অরুণিমা

‘সাগ্নিক, আজ দিদি আর জামাইবাবু আসছে খেয়াল আছে তো? ট্রেনের সময়টা নেট-এ চেক করে স্টেশনে পৌঁছে যেও। দেখো দিদিদের যেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করতে হয়। আমি আজ কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না। বাইরে থেকে ডেলিগেট্স আসছে। ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর হবে না’, অরুণিমার কথাগুলো সাগ্নিকের কানে ঢুকল। কাজের থেকে চোখ না তুলেই স্ত্রীকে উত্তর দিল, ‘আমি যেতে পারব না। ফোন করে দাও, ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবে।’

‘বিয়ের পর প্রথমবার ওরা আমাদের বাড়ি আসছে। এখান থেকে কেউ না গেলে ওরা খারাপ মনে করবে। তোমার দিদি যখন এখানে এসেছিল তখন তুমি এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে কাজ করেছিলে। এখন একটা দিন তুমি করতে পারছ না?’ বিরক্তি চাপতে পারে না অরুণিমা।

নিরুত্তাপ গলায় সাগ্নিক উত্তর দেয়, ‘দিদি আমাদের সুখের সংসার দেখতে এসেছিল। আমরা যে অত্যন্ত সুখে রয়েছি সেটা দিদিকে বোঝাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় দিদিকে খুব নিরাশ মনে হল। বিয়ের পরেই ভেবে নিয়েছিলাম যখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে, নিজের টাকাপয়সাও যার যার নিজের, বন্ধুবান্ধবও দুজনের আলাদা তখন তোমার আত্মীয়স্বজনরা আমার হয় কী করে? এটাই বেশ ভালো ব্যবস্থা। তুমিই বলো না?’

অরুণিমার নিজের করা ব্যবস্থাই আজ হঠাৎ করে মোড় ঘুরে ওকেই আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।

ছয় বছরের প্রেমপর্ব শেষ করে সাগ্নিক আর অরুণিমার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের এক বছর হতে না হতেই বিয়ের আগের গভীর প্রেম ওদের দুজনের সংসারের চৌকাঠ পার করে বাইরে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। একে অপরকে অপমান করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করত না। মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে ওদের ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে হোটেল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিল হোটেলের ম্যানেজার। অগত্যা হোটেল ছাড়তে ওরা বাধ্য হয়েছিল।

অথচ হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল ছ’দিনের জন্য। ম্যানেজারের কথা শুনেই অরুণিমা তাই রেগে ওঠে, ‘আমরা আগে থেকে পুরো টাকা দিয়ে রুম বুক করেছি। আপনি আমাদের চলে যেতে কীভাবে বলছেন?’

‘আপনি ঠিকই বলছেন ম্যাডাম। কিন্তু আপনাদের জন্য হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের আমি অসুবিধায় ফেলতে পারি না। আর আপনি অ্যাডভান্স টাকা দেওয়ার কথা বলছেন, তাহলে আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাগের মাথায় আপনারা স্বামী-স্ত্রী হোটেলের সম্পত্তির অনেক ক্ষতি করেছেন। কাপ, কাচের বাসন ভেঙেছেন। সুতরাং সেগুলোর টাকা তো আপনাদেরই চুকোতে হবে। এই সব টাকা কেটে নিয়ে যে-টাকাটা বাঁচবে সেটা আপনাদের ফেরত দেওয়া হবে।’ ম্যানেজারের উত্তরে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝতে পারে সাগ্নিক আর অরুণিমা।

হোটেলের ঘরে ফিরে আসে ওরা। হোটেল ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে স্থির করে নেয় পরের দিনই ওরা হোটেল ছেড়ে দেবে। ব্যস, আর কোনও কথা হয় না ওদের মধ্যে।

পরের দিন হোটেল ছেড়ে অন্য হোটেল খুঁজে নেয় সাগ্নিক। কারণ ফেরার টিকিট কাটা ছিল চারদিন পরের তারিখে। সুতরাং দু’জনেরই আগে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় ছিল না ওদের কাছে।

‘হ্যাঁ রে কেমন কাটল তোদের ওখানে?’ সাগ্নিকের মায়ের কণ্ঠস্বরে অরুণিমা মোবাইল থেকে মুখ তোলে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফেরার আগে সাগ্নিকের বাবা-মায়ের অনুরোধে তিনদিনের জন্য ওরা এখানে এসেছে। সাগ্নিকের বাবা, মা দুজনেরই বয়স হয়েছে তারপর ওই একমাত্র ছেলে। সুতরাং ছেলে-ছেলে বউয়ের কাছেই ওদের যা কিছু আশা। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক দূরে সুতরাং ইচ্ছে থাকলেও মেয়েকে কাছে পাওয়া হয় না। আর অরুণিমাও মেয়েই হয়ে উঠেছিল ওদের কাছে কারণ পাঁচ বছরেরও বেশি দেখছেন ওনারা ওকে।

‘হ্যাঁ জায়গাটা তো বেশ ভালোই, খারাপ কাটেনি কয়েকটা দিন’, কম কথায় সারবার চেষ্টা করে অরুণিমা কিন্তু ওর নিষ্প্রভ চেহারা সাগ্নিকের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

‘কী ব্যাপার বল তো? তোকে আর বাপ্পাকে কেমন যেন মনমরা লাগছে। মনেই হচ্ছে না এই কদিন আগে তোদের বিয়ে হয়েছে। কোনও সমস্যা?’

‘মা, তোমাকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল করে ফেলেছি। সাগ্নিক আর আমার একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।’

‘কী বলছিস তুই? ছয় বছর তো একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারতিস না। বাপ্পাকে কত বলেছিলাম, দিদির বিয়েটা হয়ে যেতে দে, তারপর বিয়ে করিস কিন্তু তোরা দুজন আমার কথাই শুনিসনি।’

‘তুমি ঠিকই বলছ। সত্যি বলতে কি এই কয়দিনে সাগ্নিকের আসল রূপটা আমার সামনে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। মনেই হচ্ছে না এই মানুষটার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম,’ গলা বুজে আসে অরুণিমার।

‘কী ভেবেছিলাম আর কী হল। ভেবেছিলাম তোরা দুজন সুখী হলে আমরাও আনন্দে থাকব। এখন তো সবই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আমার এটাই দুঃখ যে ছয় বছরের পরিচয়েও তোরা একে অপরকে চিনতে পারলি না।’

‘মা, এটা নিয়ে এত চিন্তা কোরো না। কয়েকটা দিন আরও দেখি। সাগ্নিক বলছিল একান্তই যদি কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে না পারি তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব।’

‘খবরদার, ভবিষ্যতে কখনও এই কথা মুখে আনবি না। বাপ্পার সাহস তো কম নয়। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ কখনও ডিভোর্সের কথা উচ্চারণই করেনি আর করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। চারদিন বিয়ে হয়েছে তোদের আর এখনই ডিভোর্স নেওয়ার কথা ভাবছিস!’ অরুণিমা বেশ বুঝতে পারে সাগ্নিকের মা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

‘মা, এখনই এতটা উত্তেজিত হয়ে পোড়ো না। ছয় মাসের মধ্যে কিছু করব না। তবে সব ফ্যামিলিতেই কোনও কাজ কখনও না কখনও প্রথমবারই করা হয়। বিয়ে করার অর্থ এও তো নয় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলেও বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে,’ অন্যমনস্কভাবে অরুণিমা কথাগুলো বললেও, সাগ্নিকের মায়ের ছায়াঘন অন্ধকার মুখখানা তিরের মতো অরুণিমার বুকে গিয়ে বিঁধল।

দিদিকে স্টেশন থেকে আনা নিয়ে অরুণিমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সাগ্নিকের মন বারবার অশান্ত হয়ে উঠছিল। ভাবল মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনটা একটু শান্ত হবে, এই ভেবে বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল সাগ্নিক।

‘কী রে, ব্যাপার কী তোর? আজ হঠাৎ মায়ের কথা কী করে মনে পড়ল?’ সাগ্নিকের গলা শুনেই মা অভিমানের স্বরে বলে উঠলেন।

‘তুমি কী যে বলো মা! কাউকে ভুলে গেলে তবেই মনে পড়ার প্রশ্ন আসে। আর তুমি তো সবসময় আমার সঙ্গেই আছ।’

‘ভালো লাগল বাপ্পা তোর কথা শুনে। আর বল, কেমন সংসার করছিস?’

‘আজ অরুণিমার দিদি, জামাইবাবু আমাদের এখানে আসছেন। অরুণিমা খুব খুশি। আমাকে বলেছে ওদের স্টেশন থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমার কাজ আছে, যেতে পারব না,’ বলে হালকা হবার চেষ্টা করে সাগ্নিক।

‘তোর কী হয়েছে বাপ্পা? পাড়ার মধ্যে কারও দরকার হলে, সাহায্যের জন্য তুই ঝাঁপিয়ে পড়তিস…অতিথি আমার তোমার হয় না, সকলেরই তার জন্য করা উচিত,’ মা বোঝাবার চেষ্টা করেন।

‘দিদিও তো এসেছিল। অরুণিমা দিদির সঙ্গে অপরিচিতের মতোই ব্যবহার করেছে। এটা আমি চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।’

‘সংসারে নানা কথা হয় কিন্তু তাই বলে অশান্তি বাড়ালে বাড়তেই থাকে। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে থাকতে হবে সুতরাং একটু বুঝে চললে পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’

‘মা, তুমি সবসময় আমারই দোষ ধরো। আমি যদি ঠিকমতো উত্তর না দিতে পারি তাহলে সেটা আমার হার হবে। তুমি তো জানো হার স্বীকার করা আমার ধাতে নেই।’

‘সব কিছুকেই হার-জিত হিসেবে ধরছিসই কেন? বিবেক বলেও তো মানুষের কিছু থাকে। বিবেক যা বলে তাই সকলের করা উচিত। যাই হোক, তোদের খবরাখবর বল।’

‘এমনি সব ঠিকঠাকই আছে। তুমি আর বাবা কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাও। তোমাদের ভালো লাগবে।’

‘ঠিক আছে দেখছি। এখন ফোন রাখি। অরুণিমাকে বলিস পরে ওর সঙ্গে কথা বলব কারণ এখন ওর অফিস বেরোনোর সময়।’ এই বলে ফোন রেখে দেন সাগ্নিকের মা।

ছোটো থেকেই অরুণিমার উপর ওর মায়ের প্রভাব একটু বেশিই ছিল। বাবা বরাবর বাইরে বাইরে চাকরি করেছেন তাই মায়ের সঙ্গেই সময় কেটেছে বেশি অরুণিমা ও ওর দিদি অমৃতার। বয়সে ছোটো বলেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, অরুণিমা একপ্রকার মায়ের ন্যাওটাই ছিল। ছোটো থেকেই মায়ের কাছে অরুণিমা শিখেছে, নিজের ভালোর জন্য সবসময় সজাগ থাকাটা এবং ব্যক্তিত্ব রাখাটা খুব দরকার যাতে অপর পক্ষ দেখে ভয় পায়। এমনকী কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের ভয় দেখাতে হবে এমনটাও অরুণিমার, মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা সবসময় বলতেন, ‘সবরকম বিপদ থেকে আমি তোদের বুক দিয়ে আগলেছি। তোদের বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার পরিবারের লোকজন আমার জীবন প্রায় নরক করে তুলেছিল। ওরা তখন বুঝতে পারেনি যে আমি নরম মাটি দিয়ে তৈরি হইনি, রুখে দাঁড়িয়েছি ওদের বিরুদ্ধে।’

অরুণিমার কাছে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথাই ছিল অটল সত্যি। এমনকী মায়ের অনুমতিতেই সাগ্নিকের সঙ্গে প্রেমটা এগোতে পেরেছিল।

বিয়ের পরেও নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সাগ্নিক এবং ওর মা-বাবা-দিদির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল অরুণিমা।

সংসারে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে সাগ্নিকের মনকে বিরূপ করে তুলেছিল। সাগ্নিকের প্রতিশোধপ্রবণতার প্রমাণ হাতেনাতে পেল যখন সাগ্নিক অরুণিমার দিদিকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে অস্বীকার করে মুখের উপরে ওকে জানিয়ে দিল। অরুণিমারও স্টেশন যাবার উপায় ছিল না অফিসের কাজের জন্য। অগত্যা ফোন করে অরুণিমা দিদিকে জানিয়ে দিল ট্যাক্সি করে ওদের বাড়ি চলে আসতে। বাড়িতেও কাজের লোককে অতিথিদের ঠিক করে অভ্যর্থনা করার কথা বুঝিয়ে অফিসের জন্য রওনা হল অরুণিমা। কিন্তু মন পড়ে রইল বাড়িতে।

‘জানিনা, দিদি কী ভাবছে আমাদের সম্পর্কে। বিয়ের পর প্রথমবার আমাদের বাড়ি আসছে তাও জামাইবাবু মানে কৃষ্ণেন্দুদা-র সঙ্গে। মুম্বই যখন পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম তখন প্রায়ই হস্টেল থেকে দিদির ওখানে পালিয়ে যেতাম। দিদির যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না। আর রান্না করতে দিদি প্রচণ্ড ভালোবাসে এবং সেই সঙ্গে খাওয়াতেও। রোজই নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াত। আর আজ যখন দিদিরা আসছে তখন আমরা কেউই বাড়িতে রিসিভ করার জন্য থাকছি না,’ অফিসের সহকর্মীর কাছে মনের অস্থিরতাটা চেপে রাখতে পারে না অরুণিমা।

অরুণিমা নিজে রান্নাঘরে ঢুকতে পছন্দ না করলেও দিদির কাছে শুনেছিল, কৃষ্ণেন্দুদা বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই আগে থেকেই সব রকমের ফল, সবজি, খাবার কিনে ফ্রিজ ভরে রেখেছিল অরুণিমা। সন্ধেবেলায় অফিস থেকে যখন বাড়ি পৌঁছোল, ভিতরে পা দিতেই হাসির শব্দ ভেসে এল অন্য ঘর থেকে। নিজের অজান্তেই অরুণিমার ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল। ঘরের দিকে পা বাড়াল অরুণিমা।

‘কী ব্যাপার? এত হাসাহাসি কীসের জন্য? আমাকেও তো কিছু বল দিদি।’ কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে অরুণিমা বলল, ‘ভেরি সরি, কৃষ্ণেন্দুদা। কিছুতেই স্টেশন যেতে পারলাম না, অফিসে ছুটি পেলাম না। নিজের লোকেদের জন্যই চাকরি করা অথচ দেখুন তাদের দরকারেই ছুটি পাওয়া যায় না।’

‘নিমি, এত দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাগ্নিক, অতিথি সৎকারে কোনও ত্রুটি রাখেনি। বরং বলতে পারো, তোমার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই হয়নি,’ কথাটা বলেই কৃষ্ণেন্দু হেসে ফেলে।

‘আঃ! তুমি রাখবে। নিমিকে দেখলেই হল। ওর পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চাও না। বেচারা অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছে,’ অমৃতা কৃষ্ণেন্দুকে থামাবার চেষ্টা করে।

‘আমি তোমার বোনকে কেন খ্যাপাব? আমাদের জন্য বেচারা শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগবে কেন? আমরা তো দিব্যি আরামেই সময় কাটাচ্ছিলাম,’ কৃষ্ণেন্দু পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি কৃষ্ণেন্দুদা। আমি না থাকলেই সবাই বেশি খুশি থাকে,’ সিরিয়াস হওয়ার ভান করে অরুণিমা।

‘দ্যাখো ভাই, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সাগ্নিকই দিতে পারে। আমরা তো মাত্র কয়েক ঘন্টাই এসেছি। আমার তো আবার শালির সঙ্গ বেশি ভালো লাগে।’ কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে অরুণিমাও হেসে ফেলে।

সাগ্নিক শান্তস্বরে বলে ওঠে, ‘কৃষ্ণেন্দুদা, আপনি ভুল করছেন। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমি কবেই বন্ধ করে দিয়েছি। কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিই।’

‘বাঃ, ভায়া! কৌশলটা খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেছ দেখছি। এত বছর বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এটা এখনও আমি রপ্ত করতে পারলাম না,’ কৃষ্ণেন্দু আবার হেসে ফেলে।

‘দেখছিস দিদি, যে আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতে পারে তার কাছে আমার কী আর এক্সপেকটেশন থাকতে পারে?’ অরুণিমার স্বরে কথার ঝাঁঝ স্পষ্ট ধরা পড়ে।

‘তুই শুধু শুধু সিরিয়াস হয়ে পড়ছিস। সাগ্নিক তোর সঙ্গে মজা করছে। সব কথার কি মানে ধরতে আছে?’ অমৃতা বোনকে বোঝাবার চেষ্ট করে।

‘আমি তো বলা, শোনা সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছি দিদি। মা তো প্রথমেই সাবধান করেছিল যে আমাদের আর সাগ্নিকদের বাড়ির কালচারে আকাশপাতাল তফাত। কিন্তু আমিই তখন কথা শুনিনি।’

‘বুঝেছি। আজকাল বুঝি মায়ের কথাতেই উঠছিস বসছিস?’ গম্ভীর হয় অমৃতা।

‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, আর এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? মায়ের থেকে ভালো আমার ভালো-মন্দের কথা আর কে ভাববে বল? মা আমাদের দু’জনের বন্ধুও তো বটে। কেন, তোর এটা মনে হয় না দিদি?’

‘মায়ের কথায় সংসার চালাচ্ছিস? সংসারটা তোর আর সাগ্নিকের না আমাদের মায়ের যে, মা তোর সংসারের চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখতে চাইছে?’ সাগ্নিক আর অরুণিমা দুজনের মধ্যে একটা টেনশন চলছে এমন আাঁচ পেয়ে, রাগত গলায় অমৃতা বোনকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।

দুই বোনকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণই সাগ্নিককে নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসে। অমৃতা ঠিকই করে নেয় বোনকে বোঝানো দরকার কারণ কথাবার্তার মাঝেই বুদ্ধিমতী অমৃতা বুঝে নিয়েছিল সাগ্নিক আর ওর বোনের সম্পর্কটা একটু শুধরোনো দরকার।

‘দিদি, আমি জানি সংসারটা আমাদের, কিন্তু মায়েরও আমাকে বলার অধিকার আছে। মা-কে আমি প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। প্রয়োজনে আমি মায়ের জন্য সবকিছু করতে পারি। এখন আমাদের বিয়েটা বাঁচাবার জন্য মা উঠে পড়ে লেগেছে। তুই বিশ্বাস করবি না দিদি, বিয়ের পর সাগ্নিক কতটা বদলে গেছে। সব সময় নিজের মত আমার উপর চাপাবার চেষ্টা করে। আমার যে আলাদা একটা আইডেনটিটি আছে সেটা ও মানতে চায় না। মা প্রথমেই বলে দিয়েছিল শক্ত হাতে সাগ্নিকের এই অভ্যাসটা দমন করতে, নয়তো আমাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ফেলতে ও এক মুহূর্তও দেরি করবে না। সুতরাং সাগ্নিক যাই করুক না কেন আমি সাবধান হয়ে গেছি।’

‘কী বলছিস তুই?’ অমৃতা বিস্ময় চাপতে পারে না। ‘সাগ্নিকের নিন্দে করাটা মায়ের কাছে কি খুব দরকার ছিল? আমাদের জন্য মায়ের চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও একটা সংযমের সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে। তুই এখন বাচ্চা নোস যে সব কথায় মা-কে টেনে আনতে হবে। নিজের ডিসিশন নিজেকেই নিতে হবে।’

‘আচ্ছা ছাড় দিদি, এসব কথা। স্টেশন থেকে বাড়ি আসতে তোদের কষ্ট হয়নি তো?’

‘কষ্ট কেন হবে? সাগ্নিক তো স্টেশনেই ছিল। বাড়ি নিয়ে আসা থেকে খাওয়াদাওয়া যত্নের কোনও ত্রুটি রাখেনি।’

‘আর একটা দিন দিদি কষ্ট কর। এর পর পাঁচদিনের ছুটি রোববার নিয়ে। খুব মজা করব। বাইরেই খাওয়াদাওয়া সেরে নেব। বাড়িতে ওসব ঝঞ্ঝাটই রাখব না,’ অরুণিমা দিদির গলা জড়িয়ে ধরে।

‘না রে সে হবে না। কৃষ্ণেন্দু বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করে না। আমি রান্না করতে ভালোবাসি, আমিই নতুন নতুন রান্না করে তোদের খাওয়াব। সাগ্নিক রান্না করে?’

‘হ্যাঁ। আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছেমতো নিজেরাই আলাদা করে খাবার বানিয়ে নিই। মায়ের কথামতো রান্না করে খাইয়ে সাগ্নিকের অভ্যাস আমি খারাপ করতে চাই না। রান্না করাটা কি খালি মেয়েদেরই কাজ, তুই বল না দিদি?’ দিদির কাছে সব কথা বলতে পেরে, এখন কিছুটা হালকা অরুণিমা। প্রায় জড়তাহীনভাবে বলল, ‘সংসার করবার প্রথমেই মা সাবধান করে দিয়েছিল যে, রান্না না করার সবথেকে ভালো দিক হল, বাড়িতে ভালো রান্না হলে খেয়েদেয়ে বাড়ির পুরুষ-মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হবে। অযথা মেদ বাড়বে। এই ভালো, এতে চেহারাও ভালো থাকবে, বাড়িঘর নোংরাও হবে না।’

‘হ্যাঁ। তাই জন্যই মা, বাবাকেও নিজের জীবন এবং সংসার থেকে দূরে রেখেছিল,’ অমৃতার গলায় মায়ের প্রতি বিদ্বেষ ঝরে পড়ে।

‘কী বলছিস তুই দিদি?’ অরুণিমার স্বরে অবিশ্বাস।

‘না, না কিছু না। আমার মুখ থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছে।’

‘না, দিদি। তুই আমার থেকে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিস। তোকে বলতেই হবে,’ অরুণিমা জেদ ধরে।

‘লুকোবার মতো কিছু নয়। মা তোকে যেটা শেখাচ্ছে নিজের জীবনেও ওই একই জিনিস করেছে। তুই তখন খুব ছোটো ছিলি। কিন্তু আমার সব মনে আছে। বাড়িতে রান্নার লোক ছিল কিন্তু মা ওকেও রান্না করতে দিত না আর নিজেও করত না। বাবা অফিস যেত চা পাউরুটি খেয়ে, বাড়ি এসেও কপালে কিছু জুটত না। মা বদারও করত না। বাবা নিজেই রাতে কিছু বানিয়ে নিত, আমার বাবার জন্য কষ্ট হতো, তাই বাবাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতাম। রান্না করার শখটা হয়তো আমি বাবার থেকেই পেয়েছি,’ অমৃতা বলে।

‘কিন্তু বাবা তো শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে বদলি নেয় বাবা। রান্নার লোকটাকে বাবা ছাড়িয়ে দেয় মায়ের জেদের কাছে হার মেনে। ছোটোবেলায় আমরা মানুষ হয়েছি বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে।’

‘বাবার মুখটাই আমার ঠিক করে মনে পড়ে না,’ স্মৃতি হাতড়াতে থাকে অরুণিমা।

‘তোর মনে থাকার কথাও নয়। আমারই তখন দশ বছর বয়স। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বাবা অন্য শহরে চলে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলে স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, গিফ্টও নিয়ে আসত আমাদের জন্য। মা জানতে পেরে, স্কুলকর্তৃপক্ষকে বলে, বাবার স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে আমার মায়ের ওপর রাগ বাড়তে থাকে। মায়ের স্বার্থপরতার জন্য মা-কে আমি ভালোবাসতে পারিনি। মা-ও বুঝেছিল আমার মনের কথা। তাই আমাকেও হস্টেলে পাঠিয়ে নিজের কর্তব্যে ইতি টেনে দিয়েছিল মা,’ না চাইতেও অমৃতার চোখ চলে ভরে যায়।

‘মনে আছে দিদি, তুই শুধু ছুটিতে বাড়ি আসতিস। তখন আমরা দুই বোন খুব মজা করতাম।’

‘তোর জন্যই তো বাড়িতে আসতাম। মা-র কোথায় সময় ছিল আমাদের জন্য?’

‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। পরে মা আমাকেও তো হস্টেলে পাঠিয়ে দিল। সুমন কাকু সেসময় খুব বড়িতে যাতায়াত করত। আমাদের ফ্যামিলিটা ভেঙে দেওয়ার পিছনে ওনারও বিশাল ভূমিকা রয়েছে।’ অমৃতা বুঝতে পারে সুমন কাকুর উপর অরুণিমার রাগ আজও এতটুকু কমেনি।

‘নিজের সমস্যার জন্য অপরকে দোষারোপ করিস না নিমি। এই অভ্যাস ছাড় দেখবি তোরই ভালো হবে। এখন নিজের সংসার সামলা। তোর সংসার ভেঙে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব।’

‘তোর কি মনে হয় সব দোষ আমার?’

‘আমি তোর দিদি হই। তোর থেকে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। দোষ কার সেটা বিচার করার আমি কে? কিন্তু একটা কথা বলতে চাই, তোর নিজের সংসার তুই নিজেই একমাত্র বাঁচাতে পারিস,’ অমৃতা স্পষ্ট কথাটা বোনকে বলেই ফেলে।

‘কী হল? দুই বোনের না হয় অনেকদিন বাদে একসঙ্গে দেখা হয়েছে মানছি কিন্তু তাই বলে খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ নাকি?’ কৃষ্ণেন্দু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সহাস্যে দু’জনকে প্রশ্নটা করে।

‘ওঃ সরি কৃষ্ণেন্দুদা। কথা বলতে বলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না। আমাকে দশ মিনিট দিন, ফ্রেশ হয়ে সোজা ডিনার টেবিলে পৌঁছোচ্ছি,’ জিভ কেটে অরুণিমা উত্তর দেয়।

অরুণিমার সংসারে অমৃতা আর কৃষ্ণেন্দুর আসাটা একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিয়ে এসেছিল, যেটা অরুণিমার অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলতে পেরেছিল। একটা সপ্তাহ হইচই, ঘোরাফেরা করে অমৃতারা চলে যেতেই আবার বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল।

দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো সারাদিন অরুণিমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকত। অফিসেও কাজে মন দিতে পারত না অরুণিমা।

একদিন রোজকার মতো সাগ্নিক নিজের ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। অরুণিমা এসে পিছন থেকে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে। সাগ্নিক অবাক হয়, কারণ এই স্পর্শ ও প্রায় ভুলতেই বসেছিল।

‘চলো খাবে চলো। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ অরুণিমার গলায় সেই প্রথম অন্তরঙ্গতা অনুভব করল সাগ্নিক। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আনালে?’

‘আনাইনি, নিজে বানিয়েছি। রেস্টুরেন্টে এই খাবার পাওয়া যায়?’ অরুণিমা হাসে। সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে আলো নিভিয়ে দেয় অরুণিমা। সুরভিত গন্ধের আবেশে সাগ্নিকের অরুণিমাকে যেন নতুন লাগে। অরুণিমা সাগ্নিকের বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে। মনের কথাগুলো ঠোঁটে এসে পড়ে সাগ্নিকের, ‘ইশ, দিদি যদি আরও কয়েকদিন আগে আসত!’ অরুণিমা কিছু বলে না মুখে। পরম নিশ্চিন্তে সাগ্নিকের বুকে মাথা রাখে। মোমবাতির জ্বলন্ত অগ্নিশিখা শুধু সাক্ষ্য থাকে বিরল এই মিলন দৃশ্যের।

 

টান

সবুজ ঘাসের ওপর চাপ চাপ রক্তের দাগ। জানোয়ারও সহ্য করতে করতে একসময় ফুঁসে ওঠে। আর এরা তো মানুষ! দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার লাভা স্রোত তো এরকম হবেই!

ডুয়ার্সের লাবডুঙ চা-বাগান। ছোট্ট চা-বাগান। তাই চা পাতার উৎপাদনও কম। মালিকের অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশা প্রায় অনাহারে থাকা শ্রমিকদের বঞ্চনার আগুনে পুড়িয়েছে দীর্ঘদিন। পরিণাম মালিক রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার থ্যাঁতলানো রক্তাক্ত শরীর ঘিরে জেগে থাকা একরাশ প্রশ্ন ও হতাশা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেই, ইউপিএসসি-র চাকরিটা জুটে গেল অভীকের। স্ট্যাটিসটিকাল ইনভেস্টিগেটর কাম অফিসার। অনেক পরিশ্রম ছিল তার জন্য। মেধাবী অভীক পেরেকটা ঠিক জায়গাতেই পুঁততে পেরেছিল। বেশ মোটা মাইনে। কাঁটাকলের আরও দুজন পেল। অর্ক ও দেবারতি। দেবারতি কিছুদিন পরেই বার্কলে ইউনিভার্সিটি-তে গবেষণা করতে চলে গেল। অর্করও পালাই পালাই ভাব। কলেজ সার্ভিস কমিশনের দিকে তাকিয়ে বসে।

প্রথম দিন থেকেই চা-বাগানের এতো সমস্যার মাঝেও, অভীক আস্তে আস্তে মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে কোথায় যেন ও একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করতে পেরেছিল। মায়ের কথাটা মনে ছিল, ফেস দ্য ব্রুট। চোখে চোখ রেখে সমস্যার মোকাবিলা করো। শেষ সাক্ষাতে বিদ্যামন্দিরের দীপংকর মহারাজের কথাটা যেন কানে বাজে ওর, মানুষের জন্যও কিছু করিস!

আলিপুরদুয়ার স্টেশন রোডের শেষে ওর অফিস। ডিএম অফিস লাগোয়া। ওর থাকার জায়গা কিন্তু কাছাকাছি চা-বাগান কোরাঙ্গিনির বাংলোয়। ভারি মনোরম পরিবেশ। আলিপুরদুয়ারের বারোটা চা-বাগানের বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র, শ্রমিকদের অবস্থা, অনুন্নয়নের কারণ থাকলে তার খোঁজ ও উন্নয়নের নকশা বানানো তবে সব কিছুর মূলে যেন থাকে শ্রমিকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। এক কথায়, মানব মূলধনের রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। আর মাথার ওপর ডিএম, অশোক ভুটিয়া।

ডিএম ভালো বাংলা বলতে পারেন। শিবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। প্রচন্ড মেধাবী। হাই পাওয়ার গ্লাসের নীচে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। প্রশাসনটা দারুণ বোঝেন। খুব বড়ো মনের মানুষ। কর্মীদের বিপদতারণ তিনি। এক মন ভালো করা পরিবেশ ওনার অফিসে।

প্রথম দিন থেকেই অভীকের সাথে ভালোলাগার সম্পর্ক ডিএম-এর। ওনার স্ত্রী বাঙালি। ভালো গানের গলা। সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। অশোকবাবু আবার কবি মানুষ। লেখালেখি করেন অবসরে। অভীকের কবিতা পড়ে একদম আপ্লুত। তবে ও অন্য একটা কারণও বুঝতে পেরেছে। ওনার মৃত ছেলে আকাশের সাথে নাকি ওর অনেক মিল। তাই ভালো লাগায় অপত্যস্নেহের ভাগই বেশি পায় সে।

সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য সে একটা টান অনুভব করে এখন। সত্যিই এরা যেন প্রকৃতির সন্তান। সবুজের মাঝে যেন এক একটা সবুজ মানুষ। বঞ্চনা, অবজ্ঞা এদের দিনলিপি। ওর বাবার কথা মনে পড়ে খুব। সমাজবিজ্ঞানী বাবা বলতেন, রাষ্ট্র সব মানুষের সমস্যার কাছে সব সময় পৌঁছোতে পারবে না। ট্রিকল ডাউন থিওরি থাকবেই। মানে গাছের ওপরের পাতা বেশি জল পাবে আর নীচের পাতায় জল চুঁইয়ে পড়বে। সরকারি সুবিধা কিছু মানুষের কাছে বেশি মাত্রায় যাবে। তাই বেশি-পাওয়া মানুষগুলো যখন কম-পাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, তখনই হবে প্রকৃত উন্নয়ন। তখনই বাস্তব হবে ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ প্রতি ঘরে।

আলিপুরদুয়ারের চা-বাগানগুলোতে, চা পাতার উৎপাদন অন্যান্য বাগানের তুলনায় অনেক কম। মালিকরা উৎপাদন বেশি করতে চায়। চা-বাগান ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠকে অভীক বেশ কয়েবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বহু পুরোনো চা গাছগুলো থেকে বেশি উৎপাদন আশা করা বৃথা। কচিপাতা উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে গাছগুলো। নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেও বিপুল আর্থিক চাপের কারণে, পিছিয়ে আসছে অধিকাংশ চা-বাগানের মালিকরা।

আর কথায় আছে, সুস্থ শরীরে বাস করে সুস্থ মন। অপুষ্টি যেখানে যাপন চিত্র, সেখানে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা সর্বাধিক আশা করা যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব! উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি প্রথম প্রযোজন। দিনপ্রতি একশো টাকায় অন্তত চারজনের একটা পরিবারের ভালো ভাবে চলা এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে খুবই কষ্টকর। তাই লাভের অঙ্ক কষার সাথে, শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে বাঁচার হিসাবটাও কষা দরকার।

চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের বাঁচা সত্যিই নিম্নমানের। হাজারো না পাওয়ার মাঝে বেঁচে থাকা ওদের। এদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। সাহসী অভীক একটা কাণ্ড করে বসল। বেশ কয়েবার চা-বাগান শ্রমিকদের অবস্থা জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রককে কিছু করার আর্জি মেল করেছে সে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! হঠাৎ সুযোগটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই এসে গেল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কয়েজন সদস্যকে নিয়ে চা-বাগান উন্নয়নমন্ত্রী, আলিপুরদুয়ার চা-বাগান পরিদর্শনে আসেন। ডিএম, লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার, অভীক এবং অবস্থা খারাপ এমন চা-বাগানের মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী। আশোকবাবুকে বার বার অনুরোধ করে অভীক আলোচনার স্থান কোরাঙ্গিনি চা-বাগানের অডিটোরিয়ামে করতে বলে।

উদ্দেশ্য একটাই ছিল এর পিছনে। অন্য বাগানগুলোর থেকে কোরাঙ্গিনি অনেকটাই পিছিয়ে। উৎপাদন কম এখানে। এটাকে মালিকরা ঢাল করে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজের চোখে দেখে যাক শ্রমিকদের অবস্থাটা।

আশানুরূপ কাজই হল। মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে চা-বাগানের মালিকরা, শ্রমিকদের অবস্থা বোঝাতে ভুল তথ্য দিতে থাকল। মন্ত্রী তাকে শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থাটা বোঝানোর কথা বলতেই, অভীক কাণ্ডটা করে বসে। সামনে থাকা জল ভর্তি গেলাসের মধ্যে নিজের পেনটা ডুবিয়ে দিয়ে মন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে বসে, পেনটা ঠিক কী দেখছেন? বাঁকা না সোজা? বাকরহিত মন্ত্রী ও অন্যরা। এরকম উপস্থাপনা তাঁরা আশাই করেননি। মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভীক বুঝল, কেল্লা ফতে! জল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে দেখলে, পেন তো বাঁকা দেখাবেই। অর্থাৎ ম্যানেজারদের চোখে শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে গেলে তা সত্য হবে না। অবস্থার অসদ বিম্বটাই ধরা পড়বে এবং তাতে মালিকদেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

এর পর সব কিছু তার পরিকল্পনা মাফিকই হল। শ্রমিক কলোনিতে গিয়ে তাদের ঘর, শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা দেখে আবেগতাড়িত মন্ত্রী। বাগানের ম্যানেজারকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সব কিছু ঠিকঠাক করতে নির্দেশ দিলেন। দেখভালের দাযিত্ব দিলেন ডিএম-কে। শ্রমিকদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির একটা মাস্টার প্ল্যান বানাতে বললেন অভীককে। ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামী মাসে দিল্লি আসার প্রস্তাব দিলেন। অশোকবাবুর উৎফুল্ল মুখ বলে দিল ওনার খুশির কথা।

অভীক মনে মনে এটাই চাইছিল। শ্রমিকদের বাঁচার অযোগ্য পরিবেশের কথা প্রচার করতে হবে ব্যাপক ভাবে। লজ্জায় ফেলতে হবে সভ্য সমাজকে। বোঝাতে হবে, পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে এদের ব্রাত্য করা যাবে না। তবে যদি কাজ হয়। কদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী চা-বাগান শ্রমিকদের, বিনা পয়সায় চাল-ডাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অবস্থা কতটা শোধরাবে!

সারা চা-বাগানে এখন শুধু দিন বদলের স্বপ্ন। অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলোর কাছে অভীক এখন নয়নের মণি। সে প্রত্যাশার চাপটা বোঝে। দিল্লি যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। পুরো দাযিত্ব ডিএম নিজে নিয়েছেন। সসস্ত সময় ধরে উন্নয়নের রূপরেখা বানিয়ে চলেছে অভীক। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে টি টুরিজমের প্রস্তাব রাখছে। টি টুরিজম হলে বাগানের পুরুষগুলো হোটেল, দোকান, রিকশা বা ভ্যান চালানো অথবা গাইডের কাজ করতে পারবে। সহায়ক অর্থনীতি। মহিলাদের চা পাতা তোলার সাথে সাথে, পুরুষগুলোও কিছু আয় করলে বাঁচার পরিবেশ, পদ্ধতি আস্তে আস্তে বদলাবে নিশ্চিত। বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে শুরু করবে। দিনের শেষে মাতাল মরদগুলো ভূমিকা বদলে তখন হয়ে উঠবে প্রেমিক সোয়ামি!

সারা রাত প্রজেক্টটারে কাজ করে শুতে অনেক দেরি হয়েছে অভীকের। সঞ্চিতাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছে অনেক বার। পায়নি। মেযেটা বড়ো মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে তার ভালোবাসা অনুভব করে অভীক। কতদিন দেখা হয়নি! একরাশ মন খারাপ নিয়ে শুতে গেল সে।

পরদিন সকালে চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল অভীকের। কী হল আবার! বাইরে বেরিয়ে চমক। ও কি স্বপ্ন দেখছে? একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? কাল যার কথা মনে করেছে বারবার সে-ই এখন সামনে। মূর্তিমান বর্তমান। আনন্দে উত্তেজনায় নীচে নেমে দেখল, চা-বাগানের মেয়েদের মাঝে সঞ্চিতা। অভীকের মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ল সকলের মাঝে আনন্দ-ঝরনা হয়ে সঞ্চিতা সকলকে জানিয়ে দিল, দুদিন থাকবে সে এখানে। ওইদিন সকলের জোরাজুরিতে রাত্রে খাওয়াদাওয়া, ক্যাম্প ফায়ারের আযোজন, অনেক রাত অবধি চলল নাচ গান। সারা চা-বাগান যেন নতুন প্রাণের উৎসবে মেতেছে। সঞ্চিতা যেন বঞ্চিত মানুষগুলোর মনে রাশি রাশি আনন্দ উল্লাসের জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিল।

পরদিন সকালে খুশির খবর আবার। অশোকবাবু সকালের খবরের কাগজটা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাহাদুরের হাত দিয়ে, মন্ত্রী কথা রেখেছেন। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। মালিকপক্ষের সংগঠনও মেনে নিয়েছে। বাগানের সকলেই এই খুশির খবর, সঞ্চিতা আসার কারণ হিসেবে দেখছে। হাসি মুখে সঞ্চিতার সাথে অভীকও একরাশ টাটকা বাতাস ভরে নিল আগামীর জন্য।

দুটো দিন যেন সত্যিই আনন্দ ভৈরবী তার জীবনে। সঞ্চিতার মুখে শুনেছে শিলিগুড়িতে ব্যাংক অফিসারদের ট্রেনিং ছিল। সে ম্যানেজ করে চলে এসেছে অভীকের কাছে। দুদিন পরেই তাকে আবার ফিরতে হবে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে তার অফিস মালদায়। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে।

দুটো দিন হইচই করে কেটেছে ওদের। চা-বাগান ঘুরে দেখেছে। প্ল্যান্ট-এ গিয়ে চা পাতা তৈরি দেখেছে। অভীক ওকে ফার্স্ট চা তৈরি করে খাইয়েছে। মালদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাকও করে দিয়েছে। সঞ্চিতা বাগানের বাচ্চাদের চকোলেট বিলিয়েছে। সঙ্গে আনা জামা-কাপড় চা তুলতে আসা মেয়েদের দিয়েছে। সাজের জিনিসের অবস্থাও তাই। অভীকের মুখে চা-বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনে, সত্যিই ও মানুষগুলোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। শুধু সঞ্চিতার সারপ্রাইজ ভিজিটের খবর মাকে জানাতে পারেনি অভীক। দিন পাঁচেক আগে ঝড়ের তাণ্ডবে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। শত যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ঠিক হতে কতদিন লাগবে কে জানে!

অশোকবাবু ও বউদিকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছে সঞ্চিতা চলে যাবার আগের রাত্রে। গান আড্ডা গল্প মাউথ অরগানে ভালো লাগা যেন টুপটাপ ঝরে পড়েছে ওদের ঘিরে। সেই সময়ে বিদায়বেলায় চোখের জলে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বউদিকে। সারা রাত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা ওদের দুটো শরীর চাঁদের আলো গায়ে মেখে ভালোবেসেছে, আগামীর স্বপ্ন এঁকেছে। ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সকালের প্রতীক্ষা করেছে।

তবে এ সকাল বড়ো মন খারাপ করা সকাল কোরাঙ্গিনি চা-বাগান জুড়ে। ফোনে ওর মুখে বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ কষ্টের কথা শুনে সঞ্চিতা বলেছিল, একদিন আসবে এখানে। কথা রেখেছে সে। এক সমুদ্র ভালোবাসায় সকলকে ভাসিয়েছে। চা পাতা তুলতে এসে মেযেরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। অশোকবাবু ও তনিমা বউদিরও মন ভালো নেই। সত্যিই যেন জাদু জানে মেযেটা! সকলের মতো অভীকও চেয়েছে, আর কদিন থেকে যাক। কিন্তু মুখে বলতে পারেনি। সঞ্চিতা ম্যানেজার হয়ে বছর খানেক আগে জয়েন করেছে মালদা হেড অফিসে। ওর তাই কাজের বেজায় চাপ, জানে অভীক। শুধু নির্বাক সাক্ষী থেকেছে বিদায়বেলায় চোখের জল নিয়ে। কাল সারারাত যেন শেষের কবিতা-র অনুভব ছিল অভীকের কাছে। তারাদের মিটিমিটি সঙ্গে করে সঞ্চিতার স্মৃতির কোলাজ বানিয়েছে সে রাতজাগা হয়ে কখন আকাশ আলোর খেলায় মেতেছে সে খেয়ালই করেনি। ছোট্ট পাখিটার ডাকে যেন জেগে উঠল মানসঘুম থেকে। জানলায় বসে ল্যাজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে গেয়ে তাকে সুপ্রভাত জানাল পাখিটা। তার মনের দুঃখের খবর পেয়েছে বোধহয়!

 

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। তাহলে লাইন ঠিক হল এতদিনে! ফোনের ওপাশে মায়ের গলা। ও হ্যালো বলতেই, মায়ের কান্নার আওয়াজ।

এও কী সম্ভব! শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের পাশে ট্রেনিং সেরে সেবক রোড ধরে, হোটেলে আসার পথে পিছন থেকে একটা লরি ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারে অটোর পিছনে। রাস্তায় ছিটকে পড়লে পাস থেকে একটা ট্যাক্সি চাপা দিয়ে চলে যায় সঞ্চিতাকে। থ্যাঁতলানো দেহটা আইসিসিইউতে লড়েছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সে আর নেই! সঞ্চিতা আর নেই!

অভীক মাথা ঘুরে পড়ে গেল খাটে। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। তাহলে দুদিন চা-বাগানের মানুষগুলোর মাঝে কাটিয়ে গেল, সে কে? অভীককে ভালোবাসার আবিরে যে রাঙিয়ে গেল, সে কে?

 

যে যেখানে দাঁড়িয়ে

সরাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সহেলি। পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে একটা কাক ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে। আজ যে সহেলির কী হল কে জানে। শুধু কি আজ? নাকি প্রতিদিন?

মা, ও মা। আজ তো পঞ্চমী। আজই ঠাকুর চলে আসবে। কাল বিকেল থেকে নো এন্ট্রি। তাহলে কিন্তু এগারোটার পর বাবার স্কুটারে… তুমি তো ধ্যারধ্যারে স্কুটারে যেতে চাও না। উঁহু যেতে হবে কিন্তু।

আহা, তোমার পড়া নেই নাকি বিট্টু? পড়াশোনা না করলে বাবার তবু সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটার জুটেছে, তোমার ভাঙা সাইকেলও জুটবে না। যাও পড়তে বসো।

ও মা তুমি যাবে না, তোমার ফ্রেন্ডসদের সাথে রিইউনিয়নে?

যাব না, পড়তে বসো। (বেশ জোর গলায় বলে)

পাশের ঘর থেকে সহেলির শাশুড়ি বলে উঠলেন, আহা বউমা কতবার বলেছি না, আমার দাদুভাইকে সকাল সকাল উঠেই বকবে না। যাও না একটু ঘুরেই এসো। দুপুরে তো সব হয়ে যায়। আমি, নিরু আছি তো নাকি।

বউমার বিছানায় বসে নলিনীদেবী বলতে থাকেন, বউমা ভাত-কাপড়ের শাড়িটা পরে যেও। ওটা তোমায় খুব মানায়।

সহেলি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, তাইতো আমার বন্ধুদের আর অত ভালো শাড়ি আছে নাকি? ওরা এত ভালো শাড়ি তো চোখেই দেখেনি। নলিনীদেবী খানিকটা সংকুচিত হয়ে বেরিয়ে যান।

 

বর্তমানে সুনীলের ব্যাবসাটা পড়তির দিকে। অভাবের সংসারে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় হাড়ভাঙা খাটুনি। সন্ধ্যার দিকে আবার সহেলির টিউশন ব্যাচ আসতে শুরু করবে। অলস ভাবে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তেই তোশকের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ছোটো ছোটো দুটো ডেয়ারি মিল্ক। একটা চিরকুটে জড়ানো। তাতে লেখা একটা বিট্টুর আরেকটা বিট্টুর মায়ের জন্য। হ্যাপি বার্থডে।

চকোলেট দুটো নিস্পৃহ ভাবে টেবিলের পাশে তুলে রাখে। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনটাতে পিক পিক শব্দে একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। কালই সুনীল নেট প্যাক ভরে দিয়েছে। অভাবের সংসার হলেও সহেলির জন্য এসব ছোটোখাটো বিলাসিতা করেই ফেলে সুনীল।

 

তৃণা: সহেলি আর শ্রুতকীর্তি আসবে তো রে।

মেঘনা: শ্রুতি তো আসবে। আর সহেলির বর সুনীলের দোকানটা তো আমাদের পাড়াতেই। ও বলেছে, বউকে পাঠাবে।

তৃণা: এখান থেকে কিন্তু সোজা টক-ঝাল-মিষ্টি-তে যাব। তারপর সিনেম্যাক্স।

ওই তো সহেলি আসছে। কি সুন্দর ছিল বল! আমাদের ফার্স্ট গার্ল। তেমন নাচ করত। গ্র‌্যাজুয়েশনটাও কমপ্লিট না করে, মুদির দোকানদারকে বিয়ে করে, নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারল।

মলি: মুদির দোকান তো কি? আমার বর তো স্কুল টিচার ছিল। মার সহ্য করতে না পেরে তো মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

মেঘনা: ও ভাবে বলিস না। ওর বরকে আমি চিনি। খুব কেয়ারিং। খুব ভালো। আমার কর্তার থেকে তো শতগুনে ভালো।

আরে, আয় আয় সহেলি। কতদিন পর দেখলাম, একই আছিস। আমরা তো মুটিয়ে গেছি। সেই যে কাকুর বাৎসরিকে দেখেছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাকিমাও চলে গেলেন।

সহেলি: সবই আমার ভাগ্য। আমার উপর রাগ করেই… হয়তো!

মেঘনা: ছাড় তো। জানিস শ্রুতকীর্তি আসবে। কি যে সুন্দরী হয়েছে না। ওয়েল মেইনটেইন্ড। রেডিও জকি, নিউজ রিডার কত কিছু যে করছে। অর্ঘ্যদা তো মাথায় করে রেখেছে। কাল বার্থডে পার্টির পিকগুলো দেখছিলাম। যা একটা ডায়মন্ড রিং দিয়েছে না ওর বর।

তৃণা: গতবার একটা ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট। আর আমার বর? চাকরি করি বলে, একটা পুঁতির মালাও দেয় না। এই সহেলি কিছু বল। চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ নাকি?

সহেলি: মাথাটা খুব ধরেছে রে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।

 

রাজস্থানি কারুকার্য মণ্ডিত সদর দরজাটা খুলে যায়। সহেলি ঢুকে পড়ে ১৬০০ স্কোয়ার ফিটের অন্দরমহলে। এল আকৃতির বিশাল বৈঠকখানা। তার সঙ্গে লাগোয়া ড্রযিংরুম, লিভিংরুম, কিচেন, বাথরুম আর ছোট্ট ব্যালকনি। পুরো ফ্ল্যাটটার ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের পরতে পরতে রয়েছে প্রাচুর্য আর শৌখিনতা।

দুধ সাদা মার্বেল ফ্লোর, পারসি কাজের কার্পেটে মোড়ানো। বেইজ রঙের গা ডোবানো নরম গদি আঁটা সোফা। আর তাতে রয়েছে নানা রঙের কুশন। টেক্সচার ফিনিশড দেয়ালে কোথাও যামিনী রায় কোথাও বা রাজা রবিবর্মার পেইন্টিং। একটা বিশাল ওপেন ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। তাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক শো-পিস।

ডাইনিং টেবিলটা অনেক বড়ো, সুদৃশ্য কাটলারি সেট সাজানো, মাঝখানে একটা সুদৃশ্য ঝুড়িতে রয়েছে অনেকগুলি সতেজ ফল। সহেলি একঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরে বেড়ায়। শৌখিন মডিউলার কিচেন ক্যাবিনেটে সাজানো কিচেনটা দেখে, নিজের স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরটা মনে পড়ে সহেলির। বেডশিট, পর্দা, কুশনকভার, পিলোকভার এমনকী সেন্টার টেবিলের সদ্য ধোঁয়া ওঠা টি পট-এর টি কোজি… সমগ্র আপহলোস্ট্রি জুড়ে রয়েছে নানা রঙের সমাহার। লাল, নীল, ফুশিয়া, গ্রাসগ্রিন, লেমন-ইযেলো।

এক একটা রং যেন মনের সব মেঘ কাটিয়ে একরাশ রোদ্দুর নিয়ে এসেছে। বাথরুম থেকে শাওয়ার-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গুনগুন করে ভেসে আসছে মেয়েলি কণ্ঠের গান। সহেলি ধীরে ধীরে বেডরুমের দিকে এগোয়। বিশাল খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিংটেবিল সাজানো। খাটের পাশে ছোট্ট বেডসাইড টেবিল। তাতে একটা ফটোস্ট্যান্ড-এ ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। সুখী সুখী আদুরে ছবি। সহেলি এগিয়ে আসে। ফটোর মেযেটা খুব চেনা চেনা। তারই প্রিয় বান্ধবী শ্রুতি, ওর ছেলে ও বর।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘড়িটা ঢং ঢং করে ওঠে। হয়তো এক্ষুনি শ্রুতি বেরিয়ে আসবে। আর নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হবে। কোথা থেকে শুরু করবে কে জানে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে যায়। একি! এই মলিন বেশে সে কীভাবে ওর সামনে দাঁড়াবে! কী বলবে নিজের কথা সে? না না, সে এক্ষুনি চলে যাবে। ছুটে বেরিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। হঠাৎ কে যেন পিঠে এসে হাত রাখে…

 

একি, এত বেলা অবধি শুয়ে আছো যে? তোমার শরীর কি খারাপ? সহেলি চোখ খুলে সুনীলকে দেখতে পায়। চারদিকে একবার চোখ বোলাতেই বুঝতে পারে সে শ্রুতকীর্তির লেকটাউনের ফ্ল্যাটে নয়, নিজের ইন্দিরা কলোনির জীর্ণ ঘরে শুয়ে আছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সহেলি। সুনীল বলে, শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে থাকো। আমি ম্যানেজ করছি। সারাদিন তো অনেক পরিশ্রম হয়।

সহেলি সুনীলের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, ঠিক আছে শরীর। সুনীল উজ্জ্বল মুখে বলে যায়, আজ পাঁঠার মাংস আনলাম বহুদিন পরে, জমিয়ে রান্না করো তো। সহেলি মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে চলে যায়। সুনীল একটু দমে যায়। মনে মনে তার সহেলিকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। কোথায় রাজরানি হয়ে থাকবে, তা নয়। সুনীল ওর মুখে হাসি দেখার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে কিন্তু সামর্থ্যই বা কতটুকু? সহেলির ফেলে যাওয়া স্মার্ট ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়ে, শ্রুতকীর্তি সেনের ঝাঁ চকচকে প্রোফাইল।

 

আজ বারোটা থেকে আড্ডা উইথ শ্রুতকীর্তির সম্প্রচার। রেডিও মিষ্টির অন্যতম সঞ্চালিকা সে। স্বামী অর্ঘ্য সেন একটা বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের উচ্চপদে আসীন। আয়নায় নিজেকে দেখে শ্রুতকীর্তি। তার গলা শুনেই কত মানুষের দিন শুরু হয়।

টিভির চ্যানেলে যখন আজ সকালের আমন্ত্রণে সঞ্চালনা করে তখন অগুনতি মানুষের কাছে ফ্যাশন ডিভা হয়ে ওঠে। বান্ধবীরা তার মতো কেরিয়ার আর সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে। চোখ দুটো এখনও ফোলা, তাতেই বা কি। এখনই চড়া আইলাইনার আর চড়া কাজল দিয়ে নিপুণ ভাবে ঢেকে ফেলবে, কাল রাতের সব যন্ত্রণার, সব অশ্রুর ইতিহাস। বালিশের কভারে কেউ এক ফোঁটা চোখের জলের দাগ পাবে না।

কালকের প্রবল যন্ত্রণাময় মুহূর্তেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনকী ছোট্ট রনিকেও না, ছুটে গেছে ওয়াশরুমে। চোখের জল আর শাওয়ারের জল কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে… দেয়ালে কান পাতলেও কেউ শুনতে পায়নি, এতটুকু হাহাকার! প্রতিটা দিন জলভরা চোখ দুটো সানগ্লাসে ঢেকে, মেকি হাসি মেখে, মিশে গেছে হাজার হাজার স্রোতে।

 

গাড়িতে এসে এসি-টা অফ করে জানলাটা খুলে দেয় শ্রুতকীর্তি। দমকা হাওয়া এসে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। সামনে ফ্রিঞ্জ করে কাটা লকসগুলো উড়ছে। না আজ যেতেই হবে জল শহর। সব কাজ বাতিল হয় হোক। তিস্তা পার্কে তাদের স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়ন যে।

শ্রুতকীর্তি জানে, কালকের পার্টির জের চলবে আজকের তিস্তা পার্কের বন্ধুদের সমাবেশেও। তৃণা, মেঘনা ছুটে এসে বলবে, অর্ঘ্যদা কি কেয়ারিং রে। শ্রুতকীর্তিকে মিষ্টি হেসে বলতে হবে, কী যে বলিস…। বুক ফেটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে, তোরা কিচ্ছু জানিস না… কিচ্ছু না। অর্ঘ্য তার প্রতি কোনও দিনও কেয়ারিং নয়, ওপেন রিলেশনশিপে বিশ্বাসী তার স্বামী অর্ঘ্য।

বিয়ের পরদিনই সে জেনে গেছে, স্বামীর জীবনে তার শুধু সামাজিক অস্তিত্বটুকুই আছে। এই বিশেষ দিনটা যে, কত বঞ্চনার… কত উপেক্ষার… তা সে-ই শুধু জানে। দীর্ঘ ছয় বছরে কোনও জন্মদিনকে অর্ঘ্য উষ্ণ শুভেচ্ছা আর সান্নিধ্য দিয়ে স্বাগত জানায়নি। বরং অর্ঘ্যের বস আর বিজনেস পার্টনারদের হই-হুল্লোড় আর উল্লাসে শ্রুতকীর্তির বিশেষ অনুভূতিগুলো দম আটকে মরেছে।

প্রতি বছরই অর্ঘ্য রিমাইন্ডারের দৌলতে অত্যন্ত যান্ত্রিক ভাবে এটিএম কার্ড ছুড়ে দিয়েছে। আর সে-ও কলের পুতুলের মতো স্ট্যাটাস অক্ষুণ্ণ রেখে একের পর এক ঈর্ষণীয় উপহার কিনেছে। প্রাচুর্য আর নিপুণ অভিনয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সব উপেক্ষাকে। বছরের পর বছর এভাবেই ব্লটিং পেপারের মতো সব অপমান শুষে নিতে নিতে কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

ছন্দপতন ঘটল সেদিন, যখন সে ছুটে গিয়েছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে দ্বিতীয় মাতৃত্ব লাভের সুখবর জানাতে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণী তথা নারী মুক্তির ধ্বজাধারী শাশুড়ি-মা, গর্ভপাত করার প্রস্তাব দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, বংশের প্রদীপ রনি যখন আছেই তখন দ্বিতীয় সন্তান তাদের কাছে বাহুল্য আর দুর্ঘটনা বৈ তো নয়!

প্রথম সন্তান কন্যা হলে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রশ্ন আসত। এত বড়ো আঘাত সহ্য করতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করে শ্রুতকীর্তি, আর তাতেই হিংস্র হয়ে ওঠে অমাযিক, প্রোগ্রেসিভ মুখোশের অর্ঘ্য।

মাঝে মাঝে সহেলির কথা খুব মনে পড়ে। আজ মেয়েটার জন্মদিন কেমন আছে কে জানে। তবে তার থেকে ভালো নিশ্চয়ই। মাঝে মাঝে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা ভেবেছে। স্বাধীন, চাকুরীরতা সে। কিন্তু পারেনি, ছোট্ট রনির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে যে ওর যে এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে। আর নিজের সুখী সুখী ইমেজটা যে আজকাল বড্ড প্রিয় হয়ে উঠেছে। পৈতৃক বাড়িতে শয্যাশাযী, স্থবির মা। প্রোমোটারের উৎপাত। আর অন্যদিকে সেন পরিবারের অসীম পেশি শক্তি। লড়াইটা বেশ কঠিন। কারও সহানুভূতির পাত্রী সে হতে পারবে না, কোনও দিন।

 

সই, আমি শ্রুতি, চিনতে পারছিস?

তোর গলা চিনব না। তুই আমার নম্বর পেলি কোথায়?

আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলি? পার্স ফেলে এসেছিস? শরীর ঠিক আছে? আমি আসছি। ঠিকানাটা বল।

ইয়ে মানে… থাম থাম। তুই কোথায় বল? আমি তো বেরোবই, কাজ আছে একটা। আমিই যাচ্ছি। হ্যাঁ যাচ্ছি, কদমতলায় তো?

 

বাহ শ্রুতি, তোর ডায়মন্ড রিং-টা কি দারুণ রে। বার্থডে স্পেশাল?

বাঁ হাতের কনুই-এর কাছটা ভীষণ জ্বলছে শ্রুতকীর্তির। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অর্ঘ্যর টাকায় কেনা আংটিটা দেখতে থাকে সহেলি। ধীরে ধীরে কুর্তির আস্তিনটা গোটায় শ্রুতকীর্তি। বেরিয়ে আসে দগদগে ক্ষতটা। মনে হয় ক্ষতটা যেন জ্বলজ্বলে হিরের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এ ক্ষত চিনেছে সহেলি। ননদ নিরু যখন ওর মাতাল স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্স কেস ফাইল করে ফিরে এল, তখন থেকেই খুব চেনা এই ক্ষত। এত কষ্ট শ্রুতিটার?

চোখের জল লুকিয়ে জোর করে হেসে বলে, শ্রুতি তোর কান্নার অভ্যাস নেই তো? কিছুক্ষণের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্রুতকীর্তি বলে, প্লিজ সই কাঁদিস না আমার জন্য। আমার চোখের জল একবার বেরোলে আর থামে না রে। অনেক কষ্টে আটকে রাখি। আমি তোকে কত হিংসে করেছি জানিস। তোর সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলো করতাম। কিন্তু ফ্রেন্ড রিকোযে্ট পাঠাইনি।

 

কোর্ট মোড়ের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে রাকেশকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে শ্রুতকীর্তি। এদের স্যানট্রোতে আর নয়।

খোলা আকাশের নীচে একবার বুকভরে শ্বাস নিতে পেরে অদ্ভুত আরাম লাগছে। নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর ডাকের সাজের প্রতিমা দেখল সে। মা দুর্গা তো শক্তিরূপিণী।

যদি নিরু পারে, মলি পারে, তবে সেও পারবে। এখন সোজা বসু ক্লিনিক। তারপর দেশবন্ধু পাড়ায় মায়ের কাছে। মা যতই স্থবির হয়ে যাক আজ তাকে গিয়ে বলতেই হবে, সে তার সন্তানদের নিয়ে নতুন পৃথিবী গড়বে।

 

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে-বাড়ির কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি সহেলি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। রাজবাড়ির মোড়ের সামনে ঠাকুর চলে এসেছে। একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে আপন মনেই বলে ওঠে, ক্ষমা করে দাও মা। আমি শ্রুতিকে হিংসে করেছি কিন্তু এতটা খারাপ কখনও চাইনি। আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি যেমন আছি তেমন ভাবেই থাকতে পারি যেন। বিট্টুকে মানুষ করো আর শ্রুতিকে ভালো রেখো। ওকে শান্তি দিও।

সামনে বিডিও অফিসের দোকানে ছোট্ট সিঙ্গাড়াগুলো সুনীল খুব ভালোবাসে। দাঁড়িয়ে পড়ে সহেলি। মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে…

সেই সুরে, বাঁধন খুলে

অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে, অকারণে

ভুলে যাওয়া গানের বাণী,

ভোলা দিনের কাঁদন হাসি

ভালোবাসি, ভালোবাসি।

চলতি হওয়ার স্রোতে অনেক অবহেলা করেছে সুনীলকে! আর না। ফেরার পথে নীলিমাদেবীর মিষ্টি পান নিয়ে যেতেই হবে। আজ ওনার যে বড্ড অভিমান হয়েছে।

এমন একটা মিছিল হোক…

তিতলি শেষমেশ তুই…! আমি ভাবতে পারছি না। কেন…? কেন এসব? তিস্তার কথাগুলো অনেকটা আর্তনাদের মতোন শোনাচ্ছিল।

সিরিয়াসলি আমিও ভাবিনি বউদি। তুমি এতটা রিঅ্যাক্ট করবে। নিজের মনের ইচ্ছেগুলোকে লুকিয়ে রেখে লোকজন যে ঘরে ঘরে ক্রাইম করছে তার থেকে এটা হাজার গুন বেটার। আমি যা করি সামনাসামনি। বুঝলে? আমার কোনও কিছুই যেমন লোকদেখানো নয়, তেমন কোনও কিছুই আড়াল নয়। আমি যা, আমি তাই-ই। প্লিজ তোমাকে একটাই রিকোয়েসট তুমি কথাটা বাবা-মার কানে তুলো না। সবার প্রশ্নের গাদা গাদা উত্তর দিতে দিতে সত্যি সত্যিই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি জানো! মুখ ঘুরিয়ে বলে যাচ্ছিল তিতলি।

ওর হাতে তখনও ধরা ছিল আধপোড়া সিগারেটের টুকরোটা। ছাদের ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে তিতলি সিগারেট টানছিল। আর ঠাকুরঘরে সন্ধে দিতে এসেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে তিস্তার।

ল্যাম্পপোস্ট আর ছাদের ঠাকুরঘর থেকে যে-হলুদ টিমটিমে আলোর রেখাগুলো ত্যারছা ভাবে পড়ছিল দেয়ালের অন্ধকার কোণায়, তাতে ধোঁয়া, আলো, অন্ধকার মেশামেশি করে একটা আলতো জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার নিচ্ছিল।

প্রশ্ন চিহ্ন তো বটেই। তিতলি আজ এতটা ফেরোশাস হয়ে উঠেছে ভাবতে তখনও কোথায় একটা বাধছিল তিস্তার। এমনটা কী সত্যি হবার ছিল? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।

মনে হচ্ছিল এইতো সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম মজুমদার বাড়িতে পা রেখেছিল তিস্তা। ওদের প্রেমের বিয়ে ঠিকই কিন্তু বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি আসা, আর বিয়ের পরে প্রথমবার সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে বউ হিসেবে মেলে ধরার দিনটার মধ্যে যে কতটা ফারাক, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল তিস্তা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বিয়ের পাত্রী হিসেবে তিস্তার সাতাশ বছর এমন কিছু ছোটো নয়। অনেকে তো এই বয়সে প্রথম মা-ই হয়ে যায়। সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়লে আজও একটা চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধে বুকের ভীতু তুলতুলে জায়গাটায়।

চৌকাঠে পা দিতে না দিতেই বরেরবাড়ি সমেত গোটা পাড়া অন্ধকার হয়ে গেছিল; হুলুস্থুল কাণ্ড। অপয়া অপবাদের অদৃশ্য খাঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়কের খুড়তুতো, পিসতুতো সবকটা বোন ওই অন্ধকারেই যারপরনাই টাকাপয়সার ক্লেম করতে শুরু করে দিয়েছিল। গুরুজনদের বাঁকা চোখে নতুন বউয়ের দিকে তাকানো আর বোনদের ঠিকঠাক টাকা না পাওয়ায় মন কষাকষির তেমনই একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে তিস্তার চোখের জল মুছিয়েছিল তিতলি। ঠিক যেন ছোট্ট একটা প্রজাপতিই বটে; কত বয়স হবে তখন ওর। এই তেরো-চোদ্দো বছর। দিব্যি হেসেখেলে গল্প করে মন ভুলিয়ে দিয়েছিল তিস্তার। মামাতো একমাত্র বোন হলেও সায়কের বাকি বোনেদের সঙ্গে জোট বেঁধে দাদার পকেট কাটার দিকে যায়নি সে। বরং বউদির দুঃখু দুঃখু মুখ দেখে হাসিমুখে ম্যানেজ করেছিল সবটা।

পাড়াপড়শির, ঘরের লোকের কথার খোঁচা, এমনকী সায়কের সামান্য বেসরকারি অফিসে চাকরি জানা সত্ত্বেও বাকি বোনেদের জোরাজুরিকে বিরক্তির চোখেই দেখেছিল ছোট্ট ননদ তিতলি। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এই ননদকে দিনে দিনে নিজের বোন বলেই মনে হয়েছিল তিস্তার। একটু একটু করে হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজবে জেনেও ছিল তিতলি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরি করতে চায়। পড়তে চায় ওর প্রিয় বউদির মতো সাহিত্য নিয়ে। মিষ্টি একটা ভালোলাগা ডানা ঝাপটে উঠেছিল তিস্তার বুকের মধ্যেও। মন বলেছিল, কেউ তো এখনও আছে, যে অন্তত বাংলা বিষয় নিয়ে পড়াকে কোনও উপায় নেই তাই পড়ছে, এমনটা মনে করে না।

কী গো তুমি এখনও ছাদে? করছটা কী? কখন থেকে পিসাই এসে বসে। তোমার হাতের চা চাইছে। সায়কের গলায় চমকে উঠে তিস্তা সিঁড়ির দরজার কাছে সরে গেছিল। না দেখলেও বুঝতে পারছিল ছাদের কার্নিশ টপকে একটা হলুদ আগুন পাশের জঙ্গুলে জমিটায় ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

যাচ্ছি যাচ্ছি। তুমি হঠাৎ ওপরে উঠে এলে কেন? আমি নামছি।

তিতলি কোথায়? ছাদে না? একটা হরর মুভি ডাউনলোড করেছি। কখন থেকে একসঙ্গে দেখব ভাবছি। ম্যাডামের দেখাই নেই।

তিতলি তাড়াতাড়ি নীচে আয়। মুভি দেখবি। বলে তিস্তা প্রায় জোর করেই সায়ককে নিয়ে নীচে একতলায় চলে আসে। বলা যায় না যা রাগ সায়কের। একেই কলকাতায় ওই দলবাজির কলেজটা দুচক্ষে দেখতে পারে না সায়ক। তার ওপর তার নিজের বোন এসব নেশা করছে বিন্দুমাত্র জানতে পারলে, হয়তো সারাজীবনের জন্যই কথা বন্ধ করে দেবে তিতলির সঙ্গে। জানে সব রাগটা গিয়ে পড়বে তিতলির ওপর। কারণ নিজের বাড়ি শক্তিনগরের মতো মফস্সলে রীতিমতো ভালো গভর্নমেন্ট কলেজে চান্স পেয়ে, তিতলি একটা বছর নষ্ট করে অনেকটা নিজের জেদেই কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছে। এখানে নিজের পিসির বাড়ি থাকলেও রয়েছে কলেজেরই কাছাকাছি কোনও একটা মেস-এ। তাছাড়া রয়েছে আরও নানা কারণ।

চোখে আঙুল দিয়ে যেটা দেখা যায় সেটা হল তিতলির স্বাধীনতা। তার অবাধ বাঁধনছাড়া অগ্রাহ্য করার একটা ইমম্যাচিওর মন।

 

তোর দাদা কিন্তু গন্ধটা পেয়েছে তিতলি। এখানে এলে…।

সেটাই করতে হবে। এখানে আসাটাই বন্ধ করে দিতে হবে।

আমি কি তাই বলেছি তিতলি? তোর দাদা কিছু একটা আন্দাজ করেছে, মানুষটাকে তো আমি চিনি। আমাকে কী বলছিল জানিস রাতে? বলছিল, ঠিক মনে পড়ছে না দাদু মারা যাওয়ার আগে তিতলিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিল জানো? কিছু না হলেও কবিতার শেষ একটা লাইন আজও মনে আছে আমার, জানলা দিয়ে তিতলিটা ওই খিলখিলিয়ে হাসে। আর ডায়ারির পাতা থেকে সেটাকে বেছেই সবাই ওর এই নাম দিয়েছিল।

উফ্ বউদি তুমি না সাংঘাতিক সেন্টু দাও। সত্যি এত ইমোশন রাখো কোথায়? আমি যতদূর জানি পিছন ফিরলেই সবাই তোমার সেন্টুর গাঁ…। উপ্স সরি সরি…। চোখ মুটকে তিস্তার সামনে ছদ্ম লজ্জার অভিনয় করে তিতলি।

এসব ছাড়। যেটা বলব বলব করেও তোকে বলা হচ্ছিল না, শক্তিনগর থাকতে ওই যে ছেলেটা কী নাম যেন…।

বিতান…।

হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা করিস এখন? কথা হয়?

অত ঘুরিয়ে বলার কী আছে? পোঁদে লাথ মেরেছি। বড্ড ঘ্যানঘ্যান করত। একটু কাছাকাছি ছিলাম বলেই ওর সম্পত্তি আমি? তা তো নয়। তাছাড়া কলকাতায় এসে পড়াটা, চাকরি করাটা, আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যেখানে আমার বাবা-মা সায় দিয়েছে সেখানে এলিতেলি হায়দার আলি, ও কে…?

কিন্তু তুই যে তখন বলেছিলিস ও তোকে…।

চু চু চু মুখ দিয়ে আওয়াজ করে তিতলি। তুমিও না বউদি…। সবাইকেই নিজের মতো ইমোশনের ফুল ট্যাংকার ভাবো। ছাড়ো তো। শোনো তবে কেউ পার করে দেবে না আমায়,

সময় আছে এখনও

চলো নতুন করে কাঁটাঝোপে পা ফেলি একবার…।

কবিতার লাইন বলতে বলতে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা সিগারেটের প্যাকেট পকেটে পুরে তিতলি মোবাইলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়!

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তিস্তা। একদম… একদম পালটে গেছে তিতলি। ওর ইনোসেন্সগুলো কোথায় যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। তিতলির এখন কলেজের থার্ড ইয়ার। সেই বাংলা সেই সাহিত্য ভালোবেসে জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখা মেযেরা এখন নাকি কলেজের ছাত্র সংগঠনের মিছিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। মিছিলে হাঁটছে। অনশন করছে।

রাজনীতি কী? রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? জানে না তিস্তা। সত্যি কথা বলতে কী জানতেও চায় না। তবে এটা জানে রাজনীতির রং দলভেদে পালটায় না; রাজনীতির একটাই রং স্বার্থ।

কেন জানে না আপনা আপনি মনটায় একটা খারাপ লাগার বুড়বুড়ি কাটছিল।

নিজের বোনের মতো ওর মাথায় হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করছিল, এই স্বার্থপর সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তিতলির একটা পরিচয় হোক। আর কিছু না।

 

খবরটা এত তাড়াতাড়ি এভাবে আসবে ভাবতেই পারেনি তিস্তা। তখনই ওলা বুক করে ছুটে গেছিল মামা শ্বশুরের বাড়িতে। সারাজীবনের সেই চরম অপবাদ অপয়া মাথায় করে নিয়ে নেহাত নির্লজ্জের মতো উস্কোখুস্কো চুলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তিতলিদের বাড়িতে। নাহ্ কেউ কোনও আপ্যায়ন করেনি। সেটা যে তার প্রাপ্য হবে না, সেটাও জানত। কারণ শ্বশুরবাড়ির প্রথম দিনে সে পা রাখতেই আলো নেভা, সায়কের হাজার একটা পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও, সরকারি চাকরি না পাওয়া আর শেষমেশ তিতলির…।

প্লিজ প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও। একদম ভালো লাগছে না।

কিন্তু তিতলি…।

তোমাদের কোনও ঝামেলা হবে না বলছি তো! আমি তো সবটা মিটিয়ে এসেছি।

তোর শরীরটা …।

আমার শরীর ঠিক আছে বউদি। এত কষ্ট পেও না। আমি ঠিকই আছি। আজ নতুন কিছু না। আমরা প্রায়ই মেলামেশা করতাম। কোনও কিছুই জোর করে হয়নি।

তিতলি তোর এখন সবে ২৪, আর এই বয়সে বাচ্চা নষ্ট?

আচ্ছা বউদি এটা ধরে নিতে বাধা কোথায়? আমি ছেলেতেও খুশি নই, মেয়েতেও নই, আর যদি বা হিজড়া হতো তাকে সমাজছাড়া করার আগেই সাহস দেখিয়ে তড়িঘড়ি শরীর থেকেই খসিয়ে দিলাম। হ্যাঁ তোমরা অবশ্য এর নাম নষ্টা, বেশ্যা দিতেই পার। তোমরা বড়ো। এসবের লাইসেন্স তোমাদের আছে।

তবে আমি কিনা একটু অন্য ধাঁচের, এসব গায়ে মাখি না। আবার তোমার মতো লুকিয়ে কাঁদবও না। বরং সমাজের পাঁক থেকে তুলে আনব পদ্মফুল। সেই সময় এসে গেছে বউদি। সবার যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পালটা উত্তর তো দিতেই হবে। তাই না?

তুই ওই ছেলেটাকে বিয়ে করবি? ওর বাড়ি রাজি হবে তো? তোরা যে…।

হাসালে বউদি। এমন খান্ডারনি মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না। আর আমিও চাই না। এগারো মিনিটের সুখের জন্য বিয়ে করতে লাগে না। তারপর ভালো না লাগলেই কোর্ট কাছারি হ্যানা-ত্যানা। ধুত্তোরি…।

কিন্তু মামা যে বলছিল…?

ওসব ভাটের কথা। সেদিন ক্লিনিক থেকে ফিরে একটু টান্টু খেয়ে কীসব বকেছিলাম বলে ভয় পেয়ে তোমাদের জানাল। আর তুমিও… মাইরি পারও বটে…! পরশু দুপুরে আমাদের ব্রিগেডে একটা মিটিং…

তিতলি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। কিছু কথা কানে আসছিল, কিছু আসছিল না।

তিস্তা দেখছিল শেষ বিকেলের রোদ মাখা কমলা আলোটা পর্দার পাশ দিয়ে তিতলির মুখ, বুক, চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর সদ্য মা হওয়ার অস্বীকার করা অস্তিত্বকে। তিতলির স্বপ্ন অন্য রকম। অন্য রঙের। সেই স্বপ্নের রং তিস্তা চেনে না, সেই পথের বাঁকেও কোনও দিন আটকা পড়েনি সে।

তবু দিনশেষে সায়কের কাছে ফিরে যেতে যেতে ওর একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, সমাজের যে-অন্ধকারকে আলোর পরিচয় দিতে আজ তিতলি বা তার সমবয়সিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে, গলা ফাটাচ্ছে, পুলিশের লাঠি না মেনে দিনে দিনে আরও আরও বেশি স্বাধীনতার সংজ্ঞায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, পাঁক ঘেঁটে গল্প খুঁজে পত্রিকা সাজাচ্ছে তারা নিজেরাও কি সেই একই অন্ধকারের দোষে দোষী নয়? নাহলে তিতলির শরীরে ছোট্ট একটা ভ্রূণকে এভাবে দুহাতে অগ্রাহ্য করার…। মনটা বড্ড খচখচ করছিল। আচ্ছা, চলে আসবার সময় তিতলির চোখের কোলটা কেমন যেন চিকচিকিয়ে উঠেছিল কি! নাকি সবটাই মনের ভুল…?

ওলা ক্যাবটা তিস্তার বাড়ির পথ ধরেছে। দমকা একটা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে সামনের রাস্তাটা। ঝড় উঠবে…। অন্ধকার করে এসেছে। একটা ভোঁতা শব্দ হতেই পাশ ফিরে তাকায় তিস্তা। বাইরে থেকে মথ বা প্রজাপতি জাতীয় কিছু ওলার জানলার গায়ে ক্রমাগত ফরফর করে আঘাত করছে। ও কি ভেতরে ঢুকতে চাইছে?

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। তিস্তা গাড়ির হাতল ঘুরিয়ে কাচটা নামাতে চায়। পারে না, লকটা খুব শক্ত।

কালোমেঘ চিরে শেষবারের মতো একফালি আলো আছড়ে পড়ছে শহরের রাস্তায়। নাহ্ সে আলোর কোনও রং নেই। তিস্তার মন বলছে, এ শহরের বুকে একদিন ঠিক, একদিন এমন একটা মিছিল হবে যে-মিছিলের নির্দিষ্ট কোনও রং থাকবে না, থাকবে না নির্দিষ্ট মত, মতাদর্শ। সব রং তখন মিলেমিশে যাবে। মিলেমিশে যাবে কেবল একটা… একটা মিছিলে। হাজার মানুষের সে মিছিলে একটাই জয়গান হবে। জয়গান হবে মানবতার।

 

স্বীকারোক্তি

ডা. চ্যাটার্জি বললেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার সবসময় হয় না?

টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও, অর্পণের চোখ মোটেও ডা. চ্যাটার্জির উপর ছিল না। বরং তার দৃষ্টি ছিল ঘরের দেয়াল ঘড়ি, মানুষের ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি, একটা ক্যালেন্ডার বা ওর রিভলভিং-এর একটু উপরে একটা এসির উপর। জায়গাটা চেম্বার আর কর্পোরেট অফিসের এক মিশ্রণ মনে হচ্ছিল।

মুখ ফিরিয়ে এবার বলল, একেবারেই না। হয়তো মনের কোথাও থাকে অনুভূতিটা। কিন্তু তীব্র ভাবে জেগে ওঠে, যখন ও আমার কাছাকাছি থাকে। যেমন ধরুন, খাবার টেবিলে। আমার কাছাকাছি বসে খাচ্ছে বা আমার বাইকে। বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

আর কোথাও? টেবিলের উপর দুটো কনুই তুলে, হাতের উপর কায়দা করে নিজের চিবুক রাখলেন ডা. চ্যাটার্জি। ফরসা মুখ আর হালফ্যাশনের চশমায় মুখে আগ্রহের রেখা।

না, সবচেয়ে বেশি হয়, গলা এক স্কেল নামিয়ে বলল অর্পণ, যখন আমরা বিছানা শেয়ার করি।

তখন কোনও সমস্যা? মানে, প্রসেসটা চলার সময় আপনার কোনও অনুভূতি?

ঘরে কেউ নেই। তাও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ডা. চ্যাটার্জির চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভাসা সুরে বলল, প্রবলেম মানে, ব্যাপারটার মধ্যে যেন একশো শতাংশ থাকতে পারি না। একটা নতুন বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আর সে জন্যেই তো আপনার কাছে…

আসলে, কাউন্সেলিং-এর পরিভাষায় এটাও এক ধরনের ডবল পার্সোনালিটি। এই স্টেজটাকে আমরা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির মধ্যে রাখলেও, আমরা বুঝি নর্মাল আর অ্যাবনর্মাল-এর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব, ডা. চ্যাটার্জির কাউন্সেলিং সত্তা জেগে উঠেছে।

অর্পণের মনে হচ্ছিল, উনি একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন এগোনোর। মন বলছিল, আরও প্রশ্ন ভেসে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তর তো দিতেই হবে। না হলে সমাধান মিলবে কেমন করে।

আসলে, সত্যিটা এটাই। আবার বলতে শুরু করেছেন উনি, আমরা যতই বলি, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার তা কিন্তু নয়। কিছু স্মৃতি অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি থাকলেও, ভীষণ সতেজ থাকে। মানে, আমরা ভিতর থেকে, অবচেতন মনে তার থেকে ডিট্যাচড্ হতে চাই না।

চেম্বারের ভেতরের নিস্তব্ধ হিম পরশে আর ডা. চ্যাটার্জির নরম সাহচর্যে ইতিমধ্যেই অশান্ত ভাবটা কমতে শুরু করেছিল। স্বস্তি নেমে আসছিল। অর্ণব অফিস কলিগ হলেও ইনটিমেট ফ্রেন্ড। ডা. সৌম্যশেখর চ্যাটার্জির নাম সাজেস্ট করে বলেছিল, ওনাকে সব বলতে পারবি। ওনার সমাধান একেবারেই অফবিট। পেশাদারিত্বর সঙ্গে গোপনীয়তাও দারুণ বজায় রাখেন। জাস্ট চেক করে দেখতে এসেছিল। নির্ভরতাটা তৈরি হচ্ছে। শ্রদ্ধা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সমাধান আছে নিশ্চই?

অবশ্যই আছে। আই গ্যারান্টি। বন্ধুর মতো, নিজের মতো করে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে এই টেকনিকটাকে আমরা বলি, ফ্রি অ্যাসোসিয়েন অবাধ অনুষঙ্গ। এতে আপনি অনেকটা হালকা বোধ করবেন। আর সমাধানটা অনেক মাইনর ব্যাপার। জাস্ট একটা উপসংহার টানার মতো।

থমকাল অর্পণ। এখনও পর্যন্ত ডা. চ্যাটার্জির সঙ্গে এই অ্যাপযে্টমেন্টের বেশ কয়েটা ধাপে প্রথমে থেমে, তারপর এগোতে হয়েছে। সুতো ছাড়ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে। সমস্যা নিয়ে একজন কাউন্সেলর-এর পরামর্শ নিতে আসা। লাজুক ভাব আর হাসির মোটামুটি ব্যালেন্স যেমন অফিসে করে, সেরকম ভাবে বলল, আসলে, এ রকম অ্যাফেয়ার তো আজকের যুগে সবারই একটা-দুটো থাকে। পাসিং অ্যাফেয়ারের মতো। তা পেরিয়ে সবাই চলেও যায়। বিবাহিত জীবন শুরুও হয়ে যায় জমাটি ভাবে। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগেরই কাহিনি অনেকটা এ রকমই।

একদম ঠিক বলেছেন। তবে ঘটনার রেখাপাত সবার মনে একরকম ভাবে হয় না। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মনের আলাদা আলাদা স্তর।

অর্পণকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র আর শিক্ষিত মনে হয় বলেই কি শুরু থেকেই ডা. চ্যাটার্জি এতটা টেকনিক্যাল স্বর বজায় রাখছেন? হতেও পারে। বেশ কিছুটা বাতাস বুকে ভরে নিয়ে অর্পণ বলল, যে-সমাধান আপনি দেবেন, তাতে কি মনের ভারি ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে কি আর রেজাল্ট পাবেন, মি. মিত্র? কিন্তু রেজাল্ট আসে। আর সে চেঞ্জ আপনি বুঝতে পারবেন আপনা থেকেই।

ফিল-গুড ভাবটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতেও পারছে অর্পণ। প্রথমে ভেবেছিল, কোনও জ্যোতিষের কাছে যাবে। টিভি খুললেই তিন মিনিটে কালসর্পদোষ, ব্যাংদোষ, টিকটিকিদোষ কাটানো হয়। স্ক্রিনের নীচের ফোন নাম্বারে ফোন করলেই এদের চেম্বারে। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য এদের হাতের মুঠোয়। জ্যোতিষির ডিগ্রিতে সব এক একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আর ত্রিকালজ্ঞ। অর্ণবকে বলতেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, কাউকে বলিস না, অ্যাড এজেন্সিতে এই পদে চাকরি করিস। বিজ্ঞাপন এখন তোকেই টুপি পরাচ্ছে! ভাবতে পারি না।

তখন আর কথা এগোয়নি। এখন মনে হচ্ছে অর্ণবের কথা শুনে একদম ঠিক করেছে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বলল, ওকে। কিন্তু সলিউশনটা কী?

কিছু না। ছোট্ট একটা কনফেশন।

কনফেশন! কার কাছে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে অর্পণের।

হেসে ফেলেছেন ডা. চ্যাটার্জি। নট সো ফাস্ট। কারও-র কাছে না। নিজের কাছে। কেউ থাকবেও না।

মানে?

খুব সহজ মি. মিত্র। নিজের ভেতরে যদি কোনও পাপবোধ থেকেও থাকে, তা খুঁড়ে, তুলে ফেলে দিন স্ট্রেট…

সেটাই তো বলছি। মানে…

দেখুন, আপনি নিশ্চয় চার্চে কনফেশন বক্স দেখেছেন।

হুঁ….

উলটো প্রান্তে একজন পাদরি বসে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাজ হল শুধু শুনে যাওয়া। অনেকেই বলে, তা করে তারা রিলিফ পেয়েছে।

তাহলে কি চার্চে, বিভ্রান্ত লাগছে অর্পণের।

না, না। আসলে নিজের ভেতরের কথাগুলো আপনি কোনও দিন কাউকে পুরোটা বলেননি। সেটাই নিজে এবার একটা কাগজে পুরো লিখে ফেলুন।

এক মিনিট। আপনাকে তো…

সরি, মি. মিত্র, আমাকেও আপনি পুরোটা বলেননি। ইনফ্যাক্ট বলতে পারছেন না। তাই বলছি, লিখে ফেলুন পুরোটা।

হ্যাঁ, তারপর?

সিম্পল। কোনও ভরা পূর্ণিমার রাতে, যখন কেউ দেখছে না সেটাকেই কুচিয়ে টুকরো করে চোখের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। এ টুকুই। দেখবেন, অনেকটা রিলিভড হয়ে যাবেন।

সত্যি কি এটা হতে পারে? এর কোনও সাযে্নটিফিক জাস্টিফিকেশনই তো নেই।

সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের সব সলিউশন, বিজ্ঞান মেনে হয় না মি. মিত্র। একবার ট্রাই করুন শুধু। ডা. চ্যাটার্জি হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়েছেন। টলে যাওয়া বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অর্পণ, কিন্তু মুন লাইটই কেন?

মুন ইজ আ লাভ সিম্বল। চাঁদের আলোর একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার আছে।

ওকে, কবে করতে বলছেন এটা? কাল বাদ পরশুই কিন্তু পূর্ণিমা আছে। মোবাইল খুলে বং ক্যালেন্ডার-এ ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে অর্পণ।

দুচোখ বুজে কী যেন ভাবলেন ডা. চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, পরে করতে গেলে আবার বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা। কামিং ডেটটাই কাজে লাগান।

একটা কথা, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল অর্পণ, বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা বেশ সিক্রেট। এটা নিশ্চয়ই ডিসক্লোজ হবে না কোনও ভাবেই?

শুনুন মি. মিত্র, কোনও কাউন্সেলরই এক জন পেশেন্ট-এর কেস হিস্ট্রি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

থ্যাংক ইউ। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনে অর্পণ।

 

তোফা দুপুরের ঘুমের পরও আলিস্যি ভাবটা ছেড়ে যাচ্ছিল না। রোববার মানেই শেষ তিন মাসে পাতলা খাসির মাংসের ঝোল আর ভাত। শেষ পাতে একটু টক দই। ঘুম ঘুম ভাবটা খাবার টেবিলেই ফিল করে অর্পণ। নতুন ফ্ল্যাট-এর ইএমআই-এর সময় যত এগিয়ে গেছে, তত বেশি করে এই অলস ভাবটা ঘিরে ধরেছে। উত্তরপাড়ায় জিটি রোড গঙ্গার কোল ঘেঁসে এই ফ্ল্যাট। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল। সে সময় ওর বয়স আঠাশ। কোম্পানি চেঞ্জ করে বহুজাতিকে যোগদান করে, ডিজাইনার হিসেবে তখনই ঈর্ষণীয় পে-স্কেলে চলে গিয়েছিল। আর এখন তো উন্নতির চরমসীমায়।

অ্যাড-এর ফিল্ডে অর্পণ মিত্রকে সমস্ত ক্লাযে্নট এক ডাকে চেনে। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন না করে স্পেশালাইজড কোর্স করতে গোঘাট থেকে সোজা কলকাতায়। একেবারে রেসিডেন্সিয়াল। দুবছর পর ক্যাম্পাস থেকেই একটা মোটামুটি কোম্পানিতে। দেশের বাড়িতে আর ফিরলই না। বছর তিনেক গড়িয়াতে দুজনের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকা। গোঘাটে দাদার সংসারে বাবা-মা থাকলেও, বেশ কয়েবার কাটিয়ে গেছে এখানে।

ঘরে ঢুকে বক্স খাটের পাশের ড্রয়ারের উপরে বিকেলের চা রাখল ঐশিকি। এই তিনমাসে দুপুরে অন্তত ছুটির দিনে তাকে ঘুমোতে দেখেনি অর্পণ। প্রচণ্ড হেলথ কনশাস বলেই কি ঘুমোয় না! তিন মাসের নব বিবাহিত জীবনে, এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। চায়ের গন্ধের সঙ্গে ঐশিকির লম্বা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও মিশে যাচ্ছে। একটা ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলেও এখনই কাছে টানাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

সদ্য ঘুমিয়ে উঠেছে। বাসি গন্ধ, মাথা চাড়া দিল যেন। উঠে বসে চা বিছানায় নিল। খোলা ব্যালকনিতে চলে গেছে ঐশিকি। এ সময়টায় ওর বাড়ি থেকে মা বা বাবা কেউ একজন ফোন করে। চোখ সরিয়ে রাখল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পুরুষ্ট গোঁফে আর একটু বেড়ে ওঠা ভুঁড়িতে, সুখের ঝলক নাকি স্বামী হয়ে ওঠার আদল প্রকাশ পাচ্ছে!

চা খেয়ে আলিস্যি ভাবটা যাচ্ছে না। আজ রাতে কী করবে ভাবতেই বুকে শান্তির হাওয়া। একটা বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া।

চা শেষ করে চিত হয়ে শুল অর্পণ। স্যান্ডো গেঞ্জিটা উঠে গেছিল। নামিয়ে নিল পাজামার উপর ঠিক ঠাক। সুখের উড়ানকে সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছে। এমনকী সুদেষ্ণার সঙ্গে কাটানো সময়ে তো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল বা কলেজে কারও-র সঙ্গে ক্রাশ হয়নি। প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটে যখন এসে বলেছিল, রীতিমতো মুখ টিপে হাসাহাসি হয়েছিল। হোস্টেলে অলক বলেছিল, তোরা মফস্সল বা একটু ভিতর দিকের ছেলেরা কেমন যেন একটু বাড়তি চাপা প্রকৃতির হোস। গ্রাম শব্দটা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া।

ভ্রূ কুঁচকে অর্পণ বলেছিল, আর তোরা সিটির লোকেরা সত্যি কথা বলে যে ডিক্সনারিতে কিছু হয়, তা বোধহয় বিশ্বাসই করিস না।

অলক চোখ গোল্লা করে বলেছিল, তুই কিন্তু অন্যরকম। আগ লাগা দেগা তু।

তো আগুনই লেগেছিল। সে আগুন যে কী কী পোড়ায়, বুঝতে সময় লাগেনি। ইনফরমাল কমিউনিকেশনের চতুর্থ ক্লাসেই চোখ গেছিল অর্পণের। হ্যাঁ, তবে উপরের ঠোঁটের এক সেমি উপরের তিলটায়। পাশের ডেস্কে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছিল বলে অলক এক সময়ে ফিসফিসিয়ে বলেও ছিল, পুরো ম্যাডোনা তো রে। ঠোঁটে হাসি চলে এসেছিল।

ক্লাস শেষ করেই সিনেমাটোগ্রাফিক বিস্ফোরণ। তবে ম্যাডোনা না, সুচিত্রা সেন টাইপ। এগিয়ে এসে একেবারে মিসাইল, সোজাসুজি কারও-র সম্পর্কে কিছু বলতে না পারাটা হিপোক্রেসি। বুঝতে পারছিস?

ঠোঁটে হাসিটা রেখে বলে উঠেছিল অর্পণ, ফ্যাকাল্টির সামনে তোর তিল নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগত?

বাঃ! স্মার্টনেসের তো অভাব নেই।

অভাব কেন হবে। আশির দশকের কেবলু বাংলা সিনেমার নায়ক আর কোথায় পাবি এখন!

সুদেষ্ণা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলেও, অলক পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিল, তেরা হোগা গুরু।

সত্যিই হয়েছিল এবং এগিয়ে গিয়েছিল একটু দ্রুত গতিতে। প্রথম প্রেম আর তার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে লেকের ধার সুদেষ্ণার সঙ্গে সে সম্পর্ক এগিয়েছিল চোখের পলকে। সিনেমার হলে একই ফাউন্টেনে চুমুক, লাইব্রেরিতে স্টাডিনোট লোড করা বা গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটা হু হু করে কেটে গেছিল দিনগুলো। একই গতিতে শেষ হয়েছিল কোর্সের বছর দুটোও।

অর্পণের মনে হয়েছিল ছেদ পড়তে এবার বাধ্য, কারণ সুদেষ্ণা বর্ধমানে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা বলছিল। ঠিক সেই সময় অর্পণের হঠাৎ চাকরি। আর সুদেষ্ণার আবার একটা স্পেশাল কোর্সে ভর্তি হওয়া।

 

চব্বিশে চাকরি কি অর্পণকে বেপরোয়া করে দিয়েছিল? ছুটির দিনে নতুন কেনা বাইকে বোম্বে হাই রোড ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া বা বাইকে রাতের কলকাতা আবিষ্কার ওর আর সুদেষ্ণার। এ ছাড়াও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ভাড়ার ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

অফিসিয়ালি দাঁড়ি টানলাম, এই জাতীয় কথা কোনও দিন ওরা পরস্পরকে বলে, সম্পর্ক থেকে বেরোয়নি। কেউ কোনও দিন কাউকে পরে ফোন করে বা দেখা করে কৈফিয়তও চায়নি। সেটা সম্পর্কের চোরাটানের মৃত্যু হতে পারে বা, দুজনের ইগো ফ্যাক্টর হতে পারে। এমনকী নিজের তরফে ঠিক কী, সেটাও নিশ্চিত করে অর্পণ বলতে পারে না। মনের গভীরে স্মৃতি থেকে যাওয়াতেই কি কোথাও পাপবোধ! প্রথম কয়েক মাস ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকেও মনে হতো, একবার যোগাযোগ করলে কেমন হয়। তারপর একদিন সেখানেও ধাক্কা।

ছোটোখাটো মনোমালিন্য ওদের মধ্যে হলেও তা দীর্ঘস্থাযী হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজ করে নিত সুদেষ্ণাই। তাই কোনও দিন সেভাবে ওর মুখ গম্ভীর দেখেনি। স্পেশাল কোর্স শেষের ঠিক একমাস পর এলগিন রোডের এক ক্যাফেতে রবিবারের দুপুরে হাজির হয়ে দেখতে পেয়েছিল গম্ভীর মুখ। বাইরেও আকাশের মুখ ভার। অসাধারণ সুন্দর মিউজিকের সঙ্গতেও দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ হয়েছিল নিঃশব্দে।

এই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউটা ক্র‌্যাক করতে পারলাম না। অথচ পোস্টিং কলকাতাতে ছিল, আর প্যাকেজও ছিল অ্যাট্রাকটিভ। সুদেষ্ণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নীচের ঠোঁট।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল অর্পণ, তো?

তো কিছুই নয়। দিল্লিতে একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা ইন্টারেস্টেড। এক সেকেন্ড থেমে সুদেষ্ণা যোগ করেছিল, আমিও।

সোজা হয়ে বসেছিল অর্পণ, ভালো খবর। কিন্তু কলকাতাতে আরও দুএকটা ট্রাই করলে হতো না?

ইনস্টিটিউটে শর্মা স্যার বলছিলেন, দিল্লির অফারটা নিয়ে নেওয়া উচিত। ওদের নাকি প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনিং স্টাইলটা গোটা ইন্ডিয়ায় খুব খাচ্ছে। আর আহমেদাবাদ আইআইএম-এর দুজন প্রাক্তন মিলে অফিসটা খোলায়, শেখার স্কোপটা বেশি হবে।

অন্যমনস্ক হয়ে খালি কফি কাপটা একবার নাড়াচাড়া করে অর্পণ বলেছিল, ও, তাহলে তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস।

এভাবে ভাবছিস কেন, যে-কোনও অবস্থাতেই কলকাতা ফিরে আসতে পারি। আরও অনেক বেটার এক্সপেরিযে্ন্স নিয়ে। অফিসের দুদুটো অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে চলতে থাকায় রাতের ফোন ছাড়া সে সপ্তাহে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বর্ধমানে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সুদেষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে ওর বাবা-মা ছাড়তে এসেছিল। আগে থেকে কোনও পরিচয় না থাকায় সামনে যেতে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।

দিল্লিতে সেটলড হয়ে ফোনে বেশ কয়েবার কথা হয়েছিল। সে ফোনও কমে আসছিল তিন-চার মাস পর। তারপর দুদুটো নম্বর অস্তিত্বহীন।

শোক করেনি অর্পণ। নিজের প্রেমের নির্লিপ্তিতে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভাবার এত সময় ছিল না। নিজের কেরিয়ার গ্রাফ রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। কোম্পানি চেঞ্জ করে সাধারণ বেসরকারি অফিসে চাকরি থেকে অনেকগুনে বেশি রোজগার মোটেও মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। দুবছরের মাথায় ফ্ল্যাট নিয়ে পরের ছবছর শুধু তার ইএমআই গুনে গেছে নিঃশব্দে।

১৮ লাখের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে উঠে এসে প্রথম প্রথম উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারির যুদ্ধটা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ভালো লাগত। রাতে ফ্ল্যাটে একা থাকার পীড়া যে-একেবারেই দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু ক্লান্তি খুব দ্রুত ঘুমের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলত।

এ রকম অবস্থাতে ছটা বছর কেটেছিল অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। নতুন করে কারও-র সঙ্গে জড়ানোর সময় ছিল না। ছুটির দিনে বাজার, গোছগাছ, রান্নার লোককে বুঝিয়ে দেওয়া আর বাকি সময়টা ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ডিজাইন। গোঘাট থেকে বউদি আর মায়ের অনবরত ফোন ভেসে আসছিল।

বিয়ের প্রস্তাবে খুব বেশি চমকায়নি। হিসেব কষে দেখেছিল ফ্ল্যাটের ঋণশোধে বাকি আর সাত বছর। ইনক্রিমেন্ট স্টেডি রেটে বাড়ছে। জিডিপির লোয়ার গ্রোথের দাঁত ওদের ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শরীর-মন একযোগে বলে উঠেছিল বিয়ের এটাই সঠিক সময়। আর তা ছাড়া এতগুলো বছর অন্য কারও-রও তো মনে পড়েনি। সুতরাং দায়ের প্রশ্ন আসছে না বোধহয়। আর নিশ্চিত সমাধান তো এবার হাতের কাছেই।

চন্দননগরে ঐশিকিদের বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখা। মোটামুটি খবর নেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারফেক্ট চয়েস। বাংলায় অনার্স গ্র‌্যাজুয়েট। তবুও বাইরে দুতিনবার মিট করে নিয়েছিল। লম্বা চুল, হাইট, রং-এ জোরদার লাগলেও, সুদেষ্ণার সঙ্গে তুলনায় যায়নি। চন্দননগর ষ্ট্র‌্যান্ডেই রবিবারের এক সন্ধেতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঐশিকীকে, ওর অতীত জীবনের কথা। কোনও পাস্ট অ্যাফেয়ার, এ বিয়েতে রাজি কিনা, ছোটো ছোটো প্রশ্নে জানার চেষ্টা করেছিল।

ঐশিকির সোজা-সাপটা সরল উত্তরে কিছুতেই নিজের অতীতকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পারেনি। বিয়ের পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও নিষ্কলঙ্ক ঐশিকীর আচরণে, নিজের অতীতকে বার বার গিলতে হয়েছে। একটা অ্যাফেয়ার কী করে অপরাধবোধে পরিণত হয়, ভেবে বের করতে পারেনি। অগত্যা ছুটে যাওয়া ডা. চ্যাটার্জির কাছে।

 

ঘুমানোর ভান করেই শুয়েছিল। একটা হালকা উত্তেজনা তো বটেই, দুপুরে ভালো রকম ঘুমের জন্যও ঘুম আসতে চাইছিল না। কাল খুব সকালে উঠে প্রোজেক্টের একটা কাজ ছকে নিতে হবে বলেছিল। তাই ঐশিকি আজ আর কোনও উষ্ণতা চায়নি। ভীষণ কম্প্রোমাইজিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মেয়ে। সম্পর্কের সতেজতা আর স্নিগ্ধতা দুটোই সমান ভাবে মেনটেইন করতে পারে। এভাবেই তিন মাস অর্পণকে যেন অদৃশ্য হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

মধ্য কুড়িতে সম্পর্ক উন্মাদনা খোঁজে হয়তো, মধ্য তিরিশে স্থিতাবস্থা। সংসারের বৃত্তে এ ভাবেই বোধহয় ঢুকে পড়তে হয়। আজকের রাতের পর নিশ্চই পুরোপুরি ঢুকে পড়বে। সন্ধেবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঐশিকির চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। বিশেষত ছুটির দিনে। মনে হয়েছিল রাতই সঠিক সময়।

রোজের মতো আজও ঐশিকি টয়লেটে উঠল। এসি অফ করল। মিনিট চারেক সময় ব্যয় করে টয়লেটে ও। এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এক মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়ল অর্পণ। ভাগ্যিস অ্যাটাচড্ বাথ নয়। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল। টয়লেটের আলো জ্বলছে, জলও পড়ছে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিজের ল্যাপটপে কম্পোজ করেছিল প্রায় তিন পাতার কনফেশন। প্রিন্ট আউটও বের করে রেখেছিল। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলল। সামনে চাঁদের আলোয় ভরা গঙ্গা। দ্রুত হাওয়ায় বড়ো মায়াবী এ চরাচর। টুকরোগুলো হাত থেকে ছোড়ার আগের মুহূর্তেই, স্থির হতে হয়।

পাশের ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে আসে প্রায় একই রকম কাগজের টুকরো। অসংখ্য। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের জানালা থেকে সরে যায় ঐশিকির মুখ। হাতের ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোকে এবার ছেড়ে দেয় অর্পণ। দুটো স্বীকারোক্তি প্রায় একইরকম হয়ে মিলেমিশে প্রবল হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মিশে যায়। যেমন করে বসন্তের হাওয়া আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছিল…

 

ভাঙা বনেদ

সুমির সঙ্গে অতনুর পরিচয় হয় একটি আর্ট গ্যালারিতে। পাঁচ মিনিটের আলাপেই দু’জনের মধ্যে বিজনেস কার্ড-এর আদানপ্রদানও সারা হয়ে যায়।

অতনুকে নিজের বিজনেস কার্ড-টা ধরাতে ধরাতে সুমি বলল, ‘এটা আমার কার্ড। এখানে আমার স্টুডিওর নামটা আর ঠিকানাটা দেওয়া আছে। আমার নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে। ওখানেই আমার সব পেইন্টিং-এর ছবি রয়েছে এবং দামও দেওয়া আছে।’ কার্ডে দেওয়া লিংক-টাতে আঙুল রেখে সুমি অতনুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল।

‘হ্যাঁ, ভালোই হল। আমি আপনার সব পেইন্টিংগুলো দেখতে চাই। দেখা হলে টেক্সট ম্যাসেজ করে আপনাকে ফিডব্যাকটা জানিয়ে দেব। এমনিতে প্রায় শহরের কোনও আর্ট এগ্জিবিশন আমি দেখতে বাদ রাখি না, কিন্তু আপনার মতো শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার সুযোগ কখনও হয়নি। আপনার প্রত্যেকটা ছবির যেন কোনও না কোনও বক্তব্য আছে। স্টাইলাইজড্ ফর্ম হলেও তা ভীষণভাবে মৌলিক। কার্ডটাতে চোখ বোলাতে বোলাতে অতনু সুমিকে নিজের বক্তব্য জানাল।

‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। স্টে ইন টাচ।’ সুমি হেসে উত্তর দিল। এই ছোট্ট আলাপে সুমির মনে হল, অতনুর মতো তার শিল্পের এত বড়ো অনুরাগী সারা পৃথিবীতে আর নেই।

পাঁচ মিনিটের বেশি অতনুর সঙ্গে কথা হয়নি কিন্তু গ্যালারিতে সুমির চোখ সর্বক্ষণ অতনুর দিকেই নিবদ্ধ রইল। অতনুর আকর্ষণ সুমি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছিল না। যতক্ষণ অতনু গ্যালারিতে রইল সুমির প্রত্যেকটা ছবি সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং ছোট্ট একটা নোটবুকে অতনুকে কিছু লিখে রাখতেও দেখল। ছেলেটি শিল্পের কদর করতে জানে, এই একটা কথাই অতনুর হাবভাবে সুমির মনে হল।

এই ঘটনার পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অতনু সুমিকে কন্ট্যাক্ট করার যেমন চেষ্টা করেনি সুমিও অতনুর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি।

এই ক’মাসের মধ্যে ওয়েবসাইট থেকে সুমির মাত্র দুটো তিনটে ছবিই বিক্রি হয়েছে। সুমি নানা ভাবে নিজের ছবির প্রচার চালাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। চেনা-অচেনা সুমি পরোয়া করেনি। নিজের ওয়েবসাইটের লিংক সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুমির একটাই লক্ষ্য– পেইন্টিংয়ের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজের জন্য একটা জায়গা বানানো। মানসিক এই চাহিদা পূর্ণ করার লক্ষ্যে সুমি অতনুকেও একটা মেসেজ করে, ‘আপনি যদি আজকে ফ্রি থাকেন তাহলে একসঙ্গে কফি খাওয়া যেতে পারে।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে অতনুর ‘ফ্রি আছি’ শব্দটা সুমিকে দ্বিধার মধ্যেই ফেলে দেয়। পাঁচ মিনিটের আলাপের পর দীর্ঘ ছ’মাসের বিরতি। আর আজ এতদিন পর সুমি নিজের দরকারে একটা মেসেজ পাঠাতেই সঙ্গে সঙ্গে কফি খাওয়ার জন্য আসতে রাজি! একটু অস্বাভাবিক নয় কি? সুমি, অতনুর হ্যাঁ-এর উত্তরে আর কিছু লিখল না মেসেজে।

‘পৃথিবী-টাই বড়ো অদ্ভুত’, মনে মনে বলল সুমি। ঘটনাটা মনের এক কোণায় সরিয়ে রেখে নিজের আসন্ন আর্ট এগ্জিবিশন নিয়ে সুমি মেতে উঠল।

হঠাৎই কাজের মধ্যে একদিন সুমির কাছে অতনুর ফোন এল, ‘হ্যালো সুমি, সেদিন আপনি কফি খাওয়ার জন্য ডাকলেও যে-কোনও কারণেই হোক প্ল্যান-টা ম্যাচিওর করেনি। চলুন একটা দিন ঠিক করে কফি শপ্-এ দু’জনে বসা যাক।’

‘কিন্তু আপনি আমাকে চেনেন না আর আমাদের পরিচয় মাত্র পাঁচ মিনিটের। দু’জন একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না প্রায়। সুতরাং একসঙ্গে বসে কফি খাওয়ার কোনও মানে নেই। আমি আমার কাজের জন্যই আপনাকে আগে মেসেজ করেছিলাম। এর অর্থ এটা ধরে নেবেন না যে, আমি আপনার সঙ্গে বে-ফালতু টাইম পাস করতে আগ্রহী,’ সুমির নিজেরই নিজেকে বড্ড রুড মনে হয়।

‘সুমি, আপনার আর্ট, আপনার শিল্পকলা আমাকে আকর্ষণ করে। আপনার শিল্পের গভীরতায় আমি মুগ্ধ। আপনার ছবিকে মাধ্যম করে আপনাকে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। এতে আপনার প্রতি আমার সম্মান দিনে দিনে বেড়েছে। একদিন দেখবেন আপনার সৃষ্টি আপনাকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেবে। প্রতিটি খবরের কাগজে আপনাকে নিয়ে লেখা বেরোবে। এই জার্নিটায় আমি কি আপনার একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু হতে পারি না?’

নিজের প্রশংসা কার না ভালো লাগে? অতনুর কথাগুলোর প্রভাব পড়তে শুরু করে সুমির উপরে। অতনুর প্রশংসা বাক্যের সম্মোহনী শক্তি সুমিকে আকর্ষণ করতে থাকে অতনুর দিকে। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুমি অতনুর সঙ্গে কথা বলতে থাকে। মনের সুপ্ত বাসনাগুলো শিকড় মেলতে শুরু করে।

‘সুমি, তোমার সঙ্গে যত মিশছি, কথা বলছি, তোমার প্রতি সম্মান আমার ততো বাড়ছে। সারা পৃথিবীর মানুষ একত্র হলেও তোমার প্রতি আমার এই মনোভাব কখনও ভাঙতে পারবে না। কতদিন হয়ে গেল, তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছি, অথচ এখনও একসঙ্গে বসে আমাদের কফি খাওয়া হল না,..’ প্রথম আড়ষ্টতা কাটিয়ে, অতনু এবার অনেকটা স্পষ্টবাক।

সুমির সব প্রতিরোধের দেয়াল মুহূর্তে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায় দিনই অতনুর সঙ্গে সুমির দেখা হতে থাকে। সামান্য পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। সুমি জানতে পারে অতনু বিবাহিত। ওর তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। ওর স্ত্রী মীনাক্ষী কলেজে ইতিহাসের প্রফেসর। অতনু নিজে কোনও কাজ করে না।

‘আমার কাজ করার দরকারটা কী? আমার বাবা বিধায়ক ছিলেন, সারাজীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। আমিও বিধায়কের টিকিটের জন্য দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি। আশা করছি এবার টিকিট পেয়েই যাব। হাজার-দু’হাজার টাকার চাকরি আমার জন্য নয়,’ গর্বের সঙ্গে অতনু সুমিকে বলে।

‘চাকরিতে যখন তোমার এতই ঘেন্না তাহলে মীনাক্ষীর মতো চাকুরিরতাকে কেন বিয়ে করেছ?’ সুমি জিজ্ঞাসা না করে পারে না।

‘মীনাক্ষীকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু ওর ওই এক জেদ, চাকরি কিছুতেই ছাড়বে না। অথচ বিয়ের আগে ও আর ওর পরিবারের লোকেরা প্রমিস করেছিল বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেবে। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মীনাক্ষী এতটা বদলে যাবে বুঝতে পারিনি। চাকরি ছাড়তে কিছুতেই রাজি হল না। আসলে ওর কোনও ধারণাই নেই বিধায়কের বাড়ির বউয়ের চাল-চলন কীরকম হওয়া উচিত।’ আত্মগর্বে এবং অহংকারে অতনুর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে।

অতনুর উত্তর শুনে সুমির মাথায় শঙ্কার ঘন মেঘ ঘনিয়ে আসে। সুমির কাছে সংকেত আসে, ভুল মানুষের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু অতনুর প্রশংসা আর ওর বিধায়ক বাবার পরিচিতির বিশাল পরিধির মাঝে থাকতে পারলে সুমির লাভ বই ক্ষতি নেই– এই বোধটাই সুমিকে নিজের মনের বিপদের ঘণ্টাটাকে উপেক্ষা করেই অতনুকে আঁকড়ে ধরতে চায়।

একদিন কফি শপে কফি খেতে খেতে অতনু সুমিকে বলে, ‘মন্দিরের মূর্তির মতো আমি মনে মনে তোমাকে পুজো করি। আমি তোমাকে যা-যা বলি শুধু শুনে যেও তুমি, মনের মধ্যে রেখো না তাহলে কষ্ট পাবে। তবে এটাও ঠিক, আমি বিবাহিত, তোমার হাত ধরে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘আমি জানি তুমি বিবাহিত। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আমি কোনও আশা রাখি না। কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না যখন আমরা দু’জনেই জানি আমরা এই পথে বেশিদূর এগোতে পারব না, তখন মিছিমিছি এই ভাবে দেখা করার কী লাভ?’ সুমি জিজ্ঞেস করে।

‘তোমার প্রতিভা-কে সম্মান করি। তোমাকে সাফল্যের চূড়ায় দেখতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই আশা করি না। শুধু ভালো বন্ধু হিসেবে তোমাকে সাফল্য পেতে সাহায্য করতে চাই। আসছে বছর থাইল্যান্ডে ফাইন আর্টস-এর একটা বড়ো প্রদর্শনী আছে। সেখানে যোগদান করার সব ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে ললিত কলা অ্যাকাদেমি স্কলারশিপও পাইয়ে দেব। আমার বাবার বড়োবড়ো কনট্যাক্টস আছে। সুতরাং তোমার জন্য এইটুকু করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। তোমার দুটো-চারটে ইন্টারন্যাশনাল প্রদর্শনী হয়ে গেলেই দেখবে তুমি বিখ্যাত হয়ে উঠেছ।’

অতনুর কথা শুনে সুমি উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সুমির মনে হল ও বিখ্যাত হতে পারুক চাই না পারুক, অতনুর মতো মানুষ তার প্রশংসা করছে, এর চেয়ে বড়ো পাওয়া আর কী হতে পারে?

রোজই নানা ছুতোয় অতনু আর সুমির দেখা হওয়া শুরু হল। সুমি বুঝতে পারল তার প্রতি অতনুর ব্যবহারটা শুধু বন্ধুত্বে আটকে নেই। অতনু আরও কিছু চাইছে ওর কাছে। আগে দেখা হলেই পেইন্টিং সম্পর্কে আলোচনা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে অতনুর কথার ধরন বদলাচ্ছে লক্ষ্য করল সুমি –

‘একটা জিনিস চাইব তোমার কাছে?’

‘কী?’

‘আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে চাই।’

‘একদমই না। এরকম ভুলভাল ইচ্ছা না হওয়াই ভালো।’

‘প্লিজ, শুধু একবার। জানো আমার কী মনে হয়?’

‘কি?’

‘মনে হয় তোমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সময়কে বরাবরের মতো থামিয়ে দিই। সময় নেই, অসময় নেই, চোখ খুলে বন্ধ করে সবসময় তুমিই আমার সমস্ত মন জুড়ে থাকো।’

সুমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মুখে সে যতই বলুক, তার মন-ও তো এটাই চাইছিল। তার শুভবুদ্ধি তাকে সাবধান করা সত্ত্বেও সুমি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই অতনুর বুকে নিজেকে সঁপে দেয়।

সর্প কুণ্ডলীর মতো অতনুর দুটো বাহু সুমিকে জড়িয়ে ধরে। সুমির মনে হয় কোনও গভীর অতল থেকে ভেসে আসছে অতনুর গলার স্বর, ‘সুমি আমি তোমাকে উচ্চতার শিখরে দেখতে চাই…’

সম্বিত ফেরে সুমির। নিজেকে অতনুর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে অতনুকে অনুরোধ করে, ‘প্লিজ এবার আমাকে বাড়ি যেতে দাও। কাল সন্ধের মধ্যে আমাকে আরও দুটো পেইন্টিং শেষ করতে হবে।’

‘ঠিক আছে, যাও ছেড়ে দিলাম… কিন্তু প্রমিস করো কাল-পরশুর মধ্যে আবার দেখা করবে। এই সপ্তাহের শেষে তোমার সম্পর্কে বাবার সঙ্গে কথা বলব। ললিত কলা অ্যাকাডেমির স্কলারশিপটা নিয়ে তাড়াতাড়ি এগোনো দরকার।’

দু’দিন বাদেই অতনু আর সুমি ওদের পছন্দের কফি শপে মুখোমুখি হল। আগের দিনের প্রচণ্ড বৃষ্টির পর সকালের নরম রোদ্দুরে গা ভাসাতে ইচ্ছে করছিল সুমির। অতনুর ফোনটাও এসেছিল সময় বুঝে। রেস্তোরাঁর নিমন্ত্রণটা সুমি তখনই পেয়েছিল। ভাবার জন্যে এক মুহূর্তও নষ্ট করেনি। কফি খেতে খেতে অতনু বলল, ‘চলো পাশের পার্কটাতে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। আজ দিনটা বেশ ভালো। কাল বৃষ্টি হওয়াতে গরম নেই বললেই চলে।’

পার্কের বেঞ্চিতে পিঠ এলিয়ে দিয়ে অতনু সহজ হবার চেষ্টা করে। ‘সুমি আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। একথা আমরা দুজনেই আর অস্বীকার করতে পারি না। মনের বন্ধন যেখানে আছে, সেখানে শরীরকে শাসন করতে চাইছ কেন?’

সুমি চুপ থাকতে পারল না। উত্তর দিল, ‘তুমি ঠিক কী বলতে বা বোঝাতে চাইছ অতনু?’ যদিও অতনুর ইচ্ছা দিনের মতোই পরিষ্কার ছিল সুমির কাছে তবুও না বোঝারই ভান করল সুমি।

আমার এই ইচ্ছে নতুন তো কিছু নয় সুমি। তুমি জানোই যে আমি বিবাহিত এবং শহরে বাবার একটা সম্মান আছে সুতরাং এই সম্পর্কটাকে কোনও পরিণতি দেওয়া হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তোমার সঙ্গে যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে আরও কিছু পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?’

কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই অতনু সুমিকে টেনে নিয়ে একটা মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সুমি টের পেল অতনুর তপ্ত নিঃশ্বাস ওর মুখের উপর এসে পড়ছে। তার নিজের ঠোঁটের উপর অতনুর ঠোঁট এসে প্রতিরোধের সব ক্ষমতা সুমির লুপ্ত করে দিল। সমস্ত শরীরময় অতনুকে অনুভব করছিল সুমি অথচ কোনও প্রতিরোধ কাজ করছিল না।

নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সুমি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুদিন ধরে নিজের আঁকা আর অতনুকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে ফ্ল্যাটটা অগোছালো হয়েই পড়ে আছে। আজ পরিষ্কার না করলেই নয়। সুমির মা-বাবা নিজেদের পৈত্রিক বাড়িতেই থাকেন শহরের উত্তর অংশে নিজের অন্য ভাইদের সঙ্গে। মেয়ের কাজের সুবিধার জন্য ছোট্ট ফ্ল্যাটটা সুমির বাবাই সুমিকে কিনে দিয়েছেন।

ফ্ল্যাটটা গোছগাছ করে সুমি বিছানায় এসে বসল। আজ অনেক দিন বাদে নিজের বিবেকের সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ ঘটল সুমির। পার্কে সময় কাটিয়ে অতনুই নিজের গাড়িতে সুমিকে ফ্ল্যাটে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল। অবধারিত ভাবে দুটো প্রাপ্ত বয়স্ক শরীর ডুবে গিয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল, পূর্ণতার লক্ষ্যে। অতনুর সঙ্গে তার এই সম্পর্কটার কী নাম দেওয়া যেতে পারে? সুমি ভালো করেই জানে অতনুর সঙ্গে যে রাস্তায় সে পা বাড়িয়েছে তাতে কিছু পাবার আশা নেই বরং চারিদিকে ধূ ধূ করছে প্রান্তর। মুখ লুকোবার কোনও জায়গা নেই। কী করবে সুমি ভেবে স্থির করতে পারে না। সব জেনেশুনে অতনুকে বেছে নেওয়াটা কি সুমির নিয়তি না দুর্বলতা– মনে হতে থাকে সুমির।

অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা সুমির মস্তিষ্কে ভিড় করে আসে। প্রায় দুই বছর হতে চলল সুমি আর অতনুর বন্ধুত্বের। সত্যিই কি অতনু ওকে একজন বড়ো শিল্পী ভাবে? আদৌ কি ওর জন্য অতনুর মনে কোনও সম্মান আছে? অতনু কি সত্যিই কোনওদিন একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? মুখে যা-ই বলুক, কাজে সেটা সফল হতে এখনও দেখেনি সুমি। এই দুই বছরে সুমির জন্য ও কী চেষ্টা করেছে? কিছুই তো না।

প্রশ্নের বোঝা মাথায় নিয়েই সুমি ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। পরের দিনও সুমির, ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখতে ইচ্ছে করে না। রাত্রের প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে সুমির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এমন নয়তো উচ্চাশাকাঙক্ষী হতে গিয়ে অতনুর কামনার একটা মাধ্যম হয়ে উঠছে সে? উত্তর জোগায় না। এই দু’বছরে সুমি অতনুকে নিয়ে এতটাই মেতে ছিল যে সুমির অন্য বন্ধুরা ওর থেকে দূরে সরে গেছে। ফ্ল্যাটে একা বসে বসে সুমির পুরোনো স্মৃতি, ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়তে থাকে। শেষমেশ সব গ্লানি, অপরাধের বোঝা ঝেড়ে ফেলে সুমি, বান্ধবী শ্রেয়ার বাড়ি যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।

‘অনেক দিন পর সুমি, কী ব্যাপার? কোথায় ছিলি এতদিন? তোর কোনও খবরই কারও কাছে ছিল না? শ্রেয়ার বাড়ির দরজাতেই সুমিকে দেখে শ্রেয়ার মা এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলি করে গেলেন। সামান্য হাসি টেনে ঘরের ভিতরে ঢুকতেই সুমিকে উনি জড়িয়ে ধরলেন। ওনার আন্তরিকতা সুমির চোখের পাতা ভিজিয়ে তুলল।

‘মাসিমা, কয়েকটা বড়ো পেইন্টিং প্রোজেক্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই সময় করে উঠতে পারিনি। তবে একটা দিনও এমন যায়নি, যখন আপনাদের কথা আমার মনে পড়েনি,’ রুমাল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেয় সুমি।

‘চল, ভালোই হল সুমি। এতদিন পরে হলেও তো এসেছিস। কী খাবি? শরবত নাকি গরম কিছু? হাত ধরে সুমিকে সোফায় বসাতে বসাতে শ্রেয়ার মা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কিছু খাব না মাসিমা, শুধু বলুন শ্রেয়া কোথায়… ওকে তো কোথাও দেখছি না।

‘এতদিন পর এসেছিস, কিছু তো খেতেই হবে। আর ততক্ষণে শ্রেয়াও চলে আসবে। ওর আজকে একটা বড়ো অনুষ্ঠানে সেতার বাজাবার প্রোগ্রাম আছে। প্রোগ্রামটা নিয়ে ও খুব আশাবাদী। কয়েক মাস ধরে এটা নিয়েই লেগে ছিল,’ মেয়ের প্রতিভার উপর গভীর আস্থা ফুটে ওঠে শ্রেয়ার মা-র স্বরে।

‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এত বড়ো একটা সুযোগ পেয়েছে আর আমি কিছুই জানি না,’ ভাবতে ভাবতে গ্লানিতে সুমির মন ভরে ওঠে।

গল্প করতে করতে কখন এক ঘণ্টা কেটে গেছে সুমি টের পায়নি। কলিংবেলের আওয়াজে দু’জনের ঘোর ভাঙে। শ্রেয়ার মা দরজা খুলতেই ঝড়ের গতিতে শ্রেয়া ঘরে ঢুকে মা-কে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়ার চোখমুখ উৎসাহ, উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করছে।

‘মা, মা… আজ আমার প্রোগ্রাম দারুণ হয়েছে। জানো অনুষ্ঠান চলাকালীন কী হয়েছে?’ খুশি উপচে ওঠে ওর চোখে-মুখে। মা-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, ‘মা, আজকে প্রোগ্রামে এখানকার একজন এমএলএ, পরিবারের সঙ্গে এসেছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। জানো ওদের আমার বাজনার হাত এত ভালো লেগেছে যে ওনার ছেলে অনুষ্ঠানের শেষে আলাদা করে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ছেলেটি আমাকে বলে যে, আমার বাজনার হাত নাকি এতটাই ভালো যে একদিন আমি রবিশঙ্করের মতোই নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ছেলেটি ওর বাবার সঙ্গেও কথা বলবে, যদি কোনও স্কলারশিপের ব্যবস্থা আমার জন্য করা যায়।

কথা শেষ করতেই শ্রেয়ার দৃষ্টি পড়ল সুমির উপর। আনন্দে লাফিয়ে উঠে, সুমিকে জড়িয়ে ধরল শ্রেয়া। অনেক কষ্টে সুমি মনের ভাবটা মুখে প্রকাশ হতে দিল না। কিন্তু তার বিশ্বাসের বনেদটা ক্রমশ ভেঙে চৌচির হতে থাকল, অতনুর স্বরূপটা জানতে পেরে। শ্রেয়া কিছু বলার আগেই সুমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, খালি মনে হচ্ছিল কতক্ষণে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরবে। শুধু সুমির মনে তোলপাড় হচ্ছিল, অতনুর সঙ্গে ওর দুই বছরের সম্পর্কে এটাই কি তার প্রাপ্য?

‘শ্রেয়া, প্লিজ আজকে আমাকে বাড়ি যেতে দে। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। একটু বিশ্রাম করলে মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে যাবে। আর এক দিন আসব তোর কাছে। জমিয়ে গল্প করব সেদিন দু’জনে,’ কোনওমতে সুমি বলে।

‘ঠিক আছে, তোর মুখটা কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। বিশ্রাম নিলেই মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। তোকে আমি আটকাব না, সাবধানে যেতে পারবি তো?’ শ্রেয়ার চোখে-মুখে সুমির জন্য চিন্তা ফুটে ওঠে।

রাতের শহরে স্ট্রিট লাইটগুলোর আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাসের বদলে ট্যাক্সি নিয়েছে সুমি। পিঠটা ট্যাক্সির সিটে এলিয়ে দিয়েছে, তবু যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। উঠেই ড্রাইভারকে গন্তব্য জানিয়ে গুছিয়ে বসেছে ও। চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দুই বছরের ছায়া ছায়া অন্ধকার হারিয়ে গেছে। অতনুর ব্যক্তিত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কামুক পুরুষটাই ক্রমশ সুমির চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। যে নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে, কলেজের প্রফেসর হওয়া সত্ত্বেও নিকৃষ্ট মনে করতে পারে, তার কাছ থেকে অন্য নারীরা সম্মানের আশা রাখবে কী করে? এই ধরনের লোক কারও প্রতিভার কদর করতেই পারে না। সুমির মনে হল যেটুকু নামডাক ওর হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই। অতনুর কোনও অবদান সেখানে নেই।

সুমি আর অতনুর পরিচয়ের শুরুটাই ভুল ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যতগুলি অধ্যায় ওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ভ্রান্তি আরও বেড়েছে, সম্পর্কের ধাপগুলিতে মলিনতা আশ্রয় পেয়েছে। মনের আয়না কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় সুমি, অতনুকে চিনতে ভুল করেছিল, কিন্তু কুয়াশা সরতেই চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে তার কাছে। অতনু এসেইছিল সুমিকে টেনে অন্ধকারের অতলে নিয়ে যেতে, উচ্চতার শিখরে নয়। এরপরেও যদি সম্পর্ক এগোতে থাকে তাহলে তা আরও ঘৃণ্যতর হয়ে উঠবে। সুতরাং এখানেই তা শেষ করা দরকার। সুমির পাড়া কাছাকাছি এসে পড়েছে। খুব ঠান্ডা মাথায় ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে সুমি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করল। মনে মনে অতনুর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে এখন সে নিশ্চিত। মোবাইল অন করে অতনুর ফোন নম্বরটা ব্লক করে দিল সুমি। জীবনটা এবার নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে।

 

অসত্য

সুচন্দ্রা এই পাড়ায় নতুন নয়। সেই নয় বছর বয়সে মা-বাবার হাত ধরে এই পাড়াটায় প্রথম পা রেখেছিল সে। প্রথম প্রথম বন্ধু বলতে কেউ ছিল না। খুব খারাপ লাগত সুচন্দ্রার। স্কুল থেকে ফিরে খেলার সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না।

ধীরে ধীরে একই পাড়ার ঘোষ পরিবারের সঙ্গে সুচন্দ্রার মা-বাবার আলাপ-পরিচয় গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে সুচন্দ্রাও ওদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করে। ওর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘোষদের ছোট্ট ছেলেটা। কীরকম ফুটফুটে পুতুলের মতো। ওর থেকে বয়সে চার বছরের ছোটো। সবে সবে সুচন্দ্রার স্কুলেই ভর্তি হয়েছিল। নাম অনির্বাণ। বড়োদের সবার দেখাদেখি সুচন্দ্রাও ওকে ‘অনি’ বলেই ডাকত।

মা শিখিয়ে দিয়েছিল সুচন্দ্রাকে যে, অনি-ই সুচন্দ্রার ছোটো ভাই, তাই অত কম বয়সেই সুচন্দ্রা অনি-র অনেকটা দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

স্কুলে অনি যতক্ষণ থাকত সুচন্দ্রা ওকে চোখে চোখে রাখত। একটা ক্লাস শেষ করেই দৌড়ে এসে ভাইকে দেখে যেত। ভাইয়ের ছুটি আগেই হয়ে যেত। স্কুল থেকে ফিরেই সুচন্দ্রা চলে যেত ঘোষদের বাড়ি। সারাটা বিকেল ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে সময় কেটে যেত সুচন্দ্রার। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে সুচন্দ্রা বাড়ি ফিরে আসত।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে একসাথে বড়ো হতে থাকে। কিন্তু একে অপরের প্রতি স্নেহ ওদের এতটুকুও কম হয় না। অনির্বাণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গালুরু চলে যায়। আর সুচন্দ্রা কলকাতাতেই থেকে যায়। ও কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে নিজেরই এক সহপাঠীকে বিয়ে করে নেয়। সরকারি হাসপাতালে চাকরিও হয়ে যায় ওর।

এরই মধ্যে অনির্বাণের বাবা অন্য শহরে বদলি হয়ে যান। পরিবার নিয়ে ওরা নাগপুর চলে যায়। দূরত্ব তৈরি হলেও অনির্বাণ ছুটিছাটায় সুচন্দ্রার সঙ্গে এসে দেখা করে যেত। ফোনে যোগাযোগ সুচন্দ্রা কোনওদিনই বন্ধ করেনি।

সউদি আরবে চাকরি পাওয়ার খবর অনির্বাণ ফোনেই জানিয়েছিল। অনির্বাণের সঙ্গে ফোন ছাড়াও, মেলেও সুচন্দ্রা খবরা-খবর রাখত। এরই মধ্যে তিন বছরের জন্য সুচন্দ্রা স্বামীর সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে যায় পড়াশোনা করতে। ওখানে থাকতেই খবর পায় যে অনির্বাণ দেশে ফিরে এসে একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি নিয়েছে। কলকাতাতেই ওর পোস্টিং।

কলকাতায় ফিরতেই সুচন্দ্রা, অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই সন্ধেতেই অনির্বাণ এসে হাজির হয় সুচন্দ্রার বাড়িতে।

‘আয় ভাই, ভিতরে আয়। বাব্বা কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা,’ সহাস্যে সুচন্দ্রা বলে।

‘এত দেরি করে ফিরলে তোমরা, আমার আর সময় কাটছিল না। বাবারা তো নাগপুরেই সেটেল করলেন। আমি এখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রয়েছি। সারাটা দিন অফিসে কাজেই কেটে যায় কিন্তু সন্ধে থেকে কিছুই আর করার থাকে না…’ বলতে বলতে অনির্বাণ বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দেয়।

অনির্বাণের সাড়া পেয়ে ততক্ষণে সুচন্দ্রার স্বামী অর্ক-ও বাইরের ঘরে বেরিয়ে এসেছে। বাড়িতেই চেম্বার অর্ক-র কিন্তু অনির্বাণ আসবে জেনে রুগি দেখা বন্ধ রেখেছে আজ ও।

‘কী ব্যাপার শালাবাবু? একাকিত্বে বড়োই কাহিল হয়ে পড়েছ, বোধ হচ্ছে। তা জানো তো, এর একমাত্র চিকিৎসা হয় কিন্তু ছাদনাতলায়,’ হাসতে হাসতে অর্ক বলে।

‘অর্ক ঠিকই বলেছে অনি, তুই এখনও কেন বিয়ে করিসনি?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।

‘প্রথম সউদি আরব আর এখন কলকাতা, একা একা থাকা। বিয়েটা হবে কী করে? তারপর মা আর বাবার শরীরের অবস্থা তো জানোই তুমি। ওঁদের পক্ষে মেয়ে খোঁজা অসম্ভব আর মেয়ে দেখতে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক, এখন তোমরা এসে গেছ, সুতরাং মনে হচ্ছে দিদি এবার আমার বিয়েটা হয়েই যাবে।’

‘অনি, হয়েই যাবে মনে হচ্ছে… এই কথাটার মানে কী? আর একলা থাকলে কি বাইরে বিয়ে করে এসে এখানে একটা রিসেপশন দেওয়া যেত না?’ কপট রাগের সঙ্গে সুচন্দ্রা অনি-কে বাগে আনার চেষ্টা করে।

‘দিদি, নাগপুরে কোনও বাবা-মা তাঁদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না কারণ বয়সটা আমার কম হল না। আর আমার পছন্দ মায়ের পছন্দ নয়। এই করে বিয়েটাই আর করা হচ্ছে না। দিদি, তুমি এক কাজ করো, হয় মা-বাবাকে বোঝাও যে আমি নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব আর নয়তো তুমি নিজেই এই পাত্রী ঠিক করার দায়িত্বটা নাও।’

‘কিন্তু কাকু-কাকিমা, তোর পছন্দের মেয়েকে কেন মেনে নিচ্ছেন না? অন্য কাস্ট ও, নাকি ডিভোর্সি?’ সুচন্দ্রা জানতে চায়।

‘ওই সব কিছুই না দিদি। মেয়েটি অবিবাহিত এবং আমাদেরই কাস্টের। কিন্তু ওর একটাই শর্ত যে ভবিষ্যতে আমাদের যেন কোনও সন্তান না হয়। আর এটাতেই মায়ের আপত্তি।’

‘কিন্তু মেয়েটি কেন সন্তান চায় না আর এখনও কেন মেয়েটি বিয়ে করেনি? এটা একটু অদ্ভুতই মনে হচ্ছে,’ সুচন্দ্রার গলায় স্পষ্ট শঙ্কা ফুটে ওঠে।

‘দিদি, রুমন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার সঙ্গে একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ওখানে পড়তে পড়তেই ওর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই ওর মা-ও, ওই একই রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা করিয়েও ওদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখন ও চাকরি করে। আমাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু ওর একটাই শর্ত– মা হতে চায় না,’ অনির্বাণের কণ্ঠে হতাশা ফুটে ওঠে।

‘কিন্তু কেন ওর এরকম জেদ?’

‘এটা আমি জিজ্ঞেস করিনি বা করবও না। ও আমাকে কারণটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর অতীত জানার আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি ওকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।’

‘কিন্তু এরকম একটা ডিসিশন নেওয়ার কোনও তো কারণ হবে,’ সুচন্দ্রা বলতে বাধ্য হয়।

‘রুমন আমাকে বলেছিল যে মা-বাবার চিকিৎসায় প্রচুর টাকার দরকার ছিল যার জন্য ওকে রাতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন কাজ ও কোনওদিন করেনি যাতে ওকে পরে লজ্জায় পড়তে হয়। আর ওর মা না হওয়ার ডিসিশনও সম্পূর্ণ ওর নিজের ইচ্ছেয়, এর পিছনেও কোনও অনৈতিক কারণ নেই। দিদি, আমার মনে হয় কাউকে ভালোবাসলে তাকে তার প্রয়োজনীয় প্রাইভেসিটুকু দেওয়া উচিত। আমার সন্তান হোক আর নাই হোক, তাতে মা-বাবার সমস্যা কোথায়? বাড়িতে বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো ভাই রয়েছে।’ একটু চুপ করে থেকে অনির্বাণ বলে, ‘তাছাড়া বাচ্চা দত্তক নেওয়ার অথবা সারোগেসির বিকল্প তো রয়েইছে।’

‘এই ব্যাপারটা নিয়ে রুমনের সঙ্গে কথা বলেছ?’ অর্ক এতক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ, অর্কদা। ও-ই আমাকে বলেছিল যে আমার বাড়ির লোক যদি আমার মা হওয়া নিয়ে খুব বেশি চাপ দেয়, তাহলে সারোগেসির মাধ্যমে আমি যেন ওদের ইচ্ছে পূরণ করি। ওর কোনও আপত্তি নেই। এত কিছুর পরেও মা-বাবা রাজি হয়নি। এখন তোমরা যদি কোনও ভাবে সাহায্য করো।’ অনির্বাণের কথা শুনে অর্ক চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুচন্দ্রার দিকে তাকায় অনির্বাণ, ‘দিদি জানোই তো ভালোবাসা অন্ধ। আর রুমনের প্রতি ভালোবাসাই আমার প্রথম এবং শেষ বলতে পারো।’

‘আর রুমনের ক্ষেত্রেও কি তুই-ই ওর প্রথম এবং শেষ প্রেম?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।

অনির্বাণ সম্মতিসূচক ঘাড় হেলায়। সুচন্দ্রার প্রশ্নের উত্তরে ও বলে, ‘হ্যাঁ দিদি। প্রথম থেকেই আমরা দু’জনে একে অপরকে পছন্দ করতাম। ভেবেছিলাম পড়া শেষ করে সকলকে আমাদের সম্পর্কটার বিষয়ে জানাব। কিন্তু তার আগেই রুমনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর রুমনও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইল না। কিন্তু একই শহরে থেকে সেটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সেইসময় আমিও সউদি আরবে চাকরিটা পেয়ে চলে যাই।’

‘তাই জন্যেই কি তুই হঠাৎ বাইরে চলে গিয়েছিলি?’ সুচন্দ্রা, অনিকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয়।

‘হ্যাঁ দিদি, তুমি ঠিকই ধরেছ। রুমনের জীবন থেকে আমি সরেই যেতে চেয়েছিলাম।’

‘কিন্তু তাহলে ফিরে এলি কেন?’

‘আমাদের দু’জনের কমন ফ্রেন্ড শান্তা। ওর সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ ছিল। ওই আমাকে রুমনের বাবা-মায়ের মৃত্যুসংবাদ দেয়। এই খবর পাওয়ার পরেই আমি এখানে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করি। চাকরি পেয়েই কলকাতায় ফিরে আসি। রুমন আর আমি এখন একই অফিসে চাকরি করি।’ অকপটে সবকিছু সুচন্দ্রার কাছে খুলে বলে অনির্বাণ।

‘নাঃ, শালাবাবু! তোমার কেসটা দেখতেই হচ্ছে। সুচন্দ্রা, তোমাকে অনির সাহায্য করতেই হবে। হাসপাতালে কাজের মাঝে মাঝে কীভাবে অনিকে সাহায্য করবে ভাবো,’ অর্ক এবার মুখ খোলে।

‘অনি, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজ আর কিছু করা যাবে না। কাল দেখি কোথা থেকে শুরু করা যায়,’ সুচন্দ্রা বলে।

‘তাহলে দিদি, আজ আসি। কাল তোমাকে একবার রুমনের বাড়ি নিয়ে যাব কিন্তু তার আগে পারলে মায়ের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলে নিও। দ্যাখো, মা তোমাকে কী বলেন!’ অনির্বাণ বাড়ি চলে যায়।

পরের দিন সকালে সুচন্দ্রা নাগপুরে অনির্বাণের বাড়িতে ফোন করে অনির্বাণের মা-র সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও কাকিমাকে জানায়।

‘আমার আশ্চর্য লাগছে সুচন্দ্রা, তুই ডাক্তার হয়েও এই সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছিস? তোর মনে হচ্ছে না যে, ওই মেয়েটি কোনওরকম মানসিক অথবা শারীরিক অসুস্থতার শিকার নয়তো অনির সামনে এই ধরনের শর্ত রাখে?’ অনির্বাণের মা সুচন্দ্রার কাছে প্রশ্নটা রাখেন।

‘হ্যাঁ, হতেই পারে কাকিমা… আজ আমি মেয়েটির বাড়ি যাব ওর সাথে কথা বলতে। দেখি কিছু বুঝতে পারি কিনা। কথাবার্তা যাই হোক তোমাকে এসে ফোন করব’, এই বলে সুচন্দ্রা ফোনটা কেটে দেয়।

অর্ক, সুচন্দ্রার কথাগুলো বসে শুনছিল। ও বলে ওঠে, ‘সুচন্দ্রা, এই দিকটা তো আমার মাথাতেই আসেনি। কাকিমা এর মধ্যে অনেক কিছুই ভেবে ফেলেছেন।’

‘যদি এরকম কিছু হয় তাহলে আমরা ওর চিকিৎসা করাতেই পারি। সব রোগেরই চিকিৎসা আছে। কিন্তু এখনই অনিকে ওদের কথা কিছু বোলো না তাহলে ওর মন আরও ভেঙে যাবে,’ সুচন্দ্রা ভেবে বলে।

‘ওনাদের আপত্তি হওয়াটাও স্বাভাবিক সুচন্দ্রা। কোনও রোগগ্রস্ত মেয়ের সঙ্গে কি কোনও মা-বাবা নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইবেন? অনি আর রুমনকে না জানিয়েই বুদ্ধি খাটিয়ে আসল কাহিনিটা জানতে হবে তোমাকে।’ অর্কর কথাগুলো সুচন্দ্রা মেনে নেয়।

অর্ক আরও বলে, ‘তুমি এক কাজ করো। রুমনের বাড়ি যাওয়ার থেকে অন্য কোথাও ওর সঙ্গে দেখা করো। তুমি বরং আজ না গিয়ে কাল লাঞ্চ ব্রেকে অনির অফিসে চলে যাও। রুমনও তো একই অফিসে চাকরি করে। গিয়ে বোলো, হঠাৎ কাজের জন্য তোমাকে ওদিকে আসতে হয়েছে, একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চাও। ও নিজেই হয়তো তোমাকে রুমনকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু যদি না-ও ডাকে তুমিই ওকে ডেকে নিতে পারো।’

সুচন্দ্রা কাজের দোহাই দিয়ে সেদিন রুমনের বাড়ি যাওয়া ক্যানসেল করে দিল। পরের দিন না জানিয়েই অনির অফিসে পৌঁছে গেল। দরজায় ঢুকে লিফটের সামনে দাঁড়াতেই, লিফটের দরজা খুলে দেখল অনি বেরিয়ে আসছে সঙ্গে লম্বা, শ্যামলা একটি মেয়ে, বেশ সুন্দরী।

সুচন্দ্রাকে দেখেই অনির্বাণ বলে ওঠে, ‘আরে দিদি। তুমি এখানে? সব ঠিক তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ… সব ঠিক আছে। ঘাবড়াস না। এদিকে একটু কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই। কেন, কোথাও বেরোচ্ছিস নাকি?’ সুচন্দ্রা বলে।

‘রুমনকে লাঞ্চে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বিকেলের প্রোগ্রাম ফিক্স করার ছিল… তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে,’ অনির্বাণের অনুরোধে সুচন্দ্রা ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়।

‘ঠিক আছে, চল। ভালো কোথাও একটু বসি যেখানে শান্তিতে কথা বলা যাবে।’

‘তাহলে একটু এগিয়ে ‘আঙ্গিঠি’ রেস্তোরাঁর ফ্যামিলিরুমে গিয়ে বসা যেতে পারে। ওটা বেশ ভালো আর দুপুরে ওখানে ভিড়টা কম,’ রুমন বলে ওঠে।

পাঁচ মিনিটেই ওরা রেস্তোরাঁয় এসে পৌঁছে যায়।

‘খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ রুমন। নয়তো পার্কিং পেতে আর ব্যস্ত রাস্তায় যাতায়াত করতেই অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যেত,’ সুচন্দ্রা বলে।

অনির্বাণ বলে, ‘রুমনের আইডিয়া কিন্তু সবসময়ই খুব কাজে লাগে দিদি। এটা ওর একটা বড়ো গুণ।’

‘তাহলে তো ওকে খুব শিগগিরই, পরিবারের একজন সদস্য করে নিতে হবে।’

অনির্বাণ হেসে রুমনের দিকে তাকায়। সুচন্দ্রার মনে হয়, রুমনের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলেও চোখ দুটো বিষাদ মাখানো। এই বিষাদটাকে লুকোবার জন্যেই যেন রুমন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রেস্তোরাঁয় বসে রুমন সুচন্দ্রার কাছে ওর বিদেশে থাকাকালীন দিনগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই নিয়েই খানিকটা সময় কেটে যায় ওদের। খাবার খেতে খেতে সুচন্দ্রা বলে, ‘আমার বিদেশের এক্সপিরিয়েন্স সবই তো শুনলে, এখন তোমার কথা বলো রুমন।’

‘আমার সম্পর্কে বলার মতো সবকিছুই হয়তো শুনে থাকবেন অনির্বাণের কাছে। বলার মতো কিছুই নেই। অনির্বাণের সঙ্গে কলেজে পড়তাম, এখন এক অফিসে চাকরি করি আর আমি থাকি যাদবপুরে।’

‘যাদবপুরে রুমনের বাবা খুব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। হাজার অসুবিধে হওয়া সত্ত্বেও ও ওই বাড়ি বিক্রি করেনি,’ অনি এরই সঙ্গে জুড়ে দেয়, ‘ওখানে ও একাই থাকে।’

‘ভয় লাগে না?’

‘না, দিদি। ভয় পাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি,’ রুমন হাসে।

‘বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু অনিকে ছোটোবেলায় ভীতু বলে ডাকতাম, সেটা জানো কি?’

রুমনা হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘কই না-তো দিদি। ও তো কখনও বলেনি যে ছোটোবেলায় ওকে ভীতু বলে ডাকা হতো। কীসে ভয় পেত দিদি?’

‘বলার দরকার নেই। যখন ওর সাথে থাকবে তখন নিজে থেকেই সব জানতে পারবে,’ হেসে উত্তর দেয় সুচন্দ্রা।

‘ওর সাথে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অনির মা-কে কষ্ট দিয়ে আমি অনিকে বিয়ে করতে পারব না।’ রুমনের চোখে বিষাদের ছায়া উঁকি মারলেও কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা সুচন্দ্রাকে অবাক করল।

সুচন্দ্রা হাতঘড়ির দিকে তাকায়, ‘এই কথা আলোচনা করার সময় বা জায়গা এটা নয়। আমাকে একবার হাসপাতালে ঢুঁ মারতে হবে। হাতে সময় রয়েছে। তোমার সময় হলে বোলো, আরাম করে বসে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। হয়তো সমাধানের একটা রাস্তাও পাওয়া যেতে পারে।’

‘আজ সন্ধেবেলা তুমি আর অর্কদা যাবে রুমনের বাড়ি?’ অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে।

‘এখন কাজ শেষ করে বাড়ি যাব। একবার বাড়ি গেলে দ্বিতীয়বার আর বেরোবার ইচ্ছে হবে বলে মনে হয় না। আর আজ তো তোদের সঙ্গে দেখা হয়েই গেল।’

‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু অর্কদার সঙ্গেও তো ওর আলাপ করাতে হবে।’ অনির্বাণ বলে, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে আরাম করো, আমি রুমনকে নিয়ে বরং তোমাদের বাড়ি চলে আসব।’

‘সেটা তো খুব ভালো হয়। চলে আয় রুমনকে নিয়ে। রাত্রে আমার বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরিস।’

সন্ধে হতেই অনির্বাণ, রুমনকে সঙ্গে করে সুচন্দ্রাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসাথে বসে হাসি, আড্ডায় চারজনেই জমে উঠল। গল্পের মাঝে একপ্রস্থ চা আর স্ন্যাক্স সার্ভ করল সুচন্দ্রা। গল্প চলতে চলতেই অর্ক বলল, ‘সুচন্দ্রা আর একবার চা হলে আড্ডাটা কিন্তু আরও জমে যেত।’

‘চা খাওয়ার তোমার একটা এক্সকিউজ চাই।’

‘প্লিজ, লক্ষ্মীটি…।’

অর্কর মুখের ভঙ্গি দেখে সকলে হেসে ফেলল। অগত্যা সুচন্দ্রাকে উঠতেই হল। রান্নাঘরের দিকে ও পা বাড়াল। চায়ের জলটা গরম করতে করতেই অনির্বাণ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল, ‘দিদি তুমি কি মাকে ফোন করেছিলে?’

‘হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম। কাকিমারা কেমন আছেন সেটা নিয়েই কিছুক্ষণ কথা হল।’

‘ব্যস, আর কিছু বললে না? আমাদের কথা কিছু বলোনি? তোমাকে বলেছিলাম না, মায়ের সঙ্গে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলতে,’ অনির্বাণের স্বরে সামান্য হতাশা প্রকাশ পেল।

‘সুযোগ হয়নি। আর সব কথা আলোচনা করার একটা সঠিক সময় থাকে। রুমন কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না, বিয়ে করলে তো তোকেই করবে। যখন এতদিন অপেক্ষা করলি তখন না হয় আরও কটা দিন কর।’

‘এছাড়া আর করারই বা কী আছে?’ অনির দীর্ঘশ্বাস সুচন্দ্রার কানে এসে বাজল।

রুমনের সঙ্গে সুচন্দ্রার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠল। সবদিক দিয়ে সুচন্দ্রা রুমনের বিশ্বাস অর্জন করে নিল। একদিন সুচন্দ্রার সঙ্গে কথা না হলে রুমনের মনে হতো তার জীবন থেকে একটা কিছু বাদ পড়ে গেছে। কিছু একটা অমূল্য জিনিস যেন ও হারিয়ে ফেলেছে।

সুচন্দ্রাও রুমনের প্রতি একটা স্নেহের আকর্ষণ অনুভব করত। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ ছিল। রুমনের কাছেই সুচন্দ্রা জানতে পারল, অনি অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য মুম্বই যাচ্ছে। মুম্বই চলে গেলে অনির অনুপস্থিতিতে সুচন্দ্রা একদিন ফোন করে রুমনের বাড়ি এসে উপস্থিত হল। রুমনের বাড়িটা সত্যিই দেখার মতো। বোঝাই যাচ্ছিল যিনি বানিয়েছেন তার পছন্দটা বেশ উঁচুমানের।

‘খুব ভালো করেছ বাড়িটা বিক্রি না করে রুমন। বিয়ের পরেও নিশ্চয়ই তুমি এখানেই থাকতে চাও? অনির্বাণ রাজি তোমার প্রস্তাবে?’ সুচন্দ্রা আস্তে করে রুমনকে জিজ্ঞেস করল।

‘অনি তো কোনও শর্ত ছাড়াই আমার সব প্রস্তাব মানতে রাজি। কিন্তু আমি ওর মা-বাবার আশীর্বাদ না নিয়ে অনিকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। মা-বাবার স্নেহ থেকে তাদের সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কখনও উচিত নয়। স্বার্থপর ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার জন্য অনি সবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করুক, এ আমি কিছুতেই চাই না।’

‘এটা তো খুবই ভালো কথা রুমন। কাকু, কাকিমা মানে অনির বাবা-মা খুবই ভালোমানুষ। ওদের যদি ঠিকমতো বোঝানো যায় মানে তুমি বিয়ের যে শর্ত রেখেছ, তার কারণ বলা যায়, তাহলে ওনারাও বিনা দ্বিধায় হাসতে হাসতে এই বিয়েতে মত দেবেন। কিন্তু অনি ওদের কোনও কারণও বলেনি।’

‘ও নিজে জানলে তবে তো ও, অন্য কাউকে বলবে। আমি ওকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু ও কিছুতেই শুনতে চায় না। অনির কথা হল ভবিষ্যতকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করো, অতীতকে মনে রেখে কী লাভ।

আমিও অতীতকে মনে করতে চাই না দিদি। কিন্তু অতীত অথবা জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু ঘটনা এমনও হয় যেটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সারা জীবন সেটাকে নিয়েই বাঁচতে হয় দিদি,’ রুমনের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে।

‘তুমি চাইলে তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারো,’ সুচন্দ্রা দুই হাত দিয়ে নত হয়ে আসা রুমনার মুখটা পরম স্নেহে তুলে ধরে।

‘কয়েকদিন ধরে আমি এটাই ভাবছিলাম দিদি।’ গভীর নিঃশ্বাস নেয় রুমন। একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নেয়। বলতে শুরু করে, ‘কলেজের পরেই চাকরি পেয়ে যাই। ততদিনে বাবা আর মা দু’জনেরই ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চাকরি থেকে দেরি করে ফেরা আর বারবার ছুটি নেওয়ার জন্য চাকরিটাও ঠিকমতো করতে পারছিলাম না। আর মা-বাবার দেখাশোনাও ঠিকমতো হচ্ছিল না। অতএব চাকরিটা আমি ছেড়ে দিই। মুম্বই চলে যাই মা-বাবাকে নিয়ে। আত্মীয়ের একটা ফ্ল্যাট খালি ছিল, ওখানে গিয়েই উঠি। বাবার টাকা ছিল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য আমিও কাজ করতে শুরু করি। ভ্যাকিউম ক্লিনার বেচা থেকে শুরু করে, কী না করেছি। হাসপাতালে ক্যান্টিনে কাজ করেছি, বেবি সিটিং করেছি। মা-বাবার আপত্তি সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে দু’বার স্যারোগেট মাদার হতেও লজ্জা পাইনি।

সেইসময় মেশিনের মতো বাচ্চার জন্ম দিয়েছি আর টাকার বিনিময়ে যারা টাকা দিয়েছে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি বাচ্চাকে। কিন্তু এখন মনে হয় বিয়ের পর যখন নিজের সন্তান হবে তখন তাকে মানুষ করতে গিয়ে আগের দু’টো বাচ্চার কথাও মনে পড়তে পারে। তাদের তো আমি অচেনা লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। ওদের কথা মনে পড়লে আমি যদি বিচলিত হয়ে উঠি, তাহলে সেটা অনি বা অনির সন্তানের প্রতি অন্যায় করা হবে। সুতরাং বিয়ের পর নিজের সন্তান যাতে না হয় তারই জন্য অনির কাছে ওই প্রস্তাব রেখেছিলাম। দিদি তুমি, অনি এবং ওর মা-বাবাকে পুরো সত্যিটা খুলে বলো। ওনারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা আমি মাথা পেতে নেব।’

‘ঠিক আছে রুমন, সুযোগ বুঝে আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলব,’ সুচন্দ্রা রুমনকে আশ্বাস দেয়।

সুচন্দ্রা বেরিয়ে আসে রুমনের বাড়ি থেকে। রুমনের স্বীকারোক্তি সুচন্দ্রার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রুমনের ভাবনাটা সত্যি। অনির সঙ্গে হয়তো ওর কোনও সমস্যা হবে না কারণ অনির রুমনের প্রতি ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ। রুমনের সবকিছুই ও মেনে নেবে কিন্তু অনির মা-বাবা? তারা কী করে এমন মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করবেন যে কিনা দু’বার স্যারোগেট মাদার হয়েছে? কাজটা সহজ নয়।

সুচন্দ্রা ভাবতে থাকে। কাকু, কাকিমাকে রুমনের বয়সের দোহাই দেওয়াটা কি খুব অন্যায় হবে? রুমনের যা বয়স তাতে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা বিপজ্জনক, এমনটা বোঝানো অসুবিধার নয়। কথাটা খুব একটা মিথ্যাও না। সুচন্দ্রার মনে হয় অনি আর রুমনের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে এতটুকু ছলনার আশ্রয় তো নেওয়াই যেতে পারে।

 

ছায়াবৃতা

ট্রেনের সফর বরাবরই আমার খুব প্রিয়। জানালা থেকে মুখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না আমার। ভালোবাসি প্রকৃতি দেখতে। ট্রেনের জানলায় বসে দেখতে থাকি কীভাবে প্রকৃতি বদলে যায়, বদলায় মাটির রং, মাটির গঠন। কুলটি ছাড়াতেই এরকমই বদলটা চোখে পড়ছে। কুমারডুবি ছেড়ে ট্রেন এগোতেই বুঝি, রাজ্য বদল হতে যাচ্ছে। ঝাড়খন্ডে প্রবেশ করব এবার।

বহুবছর পরে আবার প্রান্তিক মালভূমি অঞ্চলের ধূ-ধূ আবহে ফিরে এলাম। কুড়ি বছর আগে, আমি ছিলাম এই এলাকার এসডিও। যাকে সোজা ভাষায়, জেলার সর্বেসর্বা বলা চলে। তখন আমার বয়সও কম। গোটা এলাকাটাও ছিল একেবারে অন্যরকম। অনুন্নত কিছু মানুষ, আর ততধিক অনুন্নত পরিকাঠামো। রাস্তা বলতে, দীর্ঘকাল চলতে চলতে পায়ে পায়ে যে-রাস্তা তৈরি হয়ে যায়, সেটাই। বাকিটা কেবলই জঙ্গল। জঙ্গলে বেশিরভাগই পলাশ গাছ।এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পলাশফুল ফোটে। রাঙা পলাশ রক্তিম করে রাখে গাছের শীর্ষ আর শাখা।

এসডিও-র অফিস অর্থাৎ জেলার প্রধান কার্যালয় থেকে এই গভীর জঙ্গলের কাছাকাছি আসতে হলে, একাধিক নদীনালা পার হতে হতো। বর্ষায় এখানে পৌঁছনো তো বলতে গেলে অসম্ভব হয়ে পড়ত, কেন-না তখন নদীনালাগুলিও জল পেয়ে ফুলে উঠেছে। ভীষণ স্রোত। সহায় বলতে ভুটভুটি। নদী এপার-ওপার করার কোনও সেতু ছিল না।

এবার এসে দেখলাম, রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে বটে, কিন্তু বড়ো নদীর উপর কোনও সেতু এখনও তৈরি হয়নি। ক্রমাগত কেটে ফেলায় জঙ্গলের ঘনত্বও যথেষ্ট কমে এসেছে। কোথাও কোথাও তো এতটাই কমে গেছে গাছের সংখ্যা যে, সেখানে জঙ্গল নামমাত্র। দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মানুষের কি নিজের ভবিষ্যতের জন্যও কোনও আশঙ্কা হয় না! নজরদারি থাকা সত্ত্বেও এমন নির্বিবাদে গাছ কেটে নেওয়ার পিছনে বড়ো ষড়যন্ত্র আছে। যে-কটি পুরোনো পলাশগাছ এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মাথায় লাল আগুন দেখে মন ভরে গেল নিমেষে।

জঙ্গলের মধ্যে কিংবা আশেপাশে যারা থাকে, তারা সকলেই আদিবাসী। কুড়ি বছর আগে তাদেরকে নিজেদের রীতি-রেওয়াজের রক্ষণশীল চেতনাতেই আবদ্ধ দেখেছি। প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিশে ছিল এরা। যেমনভাবে জঙ্গলের আর-পাঁচটা প্রাণী থাকে। মনে হতো, এই জঙ্গলটিই ওদের পৃথিবী। এই পৃথিবীর বাইরেও যে-একটা পৃথিবী আছে, সে সম্পর্কে তারা ছিল উদাসীন। নিজেদের পৃথিবীতে বাইরের কারও আগমন তারা ভালো চোখে দেখত না। বিরক্ত হতো। লুকিয়ে পড়ত ঘন জঙ্গলের মধ্যে।

জঙ্গল ওদের রক্ষা করত। বাঁচিয়ে রাখত ওদের গোপনীয়তাকেও। এ অঞ্চলের আদিবাসী নারীদের ঊধর্বাঙ্গে বস্ত্র বিশেষ দেখিনি। তাতে তাদেরকে লজ্জা পেতেও দেখিনি কখনও। এইবার এসে দেখলাম, আদিবাসী মহিলারাও অনেক বদলে গেছে। ঊধর্বাঙ্গ আর অনাবৃত নয়। পরিবর্তন আরও অনেক জায়গায় ঘটেছে। যেমন, বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদ করার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আগে এরা বনজ সম্পদের উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখন যেন মনে হচ্ছে, এলাকাটির অর্থনীতি কৃষিপ্রধান হয়ে পড়ছে।

বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে, সরকারের পক্ষ থেকে, এই এলাকার উন্নয়নের পরিকাঠামো আর সম্ভাবনা সরেজমিনে দেখতে এসেছি। সঙ্গে, জেলার কালেক্টর, পুলিশ প্রধান এবং অন্যান্য অফিসাররাও রয়েছেন। ঠিক হল, সকলে মিলে জলখাবার খেয়েই একটি বড়ো গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়ব। কুড়ি বছর আগে এই গ্রামটিকে আমার প্রভূত সম্ভাবনার আকর মনে হয়েছিল। নানা কারণে সে সময় কাজ আর এগোয়নি। এবার সুযোগ পেয়ে প্রথমেই এই গ্রামটিতে যাব বলে মনস্থ করলাম।

গাড়ি চলাচলের রাস্তা নেই বলে, অনেকটা ঘুরে যেতে হল। ফলে, পৌঁছতে যথেষ্ট বেলা হয়ে গেল। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নিতে গিয়ে টেরই পাইনি, কখন ঝুপ করে সন্ধে নেমে পড়েছে, বাদুড়ের বেশে বিস্তৃত পাখা ছড়িয়ে দিয়ে!

এই গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। খুব সম্পন্ন পরিবারে সৌরবিদ্যুতের দুটো-একটা আলো জ্বলে। না হলে, অন্ধকার ঘোচাতে লন্ঠনই ভরসা। সরকারি বাবুরা এসেছেন বলে, আজ অবশ্য একটা হ্যাজাক জোগাড় করে আনা হয়েছে। সেটা জ্বালাতে অন্ধকারটা যেন আর একটু গাঢ় হল।কাজকর্ম মিটতে, কালেক্টর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা সামান্য বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে।এখানকার ছেলেমেয়েরা নাচে খুব ভালো!’  কবজি উলটে হাতঘড়ি দেখে বললাম, ‘নাচ দেখতে গেলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে মশাই। আর-একদিন এলে হতো না?’

কালেক্টর নিজেই যথেষ্ট উৎসাহী। স্বাভাবিক। বউ-ছেলেমেয়ে-টিভি সিরিয়াল ছেড়ে, এই নির্বান্ধব পৃথিবীতে দিনের পর দিন কাটানো, খুব সহজ কথা নয়। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করে বললেন, ‘খুব জরুরি কাজ না থাকলে, আমি বলি কী, একটু দেখেই যান। সঙ্গে তো গাড়ি আছে। পৌছনোর চিন্তা তো নেই। তা ছাড়া এখন পুলিশের যা কড়া নজরদারি শুরু হয়েছে, তাতে ডাকাতেরাও আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারছে না!’

আদিবাসীদের নাচের এক নিজস্ব মাদকতা আছে। দু’দশক আগে এখানে যখন ছিলাম, সুযোগ হয়েছিল দেখার। কিন্তু, সেসব তো প্রায় গতজন্মের কথা বলে মনে হয়! বাকি সবকিছুর মতো সেই নৃত্যশিল্পীদের মোহিনী বিভঙ্গেও পরিবর্তন এল কিনা, সেটা লক্ষ্য করার লোভ আমারও কিছু কম ছিল না। আটচালায় পাতা মাদুরের উপর পা মুড়ে বসে পড়ে কালেক্টরকে বললুম, ‘বেশ, আপনি যখন অভয় দিচ্ছেন, থাকাই যাক তাহলে কিছুক্ষণ!’

ক্লাবের সদস্যদের আনন্দ তখন আর দেখে কে! সরকারি বাবুর খামখেয়ালে এত বড়ো আয়োজনটা বানচাল হয়ে যাচ্ছিল দেখে, তারা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। এখন তেড়েফুঁড়ে উঠে, আর্জি নিয়ে আসা স্থানীয় লোকের ভিড়টা নিমেষে ফাঁকা করে, তারা নাচের জায়গা তৈরি করে নিল।

মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে গান। ক্লাবেরই দুই যুবক, তাদের নিজস্ব ভাষায় গান ধরল। ভাষাটা খানিকটা চেনা ঠেকছে, খানিকটা অচেনা। বোঝা, না-বোঝার আলো-আঁধারিতে গান শেষ হলে, কালেক্টর ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি বোধহয় ভাষাটা বুঝতে পারেননি, তাই না?’

মাথা নেড়ে লজ্জিত গলায় বললাম, ‘বাস্তবিক ভুলেছি। অনেক দিনের ব্যাপার তো!’

কালেক্টর বললেন, ‘আপনাকে স্বাগত জানাল। গাইল, ‘শহর থেকে গাঁয়ে আসা সরকারি বাবু, তোমায় নমস্কার’।’

খানিকক্ষণের বিরতির পর তিনজন আদিবাসী মহিলা মঞ্চে এল। দুজন তরুণী, অন্যজন মধ্যবয়সিনি। বয়স্কার শরীরও একটু ভারী। কিন্তু আশ্চর্যরকম টানা টানা চোখ আর ভারী কালো শরীরকে পেঁচিয়ে রাখা শাড়ি ভেদ করে, উন্নত স্তনদ্বয়ের আভাসে তার রূপ, ভারতীয় সনাতন সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিন মহিলা হাত ধরাধরি করে দাঁড়াল। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি যে, তার বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি বছর। ছিপছিপে চেহারার ছটফটে মেয়েটির চোখ-মুখ আদিবাসীদের মতো নয়, বরং বেশ চোখা। নাচের লয় যত দ্রুত হল, ততই মেয়েটির শরীরে দেখা দিল তীব্র ঘূর্ণি। কী অনায়াস দক্ষতায় যে নাচতে থাকল সে!

তিনজন নারী ঘুরে ঘুরে নাচছে আর তাদের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আর-এক দল গান গাইছে বনজ সুরে। যন্ত্রানুষঙ্গ বলতে নেই কিছুই। কেবল একটি স্টিলের থালা আর চামচ। একজন গায়িকা চামচ দিয়ে থালায় আঘাত করে তাল রাখছে। নাচের মুদ্রা এই আদিবাসীদের নিজস্ব। কয়েকটি একেবারে নতুন লাগল। হয়তো শহুরে প্রভাবেই কয়েকটি মুদ্রা নতুনভাবে যোগ হয়েছে নাচে। শহুরে দর্শক সামনের সারিতে বসে থাকায় নর্তকী ও গায়িকারা যেন নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে।

আমি মগ্ন হয়ে আছি। কিন্তু মগ্ন হয়ে যে নাচটাই দেখছি, এমন নয়। আসলে, আমার মন চলে গেছে কুড়ি বছর আগের অন্য একটি ঝাপসা হয়ে আসা দৃশ্যে। সেদিনও এমনই নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। রাতের বেলা, তবে হ্যাজাক বা লন্ঠন জ্বালতে হয়নি। আকাশ ভরা ছিল জ্যোৎস্না। জায়গাও অবশ্য এটা ছিল না। জঙ্গলের মধ্যে, চারদিকে আদিবাসীদের ঝুপড়ি দিয়ে ঘেরা একটা ফাঁকা গোল জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাচছিল নর্তকীরা। আজ যেন অলৌকিক মনে হয়। যেন, এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি, যেন এমন কোনও দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শীই আমি ছিলাম না!

আনমনা মনটাকে টেনে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। নর্তকীরা এখনও নাচছে। হঠাৎই মনে হল, ওদের মধ্যে বয়স্কা নারীটি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতে নর্তকীরা যেভাবে তাকায়, এই তাকানোর ধরনটা সেরকম নয়। একটু অন্যরকম। যেন খুব ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। বুক কেঁপে উঠল আমার।

আমিও সেই নারীকে ভালো করে দেখলাম। ততক্ষণে নর্তকীদের ঘূর্ণনের গতি বেড়ে গেছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আমার যেন মনে হল, এই মহিলাকে আগেও কোথাও আমি দেখেছি। এই দৃষ্টি আমার খুব পরিচিত।

পৃথিবীতে কত মানুষের সঙ্গেই না পরিচয় ঘটে! হূদয় খুঁড়ে অনুরূপ একটি অবয়বকে তুলে আনতে চাইলাম। ততক্ষণে নাচের অনুষ্ঠান শেষ। শিল্পীরাও আটচালার বাইরে গিয়ে ভিড় আর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

আটচালা থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের গহ্বরের দিকে একটু এগোলাম। সঙ্গী অফিসারদের মধ্যে দু-একজন পিছু পিছু আসছিলেন। হাত নেড়ে তাদের অনুসরণ করতে বারণ করে বললাম, ‘দূরে কোথাও যাচ্ছি না। এক্ষুনি আসছি।’

শুনলাম, এই আটচালায় পঞ্চায়েত মিটিংয়ে বসে। সন্ধে হয়ে যাওয়ায় চারপাশটা ইতিমধ্যেই বেশ শুনশান। একটু দূরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গায় কয়েকটি বড়ো গাছ। ধীর পায়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম সেদিকে। হঠাৎই পিছনে কারও পায়ের শব্দ শুনে ঘোর ভেঙে গেল। চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি, আদিবাসী এক মহিলা এদিকেই হেঁটে আসছে। মনে ভাবলাম, সম্ভবত কোনও ব্যক্তিগত কারণেই, এদিকটা নিরালা বলে, এদিকেই আসছে। তাকে শুনিয়ে গলাখাঁকারি দিলাম। কিন্তু, তাতে না থমকে, মহিলা দ্রুত পায়ে হেঁটে কাছে এগিয়ে এল।

এবার রাগত গলায় বলে উঠলাম, ‘কে? কী চাই?’ আসলে ভিতরে ভিতরে একটু ভয়ও হচ্ছিল। সেটাই রাগের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল।

কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল সেই মহিলা। তারপর নীচু গলাতে বলল, ‘আমায় চিনতে লারছেন, সাহেব?’

এবার একটু সাহস পেয়ে দু-পা এগোতেই মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এ তো সেই নাচের মেয়েদের দলের মধ্যবয়সিনি মহিলা! নাচতে নাচতে বারবার অদ্ভুত চোখে যে আমায় দেখছিল!

আমি এবার সত্যিই অবাক হয়ে বললাম, ‘কে তুমি? ঠিক চিনতে পারলাম না তো–!’

মহিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মিথিলাকে তুমার সত্যি মনে লাই?’

এক পলকে মন চলে গেল কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। সেই জ্যোৎস্নালোকিত, ঝুপড়ি পরিবেষ্টিত গোল নৃত্যাঙ্গন। তাতে জনাকয়েক আদিবাসী তরুণী নাচছে। তাদের কোমরে দুলকি তরঙ্গ উঠেছে। পায়ের গোছে রুপোলি চাঁদের গলিত মায়া। নর্তকীদের মধ্যে মিথিলাও ছিল, এবার মনে পড়েছে। ওর বয়স তখন কুড়ির আশেপাশে। কিন্তু তখনই যথেষ্ট বন্য শরীর। সুডৌল কায়ায় ভয়ংকর পুরুষঘাতী বাঁক। সমুদ্রের তলদেশ থেকে ফুঁসে ওঠা পাহাড়ের মতো উত্তুঙ্গ দুই বুক, নাচের ঘূর্ণিতে দুলছে। অলৌকিক ছিল সেই রাত। অবিশ্বাস্য! তখন আমিও অবিবাহিত। বান্ধবী হয়নি। এমন এক জায়গায় চাকরি সূত্রে এসে পড়েছি, যা তথাকথিত সভ্য জগৎ থেকে সবদিক দিয়ে পৃথক। টেলিফোন নেই, ডাকবিভাগের অস্তিত্বও না থাকার মতো, ইলেকট্রিক আলোর তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না!

ফলে, নাচ হচ্ছিল খুঁটিতে বাঁধা মশালের আলোয়। কখনও কখনও মাদলের শব্দকে ছাপিয়ে, দূরের কোনও জঙ্গল থেকে ভয়াবহ বন্যপ্রাণীর চিৎকার ভেসে আসছিল।

একসময় থেমে গেল নাচ-গান। আদিবাসীরা আপ্যায়ন করতে জানে। প্রত্যেকেই দিনএনে দিন খাওয়া মানুষ, হাড় জিরজিরে, অভাবে অর্ধনগ্ন–কিন্তু আন্তরিকতায় কোনও খামতি নেই। এসডিও-বাবু তাদের মহল্লায় এসেছেন, এতেই যেন তাদের মোক্ষলাভ হয়ে গেছে।

এমনিতে সারাটা দিন কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। গ্রামের মুখিয়ার সঙ্গে একটার পর একটা স্থানীয় সমস্যার সমাধান করে, একটু ফুরসত পেয়ে দেখি, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সমস্যার সমাধানে এলাকার বাসিন্দারা খুশি হল। বোধহয়, সেইজন্যই নাচ-গানের এই আয়োজন! এরপর আবার ঢালাও খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা রেখেছে। শোওয়ার বন্দোবস্ত ফাঁকা একটি ঝুপড়িতে। খেয়েদেয়ে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে কোনওমতে টেনে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় ফেলে দিলাম। গরমকাল। তাই শখ করে আনা নাইটসুটের উপরাংশটা খুলে ভাঁজ করে রেখে দিলাম পাশে।

কখন দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, নিজেই জানি না। মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে আনছে মহুয়া-পলাশের মিষ্টি গন্ধ। ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এমন নিশ্চিন্ত অবকাশ বেশিক্ষণ রইল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই হঠাৎ মনে হল, এ ঘরে আমি একা নই, আরও কেউ আছে। আশেপাশের নিস্তব্ধতায় তার নিশ্বাসের শব্দটিও তীব্রতর হয়ে প্রবেশ করছে কানে।

বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। উঠে বসে চিৎকার করে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’ ঘরের মধ্যে থিকথিকে অন্ধকার। তার মধ্যেই একটি ছায়া নড়েচড়ে উঠে, বিছানার দিকে এগিয়ে এল ধীর পায়ে। করউজ তেলের তীব্র গন্ধ নাকে এসে ঠেকল আমার। ছায়া বলে উঠল, ‘বাবু, আমি মিথিলা!’

‘মিথিলা’, আমি সতর্ক গলায় বলে উঠি, ‘তুমি এত রাতে কী করছ এখানে? কী… ক্বী…?’

মিথিলা এগিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে বসল। তারপর একটু থেমে থেকে বলল, ‘একজন মেয়ে রাতের বেলা একলা একজন পুরুষলোকের কাছে কেন আসে, তুমি বুঝো লাই বাবু? তুমি আমাদের গাঁয়ের অতিথ্। আমাদের মালিক। তাই, মুখিয়া আমায় বললে, মিথিলা, তুই যখন লাচ করছিলি, তখন সাহেব সবচেয়ে বেশি তুর দিকেই চোখ ঠারছিল। তুকেই সাহেবের বেশি মনে ধরেছে। সত্যি?’

অন্ধকারেও বুঝতে পারি, ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ধরে, মিথিলা এদিকেই তাকিয়ে আছে। মেঝের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে উঠি, ‘মুখিয়ার এত সাহস? ডাকো তো তাকে–!’

মিথিলা উঠে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ-ই আমার কাঁধে হাত রাখল। সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল আমার। ফিক করে হেসে, সে বলল, ‘আবার মুখিয়াকে কেন ডাকছ গো বাবু? আমি কি এতই খারাপ? এদিকে তাকাও, দ্যাখো না বাবু, কত সোন্দর আমি!’

মিথিলার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এমন মহাপুরুষ আমি নই। ওই তীব্রতার কাছে হার মানলাম। সে আমায় ঠেলে বিছানার উপর ফেলে দিল। অনুভব করলাম, তার চওড়া ভিজে ঠোঁটজোড়া আমার গলার কাছে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি তাকে ঠেলে উঠতে চাইলাম, কিন্তু সে যেন, এখানকার জঙ্গলের কুখ্যাত মানুষখেকো লতার মতোই আমায় জড়িয়ে ধরেছে।

এভাবে কতক্ষণ ভেসেছি জানি না। তলিয়ে যেতে যেতে, কাঁধের উপর হঠাৎ-ই দুফোঁটা গরম জল এসে পড়ায়, যেন চেতনা ফিরে পেলাম। কানের কাছে অত্যন্ত নীচু গলায় কথা বলে উঠল মিথিলা।

‘বাবু, আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। তাইলে, মুখিয়া আর তার লোকজন মনে করবে, আমারই কোনও খামতি আছে। আমি পুরা মেয়েমানুষ লই। কারও বউ কি রাখিতো হওয়ারও যোগ্য লই!’

ভোরে ঘুম ভাঙতে পুরো ঘটনাটা স্বপ্ন মনে হল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের সোনালি রোদ্দুর গলে ভিতরে ঢুকে আসছে। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিক এখনও বেশ নিরিবিলি। তবে জঙ্গলের উপর থেকে রাতের রহস্যময়তার পর্দা সরে গেছে।

সেদিন সকালেই সদরে ফিরে এলাম। তারপর মাসখানেকের মধ্যে আমার বদলি হয়ে গেল অন্য জেলায়। সেই রাতটা বিস্মৃতির ধুলোর নীচে চাপা পড়ে রইল।

তারপর আজ।

সেই রাত আর কুড়ি বছর পরের এই রাত। জায়গাটা একই। মিথিলাও সেই মিথিলা, মাত্র কয়েক হাত দূরে সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত বাড়ালেই আমি ওকে ছুঁতে পারি, ও এতটাই কাছে। স্তিমিত গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ মিথিলা, আমার সব কথা মনে পড়ে গেছে। কেমন আছ? কী করছ আজকাল?’

মিথিলা ম্লান হেসে বলল, ‘আমি ভালো আছি, বাবু। আদিবাসীরা যেভাবে ভালো থাকে! বুড়ি হয়ে গেছি, লয়? এখন আর কেউ কোনও কাজকম্ম দেয় না।’

তারপরই কী মনে পড়ে যেতে, সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে, আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেমন আছ বাবু? কত্ত বছর বাদে দেখা হল! আমি তো তুমায় একবার দেখেই চিনে ফেলেছি। মু-কে তুমি ভুলে গেছিলে, লয়?’

তার চোখদুটো অন্ধকারেও জ্বলছে। সে যেন আমার অন্তরের তলদেশ পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

বললাম, ‘মিথিলা, আমি অনেক দূরে চলে গেছিলাম। এর মধ্যে আমার বিয়ে হয়েছে। দু-দুটো সন্তান হয়েছে। এতদিন পর তোমাকে দেখেও খুব ভালো লাগছে মিথিলা–!’

মিথিলা চোখ নামিয়ে মাটির দিকে দেখছিল। চারদিক নিরালা। হঠাৎ মনে হল, আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অফিসাররা যদি এদিকেই আসে, তাহলে ভুল বুঝতে পারে। মিথিলাকে তাই বললাম, ‘চলো, ফিরে যাই। সকলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

আমি আটচালার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, সে আমার হাত চেপে ধরল। চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। মিথিলা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমি ঘুরে দাঁড়াতে, ও খুব বিব্রত মুখে বলল, ‘একটা কুথা বলার ছিল বাবু। বুঝতে লারছি, কী করে বলি সে কথাটো তুমায়!’

প্রশ্নভরা চোখে ওর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। টাকাপয়সা চাইবে নাকি? অন্ধকারে ওর মুখের ভাবও স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে না। মিথিলা বলল, ‘বাবু, আমার আর তুমার মেয়ে, পুতলি, আটচালাতেই ছিল। দেখেছ কি তাকে?’

বলে কী? আমার গলা থেকে সহসা যেন কোনও আওয়াজ বের হল না। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, মনে হল। কপালে ঘাম দেখা দিল। সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা চায় কী? কী অভিসন্ধি? দুর্বল হলে চলবে না। গলায় যতদূর সম্ভব তীব্রতা এনে বললাম, ‘তোমার আর আমার মেয়ে? বাজে কথা বলার জায়গা পাওনি? কীভাবে হবে? কীভাবে, কীভাবে? আমাকে ঠকানোর চেষ্টা করো না, বুঝলে! আমাকে খাটো করার চেষ্টা করে লাভ হবে না–!’

নিজের কথা নিজের কানেই অসংলগ্ন শোনাল। কপাল থেকে ঘামের বিন্দুগুলি মুছে নিলাম।

মিথিলার গলার স্বর আগের মতোই শান্ত। বলল, ‘চিল্লিয়ো না। সবাই তো জেনে লিবে তাইলে।… বাবু, ওই রাতের পর আমি তো তুমারই হয়ে গেছিলাম। মন থেকে আজও আমি তুমারই। আমারও শাদি-বেহা হয়ে গেছে। আরও সন্তান হয়্যেছে। ওই পুতলি কিন্তু তুমারই বাবু। তুমার এবং আমার!’

আমি সন্দিগ্ধ গলায় শেষ অস্ত্রটা ছুড়লাম, ‘যখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে বলছ, তখন এ ব্যাপারে এতখানি নিশ্চিতই বা হচ্ছ কী করে?’

‘সেই রাতের সাত মাস পরে আমার বেহা হয়ে যায়। ওই সময়ের মধ্যে আর-কোনও মরদ আমায় ছোঁয়নি। ওই রাতের ঘটনার পরে যেদিন বুঝতে পারলাম, পেটে শত্তুর এসেচে, আমাদের রীতি অনুযায়ী মুখিয়া আমার বেহা ঠিক করল। আর তার ঠিক দু-মাসের মাথায় পুতলি জন্মাল। এবার তাইলে বলো?’ সে হেসে আমার দিকে তাকায়।

‘তাহলে, এতদিন এ কথা আমায় জানাওনি কেন মিথিলা? বুঝতে পারার পরপরই যদি জানাতে আমায়…’, আমি অসহায়ের মতো আমতা-আমতা করি, ‘আর, যদি তখন না জানিয়ে থাকো, তাহলে আজ জানানোর কী দরকার ছিল?’

মিথিলা বলল, ‘পুতলি আদিবাসীদের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। আমার মরদ ওকে নিজের বাচ্চার মতোই দেখে। তুমি কুথায় থাকো, সে আমি কী করে জানব, বাবু? হাঁ, মুখিয়া বলতে পারত। কিন্তু, উহাকে আমি কিছু বলি লাই। তুমাকে এত বছর পরে দেখ্যে কথাটো মনে পড়্যে গেল। পুতলিকে চিনতে লারছ বাবু? উই যে, যে আমার সঙ্গে লাচছিল!’

আমার মনে পড়ে গেল। কমবয়েসি মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম বটে! আদিবাসীদের মধ্যে অমন চোখা নাক-চোখ তো দেখা যায় না! আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল!

কিন্তু আমার কুশলী শহুরে মনটা কথা বলে উঠল, ‘ও? ওকে তো পুরো আদিবাসী মনে হয়! দূর–!’

এবার যেন একটু রেগে যায় মিথিলা। বলে, ‘ও আমার বুকের দুধ খেয়েছে বাবু। আদিবাসী মায়ের বুকের দুধ গো! আদিবাসীদের মধ্যে ও বড়ো হয়্যেছে। তুমি উকে আদিবাসী বললে, এতে আমি খুব খুশি হয়্যেছি, বাবু!’

আমার মনের মধ্যে ঝড় বইছে। শহরে আমার বউ, ছেলেমেয়ে যদি এ কথা জানতে পারে কী হবে? যদি অফিসাররা জেনে যায়, তাহলেই বা কী হবে? যদি সরকারের কাছে খবর যায়? আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। একটা বড়ো গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘তোমার এ কথা যদিও কেউ মানতে চাইবে না, তবু তর্কের খাতিরে যদি বিশ্বাস করিও, তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কী চাও তুমি?’

‘কী চাই?’ মিথিলা ব্যঙ্গ করে হাসে, ‘তুমাকে দেখ্যে পুরোনো কুথাটো মনে পড়্যে গেল। পুতলির বাবা কে, এ কথাটো কেউ জানে না! এক রাত তোমায় ভালোবেসেছিলাম, সাহেব। সেই ভালোবাসার উপহার পুতলি। ও তুমার উপহার। মনে হল, এ কুথাটো জানা তোমার অধিকার বটে!’

মুখে হাত চাপা দিয়ে আমি ডুকরে উঠি, ‘কত বড়ো ভুল! আমাকে সকলে সম্মান করে। আমি বিবাহিত। সন্তানের বাবা। বড়ো চাকরি করি। আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারব না–!’

মিথিলা আমার পাশে সরে এসে বলল, ‘ছি বাবু, তুমি আমাকে এতটা খারাপ ভাবলে?’

আমি হঠাৎ আবেগে, মিথিলার হাতদুটো চেপে ধরে বললাম, ‘না, না, কথাটা এখানেই কি শেষ হয়ে যায় মিথিলা? পুতলি যখন আমারই মেয়ে, ওর প্রতি কিছু কর্তব্য তো আমারও আছে! সব জেনে আমিই বা কী করে চুপ করে থাকি? ওকে এখানেই বা ফেলে রেখে চলে যাই কোন প্রাণে!’

‘তুমি কিছু করব্যে বলে তো এ কুথা আমি জানাইনি, বাবু,’ মিথিলা শান্ত গলায় বলে, ‘বিশ বছর ধরে, উকে আমি এই শিমূল-পলাশের জঙ্গলে পালছি। উ গিয়ে তুমার চকচকে বাংলোয় কেমনে রইবে গো? উ তো পাগল হয়্যে যাবে। উ আদিবাসী। উর মা আদিবাসী। উ তাই এখানেই থাকবে। মায়ের কাছে। এই সমাজেই উর বেহা হবে। তুমি উকে লিয়ে যেতে পারবে লাই।’

মিথিলার গলায় হঠাৎ কাঠিন্য ভর করে। আটচালার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ-ই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমাকে কিছু না জানানোই ভালো ছিল, বাবু!’

ছুটে গিয়ে আমি মিথিলার হাত ধরলাম। অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘রাগ কোরো না। তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে। কোনওদিন ওর ‘বাবা’ পরিচয়ে ওর কাছে যাব না। আমি জানি, তাহলেই তোমাদের জীবনে ঝড় উঠবে। শুধু মাঝেমধ্যে এসে পুতলিকে একবার দেখে যাব। তুমি অনুমতি দেবে তো?’

মিথিলা আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়ে।

‘আর-একটা কথা। পুতলি আমার মেয়ে। আমার ইচ্ছে ও স্কুলে পড়বে। বড়ো মানুষ হবে। তোমাদের গ্রামে মাস্টারমশাই তো আসেন! তুমি ওকে নিয়ম করে তাঁর কাছে নিয়ে যেয়ো– আমি খরচা…!’

আমায় থামিয়ে দিতেই যেন মিথিলা আকর্ণ হাসল। তারপর বলল, ‘তুমি সোজা পথে চলে যাও বাবু। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর একটা চোরা রাস্তা আছে। আমি সেইটো দিয়ে আসছি।’

 

স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প

বাথরুম থেকে মাঝেমাঝেই স্মিতার চুড়ির টুং টাং শব্দ আসছে। আর নাকে এসে লাগছে সুন্দর একটা সাবানের গন্ধ। অস্বচ্ছলতার মধ্যেও, এই একটা বিলাস স্মিতা ত্যাগ করতে পারেনি। স্নানের জন্য একটা সুগন্ধী সাবান সে ব্যবহার করে। আজ আর সকালে বেরোয়নি স্মিতা। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কাজ আছে। তাই হয়তো একটু সময় নিয়ে স্নান করছে। ভিজে চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে একটা সুন্দর সুগন্ধের ঢেউ তুলে বাথরুম থেকে ঘরের দিকে গেল স্মিতা। একটুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই অনিকেতের মনে হল, খাবারটা বেড়ে দেওয়া দরকার। হয়তো খেয়েই বেরোবে স্মিতা। দুবেলা পরিশ্রম করে মুখ বুজে। এক এক সময় নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয় অনিকেতের।

খাবার বলতে কেবল ভাত, আর আলুভাতে। দুপুরের খাবারের তালিকায় কোনও সবজি নেই। মাসের শেষ। সংসারখরচেও তাই টান পড়েছে। অনিকেত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খেতে বসল। ‘তুমিও এসো, একসঙ্গে খাই’– খুব আন্তরিকভাবেই সে ডাকল স্মিতাকে। স্মিতা তার স্ত্রী। তার সন্তানের মা। একটা স্কুলে পড়ায়।

বাইরে থেকে দেখলে অনিকেতকে খুব সংসারী বলে মনে না হলেও দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের যথাযথভাবে পেট ভরানোর মতো খাবারের অভাব প্রতিদিনই সে টের পায়। স্মিতা সংসারের এই বেহাল দশা লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনিকেত তো লেখক, তার অতিসংবেদি মনের আয়নায় ধরা পড়ে যায় সব কিছুই। সে খাবার তুলতে পারছিল না মুখে। কেন এমন হয় যে, সম্ভাবনাময় লেখকেরা কখনওই কেবল লিখে জীবনধারণ করতে পারেন না? অনিকেত খুব জনপ্রিয় লেখক নয়। তার লেখার আবেদন এক বিশেষ শ্রেণির পাঠককুলের কাছে। সাধারণ পাঠক পাঠিকাদের কাছে সে ‘সিরিয়াস’ লেখক। বারো বছরেরও বেশি সময়ের লেখকজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় তার কমবেশি ৫০টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। যদিও না-ছাপা লেখার সংখ্যা অনেক বেশি।

এ যাবৎ মাত্র একটি গল্পসংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে অনিকেতের। প্রকাশক খুব নামি নয়। প্রত্যেকটি গল্পে অনিকেত ডুব দিয়েছে চরিত্রের মানসিকতার গভীরে। প্রত্যেকটি গল্পের শেষভাগে থাকে টানটান উত্তেজনা। যখনই কোনও পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়, অনিকেতের মানসিক জোর সেই সময়ের জন্য অনেকখানি বেড়ে যায়। পাশাপাশি যে সাম্মানিক পাওয়া যায়, তা যত সামান্যই হোক, তা দিয়ে সংসারের কিছু সুরাহা হয়। কিন্তু এরকম তো সবসময় হয় না!

‘বই ভালো বিক্রি হচ্ছে না দাদা’, প্রকাশকের মুখোমুখি হলেই তার এক কথা। কয়েকশোবার সে অনিকেতকে একথাটা বলেছে। অতএব, সে বেচারা আর কী করে রয়্যালটি দেয়। পত্রপত্রিকাগুলোও আজকাল ভালোর কদর না করে সাধারণ মানুষ যা চায় তাই ছাপতে উৎসাহী। ফলে সার্বিকভাবে সাহিত্যের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। ফলে প্রত্যেক মাসেই মূল পান্ডুলিপিসমেত ‘দুঃখিত, আপনার লেখাটি মনোনীত করা গেল না’ লেখা চিরকুট পাওয়ার পরও কোনও মনোজ্ঞ পাঠকের প্রশংসা অনিকেতকে নতুন লেখার উৎসাহ যুগিয়ে দেয়।

এই লেখালেখির প্রবণতাই আগের তিনটি চাকরি খোয়ানোর মূল কারণ। শেষ চাকরিটা যাওয়া ইস্তক অনিকেত খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। সে একজন বিবাহিত পুরুষ। বাড়িতে তার যুবতি স্ত্রী রয়েছে। রয়েছে ছোট্টো একটি শিশুসন্তান। কী করে এই সংসার চালাবে সে?

অনিকেতের মনে হয়, গৃহস্থ মানুষের স্বপ্ন দেখাই উচিত নয়। সে মাঝেমধ্যেই ভাবে, শেষ চাকরিটির মালিকের কাছে গিয়ে আবার হারানো চাকরিটি ফিরে পাওয়ার জন্য তদ্বির করে আসবে। যে-কোনও উপায়ে তাকে একটি চাকরি পেতেই হবে।

স্মিতা কিন্তু কোনওমতেই মানতে রাজি হল না সে কথা। সে স্পষ্ট বলল, ‘না অনিকেত। তুমি একজন সৃষ্টিশীল মানুষ । কেরানি নও। আমার তো একটা চাকরি আছে। কোনওরকমে দুমুঠো ডালভাত আমার টাকায় জুটে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি জানি, তুমি একজন সর্বসময়ের লেখক হতে চাও। তাই হও। আমি তোমার পাশে আছি। দেখবে একদিন তোমার লেখার জন্য অনেক সম্মান পাবে তুমি। আর, তা যদি না-ও পাও, একথাটা তো ঠিক, এই কাজেই তুমি সবচেয়ে সুখী। সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

অনিকেতের দু’চোখ জলে ভিজে এল। কোনও কথা না বলে নীরবে সে শুধু তার দু’হাত স্মিতার দু’কাঁধে রাখল। আর কীভাবেই বা সে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে? স্মিতার স্যাক্রিফাইস ছাড়া তার যাবতীয় প্রচেষ্টা জলে যেত। তার প্রতিভার উপর স্মিতার আস্থা তাকে সাফল্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলল।

অনিকেতের লেখার ঘর বাড়ির সামনের দিকের ছোটো ঘরটা। সে লেখার টেবিলে বসতে গিয়ে দেখল দরজার কাছে মেঝের উপর ডাকবিভাগের দুটো খাম পড়ে আছে। ডাকপিওন এসে সম্ভবত জানলা দিয়ে ফেলে গেছে। অনিকেত খামদুটি হাতে নিল। সে আগে লম্বা খামটি নিয়েই পড়ল। খুব নামি পত্রিকা থেকে এসেছে।  এক মাস আগে এই ছোটোগল্পটা লিখে পাঠিয়েছিল অনিকেত। সেটাই ফেরত এসেছে, সঙ্গে ‘দুঃখিত, মনোনীত হল না’ লেখা চিরকুট। আলগোছে খামসহ পাণ্ডুলিপিটাকে টেবিলের উপর ফেলে দিল অনিকেত। দ্বিতীয় খামটা দেখে সে খুব খুশি হয়ে উঠল। খামের উপরে বাঁদিকে পত্রিকার নাম লেখা। মাস দুই আগে এই পত্রিকায় একটা অণু-উপন্যাস পাঠিয়েছিল সে। সাধারণ আকৃতির হালকা খামে সব সময় ভালো খবরই আসে।

তবু একটু উৎকণ্ঠা নিয়ে সে খামের মুখটা ছিঁড়ল। এবং দেখল, তার ভাবনাটাই ঠিক। লেখাটা মনোনীত হয়েছে। সম্পাদক অণু-উপন্যাসটি সম্পর্কে চিরকুটে লিখেছেন, লেখাটি ‘সুন্দর আর

সংবেদনশীল’ হয়েছে। সম্পাদকের মন্তব্য উদ্বেল করে তুলল তাকে। সাহিত্যের পাঠক-সমালোচক মহলে পত্রিকাটির গুরুত্ব রয়েছে। খুবই শিল্পমনস্ক ত্রৈমাসিক সাহিত্য-পত্রিকা হিসাবে যথেষ্ট নাম রয়েছে। আর সেই পত্রিকাই কিনা তার লেখাকে বলছে সুন্দর আর সংবেদনশীল!

পত্রিকাটির সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি দশদিনও হয়নি প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি কপি সে কিনেওছে। যদি ধরেও নেওয়া হয় তার অণু-উপন্যাসটি আগামী সংখ্যাতেই প্রকাশিত হবে, তা হলেও এখনও তিন মাস দেরি। একটু দমে গেল অনিকেত। সাফল্যের স্বাদ পেতে তিন মাস সময়টা এমন কিছু বেশি নয়। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে বসে রইল সে। সাফল্যের স্বাদটা উপভোগ করতে চাইল। এরকম নামি পত্রিকায় আর কয়েকটা লেখা ছাপা হলেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার একটা স্থায়ী জায়গা তৈরি হতে পারে। লেখাটি ছাপা হবে তিন মাস পরে। সাম্মানিক পাওয়া যাবে লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর। সে কি একবার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে কিছু অগ্রিম চাইবে? পেয়ে গেলে আজই পরিবারসমেত রাতে ভালোমন্দ কিছু খাওয়া যেতে পারে। পেটভরে খেয়ে একবার তৃপ্তির চোখে তাকাবে স্মিতা, এই তার সুখ। এই সুখের প্রতি যে খুব লোভ অনিকেতের!

পরমুহূর্তেই তার মনে হল, অগ্রিম চাওয়াটা কি উচিত কাজ হবে? একজন লেখকের কাছে আত্মমর্যাদা অনেক মূল্যবান। কী করে অনিকেত সেই আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেবে? একজন লেখক, যিনি ‘সুন্দর এবং সংবেদনশীল’ লেখালেখি করেন, তার কি এরকম ব্যবহার করা সংগত? স্মিতাই বা কী ভাববে?

‘অনিকেত,’ স্মিতা ডাকল। পরিপাটি সুতির শাড়ি পরে আছে। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে ক্লিপে আটকেছে চুলের ঢাল। ডান কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ। অন্য হাতে অনিকেত-স্মিতার সন্তান। ‘বেরোচ্ছি, বুঝলে? আজ একবার ডিআই অফিসে যেতে হচ্ছে। বাবানকে খাইয়ে দিয়েছি। দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। রান্নাঘরে দুধ গরম করা আছে। বিকেলে ওকে খাইয়ে দিয়ো। কেমন? আমি তাড়াতাড়িই ফেরার চেষ্টা করব।’

‘আমি সব করে রাখব। তুমি কোনও চিন্তা কোরো না।’

মঞ্জুরি-চিঠিটাকে খামে ঢুকিয়ে রেখে অনিকেতও লিখতে বসল। সাড়ে চারটে নাগাদ হঠাৎ-ই তার পুরোনো সহকর্মী হরি এসে হাজির। অনিকেতের শেষ চাকরির জায়গায় গৌরহরি ছিল স্টেনোগ্রাফার।

‘কেমন আছো অনিকেত? আশা করি ভীষণ সৃষ্টিশীল হয়ে আছো।’ হাসতে হাসতে বলল হরি।

‘আরে, সেরকম কিছু না। ভেতরে এসো।’ ততোধিক আন্তরিকতা নিয়ে হরিকে আমন্ত্রণ জানাল সে।

‘কিন্তু, একটা কথা মানতেই হবে ভাই, তুমি দুর্দান্ত লেখো। সেদিন তোমার একটা বই পড়ছিলাম। প্রত্যেকটা গল্পই এত উচ্চমানের যে ভাবা যায় না!’

প্রশংসায় অনিকেতের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে জানত, হরি মন-রাখা কথা বলার লোক নয়। সে সলজ্জ হয়ে বলল ‘থ্যাংক ইউ হরি। আগে তুমি বসো।’

অনিকেত খানিকক্ষণ কথা বলার পর উঠে চা করল। হরি অনেকদিন পরে এসেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে কফি খাওয়ানোর। কিন্তু কফির চেয়ে চায়ে কম দুধ দিতে হয়। সুতরাং সে চা-ই করল । ইতিমধ্যে ছেলেও উঠে পড়েছে। কিছুক্ষণ ছেলের সঙ্গে খেলল সে। খানিকক্ষণ পরে হরি আবার বলল, ‘এবার আর একটা বই প্রকাশ করো অনিকেত।’

‘ইচ্ছে হয়। যতই বিভিন্ন ম্যাগাজিনে একটা-দুটো করে লেখা বের হোক, বই হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা আসলে একজন লেখকের আস্ত পরিচয় বহন করে। কিন্তু, আমার বই বের করবে কে, হরি? আমি সেই অর্থে জনপ্রিয় লেখক নই। আমার পাঠক সীমিত। আমার পাবলিশার তো বলে থাকে, আমার বই নাকি বিক্রিই হয় না।’

‘তাই নাকি? তোমাকে এই কথা বলেছে? বিক্রিই যদি না হবে তাহলে তোমার বই-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হল কীভাবে?’

‘কী বলছ?’ অনিকেত উত্তেজনায় ঢোঁক গিলে বলল, ‘দ্বিতীয় সংস্করণ?’

‘আসলে আমি যে-বইটা পড়েছিলাম সেটা দ্বিতীয় সংস্করণ।’

‘বলছ কী? তুমি ঠিক দেখেছিলে?’

‘আলবাত।’

‘লোকটা তো পাকা জালিয়াত দেখছি! প্রত্যেকবার যখন রয়্যালটির জন্য গেছি, লোকটা মুখের উপর বলেছে, ‘আপনার বই বিক্রি হয় না’। একবার মাত্র রয়্যালটি দিয়েছে। প্রথম যখন বইটা বের হল, অগ্রিম হিসাবে দু’হাজার টাকা দিয়েছিল। সেও তিন বছর আগে। বলেছিল, বই বিক্রি হলে আস্তে আস্তে বাকি টাকা পাওয়া যাবে।’

‘ভালোমানুষকে কীভাবে ঠকতে হয় দেখেছ? একটা পুরো সংস্করণের জন্য কত পাওনা হয় তোমার?’

‘পনেরো হাজারের মতো।’

‘আর, এই সামান্য টাকার জন্য লোকটা তোমায় ঠকাল! তোমার বই-এর ভালো কাটতি হওয়া সত্ত্বেও!’

সন্ধে নাগাদ চলে গেল হরি। তার মুখ থেকে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার কথাটা জানা ইস্তক খুবই অশান্ত হয়ে ছিল অনিকেতের মনটা। স্মিতা ফিরতেই সে পুরো ঘটনাটা বিবৃত করল। বলল, ‘কাল বদমাশ লোকটার কলার চেপে ধরে আমি পুরো পাওনা বুঝে নেব।’

কলেজ স্ট্রিটের এক সরু অন্ধকার গলির মধ্যে তার বই-এর দোকানে নিশ্চিন্তে বসে ছিল বিপ্লব দত্ত। দোকানে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। দূর থেকে অনিকেতকে আসতে দেখেই জোড়হাত করে উঠে দাঁড়াল সে। চোখেমুখে শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, উৎসাহের ভঙ্গি মিশিয়ে বলল, ‘আসুন, আসুন অনিকেতবাবু। ভীষণ খুশি হয়েছি, আপনি এসেছেন। বসুন। বলুন, চা না কফি।’ তেতো গলায় বলল অনিকেত, ‘বিপ্লব, আমি তোমার আতিথেয়তা পেতে আসিনি। আমি কাজে এসেছি।’

‘ওঃ কাজ! আপনিও স্যার এমন বলেন–।’ দেঁতো হাসি হেসে বলল বিপ্লব। অনিকেত তার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিল। চল্লিশের এপাশেই বয়স হবে। উজ্জ্বল সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবিতে খুবই স্মার্ট দেখাচ্ছে। নিষ্পাপ মুখচোখ বজায় রেখে একটা লম্বা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিপ্লব বলল, ‘আপনি একজন এরকম উঁচুমানের লেখক, আপনিও কিনা সাধারণ লেখকদের মতো বিজনেসের কথা বলেন? মনে বড়ো ব্যথা দিলেন–।’

‘রয়্যালটি চাইছেন? কীসের রয়্যালটি স্যার? কতবার আমি আপনাকে বলব, আপনার বই একেবারেই…’

‘বিক্রি হয় না, তাই তো? বেশ, সেইজন্যে বুঝি বইটার দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপাতে হল?’

‘দ্বি-দ্বিতীয় সংস্করণ?’ হাসার চেষ্টা করে বিপ্লব বলল, ‘এইসব গল্প কে শুনিয়েছে আপনাকে বলুন তো?’ কোনও কথা না বলে অনিকেত উঠে দেয়ালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত টানা বই-এর র‍্যাকগুলির দিকে এগোল। র‍্যাকের একধারে তার বইটির অসংখ্য কপি রাখা রয়েছে। সুন্দর সোনালি হরফে বইটির শিরোনাম ও তার নাম সে দেখতে পেল বাঁধাই-এর ধার বরাবর। প্রত্যেকবার যখন এই অফিসে বিপ্লবকে সে রয়্যালটির কথা বলতে এসেছে, এই তাকগুলিকে দেখিয়েই বিপ্লব বলেছে, ‘দেখেছেন তো, বইগুলি যেমন ছিল তেমনভাবেই রয়েছে। বিক্রিই হয় না। যদি বিক্রিই হতো, তাহলে কি আপনাকে রয়্যালটি দিতাম না, বলুন! অনিকেত কোনওদিনও তার কথায় অবিশ্বাস করে বইগুলো হাতে তুলে দেখেনি। নতমুখে বের হয়ে এসেছে। কী ভুলই যে করেছে! আজ আর সেই এক ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না সে। সে দ্রুত পায়ে র‍্যাকের সামনে এসে দাঁড়াল। একটি কপি তুলে প্রচ্ছদ উলটে দ্বিতীয় পাতায় আসতেই মুদ্রণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য চোখে পড়ল। হরি ঠিকই বলেছিল, অনিকেতও দেখল, লেখা আছে, ‘দ্বিতীয় সংস্করণ। ফেব্রুয়ারি ২০১৫’। বিপ্লবের টেবিলের উপর সশব্দে বইটির ওই পাতাটি খোলা অবস্থায় রাখল অনিকেত।

‘এর মানে কী বিপ্লব?’ বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল তার।

‘স্যার, আমায় ভুল বুঝবেন না…আপনি জানেন না, কী ভীষণ আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাকে।’ বিপ্লবের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ক্রমাগত কাহিনির জাল বুনে যাচ্ছিল সে। অনিকেত সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সাফ বলল, ‘তোমাকে দেখে তা মনে হয় না। এই জায়গাটারও তো যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। শেষবার যখন এখানে এসেছিলাম, এটা ছিল একটা বই-এর দোকান। এখন তো দিব্যি প্রকাশনা সংস্থার মতো মনে হয়।’

বিপ্লব বলল, ‘না স্যার। সেসব কিছু হয়নি। বিশ্বাস করুন। আমার সত্যি অনেক আর্থিক দায়দায়িত্ব রয়েছে।’

‘আরে সে তো জানি! আমাকে আমার পাওনাটুকু মিটিয়ে দেওয়ার দায়িত্বই শুধু তোমার নেই। প্রথম সংস্করণের সবক’টি কপি বিক্রি হয়ে যাওয়ার দরুন আমার পাওনা হয় পনেরো হাজার টাকা। তুমি আমাকে দু’হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলে। সুতরাং এখন তোমায় দিতে হবে পনেরো হাজার মাইনাস দু’হাজার… এক্ষুনি আমার টাকাটা আমি চাই।’

‘স্যার, আমি ধারের টাকায় ব্যাবসা চালাচ্ছি। শুধুমাত্র এই আশায় যে, আমার বইগুলো ভালো ব্যাবসা করবে। সব লেখকরাই তো নামকরা। আর আপনি সকলের মধ্যে সেরা…’

‘আমি ওসব অনেক শুনেছি বিপ্লব। আমার টাকা…।’

‘স্যার, একটা কথা বোঝার চেষ্টা করুন। বই বাজারে কাটুক বা না কাটুক, কম্পোজিটর, প্রুফ রিডার, শিল্পী, ছাপাখানা, বাঁধাইওলা, পরিবেশক—ওদের সকলকে আমায় টাকা দিতে হয়।’

‘ওদের কেউ বিনা টাকায় কাজ করবে না, তাই না?’

‘ঠিক। ওরা কি ছেড়ে দেবে বলুন?’

‘অর্থাৎ, সবার সব পাওনা তোমায় মিটিয়ে দিতে হয়, শুধু লেখকদেরই না দিলেও চলে।’

‘স্যার, আমায় শুধু একটু সময় দিন। আমার সময়টা ফিরুক। এই মুহূর্তে আমার কাঁধে পরিবারের অনেক দায়দায়িত্ব রয়েছে। আমার বোনের স্বামী হঠাৎ মারা গেল…।’

‘তোমার অর্নগল মিথ্যে বলা আমায় ক্লান্ত করে বিপ্লব।’ অনিকেত দেখল, মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ায় সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে বিপ্লবের। সে বলল, ‘আমি তো আপনার শত্রু নই। আমরা তো বন্ধু। এখন একটু টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। দেখি, এই মুহূর্তে কতটা দেওয়া যায়…। আমি আপনাকে ইতিমধ্যে দু’হাজার দিয়েছি। এখন আরও হাজার দিচ্ছি। তাহলেই তিন হাজার হয়ে গেল। কী…?’ উৎসুক চোখে সে তাকাল অনিকেতের দিকে।

‘আমি দান-খয়রাত চাইছি না বিপ্লব। আমার পাওনা বুঝে নিতে এসেছি। চলি–।’ অনিকেত উঠে দাঁড়ায় ও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।

‘আরে, না না, যাবেন না। আমি না হয় আরও এক হাজার টাকা দিচ্ছি। বাকিটা, সত্যি বলছি, আস্তে আস্তে দিয়ে দেব।’

অনিকেত চলে যেতে গিয়েও দাঁড়াল। এখন হাতে দু’হাজার টাকা মোটেও কম টাকা নয়। বিশেষ করে এই সময়ে। পেলে সংসার নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত স্মিতা অন্তত কয়েকদিনের জন্য হাঁফ ছাড়বে। কিন্তু বিপ্লব বাকি টাকাটা দেবে তো?

‘ঠিক আছে দাও দু’হাজার টাকা। এক মাসের মধ্যে বাকি টাকাটা কিন্তু দিতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই স্যার, নিশ্চয়ই। তবে আমার অবস্থা…’

‘আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি স্যার। আপনি একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। আপনার লেখারও আমি একজন ভক্ত। আসলে,’ চশমার উপর দিয়ে অনিকেতকে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘আপনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে আপনার আর একটা বই আমায় দিন। আর একটা গল্পসংগ্রহ।’

অনিকেত একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘মানে?’

‘মানে, বলতে চাইছি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এমন গল্প কি আছে আপনার কাছে। অপ্রকাশিত গল্প হলেও চলবে।’

‘বই বের করার টাকা কোথায় পাবে?’

‘ধার করব স্যার। এভাবেই তো করি। ঝুঁকি হলেও এবার আমি অনেকটা নিশ্চিত কারণ, আপনি খুব ভালো লেখেন। লোকেও আপনার লেখা নিতে শুরু করেছে। আপনার বই ভালো কাটলে আমার অন্য বইগুলোও পাঠকরা নেবে। আমি একটু সুখের মুখ দেখব স্যার। তখন আপনার সব পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেব। যতটা ভাবছেন, ততটা অসৎ লোক আমি নই।’

অনিকেতের হূৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। এক আশ্চর্য কিশোরসুলভ উত্তেজনায় বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার চোখদুটো। আর একটি বই! সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কতগুলো গল্প চাই তোমার বিপ্লব?’ বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল তার।

বিপ্লব মৃদু হাসল। ‘কুড়িটার মতো গল্প দিতে পারবেন?’

‘কুড়িটার বেশি দিতে পারব। প্রকাশিত হয়েছে এমন গল্প, অথচ প্রথম বইতে নেই কিন্তু এবার আর পনেরো নয়, তোমাকে দিতে হবে পঁচিশ।’

অনিকেতের মনে হল, কেউ যেন তার ফুসফুসে বাড়তি কিছু তাজা অক্সিজেন ভরে দিয়েছে। পাবলিশারের অফিসের বাইরে এসে সে লাফিয়ে যখন বাসে উঠল, তার মনে হল, সে যেন নিজের মধ্যে নেই। যেন মাটিতে তার পা নেই। যেন সুখের সমুদ্রে সে ভেসে বেড়াচ্ছে। বসতে জায়গা পেল না সে, তবু একটুও অস্বস্তি হল না তার। বদলে সে ভাবতে লাগল কোন গল্পগুলো যথাযথ হবে। অনিকেতের মনের পটে ভেসে উঠতে লাগল তার প্রিয় সৃষ্টিগুলি। কোনওরকমে বাড়ি পৌঁছে স্মিতার হাতে রয়্যালটির টাকাগুলো তুলে দিতে সে খুব খুশি হয়ে উঠল।

স্মিতা বলল ‘বাঃ। তোমার প্রকাশক তাহলে তোমাকে কিছুটা রয়্যালটি দিল শেষ পর্যন্ত। বাকিটা কবে দেবে গো?’

‘জানি না… কিন্তু আমি আর ওকে এর জন্য চাপ দিতেও চাইছি না। বেচারা। ও নানারকম ব্যাপারে ফেঁসে আছে। তাছাড়া…, ‘এবার নরম আর নীচু হয়ে এল অনিকেতের গলা,’ ও আমার আর একটা বই প্রকাশ করতে চাইছে।’

‘তাই?’ রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বলল স্মিতা।

‘আজ দিনটা বড্ডো সুন্দর। চলো স্মিতা, সেলিব্রেট করি। বাইরে কোথাও যাই। রাতের খাবারটা বাইরেই সেরে আসি। অনেকদিন পেটভরে কিছু ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি। ছেলের জন্য আইসক্রিমও কিনে আনব।’

পরের সন্ধেয় অনিকেত গেল হরির কাছে। হরি বাড়িতেই ছিল। অনিকেত বলল, ‘হরি, কাল আমি তোমার অফিসে আসছি। ম্যানেজারবাবুকে একবার রিকোয়েস্ট করবে আবার একটা কাজের যাতে ব্যবস্থা করে দেয়? আমি ওকে বলব, আর কোনওদিন অফিসে বসে গল্প লিখব না। আমি একটু আর্থিক অনটনে আছি হরি, তুমি জানো। আমার হয়ে একটু বলবে ম্যানেজারবাবুকে?’

ঝলমলে গড়িয়াহাট, দুপাশে পশরা সাজিয়েছে দোকানদাররা। ট্রামটা এসে থামতেই এক লাফে উঠে পড়ল অনিকেত। বুকের বাঁদিকটা অনেকটা হালকা লাগছে আজ। একটা কিছু সুরাহা যেন হয়ে যাবে। যাবেই। হঠাৎই এই কৃতঘ্ন শহরটাকে যেন, অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হল অনিকেতের।

 

পাকদণ্ডি

কেউ ঝুঁকে পড়ে পায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠল বন্দনা। ‘না-না, বলে সংকুচিত হয়ে উঠলেও যে প্রণাম করতে এসেছিল, সে কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে আগ্রহী নয়। লোকটি চলে যাওয়ার পরই বন্দনা চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। এই সময়ে তার মন অতীত স্মৃতির নানা গলিপথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। একের পর এক মুখ ভেসে উঠতে শুরু করল স্মৃতিপটে। অনেকগুলি মুখ ধোঁয়াশায় আবছা হয়ে এসেছে। মুখ মনে আসছে, অথচ মুখের মালিকের নাম মনে পড়ছে না। এখন কারওর উপরেই সে আর ভরসা করতে পারে না। তা সত্ত্বেও শৈশবের এক স্বভাব সে কখনওই ছাড়তে পারেনি। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার পাশে থাকার অভ্যাসেই সে স্কুলের চাকরির পাশাপাশি সমাজসেবাকেও ব্রত হিসাবে নিয়েছে।

সন্ধে সাতটার সময় সুদর্শন পান্ডের বাড়িতে তার ছোটোছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। বিশেষ ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার। কিন্তু সুদর্শন তার সমাজসেবী সংস্থা ‘অর্চনা’র সদস্য। বন্দনা স্নান করল, আলমারি থেকে নামিয়ে একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের উজ্জ্বল শাড়ি পরল, সামান্য সাজল, বেরিয়ে পড়ল তারপর।

সুদর্শনের বাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ। ইতিমধ্যে অন্য অতিথিরাও দলে দলে আসতে শুরু করে দিয়েছেন। সকলের সঙ্গে বন্দনার পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুদর্শন বলতে লাগল, ‘ইনি বন্দনা দত্ত, ‘অর্চনা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান।’কয়েকটি কৌতূহলী চোখ চমকে তাকাল বন্দনার দিকে। বন্দনা এ ধরনের দৃষ্টিপাতে অভ্যস্ত। আগে অস্বস্তি হতো তার। এখন আর হয় না। পঁয়তাল্লিশে পড়ল সে গতমাসে। হয়তো এখনও তার ধারালো চোখমুখ আর টানটান শরীর বাইরে লোকের কাছে আকর্ষক মনে হয়। কিন্তু, এরই পাশাপাশি তাদের চোখে অন্য একটা প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে বন্দনা ভেবে কুল পায় না। সেই চোখগুলি প্রশ্ন করে, ‘এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কেন আপনি বিয়ে করেননি বন্দনা?’

এককালে এইসব প্রশ্ন তাকে বিরক্ত করত, এখন আর করে না। এরই মধ্যে কোনও কোনও কৌতূহলী সাহসী পুরুষ তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। কারওর বাচ্চার অ্যাডমিশন নিয়ে সমস্যা, কারওর বা সংসারে পণ দেওয়া নিয়ে ঝামেলা। এসব কিছু না থাকলে সমাজসেবা করার ঝুটো ইচ্ছের ছুতোয় কাছে আসার প্রক্রিয়া জারি থাকে। অনেকক্ষেত্রে বন্দনা এমনও টের পেয়েছে, হয়তো কোনও সমস্যাই নেই, তবু, কোনও কোনও পুরুষ শুধু তার সঙ্গ পাবে এই আশায় তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে।

চিরকালই বন্দনার মধ্যে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং আত্মমর্যাদাবোধ খুবই বেশি। অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে, কার সঙ্গে কতটা কথা বলতে হবে, কার সঙ্গে কতটা দূরত্ব বজায় রাখা সংগত। সুদর্শনের ঘরোয়া পার্টি খুব জমে উঠেছিল। খাওয়াদাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত, বন্দনা দেরি করল না। এমনিতেই তার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। সামান্য কিছু খেয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছোতে চাইছিল। প্লেটে খাবার নিয়ে দু-এক চামচও খায়নি, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল বিজন। নিজের প্লেট হাতে নিয়ে সে বন্দনার পাশে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় বলল  ‘আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

বন্দনা একটু অবাক চোখে তাকাতেই সে ফের বলল, ‘আপনিই তো মৃদুলাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছেন।’

মৃদুলা বিজনের একমাত্র মেয়ে। যে-স্কুলে বন্দনা অধ্যক্ষ, সেখানেই পড়ে মৃদুলা। অনেকদিন ধরেই তার নামে নানা অভিযোগ আসছিল। ক্লাসরুমে অনুপস্থিত থাকে। ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, অভিযোগের কোনও অন্ত নেই। উপায়ান্তর না দেখে বিজন তখন বন্দনার দ্বারস্থ হয়। সেই ওদের প্রথম দেখা। তারপর বেশ কয়েকবার বিজন এসেছে তার কাছে। অনেক কষ্টের কথা বলেছে। বন্দনা এখনও বোঝে না, কোনওরকম আকর্ষণ থেকেই কি সে তার কাছে আসত? নাকি, সত্যিই সে ব্যতিব্যস্ত ছিল তার মেয়ের ব্যাপারে?

সে সময় বন্দনা মৃদুলাকে ডেকে অনেক বুঝিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, নদীর জল আর সময় কারু জন্য অপেক্ষা করে না। সময় থাকতে থাকতে তার যথাযথ উপযোগিতাটাও জরুরি। তাতে ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সুখের হবে। তার কথায় কী যে জাদু থাকে, যে-শোনে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। এসব ঘটনার পর একদিন হঠাৎ-ই বিজন এসে হাজির। তার নিশ্চিন্ত মুখচোখ দেখে খানিকটা স্বস্তি পেল বন্দনা। বিজন বললছ ‘মৃদুলা খুব প্রশংসা করে আপনার। এখন তো দেখছি বাড়িতেও খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।’উপকারের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু, বিজন সেই বিরল প্রকৃতির মানুষ, যে, কৃতজ্ঞ থাকতে ভালোবাসে আর বারবার সেই কথার পুনরাবৃত্তি করে বন্দনাকেও কিছু ভুলতে দেয় না।

‘আচ্ছা ম্যাডাম, রাজনীতির জগতের মানুষজনও তো সকলেই আপনাকে চেনে। আপনার এক কথায় কত লোকের কত কাজ হয়ে যায়!’

একটু হকচকিয়ে গেল বন্দনা। তার ব্যাপারে বিজন এত খবর রাখে কেন? মনের দোলাচল তার কথাতেও বের হয়ে এল,  ‘আপনি তো দেখছি, আমার সম্পর্কে প্রচুর খবর রাখেন।’

‘সত্যি বলতে কি ম্যাডাম,’ বিজন বলল, ‘ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলতে পারেন, কিন্তু, আপনার অতীত ও বর্তমানের অনেক কথাই আমার জানা।’

বন্দনা হেসে ফেলল, ‘আমার সম্পর্কে এত কিছু যখন জানেন, তখন নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎটাও জানেন আপনি!’

একথা শুনে একটু চুপ করে রইল বিজন। তারপর নীচু গলায় কেটে-কেটে বলল, ‘ভবিষ্যৎ তো আপনার নিজেকেই স্থির করতে হবে।’ তারপর হঠাৎ-ই সে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।

সেদিন পার্টি শেষ করে বাড়ি চলে আসার পর থেকে বেশ কিছুদিন বন্দনা বিজনের কথাগুলি ভাবছিল। ভাবছিল, কী বিচিত্র মানুষ এই বিজন! বলে কিনা তার অতীত-বর্তমান, সবকিছু সে জানে! বন্দনার অতীত… কোন অতীত?

বন্দনার বাবা ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। একসময় অনেক লড়াই দেখেছে বন্দনা, ঘরে-বাইরে। পার্টি গড়ে ওঠার সময়ে বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন স্যাক্রিফাইস করেছেন। অত্যধিক পরিশ্রমে বন্দনার বাবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল শেষদিকে। সেই টালমাটাল সময়ে বন্দনা দেখেছে কী প্রচণ্ড কষ্টে সংসার সামলেছেন মা! বিএ পাশ করেই তাই বন্দনাকে চাকরির খোঁজে বের হতে হল। অন্য আর পাঁচটা সমবয়সি মেয়ের কাছে সেই সময়টা ছিল চোখে রঙিন স্বপ্নের জাল বোনার। আর তখনই স্বপ্ন দেখার সঙ্গে বন্দনার ছিল আড়ি। কাঁধের উপর যে বিরাট সংসারের দায়! সুজয়, আরাধনা দুই ভাইবোন, আর মা। পুরো সংসারকে টানতে স্কুলের চাকরির পরেও বাড়িতে কোচিংক্লাস খুলতে হল বন্দনাকে। তারপর হঠাৎ-ই একদিন মা’ও মারা গেলেন। মাথার উপর আর রইল না কেউ। ওই সময় বড়ো অসহায় হয়ে পড়েছিল বন্দনা। সময় সব ক্ষত মুছিয়ে দেয়। জীবনের স্বভাবই হল গড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সুজয় আর আরাধনার সংসার সাজিয়ে দিয়ে যখন সে একটু নিজের দিকে তাকানোর সময় পেল, দেখল, চুলে ততদিনে পাক ধরেছে।

অতীতের ইতিহাসের পাতা উলটালে তার চোখ জলে ভিজে আসে। মনে হয়, এক পলকে সে পৌঁছে গেছে সেই গাঁ-এ, যেখানে দাদু-দিদা’র সঙ্গে কয়েকদিন খুব আনন্দে কেটেছিল। সারাদিন গ্রামের সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে প্রজাপতি ধরে বেড়ানোর সুখ ভোলা যায় না। ভোলা যায় না, তারপর পাকদণ্ডি পথ বেয়ে অনেক বেশি রাস্তা ঘুরে দেরি করে বাড়ি ফেরা …।

ওই কয়েকটা বছর সংসারের উপর দিয়ে খুবই ঝড়ঝাপটা গেছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বাবা কোনওভাবেই কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই দাদু-দিদা, মা আর ভাইবোনদের নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। আস্তে আস্তে ভাইবোনরাও বড়ো হচ্ছিল। বাবা বাধ্য হয়ে শহরে নিয়ে এলেন সকলকে। এখন এই নিশ্চিন্ত জীবনের অবসরে চোখ বুজলেই গ্রামের সেই পাকদণ্ডি পথ চোখে ভাসে। পাকদণ্ডি হচ্ছে সেই পথ, যেটি মানুষের চলাচলের মাধ্যমে আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে যায়।

বন্দনা নিজেও জানে, সারাজীবন ধরে সে পাকদণ্ডিই হয়ে রইল। চেনাপরিচিত মানুষজনের কাছে, এমনকী ভাইবোনদের কাছেও। একমাত্র বিজন অন্যরকম। যখনই দেখা হয়, অত্যন্ত আন্তরিক হাসিতে সে অভিবাদন জানায়। বিজনের ভাবনাচিন্তার ধরন ভালো লাগে বন্দনার। কিন্তু, সে তার অতীত বিষয়ে কী জানে, সেটা জানার আগ্রহ থাকলেও সংকোচবশত কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না বন্দনা। অতীত… কোন অতীত? এ প্রশ্ন কতবার তার ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছে। শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছে বন্দনা। অনেকদিন হল, বিজন আসেনি। স্কুলে মৃদুলার সঙ্গে দেখা হতে বন্দনা তার কাছে বিজনের কথা জানতে চাইল। মৃদুলা জানাল, তার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিজনের ব্যক্তিত্ব আর শালীনতাবোধ সেই প্রথমদিন থেকেই বন্দনাকে মুগ্ধ করে। হয়তো এইজন্যই সে ঠিক করল, এক সন্ধেয় বিজনকে সে দেখে আসবে।

বিজন শুয়ে ছিল, বন্দনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে। ‘আরে, ম্যাডাম…। আপনি…,’ তার মুখে যেন প্রথমে কোনও কথাই জোগাল না। বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করতে যেতেই বাধা দিল বন্দনা, বলল ‘আপনি উঠবেন না, শুয়ে থাকুন। মৃদুলা বলল আপনি অসুস্থ, তাই, দেখতে চলে এলাম।‘ যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে বন্দনার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকল বিজন। তারপর হঠাৎ-ই বিছানার উপরে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘বন্দনা, এখনও কি তোমার প্রজাপতি ধরার শখ আছে?’

বন্দনা চমকে উঠল। দুটো কারণে। বিজন ‘আপনি’র সম্পর্ক ভেঙে দিল। সচেতনভাবে ভেঙে দিল নাকি? পাশাপাশি, প্রজাপতির পিছনে ছোটার প্রসঙ্গও তাকে খুব আশ্চর্য করে দিল। ‘তুমি… আপনি…,’ কোন সম্বোধনে কীভাবে যে কথা শুরু করবে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না বন্দনা।

‘তুমি-ই চলুক না বন্দনা…। তোমার মনে আছে, তোমার প্রজাপতি ধরার অভিযানে একজন থাকত, বিজু নামে?’ বন্দনার দিকে সরাসরি না তাকিয়েই বলল বিজন।

‘আরে…?’ বলতে গিয়ে খুশি উছলে পড়ল বন্দনার গলায়। মনে হল, সত্যি সত্যি আর একবার সে প্রজাপতি ধরার সেই বয়সে পৌঁছে গেছে। ‘ছোটোবেলাটা কী আশ্চর্য, তাই না? ছেড়ে গিয়েও যেন আজীবন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আরে… সেইজন্যেই তুমি বারবার বলতে আমার অতীতের কথা জানো?’  বালিকাসুলভ খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল বন্দনার চোখে। সে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে জানতে চাইল, ‘মৃদুলাকে দেখছি না, সে কোথায়?’

‘মৃদুলা বন্ধুর বাড়ি গেছে।’

‘আর ওর মা?’, জিজ্ঞেস করল বন্দনা। একটা কৌতূহলও ছিল। বিজনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যতবার দেখা হয়েছে, ওকে একাই দেখেছে। ‘সে নেই বন্দনা,’ গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বিজন বলল, ‘মৃদুলার যখন দশ বছর বয়স, তখনই ওর মা…।’

সেদিনের পর থেকে বন্দনার সঙ্গে প্রায়ই বিজনের দেখা হতে থাকল। বন্দনা তার চাকরি ও সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কেন কে জানে, বিজনের ফোন এলে সে খুশি হয়ে উঠত, আর বিজনের সঙ্গে দেখা করা আর কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তার মন। সরষেখেতের পিছনে প্রজাপতি ধরতে যাওয়ার দিনগুলির স্মৃতি তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।

বন্দনার জীবনে কখনও প্রেম আসেনি। মাঝেমধ্যে একা থাকলে বন্দনা ভাবতে বসত, এই যে বিজনের জন্য একটা আকুলতা সে টের পায় মনের মধ্যে, একেই কি প্রেম বলে? ভিতরে ভিতরে এক ভীষণ যন্ত্রণা অথচ উপর-উপর সব শান্ত। যে-যার নিজস্ব সামাজিক মর্যাদার জালে বন্দি, যে-যার নিজস্ব খোলসে আবদ্ধ।

সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। বন্দনা যদিও টিচার্স রুম-এ বসে না, তবু, কানে এল, বন্দনা এবং বিজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরার বিষয়টিকে অনেকেই রীতিমতো চর্চার বিষয় করে তুলেছে। বন্দনা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সারাজীবনে অন্য লোকে কী ভাবল তা নিয়ে আদৌ ভাবেনি সে। কিন্তু, এখন তার একটা সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। নিজেকে কি তাহলে সে গুটিয়ে নেবে? কিন্তু, মন কেন চাইছে অন্য কিছু? কেন বালিকার মতো অবুঝ হয়ে উঠছে? আবেগে ভেসে নিজের সব প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদাকে কি সে বিসর্জনের চতুর্দোলায় তুলে দেবে? অনেক ভেবে বন্দনা স্থির করল, মনে লাগাম পরানো দরকার। বিজন এরপর থেকে ফোন করে দেখা করতে চাইলে সে ঘুরিয়ে অসম্মতি জানাতে শুরু করে দিল। বেশ কিছুদিন ‘না’  শোনার পর বিজনও ফোন করা বন্ধ করে দিল।

জীবন দৌড়ে চলছিল। প্রথম-প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও বন্দনা কাজকর্মের মধ্যে ভুলে থাকার চেষ্টা করছিল রুদ্ধ আবেগ। কিন্তু হঠাৎই একদিন মৃদুলার এক কাণ্ড বন্দনা আর বিজন দুজনকেই চমকে দিল।

তার সমাজসেবী সংস্থার দফতরে বসে ফাইলপত্র ঘাঁটছিল বন্দনা। দেখা করতে আসা মানুষজন খানিকক্ষণ আগেই বিদায় নিয়েছে। সন্ধে হয়ে এসেছে। হঠাৎ-ই ফোন। বন্দনা ‘হ্যালো’ বলতেই, ওপার থেকে মৃদুলা বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি এক্ষুনি একবার আসতে পারবেন? আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।‘ মৃদুলার উদ্বেগ-মাখা কণ্ঠস্বর খুবই বিচলিত করে দিল বন্দনাকে। ফোন রেখে কোনওমতে রাস্তায় নেমেই সে ট্যাক্সি ধরল।

বিজনের বাড়ির দরজায় ট্যাক্সি থামতে নেমে পড়ল বন্দনা। ট্যাক্সিওলাকে ভাড়া মিটিয়ে খুচরোও ফেরত নিল না। কিন্তু বিজনের ঘরে ঢুকে সে সত্যিই চমকে উঠল। বসার ঘরের হেলানো চেয়ারে দিব্যি পা তুলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল বিজন। শরীরে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ পর্যন্ত নেই। সে বলে উঠল ‘আরে, তুমি তো দেখছি দিব্যি সুস্থ আছ। মৃদুলা যে বলল তোমার ভীষণ শরীর খারাপ?’

‘তাই নাকি,’ অবাক হওয়া গলায় বিজনও বলে ওঠে, ‘মৃদুলা এরকম বলবে কেন?’ তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এল মৃদুলা। বলল, ‘আমি বলছি বাবা, কেন ফোন করেছিলাম।’

মৃদুলার কথায় বিজন ও বন্দনা দুজনেই বিব্রত হয়ে পড়ল। দুজনের অর্থবহ দৃষ্টিবিনিময় হল। দুজনের মনেই সম্ভবত একই ভাবনা খেলা করতে থাকল, তাদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে কোনও গুরুতর অভিযোগ করতে চায় নাকি মৃদুলা! বন্দনার মনে একটা গ্লানি এল। নিজের বয়স ও সম্মান ভুলে তার কখনওই এরকম আচরণ করা ঠিক হয়নি। কেন এত বড়ো ভুলের পথে পা বাড়াল সে! এখন তো এর মাশুল গুনতেই হবে। নিজের হূদস্পন্দনও তার কানে আসছিল।

ঘরের মধ্যের দমবন্ধ ভাবটা কাটিয়ে তখনই মৃদুলা হেসে বিজনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘বাবা, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।‘ বিজন খুব বিব্রত চোখে দেখল মৃদুলাকে। মৃদুলা হাসি ধরে রেখে বলল, ‘আজকাল তোমরা দুজন আর একসঙ্গে কোথাও বের হও না কেন?’

দুজনের কেউ-ই এই প্রশ্ন আশা করেনি। চমকে উঠে দুজনেই দুজনকে দেখল। খানিকক্ষণ ঘরে যেন হাওয়াবাতাস বন্ধ হয়ে রইল। তারপর বিজনই নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, ‘সময় কোথায় পাই মৃদু?’ মৃদুলা হাসল না, বলল ‘কথাটা আন্টি বললে মানা যায়। নিজের চাকরি ছাড়াও তার অনেক কাজ। তা সত্ত্বেও তো উনি সময় বের করতেন।’

মৃদুলার এমন স্পষ্ট কথায় লজ্জা পেল বন্দনা। চোখ তুলে একবার মৃদুলার দিকে তাকাতেই তার চোখে দুষ্টুমির রং দেখতে পেল সে। ‘আচ্ছা, সে না হয় ঠিক আছে! কিন্তু, আগে বলো, আমাদের দুজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরা করাটা কি তোমার অপছন্দ?’ জিজ্ঞেস করল বন্দনা।

‘একদম নয়,’ মৃদুলা বলল।

মৃদুলা নয়, বরং মা-হারা এক মেয়ের গলায় ভালোবাসা আর স্নেহের চাহিদা ঝরে পড়তে দেখল বন্দনা। তার চোখদু’টিও আবেগে ভিজে এল।

‘বাবা, তুমি নিজেই জানো না, তুমি কতটা অসুস্থ!’ একথা বলেই মৃদুলা বন্দনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আন্টি ওই দিনগুলোতে বাবার চেহারায় কত জৌলুস ছিল! যেন নতুন জীবন পেয়েছে বলে মনে হতো! অথচ, এখন…।’ মৃদুলার কথায় বিজনের দিকে তাকাল বন্দনা। মৃদুলা ঠিকই বলেছে, একই অনুভবের সাগরে সে ও বিজন দুজনেই সাঁতার কেটেছে এতদিন।

‘আর এখন…।’মৃদুলা তার বক্তব্য জারি রাখে, ‘বাবা বিকেল থেকে মনমরা হয়ে বসে থাকে। হয় টিভি দেখে, নয়তো বাসি খবরের কাগজটাই দু’বার, তিনবার করে পড়ে। বাবার মনমরা ভাবটা তুমিই দূর করতে পারো আন্টি।’

বন্দনার মনে হল, মৃদুলাকে যতটা বালিকা ভাবত সে ও বিজন, সে ততটা ছোটো আর নেই। বন্দনাকে, তার এই পরিণত বয়সেও একরাশ লজ্জা যেন ঢেকে ফেলল। তার বিব্রত ভাব কাটাতে এবার বিজনই বলে উঠল, ‘মৃদু, বাকি জীবন একসঙ্গে চলার ফয়সালা তো আমরা করেই ফেলেছি! আমাদের সিদ্ধান্তকে তুমি কীভাবে নিলে সেটাও একবার আমরা যাচাই করে নিতে চেয়েছিলাম।’

‘বাবা…,’ মৃদুলা খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠে এক হাতে বিজন, অন্য হাতে বন্দনার হাত ধরে বলে উঠল  ‘আমি একলা থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছি বাবা। আমারও মায়ের হাতের ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করে…।’ মৃদুলার চোখের কোনে টলটল করা জল বন্দনার মাতৃহূদয়কে উদ্বেল করে তুলল। হঠাৎ-ই মনে হল, এই ভালোবাসার জন্য এতকাল মরুভূমি হয়ে ছিল তার মনের ভিতরটা।

মৃদুলা পাশের ঘরে চলে যেতেই বিজন বলল, ‘বন্দনা, তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?’

‘কীসে আপত্তি?’ খুব অবাক চোখে বিজনের দিকে তাকিয়ে বলল বন্দনা। আবার একটা পাকদণ্ডির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বন্দনা। কিন্তু এই পথটা যেন তার আর অচেনা ঠেকছে না।

‘না, মানে…।’ কোনওমতে বলল বিজন।

‘আর না-মানে, না-মানে করতে হবে না। অনেক হয়েছে, এবার ওঠো। মৃদুলাকে নিয়ে আজ রাতের খাবারটা বাইরেই সারব। দেখলে না মেয়েটা কত দুঃখী!’

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব