তবু মনে রেখো…

পাবলিশারের দফতর থেকে এক কপি একটুকরো আকাশ সবেমাত্র হাতে পেল আঁচল। বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। কবি তোর্সা বসু নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিউ সার্কুলার রোডের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটটা যতই আপন হোক, সে আর সুতীর্থ বিয়ের পর প্রথম সংসার পেতেছিল মালিনী নিবাস-এই। ভাড়া বাড়ি হলেও আজও কেন জানি বড্ড নিজের!

মালিনী রায়চৌধুরী বছর ষাটের ডাকসাইটে সুন্দরী। স্বামী বেণুলাল রায়চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে তাঁর দিন কাটে। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাবার অভ্যাস কোনও কালেই নেই। সারাজীবনে, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, তার রক্ষনাবেক্ষণের দাযিত্ব স্ত্রী মালিনীদেবীর হাতে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্ত। এসব মাথায় রাখা মানেই তো উর্বর মস্তিষ্ককে কষ্ট দেওয়া। অতএব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতে হয় মালিনীদেবীকেই। নিন্দুকেরা বলে, মালিনীদেবীর শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে একটি পিঁপড়েরও প্রবেশাধিকার নেই মালিনী নিবাস-এ। যদি বা আচমকা প্রবেশ করে ফেলে, তত্ক্ষণাৎই মালিনীদেবীর সম্মার্জনী আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

বেশ মনে পড়ে আঁচলের, যারা মালিনী নিবাস-এ বাসন সাফাই আর কাপড় ধোয়ার দাযিত্বে বহাল হতো, তাদের মুখগুলো দিন কুড়ি পর পর বদলাতে থাকত। কারও তেল চিটচিটে বাসন ধোয়া তো কেউ কাপড় নিংড়ানোর কোনও ছিরি জানত না। মাঝে একবার মালিনীদেবীর তীব্র হাঁটু ব্যথার দরুন, একমাসের জন্য যে-কজন রন্ধনশিল্পী বহাল হয়েছিল তাদের কারওরই মালিনীদেবীর মাপ করা তেল-মশলায় রান্নার পারদর্শিতা ছিল না।

 

মালিনী নিবাস-এ দুটি প্রাণী। কর্তা ও গিন্নী। অনেক যত্ন নিয়ে বড়ো করেছেন একমাত্র ছেলে অবিনাশকে। সে-ও বদলি নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তার স্ত্রী তিতির সাফ জানিয়েছে, মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করার জন্য সে পৃথিবীতে জন্মায়নি। তার করার মতো অনেক কাজ রয়েছে।

মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় একবেলার জন্য অবিনাশ আসত। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র শ্বশুরালয়ে থাকায় অবিনাশের বিশেষ থাকা হতো না। এতে মালিনীদেবীর বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। বরং এ যেন একদিকে ভালোই। অন্যের আজেবাজে কাজ তার বরাবরই না-পসন্দ। খালি মাঝে মাঝে এক মাত্র নাতি তাতানের জন্য ভেতরটা হু হু করে এই যা! সাধ করে জিভেগজা, খুরমা, আচার বয়ম ধরে বানিয়ে রোদে দেন। সংরক্ষণ করেন, যদি কখনও তার দাদুভাই আসে! কিন্তু কালের নিয়মে একসময় তাতে ছাতা ধরে। তবু মালিনীদেবী প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারেন না।

মালিনী নিবাস-এর একমাত্র ভাড়াটে সুতীর্থ বসু আর তার ছোট্ট ছেলে বাবিনের প্রতি মালিনীদেবী বরাবরই স্নেহশীলা। কিন্তু সুতীর্থর বাউন্ডুলে লেখিকা বউ, আঁচলের উড়নচণ্ডী স্বভাব দেখে রেগে গজগজ করে বলতেন, মেযোনুষের অত সংসার ফেলে বাউন্ডুলেপনা ভালো লাগে না বাপু! বলি পাতাকে পাতা হিজিবিজি লিখলে সংসারের কোনও উপকার হয়? তার চেয়ে ঝুলগুলো তো একটু ঝাড়তে পারে? নেহাৎ পড়েছিল অমন ভালো ছেলেটার হাতে! আহা গো, বাচ্চাটা কেমন শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়!

প্রতিদিনের মতোই একদিন মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করতে করতে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের শিকার হয়ে শয্যাশাযী হলেন মালিনীদেবী। বাঁ দিকটা কোনও জোর নেই। ভাগ্যিস আঁচল এসে ধরেছিল, নইলে সে যাত্রা ফিরতেন না। সবই অদৃষ্ট নইলে কে ভেবেছিল, তার মতো দাপুটে মহিলাকেও কাজের মাসি আর আয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।

এদিকে পিঁপড়ে, আরশোলা, ছুঁচো মনের সুখে বাসা বেঁধেছে মালিনী নিবাস-এ। বেণুলাল খুব একটা এদিকে আসেন না। রোগীর ঘরে আসতে তাঁর গা ঘিনঘিন করে। পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, মাঝে মাঝে ভুলেই যান, ডান না বাঁ কোন দিকে অসাড় মালিনীদেবীর। না এসব করলেও বেণুবাবু যথেষ্ট কর্তব্যবান। কারণ চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় আর্থিক ভার তো তাঁরই। শুধু শুধু খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে বিপদ বাড়ানো বই-তো নয়!

বিশেষ কেউ আসে না মালিনীদেবীর ঘরে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক স্বস্তির। অবিনাশ একবেলার জন্য এসেছিল। চোখ ফেটে জল আসে মালিনীদেবীর। সামনে আলমারীর ওপরে তাঁদের বিয়ে ছবি। আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বেঢপ বেণুলালের সঙ্গে নিজের জুটিটাকে মানানসই করতে, নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন সেই কবেই! এই পুতুল খেলার নেশার মতো সংসারের নেশায় বুঁদ হয়ে সব কষ্ট ভুলেছেন। নয়তো এই স্বার্থপর, বাতিকগ্রস্ত, বদমেজাজি লোকটার সঙ্গে থাকতেন কীভাবে? মাঝে মাঝে বিভিন্ন মহিলা কলিগের সঙ্গে মাখোমাখো গল্প কানে এসেছে। শুনেও শোনেননি, বুঝেও বোঝেননি। সব কষ্ট থেকে পালানোর একটাই জায়গা ছিল। আজ আর সেটাও রইল না।

ও মাসি আমি কিন্তু ফল, হরলিক্স আনিনি, এই দ্যাখো বকুল ফুল। খুশি? বলেই হেসে ওঠে আঁচল। আঁচলের চুলের শ্যাম্পু আর পারফিউমের গন্ধে সতেজ লাগে মালিনীর। পর্দা সরাতেই ঘরে একরাশ রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।

এই দ্যাখো মাসি আমার মোবাইলে, একি! মাসি তুমি কাঁদছ?

চাঁপা কলির মতো আঙুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আঁচল স্বভাবসুলভ ভাবে বলে চলে, এটা ওয়ে ম্যাগাজিন। আমি এডিটর। সেদিন কাগজওয়ালার পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপে, তোমার কবিতার খাতাগুলো পাই। মেসো মনে হয় বোঝেননি। আমি কিন্তু আরও ছাপব মাসি! আসলে তুমি যতই খিটখিট করো, আলমারী ঠাসা রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পূর্ণ সেট আর ঝাড়ু দিতে দিতে রবিবাসরীয় পড়া দেখেই বুঝেছিলাম।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মালিনীদেবী। আঁচল বলে চলে, বারীন সেনের মতো লেখক তোমার বন্ধু? উনি পড়ে নিজে আমায় ফোন করেছেন। ভাবতেই পারছি না! কত বেস্টসেলার লিখেছেন উনি।

 

ঈষৎ বেঁকে যাওয়া, বলিরেখায় ভরা মুখটায় কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। লাজুক হেসে একটু জড়ানো স্বরে বলে চলেন, এক কালে বারীনদার সাথে কত চিঠি, কবিতা দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। মামার সংসারে মানুষ তো! বারীনদা তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তোর মেসোর ভালো চাকরি। (একটু থেমে) আচ্ছা আঁচল আমি কি আর আগের মতো জোর ফিরে পাব না রে? শুয়ে বসে খুব কষ্ট হয়। আমাকে একটু তোর মতো ফোন দিয়ে টাইপ শিখিয়ে দে না। নতুন করে লিখি।

খুব কষ্ট হয় আঁচলের। জোর করে হেসে বলে, একটু ভালো হও তারপর। এখনও তো অসুস্থ তুমি।

ধুর! আর ভালো হব নাকি! শোন না, আমার এই সোনার চুড়ি দুটো রাখ।

এ মা! কেন?

আরে সে লোক এখন টাকা পয়সা নিজের হাতে করে নিয়েছে। সময় থাকতে সরিয়ে রাখিনি আমিও যেমন! শোন না, কবিতাগুলোর একটা বই করে দিবি মা! এটা দিয়ে হবে তো? আর একটা কথা, কবির নাম দিবি তোর্সা বসু। আমার বাপের দেওয়া ডাকনাম। বাপের পদবী।

তুমি ওটা রাখো মাসি, আমি নিজে করে দেব। চাকরি করি তো না কি! একটু সময় দাও।

শোন না যাবার আগে বাবিন সোনার জন্য আমের আচার নিয়ে যাস কিন্তু।

চোখটা মুছে মোবাইলের গ্যালারি থেকে মালিনী মাসিমার ছবিটা বের করে আঁচল আপন মনেই বলে, আজ বইমেলার ৪ নম্বর স্টলে তোমার এক টুকরো আকাশ থাকবে। তোমার কথা ভুলিনি মাসি, একটু দেরি হয়ে গেল! গুছিয়ে নিতে সময় লেগে গেল।

রজনি বৃত্তান্ত

কথা হচ্ছিল ঘুঘুডাঙার দিঘির পাড়ে প্রাচীন বটগাছের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে বসে গুটি পাঁচেক মাতব্বরের মধ্যে। ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে সনাতন হাজরা হ’ল গিয়ে লায়েক। গলা খাঁকারি দিয়ে সে-ই কথাটা পেড়েছিল। ওহে মেয়েমানুষ তো লয় চামার। দজ্জাল মেয়েছেলে। ধম্মকম্ম বলে কিস্যু নাই। গলা তুলে গাল পাড়া মন্দ কথা বলা, এর বাইরে…। বাকি কথাটা লুফে নিল ভজন সামন্ত, কিস্যু নাই কিস্যু নাই। দিনকাল বদল হইচে গো, নইলে এমন মেয়েছেলেকে গাঁয়ে রাখাও কাজের কথা নয়। অমনি বাকি তিনজন তালে তাল মেলাল। হরিহর সামন্ত, শুধু এক কদম এগিয়ে বলল, বাপটা আর সোয়ামিটা কী অমনি অমনি ধেনো খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সনাতন ঘুরে বলল, ওই ঘরজামাইটার কথা বলতিছ? ও তো ক্লীব, শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে বউ-এর লাথিঝ্যাঁটা খায়। আর ওকে তাল দেয় বিষ্ণু হাজরা মানে শ্বশুরটা। হরিহর অমনি গলা তুলে বলল, সে গুড়ে বালি। ওই খান্ডারনি বউয়ের হাত থেকে সম্পত্তি গ’লে ওর হাতে যেতে যেতে মাধব মানে মেধো এমনিই অক্বা পেয়ে যাবে।

শীতের দুপুরে রোদ্দুর যেন পালাব পালাব করে। দিঘির ও’পারে তালবনে সুয্যি ঠাকুর জাল গুটোচ্ছে। সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে সনাতন বলল, চল হে একটু পরেই হিম পড়বে। এই বুড়োবেলায় সব সইতে পারি হিম সইতে পারব না।

যাকে নিয়ে এত কথা সেই রজনি তখন সাঁঝের আকাশের দিকে চেয়ে গাল পাড়ছে, একবার ঘর এসো, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। হাটে যাবার নাম করে সেই সকালে দুটিতে বেইরেছে, এতখানি বেলা পার হয়ে সুয্যি পাটে বসল, ফেরার নাম নেই। হেঁসেলের উনুনে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব। গঙ্গাজলে ভাইস্যে দেব ওই বুড়োটাকে আর পোড়ামুখো জামাইটাকে। খিড়কির চৌকাঠে একটা ছায়া চুপিসারে ঢুকতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। রজনি আকাশমুখো, ভাগ্যিস। কে জানি রজনিকে বলেছিল, আকাশমুখো সব কথা বহু দূর তক্ শোনা যায়। ছায়া আরও এক পা রাখতেই খড়ের গাদার ওপর রাখা কাটারিটা টিউবওয়েলের বাঁধানো শানে পড়ে ঠনঝন শব্দ করে উঠল। সেদিক পানে চেয়ে রজনি তিরিক্ষি চেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো ওই কাটারিতে তোমাদের টুকরো টুকরো করব।

ছায়া এবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দাঁড়াল। বিষ্ণু হাজরা। একটু টাল খেয়েছিল। ধেনোটা বুকের ভেতর থেকে তখনও পেট অবধি নামেনি। এইসময় মেয়েটা এমন তেড়ে উঠল যে চমকে আবার পিছু হঠতে গিয়ে প্রায় কাটারিতে পা দিয়ে ফেলেছিল। সামলাতে গিয়ে টিউবওয়েল-এর হাতলটা ধরে ফেলল। রজনি খানিক থমকে গিয়ে আবার সুর তুলল, বলি ল্যাজটা কোথায়?

বিষ্ণু হাজরা অমনি যেন খানিক ফুরসত পেয়ে একরকম নীচু গলায় বলল, মেধো সেই কোন দুপুরে আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে কোথায় যে গেল, বলল তো হাটে যাচ্ছি…।

কোথায় গড়াগড়ি দিচ্ছে? তুলে আনতে পাল্লে না? এবার তুমি এসো, তোমায় দেখি খানিক। মেয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে নেশা ছুটে গেছে বিষ্ণু হাজরার। মনে খানিকটা বল সঞ্চয় করে বলল, একটু ঠান্ডা হ মা। হাট তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ঠিক ফিরে আসবে। তুই বরং উনুনে আঁচ দে। বিষ্ণু হাজরা মনে মনে আওড়াল, আঁচ দেবে কী, মেয়েটা তো নিজেই আঁচ হয়ে আছে।

তারপরেই মনে হ’ল, তাই তো ছোঁড়়াটা গেল কোথা! সে কী সত্যি-ই হাটে গেছে! ধেনোর ঠেকেও তো যায়নি। তাহ’লে!

মেধো তখন অনেক দূরে। আশমান গাঁ আর চাঁপাডাঙা ছাড়িয়ে ফুলটুসি গাঁয়ের মখমল বাজারের থেকে পোয়া মাইল দূরে এক সাধু আসন গেড়েছে। তাতেই লোক হামলে পড়েছে। সাধুর নাকি মোক্ষম দিব্যদৃষ্টি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ– সব গড়গড়িয়ে বলতে পারে। এত ভিড়ের মধ্যে সাধুর নাগাল পাওয়া কঠিন। বেশ খানিক পিছনে দুটো থান ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মেধো ঠাওর করতে চাইছে। এই সাধুর খবর সে পেয়েছিল তার ছেলেবেলার বন্ধু পঙ্কার কাছ থেকে। পঙ্কা বলেছিল, একবার গেলেই টের পাবি। স্বয়ং বিশ্বনাথের চ্যালা।

তোর যা দুঃখ, যা গিয়ে বল। কিছু একটা তো হবেই। ধেনো খেয়ে তো আর সাধুর কাছে আসা যায় না, তাই ধেনোর ঠেকে যাবার আগেই বাবা শ্বশুরকে বলেছে, হাটে যাচ্ছে। তবে ভেবেছিল সাধুর সঙ্গে দেখা করে বাজার থেকে আনাজপত্র কিনে ফিরবে। কিন্তু এত ভিড় ভাবনার বাইরে ছিল। ইতিউতি দাঁড়িয়ে কোনওভাবেই যেন তার দর্শন মেলে না। তেমন একটা গাছও নেই যার ওপর চড়ে সাধুর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকে দূর দূর থেকে এসেছে। কারও মানত ফলেনি, কারও ব্যাবসা মন্দগতিক– হাজারও সমস্যা। পঙ্কা বলেছিল, সব তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে সাধুবাবা। অগত্যা বেশ খানিক দূরে মোটা গুঁড়ির একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে বসে থাকে ঠায়। তাছাড়া সব কথা তো সবার মাঝে বলাও যায় না। কথাগুলো পেরাইভেট কিনা।

সন্ধের পর একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ইয়াব্বড়ো একটা চাঁদ ফুলকো লুচির মতো আকাশে ফুটে উঠল। শাল্লা মশার ভনভন, পোকামাকড়, সাপও থাকতে পারে। তারমধ্যেই একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখদুটো রাবারের মতো চিপসে যাচ্ছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই হঠাৎ কেউ কোথাও নেই। সাধু একলা বসে। বুক পর্যন্ত সাদা কাশফুলের মতো দাড়ি, কাঁধ থেকে বুক পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে সাদা জটা। সাধু মহারাজ একটা কল্কেতে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুজে আছে। ধুনির আলো আর চাঁদের আলোতে সাধুর পদ্মাসন থেকে পা দুটো খুলে ছড়িয়ে বসে থাকার কায়দাটা খুব চেনা ঠেকল। আরে ভুতোদা না! এই বসার ধরনটা এই গাঁ ছাড়িয়ে আরও দশ গাঁয়ের পর মেধোর জন্মভিটে হরিশপুরে কে না চেনে! আর ওই দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখটাও তো…! এইরকম আয়েশ করে বসতে আর কাউকেই জানে না মেধো। শুধু সে নয়, গাঁয়ের সব্বাই…।

হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোতেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতোদা-ই তো। ভুতোদা বলে ফসকা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। শুধু শুধু বেমক্বা সব কেঁচিয়ে দিলে হয় না। এখনও বাজারের লোক হয়তো সব ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু ফসকে যাওয়া ওইটুকুতেই ভুতোদা এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে চাপা গলায় বলল, কে কে বটে?

বুনো গাছগাছালির ওপর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু দুটোর নুনছাল উঠে গিয়েছিল। জ্বালা করছে। তবু শেষবার চেষ্টার মতো করে শরীরটা একরকম ছুড়ে দিল মেধো।

আমি গো আমি। চিনতে পাচ্ছো ভুতোদা? আমি হলেম গে হরিশপুরের মাধব হুই। বাপের নাম কেষ্টচরণ হুই। মায়ের নাম…।

বলতে হবে না। তো এ তল্লাটে কি কচ্ছিস?

আমি হলেম গ্যে ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে বিষ্ণু হাজরার ঘরজামাই গো।

ছ্যাঃ ঘরজামাই। পুরুষ মানুষের কলঙ্ক।

মেধো এবার গুছিয়ে বসে ঘনিষ্ট গলায় শুধাল, তুমি সাধু হলে কবে থেকে? বে থা করনি এ’কথা জানি। কিন্তু তাই বলে সাধু!

কল্কেতে টান দিয়ে খানিক ধোঁয়া উগরে দিয়ে ভুতো বলল, আমি হলেম ভূতানন্দ স্বামী। গৃহীর নাম সাধুর হয় না। তো বল তোর সমিস্যি কী।

সমিস্যি তো একটাই। বউটা বড়ো দজ্জাল। উঠতে বসতে গাল পাড়ে। আগে অমনটি ছেল না। ছেলেপুলে হ’লনি তো। তাতেই এমন তিরিক্ষি হয়ে গেল।

শুধু তোরেই গাল দেয়?

না গো ওর বাপটারেও দেয়। দোষের মধ্যি আমরা পুরুষ মানুষ তো বটে, একটু আধটু…।

কথা শেষ হবার আগেই ভুতো বলে, মেয়েছেলের দোষ আছে? মানে খারাপ বাড়িতে যাস নাকি? তা হ’লে তো…।

ছিঃ কী যে বলো। তুমি না সাধু। এই যেমন ধরো গিয়ে তুমি কল্কেতে টান দাও আর আমরা সারাদিন পরে একটু ধেনো খাই। সেটা কি খুউব দোষের?

দোষ? দোষ গুণের বিচার করার আমি কে রে। সবই ওই ওনার– বলে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে দেখাল ভুতো। তোর ছেলেপুলে?

হয়নি। আর তার জন্যই তো এত গোল। হাকিম বদ্যিও কম হয়নি। তো ওই যে বললে না সবই তেনার ইচ্ছে। এবার গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, দাও না।

কী? ছেলেপুলে?

না গো। ওতেও শান্তি হবে না। তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কথাটা বলে ভুতোর ছড়ানো পা দুটো ধরতে যাবে অমনি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ভুতো বলল, অত সোজা। সাধু হব বললেই সাধু হওয়া যায় নাকি? মেধো দ্বিতীয়বার শরীরটা ছুড়ে দিয়ে ভুতোর দুটো পা-ই ধরে ফেলল।

আঃ ছাড় ছাড়, সাধু হলে শ্বশুরের ভিটে জমি পুকুর এ’সব যে হাতছাড়া হয়ে যাবে রে।

হাতছাড়া হয়েই আছে ধরে রাখো। অমন দজ্জাল বউ না-মরা ইস্তক কিচ্ছুটি পাবার যো নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। তারপর আর একটু এগিয়ে ভুতোর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি দলাই মলাই করতে করতে মেধো কেমন যেন আবেশ বিভোর গলায় বলল, তোমার সেবা করব। আমারে দীক্ষে দাও।

সেবা করবি? তা হ’লে কর। কল্কেটা একটু সাজিয়ে দে। বাবা বিশ্বেশ্বর কী বলেন দেখি। মেধো অমনি হাত বাড়িয়ে কল্কেটা নিল।

দু’টান মারতেই ভুতোর কেমন ফুরফুরে উদার হয়ে গেল মনটা। তোকে আমার চ্যালা করে দিলাম যাঃ। ক’দিন এ’ধার ও’ধার আমার সঙ্গে ঘুরে দেখ, তারপর না হয় দেখা যাবে। সংসারের এঁটেল মাটি গা থেকে আগে খসুক, দীক্ষা হবে।

মেধো গদগদ গলায় বলল, হবে বইলছ। তাইলে এট্টু পেসাদ…। ভুতো কল্কেটা বাড়িয়ে দিল। মেধো চোখ বুজে এক দমে খানিক টেনে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। ব্যাস হয়ে গেল, পাপ তাপ সব ছাড়িয়ে ভেতরটা কেমন যেন উদাস বাউল পারা। কোথায় পড়ে রইল রজনি, জমি জমা ভিটে– সব কেমন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শুধু ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর যেটুকু দেখা যায়, ভূতানন্দ স্বামী।

দুই

রাতে ঘুম হয় না বিষ্ণু হাজরার। ঘোলাটে চোখ দুটো পেঁয়াজের পাতলা খোসার মতো যেন ভাসছে। ছেলেটা যে কর্পূরের মতো উবে গেল। আকাশপটে বাসি কদমফুলের মতো তখন শুকতারাটা ফুটেছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বিষ্ণু হাজরা, তোমায় বইলছি তো সব তোমার নামে নেকাপড়া করি দিব, তা বুঝি বিশ্বাস হ’লনি। তোমার হলি তো মেয়েটারও হ’ল নাকি! তারপরেই মনে হ’ল বেবাক কোথাও নেশার ঘোরে পড়ে নেই তো! তবে নেশার ঠেকগুলো তো এ’কদিন ঘুরে দেখে নিয়েছে। তো সে কোথায়! তাহ’লে কী…! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

পাশের ঘরে শুয়ে অমনি এ’পাশ ও’পাশ করে জেগে আছে রজনি। মানুষটা গেল কোথা! যা গাঁয়ের ছিরি ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল না তো! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে কপাট খুলে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। রাগে জ্বলে ওঠে রজনি, রঙ্গ হচ্ছে! তামাশা! তারপরেই কেমন যেন ভেঙে পড়ল, কোথায় খুঁজবে মানুষটাকে। বাপটা কি ঘুমে নিঃসাড়, না তারই মতো…! ভেতরের কপাট আবজানই ছিল।

পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? ভাবো কি আমি তোমায় ছাড়ি দিব? মানুষটাকে কোথায় রাখি এয়েচ? দিনরাত মদ গিলেও শান্তি হয়নি? শেষে বেচি দিলে মানুষটারে! বিষ্ণু হাজরা হাতের মুদ্রায় জানান দেয়, সে জানে না। এমন কাণ্ড কোনও বাপে করতি পারে!

তারপরেও সব যেমন চলছিল তেমনি সব ঠিকঠাক। সকালের প্রথম রোদ্দুর উঠোনে চুঁয়ে পড়েছে। রজনি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে অন্য মূর্তি। পারলে রাঙা রোদ্দুর ঝাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলে। বিষ্ণু হাজরা এক পা দু’পা করে খানিকটা এগোতেই রজনি রণং দেহী ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল, ভেবেছ কী? ওই আবাগির ব্যাটার সঙ্গে খালাস হই যাতি পাল্লে না। হাড় জুড়োত।

আঃ, আমি কী তার জানি! আমায় কি বলেকয়ে গেছে?

এমনি এমনি হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল? কেমন করে ভূত ছাড়াতি হয় তোমাদের আমার জানা আছে।

তারে খুঁজতি গেলেও তো যাতি হয়।

তো যাও। সঙের মতো দাঁইড়ে না থেকে খুঁজি আনো। মানুষটারে না নিয়ে ফিরলি তোমার একদিন কি আমার একদিন।

চিন্তায় বিষ্ণু হাজরার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, বাগদিপাড়া, দুলেপাড়া, মালাপাড়া কোনওটাতেই তো বাদ দেয়নি। তাহ’লে! মাথা নাড়তে নাড়তে বিষ্ণু হাজরা বেরিয়ে যেতেই ভজন সামন্তের ছোটো ছেলে পটলা হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির। সববনাশ হই গ্যাছে। গাঁয়ের কে যেন দেখেছে, মানুষটা এক সাধুবাবার সঙ্গে বাঁকা নদী পার হয়ে কোথায় যেন…!

তা কেউ বারণ করলে না?

বারণ করবে কিগো। সাধুবাবা যে তখন বাণ মারিছে। সব বেবাক দাঁইড়্যে…!

রজনির মুখ থেকে কথা সরে না। কোথা গেল মানুষটা! কতদূর!

বিষ্ণু হাজরা ফিরল বেশ খানিক রাতে। সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে। একে তাকে জিগ্যেস করেছে। ফুলটুসি গাঁয়ের কয়েকজন অবশ্য সাধুর কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কি হদিস মেলে! দু’একজন হেসে তামাশা করে বলেছে, তা তোমরা বাপ-বেটি মিলি মানুষটারে খেদানোর ভালো কল ঠাউরেছ তো! এখন হাপিত্যেস করার যাত্রা নাই বা করলে। বিষ্ণু হাজরা কোনও উত্তর দেয়নি। কী-ই বা উত্তর দেবে!

ঘরে ফিরতেই রজনির সামনাসামনি। পাল্লে না সাধুটারে পুঁতি রাখতি? ভণ্ড আমার সংসারটারে তুক করিছে, আর তুমি বেবাক ঘরে ফিরলে? যাও না কেনে বাঁকা নদী পার হই তারে খুঁজে আনতি।

বিষ্ণু হাজরা চুপচাপ দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত শোক কি ও সইতে পারে! বাইরের কপাট ধরে তখনও রজনি দাঁড়িয়ে।

পরের দিন পুলিশ চৌকিতে হাজির বাপ-বেটি। সব শুনে বড়োবাবু হাসল, তো আমি কী করব। জামাই পালিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেয় সংসার ত্যাগ করেছে, তো আমি কী করব? এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, হঠাৎ জ্বলে উঠল রজনি, তাই তো পুলিশ তো হাবাগোবা, শুধু ঘুষ নিবে, সাধুকে জেলে পুরবে আর চোরকে ছেড়ে দিবে। বড়োবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার মুখ সামলে।

চোপ, বিষ নেই তো কুলোপানা চক্বর। ঝাঁটা মারি অমন আবাগির ব্যাটাকে।

হনহন করে বেরিয়ে এল রজনি, বাপটা পেছু পেছু একরকম ছুটতে ছুটতে পাঞ্চেত বিডিও আপিস ঘুরেও কোথাও কোনও হদিস পেল না।

ঘরে ফিরে রজনি কেমন যেন থিতিয়ে গেল। চুপ করে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসে রইল।

তিন

এতসব কাণ্ড যখন তখন হর-কী পাউরির ঘাটে বসে কল্ কল্ জল দেখছে মেধো। পাশে বসে গুরু ভূতানন্দ স্বামী। দীক্ষান্তে মেধো এখন তার চ্যালা।

কেমন লাগছে তোর?

ভালোই, তবে…।

কী তবে?

নিরামিষ এত ভাল্লাগে না।

এ তো দেবস্থান। এ’সব কথা বলাও পাপ। এরপর তো তোর গেরুয়া বসন হবে।

ও যখন হবে, হবে। তাই বলে…।

চুপ করে থাকে ভূতানন্দ। চোখ বুজে মনে মনে বলে, সংসারের গন্ধ গা থেকে খসতে তো সময় লাগবেই। মুখে বলল, তাঁর ভজনা কর। তিনিই পথ দেখাবেন।

শাল্লা ঠিক সেইসময়-ই দজ্জাল বউটার কথা মনে হ’ল। বউটার জন্য কেমন যেন দুঃখ হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এমনটা কি সবার হয়! সংসার কি এমনিই পেছন থেকে টানে! কথাগুলো শুধোতে গিয়েও শুধোল না। শুধোলে তো সেই ওপরের ওনাকেই দেখিয়ে দেবে ভুতোদা, থুরি ভূতানন্দ।

তারপর কংখল। মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ভজন, গীত, স্তোত্র, খাওয়া বলতে মালসায় খিচুড়ি ভোগ। বাকি সময়টা মাধুকরী– ভিক্ষে চেয়ে পেট ভরা। শাল্লা পেট চটকে ঠাকুর ঠাকুর। নিকুচি করেছে ঠাকুরের। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যায় গাঁয়ে। অমনি মনে হ’ল রজনির কথা। যা খান্ডারনি হাত-পা ভেঙে নুলো করে দেবে। শাল্লা জলে কুমির তো ডাঙায় বাঘ। মাঝেমধ্যে কোনও গাঁয়ে গিয়ে আসন পাতলেও তো হয়। কলাটা মুলোটা ফলটা কম তো হয় না।

চাঁদ দেখছিল ভূতানন্দ। মেধো শুধিয়েই ফেলল, কবে যাবে?

কোথায়?

এই কোনও গাঁয়ে।

বোশেখের আগে নয়। তার আগে এলাহাবাদ। মাঘী স্নান।

মাঘী স্নান!

সারা মাঘ মাস স্নান চলবে আর ঠাকুরের নাম সংকীর্তন সঙ্গে মাধুকরী।

এই হয়েছে এক গেরো। দুটো কথা সহ্য করে গাঁয়ে থাকলে ভালো হতো। ভূতানন্দ ওর দিকে ফিরে চাইল। তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠল, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…। ঝুলি থেকে একটা কল্কে বের করে বলল, নে সাজ তো।

দুটো টান দিতেই গুরু খুশ্ তো চ্যালা খুশ্।

চার

সময় যেন ডাকহরকরা। নিদানের চিঠি তার হাতে ধরা। কখনও বা সে গাঁয়ের চপলা শ্যামলাবরণ মেয়ে। ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর।

শূন্য ঘরে রজনি একা। তার শরীরেও সময় কখন গুটিগুটি প্রবেশ করেছে। গত বিশ বছরের জোয়াল এখন তার কাঁধে। বিষ্ণু হাজরা দেহ রেখেছে তা-ও দশ বছর পার। আনমনা বসে থাকতে থাকতে শোনে কোথায় যেন কোনও বৈরাগী গান ধরেছে, এ জীবন নদীর পারা যতই ভাবো যায় না ধরা। হবে হয় তো। শূন্য ঝাঁপি শূন্যই থেকে যায়, কেউ তো এক আনিও দিল না।

রাত্রে মোহন এল। মোহন রজনির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। বলল, পিসি হয় না।

কী হয় না?

খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা যায়? যায় না। সব ধম্মস্থানই তো খুঁজলে, পেলে?

রজনি মোহনের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, হয় কী না হয় সে আমি বুঝব। তোকে যেতে হবে না।

আমি কি তা-ই বলেছি?

গেলে যাবি না গেলে যাবি না। কারও জন্য কিছু…। এই যে একটা গোটা মানুষ হারিয়ে গেল তার জন্য…! রজনি থেমে গেল।

তারপর শুধু চলা আর চলা। কখনও হূষিকেশ কখনও এলাহাবাদ আবার কখনও মথুরা। কোথাও নেই। রুদ্রপ্রয়াগ। মন্দিরে গান হচ্ছে, হ্যায় জীবন কি নৈয়া তুমহারে হাওয়ালে, জিধার চাহো হম কো উধর লে চলো তুম। গানের সুর, নদীর আবিরগোলা জল– সব একাকার।

মোহন পিছন থেকে ডাকল, পিসি। রজনি সাড়া দিল না। ও তখন অনেক দূরে। মানুষ হারিয়ে যাবার সুলুক সন্ধান যেন এখন ও জানে। মোহন বলল, যাবে পিসি?

কোথায়?

সাধুভান্ডারা। ভক্তের ভোগ দান সাধু বিলিয়ে দেবে সবার মধ্যে। যাবে? রজনি অস্ফুটে বলল, যাব।

সার বেধে ভক্তের দল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য তখন পুব আকাশে। পিসি-ভাইপো সেই সারে দাঁড়িয়ে। একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে রজনি এগিয়ে এসেছে। এক ব্রহ্মচারী। শ্বেত শুভ্র বসনের সঙ্গে পক্ব কেশ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলী একাকার। চোখদুটো যেন দূর পারের কান্ডারি। তন্ময় হয়ে দেখছে রজনি। চেনা মুখটা কত যেন অচেনা। মনে মনেই বলল, কে তুমি?

একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল রজনি। করজোড়ে আঁচলের কাপড় গলায় জড়িয়ে প্রণতভঙ্গিতে রজনি মাথা নীচু করল। ব্রহ্মচারী কেঁপে উঠল। অস্থির এক ভাব। হাত তুলতে গিয়েও যেন থমকে গেল।

দেব দর্শন। রজনি মনে মনেই বলল, তোমায় মুক্তি দিলাম ঠাকুর। মোহন কিছুই টের পায়নি।

বিহান তখনও ফুটেছে কী ফোটেনি। ব্রহ্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দির লাগোয়া ধরমশালার দোরগোড়ায়। কেয়ারটেকার বাবুটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সব শুনে বলল, উ লোগ তো চলা গিয়া।

অস্পষ্ট অন্ধকারে ব্রহ্মচারী দাঁড়ালেন নদীর সঙ্গমস্থলে। পুব পাড়ে তখন সূর্য ওঠার প্রস্ততিপর্ব। দু’হাত বুকের ওপর প্রণামের ভঙ্গিতে রেখে তিনি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বললেন, এবার গেরুয়া বসনের অধিকার দাও হে প্রভু।

অন্তরালে স্বামী ভূতানন্দ হয়তো হাসলেন।

পানিবাই

ঘটকপুকুরে যেতে চাইলে দুটো স্টপেজে নামা যায়। এক, ডাক্তারখানা স্টপেজ। এক কামরার একটা মাটির চালা, সামনে ছোট্ট বারান্দা। একসময় রুগির ভিড় উপচে পড়ত সেই বারান্দায়, ভেতরঘরে নড়বড়ে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকত প্রতাপ ডাক্তার। প্রতাপ কাঁড়ার, হোমিওপ্যাথ। এক শিশি সুগার অব মিল্কে এক ফোঁটা ওষুধ ফেলে সাত গাঁয়ের লোককে খাওয়াত, লোকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, ‘সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি’। সেই ধন্বন্তরি প্রতাপ ডাক্তারকে হঠাৎ একদিন সকালে কেউ দেখতে পেল না। চেয়ার, টেবিল আছে, খোপ-খোপ ওষুধের বাক্স আছে, তক্তাপোশে তেলচিটে বিছানা, নীচে স্টোভ. কালি-লাগা হাঁড়িকুড়ি, দড়িতে ধুতি-গামছা, সব যেমনকার তেমন আছে। শুধু মানুষটা নেই। কেউ বলল, স্বপ্নে আদেশ পেয়ে হিমালয়ে চলে গেছে ডাক্তার, কেউ বলে বাড়ি থেকে খারাপ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েছে। প্রতাপ ডাক্তার চলে যেতে সাত গাঁয়ের লোক কিছুদিন হা-হুতাশ করল, তারপর নতুন ডাক্তার খুঁজে নিল। কিন্তু ডাক্তারের ঘরটা তেমনই পড়ে রইল, থাকতে থাকতে জরাজীর্ণ হয়ে গেলেও ঠিক দাঁড়িয়ে রইল মাটির ওপর। আর বাস স্টপেজের নাম হয়ে গেল ডাক্তারখানা।

দ্বিতীয় স্টপেজের নাম ঘটকপুকুর স্ট্যান্ড। এখান থেকে রাস্তা একদিকে রায়দিঘি অন্যদিকে কাকদ্বীপের দিকে চলে গেছে। জায়গাটা সবসময়ই সরগরম। তিন-চারটে মিষ্টির দোকান, চপ-ফুলুরিও বেশ কয়েকটা, সারের দোকান, টেলারিং, ইদানীং একটা টিভি মেরামতের দোকানও খুলেছে পঞ্চায়েত প্রধানের ভাইপো নাড়ু। বিকেলে একটা রোল-চাওমিনের চলমান দোকানও বসে। তার গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ঘটকপুকুর রোল কর্নার’।

ঘটকপুকুর গ্রামে যেতে গেলে এই স্ট্যান্ড থেকে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। ডাক্তারখানা স্টপেজে নেমে অবশ্য সোজা ঢুকে গেলেই হল। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়, পুকুরে হাঁসের সাঁতার দেখতে দেখতে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশ দিয়ে সোজা ঘটকপুকুর হাটতলায় ঢুকে পড়া যাবে। এই হাটতলাটাই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামটা তাকে ঘিরে পদ্মের পাপড়ির মতো ফুটে আছে।

ডাক্তারখানা আর স্ট্যান্ড– এই দুই স্টপেজের মাঝে গ্রামে ঢোকার আর একটা তৃতীয় রাস্তা আছে। বাস ওখানে দাঁড়ায় না। যদি দাঁড়ায়, তবে হয়তো স্টপেজটার নাম হতো, কাওরাপাড়া স্টপেজ। ঘটকপুকুরের কোনও মান্যগণ্য লোককে প্রকাশ্যে এ রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখা যায় না। আগেকার দিনে বাড়িতে যেমন মেথর ঢোকার আলাদা পথ থাকত, এই রাস্তাটাও তেমনি। ভদ্রসমাজের অস্পৃশ্য, অব্যবহূত। আসলে এই পাড়ার বাসিন্দারাও তাই। পন্ডিতেরা বলেন এরা আগে ছিল জমিদারের পালকিবাহক, কাহার সম্প্রদায়। কাহার থেকে কাওরা। যারা পালকি না বইলে ভদ্রলোকের সভ্যতার গতিরুদ্ধ হয়ে যেত, অফিস-কাছারি, পালা-পার্বণে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত, এমনকী পালকি শুদ্ধু গঙ্গায় ডুবিয়ে পুণ্যের থলিটা বোঝাই করা যাদের দাক্ষিণ্যে, তারা নাকি এত নীচু জাত যে গ্রামের ভেতরে তাদের বাস চলে না, তাদের রাস্তাটাও বিপদে না পড়লে কেউ ব্যবহার করে না। তো সেই কাওরাপাড়ায় লকলক করে লাউডগার মতো বেড়ে উঠছে ফুল্লরা কাওরা। তাকে নিয়েই এই গল্প।

ফুল্লরা একরাশ গোবর কুড়িয়ে ঘরে ফিরে দেখল তার মা সনকা দাওয়ায় বসে চুল খুলছে। সে প্রায়ই দড়ি দিয়ে চুল বাঁধতে গিয়ে গিঁট ফেলে দেয়, তাই দড়ির বদলে অনেকসময় শাড়ির পাড় ছিঁড়ে নেয়। আজ মার কাঁচাপাকা চুলে লালরঙের শাড়ির পাড় কেমন বেখাপ্পা লাগল ফুল্লরার। মার সিঁথির জায়গাটা ফটফটে ফাঁকা। তার বাপ দুখে মারা গেছে দু-মাসও হয়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, দুখেকে খুন করা হয়েছে।

দুখে কাওরার স্থায়ী কোনও পেশা ছিল না। মাঝে মাঝে সে নিত্য শাহ-র সিমেন্টের দোকানে মাল বওয়ার কাজ করত বটে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই তাকে কাজ করবার মতো সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যেত না। সে পড়ে থাকত পঞ্চার তাড়ির ঠেকে কিংবা মণিকা-কণিকার বাড়ি। সেখানে মদের আসর বসত, তবে সেটা মুখ্য নয়। দুখে খুব ভালো গান গাইত। তার গলায় গোষ্ঠগোপাল দাসের ‘গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে মন প্রাণ দিয়া’ শুনে মহাপাতকের চোখেও জল আসত। তার গানের সঙ্গে নাল বাজাত সাগর। আর মণিকা-কণিকা, যাদের নামে গ্রামের সবাই বলে, তারা গ্রামের বুকেই, ভদ্রপাড়ায় লাইন খুলে বসেছে, তারা গানের মাঝে মাঝে মদ, চাট এবং হাসি পরিবেশন করত আর পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের আঁচল বার-বার খসে পড়ত।

এরকম অবস্থায় তাবড়-তাবড় ঋষিদেরই ধ্যানভঙ্গ হয়, দুখে তো কোন ছার! সে শুধু মনস্থির করতে পারছিল না, মণিকা না কণিকা– কে তার মন বেশি টেনেছে। নিজের এই সংশয়ে সে এতই নিবিষ্ট ছিল যে খেয়ালই করেনি, যে তার বাজনদার সাগর, তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে। এ বাড়িতে সাগরের যাতায়াত দুখের অনেক আগে থেকে, দুটি বোনকেই সে তার হাতের বাজনার মতোই ভালো বাজাতে পারে। তারাই যখন, দুখের গানে মজে, নতুন হাতে বাজতে চাইল, সে মেনে নিল না।

দুখে আর সাগর মাঝে মাঝেই দূর দূর গ্রামে মাচা প্রোগ্রাম করতে যেত। সেবার তারা গেল কাঁটাগাছি, কাঁটাগাছি ব্যবসায়ী সমিতির ডাক পেয়ে। ফেরার সময় সাগর একাই ফিরল, দুখে নাকি ওখান থেকে কোথায় চলে গেছে, কাউকে কিছু না বলে। কয়েকদিন পর দুখের বডি ভেসে উঠল খালের জলে। সনকা থানায় রিপোর্ট লেখাতে গিয়ে ফিরে এল। একে তো সাগর উঁচুজাত, তার ওপর সে পঞ্চায়েত প্রধানের লতায়পাতায় আত্মীয় হয়। সনকা চোখের জল মুছে বাড়ি ফিরে এল।

সনকার ফটফটে সাদা সিঁথিটা দেখে ফুল্লরার মনে আবার সেই ভয়ংকর দিনগুলো ফিরে আসে। সেই জল থেকে তোলা ফুলে ঢোল বডি, বাবা বলে চেনাই যায় না। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ফুল্লরা জানে তার বাবাকে ছুরি মেরে খুন করেছে সাগর। পুলিশের মুখ বন্ধ করলেও লোকের মুখ অত সহজে বন্ধ করা যায় না। ইস্কুলের টিউকলে জল নিতে গিয়ে শুনে এসেছে সে, গাঁয়ের বউ-ঝিরা সেখানে খাবার জল নিতে ভিড় করে সকালে-বিকেলে।

যত আগে গিয়েই লাইন দিক, ফুল্লরা জানে যে, সে জল পাবে সবার পরে। ছোটোবেলা থেকেই এমন দেখে আসছে। তখন বুঝত না। জেদ করে ওদের লাইনে দাঁড়াতে গিয়েছিল একবার। ওরা ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। খোয়ার ওপর পড়ে কপাল একটুর জন্যে ফাটেনি, কিন্তু মাটির কলসি ভেঙে গিয়েছিল। ছোট্ট ফুল্লরার কপালে গাঁদা পাতার রস লাগাতে লাগাতে তার মা বুঝিয়েছিল উঁচুজাতের জলের লাইন আলাদা, ওদের ছোঁয়া লাগলে যে জল ওরা খেতে পারবে না। ফুল্লরা বুঝতে পারেনি, সরকারি কলের জল ওদের ছোঁয়ায় কী করে অশুদ্ধ হতে পারে। তখনও ইস্কুল ছাড়েনি। খিচুড়ি ইস্কুল। সেখানে খুব করে প্রার্থনা গাইতে হতো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ গাইতে গাইতে ওর বুকে কীরকম একটা কষ্ট হতো। ওর মনে হতো, এখানে যে আগুনের কথা বলা হয়েছে, সেই আগুন তো বইয়ের অক্ষরের মধ্যে লুকোনো আছে। সেই আগুন যে ছুঁয়েছে, সে-ই শুদ্ধ। তার আবার জল-অচল কী? ইস্কুলে বেশিদিন যেতে পারেনি ফুল্লরা, কিন্তু গানটা ভোলেনি।

সবার পরে জল নিতে এখন আর কষ্ট হয় না। ও জেনে গেছে এটাই নিয়ম। কাওরাপাড়ায় দুখে কাওরার ঘরে জন্মালে এরকমই হয়। সেই জন্মদাতা বাবাও যদি ওরকম বেঘোরে চলে যায়। শ্যাওলা-জড়ানো, ফুলে ঢোল দুখের লাশ মনে পড়ে যায় বারবার ফুল্লরার।

সনকার চুল খোলা হয়ে গেছিল। সে কেমন চোখে ফুল্লরাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘ঘরে শ্যাম্পুর পাতা আছে, মাথা ঘষে চান কর। বিকেলে, তোর মামি গেলবার যে শাড়িটা দিয়েছিল, নীল করে, ওটা পরবি।’

ফুল্লরা অবাক হয়ে গেল। মার ভালো শাড়ি বলতে ওই একটাই। কোনওদিন চাইলেও পরতে দেয় না। বলে ছিঁড়ে যাবে। হরিসভায় মোচ্ছবের সময় তাদের পাড়ার মেয়েরা কত সেজেগুজে যায়। সেসময় কতবার শাড়িটা পরতে চেয়েছে ফুল্লরা, মা দেয়নি। আজ কী হল তার! সে তবু কিছু জিজ্ঞেস করে না মাকে। বাবা চলে যাবার পর মা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। দশবাড়ি খেটে খেটে সারাক্ষণ তেতেপুড়ে থাকে, কিছু জিজ্ঞেস করলেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

সে গোবরটা উঠোনে রেখে হাত ধুয়ে কোমরে বাঁধা ওড়নায় মুছে নিল। তারপর ঘরে এল। শ্যাম্পুর পাতাটা নেবে। নীচু ঘর, দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না। দেয়ালে একটা আয়না ঝোলানো আছে। তার ঘষা কাচে ফুল্লরা নিজেকে দেখার চেষ্টা করে।

এ গাঁয়ের অনেক মেয়েরই সকাল সকাল বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের সরকারি বয়সে পৌছনোর অনেক আগেই। শুধু গরিব ঘরে বা নীচু জাতের মধ্যে নয়, বড়ো বড়ো ঘরেও এটাই স্বাভাবিক। ভালো ছেলে পেয়ে গেলে সবাই হাঁকপাঁক করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। সে সামনে মাধ্যমিক থাকলেও। আর ফুল্লরা তো স্কুলেই যায় না। তারওপর বাবাও নেই। তাই তার এই বয়সে বিয়ে ঠিক হওয়ায় কেউ অবাক হল না। কিন্তু ছেলের বাড়ি কোথায় জেনে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। কথায় বলে, ‘কোনও কালে নেই ষষ্ঠীপুজো। একেবারে দশভুজো।’ একেবারে বম্বে। বম্বে তো একেবারে কল্পলোক। সেখানে ক্যাটরিনা কইফ, সলমন খান, শাহরুখ খান রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ভোরে সমুদ্র ধরে হাঁটলে বিগ বি-র সঙ্গে ধাক্বা লাগতে পারে। সেখানে শ্বশুরঘর করতে যাবে কাওরাপাড়ার ফুল্লরা কাওরা!

ফুল্লরার বন্ধুরা শুনে বলল, ‘তোর নাকি শাহরুখ খানের সঙ্গে বিয়ে!’

যদিও ঠাট্টা, তবু ফুল্লরার বুক তিরতির করে কেঁপে উঠল। সত্যি তার বিয়ে, তাও আবার বম্বেতে! মাঠে গোবর কুড়োনো, সেফটিপিন দিয়ে ফ্রক আঁটা, সবার শেষে জল নেওয়া– এই ছেঁড়াফাটা, তালিমারা জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে তার? শাহরুখ খান না হোক, তার বরের নাকি মেলা জমি-জিরেত, এখনকার মতো ভাতের ভাবনা থাকবে না বিয়ের পর। কিন্তু তাদের গাঁয়ের লোকগুলো কি হিংসুটে, কেউ একবেলা ভাত দেবে না, কিন্তু কু গাইতে ওস্তাদ। তাদের কাওরা পাড়ার বউ-ঝি থেকে শুরু করে, যে-বাবুদের বাড়ি মা কাজ করে, তারাও বলছে, ‘হুট করে কোথায় বিদেশ বিভুঁইয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললে, জানো তো, বিয়ের নাম করে মেয়ে পাচার চক্র চলছে রমরমিয়ে, মেয়েগুলোকে দিয়ে কী যে করাবে–’

তার ধলাদাদু তাকে পাচার করে দেবে! ভাবলেও হাসি পায়। বাবা মারা যাবার পর এই দাদুই তো তাদের টেনেছে সাধ্যমতো। ধলাদাদু, মার কীরকম কাকা হয়, বম্বের একটা ফ্ল্যাটে পাহারাদারের কাজ করে। সেই এনেছে সম্বন্ধটা। ছেলের বাড়ি বম্বে শহর থেকে একটু দূরে। বিট্টলপুরা বলে একটা গাঁয়ে। ছেলের বয়স নাকি একটু বেশি। ছেলের এক মেসো কলকাতায় থাকে, সেই এসে দেখে গেছে ফুল্লরাকে। মা যেদিন তাকে নীল শাড়ি পরে সেজেগুজে থাকতে বলেছিল, সেইদিনই। মেসোর নাম ভগবান দাস। পাকানো গোঁফে মোচড় দিতে দিতে সেই ভগবান দাস ফুল্লরাকে একটা প্রশ্নই করেছিল–

‘পিনে কা পানি আনতে কতদূর যেতে হয় বেটি?’

প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল, কিন্তু ঠিকঠাক উত্তরই দিয়েছিল। খুশি হয়েছিল ভগবান দাস। কে জানে, এক ঘণ্টা-দু ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর কথা তাকে এত মুগ্ধ করেছিল কেন। হয়তো সে পরখ করে দেখতে চাইছিল ফুল্লরার ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা। তারপর ফুল্লরাকে সুপুরি, রুপোর টাকা ও জরিন শাড়ি দিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেছিল ভগবান দাস।

কয়েকদিনের মধ্যেই নিত্য শাহ-র বাড়ি কাজ করতে করতে ফোনে শুভ খবর পেয়েছিল সনকা। ফুল্লরাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু জমি-জিরেত ছেড়ে ছেলে বিয়ে করতে আসতে পারবে না। ফুল্লরাকেই যেতে হবে। তাকে নিয়ে যাবে ভগবান দাস।

এতদিন গাঁয়ের লোকের নানান কথাতেও সনকার মন টলেনি। কিন্তু এখন বিয়ে হবে শুনে সে কেমন কেঁপে উঠল। বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, ভাষাও অন্য, মেয়েটাকে সে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সব সে জানে, আর কী-ই বা করার আছে তার? কিন্তু সাতপাকটা অন্তত যদি তার সামনে হয়ে যেত, বুকটা আঁটা থাকত। এই ভগবান দাস, যাকে সে একদিন মাত্র দেখেছে, তার হাতে একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে সঁপে দেবে? ফোনের মধ্যে তার আশঙ্কা টের পেয়েছিল ভগবান দাস, সে আশ্বস্ত করেছিল সনকাকে। ‘আরে বেটি, ঘাবড়াও মৎ। তোর মেয়েকে আমি কোনও কোঠিতে বেচতে যাচ্ছি না। সোজা শাদির মন্ডপে নিয়ে গিয়ে তুলব। আর তোর চাচা তো আছেই ওখানে।’

নির্দিষ্ট দিনে ভগবান দাস তাকে নিতে এসেছিল। নিত্য শাহ-র বউয়ের দেওয়া একটা পুরোনো কাপড়ের ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে ফুল্লরা আবিষ্কার করেছিল মা কখন যেন নীল শাড়িটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতদিন ঘোরের মধ্যে থেকে সে ভাবেইনি বিয়ে মানে মাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়া। নীল শাড়িটা তার সেই ভুলে থাকা ব্যথাটা খুঁচিয়ে দিয়েছিল। বিছানায় উপুড় হয়ে কেঁদেছিল ফুল্লরা।

নতুন জায়গায় ঘুম আসতে দেরি হয়। কিন্তু বিট্টলপুরায় এসে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ঘুম এসে গেল ফুল্লরার। কারণ দুদিনের ট্রেন জার্নিতে সে প্রায় ঘুমোয়নি বললেই চলে। মাকে ছেড়ে এতদূর চলে আসার কষ্ট একটা ফোড়ার মতো টাটিয়ে ছিল বুকের মধ্যে, তার ওপর অচেনা একটা লোকের সঙ্গে আসা, প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল হিংস্র নেকড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

স্টেশনে নেমে ধলাদাদুকে দেখে ওর মন অনেক হালকা হয়ে গেল। ধলাদাদু আজ যেতে পারছে না, তবে বিয়ের দিন অবশ্যই যাবে। তারপর দুবার বাস পালটে সন্ধে নাগাদ বিট্টলপুরায় এসে পৌঁছলো।

বাস থেকে নেমে সে দেখল পুরো গ্রামটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো। গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। বাস থেকে নেমে কাঁচা সড়ক দিয়ে অল্প একটু হেঁটে ওর শ্বশুরবাড়ি। একটা লোক আলো নিয়ে এগোতে গেছিল। উঠোন ঘিরে ছড়ানো ছিটোনো ঘর। লণ্ঠনের আলোয় ও বুঝতে পারল না ভালো। ওরা ঢুকতেই একদল বাচ্চা ছুটে এল। ওদের চিৎকার থেকে একটাই শব্দ বুঝতে পারল ফুল্লরা।

‘পানিবাই! পানিবাই!’

কাকে বলছে কথাটা? নতুন বউকে এরা পানিবাই বলে নাকি? ওকে হাত-পা ধোবার জায়গা দেখিয়ে দিতে গেল এক মহিলা। খুব শক্ত, হাড়-হাড় চেহারা, রাগি মুখ। সে দাঁতে দাঁত চেপে যা বলল, তা থেকে মোদ্দা কথা বুঝে নিল ফুল্লরা। মহিলা ওকে বলছে, এটা শুখা দেশ, বাংলার মতো হরা-ভরা নয়, তাই পানি কম খরচ করতে হবে।

তাদের ঘটকপুকুরে তাকে খাবার জল পাবার জন্যে সবার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু সে তো অন্য কারণে। সেখানে জলের ছড়াছড়ি। বাড়ির পেছনে হাঁসপুকুরে তারা ঝাঁপাঝাঁপি করে চান করত। আর এখানে দু-এক ঘটিতে তো পুরো গা-ও ভিজবে না। রাতের খাবারে মোটা মোটা রুটি আর বিচ্ছিরি স্বাদের একটা সবজি খেতেও ওর তত কষ্ট হচ্ছিল না, যতটা জলের জন্য হচ্ছিল।

রাতে ওকে শুতে দেওয়া হল একটা বুড়ির সঙ্গে। তাদের দেশে বয়স হলে সাদা বা হালকা খোলের শাড়ি পরে, এ বুড়ি পরে আছে ক্যাটকেটে সবুজ রঙের শাড়ি। তবে মানুষটা এমনি খারাপ না। শুয়ে শুয়ে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিল। একসময় বুড়ির হাত ওর কোমরে এসে থামল। কোমর টিপে টিপে বুড়ি যেন কী পরখ করার চেষ্টা করছে। হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে ফুল্লরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে নিজেও জানে না। মাঝরাতে হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। বিছানা হাতড়ে দেখল বুড়িটা নেই। ঘরের বাইরে থেকে মেয়েগুলোর কান্না আর পুরুষের চিৎকার ভেসে আসছে। শুনতে শুনতে ফুল্লরা আবার ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন ঘুম ভাঙল শক্ত এক হাতের ধাক্বায়। সেই রাগি রাগি বউটা ওকে ঠেলা দিচ্ছে।

‘এত বেলা অবদি ঘুমোলে পানি মিলবে?’

কে যেন পাশ থেকে বলল, ‘আহা, সে তো আজই নয়, আগে তো শাদি হোক।’

‘আরে রাখো তোমার শাদি, আজ যদি ঝুঁটি ধরে না তুলি, তবে আদত পড়ে যাবে বিছানায় শুয়ে থাকার।’

আরেকটি বউ অমনি ঝনঝন করে হেসে উঠল, ‘আহা কোন সুখে বিছানা আঁকড়ে থাকবে বলো, সে তো তুমিই দখল করে আছ!’

এই কথা শুনে রাগি বউটি দপদপ করে চলে গেল। অন্য বউগুলো, যারা ফুল্লরার বিছানার চারদিক ঘিরে ছিল, তারা বলল, ‘জলদি জলদি উঠে পড়, আজ না তোর শাদি?’

তাদের গাঁয়ে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু ফুল্লরার বুক কেমন ধক্ করে উঠল শুনে। ‘আজই শাদি! ধলাদাদু যে বলল তিনদিন পরে?’

‘আহা, এই তিনদিন পানি আনার জন্য অন্য বাই রাখবে নাকি?’

আসা থেকেই ‘পানি’ শব্দটা কতবার শুনেছে ফুল্লরা। মাথায় এখন যেন সেই জল টলটল করে উঠল। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। বউগুলো চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘হায় হায়! এই দুবলি পাতলি লেড়কি কী করে পানিবাই হবে? ভগবানচাচা কেমন মেয়ে ঢুঁড়ে আনল!’

পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘আশপাশের গাঁয়ে তো কেউ রাজি হল না। ভগবানচাচা তাই বলল, বাঙালি লেড়কিরা কথা শোনে, তার ওপর বাপও নেই।’

বিয়ের মন্ডপে বসেও ফুল্লরার মাথায় টলমলানি যাচ্ছিল না। পানিবাই! পানিবাই মানে কী! নতুন বউকে এদেশে পানিবাই বলে নাকি? ভগবানচাচাকে ও কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না। পেলে বলত মাকে ফোনে ধরে দিতে। মা এখন নিত্য শাহ-র বাড়ি ঘর মুছতে মুছতে জানতেও পারছে না তার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

নিজের চিন্তায় এতখানি ডুবে ছিল ফুল্লরা, যে সে বুঝতেও পারেনি বিবাহমন্ডপে কখন বর এসে হাজির হয়েছে। বাচ্চাদের ‘দুলহা আ গয়া, দুলহা আ গয়া’ চিৎকারে সে সচকিত হয়ে দেখল তার সামনে এক দীর্ঘদেহ, প্রশস্ত বক্ষ মানুষ, এদেশের রীতি অনুযায়ী মুখ ঢেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফুল্লরার বুক দুরদুর করে উঠল, সমস্ত ভয়, সন্দেহ, অপমান, ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে এইবার। তার কল্পলোকের শাহরুখ খান এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে বরমাল্য হাতে। কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘মুখ খোলো কিষণলাল।’ দুলহা মুখের ওপর থেকে চাঁদমালার মতো ঢাকা সরিয়ে নিল। অমনি ফুল্লরার নাকে এসে লাগল একটা পচা গন্ধ। বাবাকে জল থেকে তোলার পর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি তো এমন গন্ধ কোথাও নেই। চারদিকে ঘিরে থাকা বউ-মেয়েরা সুগন্ধি ফুল ছুঁড়ছিল, কিষণলাল কড়া সেন্ট মেখে আছে, তবে? আসলে বুড়ো মানুষদের শরীর থেকে একধরনের পচা গন্ধ বেরোয়, শিথিল চামড়া, নড়া দাঁতের গন্ধ, বহু বছর দুনিয়া দেখে ভেতরটা পচে যাবার গন্ধ। সামনে দুলহা সেজে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার বয়স সত্তরের কম নয়। লোকটা ভাবলেশহীন চোখে ফুল্লরাকে দেখছিল, আর ফুল্লরার ষোলো বছরের সবুজ লাউডগা শরীর গুলিয়ে উঠছিল। এই তার শাহরুখ খান! সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল।

জ্ঞান ফিরতে দেখল, সেই বুড়ি মহিলা তার চোখমুখে অল্প অল্প জলের ছিটে দিচ্ছে। জলের স্পর্শে আরাম হচ্ছিল ফুল্লরার। আবার মায়ের কথাও মনে পড়ছিল। সে ডুকরে কেঁদে উঠতেই বুড়ি তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, ‘দুলহার বয়স আর রূপ দেখে ফালতু কষ্ট পাচ্ছিস। যেমন নাম-কা-ওয়াস্তে শাদি, তেমনি নাম-কা-ওয়াস্তে পতি। তোর আসলি মরদ তো ওইটা।’ বলে কী যেন একটা আঙুল দিয়ে দেখায় বুড়িটা। তার আঙুল অনুসরণ করে ফুল্লরা দেখে ঘরের কোণে একটা পিতলের বিশাল কলশি। গড়নটা তাদের দেশের তুলনায় খানিকটা আলাদা, কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বেশি ভারী। এতে করে জল আনতে গেলে মোষের শক্তি দরকার। আচমকা তার মাথায় পর-পর কিছু দৃশ্য-শব্দ খেলে যায়, গত রাতে বুড়ির তার কোমর পরখ করা, দুবলি-পাতলি বাঙালি, পানিবাই! সে-ই পানিবাই নয়তো?

কান্নায় তার শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। বুড়ি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘পাগলি কাঁহিকা! এখনও বরের বয়স ভাবছিস বসে বসে। আরে, ও তোকে কোনওদিনই বিছানায় নেবে না। সে তো আছেই আশাবাই। ধরমপত্নী। তবে কি না, পুরুষের কাম, কখন কাকে দেখে জেগে ওঠে। কুছ সাল পহলে, এক বরসাতের রাতে, আশাবাই বাচ্চা বিয়োতে মাইকে গেছে, আমাকে ডাকল। তা কী করে না বলি বল, পানিবাই হলেও বউ তো বটে। শরীরের স্বাদ পেয়েছিল তো, তাই আমায় তাড়ায়নি। এখন তো আর পানি আনতে পারি না, তাও রেখে দিয়েছে। অথচ কত পানিবাই এল আর গেল।’

কান্না থামিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক ফুল্লরা বুড়ির দিকে তাকায়। এই বুড়ি কিষণলালের বউ!

বুড়ি বলে চলে, ‘আসলি বাত কী জানিস? এ হল শুখা দেশ। সহজে পানি মেলে না। পানি দু-তিন গাঁও ভেঙে আনতে যেতে হয়। সকালে গেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল তিনটে-চারটে। তা ঘরের বউ যদি পানি আনতে যায়, তবে ঘরের কাম-কাজ কী করে চলবে, খানাপাকানো, বালবাচ্চাদের পালপোষ কে করবে? তাই পানিবাইদের দরকার। শাদি তো একটা হচ্ছে, তাই মাইনে দিতে হয় না, ডাল-রুটি তো মিলবে দুবেলা। তা, কিষণলালের খুব বদনাম, বউটাও রাগি, তাই এখানকার কেউ আর পানিবাই হয়ে আসতে চায় না। একজনকে তো পিটিয়েই…’ বুড়ি কী যেন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। ফুল্লরা হাঁটুর ওপর মুখ রেখে সেই নৈঃশব্দ্য থেকে কিছু খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করে, জলের মতো। শুখা দেশে চোখের জলও যে শুকিয়ে যায়, কে জানত!

দূরে দূরে ছোটো কয়েকটা টিলা। পশ্চিমের টিলার পেছন থেকে কমলা আলোর বলটাকে আস্তে আস্তে নেমে যেতে দেখল ফুল্লরা। সূর্য ডুবছে। আজ তার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখানকার বউরা মাথায় কলশি নিয়ে চলতে পারে। সেটা তার এখনও অভ্যাস হয়নি। সে কলশি নেয় কাঁখে। প্রথম প্রথম এত ভারী কলশি বইতে পারত না, একবার তো জলভরা কলশি দরজার কাছে পর্যন্ত এনে ফেলে দিয়েছিল। সেজন্য আশাবাই খুব মেরেছিল তাকে। রাতে খেতেও দেয়নি। গায়ের ব্যথায় সে পরেরদিন উঠতে পারেনি, জল আনাও হয়নি। সেই থেকে আশাবাই তাকে মারে না, কিন্তু বোলি বড়ো তীক্ষ্ণ তার। চাবুকের মতো সপাং করে গায়ে বেঁধে।

কিষণলাল বলে যে-লোকটা তার স্বামী, সে অবশ্য কিছু বলে না। উঠোনে পাতা চৌপাইতে বসে শুধু চোখ দিয়ে অনুসরণ করে তাকে। সে দৃষ্টি দেখলেই গা ছমছম করে ফুল্লরার। কারণ কিষণলাল তাকে যে দেখছে, সেটা আবার আশাবাই-এর নজর এড়ায় না। একসঙ্গে দুজোড়া চোখের ভার বহন করা কঠিন।

অন্যদিন ঠাঁ ঠাঁ দুপুর রোদে সে ফেরে। আজ রোদ পড়ে গেছে। অত কষ্ট হচ্ছে না তার। কিন্তু মাসিক শুরু হওয়ায় কোমরে সে আর কলশি রাখত পারছে না। এবার থেকে এদেশের বউ-ঝিদের মতো মাথায় কলশি বওয়া অভ্যাস করতে হবে তাকে।

রোদ নেই। তবু কলশি নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা গাছের ছায়া খুঁজল ফুল্লরা। গাছ, গাছের ছায়া তাকে বাংলার কথা, নদীর কথা, মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই বিয়ের দিন মাকে একবার ফোন করেছিল ভগবান চাচাকে ধরে করে। তারপর কত দিন, কত মাস হয়ে গেল কোনও খোঁজ খবর নেই। কিষণলালের একটা মোবাইল আছে, সারাক্ষণ সে সেটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোনও বরসাতের রাতে সে যদি ফুল্লরার শরীর চায়, তাহলে, কিষণলালের মোবাইল নাগালে পেয়েও, মাকে ফোন করা হবে না ফুল্লরার। মার তো ফোন নেই। মাকে ফোন করতে হবে দিনের বেলা, মা যখন কারও বাড়ি কাজ করে। জল আনতে আসা-যাওয়ার পথে কোনও বাজার পড়ে না, যে সেখানে একটা ফোনের বুথ খুঁজে ফোন করতে পারে। তার কাছে অবশ্য পয়সা নেই, পানিবাইরা তো পেটখোরাকি, হাতে পয়সা পায় না। কিন্তু তার নাকে এককুচি রুপোর নাকফুল আছে, বাবার শেষ স্মৃতি। ফোনের বুথ পেলে ওই ফুল দিয়ে সে মাকে ফোন করবে। মা যেন ধলাদাদুকে পাঠিয়ে তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়।

খুঁজতে খুঁজতে ফুল্লরা দেখল দূরে একটা শিমুল গাছ। মাংসল লাল ফুলে ছেয়ে আছে। শিমুল ফুল ফুটেছে! তার মানে এটা বসন্তকাল! আর কদিন পরেই বৈশাখ মাস পড়বে, তাদের হরিসভায় মোচ্ছব হবে, তাদের পাড়ার মেয়েরা সেজেগুজে গিয়ে কত মজা করবে, শুধু সে-ই থাকবে না। সবাই জানবে যে শাহরুখ খানের…

হঠাৎ শিমুলফুলের রং দেখে বুক ধক্ করে ওঠে ফুল্লরার। বসন্ত এসে গেছে! তার মানে একদিন বর্ষাও আসবে। আশাবাই-এর আবার গর্ভ হয়েছে, বুড়ি, যার নাম যশোমতী জানিয়েছে তাকে। বর্ষাকালেই হয়তো সে মাইকে যাবে। সেইসময়, অন্ধকার রাতে, কিষণলালের বুকে তৃষ্ণা জেগে ওঠে যদি? বাংলার শ্যামল-সবুজ জল-ছলছল শরীর পান করার সাধ জাগে তার? যশোমতী বলেছে তাতে অন্যায় কিছু নেই । কিষণলাল তো তার শাদি করা মরদ, সে তার শরীর নিতেই পারে। কিন্তু আশাবাই-এর মতো ঘর বা বিছানা সে পাবে না কোনওদিন। কিন্তু কিষণলালের ইচ্ছেয় সায় দিলে আখেরে তারই ভালো। যখন ফুল্লরা একদিন বুড়ি হয়ে যাবে যশোমতীর মতো, আর পানি আনতে পারবে না দূর গাঁও থেকে, তখন, কিষণলালের মনে জাগরুক থাকতে পারে তার শরীরের স্মৃতি, সে হয়তো তাড়াবে না ফুল্লরাকে। তা না হলে রাস্তায় রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াতে হবে তাকে।

ফুল্লরা কি তাহলে সারাজীবন জল বয়ে আনবে একটা সংসারের জন্য, যে-সংসারটা তার নয়। তার নিজের আনা জলে দু-ঢোঁকের বেশি অধিকার থাকবে না তার? জল আনতে আনতে যশোমতীর মতো বুড়ি হয়ে যাবে সে? তখন তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে, যদি না কোনও বরসাতের রাতে কিষণলালের ইচ্ছেয় সে সাড়া দেয়?

ভাবতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। শিমুল ফুলের টকটকে লাল রং যেন বিপদ সংকেতের মতো তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। বসন্ত থেকে বর্ষা আর কতই বা দূর। তাকে পালাতে হবে। তাকে এখনি পালাতে হবে। দৌড় শুরু করার আগে সে নিজের আনা জল, কলশি কাত করে আঁজলা ভরে আশ মিটিয়ে খেয়ে নেয়। তারপর ধাক্বা মেরে উলটে দেয় কলশিটা। জল মাটিতে গড়িয়ে যায়, শুখা মাটি তা শুষে নেয় মুহূর্তে।

অনেকক্ষণ থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিলেন ইনস্পেকটর ঘোসলে। মেয়েটার সাজপোশাক মারাঠি গাঁয়ের বউয়ের মতো, কিন্তু ওর সবুজ পানপাতার মতো মুখ, নরম চাউনি বলে দিচ্ছে ও বাঙালি। কিছুক্ষণ আগে তিনি এক দল বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করেছেন মুম্বইয়ের এক কুখ্যাত কোঠি থেকে। এদের কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দুজন প্রতিনিধি এসেছে কলকাতা থেকে। তিনি নীচুগলায় তাদের সঙ্গে কীসব বলেন…

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা থামার পর টিভি ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েগুলোর ওপর। সবাই ওড়না বা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফেলল অমনি। শুধু একটা মেয়ে উদাসীন মুখে বসেছিল। সাংবাদিকদের হাজার প্রশ্নের উত্তরে যে শুধু একটাই কথা বলল, ‘পানিবাই’।

আবার ইস্কুলের সামনের টিউকল থেকে জল নিতে এসেছে ফুল্লরা। আগে যেমন আসত। কিন্তু ঠিক আগের মতো যে আর সবকিছু নেই তা সে বুঝতে পারছে। আগের মতো জলের জন্য সবার পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে তাকে দেখে বউদের এরকম কানাকানি, গা-টেপাটেপি ছিল না। সেদিন হাওড়া স্টেশনের ছবি অনেকেই দেখেছে টিভিতে। ওকে মুম্বইয়ের কোঠি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, এরকম একটা খবর রটে গেছে চারদিকে। তাতে নতুন করে কিছু ক্ষতি হয়নি, আগেও ওরা একটেরে কাওরাপাড়ায় আধপেটা খেয়ে থাকত, এখনও তাই। মায়ের কাজগুলোও যায়নি, বরঞ্চ তার মেয়ের মুখ টিভিতে দেখা গেছে বলে খানিকটা সমীহ তৈরি হয়েছে। তবে সবাই সনকাকে বলছে, ‘আগেই তোমাকে বলেছিলাম, শুনলে না।’

তবে লাভ একটা হয়েছে, কলকাতা থেকে ভালো শাড়ি-জামা পরা, চশমা চোখে একদল মহিলা দামি গাড়ি চেপে এসেছিল শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে। তারা ওকে শহরের মহিলা স্বনির্ভর কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। কাজ শেখার পাশাপাশি কিছু রোজগারও হবে।

সবার জল নেওয়া হয়ে গেছে ভেবে ফুল্লরা তাড়াতাড়ি তার প্লাস্টিকের বোতল কলের মুখে বসাতে গেল। ঘোষেদের মেজোবউয়ের যে আর একটা বোতল বাকি আছে সে দেখতে পায়নি। মেজোবউ অমনি খরখরে গলায় বলে ওঠে, ‘আরে ছুঁড়ি, মর মর। তোকে ছুঁয়ে আবার অবেলায় চান করব নাকি? একে কাওরা-হাঁড়ি, তারওপর দিল্লি বোম্বে সৃষ্টি জজিয়ে এসেছিস!’

শুনে শুনে অভ্যস্ত, তবু খামোখা চোখে জল এল ফুল্লরার। কয়েক মাস আগেও তার আনা জলের জন্য হাঁ করে থাকত আশাবাই আর তার ছেলেমেয়েরা। কিষণলাল লোটা ভরে পানি খেয়ে তৃপ্তিতে  বলত ‘আঃ’। ফুল্লরা বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করলে যশোমতী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘লোককে পানি পিলানা বড়ো পুণ্যের কাজ রে। পানিবাই কি যে সে হতে পারে?’ কয়েক মাসের তফাতে, সেই একই জল, তার ছোঁয়ায় অশুদ্ধ হয়ে গেল!

বিকল্প

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুলল হরিয়ালি। কোলে দু বছরের ছেলে-সহ মেয়ে জামাই। জামাইয়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট, মেয়ের মাথায় এক গলা ঘোমটা যদিও এটা তার বাপের বাড়ি। যদি সব ঠিকঠাক থাকত, তাহলে ঘোমটার বহর থাকত না।

চল টুসু জলকে যাব, রানিগঞ্জের বড়তলা ঘুইরবার বেলা দেঁখায় আইনব কয়লা খাদের জলতুলা।

এখন পৌষ মাস। মাসভর সন্ধ্যা বেলায় টুসু গান শোনা যায় এই পাড়ায়। ভদ্রলোকের ভাষায় এটা বাউরি পাড়া। তবে এখানে বেশ কয়েক ঘর শুঁড়ি, গোয়ালা থেকে দু ঘর বিহারি, আর এক রাজপুত পরিবারেরও বসত। দয়াল সিং-এর পূর্বসূরিরা নিজেদের ঠাকুর পরিচয় দিয়ে থাকলেও অর্থনীতির কারণে এই অন্তজ সমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিম বর্ধমানের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই অঞ্চলে মানভুঁইয়া বাংলার সাথে হিন্দি-বিহারি মিশেল দিয়ে কথা বলে অবাঙালি পরিবারগুলো যারা দীর্ঘ দিন বাঙালিদের মাঝে থেকে বাংলাটাই স্কুলে মাতৃভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছে। অবশ্য যাদের পয়সা আছে তারা ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে যায়, তাদের কারও কারও দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। টুসু যদিও অঘ্রাণের শেষে আমন ধান তোলার পর এক ধরনের শস্যোৎসব, টুসু পাতাও হয় একটি সরায় চালের গুঁড়ি মাখিয়ে, তার ওপর তুষ ও ধান বিছিয়ে, দূর্বা ঘাস ও আলো চাল লাগানো গোবরের ঢেলা রেখে। কিন্তু পুরুলিয়া ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই ডিশেরগড় সাঁকতোড়িয়া অঞ্চলে ইদানীং নিম্ন বর্ণের যে পরিবারগুলি টুসু বা ভাদু পরবের ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে তারা আর কেউই বলতে গেলে কৃষিজীবী নয়। দু চারটি পরিবারের আবাদি জমি আছে, চাষও করে। তবে তাদের ছেলেপুলেরা আর হাল ধরতে চায় না। দেখেছে কয়লার কারবারে অনেক বেশি লাভ। জমিতে হাল দিলে অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য ধরার পরেও প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা। সেখানে আরও খানিকটা গভীরে খুঁড়ে যদি নিশ্চিত আমদানি হয় তো মানুষ সেদিকেই তো ঝুঁকবে। চোরা খাদানের জেরে ধস নামলে ইসিএল-কে দোষারোপ করে ক্ষতিপূরণ চায় স্থানীয় বাসিন্দারা, অন্য দিকে বৈধ বা অবৈধ খনি থেকে কয়লা চুরি বহু লোকের স্বীকৃত পেশায় দাঁড়িয়ে গেছে।

এবার টুসু পাতা হয়েছে মাখন বাউরির ঘরে। তার মেয়ে ময়না আসরের মধ্যমণি। কন্যাকে ঘিরে পাড়া প্রতিবেশীর বেশ একটা সমীহ ভাব। সে নাকি একবার বাজারের মাঝে হাটবারে চারটে ছেলেকে কোমর থেকে বেল্ট খুলে পেঁদিয়েছিল। ছেলেগুলো তাকে জিন্স, টি-শার্ট পরা দেখে শিস দিয়েছিল। ময়না তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দাখিল হয়েছে। হতে পারে কোটায় সুযোগ, তবু বাউরি ঘরের মেয়ে বাবুঘরে বাসন না মেজে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছে দেখে, ওই অঞ্চলের অনেকেই সমীহ মিশ্রিত কৌতূহলের চোখে দেখেছিল সেইসময়। দুহাজার সালের পর যেমন ঘরে ঘরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উৎপাদন হচ্ছে, তেমন হতো না নব্বইয়ের গোড়াতেও। ময়নাকে নিয়ে মেয়েদের মুখে মুখে টুসু গানও রচিত হয়েছে।

ময়নারানি বাপ-সোহাগি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে গো

তার সাথে লাইগতে গিয়ে চুয়াড় ব্যাটা মরে গো।

আসরে ছিল লাখো। লাখো বাউরি নয়, সিং। জশাইডি গ্রামের একমাত্র রাজপুত পরিবারের মেয়ে। নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিলেও ভদ্রলোকের ভাষায় বাউরি পাড়ার লোক হিসাবে দেগে গেছে। তাছাড়া তপশিলি জাতিভুক্ত হতে পারলে সুযোগসুবিধা আছে বলে তার দুই ভাই রাজু আর কিসান মিথ্যেটা ভাঙাতে খুব একটা উৎসাহী নয়। তারা বরং স্থানীয় কাউন্সিলরকে ধরে তপশিলি জাতির শংসাপত্র যোগাড় করে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছে। তবে দুজনেই অলস ছাত্রজীবন না কাটিয়ে যথাক্রমে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পরেই পড়াশুনোর ইতি টেনে স্বনির্ভরতার তাগিদে ঝালবাগান মোড়ে পান সিগারেটের গুমটি দিয়েছে। লাখো গ্রামের বাউরি আর গোয়ালা মেয়েদের চেয়ে নিজেকে আলাদা ভাবে না। বাংলাতেই কথা বলে আর দুর্দান্ত ভাদু, টুসু এমনকী মনসামঙ্গল গাওয়ার দৌলতে এই জাতীয় আসরে তার জায়গা বাঁধা।

ময়নার বীরত্বের কাহিনি আর তাকে নিয়ে বাঁধা গান শুনতে শুনতে লাখো ভেতরে ভেতরে বেশ উদ্দীপিত বোধ করছিল। তাকে স্কুল, দোকান, কাজের বাড়ি ইত্যাদি যাওয়া-আসার পথে কয়েকটা ছোকরা প্রায় রোজ উত্যক্ত করে। আজেবাজে ইঙ্গিত করে, সাহেব মেমদের কুৎসিত কাণ্ডকারখানার ছবি দেখাতে চায় জোর করে। শ্যামল নামের ছেলেটা একবার প্রেমপত্র দিয়েছিল। কিন্তু সে একা আসে না, তার সাথে তার তিনজন বন্ধুও থাকে যারা খ্যা খ্যা করে হাসে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রস্তাব দেয়। ওদের চোপা করেছে, সবাই মিলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ঘিরে ধরলে হাতে পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করেছে, ওদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে বলে সতর্ক করতে চেয়েছে, কিন্তু কোনওদিন একটা চড় মারার সাহস হয়নি।

কী করে হবে? ওরা চারজন লাখো একা। ওরা বড়ো ঘরের ছেলে, লাখোর মতো স্কুল করার পর লোকের বাড়ি কামিন খাটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় একথা ওদের বাড়ির লোক অবিশ্বাস না করলেও স্বীকার করতে চাইবে না। অন্তত শ্যামল, অমিতাভরা তাই দাবি করে লাখোর দরবার করার হুমকি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। ময়নার কথা শুনতে শুনতে লাখো কল্পনা করতে লাগল, হারামিগুলো আবার লাগতে এসেছে, আর ও পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিচ্ছে। তার কোমরে বেল্ট নেই তো কী, গাছের ডাল কি রাস্তার থান ইট তো আছে। আহা যদি জিন্স পরতে পেত কস্তুরী, বর্ণালিদের মতো!

গানে গলা মেলাতে গিয়েও লাখো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেগুলোর সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। খারাপ মন্তব্য থেকে এবার হাত ধরে টানাটানি, জোর করে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা এইসব শুরু করেছে। যা সব ছবি দেখায় অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার সাথে সাথে ভয়ে হাত-পা পেটে সিঁধোয়। আবার শুনতে পায় ছোটো বোন গৌরীকে নাকি তাদের সাথে হাহাহিহি করতে দেখা গেছে। বোনকে সাবধান করতে গেলে সে উলটে দিদিকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দেয়।

‘কী রে লাখো কী ভাবছিস? চুপচাপ ক্যানে?’

‘বড়ো জাড়াচ্ছে। যা ঠান্ডা।’

আজ চাউড়ির দিন, গোবরমাটি দিয়ে ঘর নিকোনোর কথা। মাখন বাউরির যেহেতু পাকা ঘর তাই ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। যে তোলা উনোনটায় বাঁউড়ির দিন পিঠে হবে তাতে গোবর-মাটি লেপা হয়েছে। সেটাই জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে বারান্দার মধ্যিখানে আর তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আঁচ পোয়াতে পোয়াতে মেয়ে বউরা আসরে মেতেছে। আগামীকাল টুসুর জাগরণ অর্থাৎ নিশিপালন। টুসুর ভোগ হিসাবে বাড়িতে বাড়িতে হলুদ মুড়ি, ছোলা-মটর ভাজা, জিলিপি ও নানা ধরনের মিষ্টি আয়োজন হলেও জাগরণের জন্য বাঁউড়ির মূল আসর হয় মাখন বাউরি আর গণেশ মণ্ডলের বাড়ি। এদের বাড়িতে গ্রামের সবচেয়ে বড়োলোক আর বনেদি পরিবারের মহিলাদেরও নেমন্তন্ন থাকে। তারা ছোটো জাতের বাড়িতে চালের তৈরি পিঠে না খেলেও, শুকনো ছোলা, মটর, মিষ্টি দাঁতে কেটে ধন্য করে দেয়। লায়েক গিন্নির সাথে ঠিক ছোঁক ছোঁক করে তার অকালকুষ্মাণ্ড মেজো ছেলেটাও এসে হাজির হয়। সে নাকি গাড়ি করে মাকে পৌঁছোতে আসে। ওদের চারজন ড্রাইভার, সবাই কি একসাথে ছুটিতে থাকে নাকি এদিন? আসলে কিংশুক আসে মেয়েদের আসরে চোখ দুটো একটু সেঁকে নিতে। শীতের মধ্যে সবার শরীর সোয়েটার চাদরে ঢাকা থাকলেও, কে পেংলি আর কে ডবকা ঠাওর করা যায়। ছেলেকে নিয়ে লায়েক গিন্নি, তার জা ও ভাসুরঝি ভেতরে ঢুকতে সবাই একটু সচকিত হয়ে উঠল। তাদের বসার জন্য দালানে চেয়ার পেতে দেওয়া হল।

‘এই লাখো, তুই একটো গান ধর ক্যানে, তুর পছন্দের গান।’ বলল স্বয়ং ময়না।

কিংশুকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে যা একখানা হাড়হিম করা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিল যে কল্পিত, সাহসিকতা ভুলে আগামীদিনের সম্ভাব্য বাস্তবতা মনে করে লাখোর ভেতরটা গুড়গুড় করতে লাগল। সে সকলের তাড়ায় ধরল–

‘আদারে-বাঁদাড়ে ঝিঙা ও ঝিঙা তুই বাড়িস না।

আমার ভাদু শিশু ছিলা ঝিঙা রাঁইধতে জানে না।’

‘ইটো তো ভাদু গান বটে। তুর কী হঁইছে বলত? আইসে অব্দি আনমনা।’

‘আরে, ভাদুর জায়গায় টুসু বসায়েন দিলেই উটো টুসু গান হঁইয়ে যায়। তা উয়ার কারও সাথে কুছু চক্বর-টক্বর চইলছে বুঝি?’ ওপাশ থেকে ফোড়ন কাটল কিংশুক।

অতসী কিংশুকদাদাবাবুর রসিকতায় হেসে গান ধরল– ‘আমার টুসু মান কইরেছে

মানে গেল সারা রাইত।

খুল টুসু মানে কপাট আইসছে তুমার প্রাণনাথ।।’

সমবেত গানে গলা মেলালেও লাখোর ভেতরে স্বস্তি নেই।

কিংশুকের জ্বলন্ত চোখের সাথে চোখাচোখি হলেই ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জ্বালায় সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছিল। কিংশুক দেখতে পেয়ে খুব আন্তরিকতাপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কী হল? শরীর খারাপ নাকি? ইস্কুলে দিদিমণি কুছু বইলছে, মেইরেছে?’

লাখো মাথা নাড়ে। প্রথমটায় জানাতে না চাইলেও সহানুভূতির স্পর্শ পেয়ে সব উগরে দিয়েছিল। কিংশুক লাখোকে ঝালবাগান মোড়ের গরাইদের বাঁধা চায়ের দোকানে বসিয়ে একরকম জোর করে তেলেভাজা, জিলিপি আর চা খাওয়ায়। বাড়িতে এইসময় স্কুল থেকে ফিরে ভাতই খায় লাখো। খেয়ে অসিত চৌধুরীর বাড়িতে কাজে যায় বিকেলের বাসন মাজতে।

কাজটা সে নিজের মর্জিমাফিক করে। খেয়াল খুশি মতো কামাই, বেলা পার করে চৌধুরী কর্তাগিন্নির মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে যখন খুশি হাজিরা দিলেই হল। তবে বিকেলে ওবাড়ি কাজ করতে যাওয়ার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে। চৌধুরীদের বড়ো মেয়ে ওই একই স্কুলে পড়ে। বয়সে লাখোর চেয়ে ছোটো হলেও দু ক্লাস উঁচুতে। সেও তৈরি থাকে খেয়েদেয়ে মার্বেল নিয়ে গুলি খেলার জন্য। দায়সারা কাজ চুকিয়েই লাখো মেতে ওঠে মনিবকন্যার সঙ্গে গুলি খেলায়। মৈত্রেয়ী হারলে আবার ঝালবাগান মোড়ের বুড়োর দোকান থেকে মার্বেল কিনে আনে মায়ের কাছে চেয়েচিন্তে পয়সা জোগাড় করে। কিন্তু লাখো হারলে নতুন গুলি কেনার পয়সা লাগে না। সে জানে মিতু অর্থাৎ মৈত্রেয়ী কোথায় নিজের মার্বেলের বাক্স লুকিয়ে রাখে। লাখোর চুরির ঠেলায় মিতু কতবার যে নিজের গোপন প্রকোষ্ঠ লুকিয়েছে তার লেখাজোকা নেই। যখনই গুলি বার করতে যায় দেখে গুনতিতে খান পাঁচ ছয় কি আরও বেশি কম পড়ছে। লাখোর ওপর চোটপাট করলে মিতুর মা মিতুকেই বকে। কাজের মেয়ে ছাড়া তার চলে না। আর কাকাবাবু গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করার বদলে বউয়ের ওপর চোটপাট করে বেশি। তাই কাকিমা ঝিয়ের হাতেপায়ে ধরে খোশামোদি করে। লাখোও সেই সুযোগে এনতার বেয়াড়াপনা করে নেয়।

কয়েক দান গুলি খেলার পর মিতুর বন্ধুরা ডাকতে আসে খেলার জন্য। বুড়ি-চু, ডাংগুলি, কবাডি, এক্বাদোক্বা, লুকোচুরি, নামডাকাডাকি, স্কিপিং– কতরকম। খেলার ভেন্যু নির্ভর করে কী খেলা হচ্ছে তার ওপর। কবাডি, বুড়ি-চু, কিতকিত কিংবা এক্বাদোক্বা হলে সাধারণত ডিপিএস-এর স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবের শান বাঁধানো ব্যাডমিন্টন কোর্টে চলে যায়। অন্যান্য খেলা কারও বাড়িতেও হতে পারে।

এমনিতে মিতুর বন্ধুরা কামিনের সঙ্গে গল্পগাছা না করলেও, খেলায় নিজেদের দল ভারী করার জন্য লাখোকে নিয়ে টানাটানি করে। মিতু তো মাছ মাংস দুধ ফল খেয়েও পেংলি, ক্ষীণজীবী। ওদিকে লাখো মাড় খেয়েও চারটে মিতুকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে। বুড়ি-চু, ডাংগুলি আর কবাডিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্র পাড়ার কোনও কোনও ছেলে পারে তাকে মাত দিতে। এই তো আজ বিকেলেও কবাডিতে কস্তুরীদের দলের খেলোয়াড়দের বলে বলে আউট করেছে। গাছে চড়াতেও তার জুড়ি নেই। পরের গাছের ফল-পাকুড়কে নিজের ভাবতে হলে এটুকু দক্ষতা তো রাখতেই হবে। আগে মারামারি লাগলে মেয়েরা গায়ের জোরেও কেউ তার সঙ্গে পেরে উঠত না। এখন বড়ো হয়ে গেছে বলে হাতাহাতি লাগে না। না হলে গুলি চুরির জন্য রোজই খণ্ডযুদ্ধ বাধার কথা। এখন মিতুদের বন্ধুরা প্রায় দিনই ছুটোছুটি খেলার বদলে রাস্তায় পা়য়চারি করতে করতে গালগল্প করে। ভদ্রলোকের মেয়েদের সঙ্গে ঝিগিরি করা মেয়ের তেমন প্রাণের কথোপকথন থাকে না। তাই ইদানীং খেলার পরিকল্পনা বাতিল হলে লাখোকে বিকেলটা নিজের সমতুল্য সামাজিক পদমর্যাদার সঙ্গী জুটিয়ে আড্ডা মারতে হয়। নাহলে গাছের মগডাল হোক কি কিতকিতের কোর্ট– লাখোকে যশাইডি আর ঝালবাগানের মেয়েরা সমঝেই চলে। এমন ডাকাবুকো মেয়ে কিনা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।

সেদিন কিংশুক লাখোকে বলেছিল, ‘পা থেইক্যে জুতাটো খুলে মুখে মাইরতে লারলি বানচোদগুলার? আমি থাইকলে দেখাইন দিথম মজা। আমার গাঁয়ের বিটির গায়ে হাত দেয় শূয়ারের বাচ্চাগুলান? আমায় আগে বলিস নাই ক্যেনে? বিচি কেইটে হাতে ধরায়েন দিথম। কিংশুক লায়েককে সবাই চিনে। তুঁই ভাবিস না। উয়াদের আমি খবর লিছি।’ দোকানে কিংশুকের জনা সাতেক বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা কিংশুকের দাদা কুন্তলের অ্যাকাউন্ট-এ ধারে চা, সিঙাড়া, মিষ্টি খাওয়ার বিনিময়ে লায়েক ভ্রাতাদ্বয়ের উচ্চারিত কথার দোয়ারকি দেয়।

আশ্বাস পেয়ে লাখো খেয়ে নিল। কিংশুক তার পিঠে কাঁধে মাঝেমাঝে হাত বোলাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে বলল, ‘চল তুখে ঘর পৌঁছায়েন দি।’ লাখো তার ষোলো বছরের জীবনে এমন আজব কথা কোনওদিন শোনেনি যে তাকে কেউ ঘরে পৌঁছোতে চাইছে। ভেতরটা একরকম পুলকে উছলে উঠলেও কুণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘একা যেইতে পাইরব। তুমি আপনার বন্ধুদের কাছে থাক।’

কিংশুক দায়িত্ববান বড়ো দাদার মতো গ্রামতুতো বোনের রক্ষক হয়ে কিছুদূর গিয়েই দুধনাথের গোয়ালটার আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে আচমকা লাখোকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। লাখো ছাড়ানোর চেষ্টা করলে তার ডান হাতখানা সজোরে পেছন দিকে মুচড়ে ধরল।

‘আঃ! আমার লাইগছে। ছেইড়ে দাও।’

‘তুকে আমি বদমাস ছিলাগুলার হাত থেইকে বাঁচাব, বদলে আমারও তো কুছু চাই।’

‘আমায় ছাড়ো বলইছি। না তো খুব খারাপ হবেক। আমি কাকিমাকে বইলে দুবো।’

‘আমি শ্যামলার পারা কেরানির ব্যাটা লই। লায়েক বাড়ির ছিলা, আদিত্য লায়েকের ব্যাটা, কুন্তল লায়েকের ভাই। তুর মতো বিটিছিলাকে আমি পায়ের জুতা বানায়েঁ রাইখতে পারি। বেহায়া মাগি ইস্কুল গিয়ে পড়াশুনার বদলে রাস্তার ছিলাদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করিস? দাঁড়া আমি তুর বাপকে জানাছি। মদনার কাছে আট গাড়ি গোবর চেঁইছিল দাদা, চার গাড়ি দিয়ে পাত্তা নেই। মদ গিলে পইড়ে থাকে, আমরা ডাইকলে আসে না।’

‘তুমরা টাকা বাকি রাখো যে।’

‘কী বইললি, খুব বাড় হঁইনছে লয়? যত বড়ো মুখ লয় তত বড়ো কথা? বাপ আর বিটি দুজনাকেই শায়েস্তা কইরতে হবেক।’

তারপর থেকে মা কালীকে ডাকতে ডাকতে একদিকে শ্যামলবাহিনী আর একদিকে কিংশুক লায়েককে চুক্বি দিতে হচ্ছে। শ্যামলরা সাঁকতোড়িয়া কলোনিতে থাকে, কিন্তু কিংশুক তো একই গ্রামের ছেলে। পৌষ পরব, পিঠেপুলি, টুসু গান– সব আনন্দ ভয়ের মেঘে ঢেকে গেছে। ও অন্যমনস্ক হবে না তো কী? মাখন বাউরির মেয়ের বীরত্বের কথা স্মরণ করেও মনে বল পাচ্ছে না।

নদী ঘাটে ভিড় দেখলে বোঝা যায় পুণ্যপিপাসার কাছে শরীরের কষ্টবোধ তুচ্ছ। এইসময় সকালের তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়, চার-পাঁচ প্রস্থ গরম জামা পরেও পাঁজরের কনকনানি কাটতে চায় না। দামোদরের হিমেল জলে এরই মধ্যে নানা বয়সি মেয়ে-পুরুষের সমাবেশে যেন মেলা লেগেছে। বয়স্ক মহিলা ও বাচ্চা দু-একটি মেয়েদের কেউ কেউ স্নানের পর শুকনো কাপড় পরলেও বেশিরভাগ মেয়ে ভেজা কাপড় ছাড়ার আড়াল না পেয়ে সেই পরেই বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে। লাখোও কাঁপতে কাঁপতে ভেজা সালোয়ার কামিজ গায়ে বাড়ির পথ ধরল। পায়ের আঙুলগুলো ঠান্ডায় জ্বলছে, হাতের পাতায় সাড় নেই, দাঁতে দাঁতে খটখটানি থামতেই চায় না। ঘাট থেকে যশাইডি গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পথ। হাসপাতাল ও ঝালবাগান মোড় পর্যন্ত অটো কি বাসে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে খরচ বেশি, পুণ্য কম। তার বাড়ি থেকে একমাত্র সেই আসে সকলের হয়ে পুণ্যার্জন করতে। মিতুদের বাড়ি আজ কাজে যাবে না, কেবল বিকেলে গিয়ে পিঠে নিয়ে আসবে। তারপর মাখন বাউরির ঘরে মোচ্ছব, রাতভর। হাঁটতে হাঁটতে একটা ডাক শুনে মুখ তুলে তাকাল লাখো।

‘কী রে, তখন থেইকে ডাকছি, শুনতে পাস না?’ শ্যামল, অমিতাভ, শিশির আর ছোটন। শ্যামল আর ছোটনের বাইকে ওরা চারজন।

লাখোর বুকের মধ্যে যে-স্রোতটা বয়ে গেল সেটার তাপমাত্রা কত কে জানে? ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে আবার পা বাড়াল।

শ্যামল বলল, ‘বড়ো জাড়াচ্ছে লয়, আয় তুকে মোটর সাইকিলে বাড়ি পৌঁছায়েন দিয়ে আসি।’

‘দরকার নাই, আমার পা আছে।’ বাজার ছাড়িয়ে তখন এমডি অফিসের কাছাকাছি। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে গেছে।

‘পায়ে হেঁইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বুকে সর্দি বইসে যাবে। আমার মোটর সাইকেলে উঠ।’ শ্যামলের ইশারায় অমিতাভ এসে লাখোর হাত ধরল। রাস্তায় লোকজন আছে, তাই ভয়টা কমে গেল। হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিতে অমিতাভ যেন একটু টলে গেল। টাল সামলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল অমিতাভ, ‘দেইখ্যে লুব তর কত ত্যাজ।’ লাখো চ্যাঁচালে হয়তো লোক জড়ো হতো, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে গেল।

সন্ধেবেলায় মিতুদের বাড়ি থেকে সবে পিঠে নিয়ে ঝালবাগান মোড় হয়ে গাঁয়ের গলিতে ঢুকছে হঠাৎ মুখে ঘাড়ে গলায় বরফ জলের কনকনে স্পর্শ, পর মুহূর্তে অবর্ণনীয় জ্বালা। ঠান্ডা নয়, প্রচণ্ড তপ্ত কিছু যেন চামড়া গলিয়ে মুখ থেকে গা বেয়ে নামছে। চিৎকার করতে করতে মাটিতে বসে পড়ল লাখো। দুটো মোটরবাইক গর্জন করে চলে যাওয়ার শব্দ হল। আশপাশের দোকানগুলো থেকে চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এল। যশাইডি গ্রামে ঢোকার দুটো পথ আছে, একটা ঝালবাগান মোড়ে, আর একটা হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তায় পড়ে।

কিংশুকের দাদা কুন্তলের গাড়ি করে অর্ধচেতন দেহটাকে ভর্তি করা হল সাঁকতোড়িয়া হাসপাতালে। হাসপাতালটা এমনিতে ইসিএল-এর হলেও স্থানীয় মানুষও কম খরচে চিকিৎসা পায়। ডাক্তাররা কেউ কেউ গরিবগুর্বোকে ওষুধ টষুধ দিয়ে দাক্ষিণ্যও করে থাকে।

মাসখানেক পর জীবিত ছাড়া পেল ঠিকই তবে মুখ আর গলা ঝলসে পুড়ে গেছে, মাথা তুলতে পারে না লাখো, খুব সামান্য ঘোরানো যায়। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশ শ্যামলদের ধরে নিয়ে গেলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কেউ বলে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, কেউ বলে জামিনে ছেড়েছে। তবে তারা আর লাখোর পথ আগলে দাঁড়ায় না, আর লাখো তো রাস্তায় বোরোয়ই না বলতে গেলে। ওদিকে কিংশুকও লাখোকে দেখলে ‘মুখপুড়ি’ বলে মাঝেমাঝে সম্বোধন ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর জ্বালায় না। বাজারে শ্যামলদের সঙ্গে তাকে গল্পও করতে দেখা গেছে। গাঁয়ের মেয়ের গায়ে হাত দিলে শাস্তি জানা আছে, কিন্তু তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারলে কী কর্তব্য জানা নেই সম্ভবত। গৌরীকে আর সাবধান করতে হয় না, সে দলবল ছাড়া স্কুলে যায় না।

গৌরীর বিয়ের জোর চেষ্টা চলছে। পাত্রপক্ষ ধানবাদ জেলার কুমারডুবিতে থাকে। তাদের হাজার বায়নাক্বা। কুমারডুবিতে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে একটা চালু গোলদারি দোকান আছে। দোকানটা একেবারে জিটি রোডের ওপরই বলা যায়। রোজগারপাতি ভালোই। তিন ননদ, কোনও দেওর-ভাসুর না থাকায় একমাত্র ছেলে বলা গেলেও সম্পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট বলা যায় না। মেজোমেয়েকে পার করতে হবে বলে লছমনের বাবা চাইছেন পণের টাকাটা তার ছেলের তরফের কুটুমের কাছ থেকে আদায় হোক। যে যেখানে মহাজন।

লাখোর মুখ পোড়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মা হরিয়ালি অসিত চৌধুরীদের বাড়ি কাজে আসে এবং সেইসূত্রে শাশ্বতী চৌধুরীর প্রিয় বান্ধবী। অবশ্য যে গাঁয়ের নিরানব্বই শতাংশ মানুষ কম বেশি চুরি করে, সেখানে লাখোর মা আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম। মেয়েরও হাতটান ছিল, কিন্তু মায়ের সামনে আলমারির চাবি ফেলে রাখলেও ভয় নেই। এমন মানুষ যতই কামাই করুক হাতছাড়া করা যায় না। বড়ো মেয়ে আইবুড়ো থাকতে ছোটো মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে বলে হরিয়ালি মন খারাপ করে। বছর খানেক পেরিয়ে গেছে, মেয়ের বিকৃত মুখে ছিরিছাঁদ ফেরেনি। লাখোর এখনও কথা বলতে, খাবার গিলতেও কষ্ট হয়। জলখাবার খেতে গিয়ে লাখোর মা প্রায় দিনই চোখের জল ফেলে।

গৌরীর বিয়েটা বোধহয় কেঁচিয়ে যাবে। পাত্রপক্ষ পণ নিয়ে বড়োই রগড়ারগড়ি করছে। রাজু কিসান পালা করে কুমারডুবিতে গিয়ে আলোচনা করেও কোনও রফাসূত্র বার করতে পারছে না। হরিয়ালি ছেলেদের দোকানে পাঠিয়ে ভাবছে আজ মিতুদের বাড়ি যাবে কিনা। এমন সময় উঠোনের দরজায় টোকা। এক কালো রোগা ছোকরা।

‘ইয়ে কা দয়াল সিংকা ঘর হ্যায়?’

‘হঁ বটে, কিন্তু উ তো অনেকদিন হইল মইরে গেছে। আমার স্বামী ছিলেক।’

‘মালুম হ্যায়। কেয়া ধানবাদমে গুরুচরণ বাঘেল কি ঘরমে আপ কি কিসি বেটি কি শাদি কি বাত চল রহি হ্যায়?’

‘হঁ হঁ। রাজু কিসানকে খবর কইরছি। উয়াদের সাথে কথা বলুন।’ হরিয়ালি একদম হিন্দি বলতে পারে না, খুব ভালো বুঝতেও পারে না। ছেলেরাও স্থানীয় ঝাড়খণ্ডি উপভাষার বাংলাতেই স্বচ্ছন্দ, কিন্তু বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদেরকেই এগিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া গৌরীর বিয়ের কথা চলছে যেখানে সেইখানে দুই ছেলেই যাওয়া আসা করেছে। সুতরাং সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারাই বেশি উপযুক্ত। হরিয়ালি মাথায় ঘোমটা টেনে বলল, ‘বসুন, আপ বইঠিয়ে। লাখো, যা তো রাজুকে ডেইকে লিয়ে আয়।’ বলেই বলল, ‘থাক তুকে আইসতে হবেক লাই। আমি ষষ্ঠীর ভাইকে বুইলছি।’ মুখ পোড়া মেয়ের কেচ্ছা আর এক মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির লোক জানতে পারুক চায় না। তাই লাখোর বৃত্তান্ত সেখানে জানানো হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি।

‘আপ পরেশান না হো, ম্যায় আপসে বাত করনা চাহতা হুঁ।’

‘হাম বাত মানে হিন্দিতে বাত কইরতে লারি। আমার ছিলাগুলাকে ডাক দিচ্ছি। উয়াদের সাথে কথা করুন। তাতখে মুখে টুকদু কুছু দ্যান।’

‘আমি বাঙালিই। আপনারা রাজপুত না? হিন্দি জানেন না?’

‘বইলতে লারি। ছুটু থেইকে বাংলাতেই কথা বইলছি লয়। অ্যাই ষষ্ঠী, অ্যাই মহেশ, রাজুদাকে টুকদু খবর কইরে আয় না। বল ঘরকে কুটুম আইসছে, জলদি আসে যেমন।’

ছেলেটার নাম প্রসূন মিশ্র। কুমারডুবিতে শঙ্কর টকিজ নামে তাদের একটা সিনেমা হল ছিল, এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাট হয়েছে, নীচে দুটো দোকান ঘর পেয়েছে প্রসূনরা। একটাতে নিজেদের আসবাবের দোকান করেছে আর একটা ভাড়া দেওয়া আছে এক মুদিখানার কারবারিকে। দোকানটা বাবা আর দাদারা দেখে, প্রসূন নিজে স্কুলে পড়ায়। কিন্তু এত কথা ও হরিয়ালিকে কেন বলছে? হরিয়ালি তো কিছু জানতে চায়নি।

ছেলেটা নিজের বাড়ির সম্পর্কে টুকটাক নানা কথা বলে গেল। যা বাবা! গৌরীর শ্বশুরবাড়ির কথা, লছমনের অর্থাৎ গৌরীর হবু বরের কথা তুলছেই না। প্রশ্ন করলে দায়সারা জবাব। তাহলে কি গুরুচরণজিরা পাঠায়নি একে? নাকি এ নিজেই? কথাটা হরিয়ালির মাথায় আসতেই খাতিরের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। উঠোনের দরজা দিয়ে রাজু ঢুকতেই বলল, ‘ইনার নাম পরসূন, পর্সূন কী যেন? ও মিশ্রা। পর্সূন মিশ্র। কুমারডুবি থেইকে আইসছে।’

একথা সেকথার পর প্রসূন গলা খাঁকারি দিয়ে খোলসা করল। সে হরিয়ালির মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। দেওয়া-থোওয়া ওদের সাধ্যমতো, কোনও দাবিদাওয়া নেই। হরিয়ালি তো হাতে স্বর্গ পেল, ‘আপনার, তুমার মা-বাবার সাথে কথা বুইলে..ছ? উনারা কী বলেন দেইখতে হবেক লয়?’

‘মা-বাবা রাজি নন। ওনারা মুখ পোড়া মেয়েকে বউ করতে চান না।’

‘মানে?’ এবার হরিয়ালির দশগুণ অবাক হওয়ার পালা। প্রসূন তাহলে গৌরীকে নয়, লক্ষ্মী অর্থাৎ লাখোকে বিয়ে করতে চায়? ইয়ার্কি করছে না হরিয়ালি স্বপ্ন দেখছে।

‘তুমি আমার ওই মেয়ের কুথা জাইনলে কেমন কইরে?’

‘গুরুচরণজির ছেলে লছ্মন আমাদের ওই দোকানঘর ভাড়া নিয়েগোলদারির দোকান দিয়েছে। কতগুলো শয়তানের জন্য ওর চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনটা তো নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।’

রাজু মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হরিয়ালি জল মিষ্টি পরিবেশন করে বলল, ‘আপনি… তুমি আজ দুপুরে আমার কাছকে ভাত খেয়ে যাবে। এ রাজু কিসনাকেও ডাক। কথা বইলতে হবেক।’

‘আর কাউকে ডাকার দরকার নাই। বিয়া আমি কইরব না। আমার মতো মুখপুড়িকে কেউ জেনেশুনে বিয়া করে?’ লাখো অন্ধকার ভেতর ঘর থেকে বাইরে এল। ও লোকজনের সামনে বড়ো একটা বেরোতে চায় না।

‘জেনেশুনেই তো কথা পাড়ছি।’ প্রসূন বলল।

‘কিন্তু আপনার বাপ-মার মত নাই। বিয়া হবে কী কইরে?’

‘বিয়েটা আমি করব। আমার মা-বাবা নয়। ওনারা রাজি হবেন না বলেই আমি নিজে কথা করতে এসেছি।’

‘আমার পারা মিয়াকে কেউ বিয়া করে? মা উয়াকে বুঝাও।’

‘হঁ বাবা। তুমার মা-বাবা রাজি লয়, ভগবানের শাপে আমার বিটিটোর এই অবস্থা। কুনো দিন উয়ার বিয়া হবার কথা লয়। ঘরে কামকাজ কইরে আপন মনে থাইকছে। তুমি জিদ কইরে বিয়া কইরলে তুমার বাড়িতে মেইনে লিবেক ক্যানে?’

রাজু এবার বলল, ‘মা ভাত বসাও। আমি কিন্তু জলদি বাইরব। কিসনা একা দোকান বন্ধ কইরতে লাইরবেক।’

‘সবসময় বিয়ে কি মা-বাবারা মেনে নিতে পারে? ওনারা স্কুল টিচার ছেলের জন্য মোটা টাকা দর হাঁকবেন। আমি পণ নেব না। শুধু একটা মেয়ের সঙ্গে যা অন্যায় হয়েছে তার কিছুটা পুষিয়ে দেব, মানে ওর তো কোনও দোষ নেই, ও কেন সারাজীবন বঞ্চিত থাকবে?’

হরিয়ালির নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তার দেখতে শুনতে ভালো ছোটো মেয়ের পাত্র ঠিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, আর বিকৃত মুখ বড়োটির জন্য যেচে এত ভালো পাত্র আসছে। আসছে কী, সাধছে, তাও আবার বিনা পণে। সে ছেলেকে ইশারা করল দিদিকে রাজি করাতে। নিজে উঠোনের এক কোণে তৈরি মাটির উনোনে ভাত ও তরিতরকারির জোগাড় করতে বসল। ইস্! কাল মিতুদের গাছ থেকে এঁচোড় নিয়ে এলে পারত। এখন অতিথিকে ভদ্রস্থ কী খাওয়ানো যায়? অল্প পোস্ত আছে। আলু পোস্ত করা যায়। সঙ্গে মাচায় যে কুমড়োর লতাটা উঠছে সেখান থেকে কয়েকটা কুমড়ো ফুল তুলে বেসনে ভেজে দেওয়া যায়। হরিয়ালি দোনোমনো করে সম্ভাব্য জামাইয়ের আদরের তোড়জোড় শুরু করল। কিন্তু এখন রাঁধতে বসলে খাবে কখন? শেষে কাজ চালানোর জন্য লাখোকে পাঠালো মিতুর মায়ের কাছ থেকে খানিক তরকারি ব্যাঞ্জন চেয়ে আনতে।

গৌরী স্কুল থেকে ফিরে দেখে এক ছোকরাকে নিয়ে বেশ খাতিরদারি চলছে। সে লছমন ভেবে বেশ একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে ঘরে ঢুকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। আলগোছে দু-একটা কথাও হল। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ওর আগমণের উদ্দেশ্য জেনে গৌরীর মূর্ছিত হওয়ার পালা। লছমনের ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রসূন তো প্রথম দর্শনেই চোখের সঙ্গে মনটাও আচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল। তার মুখপোড়া দিদির পাশে এই ছেলেটা? দিদির চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতেই পড়ে সে। দু বছর পর মাধ্যমিক পাসও করে যাবে। বড়ো ঘরের স্কুল টিচার ছেলে তবু তার বছর বছর ফেল মারা কামিন খাটা দিদিটাকে বিয়ে করতে চায়! আর তাদেরই দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মুদিখানা চালানো ছেলে গৌরীর মতো মেয়েকে নেওয়ার বিনিময়ে এত দর হাঁকছে?

লাখোকে প্রথমটায় রাজি করানো যাচ্ছিল না। বস্তুত হরিয়ালি আর তার দু ছেলেরও মনে হচ্ছে মুখপোড়া মেয়ে ঘরে কাজকর্ম করে মা-ভাইয়ের সংসার টেনে নিয়ে যেতে পারে। ও চলে গেলেই বরং অসুবিধা। বরং গৌরীটাকে প্রসূনের মতো পাত্রের সঙ্গে জুততে পারলে সব দিক থেকেই মানানসই হয়। কিঞ্চিদধিক পড়াশুনো শেখা ও অক্ষত থাকার সুবাদে গৌরী লোকের বাড়ি তো দূর ঘরেও কাজকর্ম করতে বিশেষ রাজি নয়। তাই হরিয়ালির ছেলেরা বড়দিকে রাজি করানোর চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে প্রসূনকে ছোড়দির দিকে ফেরাতে। তার মা-বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ করে দুটো বিকল্পের পথই খোলা রাখতে চাইছে। লাখো বেগতিক দেখে ঘাড় নেড়ে দিল। মেয়েরা যে শ্বশুরঘরে দাসত্ব করলেও গিন্নি আর বয়স পেরিয়ে বাপের ঘরে খেটে খেলেও আশ্রিতা, সেটা উপলব্ধি করার জন্য বেশি দূর পড়াশুনোর দরকার হয় না।

এরপর তিন বছর কেটে গেছে। প্রসূনের জেদ আর আন্তরিকতাই বজায় থেকেছে। গৌরীরও যেন কোনও অনিচ্ছুক পাত্রের পুরি ঘরওয়ালি হওয়ার বদলে একজনের আধি ঘরওয়ালি হওয়াতেই বেশি আগ্রহ। শালির বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে জামাইবাবু লড়ে যাচ্ছে। লছমনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে।

ভাই ও জামাইদাদার নতুন উদ্যোগে গৌরীরও বিয়ে হতে চলেছে কালীপাহাড়িতে। ছেলের নাকি কয়লা খনিতে মোটা মাইনের কাজ। অসিত চৌধুরী অর্থাৎ মিতুর বাবা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন খনি বলতে চোরা খাদান। এখানকার বহু লোকে জানেই না কোনটা বিধিসম্মত আর কোনটা বেআইনি খনি, বা জানলেও সেখানে কাজ করার মধ্যে অনৈতিক কিছু দেখে না। যেমন ইসিএল বা ডিপিএস-এর লাইন থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ নেওয়াকে বেশির ভাগ বাসিন্দা অনেকটা স্থানীয় মানুষের মৌলিক অধিকার বলে ধরে নিয়েছে, চুরি মনে করে না, আর করলেও ‘বেশ করেছি’ ভাব। খুব কম বাড়িতে কুয়ো বা পাম্প আছে। বড়ো বড়ো অট্টালিকাতেও ইসিএল-এর পাইপ লাইন থেকে শাখা প্রশাখা বার করে ট্যাঙ্ক ভরা হয়। একসময় কল্যাণেশ্বরীর জল ব্যবহূত হতো পানীয় জল হিসাবে, এখন সেটার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ইসিএল-ই ভরসা। হুকিং-এর তার ধরপাকড়ের সময় বাজেয়াপ্ত হলেও জলের লাইন কেটে দিলে আগুন জ্বলবে, কারণ অঞ্চলটার অধিকাংশ জায়গায় মাটির নীচটা ফাঁপা, কুয়ো খুঁড়লে জলের বদলে কয়লা নয়তো গহ্বর পাওয়া যাবে, আগুন আর ধোঁয়াও বেরিয়ে আসে জমির ফাটল বেয়ে। যশাইডি গাঁ, ঝালবাগান কলোনি আর বানডাঙার কয়েকটা বাড়িতে কুয়ো থাকলেও ‘কোম্পানিকা মাল দরিয়ামে ডাল’ দর্শনেরই জয়জয়াক্বার। কয়লা খাদানে জলও জমে, যে জল পাম্প করে আসানসোলের দু একটা অঞ্চলে, রানিগঞ্জ শহরের কিছু জায়গায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই ‘ধসা ওয়ার্ড’-এ মাটির নীচে কেবল কয়লা কিংবা আগুন। জনস্বার্থে কারচুপির জন্য প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ানদের নতুন নতুন উদ্ভাবন রীতিমতো পেটেন্টের দাবিদার হতে পারে।

গৌরীর দুই ভাই রাজু আর কিসান ছোটো বোনের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে বেশ গর্বের সঙ্গে অভিজ্ঞতা জানিয়েছিল অসিত চৌধুরীর বাড়িতে, বসার ঘরে চা খেতে খেতে তারা মাটির নীচ থেকে কয়লা কাটার ঠং ঠং শব্দ শুনতে পেয়েছে। অমন বিপজ্জনক বাড়িতে যে বোনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকতে পারে না তা বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে অসিতবাবু রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। জামাইয়ের করা সম্বন্ধ কি হেলাফেলা করা যায়। তাছাড়া ঘনঘন দিদির বাড়ি গিয়ে মাসের পর মাস থাকা নিয়ে লোকে ঠাট্টার ছলে একটু আধটু কথাও শোনাচ্ছে– দুই মেয়েকেই এক গাছতলে ফোকটে বেঁধে দিয়েছে লাখোর মা। সুতরাং অসিতবাবুর অকারণ আশঙ্কায় কান দেওয়ার মানে হয় না। বরং শাশ্বতী চৌধুরী মেয়ের বিয়েতে দেওয়া থোয়া নিয়ে কথা বলেন তার প্রিয় বান্ধবী লাখোর মায়ের সঙ্গে।

দ্বিরাগমণে ছোটো মেয়েদের আসতে দেরি দেখে লাখোর মা ঘরবার করছে। সে আজ বাবুঘরে যাবে না, সে যে লোকের বাড়ি কাজ করে তা জামাইরা জেনে ফেললেও গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। সকাল দশটা নাগাদ আসার কথা ছিল, বিকেল সাড়ে চারটে গড়াতে চলল। মিতুর মায়ের মতো মেয়েদের নিয়ে অত আতুপুতু করা লোকের বাড়ি খেটে খাওয়া মায়েদের থাকে না। কিন্তু এত দেরি? হরিয়ালি কেন, তাকে ঘণ্টাখানেক আগে দুশ্চিন্তার জন্য মুখ ঝামটা দেওয়া রাজুও উদ্বিগ্ন হয়ে টেলিফোন বুথে ছুটল।

প্রায় সাথে সাথেই দুই ভাই একত্রে ঘরে ঢুকল। কিসান হাঁপাতে হাঁপাতে খাটিয়ায় বসে পড়ল।

‘কী হইল রে? গৌরীর একটো খবর লিয়ে আসতে পাঠালম রাজুকে সিটো না কইরে ঘরকে চলে এলি যে? বুনটোর জইন্য কি টুকদু চিন্তা হয় না তুদের?’

‘মা!’ ডাকটা আর্তনাদের মতো শোনাল যেন। ‘গোরীদের বাড়িটো ধসে গেঁইনছে। দিলীপ খাদে ছিল। উঠে আইসতে পারে নাই। আর ছাদ চাপা পইড়ে গৌরী আর উয়ার শাশুড়িটোও গেঁইনছে। দোফোর থেইক্যে হাসপাতাল ডাক্টার এইসব চইলছে উয়াদের। বডি এইমাত্তর হাসপাতাল থেইক্যে ছাইড়লেক।’

লাখো উঠোনে বেড়া আর খড়ের ছাউনি দেওয়া হেঁসেলে চায়ের যোগাড় করছিল। বোন-ভগ্নীপতি আসবে বলে মাকে সাহায্য করতে কুমারডুবি থেকে দৌড়ে এসেছে। বাসনপত্র ফেলে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়ে জামাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অলীক সাব্যস্ত হওয়াতে হরিয়ালি ডুকরে উঠল, ‘হেই ভগমান, ভগমানের কেমুন বিচার গো! আমার মুখপুড়ি বিটিটোকে ছেইড়ে ভালোটাকে লিয়ে লিলেক…!’

(এই গল্পের সব চরিত্র ও নাম কাল্পনিক)

প্রতুলের দিনগুলি

‘রাধা কৃষ্ণ। রাধা কৃষ্ণ। কই গেলি রে রাধাকৃষ্ণ। চলে আয়। আমি এসেছি।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের ভেতর থেকে হাত বের করে বিস্কুটের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রতুল। কিন্তু ওদের দেখা নেই। প্রতুল চায়ের কাপে চুমুক দিল। চার-পাঁচটা ঝগড়ুটে কাক আর কয়েকটা শালিক উড়ে এসে বিস্কুটের দখল নিল। চড়ুইয়ের দল নিম গাছের মাথায় চ্যাঁচামেচি করছে। বাউন্ডারিওয়াল বা পেয়ারা-নিমের ডালে কোথাও রাধাকৃষ্ণের দেখা নেই। ওরা কি আজ আসবে না! প্রতুল ভাবল, ওরা এখন এলেও কাকের দলের সাথে পেরে উঠবে না। কাক ভীষণ চালাক আর বুদ্ধিমান, শালিকও।

সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার দুদিন পরের কথা। প্রতুল সকালে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল বারান্দায়। একটা জড়পদার্থের মতো, নিস্তেজ হয়ে। চুমুক দিতে ভুলে গেছে। তখনই ছোট্ট বাগানের এককোণে লম্বা ঘাস আর লজ্জাবতীর আড়ালে পাখিদুটোকে নজর পড়ল। ধূসর রঙের দুটো ঘুঘু। মেয়ে পাখিটার গলায় বাদামি গোল দাগ, মনে হয় গলার হার। ঘাসের মধ্যে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছিল ওরা। ছেলে পাখিটার ডান পায়ে খুঁত আছে। পা-টা ভাঁজ হয় না, হাঁটার সময় একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। মেয়ে পাখিটা বেশ চালাক-চতুর মনে হয়। খাবারের টুকরো বা শস্যদানা খুঁজে দিচ্ছে সঙ্গীকে। ছেলেটা ডান পা পালকে ঢেকে মাথা নীচু করে সেই শস্যদানা গিলে নিচ্ছে।

প্রতুলের মনে পড়ল ওর ভাঁজ-করা বাঁ-পা চেয়ারের ওপর, ডান-পা লম্বা করে ছড়িয়ে রেখেছে মেঝেতে। সুলেখার মৃত্যুর পর থেকে জটিল নার্ভের অসুখে ভুগে ভুগে এখন ওর দুটো হাত কাঁপে, ডান পা-টা হাঁটু থেকে ভাঁজ হতে চায় না। ছেলে পাখিটার সাথে ওর মিল আছে। একটা বিস্কুট ভেঙে বাগানে ছড়িয়ে দিতেই পাখিদুটো এগিয়ে এল। প্রথমে ও ভেবেছিল পায়রা। পরে ভালো করে দেখে বুঝল পায়রা নয়, ঘুঘু পাখি। গলা আর পেটের দিকে সামান্য সাদা, মাথার ওপরে আর ডানায় বাদামি-খয়েরি রঙের ছিটে। মেয়েটার গলার চারপাশে বাদামি গোল দাগ, রিং-এর মতো।

প্রতুল ওদের নামকরণ করল, রাধাকৃষ্ণ। সেই থেকে প্রায় তিনমাস হতে চলল ওরা নিয়মিত ওর বারান্দার সামনে আসছে। ওদের জন্য দুটো বিস্কুট বরাদ্দ। আগে কখনও ভোরবেলা এসে হাজির হতো। অত সকালে প্রতুল উঠতে পারে না।

দুটো কাক ওর দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। হদ্দ বোক্বা, হদ্দ বোক্বা। বো-কা-কা।

চায়ের কাপটা এককোণে রেখে প্রতুল ভাবল, কে বোকা! কাকে বোকা বলছে ওরা! কাকগুলোও কি জেনে গেছে, প্রতুল একটা হদ্দ বোকা। ওই ঘটনার আগে ও নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ভাবত। বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, শিক্ষিত এবং ভদ্র। বিশেষ বিশেষ সময়ে অন্যের চেয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবতে ভালোও লাগত। এখন ওর আত্মবিশ্বাসের পারদ শূন্যে নেমে গেছে। নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

কাকগুলো উড়ে গিয়ে বসেছে রাস্তার ওপারে সরকারদের বাড়ির ছাদের কার্নিশে। ওরা উড়ে যেতেই কয়েকটা চড়ুই কিচিরমিচির করে প্রতুলের সামনে এসে রীতিমতো অভিযোগ শুরু করে দিল। আমরা ফেলনা নাকি। আমাদের ভাগেরটা কই। সারাদিন তো আমরাই তোমার বাড়ির বারান্দায় হুটোপাটি করি। পাশে নিমের ডালে ঠোঁট ঘষি, সুখ-দুঃখের কথা বলি, বসে বিশ্রাম নিই। বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর দিয়ে হুলোটা যখন নিঃশব্দে দৌড়ে যায়, রান্নাঘরের জানালার ভেতর উঁকি দেয়, আমরাই চ্যাঁচামেচি করি। প্রতুল ঘরে গিয়ে আবার বিস্কুট নিয়ে আসে। গ্রিলের বড়ো বড়ো ফাঁক দিয়ে চড়ুইগুলো বারান্দায় চলে আসে। একেবারে প্রতুলের হাতের কাছাকাছি। ওরাই এখন ওর বন্ধু, সময় কাটাবার, নিঃসঙ্গতা দূর করার সাথি। কিন্তু রাধাকৃষ্ণ আজ গেল কই? ওদের কি শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু?

অর্চনা মোবাইল হাতে বারান্দায়, ‘অ্যাই তোমার ফোন। দ্যাখো, সুভাষদা আবার কী বলবে। টাকা-পয়সার কথা বলতে পারে। তুমি রাজি হবে না কিন্তু। আর ব্যাপারটা ভালো করে শুনে নিও। যদি সেরকম মনে করো, টাকা পয়সা কিছু দিতে হবে, তাহলে আপ-ডাউন ভাড়াটা শুধু দিয়ে দিও। কাজ শেষ করে ফিরে আসলে ফিজটা দিও।’

অর্চনা মোবাইলটা প্রতুলের হাতে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ও এখন গতকালের এঁটো বাসন মাজবে, বালতির জলে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে বাসি কাপড় ভেজাবে, তারপর সবজি কুটতে বসবে। দুপুর একটা বেজে যাবে তাও অর্চনার কাজ শেষ হবে না।

কাঁপতে কাঁপতে একসময় ছোট্ট যন্ত্রটা থেমে গেল। প্রতুল ফোনটা রিসিভ করল না। কী বলবে ওই প্রান্ত থেকে সুভাষদা, প্রতুল অনুমান করতে পারে। অর্চনার দূর সম্পর্কের মাসতুতো না পিসতুতো দাদা, সুভাষ ঘোষ, বার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র উকিল। হয়তো আরেকবার ফোন করবে। প্রতুল রিসিভ না করলে ল্যান্ড-লাইনে ফোন করবে। শেষে স্কুটারে চেপে নিজেই হয়তো চলেই আসবে এ বাড়িতে। লোকটাকে গত দুমাস ধরে দেখছে ও। ওর চাকরিজীবনে সেই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটে যাবার পর, অর্চনাই পরামর্শ দিয়েছিল সুভাষদাকে ধরতে। ফোন করে এবাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিল অর্চনাই। আইনি পরামর্শ পেতে। এর আগে প্রতুল কখনও লোকটাকে দেখেনি, নামও শোনেনি। লোকটির কথাবার্তা শুনে প্রথমদিনই প্রতুল বুঝে গিয়েছিল উকিলের ছোঁয়া মানেই ছত্রিশ ঘা। শুধু পুলিশে ছুঁলে তাও হয়তো বাঁচতে পারত।

এপর্যন্ত ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেছে ও। প্রথমে অ্যান্টিসিপেটরি বেল-এর জন্য আবেদন করেছিল লোকাল কোর্টে। সেই আবেদন নাচক করে দিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন জানাতে হবে। সেই ব্যাবস্থাও পাকা করে ফেলেছে সুভাষদা। এখন কলকাতায় যাবে কেসটাকে মুভ করাতে। প্রতুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে। ও চাইছিল না হাইকোর্টে কেসটা মুভ করুক। কিন্তু সুভাষদা জোঁকের মতো ওর রক্ত খেয়েই চলেছে।

আশিস, নির্মল, কল্যাণ, টিকালাল কেউ উকিলের খপ্পরে পড়েনি, একমাত্র ও ছাড়া। ভয় তো সকলেরই ছিল, এখনও আছে। সকলেই আত্মীয়-বন্ধুদের চেনাজানা উকিলদের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিয়েছে, কিন্তু জড়িয়ে পড়েনি। সবাই ভয়ে ভয়ে আছে, কী হয় কী হয়। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারিতে নাকি প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে।

যাদের জেল হাজত হয়েছে, ওদের কথা আলাদা। একজনের জায়গায় দুজন উকিল নিয়োগ করেছে কেউ কেউ। একের পর এক হেয়ারিং-এর ডেট পড়ছে, ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন, রায় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু জেল হাজত থেকে মুক্তি মিলছে না। স্থগিতাদেশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট। কখনও পুলিশের জোগাড় করা নথিপত্র যথেষ্ট নয়, কখনও জেলা আদালত থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হাতে আসেনি– এইসব অজুহাতে একের পর ডেট পেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। এখন জানা যাচ্ছে, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পার্টির বয়ান এখনও শেষ হয়নি, প্রতিদিন নাকি নতুন নতুন পার্টি আসছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছে। জেলা আদালতের নির্দেশে সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে মহকুমা কোর্টে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেতে সেইসব বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কিছুতেই জামিন হচ্ছে না চারজনের। মূল জালিয়াত বৃন্দাবন মণ্ডল সহ তিনজন আধিকারিক। দুজন সহকারী ম্যানেজার, একজন হেড ক্যাশিয়ার।

ব্যাংকের এক কোটি সাত লাখ টাকার জালিয়াতির ঘটনায় সিনিয়ার ম্যানেজারসহ ব্রাঞ্চের তেরোজন স্টাফ, সবাই সাসপেন্ড হয়েছে। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস হতে চলল। প্রতুলের কাছে এখনও মনে হয় সবটাই স্বপ্ন। চোখের সামনে দিনের পর দিন চার ফুট দশ ইঞ্চির রোগা-পটকা একটা ছেলে কাস্টমারের লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করে হজম করে ফেলল, ব্যাংকের কেউ কিচ্ছুটি টের পেল না! অসংখ্য কাস্টমারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাতে লেখা ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট দিয়েছে ছেলেটা, যথাযথ জায়গায় সই-সাবুদ করা রিসিপ্ট। মান্থলি ইনকাম স্কিম যাদের, তাদের অ্যাকাউন্টে মাসের প্রথমে নিয়মিত টাকা জমা পড়েছে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি।

দৈনিক একশো কুড়ি টাকা মজুরির অস্থায়ী কর্মী বৃন্দাবন দুবছরের মধ্যে কয়েকটি গাড়ির মালিক হবার পরেও কেউ কোনওরকম সন্দেহ করল না। প্রতুল সামান্য সিঙ্গল উইন্ডো অপারেটর। কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। কে কী করছে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু যারা ব্যাংকের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থেকে গাড়ির ব্যাবসা করে, শেয়ার বাজারে টাকা খাটায়, এমনকী ঠিকাদারি পর্যন্ত করে, তারা? বিকেল পাঁচটার পর যারা বোতল খুলে বসে, বৃন্দাবনকে দিয়ে কাজুবাদাম, ভুজিয়ার প্যাকেট আনায়, তারা? কারও মনে কোনও প্রশ্ন জাগল না?

বারান্দায় বসে প্রতুলের খুব মনে হয়, এরা সব কাকের দল। এ মার্ডার অব ক্রোস। ঠুকরে ঠুকরে মাংস খেল, ঠোঁট মুছে উড়ে পালাল। আর ভয়ংকর ধূর্ত সেইসব নেকড়ে আর শেয়ালের দল! ওরাই তো ব্যাংকের দণ্ডমুন্ডের কর্তা। জোনাল ম্যানেজার, চিফ অফিসার, এমনকী জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের এসি গাড়িতে বিভিন্ন সময়ে টুর করেছে দিনের পর দিন। এয়ারপোর্টে গাড়ি পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে দার্জিলিং-গ্যাংটকে লাক্সারি হোটেল বুক করা সবটাই হতো বৃন্দাবনের সৌজন্যে। অত বড়ো মাপের কোনও অফিসার কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি এই ছেলেটির আয়ের উৎস কী? বিলাসবহুল হোটেলে দামি খাদ্য-পানীয় ইত্যাদিতেই মজে থাকত। কেউ কখনও কোনও সন্দেহ করল না। অফিসে অডিটর এলে খাতা-পত্র এগিয়ে সামাল দিত বৃন্দাবনই। ‘বৃন্দাবনজি আপ’ বলে সম্বোধন করত জোনাল ম্যানেজার, প্রতুল নিজের কানে শুনেছে। তিন বছরের মাথায় বিশাল দুটি ফ্ল্যাটের মালিক। পরের বছর যাত্রীবাহী লাক্সারি বাস, নামে-বেনামে অসংখ্য জমির প্লট– এসব দেখেশুনে খোদ সিনিয়র ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের সাথে সম্ভ্রমের সাথে কথা বলত। প্রতুল কিছুটা দূর থেকে এসব লক্ষ্য করত, কিন্তু কখনও ভেতরে ঢুকত না। এখন মনে হচ্ছে, প্রতুল সত্যিই ভীষণ বোকা, কমবুদ্ধির মানুষ।

বৃন্দাবনের ছুড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে শেয়াল-নেকড়ের দল মুখ মুছে ফেলল। ওদের দোষ দেখার তো কেউ নেই। অথচ ওরাই অফিসসুদ্ধ সবাইকে সাসপেন্ড করল। প্রতুলরাই নাকি বৃন্দাবনের সাথে মিলেমিশে ব্যাংকের টাকা জালিয়াতি করেছে। ভিজিলেন্স অফিসারের সাথে চিফ অফিসার যখন ইন্সপেকশান করছিলেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছিলেন কর্মীদের বাবা-মায়ের নাম তুলে।

গ্যারাজের একটা ছেলে সেদিন রাস্তায় প্রতুলকে দেখে জোরে জোরে বলছিল, ‘ওই যে লোকটা যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যাটা। এখন চাকরি গেলেই বা কী! কেমন গরুচোরের মতো মুখ করে চুপচাপ হাঁটছে লোকটা, দ্যাখ।’ প্রতুল বাজারে যাচ্ছিল সামান্য মাছ আর সবজি কিনতে। দুজন লোকের জন্য কতটুকুই আর বাজার লাগে। তবু সপ্তাহে একবার বাজারের জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই হয়। কথাটা শুনে দপ করে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। সেই রক্ত সহজে মাথা থেকে নামল না।

অর্চনা বলেছিল, ‘শরীর খারাপ লাগছে? ছাতা নিয়ে বাজারে যেতে পারো না? প্রেশার-সুগার চেক করিয়ে নেবে কাল-পরশু। এখন শুয়ে থাকো। একদম উঠবে না বিছানা থেকে।’

ওদের ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটা গোটা শহরে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে সারাদিন বারান্দায় বসে, নয়তো শুয়েই দিন কাটছে ওর। সকালে খবরের কাগজ, বিকেলে অর্চনার সাথে বসে টিভি সিরিয়াল, নিউজ দেখা। এর বাইরে ওর কোনও কাজও নেই। অফিস কলিগদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছে বহুদিন। বিরাট একটা সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা মাথায় নিয়ে ও ধীরে ধীরে একটা কেঁচোর মতো মাটির নীচে চলে যেতে চাইছিল। এই শহরেই ওর রক্তের সম্পর্কের মানুষ আছে তিনজন। ওদের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ হয়েছে বহুদিন। অর্চনাকে বিয়ের পর থেকে।

থানা থেকে ফোন করে ওকে দেখা করতে বলেছিলেন আইসি। এমনিতে ও দুর্বল মনের মানুষ, থানা-পুলিশের নাম শুনলে ভয় পায়, ঝুটঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায় না। ফোনটা পেয়ে ও কাঁপতে শুরু করল। অর্চনা বার-দুই বমি করে অজ্ঞান হয়ে গেল। সুভাষদা এসে পরিস্থিতি সামাল দিল। থানার ঝামেলাটা মিটতে না মিটতেই ব্যাংকের চার্জশিট এসে হাজির প্রতুলের নামে। অন্যদের একপাতা, নয়তো দুপাতা। প্রতুলের তিনপাতা। কাজে মারাত্মক গাফিলতি, নিয়ম বহির্ভূত লেনদেনে যুক্ত থাকা, মূল অভিযুক্ত বৃন্দাবনের সঙ্গে সরাসরি লক্ষাধিক টাকার লেনদেন– চার্জশিটে এরকম চব্বিশটা অভিযোগ আছে ওর নামে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওর নামে।

প্রতুল ভাবছিল এবার ও কী করবে? বাঁচার বোধহয় আর কোনও রাস্তা নেই। চাকরিটা গেলে ও খাবে কী? এত খারাপ কপাল কারও হয়? ছোটোবেলা থেকেই ও দেখছে, ওর পোড়া কপাল। পৈতৃক দোতলা বাড়ি ভাড়াটে দখল করে নিল। আর ও বছরের পর বছর ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দিল। দুর্ভাগ্য নিয়েই বোধহয় ও জন্মেছিল। নইলে সুলেখার সাথে ওর বিয়েটাও কেন সুখের হল না। ষোলো বছর ঘর করার পরও, সুলেখা একটা সন্তানের জন্ম দিতে পারল না। শেষদিকে ওর দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছিল, চার মাস ডায়ালেসিস-এর পর মারা গেল। আর ও মারা যাবার পর যেন দুর্যোগের ঝড়টা সাইক্লোন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুলেখার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই ও আবার বিয়ে করে বসল। প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির লোকজন, অফিস কলিগ, পাড়ার দুচারজন ছ্যা-ছ্যা করল। প্রতুল পাত্তা দিল না। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, বয়স ওর বয়সের প্রায় অর্ধেক। প্রতুল ভেবেছিল, সুলেখা ওকে যা দিতে পারেনি, অর্চনা সেটা পারবে। এবার নিশ্চয়ই একটা সন্তান আসবে। বিয়ের চার বছর হতে চলল। কিন্তু এখনও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। দুবার ডাক্তার দেখিয়ে টেস্ট করা হয়েছে। অর্চনার কোনও গন্ডগোল নেই, সবকিছুই স্মুথ। তাহলে কি দোষটা ওর? নাকি ওর ভাগ্যের!

সুলেখা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে কম তরজা হয়নি। সুলেখার বোন সুরেখা তো একদিন রীতিমতো ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘প্রতুলদা, দিদিকে দোষারোপ করার আগে, নিজের দোষটা দেখুন। ভুল ট্রিটমেন্ট আর ওষুধ খেয়ে খেয়ে দিদির শরীর এখন না-হয় ভেঙে গেছে। প্রথম থেকে আপনি যদি নিজের ট্রিটমেন্টটা করাতেন, তাহলে দিদিকে আজ ভুগতে হতো না।’

নিমের ডালে বসে দুটো কাক মন্থর গলায় ডাকছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। তাকিয়ে আছে প্রতুলের দিকেই। হদ্দ বোকা, অপদার্থ, অলস, ভীতু আর আর…? সুরেখা একদিন রেগে গিয়ে ওকে বলেছিল, ‘প্রতুলদা আপনি নিজের দোষ ঢাকতে দিদির ওপর অত্যাচার করছেন। শুধু ষাঁড়ের মতো উচিয়ে গেলেই হয় না। ভেতরে কিছু থাকতে হয়, বুঝলেন! নপুংসক একটা!’ আরও বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল সুরেখা। সুলেখা ওকে থামিয়েছিল।

ইউনিয়ন চার্জশিটের সব অভিযোগের উত্তর লিখে দিয়েছে। কাগজপত্রের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন শেষ হতে লাগল তিন মাস। তারপর চলল স্ক্রুটিনি, ক্রস এক্সামিনেশন। কখনও ব্রাঞ্চে, কখনও জোনাল অফিসে ওকে ছুটতে হল। সঙ্গে ইউনিয়নের লিডার, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরমেশ লাহিড়ি। কলকাতার লোক। এই করতেই বছর ঘুরে গেল। এখন অর্ধেক নয়, পুরো মাইনেটাই পাওয়া যাচ্ছে।

হেয়ারিং শেষ। পরমেশদা এবার কলকাতা ফিরবে। প্রতুল পরমেশদাকে একান্তে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা পরমেশদা, আমার বিরুদ্ধে এতগুলো মারাত্মক অভিযোগ, বাঁচার কোনও রাস্তা সত্যি আছে?’

‘ম্যানেজমেন্ট বৃন্দাবনের সাথে তোমার, তোমাদের ইনভলভমেন্টের অনেকগুলো প্রমাণ পেয়েছে। এতসব তুমি অস্বীকার করবে কী করে?’

‘কিন্তু, পরমেশদা, সত্যি বলছি, আপনি লোকাল লিডারদের কাছেও এর প্রমাণ পাবেন। অন্যদের সাথে বৃন্দাবনের যেমন ওঠাবসা ছিল, আমার সাথে কিছুই ছিল না। অন্যরা ওর গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরতে চলে যেত, টাকা ধার নিয়ে সময়মতো ফেরত দিত না, বৃন্দাবনের পয়সায় হোটেলে খেত। আমি কিন্তু কখনও ওর গাড়ি ভাড়া নিইনি, টাকাও ধার নিইনি।’

‘তার মানে এদের চোখে তুমি বোকা। সবাই তোমাকে ইউজ করেছে। বৃন্দাবনের সাথে তোমাদের স্টাফদের মধ্যে লেনদেনগুলো এমন হয়েছে যাতে পরিষ্কার ইউ আর ভেরি মাচ ইনভলভড। এনিওয়ে, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। এখানে একটা কথা তোমাকে বলি, ট্রেড ইউনিয়ন লড়াই করে, জিততেও পারে, হারতেও পারে। হারা-জেতাটাকে আমরা গুরুত্ব দিই না। গুরুত্ব দিলেই লড়াইটা থেমে যাবে। দরকার হলে আমরা আরও বড়ো আন্দোলনে যাব।’

রাধা-কৃষ্ণ এখনও ওর ছোট্ট বাগানে আসে বিস্কুট খেতে। কৃষ্ণের ডান-পাটা ভাঁজ হয় না, টেনে টেনে চলে। প্রতুলের মতো। ওদেরও হয়তো ছেলেমেয়ে নেই। ওদের জীবনে কি হারা-জেতা আছে? প্রতুল ভাবল, ওর চাকরিটা চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। চাকরিটা চলে গেলেও ও না খেয়ে মরবে না। কারণ পেনশন, গ্র্যাচুইটি নিশ্চয়ই পাবে। রেকারিং, ফিক্সড ডিপোজিটে বেশ কিছু টাকাও আছে। দুটো মানুষের আর কত চাই। দিব্যি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারবে। রাধা-কৃষ্ণের মতো এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সোশ্যাল স্টিগমা! কলঙ্কচিহ্ন মুছবে কেমন করে! পাখিদের সমাজে কি কলঙ্কচিহ্ন আছে! ডানা ঝাপটালেই সব ক্লেদ-কলঙ্কচিহ্ন ঝরে পড়বে না!

প্রতুল ভাবল, মানুষের সমাজ মানে কী? বৃন্দাবন মণ্ডল তিন মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওর বিরুদ্ধে জালিয়াতি-প্রতারণা-সরকারি টাকা নয়ছয় সহ যতগুলি ভারী ভারী কেস ছিল সেগুলি এখন তুলোর মতো হালকা। প্রতুল শুনেছে, এজন্য বৃন্দাবন সাত লাখ টাকা ছড়িয়েছে। শকুন-কাকের দলে পাউরুটি ছুড়ে দেবার মতো– ওর উকিল, অখিল ঝা-র হাত দিয়ে। আন্ডার-লাইন পাইপের জলের মতো এই টাকা ছড়িয়েছে থানার ইন-চার্জ থেকে কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত। অথচ থানার এই ইন-চার্জ প্রতুলকে মুখোমুখি বসিয়ে ঠান্ডা গলায় কী সাংঘাতিক হুমকি দিয়েছিল সাত-আট মাস আগে।

বৃন্দাবন এখন লাইন-হোটেল খুলেছে বড়ো রাস্তার পাশে। মাত্র পনেরো কিলোমিটার দূরে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। অনেক যুব-নেতা, পুলিশের ছোটোবাবু, মেজোবাবু সন্ধে নাগাদ এই লাইন-হোটেলে বসে খানা-পিনা করেন, কিছুটা সময় কাটান। বেশি রাতে নাকি একদুজন উর্বশী-অপ্সরা আসে সেখানে, বিনোদনের অঢেল আয়োজন। এছাড়া বিরাট এক স্টেশনারি দোকান খুলেছে বৃন্দাবন পাশের শহরে।

প্রতুল বুঝতে পারল, আমাদের সমাজটাও বেশ সুশৃঙ্খল, পাখিদের মতোই। কাক-শালিকদের রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিলেই আর সমস্যা থাকে না। ওরা দুয়ারের সামনে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে না, ছাদের মাথায় ঝামেলা করে না। পাড়ার সবচেয়ে মস্তান কুকুরটাও দুয়ারের সামনে পাহারা দেয়, যদি নিয়মিত দুবেলা এঁটো-কাঁটা পায়। বৃন্দাবন সুন্দর বুঝেছে এই সমাজ আর তার মানুষগুলোকে। তাই আজ ওর লাইন-হোটেলের রমরমা। এই কথাগুলো বুঝতে প্রতুলের অনেকসময় লেগে গেল।

কিন্তু ইউনিয়ন লিডার পরমেশ লাহিড়ি। সে তো এই গ্রহেরই মানুষ। পরমেশদা যা পারে, প্রতুল তার একাংশও পারে না কেন? ও একজন দুর্ভাগা লোক, হেরো লোক, এটাই কি একমাত্র কারণ? দুর্ভাগ্যের ভাবনাটা নিয়েই যে ও অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিল। শেষবারের মতো কলকাতা ফিরে যাবার আগে পরমেশদা ওকে কী বোঝাতে চেয়েছিল? হেরে-যাওয়াটাকে গুরুত্ব দিলে সব থেমে যাবে? কিন্তু ও তো লড়াইটা শুরুই করতে পারেনি।

সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার বোধমুক্ত রাধা-কৃষ্ণ কীভাবে ওর ছোট্ট বাগান থেকে উড়াল দেয় কাল সকালে, দেখতে হবে মন দিয়ে।

 

ঝিলমিল

ঝিলমিল তার বাবা, মা আর প্রতিবেশী কয়েজন বন্ধুবান্ধবের সাথে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছে। ঝিলমিল ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, তাই ধরাবাঁধা জীবনের থেকে কটা দিন মুক্তি। সবাই সহমত হয়ে জল-জঙ্গল দেখবার আকর্ষণে মেতে উঠেছে। লঞ্চের নামটাও কি সুন্দর, মালঞ্চ। টুরিস্টরা যখন ভয়ে ভয়ে পদক্ষেপ ফেলছে, ওঠানামায় সাহায্যের দরকার হচ্ছে, সেখানে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেগুলো এ-লঞ্চ ও-লঞ্চ অনায়াসেই টপকে যাচ্ছে। যেন জলেই ওদের জন্ম হয়েছে।

গদখালি থেকে যখন লঞ্চ ছাড়ল তখন চারদিক সোনা রোদে চিকচিক করছে। বিদ্যাধরীর পাড়ে পাড়ে সুন্দরী, বাইন, হেতাল আর গর্জনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে সবুজের হাতছানি। সবাই মনোনিবেশ করে আছে যদি দক্ষিণরায়কে দেখা যায় কিন্তু তাকে দেখা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। একটা বাজপাখি ছোঁ মেরে একটা মাছকে ওঠাতেই ঝিলমিল হাততালি দিয়ে বলে উঠল, আরে দ্যাখো দ্যাখো বাজপাখি এখন জেলে হয়ে গেছে।

উঁচু ক্লাসে পড়া রাহুল বিবেচকের মতো বলল, আরে ওটা ওদের খাদ্য খাদকের সম্পর্ক। মাছ খাদ্য আর বাজপাখি খাদক। ঝিলমিলের মা ঝলমলে হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ওই দ্যাখো কাকের কাণ্ড দ্যাখো। বাজপাখির নেওয়া মাছটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল! রাহুল বিজ্ঞের মতো বলল, প্রকৃতির বুকে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম চলছে।

এই সবকিছুর মাঝে টুর কোম্পানির রান্নার বউ কমলা ওদের জন্য গরম ভাতের সঙ্গে ঝুরি আলুভাজা, মুগডাল, চিকেন কষা আর টম্যাটোর চাটনি রেঁধে ফেলেছে। লঞ্চের ডেকের ওপর সুন্দর আযোজনে লাঞ্চ সারা হল। সবাইকে খাইয়ে সার্ভিস বয় মিঠুন সবার অনুরোধে নদী আর বনবিবিকে নিয়ে লোকসঙ্গীত গাইল। ওর অকৃত্রিম মেঠো সুর সবাই খুব উপভোগ করল।

পাখিরালয়ে পাখিরা হোটেলে সবার থাকার ব্যবস্থা। ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে নেমে গেল। পলিতে জল পড়ে জায়গায় জায়গায় পিচ্ছিল, ওরকম একটা রাস্তা পেরিয়ে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে ঝাঁ চকচকে একটা হোটেলে পৌঁছোনো গেল। সবার ছোটো দিব্য আর ঝিলমিল তো ঘুমিয়ে কাদা। হোটেল ম্যানেজারের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সবার মন ভরে গেল। তবে রান্নার দাযিত্ব সেই কমলা আর ওর স্বামী ফটিকের।

সন্ধেবেলায় সুন্দর সময় কাটানোর জন্য বসল বাউল-গানের আসর। চরম দারিদ্র‌্যের মধ্যে থেকেও গানের কলিতে ওরা আপ্রাণ ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে গেল। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর পূর্ণিমার আলোয় সে বাউল-গান, মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় সুরধ্বনি।

ছোট্ট দিব্য বেশ চাঙ্গা হয়ে বাউলদের নাচের দলে ভিড়ে গেল। দিব্যর বাবা ছেলের নাচের ভিডিও তুলছেন। কমলাও এসে দাঁড়িয়েছে, ওর কোলে তার আট মাসের সন্তান নয়ন। রুজির তাগিদে ওদের সপরিবারে জলে ভেসে থাকা।

রাতে কাঁকড়ার ঝোল মেখে ভাত খেতে খেতে রাহুল মস্করা করল, বুঝলে সবাই আমরা সর্বোচ্চ সারির খাদক তথা সর্বভুক। ডাল আলুভাজাও খেলাম, আবার কাঁকড়াও খাচ্ছি। সকলে এ বিষয়ে ওর সঙ্গে সহমত হল।

দিব্য আর ঝিলমিলকে তাদের মাযেরা ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে। বাইরে দরজার কাছে একটা নেড়ি আর তার বাচ্চা লেজ নেড়ে নেড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। দিব্যর বাবা কিছুটা মাখা ভাত নিয়ে নেড়িকে খাওয়াতে গেলে, দিব্য আর ঝিলমিলও খাওয়া ফেলে ছুটল। সব বাচ্চার মতো দিব্য আর ঝিলমিলও পশুপাখি ভালোবাসে।

নেড়ি ভাত খাচ্ছে, ঝিলমিলরা নেড়ির বাচ্চাকে আদর করছে। খাওয়া শেষ হতে যে যার রুমে ফিরল। শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কমলা, ফটিক, মিঠুন আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে আগুন পোহাচ্ছে। দিব্য আর ঝিলমিলের সে দৃশ্য দেখারও ইচ্ছে ছিল, মায়ের বকুনি খেয়ে ফিরতে হল।

পরদিন সকালে কুয়াশা কেটে গেলে ওদের গন্তব্য হবে সুধন্যখালি, যেখানে সাতটা নদী এসে মিশেছে। শরীরের ক্লান্তি আর পরদিন ভোর ভোর ওঠার তাড়ায় সবাই ঘুমোতে গেল।

ঝিলমিল মায়ের কোল ঘেঁষে বালিহাঁসের ডাকে চমকে চমকে উঠছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর বাবা পরেশ সেনের নাক ডাকা। মায়ের আদরের থাবড়ানিতে ঝিলমিল ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঝিলমিল জলের স্বপ্ন দেখল, সে যেন একা একটা নৌকায় কোথায় ভেসে যাচ্ছে।

 

পরদিন কুয়াশা না কাটতে মিঠুন এসে জানিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করতে হবে না, লঞ্চ সকাল দশটার আগে ছাড়বে না। অতএব সবাই বেরোল স্থানীয় বাজারে মধু কিনতে আর খেজুরের রস খেতে। সুন্দরী, বাইন আর গর্জনের ছোটো ছোটো চারাও পাওয়া যাচ্ছিল। দিব্যর খুব ইচ্ছে ওই চারাগুলো দিয়ে ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে একটা জঙ্গল বানায়। অনেক করে বোঝানোর পর একটা খেলনা বাঘ হস্তগত করে ওর বায়না থামল।

সুন্দরবনে মধুরই মাহাত্ম্য, তারল্য বেশি খাঁটি মধু। আর একে সংগ্রহ করতে গিয়ে ওদের পরিবারে কতই না বিষাদের ইতিহাস। কখনও সাপের কামড়ে, কখনও কুমীরের কবলে কখনও বা বাঘের পেটে চলে যাওয়া। অনায়াসে সবকিছু পাওয়ার জীবন ওদের নয়, বড়ো কষ্টের ওদের যাপন।

পরেশ সেনদের গোটা দলটাই ফেরিঘাটে লঞ্চে উঠল। সকালের জলখাবারে ছাতুর কচুরি আর কাবলি চানার ঘুগনি। ডেকের ওপর নদীর শোভা, লঞ্চ-জাহাজের যাতায়াত দেখতে দেখতে খাওয়া এক অনন্য অনুভূতি। দিব্য একটা কচুরি নিয়ে হাঁ করে বসে রইল। ঝিলমিলকে আজ বেশ চনমনে লাগছে, রাহুল যথারীতি প্রাজ্ঞ, অনুসন্ধিৎসু।

প্রায় দু-ঘন্টা নদীবক্ষে ভেসে থাকার পর এল দোবাঁকি। প্রত্যেকেরই আশা যদি হঠাৎ করে দক্ষিণরায়কে দেখা যায়। কারণ এখানে হোগলা আর হেতালের মাঝে একটা বড়ো পানীয় জলের জলাশয় আছে। আহা কি অপূর্ব, সেই জলাশয় ঘিরে চিতল হরিণ আর বালি হাঁস বিচরণ করছে। দিব্য হাততালি দিয়ে খুশিতে বলে উঠল, কত হরিণ, একটা বাড়ি নিয়ে যাব, পুষব!

দলের প্রধান খাদ্যরসিক মন্ডলদা বলে উঠলেন, হরিণের মাংস দারুণ স্বাদের, একসময় কত খেয়েছি। দিব্য আর ঝিলমিলের একটুও পছন্দ হল না মন্ডলকাকুর কথা। প্রাণভরে ছবি তুললেন ঝিলমিলের বাবা। অনেকগুলো লঞ্চ একসঙ্গে আসায় বেশ ভিড় জমে গেছে। শান্ত প্রকৃতি এই কোলাহলে বিরূপ হচ্ছে, তবুও সইতে হচ্ছে। একটা জিনিস ভালো লাগার মতো যে, কেউ এদিক ওদিক ময়লা ফেলছে না।

ঝিলমিল একবার জঙ্গল, একবার হরিণের দল আর নদীর দিগন্ত জোড়া বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে সবাই লঞ্চে ফিরে এল। এবারের গন্তব্য ঝড়খালি।

লঞ্চে পাঁঠার মাংস, ভাতের বিপুল আযোজন কমলার কল্যাণে। অসম্ভব সুন্দর স্বাদে সবাই পরিতৃপ্ত। দিব্য আর ঝিলমিল তাদের পছন্দের মাংসের মেটে পেয়ে গেছে, ওদের আর পায় কে!

ঝড়খালিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে বুড়ো অসুস্থ বাঘ দেখে ঝিলমিলের মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে গডের কাছে ওদের জন্য অনেক প্রে করল। কুমীর দেখে সবাই খুব খুশি হল, কারণ ওদের বেশ চনমনে লাগছিল। পাখিরালয়ে ওদের হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে গেল।

প্রতিদিনের মতো আজ ঝুমুর নাচের ব্যবস্থা। কী সুন্দর স্থানীয় মহিলারা নাচল সেই শ্রমসাধ্য নাচ! কাহিল হয়েও মুখের হাসিটুকু ধরে রাখল। দিব্য, ঝিলমিল, রাহুল, এমনকী দিব্য আর রাহুলের মা-ও নাচে অংশ নিল ওদের ডাকে। খুশি হয়ে যে যা দিল তাই নিয়ে ওরা হাসিমুখে চলে গেল।

ওরা বাড়ি ফিরবে কেউ পায়ে হেঁটে কেউ বা সাইকেলে। ঝিলমিল কমলার বাচ্চাকে কোলে তুলতে চেষ্টা করছে আর সে মায়ের কাছে থাকবে বলে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে। কমলার হাতের পারশের ঝাল খেয়ে হাত চাটতে চাটতে সব পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। সবার এই পরিতৃপ্তিটুকু কমলা উপভোগ করছে।

পরদিন সকাল নটা নাগাদ সবাই হোটেল ছাড়ল। ফিরতে হবে, তাই সবার মন খারাপ! ডেকের ওপর যে-যার মতো গল্প করছে। দূরে বকের সারি, জলের স্রোত, আকাশের ছড়ানো রোদ সবাই যেন বিদায় জানাচ্ছে। বাতাস কানে কানে বলে যাচ্ছে আবার এসো কিন্তু। বকশিশের টাকা হাতে করে কমলার চোখেও জল। দিব্য, ঝিলমিল মিঠুনের দুপাশে জমিয়ে বসে জল-জঙ্গল, রয্যাল বেঙ্গল টাইগার আর বনবিবির গল্প শুনছে।

গদখালি পৌঁছোতে প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে তাই লাঞ্চের ব্যবস্থা লঞ্চেই। কমলা ওর কচিটাকে নিয়ে ব্যস্ত রান্নায়। লঞ্চ চালাচ্ছে যে-ছেলেটা ওর চোখেমুখেও বাড়ি ফেরার ছটফটানি। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, জোয়ারের টানও ভালো আছে তাই লঞ্চ তরতরিয়ে চলেছে।

 

হঠাৎ একটা ঝুপ শব্দ। আরে ঝিলমিল পড়ে গেল যে জলে, সবার মিলিত আর্তনাদের মাঝে ‘মা মা গো আমি ডুবে যাচ্ছি’।

কমলা সেই ডাক শুনে এসে কোলের ছেলেটাকে নামিয়ে রেখে ঝাঁপ দিল জলে। সবাই আতঙ্কিত, কমলা জল তোলপাড় করে ফেলছে, হ্যাঁ হাতে একটা কিছু ঠেকল ওর, আরে এ তো ঝিলমিলের চুল। তাই ধরেই টেনে তুলল কমলা, নিজের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। হ্যাঁ কমলা পেরেছে ঝিলমিলকে জলে ডুবে যাওয়ার থেকে বাঁচাতে।

ডেকের ওপর ওঠানোর পর মিঠুন ঝিলমিলের গিলে ফেলা জল ওকে শুইয়ে চাপড় মেরে মেরে বার করল। একটু সুস্থ হতে ঝিলমিলকে গরম দুধ খাওয়ানো হল কিন্তু আতঙ্কে ও পুরোপুরি ট্রমাটাইজড। ঝিলমিলের মা এখনও কেঁদে চলেছে। ফেরার অভিজ্ঞতা সকলের জন্য ভীষণ খারাপ হল।

কমলা সকলের খাওয়ার বন্দোবস্ত করল, ও যে এত বড়ো একটা কাজ করল তা ওর মুখ দেখে এখন বোঝবার উপায় নেই। খাওয়াদাওয়া মিটলে ঝিলমিলের বাবা কমলাকে কিছু টাকা দিতে চাইলেন। কমলা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার ছেলে যদি জলে পড়ে যেত, আমি কি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না! সেরকমই তো, মাফ করবেন আমায়। এ টাকা আমি নিতে পারব না। কমলার ওপর কৃতজ্ঞতায় সবার অন্তর ভরে ওঠে।

তুমি আমার যে-উপকার করলে, তা সাত জন্মেও শোধ করতে পারব না, বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে ঝিলমিলের মা। কমলা শান্ত ভাবে বলে, এতে উপকারের কিছু নেই। আপনারা আবার এখানে বেড়াতে আসবেন আর আশীর্বাদ করুন আমার নয়নকে যেন ঠিকমতো মানুষ করতে পারি।

ঝিলমিল ওর কানে এখনও জলের গর্জন শুনছে আর কমলামাসিকে মিঠুনদার গল্পের বনবিবির মতো লাগছে, যে তাকে উদ্ধার করছে।

 

সুন্দরবনের ঘটনার পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরেশবাবু সপরিবারে অনেকবার এসেছেন সুন্দরবনে। মালঞ্চ লঞ্চটা খুঁজে পেলেও কমলাকে আর খুঁজে পাননি তাঁরা। বিশেষ করে মায়ের কাছে ওই দুর্ঘটনার বিবরণ বারবার শুনতে শুনতে কমলাকে দেবীর আসনে বসিয়ে রেখেছে ঝিলমিল। যার জন্য সে পঁচিশটা বসন্ত পার করতে পেরেছে, না হলে তো দুর্গাদোয়ানি নদীতে কবেই ওর সলিলসমাধি ঘটে যেত।

কমলামাসির মুখটা ঝিলমিলের হালকা মনে পড়ে, তার চেয়ে বেশি মনে পড়ে জলের মধ্যের সেই দমবন্ধ পরিবেশ, যা অনেক দিন ওকে তাড়া করেছিল।

ঝিলমিল এখন ডাক্তারির চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী। কত জলে ডোবা রোগী আসে। কাউকে বা আনা হয় মৃত অবস্থায়। তখন ঝিলমিল আঁতকে ওঠে! মনে মনে ভাবে তারও তো এই অবস্থা হতে পারত, হয়নি যে তা ঈশ্বরের নয় কমলামাসির দান।

ঝিলমিল ভাবে, এবারে যে করেই হোক কমলামাসিকে খুঁজে বের করতেই হবে। নিশ্চয়ই এখন বয়স হয়ে গেছে, একবার দেখা করতেই হবে। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, ঝিলমিলদি একবার আসুন ডাক্তার কনক বসু আপনাকে তাড়াতাড়ি ডাকছেন। বলেই সিস্টার বোস ছুট লাগালেন।

ঝিলমিল ডাক্তার কনক বসুকে খুঁজতে খুঁজতে এমার্জেন্সিতে হাজির হল। আরে এখানটা এত লোকে লোকারণ্য কেন? মানিকতলায় একটা মেলা চলছে, সেখানে গ্যাস বার্স্ট করে কয়েজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে তাদেরকে আনা হয়েছে ঝিলমিলের হাসপাতালে।

সেই ভিড় থেকে একজন বয়স্ক মানুষ ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে এল। তুমি ঝিলমিল দিদিমণি না, আমাকে চিনতে পারছ? আমি কমলার স্বামী ফটিক, সেই তুমি সুন্দরবন বেড়াতে এসে জলে ডুবে যাচ্ছিলে মনে আছে?

কমলামাসি কোথায়? ঝিলমিলের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল কথাটা। ফটিক ইশারায় মেঝের বিছানায় শুয়ে থাকা অর্ধদগ্ধ এক মহিলাকে দেখাল।

অগ্নিকাণ্ডে কমলা মারাত্মক জখম হয়েছে তাদের মেলায় দেওয়া চপের দোকানে। ঝিলমিল আর অপেক্ষা করেনি, চেষ্টা করে কেবিনে ভেন্টিলেশনে রেখে চিকিৎসা করছে কমলামাসির। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে ঝিলমিল, নয়নের মাকে যেন নয়নের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। যেমন করে একদিন কমলামাসি ফিরিয়ে দিয়েছিল ঝিলমিলকে তার মায়ের কোলে।

 

শিকার

শেষ রাতের আবছা অন্ধকার। লোকটা এক বুক ঘৃণা আর আদিম এক প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বন্দুকটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে। আজ সে দৃঢ়সংকল্প। খতম করবে ওই নোংরা লোভী আর তস্কর জীবটাকে! তার হাত থেকে নিস্তার নেই বাছাধনের।

দিন দিন ওর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। পোলট্রির অর্ধেক মুরগির বাচ্চা খেয়ে সাবাড় করেছে এই ক’দিনে। এভাবে চললে পোলট্রির সব মুরগি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। আর তার এতদিনের লাভবান ব্যাবসা বন্ধ হয়ে, সে দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যাবে। তাই আজ একটা শেষ নিষ্পত্তি সে করবেই!

ভোর হবার এখনও অনেক দেরি। অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে লোকটার স্নায়ুগুলো কিঞ্চিৎ শ্লথ। আর কিছুক্ষণ পরেই পুবদিকের আকাশ হালকা হবে। আর হালকা হলেই সে বেরুবে রোজকার মতো।

মুরগির বাচ্চাগুলো কারা যে খেয়ে যাচ্ছে তা প্রথমে বুঝতে পারেনি লোকটা। বহু ঘুমহীন রাত অপেক্ষা করে ওত পেতে শেষে সে বুঝতে পারে শিয়াল না, খটাশ না একটা কালো হুতুম পেঁচাই ঘাতক। তার সমস্ত মুরগির বাচ্চা খেয়ে যাচ্ছে।

আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর লোকটা জেনেছে পোলট্রির পেছনে কিছুটা দূরে যে বুড়ো খিরিশ গাছটা আছে তার একটা উঁচু মোটা ডালের কোটরে সে থাকে। ওরা দুজন। একটা ছেলে অন্যটা মেয়ে পেঁচা।

এতক্ষণে পুবদিকের আকাশ ফিকে হতে শুরু করেছে। একটা লালের আভা। এবার পেঁচাটার বেরুবার সময়। আবছা অস্পষ্টতার বুক চিরে একটা বিশ্রি কর্কশ ডাক ভেসে এল। শয়তান পেঁচাটার ডাক। লোকটা সতর্ক হয়। হাতের মুঠোর বন্দুকটা শক্ত হাতে চেপে ধরে। এবার সে ওই ধূর্ত লোভী শঠ পেঁচাটাকে নির্দয়ভাবে মারবে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে, তার সীমাহীন অপরাধ আর কৃতকর্মের জন্য।

পেঁচাটা তার কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে পাখনাটা মেলে সে উড়ে আসছে, পোলট্রি ঘরের চালার মাথায়। যতটা শব্দ কম করা যায় সেইভাবে নিঃশব্দে উড়ে আসছে। এই আবছা অন্ধকারে উড়ন্ত টার্গেটকে গুলি করা মুশকিল। তবুও লোকটা আজ বদ্ধপরিকর। ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে কালো ছায়াটা যখন উড়ে যাচ্ছে, তখনই বন্দুকের ট্রিগারটা সে টিপে দিল অনেকটা আন্দাজে। নিশানা ব্যর্থ হয়েছে মনে হয়। কারণ মাটিতে আছড়ে পড়ার কোনও শব্দ বা ডানার ঝাপটানি তার কানে যায়নি।

পুব আকাশ আরও অনেকটা ফর্সা হয়েছে। লোকটা পায়ে পায়ে পোলট্রি ফার্মের দিকে এগোল। মুরগির বাচ্চাগুলো ঠিক আছে কিনা একবার গুনে এল। চারপাশটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিছু পড়ে আছে কিনা। আর ঠিক সেই সময় কাছে কোথাও ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে এল। প্রাণীটা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। লোকটার মন আনন্দে ভরে গেল। যাক তাহলে নিশানা ব্যর্থ হয়নি। শিকার গুলি খেয়েছে। অব্যক্ত বর্বর এক জিঘাংসায় তার মন ভরে গেল।

কাছে গিয়ে লোকটা দেখল, পেঁচাটা বেশ বড়ো সাইজের। মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। বৃথা চেষ্টা করছে ওড়বার। ওর ধূসর রঙের ডানা দুটোর একটাতে গুলি লেগেছে। সে ডানাটা অকেজো হয়ে দেহ থেকে ঝুলছে। সারা ডানাটা মাটি আর রক্তে মাখামাখি। ওর বিশ্রি গোল মুখের হলদেটে চোখদুটোতে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। লোকটা দেখল, সে চোখে হিংস্র একটা বিদ্বেষ আর ক্রোধ জমা হয়েছে।

এখন আর আলো আঁধারির অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার ভোর। আর সেই ফুটে ওঠা ভোরের আলোয় পেঁচার সঙ্গে মানুষের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হল। দুজনের চোখে বিজাতীয় হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর জিঘাংসা কাজ করছে। কিন্তু লোকটার চোখে অতিরিক্ত কিছু একটা ছিল। তা হল শত্রু নির্যাতনের উৎকট আনন্দ আর পরিতৃপ্তি!

আহত প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে অপরিসীম ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লোকটা বলে উঠল, ‘কিরে কেমন জব্দ! কেমন লাগল গুলি খেতে? আর একটা গুলি খাবি?’

পেঁচাটা তার ভালো ডানাটা ঝাপটে মাটি থেকে একটু ওঠার চেষ্টা করল। কিছুটা উঠেই আবার পড়ে গেল মাটিতে। পেঁচাটার এই ব্যর্থতা ও হতাশা দেখে লোকটা জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে।

এবার গলা বাড়িয়ে রাগে পেঁচাটা তেড়ে আসে লোকটার দিকে। তার পায়ের জুতোয় ঠোঁট দিয়ে জোরে ঠোক্বর মারে। লোকটা লাথি মেরে পেঁচাটাকে দূরে ফেলে দেয়। অসহায় ভাবে মড়ার মতো কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে পেঁচাটা।

লোকটা একবার বন্দুক দেখায়। পেঁচাটার চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। বন্দুকের নলটা তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খোঁচা দেয়। পেঁচাটার হলদে চোখদুটোতে শুধু জ্বালা। অসহায় আক্রোশ! কিন্তু ভয় কোথাও নেই।

প্রচণ্ড রেগে গেল এবার লোকটা। তার অহংকারে ঘা লাগল। সে মনে মনে স্থির করে ফেলল, এটাকে সে এখনই মারবে না। একে বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে যন্ত্রণা দেবে। যেমন কষ্ট সে পেয়েছে এত দিন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা নিয়ে। তেমনি করে একে দগ্ধে দগ্ধে যন্ত্রণা দিয়ে এর পাপের শাস্তি দেবে। এর ঔদ্ধত্য আর দম্ভকে চিরতরে ভেঙে দেবে!

জখম ডানাটা এড়িয়ে অন্য ডানাটা ধরে সে পেঁচাটাকে তুলতে গেল। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড আক্রোশে পাখিটা তার তীক্ষ্ণ নখ লোকটার হাতে বসিয়ে দিল। চামড়া ভেদ করে সুচলো নখ মাংসের অনেক গভীরে ঢুকে গেল। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। যতই সে চেষ্টা করে পেঁচাটাকে ফেলে দিতে, বিচ্ছিন্ন করতে তার শরীর থেকে, ততই তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। আঁচড়াতে কামড়াতে থাকে। লোকটার হাত থেকে রক্ত ঝরে। পেঁচাটার পালকে রক্ত। লোকটা এবার চেঁচাতে থাকে। শাপশাপান্ত করে। তার একবার মনে হয় গিয়ে দেয়ালের গায়ে জোরে আছাড় মারে জীবটাকে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। একে সে সহজে মারবে না। বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেবে। তারপর পরিশেষে চরম শাস্তিদান।

এবার সে দুটো হাত দিয়ে পেঁচাটাকে চেপে ধরে শক্ত করে। তারপর তার মুখে একদলা থুতু ছেটাল। পাখিটা বার দুই চোখ পিট পিট করল। কিন্তু ভয় পেল না একটুকুও। লোকটা রাগে কাঁপতে কাঁপতে তার ফার্ম হাউসের বারান্দায় এক কোণে ঝোলানো একটা বড়ো লোহার খাঁচায় পেঁচাটাকে ঢুকিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিল।

পেঁচাটাকে খাঁচাবন্দি করার পর লোকটা কিছুটা শান্ত হল। বন্দুকটা যথাস্থানে রেখে এল। তারপর জল দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফার্স্ট-এড বক্স বের করে আনল। প্রথমে সে রক্তাক্ত পাখিটার ডানা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিল। তারপর নিজের হাতেও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগাল। ব্যান্ডেজ বাঁধল।

সেদিন বিকেলে কাছের শহর থেকে কয়েকজন খদ্দের মুরগি কিনতে এল তার পোলট্রি ফার্মে। খাঁচার মধ্যে পেল্লাই ওই পেঁচাটাকে দেখে তো তারা তাজ্জব। জিজ্ঞেস করল, ‘এটাকে ধরলে কী ভাবে?’

লোকটা তার খদ্দেরদের কাছে পেঁচাটার যাবতীয় কীর্তিকলাপ খোলসা করে বলল। ব্যান্ডেজবাঁধা হাতটাও দেখাল। সব শুনে খদ্দেরদের মধ্যে একজন বলল, ‘এখন এটাকে নিয়ে কী করতে চাও?’

জবাবে লোকটা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘আমার হাতটা আগে ভালো হয়ে যাক। তারপর এটাকে গুলি করে মারব। পায়ের নখগুলো কেটে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখব স্মৃতি হিসেবে।’

পোলট্রি মালিকের মুখে এধরনের কথা শুনে খরিদ্দার লোকটির মনে দৃঢ় ধারণা হল, মুরগির বাচ্চার শোকে ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই। সে আর কথা না-বাড়িয়ে চলে গেল।

টুকিটাকি কিছু কাজ শেষ করে লোকটি আবার পেঁচাটার খাঁচার কাছে এল। খাঁচাটার দিকে তাকাতে তার গা রিরি করে উঠল রাগে। দেখল, পেঁচাটা তার দিকে স্থির ভাবে চেয়ে আছে। পায়ের নখ দিয়ে খাঁচার গা আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটা রেগে গিয়ে খাঁচাটা নামিয়ে নীচে বসাল। তারপর জোরে লাথি কষাল। পেঁচাটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তার চোখে অতলান্ত ঘৃণা।

সেদিন সারারাত লোকটা শুনতে পেল পেঁচাটা তার সাথিটাকে ডাকছে। ওপাশে গাছের আড়াল থেকে সাড়াও আসছে। লোকটার মনে খুব আনন্দ হল পেঁচাটাকে জ্যান্ত ধরতে পেরেছে বলে।

পরদিন সকালে উঠে লোকটা খাঁচার কাছে গেল। আজও সে পেঁচাটার চোখে কোনও ভয় দেখল না। আর সে জন্য সে হতাশ হল। হতাশা তাকে এক সময় ক্ষিপ্ত করে তুলল। সে চিৎকার জুড়ে দিল। ‘দাঁড়া, দাঁড়া। সবুর কর। আমি তোকে ভয় পাইয়েই ছাড়ব।’

লোকটা খাঁচাটা মাটিতে নামাল। খাঁচার বাইরে জল রাখল। খাবার হিসেবে একটা ছোট্ট মুরগির বাচ্চা। খাঁচার খুব কাছে কিন্তু পাখিটার নাগালের বাইরে। পেঁচাটা নির্বিকার চোখে সব দেখল। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় সে কাতর। তবু লোকটার চালাকি সে ধরে ফেলেছে। ভয় বা কাতরতা তাকে গ্রাস করল না। সে একটা বড়ো তাচ্ছিল্য খাঁচার বাইরের লোকটার দিকে ছুড়ে দিল।

এরপর আবার একদিন মুরগি কিনতে এক খদ্দের এল। ইনি বেশ সম্ভ্রান্ত। মনে হয় অপেক্ষাকৃত বড়ো ব্যবসায়ী। লোকমুখে পেঁচাটার কথা শুনে তিনি লোকটার কাছে প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনি পেঁচাটা আমাকে পাঁচশো টাকায় বেচে দিন। এতবড়ো সাইজের পেঁচা সাধারণত পাওয়া যায় না। রেয়ার। তাছাড়া আমার এজাতীয় রেয়ার পাখিদের একটা কালেকশন আছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবব, যদি ওটা আমাকে বেচেন।’

লোকটা ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘না মশাই। মাফ করবেন। আমি ওকে হাতছাড়া করতে চাই না।’

ক্রেতা ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, বোধহয় দাম পছন্দ হয়নি। তাই সে রাজি হচ্ছে না বেচতে।

‘আচ্ছা বেশ, আমি আপনাকে সাতশো টাকা দেব। তাহলে দেবেন তো?’

এতেও লোকটা রাজি হল না। ‘না, মাফ করবেন। আমি ওকে বেচব না।’

‘কিন্তু কেন? আমি যদি হাজার দিই?’

‘তাহলেও না। হাজার কেন, পাঁচ হাজার দিলেও না। ওটার জন্য আমার হাতের অবস্থা দেখেছেন? টিটেনাস ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। আমার ফার্মের অর্ধেক মুরগির বাচ্চা ও খেয়ে ফেলেছে।’

‘বেশ তো, বুঝেছি। ও আপনার অনেক ক্ষতি করেছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ও তো অবুঝ পাখি একটা। ও খিদের জ্বালায় আপনার ফার্মে ঢুকে মুরগির বাচ্চা খেয়েছে। অন্যায় তো কিছু করেনি। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। তাছাড়া অমন সুন্দর দেখতে’ –

লোকটার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। – ওই শয়তান পাখিটাকে আপনি বলছেন সুন্দর দেখতে! কি বিশ্রি চোখ ওর। ওকে আমি গুলি করে মারব।

‘তা হোক। রাগের মাথায় বোধবুদ্ধি হারিয়েছেন। একটা পাখিকে কেন অযথা গুলি করে মারবেন?’

‘মারব, মারব, নিশ্চয়ই মারব। ও আমার বড়ো শত্রু। নিজের হাতে ওকে শাস্তি দেব। আপনি এখন যান’-

বেচারা ভদ্রলোক বেগতিক দেখে কেটে পড়ে।

লোকটা এবার দিন গোনে। কবে ওকে খতম করবে। খতম করার আগে ওর মনোবল ভাঙতে হবে। ও আজকাল কিছুই খায় না। খাবারের দিকে তাকায় না। অথচ একদৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। যখন সে খাঁচার কাছে আসে পেঁচাটা একটা বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি ছোড়ে।

লোকটার মাথায় এক নতুন মতলব আসে। সেও আরও হিংস্র আরও ভয়ংকর প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরুষ পেঁচার মেয়ে সঙ্গীটি আজকাল প্রায়শই খাঁচার আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। কখনও দূরে পাঁচিলটার উপর এসে বসে। খুব সকালে কিংবা সন্ধের দিকে প্রায়ই ডাকে। কিন্তু পুরুষটি তেমন ভাবে সাড়া দেয় না। ভাবটা যেন একদম এদিকে আসিস না। লোকটা ভয়ানক বজ্জাত! হাড় শয়তান!

আজকাল লোকটা সব সময় নিজের হাতের কাছে বন্দুকটা রাখে। সাবধানে থাকে। ওত পাতে। সুযোগ এলে যেন ফসকে না যায়। প্রথমে সে মাদি পেঁচাটাকে শেষ করে পুরুষটির সামনে ফেলবে। দেখতে চায় ওর যন্ত্রণা হয় কি না! কষ্ট হয় কি না! তারপর তো ওর পালা!

সুযোগও এসে গেল অচিরেই। তিন-চার দিন পর। মেয়ে পেঁচাটা ক্ষুধা উদ্বেগ বা কৌতূহলে পুরুষ সঙ্গীটিকে খুঁজতে খুজতে খাঁচার কাছাকাছি চলে এসেছিল। তাকে দেখে পুরুষ সঙ্গীটি ঝটপট করছিল। তাকে কেমন উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মেয়ে সঙ্গীটির নিরাপত্তার কথাই কি সে ভাবছিল! লোকটাকে বিশ্বাস নেই। মেয়ে পেঁচাটা বার দুই ডেকে পাঁচিলের ওপর গিয়ে বসল। লোকটার কানে গেল সেই ডাক। ভোর হয় হয়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে বিছানায়। মুহূর্তে বন্দুকটা হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। ‘দাঁড়া, দিচ্ছি তোকে সাবড়ে!’ লোকটার ঠোঁটে ব্যঙ্গ। খাঁচায় বন্দি পেঁচাটা বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছে। সে এবার ডাক বন্ধ করে দেয়। প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। যাতে মেয়ে পেঁচাটা সাড়া না পেয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

কিন্তু লোকটা আর বিলম্ব চায় না। পাঁচিলের ওপর বসা মেয়ে পেঁচাটা তার নজরে এসেছে। অন্যদিন উড়ে যায়। আজ কিন্তু সে উড়ছে না। বৃথা কালক্ষেপ না করে লোকটা তাক করে মেয়ে পেঁচাটার দিকে। তার দোনলা বন্দুকের দুটো নলই সে ব্যবহার করে। একটা শব্দ, কিছু ধোঁয়া। মুহূর্তে মেয়ে পেঁচাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এবার আর আধমরা নয়। অব্যর্থ অমোঘ মৃত্যু।

লোকটার হাতে বারুদের গন্ধ। চোখে অদ্ভুত খুশি নিয়ে সে মেয়ে পেঁচাটার মৃতদেহ এনে পুরুষ পেঁচাটার খাঁচার সামনে ফেলে।

‘কিরে? দেখলি? দ্যাখ্ কেমন লাগে?’ লোকটার চোখ-দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে প্রতিশোধের আগুন।

খাঁচার বন্দি পাখিটা তার মৃত সঙ্গিনীটির দিকে একবার তাকায়। তারপর লোকটাকে দেখে। ওর হলদে চোখদুটোতে কোনও পরিবর্তন নেই। সেই সীমাহীন ঘৃণা আর অঢেল বিতৃষ্ণা! ওর ওই বুনো চোখদুটোতে লোকটা ভয় আনতে চেয়েছিল। ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে সর্বহারার হাহাকার বাজুক সেটাই চেয়েছিল লোকটা। কিন্তু না। তা হয়নি। কিন্তু লোকটা নিজেকে এবার পরাজিত ভাবল। সে ভেবেছিল খাওয়া বন্ধ করে, অত্যাচার চালিয়ে সঙ্গিনীকে নিধন করলে ওর মনোবল ভেঙে যাবে। ওকে ধবস্ত বিবর্ণ দেখাবে। তা না হওয়ায় লোকটা নিজের মনে পরাজয়ের একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল। এক সামান্য নিশাচর তস্কর পেঁচার কাছে সে হেরে গেল! লোকটা সদর্পে ঘরের মধ্যে ঢুকে তার দোনলা বন্দুকে আবার দুটো টোটা ভরে নেয়। বাইরে বেরিয়ে এসে সে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘শয়তান এবার তোকে শেষ করব!’

খাঁচার তারের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে বন্দুকের নলটা ঢুকিয়ে দিতে পেঁচাটা সরোষে এসে নলটাকে আক্রমণ করল। কিন্তু লোহার নলের কোনও ক্ষতি সে করতে পারল না। হতাশ হয়ে খাঁচার অন্যপাশে সরে গেল।

লোকটা বন্দুকের নলটা খানিকটা পেছন দিকে সরিয়ে আনল। যাতে পেঁচা থেকে বন্দুকের দূরত্ব যেন কয়েক ফুট থাকে। শেষবারের মতো সে ওই কুৎসিত বদমায়েশ লোভী বেয়াড়া পেঁচাটার চোখে কোনও অন্তিম ভয় আছে কিনা দেখল। না, কিছু নেই। শুধুই ঘৃণা। লোকটার সমস্ত বোধবুদ্ধি দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ক্রোধান্ধ হয়ে সে ট্রিগার টেপার পরিবর্তে সেটাতে একটা জোরে ধাক্বা দিয়ে বসল। গুলি রিবাউন্ড বা রি-কয়েল করা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। জিঘাংসাপ্রিয় রাগান্ধ লোকটির বিবেচনাতে সে কথা আসেনি। আর তাতেই ঘটল বিপদ।

প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি কী ব্যাপার হল। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটা অনুভব করল কি যেন একটা অকস্মাৎ ভয়ংকর তীক্ষ্ণ ও তীব্র আঘাত করল তার বুকে। সে আঘাতের তীব্রতা এতটাই ছিল যে লোকটা টলে পড়ে গেল। তার হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল দূরে। সে বুকে হাত দিয়ে দেখল তার হাত রক্তে ভিজে উঠছে। বুকে প্রচণ্ড আঘাত আর যন্ত্রণা অনুভব করল। নিশ্বাস আটকে আসছে। গলা দিয়ে গরম তরল লাল বর্ণের পদার্থ উঠে আসছে। চোখের সামনের পৃথিবীটা একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে।

অন্তিম অন্ধকার নেমে আসার আগে, সম্পূর্ণ চেতনাহীন হবার আগে লোকটা বুঝতে পারছিল ভয়ংকর দুর্ঘটনাটা কী ঘটেছে। খাঁচার ঠিক পেছনে যে সরু লোহার পাত ছিল, তাতে গুলিটা লেগে ঠিকরে এসে উলটো দিকে দাঁড়ানো তারই বুকে ঢুকেছে। শিকারি নিজেই শিকার হয়ে গেছে!

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! হঠকারিতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে পেঁচাটা শুধু বেঁচে যায়নি, গুলির আঘাতে লোহার খাঁচাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বন্দি পাখি এখন মুক্ত। পেঁচার জখম ডানাটা এই কদিনে অনেকটা ভালো হয়েছে। ভাঙা খাঁচা থেকে গুটি গুটি পায়ে সে বেরিয়ে এল। পিট পিট করে চোখ মেলে মরনোন্মুখ মানুষটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন আর তার চোখে কোনও ঘৃণা নেই। বিদ্বেষ নেই। অভিযোগের লেশমাত্র নেই। যা কিছু বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জিঘাংসা বা মানসিক বিকার সবই ওই লোকটার মধ্যেই ছিল।

 

একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।

 

অগ্নিশুদ্ধি

জাতীয় স্তরে খুব বড়ো করেই এবার প্রতিযোগিতার আসর বসানো হয়েছে। গল্পের প্রতিযোগিতা। দেশের প্রায় সব রাজ্য থেকেই ছোটো-বড়ো বহু গল্প জমা পড়েছিল। তারই মধ্যে পঁচিশজন লেখককে সনাক্ত করা হয়েছে যাদের লেখা পুরস্কার পেতে চলেছে। বিশাল আয়োজন। স্টেজের উপর বেশ কিছু লেখক চেয়ারে বসে রয়েছেন। লেখকদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রঞ্জন কর্মকার। গল্পটি একটি বাচ্চাকে নিয়ে।

অনাথ একটি বাচ্চা জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে কীভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবে তাই নিয়ে গল্প। গল্পগুলি যারা সিলেক্ট করেছেন সেই বিচারকদের মধ্যেই মাধবীও একজন। তিন বছর আগে এই সংস্থাই মাধবী-কেও বেস্ট রাইটার-এর খেতাবে সম্মানিত করেছিল। মাধবী প্রথম যখন গল্পটি পড়ে, খুবই প্রভাবিত হয় কিন্তু লেখকের নাম দেখে তার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে। রঞ্জন কর্মকার… এ সে-ই লোক নয়তো! মনের মধ্যে ঝড় ওঠে মাধবীর।

স্টেজে উপস্থিত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে মাধবী জিজ্ঞেস করে, অরুণদা এই রঞ্জন কর্মকারকে আপনি চেনেন? তার কোনও ছবি দেখাতে পারবেন?

মাধবী, তুমি তো জানো প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাবার নিয়ম নেই। নয়তো সংস্থারই বদনাম হয়ে যাবে যে চেনা লোকেদেরই এরা পুরস্কার দেয়।

মাধবী লজ্জিত হল, সরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কী ব্যাপার, বলো তো?

না না, সেরকম কোনও ব্যাপার নয়, জাস্ট কৌতূহল হল বলে জিজ্ঞেস করলাম, কথোপকথন শেষ করতে মাধবী তৎপর হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরতে হবে। আজকে এখানকার সব কাজ বসে শেষ করে ফেলেছে মাধবী।

বাড়ি পৌঁছেও মনের উপর একটা ভার চেপে বসেছে অনুভব করল সে। ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারল না। অদিতি এসে জড়িয়ে ধরল মাধবীকে একটু আদর পাওয়ার আশায়। কিন্তু মাধবীর মন আজ স্মৃতির পাতা উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে বর্তমানের পটভূমিকা ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। শুধু একটা নাম, যা মনের মধ্যে সংগোপনে রাখা আগুনের ফুলকিকে উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মাধবী তো ভুলতে বসেছিল সবকিছু কিন্তু ওই একটা নাম আবার অতীতের ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে দগদগে করে দিতে চাইল। মাথা ভারী মনে হল মাধবীর, লুকোনো একটা ব্যথা বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হচ্ছিল এই তো সেদিনকার কথা, যেটা ভুলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল ও মনে মনে। না চাইতেও পুরোনো স্মৃতির পাতাগুলো একটার পর একটা খুলে যেতে লাগল চোখের সামনে।

 

দেয়াল ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠতেই মাধবী দৌড়ে জানলাটার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। লোকটা এত রাতে কোথায় কে জানে। এখন তো এটাই মাধবীর জীবনে রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত লোকটার অপেক্ষায় ঘড়িতে সময় দেখে কাটানো। অথচ লোকটার এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই।

মাধবী প্রথমে ঘড়ি দেখত, তারপর জানলা খুলে রাস্তা, যদি লোকটাকে দেখতে পায়। আজও রাস্তা ফাঁকা, বহুদূর পর্যন্ত একটা মানুষও ওর চোখে পড়ল না।

প্রায় দেড়টা বাজতে যায়, দরজায় ধাক্কা শুনে উঠে এল মাধবী। দরজা খুলতেই টলোমলো পায়ে লোকটা ভিতরে ঢুকে এল।

আজকে তুমি আবার এক গলা খেয়ে এসেছ? রাগে, দুঃখে মাধবীর চোখে জল চলে এল।

হ্যাঁ খেয়ে এসেছি। তোমার বাবার টাকায় তো খাইনি। অশ্লীল ভাষায় আরও দুটো গালমন্দ করে লোকটা থামল।

কেন এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছ?

নষ্ট করতে! পাগলের মতো হেসে উঠল বাহ্যজ্ঞানশূন্য লোকটা। জীবনটা স্বস্তি দিলই কখন? যবে থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছ, আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছে।

কেন কী এমন করেছি আমি? মাধবী জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কী চাই।

কিন্তু সেটার জন্য আমি কী করতে পারি? ক্লিনিকে গিয়ে তো নিজের চেক-আপ করিয়েছিলাম। মা হওয়ার জন্য আমি সব দিক থেকে সক্ষম। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে দুজনের চেক-আপ…

কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে, তুমি কি মনে করো আমি নপুংসক? সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার?

আমি একথা কখন বললাম? আমি খালি…

নিজেই নিজের ঝোল টানছ? বেয়াদপ মেয়েছেলে, আরও একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে।

তুমি যদি চাও আমি ঠিকমতো ব্যবহার করি তাহলে আমার যা চাহিদা সেটা পূরণ করো। পাঁচবছর আমাদের বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত বাচ্চার কান্না-হাসিতে বাড়িটার শূন্যতা ভরল না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে। আর আমি সহ্য করতে পারছি না।

তুমি চেক-আপও করাবে না আর আমাকে বাচ্চার জন্য জোরও দেবে! এটা কি আমার একার পক্ষে সম্ভব? মাধবী বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি শুধু রেজাল্ট চাই ব্যস, গলার আওয়াজ জোরালো হয়।

শোনো না, আমরা অনাথাশ্রম থেকেও তো বাচ্চা নিয়ে এসে মানুষ করতে পারি, সাহস জুটিয়ে বলে মাধবী।

কী বললে, আর একবার বলো, অনাথাশ্রমের বাচ্চা?

ক্ষতি কী?

মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। লাথি, চড়, ঘুঁসি এসে পড়ে মাধবীর উপর। এতেও লোকটার রাগ শান্ত হয় না। মাধবীর হাত ধরে টানতে টানতে দরজা খুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। পিঠে একটা লাথি মেরে মাধবীকে রাস্তায় ফেলে দেয়, আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ। যেখানে যেতে ইচ্ছে করে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। বাঁজা কোথাকার।

লোকটার মুখের এই অশ্লীল শব্দ, মাধবীর কানের মধ্যে যেন গরম তরল লোহা ঢেলে দিল। রাস্তাতেই পড়েছিল সে, হঠাৎই শরীরে উপলব্ধি করল এক দুর্জয় শক্তি। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বাঃ বাঃ খুব ভালো, ভালো লাগল নারীবাদী লেখকের মুখে এমন কথা শুনে। অথচ নিজের বাড়ির মেয়েদের প্রতি যার মনে এতটুকু সম্মান নেই। যাও যাও বাড়ির এই গল্পটাও লিখে ফেলো। তোমার দুঃখের কাহিনিটা-ও সকলকে জানাও, তবেই না তোমার জয়জয়কার হবে।

আমাদের মতো পুরুষপ্রধান দেশে মেয়েদের নিয়ে গল্পই খালি লেখা হয়। তোমার লেখাটাও আর একটা গল্প যোগ করবে। কিন্তু মনে রেখো রঞ্জন কর্মকার, সন্তানের মুখ তুমি কোনও দিনই দেখতে পাবে না। পারো তো একবার গিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নিও। হাজার বার বলব তুমি নপুংসক। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে বাড়ি থেকে কী বার করবে, আমি নিজেই এই নরকের পরিবেশ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, যেখানে তোমার মতো লোকের ছায়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।

রঞ্জন পাথরের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাধবীকে আটকাবার কোনও চেষ্টাই করে না। জনশূন্য রাস্তার নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে মাধবী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।

 

আজ চোদ্দো বছর পর ওই ফেলে আসা নামটা আবার মাধবীর চোখের সামনে অক্ষর হয়ে এসে দাঁড়াল। এতগুলো বছর মাধবীকে কম লড়াই করতে হয়নি। কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সব মনে আছে ওর, লোকের বাড়িতে কাজ করেছে পর্যন্ত। একটাই ভালো হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অরুণ বসুর আশীর্বাদধন্য হতে পেরেছে মাধবী। তাঁরই উৎসাহে এ কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা বই লিখে বেশ নাম করেছে মাধবী। অবশ্য লেখাগুলো সবই মধুমালতী ছদ্মনামে। অরুণ বসুই প্রকাশনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মাধবী যথেষ্ট জনপ্রিয় লেখিকা এখন। অর্থের কোনও অভাব আর নেই মাধবীর। নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে অনাথাশ্রম থেকে একটি শিশুকন্যাও দত্তক নিয়েছে সে। বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু রঞ্জন কর্মকারের নামটা ওর চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়ে সব কেমন এলোমেলো করে দিল। মন খালি বলছে, এটা হওয়া সম্ভব নয়। একই নামে বহু লোক আছে এই পৃথিবীতে। সুতরাং এ কিছুতেই অতীতের সেই রঞ্জন নয়।

ফোনটা বেজে উঠতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল মাধবীর। অরুণ বসুর নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ফোন তুলতেই অরুণবাবু জানালেন, লেখক সংগঠন থেকে ঠিক করা হয়েছে, রঞ্জন কর্মকারের হাতে প্রথম পুরস্কার তুলে দেওয়ার দাযিত্ব মাধবী তোমাকে নিতে হবে।

অবাক হল মাধবী, যেটাই এড়াতে চায় সেটাই আরও বেশি করে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ফোনেই মাধবী জানাল, সেদিন ওর পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু অরুণবাবু জোর দিলেন, ডাকযোগে লেখকদের জানানো হয়ে গেছে যে, মাধবী-ই সেদিন পুরস্কার দেওয়ার দাযিত্বে থাকবে।

কিন্তু এটা ঠিক করার আগে একবার আপনি কেন আমাকে জানালেন না? বিরক্তির স্বরে মাধবী জিজ্ঞেস করল।

এটা কী ধরনের কথা মাধবী! লোকে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, আর তুমি কিনা… কথার মাঝেই মাধবী বলে উঠল, সরি অরুণদা, সেদিন আমি কিছুতেই আসতে পারব না।

তার মানে আমার সম্মানটা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাও। এখন তো কার্ডগুলোও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ তখন আর আমি কী বলব?

অরুণদার গলাটা শুনে মাধবীর মনে হল, যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক সৈনিক। যুদ্ধ করার আগেই হেরে বসে আছেন। ঠিক আছে অরুণদা আমি যাব, নিশ্চিন্ত করে মাধবী।

অরুণ বসুকে মাধবী আদর্শ মনে করে চলে। বড়ো ভাইয়ের স্নেহই পেয়ে এসেছে মাধবী ওনার কাছে বরাবর। সুতরাং আজ সেই মানুষটার মনে আঘাত দেওয়ার মানসিকতা কিছুতেই হল না তার।

ঘড়িতে ঠিক সন্ধে সাতটা। লেখক ও বুদ্ধিজীবীর ভিড়ে হল গমগম করছে। আলো বন্ধ হতেই পিন পতন নিস্তব্ধতা গোটা প্রেক্ষাগৃহে। স্টেজের উপরে মাইকে অরুণ বসু ঘোষণা করলেন, প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে লেখক রঞ্জন কর্মকারকে। দয়া করে স্টেজে এসে আসন গ্রহণ করুন।

মাধবী তৈরিই ছিল। স্টেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা ব্যক্তিটিকে দেখে মাধবী পাথর হয়ে গেল। রঞ্জনও এক ঝলক মাধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। এত বছর ধরে যে-মুহূর্তটাকে মাধবী ভুলে যেতে চেয়েছে, এড়িয়ে এসেছে, আজ সেই মুহূর্তটাই এক বুক কষ্টর ঝাঁপি খুলে মাধবীর মনটাকে তাতে ডুবিয়ে দিল।

এতগুলো বছর ধরে রঞ্জনও ভেবে এসেছে, মাধবী ওর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। গুম হয়ে গেছে, যেখান থেকে সভ্য সমাজে ফিরে আসা আর কখনও সম্ভব নয়। অথচ, অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই মাধবী ওরফে মধুমালতী-র হাত থেকেই তাকে আজ পুরস্কার গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর থেকে নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?

মাধবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রঞ্জনের অহংকার, ভাঙা কাচের মতো গুঁড়ো হয়ে রঞ্জনকেই বিদ্ধ করল। মাধবী অরুণদার হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে রঞ্জনের হাতে ধরাল। রঞ্জনও কলের পুতুলের মতো পুরস্কার গ্রহণ করে, কোনও রকমে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে, স্টেজে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। দেখে যে-কেউই ভাবতে পারে রঞ্জন কর্মকারকে সম্মানিত করার বদলে জুতোপেটা করা হয়েছে।

এরপর ধীরে ধীরে অন্য লেখকদের পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ হতেই অরুণদাকে বলে হল ছেড়ে বেরিয়ে এল মাধবী। অন্য আরও অনুষ্ঠানগুলো দেখার মতো মানসিকতা ছিল না তার। গাড়ি বাইরেই রাখা ছিল। গাড়িতে উঠে বসল মাধবী।

 

বাড়িতে ঢুকতেই মাধবীর মনে হল একটু কাঁদতে পারলে হয়তো বুকের উপর চেপে বসে থাকা বোঝাটা হালকা হতো। কিন্তু একফোঁটা জলও চোখ দিয়ে বেরোল না। গলার কাছটায় শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে মাধবীর ঘোর কাটল।

কে? চোখের জল মুছে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল মাধবী কে এসেছে দেখতে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনকে দেখে ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে উঠল ওর।

তুমি কেন এসেছ এখানে? জানলা দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল মাধবী।

আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মাধবী।

মাধবী? কে মাধবী? চোদ্দো বছর আগে মাধবী মারা গেছে। আমার নাম মালতী, মধুমালতী। আমি তোমাকে চিনি না, চলে যাও এখান থেকে। শেষের দিকে মাধবীর গলার স্বর বেশ জোরালো শোনালো।

চলে যাব, শুধু একবার বলে দাও যে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রঞ্জন বন্ধ দরজার সামনে, গলায় কাকুতি।

বললাম তো আমি তোমাকে চিনি না। ভালোয় ভালোয় চলে যাও নয়তো চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, বলে জানলা বন্ধ করে দেয় মাধবী।

বহুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই, মাধবীর মনে হল রঞ্জন নিশ্চয়ই চলে গেছে। ভালোই হয়েছে। ওর সঙ্গে যখন কোনও সম্পর্কই নেই, তখন ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠছে কোথা থেকে। আমার জীবন নরক করে তুলে আজ আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে!

হঠাৎ-ই নিজের মনেই ধিক্কার অনুভব করল মাধবী। ভিতর থেকে নিজের বিবেকই প্রশ্ন তুলল, বাহ! মালতী এখন তুমি মাধবী থেকে মধুমালতী হয়েছ, নাম বদলে ফেলেছ জনপ্রিয়তা পেয়ে, কিন্তু স্ত্রীধর্ম? তুমি যদি ওকে চেনো না, তাহলে কার জন্য হাতে লোহা, মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ানো? হাতের লোহা খুলে ফেলে দাও, মাথার সিঁদুর মুছে ফেলো। রঞ্জন কর্মকারের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই বন্ধন আজও কেন বয়ে বেড়াচ্ছ? না মাধবী তুমি এসব কিছুই করতে পারবে না। উপরে উপরে যাই তুমি বলো না কেন, তোমার মন কি কখনও ওকে ভুলতে পেরেছে? না পারেনি। তোমার লেখায় এত দরদ কোথা থেকে আসে? জীবন দিয়ে তুমি উপলব্ধি করেছ বলেই না!

চুপ করো, আমি কিছু শুনতে চাই না, হঠাৎই নিজে নিজেই চেঁচিয়ে ওঠে মাধবী।

মাধবীর গলা শুনে অদিতি জেগে যায়। কোনও ভাবে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয় মেয়েকে কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারে না মাধবী। পুরোনো ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে চোখের সামনে আসতে থাকে।

রাত প্রায় একটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাধবী ঘুমোবার চেষ্টা করে। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ওর কেটে যায়। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না কিন্তু এক নাগাড়ে বাজতে থাকায় বাধ্য হয়ে উঠে আসে মাধবী।

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি অরুণ বলছি, শান্ত আওয়াজ ভেসে আসে ওপার থেকে।

এত রাতে অরুণদা… সব ঠিক আছে তো? চিন্তিত হয় মাধবী।

আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার সত্যি উত্তর দেবে? তুমি কি রঞ্জন… মানে রঞ্জন কর্মকারকে চেনো?

চমকে ওঠে মাধবী কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হঠাৎ এত রাতে ফোন করে এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আগে উত্তর দাও তুমি ওকে চেনো কি চেনো না?

হ্যাঁ, একসময় আমার স্বামী ছিলেন। ছিলেন শব্দটার উপর বিশেষ জোর দেয় মাধবী।

মাধবী, ছিলেন নয় আজও তিনি তোমার স্বামী কারণ তোমাদের ডিভোর্স হয়নি।

কিন্তু অরুণদা কী ব্যাপার বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মাধবী।

হয়তো রঞ্জন আর বাঁচবে না। কাল যখন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল, তুমি দরজা খুলে না দেওয়াতে ও অনেক্ষণ ওখানেই বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল তুমি দরজা খুলবে। বহুক্ষণ পরে সব আশা ত্যাগ করে ও যখন ওখান থেকে উঠে পড়ে রাস্তায় পা বাড়ায়, তখনও হয়তো মনে ক্ষীণ আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল যে দরজা খুলে তুমি নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। পিছন ফিরে সেটাই দেখতে গিয়ে একটা চলন্ত ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা মারে। হাসপাতালে ও এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ও একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কী করে? চোখের জল সামলাতে সামলাতে মাধবী প্রশ্ন করে।

প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর তুমি যখন হঠাৎ অনুষ্ঠান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে, রঞ্জনও তোমার পিছনে পিছনে দৌড়োল। আমার একটু সন্দেহ হয় কারণ যখনই এই নামটা তোমার সামনে আসে, তুমি কীরকম যেন অস্থির হয়ে ওঠো। আমিও বেরিয়ে আসি হল ছেড়ে আর তোমাদের পিছু নিই। তোমাদের বাড়ির কাছে এসেই রঞ্জন ট্যাক্সি ছেড়ে দেয় কিন্তু ততক্ষণে তুমি বাড়ি ঢুকে গেছ। আমিও একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকি। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ট্রাকটা ওকে ধাক্কা মারে। আমারও কিছু করার ছিল না। ওকে তুলে হাসপাতাল নিয়ে আসি। ডাক্তাররা আশা দিতে পারছেন না।

অরুণদা, আমি এখুনি আসছি, রিসিভার নামিয়ে রাখে মাধবী।

মাথার সিঁদুরের উপর চোখ যায় মাধবীর। মলিন সিঁদুরের রেখাটা খুব কষ্ট করে চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হয়ে গাড়িতে এসে বসে। হাসপাতালের দিকে গাড়ি ঘোরায় মাধবী।

মা এত রাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি? অদিতি জিজ্ঞেস করে।

তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

মিথ্যা কথা, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমিই তো এতদিন বলেছ, আমার বাবা কোথাও হারিয়ে গেছে, চেঁচিয়ে ওঠে অদিতি।

হ্যাঁ বলতাম কিন্তু আজই হঠাৎ ওনার খোঁজ পাওয়া গেছে।

তাহলে এখন থেকে বাবা কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

হয়তো।

তাহলে তো খুব মজা হবে, অদিতি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

অদিতি, এখন একটু চুপ করো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

হাসপাতালে পৌঁছতেই গাড়ি রেখে রিসেপশনেই অরুণদার দেখা পেল মাধবী। মাধবীদের নিয়ে রঞ্জনের বেড-এর সামনে দাঁড়াতেই চোখ খুলে চাইল ও। এসে গেছ। তোমারই আসার প্রতীক্ষা করছিলাম। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে রঞ্জনকে। মাধবীদের ঘরে রেখে অরুণ বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

রক্তাক্ত শরীরটাকে কোনও ভাবে টেনে তুলে রঞ্জন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাধবী জোর করে ওকে শুইয়ে দিল।

এ কী হাল করছে শরীরের? কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করে মাধবী।

সবই আমার কর্মদোষ! আমি তোমার উপর যে-অত্যাচার করেছি, আজ তারই ফল আমাকে ভুগতে হচ্ছে। আমার এই নিয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ নেই। আর তো কিছুক্ষণের অতিথি আমি। আমার শেষ ইচ্ছা, যেন তোমার সামনেই এই পাপে ভরা প্রাণটা ত্যাগ করতে পারি।

মাধবী রঞ্জনের হাত দুটো নিজের মুঠিতে তুলে নেয়, তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি তোমাকে বাঁচাব।

আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। হঠাৎ অদিতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই ইশারায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জন, এটি তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, দত্তক নিয়েছি।

ভালো করেছ মাধবী, নয়তো আমার চিতায় কে আগুন দিত? সারা জীবন এই একটাই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে যে, মৃত্যুর পর আমার কী হবে? কিন্তু এখন আর কোনও চিন্তা নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব, বলে রঞ্জন অদিতিকে স্নেহের স্পর্শে কাছে টেনে নেয়।

 

কী শান্তি! এই শান্তি আগে তো কোনও দিন অনুভব করেনি রঞ্জন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কে আপন কে পর তার হিসেব কে রাখে? আর তো কিছু মুহূর্ত…

যদি রঞ্জন সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে আজ আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আ.., মুখের কথা মুখেই থেকে যায় মাধবীর। গলা শুকিয়ে ওঠে। রুদ্ধ হয়ে আসে স্বর।

আমি তোমাকে কখনও হেয় করতে চাইনি মাধবী। কিন্তু কী যে পশু ভর করেছিল আমার মাথায়! সময়, কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিয়েছে আমার পাপের! এমন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বেরোবার শক্তি আমি জোটাতে পারিনি। তবুও বলব আজ আমি খুব খুশি। মৃত্যুর সময তো আমি তোমাকে কাছে পেলাম। আমার লেখায় আদর্শের ছড়াছড়ি কিন্তু বাস্তবে নিজের জীবনে আদর্শকে কোনও ঠাঁই দিইনি। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে যদি সুখী রাখতে পারতাম। আমি সত্যিই লজ্জিত মাধবী, ক্ষমা কোরো আমাকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মাধবী।

মাধবী কিছু বলার আগেই রঞ্জনের মাথা একপাশে হেলে পড়ল। মাধবী কাছে আসতেই বুঝতে পারল রঞ্জনের যাবতীয় কষ্টের অবসান ঘটেছে।

পরের দিন হাজারো সাহিত্যকারের ভিড়ে অদিতি, রঞ্জনের মুখাগ্নি করল। মাধবী অপলক দৃষ্টিতে চিতার আগুনের দিকে তাকাতেই মনে হল, আগুনের শিখার ভিতর থেকে রঞ্জনের হাসিমাথা মুখটা যেন মূর্ত হয়ে উঠছে। মাধবীকে বলছে, তুমি আমার শেষইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছ, যেটা এতগুলো বছর ধরে আমার গলায় ফাঁসের মতো আটকে ছিল, আমার অসম্পূর্ণ গল্প আজ সম্পূর্ণ হল মাধবী। এখন আমি নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছি।

মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুও জোর করে মুছে নিল। আর কান্না নয়, অদিতির জন্য বাকিটা জীবন তাকে হাসি মুখেই কাটাতে হবে।

 

নাম জানা হয়নি

একদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতা আর অন্যদিকে মাউন্ট ফুজির গগনচুম্বী বরফঢাকা শিখর। দু’পাশে প্রকৃতির সবুজ গালিচাকে সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে শিনকানসেন– জাপানি বুলেট ট্রেন। অসম্ভব গতির জন্য জানলার বাইরের সমস্ত দৃশ্যই যেন ঘষা ছবি। যেন একটা সদ্য জলরং করা ছবি অনবরত কেউ ঘেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইল না সার্থকের।

সংরক্ষিত আসনের বিলাসী ব্যাকরেস্ট পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, সে তার ক্লান্ত চোখদুটি বন্ধ করল। একটু-একটু তন্দ্রা মাঝেমধ্যে তাকে আচ্ছন্ন করে যাচ্ছে। খানিকটা তার অজান্তে আর খানিকটা সচেতনে তার মন বুলেটের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে অতীতে। মুহূর্তে আশেপাশের রঙিন প্রকৃতি চোখের সামনে থেকে উধাও। তার বদলে ফিরে এল অন্য সময়, অন্য পরিপ্রেক্ষিত।

বছরখানেক আগে সেই মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট দেখে এসে আর একমুহূর্তও খামোখা নষ্ট করতে চায়নি সার্থক। বাবা রাগারাগি করেছিলেন। মা কেঁদেকেটে একশা হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই টলানো যায়নি সার্থককে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলেছিল আগেই। সম্ভবত তার ছেলেবয়সেই। বাবা বলেছিলেন, ‘পড়াশোনা করতে না চাস তো সমবায় থেকে লোন নিয়ে ছোটোখাটো একটা দোকান করে দিচ্ছি। তিনটে তো পেট

সংসারে। ঠিক চলে যাবে–!’

সার্থক বাবাকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেনি। গররাজি মুখ করে চুপ করে গিয়েছিল। বাবা এই মফসসল শহরে বসে কী করেই বা বুঝবেন, তাঁর সীমাবদ্ধ ভাবনা আর সার্থকের লাগামবিহীন স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব কত যোজন! ছোটোবেলা থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে বিদেশে তাকে যেতেই হবে। উন্নতির একমাত্র ঠিকানাই বিদেশ।

অনেক আগে এ কথাটা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাদেরই পাড়ার ছেলে সুধন্য। বছরতিনেক আগে কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে সেও কেটে পড়ল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে ফোন করত। আইএসডি। সেই উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীকালে বজায় থাকেনি। কিন্তু সুধন্যর কথাগুলো মনে আছে সার্থকের। সুধন্য গল্প করেছিল, কীভাবে জাহাজের খালাসি হয়ে একজন পৌঁছে গিয়েছিল আমেরিকাতে। এখনও কত লোক প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়! তাদের বেশিরভাগের আবার ভিসা-পাসপোর্ট কিছুই নেই।

সেইদিন থেকে সার্থক একটাই লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বেসরকারি অফিসের অল্প মাইনের কেরানি তার বাবা। সামান্য মাইনেয় তিনজনের পরিবার টানতেই তাঁর প্রাণান্ত দশা হয়। সে তো চোখের সামনে দেখেছে, দিনের পর দিন কত কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে! একটা ছোটো সাইজের জামাকে অনেক বড়োসড়ো বপুতে গলানোর চেষ্টা করতে করতেই জীবন কেটে গেল বাবার। একই ভবিতব্য তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে, এ কথা ভাবতে গেলেই সে শিউরে ওঠে। বিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরেই সে যেন মরিয়া হয়ে উঠল।

সার্থককে বুঝিয়ে যখন হার মানলেন মা, খুব উদ্বিগ্ন আর হতাশ গলায় জানতে চাইলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে কী করবি?’

‘প্রথমে একটা চাকরির চেষ্টা করব।’

‘মেসে কষ্ট করে থাকতে পারবি তো বাবা?’ মা চোখের জল মোছেন আঁচলে।

‘নিশ্চয়ই পারব। কেন পারব না?’ সার্থক কঠিন গলায় বলে।

বৈশাখের কড়া রোদেলা শহর। সারাদিন ব্যস্ত মানুষ রাস্তা পারাপার করে। পথে কাটাকুটি খেলে অসংখ্য বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-রিকশা। সবাই যে কলকাতার, তা তো নয়। আশেপাশের জেলাশহর থেকেও প্রতিদিন কত মানুষ আসছে ক্ষুধার অন্ন জোটাতে।

একটা চলনসই গোছের চাকরি জুটে গেল অল্পদিনেই। এক ছোটোখাটো কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ। মাইনে সামান্য। কিন্তু ঘুরে বেড়িয়ে শহরটাকে আবিষ্কারের নেশাটা পেয়ে বসল তাকে অচিরেই।

এমনই একদিন সে বসে ছিল জাপান দূতাবাসের উলটো দিকে ফুটপাথের এক চায়ের দোকানে। দুপুর রোদে একটু ছায়া উপভোগ করছিল। গ্রীষ্মের দুপুর বলেই শহরটা একটু নিস্তরঙ্গ, নিস্তেজ। জাপান দূতাবাসের মূল দরজা পেরিয়ে ছোটোখাটো চেহারার এক জাপানি মহিলাকে সে অলস চোখে রাস্তা পেরোতে দেখল। জাপানি মেয়েদের গায়ের রং পার্ক স্ট্রিটে দেখা ফরাসি কিংবা বেলজিয়ান মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লালচে ফরসা এবং ত্বকও অনেক বেশি মসৃণ।

মেয়েটি রাস্তা পেরিয়ে এসে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াতে, সার্থক আন্দাজ করল মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে। হয়তো এই প্রথমবার কলকাতায় এসেছে। চোখমুখের উৎকণ্ঠিত ভাব সে কথাই বলছে। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে সে বোধকরি ফাঁকা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

মেয়েটি কি ইংরেজি বোঝে? সার্থক থেমে থেমে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কি বুঝবে মেয়েটির ভাষা? কিংবা মেয়েটি তার? অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে বিদেশবিভুঁইয়ে, অপরিচিত পরিবেশে সে যেন খানিকটা হতচকিত, থতোমতো!

তার চা খাওয়া হয়ে গেছিল। সঙ্গে প্রজাপতি বিস্কুট।

চা-ওয়ালাকে দাম মিটিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে সে থমকে তাকাল। মেয়েটি তেমনই বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ইতস্তত পায়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই হেলপ ইউ?… আপনি কি ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ?’

মেয়েটি স্মিত হেসে নাতিদীর্ঘ গ্রীবা হেলাল, অর্থাৎ, জানে।

সার্থক আশ্বস্ত হয়ে জানতে চাইল, ‘কোনও সাহায্য করতে পারি?’

‘আসলে, কাল রাতেই আমি কলকাতায় এসেছি। কাল সকালের ফ্লাইটে জয়পুর চলে যাব। ভাবছি যতটা সময় পাচ্ছি, তার মধ্যে শহরটাকে একটু দেখে নেব। শুনেছি, কলকাতা ইজ আ বিউটিফুল সিটি। অনেক কিছু দেখার আছে–!’

এ’কদিনের শহরবাসে কলকাতা শহরটাকে পায়ে হেঁটে ভালোই চিনে ফেলেছে সার্থক। তার পেশাটাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করেছে।

সে তাই বলল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, অ্যান্ড ফিল কমফর্টেব্ল, আমি কিন্তু শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি আপনাকে–!’

মুহূর্তের জন্য জাপানি তন্বী চুপ করে রইল। স্বাভাবিক, যে এ শহরটাকে চেনেই না, সংস্কৃতিটাকে জানেই না, সে কীভাবে তক্ষুনি এক অপরিচিত পুরুষের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেয়! তার পক্ষে সহজ নয় ব্যাপারটা।

মেয়েটির হ্যাঁ ও না-এর সম্ভাবনার দোলায় খানিকক্ষণ দুলল সার্থক নিজেও। অনেক সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসেছে সে, প্রত্যাখ্যানে মন ভেঙে যাবে তার। হঠাৎ-ই মেয়েটি বলল, ‘শিয়োর। কিন্তু আপনি সব জায়গা চেনেন তো?’

হ্যাঁ-বাচক ঘাড় নেড়ে একটা চলতি ট্যাক্সিকে থামাল সার্থক। শিভালরি দেখিয়ে পিছনের দরজা খুলে ধরল জাপানি মেয়েটির জন্য। নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে।

শহরের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লালদিঘি, যাদুঘর, সিটি সেন্টার…। জাপানি তরুণী অবাক চোখে দেখছিল। প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা উপভোগ করছিল। হুইলার স্টল থেকে একগোছা গোলাপি ক্যান্ডিফ্লস কিনে সেটি কী করে খেতে হয়, শিখিয়ে দিল সার্থককে। সার্থক অবশ্য জানত। ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ নামে এ জিনিসটাই ফেরিওয়ালার কাঁধে চেপে প্রায়ই আসত তাদের মফসসল শহরে। এখন সেই জিনিসটাই জাপানি মেয়ের মসৃণ, চকচকে গোলাপি ঠোঁটে মিশে যাচ্ছে।

জাপানি যুবতির সান্নিধ্য খুবই ভালো লাগছিল সার্থকের। কিন্তু দেখতে দেখতে দিনটা ফুরিয়ে এল। খিদে পেয়েছিল ওদের। জাপানি কন্যে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার খিদে পায়নি সার্থক?’

সার্থক সলজ্জে বলল, ‘হুঁ।’ কাউকে খিদের কথা জানাতে তার ভারি লজ্জা হয়। ছোটোবেলার অভ্যেস।

যুবতি বলল, ‘তাহলে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় চলো–!’

সার্থক ওর চেনা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল। এর আগে মাত্র একবারই এসেছে। সেই অর্থে চেনা নয়। তবে জানে, এটা তার পকেট এবং মধ্যবিত্ত ম্যানারের মাপেমাপে। আরও বড়ো রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাহস পেল না সার্থক।

জাপানি তরুণী যে-কোনও বিষয়েই তার উপর বড়ো নির্ভরশীল। সার্থকের সব কথাতেই তার হ্যাঁ। খাওয়াদাওয়ার পরে রাস্তায় এসে তার কী মনে হল, জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, সার্থক, তোমাদের শহরে কোনও নদী নেই?’

‘আছে তো। গঙ্গা। বিশাল নদী।’

‘নদীতে নৌকো চলে?’

‘চলে।’

‘আমায় নিয়ে যাবে?’

শহরের গঙ্গায় শেষ লঞ্চ অনেক আগেই চলে গেছে। যে-কটি আলো জ্বলছে বাতিস্তম্ভে, তাতে অন্ধকারটাই যেন আরও গাঢ় হয়েছে। কেবল কালো গঙ্গার বুক ভেসে যাচ্ছে হলুদ জ্যোৎস্নায়। ইতিউতি কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছায়ার মতো পরস্পরের লগ্ন হয়ে আছে। দূরে কয়েকটি নৌকো দেখা যায়। হ্যারিকেনের ম্লান আলো তাদের প্রায়-অনস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলছে।

সেদিকে আঙুল দেখিয়ে যুবতি বলল, ‘সার্থক, ওই নৌকোগুলোয় চড়া যায়?’

মুখের কাছে দু’হাতের তালু জড়ো করে সার্থক ডাক দিল, ‘মাঝিভাই, ও মাঝিভাই, নেবে নাকি?’

খানিক পরে নৌকো ঘাটে লাগলে, ওরা উঠে বসল ছইয়ের ভিতর। মাঝির হাতে দাঁড়ের প্রথম টানে দুলে উঠল নৌকো। আর, যুবতির শরীরও যেন টলে পড়ল সার্থকের গায়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল বিদেশিনি। সার্থকের একটি হাত নিজের হাতে বন্দি করে আনমনা গলায় বলে উঠল, ‘আমি অনেক দেশে ঘুরেছি সার্থক। দেশে দেশে কত বন্ধু হয়েছে। কিন্তু তারা একজনও তোমার মতো নয়। তোমার শহর থেকে অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি।’

বুক ভর্তি করে খোলা হাওয়া নিল তরুণী। সার্থকের হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলল, ‘জাপানে চলে আসছ না কেন? ওখানে অনেক সুযোগ। যদি আসতে চাও, আমায় জানিয়ো। কাল সকাল পৌনে নটায় আমার ফ্লাইট। সাতটা নাগাদ একবার হোটেলে এসো। আমার কার্ডটা তোমায় দিয়ে দেব।’

মিষ্টি হাওয়া বইছে। নৌকো কি এখন মাঝগঙ্গায়? ঘাট দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। মেয়েটি গুনগুন করে কোনও জাপানি সুর গাইছে। সুরটা অনেকটা ভাটিয়ালির মতোই। যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়। আশ্চর্য তৃপ্ত আর ভরাট লাগছে মেয়েটির মুখ। সে যেন সার্থকের ভালোবাসায় লীন হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটির মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সার্থক অস্ফুটে বলল, ‘মাঝিকে ঘাটে নৌকো ভেড়াতে বলি? অনেক রাত হল।’

মেয়েটিও যেন তন্দ্রা ভেঙে উঠে বসল। হোটেলে তাকে পৌঁছে দিল সার্থক। বিদায়ের মুহূর্তে হাত নেড়ে সে বলল, ‘কাল সকালে দেখা হচ্ছে।’

রাস্তায় নেমে সার্থকের মনে পড়ল, মেয়েটির নাম-ই জানা হয়নি। সে পিছন ফিরে ডাকবে তাকে, ভাবল। কিন্তু মেয়েটি চলে গেছে। তাকে আর দেখতে পেল না সার্থক।

অনেক রাতে সার্থক ফিরে এল মেসে। খাওয়াদাওয়ার পাট ছিল না। কেন-না রেস্তোরাঁয় খেয়ে তখনও পেট ভর্তি। সে সরাসরি বিছানায় শরীর ছুড়ে দিল। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, তবু তার ঘুম এল না। সন্ধের সুখস্মৃতি তাকে ঘুমোতে দিল না। রোমন্থনে জাগিয়ে রাখল। মনে হল, তার হাতটি যেন এখনও নিজের উষ্ণ করতলে ধরে রেখেছে সেই বিদেশিনি, যার নাম সে জানে না। ইস, কী ভুলটাই না সে করেছে! সার্থক ভাবে।

ঘুম না আসার অবশ্য আরও এক কারণ ছিল। সেটা তার উদ্বেগজনিত। ভোরবেলা উঠতে হবে। না উঠতে পারলে, হোটেলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যেতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্কতায় অনেকসময় ভুল হয়ে যায় বেশি।

কখন তার চোখদুটো লেগে এসেছে সার্থক জানে না। ধড়ফড় করে জেগে উঠে, বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটায় দেখল, আটটা বাজে। হোটেলে গিয়ে এখন জাপানি যুবতিকে দেখতে পাওয়া একরকম দুরাশাই। পৌনে নটায় তার ফ্লাইট, সার্থক জানে। তবু, বড়ো আশায় বুক বেঁধে সে হোটেলের দিকে রওনা দিল।

সকালে হোটেলে তেমন ব্যস্ততা নেই। হাতেগোনা কয়েকজন চেক আউট করা বোর্ডার, বাক্স-ব্যাগ নিয়ে বড়ো দরজার কাছে অপেক্ষা করছে ট্যাক্সির জন্য।

রিসেপশনের সদ্য ঘুমভাঙা ডাগর চোখমুখের মেয়েটি বলল, ‘কাল সন্ধেয় আপনি যাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে, তার কথা জানতে চাইছেন তো? উনি তো অনেকক্ষণ চেক আউট করে গেছেন। বোধহয় আপনার জন্যই লবিতে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। কেন-না, ওর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছিল, কাউকে খুঁজছেন। তারপর চলে গেলেন।’

সার্থকের বুকের মধ্যেটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল। সব হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থাকল তাকে। তার সব আশা যেন ভেঙে গেছে। সব ভাবনা যেন মিশে গেছে ধুলোয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকেই তার মধ্যে আর-এক ধরনের শক্তিপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে, টের পেল সার্থক। সেই শক্তি তাকে বেঁধে দিল এক কঠিন অঙ্গীকারের রজ্জুতে। একদিন নিশ্চয়ই সে তাকে খুঁজে বের করতে পারবে।

সামান্য হোঁচট খেয়ে শিনকানসেন থেমে যেতে, ভাবনার গতিপথেও বাধা পড়ল। ট্রেনের স্বচ্ছ কাচের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল সার্থক। নিরিবিলি স্টেশন। দু-চারজন মানুষ চলাফেরা করছে। একটা বোর্ড আছে বটে, কিন্তু জাপানি ভাষায় লেখা বলে, স্টেশনের নামটা পড়তে পারল না সার্থক। পাশের সিটের প্রৌঢ় সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে সার্থক জানতে পারল, স্টেশনের নাম হমামাতসুচো। একটা হাঁফ ছাড়ল সে। তার মানে, অর্ধেক পথ আসা গেছে এতক্ষণে। এবার সে স্টেশনটিকেই একটু ভালো করে ঠাহর করে দেখতে থাকল। ভারতের যে-কোনও স্টেশনের থেকে কত ফারাক! কোনও চ্যাঁচামেচি নেই, ব্যস্ততাও কত ব্যক্তিগত ও নীরব, প্ল্যাটফর্মটা এতই সাফসুতরো যে, জুতো পরে হাঁটতে সংকোচ হয়।

ট্রেন সামান্য সময়ের জন্য থেমেছিল। কিছু যাত্রী নেমে গেল, আবার অনেকে উঠল। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ধাক্বাধাক্বি নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আবার তীব্র গতিতে ছুট লাগাল। অমনি বাইরের যাবতীয় ছবি ঘেঁটে একশা। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সার্থক। এত গতি তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।

সার্থকের আবার মনে পড়তে থাকল, জাপানি যুবতির সেই পর্বটি মিটলে, সেলসম্যানের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সার্থক। পরিশ্রম আর উপার্জনে সামঞ্জস্য হচ্ছিল না কিছুতেই। এবার সে চাকরি নিল শহরের এক নামি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। মাইনে ভালোই, উপরন্তু দুপুরে ও রাতে খাওয়াটা ফ্রি। পেটের চিন্তা অনেকটা মিটল। কিন্তু তবু যেন কীসের অমোঘ টানে সে এখনও মাঝেমধ্যেই নিয়ম করে জাপানি দূতাবাসের উলটোদিকের ফুটপাথে, গাছতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ দোকানিটি মরে গেছে। এখন তার ছেলে চা বানায়। তাগড়া যুবক।

রেস্তোরাঁর কাজে ছুটিছাটা কম। সন্ধেগুলোতেই ভিড় বেশি। তার উপর সাধারণ ছুটির দিনেও খদ্দেরদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কেবল দুপুরটায় কাজের চাপ একটু কম থাকে। তখন রসুইঘরে খাবার তৈরির আগের পর্যায়ের কাজ চলে।

এই সময়টাতেই মাঝেমধ্যে ফুটপাথের সেই চায়ের দোকানে চলে আসে সার্থক। এক কাপ চা নিয়ে একঘণ্টা বসে থাকে। সঙ্গে দুটো প্রজাপতি বিস্কুট।

একদিন একটা কাণ্ড ঘটল।

দুপুরে রাস্তা এমনিতে ফাঁকাই থাকে। একটা অটোরিকশা তীব্র বেগে এগিয়ে এসে, ঠিক চায়ের দোকানের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক জাপানি যুবক নেমে জিন্সের পিছনের পকেট থেকে পার্স বের করে ভাড়া মেটালেন। তারপর পার্সটিকে আবার পিছনের পকেটে চালান করে দিয়ে, দূতাবাসের দিকে হাঁটা দিলেন। দেখে মনে হল যুবকের খুব তাড়া।

অলস চোখে তাকে লক্ষ করছিল সার্থক। এও তার চোখে পড়ল, তাড়াহুড়োয় পার্সটি যুবকের জিন্সের পকেটে না ঢুকে সশব্দে পড়ল রাস্তায়। ব্যস্ততায় যুবক তা খেয়াল করল না। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সার্থক যে তাকে ডেকে উঠল, সেটাও কানে গেল না তার। লম্বা পা ফেলে, সে দূতাবাসের অন্দরে সেঁধিয়ে গেল।

রাস্তা থেকে পার্সটা কুড়িয়ে আনল সার্থক। খুলে দেখল তাতে একগোছা দুই হাজার টাকার নোট। এত টাকা কোনওদিনও একসাথে দেখেনি সে। হাত কাঁপছে তার। কাউকে বলতেও পারছে না। পার্সটা বন্ধ করে, দুহাতের করতলে শক্ত করে ধরে রেখে সে ভাবতে থাকল, এখন কী করণীয়!

একঝলক দেখে সার্থকের মনে হয়েছে, অন্তত পঞ্চাশটা দু’হাজার টাকার নোট রয়েছে সেই গোছায়। মুহূর্তের জন্য চকচক করে উঠল তার চোখদুটো। এই টাকাগুলো বাবা পেলে, বাড়ির অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ করে ফেলত। রান্নাঘরটা মেরামত করত। ছাদের যে-জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়ে, সারাত সেগুলোও। মাকে কয়েকটা নতুন শাড়িও হয়তো কিনে দিত। আর স্যাকরার দোকানে মায়ের কানের যে দুলটা বাঁধা রেখে টাকা নিতে হয়েছিল সেবার মায়ের অসুস্থতার সময়, সেটাও হয়তো ছাড়িয়ে আনত।

পার্সটা একবার খুলল সার্থক। একগোছা কাগজের টুকরো। অথচ কী অসীম ক্ষমতা তাদের। পরমুহূর্তেই পার্স বন্ধ করে সে নিজের মনেই বলল, ছি। সে এসব কী ভাবছে?

তখনই উদ্ভ্রান্তের মতো সেই জাপানি যুবককেও রাস্তা পেরিয়ে এপাশে আসতে দেখা গেল। তার চেহারা ইতিমধ্যেই বেশ পালটেছে। চুল এলোমেলো। চোখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। কিছু খুঁজছে যেন।

সার্থক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যুবকের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আই হ্যাভ ইয়োর ওয়ালেট। ইউ ড্রপ্ড ইট হিয়ার।’

যুবকটি সার্থকের হাত থেকে খপ করে পার্সটি কেড়ে নিয়ে ভিতরটা আঁতিপাঁতি করে দেখল। তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঠায় সার্থকের দিকে।

সার্থক ম্লান হাসল। যুবক নিজের অভিভূত ভাবটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আই অ্যাম ভেরি মাচ ইমপ্রেসড। মে আই ডু সামথিং ফর ইউ?’

সার্থক যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষা করছিল এই প্রশ্নটার জন্য! উত্তরটা সাজানোই ছিল জিভের ডগায়, এমনভাবে সে বলে ফেলল, ‘আমি আপনার দেশে যেতে চাই। শুনেছি ওখানে কেরিয়ার তৈরির অনেক সুযোগ–!’

জাপানি যুবক হঠাৎ কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর সার্থকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁ আছে? আমার খুব খিদে পেয়েছে!’

কাছাকাছি সত্যিই একটা রেস্তোরাঁ আছে, জানে সার্থক। যুবকটি নিজেই অর্ডার করল। সার্থকের যদিও খিদে ছিল না, তবু অল্পস্বল্প কিছু নিতে হল। খেতে খেতে যুবকটি প্রশ্ন করে জেনে নিতে থাকে সার্থকের জীবনের নানা কথা। কেবল শোনেই না, নিজের কথাও বলে।

যুবকের নাম হারুকি। সম্প্রতি সে বিয়ে করেছে। পেশায় সে ব্যবসায়ী। এক বছর আগে হারুকির বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে হারুকি এখন তাঁর প্লাস্টিক কারখানাটির মালিক। ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজেই এবার সে ভারতে এসেছে। তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী অবশ্য এর আগে অনেকবারই এদেশে এসেছে। ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে সেসময় রিসার্চ করছিল সে।

গত বছর হারুকির কোম্পানি অপ্রত্যাশিত লাভ করেছে। জাপানি ভাষায় কোম্পানিকে বলে ‘খায়শা’। হারুকির খায়শা এখন রমরম করে চলায়, সে কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রীর হাতে দায়িত্ব সঁপে ভারতে এসেছে।

হারুকি বলল, ‘সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী কয়েক বছরে কোম্পানি আরও বড়ো হবে সার্থক! কারখানা করার জন্য জমিও কিনেছি। অনেক কর্মীরও দরকার হবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও, তাহলে আমার কোম্পানিতে একটা চাকরি তোমায় দিতে পারি। শর্ত দুটো। এক, পাকাপাকিভাবে জাপানেই থাকতে হবে। নাগরিকত্বের ব্যবস্থা আমি করে দেব। আর দুই, মন দিয়ে কাজ করতে হবে। জাপানে সকলকেই কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে হয়।’

খানিকটা সময় থেমে থেকে হারুকি আবার বলল, ‘তুমি রাজি থাকলে বলো–!’

সার্থক যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল। হারুকির প্রশ্নে চমকে উঠে বলল, ‘কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। আমি যাব।’

হারুকি উঠে পড়ে বলল, ‘আজ রাতের ফ্লাইটে আমি মুম্বই উড়ে যাচ্ছি। দু’দিন ওখানে থাকব। তারপর ফিরে যাব জাপানে। ওখান থেকে যাবতীয় জরুরি ডকুমেন্টস তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা কোরো।’

একটা ট্যাক্সি ডেকে হারুকিকে তুলে দিয়ে, বাস ধরে নিজের রেস্তোরাঁয় ফিরে এল সার্থক। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। মানুষের ভিড়ও বাড়ছিল। আজ ক্রেতারা তার কাছ থেকে পেল একটু বাড়তি হাসি। একটু বেশি সৌজন্য। তখন এক আশ্চর্য ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছে সার্থক। আর মাত্র কয়েক দিন, বন্ধু। ওগো চেনা মুখ, তোমাদের বড়ো মিস করব জাপানে।

হারুকি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়নি। সে জাপানে ফিরে যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায়, সার্থকদের রেস্তোরাঁর ঠিকানায় তার নামে একটা প্যাকেট এল। নিজের মেসে গিয়ে কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুলল সার্থক। ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় জরুরি কাগজপত্র, সেইসঙ্গে একটা ওপন ডেটেড এয়ার টিকিট। তার উপর সরু ক্লিপে আটকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে স্বহস্তে হারুকি লিখেছে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাপানে চলে আসার চেষ্টা করো!’

চোখে হঠাৎই জল চলে এল সার্থকের। সেই কোন ছোটোবেলার অধরা স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। পরের কয়েক দিন কেটে গেল দূতাবাসে ভিসা সংক্রান্ত কাজকর্মের ব্যস্ততায়। তার কয়েক দিন পরেই তার উড়ান নামল অশোকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। এয়ারপোর্টে ক্লিয়ারেন্সের যাবতীয় কাজ মিটে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। হারুকি যেভাবে বলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে অশোকা স্টেশন থেকে টোকিয়োগামী বুলেট ট্রেনে উঠে বসেছিল সার্থক।

শিনকানসেন এখন সাঁঝবেলার কুয়াশামাখা অন্ধকার ভেদ করে ছুটছে। দূরে দূরে ছোটো ছোটো জনপদ টের পাওয়া যায় মিটমিট করে জ্বলা আলো দেখে। পিছনে পড়ে রইল তার দেশ। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। দেশের বাড়ি, বাবা-মা…। চোখ জ্বালা করে উঠল সে কথা মনে পড়তে। প্রৌঢ় সহযাত্রীটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বললেন, ‘টোকিয়ো স্টেশন আসছে। আর দশ মিনিট।’

সত্যিই তাই! চোখেমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে বলে টয়লেটে ঢুকেছিল সার্থক। বেরিয়েই চমকে গেল। অন্ধকার উধাও। মিটমিট করে জ্বলা আলোরাও বিগত অতীত। তার বদলে মসৃণ এক শহর আলোয় আলোয় খিলখিল করে হাসছে। সিটে ফিরে আসতে বৃদ্ধ সহযাত্রী একগাল হেসে বললেন, ‘টোকিয়ো এসে গেছে।’

আগেই ফোনে কোথায় সার্থকের জন্য অপেক্ষা করবে বলে দিয়েছিল হারুকি। সেইমতো, পশ্চিমের দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে বের হয়ে, রিজার্ভেশন কাউন্টারের কাছে যেতেই সে হারুকিকে দেখতে পেল। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল হারুকি। বলল, ‘কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’

সার্থক মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল হারুকি। গাড়ি চলতে শুরু করল ফ্লাইওভার ধরে। এমন শহর সার্থক কেবল ছবিতে দেখেছে। আকাশে থেকে থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে রংবেরঙের ফুল হয়ে যাচ্ছে।

অবাক চোখে সেদিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুকি বলল, ‘খুব কাছে সুমিদা নদী। প্রত্যেক বছর এই দিনে নদীর পারে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছ। আমরা নদীর পার ধরেই যাব। দেখতে পাবে–!’

‘তোমার বাড়ি কি কাছেই?’

‘ফ্ল্যাট…। হ্যাঁ কাছেই।’

আধঘণ্টার মধ্যে গাড়িটা বাঁক নিয়ে একটা বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে খানিকটা গিয়ে থামল। সেখানে আরও অনেক গাড়ি রয়েছে। সার্থক বুঝতে পারল, এই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও ফ্ল্যাটেই থাকে হারুকি ও তার বউ। সাজানো ফ্ল্যাটে ঢুকে, ড্রয়িংরুমে বসার পর, হারুকি বলল, ‘তুমি কি টয়লেটে যেতে চাও?’

সত্যিই শরীর এখন চাইছে স্নান। দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে রাতপোশাকটা বের করে টয়লেটে ঢুকল সার্থক। আহা, স্নানের ঘর যে এমন হয়, সে কি জানে দেশে তার পরিচিত মানুষরা? কত বড়ো বাথটাব! দেয়ালে কতরকম কলের প্যাঁচ। কোনটার কী কাজ কে জানে! জেনেই বা কী দরকার! দেশে তো বাড়ির বাইরের টিপকল থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে ছাদখোলা টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে স্নান করত তারা।

বাথটাবের কল ছেড়ে দিয়ে, সার্থক আক্ষরিক অর্থে গা ভাসাল। টয়লেটের বাইরে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে পানীয় হাতে নিয়ে একাই বসে আছে হারুকি।

তাকে দেখে বলল, ‘একটু বোসো। আমার বউ এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। ওকে খবরটা দিয়ে আসি।’

সোফার নরম গদিতে প্রায় পুরোটাই ডুবে যায় সার্থক। সামলে নিয়ে সতর্ক হয়ে বসে। মাথাটা হেলিয়ে দিতেই বুজে আসে ক্লান্ত চোখদুটো। আর তখনই চোখের পর্দায় ভাসে সেই আশ্চর্য সুন্দর মুখটা। তার দেশের কেউ নয় সে, তার দেশের কারু মতো দেখতে নয় তাকে। তবু, সেদিন যখন সন্ধেবেলা গঙ্গার বুকে ভাসা নৌকোর ছইয়ের মধ্যে সে চেপে ধরেছিল সার্থকের হাতদুটি, তাকে দেখতে লাগছিল প্রতিমার মতো। সে মুখ ভোলার নয় কখনও। শুধু তাকে একটিবার দেখবে বলে, সে গিয়ে বসে থাকত দূতাবাসের উলটোদিকে চা-দোকানের ভাঙা চেয়ারে। শুধু জীবনধারণ নয়, তাকে খোঁজার জন্যও জাপানে আসা তার। তার নামও যে জানা হয়নি সেদিন।

হারুকির ডাকে ভাবনার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল সার্থকের। হারুকি ফিরে এসেছে ঘরে।

‘সার্থক, এই হচ্ছে আমার বউ, মিকা–!’ তার পাশ থেকে কেউ রিনরিনে গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো!

জবাবে ‘হ্যালো’ বলতে গিয়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল সার্থক। সেই মুখ। নরম দুটো চোখ। একবার সার্থকের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি যেন মেঝেয় গেঁথে ফেলেছে মেয়েটা। তার মানে, সার্থককে সে আগেই চিনেছে। ধরা দিতে চায় না। সার্থকের কাছেও না, তার স্বামীর কাছেও না।

মিকা বলল, ‘আমি যাই। খুব ক্লান্ত। কাল কথা হবে–।’

সে চলে যেতে, নিজের মনেই একচোট হাসল সার্থক। তারপর অকম্পিত গলায়, ‘সি ইউ’ বলে সোফার নরম ঔদার্যে ডুবিয়ে দিল শরীর।

তার এখন জব্বর ঘুম পাচ্ছে।

 

দেবীজন্ম

ঘুসঘুসে জ্বরটা কিছুতেই ছাড়ছে না সনাতনের। প্যারাসিটামল দিয়েই চালাচ্ছে, খেলে জ্বর নেমে যায়, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে, মাথাটা হালকা আর ফাঁকা ফাঁকা। মনে হয় যেন অনেক দিন বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে, মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আবার সে আগের মতো ঝাঁপিয়ে কাজ করতে পারবে। আর কাজ তো মেলা। পুজোর মুখে এ পাড়ায় কেই বা বসে থাকে। সবাই একগাদা বায়না নিয়ে গলা অবধি ডুবে আছে। যেটুকু পয়সা ঘরে আসে তা তো এই বড়োপুজোতেই। সারা বছর পুজো লেগে আছে যদিও। কিন্তু লক্ষ্মী সরস্বতী বিশ্বকর্মা যতই জুলুস করে হোক, সে যেন পাড়ার ম্যাচ খেলা, দুর্গাপ্রতিমা না গড়লে কোনও পটুয়াই জাতে ওঠে না। তবে টাকাও নয়, জাতে ওঠাও নয়, আরও একটা কিছু থাকে যার জন্যে রাত জাগে কুমোরটুলি। শরীরের কোশে কোশে কী উত্তেজনা, ঝমঝম করে আনন্দ, সারা শরীরে যেন আবার নবযৌবন অনুভব, পার্টি যেদিন ঠাকুর ডেলিভারি নিয়ে যায়, সেদিন মনে হয় ঠাকুরের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে যেন প্রসাদ খাওয়ার আনন্দ পাচ্ছে।

কিন্তু এ বছর একটা ঠাকুরও কি গড়ে শেষ করতে পারবে? তার প্রতিমা কি আলো করে থাকবে কোনও পুজোমণ্ডপ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয় সনাতন, জানলা দিয়ে চোখে পড়ে তার কাজের ঘর, এখনকার ছেলেরা বলে স্টুডিও, কিন্তু সনাতনের কাছে এটা মন্দির। একটাই ভালো কথা যে তার কাজের ঘর তার বাড়ির সঙ্গেই, বাইরে যেতে হয় না, কিন্তু আজ সেটুকু উঠে যাবার ক্ষমতাও সনাতনের নেই। তার একটা ছেলেও নেই যে হাতে হাতে কাজ করবে, দুটোই মেয়ে। বড়োটার বিয়ে হয়ে গেছে, গলায় ঝুলছে ছোটোটা, এগারো ক্লাসের পর তাকে আর পড়াতে পারেনি সনাতন। জানলা দিয়ে সনাতন দেখল কাজের ঘর শূন্য, আধগড়া এক মেটে প্রতিমার খণ্ড খণ্ড পড়ে রয়েছে এদিক ওদিক, রঙের বাটি, তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু ঘরটা যতটা লক্ষ্মীছাড়া থাকার কথা ছিল, তত তো লাগছে না। বরং সনাতন কাজ করার সময় যতটা অগোছালো থাকে, তার তুলনায় এখন অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কে করল? কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল সনাতন ভালো করে দেখবে বলে। যা দেখল তাতে সে অবাক হয়ে গেল। শুয়ে ঘরের ওই কোণটা দেখতে পাচ্ছিল না। এখন আধবসা হয়ে সে দেখল কাজঘরের একেবারে ওই কোণটায় তার মেয়ে শংকরী খুব মন দিয়ে মাটি ছানছে, তার সামনে একটা ছোট্ট, একহাত ঠাকুর, অর্ধেক বানানো হলেও ওটা যে মায়ের প্রতিমা তা এখান থেকেই বুঝতে পারল সনাতন। বিস্ময়ে সে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। শংকরী বানিয়েছে ওই ঠাকুর? কে শিখিয়েছে? কখন শিখল সে? বরাবর সে একাই কাজ করে, একটা ফাইফরমাশের ছোড়া আছে, অর্ধেকদিন তার টিকি দেখা যায় না, রংটা এগিয়ে দেওয়া, মাটি ছানা সব সনাতনকে একা হাতেই করতে হয়। শংকরী আসে মাঝে মাঝে চা টিফিন দিতে। সনাতন টের পায় সে পেছনে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টের পেলেই সে খেদিয়ে দেয় ‘যা যা মেয়েমানুষের এখানে কী? দেখ মা কী করছে? আজ ভাতের মধ্যে কটা কাঁঠাল বিচি ফেলে দিস তো। নুন তেল কাঁচালংকা দিয়ে ভলো করে মাখবি’ শংকরী তবু যেত না এক তাড়ায়, দাঁড়িয়েই থাকত। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, যার মানে একটাই ভবিষ্যৎ তার। বিয়ে। বিয়ের কথা খুব একটা ভাবতে চায় না সনাতন। এক তো তার টাকার জোর নেই। দুই, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে সংসার অচল হয়ে পড়বে। তিন, হ্যাঁ বিয়ের সবচেয়ে বড়ো বাধা তিন নম্বর কারণটা। আসলে শংকরীর মুখশ্রী যেমনই হোক চোহারাটা বড্ড দাম্বালে গোছের। যেমন লম্বা, তেমন চওড়া, খাটতে পারে সে কারণেই প্রচুর, শরীরে যেন বুনো মোষের তাকত, কিন্তু একটু নরমসরম মেয়েলি চেহারা না হলে বিয়ের বাজারে চালানো যাবে ও মেয়েকে?

বড়োটার চেহারাটা মেয়েলি ছিল, টুকটুকে ফরসা, পাতলা পাতলা গড়ন। মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে পলতা গেছিল, সেখানেই পছন্দ করে ছেলের দিদি, শাঁখা সিঁদুরেই পার হয়ে গেছে বড়ো মেয়ে, এখন দিব্যি সংসার করছে। আর এ মেয়ের কপালে কী যে আছে। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে ওঘরে যায় সনাতন। শংকরী টের পায় না বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। মাটি রং দিয়ে সে তখন আস্ত একটা পৃথিবী গড়তে ব্যস্ত। সনাতন মুগ্ধ হয়ে দেখে তার কাজ। একটা অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে, কখনও তো হাতে ধরে শেখায়নি মেয়েটাকে, সারাজীবন খেদিয়েছে শুধু। জ্বর বলেই নাকি অন্য কোনও কারণে তার চোখে জল এসে যায়। সে শংকরীর মাথায় হাত ছুঁয়ে ডাকে ‘মাগো, তুই নিজে, একা একা’ আর সে বলতে পারে না, গলা বুজে যায়। শংকরী চমকে উঠে দাঁড়ায়, ধরা পড়ে যাবার লজ্জা ও ভয়ে সে মাথা নিচু করে ঘামতে থাকে। তার দিকে না তাকিয়ে সনাতন ভালো করে তার গড়া ঠাকুরটি নিরীক্ষণ করে। প্রতিমার আসল জিনিস অঙ্গসংস্থান, সেটা যে আয়ত্ত করতে পারে, তার কাছে ছোটো বড়ো প্রতিমা কোনও ব্যাপার নয়। পারবে, শংকরী পারবে, এই তো তার উত্তরসূরি। কথাটা মনে হতেই সনাতনের ম্যাজমেজে ভাব কেটে যায়, শরীরে যেন তাজা রক্তস্রোত বয়ে যায়। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা আসে। মেয়েমানুষের তো হাজারটা ফ্যাকড়া। সে গলা ঝেড়ে মেয়েকে বলে, ‘হ্যাঁ মা, তোর কাচা কাপড় তো? শরীর ঠিক আছে তো, মানে ওই ঋতুস্রাব…’

পরদিন তেড়েফুঁড়ে উঠল সনাতন। এতবছরের অপরাধ ও একদিনে স্খালন করবে এমন যেন সংকল্প তার। তার বউ অষ্টমী, বাতের ব্যথা আর নানা মেয়েলি অসুখে বারো মাস বিছানায় শোয়া, তার কানে গেল কথাটা। সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করল।

‘ভীমরতি হয়েছে এই বয়সেই? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েমানুষ পটুয়া হবে? একে ওইরকম হিড়িম্বা রাক্ষুসীর মতো চেহারা, ওর ওপর পটুয়া রটে গেলে ও মেয়ের আর বর জুটবে?’

সনাতন কান দেয় না ও কথায়। মেয়েমানুষ নাকি চাঁদে যাচ্ছে, তা আকাশের মাথায় উঠতে যদি পারে মাটি ঘেঁটে ঠাকুর বানাতে পারবে না? আরে মাটি মানে তো স্বয়ং জননী বসুন্ধরা। তা তিনি নিজেই তো মেয়েমানুষ। এসব কথা নিজের মধ্যেই রাখে সনাতন। এত কথা বলেই কি লাভ? অষ্টমী ওসব শোনার লোকই নয়। তাছাড়া সনাতনের সময় নষ্ট করার সময় নেই মোটে। পুজো এবার আগে পড়েছে। এতগুলো বায়না। চকগড়িয়া বারোয়ারি পুজো, টালিগঞ্জের সেভেন ফাইটার্স ক্লাব, সবচেয়ে চাপের ওই বেহালার মন্ত্রীর পুজোটা, দুম করে কোনদিন যে বলে বসবে ডেলিভারি নেব। তবু বুকের মধ্যে ভরসা টের পায় সনাতন। এবছর তার সঙ্গে শংকরী আছে। ভোর থেকে উঠেই কাজে লেগে পড়ে সনাতন, রান্নাবান্না সেরে সংসারের কাজ গুছিয়ে শংকরী আসে একটু পরে। সনাতনের কড়া নির্দেশ স্নান সেরে আসতে হবে আর মাসের ওই চারটে দিন সে কাজে হাত দিতে পারবে না। শংকরী এমনিতে কম কথা বলে। শক্ত চেহারার ঠোঁটটেপা মেয়ে সে। কিন্তু চারদিন কাজে হাত দিতে পারবে না শুনে সে আস্তে করে বলেছিল ‘মা দুগ্গাও তো মেয়েমানুষ বাবা, মহিষাসুরকে মারার সময় যে তাঁর মাসিক হচ্ছিল না, এ কথা কে বলতে পারে?’

সনাতনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল শুনে। আজকালকার মেয়েদের মুখে কিছুই আটকায় না। সে ঢোঁক গিয়ে বলেছিল ‘শোন ঠাকুর গড়া অত হতচ্ছেদ্দার কাজ নয় বুঝেছিস। জি পালের নাম শুনেছিস?’

জি পালের নাম বলার সময় কপালে হাত ঠেকায় সনাতন।

শংকরী হাঁ করে শোনে সে গল্প।

‘জি পাল মানে গোপেশ্বর পাল। বিলেতে গিয়ে সাহেবদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।’ সনাতন বলে যায় গোপেশ্বর পালের জন্ম ১৮৯৫ সালে, তিন বছরে মা মারা যায়, মামার বাড়িতে মানুষ, কৃষ্ণনগরে মাটির কাজে হাতেখড়ি। সেখানে একবার ঘূর্নিতে এলেন স্বয়ং ছোটোলাট কারমাইকেল, তাঁর চোখে পড়ল গোপেশ্বরের প্রতিভা। সেটা ১৯১৫ সাল, গোপেশ্বর তখন কুড়ি বছরের যুবক। তারপর সে চলে এল কলকাতা। আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। ১৯২৮ সালে গোপেশ্বর পাল বিলেতে যায়। সেখানে পঞ্চম জর্জের ভাই ডিউক অব কনটের মূর্তি পাঁচ মিনিটে বানিয়ে ধন্য ধন্য ফেলে দেয়। সাহেবদের কাগজেও ছাপা হয়েছিল সে খবর।

‘জি পালের সঙ্গে জাহাজে চেপে বিলেতে আর কী গেছিল জানিস?’

এই অবধি বলে সনাতন খানিকটা কুইজমাস্টারের ঢঙে শংকরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওর জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই বলে ‘মাটি রে মাটি। বড়ো বড়ো দু-ব্যারেল ভর্তি বাংলার মাটি। তাহলে বুঝলি তো মাটি কত পবিত্র জিনিস। সবসময় এই মাটিকে প্রণাম করে কাজ শুরু করবি।’

শংকরী বলে ‘আমাদের নিজেদের লোক বিলেত গেলেন, সে তো কত আগে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কি কিছু পালটাল? এই নোংরা গলি, প্যাচপ্যাচে রাস্তা, অন্ধকার ঘরে কাজ – এই চলছে।’

সনাতন একটু থমকে যায়, তারপর বলে ‘মা যদি তাঁর সন্তানের কপালে দুঃখ লিখে রাখেন, খন্ডাবে কার বাপের সাধ্যি? নে নে কার্তিকটা ধরে ফেল।’

‘কার্তিক?’ কেমন ধন্দে পড়ে যায় শংকরী। ‘আমি কার্তিক করব?’

‘কেন? পারবি না? খুব পারবি’ বলে সনাতনের খেয়াল হয় মেয়ের কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। সে শংকরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ‘ওরে দেবতার যেমন নারী পুরুষ হয় না, শিল্পীরও নারী পুরুষ হয় না। মনে রাখবি, সব মূর্তিই তোর কাছে সমান।’

সনাতন আরো কিছু বলত হয়তো। কিন্তু কে যেন ডাকে তাকে বাইরে থেকে। বাইরে এসে দেখে নাড়ু। কারুভান্ডার দোকানটা ওদের। প্রতিমার চুল, চাঁদমালা, চুমকি, কিরণ, গোখরী, জামীর ভুরো, পাট, অস্ত্র সব ওরা সাপ্লাই দেয়। নাড়ু জানতে এসেছে কটা কী লাগবে। সনাতন ওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে তখন বাবার অর্ধেক গড়া কার্তিক মূর্তির সামনে অচঞ্চল হয়ে বসে থাকে শংকরী। পরম রূপবান পুরুষ তার সামনে। মূর্তির ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায় শংকরী, ওর আঙুল আস্তে আস্তে মূর্তির শরীরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে। আপাদমস্তক এক পুরুষশরীর প্রথমবার ছুঁয়ে শরীর-মনে কেমন এক জোয়ার অনুভব করে শংকরী। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলায়। চোখ বুজে কী যেন ভাবে একটুক্ষণ। তারপর যখন চোখ খোলে, তখন সে দেখে কার্তিক কোনও পুরুষ নয়, সে শংকরীর সামনে একটি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে এটুকুই জানে শংকরী।

পটুয়াপাড়ায় বছরের এই ক’টা মাস কখন সকাল সন্ধেয় গড়ায়, সন্ধে গভীর রাতে কেউ জানতেও পারে না। এ বছর তার সঙ্গে লেগেছে বৃষ্টি। প্রতিমাশিল্পীদের মাথায় হাত, মাটি শুকোচ্ছে না। রং লাগানো হবে কখন? গলি ভেসে যাচ্ছে সকাল থেকে। কী একটা দম বন্ধ করা গন্ধ উঠেছে। কাজ করতে করতে নাড়ুর গলা পেয়ে রাগ ওঠে শংকরীর। নাড়ু আজকাল বড্ড ঘন ঘন আসছে আর লাগাতার আনসান বকুনি। আজ ভিজে জাব হয়ে এসেছে। আর এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে নাড়ু বলে, ‘ও কাকা, কী শুনে এলাম শোনো। রেনবো চ্যানেল থেকে আসবে শংকরীর ইন্টারভিউ নিতে!’

সনাতনের হাত থেমে যায়।

‘হ্যাঁ গো কাকা, মেয়েছেলে মূর্তি গড়ছে, চাউর হয়ে গেছে তো। ওরা দেখাবে টিভিতে।’

সনাতনের বুকে ধক্ করে লাগে কথাটা। এত বছর সে মাটিতে মুখ ঘষছে কেউ ফিরেও তাকায়নি, টিভি দূরের কথা কাগজেও ছবি ওঠেনি তার, আর তার মেয়ে দুদিন কাজ করেই এত মাতব্বর হয়ে গেল!

সে শক্ত মুখে বলে ‘না না, ওসব মাতনে মাতলে কাজবাজ মাথায় উঠবে। পুজো তো দোরগোড়ায় এসে গেল। মন্ত্রীর পুজো নিয়েই বেশি চিন্তা। কবে যে ফিতে কাটার দিন ফেলে।’

নাড়ু বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘আরে কাকা, এসব এখন দরকার। প্রচার হবে, তাও ফ্রিতে। টিভিতে মুখ দেখাবার জন্যে সবাই হন্যে হয়ে ঘুরছে।’

সনাতন এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘নাড়ু, তুই এখন যা দিকিনি। এই তো ঘরের ছিরি, চারদিকে সব থইথই করছে, কোথায় বসতে দেব ওদের? আর আমাকে তুই টিভি শেখাচ্ছিস? আমি দেখিনি, বাবু পালের বাড়ি কতবার এল ওরা। একেবারে একগাড়ি লোক। কাজ নষ্ট সারাদিনের।’

‘হ্যাঁ, তা একটু হবে, তবে এই ঘরটাই তো তুলতে চাইছে ওরা। আবার বলছে একদিন শংকরীকে নিয়ে যাবে, রিয়েলিটি শো হয় না, লাগ ভেলকি লাগ? সেখানে পার্টিসিপেট করতে হবে ওকে। কত প্রাইজ আছে জানো?’

‘না না ওসব হবে না। মেয়েমানুষ একবার ঘরের বার হলে রক্ষে আছে? এই কাজ কি ও বারোমাস করবে নাকি? এবছর আমার শরীরটা যুতে নেই, ও বাড়ি বসে আছে, বিয়ের পর বাচ্চার কাঁথা কাচবে, না ঠাকুর গড়বে? যত পাগলের কাণ্ড। ভাগ তুই।’

‘দাঁড়া নাড়ু’ হঠাৎ কার গলা? চমকে তাকায় সনাতন, শংকরী এতক্ষণ মুখ নীচু করে কাজে মন বসাবার চেষ্টা করছিল, একটা রা-ও কাটেনি, মুখ তুলে অষ্টমীকে দেখতে পায়। অষ্টমী, বারোমাস বিছানায় পড়া মানুষটা উঠে এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সনাতন অবাক গলায় বলে ‘তুমি রুগি মানুষ উঠে এলে যে বড়ো? মেয়েমানুষ এসবের মধ্যে কেন আবার?’

‘মেয়েমানুষের মূর্তি গড়ে ভাত খাও আর ঘরের মেয়েমানুষদের দাবিয়ে রাখো, আমি বলছি আমার মেয়ে যাবে।’ অষ্টমী চ্যাঁচায় না, অদ্ভুত শান্তগলায় বলে ‘বিয়ে দিলেই সব মিটে গেল? ওর ভবিষ্যৎ নেই? দরজায় সুযোগ হেঁটে আসছে, উনি বলছেন যাবে না। বড্ড জ্বলুনি না? কেমন বাপ তুমি? মেয়েকে হিংসে করো?’

সনাতন রাগে থরথর করে কাঁপে। হাতের কাছে থাকা একটা মাটির খুরি ছুড়ে মারে, অষ্টমী মাথা সরিয়ে নেয় চট করে, দরজায় লেগে ভেঙে যায় খুরিটা। পা বাঁচিয়ে গিয়ে মাকে ধরে শংকরী।

দরজার পাশে ডাঁই করা অস্ত্র, নাড়ু রেখে গিয়েছিল কাল। সেখান থেকে একটা ত্রিশূল তুলে নিয়ে খুরির টুকরোগুলো একপাশে ঝেঁটিয়ে আনে শংকরী, তারপর সেই ত্রিশূল হাতে মার পাশে যখন দাঁড়ায়, সনাতনের তাক লেগে যায় দেখে। তার ভাঙা ঘরের নড়বড়ে দরজার চালচিত্রে তার অসুন্দর মেয়েটাকে অবিকল গর্জনতেল মাখা দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখায়…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব