা-মা ছেলের বডিগার্ডকে খুব ভালোবাসতেন। প্রকাশ স্কুল বদল করার আগে পর্যন্ত তার প্রত্যেক জন্মদিনে বডিগার্ড-এর নিমন্ত্রণ বাঁধা ছিল। প্রকাশরা কোন্নগরে নিজেদের বাড়িতে উঠে আসতে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আজকের ঘটনার কথা ভেবে অসহায় প্রকাশের নিজের প্রতি চরম বিরক্তি জাগল, অসভ্য লোকগুলো দিদিকে অপমান করে গেল আর উচিত জবাবটুকুও একজন পুরুষ হয়ে সে দিতে পারল না। নিজের দু’গালে চড় কষালেও বোধহয় খারাপ লাগা দূর হবে না।

কোন্নগরে তখন রাত প্রায় এগারোটা। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রকাশ। কুরলা এক্সপ্রেসের সেই তাসুড়েদের মধ্যে কোন্নগরের বাসিন্দা দু’জন প্লাটফর্ম থেকে নামার পথে আবিষ্কার করল তাকে। শুনিয়ে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে বলল– দ্যাখ, ভ্যাবলাটা দাঁড়িয়ে আছে। বউদির বডিগার্ড।

কক্ষচ্যুত

ঘরের দেয়ালময় দাদার পছন্দের ক্রিকেটারদের পাশাপাশি ইন্দ্রজিতের নায়করা– ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যান, অক্ষয় কুমার। এই তিনজন তারকার চটকদার অনাচ্ছাদিত সিক্সপ্যাক সমৃদ্ধ পোস্টারের পাশে, এখন জুড়েছে আরও কয়েক জনের মলিন ছবি– মাসুতাৎসু ওয়্যামা, হিদেয়েৎসু আশিয়ারা। পত্রিকার পাতা কাটা কাগজের ঝাপসা ছবিতে মুখ চেনার উপায় নেই, শুধু পোশাক জানান দিচ্ছে তারা মার্শাল আর্টিস্ট। জ্যাকি চ্যান-এর মতো কমেডি বা ব্রুসলির মতো তাক লাগানো হলিউডি অ্যাকশন হিরো নয়, অক্ষয় কুমারের মতো নাচিয়ে ঝাড়পিট করা বলিউড তারকাও নয়। এরা ক্যারাটের এক একটি ঘরানার নির্মাতা। অবশ্য জিৎকোন্ডোর মতো ক্যারাটে আর তাইকোন্ডোর মিশেল দেওয়া লড়াকু শিল্পের জনক হিসাবে ব্রুস লিরও একটা বাড়তি সমীহ প্রাপ্য। ইন্দ্রজিৎ অতশত না বুঝে অক্ষয়, ব্রুসলিদের দেখেই ক্যারাটেতে ঝুঁকেছিল। মার্শাল আর্ট কথাটার সঙ্গেও তখন পরিচয় ঘটেনি। দত্তপুকুরে তাদের বাড়ির কাছে যে – সম্মিলনি ক্লাব, সেখানে সাদা ঢোলা পোশাক আর কোমরে বাঁধা বেল্ট নিয়ে ছেলেদের ‘ইয়া ইয়া’ করে হাত পা ছুড়তে দেখে তারও শখ তীব্র হয়। মা-বাবার কাছে আবদার করে ঢুকেও পড়ে।

একদিন এক বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা মাঝ বয়সি এক পুরুষকে তাদের অনুশীলন দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসতে দেখে। মন্তব্য কানে আসে, ‘বেসিক স্টান্সগুলো না শিখেই কিক, আপার ব্লক, লোয়ার ব্লক? বেশ বেশ। এসবই তো চলছে এখন। কারই বা জ্ঞান আছে আসল জিনিস শেখাবার আর কজনেরই বা ধৈর্য আছে শেখবার? কয়েক বছরের মধ্যেই তো সব ব্রাউন বেল্ট, ব্ল্যাক বেল্ট পেয়ে যাবে সিলেবাস কমপ্লিট করে।’

ইন্দ্রজিৎ সেদিন থেকে পিছু নিয়েছিল ব্রহ্মদেশ থেকে আসা এই একটেরে লোকটার। আসল জিনিস শিখবে। ভদ্রলোকের ছাত্র পেটানোর মোহ নেই। খেদিয়েই দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎকে আজকালকার নিষ্ঠাহীন ফাঁকিবাজ ওপর চালাক ছোকরার দলে ফেলে। ইন্দ্রজিৎও একদিন বলেই ফেলল, ‘শেখানোর মুরোদ নেই যখন, অন্যের তালিমকে হ্যাটা দেওয়া কেন? শুভ্রাংশু স্যাররা তো কিছু দিচ্ছে আমাদের মতো ফালতু ছেলে ছোকরাদের। আপনি ক’জনকে তৈরি করেছেন?’

ভদ্রলোক খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ইন্দ্রজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘বেশ কাল ভোর পাঁচটায় এসো। স্কুল কটা থেকে? দেখি তোমার কত এলেম, কত নিষ্ঠা।’ ওঁর কাছ থেকেই শোনা মাসুতাৎসু হলেন কায়োকুশিন ধারার প্রবর্তক। অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এই শৈলীটি ক্রীড়ামঞ্চে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বজুড়ে শোটোকান ও গোজুকান-এরই রমরমা। হিদেয়ুকো আশিয়ারা কায়োকুশিনকে একটু নরম ধাঁচে ফেলে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেন, কায়োকুশিন আশিয়ারা। বিনোদ শেঠ ব্রহ্মদেশে থাকা কালে এই শৈলীটিই ‘সামান্য একটু’ শিখেছিলেন।

পরের দিন ইন্দ্রজিতের নবলব্ধ জেনারেল নলেজের ভাণ্ডার দেখে আকৃষ্ট হয়ে সম্মিলনি ক্লাবের আরও কিছু ছেলে বিনোদদার বাড়িতে হানা দেয়। বিনোদদার উঠোনে অতজনের জায়গা হবে না। তিনি বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করলেন। দক্ষিণার কথা জানতে চাইলে হাসতেন, ‘আগে মাসখানেক দেখি।’

বস্তুত এক মাসের আগেই ইন্দ্রজিৎ আর সুজয় ছাড়া বাকিরা কেটে পড়েছিল। তারা আবার নাকে খত দিয়ে সম্মিলনিতে। অনেক ত্যারছা মন্তব্য হজম করতে হয়েছিল তাদের, ‘দেখি আসল জিনিস কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তোরা? শার্টের পকেটে না প্যান্টের পকেটে, নাকি জাঙিয়ার বুক পকেটে?’

বিনোদদা শুরু করেছিলেন দাচি বা স্টান্স দিয়ে। কিবাদাচি বা ঘোড়সওয়ারের ভঙ্গি, জাঙ্গুৎসুদাচি বা সামনে ঝোঁকার কায়দা, কোকুৎসুদাচি বা পেছনে ঝুঁকে দাঁড়ানোর কৗশল, সানচিংদাচি বা থ্রি পয়েন্ট স্টান্স, কুমিতেদাচি বা রণপ্রস্তুতি– এইসব। দুই পায়ের নানারকম অস্বাচ্ছন্দ্যকর ভঙ্গি ও হাতকে বিশেষ অবস্থানে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা। শুরুর কিবাদাচি অনেকটা ভরতনাট্যমের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। প্রথমটায় উৎকটাসনের মতো সহজ মনে হলেও যখন ওই স্টান্সে পনেরো মিনিট দাঁড়াতে বলা হতো, বেশিরভাগই ‘উঃ আঃ’ করে সাত আট মিনিটের মাথায় উঠে দাঁড়াত।

সময়টা বাড়তে থাকলে ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকল। কেউই জাঙ্গুৎসুদাচির পর টিকে থাকেনি। ইন্দ্রজিৎ আর সুজয়কে যখন কোনও স্টান্সে এক ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখে দিতেন বিনোদদা, প্রবল যন্ত্রণাবোধটা যখন ক্রমশ অস্তিত্ব অসাড় করে দিত, তখন ইন্দ্রজিতের সংশয় হতো, লোকটা সত্যিই কিছু শেখাতে চায় তো। কিন্তু কষ্ট সহ্য করার অলৗকিক ক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে মাসখানেক পর স্নানের সময় নিজের উরু আর গুলির পেশির দিকে তাকিয়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নার্সিসাসের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে যেত। মুখখানা তো তার মারকাটারি ছিলই। কিন্তু শরীর ডিগডিগে, হাত-পা টিংটিঙে। ওই সুগঠিত পা’দুটো ইন্দ্রজিৎ পুরকায়স্থেরই তো? শুধু দাঁড়াতে শিখেই এই? তাহলে হাত পা ছুড়ে অক্ষয় মার্কা চেহারা পেতে কত দিন?

সুজয়ের চেহারা বরাবরই দোহারা। তার গায়ের জোর, ঘুসির পরিধি অনেক বেশি। তবু ইন্দ্রজিৎ ওর সঙ্গে সমানে টক্বর দিয়ে যেত। ওর সম্পদ ছিল নমনীয়তা, গতি আর অ্যাকিউরেসি যাকে বাংলা করে ত্রুটিহীনতা বললে বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে। সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন কেই বা হতে পারে? বছর তিনেক পর সুজয় গেল অন্য গুরুর কাছে। বিনোদদার শিক্ষানবিশি যত উচ্চাঙ্গেরই হোক, তিন বছরেও একটা ন্যূনতম ‘ইয়েলো বেল্ট’-ও দিতে পারল না। কোনও স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় যে। ওদিকে, গৗরাঙ্গরা লম্ফঝম্প করে ব্রাউন বেল্ট থেকে এখন ব্ল্যাক বেল্টের দাবিদার। সম্মিলনি নয়, সুজয় গেল কলকাতার এক নাম করা প্রতিষ্ঠানে। তারা সোটোকান শৈলী শেখায়। তা হোক। সুজয়ের অসুবিধা হল না। বছর দুয়েকের মধ্যে সে-ই নতুন বাচ্চাদের তালিম দেওয়ার কাজ পেয়ে গেল। ক্যারাটেকেই ধ্যান জ্ঞান করেছে সে। মাধ্যমিকে ভালো ফলের অভিলাষ নেই, উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায় না, তার পরে না পড়লেও চলে।

সুজয় বন্ধুকে লুকিয়ে চলে যায়নি। সঙ্গে নিতেই চেয়েছিল। কিন্তু ইন্দ্রজিতের পড়াশুনোয় ভালো হিসাবে মাধ্যমিকে স্টার পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, উচ্চমাধ্যমিকের পর জয়েন্ট ইত্যাদির পরিকল্পনা ছিল। স্কুল টিউটোরিয়াল করে বাড়ির কাছে বিনোদদার আখড়াটা চালানো যায়, কলকাতায় দৗড়ে সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বিনোদদাকে ভালোও বেসে ফেলেছিল। ইন্দ্রজিতের বাবা এসে মাস তিনেক বিনে পয়সায় শিক্ষার পর খামে ভরে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ছেলের হাতেও মাসের শুরুতে খাম পাঠিয়ে দিতেন। সুজয়কেও লজ্জায় পড়ে গুরুদক্ষিণা চালু করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন নির্লোভ আপনভোলা গুরু আজকের যুগে কেন, ত্রেতা যুগেও কেউ ছিল কিনা কে জানে? অন্তত দাপরে যে ছিল না, তার প্রমাণ দ্রোণাচার্য, পরশুরামরা রেখে গেছেন। গুরুগৃহে শ্লোক মুখস্থ ও পেট ভাতার বিনিময়ে বৈদিক যুগের ছাত্রদের গুরুর গরু চরানো, ক্ষেত চষা, বাড়ির কাজ সবই করতে হতো। সে অন্যত্র গেল না।

কিন্তু বিনোদদা বিনা নোটিসে বেমক্বা হার্টফেল করে চলে গেলেন। অমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কোনও মন্দ দোষ বা নেশা অন্তত ছিল না। হিসাব মিলছিল না। অনাত্মীয় মানুষটা কেন বার্মা ছেড়ে এই দত্তপুকুরে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছিলেন, সেটাও অজানা থেকে গেল। উনি মারা যাওয়ার পর কোনও এক দূর সম্পর্কের ভাইপো নিজেকে একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী প্রমাণ করে ওই বাড়িতে সপরিবারে প্রতিষ্ঠিত। বাড়ির উঠোনে এখন দড়িতে শাড়ি, জামা, কাঁথা ঝোলে এক গাদা। সম্মিলনিতে ফিরে যাওয়ার মুখ নেই। ক্যারাটে তার এই পর্যন্তই ভাগ্যে ছিল।

আজকাল জয়েন্টের সিট অনেক বাড়ানো হয়েছে। নব্বই দশকের গোড়াতেও মেডিকেলের আসন ছিল হাজারের কম, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বারোশোর মতো। এখন নাকি বসলেই পাওয়া যায় প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রমরমায়। বাবার ইচ্ছে কারিগরি, নিজের আয়ত্বে জীবনবিজ্ঞান। দুটোতেই বসেছিল। মেদিনীপুরের একটা কলেজে অ্যাডমিশন হয়েও যেত। কিন্তু বাবা শিবপুর, যাদবপুর বা বড়ো জোর উত্তরবঙ্গের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাড়া প্রাইভেট কলেজগুলোতে পড়ে কিছু শেখা যায় বলে মানতেই নারাজ। হয়তো খরচায় কুলোলে মত বদলাতেন। মা বলেছিলেন, ‘পলিটেকনিক দে’। বাবা নাক সিঁটকে বলেন, ‘কোথায় বিই, আর কোথায় পলিটেকনিক ইঞ্জিনিয়ার? যে ডাক্তার হওয়ার যোগ্য, তাকে বলছ আয়া হয়ে থাক। অশিক্ষিত মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কাকে বলে? দরকার হলে ফিজিক্স নিয়ে জেনারেল পড়বে।’

‘কেন তোমার বন্ধু তিমিরবাবু পলিটেকনিক পাস করেই তো কোম্পানির অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রিটায়ার করবে। আমি যেটা সহজে হবে আর ও পারবে সেটা বলেছি। মুখ্যু মানুষের খোঁটা তো নতুন নয়। তুমি ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে টেকনিক্যাল অফিসার…’

‘যা বোঝো না, তাই নিয়ে কথা বোলো না। অফিসে আমার কাছে এখনও সবাই আসে যে-কোনও টেকনিক্যাল সমস্যা নিয়ে, এমনকী যে-কোনও ক্রিটিক্যাল চিঠি ড্রাফট্ করাতে হলেও অবিনাশ পুরকায়েত। এত বছর কাজ দেখিয়ে…। আমার দুর্বল জায়গায় একদম ঘা দেবে না। আদর্শ স্ত্রী হওয়ার শিক্ষাই পাওনি, আর ছেলের পড়াশুনো নিয়ে ফোড়ন কাটতে এসেছে…’

দাদা বাবাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। মায়ের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করে। সে নিজের জেদে এমকম করে আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করে। ইন্দ্রজিতের এখনও পড়াশুনোই শেষ হয়নি। তবু দাদা অরবিন্দের ভাষায় সে বেকার। ছোটো ভাইয়ের কেরিয়ার নিয়ে আলোচনা হতে একদিন মন্তব্য করল, ‘মা, বাবার কিন্তু বেশিদিন চাকরি নেই। ভস্মে ঘি ঢালার পর নিজেদের খাওয়া পরার ব্যবস্থাটা যাতে থাকে সেটা দেখো।’

সারা জীবন সবার জন্য এত করে নিজের ছেলেকে কি কোনও নৈতিকতা শেখাতে পারেননি অবিনাশ? বুড়ো মানে অরবিন্দ নিজের বাবাকে দেখেনি কীভাবে ঠাকুমা দাদু তিন কাকা, তিন পিসির অত বড়ো সংসার টেনেছেন? বাড়িতে এসোজন বোসোজন লেগেই থাকত। মা অভূক্ত থাকলেও কোনওদিন অভিযোগ করেননি। এখনও দুপুরে এলে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না। সেই বাপ মার ছেলে হয়ে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের দায়িত্ব এড়িয়ে হিংসা? ছোটনের তো এখনও দায়িত্ব নেওয়ার সময় শুরুই হয়নি। এখনও এই সংসার বাপের টাকায় চলে। রোজগেরে ছেলে খেয়াল খুশি মতো এটা সেটা শখের জিনিস কিনে নিজের ঘর সাজায়। সংসারে দেওয়ার মধ্যে পুরোনো ফ্রিজ বদলে একটা দুই দরজার ফ্রিজ কিনেছে। সেটাতেও সদা সতর্ক। যেন সে ছাড়া আর কেউ রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করতে জানে না, নষ্ট করে ফেলবে। ছোটনের মতো শান্ত ও বাধ্য ভাই, যে বাবা দাদার ফরমাসে দিনে শতবার দোকান হাট ইলেকট্রিক অফিস, গ্যাসের দোকান দৌড়োচ্ছে, এমনকী পরীক্ষার আগেও মুখে কোনও ভাবান্তর ঘটায় না, তার প্রতি কেন এত বিদ্বেষ? ছোটো ছেলেটার মুখচোখ মায়ের আদলে বেশ চোখা চোখা, বাবার মতো মাঠো মাঠো গায়ের রং। বড়োর মাথা আর গায়ের রং দুটোই টকটকে পরিষ্কার, শুধু মনটাই সাফ হয়নি। …কাঁধে ব্যথা নিয়ে ইন্দ্রজিৎ দাদার ঝাঁজের কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারে।

কস্তুরী সল্টলেকের একটা কল সেন্টারে চাকরি করে। শিফ্ট ডিউটি। কখনও ভোরে উঠে দৗড়োতে হয়, কখনও দুপুরে আবার কখনও সময় রাত্রি আটটায় অফিসের বাস ধরার জন্য এই মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ায়। অফিস ফেরতা তাকে প্রায় রোজই দেখত অরবিন্দ। একবার রবিবারে বাজারে দেখা হওয়াতে দুজনেই দুজনকে দেখে হেসেছিল, ‘বাজার করতে?’

কস্তুরীর নাইট শিফ্ট না থাকলে নিয়মিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই ছোটো ভাই নিয়ম করে বাজার করলেও রবিবার অরবিন্দ একবার বাজারে চক্বর দিয়ে যায়। রবিবার সকাল আটটা নাগাদ যেতে পারলে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সবজিপাতি, মাছ মাংস কী লাগবে জানা না থাকায় খান দশেক মিষ্টি কিনে বাড়ি ফেরে। কস্তুরীকে দেখতে পেলে খানিক গল্পগুজব আর প্রশ্ন, ‘নাইট শিফট কবে থেকে?’

আমেরিকান শিফট থাকলে কস্তুরী আজকাল একটু আগে আগেই অফিসের বাসের জন্য মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করতে থাকে। আর অরবিন্দ স্টেশনে নেমে একটু দেরিতে বাড়ি ঢোকে।

‘রবিবার দিন বাজার ছাড়া আর কোথাও দেখা করা যায় না?’

‘এই তো দেখা হচ্ছে।’ হেসেছিল কস্তুরী।

অতঃপর দুজনেরই বাজারের ঘটা বেড়ে যায়। রোজগেরে ছেলে শুধু মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরলে ভালো দেখায় না বলে মাছ, মাংস, পনির, গোলদারি যেসব দোকানে কস্তুরী লাইন দেয়, অরবিন্দকেও সেখানে সেখানে হাজিরা দিতে গিয়ে এটা সেটা কিনতেও হয় মাঝেমধ্যে। যদিও জানিয়ে দেয়, সংসার খরচ বাবদ মা আর বাজার বাবদ ছোটো ভাইকে টাকা দেওয়াই আছে। কস্তুরীর একটাই উত্তর, মৃদু হাসি।

ফেরার পথে একটা চায়ের দোকানে খানিকক্ষণ বসা। দুজনেই বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে বানানো চা খেতেই পছন্দ করে। তবু। চায়ের দোকানে বসার প্রস্তাব অরবিন্দের হলেও তার খুচরোর অভাবে দাম বেশির ভাগ কস্তুরীই মেটায়। সঙ্গের হাসিটা ফাউ।

সেদিনও চা খেতেই ঢুকেছিল। দোকানটায় বড্ড বেশি ভিড় ছিল ওইদিন। একদল টি-শার্ট পরা ছোকরা উচ্চকণ্ঠে গুলতানি করছিল। কস্তুরী বলল, ‘আজ থাক। এত ভিড়ের মধ্যে…। চেয়ারও তো ফাঁকা দেখছি না’।

‘কেন, এই তো জায়গা ফাঁকা ওদিকে। সব সময় কি অধৈর্য হলে চলে? ফাইভস্টার হোটেলেও অনেক সময় ক্যাফেটেরিয়ায় টেবিল পেতে লাইন দিতে হয়। হাবু দা চারটে বেগুনি আর দুটো চা দাও।’

‘না না। আজ এই ক্যালর-ব্যালোরের মধ্যে বসতে ইচ্ছা করছে না। আমার বাড়িতে এসো বরং, চা খেয়ে যাও।’

একটা তালঢ্যাঙা লোক কস্তুরীর দিকে মন্তব্য ছুড়ে দিল, ‘ভিড়ে পোষাচ্ছে না? নিরিবিলি চাও? সকালবেলাতেই ফুর্তির ফোয়ারা বসাবে নাকি মান্তু? সন্ধেটা ফ্রি থাকলে আমাদের কাছে এসো না, সব পুষিয়ে দেব।’

‘একদম বাজে কথা বলবেন না। মিনিমাম ভদ্রতাটুকু নেই। এদের জন্যই আমি এখানে বসতে চাইছিলাম না। এখন বুঝেছ তো? শুধু শুধু এইসব নোংরা কথা শুনতে হল।’ কস্তুরী বেশ শান্ত মিষ্টি মেয়ে। এভাবে রেগে গলা চড়িয়ে কথা বলতে দেখেনি অরবিন্দ।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজ থাক। চলো যাই।’ অরবিন্দ কস্তুরীর বাহু ধরে টান দিল।

ওই দলের আর একজন উঠে এসে বলল, ‘মেয়েছেলের হাত ধরে টানাটানি করছিস। তার বেলা কিছু নয়। আর আমার ফ্রেন্ড দুটো রসিকতা করল তো ইজ্জত খসে গেল?’ ছেলেটা সোজা কস্তুরীর অন্য হাত ধরে টান লাগাল।

‘একী? একী অসভ্যতা! ছাড়ুন বলছি হাত। আমি কোথায় বসব, কার সাথে চা খাব আমার ব্যাপার। আপনারা মাথা গলানোর কে? হাবুদা কিছু বলুন। দেখছেন তো কী করছে।’

হাবুদা মন্তব্য করল, ‘শালা, মেয়েছেলে থাকা মানেই ঝঞ্ঝাট!’

বাকিরা কেউ কিছুই বলছে না। গুনগুন করে যে আওয়াজটা হল তাতে মনে হল হাবুর কথাটা একাধিক সমর্থন পেল। অরবিন্দও চুপ। সে কস্তুরীর হাত ছেড়ে দিয়েছে।

কস্তুরী স্তম্ভিত হয়ে অরবিন্দের দিকে তাকাল, ‘তুমিও কিছু বলবে না? আমাকে এখানে নিয়ে এসে এখন বিপদে ফেলে ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে?’

‘তুমি চুপচাপ ওই কোণার টেবিলে ওয়েট করলে এত কথা হতো না। তা নয়, ঘটা করে নিজের চলে যাওয়া অ্যানাউন্স করে ওদের প্রভোক করলে।’

‘আমি প্রভোক করেছি? তোমাকে দোকানে ঢোকার আগেই বললাম এখান থেকে চলো যাই। ছেলেগুলোর হাবভাব দেখেই সুবিধের নয় মনে হয়েছিল। আমরা ভেতরে ঢুকলে কি ওরা টিজ করত না? এত স্পর্ধা আমার গায়ে হাত দিচ্ছে!’ কস্তুরী উত্তেজনায় কাঁপছিল।

‘গায়ে তো হাতই দিয়েছি সোনা। অন্য কিছু তো নয়। খিক্খিক্।’ ঢ্যাঙার মন্তব্যে দলের সবকটা মিলে বিকট হাসতে শুরু করল। দোকানের ভেতরে খদ্দেরের ভিড় কমে গেল, বাইরে দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগল।

হাবুদা গজগজ করল, ‘মেয়েছেলে রোজগার করলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।’ কী আশ্চর্য! লোকটা সব দেখেও ছেলেগুলোকে কিছু বলছে না। কস্তুরীর ওপর ঝাল ঝাড়ছে, যে নিয়মিত আসে। আরও আশ্চর্য– অরবিন্দের প্রতিবাদের সাহস না থাকুক, কস্তুরীকে দোষ দিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে?

‘এবারের মতো ছেড়ে দিন। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’ বাপরে, অরবিন্দ অনেক সাহস দেখিয়ে ফেলল তো।

‘আমরা কি খুকিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি না?’

অকস্মাৎ জনতার জটলা ভেদ করে এক সুদেহী যুবক বেরিয়ে এল। আততায়ীর কবজি চেপে ধরে কস্তুরীর হাত ছাড়িয়ে নিল ওদের হাত থেকে। ‘দাদা তুই কস্তুরীদিকে নিয়ে চলে যা, আমি এদের দেখছি– কত বড়ো মস্তান। চিন্টু সুজয়কে খবর দে তো।’

সুজয় আসার আগেই তিনটে ছেলেকে দোকান থেকে টেনে বের করে মেরে পাট করে দিল ইন্দ্রজিৎ। বাকিরা আক্রোশে কাপ-প্লেট ভেঙে, চেয়ার হাতে নিয়ে আক্রমণ করতে এল ইন্দ্রজিৎকে। অরবিন্দ সেদিন কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে? কিন্তু ভাইকে সাবধান করার মতো গলার জোরটাও নেই। কস্তুরীর উদ্দেশ্যে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তোমার জন্য এই ঝামেলার উৎপত্তি। ছেলেগুলোকে গালাগাল না দিয়ে ভদ্র ভাষায় বলা যেত না? বোলতার চাকে ঢিল ছুড়েছ। এবার দেখো, কদ্দুর গড়ায়। চলে এসো।’ হাত ধরে টানল অরবিন্দ।

কস্তুরী এক ঝট্কায় হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘আর যার সাথে যাই, তোমার সঙ্গে তো নয়ই। আর কাউকে আমার জন্য বিপদে পড়তে দেখে তোমার মতো পালিয়ে যেতে আমি পারব না। ছোটন, তোমায় চেয়ার তুলে মারতে আসছে!’ কস্তুরী চেয়ার মাথায় ছেলেটাকে ঠেলার চেষ্টা করল। বাকিরা ওকে যাচ্ছেতাই ভাবে জড়িয়ে ধরল।

সুজয় আর সম্মিলনি কতগুলো ছেলে চলে এসেছে। অত বড়ো হাট্টাকাট্টা চেহারা নিয়ে সুজয় এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অতনু তার প্যানপ্যাঁকাটি চেহারা নিয়ে চিতার মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার দেখাদেখি তনয়। সুজয় সামান্য খাঁকারি দিল দল ভারি হতে, কিন্তু ষোলো ইঞ্চির বাইসেপস্ওয়ালা হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। মাথা বাঁচলেও চেয়ার কাঁধে লেগে ইন্দ্রজিতের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল।

‘তোমার পরিচয় পেয়ে গেছি। আমার সঙ্গ পাবে বলে এখানে নিয়ে এসে কতগুলো ইতর হুলিগানের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ? নিজের ভাইকে দ্যাখো’।

‘ওর মাস্তানি দেখানো বেরিয়ে যাবে। গুন্ডা বদমাশদের সঙ্গে যেচে কেউ লাগে? ওদের কাছে ছুরি-ছোরা, আর্মস থাকে। ক্যারাটে শিখে হিরোগিরি দেখাচ্ছে।’

‘ছিঃ! প্রতিবাদ করার সাহস সবার থাকে না। যা ঘটছে চারদিকে, সেটা করা নিরাপদও নয়। কিন্তু নিজের অক্ষমতা ঢাকতে কখনও আমাকে দোষারোপ করছ, কখনও নিজের ভাইকে। আমি কিন্তু ছোটনের সঙ্গে নয়, তোমার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। ও মাগো! ছোটন সাবধান!’

সুজয় এসে আক্রমণকারীকে অনুনয়ের ভঙ্গিতে পেছন থেকে জাপটে ধরল। ‘ভাই কী হচ্ছে কী? শান্ত হও। শুধু শুধু…।’

সুজয়ের দুই বাহুর আলিঙ্গনে একসাথে দুজন চ্যাঙড়া চলৎশক্তিহীন হয়ে গেল। অথচ ওই বিশাল দেহ আর বল নিয়ে সে এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল। ও আগে এগিয়ে এলে ইন্দ্রজিতের আঘাত লাগত না, অতনুর মুখ মাথা ফেটে কনুই কেটে রক্তারক্তি হতো না। সুজয় ছাড়া অল্প-বিস্তর চোট লেগেছে, এ পাড়ার যে ছেলেগুলো এগিয়ে এসেছিল তাদের সবারই।

অরবিন্দের সঙ্গে এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নয় দেখে, কস্তুরীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুজয় রিকশা ডেকে চড়ে বসল। কস্তুরী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি একাই যেতে পারব। তার আগে আমার জন্য যারা ইনজিওরড্ হল তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।’

কস্তুরীর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে অরবিন্দর কী ঝাঁজ! ‘ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট, বীরত্ব দেখানোর হাতে গরম পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল তো? ইস্! এমন দয়াময়ী সাহসিনী আর দুচার পিস থাকলে ওই ইভটিজিং-এর প্রোটেস্ট করা ছোকরাগুলোকে বেঘোরে মরতে হতো না।’

কস্তুরী মুখ খুলল, ‘নিজের ভাইয়ের ওই ছেলেগুলোর মতো পরিণতি হোক চাইছিলে মনে হচ্ছে!’

‘আমাকে ভদ্রলোকের মতো খেটে খেতে হয়। বাপের হোটেলে থেকে আর ভাইয়ের অন্ন ধবংস করে মারামারি শেখার সৌভাগ্য তো সবার হয় না। আর লম্বা চওড়া মাসল্ বাগানো বডি নিয়ে হিরোইজম দেখাতে কার না সাধ যায়?’

‘দাদা, অন্যায়ের প্রোটেস্ট করতে সবার আগে যেটা দরকার হয় সেটা হল মেরুদণ্ড। স্ট্রিট-ফাইটিং-এর জন্য মাসলস-এর চেয়ে আগে দরকার কলজে। অতনুকে দেখলি না? ওই নিঙলে চেহারা নিয়ে কীভাবে ফুঁসে উঠল? তনয়, বাপি এরাও কেউ ব্রুস লি বা হলিফিল্ড নয়। ওদিকে সুজয় আমার দেড়া চেহারা নিয়ে চুপচাপ আমাদের মার খেতে দেখে গেল। ওরা কোণঠাসা হওয়ার পর শালা মিটমাট করতে ময়দানে নামল। না হলে সবকটাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখাতাম আমরা। কস্তুরীদি তো আগে অতনুকে হাসপাতালে অ্যাডমিট করার ব্যবস্থা করল। বাকিদেরও হসপিটালে ফার্স্টএইড দেওয়া হয়েছে।’

অরবিন্দ ভেতর ঘরে যাওয়ার আগে হিসহিসিয়ে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে কথা ছুড়ে দিয়ে গেল, ‘সবচেয়ে উপাদেয় পদটা শেষপাতের জন্য তোলা থাকে।’

কস্তুরী চোয়াল শক্ত করে তারপর চোখ বুজিয়ে রাগের সঙ্গে বোধহয় খানিকটা কান্নার দলাও গিলে ফেলল। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘মাসিমা, এলাম। ডাক্তার কিন্তু গরম জল নয়, আইস কম্প্রেস করতে বলেছেন। হট ওয়াটার ব্যাগ থাকলে তার মধ্যেও বরফ ভরে নিতে পারেন। ডাক্তারবাবু এক্স-রে প্লেট দেখে নিয়েছেন, কিন্তু ক্লিনিক থেকে রিপোর্টটা আজ সন্ধেবেলায় কালেক্ট করতে হবে। ওষুধগুলো মনে করে খেও ছোটন। আর পরের কথা– ভগবান দুটো কান দিয়েছেন কেন জানো তো?’ তারপর নিজেকেই বলল, ‘আমি ভেবে পাই না, মেয়েরাই যেখানে টার্গেট হয় সেখানে তাদের নিদেন পক্ষে সেলফ্ ডিফেন্সটুকু শেখারও ব্যবস্থা থাকে না বেশিরভাগ জায়গায়। অ্যাটাক করে ভয় না দেখালে রেসকিউ করে ছেলেরা কথা শোনাবে কী করে?’

বাকিদের কাটা ছড়া, হাড়ে ফাটল ধীরে ধীরে সেরে গেলেও ইন্দ্রজিতের কাঁধের ব্যথাটা ছ মাস পরেও পুরোপুরি গেল না। এখনও বাজার দোকান করে, মানে করতে হয়। কিন্তু ডান হাতে বা কাঁধে ভারি ব্যাগ নিলেই পুরো হাতটাই খচকা লেগে অবশ হয়ে আসে। কস্তুরী জোর করে কিছুদিন ওর চিকিৎসার খরচ চালিয়েছিল। বাড়ি এসে খোঁজ করে যেত মাঝে মাঝে। অরবিন্দের উপস্থিতি বা প্রতিক্রিয়া যেন দেখতেই পেত না। রিকশায় বসিয়ে সঙ্গে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত।

অতনুরা ওদের একসাথে দেখে একবার দুই আঙুলে ‘দারুণ’ মুদ্রা ফুটিয়ে মন্তব্য ছোড়ে, ‘বস, সচীনের চেয়ে অঞ্জলি সাত বছরের বড়ো, অভিষেকের চেয়ে ঐশ্বর্যও দু-তিন বছরের বড়ো।’ বুকের ভেতরটা যে একটু শিরশির করেনি তা নয়। দাদার বান্ধবী বলে কস্তুরীকে দিদি ডাকে, না হলে বয়সের ফারাক তেমন কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুদের রসিকতায় কস্তুরীর সাহস ও সহানুভূতি দুটোর প্রবাহই বন্ধ হয়ে গেল। এখন রাস্তাঘাটে চোখাচোখি হলে, ‘ভালো?’– এর বেশি কথা হয় না।

কাঁধের ব্যথাটা এমনিতে নিয়ন্ত্রণেই থাকে। কিন্তু ডাক্তার ও ফিজিওথেরাপিস্টের দেখানো ব্যায়াম ছাড়া আর কোনও কসরত করতে গেলেই হাত নড়ানো, ঘাড় ঘোরানোর উপায় থাকে না বেশ কিছু দিন। ওয়েট ট্রেনিং তো নৈব নৈব।

বিনোদদা চলে গেছেন চার বছরের ওপর। সুজয় এখন সম্মিলনি ক্লাবের সুজয় স্যর। কস্তুরী কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। কথা তো দূর, দেখাই হয় না আর। নতুন নম্বরও নেওয়া হয়নি। চাকরির পরীক্ষা সাক্ষাৎকারের ছোটাছুটির মধ্যে দেহটাকে যোগাসন করে সচল রেখে চলেছে। কাঁধে মাঝেমধ্যে চিড়িক মারা চিনচিনে ব্যথার মতো দাদার এখনও অবদি চালিয়ে যাওয়া তির্যক মন্তব্যগুলোও যেন জিইয়ে রেখেছে কিছু গোপন পর্বের স্মৃতি– চার বছরের তদগত মার্শাল আর্ট সাধনা অথবা কাঁধে কস্তুরী…দির হাতের স্পর্শ, ‘ছোটন পেইনকিলার বেশি খেয়ো না, সেঁক নিও। তুমি আবার প্রাকটিস শুরু করতে না পারলে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হবে।’

অসত্য

সুচন্দ্রা এই পাড়ায় নতুন নয়। সেই নয় বছর বয়সে মা-বাবার হাত ধরে এই পাড়াটায় প্রথম পা রেখেছিল সে। প্রথম প্রথম বন্ধু বলতে কেউ ছিল না। খুব খারাপ লাগত সুচন্দ্রার। স্কুল থেকে ফিরে খেলার সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না।

ধীরে ধীরে একই পাড়ার ঘোষ পরিবারের সঙ্গে সুচন্দ্রার মা-বাবার আলাপ-পরিচয় গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে সুচন্দ্রাও ওদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করে। ওর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘোষদের ছোট্ট ছেলেটা। কীরকম ফুটফুটে পুতুলের মতো। ওর থেকে বয়সে চার বছরের ছোটো। সবে সবে সুচন্দ্রার স্কুলেই ভর্তি হয়েছিল। নাম অনির্বাণ। বড়োদের সবার দেখাদেখি সুচন্দ্রাও ওকে ‘অনি’ বলেই ডাকত।

মা শিখিয়ে দিয়েছিল সুচন্দ্রাকে যে, অনি-ই সুচন্দ্রার ছোটো ভাই, তাই অত কম বয়সেই সুচন্দ্রা অনি-র অনেকটা দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

স্কুলে অনি যতক্ষণ থাকত সুচন্দ্রা ওকে চোখে চোখে রাখত। একটা ক্লাস শেষ করেই দৌড়ে এসে ভাইকে দেখে যেত। ভাইয়ের ছুটি আগেই হয়ে যেত। স্কুল থেকে ফিরেই সুচন্দ্রা চলে যেত ঘোষদের বাড়ি। সারাটা বিকেল ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে সময় কেটে যেত সুচন্দ্রার। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে সুচন্দ্রা বাড়ি ফিরে আসত।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে একসাথে বড়ো হতে থাকে। কিন্তু একে অপরের প্রতি স্নেহ ওদের এতটুকুও কম হয় না। অনির্বাণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গালুরু চলে যায়। আর সুচন্দ্রা কলকাতাতেই থেকে যায়। ও কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে নিজেরই এক সহপাঠীকে বিয়ে করে নেয়। সরকারি হাসপাতালে চাকরিও হয়ে যায় ওর।

এরই মধ্যে অনির্বাণের বাবা অন্য শহরে বদলি হয়ে যান। পরিবার নিয়ে ওরা নাগপুর চলে যায়। দূরত্ব তৈরি হলেও অনির্বাণ ছুটিছাটায় সুচন্দ্রার সঙ্গে এসে দেখা করে যেত। ফোনে যোগাযোগ সুচন্দ্রা কোনওদিনই বন্ধ করেনি।

সউদি আরবে চাকরি পাওয়ার খবর অনির্বাণ ফোনেই জানিয়েছিল। অনির্বাণের সঙ্গে ফোন ছাড়াও, মেলেও সুচন্দ্রা খবরা-খবর রাখত। এরই মধ্যে তিন বছরের জন্য সুচন্দ্রা স্বামীর সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে যায় পড়াশোনা করতে। ওখানে থাকতেই খবর পায় যে অনির্বাণ দেশে ফিরে এসে একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি নিয়েছে। কলকাতাতেই ওর পোস্টিং।

কলকাতায় ফিরতেই সুচন্দ্রা, অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই সন্ধেতেই অনির্বাণ এসে হাজির হয় সুচন্দ্রার বাড়িতে।

‘আয় ভাই, ভিতরে আয়। বাব্বা কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা,’ সহাস্যে সুচন্দ্রা বলে।

‘এত দেরি করে ফিরলে তোমরা, আমার আর সময় কাটছিল না। বাবারা তো নাগপুরেই সেটেল করলেন। আমি এখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রয়েছি। সারাটা দিন অফিসে কাজেই কেটে যায় কিন্তু সন্ধে থেকে কিছুই আর করার থাকে না…’ বলতে বলতে অনির্বাণ বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দেয়।

অনির্বাণের সাড়া পেয়ে ততক্ষণে সুচন্দ্রার স্বামী অর্ক-ও বাইরের ঘরে বেরিয়ে এসেছে। বাড়িতেই চেম্বার অর্ক-র কিন্তু অনির্বাণ আসবে জেনে রুগি দেখা বন্ধ রেখেছে আজ ও।

‘কী ব্যাপার শালাবাবু? একাকিত্বে বড়োই কাহিল হয়ে পড়েছ, বোধ হচ্ছে। তা জানো তো, এর একমাত্র চিকিৎসা হয় কিন্তু ছাদনাতলায়,’ হাসতে হাসতে অর্ক বলে।

‘অর্ক ঠিকই বলেছে অনি, তুই এখনও কেন বিয়ে করিসনি?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।

‘প্রথম সউদি আরব আর এখন কলকাতা, একা একা থাকা। বিয়েটা হবে কী করে? তারপর মা আর বাবার শরীরের অবস্থা তো জানোই তুমি। ওঁদের পক্ষে মেয়ে খোঁজা অসম্ভব আর মেয়ে দেখতে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক, এখন তোমরা এসে গেছ, সুতরাং মনে হচ্ছে দিদি এবার আমার বিয়েটা হয়েই যাবে।’

‘অনি, হয়েই যাবে মনে হচ্ছে… এই কথাটার মানে কী? আর একলা থাকলে কি বাইরে বিয়ে করে এসে এখানে একটা রিসেপশন দেওয়া যেত না?’ কপট রাগের সঙ্গে সুচন্দ্রা অনি-কে বাগে আনার চেষ্টা করে।

‘দিদি, নাগপুরে কোনও বাবা-মা তাঁদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না কারণ বয়সটা আমার কম হল না। আর আমার পছন্দ মায়ের পছন্দ নয়। এই করে বিয়েটাই আর করা হচ্ছে না। দিদি, তুমি এক কাজ করো, হয় মা-বাবাকে বোঝাও যে আমি নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব আর নয়তো তুমি নিজেই এই পাত্রী ঠিক করার দায়িত্বটা নাও।’

‘কিন্তু কাকু-কাকিমা, তোর পছন্দের মেয়েকে কেন মেনে নিচ্ছেন না? অন্য কাস্ট ও, নাকি ডিভোর্সি?’ সুচন্দ্রা জানতে চায়।

‘ওই সব কিছুই না দিদি। মেয়েটি অবিবাহিত এবং আমাদেরই কাস্টের। কিন্তু ওর একটাই শর্ত যে ভবিষ্যতে আমাদের যেন কোনও সন্তান না হয়। আর এটাতেই মায়ের আপত্তি।’

‘কিন্তু মেয়েটি কেন সন্তান চায় না আর এখনও কেন মেয়েটি বিয়ে করেনি? এটা একটু অদ্ভুতই মনে হচ্ছে,’ সুচন্দ্রার গলায় স্পষ্ট শঙ্কা ফুটে ওঠে।

‘দিদি, রুমন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার সঙ্গে একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ওখানে পড়তে পড়তেই ওর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই ওর মা-ও, ওই একই রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা করিয়েও ওদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখন ও চাকরি করে। আমাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু ওর একটাই শর্ত– মা হতে চায় না,’ অনির্বাণের কণ্ঠে হতাশা ফুটে ওঠে।

‘কিন্তু কেন ওর এরকম জেদ?’

‘এটা আমি জিজ্ঞেস করিনি বা করবও না। ও আমাকে কারণটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর অতীত জানার আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি ওকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।’

‘কিন্তু এরকম একটা ডিসিশন নেওয়ার কোনও তো কারণ হবে,’ সুচন্দ্রা বলতে বাধ্য হয়।

‘রুমন আমাকে বলেছিল যে মা-বাবার চিকিৎসায় প্রচুর টাকার দরকার ছিল যার জন্য ওকে রাতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন কাজ ও কোনওদিন করেনি যাতে ওকে পরে লজ্জায় পড়তে হয়। আর ওর মা না হওয়ার ডিসিশনও সম্পূর্ণ ওর নিজের ইচ্ছেয়, এর পিছনেও কোনও অনৈতিক কারণ নেই। দিদি, আমার মনে হয় কাউকে ভালোবাসলে তাকে তার প্রয়োজনীয় প্রাইভেসিটুকু দেওয়া উচিত। আমার সন্তান হোক আর নাই হোক, তাতে মা-বাবার সমস্যা কোথায়? বাড়িতে বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো ভাই রয়েছে।’ একটু চুপ করে থেকে অনির্বাণ বলে, ‘তাছাড়া বাচ্চা দত্তক নেওয়ার অথবা সারোগেসির বিকল্প তো রয়েইছে।’

‘এই ব্যাপারটা নিয়ে রুমনের সঙ্গে কথা বলেছ?’ অর্ক এতক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ, অর্কদা। ও-ই আমাকে বলেছিল যে আমার বাড়ির লোক যদি আমার মা হওয়া নিয়ে খুব বেশি চাপ দেয়, তাহলে সারোগেসির মাধ্যমে আমি যেন ওদের ইচ্ছে পূরণ করি। ওর কোনও আপত্তি নেই। এত কিছুর পরেও মা-বাবা রাজি হয়নি। এখন তোমরা যদি কোনও ভাবে সাহায্য করো।’ অনির্বাণের কথা শুনে অর্ক চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুচন্দ্রার দিকে তাকায় অনির্বাণ, ‘দিদি জানোই তো ভালোবাসা অন্ধ। আর রুমনের প্রতি ভালোবাসাই আমার প্রথম এবং শেষ বলতে পারো।’

‘আর রুমনের ক্ষেত্রেও কি তুই-ই ওর প্রথম এবং শেষ প্রেম?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।

অনির্বাণ সম্মতিসূচক ঘাড় হেলায়। সুচন্দ্রার প্রশ্নের উত্তরে ও বলে, ‘হ্যাঁ দিদি। প্রথম থেকেই আমরা দু’জনে একে অপরকে পছন্দ করতাম। ভেবেছিলাম পড়া শেষ করে সকলকে আমাদের সম্পর্কটার বিষয়ে জানাব। কিন্তু তার আগেই রুমনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর রুমনও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইল না। কিন্তু একই শহরে থেকে সেটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সেইসময় আমিও সউদি আরবে চাকরিটা পেয়ে চলে যাই।’

‘তাই জন্যেই কি তুই হঠাৎ বাইরে চলে গিয়েছিলি?’ সুচন্দ্রা, অনিকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয়।

‘হ্যাঁ দিদি, তুমি ঠিকই ধরেছ। রুমনের জীবন থেকে আমি সরেই যেতে চেয়েছিলাম।’

‘কিন্তু তাহলে ফিরে এলি কেন?’

‘আমাদের দু’জনের কমন ফ্রেন্ড শান্তা। ওর সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ ছিল। ওই আমাকে রুমনের বাবা-মায়ের মৃত্যুসংবাদ দেয়। এই খবর পাওয়ার পরেই আমি এখানে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করি। চাকরি পেয়েই কলকাতায় ফিরে আসি। রুমন আর আমি এখন একই অফিসে চাকরি করি।’ অকপটে সবকিছু সুচন্দ্রার কাছে খুলে বলে অনির্বাণ।

‘নাঃ, শালাবাবু! তোমার কেসটা দেখতেই হচ্ছে। সুচন্দ্রা, তোমাকে অনির সাহায্য করতেই হবে। হাসপাতালে কাজের মাঝে মাঝে কীভাবে অনিকে সাহায্য করবে ভাবো,’ অর্ক এবার মুখ খোলে।

‘অনি, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজ আর কিছু করা যাবে না। কাল দেখি কোথা থেকে শুরু করা যায়,’ সুচন্দ্রা বলে।

‘তাহলে দিদি, আজ আসি। কাল তোমাকে একবার রুমনের বাড়ি নিয়ে যাব কিন্তু তার আগে পারলে মায়ের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলে নিও। দ্যাখো, মা তোমাকে কী বলেন!’ অনির্বাণ বাড়ি চলে যায়।

পরের দিন সকালে সুচন্দ্রা নাগপুরে অনির্বাণের বাড়িতে ফোন করে অনির্বাণের মা-র সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও কাকিমাকে জানায়।

‘আমার আশ্চর্য লাগছে সুচন্দ্রা, তুই ডাক্তার হয়েও এই সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছিস? তোর মনে হচ্ছে না যে, ওই মেয়েটি কোনওরকম মানসিক অথবা শারীরিক অসুস্থতার শিকার নয়তো অনির সামনে এই ধরনের শর্ত রাখে?’ অনির্বাণের মা সুচন্দ্রার কাছে প্রশ্নটা রাখেন।

‘হ্যাঁ, হতেই পারে কাকিমা… আজ আমি মেয়েটির বাড়ি যাব ওর সাথে কথা বলতে। দেখি কিছু বুঝতে পারি কিনা। কথাবার্তা যাই হোক তোমাকে এসে ফোন করব’, এই বলে সুচন্দ্রা ফোনটা কেটে দেয়।

অর্ক, সুচন্দ্রার কথাগুলো বসে শুনছিল। ও বলে ওঠে, ‘সুচন্দ্রা, এই দিকটা তো আমার মাথাতেই আসেনি। কাকিমা এর মধ্যে অনেক কিছুই ভেবে ফেলেছেন।’

‘যদি এরকম কিছু হয় তাহলে আমরা ওর চিকিৎসা করাতেই পারি। সব রোগেরই চিকিৎসা আছে। কিন্তু এখনই অনিকে ওদের কথা কিছু বোলো না তাহলে ওর মন আরও ভেঙে যাবে,’ সুচন্দ্রা ভেবে বলে।

‘ওনাদের আপত্তি হওয়াটাও স্বাভাবিক সুচন্দ্রা। কোনও রোগগ্রস্ত মেয়ের সঙ্গে কি কোনও মা-বাবা নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইবেন? অনি আর রুমনকে না জানিয়েই বুদ্ধি খাটিয়ে আসল কাহিনিটা জানতে হবে তোমাকে।’ অর্কর কথাগুলো সুচন্দ্রা মেনে নেয়।

অর্ক আরও বলে, ‘তুমি এক কাজ করো। রুমনের বাড়ি যাওয়ার থেকে অন্য কোথাও ওর সঙ্গে দেখা করো। তুমি বরং আজ না গিয়ে কাল লাঞ্চ ব্রেকে অনির অফিসে চলে যাও। রুমনও তো একই অফিসে চাকরি করে। গিয়ে বোলো, হঠাৎ কাজের জন্য তোমাকে ওদিকে আসতে হয়েছে, একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চাও। ও নিজেই হয়তো তোমাকে রুমনকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু যদি না-ও ডাকে তুমিই ওকে ডেকে নিতে পারো।’

সুচন্দ্রা কাজের দোহাই দিয়ে সেদিন রুমনের বাড়ি যাওয়া ক্যানসেল করে দিল। পরের দিন না জানিয়েই অনির অফিসে পৌঁছে গেল। দরজায় ঢুকে লিফটের সামনে দাঁড়াতেই, লিফটের দরজা খুলে দেখল অনি বেরিয়ে আসছে সঙ্গে লম্বা, শ্যামলা একটি মেয়ে, বেশ সুন্দরী।

সুচন্দ্রাকে দেখেই অনির্বাণ বলে ওঠে, ‘আরে দিদি। তুমি এখানে? সব ঠিক তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ… সব ঠিক আছে। ঘাবড়াস না। এদিকে একটু কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই। কেন, কোথাও বেরোচ্ছিস নাকি?’ সুচন্দ্রা বলে।

‘রুমনকে লাঞ্চে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বিকেলের প্রোগ্রাম ফিক্স করার ছিল… তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে,’ অনির্বাণের অনুরোধে সুচন্দ্রা ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়।

‘ঠিক আছে, চল। ভালো কোথাও একটু বসি যেখানে শান্তিতে কথা বলা যাবে।’

‘তাহলে একটু এগিয়ে ‘আঙ্গিঠি’ রেস্তোরাঁর ফ্যামিলিরুমে গিয়ে বসা যেতে পারে। ওটা বেশ ভালো আর দুপুরে ওখানে ভিড়টা কম,’ রুমন বলে ওঠে।

পাঁচ মিনিটেই ওরা রেস্তোরাঁয় এসে পৌঁছে যায়।

‘খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ রুমন। নয়তো পার্কিং পেতে আর ব্যস্ত রাস্তায় যাতায়াত করতেই অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যেত,’ সুচন্দ্রা বলে।

অনির্বাণ বলে, ‘রুমনের আইডিয়া কিন্তু সবসময়ই খুব কাজে লাগে দিদি। এটা ওর একটা বড়ো গুণ।’

‘তাহলে তো ওকে খুব শিগগিরই, পরিবারের একজন সদস্য করে নিতে হবে।’

অনির্বাণ হেসে রুমনের দিকে তাকায়। সুচন্দ্রার মনে হয়, রুমনের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলেও চোখ দুটো বিষাদ মাখানো। এই বিষাদটাকে লুকোবার জন্যেই যেন রুমন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রেস্তোরাঁয় বসে রুমন সুচন্দ্রার কাছে ওর বিদেশে থাকাকালীন দিনগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই নিয়েই খানিকটা সময় কেটে যায় ওদের। খাবার খেতে খেতে সুচন্দ্রা বলে, ‘আমার বিদেশের এক্সপিরিয়েন্স সবই তো শুনলে, এখন তোমার কথা বলো রুমন।’

‘আমার সম্পর্কে বলার মতো সবকিছুই হয়তো শুনে থাকবেন অনির্বাণের কাছে। বলার মতো কিছুই নেই। অনির্বাণের সঙ্গে কলেজে পড়তাম, এখন এক অফিসে চাকরি করি আর আমি থাকি যাদবপুরে।’

‘যাদবপুরে রুমনের বাবা খুব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। হাজার অসুবিধে হওয়া সত্ত্বেও ও ওই বাড়ি বিক্রি করেনি,’ অনি এরই সঙ্গে জুড়ে দেয়, ‘ওখানে ও একাই থাকে।’

‘ভয় লাগে না?’

‘না, দিদি। ভয় পাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি,’ রুমন হাসে।

‘বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু অনিকে ছোটোবেলায় ভীতু বলে ডাকতাম, সেটা জানো কি?’

রুমনা হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘কই না-তো দিদি। ও তো কখনও বলেনি যে ছোটোবেলায় ওকে ভীতু বলে ডাকা হতো। কীসে ভয় পেত দিদি?’

‘বলার দরকার নেই। যখন ওর সাথে থাকবে তখন নিজে থেকেই সব জানতে পারবে,’ হেসে উত্তর দেয় সুচন্দ্রা।

‘ওর সাথে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অনির মা-কে কষ্ট দিয়ে আমি অনিকে বিয়ে করতে পারব না।’ রুমনের চোখে বিষাদের ছায়া উঁকি মারলেও কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা সুচন্দ্রাকে অবাক করল।

সুচন্দ্রা হাতঘড়ির দিকে তাকায়, ‘এই কথা আলোচনা করার সময় বা জায়গা এটা নয়। আমাকে একবার হাসপাতালে ঢুঁ মারতে হবে। হাতে সময় রয়েছে। তোমার সময় হলে বোলো, আরাম করে বসে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। হয়তো সমাধানের একটা রাস্তাও পাওয়া যেতে পারে।’

‘আজ সন্ধেবেলা তুমি আর অর্কদা যাবে রুমনের বাড়ি?’ অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে।

‘এখন কাজ শেষ করে বাড়ি যাব। একবার বাড়ি গেলে দ্বিতীয়বার আর বেরোবার ইচ্ছে হবে বলে মনে হয় না। আর আজ তো তোদের সঙ্গে দেখা হয়েই গেল।’

‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু অর্কদার সঙ্গেও তো ওর আলাপ করাতে হবে।’ অনির্বাণ বলে, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে আরাম করো, আমি রুমনকে নিয়ে বরং তোমাদের বাড়ি চলে আসব।’

‘সেটা তো খুব ভালো হয়। চলে আয় রুমনকে নিয়ে। রাত্রে আমার বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরিস।’

সন্ধে হতেই অনির্বাণ, রুমনকে সঙ্গে করে সুচন্দ্রাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসাথে বসে হাসি, আড্ডায় চারজনেই জমে উঠল। গল্পের মাঝে একপ্রস্থ চা আর স্ন্যাক্স সার্ভ করল সুচন্দ্রা। গল্প চলতে চলতেই অর্ক বলল, ‘সুচন্দ্রা আর একবার চা হলে আড্ডাটা কিন্তু আরও জমে যেত।’

‘চা খাওয়ার তোমার একটা এক্সকিউজ চাই।’

‘প্লিজ, লক্ষ্মীটি…।’

অর্কর মুখের ভঙ্গি দেখে সকলে হেসে ফেলল। অগত্যা সুচন্দ্রাকে উঠতেই হল। রান্নাঘরের দিকে ও পা বাড়াল। চায়ের জলটা গরম করতে করতেই অনির্বাণ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল, ‘দিদি তুমি কি মাকে ফোন করেছিলে?’

‘হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম। কাকিমারা কেমন আছেন সেটা নিয়েই কিছুক্ষণ কথা হল।’

‘ব্যস, আর কিছু বললে না? আমাদের কথা কিছু বলোনি? তোমাকে বলেছিলাম না, মায়ের সঙ্গে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলতে,’ অনির্বাণের স্বরে সামান্য হতাশা প্রকাশ পেল।

‘সুযোগ হয়নি। আর সব কথা আলোচনা করার একটা সঠিক সময় থাকে। রুমন কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না, বিয়ে করলে তো তোকেই করবে। যখন এতদিন অপেক্ষা করলি তখন না হয় আরও কটা দিন কর।’

‘এছাড়া আর করারই বা কী আছে?’ অনির দীর্ঘশ্বাস সুচন্দ্রার কানে এসে বাজল।

রুমনের সঙ্গে সুচন্দ্রার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠল। সবদিক দিয়ে সুচন্দ্রা রুমনের বিশ্বাস অর্জন করে নিল। একদিন সুচন্দ্রার সঙ্গে কথা না হলে রুমনের মনে হতো তার জীবন থেকে একটা কিছু বাদ পড়ে গেছে। কিছু একটা অমূল্য জিনিস যেন ও হারিয়ে ফেলেছে।

সুচন্দ্রাও রুমনের প্রতি একটা স্নেহের আকর্ষণ অনুভব করত। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ ছিল। রুমনের কাছেই সুচন্দ্রা জানতে পারল, অনি অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য মুম্বই যাচ্ছে। মুম্বই চলে গেলে অনির অনুপস্থিতিতে সুচন্দ্রা একদিন ফোন করে রুমনের বাড়ি এসে উপস্থিত হল। রুমনের বাড়িটা সত্যিই দেখার মতো। বোঝাই যাচ্ছিল যিনি বানিয়েছেন তার পছন্দটা বেশ উঁচুমানের।

‘খুব ভালো করেছ বাড়িটা বিক্রি না করে রুমন। বিয়ের পরেও নিশ্চয়ই তুমি এখানেই থাকতে চাও? অনির্বাণ রাজি তোমার প্রস্তাবে?’ সুচন্দ্রা আস্তে করে রুমনকে জিজ্ঞেস করল।

‘অনি তো কোনও শর্ত ছাড়াই আমার সব প্রস্তাব মানতে রাজি। কিন্তু আমি ওর মা-বাবার আশীর্বাদ না নিয়ে অনিকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। মা-বাবার স্নেহ থেকে তাদের সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কখনও উচিত নয়। স্বার্থপর ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার জন্য অনি সবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করুক, এ আমি কিছুতেই চাই না।’

‘এটা তো খুবই ভালো কথা রুমন। কাকু, কাকিমা মানে অনির বাবা-মা খুবই ভালোমানুষ। ওদের যদি ঠিকমতো বোঝানো যায় মানে তুমি বিয়ের যে শর্ত রেখেছ, তার কারণ বলা যায়, তাহলে ওনারাও বিনা দ্বিধায় হাসতে হাসতে এই বিয়েতে মত দেবেন। কিন্তু অনি ওদের কোনও কারণও বলেনি।’

‘ও নিজে জানলে তবে তো ও, অন্য কাউকে বলবে। আমি ওকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু ও কিছুতেই শুনতে চায় না। অনির কথা হল ভবিষ্যতকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করো, অতীতকে মনে রেখে কী লাভ।

আমিও অতীতকে মনে করতে চাই না দিদি। কিন্তু অতীত অথবা জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু ঘটনা এমনও হয় যেটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সারা জীবন সেটাকে নিয়েই বাঁচতে হয় দিদি,’ রুমনের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে।

‘তুমি চাইলে তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারো,’ সুচন্দ্রা দুই হাত দিয়ে নত হয়ে আসা রুমনার মুখটা পরম স্নেহে তুলে ধরে।

‘কয়েকদিন ধরে আমি এটাই ভাবছিলাম দিদি।’ গভীর নিঃশ্বাস নেয় রুমন। একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নেয়। বলতে শুরু করে, ‘কলেজের পরেই চাকরি পেয়ে যাই। ততদিনে বাবা আর মা দু’জনেরই ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চাকরি থেকে দেরি করে ফেরা আর বারবার ছুটি নেওয়ার জন্য চাকরিটাও ঠিকমতো করতে পারছিলাম না। আর মা-বাবার দেখাশোনাও ঠিকমতো হচ্ছিল না। অতএব চাকরিটা আমি ছেড়ে দিই। মুম্বই চলে যাই মা-বাবাকে নিয়ে। আত্মীয়ের একটা ফ্ল্যাট খালি ছিল, ওখানে গিয়েই উঠি। বাবার টাকা ছিল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য আমিও কাজ করতে শুরু করি। ভ্যাকিউম ক্লিনার বেচা থেকে শুরু করে, কী না করেছি। হাসপাতালে ক্যান্টিনে কাজ করেছি, বেবি সিটিং করেছি। মা-বাবার আপত্তি সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে দু’বার স্যারোগেট মাদার হতেও লজ্জা পাইনি।

সেইসময় মেশিনের মতো বাচ্চার জন্ম দিয়েছি আর টাকার বিনিময়ে যারা টাকা দিয়েছে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি বাচ্চাকে। কিন্তু এখন মনে হয় বিয়ের পর যখন নিজের সন্তান হবে তখন তাকে মানুষ করতে গিয়ে আগের দু’টো বাচ্চার কথাও মনে পড়তে পারে। তাদের তো আমি অচেনা লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। ওদের কথা মনে পড়লে আমি যদি বিচলিত হয়ে উঠি, তাহলে সেটা অনি বা অনির সন্তানের প্রতি অন্যায় করা হবে। সুতরাং বিয়ের পর নিজের সন্তান যাতে না হয় তারই জন্য অনির কাছে ওই প্রস্তাব রেখেছিলাম। দিদি তুমি, অনি এবং ওর মা-বাবাকে পুরো সত্যিটা খুলে বলো। ওনারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা আমি মাথা পেতে নেব।’

‘ঠিক আছে রুমন, সুযোগ বুঝে আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলব,’ সুচন্দ্রা রুমনকে আশ্বাস দেয়।

সুচন্দ্রা বেরিয়ে আসে রুমনের বাড়ি থেকে। রুমনের স্বীকারোক্তি সুচন্দ্রার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রুমনের ভাবনাটা সত্যি। অনির সঙ্গে হয়তো ওর কোনও সমস্যা হবে না কারণ অনির রুমনের প্রতি ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ। রুমনের সবকিছুই ও মেনে নেবে কিন্তু অনির মা-বাবা? তারা কী করে এমন মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করবেন যে কিনা দু’বার স্যারোগেট মাদার হয়েছে? কাজটা সহজ নয়।

সুচন্দ্রা ভাবতে থাকে। কাকু, কাকিমাকে রুমনের বয়সের দোহাই দেওয়াটা কি খুব অন্যায় হবে? রুমনের যা বয়স তাতে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা বিপজ্জনক, এমনটা বোঝানো অসুবিধার নয়। কথাটা খুব একটা মিথ্যাও না। সুচন্দ্রার মনে হয় অনি আর রুমনের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে এতটুকু ছলনার আশ্রয় তো নেওয়াই যেতে পারে।

 

ছায়াবৃতা

ট্রেনের সফর বরাবরই আমার খুব প্রিয়। জানালা থেকে মুখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না আমার। ভালোবাসি প্রকৃতি দেখতে। ট্রেনের জানলায় বসে দেখতে থাকি কীভাবে প্রকৃতি বদলে যায়, বদলায় মাটির রং, মাটির গঠন। কুলটি ছাড়াতেই এরকমই বদলটা চোখে পড়ছে। কুমারডুবি ছেড়ে ট্রেন এগোতেই বুঝি, রাজ্য বদল হতে যাচ্ছে। ঝাড়খন্ডে প্রবেশ করব এবার।

বহুবছর পরে আবার প্রান্তিক মালভূমি অঞ্চলের ধূ-ধূ আবহে ফিরে এলাম। কুড়ি বছর আগে, আমি ছিলাম এই এলাকার এসডিও। যাকে সোজা ভাষায়, জেলার সর্বেসর্বা বলা চলে। তখন আমার বয়সও কম। গোটা এলাকাটাও ছিল একেবারে অন্যরকম। অনুন্নত কিছু মানুষ, আর ততধিক অনুন্নত পরিকাঠামো। রাস্তা বলতে, দীর্ঘকাল চলতে চলতে পায়ে পায়ে যে-রাস্তা তৈরি হয়ে যায়, সেটাই। বাকিটা কেবলই জঙ্গল। জঙ্গলে বেশিরভাগই পলাশ গাছ।এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পলাশফুল ফোটে। রাঙা পলাশ রক্তিম করে রাখে গাছের শীর্ষ আর শাখা।

এসডিও-র অফিস অর্থাৎ জেলার প্রধান কার্যালয় থেকে এই গভীর জঙ্গলের কাছাকাছি আসতে হলে, একাধিক নদীনালা পার হতে হতো। বর্ষায় এখানে পৌঁছনো তো বলতে গেলে অসম্ভব হয়ে পড়ত, কেন-না তখন নদীনালাগুলিও জল পেয়ে ফুলে উঠেছে। ভীষণ স্রোত। সহায় বলতে ভুটভুটি। নদী এপার-ওপার করার কোনও সেতু ছিল না।

এবার এসে দেখলাম, রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে বটে, কিন্তু বড়ো নদীর উপর কোনও সেতু এখনও তৈরি হয়নি। ক্রমাগত কেটে ফেলায় জঙ্গলের ঘনত্বও যথেষ্ট কমে এসেছে। কোথাও কোথাও তো এতটাই কমে গেছে গাছের সংখ্যা যে, সেখানে জঙ্গল নামমাত্র। দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মানুষের কি নিজের ভবিষ্যতের জন্যও কোনও আশঙ্কা হয় না! নজরদারি থাকা সত্ত্বেও এমন নির্বিবাদে গাছ কেটে নেওয়ার পিছনে বড়ো ষড়যন্ত্র আছে। যে-কটি পুরোনো পলাশগাছ এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মাথায় লাল আগুন দেখে মন ভরে গেল নিমেষে।

জঙ্গলের মধ্যে কিংবা আশেপাশে যারা থাকে, তারা সকলেই আদিবাসী। কুড়ি বছর আগে তাদেরকে নিজেদের রীতি-রেওয়াজের রক্ষণশীল চেতনাতেই আবদ্ধ দেখেছি। প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিশে ছিল এরা। যেমনভাবে জঙ্গলের আর-পাঁচটা প্রাণী থাকে। মনে হতো, এই জঙ্গলটিই ওদের পৃথিবী। এই পৃথিবীর বাইরেও যে-একটা পৃথিবী আছে, সে সম্পর্কে তারা ছিল উদাসীন। নিজেদের পৃথিবীতে বাইরের কারও আগমন তারা ভালো চোখে দেখত না। বিরক্ত হতো। লুকিয়ে পড়ত ঘন জঙ্গলের মধ্যে।

জঙ্গল ওদের রক্ষা করত। বাঁচিয়ে রাখত ওদের গোপনীয়তাকেও। এ অঞ্চলের আদিবাসী নারীদের ঊধর্বাঙ্গে বস্ত্র বিশেষ দেখিনি। তাতে তাদেরকে লজ্জা পেতেও দেখিনি কখনও। এইবার এসে দেখলাম, আদিবাসী মহিলারাও অনেক বদলে গেছে। ঊধর্বাঙ্গ আর অনাবৃত নয়। পরিবর্তন আরও অনেক জায়গায় ঘটেছে। যেমন, বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদ করার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আগে এরা বনজ সম্পদের উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখন যেন মনে হচ্ছে, এলাকাটির অর্থনীতি কৃষিপ্রধান হয়ে পড়ছে।

বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে, সরকারের পক্ষ থেকে, এই এলাকার উন্নয়নের পরিকাঠামো আর সম্ভাবনা সরেজমিনে দেখতে এসেছি। সঙ্গে, জেলার কালেক্টর, পুলিশ প্রধান এবং অন্যান্য অফিসাররাও রয়েছেন। ঠিক হল, সকলে মিলে জলখাবার খেয়েই একটি বড়ো গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়ব। কুড়ি বছর আগে এই গ্রামটিকে আমার প্রভূত সম্ভাবনার আকর মনে হয়েছিল। নানা কারণে সে সময় কাজ আর এগোয়নি। এবার সুযোগ পেয়ে প্রথমেই এই গ্রামটিতে যাব বলে মনস্থ করলাম।

গাড়ি চলাচলের রাস্তা নেই বলে, অনেকটা ঘুরে যেতে হল। ফলে, পৌঁছতে যথেষ্ট বেলা হয়ে গেল। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নিতে গিয়ে টেরই পাইনি, কখন ঝুপ করে সন্ধে নেমে পড়েছে, বাদুড়ের বেশে বিস্তৃত পাখা ছড়িয়ে দিয়ে!

এই গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। খুব সম্পন্ন পরিবারে সৌরবিদ্যুতের দুটো-একটা আলো জ্বলে। না হলে, অন্ধকার ঘোচাতে লন্ঠনই ভরসা। সরকারি বাবুরা এসেছেন বলে, আজ অবশ্য একটা হ্যাজাক জোগাড় করে আনা হয়েছে। সেটা জ্বালাতে অন্ধকারটা যেন আর একটু গাঢ় হল।কাজকর্ম মিটতে, কালেক্টর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা সামান্য বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে।এখানকার ছেলেমেয়েরা নাচে খুব ভালো!’  কবজি উলটে হাতঘড়ি দেখে বললাম, ‘নাচ দেখতে গেলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে মশাই। আর-একদিন এলে হতো না?’

কালেক্টর নিজেই যথেষ্ট উৎসাহী। স্বাভাবিক। বউ-ছেলেমেয়ে-টিভি সিরিয়াল ছেড়ে, এই নির্বান্ধব পৃথিবীতে দিনের পর দিন কাটানো, খুব সহজ কথা নয়। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করে বললেন, ‘খুব জরুরি কাজ না থাকলে, আমি বলি কী, একটু দেখেই যান। সঙ্গে তো গাড়ি আছে। পৌছনোর চিন্তা তো নেই। তা ছাড়া এখন পুলিশের যা কড়া নজরদারি শুরু হয়েছে, তাতে ডাকাতেরাও আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারছে না!’

আদিবাসীদের নাচের এক নিজস্ব মাদকতা আছে। দু’দশক আগে এখানে যখন ছিলাম, সুযোগ হয়েছিল দেখার। কিন্তু, সেসব তো প্রায় গতজন্মের কথা বলে মনে হয়! বাকি সবকিছুর মতো সেই নৃত্যশিল্পীদের মোহিনী বিভঙ্গেও পরিবর্তন এল কিনা, সেটা লক্ষ্য করার লোভ আমারও কিছু কম ছিল না। আটচালায় পাতা মাদুরের উপর পা মুড়ে বসে পড়ে কালেক্টরকে বললুম, ‘বেশ, আপনি যখন অভয় দিচ্ছেন, থাকাই যাক তাহলে কিছুক্ষণ!’

ক্লাবের সদস্যদের আনন্দ তখন আর দেখে কে! সরকারি বাবুর খামখেয়ালে এত বড়ো আয়োজনটা বানচাল হয়ে যাচ্ছিল দেখে, তারা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। এখন তেড়েফুঁড়ে উঠে, আর্জি নিয়ে আসা স্থানীয় লোকের ভিড়টা নিমেষে ফাঁকা করে, তারা নাচের জায়গা তৈরি করে নিল।

মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে গান। ক্লাবেরই দুই যুবক, তাদের নিজস্ব ভাষায় গান ধরল। ভাষাটা খানিকটা চেনা ঠেকছে, খানিকটা অচেনা। বোঝা, না-বোঝার আলো-আঁধারিতে গান শেষ হলে, কালেক্টর ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি বোধহয় ভাষাটা বুঝতে পারেননি, তাই না?’

মাথা নেড়ে লজ্জিত গলায় বললাম, ‘বাস্তবিক ভুলেছি। অনেক দিনের ব্যাপার তো!’

কালেক্টর বললেন, ‘আপনাকে স্বাগত জানাল। গাইল, ‘শহর থেকে গাঁয়ে আসা সরকারি বাবু, তোমায় নমস্কার’।’

খানিকক্ষণের বিরতির পর তিনজন আদিবাসী মহিলা মঞ্চে এল। দুজন তরুণী, অন্যজন মধ্যবয়সিনি। বয়স্কার শরীরও একটু ভারী। কিন্তু আশ্চর্যরকম টানা টানা চোখ আর ভারী কালো শরীরকে পেঁচিয়ে রাখা শাড়ি ভেদ করে, উন্নত স্তনদ্বয়ের আভাসে তার রূপ, ভারতীয় সনাতন সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিন মহিলা হাত ধরাধরি করে দাঁড়াল। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি যে, তার বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি বছর। ছিপছিপে চেহারার ছটফটে মেয়েটির চোখ-মুখ আদিবাসীদের মতো নয়, বরং বেশ চোখা। নাচের লয় যত দ্রুত হল, ততই মেয়েটির শরীরে দেখা দিল তীব্র ঘূর্ণি। কী অনায়াস দক্ষতায় যে নাচতে থাকল সে!

তিনজন নারী ঘুরে ঘুরে নাচছে আর তাদের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আর-এক দল গান গাইছে বনজ সুরে। যন্ত্রানুষঙ্গ বলতে নেই কিছুই। কেবল একটি স্টিলের থালা আর চামচ। একজন গায়িকা চামচ দিয়ে থালায় আঘাত করে তাল রাখছে। নাচের মুদ্রা এই আদিবাসীদের নিজস্ব। কয়েকটি একেবারে নতুন লাগল। হয়তো শহুরে প্রভাবেই কয়েকটি মুদ্রা নতুনভাবে যোগ হয়েছে নাচে। শহুরে দর্শক সামনের সারিতে বসে থাকায় নর্তকী ও গায়িকারা যেন নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে।

আমি মগ্ন হয়ে আছি। কিন্তু মগ্ন হয়ে যে নাচটাই দেখছি, এমন নয়। আসলে, আমার মন চলে গেছে কুড়ি বছর আগের অন্য একটি ঝাপসা হয়ে আসা দৃশ্যে। সেদিনও এমনই নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। রাতের বেলা, তবে হ্যাজাক বা লন্ঠন জ্বালতে হয়নি। আকাশ ভরা ছিল জ্যোৎস্না। জায়গাও অবশ্য এটা ছিল না। জঙ্গলের মধ্যে, চারদিকে আদিবাসীদের ঝুপড়ি দিয়ে ঘেরা একটা ফাঁকা গোল জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাচছিল নর্তকীরা। আজ যেন অলৌকিক মনে হয়। যেন, এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি, যেন এমন কোনও দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শীই আমি ছিলাম না!

আনমনা মনটাকে টেনে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। নর্তকীরা এখনও নাচছে। হঠাৎই মনে হল, ওদের মধ্যে বয়স্কা নারীটি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতে নর্তকীরা যেভাবে তাকায়, এই তাকানোর ধরনটা সেরকম নয়। একটু অন্যরকম। যেন খুব ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। বুক কেঁপে উঠল আমার।

আমিও সেই নারীকে ভালো করে দেখলাম। ততক্ষণে নর্তকীদের ঘূর্ণনের গতি বেড়ে গেছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আমার যেন মনে হল, এই মহিলাকে আগেও কোথাও আমি দেখেছি। এই দৃষ্টি আমার খুব পরিচিত।

পৃথিবীতে কত মানুষের সঙ্গেই না পরিচয় ঘটে! হূদয় খুঁড়ে অনুরূপ একটি অবয়বকে তুলে আনতে চাইলাম। ততক্ষণে নাচের অনুষ্ঠান শেষ। শিল্পীরাও আটচালার বাইরে গিয়ে ভিড় আর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

আটচালা থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের গহ্বরের দিকে একটু এগোলাম। সঙ্গী অফিসারদের মধ্যে দু-একজন পিছু পিছু আসছিলেন। হাত নেড়ে তাদের অনুসরণ করতে বারণ করে বললাম, ‘দূরে কোথাও যাচ্ছি না। এক্ষুনি আসছি।’

শুনলাম, এই আটচালায় পঞ্চায়েত মিটিংয়ে বসে। সন্ধে হয়ে যাওয়ায় চারপাশটা ইতিমধ্যেই বেশ শুনশান। একটু দূরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গায় কয়েকটি বড়ো গাছ। ধীর পায়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম সেদিকে। হঠাৎই পিছনে কারও পায়ের শব্দ শুনে ঘোর ভেঙে গেল। চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি, আদিবাসী এক মহিলা এদিকেই হেঁটে আসছে। মনে ভাবলাম, সম্ভবত কোনও ব্যক্তিগত কারণেই, এদিকটা নিরালা বলে, এদিকেই আসছে। তাকে শুনিয়ে গলাখাঁকারি দিলাম। কিন্তু, তাতে না থমকে, মহিলা দ্রুত পায়ে হেঁটে কাছে এগিয়ে এল।

এবার রাগত গলায় বলে উঠলাম, ‘কে? কী চাই?’ আসলে ভিতরে ভিতরে একটু ভয়ও হচ্ছিল। সেটাই রাগের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল।

কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল সেই মহিলা। তারপর নীচু গলাতে বলল, ‘আমায় চিনতে লারছেন, সাহেব?’

এবার একটু সাহস পেয়ে দু-পা এগোতেই মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এ তো সেই নাচের মেয়েদের দলের মধ্যবয়সিনি মহিলা! নাচতে নাচতে বারবার অদ্ভুত চোখে যে আমায় দেখছিল!

আমি এবার সত্যিই অবাক হয়ে বললাম, ‘কে তুমি? ঠিক চিনতে পারলাম না তো–!’

মহিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মিথিলাকে তুমার সত্যি মনে লাই?’

এক পলকে মন চলে গেল কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। সেই জ্যোৎস্নালোকিত, ঝুপড়ি পরিবেষ্টিত গোল নৃত্যাঙ্গন। তাতে জনাকয়েক আদিবাসী তরুণী নাচছে। তাদের কোমরে দুলকি তরঙ্গ উঠেছে। পায়ের গোছে রুপোলি চাঁদের গলিত মায়া। নর্তকীদের মধ্যে মিথিলাও ছিল, এবার মনে পড়েছে। ওর বয়স তখন কুড়ির আশেপাশে। কিন্তু তখনই যথেষ্ট বন্য শরীর। সুডৌল কায়ায় ভয়ংকর পুরুষঘাতী বাঁক। সমুদ্রের তলদেশ থেকে ফুঁসে ওঠা পাহাড়ের মতো উত্তুঙ্গ দুই বুক, নাচের ঘূর্ণিতে দুলছে। অলৌকিক ছিল সেই রাত। অবিশ্বাস্য! তখন আমিও অবিবাহিত। বান্ধবী হয়নি। এমন এক জায়গায় চাকরি সূত্রে এসে পড়েছি, যা তথাকথিত সভ্য জগৎ থেকে সবদিক দিয়ে পৃথক। টেলিফোন নেই, ডাকবিভাগের অস্তিত্বও না থাকার মতো, ইলেকট্রিক আলোর তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না!

ফলে, নাচ হচ্ছিল খুঁটিতে বাঁধা মশালের আলোয়। কখনও কখনও মাদলের শব্দকে ছাপিয়ে, দূরের কোনও জঙ্গল থেকে ভয়াবহ বন্যপ্রাণীর চিৎকার ভেসে আসছিল।

একসময় থেমে গেল নাচ-গান। আদিবাসীরা আপ্যায়ন করতে জানে। প্রত্যেকেই দিনএনে দিন খাওয়া মানুষ, হাড় জিরজিরে, অভাবে অর্ধনগ্ন–কিন্তু আন্তরিকতায় কোনও খামতি নেই। এসডিও-বাবু তাদের মহল্লায় এসেছেন, এতেই যেন তাদের মোক্ষলাভ হয়ে গেছে।

এমনিতে সারাটা দিন কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। গ্রামের মুখিয়ার সঙ্গে একটার পর একটা স্থানীয় সমস্যার সমাধান করে, একটু ফুরসত পেয়ে দেখি, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সমস্যার সমাধানে এলাকার বাসিন্দারা খুশি হল। বোধহয়, সেইজন্যই নাচ-গানের এই আয়োজন! এরপর আবার ঢালাও খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা রেখেছে। শোওয়ার বন্দোবস্ত ফাঁকা একটি ঝুপড়িতে। খেয়েদেয়ে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে কোনওমতে টেনে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় ফেলে দিলাম। গরমকাল। তাই শখ করে আনা নাইটসুটের উপরাংশটা খুলে ভাঁজ করে রেখে দিলাম পাশে।

কখন দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, নিজেই জানি না। মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে আনছে মহুয়া-পলাশের মিষ্টি গন্ধ। ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এমন নিশ্চিন্ত অবকাশ বেশিক্ষণ রইল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই হঠাৎ মনে হল, এ ঘরে আমি একা নই, আরও কেউ আছে। আশেপাশের নিস্তব্ধতায় তার নিশ্বাসের শব্দটিও তীব্রতর হয়ে প্রবেশ করছে কানে।

বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। উঠে বসে চিৎকার করে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’ ঘরের মধ্যে থিকথিকে অন্ধকার। তার মধ্যেই একটি ছায়া নড়েচড়ে উঠে, বিছানার দিকে এগিয়ে এল ধীর পায়ে। করউজ তেলের তীব্র গন্ধ নাকে এসে ঠেকল আমার। ছায়া বলে উঠল, ‘বাবু, আমি মিথিলা!’

‘মিথিলা’, আমি সতর্ক গলায় বলে উঠি, ‘তুমি এত রাতে কী করছ এখানে? কী… ক্বী…?’

মিথিলা এগিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে বসল। তারপর একটু থেমে থেকে বলল, ‘একজন মেয়ে রাতের বেলা একলা একজন পুরুষলোকের কাছে কেন আসে, তুমি বুঝো লাই বাবু? তুমি আমাদের গাঁয়ের অতিথ্। আমাদের মালিক। তাই, মুখিয়া আমায় বললে, মিথিলা, তুই যখন লাচ করছিলি, তখন সাহেব সবচেয়ে বেশি তুর দিকেই চোখ ঠারছিল। তুকেই সাহেবের বেশি মনে ধরেছে। সত্যি?’

অন্ধকারেও বুঝতে পারি, ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ধরে, মিথিলা এদিকেই তাকিয়ে আছে। মেঝের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে উঠি, ‘মুখিয়ার এত সাহস? ডাকো তো তাকে–!’

মিথিলা উঠে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ-ই আমার কাঁধে হাত রাখল। সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল আমার। ফিক করে হেসে, সে বলল, ‘আবার মুখিয়াকে কেন ডাকছ গো বাবু? আমি কি এতই খারাপ? এদিকে তাকাও, দ্যাখো না বাবু, কত সোন্দর আমি!’

মিথিলার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এমন মহাপুরুষ আমি নই। ওই তীব্রতার কাছে হার মানলাম। সে আমায় ঠেলে বিছানার উপর ফেলে দিল। অনুভব করলাম, তার চওড়া ভিজে ঠোঁটজোড়া আমার গলার কাছে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি তাকে ঠেলে উঠতে চাইলাম, কিন্তু সে যেন, এখানকার জঙ্গলের কুখ্যাত মানুষখেকো লতার মতোই আমায় জড়িয়ে ধরেছে।

এভাবে কতক্ষণ ভেসেছি জানি না। তলিয়ে যেতে যেতে, কাঁধের উপর হঠাৎ-ই দুফোঁটা গরম জল এসে পড়ায়, যেন চেতনা ফিরে পেলাম। কানের কাছে অত্যন্ত নীচু গলায় কথা বলে উঠল মিথিলা।

‘বাবু, আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। তাইলে, মুখিয়া আর তার লোকজন মনে করবে, আমারই কোনও খামতি আছে। আমি পুরা মেয়েমানুষ লই। কারও বউ কি রাখিতো হওয়ারও যোগ্য লই!’

ভোরে ঘুম ভাঙতে পুরো ঘটনাটা স্বপ্ন মনে হল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের সোনালি রোদ্দুর গলে ভিতরে ঢুকে আসছে। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিক এখনও বেশ নিরিবিলি। তবে জঙ্গলের উপর থেকে রাতের রহস্যময়তার পর্দা সরে গেছে।

সেদিন সকালেই সদরে ফিরে এলাম। তারপর মাসখানেকের মধ্যে আমার বদলি হয়ে গেল অন্য জেলায়। সেই রাতটা বিস্মৃতির ধুলোর নীচে চাপা পড়ে রইল।

তারপর আজ।

সেই রাত আর কুড়ি বছর পরের এই রাত। জায়গাটা একই। মিথিলাও সেই মিথিলা, মাত্র কয়েক হাত দূরে সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত বাড়ালেই আমি ওকে ছুঁতে পারি, ও এতটাই কাছে। স্তিমিত গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ মিথিলা, আমার সব কথা মনে পড়ে গেছে। কেমন আছ? কী করছ আজকাল?’

মিথিলা ম্লান হেসে বলল, ‘আমি ভালো আছি, বাবু। আদিবাসীরা যেভাবে ভালো থাকে! বুড়ি হয়ে গেছি, লয়? এখন আর কেউ কোনও কাজকম্ম দেয় না।’

তারপরই কী মনে পড়ে যেতে, সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে, আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেমন আছ বাবু? কত্ত বছর বাদে দেখা হল! আমি তো তুমায় একবার দেখেই চিনে ফেলেছি। মু-কে তুমি ভুলে গেছিলে, লয়?’

তার চোখদুটো অন্ধকারেও জ্বলছে। সে যেন আমার অন্তরের তলদেশ পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

বললাম, ‘মিথিলা, আমি অনেক দূরে চলে গেছিলাম। এর মধ্যে আমার বিয়ে হয়েছে। দু-দুটো সন্তান হয়েছে। এতদিন পর তোমাকে দেখেও খুব ভালো লাগছে মিথিলা–!’

মিথিলা চোখ নামিয়ে মাটির দিকে দেখছিল। চারদিক নিরালা। হঠাৎ মনে হল, আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অফিসাররা যদি এদিকেই আসে, তাহলে ভুল বুঝতে পারে। মিথিলাকে তাই বললাম, ‘চলো, ফিরে যাই। সকলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

আমি আটচালার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, সে আমার হাত চেপে ধরল। চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। মিথিলা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমি ঘুরে দাঁড়াতে, ও খুব বিব্রত মুখে বলল, ‘একটা কুথা বলার ছিল বাবু। বুঝতে লারছি, কী করে বলি সে কথাটো তুমায়!’

প্রশ্নভরা চোখে ওর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। টাকাপয়সা চাইবে নাকি? অন্ধকারে ওর মুখের ভাবও স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে না। মিথিলা বলল, ‘বাবু, আমার আর তুমার মেয়ে, পুতলি, আটচালাতেই ছিল। দেখেছ কি তাকে?’

বলে কী? আমার গলা থেকে সহসা যেন কোনও আওয়াজ বের হল না। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, মনে হল। কপালে ঘাম দেখা দিল। সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা চায় কী? কী অভিসন্ধি? দুর্বল হলে চলবে না। গলায় যতদূর সম্ভব তীব্রতা এনে বললাম, ‘তোমার আর আমার মেয়ে? বাজে কথা বলার জায়গা পাওনি? কীভাবে হবে? কীভাবে, কীভাবে? আমাকে ঠকানোর চেষ্টা করো না, বুঝলে! আমাকে খাটো করার চেষ্টা করে লাভ হবে না–!’

নিজের কথা নিজের কানেই অসংলগ্ন শোনাল। কপাল থেকে ঘামের বিন্দুগুলি মুছে নিলাম।

মিথিলার গলার স্বর আগের মতোই শান্ত। বলল, ‘চিল্লিয়ো না। সবাই তো জেনে লিবে তাইলে।… বাবু, ওই রাতের পর আমি তো তুমারই হয়ে গেছিলাম। মন থেকে আজও আমি তুমারই। আমারও শাদি-বেহা হয়ে গেছে। আরও সন্তান হয়্যেছে। ওই পুতলি কিন্তু তুমারই বাবু। তুমার এবং আমার!’

আমি সন্দিগ্ধ গলায় শেষ অস্ত্রটা ছুড়লাম, ‘যখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে বলছ, তখন এ ব্যাপারে এতখানি নিশ্চিতই বা হচ্ছ কী করে?’

‘সেই রাতের সাত মাস পরে আমার বেহা হয়ে যায়। ওই সময়ের মধ্যে আর-কোনও মরদ আমায় ছোঁয়নি। ওই রাতের ঘটনার পরে যেদিন বুঝতে পারলাম, পেটে শত্তুর এসেচে, আমাদের রীতি অনুযায়ী মুখিয়া আমার বেহা ঠিক করল। আর তার ঠিক দু-মাসের মাথায় পুতলি জন্মাল। এবার তাইলে বলো?’ সে হেসে আমার দিকে তাকায়।

‘তাহলে, এতদিন এ কথা আমায় জানাওনি কেন মিথিলা? বুঝতে পারার পরপরই যদি জানাতে আমায়…’, আমি অসহায়ের মতো আমতা-আমতা করি, ‘আর, যদি তখন না জানিয়ে থাকো, তাহলে আজ জানানোর কী দরকার ছিল?’

মিথিলা বলল, ‘পুতলি আদিবাসীদের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। আমার মরদ ওকে নিজের বাচ্চার মতোই দেখে। তুমি কুথায় থাকো, সে আমি কী করে জানব, বাবু? হাঁ, মুখিয়া বলতে পারত। কিন্তু, উহাকে আমি কিছু বলি লাই। তুমাকে এত বছর পরে দেখ্যে কথাটো মনে পড়্যে গেল। পুতলিকে চিনতে লারছ বাবু? উই যে, যে আমার সঙ্গে লাচছিল!’

আমার মনে পড়ে গেল। কমবয়েসি মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম বটে! আদিবাসীদের মধ্যে অমন চোখা নাক-চোখ তো দেখা যায় না! আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল!

কিন্তু আমার কুশলী শহুরে মনটা কথা বলে উঠল, ‘ও? ওকে তো পুরো আদিবাসী মনে হয়! দূর–!’

এবার যেন একটু রেগে যায় মিথিলা। বলে, ‘ও আমার বুকের দুধ খেয়েছে বাবু। আদিবাসী মায়ের বুকের দুধ গো! আদিবাসীদের মধ্যে ও বড়ো হয়্যেছে। তুমি উকে আদিবাসী বললে, এতে আমি খুব খুশি হয়্যেছি, বাবু!’

আমার মনের মধ্যে ঝড় বইছে। শহরে আমার বউ, ছেলেমেয়ে যদি এ কথা জানতে পারে কী হবে? যদি অফিসাররা জেনে যায়, তাহলেই বা কী হবে? যদি সরকারের কাছে খবর যায়? আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। একটা বড়ো গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘তোমার এ কথা যদিও কেউ মানতে চাইবে না, তবু তর্কের খাতিরে যদি বিশ্বাস করিও, তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কী চাও তুমি?’

‘কী চাই?’ মিথিলা ব্যঙ্গ করে হাসে, ‘তুমাকে দেখ্যে পুরোনো কুথাটো মনে পড়্যে গেল। পুতলির বাবা কে, এ কথাটো কেউ জানে না! এক রাত তোমায় ভালোবেসেছিলাম, সাহেব। সেই ভালোবাসার উপহার পুতলি। ও তুমার উপহার। মনে হল, এ কুথাটো জানা তোমার অধিকার বটে!’

মুখে হাত চাপা দিয়ে আমি ডুকরে উঠি, ‘কত বড়ো ভুল! আমাকে সকলে সম্মান করে। আমি বিবাহিত। সন্তানের বাবা। বড়ো চাকরি করি। আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারব না–!’

মিথিলা আমার পাশে সরে এসে বলল, ‘ছি বাবু, তুমি আমাকে এতটা খারাপ ভাবলে?’

আমি হঠাৎ আবেগে, মিথিলার হাতদুটো চেপে ধরে বললাম, ‘না, না, কথাটা এখানেই কি শেষ হয়ে যায় মিথিলা? পুতলি যখন আমারই মেয়ে, ওর প্রতি কিছু কর্তব্য তো আমারও আছে! সব জেনে আমিই বা কী করে চুপ করে থাকি? ওকে এখানেই বা ফেলে রেখে চলে যাই কোন প্রাণে!’

‘তুমি কিছু করব্যে বলে তো এ কুথা আমি জানাইনি, বাবু,’ মিথিলা শান্ত গলায় বলে, ‘বিশ বছর ধরে, উকে আমি এই শিমূল-পলাশের জঙ্গলে পালছি। উ গিয়ে তুমার চকচকে বাংলোয় কেমনে রইবে গো? উ তো পাগল হয়্যে যাবে। উ আদিবাসী। উর মা আদিবাসী। উ তাই এখানেই থাকবে। মায়ের কাছে। এই সমাজেই উর বেহা হবে। তুমি উকে লিয়ে যেতে পারবে লাই।’

মিথিলার গলায় হঠাৎ কাঠিন্য ভর করে। আটচালার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ-ই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমাকে কিছু না জানানোই ভালো ছিল, বাবু!’

ছুটে গিয়ে আমি মিথিলার হাত ধরলাম। অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘রাগ কোরো না। তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে। কোনওদিন ওর ‘বাবা’ পরিচয়ে ওর কাছে যাব না। আমি জানি, তাহলেই তোমাদের জীবনে ঝড় উঠবে। শুধু মাঝেমধ্যে এসে পুতলিকে একবার দেখে যাব। তুমি অনুমতি দেবে তো?’

মিথিলা আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়ে।

‘আর-একটা কথা। পুতলি আমার মেয়ে। আমার ইচ্ছে ও স্কুলে পড়বে। বড়ো মানুষ হবে। তোমাদের গ্রামে মাস্টারমশাই তো আসেন! তুমি ওকে নিয়ম করে তাঁর কাছে নিয়ে যেয়ো– আমি খরচা…!’

আমায় থামিয়ে দিতেই যেন মিথিলা আকর্ণ হাসল। তারপর বলল, ‘তুমি সোজা পথে চলে যাও বাবু। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর একটা চোরা রাস্তা আছে। আমি সেইটো দিয়ে আসছি।’

 

জোড়া-বকুল

বকুলগাছটার ভেতরে কী ছিল কে জানে! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলেই গাছটা কেমন যেন মোহময়ী রহস্যের ঘোমটা পরে নিত। তখন তার পাতায় পাতায় হিল্লোল। ডালপালায় দু’হাত বাড়ানো আর্তি। ইমন এসব ছোটোবেলায় বুঝত না। ধীরে ধীরে পরত খোলার মতো জেনেছে নিজের অনুভূতি দিয়ে। পুরো বর্ষাকাল এখন তাকিয়ে থাকে বকুলগাছটার পাতার দিকে। গাঢ় সবুজ পাতার প্রান্তে সামান্য কোঁকড়ানো ভাব, স্থূল চোখে দেখা যায় না। মন দিয়ে দেখলে, যেমন সব মেয়ের লম্বা চুলেই ঢেউ খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের বকুলগাছের সব পাতাতেই তেমন প্রান্ততরঙ্গ দেখা যাবে, ইমন লক্ষ্য করেছে।

– এই ইমন, ইস্কুল যাবি না?

ইমনের মা প্রতিভা মেয়ের কাছে জানতে চায়। ইমনের আজ স্কুলে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নেই। আজ ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। স্কুলে পড়াশোনা বিশেষ হবে না। নাম কা ওয়াস্তে স্কুল। তাই যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা নেই। আবার সিএল-ও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। কিছুটা সময় নিয়ে ইমন নিজেকে রাজি করায় স্কুলে যাওয়ার পক্ষে।

– হ্যাঁ মা, যাব। তুমি ওয়াড্রোব থেকে কমলা ঘিয়ে পিত্তর সিল্কটা বের করে রাখো। আর কালো ব্লাউজটা। আমি বাথরুমে গেলাম।

– কোনটা বলতে কোনটা বের করব! তুই এসেই বের করিস।

প্রতিভা ঈষৎ বিরক্ত হয় মনে মনে। কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেয় না। শাড়ি ব্লাউজ বার করে দিতে তার অসুবিধা নেই কিন্তু ঠিক ঠিক কোনও দিনই বার করতে পারে না।

বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে ইমন মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করে, তবে তোমার পছন্দের শাড়ি একটা বেছে দাও। যেটা পরলে তোমার মেয়েকে যে-কোনও পাত্রের একবারেই পছন্দ হয়ে যায়।

– সে ভাগ্য কি আমার হবে! তোর বাবা থাকলে এত চিন্তা করতাম না!

ইমন মায়ের সঙ্গে কথা বাড়ায় না। হড়াৎ করে বাথরুমে ঢুকে যায়। তার দেরিও হয়ে গেছে। ন’টা কুড়ির শিয়ালদা লোকালটা ধরতে হবে। হাতে আর মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ মিনিট। এই ট্রেনটা মিস করলে পরেরটা ন’টা পঞ্চাশে। বলরামপুর স্টেশন থেকে বারুইপুর এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। স্কুল অবশ্য স্টেশনের কাছেই। রিকশায় পাঁচ মিনিট আর হাঁটলে মিনিট দশেক। আজকাল লোকের যা চাপ গাড়ি ঘোড়া চালানোই যায় না। ইমন অবশ্য রোজ রিকশাতেই যায়। লোকের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি তার ঠিক পছন্দ হয় না। গা চিড়বিড় করে যেন। অবশ্য ট্রেনের কথাটা আলাদা। উপায় নেই। তবুও সে চেষ্টা করে লেডিজ কম্পার্টমেন্ট ধরতে।

হাতে সময় না থাকলে মানুষ বাথরুমে ঢুকেই জামাকাপড় খুলে ফেলে। তারপর ঝপাৎ ঝপাৎ জল ঢালে শরীরে। নগ্নতার গা মোছে। কিন্তু ইমন সেটা পারল না। বাথরুমের জানলা দিয়ে বকুলগাছটা দেখা যায়! আজ ইমনের চোখে পড়ল বকুলগাছটা কেমন চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। অন্যদিনের থেকে বেশ অন্যরকম তাকানো। ইমন কিছুতেই সালোয়ার খুলতে পারে না। কোনওদিনই পারে না। ইমন আজ বাথরুমের ছোটো জানলাটা বন্ধ করে। খুব লজ্জা পাচ্ছে আজ তার। জানলাটা বন্ধ করার পরেও সে জামাকাপড় পরেই স্নানটা সারে। বাথরুম থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে যেন বাঁচে। বকুলের চোখের আড়াল না হলে লজ্জা যেন যাবার নয়।

অনেকটা জায়গা নিয়ে ইমনদের বাড়ি। বাড়ির পরেই পরিখা। আসলে লম্বা খালের মতো চারদিকে চারটে পুকুর। বাবা খুব গর্ব করে পুকুরগুলোকে পরিখা বলত। তাই ইমনও পরিখা বলে। সেই পুকুরগুলোর চওড়া উঁচু পাড়। সেই উঁচু পাড়ে নানান বৃক্ষের সমাবেশ। শিরীষ, সেগুন, সোনাঝুরি, অর্জুন, কদম প্রভৃতি দামি কাঠের গাছগুলো পুকুরের বাইরে সার সার দাঁড়িয়ে আছে যেন প্রহরী। তাদেরই মধ্যে পশ্চিম দিকে ইমনের প্রিয় বকুল গাছ ঝাঁকড়া হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। বকুলগাছটা ইমনের বাবারও প্রিয় ছিল। আলাদা ভাবে যত্ন করত বকুলগাছটার, ইমনের মনে আছে। আর মনে আছে একটা কথা। গাছটা বসানোর দিনেই বাবা কাউকে ফোনে বলছিল, গাছটা যতদিন বাঁচবে তোমাকে পাব!

পরিখার ভেতরে যত ফলের গাছ। নানান আমগাছ। এমনকী একটা আলফানসো আমেরও গাছ বসিয়েছিল ইমনের বাবা। কোথা থেকে কিনে এনেছিল ইমন জানে না। ইমন তখন খুব ছোট্ট। ক্লাস থ্রি। জাম, লিচু, জামরুল, সবেদা, চালতা, ডেয়াঁ ফল। এমন ফল নেই তাদের বাগানে, যা এ অঞ্চলে ফলে না। ইমনের সামনেই গাছগুলো বড়ো হল, এখন ফল দিচ্ছে। সব ঠিকঠাক। যেমন যেমন বাবা বলেছিল, দেখিস আম ফলবে আগে, তারপর লিচু, হয়তো সে বছরই জাম ধরবে। চালতার একটু দেরি হবে। সবেদা অল্প অল্প দু’বছর পর থেকেই ফলবে। সব বাবার কথামতোই ফল দিচ্ছে। শুধু বাবাই হঠাৎ করে চলে গেল। দুদিনের ধুম জ্বর। ডাক্তার, হসপিটাল করার আগেই সব শেষ।

ইমনের তখন ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ি ভর্তি লোকজন। চেনে না জানে না এমন সব লোক বাবার বসানো গাছগুলোর গায়ে উঠে পড়ছে যেন। গাছগুলো তখনও বেশ ছোটো। ধাক্বা মারলে ভেঙে যাবে। ইমনের খুব রাগ ধরছিল লোকগুলোর উপর। তার থেকেও বিস্ময়। এত লোক কেন! দৗড়ে ঘরে ঢুকে দেখে বাবা বিছানায় নিস্পলক শুয়ে। সেই প্রথম মৃত্যু-ছুঁয়ে দেখে ইমন। তবু তার মনে যে-প্রশ্নটা প্রথম জাগে, সেটা বকুলগাছটা নিয়ে। বাবার থেকে জানা হল না, বকুলগাছটা কার নামে বসানো!

বাবা মারা যাওয়ার পর বকুলগাছটার যত্ন নিতে শুরু করে ইমন। কিন্তু বৃক্ষের যত্ন কিবা! যত্ন নেবার কিছুই নেই। ইমন লোক দিয়ে বকুলগাছটার গোড়ার মাটি কুপাতো। মা হাঁ হাঁ করে উঠত! কাঠের গাছের অত যত্ন নিতে হবে না!

তবু ইমন লুকিয়ে সার কিনে আনত। বোনডাস্ট। ছড়িয়ে দিত বকুলতলায়। কিন্তু বকুলের শিকড় তো অনেক গভীরে! তার জল হলেই চলবে। তবে গভীর শিকড়ে বকুলটা আস্তে আস্তে জড়িয়ে নিচ্ছিল ইমনকেও। ইমন প্রথম দিকে গাছটার প্রতি বাবার ভালোবাসার কথা ভেবে যত্ন করত। বাবার কোনও গোপন মানুষের কথা ভেবে হয়তো বসানো।

সে মাকে এ নিয়ে কিছু বলেনি। তার মা বকুলগাছটা সম্বন্ধে কিছুই জানত না। তাছাড়া মা তখন সদ্য বিধবা হয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম। ঢেউ-এর মাথায় পানসি নৗকার মতো চলছে কোনওক্রমে তাদের সংসার। ইমনের বাবার দোকান বিক্রির টাকায় আর বাগানের ফলমূল বেচে কত আর চলে সংসার। সোনায় হাত পড়ে বছর বছর। প্রতিভার বকুল নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় কোথায়! ইমন হয়েছে বাবার মতো! ইমনের বাবার মোড়ের মাথায় স্টেশনারি দোকান ছিল। লাভ ছিল ভালোই। কিন্তু লাভের থেকে বাবার খরচ ছিল বেশি। তাছাড়া দোকানের টাকা জমিয়েই তো বাবা সখের এই বাড়ি বাগান করেছিল।

একটু বড়ো হতে, ক্লাস টেন ইলেভেনে উঠতে বকুলগাছটার ফুল ফোটে, ফল হয়। পাকা ফল বকুলগাছের গোড়ায় বিছিয়ে পড়ে থাকে। বিস্কুট রঙের ফল অনেকটা খেজুরের মতো। বকুলফুলের কী সুবাস। প্রাণ ভরে যায় যেন। তখন থেকে বকুলগাছটা তার কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। বাবার প্রিয় মানুষ, কিংবা তার নিজস্ব বন্ধু। বকুলগাছটা যেন তখন থেকেই কথা বলে ইমনের সঙ্গে। ইমন তখন থেকে একটু একটু বুঝতে শেখে বকুলের ভাষা।

– এই ইমন, দিনরাত বকুলতলায় কী করিস তুই?

ছোটোবেলায় ইমন সঙ্গীর অভাবে খেলতে পেত না। কিন্তু তার খেলার সঙ্গীর অভাব হয়নি। বাগানের সবকটা গাছ ছিল তার বন্ধু। বিশেষকরে বকুলের সঙ্গে তার ভাব ছিল খুব। বকুলটাকে নিয়েই সে পুতুল খেলত। তখন খুব মোটা হয়নি। ফুট খানেক বেড় আর সবে সবে বাড়ির দোতলা ছুঁয়েছে তখন। গাছের গোড়ায় কাপড়ের বেড় দিয়ে শাড়ি পরাত। কখনও ইমন বকুলকে মেয়ে করে বিয়ে দিত বাগানের সেগুন গাছের সঙ্গে। আবার কখনও বকুলকে নিয়ে নিজেই বর-বউ খেলত। কখনও সে বউ, কখনও বকুল। তার সময় কেটে যেত কোনও বন্ধু ছাড়াই।

– আসছি মা!

আসছি বলেও ইমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত বকুলগাছটার সঙ্গে।

ইমনের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা অন্য একটা কারণেও নেই। সুমনবাবু স্কুলের নতুন ম্যাথের টিচার। মাস ছয়েক জয়েন করেছে। ইমনের থেকে টিচার হিসাবে জুনিয়র। কী নাকি বিসিএস দেবে বলে টিচারি নেয়নি। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে স্কুলে ঢুকে বিসিএস-এর জন্যও পড়ছে। ক’মাসেই স্কুলে খুব জনপ্রিয়। ছাত্ররা তো সুমনবাবু বলতে অজ্ঞান।

যদিও কো-এড স্কুলে ছাত্রীরা সবথেকে পছন্দ করে তাদের সুন্দরী কেমিস্ট্রি টিচার ইমনকে। কিন্তু ছাত্রীরা তো আর ছেলেদের মতো হই হই করে জানান দিতে জানে না। তারা ইমনকে ভালোবাসে গোপনে, মনে মনে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রাখে। ছাত্ররা সেই মাথায় করে রাখা সুমনবাবুর সঙ্গে ইমনদির তুলনা করে। কে বেশি ভালো তাই নিয়ে। আর প্রতিবার নিজেরাই জিতিয়ে দেয় সুমনবাবুকে। এইসব ইমনের একদম ভালো লাগত না প্রথম প্রথম। তখন ভাবত জেনারেল ট্রান্সফার নিয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে! এই স্কুলে আর না।

তারপর ঘটনা বদলে গেল অন্যদিকে। ছাত্রদের প্রিয় সুমনবাবু কয়েক মাসেই ইমনদির সঙ্গে এক রিক্সায় স্টেশন থেকে স্কুলে যেতেই ইমনের স্কুলটা আবার ভালো লাগতে শুরু করে। কিন্তু ছেলেটার বড্ড তাড়া। সব যেন একদিনেই চায়। গ্রীষ্মের শুরুতে স্কুলে জয়েন করল। বর্ষা পড়তে না পড়তেই ইমনকে প্রপোজ করে বসে। আর সারাটা বর্ষা জ্বালাচ্ছে, কী হল ইমন আমাকে চুমু দেওয়ার?

আরে বাবা বললেই কি সবাই এত দ্রুত সব কিছু পারে? ইমন ছোটোবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের। সুমনের সব কথায় চুপ থাকা মানে কি যে ইমন তার সব কথা মেনে নিয়েছে! যদিও ইমনের সুমনকে খুব ভালো লাগে। ইমনের বাবার মতোই দিলদার হাসি। দেখতেও সুন্দর। ম্যাথে মাস্টার্স করা। যে-কোনওদিন বিসিএস লাগিয়ে দেবে। পাত্র হিসাবে সত্যিই ভালো সুমন। কিন্তু ইমন যেই সুমনের কথা ভাবে, বিশেষকরে বাড়িতে থাকলে, বকুলগাছটার পাতায় পাতায় মন খারাপের পলক পড়ে। ইমন বুঝতে পারে।

ইমন এক পা বাড়ায় সুমনের দিকে আর বাড়ি ফিরেই দু’পা পিছিয়ে যায় বকুলগাছটার কথা ভেবে। সে বকুলগাছটাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। পুরো বর্ষাটা সে ভাবছে উচ্ছল সুমনকে কী বলবে! হ্যাঁ বলাটাই স্বাভাবিক। তবু বকুলগাছটা পিছনে টানছে খুব। আজ আবার সুমনের নানান পরিকল্পনা ইমনকে নিয়ে। শিক্ষকদিবসের তাড়াতাড়ি ছুটিতে ওকে নাকি মুখ ফুটে জানাতেই হবে, ভালোবাসি।

ইমন মাকে কিছুই বলে না। প্রতিভা একটুতেই উৎকণ্ঠিত হয়। না হলে আজকের দিনে মাত্র সাতাশ বছরের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেউ মাথায় ভাদ্রের তালপড়া ব্যথা নিয়ে চিন্তা করে না। ইমন সুমনের কথা ভেবেই আজ স্কুলে যেতে চাইছিল না। অথচ তার কথা ভেবেই স্কুলের দিকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়।

স্টেশন থেকে স্কুল পর্যন্ত রিকশায় আসতে আসতেই সুমন ইমনকে জানিয়ে দিয়েছে, আজ তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সেই থেকে ইমন রেগে আছে সুমনের উপর। সুমন যেন ধরেই নিয়েছে ইমন ওকে ভালোবাসে বা ভালোবাসতে বাধ্য। অবশ্য একা সুমন কেন, সারা স্কুল যেন ধরেই নিয়েছে দুই সুন্দরের মিলন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অথচ ইমন নিজেই জানে না সে সুমনের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী। বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে।

অবশ্য আজকে এই মুহূর্তে ইমন সুমনের উপর রেগে আছে অন্য কারণে। ইমন আজ স্কুলের ধকলের কথা ভেবে পিওর সিল্ক শাড়ি পরেছে। কিন্তু তার চেহারা রোগার দিকে। আগে থেকে যদি বলত, তাহলে সে তাঁতের শাড়ি পরে আসত। তাঁতের শাড়িতে তাকে মানায় ভালো।

স্কুলের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান বড়ো করে কিছু হয় না। প্রার্থনার সময়েই বড়দি শিক্ষকদিবস সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার পর জানিয়ে দিয়েছেন, উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা জুনিয়রদের ক্লাস নেবে। বড়োদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা আর ছোটোদের মধ্যে গুনগুন গুঞ্জন। টিফিনের আগেই সব স্যার ম্যাডামরা যে যে-ক্লাসের ক্লাসটিচার সেখান থেকে ছোটোখাটো উপহার পেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে। ইমনও ক্লাস নাইন ‘বি’-এর ছেলেমেয়েদের থেকে একটা দামি পেন পেয়েছে। প্রতি বছর সে এদিন তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের লজেন্স দেয়। আজ সে ভুলে গেছে একদম। খুব রাগ হয় সুমনের উপর। তার ছন্দে বাঁধা জীবন, যেখানে বকুলফুলের মৃদু সুবাস নিয়ে সে বেঁচে থাকে, সেখানে সুমন তার সমস্ত আকর্ষণ দিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। বাবার তৈরি বাড়ি ছেড়ে সে যাওয়ার কথা ভাবেনি এখনও। বিয়ের কথা তো সুমনের নাছোড় আবেগের আগে কখনও ভাবেইনি! ইমন মনে মনে ঠিক করে, আজই সুমনকে না বলে দেবে। সুমনের মায়ের সামনেই ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে। জানিয়ে দেবে, তার পক্ষে বকুলগাছটাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়।

ট্রেনে একটাও কথা বলেনি ইমন। সুমনের পাশে শক্ত হয়ে বসে আছে। মনে মনে শক্ত হয়ে উঠতে শরীরের কাঠ কাঠ ভাবটা খুব কাজে দেয় ইমন জানে। কিন্তু সুমন সেসব খেয়ালই করছে না। সে আগের মতোই কানের কাছে বকবক করে চলেছে আলতু ফালতু অথবা দামি সব আবেগের কথা। ইমন সেসব আবেগ নিতে পারছে না। সে হয়তো তার সব আবেগ জমা রেখে এসেছে বকুলগাছের পাতায় পাতায়।

বারুইপুর থেকে সোনারপুর হয়ে চম্পাহাটি এমন কিছু দূর না। জায়গাটা এখনও গ্রাম গ্রাম। অনেকটা তাদের বলরামপুরের মতোই। চম্পাহাটি থেকে রিকশা নিতে হয় সুমনের বাড়ি পর্যন্ত। বেশ পুরোনো পাড়া। ছাড়াছাড়া বাড়ি। সুমনদের বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দুজনে একছাতার নীচেতেই সুমনের বাড়ি ঢোকে। সুমনের মা-ই দরজা খোলে। সুমনের মাকে দেখেই ইমনের মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ইমন বুঝতে পারে, ভদ্রমহিলা ভাদ্রের বৃষ্টিভেজা বিকালে ছেলে কোনও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবু আপ্যায়নে আন্তরিকতার অভাব রাখে না, সম্ভবত ছেলের সততার উপর বিশ্বাস রেখে।

– মা, এ ইমন। আমাদের স্কুলের জনপ্রিয় কেমিস্ট্রির টিচার। আমার থেকে টিচার হিসাবে সিনিয়র তবে এমনিতে জুনিয়র। ভালো গান গাইতে পারে। আবৃত্তিও শিখেছে ব্রততীর কাছে…

সুমনের মা হেসে ফেলেন। ছেলেকে ভালোই চেনেন। বলেন, তুই সব বলবি না ওকেও কিছু বলতে দিবি!

তারপর ইমনকে হাত ধরে নিয়ে যান নিজের ঘরে। ফ্যান চালিয়ে বসান বিছানায়। আর নিজে পাশের রান্না ঘরে চলে যান, জল, শরবত আনতে। সেখান থেকে কাচের গ্লাসে স্টিলের চামচ দিয়ে টুং টাং করে শরবত বানাতে বানাতে ইমনের সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। সুমন এইসময় ছাতা মাথায় সাইকেল নিয়ে বের হয়। সম্ভবত ইমনের জন্য মিষ্টি কিনতে। ইমন ভাবে আসার সময়ই তো কিনে নিতে পারত সুমন। আচ্ছা বোকা সুমনটা। বকবক করা ছাড়া কিচ্ছু জানে না।

– কী নাম মা তোমার? পাগলটা হুড়মুড় করে কী বলল বুঝতে পারিনি। খুব জ্বালায় না, তোমায়!

– আমি ইমন বিশ্বাস।

– কোথায় বাড়ি তোমার? বাড়িতে কে কে আছে?

– জয়নগর লাইনের বলরামপুরে বাড়ি আমার। বাবা নেই। মা আর আমি থাকি। শরবত করা বন্ধ রেখে সুমনের মা ঘরে ঢুকে আসে। ইমনের খুব কাছে এসে বলেন, কোথায় বাড়ি বললে?

– বলরামপুর।

– তোমার বাবার নাম কী?

ইমন তার বাবার নাম বলে।

সুমনের মা এবার খাটে বসা ইমনের মুখটা তুলে ধরে বলেন, তোমাদের বাড়িতে একটা বকুলগাছ আছে না? বাড়ির পশ্চিমদিকে?

কথাটা শেষ করতে করতে সুমনের মা জানলার কাছে চলে যান। ইমন হঠাৎ যেন কোনও পরিচিতকে দেখতে পেয়েছে পূর্বজন্ম থেকে, জানলার কাছে গিয়ে সুমনের মায়ের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে, আপনি কী করে জানলেন? আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকে বকুলগাছ আছে!

সুমনের মা জানলা দিয়ে যেন বহুদূরে তাকিয়ে। দিগন্ত থেকে বলে, আমার বাপের বাড়িও তো বলরামপুরের পাশের গ্রাম সুজনপুর।

তারপর ইমনকে জানলার কাছে টেনে যুবতির উচ্ছ্বাসে প্রৌঢ়া  বলেন, দেখো দেখো ইমন, আমাদের পশ্চিমেও একটা বকুলগাছ। বলরামপুরের বকুলগাছটার সমবয়সিই হবে জানো!

উপলব্ধি

মঞ্জরির আজকাল কিছুতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, অথচ আগে ও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। সেই কবে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে শিশিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে সেই থেকে সংসারটা যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সংসার ছাড়া অন্য কিছুতে মন দেওয়ার কোনও আগ্রহই বোধ করেনি কোনওদিন।

ছেলে-মেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। শিশিরও ব্যাবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে থাকে। ছেলে অতনু এমএস করতে আমেরিকা গিয়েছিল এখন ওখানেই ও ওয়েল সেটেলড। মঞ্জরি ভালো মতোই জানে ও কোনওদিন দেশে ফিরবে না। এষা আর মঞ্জরির সম্পর্কটা ঠিক মা-মেয়ের মতো নয়। দুটিকে দেখে মনে হয় অসমবয়সি বান্ধবী। সর্বদা একসঙ্গে, দেখে মনে হয় না ওদের জীবনে অন্য কারও প্রয়োজন আছে।

অথচ এই বন্ধুত্বের মায়াও মঞ্জরিকে ত্যাগ করতে হল। আগের সপ্তাহেই এষাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এসে মঞ্জরি চোখের জল কিছুতেই আটকাতে পারল না। মনে হচ্ছিল শরীরের একটা অংশ যেন কেটে নেওয়া হচ্ছে। অথচ মিলানে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার কথাটা যখন এষা জানিয়েছিল তখন সবথেকে বেশি খুশি বোধহয় মঞ্জরি-ই হয়েছিল।

শিশির অবশ্য ওকে বলেছিল মহিলাদের কোনও সংস্থার হয়ে সোশ্যাল ওয়ার্ক করার জন্য কিন্তু মঞ্জরি রাজি হয়নি। ওর মনে হয় সোশ্যাল ওয়ার্কের নামে সমাজসেবা করাটা সংস্থার উদ্দেশ্য নয় বরং অর্থবান স্বামীদের অর্ধাঙ্গিনিরা নিজেদের টাইম পাস করার জন্য এই সব সংস্থায় জয়েন করে। অন্যদের মতো কার চারিত্রিক দুর্বলতা কোনটা, কে কোন গয়না কিনল বা কত টাকা গয়না কিনতে খরচ করল অথবা বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে দামি আসবাবপত্র বা নতুন ক্রকারি দেখাবার মতো মানসিকতা মঞ্জরির ছিল না। আগেও ও দুবার সংস্থার হয়ে কাজ করেছে কিন্তু পুরোটাই ছিল দুঃস্থ পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ। বাচ্চাদের নিয়ে সারাদিন কাটাতে ওর খুব ভালো লাগত। ও যেন নিজের শৈশবে ফিরে যেতে পারত, ভুলে যেত পঞ্চাশের কোঠা ও পার করে ফেলেছে। কিন্তু সংসারের প্রয়োজনে সংস্থা যখন ওকে ছাড়তে হয়েছিল তখনকার স্মৃতি ওর কাছে মোটেই মধুর ছিল না। সংস্থার অন্যান্য সদস্যরা ওর এই হঠাৎ ছেড়ে দেওয়াটা ভালো চোখে দেখেননি এবং এই বিষয়ে কিছু কটূক্তি শুনতেও মঞ্জরি বাধ্য হয়েছিল।

এষা চলে যাওয়ার পর সময় কাটাতে মঞ্জরি প্রায়শই বাড়ির কাছের পার্ক-টায় গিয়ে বিকেলে বসত। বাচ্চাদের খেলাধূলো দেখতে দেখতে বেশ সময়টা কেটে যেত। একদিন পার্কে বসে মোবাইলে এষার পাঠানো ছবিগুলোতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল মঞ্জরি, হঠাৎই ধ্যানভঙ্গ হল একটি কণ্ঠস্বরে, ‘এক্সকিউজ মি’।

চমকে তাকাতেই দেখল সামনে ২৯ বছর বয়সি একজন যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটি বেশ লম্বা এবং হ্যান্ডসাম। বেঞ্চে পাশে রাখা মঞ্জরির পার্স-টা সরাতে অনুরোধ করছে। পার্সটা সরাতেই যুবকটি মঞ্জরির পাশে এসে বসল।

মিনিট পাঁচেক এইভাবেই কাটল দু’জনের। কেউ কাউকে চেনে না। যুবকটি মাঝেমধ্যেই অধীর আগ্রহ নিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে কারও যেন অপেক্ষা করছে। মঞ্জরি কোতূহল দমন করতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, ‘কারও অপেক্ষা করছেন?’

মঞ্জরি প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক যুবক সুতরাং তাকে প্রশ্ন করার অধিকার ওর নেই। নিশ্চই যুবকটি বিরক্ত হয়েছে ওর আচরণে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, যুবকটি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে মঞ্জরি-কে বলল, ‘হ্যাঁ… হ্যাঁ… আমি একজনের আসার অপেক্ষা করছি… কিন্তু আপনি একলা নাকি?’

‘হ্যাঁ… বাড়িতে ভালো না লাগলে এখানে এসে একটু বসি। আমার বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত মানুষ শুধু আমি ছাড়া। হয়তো আপনজনের সঙ্গ পাওয়ার আশায় এখানে এসে বসে থাকি’, মঞ্জরির কথায় হতাশা ফুটে উঠলেও একটু মজার ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলল।

‘হয়তো… হয়তো এটাই ঠিক। আমিও আমার গার্লফ্রেন্ডের অপেক্ষা করছি। অবশ্য গার্লফ্রেন্ড না বলে হাফ গার্লফ্রেন্ড বলাটাই ভালো। ও বাচ্চাদের হোস্টেলে অফিসার ইনচার্জ। ওর প্রচুর কাজ থাকে সুতরাং টাইমে কোনও দিনই আসতে পারে না’, পাশে বসা মঞ্জরিকে মনের কথা খুলে বলে যুবকটি। মঞ্জরির ব্যবহারে এমন একটা আন্তরিকতা অনুভব করে ও যে, নিজের কথা বলতে দ্বিধা করে না। নিজের পরিচয় দিয়ে নামটা বলে মঞ্জরিকে, ‘আমার নাম সম্রাট, আর আপনার?’

‘মঞ্জরি’, একটু ইতস্তত করে মঞ্জরি নিজের পরিচয় দেয়।

‘আপনার গার্লফ্রেন্ডের নামটা কি আর কেনোই বা ও এখনও আপনার হাফ গার্লফ্রেন্ড?’

‘ওর নাম রিয়া… মুম্বইতে আমরা ক্লাস সেভেন অবধি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। তারপর ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় কলকাতায়। হঠাৎ-ই তিনমাস আগে ওর সঙ্গে আবার দেখা হয়। প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও একে অপরের পরিচয় দিতেই বুঝতে পারি যে ও আমার পুরোনো পরিচিত। ব্যস, তারপর থেকেই মেলামেশা শুরু হয়। আমরা দুজনেই একে অপরকে পছন্দ করি কিন্তু এখনও কেউ কাউকে ওই তিনটে ম্যাজিক শব্দ বলে উঠতে পারিনি।’ মঞ্জরিকে এত কথা বলতে গিয়ে সম্রাট কিছুটা লজ্জা বোধ করে।

‘তাহলে তো তুমিও রিয়ার হাফ বয়ফ্রেন্ড, তাই না?’ মঞ্জরি বুঝতে পারে ছেলেটির সঙ্গে গল্প করতে ওর বেশ ভালো লাগছে।

‘না… না একদমই না কারণ রিয়া আমার মনের কথা খুব ভালো করেই জানে। আমি অত রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না কিন্তু ম্যাডাম… বাপরে, পুরোনো দিনের সাইলেন্ট মুভির হিরোইন। আগেও যেমনি নায়িকারা নায়কদের নিজেদের পিছনে ছুটিয়ে মারত এখনকার মেয়েরাও ছেলেগুলোকে বাধ্য করে পিছনে পিছনে দৌড়োবার জন্য।’ সম্রাটের এই শিশুর মতো স্বীকারোক্তি মঞ্জরির হৃদয়ে স্নেহের  উদ্রেক করে। ওর প্রতি কেমন যেন একটা মায়া অনুভব করে মঞ্জরি।

‘সম্রাট, তুমি যা বললে সেটা পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের উপর। আমি কোনওদিন কাউকে আমার পিছনে দৗড় করাইনি। যেদিনই বুঝেছিলাম শিশিরকে ভালোবাসি, সেদিনই সময় নষ্ট না করে ওর কাছে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। শিশির কেন, আমি কারও কাছেই মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। আমার সন্তানই হোক বা বন্ধু, সকলের কাছেই আমার ফিলিংস পরিষ্কার হয়ে যায়।’ মঞ্জরি কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে পড়ে।

‘ঠিকই বলেছেন, আমিও চুপ থাকতে পারিনি। রিয়াকে পরিষ্কারই নিজের মনের কথা বলে দিয়েছি। এখন ওর মুখ থেকে শুনতে চাই আমার প্রতি ওর কী ফিলিংস’, উত্তেজিত হয়ে পড়ে সম্রাট।

‘সম্রাট, আমি সহজে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এটার জন্য লোকে আমার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলবে। কিন্তু এটার জন্য জীবনে অনেক কিছু শিখেওছি। রিয়ার মনের কথা কীভাবে বার করবে আমি তোমাকে বলে দেব… ঠিক আছে?’

‘ডিল?’

‘ডিল!’

দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। একে অপরের ফোন নম্বর নিয়ে মঞ্জরি বেরিয়ে আসে পার্ক থেকে।

সেক্টর ফাইভে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সম্রাট ভালো পদে কাজ করে। ও একাই কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকে। মা-বাবা দুজনেই মুম্বই থাকেন। সম্রাটের স্বভাব মিশুকে হলেও খুব কমজনই ওর হূদয় অবধি পৌঁছোতে পারত। বন্ধু বাছার ব্যাপারে ও খুব চুজি ছিল। মঞ্জরির স্নেহশীল ব্যবহারে সম্রাট ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়। দুজনের মধ্যে প্রায়শই দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে, ফোনেও দুজনের কথাবার্তা চলতে থাকে।

মঞ্জরির সঙ্গে দেখা হলেই, সম্রাট হাজারো মনের মধ্যে জমে থাকা সমস্যা মঞ্জরির সামনে উজাড় করে দিত সমাধান পাওয়ার আশায়। মঞ্জরিও ধীর ভাবে সম্রাটের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করত। রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন যখনই সম্রাটের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠত, মঞ্জরি তৎক্ষণাৎ গভীর ব্যাখ্যার মাধ্যমে রিয়া সম্পর্কে সম্রাটের মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর করে দিত।

সম্রাট বুঝে গিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ মঞ্জরির কাছে আজও প্রেম শব্দটার একটা গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য রয়েছে। বয়সের সাথে সাথে মঞ্জরির জীবন থেকে প্রেম দূরে সরে যেতে পারেনি। তাই সম্পর্কের মাধুর্য আজও মঞ্জরিকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রেমকে অবহেলা করলে মঞ্জরি সেটা সহ্য করতে পারে না। তবে মঞ্জরির মূল্যবোধগুলো জীবনের প্রান্তে এসে অনেক বেশি পরিপক্ব যার প্রশংসা সম্রাটকে মনে মনে করতেই হয়। মঞ্জরির স্নেহধন্য হয়ে সম্রাট মনের মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি লাভ করে। মঞ্জরিও সম্রাটের উৎসাহে প্রভাবিত হয়ে মনের মধ্যে এক উদ্দাম শক্তির প্রকাশকে অনুভব করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দুজনে এক অজানা সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে লাগল।

প্রায় একমাস বাইরে বাইরে থাকার পর শিশির বাড়ি ফিরে নতুন এক মঞ্জরিকে আবিষ্কার করল। এই মঞ্জরি অনেক বেশি হাসিখুশি। লাল কেপ্রির উপর লম্বা ক্রিম কালারের কুর্তা পরে, পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে যে মেয়েটি শিশিরকে স্বাগত জানাল সে যেন তিরিশ বছর আগের ফেলে আসা মঞ্জরি।

সুটকেশ হাতে করে নিজের ঘরে ঢুকতেই শিশির দেখল খাটের পাশে রাখা সোফাটায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে একজন অচেনা যুবক। শিশির কিছু বলার আগেই মঞ্জরি কফির ট্রে সাজিয়ে ঘরে ঢুকল। শিশিরের সঙ্গে সম্রাটের পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার বন্ধু সম্রাট।’

শিশিরকে অবাক হতে দেখে এবার সম্রাটই কথা বলল, ‘জানি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন কারণ আমাদের বয়সের অনেকটা তফাত। তবু আমিও এই সম্পর্কটাকে বন্ধুত্বই বলব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো? আমি ওনাকে আমার বন্ধু বলতে পারি?’ সম্রাটের সরলতা মুহূর্তে শিশিরের মন জয় করে নিল।

‘শুধু বন্ধু বললেই হবে, মন থেকেও তো ওকে বন্ধু বলে মেনেও নিতে হবে। মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে ও এমন একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে যাতে আমাদের ম্যাডাম দুনিয়াদারি সব ভুলে গিয়েছে। যাক একটা ভালো হয়েছে, এবার থেকে কলকাতার বাইরে গেলে মঞ্জরিকে নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।’ শিশির সম্রাটের পিঠ চাপড়ায়। কফি খেতে খেতে তিনজন গল্পে বুঁদ হয়ে যায়। সময়ের খেয়াল থাকে না কারওরই।

রিয়াকে নিয়ে সম্রাটের চিন্তা দেখে মঞ্জরি মাঝে মাঝে না হেসে পারত না। রিয়ার মনের কথা জানার জন্য সম্রাট ব্যস্ত হয়ে পড়ত। নিজেদের সম্পর্কটাকে একটা নাম দেওয়ার অধীর অপেক্ষায় থাকত। মঞ্জরি সম্রাট-কে রিয়ার সামনে একটু রিজার্ভ থাকার পরামর্শ দিল যাতে রিয়া নিজে থেকে সম্রাটের প্রতি ইন্টারেস্ট নেয়। মঞ্জরির কথা মেনে সম্রাট রিয়াকে বারবার ফোন আর মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। কাজের প্রেশারের দোহাই দিয়ে হোয়াট্‌সঅ্যাপ থেকেও নিজের নাম তুলে নিল। এতে ভিতরে ভিতরে সম্রাট কিছুটা আন-ইজি ফিল করলেও শেষমেশ ও যা চাইছিল তাই হল।

কফি শপে মুখোমুখি বসে দুজন। সম্রাট চাইছিল রিয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে। মঞ্জরির কথা মনে পড়ল। নিজেকে রিয়ার চোখে কাচের মতো পরিষ্কার করে তুলে ধরার দিন শেষ। নিজের আঙুলগুলো নিয়েই খেলা করতে লাগল সম্রাট। রিয়া একটু অবাকই হল। ওর সামনে সম্রাটকে এতটা চুপচাপ হয়ে থাকতে কোনওদিন দেখেনি। ওর অনর্গল কথার স্রোতের মাঝে লাগাম লাগাবার কাজটা রিয়াকেই করতে হতো। সম্রাটই মুখ খুলল তবে নিজের কথা দিয়ে নয়। অফিসের নানা সমস্যা, তাই নিয়ে কথা। চুপচাপ খানিক্ষণ শোনার পর রিয়া বোর হতে শুরু করল, ‘প্লিজ সম্রাট… অফিসের কথা ছাড়ো না। বরং তোমার ছোটোবেলা, কলেজের কথা বলো। স্কুলে তোমাকে দেখেছি, তখন তুমি খুব চুপচাপ থাকতে।’

‘উফ! আবার আমার লাইফের বোরিং অধ্যায়গুলো’, কপট বিরক্তি প্রকাশ করল সম্রাট।

‘আমার তো খুব ভালো লাগে তোমার সম্পর্কে জানতে।’

‘রিয়েলি… কিন্তু আমার কথা ভালো লাগার নিশ্চয়ই একটা কারণ তো হবে?’ আশা জাগে সম্রাটের মনে।

‘সব কিছুর কি কারণ থাকতেই হবে… তোমার চিন্তাধারাই অন্যরকম।’

‘আমার উপর রাগ করে কি লাভ? আমাকে তুমি ভালোবাসো, এই কথাটা তুমিই বলতে পারছ না উলটে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ।’

‘সব কথা মুখে বলার দরকার পড়ে না। আমি কি কখনও তোমাকে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে চাপ সৃষ্টি করেছি? তোমার কথায়, মেসেজে সব পরিষ্কার এমনিতেই হয়ে গেছে’, রিয়া হাসি চাপতে পারে না।

সম্রাট এবার সত্যি রেগে যায়, ‘হ্যাঁ, আমি মানুষটাই এরকম। মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। অথচ এতদিন হয়ে গেল তুমি সেই

মা-বাবার লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই রয়ে গেলে।’

‘আরে বাবা… এত রাগ। ঠিক আছে, আজ থেকে আমি তোমার ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। কি… আশ্রয় দেবে তো?’

আনন্দে সম্রাট রিয়ার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। মনে মনে মঞ্জরিকে ধন্যবাদ জানায়। সাফল্যের এই রাস্তা তো ওই সম্রাটকে চিনিয়ে দিয়েছে।

বাড়ি পৌঁছেই সম্রাট মঞ্জরিকে ফোন করল। কিন্তু ফোনে মঞ্জরিকে না পেয়ে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে ও শুয়ে পড়ল। সকালেও কোনও উত্তর না দেখে আবার ফোন করতে লাগল কিন্তু কোনও সাড়া নেই। এবার চিন্তা হতে শুরু করল সম্রাটের। শিশির শহরের বাইরে সুতরাং দূরে কোথাও যাবে না মঞ্জরি। তাহলে ফোন ধরছে না কেন? ঠিক করল অফিস যাওয়ার আগে একবার মঞ্জরির বাড়ি হয়ে যাবে। গাড়ি বার করতে যাবে এমন সময় মঞ্জরির ফোন এল। মঞ্জরি জানাল গতকাল থেকে ওর প্রচণ্ড জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না।

‘আমি এক্ষুনি আসছি’, বলে সম্রাট গাড়ি বার করল। রিয়াকে ফোন করে জানাল যে, একজন বন্ধু অসুস্থ হওয়াতে ও তার বাড়ি যাচ্ছে। ওখান থেকেই অফিস চলে যাবে আর বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না পারলে ও যেন রাগ বা চিন্তা না করে।

মঞ্জরির বাড়ি গিয়েই প্রথমে ওর কাছ থেকে ডাক্তারের ফোন নম্বর নিয়ে ডাক্তারকে কল করল। মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করে সম্রাট অফিস গেল। বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করল। সম্রাটের সঙ্গে দেখা হতেই রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বন্ধু কেমন আছে?’

‘মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে এসেছিলাম। এবেলা অনেকটা ভালো।’

‘তুমি তো বলেছিলে তোমার বন্ধুর শরীর খারাপ।’

‘হ্যাঁ, মঞ্জরি তো আমার বন্ধু।’

‘মানে?’ রিয়ার গলায় অবিশ্বাস ঝরে পড়ে।

‘মানে, তোমারও কি মনে হয় যে একজন পুরুষ কখনও কোনও মেয়ের বন্ধু হতে পারে না?’ খুব সিরিয়াস শোনায় সম্রাটের কণ্ঠস্বর।

‘সম্রাট, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন আধুনিকা। নিশ্চই বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু ৫০ বছর বয়সি কাকিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব? এটা একটু বাড়াবাড়ি হল না… আই কান্ট বিলিভ ইট…’ বলে রিয়া উঠে দাঁড়াল।

মঞ্জরির বাড়ি হয়ে সম্রাট তাড়াতাড়িই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। খুব ক্লান্ত বোধ করছিল সম্রাট। সারাদিনের ছোটাছুটি, স্ট্রেস তার উপর রিয়ার অবুঝের মতো ব্যবহার। রাগে সম্রাটের মাথাটা দপদপ করছিল। ও একটা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল সকাল মঞ্জরি ফোন করল ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। অনেক সুস্থ শোনাচ্ছিল ওর গলা। কিন্তু সম্রাটের গলা শুনে ভালো লাগল না মঞ্জরির, ‘কী হল সম্রাট? মন ভালো নেই নাকি? রিয়া ভালো আছে?’ মঞ্জরির গলা চিন্তিত শোনাল।

‘মঞ্জরি, রিয়া বড্ড ছেলেমানুষ। ও কি সত্যিই কোনওদিন অ্যাডজাস্ট করতে পারবে আমার সঙ্গে?’

‘কেন নতুন করে কী হল আবার?’ মঞ্জরি এটা জিজ্ঞেস করতেই সম্রাট গতকালের পুরো ঘটনা খুলে বলল ওকে।

‘সম্রাট এতে রিয়ার কি দোষ? আমরা এমন সংস্কার নিয়ে বড়ো হই যে নিজেদের স্বাধীন ভাবে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই পারি না। সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতার কিছু লোক এমন কিছু নিয়ম শৃঙ্খলে আমাদের মনটাকে বেঁধে রেখেছে যে, আমরা সেটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে ভয় পাই। সারা জীবনই সেটা অাঁকড়ে বেঁচে থাকতেই ভালোবাসি। রিয়াকেও একটু শুধু বোঝাতে হবে। তুমি চিন্তা কোরো না প্লিজ… দেখছি এখন কী করা যায়’, মঞ্জরির কথায় সম্রাট আশ্বস্ত হয়। ফোন রেখে দেয় মঞ্জরি।

দুদিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে মঞ্জরি। সুস্থ হতেই দোকানে গিয়ে প্রচুর চকোলেট কিনে সম্রাটের থেকে ঠিকানা জোগাড় করে, রিয়া

যে-বাচ্চাদের হোস্টেলের ইনচার্জ, সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়। ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে চকোলেট বণ্টনের ইচ্ছা প্রকাশ করতেই ওর আশা মতো ওকে হোস্টেলের ইনচার্জ রিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফরসা, তন্বী চেহারার যে-মেয়েটির কাছে মঞ্জরিকে নিয়ে যাওয়া হল সেই মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। সম্রাটের কাছে কোনওদিন ছবিও দেখেনি মেয়েটির কারণ সম্রাটের ইচ্ছা ছিল রিয়ার সঙ্গে ওকে মুখোমুখি আলাপ করিয়ে দেবে। মনে মনে রিয়ার সৗন্দর্যের প্রশংসা করল মঞ্জরি। মঞ্জরি নিজের নাম বলল না। ও জানত রিয়া ওকে সামনাসামনি কখনও দেখেনি। সুতরাং ওকে দেখেও রিয়া কিছুতেই চিনতে পারবে না।

রিয়া মঞ্জরিকে হোস্টেলের খেলার মাঠটায় নিয়ে গেল। ওখানেই হোস্টেলের সব বাচ্চদের একত্রিত করা হল। বেশিরভাগই পাঁচ থেকে দশ বছর বয়স। ওখানে যেসব বাচ্চারা থাকে তাদের

থাকা-খাওয়া-জামাকপড় আর পড়াশোনা করাবার সুব্যবস্থা একটি এনজিওর উপর। রিয়া মঞ্জরিকে বলল, ‘জানেন ম্যাডাম, এদের সঙ্গে আমার সময় খুব ভালো কাটে। ওদের থেকেই আমি শক্তি ও সাহস পাই। জীবনের একটা নতুন দিশার সন্ধান ওদের মাধ্যমেই আমি খুঁজে পেয়েছি।’

বাচ্চাদের প্রতি রিয়ার ভালোবাসা মঞ্জরিকে মুগ্ধ করল। রিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটি বাচ্চা এগিয়ে এসে রিয়ার দিকে একটি চকোলেট বাড়িয়ে দিল, ‘ম্যাম এটা আপনি খান।’ রিয়া সামান্য একটু ভেঙে নিয়ে বাকিটা ওর হাতে ধরিয়ে বাচ্চাটিকে আদর করল আর ওকে খেলতে পাঠিয়ে দিল।

‘ওর নাম শ্রেষ্ঠ। একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওর মা-বাবা মারা যায় আর ওর চোখও নষ্ট হয়ে যায়। কেন জানি না, ও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও ওর দুঃখ দেখতে পারি না, বাচ্চাটার প্রতি অসম্ভব একটা টান অনুভব করি। আমারও কোনও কষ্ট হলে আমাকে ছুঁয়ে ও বলে দেয় যে আমার মন খারাপ। আমাকে খুশি করার সবরকম চেষ্টা করতে থাকে।’

‘সত্যিই… খুব দুঃখের। তবে একটাই ভালো হয়েছে সে তোমার মতো একজন বন্ধু পেয়েছে।’

‘আমি জানি না ম্যাডাম এটা আপনি কতটা বুঝবেন… শ্রেষ্ঠ আর আমি একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এত ভালো বন্ধু আমার আর নেই’, মঞ্জরির কাছে রিয়ার নিজেকে তুলে ধরতে কোনও অসুবিধা হল না। মঞ্জরির মিষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য।

‘তাহলে আজ থেকে ২০-২৫ বছর পরেও তুমি কি চাইবে না যে, তোমাদের বন্ধুত্বটা এরকমই অটুট থাকুক? পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেই কি তোমার জীবন থেকে বন্ধুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? একটা বয়সের পর মনের চাহিদা কি সত্যিই দাবিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়? ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ যদি আজকের মতোই তোমাকে ভালোবাসে, একাত্মতা অনুভব করে, তাহলেও কি বয়সের এতটা তফাতের কথা মনে রেখে তোমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা কমিয়ে ফেলতে হবে? সম্পর্কটা তখন বদলে বন্ধুত্ব থেকে অন্য কিছু হয়ে যাবে? কী নাম দেবে সেই সম্পর্কটার? হয়তো কোনও-ই নাম নেই সম্পর্কটার, সেই ক্ষেত্রে তুমি কী করবে রিয়া?’ রিয়ার দিকে তাকিয়ে মঞ্জরি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে।

‘ভালোবাসাটা তো একইরকম থাকবে, আমার দিক থেকেও আবার শ্রেষ্ঠর দিক থেকেও। আর নাম… সম্পর্কটার নাম তো বন্ধুত্বই থাকবে। এখনও তাই। পরেও ব্যাপারটা একই…’, রিয়াকে চিন্তিত লাগে।

‘যদি শ্রেষ্ঠ আর তোমার সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব বলা যায় তাহলে সম্রাট আর মঞ্জরির সম্পর্কটাকে নয় কেন…?’ বলতে বলতে মঞ্জরির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চেপে রাখা অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে ওর দু’চোখ বেয়ে।

সময় গড়িয়ে চলে। দু’জনেই বসে থাকে চুপচাপ। মঞ্জরি-ই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, ‘আমি আজ উঠি রিয়া। কাল আমার বাড়িতে এসো। সম্রাটকে ওখানেই ডেকে নেব। প্রচুর গল্প করার আছে তোমাদের সঙ্গে।’ রিয়া সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে মঞ্জরিকে বিদায় জানায়।

রিয়ার মনে হল আজ ওর সামনে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হল। অপরকে ভালোবাসা, তার জন্য চিন্তা করা, ত্যাগ, আকর্ষণ ইত্যাদি মানুষের সুকোমল বৃত্তিগুলিরই অন্য নাম। এগুলির একত্রে সমাবেশই গড়ে তোলে বন্ধুত্ব সুতরাং এটা সম্পূর্ণই মনের সম্পদ। একজন মানুষের মন একটাই হয়… বন্ধুত্ব কেন তাহলে মনের না হয়ে বয়সের উপর নির্ভর করবে?

সঙ্গে সঙ্গে রিয়া সম্রাটকে মেসেজ করল, সম্রাট…

সম্পর্কের গভীরত্ব এতদিন আমি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনি। কোনও সম্পর্কই ফুরিয়ে যাওয়া উচিত নয় জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত। আমার ইচ্ছে তোমার এবং মঞ্জরির বন্ধুত্ব সারাজীবন সুরভিত হয়ে থাকুক। আজ বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর সেরা উপরহাটা হল ‘বন্ধুত্ব’।

ইতি তোমার রিয়া।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব