দিতি-ও বাঁচতে চায়

হাতে ধরা ব্লাড স্যাম্পল-এর শিশি দুটো আর রিকুইজিশন স্লিপটা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের কোলাপ্সিবল গেটের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দেয় নীলাদ্রি। ও পাশে থাকা ভদ্রলোক স্যাম্পল জমা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে জানিয়ে দিল, ‘ঘন্টা খানেক পরে আসুন’।

কাল সকাল আটটায় দিতির অপারেশন। অত সকালে ব্লাড জোগাড় করা যাবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। খামোকা টেনশন না পুষে, অমিতকে নিয়ে নীলাদ্রি তাই আগের দিন-ই এসেছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। ব্লাড স্যাম্পল জমা দিয়ে এখন খানিকটা রিলিভড্। এলোমেলো চুল বাঁ হাতে ঠিক করতে করতে, সিগারেটের লম্বা টানের ধোঁয়ার সাথে, টেনশন হালকা করে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় নীলাদ্রি।

‘টেস্ট করতে, গ্রুপ মেলাতে এটুকু সময় তো লাগবেই। এক ঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বা করবি কী! চল একটু হেঁটে হেদুয়ায় গিয়ে বসি’– অমিত ঘুরে, সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। অমিতের সঙ্গে পা মিলিয়ে নীলাদ্রিও মানিকতলা মোড় পেরিয়ে হেদুয়ার দিকে এগিয়ে চলে। রবিবারের শান্ত বিকেলে বড়ো রাস্তাগুলো যেন ক্লান্ত বিবশ হয়ে শুয়ে আছে। এই ফাঁকা শান্ত রাস্তাঘাট হঠাৎ করে নীলাদ্রিকে দিতি-র কথা মনে করিয়ে দেয়। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর অনেকবার দিতিকেও এরকমই বিবশ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে নীলাদ্রি। অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোর কাটে না তখনও, আধো ঘুমে আচ্ছন্ন। হসপিটালে দিতিকে দেখতে অনেকেই আসে। জানতে চায় কেমন আছে সে। কিছুক্ষণ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে যায় তারা। কিন্তু দিতি কিছুই বুঝতে পারে না। জানতে পারে না কারা কারা এসেছিল ওকে দেখতে। কাটাছেঁড়া – অপারেশন – ব্যান্ডেজ – ড্রেসিং – ভয় – টেনশন সবগুলো মিলে যায় অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোরে। হসপিটালের ধবধবে সাদা বেডে, ফ্যাকাশে দিতি তখন ঘোরের মধ্যে শুয়ে।

নীলাদ্রিকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে, অমিত বলে, ‘কী ভাবছিস? গ্রুপ মিলিয়ে ব্লাড পাওয়া যাবে কিনা! চিন্তার কিছু নেই, এখানে না পাওয়া গেলে পিপলস্-এ যাব, সেখানে না পাওয়া গেলে লায়ন্স এ…’, হঠাৎ থেমে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা দিতির ব্লাড গ্রুপ কী জানিস?’

‘জানি ‘বি’ পজিটিভ।’

‘তোর?’

‘বি পজিটিভ।’

‘আমারও। তাহলে তো চিন্তার কিছু নেই। কোথাও না পাওয়া গেলে আমরা তো আছিই।’

অমিত যেন সত্যিই চিন্তামুক্ত হল। নীলাদ্রিও অমিতের কথায় ভরসা পায়। রক্ত চাই– রক্ত। এক বোতল, দু বোতল, তিন… চার। নেই শুনলেই মাথায় হাত। পৃথিবীতে এই একটা জিনিসের জন্য মানুষকে মানুষের উপরই নির্ভর করতে হয়। যার কোনও বিকল্প নেই। টাকা পয়সায় যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।

পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, সন্ত্রাস, হিংসা– রক্ত হোলির এক বিভৎস উৎসব, কত রক্তের অপচয়। অথচ এই রক্তের জন্য, জীবনের জন্য কত না কাতর চাহিদা আর উৎকণ্ঠার অপেক্ষা। কিছু মানুষ আছে এখনও, যারা মানুষের জন্য ভাবে, চায় সব মানুষ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুক এই সুন্দর পৃথিবীতে। তারাই তো অকৃপণ হয়ে দান করে দেহের লাল তরল অংশ– অমূল্য ধন ‘রক্ত’।

যেদিন লাল মারুতি চেপে পাঁচ-ছ’ জন এসে মালঞ্চ সিনেমা হলের সামনে সত্যকেই প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে রেখে গেল। সেদিন রক্তে ভেজা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নীলাদ্রি, রাজনৈতিক ধিক্বার সভায় কোনও একজন নেতার মুখে শুনেছিল, ‘এসব বরদাস্ত করা হবে না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিশোধ হবেই। রক্তের বদলে রক্ত চাই। আরও রক্ত।’

হঠাৎই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল নীলাদ্রির। নিজের মনে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, ওই যারা সত্যকে মেরে রাস্তায় রক্ত ছিটিয়ে গেল বা যে নেতারা রক্তের বদলে রক্ত চাইছিল, ওরা কি কখনও কাউকে রক্ত দেয়? তাহলে এত রক্ত আসে কোথা থেকে? যারা দেয় তারা নিশ্চয়ই দেওয়া-নেওয়ার হিসাব করে না। রক্তের বদলে রক্ত চাই বলে না।’

‘তুই কখনও ব্লাড ডোনেট করেছিস?’ নীলাদ্রির প্রশ্নে অমিত খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়, ‘না, দিইনি। অফিসে একবার হেল্থ চেক-আপ ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করিয়েছি।’

‘আমি দু-একবার ব্লাড দিয়েছি, কিন্তু দিতি দিত– বছর বছর, ক্লাবের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে। ব্লাড নেওয়ার জন্য কার্ডগুলো তো ক্লাব থেকেই আনলাম।’

হাঁটতে হাঁটতে হেদুয়ার কাছে এসে বাঁদিকের বড়ো বিল্ডিংটার দিকে আঙুল তুলে অমিত নীলাদ্রিকে বলে, ‘এই স্কটিশে ভারতবর্ষের দু-দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি পড়াশুনা করেছেন, যারা পৃথিবীর কাছে ভারতবর্ষকে নতুন করে পরিচিত করেছেন, গর্বের আসনে বসিয়েছেন। বলতো কে সেই দুজন?’

নীলাদ্রির মাথাটা যেন ফাঁকা ডিব্বা, সব ভুলে বসে আছে। অমিতের মুখের দিকে বোকা বোকা ভাবে তাকিয়ে থাকে।

‘স্বামী বিবেকানন্দ আর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।’

উত্তর না দিতে পারায় নীলাদ্রি লজ্জাবোধ করে। ‘সরি! এটা বলা উচিত ছিল।’

কথা বলতে বলতে ওরা হেদুয়ায় ঢুকে পড়েছে। নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে নেয়, এক ঘন্টা হতে কত দেরি আছে।

‘দিতিটা কি বল তো! সব কিছু ভুলে, নিজের গায়ে আগুন লাগাল ও! মৃত্যুকে এত কাছের মনে হল? কী দুঃসাহস!’

অমিতের কথায় নীলাদ্রি চকিতে ফিরে দাঁড়ায়– ‘না রে, মৃত্যুর কাছে এসে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা যে কত প্রকট হয়ে ওঠে, দিতিকে তখন দেখলে বুঝতিস। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য আকুল হয়ে ওঠে মানুষ– আমি দেখেছি।’

সুইমিং পুলের রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি আর অমিত। সামনেই ডাইভ দেওয়ার জন্য ঢালাই করা জায়গাটা, যার একাংশ ঝুলে আছে পুলের মধ্যে। সেখানে বসে একজন অল্পবয়সি বউ আপন মনে শাড়িতে অ্যাপ্লিকের কাজ করছে। বোধহয় স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। বাদ দেওয়া টুকরো কাপড়গুলোর কিছু কিছু হাওয়ায় উড়তে উড়তে সুইমিং পুলের জলে এসে পড়ছে। ওই টুকরোগুলো উড়ে গিয়ে জলে পড়ছে কিনা বা জল নোংরা করছে কিনা সে ভাবনা নেই– স্বার্থপরের মতো বউটি নিজের কাজে মগ্ন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা বা মৃত্যুর জন্য দুঃসাহসী প্রয়াস। কোনও ক্ষেত্রেই বোধহয় মানুষ ভাবে না অন্যের কথা।

নীলাদ্রি আর অমিত পার্কের এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কের এক পাশে গোল হয়ে বসে আছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। পাশের কলেজ হোস্টেল থেকেই বোধহয় এসেছে ওরা। কোনও বিশেষ আলোচনা বা পরিকল্পনায় তারা মশগুল। এরকম সুশৃঙ্খল ভাবে ওদের বসে থাকতে দেখে নীলাদ্রির বেশ ভালো লাগে। চারিদিকের অশালীন গুলতানি, ছন্নছাড়া অসহিষ্ণু চেনা সমাজ থেকে পৃথক ভালো কিছু দেখে মনটাও যেন শান্তি পায়। নীলাদ্রি মনে মনে ভাবে, এদের মতো মানুষেরাই নিশ্চয়ই মানুষের জন্য রক্ত দেয়।

একটু এগিয়ে এসে গাছতলায় সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটায় এসে বসে নীলাদ্রি-অমিত। আগে থেকেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন ওখানে। পরিপাটি পোশাক, পাট ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কেয়ারি করে চুল আঁচড়ানো, গলাবন্ধ ফুল হাতা সোয়েটার পরা।

সামনে দিয়ে অন্য একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে ধরা বন্ধ ছাতায় ভর দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন। তার উদ্দেশ্যে পাশে বসা ভদ্রলোক হাঁক ছাড়েন, ‘দাদা কত হল?’

ভদ্রলোক কানে কম শোনেন, থেমে, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী বললেন, কীসে বদহজম হল?’

‘না না, বয়স কত হল?’

‘এই তো একানব্বই। শয়ে পড়তে এখনও নয় নয় করে ন’টা বছর বাকি।’

‘তা প্রায় টেনে এনেছেন। আমার তো একাশি, আমার থেকে পুরো দশ বছর এগিয়ে। আমরা কি আর পারব, আপনার মতো?’

মৃদু হেসে ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘যা ঠান্ডা পড়েছে।’

পাশের ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘দেখুন কী হয়?’

নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে, অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘এখনও আধ ঘন্টা।’

অন্য একজন ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক পাশে এসে বসলেন। তার পায়ের কেডস্টিও ধবধবে সাদা। আগের সেই ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করতে করতে প্রশ্ন করেন, ‘ক পাক হল?’

নস্যির কৌটো বের করার সময় পকেটে রাখা খুচরো পয়সাগুলো ঝনঝন করে বেজে ওঠে।

‘এই তো সবে এক পাক দিয়ে এসে বসলাম।’

নস্যি নিয়ে পরিষ্কার রুমাল দিয়ে নাক, হাত মুছে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসেন।

‘ঘোষবাবুকে দেখলেন? এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ্যই আছেন। একানব্বই চলছে!’

‘ভাইপোদের কাছে থাকেন। ভালো চাকরি করতেন, ভালো পেনশন। বিয়ে থা তো করেননি। সাংসারিক চিন্তাভাবনা নেই। সুস্থ থাকারই কথা।

‘আপনার কত চলছে?’

‘ক’দিন আগে সত্তর পার হলাম।’

‘আমার থেকে তো অনেক ছোটো। যান সন্ধে হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি আরও দু-চার পাক ঘুরে আসুন। ভালো করে বাঁচতে হবে। কত কী আরও দেখবার আছে।’

‘না না, আর দেখবার ইচ্ছে নেই। ঘরে-বাইরে যা চলছে। তাড়াতাড়ি গেলেই বাঁচি।’

‘মানুষ হয়ে এসেছেন, অত তাড়াতাড়ি করে লাভ কী? যতদিন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা যায় সেটাই ভালো। মরলে পরে কে যে কী হবে কে জানে!’

‘ওই দেখুন বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের প্রোগ্রাম সেট করছে, আর আমরা রক্তচোষারা বসে আছি শুধু সময়ের অপেক্ষায়।’ একটু থামেন। ‘আচ্ছা, মানুষের জন্য কোনওদিন রক্ত দিয়েছেন?’

সংক্ষিপ্ত উত্তর– ‘না’।

ভদ্রলোক তবুও থামেন না, ‘সে কি কথা।’ মানুষইতো কেবল মানুষের জন্য রক্ত দিতে পারে। জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ওরা কিন্তু পারে না। একবার চেষ্টা করে দেখুন না।’

‘আমাদের চেষ্টার দিন তো শেষ। আমাদের রক্ত সব শুকিয়ে গেছে। না হলে এত অনাচার, এই খারাপ সময়ে একটুও গরম হয় না কেন রক্ত?’ নীলাদ্রি-অমিতের দিকে ফিরে বলে, ‘এখন চেষ্টা করবে এরা। চারিদিকে লড়াই। অনেক অনেক রক্তের দরকার।’ বেঞ্চ থেকে উঠে ভদ্রলোক এগিয়ে যান। পাশের ভদ্রলোক অমিতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যাই যাই করছে। ওসব মিথ্যে মুখোশ। মরতে কেউ-ই চায় না। মরতেই যদি চায় তাহলে প্রতিদিন পার্কে এসে পাঁচ পাক ঘুরছে কেন? বাঁচতে চায় বলেই তো শরীরটাকে সতেজ রাখার চেষ্টা। রক্ত ফুরিয়ে গেলে দেখবে রক্ত চাইবে। এক বোতল, দু বোতল, তিন বোতল…।’

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ায়।

অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘মিনিট দশেক।’

বেঞ্চ ছেড়ে অমিতও উঠে দাঁড়ায়। পাশের ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমাদের দুজনেরই বি পজিটিভ। কখনও রক্ত লাগলে বলবেন।’

পার্কের রাস্তা– মানিকতলা মোড়– সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক, পায়ে পায়ে শেষ হয় নীলাদ্রি অমিতের রাস্তা।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ব্লাড কালেক্ট করে হসপিটালের ফ্রিজে সেই ব্লাড ঢুকিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নীলাদ্রি অমিতকে নিয়ে দিতির কেবিনের দরজা খুলে দাঁড়ায়, দরজা খোলার হালকা শব্দে দিতি ঘুরে তাকায় ওদের দিকে।

দিতির চোখে-মুখে আবার একবার দেখতে পায় বেঁচে থাকার আকুল আগ্রহ – ‘ব্লাড পেয়েছ?’

 

স্নেহ

অর্ক মায়ের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ও জানে মা অনেকদিন ধরেই মাসিকে ফোনে চেষ্টা করছে কিন্তু মাসিকে কিছুতেই ফোনে ধরা যাচ্ছে না। আর মাসির খবর কয়েকদিন না পেলেই মায়ের কী অবস্থা হয় আন্দাজ করে নিয়েই অর্ক বলে, ‘মাসির চিন্তা করা বন্ধ করো এবার। মা, তুমি খুব ভালো করেই জানো মাসি ভালো আছে বলেই এখন তোমার ফোনও ধরছে না, তোমাকে একটা ফোন করারও প্রয়োজন মনে করছে না। কোনও প্রবলেম হলে কাঁদতে কাঁদতে আগে তোমাকেই ফোন করত।’

সুচরিতা অর্কর কথার কোনও প্রত্যুত্তর দিতে পারে না শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নেয়। আজকালকার ছেলে, ইমোশন খুব কম, তবে জীবনের উঁচু-নীচু পথটাকে অনেক ভালো ভাবে বোঝে, চেনে ওরা। তবে সেটা সুচরিতার কাছে কষ্টের নয়, গর্বের।

সুচরিতা বোঝে আজকের দিনে ওর নিজের ভালোমানুষি স্বভাবটাকে নিয়ে লোকেরা হাসিঠাট্টাই করবে, আড়ালে সকলে নিরেট, বুদ্ধিহীন বলবে। অথচ সত্যিই তো ছোটোবেলায় এত বুদ্ধি ছিলটাই বা কোথায় যে এক-দু’বার সাক্ষাতেই কাউকে বুঝে ফেলবে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়ো হওয়ার কারণে, বড়োদের মধ্যে সুচরিতার থাকার সুযোগ হয়নি। পরিবারের অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গেই মিলেমিশে মানুষ হয়েছে। বড়োরা কীভাবে ঘরসংসার সামলাচ্ছেন সেটা ঘুণাক্ষরেও সুচরিতা কখনও বুঝতে পারেনি। অথচ এখন তিন-চার সদস্যের পরিবারে বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে কিন্তু সবদিকেই তাদের তীক্ষ্ণ  নজর। কারও সঙ্গে দুটো কথা বলেই ওরা বুঝে ফেলে মানুষটা কেমন।

‘আজই আমি মাসিকে দোকানে শপিং করতে দেখেছি। হয়তো অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। মাসির সঙ্গে আরও দুজন ছিল। ওদের সকলের হাতেই অনেকগুলো করে ব্যাগ ছিল।’

‘তোর সঙ্গে কোনও কথা হয়েছে?’

‘না, আমি ফুটপাথে একটা দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। মাসিকে একটা দোকান থেকে বেরিয়ে আর একটা দোকানে ঢুকতে দেখলাম।’

‘তুই তো ভুলও দেখে থাকতে পারিস।’

‘কেন, আমি কি অন্ধ, নাকি চোখে কম দেখি যে মাসিকে দেখে চিনতে পারব না?’

‘তাহলে কথা বললি না কেন?’

‘বাব্বা! মাসি হেসে গড়িয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আমাকে দেখতেই পায়নি। দিব্যি খোশমেজাজে ছিল… আর যেই তুমি ফোন করো অমনি মাসির কান্নাকাটি আরম্ভ হয়ে যায় যেন ওর চেয়ে দুঃখী সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর একটাও নেই। মাসির যখন ভালো সময় যায় তখন কই, তোমাকে তো বলতে আসে না অথচ যেই সামান্য প্রবলেমের আঁচ পায় ওমনি তোমার কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মা, মাসির চিন্তা করা ছাড়ো। ফোন আসেনি মানে ধরে নাও মাসি বহাল তবিয়তে আছে।’

সুচরিতা শাসনের ভঙ্গিতে অর্কর দিকে চোখ ফেরায়। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে কারণ সুপর্ণার নামে আরও দুটো বাজে কথা অর্কর মুখ থেকে শুনতে সুচরিতার ভালো লাগছিল না। অথচ মনে মনে সুচরিতা ভালো করেই জানে অর্কর প্রতিটা কথা সত্যি। ও ঠিকঠাকই চিনেছে নিজের মাসিকে। সুপর্ণার এটা বরাবরের স্বভাব। সাধারণ সমস্যাকে বাড়িয়ে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না অথচ কোনও আনন্দের খবর থাকলে এমনভাবে সকলের কাছে চেপে যাবে যে অন্য লোকে মনে করবে দুঃখ ছাড়া মেয়েটার জীবনে সুখশান্তি একেবারেই নেই।

সুপর্ণাকে যতবার সুচরিতা এটা নিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে প্রত্যেকবারই ওর একটাই উত্তর শুনে এসেছে, ‘তুই জানিস না দিদি, আমার ভালো কেউ সহ্য করতে পারে না। সকলে আমাকে হিংসা করে। ভালো কিছু আমার জীবনে ঘটলে অন্যের নজর লেগে যায়, তাই কাউকে আমি কিছু জানতে দিই না।’

সুচরিতা আশ্চর্য হয় সুপর্ণার কথা শুনে। আশ্চর্য, নিজের দিদিকেও বলা যায় না। তার মানে কি সুপর্ণা বলতে চায় ছোটো বোনকে দিদি হিংসা করছে? অথচ দিনরাত সুচরিতার একটাই চিন্তা, ছোটো বোনটা কীভাবে ভালো থাকবে? কী করে ওকে আরও সাহায্য করা যাবে?

সুচরিতার মনে পড়ল, এই তো কয়েকদিন আগেই সুপর্ণা কাজের মেয়েটার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল কিছু টাকা চাই লিখে। সংসার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সুচরিতা সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখে দুর্দিনের কথা মাথায় রেখে। ভেবেছিল বোন এলে ওখান থেকেই কিছু টাকা সুপর্ণাকে দিয়ে দেবে। ও ভালো করেই জানে ওই টাকা সুপর্ণা কবে ফেরত দেবে কোনও ঠিক নেই। আদৌ দেবে কিনা সেটাও অজানা।

এই ভাবেই দুই বোন মানুষ হয়েছে। দশ বছরের ছোটো সুপর্ণা। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মা-বাবার কাছে সমানে শুনে এসেছে, ছোটো বোনের সব দায়িত্বই সুচরিতার। বোনকে চোখে চোখে রাখা, সঙ্গে করে স্কুল নিয়ে যাওয়া, টিফিন খেয়েছে কিনা দেখা, বোনকে আগলে আগলে রাখা সবই করেছে সুচরিতা। বিয়ের পরেও এর অন্যথা হয়নি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরেও সুপর্ণার দায়িত্ব সুচরিতার ঘাড়েই এসে পড়েছে। সুচরিতা নিজেই বুঝতে পারেনি কবে থেকে ও বড়ো দিদির খোলস ত্যাগ করে সুপর্ণার মা হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই নিয়ে সুচরিতার স্বামী এবং ছেলে প্রচুর হাসিঠাট্টাও করেছে, কিন্তু সুচরিতা কখনও প্রতিবাদ করেনি।

‘সুচি, তুমি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালোমানুষ। নিজের বোনকে ভালোবাসো ক্ষতি নেই কিন্তু এতটা স্বার্থপরও ওকে করে তুলো না যে ওর নিজের চরিত্রই একদিন ওর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মা-বাবাও শক্ত হাতে সন্তানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তাকে শাসন করে কিন্তু তাই বলে কি তারা তাদের সন্তানের শত্রু? তাহলে তুমি কেন সুপর্ণার সব দোষ ঢাকবার চেষ্টা করো?’

‘আমি ওকে কী বলব? ও নিজে পড়াশোনা করেছে, ব্যাংকে চাকরি করে। ও বাচ্চা মেয়ে নয় যে ওকে বোঝাব। সবারই স্বভাবের কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে।’

‘যদি আলাদা আলাদা স্বভাবের কথাই বলো তাহলে ওকে ওর স্বভাব নিয়েই থাকতে দাও। ওর নিজের স্বভাবের জন্য যা কিছু সমস্যা সেটা সুপর্ণার একার, সেটা সমাধানের দায়িত্বও ওর উপরে কেন ছেড়ে দিচ্ছ না? সেখানে তুমি কেন ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? আমার আপত্তিটা এখানেই।’

শেখরের কথাটা ফেলতে পারে না সুচরিতা কারণ সুচরিতা জানে শেখর সত্যি বলছে। কিন্তু মনকে কীভাবে বোঝাবে সুচরিতা। বোনের প্রতি গভীর মমতাবোধ সবসময় সুচরিতাকে দুর্বল করে তোলে। এই যে সুপর্ণা টাকা চেয়েছে সেটা শেখরকে এখনও বলতে পারেনি সুচরিতা। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে নিজের জমানো টাকা থেকেই সুপর্ণাকে কুড়ি হাজার টাকা এখন দিয়ে দেবে। কিন্তু কেনই বা এই টাকার দরকার সুপর্ণার, নিজের মনকেই সুচরিতা প্রশ্ন করে। সুপর্ণা ব্যাংকে চাকরি করে, মাইনেও খারাপ নয়। তাহলে? আর কতদিন সুপর্ণাকে এইভাবে সাহায্য করে যেতে হবে? মনে মনে বিরক্ত হয় সুচরিতা। কেন ও সুপর্ণার মুখের উপর ‘না’ বলতে পারে না? বেশ বুঝতে পারে সুচরিতা, সুপর্ণা ওর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ওকে ব্যবহার করছে।

শেখর বহুবার সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে সুপর্ণা ওকে নিজের কাজ গুছোবার জন্য খালি ব্যবহার করছে। সুপর্ণার এই স্বভাবের জন্য সুচরিতা অনেকটাই দায়ী। বোনের অন্যায় কোনওদিন সুচরিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি উপরন্তু সকলের সামনে ঢাকবারই চেষ্টা করেছে। এমন অনেক সম্পর্ক রয়েছে যেগুলো ছাড়া জীবন এগোতে চায় না অথচ সম্পর্কগুলো শুধু ব্যথাই দেয়। দেওয়ার ইচ্ছেটা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। আর পিছন ফিরে কিছুতেই তাকানো যায় না। অথচ যে পাচ্ছে, তার কিছুতেই আর আশ মেটে না। গোগ্রাসে সারা পৃথিবীটাকে যেন গিলে খেতে চায়।

সুপর্ণার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। অথচ নিজেকে বদলাবার কোনও চেষ্টা নেই ওর। সুচরিতা ভাবে, সুপর্ণা কখনও কি বদলাবে? হয়তো না। অথচ ওর জন্য সুচরিতার সংসারে মাঝেমধ্যেই অশান্তির ঝড় বয়ে যায়। আশকারা তো সুচরিতাই দিয়েছে। যখন তখন এসে কেঁদে পড়া, টাকা ধার চাওয়া, সুচরিতার জীবনে নাক গলানো এগুলো সুপর্ণার অভ্যাস হয়ে গেছে। সন্তানকে শাসন করা যায়, গায়ে হাতও তোলা যায়। কিন্তু একটা বয়সের পরে কেউ কথা শুনবে কি শুনবে না সেটা পুরোটাই তার মানসিকতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু সব জেনেশুনে চুপচাপ বসে থাকাটাও বোকামি। গায়ে হাত তুলে শাসন করা না-ই বা গেল কিন্তু শাসনের ভঙ্গিতে হাত তো তোলাই যেতে পারে, শরীরে না ঠেকালেই হল।

সুচরিতাও মনে মনে দৃঢ় হল, এভাবে আর সুপর্ণার অন্যায়গুলোতে সায় দেওয়া যায় না। বিকেলে সুপর্ণার বাড়ির রাস্তা ধরল। শেখরের ফিরতে রাত হবে, অতএব অর্কই মা-কে অটোতে উঠিয়ে দিল। গলির মুখটাতে অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল সুচরিতা। সুপর্ণাকে অগ্রিম কিছু জানায়নি ফোন করে যা এতদিন করে এসেছে ও। ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল বাজায় সুচরিতা। অল্প অপেক্ষার পরই দরজা খুলে দাঁড়ায় সুপর্ণা। দিদিকে হঠাৎ সামনে দেখে সুপর্ণার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, ‘দিদি তুই?’

সুচরিতার পেছনে আরও কেউ আছে কিনা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে সুপর্ণা শুকনো গলায় আবার জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি তুই? একটা ফোন করিসনি কেন?’

‘ভাবলাম তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব, তাই চলে এলাম। ভিতরে আসতে বলবি না… নাকি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব?’

সুপর্ণাকে পাশ কাটিয়েই সুচরিতা বসার ঘরে পা দেয়। সোফাতে সুপর্ণার কোনও সহকর্মী বসে আছে দেখে সুচরিতা থমকায়। ঘরে চোখ বুলোতেই চোখে পড়ে কার্পেটের উপর কাগজ পেতে হোটেল থেকে আনানো খাবার রাখা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্লেটে খাবার নিয়ে গুছিয়ে সুপর্ণাকে কোনওদিন খেতে দেখেনি সুচরিতা। এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে সুপর্ণার। সুচরিতার চোখ পড়ে সোফায় বসা ভদ্রলোকের হাতেও হোটেলেরই খাবারের একটা বাক্স ধরা। চামচে করে সরাসরি বাক্স থেকেই খাওয়া হচ্ছিল সেটা বুঝতে ভুল হয় না। একটু লজ্জা অনুভব করে। সুপর্ণা নিজে এভাবে খায় ঠিক আছে তাই বলে অতিথির বেলাতেও একই নিয়ম?

সোফায় এসে বসে সুচরিতা। ওর মনে হয়, ভদ্রলোক যেন ওকে দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছেন। ব্যবহারটা কেমন যেন অসহজ মনে হয়।

সুপর্ণা ঘরে এসে বসতেই সুচরিতা চোখ ফেরায় ওর দিকে, ‘নিজেরই তো বোনের বাড়ি… শুধু শুধু ফোন করতে ইচ্ছে করল না। বসে বসে হঠাৎ মনে হল অনেকদিন ফোনে তোর সঙ্গে কথা হয়নি, তোকে দেখিনি। ব্যস চলে এলাম অটো ধরে। তুই কেমন আছিস? তোর কোথাও বেরোনোর নেই তো এখন?’

সুচরিতার মনে হয় সুপর্ণাকে একটু শুকনো লাগছে দেখতে। পাশের ভদ্রলোকটিও কেন জানি না উশখুশ করতে থাকেন। দু’জনকে দেখেই সুচরিতার মনে হয় যেন ওদের জীবনে একটা সাংঘাতিক অঘটন ঘটে গেছে।

‘কী হয়েছে, তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

সুচরিতা জিজ্ঞেস না করে পারে না।

‘হ্যাঁ, মাঝে একটু শরীরটা খারাপ হয়েছিল। দিদি, ইনি ব্যাংকে আমার সহকর্মী। নাম সৃজিত। আমার শরীর খারাপের খবর শুনে আমাকে দেখতে এসেছেন।’

সুচরিতা স্পষ্ট বুঝতে পারে সুপর্ণা মিথ্যা কথা বলছে। ওর নিজের করা প্রশ্নটাই সুপর্ণার মুখে উত্তর জুগিয়েছে এটা কাউকে এসে বলে দেওয়ার দরকার নেই। সুচরিতা শরীর খারাপের প্রশ্নটা না তুললে হয়তো সুপর্ণার ঠোঁটে সদুত্তর কিছু জুটত না।

ছোটো থেকে সুপর্ণাকে দেখছে তাই ওকে বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না সুচরিতার। প্রত্যেকটা গতিবিধি ওর চেনা। অনেকটা বয়সের পার্থক্য দুই বোনের মধ্যে। সুচরিতার জন্মের পর দশ বছর পর্যন্ত ওর মা-বাবা দ্বিতীয় সন্তানের কথা চিন্তাতেও আনেননি। সুচরিতার নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে এবং ওর বারো মাস অসুস্থ থাকার কারণে বাড়ির বড়োরা ওদের পরামর্শ দেন দ্বিতীয় সন্তানের জন্য। কারণ বাড়িতে আর সকলেরই দুটি করে সন্তান ছিল। সুচরিতা একা হওয়ার কারণে খেলার কোনও সঙ্গী ছিল না ফলে ও ধীরে ধীরে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠছিল। সুচরিতার এই সমস্যার একমাত্র সমাধানের রাস্তা ছিল বাড়িতে ভাই কিংবা একটা বোন হওয়া।

ভাই, বোন হওয়ার আগে থেকেই সুচরিতার মা-বাবা ওকে বোঝাতে শুরু করেন বাড়িতে নতুন অতিথি এলে সুচরিতার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সত্যি সত্যিই সুপর্ণার জন্মের পর সুচরিতার শৈশব হারিয়ে গেল সুপর্ণার প্রতি কর্তব্য পালনে। সকলে এসে একটাই কথা সুচরিতাকে বলে গেল, ‘তুই বড়ো দিদি, দশ বছরের বড়ো। তোকে বোনের দায়িত্ব নিতে হবে বই-কি।’ ব্যস সুচরিতাও, বোনের কীসে ভালো, তাতেই নিজেকে সমর্পণ করে দিল। দশ বছরের মেয়েটার ঘাড়ে সুপর্ণা নামের দায়িত্ব বেশ শিকড় গেড়ে বসল।

‘সুচি, তুমি ওর মা নও… তোমারা তো একই মায়ের পেটের বোন, তাহলে তুমি এত কেন চিন্তা করো ওকে নিয়ে?’ কতবার শেখর সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু সুচরিতার অবচেতনে গভীরভাবে ওর মা-বাবা এটাই রোপণ করে দিয়েছিলেন যে সুচরিতার প্রয়োজনেই সুপর্ণাকে সংসারে নিয়ে আসা হয়েছে। ছোটোবেলার কোনও কথা সুচরিতা ভোলেনি। একসঙ্গে যখন খেতে বসত, তখন হঠাৎ যদি সুপর্ণা বিছানা ভিজিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ত অথবা খিদের জ্বালায় কান্নাকাটি জুড়ে দিত, খাবার ফেলে রেখে সুচরিতাকেই দৌড়োতে হতো। এখন সুচরিতার মাঝেমধ্যেই মনে হয় ওই কাজগুলো সত্যিই কি ওর করার কথা ছিল? ওগুলো তো মা-বাবার দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল। বোনকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তারা সুচরিতার কাছে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন? সুচরিতার জীবনে যে সঙ্গীর অভাব ছিল সেটার অভাব পূরণ করে তারা কি সুচরিতার উপকার করতে চেয়েছিলেন? এই ভার আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সুচরিতা বয়ে চলেছে। এখন বড়ো ক্লান্ত বোধ করে সুচরিতা। মা-বাবার প্রতি এই কর্তব্যের থেকে কবে মুক্তি পাবে সুচরিতা? সুপর্ণার ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ে বর্তমানে ফিরে আসে সুচরিতা–

‘এই দিদি, কী ভাবছিস তুই? কোনও কথা বলছিস না কেন?’

সোফায় পড়ে থাকা প্যাকেটগুলোর উপর চোখ চলে যায় সুচরিতার। শহরের নামি কয়েকটা দোকানের নাম লেখা প্যাকেটগুলোয়। অর্ক সত্যি কথাই বলেছিল, বুঝতে পারে সুচরিতা। শরীর খারাপটা বাহানা মাত্র, আসলে সুপর্ণা ঘোরা-বেড়ানো, মার্কেটিং নিয়েই ব্যস্ত ছিল। দিদির একটা খোঁজ নেওয়া দরকার, সেটা ওর মনেও আসেনি।

সুচরিতা লক্ষ্য করে দুটো, তিনটে পোশাক ইতিউতি চেয়ারের উপর পড়ে রয়েছে। দেখে তো নতুনই মনে হচ্ছে। হয়তো সুপর্ণা পরে পরে দেখছিল আর নয়তো পরে দেখাচ্ছিল!

হঠাৎই সুচরিতার মনে হয়, তাহলে কি বসে থাকা পুরুষটির সঙ্গে সুপর্ণার কোনও গভীর সম্পর্ক রয়েছে নয়তো কোনও বাইরের পুরুষের উপস্থিতিতে সুপর্ণা পোশাক বদলাবার মতো নির্লজ্জ আচরণ করে কী করে?

‘তোর কি জ্বর হয়েছিল? ক্লাইমেট বদলাচ্ছে… চারদিকে ভাইরাল চলছে, একটু সাবধানে থাকতে পারিস তো’, এই বলে সুচরিতা চেয়ার থেকে জামাকাপড়গুলো উঠিয়ে একটা জায়গায় জড়ো করে। ঠিক সেই মুহূর্তে সোফায় বসা ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘আচ্ছা সুপর্ণা আমি এখন বেরোচ্ছি।’

‘আপনি উঠছেন কেন, বসুন না… খাবারটা তো এখনও শেষ হল না। সুপর্ণা, তুইও এসে এখানে একটু বস না,’ সুচরিতার গলার স্বরে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে ওরা দু’জনেই চমকে সুচরিতার দিকে তাকায়।

ভদ্রলোক কোনও কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়ান। সুপর্ণাকে দেখেও একটু আনমনা মনে হয় সুচরিতার।

‘অসুস্থ ছিলি যদি তাহলে হোটেলের খাবারগুলো খাচ্ছিস কেন?’ না চাইতেও সুচরিতার চোখ চলে যায় পড়ে থাকা খাবারের কৌটোতে। তেলের মধ্যে মাংসের টুকরোগুলো ভাসছে, একটা কোনও সবজি আর রুমালি রুটি পড়ে রয়েছে। ‘তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল, তাই আর আসার আগে তোকে ফোন করিনি। আমার কিছু টাকার দরকার… অর্কর একটা কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য। তোর কাছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো পাই।’

মুহূর্তেই সুপর্ণার মুখের চেহারা বদলে যায়, বিবর্ণ রং ধারণ করে। কারণটা সুচরিতা জানে তাই আবার জানার চেষ্টা করে না। সুপর্ণাকে টাকা দিয়ে এই প্রথম টাকা ফেরত চাইল সুচরিতা। সুপর্ণাও টাকা নিয়ে কোনওদিন ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সুচরিতা খুব খুঁটিয়ে সুপর্ণার চোখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে কারণ ও বুঝতে পেরেছিল এখানে এসে সুপর্ণার সন্ধেটা মাটি করে দিয়েছে।

আপশোশ হয় সুচরিতার। একই মা-বাবার সন্তান হয়েও দুই বোনের চরিত্র কতখানি আলাদা। একই বাড়ির পরিবেশ কীভাবে দুজনের রক্তে আলাদা প্রভাব ফেলল?

‘আমার কাছে টাকা কোথায়?’ সুপর্ণা অস্ফুটে বলে।

‘কেন? একলা ফ্ল্যাটে থাকিস। তোর স্বামী আর ছেলে দুজনেই অন্য শহরে রয়েছে। তোর পুরো খরচা ভাস্কর পাঠায়। তোর নিজের মাইনের পুরোটা যায় কোথায়? নিজের জন্য একটা পয়সাও তো খরচ করিস না।’

সুপর্ণা অবাক হয়ে যায় দিদির কথা শুনে। সবসময় ওর হয়েই সুচরিতা মুখ খুলেছে তাহলে আজ হঠাৎ দিদি বিপক্ষে কী করে চলে গেল। অথচ সুচরিতা সবসময়েই চেয়েছে সুপর্ণা বিপথে না যাক। প্রতিদিন ভেবেছে, সুপর্ণা এবার নিজেকে বদলাবে। ওর স্বামী, ছেলে সকলেই ওর আচরণে বিরক্ত। সুচরিতারও বাড়ির কেউ সুপর্ণাকে পছন্দ করে না। একমাত্র ওই ঢাল হয়ে সুপর্ণাকে আগলেছে। সেই ঢাল-ই আজ তির হয়ে সুপর্ণাকে আঘাত করতে উদ্যত।

‘একটু একটু করে সংসার থেকে বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছি… অর্কর ভর্তির জন্য অনেকগুলো টাকা লাগবে এটা তো তুই জানতিস। আমাকে সাহায্য করতে হবে না কিন্তু আমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দে। আমার তাতেই কাজ মিটে যাবে,’ উঠে দাঁড়ায় সুচরিতা।

সুপর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছিল কাটলেও এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়বে না। মরা মানুষের মতো ফ্যাকাসে চেহারা হয়েছে ওর। ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সুচরিতা এতটা মুখরা হয়ে উঠতে পারে, এতটা নির্দয় ভাবে সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলতে পারে। সুপর্ণার স্ন্দুর সন্ধের শেষটার যে এমন পরিণাম হতে পারে, সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।

‘দ্যাখ না দিদি, ভাস্কর কিছুই বুঝতে চায় না…’

ভাস্করকে খুব ভালো করেই জানে সুচরিতা। সুপর্ণা বরাবরই স্বামীকে ডমিনেট করে এসেছে। নিজের ইচ্ছে ওর উপর চাপাতে চাপাতে ভাস্করের জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। ছেলেটাকেও কোনওদিন আদর করে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। বাড়ির বাইরেই সময় কাটিয়েছে বেশি। তাই চাকরির বদলি হওয়াতে ভাস্কর যে খুশিই হয়েছিল সেটা সুচরিতার অজানা নয়। চাকরির দোহাই দিয়ে সুপর্ণা ওদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করে। আর এই সুপর্ণাকে এতদিন, এতবছর ধরে সুচরিতা সকলের চোখের আড়ালে স্নেহ মমতা দিয়ে সিঞ্চন করে এসেছে। আজ আপশোশ হয় সুচরিতার।

দম আটকে আসতে থাকে ওর, সুপর্ণার ফ্ল্যাটের ভিতরে। একটা নেগেটিভ এনার্জি সুচরিতাকে সদর দরজার দিকে ধাক্বা মারতে থাকে। নিজের বোনের প্রতি এই ধরনের মনোভাব কোনওদিন সুচরিতা আগে ফিল করেনি। নিজেই ও সবথেকে বেশি দোষী। ঘৃণা হতে থাকে নিজের উপরেই সুচরিতার।

‘দিদি আর একটু বস না।’

‘না সুপর্ণা… আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর সঙ্গে আমার এইটুকুই কাজ ছিল’, বলে সুপর্ণার হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে সুচরিতা বাইরে বেরিয়ে আসে। বাধভাঙা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে সুচরিতার দুই গাল বেয়ে। কী যেন আশায় একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে, ফেলে আসা বাড়িটার দিকে। ওকে পেছন থেকে ডাকার মতো একটা মানুষের মুখও চোখে পড়ে না। গভীর শ্বাস নেয় সুচরিতা। এই তো বেশ ভালো হল। টাকা ফেরত পাবার আশা কম তবে ‘দিদি কিছু টাকা দে’ বলে হাত বাড়ানো সুপর্ণাকে আর দেখতে হবে না। হঠাৎই সুচরিতা বুঝতে পারে ঘাড়ের ভারী বোঝাটা কখন যেন হালকা হয়ে গেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অটো ধরতে এগিয়ে যায় সুচরিতা।

আই অ্যাম নট ভার্জিন

মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই শ্রীতমা ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে। প্রায় মরার মতো ঘুমোচ্ছিল। কাল অনেকটা ধকল গিয়েছে। অ্যালার্ম না দিলে হয়তো উঠতেই পারত না। কাল রাত্রে পার্টি করতে অত দূর যাওয়া উচিত হয়নি। ফিরতে ফিরতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিল। আজ সকালে অডিশন আছে। মোনালিসাটা ছাড়ল না, জোর করে নিয়ে গেল। ওর বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি, যেতেই হবে। লং ড্রাইভে যাবে কোলাঘাট, ওখানে শের-এ-পাঞ্জাব-এ খানাপিনা, পার্টি হবে।

মোনালিসা, শ্রীতমা স্কুল-জীবন থেকে বন্ধু। এক সঙ্গে কলেজেও পড়েছে। মোনালিসা ব্যাংকে চাকরি করে, এখন কলকাতায় পোস্টিং। খাওয়াদাওয়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ না থাকলেও, লং ড্রাইভে যাওয়ার লোভটা ছাড়তে পারল না শ্রীতমা। এটা ওর খুব পছন্দের। কখনও কখনও কার বুক করে একলাই বেরিয়ে পড়ে লং ড্রাইভে। মাঝে মাঝে শ্রীতমা স্বপ্ন দেখে লং ড্রাইভে এক অনন্ত যাত্রায় চলেছে সে। কখনও গন্তব্যে পৌঁছোতে পারে কখনও বা পৌঁছানোর আগেই ঘুম ভেঙে যায়।

লং ড্রাইভ শেষে বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র কিনারে সে একা। ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় থাকে অন্য কারও। যাকে সে চেনে না, জানে না, দেখেনি কখনও। আলস্য ঝেড়ে উঠতে উঠতে কাল রাত্রির পার্টির মজাগুলো মনে পড়ে খুশির রেখা দেখা দেয় শ্রীতমার মুখে।

মোনালিসার বয়ফ্রেন্ড ঈশান ইঞ্জিনিয়র, আইআইএম থেকে এমবিএ করেছে। মাইক্রোসফট-এ বড়ো পোস্টে চাকরি করে। স্মার্ট, হাসিখুশি ছেলে। কাল মজা করে বলছিল, আগে দেখা হলে সে শ্রীতমাকেই প্রোপোজ করত। ঈশানের কথা শুনে মোনালিসা একপ্রস্থ পিটিয়ে নেয় তাকে।

পার্টিতে ঈশানের বন্ধু সূর্য ছিল সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়রিং আর এমবিএ ঈশানের সঙ্গে করেছে, এখন সিঙ্গাপুরে বড়ো মাইনের চাকরি করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। বন্ধুর বার্থডে পার্টি তো মিস করা যায় না কোনও ভাবেই! চারজনে মিলে বেশ এনজয় করেছে কাল। পার্টি শেষে ফেরবার পথে সূর্য‌ শ্রীতমাকে প্রোপোজ করে। মোনালিসা উস্কায়, হ্যাঁ করে দে।

শ্রীতমা হেসে উড়িয়ে দেয়, এটা লালজল পানের আফটার এফেক্ট। দেখবে সকাল হলেই ঘোর কেটে যাবে।

সূর্য‌ শ্রীতমার হাতে হাত রেখে বলে, নো বেবি, ইটস রিয়েল।

বাঁকা হেসে শ্রীতমা হাতের উপর থেকে  সূর্য‌র  হাত নামিয়ে দেয়। বিভিন্ন পার্টিতে এমন ঘটনা অনেক বার ফেস করেছে সে, এমন কথা অনেকবার শুনেছে। পরের দিন তারাও ভুলে যায়, শ্রীতমাও আর মনে করার চেষ্টা করে না।

কাল রাত্রে সকলের সঙ্গে সেও অল্প ড্রিংক করেছিল। তবুও ঘুম ভেঙে সকালে সূর্য‌র মুখটা, সূর্য‌র কথাগুলো কেন যে মনে পড়ে গেল! গত রাত্রির স্মৃতি ঠেলে সরিয়ে রেখে বেড থেকে নেমে আসে শ্রীতমা।

বাথরুম থেকে একেবারে স্নান সেরে বেরোয় সে। সকাল নটা থেকে অডিশন। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে ইন্ডাকশন অ্যাভেনে চাপায় গরম করার জন্য। বেডরুমে এসে ওয়ার্ডরব থেকে নতুন কেনা ওয়েস্টার্ন ড্রেসটা বের করে পরে, হালকা প্রসাধন করে।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে দেখে নেয় নিজেকে। পাঁচ পাঁচ হাইটে, চৌত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ ফিগারটা বেশ মোহময়ী লাগছে এই নতুন ওয়েস্টার্ন ড্রেসটায়। শরীরে চেপে বসা ড্রেসটা স্পষ্ট করে রেখেছে শরীরের বিভিন্ন কার্ভ। চনমনে সেক্সি-সেক্সি ফিল হচ্ছে ভিতর থেকে।

কিচেনে গিয়ে গরম দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেয়ে বেরোনের জন্য রেডি হয় শ্রীতমা। ড্রেসের সঙ্গে মানানসই সিলভার কালারের পেনসিল হিল শু-টা টেনে নিয়ে সোফায় বসে পা গলিয়ে উঠে এসে আরও একবার নিজেকে দেখে নেয় ড্রেসিং টেবিলে। এখন সে আরও দীর্ঘাঙ্গী, পাঁচ ফুট পাঁচ নয়।

পোশাকের সঙ্গে মানানসই আগে থেকে বের করে রাখা হাত ব্যাগটা তুলে নেয়। চেন খুলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সারফেস স্যানিটাইজার স্প্রে ব্যাগে ঢোকায়। নিজে পরে নেয় ডিজাইনার মাস্ক। মোবাইল অ্যাপে ক্যাব বুক করে ফ্ল্যাটের দরজা লক করে, নীচে নামার জন্য লিফ্ট-এ চড়ে শ্রীতমা।

নাকতলায় গলির মধ্যে পাঁচতলা বিল্ডিংটার, তিনতলার ওয়ান বিএইচকে এই ফ্ল্যাটে শ্রীতমা আছে বছর দেড়েক হবে। যখন প্রথম ছবির কাজ শুরু হল, তখন থেকে। ফ্ল্যাটের সামনের সরু রাস্তায় ক্যাব ঢোকে না, সেজন্য ভাড়াটা একটু কম। কাছেই বড়ো রাস্তা, অসুবিধা হয় না । এগিয়ে এসে বড়ো রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, এই যা।

প্রথম ছবিতে সে লিড রোল করেছিল। ছবিটা ভালো বিজনেস করেছিল। তার অভিনয়ে প্রশংসাও হয়েছিল। এর পর পরই দ্বিতীয় ছবিটার অফার পেল। ভালো রেমুনারেশনে কন্ট্যাক্ট হয়েছে। প্যান্ডেমিকের জন্য এখন শুটিং বন্ধ আছে, অসুবিধাটা সেখানেই। ফ্ল্যাটের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, নিজের খাওয়াদাওয়া ও অন্য সব খরচা তো আর বন্ধ নেই। সেজন্য অন্য কাজের ব্যাপারে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

সকাল সকাল একগাদা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকেছে। লিফটে নামতে নামতে মেসেজগুলো দেখে নেয় শ্রীতমা। এতক্ষণ দেখার সময় পায়নি। চেনাজানা লোকজনের গুড মর্নিং মেসেজে ভরা। অচেনা একটা নাম্বার থেকেও মেসেজ এসেছে, সঙ্গে রেড হার্ট লাভ সিম্বল। শ্রীতমা হাসে, কোন পাগলের কাজ কে জানে!

লিফট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বড়ো রাস্তার দিকে এগোয়। অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভারের ফোন ঢুকছে। শ্রীতমা ফোন ধরে বলে, মেন রোডে কালী মন্দিরের সামনে থাকছি। কতক্ষণে আসছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। শ্রীতমা আবার মোবাইলটায় চোখ রাখে। ভাবতে থাকে, অচেনা নাম্বার থেকে কে মেসেজ পাঠাল।

বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াতে লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে শ্রীতমাকে। ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নেয়। ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াতে দরজা খুলে সারফেস স্যানিটাইজার ক্যাবের ভিতরে স্প্রে করে উঠে বসে। শ্রীতমাকে স্প্রে করতে দেখে ড্রাইভার বলে, ম্যাম, আমি এখনই গাড়ি বের করেছি। ভালো করে স্যানিটাইজ করে এনেছি। ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরও তো প্রাণের মায়া আছে! সারাদিনে কত রকমের প্যাসেঞ্জার চড়ছে।

শ্রীতমা হুম বলে চুপ করে যায়। ব্যাগ পাশে রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসে। অডিশনের জন্য কনসেন্ট্রেট করার চেষ্টা করে। একটু এগোতে না এগোতে ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে। রিচা ফোন করছে। ওর প্রথম ফিলম লাভ মি-তে সেকেন্ড লিড ছিল রিচা।

গুড মর্নিং। কী করছিস বল।

আর কী! বসে আছি। তোর খবর বল।

আমিও বসেই ছিলাম। এই ক’দিন হল একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করছি। লিড রোল। ভালো পেমেন্ট করছে। একটু আধটু বোল্ড সিন আছে, এই যা। এমনিতে ইউনিটটা ভালো, সব লোকজনও বেশ ভালো। একটু থেমে রিচা বলে, তুই ওয়েব সিরিজ করবি?

এখনও ভাবিনি। ফিলমের শুট শিগগিরি শুরু হবে বলছে। দেখি, ফিলমের শুট শুরু হয়ে গেলে তো আর হবে না। না হলে হয়তো…

বলিস। বড়ো প্ল্যাটফর্মে এদের একটা নতুন প্রোজেক্ট আসছে। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।

শ্রীতমা মিষ্টি করে বলে, থ্যাংকস।

রিচার ফোনে অন্য একটা ফোন ঢুকছে। একটা ইম্পট্যান্ট ফোন আসছেরে। পরে ফোন করছি, বলে রিচা ফোন কাটে।

শ্রীতমা সময় দেখে। এখনও মিনিট চল্লিশ হাতে আছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে নিউটাউন। আজ ওখানেই অডিশন। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে শ্রীতমা।

শুরুর দিন থেকে ফিলম কেরিয়ারের আজ পর্যন্ত জার্নিটা ভেসে ওঠে শ্রীতমার মনে। পরিস্থিতির চাপে সে যে এক অনিশ্চিত পথে চলতে শুরু করেছিল বছর কয়েক আগে, তা কি আর এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে!

শ্রীতমা সবে মাত্র গ্র‌্যাজুয়েন শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে, সে সময় বাবা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন। আগে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি। ছোটো ভাইটা এইচএস পড়ছে। বাবা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী ছিলেন। একটা নিজস্ব বাড়ি বানিয়ে রেখে গিয়েছেন, এইটাই ভরসার। মাথার উপর একটা ছাদ আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সামান্য পেনশন পান। জমানো টাকা বলতে তেমন কিছু নেই। সে টাকায় সংসার চালিয়ে দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা চালানো খুবই কঠিন। তখন থেকেই কোনও ভাবে ইনকাম করার চিন্তাটা শ্রীতমার মাথায় চেপে বসে।

পাঁচ ফুট পাঁচ-এর দীঘল শরীর, সুন্দর মুখশ্রী আর নজর কাড়া ফিগারের জন্য রাস্তায়, এলাকার ছেলেদের চোখ সব সময় তার উপর পড়ে থাকত। বান্ধবীরাও তার রূপের প্রশংসা করত। সে নাকি বাংলা ফিলম ইন্ডাস্ট্রির নায়িকার আকাল মেটাতে সক্ষম। ছোটোবেলা থেকে শ্রীতমা নাচ শিখেছে আর বড়ো হয়ে কলেজে পড়ার সময় থেকে দুর্গাপুরের নামি নাটকের গ্রুপে নিয়মিত অভিনয় করছে। কলকাতাতেও বেশ কয়েকটা শো করে গিয়েছে। তাই শ্রীতমার মনেও আশা জাগে, হয়তো সত্যিই সে পারবে!

তখন মাস্টার্স-এর ফার্স্ট ইয়ার। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে নিজের ফটো আর রেজিউমে মেল করে পাঠায় শ্রীতমা। কলকাতার একটা নামি শপিং মলের হোর্ডিং-এর জন্য মডেল চেয়ে বিজ্ঞাপন ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে অ্যাড এজেন্সি থেকে রিপ্লাই পেল, সে শর্ট লিস্টেড হয়েছে। ফাইনাল সিলেকশনের জন্য কলকাতায় এসে অডিশন দিতে হবে। সিলেক্ট হয়েছিল। সেই শুরু।

অ্যাড এজেন্সির মালিক সার্থকদার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। সার্থকদার রেফারেন্সে প্রায় প্রতি মাসে একটা দুটো মডেল শুট-এর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে যেত। পেমেন্টও খারাপ নয়। আসা যাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে আট-দশ হাজার টাকা। সংসারের, নিজের আর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ অনেকটাই মিটে যেত সে টাকায়। এমন করেই দুই আড়াই বছর চলে গেল। মাস্টার্সের ফাইনালের আগে মাস কয়েক ব্রেক দিয়েছিল, পরীক্ষাটা ঠিকমতো দেওয়ার জন্য।

মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরনোর আগেই একদিন সার্থকদার ফোন, এবার পাকাপাকি ভাবে কলকাতাতে চলে এসো।

শ্রীতমা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, কেন, কী হল আবার?

কেন আবার কি! তুমি ফিলমের হিরোইন হচ্ছো। আমাদের হাউস থেকে একটা ফিলম প্রোডিউস করছি। আর সেটাতে তোমাকে ছাড়া আর কাকে নিই বলো? তোমার অপোজিটে টলিউডের হট হিরো কাজ করবে। নামটা বলছি না। ওটা এখন সারপ্রাইজ হিসাবেই থাক।

শ্রীতমা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সামনে থাকলে হয়তো সার্থককে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিত। ফোনেই থ্যাংক ইউ সো মাচ বলে একটা চুমু ছুড়ে দেয়।

সে এবার টলিউডের নায়িকা হবে। যে টলিউডে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, সন্ধ্যা রায়, মহুয়া রায় চৌধুরী, ঋতুপর্ণা, শতাব্দী, ইন্দ্রাণী, এই সময়ে মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তী, শুভশ্রী কাজ করছে, সেই টলিউডে তার নামটাও নায়িকা হিসাবে যুক্ত হয়ে যাবে। উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রীতমা ঘরময় নেচে বেড়ায়। সার্থকদার কাছে সে চিরঋণী হয়ে গেল।

সত্যিই এখন আর দুর্গাপুর থেকে যাওয়া আসা করে কাজ করা যাবে না। মডেলিং শুট-এর সময় এক দুদিনের কাজ থাকত। কোনও ভাবে ম্যানেজ হয়ে যেত। সিনেমা, সিরিয়ালে তো তা সম্ভব নয়। কখন কল টাইম দেবে কে জানে। কলকাতায় সেটেল করার কথা শুনেই মা ঝামেলা করতে শুরু করেছে, এবার একেবারে গোল্লায় যাবে, বিয়ে টিয়ে আর হবে না।

শ্রীতমাও থামে না, না হোক বিয়ে তাই বলে তো সে তার কেরিয়ার নষ্ট করবে না। এমন সুযোগ কজন পায়?

চেনাজানা ব্রোকারের মাধ্যমে সার্থক-ই ফ্ল্যাটটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আর অ্যাডভান্স রেন্ট পেমেন্টটাও। ডেবিউ ফিলম হলেও ভালোই পেমেন্ট করেছিল সার্থকদা। হয়তো তাকে বিশেষ পছন্দ করত বলেই।

ফিলমের অফারটা পেয়ে যেন স্বপ্নের দুনিয়াটা শ্রীতমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বেশ কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে দিয়ে কাটল। মহরত থেকে শুরু করে শুটিং এর প্রতিটা দিন, বিদেশে গানের শুটিং, প্রিমিয়ার শো, প্রেস মিট অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে দিল শ্রীতমাকে। বাস্তব যেন পিছনে ফেলে আসা অতীত। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন গ্ল্যামারের জগত্টাই এখন আসল শ্রীতমার কাছে।

প্রথম ছবির ঘোরটা কাটতে না কাটতে দ্বিতীয় ছবির অফারটা পেয়ে গেল প্রভাসদার রেফারেন্সে। প্রথম ছবির ডিওপি প্রভাসদার সঙ্গে শ্রীতমার সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল মরিশাসে।  গানের শুট করতে গিয়ে সার্থকদার অনুপস্থিতে তখন প্রভাসদাই শ্রীতমার ফ্রেন্ড, ফিলজফার, গাইড।

কীভাবে লাইট নিলে, কেমন লুক দিলে ফিলমে তাকে আরও সুন্দর দেখাবে, আলাদা করে সে সব টিপ্স দিত প্রভাসদা। আর নিজের হাতে ক্যামেরার কারসাজি তো করতই। ভবিষ্যতে কীভাবে ক্যারেক্টার বুঝে ফিলম সাইন করবে, সে সব অ্যাডভাইস দিত। এত কিছুর পর কিছু প্রত্যাশা তো থেকেই যায়! ইউনিটের লোকের মুখে রং মাখানো গসিপ হয়তো সার্থকের কানেও পৌঁছেছিল।

প্রভাসদার রেফারেন্সে অন্য হাউসের ফিলমে কাজ শুরু করার পর থেকে সার্থকদা শ্রীতমার ফোন ধরাই বন্ধ করে দিল। শ্রীতমা অফিসে দেখা করতে গেলেও দেখা করেনি। মিটিং-এ বিজি আছে বলে অ্যাভয়েড করেছে। রিসেপসনিস্টকে দিয়ে সে রকমই বলেছিল। এসব হওয়ার পর থেকে শ্রীতমার মনটাও কয়েকদিন বেশ খারাপ ছিল। নতুন লোকজনের সঙ্গে নতুন কাজ শুরু করার পর থেকে মনটাও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

শ্রীতমা শিখে গিয়েছে ফিলম ইন্ডাস্ট্রিতে সম্পর্ক ভাঙা-গড়ায় মনখারাপ করতে নেই। কিন্তু হঠাৎ করে শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সব দিক থেকে মুশকিল হয়ে গিয়েছে। সবে মাত্র একটা ফিলম রিলিজ করেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে সে রকম চেনাজানা পরিচিতি হয়ে ওঠেনি এখনও, যে ডেকে ডেকে কাজ দেবে। এখনও ফ্রেশ ফেস বা স্ট্রাগলিং অ্যাক্ট্রেস বলা যায়।

জমানো টাকা খরচ করতে করতে প্রায় শেষ। শুধু তো নিজের খরচা নয়, বাড়ির জন্যও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। ভাইটা কলেজে পড়ছে তার পড়াশুনার খরচও আছে। ফিলমের শুটিং শুরু হয়নি। এখন শুধু মডেল শুট, ওয়েব সিরিজ আর সিরিয়ালের শুটিং হচ্ছে। তাও অনেক বাধা নিষেধ মেনে।

শ্রীতমার পরিচিত ইন্ডাস্ট্রির মেয়েরা, যারা বিভিন্ন ছোটোখাটো প্রোজেক্টে কাজ করত, অ্যালবাম, শর্ট ফিলম-এ অ্যাক্টিং করত, তাদের অনেকেই আজকাল ওয়েব সিরিজের কাজ করছে শুনেছে। ভালো পেমেন্ট কিন্তু ওয়েব সিরিজগুলোর সবই প্রায় অ্যাডাল্ট কন্টেন্টে ভরপুর।

হাজার লোকের সামনে নিজের নগ্ন শরীর দেখিয়ে উপার্জনে তার ঘোর আপত্তি। আর বাড়ির লোকজন সে এমন কিছু করছে জানতে পারলে একেবারে অনর্থ হয়ে যাবে! এমনিতেই দুর্গাপুর ছেড়ে যখন থেকে কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে, তখন থেকেই বাড়ির সঙ্গে ঝামেলা। শ্রীতমা বোঝাতে পারে না ফিলমের কাজ আসা-যাওয়া করে হয় না, কলকাতায় একটা থাকার জায়গার দরকার।

এই সময় কিছু অ্যাডের কাজ বা মডেল শুট-এর কাজ পেলে ভালো হতো। কিন্তু সার্থকদার সঙ্গে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অ্যাড বা মডেলিং-এর কাজ সে তেমন আর পায়নি। সব জায়গাতেই তো সেটিং আর কমপ্রোমাইজের গল্প। ফিলমে লিড রোল করার পর একদম ছোটোখাটো অ্যাডে কাজ করাটা ঠিক হবে না। তার স্ট্যাটাসে সেটা মানাবে না। বড়ো কোনও ব্র‌্যান্ডের অ্যাড হলে ঠিক আছে। কিন্তু সেরকম যোগাযোগ এখনও হয়নি।

প্রভাসদা বলেছে এমএনসি কোম্পানির একটা নামি ব্র‌্যান্ডের অ্যাড করার কথা চলছে। সেটা হলে শ্রীতমাকে সেখানে প্লেস করবে। বিগ বাজেট, ভালো পেমেন্ট পাবে। সেও কবে হবে কে জানে! কিছু তো একটা করতে হবে। না হলে চলবে কী করে। আজকের অডিশনের খবরটা পেয়েছে পরিচিত এক প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদার কাছ থেকে।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় নটা বেজে গেল। তাড়াহুড়ো করে পৌঁছে দেখে বিভিন্ন বয়সের অনেক ছেলে মেয়ের ভিড়। শ’খানেক তো হবেই। বড়ো প্রোডাকশন হাউস, অফিসটাও বড়ো। বিভিন্ন চ্যানেলে এদের অনেকগুলো সিরিয়াল চলছে। বাংলার এক নম্বর পপুলার চ্যানেলে নতুন একটা পিরিয়ড ড্রামা শুরু হচ্ছে তার জন্য অডিশন। অনেকগুলো ফিমেল ক্যারেক্টারের প্রয়োজন। পনেরো-কুড়িটা তো লিড ক্যারেক্টারই আছে। শ্রীতমা নাম রেজিস্টার করিয়ে অপেক্ষা করে।

প্রভাসের ফোন ঢোকে, হ্যালো, কোথায় আছো? কী করছ? মেসেজেরও রিপ্লাই দিলে না!

পরে ফোন করছি, বলে শ্রীতমা ফোন কেটে দেয়। শ্রীতমা জানে এই কেয়ারিং-এর আড়ালে আসলে নজরদারি করছে প্রভাসদা। ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি ওকে। শুনে হয় নানান নেগেটিভ কথা বলত, নয়তো সঙ্গে চলে আসত। কাজের জায়গায় লেজুড় নিয়ে ঘোরা একদমই পছন্দ নয় শ্রীতমার।

এখানে আসা মেয়েদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশিরভাগই শহরতলীর কোনও না কোনও জায়গা থেকে এসেছে। সঙ্গে মা বা অন্য কোনও অভিভাবক। চেহারা পোশাকআশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সকলেই প্রায় মধ্যবিত্ত ঘরেরই মেয়ে, শুরুর দিনের তারই মতো। সে যেমন কিছু ইনকাম করে সংসারে সাহায্য করবে বলে মডেলিং-এর পথ বেয়ে অভিনয় জগতে ঢুকে পড়েছিল। হয়তো এদের অনেকেই সে রকম পরিস্থিতির মধ্যেই বড়ো বড়ো স্বপ্ন সাজিয়ে এসেছে আজকের অডিশনে। আজকের পর এদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো ভবিষ্যৎ জীবন বদলে যাবে। আবার অনেকেরই স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। হয়তো এই অডিশনের গণ্ডি পার হতে মেনে নেবে অনেক কিছু।

যার কাছে শ্রীতমা অডিশনের জন্য নাম লেখাল সে তাকে চিনতে পারেনি। মনে মনে একটু অভিমান-ই হয় তার। তার একটা ফিলম রিলিজ হয়েছে। শহর জুড়ে হোর্ডিং পড়েছিল তবুও…। শ্রীতমা একপাশে সরে এসে বসার জন্য সাজিয়ে রাখা একটা চেয়ার টেনে বসে।

এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছে, ভিতরে ঢুকে অডিশন দিয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রত্যেকের ভিন্ন অভিব্যক্তি চোখ মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। কেউ ঘেমে নেয়ে অস্থির। ঘটনার আকস্মিকতায় কারও মুখে কালো মেঘের ছায়া। কেউ বা ফিরছে দুষ্টু হাসি মেখে শরীরী ভঙ্গিতে হরিণী চপলতা নিয়ে। উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে পোশাকে প্রসাধনে শ্রীতমাই শ্রেষ্ঠ বলা যেতে পারে।

অপেক্ষায় থাকা মেয়েদের অনেকেই ঘুরে ফিরে শ্রীতমাকে দেখছে। ওরা ওর সাজ পোশাক, ওর সৌন্দর্য দেখছে নাকি ওদের মধ্যে কেউ কেউ ওকে রিকগনাইজ করতে পেরেছে লাভ মি ফিলমের নায়িকা হিসাবে। একটু প্রাউড ফিল করে।

শ্রীতমা নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার জন্য মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি শুরু করে। ফেসবুক পেজ ঘুরে ফিরে দেখে অস্থির সময়টুকু কাটানোর জন্য। ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। কেমন যেন সাফোকেটেড লাগছে শ্রীতমার। নিজেকে ভ্যালুলেস, ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো ফিলমের হিরোইন। সিরিয়ালের একটা ক্যারেক্টার পাওয়ার জন্য এভাবে এতক্ষণ বসে থাকতে হবে! ভাবে প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদাকে ফোন করে একটু ঝাড় দেবে, এ কোথায় আসতে বললে? এখানে তো দেখছি গরু ছাগল সব সমান। আলাদা কোনও ট্রিটমেন্টই নেই। আগে জানলে আসতাম না। আবার পরক্ষণেই ভাবে, রাজুদার কি আর দোষ। হেল্পিং মাইন্ড নিয়ে তো খবরটা দিয়েছে।

শ্রীতমা ভাবে এত এত মেয়ের এত কাজের অভাব! এত অর্থের অভাব, তবেই না! হলগুলো খোলা থাকলে সে সিরিয়ালে নাম না লিখিয়ে আবার মঞ্চের নাটকে ফিরে যেত। কিন্তু সমস্যাটা তো সেই অর্থের। অর্থের জন্যই আজ মেয়েগুলো ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের নামে সফট পর্ন করছে। হয়তো পর্দায় যা দেখানো হচ্ছে পর্দার পিছনে করতে হচ্ছে তার থেকেও বেশি।

অনেকটা সময় অভিনয় অভিনয় করে কাটিয়ে দেওয়ার পর এখন আর ফেরবার জায়গা নেই। মনে প্রাণে বাঁধা পড়ে গিয়েছে এখানে। শুধু বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরা। অভিনয়ের জায়গাটা দিন দিন ছোটো হয়ে আসছে। শরীর প্রদর্শনই এখন মুখ্য অভিনয়। সরকারই তো ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এমন সব কনটেন্ট সকলের হাতের মধ্যে পৌঁছে দিতে। পছন্দ মতো অ্যাপ ডাউনলোড করে সাবস্ক্রাইব করো। তারপর মোবাইলে হাত ছোঁয়ালেই কত না ওয়েব সিরিজ, শর্ট ফিলম। গুলে যাও ঘোলা দুনিয়ায়!

বসে বসে উলটোপালটা ভাবতে ভাবতে শ্রীতমা শুনতে পেল তার নাম ডাকছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে সপ্রতিভ ভাবে এগিয়ে রিসেপসনিস্ট-এর সামনে যেতে, সে দেখিয়ে দিল কোন ঘরে যেতে হবে। পারমিশন নিয়ে শ্রীতমা অডিশন রুমে ঢোকে। সুন্দর করে সাজানো অফিসরুমের একটা ওয়ালে লাগানো ডিসপ্লে বোর্ডে এদের হাউসের পপুলার সিরিয়ালগুলোর বিভিন্ন ফোটো লাগানো আছে। ফলস সিলিং-এ লাগানো ডিজাইনার এলইডি লাইটগুলো ঘরের মধ্যে একটা মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এ পরিবেশ যেন সম্মোহিত করার জন্য।

বড়ো এগজিকিউটিভ টেবিলের ও পাশে কাঁচাপাকা চুলের সুদর্শন যে-ভদ্রলোক বসে, উনি দেবাদিত্য বোস। সিরিয়ালের নামি পরিচালক। টেবিলের পাশে বসা অন্য জন হাউসের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার।

শ্রীতমাকে ওরা বসতে বলে। ঘরে ঢোকা থেকে বসা পর্যন্ত ওদের নজর শ্রীতমার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী কী করেছে, এখন কী করছে রুটিন প্রশ্ন করে। নানা রকম হ্যাজানো প্রশ্ন কথাবার্তা শুরু করে। শ্রীতমা ভাবে নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে ওকে, তাই এতটা সময় নিচ্ছে।

মাথা গরম করা প্রশ্নটা হঠাৎ উড়ে আসে।

আর ইউ ভার্জিন?

শ্রীতমা নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের সব রক্ত মাথায় চড়ে ধাক্কা দিচ্ছে। বার্স্ট করে শ্রীতমা…হাউ ডেয়ার ইউ আস্ক মি সাচ রাবিশ?

ওরা থতমতো খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। শ্রীতমার চিৎকার বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে।

শ্রীতমা আরও রেগে টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে, চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়, নো। আই অ্যাম নট দ্যাট। আই অ্যাম নট ভার্জিন।

প্রোডাকশন কন্ট্রোলার কোনও মতে বলে সরি, আপনাকে সিলেক্ট করতে পারলাম না।

ইয়োর সিলেকশন! মাই ফুট। সজোরে দরজা খুলে গট গট করে বেরিয়ে যায় শ্রীতমা। অডিশন রুমের দরজাটা নিস্তব্ধতা ভেঙে সশব্দে বন্ধ হয়। শ্রীতমার সদর্পে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাইরে উপস্থিত সকলে।

বাড়ি ফিরে হাতব্যাগ, জুতো, জামা এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোফায় হতাশ শরীর এলিয়ে দেয় শ্রীতমা। সকালে লাভ মেসেজ করা সেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন কল আসছে। শ্রীতমা ফোন ধরে খিঁচিয়ে ওঠে, কে রে বো…দা সকাল থেকে ডিস্টার্ব করছিস?

সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। আমি সূর্য‌। পরশু সিঙ্গাপুর ফিরে যাচ্ছি। তার আগে কি একবার দেখা করা যায়?

শ্রীতমা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। এর মধ্যে প্রভাসদার ফোন ঢুকছে।

শ্রীতমা রিকল করতে থাকে প্রথম কবে সে ভার্জিনিটি লুজ করেছিল কার সঙ্গে! তারপর… তারপর…

সে কি সূর্য‌কে, প্রভাসদাকে বলে দেবে, আই অ্যাম নট ভার্জিন। তারপরেও কি প্রভাসদা তাকে কাজ খুঁজে দেবে! আগের মতো গাইড করবে? তার পরেও কি সূর্য‌ তাকে বলবে, বেবি আই লাভ ইউ?

শ্রীতমা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। কে জানে অন্য প্রান্তে সূর্য‌ বা প্রভাসদা উত্তরের অপেক্ষায় এখনও লাইনে আছে কিনা!

ক্যানভাস

দুচোখের পাতা অর্ধেক খুলতে না খুলতেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল সাত সকালের সোনালি রোদের ছটা। বিছানার পাশের জানলার ভারী পর্দাগুলো সরানো। এ নিশ্চয়ই অয়নের কাজ। এত বারণ করি তবুও শুনবে না। আমাকে বিরক্ত করে যে ও কী আনন্দ পায় কে জানে! এত রাগারাগি, চ্যাঁচামেচি কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না। সবসময় ওই এক ভালোমানুষের ভাবমূর্তি, অসহ্য!

ওকে যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। কী ধাতুতে গড়া! কম তো অত্যাচার করি না। বিয়ের আগেই জানিয়েছিলাম আমার আর রূপমের খোলামেলা সম্পর্কের কথা। যাতে ও এই বিয়েতে রাজি না হয়। কিন্তু কোথায় কী! আমার কোনও কথারই কোনও ফল হয়নি। তিন মাস হয়ে গেল বিয়ে, এখনও ওকে ছুঁতে পর্যন্ত দিইনি আমার শরীর। তবুও সে একই রকম নিরুত্তাপ! আমার মেজাজ, অহেতুক ঝগড়াঝাঁটি, জিনিসপত্র ভাঙা সব সহ্য করছে নিঃশব্দে।

বাবা যেদিন আমার বিয়ের ভাবনার কথা প্রথম বলেছিল পিকলুদাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব করেছিল তার শান্তশিষ্ট সহকর্মী অয়নের নাম। সব দেখে শুনে বাবা-মা একবারে রাজি হয়ে যায়। আমার আপত্তির পরোয়া কেউ করেনি। রূপমও তখন ছিল না আমার কাছে। দিন কাটাচ্ছিল কলকাতার কোনও এক রিহ্যাবে।

সন্ধে নামলেই অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে থাকি আজকাল। আকাশের অগুনতি তারাদের ভিড়ে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। আজও বেতের হেলানো চেয়ারটায় বসে একমনে ভাবছিলাম রূপমের কথা। আজ প্রায় ছমাস হতে চলল, দেখা হয়নি আমাদের। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানি না আমি।

কী করছিস এখানে? তারা গুনছিস? পেছন থেকে চুপি চুপি বলল ঝুম্পাদি, আমার পিসতুতো দিদি।

আরে, তুমি কখন এলে? পিকলুদা আসেনি?

এসেছে। ওই তো ড্রযিংরুমে আছে অয়নের সঙ্গে। কিন্তু গুনগুন একি চেহারা হয়েছে তোর? ফ্যাকাশে চোখমুখ, এলোমেলো চুল!

ধুস! ছাড়ো তো। সাজগোজটা কোনও কালেই আমার দ্বারা ঠিক হয় না।

সে আমি জানি। তাই বলে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো হয়ে থাকবি। অয়ন কী ভাবে বলতো? আহত স্বরে বললাম, অয়ন কী ভাবে! আচ্ছা, আমার ভাবনার পরোয়া কেউ কখনও করেছে ঝুম্পাদি? তোমরা তো জানতে যে রূপমকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তবুও জোর করে, রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে বাড়ির সকলে মিলে আমাকে ঝুলিয়ে দিলে অয়ন পুরকায়স্থ নামক এক নিপাট ভদ্রলোকের গলায়!

তুই একটা আস্ত পাগল রে গুনগুন! এখনও ওই বদমেজাজি, নেশাখোর ছেলেটার কথা ভাবছিস? নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, আর অয়নকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

তোমরা জানো না, রিহ্যাবে যাবার আগে রূপমকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ওর জন্যে অপেক্ষা করব। কথা না রাখতে পারার জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছি আমি প্রতিটা দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে। আমার জীবনে আর কোনও রং অবশিষ্ট নেই গো ঝুম্পাদি। স্রেফ পড়ে আছি একটা ফাঁকা ক্যানভাসের মতো।

আমার সামনে এসে দাঁড়াল ঝুম্পাদি। বলল, এখন কথা খেলাপির জন্যে কষ্ট পাচ্ছিস আর রূপমকে বিয়ে করলে অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতিই রে বোকা মেয়ে।

 

( ২ )

ড্রাইভিং সিটে বসে আছে পিকলুদা। পাশে অয়ন। পেছনে আমি আর ঝুম্পাদি।

জায়গার নামটা যেন কী?

ওই তো শামুকতলা থেকে কিছুটা দূরে। গ্রামের নাম একটা বলেছিল বটে রঞ্জন কিন্তু সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের পৈতৃক বাড়ি ওখানে। ঝুম্পাদির প্রশ্নের উত্তরে বলল পিকলুদা।

দেখেছিস এই একজন মানুষ! কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি ঠিক মতো না জেনেই রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি। বলি জায়গাটার নামটা তো শুনবে খেয়াল করে। তাহলে গুগল ম্যাপে একটু সার্চ করে দেখতাম। গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বলে উঠল ঝুম্পাদি।

পিকলুদাও দমবার পাত্র নয়। আরে রাখো তো তোমার গুগল ম্যাপ-ট্যাপ। বিরাট টেক স্যাভি হয়েছে আজকাল! শামুকতলা বাজারে পৌঁছে ফোন করতে বলেছে রঞ্জন। ওখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ও। তারপর নিয়ে যাবে গন্তব্যে। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কলকাতায় রেখে অনেকদিন বাদে দেশের বাড়িতে এসেছে রঞ্জন, আমার ইউনিভার্সিটির রুমমেট। সেদিন ফোনে আমন্ত্রণ জানাল ওদের গ্রামের বাড়িতে দু-একটা দিন সপরিবারে কাটিয়ে যাবার। এই উইক-এন্ডে তিনদিন পরপর ছুটি আছে। তাই লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কম খরচে ছোটোখাটো একটা আউটিং হয়ে যাবে। ঠিক কিনা বল, গুনগুন?

জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে পিকলুদার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। ঝুম্পাদিরা নিঃসন্তান। তাই ঘোরাফেরা, হইচই করেই চেষ্টা করে নিজেদের জীবনের শূন্যতাটাকে ভরিয়ে রাখতে। আজকাল ওদের সঙ্গী হয়েছি আমি আর অয়ন। আমাদের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা অন্ধকার নদীটাকে আলোয় ভরাতে চায় ওরা।

 

( ৩ )

একটু দূরেই ভুটান পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নাম না জানা পাহাড়ি ঝোরা। ধারে কাছে ঘরবাড়ি বিশেষ নেই। নৈঃশব্দের ভিড়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটা। চারপাশে কত রকমের ফুলের গাছ। নিকোনো উঠোন। গ্রামের বাড়ি হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রুচির ছাপ স্পষ্ট।

সন্ধের মুখে দোতলার ঘরে চলছিল গল্পগুজব। রঞ্জনদা দামি স্কচের বোতল খুলে বসেছেন। ওঁকে সঙ্গ দিচ্ছে পিকলুদা আর অয়ন। রাঁধুনি সোমরাজ প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে কুচো চিংড়ির পকোড়া আর ফ্রায়েড কাজু। কফির কাপ হাতে আমি আর ঝুম্পাদি নির্বাক দর্শক। কথায় কথায় রঞ্জনদা বলছিলেন অকৃতদার বিরাজকাকু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওনার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন, তাই বহুদিন ওনারা গ্রামছাড়া। পনেরো বছর আগে হঠাৎ বিরাজকাকু ফিরে আসে এখানে। বাবা গত হয়েছেন। মা অথর্ব। অকূল সমুদ্রে খাবি খাচ্ছি একলা আমি। বিরাজকাকুকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। সব দাযিত্ব ওঁর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেলাম কলকাতা, রুজিরুটির টানে। বিরাজকাকু না থাকলে সব সাত ভূতে খেত এতদিনে। শিল্পী মানুষ তো, তাই খুব শৌখিন। যত্ন করে আগলে রেখেছে আমার পৈত্রিক ভিটেমাটি, জমিজিরেত।

রঞ্জনদার একটু টিপসি লাগতে শুরু করেছে সবে। মাঝে মাঝেই বাঁক বদলাচ্ছে কথার স্রোত। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একমাথা কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক।

আরে বিরাজকাকু আসুন আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তাঁকে দেখে বলে উঠল পিকলুদা।

অয়ন-এর সঙ্গে তো পরিচয় হয়েছে। এই আমার মিসেস ঝুম্পা আর ওটি আমার শ্যালিকা গুনগুন।

আমার দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক কেমন যেন চমকে উঠলেন। অবাক চোখে দেখছিলেন আমাকে। সেই দৃষ্টিতে যে কী ছিল বলে বোঝানো যাবে না। রাগ? দুঃখ? ভয়? আনন্দ? নাকি অন্য কিছু? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার! ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অয়নকে বললাম আচ্ছা বিরাজকাকু ওভাবে কেন দেখছিলেন আমাকে?

কী জানি! রঞ্জনদা বলছিলেন উনি একটু আপনভোলা গোছের মানুষ।

আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ওঁর চোখ দুটো মনে পড়লেই কাঁটা দিচ্ছে গায়ে কে জানে আবার মাথাটাথা খারাপ কী না? এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় একা থাকেন। বেশ সন্দেহ হচ্ছে।

একটা অভয় দেবার হাসি হেসে অয়ন বলল অত ভেবো না। আমি, মানে আমরা সকলে আছি তো। কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। মোটা চাদরটা আমার গায়ে টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল অয়ন।

 

( ৪ )

ঘুমের ওষুধ ছাড়া আজকাল ঘুম আসে না সহজে। কিন্তু কাল রাতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ওষুধ খাবার কথাটা। তবুও অনেকদিন পর নিখাদ শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি আমি। হয়তো এই শান্ত পরিবেশে এসে অস্থির মনটাও বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা অয়নের দিকে। শিশুর মতো সারল্য ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।

ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। হালকা মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সূর্য। সকাল সকাল বৃষ্টিস্নান সেরে আরও বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে গাছগাছালি। কখনও কখনও মেঘছেঁড়া রোদ এসে পড়ছে তাদের গায়ে। ভেজা শরীরে রোদের আদর মেখে ঝিকমিক করে উঠছে বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলো। পরক্ষণেই কোথা থেকে এক টুকরো মেঘ এসে বিষাদের পর্দা টেনে দিচ্ছে সেই সোহাগি আলোর প্রবাহপথে।

রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে একটা ঘরের কাছে এসে থেমে গেল পা দুটো। দরজাটা হাট করে খোলা। জানলা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে একটা ক্যানভাসের ওপর। দেখি হাতে রঙের প্যালেট আর পয়েন্টেড তুলি নিয়ে বিরাজকাকু একমনে তাকিয়ে আছেন ফাঁকা ক্যানভাসটার দিকে। শুনেছিলাম সব শিল্পীর কাছেই তাঁর সৃষ্টি নিছক কাজ নয়, সাধনা। হয়তো বিরাজকাকু সে রকমই কোনও সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন। মনে মনে সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন কিছু। একটু পরেই যা তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠবে এই শূন্য ক্যানভাসের ওপর। পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন বিরাজকাকু। সেই একই রকম দুর্বোধ্য চাহনি।

 

আলিপুরদুয়ার জেলার এই অঞ্চলে অনেক জনজাতির মানুষের বাস। এদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন একটা সময়। তাই গ্রামের মাঝে তৈরি হয়েছে একটা বড়োসড়ো প্রটেস্টান্ট গির্জা। দুপুর দুপুর চার্চ, সিমেট্রি ঘুরে আমরা সবে ফিরেছি। এমন সময় সোমরাজ এসে বলল কাকাবাবু সেই সকাল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া কিছুই করেননি। আপনারা একবার ডাকবেন? শরীরটরির ঠিক আছে কিনা দেখবেন একটু?

সেকি! বিরাজকাকু তো কখনও এমন করেন না। শঙ্কিত গালায় বললেন রঞ্জনদা।

বিস্তর হাঁকডাকের পর অবশেষে খুলল দরজা। এদিক ওদিক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে দেখে বিরাজকাকুর চোখ স্থির হল আমার চোখের দিকে। একটা অস্বস্তি ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে। একটু একটু করে আমার কাছে এগিয়ে আসছিলেন বিরাজকাকু। বাড়তে থাকা হৃদকম্পটা টের পাচ্ছিলাম ভালো ভাবে। নিজের অজান্তেই কখন যেন শক্ত করে ধরে ফেলেছি আমার পাশে দাঁড়ানো অয়নের হাতটা।

কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? সেই যে আমাকে ম্যারেজ রেজিস্ট্যারের অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে বলেছিলে, মনে পড়ে? তুমি আর এলে না তো! কত খুঁজেছি তোমায়। বন্ধু, পড়শিরা বলল, তোমার বাড়ির লোকেরা নাকি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে বিয়ে হবে তোমার। সত্যিই হয়েছিল? জানো, সব ছেড়ে এসেছি আমি। সেই শহর, পুরোনো রাস্তা, গলি, চৌমাথা যা কিছু তোমার কথা মনে করাত, স…ব।

খড়খড়ে গলায় বলা কথাগুলো শুনে আমার সারা শরীরটা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমার সামনে বিরাজকাকু নয় রূপম দাঁড়িয়ে আছে। আজ যদি সে ফিরে আসে তবে এভাবেই অভিযোগের তিরে বিদ্ধ করবে আমাকে। কাঁপুনিটা যত বাড়ছিল, তত শক্ত করে ধরছিলাম অয়নের হাতটা। সকলেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিহ্বল ভাবে কথা বলছেন শুধু বিরাজকাকু, তুমি প্রায়ই অভিযোগ করতে আমি কত কিছু আঁকি কিন্তু কখনও তোমার ছবি আঁকি না। বিশ্বাস করো, তুমি চলে যাবার পর আমি আর অন্য কিছু আঁকতে পারিনি। রং তুলির আঁচড়ে শুধু ধরে রাখতে চেয়েছি তোমাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার। দিনের পর দিন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে। এতদিন ধরে যে-ব্যর্থতার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তার থেকে আজ হয়তো মুক্তি পাব আমি। সেই চোখ, সেই মায়াভরা দৃষ্টি… সব অতীত আমার সম্মুখে। আমি পারব এবার। দেখে নিও ঠিক পারব তোমার ছবি আঁকতে। এসো আরফিন, বসো এখানে।

রঞ্জনদা অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, ও আরফিন নয়, গুনগুন। অয়নের স্ত্রী।

বিরাজকাকু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তুই জানিস না রঞ্জন, ডিব্রুগড়ে আমাদের বাড়ির পাশে থাকত ওরা। আরফিন, আমার আরফিন।

আবার আরফিন! বললাম না ওর নাম…

জানি না হঠাৎ অয়নের কী হল। রঞ্জনদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ছেড়ে দিন রঞ্জনদা, এসব বুঝবেন না বিরাজকাকু। দেখছেন না একটা ঘোরের মধ্যে আছেন উনি, বন্দি হয়ে আছেন ভালোবাসার মায়াজালে। আরফিন এখনও ভীষণ ভাবে জীবন্ত ওনার অনুভবে। তাকে ফিরে পাবার ইচ্ছে এতটাই প্রবল যে বাদামি চোখ আর বড়ো বড়ো আঁখিপল্লবের গুনগুন ওনার কাছে ধরা দিচ্ছে আরফিন হিসেবে। সেদিনের আরফিন আর আজকের গুনগুনের মধ্যে যে পনেরোটা বছরের ফারাক, সে খেয়াল ওনার নেই। একটা ইলিউশনকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন উনি। আসুন না আমরা বাঁচতে দিই ওনাকে।

বিরাজকাকুর দিকে মুখ ফিরিয়ে অয়ন বলল, হ্যাঁ আরফিন, ও আপনারই আরফিন। আঁকুন বিরাজকাকু। ঘুমিয়ে থাকা শিল্পীমনকে জাগিয়ে তুলুন আবার। শূন্য ক্যানভাস ভরে উঠুক রঙে রঙে।

বিরাজকাকু মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছেন আমাকে। আর আমি, অয়নকে। কোথা থেকে একটা হালকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল আমাদের। ভেতরের কাঁপুনিটা থেমে গিয়েছে কখন যেন। অয়নের বাম হাতটা কিন্তু এখনও রয়েছে আমার ডান হাতের ভেতর, নির্বিকারে উষ্ণতা বিনিময় করছে তারা একে অপরের সঙ্গে।

 

অপত্য

অফিস ফেরত রোজই একবার করে থানায় ঘুরে আসে দেবেশ। আজ তিন মাস যাবৎ এই চলে আসছে। এই কয়েকদিনের ধকলেই আদ্যোপান্ত বুড়ো হয়ে গেছে মানুষটা। মাথায় এখন কাঁচার তুলনায় পাকারই আধিক্য। চোয়াল ভেঙে গালদুটো ভিতর দিকে ঢুকে গেছে। চোখের নীচে একরাশ কালি। দেখলেই বোঝা যায় বেশ কয়েকরাত ঠিক করে ঘুমোয়নি।

আজও রুটিনের বড়ো একটা হেরফের হয়নি। অফিস চলাকালীন ইন্সপেক্টর তপন সিকদারের ফোন পেয়ে কয়েকঘন্টা আগেই থানায় ছুটে গিয়েছিল দেবেশ। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারের ঘরের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, যে-খবরটা নিয়ে ফিরেছিল দেবেশ, তাতে তাকে আরও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

স্বামীর অপেক্ষাতেই বারান্দায় পায়চারি করছিল কাবেরী। তার নজর আটকে ছিল বাইরের মূল ফটকের দিকে। দেবেশকে ঢুকতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে দেয় সে। এক মিনিটও ব্যয় না করে প্রশ্ন করে বসে, ‘কোনও খবর পেলে?’ স্ত্রী-র কথার কোনও সদুত্তর দিতে পারে না দেবেশ। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চুপচাপ জুতোটা খুলে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। সামনে থাকা সোফাটার উপরে ব্যাগটা রেখে মাথা নীচু করে বসে পড়ে। সেই প্রশ্নটা আবার তিরের মতো কানে এসে বেঁধে। ‘বললে না তো, কোনও খবর পেলে?’

উত্তরটা হয়তো কাবেরীরও অজানা নয়, তবু মন যে মানে না। দেবেশের কাছেও যে কোনও উত্তর নেই। কী জবাব দেবে দেবেশ, স্ত্রী-র চোখের দিকে তাকাতে পারে না সে। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘না’। একটা অস্ফুট স্বর কানে আসে কাবেরীর। পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে থাকে সে। দীর্ঘ তিনমাস যাবৎ একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। পুলিশের অক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্নও তুলেছে। ক্রমশ নিরাশা যেন গ্রাস করে ফেলছে তাদের। তাদের যে আর কিছুই করার নেই। সাধ্য অনুযায়ী সবরকম চেষ্টা তো করল এতদিন। দিনরাত থানায় পড়ে থেকেছে। এদিক-সেদিক ছুটেছে। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব কম করেনি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছে। এখন সবই উপরওয়ালার হাতে।

সোফার পাশে কাবেরীকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কষ্ট যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায় দেবেশের। গলা শুকিয়ে আসে তার। খানিক স্বস্তি পেতে সামনের টি-টেবিলে ঢেকে রাখা জল ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সে। তারপর কাবেরীকে কাছে ডেকে বসিয়ে বলে, ‘আজকে অসীমবাবু আবার একটা নতুন খবর দিলেন।’

‘নতুন খবর!’ মুখে যেন একশো ওয়াটের বাল্ব জলে ওঠে কাবেরীর। কিন্তু সেই আলো আবার নিভেও যায়। মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করে। ভাবে, যে-কথাটা তারা কিছুতেই মন থেকে স্বীকার করতে পারছে না, তাহলে কী অবশেষে সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। মনটা কেমন যেন কু-গাইতে থাকে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন ভাবে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ঋকের বন্ধুরা পুলিশের মারের চাপে স্বীকার করেছে যে, তারা আমাদের ঋককে এ-পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলেছে।’ বলতে বলতে গলা কেঁপে ওঠে দেবেশের। জল চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণায়।

কথাটা শোনামাত্রই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে কাবেরী। থামানোর চেষ্টাও করে না দেবেশ। যদিও সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। মেয়েরা তো কেঁদে-কেটে খানিক হালকা হতে পারে, কিন্তু পুরুষরা তো সেটাও পারে না। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। মাথা নীচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে দেবেশ। সম্বিৎ ফেরে কাবেরীর গোঙানির শব্দে। তাড়াতাড়ি উঠে একগ্লাস জল বাড়িয়ে দেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘বডি পাওয়া যায়নি, তবে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে। ওটা দেখে তো সনাক্ত করা সম্ভব নয়।’

কাতরস্বরে কাবেরী বলে ওঠে, ‘তাহলে কী করে ওরা এত নিশ্চিত হচ্ছে যে, ও-ই আমাদের ঋক। এমনও তো হতে পারে ওটা অন্য কেউ। ওরা ভুল ভাবছে।’ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে কাবেরী।

‘হ্যাঁ, ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। সেই কারণেই তো ওরা ডিএনএ টেস্ট করে দেখতে চাইছে। কাল একবার থানায় গিয়ে ব্লাড স্যাম্পেল দিয়ে আসতে বলেছে।’

‘ব্লাড স্যাম্পল?’ কেমন যেন চমকে ওঠে কাবেরী। একমুহূর্তেই আতঙ্কের কালো মেঘ ছেয়ে যায় কাবেরীর চোখেমুখে।

‘ভয় পাচ্ছ কেন, এমনও তো হতে পারে তোমার ধারণাই ঠিক। ও আমাদের ঋক নয়।’

দেবেশের সান্ত্বনা কাজে আসে না। ছটফট করতে থাকে কাবেরী। দেবেশ ভাবে ছেলে হারানোর শোক একজন মা-কে অস্থির করে তুলেছে। কোনওরকমে শান্ত করে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয় কাবেরীকে। তারপর নিজে ড্রইং রুমে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিতেই বহু পুরোনো কথা মনের মধ্যে ভিড় করে আসে।

দেবেশের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ ভালো। সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা রিজার্ভ ব্যাংক-এ চাকরি করতেন। মা হাউজওয়াইফ হলেও যথেষ্ট কোয়ালিফায়েড। তখনকার দিনে এমএ পাশ করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুমাত্র সংসার আর বাচ্চাকে ভালোবেসে কেরিয়ারের কথা ভাবেননি। সংসার আর ছেলেকে নিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছেন। প্রভাব প্রতিপত্তি, বৈভবের মাঝে কখনও হারিয়ে ফেলেননি নিজেকে। ছেলেকেও ঠিক নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছেন। দেবেশ যখন বছর আঠাশের তখনই মারা যান দেবেশের বাবা। তখন সবে সবে রেলে-র চাকরিতে জয়েন করেছে দেবেশ। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছাত্র হিসাবে কলেজে নামডাক ছিল। চাকরিটাও পেয়ে যায় জীবনের প্রথম পরীক্ষাতে বসেই। সংসার বলতে মা আর ছেলে। ছেলে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর বড়ো একাকী বোধ করতেন দেবেশের মা। তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেশের বাবা তাঁর ছোটোবেলার বন্ধুর একমাত্র মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে একরকম পাকা করেই রেখেছিলেন। বাবার পছন্দ করা পাত্রী কাবেরী-র সাথেই বিয়ে হয়েছিল দেবেশের। অবশ্য দেবেশও যে বিয়ের আগে কাবেরীকে দেখেনি এমন নয়। একই কলেজে পড়াশোনা করেছে, বেশ কয়েকবার আলাদা করে কথাও বলেছে। বিয়ের আগে বার দুয়েক কলেজের বাইরে দেখাও করেছে তারা।

দেবেশের মা উমাদেবী ভেবেছিলেন বউমাকে একেবারে মেয়ের মতো করে রাখবেন। ঘুরবেন, ফিরবেন, গল্প করবেন। নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে সংসার করবেন। কিন্তু ভাবনা তো ভাবনাই। বাস্তবের সঙ্গে এর তফাত অনেকটা। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও দিনকতক পর উমাদেবী বুঝতে পারেন তাঁর আধুনিক মনস্ক বউমার মন সংসারের তুলনায় বাইরের দিকেই বেশি। সবসময় বন্ধুবান্ধব, পার্টি। সমাজসেবার নামে এখানে সেখানে বেরিয়ে পড়া।

উমাদেবী বউমার এই যখন-তখন বেরিয়ে পড়া, রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মাঝেমধ্যেই আপত্তি তুলতেন। এই নিয়ে শাশুড়ি-বউমার টুকটাক অশান্তিও লেগে থাকত। তবে এসব ব্যাপারে বড়ো একটা মাথা ঘামাত না দেবেশ। বরং তার ধারণা ছিল সংসারের চাপ পড়লে কাবেরী নিজে থেকেই ক্লাব, পার্টি এসমস্ত ছেড়ে দেবে। তখন বাচ্চার টানে নিজেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। কাজেই শুধু শুধু অশান্তি করে লাভ কী। এরকম তো অনেক মেয়েই ভাবে বাচ্চা নিলে তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে। আগের মতো আর আকর্ষণীয় থাকবে না। কিন্তু ক’টা মেয়ে এই ভাবনা-চিন্তায় অনড় থাকতে পারে। একবার মা হলে এসমস্ত তাদের আর খেয়ালই থাকে না।

কিন্তু কাবেরীর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। বিয়ের পাঁচ বছর পরে পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেও কাবেরীর স্বভাবে কিছুমাত্র রদবদল ঘটে না।

মাস তিনেক বাড়িতে থাকার পর শাশুড়ি আর আয়ার ভরসায় আবার আগের মতো ক্লাব, পার্টি করতে শুরু করে সে। বয়সের ভারে আয়ার সাহায্য নিতে হয়েছে ঠিকই তবে যতদিন উমাদেবী বেঁচেছিলেন ততদিন ঋক-কে উনিই সামলেছেন। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর কথা কে বলতে পারে, যখন ঋকের বছর দশ বয়স তখনই একদিন হঠাৎ করে বুকে ব্যথা। আধ ঘন্টাও সময় দেননি। ডাক্তার নিয়ে আসতে আসতেই সব শেষ। তার পর থেকেই ঋক বড়ো একা। কারও সাথে তেমনভাবে কথা বলে না। সারাক্ষণ হয় টিভি দেখে নয়তো বাচ্চাদের পত্রিকা হাতে বসে থাকে। সে যেন নিজের একটা আলাদা পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে কারওর অবাধ প্রবেশ নিষেধ। দেবেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে ছেলেকে খুশি করার, যার জন্যই ছেলের পছন্দের এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসে। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে ছেলের হোমওয়ার্ক করানো, তাকে খাওয়ানো, খেলা করা সবশেষে ঘুম পাড়ানো, সমস্তটাই নিজে হাতে করার চেষ্টা করত দেবেশ। কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকেই যেত। রাত দশটার পরে কখনও বা তারও পরে কিটি পার্টি সেরে ফিরত কাবেরী। তখন তার এমন হুঁশ থাকত না যে একমাত্র ছেলের ঘরে গিয়ে তার সাথে দুটো কথা বলে বা মমত্ব উজাড় করে দেয়। কখনও তো ঠিক করে এটা জানার চেষ্টা করেনি যে, তার নাড়ি ছেঁড়া সন্তান কীভাবে বড়ো হচ্ছে, তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, মায়ের জন্য তার মন কাঁদে কিনা। কোনওদিন কাছে ডেকে সুখ-দুঃখের কথাও যেমন বলেনি তেমনি আদর করে ছেলের পাশে বসে তাকে খাওয়ায়ওনি। মা-ছেলের মধ্যে সেই বন্ডিং-টাই কোনওদিন তৈরি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে মল থেকে চারটে দামিদামি জামাকাপড় এনে দিয়েই কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, কাজেই দূরত্ব তৈরি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

বছরের পর বছর চলে যায়। কিন্তু কাবেরীর মধ্যে কোনও পরিবর্তন আসে না। ঋকও এখন বছর সতেরোর। বারো ক্লাসের ছাত্র। তারও লাইফস্টাইলে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সে ও রাত করে বাড়ি ফিরতে শিখেছে। নজর এড়ায়নি দেবেশেরও। খেয়াল করে দেখেছে বাড়ি ফিরেই সে, সোজা নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে নেয়। হাজার ডাকাডাকি করলেও দরজা খোলে না। বিভিন্ন রকম টালবাহানা করে এড়িয়ে যায়। কখনও বলে শরীর ভালো নয়, কখনও খেতে ইচ্ছে করছে না বলে ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা কাটিয়ে দেয়। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। মনস্থির করে, এই নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলবে।

সেইমতো পরদিন সকালবেলা খাবার টেবিলে ছেলেকে পাকড়াও করে দেবেশ। ‘তুই রোজ রোজ দেরি করে বাড়ি ফিরছিস। অর্ধেক দিন বাড়িতে খাচ্ছিস না। ব্যাপারটা কী বলতো? অত রাত পর্যন্ত থাকিস কোথায়? পড়াশোনাটাই বা কেমন চলছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। সামনের বছর বোর্ড দিবি, মাথায় আছে সেটা?’

‘আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। স্কুলের পর পাপানদের বাড়িতে আমরা সবাই একসাথে পড়াশোনা করি। সেইজন্যই ফিরতে দেরি হয়।’

‘পাপান-টা কে? এর নাম তো আগে কখনও শুনিনি। থাকে কোথায়?’

‘তুমি কী সবাইকে চেনো নাকি। ও বাপ্পাদের বাড়ির কাছে থাকে।’

ঋকের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আর কথা বাড়ায় না দেবেশ। কিন্তু ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যে দেবেশ বুঝে গিয়েছিল ছেলে কোনও অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়েছে। মাঝে দু-দিন তো ঠিকভাবে হেঁটে চলে বাড়ি ফিরতে পারেনি। কোনও রকমে এদিক-ওদিক করতে করতে সোজা নিজের ঘরে। দেবেশের বারবার ডাকা সত্ত্বেও উত্তর করেনি ঋক। পরদিন সকাল পার হয়ে দুপুর গড়াতে তবে তার ঘুম ভেঙেছে।

চিন্তায় দেবেশের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে। এইভাবে চলতে থাকলে কেরিয়ার, ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে যাবে। একেবারে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে ছেলেটা। এই প্রসঙ্গে কাবেরীর সঙ্গেও কথা বলেছে দেবেশ। হালকা হওয়ার বদলে আশ্চর্যই হয়েছে। ‘এখন এনজয় করবে না তো কবে করবে, এই তো বয়স। তাছাড়া রোজ তো আর এমনটা করছে না। মাঝেমধ্যে এক-আধটা দিন হতেই পারে। এগুলো ধরলে কী চলে। খেলনা নিয়ে খেলার বয়স তো আর নেই। কাজেই এই বয়সে একটু অন্যরকম কিছু করার ইচ্ছে জাগবে সেটাই স্বাভাবিক। এই নিয়ে অযথা টেনশন নিও না।’

সত্যিই একেবারে অন্যরকম কিছুই করে দেখাল ঋক। দেবেশ তো দূর, কাবেরীও বোধহয় এরকমটা কখনও কল্পনা করেনি।

কোনওরকমে এইচএস পাশ করেছে ঋক, কিন্তু নাম্বার এতটাই কম পেয়েছে যে ভালো কোনও কলেজে ভর্তি করানোটাই বড়োরকমের সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এখন তো বাচ্চারা কম্পিটিশনের কারণে বিভিন্ন কোচিং ক্লাস নিয়ে আটানব্বই শতাংশ পর্যন্ত মার্কস তুলছে। নব্বই শতাংশ পেয়েও ভালো কলেজে অ্যাডমিশন পেতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সেখানে ঋকের নম্বর তো একেবারে চল্লিশ

শতাংশের কোটায়। দেবেশ নিজের সোর্স লাগিয়ে কোনওমতে একটা কলেজে অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা করিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভর্তি করলেই তো হবে না, পড়াশোনাটাও তো জরুরি। জোর করে তো কারওর উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ছেলে বড়ো হয়ে গেলে তার গায়ে হাত তোলাও সম্ভব নয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কত বুঝিয়েছে। ততদিনে ড্রাগস, মদে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে ঋক।

বাবা-মা যতরকম ভাবে ছেলেকে শোধরানোর চেষ্টা করে দেবেশ, কাবেরীও ঠিক ততটাই করেছিল। ঋক-এর নেশায় আসক্ত হওয়ার পর থেকে কাবেরীর মধ্যে অনেক চেঞ্জ এসেছে। এখন ক্লাব, পার্টির নামও মুখে আনে না। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। মুখে না বললেও মনে মনে নিজেকে দূষতে থাকে সে। ভাবে সে যদি সোশ্যালাইজ না করে আর পাঁচটা মায়ের মতো আদর-স্নেহে লালনপালন করত ছেলেকে, সবসময় তার পাশেপাশে থাকত– তাহলে বোধহয় ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।

একাধিক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে। এমনকী প্রয়োজনে রি-হ্যাব সেন্টারের কথাও ভেবেছে তারা। এতে ফল আরও উলটোই হয়েছে। রি-হ্যাবের নাম শুনে বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে ঋক। রাতের পর রাত বন্ধুদের সঙ্গে তাদের ভাড়া করা বাসায় পড়ে থেকেছে। তারাও ঋকের মতো ড্রাগ অ্যাডিকটেড। পড়াশোনার নামে বাড়ির থেকে দূরে থাকে। আর এই সমস্ত করে বেড়ায়। অথচ বাবা-মায়েরা এই ভেবে বুকের উপর পাথর চেপে রাখে যে, তাদের বাচ্চারা পড়াশোনা করে নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করছে।

দেবেশের হাতে আর কিছুই ছিল না। কাবেরীর অবস্থা তো আরও করুণ। আপশোশ করা ছাড়া আর কোনও পথ দেখছিল না সেও। কতদিন এমন হয়েছে ছেলেকে খুঁজতে, এই ক্লাব, সেই ক্লাব, এই বন্ধুর বাড়ি, সেই বন্ধুর বাড়ি করে বেড়িয়েছে। কখনও ছেলেকে বেহুঁশ অবস্থায় নিয়ে ফিরেছে। আবার কখনও নিরাশ হয়ে ফিরেছে খালি হাতে। এমনও দিন গেছে খাটের মধ্যে বেহুঁশ ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখে, ঘরের কোণায় বসে রাতের পর রাত কাটিয়েছে দুজনে। চোখের জল ফেলেছে। ঋকের এই বিপথে যাওয়ার আসল কারণটা কী, সেটা বিলক্ষণ জানত দেবেশ। সেই নিয়ে যে ক্ষোভও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু এখন আর সেই বিতর্কেও গিয়ে লাভ নেই। কোনও কিছুই আর কাজে আসবে না।

শেষমেশ ঠিক হল ঋককে জোর করেই রি-হ্যাব-এ পাঠানো হবে। সেইমতো সমস্ত কথাবার্তা পাকা করা হল। এর মাঝেই ঘটল এক বিপত্তি। হঠাৎ একদিন একটা নিউজ চ্যানেলে বারবার ঋকের সঙ্গে তার কয়েকজন বন্ধুকে আপত্তিকর অবস্থায় একটা ঘরে পড়ে থাকতে দেখাল। বেশ কয়েকজন একেবারে বিবস্ত্র। খবর করা হচ্ছে, শহরের স্বচ্ছল পরিবারের বেশ কয়েকটি বখে যাওয়া ড্রাগ অ্যাডিকটেড সমকামী ছেলেদের কুকীর্তি নিয়ে। একের পর এক ফোন। হাজারো প্রশ্ন। কী জবাব দেবে দেবেশ। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার উপক্রম হয়েছিল তাদের। কী করবে সে। ড্রাগ, মদের নেশা না হয় ছাড়াতে পারবে। কিন্তু তাই বলে সমকামীতা! এটা একজন বাবা-মায়ের কাছে মারাত্মক লজ্জার। এর আগেও নেশার কারণে ঋক যখন মায়ের বালা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিল, তখনও বোধহয় এতটা শক্ড হয়নি তারা, যতটা এখন। পরিস্থিতি যে কখন কাকে কোথায় নিয়ে ফেলে। তবু ছেলে তো। হাল তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঋকদের। সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে সোজা রি-হ্যাব। তারপর দীর্ঘদিন কাউন্সেলিং।

মাস ছয়েক পরে ঋক যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন একেবারে স্বাভাবিক। দেবেশ – কাবেরী কল্পনাই করতে পারেনি যে ঋক আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। টাইমে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা, বেড়ানো। ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিল তারা। মাস দেড়েক এভাবেই কেটে গেল।

একদিন সকালে সকলে মিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে, ঠিক সেই সময়ে ঋকের ফোনটা বেজে উঠল। সেই দিন বিকেলে ‘ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসব’ বলে সেই যে বাড়ির বাইরে বেরোল আর বাড়িমুখো হয়নি ছেলেটা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন, ক্লাব– কোনও হদিশ মেলেনি তার। নিরুপায় হয়ে থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করে এসেছিল দেবেশ। তারপর কেটে গেছে আরও তিনটে মাস। নিরন্তর মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়ে গেছে তারা।

প্রথমদিকে তো পুলিশ সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তারা ভেবেছিল ছোটো ছেলে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেলেই আবার বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ঋক-এর পাস্ট লাইফের ঘটনা শুনে দেবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও মনে হয়েছে এটা নিছক কোনও সাধারণ ঘটনা হতে পারে না, অন্য রহস্যের গন্ধ পায় তারাও। সেইমতো তারা তদন্ত করতে থাকে। ঋক-এর সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের থানায় ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

তারপর থেকে দেবেশ রোজই একবার করে থানায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসে। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদার কতবার বলেছেন এভাবে রোজ-রোজ থানায় না যেতে। কোনও খবর হলে উনি নিজেই ফোন করে ডেকে নেবেন। কিন্তু একজন বাবার মন কী আর সে-সব মানে। আশায় বুক বেঁধে রোজই ছুটে যায়।

আর আজ তো একেবারে ছেলের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত করে দিলেন জোয়ারদার সাহেব। ঋকের বন্ধুদের কথা অনুযায়ী দুর্ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কিছু অস্থি পেয়েছে। যেহেতু ঋকের বডি পাওয়া যায়নি, সেই কারণেই ডিএনএ টেস্ট জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই তাকে আর কাবেরীকে থানায় যেতে হবে, সেখান থেকে হাসপাতালে। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে দেবেশ। ঘুম ভাঙে সকালবেলা বংশী দুধওয়ালার বেলের আওয়াজে। কথামতো সকাল সকাল থানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে দেবেশ আর কাবেরী।

এর প্রায় একমাস পরে বেলা এগারোটা নাগাদ থানা থেকে বড়োবাবুর ফোন আসে। দেবেশ তখন অফিসের ফাইলে মুখ গুঁজে আছে। ‘ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্টটা চলে এসেছে। একবার থানায় চলে আসুন।’

‘রিপোর্টে কী আছে?’ উদ্বেগজনক ভাবে প্রশ্ন করে দেবেশ।

‘আপনি থানায় এলে তো সবই জানতে পারবেন।’ বেশ গম্ভীর শোনায় জোয়ারদারের গলা।

জোয়ারদারের ফোন পাওয়ামাত্রই ফাইল-টাইল ভুলে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিল দেবেশ। অফিস থেকে বেরোনোর আগেই কাবেরীকে সমস্তটা জানিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল সে। সেই মতো দুজনে হাজির হয়েছিল থানায়। কাবেরীর মধ্যে একটা অস্বস্তির ছাপ দেখা গেলেও আজ দেবেশ অনেক স্থিতধী। যেন সবকিছুর জন্যই সে প্রস্তুত।

থানার আর এক ইন্সপেক্টর দেবেশকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর কাবেরীকে সেইখানেই অপেক্ষা করতে বলে। দেবেশকে ভিতরের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারও উপস্থিত রয়েছেন। একটু অবাক হয় দেবেশ। তারপর ধীর কণ্ঠে বড়োবাবুকে জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে কী…?’ বলেই ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে।

দেবেশবাবুর মনের অবস্থা আঁচ করতে পারেন অসীম জোয়ারদার। তারপর বলতে শুরু করেন, ‘দেখুন দেবেশবাবু, আমাদেরও বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু সত্যিটা তো সামনে আনতেই হবে। ব্যাপারটা সত্যিই খুব সিরিয়াস, তাই আপনাকে জানানোটা জরুরি। ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী যে ব্যক্তির অস্থি পেয়েছিলাম, সেটা ঋকেরই।’

ক্ষণিকের একটা ঝটকা লাগলেও, বুকের উপর পাথর রেখে প্রশ্ন করেছিল বড়োবাবুকে, ‘কিন্তু ওর হত্যার পিছনে কোনও সঠিক কারণ তো থাকবে। সেগুলো আমি জানতে চাই অসীমবাবু। কেন এত

নৃশংসভাবে মারা হল আমার ওই একরত্তি ছেলেটাকে?’

‘আপনি তো জানতেন-ই যে আপনার ছেলে, আর-পাঁচটা ছেলের মতো স্বাভাবিক নয়। একাধিক ছেলের সঙ্গে তার সমকামী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাই হোক, যে ছেলেগুলো ধরা পড়েছে এরা তাদেরই একটা গ্রুপ। একটা সময় ঋকের এদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল। সারাদিন হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত ছেলেগুলো। ওদেরই মধ্যে ম্যাক বলে একটি ছেলে, শহরের নামি উকিল অভিষেক জালানের একমাত্র বখাটে ছেলে। সে নিজেও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আর অন্যদের নেশা করার জন্য টাকা ধার দেয়। নতুন নতুন পার্টনারের ব্যাপারেও তার প্রবল আগ্রহ। ঋক-কে খুব মনে ধরেছিল তার। তাই কখনও টাকা চাইত না ঋকের কাছ থেকে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋকের নেশা ছেড়ে দেওয়া, তার সঙ্গ ছেড়ে দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি সে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋককে বারবার ফোন করেছে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। ঋক রাজি না হওয়াতেই এই বিপত্তি। সে শর্ত দিয়েছিল, হয় তাকে টাকা ফেরত দিতে হবে, নয়তো আগের মতো সঙ্গ দিতে হবে। টাকা ফেরতের ব্যাপারটা তো অজুহাত মাত্র, তার উদ্দেশ্যই ছিল ঋককে পাওয়া। কল লিস্ট দেখে আমরা জানতে পেরেছি, সেদিনের ওই ফোনটা ম্যাক-এরই ছিল। সে-ই ডেকেছিল তাকে। টাকাপয়সা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছিল ঋক-কে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ঋক সেদিন জানাতে গিয়েছিল, টাকা সে ধীরে ধীরে শোধ করে দেবে। ঋক-কে না পেয়ে সেদিন জোশের মাথায় গুলি চালিয়ে দিয়েছিল ছেলেটি। তারপর বাকি বন্ধুদের সহায়তায় লাশ গায়েব করে দিয়েছিল।’ অসীমবাবুর কথাগুলো শেলের মতো বুকে এসে বিঁধছিল দেবেশের। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে জামার উপরের দিকে বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গিয়েছে। সহানুভূতি দেখাতে, অসীমবাবু দেবেশের কাঁধে হাত রাখেন। দেবেশের দিকে একগ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেবেশবাবু আর একটা কথা জানানোর ছিল। জানি না, কথাটা বলার এটাই উপযুক্ত সময় কিনা, তবুও ডিউটির খাতিরে আমাকে বলতেই হবে। নয়তো আদালতে জেরার সময়ে আপনি জানতেই পারবেন।’

নিজেকে খানিক শক্ত করার চেষ্টা করে দেবেশ। ‘কী ব্যাপার বলুন না। এই কষ্টটা যখন সহ্য করতে পেরেছি, তখন আর কোনও কিছুই আমাকে ছুঁতে পারবে না। আপনি বলুন।’

‘দেবেশবাবু, ঋক কাবেরীদেবীর ছেলে এটা যেমন সত্যি, তেমনি রিপোর্ট অনুযায়ী এটাও সামনে এসেছে যে, ঋক আপনার ঔরসজাত সন্তান নয়।’

একমুহূর্তেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে দেবেশের। মাথাটা ঘুরে যায় তার। যেন কেউ সপাটে তার গালে একটা চড় কষিষে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ ওইভাবেই ঘোরের মধ্যে বসে থাকে দেবেশ। ইন্সপেক্টরও তার মনের কথা বুঝে চুপ করে যান।

খানিক পরে কাবেরীর চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে দেবেশের। ‘আমাকে কেন ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।’

কী যেন ভাবে দেবেশ। তারপর হাতজোড় করে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারকে বলে, ‘অসীমবাবু, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমাদের ঋক আর কোনওদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট, আমি এতদিন যে-মিথ্যেটাকে সত্যি ভেবে বেঁচে এসেছি, বাকি জীবনটাও সেটা নিয়েই কাটাতে চাই। এটা আমার আর কাবেরীর দাম্পত্যের জন্যও জরুরি।’

‘ঠিক বুঝলাম না দেবেশবাবু।’

‘প্লিজ অসীমবাবু, আপনি আমার স্ত্রীকে এটা কখনওই জানতে দেবেন না যে আমি জেনে গেছি যে ঋক আমার আপন সন্তান নয়।’

কী যেন ভেবে মাথা চুলকে নেন অসীম জেয়ারদার। দেবেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। চেষ্টা করব আপনার স্ত্রীকে সাক্ষী না বানাবার।’

‘অশেষ ধন্যবাদ অসীমবাবু। আপনার ঋণ আমি কোনওদিনও শোধ করতে পারব না।’ কৃতজ্ঞতা জানাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বড়োবাবুর হাতদুটো চেপে ধরে দেবেশ।

কিছুক্ষণ পর একেবারে বিধবস্ত অবস্থায় থানা থেকে কাবেরীকে নিয়ে বের হয় দেবেশ। কাবেরী পাগলের মতো করতে থাকে। বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকে, ‘কী হল? বড়োবাবু কী বলছেন? ডিএনএ রিপোর্ট-এ কী এল। ওটাই আমাদের ঋক?’

গাড়িতে উঠে কাবেরীর মাথা নিজের কাঁধের উপর টেনে নেয় দেবেশ। তারপর খুব ধীর কণ্ঠে বলে, ‘কাবেরী নিজের মনকে শক্ত করো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমার ঋক যে পথে এগিয়ে গিয়েছিল তাতে ভগবান বোধহয় এটাই সঠিক মনে করেছেন।’

হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে কাবেরী। বাধা দেয় না দেবেশ। শুধু শক্ত করে ধরে রাখে তাকে।

 

তবু মনে রেখো…

পাবলিশারের দফতর থেকে এক কপি একটুকরো আকাশ সবেমাত্র হাতে পেল আঁচল। বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। কবি তোর্সা বসু নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিউ সার্কুলার রোডের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটটা যতই আপন হোক, সে আর সুতীর্থ বিয়ের পর প্রথম সংসার পেতেছিল মালিনী নিবাস-এই। ভাড়া বাড়ি হলেও আজও কেন জানি বড্ড নিজের!

মালিনী রায়চৌধুরী বছর ষাটের ডাকসাইটে সুন্দরী। স্বামী বেণুলাল রায়চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে তাঁর দিন কাটে। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাবার অভ্যাস কোনও কালেই নেই। সারাজীবনে, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, তার রক্ষনাবেক্ষণের দাযিত্ব স্ত্রী মালিনীদেবীর হাতে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্ত। এসব মাথায় রাখা মানেই তো উর্বর মস্তিষ্ককে কষ্ট দেওয়া। অতএব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতে হয় মালিনীদেবীকেই। নিন্দুকেরা বলে, মালিনীদেবীর শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে একটি পিঁপড়েরও প্রবেশাধিকার নেই মালিনী নিবাস-এ। যদি বা আচমকা প্রবেশ করে ফেলে, তত্ক্ষণাৎই মালিনীদেবীর সম্মার্জনী আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

বেশ মনে পড়ে আঁচলের, যারা মালিনী নিবাস-এ বাসন সাফাই আর কাপড় ধোয়ার দাযিত্বে বহাল হতো, তাদের মুখগুলো দিন কুড়ি পর পর বদলাতে থাকত। কারও তেল চিটচিটে বাসন ধোয়া তো কেউ কাপড় নিংড়ানোর কোনও ছিরি জানত না। মাঝে একবার মালিনীদেবীর তীব্র হাঁটু ব্যথার দরুন, একমাসের জন্য যে-কজন রন্ধনশিল্পী বহাল হয়েছিল তাদের কারওরই মালিনীদেবীর মাপ করা তেল-মশলায় রান্নার পারদর্শিতা ছিল না।

 

মালিনী নিবাস-এ দুটি প্রাণী। কর্তা ও গিন্নী। অনেক যত্ন নিয়ে বড়ো করেছেন একমাত্র ছেলে অবিনাশকে। সে-ও বদলি নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তার স্ত্রী তিতির সাফ জানিয়েছে, মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করার জন্য সে পৃথিবীতে জন্মায়নি। তার করার মতো অনেক কাজ রয়েছে।

মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় একবেলার জন্য অবিনাশ আসত। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র শ্বশুরালয়ে থাকায় অবিনাশের বিশেষ থাকা হতো না। এতে মালিনীদেবীর বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। বরং এ যেন একদিকে ভালোই। অন্যের আজেবাজে কাজ তার বরাবরই না-পসন্দ। খালি মাঝে মাঝে এক মাত্র নাতি তাতানের জন্য ভেতরটা হু হু করে এই যা! সাধ করে জিভেগজা, খুরমা, আচার বয়ম ধরে বানিয়ে রোদে দেন। সংরক্ষণ করেন, যদি কখনও তার দাদুভাই আসে! কিন্তু কালের নিয়মে একসময় তাতে ছাতা ধরে। তবু মালিনীদেবী প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারেন না।

মালিনী নিবাস-এর একমাত্র ভাড়াটে সুতীর্থ বসু আর তার ছোট্ট ছেলে বাবিনের প্রতি মালিনীদেবী বরাবরই স্নেহশীলা। কিন্তু সুতীর্থর বাউন্ডুলে লেখিকা বউ, আঁচলের উড়নচণ্ডী স্বভাব দেখে রেগে গজগজ করে বলতেন, মেযোনুষের অত সংসার ফেলে বাউন্ডুলেপনা ভালো লাগে না বাপু! বলি পাতাকে পাতা হিজিবিজি লিখলে সংসারের কোনও উপকার হয়? তার চেয়ে ঝুলগুলো তো একটু ঝাড়তে পারে? নেহাৎ পড়েছিল অমন ভালো ছেলেটার হাতে! আহা গো, বাচ্চাটা কেমন শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়!

প্রতিদিনের মতোই একদিন মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করতে করতে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের শিকার হয়ে শয্যাশাযী হলেন মালিনীদেবী। বাঁ দিকটা কোনও জোর নেই। ভাগ্যিস আঁচল এসে ধরেছিল, নইলে সে যাত্রা ফিরতেন না। সবই অদৃষ্ট নইলে কে ভেবেছিল, তার মতো দাপুটে মহিলাকেও কাজের মাসি আর আয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।

এদিকে পিঁপড়ে, আরশোলা, ছুঁচো মনের সুখে বাসা বেঁধেছে মালিনী নিবাস-এ। বেণুলাল খুব একটা এদিকে আসেন না। রোগীর ঘরে আসতে তাঁর গা ঘিনঘিন করে। পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, মাঝে মাঝে ভুলেই যান, ডান না বাঁ কোন দিকে অসাড় মালিনীদেবীর। না এসব করলেও বেণুবাবু যথেষ্ট কর্তব্যবান। কারণ চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় আর্থিক ভার তো তাঁরই। শুধু শুধু খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে বিপদ বাড়ানো বই-তো নয়!

বিশেষ কেউ আসে না মালিনীদেবীর ঘরে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক স্বস্তির। অবিনাশ একবেলার জন্য এসেছিল। চোখ ফেটে জল আসে মালিনীদেবীর। সামনে আলমারীর ওপরে তাঁদের বিয়ে ছবি। আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বেঢপ বেণুলালের সঙ্গে নিজের জুটিটাকে মানানসই করতে, নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন সেই কবেই! এই পুতুল খেলার নেশার মতো সংসারের নেশায় বুঁদ হয়ে সব কষ্ট ভুলেছেন। নয়তো এই স্বার্থপর, বাতিকগ্রস্ত, বদমেজাজি লোকটার সঙ্গে থাকতেন কীভাবে? মাঝে মাঝে বিভিন্ন মহিলা কলিগের সঙ্গে মাখোমাখো গল্প কানে এসেছে। শুনেও শোনেননি, বুঝেও বোঝেননি। সব কষ্ট থেকে পালানোর একটাই জায়গা ছিল। আজ আর সেটাও রইল না।

ও মাসি আমি কিন্তু ফল, হরলিক্স আনিনি, এই দ্যাখো বকুল ফুল। খুশি? বলেই হেসে ওঠে আঁচল। আঁচলের চুলের শ্যাম্পু আর পারফিউমের গন্ধে সতেজ লাগে মালিনীর। পর্দা সরাতেই ঘরে একরাশ রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।

এই দ্যাখো মাসি আমার মোবাইলে, একি! মাসি তুমি কাঁদছ?

চাঁপা কলির মতো আঙুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আঁচল স্বভাবসুলভ ভাবে বলে চলে, এটা ওয়ে ম্যাগাজিন। আমি এডিটর। সেদিন কাগজওয়ালার পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপে, তোমার কবিতার খাতাগুলো পাই। মেসো মনে হয় বোঝেননি। আমি কিন্তু আরও ছাপব মাসি! আসলে তুমি যতই খিটখিট করো, আলমারী ঠাসা রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পূর্ণ সেট আর ঝাড়ু দিতে দিতে রবিবাসরীয় পড়া দেখেই বুঝেছিলাম।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মালিনীদেবী। আঁচল বলে চলে, বারীন সেনের মতো লেখক তোমার বন্ধু? উনি পড়ে নিজে আমায় ফোন করেছেন। ভাবতেই পারছি না! কত বেস্টসেলার লিখেছেন উনি।

 

ঈষৎ বেঁকে যাওয়া, বলিরেখায় ভরা মুখটায় কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। লাজুক হেসে একটু জড়ানো স্বরে বলে চলেন, এক কালে বারীনদার সাথে কত চিঠি, কবিতা দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। মামার সংসারে মানুষ তো! বারীনদা তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তোর মেসোর ভালো চাকরি। (একটু থেমে) আচ্ছা আঁচল আমি কি আর আগের মতো জোর ফিরে পাব না রে? শুয়ে বসে খুব কষ্ট হয়। আমাকে একটু তোর মতো ফোন দিয়ে টাইপ শিখিয়ে দে না। নতুন করে লিখি।

খুব কষ্ট হয় আঁচলের। জোর করে হেসে বলে, একটু ভালো হও তারপর। এখনও তো অসুস্থ তুমি।

ধুর! আর ভালো হব নাকি! শোন না, আমার এই সোনার চুড়ি দুটো রাখ।

এ মা! কেন?

আরে সে লোক এখন টাকা পয়সা নিজের হাতে করে নিয়েছে। সময় থাকতে সরিয়ে রাখিনি আমিও যেমন! শোন না, কবিতাগুলোর একটা বই করে দিবি মা! এটা দিয়ে হবে তো? আর একটা কথা, কবির নাম দিবি তোর্সা বসু। আমার বাপের দেওয়া ডাকনাম। বাপের পদবী।

তুমি ওটা রাখো মাসি, আমি নিজে করে দেব। চাকরি করি তো না কি! একটু সময় দাও।

শোন না যাবার আগে বাবিন সোনার জন্য আমের আচার নিয়ে যাস কিন্তু।

চোখটা মুছে মোবাইলের গ্যালারি থেকে মালিনী মাসিমার ছবিটা বের করে আঁচল আপন মনেই বলে, আজ বইমেলার ৪ নম্বর স্টলে তোমার এক টুকরো আকাশ থাকবে। তোমার কথা ভুলিনি মাসি, একটু দেরি হয়ে গেল! গুছিয়ে নিতে সময় লেগে গেল।

রজনি বৃত্তান্ত

কথা হচ্ছিল ঘুঘুডাঙার দিঘির পাড়ে প্রাচীন বটগাছের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে বসে গুটি পাঁচেক মাতব্বরের মধ্যে। ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে সনাতন হাজরা হ’ল গিয়ে লায়েক। গলা খাঁকারি দিয়ে সে-ই কথাটা পেড়েছিল। ওহে মেয়েমানুষ তো লয় চামার। দজ্জাল মেয়েছেলে। ধম্মকম্ম বলে কিস্যু নাই। গলা তুলে গাল পাড়া মন্দ কথা বলা, এর বাইরে…। বাকি কথাটা লুফে নিল ভজন সামন্ত, কিস্যু নাই কিস্যু নাই। দিনকাল বদল হইচে গো, নইলে এমন মেয়েছেলেকে গাঁয়ে রাখাও কাজের কথা নয়। অমনি বাকি তিনজন তালে তাল মেলাল। হরিহর সামন্ত, শুধু এক কদম এগিয়ে বলল, বাপটা আর সোয়ামিটা কী অমনি অমনি ধেনো খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সনাতন ঘুরে বলল, ওই ঘরজামাইটার কথা বলতিছ? ও তো ক্লীব, শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে বউ-এর লাথিঝ্যাঁটা খায়। আর ওকে তাল দেয় বিষ্ণু হাজরা মানে শ্বশুরটা। হরিহর অমনি গলা তুলে বলল, সে গুড়ে বালি। ওই খান্ডারনি বউয়ের হাত থেকে সম্পত্তি গ’লে ওর হাতে যেতে যেতে মাধব মানে মেধো এমনিই অক্বা পেয়ে যাবে।

শীতের দুপুরে রোদ্দুর যেন পালাব পালাব করে। দিঘির ও’পারে তালবনে সুয্যি ঠাকুর জাল গুটোচ্ছে। সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে সনাতন বলল, চল হে একটু পরেই হিম পড়বে। এই বুড়োবেলায় সব সইতে পারি হিম সইতে পারব না।

যাকে নিয়ে এত কথা সেই রজনি তখন সাঁঝের আকাশের দিকে চেয়ে গাল পাড়ছে, একবার ঘর এসো, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। হাটে যাবার নাম করে সেই সকালে দুটিতে বেইরেছে, এতখানি বেলা পার হয়ে সুয্যি পাটে বসল, ফেরার নাম নেই। হেঁসেলের উনুনে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব। গঙ্গাজলে ভাইস্যে দেব ওই বুড়োটাকে আর পোড়ামুখো জামাইটাকে। খিড়কির চৌকাঠে একটা ছায়া চুপিসারে ঢুকতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। রজনি আকাশমুখো, ভাগ্যিস। কে জানি রজনিকে বলেছিল, আকাশমুখো সব কথা বহু দূর তক্ শোনা যায়। ছায়া আরও এক পা রাখতেই খড়ের গাদার ওপর রাখা কাটারিটা টিউবওয়েলের বাঁধানো শানে পড়ে ঠনঝন শব্দ করে উঠল। সেদিক পানে চেয়ে রজনি তিরিক্ষি চেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো ওই কাটারিতে তোমাদের টুকরো টুকরো করব।

ছায়া এবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দাঁড়াল। বিষ্ণু হাজরা। একটু টাল খেয়েছিল। ধেনোটা বুকের ভেতর থেকে তখনও পেট অবধি নামেনি। এইসময় মেয়েটা এমন তেড়ে উঠল যে চমকে আবার পিছু হঠতে গিয়ে প্রায় কাটারিতে পা দিয়ে ফেলেছিল। সামলাতে গিয়ে টিউবওয়েল-এর হাতলটা ধরে ফেলল। রজনি খানিক থমকে গিয়ে আবার সুর তুলল, বলি ল্যাজটা কোথায়?

বিষ্ণু হাজরা অমনি যেন খানিক ফুরসত পেয়ে একরকম নীচু গলায় বলল, মেধো সেই কোন দুপুরে আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে কোথায় যে গেল, বলল তো হাটে যাচ্ছি…।

কোথায় গড়াগড়ি দিচ্ছে? তুলে আনতে পাল্লে না? এবার তুমি এসো, তোমায় দেখি খানিক। মেয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে নেশা ছুটে গেছে বিষ্ণু হাজরার। মনে খানিকটা বল সঞ্চয় করে বলল, একটু ঠান্ডা হ মা। হাট তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ঠিক ফিরে আসবে। তুই বরং উনুনে আঁচ দে। বিষ্ণু হাজরা মনে মনে আওড়াল, আঁচ দেবে কী, মেয়েটা তো নিজেই আঁচ হয়ে আছে।

তারপরেই মনে হ’ল, তাই তো ছোঁড়়াটা গেল কোথা! সে কী সত্যি-ই হাটে গেছে! ধেনোর ঠেকেও তো যায়নি। তাহ’লে!

মেধো তখন অনেক দূরে। আশমান গাঁ আর চাঁপাডাঙা ছাড়িয়ে ফুলটুসি গাঁয়ের মখমল বাজারের থেকে পোয়া মাইল দূরে এক সাধু আসন গেড়েছে। তাতেই লোক হামলে পড়েছে। সাধুর নাকি মোক্ষম দিব্যদৃষ্টি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ– সব গড়গড়িয়ে বলতে পারে। এত ভিড়ের মধ্যে সাধুর নাগাল পাওয়া কঠিন। বেশ খানিক পিছনে দুটো থান ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মেধো ঠাওর করতে চাইছে। এই সাধুর খবর সে পেয়েছিল তার ছেলেবেলার বন্ধু পঙ্কার কাছ থেকে। পঙ্কা বলেছিল, একবার গেলেই টের পাবি। স্বয়ং বিশ্বনাথের চ্যালা।

তোর যা দুঃখ, যা গিয়ে বল। কিছু একটা তো হবেই। ধেনো খেয়ে তো আর সাধুর কাছে আসা যায় না, তাই ধেনোর ঠেকে যাবার আগেই বাবা শ্বশুরকে বলেছে, হাটে যাচ্ছে। তবে ভেবেছিল সাধুর সঙ্গে দেখা করে বাজার থেকে আনাজপত্র কিনে ফিরবে। কিন্তু এত ভিড় ভাবনার বাইরে ছিল। ইতিউতি দাঁড়িয়ে কোনওভাবেই যেন তার দর্শন মেলে না। তেমন একটা গাছও নেই যার ওপর চড়ে সাধুর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকে দূর দূর থেকে এসেছে। কারও মানত ফলেনি, কারও ব্যাবসা মন্দগতিক– হাজারও সমস্যা। পঙ্কা বলেছিল, সব তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে সাধুবাবা। অগত্যা বেশ খানিক দূরে মোটা গুঁড়ির একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে বসে থাকে ঠায়। তাছাড়া সব কথা তো সবার মাঝে বলাও যায় না। কথাগুলো পেরাইভেট কিনা।

সন্ধের পর একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ইয়াব্বড়ো একটা চাঁদ ফুলকো লুচির মতো আকাশে ফুটে উঠল। শাল্লা মশার ভনভন, পোকামাকড়, সাপও থাকতে পারে। তারমধ্যেই একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখদুটো রাবারের মতো চিপসে যাচ্ছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই হঠাৎ কেউ কোথাও নেই। সাধু একলা বসে। বুক পর্যন্ত সাদা কাশফুলের মতো দাড়ি, কাঁধ থেকে বুক পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে সাদা জটা। সাধু মহারাজ একটা কল্কেতে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুজে আছে। ধুনির আলো আর চাঁদের আলোতে সাধুর পদ্মাসন থেকে পা দুটো খুলে ছড়িয়ে বসে থাকার কায়দাটা খুব চেনা ঠেকল। আরে ভুতোদা না! এই বসার ধরনটা এই গাঁ ছাড়িয়ে আরও দশ গাঁয়ের পর মেধোর জন্মভিটে হরিশপুরে কে না চেনে! আর ওই দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখটাও তো…! এইরকম আয়েশ করে বসতে আর কাউকেই জানে না মেধো। শুধু সে নয়, গাঁয়ের সব্বাই…।

হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোতেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতোদা-ই তো। ভুতোদা বলে ফসকা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। শুধু শুধু বেমক্বা সব কেঁচিয়ে দিলে হয় না। এখনও বাজারের লোক হয়তো সব ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু ফসকে যাওয়া ওইটুকুতেই ভুতোদা এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে চাপা গলায় বলল, কে কে বটে?

বুনো গাছগাছালির ওপর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু দুটোর নুনছাল উঠে গিয়েছিল। জ্বালা করছে। তবু শেষবার চেষ্টার মতো করে শরীরটা একরকম ছুড়ে দিল মেধো।

আমি গো আমি। চিনতে পাচ্ছো ভুতোদা? আমি হলেম গে হরিশপুরের মাধব হুই। বাপের নাম কেষ্টচরণ হুই। মায়ের নাম…।

বলতে হবে না। তো এ তল্লাটে কি কচ্ছিস?

আমি হলেম গ্যে ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে বিষ্ণু হাজরার ঘরজামাই গো।

ছ্যাঃ ঘরজামাই। পুরুষ মানুষের কলঙ্ক।

মেধো এবার গুছিয়ে বসে ঘনিষ্ট গলায় শুধাল, তুমি সাধু হলে কবে থেকে? বে থা করনি এ’কথা জানি। কিন্তু তাই বলে সাধু!

কল্কেতে টান দিয়ে খানিক ধোঁয়া উগরে দিয়ে ভুতো বলল, আমি হলেম ভূতানন্দ স্বামী। গৃহীর নাম সাধুর হয় না। তো বল তোর সমিস্যি কী।

সমিস্যি তো একটাই। বউটা বড়ো দজ্জাল। উঠতে বসতে গাল পাড়ে। আগে অমনটি ছেল না। ছেলেপুলে হ’লনি তো। তাতেই এমন তিরিক্ষি হয়ে গেল।

শুধু তোরেই গাল দেয়?

না গো ওর বাপটারেও দেয়। দোষের মধ্যি আমরা পুরুষ মানুষ তো বটে, একটু আধটু…।

কথা শেষ হবার আগেই ভুতো বলে, মেয়েছেলের দোষ আছে? মানে খারাপ বাড়িতে যাস নাকি? তা হ’লে তো…।

ছিঃ কী যে বলো। তুমি না সাধু। এই যেমন ধরো গিয়ে তুমি কল্কেতে টান দাও আর আমরা সারাদিন পরে একটু ধেনো খাই। সেটা কি খুউব দোষের?

দোষ? দোষ গুণের বিচার করার আমি কে রে। সবই ওই ওনার– বলে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে দেখাল ভুতো। তোর ছেলেপুলে?

হয়নি। আর তার জন্যই তো এত গোল। হাকিম বদ্যিও কম হয়নি। তো ওই যে বললে না সবই তেনার ইচ্ছে। এবার গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, দাও না।

কী? ছেলেপুলে?

না গো। ওতেও শান্তি হবে না। তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কথাটা বলে ভুতোর ছড়ানো পা দুটো ধরতে যাবে অমনি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ভুতো বলল, অত সোজা। সাধু হব বললেই সাধু হওয়া যায় নাকি? মেধো দ্বিতীয়বার শরীরটা ছুড়ে দিয়ে ভুতোর দুটো পা-ই ধরে ফেলল।

আঃ ছাড় ছাড়, সাধু হলে শ্বশুরের ভিটে জমি পুকুর এ’সব যে হাতছাড়া হয়ে যাবে রে।

হাতছাড়া হয়েই আছে ধরে রাখো। অমন দজ্জাল বউ না-মরা ইস্তক কিচ্ছুটি পাবার যো নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। তারপর আর একটু এগিয়ে ভুতোর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি দলাই মলাই করতে করতে মেধো কেমন যেন আবেশ বিভোর গলায় বলল, তোমার সেবা করব। আমারে দীক্ষে দাও।

সেবা করবি? তা হ’লে কর। কল্কেটা একটু সাজিয়ে দে। বাবা বিশ্বেশ্বর কী বলেন দেখি। মেধো অমনি হাত বাড়িয়ে কল্কেটা নিল।

দু’টান মারতেই ভুতোর কেমন ফুরফুরে উদার হয়ে গেল মনটা। তোকে আমার চ্যালা করে দিলাম যাঃ। ক’দিন এ’ধার ও’ধার আমার সঙ্গে ঘুরে দেখ, তারপর না হয় দেখা যাবে। সংসারের এঁটেল মাটি গা থেকে আগে খসুক, দীক্ষা হবে।

মেধো গদগদ গলায় বলল, হবে বইলছ। তাইলে এট্টু পেসাদ…। ভুতো কল্কেটা বাড়িয়ে দিল। মেধো চোখ বুজে এক দমে খানিক টেনে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। ব্যাস হয়ে গেল, পাপ তাপ সব ছাড়িয়ে ভেতরটা কেমন যেন উদাস বাউল পারা। কোথায় পড়ে রইল রজনি, জমি জমা ভিটে– সব কেমন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শুধু ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর যেটুকু দেখা যায়, ভূতানন্দ স্বামী।

দুই

রাতে ঘুম হয় না বিষ্ণু হাজরার। ঘোলাটে চোখ দুটো পেঁয়াজের পাতলা খোসার মতো যেন ভাসছে। ছেলেটা যে কর্পূরের মতো উবে গেল। আকাশপটে বাসি কদমফুলের মতো তখন শুকতারাটা ফুটেছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বিষ্ণু হাজরা, তোমায় বইলছি তো সব তোমার নামে নেকাপড়া করি দিব, তা বুঝি বিশ্বাস হ’লনি। তোমার হলি তো মেয়েটারও হ’ল নাকি! তারপরেই মনে হ’ল বেবাক কোথাও নেশার ঘোরে পড়ে নেই তো! তবে নেশার ঠেকগুলো তো এ’কদিন ঘুরে দেখে নিয়েছে। তো সে কোথায়! তাহ’লে কী…! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

পাশের ঘরে শুয়ে অমনি এ’পাশ ও’পাশ করে জেগে আছে রজনি। মানুষটা গেল কোথা! যা গাঁয়ের ছিরি ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল না তো! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে কপাট খুলে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। রাগে জ্বলে ওঠে রজনি, রঙ্গ হচ্ছে! তামাশা! তারপরেই কেমন যেন ভেঙে পড়ল, কোথায় খুঁজবে মানুষটাকে। বাপটা কি ঘুমে নিঃসাড়, না তারই মতো…! ভেতরের কপাট আবজানই ছিল।

পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? ভাবো কি আমি তোমায় ছাড়ি দিব? মানুষটাকে কোথায় রাখি এয়েচ? দিনরাত মদ গিলেও শান্তি হয়নি? শেষে বেচি দিলে মানুষটারে! বিষ্ণু হাজরা হাতের মুদ্রায় জানান দেয়, সে জানে না। এমন কাণ্ড কোনও বাপে করতি পারে!

তারপরেও সব যেমন চলছিল তেমনি সব ঠিকঠাক। সকালের প্রথম রোদ্দুর উঠোনে চুঁয়ে পড়েছে। রজনি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে অন্য মূর্তি। পারলে রাঙা রোদ্দুর ঝাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলে। বিষ্ণু হাজরা এক পা দু’পা করে খানিকটা এগোতেই রজনি রণং দেহী ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল, ভেবেছ কী? ওই আবাগির ব্যাটার সঙ্গে খালাস হই যাতি পাল্লে না। হাড় জুড়োত।

আঃ, আমি কী তার জানি! আমায় কি বলেকয়ে গেছে?

এমনি এমনি হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল? কেমন করে ভূত ছাড়াতি হয় তোমাদের আমার জানা আছে।

তারে খুঁজতি গেলেও তো যাতি হয়।

তো যাও। সঙের মতো দাঁইড়ে না থেকে খুঁজি আনো। মানুষটারে না নিয়ে ফিরলি তোমার একদিন কি আমার একদিন।

চিন্তায় বিষ্ণু হাজরার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, বাগদিপাড়া, দুলেপাড়া, মালাপাড়া কোনওটাতেই তো বাদ দেয়নি। তাহ’লে! মাথা নাড়তে নাড়তে বিষ্ণু হাজরা বেরিয়ে যেতেই ভজন সামন্তের ছোটো ছেলে পটলা হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির। সববনাশ হই গ্যাছে। গাঁয়ের কে যেন দেখেছে, মানুষটা এক সাধুবাবার সঙ্গে বাঁকা নদী পার হয়ে কোথায় যেন…!

তা কেউ বারণ করলে না?

বারণ করবে কিগো। সাধুবাবা যে তখন বাণ মারিছে। সব বেবাক দাঁইড়্যে…!

রজনির মুখ থেকে কথা সরে না। কোথা গেল মানুষটা! কতদূর!

বিষ্ণু হাজরা ফিরল বেশ খানিক রাতে। সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে। একে তাকে জিগ্যেস করেছে। ফুলটুসি গাঁয়ের কয়েকজন অবশ্য সাধুর কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কি হদিস মেলে! দু’একজন হেসে তামাশা করে বলেছে, তা তোমরা বাপ-বেটি মিলি মানুষটারে খেদানোর ভালো কল ঠাউরেছ তো! এখন হাপিত্যেস করার যাত্রা নাই বা করলে। বিষ্ণু হাজরা কোনও উত্তর দেয়নি। কী-ই বা উত্তর দেবে!

ঘরে ফিরতেই রজনির সামনাসামনি। পাল্লে না সাধুটারে পুঁতি রাখতি? ভণ্ড আমার সংসারটারে তুক করিছে, আর তুমি বেবাক ঘরে ফিরলে? যাও না কেনে বাঁকা নদী পার হই তারে খুঁজে আনতি।

বিষ্ণু হাজরা চুপচাপ দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত শোক কি ও সইতে পারে! বাইরের কপাট ধরে তখনও রজনি দাঁড়িয়ে।

পরের দিন পুলিশ চৌকিতে হাজির বাপ-বেটি। সব শুনে বড়োবাবু হাসল, তো আমি কী করব। জামাই পালিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেয় সংসার ত্যাগ করেছে, তো আমি কী করব? এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, হঠাৎ জ্বলে উঠল রজনি, তাই তো পুলিশ তো হাবাগোবা, শুধু ঘুষ নিবে, সাধুকে জেলে পুরবে আর চোরকে ছেড়ে দিবে। বড়োবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার মুখ সামলে।

চোপ, বিষ নেই তো কুলোপানা চক্বর। ঝাঁটা মারি অমন আবাগির ব্যাটাকে।

হনহন করে বেরিয়ে এল রজনি, বাপটা পেছু পেছু একরকম ছুটতে ছুটতে পাঞ্চেত বিডিও আপিস ঘুরেও কোথাও কোনও হদিস পেল না।

ঘরে ফিরে রজনি কেমন যেন থিতিয়ে গেল। চুপ করে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসে রইল।

তিন

এতসব কাণ্ড যখন তখন হর-কী পাউরির ঘাটে বসে কল্ কল্ জল দেখছে মেধো। পাশে বসে গুরু ভূতানন্দ স্বামী। দীক্ষান্তে মেধো এখন তার চ্যালা।

কেমন লাগছে তোর?

ভালোই, তবে…।

কী তবে?

নিরামিষ এত ভাল্লাগে না।

এ তো দেবস্থান। এ’সব কথা বলাও পাপ। এরপর তো তোর গেরুয়া বসন হবে।

ও যখন হবে, হবে। তাই বলে…।

চুপ করে থাকে ভূতানন্দ। চোখ বুজে মনে মনে বলে, সংসারের গন্ধ গা থেকে খসতে তো সময় লাগবেই। মুখে বলল, তাঁর ভজনা কর। তিনিই পথ দেখাবেন।

শাল্লা ঠিক সেইসময়-ই দজ্জাল বউটার কথা মনে হ’ল। বউটার জন্য কেমন যেন দুঃখ হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এমনটা কি সবার হয়! সংসার কি এমনিই পেছন থেকে টানে! কথাগুলো শুধোতে গিয়েও শুধোল না। শুধোলে তো সেই ওপরের ওনাকেই দেখিয়ে দেবে ভুতোদা, থুরি ভূতানন্দ।

তারপর কংখল। মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ভজন, গীত, স্তোত্র, খাওয়া বলতে মালসায় খিচুড়ি ভোগ। বাকি সময়টা মাধুকরী– ভিক্ষে চেয়ে পেট ভরা। শাল্লা পেট চটকে ঠাকুর ঠাকুর। নিকুচি করেছে ঠাকুরের। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যায় গাঁয়ে। অমনি মনে হ’ল রজনির কথা। যা খান্ডারনি হাত-পা ভেঙে নুলো করে দেবে। শাল্লা জলে কুমির তো ডাঙায় বাঘ। মাঝেমধ্যে কোনও গাঁয়ে গিয়ে আসন পাতলেও তো হয়। কলাটা মুলোটা ফলটা কম তো হয় না।

চাঁদ দেখছিল ভূতানন্দ। মেধো শুধিয়েই ফেলল, কবে যাবে?

কোথায়?

এই কোনও গাঁয়ে।

বোশেখের আগে নয়। তার আগে এলাহাবাদ। মাঘী স্নান।

মাঘী স্নান!

সারা মাঘ মাস স্নান চলবে আর ঠাকুরের নাম সংকীর্তন সঙ্গে মাধুকরী।

এই হয়েছে এক গেরো। দুটো কথা সহ্য করে গাঁয়ে থাকলে ভালো হতো। ভূতানন্দ ওর দিকে ফিরে চাইল। তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠল, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…। ঝুলি থেকে একটা কল্কে বের করে বলল, নে সাজ তো।

দুটো টান দিতেই গুরু খুশ্ তো চ্যালা খুশ্।

চার

সময় যেন ডাকহরকরা। নিদানের চিঠি তার হাতে ধরা। কখনও বা সে গাঁয়ের চপলা শ্যামলাবরণ মেয়ে। ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর।

শূন্য ঘরে রজনি একা। তার শরীরেও সময় কখন গুটিগুটি প্রবেশ করেছে। গত বিশ বছরের জোয়াল এখন তার কাঁধে। বিষ্ণু হাজরা দেহ রেখেছে তা-ও দশ বছর পার। আনমনা বসে থাকতে থাকতে শোনে কোথায় যেন কোনও বৈরাগী গান ধরেছে, এ জীবন নদীর পারা যতই ভাবো যায় না ধরা। হবে হয় তো। শূন্য ঝাঁপি শূন্যই থেকে যায়, কেউ তো এক আনিও দিল না।

রাত্রে মোহন এল। মোহন রজনির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। বলল, পিসি হয় না।

কী হয় না?

খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা যায়? যায় না। সব ধম্মস্থানই তো খুঁজলে, পেলে?

রজনি মোহনের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, হয় কী না হয় সে আমি বুঝব। তোকে যেতে হবে না।

আমি কি তা-ই বলেছি?

গেলে যাবি না গেলে যাবি না। কারও জন্য কিছু…। এই যে একটা গোটা মানুষ হারিয়ে গেল তার জন্য…! রজনি থেমে গেল।

তারপর শুধু চলা আর চলা। কখনও হূষিকেশ কখনও এলাহাবাদ আবার কখনও মথুরা। কোথাও নেই। রুদ্রপ্রয়াগ। মন্দিরে গান হচ্ছে, হ্যায় জীবন কি নৈয়া তুমহারে হাওয়ালে, জিধার চাহো হম কো উধর লে চলো তুম। গানের সুর, নদীর আবিরগোলা জল– সব একাকার।

মোহন পিছন থেকে ডাকল, পিসি। রজনি সাড়া দিল না। ও তখন অনেক দূরে। মানুষ হারিয়ে যাবার সুলুক সন্ধান যেন এখন ও জানে। মোহন বলল, যাবে পিসি?

কোথায়?

সাধুভান্ডারা। ভক্তের ভোগ দান সাধু বিলিয়ে দেবে সবার মধ্যে। যাবে? রজনি অস্ফুটে বলল, যাব।

সার বেধে ভক্তের দল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য তখন পুব আকাশে। পিসি-ভাইপো সেই সারে দাঁড়িয়ে। একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে রজনি এগিয়ে এসেছে। এক ব্রহ্মচারী। শ্বেত শুভ্র বসনের সঙ্গে পক্ব কেশ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলী একাকার। চোখদুটো যেন দূর পারের কান্ডারি। তন্ময় হয়ে দেখছে রজনি। চেনা মুখটা কত যেন অচেনা। মনে মনেই বলল, কে তুমি?

একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল রজনি। করজোড়ে আঁচলের কাপড় গলায় জড়িয়ে প্রণতভঙ্গিতে রজনি মাথা নীচু করল। ব্রহ্মচারী কেঁপে উঠল। অস্থির এক ভাব। হাত তুলতে গিয়েও যেন থমকে গেল।

দেব দর্শন। রজনি মনে মনেই বলল, তোমায় মুক্তি দিলাম ঠাকুর। মোহন কিছুই টের পায়নি।

বিহান তখনও ফুটেছে কী ফোটেনি। ব্রহ্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দির লাগোয়া ধরমশালার দোরগোড়ায়। কেয়ারটেকার বাবুটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সব শুনে বলল, উ লোগ তো চলা গিয়া।

অস্পষ্ট অন্ধকারে ব্রহ্মচারী দাঁড়ালেন নদীর সঙ্গমস্থলে। পুব পাড়ে তখন সূর্য ওঠার প্রস্ততিপর্ব। দু’হাত বুকের ওপর প্রণামের ভঙ্গিতে রেখে তিনি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বললেন, এবার গেরুয়া বসনের অধিকার দাও হে প্রভু।

অন্তরালে স্বামী ভূতানন্দ হয়তো হাসলেন।

পানিবাই

ঘটকপুকুরে যেতে চাইলে দুটো স্টপেজে নামা যায়। এক, ডাক্তারখানা স্টপেজ। এক কামরার একটা মাটির চালা, সামনে ছোট্ট বারান্দা। একসময় রুগির ভিড় উপচে পড়ত সেই বারান্দায়, ভেতরঘরে নড়বড়ে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকত প্রতাপ ডাক্তার। প্রতাপ কাঁড়ার, হোমিওপ্যাথ। এক শিশি সুগার অব মিল্কে এক ফোঁটা ওষুধ ফেলে সাত গাঁয়ের লোককে খাওয়াত, লোকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, ‘সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি’। সেই ধন্বন্তরি প্রতাপ ডাক্তারকে হঠাৎ একদিন সকালে কেউ দেখতে পেল না। চেয়ার, টেবিল আছে, খোপ-খোপ ওষুধের বাক্স আছে, তক্তাপোশে তেলচিটে বিছানা, নীচে স্টোভ. কালি-লাগা হাঁড়িকুড়ি, দড়িতে ধুতি-গামছা, সব যেমনকার তেমন আছে। শুধু মানুষটা নেই। কেউ বলল, স্বপ্নে আদেশ পেয়ে হিমালয়ে চলে গেছে ডাক্তার, কেউ বলে বাড়ি থেকে খারাপ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েছে। প্রতাপ ডাক্তার চলে যেতে সাত গাঁয়ের লোক কিছুদিন হা-হুতাশ করল, তারপর নতুন ডাক্তার খুঁজে নিল। কিন্তু ডাক্তারের ঘরটা তেমনই পড়ে রইল, থাকতে থাকতে জরাজীর্ণ হয়ে গেলেও ঠিক দাঁড়িয়ে রইল মাটির ওপর। আর বাস স্টপেজের নাম হয়ে গেল ডাক্তারখানা।

দ্বিতীয় স্টপেজের নাম ঘটকপুকুর স্ট্যান্ড। এখান থেকে রাস্তা একদিকে রায়দিঘি অন্যদিকে কাকদ্বীপের দিকে চলে গেছে। জায়গাটা সবসময়ই সরগরম। তিন-চারটে মিষ্টির দোকান, চপ-ফুলুরিও বেশ কয়েকটা, সারের দোকান, টেলারিং, ইদানীং একটা টিভি মেরামতের দোকানও খুলেছে পঞ্চায়েত প্রধানের ভাইপো নাড়ু। বিকেলে একটা রোল-চাওমিনের চলমান দোকানও বসে। তার গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ঘটকপুকুর রোল কর্নার’।

ঘটকপুকুর গ্রামে যেতে গেলে এই স্ট্যান্ড থেকে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। ডাক্তারখানা স্টপেজে নেমে অবশ্য সোজা ঢুকে গেলেই হল। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়, পুকুরে হাঁসের সাঁতার দেখতে দেখতে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশ দিয়ে সোজা ঘটকপুকুর হাটতলায় ঢুকে পড়া যাবে। এই হাটতলাটাই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামটা তাকে ঘিরে পদ্মের পাপড়ির মতো ফুটে আছে।

ডাক্তারখানা আর স্ট্যান্ড– এই দুই স্টপেজের মাঝে গ্রামে ঢোকার আর একটা তৃতীয় রাস্তা আছে। বাস ওখানে দাঁড়ায় না। যদি দাঁড়ায়, তবে হয়তো স্টপেজটার নাম হতো, কাওরাপাড়া স্টপেজ। ঘটকপুকুরের কোনও মান্যগণ্য লোককে প্রকাশ্যে এ রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখা যায় না। আগেকার দিনে বাড়িতে যেমন মেথর ঢোকার আলাদা পথ থাকত, এই রাস্তাটাও তেমনি। ভদ্রসমাজের অস্পৃশ্য, অব্যবহূত। আসলে এই পাড়ার বাসিন্দারাও তাই। পন্ডিতেরা বলেন এরা আগে ছিল জমিদারের পালকিবাহক, কাহার সম্প্রদায়। কাহার থেকে কাওরা। যারা পালকি না বইলে ভদ্রলোকের সভ্যতার গতিরুদ্ধ হয়ে যেত, অফিস-কাছারি, পালা-পার্বণে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত, এমনকী পালকি শুদ্ধু গঙ্গায় ডুবিয়ে পুণ্যের থলিটা বোঝাই করা যাদের দাক্ষিণ্যে, তারা নাকি এত নীচু জাত যে গ্রামের ভেতরে তাদের বাস চলে না, তাদের রাস্তাটাও বিপদে না পড়লে কেউ ব্যবহার করে না। তো সেই কাওরাপাড়ায় লকলক করে লাউডগার মতো বেড়ে উঠছে ফুল্লরা কাওরা। তাকে নিয়েই এই গল্প।

ফুল্লরা একরাশ গোবর কুড়িয়ে ঘরে ফিরে দেখল তার মা সনকা দাওয়ায় বসে চুল খুলছে। সে প্রায়ই দড়ি দিয়ে চুল বাঁধতে গিয়ে গিঁট ফেলে দেয়, তাই দড়ির বদলে অনেকসময় শাড়ির পাড় ছিঁড়ে নেয়। আজ মার কাঁচাপাকা চুলে লালরঙের শাড়ির পাড় কেমন বেখাপ্পা লাগল ফুল্লরার। মার সিঁথির জায়গাটা ফটফটে ফাঁকা। তার বাপ দুখে মারা গেছে দু-মাসও হয়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, দুখেকে খুন করা হয়েছে।

দুখে কাওরার স্থায়ী কোনও পেশা ছিল না। মাঝে মাঝে সে নিত্য শাহ-র সিমেন্টের দোকানে মাল বওয়ার কাজ করত বটে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই তাকে কাজ করবার মতো সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যেত না। সে পড়ে থাকত পঞ্চার তাড়ির ঠেকে কিংবা মণিকা-কণিকার বাড়ি। সেখানে মদের আসর বসত, তবে সেটা মুখ্য নয়। দুখে খুব ভালো গান গাইত। তার গলায় গোষ্ঠগোপাল দাসের ‘গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে মন প্রাণ দিয়া’ শুনে মহাপাতকের চোখেও জল আসত। তার গানের সঙ্গে নাল বাজাত সাগর। আর মণিকা-কণিকা, যাদের নামে গ্রামের সবাই বলে, তারা গ্রামের বুকেই, ভদ্রপাড়ায় লাইন খুলে বসেছে, তারা গানের মাঝে মাঝে মদ, চাট এবং হাসি পরিবেশন করত আর পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের আঁচল বার-বার খসে পড়ত।

এরকম অবস্থায় তাবড়-তাবড় ঋষিদেরই ধ্যানভঙ্গ হয়, দুখে তো কোন ছার! সে শুধু মনস্থির করতে পারছিল না, মণিকা না কণিকা– কে তার মন বেশি টেনেছে। নিজের এই সংশয়ে সে এতই নিবিষ্ট ছিল যে খেয়ালই করেনি, যে তার বাজনদার সাগর, তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে। এ বাড়িতে সাগরের যাতায়াত দুখের অনেক আগে থেকে, দুটি বোনকেই সে তার হাতের বাজনার মতোই ভালো বাজাতে পারে। তারাই যখন, দুখের গানে মজে, নতুন হাতে বাজতে চাইল, সে মেনে নিল না।

দুখে আর সাগর মাঝে মাঝেই দূর দূর গ্রামে মাচা প্রোগ্রাম করতে যেত। সেবার তারা গেল কাঁটাগাছি, কাঁটাগাছি ব্যবসায়ী সমিতির ডাক পেয়ে। ফেরার সময় সাগর একাই ফিরল, দুখে নাকি ওখান থেকে কোথায় চলে গেছে, কাউকে কিছু না বলে। কয়েকদিন পর দুখের বডি ভেসে উঠল খালের জলে। সনকা থানায় রিপোর্ট লেখাতে গিয়ে ফিরে এল। একে তো সাগর উঁচুজাত, তার ওপর সে পঞ্চায়েত প্রধানের লতায়পাতায় আত্মীয় হয়। সনকা চোখের জল মুছে বাড়ি ফিরে এল।

সনকার ফটফটে সাদা সিঁথিটা দেখে ফুল্লরার মনে আবার সেই ভয়ংকর দিনগুলো ফিরে আসে। সেই জল থেকে তোলা ফুলে ঢোল বডি, বাবা বলে চেনাই যায় না। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ফুল্লরা জানে তার বাবাকে ছুরি মেরে খুন করেছে সাগর। পুলিশের মুখ বন্ধ করলেও লোকের মুখ অত সহজে বন্ধ করা যায় না। ইস্কুলের টিউকলে জল নিতে গিয়ে শুনে এসেছে সে, গাঁয়ের বউ-ঝিরা সেখানে খাবার জল নিতে ভিড় করে সকালে-বিকেলে।

যত আগে গিয়েই লাইন দিক, ফুল্লরা জানে যে, সে জল পাবে সবার পরে। ছোটোবেলা থেকেই এমন দেখে আসছে। তখন বুঝত না। জেদ করে ওদের লাইনে দাঁড়াতে গিয়েছিল একবার। ওরা ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। খোয়ার ওপর পড়ে কপাল একটুর জন্যে ফাটেনি, কিন্তু মাটির কলসি ভেঙে গিয়েছিল। ছোট্ট ফুল্লরার কপালে গাঁদা পাতার রস লাগাতে লাগাতে তার মা বুঝিয়েছিল উঁচুজাতের জলের লাইন আলাদা, ওদের ছোঁয়া লাগলে যে জল ওরা খেতে পারবে না। ফুল্লরা বুঝতে পারেনি, সরকারি কলের জল ওদের ছোঁয়ায় কী করে অশুদ্ধ হতে পারে। তখনও ইস্কুল ছাড়েনি। খিচুড়ি ইস্কুল। সেখানে খুব করে প্রার্থনা গাইতে হতো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ গাইতে গাইতে ওর বুকে কীরকম একটা কষ্ট হতো। ওর মনে হতো, এখানে যে আগুনের কথা বলা হয়েছে, সেই আগুন তো বইয়ের অক্ষরের মধ্যে লুকোনো আছে। সেই আগুন যে ছুঁয়েছে, সে-ই শুদ্ধ। তার আবার জল-অচল কী? ইস্কুলে বেশিদিন যেতে পারেনি ফুল্লরা, কিন্তু গানটা ভোলেনি।

সবার পরে জল নিতে এখন আর কষ্ট হয় না। ও জেনে গেছে এটাই নিয়ম। কাওরাপাড়ায় দুখে কাওরার ঘরে জন্মালে এরকমই হয়। সেই জন্মদাতা বাবাও যদি ওরকম বেঘোরে চলে যায়। শ্যাওলা-জড়ানো, ফুলে ঢোল দুখের লাশ মনে পড়ে যায় বারবার ফুল্লরার।

সনকার চুল খোলা হয়ে গেছিল। সে কেমন চোখে ফুল্লরাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘ঘরে শ্যাম্পুর পাতা আছে, মাথা ঘষে চান কর। বিকেলে, তোর মামি গেলবার যে শাড়িটা দিয়েছিল, নীল করে, ওটা পরবি।’

ফুল্লরা অবাক হয়ে গেল। মার ভালো শাড়ি বলতে ওই একটাই। কোনওদিন চাইলেও পরতে দেয় না। বলে ছিঁড়ে যাবে। হরিসভায় মোচ্ছবের সময় তাদের পাড়ার মেয়েরা কত সেজেগুজে যায়। সেসময় কতবার শাড়িটা পরতে চেয়েছে ফুল্লরা, মা দেয়নি। আজ কী হল তার! সে তবু কিছু জিজ্ঞেস করে না মাকে। বাবা চলে যাবার পর মা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। দশবাড়ি খেটে খেটে সারাক্ষণ তেতেপুড়ে থাকে, কিছু জিজ্ঞেস করলেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

সে গোবরটা উঠোনে রেখে হাত ধুয়ে কোমরে বাঁধা ওড়নায় মুছে নিল। তারপর ঘরে এল। শ্যাম্পুর পাতাটা নেবে। নীচু ঘর, দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না। দেয়ালে একটা আয়না ঝোলানো আছে। তার ঘষা কাচে ফুল্লরা নিজেকে দেখার চেষ্টা করে।

এ গাঁয়ের অনেক মেয়েরই সকাল সকাল বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের সরকারি বয়সে পৌছনোর অনেক আগেই। শুধু গরিব ঘরে বা নীচু জাতের মধ্যে নয়, বড়ো বড়ো ঘরেও এটাই স্বাভাবিক। ভালো ছেলে পেয়ে গেলে সবাই হাঁকপাঁক করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। সে সামনে মাধ্যমিক থাকলেও। আর ফুল্লরা তো স্কুলেই যায় না। তারওপর বাবাও নেই। তাই তার এই বয়সে বিয়ে ঠিক হওয়ায় কেউ অবাক হল না। কিন্তু ছেলের বাড়ি কোথায় জেনে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। কথায় বলে, ‘কোনও কালে নেই ষষ্ঠীপুজো। একেবারে দশভুজো।’ একেবারে বম্বে। বম্বে তো একেবারে কল্পলোক। সেখানে ক্যাটরিনা কইফ, সলমন খান, শাহরুখ খান রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ভোরে সমুদ্র ধরে হাঁটলে বিগ বি-র সঙ্গে ধাক্বা লাগতে পারে। সেখানে শ্বশুরঘর করতে যাবে কাওরাপাড়ার ফুল্লরা কাওরা!

ফুল্লরার বন্ধুরা শুনে বলল, ‘তোর নাকি শাহরুখ খানের সঙ্গে বিয়ে!’

যদিও ঠাট্টা, তবু ফুল্লরার বুক তিরতির করে কেঁপে উঠল। সত্যি তার বিয়ে, তাও আবার বম্বেতে! মাঠে গোবর কুড়োনো, সেফটিপিন দিয়ে ফ্রক আঁটা, সবার শেষে জল নেওয়া– এই ছেঁড়াফাটা, তালিমারা জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে তার? শাহরুখ খান না হোক, তার বরের নাকি মেলা জমি-জিরেত, এখনকার মতো ভাতের ভাবনা থাকবে না বিয়ের পর। কিন্তু তাদের গাঁয়ের লোকগুলো কি হিংসুটে, কেউ একবেলা ভাত দেবে না, কিন্তু কু গাইতে ওস্তাদ। তাদের কাওরা পাড়ার বউ-ঝি থেকে শুরু করে, যে-বাবুদের বাড়ি মা কাজ করে, তারাও বলছে, ‘হুট করে কোথায় বিদেশ বিভুঁইয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললে, জানো তো, বিয়ের নাম করে মেয়ে পাচার চক্র চলছে রমরমিয়ে, মেয়েগুলোকে দিয়ে কী যে করাবে–’

তার ধলাদাদু তাকে পাচার করে দেবে! ভাবলেও হাসি পায়। বাবা মারা যাবার পর এই দাদুই তো তাদের টেনেছে সাধ্যমতো। ধলাদাদু, মার কীরকম কাকা হয়, বম্বের একটা ফ্ল্যাটে পাহারাদারের কাজ করে। সেই এনেছে সম্বন্ধটা। ছেলের বাড়ি বম্বে শহর থেকে একটু দূরে। বিট্টলপুরা বলে একটা গাঁয়ে। ছেলের বয়স নাকি একটু বেশি। ছেলের এক মেসো কলকাতায় থাকে, সেই এসে দেখে গেছে ফুল্লরাকে। মা যেদিন তাকে নীল শাড়ি পরে সেজেগুজে থাকতে বলেছিল, সেইদিনই। মেসোর নাম ভগবান দাস। পাকানো গোঁফে মোচড় দিতে দিতে সেই ভগবান দাস ফুল্লরাকে একটা প্রশ্নই করেছিল–

‘পিনে কা পানি আনতে কতদূর যেতে হয় বেটি?’

প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল, কিন্তু ঠিকঠাক উত্তরই দিয়েছিল। খুশি হয়েছিল ভগবান দাস। কে জানে, এক ঘণ্টা-দু ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর কথা তাকে এত মুগ্ধ করেছিল কেন। হয়তো সে পরখ করে দেখতে চাইছিল ফুল্লরার ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা। তারপর ফুল্লরাকে সুপুরি, রুপোর টাকা ও জরিন শাড়ি দিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেছিল ভগবান দাস।

কয়েকদিনের মধ্যেই নিত্য শাহ-র বাড়ি কাজ করতে করতে ফোনে শুভ খবর পেয়েছিল সনকা। ফুল্লরাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু জমি-জিরেত ছেড়ে ছেলে বিয়ে করতে আসতে পারবে না। ফুল্লরাকেই যেতে হবে। তাকে নিয়ে যাবে ভগবান দাস।

এতদিন গাঁয়ের লোকের নানান কথাতেও সনকার মন টলেনি। কিন্তু এখন বিয়ে হবে শুনে সে কেমন কেঁপে উঠল। বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, ভাষাও অন্য, মেয়েটাকে সে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সব সে জানে, আর কী-ই বা করার আছে তার? কিন্তু সাতপাকটা অন্তত যদি তার সামনে হয়ে যেত, বুকটা আঁটা থাকত। এই ভগবান দাস, যাকে সে একদিন মাত্র দেখেছে, তার হাতে একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে সঁপে দেবে? ফোনের মধ্যে তার আশঙ্কা টের পেয়েছিল ভগবান দাস, সে আশ্বস্ত করেছিল সনকাকে। ‘আরে বেটি, ঘাবড়াও মৎ। তোর মেয়েকে আমি কোনও কোঠিতে বেচতে যাচ্ছি না। সোজা শাদির মন্ডপে নিয়ে গিয়ে তুলব। আর তোর চাচা তো আছেই ওখানে।’

নির্দিষ্ট দিনে ভগবান দাস তাকে নিতে এসেছিল। নিত্য শাহ-র বউয়ের দেওয়া একটা পুরোনো কাপড়ের ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে ফুল্লরা আবিষ্কার করেছিল মা কখন যেন নীল শাড়িটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতদিন ঘোরের মধ্যে থেকে সে ভাবেইনি বিয়ে মানে মাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়া। নীল শাড়িটা তার সেই ভুলে থাকা ব্যথাটা খুঁচিয়ে দিয়েছিল। বিছানায় উপুড় হয়ে কেঁদেছিল ফুল্লরা।

নতুন জায়গায় ঘুম আসতে দেরি হয়। কিন্তু বিট্টলপুরায় এসে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ঘুম এসে গেল ফুল্লরার। কারণ দুদিনের ট্রেন জার্নিতে সে প্রায় ঘুমোয়নি বললেই চলে। মাকে ছেড়ে এতদূর চলে আসার কষ্ট একটা ফোড়ার মতো টাটিয়ে ছিল বুকের মধ্যে, তার ওপর অচেনা একটা লোকের সঙ্গে আসা, প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল হিংস্র নেকড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

স্টেশনে নেমে ধলাদাদুকে দেখে ওর মন অনেক হালকা হয়ে গেল। ধলাদাদু আজ যেতে পারছে না, তবে বিয়ের দিন অবশ্যই যাবে। তারপর দুবার বাস পালটে সন্ধে নাগাদ বিট্টলপুরায় এসে পৌঁছলো।

বাস থেকে নেমে সে দেখল পুরো গ্রামটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো। গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। বাস থেকে নেমে কাঁচা সড়ক দিয়ে অল্প একটু হেঁটে ওর শ্বশুরবাড়ি। একটা লোক আলো নিয়ে এগোতে গেছিল। উঠোন ঘিরে ছড়ানো ছিটোনো ঘর। লণ্ঠনের আলোয় ও বুঝতে পারল না ভালো। ওরা ঢুকতেই একদল বাচ্চা ছুটে এল। ওদের চিৎকার থেকে একটাই শব্দ বুঝতে পারল ফুল্লরা।

‘পানিবাই! পানিবাই!’

কাকে বলছে কথাটা? নতুন বউকে এরা পানিবাই বলে নাকি? ওকে হাত-পা ধোবার জায়গা দেখিয়ে দিতে গেল এক মহিলা। খুব শক্ত, হাড়-হাড় চেহারা, রাগি মুখ। সে দাঁতে দাঁত চেপে যা বলল, তা থেকে মোদ্দা কথা বুঝে নিল ফুল্লরা। মহিলা ওকে বলছে, এটা শুখা দেশ, বাংলার মতো হরা-ভরা নয়, তাই পানি কম খরচ করতে হবে।

তাদের ঘটকপুকুরে তাকে খাবার জল পাবার জন্যে সবার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু সে তো অন্য কারণে। সেখানে জলের ছড়াছড়ি। বাড়ির পেছনে হাঁসপুকুরে তারা ঝাঁপাঝাঁপি করে চান করত। আর এখানে দু-এক ঘটিতে তো পুরো গা-ও ভিজবে না। রাতের খাবারে মোটা মোটা রুটি আর বিচ্ছিরি স্বাদের একটা সবজি খেতেও ওর তত কষ্ট হচ্ছিল না, যতটা জলের জন্য হচ্ছিল।

রাতে ওকে শুতে দেওয়া হল একটা বুড়ির সঙ্গে। তাদের দেশে বয়স হলে সাদা বা হালকা খোলের শাড়ি পরে, এ বুড়ি পরে আছে ক্যাটকেটে সবুজ রঙের শাড়ি। তবে মানুষটা এমনি খারাপ না। শুয়ে শুয়ে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিল। একসময় বুড়ির হাত ওর কোমরে এসে থামল। কোমর টিপে টিপে বুড়ি যেন কী পরখ করার চেষ্টা করছে। হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে ফুল্লরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে নিজেও জানে না। মাঝরাতে হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। বিছানা হাতড়ে দেখল বুড়িটা নেই। ঘরের বাইরে থেকে মেয়েগুলোর কান্না আর পুরুষের চিৎকার ভেসে আসছে। শুনতে শুনতে ফুল্লরা আবার ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন ঘুম ভাঙল শক্ত এক হাতের ধাক্বায়। সেই রাগি রাগি বউটা ওকে ঠেলা দিচ্ছে।

‘এত বেলা অবদি ঘুমোলে পানি মিলবে?’

কে যেন পাশ থেকে বলল, ‘আহা, সে তো আজই নয়, আগে তো শাদি হোক।’

‘আরে রাখো তোমার শাদি, আজ যদি ঝুঁটি ধরে না তুলি, তবে আদত পড়ে যাবে বিছানায় শুয়ে থাকার।’

আরেকটি বউ অমনি ঝনঝন করে হেসে উঠল, ‘আহা কোন সুখে বিছানা আঁকড়ে থাকবে বলো, সে তো তুমিই দখল করে আছ!’

এই কথা শুনে রাগি বউটি দপদপ করে চলে গেল। অন্য বউগুলো, যারা ফুল্লরার বিছানার চারদিক ঘিরে ছিল, তারা বলল, ‘জলদি জলদি উঠে পড়, আজ না তোর শাদি?’

তাদের গাঁয়ে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু ফুল্লরার বুক কেমন ধক্ করে উঠল শুনে। ‘আজই শাদি! ধলাদাদু যে বলল তিনদিন পরে?’

‘আহা, এই তিনদিন পানি আনার জন্য অন্য বাই রাখবে নাকি?’

আসা থেকেই ‘পানি’ শব্দটা কতবার শুনেছে ফুল্লরা। মাথায় এখন যেন সেই জল টলটল করে উঠল। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। বউগুলো চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘হায় হায়! এই দুবলি পাতলি লেড়কি কী করে পানিবাই হবে? ভগবানচাচা কেমন মেয়ে ঢুঁড়ে আনল!’

পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘আশপাশের গাঁয়ে তো কেউ রাজি হল না। ভগবানচাচা তাই বলল, বাঙালি লেড়কিরা কথা শোনে, তার ওপর বাপও নেই।’

বিয়ের মন্ডপে বসেও ফুল্লরার মাথায় টলমলানি যাচ্ছিল না। পানিবাই! পানিবাই মানে কী! নতুন বউকে এদেশে পানিবাই বলে নাকি? ভগবানচাচাকে ও কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না। পেলে বলত মাকে ফোনে ধরে দিতে। মা এখন নিত্য শাহ-র বাড়ি ঘর মুছতে মুছতে জানতেও পারছে না তার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

নিজের চিন্তায় এতখানি ডুবে ছিল ফুল্লরা, যে সে বুঝতেও পারেনি বিবাহমন্ডপে কখন বর এসে হাজির হয়েছে। বাচ্চাদের ‘দুলহা আ গয়া, দুলহা আ গয়া’ চিৎকারে সে সচকিত হয়ে দেখল তার সামনে এক দীর্ঘদেহ, প্রশস্ত বক্ষ মানুষ, এদেশের রীতি অনুযায়ী মুখ ঢেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফুল্লরার বুক দুরদুর করে উঠল, সমস্ত ভয়, সন্দেহ, অপমান, ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে এইবার। তার কল্পলোকের শাহরুখ খান এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে বরমাল্য হাতে। কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘মুখ খোলো কিষণলাল।’ দুলহা মুখের ওপর থেকে চাঁদমালার মতো ঢাকা সরিয়ে নিল। অমনি ফুল্লরার নাকে এসে লাগল একটা পচা গন্ধ। বাবাকে জল থেকে তোলার পর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি তো এমন গন্ধ কোথাও নেই। চারদিকে ঘিরে থাকা বউ-মেয়েরা সুগন্ধি ফুল ছুঁড়ছিল, কিষণলাল কড়া সেন্ট মেখে আছে, তবে? আসলে বুড়ো মানুষদের শরীর থেকে একধরনের পচা গন্ধ বেরোয়, শিথিল চামড়া, নড়া দাঁতের গন্ধ, বহু বছর দুনিয়া দেখে ভেতরটা পচে যাবার গন্ধ। সামনে দুলহা সেজে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার বয়স সত্তরের কম নয়। লোকটা ভাবলেশহীন চোখে ফুল্লরাকে দেখছিল, আর ফুল্লরার ষোলো বছরের সবুজ লাউডগা শরীর গুলিয়ে উঠছিল। এই তার শাহরুখ খান! সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল।

জ্ঞান ফিরতে দেখল, সেই বুড়ি মহিলা তার চোখমুখে অল্প অল্প জলের ছিটে দিচ্ছে। জলের স্পর্শে আরাম হচ্ছিল ফুল্লরার। আবার মায়ের কথাও মনে পড়ছিল। সে ডুকরে কেঁদে উঠতেই বুড়ি তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, ‘দুলহার বয়স আর রূপ দেখে ফালতু কষ্ট পাচ্ছিস। যেমন নাম-কা-ওয়াস্তে শাদি, তেমনি নাম-কা-ওয়াস্তে পতি। তোর আসলি মরদ তো ওইটা।’ বলে কী যেন একটা আঙুল দিয়ে দেখায় বুড়িটা। তার আঙুল অনুসরণ করে ফুল্লরা দেখে ঘরের কোণে একটা পিতলের বিশাল কলশি। গড়নটা তাদের দেশের তুলনায় খানিকটা আলাদা, কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বেশি ভারী। এতে করে জল আনতে গেলে মোষের শক্তি দরকার। আচমকা তার মাথায় পর-পর কিছু দৃশ্য-শব্দ খেলে যায়, গত রাতে বুড়ির তার কোমর পরখ করা, দুবলি-পাতলি বাঙালি, পানিবাই! সে-ই পানিবাই নয়তো?

কান্নায় তার শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। বুড়ি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘পাগলি কাঁহিকা! এখনও বরের বয়স ভাবছিস বসে বসে। আরে, ও তোকে কোনওদিনই বিছানায় নেবে না। সে তো আছেই আশাবাই। ধরমপত্নী। তবে কি না, পুরুষের কাম, কখন কাকে দেখে জেগে ওঠে। কুছ সাল পহলে, এক বরসাতের রাতে, আশাবাই বাচ্চা বিয়োতে মাইকে গেছে, আমাকে ডাকল। তা কী করে না বলি বল, পানিবাই হলেও বউ তো বটে। শরীরের স্বাদ পেয়েছিল তো, তাই আমায় তাড়ায়নি। এখন তো আর পানি আনতে পারি না, তাও রেখে দিয়েছে। অথচ কত পানিবাই এল আর গেল।’

কান্না থামিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক ফুল্লরা বুড়ির দিকে তাকায়। এই বুড়ি কিষণলালের বউ!

বুড়ি বলে চলে, ‘আসলি বাত কী জানিস? এ হল শুখা দেশ। সহজে পানি মেলে না। পানি দু-তিন গাঁও ভেঙে আনতে যেতে হয়। সকালে গেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল তিনটে-চারটে। তা ঘরের বউ যদি পানি আনতে যায়, তবে ঘরের কাম-কাজ কী করে চলবে, খানাপাকানো, বালবাচ্চাদের পালপোষ কে করবে? তাই পানিবাইদের দরকার। শাদি তো একটা হচ্ছে, তাই মাইনে দিতে হয় না, ডাল-রুটি তো মিলবে দুবেলা। তা, কিষণলালের খুব বদনাম, বউটাও রাগি, তাই এখানকার কেউ আর পানিবাই হয়ে আসতে চায় না। একজনকে তো পিটিয়েই…’ বুড়ি কী যেন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। ফুল্লরা হাঁটুর ওপর মুখ রেখে সেই নৈঃশব্দ্য থেকে কিছু খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করে, জলের মতো। শুখা দেশে চোখের জলও যে শুকিয়ে যায়, কে জানত!

দূরে দূরে ছোটো কয়েকটা টিলা। পশ্চিমের টিলার পেছন থেকে কমলা আলোর বলটাকে আস্তে আস্তে নেমে যেতে দেখল ফুল্লরা। সূর্য ডুবছে। আজ তার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখানকার বউরা মাথায় কলশি নিয়ে চলতে পারে। সেটা তার এখনও অভ্যাস হয়নি। সে কলশি নেয় কাঁখে। প্রথম প্রথম এত ভারী কলশি বইতে পারত না, একবার তো জলভরা কলশি দরজার কাছে পর্যন্ত এনে ফেলে দিয়েছিল। সেজন্য আশাবাই খুব মেরেছিল তাকে। রাতে খেতেও দেয়নি। গায়ের ব্যথায় সে পরেরদিন উঠতে পারেনি, জল আনাও হয়নি। সেই থেকে আশাবাই তাকে মারে না, কিন্তু বোলি বড়ো তীক্ষ্ণ তার। চাবুকের মতো সপাং করে গায়ে বেঁধে।

কিষণলাল বলে যে-লোকটা তার স্বামী, সে অবশ্য কিছু বলে না। উঠোনে পাতা চৌপাইতে বসে শুধু চোখ দিয়ে অনুসরণ করে তাকে। সে দৃষ্টি দেখলেই গা ছমছম করে ফুল্লরার। কারণ কিষণলাল তাকে যে দেখছে, সেটা আবার আশাবাই-এর নজর এড়ায় না। একসঙ্গে দুজোড়া চোখের ভার বহন করা কঠিন।

অন্যদিন ঠাঁ ঠাঁ দুপুর রোদে সে ফেরে। আজ রোদ পড়ে গেছে। অত কষ্ট হচ্ছে না তার। কিন্তু মাসিক শুরু হওয়ায় কোমরে সে আর কলশি রাখত পারছে না। এবার থেকে এদেশের বউ-ঝিদের মতো মাথায় কলশি বওয়া অভ্যাস করতে হবে তাকে।

রোদ নেই। তবু কলশি নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা গাছের ছায়া খুঁজল ফুল্লরা। গাছ, গাছের ছায়া তাকে বাংলার কথা, নদীর কথা, মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই বিয়ের দিন মাকে একবার ফোন করেছিল ভগবান চাচাকে ধরে করে। তারপর কত দিন, কত মাস হয়ে গেল কোনও খোঁজ খবর নেই। কিষণলালের একটা মোবাইল আছে, সারাক্ষণ সে সেটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোনও বরসাতের রাতে সে যদি ফুল্লরার শরীর চায়, তাহলে, কিষণলালের মোবাইল নাগালে পেয়েও, মাকে ফোন করা হবে না ফুল্লরার। মার তো ফোন নেই। মাকে ফোন করতে হবে দিনের বেলা, মা যখন কারও বাড়ি কাজ করে। জল আনতে আসা-যাওয়ার পথে কোনও বাজার পড়ে না, যে সেখানে একটা ফোনের বুথ খুঁজে ফোন করতে পারে। তার কাছে অবশ্য পয়সা নেই, পানিবাইরা তো পেটখোরাকি, হাতে পয়সা পায় না। কিন্তু তার নাকে এককুচি রুপোর নাকফুল আছে, বাবার শেষ স্মৃতি। ফোনের বুথ পেলে ওই ফুল দিয়ে সে মাকে ফোন করবে। মা যেন ধলাদাদুকে পাঠিয়ে তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়।

খুঁজতে খুঁজতে ফুল্লরা দেখল দূরে একটা শিমুল গাছ। মাংসল লাল ফুলে ছেয়ে আছে। শিমুল ফুল ফুটেছে! তার মানে এটা বসন্তকাল! আর কদিন পরেই বৈশাখ মাস পড়বে, তাদের হরিসভায় মোচ্ছব হবে, তাদের পাড়ার মেয়েরা সেজেগুজে গিয়ে কত মজা করবে, শুধু সে-ই থাকবে না। সবাই জানবে যে শাহরুখ খানের…

হঠাৎ শিমুলফুলের রং দেখে বুক ধক্ করে ওঠে ফুল্লরার। বসন্ত এসে গেছে! তার মানে একদিন বর্ষাও আসবে। আশাবাই-এর আবার গর্ভ হয়েছে, বুড়ি, যার নাম যশোমতী জানিয়েছে তাকে। বর্ষাকালেই হয়তো সে মাইকে যাবে। সেইসময়, অন্ধকার রাতে, কিষণলালের বুকে তৃষ্ণা জেগে ওঠে যদি? বাংলার শ্যামল-সবুজ জল-ছলছল শরীর পান করার সাধ জাগে তার? যশোমতী বলেছে তাতে অন্যায় কিছু নেই । কিষণলাল তো তার শাদি করা মরদ, সে তার শরীর নিতেই পারে। কিন্তু আশাবাই-এর মতো ঘর বা বিছানা সে পাবে না কোনওদিন। কিন্তু কিষণলালের ইচ্ছেয় সায় দিলে আখেরে তারই ভালো। যখন ফুল্লরা একদিন বুড়ি হয়ে যাবে যশোমতীর মতো, আর পানি আনতে পারবে না দূর গাঁও থেকে, তখন, কিষণলালের মনে জাগরুক থাকতে পারে তার শরীরের স্মৃতি, সে হয়তো তাড়াবে না ফুল্লরাকে। তা না হলে রাস্তায় রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াতে হবে তাকে।

ফুল্লরা কি তাহলে সারাজীবন জল বয়ে আনবে একটা সংসারের জন্য, যে-সংসারটা তার নয়। তার নিজের আনা জলে দু-ঢোঁকের বেশি অধিকার থাকবে না তার? জল আনতে আনতে যশোমতীর মতো বুড়ি হয়ে যাবে সে? তখন তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে, যদি না কোনও বরসাতের রাতে কিষণলালের ইচ্ছেয় সে সাড়া দেয়?

ভাবতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। শিমুল ফুলের টকটকে লাল রং যেন বিপদ সংকেতের মতো তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। বসন্ত থেকে বর্ষা আর কতই বা দূর। তাকে পালাতে হবে। তাকে এখনি পালাতে হবে। দৌড় শুরু করার আগে সে নিজের আনা জল, কলশি কাত করে আঁজলা ভরে আশ মিটিয়ে খেয়ে নেয়। তারপর ধাক্বা মেরে উলটে দেয় কলশিটা। জল মাটিতে গড়িয়ে যায়, শুখা মাটি তা শুষে নেয় মুহূর্তে।

অনেকক্ষণ থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিলেন ইনস্পেকটর ঘোসলে। মেয়েটার সাজপোশাক মারাঠি গাঁয়ের বউয়ের মতো, কিন্তু ওর সবুজ পানপাতার মতো মুখ, নরম চাউনি বলে দিচ্ছে ও বাঙালি। কিছুক্ষণ আগে তিনি এক দল বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করেছেন মুম্বইয়ের এক কুখ্যাত কোঠি থেকে। এদের কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দুজন প্রতিনিধি এসেছে কলকাতা থেকে। তিনি নীচুগলায় তাদের সঙ্গে কীসব বলেন…

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা থামার পর টিভি ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েগুলোর ওপর। সবাই ওড়না বা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফেলল অমনি। শুধু একটা মেয়ে উদাসীন মুখে বসেছিল। সাংবাদিকদের হাজার প্রশ্নের উত্তরে যে শুধু একটাই কথা বলল, ‘পানিবাই’।

আবার ইস্কুলের সামনের টিউকল থেকে জল নিতে এসেছে ফুল্লরা। আগে যেমন আসত। কিন্তু ঠিক আগের মতো যে আর সবকিছু নেই তা সে বুঝতে পারছে। আগের মতো জলের জন্য সবার পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে তাকে দেখে বউদের এরকম কানাকানি, গা-টেপাটেপি ছিল না। সেদিন হাওড়া স্টেশনের ছবি অনেকেই দেখেছে টিভিতে। ওকে মুম্বইয়ের কোঠি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, এরকম একটা খবর রটে গেছে চারদিকে। তাতে নতুন করে কিছু ক্ষতি হয়নি, আগেও ওরা একটেরে কাওরাপাড়ায় আধপেটা খেয়ে থাকত, এখনও তাই। মায়ের কাজগুলোও যায়নি, বরঞ্চ তার মেয়ের মুখ টিভিতে দেখা গেছে বলে খানিকটা সমীহ তৈরি হয়েছে। তবে সবাই সনকাকে বলছে, ‘আগেই তোমাকে বলেছিলাম, শুনলে না।’

তবে লাভ একটা হয়েছে, কলকাতা থেকে ভালো শাড়ি-জামা পরা, চশমা চোখে একদল মহিলা দামি গাড়ি চেপে এসেছিল শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে। তারা ওকে শহরের মহিলা স্বনির্ভর কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। কাজ শেখার পাশাপাশি কিছু রোজগারও হবে।

সবার জল নেওয়া হয়ে গেছে ভেবে ফুল্লরা তাড়াতাড়ি তার প্লাস্টিকের বোতল কলের মুখে বসাতে গেল। ঘোষেদের মেজোবউয়ের যে আর একটা বোতল বাকি আছে সে দেখতে পায়নি। মেজোবউ অমনি খরখরে গলায় বলে ওঠে, ‘আরে ছুঁড়ি, মর মর। তোকে ছুঁয়ে আবার অবেলায় চান করব নাকি? একে কাওরা-হাঁড়ি, তারওপর দিল্লি বোম্বে সৃষ্টি জজিয়ে এসেছিস!’

শুনে শুনে অভ্যস্ত, তবু খামোখা চোখে জল এল ফুল্লরার। কয়েক মাস আগেও তার আনা জলের জন্য হাঁ করে থাকত আশাবাই আর তার ছেলেমেয়েরা। কিষণলাল লোটা ভরে পানি খেয়ে তৃপ্তিতে  বলত ‘আঃ’। ফুল্লরা বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করলে যশোমতী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘লোককে পানি পিলানা বড়ো পুণ্যের কাজ রে। পানিবাই কি যে সে হতে পারে?’ কয়েক মাসের তফাতে, সেই একই জল, তার ছোঁয়ায় অশুদ্ধ হয়ে গেল!

বিকল্প

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুলল হরিয়ালি। কোলে দু বছরের ছেলে-সহ মেয়ে জামাই। জামাইয়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট, মেয়ের মাথায় এক গলা ঘোমটা যদিও এটা তার বাপের বাড়ি। যদি সব ঠিকঠাক থাকত, তাহলে ঘোমটার বহর থাকত না।

চল টুসু জলকে যাব, রানিগঞ্জের বড়তলা ঘুইরবার বেলা দেঁখায় আইনব কয়লা খাদের জলতুলা।

এখন পৌষ মাস। মাসভর সন্ধ্যা বেলায় টুসু গান শোনা যায় এই পাড়ায়। ভদ্রলোকের ভাষায় এটা বাউরি পাড়া। তবে এখানে বেশ কয়েক ঘর শুঁড়ি, গোয়ালা থেকে দু ঘর বিহারি, আর এক রাজপুত পরিবারেরও বসত। দয়াল সিং-এর পূর্বসূরিরা নিজেদের ঠাকুর পরিচয় দিয়ে থাকলেও অর্থনীতির কারণে এই অন্তজ সমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিম বর্ধমানের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই অঞ্চলে মানভুঁইয়া বাংলার সাথে হিন্দি-বিহারি মিশেল দিয়ে কথা বলে অবাঙালি পরিবারগুলো যারা দীর্ঘ দিন বাঙালিদের মাঝে থেকে বাংলাটাই স্কুলে মাতৃভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছে। অবশ্য যাদের পয়সা আছে তারা ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে যায়, তাদের কারও কারও দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। টুসু যদিও অঘ্রাণের শেষে আমন ধান তোলার পর এক ধরনের শস্যোৎসব, টুসু পাতাও হয় একটি সরায় চালের গুঁড়ি মাখিয়ে, তার ওপর তুষ ও ধান বিছিয়ে, দূর্বা ঘাস ও আলো চাল লাগানো গোবরের ঢেলা রেখে। কিন্তু পুরুলিয়া ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই ডিশেরগড় সাঁকতোড়িয়া অঞ্চলে ইদানীং নিম্ন বর্ণের যে পরিবারগুলি টুসু বা ভাদু পরবের ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে তারা আর কেউই বলতে গেলে কৃষিজীবী নয়। দু চারটি পরিবারের আবাদি জমি আছে, চাষও করে। তবে তাদের ছেলেপুলেরা আর হাল ধরতে চায় না। দেখেছে কয়লার কারবারে অনেক বেশি লাভ। জমিতে হাল দিলে অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য ধরার পরেও প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা। সেখানে আরও খানিকটা গভীরে খুঁড়ে যদি নিশ্চিত আমদানি হয় তো মানুষ সেদিকেই তো ঝুঁকবে। চোরা খাদানের জেরে ধস নামলে ইসিএল-কে দোষারোপ করে ক্ষতিপূরণ চায় স্থানীয় বাসিন্দারা, অন্য দিকে বৈধ বা অবৈধ খনি থেকে কয়লা চুরি বহু লোকের স্বীকৃত পেশায় দাঁড়িয়ে গেছে।

এবার টুসু পাতা হয়েছে মাখন বাউরির ঘরে। তার মেয়ে ময়না আসরের মধ্যমণি। কন্যাকে ঘিরে পাড়া প্রতিবেশীর বেশ একটা সমীহ ভাব। সে নাকি একবার বাজারের মাঝে হাটবারে চারটে ছেলেকে কোমর থেকে বেল্ট খুলে পেঁদিয়েছিল। ছেলেগুলো তাকে জিন্স, টি-শার্ট পরা দেখে শিস দিয়েছিল। ময়না তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দাখিল হয়েছে। হতে পারে কোটায় সুযোগ, তবু বাউরি ঘরের মেয়ে বাবুঘরে বাসন না মেজে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছে দেখে, ওই অঞ্চলের অনেকেই সমীহ মিশ্রিত কৌতূহলের চোখে দেখেছিল সেইসময়। দুহাজার সালের পর যেমন ঘরে ঘরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উৎপাদন হচ্ছে, তেমন হতো না নব্বইয়ের গোড়াতেও। ময়নাকে নিয়ে মেয়েদের মুখে মুখে টুসু গানও রচিত হয়েছে।

ময়নারানি বাপ-সোহাগি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে গো

তার সাথে লাইগতে গিয়ে চুয়াড় ব্যাটা মরে গো।

আসরে ছিল লাখো। লাখো বাউরি নয়, সিং। জশাইডি গ্রামের একমাত্র রাজপুত পরিবারের মেয়ে। নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিলেও ভদ্রলোকের ভাষায় বাউরি পাড়ার লোক হিসাবে দেগে গেছে। তাছাড়া তপশিলি জাতিভুক্ত হতে পারলে সুযোগসুবিধা আছে বলে তার দুই ভাই রাজু আর কিসান মিথ্যেটা ভাঙাতে খুব একটা উৎসাহী নয়। তারা বরং স্থানীয় কাউন্সিলরকে ধরে তপশিলি জাতির শংসাপত্র যোগাড় করে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছে। তবে দুজনেই অলস ছাত্রজীবন না কাটিয়ে যথাক্রমে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পরেই পড়াশুনোর ইতি টেনে স্বনির্ভরতার তাগিদে ঝালবাগান মোড়ে পান সিগারেটের গুমটি দিয়েছে। লাখো গ্রামের বাউরি আর গোয়ালা মেয়েদের চেয়ে নিজেকে আলাদা ভাবে না। বাংলাতেই কথা বলে আর দুর্দান্ত ভাদু, টুসু এমনকী মনসামঙ্গল গাওয়ার দৌলতে এই জাতীয় আসরে তার জায়গা বাঁধা।

ময়নার বীরত্বের কাহিনি আর তাকে নিয়ে বাঁধা গান শুনতে শুনতে লাখো ভেতরে ভেতরে বেশ উদ্দীপিত বোধ করছিল। তাকে স্কুল, দোকান, কাজের বাড়ি ইত্যাদি যাওয়া-আসার পথে কয়েকটা ছোকরা প্রায় রোজ উত্যক্ত করে। আজেবাজে ইঙ্গিত করে, সাহেব মেমদের কুৎসিত কাণ্ডকারখানার ছবি দেখাতে চায় জোর করে। শ্যামল নামের ছেলেটা একবার প্রেমপত্র দিয়েছিল। কিন্তু সে একা আসে না, তার সাথে তার তিনজন বন্ধুও থাকে যারা খ্যা খ্যা করে হাসে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রস্তাব দেয়। ওদের চোপা করেছে, সবাই মিলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ঘিরে ধরলে হাতে পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করেছে, ওদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে বলে সতর্ক করতে চেয়েছে, কিন্তু কোনওদিন একটা চড় মারার সাহস হয়নি।

কী করে হবে? ওরা চারজন লাখো একা। ওরা বড়ো ঘরের ছেলে, লাখোর মতো স্কুল করার পর লোকের বাড়ি কামিন খাটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় একথা ওদের বাড়ির লোক অবিশ্বাস না করলেও স্বীকার করতে চাইবে না। অন্তত শ্যামল, অমিতাভরা তাই দাবি করে লাখোর দরবার করার হুমকি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। ময়নার কথা শুনতে শুনতে লাখো কল্পনা করতে লাগল, হারামিগুলো আবার লাগতে এসেছে, আর ও পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিচ্ছে। তার কোমরে বেল্ট নেই তো কী, গাছের ডাল কি রাস্তার থান ইট তো আছে। আহা যদি জিন্স পরতে পেত কস্তুরী, বর্ণালিদের মতো!

গানে গলা মেলাতে গিয়েও লাখো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেগুলোর সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। খারাপ মন্তব্য থেকে এবার হাত ধরে টানাটানি, জোর করে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা এইসব শুরু করেছে। যা সব ছবি দেখায় অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার সাথে সাথে ভয়ে হাত-পা পেটে সিঁধোয়। আবার শুনতে পায় ছোটো বোন গৌরীকে নাকি তাদের সাথে হাহাহিহি করতে দেখা গেছে। বোনকে সাবধান করতে গেলে সে উলটে দিদিকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দেয়।

‘কী রে লাখো কী ভাবছিস? চুপচাপ ক্যানে?’

‘বড়ো জাড়াচ্ছে। যা ঠান্ডা।’

আজ চাউড়ির দিন, গোবরমাটি দিয়ে ঘর নিকোনোর কথা। মাখন বাউরির যেহেতু পাকা ঘর তাই ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। যে তোলা উনোনটায় বাঁউড়ির দিন পিঠে হবে তাতে গোবর-মাটি লেপা হয়েছে। সেটাই জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে বারান্দার মধ্যিখানে আর তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আঁচ পোয়াতে পোয়াতে মেয়ে বউরা আসরে মেতেছে। আগামীকাল টুসুর জাগরণ অর্থাৎ নিশিপালন। টুসুর ভোগ হিসাবে বাড়িতে বাড়িতে হলুদ মুড়ি, ছোলা-মটর ভাজা, জিলিপি ও নানা ধরনের মিষ্টি আয়োজন হলেও জাগরণের জন্য বাঁউড়ির মূল আসর হয় মাখন বাউরি আর গণেশ মণ্ডলের বাড়ি। এদের বাড়িতে গ্রামের সবচেয়ে বড়োলোক আর বনেদি পরিবারের মহিলাদেরও নেমন্তন্ন থাকে। তারা ছোটো জাতের বাড়িতে চালের তৈরি পিঠে না খেলেও, শুকনো ছোলা, মটর, মিষ্টি দাঁতে কেটে ধন্য করে দেয়। লায়েক গিন্নির সাথে ঠিক ছোঁক ছোঁক করে তার অকালকুষ্মাণ্ড মেজো ছেলেটাও এসে হাজির হয়। সে নাকি গাড়ি করে মাকে পৌঁছোতে আসে। ওদের চারজন ড্রাইভার, সবাই কি একসাথে ছুটিতে থাকে নাকি এদিন? আসলে কিংশুক আসে মেয়েদের আসরে চোখ দুটো একটু সেঁকে নিতে। শীতের মধ্যে সবার শরীর সোয়েটার চাদরে ঢাকা থাকলেও, কে পেংলি আর কে ডবকা ঠাওর করা যায়। ছেলেকে নিয়ে লায়েক গিন্নি, তার জা ও ভাসুরঝি ভেতরে ঢুকতে সবাই একটু সচকিত হয়ে উঠল। তাদের বসার জন্য দালানে চেয়ার পেতে দেওয়া হল।

‘এই লাখো, তুই একটো গান ধর ক্যানে, তুর পছন্দের গান।’ বলল স্বয়ং ময়না।

কিংশুকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে যা একখানা হাড়হিম করা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিল যে কল্পিত, সাহসিকতা ভুলে আগামীদিনের সম্ভাব্য বাস্তবতা মনে করে লাখোর ভেতরটা গুড়গুড় করতে লাগল। সে সকলের তাড়ায় ধরল–

‘আদারে-বাঁদাড়ে ঝিঙা ও ঝিঙা তুই বাড়িস না।

আমার ভাদু শিশু ছিলা ঝিঙা রাঁইধতে জানে না।’

‘ইটো তো ভাদু গান বটে। তুর কী হঁইছে বলত? আইসে অব্দি আনমনা।’

‘আরে, ভাদুর জায়গায় টুসু বসায়েন দিলেই উটো টুসু গান হঁইয়ে যায়। তা উয়ার কারও সাথে কুছু চক্বর-টক্বর চইলছে বুঝি?’ ওপাশ থেকে ফোড়ন কাটল কিংশুক।

অতসী কিংশুকদাদাবাবুর রসিকতায় হেসে গান ধরল– ‘আমার টুসু মান কইরেছে

মানে গেল সারা রাইত।

খুল টুসু মানে কপাট আইসছে তুমার প্রাণনাথ।।’

সমবেত গানে গলা মেলালেও লাখোর ভেতরে স্বস্তি নেই।

কিংশুকের জ্বলন্ত চোখের সাথে চোখাচোখি হলেই ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জ্বালায় সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছিল। কিংশুক দেখতে পেয়ে খুব আন্তরিকতাপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কী হল? শরীর খারাপ নাকি? ইস্কুলে দিদিমণি কুছু বইলছে, মেইরেছে?’

লাখো মাথা নাড়ে। প্রথমটায় জানাতে না চাইলেও সহানুভূতির স্পর্শ পেয়ে সব উগরে দিয়েছিল। কিংশুক লাখোকে ঝালবাগান মোড়ের গরাইদের বাঁধা চায়ের দোকানে বসিয়ে একরকম জোর করে তেলেভাজা, জিলিপি আর চা খাওয়ায়। বাড়িতে এইসময় স্কুল থেকে ফিরে ভাতই খায় লাখো। খেয়ে অসিত চৌধুরীর বাড়িতে কাজে যায় বিকেলের বাসন মাজতে।

কাজটা সে নিজের মর্জিমাফিক করে। খেয়াল খুশি মতো কামাই, বেলা পার করে চৌধুরী কর্তাগিন্নির মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে যখন খুশি হাজিরা দিলেই হল। তবে বিকেলে ওবাড়ি কাজ করতে যাওয়ার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে। চৌধুরীদের বড়ো মেয়ে ওই একই স্কুলে পড়ে। বয়সে লাখোর চেয়ে ছোটো হলেও দু ক্লাস উঁচুতে। সেও তৈরি থাকে খেয়েদেয়ে মার্বেল নিয়ে গুলি খেলার জন্য। দায়সারা কাজ চুকিয়েই লাখো মেতে ওঠে মনিবকন্যার সঙ্গে গুলি খেলায়। মৈত্রেয়ী হারলে আবার ঝালবাগান মোড়ের বুড়োর দোকান থেকে মার্বেল কিনে আনে মায়ের কাছে চেয়েচিন্তে পয়সা জোগাড় করে। কিন্তু লাখো হারলে নতুন গুলি কেনার পয়সা লাগে না। সে জানে মিতু অর্থাৎ মৈত্রেয়ী কোথায় নিজের মার্বেলের বাক্স লুকিয়ে রাখে। লাখোর চুরির ঠেলায় মিতু কতবার যে নিজের গোপন প্রকোষ্ঠ লুকিয়েছে তার লেখাজোকা নেই। যখনই গুলি বার করতে যায় দেখে গুনতিতে খান পাঁচ ছয় কি আরও বেশি কম পড়ছে। লাখোর ওপর চোটপাট করলে মিতুর মা মিতুকেই বকে। কাজের মেয়ে ছাড়া তার চলে না। আর কাকাবাবু গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করার বদলে বউয়ের ওপর চোটপাট করে বেশি। তাই কাকিমা ঝিয়ের হাতেপায়ে ধরে খোশামোদি করে। লাখোও সেই সুযোগে এনতার বেয়াড়াপনা করে নেয়।

কয়েক দান গুলি খেলার পর মিতুর বন্ধুরা ডাকতে আসে খেলার জন্য। বুড়ি-চু, ডাংগুলি, কবাডি, এক্বাদোক্বা, লুকোচুরি, নামডাকাডাকি, স্কিপিং– কতরকম। খেলার ভেন্যু নির্ভর করে কী খেলা হচ্ছে তার ওপর। কবাডি, বুড়ি-চু, কিতকিত কিংবা এক্বাদোক্বা হলে সাধারণত ডিপিএস-এর স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবের শান বাঁধানো ব্যাডমিন্টন কোর্টে চলে যায়। অন্যান্য খেলা কারও বাড়িতেও হতে পারে।

এমনিতে মিতুর বন্ধুরা কামিনের সঙ্গে গল্পগাছা না করলেও, খেলায় নিজেদের দল ভারী করার জন্য লাখোকে নিয়ে টানাটানি করে। মিতু তো মাছ মাংস দুধ ফল খেয়েও পেংলি, ক্ষীণজীবী। ওদিকে লাখো মাড় খেয়েও চারটে মিতুকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে। বুড়ি-চু, ডাংগুলি আর কবাডিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্র পাড়ার কোনও কোনও ছেলে পারে তাকে মাত দিতে। এই তো আজ বিকেলেও কবাডিতে কস্তুরীদের দলের খেলোয়াড়দের বলে বলে আউট করেছে। গাছে চড়াতেও তার জুড়ি নেই। পরের গাছের ফল-পাকুড়কে নিজের ভাবতে হলে এটুকু দক্ষতা তো রাখতেই হবে। আগে মারামারি লাগলে মেয়েরা গায়ের জোরেও কেউ তার সঙ্গে পেরে উঠত না। এখন বড়ো হয়ে গেছে বলে হাতাহাতি লাগে না। না হলে গুলি চুরির জন্য রোজই খণ্ডযুদ্ধ বাধার কথা। এখন মিতুদের বন্ধুরা প্রায় দিনই ছুটোছুটি খেলার বদলে রাস্তায় পা়য়চারি করতে করতে গালগল্প করে। ভদ্রলোকের মেয়েদের সঙ্গে ঝিগিরি করা মেয়ের তেমন প্রাণের কথোপকথন থাকে না। তাই ইদানীং খেলার পরিকল্পনা বাতিল হলে লাখোকে বিকেলটা নিজের সমতুল্য সামাজিক পদমর্যাদার সঙ্গী জুটিয়ে আড্ডা মারতে হয়। নাহলে গাছের মগডাল হোক কি কিতকিতের কোর্ট– লাখোকে যশাইডি আর ঝালবাগানের মেয়েরা সমঝেই চলে। এমন ডাকাবুকো মেয়ে কিনা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।

সেদিন কিংশুক লাখোকে বলেছিল, ‘পা থেইক্যে জুতাটো খুলে মুখে মাইরতে লারলি বানচোদগুলার? আমি থাইকলে দেখাইন দিথম মজা। আমার গাঁয়ের বিটির গায়ে হাত দেয় শূয়ারের বাচ্চাগুলান? আমায় আগে বলিস নাই ক্যেনে? বিচি কেইটে হাতে ধরায়েন দিথম। কিংশুক লায়েককে সবাই চিনে। তুঁই ভাবিস না। উয়াদের আমি খবর লিছি।’ দোকানে কিংশুকের জনা সাতেক বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা কিংশুকের দাদা কুন্তলের অ্যাকাউন্ট-এ ধারে চা, সিঙাড়া, মিষ্টি খাওয়ার বিনিময়ে লায়েক ভ্রাতাদ্বয়ের উচ্চারিত কথার দোয়ারকি দেয়।

আশ্বাস পেয়ে লাখো খেয়ে নিল। কিংশুক তার পিঠে কাঁধে মাঝেমাঝে হাত বোলাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে বলল, ‘চল তুখে ঘর পৌঁছায়েন দি।’ লাখো তার ষোলো বছরের জীবনে এমন আজব কথা কোনওদিন শোনেনি যে তাকে কেউ ঘরে পৌঁছোতে চাইছে। ভেতরটা একরকম পুলকে উছলে উঠলেও কুণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘একা যেইতে পাইরব। তুমি আপনার বন্ধুদের কাছে থাক।’

কিংশুক দায়িত্ববান বড়ো দাদার মতো গ্রামতুতো বোনের রক্ষক হয়ে কিছুদূর গিয়েই দুধনাথের গোয়ালটার আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে আচমকা লাখোকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। লাখো ছাড়ানোর চেষ্টা করলে তার ডান হাতখানা সজোরে পেছন দিকে মুচড়ে ধরল।

‘আঃ! আমার লাইগছে। ছেইড়ে দাও।’

‘তুকে আমি বদমাস ছিলাগুলার হাত থেইকে বাঁচাব, বদলে আমারও তো কুছু চাই।’

‘আমায় ছাড়ো বলইছি। না তো খুব খারাপ হবেক। আমি কাকিমাকে বইলে দুবো।’

‘আমি শ্যামলার পারা কেরানির ব্যাটা লই। লায়েক বাড়ির ছিলা, আদিত্য লায়েকের ব্যাটা, কুন্তল লায়েকের ভাই। তুর মতো বিটিছিলাকে আমি পায়ের জুতা বানায়েঁ রাইখতে পারি। বেহায়া মাগি ইস্কুল গিয়ে পড়াশুনার বদলে রাস্তার ছিলাদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করিস? দাঁড়া আমি তুর বাপকে জানাছি। মদনার কাছে আট গাড়ি গোবর চেঁইছিল দাদা, চার গাড়ি দিয়ে পাত্তা নেই। মদ গিলে পইড়ে থাকে, আমরা ডাইকলে আসে না।’

‘তুমরা টাকা বাকি রাখো যে।’

‘কী বইললি, খুব বাড় হঁইনছে লয়? যত বড়ো মুখ লয় তত বড়ো কথা? বাপ আর বিটি দুজনাকেই শায়েস্তা কইরতে হবেক।’

তারপর থেকে মা কালীকে ডাকতে ডাকতে একদিকে শ্যামলবাহিনী আর একদিকে কিংশুক লায়েককে চুক্বি দিতে হচ্ছে। শ্যামলরা সাঁকতোড়িয়া কলোনিতে থাকে, কিন্তু কিংশুক তো একই গ্রামের ছেলে। পৌষ পরব, পিঠেপুলি, টুসু গান– সব আনন্দ ভয়ের মেঘে ঢেকে গেছে। ও অন্যমনস্ক হবে না তো কী? মাখন বাউরির মেয়ের বীরত্বের কথা স্মরণ করেও মনে বল পাচ্ছে না।

নদী ঘাটে ভিড় দেখলে বোঝা যায় পুণ্যপিপাসার কাছে শরীরের কষ্টবোধ তুচ্ছ। এইসময় সকালের তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়, চার-পাঁচ প্রস্থ গরম জামা পরেও পাঁজরের কনকনানি কাটতে চায় না। দামোদরের হিমেল জলে এরই মধ্যে নানা বয়সি মেয়ে-পুরুষের সমাবেশে যেন মেলা লেগেছে। বয়স্ক মহিলা ও বাচ্চা দু-একটি মেয়েদের কেউ কেউ স্নানের পর শুকনো কাপড় পরলেও বেশিরভাগ মেয়ে ভেজা কাপড় ছাড়ার আড়াল না পেয়ে সেই পরেই বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে। লাখোও কাঁপতে কাঁপতে ভেজা সালোয়ার কামিজ গায়ে বাড়ির পথ ধরল। পায়ের আঙুলগুলো ঠান্ডায় জ্বলছে, হাতের পাতায় সাড় নেই, দাঁতে দাঁতে খটখটানি থামতেই চায় না। ঘাট থেকে যশাইডি গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পথ। হাসপাতাল ও ঝালবাগান মোড় পর্যন্ত অটো কি বাসে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে খরচ বেশি, পুণ্য কম। তার বাড়ি থেকে একমাত্র সেই আসে সকলের হয়ে পুণ্যার্জন করতে। মিতুদের বাড়ি আজ কাজে যাবে না, কেবল বিকেলে গিয়ে পিঠে নিয়ে আসবে। তারপর মাখন বাউরির ঘরে মোচ্ছব, রাতভর। হাঁটতে হাঁটতে একটা ডাক শুনে মুখ তুলে তাকাল লাখো।

‘কী রে, তখন থেইকে ডাকছি, শুনতে পাস না?’ শ্যামল, অমিতাভ, শিশির আর ছোটন। শ্যামল আর ছোটনের বাইকে ওরা চারজন।

লাখোর বুকের মধ্যে যে-স্রোতটা বয়ে গেল সেটার তাপমাত্রা কত কে জানে? ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে আবার পা বাড়াল।

শ্যামল বলল, ‘বড়ো জাড়াচ্ছে লয়, আয় তুকে মোটর সাইকিলে বাড়ি পৌঁছায়েন দিয়ে আসি।’

‘দরকার নাই, আমার পা আছে।’ বাজার ছাড়িয়ে তখন এমডি অফিসের কাছাকাছি। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে গেছে।

‘পায়ে হেঁইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বুকে সর্দি বইসে যাবে। আমার মোটর সাইকেলে উঠ।’ শ্যামলের ইশারায় অমিতাভ এসে লাখোর হাত ধরল। রাস্তায় লোকজন আছে, তাই ভয়টা কমে গেল। হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিতে অমিতাভ যেন একটু টলে গেল। টাল সামলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল অমিতাভ, ‘দেইখ্যে লুব তর কত ত্যাজ।’ লাখো চ্যাঁচালে হয়তো লোক জড়ো হতো, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে গেল।

সন্ধেবেলায় মিতুদের বাড়ি থেকে সবে পিঠে নিয়ে ঝালবাগান মোড় হয়ে গাঁয়ের গলিতে ঢুকছে হঠাৎ মুখে ঘাড়ে গলায় বরফ জলের কনকনে স্পর্শ, পর মুহূর্তে অবর্ণনীয় জ্বালা। ঠান্ডা নয়, প্রচণ্ড তপ্ত কিছু যেন চামড়া গলিয়ে মুখ থেকে গা বেয়ে নামছে। চিৎকার করতে করতে মাটিতে বসে পড়ল লাখো। দুটো মোটরবাইক গর্জন করে চলে যাওয়ার শব্দ হল। আশপাশের দোকানগুলো থেকে চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এল। যশাইডি গ্রামে ঢোকার দুটো পথ আছে, একটা ঝালবাগান মোড়ে, আর একটা হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তায় পড়ে।

কিংশুকের দাদা কুন্তলের গাড়ি করে অর্ধচেতন দেহটাকে ভর্তি করা হল সাঁকতোড়িয়া হাসপাতালে। হাসপাতালটা এমনিতে ইসিএল-এর হলেও স্থানীয় মানুষও কম খরচে চিকিৎসা পায়। ডাক্তাররা কেউ কেউ গরিবগুর্বোকে ওষুধ টষুধ দিয়ে দাক্ষিণ্যও করে থাকে।

মাসখানেক পর জীবিত ছাড়া পেল ঠিকই তবে মুখ আর গলা ঝলসে পুড়ে গেছে, মাথা তুলতে পারে না লাখো, খুব সামান্য ঘোরানো যায়। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশ শ্যামলদের ধরে নিয়ে গেলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কেউ বলে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, কেউ বলে জামিনে ছেড়েছে। তবে তারা আর লাখোর পথ আগলে দাঁড়ায় না, আর লাখো তো রাস্তায় বোরোয়ই না বলতে গেলে। ওদিকে কিংশুকও লাখোকে দেখলে ‘মুখপুড়ি’ বলে মাঝেমাঝে সম্বোধন ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর জ্বালায় না। বাজারে শ্যামলদের সঙ্গে তাকে গল্পও করতে দেখা গেছে। গাঁয়ের মেয়ের গায়ে হাত দিলে শাস্তি জানা আছে, কিন্তু তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারলে কী কর্তব্য জানা নেই সম্ভবত। গৌরীকে আর সাবধান করতে হয় না, সে দলবল ছাড়া স্কুলে যায় না।

গৌরীর বিয়ের জোর চেষ্টা চলছে। পাত্রপক্ষ ধানবাদ জেলার কুমারডুবিতে থাকে। তাদের হাজার বায়নাক্বা। কুমারডুবিতে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে একটা চালু গোলদারি দোকান আছে। দোকানটা একেবারে জিটি রোডের ওপরই বলা যায়। রোজগারপাতি ভালোই। তিন ননদ, কোনও দেওর-ভাসুর না থাকায় একমাত্র ছেলে বলা গেলেও সম্পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট বলা যায় না। মেজোমেয়েকে পার করতে হবে বলে লছমনের বাবা চাইছেন পণের টাকাটা তার ছেলের তরফের কুটুমের কাছ থেকে আদায় হোক। যে যেখানে মহাজন।

লাখোর মুখ পোড়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মা হরিয়ালি অসিত চৌধুরীদের বাড়ি কাজে আসে এবং সেইসূত্রে শাশ্বতী চৌধুরীর প্রিয় বান্ধবী। অবশ্য যে গাঁয়ের নিরানব্বই শতাংশ মানুষ কম বেশি চুরি করে, সেখানে লাখোর মা আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম। মেয়েরও হাতটান ছিল, কিন্তু মায়ের সামনে আলমারির চাবি ফেলে রাখলেও ভয় নেই। এমন মানুষ যতই কামাই করুক হাতছাড়া করা যায় না। বড়ো মেয়ে আইবুড়ো থাকতে ছোটো মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে বলে হরিয়ালি মন খারাপ করে। বছর খানেক পেরিয়ে গেছে, মেয়ের বিকৃত মুখে ছিরিছাঁদ ফেরেনি। লাখোর এখনও কথা বলতে, খাবার গিলতেও কষ্ট হয়। জলখাবার খেতে গিয়ে লাখোর মা প্রায় দিনই চোখের জল ফেলে।

গৌরীর বিয়েটা বোধহয় কেঁচিয়ে যাবে। পাত্রপক্ষ পণ নিয়ে বড়োই রগড়ারগড়ি করছে। রাজু কিসান পালা করে কুমারডুবিতে গিয়ে আলোচনা করেও কোনও রফাসূত্র বার করতে পারছে না। হরিয়ালি ছেলেদের দোকানে পাঠিয়ে ভাবছে আজ মিতুদের বাড়ি যাবে কিনা। এমন সময় উঠোনের দরজায় টোকা। এক কালো রোগা ছোকরা।

‘ইয়ে কা দয়াল সিংকা ঘর হ্যায়?’

‘হঁ বটে, কিন্তু উ তো অনেকদিন হইল মইরে গেছে। আমার স্বামী ছিলেক।’

‘মালুম হ্যায়। কেয়া ধানবাদমে গুরুচরণ বাঘেল কি ঘরমে আপ কি কিসি বেটি কি শাদি কি বাত চল রহি হ্যায়?’

‘হঁ হঁ। রাজু কিসানকে খবর কইরছি। উয়াদের সাথে কথা বলুন।’ হরিয়ালি একদম হিন্দি বলতে পারে না, খুব ভালো বুঝতেও পারে না। ছেলেরাও স্থানীয় ঝাড়খণ্ডি উপভাষার বাংলাতেই স্বচ্ছন্দ, কিন্তু বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদেরকেই এগিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া গৌরীর বিয়ের কথা চলছে যেখানে সেইখানে দুই ছেলেই যাওয়া আসা করেছে। সুতরাং সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারাই বেশি উপযুক্ত। হরিয়ালি মাথায় ঘোমটা টেনে বলল, ‘বসুন, আপ বইঠিয়ে। লাখো, যা তো রাজুকে ডেইকে লিয়ে আয়।’ বলেই বলল, ‘থাক তুকে আইসতে হবেক লাই। আমি ষষ্ঠীর ভাইকে বুইলছি।’ মুখ পোড়া মেয়ের কেচ্ছা আর এক মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির লোক জানতে পারুক চায় না। তাই লাখোর বৃত্তান্ত সেখানে জানানো হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি।

‘আপ পরেশান না হো, ম্যায় আপসে বাত করনা চাহতা হুঁ।’

‘হাম বাত মানে হিন্দিতে বাত কইরতে লারি। আমার ছিলাগুলাকে ডাক দিচ্ছি। উয়াদের সাথে কথা করুন। তাতখে মুখে টুকদু কুছু দ্যান।’

‘আমি বাঙালিই। আপনারা রাজপুত না? হিন্দি জানেন না?’

‘বইলতে লারি। ছুটু থেইকে বাংলাতেই কথা বইলছি লয়। অ্যাই ষষ্ঠী, অ্যাই মহেশ, রাজুদাকে টুকদু খবর কইরে আয় না। বল ঘরকে কুটুম আইসছে, জলদি আসে যেমন।’

ছেলেটার নাম প্রসূন মিশ্র। কুমারডুবিতে শঙ্কর টকিজ নামে তাদের একটা সিনেমা হল ছিল, এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাট হয়েছে, নীচে দুটো দোকান ঘর পেয়েছে প্রসূনরা। একটাতে নিজেদের আসবাবের দোকান করেছে আর একটা ভাড়া দেওয়া আছে এক মুদিখানার কারবারিকে। দোকানটা বাবা আর দাদারা দেখে, প্রসূন নিজে স্কুলে পড়ায়। কিন্তু এত কথা ও হরিয়ালিকে কেন বলছে? হরিয়ালি তো কিছু জানতে চায়নি।

ছেলেটা নিজের বাড়ির সম্পর্কে টুকটাক নানা কথা বলে গেল। যা বাবা! গৌরীর শ্বশুরবাড়ির কথা, লছমনের অর্থাৎ গৌরীর হবু বরের কথা তুলছেই না। প্রশ্ন করলে দায়সারা জবাব। তাহলে কি গুরুচরণজিরা পাঠায়নি একে? নাকি এ নিজেই? কথাটা হরিয়ালির মাথায় আসতেই খাতিরের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। উঠোনের দরজা দিয়ে রাজু ঢুকতেই বলল, ‘ইনার নাম পরসূন, পর্সূন কী যেন? ও মিশ্রা। পর্সূন মিশ্র। কুমারডুবি থেইকে আইসছে।’

একথা সেকথার পর প্রসূন গলা খাঁকারি দিয়ে খোলসা করল। সে হরিয়ালির মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। দেওয়া-থোওয়া ওদের সাধ্যমতো, কোনও দাবিদাওয়া নেই। হরিয়ালি তো হাতে স্বর্গ পেল, ‘আপনার, তুমার মা-বাবার সাথে কথা বুইলে..ছ? উনারা কী বলেন দেইখতে হবেক লয়?’

‘মা-বাবা রাজি নন। ওনারা মুখ পোড়া মেয়েকে বউ করতে চান না।’

‘মানে?’ এবার হরিয়ালির দশগুণ অবাক হওয়ার পালা। প্রসূন তাহলে গৌরীকে নয়, লক্ষ্মী অর্থাৎ লাখোকে বিয়ে করতে চায়? ইয়ার্কি করছে না হরিয়ালি স্বপ্ন দেখছে।

‘তুমি আমার ওই মেয়ের কুথা জাইনলে কেমন কইরে?’

‘গুরুচরণজির ছেলে লছ্মন আমাদের ওই দোকানঘর ভাড়া নিয়েগোলদারির দোকান দিয়েছে। কতগুলো শয়তানের জন্য ওর চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনটা তো নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।’

রাজু মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হরিয়ালি জল মিষ্টি পরিবেশন করে বলল, ‘আপনি… তুমি আজ দুপুরে আমার কাছকে ভাত খেয়ে যাবে। এ রাজু কিসনাকেও ডাক। কথা বইলতে হবেক।’

‘আর কাউকে ডাকার দরকার নাই। বিয়া আমি কইরব না। আমার মতো মুখপুড়িকে কেউ জেনেশুনে বিয়া করে?’ লাখো অন্ধকার ভেতর ঘর থেকে বাইরে এল। ও লোকজনের সামনে বড়ো একটা বেরোতে চায় না।

‘জেনেশুনেই তো কথা পাড়ছি।’ প্রসূন বলল।

‘কিন্তু আপনার বাপ-মার মত নাই। বিয়া হবে কী কইরে?’

‘বিয়েটা আমি করব। আমার মা-বাবা নয়। ওনারা রাজি হবেন না বলেই আমি নিজে কথা করতে এসেছি।’

‘আমার পারা মিয়াকে কেউ বিয়া করে? মা উয়াকে বুঝাও।’

‘হঁ বাবা। তুমার মা-বাবা রাজি লয়, ভগবানের শাপে আমার বিটিটোর এই অবস্থা। কুনো দিন উয়ার বিয়া হবার কথা লয়। ঘরে কামকাজ কইরে আপন মনে থাইকছে। তুমি জিদ কইরে বিয়া কইরলে তুমার বাড়িতে মেইনে লিবেক ক্যানে?’

রাজু এবার বলল, ‘মা ভাত বসাও। আমি কিন্তু জলদি বাইরব। কিসনা একা দোকান বন্ধ কইরতে লাইরবেক।’

‘সবসময় বিয়ে কি মা-বাবারা মেনে নিতে পারে? ওনারা স্কুল টিচার ছেলের জন্য মোটা টাকা দর হাঁকবেন। আমি পণ নেব না। শুধু একটা মেয়ের সঙ্গে যা অন্যায় হয়েছে তার কিছুটা পুষিয়ে দেব, মানে ওর তো কোনও দোষ নেই, ও কেন সারাজীবন বঞ্চিত থাকবে?’

হরিয়ালির নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তার দেখতে শুনতে ভালো ছোটো মেয়ের পাত্র ঠিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, আর বিকৃত মুখ বড়োটির জন্য যেচে এত ভালো পাত্র আসছে। আসছে কী, সাধছে, তাও আবার বিনা পণে। সে ছেলেকে ইশারা করল দিদিকে রাজি করাতে। নিজে উঠোনের এক কোণে তৈরি মাটির উনোনে ভাত ও তরিতরকারির জোগাড় করতে বসল। ইস্! কাল মিতুদের গাছ থেকে এঁচোড় নিয়ে এলে পারত। এখন অতিথিকে ভদ্রস্থ কী খাওয়ানো যায়? অল্প পোস্ত আছে। আলু পোস্ত করা যায়। সঙ্গে মাচায় যে কুমড়োর লতাটা উঠছে সেখান থেকে কয়েকটা কুমড়ো ফুল তুলে বেসনে ভেজে দেওয়া যায়। হরিয়ালি দোনোমনো করে সম্ভাব্য জামাইয়ের আদরের তোড়জোড় শুরু করল। কিন্তু এখন রাঁধতে বসলে খাবে কখন? শেষে কাজ চালানোর জন্য লাখোকে পাঠালো মিতুর মায়ের কাছ থেকে খানিক তরকারি ব্যাঞ্জন চেয়ে আনতে।

গৌরী স্কুল থেকে ফিরে দেখে এক ছোকরাকে নিয়ে বেশ খাতিরদারি চলছে। সে লছমন ভেবে বেশ একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে ঘরে ঢুকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। আলগোছে দু-একটা কথাও হল। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ওর আগমণের উদ্দেশ্য জেনে গৌরীর মূর্ছিত হওয়ার পালা। লছমনের ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রসূন তো প্রথম দর্শনেই চোখের সঙ্গে মনটাও আচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল। তার মুখপোড়া দিদির পাশে এই ছেলেটা? দিদির চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতেই পড়ে সে। দু বছর পর মাধ্যমিক পাসও করে যাবে। বড়ো ঘরের স্কুল টিচার ছেলে তবু তার বছর বছর ফেল মারা কামিন খাটা দিদিটাকে বিয়ে করতে চায়! আর তাদেরই দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মুদিখানা চালানো ছেলে গৌরীর মতো মেয়েকে নেওয়ার বিনিময়ে এত দর হাঁকছে?

লাখোকে প্রথমটায় রাজি করানো যাচ্ছিল না। বস্তুত হরিয়ালি আর তার দু ছেলেরও মনে হচ্ছে মুখপোড়া মেয়ে ঘরে কাজকর্ম করে মা-ভাইয়ের সংসার টেনে নিয়ে যেতে পারে। ও চলে গেলেই বরং অসুবিধা। বরং গৌরীটাকে প্রসূনের মতো পাত্রের সঙ্গে জুততে পারলে সব দিক থেকেই মানানসই হয়। কিঞ্চিদধিক পড়াশুনো শেখা ও অক্ষত থাকার সুবাদে গৌরী লোকের বাড়ি তো দূর ঘরেও কাজকর্ম করতে বিশেষ রাজি নয়। তাই হরিয়ালির ছেলেরা বড়দিকে রাজি করানোর চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে প্রসূনকে ছোড়দির দিকে ফেরাতে। তার মা-বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ করে দুটো বিকল্পের পথই খোলা রাখতে চাইছে। লাখো বেগতিক দেখে ঘাড় নেড়ে দিল। মেয়েরা যে শ্বশুরঘরে দাসত্ব করলেও গিন্নি আর বয়স পেরিয়ে বাপের ঘরে খেটে খেলেও আশ্রিতা, সেটা উপলব্ধি করার জন্য বেশি দূর পড়াশুনোর দরকার হয় না।

এরপর তিন বছর কেটে গেছে। প্রসূনের জেদ আর আন্তরিকতাই বজায় থেকেছে। গৌরীরও যেন কোনও অনিচ্ছুক পাত্রের পুরি ঘরওয়ালি হওয়ার বদলে একজনের আধি ঘরওয়ালি হওয়াতেই বেশি আগ্রহ। শালির বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে জামাইবাবু লড়ে যাচ্ছে। লছমনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে।

ভাই ও জামাইদাদার নতুন উদ্যোগে গৌরীরও বিয়ে হতে চলেছে কালীপাহাড়িতে। ছেলের নাকি কয়লা খনিতে মোটা মাইনের কাজ। অসিত চৌধুরী অর্থাৎ মিতুর বাবা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন খনি বলতে চোরা খাদান। এখানকার বহু লোকে জানেই না কোনটা বিধিসম্মত আর কোনটা বেআইনি খনি, বা জানলেও সেখানে কাজ করার মধ্যে অনৈতিক কিছু দেখে না। যেমন ইসিএল বা ডিপিএস-এর লাইন থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ নেওয়াকে বেশির ভাগ বাসিন্দা অনেকটা স্থানীয় মানুষের মৌলিক অধিকার বলে ধরে নিয়েছে, চুরি মনে করে না, আর করলেও ‘বেশ করেছি’ ভাব। খুব কম বাড়িতে কুয়ো বা পাম্প আছে। বড়ো বড়ো অট্টালিকাতেও ইসিএল-এর পাইপ লাইন থেকে শাখা প্রশাখা বার করে ট্যাঙ্ক ভরা হয়। একসময় কল্যাণেশ্বরীর জল ব্যবহূত হতো পানীয় জল হিসাবে, এখন সেটার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ইসিএল-ই ভরসা। হুকিং-এর তার ধরপাকড়ের সময় বাজেয়াপ্ত হলেও জলের লাইন কেটে দিলে আগুন জ্বলবে, কারণ অঞ্চলটার অধিকাংশ জায়গায় মাটির নীচটা ফাঁপা, কুয়ো খুঁড়লে জলের বদলে কয়লা নয়তো গহ্বর পাওয়া যাবে, আগুন আর ধোঁয়াও বেরিয়ে আসে জমির ফাটল বেয়ে। যশাইডি গাঁ, ঝালবাগান কলোনি আর বানডাঙার কয়েকটা বাড়িতে কুয়ো থাকলেও ‘কোম্পানিকা মাল দরিয়ামে ডাল’ দর্শনেরই জয়জয়াক্বার। কয়লা খাদানে জলও জমে, যে জল পাম্প করে আসানসোলের দু একটা অঞ্চলে, রানিগঞ্জ শহরের কিছু জায়গায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই ‘ধসা ওয়ার্ড’-এ মাটির নীচে কেবল কয়লা কিংবা আগুন। জনস্বার্থে কারচুপির জন্য প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ানদের নতুন নতুন উদ্ভাবন রীতিমতো পেটেন্টের দাবিদার হতে পারে।

গৌরীর দুই ভাই রাজু আর কিসান ছোটো বোনের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে বেশ গর্বের সঙ্গে অভিজ্ঞতা জানিয়েছিল অসিত চৌধুরীর বাড়িতে, বসার ঘরে চা খেতে খেতে তারা মাটির নীচ থেকে কয়লা কাটার ঠং ঠং শব্দ শুনতে পেয়েছে। অমন বিপজ্জনক বাড়িতে যে বোনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকতে পারে না তা বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে অসিতবাবু রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। জামাইয়ের করা সম্বন্ধ কি হেলাফেলা করা যায়। তাছাড়া ঘনঘন দিদির বাড়ি গিয়ে মাসের পর মাস থাকা নিয়ে লোকে ঠাট্টার ছলে একটু আধটু কথাও শোনাচ্ছে– দুই মেয়েকেই এক গাছতলে ফোকটে বেঁধে দিয়েছে লাখোর মা। সুতরাং অসিতবাবুর অকারণ আশঙ্কায় কান দেওয়ার মানে হয় না। বরং শাশ্বতী চৌধুরী মেয়ের বিয়েতে দেওয়া থোয়া নিয়ে কথা বলেন তার প্রিয় বান্ধবী লাখোর মায়ের সঙ্গে।

দ্বিরাগমণে ছোটো মেয়েদের আসতে দেরি দেখে লাখোর মা ঘরবার করছে। সে আজ বাবুঘরে যাবে না, সে যে লোকের বাড়ি কাজ করে তা জামাইরা জেনে ফেললেও গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। সকাল দশটা নাগাদ আসার কথা ছিল, বিকেল সাড়ে চারটে গড়াতে চলল। মিতুর মায়ের মতো মেয়েদের নিয়ে অত আতুপুতু করা লোকের বাড়ি খেটে খাওয়া মায়েদের থাকে না। কিন্তু এত দেরি? হরিয়ালি কেন, তাকে ঘণ্টাখানেক আগে দুশ্চিন্তার জন্য মুখ ঝামটা দেওয়া রাজুও উদ্বিগ্ন হয়ে টেলিফোন বুথে ছুটল।

প্রায় সাথে সাথেই দুই ভাই একত্রে ঘরে ঢুকল। কিসান হাঁপাতে হাঁপাতে খাটিয়ায় বসে পড়ল।

‘কী হইল রে? গৌরীর একটো খবর লিয়ে আসতে পাঠালম রাজুকে সিটো না কইরে ঘরকে চলে এলি যে? বুনটোর জইন্য কি টুকদু চিন্তা হয় না তুদের?’

‘মা!’ ডাকটা আর্তনাদের মতো শোনাল যেন। ‘গোরীদের বাড়িটো ধসে গেঁইনছে। দিলীপ খাদে ছিল। উঠে আইসতে পারে নাই। আর ছাদ চাপা পইড়ে গৌরী আর উয়ার শাশুড়িটোও গেঁইনছে। দোফোর থেইক্যে হাসপাতাল ডাক্টার এইসব চইলছে উয়াদের। বডি এইমাত্তর হাসপাতাল থেইক্যে ছাইড়লেক।’

লাখো উঠোনে বেড়া আর খড়ের ছাউনি দেওয়া হেঁসেলে চায়ের যোগাড় করছিল। বোন-ভগ্নীপতি আসবে বলে মাকে সাহায্য করতে কুমারডুবি থেকে দৌড়ে এসেছে। বাসনপত্র ফেলে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়ে জামাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অলীক সাব্যস্ত হওয়াতে হরিয়ালি ডুকরে উঠল, ‘হেই ভগমান, ভগমানের কেমুন বিচার গো! আমার মুখপুড়ি বিটিটোকে ছেইড়ে ভালোটাকে লিয়ে লিলেক…!’

(এই গল্পের সব চরিত্র ও নাম কাল্পনিক)

প্রতুলের দিনগুলি

‘রাধা কৃষ্ণ। রাধা কৃষ্ণ। কই গেলি রে রাধাকৃষ্ণ। চলে আয়। আমি এসেছি।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের ভেতর থেকে হাত বের করে বিস্কুটের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রতুল। কিন্তু ওদের দেখা নেই। প্রতুল চায়ের কাপে চুমুক দিল। চার-পাঁচটা ঝগড়ুটে কাক আর কয়েকটা শালিক উড়ে এসে বিস্কুটের দখল নিল। চড়ুইয়ের দল নিম গাছের মাথায় চ্যাঁচামেচি করছে। বাউন্ডারিওয়াল বা পেয়ারা-নিমের ডালে কোথাও রাধাকৃষ্ণের দেখা নেই। ওরা কি আজ আসবে না! প্রতুল ভাবল, ওরা এখন এলেও কাকের দলের সাথে পেরে উঠবে না। কাক ভীষণ চালাক আর বুদ্ধিমান, শালিকও।

সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার দুদিন পরের কথা। প্রতুল সকালে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল বারান্দায়। একটা জড়পদার্থের মতো, নিস্তেজ হয়ে। চুমুক দিতে ভুলে গেছে। তখনই ছোট্ট বাগানের এককোণে লম্বা ঘাস আর লজ্জাবতীর আড়ালে পাখিদুটোকে নজর পড়ল। ধূসর রঙের দুটো ঘুঘু। মেয়ে পাখিটার গলায় বাদামি গোল দাগ, মনে হয় গলার হার। ঘাসের মধ্যে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছিল ওরা। ছেলে পাখিটার ডান পায়ে খুঁত আছে। পা-টা ভাঁজ হয় না, হাঁটার সময় একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। মেয়ে পাখিটা বেশ চালাক-চতুর মনে হয়। খাবারের টুকরো বা শস্যদানা খুঁজে দিচ্ছে সঙ্গীকে। ছেলেটা ডান পা পালকে ঢেকে মাথা নীচু করে সেই শস্যদানা গিলে নিচ্ছে।

প্রতুলের মনে পড়ল ওর ভাঁজ-করা বাঁ-পা চেয়ারের ওপর, ডান-পা লম্বা করে ছড়িয়ে রেখেছে মেঝেতে। সুলেখার মৃত্যুর পর থেকে জটিল নার্ভের অসুখে ভুগে ভুগে এখন ওর দুটো হাত কাঁপে, ডান পা-টা হাঁটু থেকে ভাঁজ হতে চায় না। ছেলে পাখিটার সাথে ওর মিল আছে। একটা বিস্কুট ভেঙে বাগানে ছড়িয়ে দিতেই পাখিদুটো এগিয়ে এল। প্রথমে ও ভেবেছিল পায়রা। পরে ভালো করে দেখে বুঝল পায়রা নয়, ঘুঘু পাখি। গলা আর পেটের দিকে সামান্য সাদা, মাথার ওপরে আর ডানায় বাদামি-খয়েরি রঙের ছিটে। মেয়েটার গলার চারপাশে বাদামি গোল দাগ, রিং-এর মতো।

প্রতুল ওদের নামকরণ করল, রাধাকৃষ্ণ। সেই থেকে প্রায় তিনমাস হতে চলল ওরা নিয়মিত ওর বারান্দার সামনে আসছে। ওদের জন্য দুটো বিস্কুট বরাদ্দ। আগে কখনও ভোরবেলা এসে হাজির হতো। অত সকালে প্রতুল উঠতে পারে না।

দুটো কাক ওর দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। হদ্দ বোক্বা, হদ্দ বোক্বা। বো-কা-কা।

চায়ের কাপটা এককোণে রেখে প্রতুল ভাবল, কে বোকা! কাকে বোকা বলছে ওরা! কাকগুলোও কি জেনে গেছে, প্রতুল একটা হদ্দ বোকা। ওই ঘটনার আগে ও নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ভাবত। বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, শিক্ষিত এবং ভদ্র। বিশেষ বিশেষ সময়ে অন্যের চেয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবতে ভালোও লাগত। এখন ওর আত্মবিশ্বাসের পারদ শূন্যে নেমে গেছে। নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

কাকগুলো উড়ে গিয়ে বসেছে রাস্তার ওপারে সরকারদের বাড়ির ছাদের কার্নিশে। ওরা উড়ে যেতেই কয়েকটা চড়ুই কিচিরমিচির করে প্রতুলের সামনে এসে রীতিমতো অভিযোগ শুরু করে দিল। আমরা ফেলনা নাকি। আমাদের ভাগেরটা কই। সারাদিন তো আমরাই তোমার বাড়ির বারান্দায় হুটোপাটি করি। পাশে নিমের ডালে ঠোঁট ঘষি, সুখ-দুঃখের কথা বলি, বসে বিশ্রাম নিই। বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর দিয়ে হুলোটা যখন নিঃশব্দে দৌড়ে যায়, রান্নাঘরের জানালার ভেতর উঁকি দেয়, আমরাই চ্যাঁচামেচি করি। প্রতুল ঘরে গিয়ে আবার বিস্কুট নিয়ে আসে। গ্রিলের বড়ো বড়ো ফাঁক দিয়ে চড়ুইগুলো বারান্দায় চলে আসে। একেবারে প্রতুলের হাতের কাছাকাছি। ওরাই এখন ওর বন্ধু, সময় কাটাবার, নিঃসঙ্গতা দূর করার সাথি। কিন্তু রাধাকৃষ্ণ আজ গেল কই? ওদের কি শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু?

অর্চনা মোবাইল হাতে বারান্দায়, ‘অ্যাই তোমার ফোন। দ্যাখো, সুভাষদা আবার কী বলবে। টাকা-পয়সার কথা বলতে পারে। তুমি রাজি হবে না কিন্তু। আর ব্যাপারটা ভালো করে শুনে নিও। যদি সেরকম মনে করো, টাকা পয়সা কিছু দিতে হবে, তাহলে আপ-ডাউন ভাড়াটা শুধু দিয়ে দিও। কাজ শেষ করে ফিরে আসলে ফিজটা দিও।’

অর্চনা মোবাইলটা প্রতুলের হাতে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ও এখন গতকালের এঁটো বাসন মাজবে, বালতির জলে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে বাসি কাপড় ভেজাবে, তারপর সবজি কুটতে বসবে। দুপুর একটা বেজে যাবে তাও অর্চনার কাজ শেষ হবে না।

কাঁপতে কাঁপতে একসময় ছোট্ট যন্ত্রটা থেমে গেল। প্রতুল ফোনটা রিসিভ করল না। কী বলবে ওই প্রান্ত থেকে সুভাষদা, প্রতুল অনুমান করতে পারে। অর্চনার দূর সম্পর্কের মাসতুতো না পিসতুতো দাদা, সুভাষ ঘোষ, বার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র উকিল। হয়তো আরেকবার ফোন করবে। প্রতুল রিসিভ না করলে ল্যান্ড-লাইনে ফোন করবে। শেষে স্কুটারে চেপে নিজেই হয়তো চলেই আসবে এ বাড়িতে। লোকটাকে গত দুমাস ধরে দেখছে ও। ওর চাকরিজীবনে সেই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটে যাবার পর, অর্চনাই পরামর্শ দিয়েছিল সুভাষদাকে ধরতে। ফোন করে এবাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিল অর্চনাই। আইনি পরামর্শ পেতে। এর আগে প্রতুল কখনও লোকটাকে দেখেনি, নামও শোনেনি। লোকটির কথাবার্তা শুনে প্রথমদিনই প্রতুল বুঝে গিয়েছিল উকিলের ছোঁয়া মানেই ছত্রিশ ঘা। শুধু পুলিশে ছুঁলে তাও হয়তো বাঁচতে পারত।

এপর্যন্ত ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেছে ও। প্রথমে অ্যান্টিসিপেটরি বেল-এর জন্য আবেদন করেছিল লোকাল কোর্টে। সেই আবেদন নাচক করে দিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন জানাতে হবে। সেই ব্যাবস্থাও পাকা করে ফেলেছে সুভাষদা। এখন কলকাতায় যাবে কেসটাকে মুভ করাতে। প্রতুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে। ও চাইছিল না হাইকোর্টে কেসটা মুভ করুক। কিন্তু সুভাষদা জোঁকের মতো ওর রক্ত খেয়েই চলেছে।

আশিস, নির্মল, কল্যাণ, টিকালাল কেউ উকিলের খপ্পরে পড়েনি, একমাত্র ও ছাড়া। ভয় তো সকলেরই ছিল, এখনও আছে। সকলেই আত্মীয়-বন্ধুদের চেনাজানা উকিলদের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিয়েছে, কিন্তু জড়িয়ে পড়েনি। সবাই ভয়ে ভয়ে আছে, কী হয় কী হয়। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারিতে নাকি প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে।

যাদের জেল হাজত হয়েছে, ওদের কথা আলাদা। একজনের জায়গায় দুজন উকিল নিয়োগ করেছে কেউ কেউ। একের পর এক হেয়ারিং-এর ডেট পড়ছে, ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন, রায় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু জেল হাজত থেকে মুক্তি মিলছে না। স্থগিতাদেশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট। কখনও পুলিশের জোগাড় করা নথিপত্র যথেষ্ট নয়, কখনও জেলা আদালত থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হাতে আসেনি– এইসব অজুহাতে একের পর ডেট পেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। এখন জানা যাচ্ছে, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পার্টির বয়ান এখনও শেষ হয়নি, প্রতিদিন নাকি নতুন নতুন পার্টি আসছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছে। জেলা আদালতের নির্দেশে সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে মহকুমা কোর্টে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেতে সেইসব বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কিছুতেই জামিন হচ্ছে না চারজনের। মূল জালিয়াত বৃন্দাবন মণ্ডল সহ তিনজন আধিকারিক। দুজন সহকারী ম্যানেজার, একজন হেড ক্যাশিয়ার।

ব্যাংকের এক কোটি সাত লাখ টাকার জালিয়াতির ঘটনায় সিনিয়ার ম্যানেজারসহ ব্রাঞ্চের তেরোজন স্টাফ, সবাই সাসপেন্ড হয়েছে। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস হতে চলল। প্রতুলের কাছে এখনও মনে হয় সবটাই স্বপ্ন। চোখের সামনে দিনের পর দিন চার ফুট দশ ইঞ্চির রোগা-পটকা একটা ছেলে কাস্টমারের লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করে হজম করে ফেলল, ব্যাংকের কেউ কিচ্ছুটি টের পেল না! অসংখ্য কাস্টমারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাতে লেখা ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট দিয়েছে ছেলেটা, যথাযথ জায়গায় সই-সাবুদ করা রিসিপ্ট। মান্থলি ইনকাম স্কিম যাদের, তাদের অ্যাকাউন্টে মাসের প্রথমে নিয়মিত টাকা জমা পড়েছে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি।

দৈনিক একশো কুড়ি টাকা মজুরির অস্থায়ী কর্মী বৃন্দাবন দুবছরের মধ্যে কয়েকটি গাড়ির মালিক হবার পরেও কেউ কোনওরকম সন্দেহ করল না। প্রতুল সামান্য সিঙ্গল উইন্ডো অপারেটর। কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। কে কী করছে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু যারা ব্যাংকের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থেকে গাড়ির ব্যাবসা করে, শেয়ার বাজারে টাকা খাটায়, এমনকী ঠিকাদারি পর্যন্ত করে, তারা? বিকেল পাঁচটার পর যারা বোতল খুলে বসে, বৃন্দাবনকে দিয়ে কাজুবাদাম, ভুজিয়ার প্যাকেট আনায়, তারা? কারও মনে কোনও প্রশ্ন জাগল না?

বারান্দায় বসে প্রতুলের খুব মনে হয়, এরা সব কাকের দল। এ মার্ডার অব ক্রোস। ঠুকরে ঠুকরে মাংস খেল, ঠোঁট মুছে উড়ে পালাল। আর ভয়ংকর ধূর্ত সেইসব নেকড়ে আর শেয়ালের দল! ওরাই তো ব্যাংকের দণ্ডমুন্ডের কর্তা। জোনাল ম্যানেজার, চিফ অফিসার, এমনকী জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের এসি গাড়িতে বিভিন্ন সময়ে টুর করেছে দিনের পর দিন। এয়ারপোর্টে গাড়ি পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে দার্জিলিং-গ্যাংটকে লাক্সারি হোটেল বুক করা সবটাই হতো বৃন্দাবনের সৌজন্যে। অত বড়ো মাপের কোনও অফিসার কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি এই ছেলেটির আয়ের উৎস কী? বিলাসবহুল হোটেলে দামি খাদ্য-পানীয় ইত্যাদিতেই মজে থাকত। কেউ কখনও কোনও সন্দেহ করল না। অফিসে অডিটর এলে খাতা-পত্র এগিয়ে সামাল দিত বৃন্দাবনই। ‘বৃন্দাবনজি আপ’ বলে সম্বোধন করত জোনাল ম্যানেজার, প্রতুল নিজের কানে শুনেছে। তিন বছরের মাথায় বিশাল দুটি ফ্ল্যাটের মালিক। পরের বছর যাত্রীবাহী লাক্সারি বাস, নামে-বেনামে অসংখ্য জমির প্লট– এসব দেখেশুনে খোদ সিনিয়র ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের সাথে সম্ভ্রমের সাথে কথা বলত। প্রতুল কিছুটা দূর থেকে এসব লক্ষ্য করত, কিন্তু কখনও ভেতরে ঢুকত না। এখন মনে হচ্ছে, প্রতুল সত্যিই ভীষণ বোকা, কমবুদ্ধির মানুষ।

বৃন্দাবনের ছুড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে শেয়াল-নেকড়ের দল মুখ মুছে ফেলল। ওদের দোষ দেখার তো কেউ নেই। অথচ ওরাই অফিসসুদ্ধ সবাইকে সাসপেন্ড করল। প্রতুলরাই নাকি বৃন্দাবনের সাথে মিলেমিশে ব্যাংকের টাকা জালিয়াতি করেছে। ভিজিলেন্স অফিসারের সাথে চিফ অফিসার যখন ইন্সপেকশান করছিলেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছিলেন কর্মীদের বাবা-মায়ের নাম তুলে।

গ্যারাজের একটা ছেলে সেদিন রাস্তায় প্রতুলকে দেখে জোরে জোরে বলছিল, ‘ওই যে লোকটা যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যাটা। এখন চাকরি গেলেই বা কী! কেমন গরুচোরের মতো মুখ করে চুপচাপ হাঁটছে লোকটা, দ্যাখ।’ প্রতুল বাজারে যাচ্ছিল সামান্য মাছ আর সবজি কিনতে। দুজন লোকের জন্য কতটুকুই আর বাজার লাগে। তবু সপ্তাহে একবার বাজারের জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই হয়। কথাটা শুনে দপ করে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। সেই রক্ত সহজে মাথা থেকে নামল না।

অর্চনা বলেছিল, ‘শরীর খারাপ লাগছে? ছাতা নিয়ে বাজারে যেতে পারো না? প্রেশার-সুগার চেক করিয়ে নেবে কাল-পরশু। এখন শুয়ে থাকো। একদম উঠবে না বিছানা থেকে।’

ওদের ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটা গোটা শহরে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে সারাদিন বারান্দায় বসে, নয়তো শুয়েই দিন কাটছে ওর। সকালে খবরের কাগজ, বিকেলে অর্চনার সাথে বসে টিভি সিরিয়াল, নিউজ দেখা। এর বাইরে ওর কোনও কাজও নেই। অফিস কলিগদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছে বহুদিন। বিরাট একটা সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা মাথায় নিয়ে ও ধীরে ধীরে একটা কেঁচোর মতো মাটির নীচে চলে যেতে চাইছিল। এই শহরেই ওর রক্তের সম্পর্কের মানুষ আছে তিনজন। ওদের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ হয়েছে বহুদিন। অর্চনাকে বিয়ের পর থেকে।

থানা থেকে ফোন করে ওকে দেখা করতে বলেছিলেন আইসি। এমনিতে ও দুর্বল মনের মানুষ, থানা-পুলিশের নাম শুনলে ভয় পায়, ঝুটঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায় না। ফোনটা পেয়ে ও কাঁপতে শুরু করল। অর্চনা বার-দুই বমি করে অজ্ঞান হয়ে গেল। সুভাষদা এসে পরিস্থিতি সামাল দিল। থানার ঝামেলাটা মিটতে না মিটতেই ব্যাংকের চার্জশিট এসে হাজির প্রতুলের নামে। অন্যদের একপাতা, নয়তো দুপাতা। প্রতুলের তিনপাতা। কাজে মারাত্মক গাফিলতি, নিয়ম বহির্ভূত লেনদেনে যুক্ত থাকা, মূল অভিযুক্ত বৃন্দাবনের সঙ্গে সরাসরি লক্ষাধিক টাকার লেনদেন– চার্জশিটে এরকম চব্বিশটা অভিযোগ আছে ওর নামে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওর নামে।

প্রতুল ভাবছিল এবার ও কী করবে? বাঁচার বোধহয় আর কোনও রাস্তা নেই। চাকরিটা গেলে ও খাবে কী? এত খারাপ কপাল কারও হয়? ছোটোবেলা থেকেই ও দেখছে, ওর পোড়া কপাল। পৈতৃক দোতলা বাড়ি ভাড়াটে দখল করে নিল। আর ও বছরের পর বছর ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দিল। দুর্ভাগ্য নিয়েই বোধহয় ও জন্মেছিল। নইলে সুলেখার সাথে ওর বিয়েটাও কেন সুখের হল না। ষোলো বছর ঘর করার পরও, সুলেখা একটা সন্তানের জন্ম দিতে পারল না। শেষদিকে ওর দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছিল, চার মাস ডায়ালেসিস-এর পর মারা গেল। আর ও মারা যাবার পর যেন দুর্যোগের ঝড়টা সাইক্লোন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুলেখার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই ও আবার বিয়ে করে বসল। প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির লোকজন, অফিস কলিগ, পাড়ার দুচারজন ছ্যা-ছ্যা করল। প্রতুল পাত্তা দিল না। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, বয়স ওর বয়সের প্রায় অর্ধেক। প্রতুল ভেবেছিল, সুলেখা ওকে যা দিতে পারেনি, অর্চনা সেটা পারবে। এবার নিশ্চয়ই একটা সন্তান আসবে। বিয়ের চার বছর হতে চলল। কিন্তু এখনও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। দুবার ডাক্তার দেখিয়ে টেস্ট করা হয়েছে। অর্চনার কোনও গন্ডগোল নেই, সবকিছুই স্মুথ। তাহলে কি দোষটা ওর? নাকি ওর ভাগ্যের!

সুলেখা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে কম তরজা হয়নি। সুলেখার বোন সুরেখা তো একদিন রীতিমতো ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘প্রতুলদা, দিদিকে দোষারোপ করার আগে, নিজের দোষটা দেখুন। ভুল ট্রিটমেন্ট আর ওষুধ খেয়ে খেয়ে দিদির শরীর এখন না-হয় ভেঙে গেছে। প্রথম থেকে আপনি যদি নিজের ট্রিটমেন্টটা করাতেন, তাহলে দিদিকে আজ ভুগতে হতো না।’

নিমের ডালে বসে দুটো কাক মন্থর গলায় ডাকছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। তাকিয়ে আছে প্রতুলের দিকেই। হদ্দ বোকা, অপদার্থ, অলস, ভীতু আর আর…? সুরেখা একদিন রেগে গিয়ে ওকে বলেছিল, ‘প্রতুলদা আপনি নিজের দোষ ঢাকতে দিদির ওপর অত্যাচার করছেন। শুধু ষাঁড়ের মতো উচিয়ে গেলেই হয় না। ভেতরে কিছু থাকতে হয়, বুঝলেন! নপুংসক একটা!’ আরও বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল সুরেখা। সুলেখা ওকে থামিয়েছিল।

ইউনিয়ন চার্জশিটের সব অভিযোগের উত্তর লিখে দিয়েছে। কাগজপত্রের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন শেষ হতে লাগল তিন মাস। তারপর চলল স্ক্রুটিনি, ক্রস এক্সামিনেশন। কখনও ব্রাঞ্চে, কখনও জোনাল অফিসে ওকে ছুটতে হল। সঙ্গে ইউনিয়নের লিডার, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরমেশ লাহিড়ি। কলকাতার লোক। এই করতেই বছর ঘুরে গেল। এখন অর্ধেক নয়, পুরো মাইনেটাই পাওয়া যাচ্ছে।

হেয়ারিং শেষ। পরমেশদা এবার কলকাতা ফিরবে। প্রতুল পরমেশদাকে একান্তে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা পরমেশদা, আমার বিরুদ্ধে এতগুলো মারাত্মক অভিযোগ, বাঁচার কোনও রাস্তা সত্যি আছে?’

‘ম্যানেজমেন্ট বৃন্দাবনের সাথে তোমার, তোমাদের ইনভলভমেন্টের অনেকগুলো প্রমাণ পেয়েছে। এতসব তুমি অস্বীকার করবে কী করে?’

‘কিন্তু, পরমেশদা, সত্যি বলছি, আপনি লোকাল লিডারদের কাছেও এর প্রমাণ পাবেন। অন্যদের সাথে বৃন্দাবনের যেমন ওঠাবসা ছিল, আমার সাথে কিছুই ছিল না। অন্যরা ওর গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরতে চলে যেত, টাকা ধার নিয়ে সময়মতো ফেরত দিত না, বৃন্দাবনের পয়সায় হোটেলে খেত। আমি কিন্তু কখনও ওর গাড়ি ভাড়া নিইনি, টাকাও ধার নিইনি।’

‘তার মানে এদের চোখে তুমি বোকা। সবাই তোমাকে ইউজ করেছে। বৃন্দাবনের সাথে তোমাদের স্টাফদের মধ্যে লেনদেনগুলো এমন হয়েছে যাতে পরিষ্কার ইউ আর ভেরি মাচ ইনভলভড। এনিওয়ে, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। এখানে একটা কথা তোমাকে বলি, ট্রেড ইউনিয়ন লড়াই করে, জিততেও পারে, হারতেও পারে। হারা-জেতাটাকে আমরা গুরুত্ব দিই না। গুরুত্ব দিলেই লড়াইটা থেমে যাবে। দরকার হলে আমরা আরও বড়ো আন্দোলনে যাব।’

রাধা-কৃষ্ণ এখনও ওর ছোট্ট বাগানে আসে বিস্কুট খেতে। কৃষ্ণের ডান-পাটা ভাঁজ হয় না, টেনে টেনে চলে। প্রতুলের মতো। ওদেরও হয়তো ছেলেমেয়ে নেই। ওদের জীবনে কি হারা-জেতা আছে? প্রতুল ভাবল, ওর চাকরিটা চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। চাকরিটা চলে গেলেও ও না খেয়ে মরবে না। কারণ পেনশন, গ্র্যাচুইটি নিশ্চয়ই পাবে। রেকারিং, ফিক্সড ডিপোজিটে বেশ কিছু টাকাও আছে। দুটো মানুষের আর কত চাই। দিব্যি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারবে। রাধা-কৃষ্ণের মতো এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সোশ্যাল স্টিগমা! কলঙ্কচিহ্ন মুছবে কেমন করে! পাখিদের সমাজে কি কলঙ্কচিহ্ন আছে! ডানা ঝাপটালেই সব ক্লেদ-কলঙ্কচিহ্ন ঝরে পড়বে না!

প্রতুল ভাবল, মানুষের সমাজ মানে কী? বৃন্দাবন মণ্ডল তিন মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওর বিরুদ্ধে জালিয়াতি-প্রতারণা-সরকারি টাকা নয়ছয় সহ যতগুলি ভারী ভারী কেস ছিল সেগুলি এখন তুলোর মতো হালকা। প্রতুল শুনেছে, এজন্য বৃন্দাবন সাত লাখ টাকা ছড়িয়েছে। শকুন-কাকের দলে পাউরুটি ছুড়ে দেবার মতো– ওর উকিল, অখিল ঝা-র হাত দিয়ে। আন্ডার-লাইন পাইপের জলের মতো এই টাকা ছড়িয়েছে থানার ইন-চার্জ থেকে কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত। অথচ থানার এই ইন-চার্জ প্রতুলকে মুখোমুখি বসিয়ে ঠান্ডা গলায় কী সাংঘাতিক হুমকি দিয়েছিল সাত-আট মাস আগে।

বৃন্দাবন এখন লাইন-হোটেল খুলেছে বড়ো রাস্তার পাশে। মাত্র পনেরো কিলোমিটার দূরে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। অনেক যুব-নেতা, পুলিশের ছোটোবাবু, মেজোবাবু সন্ধে নাগাদ এই লাইন-হোটেলে বসে খানা-পিনা করেন, কিছুটা সময় কাটান। বেশি রাতে নাকি একদুজন উর্বশী-অপ্সরা আসে সেখানে, বিনোদনের অঢেল আয়োজন। এছাড়া বিরাট এক স্টেশনারি দোকান খুলেছে বৃন্দাবন পাশের শহরে।

প্রতুল বুঝতে পারল, আমাদের সমাজটাও বেশ সুশৃঙ্খল, পাখিদের মতোই। কাক-শালিকদের রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিলেই আর সমস্যা থাকে না। ওরা দুয়ারের সামনে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে না, ছাদের মাথায় ঝামেলা করে না। পাড়ার সবচেয়ে মস্তান কুকুরটাও দুয়ারের সামনে পাহারা দেয়, যদি নিয়মিত দুবেলা এঁটো-কাঁটা পায়। বৃন্দাবন সুন্দর বুঝেছে এই সমাজ আর তার মানুষগুলোকে। তাই আজ ওর লাইন-হোটেলের রমরমা। এই কথাগুলো বুঝতে প্রতুলের অনেকসময় লেগে গেল।

কিন্তু ইউনিয়ন লিডার পরমেশ লাহিড়ি। সে তো এই গ্রহেরই মানুষ। পরমেশদা যা পারে, প্রতুল তার একাংশও পারে না কেন? ও একজন দুর্ভাগা লোক, হেরো লোক, এটাই কি একমাত্র কারণ? দুর্ভাগ্যের ভাবনাটা নিয়েই যে ও অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিল। শেষবারের মতো কলকাতা ফিরে যাবার আগে পরমেশদা ওকে কী বোঝাতে চেয়েছিল? হেরে-যাওয়াটাকে গুরুত্ব দিলে সব থেমে যাবে? কিন্তু ও তো লড়াইটা শুরুই করতে পারেনি।

সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার বোধমুক্ত রাধা-কৃষ্ণ কীভাবে ওর ছোট্ট বাগান থেকে উড়াল দেয় কাল সকালে, দেখতে হবে মন দিয়ে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব