ধন্যবাদ

ঘড়িটাতে প্রায় নিভে যাওয়া টর্চের আলো ফেলতেই সুনন্দর একটা ঝটকা লাগল। অন্ধকারে এগারোটা বেজে গেছে। বাজবে না-ই বা কেন, সেই কতক্ষণ আগে সাড়ে দশটা দেখে গুটিগুটি পায়ে শেষ মোমবাতিখণ্ডটা জ্বালিয়ে, খাওয়া শেষ করেই নিভিয়ে দিয়েছে। কিছুটা গাফিলতি থেকেই ঘরে আর মোমবাতি কিনে রাখেনি। সেরকম দরকারও পড়েনি। কোনওদিন এই তিন বছরে দু পাঁচ মিনিটের জন্য কারেন্ট গেলেও সেটা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে নয়। কিন্তু গত রাতে ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পর, কত যে ইলেকট্রিকের পোল উপড়ে পড়েছে তার কোনও হিসেব নেই। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোথাও তার ছিঁড়েছে তো কোথাও গাছের ডাল বা আস্ত একটা গাছই পড়ে গেছে পোলে ।

সকালে স্কুলে যে যার খুশি মতো কারেন্টের কথা বলতে আরম্ভ করেছিল। তবে ইতিহাসের তাজমুল সাহেব একটু আশার কথা শোনাল, ‘ম্যাক্সিমাম কালকের দিন, কারেন্ট চলে আসবে, জোর কাজ হচ্ছে।’ সবাই শুনে বলে উঠল, ‘আপনার মুখে ফুল চন্দন পডুক।’ সুনন্দ কিছু মন্তব্য করেনি, যে বিষয় জানে না, সে বিষয়ে কোনও রকমের মন্তব্য করা থেকে সবসময় নিজেকে সরিয়ে রাখে। তাছাড়া মাত্র তিনবছর হল এখানে এসেছে। এখনও এখানকার ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে কোনও জ্ঞান হয়নি বলে নিজে মনে করে। কারেন্ট না থাকলেও অর্থদফতরের একটা বিশেষ বিজ্ঞপ্তির জন্য স্কুলের সবাই বারবার মোবাইলের নেট খুলেছে। সেখানে সুনন্দের মোবাইলটাও বাদ পড়েনি। বাড়িতেও মা, ঝুমা এমনকী বিটকুর সাথে কথাও বলেছে, সকালে সন্ধেবেলাতেও। ঝুমা কারেন্টের কথাও জিজ্ঞেস করেছে। আসেনি, শুনে বলেছে, ‘তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘সেটা এমনিতেই করতে হবে। যা দু-এক টুকরো মোমবাতি আছে তা দিয়ে কোনও রকমে খাওয়াটুকু হবে।’ সুনন্দ বলে।

ঝুমা প্রতিবারের মতো সেই একই রেকর্ড করা কিছু বুলি আউড়ে ফোন বন্ধ করে। সুনন্দ ফোনটা কাটবার সময় লক্ষ্য করে চার্জ শেষ। ইন্ডিকেটরটাও ব্রিম করছে। উপায় না দেখে ফোনটা পুরোপুরি বন্ধ করে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। মাঝে একবার উঠে মোম জ্বেলেই খান চার রুটি তৈরি করে দুধ গরম করে নেয়। তরকারি করতে আর ইচ্ছে করে না। আধপো দুধ, একটা মিষ্টি, তিনটে রুটি খাওয়া হয়ে যাবে। একটা বাড়তি করা থাকল। কোনদিন কীরকম খিদে থাকে। না হলে সকালে ভুলো তো আছেই। প্রতি সকালে গোপালদা দুধ দিতে আসার সময় ওটাও চলে আসে, লেজ নাড়ে। সুনন্দ রুটি, বিস্কুট কিছু একটা দিলে খেয়ে পালিয়ে যায়, পরের দিনের আগে আর ওর পাত্তা পাওয়া যায় না। এই বাড়িতে ভাড়া আসার মাস কয়েক পর থেকেই ভুলোর রুটিন মোটামুটি এই রকম। অবশ্য মাঝে কোনওসময় আর ঘুরতে আসে কিনা সুনন্দ জানে না। সারাদিন স্কুল, ফিরে সামনের লাইব্রেরিতে ছোটোখাটো একটা আড্ডা দিয়ে, রুটি তৈরি করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। বেশির ভাগ শুক্রবার বাড়ি চলে যায়, ফেরে হয় রবিবার রাতে না হয় সোমবার সকালে। এই প্রোগ্রাম বদল বলতে মাঝে মাঝে স্কুলের কোনও স্যার বা দিদিমণিদের বাড়িতে গেট টুগেদার, তাও সব সময় যায় না।

প্রথম প্রথম ভাড়ার এক কামরার এই ঘরটাও গিলে খেতে আসত। কোনওদিন বাবা-মাকে ছেড়ে একা থাকেনি। ভালো কাজ পেয়েও ভিন রাজ্যে যায়নি। তবে সব সময় তো সবকিছু নিজের মর্জি মতো হয় না। বাবা মারা গেল। সেই বছরই আবার স্কুলে চাকরি পেল। প্রথম বছরটা প্রতিদিন আড়াইশো কিলোমিটার আপ ডাউন যাতায়াত করে শরীরের কলকব্জা সব ঢিলে হতে আরম্ভ করল। তারপরেই স্কুলের কয়েকজন স্যার দিদিমণির পরামর্শে বাড়ি ভাড়া করে মাকে এনে রাখলেও, মায়ের শরীর মন কোনওটাই জায়গাটার সাথে খাপ খাওয়াতে পারল না। অগত্যা আবার ডেলি-প্যাসেঞ্জারি। তারপরেই ঝুমা এল, এক বছরের মাথায় বিটকু। বিটকু জন্মাবার পরেও কয়েকটা মাস

ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে বাধ্য হয়ে স্কুলের কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিল, একটাই ঘর সঙ্গে বাথরুম। বাড়ি মালিকের সাথে দেখা হওয়ার কোনও উপায় নেই। তবে ভাড়া দেওয়ার সময় প্রায় কান কামড়ে বলে দিয়েছিল, ‘সামনের স্কুলের মাস্টার তাই ঘরটা দিলাম, না হলে একা পুরুষ মানুষকে কোনওমতেই ঘর ভাড়া নয়।’ সুনন্দ কথাগুলো ঝুমাকে বলতেই সে কি হাসি। মজা করে বলে উঠল, ‘তাহলে আমি সব থেকে নিশ্চিন্ত, কিছু হলে ঠিক খবর পেয়ে যাব, ফোন নম্বরটা দিয়ে আসতে হবে।’

আবার বৃষ্টি নামল। সন্ধে থেকে একভাবে হয়ে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়ে আবার। মাঝে কয়েকটা ঘন্টা হুডুম হাডুম থাকলেও বৃষ্টিটা পড়েনি। সুনন্দ ঘরে চেয়ারে বসে বসে পাশে গোয়ালঘরের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বার শব্দ শুনতে পেল। জানলার পর্দা টেনে মশারি খাটিয়ে শুতে যাবে, এমন সময় দরজার কড়া নাড়াবার শব্দ পেল। সুনন্দ প্রথমবার কোনও আমল না দিয়ে আগের মতোই শোওয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগল। কিন্তু আবার শব্দটা পেতে চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। ঠিক বিপদে পড়লে কেউ কড়া নাড়লে যেমন শব্দ করে, তেমনি শব্দ।

চেষ্টা করেও মনের ভুল এটা নিজেকে বোঝাতে পারল না। দরজাটাও খুলতে সাহস হল না। কানের বা মনের কোনও ভুল নয় তো? তাও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময়। আবার সব চুপচাপ। অন্ধকার এখন আরও প্রকট। ঘরের ভিতরটা আরেকবার দেখে নিল। একটু গিয়ে দরজার উলটো দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করল। সেই অন্ধকার, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানি। দরজার কড়াটা আবার নড়ে উঠল। সুনন্দ আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় ‘কে…?’ জিজ্ঞেস করতে ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি গলা শুনল, ‘একটু দরজাটা খুলবেন, খুব বিপদে পড়ে গেছি।’

মেয়ের গলা পেয়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। মেয়েটিরও গলাতে শব্দগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির কাকুর কি কোনও বিপদ হল? বউদি এসেছে নাকি না, বউদি হলে তো নাম ধরে ডাকত। কিছুসময় দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, বাইরের কড়া নড়ে উঠল আবার।

আস্তে আস্তে দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু মেঘে ঢাকা। অন্ধকার রাত্রি চোখ দুটো আটকে দিল। কিছু বুঝতে পারল না। কিছু সময় পরেই একটা গলা শুনতে পেল, ‘ভিতরে আসব, বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে , দরজাটা ভালো ভাবে খুলুন।’

–আপনি কে, হঠাৎ আমার এ ঘরে তাও রাত্রিবেলা?

–সব পরে বলছি আপনি আগে দরজাটা খুলুন।

সুনন্দ দরজাটা ভালো ভাবে খুলে কিছু বলবার আগেই আগন্তুক ঘরের ভিতর সুনন্দকে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকে দরজার কাছে, সুনন্দের বিপরীতে বাঁদিক থেকে হাত পাঁচ দূরে দাঁড়িয়ে, বলে উঠল, ‘একটা গামছা টামছা কিছু দিতে পারবেন?’

সুনন্দের ঘোর তখনও কাটেনি। অন্ধকার হলেও চোখের সামনে দিয়ে একজন ভিতরে ঢুকল। রোগা নয় বোঝা গেল, সুনন্দের শরীরের সঙ্গে  হালকা ধাক্বা লাগল। চুড়িদার বা পাঞ্জাবি কিছু একটা পরে আছে।

আগন্তুকের পোশাকের জল গায়ে লাগার পরে দরজার ছিটকিনিটা তখনও না লাগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল ,‘আপনি এভাবে ঘরে ঢুকে গেলেন?’

–দেখছেন না বাইরে কি অবস্থা!

–বাইরে এমন অবস্থা তো আমার বাড়িতে এলেন কেন? আর বাড়ি ছিল না?

–আসলে রাস্তার থেকে এই বাড়িটাই সামনে পেলাম, আলোও জ্বলছিল একটু আগে।

–আমি এ বাড়িতে একা থাকি।

–সেটা আমি বাইরে থেকে কীভাবে জানব?

–এবার তো জানলেন, তাহলে আসুন এবার। আমি আপনাকে পাশের বাড়ির বউদির কাছে দিয়ে আসছি।

–ভয় পাচ্ছেন? আপনার অতো ভয় কীসের?

–দিনকাল তো ভালো নয়।

–সে ভয় তো আমারও থাকবার কথা।

বাইরের বৃষ্টির ঝাপটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর আসছে দেখে মেয়েটি বলে উঠল, ‘দরজাটা লাগিয়ে দিন, জল আসছে।’ সুনন্দ বুঝল মেয়েটির কথাগুলো একটু স্বাভাবিক হয়েছে। একটু আগেই হাঁপাচ্ছিল।

ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। সুনন্দ মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে না পাবার জন্য মেয়েটির বয়স, কালো না ফরসা, মুখ শরীর কিছুই বুঝল না।

–আপনি এত রাতে আমার দরজায় কড়া নাড়লেন, ঘরে ঢুকলেন, কি অসম্ভব আতান্তরে পড়লাম বলুন তো।

–সব বলছি, তার আগে কিছু একটা দিন মাথাটা মুছতে হবে। একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?

একটু কষ্ট করে হেঁটে আগন্তুককে একটা বোতল ধরিয়ে বললাম, ‘জলটা নিন, গামছা দিচ্ছি।’ পিছনের দিকে ফিরতেই মেয়েটির জল পানের শব্দ শুনতে পেল। তার পরে একটা তৃপ্তির শব্দ এল, ‘আঃ।’

সুনন্দর হাত থেকে গামছা নিয়ে মাথাটা মুছে বলে উঠল, ‘আমি নন্দিতা। যাত্রাাদলে কাজ করি, কুশপুর গ্রামে যাচ্ছিলাম, কমলপুর চেনেন? এখান থেকে এক কিলোমিটার হবে নাকি?

–আরও বেশি। আমাদের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী আসে।

–ও আপনি স্যার? কোন স্কুলে পড়ান?

–এই গ্রামের হাইস্কুলে।

–যাই হোক। কমলপুরে আমার মাসি থাকে। ওখানে দেখা করে ভেবেছিলাম হেঁটে বা ভ্যানে কুশপুরে চলে যাব। বেরিয়েও ছিলাম। মাঝরাস্তায় এই বৃষ্টি।

–আপনি কি পাগল, রাত্রিবেলা এই গ্রামে ভ্যান কোথায় পাবেন?

–না না, রাত্রিবেলা নয়। আমি সন্ধের আগেই বেরিয়ে ছিলাম।

–তাহলেও এই গ্রামে-ঘরে এমনি ভাবে সন্ধেবেলাতে একা বের হতে নেই।

–আসলে আমি তো এদিককার কিছু জানি না। মাসিও একা থাকে। বাসে চেপেছিলাম। ঠিক চললে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতাম। কিন্তু মাঝরাস্তায় বাস খারাপ। বাসেই বলল, ‘ভ্যান পেয়ে যাবেন।’ ভ্যানের আশায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম। মোবাইলে চার্জ নেই, তার উপর জল ঢুকে গেছে, দলের কারোর সাথে কথাও বলতে পারলাম না। মাঝরাস্তায় বৃষ্টি নামতে একটা মন্দিরে দাঁড়ালাম।

–কোন দিকে

এই বাড়ির পূর্ব দিকে মনে হয়।

–পূর্ব দিকে কোনও মন্দির নেই, উত্তরে আছে, ধর্মরাজের মন্দির।

–যাই হোক, সেই মন্দিরের চাতালে বসেছিলাম।

–আপনি তো অদ্ভুত, একে অন্ধকার, তার উপর এই বৃষ্টি, আর আপনি একা মন্দিরে বসেছিলেন! যে-কোনও রকম বিপদ হতে পারত।

–প্রথমে একাই ছিলাম, তাতে অসুবিধা হয়নি, কিছুক্ষণ পরে কোথা থেকে তিন-চারজন ছেলে এসে বিরক্ত করতে আরম্ভ করল, তাই পালিয়ে এদিকে চলে এলাম। আপনাদের গ্রামে তো সন্ধেবেলাতেই রাত্রি নেমে আসে দেখছি।

–আপনি এখানে কখন এসেছেন?

–আধঘণ্টা হবে।

–এখন এগারোটার বেশি বাজে, এই বৃষ্টিতে কি সবাই বাইরে নাচবে? কারেন্ট নেই, খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আপনি কটার সময় মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?

–ক’টা হবে, সাড়ে ছটা, সাতটা।

–তখন তো বৃষ্টি পড়ছিল।

–সেই রকম জোরে পড়েনি।

–আপনার কথাবার্তাতে কীরকম সন্দেহ হচ্ছে। গ্রামে রাতেরবেলা কেউ বের হয় না, তারপর ওই মন্দিরেও সন্ধেবেলা কেউ যায় না।

–স্যার পৃথিবীর সব কিছু কি অঙ্কের নিয়মে হয়?

কিছু সময় দুজনেই চুপ থাকল। বাইরে তখনও সমানে বৃষ্টি পড়ছে, কমবার কোনও লক্ষণই নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক ঘরের ভিতরের অন্ধকারকে কাঁপিয়ে আরও অন্ধকার করে, অদৃশ্য হয়ে নিজে সেই আগন্তুককে আরও রহস্যের চাদরে ঢেকে দিচ্ছে।

–আমি আজকের রাতটা আপনার ঘরে থাকব।

নিঃশব্দ অন্ধকার ঠেলে কথাটা কানে যেতেই সুনন্দের গলাতেও বজ্রপাত হল– মানে?

–মানে, যেটা বললাম।

–ক্ষ্যাপা পেয়েছেন নাকি আমাকে?

–কাল সকালেই চলে যাব।

–শুনুন একা থাকি, তাতে আবার স্কুলটিচার, কেউ জানতে পারলে আমাকে পিটিয়ে পায়েস বানিয়ে দেবে, সঙ্গে উপরি পাওনা বদনাম। বাড়ি থেকেও বের করে দেবে।

–এই যে বললেন আপনি এখানে একা থাকেন, তাতে আপনাকে কে বের করবে?

– বাড়ির লোক জানতে কতক্ষণ।

–কে আছে বাড়িতে?

–মা, বউ, ছেলে।

–তার মানে আপনি বউকে ভয় পান।

– আপনি খুব বাজে বকছেন।

–কেউ কিছু জানতে পারবে না, আমি খুব ভোরেই বেরিয়ে যাব।

–যত ভোরেই বের হন, এটা হতে পারে না। এমনি ভাবে রাতে আপনাকে আমি থাকতে দিতে পারি না।

–আপনি এক কাজ করুন, বউয়ের ফোন নম্বরটা দিন। আমি সব জানিয়ে দিচ্ছি।

–আপনি তো আমাকে আচ্ছা ঝামেলাতে ফেললেন, এটা সম্ভব নয়। আপনি প্লিজ বোঝবার চেষ্টা করুন। দরজা খুলে দিচ্ছি আপনি বাইরে চলে যান। সুনন্দর গলার উষ্মা বাড়তে লাগল।

–আপনি আস্তে আস্তে কথা বলুন, সবাই চলে আসবে।

সুনন্দ একপা এগিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খুলতে গিয়ে ডান হাতে আরেকটা নরম হাতের ছোঁয়া পেল, সেই সঙ্গে ডান কানে একটা ফিসফিস হাওয়া, ‘আমাকে বের করে দেবেন না প্লিজ।’

সুনন্দর সারা শরীর ঝন্ঝন্ করে উঠল। ছিটকিনি থেকে হাতটা সরিয়ে দরজার ডানদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতেই সামনের জন বলে উঠল, ‘এই মুহূর্তে আমি যদি বাইরে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি, কী হবে বলুন তো?’

–মানে! কথাটা বলবার সময় সুনন্দ ঢোঁক গিলল।

–মানে কাল সকালের আগেই আপনার স্কুল, বাড়ি, সবাই জানতে পারবে আপনি…

–কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছু করিনি।

–রাতটা থাকি। কাল আলো ফোটার আগে বেরিয়ে যাব, কেউ কিছু জানতে পারবে না, কথা দিলাম।

সুনন্দ একটা শ্বাস ফেললেও বৃষ্টির শব্দে নিজের জায়গায় ঢাকা পড়ে গেল। কিছু সময় চুপ থেকে বলল, ‘আপনি কিন্তু ভোর তিনটে সাড়ে তিনটের সময় বেরিয়ে যাবেন, এখানে চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ সবাই উঠে পড়ে। কেউ দেখতে পেলে আমাকে সুইসাইড করতে হবে।

–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি আমার এত উপকার করলেন আর আমি এইটুকু করব না?

সুনন্দ সামনের দিকে এগোতেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনার ঘরে শাড়িটাড়ি তো নেই। আমার সালায়োরটা ভিজে জবজব করছে। এখানটাও ভিজে গেছে। এটা পড়ে থাকলে তো সমস্যা।

– লুঙ্গি চলবে ?

–লুঙ্গি! দারুণ। যাত্রাতে অনেকবার পরেছি। তাছাড়া র‍্যাপার তো পরি।

–তাহলে লুঙ্গি আর একটা শার্ট দিয়ে দিচ্ছি। তবে আর একটা সমস্যা হবে। আপনি এই ভিজে জামা কাপড়গুলো নিয়ে কী করবেন, এখানে তো রাখা যাবে না।

–না না এখানে রাখব কেন? চার পাঁচ ঘন্টাতে জল ঝরে যাবে, তারপর আমি পরে চলে যাব। সুনন্দ অন্ধকার হাতড়ে দেয়ালে ঝোলানো দড়ি থেকে লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে আগের মতোই অন্ধকার হাতড়ে এসে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘এই যে, সোজা আস্তে আস্তে হেঁটে বাথরুমে গিয়ে পোশাকটা ছেড়ে নিন।’

–অত দূর যাওয়া যাবে না। আপনার ঘরটা পুরো ভিজে যাবে। আমি এখানে চেঞ্জ করে নিচ্ছি, আপনি একটু দূরে দাঁড়ান।

–বাথরুমে গেলে ভালো হতো না?

–এখানেও খারাপ হবে না।

সুনন্দ সেই ছায়ানারীর কথামতো চেয়ারে বসল। অন্ধকারে ছায়ানারীর পোশাক বদলানো না- দেখতে পেলেও, বুঝতে পেরে চোখদুটো বন্ধ করে নিল। বন্ধ চোখেও মাঝে মাঝে ভালো দেখা যায়।

কিছু সময় পরে কানে এল, ‘ঘরে কিছু খাবার হবে?

কথাটা শুনে সুনন্দ চোখ খুললে সামনেটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল।

কিছু বললেন?

–ঘুমিয়ে গেছিলেন?

না না, চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম।

–ও! কিছু খাবার হবে?

–একটা রুটি আছে। মুড়ি হতে পারে। আর তো কিছু নেই।

–চিনি গুড় কিছু?

–চিনি আছে।

–ব্যস ব্যস। একটা রুটি চিনি মুড়ে দিয়ে দিন। প্লেট-ফেট দিতে হবে না।

–তা কি করে হয়, আমি প্লেটেই দিচ্ছি, আপনি ততক্ষণ ভিজে জামাটামাগুলো বাথরুমে মেলে দিয়ে আসুন। সোজা, আস্তে আস্তে হাঁটুন অসুবিধা হবে না। আমার টর্চটারও ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।

–ভালোই হয়েছে, মাঝে মাঝে অন্ধকার ভালো।

কিছুসময় পর একটা জোরে শব্দ আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উফ্ কথাটা শুনেই সুনন্দ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হল, কোথায় ধাক্বা লাগল?’

–এই যে শক্ত মতন কিছুতে।

–বিছানা, একটু আস্তে আস্তে চলুন।

আগন্তুক বাথরুমে গেলে সুনন্দ একটা প্লেটে চারটে বিস্কুট, রুটি, চিনি নিয়ে বিছানাতে রেখে বলল, ‘এই বিছানাতে রাখলাম, খেয়ে নেবেন।’

আবার চেয়ারের জায়গায় ফিরে বসতেই বাথরুম থেকে ছায়ানারীর গলার আওয়াজ পেল, ‘বাথরুমে মেলব কোথায়?’

–একটা দড়ি আছে, দেয়ালের দিকে, সাবধানে দেয়াল ধরে ধরে যাবেন। চেয়ারে বসে থাকবার কিছুসময় পরেই কাঠের আলমারির উপর কিছু একটা পড়বার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে বলল ‘কিছু ফেললেন নাকি?’

– এখানে ধাক্বা লাগল।

–আপনি ওদিকে গেছেন কেন, সোজা যেভাবে গেছিলেন সেভাবেই চলে আসুন। আস্তে আস্তে আসুন, বিছানাতে খাবার দেওয়া আছে।

চেয়ারে বসেই সুনন্দ পায়ের আওয়াজ এবং কিছুপরে বিছানার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ পেল। কিছু সময় পরে মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনি বিস্কুটও দিয়েছেন, ভালো।’

সুনন্দের কানে চেবানোর আওয়াজ এল।

–আপনার বাড়িতে বউ মা আর ছেলে, বাঃ বেশ ছোটো পরিবার।

প্রথমবার কথাটার কোনও জবাব না পেয়ে আগন্তুক খেতে খেতেই বলে উঠল, ‘ঘুমিয়ে গেলেন?’

–আপনি তো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।

–আপনি রেগে গেছেন?

–কী হবে আপনার এই সব জেনে?

–মাত্র তো কয়েক ঘন্টা, চাপ নেবেন না।

–আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

–হ্যাঁ।

–শুয়ে পডু়ন। আমি মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছি।

–আপনি?

–আমার কথা অনেক ভেবেছেন, ঘুমোন।

–ছিঃ ছিঃ। তা কি করে হয়। তার থেকে আপনি ঘুমোন আমি বসে থাকি। আমার রাত জাগা অভ্যাস আছে।

–বিছানাতে শুলে আমি আর উঠতে পারব না। ভোরে আপনাকে ডাকতেও পারব না। ।

–বাঃ বাঃ আপনি সেই একই কথা ভাবছেন। আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছি।

–ঠিক আছে আপনি শুয়ে পড়ুন।

–আমি কি এই বিছানাতে শোবো?

–তাছাড়া, মাটিতে শুতে পারবেন না, জায়গাও নেই।

কিছুসময় দুজনেই চুপচাপ। বাইরে বৃষ্টির সাথে ঝড় উঠেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো। ঘরের ভিতর দুজন অচেনা অল্প জানা মানুষদের একে অপরের কাছে কিছুসময়ের জন্য দৃশ্যমান করেই আবার নিজেকে লুকিয়ে দিচ্ছে।

–শুনুন না, আমার খুব খারাপ লাগছে, আপনি এইভাবে সারারাত বসে থাকবেন, আর আমি শুয়ে থাকব। তার থেকে আপনি শুয়ে পড়ুন।

–অনেক জ্বালিয়েছেন এবার একটু ক্ষ্যামা দিয়ে শান্তিতে বসতে দিন। রাতে ঘরে ঢুকেছেন, খেতে পেয়েছেন, শুতে পেয়েছেন, এবার ঘুমোন। আমাকে শুধু চাদরটা বের করে দিন। বালিশের নীচে পাবেন।

চাদর ঢাকা নিয়ে পাদুটো সোজা করে বসতে সুনন্দ স্পষ্ট বুঝতে পারল আগন্তুক শুয়ে পড়েছে।

সুনন্দ চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এই অন্ধকার বৃষ্টির রাতে ঝুমা থাকলে অন্যরকম সমীকরণ তৈরি হতো। সুনন্দ চারদিকটা আরেকবার দেখে নিল। ছায়ানারী শুয়ে আছে। সুনন্দের শরীরের অনেক অঙ্ক, অসমীকরণ ঝাঁপাঝাঁপি আরম্ভ করলেও উত্তর নেই, পাতা উলটে সমাধান করবার উপায় নেই। এক একটা দিনের উচ্চতা, দূরত্ব বাকি সব দিন বা রাতের সূচক ছাড়িয়ে যায়। উত্তর মেলে না, শুধু পাতার পর পাতা ব্যর্থ কষা। সমীকরণ, অসমীকরণের গ্রাফ, লগ, বা পাটিগণিতে শরীর নষ্ট হয়, পায়জামা, লুঙ্গি ভিজে দাগ হলেও শুধু জয় জগন্নাথ বলে রণে ভঙ্গ দেওয়ার অঙ্ক শিখে নেওয়ার মধ্যেই তো সব গ্রাফ, সব জটিল বিষয়ের মিল!

–মাস্টারদা, ও মাস্টারদা।

বাইরের আওয়াজে থতমত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুনন্দ। ঘরের ভিতরে সব আলো জ্বলছে। মশারিটা এখনও খাটানো রয়েছে। তার মানে গতরাতের মেয়েটা এখনও শুয়ে আছে। মাথার ভিতরটা দপ্দপ্ করতে লাগল। জীবন, জীবিকা সবের বারাটো বেজে যাবে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে দুধের বাটি নিয়ে দরজার কাছে আসতেই জলে হালকা পিছলে গেলেও সামলে নিয়ে, ছিটকিনি খুলে ডান হাতটা বের করে দুধ নিল।

–কি ব্যাপার মাস্টারদা, আজ এত ঘুম, কখন থেকে ডাকছি।

–কাল সারারাত কারেন্ট ছিল না, ঘুম হয়নি, ভোরে ঘুমিয়ে গেছি।

বেশি কথা আর না বাড়িয়ে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিল। মেয়েটা কথা রাখল না। বলেছিল ভোরে চলে যাবে। এবার কী হবে? সুনন্দ মশারির কাছে আসতেই দেখল বিছানা ফাঁকা। মেয়েটা? বাথরুমে!

সুনন্দ বাথরুমের কাছে এসে দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। তাহলে মেয়েটা!

চোখ পড়ল বাথরুমের দেয়ালের টাঙানো দড়িটাতে, ওই তো, লুঙ্গি, শার্ট।

তাহলে মেয়েটা! চলে গেল? না, তাহলে তো দরজার ছিটকিনিটা ভিতর থেকে দেওয়া থাকত না। কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। মেয়েটা তো গতকাল রাতে ঘরে এসেছিল, অন্ধকার হলেও সুনন্দ এতটা ভুল দেখেনি।

সুনন্দ রুটির জায়গাটা খুলল, কী আশ্চর্য এই তো রুটিটা আছে। কিন্তু কাল রাতে নিজে একটা প্লেটে মেয়েটাকে রুটিটা দিয়েছিল, তাহলে!

মশারিটা তাড়াতাড়িতে খুলতে গিয়ে দুটো দড়ি ছিঁড়ে ফেলল। দলা পাকিয়ে একপাশে সরিয়ে রেখে বিছানাতে হাত দিল। এই তো পায়ের দিকটা ভিজে। বালিশটাও সাঁতস্যাত করছে। চাদরটা কুঁচকে আছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কেউ শুয়ে ছিল।

সুনন্দর শরীরে একটা অসমীকরণের স্রোত বইতে আরম্ভ করলেও, এবারেও কোনও সমাধান বা উত্তর মেলাতে পারল না। বালিশটা সরাতে একটা ভাঁজ করা ছোটো কাগজ দেখতে পেল। হাতে নিয়ে খুলতেই বুঝল বাসের টিকিট। ভাড়ার টাকা কিছু না লেখা থাকলেও টিকিটের নীচের দিকে ধন্যবাদ লেখাটাতে চোখদুটো আটকে গেল।

 

সহমর্মিতা

খোলা হাওয়ায় শ্রীরাধা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। শহরের শেষপ্রান্তে থাকা ঝিলটায় পৌঁছোতে গেলে এই একটাই রাস্তা ধরতে হয়। এদিকটা বেশ নির্জন। চারিদিকে নিবিড় সবুজ গাছগাছালি তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। পিচ বাঁধানো ঢালাই মসৃণ রাস্তা। একটাই বেশ বড়ো হাসপাতাল রয়েছে এই চত্বরে, ঝিলের থেকে কিছুটা দূরত্বে। আর কোনও লোকবসতি নেই এই দিকটায়।

আজ অনেক দিন পর গৌতমের সঙ্গে বাইকে শ্রীরাধা বাড়ি ছাড়িয়ে এতটা দূরে এসেছে, একান্তে কিছুটা সময় কাটাবে বলে। জায়গাটা বরাবরই তার বড়ো প্রিয়। চারপাশের নিসর্গ দেখতে দেখতেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই গৌতম যখন এখানে আসার কথা বলল, দ্বিধা করেনি শ্রীরাধা মুহূর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

ঝিলের চারপাশে কিছু কিছু আগাছার ভিড় থাকলেও একটু পরিষ্কার দেখে ওরা দুজনে একটা কাগজ বিছিয়ে ঘাসের উপর বসল। গৌতম একটু কাছে ঘেঁষে আসতে চাইলে, শ্রীরাধা কপট রাগ দেখিয়ে ওকে দূরত্ব রেখে বসতে বলল। দুজনেই পা মেলে বসল ঘাসের উপর। হঠাৎই ঝিলের জলে একটা মৃদু কম্পন আর তার সঙ্গে ঝুপ একটা শব্দ শুনে, শ্রীরাধা একটু সজাগ হয়ে উঠল।

মনে হচ্ছে জলে কেউ পাথর ফেলল। নিশ্চয়ই আশেপাশে কেউ আছে আর আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে।

এখানে কেউ প্রায় আসে না। অনেক সময় জলের উপরে মাছ লাফিযে ওঠে। তারই আওয়াজ তুমি শুনে থাকবে। গৌতম নিশ্চিন্ত করতে চায় শ্রীরাধাকে।

শ্রীরাধার শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ এসে গৌতমের দেহ-মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েে। নিজেকে সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছিল গৌতমের। কিন্তু শ্রীরাধার যা ব্যক্তিত্ব তাতে কোনও ভাবেই ওর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া চলে না। তাই ধীরে ধীরে ওর চুলের লম্বা বিনুনিটা হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে হালকা করে জিজ্ঞেস করে, তোমার পারফিউম-টার নাম কী?

উত্তর দেয় না শ্রীরাধা। মৃদু হেসে গৌতমের কাঁধে মাথা রাখে সে। সুযোগ বুঝে গৌতমের চোখদুটো শ্রীরাধার রূপ-মাধুর‌্য পান করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই কাটে কিছুটা সময়।

কী দেখছ এমন করে?

তোমার চোখ।

এতে দেখার কী আছে? তোমার সবেতেই বেশি বেশি।

ওই চোখে কী শুধু আমিই জানি।

থামো তো, বাড়িয়ে বলাটা তোমার স্বভাব। এবার চলো উঠি। আর একটু পরেই সন্ধে নামবে। বলে শ্রীরাধা উঠে পড়ল। শাড়িটা ঠিকঠাক করে গুছিযে নিল। সেই সময় দমকা একটা হাওয়ার বেগ ওর আঁচলটা উড়িয়ে নিয়ে গৌতমের মুখ ঢেকে দিল।

গৌতম আঁচলটা হাত দিয়ে ধরতেই শ্রীরাধা বলে উঠল, আঁচলটা প্লিজ ছেড়ে দাও, কেউ দেখে ফেলবে।

আজকের দিনটাই ভালোবাসার জন্য। আমারও প্রাণভরে তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।

প্লিজ ছাড়ো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ঠিক আছে ম্যাডাম আজ ছেড়ে দিচ্ছি, বলে শ্রীরাধার কোমরের খোলা অংশ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গৌতম গভীর চুম্বনে শ্রীরাধাকে সিক্ত করল।

ওদের এই ভালোবাসার সাক্ষী থাকে ঝিলের জল, আশেপাশের গাছপালা আর এক দম্পতি যুগল। ডক্টর সৌম্য বোস এবং ডক্টর শীলা বোস। ঝিলের অনতিদূরেই তাঁদের হাসপাতালটি। কখনও কখনও দুজনের কাজ একই সমযে শেষ হলে, নিজেদের ক্লান্তি দূর করতে, স্বামী-স্ত্রী এই ঝিলটির ধারে এসে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটিযে যান।

গৌতম-শ্রীরাধা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর শীলা তাঁর স্বামীকে বললেন, এই ছেলেটিকে আমি চিনি। আমার বাপেরবাড়ির পাড়ায় থাকে। খুব বাজে ছেলে। এক কথায় বলা যায় ধনী বাপের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। পড়াশোনা কতদূর করেছে জানা নেই, তবে নিত্য নতুন মেয়েে ফাঁসাতে ওস্তাদ। একবার তো এই ছেলেটির দুশ্চরিত্র স্বভাবের কারণে, একটি মেয়ে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছিল।

ছাড়ো তো ছেলেটার কথা, ওদের সঙ্গে আমাদের তো কোনও লেনদেন নেই, ডা. সৌম্য স্ত্রীকে বলেন।

এই ঘটনার পর ছয়-সাত মাস কেটে গেছে। সৌম্য এবং শীলা দুজনেরই সেদিন নাইট ডিউটি। হঠাৎই একটা ট্যাক্সি এসে থামে হাসপাতালের সামনে। এক দম্পতি একটি মেয়েে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে হাসপাতালে ঢোকেন। দুজনে মেয়েটিকে ধরে, ধীরে ধীরে এমারজেন্সি-তে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডাক্তারবাবু দম্পতির দিকে চাইলে, মহিলা এগিয়ে আসেন।

ডাক্তারবাবু, এ আমার মেয়ে আজ দুপুর থেকে ওর পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আর সেই সঙ্গে খুব ব্লিডিং-ও হচ্ছে।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েির ব্লাড প্রেশার চেক করে একটা ফোন করলেন। ডক্টর শীলা, প্লিজ তাড়াতাড়ি একবার এমারজেন্সি-তে আসুন। একটা ক্রিটিক্যাল কেস এসেছে।

দুমিনিটের মধ্যেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শীলা এসে সেখানে পেঁছোলেন। ঝড়ের গতিতে মেয়েিকে বিছানায় শুইযে পর্দা টেনে দিলেন। একটু পরেই বেরিয়ে এসে জানালেন, মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছে। এখুনি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। সার্জারি করতে হবে।

অপারেশনের নাম শুনেই মেয়েটির মা-বাবা ঘাবড়ে গেলেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর, ভয়ে কোনও কারণ আছে নাকি?

এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা ফর্মালিটিজগুলো সেরে, ওটি-র সামনে অপেক্ষা করুন।

ওটি-তে সৌম্যও স্ত্রী-কে জয়েন করলেন। একটু পরেই একজন নার্স বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ওটি-তে থাকা অসুস্থ মেয়েটির অভিভাবক কি আপনারা? নার্স একটি কাগজ এগিয়ে দিল ভদ্রলোকটির দিকে, তাড়াতাড়ি করে এটাতে সাইন করে দিন। অপারেশন করতে হবে। এখনই করুন।

কী হয়েে সিস্টার?

এখন কথা বলার সময় নেই। যা প্রশ্ন আছে অপারেশনের পরে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। মেয়েিকে ডিসচার্জ করার আগে এক বোতল রক্ত আমাদের ব্লাড ব্যাংক-এ জমা করতে হবে। এখন আমরা আমাদের স্টক থেকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

নার্স চলে গেলে একজন অ্যাটেনডেন্ট-এর সঙ্গে গিয়ে ভদ্রলোক এক বোতল নিজের রক্ত জমা দিয়ে আবার এসে স্ত্রীয়ের পাশে, ওটি-র সামনের বেঞ্চটাতে বসলেন।

হঠাৎ করে শ্রীরাধার কী হল? ভালোই তো ছিল। ভিতরের টেনশন কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলেন না শ্রীরাধার বাবা।

অপারেশন টেবিলে শ্রীরাধাকে শুইয়ে দিয়ে শীলা জিজ্ঞেস করলেন, যার সঙ্গে তুমি প্রায়শই ওই ঝিলটায় যাও এটা তারই কীর্তি, তাইতো?

চোখের জল বাধ মানে না শ্রীরাধার। হ্যাঁ ডক্টর, আমার একটা ভুলের জন্য এই পরিণতি হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাকে প্লিজ বাঁচাবার চেষ্টা করবেন না। আমার মরে যাওয়াই উচিত।

আমি তোমার মতো বোকা এবং দাযিত্বজ্ঞানহীন নই। আমার কী কর্তব্য সেটা আমি ভালোই জানি।

কিন্তু এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে আমি কী করে বাঁচব? আপনি আমাকে এখন বাঁচিয়ে দিতে পারেন ঠিকই কিন্তু পরেও তো আবার আমি আত্মহত্যা করতেই পারি। দয়া করে আমাকে মরতে দিন।

ঘাবড়ে যেও না, আমি তোমার বদনাম হতে দেব না। এখান থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তুমি বাড়ি যাবে। নিজের পড়াশোনার ওপর বেশি ফোকাস রাখো। এখন থেকে মা-বাবার সম্মানের কথাটা মাথায় রেখো দয়া করে। সম্মতিসূচক মাথা হেলায় শ্রীরাধা। আর কথা বোলো না, এখনই অ্যানাস্থেশিযার প্রভাব ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যাবে। তার পরেই আমি অপারেশন শুরু করব।

প্রায় দুঘন্টা পর ওটি থেকে শীলা বাইরে বেরোতেই, শ্রীরাধার মা-বাবা দৌড়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের মেয়ে কেমন আছে?

ভালো আছে। আপনারা ঠিক সময়ে মেয়েটির হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন, নয়তো বেশি ব্লিডিং হওয়ার ফলে প্রাণটাও যেতে পারত। অপারেশন সাকসেসফুল। এখন আর কোনও ভয় নেই আপনাদের মেয়ে।

কিন্তু ডক্টর, আমার মেয়ের কী হয়েছে ? শ্রীরাধার বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

আপনারা আমার কেবিনে আসুন।

শ্রীরাধার মা-বাবা ডা. শীলার সঙ্গে ওনার চেম্বারে গিয়ে বসলেন। শীলা, শ্রীরাধার ফাইলে দেওয়া বিবরণ চোখের সামনে খুলে ধরলেন। পেশেন্টের বাবার দিকে সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি ফাইলে মেয়ে বয়স লিখিয়েেন সতেরো অর্থাৎ নাবালিকা। আপনারা কি জানতেন, শ্রীরাধা গর্ভবতী ছিল?

কিন্তু এটা কী করে সম্ভব?

তার উত্তর তো একমাত্র শ্রীরাধাই দিতে পারবে। ওর একটি ফার্টিলাইজড এগ গর্ভাশয় অবধি পৌঁছোতে পারেনি। ফ্যালোপিয়ন টিউবেই আটকে ছিল। গর্ভের আকার বড়ো হতেই নালি ফেটে গিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়েছিল। আমরা নালির ওই অংশ কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন আর ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।

ডাক্তারের কথা শুনে শীলার মা-বাবার মুখে আশ্চর্য হওয়ার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে ওঁরা লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলেন।

সপ্তাহ খানিক পর শ্রীরাধার ডিসচার্জ হওয়ার কথা। শীলার অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে জিজ্ঞেস করল, ডিসচার্জ ফাইলে কী লিখব ম্যাডাম? আপনি বলেছিলেন ডিসচার্জ ফাইল তৈরি করার সময় আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করতে।

ওকে, পেশেন্টকে যে ডিসচার্জ স্লিপটা দেওয়া হবে, তুমি তাতে সব সত্যিটা লেখো। আর হাসপাতালের ফাইলে লেখো ডান দিকের ফ্যালোপিয়ন টিউব ফেটে যাওয়ার পরে, সেটা আপারেশন করে বার করে দেওয়া হয়েছে। একটা নোট লিখে দিও যে, সার্জারির ডিটেল রিপোর্ট গাইনিকোলজিস্টের ফাইলে রয়েছে। এই ডিটেল পেপার্স-এর ফাইল আমাকে দিয়ে দিও। এই পুরো ব্যাপারটা যেন আমাদের দুজনের মধ্যেই থাকে। তুমি নিজে একজন মেয়ে হয়ে নিশ্চয়ই এটার গুরুত্ব বুঝতে পারছ।

কথোপকথনের মধ্যেই সৌম্য এসে স্ত্রীয়ের কেবিনে ঢুকেছিলেন। চুপচাপ বসে স্ত্রীয়ের কথা শুনছিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই শীলাকে বললেন, এটা তুমি কী করছ? হাসপাতালের ফাইলেই অপারেশন নোটস থাকতে দাও। এটা তোমার করা উচিত নয়। পেশেন্টের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে বলে, তুমি হাসপাতালের নিয়ম ভাঙতে পারো না।

সৌম্য তুমি যা বলছ, তা একদম ঠিক। কিন্তু ভেবে দ্যাখো মেয়েটি নাবালিকা, বাচ্চা মেয়ে বললেও ভুল হবে না। ওর এই অবৈধ প্রেগন্যান্সি যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মেয়েটির বদনামের শেষ থাকবে না। মেয়েটির ভবিষ্যৎও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী। আমি মেয়েটির ব্যথা খুব ভালো বুঝতে পারি।

শীলা, শ্রীরাধার মা-বাবাকে ডেকে পাঠালেন নিজের কেবিনে। হাসপাতালের নিয়মকানুন বুঝিয়ে বললেন, দেখুন আপনাদের ফাইলে আমাকে সত্যিটা লিখতেই হবে। ফাইল আপনাদের সুতরাং ওটা নিয়ে আপনারা যা খুশি করতে পারেন। চাইলে নষ্ট করেও দিতে পারেন। আপনাদের মেয়ে ভালোর জন্য আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি সেটা করেছি। এবার ওর ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, শ্রীরাধা ভবিষ্যতে আদৌ মা হতে পারবে কি?

হ্যাঁ, মা হতে পারবে। ওর একটা ফ্যালোপিয়ন টিউব সম্পূর্ণ ঠিক আছে।

কিন্তু অপারেশনের দাগ তো পেটে থেকেই যাবে। বিয়ের পর যদি ওর স্বামী দেখে কিছু সন্দেহ করে?

আমি ল্যাপ্রোস্কোপিক পদ্ধতিতে সার্জারি করেছি। ছোট্ট একটুখানি জায়গা কাটতে হয়েছে। সুতরাং পেটে কোনও বড়ো দাগ থাকবে না, তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। শ্রীরাধার বিয়ে এখনও অনেক দেরি আছে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি, ও এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। মাস্টার্স করে তবেই বিয়ে করবে আপনাদের মেয়ে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেওয়ার পর বাড়ি এসে শ্রীরাধা মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ল। লজ্জা যেন ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। মা, আমি আর কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না! বেঁচে থেকে আমি কী করব?

খবরদার রাধা এমন বোকার মতো কথা মাথাতেও আনবি না। একটা দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যা। এটা নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা করবি না। এমনকী বিয়ে পর স্বামীর সঙ্গেও না। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমরা খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেব, চিন্তা করিস না।

শ্রীরাধার মা স্বামীকেও বললেন, এই ব্যাপার নিয়ে রাধাকে তুমি কিচ্ছু বলবে না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি। এই পুরো ঘটনায় ও খুব লজ্জিত। ও এখন পড়াশোনা নিয়ে থাকতে চায়। ভাগ্য ভালো যে, এরকম একজন ভালো লেডি ডক্টর-এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল। যিনি আমাদের সম্মান বাঁচাবার জন্য যতখানি সম্ভব সহযোগিতা করেছেন।

এই ঘটনার পর আট বছর কেটে গেছে। আজ শ্রীরাধা নিজের স্বামীর সঙ্গে আবার ডা. শীলার হাসপাতালে এসে হাজির হয়েে। আড়াই মাসের গর্ভবতী সে। ওর ডাক্তারই শ্রীরাধাকে, ডা. শীলা বোসের কাছে রেফার করেছেন।

শ্রীরাধা আর তার স্বামীর সঙ্গে কথার শেষে, শ্রীরাধার স্বামীকে কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ডা. শীলা চেক-আপের জন্য শ্রীরাধাকে বেডে শুইযে দিলেন। পরীক্ষা করে বললেন, পেটের দাগটা তো একেবারেই মিলিয়ে গেছে দেখছি। এখন ক’মাস চলছে?

আড়াই মাস চলছে ম্যাম।

বাচ্চা একদম ঠিক আছে। খাওয়া-দাওয়ার খেযাল রাখতে হবে আর অ্যাক্টিভ থাকবার চেষ্টা করবে সবসময়। এতে নর্মাল ডেলিভারি হতে সুবিধা হবে। কমপ্লিট রেস্টের কোনও দরকার নেই তোমার। তোমার স্বামী বাইরে বসে ছটফট করছেন, তোমাকে খুবই ভালোবাসেন, তাই না?

হ্যাঁ ম্যাম। আমার অতীতের ঘটনা ওনাকে কিছুই জানাইনি। আমি তো আত্মহত্যা করব বলেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, আপনিই আমাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আপনার জন্যই এত সুন্দর জীবন পেয়েছি। এই ঋণ কোনও দিন আমি শোধ করতে পারব না। শ্রীরাধার চোখ জলে ভরে আসে।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন শিগগির স্বামীর কাছে যাও। ও বেচারা উত্কণ্ঠায় ছটফট করে মরছে। হাসতে হাসতে শীলা বললেন।

চোখে জল নিয়ে শ্রীরাধা কেবিন থেকে বাইরে এল। ওকে দেখে স্বামী রথীন দৌড়ে এল, কী হল শ্রীরাধা, সব ঠিক আছে তো? তোমার চোখে জল কেন?

রথীন এটা হচ্ছে আনন্দের অশ্রু। শ্রীরাধার শরীর আর বাচ্চা দু-ই একদম ঠিক আছে। পরের বার মিষ্টি নিয়ে আসতে ভুলো না শ্রীরাধা। ওরা দুজনের কেউই খেয়াল করেনি, কখন ডা. শীলাও শ্রীরাধার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওনার কথাতে দুজনের চমক ভাঙে। রথীন আর শ্রীরাধা হাসিমুখে শীলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসে। নবজাতকের আগমনের স্বপ্নে দুজনেই বিভোর হয়ে ওঠে।

আলোয় ফেরা

‘মিত্রা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। এখুনি বেরোতে হবে। একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান দিল এজেন্ট। এখন না গেলে যার ফ্ল্যাট সে চলে যাবে’, শংকর তাড়া লাগাল বউকে।

আজ এক সপ্তাহ হল শংকর আর মিত্রা বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি এসে হোটেলে উঠেছে। শংকর বেঙ্গালুরুর চাকরি ছেড়ে আরও ভালো প্যাকেজ পেয়ে দিল্লি এসেছে। বরের সঙ্গে থাকবে বলে মিত্রা ওখানকার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। ও জানে এখানে সেটল করে ঠিক একটা চাকরি ও জোগাড় করে নেবে। বেঙ্গালুরুর ফার্নিশড ফ্ল্যাটটাও ওরা আসার সময় ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ওরা ঠিকই করে রেখেছে নিজস্ব ফ্ল্যাট না হওয়া পর্যন্ত ফার্নিশড ফ্ল্যাট-ই ভাড়া নিয়ে থাকবে। এতে সুবিধা হচ্ছে, গুচ্ছের জিনিসপত্র কিনে টানা-হ্যাঁচড়ার কোনও প্রশ্ন নেই। শুধু নিজেদের ব্যবহার্য জামাকাপড় এবং দৈনন্দিন কিছু জিনিস ছাড়া শিফটিংয়ের সময় গুচ্ছের জিনিস বইতে হয় না। সুতরাং দিল্লিতে আসা থেকে ওরা নতুন ফ্ল্যাটের সন্ধানে রয়েছে। কয়েকটা দেখেওছে কিন্তু কোনওটাই ফার্নিশড ছিল না। হোটেলে থাকতেও ওদের আর ভালো লাগছিল না।

নতুন ফ্ল্যাটটা দেখেই দুজনেরই পছন্দ হয়ে গেল। নতুন ফার্নিচারে সাজানো দুটো বেডরুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিং, ঝকঝকে মডার্ন কিচেন, বাথরুম– সবই প্রশংসার যোগ্য কিন্তু মিত্রার সবথেকে পছন্দ হল ফ্ল্যাটের সঙ্গে লাগোয়া সার্ভেন্ট কোয়ার্টারটা দেখে। বাড়িওয়ালা জানালেন, ওই সোসাইটিতে প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে একটি করে সার্ভেন্ট কোয়ার্টার আছে। তাতে একটি রুম সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম এবং রান্নাঘর। কোয়ার্টারে ঢোকার রাস্তাও আলাদা।

ফ্ল্যাটে যে কাজ করবে সে পরিবারের সঙ্গে ওখানে থাকতে পারবে পরিবর্তে কম টাকায় তাকে ওই ফ্ল্যাটের সব কাজ করতে হবে। এটাই নাকী ওই সোসাইটির নিয়ম। যারা এই শর্তে কাজ করতে ইচ্ছুক তারা সিকিউরিটি গার্ডের কাছে নিজেদের মোবাইল নম্বর দিয়ে রেখেছে সুতরাং যোগাযোগ করতে হলে সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সব দেখেশুনে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ করে দিল শংকর। মিত্রার মুখ দেখে বুঝতে পারছিল ওরও খুব পছন্দ হয়েছে পুরো ব্যবস্থা। টাকা দিতে যাওয়ার একটা দিন ধার্য করে ওরা স্বামী-স্ত্রী বেরিয়ে এল সোসাইটি থেকে। মিত্রা আনন্দ চেপে রাখতে পারল না। বাইরে পা দিয়েই বলল, ‘আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে ফ্ল্যাটটা, বিশেষ করে সার্ভেন্ট কোয়ার্টার থাকায় চাকরি করাটা খুব সুবিধা হবে তাই না?’

ছোট্ট একটা ‘হ্যাঁ’ বলেই শংকর চুপ করল।

‘এখানে শিফট করেই একজন কাজের লোক রেখে নেব। তাহলে অফিস জয়েন যখন করব কোনও চিন্তা থাকবে না আর অফিস থেকে ফিরেও রান্না করার ঝামেলায় পড়তে হবে না’, মিত্রা আনন্দ কিছুতেই চাপতে পারে না।

তিন দিনের মাথায় শংকর আর মিত্রা নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করল। মিত্রা এসেই সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলে চার-পাঁচজন পরিচারিকার নম্বর নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখল, সময় করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে।

একটু গুছিয়ে বসতেই মিত্রা কাজের লোক খুঁজতে লেগে পড়ল। দুটো তিনটে ফোন করার পর একজনকে পছন্দ হল কিন্তু তার এক মাসের বাচ্চা আছে শুনে পিছিয়ে গেল আবার। অতটুকু বাচ্চা নিয়ে পুরো বাড়ি কীভাবে মেয়েটি সামাল দেবে ভেবে পেল না মিত্রা। অগত্যা তাকেও না করতে হল।

শংকর অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে দেখে মিত্রা রান্নাঘরে ঢুকল। মনটা পড়ে রইল কাজের লোকের চিন্তায়। কী জানি কটা দিন আর অপেক্ষা করতে হবে? আনমনা হয়েই দরজা অবধি এগিয়ে গেল মিত্রা, শংকরকে সিঅফ করতে। দরজা বন্ধ করে সোফায় এসে বসল। এখনও ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়নি। মনে মনে কাজের একটা লিস্ট ছকে নেয় ও। সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে আরও কটা নম্বর জোগাড় করে নিয়ে আসতে হবে। সুতরাং দেরি না করে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। তক্ষুনি ডোর বেলটা বেজে ওঠে। মিত্রা দরজার দিকে এগোয়। দরজা খুলতেই দ্যাখে সামনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি একটি মহিলা। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সুতির ছাপা একটি শাড়ি পরনে। গায়ের রং শ্যামলা এবং ছিপছিপে শরীর।

মিত্রাকে দেখে মহিলাটি হাত তুলে নমস্কার জানাল। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই মিত্রার জিজ্ঞাসু এবং উৎসুক মুখ দেখে মহিলাটি বলল, ‘ম্যাডাম, আমার নাম শ্যামা। থাকার জন্য আমার ঘরের খুব দরকার। আপনি লোক খুঁজছেন কাজের জন্য। আমি এখানে কাজ করতে রাজি আছি। আমার স্বামী তিনবছর আগে মারা গেছে, দুটো মেয়ে আছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। পাশেই বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। আগে অনেক বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতাম কিন্তু এখন আর পারি না। এখন একটা বাড়িতে থেকে সেখানেই রাত-দিনের কাজ করতে চাই। এটুকু বলতে পারি আমাকে নিয়ে বা আমার কাজ নিয়ে আপনাকে নালিশ করতে হবে না। সারাদিন পরিশ্রম করতে আমার কোনও অসুবিধা নেই।’

মহিলাটির কথাবার্তা শুনে, মিত্রার মহিলাটিকে ভালোই মনে হল, তবে কয়েকটা প্রশ্ন আগে থেকে জিজ্ঞেস করে নেওয়াটা উচিত মনে হল মিত্রার। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি জানো, এখানে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাকতে হলে, তোমাকে কম টাকায় বাড়ির কাজ করতে হবে? তাহলে তোমার মাসে চলবে কী করে?’

‘সে চিন্তা নেই ম্যাডাম। ছয় মাস বাদে বাদে গ্রাম থেকে আমার চাল, ডাল গম সব আসে। গ্রামে আমাদের জমিজমা কিছু আছে। এছাড়া আমার দুই জামাইও খুব ভালো। টাকাপয়সা দিয়ে ওরা সবসময় আমাকে সাহায্য করে। আমার শুধু থাকার জন্য ঘরের খুব দরকার।’

‘ঠিক আছে, তুমি কবে থেকে আসতে পারবে? মিত্রা জিজ্ঞেস করল।’

‘ম্যাডাম, কাল বাদে পরশু সকালেই আমি জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসব’, বলে শ্যামা চলে গেল। মিত্রাও দরজা বন্ধ করে ভিতরে আসতে আসতে অনেকটা হালকা বোধ করল। মহিলাটি একাই থাকবে সুতরাং ওর নিজের ঝামেলা খুব একটা থাকবে না, ফলে মিত্রার সংসারে ও ভালোমতোই সময় দিতে পারবে। শংকরকে ফোন করে সুখবরটা দিতে হবে ভেবে মিত্রা মুঠোফোনটা হাতে তুলে নিল।

একদিন পরই শ্যামা নিজের জিনিসপত্র নিয়ে মিত্রার কাছে হাজির হল। মিত্রা সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের চাবি খুলে দিয়ে শ্যামার হাতে চাবিটা ধরিয়ে দিল। হাতমুখ ধুয়ে জিনিসপত্র রেখে শ্যামা মিত্রার ফ্ল্যাটে চলে এল এবং বাড়ির সব কাজ বুঝে নিল। শ্যামার গোছালো কাজ দেখে মিত্রা নিশ্চিন্ত বোধ করল এবং নিজের চাকরির জন্য খোঁজখবর নিতে শুরু করে দিল। দেখতে দেখতে একটা মাসের মধ্যে তিনটে ইন্টারভিউ দেওয়া হয়ে গেল মিত্রার। মাস কাটতেই হঠাৎই শ্যামার ব্যবহারে কিছু অসংগতি মিত্রার চোখে ধরা পড়তে আরম্ভ করল।

গ্রামের থেকে চাল, ডাল, গম আসে, শ্যামার কাছে এই গল্প প্রথমে বিশ্বাসই করেছিল মিত্রা। কিন্তু রোজ রোজ যখন জিনিস চাওয়া আরম্ভ করল শ্যামা তখনই মিত্রার সন্দেহ হওয়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে সাহস বাড়তে থাকে শ্যামার। মিত্রাকে কিছু না জানিয়েই রান্নাঘর থেকে চাল, আটা, ডাল, ফ্রিজ থেকে দুধ, সবজি নিয়ে যেতে আরম্ভ করল ও।

একদিন মিত্রা এই নিয়ে একটু চ্যাঁচামেচি করতেই শ্যামাও গলার জোর বাড়াল, ‘আমি কি চুরি করেছি নাকি? আপনার সামনেই তো বার করেছি। এখানে কাজ করছি আর গ্রাম থেকেও এখনও কেউ চাল, ডাল দিতে আসেনি। এই অবস্থায় আপনার থেকে নেব না তো আর কোথায় যাব?’

মিত্রা রাগের মাথায় আর কিছু না বলে চুপ করে গেল।

কিন্তু ধীরে ধীরে শ্যামার চাহিদা বাড়তে আরম্ভ করল। কখনও বিছানায় পাতার জন্য চাদর চেয়ে বসে আবার কখনও কোথাও যাওয়ার দরকার হলে মিত্রার থেকে শাড়ি চেয়ে বসে। শুধু চাওয়া নয়, প্রতিটা কথায় মিত্রার আচার আচরণ নিয়ে টিটকিরি দেওয়া শুরু করে দিল। কখনও মিত্রা সিঁদুর পরে না বলে কথা শোনাত তো কখনও বাড়িতে পুজোপাঠ করে না বলে তাচ্ছিল্য করা শুরু করে দিল। অথচ কাজের কথা মিত্রা কিছু বললে, না-শোনার ভান করত। টাকাপয়সাও মাঝেমধ্যেই চাওয়া শুরু করল। মিত্রা দিতে না চাইলে মেজাজ দেখিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেত শ্যামা। মিত্রার কাছে সব শুনে শংকর ওকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও মিত্রা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না শ্যামাকে নিয়ে ও কী করবে।

একদিন ফোনে যখন ব্যস্ত মিত্রা, ডোরবেল বেজে ওঠে। শ্যামাকে ডেকে দরজাটা খুলে কে এসেছে দেখতে বলে মিত্রা। ঝনঝন করে রান্নাঘর থেকে বাসন পড়ার শব্দ পায়। মিত্রা বুঝতে পারে দরজা খুলতে বলায় শ্যামা রেগে বেসিনে বাসন ছুঁড়ে দিয়ে দরজা খুলতে গেছে। বিরক্ত বোধ করে মিত্রা। সঙ্গে সঙ্গেই একটা প্যাকেট হাতে করে নিয়ে উপস্থিত হয় শ্যামা। ‘নিন, ধরুন, দরজাটা আপনিও তো খুলে দিতে পারতেন… এই ভাবে কাজই তো শেষ করতে পারব না… সারাদিনটা কি এখানেই কাটাব আমি?’

রাগ সামলে প্যাকেট খোলায় মন দেয় মিত্রা। অনলাইনে বুক করা নতুন জুতোটা পাঠিয়েছে। প্যাকেট খুলতেই নতুন জুতো দেখে শ্যামা চুপ থাকতে পারে না, ‘বাবাঃ, শু-র‍্যাক-টা তো আগে থেকেই উপচে পড়ছে, আবার একটা জুতো কিনলেন? একেবারে বাজে খরচা। এর জন্য আপনাদের কাছে টাকা রয়েছে আর আমরা গরিব মানুষরা একটা জিনিস নিলেই আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়।’

শ্যামার স্পর্ধা দেখে মিত্রা অবাক হয়ে গেল। কয়েক মাসের মধ্যে শ্যামার চরিত্রের এই পরিবর্তন মিত্রার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে মিত্রা, শ্যামাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করে দিল আর চার ঘণ্টা সময় দিল কোয়ার্টার ছেড়ে দেবার জন্য।

শ্যামাও রাগ দেখাতে ছাড়ল না, ‘দরকার নেই আমার এরকম কাজের। আমি মেয়ে জামাইয়ের কাছে আরামে থাকব… লোক রেখে দেখুনই না… বুঝতে পারবেন’, বলে দুড়দাড় করে কোয়ার্টারে ঢুকে গেল। খানিক্ষণ পরেই মেয়ে, জামাই এসে শ্যামাকে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় মিত্রা, কোয়ার্টারের চাবিটা ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিল।

রাগের মাথায় শ্যামাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আর এতগুলো কথা বলে বড়ো ক্লান্ত অনুভব করছিল মিত্রা। বাড়ির পড়ে থাকা সমস্ত কাজ সেরে মিত্রা একটু গড়িয়ে নিতে বিছানায় এসে বসে। ক্লান্ত শরীরে কখন যে চোখ বুজে এসেছিল ও নিজেও বুঝতে পারেনি। দরজায় ধাক্বা শুনে ঘুমটা ভাঙে ওর। বাইরেটা বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। শংকরের ফেরার সময় তো এখনও হয়নি। তবে কে এল এই অসময়ে? উঠতে ইচ্ছে করছিল না, জোর করে উঠল।

দরজা খুলে দেখল তেইশ-চব্বিশ বছরের একজন যুবতি মেয়ে। দেখে মনে হচ্ছিল নতুন বিয়ে হয়েছে বেশ হাসি মুখ। পাশেই দাঁড়িয়ে একটি যুবক। মিত্রার মনে হল মেয়েটির স্বামী নিশ্চয়ই।

‘দিদি, আমার নাম সীমা, এ হল রানা… আমার… আমি কাজের জন্য এসেছি।’

ছেলেটি হাতজোড় করে মিত্রাকে নমস্কার জানাল। দুজনের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মিত্রা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী করে জানলে আমি কাজের জন্য লোক খুঁজছি? আমার লোক তো আজ সকালেই ছেড়ে গেছে। আমি তো এখনও কাউকে কিছু জানাইনি পর্যন্ত’, কথা শেষ করে মিত্রা দুজনকে ভিতরে এসে কথা বলার জন্য ইশারা করল। দুজনে ভিতরে এসে দরজার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

‘দিদি, আপনার কাছে আমার পিসি এতদিন কাজ করছিল। আজকে রেগে গিয়ে আপনাকে কী বলেছে জানি না কিন্তু বাড়ি গিয়ে নিজেকেই দোষারোপ করছিল। পিসি খুব ভালো করেই জানে ওকে আপনি আর কাজে নেবেন না তাই আমাকে এখানে কাজের কথা বলল’ সীমা মিত্রার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল।

‘ও… তাই বলো! তোমাকে তাহলে শ্যামা আমার কাছে পাঠিয়েছে? তুমি পারবে সব কাজকর্ম ঠিক করে করতে?’ মেয়েটির ব্যবহার মিত্রার ঠিকই মনে হল অগত্যা মেয়েটিকে কাজে বহাল করার কথা ঠিক করে নিল মিত্রা।

‘দিদি, আমি এই হাউজিং-এ আমার ভাসুর-জায়ের সঙ্গে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকি, বাইরের একটা কাজও করি… কিন্তু দিদি থাকার খুব অসুবিধে হচ্ছে। আমার জায়ের দুটো বাচ্চা সঙ্গে আবার আমরা দুজন। একটা ঘরে গাদাগাদি করে কোনওমতে থাকা। এখানে আপনার কাছে কাজ করলে থাকার অসুবিধে থাকবে না। এবার যদি আপনি আমাকে রাখেন।’

সীমাকে রাখার সিদ্ধান্ত আগেই মনে মনে নিয়ে নিয়েছিল মিত্রা। সুতরাং মুখে বলল ‘ঠিক আছে, তোমরা তাহলে চলে এসো। যখন আসবে চাবিটা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিও।’

রাত্তিরেই একটা খাট আর কিছু জামাকাপড় নিয়ে সীমা, রানার সঙ্গে মিত্রার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে চলে এল।

পরের দিন সকালেই রানা নিজের কাজে চলে গেলে সীমা মিত্রাদের ফ্ল্যাটে চলে এল। মিত্রার কাছ থেকে সব কাজ বুঝে নিয়ে মিত্রাকে জোর করে বসিয়ে দিল, ‘দিদি, আপনি বসে থাকুন, আমি সব কাজ করে দেব। যদি মনে হয় কাজটা ঠিকমতো হয়নি তাহলে আমাকে ডেকে শুধু বলে দেবেন।’

রবিবার সাধারণত সীমা, অর্ধেক দিনের ছুটি চেয়ে নিত মিত্রার কাছে। দুপুরে কাজ সেরে বরের সঙ্গে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেত ও। কখনও সিনেমা দেখতে, কখনও এমনি ঘুরতে অথবা আত্মীয়স্বজনদের বাড়িও যেত ওরা। কখনও কখনও বেরোত যখন, মিত্রার চোখেও পড়ত। সীমার সাজগোজ দেখে মিত্রার একটু অবাকই লাগত কারণ ইমিটেশন গয়না থেকে মেক-আপ, পোশাক-আশাক কিছুতেই কোনও খামতি ওর চোখে পড়ত না। এত সব করার টাকা কোথা থেকে আসে বুঝতে পারত না মিত্রা।

মিত্রা যখনই এ বিষয়ে সীমার সঙ্গে কথা বলত, একই উত্তর শুনত, ‘দিদি, আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে… ও সেজেগুজে থাকা খুব পছন্দ করে। সাজগোজের বেশিরভাগ জিনিসই তো ওই কিনে আনে।’

বেশি মাথা ঘামায়নি মিত্রা এই নিয়ে। এটা ওদের ব্যক্তিগত জীবন, যতক্ষণ বাড়ির কাজ ঠিকমতো হয়ে যাচ্ছে এইসব ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনও কারণ নেই মিত্রার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাকরি খুঁজে জয়েন করাটাই মিত্রার লক্ষ্য। এই নিয়েই আপাতত ও ব্যস্ত থাকতে চায়।

ল্যাপটপ-টা খুলে মেলগুলো চেক করতে বসে মিত্রা। হতাশ হয়, কোনও মেল ঢোকেনি দেখে। কী করবে ভেবে না পেয়ে অনলাইন শপিং সাইটগুলো একটার পর একটা দেখতে শুরু করে। অবসাদ কাটাবার একমাত্র উপায় শপিং, সুতরাং তাতেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে সে। হঠাৎ চোখ আটকায় একটা কুর্তা দেখে। কিনলে বেশ খানিকটা রিবেট পাওয়া যাবে দেখে প্লাস্টিক কার্ডটা নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। মনে করার চেষ্টা করে পার্সটা কোথায় রেখেছে। খেয়াল হয় কাল থেকে ড্রয়িংরুমের টিভির পাশেই পড়ে রয়েছে পার্সটা। তাড়াতাড়ি ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু ঘরে ঢুকেই যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মিত্রা। সীমা সোফায় গা এলিয়ে বসে মিত্রার পার্সটা নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সীমার পিঠ মিত্রার দিকে থাকায় ও মিত্রাকে দেখতে পায়নি। মিত্রা সোফা অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে সীমা পার্স থেকে টাকা বার করে ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়। মিত্রাও বিন্দুমাত্র শব্দ না করে পিছন থেকে সীমার হাতটা ধরে ফেলে। চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়াতে সীমা ঘাবড়ে যায়।

‘দিদি, তুমি!’ মিত্রার মুখ-চোখ দেখে সীমা তোতলাতে থাকে, ‘আমা…কে ক্ষমা করে দাও। আমি কখনও চুরি করি না… আজ শরীরটা ঠিক নেই তাই ডাক্তার দেখাতে যাব… টাকার দরকার ছিল, তাই এই টাকাটা… আর কখনও হবে না দিদি’। ব্লাউজের ভিতর থেকে পাঁচশোর নোটটা বার করতে করতে সীমা বলে।

‘তোমার শরীর খারাপ? কিন্তু সকাল থেকে তো দেখে কিছু মনে হয়নি, বরং আনন্দেই আছ বলে মনে হচ্ছিল। এখন বুঝতে পারছি বাথরুম থেকে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার কীভাবে এত তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে? কয়েকটা লিপস্টিকও আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর তো আরও আছে, মাঝেমধ্যেই কাজ করতে করতে কোয়ার্টারে চলে যাও… এখন বুঝতে পারছি যাওয়ার কারণ। আমি আর কিছু জানতে চাই না। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। যত তাড়াতাড়ি পারো কোয়ার্টার খালি করে দাও’, রাগে আর কথা বলতে পারে না মিত্রা। ইচ্ছে হয় এখুনি পুলিশ ডেকে সীমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে।

সন্ধেবেলায় শংকর বাড়ি ফেরার পরেই সীমা এসে কোয়ার্টারের চাবি মিত্রাকে ধরিয়ে গেল। চুপচাপ স্বামী-স্ত্রী জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়।

আবার সেই কাজের লোকের সমস্যা। মিত্রা মুষড়ে পড়ল তবুও প্রতিজ্ঞা করল এবার আর কোনওরকম তাড়াহুড়ো করবে না। দেখেশুনে তবেই বাড়িতে কাজের লোক ঢোকাবে। সিকিউরিটি গার্ডকেও ফোন করে একটু চেনাশোনা লোকের খোঁজ করতে অনুরোধ করল।

রবিবার শংকরের অফিস ছুটি, ফলে উঠতে একটু দেরিই হয়েছে। মুখ ধুয়ে চা বানিয়ে মিত্রা শোবার ঘরে ঢোকে। শংকর তখনও বিছানা ছাড়েনি। বেডসাইড টেবিলে চায়ের ট্রে টা নামিয়ে বিছানায় গুছিয়ে বসে মিত্রা। কাপটা এগিয়ে দেয় শংকরের দিকে। এই একটা দিনই শংকরের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে পারে মিত্রা। নয়তো রোজই তো সকালে উঠেই অফিস যাওয়ার তাড়া। আর প্রাইভেট চাকরিতে ফেরার কোনও ঠিক নেই।

সবে গল্প করতে করতে চায়ের কাপটা শেষ করেছে, এমন সময় কলিং বেলটা কারও আসার বার্তা জানায়। এই সময় কে রে বাবা! অজান্তেই ঘড়ির দিকে চোখটা চলে যায় মিত্রার। সবে আটটা বাজছে।

বিরক্ত হয়েই বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় ও। হয়তো সিকিউরিটি গার্ড কাউকে পাঠিয়েছে সকাল সকাল, ভেবে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে মিত্রা।

দরজা খুলতেই দ্যাখে সামনে দাঁড়িয়ে পঁয়ষট্টি-সত্তর বছর বয়সি বৃদ্ধ দম্পতি। সঙ্গে রয়েছে ছোটোখাটো চেহারার কুড়ি-একুশ বছরের একটি যুবতি।

মিত্রাকে দেখতেই বৃদ্ধটি হাতজোড় করে বলে, ‘ম্যাডাম, আমি রিটায়ার্ড সরকারি চাপরাশি। বহুদিন ধরে কৈলাশ কলোনিতে একটি ফ্যামিলির সঙ্গে রয়েছি। আমার বউ আগে ওখানে কাজ করত এখন বয়স হয়ে যাওয়াতে আমার এই নাতনি ওদের সব কাজ করে।’

‘আচ্ছা এটি আপনার নাতনি?’ মিত্রা প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। আমরা ওই সাহেবের বাড়ির সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে এতদিন ধরে রয়েছি। এই মাসে ওই সাহেব দিল্লির বাইরে বদলি হয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং আমাদেরও কোয়ার্টার ছাড়তে হবে। শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে থাকার ক্ষমতা নেই আমাদের। আমার পেনশনে সংসারটা চলে কোনওরকমে। তাই এখানে কোয়ার্টার পাওয়া যাবে শুনেই আমি এসেছি।’

‘আপনাদের ছেলে, ছেলের বউ কোথায় থাকে? নাতনি তো দেখছি আপনাদের সঙ্গেই থাকে।’

‘ম্যাডাম, আমাদের ভাগ্যের কথা আর বলবেন না। মেয়েটির জন্মের সময়ই ওর মা মারা যায়। কয়েক বছর বাদেই মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে আমার ছেলে…’ বলতে বলতে বৃদ্ধের গলা

ধরে আসে।

‘আপনাদের নাম কী’, মিত্রা জানতে চায়।

‘আমার নাম রতন আর আমার স্ত্রী সারদা। নাতনির নাম ওর বাবাই রেখেছিল রেশমি।’

‘একটু দাঁড়ান, আমি আসছি’, বলে মিত্রা শোবার ঘরে এসে ঢোকে। শংকর ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। শংকরকে রতনের সম্পর্কে সব বলে মিত্রা। দুজনেরই মনে হয় ওদের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে রাখলে কোনওরকম অসুবিধায় পড়তে হবে না। বৃদ্ধের কথায় মিত্রা বুঝে গিয়েছিল রেশমিই ওর কাছে কাজ করবে। সুতরাং বাইরে এসে মিত্রা ওদের জানিয়ে দেয়, ওদের কাজে বহাল করতে ও রাজি।

সন্ধের আগেই রতন, স্ত্রী এবং নাতনিকে নিয়ে মিত্রার কাছে হাজির হল। মিত্রা কোয়ার্টারের দরজা খুলে দিয়ে ওদের সবকিছু বুঝিয়ে দিল। মিত্রার মনেও সামান্য আশার সঞ্চার হল, ওর মনে হল এবারটা শ্চিয়ই ওর কাজের লোকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে।

পরের দিন দরজা খুলতেই সকালে, মিত্রা দেখে রতন আর সারদা দরজায় দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই রতন জানায়, ‘ম্যাডাম, রেশমির জ্বর এসেছে। ওর বদলে আমরা দুজন মিলে কয়েকদিন আপনার কাজ করে দেব।’

বয়স্ক মানুষকে দিয়ে কাজ করাতে মিত্রার খুবই খারাপ লাগছিল কিন্তু ওর কাছে কোনও উপায়ও ছিল না। ওদের কাজটাও ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না মিত্রার।

দু সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেও যখন রেশমি কাজ করতে এল না, মিত্রার সন্দেহ হতে লাগল, ওরা মিথ্যা কথা বলে কোয়ার্টার পাওয়ার লোভে এখানে ঢোকেনি তো? মেয়েটা হয়তো অন্য কোনও বাড়ির কাজ ধরেছে।

এইভাবে তো চলতে পারে না, এই ভেবে মিত্রা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কোয়ার্টারের দরজায় কড়া নাড়ল। রতন আর সারদা তখন মিত্রার ফ্ল্যাটে কাজ করছিল। দরজার কড়া নাড়তেই রেশমি এসে দরজা খুলে দিল। মিত্রার ওকে দেখে এতটুকুও অসুস্থ বলে মনে হল না।

‘তুমি তো দেখছি দিব্যি সুস্থ আছ, তাহলে কাজে আসছ না কেন?’ মিত্রা জানতে চাইল।

‘না… মানে… আমার…. আমি একটু….’ রেশমি তোতলাতে থাকে।

মিত্রা কথা না বাড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসে দরজা বন্ধ করতে যাবে, চোখে পড়ল তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একটি লোক রতনদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে গেল মিত্রা। ওদের কাছে কোনও আত্মীয়স্বজনের কথা মিত্রা তো কিছু শোনেনি। তাহলে পুরুষটি কে হতে পারে? চোরের মতন লুকিয়ে পড়ারই বা কী দরকার বুঝে পেল না মিত্রা। কিন্তু মিত্রা মনে মনে স্থির করে নিল, এই রহস্যের অনুসন্ধান ওকে করতেই হবে।

লক্ষ্য রাখা শুরু করল মিত্রা। রতন আর সারদা কাজ করতে সকালেই এসে যেত। ওরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই মিত্রা খেয়াল করত, প্রত্যেকদিনই আলাদা আলাদা পুরুষমানুষ কোয়ার্টারে আসছে। মিত্রা, কয়েকদিন পর পর নতুন নতুন পুরুষকে কোয়ার্টারে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেল, ওখানে এরা দেহব্যাবসা ফেঁদে বসেনি তো? শংকরকে জানানোটা সবথেকে আগে দরকার।

একদিন বাড়ি ফিরে আসার পর মিত্রা শংকরকে সবকিছু খুলে বলল। শংকর সব শুনে প্রচণ্ড রেগে গেল, ‘প্রথম দিনই তোমার আমাকে সব খুলে বলা উচিত ছিল। এতগুলো দিন হয়ে গেল। কিন্তু দোষ চাপালেই তো হবে না! হাতেনাতে ওদের ধরতে হবে। তুমি একটু চোখ কান খোলা রেখো। হতে পারে এটা একটা র‍্যাকেট।’

পরের দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে শংকর বাড়িতেই থেকে গেল। রোজের মতোই রতন আর সারদা এসে কাজে লেগে পড়ল। মিত্রা আগেই নিজেকে তৈরি রেখেছিল, ওদের কাজের মাঝেই মিত্রা জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার রতনদা? আপনার নাতনির অসুখ এতদিনেও ঠিক হল না? আপনারা আমাকে গাধা ভেবেছেন? আজ আমি সত্যিটা না জেনে ছাড়ছি না।’

কথার মাঝেই শংকরও এসে দাঁড়াল মিত্রার পাশে, ‘হ্যাঁ, রতনদা আজকে উত্তর তো তোমাকে দিতেই হবে। আর একবার আমার সঙ্গে তোমাদের কোয়ার্টারে চলো। আমি একটা ছোটো আলমারি ওখানে রাখব। জায়গাটা তাই আমি আগে একটু দেখে নিতে চাই।’

‘কিন্তু সাহেব… এখুনি…’, রতনের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে শংকর ধমক দিয়ে উঠল জোরে।

শান্ত স্বভাবের শংকরের অগ্নিমূর্তি দেখে রতন ভয় পেয়ে গেল। সারদা ভয়ে রতনের হাত জড়িয়ে ধরল, ‘তুমি এনাদের সব কথা বলে দাও… এভাবে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

ততক্ষণে রতন নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে। ও বলতে শুরু করে, ‘সাহেব, আমরা মিথ্যা বলেছিলাম, রেশমির বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের জামাই খুব বাজে লোক। সবসময় মদ খেয়ে থাকে। যখন বিয়ে হয় জামাইয়ের একটা ছোটো চায়ের দোকান ছিল। বিয়ের পর আমাদের মেয়ের যে-কটা গয়না ছিল সব বিক্রি করে দিল। যখন দোকানটাও বিক্রি করে দিল তখন রেশমিকে দিয়ে খারাপ খারাপ কাজ করাত। আমরা মেয়েটাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে আসি কিন্তু সেখানেও সে আমাদের পিছু ছাড়ল না। ওখানেও লোক পাঠাত জামাই। আপনাদের এখানে কোয়ার্টার পেতেই একরকম লুকিয়েই এখানে পালিয়ে আসি… কিন্তু এখানকার ঠিকানাও ও কী করে জোগাড় করল জানি না, এখানেও লোক পাঠানো…’, চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে না রতন।

‘পুলিশে জানাওনি কেন’, শংকর প্রশ্ন করে।

‘ও শাসিয়ে গিয়েছিল, পুলিশে জানালে আমাদের মেয়েটাকে মেরে দেবে’, ভীত রতন স্বীকার করে।

‘ভাবা যায়, মাত্র একটা লোক এতগুলো মানুষকে ভয় দেখিয়ে খারাপ কাজ করাতে বাধ্য করছে?’ শংকরের উক্তিটা মিত্রার উদ্দেশ্যে হলেও অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই শোনাল।

‘সাহেব, রেশমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। আমরা ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওই জানোয়ারটা আমাদের জীবন নরক করে তুলেছে’, করুণ শোনায় রতনের স্বর।

মুহূর্ত দেরি না করে সারদা আর রতনকে সঙ্গে নিয়ে শংকর পুলিশের কাছে রিপোর্ট লিখিয়ে আসে। পরের দিনই রেশমির স্বামীর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার খবর আসে। খবরটা শুনেই রতনের পরিবারের মুখে হাসি ফোটে। শংকর আর মিত্রা দুজনেই অনুভব করে, লজ্জা গ্লানির জীবন পিছনে ফেলে আজ এই গরিব পরিবারটি রৌদ্রজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

 

শেষযাত্রা

তিনি একমনে ছবি আঁকছিলেন। ক্যানভাস জুড়ে শুধু নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্র মিশে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে একটা নৌকো চলছে। নৌকো না বলে কলার ভেলা বলাই ভালো। এই বিরাট সমুদ্রে তার কখন তলিয়ে যাবার কথা। তবু চলছে। তিনি নৌকোটার গায়ে বাদামি রঙের পোঁচ দিতে লাগলেন জোরে জোরে। না, না, নৗকোটাকে কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবে না।

ক্যানভাসে যেমন, জানলার বাইরেও তেমন সমুদ্র, ঢেউয়ের পরে ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। দূরে দূরে নৌকো, জাহাজও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে মেলার মতো ভিড়। বড়া পাও, পাপড়ি চাট, কুলফির পসরা। ঘোড়া নিয়ে দর কষাকষি। বেলুন কিনে দেবার জন্যে বাচ্চাদের মার হাত ধরে ঝুলোঝুলি। জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে তাঁর হাত ক্যানভাসের ওপর থমকে গেল। ছোটোবেলায়, খুব ছোটোবেলায়, মা তাঁর হাত ধরে জুহু বিচে নিয়ে আসত। কিন্তু সেটা বিকেলে বা সন্ধেবেলা নয়, খুব ভোররাতে। কার কাছ থেকে শুনেছিল নামিদামি ফিল্ম স্টার আর প্রডিউসাররা একটু নির্জনতার জন্যে নাকি এই সময়টা হাঁটতে আসে বিচে। মা আসত তাদের এক ঝলক দেখার জন্য নয়, ফিলমে একটা ব্রেক পাওয়ার জন্য। মা তখনও ভাবত, আগের মতোই সুন্দরী আছে, একটা, জাস্ট একটা ব্রেক পেলেই মাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তখন জুহুতেই তাদের বিরাট বাংলো, বিদেশি গাড়ি, সুববু বিদেশে পড়াশোনা করবে। মা তাকে সুববু বলে ডাকত। বাবা-ই সুববু ডাকতে শুরু করেছিল প্রথম থেকে, বাবার দেখাদেখি মা। শুভলক্ষ্মী থেকে সুববু। শুভলক্ষ্মী নামটা অবশ্য সিনেমায় চলেনি। মেহেরা সাবের কথাটা এখনও কানে বাজে ‘ম্যায় কেয়া মইথোলজিকাল ফিল্ম বানাউঙ্গা যাঁহা হিরোইন কা নাম শুভলক্ষ্মী হোগা। আরে মেরে ফিল্ম মে তো তুমকো বিকিনি ভি পেহননা হোগা। বিকিনি অউর শুভলক্ষ্মী –নেহি চলেগা। তুমহারা নাম রাখা হু কায়রা, ভেরি সেক্সি নেম, তুমহারি তরহা’

এইভাবে শুভলক্ষ্মী নামটা হারিয়ে গেলেও সুববু রয়ে গেল সারাজীবন। বাবার ওই একটাই জিনিস মা ফেলে দেয়নি কখনও। শুধু সুববু নামটা নয়, সুববুও তো বাবারই দান। বাবা বলে যে লোকটাকে জানেন তিনি, ফর্ম ভরার সময় কতবার লিখতে হয়েছে, শিবদাস আয়েঙ্গার। সেই শিবদাস একটা নয়, দু দুটো সন্তান দিয়েছিল ললিতাকে। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে চলে গিয়েছিল প্রথম সন্তান, সুববুর দাদা। তার নাম রাখা হয়েছিল শিবললিত, শিবদাসের শিব আর ললিতার ললিত মিশিয়ে তৈরি সে নাম। শিবললিতকে সুববু দেখেনি, সে আসার আগেই চলে গিয়েছিল সেই ছেলে, আর সুববু হবার বছর খানেকের মধ্যে বাবা চলে গেল। মারা যায়নি, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে ভেগে গেল। মা বলত মরে গেলেই ভালো হতো এর চেয়ে। বাবা কিন্তু মরেনি। সেই শীলা বলে মেয়েটাকে ছেড়ে একটা কোংকনী মেয়ের সঙ্গে থিতু হয়েছিল শেষমেশ। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসত সুববুর সঙ্গে স্টুডিওয়। টাকা চাইত না, কিচ্ছু না। শুধু সুববু বলে ডেকে মাথায় হাত রাখত আর বলত নিজের টাকা পয়সার খেয়াল রাখতে, ললিতার ওপর সব ছেড়ে না দিতে।

সমুদ্রে আরও একটু নীল রং দিতে দিতে তাঁর আজ হঠাৎ মনে হল, বাবার বদলে মা যদি তাকে ছেড়ে চলে যেত, তাঁর জীবনটা একদম অন্যরকম হতো। পালিয়ে যাবার মতো আশিক তো কম ছিল না মা-র জীবনে। কিন্তু মা তাদের কাউকে চাইত কি আদৌ? ফিল্ম ছাড়া মার মাথায় কোনওদিন কিছু ছিল না। তাই অন্ধকার বিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত একটা ব্রেকের আশায়। সুববুকে একা রেখে যেতে হবে বলে সঙ্গে নিত। আর তাই অতো ছোটোবেলাতেও সুববু বুঝে গেছিল, সাধারণ চোখে যা সুন্দর লাগে, ফিল্ম লাইনে তার কোনও দাম নেই। শরীরের ধকটাই আসল এখানে আর কচ্চি কলি হলে তো কোনও কথাই নেই।  সুন্দরী হলেও তখন মা-র শরীরে এসব কোনওটাই ছিল না। দু দুটো বাচ্চার জন্ম, অভাব, নিত্য অশান্তি মা-র সব গ্ল্যামার কখন যে শুষে নিয়েছিল, মা বুঝতে পারেনি। অথচ সুববু, তখন মাত্র তিন-চার বছরের মেয়ে হলেও বুঝতে পেরেছিল মা কোনওদিন সিনেমায় চান্স পাবে না, বুঝে গিয়েছিল মার মুখের দিকে ছুড়ে দেওয়া লোকজনের উপেক্ষিত দৃষ্টি দেখে। ওইসময় কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যেত বলে এমনিই তার ভালো লাগত না। আরও খারাপ লাগত তখন কোনও বেলুনওলা থাকত না বলে। সে মনে মনে চাইত মা তাকে বিকেলে বা সন্ধের সময় বেড়াতে নিয়ে যাক, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সে যখন বেলুনের জন্য বায়না করতে পারে। বেলুন পায়নি সত্যি, কিন্তু সিনেমায় রোল পেয়েছিল। মার কোলে থাকা তার গাল টিপে একজন প্রডিউসার বলেছিল তার পরের ফিল্মে এইরকম একটা বাচ্চার রোল আছে, ললিতা কি দেবে তার বাচ্চাকে?

তুলি থামিয়ে তিনি বাইরের দিকে তাকালেন। মুম্বাইতে আটটার আগে সন্ধে নামে না। আকাশে এখনও অনেক আলো, সমুদ্র কি তীব্র নীল, হাওয়ায় একগোছা বেলুন উড়ছে। সব, সব আগের মতো আছে। শুধু তাঁর জীবনটাই এমন ঘেঁটে গেল কেন?

ফোনটা বাজছে। ঠিক বাজছে না, কাঁপছে। ভাইব্রেশনে দেওয়া আছে।  আওয়াজটা শুনবেন না বলে ভাইব্রেশনে দিয়ে রেখেছেন। খুব মৃদু সরোদ বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে। এ রাগটা তিনি চেনেন, মারুবেহাগ। ভালোবাসার রাগ। আগে চিনতেন না কোনটা মারুবেহাগ, কোনটা দেশ, কোনটা কেদার। অবিনাশ চিনিয়েছে। ভালোবাসার রাগ থেকে ভালবাসা –সব। ওই শিখিয়েছে কাজের সময় ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল চালিয়ে রাখতে, এতে নার্ভ ঠান্ডা থাকে, কাজে মন বসে, স্ট্রেস কমে। স্ট্রেসের কারণগুলো জীবন থেকে ছেঁটে ফেলবেন বলেই তো এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছেন, রং তুলি গান আর খুব দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে। এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে বুঝতে পারছেন, জীবনে কোন কোন জিনিসগুলো সত্যি দরকারি। সারাজীবন তো মা চালিয়েছে, মা ঠিক করে দিয়েছে সব। নিজের সত্যি কী দরকার, কাকে দরকার, বুঝতেই পারেননি।

মা যখন আর পারল না, প্যারালিসিসে শরীরের ডান দিকটা, এমনকী কথা বলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল, ততদিনে তো ভিকি মালহোত্রা তাঁর জীবনে এসে গেছে। মার বদলে ভিকি ঠিক করত সব তাঁর জন্য। ছবি সাইন করা থেকে পার্টির পোশাক, ডায়েট চার্ট থেকে জিম রেজিম– সব। ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা, ভিকির জীবনটাই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হতে শুরু করেছিল। সেটা এতটাই যে ও নিজের ১৪ বছরের বিবাহিত বউ, ফুটফুটে দুই ছেলেমেয়ে সবাইকে ছেড়ে তাঁর সাথে লিভ ইন করতে শুরু করল।

মা তখন উঠতে পারে না, কথা বলতে পারে না কিন্তু বুঝতে তো পারে সব কিছু। নিজের মেয়ে এভাবে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছিল না। ওষুধ না খেয়ে, খাবার না খেয়ে, নানাভাবে জেদ অশান্তি করে সে প্রতিবাদ জারি রেখেছিল। বাধ্য হয়ে মাকে ছেড়ে অন্য একটা ফ্ল্যাটে, মার চোখের আড়ালে থাকতে শুরু করলেন ভিকির সঙ্গে। সমাজ, তারকাদেরও সমাজ থাকে একটা, সেখান থেকে চাপ আসছিল। সবাই ভাবছিল কায়রার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নইলে কেউ ভিকি মালহোত্রার মতো ফ্লপ প্রডিউসারের সঙ্গে জড়ায়। ভিকি তো স্রেফ চেনে টাকা, আগের বউটাও তো রাইজিং স্টার ছিল, সনিয়া কপূর। ওর টাকা, শরীর, কেরিয়ার, সব ছিবড়ে করে এখন ভিকি কায়রার দিকে ঝুঁকেছে। এটাই ওর আসল ব্যাবসা, সুন্দরী নায়িকাদের সিঁড়ির মতো ব্যবহার করা। এমনিতে তো একটা সিনেমাও চলে না।

এসব বিষে মুম্বাইয়ের বাতাস ভারি হচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই তিনি ভিকিকে বিয়ে করলেন। আর বিয়ের দিন রাতে, মা চলে গেল। সেটাও নিঃশব্দে নয়, মেয়ের উপেক্ষার প্রতিশোধ মা নিল সুইসাইড করে। একজন প্যরালিসিস মহিলা কীভাবে এত স্লিপিং পিল জোগাড় করতে পারে– সেটা নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস চলতে চলতে পুলিশ পর্যন্ত পৗঁছোল। বলা হল পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য মাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে কায়রা আর ভিকি। খুন করার হলে মাকে তো অনেক আগেই খুন করা উচিত ছিল তাঁর। করতে পারলে জীবনটা অনেক সুন্দর করে বাঁচা যেত। তাঁর জীবনের প্রথম, হয়তো একমাত্র প্রেমকে ওভাবে গলা টিপে মারতে হতো না। শাওন কুমার, আসল নাম শ্রাবণ মুখার্জি, বাংলার ছেলে, তীব্র ভাবে চেয়েছিল তাঁকে। পুণের এক মন্দিরে গোপনে বিয়েও হয়ে গিয়েছিল তাঁদের মালা বদল করে, মা ঠিক জেনে গেল। গুন্ডা বাহিনী নিয়ে হাজির হল মন্দিরে, শাওনকে খুনই করত, কায়রা মা-র হাতে পায়ে ধরে, বিয়ে ভাঙার প্রমিস করে শাওনকে বাঁচান। শাওন সেই নবলব্ধ জীবন নিয়ে আর তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি, তিনি নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। শাওন ফোন ধরেনি, দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এক, সব পুরুষ এক। মেয়েদের মন ওরা বোঝে না। ওরা জানে শুধু মেয়ে-শরীর আর নিজেদের ইগো। মার মৃত্যু নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। নীচ থেকে ওপর সবার মুখ বন্ধ করতে অনেক টাকা খসল, অনেক টেনশন ছুটোছুটি। বিয়ের প্রথম বছরটা এইভাবেই কেটে গেল। যেই ভাবতে শুরু করলেন এবার একটু থিতু হয়েছেন, ভিকির ভালোবাসায় বাকি জীবনটা শান্তিতে কেটে যাবে, তখনই ভিকি স্বমূর্তি ধরল। মদ, উঠতি নায়িকাদের কাজের টোপ দিয়ে ফস্টিনস্টি, সবই তাঁর টাকায়। বাধা দিলে অকথ্য গালাগাল, এমনকী মারধোর।

কিন্তু এত ঝড়ঝাপটার কোনও প্রভাব কায়রার কাজে পড়েনি। মা তার চারপাশে কেমন একটা বায়ুনিরোধক বর্ম তৈরি করে গেছিল, সেটা খুব কাজে লেগেছে সারাজীবন। এই যে এখন কোলাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা রয়েছেন, এখান থেকেই শুটিং-এ যাচ্ছেন। এখন তো বেছে বেছে ছবি করা। খুব পাওয়ারফুল চরিত্র পেলে তবেই করেন। সেসব নিজেই সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু ভিকির সঙ্গে আর নয়।  এনাফ ইজ এনাফ। শুধু মেয়েটার জন্যে বুকের মধ্যে চিন চিনে ব্যথা। এই মেয়েকে আঁকড়েই তো ভিকির সঙ্গে কাটালেন এতগুলো বছর। কিন্তু আর নয়।

ফোনটা আবার কাঁপছে, চিংকি, তাঁর মেয়ে ফোন করছে। ওর ভালো নাম তিনিও রেখেছেন শুভলক্ষ্মী, তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া নামটা। নামটা যেন তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোনও দামি গহনার মতো, যা কেবল একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে চলে যাবে, কিন্তু ব্যবহার হবে না। কারণ তিনি  জানেন এই নামটাও বদলে যাবে, চিংকিও সিনেমায় নামছে যে। ওর বাবারই বিশেষ আগ্রহ। এতদিন কায়রার পয়সায় খেয়েছে, এবার কায়রার মেয়ের পয়সায় খাবে।

চিংকিকে অনেক বুঝিয়েছেন তিনি, বলেছেন তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে আসতে। মেয়ে আসেনি। এখন কেন ফোন করছে? মাকে কীসের দরকার?

অবিনাশ বলেছিল আসবে দেখা করতে। তিনি বারণ করেছেন। অবিনাশকে দেখলে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না। আর এই বয়সে সে ধাক্বা সামলাতে পারবেন? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অবিনাশকে ডেকে পাঠাবেন। ফোনটা তাঁকে খুব অস্থির করে দিয়েছে। অবিনাশকে সব বলা দরকার।

চিংকির ডেবিউ এ বছর শেষের দিকে, ওর অপোজিটে আছে শাওনকুমারের ছেলে অঙ্কিত। তাঁর আদৗ ইচ্ছে ছিল না চিংকি সিনেমায় নামুক। তিনি চেয়েছিলেন ও আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক। সেই ৪ বছর বয়স থেকে তিনি লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন শুনে আসছেন, এই ইন্ডাস্ট্রির হাড়ে হদ্দ জানেন। তাঁর কাছে খিদে একটা মোটিভেশন ছিল, কাজ না পেলে না খেয়ে মরতে হবে। চিংকির সামনে তো তা নেই, ওর মতো নরম আদুরে মেয়ে এই লাইনের ওঠাপড়া নিতে পারবে না। এই নিয়েই ভিকির সঙ্গে খিটিমিটি শুরু তাঁর। তাও হয়তো মেনে নিতেন, যদি না অঙ্কিতের অপোজিটে কাস্ট করা হতো চিংকিকে। নিউ কামার পেয়ারদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি নানা গসিপ বাজারে ছাড়ে ছবি হিট করাবার জন্যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা সত্যি হয়ে যায়। রোমান্টিক সিন করতে করতে সত্যিকারের রোমান্সে জড়িয়ে পড়ে নতুন হিরো হিরোইন। হায় ভগবান! সেরকম যদি হয়! ওরা যে ভাইবোন!

মন্দিরে বিয়ের আগেই শাওনের সন্তান এসেছিল তাঁর গর্ভে। মা যখন সব শেষ করে দিল, তখন জেদ করে শাওনের সন্তানকে অ্যাবর্ট করেননি কায়রা, আর সেই খবরটা শাওনের  নিঃসন্তান স্ত্রী রিতার কানে পৌঁছোয়। এক দুপুরে রিতা এসে তাঁর কাছে প্রায় ভিক্ষে চায় অনাগত সন্তানকে। তাঁকে বোঝায় একে বড়ো করে তুলতে গেলে সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে থাকবে চিরকাল, তার থেকে শাওন আর রিতার বৈধ সন্তান হিসেবে বড়ো হোক সে। তিনি রাজি হয়ে যান, এর থেকে ভালো লালন তিনি কি দিতে পারতেন? সমস্ত পৃথিবী জানে অঙ্কিত শাওন আর রিতার ছেলে। শুধু তাঁরা তিনজন ছাড়া। আর মা জানত। ভিকিও না। জানলে হয়তো ওকে বোঝানো যেত।

চিংকি ফোন করে বলল ‘মা, আজ পার্টিতে কী পরে যাব?’ সেই আদুরে গলা। এমনভাবে বলছে যেন কিছুই ঘটেনি, তিনি চলে আসেননি বাড়ি ছেড়ে। শুনে গলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মন কু গাইল ‘কীসের পার্টি রে সপ্তার মাঝে?’

‘অঙ্কিত থ্রো করছে মা, প্রাইভেট পার্টি’

‘না’

‘কি না?’

‘ওখানে যেও না সোনা, আগে ছবি রিলিজ করুক, প্লিজ মার কথা শোনো, প্লিজ চিংকি’

‘কিন্তু মা’

‘কোনও কিন্তু না মা’।

‘আচ্ছা মা তুমি বারণ করলে যাব না কিন্তু একটা ফোন বারবার আসছে দুবাই থেকে, একটা ওয়েডিং রিসেপশনে এক নাইট অ্যাপিয়ারেন্স। হিউজ পে করবে’। থরথর করে কেঁপে উঠল শরীর। দুবাই, ওয়েডিং রিসেপশন, এক নাইট অ্যাপিয়ারেন্স– এই শব্দগুলো ভীষণ চেনা। সারাজীবন কতভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে এগুলোকে। ভীষণ মা-র অভাব বোধ করলেন এই মুহূর্তে। মা বাঘিনীর মতো আগলে রাখত তাঁকে। আর তিনি এই সময় কেন যে চলে এলেন মেয়েটার পাশ থেকে? আসলে ভিকিকে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ও মেয়েটাকে শেষ করে দেবে। কে জানে ওই হয়তো ডিল করছে। পিম্প!

তিনি শক্ত গলায় বললেন ‘সোনা, যা বলছি মাথা ঠান্ডা করে শোনো। এখন কোনও পার্টিতে যেও না, যেই ডাকুক। আর ওই নম্বরটা দাও। লিখে নিচ্ছি’ নম্বরটা লিখে অবিনাশকে ফোন করলেন কায়রা।

সাদা ফুলে ঢাকা গাড়িটা জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। পেছনের গাড়িতে কালো চশমায় চোখ ঢাকা চিংকি ভাবছিল মাকে এত লোক ভালোবাসত? মা তো সে হওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনও ছবি সাইন করেনি, কিন্তু বারো বছর পরে যখন করল, সে ছবি সুপার ডুপার হিট। কী একটা যেন ছিল মার মধ্যে। যেমন অভিনয়, তেমনি সৌন্দর্য। সেই মা মাত্র পঞ্চান্ন বছরে চলে গেল! মেনে নিতে পারেনি ফ্যানেরা। একজন নাকি সুইসাইড করেছে। আচ্ছা, মা কি কিছু দেখতে পাচ্ছে? তাকে ঘিরে এই উন্মাদনা? এত লোকের ভালোবাসা? যাকে এত লোক ভালোবাসত, সে ভালোবাসত তাকে, শুধু তাকে?

কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, অথচ কথাটা সত্যি। তাকে বাঁচাতেই তো চলে গেল মা। ওই অদৃশ্য হাতের বিরুদ্ধে আঙুল যেই তুলবে, তাকেই সরিয়ে দেওয়া হবে। অবিনাশ আংকল বলেছে সব তাকে। বাথটবে পড়ে থাকা নিস্পন্দ শরীর কাটাছেঁড়া করে কী পাওয়া গেছে, সেই তথ্য আর কখনও সামনে আসতে দেওয়া হবে না, চিংকি জানে। আর শুধু দুবাই কানেকশন নয়, তার বাবা লোকটা, মানে ভিকি মালহোত্রা এর মধ্যে আছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি ওরা মা-কে মেরে ফেলতে পারত না। অবিনাশ আংকল তাকে বলেছে ‘তোমার মার শেষ ইচ্ছে শুধু সাদা ফুল নয়। তুমি জানো কায়রা চায়নি তুমি সিনেমায় নামো। কিন্তু সে জানত একবার ঢুকলে এখান থেকে বেরনো অসম্ভব, অনেকটা বাঘের পিঠে চড়ার মতো। তাই সে বারবার বলেছে চিংকি যেন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়, কারও হাতের পুতুল হয়ে না থাকে।’

চিংকি চোখের জল মুছে মোবাইলে একটা ফোন করে। যাকে ফোন করছে, সে ঠিক তার পেছনের গাড়িতে সাদা পাঞ্জাবি পাজামায় আপাদমস্তক শোকের প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছে। সমস্ত মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে চলেছে সে কতটা শোকার্ত কায়রাকে হারিয়ে। চিংকি ওর শোকের বুদবুদ এক লহমায় ফুটো করে দেয় একটা কথা বলে।

‘আপ মম কি ফিউনারেল মে না জায়ে তো আপকো  লিয়ে আচ্ছা হোগা। সবাই জেনে গেছে মম কীভাবে মারা গেছে। পাবলিক খুব ফিউরিয়াস হয়ে আছে। তোমাকে  ওরা ছাড়বে না।’

সেদিন চ্যানেলে চ্যানেলে চর্চার বিষয় ছিল কায়রার শেষযাত্রায় ভিকির অনুপস্থিতি। মুখাগ্নির সময় চিংকির সঙ্গে অঙ্কিতও কেন এগিয়ে এসেছিল, সেটা নিয়েও জল্পনা কল্পনা চলছে। এটাও কি নতুন ছবির প্রমোশানের মধ্যে পড়ে? খানিকটা দূরে বসে থাকা অবিনাশের মনে হচ্ছিল, কায়রাকে কি এতদিনে একটু শান্তি দিতে পারল? আর ওই জনসমুদ্র, কলরব থেকে অনেক অনেক দূরে সমুদ্রের ধারে এক বৃদ্ধ, একা একা, একটার পর একটা রঙিন বেলুন আকাশে উড়িয়ে চলেছিলেন, আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিলেন। কেউ যদি কান পাতত, তবে শুনতে পেত ‘সুববু, শুভলক্ষ্মী, মা আমার, তুই ছোটোবেলায় যে বেলুনগুলো ওড়াতে চেয়েছিলি– নীল লাল, হলুদ, ববি প্রিন্ট– সমস্ত বেলুন তোর সঙ্গে দিয়ে দিলাম। এদের সঙ্গে তুই  মনের আনন্দে  উড়ে যা।’

মরমির কথা

অসমের শান্ত সুন্দর প্রকৃতি যেমন খেয়ালি, মরমিও তেমনি খেয়ালি চরিত্রের হয়েছে। কখন কী মুডে থাকে বোঝা মুশকিল। এই হাসিখুশি উচ্ছল, তো পরমুহূর্তেই থমথমে বিষাদ কালো মুখ। ওর সঙ্গে বেশ বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। কখন কী ভেবে বসে কে জানে। একবার বর্ষার সময়ে বেশ কিছুদিন অসমে দিদির বাড়িতে থেকেছিলাম। তখন দেখেছি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা কাকে বলে।

ঘুম থেকে উঠে হয়তো দেখলাম ঝকঝকে সুন্দর একটা দিন, চারদিকে সোনা রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে। দেখেই আমি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর ছক করে ফেলেছি। কিন্তু পরক্ষণেই আমার সমস্ত প্ল্যানের ওপর জল ঢেলে আকাশে দেখা দিল মেঘের ঘনঘটা! এমনটা প্রায়ই হতো। আবার বৃষ্টি দেখে দিদি হয়তো খিচুড়ির আয়োজন করেছে, একটু পরেই দেখা গেল মেঘ-বৃষ্টি দূরে ঠেলে সূর্যিদেব প্রবল তেজে বিরাজমান হয়েছেন মধ্য গগনে। তখন গনগনে গরমে খিচুড়ি হয়ে উঠত অসহ্য। যতদিন ওখানে ছিলাম মেঘ-রোদ্দুরের খেলা দেখেই কেটেছে। এখন মরমিকে দেখে আমার সেই স্মৃতি মনে এসে যায়। অসমে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলেই হয়তো প্রকৃতির এই খেয়ালিপনাটুকু ওর চরিত্রে গেঁথে আছে।

মরমি আমার বড়দির একমাত্র সন্তান। বড়দির শ্বশুরালয় অসমের গৌরীপুরে। বিয়ে ইস্তক দিদি সেখানেই আছে। মরমিও ওখানেই জন্মেছে। এতদিন পড়াশোনা, বড়ো হয়ে ওঠাও সেখানেই। এখন কলকাতায় এসে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্প্যারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়ছে। যাদবপুরেই হোস্টেলে থাকে ও। আমি ওর মামা তো বটেই, ইউনিভার্সিটির নথিতে লোকাল গার্জেনও। ও হোস্টেলে থাকলেও মামা হিসেবে যতটা সম্ভব খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি।

ছুটি-ছাটায় বাড়িতে নিয়ে আসি ওকে। আর প্রতি রবিবার বা শনিবারে নিয়ম করে আমি ওর হোস্টেলে দেখা করতে যাই। কতদিন ওকে বলেছি, ছুটির দিনগুলোতে সবসময় আমার বাড়িতে চলে আসতে। সারা সপ্তাহ তো হোস্টেলের ওই আধসেদ্ধ খাবার খেতে হয়, সপ্তাহান্তে একদিন না হয় বাড়িতে এসে একটু ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া করল।

প্রথম প্রথম মরমি আসতও। কিন্তু ইদানীং আর সেভাবে আসেই না। অনেক বলার পরে হয়তো এক আধদিন এল। আমি সপ্তাহে একদিন ওর ওখানে যাই বলেই যা একটু দেখা হয়, খোঁজখবর পাই। আজকাল যেন মনে হয়, আমি ওর হোস্টেলে গেলে ও যে খুব একটা খুশি হয় সেটা নয়। আমাকে পাশ কাটাতে পারলেই যেন বাঁচে। সেদিন তো বলেই ফেলল, ‘ওফ মামা, তুমি কি আমাকে এখনও সেই ছোট্টটি ভাবো যে সবসময় পিছে পিছে থাকতে হবে? আমার বন্ধুরা এই নিয়ে হাসাহাসি করে জানো?’

আমি বলি, ‘জানি তুই এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছিস, কিন্তু আমাদের কাছে এখনও সেই ছোটোটিই আছিস। আর এতে বন্ধুদের হাসাহাসির কী হল? আমি তোর সুবিধা অসুবিধা না দেখলে কে দেখবে? এখানে তোর আর কে আছে? বড়দি আমার ওপরে কত ভরসা করেই না তোকে এখানে পড়তে পাঠিয়েছে।’

আর কথা বাড়ায়নি। তবে আমি বেশ বুঝতে পারি, আমার ওখানে ঘনঘন যাওয়াটা ওর খুব একটা পছন্দের নয়। তবু যাই। নিজের কর্তব্যবোধেই যাই। হাজার হোক নিজের একমাত্র বোনঝি বলে কথা। যখন যাই তখন মাঝেমধ্যে ওর পছন্দের মোগলাই, চিকেন কাটলেট বা চাউমিনও সাথে করে নিয়ে যাই। পছন্দের জিনিসগুলো পেলে ভারি খুশি হয় মেয়েটা। আর ওকে খুশি দেখলে আমার মধ্যেও খুশির স্রোত বয়ে যায়। মরমিটা যেন একেবারে আমার কৈশোরের বড়দি। সেই গভীর টানা টানা দুটো চোখ, আর তেমনি সেই দুধে আলতা গায়ের রং। সুন্দরী বলেই গৌরীপুরের সেই বনেদি পরিবারে এক দেখাতেই বড়দির বিয়ে হয়ে গেছিল।

মরমিও বড়দির মতোই সুন্দরী হয়েছে। হয়তো বড়দির থেকেও খানিক বেশি। জামাইবাবুর মতো সুঠাম ও দীর্ঘাঙ্গীও হয়েছে। আর এত সুন্দরী বলেই ওকে নিয়ে আমার চিন্তাও বেশি। সুন্দরীরা সহজেই নজরে পড়ে যায় যে। যা দিনকাল পড়েছে, মেয়েদের জন্যে নিরাপত্তা বলতে আর কিছুই রইল না। টিভি বা পত্র-পত্রিকা খুললে চারদিকে একই খবর –শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, খুন এসব ছাড়া যেন আর খবরই নেই! কলেজ, ইউনিভার্সিটির পরিবেশও তো তথৈবচ। এমনকী স্কুলেও নানারকম যৌন অপরাধের ছড়াছড়ি।

সাত থেকে সত্তর, নারী শরীর হলেই হল, একদল নরপিশাচ সবসময় জিভ লকলকিয়ে আছে। সবচাইতে বড়ো কথা, যারা এসব জঘন্য কাণ্ড ঘটাচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা দাগি ক্রিমিনাল নয়। স্কুল শিক্ষক, রিসার্চ গাইড, তুখোড় সাংবাদিক, এমনকী মহামান্য বিচারপতির বিরুদ্ধে পর্যন্ত ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে! কোথায় যাবে সাধারণ মানুষ? এ দেশে সত্যিই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

নাঃ, এসব ভেবে আর কাজ নেই। আমি অতি সাধারণ মানুষ। আমার ভাবনায় কোনও সুরাহা হওয়ার নয়। বরং যত ভাবব, কেবল নিজের শান্তিই বিঘ্নিত হবে। আমি শুধু নিজের কথা ও নিজের পরিবার, প্রিয়জনের কথা ভাবতে পারি। সেজন্যে মরমিকে সবসময় পই পই করে বলে যাই সাবধানে থাকতে, আর বুঝেশুনে চলতে। কোনও অসুবিধে হলেই যেন আমাকে জানায়। মরমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে বটে কিন্তু মুখ দেখে মনে হয় না আমার কথার খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে। একদিন তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, ‘মামা, তুমি না বড়ো ওভার প্রোটেকটিভ’!

শুনে আমি রাগ করিনি। এটা মরমির দোষ নয়, যুগের দোষ আর বয়েসের ধর্ম। এ যুগের ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের তেমন শ্রদ্ধা সন্মান করে না। সারাক্ষণ মুখে কেবল ইংরেজির খই ফুটছে। গুরুজনেরা যেটা বলবে, সেটার বিরোধিতা করা যেন এদের অবশ্য করণীয় কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সেজন্যে এদের কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। আমাদের শুধু কর্তব্য করে যাওয়া। বাকিটা ভবিতব্য।

বিনতা মানে আমার স্ত্রী হয়তো ঠিকই বলে, কলির হাওয়া লেগে গেছে মেয়েটার। এখন কলকাতা শহর চিনেছে, বন্ধু-বান্ধব হয়েছে, এখন কি আর মামা-মামির নীরস সান্নিধ্য ভালো লাগে? কথাটা যে মিথ্যে নয়, এর প্রমাণ প্রতি পদে পদেই পাই। প্রায়ই ফোন করলে শুনি, বন্ধুদের সাথে শপিং মলে, নয়তো মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখতে গেছে। কখনও কখনও দল বেঁধে কলকাতার আশেপাশেও ঘুরে এসেছে জানতে পারি। আজকাল মরমির হাবভাব আচার আচরণ দেখলেও বোঝা যায়, অসমের সেই সিধেসাদা সরল মেয়েটি আর সে নেই। যুগের হাওয়া স্পষ্ট। দেখে খারাপই লাগে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সর্বস্তরেই যে একটা অবক্ষয় চলছে, সেটা আমাকে ভীষণ ভাবায়। অবশ্য ভেবেই বা কী করব? যে যুগ চলেছে, ঘোর কলি, এতে তো শুধু অবক্ষয় আর অবনতিই দৃশ্য হওয়ার কথা ।

এ পর্যন্ত তবু সব ঠিকই ছিল। অনেক বলতে বলতে বহুদিন পরে গতকাল সন্ধেতে মরমি আমাদের বাড়ি এসেছে। শনি, রবির ছুটিটা কাটিয়ে সোমবার হোস্টেলে ফিরে যাবে। মেয়েটা এলে আমাদের স্বামী-স্ত্রী-র গুমোট সংসারেও যেন প্রাণবায়ু আসে। বিনতাও ওকে সন্তানের মতোই স্নেহ করে। ও আসছে বলে কত কি খাবার বানিয়ে রেখেছে আগে থেকেই। প্রতিবারই তাই করে। অথচ যার জন্যে করে সে তো খায় পাখির মতো যৎসামান্য।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমন রূপ সচেতন যে, ফিগার বা ত্বক খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কত চর্বচোষ্য আর অমৃতের স্বাদ হেলায় ত্যাগ করে চলে। মরমির মধ্যে সবসময় মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়। সেজন্যে একেবারে খেতে চায় না মেয়েটা। আর খেলেও ফলমূল আর স্যালাডে পেট ভরিয়ে রাখে। একদিকে অবশ্য ভালো এই ভেজালের যুগে মানুষ যত প্রকৃতিতে ফিরে যায় ততই মঙ্গল। তবু ভাবি এই বয়েসেই যদি ছেলেমেয়েরা মন ভরে না খাবে, তবে কখন খাবে। আমাদের মতো বুড়ো বয়সে, নানা রোগে ব্যাতিব্যস্ত হলে খেতে ইচ্ছে করলেও তো কত কিছু পেটে সইবে না। কিন্তু ওরা সেটা বুঝলে তো। মরমির সাথে থাকলে নতুন প্রজন্মের সাথে আমাদের ভাবধারার বিস্তর ফারাক প্রতি মুহূর্তে প্রকট হয়ে ওঠে।

আমার চাইতে ওর মামির সাথেই মরমির অন্তরঙ্গতা বেশি। মরমিকে পেলে বিনতাও যেন গল্পের ঝুলি খুলে বসে। ওদের হাসি ঠাট্টায় ভরে থাকে ঘর। ওদের আড্ডায় আমি বিশেষ গুরুত্ব না পেলেও ওদের খুশি আমার মধ্যেও এনে দেয় চোরা সুখ। কিন্তু গতকাল আমার কৌতুহলী মন এমন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে, কাল রাত থেকেই প্রচণ্ড অস্থিরতায় আছি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এমন একটা বিষয় যে মরমির সাথেও সরাসরি কথা বলতে বিবেকে বাধছে। নিজের বোনঝি বলে বিনতাকেও জানাতে জড়তা হচ্ছে। লজ্জা ঘেন্নায় আমার মাথা নত হয়ে গেছে। এত অধঃপতন হয়ে গেছে মেয়েটার! অথচ ওকে দেখলে কে বলবে যে এমন একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছে?

বাড়িতে আসার পর থেকে ওকে একেবারেই স্বাভাবিক দেখছি। দিব্যি খাচ্ছে দাচ্ছে, গপ্পো, হাসি ঠাট্টা করছে! চোখে মুখে কোনও টেনশনের নামগন্ধ নেই। এসব কী এখন এতই জলভাত হয়ে গেছে এই প্রজন্মের কাছে? সব যেন আমার ভাবনার অতীত। বড়দিকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। দিদিই পারবে নিজের মেয়েকে শাসন করতে। তবে তার আগে আমি প্রমানসহ মরমিকে হাতেনাতে ধরতে চাই।

কাল যখন মরমি ওর মামির সাথে গপ্পো গুজবে মশগুল ছিল, পাশের ঘরে টেবিলের ওপরে ওর মোবাইল ফোনটা রাখা ছিল। তখন একটা মেসেজ রিসিভের ‘বিপ’শব্দ শুনে মোবাইলটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হল। নিছকই কৌতূহলবশত ওটা হাতে তুলে নিই। নজর পড়ে, নতুন একটা এসএমএস এসেছে। আমি সেটা খুলে পড়তেই অবাক হয়ে যাই। একটা নার্সিংহোমের ঠিকানা! মরমিকে রবিবার ঠিক সকাল ন’টার মধ্যে ওখানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। নার্সিংহোম যাবে কেন মরমি? ওখানে কী কাজ থাকতে পারে? মনে নানা ভাবনার উথাল-পাতাল চলতে লাগল। দ্রুত ওর মেসেজ বক্সে গিয়ে অন্যান্য মেসেজগুলো পড়তে লাগলাম। সেগুলোর মধ্যে তাৎক্ষণিক কেবল দুটো মেসেজ পেলাম যেটা নার্সিংহোমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটাতে মরমিকে প্রশ্ন করা হয়েছে, ওর রক্তের গ্রুপ কী? দ্বিতীয়টি মরমির জবাব। নিজের রক্তের গ্রুপ জানিয়ে মরমি নার্সিংহোমের ঠিকানা জানতে চেয়েছে। অসংখ্য মেসেজের ভিড়ে এই রিলেটেড আর কোনও মেসেজ আমি পেলাম না। কিন্তু এটুকু তথ্যই আমার জন্যে সাংঘাতিক।

রক্তের গ্রুপ জানতে চাওয়া কেন? তবে কি মরমি এমন কিছু করাতে চলেছে যার জন্যে রক্তের প্রয়োজন হতে পারে? শেষ পর্যন্ত মেয়েটা এমন কাণ্ড বাধিয়ে বসল যে, নার্সিংহোমে ছুটতে হচ্ছে! আর পাপ কাজ বলেই কি আমাদের জানাতে সাহস করেনি? আমার মধ্যে সীমাহীন প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠেছে। মাথাটা সেই থেকে ঝিম ধরে আছে। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। আজকাল ভাব-ভালোবাসার নামে যেমন খুল্লামখুল্লা যথেচ্ছ যৌনাচার চলছে সর্বত্র, তাতে কোনওকিছুই আর অস্বাভাবিক নয়। মাঝে একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম, সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে যৌন সম্পর্কের রাখঢাক ব্যাপারটা অনেকটাই উঠে গেছে। ‘কৌমার্য’ বা ভার্জিনিটি শব্দগুলো অভিধানে বিলীন হতে বসেছে। কৌমার্য রক্ষা করার ধারণাটাই নাকি অনেক আধুনিকার কাছে এখন সাপ্রেশনের আর-এক নাম। ভাবি কোথায় চলে যাচ্ছে সমাজ! বৃহত্তর সমাজের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এখন তো ঘরেই এ অভিজ্ঞতা হওয়ার দুর্ভাগ্য ঘটছে।

মরমি তখনও মেসেজটি দেখেনি। তবে আগের মেসেজেই যখন নার্সিংহোমের ঠিকানা জানতে চেয়েছিল, সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, ওখানে যাওয়ার জন্যে ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত। আমার ধারণা, ওর সাথে যুক্ত ছোকরাটিই মেসেজ প্রেরক। সেই সমস্ত ব্যাবস্থাপনা করেছে। নিজের পাপ ঢাকতে এসব তো করতেই হবে। তবে আমি মেয়েটাকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। চিন্তা ভাবনা বা টেনশনের লেশমাত্র নেই ওর চেহারাতে! এসব এতই জলভাত হয়ে গেছে এদের কাছে?

ঠিক করেছি মরমিকে হাতেনাতে ধরব। ‘টোটাল কিওর’ নার্সিংহোম আমার চেনা। মরমি ওখানে গেলেই আমিও পিছু নেব। সেজন্যেই সকালে দায়সারা প্রাত ভ্রমণ করেই তাড়াহুড়ো করে বাজার সেরে বাড়ি ফিরেছি। এসেই দেখি, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। মরমি আমি আসার আগেই বেরিয়ে গেছে। ওর মামিকে নাকি বলে গেছে, প্রফেসর ডেকেছেন, তাই কোচিং-ক্লাস এ পড়তে যাচ্ছে। ফিরতে দেরি হবে আর বেশি দেরি হলে এখানে না এসে ও সরাসরি হোস্টেলেই ফিরে যাবে। বিনতা ঘরে মন বিষণ্ণ করে বসে আছে। স্বাভাবিক, কতদিন পরে মেয়েটা এসেছিল, অথচ রাত পোহাতেই এমন আকস্মিক চলে গেল। মনটা আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু তার চাইতে উদ্বিগ্নতা ও অস্থিরতা অনেক বেশি। আমি বাজার রেখেই বিনতাকে তেমন কিছু না জানিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

‘টোটাল কিওর’নার্সিংহোম খুব একটা দূরে নয়। বড়োজোর মিনিট কুড়ির পথ। দুবার অটো পালটাতে হয় কেবল। তবে আজ বারবার সিগনাল আর ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে অনেকটাই সময় লেগে গেল। নার্সিংহোমে যখন পৌঁছলাম, ন’টা বেজে গেছে। গেট দিয়ে টোটাল কিওর-এর চত্বরে ঢুকেই চারদিকে তাকিয়ে মরমিকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। বিনতার কথা মতো মরমি আমারও প্রায় একঘন্টা আগে ঘর থেকে বেরিয়েছে। সুতরাং অনেক আগেই ওর পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু খোলা চত্বরে কোথাও ও নজরে এল না। অগত্যা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।

রিসেপশনের সামনেই ভিজিটরস এনক্লেভ-এ অনেকেই বসে আছে। আমি ওখানেও মরমির দেখা পেলাম না। অথচ আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত যে কোচিং-ক্লাস এর নাম করে মরমি এখানেই এসেছে। এ ধরনের অনেক প্রাইভেট নার্সিংহোমেই চলে যত অবৈধ কাণ্ডকারখানা। কিছু কিছু গাইনি, এমনকী হাতুড়ে পর্যন্ত মালামাল হয়ে যাচ্ছে শুধু অন্যের পাপ ধুয়ে ধুয়ে। আমি জানি শুধু মরমিই নয়, সেই ছোকরাটিও এখানেই আছে।

কোথাও মরমির দেখা না পেয়ে অগত্যা রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলাম। মরমি নিশ্চয়ই ভেতরে ঢুকে গেছে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে বললাম, একজন পেশেন্টকে দেখতে এসেছি, নাম মরমি ঘোষ।

মেয়েটি কম্পিউটারে চোখ রেখে বলল, সরি, এই নামে কোনও পেশেন্ট নেই এখানে।

– কী বলছেন কী? ভালো করে দেখুন, নামটা নিশ্চয়ই আছে। ও এখানেই আছে আমি জানি। আমি উত্তেজিত হয়ে বলি।

– না স্যার, আমাদের পেশেন্ট লিস্টে এমন কোনও নাম নেই। মেয়েটি একইরকম শান্ত হয়ে জানায়।

টের পাচ্ছি, আমার হূদ্কম্পন ক্রমশ বেড়ে চলেছে, কপালে চিন্তার ভাঁজগুলো গাঢ় হচ্ছে, হাতের তালু ঘেমে উঠেছে। ওরা যাই বলুক, আমি নিশ্চিত মরমি এখানেই আছে। তবে কি এসব অবৈধ কাজগুলো অফ দ্য রেকর্ড হয়? যার জন্যে ওর নাম পেশেন্ট লিস্টে নেই? নাকি মরমি নাম ভাঁড়িয়ে আছে? এও কী সম্ভব? আমি এবারে অনুনয়ের সুরে বলি, দেখুন ম্যাডাম, একটু আগেই সে এখানে এসেছে। লম্বা করে, খুব ফরসা, …সুন্দরী একটি মেয়ে…

মেয়েটি মৃদু হাসল। বলল, দেখুন অনেকেই তো এখানে আসছেন, কারও চেহারা দেখে তো মনে রাখা সম্ভব নয়। আমরা যা রেকর্ডে আছে সেটুকুই বলতে পারি। আমার মনে হয় আপনার কিছু একটা ভুল হচ্ছে।

আমি প্রায় হতাশ, তীরে এসে এভাবে তরি ডুববে ভাবতেও পারিনি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অসহায়ের মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক তখনই পাশে বসে থাকা অপর রিসেপশনিস্ট মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, একটু দাঁড়ান, কী নাম যেন বলেছিলেন আপনি?

– মরমি। মরমি ঘোষ। আমি শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠি।

– হ্যাঁ হ্যাঁ নামটা যেন একটু আগেই শুনেছি। একটু আনকমন নাম বলে কানে গেঁথে আছে।

আমি আশার ঝলক দেখতে পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটি কম্পিউটার স্ক্রীন-এ কিছুক্ষণ চোখ রেখে বলতে লাগল, একজন মরমি ঘোষ আছেন। বয়স একুশ। কিন্তু তিনি তো পেশেন্ট নন।

– হ্যাঁ হ্যাঁ ওর কথাই বলছি। সবে একুশ হয়েছে ওর। আমি একরকম উল্লাসেই বলে উঠি।

– কিন্তু তিনি তো পেশেন্ট হিসেবে এখানে আসেননি।

– তবে কী জন্যে এসেছেন? আমি সবিস্ময় প্রশ্ন করি।

– উনি এসেছেন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত একটি ছ’বছরের শিশুকে রক্ত দিতে।

– রক্ত দিতে? কোন শিশুকে? সে কে হয় ওর? আমার বিস্ময় আর প্রশ্নের অন্ত নেই।

মেয়েটি বলে চলে, শিশুটির কেউ হন না উনি। খুব গরিব ঘরের একটা শিশু। আকস্মিক রক্তের প্রয়োজন হওয়ায় পত্রিকায় আবেদন করেছিল শিশুটির পরিবার। খুব রেয়ার রক্তের গ্রুপ কিনা, তাই ডোনার পাওয়াই কঠিন। সেই আবেদনেই সাড়া দিয়ে মিস মরমি ঘোষ রক্ত দিতে এসেছেন।

যা শুনছি, নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। মাথার থেকে একটা ভার যেন আকস্মিক নেমে গেছে। সেই সঙ্গে নিজের হীন্মন্যতার বোঝায় নিজেই নত হয়ে যাচ্ছি। ইশ, কী ভুলটাই না করে চলছিলাম! কেবল অন্ধকারটুকুই দেখে গেলাম এতদিন! নতুন প্রজন্মের এই অপরূপ রূপটি নিজের অজ্ঞতা আর হীন্মন্যতার দরুন দৃষ্টির অগোচরেই থেকে গেছিল। টলমল পায়ে ভিজিটরস এনক্লেভ-এ এসে বসি। মরমির জন্যে অপেক্ষা করছি। মেয়েটাকে সাথে করেই বাড়ি ফিরব। রক্ত দিচ্ছে, এখন ওর পুষ্টিকর খাওয়া ও যত্নের বিশেষ প্রয়োজন। ভাবছি, মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে মনে মনে ওর থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব।

 

আত্মজ

রবিদার চায়ের দোকানে বসে সিগারেট টানছিল। ভাবনায় সলিলদা। যাওয়াটা ঠিক হবে? কিছুদিন হল খবর পাঠাচ্ছে। রাস্তায় দেখা হয়েছিল, প্রসঙ্গ তুলতে বলল, বাড়ি আয়। সব কথা রাস্তায় হয় না।

কী কথা কে জানে! হতে পারে সেদিনের জের। বউদি হয়তো কানে তুলেছে। ভয় হচ্ছে। সংকোচও।

পাগলিটার চিৎকার কানে আসে। অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছে। তেড়ে যাচ্ছে কারও দিকে। হুটোপাটি পালানোর শব্দ। হা হা হো হো…

বিভাসের অস্বস্তি হয়। ভাবনায় চিড় খাচ্ছে। কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না সলিলদার বিষয়টা। ভদ্রলোকের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। তাকে স্নেহ করেন। তাঁর পরামর্শেই কন্ট্রাকটারি ব্যাবসায় নেমেছে। নিজে পিডব্লউডি-র অফিসার হওয়ায় কন্ট্রাক্ট পেতে সমস্তরকম সাহায্য করেন। বিনিময়ে এতটুকু সুবিধা নেননি কখনও। ভয় হচ্ছে, পাছে সম্পর্কে চিড় ধরে। কেন যে মরতে গৌরী বউদির সাথে সেদিন খারাপ ব্যবহার করল!

‘মর মর খান্কির বাচ্চারা…’

পাগলিটা গালাগাল দিচ্ছে। মাথার প্রতিটি কোশে আঘাত করে শব্দগুলো। রক্তক্ষরণ টের পায়। শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে আরও একটা ধরায়। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টায় পুরোনো ভাবনায় ফিরে আসতে চায়। দিন পনেরো আগের ঘটনা, ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে সলিলদার বাড়়ি যেতে হয়েছিল। সলিলদা তখন বাড়িতে ছিলেন না। গৌরী বউদি ভেতরে ডাকলেন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন বসতে হয়েছিল বিভাসকে। ভদ্রমহিলাকে সে পছন্দ করে না। কেবল গৌরী বউদি কেন, কোনও মহিলাকেই সে সহ্য করতে পারে না। ঘৃণা করে। আর গৌরী বউদিকে তো অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে। সেজেগুজে সারাদিন পটের বিবি, দিনভোর বিউটিপার্লার-ফেসিয়াল-ম্যানিকিয়োর কিংবা টিভি সিরিয়াল… শো-কেসের পুতুল যেন একটা। কেন জানে না, গৌরী বউদিকে দেখলে মনোকামিনীর কথা মনে পড়ে। ভদ্রমহিলাকে মা ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে। সজ্ঞানে ‘মা’ শব্দটা কখনও উচ্চারণ করেনি সে। ভবিষ্যতেও করবে না।

মাথার ভিতর ঘুণপোকার উপস্থিতি টের পায়। বিভাস তবু সামলে নিতে পারত। সামাজিক ভদ্রতা রক্ষা করতে বহু অভ্যাসে, নিজের সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে ইদানীং এ ক্ষমতা সে অর্জন করেছে। আচরণে কোনও প্রভাব পড়তে দেয় না। গৌরী বউদি বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই সব গোলমাল হয়ে গেল। জানে এ প্রসঙ্গে সে বিরক্ত হয়। একাধিকবার বলেছে, কোনও মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় সারাজীবন কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব। সেদিন এমন বাড়াবাড়ি করতে লাগল বউদি যে, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। বেশ দু’কথা শুনিয়ে, রাগ দেখিয়ে উঠে এসেছিল। পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়েছে।

গৌরী বউদি নিশ্চয় অপমানিত হয়েছিল। কথাটা হয়তো সলিলদার কানে তুলেছে। হতে পারে এই জরুরি তলব…

পাগলিটাকে ঘিরে ছেলেগুলোর অসভ্যতা বাড়ছে। বাড়ছে চিৎকার চ্যাঁচামেচি। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাগলির খিস্তি-খেউড়… সেই সাথে মাথার ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথার অনুভব। রবিদার চায়ের দোকানের সামনেই আইল্যান্ড, তিন রাস্তার সংযোগস্থল। মাঝখানে রবীন্দ্রমূর্তি। মূর্তির নীচে পাগলির বর্তমান ঠিকানা। কিছু কংক্রিটের বেঞ্চ আছে চারপাশে। সকাল-সন্ধে এখানেই আড্ডা মারে ছেলেগুলো। সকলে শিক্ষিত, ভালো পরিবারের। চাকরি জোটাতে না পেরে বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়ায়, বাকি সময়টা এখানেই। এদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ মেনে নিতে পারে না বিভাস।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে পার্কের গেটের মুখে এসে দাঁড়ায়। পাগলিটার একটা হাত স্ফীত পেটের উপর, অন্যহাতে একটা লাঠি– কখনও এর দিকে তেড়ে যাচ্ছে তো কখনও অন্যজনের দিকে। তাড়া খেয়ে প্রথমজন দৌড়ে পালাচ্ছে তো দ্বিতীয়জন এগিয়ে আসছে… পাগলির গর্ভস্থ সন্তান চুরি করার ভয় দেখাচ্ছে। আর তাতেই পাগলির আক্রোশ। পরনের কাপড় অর্ধেকের বেশি মাটিতে লুটোচ্ছে, উপরিভাগ সম্পূর্ণ অনাবৃত।

পাগলির ভারী তলপেটের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বিভাস। অসুস্থ শরীরে এমন দৌড়-ঝাঁপ… ভদ্দর ঘরের বউ হলে বিছানায় কেতরে থাকত। একটা রাস্তার পাগলিকেও, কারা যে এসব করে! আজব দেশ মাইরি!

–কী হচ্ছে এখানে? এত চিৎকার কীসের?

বিভাস প্রায় গর্জন করে ওঠে। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। ছেলেগুলোর সাথে সাথে পাগলিটাও থতমত খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সকলের চোখে ভয়।  এলাকায় একটা ‘দাদা’ ইমেজ আছে বিভাসের।

বিভাস তখনও পাগলিটার দিকে তাকিয়ে। এই প্রথম এত কাছ থেকে, সময় নিয়ে পাগলিটাকে দেখছে। এখানে নতুন এসেছে, শরীরে বয়ে এনেছে বীজ। বয়স তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। গায়ের রং একসময় ফর্সা ছিল। এখন রোদেপোড়া তামাটে। ছাই-ভস্ম মাখা চুলে জট পাকাতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আঙুল ডুবিয়ে চুলকোচ্ছে। এসবের মধ্যেও বেশ একটা ঢলঢলে ভাব আছে চেহারায়। সবচেয়ে মারাত্মক পাগলির চোখদুটো। কী এক মায়ায় যেন তার দিকে অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভরসা খুঁজছে।

চোখের এই আকুতি আগে কখনও দেখেনি বিভাস। নিজেকে সে নিষ্ঠুর, পাষাণ হূদয় হিসাবে ভাবতেই  অভ্যস্ত। তবু বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভূতি, শিরশির করে শরীর। পাগলিটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। অস্বস্তি হয়। চোখ ফিরিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকায়। ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলে, তোরা সব শিক্ষিত না?

– সরি বিভাসদা, ভুল হয়ে গেছে…

বিভাস কথা বাড়াল না। শব্দ করে থুতু ফেলল একদলা। পাগলিটার দিকে তাকাল। তখনও তার দিকে তাকিয়ে। চোখে করুণ আর্তি। বিভাস চোখ সরিয়ে নিল। সকলকে চমকে দিয়ে যেভাবে আচমকা ঢুকেছিল সেভাবেই আবার বেরিয়ে এল। রবিদার চায়ের দোকানে এসে ঢুকল।

–এরা কি ভদ্দরলোকের ছেলে!

দোকানে খদ্দের ছিল না, সমস্ত ঘটনা লক্ষ্য করেছে রবিদা। ভিতরে ক্ষোভ জমে ছিল, এতক্ষণে মুখ খুলল, কী বলব বলো! ব্যাবসা করে খাই, কিছু বলতেও পারিনে–

–একটা চা দিও।

মুড অফ হয়ে আছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না। রবিদার কথায় সরাসরি উত্তর দিল না।

–কি অমানবিক ব্যাপার বলো তো! চা দিতে দিতে রবিদা আবার আক্ষেপ করল।

যে-কোনও কারণেই হোক, বিভাস জানে, পাগলিটার উপর একটু সহানুভূতি আছে রবিদার। যখনই দোকানে এসে হাত পাতে, কেকটা রুটিটা… যা হোক কিছু একটা দেবে। ফেরায় না কখনও। বাড়ি থেকে বউদির বাদ দেওয়া একটা কাপড়ও এনে দিয়েছে।

চা খেতে খেতে মানুষটাকে খেয়াল করছিল বিভাস। তার দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে মুখ গোমড়া করে আছে। পরিবেশটা আরও গুমোট হয়ে ওঠে। বিভাসের ভালো লাগে না। উঠে পড়ে সে। সলিলদার বাড়ি থেকে বরং ঘুরে আসবে।

কাঁধ অবধি ঝাঁকড়া চুলে ঢেউ তুলে অভ্যর্থনা জানালেন গৌরী বউদি। বাব্বা, এতদিনে মনে পড়ল! আমি ভাবলাম রাগ করেছ, আর বুঝি আসবেই না। এসো ভেতরে এসো–

বিভাস অবাক হল। এমন প্রত্যাশা ছিল না। বরং উলটোটা আশঙ্কা করেছিল। ভয়ে ভয়ে ছিল। ফুরফুরে মেজাজে দেখে ভারটা নেমে গেল।

বিভাসকে বসার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, একটু বোসো। দাদা আসছে। বাথরুমে ঢুকেছে।

মিনিট দশেক পরে সলিলদা এলেন। স্নান সেরে ধোপদুরস্ত হয়ে এসেছেন। পেছনে গৌরী বউদি, তবে ভেতরে ঢুকলেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন পর্দা ধরে!

–সারাদিন কী এমন রাজকার্য থাকে, খবর দিয়েও পাওয়া যায় না!

–কিছুদিন আগেই তো এলাম। তাছাড়া আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে–

– সব কথা সব জায়গায় হয় না। কই গো, এবার বলো কী বলবে বলছিলে।

শেষ কথাগুলো বউদিকে উদ্দেশ্য করে। বউদি মুখ নামিয়ে নিলেন। মেঝেতে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের আঁচড় কাটতে কাটতে সংকোচ জড়ানো গলায় বললেন, তুমি বলো। চায়ের জল চাপিয়ে এসেছি–

কথা শেষ করে ধীর পায়ে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন তিনি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ তুললেন সলিলদা। সরাসরি বিভাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাজের কথায় আসি। মন দিয়ে শুনবে, বিষয়টা অনুভব করার চেষ্টা করবে।

বিভাস কিছু অনুমান করতে পারে না। বুঝতে পারে না সলিলদার মতো মানুষের কী এমন দরকার থাকতে পারে তার কাছে, যে জন্যে এত হেঁয়ালি। চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়।

–কিছুদিন হল তোমার বউদি খুব করে ধরেছে। চেষ্টা করলে তুমিই নাকি ওর সমস্যার সমাধান করতে পারো। আমিও ভেবে দেখলাম, খুব একটা ভুল বলেনি।

–সমস্যাটা কী? বিভাস কৌতূহল চাপতে পারে না।

–বলছি। তার আগে কথা দিতে হবে, সমস্ত রকম হেলপ পাব তোমার কাছে।

–সম্ভব হলে নিশ্চয় পাবেন।

সলিলদা গম্ভীর, তুমি তো জানো, প্রায় বারো বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। সন্তানাদি কিছু হল না। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। গৌরীকে দু-দুবার অপারেশন করিয়েছি। নিট লাভ জিরো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার অ্যাডপ্ট করব। সেই দু’বছর হতে চলল। বিভিন্ন জায়গায় নাম লিখিয়ে রেখেছি, এখনও কোনও জায়গা থেকে গ্রিন সিগনাল আসেনি। সব জায়গায় লম্বা লাইন। যতদিন যাচ্ছে ভরসা হারিয়ে ফেলছি।

বিভাস বোঝে না এসব অতি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তার সাথে কেন! জিজ্ঞাসাও করতে পারে না। অস্বস্তি হয় তার।

–কিছুদিন আগে একটা পাগলির কথা বলেছিলে না? অচমকা প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন, তোমাদের ওই রবীন্দ্রপার্কে থাকে…

–হ্যাঁ, কিন্তু…

–শুনেছি সে প্রেগন্যান্ট। তো, এর মধ্যে একদিন গিয়েছিলাম। দেখলাম তাকে। সাত-আট মাস তো হবেই, বেশিও হতে পারে। দেখে কষ্ট লাগে।

বিভাস ধন্দে পড়ে। এর মধ্যে আবার পাগলি এল কোত্থেকে! বিষয়টা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গালে রেখে কথা বলছে সলিলদা। অস্বস্তি হচ্ছে।

–তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, সলিলদা আবার মুখ খোলেন, কিছুদিন একটু চোখে চোখে রাখতে হবে পাগলিটাকে। তুমি তো বেশিরভাগ সময় ও দিকেই থাকো, প্রয়োজনে একজন লোক রাখবে দেখাশোনা করার জন্য।

–আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

–বলছি, সব খুলে বলছি। প্ল্যানটা আমার নয়, তোমার বউদির। তবে আমার সম্মতি আছে। আমরা ঠিক করেছি, পাগলির বাচ্চাটাকে আমরা অ্যাডপ্ট করব।

–এটা কী করে সম্ভব?

–তুমি হেলপ করলেই সম্ভব।

– তা বলে একটা রাস্তার পাগলির বাচ্চা!

–সন্তান সন্তানই। সে যার হোক, যেখানকার হোক।

–তা নয়, আমি ভাবছি…, ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত কথাটা বলে ফেলল, আমাদের দেশে একটা রাস্তার পাগলিও প্রেগন্যান্ট হয়, এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে! আর এ জন্যে যে বা যারা দায়ী, শিশুটার শরীরে সেইসব পশুর রক্ত রয়েছে।

–রক্তের পরিচয় কী সব! শিক্ষা, পরিবেশ… এসবের কোনও মূল্য নেই। তাছাড়া কোনও হোম থেকে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করলেও তার জন্ম পরিচয় আমরা জানতে পারব না। সেখানেও তো এ ধরনের পথ শিশুদেরই ঠাঁই হয়…

–আমি রক্তের পরিচয় নয়, রক্তের সম্পর্কের কথা বলছি। জিনকে তো অস্বীকার করা যায় না।

–আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে আমাদের মনের মতো করে মানুষ করে নেব। বিভাস বোঝে, সলিলদা এ বিষয়ে আর কোনও তর্ক চাইছে না। একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। মাথাটা আবার টিপটিপ করতে শুরু করে তার।

–তুমি শুধু পাগলিটাকে চোখে চোখে রাখবে। দেখবে কোনও অসুবিধা না হয়। আর নিয়মিত খবরগুলো দিতে থাকবে। পারবে না?

–চেষ্টা করব। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হল সে।

–চেষ্টা নয়, পারতেই হবে–

গৌরী বউদির গলা। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আবার। চোখ দুটো চিকচিক করছে। বিভাস অবাক হয়, ঠিক দেখছে তো! গৌরী বউদির চোখে জল! ভদ্রমহিলা তাহলে কাঁদতে জানে! তাও সন্তানের জন্য!

বিভাস উঠে দাঁড়ায়। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। বেরোতে হবে।

–বিষয়টা তাহলে তোমার উপরেই ছেড়ে দিলাম।

–আপনিও আর একবার ভাবুন।

কথা শেষ করে বেরিয়ে আসে বিভাস।

মাঝে মাঝে রবিদার দোকানে আসছে সলিলদা। দীর্ঘক্ষণ কাটাচ্ছে। ইতিমধ্যে রবিদার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। রবিদাকেও জানিয়েছে বিষয়টা। রবিদা খুশি এমন একটা সিদ্ধান্তে। অকুণ্ঠ সাধুবাদ সহ সমস্তরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।

দোকানে খদ্দের না থাকলে পাগলিটাকে দেখতে যায় রবিদা। পাগলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। সময় পেলে বিভাসও যায়। সলিলদার সিদ্ধান্ত হঠকারী মনে হলেও, তাকেও যেন কী এক নেশায় পেয়েছে। মাঝে মাঝে পার্কের ভিতরে ঢুকে যায়। খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে পাগলিটাকে। ছেলেগুলোর সাথেও ভাব হয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনার পর আর তারা পাগলিটাকে উত্যক্ত করেনি। বরং পাগলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে নজর রাখছে। তবুও একটা অঘটন ঘটে গেল।

পার্কের বাইরে রিকশা স্ট্যান্ড। চালকরা মাঝে মাঝে ভিতরে গিয়ে বসে কাজের চাপ না থাকলে। তাস খেলে, গল্প গুজব করে। সেদিন কেউ একজন পাগলিকে রাগানোর জন্যে বলেছিল, তোর বাচ্চাকে নিয়ে নেব। পাগলি ইট ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।

ঘটনাটা জানানোর জন্যে তখনই সলিলদার বাড়ি গিয়েছিল বিভাস। সবটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল সলিলদা। বউদির মুখেও দুশ্চিন্তার ছায়া।

–কাজটা কি সহজ হবে?

–দেখা যাক। সলিলদার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

আরও একটা সংশয় কিছুদিন হল বিভাসের মনে উঁকি মারছে। পাগলিটাকে নিয়ে হয়তো একটু বেশিই ভাবছে, যা আগে কখনও কারও ক্ষেত্রে হয়নি। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? এতদিন সলিলদাকে বলতে সাহস হয়নি। আজ হঠাৎ আবেগের বশে বলে ফেলল, আমরা বোধহয় অন্যায় করছি।

–কীসের? সলিলদার চোখে সংশয়।

–এভাবে কারও বাচ্চা…

কথা শেষ করতে পারে না, সলিলদার চোখে চোখ পড়তেই থেমে যায়। সলিলদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ খোলে, একটা বাচ্চা, আনওয়ানটেড বেবি, এভাবে ফুটপাথে বেড়ে উঠবে! যার ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সেটা অন্যায় নয়? তাকে ভদ্রসমাজে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দেওয়াটা অন্যায়?

গৌরী বউদি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার তিনিও মুখ খুললেন, নিজেকে দিয়ে ভাবো না, তোমার মাসি যদি দায়িত্ব না নিতেন, তোমার ভবিষ্যৎ কী হতো কল্পনা করেছ কখনও? তিনি কি অন্যায় করেছেন?

–এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম।

–কিচ্ছু অন্যরকম না। দুটি ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে একটা শিশুর ভবিষ্যৎ। বিনিময়ে সন্তানহীনা সন্তান পাচ্ছে। তিনি তো তোমাকে তোমার মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেননি। তার আত্মত্যাগ, ভালোবাসা… এসব অস্বীকার করতে পারবে?

স্বীকারও করেনি কোনওদিন। আসলে ভাবেইনি মনোময়ীকে নিয়ে। হতে পারে সে মনোকামিনীর বোন, গৌরী বউদির কথায় নাড়া খেল একটু। প্রসঙ্গটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল। মনোময়ী সত্যিই বিস্ময়কর।

বিভাসের বয়স তখন দু’বছর। মা মনোকামিনী বিনোদ বিশ্বাসের এক বন্ধুর সঙ্গে পালাল। আর ফেরেনি। নিঃসন্তান মনোময়ী ততদিনে বিধবা হয়েছেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাপের সংসারে। অন্যদিকে দু’বছরের শিশু সন্তান নিয়ে বিনোদ বিশ্বাসের মানসিক অবস্থাও তখন শোচনীয়। এমন সময় মনোময়ী এসে সংসারের হাল ধরেছিলেন। কোলে তুলে নিয়েছিলেন বিভাসকে। সেই থেকে এ বাড়িতে। এমন নয় যে অস্তিত্বের সংকটে তিনি একাজ করেছেন। মনোময়ীর বাবা অর্থাৎ বিভাসের দাদামশায়ের আর্থিক অবস্থাও ভালো। ইচ্ছা করলেই জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। তবু কোন স্বার্থে তিনি এখানে রয়ে গেলেন? বিভাসকে মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেননি। বিভাসের জন্যে তার উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তাও অস্বীকার করার মতো নয়। কীসের টানে এই ত্যাগ স্বীকার? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতরে পাক খায়। চিনচিন ব্যথাটা টের পায় আবার।

–তোমার মাসির কথা না হয় বাদ দিচ্ছি। এবার সলিলদা। দু’জনে যেন পরিকল্পনা করে তাকে আজ ধরেছে। বললেন, কিন্তু ওই পাগলি? পাগলিটার ক্ষেত্রে কী বলবে? যে-সন্তান এখনও পৃথিবীর আলোই দেখল না, তার জন্যে এখনই একজনের মাথা ফাটিয়ে ফেলল?

বিভাস চুপ করে রইল। কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না। ভাবাচ্ছে। ভাবাচ্ছে বলেই সলিলদার কাছে ছুটে এসেছে সংবাদটা জানানোর জন্যে। পাগলিটাও ভাবাচ্ছে। কী এক আকর্ষণে সময় পেলেই ছুটে যাচ্ছে পাগলিটাকে দেখতে। কীসের টানে? এই মুহূর্তে মনে হল, হঠাৎই মাথায় এল ভাবনাটা, পাগলির গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে কোথায় যেন তারও একটা যোগসূত্র আছে। নইলে এমন টান অনুভব করবে কেন? কিন্তু সূত্রটা ধরতে পারছে না…

পাগলির জন্যে আরও অনেক ব্যবস্থা নিয়েছেন সলিলদা। পাশের হোটেলে বলে রেখেছেন, কাজের ছেলেটা দু’বেলা শালপাতার থালায় ভাত দিয়ে যায়। এক ডাক্তার বন্ধুকে এনে দেখিয়েছে দুদিন মাঝরাতে। একদিন জোর করে দুটো ইনজেকশন দিয়েছেন তিনি। ডেলিভারির জন্যে নার্সিংহোমও ঠিক করে রেখেছেন, পেইন উঠলেই…

দিন যত এগোচ্ছে, পাগলিটার উপর তাদের সতর্ক দৃষ্টি তত তীক্ষ্ণ হচ্ছে। বিভাস যদিও মানসিক ভাবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

আরও একটা ঘটনা সেদিন খুব স্ট্রাইক করল। পার্কের এক কোণে বসে আনমনে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ পাগলিটার গলা কানে আসতে দেখল পাগলিটা তার স্ফীত তলপেটে হাত বোলাচ্ছে আর নাকি সুরে গাইছে–

খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল

বর্গি এল দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে…

হঠাৎ বর্গির প্রসঙ্গ কেন? কথাগুলো কি তাকে উদ্দেশ্য করে। তাদের অভিসন্ধি কিছু অনুমান করেছে? যেজন্যে এখন থেকেই গর্ভস্থ সন্তানকে সাবধান করছে। নিজেকে বর্গি বলে মনে হল বিভাসের। –অন্যায়! মনে মনে আবার বিড়বিড় করল, সলিলদা অন্যায় করছে। খবরটা তাকে জানানো দরকার।

বিভাস তখনই বাইক নিয়ে ছুটল।

আর মাত্র কয়েকটা দিন। খাওয়া-ঘুম ছুটেছে সলিলদার।

খাওয়া-ঘুম ছুটেছে বিভাসের। রবিদা এখন রাতে দোকানেই থাকছে। রাতবেরাতে কিছু একটা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে জানাবে। রবিদার মোবাইল ছিল না, সলিলদা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসবে। ড্রাইভারকেও সেইভাবে বলে রেখেছে।

সেদিন সন্ধ্যা থেকে আকাশের মুখ ভার। মাঝে মাঝে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে প্রবল। রাত দশটা পর্যন্ত রবিদার দোকানে কাটিয়ে গেল সলিলদা। লক্ষণ সুবিধার নয়। যাওয়ার আগে বারবার রবিদাকে সাবধান করে গেল। বিভাসকেও বলে গেল মোবাইল খোলা রাখতে।

বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না বিভাস। রবিদাকে পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। সন্ধ্যার পর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। বৃষ্টির কারণে আজ আবার বেশি টেনেছে।

এগারোটার পর মুষলধারে নামল। প্রবল বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। অস্থির পায়চারি করছিল ঘরের মধ্যে। দুর্যোগের মধ্যেই যদি কিছু একটা ঘটে যায়।

আধ ঘণ্টা হতে চলল, বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। বরং বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। উলটোপালটা হাওয়া। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। ইতিমধ্যে জল জমেছে বাড়ির সামনে। ব্যাং ডাকছে। সবমিলে অদ্ভুত একটা শব্দ। বিভাসের মনে হল, দূরে কোথাও অসংখ্য মানুষ চিৎকার করছে। কে জানে এদের মধ্যে পাগলিটাও আছে কিনা!

বিভাস আর থাকতে পারে না। দরজা খুলে বাইরে আসে। সোজা রাস্তায়। দ্রুত পা চালায় পার্কের দিকে। হাতে টর্চ। ভয় রবিদাকে নিয়ে, যদি ঘুমিয়ে পড়ে! রবিদা কী শুনতে পাবে পাগলির চিৎকার? সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দেয় যথাসম্ভব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে পৌঁছোতে হবে।

বাড়ি থেকে পার্কের দূরত্ব মাইলখানেক। হাঁটা পথে মিনিট পনেরো-কুড়ি। অথচ পথ যেন শেষ হচ্ছে না। অন্তহীন পথ হেঁটে চলেছে সে। কতদিন, কত মাস, বছর, যুগ ধরে… কিংবা তারও বেশি সময়… তবু গন্তব্যে পৌঁছোতে পারছে না।

বিভাস দৌড়োতে শুরু করে।

বৃষ্টিতে ঝাপসা সবকিছু। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বিদ্যুতের আস্ফালন। টর্চের আলো বৃষ্টি ভেদ করে বেশিদূর পৌঁছোয় না। মাঝে মাঝে হোঁচট খায় রাস্তার জল জমা খানাখন্দে। তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। পাগলের মতো সে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে যখন পার্কের কাছাকাছি, দূর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ কানে আসে। তবে কী…

সন্দেহ সত্যি। রবিদা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সলিলদা নেই। এদিকে রবীন্দ্রনাথের পায়ের গোড়ায় সদ্যজাতের কান্না। ভিতরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে গেল। রক্তে ভাসছে চারপাশ। একপাশে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে পাগলিটা, অন্যপাশে রক্তজলে মাখামাখি একতাল মাংস পিণ্ড। গলায় তীব্র চিৎকার। একটু দূরেই ওত পেতে বসে আছে দুটো রাস্তার কুকুর। চোখের তারায় লোভের ঝিলিক।

যে-কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমন বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। শিউরে উঠল সে। অস্ফূটে কাতরে উঠল, মাগো–

বহু বছর বাদে সে ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করল। নিজের অজ্ঞাতেই। তারপর টর্চ হাতে তেড়ে গেল কুকুর দুটোর দিকে। যে-কোনও মূল্যেই হোক এদের সে রক্ষা করবে। নইলে সে নিজের কাছেই মিথ্যে হয়ে যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে তার অস্তিত্ব।

 

অন্য নদীর গল্প

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে মা বলল, ‘শৌভিকের একটা চিঠি এসেছে, রেজিস্ট্রি পোস্টে। পিওনটা মহা পাজি, আমাকে কিছুতেই দিতে চাইছিল না। অনেক করে বলবার পর দিল।’ রেজিস্ট্রি পোস্টের ব্যাপারটা শুনেই আমার একটু খটকা লাগল। এই তো দিন সাতেক আগে ওর সাথে ফোনে কথা হল। শুধু বলল, ‘বাড়িতে একটা ছোটো অনুষ্ঠান হবে, ইনভাইট করব।’ কিন্তু সেদিনও তো চিঠির ব্যাপারে কিছু বলেনি।

শৌভিক আমার কলেজের বন্ধু। আমরা দুজন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত একসঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, পড়েছি। আমাদের দুজনের বাড়িও কাছাকাছি ছিল। আমি থাকতাম তেঘড়িয়া, আর ওরা কেষ্টপুরে। এখন অবশ্য ওরা এক নম্বর গেটের কাছে নতুন বাড়ি কিনেছে, আর আমাকে আসতে হয়েছে বীরভূম জেলার এক গ্রামে। শৌভিক চাকরির চেষ্টা করেনি। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পারিবারিক ব্যাবসার খুঁটি ধরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ওর দাদার আবার পারিবারিক ব্যাবসা ছাড়াও আরও কী সব ব্যাবসা রয়েছে। তাদের বউরাও পারিবারিক ব্যাবসাতে সাহায্য করে। ওর দাদার এক মেয়ে, পড়াশোনার সূত্রে বাইরে থাকে। শৌভিকের এখনও পর্যন্ত সন্তান হয়নি। বাড়িতে একা থাকে শৌভিকের মা। কাকু বছর তিন আগে মারা যান।

কলেজ বা ইউনির্ভাসিটিতে পড়বার সময় প্রায় দিনই সময়ে অসময়ে ওর বাড়ি চলে যেতাম, কতদিন ওদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি তার হিসেব নেই। এখন অবশ্য আর সেরকম ভাবে ওদের বাড়িতে থাকা হয় না, সেরকম ভাবে কেন বলব, একরকম হয়ই না। ইউনিভার্সিটির পাঠ শেষ হওয়ার পরের কয়েক বছর বেকারত্বের জ্বালা রগড়াতে রগড়াতে সরকারি চাকরি পেলাম। তবে খুব ভালো চাকরি নয়, পঞ্চায়েত অফিসের সহায়কের চাকরি। প্রথম সপ্তাহে বাড়ি থেকে যাতায়াত করলাম। কিন্তু সপ্তাহের শেষে মনে হল, এই তেঘড়িয়া থেকে বাসে বাদুড় ঝুলে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে বোলপুর স্টেশন, তারপর বাস থেকে নেমে সাইকেল, এত সবের পর অফিস করে বাড়ি ফিরতাম প্রায় জাম্বি হয়ে। কোনওদিন আটটা বাজত, কোনওদিন নটা। তারপর কারওর ভালো কথাও খারাপ লাগত।

আমার বাবার কোনও ব্যাবসা ছিল না। বাবাও আমার মতো সরকারি কর্মচারি ছিল, তবে কেন্দ্রীয়। চাকরি জীবনে সংসার খরচ, আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ বাদ দিয়ে যে-ক’টা টাকা বাবা জমাতে পেরেছিল, তা দিয়ে একতলার এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছু হয়নি। তাও আবার চাকরি শেষ হবার ছয়মাস আগে কাউকে কিছু না বলে, বাবা চলে গেল। আমি, দাদা পিতৃহারা হলাম। দাদার পড়াটা সেই সময় শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু দাদা স্থানীয় একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করবার সুবাদে দাদা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে একটি বড়ো কোম্পানির চেন্নাই অফিসে পোস্টিং নিয়ে দাদা চলে গেল। ফোন করত, চিঠি লিখত, কিন্তু মায়ের মন তো, চোখের আড়াল হলেই চোখের জল ফেলত। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও খুব বেশি বোঝাতে পারতাম না। এর মধ্যেই আমার বেকারত্বের জ্বালা আরম্ভ হল। একই বাড়িতে থেকেও কিছুটা অসামাজিক হয়ে পড়লাম। নিজের চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যে, কোথা দিয়ে যে সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। এই সময় মা আরও একা হয়ে গেলেও আমার কিছু করবার ছিল না। মাঝে মাঝে শৌভিকদের বাড়িতে কাকিমাকে দেখলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

শৌভিকদের বড়ো বাড়ি, তবে সবাই ব্যস্ত, ব্যতিক্রম শুধু কাকিমা। বয়সে কাকিমা মায়ের থেকে কয়েক বছরের বড়ো। ওদের বাড়িতে গেলেই কাকিমাকে দোতলার ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখতাম। ‘কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করলেই, এক বুক হতাশা নিয়ে বলত, ‘এই বাড়িটার মতো।’

তারপরেই কাকু মারা যাওয়ার পরে কীভাবে শূন্যতা, একাকিত্ব, কাকিমাকে গ্রাস করেছিল, তার বর্ণনা দিতে আরম্ভ করত। আমার তখনই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

বাড়ি ফিরে মায়ের পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করত, করতামও। সেই দিন থেকে পরের কয়েকটা দিন নিয়ম করে বসে গল্প করবার মাধ্যমে মায়ের সাথে সময় কাটাতাম।

কয়েক দিন পরেই অবশ্য মা বলে উঠত, ‘তুই তোর পড়াশোনা কর, আমি ঠিক আছি।’ আমি আবার বাধ্য ছেলের মতো পড়াশোনাতে মন দিতাম।

এমনি ভাবেই চলছিল। তারপরেই চাকরি পেলাম। অফিসের কাছে একটা বাসা দেখে মাকে বললাম, ‘কাজের খুব চাপ, এবার থেকে আমার বাড়ি ফিরতে রাত্রি বারোটা, একটা হতে পারে।’

ভীতু মনের মা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানে থাকবার কোনও ব্যবস্থা করতে পারবি না? না হলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।’

আমি একটা বাড়ি নেওয়ার কথা জানাতেই মা বলে উঠল, ‘তাহলে তো আর অসুবিধা নেই। তুই ওখানেই চলে যা। আগে তো তোর শরীর।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর তুমি? তোমারও তো বয়স বাড়ছে।’

তুই আমার কথা ভাবিস না। আমি ঠিক থাকব। তাছাড়া চুয়ান্ন বছর বয়সটা কোনও বয়স নয়, তোর কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে তো থাকব। বুকুর কাছেও চলে যাব।

তার থেকে তুমিও আমার সঙ্গে চলো। এই ঘরটা তালাবন্ধ থাক। শনি, রবি তো আমার ছুটি, চলে আসব। তাছাড়া আরও তো ছুটি আছে, ছুটি থাকলেই এখানে চলে আসব।

তা হয় না, এটা তোর বাবার তৈরি বাড়ি। এখানে আশেপাশের সবাই আমাকে চেনে। প্রয়োজনে বিপদে আপদে আমার পাশে দাঁড়াতে পারবে। তাছাড়া তোর বাড়িতে থাকলেও সারাটা দিন তো তুই অফিসে থাকবি। আমাকে ঘরের মধ্যে ভূতের মতো একাই থাকতে হবে। ওখানে একা থাকবার থেকে এখানে একা থাকাটাই ভালো।

এরপর আমি আর কোনও কথা না বলে, আমার নেওয়া বাড়িতে চলে গেলাম। প্রথম প্রথম একাই রান্না বা অন্য কাজকর্ম করতাম। মাস দেড় পরে একটা রান্না করবার ছেলে পেলাম। ছেলেটি প্রতিদিন সকাল সন্ধে রান্না করে দিয়ে যেত। আমি রবিবার রাত্রে বাড়ি থেকে অফিসের গ্রামে চলে এসে আবার শুক্রবার কোলকাতা ফিরে যেতাম। থাকল একা মা, আর বাবার তৈরি করা বাড়ি।

এমনিভাবেই পাঁচ মাস কাটল। এই পাঁচ মাসে চাকরির জায়গায় বেশ সুনাম অর্জন করলাম। প্রধান থেকে পার্টির স্থানীয় নেতাদের সাথে সখ্যতা বাড়ল। সেই সঙ্গে নতুন আরেক উপদ্রব আরম্ভ হল। অবশ্য এই উপদ্রবে শরীর মন, ভবিষ্যতের এক অলীক আনন্দের জন্য বেশ শিহরিত হয়ে উঠত। কিন্তু মা, দাদা জীবিত, তাই এই ব্যাপারে নিজেই কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে আমার মরালিটিতে বাধল। দাদা তখনও পর্যন্ত সংসার করেনি।

এই সব সাতপাঁচ ভেবেই মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আমার বাড়িতে কয়েকদিনের জন্যে মাকে নিয়ে এলাম। দুদিনের মাথায় শৌভিকের এই চিঠি।

হাত মুখ ধোয়ার আগেই খাম খুলে চিঠিটা বের করে পড়লাম। মা পাাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী লিখেছে?’

‘সামনের শনিবার ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। অবশ্যই যাওয়ার জন্য লিখেছে। তোমাকেও নিয়ে যেতে বলেছে।’

আমি জানি, মা শেষের কথাগুলো শোনেনি। এত তাড়াতাড়ি কলকাতাতে ফেরার কথা শুনে, মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেছে। বুঝলাম যে-কাজে মা এসেছিল সেটা এবারে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। সেই শনিবার আমি একাই সন্ধেবেলা শৌভিকদের বাড়ি পৌঁছলাম। আগেই জানতাম, বাড়িতে কিছু একটা উৎসব হচ্ছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ওরা প্রায় দিন বিভিন্ন কারণে উৎসব করে, তা সে নিজেদের বিবাহবার্ষিকী হোক, বা ছেলে মেয়েদের জন্মদিন, ওদের বাড়ি আলোতে সেজে ওঠে, সেই সঙ্গে এলাহি খাওয়াদাওয়া। শৌভিকদের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান মানেই, আমার নিমন্ত্রণ পাকা। মায়েরও থাকে, তবে মা, সব অনুষ্ঠানে যায় না।

শৌভিকদের বাড়ি পৌছনো মাত্রই বউদি এগিয়ে এসে আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। আমি বউদিকে বললাম, ‘আমাকে যে শৌভিক এমনি আসতে বলল। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে তো দেখছি বড়ো কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি কিন্তু কী অনুষ্ঠান কিছুই জানি না, কোনও কিছু উপহার আনতে পারিনি।’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই শৌভিকের বউদি বলে উঠল, ‘আমরা এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে কাউকে বলিনি। সবাইকে অবাক করে দেওয়ার জন্যেই শুধু চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ করলেও কী অনুষ্ঠান সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আর তুমি তো আমাদের ঘরের লোক, তুমি আবার উপহার কি আনবে?’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়াতে মন দিলাম।

নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। একশো দশ পনেরো হবে। আমার তো সবাইকে মনে হল আমারই মতো অবাক হওয়াদের দলে।

কিছু সময় পরে শৌভিকের সাথে দেখা হল। মা, না আসবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই শৌভিক বলল, ‘আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ব্রাদার উত্তর পেয়ে যাবে।’

অন্য সব অনুষ্ঠানের মতো এবারেও ওদের বাড়িতে খাবারের অঢেল আয়োজন। সেইসব খাবার টুকটাক খেতে খেতে অন্য সবার সাথে কথা বলছি, এমন সময় শৌভিকের দাদা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে অনুষ্ঠানে আসবার জন্য ধন্যবাদ জানাল।

আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ‘আরে, আমরা তো কেউই কোন অনুষ্ঠানে এসেছি, সে সব কিছুই জানি না, সেটা আগে বল।’

দাদা মুচকি হেসে আমাদের আরও কিছুসময় অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল।

অবশ্য আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না, কিন্তু তারপর যা দেখলাম, প্রথমে আমার নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরকম কিছু একটা দেখব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মতো যারা নিমন্ত্রত হয়ে এসেছিল, তারা প্রায় সকলেই কয়েকটা মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। একটা চাপা গুঞ্জনও আরম্ভ হল।

আমি কারওর সাথে কোনও কথা আলোচনা না করলেও সব কিছু দেখে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ বন্ধ করলেও ভেসে উঠল একটাই ছবি, কনের সাজে কাকিমা, পাশে ষাটোর্দ্ধ এক ভদ্রলোক, সঙ্গে শৌভিকদের বাকি সবাই।

মা একা থাকবে বলে, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। অল্প একটু খেয়ে, মায়ের জন্যে খাবার পার্সেল করে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিলাম। শৌভিকের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে সব হল?’

শৌভিক খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘তুই তো জানিস, আমরা সবাই ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। দাদার মেয়েটাও হস্টেলে। একা থাকতে থাকতে মা ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছিল। আর কয়েক দিন চললে অন্য রকম বিপদ হয়ে যেতে পারত। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার বললেন, কম্পানির প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মধ্যে সেরকম কে কম্পানি দেবে বলতো? একটা আয়া ঠিক করলাম। মায়ের সাথে সবসময় থাকত, তার সাথেই মর্নিংওয়াকে বের হতো। এই মর্নিংওয়াকের সময় কাকুর সাথে আলাপ পরিচয়। মায়ের সাথে বন্ধুত্ব হল। বাড়িতে কাকু আসতে লাগলেন। দেখলাম কাকু বাড়িতে আসাতে মা বেশ হাশিখুশি থাকত, সাজগোজ করত। একদিন কাকুই প্রস্তাবটা মাকে দিলেন। মা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কাকু তখন দাদার সাথে কথা বলেন। এরপর আমরা সবাই আলোচনা করতে বসি। আলোচনাতে অনেক কিছু কনফিউশন মিটিয়ে তারপর এই অনুষ্ঠান।’

শৌভিক সেদিন ব্যস্ত ছিল। আমাকে বলল, ‘পরে আরেকদিন আসবি, চুটিয়ে আড্ডা দেব।’ তারপরেই ওদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে, মোবাইলে কাকিমা আর নতুন কাকুর একটা ছবি তুলে, বাসস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াতেই, কানে এল নিমন্ত্রিতদের মধ্যে মাঝবয়সি এক মহিলা মোনোপজ সংক্রান্ত আলোচনা করতে করতে গাড়িতে উঠছে।

আমাদের হয়তো সব বয়সেই বিশেষ কারওর কম্পানির প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এই কম্পানি ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি দিয়ে পূরণ করা যায় না। আমরা এত কিছু বুঝি না, বুঝতে চাইও না। ইনফ্যাক্ট আমার নিজের মায়ের ব্যাপারেও এতসব ভাবার প্রয়াজন আছে বলে, মনে করিনি। এমনকী মায়ের কাছে গেলে এরপরেও অন্য কিছু ভাবব।

বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, শৌভিকদের বাড়িতে কী ছিল?’

আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ‘কাকিমার বিয়ে।’

‘কী বাজে বকছিস! বড়োদের নিয়ে কেউ এমনি কথা বলে?

মা রেগে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে সবকিছু ভালো ভাবে বলে, কিছুক্ষণ আগে মোবাইলে নেওয়া কাকিমাদের ছবিটা দেখালাম। মা সব কিছু দেখে কোনও কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি জামাকাপড় বদলে একটু ইতস্তত করে মায়ের ঘরে গিয়ে বললাম, ‘ঘুমোলে?’

মা শুয়ে শুয়েই উত্তর দিল, ‘না, কিছু বলবি?’

‘দাদাকে একটা ফোন করব?’

‘কেন?’

‘না, মানে তুমিও তো একা থাকো, তাই ভাবছিলাম…’

মা কিছু সময় চুপ করে শুয়ে থাকল। আমিও আর কোনও কথা না বলে আস্তে আস্তে মায়ের ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই মা বলল, ‘বুকু আজ ফোন করেছিল, পরের সপ্তাহে আসছে।’

 

আপসনামা

কুড়ি পাতা দীর্ঘ আট পরিচ্ছদের গল্পটার ফোটোকপির বদলে হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি চেয়ে নেওয়ায় মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল। তবে আনন্দও হচ্ছিল। লিটিল ম্যাগাজিন হলেও, এই প্রথম কেউ বাড়ি বয়ে এসে লেখা চেয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাও শারদ সংখ্যার জন্য। তখন কি ঘুণাক্ষরে আঁচ পেয়েছিল, এই অমল চক্রবর্তীই পুজোর পর শ্রীতমা ফোন করলে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাবে না এবং বিরাটাকার গল্পটা ‘পরিব্রাজক’-এর দফতরে না পৌঁছে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হতচ্ছাড়া নির্ঘাত অন্যত্র নিজের নামে ছাপিয়েছে।

আর একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বন্ধুপ্রেম। অমলের পরম বান্ধব মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের সাথে শ্রীতমার একটা মনোমালিন্য হয়েছিল। এমন তস্করবৃত্তির প্রেরণা নিজের যশলোভ, না বন্ধুর প্রতিশোধস্পৃহা কে জানে। বন্ধুটি তো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, সঞ্চালক, সংগঠক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। সাড়ে ষাট হাজার শব্দের একটা স্বাস্থ্যকর সুপুষ্ট গল্প তার কাজে লাগবে বেশি। অবশ্য সবটাই অনুমান। হতেই পারে শ্রীতমাকে খানিকটা হয়রান করে মজা পাওয়াটাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। তারপর থেকে কাউকে লেখা দিলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু লেখা চাইলে দেবে না এত হুপো দেখানোর জায়গায় পৗঁছোয়নি শ্রীতমা। তাছাড়া বড়ো পত্রিকায় লেখাগুলো পড়া হয় কিনা, তাই নিয়েও সংশয় থাকে। তাই বিশ্বাস করতেই হয় কাউকে না কাউকে। যেমন এখন করছে গৌরব পাত্র নামে এক মাঝবয়সি লেখককে এবং দেবপ্রিয় দামকে।

দেবপ্রিয় দামের প্রযোজনা সংস্থায় শ্রীতমা যোগাযোগ করেছিল কন্যা ও নিজের মডেলিং-এর জন্য। সে সব কিছু না হলেও শ্রীতমার একটি কবিতার বই কিনেছিল দেবপ্রিয়। সেখান থেকেই বইটা পড়ে অমল চক্রবর্তী, শ্রীতমার কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখায়। সেই সূত্রেই অমলের পত্রিকা ‘পরিব্রাজক’এর সঙ্গে সম্পর্ক শুরু ছড়া ও কবিতা দিয়ে। অমলের বন্ধু হিসাবেই আলাপ মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। আলাপ থেকে প্রলাপ। প্রলাপের পর বিলাপ। এক সময় – শ্রীতমার তখন একুশ, কারও সাথে অ্যাফেয়ার আছে শুধু এই গুজবটুকুর জন্য ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিটা পূর্ণতা পায়নি। সঙ্কল্প সরে গিয়েছিল নীরবে। আজ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে সে বিবাহিতা এবং এক সন্তানের জননী – এগুলোও অধুনার প্রেমপ্রার্থীদের নিরস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এক নাছোড়বান্দা ছোকরাকে তো রুঢ়ভাবেই কাটাতে হয়েছে, কারণ ভালো ব্যবহার প্রশয় দেওয়ার সমার্থক হয়ে যাচ্ছিল। সমাজ এতটাই বদলেছে যে নিজেকে সেকেলে লাগে। অবশ্য তলিয়ে দেখলে আধুনিকতার বুলি আসলে আদিম রিপুর ছদ্মবেশ।

মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ ওর চেয়ে বছর দুই তিন বড়োই, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে পড়ে না। তবে আঁতেল সমাজে নাম লেখানো ব্যাটাছেলেদের ছোঁকছোঁকানির লাইসেন্স থাকে। প্রথম আলাপ অমল চক্রবর্তীর সাথে শ্রীতমার ফ্ল্যাটে ‘পরিব্রাজক’ সঙ্গে এনে। এক কাপ চা-ও স্পর্শ করেনি। দুর্দান্ত গরমে শরবত দিতে চাইলে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘ওসব মেয়েলি ড্রিংক’। পরে শ্রীতমাও বার কয়েক রহড়ায় ওর বাড়ির আড্ডায় গিয়েছিল। ক্রমশ ফোনে কথা হলে শ্রীতমাকে মদ্যপান ও চুম্বনের ওপর থিসিস শোনানো শুরু করে।

ধরা যাক মৃত্যুঞ্জয় শ্রীতমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসেছে শুনে শ্রীতমা ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘তাহলে দেখা করে যান।’ প্রশ্ন এসেছে, ‘গেলে কী খাওয়াবেন?’

‘আগে খবর দিয়ে এলে আয়োজন রাখতাম। এখন না হয় চা পান করবেন টা সহযোগে। শরবত মেয়েলি পানীয় হতে পারে, কিন্তু চা তো দেখেছি আপনি ঘন ঘন খান।’

‘ধুর মশাই, আপনার কাছে গেলে চা খাব কেন? অন্য জিনিস চাই।’

বিব্রত করেই আনন্দ। সত্যি সত্যি এসে হানা দেয়নি কোনও দিন শ্রীতমাকে বাড়িতে একা পেতে।

শ্রীতমার কবিতার বই হাতে পেয়ে ক্যাটকেটে তির্যক মন্তব্য করলেও একটা দায়সারা প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখে দিয়েছিল। সেটা কোথাও ছাপেনি, শংসাপত্রের মতো নিজেরই সংগ্রহে রাখতে হয়েছে। শ্রীতমার একখানা কবিতাও চেয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটি ক্ষুদ্র পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। সেটা চটপট ছেপে বেরোনোর পর ফোন করে বলে, ‘আপনার বইয়ের রিভিউ লেখা হল, কবিতা ছাপা হল, আমার তো কিছু প্রাপ্য হয়।’

চড়াক করে মাথায় রক্ত উঠলেও ইঙ্গিতটা উপেক্ষা করতে হল, উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে।

‘আপনার লেখা তো আমার পাঠানোর অপেক্ষা রাখে না। তবে আপনার বইয়ের রিভিউ আমাকে দিয়ে করাতে চাইলে করতে পারি।’

‘আপনার ভাষায় বলি, আমি হালুম করলাম। পাওনাটাও সেই মতো হয়।’

আর ন্যাকা সেজে থাকা সম্ভব নয়। পরের দিন দুপুরে একটা বার্তা পাঠায় মুঠোফোন থেকে, ‘আপনার সহযোগিতার দাম দিতে না পারায় আমি দুঃখিত।’

সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি কল। ঝাড়া পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে বক্তৃতা উপদেশের বন্যা। মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ যা করে, মনে ধান্দা নিয়ে নয়। সে যে রসিকতা করেছে সেগুলো আদি রসাত্মক হতে পারে কিন্তু তাতে নাকি যৗনতা নেই। কথাটার মাথা-মুণ্ড বোঝা গেল না। কিন্তু প্রশ্নও করল না শ্রীতমা। লোকটা দর্পিত ভাবে নিজের চরিত্রের সাফাই দিয়ে গেল– ‘সঙ্গ পেলাম না বলে অন্যদের মতো আপনার লেখা প্রকাশে ব্যাগড়াও দেব না। আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি কতই বা দূর? সেরকম মতলব থাকলে তো বাড়িতেই যেতে পারতাম। আপনাকে একা পাওয়া কি অসুবিধার ছিল?’… ইত্যাদি। শেষে যোগ করল, ‘কিন্তু ভেবে দেখুন আপনি যদি এটুকুও না নিতে পারেন, তা হলে লোকে আপনার জন্য করবে কেন?’

অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়ে সেদিন আমতা আমতা করে গিয়েছে শ্রীতমা। ঘণিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েও এমন কথা ঘোরাল যেন শ্রীতমার চিন্তাটাই অপরিচ্ছন্ন। জবাব খুঁজে না পাওয়ার পেছনে কি এই ভয়টাও কাজ করেছিল, প্রভাব খাটিয়ে যদি শ্রীতমার সদ্য তৈরি হওয়া লেখার জায়গাগুলো নষ্ট করে দেয়? ফোন রাখার পর জুতসই জবাবটা মনে মনে সাজানো গেল, ‘আপনার অশালীন রসিকতা বরদাস্ত করে আমায় এগোতে হবে না, নিজের কলমের জোরেই যত দূর পারি যাব।’ আগেও বলবে ভেবেছিল,বলেনি। এবারেও শুনেই গেল। একতরফা।

এর কদিন পরেই তার বন্ধুটি পুজো সংখ্যার জন্য কবিতা নয়, ঐ বড়োসড়ো গল্পটা যাকে নভেলেটও বলা যায়, নিয়ে গিয়েছিল। পুজোর আগে পর্যন্ত ফোন করলে বলেছে, ‘আপনার কপি আপনার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব।’ কিন্তু পরে যখন অন্য সূত্রে শ্রীতমা পত্রিকাটির শারদ-সংখ্যা প্রকাশের খবর পেল, তখন অমল চক্রবর্তী ফোনের টাওয়ার পাওয়া ছেড়ে দিল।’ ‘হ্যালো, হ্যালো। শুনতে পাচ্ছি না’ পরিব্রাজকের প্রধান সম্পাদককে ফোন করে প্রশ্ন করায় সে তো আকাশ থেকে পড়ল। এমন কোনও লেখা তাদের দফতরে জমাই পড়েনি। বিশুদ্ধ হাপিশ! অন্য কোথাও অন্য কোনও শিরোনামে, স্থান-কাল-পাত্র বদলে, লেখকের নাম বদলে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখা হয়নি। এর পেছনে তার চুম্বন রসিক বন্ধুর কোনও ইন্ধন ছিল কিনা সেটাও প্রমাণিত নয়।

তবে ব্যাপারটা শ্রীতমা, দেবপ্রিয়কে জানায়। মনে হয় দেবপ্রিয় একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। শ্রীতমাকে মডেল বা অভিনেত্রী হিসাবে না হলেও লেখিকা হিসাবে পথ খুলে দেওয়ার ব্যক্তিগত রাস্তাগুলো দেখছিল। অন্তত ব্যাপারটা শ্রীতমার কাছে এমনই। সেই সাথে শ্রীতমার প্রতি মানুষটার একটা আলগা ভালোলাগা যে কাজ করছে, সেটা টের পেলেও তেমন আপত্তিকর বলে মনে হয়নি। শ্রীতমাকে অপমান করেনি, ছুতোনাতায় গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেনি, রুঢ় ব্যবহারও করেনি। বস্তুত দেবপ্রিয় ফোন করলে শ্রীতমা খুশিই হয়। গলাটা বেশ আশ্বাস জাগানো।

‘হ্যালো। শ্রীতমা বলছি।’

‘আরে গুড মর্নিং। কী খবর বলুন?’

‘খবর নিতেই তো ফোন করা। ওই লেখাগুলোর কোনও গতি হয়েছে?’

‘সুখবরটা আমিই জানাতাম। তার আগেই আপনার ফোন এল। ‘পিঁপড়ের রানি’ গল্পটা বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিলাম। সুরেন্দ্র নস্কর নামে আমার এক বন্ধুরও লেখা পাঠিয়েছিলাম। ওরা সুরেন্দ্রর কবিতাটা নিয়ে খুঁতখুঁত করছে, কিন্তু আপনার গল্পটা পড়েই পছন্দ করেছে। তা দেখা কবে হচ্ছে?’

‘যবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাব।’

‘আরে, সুন্দরী নায়িকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটাই তো সৌভাগ্যের। কাল, না কাল একটা কাজ আছে, পরশু আসুন। আছেন কেমন বলুন। কেমন ঘুরলেন?’

‘আমার যে শনি-রবি ছাড়া বেরোনোর উপায় নেই। তাও চূর্ণীর বাবা অফিস গেলে হয়ে গেল। জানেন তো মা বাবাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মায়ের অ্যাক্সিডেন্টে হিপজয়েন্ট ভেঙে যায়। নড়াচড়া অসম্ভব। ট্রাভেল এজেন্টকে যা দেওয়া হয়েছে, তা তো ফেরত হলই না, কাশ্মীরের কোথাও কিছু না দেখে কাটরায় বাড়তি হোটেল ভাড়া গুণে ফেরার দিন পর্যন্ত বসে রইলাম। কী ভাবে যে একটা গাড়ি নিয়ে জম্মু এসে ফেরার ট্রেনে উঠেছি, তা ভাবলে এখনও অবাক লাগে…!’

‘কেন, বিকেলে কী অসুবিধা?’ লোকটা মায়ের অত বড়ো দুর্ঘটনার কথা শুনেও গ্রাহ্য করল না। শ্রীতমার কথা শেষ করতে না দিয়ে এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বলছে দেখা করতে!

‘দুপুর সোয়া দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে চূর্ণী স্কুল থেকে ফেরে। ওকে নাইয়ে খাইয়ে সব সারতে বিকেল সোয়া তিনটে ছাড়িয়ে যায়। মেয়েকে কার জিম্মা করে যাব? যাঁর দায়িত্বে রেখে বেরোতাম, তিনি তো নিজে পাশও ফিরতে পারছেন না। যতক্ষণ আয়া আছে, আছে। তারপর বাকি সময়টা আয়া তো আমিই। খড়দা থেকে বেহালা শখের বাজার– একটুখানি রাস্তা তো নয়। চূর্ণীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারি, কিন্তু ও টায়ার্ড থাকে। ওর কোনও কাজ হলে না হয় কষ্ট দেওয়া যেত। তিন চারটে ট্রান্সপোর্ট চেঞ্জ করে বেহালা যেতেই হয়তো ছ’টা বেজে যাবে। ফিরতে–’

‘আরে, বাচ্চা আনলে আপনার সাথে অভিসারটা হয় কী করে? আজ পর্যন্ত ঠিকমতো প্রেমালাপটাই তো হল না। চলে আসুন সময় করে।’

শ্রীতমা এবার হোঁচট খেল। ভদ্রলোক তাকে অনেকবার সুন্দরী বলেছে। চূর্ণী অর্থাৎ কাজু সম্পর্কেও প্রথম বার উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেখে যেহেতু কন্যার মডেলিং-এর উদ্দেশ্যেই যোগাযোগ, তাই রূপের প্রশংসাটা শংসাপত্র হিসাবেই নিয়েছে বরাবর। শ্রীতমাকে সংস্কার ত্যাগ করে তথাকথিত সাহসী হবার প্রস্তাব দিলেও ব্যবহারের মধ্যে এমন এক মার্জিত ভাব থাকে, যে অসভ্যতা মনে হয় না। আসলে মনে হলে চলবেও না। আলগোছে এড়িয়ে না চটিয়ে যদি সখ্যতা বজায় রাখা যায়। রূপের জন্য দরাজ সার্টিফিকেট দিলেও এবং একাধিক বিজ্ঞাপনের জন্য অফিসে ডেকে বিস্তর আলাপ আলোচনা করলেও আজ পর্যন্ত মা মেয়ে কাউকেই কাজ করায়নি। কেবল শ্রীতমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাগ্রহে কিনে নিয়েছিল প্রথম সাক্ষাতেই। সেই সূত্রেই পরিব্রাজক এবং জোচ্চুরি কাণ্ড।

চমক সামলে হেসে উঠল শ্রীতমা, ‘দূর মশাই, আমার প্রেমে পড়লে কি অমল চক্রবর্তীর মতো তস্করের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন? ভয়েস ওভার করার মতো মেল ভয়েস কি নেই বাজারে?’

‘অমলের সঙ্গে অনেকদিন পর কাল যোগাযোগ হল। ওই ফোন করেছিল।’

‘আমার গল্পটার খোঁজ নিয়েছেন?’

‘না, না। সেসব কথা হয়নি। সে এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানান ডক্যুমেন্ট্রিতে কমেন্ট্রি করে।’

‘বাঃ! চুরির পুরস্কার? ভালো। ওই যে ডোর বেল বাজছে। মেয়ে চলে এসেছে। দেখছেন, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে নীচেই নামা হয়নি। বেচারা ভারী ব্যাগ নিয়ে একাই উঠে এসেছে। ঠিক আছে…’

দরজা খুলে মেয়েকে ঢুকিয়ে নিল শ্রীতমা। ‘রাখছি এখন। চূর্ণীর জন্য কোনও অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে দেখুন না। মেয়েটাকে যে দেখে অটো-অটো করে। কিন্তু কোনও কাজই মেটিরিয়ালাইজ করছে না।’

‘ওকেও লাগবে আর একটা অ্যাডে। আগে আপনাকে কাস্ট করি। নেচার কিওরের অ্যাডে আপনাকে লাগতে পারে।’

‘আচ্ছা। ওকে খাওয়াতে হবে। পরে কথা হবে।’

‘আমি কল ব্যাক করব? ধরুন এক ঘণ্টা পরে?’

‘করুন। রাখছি। বাই।’

‘কার ফোন?’ মায়ের গলা। শোবার ঘর থেকে। এসি চালাতে হয়েছে বলে দরজা বন্ধ থাকার কথা। এখন দেখছে খোলা। বোধ হয় বাবা খুলে এসেছে।

সুন্দর মুখের জয় নাকি সর্বত্র। কিন্তু শ্রীতমার ক্ষেত্রে তো বিড়ম্বনা। ওর লেখা যারা পছন্দ করে অথবা যারা করে না, প্রায় সব পুরুষ কবি লেখকই, শ্রীতমা সৌন্দর্যের খাতিরে সুবিধা পাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। শ্রীতমার কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রায় নিঃশেষিত, সবটাই যদিও নিজে ফেরি করে। সেটা নাকি ওর মুখ দেখে, কবিতার গুণে নয়। এমন মন্তব্য কবি নির্মল সমাদ্দারের মতো বরিষ্ঠ মানুষেরও, যাঁর স্নেহ-ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক স্তাবক প্রতিপালিত। নির্মলকাকু যথেষ্ট সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গাত্রদাহ কীসের? ওঁর পারিষদবর্গ কুড়ি বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনে ঘষ্টেও বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে, নাকি শ্রীতমা কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখিয়ে হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে বলে? কোনও নামি বাণিজ্যিক পত্রিকায় গল্প বার হওয়ার কথা জানলেই অভিনন্দন জানাতে গিয়েও বেশির ভাগ কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বয়ং কবিতার বইয়ের প্রকাশকের মন্তব্য, ‘তোমার বই বি ডাবল ও কে – বুক দেখে বিক্রি হয়নি, হয়েছে বয় হ্রস্ব-উ ক – দেখে।’ মাথাটার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেও না বোঝার ভান করতে হয়।

শ্রীতমার হাবেভাবে মাঝেমাঝে একটু অপরিণত মনস্কতা ফুটে ওঠে। নিজেও বুঝতে পারে। কাউকে তোয়াজ করে না, বরং একটু অসহিষ্ণু, কিন্তু লেখার জন্য ব্যকুলতা গোপন থাকে না। এটাই কি অপমানের আমন্ত্রক? এ যাবৎ দেবপ্রিয় দামকে তো হিতৈষী বলেই মনে হয়েছে। হঠাৎ কথাবার্তায় এমন লাগাম ছাড়া ভাবগতিক? এর সাথেও সম্পর্ক টিঁকলে হয়। দেবপ্রিয় চেয়েছিল বলেই কয়েকটা লেখার ফোটোকপি দিয়ে এসেছিল, সেখান থেকেই একখানা ‘বাল্যবন্ধু’-তে প্রকাশিতব্য। গল্পটা সন্ধ্যাতারাতেও মনোনীত, কিন্তু কত বছর পরে ছাপবে কেউ জানে না। ‘বাল্যবন্ধু’ টাকা না দিলেও চটপট বার করে দেবে। এই অবস্থায় দেবপ্রিয়কে অসন্তুষ্ট না করাই মঙ্গল।

সারা দিন নানা কাজের ব্যস্ততা, রাতে আয়ার বদলে নাইট ডিউটি। ব্যস্ততার মধ্যেও খচ্খচানিটা বিঁধে রইল। রাত বারোটায় ফোন।

‘বলুন।’

‘বড্ড অসময়ে ফোন করলাম না? কথা বলা যাবে?’

‘এতক্ষণে আপনার এক ঘণ্টা হল? অসময় তো বটেই, বলুন।’

‘নাথিং স্পেসিফিক। ওই নেচার কিওরের অ্যাডটার ব্যাপারে আপনাকে একবার আসতে হবে। পেমেন্ট বেশি নয়। হাজার টাকা। ডাবিংও করতে হবে। ডায়ালগ আছে। ওরাই শিখিয়ে দেবে। এমন কিছু নয়। আপনার আবার উইক-ডে-তে প্রবলেম। একটু দুপুর করেও যদি আসতে পারতেন। ঠিক আছে শনিবারেই আসুন।’

‘বেশ কয়েকবার তো দেখলেন। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত মেটিরিয়ালাইজ করল না। আবার বেকার দৌড়াদৗড়ি না হয়। তাছাড়া শনিবার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে কয়েকজনকে লেখা দিতে হবে।’

‘কখন যাবেন?’

‘বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছোতে হবে।’

‘তার আগেই আমার সাথে দেখা করে যান না। কাজটা ফেলে রাখতে চাই না। আর আপনাকেও অনেক দিন দেখিনি।’

শ্রীতমা নিরুত্তর।

‘কিছু বলছেন না যে।’

‘শনিবার আসুক, দেখব।’

‘শনিবার তো কাজের কথা হবে। একটু অকাজের কথাও তো হওয়া দরকার। আমার তো আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করে। একটা ইনোসেন্স আর সেক্স অ্যাপিলের দারুণ কম্বিনেশন। আর এখন কাশ্মীর থেকে ফিরে কাশ্মীর কি কলি হয়েছেন কিনা দেখতে আরও ইচ্ছা করছে।’

‘আপনার কি মনে নেই যে আমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কাশ্মীর ঘোরাই হয়নি? তাছাড়া শর্মিলার তখন বয়স ছিল ষোলো সতেরো। আমি এখন চল্লিশ। এই ভুঁড়িদার চেহারা আপনার ফ্যান্টাসির সাথে মিলবে না।’

শ্রীতমা ওপাশে কোমরতলি ভাঙা মায়ের দিকে তাকাল। এখনও ঘুমোয়নি। মেয়েটাও দিদা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে উশখুশ করছে। ওর গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েই বিপত্তি। জানলাহীন বসার ঘরে উদ্ভব মশা তাড়ানো তরল জ্বালিয়ে শুয়ে আছে। এমনিতে মশারি ছাড়া শুতেই চায় না। ফ্ল্যাটের একমাত্র বাতানুকুল ঘরখানা শাশুড়ির জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে কষ্ট করছে। মাকে গাড়িতে তোলা নামানো ছাড়াও বাথরুম ইত্যাদির ব্যাপারেও যেভাবে শ্রীতমাকে সাহায্য করেছে, নিজের ছেলেও পারে না। কলকাতায় ফিরে অবধি তার বিশ্রাম নেই। গাড়ি অ্যাম্বুল্যান্স দৌড়াদৌড়ি তো আছেই, জটিল অপারেশনের অনেকটা খরচই আপাতত উদ্ভব দিয়েছে। মা-বাবা চিকিৎসা বিমার টাকা না পেলে ফেরত নেবে না পণ করে আছে। সারা দিন অফিস ডাক্তার ওষুধ-পত্র করে ফিরে এসে মেয়েকে নিয়ে বসে। তারপর বালিশে মাথা ঠেকাতেই ঘরের বাতাস ওর নাকের গর্জনে মন্দ্রিত হতে থাকে। মেয়ে বাবাকে পাশে না পেয়ে ঘুমোবে না বলে একদিন এই গরমের মধ্যেই বসার ঘরের সরু ডিভানে পাশে শুয়ে উদ্ভবকে সারা রাত এক কাতে রেখেছিল। আর শ্রীতমা!  অসুস্থ মাকে আর মেয়েকে পাশে নিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে মাঝরাতে পরপুরুষের সঙ্গে হেজাচ্ছে? কীসের জন্য? ক্যামেরার সামনে আসার তাগিদটা তো মরেই গেছে, তবু সুযোগ এলে না করতে পারে না বলে? নাকি তার লেখা কবিতা গল্পগুলো যাতে মাঝপথে হারিয়ে না যায়, সেই দুর্ভাবনায়? ওর তো এক্ষুনি ফোন কেটে দেওয়া উচিত। মায়ের নাক বিরতি দিয়ে ডাকছে। কাজু চুপচাপ শুয়ে। উদ্ভবের নাকের শব্দ মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। বসার ঘর থেকে আসা সেই আওয়াজ শ্রীতমাকে কিছুটা আশ্বস্তর সাথে অনেকটা অপরাধবোধে বিক্ষত করছে।

‘কোথায় ভুঁড়ি? ওটুকু না থাকলে তো আইটেম গার্লদের বাজার পড়ে যেত। ওই পেটের নাভিতে চুমু খাওয়াতেই তো মজা।’

‘হোয়াট? আর ইউ ড্রাংক?’ গলাটা চড়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত ঘষে গলা নামিয়ে আনল শ্রীতমা। ‘এরকম সর্বনেশে ইচ্ছা হলে তো আপনার সাথে দেখা করাই চলবে না। রাখছি।’

‘এতেই সর্বনাশ বললে কী করে হয়? একটু ইনহিবিশন ত্যাগ করে দেখুন, আপনারও ভালো লাগবে। আর আমি ড্রিংক করি না। যা বলছি পরিষ্কার মাথাতেই বলছি।’

‘পরে কথা হবে গুড নাইট।’

‘গুড নাইট। শনিবার আসার আগে ফোন করে নেবেন। দেখি বাল্যবন্ধু যদি ছাপায় তাহলে জানাব।’

বালিশের ফাঁকে চলভাষ ঢোকানোর পর মায়ের প্রশ্ন, ‘কার ফোন তপা?’

‘আমার কয়েকটা লেখা আছে এর কাছে। আসলে প্রযোজক। আবার হোটেলও আছে শঙ্করপুরে। এখনও পর্যন্ত তোমার নাতনিকে বা আমাকে কোনও কাজ দেয়নি। তবে কয়েকটা পত্রিকায় যোগাযোগ আছে। সেই সূত্রে আমার একটা ছোটোদের গল্প বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিল। শুনছি এ মাসেই বেরোবে।’

‘এত রাতে ফোন করে কী এত বকছিল?’

‘আমার মতো বেকার তো নয়। সারা দিন ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত। শুটিং-ফুটিংও থাকে। কখনও কখনও সারা রাতই হয়তো জেগে থাকতে হয়।’

মনটা আবার খচ্খচ্ করছে। লোকটা বলল শনিবার যাওয়ার আগে ফোন করতে। তাছাড়া আগে বলেছিল ‘বাল্যবন্ধু’-তে গল্প বেরোচ্ছেই। এখন ‘যদি’ যোগ করল কেন? এভাবে ‘গুড নাইট’ বলে ফোন কেটে দেওয়া কি ঠিক হল? মৃত্যুঞ্জয়ের উপদেশ মনে পড়ল। সামান্য রসিকতাও যদি না নিতে পারে তাহলে লোকে আনস্পোর্টিং ভেবে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেবে। দেবপ্রিয়র মতো একজন হিতৈষীর রসিকতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানানোটা কি ঠিক হল? নির্ঘাত রসিকতাই। লোকটার বউ আছে, ছেলে আছে। আর অমন ডাকসাইটে প্রযোজক চাইলেই অনেক অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে। হয়তো শ্রীতমার জন্য সত্যিই একটু কোমল জায়গা আছে, অমলের জোচ্চুরির জন্য একটা সংকোচবোধও আছে। কলকাতায় ফিরে এসে শ্রীতমাই তো ফোন করে জানল যে দেবপ্রিয় তার লেখা পাঠিয়েছে যেটা ছাপতেও চলেছে। লোকটা তো পাওনা গণ্ডার হিসাব বুঝে নিয়ে কাজটা করেনি। আজ সকালে শ্রীতমা ফোন না করলে এখন এতসব কথা হতোই না। প্রার্থী যদি তেজ দেখায়, তাহলে ‘নিশ্চিত’ প্রকাশিত হচ্ছেগুলো ‘যদি তবে’র গেরোয় পড়ে যাবে। মাথার বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে একটা ‘স্পোর্টিং’ বার্তা পাঠাল, ‘সর্বনেশে কথা শুনতে মন্দ লাগে না, যদি সেগুলো কথার জায়গাতেই থাকে।’

মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরতি দুটো বার্তা। টুংটাং টুংটাং। ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে, আমার আঙুলের আর ঠোঁটের আদর রইল ওই বুকে আর নাভিতে। যদি এসএমএস করার থাকে এক্খুনি করুন। সকালে ফোন সুইচ অন করার পর আর কারও চোখে পড়লে অসুবিধা আছে।’

কান-মাথা গরম হয়ে গেল। শ্রীতমার চলভাষ সারা রাত জাগ্রত থাকে। যা কোনওদিন করে না, তাই করল আজ– সুইচ অফ।

‘কাকে মেসেজ করলে মা?’ কাজু জেগে আছে!

সত্যিই কি শ্রীতমার এই লোকটার সাহায্য দরকার? সে ‘সন্ধ্যাতারা’য় যেসব গল্প ও ছড়া দিয়ে এসেছিল, সেগুলোর মধ্যে দুটো মনোনীত হবার চিঠি পেয়েছে জমা দেওয়ার এগারো মাস পরে। তার পরেও সাত মাস পেরোল। পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছে আরও অন্তত বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পটাও মনোনীত জানল তখন, যখন সেটা অন্যত্র প্রকাশ পেতে চলেছে। এখন সন্ধ্যাতারার ভরসায় বাল্যবন্ধু থেকে গল্পটা তুলেও নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্য মাত্রা ছাড়ানো, মুখোশ খোলা পুরুষটাকে টুইয়ে চলা? ছিঃ!

কিন্তু কিছু প্রাপ্তির জন্য একটু উদার হওয়ার অভিনয় কি খুব দোষের? গত দু বছরে এইভাবে শ্রীতমা অনেককেই শত্রু করেছে। তাদের ক্ষেত্রে সরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। তারা আগেই নিজেদের পাওনাটা আদায়ের তালে থাকত। দেবপ্রিয় কি একটু ব্যতিক্রম নয়? এই লোকটাকে যে ভালো মানুষ বলে শ্রীতমা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। একটা নির্ভরতাও তৈরি হচ্ছে। এই সময় সব কিছু একদিনের ফোনের বাচালতায় নষ্ট করে ফেলতে হবে? নিশ্চই দেবপ্রিয় দাম নিজের কাঁচা আবেগ দেখিয়ে ফেলার জন্য লজ্জিত হবে। হয়তো দেখা হলে ঘুণাক্ষরেও এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে না। ভিড়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজা পুরুষ যেমন আছে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার মতো ভদ্রলোক কি ও দেখেনি ট্রেনে বাসে? কিন্তু….?

মা বোধহয় এখনই বেডপ্যান চাইবে। নড়ছে। মেয়ে কচি হাতে গলায় বেড় দিয়ে গায়ে পা চাপিয়ে বলল, ‘মা, তুমি শুধু গল্প লিখে যাও। আমায় বলো না।’

সকাল বেলা আয়া আসার আগে যথারীতি মাকে বেডপ্যান দিতে হল। শ্রীতমা দু জোড়া একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাভস্ বারবার ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে। একটা ও নিজে পরে আর একটা যে আয়া আসে তাকে দেয়। আয়া থাকলে রান্নার মেয়ের খুব একটা দরকার পড়ে না। একটু হাতে হাতে সাহায্য করলে নিজেই চালিয়ে নিতে পারে। তবু পুরোনো রান্নার মহিলা এসে টুকি দেওয়ায় হাতছাড়া করবে না বলে তাকেও বহাল করেছে এই বিপুল খরচের মধ্যে। উদ্ভবই বলেছে।

সকালে বর বেরিয়ে যেতে কম্পিউটারে বসেছে শ্রীতমা লেখা নিয়ে। মাঝে কয়েকদিন খুব উঠে পড়ে লেগেছিল মেয়ের মডেলিং কেরিয়ার গড়বে বলে। নিজেরও ছবি পাঠিয়েছে কয়েক জায়গায়। কেউ ঘরোয়া ছবি চায়, তো কেউ পোর্টফোলিও। বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় এখন সে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। এখন ও লেখালিখি নিয়েই ভাবতে চায়। কিন্তু সেখানেও প্রতি পদক্ষেপে আপোস। মাঝারি পত্রিকাও ভাব করে যেন বিশাল কিছু। তারা কেউ লেখার শিরোনাম বদলে দেয় তো কেউ কবিতার পিণ্ডি চটকে প্রকাশ করে। কেউকেটা নয় বলে অপছন্দসই সম্পাদনাও মাথা পেতে নেয়। আর শ্রীতমার গল্পের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েও গৗরবদার যা মেজাজ। খোঁজ নিলেই বলেন, তাড়া থাকলে লেখা তুলে নাও।

শ্যামের বাঁশি। দেবপ্রিয় ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করছে।

‘তাহলে শনিবার আসছেন তো।’

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ফোনটা ড্রিম শেয়ার করছে না দেবপ্রিয় করছে?’

‘দু জনেই। কাজ তো আছেই। প্রেমটাও আছে।’

‘….আসলে আমি একটা ট্রাভেলগ লিখছি। সিকিম ভ্রমণের ওপর। কাশ্মীর দর্শন তো রসাতলে গেল। লেখাটা রবিবারের মধ্যে শেষ করতে হবে, মানে শনিবার বেরোলে অসুবিধা–’

‘আচ্ছা, আপনি লেখার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, না? আমায় দেখতে ইচ্ছা করে না? আর আপনি কমিট করাতেই কিন্তু অ্যাডটা নিয়ে এগিয়েছি।’

লোকটা নিজের টপিক থেকে সরছে না। একটু চুপ করে থেকে শ্রীতমা বলল, ‘যেতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না। কলেজ স্ট্রিটে যেতেই হবে।’

লেখার প্রবাহ ঝিমিয়ে গেল। যেচে বিপদ ডেকে আনছে না তো। উদ্ভবকে জানাতে হবে। একটা ছোটো পত্রিকায় শ্রীতমার খাতিরে দেবপ্রিয় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর উদ্ভব ঠাট্টা করেছিল, দেবপ্রিয় দামকে বিয়ে করলে তোমার বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু ইদানীং রাত বিরেতে ফোন এলে বিরক্তি চাপা থাকে না। এতদিন পরস্পরের অনুরাগী বা অনুরাগিনীদের নিয়ে দুজনে খোঁচাহীন নির্দোষ রসিকতাই করে এসেছে। মাঝে মাঝে শ্রীতমাই কপট সন্দহের ভান করে। বারো বছরের দাম্পত্যে কোনও দিন তৃতীয় ব্যক্তি বা সন্দেহের মতো বিষয় দানা বাঁধেনি। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি লিপ্সার অপরাধে কি সিনেমা সিরিয়ালে এই বহু ব্যবহূত ক্লিশে বিষয়টার অনুপ্রবেশ ঘটছে? শ্রীতমার একটাই জোরের জায়গা সে বরকে কিছুই গোপন করে না। নিজের পুরোনো কিছু একতরফা অন্ভুূতির কথা লুকোয়নি। কেউ বিরক্ত করলে তো নয়ই। কিন্তু কিছু পাবার আশায় এভাবে? ঠিক পাওয়ার আশাও নয়, যেহেতু একটু সহযোগিতা পেয়েছে তাই সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেও ভদ্রতায় বাধছে। নাঃ! পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরার খেলা ওর জন্য নয়।

মা কিচ্ছু খাচ্ছে না। শরীর ভয়ানক দুর্বল। অন্যের হাতের রান্না পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই অনশনে শরীর আরও বিগড়োলে কে দায়িত্ব নেবে? বাবা? থাক, তার কথা না বলাই ভালো। একেই সারাটা দিন অস্বস্তি আর উশখুশানির মধ্যে কাটছে। দুপুরে মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকাটা শ্রীতমার ভীষণ প্রিয় ব্যাপার। অনেক অশান্তি অতৃপ্তির উপশম ঘটে বুকের ওপর ছোট্ট হাতের স্পর্শে, পেটে তুলে দেওয়া আলতো পায়ের চাপে। আজ যে এতেও স্বস্তি হচ্ছে না। খানিকক্ষণ আদর করল। ঘাড়ে মুখ গুঁজে ‘বুজকু-বুজকু, মাম্মাম্ মাম্মাম্’ গন্ধ নিল। তবুও না।

বাড়ির যা অবস্থা দুই শোবার ঘর বিশিষ্ট ফ্ল্যাটে বরের সঙ্গে দুটো কথা বলারও অবকাশ ঘটছে না। ডাক্তার, ওষুধ, টেস্ট-রিপোর্ট, মেডিক্লেম, আয়া, ঝি, রাঁধুনি এসবের ফাঁকে কাজুর পড়া, ইউনিট টেস্ট, উদ্ভবের অফিসে আবার ট্রান্সফারের গুঞ্জন। বেশ হয় কলকাতার বাইরে বদলি হলে। যে নগরটিকে নিজের কেরিয়ার, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য একদা গন্তব্য আর বর্তমানে আশ্রয় করেছে, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। লেখালিখির জগতে সেরা রাজনীতিকরা বিরাজমান। পৃষ্ঠ দংশন, লেঙ্গি মারা, ঈর্ষা, হরেক কিসিমের নোংরামি। এসবের মধ্যে টিঁকে থাকার চামড়া বা কৗশল কোনওটাই শ্রীতমার নেই। আবার এমন বিরাট মাপের প্রতিভাও ও নয়, যে পর্বত সরিয়ে জায়গা করে নেবে। আর এত দৌড়েই বা কী হবে? পারবে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রাদের মতো বছরে ডজন ডজন গল্প, সাত আটখানা করে উপন্যাস, ছোটোদের গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে, যদি তেমন বরাত পায়ও? আসলে পারবে না ভাবলেই কান্না পায়।

উদ্ভব আজকাল শ্রীতমার দেহের ভাষা খেয়াল করে না। একটা ভালো মতো চটকাই মটকাই দিলেই পাগলি বউটা শান্ত হয়ে যায়, ভালো করেই জানে। তবু কেন যে না দেখার ভান করছে? আগে বউয়ের সামান্যতম ভাবান্তরও ওর নজর এড়াত না। কোনও দিন কোনও কথায় আহত হলে শ্রীতমা যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক, ও যে রাগ করে আছে এটা ইঙ্গিতেও প্রকাশ করতে হতো না। এখন ওর চূড়ান্ত অস্থিরতা, বিরক্তি কোনওটাই যেন চোখে পড়ছে না। উদ্ভবের মতো মানুষ বছরের পর বছর পারে নিস্পৃহ থাকতে। শ্রীতমা এগিয়ে না গেলে এমনটাই চলতে থাকবে কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই। ঘুমের মধ্যে কখনও স্ত্রী-র ঘনিষ্ঠ হবার অনীহা প্রকাশ পেলে মাসের পর মাস আর কাছে আসে না। এখন তো বাড়ি ভর্তি মানুষ। পালানোর অনেক পরিসর। কিন্তু শ্রীতমার যে আদর ছাড়াও আশ্রয় দরকার এই সংকটে।

উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে। মাকে আজকাল ডিভানে খানিকটা ঠেকের ব্যবস্থা করে দিলে সন্ধে বেলায় টিভি দেখতে পারে। বাবার দখলে রিমোট থাকে। তাই নিয়ে এক দিকে স্ত্রী আর এক দিকে নাতনিকে যুঝে চলে। গ্লোকোমা আক্রান্ত চোখ দিয়ে একটা মানুষ এত টিভিই বা দেখে কী করে, আর এত বই-ই বা পড়ে কী করে? শ্রীতমা বরকে ছোটো ঘরটায় ডাকল, ‘শোনো।’

‘কী?’

‘তুমি তো এখন আমার সাথে কথা বলার সময়ই পাও না। গলা ধরে এল।’

উদ্ভবের ভাবান্তর নেই।

‘ওই দেবপ্রিয় দাম। …এতদিন তো বেশ নিঃস্বার্থ হিতৈষীই মনে হচ্ছিল। এখন দুটো লেখা দুটো পত্রিকায় পাঠিয়েই গলার সুর বদলে গেছে। তাও তো রবিবারের ‘হট্টমেলা’ থেকে পরমার্থ সেনের কাছে ঠোক্বর খেয়ে তো ছড়াটা বাউন্সই করেছে। ‘বাল্যবন্ধু’-তে’ পাঠানো গল্পটাও এখন দেনা পাওনায় আটকে যেতে পারে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নেমে এল।

‘পৃথিবীতে একশো জনের মধ্যে নববইজন পুরুষ মেয়েদের একই রকম নজরে দেখে। তুমি যদি বোকা সেজে থাকো আমার কী করার আছে? তুমি কম্প্রোমাইজ করে লেখিকা হতে চাও না নিজের জোরে, সেটা নিজেই ঠিক করবে।’

‘একটা অ্যাডে কাস্ট করার কথাও বলছিল।’

‘তাহলে আর কী? যা ইচ্ছা করো। যে লোক রাত সাড়ে বারোটার সময় কোনও ভদ্রমহিলাকে ফোন করে গ্যাঁজায়, সে কী ধরনের মানুষ তা যদি তুমি এই চল্লিশ বছরেও না বোঝ, তাহলে কিছু বলার নেই।’

‘সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া ফিল্ম লাইনের লোক। সারা রাত জেগে থাকাটাও স্বাভাবিক।’

‘তাহলে আমায় প্রশ্ন করছ কেন?’

‘আর কাকে করব?’

‘আমার উত্তর তো আমি দিয়েই দিয়েছি। জাস্ট যোগাযোগ রাখবে না। নম্বরটাই ডিলিট করে দাও। ফোন এলে রিসিভ কোরো না।’

‘বলছিল এই জুনেই বাল্যবন্ধু-তে বেরোবে। অন্য দিকে ‘সন্ধ্যাতারা’য় লেখা জমা দেওয়ার এক বছর পর চিঠিতে কনফার্ম করার পরেও সাত মাস পেরিয়ে গেল। শুনছি পুজো পর্যন্ত সব সংখ্যা তৈরি। তারপর ভূত-স্পেশাল। কবে আমার গল্প বেরোবে কোনও ঠিক নেই। লিটল ম্যাগগুলোতেও দলাদলি। ‘দিনকাল’-এ যে আমার গল্প ছাপল অজস্র ভুল করে, সেন্টেন্সগুলো পর্যন্ত এলোমেলো করে দিয়ে গল্পের বারোটা বাজিয়ে। বড়ো পত্রিকা বলে ওরা চাইলেই আমি আবার লেখা দিতে এক পায়ে খাড়া– এটা কম্প্রোমাইজ নয়? তাই এই লোকটাকে চটাতে পারছি না। লেখার কয়েকটা জায়গা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইনফ্লুয়েন্শিয়াল…’

উদ্ভব উত্তর না দিয়ে স্নানঘরে চলে গেল।

শনিবার কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বাস ধরল। ট্রেন জার্নিটা ভিড়ের জন্য এড়াতেই চায়। তাছাড়া স্টেশনগুলোর চত্তরে বড়ো কটু গন্ধ। শহর ও শহরতলির সমস্ত রাস্তা ঘাটই অবশ্য পুরুষ মানুষের জল বিয়োগ ক্ষেত্র। এই গন্ধের জন্য হাঁটতে চলতে নাকে-মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে প্রাণায়াম করে যেতে হয়। সময় অনেক বেশি লাগলেও তাই বাসটাই ধরতে চায়। বেরোতে বেরোতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। এখন বেহালা যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ফোন।

‘আসছেন তো?’

‘দেরি হয়ে গেছে অনেক। সামনের সপ্তাহে না হয় উইক ডে দেখেই সময় করে যাব।’

‘নেচার কিওয়ের অ্যাডটাও তো ফাইনাল করা দরকার। পরের শনি নয়তো রবি শ্যুটিং। আজই ফাইনাল করে নিতাম।’

‘আ..চ্ছা। আমার কিন্তু দেরি হবে। আর যখন পৌঁছোব, তখন বসার সময় বেশি থাকবে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মিনিট পনেরো থেকে আধ ঘণ্টার ডিসকাশন।’

‘আপনার অ্যাড দেওয়া ‘ক্রমাগত’টাও অবশ্য সঙ্গে রয়েছে।’

‘ওটা এমন কিছু না। আপনি আসুন।’

দোনোমনো করে শ্যামবাজারে নেমে মেট্রো ধরল। কালীঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বদলে বা টানা বাস পেলে বেহালা শখের বাজার। আজ কফি হাউসে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। একটা পত্রিকা হাতে পাওয়ার কথা, আর দুটোতে লেখা দেওয়ার। আর শনিবার গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়। লেখার পরিসর বাড়তে পারে। নিছক আড্ডা মারতে যাওয়ার তাগিদ নেই। তাছাড়া ওই মাছের বাজারকে মাত দেওয়া শোরগোলে গলা তুলে কথা বলায় কোনও সুখ নেই। কেউ কেউ অবশ্য এজন্য শ্রীতমাকে ধান্দাবাজ ইঙ্গিত করে।

শখের বাজারে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয়। জেমস্ লং সরণি পেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গলির ভেতর হাঁটলে, তবে মহাশয়ের বাড়ি তথা দফতর। হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে বার্তা আসার শব্দ পেল। মোবাইল কোম্পানির বা অন্য কোনও প্রমোশনাল মেসেজ হতে পারে। দেখা হল না। জৈষ্ঠের আকাশে আলো ম্লান হয়নি তখনও। আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিটটাও ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করবে।

গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে দারোয়ানকে বলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হয়। অফিসের রিসেপশনের মতো জায়গাটা ফাঁকাই দেখেছে এযাবত। ভেতরের ঘরে বসে মালিক। দারোয়ান দোতলার অফিসের বাইরের ঘরে শ্রীতমাকে বসিয়ে তিনতলা গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘স্যার চান করছেন। এক ঘণ্টা বসতে হবে।’

পাঁচবার ফোন করে ডেকে এনে এ কী রসিকতা! ফোন বার করে দেখল রাস্তায় আসা মেসেজটা দেবপ্রিয়ই করেছে। সেটা না পড়ে অসহিষ্ণু ভাবে ফোন করল। দূর! বাথরুমে গেলে কি মোবাইল ধরতে পারবে? অবশ্য বাড়ির লোক ধরতে পারে। কাটতে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে পরিচিত গলা, ‘হ্যালো। কোথায়?’

‘আপনার অফিসে। কিন্তু আমাকে ডেকে আপনি এখন কী করছেন?’

‘স্নান করছি। মিনিট পনেরো কুড়ি বসুন।’

‘আমার তাড়া আছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’

লাইন কেটে মেসেজটা পড়ল। ‘আজ আমার আঙুল আর ঠোঁট– আদরে পাগল করে দেবে ঠিক তো?’

চড়াং! কাজের দোহাই দিয়ে ডেকে এনে বাথরুম থেকে পরনারীকে এই বার্তা? এরপর বসে থাকার একটাই অর্থ হয়। তরতর করে নীচে গিয়ে দারোয়ানকে বলল শ্রীতমা, ‘আমায় বেরিয়ে যেতে হবে। একটা বই আপনার স্যারের জন্য রেখে যাচ্ছি। এক টুকরো কাগজ দিতে পারবেন? চিঠি লিখে দিয়ে যাব।’

কাঁপা হাতে নোটপ্যাডের পাতায় লিখল, ‘দেবপ্রিয়বাবু, আজ আমার পক্ষে অপেক্ষা করা আর সম্ভব হল না। ‘ক্রমাগত’র কপি রেখে গেলাম। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এসএমএসটা আমার সঙ্গে রইল।’

এর আগের বার্তাগুলো মুছে ফেলেছে। এটাকে না মুছে একটা ফোল্ডারে সেভ করে রাখবে। ভাগ্যিস লোকটা স্নানে ঢুকেছে। উর্দ্ধ্বশ্বাসে ছুটল ডায়মন্ড হারবার রোডের দিকে। বড়ো রাস্তায় পৗঁছেই একটা ডাবের খোলায় হোঁচট খেয়ে সপাটে আছাড়। সর্বনাশ! বাড়ির এই অবস্থায় ওরও কিছু হলে আর দেখতে হবে না। বাঁ হাতের কবজির ষন্ত্রণায় প্রথমটায় খেয়াল করেনি তালুটাও সামান্য ছড়ে গেছে।

সাড়ে ছটা। এখন আর কফিহাউস নয়। সোজা বাড়ি। সামনে যে বাস এল তাতেই চড়ে পড়ল। শিয়ালদা যাচ্ছে। ভালোই।

বাসে পরের স্টপেই জায়গা পেল মহিলা সিটে। তবে জানলার দিকে নয়। বসতে না বসতেই আবার চলভাষে সুরধবনি। কাঁপা হাতে ফোন ধরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বলুন।’

‘কী বলি বলুন তো। কীভাবে স্যরি বলব?’

‘বলতে হবে না। শুধু বুঝুন বেকারদের সময়ও দামি। আর স্যরি যদি বলতেই হয়, আপনার মেসেজটার জন্য বলুন।’

‘মেসেজ মানে? ওহ্! হো হো হো! এই ব্যাপার? হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলেন? এতদিন তো…’

‘এতদিন কী? আপনার রসিকতাকে রসিকতা হিসাবেই দেখেছি।…’

‘এভাবে পৃথিবীর সাথে মানাবেন কী করে? সুমনের একটা গান আছে, …। আমার নিজেরও একটা কবিতা আছে, শুনবেন…’

‘…নিজের ই-ইল্লিসিট ইচ্ছাকে …র-র্যাশনালাইজ করার জন্য হাজারটা উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। আর নেচার কিওর অ্যাডটার জন্য বোধহয় আমাকে আর দরকার লাগবে না।’

‘ওটার জন্য তো আপনার সিলেকশন হয়েই আছে। আপনি এখন নিজে রাজি না থাকলে–’

‘প্রফেশনালি কাজ তো হবার নয়।’

‘আপনি চাইলেই হতে পারে।’

ছিছিঃ! শ্রীতমা এখনও লোকটার মুখের ওপর উচিত কথা না শুনিয়ে নিজেকে খেলো করে যাচ্ছে? নিজের লেখায় যে এত আপসহীন, এত সাহসী, এত অকপট, লেখাগুলোর প্রতি অপত্যস্নেহে সেই মানুষ এত দুর্বল? দেবপ্রিয় দামের কত বড়ো হাত?

‘চুপ করে আছেন যে?’

‘আপনার সঙ্গে এখনও কথা বলছি, ইজন্ট ইট স্ট্রেঞ্জ? সুরেন্দ্র নস্করের কাছেও কি একই এক্সপেক্টেশন রাখেন?’

কী জবাব এল বোঝা গেল না বাসের আওয়াজে। বোধহয় সুরেন্দ্র আর শ্রীতমা এক নয় সেটাই বোঝাতে চাইল।

‘ওই ভদ্রলোক আপনার বন্ধু। তিনি ভাগ্যবান। বিকজ ইউ আর নট আ গে আই থিংক। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলেন না। গিভ এ্যান্ড টেক চলে এল। আমি দেখতে ভালো, এটা কি আমার দোষ?’

‘ও হো হো হো। আচ্ছা, আপনি সুন্দর কে বলেছে? কতজন বলেছে?’

মনে হল সপাটে গালে চড় পড়ল। দাঁত চিপে বলল, ‘অনেকেই। আর একজন মিথ্যুক তো অনেকবার বলেছে।

আবার হাসি, উপদেশ। খেলো মেলোড্রামা ভরা স্থূল বার্তা পাঠিয়ে এখন এমন ভাবে হাসছে যেন শ্রীতমার মতো অপরিণত মেয়ে আর হয় না। এখনও কেন লোকটাকে বাজে বকার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে? কেন গল্প, উপন্যাসের নায়িকাদের মতো, সিদ্ধান্তহীনতায় না ভোগা ঋজু চরিত্রের মানুষের মতো কড়া কথা বলে ফোন কেটে দিতে পারছে না? অ্যাড ফিল্ম না বাল্যবন্ধু পত্রিকা? দুটোই তো গেল। নাকি নিজের বোকার মতো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার মরিয়া চেষ্টা, বন্ধুত্বের লোভ?

কথা যখন শেষ হল তখন খেয়াল করল, তার ডান কাঁধে ভর দিয়ে তার গোপন অঙ্গটিকে একরকম শ্রীতমার কাঁধে চেপে ধরে জুত করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীতমা ফোন কেটে সচকিত হতেই জানোয়ারটা ঝট্ করে সরে গেল।

‘ইতর কোথাকার! কেটে ফেলতে হয়! বাসে কী এমন ভিড় যে ঠিকভাবে দাঁড়ানো যায় না?’

ঘেন্নায় অপমানে উদ্গত অশ্রু সামলাতে গিয়ে গলা কন্কন্ করে উঠল। শ্রীতমা সত্যিই অপরিণত। তার বয়সি মহিলাদের সাথে বাসে ট্রেনে এমন বজ্জাতি করার সাহস চট্ করে দেখানো যায় না। ও একাই চেঁচিয়ে গেল। বাসে কেউ কিছু বলল না। কন্ডাক্টর বোবা।

দেবপ্রিয়র প্রতি আর কোনও বিদ্বেষ নেই। বাসের এই নরকের কীটটা দেবপ্রিয়র মতো বুকে পেটে চুমু খাওয়ার আবেদন করেনি। সুযোগ বুঝে নিজের নোংরা প্রত্যঙ্গটা ওর কাঁধে ঠেকিয়ে দিয়েছে। পোশাকের আবরণ সত্ত্বেও ঘেন্না আর রাগে গা রিরি করছে।

যে মানুষটা দু বছরের পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রীতমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, হয়তো মতলবই করেছিল, সে তো স্নান করে পরিষ্কার হয়ে তৈরি হচ্ছিল অভিসারের জন্য। নৈতিকতার খাতিরে তার কাছ থেকে সব সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে এসে ভাগ্যের কাছে কী প্রতিদান পেল?

অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাসের জানলা দিয়ে ভেসে আসা উন্মুক্ত পুরুষ ইউরিনালের গা গোলানো দূষিত গন্ধ নাকে মুখে ঝাপটা মারছে অনুমতির তোয়াক্বা না করে।

সময়ের স্রোতে

অভিকে গেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে মানস গাড়িতে উঠতে যাবে, গেট খুলে দৌড়ে এসে অভি মানসের হাত জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি যেও না বাবা, প্লিজ এখানেই থেকে যাও… তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না…।’

‘আসছে রবিবার তো আবার আসব অভি। প্রতিবারই তো আসি’, মানস অভির গালে আলতো টোকা দেয়।

‘না, তুমি অনেকদিন পর পর আসো। তোমার কথা খুব মনে হয় বাবা, বন্ধুরাও সব সময় তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। তুমি আমার স্কুলেও কখনও আসো না। অন্য বন্ধুদের বাবারা তো সবাই আসে… তাহলে তুুমি কেন আস না বাবা?’

মানস ওর আট বছরের ছেলের অজস্র প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। যে প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজেই ঠিকমতো জানে না মানস। ছেলেকে সেগুলোর উত্তর কীভাবে দেবে? মানস বুঝতে পারে না এইভাবে আর কতদিন ও ছেলের কাছে সব চেপে যেতে পারবে?

‘আমি আবার আসব অভি। তুমি তো খুব ভালো ছেলে সবকিছুই বোঝো। এরকম জেদ কোরো না। এখন লক্ষ্মী হয়ে উপরে যাও। আমি কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব। তখন আমরা খুব মজা করব।’

‘কিন্তু মজা কী করে হবে? মা তো ওখানে থাকবে না।’

‘অভি, এখন তুমি উপরে যাও। পরে আবার তোমার সঙ্গে কথা হবে। আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানস গেট খুলে অভিকে লিফটে ঢুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসল। একই শহরে থাকলেও দুটো বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই। তা-সত্ত্বেও প্রতি রবিবার মানস অভিকে নিয়ে কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরোয়।

মানস একটা বড়ো কোম্পনিতে বড়ো পদে রয়েছে ওর উপরে বড়ো দায়িত্ব ফলে কাজের ব্যস্ততার সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরও করতে হয় ওকে। দশ বছর আগে মধুমিতার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। বিয়েটা লাভ ম্যারেজই ছিল। একসঙ্গেই দুজনে এমবিএ পড়েছিল এবং প্রেমটা ওদের সেখান থেকেই। মিশুখে, সুন্দরী এবং ফ্যাশনেবল মধুমিতাকে দেখেই মানস ওর প্রেমে পড়ে। এমবিএ কমপ্লিট করার আগেই ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টে দুজনেই ভালো চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়েই দুজনে বাড়িতে পরস্পরের সম্পর্কে জানায়। দু’জনের বাড়ি থেকেই আনন্দের সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দিলে, কিছু দিনের মধ্যেই ওরা বিয়ে করে নেয়। দুজনেরই প্রথম পোস্টিং বেঙ্গালুরু। সুতরাং বিয়ের পর ওরা বেঙ্গালুরুতেই নতুন সংসার পাতে।

নতুন চাকরির ব্যস্ততা এবং নতুন বিয়ে, দিনগুলো যেন খুশির পাখায় ভর দিয়ে উড়তে থাকে। প্রথম বছরটা হইচই,আনন্দে কীভাবে কেটে যায় ওরা বুঝতেও পারে না। দ্বিতীয় বছরে না চাইতেও মধুমিতা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে যেটার জন্য ওরা স্বামী-স্ত্রী মানসিক ভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বাড়ির লোকেদের কাছে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে চাপে পড়ে ওরা পরিবার বাড়াতে রাজি হয়ে যায়।

মধুমিতাকে বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয় যেটার জন্য ও একেবারেই তৈরি ছিল না। মানস ওকে বোঝায় যে বাচ্চা একটু বড়ো হয়ে গেলেই ও আবার চাকরি জয়েন করতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা এবং বাড়ির দায়িত্ব এতটাই বেড়ে গেল যে, মধুমিতা চাকরি করতে যাওয়ার কথা চিন্তাতেই আনতে পারল না। এদিকে বাড়ির দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসেরও কোম্পানিতে পদোন্নতি হতে থাকল। ফলে কর্মক্ষেত্রে কাজের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেল।

দায়িত্ব বাড়তেই মানসের শুরু  হল দেরি করে বাড়ি ফেরা। মধুমিতার ধৈর্য প্রথম থেকেই একটু কম ছিল। তার উপর চাকরি ছাড়তে হয়েছিল বলে মনে মনে মানসের উপর একটা রাগও তৈরি হয়েছিল। সুতরাং মানসের অত্যধিক ব্যস্ততা মধুমিতার সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে লাগল সে। কথায় কথায় মানসের সঙ্গে ঝগড়া, রাগারাগি –এটা ওদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়াল। রোজই প্রায় মানস রাত করে বাড়ি ফিরত।

‘এই ভাবে আর কতদিন চলবে? আমি, অভি কি তোমার কেউ হই না? সংসারে এতটুকু সময় তুমি দাও না। আমাদের প্রতি তোমার কি কোনও দায়িত্ব নেই?’ মধুমিতার এই প্রশ্নের উত্তরে মানসও রাগ না দেখিয়ে চুপ থাকতে পারে না, ‘আমি কি দায়িত্ব পালন করছি না? তোমাদের জন্য এবার কি তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব?’ ক্লান্তিতে মানস চেয়ারে বসে পড়ে। রেগে থাকাতে, ক্লান্ত মানসের চোখের অভিব্যক্তি মধুমিতার চোখ এড়িয়ে যায়। ঝাঁঝালো স্বরে বলে, ‘এমন কী চাকরি তুমি করো? কতদিন হয়ে গেলো অভির সঙ্গে খেলা তো দূরে থাক, ঠিকমতো কথাও বলোনি। রাত্রে যখন বাড়িতে আসো ও তখন ঘুমিয়ে থাকে। আর সকালে যখন ও স্কুলে যাচ্ছে তখন তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ট্যুর-এ যাও। ফিরে একদিন দুদিন শহরে থাকো আবার অন্য ট্যুর-এ বেরিয়ে যাও। নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনও তুমি নরক বানিয়ে দিয়েছ।’

‘মধুমিতা, তুমিও তো প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতে…! সুতরাং প্রাইভেট কোম্পানির ব্যস্ততা তুমি ভালো মতোই বোঝো, তাহলে এরকম অবুঝের মতো কথা বলছ কেন? এমনি, এমনি তো এত উঁচু পদে পৌঁছোইনি… পরিশ্রম এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি বলেই কোম্পানি আমাকে ওই পদে বসিয়েছে। তোমাদের টাকাপয়সা, আরামের কোনও অভাব আমি রাখিনি… এই সবই তো আমার প্ররিশ্রমেরই ফল।’

‘এই আরাম, টাকাপয়সা আমরা চাই না মানস। আমারা তোমাকে চাই। তোমাকে আমাদের সময় দিতে হবে।’ মধুমিতার গলা ভেঙে আসে, ‘বাড়িতে এসেও তুমি ফোনে ব্যস্ত থাকো।ঞ্জআমার সঙ্গে কথা বলারও তোমার সময় হয় না।’

‘অফিসের কাজের জন্যই তো ফোন আসে। তোমার জন্য কি সেগুলোও অ্যাটেন্ড করা বন্ধ করে দেব?’

মানসের রাগের পারদ চড়তে থাকে।

‘কতদিন হয়ে গেছে, তোমার অফিসের ব্যস্ততার জন্য, আমরা কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যেতে পারি না, কাউকে আমাদের এখানেও ডাকতে পারি না। কোথাও বাইরে যাই না ছুটির দিনে তুমি ক্লান্ত হয়ে থাকো।’

‘তাই বলে, আমি কি তোমাকে সোশ্যাল হতে বাধা দিয়েছি? তুমি নিজের মেলামেশা বাড়াও না, কে মানা করেছে? ব্যস্ত থাকলে আজেবাজে ব্যাপারগুলোয় মন দেবার সময় পাবে না’, এই বলে মানস চেয়ার থেকে উঠে পড়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আহত সিংহীর মতো মধুমিতা নিজের মধ্যেই গুমরাতে থাকে।

এই কথাকাটাকাটি, ঝগড়ার পরিবেশই ধীরে-ধীরে মধুমিতা আর মানসের দাম্পত্যে বড়ো একটা ফাটল ধরাতে শুরু করল। বরং টুর থাকলেই মানস, মধুমিতার অনুপস্থিতিতে বাড়ির ঘটনাক্রমকে লজিক্যালি দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করত। মানস বুঝতে পারত, মধুমিতার তার প্রতি ক্ষোভ, নালিশ সম্পূর্ণ মিথ্যাও তো নয়। মনে মনে ঠিক করত, এবার বাড়ি ফিরে মধুমিতা আর অভিকে একটু বেশি সময় দেবে।

মানস শহরের বাইরে থাকলে মানসের অবস্থাটাও মধুমিতা বোঝার চেষ্টা করত। সত্যিই, লোকটা করবেটাই বা কী? কোম্পানির বড়ো পদ সামলাচ্ছে যখন, তখন সঙ্গে দায়িত্ব তো থাকবেই। সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে মানস…। কোথায় ওর ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করবে, তা নয়, উলটে ঝগড়া করেই সময় নষ্ট করে সে।

অথচ এই একই মানুষ দুটো যখন সামনাসামনি হয় তখন মনের এই ভাবনাগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। মানসের ব্যস্ততা স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কও প্রভাবিত ফেলতে শুরু করল। একে তো সময়ের অভাব, তার মধ্যে আবার ঝগড়া, কথাবন্ধ। মাস গড়িয়ে যেত, শারীরিক সম্পর্কটুকু রাখাও ওদের হয়ে উঠত না। দুজনেই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে একাকিত্ব বোধ করতে শুরু করল।

এই সমস্যা শুধু মানস আর মধুমিতারই নয়, আজকের বহু দম্পতির এই একই সমস্যা। দুজনের চাকরির ব্যস্তস্তা সঙ্গে অফিস আর বাড়ির দূরত্ব এতটাই যে, রোজ যাতায়াত করার কষ্ট এবং ক্লান্তি দূর করতে করতেই ছুটি শেষ, সঙ্গে অন্যান্য জরুরি কাজগুলো তো আছেই। ফলে ছেলে বা মেয়ে কেউই এখন বিয়ের দায়িত্ব নিতে চাইছে না অথবা বিয়ের পর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছে না। কারণ তারা জানে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর নিজের স্বাধীনতা এবং চাকরি ছাড়তে হতে পারে।

ধীরে ধীরে মানস আর মধুমিতার মৌখিক ঝগড়া ঠান্ডা লড়াইয়ে পরিণত হল। দুজনের মধ্যে কথা প্রায় হতো না বললেই হয়। হঠাৎ-ই একদিন মধুমিতা জানাল ও একটা চাকরি পেয়ে গেছে এবং অফিসের পাশেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়াও নিয়ে নিয়েছে। সেখানেই ও অভিকে সঙ্গে নিয়ে উঠে যাবে।

মানসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মধুমিতার প্রস্তাবে। মধুমিতাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর বলতে ইচ্ছে করছিল একলা চাকরি করে অভিকে ও কী করে মানুষ করবে, আর যদি একান্তই চাকরি করতে হয় তাহলে এখানে থেকেও তো অনায়াসেই সেটা করা যায়। কিন্তু মানসের আত্মাভিমান ওর গলা টিপে ধরল। যেখানে মধুমিতাকে নিয়ে ও এত চিন্তা করছে, সেখানে মানসকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ডিসিশন নিতে মধুমিতার তো এতটুকুও বাধল না। পরের দিনই অভিকে নিয়ে মধুমিতা ঘর ছাড়ল। দিনটা আজও মানস ভুলতে পারে না। দু’বছর প্রায় হতে চলল। ছয় বছরের অভি আজ আট বছরের হয়ে গেল। মানসের জীবন, চাকরি এবং এই দুটো বাড়ির দূরত্ব মাপতে মাপতেই বেশ কেটে যাচ্ছিল।

লাল বাতিতে গাড়ি ব্রেক কষতেই মানসের চিন্তা ভগ্ন হল। আর কত দিন এভাবে চালানো সম্ভব? মানস সব সময় চেষ্টা করত ওদের স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব যেন অভির উপর কোনওরকম প্রভাব না ফেলে। দুজনেরই ভালোবাসায় ও যেন বড়ো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু চাইলেও এটা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না।ঞ্জঅভির ব্যক্তিত্ব দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে এটা মানস খুব ভালো বুঝতে পারছিল। অভির জীবনে একটা শূন্যতাবোধ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

রাস্তার ভিড় অতিক্রম করে বাড়ি পৌঁছোতে মানসের অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। মনটা ভারাক্রান্ত লাগছিল। অভির অগুনতি প্রশ্নের কোনও উত্তর ওর কাছে ছিল না। মনে হল, অভি নিশ্চয়ই এই প্রশ্নগুলো ওর মা-কেও করে, মধুমিতার কাছে কি এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর আছে…? আর কতদিন এসব সহ্য করতে হবে?

মানস এবং মধুমিতার পরিবারের সকলে দুজনকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করে যাতে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সরিয়ে দুজনে একসঙ্গে আবার জীবন শুরু করে। কিন্তু দুজনেই নিজের নিজের জেদে অটল, কেউ এক চুলও জেদ ছাড়তে রাজি নয়। বিরক্ত হয়েই মানসের মা-বাবা ছেলের কাছে প্রস্তাব রাখেন, ‘সঙ্গে যদি থাকতেই না চাস তাহলে ডিভোর্স নিয়ে নে। জীবন আবার নতুন করে শুরু করার চিন্তাভাবনা কর।’

মানসের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে যায়। সত্যিই কি জীবনের একটা অধ্যায় এত সহজে শেষ করে ফেলা যায়? নতুন শুরু করার কথা ভাবাই যায় না। আজ ও লাইফে ব্যস্ত কিন্তু কালও কি এতটাই ব্যস্ত থাকবে ও? আর অভি? ওর কী হবে? অভির করা প্রশ্নগুলো ওর মাথায় ভিড় করে আসে। কী করবে ও? অনেকবার মনে হয়েছে মধুমিতা যেমন নিজের ইচ্ছেয় ঘর ছেড়েছিল একদিন হঠাৎই আবার ফিরে আসবে কিন্তু অপেক্ষা করে করে দুই বছর কাটতে চলল। মধুমিতা নিজে থেকে কোনওদিন ওকে ডেকে পাঠাল না। আর এখন তো একা থাকারই অভ্যাস হয়ে গেছে।

অভি বাড়িতে ঢুকেই সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কিছু ভালো লাগছিল না ওর। এতটুকু বয়সেই মনটা ওর যেন ক্লান্তিতে ভেঙে আসছিল। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কবে থেকে মা আর বাবা একসঙ্গে ওর সাথে থাকবে, এই অপেক্ষায় ও রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই রবিবার আসে। বাবাও আসে আর এসেই ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে চলে যায়। পছন্দের খাবার খাওয়ায়, জিনিসপত্রও কিনে দেয়। কিছু প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞেস করে এবং সন্ধেবেলায় আবার মা-র কাছে পৌঁছে দিয়ে, অন্য বাড়ি চলে যায়। সোমবার হলেই মায়ের অফিস আর ওর স্কুল। এইভাবেই সপ্তাহ কেটে গিয়ে আবার রবিবার আসে। এটাই অভির সারা সপ্তাহের রুটিন। ওর কিচ্ছু ভালো লাগে না। বাবার সঙ্গে থাকলে মায়ের জন্য মন খারাপ লাগে আর সারাটা সপ্তাহ বাবাকে অভি মিস করে খুব। সব সময়ই মনে হয় কেন মা-বাবা একসঙ্গে থাকতে পারে না?

মানসের সঙ্গে ঘুরে আসার পর এক ঝলক ছেলেকে দেখল মধুমিতা তারপর তার আর কোনও আওয়াজ না পেয়ে মধুমিতা রান্নাঘর থেকে ছেলের নাম ধরে হাঁক পাড়ল। না, কোনও শব্দ নেই! কী হল, চিন্তিত হল মধুমিতা। হাতটা মুছে নিয়ে অভির স্টাডিরুমে ঢুকল ও। ছেলেটা টেবিলে মাথা রেখে মুখটা ঢেকে রয়েছে। ঘরের আলোটা পর্যন্ত জ্বালায়নি।

ঘরের আলো জ্বালিয়ে মধুমিতা এসে অভির মাথায় হাত রাখল, ‘কী হল অভি? কেমন কাটল আজ সারাটা দিন?’

অভি উত্তর দিল না। টেবিল থেকে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

‘কী হল? মন খারাপ।’ ছেলের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে মধুমিতা জিজ্ঞেস করল।

‘কিছু হয়নি’, বলে অভি মায়ের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল।

‘চুপচাপ কেন বসে আছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে?’

‘না’, বলেই মধুমিতার হাত আঁকড়ে ধরে অভি, ‘মা, আমরা কেন বাবার সঙ্গে গিয়ে থাকতে পারি না? বলো না, কবে আমরা বাবার কাছে গিয়ে থাকব? চলো না আমরা বাবার কাছে গিয়ে থাকি।’

‘বাজে কথা শুনতে ভালো লাগে না অভি’, মধুমিতার কোমল কণ্ঠস্বর হঠাৎই রুক্ষ হয়ে ওঠে, ‘রাত হয়েছে, ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল স্কুল রয়েছে।’

‘আমি খাব না। আগে তুমি আমার কথার উত্তর দাও,’ অভি জেদ করতে থাকে।

‘বললাম না, ফালতু কথা শোনার আমার সময় নেই। আমরা এখানেই থাকব, খেয়ে শুয়ে পড়ো’, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় মধুমিতা।

অভি বসেই থাকে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই দুজনের কেউই জবাব দেয় না, বরং বকে ওকে থামিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করে। অভি কী করবে বুঝে পায় না।

কাজ শেষ করে মধুমিতা শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল, অভি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর কচি মুখটা দেখে মধুমিতার মনে হল কোলে টেনে নিয়ে অজস্র চুম্বনে ভরে দেবে ওর ছোট্ট মুখটা। নিজেকে সংযত করল ও। ঘুম ভেঙে যাবে ছেলেটার। বড্ড প্রশ্ন করে আজকাল অভি। সেই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর ওর জানা নেই। অভির শৈশবটা সত্যিই হাজার সমস্যায় ভরা। মধুমিতা উদ্দেশ্যহীন ভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাইছে, সিরিয়াসলি কখনও ও নিজেকে এবং অভিকে নিয়ে ভাবে না। জাস্ট এক একটা করে দিন কাটাচ্ছে? অভি ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। ওর শিশুসুলভ প্রশ্নগুলোই জেদের বশে কবে কঠোর হয়ে উঠবে কে বলতে পারে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মধুমিতা।

মানসের সঙ্গে জীবন কাটানো অসহনীয় হয়ে উঠেছিল ওর কাছে, কিন্তু ওকে ছেড়ে এসেও কি ভালো আছে ও? মধুমিতা মনে মনে ভাবে। ছেড়ে আসার সময় মনে হয়েছিল মানসকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার যাতে ওর জীবনে স্ত্রী-র গুরুত্ব ও উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত চলে আসাটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। প্রথম প্রথম মধুমিতা মানসের আসার অপেক্ষা করে থেকেছে। ওর মনে হতো, মানস নিশ্চয়ই একদিন এসে ওর রাগ ভাঙিয়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাবে। মধুমিতাও সব ভুলে গিয়ে মানসের সঙ্গে ফিরে যাবে। কিন্তু অপেক্ষা, অপেক্ষা হয়েই থেকে গেছে। মানসও আসেনি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আর মধুমিতাও ফিরে যেতে পারেনি মানসের কাছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূরত্বও বাড়তে থেকেছে। নিজের নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুজনেই। মাঝেমধ্যে শুধু অভির প্রশ্নগুলো মধুমিতাকে বাস্তবের সম্মুখীন হতে বাধ্য করত।

গতকালই মায়ের ফোন এসেছিল। সেই-ই একই কথা। মানসের কাছে ফিরে না গেলে ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু তো একটা ভাবা দরকার। মধুমিতা খুব ভালো করেই জানে মা, ভবিষ্যৎ মানে কী বোঝাতে চাইছেন। মানসকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসা। কিন্তু এটা বলা এবং করার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এতই কি সোজা পুরো ব্যাপারটা? অভির কী হবে? ও আর মানস দুজনেই যদি আলাদা করে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবে তাহলে দুজনের কাছেই অভির প্রেজেন্সটা অবাঞ্ছিত হয়ে উঠবে না? চিন্তাটা আসাতেই মধুমিতা শিউরে উঠে অভিকে নিজের কোলের কাছে টেনে আনে।

মধুমিতা অভির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। সত্যিই, ছোটো থেকেই ছেলেটার জীবনে সমস্যার শেষ নেই, মা-বাবার যৗথ ভালোবাসা ওর কপালে আজ পর্যন্ত জুটল না। এর উপর মধুমিতা নিজে আর ওর সমস্যা বাড়াতে একেবারে চায় না। অভির শরীরের ওম ধীরে ধীরে মধুমিতার চোখে তন্দ্রা এনে দিতে সাহায্য করে। আজ কেন জানি না মধুমিতার মনে হল ওর মনের ভিতর জমে থাকা বরফটা সামান্য হলেও গলতে শুরু করেছে। যেগুলো মেনে নিতে আগে কিছুতেই মন চাইত না আজ সেগুলো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। সমস্যাগুলো রয়েই গেছে মধুমিতার জীবনে তবুও ওর মনে হল, সমস্যাগুলোকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে ওর। ও নিজের মন-কে বোঝার চেষ্টা করে। ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেই টের পায় না মধুমিতা।

সকালে অভি আবার স্বাভাবিক। কিছু কিছু জিনিস যে ওর জীবনে বদলাবার নয় সেটা ও ভালোমতোই এতদিনে বুঝে গিয়েছিল।

স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল অভি। অভিকে স্কুলে পাঠিয়ে মধুমিতাও নিজের অফিস এসে পৌঁছোল। রোজকার মতোই একটা দিন, কিন্তু মনের ভিতর সন্তুষ্টি অনুভব করছিল মধুমিতা। সারাটা সপ্তাহ ব্যস্ততার মধ্যেই ওদের কেটে গেল। আবার এসে গেল রবিবারের পালা।

মানস যথারীতি মধুমিতার ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে ফোন করে নিয়ম মতো অভিকে ডেকে পাঠাল। কিন্তু প্রতি রবিবরের মতো অভি একা নামল না, মধুমিতাও এল ওর সঙ্গে যেটাতে শুধু মানস-ই নয় অভিও খুবই অশ্চর্য হল।

মানস লক্ষ করল, মধুমিতার চেহারায় লাবণ্য যেন অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে। কঠোরতাটা অনেক কম। একলা লড়াই চালাতে চালাতে সৌন্দর্য কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছে। তিনজন সামনাসামনি হলেও কারও মুখে কোনও শব্দ জোগাল না। মনের মধ্যে নানা কথা ভিড় করে আসছিল কিন্তু বলার ভাষা জোগাতে পারল না কেউই।

‘অভি চলো’, মানসই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। মধুমিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মধুমিতা চোখ নামিয়ে নিল। মানসের মনে হল মধুমিতা কিছু বলতে চায় কিন্তু ওর দিক থেকে কোনও কথা না আসায় মানস অভির হাত ধরে গাড়িতে ওঠার উপক্রম করতেই পিছন থেকে মধুমিতার কণ্ঠস্বর কানে এল, ‘মানস’। মানসের মনে হল একটা যুগ পার করে মধুমিতার গলায় নিজের নামটা ও শুনল। ‘কাল অভির স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং আছে। তুমি যদি একটু সময় বার করে আসতে পার অভির খুব ভালো লাগবে।’

মানসের ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু ও উত্তর দিল, ‘আমার সময় হবে না… কাল টুরে বেরিয়ে যাব আমি।’ উত্তর দিয়েই পালটা জবাবের জন্য প্রতীক্ষা না করে মানস ড্রাইভার সিটে উঠে বসল।

মধুমিতা নিজের জায়গায় পাথর  হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। মন চাইছিল মানসের নাম ধরে আর একবার ডাকার কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ততক্ষণে মানস গাড়ি স্টার্ট করে দিয়েছে। সম্পর্কের বরফ গলাবার চেষ্টা করাটা ব্যর্থ হয়ে গেল মধুমিতার। মানসের, মুখের উপর ‘না’ বলে দেওয়ার ভয়েই মধুমিতা সম্পর্কের এই বরফ গলাবার চেষ্টা করতেই বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে। ক্লান্ত পায়ে মধুমিতা লিফটের দিকে পা বাড়ায়।

সন্ধেবেলায় অভি বাড়ি আসতে প্রত্যেকবারের মতো মধুমিতা এবারে ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। অভিও সারাদিন  কী করল– না করল কিছুই মধুমিতাকে বলল না, কারণ বলার মতো কিছুই ছিল না। পুরোটা দিন দুজনের মধ্যে কথা প্রায়ই হয়নি। নিজের নিজের চিন্তাতেই দুজনে বিভোর ছিল। অভি একবারও মানসকে স্কুলে পেরেন্টটিচার মিটিং-এ আসার জন্য বায়না করেনি।

অভিকে ছেড়ে বাড়িতে আসার পর মধুমিতার মুখটাই মানসের খালি মনে পড়ছিল। স্কুলের জন্য ‘না’ বলে দেওয়াতে মধুমিতার চোখে যে ব্যথার ঝলক মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল, সেটা আর কেউ না হলেও মানসের চোখ এড়ায়নি। অভিও, একবার ওকে স্কুলে আসার জন্য বায়না করেনি। হয়তো অভিও ওর কাছ থেকে উত্তর আশা করাই ছেড়ে দিয়েছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই বাইরের পোশাক ছেড়ে মানস বিছানায় গা এলিয়ে দিল। খাওয়ার ইচ্ছে হল না কিছুতেই।

পরের দিন মধুমিতা অভিকে সঙ্গে নিয়ে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছে গেল। ক্লাসরুমের দিকে যেতে গিয়ে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। করিডরে মানস ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অভি ছুট্টে গিয়ে মানসকে জড়িয়ে ধরল।

অভির আনন্দ দেখে মানস আর মধুমিতা দুজনেরই চোখে জল এসে গেল। মধুমিতা ওদের দুজনের কাছে আর একটু ঘন হয়ে সরে এল। ওর মুখও প্রসন্ন হাসিতে ভরে যায়। ‘থ্যাংকস, মানস… তোমাকে দেখে অভি প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। আমরা ভাবতেই পারিনি তুমি…’

পেরেন্ট-টিচার মিটিং শেষ হতেই বাইরে এসে অভি বন্ধুদের সঙ্গে মানসের আলাপ করাতে শুরু করল। ওর আনন্দ দেখে মানসেরও মনে হল ও স্কুলে এসে ঠিক কাজই করেছে।ঞ্জঅভিকে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে ছেড়ে দিয়ে মানস স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়াল। মধুমিতাও ওর পিছন পিছন স্কুলের বাইরে বেরিয়ে আসে।

মধুমিতাই প্রথম কথা শুরু করে, ‘এত খুশি হতে অভিকে আমি অনেক দিন দেখিনি মানস।’

‘হ্যাঁ, অভি এখনও বাচ্চা… সুতরাং ছোটো ছোটো জিনিসেই ও খুশি হয়ে ওঠে’, বলে আবার মানস চুপ হয়ে যায়। মধুমিতাও কথা খুঁজে পায় না। ‘ঠিক আছে… এবার আমি যাব। অভিকে বলে দিও আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল… রবিবার ওকে নিতে আসব’, কথা শেষ করে মানস যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

‘মানস’, অনুশোচনায় মধুমিতার গলা বুজে আসে, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

‘হ্যাঁ, করো।  কী জিজ্ঞেস করতে চাও?’

মানসের কণ্ঠস্বরে প্রশ্রয় অনুভব করে মধুমিতার ইচ্ছে হচ্ছিল দুই বছরের জমে থাকা চোখের জল বইয়ে দেয় মানসের কাঁধে মাথা রেখে। নিজেকে সংযত করল ও, ‘আচ্ছা মানস, এই দুই বছরে কখনও আমার অভাব বোধ করেছ? আমাদের ছাড়া তুমি জীবনে খুশি হতে পেরেছ? মধুমিতার স্বর খুব ক্লান্ত শোনাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কথাগুলো বলার জন্য ওর নিজের সঙ্গেই নিজেকে লড়তে হচ্ছে। অথচ বলে দেওয়ার পর ওর মনে হচ্ছিল বলাটা এতটাও কঠিন ছিল না। আগে কেন তাহলে কথাগুলো বলতে পারেনি ও? কথাগুলো বলে মধুমিতা, মানসের দিকে তাকাল, চেষ্টা করল ওর মুখের অভিব্যক্তিগুলো পড়ার।

‘আমার অভাব তুমি কখনও ফিল করেছ?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মানস জিজ্ঞেস করল।

মধুমিতা উত্তর দিল না। উত্তর না পেয়ে মানস বলল, ‘ছাড়ো এসব কথা… এখন ও সব কথা বলে কী লাভ? অনেক দেরি করে ফেলেছি দুজনেই।’

‘এখন না হয় দেরি হয়ে গেছে, আগেও তো তুমি কখনও আমাকে একবারও ডাকোনি’, ভিজে স্বরে মধুমিতা বলে।

‘আমি তোমাকে ডাকিনি ঠিকই কিন্তু আমি তোমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতেও বলিনি। তুমি নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ছেড়েছিলে, আবার নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ফিরেও আসতে পারতে, মানস বলে।

‘একবার তো ডাকতে পারতে। আমি ঠিক ফিরে আসতাম’, চোখের পাতা ভিজে আসে মধুমিতার।

‘তখন তোমাকে ডাকলেও তুমি ফিরতে না। ফেরারই যদি হতো তাহলে তুমি বাড়ি ছেড়ে যেতেই কেন? বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় শুধু নিজের কথা না ভেবে একবারও যদি অভির কথা চিন্তা করতে, তাহলে কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারতে না। আমাদের দুজনের জেদের বলি হতে চলেছে অভি। ওর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে বড়োদের ঝগড়ার মাঝে। আমরা ওকে কী দিতে পেরেছি? না নিজেরা আনন্দে আছি না সন্তানকে আনন্দে রাখতে পেরেছি’, বলে মানস নিজের চোখের জল লুকোতে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করে।

মুহূর্তে মধুমিতার মনে হয়, গিয়ে মানসের রাস্তা আটকে দাঁড়ায়, ওকে জড়িয়ে ধরে বলে যে ওর কাছে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই মানস গাড়ি স্টার্ট করে ট্র্যাফিকের সঙ্গে মিশে যায়। নিজের মন ঠিক করে নেয় মধুমিতা। অনেক দেরি করে ফেলেছে ও আত্মসম্মান বজায় রাখার নাম করে। কিন্তু আর নয়, দোষ যখন নিজে করেছে, শুধরোতেও নিজেকেই হবে। অভিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ও।

পরের দিন অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে মানস, নীচের কলিংবেলটা বেজে উঠল। এত সকাল সকাল কে এল ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতে নামল ও। দরজা খুলতেই দেখল, মধুমিতা আর অভি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

‘তোমরা!’ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না মানস।

‘ভেতরে আসতে বলবে না?’ মধুমিতা জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি নিজের বাড়ি এসেছ মধুমিতা আমি তোমার রাস্তা আটকাবার কে?’ মানস দরজার পাশে সরে দাঁড়াল। মধুমিতা আর অভি ভিতরে ঢুকে এল। মানস দরজা বন্ধ করতে করতে নিজের মনেই একটা প্রতিজ্ঞা করল, এবার আর ও নিজের খুশিকে দরজা দিয়ে কখনও বাইরে বার হয়ে যেতে দেবে না।

রুমাল

মাথা নীচু করে ক্লাসে ঢুকতেই শুনতে পেলাম একজন ক্লাসমেট-এর মন্তব্য— শালা ভিখারির বাচ্চাটা এসে গেছে।

আর একজনের কটূক্তি শব্দভেদী বানের মতো অতর্কিতে ছুটে এল আমার দিকে– ব্যাটার হিরো হওয়ার শখ একেবারে ঘুচে গেছে।

আমি ওদের কথায় কান না দিয়ে পাস কাটিয়ে লাস্টবেঞ্চের এক কোণে বসলাম। এখন শুধু কটূক্তি শোনার পালা, র্যালা মারার দিন আমার শেষ। আমি শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজারের মতো পরাজিত রোমান সম্রাট। আমার চারপাশে ব্রুটাসের দল আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে আছে। আমার পরাজয়েই তাদের সুখ। তাদের আনন্দ।

রাগে আমার গা রি রি করছে। অথচ কিছু করার নেই। ক্লাসের সমস্ত সিলিং ফ্যানগুলো ফুল স্পিডে চলা সত্ত্বেও আমার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। অথচ এটা গ্রীষ্মকাল নয়, ভরা শ্রাবণ। শরৎ আসতে আর দেরি নেই। এর মধ্যেই একটু ঠান্ডা ভাব এসে গেছে। ভোরের দিকে শীত শীত মনে হয়। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। ভোরের দিকে শিউলির গন্ধ টের পাই।

কী শীত কী গ্রীষ্ম, সব সময়েই আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরে। মনে হয় আমার শরীরে নুনের পরিমাণ একটু বেশি আছে। যাই হোক,

জিন্স-এর ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘাম মোছার জন্য রুমালটা বার করতে যেতেই শূন্য হাতটা উঠে এল। অর্থাৎ আমার রুমাল হাওয়া। বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সুগন্ধি লাল রুমালটা পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে যত্ন করে রেখেছিলাম। পকেটে এখনও সেন্টের গন্ধ ম-ম করছে। এই, এই একটা জিনিস পকেটে রাখতে কখনও ভুল করি না। ও আমার নিত্য সহচর। একান্ত আপন।

একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গার্ডেনে কলেজ থেকে কাট মেরে আমি আর নন্দিতা বসে গল্প করছিলাম। একবার গল্প শুরু হলে বাড়ি ফেরার কথা আমাদের মনেই থাকত না। হঠাৎ অস্তমিত সূর্যের কিরণ চোখে এসে পড়তেই নন্দিতা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল– এই রে দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চল বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়িতে বলেছি অনার্সের স্পেশাল ক্লাস আছে। দেরি হলেই মা চিন্তা করবে।

নন্দিতা সবুজ ঘাসের ওপর যে রুমালটা পেতে বসেছিল সেটা না নিয়েই উঠে পড়েছিল। আমি ওর অলক্ষ্যে সেই রুমালটা কুড়িয়ে পকেটে পুরেছিলাম। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক কুড়িয়ে পেয়েছি। ট্রেনে জানলার ধারে বসে গরমে ঘাম মুছতে গিয়ে তার মনে পড়েছিল রুমালটার কথা। মনে পড়া মাত্রই সে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, ‘এইরে ভিক্টোরিয়ার মাঠে রুমালটা ফেলে এসেছি।’

আমি আমার রুমালটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চাপাস্বরে বলেছিলাম, ‘ওটা আমার পকেটে আছে।’

–তা হলে তোরটা কেন, আমার রুমালটা দে।

–ওটা আর তোকে দেব না। তুই যখন আমার পাশে থাকবি না তখন এই রুমালটার সুগন্ধ তোর কথা আমায় মনে করিয়ে দেবে। তোর ঘামে ভেজা শরীরের সুগন্ধ ওই রুমালটার মধ্যেই খুঁজে পাব।

আমার কথা শুনে নন্দিতা বলেছিল, ‘রুমাল নিলে কিন্তু প্রেম টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়।’

বলেছিলাম, ‘সেই জন্যই তো এখন থেকে তোর একটা স্মৃতি নিয়ে রাখলাম।’

আমার বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় রুমালটা পকেটে রেখেছিলাম। সেটা কোথায় হারিয়েছি কে জানে। আজ যে এরকম অঘটন হবে বুঝতেই পারিনি। সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে।

আজ শনিবার। মনে হয় আজ আমার ওপর শনির কোপ পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যথারীতি মা তারার ফটোকে ভক্তি ভরে প্রণাম করেছি। তবে কোন পাপে আমার এই দশা হল। মনে করতে চেষ্টা করলাম আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত কী কী পাপ করেছি। যতদূর মনে পড়ে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। কাউকে কটু কথা বলিনি। এমনকী কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি। বরং শেওড়াফুলি স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের সামনে বসা ভিখারিকে আজ এক টাকার একটা কয়েন দিয়েছি। তাকে দেখলেই কেন জানি না আমার মৃত ঠাকুমার কথা মনে পড়ে। আমার ঠাকুমার মুখের সঙ্গে তার হুবহু মিল আছে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের বাড়ির মাকুন্দ নিতাইয়ের মুখ দেখেছি। লোকে বলে ওর মুখ দেখলেই নাকি দিনটা খারাপ যায়। হলও তাই। একটা অপয়া লোকের মুখ দেখার জন্যই আমার রুমাল হারিয়ে গেছে। রুমাল হারানোর কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ আমার মাথার বাঁদিকে মৃদু যন্ত্রণা শুরু হল। চোখে অন্ধকার দেখলাম। একটা অ্যানাসিন পেলে হতো। হাতের কাছে তা যখন নেই, তখন জলই খাওয়া ভালো। ফোলিও ব্যাগের চেনটা খুলে প্লাস্টিকের বোতল বার করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিলাম। তাতেও আমার যন্ত্রণা কমল না বরং বেড়ে গেল। যন্ত্রণাটা মাথার না মনের কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

আমার পাশে বসা সুনীতি ব্যানার্জী হঠাৎ বলে উঠল, ‘কিরে ভাস্কর তোর মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? কি হয়েছে তোর? এনিথিং রঙ?’

ওর কথা কানে ভেসে আসতেই আমার তন্ময়তা কাটল। আমি এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বুঝতেই পারিনি কখন ইংরেজির প্রফেসর পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে চলে গেছেন। কখন গুলতানি শুরু হয়েছে ক্লাসে।

বললাম, ‘জানিস আজ আমার রুমালটা হারিয়ে গেছে। ওটা আমার ভীষণ পয়া ছিল।’

ব্যস পাগলকে দিয়েছি সাঁকো নাড়া দিতে। সুনীতি আমার কথা শুনে ব্ল্যাক বোর্ডের কাছে গিয়ে গলা চড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলল, ‘লেডিজ এ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজ আমাদের ভাস্কর স্যান্যালের রুমাল হারিয়ে গেছে। ওর মন খারাপ। তাই ওর শোকাচ্ছন্ন মনের শান্তির জন্য এসো আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি।’

তার কথা শুনে ক্লাস শুদ্ধু সকলের সে কি হাসি। চন্দননগরের মেয়ে কস্তুরী সিন্হা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। আমার এখন ইচ্ছে করছে এক ঘুসি মেরে ওর বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দিতে। ও আগে বিধান কলেজে পড়ত। হঠাৎ কি খেয়াল হল ওখানে এক বছর পড়ে আমাদের কলেজে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অনেকের মুখে শুনেছি রিষড়ার বিধান কলেজের অনেক ছেলের মাথা খেয়ে আমাদের কলেজে ঢুকেছে। এক নম্বর ছেলেবাজ।

কস্তুরী আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই অনেকেরই চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে। চারটে বাজলেই যারা পালাই পালাই করত, তারা পাঁচটা পর্যন্ত কলেজে থাকে। আসলে কস্তুরীর মেয়েদের চাইতে ছেলে বন্ধু বেশি। কস্তুরী যেখানে ছেলেরাও সেখানে। এ যেন সেই চিটে গুড়। যেখানে রাজ্যের মাছি ভন ভন করে। অথচ কস্তুরীকে দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। খুবই সাধারণ। গায়ের রং কালো, মুখটা লম্বা মতন, চোখ দুটো বড়ো বড়ো। দেহে মেদের পরিমাণ বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একেবারে সাক্ষাৎ মা কালি। তবু কি আশ্চর্য সে আমাদের কলেজের অনেক ছেলের চোখে বিশ্ব সুন্দরী, মিস ইউনিভার্স। টিফিনের সময় ক্যান্টিনে গেলেই কলেজের ছেলেগুলো ওর সামনে মাছির মতো লেপটে থাকে।

ওদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায় কস্তুরীর পাশের চেয়ারে কে বসবে। পাশে বসলে কস্তুরীর শরীরের অল্প বিস্তর স্পর্শ সুখ ফাউ পাওয়া যায়। আমি ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভুলেও অংশগ্রহণ করি না। ওরা যখন অফ পিরিয়ডে খোশ মেজাজে গল্প করে আমি তখন এক কোণে বসে বাংলা অনার্সের রেফারেন্স বইয়ের ভেতর ডুবে থাকি। ওদের আলোচনার বিষয় হল পরচর্চা আর রাজনীতি যা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। আমি আসলে হই হট্টগোল পছন্দ করি না। তা ছাড়া যেখানে একজন মেয়ের সঙ্গ অনেকে কামনা করে, আমি তাদের থেকে সব সময় দূরে থাকি।

তবু চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে কস্তুরী যখন ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে আসে, আমার তখন বুকের মধ্যে ধুক-পুকুনি শুরু হয়। আমি তখন ইষ্টনাম জপ করতে থাকি। ক্লাসের ছেলেগুলো বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কস্তুরী ওদের যেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওদের জিনিসে ভাগ বসাব এমন ইচ্ছে আমার কখনও হয়নি। কস্তুরী যদি সেধে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে আমি কী করব?

একদিন লাইব্রেরি রুমে ও আমাকে বলেছিল, ‘তোমার গায়ে প্রেম প্রেম গন্ধ। তুমি অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে।’

বলেছিলাম, ‘প্রেমের আবার আলাদা গন্ধ আছে না কি?’

কস্তুরী বলেছিল, ‘তোমার কথাবার্তায়, চালচলনে তো অনুভব করা যায়। তা ছাড়া তুমি তো আমাদের পাত্তাই দাও না।’

বলেছিলাম, ‘ওটা তোমাদের ভুল ধারণা। তোমাদের সঙ্গে নিজেকে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। তা ছাড়া আমি একটু নির্জনতা পছন্দ করি।’

কস্তুরী তখন বলেছিল, ‘বলো কোন নির্জন জায়গায় তুমি যেতে চাও? জু গার্ডেন, মিলেনিয়াম পার্ক, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাট। যেখানে শুধু আমি আর তুমি সারাদিন মজা করে কাটাব।’

বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে। পরে ভেবে বলব।’

হঠাৎ রঙ্গমঞ্চে গদা হাতে ভীমের প্রবেশের মতো পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর এন দে, এসে হাজির। উনি সাধারণত ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসেন না। আজ হঠাৎ এসে গেলেন। ওকে ঢুকতে দেখে ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা হাসি বন্ধ করে ক্লাস নোটের খাতা খুলে বসল। ভয়ে কস্তুরীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল।

প্রফেসর এন দে তাঁর চেয়ারে বসে প্রথমেই বললেন, ‘আমি জানতে চাই তোমাদের হাসির কারণটা কি?’

শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আমাদের ভাস্কর স্যান্যাল

মা-আ-নে…’

প্রফেসর এন দে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার ভাস্কর।’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে বললাম, ‘স্যার আমার একটা রুমাল হারিয়ে গেছে। শুনে ওরা সবাই হাসছিল।’

আমার কথা শুনে ক্লাসের সকলকে উদ্দেশ্য করে এন দে বললেন, ‘মনে রেখো এটা কলেজ। ক্লাবঘর নয়। আর যেন কখনও এরকম না হয়। তোমাদের মনে রাখা উচিত পাশের ঘরে আর একটা ক্লাস চলছে। অসভ্যতা তোমাদের এখনও গেল না।’

কলেজ ছুটির পর মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। না ভালো লাগছে টিফিন খেতে, না ভালো লাগছে পার্ট টু-এর পড়া করতে। মাকে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে রাতে কিছু না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বারবার লাল রুমালটার কথা মনে পড়ল। নন্দিতার সব চিঠি পুড়িয়ে ফেললেও রুমালটা ফেলে দিতে পারিনি। লেডিস রুমালটা আমার রক্ত মাংস, মেদ মজ্জার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল। আজ সেটা হারিয়ে যেতে মনে হচ্ছে এত দিন নন্দিতার যে স্মৃতি উজবুকের মতো বয়ে বেড়িয়েছি, আজ তা থেকে মুক্তি পেলাম। স্বপ্নে দেখতে পেলাম নন্দিতার লাল রুমালটা রাজপথে অযত্নে পড়ে আছে। পথচারীরা রুমালটা মাড়িয়ে আমার প্রেমকে দুপায়ে থেঁতলে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ মাঝরাতে বাড়ির ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মিউজিক থামার পর ফোনটা ধরতেই ক্লাসমেট সুনীতি ব্যানার্জীর গলা ভেসে এল, ‘হ্যালো ভাস্কর সুখবর আছে।’

–সুখবর?

–হ্যাঁ, নন্দিতার সঙ্গে বলাই-এর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

–কেন ?

–বলাই এখন রীনার প্রেমে মেতেছে। বড়োলোকের প্রেম মানেই চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে ফেলে দেওয়া।

–খবরটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। গুড নাইট, বলে আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সোমবার প্রফেসর প্রতাপরঞ্জন হাজরার ক্লাস ছিল এগারোটায় কিন্তু আমি চলে এলাম পৌনে দশটায়। এত আগে আমার কলেজে আসার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি না আমি খানিকটা ঘোরের মধ্যে এক ঘন্টা আগে চলে এসেছি। ঘোরের মধ্যেই কখন জিন্স-এর ট্রাউজারের বদলে পাজামা পাঞ্জাবি পরেছি খেয়াল নেই। এই কেন-র উত্তর আমার জানা নেই। কে জানে কেন আজ সকাল হতেই একজনের মুখ আমার অবচেতন মনে ভেসে উঠেছিল। তাকে দেখার জন্যই কি আজ আমি সাত তাড়াতাড়ি কলেজে চলে এসেছি। কে জানে হয় তো তাই। কিন্তু যে আমাকে বিট্রে করেছে তার জন্য কেন এত ভেবে মরছি। ভালোবাসা কি এতই ঠুনকো।

যাইহোক সাত তাড়াতাড়ি যখন কলেজে এসেই পড়েছি তখন রেফারেন্স বই দেখে নোটটা লিখে ফেলা যাক। কারণ বইটা আর একদিন রাখলেই লাইব্রেরিতে আমাকে ফাইন দিতে হবে। এখনও কলেজে কোনও ছাত্র আসেনি। নিরিবিলিতে রেফারেন্স বই দেখে যতটা লেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একেবারে কোণের ক্লাস রুমের ভেজানো দরজা ঠেলতেই চোখ পড়ল লাস্ট বেঞ্চে কে যেন আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে দূর থেকে দেখা গেল বেঞ্চের নীচে গোলাপি ফলস্ পাড় ঝুলছে।

বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। অশরীরী প্রেতাত্মা নয় তো? দু’বছর আগে পার্ট ওয়ানের একজন ছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল বলে গলায় ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যে ঘরে সে আত্মহত্যা করেছিল আমি এখন সেই ঘরের দরজার সামনে একা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার নাম সুমনা রায়। শ্রীরামপুরে বাড়ি। খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল। অনেকেই নাকি সন্ধের পর তাকে তিন তলার ছাদে ঘুরতে দেখেছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগ, চুলে বিনুনি। দু’বছর আগে মারা গেলেও সে এখনও কোন্নগর হীরালাল পাল কলেজের মায়া ছাড়তে পারেনি।

আমি যে এক ছুটে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে যাব তার উপায় নেই। কে যেন আমার পায়ে পেরেক ঠুকে এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ নারী কণ্ঠের মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম। আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে দেখলাম নন্দিতা হাঁটু মুড়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। মাথার নীচে বইয়ের ব্যাগ। জল ভরা প্ল্যাস্টিকের বোতল রয়েছে পাশের বেঞ্চিতে। মেহগনি গাছের ফাঁক দিয়ে একফালি রোদ্দুর জানলা দিয়ে টপকে তার মেক-আপ করা মুখে এসে পড়েছে।

আমি তার যন্ত্রণা কাতর মুখটা দেখে বললাম, ‘এই তোর কি হয়েছে?’

আমাকে দেখে তার কাজল টানা চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। এর আগে নন্দিতাকে কলেজে অনর্গল কথা বলতে দেখেছি, হাসতে দেখেছি। কখনও এরকম কাঁদতে দেখিনি। কাঁদলেও যে তোকে কত মধুর লাগে তা এই প্রথম দেখলাম। সে চোখের জল মুছে বলল, আজ সকাল থেকে এ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথাটা হচ্ছে।

বললাম, ‘ডাক্তার দেখাসনি কেন?’

‘দেখিয়েছিলাম। পার্ট টু পরীক্ষা হলেই অপারেশন করতে হবে’, বলে নন্দিতা কপাল থেকে হাতটা সরাল।

হাতটা সরাতেই তার লাল কাচের চুড়ির শব্দে মল্লার রাগ বেজে উঠল। কোথা থেকে একটা পায়রা ডানা ঝাপটিয়ে ভেন্টিলেটারে গিয়ে বসল। মুখে মুখ লাগিয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে বকবকম শুরু করে দিল।

 

আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, ‘তোর পেটে একটু হাত বুলিয়ে দিই। দেখবি ভালো লাগবে।’

 

সে কোনও কথা না বলে শুধু তার পেটের কাছ থেকে শাড়ির অাঁচলটা সরিয়ে দিল। যন্ত্রণা কমানোর উদ্দেশ্যে আমি তার মাখনের মতো নরম ফরসা পেটে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘জানিস তোর রুমালটা কাল হারিয়ে গেছে।’

সে কথা শুনে নন্দিতা উঠে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘রুমাল হারিয়েছে তো কী হয়েছে? আমাকে তো পেয়েছিস।’

আমি কিছু বলার আগেই সে তার উষ্ণ চুম্বনে আমার ঠোঁট দুটো পুড়িয়ে দিল। ভুলিয়ে দিল রুমাল হারানোর কষ্টটা।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব