ঝিলমিল

ঝিলমিল তার বাবা, মা আর প্রতিবেশী কয়েজন বন্ধুবান্ধবের সাথে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছে। ঝিলমিল ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, তাই ধরাবাঁধা জীবনের থেকে কটা দিন মুক্তি। সবাই সহমত হয়ে জল-জঙ্গল দেখবার আকর্ষণে মেতে উঠেছে। লঞ্চের নামটাও কি সুন্দর, মালঞ্চ। টুরিস্টরা যখন ভয়ে ভয়ে পদক্ষেপ ফেলছে, ওঠানামায় সাহায্যের দরকার হচ্ছে, সেখানে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেগুলো এ-লঞ্চ ও-লঞ্চ অনায়াসেই টপকে যাচ্ছে। যেন জলেই ওদের জন্ম হয়েছে।

গদখালি থেকে যখন লঞ্চ ছাড়ল তখন চারদিক সোনা রোদে চিকচিক করছে। বিদ্যাধরীর পাড়ে পাড়ে সুন্দরী, বাইন, হেতাল আর গর্জনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে সবুজের হাতছানি। সবাই মনোনিবেশ করে আছে যদি দক্ষিণরায়কে দেখা যায় কিন্তু তাকে দেখা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। একটা বাজপাখি ছোঁ মেরে একটা মাছকে ওঠাতেই ঝিলমিল হাততালি দিয়ে বলে উঠল, আরে দ্যাখো দ্যাখো বাজপাখি এখন জেলে হয়ে গেছে।

উঁচু ক্লাসে পড়া রাহুল বিবেচকের মতো বলল, আরে ওটা ওদের খাদ্য খাদকের সম্পর্ক। মাছ খাদ্য আর বাজপাখি খাদক। ঝিলমিলের মা ঝলমলে হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ওই দ্যাখো কাকের কাণ্ড দ্যাখো। বাজপাখির নেওয়া মাছটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল! রাহুল বিজ্ঞের মতো বলল, প্রকৃতির বুকে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম চলছে।

এই সবকিছুর মাঝে টুর কোম্পানির রান্নার বউ কমলা ওদের জন্য গরম ভাতের সঙ্গে ঝুরি আলুভাজা, মুগডাল, চিকেন কষা আর টম্যাটোর চাটনি রেঁধে ফেলেছে। লঞ্চের ডেকের ওপর সুন্দর আযোজনে লাঞ্চ সারা হল। সবাইকে খাইয়ে সার্ভিস বয় মিঠুন সবার অনুরোধে নদী আর বনবিবিকে নিয়ে লোকসঙ্গীত গাইল। ওর অকৃত্রিম মেঠো সুর সবাই খুব উপভোগ করল।

পাখিরালয়ে পাখিরা হোটেলে সবার থাকার ব্যবস্থা। ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে নেমে গেল। পলিতে জল পড়ে জায়গায় জায়গায় পিচ্ছিল, ওরকম একটা রাস্তা পেরিয়ে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে ঝাঁ চকচকে একটা হোটেলে পৌঁছোনো গেল। সবার ছোটো দিব্য আর ঝিলমিল তো ঘুমিয়ে কাদা। হোটেল ম্যানেজারের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সবার মন ভরে গেল। তবে রান্নার দাযিত্ব সেই কমলা আর ওর স্বামী ফটিকের।

সন্ধেবেলায় সুন্দর সময় কাটানোর জন্য বসল বাউল-গানের আসর। চরম দারিদ্র‌্যের মধ্যে থেকেও গানের কলিতে ওরা আপ্রাণ ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে গেল। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর পূর্ণিমার আলোয় সে বাউল-গান, মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় সুরধ্বনি।

ছোট্ট দিব্য বেশ চাঙ্গা হয়ে বাউলদের নাচের দলে ভিড়ে গেল। দিব্যর বাবা ছেলের নাচের ভিডিও তুলছেন। কমলাও এসে দাঁড়িয়েছে, ওর কোলে তার আট মাসের সন্তান নয়ন। রুজির তাগিদে ওদের সপরিবারে জলে ভেসে থাকা।

রাতে কাঁকড়ার ঝোল মেখে ভাত খেতে খেতে রাহুল মস্করা করল, বুঝলে সবাই আমরা সর্বোচ্চ সারির খাদক তথা সর্বভুক। ডাল আলুভাজাও খেলাম, আবার কাঁকড়াও খাচ্ছি। সকলে এ বিষয়ে ওর সঙ্গে সহমত হল।

দিব্য আর ঝিলমিলকে তাদের মাযেরা ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে। বাইরে দরজার কাছে একটা নেড়ি আর তার বাচ্চা লেজ নেড়ে নেড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। দিব্যর বাবা কিছুটা মাখা ভাত নিয়ে নেড়িকে খাওয়াতে গেলে, দিব্য আর ঝিলমিলও খাওয়া ফেলে ছুটল। সব বাচ্চার মতো দিব্য আর ঝিলমিলও পশুপাখি ভালোবাসে।

নেড়ি ভাত খাচ্ছে, ঝিলমিলরা নেড়ির বাচ্চাকে আদর করছে। খাওয়া শেষ হতে যে যার রুমে ফিরল। শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কমলা, ফটিক, মিঠুন আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে আগুন পোহাচ্ছে। দিব্য আর ঝিলমিলের সে দৃশ্য দেখারও ইচ্ছে ছিল, মায়ের বকুনি খেয়ে ফিরতে হল।

পরদিন সকালে কুয়াশা কেটে গেলে ওদের গন্তব্য হবে সুধন্যখালি, যেখানে সাতটা নদী এসে মিশেছে। শরীরের ক্লান্তি আর পরদিন ভোর ভোর ওঠার তাড়ায় সবাই ঘুমোতে গেল।

ঝিলমিল মায়ের কোল ঘেঁষে বালিহাঁসের ডাকে চমকে চমকে উঠছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর বাবা পরেশ সেনের নাক ডাকা। মায়ের আদরের থাবড়ানিতে ঝিলমিল ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঝিলমিল জলের স্বপ্ন দেখল, সে যেন একা একটা নৌকায় কোথায় ভেসে যাচ্ছে।

 

পরদিন কুয়াশা না কাটতে মিঠুন এসে জানিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করতে হবে না, লঞ্চ সকাল দশটার আগে ছাড়বে না। অতএব সবাই বেরোল স্থানীয় বাজারে মধু কিনতে আর খেজুরের রস খেতে। সুন্দরী, বাইন আর গর্জনের ছোটো ছোটো চারাও পাওয়া যাচ্ছিল। দিব্যর খুব ইচ্ছে ওই চারাগুলো দিয়ে ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে একটা জঙ্গল বানায়। অনেক করে বোঝানোর পর একটা খেলনা বাঘ হস্তগত করে ওর বায়না থামল।

সুন্দরবনে মধুরই মাহাত্ম্য, তারল্য বেশি খাঁটি মধু। আর একে সংগ্রহ করতে গিয়ে ওদের পরিবারে কতই না বিষাদের ইতিহাস। কখনও সাপের কামড়ে, কখনও কুমীরের কবলে কখনও বা বাঘের পেটে চলে যাওয়া। অনায়াসে সবকিছু পাওয়ার জীবন ওদের নয়, বড়ো কষ্টের ওদের যাপন।

পরেশ সেনদের গোটা দলটাই ফেরিঘাটে লঞ্চে উঠল। সকালের জলখাবারে ছাতুর কচুরি আর কাবলি চানার ঘুগনি। ডেকের ওপর নদীর শোভা, লঞ্চ-জাহাজের যাতায়াত দেখতে দেখতে খাওয়া এক অনন্য অনুভূতি। দিব্য একটা কচুরি নিয়ে হাঁ করে বসে রইল। ঝিলমিলকে আজ বেশ চনমনে লাগছে, রাহুল যথারীতি প্রাজ্ঞ, অনুসন্ধিৎসু।

প্রায় দু-ঘন্টা নদীবক্ষে ভেসে থাকার পর এল দোবাঁকি। প্রত্যেকেরই আশা যদি হঠাৎ করে দক্ষিণরায়কে দেখা যায়। কারণ এখানে হোগলা আর হেতালের মাঝে একটা বড়ো পানীয় জলের জলাশয় আছে। আহা কি অপূর্ব, সেই জলাশয় ঘিরে চিতল হরিণ আর বালি হাঁস বিচরণ করছে। দিব্য হাততালি দিয়ে খুশিতে বলে উঠল, কত হরিণ, একটা বাড়ি নিয়ে যাব, পুষব!

দলের প্রধান খাদ্যরসিক মন্ডলদা বলে উঠলেন, হরিণের মাংস দারুণ স্বাদের, একসময় কত খেয়েছি। দিব্য আর ঝিলমিলের একটুও পছন্দ হল না মন্ডলকাকুর কথা। প্রাণভরে ছবি তুললেন ঝিলমিলের বাবা। অনেকগুলো লঞ্চ একসঙ্গে আসায় বেশ ভিড় জমে গেছে। শান্ত প্রকৃতি এই কোলাহলে বিরূপ হচ্ছে, তবুও সইতে হচ্ছে। একটা জিনিস ভালো লাগার মতো যে, কেউ এদিক ওদিক ময়লা ফেলছে না।

ঝিলমিল একবার জঙ্গল, একবার হরিণের দল আর নদীর দিগন্ত জোড়া বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে সবাই লঞ্চে ফিরে এল। এবারের গন্তব্য ঝড়খালি।

লঞ্চে পাঁঠার মাংস, ভাতের বিপুল আযোজন কমলার কল্যাণে। অসম্ভব সুন্দর স্বাদে সবাই পরিতৃপ্ত। দিব্য আর ঝিলমিল তাদের পছন্দের মাংসের মেটে পেয়ে গেছে, ওদের আর পায় কে!

ঝড়খালিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে বুড়ো অসুস্থ বাঘ দেখে ঝিলমিলের মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে গডের কাছে ওদের জন্য অনেক প্রে করল। কুমীর দেখে সবাই খুব খুশি হল, কারণ ওদের বেশ চনমনে লাগছিল। পাখিরালয়ে ওদের হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে গেল।

প্রতিদিনের মতো আজ ঝুমুর নাচের ব্যবস্থা। কী সুন্দর স্থানীয় মহিলারা নাচল সেই শ্রমসাধ্য নাচ! কাহিল হয়েও মুখের হাসিটুকু ধরে রাখল। দিব্য, ঝিলমিল, রাহুল, এমনকী দিব্য আর রাহুলের মা-ও নাচে অংশ নিল ওদের ডাকে। খুশি হয়ে যে যা দিল তাই নিয়ে ওরা হাসিমুখে চলে গেল।

ওরা বাড়ি ফিরবে কেউ পায়ে হেঁটে কেউ বা সাইকেলে। ঝিলমিল কমলার বাচ্চাকে কোলে তুলতে চেষ্টা করছে আর সে মায়ের কাছে থাকবে বলে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে। কমলার হাতের পারশের ঝাল খেয়ে হাত চাটতে চাটতে সব পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। সবার এই পরিতৃপ্তিটুকু কমলা উপভোগ করছে।

পরদিন সকাল নটা নাগাদ সবাই হোটেল ছাড়ল। ফিরতে হবে, তাই সবার মন খারাপ! ডেকের ওপর যে-যার মতো গল্প করছে। দূরে বকের সারি, জলের স্রোত, আকাশের ছড়ানো রোদ সবাই যেন বিদায় জানাচ্ছে। বাতাস কানে কানে বলে যাচ্ছে আবার এসো কিন্তু। বকশিশের টাকা হাতে করে কমলার চোখেও জল। দিব্য, ঝিলমিল মিঠুনের দুপাশে জমিয়ে বসে জল-জঙ্গল, রয্যাল বেঙ্গল টাইগার আর বনবিবির গল্প শুনছে।

গদখালি পৌঁছোতে প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে তাই লাঞ্চের ব্যবস্থা লঞ্চেই। কমলা ওর কচিটাকে নিয়ে ব্যস্ত রান্নায়। লঞ্চ চালাচ্ছে যে-ছেলেটা ওর চোখেমুখেও বাড়ি ফেরার ছটফটানি। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, জোয়ারের টানও ভালো আছে তাই লঞ্চ তরতরিয়ে চলেছে।

 

হঠাৎ একটা ঝুপ শব্দ। আরে ঝিলমিল পড়ে গেল যে জলে, সবার মিলিত আর্তনাদের মাঝে ‘মা মা গো আমি ডুবে যাচ্ছি’।

কমলা সেই ডাক শুনে এসে কোলের ছেলেটাকে নামিয়ে রেখে ঝাঁপ দিল জলে। সবাই আতঙ্কিত, কমলা জল তোলপাড় করে ফেলছে, হ্যাঁ হাতে একটা কিছু ঠেকল ওর, আরে এ তো ঝিলমিলের চুল। তাই ধরেই টেনে তুলল কমলা, নিজের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। হ্যাঁ কমলা পেরেছে ঝিলমিলকে জলে ডুবে যাওয়ার থেকে বাঁচাতে।

ডেকের ওপর ওঠানোর পর মিঠুন ঝিলমিলের গিলে ফেলা জল ওকে শুইয়ে চাপড় মেরে মেরে বার করল। একটু সুস্থ হতে ঝিলমিলকে গরম দুধ খাওয়ানো হল কিন্তু আতঙ্কে ও পুরোপুরি ট্রমাটাইজড। ঝিলমিলের মা এখনও কেঁদে চলেছে। ফেরার অভিজ্ঞতা সকলের জন্য ভীষণ খারাপ হল।

কমলা সকলের খাওয়ার বন্দোবস্ত করল, ও যে এত বড়ো একটা কাজ করল তা ওর মুখ দেখে এখন বোঝবার উপায় নেই। খাওয়াদাওয়া মিটলে ঝিলমিলের বাবা কমলাকে কিছু টাকা দিতে চাইলেন। কমলা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার ছেলে যদি জলে পড়ে যেত, আমি কি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না! সেরকমই তো, মাফ করবেন আমায়। এ টাকা আমি নিতে পারব না। কমলার ওপর কৃতজ্ঞতায় সবার অন্তর ভরে ওঠে।

তুমি আমার যে-উপকার করলে, তা সাত জন্মেও শোধ করতে পারব না, বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে ঝিলমিলের মা। কমলা শান্ত ভাবে বলে, এতে উপকারের কিছু নেই। আপনারা আবার এখানে বেড়াতে আসবেন আর আশীর্বাদ করুন আমার নয়নকে যেন ঠিকমতো মানুষ করতে পারি।

ঝিলমিল ওর কানে এখনও জলের গর্জন শুনছে আর কমলামাসিকে মিঠুনদার গল্পের বনবিবির মতো লাগছে, যে তাকে উদ্ধার করছে।

 

সুন্দরবনের ঘটনার পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরেশবাবু সপরিবারে অনেকবার এসেছেন সুন্দরবনে। মালঞ্চ লঞ্চটা খুঁজে পেলেও কমলাকে আর খুঁজে পাননি তাঁরা। বিশেষ করে মায়ের কাছে ওই দুর্ঘটনার বিবরণ বারবার শুনতে শুনতে কমলাকে দেবীর আসনে বসিয়ে রেখেছে ঝিলমিল। যার জন্য সে পঁচিশটা বসন্ত পার করতে পেরেছে, না হলে তো দুর্গাদোয়ানি নদীতে কবেই ওর সলিলসমাধি ঘটে যেত।

কমলামাসির মুখটা ঝিলমিলের হালকা মনে পড়ে, তার চেয়ে বেশি মনে পড়ে জলের মধ্যের সেই দমবন্ধ পরিবেশ, যা অনেক দিন ওকে তাড়া করেছিল।

ঝিলমিল এখন ডাক্তারির চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী। কত জলে ডোবা রোগী আসে। কাউকে বা আনা হয় মৃত অবস্থায়। তখন ঝিলমিল আঁতকে ওঠে! মনে মনে ভাবে তারও তো এই অবস্থা হতে পারত, হয়নি যে তা ঈশ্বরের নয় কমলামাসির দান।

ঝিলমিল ভাবে, এবারে যে করেই হোক কমলামাসিকে খুঁজে বের করতেই হবে। নিশ্চয়ই এখন বয়স হয়ে গেছে, একবার দেখা করতেই হবে। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, ঝিলমিলদি একবার আসুন ডাক্তার কনক বসু আপনাকে তাড়াতাড়ি ডাকছেন। বলেই সিস্টার বোস ছুট লাগালেন।

ঝিলমিল ডাক্তার কনক বসুকে খুঁজতে খুঁজতে এমার্জেন্সিতে হাজির হল। আরে এখানটা এত লোকে লোকারণ্য কেন? মানিকতলায় একটা মেলা চলছে, সেখানে গ্যাস বার্স্ট করে কয়েজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে তাদেরকে আনা হয়েছে ঝিলমিলের হাসপাতালে।

সেই ভিড় থেকে একজন বয়স্ক মানুষ ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে এল। তুমি ঝিলমিল দিদিমণি না, আমাকে চিনতে পারছ? আমি কমলার স্বামী ফটিক, সেই তুমি সুন্দরবন বেড়াতে এসে জলে ডুবে যাচ্ছিলে মনে আছে?

কমলামাসি কোথায়? ঝিলমিলের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল কথাটা। ফটিক ইশারায় মেঝের বিছানায় শুয়ে থাকা অর্ধদগ্ধ এক মহিলাকে দেখাল।

অগ্নিকাণ্ডে কমলা মারাত্মক জখম হয়েছে তাদের মেলায় দেওয়া চপের দোকানে। ঝিলমিল আর অপেক্ষা করেনি, চেষ্টা করে কেবিনে ভেন্টিলেশনে রেখে চিকিৎসা করছে কমলামাসির। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে ঝিলমিল, নয়নের মাকে যেন নয়নের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। যেমন করে একদিন কমলামাসি ফিরিয়ে দিয়েছিল ঝিলমিলকে তার মায়ের কোলে।

 

শিকার

শেষ রাতের আবছা অন্ধকার। লোকটা এক বুক ঘৃণা আর আদিম এক প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বন্দুকটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে। আজ সে দৃঢ়সংকল্প। খতম করবে ওই নোংরা লোভী আর তস্কর জীবটাকে! তার হাত থেকে নিস্তার নেই বাছাধনের।

দিন দিন ওর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। পোলট্রির অর্ধেক মুরগির বাচ্চা খেয়ে সাবাড় করেছে এই ক’দিনে। এভাবে চললে পোলট্রির সব মুরগি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। আর তার এতদিনের লাভবান ব্যাবসা বন্ধ হয়ে, সে দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যাবে। তাই আজ একটা শেষ নিষ্পত্তি সে করবেই!

ভোর হবার এখনও অনেক দেরি। অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে লোকটার স্নায়ুগুলো কিঞ্চিৎ শ্লথ। আর কিছুক্ষণ পরেই পুবদিকের আকাশ হালকা হবে। আর হালকা হলেই সে বেরুবে রোজকার মতো।

মুরগির বাচ্চাগুলো কারা যে খেয়ে যাচ্ছে তা প্রথমে বুঝতে পারেনি লোকটা। বহু ঘুমহীন রাত অপেক্ষা করে ওত পেতে শেষে সে বুঝতে পারে শিয়াল না, খটাশ না একটা কালো হুতুম পেঁচাই ঘাতক। তার সমস্ত মুরগির বাচ্চা খেয়ে যাচ্ছে।

আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর লোকটা জেনেছে পোলট্রির পেছনে কিছুটা দূরে যে বুড়ো খিরিশ গাছটা আছে তার একটা উঁচু মোটা ডালের কোটরে সে থাকে। ওরা দুজন। একটা ছেলে অন্যটা মেয়ে পেঁচা।

এতক্ষণে পুবদিকের আকাশ ফিকে হতে শুরু করেছে। একটা লালের আভা। এবার পেঁচাটার বেরুবার সময়। আবছা অস্পষ্টতার বুক চিরে একটা বিশ্রি কর্কশ ডাক ভেসে এল। শয়তান পেঁচাটার ডাক। লোকটা সতর্ক হয়। হাতের মুঠোর বন্দুকটা শক্ত হাতে চেপে ধরে। এবার সে ওই ধূর্ত লোভী শঠ পেঁচাটাকে নির্দয়ভাবে মারবে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে, তার সীমাহীন অপরাধ আর কৃতকর্মের জন্য।

পেঁচাটা তার কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে পাখনাটা মেলে সে উড়ে আসছে, পোলট্রি ঘরের চালার মাথায়। যতটা শব্দ কম করা যায় সেইভাবে নিঃশব্দে উড়ে আসছে। এই আবছা অন্ধকারে উড়ন্ত টার্গেটকে গুলি করা মুশকিল। তবুও লোকটা আজ বদ্ধপরিকর। ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে কালো ছায়াটা যখন উড়ে যাচ্ছে, তখনই বন্দুকের ট্রিগারটা সে টিপে দিল অনেকটা আন্দাজে। নিশানা ব্যর্থ হয়েছে মনে হয়। কারণ মাটিতে আছড়ে পড়ার কোনও শব্দ বা ডানার ঝাপটানি তার কানে যায়নি।

পুব আকাশ আরও অনেকটা ফর্সা হয়েছে। লোকটা পায়ে পায়ে পোলট্রি ফার্মের দিকে এগোল। মুরগির বাচ্চাগুলো ঠিক আছে কিনা একবার গুনে এল। চারপাশটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিছু পড়ে আছে কিনা। আর ঠিক সেই সময় কাছে কোথাও ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে এল। প্রাণীটা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। লোকটার মন আনন্দে ভরে গেল। যাক তাহলে নিশানা ব্যর্থ হয়নি। শিকার গুলি খেয়েছে। অব্যক্ত বর্বর এক জিঘাংসায় তার মন ভরে গেল।

কাছে গিয়ে লোকটা দেখল, পেঁচাটা বেশ বড়ো সাইজের। মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। বৃথা চেষ্টা করছে ওড়বার। ওর ধূসর রঙের ডানা দুটোর একটাতে গুলি লেগেছে। সে ডানাটা অকেজো হয়ে দেহ থেকে ঝুলছে। সারা ডানাটা মাটি আর রক্তে মাখামাখি। ওর বিশ্রি গোল মুখের হলদেটে চোখদুটোতে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। লোকটা দেখল, সে চোখে হিংস্র একটা বিদ্বেষ আর ক্রোধ জমা হয়েছে।

এখন আর আলো আঁধারির অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার ভোর। আর সেই ফুটে ওঠা ভোরের আলোয় পেঁচার সঙ্গে মানুষের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হল। দুজনের চোখে বিজাতীয় হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর জিঘাংসা কাজ করছে। কিন্তু লোকটার চোখে অতিরিক্ত কিছু একটা ছিল। তা হল শত্রু নির্যাতনের উৎকট আনন্দ আর পরিতৃপ্তি!

আহত প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে অপরিসীম ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লোকটা বলে উঠল, ‘কিরে কেমন জব্দ! কেমন লাগল গুলি খেতে? আর একটা গুলি খাবি?’

পেঁচাটা তার ভালো ডানাটা ঝাপটে মাটি থেকে একটু ওঠার চেষ্টা করল। কিছুটা উঠেই আবার পড়ে গেল মাটিতে। পেঁচাটার এই ব্যর্থতা ও হতাশা দেখে লোকটা জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে।

এবার গলা বাড়িয়ে রাগে পেঁচাটা তেড়ে আসে লোকটার দিকে। তার পায়ের জুতোয় ঠোঁট দিয়ে জোরে ঠোক্বর মারে। লোকটা লাথি মেরে পেঁচাটাকে দূরে ফেলে দেয়। অসহায় ভাবে মড়ার মতো কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে পেঁচাটা।

লোকটা একবার বন্দুক দেখায়। পেঁচাটার চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। বন্দুকের নলটা তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খোঁচা দেয়। পেঁচাটার হলদে চোখদুটোতে শুধু জ্বালা। অসহায় আক্রোশ! কিন্তু ভয় কোথাও নেই।

প্রচণ্ড রেগে গেল এবার লোকটা। তার অহংকারে ঘা লাগল। সে মনে মনে স্থির করে ফেলল, এটাকে সে এখনই মারবে না। একে বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে যন্ত্রণা দেবে। যেমন কষ্ট সে পেয়েছে এত দিন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা নিয়ে। তেমনি করে একে দগ্ধে দগ্ধে যন্ত্রণা দিয়ে এর পাপের শাস্তি দেবে। এর ঔদ্ধত্য আর দম্ভকে চিরতরে ভেঙে দেবে!

জখম ডানাটা এড়িয়ে অন্য ডানাটা ধরে সে পেঁচাটাকে তুলতে গেল। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড আক্রোশে পাখিটা তার তীক্ষ্ণ নখ লোকটার হাতে বসিয়ে দিল। চামড়া ভেদ করে সুচলো নখ মাংসের অনেক গভীরে ঢুকে গেল। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। যতই সে চেষ্টা করে পেঁচাটাকে ফেলে দিতে, বিচ্ছিন্ন করতে তার শরীর থেকে, ততই তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। আঁচড়াতে কামড়াতে থাকে। লোকটার হাত থেকে রক্ত ঝরে। পেঁচাটার পালকে রক্ত। লোকটা এবার চেঁচাতে থাকে। শাপশাপান্ত করে। তার একবার মনে হয় গিয়ে দেয়ালের গায়ে জোরে আছাড় মারে জীবটাকে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। একে সে সহজে মারবে না। বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেবে। তারপর পরিশেষে চরম শাস্তিদান।

এবার সে দুটো হাত দিয়ে পেঁচাটাকে চেপে ধরে শক্ত করে। তারপর তার মুখে একদলা থুতু ছেটাল। পাখিটা বার দুই চোখ পিট পিট করল। কিন্তু ভয় পেল না একটুকুও। লোকটা রাগে কাঁপতে কাঁপতে তার ফার্ম হাউসের বারান্দায় এক কোণে ঝোলানো একটা বড়ো লোহার খাঁচায় পেঁচাটাকে ঢুকিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিল।

পেঁচাটাকে খাঁচাবন্দি করার পর লোকটা কিছুটা শান্ত হল। বন্দুকটা যথাস্থানে রেখে এল। তারপর জল দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফার্স্ট-এড বক্স বের করে আনল। প্রথমে সে রক্তাক্ত পাখিটার ডানা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিল। তারপর নিজের হাতেও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগাল। ব্যান্ডেজ বাঁধল।

সেদিন বিকেলে কাছের শহর থেকে কয়েকজন খদ্দের মুরগি কিনতে এল তার পোলট্রি ফার্মে। খাঁচার মধ্যে পেল্লাই ওই পেঁচাটাকে দেখে তো তারা তাজ্জব। জিজ্ঞেস করল, ‘এটাকে ধরলে কী ভাবে?’

লোকটা তার খদ্দেরদের কাছে পেঁচাটার যাবতীয় কীর্তিকলাপ খোলসা করে বলল। ব্যান্ডেজবাঁধা হাতটাও দেখাল। সব শুনে খদ্দেরদের মধ্যে একজন বলল, ‘এখন এটাকে নিয়ে কী করতে চাও?’

জবাবে লোকটা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘আমার হাতটা আগে ভালো হয়ে যাক। তারপর এটাকে গুলি করে মারব। পায়ের নখগুলো কেটে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখব স্মৃতি হিসেবে।’

পোলট্রি মালিকের মুখে এধরনের কথা শুনে খরিদ্দার লোকটির মনে দৃঢ় ধারণা হল, মুরগির বাচ্চার শোকে ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই। সে আর কথা না-বাড়িয়ে চলে গেল।

টুকিটাকি কিছু কাজ শেষ করে লোকটি আবার পেঁচাটার খাঁচার কাছে এল। খাঁচাটার দিকে তাকাতে তার গা রিরি করে উঠল রাগে। দেখল, পেঁচাটা তার দিকে স্থির ভাবে চেয়ে আছে। পায়ের নখ দিয়ে খাঁচার গা আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটা রেগে গিয়ে খাঁচাটা নামিয়ে নীচে বসাল। তারপর জোরে লাথি কষাল। পেঁচাটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তার চোখে অতলান্ত ঘৃণা।

সেদিন সারারাত লোকটা শুনতে পেল পেঁচাটা তার সাথিটাকে ডাকছে। ওপাশে গাছের আড়াল থেকে সাড়াও আসছে। লোকটার মনে খুব আনন্দ হল পেঁচাটাকে জ্যান্ত ধরতে পেরেছে বলে।

পরদিন সকালে উঠে লোকটা খাঁচার কাছে গেল। আজও সে পেঁচাটার চোখে কোনও ভয় দেখল না। আর সে জন্য সে হতাশ হল। হতাশা তাকে এক সময় ক্ষিপ্ত করে তুলল। সে চিৎকার জুড়ে দিল। ‘দাঁড়া, দাঁড়া। সবুর কর। আমি তোকে ভয় পাইয়েই ছাড়ব।’

লোকটা খাঁচাটা মাটিতে নামাল। খাঁচার বাইরে জল রাখল। খাবার হিসেবে একটা ছোট্ট মুরগির বাচ্চা। খাঁচার খুব কাছে কিন্তু পাখিটার নাগালের বাইরে। পেঁচাটা নির্বিকার চোখে সব দেখল। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় সে কাতর। তবু লোকটার চালাকি সে ধরে ফেলেছে। ভয় বা কাতরতা তাকে গ্রাস করল না। সে একটা বড়ো তাচ্ছিল্য খাঁচার বাইরের লোকটার দিকে ছুড়ে দিল।

এরপর আবার একদিন মুরগি কিনতে এক খদ্দের এল। ইনি বেশ সম্ভ্রান্ত। মনে হয় অপেক্ষাকৃত বড়ো ব্যবসায়ী। লোকমুখে পেঁচাটার কথা শুনে তিনি লোকটার কাছে প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনি পেঁচাটা আমাকে পাঁচশো টাকায় বেচে দিন। এতবড়ো সাইজের পেঁচা সাধারণত পাওয়া যায় না। রেয়ার। তাছাড়া আমার এজাতীয় রেয়ার পাখিদের একটা কালেকশন আছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবব, যদি ওটা আমাকে বেচেন।’

লোকটা ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘না মশাই। মাফ করবেন। আমি ওকে হাতছাড়া করতে চাই না।’

ক্রেতা ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, বোধহয় দাম পছন্দ হয়নি। তাই সে রাজি হচ্ছে না বেচতে।

‘আচ্ছা বেশ, আমি আপনাকে সাতশো টাকা দেব। তাহলে দেবেন তো?’

এতেও লোকটা রাজি হল না। ‘না, মাফ করবেন। আমি ওকে বেচব না।’

‘কিন্তু কেন? আমি যদি হাজার দিই?’

‘তাহলেও না। হাজার কেন, পাঁচ হাজার দিলেও না। ওটার জন্য আমার হাতের অবস্থা দেখেছেন? টিটেনাস ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। আমার ফার্মের অর্ধেক মুরগির বাচ্চা ও খেয়ে ফেলেছে।’

‘বেশ তো, বুঝেছি। ও আপনার অনেক ক্ষতি করেছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ও তো অবুঝ পাখি একটা। ও খিদের জ্বালায় আপনার ফার্মে ঢুকে মুরগির বাচ্চা খেয়েছে। অন্যায় তো কিছু করেনি। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। তাছাড়া অমন সুন্দর দেখতে’ –

লোকটার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। – ওই শয়তান পাখিটাকে আপনি বলছেন সুন্দর দেখতে! কি বিশ্রি চোখ ওর। ওকে আমি গুলি করে মারব।

‘তা হোক। রাগের মাথায় বোধবুদ্ধি হারিয়েছেন। একটা পাখিকে কেন অযথা গুলি করে মারবেন?’

‘মারব, মারব, নিশ্চয়ই মারব। ও আমার বড়ো শত্রু। নিজের হাতে ওকে শাস্তি দেব। আপনি এখন যান’-

বেচারা ভদ্রলোক বেগতিক দেখে কেটে পড়ে।

লোকটা এবার দিন গোনে। কবে ওকে খতম করবে। খতম করার আগে ওর মনোবল ভাঙতে হবে। ও আজকাল কিছুই খায় না। খাবারের দিকে তাকায় না। অথচ একদৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। যখন সে খাঁচার কাছে আসে পেঁচাটা একটা বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি ছোড়ে।

লোকটার মাথায় এক নতুন মতলব আসে। সেও আরও হিংস্র আরও ভয়ংকর প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরুষ পেঁচার মেয়ে সঙ্গীটি আজকাল প্রায়শই খাঁচার আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। কখনও দূরে পাঁচিলটার উপর এসে বসে। খুব সকালে কিংবা সন্ধের দিকে প্রায়ই ডাকে। কিন্তু পুরুষটি তেমন ভাবে সাড়া দেয় না। ভাবটা যেন একদম এদিকে আসিস না। লোকটা ভয়ানক বজ্জাত! হাড় শয়তান!

আজকাল লোকটা সব সময় নিজের হাতের কাছে বন্দুকটা রাখে। সাবধানে থাকে। ওত পাতে। সুযোগ এলে যেন ফসকে না যায়। প্রথমে সে মাদি পেঁচাটাকে শেষ করে পুরুষটির সামনে ফেলবে। দেখতে চায় ওর যন্ত্রণা হয় কি না! কষ্ট হয় কি না! তারপর তো ওর পালা!

সুযোগও এসে গেল অচিরেই। তিন-চার দিন পর। মেয়ে পেঁচাটা ক্ষুধা উদ্বেগ বা কৌতূহলে পুরুষ সঙ্গীটিকে খুঁজতে খুজতে খাঁচার কাছাকাছি চলে এসেছিল। তাকে দেখে পুরুষ সঙ্গীটি ঝটপট করছিল। তাকে কেমন উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মেয়ে সঙ্গীটির নিরাপত্তার কথাই কি সে ভাবছিল! লোকটাকে বিশ্বাস নেই। মেয়ে পেঁচাটা বার দুই ডেকে পাঁচিলের ওপর গিয়ে বসল। লোকটার কানে গেল সেই ডাক। ভোর হয় হয়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে বিছানায়। মুহূর্তে বন্দুকটা হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। ‘দাঁড়া, দিচ্ছি তোকে সাবড়ে!’ লোকটার ঠোঁটে ব্যঙ্গ। খাঁচায় বন্দি পেঁচাটা বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছে। সে এবার ডাক বন্ধ করে দেয়। প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। যাতে মেয়ে পেঁচাটা সাড়া না পেয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

কিন্তু লোকটা আর বিলম্ব চায় না। পাঁচিলের ওপর বসা মেয়ে পেঁচাটা তার নজরে এসেছে। অন্যদিন উড়ে যায়। আজ কিন্তু সে উড়ছে না। বৃথা কালক্ষেপ না করে লোকটা তাক করে মেয়ে পেঁচাটার দিকে। তার দোনলা বন্দুকের দুটো নলই সে ব্যবহার করে। একটা শব্দ, কিছু ধোঁয়া। মুহূর্তে মেয়ে পেঁচাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এবার আর আধমরা নয়। অব্যর্থ অমোঘ মৃত্যু।

লোকটার হাতে বারুদের গন্ধ। চোখে অদ্ভুত খুশি নিয়ে সে মেয়ে পেঁচাটার মৃতদেহ এনে পুরুষ পেঁচাটার খাঁচার সামনে ফেলে।

‘কিরে? দেখলি? দ্যাখ্ কেমন লাগে?’ লোকটার চোখ-দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে প্রতিশোধের আগুন।

খাঁচার বন্দি পাখিটা তার মৃত সঙ্গিনীটির দিকে একবার তাকায়। তারপর লোকটাকে দেখে। ওর হলদে চোখদুটোতে কোনও পরিবর্তন নেই। সেই সীমাহীন ঘৃণা আর অঢেল বিতৃষ্ণা! ওর ওই বুনো চোখদুটোতে লোকটা ভয় আনতে চেয়েছিল। ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে সর্বহারার হাহাকার বাজুক সেটাই চেয়েছিল লোকটা। কিন্তু না। তা হয়নি। কিন্তু লোকটা নিজেকে এবার পরাজিত ভাবল। সে ভেবেছিল খাওয়া বন্ধ করে, অত্যাচার চালিয়ে সঙ্গিনীকে নিধন করলে ওর মনোবল ভেঙে যাবে। ওকে ধবস্ত বিবর্ণ দেখাবে। তা না হওয়ায় লোকটা নিজের মনে পরাজয়ের একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল। এক সামান্য নিশাচর তস্কর পেঁচার কাছে সে হেরে গেল! লোকটা সদর্পে ঘরের মধ্যে ঢুকে তার দোনলা বন্দুকে আবার দুটো টোটা ভরে নেয়। বাইরে বেরিয়ে এসে সে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘শয়তান এবার তোকে শেষ করব!’

খাঁচার তারের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে বন্দুকের নলটা ঢুকিয়ে দিতে পেঁচাটা সরোষে এসে নলটাকে আক্রমণ করল। কিন্তু লোহার নলের কোনও ক্ষতি সে করতে পারল না। হতাশ হয়ে খাঁচার অন্যপাশে সরে গেল।

লোকটা বন্দুকের নলটা খানিকটা পেছন দিকে সরিয়ে আনল। যাতে পেঁচা থেকে বন্দুকের দূরত্ব যেন কয়েক ফুট থাকে। শেষবারের মতো সে ওই কুৎসিত বদমায়েশ লোভী বেয়াড়া পেঁচাটার চোখে কোনও অন্তিম ভয় আছে কিনা দেখল। না, কিছু নেই। শুধুই ঘৃণা। লোকটার সমস্ত বোধবুদ্ধি দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ক্রোধান্ধ হয়ে সে ট্রিগার টেপার পরিবর্তে সেটাতে একটা জোরে ধাক্বা দিয়ে বসল। গুলি রিবাউন্ড বা রি-কয়েল করা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। জিঘাংসাপ্রিয় রাগান্ধ লোকটির বিবেচনাতে সে কথা আসেনি। আর তাতেই ঘটল বিপদ।

প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি কী ব্যাপার হল। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটা অনুভব করল কি যেন একটা অকস্মাৎ ভয়ংকর তীক্ষ্ণ ও তীব্র আঘাত করল তার বুকে। সে আঘাতের তীব্রতা এতটাই ছিল যে লোকটা টলে পড়ে গেল। তার হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল দূরে। সে বুকে হাত দিয়ে দেখল তার হাত রক্তে ভিজে উঠছে। বুকে প্রচণ্ড আঘাত আর যন্ত্রণা অনুভব করল। নিশ্বাস আটকে আসছে। গলা দিয়ে গরম তরল লাল বর্ণের পদার্থ উঠে আসছে। চোখের সামনের পৃথিবীটা একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে।

অন্তিম অন্ধকার নেমে আসার আগে, সম্পূর্ণ চেতনাহীন হবার আগে লোকটা বুঝতে পারছিল ভয়ংকর দুর্ঘটনাটা কী ঘটেছে। খাঁচার ঠিক পেছনে যে সরু লোহার পাত ছিল, তাতে গুলিটা লেগে ঠিকরে এসে উলটো দিকে দাঁড়ানো তারই বুকে ঢুকেছে। শিকারি নিজেই শিকার হয়ে গেছে!

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! হঠকারিতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে পেঁচাটা শুধু বেঁচে যায়নি, গুলির আঘাতে লোহার খাঁচাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বন্দি পাখি এখন মুক্ত। পেঁচার জখম ডানাটা এই কদিনে অনেকটা ভালো হয়েছে। ভাঙা খাঁচা থেকে গুটি গুটি পায়ে সে বেরিয়ে এল। পিট পিট করে চোখ মেলে মরনোন্মুখ মানুষটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন আর তার চোখে কোনও ঘৃণা নেই। বিদ্বেষ নেই। অভিযোগের লেশমাত্র নেই। যা কিছু বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জিঘাংসা বা মানসিক বিকার সবই ওই লোকটার মধ্যেই ছিল।

 

একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।

 

অগ্নিশুদ্ধি

জাতীয় স্তরে খুব বড়ো করেই এবার প্রতিযোগিতার আসর বসানো হয়েছে। গল্পের প্রতিযোগিতা। দেশের প্রায় সব রাজ্য থেকেই ছোটো-বড়ো বহু গল্প জমা পড়েছিল। তারই মধ্যে পঁচিশজন লেখককে সনাক্ত করা হয়েছে যাদের লেখা পুরস্কার পেতে চলেছে। বিশাল আয়োজন। স্টেজের উপর বেশ কিছু লেখক চেয়ারে বসে রয়েছেন। লেখকদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রঞ্জন কর্মকার। গল্পটি একটি বাচ্চাকে নিয়ে।

অনাথ একটি বাচ্চা জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে কীভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবে তাই নিয়ে গল্প। গল্পগুলি যারা সিলেক্ট করেছেন সেই বিচারকদের মধ্যেই মাধবীও একজন। তিন বছর আগে এই সংস্থাই মাধবী-কেও বেস্ট রাইটার-এর খেতাবে সম্মানিত করেছিল। মাধবী প্রথম যখন গল্পটি পড়ে, খুবই প্রভাবিত হয় কিন্তু লেখকের নাম দেখে তার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে। রঞ্জন কর্মকার… এ সে-ই লোক নয়তো! মনের মধ্যে ঝড় ওঠে মাধবীর।

স্টেজে উপস্থিত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে মাধবী জিজ্ঞেস করে, অরুণদা এই রঞ্জন কর্মকারকে আপনি চেনেন? তার কোনও ছবি দেখাতে পারবেন?

মাধবী, তুমি তো জানো প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাবার নিয়ম নেই। নয়তো সংস্থারই বদনাম হয়ে যাবে যে চেনা লোকেদেরই এরা পুরস্কার দেয়।

মাধবী লজ্জিত হল, সরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কী ব্যাপার, বলো তো?

না না, সেরকম কোনও ব্যাপার নয়, জাস্ট কৌতূহল হল বলে জিজ্ঞেস করলাম, কথোপকথন শেষ করতে মাধবী তৎপর হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরতে হবে। আজকে এখানকার সব কাজ বসে শেষ করে ফেলেছে মাধবী।

বাড়ি পৌঁছেও মনের উপর একটা ভার চেপে বসেছে অনুভব করল সে। ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারল না। অদিতি এসে জড়িয়ে ধরল মাধবীকে একটু আদর পাওয়ার আশায়। কিন্তু মাধবীর মন আজ স্মৃতির পাতা উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে বর্তমানের পটভূমিকা ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। শুধু একটা নাম, যা মনের মধ্যে সংগোপনে রাখা আগুনের ফুলকিকে উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মাধবী তো ভুলতে বসেছিল সবকিছু কিন্তু ওই একটা নাম আবার অতীতের ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে দগদগে করে দিতে চাইল। মাথা ভারী মনে হল মাধবীর, লুকোনো একটা ব্যথা বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হচ্ছিল এই তো সেদিনকার কথা, যেটা ভুলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল ও মনে মনে। না চাইতেও পুরোনো স্মৃতির পাতাগুলো একটার পর একটা খুলে যেতে লাগল চোখের সামনে।

 

দেয়াল ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠতেই মাধবী দৌড়ে জানলাটার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। লোকটা এত রাতে কোথায় কে জানে। এখন তো এটাই মাধবীর জীবনে রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত লোকটার অপেক্ষায় ঘড়িতে সময় দেখে কাটানো। অথচ লোকটার এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই।

মাধবী প্রথমে ঘড়ি দেখত, তারপর জানলা খুলে রাস্তা, যদি লোকটাকে দেখতে পায়। আজও রাস্তা ফাঁকা, বহুদূর পর্যন্ত একটা মানুষও ওর চোখে পড়ল না।

প্রায় দেড়টা বাজতে যায়, দরজায় ধাক্কা শুনে উঠে এল মাধবী। দরজা খুলতেই টলোমলো পায়ে লোকটা ভিতরে ঢুকে এল।

আজকে তুমি আবার এক গলা খেয়ে এসেছ? রাগে, দুঃখে মাধবীর চোখে জল চলে এল।

হ্যাঁ খেয়ে এসেছি। তোমার বাবার টাকায় তো খাইনি। অশ্লীল ভাষায় আরও দুটো গালমন্দ করে লোকটা থামল।

কেন এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছ?

নষ্ট করতে! পাগলের মতো হেসে উঠল বাহ্যজ্ঞানশূন্য লোকটা। জীবনটা স্বস্তি দিলই কখন? যবে থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছ, আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছে।

কেন কী এমন করেছি আমি? মাধবী জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কী চাই।

কিন্তু সেটার জন্য আমি কী করতে পারি? ক্লিনিকে গিয়ে তো নিজের চেক-আপ করিয়েছিলাম। মা হওয়ার জন্য আমি সব দিক থেকে সক্ষম। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে দুজনের চেক-আপ…

কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে, তুমি কি মনে করো আমি নপুংসক? সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার?

আমি একথা কখন বললাম? আমি খালি…

নিজেই নিজের ঝোল টানছ? বেয়াদপ মেয়েছেলে, আরও একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে।

তুমি যদি চাও আমি ঠিকমতো ব্যবহার করি তাহলে আমার যা চাহিদা সেটা পূরণ করো। পাঁচবছর আমাদের বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত বাচ্চার কান্না-হাসিতে বাড়িটার শূন্যতা ভরল না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে। আর আমি সহ্য করতে পারছি না।

তুমি চেক-আপও করাবে না আর আমাকে বাচ্চার জন্য জোরও দেবে! এটা কি আমার একার পক্ষে সম্ভব? মাধবী বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি শুধু রেজাল্ট চাই ব্যস, গলার আওয়াজ জোরালো হয়।

শোনো না, আমরা অনাথাশ্রম থেকেও তো বাচ্চা নিয়ে এসে মানুষ করতে পারি, সাহস জুটিয়ে বলে মাধবী।

কী বললে, আর একবার বলো, অনাথাশ্রমের বাচ্চা?

ক্ষতি কী?

মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। লাথি, চড়, ঘুঁসি এসে পড়ে মাধবীর উপর। এতেও লোকটার রাগ শান্ত হয় না। মাধবীর হাত ধরে টানতে টানতে দরজা খুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। পিঠে একটা লাথি মেরে মাধবীকে রাস্তায় ফেলে দেয়, আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ। যেখানে যেতে ইচ্ছে করে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। বাঁজা কোথাকার।

লোকটার মুখের এই অশ্লীল শব্দ, মাধবীর কানের মধ্যে যেন গরম তরল লোহা ঢেলে দিল। রাস্তাতেই পড়েছিল সে, হঠাৎই শরীরে উপলব্ধি করল এক দুর্জয় শক্তি। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বাঃ বাঃ খুব ভালো, ভালো লাগল নারীবাদী লেখকের মুখে এমন কথা শুনে। অথচ নিজের বাড়ির মেয়েদের প্রতি যার মনে এতটুকু সম্মান নেই। যাও যাও বাড়ির এই গল্পটাও লিখে ফেলো। তোমার দুঃখের কাহিনিটা-ও সকলকে জানাও, তবেই না তোমার জয়জয়কার হবে।

আমাদের মতো পুরুষপ্রধান দেশে মেয়েদের নিয়ে গল্পই খালি লেখা হয়। তোমার লেখাটাও আর একটা গল্প যোগ করবে। কিন্তু মনে রেখো রঞ্জন কর্মকার, সন্তানের মুখ তুমি কোনও দিনই দেখতে পাবে না। পারো তো একবার গিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নিও। হাজার বার বলব তুমি নপুংসক। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে বাড়ি থেকে কী বার করবে, আমি নিজেই এই নরকের পরিবেশ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, যেখানে তোমার মতো লোকের ছায়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।

রঞ্জন পাথরের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাধবীকে আটকাবার কোনও চেষ্টাই করে না। জনশূন্য রাস্তার নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে মাধবী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।

 

আজ চোদ্দো বছর পর ওই ফেলে আসা নামটা আবার মাধবীর চোখের সামনে অক্ষর হয়ে এসে দাঁড়াল। এতগুলো বছর মাধবীকে কম লড়াই করতে হয়নি। কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সব মনে আছে ওর, লোকের বাড়িতে কাজ করেছে পর্যন্ত। একটাই ভালো হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অরুণ বসুর আশীর্বাদধন্য হতে পেরেছে মাধবী। তাঁরই উৎসাহে এ কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা বই লিখে বেশ নাম করেছে মাধবী। অবশ্য লেখাগুলো সবই মধুমালতী ছদ্মনামে। অরুণ বসুই প্রকাশনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মাধবী যথেষ্ট জনপ্রিয় লেখিকা এখন। অর্থের কোনও অভাব আর নেই মাধবীর। নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে অনাথাশ্রম থেকে একটি শিশুকন্যাও দত্তক নিয়েছে সে। বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু রঞ্জন কর্মকারের নামটা ওর চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়ে সব কেমন এলোমেলো করে দিল। মন খালি বলছে, এটা হওয়া সম্ভব নয়। একই নামে বহু লোক আছে এই পৃথিবীতে। সুতরাং এ কিছুতেই অতীতের সেই রঞ্জন নয়।

ফোনটা বেজে উঠতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল মাধবীর। অরুণ বসুর নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ফোন তুলতেই অরুণবাবু জানালেন, লেখক সংগঠন থেকে ঠিক করা হয়েছে, রঞ্জন কর্মকারের হাতে প্রথম পুরস্কার তুলে দেওয়ার দাযিত্ব মাধবী তোমাকে নিতে হবে।

অবাক হল মাধবী, যেটাই এড়াতে চায় সেটাই আরও বেশি করে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ফোনেই মাধবী জানাল, সেদিন ওর পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু অরুণবাবু জোর দিলেন, ডাকযোগে লেখকদের জানানো হয়ে গেছে যে, মাধবী-ই সেদিন পুরস্কার দেওয়ার দাযিত্বে থাকবে।

কিন্তু এটা ঠিক করার আগে একবার আপনি কেন আমাকে জানালেন না? বিরক্তির স্বরে মাধবী জিজ্ঞেস করল।

এটা কী ধরনের কথা মাধবী! লোকে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, আর তুমি কিনা… কথার মাঝেই মাধবী বলে উঠল, সরি অরুণদা, সেদিন আমি কিছুতেই আসতে পারব না।

তার মানে আমার সম্মানটা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাও। এখন তো কার্ডগুলোও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ তখন আর আমি কী বলব?

অরুণদার গলাটা শুনে মাধবীর মনে হল, যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক সৈনিক। যুদ্ধ করার আগেই হেরে বসে আছেন। ঠিক আছে অরুণদা আমি যাব, নিশ্চিন্ত করে মাধবী।

অরুণ বসুকে মাধবী আদর্শ মনে করে চলে। বড়ো ভাইয়ের স্নেহই পেয়ে এসেছে মাধবী ওনার কাছে বরাবর। সুতরাং আজ সেই মানুষটার মনে আঘাত দেওয়ার মানসিকতা কিছুতেই হল না তার।

ঘড়িতে ঠিক সন্ধে সাতটা। লেখক ও বুদ্ধিজীবীর ভিড়ে হল গমগম করছে। আলো বন্ধ হতেই পিন পতন নিস্তব্ধতা গোটা প্রেক্ষাগৃহে। স্টেজের উপরে মাইকে অরুণ বসু ঘোষণা করলেন, প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে লেখক রঞ্জন কর্মকারকে। দয়া করে স্টেজে এসে আসন গ্রহণ করুন।

মাধবী তৈরিই ছিল। স্টেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা ব্যক্তিটিকে দেখে মাধবী পাথর হয়ে গেল। রঞ্জনও এক ঝলক মাধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। এত বছর ধরে যে-মুহূর্তটাকে মাধবী ভুলে যেতে চেয়েছে, এড়িয়ে এসেছে, আজ সেই মুহূর্তটাই এক বুক কষ্টর ঝাঁপি খুলে মাধবীর মনটাকে তাতে ডুবিয়ে দিল।

এতগুলো বছর ধরে রঞ্জনও ভেবে এসেছে, মাধবী ওর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। গুম হয়ে গেছে, যেখান থেকে সভ্য সমাজে ফিরে আসা আর কখনও সম্ভব নয়। অথচ, অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই মাধবী ওরফে মধুমালতী-র হাত থেকেই তাকে আজ পুরস্কার গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর থেকে নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?

মাধবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রঞ্জনের অহংকার, ভাঙা কাচের মতো গুঁড়ো হয়ে রঞ্জনকেই বিদ্ধ করল। মাধবী অরুণদার হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে রঞ্জনের হাতে ধরাল। রঞ্জনও কলের পুতুলের মতো পুরস্কার গ্রহণ করে, কোনও রকমে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে, স্টেজে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। দেখে যে-কেউই ভাবতে পারে রঞ্জন কর্মকারকে সম্মানিত করার বদলে জুতোপেটা করা হয়েছে।

এরপর ধীরে ধীরে অন্য লেখকদের পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ হতেই অরুণদাকে বলে হল ছেড়ে বেরিয়ে এল মাধবী। অন্য আরও অনুষ্ঠানগুলো দেখার মতো মানসিকতা ছিল না তার। গাড়ি বাইরেই রাখা ছিল। গাড়িতে উঠে বসল মাধবী।

 

বাড়িতে ঢুকতেই মাধবীর মনে হল একটু কাঁদতে পারলে হয়তো বুকের উপর চেপে বসে থাকা বোঝাটা হালকা হতো। কিন্তু একফোঁটা জলও চোখ দিয়ে বেরোল না। গলার কাছটায় শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে মাধবীর ঘোর কাটল।

কে? চোখের জল মুছে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল মাধবী কে এসেছে দেখতে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনকে দেখে ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে উঠল ওর।

তুমি কেন এসেছ এখানে? জানলা দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল মাধবী।

আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মাধবী।

মাধবী? কে মাধবী? চোদ্দো বছর আগে মাধবী মারা গেছে। আমার নাম মালতী, মধুমালতী। আমি তোমাকে চিনি না, চলে যাও এখান থেকে। শেষের দিকে মাধবীর গলার স্বর বেশ জোরালো শোনালো।

চলে যাব, শুধু একবার বলে দাও যে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রঞ্জন বন্ধ দরজার সামনে, গলায় কাকুতি।

বললাম তো আমি তোমাকে চিনি না। ভালোয় ভালোয় চলে যাও নয়তো চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, বলে জানলা বন্ধ করে দেয় মাধবী।

বহুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই, মাধবীর মনে হল রঞ্জন নিশ্চয়ই চলে গেছে। ভালোই হয়েছে। ওর সঙ্গে যখন কোনও সম্পর্কই নেই, তখন ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠছে কোথা থেকে। আমার জীবন নরক করে তুলে আজ আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে!

হঠাৎ-ই নিজের মনেই ধিক্কার অনুভব করল মাধবী। ভিতর থেকে নিজের বিবেকই প্রশ্ন তুলল, বাহ! মালতী এখন তুমি মাধবী থেকে মধুমালতী হয়েছ, নাম বদলে ফেলেছ জনপ্রিয়তা পেয়ে, কিন্তু স্ত্রীধর্ম? তুমি যদি ওকে চেনো না, তাহলে কার জন্য হাতে লোহা, মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ানো? হাতের লোহা খুলে ফেলে দাও, মাথার সিঁদুর মুছে ফেলো। রঞ্জন কর্মকারের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই বন্ধন আজও কেন বয়ে বেড়াচ্ছ? না মাধবী তুমি এসব কিছুই করতে পারবে না। উপরে উপরে যাই তুমি বলো না কেন, তোমার মন কি কখনও ওকে ভুলতে পেরেছে? না পারেনি। তোমার লেখায় এত দরদ কোথা থেকে আসে? জীবন দিয়ে তুমি উপলব্ধি করেছ বলেই না!

চুপ করো, আমি কিছু শুনতে চাই না, হঠাৎই নিজে নিজেই চেঁচিয়ে ওঠে মাধবী।

মাধবীর গলা শুনে অদিতি জেগে যায়। কোনও ভাবে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয় মেয়েকে কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারে না মাধবী। পুরোনো ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে চোখের সামনে আসতে থাকে।

রাত প্রায় একটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাধবী ঘুমোবার চেষ্টা করে। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ওর কেটে যায়। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না কিন্তু এক নাগাড়ে বাজতে থাকায় বাধ্য হয়ে উঠে আসে মাধবী।

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি অরুণ বলছি, শান্ত আওয়াজ ভেসে আসে ওপার থেকে।

এত রাতে অরুণদা… সব ঠিক আছে তো? চিন্তিত হয় মাধবী।

আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার সত্যি উত্তর দেবে? তুমি কি রঞ্জন… মানে রঞ্জন কর্মকারকে চেনো?

চমকে ওঠে মাধবী কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হঠাৎ এত রাতে ফোন করে এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আগে উত্তর দাও তুমি ওকে চেনো কি চেনো না?

হ্যাঁ, একসময় আমার স্বামী ছিলেন। ছিলেন শব্দটার উপর বিশেষ জোর দেয় মাধবী।

মাধবী, ছিলেন নয় আজও তিনি তোমার স্বামী কারণ তোমাদের ডিভোর্স হয়নি।

কিন্তু অরুণদা কী ব্যাপার বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মাধবী।

হয়তো রঞ্জন আর বাঁচবে না। কাল যখন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল, তুমি দরজা খুলে না দেওয়াতে ও অনেক্ষণ ওখানেই বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল তুমি দরজা খুলবে। বহুক্ষণ পরে সব আশা ত্যাগ করে ও যখন ওখান থেকে উঠে পড়ে রাস্তায় পা বাড়ায়, তখনও হয়তো মনে ক্ষীণ আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল যে দরজা খুলে তুমি নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। পিছন ফিরে সেটাই দেখতে গিয়ে একটা চলন্ত ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা মারে। হাসপাতালে ও এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ও একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কী করে? চোখের জল সামলাতে সামলাতে মাধবী প্রশ্ন করে।

প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর তুমি যখন হঠাৎ অনুষ্ঠান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে, রঞ্জনও তোমার পিছনে পিছনে দৌড়োল। আমার একটু সন্দেহ হয় কারণ যখনই এই নামটা তোমার সামনে আসে, তুমি কীরকম যেন অস্থির হয়ে ওঠো। আমিও বেরিয়ে আসি হল ছেড়ে আর তোমাদের পিছু নিই। তোমাদের বাড়ির কাছে এসেই রঞ্জন ট্যাক্সি ছেড়ে দেয় কিন্তু ততক্ষণে তুমি বাড়ি ঢুকে গেছ। আমিও একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকি। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ট্রাকটা ওকে ধাক্কা মারে। আমারও কিছু করার ছিল না। ওকে তুলে হাসপাতাল নিয়ে আসি। ডাক্তাররা আশা দিতে পারছেন না।

অরুণদা, আমি এখুনি আসছি, রিসিভার নামিয়ে রাখে মাধবী।

মাথার সিঁদুরের উপর চোখ যায় মাধবীর। মলিন সিঁদুরের রেখাটা খুব কষ্ট করে চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হয়ে গাড়িতে এসে বসে। হাসপাতালের দিকে গাড়ি ঘোরায় মাধবী।

মা এত রাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি? অদিতি জিজ্ঞেস করে।

তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

মিথ্যা কথা, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমিই তো এতদিন বলেছ, আমার বাবা কোথাও হারিয়ে গেছে, চেঁচিয়ে ওঠে অদিতি।

হ্যাঁ বলতাম কিন্তু আজই হঠাৎ ওনার খোঁজ পাওয়া গেছে।

তাহলে এখন থেকে বাবা কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

হয়তো।

তাহলে তো খুব মজা হবে, অদিতি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

অদিতি, এখন একটু চুপ করো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

হাসপাতালে পৌঁছতেই গাড়ি রেখে রিসেপশনেই অরুণদার দেখা পেল মাধবী। মাধবীদের নিয়ে রঞ্জনের বেড-এর সামনে দাঁড়াতেই চোখ খুলে চাইল ও। এসে গেছ। তোমারই আসার প্রতীক্ষা করছিলাম। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে রঞ্জনকে। মাধবীদের ঘরে রেখে অরুণ বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

রক্তাক্ত শরীরটাকে কোনও ভাবে টেনে তুলে রঞ্জন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাধবী জোর করে ওকে শুইয়ে দিল।

এ কী হাল করছে শরীরের? কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করে মাধবী।

সবই আমার কর্মদোষ! আমি তোমার উপর যে-অত্যাচার করেছি, আজ তারই ফল আমাকে ভুগতে হচ্ছে। আমার এই নিয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ নেই। আর তো কিছুক্ষণের অতিথি আমি। আমার শেষ ইচ্ছা, যেন তোমার সামনেই এই পাপে ভরা প্রাণটা ত্যাগ করতে পারি।

মাধবী রঞ্জনের হাত দুটো নিজের মুঠিতে তুলে নেয়, তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি তোমাকে বাঁচাব।

আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। হঠাৎ অদিতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই ইশারায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জন, এটি তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, দত্তক নিয়েছি।

ভালো করেছ মাধবী, নয়তো আমার চিতায় কে আগুন দিত? সারা জীবন এই একটাই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে যে, মৃত্যুর পর আমার কী হবে? কিন্তু এখন আর কোনও চিন্তা নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব, বলে রঞ্জন অদিতিকে স্নেহের স্পর্শে কাছে টেনে নেয়।

 

কী শান্তি! এই শান্তি আগে তো কোনও দিন অনুভব করেনি রঞ্জন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কে আপন কে পর তার হিসেব কে রাখে? আর তো কিছু মুহূর্ত…

যদি রঞ্জন সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে আজ আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আ.., মুখের কথা মুখেই থেকে যায় মাধবীর। গলা শুকিয়ে ওঠে। রুদ্ধ হয়ে আসে স্বর।

আমি তোমাকে কখনও হেয় করতে চাইনি মাধবী। কিন্তু কী যে পশু ভর করেছিল আমার মাথায়! সময়, কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিয়েছে আমার পাপের! এমন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বেরোবার শক্তি আমি জোটাতে পারিনি। তবুও বলব আজ আমি খুব খুশি। মৃত্যুর সময তো আমি তোমাকে কাছে পেলাম। আমার লেখায় আদর্শের ছড়াছড়ি কিন্তু বাস্তবে নিজের জীবনে আদর্শকে কোনও ঠাঁই দিইনি। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে যদি সুখী রাখতে পারতাম। আমি সত্যিই লজ্জিত মাধবী, ক্ষমা কোরো আমাকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মাধবী।

মাধবী কিছু বলার আগেই রঞ্জনের মাথা একপাশে হেলে পড়ল। মাধবী কাছে আসতেই বুঝতে পারল রঞ্জনের যাবতীয় কষ্টের অবসান ঘটেছে।

পরের দিন হাজারো সাহিত্যকারের ভিড়ে অদিতি, রঞ্জনের মুখাগ্নি করল। মাধবী অপলক দৃষ্টিতে চিতার আগুনের দিকে তাকাতেই মনে হল, আগুনের শিখার ভিতর থেকে রঞ্জনের হাসিমাথা মুখটা যেন মূর্ত হয়ে উঠছে। মাধবীকে বলছে, তুমি আমার শেষইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছ, যেটা এতগুলো বছর ধরে আমার গলায় ফাঁসের মতো আটকে ছিল, আমার অসম্পূর্ণ গল্প আজ সম্পূর্ণ হল মাধবী। এখন আমি নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছি।

মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুও জোর করে মুছে নিল। আর কান্না নয়, অদিতির জন্য বাকিটা জীবন তাকে হাসি মুখেই কাটাতে হবে।

 

নাম জানা হয়নি

একদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতা আর অন্যদিকে মাউন্ট ফুজির গগনচুম্বী বরফঢাকা শিখর। দু’পাশে প্রকৃতির সবুজ গালিচাকে সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে শিনকানসেন– জাপানি বুলেট ট্রেন। অসম্ভব গতির জন্য জানলার বাইরের সমস্ত দৃশ্যই যেন ঘষা ছবি। যেন একটা সদ্য জলরং করা ছবি অনবরত কেউ ঘেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইল না সার্থকের।

সংরক্ষিত আসনের বিলাসী ব্যাকরেস্ট পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, সে তার ক্লান্ত চোখদুটি বন্ধ করল। একটু-একটু তন্দ্রা মাঝেমধ্যে তাকে আচ্ছন্ন করে যাচ্ছে। খানিকটা তার অজান্তে আর খানিকটা সচেতনে তার মন বুলেটের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে অতীতে। মুহূর্তে আশেপাশের রঙিন প্রকৃতি চোখের সামনে থেকে উধাও। তার বদলে ফিরে এল অন্য সময়, অন্য পরিপ্রেক্ষিত।

বছরখানেক আগে সেই মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট দেখে এসে আর একমুহূর্তও খামোখা নষ্ট করতে চায়নি সার্থক। বাবা রাগারাগি করেছিলেন। মা কেঁদেকেটে একশা হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই টলানো যায়নি সার্থককে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলেছিল আগেই। সম্ভবত তার ছেলেবয়সেই। বাবা বলেছিলেন, ‘পড়াশোনা করতে না চাস তো সমবায় থেকে লোন নিয়ে ছোটোখাটো একটা দোকান করে দিচ্ছি। তিনটে তো পেট

সংসারে। ঠিক চলে যাবে–!’

সার্থক বাবাকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেনি। গররাজি মুখ করে চুপ করে গিয়েছিল। বাবা এই মফসসল শহরে বসে কী করেই বা বুঝবেন, তাঁর সীমাবদ্ধ ভাবনা আর সার্থকের লাগামবিহীন স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব কত যোজন! ছোটোবেলা থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে বিদেশে তাকে যেতেই হবে। উন্নতির একমাত্র ঠিকানাই বিদেশ।

অনেক আগে এ কথাটা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাদেরই পাড়ার ছেলে সুধন্য। বছরতিনেক আগে কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে সেও কেটে পড়ল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে ফোন করত। আইএসডি। সেই উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীকালে বজায় থাকেনি। কিন্তু সুধন্যর কথাগুলো মনে আছে সার্থকের। সুধন্য গল্প করেছিল, কীভাবে জাহাজের খালাসি হয়ে একজন পৌঁছে গিয়েছিল আমেরিকাতে। এখনও কত লোক প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়! তাদের বেশিরভাগের আবার ভিসা-পাসপোর্ট কিছুই নেই।

সেইদিন থেকে সার্থক একটাই লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বেসরকারি অফিসের অল্প মাইনের কেরানি তার বাবা। সামান্য মাইনেয় তিনজনের পরিবার টানতেই তাঁর প্রাণান্ত দশা হয়। সে তো চোখের সামনে দেখেছে, দিনের পর দিন কত কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে! একটা ছোটো সাইজের জামাকে অনেক বড়োসড়ো বপুতে গলানোর চেষ্টা করতে করতেই জীবন কেটে গেল বাবার। একই ভবিতব্য তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে, এ কথা ভাবতে গেলেই সে শিউরে ওঠে। বিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরেই সে যেন মরিয়া হয়ে উঠল।

সার্থককে বুঝিয়ে যখন হার মানলেন মা, খুব উদ্বিগ্ন আর হতাশ গলায় জানতে চাইলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে কী করবি?’

‘প্রথমে একটা চাকরির চেষ্টা করব।’

‘মেসে কষ্ট করে থাকতে পারবি তো বাবা?’ মা চোখের জল মোছেন আঁচলে।

‘নিশ্চয়ই পারব। কেন পারব না?’ সার্থক কঠিন গলায় বলে।

বৈশাখের কড়া রোদেলা শহর। সারাদিন ব্যস্ত মানুষ রাস্তা পারাপার করে। পথে কাটাকুটি খেলে অসংখ্য বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-রিকশা। সবাই যে কলকাতার, তা তো নয়। আশেপাশের জেলাশহর থেকেও প্রতিদিন কত মানুষ আসছে ক্ষুধার অন্ন জোটাতে।

একটা চলনসই গোছের চাকরি জুটে গেল অল্পদিনেই। এক ছোটোখাটো কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ। মাইনে সামান্য। কিন্তু ঘুরে বেড়িয়ে শহরটাকে আবিষ্কারের নেশাটা পেয়ে বসল তাকে অচিরেই।

এমনই একদিন সে বসে ছিল জাপান দূতাবাসের উলটো দিকে ফুটপাথের এক চায়ের দোকানে। দুপুর রোদে একটু ছায়া উপভোগ করছিল। গ্রীষ্মের দুপুর বলেই শহরটা একটু নিস্তরঙ্গ, নিস্তেজ। জাপান দূতাবাসের মূল দরজা পেরিয়ে ছোটোখাটো চেহারার এক জাপানি মহিলাকে সে অলস চোখে রাস্তা পেরোতে দেখল। জাপানি মেয়েদের গায়ের রং পার্ক স্ট্রিটে দেখা ফরাসি কিংবা বেলজিয়ান মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লালচে ফরসা এবং ত্বকও অনেক বেশি মসৃণ।

মেয়েটি রাস্তা পেরিয়ে এসে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াতে, সার্থক আন্দাজ করল মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে। হয়তো এই প্রথমবার কলকাতায় এসেছে। চোখমুখের উৎকণ্ঠিত ভাব সে কথাই বলছে। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে সে বোধকরি ফাঁকা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

মেয়েটি কি ইংরেজি বোঝে? সার্থক থেমে থেমে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কি বুঝবে মেয়েটির ভাষা? কিংবা মেয়েটি তার? অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে বিদেশবিভুঁইয়ে, অপরিচিত পরিবেশে সে যেন খানিকটা হতচকিত, থতোমতো!

তার চা খাওয়া হয়ে গেছিল। সঙ্গে প্রজাপতি বিস্কুট।

চা-ওয়ালাকে দাম মিটিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে সে থমকে তাকাল। মেয়েটি তেমনই বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ইতস্তত পায়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই হেলপ ইউ?… আপনি কি ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ?’

মেয়েটি স্মিত হেসে নাতিদীর্ঘ গ্রীবা হেলাল, অর্থাৎ, জানে।

সার্থক আশ্বস্ত হয়ে জানতে চাইল, ‘কোনও সাহায্য করতে পারি?’

‘আসলে, কাল রাতেই আমি কলকাতায় এসেছি। কাল সকালের ফ্লাইটে জয়পুর চলে যাব। ভাবছি যতটা সময় পাচ্ছি, তার মধ্যে শহরটাকে একটু দেখে নেব। শুনেছি, কলকাতা ইজ আ বিউটিফুল সিটি। অনেক কিছু দেখার আছে–!’

এ’কদিনের শহরবাসে কলকাতা শহরটাকে পায়ে হেঁটে ভালোই চিনে ফেলেছে সার্থক। তার পেশাটাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করেছে।

সে তাই বলল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, অ্যান্ড ফিল কমফর্টেব্ল, আমি কিন্তু শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি আপনাকে–!’

মুহূর্তের জন্য জাপানি তন্বী চুপ করে রইল। স্বাভাবিক, যে এ শহরটাকে চেনেই না, সংস্কৃতিটাকে জানেই না, সে কীভাবে তক্ষুনি এক অপরিচিত পুরুষের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেয়! তার পক্ষে সহজ নয় ব্যাপারটা।

মেয়েটির হ্যাঁ ও না-এর সম্ভাবনার দোলায় খানিকক্ষণ দুলল সার্থক নিজেও। অনেক সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসেছে সে, প্রত্যাখ্যানে মন ভেঙে যাবে তার। হঠাৎ-ই মেয়েটি বলল, ‘শিয়োর। কিন্তু আপনি সব জায়গা চেনেন তো?’

হ্যাঁ-বাচক ঘাড় নেড়ে একটা চলতি ট্যাক্সিকে থামাল সার্থক। শিভালরি দেখিয়ে পিছনের দরজা খুলে ধরল জাপানি মেয়েটির জন্য। নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে।

শহরের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লালদিঘি, যাদুঘর, সিটি সেন্টার…। জাপানি তরুণী অবাক চোখে দেখছিল। প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা উপভোগ করছিল। হুইলার স্টল থেকে একগোছা গোলাপি ক্যান্ডিফ্লস কিনে সেটি কী করে খেতে হয়, শিখিয়ে দিল সার্থককে। সার্থক অবশ্য জানত। ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ নামে এ জিনিসটাই ফেরিওয়ালার কাঁধে চেপে প্রায়ই আসত তাদের মফসসল শহরে। এখন সেই জিনিসটাই জাপানি মেয়ের মসৃণ, চকচকে গোলাপি ঠোঁটে মিশে যাচ্ছে।

জাপানি যুবতির সান্নিধ্য খুবই ভালো লাগছিল সার্থকের। কিন্তু দেখতে দেখতে দিনটা ফুরিয়ে এল। খিদে পেয়েছিল ওদের। জাপানি কন্যে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার খিদে পায়নি সার্থক?’

সার্থক সলজ্জে বলল, ‘হুঁ।’ কাউকে খিদের কথা জানাতে তার ভারি লজ্জা হয়। ছোটোবেলার অভ্যেস।

যুবতি বলল, ‘তাহলে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় চলো–!’

সার্থক ওর চেনা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল। এর আগে মাত্র একবারই এসেছে। সেই অর্থে চেনা নয়। তবে জানে, এটা তার পকেট এবং মধ্যবিত্ত ম্যানারের মাপেমাপে। আরও বড়ো রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাহস পেল না সার্থক।

জাপানি তরুণী যে-কোনও বিষয়েই তার উপর বড়ো নির্ভরশীল। সার্থকের সব কথাতেই তার হ্যাঁ। খাওয়াদাওয়ার পরে রাস্তায় এসে তার কী মনে হল, জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, সার্থক, তোমাদের শহরে কোনও নদী নেই?’

‘আছে তো। গঙ্গা। বিশাল নদী।’

‘নদীতে নৌকো চলে?’

‘চলে।’

‘আমায় নিয়ে যাবে?’

শহরের গঙ্গায় শেষ লঞ্চ অনেক আগেই চলে গেছে। যে-কটি আলো জ্বলছে বাতিস্তম্ভে, তাতে অন্ধকারটাই যেন আরও গাঢ় হয়েছে। কেবল কালো গঙ্গার বুক ভেসে যাচ্ছে হলুদ জ্যোৎস্নায়। ইতিউতি কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছায়ার মতো পরস্পরের লগ্ন হয়ে আছে। দূরে কয়েকটি নৌকো দেখা যায়। হ্যারিকেনের ম্লান আলো তাদের প্রায়-অনস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলছে।

সেদিকে আঙুল দেখিয়ে যুবতি বলল, ‘সার্থক, ওই নৌকোগুলোয় চড়া যায়?’

মুখের কাছে দু’হাতের তালু জড়ো করে সার্থক ডাক দিল, ‘মাঝিভাই, ও মাঝিভাই, নেবে নাকি?’

খানিক পরে নৌকো ঘাটে লাগলে, ওরা উঠে বসল ছইয়ের ভিতর। মাঝির হাতে দাঁড়ের প্রথম টানে দুলে উঠল নৌকো। আর, যুবতির শরীরও যেন টলে পড়ল সার্থকের গায়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল বিদেশিনি। সার্থকের একটি হাত নিজের হাতে বন্দি করে আনমনা গলায় বলে উঠল, ‘আমি অনেক দেশে ঘুরেছি সার্থক। দেশে দেশে কত বন্ধু হয়েছে। কিন্তু তারা একজনও তোমার মতো নয়। তোমার শহর থেকে অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি।’

বুক ভর্তি করে খোলা হাওয়া নিল তরুণী। সার্থকের হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলল, ‘জাপানে চলে আসছ না কেন? ওখানে অনেক সুযোগ। যদি আসতে চাও, আমায় জানিয়ো। কাল সকাল পৌনে নটায় আমার ফ্লাইট। সাতটা নাগাদ একবার হোটেলে এসো। আমার কার্ডটা তোমায় দিয়ে দেব।’

মিষ্টি হাওয়া বইছে। নৌকো কি এখন মাঝগঙ্গায়? ঘাট দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। মেয়েটি গুনগুন করে কোনও জাপানি সুর গাইছে। সুরটা অনেকটা ভাটিয়ালির মতোই। যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়। আশ্চর্য তৃপ্ত আর ভরাট লাগছে মেয়েটির মুখ। সে যেন সার্থকের ভালোবাসায় লীন হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটির মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সার্থক অস্ফুটে বলল, ‘মাঝিকে ঘাটে নৌকো ভেড়াতে বলি? অনেক রাত হল।’

মেয়েটিও যেন তন্দ্রা ভেঙে উঠে বসল। হোটেলে তাকে পৌঁছে দিল সার্থক। বিদায়ের মুহূর্তে হাত নেড়ে সে বলল, ‘কাল সকালে দেখা হচ্ছে।’

রাস্তায় নেমে সার্থকের মনে পড়ল, মেয়েটির নাম-ই জানা হয়নি। সে পিছন ফিরে ডাকবে তাকে, ভাবল। কিন্তু মেয়েটি চলে গেছে। তাকে আর দেখতে পেল না সার্থক।

অনেক রাতে সার্থক ফিরে এল মেসে। খাওয়াদাওয়ার পাট ছিল না। কেন-না রেস্তোরাঁয় খেয়ে তখনও পেট ভর্তি। সে সরাসরি বিছানায় শরীর ছুড়ে দিল। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, তবু তার ঘুম এল না। সন্ধের সুখস্মৃতি তাকে ঘুমোতে দিল না। রোমন্থনে জাগিয়ে রাখল। মনে হল, তার হাতটি যেন এখনও নিজের উষ্ণ করতলে ধরে রেখেছে সেই বিদেশিনি, যার নাম সে জানে না। ইস, কী ভুলটাই না সে করেছে! সার্থক ভাবে।

ঘুম না আসার অবশ্য আরও এক কারণ ছিল। সেটা তার উদ্বেগজনিত। ভোরবেলা উঠতে হবে। না উঠতে পারলে, হোটেলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যেতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্কতায় অনেকসময় ভুল হয়ে যায় বেশি।

কখন তার চোখদুটো লেগে এসেছে সার্থক জানে না। ধড়ফড় করে জেগে উঠে, বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটায় দেখল, আটটা বাজে। হোটেলে গিয়ে এখন জাপানি যুবতিকে দেখতে পাওয়া একরকম দুরাশাই। পৌনে নটায় তার ফ্লাইট, সার্থক জানে। তবু, বড়ো আশায় বুক বেঁধে সে হোটেলের দিকে রওনা দিল।

সকালে হোটেলে তেমন ব্যস্ততা নেই। হাতেগোনা কয়েকজন চেক আউট করা বোর্ডার, বাক্স-ব্যাগ নিয়ে বড়ো দরজার কাছে অপেক্ষা করছে ট্যাক্সির জন্য।

রিসেপশনের সদ্য ঘুমভাঙা ডাগর চোখমুখের মেয়েটি বলল, ‘কাল সন্ধেয় আপনি যাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে, তার কথা জানতে চাইছেন তো? উনি তো অনেকক্ষণ চেক আউট করে গেছেন। বোধহয় আপনার জন্যই লবিতে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। কেন-না, ওর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছিল, কাউকে খুঁজছেন। তারপর চলে গেলেন।’

সার্থকের বুকের মধ্যেটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল। সব হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থাকল তাকে। তার সব আশা যেন ভেঙে গেছে। সব ভাবনা যেন মিশে গেছে ধুলোয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকেই তার মধ্যে আর-এক ধরনের শক্তিপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে, টের পেল সার্থক। সেই শক্তি তাকে বেঁধে দিল এক কঠিন অঙ্গীকারের রজ্জুতে। একদিন নিশ্চয়ই সে তাকে খুঁজে বের করতে পারবে।

সামান্য হোঁচট খেয়ে শিনকানসেন থেমে যেতে, ভাবনার গতিপথেও বাধা পড়ল। ট্রেনের স্বচ্ছ কাচের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল সার্থক। নিরিবিলি স্টেশন। দু-চারজন মানুষ চলাফেরা করছে। একটা বোর্ড আছে বটে, কিন্তু জাপানি ভাষায় লেখা বলে, স্টেশনের নামটা পড়তে পারল না সার্থক। পাশের সিটের প্রৌঢ় সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে সার্থক জানতে পারল, স্টেশনের নাম হমামাতসুচো। একটা হাঁফ ছাড়ল সে। তার মানে, অর্ধেক পথ আসা গেছে এতক্ষণে। এবার সে স্টেশনটিকেই একটু ভালো করে ঠাহর করে দেখতে থাকল। ভারতের যে-কোনও স্টেশনের থেকে কত ফারাক! কোনও চ্যাঁচামেচি নেই, ব্যস্ততাও কত ব্যক্তিগত ও নীরব, প্ল্যাটফর্মটা এতই সাফসুতরো যে, জুতো পরে হাঁটতে সংকোচ হয়।

ট্রেন সামান্য সময়ের জন্য থেমেছিল। কিছু যাত্রী নেমে গেল, আবার অনেকে উঠল। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ধাক্বাধাক্বি নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আবার তীব্র গতিতে ছুট লাগাল। অমনি বাইরের যাবতীয় ছবি ঘেঁটে একশা। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সার্থক। এত গতি তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।

সার্থকের আবার মনে পড়তে থাকল, জাপানি যুবতির সেই পর্বটি মিটলে, সেলসম্যানের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সার্থক। পরিশ্রম আর উপার্জনে সামঞ্জস্য হচ্ছিল না কিছুতেই। এবার সে চাকরি নিল শহরের এক নামি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। মাইনে ভালোই, উপরন্তু দুপুরে ও রাতে খাওয়াটা ফ্রি। পেটের চিন্তা অনেকটা মিটল। কিন্তু তবু যেন কীসের অমোঘ টানে সে এখনও মাঝেমধ্যেই নিয়ম করে জাপানি দূতাবাসের উলটোদিকের ফুটপাথে, গাছতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ দোকানিটি মরে গেছে। এখন তার ছেলে চা বানায়। তাগড়া যুবক।

রেস্তোরাঁর কাজে ছুটিছাটা কম। সন্ধেগুলোতেই ভিড় বেশি। তার উপর সাধারণ ছুটির দিনেও খদ্দেরদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কেবল দুপুরটায় কাজের চাপ একটু কম থাকে। তখন রসুইঘরে খাবার তৈরির আগের পর্যায়ের কাজ চলে।

এই সময়টাতেই মাঝেমধ্যে ফুটপাথের সেই চায়ের দোকানে চলে আসে সার্থক। এক কাপ চা নিয়ে একঘণ্টা বসে থাকে। সঙ্গে দুটো প্রজাপতি বিস্কুট।

একদিন একটা কাণ্ড ঘটল।

দুপুরে রাস্তা এমনিতে ফাঁকাই থাকে। একটা অটোরিকশা তীব্র বেগে এগিয়ে এসে, ঠিক চায়ের দোকানের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক জাপানি যুবক নেমে জিন্সের পিছনের পকেট থেকে পার্স বের করে ভাড়া মেটালেন। তারপর পার্সটিকে আবার পিছনের পকেটে চালান করে দিয়ে, দূতাবাসের দিকে হাঁটা দিলেন। দেখে মনে হল যুবকের খুব তাড়া।

অলস চোখে তাকে লক্ষ করছিল সার্থক। এও তার চোখে পড়ল, তাড়াহুড়োয় পার্সটি যুবকের জিন্সের পকেটে না ঢুকে সশব্দে পড়ল রাস্তায়। ব্যস্ততায় যুবক তা খেয়াল করল না। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সার্থক যে তাকে ডেকে উঠল, সেটাও কানে গেল না তার। লম্বা পা ফেলে, সে দূতাবাসের অন্দরে সেঁধিয়ে গেল।

রাস্তা থেকে পার্সটা কুড়িয়ে আনল সার্থক। খুলে দেখল তাতে একগোছা দুই হাজার টাকার নোট। এত টাকা কোনওদিনও একসাথে দেখেনি সে। হাত কাঁপছে তার। কাউকে বলতেও পারছে না। পার্সটা বন্ধ করে, দুহাতের করতলে শক্ত করে ধরে রেখে সে ভাবতে থাকল, এখন কী করণীয়!

একঝলক দেখে সার্থকের মনে হয়েছে, অন্তত পঞ্চাশটা দু’হাজার টাকার নোট রয়েছে সেই গোছায়। মুহূর্তের জন্য চকচক করে উঠল তার চোখদুটো। এই টাকাগুলো বাবা পেলে, বাড়ির অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ করে ফেলত। রান্নাঘরটা মেরামত করত। ছাদের যে-জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়ে, সারাত সেগুলোও। মাকে কয়েকটা নতুন শাড়িও হয়তো কিনে দিত। আর স্যাকরার দোকানে মায়ের কানের যে দুলটা বাঁধা রেখে টাকা নিতে হয়েছিল সেবার মায়ের অসুস্থতার সময়, সেটাও হয়তো ছাড়িয়ে আনত।

পার্সটা একবার খুলল সার্থক। একগোছা কাগজের টুকরো। অথচ কী অসীম ক্ষমতা তাদের। পরমুহূর্তেই পার্স বন্ধ করে সে নিজের মনেই বলল, ছি। সে এসব কী ভাবছে?

তখনই উদ্ভ্রান্তের মতো সেই জাপানি যুবককেও রাস্তা পেরিয়ে এপাশে আসতে দেখা গেল। তার চেহারা ইতিমধ্যেই বেশ পালটেছে। চুল এলোমেলো। চোখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। কিছু খুঁজছে যেন।

সার্থক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যুবকের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আই হ্যাভ ইয়োর ওয়ালেট। ইউ ড্রপ্ড ইট হিয়ার।’

যুবকটি সার্থকের হাত থেকে খপ করে পার্সটি কেড়ে নিয়ে ভিতরটা আঁতিপাঁতি করে দেখল। তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঠায় সার্থকের দিকে।

সার্থক ম্লান হাসল। যুবক নিজের অভিভূত ভাবটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আই অ্যাম ভেরি মাচ ইমপ্রেসড। মে আই ডু সামথিং ফর ইউ?’

সার্থক যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষা করছিল এই প্রশ্নটার জন্য! উত্তরটা সাজানোই ছিল জিভের ডগায়, এমনভাবে সে বলে ফেলল, ‘আমি আপনার দেশে যেতে চাই। শুনেছি ওখানে কেরিয়ার তৈরির অনেক সুযোগ–!’

জাপানি যুবক হঠাৎ কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর সার্থকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁ আছে? আমার খুব খিদে পেয়েছে!’

কাছাকাছি সত্যিই একটা রেস্তোরাঁ আছে, জানে সার্থক। যুবকটি নিজেই অর্ডার করল। সার্থকের যদিও খিদে ছিল না, তবু অল্পস্বল্প কিছু নিতে হল। খেতে খেতে যুবকটি প্রশ্ন করে জেনে নিতে থাকে সার্থকের জীবনের নানা কথা। কেবল শোনেই না, নিজের কথাও বলে।

যুবকের নাম হারুকি। সম্প্রতি সে বিয়ে করেছে। পেশায় সে ব্যবসায়ী। এক বছর আগে হারুকির বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে হারুকি এখন তাঁর প্লাস্টিক কারখানাটির মালিক। ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজেই এবার সে ভারতে এসেছে। তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী অবশ্য এর আগে অনেকবারই এদেশে এসেছে। ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে সেসময় রিসার্চ করছিল সে।

গত বছর হারুকির কোম্পানি অপ্রত্যাশিত লাভ করেছে। জাপানি ভাষায় কোম্পানিকে বলে ‘খায়শা’। হারুকির খায়শা এখন রমরম করে চলায়, সে কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রীর হাতে দায়িত্ব সঁপে ভারতে এসেছে।

হারুকি বলল, ‘সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী কয়েক বছরে কোম্পানি আরও বড়ো হবে সার্থক! কারখানা করার জন্য জমিও কিনেছি। অনেক কর্মীরও দরকার হবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও, তাহলে আমার কোম্পানিতে একটা চাকরি তোমায় দিতে পারি। শর্ত দুটো। এক, পাকাপাকিভাবে জাপানেই থাকতে হবে। নাগরিকত্বের ব্যবস্থা আমি করে দেব। আর দুই, মন দিয়ে কাজ করতে হবে। জাপানে সকলকেই কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে হয়।’

খানিকটা সময় থেমে থেকে হারুকি আবার বলল, ‘তুমি রাজি থাকলে বলো–!’

সার্থক যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল। হারুকির প্রশ্নে চমকে উঠে বলল, ‘কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। আমি যাব।’

হারুকি উঠে পড়ে বলল, ‘আজ রাতের ফ্লাইটে আমি মুম্বই উড়ে যাচ্ছি। দু’দিন ওখানে থাকব। তারপর ফিরে যাব জাপানে। ওখান থেকে যাবতীয় জরুরি ডকুমেন্টস তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা কোরো।’

একটা ট্যাক্সি ডেকে হারুকিকে তুলে দিয়ে, বাস ধরে নিজের রেস্তোরাঁয় ফিরে এল সার্থক। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। মানুষের ভিড়ও বাড়ছিল। আজ ক্রেতারা তার কাছ থেকে পেল একটু বাড়তি হাসি। একটু বেশি সৌজন্য। তখন এক আশ্চর্য ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছে সার্থক। আর মাত্র কয়েক দিন, বন্ধু। ওগো চেনা মুখ, তোমাদের বড়ো মিস করব জাপানে।

হারুকি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়নি। সে জাপানে ফিরে যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায়, সার্থকদের রেস্তোরাঁর ঠিকানায় তার নামে একটা প্যাকেট এল। নিজের মেসে গিয়ে কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুলল সার্থক। ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় জরুরি কাগজপত্র, সেইসঙ্গে একটা ওপন ডেটেড এয়ার টিকিট। তার উপর সরু ক্লিপে আটকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে স্বহস্তে হারুকি লিখেছে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাপানে চলে আসার চেষ্টা করো!’

চোখে হঠাৎই জল চলে এল সার্থকের। সেই কোন ছোটোবেলার অধরা স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। পরের কয়েক দিন কেটে গেল দূতাবাসে ভিসা সংক্রান্ত কাজকর্মের ব্যস্ততায়। তার কয়েক দিন পরেই তার উড়ান নামল অশোকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। এয়ারপোর্টে ক্লিয়ারেন্সের যাবতীয় কাজ মিটে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। হারুকি যেভাবে বলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে অশোকা স্টেশন থেকে টোকিয়োগামী বুলেট ট্রেনে উঠে বসেছিল সার্থক।

শিনকানসেন এখন সাঁঝবেলার কুয়াশামাখা অন্ধকার ভেদ করে ছুটছে। দূরে দূরে ছোটো ছোটো জনপদ টের পাওয়া যায় মিটমিট করে জ্বলা আলো দেখে। পিছনে পড়ে রইল তার দেশ। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। দেশের বাড়ি, বাবা-মা…। চোখ জ্বালা করে উঠল সে কথা মনে পড়তে। প্রৌঢ় সহযাত্রীটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বললেন, ‘টোকিয়ো স্টেশন আসছে। আর দশ মিনিট।’

সত্যিই তাই! চোখেমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে বলে টয়লেটে ঢুকেছিল সার্থক। বেরিয়েই চমকে গেল। অন্ধকার উধাও। মিটমিট করে জ্বলা আলোরাও বিগত অতীত। তার বদলে মসৃণ এক শহর আলোয় আলোয় খিলখিল করে হাসছে। সিটে ফিরে আসতে বৃদ্ধ সহযাত্রী একগাল হেসে বললেন, ‘টোকিয়ো এসে গেছে।’

আগেই ফোনে কোথায় সার্থকের জন্য অপেক্ষা করবে বলে দিয়েছিল হারুকি। সেইমতো, পশ্চিমের দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে বের হয়ে, রিজার্ভেশন কাউন্টারের কাছে যেতেই সে হারুকিকে দেখতে পেল। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল হারুকি। বলল, ‘কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’

সার্থক মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল হারুকি। গাড়ি চলতে শুরু করল ফ্লাইওভার ধরে। এমন শহর সার্থক কেবল ছবিতে দেখেছে। আকাশে থেকে থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে রংবেরঙের ফুল হয়ে যাচ্ছে।

অবাক চোখে সেদিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুকি বলল, ‘খুব কাছে সুমিদা নদী। প্রত্যেক বছর এই দিনে নদীর পারে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছ। আমরা নদীর পার ধরেই যাব। দেখতে পাবে–!’

‘তোমার বাড়ি কি কাছেই?’

‘ফ্ল্যাট…। হ্যাঁ কাছেই।’

আধঘণ্টার মধ্যে গাড়িটা বাঁক নিয়ে একটা বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে খানিকটা গিয়ে থামল। সেখানে আরও অনেক গাড়ি রয়েছে। সার্থক বুঝতে পারল, এই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও ফ্ল্যাটেই থাকে হারুকি ও তার বউ। সাজানো ফ্ল্যাটে ঢুকে, ড্রয়িংরুমে বসার পর, হারুকি বলল, ‘তুমি কি টয়লেটে যেতে চাও?’

সত্যিই শরীর এখন চাইছে স্নান। দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে রাতপোশাকটা বের করে টয়লেটে ঢুকল সার্থক। আহা, স্নানের ঘর যে এমন হয়, সে কি জানে দেশে তার পরিচিত মানুষরা? কত বড়ো বাথটাব! দেয়ালে কতরকম কলের প্যাঁচ। কোনটার কী কাজ কে জানে! জেনেই বা কী দরকার! দেশে তো বাড়ির বাইরের টিপকল থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে ছাদখোলা টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে স্নান করত তারা।

বাথটাবের কল ছেড়ে দিয়ে, সার্থক আক্ষরিক অর্থে গা ভাসাল। টয়লেটের বাইরে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে পানীয় হাতে নিয়ে একাই বসে আছে হারুকি।

তাকে দেখে বলল, ‘একটু বোসো। আমার বউ এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। ওকে খবরটা দিয়ে আসি।’

সোফার নরম গদিতে প্রায় পুরোটাই ডুবে যায় সার্থক। সামলে নিয়ে সতর্ক হয়ে বসে। মাথাটা হেলিয়ে দিতেই বুজে আসে ক্লান্ত চোখদুটো। আর তখনই চোখের পর্দায় ভাসে সেই আশ্চর্য সুন্দর মুখটা। তার দেশের কেউ নয় সে, তার দেশের কারু মতো দেখতে নয় তাকে। তবু, সেদিন যখন সন্ধেবেলা গঙ্গার বুকে ভাসা নৌকোর ছইয়ের মধ্যে সে চেপে ধরেছিল সার্থকের হাতদুটি, তাকে দেখতে লাগছিল প্রতিমার মতো। সে মুখ ভোলার নয় কখনও। শুধু তাকে একটিবার দেখবে বলে, সে গিয়ে বসে থাকত দূতাবাসের উলটোদিকে চা-দোকানের ভাঙা চেয়ারে। শুধু জীবনধারণ নয়, তাকে খোঁজার জন্যও জাপানে আসা তার। তার নামও যে জানা হয়নি সেদিন।

হারুকির ডাকে ভাবনার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল সার্থকের। হারুকি ফিরে এসেছে ঘরে।

‘সার্থক, এই হচ্ছে আমার বউ, মিকা–!’ তার পাশ থেকে কেউ রিনরিনে গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো!

জবাবে ‘হ্যালো’ বলতে গিয়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল সার্থক। সেই মুখ। নরম দুটো চোখ। একবার সার্থকের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি যেন মেঝেয় গেঁথে ফেলেছে মেয়েটা। তার মানে, সার্থককে সে আগেই চিনেছে। ধরা দিতে চায় না। সার্থকের কাছেও না, তার স্বামীর কাছেও না।

মিকা বলল, ‘আমি যাই। খুব ক্লান্ত। কাল কথা হবে–।’

সে চলে যেতে, নিজের মনেই একচোট হাসল সার্থক। তারপর অকম্পিত গলায়, ‘সি ইউ’ বলে সোফার নরম ঔদার্যে ডুবিয়ে দিল শরীর।

তার এখন জব্বর ঘুম পাচ্ছে।

 

দেবীজন্ম

ঘুসঘুসে জ্বরটা কিছুতেই ছাড়ছে না সনাতনের। প্যারাসিটামল দিয়েই চালাচ্ছে, খেলে জ্বর নেমে যায়, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে, মাথাটা হালকা আর ফাঁকা ফাঁকা। মনে হয় যেন অনেক দিন বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে, মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আবার সে আগের মতো ঝাঁপিয়ে কাজ করতে পারবে। আর কাজ তো মেলা। পুজোর মুখে এ পাড়ায় কেই বা বসে থাকে। সবাই একগাদা বায়না নিয়ে গলা অবধি ডুবে আছে। যেটুকু পয়সা ঘরে আসে তা তো এই বড়োপুজোতেই। সারা বছর পুজো লেগে আছে যদিও। কিন্তু লক্ষ্মী সরস্বতী বিশ্বকর্মা যতই জুলুস করে হোক, সে যেন পাড়ার ম্যাচ খেলা, দুর্গাপ্রতিমা না গড়লে কোনও পটুয়াই জাতে ওঠে না। তবে টাকাও নয়, জাতে ওঠাও নয়, আরও একটা কিছু থাকে যার জন্যে রাত জাগে কুমোরটুলি। শরীরের কোশে কোশে কী উত্তেজনা, ঝমঝম করে আনন্দ, সারা শরীরে যেন আবার নবযৌবন অনুভব, পার্টি যেদিন ঠাকুর ডেলিভারি নিয়ে যায়, সেদিন মনে হয় ঠাকুরের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে যেন প্রসাদ খাওয়ার আনন্দ পাচ্ছে।

কিন্তু এ বছর একটা ঠাকুরও কি গড়ে শেষ করতে পারবে? তার প্রতিমা কি আলো করে থাকবে কোনও পুজোমণ্ডপ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয় সনাতন, জানলা দিয়ে চোখে পড়ে তার কাজের ঘর, এখনকার ছেলেরা বলে স্টুডিও, কিন্তু সনাতনের কাছে এটা মন্দির। একটাই ভালো কথা যে তার কাজের ঘর তার বাড়ির সঙ্গেই, বাইরে যেতে হয় না, কিন্তু আজ সেটুকু উঠে যাবার ক্ষমতাও সনাতনের নেই। তার একটা ছেলেও নেই যে হাতে হাতে কাজ করবে, দুটোই মেয়ে। বড়োটার বিয়ে হয়ে গেছে, গলায় ঝুলছে ছোটোটা, এগারো ক্লাসের পর তাকে আর পড়াতে পারেনি সনাতন। জানলা দিয়ে সনাতন দেখল কাজের ঘর শূন্য, আধগড়া এক মেটে প্রতিমার খণ্ড খণ্ড পড়ে রয়েছে এদিক ওদিক, রঙের বাটি, তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু ঘরটা যতটা লক্ষ্মীছাড়া থাকার কথা ছিল, তত তো লাগছে না। বরং সনাতন কাজ করার সময় যতটা অগোছালো থাকে, তার তুলনায় এখন অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কে করল? কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল সনাতন ভালো করে দেখবে বলে। যা দেখল তাতে সে অবাক হয়ে গেল। শুয়ে ঘরের ওই কোণটা দেখতে পাচ্ছিল না। এখন আধবসা হয়ে সে দেখল কাজঘরের একেবারে ওই কোণটায় তার মেয়ে শংকরী খুব মন দিয়ে মাটি ছানছে, তার সামনে একটা ছোট্ট, একহাত ঠাকুর, অর্ধেক বানানো হলেও ওটা যে মায়ের প্রতিমা তা এখান থেকেই বুঝতে পারল সনাতন। বিস্ময়ে সে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। শংকরী বানিয়েছে ওই ঠাকুর? কে শিখিয়েছে? কখন শিখল সে? বরাবর সে একাই কাজ করে, একটা ফাইফরমাশের ছোড়া আছে, অর্ধেকদিন তার টিকি দেখা যায় না, রংটা এগিয়ে দেওয়া, মাটি ছানা সব সনাতনকে একা হাতেই করতে হয়। শংকরী আসে মাঝে মাঝে চা টিফিন দিতে। সনাতন টের পায় সে পেছনে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টের পেলেই সে খেদিয়ে দেয় ‘যা যা মেয়েমানুষের এখানে কী? দেখ মা কী করছে? আজ ভাতের মধ্যে কটা কাঁঠাল বিচি ফেলে দিস তো। নুন তেল কাঁচালংকা দিয়ে ভলো করে মাখবি’ শংকরী তবু যেত না এক তাড়ায়, দাঁড়িয়েই থাকত। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, যার মানে একটাই ভবিষ্যৎ তার। বিয়ে। বিয়ের কথা খুব একটা ভাবতে চায় না সনাতন। এক তো তার টাকার জোর নেই। দুই, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে সংসার অচল হয়ে পড়বে। তিন, হ্যাঁ বিয়ের সবচেয়ে বড়ো বাধা তিন নম্বর কারণটা। আসলে শংকরীর মুখশ্রী যেমনই হোক চোহারাটা বড্ড দাম্বালে গোছের। যেমন লম্বা, তেমন চওড়া, খাটতে পারে সে কারণেই প্রচুর, শরীরে যেন বুনো মোষের তাকত, কিন্তু একটু নরমসরম মেয়েলি চেহারা না হলে বিয়ের বাজারে চালানো যাবে ও মেয়েকে?

বড়োটার চেহারাটা মেয়েলি ছিল, টুকটুকে ফরসা, পাতলা পাতলা গড়ন। মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে পলতা গেছিল, সেখানেই পছন্দ করে ছেলের দিদি, শাঁখা সিঁদুরেই পার হয়ে গেছে বড়ো মেয়ে, এখন দিব্যি সংসার করছে। আর এ মেয়ের কপালে কী যে আছে। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে ওঘরে যায় সনাতন। শংকরী টের পায় না বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। মাটি রং দিয়ে সে তখন আস্ত একটা পৃথিবী গড়তে ব্যস্ত। সনাতন মুগ্ধ হয়ে দেখে তার কাজ। একটা অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে, কখনও তো হাতে ধরে শেখায়নি মেয়েটাকে, সারাজীবন খেদিয়েছে শুধু। জ্বর বলেই নাকি অন্য কোনও কারণে তার চোখে জল এসে যায়। সে শংকরীর মাথায় হাত ছুঁয়ে ডাকে ‘মাগো, তুই নিজে, একা একা’ আর সে বলতে পারে না, গলা বুজে যায়। শংকরী চমকে উঠে দাঁড়ায়, ধরা পড়ে যাবার লজ্জা ও ভয়ে সে মাথা নিচু করে ঘামতে থাকে। তার দিকে না তাকিয়ে সনাতন ভালো করে তার গড়া ঠাকুরটি নিরীক্ষণ করে। প্রতিমার আসল জিনিস অঙ্গসংস্থান, সেটা যে আয়ত্ত করতে পারে, তার কাছে ছোটো বড়ো প্রতিমা কোনও ব্যাপার নয়। পারবে, শংকরী পারবে, এই তো তার উত্তরসূরি। কথাটা মনে হতেই সনাতনের ম্যাজমেজে ভাব কেটে যায়, শরীরে যেন তাজা রক্তস্রোত বয়ে যায়। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা আসে। মেয়েমানুষের তো হাজারটা ফ্যাকড়া। সে গলা ঝেড়ে মেয়েকে বলে, ‘হ্যাঁ মা, তোর কাচা কাপড় তো? শরীর ঠিক আছে তো, মানে ওই ঋতুস্রাব…’

পরদিন তেড়েফুঁড়ে উঠল সনাতন। এতবছরের অপরাধ ও একদিনে স্খালন করবে এমন যেন সংকল্প তার। তার বউ অষ্টমী, বাতের ব্যথা আর নানা মেয়েলি অসুখে বারো মাস বিছানায় শোয়া, তার কানে গেল কথাটা। সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করল।

‘ভীমরতি হয়েছে এই বয়সেই? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েমানুষ পটুয়া হবে? একে ওইরকম হিড়িম্বা রাক্ষুসীর মতো চেহারা, ওর ওপর পটুয়া রটে গেলে ও মেয়ের আর বর জুটবে?’

সনাতন কান দেয় না ও কথায়। মেয়েমানুষ নাকি চাঁদে যাচ্ছে, তা আকাশের মাথায় উঠতে যদি পারে মাটি ঘেঁটে ঠাকুর বানাতে পারবে না? আরে মাটি মানে তো স্বয়ং জননী বসুন্ধরা। তা তিনি নিজেই তো মেয়েমানুষ। এসব কথা নিজের মধ্যেই রাখে সনাতন। এত কথা বলেই কি লাভ? অষ্টমী ওসব শোনার লোকই নয়। তাছাড়া সনাতনের সময় নষ্ট করার সময় নেই মোটে। পুজো এবার আগে পড়েছে। এতগুলো বায়না। চকগড়িয়া বারোয়ারি পুজো, টালিগঞ্জের সেভেন ফাইটার্স ক্লাব, সবচেয়ে চাপের ওই বেহালার মন্ত্রীর পুজোটা, দুম করে কোনদিন যে বলে বসবে ডেলিভারি নেব। তবু বুকের মধ্যে ভরসা টের পায় সনাতন। এবছর তার সঙ্গে শংকরী আছে। ভোর থেকে উঠেই কাজে লেগে পড়ে সনাতন, রান্নাবান্না সেরে সংসারের কাজ গুছিয়ে শংকরী আসে একটু পরে। সনাতনের কড়া নির্দেশ স্নান সেরে আসতে হবে আর মাসের ওই চারটে দিন সে কাজে হাত দিতে পারবে না। শংকরী এমনিতে কম কথা বলে। শক্ত চেহারার ঠোঁটটেপা মেয়ে সে। কিন্তু চারদিন কাজে হাত দিতে পারবে না শুনে সে আস্তে করে বলেছিল ‘মা দুগ্গাও তো মেয়েমানুষ বাবা, মহিষাসুরকে মারার সময় যে তাঁর মাসিক হচ্ছিল না, এ কথা কে বলতে পারে?’

সনাতনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল শুনে। আজকালকার মেয়েদের মুখে কিছুই আটকায় না। সে ঢোঁক গিয়ে বলেছিল ‘শোন ঠাকুর গড়া অত হতচ্ছেদ্দার কাজ নয় বুঝেছিস। জি পালের নাম শুনেছিস?’

জি পালের নাম বলার সময় কপালে হাত ঠেকায় সনাতন।

শংকরী হাঁ করে শোনে সে গল্প।

‘জি পাল মানে গোপেশ্বর পাল। বিলেতে গিয়ে সাহেবদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।’ সনাতন বলে যায় গোপেশ্বর পালের জন্ম ১৮৯৫ সালে, তিন বছরে মা মারা যায়, মামার বাড়িতে মানুষ, কৃষ্ণনগরে মাটির কাজে হাতেখড়ি। সেখানে একবার ঘূর্নিতে এলেন স্বয়ং ছোটোলাট কারমাইকেল, তাঁর চোখে পড়ল গোপেশ্বরের প্রতিভা। সেটা ১৯১৫ সাল, গোপেশ্বর তখন কুড়ি বছরের যুবক। তারপর সে চলে এল কলকাতা। আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। ১৯২৮ সালে গোপেশ্বর পাল বিলেতে যায়। সেখানে পঞ্চম জর্জের ভাই ডিউক অব কনটের মূর্তি পাঁচ মিনিটে বানিয়ে ধন্য ধন্য ফেলে দেয়। সাহেবদের কাগজেও ছাপা হয়েছিল সে খবর।

‘জি পালের সঙ্গে জাহাজে চেপে বিলেতে আর কী গেছিল জানিস?’

এই অবধি বলে সনাতন খানিকটা কুইজমাস্টারের ঢঙে শংকরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওর জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই বলে ‘মাটি রে মাটি। বড়ো বড়ো দু-ব্যারেল ভর্তি বাংলার মাটি। তাহলে বুঝলি তো মাটি কত পবিত্র জিনিস। সবসময় এই মাটিকে প্রণাম করে কাজ শুরু করবি।’

শংকরী বলে ‘আমাদের নিজেদের লোক বিলেত গেলেন, সে তো কত আগে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কি কিছু পালটাল? এই নোংরা গলি, প্যাচপ্যাচে রাস্তা, অন্ধকার ঘরে কাজ – এই চলছে।’

সনাতন একটু থমকে যায়, তারপর বলে ‘মা যদি তাঁর সন্তানের কপালে দুঃখ লিখে রাখেন, খন্ডাবে কার বাপের সাধ্যি? নে নে কার্তিকটা ধরে ফেল।’

‘কার্তিক?’ কেমন ধন্দে পড়ে যায় শংকরী। ‘আমি কার্তিক করব?’

‘কেন? পারবি না? খুব পারবি’ বলে সনাতনের খেয়াল হয় মেয়ের কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। সে শংকরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ‘ওরে দেবতার যেমন নারী পুরুষ হয় না, শিল্পীরও নারী পুরুষ হয় না। মনে রাখবি, সব মূর্তিই তোর কাছে সমান।’

সনাতন আরো কিছু বলত হয়তো। কিন্তু কে যেন ডাকে তাকে বাইরে থেকে। বাইরে এসে দেখে নাড়ু। কারুভান্ডার দোকানটা ওদের। প্রতিমার চুল, চাঁদমালা, চুমকি, কিরণ, গোখরী, জামীর ভুরো, পাট, অস্ত্র সব ওরা সাপ্লাই দেয়। নাড়ু জানতে এসেছে কটা কী লাগবে। সনাতন ওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে তখন বাবার অর্ধেক গড়া কার্তিক মূর্তির সামনে অচঞ্চল হয়ে বসে থাকে শংকরী। পরম রূপবান পুরুষ তার সামনে। মূর্তির ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায় শংকরী, ওর আঙুল আস্তে আস্তে মূর্তির শরীরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে। আপাদমস্তক এক পুরুষশরীর প্রথমবার ছুঁয়ে শরীর-মনে কেমন এক জোয়ার অনুভব করে শংকরী। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলায়। চোখ বুজে কী যেন ভাবে একটুক্ষণ। তারপর যখন চোখ খোলে, তখন সে দেখে কার্তিক কোনও পুরুষ নয়, সে শংকরীর সামনে একটি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে এটুকুই জানে শংকরী।

পটুয়াপাড়ায় বছরের এই ক’টা মাস কখন সকাল সন্ধেয় গড়ায়, সন্ধে গভীর রাতে কেউ জানতেও পারে না। এ বছর তার সঙ্গে লেগেছে বৃষ্টি। প্রতিমাশিল্পীদের মাথায় হাত, মাটি শুকোচ্ছে না। রং লাগানো হবে কখন? গলি ভেসে যাচ্ছে সকাল থেকে। কী একটা দম বন্ধ করা গন্ধ উঠেছে। কাজ করতে করতে নাড়ুর গলা পেয়ে রাগ ওঠে শংকরীর। নাড়ু আজকাল বড্ড ঘন ঘন আসছে আর লাগাতার আনসান বকুনি। আজ ভিজে জাব হয়ে এসেছে। আর এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে নাড়ু বলে, ‘ও কাকা, কী শুনে এলাম শোনো। রেনবো চ্যানেল থেকে আসবে শংকরীর ইন্টারভিউ নিতে!’

সনাতনের হাত থেমে যায়।

‘হ্যাঁ গো কাকা, মেয়েছেলে মূর্তি গড়ছে, চাউর হয়ে গেছে তো। ওরা দেখাবে টিভিতে।’

সনাতনের বুকে ধক্ করে লাগে কথাটা। এত বছর সে মাটিতে মুখ ঘষছে কেউ ফিরেও তাকায়নি, টিভি দূরের কথা কাগজেও ছবি ওঠেনি তার, আর তার মেয়ে দুদিন কাজ করেই এত মাতব্বর হয়ে গেল!

সে শক্ত মুখে বলে ‘না না, ওসব মাতনে মাতলে কাজবাজ মাথায় উঠবে। পুজো তো দোরগোড়ায় এসে গেল। মন্ত্রীর পুজো নিয়েই বেশি চিন্তা। কবে যে ফিতে কাটার দিন ফেলে।’

নাড়ু বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘আরে কাকা, এসব এখন দরকার। প্রচার হবে, তাও ফ্রিতে। টিভিতে মুখ দেখাবার জন্যে সবাই হন্যে হয়ে ঘুরছে।’

সনাতন এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘নাড়ু, তুই এখন যা দিকিনি। এই তো ঘরের ছিরি, চারদিকে সব থইথই করছে, কোথায় বসতে দেব ওদের? আর আমাকে তুই টিভি শেখাচ্ছিস? আমি দেখিনি, বাবু পালের বাড়ি কতবার এল ওরা। একেবারে একগাড়ি লোক। কাজ নষ্ট সারাদিনের।’

‘হ্যাঁ, তা একটু হবে, তবে এই ঘরটাই তো তুলতে চাইছে ওরা। আবার বলছে একদিন শংকরীকে নিয়ে যাবে, রিয়েলিটি শো হয় না, লাগ ভেলকি লাগ? সেখানে পার্টিসিপেট করতে হবে ওকে। কত প্রাইজ আছে জানো?’

‘না না ওসব হবে না। মেয়েমানুষ একবার ঘরের বার হলে রক্ষে আছে? এই কাজ কি ও বারোমাস করবে নাকি? এবছর আমার শরীরটা যুতে নেই, ও বাড়ি বসে আছে, বিয়ের পর বাচ্চার কাঁথা কাচবে, না ঠাকুর গড়বে? যত পাগলের কাণ্ড। ভাগ তুই।’

‘দাঁড়া নাড়ু’ হঠাৎ কার গলা? চমকে তাকায় সনাতন, শংকরী এতক্ষণ মুখ নীচু করে কাজে মন বসাবার চেষ্টা করছিল, একটা রা-ও কাটেনি, মুখ তুলে অষ্টমীকে দেখতে পায়। অষ্টমী, বারোমাস বিছানায় পড়া মানুষটা উঠে এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সনাতন অবাক গলায় বলে ‘তুমি রুগি মানুষ উঠে এলে যে বড়ো? মেয়েমানুষ এসবের মধ্যে কেন আবার?’

‘মেয়েমানুষের মূর্তি গড়ে ভাত খাও আর ঘরের মেয়েমানুষদের দাবিয়ে রাখো, আমি বলছি আমার মেয়ে যাবে।’ অষ্টমী চ্যাঁচায় না, অদ্ভুত শান্তগলায় বলে ‘বিয়ে দিলেই সব মিটে গেল? ওর ভবিষ্যৎ নেই? দরজায় সুযোগ হেঁটে আসছে, উনি বলছেন যাবে না। বড্ড জ্বলুনি না? কেমন বাপ তুমি? মেয়েকে হিংসে করো?’

সনাতন রাগে থরথর করে কাঁপে। হাতের কাছে থাকা একটা মাটির খুরি ছুড়ে মারে, অষ্টমী মাথা সরিয়ে নেয় চট করে, দরজায় লেগে ভেঙে যায় খুরিটা। পা বাঁচিয়ে গিয়ে মাকে ধরে শংকরী।

দরজার পাশে ডাঁই করা অস্ত্র, নাড়ু রেখে গিয়েছিল কাল। সেখান থেকে একটা ত্রিশূল তুলে নিয়ে খুরির টুকরোগুলো একপাশে ঝেঁটিয়ে আনে শংকরী, তারপর সেই ত্রিশূল হাতে মার পাশে যখন দাঁড়ায়, সনাতনের তাক লেগে যায় দেখে। তার ভাঙা ঘরের নড়বড়ে দরজার চালচিত্রে তার অসুন্দর মেয়েটাকে অবিকল গর্জনতেল মাখা দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখায়…

 

অরুণিমা

‘সাগ্নিক, আজ দিদি আর জামাইবাবু আসছে খেয়াল আছে তো? ট্রেনের সময়টা নেট-এ চেক করে স্টেশনে পৌঁছে যেও। দেখো দিদিদের যেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করতে হয়। আমি আজ কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না। বাইরে থেকে ডেলিগেট্স আসছে। ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর হবে না’, অরুণিমার কথাগুলো সাগ্নিকের কানে ঢুকল। কাজের থেকে চোখ না তুলেই স্ত্রীকে উত্তর দিল, ‘আমি যেতে পারব না। ফোন করে দাও, ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবে।’

‘বিয়ের পর প্রথমবার ওরা আমাদের বাড়ি আসছে। এখান থেকে কেউ না গেলে ওরা খারাপ মনে করবে। তোমার দিদি যখন এখানে এসেছিল তখন তুমি এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে কাজ করেছিলে। এখন একটা দিন তুমি করতে পারছ না?’ বিরক্তি চাপতে পারে না অরুণিমা।

নিরুত্তাপ গলায় সাগ্নিক উত্তর দেয়, ‘দিদি আমাদের সুখের সংসার দেখতে এসেছিল। আমরা যে অত্যন্ত সুখে রয়েছি সেটা দিদিকে বোঝাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় দিদিকে খুব নিরাশ মনে হল। বিয়ের পরেই ভেবে নিয়েছিলাম যখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে, নিজের টাকাপয়সাও যার যার নিজের, বন্ধুবান্ধবও দুজনের আলাদা তখন তোমার আত্মীয়স্বজনরা আমার হয় কী করে? এটাই বেশ ভালো ব্যবস্থা। তুমিই বলো না?’

অরুণিমার নিজের করা ব্যবস্থাই আজ হঠাৎ করে মোড় ঘুরে ওকেই আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।

ছয় বছরের প্রেমপর্ব শেষ করে সাগ্নিক আর অরুণিমার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের এক বছর হতে না হতেই বিয়ের আগের গভীর প্রেম ওদের দুজনের সংসারের চৌকাঠ পার করে বাইরে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। একে অপরকে অপমান করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করত না। মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে ওদের ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে হোটেল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিল হোটেলের ম্যানেজার। অগত্যা হোটেল ছাড়তে ওরা বাধ্য হয়েছিল।

অথচ হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল ছ’দিনের জন্য। ম্যানেজারের কথা শুনেই অরুণিমা তাই রেগে ওঠে, ‘আমরা আগে থেকে পুরো টাকা দিয়ে রুম বুক করেছি। আপনি আমাদের চলে যেতে কীভাবে বলছেন?’

‘আপনি ঠিকই বলছেন ম্যাডাম। কিন্তু আপনাদের জন্য হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের আমি অসুবিধায় ফেলতে পারি না। আর আপনি অ্যাডভান্স টাকা দেওয়ার কথা বলছেন, তাহলে আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাগের মাথায় আপনারা স্বামী-স্ত্রী হোটেলের সম্পত্তির অনেক ক্ষতি করেছেন। কাপ, কাচের বাসন ভেঙেছেন। সুতরাং সেগুলোর টাকা তো আপনাদেরই চুকোতে হবে। এই সব টাকা কেটে নিয়ে যে-টাকাটা বাঁচবে সেটা আপনাদের ফেরত দেওয়া হবে।’ ম্যানেজারের উত্তরে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝতে পারে সাগ্নিক আর অরুণিমা।

হোটেলের ঘরে ফিরে আসে ওরা। হোটেল ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে স্থির করে নেয় পরের দিনই ওরা হোটেল ছেড়ে দেবে। ব্যস, আর কোনও কথা হয় না ওদের মধ্যে।

পরের দিন হোটেল ছেড়ে অন্য হোটেল খুঁজে নেয় সাগ্নিক। কারণ ফেরার টিকিট কাটা ছিল চারদিন পরের তারিখে। সুতরাং দু’জনেরই আগে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় ছিল না ওদের কাছে।

‘হ্যাঁ রে কেমন কাটল তোদের ওখানে?’ সাগ্নিকের মায়ের কণ্ঠস্বরে অরুণিমা মোবাইল থেকে মুখ তোলে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফেরার আগে সাগ্নিকের বাবা-মায়ের অনুরোধে তিনদিনের জন্য ওরা এখানে এসেছে। সাগ্নিকের বাবা, মা দুজনেরই বয়স হয়েছে তারপর ওই একমাত্র ছেলে। সুতরাং ছেলে-ছেলে বউয়ের কাছেই ওদের যা কিছু আশা। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক দূরে সুতরাং ইচ্ছে থাকলেও মেয়েকে কাছে পাওয়া হয় না। আর অরুণিমাও মেয়েই হয়ে উঠেছিল ওদের কাছে কারণ পাঁচ বছরেরও বেশি দেখছেন ওনারা ওকে।

‘হ্যাঁ জায়গাটা তো বেশ ভালোই, খারাপ কাটেনি কয়েকটা দিন’, কম কথায় সারবার চেষ্টা করে অরুণিমা কিন্তু ওর নিষ্প্রভ চেহারা সাগ্নিকের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

‘কী ব্যাপার বল তো? তোকে আর বাপ্পাকে কেমন যেন মনমরা লাগছে। মনেই হচ্ছে না এই কদিন আগে তোদের বিয়ে হয়েছে। কোনও সমস্যা?’

‘মা, তোমাকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল করে ফেলেছি। সাগ্নিক আর আমার একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।’

‘কী বলছিস তুই? ছয় বছর তো একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারতিস না। বাপ্পাকে কত বলেছিলাম, দিদির বিয়েটা হয়ে যেতে দে, তারপর বিয়ে করিস কিন্তু তোরা দুজন আমার কথাই শুনিসনি।’

‘তুমি ঠিকই বলছ। সত্যি বলতে কি এই কয়দিনে সাগ্নিকের আসল রূপটা আমার সামনে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। মনেই হচ্ছে না এই মানুষটার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম,’ গলা বুজে আসে অরুণিমার।

‘কী ভেবেছিলাম আর কী হল। ভেবেছিলাম তোরা দুজন সুখী হলে আমরাও আনন্দে থাকব। এখন তো সবই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আমার এটাই দুঃখ যে ছয় বছরের পরিচয়েও তোরা একে অপরকে চিনতে পারলি না।’

‘মা, এটা নিয়ে এত চিন্তা কোরো না। কয়েকটা দিন আরও দেখি। সাগ্নিক বলছিল একান্তই যদি কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে না পারি তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব।’

‘খবরদার, ভবিষ্যতে কখনও এই কথা মুখে আনবি না। বাপ্পার সাহস তো কম নয়। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ কখনও ডিভোর্সের কথা উচ্চারণই করেনি আর করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। চারদিন বিয়ে হয়েছে তোদের আর এখনই ডিভোর্স নেওয়ার কথা ভাবছিস!’ অরুণিমা বেশ বুঝতে পারে সাগ্নিকের মা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

‘মা, এখনই এতটা উত্তেজিত হয়ে পোড়ো না। ছয় মাসের মধ্যে কিছু করব না। তবে সব ফ্যামিলিতেই কোনও কাজ কখনও না কখনও প্রথমবারই করা হয়। বিয়ে করার অর্থ এও তো নয় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলেও বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে,’ অন্যমনস্কভাবে অরুণিমা কথাগুলো বললেও, সাগ্নিকের মায়ের ছায়াঘন অন্ধকার মুখখানা তিরের মতো অরুণিমার বুকে গিয়ে বিঁধল।

দিদিকে স্টেশন থেকে আনা নিয়ে অরুণিমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সাগ্নিকের মন বারবার অশান্ত হয়ে উঠছিল। ভাবল মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনটা একটু শান্ত হবে, এই ভেবে বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল সাগ্নিক।

‘কী রে, ব্যাপার কী তোর? আজ হঠাৎ মায়ের কথা কী করে মনে পড়ল?’ সাগ্নিকের গলা শুনেই মা অভিমানের স্বরে বলে উঠলেন।

‘তুমি কী যে বলো মা! কাউকে ভুলে গেলে তবেই মনে পড়ার প্রশ্ন আসে। আর তুমি তো সবসময় আমার সঙ্গেই আছ।’

‘ভালো লাগল বাপ্পা তোর কথা শুনে। আর বল, কেমন সংসার করছিস?’

‘আজ অরুণিমার দিদি, জামাইবাবু আমাদের এখানে আসছেন। অরুণিমা খুব খুশি। আমাকে বলেছে ওদের স্টেশন থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমার কাজ আছে, যেতে পারব না,’ বলে হালকা হবার চেষ্টা করে সাগ্নিক।

‘তোর কী হয়েছে বাপ্পা? পাড়ার মধ্যে কারও দরকার হলে, সাহায্যের জন্য তুই ঝাঁপিয়ে পড়তিস…অতিথি আমার তোমার হয় না, সকলেরই তার জন্য করা উচিত,’ মা বোঝাবার চেষ্টা করেন।

‘দিদিও তো এসেছিল। অরুণিমা দিদির সঙ্গে অপরিচিতের মতোই ব্যবহার করেছে। এটা আমি চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।’

‘সংসারে নানা কথা হয় কিন্তু তাই বলে অশান্তি বাড়ালে বাড়তেই থাকে। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে থাকতে হবে সুতরাং একটু বুঝে চললে পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’

‘মা, তুমি সবসময় আমারই দোষ ধরো। আমি যদি ঠিকমতো উত্তর না দিতে পারি তাহলে সেটা আমার হার হবে। তুমি তো জানো হার স্বীকার করা আমার ধাতে নেই।’

‘সব কিছুকেই হার-জিত হিসেবে ধরছিসই কেন? বিবেক বলেও তো মানুষের কিছু থাকে। বিবেক যা বলে তাই সকলের করা উচিত। যাই হোক, তোদের খবরাখবর বল।’

‘এমনি সব ঠিকঠাকই আছে। তুমি আর বাবা কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাও। তোমাদের ভালো লাগবে।’

‘ঠিক আছে দেখছি। এখন ফোন রাখি। অরুণিমাকে বলিস পরে ওর সঙ্গে কথা বলব কারণ এখন ওর অফিস বেরোনোর সময়।’ এই বলে ফোন রেখে দেন সাগ্নিকের মা।

ছোটো থেকেই অরুণিমার উপর ওর মায়ের প্রভাব একটু বেশিই ছিল। বাবা বরাবর বাইরে বাইরে চাকরি করেছেন তাই মায়ের সঙ্গেই সময় কেটেছে বেশি অরুণিমা ও ওর দিদি অমৃতার। বয়সে ছোটো বলেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, অরুণিমা একপ্রকার মায়ের ন্যাওটাই ছিল। ছোটো থেকেই মায়ের কাছে অরুণিমা শিখেছে, নিজের ভালোর জন্য সবসময় সজাগ থাকাটা এবং ব্যক্তিত্ব রাখাটা খুব দরকার যাতে অপর পক্ষ দেখে ভয় পায়। এমনকী কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের ভয় দেখাতে হবে এমনটাও অরুণিমার, মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা সবসময় বলতেন, ‘সবরকম বিপদ থেকে আমি তোদের বুক দিয়ে আগলেছি। তোদের বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার পরিবারের লোকজন আমার জীবন প্রায় নরক করে তুলেছিল। ওরা তখন বুঝতে পারেনি যে আমি নরম মাটি দিয়ে তৈরি হইনি, রুখে দাঁড়িয়েছি ওদের বিরুদ্ধে।’

অরুণিমার কাছে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথাই ছিল অটল সত্যি। এমনকী মায়ের অনুমতিতেই সাগ্নিকের সঙ্গে প্রেমটা এগোতে পেরেছিল।

বিয়ের পরেও নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সাগ্নিক এবং ওর মা-বাবা-দিদির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল অরুণিমা।

সংসারে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে সাগ্নিকের মনকে বিরূপ করে তুলেছিল। সাগ্নিকের প্রতিশোধপ্রবণতার প্রমাণ হাতেনাতে পেল যখন সাগ্নিক অরুণিমার দিদিকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে অস্বীকার করে মুখের উপরে ওকে জানিয়ে দিল। অরুণিমারও স্টেশন যাবার উপায় ছিল না অফিসের কাজের জন্য। অগত্যা ফোন করে অরুণিমা দিদিকে জানিয়ে দিল ট্যাক্সি করে ওদের বাড়ি চলে আসতে। বাড়িতেও কাজের লোককে অতিথিদের ঠিক করে অভ্যর্থনা করার কথা বুঝিয়ে অফিসের জন্য রওনা হল অরুণিমা। কিন্তু মন পড়ে রইল বাড়িতে।

‘জানিনা, দিদি কী ভাবছে আমাদের সম্পর্কে। বিয়ের পর প্রথমবার আমাদের বাড়ি আসছে তাও জামাইবাবু মানে কৃষ্ণেন্দুদা-র সঙ্গে। মুম্বই যখন পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম তখন প্রায়ই হস্টেল থেকে দিদির ওখানে পালিয়ে যেতাম। দিদির যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না। আর রান্না করতে দিদি প্রচণ্ড ভালোবাসে এবং সেই সঙ্গে খাওয়াতেও। রোজই নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াত। আর আজ যখন দিদিরা আসছে তখন আমরা কেউই বাড়িতে রিসিভ করার জন্য থাকছি না,’ অফিসের সহকর্মীর কাছে মনের অস্থিরতাটা চেপে রাখতে পারে না অরুণিমা।

অরুণিমা নিজে রান্নাঘরে ঢুকতে পছন্দ না করলেও দিদির কাছে শুনেছিল, কৃষ্ণেন্দুদা বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই আগে থেকেই সব রকমের ফল, সবজি, খাবার কিনে ফ্রিজ ভরে রেখেছিল অরুণিমা। সন্ধেবেলায় অফিস থেকে যখন বাড়ি পৌঁছোল, ভিতরে পা দিতেই হাসির শব্দ ভেসে এল অন্য ঘর থেকে। নিজের অজান্তেই অরুণিমার ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল। ঘরের দিকে পা বাড়াল অরুণিমা।

‘কী ব্যাপার? এত হাসাহাসি কীসের জন্য? আমাকেও তো কিছু বল দিদি।’ কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে অরুণিমা বলল, ‘ভেরি সরি, কৃষ্ণেন্দুদা। কিছুতেই স্টেশন যেতে পারলাম না, অফিসে ছুটি পেলাম না। নিজের লোকেদের জন্যই চাকরি করা অথচ দেখুন তাদের দরকারেই ছুটি পাওয়া যায় না।’

‘নিমি, এত দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাগ্নিক, অতিথি সৎকারে কোনও ত্রুটি রাখেনি। বরং বলতে পারো, তোমার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই হয়নি,’ কথাটা বলেই কৃষ্ণেন্দু হেসে ফেলে।

‘আঃ! তুমি রাখবে। নিমিকে দেখলেই হল। ওর পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চাও না। বেচারা অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছে,’ অমৃতা কৃষ্ণেন্দুকে থামাবার চেষ্টা করে।

‘আমি তোমার বোনকে কেন খ্যাপাব? আমাদের জন্য বেচারা শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগবে কেন? আমরা তো দিব্যি আরামেই সময় কাটাচ্ছিলাম,’ কৃষ্ণেন্দু পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি কৃষ্ণেন্দুদা। আমি না থাকলেই সবাই বেশি খুশি থাকে,’ সিরিয়াস হওয়ার ভান করে অরুণিমা।

‘দ্যাখো ভাই, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সাগ্নিকই দিতে পারে। আমরা তো মাত্র কয়েক ঘন্টাই এসেছি। আমার তো আবার শালির সঙ্গ বেশি ভালো লাগে।’ কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে অরুণিমাও হেসে ফেলে।

সাগ্নিক শান্তস্বরে বলে ওঠে, ‘কৃষ্ণেন্দুদা, আপনি ভুল করছেন। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমি কবেই বন্ধ করে দিয়েছি। কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিই।’

‘বাঃ, ভায়া! কৌশলটা খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেছ দেখছি। এত বছর বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এটা এখনও আমি রপ্ত করতে পারলাম না,’ কৃষ্ণেন্দু আবার হেসে ফেলে।

‘দেখছিস দিদি, যে আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতে পারে তার কাছে আমার কী আর এক্সপেকটেশন থাকতে পারে?’ অরুণিমার স্বরে কথার ঝাঁঝ স্পষ্ট ধরা পড়ে।

‘তুই শুধু শুধু সিরিয়াস হয়ে পড়ছিস। সাগ্নিক তোর সঙ্গে মজা করছে। সব কথার কি মানে ধরতে আছে?’ অমৃতা বোনকে বোঝাবার চেষ্ট করে।

‘আমি তো বলা, শোনা সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছি দিদি। মা তো প্রথমেই সাবধান করেছিল যে আমাদের আর সাগ্নিকদের বাড়ির কালচারে আকাশপাতাল তফাত। কিন্তু আমিই তখন কথা শুনিনি।’

‘বুঝেছি। আজকাল বুঝি মায়ের কথাতেই উঠছিস বসছিস?’ গম্ভীর হয় অমৃতা।

‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, আর এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? মায়ের থেকে ভালো আমার ভালো-মন্দের কথা আর কে ভাববে বল? মা আমাদের দু’জনের বন্ধুও তো বটে। কেন, তোর এটা মনে হয় না দিদি?’

‘মায়ের কথায় সংসার চালাচ্ছিস? সংসারটা তোর আর সাগ্নিকের না আমাদের মায়ের যে, মা তোর সংসারের চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখতে চাইছে?’ সাগ্নিক আর অরুণিমা দুজনের মধ্যে একটা টেনশন চলছে এমন আাঁচ পেয়ে, রাগত গলায় অমৃতা বোনকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।

দুই বোনকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণই সাগ্নিককে নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসে। অমৃতা ঠিকই করে নেয় বোনকে বোঝানো দরকার কারণ কথাবার্তার মাঝেই বুদ্ধিমতী অমৃতা বুঝে নিয়েছিল সাগ্নিক আর ওর বোনের সম্পর্কটা একটু শুধরোনো দরকার।

‘দিদি, আমি জানি সংসারটা আমাদের, কিন্তু মায়েরও আমাকে বলার অধিকার আছে। মা-কে আমি প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। প্রয়োজনে আমি মায়ের জন্য সবকিছু করতে পারি। এখন আমাদের বিয়েটা বাঁচাবার জন্য মা উঠে পড়ে লেগেছে। তুই বিশ্বাস করবি না দিদি, বিয়ের পর সাগ্নিক কতটা বদলে গেছে। সব সময় নিজের মত আমার উপর চাপাবার চেষ্টা করে। আমার যে আলাদা একটা আইডেনটিটি আছে সেটা ও মানতে চায় না। মা প্রথমেই বলে দিয়েছিল শক্ত হাতে সাগ্নিকের এই অভ্যাসটা দমন করতে, নয়তো আমাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ফেলতে ও এক মুহূর্তও দেরি করবে না। সুতরাং সাগ্নিক যাই করুক না কেন আমি সাবধান হয়ে গেছি।’

‘কী বলছিস তুই?’ অমৃতা বিস্ময় চাপতে পারে না। ‘সাগ্নিকের নিন্দে করাটা মায়ের কাছে কি খুব দরকার ছিল? আমাদের জন্য মায়ের চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও একটা সংযমের সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে। তুই এখন বাচ্চা নোস যে সব কথায় মা-কে টেনে আনতে হবে। নিজের ডিসিশন নিজেকেই নিতে হবে।’

‘আচ্ছা ছাড় দিদি, এসব কথা। স্টেশন থেকে বাড়ি আসতে তোদের কষ্ট হয়নি তো?’

‘কষ্ট কেন হবে? সাগ্নিক তো স্টেশনেই ছিল। বাড়ি নিয়ে আসা থেকে খাওয়াদাওয়া যত্নের কোনও ত্রুটি রাখেনি।’

‘আর একটা দিন দিদি কষ্ট কর। এর পর পাঁচদিনের ছুটি রোববার নিয়ে। খুব মজা করব। বাইরেই খাওয়াদাওয়া সেরে নেব। বাড়িতে ওসব ঝঞ্ঝাটই রাখব না,’ অরুণিমা দিদির গলা জড়িয়ে ধরে।

‘না রে সে হবে না। কৃষ্ণেন্দু বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করে না। আমি রান্না করতে ভালোবাসি, আমিই নতুন নতুন রান্না করে তোদের খাওয়াব। সাগ্নিক রান্না করে?’

‘হ্যাঁ। আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছেমতো নিজেরাই আলাদা করে খাবার বানিয়ে নিই। মায়ের কথামতো রান্না করে খাইয়ে সাগ্নিকের অভ্যাস আমি খারাপ করতে চাই না। রান্না করাটা কি খালি মেয়েদেরই কাজ, তুই বল না দিদি?’ দিদির কাছে সব কথা বলতে পেরে, এখন কিছুটা হালকা অরুণিমা। প্রায় জড়তাহীনভাবে বলল, ‘সংসার করবার প্রথমেই মা সাবধান করে দিয়েছিল যে, রান্না না করার সবথেকে ভালো দিক হল, বাড়িতে ভালো রান্না হলে খেয়েদেয়ে বাড়ির পুরুষ-মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হবে। অযথা মেদ বাড়বে। এই ভালো, এতে চেহারাও ভালো থাকবে, বাড়িঘর নোংরাও হবে না।’

‘হ্যাঁ। তাই জন্যই মা, বাবাকেও নিজের জীবন এবং সংসার থেকে দূরে রেখেছিল,’ অমৃতার গলায় মায়ের প্রতি বিদ্বেষ ঝরে পড়ে।

‘কী বলছিস তুই দিদি?’ অরুণিমার স্বরে অবিশ্বাস।

‘না, না কিছু না। আমার মুখ থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছে।’

‘না, দিদি। তুই আমার থেকে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিস। তোকে বলতেই হবে,’ অরুণিমা জেদ ধরে।

‘লুকোবার মতো কিছু নয়। মা তোকে যেটা শেখাচ্ছে নিজের জীবনেও ওই একই জিনিস করেছে। তুই তখন খুব ছোটো ছিলি। কিন্তু আমার সব মনে আছে। বাড়িতে রান্নার লোক ছিল কিন্তু মা ওকেও রান্না করতে দিত না আর নিজেও করত না। বাবা অফিস যেত চা পাউরুটি খেয়ে, বাড়ি এসেও কপালে কিছু জুটত না। মা বদারও করত না। বাবা নিজেই রাতে কিছু বানিয়ে নিত, আমার বাবার জন্য কষ্ট হতো, তাই বাবাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতাম। রান্না করার শখটা হয়তো আমি বাবার থেকেই পেয়েছি,’ অমৃতা বলে।

‘কিন্তু বাবা তো শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে বদলি নেয় বাবা। রান্নার লোকটাকে বাবা ছাড়িয়ে দেয় মায়ের জেদের কাছে হার মেনে। ছোটোবেলায় আমরা মানুষ হয়েছি বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে।’

‘বাবার মুখটাই আমার ঠিক করে মনে পড়ে না,’ স্মৃতি হাতড়াতে থাকে অরুণিমা।

‘তোর মনে থাকার কথাও নয়। আমারই তখন দশ বছর বয়স। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বাবা অন্য শহরে চলে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলে স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, গিফ্টও নিয়ে আসত আমাদের জন্য। মা জানতে পেরে, স্কুলকর্তৃপক্ষকে বলে, বাবার স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে আমার মায়ের ওপর রাগ বাড়তে থাকে। মায়ের স্বার্থপরতার জন্য মা-কে আমি ভালোবাসতে পারিনি। মা-ও বুঝেছিল আমার মনের কথা। তাই আমাকেও হস্টেলে পাঠিয়ে নিজের কর্তব্যে ইতি টেনে দিয়েছিল মা,’ না চাইতেও অমৃতার চোখ চলে ভরে যায়।

‘মনে আছে দিদি, তুই শুধু ছুটিতে বাড়ি আসতিস। তখন আমরা দুই বোন খুব মজা করতাম।’

‘তোর জন্যই তো বাড়িতে আসতাম। মা-র কোথায় সময় ছিল আমাদের জন্য?’

‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। পরে মা আমাকেও তো হস্টেলে পাঠিয়ে দিল। সুমন কাকু সেসময় খুব বড়িতে যাতায়াত করত। আমাদের ফ্যামিলিটা ভেঙে দেওয়ার পিছনে ওনারও বিশাল ভূমিকা রয়েছে।’ অমৃতা বুঝতে পারে সুমন কাকুর উপর অরুণিমার রাগ আজও এতটুকু কমেনি।

‘নিজের সমস্যার জন্য অপরকে দোষারোপ করিস না নিমি। এই অভ্যাস ছাড় দেখবি তোরই ভালো হবে। এখন নিজের সংসার সামলা। তোর সংসার ভেঙে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব।’

‘তোর কি মনে হয় সব দোষ আমার?’

‘আমি তোর দিদি হই। তোর থেকে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। দোষ কার সেটা বিচার করার আমি কে? কিন্তু একটা কথা বলতে চাই, তোর নিজের সংসার তুই নিজেই একমাত্র বাঁচাতে পারিস,’ অমৃতা স্পষ্ট কথাটা বোনকে বলেই ফেলে।

‘কী হল? দুই বোনের না হয় অনেকদিন বাদে একসঙ্গে দেখা হয়েছে মানছি কিন্তু তাই বলে খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ নাকি?’ কৃষ্ণেন্দু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সহাস্যে দু’জনকে প্রশ্নটা করে।

‘ওঃ সরি কৃষ্ণেন্দুদা। কথা বলতে বলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না। আমাকে দশ মিনিট দিন, ফ্রেশ হয়ে সোজা ডিনার টেবিলে পৌঁছোচ্ছি,’ জিভ কেটে অরুণিমা উত্তর দেয়।

অরুণিমার সংসারে অমৃতা আর কৃষ্ণেন্দুর আসাটা একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিয়ে এসেছিল, যেটা অরুণিমার অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলতে পেরেছিল। একটা সপ্তাহ হইচই, ঘোরাফেরা করে অমৃতারা চলে যেতেই আবার বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল।

দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো সারাদিন অরুণিমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকত। অফিসেও কাজে মন দিতে পারত না অরুণিমা।

একদিন রোজকার মতো সাগ্নিক নিজের ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। অরুণিমা এসে পিছন থেকে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে। সাগ্নিক অবাক হয়, কারণ এই স্পর্শ ও প্রায় ভুলতেই বসেছিল।

‘চলো খাবে চলো। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ অরুণিমার গলায় সেই প্রথম অন্তরঙ্গতা অনুভব করল সাগ্নিক। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আনালে?’

‘আনাইনি, নিজে বানিয়েছি। রেস্টুরেন্টে এই খাবার পাওয়া যায়?’ অরুণিমা হাসে। সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে আলো নিভিয়ে দেয় অরুণিমা। সুরভিত গন্ধের আবেশে সাগ্নিকের অরুণিমাকে যেন নতুন লাগে। অরুণিমা সাগ্নিকের বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে। মনের কথাগুলো ঠোঁটে এসে পড়ে সাগ্নিকের, ‘ইশ, দিদি যদি আরও কয়েকদিন আগে আসত!’ অরুণিমা কিছু বলে না মুখে। পরম নিশ্চিন্তে সাগ্নিকের বুকে মাথা রাখে। মোমবাতির জ্বলন্ত অগ্নিশিখা শুধু সাক্ষ্য থাকে বিরল এই মিলন দৃশ্যের।

 

টান

সবুজ ঘাসের ওপর চাপ চাপ রক্তের দাগ। জানোয়ারও সহ্য করতে করতে একসময় ফুঁসে ওঠে। আর এরা তো মানুষ! দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার লাভা স্রোত তো এরকম হবেই!

ডুয়ার্সের লাবডুঙ চা-বাগান। ছোট্ট চা-বাগান। তাই চা পাতার উৎপাদনও কম। মালিকের অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশা প্রায় অনাহারে থাকা শ্রমিকদের বঞ্চনার আগুনে পুড়িয়েছে দীর্ঘদিন। পরিণাম মালিক রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার থ্যাঁতলানো রক্তাক্ত শরীর ঘিরে জেগে থাকা একরাশ প্রশ্ন ও হতাশা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেই, ইউপিএসসি-র চাকরিটা জুটে গেল অভীকের। স্ট্যাটিসটিকাল ইনভেস্টিগেটর কাম অফিসার। অনেক পরিশ্রম ছিল তার জন্য। মেধাবী অভীক পেরেকটা ঠিক জায়গাতেই পুঁততে পেরেছিল। বেশ মোটা মাইনে। কাঁটাকলের আরও দুজন পেল। অর্ক ও দেবারতি। দেবারতি কিছুদিন পরেই বার্কলে ইউনিভার্সিটি-তে গবেষণা করতে চলে গেল। অর্করও পালাই পালাই ভাব। কলেজ সার্ভিস কমিশনের দিকে তাকিয়ে বসে।

প্রথম দিন থেকেই চা-বাগানের এতো সমস্যার মাঝেও, অভীক আস্তে আস্তে মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে কোথায় যেন ও একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করতে পেরেছিল। মায়ের কথাটা মনে ছিল, ফেস দ্য ব্রুট। চোখে চোখ রেখে সমস্যার মোকাবিলা করো। শেষ সাক্ষাতে বিদ্যামন্দিরের দীপংকর মহারাজের কথাটা যেন কানে বাজে ওর, মানুষের জন্যও কিছু করিস!

আলিপুরদুয়ার স্টেশন রোডের শেষে ওর অফিস। ডিএম অফিস লাগোয়া। ওর থাকার জায়গা কিন্তু কাছাকাছি চা-বাগান কোরাঙ্গিনির বাংলোয়। ভারি মনোরম পরিবেশ। আলিপুরদুয়ারের বারোটা চা-বাগানের বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র, শ্রমিকদের অবস্থা, অনুন্নয়নের কারণ থাকলে তার খোঁজ ও উন্নয়নের নকশা বানানো তবে সব কিছুর মূলে যেন থাকে শ্রমিকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। এক কথায়, মানব মূলধনের রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। আর মাথার ওপর ডিএম, অশোক ভুটিয়া।

ডিএম ভালো বাংলা বলতে পারেন। শিবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। প্রচন্ড মেধাবী। হাই পাওয়ার গ্লাসের নীচে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। প্রশাসনটা দারুণ বোঝেন। খুব বড়ো মনের মানুষ। কর্মীদের বিপদতারণ তিনি। এক মন ভালো করা পরিবেশ ওনার অফিসে।

প্রথম দিন থেকেই অভীকের সাথে ভালোলাগার সম্পর্ক ডিএম-এর। ওনার স্ত্রী বাঙালি। ভালো গানের গলা। সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। অশোকবাবু আবার কবি মানুষ। লেখালেখি করেন অবসরে। অভীকের কবিতা পড়ে একদম আপ্লুত। তবে ও অন্য একটা কারণও বুঝতে পেরেছে। ওনার মৃত ছেলে আকাশের সাথে নাকি ওর অনেক মিল। তাই ভালো লাগায় অপত্যস্নেহের ভাগই বেশি পায় সে।

সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য সে একটা টান অনুভব করে এখন। সত্যিই এরা যেন প্রকৃতির সন্তান। সবুজের মাঝে যেন এক একটা সবুজ মানুষ। বঞ্চনা, অবজ্ঞা এদের দিনলিপি। ওর বাবার কথা মনে পড়ে খুব। সমাজবিজ্ঞানী বাবা বলতেন, রাষ্ট্র সব মানুষের সমস্যার কাছে সব সময় পৌঁছোতে পারবে না। ট্রিকল ডাউন থিওরি থাকবেই। মানে গাছের ওপরের পাতা বেশি জল পাবে আর নীচের পাতায় জল চুঁইয়ে পড়বে। সরকারি সুবিধা কিছু মানুষের কাছে বেশি মাত্রায় যাবে। তাই বেশি-পাওয়া মানুষগুলো যখন কম-পাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, তখনই হবে প্রকৃত উন্নয়ন। তখনই বাস্তব হবে ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ প্রতি ঘরে।

আলিপুরদুয়ারের চা-বাগানগুলোতে, চা পাতার উৎপাদন অন্যান্য বাগানের তুলনায় অনেক কম। মালিকরা উৎপাদন বেশি করতে চায়। চা-বাগান ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠকে অভীক বেশ কয়েবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বহু পুরোনো চা গাছগুলো থেকে বেশি উৎপাদন আশা করা বৃথা। কচিপাতা উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে গাছগুলো। নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেও বিপুল আর্থিক চাপের কারণে, পিছিয়ে আসছে অধিকাংশ চা-বাগানের মালিকরা।

আর কথায় আছে, সুস্থ শরীরে বাস করে সুস্থ মন। অপুষ্টি যেখানে যাপন চিত্র, সেখানে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা সর্বাধিক আশা করা যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব! উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি প্রথম প্রযোজন। দিনপ্রতি একশো টাকায় অন্তত চারজনের একটা পরিবারের ভালো ভাবে চলা এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে খুবই কষ্টকর। তাই লাভের অঙ্ক কষার সাথে, শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে বাঁচার হিসাবটাও কষা দরকার।

চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের বাঁচা সত্যিই নিম্নমানের। হাজারো না পাওয়ার মাঝে বেঁচে থাকা ওদের। এদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। সাহসী অভীক একটা কাণ্ড করে বসল। বেশ কয়েবার চা-বাগান শ্রমিকদের অবস্থা জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রককে কিছু করার আর্জি মেল করেছে সে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! হঠাৎ সুযোগটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই এসে গেল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কয়েজন সদস্যকে নিয়ে চা-বাগান উন্নয়নমন্ত্রী, আলিপুরদুয়ার চা-বাগান পরিদর্শনে আসেন। ডিএম, লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার, অভীক এবং অবস্থা খারাপ এমন চা-বাগানের মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী। আশোকবাবুকে বার বার অনুরোধ করে অভীক আলোচনার স্থান কোরাঙ্গিনি চা-বাগানের অডিটোরিয়ামে করতে বলে।

উদ্দেশ্য একটাই ছিল এর পিছনে। অন্য বাগানগুলোর থেকে কোরাঙ্গিনি অনেকটাই পিছিয়ে। উৎপাদন কম এখানে। এটাকে মালিকরা ঢাল করে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজের চোখে দেখে যাক শ্রমিকদের অবস্থাটা।

আশানুরূপ কাজই হল। মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে চা-বাগানের মালিকরা, শ্রমিকদের অবস্থা বোঝাতে ভুল তথ্য দিতে থাকল। মন্ত্রী তাকে শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থাটা বোঝানোর কথা বলতেই, অভীক কাণ্ডটা করে বসে। সামনে থাকা জল ভর্তি গেলাসের মধ্যে নিজের পেনটা ডুবিয়ে দিয়ে মন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে বসে, পেনটা ঠিক কী দেখছেন? বাঁকা না সোজা? বাকরহিত মন্ত্রী ও অন্যরা। এরকম উপস্থাপনা তাঁরা আশাই করেননি। মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভীক বুঝল, কেল্লা ফতে! জল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে দেখলে, পেন তো বাঁকা দেখাবেই। অর্থাৎ ম্যানেজারদের চোখে শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে গেলে তা সত্য হবে না। অবস্থার অসদ বিম্বটাই ধরা পড়বে এবং তাতে মালিকদেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

এর পর সব কিছু তার পরিকল্পনা মাফিকই হল। শ্রমিক কলোনিতে গিয়ে তাদের ঘর, শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা দেখে আবেগতাড়িত মন্ত্রী। বাগানের ম্যানেজারকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সব কিছু ঠিকঠাক করতে নির্দেশ দিলেন। দেখভালের দাযিত্ব দিলেন ডিএম-কে। শ্রমিকদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির একটা মাস্টার প্ল্যান বানাতে বললেন অভীককে। ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামী মাসে দিল্লি আসার প্রস্তাব দিলেন। অশোকবাবুর উৎফুল্ল মুখ বলে দিল ওনার খুশির কথা।

অভীক মনে মনে এটাই চাইছিল। শ্রমিকদের বাঁচার অযোগ্য পরিবেশের কথা প্রচার করতে হবে ব্যাপক ভাবে। লজ্জায় ফেলতে হবে সভ্য সমাজকে। বোঝাতে হবে, পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে এদের ব্রাত্য করা যাবে না। তবে যদি কাজ হয়। কদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী চা-বাগান শ্রমিকদের, বিনা পয়সায় চাল-ডাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অবস্থা কতটা শোধরাবে!

সারা চা-বাগানে এখন শুধু দিন বদলের স্বপ্ন। অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলোর কাছে অভীক এখন নয়নের মণি। সে প্রত্যাশার চাপটা বোঝে। দিল্লি যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। পুরো দাযিত্ব ডিএম নিজে নিয়েছেন। সসস্ত সময় ধরে উন্নয়নের রূপরেখা বানিয়ে চলেছে অভীক। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে টি টুরিজমের প্রস্তাব রাখছে। টি টুরিজম হলে বাগানের পুরুষগুলো হোটেল, দোকান, রিকশা বা ভ্যান চালানো অথবা গাইডের কাজ করতে পারবে। সহায়ক অর্থনীতি। মহিলাদের চা পাতা তোলার সাথে সাথে, পুরুষগুলোও কিছু আয় করলে বাঁচার পরিবেশ, পদ্ধতি আস্তে আস্তে বদলাবে নিশ্চিত। বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে শুরু করবে। দিনের শেষে মাতাল মরদগুলো ভূমিকা বদলে তখন হয়ে উঠবে প্রেমিক সোয়ামি!

সারা রাত প্রজেক্টটারে কাজ করে শুতে অনেক দেরি হয়েছে অভীকের। সঞ্চিতাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছে অনেক বার। পায়নি। মেযেটা বড়ো মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে তার ভালোবাসা অনুভব করে অভীক। কতদিন দেখা হয়নি! একরাশ মন খারাপ নিয়ে শুতে গেল সে।

পরদিন সকালে চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল অভীকের। কী হল আবার! বাইরে বেরিয়ে চমক। ও কি স্বপ্ন দেখছে? একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? কাল যার কথা মনে করেছে বারবার সে-ই এখন সামনে। মূর্তিমান বর্তমান। আনন্দে উত্তেজনায় নীচে নেমে দেখল, চা-বাগানের মেয়েদের মাঝে সঞ্চিতা। অভীকের মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ল সকলের মাঝে আনন্দ-ঝরনা হয়ে সঞ্চিতা সকলকে জানিয়ে দিল, দুদিন থাকবে সে এখানে। ওইদিন সকলের জোরাজুরিতে রাত্রে খাওয়াদাওয়া, ক্যাম্প ফায়ারের আযোজন, অনেক রাত অবধি চলল নাচ গান। সারা চা-বাগান যেন নতুন প্রাণের উৎসবে মেতেছে। সঞ্চিতা যেন বঞ্চিত মানুষগুলোর মনে রাশি রাশি আনন্দ উল্লাসের জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিল।

পরদিন সকালে খুশির খবর আবার। অশোকবাবু সকালের খবরের কাগজটা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাহাদুরের হাত দিয়ে, মন্ত্রী কথা রেখেছেন। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। মালিকপক্ষের সংগঠনও মেনে নিয়েছে। বাগানের সকলেই এই খুশির খবর, সঞ্চিতা আসার কারণ হিসেবে দেখছে। হাসি মুখে সঞ্চিতার সাথে অভীকও একরাশ টাটকা বাতাস ভরে নিল আগামীর জন্য।

দুটো দিন যেন সত্যিই আনন্দ ভৈরবী তার জীবনে। সঞ্চিতার মুখে শুনেছে শিলিগুড়িতে ব্যাংক অফিসারদের ট্রেনিং ছিল। সে ম্যানেজ করে চলে এসেছে অভীকের কাছে। দুদিন পরেই তাকে আবার ফিরতে হবে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে তার অফিস মালদায়। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে।

দুটো দিন হইচই করে কেটেছে ওদের। চা-বাগান ঘুরে দেখেছে। প্ল্যান্ট-এ গিয়ে চা পাতা তৈরি দেখেছে। অভীক ওকে ফার্স্ট চা তৈরি করে খাইয়েছে। মালদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাকও করে দিয়েছে। সঞ্চিতা বাগানের বাচ্চাদের চকোলেট বিলিয়েছে। সঙ্গে আনা জামা-কাপড় চা তুলতে আসা মেয়েদের দিয়েছে। সাজের জিনিসের অবস্থাও তাই। অভীকের মুখে চা-বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনে, সত্যিই ও মানুষগুলোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। শুধু সঞ্চিতার সারপ্রাইজ ভিজিটের খবর মাকে জানাতে পারেনি অভীক। দিন পাঁচেক আগে ঝড়ের তাণ্ডবে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। শত যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ঠিক হতে কতদিন লাগবে কে জানে!

অশোকবাবু ও বউদিকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছে সঞ্চিতা চলে যাবার আগের রাত্রে। গান আড্ডা গল্প মাউথ অরগানে ভালো লাগা যেন টুপটাপ ঝরে পড়েছে ওদের ঘিরে। সেই সময়ে বিদায়বেলায় চোখের জলে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বউদিকে। সারা রাত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা ওদের দুটো শরীর চাঁদের আলো গায়ে মেখে ভালোবেসেছে, আগামীর স্বপ্ন এঁকেছে। ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সকালের প্রতীক্ষা করেছে।

তবে এ সকাল বড়ো মন খারাপ করা সকাল কোরাঙ্গিনি চা-বাগান জুড়ে। ফোনে ওর মুখে বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ কষ্টের কথা শুনে সঞ্চিতা বলেছিল, একদিন আসবে এখানে। কথা রেখেছে সে। এক সমুদ্র ভালোবাসায় সকলকে ভাসিয়েছে। চা পাতা তুলতে এসে মেযেরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। অশোকবাবু ও তনিমা বউদিরও মন ভালো নেই। সত্যিই যেন জাদু জানে মেযেটা! সকলের মতো অভীকও চেয়েছে, আর কদিন থেকে যাক। কিন্তু মুখে বলতে পারেনি। সঞ্চিতা ম্যানেজার হয়ে বছর খানেক আগে জয়েন করেছে মালদা হেড অফিসে। ওর তাই কাজের বেজায় চাপ, জানে অভীক। শুধু নির্বাক সাক্ষী থেকেছে বিদায়বেলায় চোখের জল নিয়ে। কাল সারারাত যেন শেষের কবিতা-র অনুভব ছিল অভীকের কাছে। তারাদের মিটিমিটি সঙ্গে করে সঞ্চিতার স্মৃতির কোলাজ বানিয়েছে সে রাতজাগা হয়ে কখন আকাশ আলোর খেলায় মেতেছে সে খেয়ালই করেনি। ছোট্ট পাখিটার ডাকে যেন জেগে উঠল মানসঘুম থেকে। জানলায় বসে ল্যাজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে গেয়ে তাকে সুপ্রভাত জানাল পাখিটা। তার মনের দুঃখের খবর পেয়েছে বোধহয়!

 

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। তাহলে লাইন ঠিক হল এতদিনে! ফোনের ওপাশে মায়ের গলা। ও হ্যালো বলতেই, মায়ের কান্নার আওয়াজ।

এও কী সম্ভব! শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের পাশে ট্রেনিং সেরে সেবক রোড ধরে, হোটেলে আসার পথে পিছন থেকে একটা লরি ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারে অটোর পিছনে। রাস্তায় ছিটকে পড়লে পাস থেকে একটা ট্যাক্সি চাপা দিয়ে চলে যায় সঞ্চিতাকে। থ্যাঁতলানো দেহটা আইসিসিইউতে লড়েছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সে আর নেই! সঞ্চিতা আর নেই!

অভীক মাথা ঘুরে পড়ে গেল খাটে। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। তাহলে দুদিন চা-বাগানের মানুষগুলোর মাঝে কাটিয়ে গেল, সে কে? অভীককে ভালোবাসার আবিরে যে রাঙিয়ে গেল, সে কে?

 

যে যেখানে দাঁড়িয়ে

সরাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সহেলি। পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে একটা কাক ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে। আজ যে সহেলির কী হল কে জানে। শুধু কি আজ? নাকি প্রতিদিন?

মা, ও মা। আজ তো পঞ্চমী। আজই ঠাকুর চলে আসবে। কাল বিকেল থেকে নো এন্ট্রি। তাহলে কিন্তু এগারোটার পর বাবার স্কুটারে… তুমি তো ধ্যারধ্যারে স্কুটারে যেতে চাও না। উঁহু যেতে হবে কিন্তু।

আহা, তোমার পড়া নেই নাকি বিট্টু? পড়াশোনা না করলে বাবার তবু সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটার জুটেছে, তোমার ভাঙা সাইকেলও জুটবে না। যাও পড়তে বসো।

ও মা তুমি যাবে না, তোমার ফ্রেন্ডসদের সাথে রিইউনিয়নে?

যাব না, পড়তে বসো। (বেশ জোর গলায় বলে)

পাশের ঘর থেকে সহেলির শাশুড়ি বলে উঠলেন, আহা বউমা কতবার বলেছি না, আমার দাদুভাইকে সকাল সকাল উঠেই বকবে না। যাও না একটু ঘুরেই এসো। দুপুরে তো সব হয়ে যায়। আমি, নিরু আছি তো নাকি।

বউমার বিছানায় বসে নলিনীদেবী বলতে থাকেন, বউমা ভাত-কাপড়ের শাড়িটা পরে যেও। ওটা তোমায় খুব মানায়।

সহেলি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, তাইতো আমার বন্ধুদের আর অত ভালো শাড়ি আছে নাকি? ওরা এত ভালো শাড়ি তো চোখেই দেখেনি। নলিনীদেবী খানিকটা সংকুচিত হয়ে বেরিয়ে যান।

 

বর্তমানে সুনীলের ব্যাবসাটা পড়তির দিকে। অভাবের সংসারে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় হাড়ভাঙা খাটুনি। সন্ধ্যার দিকে আবার সহেলির টিউশন ব্যাচ আসতে শুরু করবে। অলস ভাবে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তেই তোশকের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ছোটো ছোটো দুটো ডেয়ারি মিল্ক। একটা চিরকুটে জড়ানো। তাতে লেখা একটা বিট্টুর আরেকটা বিট্টুর মায়ের জন্য। হ্যাপি বার্থডে।

চকোলেট দুটো নিস্পৃহ ভাবে টেবিলের পাশে তুলে রাখে। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনটাতে পিক পিক শব্দে একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। কালই সুনীল নেট প্যাক ভরে দিয়েছে। অভাবের সংসার হলেও সহেলির জন্য এসব ছোটোখাটো বিলাসিতা করেই ফেলে সুনীল।

 

তৃণা: সহেলি আর শ্রুতকীর্তি আসবে তো রে।

মেঘনা: শ্রুতি তো আসবে। আর সহেলির বর সুনীলের দোকানটা তো আমাদের পাড়াতেই। ও বলেছে, বউকে পাঠাবে।

তৃণা: এখান থেকে কিন্তু সোজা টক-ঝাল-মিষ্টি-তে যাব। তারপর সিনেম্যাক্স।

ওই তো সহেলি আসছে। কি সুন্দর ছিল বল! আমাদের ফার্স্ট গার্ল। তেমন নাচ করত। গ্র‌্যাজুয়েশনটাও কমপ্লিট না করে, মুদির দোকানদারকে বিয়ে করে, নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারল।

মলি: মুদির দোকান তো কি? আমার বর তো স্কুল টিচার ছিল। মার সহ্য করতে না পেরে তো মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

মেঘনা: ও ভাবে বলিস না। ওর বরকে আমি চিনি। খুব কেয়ারিং। খুব ভালো। আমার কর্তার থেকে তো শতগুনে ভালো।

আরে, আয় আয় সহেলি। কতদিন পর দেখলাম, একই আছিস। আমরা তো মুটিয়ে গেছি। সেই যে কাকুর বাৎসরিকে দেখেছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাকিমাও চলে গেলেন।

সহেলি: সবই আমার ভাগ্য। আমার উপর রাগ করেই… হয়তো!

মেঘনা: ছাড় তো। জানিস শ্রুতকীর্তি আসবে। কি যে সুন্দরী হয়েছে না। ওয়েল মেইনটেইন্ড। রেডিও জকি, নিউজ রিডার কত কিছু যে করছে। অর্ঘ্যদা তো মাথায় করে রেখেছে। কাল বার্থডে পার্টির পিকগুলো দেখছিলাম। যা একটা ডায়মন্ড রিং দিয়েছে না ওর বর।

তৃণা: গতবার একটা ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট। আর আমার বর? চাকরি করি বলে, একটা পুঁতির মালাও দেয় না। এই সহেলি কিছু বল। চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ নাকি?

সহেলি: মাথাটা খুব ধরেছে রে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।

 

রাজস্থানি কারুকার্য মণ্ডিত সদর দরজাটা খুলে যায়। সহেলি ঢুকে পড়ে ১৬০০ স্কোয়ার ফিটের অন্দরমহলে। এল আকৃতির বিশাল বৈঠকখানা। তার সঙ্গে লাগোয়া ড্রযিংরুম, লিভিংরুম, কিচেন, বাথরুম আর ছোট্ট ব্যালকনি। পুরো ফ্ল্যাটটার ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের পরতে পরতে রয়েছে প্রাচুর্য আর শৌখিনতা।

দুধ সাদা মার্বেল ফ্লোর, পারসি কাজের কার্পেটে মোড়ানো। বেইজ রঙের গা ডোবানো নরম গদি আঁটা সোফা। আর তাতে রয়েছে নানা রঙের কুশন। টেক্সচার ফিনিশড দেয়ালে কোথাও যামিনী রায় কোথাও বা রাজা রবিবর্মার পেইন্টিং। একটা বিশাল ওপেন ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। তাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক শো-পিস।

ডাইনিং টেবিলটা অনেক বড়ো, সুদৃশ্য কাটলারি সেট সাজানো, মাঝখানে একটা সুদৃশ্য ঝুড়িতে রয়েছে অনেকগুলি সতেজ ফল। সহেলি একঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরে বেড়ায়। শৌখিন মডিউলার কিচেন ক্যাবিনেটে সাজানো কিচেনটা দেখে, নিজের স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরটা মনে পড়ে সহেলির। বেডশিট, পর্দা, কুশনকভার, পিলোকভার এমনকী সেন্টার টেবিলের সদ্য ধোঁয়া ওঠা টি পট-এর টি কোজি… সমগ্র আপহলোস্ট্রি জুড়ে রয়েছে নানা রঙের সমাহার। লাল, নীল, ফুশিয়া, গ্রাসগ্রিন, লেমন-ইযেলো।

এক একটা রং যেন মনের সব মেঘ কাটিয়ে একরাশ রোদ্দুর নিয়ে এসেছে। বাথরুম থেকে শাওয়ার-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গুনগুন করে ভেসে আসছে মেয়েলি কণ্ঠের গান। সহেলি ধীরে ধীরে বেডরুমের দিকে এগোয়। বিশাল খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিংটেবিল সাজানো। খাটের পাশে ছোট্ট বেডসাইড টেবিল। তাতে একটা ফটোস্ট্যান্ড-এ ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। সুখী সুখী আদুরে ছবি। সহেলি এগিয়ে আসে। ফটোর মেযেটা খুব চেনা চেনা। তারই প্রিয় বান্ধবী শ্রুতি, ওর ছেলে ও বর।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘড়িটা ঢং ঢং করে ওঠে। হয়তো এক্ষুনি শ্রুতি বেরিয়ে আসবে। আর নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হবে। কোথা থেকে শুরু করবে কে জানে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে যায়। একি! এই মলিন বেশে সে কীভাবে ওর সামনে দাঁড়াবে! কী বলবে নিজের কথা সে? না না, সে এক্ষুনি চলে যাবে। ছুটে বেরিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। হঠাৎ কে যেন পিঠে এসে হাত রাখে…

 

একি, এত বেলা অবধি শুয়ে আছো যে? তোমার শরীর কি খারাপ? সহেলি চোখ খুলে সুনীলকে দেখতে পায়। চারদিকে একবার চোখ বোলাতেই বুঝতে পারে সে শ্রুতকীর্তির লেকটাউনের ফ্ল্যাটে নয়, নিজের ইন্দিরা কলোনির জীর্ণ ঘরে শুয়ে আছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সহেলি। সুনীল বলে, শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে থাকো। আমি ম্যানেজ করছি। সারাদিন তো অনেক পরিশ্রম হয়।

সহেলি সুনীলের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, ঠিক আছে শরীর। সুনীল উজ্জ্বল মুখে বলে যায়, আজ পাঁঠার মাংস আনলাম বহুদিন পরে, জমিয়ে রান্না করো তো। সহেলি মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে চলে যায়। সুনীল একটু দমে যায়। মনে মনে তার সহেলিকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। কোথায় রাজরানি হয়ে থাকবে, তা নয়। সুনীল ওর মুখে হাসি দেখার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে কিন্তু সামর্থ্যই বা কতটুকু? সহেলির ফেলে যাওয়া স্মার্ট ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়ে, শ্রুতকীর্তি সেনের ঝাঁ চকচকে প্রোফাইল।

 

আজ বারোটা থেকে আড্ডা উইথ শ্রুতকীর্তির সম্প্রচার। রেডিও মিষ্টির অন্যতম সঞ্চালিকা সে। স্বামী অর্ঘ্য সেন একটা বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের উচ্চপদে আসীন। আয়নায় নিজেকে দেখে শ্রুতকীর্তি। তার গলা শুনেই কত মানুষের দিন শুরু হয়।

টিভির চ্যানেলে যখন আজ সকালের আমন্ত্রণে সঞ্চালনা করে তখন অগুনতি মানুষের কাছে ফ্যাশন ডিভা হয়ে ওঠে। বান্ধবীরা তার মতো কেরিয়ার আর সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে। চোখ দুটো এখনও ফোলা, তাতেই বা কি। এখনই চড়া আইলাইনার আর চড়া কাজল দিয়ে নিপুণ ভাবে ঢেকে ফেলবে, কাল রাতের সব যন্ত্রণার, সব অশ্রুর ইতিহাস। বালিশের কভারে কেউ এক ফোঁটা চোখের জলের দাগ পাবে না।

কালকের প্রবল যন্ত্রণাময় মুহূর্তেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনকী ছোট্ট রনিকেও না, ছুটে গেছে ওয়াশরুমে। চোখের জল আর শাওয়ারের জল কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে… দেয়ালে কান পাতলেও কেউ শুনতে পায়নি, এতটুকু হাহাকার! প্রতিটা দিন জলভরা চোখ দুটো সানগ্লাসে ঢেকে, মেকি হাসি মেখে, মিশে গেছে হাজার হাজার স্রোতে।

 

গাড়িতে এসে এসি-টা অফ করে জানলাটা খুলে দেয় শ্রুতকীর্তি। দমকা হাওয়া এসে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। সামনে ফ্রিঞ্জ করে কাটা লকসগুলো উড়ছে। না আজ যেতেই হবে জল শহর। সব কাজ বাতিল হয় হোক। তিস্তা পার্কে তাদের স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়ন যে।

শ্রুতকীর্তি জানে, কালকের পার্টির জের চলবে আজকের তিস্তা পার্কের বন্ধুদের সমাবেশেও। তৃণা, মেঘনা ছুটে এসে বলবে, অর্ঘ্যদা কি কেয়ারিং রে। শ্রুতকীর্তিকে মিষ্টি হেসে বলতে হবে, কী যে বলিস…। বুক ফেটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে, তোরা কিচ্ছু জানিস না… কিচ্ছু না। অর্ঘ্য তার প্রতি কোনও দিনও কেয়ারিং নয়, ওপেন রিলেশনশিপে বিশ্বাসী তার স্বামী অর্ঘ্য।

বিয়ের পরদিনই সে জেনে গেছে, স্বামীর জীবনে তার শুধু সামাজিক অস্তিত্বটুকুই আছে। এই বিশেষ দিনটা যে, কত বঞ্চনার… কত উপেক্ষার… তা সে-ই শুধু জানে। দীর্ঘ ছয় বছরে কোনও জন্মদিনকে অর্ঘ্য উষ্ণ শুভেচ্ছা আর সান্নিধ্য দিয়ে স্বাগত জানায়নি। বরং অর্ঘ্যের বস আর বিজনেস পার্টনারদের হই-হুল্লোড় আর উল্লাসে শ্রুতকীর্তির বিশেষ অনুভূতিগুলো দম আটকে মরেছে।

প্রতি বছরই অর্ঘ্য রিমাইন্ডারের দৌলতে অত্যন্ত যান্ত্রিক ভাবে এটিএম কার্ড ছুড়ে দিয়েছে। আর সে-ও কলের পুতুলের মতো স্ট্যাটাস অক্ষুণ্ণ রেখে একের পর এক ঈর্ষণীয় উপহার কিনেছে। প্রাচুর্য আর নিপুণ অভিনয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সব উপেক্ষাকে। বছরের পর বছর এভাবেই ব্লটিং পেপারের মতো সব অপমান শুষে নিতে নিতে কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

ছন্দপতন ঘটল সেদিন, যখন সে ছুটে গিয়েছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে দ্বিতীয় মাতৃত্ব লাভের সুখবর জানাতে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণী তথা নারী মুক্তির ধ্বজাধারী শাশুড়ি-মা, গর্ভপাত করার প্রস্তাব দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, বংশের প্রদীপ রনি যখন আছেই তখন দ্বিতীয় সন্তান তাদের কাছে বাহুল্য আর দুর্ঘটনা বৈ তো নয়!

প্রথম সন্তান কন্যা হলে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রশ্ন আসত। এত বড়ো আঘাত সহ্য করতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করে শ্রুতকীর্তি, আর তাতেই হিংস্র হয়ে ওঠে অমাযিক, প্রোগ্রেসিভ মুখোশের অর্ঘ্য।

মাঝে মাঝে সহেলির কথা খুব মনে পড়ে। আজ মেয়েটার জন্মদিন কেমন আছে কে জানে। তবে তার থেকে ভালো নিশ্চয়ই। মাঝে মাঝে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা ভেবেছে। স্বাধীন, চাকুরীরতা সে। কিন্তু পারেনি, ছোট্ট রনির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে যে ওর যে এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে। আর নিজের সুখী সুখী ইমেজটা যে আজকাল বড্ড প্রিয় হয়ে উঠেছে। পৈতৃক বাড়িতে শয্যাশাযী, স্থবির মা। প্রোমোটারের উৎপাত। আর অন্যদিকে সেন পরিবারের অসীম পেশি শক্তি। লড়াইটা বেশ কঠিন। কারও সহানুভূতির পাত্রী সে হতে পারবে না, কোনও দিন।

 

সই, আমি শ্রুতি, চিনতে পারছিস?

তোর গলা চিনব না। তুই আমার নম্বর পেলি কোথায়?

আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলি? পার্স ফেলে এসেছিস? শরীর ঠিক আছে? আমি আসছি। ঠিকানাটা বল।

ইয়ে মানে… থাম থাম। তুই কোথায় বল? আমি তো বেরোবই, কাজ আছে একটা। আমিই যাচ্ছি। হ্যাঁ যাচ্ছি, কদমতলায় তো?

 

বাহ শ্রুতি, তোর ডায়মন্ড রিং-টা কি দারুণ রে। বার্থডে স্পেশাল?

বাঁ হাতের কনুই-এর কাছটা ভীষণ জ্বলছে শ্রুতকীর্তির। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অর্ঘ্যর টাকায় কেনা আংটিটা দেখতে থাকে সহেলি। ধীরে ধীরে কুর্তির আস্তিনটা গোটায় শ্রুতকীর্তি। বেরিয়ে আসে দগদগে ক্ষতটা। মনে হয় ক্ষতটা যেন জ্বলজ্বলে হিরের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এ ক্ষত চিনেছে সহেলি। ননদ নিরু যখন ওর মাতাল স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্স কেস ফাইল করে ফিরে এল, তখন থেকেই খুব চেনা এই ক্ষত। এত কষ্ট শ্রুতিটার?

চোখের জল লুকিয়ে জোর করে হেসে বলে, শ্রুতি তোর কান্নার অভ্যাস নেই তো? কিছুক্ষণের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্রুতকীর্তি বলে, প্লিজ সই কাঁদিস না আমার জন্য। আমার চোখের জল একবার বেরোলে আর থামে না রে। অনেক কষ্টে আটকে রাখি। আমি তোকে কত হিংসে করেছি জানিস। তোর সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলো করতাম। কিন্তু ফ্রেন্ড রিকোযে্ট পাঠাইনি।

 

কোর্ট মোড়ের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে রাকেশকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে শ্রুতকীর্তি। এদের স্যানট্রোতে আর নয়।

খোলা আকাশের নীচে একবার বুকভরে শ্বাস নিতে পেরে অদ্ভুত আরাম লাগছে। নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর ডাকের সাজের প্রতিমা দেখল সে। মা দুর্গা তো শক্তিরূপিণী।

যদি নিরু পারে, মলি পারে, তবে সেও পারবে। এখন সোজা বসু ক্লিনিক। তারপর দেশবন্ধু পাড়ায় মায়ের কাছে। মা যতই স্থবির হয়ে যাক আজ তাকে গিয়ে বলতেই হবে, সে তার সন্তানদের নিয়ে নতুন পৃথিবী গড়বে।

 

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে-বাড়ির কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি সহেলি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। রাজবাড়ির মোড়ের সামনে ঠাকুর চলে এসেছে। একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে আপন মনেই বলে ওঠে, ক্ষমা করে দাও মা। আমি শ্রুতিকে হিংসে করেছি কিন্তু এতটা খারাপ কখনও চাইনি। আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি যেমন আছি তেমন ভাবেই থাকতে পারি যেন। বিট্টুকে মানুষ করো আর শ্রুতিকে ভালো রেখো। ওকে শান্তি দিও।

সামনে বিডিও অফিসের দোকানে ছোট্ট সিঙ্গাড়াগুলো সুনীল খুব ভালোবাসে। দাঁড়িয়ে পড়ে সহেলি। মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে…

সেই সুরে, বাঁধন খুলে

অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে, অকারণে

ভুলে যাওয়া গানের বাণী,

ভোলা দিনের কাঁদন হাসি

ভালোবাসি, ভালোবাসি।

চলতি হওয়ার স্রোতে অনেক অবহেলা করেছে সুনীলকে! আর না। ফেরার পথে নীলিমাদেবীর মিষ্টি পান নিয়ে যেতেই হবে। আজ ওনার যে বড্ড অভিমান হয়েছে।

এমন একটা মিছিল হোক…

তিতলি শেষমেশ তুই…! আমি ভাবতে পারছি না। কেন…? কেন এসব? তিস্তার কথাগুলো অনেকটা আর্তনাদের মতোন শোনাচ্ছিল।

সিরিয়াসলি আমিও ভাবিনি বউদি। তুমি এতটা রিঅ্যাক্ট করবে। নিজের মনের ইচ্ছেগুলোকে লুকিয়ে রেখে লোকজন যে ঘরে ঘরে ক্রাইম করছে তার থেকে এটা হাজার গুন বেটার। আমি যা করি সামনাসামনি। বুঝলে? আমার কোনও কিছুই যেমন লোকদেখানো নয়, তেমন কোনও কিছুই আড়াল নয়। আমি যা, আমি তাই-ই। প্লিজ তোমাকে একটাই রিকোয়েসট তুমি কথাটা বাবা-মার কানে তুলো না। সবার প্রশ্নের গাদা গাদা উত্তর দিতে দিতে সত্যি সত্যিই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি জানো! মুখ ঘুরিয়ে বলে যাচ্ছিল তিতলি।

ওর হাতে তখনও ধরা ছিল আধপোড়া সিগারেটের টুকরোটা। ছাদের ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে তিতলি সিগারেট টানছিল। আর ঠাকুরঘরে সন্ধে দিতে এসেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে তিস্তার।

ল্যাম্পপোস্ট আর ছাদের ঠাকুরঘর থেকে যে-হলুদ টিমটিমে আলোর রেখাগুলো ত্যারছা ভাবে পড়ছিল দেয়ালের অন্ধকার কোণায়, তাতে ধোঁয়া, আলো, অন্ধকার মেশামেশি করে একটা আলতো জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার নিচ্ছিল।

প্রশ্ন চিহ্ন তো বটেই। তিতলি আজ এতটা ফেরোশাস হয়ে উঠেছে ভাবতে তখনও কোথায় একটা বাধছিল তিস্তার। এমনটা কী সত্যি হবার ছিল? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।

মনে হচ্ছিল এইতো সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম মজুমদার বাড়িতে পা রেখেছিল তিস্তা। ওদের প্রেমের বিয়ে ঠিকই কিন্তু বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি আসা, আর বিয়ের পরে প্রথমবার সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে বউ হিসেবে মেলে ধরার দিনটার মধ্যে যে কতটা ফারাক, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল তিস্তা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বিয়ের পাত্রী হিসেবে তিস্তার সাতাশ বছর এমন কিছু ছোটো নয়। অনেকে তো এই বয়সে প্রথম মা-ই হয়ে যায়। সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়লে আজও একটা চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধে বুকের ভীতু তুলতুলে জায়গাটায়।

চৌকাঠে পা দিতে না দিতেই বরেরবাড়ি সমেত গোটা পাড়া অন্ধকার হয়ে গেছিল; হুলুস্থুল কাণ্ড। অপয়া অপবাদের অদৃশ্য খাঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়কের খুড়তুতো, পিসতুতো সবকটা বোন ওই অন্ধকারেই যারপরনাই টাকাপয়সার ক্লেম করতে শুরু করে দিয়েছিল। গুরুজনদের বাঁকা চোখে নতুন বউয়ের দিকে তাকানো আর বোনদের ঠিকঠাক টাকা না পাওয়ায় মন কষাকষির তেমনই একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে তিস্তার চোখের জল মুছিয়েছিল তিতলি। ঠিক যেন ছোট্ট একটা প্রজাপতিই বটে; কত বয়স হবে তখন ওর। এই তেরো-চোদ্দো বছর। দিব্যি হেসেখেলে গল্প করে মন ভুলিয়ে দিয়েছিল তিস্তার। মামাতো একমাত্র বোন হলেও সায়কের বাকি বোনেদের সঙ্গে জোট বেঁধে দাদার পকেট কাটার দিকে যায়নি সে। বরং বউদির দুঃখু দুঃখু মুখ দেখে হাসিমুখে ম্যানেজ করেছিল সবটা।

পাড়াপড়শির, ঘরের লোকের কথার খোঁচা, এমনকী সায়কের সামান্য বেসরকারি অফিসে চাকরি জানা সত্ত্বেও বাকি বোনেদের জোরাজুরিকে বিরক্তির চোখেই দেখেছিল ছোট্ট ননদ তিতলি। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এই ননদকে দিনে দিনে নিজের বোন বলেই মনে হয়েছিল তিস্তার। একটু একটু করে হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজবে জেনেও ছিল তিতলি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরি করতে চায়। পড়তে চায় ওর প্রিয় বউদির মতো সাহিত্য নিয়ে। মিষ্টি একটা ভালোলাগা ডানা ঝাপটে উঠেছিল তিস্তার বুকের মধ্যেও। মন বলেছিল, কেউ তো এখনও আছে, যে অন্তত বাংলা বিষয় নিয়ে পড়াকে কোনও উপায় নেই তাই পড়ছে, এমনটা মনে করে না।

কী গো তুমি এখনও ছাদে? করছটা কী? কখন থেকে পিসাই এসে বসে। তোমার হাতের চা চাইছে। সায়কের গলায় চমকে উঠে তিস্তা সিঁড়ির দরজার কাছে সরে গেছিল। না দেখলেও বুঝতে পারছিল ছাদের কার্নিশ টপকে একটা হলুদ আগুন পাশের জঙ্গুলে জমিটায় ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

যাচ্ছি যাচ্ছি। তুমি হঠাৎ ওপরে উঠে এলে কেন? আমি নামছি।

তিতলি কোথায়? ছাদে না? একটা হরর মুভি ডাউনলোড করেছি। কখন থেকে একসঙ্গে দেখব ভাবছি। ম্যাডামের দেখাই নেই।

তিতলি তাড়াতাড়ি নীচে আয়। মুভি দেখবি। বলে তিস্তা প্রায় জোর করেই সায়ককে নিয়ে নীচে একতলায় চলে আসে। বলা যায় না যা রাগ সায়কের। একেই কলকাতায় ওই দলবাজির কলেজটা দুচক্ষে দেখতে পারে না সায়ক। তার ওপর তার নিজের বোন এসব নেশা করছে বিন্দুমাত্র জানতে পারলে, হয়তো সারাজীবনের জন্যই কথা বন্ধ করে দেবে তিতলির সঙ্গে। জানে সব রাগটা গিয়ে পড়বে তিতলির ওপর। কারণ নিজের বাড়ি শক্তিনগরের মতো মফস্সলে রীতিমতো ভালো গভর্নমেন্ট কলেজে চান্স পেয়ে, তিতলি একটা বছর নষ্ট করে অনেকটা নিজের জেদেই কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছে। এখানে নিজের পিসির বাড়ি থাকলেও রয়েছে কলেজেরই কাছাকাছি কোনও একটা মেস-এ। তাছাড়া রয়েছে আরও নানা কারণ।

চোখে আঙুল দিয়ে যেটা দেখা যায় সেটা হল তিতলির স্বাধীনতা। তার অবাধ বাঁধনছাড়া অগ্রাহ্য করার একটা ইমম্যাচিওর মন।

 

তোর দাদা কিন্তু গন্ধটা পেয়েছে তিতলি। এখানে এলে…।

সেটাই করতে হবে। এখানে আসাটাই বন্ধ করে দিতে হবে।

আমি কি তাই বলেছি তিতলি? তোর দাদা কিছু একটা আন্দাজ করেছে, মানুষটাকে তো আমি চিনি। আমাকে কী বলছিল জানিস রাতে? বলছিল, ঠিক মনে পড়ছে না দাদু মারা যাওয়ার আগে তিতলিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিল জানো? কিছু না হলেও কবিতার শেষ একটা লাইন আজও মনে আছে আমার, জানলা দিয়ে তিতলিটা ওই খিলখিলিয়ে হাসে। আর ডায়ারির পাতা থেকে সেটাকে বেছেই সবাই ওর এই নাম দিয়েছিল।

উফ্ বউদি তুমি না সাংঘাতিক সেন্টু দাও। সত্যি এত ইমোশন রাখো কোথায়? আমি যতদূর জানি পিছন ফিরলেই সবাই তোমার সেন্টুর গাঁ…। উপ্স সরি সরি…। চোখ মুটকে তিস্তার সামনে ছদ্ম লজ্জার অভিনয় করে তিতলি।

এসব ছাড়। যেটা বলব বলব করেও তোকে বলা হচ্ছিল না, শক্তিনগর থাকতে ওই যে ছেলেটা কী নাম যেন…।

বিতান…।

হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা করিস এখন? কথা হয়?

অত ঘুরিয়ে বলার কী আছে? পোঁদে লাথ মেরেছি। বড্ড ঘ্যানঘ্যান করত। একটু কাছাকাছি ছিলাম বলেই ওর সম্পত্তি আমি? তা তো নয়। তাছাড়া কলকাতায় এসে পড়াটা, চাকরি করাটা, আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যেখানে আমার বাবা-মা সায় দিয়েছে সেখানে এলিতেলি হায়দার আলি, ও কে…?

কিন্তু তুই যে তখন বলেছিলিস ও তোকে…।

চু চু চু মুখ দিয়ে আওয়াজ করে তিতলি। তুমিও না বউদি…। সবাইকেই নিজের মতো ইমোশনের ফুল ট্যাংকার ভাবো। ছাড়ো তো। শোনো তবে কেউ পার করে দেবে না আমায়,

সময় আছে এখনও

চলো নতুন করে কাঁটাঝোপে পা ফেলি একবার…।

কবিতার লাইন বলতে বলতে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা সিগারেটের প্যাকেট পকেটে পুরে তিতলি মোবাইলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়!

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তিস্তা। একদম… একদম পালটে গেছে তিতলি। ওর ইনোসেন্সগুলো কোথায় যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। তিতলির এখন কলেজের থার্ড ইয়ার। সেই বাংলা সেই সাহিত্য ভালোবেসে জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখা মেযেরা এখন নাকি কলেজের ছাত্র সংগঠনের মিছিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। মিছিলে হাঁটছে। অনশন করছে।

রাজনীতি কী? রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? জানে না তিস্তা। সত্যি কথা বলতে কী জানতেও চায় না। তবে এটা জানে রাজনীতির রং দলভেদে পালটায় না; রাজনীতির একটাই রং স্বার্থ।

কেন জানে না আপনা আপনি মনটায় একটা খারাপ লাগার বুড়বুড়ি কাটছিল।

নিজের বোনের মতো ওর মাথায় হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করছিল, এই স্বার্থপর সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তিতলির একটা পরিচয় হোক। আর কিছু না।

 

খবরটা এত তাড়াতাড়ি এভাবে আসবে ভাবতেই পারেনি তিস্তা। তখনই ওলা বুক করে ছুটে গেছিল মামা শ্বশুরের বাড়িতে। সারাজীবনের সেই চরম অপবাদ অপয়া মাথায় করে নিয়ে নেহাত নির্লজ্জের মতো উস্কোখুস্কো চুলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তিতলিদের বাড়িতে। নাহ্ কেউ কোনও আপ্যায়ন করেনি। সেটা যে তার প্রাপ্য হবে না, সেটাও জানত। কারণ শ্বশুরবাড়ির প্রথম দিনে সে পা রাখতেই আলো নেভা, সায়কের হাজার একটা পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও, সরকারি চাকরি না পাওয়া আর শেষমেশ তিতলির…।

প্লিজ প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও। একদম ভালো লাগছে না।

কিন্তু তিতলি…।

তোমাদের কোনও ঝামেলা হবে না বলছি তো! আমি তো সবটা মিটিয়ে এসেছি।

তোর শরীরটা …।

আমার শরীর ঠিক আছে বউদি। এত কষ্ট পেও না। আমি ঠিকই আছি। আজ নতুন কিছু না। আমরা প্রায়ই মেলামেশা করতাম। কোনও কিছুই জোর করে হয়নি।

তিতলি তোর এখন সবে ২৪, আর এই বয়সে বাচ্চা নষ্ট?

আচ্ছা বউদি এটা ধরে নিতে বাধা কোথায়? আমি ছেলেতেও খুশি নই, মেয়েতেও নই, আর যদি বা হিজড়া হতো তাকে সমাজছাড়া করার আগেই সাহস দেখিয়ে তড়িঘড়ি শরীর থেকেই খসিয়ে দিলাম। হ্যাঁ তোমরা অবশ্য এর নাম নষ্টা, বেশ্যা দিতেই পার। তোমরা বড়ো। এসবের লাইসেন্স তোমাদের আছে।

তবে আমি কিনা একটু অন্য ধাঁচের, এসব গায়ে মাখি না। আবার তোমার মতো লুকিয়ে কাঁদবও না। বরং সমাজের পাঁক থেকে তুলে আনব পদ্মফুল। সেই সময় এসে গেছে বউদি। সবার যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পালটা উত্তর তো দিতেই হবে। তাই না?

তুই ওই ছেলেটাকে বিয়ে করবি? ওর বাড়ি রাজি হবে তো? তোরা যে…।

হাসালে বউদি। এমন খান্ডারনি মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না। আর আমিও চাই না। এগারো মিনিটের সুখের জন্য বিয়ে করতে লাগে না। তারপর ভালো না লাগলেই কোর্ট কাছারি হ্যানা-ত্যানা। ধুত্তোরি…।

কিন্তু মামা যে বলছিল…?

ওসব ভাটের কথা। সেদিন ক্লিনিক থেকে ফিরে একটু টান্টু খেয়ে কীসব বকেছিলাম বলে ভয় পেয়ে তোমাদের জানাল। আর তুমিও… মাইরি পারও বটে…! পরশু দুপুরে আমাদের ব্রিগেডে একটা মিটিং…

তিতলি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। কিছু কথা কানে আসছিল, কিছু আসছিল না।

তিস্তা দেখছিল শেষ বিকেলের রোদ মাখা কমলা আলোটা পর্দার পাশ দিয়ে তিতলির মুখ, বুক, চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর সদ্য মা হওয়ার অস্বীকার করা অস্তিত্বকে। তিতলির স্বপ্ন অন্য রকম। অন্য রঙের। সেই স্বপ্নের রং তিস্তা চেনে না, সেই পথের বাঁকেও কোনও দিন আটকা পড়েনি সে।

তবু দিনশেষে সায়কের কাছে ফিরে যেতে যেতে ওর একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, সমাজের যে-অন্ধকারকে আলোর পরিচয় দিতে আজ তিতলি বা তার সমবয়সিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে, গলা ফাটাচ্ছে, পুলিশের লাঠি না মেনে দিনে দিনে আরও আরও বেশি স্বাধীনতার সংজ্ঞায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, পাঁক ঘেঁটে গল্প খুঁজে পত্রিকা সাজাচ্ছে তারা নিজেরাও কি সেই একই অন্ধকারের দোষে দোষী নয়? নাহলে তিতলির শরীরে ছোট্ট একটা ভ্রূণকে এভাবে দুহাতে অগ্রাহ্য করার…। মনটা বড্ড খচখচ করছিল। আচ্ছা, চলে আসবার সময় তিতলির চোখের কোলটা কেমন যেন চিকচিকিয়ে উঠেছিল কি! নাকি সবটাই মনের ভুল…?

ওলা ক্যাবটা তিস্তার বাড়ির পথ ধরেছে। দমকা একটা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে সামনের রাস্তাটা। ঝড় উঠবে…। অন্ধকার করে এসেছে। একটা ভোঁতা শব্দ হতেই পাশ ফিরে তাকায় তিস্তা। বাইরে থেকে মথ বা প্রজাপতি জাতীয় কিছু ওলার জানলার গায়ে ক্রমাগত ফরফর করে আঘাত করছে। ও কি ভেতরে ঢুকতে চাইছে?

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। তিস্তা গাড়ির হাতল ঘুরিয়ে কাচটা নামাতে চায়। পারে না, লকটা খুব শক্ত।

কালোমেঘ চিরে শেষবারের মতো একফালি আলো আছড়ে পড়ছে শহরের রাস্তায়। নাহ্ সে আলোর কোনও রং নেই। তিস্তার মন বলছে, এ শহরের বুকে একদিন ঠিক, একদিন এমন একটা মিছিল হবে যে-মিছিলের নির্দিষ্ট কোনও রং থাকবে না, থাকবে না নির্দিষ্ট মত, মতাদর্শ। সব রং তখন মিলেমিশে যাবে। মিলেমিশে যাবে কেবল একটা… একটা মিছিলে। হাজার মানুষের সে মিছিলে একটাই জয়গান হবে। জয়গান হবে মানবতার।

 

স্বীকারোক্তি

ডা. চ্যাটার্জি বললেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার সবসময় হয় না?

টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও, অর্পণের চোখ মোটেও ডা. চ্যাটার্জির উপর ছিল না। বরং তার দৃষ্টি ছিল ঘরের দেয়াল ঘড়ি, মানুষের ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি, একটা ক্যালেন্ডার বা ওর রিভলভিং-এর একটু উপরে একটা এসির উপর। জায়গাটা চেম্বার আর কর্পোরেট অফিসের এক মিশ্রণ মনে হচ্ছিল।

মুখ ফিরিয়ে এবার বলল, একেবারেই না। হয়তো মনের কোথাও থাকে অনুভূতিটা। কিন্তু তীব্র ভাবে জেগে ওঠে, যখন ও আমার কাছাকাছি থাকে। যেমন ধরুন, খাবার টেবিলে। আমার কাছাকাছি বসে খাচ্ছে বা আমার বাইকে। বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

আর কোথাও? টেবিলের উপর দুটো কনুই তুলে, হাতের উপর কায়দা করে নিজের চিবুক রাখলেন ডা. চ্যাটার্জি। ফরসা মুখ আর হালফ্যাশনের চশমায় মুখে আগ্রহের রেখা।

না, সবচেয়ে বেশি হয়, গলা এক স্কেল নামিয়ে বলল অর্পণ, যখন আমরা বিছানা শেয়ার করি।

তখন কোনও সমস্যা? মানে, প্রসেসটা চলার সময় আপনার কোনও অনুভূতি?

ঘরে কেউ নেই। তাও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ডা. চ্যাটার্জির চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভাসা সুরে বলল, প্রবলেম মানে, ব্যাপারটার মধ্যে যেন একশো শতাংশ থাকতে পারি না। একটা নতুন বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আর সে জন্যেই তো আপনার কাছে…

আসলে, কাউন্সেলিং-এর পরিভাষায় এটাও এক ধরনের ডবল পার্সোনালিটি। এই স্টেজটাকে আমরা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির মধ্যে রাখলেও, আমরা বুঝি নর্মাল আর অ্যাবনর্মাল-এর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব, ডা. চ্যাটার্জির কাউন্সেলিং সত্তা জেগে উঠেছে।

অর্পণের মনে হচ্ছিল, উনি একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন এগোনোর। মন বলছিল, আরও প্রশ্ন ভেসে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তর তো দিতেই হবে। না হলে সমাধান মিলবে কেমন করে।

আসলে, সত্যিটা এটাই। আবার বলতে শুরু করেছেন উনি, আমরা যতই বলি, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার তা কিন্তু নয়। কিছু স্মৃতি অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি থাকলেও, ভীষণ সতেজ থাকে। মানে, আমরা ভিতর থেকে, অবচেতন মনে তার থেকে ডিট্যাচড্ হতে চাই না।

চেম্বারের ভেতরের নিস্তব্ধ হিম পরশে আর ডা. চ্যাটার্জির নরম সাহচর্যে ইতিমধ্যেই অশান্ত ভাবটা কমতে শুরু করেছিল। স্বস্তি নেমে আসছিল। অর্ণব অফিস কলিগ হলেও ইনটিমেট ফ্রেন্ড। ডা. সৌম্যশেখর চ্যাটার্জির নাম সাজেস্ট করে বলেছিল, ওনাকে সব বলতে পারবি। ওনার সমাধান একেবারেই অফবিট। পেশাদারিত্বর সঙ্গে গোপনীয়তাও দারুণ বজায় রাখেন। জাস্ট চেক করে দেখতে এসেছিল। নির্ভরতাটা তৈরি হচ্ছে। শ্রদ্ধা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সমাধান আছে নিশ্চই?

অবশ্যই আছে। আই গ্যারান্টি। বন্ধুর মতো, নিজের মতো করে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে এই টেকনিকটাকে আমরা বলি, ফ্রি অ্যাসোসিয়েন অবাধ অনুষঙ্গ। এতে আপনি অনেকটা হালকা বোধ করবেন। আর সমাধানটা অনেক মাইনর ব্যাপার। জাস্ট একটা উপসংহার টানার মতো।

থমকাল অর্পণ। এখনও পর্যন্ত ডা. চ্যাটার্জির সঙ্গে এই অ্যাপযে্টমেন্টের বেশ কয়েটা ধাপে প্রথমে থেমে, তারপর এগোতে হয়েছে। সুতো ছাড়ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে। সমস্যা নিয়ে একজন কাউন্সেলর-এর পরামর্শ নিতে আসা। লাজুক ভাব আর হাসির মোটামুটি ব্যালেন্স যেমন অফিসে করে, সেরকম ভাবে বলল, আসলে, এ রকম অ্যাফেয়ার তো আজকের যুগে সবারই একটা-দুটো থাকে। পাসিং অ্যাফেয়ারের মতো। তা পেরিয়ে সবাই চলেও যায়। বিবাহিত জীবন শুরুও হয়ে যায় জমাটি ভাবে। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগেরই কাহিনি অনেকটা এ রকমই।

একদম ঠিক বলেছেন। তবে ঘটনার রেখাপাত সবার মনে একরকম ভাবে হয় না। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মনের আলাদা আলাদা স্তর।

অর্পণকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র আর শিক্ষিত মনে হয় বলেই কি শুরু থেকেই ডা. চ্যাটার্জি এতটা টেকনিক্যাল স্বর বজায় রাখছেন? হতেও পারে। বেশ কিছুটা বাতাস বুকে ভরে নিয়ে অর্পণ বলল, যে-সমাধান আপনি দেবেন, তাতে কি মনের ভারি ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে কি আর রেজাল্ট পাবেন, মি. মিত্র? কিন্তু রেজাল্ট আসে। আর সে চেঞ্জ আপনি বুঝতে পারবেন আপনা থেকেই।

ফিল-গুড ভাবটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতেও পারছে অর্পণ। প্রথমে ভেবেছিল, কোনও জ্যোতিষের কাছে যাবে। টিভি খুললেই তিন মিনিটে কালসর্পদোষ, ব্যাংদোষ, টিকটিকিদোষ কাটানো হয়। স্ক্রিনের নীচের ফোন নাম্বারে ফোন করলেই এদের চেম্বারে। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য এদের হাতের মুঠোয়। জ্যোতিষির ডিগ্রিতে সব এক একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আর ত্রিকালজ্ঞ। অর্ণবকে বলতেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, কাউকে বলিস না, অ্যাড এজেন্সিতে এই পদে চাকরি করিস। বিজ্ঞাপন এখন তোকেই টুপি পরাচ্ছে! ভাবতে পারি না।

তখন আর কথা এগোয়নি। এখন মনে হচ্ছে অর্ণবের কথা শুনে একদম ঠিক করেছে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বলল, ওকে। কিন্তু সলিউশনটা কী?

কিছু না। ছোট্ট একটা কনফেশন।

কনফেশন! কার কাছে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে অর্পণের।

হেসে ফেলেছেন ডা. চ্যাটার্জি। নট সো ফাস্ট। কারও-র কাছে না। নিজের কাছে। কেউ থাকবেও না।

মানে?

খুব সহজ মি. মিত্র। নিজের ভেতরে যদি কোনও পাপবোধ থেকেও থাকে, তা খুঁড়ে, তুলে ফেলে দিন স্ট্রেট…

সেটাই তো বলছি। মানে…

দেখুন, আপনি নিশ্চয় চার্চে কনফেশন বক্স দেখেছেন।

হুঁ….

উলটো প্রান্তে একজন পাদরি বসে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাজ হল শুধু শুনে যাওয়া। অনেকেই বলে, তা করে তারা রিলিফ পেয়েছে।

তাহলে কি চার্চে, বিভ্রান্ত লাগছে অর্পণের।

না, না। আসলে নিজের ভেতরের কথাগুলো আপনি কোনও দিন কাউকে পুরোটা বলেননি। সেটাই নিজে এবার একটা কাগজে পুরো লিখে ফেলুন।

এক মিনিট। আপনাকে তো…

সরি, মি. মিত্র, আমাকেও আপনি পুরোটা বলেননি। ইনফ্যাক্ট বলতে পারছেন না। তাই বলছি, লিখে ফেলুন পুরোটা।

হ্যাঁ, তারপর?

সিম্পল। কোনও ভরা পূর্ণিমার রাতে, যখন কেউ দেখছে না সেটাকেই কুচিয়ে টুকরো করে চোখের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। এ টুকুই। দেখবেন, অনেকটা রিলিভড হয়ে যাবেন।

সত্যি কি এটা হতে পারে? এর কোনও সাযে্নটিফিক জাস্টিফিকেশনই তো নেই।

সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের সব সলিউশন, বিজ্ঞান মেনে হয় না মি. মিত্র। একবার ট্রাই করুন শুধু। ডা. চ্যাটার্জি হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়েছেন। টলে যাওয়া বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অর্পণ, কিন্তু মুন লাইটই কেন?

মুন ইজ আ লাভ সিম্বল। চাঁদের আলোর একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার আছে।

ওকে, কবে করতে বলছেন এটা? কাল বাদ পরশুই কিন্তু পূর্ণিমা আছে। মোবাইল খুলে বং ক্যালেন্ডার-এ ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে অর্পণ।

দুচোখ বুজে কী যেন ভাবলেন ডা. চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, পরে করতে গেলে আবার বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা। কামিং ডেটটাই কাজে লাগান।

একটা কথা, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল অর্পণ, বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা বেশ সিক্রেট। এটা নিশ্চয়ই ডিসক্লোজ হবে না কোনও ভাবেই?

শুনুন মি. মিত্র, কোনও কাউন্সেলরই এক জন পেশেন্ট-এর কেস হিস্ট্রি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

থ্যাংক ইউ। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনে অর্পণ।

 

তোফা দুপুরের ঘুমের পরও আলিস্যি ভাবটা ছেড়ে যাচ্ছিল না। রোববার মানেই শেষ তিন মাসে পাতলা খাসির মাংসের ঝোল আর ভাত। শেষ পাতে একটু টক দই। ঘুম ঘুম ভাবটা খাবার টেবিলেই ফিল করে অর্পণ। নতুন ফ্ল্যাট-এর ইএমআই-এর সময় যত এগিয়ে গেছে, তত বেশি করে এই অলস ভাবটা ঘিরে ধরেছে। উত্তরপাড়ায় জিটি রোড গঙ্গার কোল ঘেঁসে এই ফ্ল্যাট। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল। সে সময় ওর বয়স আঠাশ। কোম্পানি চেঞ্জ করে বহুজাতিকে যোগদান করে, ডিজাইনার হিসেবে তখনই ঈর্ষণীয় পে-স্কেলে চলে গিয়েছিল। আর এখন তো উন্নতির চরমসীমায়।

অ্যাড-এর ফিল্ডে অর্পণ মিত্রকে সমস্ত ক্লাযে্নট এক ডাকে চেনে। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন না করে স্পেশালাইজড কোর্স করতে গোঘাট থেকে সোজা কলকাতায়। একেবারে রেসিডেন্সিয়াল। দুবছর পর ক্যাম্পাস থেকেই একটা মোটামুটি কোম্পানিতে। দেশের বাড়িতে আর ফিরলই না। বছর তিনেক গড়িয়াতে দুজনের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকা। গোঘাটে দাদার সংসারে বাবা-মা থাকলেও, বেশ কয়েবার কাটিয়ে গেছে এখানে।

ঘরে ঢুকে বক্স খাটের পাশের ড্রয়ারের উপরে বিকেলের চা রাখল ঐশিকি। এই তিনমাসে দুপুরে অন্তত ছুটির দিনে তাকে ঘুমোতে দেখেনি অর্পণ। প্রচণ্ড হেলথ কনশাস বলেই কি ঘুমোয় না! তিন মাসের নব বিবাহিত জীবনে, এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। চায়ের গন্ধের সঙ্গে ঐশিকির লম্বা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও মিশে যাচ্ছে। একটা ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলেও এখনই কাছে টানাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

সদ্য ঘুমিয়ে উঠেছে। বাসি গন্ধ, মাথা চাড়া দিল যেন। উঠে বসে চা বিছানায় নিল। খোলা ব্যালকনিতে চলে গেছে ঐশিকি। এ সময়টায় ওর বাড়ি থেকে মা বা বাবা কেউ একজন ফোন করে। চোখ সরিয়ে রাখল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পুরুষ্ট গোঁফে আর একটু বেড়ে ওঠা ভুঁড়িতে, সুখের ঝলক নাকি স্বামী হয়ে ওঠার আদল প্রকাশ পাচ্ছে!

চা খেয়ে আলিস্যি ভাবটা যাচ্ছে না। আজ রাতে কী করবে ভাবতেই বুকে শান্তির হাওয়া। একটা বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া।

চা শেষ করে চিত হয়ে শুল অর্পণ। স্যান্ডো গেঞ্জিটা উঠে গেছিল। নামিয়ে নিল পাজামার উপর ঠিক ঠাক। সুখের উড়ানকে সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছে। এমনকী সুদেষ্ণার সঙ্গে কাটানো সময়ে তো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল বা কলেজে কারও-র সঙ্গে ক্রাশ হয়নি। প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটে যখন এসে বলেছিল, রীতিমতো মুখ টিপে হাসাহাসি হয়েছিল। হোস্টেলে অলক বলেছিল, তোরা মফস্সল বা একটু ভিতর দিকের ছেলেরা কেমন যেন একটু বাড়তি চাপা প্রকৃতির হোস। গ্রাম শব্দটা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া।

ভ্রূ কুঁচকে অর্পণ বলেছিল, আর তোরা সিটির লোকেরা সত্যি কথা বলে যে ডিক্সনারিতে কিছু হয়, তা বোধহয় বিশ্বাসই করিস না।

অলক চোখ গোল্লা করে বলেছিল, তুই কিন্তু অন্যরকম। আগ লাগা দেগা তু।

তো আগুনই লেগেছিল। সে আগুন যে কী কী পোড়ায়, বুঝতে সময় লাগেনি। ইনফরমাল কমিউনিকেশনের চতুর্থ ক্লাসেই চোখ গেছিল অর্পণের। হ্যাঁ, তবে উপরের ঠোঁটের এক সেমি উপরের তিলটায়। পাশের ডেস্কে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছিল বলে অলক এক সময়ে ফিসফিসিয়ে বলেও ছিল, পুরো ম্যাডোনা তো রে। ঠোঁটে হাসি চলে এসেছিল।

ক্লাস শেষ করেই সিনেমাটোগ্রাফিক বিস্ফোরণ। তবে ম্যাডোনা না, সুচিত্রা সেন টাইপ। এগিয়ে এসে একেবারে মিসাইল, সোজাসুজি কারও-র সম্পর্কে কিছু বলতে না পারাটা হিপোক্রেসি। বুঝতে পারছিস?

ঠোঁটে হাসিটা রেখে বলে উঠেছিল অর্পণ, ফ্যাকাল্টির সামনে তোর তিল নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগত?

বাঃ! স্মার্টনেসের তো অভাব নেই।

অভাব কেন হবে। আশির দশকের কেবলু বাংলা সিনেমার নায়ক আর কোথায় পাবি এখন!

সুদেষ্ণা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলেও, অলক পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিল, তেরা হোগা গুরু।

সত্যিই হয়েছিল এবং এগিয়ে গিয়েছিল একটু দ্রুত গতিতে। প্রথম প্রেম আর তার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে লেকের ধার সুদেষ্ণার সঙ্গে সে সম্পর্ক এগিয়েছিল চোখের পলকে। সিনেমার হলে একই ফাউন্টেনে চুমুক, লাইব্রেরিতে স্টাডিনোট লোড করা বা গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটা হু হু করে কেটে গেছিল দিনগুলো। একই গতিতে শেষ হয়েছিল কোর্সের বছর দুটোও।

অর্পণের মনে হয়েছিল ছেদ পড়তে এবার বাধ্য, কারণ সুদেষ্ণা বর্ধমানে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা বলছিল। ঠিক সেই সময় অর্পণের হঠাৎ চাকরি। আর সুদেষ্ণার আবার একটা স্পেশাল কোর্সে ভর্তি হওয়া।

 

চব্বিশে চাকরি কি অর্পণকে বেপরোয়া করে দিয়েছিল? ছুটির দিনে নতুন কেনা বাইকে বোম্বে হাই রোড ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া বা বাইকে রাতের কলকাতা আবিষ্কার ওর আর সুদেষ্ণার। এ ছাড়াও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ভাড়ার ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

অফিসিয়ালি দাঁড়ি টানলাম, এই জাতীয় কথা কোনও দিন ওরা পরস্পরকে বলে, সম্পর্ক থেকে বেরোয়নি। কেউ কোনও দিন কাউকে পরে ফোন করে বা দেখা করে কৈফিয়তও চায়নি। সেটা সম্পর্কের চোরাটানের মৃত্যু হতে পারে বা, দুজনের ইগো ফ্যাক্টর হতে পারে। এমনকী নিজের তরফে ঠিক কী, সেটাও নিশ্চিত করে অর্পণ বলতে পারে না। মনের গভীরে স্মৃতি থেকে যাওয়াতেই কি কোথাও পাপবোধ! প্রথম কয়েক মাস ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকেও মনে হতো, একবার যোগাযোগ করলে কেমন হয়। তারপর একদিন সেখানেও ধাক্কা।

ছোটোখাটো মনোমালিন্য ওদের মধ্যে হলেও তা দীর্ঘস্থাযী হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজ করে নিত সুদেষ্ণাই। তাই কোনও দিন সেভাবে ওর মুখ গম্ভীর দেখেনি। স্পেশাল কোর্স শেষের ঠিক একমাস পর এলগিন রোডের এক ক্যাফেতে রবিবারের দুপুরে হাজির হয়ে দেখতে পেয়েছিল গম্ভীর মুখ। বাইরেও আকাশের মুখ ভার। অসাধারণ সুন্দর মিউজিকের সঙ্গতেও দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ হয়েছিল নিঃশব্দে।

এই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউটা ক্র‌্যাক করতে পারলাম না। অথচ পোস্টিং কলকাতাতে ছিল, আর প্যাকেজও ছিল অ্যাট্রাকটিভ। সুদেষ্ণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নীচের ঠোঁট।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল অর্পণ, তো?

তো কিছুই নয়। দিল্লিতে একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা ইন্টারেস্টেড। এক সেকেন্ড থেমে সুদেষ্ণা যোগ করেছিল, আমিও।

সোজা হয়ে বসেছিল অর্পণ, ভালো খবর। কিন্তু কলকাতাতে আরও দুএকটা ট্রাই করলে হতো না?

ইনস্টিটিউটে শর্মা স্যার বলছিলেন, দিল্লির অফারটা নিয়ে নেওয়া উচিত। ওদের নাকি প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনিং স্টাইলটা গোটা ইন্ডিয়ায় খুব খাচ্ছে। আর আহমেদাবাদ আইআইএম-এর দুজন প্রাক্তন মিলে অফিসটা খোলায়, শেখার স্কোপটা বেশি হবে।

অন্যমনস্ক হয়ে খালি কফি কাপটা একবার নাড়াচাড়া করে অর্পণ বলেছিল, ও, তাহলে তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস।

এভাবে ভাবছিস কেন, যে-কোনও অবস্থাতেই কলকাতা ফিরে আসতে পারি। আরও অনেক বেটার এক্সপেরিযে্ন্স নিয়ে। অফিসের দুদুটো অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে চলতে থাকায় রাতের ফোন ছাড়া সে সপ্তাহে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বর্ধমানে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সুদেষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে ওর বাবা-মা ছাড়তে এসেছিল। আগে থেকে কোনও পরিচয় না থাকায় সামনে যেতে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।

দিল্লিতে সেটলড হয়ে ফোনে বেশ কয়েবার কথা হয়েছিল। সে ফোনও কমে আসছিল তিন-চার মাস পর। তারপর দুদুটো নম্বর অস্তিত্বহীন।

শোক করেনি অর্পণ। নিজের প্রেমের নির্লিপ্তিতে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভাবার এত সময় ছিল না। নিজের কেরিয়ার গ্রাফ রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। কোম্পানি চেঞ্জ করে সাধারণ বেসরকারি অফিসে চাকরি থেকে অনেকগুনে বেশি রোজগার মোটেও মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। দুবছরের মাথায় ফ্ল্যাট নিয়ে পরের ছবছর শুধু তার ইএমআই গুনে গেছে নিঃশব্দে।

১৮ লাখের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে উঠে এসে প্রথম প্রথম উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারির যুদ্ধটা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ভালো লাগত। রাতে ফ্ল্যাটে একা থাকার পীড়া যে-একেবারেই দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু ক্লান্তি খুব দ্রুত ঘুমের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলত।

এ রকম অবস্থাতে ছটা বছর কেটেছিল অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। নতুন করে কারও-র সঙ্গে জড়ানোর সময় ছিল না। ছুটির দিনে বাজার, গোছগাছ, রান্নার লোককে বুঝিয়ে দেওয়া আর বাকি সময়টা ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ডিজাইন। গোঘাট থেকে বউদি আর মায়ের অনবরত ফোন ভেসে আসছিল।

বিয়ের প্রস্তাবে খুব বেশি চমকায়নি। হিসেব কষে দেখেছিল ফ্ল্যাটের ঋণশোধে বাকি আর সাত বছর। ইনক্রিমেন্ট স্টেডি রেটে বাড়ছে। জিডিপির লোয়ার গ্রোথের দাঁত ওদের ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শরীর-মন একযোগে বলে উঠেছিল বিয়ের এটাই সঠিক সময়। আর তা ছাড়া এতগুলো বছর অন্য কারও-রও তো মনে পড়েনি। সুতরাং দায়ের প্রশ্ন আসছে না বোধহয়। আর নিশ্চিত সমাধান তো এবার হাতের কাছেই।

চন্দননগরে ঐশিকিদের বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখা। মোটামুটি খবর নেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারফেক্ট চয়েস। বাংলায় অনার্স গ্র‌্যাজুয়েট। তবুও বাইরে দুতিনবার মিট করে নিয়েছিল। লম্বা চুল, হাইট, রং-এ জোরদার লাগলেও, সুদেষ্ণার সঙ্গে তুলনায় যায়নি। চন্দননগর ষ্ট্র‌্যান্ডেই রবিবারের এক সন্ধেতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঐশিকীকে, ওর অতীত জীবনের কথা। কোনও পাস্ট অ্যাফেয়ার, এ বিয়েতে রাজি কিনা, ছোটো ছোটো প্রশ্নে জানার চেষ্টা করেছিল।

ঐশিকির সোজা-সাপটা সরল উত্তরে কিছুতেই নিজের অতীতকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পারেনি। বিয়ের পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও নিষ্কলঙ্ক ঐশিকীর আচরণে, নিজের অতীতকে বার বার গিলতে হয়েছে। একটা অ্যাফেয়ার কী করে অপরাধবোধে পরিণত হয়, ভেবে বের করতে পারেনি। অগত্যা ছুটে যাওয়া ডা. চ্যাটার্জির কাছে।

 

ঘুমানোর ভান করেই শুয়েছিল। একটা হালকা উত্তেজনা তো বটেই, দুপুরে ভালো রকম ঘুমের জন্যও ঘুম আসতে চাইছিল না। কাল খুব সকালে উঠে প্রোজেক্টের একটা কাজ ছকে নিতে হবে বলেছিল। তাই ঐশিকি আজ আর কোনও উষ্ণতা চায়নি। ভীষণ কম্প্রোমাইজিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মেয়ে। সম্পর্কের সতেজতা আর স্নিগ্ধতা দুটোই সমান ভাবে মেনটেইন করতে পারে। এভাবেই তিন মাস অর্পণকে যেন অদৃশ্য হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

মধ্য কুড়িতে সম্পর্ক উন্মাদনা খোঁজে হয়তো, মধ্য তিরিশে স্থিতাবস্থা। সংসারের বৃত্তে এ ভাবেই বোধহয় ঢুকে পড়তে হয়। আজকের রাতের পর নিশ্চই পুরোপুরি ঢুকে পড়বে। সন্ধেবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঐশিকির চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। বিশেষত ছুটির দিনে। মনে হয়েছিল রাতই সঠিক সময়।

রোজের মতো আজও ঐশিকি টয়লেটে উঠল। এসি অফ করল। মিনিট চারেক সময় ব্যয় করে টয়লেটে ও। এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এক মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়ল অর্পণ। ভাগ্যিস অ্যাটাচড্ বাথ নয়। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল। টয়লেটের আলো জ্বলছে, জলও পড়ছে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিজের ল্যাপটপে কম্পোজ করেছিল প্রায় তিন পাতার কনফেশন। প্রিন্ট আউটও বের করে রেখেছিল। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলল। সামনে চাঁদের আলোয় ভরা গঙ্গা। দ্রুত হাওয়ায় বড়ো মায়াবী এ চরাচর। টুকরোগুলো হাত থেকে ছোড়ার আগের মুহূর্তেই, স্থির হতে হয়।

পাশের ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে আসে প্রায় একই রকম কাগজের টুকরো। অসংখ্য। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের জানালা থেকে সরে যায় ঐশিকির মুখ। হাতের ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোকে এবার ছেড়ে দেয় অর্পণ। দুটো স্বীকারোক্তি প্রায় একইরকম হয়ে মিলেমিশে প্রবল হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মিশে যায়। যেমন করে বসন্তের হাওয়া আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছিল…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব