হার-জিত

রাত প্রায় বারোটা বাজে। রোজকার মতো প্রিয়া বইখাতা খুলে পড়াশোনায় ব্যস্ত। প্রিয়ার বাবা, সোমনাথ দরজায় এসে দাঁড়ালেন। ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলেন, এখনও পড়ছিস?

প্রিয়া না তাকিয়ে জবাব দিল, যা বলতে এসেছ বলে চলে যাও।

প্রিয়া জানত এত রাতে বাবা শুধু এখনও পড়ছিস, জিজ্ঞেস করতে ওর ঘরে আসেননি। অন্য কোনও কারণ আছে। কথা বলার আগে একটা ভূমিকা করা, প্রিয়ার একেবারে অপছন্দের। ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হল সে।

সোমনাথ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার ওকে ক্ষমা করে দে প্রিয়া…এমনিতেই ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

ক্ষমা, কখনও না, আমি ওকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না, অনেক কষ্টে প্রিয়া নিজের রাগ সংযত করে।

কিন্তু প্রিয়া ও তোর মা…

সোমনাথের কথাগুলো প্রিয়ার ভিতরে ঢুকে সজোরে ওকে ধাক্কা মারে, চেঁচিয়ে ওঠে সে। বাবা ওই মহিলা তোমার বউ হতে পারে কিন্তু আমার মা নয়। আর তাছাড়া মায়ের জায়গায় ওকে আমি কোনও দিনই বসাতে পারব না। কোনও শক্তিই আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিতে পারবে না।

কিন্তু প্রিয়া…

কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়া হাতের বইটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল, প্লিজ যাবে এখান থেকে? আমাকে একা ছেড়ে দাও।

মেয়ের রাগ দেখে সোমনাথ চলে গেলেন। প্রিয়া ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে লাগল। পনেরোয় পড়েছে প্রিয়া কিন্তু পরিস্থিতি ওকে বয়সের তুলনায় অনেকটাই বড়ো করে তুলেছে। রাগেতে চোখে জল চলে এল তার। হঠাৎই বাবার কথাগুলো তার মনে হল… ও আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুশিতে ভরে উঠল তার।

বাবার কথার সহজ মানেটা করে ফেলল প্রিয়া। তার মানে বাবার সঙ্গে ওই মহিলার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই কি বাবার এত মন খারাপ? বাবার থেকে মনটা সরিয়ে নিজের মনের মধ্যে ডুব দিল প্রিয়া। এতটা খুশি সে অনেকদিন বোধ করেনি।

পরের দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের ক্যান্টিনে নিয়ে গেল প্রিয়া। আজ ট্রিট আমার তরফ থেকে।

কেন রে, হঠাৎ এত খুশির কী হল? বন্ধুদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল।

ফাইনালি… ফাইনালি অ্যান্ড ফাইনালি আমার বাবার আর মণিকার ডিভোর্স হচ্ছে। মণিকা আমাদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে, উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল প্রিয়াকে।

সত্যি করেই মণিকাকে কখনও-ই প্রিয়া নিজের মায়ের আসনে বসাতে পারেনি। তাই মা বলা দূরে থাক বরাবরই নাম ধরেই ডেকে এসেছে। সোমনাথ মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাবার একটা কথাও কানে তোলেনি প্রিয়া।

চিন্তা ভঙ্গ হল রিয়ার ডাকে, এই কী ভাবছিস বল তো? আচ্ছা, তোর বাবা আর সৎমায়ের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়?

না তো!

বলতে বলতেই প্রিয়া আবার অতীতের দরজায় এসে দাঁড়াল। মনে পড়ে যখন ছোটো ছিল, মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া হতো। ওদের ঝগড়া দেখে প্রিয়া কাঁদতে থাকত। প্রিয়াকে কাঁদতে দেখে ঝগড়া ক্ষণকালের জন্য থেমে গেলেও, আবার শুরু হতো। ওদের ঝগড়ায বারবার প্রিয়ার নামটাও উঠে আসত। দুজনের একই অভিযোগ, অপরজনের জন্য নাকি প্রিয়ার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে। প্রিয়া চুপ করে থাকত কারণ মা-বাবার মধ্যে কাউকেই আলাদা করে বেছে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কখনও ঘুম ভেঙে গেলেও মৃতের মতো বিছানায় পড়ে থাকত। সে খুব ভালো ভাবে জানত, তাকে কাঁদতে দেখলে মা আর বাবা একে অপরকে দোষারোপ শুরু করবে। ক্রমশ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হতে আরম্ভ করল যে, মা-বাবা প্রিয়াকে আলাদা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

দুর্ভাগ্যের বিষয, সেখানেও প্রিয়া স্বস্তি পেত না। ওদের ঝগড়ার আওয়াজ প্রিয়ার ঘর পর্যন্ত চলে আসত। বালিশ দিয়ে কান চেপে ধরলেও লাভ হতো না। মনে মনে কামনা করত, সব যেন ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তার মনের আশা কখনও পূরণ হয়নি।

আজও ওই দিনটা প্রিয়া ভুলতে পারে না। ছয় বছর বয়স হবে তখন তার। মা তাকে একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরিয়ে খুব আদর করছিলেন। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল তাঁর চোখ-মুখ। কাঁদতে কাঁদতেই প্রিয়াকে কোলে বসিযে বললেন, প্রিয়া আমি কেস হেরে গেছি। তোমার বাবা তোমার কাস্টডি পেয়েছেন। আমাকে চলে যেতে হবে। বড়ো হও, আমি তখন যেমন করে হোক, আমার কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।

ব্যস, ওর মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিয়া বাবার সঙ্গে রয়ে গেল। প্রথম দুবছর বাবা মাসে একবার করে হলেও মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। মা, অবশ্য মাঝেমধ্যে প্রিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন আর কাঁদতেন। মায়ের কান্না প্রিয়ার কোমল মনটাকে ভেঙে চুরমার করে দিত। ফলে ইমোশনাল সাপোর্ট পেতে প্রিয়া নিজের বাবার উপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।

 

সেবার প্রিয়ার চতুর্থতম জন্মদিন পালিত হচ্ছিল। বাড়িতেই সোমনাথ সব ব্যবস্থা করেছিলেন ক্যাটেরার দিয়ে। অতিথিরা সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল। মণিকাকে প্রিয়া সেই প্রথম দ্যাখে। লক্ষ্য করে, বাবা একটু বেশিই হেসে হেসে কথা বলছেন মহিলাটির সঙ্গে। মহিলাটির সঙ্গে বাবাকে এতটা কথা বলতে দেখে, প্রথম দিনেই মণিকার প্রতি মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে যায় প্রিয়ার। অথচ মণিকার ছেলে অয়নের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার।

এর পর থেকে প্রায়দিনই মণিকা চলে আসত ওদের বাড়ি। যে সময়টা সোমনাথ মেয়ের সঙ্গে কাটাতেন, সেই সময়টার দখল নিল মণিকা। বাবাকে ওই মহিলার সঙ্গে দেখে প্রিয়ার মনের ভিতর আগুন জ্বলে উঠত। ওর খালি মনে হতো, বাবার পাশে বসার অধিকার শুধু তার আর মায়ের আছে। সেই অধিকার আর কেউ পেতে পারে না।

নানারকম ফন্দি আঁটত সে, কী করে মণিকাকে বাবার থেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু ওদের প্রেমের গভীরতা প্রিয়ার মতো ওইটুকু মেয়ে ফন্দিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত। কথাতেই আছে প্রেম অন্ধ। প্রিয়ার আজও মনে হয়, মণিকাকে বিয়ে করার সময় একবারের জন্যও বাবা তার কথা ভাবেননি।

বিয়ের পর মণিকার সঙ্গে ওর ছেলে অয়নও প্রিয়াদের বাড়িতেই থাকতে আরম্ভ করল। অয়নকে ছোটো ভাই হিসেবে স্বীকার করে নিলেও মণিকাকে সে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল না। আর না তো মা হিসেবে মেনে নিল।

প্রিয়ার মনে পড়ল বিয়ের পর মণিকা যখন প্রথমবার ওদের বাড়িতে পা রাখল, প্রিয়া ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, দুচোখে শুধু ঘৃণা নিয়ে ।মণিকা কিন্তু আদর করে ওকে কাছে টেনে নিয়েছিল। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল, প্রিয়া আমাদের জীবনটা একটা নদীর মতো। নদীর স্রোত কখনও পাথর ভেঙে নিজের রাস্তা তৈরি করে নেয় কখনও বা পাহাড় কেটে। আবার কখনও কাউকে আঘাত না করেই চুপচাপ নিজের গতিপথ বদলে নেয়। এর জন্য আমরা নদীকে দোষ দিতে পারি না। আমিও অনেকটা ওই নদীর মতোই। হঠাৎ তোমার জীবনে ঢুকে পড়েছি। আমি জানি তুমি আমাকে অপছন্দ করো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমরা এখন একটাই পরিবার। আমি চেষ্টা করব পরিবারটাকে যেন ভালো রাখতে পারি।

 

প্রিয়া, এই প্রিয়া কী অতশত ভাবছিস? রিয়ার ডাকে সংবিৎ ফিরল প্রিয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে আবার মেতে উঠল সে।

পরের চার-পাঁচদিন খুব আনন্দে কাটল প্রিয়ার। গান শোনা, আড্ডা মারা, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে দিল দিনগুলো। এই চার-পাঁচ দিনই মণিকা বা অয়ন কারওরই মুখোমুখি হতে হল না তাকে।

সপ্তাহ শেষে স্কুল ছুটি থাকায় বাড়িতে ছিল প্রিয়া। ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়েছিল  উঠে বাইরের ঘরে আসতেই দেখল অয়ন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। অয়নের কাছেই প্রিয়া জানতে পারল, মণিকা হাসপাতালে ভর্তি। জানার ইচ্ছা না থাকলেও সৌজন্য বজায় রাখতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মায়ের লাং ক্যান্সার। টার্মিনাল স্টেজ।

হোয়াট? চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়া। এখনই ধরা পড়ল আর এর মধ্যেই টার্মিনাল স্টেজ! কী করে সম্ভব?

প্রিয়ার চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। তাই দেখে অয়ন বলল, শুরুতে লাং-এই ক্যান্সার ধরা পড়েছিল কিন্তু এখন ব্রেনেও ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা শক খেল প্রিয়া। ঘটনার গতিপথ যে এরকম একটা মোড় নিতে পারে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। একটা ছোট্ট অপরাধবোধ গুঁড়ি মেরে যেন তার মনে জায়গা করে নিতে চাইছে। অয়নের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রিয়া বলল, অয়ন চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে নিজের ঘরে ফিরে এল প্রিয়া।

আজ বুঝতে পারছিল, কেন বাবা সেদিন বলেছিলেন মণিকার চলে যাওয়ার কথা। মণিকাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠল প্রিয়া। মনে পড়ল এক একদিন এমনও গেছে, মণিকা তার কাছে এসে কত অনুনয়বিনয় করেছে, ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রিয়াই পাষাণ হয়ে থেকেছে। অবশ্য তাতেও মণিকার দিক থেকে তার যত্নের কোনও কমতি কোনও দিনই হয়নি। মায়ের কর্তব্য মণিকা একনিষ্ঠ ভাবে পালন করে গেছে।

 

আজ মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে প্রিয়া বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আমি আজ তোমার সঙ্গে হাসপাতালে যাব মণিকাকে দেখতে। সন্ধেবেলায় হাসপাতালে গিয়ে মণিকার সঙ্গে দেখা হল না। মণিকাকে কাচের ঘরে রাখা হয়েছিল। সেখানে ভিজিটর যাওয়ার অনুমতি ছিল না।

মণিকাকে এভাবে কেন রাখা হয়েছে? প্রিয়া বাবাকে জিজ্ঞেস করল।

কেমো নেওয়ার পর মণিকার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায়, বুকে শুরুতেই সংক্রমণ হয়েছিল। তাই, ওকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারণ যাতে আর কোনও রকম সংক্রমণ না হয়।

কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে মণিকার শরীরের সঙ্গে লাগানো বিভিন্ন যন্ত্র ও নলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল প্রিয়া। মণিকা বাবার থেকে দূরে চলে যাবে এই স্বপ্নই দেখছিল এতদিন। কিন্তু এভাবে সেটা হোক, তা কখনওই চায়নি প্রিয়া। মণিকাকে মনে মনে সে ঘৃণা করত ঠিকই কিন্তু এতটাও ঘৃণা কখনও করেনি যে, মণিকাকে এই অবস্থায দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে।

আজ এইখানে মণিকার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রথমবার প্রিয়ার মনে হল একবার যদি সে মণিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পেত, তাহলে ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলত, মণিকা আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। প্রিয়ার চোখের জল বাঁধ মানে না।

বারবার প্রিয়ার মনে হতে থাকে, আজ এত বছর জিতে আসার পর মণিকার কাছে আজ সে সম্পূর্ণ হেরে গেছে। মণিকাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ডুবে যায় প্রিয়া। হঠাৎ করে বয়সের থেকে অনেকটাই বড়ো গেছে বলে মন হয় নিজেকে। উপলব্ধি করে, কোনও সম্পর্ক শেষ হওয়ার মূলে সবসময় যে অন্য কোনও নারীর হাত থাকে এই ধারণা ওর সম্পূর্ণ ভুল। ওর মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কটা ভাঙারই ছিল। তাহলে কেন ওর সবসময় মনে হয়েছে মণিকাই দোষী? প্রিয়ার নিজের কাছেও এর উত্তর অজানাই।

মণিকাও তো জানত সে প্রিয়ার নিজের মা নয়। তবুও সুখী পরিবার তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। সেই স্বপ্ন সত্যি করার লক্ষ্যে মণিকার দিক থেকে কোনও কমতি কোনও দিনও হয়নি। অথচ ওর সমস্ত চেষ্টা চালানোটাকে ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়েছে প্রিয়ার। আর সে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেওয়াকেই নিজের জয় বলে ধরে এসেছে প্রিয়া।

প্রতি বছরই একটু একটু করে বয়স বেড়েছে প্রিয়ার কিন্তু কেন জানি না এই সহজ সত্যটাকে দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে আর একটু সময় যদি ও হাতে পায়, তাহলে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। কিন্তু জীবন কী তাকে সেই সুযোগ দেবে? মনে মনে অস্থির হয় প্রিয়া।

এক সপ্তাহ কেমো আর রেডিয়েশন চলার জন্য মণিকাকে কাচের ঘরেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুধু প্রিয়া কেন, কারুরই ওর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল না।

এদিকে মণিকার অবস্থা শুধরোনোর বদলে আরও খারাপ হওয়া শুরু হল। ট্রিটমেন্ট কোনও কাজই করছিল না। রেডিয়েশনের জন্য সারা শরীরে জ্বলুনি অনুভব করছিল মণিকা। বাড়ির সকলে মণিকার জন্য উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিল। শুধু অপেক্ষা, কবে মণিকাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে। এছাড়া আর কোনও পথও খোলা ছিল না তাদের কাছে।

তাদের আশা অনুযায়ী মণিকাকে ওয়ার্ডে শিফ্ট করা হল না। অবস্থার অবণতি হওয়াতে এবং সোমনাথের বিশেষ চেনাশোনা থাকার কারণে হাসপাতালেই বিশেষ একটা কেবিনে আলাদা করে মণিকাকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার আর নার্সেরও ব্যবস্থা হল। সোমনাথ আর অয়ন হাসপাতালেই শিফট করে গেলেন যাতে পালা করে মণিকার দেখাশোনা করতে পারেন।

প্রিয়া কিছুতেই মণিকার সামনাসামনি হওয়ার সাহস জোটাতে পারল না। সে বাড়িতেই থেকে গেল। বাবার কাছ থেকে জানল, আর কিছু দিনের অতিথি মণিকা।

অনেক কষ্ট করে ভয় কাটিয়ে নিজের মনকে তৈরি করল প্রিয়া। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল মণিকার দুর্বল শরীরটা বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। চোখ জলে ভরে এল। তার দিকে মণিকার চোখ পড়তেই হাত তুলে কোনও রকমে ওকে কাছে ডাকল মণিকা। মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে সোমনাথ আর অয়ন কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মণিকা প্রিয়াকে ইশারা করল, তাকে খাটে বসিয়ে দিতে।

প্রিয়া ধীরে ধীরে বেডের হাতল ঘুরিয়ে বসানোর অবস্থায় নিয়ে এল। হাত দিয়ে ধরে থাকল মণিকাকে। মণিকা তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মনের ভিতর চলতে থাকা প্রতিটা সংঘর্ষ প্রিয়া চাইছিল মণিকার সঙ্গে শেযার করতে। কিন্তু হঠাৎ-ই ওর মনে হল মণিকা ওকে খুব জোরে ধরে রয়েছে। একটু চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ার খেযাল হল, মণিকা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মৃত্যু জিনিসটা যে কী, তা এর আগে কোনও দিন প্রিয়া দেখেনি। কিন্তু খারাপ কিছু আশঙ্কা করে প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ডক্টর… ডক্টর! ততক্ষণে মণিকা সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।

মণিকার মৃত্যুর পর সারা বাড়িটা যেন প্রিয়াকে গিলতে আসত। মা চলে যাওয়ার পরেও, এতটা একাকিত্ব কখনও বোধ করেনি প্রিয়া। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, শুধু বাড়িটাই নয়, ওর নিজের মনের অনেকটা জুড়েও মণিকা জায়গা দখল করে নিয়েছিল।

আত্মগ্লানিতে পুড়তে লাগল প্রিয়া। ইশ যদি সুযোগ পেত তাহলে মনের কথাটা মণিকাকে বলতে পারত! যেটা শোনার জন্য মণিকা এতটা অধীর হয়ে ছিল। আদৌ কি সে শুনতে পেত? মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে সত্যিই কি তার কথাটা কোনও গুরুত্ব পেত? প্রিয়া সবসময় শুনে এসেছে, সময় থেমে থাকে না। তাহলে কেন সে সময় থাকতে থাকতে নিজের মনের কথাটা খুলে বলতে পারল না?

নিজের উপরই ঘৃণা হল প্রিয়ার। অস্থির বোধ করল। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে মনে হল প্রিয়ার। ভিতর থেকে একটাই শব্দ ঠেলে বেরোতে চাইছে, মণিকা… মণিকা। চীৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে। স্বর বেরোচ্ছে না কিছুতেই প্রিয়ার গলা দিয়ে।আকাশে মেঘের ঘূর্ণায়মান গতিপথের দিকে চেয়ে সমস্ত শক্তি একত্র করে চ্যাঁচাল প্রিয়া, মণিকা প্লিজ… প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

কিন্তু খুব ভালো করেই জানে প্রিয়া, আজ মণিকা আর কোনও কথাই শুনবে না। আজ যে মণিকারই জয় হয়েছে।

ভাইরাল

বলছি আপনার প্রোফাইলটা একটু বলুন দিকি।

রায়বাবুর কথা শুনে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটা।

রায়বাবু তাড়া দিলেন, আচ্ছা লোক তো মশায় আপনি, প্রোফাইল বোঝেন না? মানে কী করেন? পলিটিকাল লিংক আছে কী না? মানে ধরুন মাঝামাঝি মানের নেতা হলেও চলবে। ভিআইপি-দের সাথে লিংক আছে? নিদেনপক্ষে ওনাদের সাথে কযেটা সেলফি, কিংবা কোনও এমএলএ বা মিনিস্টার রেকমেন্ডেশন?

লোকটা আবার চুপ।

রায়বাবু আর একটু ব্যাখ্যা করে বললেন, বলছি বিদেশ গেছেন কখনও? এনআরআই ছাপ আছে? বাড়ির কেউ বড়ো ডাক্তার বা নামকরা ইঞ্জিনিয়র আছেন? বা ধরুন কবি। মানে রিলেটিভে কি কোনও সেলিব্রিটি আছে?

লোকটা আবার চুপ। এবার রায়বাবু বিরক্ত।

আরে দূর মশাই আপনি কালা নাকি? আচ্ছা, ফেসবুক আইডি-টা বলুন, দেখি ভেরিফায়েড আইডি কিনা। লেখা শেযার করেন তো নাকি? তা ফ্যান ফলোয়ার কেমন আপনার? বলছি লাইক-টাইক পড়ে? শেযার হয় আপনার লেখা? কতগুলো পেজে লেখা বেরোয় আপনার? নিজের বন্ধু বান্ধবের ফলোয়ার আছে? কমেন্ট টমেন্ট পড়ে? ওই ম্যাগগুলোতে রেগুলার লেখেন তো না কী?

লোকটা আবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চুপ।

রায়বাবু বিরক্ত হয়ে হাঁক পাড়েন, কী রে কেষ্ট, যাকে তাকে অফিসে ঢোকাস কেন? যতসব সময় নষ্ট। দাদা আপনি আসুন, অনেক কাজ বাকি। আসুন তো মশাই।

লোকটা এবার আমতা আমতা করে বলল, মানে কোনও ভাবেই কী লেখা বের করা যাবে না?

রায়বাবু তাচ্ছিল্য করে বললেন, দূর মশাই আপনার তো কোনও প্রোফাইলই নেই। অচেনা লোকের লেখা লোক পড়বে কেন? চোখ ছোটো করে বললেন ৩০ হাজার দিতে পারবেন, ভাইরাল করে দেব আপনাকে।

লোকটা আবার চুপ।

 

লোকটা মানে আকাশ মুখার্জি। ১০ ফুট বাই ৯ ফুট-এর খুপরিতে ছেলে বউ নিয়ে অশান্তির সংসার। অশান্তিরই বললাম, এত অশান্তি আগে ছিল না, ভালোবাসার বিয়ে উদ্দাম আঠারোর আবেগের দিনে, আকাশের প্রায় সব কিছু ভালোলাগা নিয়ে ওর হাত ধরেছিল কুর্চি। কুর্চি নামটাও আকাশেরই দেওয়া। ছেলে বিতান আসার সময় পর্যন্ত সম্পর্কটা বেশ ছিল। তারপর অভাবের কালো হাঁ সব সম্পর্কগুলোকে কেমন যেন গিলে খেল। আকাশ গুণী ছিল কিনা সেটা কোনও দিন ভেবে দেখেনি কুর্চি। কিন্তু আকাশের সততা আর সারল্য কাছে টেনেছিল তাকে। আজ বিয়ের এত বছর পর কুর্চির মনে হয় কোথাও হয়তো একটা ভুল হয়ে গেছে। লোকটার সততা বা সারল্য-টা ভন্ডামি। আসলে লোকটা অলস আর ভীতু টাইপের। পরিবর্তনের নামে লোকটার গায়ে জ্বর আসে। সারাক্ষণ বইয়ে মুখে গুঁজে বসে থাকলে সংসার চলে না, এটা লোকটা বোঝে না। বিতানের মুখ চেযে চুপ থাকে। অন্য কেউ হলে কবে সংসার ছেড়ে চলে যেত। এখন কুর্চির একটাই স্বপ্ন বিতানটার কিছু একটা হোক।

অভাব যখন চাওয়া পাওয়ার থেকে কম হয়, তখন ভিখারীও রাজা হয় এই প্রবাদটা আকাশের জীবনের এক অমোঘ সত্যি। ছোটো থেকে অভাবের সংসার আকাশকে অতটা আঘাত দেয়নি যতটা আঘাত করত ওর না-পারা নিয়ে সমাজের পরিহাস। না, আকাশ কিচ্ছু পারত না। মানে যেগুলো পারলে সমাজ ওকে মনে রাখবে সেগুলোর প্রায় কিছুই আকাশ কোনও দিন পারেনি। আকাশ কোনও হোমড়াচোমড়া ক্লাবের মেম্বার ছিল না, না ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, না স্টেজ পারফর্মার। আর পড়াশোনা! টিউশন ছাড়া পাশ করে যেত কোনওরকমে। তবে আকাশ কবিতা লিখত, গল্প বুনত। যে-কবিতা কেউ পড়েনি, আকাশও কাউকে পড়ায়নি। সারাদিন ফ্যাক্টরির কালো ঘামে নিজেকে নিংড়ে যখন রাতের কালো হাতগুলো তাকে ভবিষ্যতের ভয় দেখাত, তখন আকাশ আর ওর লেখাগুলো, দিস্তাখাতায় জীবন্ত হয়ে জীবনের প্রতিটা বাস্তবকে কল্পনার চাদরে জড়িয়ে ওম দিত সুখের। কুর্চিকে নিয়ে লিখেছিল জীবনের প্রথম অনু কবিতা ইচ্ছে। ওর ব্যাগে চুপিচুপি ফেলেছিল চিরকুটটা,

ইচ্ছেটা ছিল সুযোগ হয়নি

এক থেকে মুহূর্তে একশো দেখার ইচ্ছে ছিল

এক থেকে দোকা হয়ে হারানোর ইচ্ছে ছিল

কাঁধে নির্ভরতা খোঁজার হাতকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল

মেঠো ধুলোয় নিজেকে ঝাপসা দেখার ইচ্ছে ছিল

পাহাড়ি রাস্তায় চুপিসারে বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে ছিল

পেট্রল পোড়া গন্ধে নিকোটিনের গন্ধ মেলানোর ইচ্ছে ছিল

ইচ্ছে কী জানে?

উত্তরটা কুর্চি দিয়েছিল। জীবনসঙ্গী হয়ে কী মধুরই না ছিল দিনগুলো। এখন সাধ্যগুলো সব একই আছে, ইচ্ছেটাই শুধু নেই। কুর্চিকেও দোষ দেয় না আকাশ, ব্যর্থ স্বামী নিয়ে সংসার করা সহজ নয়! আকাশেরও চাওয়া-পাওয়া কোনও দিন ছিল না, আজও নেই। শুধু দিস্তাখাতায় স্বপ্নগুলো বেড়েই চলত, পাতার পর পাতা, দিস্তার পর দিস্তা।

 

প্রিন্টিং প্রেসের মালিক যেদিন প্রুফ রিডার রায়বাবুকে কোরাল ড্র বা অ্যাডোব ফটোশপের কাজ শিখতে বলেছিল, সেদিনই মাথায় আকাশ ভেঙেছিল। সারা জীবন হাতে কালি লাগিয়ে কাজ করা আর বানান ভুল ধরা প্রিন্টিং-এর মানুষ রায়বাবু। দুম করে কম্পিউটার শেখা, তাও আবার যেগুলো কখনও নাম শোনেনি, সেগুলো শেখা অসম্ভব, রায়বাবু তা জানত। মারওয়াড়ি মালিক বলত, বেওসা চেঞ্জ হচ্ছে রায়বাবু। সোব কম্পুটারিজ হবে, না শিখলে আর আগে বাড়বে কী করে?

চাকরিটা হারাবে এটা জেনে আর পোযাতি বউটার ভবিষ্যৎ-এর চিন্তায় যখন বাজারে ফলিডলের খোঁজে রায়বাবু ব্যস্ত, তখন কেষ্টর সাথে আলাপ। কেষ্টর আসল নাম কী, কেউ জানে না। সবাই কেষ্ট দাস নামেই চেনে। লেখালিখি বলে একটা অনলাইন ফেক পাবলিকেশন চালায় বেনামে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতাল, প্রেমে ধোকা খাওয়া সাপ-ব্যাঙ-আগডুম-বাগডুম লেখাগুলোকে ফলস পাবলিসিটি দিয়ে লেখার রিচ বাড়ায়। তারপর শখের কবিদের লেখা বই করে ছাপাব বলে, হাজার হাজার টাকা ডোনেশন নেয়। ভালো ব্যাবসা। রায়বাবুকে পার্টনারশিপের কথা বলতেই, রায়বাবু রাজি। এখন দুজনের যৌথ ব্যাবসা। ইনভেস্টমেন্ট বলতে একটা অ্যান্ড্রোয়েড স্মার্ট ফোন, একটা কম্পিউটার, কয়েকশো ফেক সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট।

ফ্রাস্ট্রু খাওয়া হযবরল লেখাগুলোকে নিপুণ হাতে রায়বাবু বেছে নেন। কেষ্ট হাজারখানেক লাইক আর শেযার করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তারপর দম দেখে একদিন ফোন করে লেখক বা লেখিকাকে, সেটাও পোর্টফোলিও দেখে ডিমান্ড। ওনাদের টার্গেট ক্ষেত্র একটু অন্যরকম, বেশিরভাগই গৃহবধূ। যেমন বড়ো সরকারি নেতার বউ, ডাক্তারদের বউ, ইঞ্জিনিয়রদের বেকার বউ, সরকারি অফিসারদের বউ কিংবা এনআরআই-দের বউ।

শুধু গৃহবধূই নয়, আছে ফাস্ট্রেটেড যুবসমাজ, বাউন্ডুলে বড়োলোক আর তাদের সুপুত্ররা। প্রথমে ওনাদের প্রতিভার মেকি প্রশংসা তারপর ডিমান্ড। আর ডিমান্ড পেলেই একটা ভুলভাল প্রিন্টিং সেন্টার থেকে একটা বই। আর বই বেরোলেই হাজারটা ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েকশো শেয়ার। মালিক আর ক্লায়েনট দুজনেরই প্রফিট আর দুজনেই খুশ। মানে পুরো সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর লেখার মাফিয়া নেটওয়ার্ক, ফেলো কড়ি ছাপো লেখা, প্রতিভা কী আর দেখা যায়।

 

ডুবন্ত শিল্পরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ইউনিয়ন বাজিতে অনেকে ছাঁটাই হবার পরেও পুরোনো লোক হিসেবে আকাশকে রেখে দিয়েছিল কোম্পানি। শুধু ভালো কর্মীর জন্য নয়, এই ফ্যাক্টরির সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের লেখালেখির সব কাজ এতদিন আকাশই করে এসেছেন। সে ফ্যাক্টরির উদযাপন দিবস হোক বা শ্রমিকদের মে দিবস, লেবার ইউনিয়নের নেতা হোক বা কোম্পানির অবাঙালি ইঞ্জিনিয়র সবাই শুধু একবার বলে দিত আকাশদা কাল ভাষণ দিতে হবে, একটু লিখে দিও তো। ব্যস আকাশ নিজের ভঙ্গিতে সাবলীল ভাবে লিখে দিতেন। স্টেজে ওর লেখা অন্য কেউ পড়ে যখন হাততালিতে পুরো মঞ্চটা ভেসে যেত, তখন একবারও কেউ ওর নাম উচ্চারণ না করলেও আকাশ নিজের থেকেই খুশি হতো, এতদিন এটাই চলছিল।

এবারের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আকাশকে কেউ কিছু না বলায় খানিকটা অবাক হয়েছিল। অনুষ্ঠানের দিন শুনল ফ্যাক্টরির নতুন জয়েন করা এক ফিটার ওয়ার্কার, নাকি সব লেখালেখি করছে। প্রোডাকশনের জমাদারবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে জানল, নতুন ছেলেটা নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনসেশন। ইদানীং নাকি কী সব ব্যাপারে ভাইরাল হয়েছে। ফ্যান ফলোয়ারও নাকি অনেক। তাই এবার ম্যানেজারবাবু ওকে দাযিত্ব দিয়েছেন। এইসব অত্যাধুনিক ভাষাজ্ঞান বা উন্নত প্রযুক্তির কোনওটাই আকাশের কোনওদিন ছিল না। আর ইন্টারনেটটা এখনও গরিবের কাছে আলাদিনের প্রদীপ। আঘাতটা লেগেছিল। কুর্চিকে এগুলো বলেও লাভ নেই । বাড়ি ফিরে রাতের কালো অন্ধকারে চোখের জল লুকিয়ে বাঁধাই করা লেখাবোঝাই দিস্তাখাতাটা বুকে চেপেই শুয়ে পড়েছিল।

লেখালিখি পাবলিকেশন-এর খবরটা ফ্যাক্টরির নতুন ছেলেটাই আকাশকে দিয়েছিল। নিজে থেকেই এসে বলেছিল, কাকা তোমাদের ওই পুরোনো খাতা কলমে লেখা আর চলে না। আজকাল জো দিখতা হ্যায়, ওহি বিকতা হ্যায়। নতুন নতুন পেজে মিউজিক দিয়ে লেখা ইন্টারনেটে বেরোয় কাকা, পাবলিক ওটাই খায়। ঠিকানা নিয়ে বুকে সাহস করে কেষ্ট দাসের অফিসে এসে হাজির হয়েছিল আকাশ। যদি তার সারাজীবনের লেখাগুলো ইন্টারনেটে দেওয়া যায়। তারপর ওপরের ওই আলাপচারিতা। রায়বাবুর কাছ থেকে প্রশ্নগুলো শুনে বাড়ি ফেরার পথে কুর্চির জন্য প্রেশার-এর ওষুধটা একপাতা বেশি কিনল। সাথে একটা পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্প পেপার। ওদের যাতে উইল নিয়ে কোনও অসুবিধা না হয়।

 

আজ বিতান জয়েন করল। বাবা সুইসাইড করার পর মাকে নিয়ে দাঁত চেপে লড়ে আজ বিতান বড়ো সরকারি আধিকারিক। পুরোনো ঘর ভেঙে নতুন ঘর হয়েছে। বাবার দিস্তামার্কা খাতাটা এ পর্যন্ত কয়েক হাজারবার ওর পড়া। প্রায় সব লেখাগুলোই ওর মুখস্থ।

এই দিনটার জন্য বিতান অনেক দিন অপেক্ষা করেছে। এখন গভীর রাত। ফেসবুক প্রোফাইলে বিতান জব প্রোফাইলটা আপডেট দিল। সাথে দফতরের মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নেওয়া পোস্ট। তারপর দশ বছর ধরে অপেক্ষা করা দুটো ফ্রেন্ড রিকোয়েসট পাঠাল, একটা কেষ্ট দাস আর একটা রায়বাবুকে, সাথে লেখালিখি পেজে একটা মেসেজ,  অনেকগুলো লেখা ভাইরাল করতে চাই, যা লাগে দেব।

কেশকাঞ্চন

চুলের ব্যাবসা করবি?

প্রশ্ন শুনে বেটাকে আচ্ছা করে গাল পাড়ল তারাপদ। শ’কার, ব’কার, খ’কার, কিছুই বাদ গেল না।  হয়তো মেরেই দিত। চুলের আবার ব্যাবসা কী?  মশকরা করার জায়গা পায় না? আর পঙ্গু মানুষকে নিয়ে কেউ মশকরা করে? নেহাত পুরোনো বন্ধু তাই বেশি কিছু বলল না। বিড়ি ধরিয়ে রাস্তায় মন দিল।

বাসন্তী হাইওয়ে পিচঢালা, মসৃণ। পাশেই খাল। অবজ্ঞা, অবহেলা সয়েও একনিষ্ঠ। নিঃশব্দে বহন করে চলেছে কলকাতার নিকাশি। ওপারে ধাপা। আবর্জনার পাহাড়ে যেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। সায়েন্সসিটি ব্রিজের নীচে পুবমুখী রাস্তাটাই বাসন্তী হাইওয়ে। সোজা চলে গিয়েছে বাসন্তী। সেখান থেকে মাতলা পেরিয়ে গোসাবা হয়ে সুন্দরবন, অথবা রাজারহাট-বসিরহাট-বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশ। মাঝে বানতলা, বামনঘাটা, ভোজেরহাট, ঘটকপুকুর, ভাঙ্গড়, মালঞ্চ। রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে নিজগুণে। মারামারি, খুনোখুনি লেগেই আছে। অঞ্চলের বেশিরভাগটাই ভেড়ি। মিষ্টিতে যেমন পিঁপড়ে, মাছের ভেড়িতে তেমনি ক্রিমিনাল।

দুপুর সময়টা বড়োই গ্যাঁড়াকলের। নিষ্কর্মা মানুষকে উদোম করে দেয়। সকালটা কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রাতঃকৃত্য, চুল-দাড়ি কাটা, স্নান, চায়ের দোকান, এটা-সেটা করে। খবরের কাগজ তো ত্রাতা মধুসূদন। ‘অনেক কাজ পড়ে আছে’ বা ‘যেতে হবে বহু দূর’ও মানানসই। কে আর সত্যান্বেষণ করছে! আঁধার তো খুবই সুবিধের। দিব্যি লোকচক্ষুর আড়াল হওয়া যায়। যা হোক দুটি পেটে ফেলে শুয়ে পড়লেই হল। ঘুম আসুক না আসুক, সুখনিদ্রার ভানে অসুবিধে নেই। ঘুম অবশ্য দুপুরেও দেওয়া যায়। তবে লাভ নেই। কর্মব্যস্ত ধরণীতে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা একান্তই দৃষ্টিকটু। নিষ্কর্মার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তা ছাড়া অত ঘুমও কি মানুষের আসে? কাঁহাতক ভালো লাগে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে?

রোজ দুপুরে বানতলা বাজারে এসে বসতেই হয় তারাপদকে। গাছতলা, পুকুরপাড়, ভাঙা মন্দির, কোনওটাই তেমন জুতসই নয়। যেন আরও উদোম হওয়া। তার চেয়ে রাস্তার ধারই ভালো। গাড়িঘোড়া, মানুষজনের মাঝে দিব্যি মিশে থাকা যায়। চোখে লাগে না অতটা। ভরদুপুরে মানুষজন সামান্যই। গাড়িই ভরসা। গুনতি করে সময় মন্দ কাটে না। তবে মুশকিলও আছে। বেকার মানুষ পেলেই লোকের উপদেশ দেবার বাসনা উশখুশ করে। সেই কারণেই বটকেষ্টর, ‘চুলের ব্যাবসা করবি?’

কলকাতার এত কাছে, তবুও জীবন যেন এখানে থমকে আছে। হাইওয়ের উপর বিশাল চর্মনগরী, ছোটোখাটো কারখানা বা দু’একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকলেও, গ্রামের ভিতরে প্রায় উলটো চিত্র। বিদ্যুৎ থাকলেও সব রাস্তা পাকা নয়! সর্বসাধারণের স্কুল মাধ্যমিক পর্যন্ত। কাছের হাসপাতাল বলতে পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন। মানুষের রোজগার মূলত ভেড়ি থেকে। এখনও হাট বসে। রাস্তার দু’ধারে সার দেওয়া ‘কাঁটা, ওজন করার যন্ত্র। আশপাশের ভেড়ি থেকে মাছ এসে কাঁটায় ওঠে। শুরু হয় ‘অকশন। যার ডাক বেশি সেই দাবিদার। মিষ্টি জলের রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, পাড়ি দেয় গড়িয়াহাট, লেকমার্কেট, যদুবাবু বা মানিকতলা বাজারে। হইচই, হল্লাগুল্লায় হাট সরগরম। ঝগড়াঝাঁটি লাগলেও, বাজারে মাছ পৌঁছোনোর তাড়ায় আমল পায় না। মাছের সঙ্গে তরিতরকারিও থাকে। কলকাতার বাবুরা চলে আসে টাটকা মাছ-সবজির সন্ধানে। সস্তাও হয়! শপিং মল বা ফুডমার্টের চেয়ে তো বটেই। শুধু একটু চিনতে আর দরদাম করতে হয়। তাছাড়া গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে আসার অ্যাডভেঞ্চার তো আছেই। সাইট সিয়িং ফাউ।

সার দেওয়া কাঁটাগুলো বিশ্রামে! জেগে উঠবে সকালে। নির্ধারণ করবে লাভ-লোকশান। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারাপদ। আবার বিড়ি ধরাল। বিড়িও অন্যতম অবলম্বন। ‘কিছু একটা করছি’বা ,শেষ করেই যাব অন্যখানে। দু’টান মেরেই ফেলে দিল। মুখটা তিতকুটে। মনও। এই হাটেই একসময় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত টেরও পেত না। মানিকতলা বাজারের বিধু সাহার মাছ সওদা করত। অগাধ আস্থা ছিল বিধুর। মাছ চেনার ব্যাপারে তারাপদরও জুড়ি ছিল না। কোন কাঁটায় কারচুপি আছে সেও ছিল নখদর্পণে। ফলে সেরা দামের সঠিক ওজনের মাছ চালান যেত বিধুর আড়তে। বিধুও গুণীর কদর করত। মাস গেলে প্রাপ্য মেটাতে কসুর করত না।

বিধু কদর করলেও, ভেড়িওয়ালারা তারাপদর গুণপনায় অতিষ্ঠ। বিধুর মতো বড়ো খরিদ্দারের কাছে মাছ গছাতে পারলে একসঙ্গে অনেকটা মাছেরই হিল্লে হয়। কিন্তু তারাপদর জ্বালায় সে উপায় নেই। সেরা মাছ ছাড়া তুলবে না। ওজনেও একচুল এদিক-ওদিক করবার জো নেই। ভগবানও বোধহয় ব্যাপারীদের সহায়। একসময় দুটো পা’ই অসাড় হতে লাগল তারাপদর। ডাক্তারবাবুরাও ধরতে পারল না অসুখটা। হেকিমি, কবিরাজিতেও লাভ হল না। ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুস্পদ বনে গেল তারাপদ।

কোনও যুক্তি না পেলে সহজতম গ্রাম্য সমাধান, ‘কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে’ অথবা ‘বাণ মেরেছে’। এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। তবে কারওরই ‘কেউ’ বা ‘কিছু’ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। বাণ জিনিসটাও ভজকট। তন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকলেও, কেউই চাক্ষুষ করেনি কখনও। তাই পরিবার ভেড়িওয়ালাদের দিকে আঙুল তুললেও, প্রমাণ করতে পারল না কিছুই। বিধু অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছিল। সহকারী রেখে তারাপদ তদারকি করবে। করলও কিছুদিন। তারপরে আস্তে আস্তে ভাটা পড়ল। কাঁহাতক আর ভালো লাগে অন্যের বোঝা হতে? তা ছাড়া গুরুত্বও কমছিল। সবার চোখেই দয়া, করুণা, অনুকম্পা। একদিন যেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, সেখানে এই দুর্দশা মেনে নিতে পারল না। লাইনই ছেড়ে দিল। তারপর কাঠ বেকার।

‘একবার ভেবে দেখলে পারতিস। লাইনটা খারাপ কিছু নয়। বসেই তো থাকিস…’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তারাপদ। শব্দ করে একদলা থুতু ছেটাল।

‘আমি বসে থাকি তো তোর বাপের কী রে? তুই কি খাওয়াস না পরাস?’, মনে মনে গজরাল। চৈত্রের গনগনে রোদে তর্ক জুড়তে ইচ্ছে হল না।

‘প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। ইনকামও মন্দ নয়’, বটকেষ্ট নাছোড়বান্দা।

‘তা সে ইনকাম তুই কর না। আমার পেছনে পড়েছিস কেন?’, না বলে পারল না তারাপদ।

‘আমি তো চৌবাগা, ভিআইপি বাজার, পঞ্চান্নগ্রাম, এই এলাকাগুলো দেখছি। তুই এদিকটা দেখ না, বটকেষ্টর প্রস্তাব।

‘কেন রে শালা, আমি ছাড়া কি আর লোক নেই?’ পোঁদ ঘষটে আমাকেই গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে হবে?’, খিঁচিয়ে উঠল তারাপদ। হাঁটাচলা বলতে দু’হাতে ভর দিয়ে ঘষে ঘষে চলা। সব জেনেও বটা এইরকম প্রস্তাব দিচ্ছে? নাকি মজা করছে?

বটকেষ্ট পাকা ব্যাবসাদার। এ অঞ্চলে ব্যাবসা করা বিরাট ঝকমারি। লাইন দিয়ে টাকা নেবার লোক দাঁড়িয়ে। তোলা না দিয়ে এক পা-ও এগোনোর উপায় নেই। শালাগুলো কাজ-কম্ম কিছু করবে না, শুধু পরের ধনে পোদ্দারি মেরে মদ-মাংস খাবে। খাওয়া বেশি হলে পড়শির বউ-মেয়ের হাত ধরে টানবে। তবে তারাপদর কথা আলাদা। একে পঙ্গু তায় গ্রামের লোক। দয়া, করুণা, তাচ্ছিল্য যাই করুক না কেন, তোলা চাইবে না! ‘খোঁড়াটা আর কতই বা কামাবে’র যুক্তিতে ছাড়পত্র পাবে। এতসব না বলে হাসি মুখে বলল, ‘তুই আমার বন্ধু বলেই বলছি। তেমন হলে আমি নয় তোকে চাকা লাগানো গাড়ি বানিয়ে দিচ্ছি। ঠেলে ঠেলে ঘুরতে অসুবিধে হবে না।’

বিড়ি ধরাল তারাপদ। একটা হাতে চালানো সাইকেল গাড়ির জন্য কত তদবিরই না করেছে। নেতা থেকে এমএলএ পর্যন্ত। আশ্বাস ছাড়া জোটেনি কিছুই। অথচ ভোটটা কিন্তু ওই পার্টিকেই দিয়েছিল। কে জানে কেন, তালিকায় নাম আর উঠল না।।

তারাপদ চুপ করাতে বটকেষ্ট যেন ভরসা পেল। এদিককার গ্রামগুলো ছড়ানো-ছেটানো। দু’চারটে ঘুরতেই দিন কাবার। পড়তায় পোষায় না। লোক রেখেও সুবিধে হয় না। সকলেরই নজর ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে গৃহস্থের সঙ্গে বিউটি পার্লারও আছে। একলন্ধে চুল মেলে অনেকটা। তাই তারাপদ যদি রাজি হয়, তা হলে গাড়ি দিয়েও লাভ। পাশ ঘেঁসে বসে মোলায়েম স্বরে বলল, ‘নিজের কথা নয় নাই ভাবলি তোরা। সংসারের কথা তো একটু ভাবতে হয়। দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’

‘দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’ বটার এই কথাটাই টলিয়ে দিল তারাপদকে! সংসার বলতে বউ মালতী আর মেয়ে ঝুমুর। জমিজমা না থাকলেও বাড়িটা নিজের। একতলা। ইটের গাঁথনি, অ্যাসবেস্টসের চাল। প্লাস্টার বা রং করা হয়ে ওঠেনি। জমির প্রতি মোহ কোনওদিনই ছিল না তারাপদর। রক্ষণাবেক্ষণ ভয়ানক ঝামেলার। ব্যাংকে যাবারও প্রয়োজন বোধ করেনি কখনও। ঈশ্বর যখন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী করেছেন, তখন চিন্তা কী? এক বিধু গেলে অন্য বিধু আসতে সময় লাগবে না।

খাটা-খাটনিও তেমন কিছু নয় যে শরীর ভেঙে পড়বে। সকালে খানিক দৌড়ঝাঁপ, খিস্তি-খেউড়, হম্বিতম্বি, তারপরেই অখণ্ড বিশ্রাম। ম্যাটাডোরে মাল চাপিয়ে বোতল খুলে বসা। নিখরচায়। দায় ভেড়িওয়ালাদের। তোয়াজ, তোষামোদে গদগদ। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোক না হোক, শনি দেবতাকে তুষ্ট রাখতেই হয়। আমোদ-আাদে তোফা কাটছিল দিনগুলো। যেন রাজা-বাদশা!

গোল বাধল পায়ের অসুখটার পর। আচমকাই রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখি। টাকার জোগান থাকলে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। যেমন পড়েনি মালতীকে। দিব্যি হাসিখুশি গৃহকর্মনিপুণা! ভালো-মন্দ রান্না করা, ঘর-দোর গুছিয়ে রাখা, আত্মীয়-কুটুম্বিতা দরাজ হাতে। চারিদিকে ধন্য ধন্য, ‘বউ বটে তারাপদর!’ তারাপদও কোনও ফাঁক পায়নি। শরীর, মন দুইয়েরই চাহিদা মিটেছে অগাধ। বেসামাল অবস্থায় যত্ন-আত্তি তো দেখার মতো! জামা-জুতো খুলে, গা-হাত-পা মুছিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঘুম পাড়াত। পরম তৃপ্তিতে মনে হতো, ‘যাক, শেষ বয়সটায় কষ্ট পেতে হবে না!’

বোঝা যায়নি। হয়তো যায়ও না। সবুজে ভরা বনভূমি দেখে কি মরুভূমির আঁচ পাওয়া যায়? নাকি টলটলে নদীতে চরের পূর্বাভাস থাকে? সুউচ্চ মিনার আচমকা ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হবে, তা কী ভাবা যায়? না গেলেও, গেল একসময়। অভাব তাণ্ডব শুরু করতেই মালতী যেন ধূধূ মরুভূমি, রুক্ষ চর। প্রত্যাশার মিনার গুঁড়িয়ে চুরমার। শুরুতে মন দিয়েই চিকিৎসা করাচ্ছিল। আশা ছিল সুদিনের। যখন বুঝতে পারল দুর্দিন নিশ্চিত, তখনই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। প্রথমে ভাগ্যকে দোষারোপ, তারপর মানুষকে। তারাপদর মতো অবিবেচক মানুষ নাকি জীবনে দেখেনি। অথচ প্রতি রাত-সোহাগেই তারাপদর দিলদরিয়া স্বভাবের গুনগুনানি ছিল অনিবার্য। অনেক ভাগ্য করলে নাকি এমন স্বামী পাওয়া যায়।

বউয়ের তাগাদা, খ্যাচখ্যাচ, মুখঝামটায় ঠোঙা বানানোর কাজে হাত লাগাল তারাপদ। কিন্তু সারাদিন ঘরে বসে ঠোঙা বানানো পোষায়? কাজটাও ঘ্যানঘ্যানে, ম্যাদামারা টাইপের। মাছের কারবারের ছিটেফোঁটা উত্তেজনাও নেই। আর বানিয়েই বা লাভ কী? সব রোজগারই তো ঢুকবে সংসার ‘গভ্ভে’। এক ছিপি মালও বরাদ্দ হবে না নিজের জন্য। সবদিক বিবেচনা করে ঝিম মারল তারাপদ। হাজার মুখ ঝামটাতেও রা নেই। যেন বোবা, বধির।

ঠোঙা বানানো ছিল ফ্যামিলি বিজনেস। প্রথমে মেয়ে তারপর বাপ-মেয়েই ছিল প্রধান কারিগর। মালতী ঘরের কাজ সেরে হাত লাগাত। তারাপদ গুটিয়ে যাবার পর মসৃণ অ্যাসেম্বলি লাইনে ছেদ পড়ল। মা মেয়ের পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল। মেয়ে হোলটাইমার হলেও মাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ‘গুষ্টির গেলার জোগাড়ে’! আলুটা মুলোটা চেয়ে, গেঁড়ি-গুগলি জোগাড় করে তবে রান্না। মাঝেমধ্যে মরা মাছ জুটলেও, ভাতের বড়োই আকাল। উপায় না দেখে একসময় মালতী রান্নার কাজ নিল। আনন্দপুরের দিকটায় বড়ো-বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি। পয়সার কমতি নেই কারও! সেরকমই তিনটে বাড়িতে কাজ জোটাল। সাত সকালে বেরিয়ে মাঝ দুপুরে ফেরা। একবেলা খাওয়ার সঙ্গে হাজার পাঁচেক মাইনে। কোনওরকমে দিন গুজরান।

টাকার চেয়ে বড়ো জোর আর কিছুই নেই। এতএব ‘জোর যার মুলুক তার’ – এই যুক্তিতেই সংসারের রাশ মালতীর হাতে। তারাপদ যেন কীটাণুকীট, অপাংতেয়। নেহাত তাড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে সহ্য করা। তারাপদও মেনে নিল বউয়ের অহংকার, ঔদ্ধত্য। না মেনে উপায়ই বা কী? আত্মহত্যা? সম্ভব নয়! বড়ো ভয় জলে ডুবতে, গায়ে আগুন লাগাতে অথবা আচমকা গাড়ির সামনে পড়তে। দিনে দিনে আরও গুটিয়ে গেল। পারতপক্ষে রাতের আগে বাড়ি ফেরে না। ফিরেও চোরের মতো দুটো মুখে দিয়েই ঘুম। ঘুম মানে চোখ বুজে থাকা। মেয়েই খেতে দেয়। রাতে ঘুম না এলে পাশে এসে বসে কখনও-সখনও। মায়ের চোখে পড়লে মুখঝামটা, গালাগাল।

‘স্বামী তো নয়, শত্তুর।’

মেয়ে যেন আক্ষরিক অর্থেই গলার কাঁটা। রূপ না থাকলেও বেশিরভাগ মেয়েরই আলগা চটক বা লালিত্য থাকে। ঝুমুর যেন কুরুপার অধিক। চটক তো নেই-ই, লালিত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। আলকাতরার মতো রং, খরখরে চামড়া, মুখের দিকে না তাকালেই স্বস্তি! গুণ বলতে নম্র, গৃহকর্মনিপুণা, সরলমতি। একেবারে খাদহীন। কাদার তাল যেন! ওইসবের কদর বাপ-মায়ের কাছে থাকলেও, বাইরের লোকের দায় পড়েনি নজর করবার।

পায়ের গোলমাল শুরু হতেই মনে কু ডেকেছিল তারাপদর। মেয়ের বিয়েটা এইবেলা না দিলেই নয়। পাত্রী পছন্দ হবার প্রশ্ন নেই, তাই প্রথম থেকেই টাকার চার ফেলেছিল। মাছও এল! ছেলের বাড়ি জয়নগর। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে। দিল্লি, মুম্বাইতেও যায়। বাড়িতে বিধবা মা। জমিজমা না থাকলেও অভাব নেই। দেরি করল না তারাপদ। পঞ্চাশ হাজার টাকা বরপণে রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে মোটরবাইক। দয়াপরবশ হয়ে হাজার তিরিশেক টাকা দিল বিধু সাহা। বোধহয় লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট। বাকিটা মহাজনের কাছে ধার! মোটরবাইকও ধারে। পড়শি নগেন পালের কাছে বিনা সুদে। আয়োজন তেমন কিছু ছিল না। কালীঘাটে বিয়ে আর বাড়িতে জনা পঞ্চাশের নিমন্ত্রণ। কাজ উতরাল নির্বিঘ্নে। ট্রেনে চড়ে মেয়ে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। দ্বিরাগমনেও এল। বর ছ’মাসের জন্য দিল্লি যাচ্ছে। ফিরে এসে নিয়ে যাবে। সেই যে জামাই গেল, তিন বছর পার হতে চলল ফিরল না এখনও। জয়নগরে খোঁজ নিয়ে লাভ হয়নি। শাশুড়ির কাছেও হদিশ নেই। মোবাইল সুইচড-অফ। শুরু হল শবরীর প্রতীক্ষা।

শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে ঝুমুরও যেন পালটে গেল। যে-মেয়ে সাজগোজের ধারপাশ দিয়েও যেত না, সে নানারকম আবদার শুরু করল। ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য আর নেই। চিকিৎসা, বিয়েতে সর্বস্বান্ত। মালতীকে টানতে হচ্ছে মোটরবাইক, মহাজনের ধার। ঝুমুরেরও যেন তাড়া নেই শ্বশুরবাড়ি ফেরার। রহস্য উদ্ঘাটন হল ছ’মাস পার হবার পর। বর নানারকম দাওয়াই বাতলে দিয়েছে ফরসা হবার। টিভিতে চাক্ষুষ করিয়েছে সিনেমার হিরো হিরোইনদের রূপ রহস্য। আশ্বাস দিয়েছে ফরসা হলেই ফেরত নিয়ে যাবে। নইলে সমাজে মান রাখাই দায়। ঝুমুরও বিশ্বাস করেছে সরল মনে! উপায় বাতলালেও, সংস্থানের কোনও ব্যবস্থা করেনি পতিদেবতা। অগত্যা পাড়ার মেয়েদের থেকে চেয়ে-চিন্তে ক্রিম, সাবান জোগাড় করে ঝুমুর। মনে দুর্বার আকাঙক্ষা। হবে সাধের উত্তরণ।

চোখে জল এসেছিল তারাপদর। তীব্র অভিমান হয়েছিল ঈশ্বরের উপর। মনটার মতো মেয়েটার চেহারাটা একটু সাদা করতে পারল না? কালো মনের সাদা মানুষ তো আকছার! বেশ বুঝতে পারল টোপ গিললেও মাছ বঁড়শিতে গাঁথেনি! মেয়ে আজও কুমারী। হয়তো আজীবনই থাকবে। টাকা, বাইকের সংস্থান হতেই পালিয়েছে জামাই বাবাজি। সেই থেকেই ঝুমুর একনিষ্ঠ রূপ সাধনায় ব্রতী। পাড়ার লোকে হাসে, ব্যঙ্গ করে, আবার কৗতূহলে খয়রাতিও করে। অপেক্ষা করে চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সের। মিলনান্তক না বিয়োগান্তক? মিলনান্তক হলে, ‘আমিই তো…’, অন্যথায় মুখ বেঁকিয়ে ‘বোকার হদ্দ কোথাকার। সাধ্য নেই, সাধ আছে ষোলোআনা’। ঝুমুর অতশত বোঝে না। যে যা দেয় তাই নিয়েই খুশি। চালায় নিরলস প্রচেষ্টা। ডাক আসবে প্রিয়তমের।

নিরুত্তাপ, নিস্তরঙ্গ জীবনেও একসময় সিঁদুরে মেঘ দেখল তারাপদ। মালতীর শরীর ভেঙে পড়ছে। আজকাল প্রায়ই হাঁপ ধরে, বুক ধড়ফড় করে। অপুষ্টি, অধিক পরিশ্রমে শরীর কাহিল। মেজাজও তিরিক্ষি। স্বামীর উপর ক্ষোভ উগরেও শান্তি হয় না। মেয়েকেও জুড়ে নেয়। এমন বাপ-মেয়ের জন্যই নাকি জীবনটা দুর্বিষহ হল। বাপ-মেয়ে দুজনেই সর্বংসহা। এতএব মেজাজ আরও তিরিক্ষি! তবে ঠান্ডা হলে ঠোঙা বানানোয় হাত লাগায়। তারাপদ হাত উঠিয়ে নিলেও, মা-মেয়েতেই চালাচ্ছে ফ্যামিলি বিজনেস। মোটরবাইক, মহাজনের ধার এখনও চলছে। শুধু রান্নার কাজের মাইনেতে বাড়িতে রান্না চড়ানো মুশকিল। কিন্তু মালতী হঠাৎ অসুস্থ হলে? কেমন করে বাঁচাবে হাবাগোবা মেয়েটাকে?

‘ঘুম আসছে না বাবা?’

চমকে উঠল তারাপদ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করেনি কখন ঝুমুর শিয়রে এসে বসেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মালতীকে খুঁজল। চাপা স্বরে বলল, ‘এই ঘুমব… তুই এখন যা। মা দেখতে পেলে অযথা মুখঝামটা শুনবি!’

‘মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ঝুমুর হাসি মুখে জানায়।

নিশ্চিন্ত হল তারাপদ। মেয়ের হাতে হাত রেখে বলল, ‘বুঝলি মা, এবার একটা নতুন কারবারে হাত দিচ্ছি।’

‘কীসের কারবার?’

‘চুলের।’

চুল নিয়ে যে কারবার হয়, তারাপদর ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না। খদ্দের দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। বুঝল মহিলা মহলে এই ব্যাবসা খুবই জনপ্রিয়। নিজের মাথার ঝড়তি-পড়তি চুল বেচে যদি দুটো পয়সা মেলে, মন্দ কী? তাই ফেলে না দিয়ে কাচের শিশি বা প্লাস্টিকে জমায়। পরিমাণমতো হলে বেচে দেয়। দেড় থেকে তিন হাজার টাকা কিলো।

তারাপদকে পেয়ে মহিলা মহল যেন বর্তে গেল। খাপছাড়া গ্রামগুলোয় কোনও ক্রেতা না থাকায় বাড়ির পুরুষ মানুষদের শরণাপন্ন হতেই হতো। বিস্তর সাধাসাধি, তোষামোদ। তারপর নেহাতই দয়াপরবশ হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ! তাও সব সময় যে সঠিক পয়সা ঘরে আসবে এমনটা নয়। ব্যস্ত পুরুষকুল উপকারের বিনিময়ে মাঝেমধ্যেই এক বান্ডিল বিড়ি বরাদ্দ করে নেয়। ঝরা চুল কিলোখানেক হবার প্রশ্ন নেই। সাকুল্যে হয়তো কয়েকগ্রাম। সেটুকুতেও যদি নজর পড়ে, সহ্য হয়! বলতে গেলে পালটা রাগ, দায়িত্ব অস্বীকারের হুমকি। সেদিক দিয়ে তারাপদ শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। চোখের সামনে পুরো পয়সা মিলবে। তা ছাড়া চেনা লোক, ওজনে মারবে না ধরেই নেওয়া যায়। তবে কেউ কেউ নগদের বদলে বাসন প্রত্যাশী। কারও কারও নগদ নিয়েও অসন্তোষ। তারাপদ নাচার। ছোটো গাড়িতে বাসনের বোঝা বয়ে বেড়ানো দুঃসাধ্য। নগদ বাড়াবারও উপায় নেই। তা হলে নিজের বাড়া ভাতেই ছাই পড়ে। তা ছাড়া সবাইকে সমান নগদ দেওয়াও যায় না। দাম মেলে চুলের দৈর্ঘ্য অনুয়ায়ী। তবুও হাতের কাছে অন্য ক্রেতা না মেলায় তারাপদর কপালেই বরাত জোটে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

সময় মন্দ কাটে না তারাপদর। বটকেষ্টর দেওয়া গাড়িটা বেশ মজবুত। কাঠের তক্তার উপর চাকা লাগানো। হাত দিয়ে ঠেলে দিব্যি গড়গড়িয়ে যাওয়া যায়। অন্যদের মতো ডুগডুগিও দিতে চেয়েছিল। এক কথায় নাকচ করেছে তারাপদ। চেনা লোকজনের মাঝে ডুগডুগি বাজিয়ে ফেরি করবে। এ কি ব্যাবসা নাকি বাঁদর নাচ দেখানো? জোর করেনি বটকেষ্ট। এলাকায় পরিচিতি এবং অন্য ক্রেতা না থাকার সুবাদে তেমন অসুবিধে হবে না তারাপদর। ‘চুল দেবেন গো’ হাঁক পাড়ারও দরকার পড়বে না। মেয়ে-বউরা এমনিই উজিয়ে আসবে। তাই গাড়ির সঙ্গে শুধু ওজন করবার সূক্ষ্ম যন্ত্রটা দিয়েছে, যাতে কয়েক গ্রামও অনায়াসে ওজন করা যায়। আর দিয়েছে ধার হিসেবে দশটাকার বান্ডিল। বেশিরভাগের প্রাপ্যই পঞ্চাশ, একশো ছাড়ায় না। খুচরো রাখতেই হয়। তারাপদ ঠকায় না কাউকেই। সেই কারণেই হয়তো বাড়তি খাতির মেলে। চাইলে জল পাওয়া যায়। সঙ্গে বাতাসাও আসে কখনও।

‘তুই করিস কী চুলগুলো দিয়ে?’

‘বেচে দি।’

‘কাকে?’

‘সে খোঁজে তোর দরকার কী? তুই কামাচ্ছিস কামা না’, বটকেষ্টর সাফ জবাব। এই হল মানুষের দোষ। নিজেরটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না, অন্যের দিকে নজর । একেবারে নিশ্চিত, পরের প্রশ্ন দাম সম্বন্ধীয়।

‘তুই কী দাম পাস?’

হো-হো করে হেসে উঠল বটকেষ্ট! মানুষ ঘাঁটা সার্থক। তারাপদর পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘তোর তাতে দরকার কি রে শালা? তোকে একটা লাইন চেনালাম, গাড়ি বানিয়ে দিলাম, হাজার টাকা ধার দিলাম, এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক না। জাহাজের খবর জেনে তুই আদার ব্যাপারী কী করবি?’

চুপসে গেল তারাপদ। নেহাতই কৗতূহলী জিজ্ঞাসা। বটা যে কিছু মনে করবে ভাবেনি।

‘শোন, তোকে আর একটা রোজগারের উপায় বাতলাই’, পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল বটকেষ্ট। চুলের জট ছাড়িয়ে, সাবান দিয়ে ধুয়ে সাইজ অনুযায়ী আলাদা আলাদা বান্ডিল করবি। এ বাবদও কিছু পাবি। বিড়ি খরচটা উঠে যাবে।’

বিড়ির কথা উঠতেই হাত পাতল তারাপদ। দুটো আয়েশি টান মেরে বলল, ‘চুলগুলো কী কাজে লাগে বলবি?’

‘পরচুলা বানায়। বিদেশেও নাকি যায়। আমি সব জানিও না।’

চুলের জট ছাড়ানোর কাজটা বেশ পছন্দ হল তারাপদর। রোজগারও আছে, সময়ও কাটবে। পরে অনেকবারই বিড়ি বা ঠোঙা বানানোয় হাত লাগাবার কথা ভেবেছে। কিন্তু মালতীর রণংদেহি মেজাজের সামনে পড়তে মন চায়নি। তা ছাড়া, আবার যদি ভালো না লাগে? এবার আর রেয়াত করবে না মালতী। হয়তো ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বেরই করে দেবে। কী দরকার যেচে ঝামেলায় জড়ানোর! তার চেয়ে অনন্ত সময় ধরে জট ছাড়ানো ঢের ভালো। যেন মা-মেয়ের সঙ্গে অলিখিত প্রতিযোগিতা। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা। সামান্য হলেও কিছু টাকা তো দিচ্ছে সংসারে। তবে লাভ যৎসামান্যই। একবার কেনার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হয়। গ্রামগুলোও বেশি বড়ো নয়। গাড়ি ঠেলে দূরে যাওয়াও মুশকিল।

ইদানীং মালতীর আচরণ যেন অদ্ভুত! দূরছাইও করে আবার টাকাও নেয়। যেন ধার দিয়েছিল। টাকা অবশ্য মেয়ের হাতে দেয় তারাপদ! খামোখা সন্মুখ সমরে লাভ কী? তা হলেও, একটু সহানুভূতি পেতে মন চায়। শুনতে চায় সুবুদ্ধির প্রশংসা। আগেরই সেই মাখোমাখো ভাব না থাকলেও, প্রত্যাশা করে নরম সুর। মরুভূমি সবুজ না-ই হতে পারে, তা বলে কী মেঘের ছায়াটুকুও প্রাপ্য নয়? দু’ফোটা বৃষ্টিও কী বেশি চাওয়া হল? হাজার হলেও স্বামী তো! প্রত্যাশার ধারপাশও মাড়ায় না মালতী। মেজাজ রুক্ষতর। দিনগত পাপক্ষয়ে ক্লান্ত। তারাপদ হতাশ। নিজের কর্মকাণ্ডে অতিমনোযোগী। খেয়াল থাকে না, মরা নদীতে জোয়ার আসে না।

ঝুমুর যেন বৈশাখী বাতাস। খরা-মনে শান্তির প্রলেপ। মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি আসে। জট ছাড়াতে হাত লাগায়। ধুয়েও দেয়। তারাপদ বিশ্রাম নেয়। মেয়েলি হাতে কাজ এগোয় তরতরিয়ে। একদিন কাজ করতে করতেই বলল,

‘বাবা… আমাকে একটা জিনিস এনে দেবে?’

‘কী’? তারাপদর প্রশ্রয়। সারা জীবনে মেয়েকে দেওয়া হয়নি কিছুই। কাজ আর মদ খাওয়ার ব্যস্ততায় ফুরসতও মেলেনি! বিয়েটাও দিয়েছিল যত না মেয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি দায়মুক্ত হতে।

ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল ঝুমুর। তারাপদ দেখল পাতা জোড়া ক্রিমের বিজ্ঞাপন। সাত দিনেই বদলে যাবে ত্বকের রং! মেয়ে জুলজুল চোখে তাকিয়ে। মায়া হল তারাপদর। কত না স্বপ্ন মেয়েটার চোখে। ক্রিম লাগাবে, ফরসা হবে, বর নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। গড়ে উঠবে সংসার, আসবে সন্তান, সার্থক হবে নারী জনম!

ভাবনার মাঝেই মাথা নীচু করে ঝুমুর বলল, ‘অনেক দাম জিনিসটার। পাড়ায় কারও কাছে নেই। তুমি…’

‘তুই ভাবিস না মা! আমি নিশ্চয়ই কিনে দেব।’

‘দুশো টাকা!’

দাম শুনে আঁতকে উঠল তারাপদ। এ সপ্তাহে দুশো টাকাই জুটেছে। মালতী নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে। না পেলে কী কাণ্ড বাধাবে কে জানে! যা হয় হবে, মেয়ের শখপূরণ আজ করবেই। কত আশা করে রয়েছে মেয়েটা! জিনিসটা পেলেই হাসিতে ভরে উঠবে মুখ! মেয়ের হাসি মুখকে গুরুত্ব দিয়েই ক্রিমটা কিনে ফেলল তারাপদ। ঝড়-ঝাপটা যা আসে আসুক। ঠিক সামলে নেবে।

 

বাড়ির কাছাকাছি এসে কান্নার আওয়াজ পেল তারাপদ। তবে কি জামাই এল? মেয়ে চলে যাবে বলে মালতী কাঁদছে? নিশ্চয়ই তাই । ভগবান সবাইকেই একসময় সুখের মুখ দেখান। এবার নিশ্চয়ই মেয়ের কথা মনে পড়েছে! হয় জামাইয়ের মত বদল ঘটেছে অথবা মা অসুস্থ হবার কারণে বউয়ের প্রয়োজন পড়েছে। দুটোই মেয়ের পক্ষে মঙ্গল। শ্বশুরবাড়ি গেলে অনেকটাই নিশ্চিন্তি। একটা পেট কমলে মালতীর ভারও খানিকটা লাঘব হবে। অসুবিধে হবে তারাপদর। মেয়ের কল্যাণে যে দু’বেলা জুটত, সেটা হয়তো জুটবে না। চলতে হবে বউয়ের মর্জিমাফিক। সে হোক, মেয়ের সুখের জন্য এটুকু সওয়াই যায়। শুধু ক্রিমটার জন্য মন খচখচ করল। জামাই নিতে এসেছে মানে ওটার আর প্রয়োজন নেই। ফেরত না নিলে খামোখা গচ্চা।

বাড়ি পৌঁছে তারাপদ অবাক। সারা পাড়া ভেঙে পড়েছে উঠোনে। পড়শিদেরও নিশ্চয়ই মন খারাপ। দেখতে যেমনই হোক, সরল ব্যবহারে মেয়েটা সকলেরই মন টেনে নেয়। তাই চলে যাবার আগে সবাই দেখা করতে এসেছে। তারাপদরও দেখতে ইচ্ছে করল মেয়েকে। শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে নিশ্চয়ই লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা কান্না জুড়েছে মায়ের সঙ্গে। কান্না বড়োই সংক্রামক। কিছুতেই বাঁধ দেওয়া যায় না। তবে শুভক্ষণে কাম্য নয় একেবারেই। খামোখা অমঙ্গলের আহ্বান। মা-মেয়েকে সামলাতে এগিয়ে গেল তারাপদ।

‘ও কে ওখানে!’

দোরগোড়ায় বসে মালতী কাঁদছে। সামনে শুয়ে ঝুমুর।

‘ও ওরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন?’ মাথায় কিছুই ঢুকল না তারাপদর।

মালতীর কান্নার তোড় হঠাৎই বাড়ল।

সেই কান্নাই তারাপদকে জানিয়ে দিল, ঈশ্বরের বিধান সকলের জন্য সমান নয়। কাউকে কাউকে তিনি পৃথিবীতে পাঠান শুধুমাত্র দুঃখভোগের জন্যই। নইলে বাপ-মাকে সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়? আচমকাই তারাপদর পৃথিবী যেন থমকে গেল। বাতাস বইছে না, পাখি ডাকছে না, চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। হতভম্বের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। খানিক বাদে বুঝল, পৃথিবী চলছে আপন গতিতে, শুধু তার মেয়েটাই থেমে গিয়েছে।

‘আর সাতটা দিন, তারপরেই শাপমুক্তি।’

ঘুম থেকে উঠেই মাকে বলেছিল ঝুমুর! বাবা আনবে বিশল্যকরণী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল মালতী। সরল মেয়েটার জন্য বুক ফেটেছিল। গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোঁটা জল। সবাই শুধু বাইরেটাই দেখল, ভিতরটায় ভুলেও চোখ বোলাল না কেউ। দুঃখ চাপা দিতেই যে রাগ, বোঝাতেও পারল না কাউকে। সন্তানের ব্যর্থতার দায়ভার তো বাপ-মায়েরই। রাগ হয়, কষ্ট হয়, অনুশোচনায় জর্জরিত হয় মন। কিছু করার থাকলে সান্ত্বনা মেলে, নয়তো তীব্র আক্রোশ! একমাত্র মুক্তি আত্মপীড়নে। সেও বা কতক্ষণ? কাঁহাতক আর না খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে কষ্ট দেওয়া যায়? তাই রাগ গিয়ে পড়ে আপনজনদের উপর। অকারণেই রুঢ় ব্যবহার করে ফেলে মেয়েটার সঙ্গে। স্বামী যদি সহমর্মী হতো, তা হলে হয়তো মনের ভার কিছুটা কমত। কিন্তু সে মানুষটাও দুর্ভোগ, দুর্দশায় অনুভূতিহীন। দুর্বিপাকে কি মানুষ পড়ে না? পড়লে আবার কাটিয়েও তো ওঠে। কিন্তু মানুষটার কোনও চেষ্টাই নেই। সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ইদানীং চেষ্টা অবশ্য করছে। কতদিন স্থায়ী হয় কে জানে! আঁচলে ঠোঁট চেপে বিছানা ছেড়েছিল মালতী। তবে ভালো লেগেছিল মেয়ের প্রতি বাবার সামান্যতম দায়িত্ব পালন। কিছু তো করুক!

 

খবরটা দিয়েছিল বারুইবাড়ির ছোটো-বউ। বাপের বাড়ি জয়নগরে। নিজের চোখে দেখে এসেছে জামাইয়ের নতুন বউ। দিল্লি থেকে বিয়ে করে দিন সাতেক হল ফিরেছে। বিশ্বাস করেনি ঝুমুর। ছোটো বউ যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। অন্যের দুর্ভাগ্যে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করার সুযোগ ছাড়তে চায়নি। মোবাইলে ছবি তুলে এনেছিল। ঝুমুরের ছবিও তুলল। সতিন দেখার ফাস্ট রিয়েকশন। ছবি দেখে চুপ মারল ঝুমুর। তারপর দৌড়। মালতী, তারাপদ দুজনেই কাজে। ফাঁকা বাড়িতে গলায় দড়ি দিল।

মুখে কথা জোগাল না তারাপদর। হাতে তখনও বিশল্যকরণী। বুক ঠেলে কান্না উঠতে চাইলেও, কাঁদল না। কেনই বা কাঁদবে? তেমন করে আর মেয়েকে ভালোবাসল কই যে, হারাবার অনুতাপ করবে? ঝুমুরের মাথার কাছে ক্রিমের কৌটোটা রেখে দাওয়ায় বসল। পুলিশ এল খানিক বাদে। লাশ চলে গেল লাশকাটা ঘরে। প্রতিবেশিরা দু’একজন গেল সঙ্গে। বাকিরা নিজ নিজ কাজে। শূন্য উঠোনে সন্তানহারা বাপ-মা একাকী ।

ঝুমুর ফিরল পরদিন। খাটে শুয়ে, ফুলের মালা পরে। পাড়ার লোকেরাই ব্যবস্থা করেছে। শ্মশানে যাওয়ার ডাক পড়ল তারাপদর।

‘কোথায় যাচ্ছিস মুখপুড়ি? ধার শোধ না করে এক পা-ও নড়তে পারবি না তুই’ , হাউহাউ কান্নায় বলে উঠল মালতী। যদি আটকানো যায়!

রক্ত চলকে উঠল তারাপদর! ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরে ঢুকল। বেরিয়ে এল হাঁসুয়া নিয়ে! সবাই হতবাক। মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি বাপটা?

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারাপদ পৌঁছে গেল মেয়ের শিয়রে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হাসি পেল ঈশ্বরের লীলায়। মেয়েটাকে সামান্যতম রূপ না দিলেও, দিয়েছেন এক মাথা চুল। কোমর ছাড়িয়ে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। ক্ষিপ্র হাতে হাঁসুয়া চালাল তারাপদ। প্রায় গোড়া শুদ্ধ উঠে এল এক ঢাল চুল।

সেই চুলের গোছা হাতে চিৎকার করে উঠল তারাপদ,

‘ধার শোধ…’

 

 

ছবি

অনেক মানুষ জীবনে ভুল করে থাকে, তা হয়তো পরে তার অনুতাপের কারণ হয়। রহমান সামান্য ফুর্তি আর আনন্দ পাওয়ার জন্য যে ভুল করেছিল তা যেন কেউ কোনও দিন না  করে।

হাসানপুরের রহমান আর দীপক ছোটোবেলা থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু। একই বছরে গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স-সহ একজন বিএ অন্যজন বিএসসি পাশ করে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রহমান এমএ পাশ করে একটি গ্রামের স্কুলে মাস্টারি পায়, আর দীপক এমএসসি করে কলকাতার এক নামি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়।

দীপকের মা শান্তাদেবী রহমানকে রমেন বলেই ডাকেন। মায়ের কথামতো দীপকও তাই। শান্তাদেবী রমেনকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। জাতপাতের বিচার তাঁর নেই।

দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুতে বেশ কিছুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মোবাইল থাকলেও পত্র লেখাতেই এদের বেশি আনন্দ। রহমানের প্রতি পত্রেই থাকে ওর ওখানে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। দীপকেরও মাঝে মাঝে কলকাতার গণ্ডিবদ্ধ জীবনধারার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কাজের চাপে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

এবার রহমান লিখেছে, ‘কলকাতার বাবু, বড়োদিনের ছুটিতে না এলে আর পত্র লিখব না। মোবাইলও বন্ধ করে রাখব।’ আগত্যা দীপককে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।

স্টেশনে রহমান নিজে উপস্থিত ছিল। দু’বন্ধুতে দু’বছর পর দেখা। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে একই বিছানায় আশ্রয় নেয়। সারারাত গল্পের পর ভোরের দিকে দুজনেই গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়ে।

– বাবু আপনার প্রাইভেটের ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়েছে। সাতটা বাজে। চাকর রামু দরজায় ধাক্বা দিতে দিতে বলে।

রমেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে, দীপক তখনও অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।

প্রাইভেট পড়ানো প্রায় শেষ হওয়ার মুখে দীপক রমেনকে ডাক দেয়।

– বাবু পড়াতে বসেছে, আপনি মুখ হাত ধুয়ে নেন। চা-জলখাবার রেডি, বাবুরও ততক্ষণে পড়ানো শেষ হয়ে যাবে। রামু এসে জানায়।

– রমেন প্রাইভেট পড়ায় নাকি?

– হ্যাঁ, এখানের সব মাস্টারবাবুরাই তো পড়ায়।

এমন সময় রমেন এসে বলে, ‘দীপক উঠেছিস বুঝি? আমারও হয়ে এসেছে। চা খেয়ে তোকে আমাদের এখানকার বাজার দেখিয়ে আনব।’

রমেনের বাইরের ঘরে আঠারো-কুড়িটি ছেলেমেয়ে একমনে লেখাতে ব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়ে একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে যায় দীপক। পরনে দামি চুড়িদার, গায়ে রুচিসম্মত ওড়না জড়ানো, পিঠভর্তি কোঁকড়ানো চুলে দুটি বেনি, বেনি দুটিতে লাল ফিতে দিয়ে তৈরি দুটি গোলাপ ফুল আঁটা। কি অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা মুখশ্রী। এমন রূপসী মেয়ে দীপক জীবনে দেখেছে কি না সন্দেহ? এই বোধ হয় প্রথম।

আবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে দীপক। হঠাৎ রমেনের ডাকে তার চেতনা ফেরে।

– কিরে আয়, জলখাবার খেতে হবে না?

খেয়েদেয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে বাজারের দিকে। গ্রামটি যেন পটে আঁকা ছবির মতো। বেশির ভাগই ধনী। রমেনের স্কুলটিও বেশ সুন্দর জায়গায়, গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট্ট নদী, রূপসী। এর চারপাশের সৗন্দর্য সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করবে!

বাজার বেড়িয়ে ফেরার পথে হঠাৎ নারী কণ্ঠের ডাকে দুজনেই চমকে ওঠে। দীপক তাকিয়ে দেখে একটি বড়ো বাড়ির বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি। কতরকমের ফুলে ভরা বাগানটির বেশিরভাগই গোলাপ, তাও লালই বেশি।

– মাস্টারমশাই, আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাবা আছেন।

রমেন উত্তর দেয়, ‘আজ থাক্। পরে একদিন আসব।’

– বেশ প্রাইভেট টিউশন শুরু করেছিস রে ভাই, পথেঘাটে আমন্ত্রণ। শুধু পড়ানো, না আরও কিছু? হাসতে হাসতে টিপ্পনি কাটে দীপক।

–সে ভাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। মেয়েটি যদিও আমাদের স্বজাতি, কিন্তু মস্ত বনেদি বাড়ির মেয়ে। কত যে ধনী তা তো দেখেছিস-ই। ওর নাম ফিরোজা। ওর বাবা এখানকার একজন নামকরা ডাক্তার। দুই দাদা, বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, ছোটদাদা বিদেশে গবেষণা করছে। মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো। ভালো রেজাল্ট করে।

– আহা বড়ো বাড়ির মেয়ে তো কি হল? তোর ওকে ভালো লাগে না?

– না ভাই ও জিনিসে লোভ না করাই ভালো। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়ে কী লাভ বল? আমি হচ্ছি গরিব স্কুল মাস্টার। যেমন আছি ঠিক আছি। বুঝলি দীপক তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। মেয়েটির ব্যবহার খুব ভালো। কোনও অহংকার নেই।

দীপক বলে, ‘সত্যি রমেন এমন সুন্দরী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।’

– কিরে তুই দেখছি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস? বলে রমেন।

– তা পড়লে দোষ কি?

সারারাত গল্পের পর ভোরবেলায় দীপক ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোনোর ইচ্ছা তার মোটেও ছিল না। সকাল সাতটায় ফিরোজা আসবে। ওকে দেখার জন্য যে ওর প্রবল একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে আছে, তা তো আর রমেনকে বলতে পারে না। ভোরের ঘুমটা সব বারোটা বাজিয়ে দিল।

দীপকের ঘুম ভাঙল রমেনের ডাকে। সব ছাত্র-ছাত্রী তখন চলে গেছে যে যার নিজের বাড়িতে।

– কিরে ওঠ। ন’টা বাজে যে।

– ন’টা, আমাকে তুলিসনি কেন?

– তোমার সুন্দরী নূরজাহান আজ আসেনি বন্ধু। উঠলেও কিছু লাভ হতো না।

– বাঃ নামটা বেশ দিয়েছিস তো? ওই নামেই ওকে ডাকা উচিত। কি বলিস রমেন?

সেদিন ওরা ঘুরতে ঘুরতে ফিরোজাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। রমেন অবশ্য বারকতক গেছে এর আগে। কাছে যেতেই ফিরোজার মধুর আহ্বানে ফিরে তাকায় দুজনেই।

– একি, ফিরোজা তুমি! বলে রমেন।

পরনে জাফরানি রঙের চুড়িদার, নীল ওড়না, তার দুটি বেনিতে ওদেরই বাগানের দুটি রক্ত গোলাপ।

সত্যি এ মেয়ের তুলনা বুঝি কারও সাথেই চলে না। দীপক অবাক হয়ে ভাবতে থাকে।

এবার আর ফিরোজার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না ওরা। তবে দীপকের আর এক দফা অবাক হবার পালা। যেরকম সুরুচি সম্পন্ন আসবাবপত্র, সেরকম নিপুণ হাতে সাজানো সারা বাড়িটি! গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা জাগে তার।

ফিরোজার বাবার সাথে আলাপের পর ফিরোজাকে জিজ্ঞাসা করে রমেন, ‘আজ পড়তে যাওনি কেন?’

‘উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল স্যার।’ ছোট্ট উত্তর ফিরোজার।

এবার দীপকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে রমেন। কথায় কথায় প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে যায় ওদের। ফিরোজার মা আর বড়ো দাদার সাথেও পরিচয় হয় দীপকের। ফেরার সময় ফিরোজা ওদের মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আবার আসার আনুরোধ করে।

পথে নেমে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে দুটি নির্বাক মন। মৌনতা ভেঙ্গে রমেন প্রশ্ন করে, ‘কিরে দীপক বাকশক্তি হারিয়ে ফেললি নাকি?’

– তা হারালে দোষের কি ভাই!

– তুই কী ভাবছিস বল তো?

– ভাবছি, ভগবানের কি নিখুঁত তুলির কাজ।

– কিন্তু একটু ওলট-পালট হয়ে গেছে বন্ধু। তবে এ ব্যাপারে মন খারাপ কোরো না, ঘটকালিটা না হয় আমিই করব!

পরদিন অবশ্য ঘুম থেকে উঠতে দীপকের দেরি হয় না। তখন রমেন পড়াতে বসে গেছে। দীপক একটু ঘোরাফেরা করে সামনের রাস্তায়। দূর থেকে ফিরোজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখে ফিরোজা ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি মেয়েটিকে যেন সবসময় দেখতে ইচ্ছা করে। চোখ ফেরাতে মন চায় না। কেন যে এমন হয়?

ফিরোজা এসেছে আজ দেরি করে। আগের দিন আসতে পারেনি তাই আজ সবার ছুটির পরেও ফিরোজা একাই কিছুক্ষণ পড়ছে। রমেন ওকে পড়াচ্ছে। বাড়ির থেকে গাড়ি এসে ওকে নিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে দীপক আসে সেখানে। বলে,‘ রমেন এবেলা আর তোকে বাজারে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি।’

– আরে বাবা বোস না একটু এখানে, দুজনেই যাব। ফিরোজার গাড়ি এল বলে। হ্যাঁ ফিরোজা, তোমার বই রেখে যেও।

দীপক বলে, ‘আমি ভেতরে যাচ্ছি। তুই আয়, তারপর দুজনে বেরোব।’

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ফিরোজার বইটি দাগ দিতে দিতে বইয়ের ভিতরে একখানা ছবি দেখে রমেন দীপককে ডাকে।

– শোনো শোনো দীপকবাবু, তোমার স্বপ্নসুন্দরী নিজেই ধরা দিয়েছে। একবার এসে দেখে যাও।

ফিরোজার একখানা ছবি। শাড়ি পরা, চুল একই ভাবে সামনের দিকে বেনি বাঁধা আর তাতে গোঁজা ফুটন্ত লাল গোলাপ। মেয়েটা সত্যিই খুব ফুল ভালোবাসে।

দীপক ছবিটা রেখে দেয় নিজের কাছে গোপনে।

সেদিন রবিবার। দুপুরের দিকে রমেন পড়াশোনা করছে।। বিকেলে রমেনের টিউশনি আছে। আজ আর ফিরোজাদের নয়, অন্যদের। দীপক আস্তে আস্তে হেঁটে নদীর কাছাকাছি চলে যায়। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে চুপ করে বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে হয়, এখানকার সবই সুন্দর। রমেনটা বেশ আছে।

– আপনি এখানে যে সাহেব?

হঠাৎ ফিরোজার ডাকে তাকায় দীপক।

– এমনি বসে আছি। রমেনের ব্যাচ আছে তাই। তা তুমি এদিকে কোথায়?

– আমি আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে আসছি। চলুন না আমাদের বাড়ি। বলে ফিরোজা।

– না আজ থাক। তাছাড়া রমেনও সঙ্গে নেই। তুমি বুঝি মোটর সাইকেল চালাতে পারো?

– হ্যাঁ কিছুদিন হল শিখেছি। আপনি কলকাতায় থাকেন তাই না।

– হ্যাঁ ওখানে একটা কলেজে পড়াই।

– স্যার বলেছেন।

– তোমার নাম তো ফিরোজা?

– হ্যাঁ সাহেব।

দীপক বলে, ‘নূরজাহান তোমার উপযুক্ত নাম।’

– ধ্যাৎ কি যে বলেন। লজ্জায় মুখ নামায় ফিরোজা।

– আমি এখন যাই। যাবেন স্যারের সাথে আমাদের বাড়ি।

–আচ্ছা ফিরোজা তুমি আমাকে সাহেব বললে কেন?

– বাঃ রে আপনার গায়ের রং সাহেবকেও হার মানায়। সাহেব, এবার আমি আসি।

বলেই মুচকি হেসে ফিরোজা বাড়ির পথ ধরে।

ফিরোজার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীপক। সত্যি এই বুঝি ভালোবাসার নিয়ম। এদিকে কখন যে রমেন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি দীপক।

– কিরে তুই এখানে? আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অমন করে কী দেখছিলিরে ভাই?

– তুই তো সবই দেখেছিস। আবার জিজ্ঞাসা করছিস কেন?

– দীপক তুই ভুল করছিস। এ হবার নয়।

– কেন নয়? ভালোবাসা কি মানুষ ইচ্ছা করে করে? ভালোবাসা কি চেষ্টা করে করতে হয়? ভালোবাসা হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই হয়তো হয়ে যায়। যখন এমন ঘটে যায় তখন জাত-ধর্ম খড়কুটোর মতো উড়ে যায়।

– তা না হয় হল, কিন্তু ওর বাবাকে তুই চিনিস না। তাছাড়া তোর মা কি মেনে নেবেন? দ্যাখ ফিরোজাকে তুই ভুলে যা ভাই। বলিস তো সুন্দরী শিক্ষিতা তোর উপযুক্ত মেয়ে আমি দেখি।

দীপক নিরুত্তর থাকে।

দেখতে দেখতে দীপকের ছুটিও একদিন শেষ হয়ে যায়। বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় কলকাতায়। ছবিটা রয়ে যায় দীপকের কাছে আর মনটা পড়ে থাকে ফিরোজার কাছে।

বন্ধুর চিঠিতে ফিরোজার খবরাখবর দীপক মাঝে মাঝে পায়। ফিরোজাকে দেখতেও মন চায় কিন্তু লজ্জায় এত তাড়াতাড়ি বন্ধুর ওখানে যেতে পারে না।

কেটে যায় একটা বছর।

যৌবনে নারী-পুরুষ দুজনে দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এতে দোষের কিছু নেই। যদি জাত, ধর্ম, বয়স সব ক্ষেত্রে মিলে যায়, তাহলে তাদের প্রেম সঠিক পথে এগোয় আর যদি এগুলি না মেলে, তাদের প্রেমের পথে বাধা আসে প্রচুর। দীপকের বেলাতেও তাই হল। কোনও ব্যতিক্রম ঘটল না।

ছেলের বইয়ের আলমারি গোছাতে গিয়ে একটি সুন্দরী মেয়ের ছবি পান দীপকের মা শান্তা। ব্যস সেই শুরু! এ মেয়েকে তাঁরও খুব পছন্দ। কিন্তু যখন জানতে পারলেন এ মেয়ে ভিন্নধর্মের, আর এর সূত্রপাত রমেনের বাড়ি, তখন রমেনকে আসতে পত্র লিখলেন। সব জেনেও ছেলের বিয়ের জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করলেন। ছেলের বন্ধুকে নিজের ছেলের মতো দেখা, সে যতই বিধর্মী হোক, তা দোষের নয়! তবে একটি মুসলমানের মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনা সেটা বোধ হয় কোনও হিন্দু মা-ই পারে না। এতটা উদার মনের মানুষ দীপকের মা-ও নন এইক্ষেত্রে।

নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগল। কয়েকটি মেয়ে সত্যিই সুন্দরী। অবশেষে একটি মেয়েকে পছন্দ করে তাদের বাড়িতে ওর মা কথা দিয়ে এলেন। দীপক কিছুতেই রাজি হল না।

এদিকে ফিরোজার অবস্থাও সঙ্গিন। প্রথম কয়েকবার চিঠি  আদান-প্রদানে বাড়ির কেউ তেমন জানতে বা বুঝতে পারেনি। পরে সব জানাজানি হয়ে যায়। পাছে রহমানের মাধ্যমে সূক্ষ্ম যোগাযোগ থেকে যায় এবং কোনওদিন ওরা লুকিয়ে চলে যেতে পারে এই ভয়ে, ফিরোজার বাবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মেয়েকে সৌদি আরবে ওর কাকার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

বছর দুই পরে ওখানেই ফিরোজার কাকা বিয়ের ঠিক করেন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে! কোনও কিছুতেই কোনও শুভফল হল না! ছেলেটিকে সব কথা জানিয়ে দেয় ফিরোজা।

অবশেষে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে প্রায় জোর করে রহমানের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেন ফিরোজার বাবা ডাক্তারসাহেব। রহমানকে তিনি অনেকদিন ধরেই দেখছেন। পাত্র হিসাবে মোটেই খারাপ নয়। হয়তো ওদের মতো ধনী নয়, তবে ছেলেকে বাড়ি, গাড়ি, মূল্যবান জিনিসপত্র আর মেয়েকে সোনা দিয়ে মুড়ে দিলেন। সর্বতোভাবে মেয়েকে সুখী করার চেষ্টা করলেন!

এতেও ফল ভালো হল না। মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই তবে ফিরোজা বা রহমান কেউই সুখী হল না জীবনে। প্রথম প্রেমিককে ফিরোজা কিছুতেই ভুলতে পারল না। ফিরোজার মন আর ভালোবাসা কোনওদিনই পেল না রহমান। নিত্য অশান্তি আর অসুখের সংসার করতে করতে দুজনেই জেরবার। ফিরোজার মনে আজও একটা সংশয়, দুদিক দিয়ে কথা চালাচালি রহমানই করেছে তাকে পাওয়ার জন্য। হয়তো এই জন্যই ওর বাবা এ বিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে মায়ের চোখের জলের কাছে হার মেনে মায়ের কথা দেওয়া মেয়েটিকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয় দীপক। মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অপরূপা না হলেও বেশ সুন্দরী। তবে ফিরোজাকে শত চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারেনি আজও। এ নিয়ে ওদের সুখের সংসারে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তবুও অনেক যন্ত্রণা, অনেক কষ্টের পর একটি পুত্র সন্তান এসেছে ওদের সংসারে।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। ফিরোজার ছবিটি এখনও আছে দীপকের কাছে। সেই ছবিটি সে নিজের হাতে রং তুলি দিয়ে এঁকেছে। ছবিটি এতটাই জীবন্ত যেন এক্ষুনি কথা বলবে। সেটি সে রহমানকে পাঠিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে।

শান্তি-অশান্তি নিয়ে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকটা বছর। দেখতে দেখতে দীপকের ছোট্ট ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেল। সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বর্তমানে চেন্নাই-এ কর্মরত। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশ যাবে। দীপকের মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ফিরোজার আর বেশি খবর সে রাখে না। হয়তো রহমানের সাথে ভালোই আছে!

ঘটনার চোরাস্রোতে এক বর্ণমুখর সন্ধ্যায় রহমানের সঙ্গে হঠাৎ দীপকের দেখা হয়ে যায়। প্রথমে না চেনার ভান করে রহমান। পরে অবশ্য সবই বলে সে দীপককে। চেহারারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে রহমানের। ওর কাছেই জানতে পারে, ফিরোজা আর বেঁচে নেই। রমেন এখন ফিরোজাদের গ্রামে থাকেও না। তার একমাত্র মেয়েকে ওর মামা নিয়ে চলে গেছে, তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ। তারপর থেকে সে তাকে আজও দেখেনি! ওখানকার স্কুলের চাকরি অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে।

শত অনুরোধ সত্ত্বেও রহমান সেদিন দীপকের বাড়িতে যায়নি। কোথায় থাকে, কীভাবে চলছে তার সেসব কিছু সে বলেনি। যেমন এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

বাড়ি ফিরে দীপক একটি মজার কথা শোনে ওর স্ত্রীর কাছে। তার ছেলে রোহন নাকি তহমিনা বলে একটি প্রবাসী মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে সে বিয়ে করবে। এ বিয়ে যেন বাড়ি থেকে মেনে নেওয়া হয়।

মনে মনে হাসতে থাকে দীপক।

ফিরোজার বাবা ডাক্তার সাহেব বেঁচে আছেন। রহমান ফিরোজারা আজ না থাকলেও, ওদের বাড়িটি রং করানো চলছে, ঘরের সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে। তবে বাড়ির দেখভাল করার লোকটি একটি ছবি সরিয়ে ফেলে, কলকাতায় বিক্রি করলে এসব ছবির ভালো দাম পাওয়া যাবে ভেবে। বিয়ের পর ডাক্তার সাহেবের নাতনি নাতজামাই এই প্রথম আসবে। তাই এই সাজ সাজ রব। এত আয়োজন। অবশ্য মা মরা তহমিনার বিয়ে দিয়েছে ওর ছোটো মামা।

এদিকে রোহন তার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসেছে। ওদের মেনে নিতে হয়েছে সবকিছু। কিন্তু বউমাকে দেখে দীপক অবাক। একি! এ যে ফিরোজার প্রতিমূর্তি। ঠিক যেন যৌবনের ফিরোজা। এ কী করে সম্ভব?

রোহন যে-মেয়েটিকে বিয়ে করেছে তার বাবা মা কেউ নেই। ধনী মামারাই তাকে মানুষ করেছে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই সে প্যারিসে মানুষ। এখন চাকরি করে প্যারিসেই। রোহনকে তার কোম্পানি প্যারিসের একটি প্রোজেক্ট হ্যান্ডল করতে পাঠায়। সেখানেই তহমিনার সঙ্গে  তার আলাপ এবং প্রেম। মা-বাবা রাজি থাকায় রোহন আর দেরি করতে চায়নি। বিয়েটা সেরে ফেলে চটজলদি। এদিকে মা বাবা কাউকেই তহমিনার ভালো করে মনে নেই। ছোটোমামার কাছেই সে থাকত। তহমিনার মুখে তার মামার বাড়ির কথা শুনে স্তব্ধবাক্ হয়ে যায় দীপক। ডাক্তারসাহেবের সঙ্গে তার কি নতুন করে আত্মীয়তা তৈরি করা উচিত? নাকি পরিচয়টুকু গোপন-ই থাক– এই দোলাচলে মনটা বেশ অস্থির হয়ে ওঠে তার।

দীপক ভাবে তার মা যা পারেননি ওদের তা পারতে হল। রোহনদের এ বাড়িতে আসা বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। রোজই বিকালের দিকে ওরা কোথাও না কোথাও বেড়িয়ে আসে। এই কদিনে অনেক জায়গা ঘুরে, দেখে এসেছে। আর কদিন পরে ওরা যাবে তহমিনাদের বাড়িতে। ওখান থেকেই চলে যাবে নিজেদের কাজের জায়গায়।

সেদিন রোহন-তহমিনা রাত্রে ফিরে একটি মজার ঘটনা শোনায়। আজ একটি ছবির দোকানে ওরা একখানি বাঁধানো ছবি দেখে অবাক হয়ে গেছে। ছবিটি অপরূপা এক নারীর। ছবির নীচের কোণে ডি কে স্বাক্ষর করা। আশ্চর্যের ব্যাপার ছবিটি যেন হুবহু তহমিনাকে দেখে আঁকা।

সবই বুঝতে পারে দীপক। ফিরোজাকে উপহার দেওয়া তারই নিজের হাতে আঁকা ছবি।

আজ সকালে মাকে নিয়ে রোহনরা দক্ষিণেশ্বরে গেছে। বিকালে ওরা ছবিটি কিনে নিয়ে আসবে বলে ঠিক করেছে। ভেবে কূলকিনারা পায় না দীপক কী করবে সে এখন। আজ বাড়িতে কেউ নেই, যা করার তাকে এবেলাতেই করতে হবে। আজ সে কলেজে যাবে না।

এগারোটা নাগাদ সে ছবির দোকানে যায়। বহু অর্থের বিনিময়ে দীপক ছবিটি কিনে নেয়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে খবরের কাগজে মোড়া ছবিটি গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। সেই সঙ্গে ফিরোজার বই থেকে পাওয়া ছবিটিও।

যে অন্তরে আছে তাকে বাইরে রেখে লাভ কি? ডি কে নামের অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেষে সব জানাজানি হওয়ারই বা দরকার কি!

 

মেঘলা আকাশ

মেঘলা, আকাশ মেঘা বলে ডাকে। নামটা বেশ রোমান্টিক। সূর্য হাপুচুপু খায়। ভিজে যায় শরীর। আবার কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদে মন। আকাশ যখন মেঘা বলে ডাকে,মেঘার শরীরজুড়ে শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়। আকাশের চোখে মুখে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ লেপটে রয়েছে।

দীর্ঘ শীতাবকাশের পর আজ ছিল কলেজ খোলার দিন। কলেজ ফেরত আকাশ রোজকার মতো ফিরছে তার মেসে। কিন্তু মেঘার সঙ্গে দেখা হয়নি! এই পাহাড়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শীতের ছুটি পড়ে ডিসেম্বর মাস থেকে। মেঘা আসেনি কেন বুঝতে পারছে না আকাশ। অথচ, ওর তো আসার কথা ছিল। কিংবা একটা তো খবর দেবে। এমন তো করে না মেঘা!

কলেজের শেষ পিরিয়ডটা করে বেশ কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে দু’কাপ চায়ের ধূমায়িত পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে সেসব কথা। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে মেসে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। কিছুটা আলো থাকলেও সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই। এমন সময় আকাশের মুখ ভার। মেঘের গর্জন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি কিংবা বিদ্যুতের ঝিলিক। ঝোড়ো পরিবেশ। কারেন্ট নেই। বিদ্যুতের ঝলকানির আলোতে ঝাপসা পথটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বেশ কয়েকটা চড়াই-উতরাই পার করে আকাশের ছাত্রাবাস। সবুজ চা-বাগিচায় মোড়া সুখি উপত্যকার ঢালে মেস। স্থানীয় একজনের বাড়িতে প্রায় চার বছর ভাড়া রয়েছে। কাঠের সারি সারি ঘর, খুব পরিচ্ছন্ন আর লম্বা সরু এক ফালি বারান্দা। এই বারান্দা থেকে দূর পাহাড়ের বসতি ও উপত্যকায় চা-বাগিচার সবুজ যেন চুঁইয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য চোখের আরাম হয় বইকি।

এই পাহাড়ি শহরে অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার ডিগ্রি করছে আকাশ-মেঘলা। বিষয় ভূগোল। ফাইনাল ইয়ার। আর প্রথম যেদিন ভর্তি হতে আসে সেদিন মেঘলার সঙ্গে পরিচয়। মেঘলার মাস্টারমশাই মনোময়বাবু সজ্জন মানুষ। প্রথম দিনই আলাপ জমে যায় আকাশের সঙ্গে। মেঘলাকে ভর্তির পর ক্যান্টিনে মোমো খেতে খেতে সব কিছু মনের কথা উজাড় করে দিয়েছেন মনোময় স্যার। আকাশের সহযোগিতায় মেঘলার জন্য একটা ঘরে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করেন মনোময়বাবু। কিছুটা গার্জেনের ভূমিকা পালন করেন।

আজ দুর্যোগের দিন। মনখারাপ করা বিকালে হাঁটতে থাকে একাকী আকাশ। সাতপাঁচ ভাবতে থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। সবুজ কচিপাতায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি বিকালের রোদে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। পাহাড়ের সামনের ঢালে বৌদ্ধ মন্দিরে সান্ধ্য আরাধনার প্রস্তুতি চলছে। ঘন ধুপিগাছের সরলবর্গীয় কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি ঠিকরে পড়ছে চোখে মুখে। আরও কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা পার হলেই হেয়ার পিন বেন্ড পথ। তামাটে বিকালের রং চোখে মুখে।

দুর্যোগ কিছুটা কমল মনে হচ্ছে। বাঁকটার কাছে আসতেই কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল আকাশ। এই পথ যা স্মৃতির সরণি বেয়ে উঠে গিয়েছে শর্বরী পার্কে। বেশ কিছুটা ছায়া-সুনিবিড়, সমতল সবুজ ঘাসের মখমলে ঢাকা। দেখা যায় তুষারধবল কাঞ্চনজঙঘার মোহনীয় রূপ। কিছুটা পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া। রামধনু আকাশ ছুঁয়ে পাহাড়ের উপত্যকায় যেন জিরিয়ে নিচ্ছে। আকশের নীচে সবুজ উপত্যকা যেন সাতরঙের পেখম মেলেছে।

যেদিন শীতের ছুটি পড়ল সেদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিল আকাশ মেঘলা এইখানে। সেইসব স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। প্রায় দিন কলেজ শেষে এই পার্কে বসত। একটা ভিউ পয়েন্ট। পরিচ্ছন্ন আবহাওয়ায় মেঘেদের লুটোপুটি উপত্যকার বুকজুড়ে। দেখতে দেখতে কত সময় কেটে গেছে তাদের।

কখনও মেঘের দল এসে আকাশ-মেঘলাকে ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েও খুঁজে পেয়েছে। হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার একটা আনন্দ আছে বইকি! গভীর খাদটা যখন ভরে যেত মেঘে মেঘে তখন মনে হতো মেঘের সাগর। বিকালের ফুরফুরে হওয়ায় একটা ফুরফুরে মেজাজ। মেঘার এলোচুল কপালে চোখে মুখে উড়তে থাকত। আর ছোটো সাদা ধবধবে হাত দুটো দিয়ে নিমেষে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত মেঘলা। একটা দূরত্ব রেখে বসত দুজনেই।

লাল টুকটুকে ঠোঁটের ওঠানামায় আর চোখে কী দারুণ একটা মাদকতা ছিল মেঘলার। দূর থেকে দেখত কীভাবে মেঘেরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ। দেশলাই-বাক্সের মতো পাহাড়ি গাঁয়ের বসতি দেখা যায়। আর যে-পাথরটায় রোজ বসে গল্প করত সেই পাথরটাও খুব আপন হয়ে গিয়েছিল। দিনের শেষে বাগিচার শ্রমিকরা পিঠের ওপর দুধের শিশু নিয়ে ঘরে ফিরত। একটা সর্পিল পথ এই পাহাড়ের বাঁকটা ছুঁয়ে বেশ কিছুটা নীচে অন্য উপত্যকায় নেমে গিয়েছে। এই পথের নিয়মিত পথচারীরাও তাদের চিনে ফেলেছিল।

লেখাপড়ার গল্প আর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে বেশি আলোচনা চলত। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত না কেউই। ভাসা ভাসা কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকত নির্ভেজাল মনের গল্প। রাতের বিছানায় স্মৃতি রোমন্থনে দুটো মন সময়ের বয়সে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে।

খুব দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা মেঘলার। মনোময় স্যার না থাকলে এই নামি কলেজটায় আসতেই পারত না। আকাশ প্রথম দিন কিছু কথা শুনেছিল মনোময়বাবুর কাছে।

এই সেই পাহাড়ি বাঁক, যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে জীবনের প্রায় সব কথাই বলেছিল মেঘলা। আকশের মনে পড়ছে এখন সে সব কথাকাহিনি। মেঘলা সেদিন বলেছিল, ছোটো বোন চন্দ্রিমার কথা। বাবার কথা মনে করতে পারি না। মেঘলার মা সীমা জ্যোৎস্না রাতে ফুটফুটে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনিয়েছে হারিয়ে যাওয়া পিতার গল্প। সেসব কথাও বলেছে মেঘলা আকাশকে একটু একটু করে। মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা সইফুদ্দিন আকাশে তারা হয়ে জ্বলছে। পরে তারা দেখতে দেখতে যখন বড়ো হয়েছে সব বুঝেছে।

মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি নদী সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট লাগোয়া অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত কিছু খাসি জনজাতির বাস। আর পাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোটো গাঁয়ে বসবাস করত মেঘলাদের আদি খাসি পরিবার। সইফুদ্দিন সিলেটের বাসিন্দা। পুরুষানুক্রম থেকে চলে আসা ওদের মৎস্যশিকার আর জমিতে কৃষিকাজ-ই ছিল জীবিকা। পরিবহণ ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল সইফুদ্দিন।

নৌকা নিয়ে প্রায় দিন ডাউকি নদীর জল ভেঙে মাছ ধরত! কখনও পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে নৗকাবিহার করাত। কিছুটা পর্যটনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। ভালোই আয় হতো। আসা যাওয়ার পথে এই পাহাড়ি বসতির মানুষজন তার মুখচেনা হয়ে যায়। প্রথমে পরিচয়, মন দেওয়া নেওয়া তারপর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়! সীমা সফি বলে ডাকত। সফির বাবা মা পরিবার তা মেনে নেয়নি। ঘর থেকে পালিয়ে সীমার বন্ধনে আবদ্ধ হয় সফি।

খাসি পাহাড়ের পাদদেশে সুখের সংসার পেতেছিল সীমা-সফি। সইফুদ্দিন চোস্ত খাসি ভাষায় কথা বলতে পারত। বিয়ের পর দায়িত্ব বেড়ে যায় সফির। পরবর্তীতে পর্যটকদের সঙ্গী করে নৌকাবিহার পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হয়। তার নৗকাটাও বেশ সাজানো। নৌকার গায়ে আঁকা থাকত নদী, বিভিন্ন মাছের ছবি। ডাউকি বাজারলাগোয়া ডাউকি নদীর ঘাট পর্যটন মরশুমে পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা থাকত। নিশ্বাস ফেলার সময় হতো না সফির। নদীর স্বচ্ছ জলে নৌকা বিহার এখানে খুব জনপ্রিয়। আবার অফসিজনে কখনও মালবাহী ছোটো গাড়ি নিয়ে শিলং চেরাপুঞ্জি রওনা দিত। প্রায় দিন পাহাড়ি পথে সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরত।

সীমা ভুট্টা খেতে ভালোবাসত। সারাদিন স্টিয়ারিং ধরে ক্লান্ত অবসন্ন শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিত সীমার কোলে। সন্ধ্যায় ওরা দুজনে ডাউকির তীরে ভুট্টা খেতে খেতে গল্প করত। ডাউকি নদী যেন সীমা সফির কাছে ভালোবাসার পূণ্যতোয়া। রামধনু রঙে মাখামাখি জলে হরেক রকমের মাছের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে বাসায় ফিরে যেত। এ ছিল তাদের রোজকার রুটিন।

মেঘলার মা সীমা সেই স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রিয় সফিকে খুঁজে পেত। স্মৃতির চাতালে আজও দপদপ করে সেইসব দিনের কথা। মায়ের কাছে শুনেছে মেঘলা– তখনও সন্ধ্যা নামেনি, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে পাহাড়, যেন নৃত্য করছে। ডাউকির মাছরাঙা জল, উথলে উঠছে আকাশ ছোঁবে বলে। এমন একটা ধবংসলীলার চলচ্চিত্র সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিল মা।

বাবা গাড়ি নিয়ে চেরাপুঞ্জির রাস্তায় ছিল সেদিন। শুনেছি বহু মানুষ সেই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল। তারপর চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। কিছুটা সামলে আবার বলতে থাকে– সেই সন্ধ্যায় আর ফেরা হয়নি সফির। আসলে সেই সময়টায় কে কোন দিকে গিয়েছে জানা যায়নি। আত্মীয়স্বজন অনেকেই খবর নিয়েছে কিন্তু খোঁজ মেলেনি বাবার। মেঘলা বলে, মায়ের কাছে শুনেছে বীভৎস সেই রাতের কথা।

সবুজ শৈলশিরাটা যেখানে শিকলের মতো নদীর স্রোত ছুঁয়েছে সেই ঢালে বিক্ষিপ্ত জনবসতি সেখানেই দু-কামরার সীমা-সফির সাধের ছোটো সাংসার। কুটির বলাই ভালো। নদীর কাছে কিছুটা সমতল জায়গায় কয়েকজন মিলে তাড়াহুড়ো করে বার হয়ে আসে তাই বেঁচে যায়। বহু ছবির মতো পাহাড়ি বসতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণশিবিরে আশ্রয়।

তখন মা সন্তানসম্ভবা। একটি ত্রাণশিবিরে প্রথম প্রসব! সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। যদিও বৃষ্টি-মেঘের খেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সীমা যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। ত্রাণশিবিরের সকলে নাম রেখেছিল মেঘলা, চন্দ্রিমা।

এরপর ডাউকি নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। সীমান্তঘেঁষা উত্তর-পূর্বের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত ডাউকি নদীর সীমান্তঘেঁষে মেঘার পাহাড়ি গ্রাম। ঢিলছোড়া দূরত্বে বাংলাদেশের সিলেট শহর। খাসি ভাষা একটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা যা মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচলিত।

ত্রাণ শিবিরের পর কোনওরকম একটা তাঁবুর মতো ছেঁড়া প্লাস্টিকের ছাউনিতে ঠাঁই হয়। কিংবা বর্ষার দিন প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় ঠাঁই নিত। মেঘালয়ের ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির মতো বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল দরিদ্র পরিবার। খাসি রমণী সীমা পরিশ্রমী। দুই কন্যাসন্তানকে শিক্ষায় আচার-আচরণে উন্নত করেছে সে। মায়ের স্থানীয় হোটেলে রান্নার কাজ নেওয়া, কখনও-বা ডাউকি নদীর ঘাটের কাছে ছোটো দোকান দিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করা। এসব জীবনযন্ত্রণার কথা দিনের পর দিন বলেছে মেঘলা আকাশকে।

ডাউকি নদীর বর্ডার প্রসিদ্ধ প্রাকৃতিক পর্যটন। নদীর মনোলোভা সৗন্দর্য চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে পর্যটকদের। এরকম মনোরম পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেঘলার।

ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়ে যায় চন্দ্রিমার। ভীষণ জেদ ছিল মেঘলার। বড়ো হবার জেদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের খুব কাছ থেকে দেখেছে নদীতে নৗকা বিহার করতে। মায়ের সঙ্গে ডাউকি নদীর ধারে দোকানদারি করেছে সে। স্কুল পড়াশোনা, পাহাড়ের ঢালে জ্বালানি সংগ্রহ এই ছিল রোজকার রুটিন। শুকনো কাঠের জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কতবার কাঁটাঝোপে দুই বোনের আপেলের মতো গাল চিরে রক্ত ঝরেছে। সেই রক্ত রোদে জলে ধুয়ে গিয়েছে। খেয়ালই নেই মেঘলা, চন্দ্রিমার। ডাউকি নদীর আয়নার মতো জলে যখন সূর্যাস্ত হতো সিঁদুর মেঘের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত, তারপর ক্রমশ ঘন রাত আঁকড়ে ধরত ডাউকির এই পাহাড়ি গ্রামকে।

ডাউকির জনপথলাগোয়া ফুটপাথেই ছিল সীমা-মেঘলা-চন্দ্রিমার বাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। তারপর হাইস্কুল উচ্চমাধ্যমিক স্তর পার করেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকত মেঘলা। দূর পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতলে সিলেট শহরের রূপ দেখতে কখন সে আনমনা হয়ে পড়ত।

খাসি ভাষার কবি সো সো থামের কবিতা পড়তে ভালোবাসত মেঘলা। খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে এই প্রাচীনতম জনজাতির বাস। প্রকৃতি, প্রেম, কল্পনা, মননশীলতায় ভরপুর সো সো থামের খাসি কবিতার পুস্তকটি ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে মেঘলা। এমন সুন্দরী সবুজ উপত্যকায় বসে দেখেছে পাহাড়ি ঝরনা আর সূর্যমেঘের লুকোচুরি। পিতৃহারা মেঘলা-চন্দ্রিমা দেখেছে তাদের মায়ের কঠোর শ্রম।

কল্পনা, প্রকৃতি আর বাস্তবতা এসব নিয়ে তাদের ছোটো সংসার।নংক্রেম নৃত্যও অতি প্রসিদ্ধ খাসি উৎসব। লোক নাচে বেশ দক্ষ ছিল মেঘলা চন্দ্রিমা। পুরোনা অ্যালবাম ঘেঁটে কয়েকটা স্কুলজীবনের নাচগানের ছবিও দেখিয়েছে। চন্দ্রিমা ভালো গান গাইত। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের উপজাতীয়দের পার্বণ বেহদিয়েংখ্লাম পালিত হয় প্রতি বছর জুলাই মাসে। গারোরা পালন করেন ওয়াংগালা উৎসব যা আদতে সূর্যের উপাসনা। এসব কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা নেমেছে পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলত মেঘলা। দার্জিলিং পাহাড়ের সিঙ্গালিলা শৈলশিরায় বসে কলেজপড়ুয়া আকাশ জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মেঘলার কথা শুনেছে।

‘প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাধ্যামিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেশ কিছুদিন বাড়িতেই বসেছিলাম। কয়েকজন প্রতিবেশীর বাচ্চাদের টিউশন পড়াতাম।’ আকাশকে তাদের পরিবারের অনেক কথাই বলেছে মেঘলা। ‘জানো, স্যার আসত প্রায় খোঁজখবর নিতে। বোনের খুব ছোটোতে বিয়ে হয়ে যায়। পরির মতো টুকটুকে সুন্দরী বোন। ঘটকের পাল্লায় পড়ে আমারও বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল বহুবার। কিন্তু রাজি হইনি। বাড়ির কোণে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। পরে একদিন স্যার কে সব কথা বললাম। আমি শুধু পড়তে চাই।

স্যার আমাদের ক্লাসে বলতেন, ‘মেয়েদের পড়তে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।’ সে অনেক কথা– বলতে বলতে চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। মনোময় স্যার প্রবাসী বাঙালি। শিলং শহরে তাদের বাস। প্রাচীন বাঙালি পরিবার। অবিভক্ত দেশের এই পাহাড়ি স্কুলটা ডাউকি সীমান্তে অবস্থিত। মনোময় স্যার এই স্কুলের একজন শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগে মেঘলার এতটা পথ আসা। মেঘলা বলেছিল, সে পড়তে চায়! বড়ো হতে চায়। এদিকে মনোময় স্যার অবসর নেন যে-বছর, সেই বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মেঘলা।

মাধ্যমিক পাস করবার পর থেকে অভাবী ঘরের মেধাবী ছাত্রী সকলের নজর কাড়ে। মনোময় মেঘলাকে স্নেহ করতেন। তিনি দুঃস্থ অসহায় পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা করতেন। মনোময়বাবুর সহযোগিতা নিয়ে দার্জিলিঙে ভূগোল পড়তে আসা মেঘলার। সব কথাই আকাশকে বলেছিল মেঘলা দার্জিলিঙের শর্বরী পার্কের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে। কোনওদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গাঢ় অন্ধকার নামত পাহাড়ে।

ভোঁ ভোঁ শব্দে মেঘের চাদর ফুঁড়ে ফিরতি জিপগাড়িগুলো পাকদণ্ডি পথে হর্ন বাজিয়ে চলছে। সার্চলাইটের মতো গাড়ির হেডলাইট মেঘার কখনওবা আকাশের চোখে মুখে পড়ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে ফিরে যেত আপন আপন মেসে। একদিন তো ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসব থরেথরে সাজানো স্মৃতি কথাগুলো মনে করতে করতে আজ মেসে ফিরল একলা আকাশ। সঙ্গে মেঘলা নেই । কিন্তু মেঘলার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখনও পথে থমকে দাঁড়িয়েছে। আবার হাঁটা শুরু।

মূল সড়ক থেকে কিছুটা এবড়োখেবড়ো পথ নেমে গিয়েছে হ্যাপিভ্যালি চা বাগানের দিকে। এখন বৃষ্টি নেই। পরিচ্ছন্ন মেঘমুক্ত আকাশ। কয়েকটা ধাপ পা ফেলে ফেলে উঠলেই বারান্দা তার পর গভীর খাদ। ভেজানো দরজা খুলে লাইটের সুইচে হাত দিতেই আলোকিত হল ঘর। লাইট জ্বালিয়ে লেপটা বিছানায় বিছিয়ে দেয়। কারণ রাতের দিকে সব কিছু হিমশীতল হয়ে যায়।

সেই সকালে নীচের ঝরনা থেকে সংগৃহীত পানীয় জল বালতিতে কতটুকু রয়েছে দেখে নেয়। এর পর রান্নার তোড়জোড়। ডিম আলু ডাল একসঙ্গে সেদ্ধ করে নেওয়া। খিদে পেটে সব কিছুর স্বাদ অমৃত। রাত আটটার পর সব নিঝুম। তারার মতো দূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলজ্বল করে আলো। টগবগ করে ফুটছে ভাতের হাঁড়ির জল। কাঠের ছোটো ঘরের ফাঁকে খবরের কাগজ সাঁটানো।

শীতের রাতে গুনগুন করে গাইতে থাকে নেপালি গান, হিজো রাতি কিনো? কিনো? নিদ্রা লাগিনো, কসতো মায়া… কসতো মায়া… গানের কলি। ডেকচি উপচে ভাতের ফ্যানা পড়ছে।

ডালে-চালে আর আলু সেদ্ধ পেঁয়াজ লংকার তরিবতের খানা রেডি। কিছুক্ষণ সব ভুলে কলেজের পড়াসংক্রান্ত কাজ।

আকাশ রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে এখন ব্যালকনিতে। নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে পাহাড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে। এই সময়টা সে তার পড়া আর ভাবনাগুলোকে এক সূত্রে গাঁথে। আরও কয়েকটা মাস কাটাতে হবে পাহাড়ি শহরে। মনের মানুষের সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নদী বিষয়ে গবেষণার বড়ো ইচ্ছা আকাশের। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। এসব এলোমেলো ইচ্ছের কথাও বলে ছিল আকাশ মেঘলাকে। বলেছিল, ডুয়ার্সের ছবির মতো তার গ্রামের কথাও! কখন যে মেঘালায়ের ডাউকি আর আকাশের রায়ডাক মিলেমিশে একাকার হয়েছে মনের মোহনায়, হয়তো টের পায়নি কেউ। বন্ধুত্ব থেকে ভালোলাগা ভালোবসায় রূপান্তরিত হয়েছে সময়ে সময়ে। দিনের পর দিন ভালোবাসা ঘন হয়েছে।

আসলে এই তো সেদিন ডুয়ার্সের ভূটান সীমান্ত গাঁ থেকে আকাশ এই পাহাড়ি শহরে এসেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। পাহাড়ে খরচ বেশি। কিন্তু ভূগোল বিষয়ে সব কলেজে তখন পড়ার সুযোগ ছিল না। জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড়! মাসে মাসে আবার খরচ আছে। আকাশদের একান্নবর্তী পরিবার। বাবা বিমল রায় একজন কৃষিজীবী।

আকাশের বাবারা ছিল তিন ভাই। বাকিরা সকলেই ব্যাবসাবাণিজ্য সরকারি চাকরি নিয়ে থাকত। ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম ব্লকের খোঁয়াড়ডাঙা এলাকার নারারথলি গ্রামের এটাই সব চেয়ে বড়ো পরিবার। আকাশের বাবা খেতি কাজের পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর কাজও বেশ সফলতার সঙ্গে করেন।

স্থানীয় জঙ্গলের বিভিন্ন লতাগুল্ম দিয়ে হাড়গোড় জোড়া লাগাতেন আকাশের বাবা। ভোর থেকে লেগে থাকত ঘরময় রোগীর ভিড়। আকাশকে বড়ো মানুষ করে গড়ে তোলবার ইচ্ছা। সাত-পাঁচ করেই দার্জিলিং পাহাড়ের কলেজে ভর্তির বন্দোবস্ত করেছেন। আসলে, আকাশের দাদু হাড়ভাঙা ডাক্তার নামে এই সীমান্ত লাগায়ো আসাম-ভূটান স্ললাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন।

কলেজ ছুটির ফাঁকে পাহাড় থেকে নেমে পড়ত আকাশ। জীবনের গতি এখানে যেন ধীর। আলিপুরদুয়ার ছুঁয়ে জাতীয় সড়কটা অসমের দিকে গিয়েছে। আর তেলিপাড়া থেকেই বাঁ দিকে পিচ ঢালা এক ফালি রাস্তা ছুটছে খোঁয়াড়ডাঙা অভিমুখে! যা ভূটানের গা-ছমছম গভীর জঙ্গলে ঢুকেছে। রাস্তার দু-ধারে ছায়াসুনিবিড় গাছ গাছালি। চরম গ্রীষ্মে যখন হাঁসফাঁস করে মানুষ তখন রোদের তীব্রতাকে এই পথছায়া গোগ্রাসে গিলে খায়। আর শরীরে এক মনোরম শীতল অনুভূতি জেগে উঠে। এমন একটা রূপকথার গাঁয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে মনে মনে দানা বাঁধত মেঘলার।

আকাশের গ্রামের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ভূটান। জমজমাট গ্রামীণ বাজার। হাটের দিনগুলোতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। আকাশ যখন ছোটো ছিল বাবার সঙ্গে ঘরের মুরগি ও মরশুমের সবজি নিয়ে হাটে বসত। স্থানীয় নদ-নদীর তাজা নদীয়ালি মাছ যেমন পাওয়া যায় তেমনি ঘরের পোষা মুরগি হাঁস নিয়েও হাটুরেরা হাজির হয়। বিভিন্ন জনজাতীর মনপছন্দ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী রকমারি সব কিছু হাটে মিলবে।

এখানকার গ্রামীণ হাটগুলো মেলার রূপ নেয়। এলাকাটি যেন মিনি ভারতবর্ষ। বিভিন্ন জাতি উপজাতি ধর্মের আর সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র। সহজসরল জীবনযাপন আর অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর মানুষজন। ভাষা পোশাক ধর্ম আচার ভিন্ন হলেও কোথায় যেন একটা ঐক্যের সুর বাঁধা আছে। কৃষিপ্রধান এলাকা। রয়েছে বন বস্তি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘরবাড়ি পোশাকেও ছাপ পড়েছে। সব কথা মেঘলাকে শুনিয়েছে আকাশ। সকলকে আপন করে নেওয়ার কি অসাধারণ জাদু আছে আকাশের!

কলেজ জীবন শেষ করে এবার ঘরে ফেরা। তাঁর প্রিয় অধ্যাপকের পরামর্শ মতো নদী বিষয়ে গবেষণা শুরু করবে। ছোটো থেকেই নদীকে সঙ্গী করে জীবন। খুব কাছ থেকে দেখেছে কীভাবে ভূটান থেকে নেমে আসছে বিভিন্ন নদনদী! সংকোষ, রায়ডাকের মতো আন্তর্জাতিক নদী যেমন রয়েছে, তেমনি ঘোড়ামারা, জোড়াই, কুলকুলি প্রভৃতি নদী শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। অতি বর্ষণে বন্যা এই এলাকার স্থায়ী সঙ্গী। ভূটান পাহাড়ের অবৈজ্ঞানিকভাবে ডোলোমাইট উত্তোলন একটা কারণ। এই অঞ্চলের ঢাল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।

আকাশ দেখেছে নদীগুলোর পূর্ব দিকের পাড় ভাঙার প্রবণতা। হঠাৎ করে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসায় নদীর গতিবেগ কমে যায়। নদী পাথরনুড়িতে বোঝাই হয়ে থাকে। ফলত বন্যার কবলে পড়ে এলাকা। এখান থেকে যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নদীমাতৃক বাংলার রূপসী রুপ যেন এখানে উপচে পড়ছে। এলোকেশী-নারী যেন ভরা বর্ষায় ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভীষণ গর্জন করে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম। শীতের মরশুমে শুধু শোনা যায় নদীর কুলুকুলু শব্দ আর নিস্তব্ধতা ভাঙে কোকিলের কুহু কুহু ডাকে।

বনবস্তির চরে বেড়ানো গরু-ছাগলের গলায় ঝুলানো টিনের তৈরি ঘণ্টা জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। নদী যেন একা নীরবে শুয়ে থাকে। এমন এক অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা আকাশের। নদী পাহাড় তাকে আজও চুম্বকের মতো টানে।

শীতের ছুটির পর আর ফেরা হয়নি মেঘলার। ফিরবে কি করে! ফেরার দিন ঘটে গেল অঘটন। প্রতিদিন শিলং-গৗহাটি মেল নামে দুধসাদা বাসটা সাতসকালে হর্ন বাজিয়ে ডাউকি বাজার থেকে ছাড়ে। আর তখনই মেঘলাদের পুরোনো ঘড়িটা পেন্ডুলাম দোলাতে দোলাতে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ করে ঘড়ির কাঁটা মিলে যায় সাতের ঘরে।

সকাল সাতটা বাজে। এই সাত-পুরোনো ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে। মেঘলার বাবা সইফুদ্দিন বাংলাদেশ থেকে যখন চলে আসে তখন সীমাকে উপহার দিয়েছিল। সীমা দেওয়াল ঘড়িটা আগলে থাকে।

আজ মেঘলার দর্জিলিং ফেরার দিন। কিন্তু মা সীমার ঘুম ভাঙেনি। চলে গিয়েছে ঘুমের দেশে। হার্টের পেশেন্ট। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। শোকের ছায়া ঘরজুড়ে! মাস্টারমশায় মনোময়বাবুর কাছে খবর যায়। মেঘলার বুকে তখন একটা নোনা বঙ্গোপসাগর তৈরি হয়েছে। ঘড়িটার দিকে নিঃষ্পলক তাকিয়ে থাকে মেঘলা।

কিছুদিন মনোময়বাবুর ঘরে থাকে। পরে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হয়। আকাশকে সেসব কথা জানিয়ে চিঠিও লিখে রেখেছিল। কিন্তু চিঠিটা ফেলা হয়নি ডাকবক্সে! কচিকাঁচা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। প্রতিদিন সাতসকালে রাস্তায় পথ চলতি গাড়ি ধরে স্কুলে যায় মেঘলা। দুষ্টু-মিষ্টি শিক্ষার্থীরা তার বেঁচে থাকার রসদ। মনে মনে ভাবে জীবনটা যেন একটা অসম্পূর্ণ সনদ।

এদিকে দার্জিলিঙের পাট চুকিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘরে ফিরেছে আকাশ। ফিরেই সংবাদ পেল আকাশ গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। কৃষকের ছেলের এমন সাফল্যে গোটা গ্রামে উৎসবের মেজাজ। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারশিপ ও নদী বিষয়ে গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। গবেষণার কাজ শুরু করতে রওনা দিল আকাশ।

ডুয়ার্সের গা ঘেঁষেই অসম। গুয়াহাটি হয়ে সেদিন শিলং পৌঁছোল আকাশ। আবার একটা মেসের মতো কোয়ার্টারে থাকবার ব্যবস্থা। উত্তর-পূর্ব ভারতের নদনদী চরিত্র ও নদী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত টাটকা তথ্য সংগ্রহ করতে পাহাড়ি রাজ্য চষে ফেলেছে আকাশ। যখন কাজ শেষে রুমে ফেরে মেঘার কথা মনে পড়ে।

যাইহোক যদি পথে দেখা হয় কোনওদিন কি বলবে মেঘলাকে! কখনও রাগ অভিমানে গাল ফুলে যায়। আবার গবেষণার কাজে ডুবে যায় আকাশ। ভোলার চেষ্টা করে সব কথা। এবার ডাউকি নদী সীমান্তে যাবে। মেঘালয় মালভূমি থেকে আগত একটি পাহাড়ি নদী। ডাউকি চ্যুতির নাম অনুসারে নদীটির নাম ডাউকি। জল স্বচ্ছ কাচের মতো নান্দনিক সৗন্দর্যের যেন লীলাভূমি।

আকাশের গা ছমছম করে। সবে ডাউকি ব্রিজটা পার হয়ে গাড়িটা থামল। হকারের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে একটু কফি কাপে চুমুক। শিলং থেকে যখন গাড়িটা ছাড়ে তখনই বৃষ্টি শুরু। আজ সকাল থেকে খুব মেঘলা। ডাউকি ঢোকার মুখে ব্রিজ। মনে পড়ছে মেঘলার কথা। ডাউকি মেঘলা মেঘালয় যেন অজান্তেই তার নিজের হয়ে গিয়েছে। শরীরটা যেন হিমশীতল হয়ে আসে!

গাড়িটা স্টার্ট দিতে আবার ঝমঝম শিলা বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটায় নদীর জলে বুদবুদ উঠছে। হু হু করে পাহাড়ি ঝরনা মূল সড়কে ধুয়ে খাদে পড়ছে বীভৎস গর্জন করতে করতে। অগত্যা গাড়ি থামাল চালক! মেইন রোডের পাশে একটা বেসরকারি স্কুল। নাম রিভার পয়েন্ট নার্সারি। এখানে কিছুক্ষণ বিরতি। মেঘে ঢাকা আকাশ। দিনের বেলায় যেন অন্ধকার নেমে আসছে।

গাড়ির জানলার কাচটা খুলতেই আকাশ দেখে বেশ চমকে গেল, পরির মতো অপ্সরা একজন মহিলা মেঘেঢাকা পাহাড়ের সর্পিল পথ বেয়ে নেমে আসছে। লুকস লাইক আ ফাউন্টেন, হয়তো মূল সড়কে উঠবে! হাত নেড়ে গাড়িটাকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলছে। যদিও আকাশদের গাড়িটা এমনি অতিবৃষ্টির দরুন দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ কিছুটা হতোভম্ব হয়ে গাড়ির গেটটা খুলে দিল। সটান গেটে ছোটো হাতটা চেপে গাড়িতে উঠে পড়ল মহিলা।

খুব চেনা খুব জানা। কিন্তু দুজনেই নির্বাক। তখন আবার মেঘেঢাকা আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের রক্তিম আভায় টুকটুকে গাল দুটো স্মৃতির আলোর ঝরনাধারা। চোখের তারায় তারায় আনন্দ অশ্রুর প্লাবন।

জীবনের গাড়িটা হয়তো ছুটল পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথ পেরিয়ে আলোর ঠিকানায়।

অলকানন্দার জলে

অলকানন্দা,

প্রথম দর্শনে মানুষ প্রেমিকার প্রেমে পড়ে। আমি প্রথম দর্শনে তোমাকে চরিত্রহীন ভেবে বসি। তাছাড়া তোমার শরীরটাও বেশ পুরুষ্ট। সালোয়ারের ভেতর থেকে দুটো পুষি বিড়াল সবসময় উঁকি দেয়। প্রতি মুহূর্তে মনে হতো হাত লেগে গেলে ম্যাও করে ডেকে উঠবে। পরে বুঝেছি হুলোই। এসব অবশ্য শাহিনকে বলিনি। তোমার স্তন দুটোর দুটো নাম দিয়ে ছিলাম তুমি জানো? দোয়েল আর কোয়েল। মনে রাখার সুবিধার জন্য। আসলে আমি মনে মনে দুটোকেই হুলো বেড়াল বলতাম। অত সেজে বাড়িতে কেউ থাকে! থাকে হয়তো। আমার জানা ছিল না। তোমাকেই প্রথম দেখেছিলাম বাড়িতে অত সেজে থাকতে। অবশ্য তোমার থেকে প্রথম দেখা প্রথম শেখা জিনিস আমার জীবনে অনেক। অথচ তুমি আমি কেউ কারও প্রথম প্রেমিক বা প্রেমিকা ছিলাম না।

তোমার খিদিরপুরের যে-অঞ্চলে বাড়ি, সেটা মারদাঙ্গা, খুনখারাপি, রাহাজানির জন্য এক সময়ে কুখ্যাত ছিল। তখন থেমে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বদনামটা এখনও রয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার মতো মফস্সলের ছেলের কাছে তো বটেই। অবশ্য পৃথিবীর যে-কোনও বন্দর শহরের সে বদনাম একটু আধটু থাকেই। তাই বলে কি সেখানে সুন্দরী থাকে না! জলপরিদেরও তো জল থেকে উঠে আসতে বন্দর লাগে। লাগে না? না লাগলে তুমি ওখানে গেলে কী করে?

বদনামটার ভয়ে সেদিন শাহিনকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। ও বেচে গাড়ি আর আমি গাড়ির ইনসিওরেন্স। সেদিন ওর ওদিকে কোনও দরকারই ছিল না। ওকে বলেছিলাম তোমরা একটা নতুন প্রাইভেট কার নেবে। আমরা দুজনেই গুড্‌স ভেহিকেলস মানে মালবাহী বড়ো বড়ো লরির এক্সপার্ট। কিন্তু তোমরা তখন সবে চবিবশটা লরির ফ্লিট্ নিচ্ছ। শাহিন আপশোশ করছিল, লিডটা আগে পেলে ও ডিলটা ডান করতে পারত। মার্কেটে চাপা খবর ছিল, তাই ওকে কারের টোপটা দিই। মার্কেটিং লাইনে এসব টুকটাক মিথ্যে কথা চলতেই থাকে। শাহিনও হয়তো মিথ্যেটা বুঝেছিল, কিন্তু ও একবার তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিল যদি পরে কখনও গাড়ি কেনার সময় ওকে ডাকো।

খিদিরপুর অঞ্চলে তোমাদের অনেকগুলো বাড়ি। গলি, তার ভেতরে গলি, কখনও কখনও কানা গলিতে ধাক্বা মেরেছি বাইক নিয়ে। তোমাদের ব্যাবসার তখনও অফিস ছিল না। সবে সবে ব্যাবসায় নেমেছ। বাড়ির ঠিকানা একটা ছিল। কিন্তু ঠিকানা থাকলেও কলকাতাতে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যে এত কঠিন, সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম। গলিগুলোর কত বাহারি নাম। হরিমঞ্চলেন, রামবাবু গুপ্তা রোড, এডেন ভিলা রোড! বললাম না তোমার থেকে কত কী প্রথম শিখেছি। অথচ সেল্সে কয়েক বছর কাজ করার সুবাদে কলকাতায় এ-মাথা ও-মাথা করেছি, কখনও কখনও বাড়ির নাম্বার, রাস্তার নাম না জেনে কিছু ল্যান্ডমার্ক জেনে নিয়েই ঠিক পৌঁছে গেছি।

অনেকটা গলির ভেতর তোমাদের প্রথম বাড়িতে পৌঁছে শুনলাম ঋষি রাজা লেনের বাড়িতে গেলে মালিককে এখন পাওয়া যাবে। গলির ভেতরে গাড়ি ঘোরানো কী যে কষ্টের তোমাকে বোঝানো যাবে না। ওই রকম সরু গলির ভেতর অত লোক যাতায়াত করে সব সময়, বাইক ঘোরাতে গেলেই বোঝা যায়। দু-দিক দিয়ে হইহট্টগোল। জলদি কিজিয়ে, জলদি কিজিয়ে! আরে বাবা জলদিই তো করছি। জলদিরও তো একটা সময় লাগে নাকি!

তবে তোমাদের প্রথম বাড়িটা গলির অনেক ভেতরে হলে কী হবে, ঢুকেই বুঝেছিলাম অর্থের বৈভব। একটা ছাবিবশ-সাতাশ বছর বয়সি ছেলে, পরে তুমি বলেছিলে তোমার ভাই, হিন্দিতে খুব রোয়াবে ঠিকানাটা বলেছিল। অর্ধেক বুঝিনি। শাহিন চট করে ধরে নিয়েছিল ঠিকানাটা। ওর মামার বাড়ি ওই অঞ্চলেই। ছোটো বেলায় খুব থাকত। পার্ক সার্কাস লোহাপুলের বাড়ি থেকে খিদিরপুর কার্ল মার্ক্স সরণিতে সাইকেল নিয়েই যাতায়াত করত তখন। এখন রয়েল এন্ডফিল্ড। যাকে তুমি বুলেট বলো। তোমার বরের তো বুলেট ছিল, বলেছিলে।

দ্বিতীয় বাড়িটায় পৌঁছোলাম চট করে। রাস্তাটা শাহিন চিনত। ওর বাল্যবন্ধুর বাড়ি। আর বাড়িটাও চওড়া রাস্তার ধারে। অথচ দেখো চওড়া রাস্তার নামে লেনের পদবি আর গলিগুলোর রোড, স্ট্রিট। পরে এই নিয়ে দুজনে খুব হাসাহাসি করেছিলাম তোমার মনে আছে? কিন্তু দ্বিতীয় বাড়িতে গিয়ে শুনলাম মালিকের শরীর খারাপ, তাই জিতেন সিং স্ট্রিটের বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছেন। এ লোকটা তোমাদের ভাড়াটে। খুব বাবু বাবু করছিল।

দুপুর ঢিঢি করছে চারিদিকে। গরমকাল ছিল মনে আছে। সেল্স-এর লোকেদের অবশ্য এসব অভ্যাস আছে। আমরা মনে মনে নাছোড়বান্দা যে-কোনও সেল্স কলেই। বিশেষ করে এক সাথে চবিবশটা গাড়ির ইনসিওরেন্স মানে আমার বাঁধা ইনসেন্টিভ সে মাসে! অনেকদিন ধরে বউ একটা বালা চাইছিল। সেটা মাথায় ছিল। ফিরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবু একটা তো মানসিক ক্লান্তি আসে। দুই বন্ধুতে রাস্তার পাশের গুমটি থেকে দুটো দামি ব্র্যান্ডের মেন্থল সিগারেট কিনে ধরাই। আমাদের টিফিন বলো, রেস্ট বলো সবই ওই সাদা কাঠির সুখ টান আর ধোঁয়া ভর্তি গালের জাবর কাটা। অবশেষে তৃতীয় বাড়িতে তোমাদের পেলাম। না তোমাকে তো খুঁজতে যাইনি। চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের সন্ধান পেলাম।

খিদিরপুর অঞ্চলের গলির ভেতর গলি, তার ভেতরে বাড়ি যে এত বৈভবের হতে পারে ধারণা ছিল না। তৃতীয় বাড়িটা ফ্ল্যাট টাইপের। প্রথম বাড়িটার থেকেও বেশি সাজানো। বাড়িগুলো বাইরে থেকে ইট বালির কঙ্কাল লাগে কিন্তু ভেতরের আসবাব, মেঝে, দেয়ালের কারুকাজ সব অন্যরকম। ওই ঘিঞ্জির মাঝেও যে ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে দেখব ভাবিনি। পুরো ফ্ল্যাটটাই সেন্ট্রালি এসি। গরম থেকে বাড়িতে ঢুকতেই এক রাশ স্বস্তি। যতটা না এসির কৃত্রিম ঠান্ডার জন্য, তার থেকেও বেশি অবশেষে চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের কাছে পৌঁছোতে পারার জন্য। দুজনের দুটো ভালো পদ-নাম ছিল। আমি সেল্স ম্যানেজারের তকমা নিয়ে ঘুরি আর শাহিন ব্রাঞ্চ ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। আসলে আমরা বেচুবাবু। মাল বেচাই কাজ। আমরা যা পাই বেচে দেবার সুযাগ খুঁজি।

অনেক বার বলেছি, তোমাদের ফ্ল্যাটটার নকশা ভালো নয়। কোনও প্রাইভেসি নেই। অতবড়ো ফ্ল্যাট অথচ উদোম। প্রথমে তোমাকে দেখার কথাটা বলি। চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের নাম সতীশবাবু, টাইটেল জানি না। আধজানা ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম বড়ো ফ্ল্যাট। নিঃশব্দ। বয়স্ক কাজের মহিলা দরজা খুলে ড্রইংরুমে বসতে দিয়েছে। সোফাটা দামি। বসতেই ডুবে গেলাম। বসেছি ভেতরের দিকে মুখ করে। অপেক্ষা করছি। বেশ অনেকক্ষণ। মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি বিমাকথা। যে-কোনও ভাবে তুলতেই হবে চেকটা। বউ যে নতুন ডিজাইনের বালা দেখেছে, এক জোড়া না একটাই বানাবে বলেছে। ইনসিওরেন্স ইজ আ সাবজেক্ট ম্যাটার অফ সলিসিটেশন। গুলি মার সলিসিটেশনের। যে করে হোক চেকটা আমার চাই।

আমি বা শাহিন কেউ কথা বলছি না। কাস্টমারের বাড়িতে আমরা একদম শান্ত ভদ্র। চোখে চোখে কথা হচ্ছে। ঠোঁটের অল্প নড়াচড়াতে দুজনে দুজনের ভাষা বুঝতে পারি। দু-একবার পর্দার আড়ালে তোমাকে দেখলাম। নিঃশব্দে নড়াচড়া করছ। আমি আর শাহিন চোখাচোখি করলাম। আবছা অবয়ব। শরীরের বর্ণনা দেব না। প্রেমিকার শরীর নিয়ে কথা বলা নোংরামি। কিন্তু দুজনে তোমাদের সোফায় বসে চোখ দিয়ে নোংরামিই করছিলাম। ওসব ছেলে ছেলেতে হয়ে থাকে। রাগ কোরো না। আর তখন কি জানতাম যে তোমার সাথে ওরকম দুনিয়া ভোলানো প্রেম হবে। আমি দেখতে শুনতে ভালো, লোকে স্মার্ট বলে। বেশ লম্বা চওড়া। ফর্মাল ড্রেসে সবাইকেই ভালো লাগার কথা। তাই বলে তোমার মত মারকাটারি সুন্দরী, সেক্সি বলব না। প্রেমিকাকে সেক্সি বলতে নেই, আমার সাথে প্রেম করবে ভাবতেই পারিনি।

মিনিট কুড়ি মানে অনেকক্ষণ। নতুন জায়গায় এসে বসে আছি অথচ কেউ কোনও কথা বলছে না। কোনও শব্দ নেই। নিঝুম। শুধু তুমি হেঁটেছ কয়েক বার খসখস করে। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হওয়ার পরেই বাইরের রোদ, তাপ, কোলাহল থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। অন্য একটা শহর মনে হতে শুরু করেছে। ঘরের আসবাব সব অন্যরকম। একবার সদর স্ট্রিটের একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়িতে ঢুকে এরকম মনে হয়েছিল। যেন অন্য শহরের বাড়ি। সে বাড়িটা অবশ্য কেমন পড়ো শহর মনে হয়েছিল। আর এ বাড়িটা খুব উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে কোনও অন্তরীপ শহরের আসবাব।

সেল্সম্যানদের ধৈর্য অকল্পনীয়। তবু অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। বাইরে বাইকটা পড়ে আছে। এ অঞ্চলের বদনাম ভয় ধরাচ্ছে। চুরি গেলে ইনসিওরেন্সের ফুল ক্লেম পেলেও নতুন বাইক হবে না। আর ক্লেম পেতেও বেশ সময় লাগবে। ততদিন চলবে কী করে! তখনই তুমি বাইরে এলে, এক বৃদ্ধকে প্রায় জাপটে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছ। একজন পুরুষ আর নারীর প্রকাশ্যে জাপটে থাকা সব সময়ই অশোভন। আর তোমার সেজে থাকা! নেল পালিশ, লিপস্টিক, টিপ। সব কিছু গুলিয়ে দিচ্ছিল তোমার ফেটে পড়া শরীর। অনেক সুন্দরী দেখেছি কিন্তু তোমার মতো যৌবনবতী সুন্দরী আর দেখা হয়নি। তাছাড়া সতীশবাবু বৃদ্ধ হলেও বৃষস্কন্ধ, বয়সের তুলনায় সুঠাম। আমার দোষ কী বলো!

শাহিনও তো তোমাকে ভুল বুঝেছিল। আমি ও শাহিন তোমাকে নিয়ে কত কী ভেবেছি। তৃতীয় পক্ষের বউ, বউমা, নাতনি এমনকী রক্ষিতাও। সেই জন্যই তোমাকে বললাম না, প্রথম দর্শনেই তোমাকে চরিত্রহীন ভাবি। তোমাকে নিয়ে কত গবেষণা করেছি দুজনে। তবু বাপ-মেয়ে একবারও ভাবতে পারিনি। ওরকম জাপটে থাকলে কেউ ভাবতে পারে না। তুমি পরে বলেছিলে বাবা অসুস্থ ছিল। সরি অলকা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তুমি সতীশবাবুকে আমাদের কাছে সোফায় বসিয়ে দিয়ে গেলে। বসাতে গেলে ঝুঁকতেই হয়। আর ঝুঁকতেই তোমার সালোয়ারের ভেতর থেকে দুটো পুষি বিড়াল উঁকি দিয়ে গেল।

কাজের কথা বিশেষ কিছু হল না। তুমিও ওই যে সতীশবাবুকে বসিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলে আর বেরোলে না। সতীশবাবুর সামনে থেকে তো আর ঘরের পর্দার দিকে তাকিয়ে তোমাকে খোঁজা যায় না। তবু মনে মনে খুঁজছিলাম, যদি আর একবার দেখা যায় সুন্দরীকে। সতীশবাবু জাহাজে কাজ করতেন। আর জাহাজি মানুষের গল্পের শেষ নেই। সমুদ্র বৈচিত্র্যহীন কিন্তু বন্দরের তো গল্প অনেক। তখনই বুঝলাম তোমাদের বাড়ির অঙ্গসজ্জায় কেন বিদেশি সুবাস। বুঝলাম তোমার বাবা আর সমুদ্রে যেতে চায় না, এবার স্থলপথে আয় চায়। অনেক কষ্টে মুক্তি পেলাম। গল্প শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু কাজের তাড়া সেল্স-এর লোকেদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এডেন বন্দর, তাহিতি, সুয়েজ ক্যানাল এসব গল্প কার না ভালো লাগে। আমার ভূগোলে জ্ঞান খারাপ, তবু ভালো লাগছিল। কানের মধ্যে একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল হূদয়ে। শুধুমাত্র সতীশবাবুর মোবাইল নাম্বারটাই পেয়েছিলাম সেদিন। কবে আসব ইন্সিওরেন্সের জন্য জিজ্ঞাসা করতে নাম্বারটা দিয়ে বলেছিলেন, আসক্ মি ওভার টেলিফোন অ্যান্ড গিভ মি দ্য কোটেশন! তোমার বাবা ইংরেজি ছাড়া প্রায় কথাই বলতে পারে না।

চিঠিটা খুব বড়ো হয়ে যাচ্ছে জানি। আসলে আমারও তো বয়স বেড়েছে আরও দু-বছর, তোমারও। তোমার আমার গল্পও জমে গেছে অনেক। খুব স্মৃতি জমে গেলে রোমন্থন করেই আনন্দ। এসব কথা ফোনে হয় না। তুমি পড়লে আনন্দ পাবে ভেবেই লেখা। গতকাল আর আগামীকাল দুটোই আমাদের জীবনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই লিখছি আনন্দে আর বিষাদে।

শাহিনের কাছে সতীশবাবু নেগেটিভ কাস্টমার। আমার কাছে ইনসেন্টিভ, বউ-এর গয়না গড়িয়ে দেওয়া প্রত্যাশা। আমি ফলো আপ করব ঠিক করেই সতীশবাবুর থেকে বিদায় নিলাম। তোমাকে নিয়ে বেশি কথা ভাবার ছিল না। শাহিনের সাথে দেখা হলেই ও তোমার রূপ, রূপসজ্জা অথবা রূপটান নিয়ে বলে। তার বেশি কিছু না। আমিই শরীরের বেশি বর্ণনা দিতাম। শাহিন শুনত। তবে তোমাকে নিয়ে আমরা অন্য কোনও লোকের কাছে কথা বলতাম না। যেন আমাদের গোপন অভিযানে পাওয়া সম্পত্তি। জানাজানি হলে অংশীদারের ভয়।

তিনদিন পরে সতীশবাবুকে ফোন করলাম। তোমার বাবা কোটেশন চাইল। কোটেশন তো তৈরিই ছিল। আমি বললাম এখুনি দিয়ে আসছি। এবার আর শাহিনকে নিলাম না। চেনা হয়ে গেছে। সোজা চলে গেলাম জিতেন সিং স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। যে-ফ্ল্যাটে তোমাকে প্রথম তোমার বাবার সাথে দেখেছিলাম। একবারও ভাবিনি অন্য কোনও বাড়ির কথা।

তোমার একটা অমোঘ টান তো ছিলই। দরজা খুললে তুমি নিজেই। খুব অবাক হলাম তোমাকে দেখে। বিষণ্ণতার ঘন কুয়াশা তোমায় যেন মুড়ে রেখেছে। সেই প্রথম তোমার উপর মায়া হল। ধনীকে হঠাৎ গরিব দেখলে যেমন মায়া লাগে তার অস্বাচ্ছন্দ্যর কথা ভেবে, তেমনি। ভুল ভাঙল একটু পরেই। তুমি ভেতরে বসালে, যেন বাবাকে ডাকতে গেলে। বেশ কিছুক্ষণ আমি একাই সোফায়। খুব অস্বস্তিকর সময়। বাড়িতে একটাও বই নেই। টিভিও নেই যে চোখ মেলে সময় কাটাব। তোমার বাবা এল না। তুমিই এলে। আমার সামনের সোফায় বসলে। বসেই আমাকে সপাটে প্রশ্ন করলে, হ্যাংলার মতো আগের দিন তাকিয়ে ছিলেন কেন? আমি কী উত্তর দেব! লম্বায় ছয় ছুঁই ছুঁই কিন্তু লজ্জায় তখন জল ছুঁই ছুঁই। সেল্স লাইনে আমাকে সবাই ড্যাম স্মার্ট বলে। আমি বেচুবাবু হিসাবে যথেষ্ট কৃতি। গত তিনবছরে আমার মাইনে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, প্রোমোশন আর কোম্পানি পালটে। সেই আমি এসির ঠান্ডায় ঘামতে শুরু করি। এক গেলাস জল হলে ভালো হতো। ভাবি, একটা কমপ্লেন দিলেই চাকরিটা যাবে। আর এ-লাইনে চাকরি পাওয়া যাবে না। বউ বাচ্চা খাবে কী!

আমার অবস্থা দেখে তুমি নিজেই হেসে উঠলে। ছোটোবেলায় কুলগাছ নাড়িয়ে যেমন পাকা কুল পাড়তাম, কুল কুল করে তেমনি তুমি হেসে উঠলে। কোটেশন এনেছেন? দিন। বাবাকে দিয়ে দেব। এটা আমার বাড়ি। বাবার বাড়ি নয়। হাসতে হাসতে শুরু করে গম্ভীর হয়ে শেষ করলে কথাগুলো। পরে জেনেছি তুমি নাকি জানতে আমি আসব ওই ফ্ল্যাটেই। তুমি নাকি জানতে আমি ভালোবাসবই।

২৮ মার্চ, রবিবার ৮.১০ সকাল

জামদানীপুর।

রাজেন্দ্রনন্দিনী অলকানন্দা,

বাজার করতে গিয়েছিলাম। তুমি অবশ্য বাজার করা ব্যাপারটা বুঝবে না। নিজের হাতে বাজার করাটা খুব মজার ব্যাপার। টাটকা সবজি বেছে কেনা বা বড়ো হাঁসের ডিমটা খুঁজে নেওয়া। তোমরা ধনী। তোমাদের নিজস্ব বাজার সরকার আছে। সে-ই বাজার করে আনে। তিন বাড়িতে ভাগ করে দেয় বাজার। তুমি অবশ্য বেশির ভাগ দিন হোটেল থেকে খাবার কিনে আনাও বলেছ। তুমি ঝাল খেতে ভালোবাসো। লুকিয়ে দেখা করতে এসে দু-একবার তোমার বাড়িতে রান্না করা খাবার, টিফিন বাক্সে এনেছ। কী ঝাল, কী ঝাল! ঝালে আমি মরে যাই অবস্থা। আমি ভাবলাম তোমার জিভ থেকে ঠান্ডা নেব কিন্তু তোমার জিভও অত ঝাল কে জানত! তুমি ওই ঝাল চিলি চিকেন খেয়েই বেরিয়েছ বাড়ি থেকে। আমাকে বলোনি কেন? সেদিন তোমাকে বিষকন্যার মতো লাগছিল। সেদিন সেজেও ছিলে পাকা লংকা রঙের শাড়িতে।

প্রথম থেকেই তোমাদের ব্যাপারগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ছিল। তোমার বাবার ইংরেজি আর ভাইয়ের হিন্দি শুনে ভেবেছিলাম তোমরা অবাঙালি হবে। ‘সতীশ সিং’ তোমার বাবার নাম লিখেছিলাম ইন্সিওরেন্স কভার নোটে মনে আছে। পরে তুমি বললে, তোমরা মুঙ্গেরের প্রবাসী বাঙালি। সিনহা, সিংহ হয়ে সিং-এ পৌঁছেছে। বারুইপুরে তোমাদের আদি শিকড়। বারুইপুর থেকে কয়েক পুরুষ আগে ভাগ্য অন্বেষণে মুঙ্গের। আবার ফেরা কলকাতায়। তোমার সাথে না আলাপ হলে জানতাম না, বারুইপুরে তোমার বাবার বিশাল অট্টালিকার কথা। অবশ্য তোমার সাথে আমার যেটা হয়েছে সেটা আলাপ নয়, দুকূল ছাপানো প্রেম। বারুইপুরের উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাগানবাড়িতে একটা যৌবনবতী মহিলা কী করে বালিকাবেলায় ফিরে যেতে পারে সেদিন দেখেছিলাম। সেই প্রথম তোমাকে অযৌনতায় দেখি। খালি পায়ে মেক্সিকান ঘাসের উপর দৌড়োতে দৌড়োতে ক্লান্ত হয়ে আমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলে। আমি ঘাসে বসে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, যেমন বাড়িতে তিন বছরের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।

আমার মেয়ে তিন্নি খুব আদর খেতে চায়। খুব বায়না। এটা আনবে ওটা আনবে। আজ ক্যাডবেরি তো কাল খেলনা গাড়ি। ওর বায়না মেটাই বলে আমার বউ খুব রাগ করে। মানসী স্কুল মাস্টারের মেয়ে। ওর কাছে আদর্শ ব্যাপারটা সহজাত। পয়সা একদমই নষ্ট করতে চায় না। নিজে দামি পরবে না, মেয়েকেও পরাতে দেবে না। আমার ওইটুকু মেয়ের সাজার খুব শখ। ঠিক তোমার মতো। মাঝে মাঝে মনে হয় তিন্নি তোমার মেয়ে। মানসীর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র তোমার ও তিন্নির। মানসী অপ্রয়োজনে সাজে না। বাড়িতে টিপ পরতে বললেও লজ্জা অথচ মানসী দেখতে ভালোই। মুখশ্রী সুন্দর। তোমাকে তো আমাদের বিয়ের ফটো দেখিয়েছি। বাড়ি থেকে লুকিয়ে অ্যালবাম নিয়ে গেছি আমাদের বিয়ের। তুমি বহুবার আমাকে বলেছ তুমি মানসীকে খুব পছন্দ করো। আর তিন্নিকে তোমার খুব ভালো লাগে বলে সেই পছন্দটা এসেছে। তিন্নিকে তুমি বহুবার দেখতে চেয়েছ কিন্তু তিন বছরের মেয়েকে কী করে দেখাই বলো? আরও একটু বড়ো হোক কলকাতায় তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাব। এই মফস্সল থেকে এখনই নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মানসী এখন তিন্নিকে আমার সাথে একা ছাড়বেও না।

আমার মেয়ের কথা, বউয়ের কথা সব বলেছি। আমার বাড়ির সব কথাও। বাবা ঠাকুরদার গরিব জীবনের কথা। বিয়ে করার কথা। অথচ তুমি নিজের কথা ছাড়া বিশেষ কিছু বলতে চাও না। তোমার বাবার কথা মায়ের কথা প্রায় কিছুই বলোনি। যেটুকু জেনেছি তাও আমার অনন্ত প্রশ্নের আগ্রহে শোনা। তোমার মা দুটো বলেছিলে। তারা দুজনেই বেঁচে আছে না মরে গেছে কোনওদিন বলোনি। তোমার ভাই যাকে আমি প্রথমদিনই শাহিনের সাথে প্রথম বাড়িতে দেখি, সে কি তোমার সৎ ভাই? জিজ্ঞাসা করলে তুমি এড়িয়ে যাও। এই সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেই তুমি শরীর দেখাও আর আমাকে জাগিয়ে দাও শরীরে। আমি রম্ভার শরীর দেখি, মাখি, ছানি, অসম্ভব সব বক্রতা থেকে আমার মনের মতো যৌনতা খুঁজি। আমাকে তুমি এত শরীরী-সুখ দিয়েছ মাঝে মাঝে মনে হয় তুমিই স্বর্গ অথবা চরম সত্য। অথচ তোমার সাথে যৌনসম্ভোগ তখনও হয়নি। চূড়ান্ত সম্ভোগের কোনও সম্ভাবনাও ছিল না। তুমি কিছুতেই রাজি ছিলে না। তুমি আমাকে শরীরে মাখতে কিন্তু শরীরে নিতে রাজি ছিলে না।

আজ রবিবার। বাজার করে এনে দিয়েছি। এখন খাবার সময় হয়ে এসেছে। মুড়িঘণ্ট ডাল আর খাসির মাংস। স্নান করতে হবে এবার। অথচ কিছুতেই স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গত দু-বছর আমাদের সম্পর্ক। দু-বছরে অনেক কথা হয়েছে। তুমি ভালোবাসবে না শুধু বন্ধুত্ব রাখতে চেয়েছ। সেখান থেকে অনেক কষ্টে তুমি স্বীকার করেছ ভালোবাসো। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্কটা টিকত না। ‘ভালোবাসি’ কথাটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম। একটা অন্য রকম স্বীকৃতি। তুমি বললে, সেই অমোঘ শব্দরাশি ভালোবাসি, ভালোবাসি। আমাকে বললে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে ভালোবাসো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম বরের থেকেও? তুমি থমকে গেলে। তারপর আবার সময় চাইলে। তোমার বর কী করে, কোথায় থাকে জানি না। পরে বলেছ সেও বাবার মতো জাহাজি। বাবার দেখে দেওয়া পাত্র। সেও নীল সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। নীল আকাশে সমুদ্র-পাখি খোঁজে। আমি বলেছিলাম নাবিকের সংসার তো বন্দরে বন্দরে। তুমি কোনও উত্তর দাওনি। আমার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছিলে অসম্ভব যৌনতা। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই তোমার কৌশলে। আমার সমস্ত প্রশ্ন হারিয়ে যায়। আমি তখন শিশুর মত পৃথিবী ভুলে মায়ের কোল খুঁজি নির্মল আনন্দে। আমার নিবাস, আবাস, পরবাস, সুবাস তখন তোমার মধ্যে। তুমি নিতেও পারো আমাকে অসম্ভব। যেন তুমিও আমার মধ্যে খুঁজতে অন্য পৃথিবী। একটা দুরন্ত বালকের মাতৃত্ব সামলানোর মতো আমায় তৃপ্ত করতে, দৃপ্ত করতে, দৃঢ় করতে।

আজ কিছুতেই স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গত দু-বছরে আমরা দুজনে দুজনকে কাল প্রথম সম্পূর্ণ পেলাম। তুমি স্বীকার করেছ আমাকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসো। আমিই তোমাকে সব থেকে বেশি বুঝি অথবা তুমি আমার সঙ্গেই সময় কাটিয়ে সব থেকে বেশি সুখ পাও। তোমার কোনও সন্তান নেই। তবু তুমি আমার সাথে পালাতে পারবে না। আমার সংসার তুমি ভাঙতে চাও না। আর আমিও যতই তোমাকে ভালোবাসি, মানসীকে বা তিন্নিকে ছাড়তে চাই না। তোমার মতো উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়ে আমার মধ্যে কী দেখেছে জানি না কিন্তু কাল প্রথম যখন অনেক দূরের একটা হোটেলে আমাকে শরীরে নিলে, আমার মনে হয়েছিল তুমিও আমাতে তৃপ্ত। শুধু একবার চরম তৃপ্তির আগের মুহূর্তে দ্বিতীয় দিনে দেখা বিষণ্ণতা কয়েক পলের জন্য ফিরে এসেছিল। কাল আমাকে যেতেই হবে। কোম্পানি আমাকে সেল্স ম্যানেজার থেকে অসমের তিনসুকিয়ায় ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করে পাঠাচ্ছে। এটাও সম্ভব হয়েছে তোমাদের চবিবশটা গাড়ির ইন্সিওরেন্স পাবার জন্য। তুমি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও মতামত দাওনি। তুমি কি চাইছ আমি দূরে চলে যাই? না হলে একবারও কেন বললে না থেকে যেতে? কালই তোমাকে পুরোপুরি পেলাম আর আজ আমাকে চলে যেতে হবে ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে। তুমি অবশ্য কথা দিয়েছ তিনসুকিয়ায় আসবে। থাকবে বেশ কিছুদিন। খুব মজা হবে পাহাড়ি ঝরনার নীচে জলপরিকে পেলে! এখন যাই। স্নান করি। না হলে মানসী রাগারাগি করবে। শরীরে তোমার সুবাস নিয়ে আবার আজ শাওয়ারের নীচে দাঁড়াব শুধু আজ পাশে তোমাকে, রতিক্লান্ত তোমাকে পাব না।

২৮ মার্চ, ১.৫৫ দুপুর,

জামদানীপুর।

অলকানন্দা,

চিঠিগুলো পোস্ট করা হয়নি। ভেবেছিলাম পরিষ্কার করে আবার লিখে তোমাকে তিনসুকিয়া থেকে পোস্ট করব। কিন্তু এখানে এসে চার্জ নিয়ে সব কাজকর্ম বুঝে নিতেই দিন দশেক হয়ে গেল। তোমাকে এখানের ফোন নাম্বার আগেই দিয়ে এসেছিলাম। আমি অফিসে এসেও তোমাকে ফোন করেছিলাম দু-দুবার। দুবারই তোমার মোবাইল বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। তুমি বলেছিলে কোনও বিপদ বা জানাজানি হয়ে গেলে চুপচাপ হয়ে যেতে। ছ-মাস পর সব ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার যোগাযোগ করা হবে। আমি ভয় পেলাম বোধহয় জানাজানি হয়ে গেছে! তোমার কথা ভেবেই আমার কলকাতার মোবাইল নাম্বার চালু রেখেছি। কলকাতার কাস্টমাররা বিরক্ত করছে, ইনকামিং টাকা কাটছে, তবুও তোমার কথা ভেবে চালু আছে আজও। আমি ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে যাই। এখানে অনেক দায়িত্ব। তবু রোজ রাতে তোমাকে ফোন করতে চাইতাম। এখানে একা থাকি। ফোন করলে বউয়ের কাছে ধরা পড়ার ভয় নেই। ফোনটা বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাবতাম এই বুঝি তুমি ফোন করবে। তবু তোমার বিপদের কথা ভেবে কোনও দিন ফোন করতাম না। তুমি বলেছিলে তোমার বাবা জানতে পারলে অনার কিলিং-এ তোমার নাম উঠবে। আমি স্রেফ ভয়ে ফোন করিনি। চিঠি পোস্ট করার প্রশ্নই ওঠে না।

গত কয়েকদিন থেকে মনে হচ্ছে ধনীর মেয়ে, বড়োলোকের বউ। বর বিদেশে থাকে! শরীরের চাহিদায় তুমি আমার কাছে এসেছিলে। শরীর যখন পেলে তখনই আমাকে বহুদূরে চলে আসতে হল। তাই আমার প্রতি আর কোনও টান নেই। হয়তো এরকমই করো তুমি। বা সব নাবিকের ঘরনিই এরকম ভাবে সময় কাটায়। আবার মনে হচ্ছিল তুমি বুঝি সত্যিই ভালো। যেমন দেখেছি তেমনই ভালো। শরীর চাইলে পাঁচতারা হোটেলে শরীর খেলাতে পারতে। সব রকমই ভাবছি। সন্ধে থেকে একা এবং অফুরান সময়। ভাবনারাও খেলে বেড়ায় বামদিক ডানদিক, দুদিক। ভাবছি চূড়ান্ত তৃপ্তির আগের মুহূর্তের বিষাদ ব্যাধ কী তির মারল যে, তুমি এক পলকের জন্য উদাস হয়ে গেলে! বরের কথা মনে পড়েছিল? অথবা ব্যভিচারের সূক্ষ্ম পাপবোধ?

সব ভাবনাই শুধু ভাবার জন্য। উত্তর পাওয়ার কোনও উপায় নেই। কেউ জানে না আমাদের গোপন সম্পর্ক। কেউ না। শুধু শাহিন হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। শাহিনকে জিজ্ঞাসা করব কিনা কয়েকদিন মরিয়া চিন্তায় আছি। হঠাৎ কাল অনেক রাতে শাহিন ফোন করে। আমি তোমার ব্যাপারে জানতে যাব, শাহিনই তুলল তোমার কথা। জানো বস্ খিদিরপুরের সতীশ সিং-এর বাড়ির সেই সুন্দরী মেয়েটা উত্তরাখণ্ডের একটা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেছে। নদীটার নাম নাকি মেয়েটার নামেই ছিল। মেয়েটাকে মনে পড়ে তোমার?

১২ এপ্রিল সকাল ৮টা

বক্স রোড তিনসুকিয়া, অসম।

 

প্রিয়জন

রাত দুটোর সময় হঠাৎ মোবাইলের শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসল দীপ্ত। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ছোড়দির কল। ধড়াস করে ওঠে বুকটা, মায়ের কিছু হয়নি তো? না হলে এত রাতে ফোন? কোনওমতে ফোন অন করে বলল,  ‘হ্যা ছোড়দি দীপ বলছি। এত রাতে ফোন করলি? সব ভালো তো?’

ও-প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘সরি ভাই এতরাতে তোদের ডিস্টার্ব করার জন্য। চিন্তা করিস না, মা-র কিছু হয়নি। তোদের অসুবিধা না থাকলে এক মিনিট কথা বলতে পারব কি?’

ছোড়দি সুপ্রিয়ার কথা বলার ধরন দেখে দীপ আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘না না অসুবিধা কেন হবে?  বল না কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?’

‘শোন তোকে আর তোতলাতো হবে না। মিতার নিশ্চয় ঘুমটা ভেঙে গেছে। ফোনটা স্পিকারে রাখ, তাহলে দুজনেই শুনতে পারবি। এবার শোন আমাদের রুমা এখন বিয়ে করতে চলেছেন। বুঝতে পারছিস রুমা বিয়ে করবে? সম্ভব হলে সামনের মাসেই।’

একটা ছোট্ট হাই তুলতে তুলতে দী৫ বলল, ‘ও… এই কথা, এর জন্য এত রাতে–’

দীপ্তকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে পাশ থেকে ঘুম জড়ানো চোখে, গলায় যথা সম্ভব উদ্বেগ ঢেলে দিয়ে মিতা বলে উঠল, ‘সে কি? তুমি কী করে জানলে ছোড়দিভাই? রুমা কি নিজে বলেছে তোমাকে? ছেলেটা কে? কী করে হল?

‘জানি না রে মিতা। কী করে হল? কবে হল? কিচ্ছু জানি না। কিন্তু এর পর কী হবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছি।’

‘বড়দি জানেন?’ মিতা জানতে চাইল

‘হ্যাঁ বড়দিই তো আমাকে মেসেজ করে জানাল। আমি তক্ষুনি ফোন করাতে জানলাম তিনি রোগী নিয়ে ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন। তাই তোদের ফোন করলাম। সরি রে তোদের ঘুম নষ্ট করলাম। তোরা শুয়ে পড়। সম্ভব হলে সন্ধে সাতটার পরে ফোন করিস। অলোচনা করে কিছু তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

দীপ তখনও বুঝতে পারছিল না রাত দুটোর সময় হাজার মাইল দূরে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকে ছোড়দি ঘুম থেকে তুলল এই খবরটা দেবার জন্য। এটা তো মেসেজ বা ইমেইল করেও জানাতে পারত। কিংবা দিনের বেলাতেও ফোন করতে পারত। তা না, দিল ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। এবার জোর করে একটা হাইকে বুক থেকে টেনে মুখ দিয়ে বের করে দিতে দিতে চোখ বুজে দীপ নিদ্রাদেবীকে আহ্বান জানাল। কিন্তু পেছন থেকে তখনই মিতা একটা ছোট্ট গুঁতো মারল, ‘কি হল ঘুমিয়ে পড়লে? বুঝতে পারছ এবার কী হবে?’

‘না ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। তবে রুমা বিয়ে করবে –এই তো? হয়তো কিছু টাকা পয়সা চাইবে। দ্যটস্ ওকে। সি ইজ লাইক আ ফ্যামিলি মেম্বার।’

দী৫ আবার ওপাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল অদ্ভুত কায়দায় মিতা শোয়া অবস্থা থেকে তড়াক করে উঠে বসল। দীপ ভাবল জিমটিম গিয়ে মিতা ভীষণ ভাবে ফিট হয়ে গেছে।

কিন্তু দীপ্তকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে মিতা বলল, ‘সত্যি তোমার বুদ্ধির বলিহারি। তুমি টাকা দিলে আর রুমা বিয়ে করে ড্যাং ড্যাং করে নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। ব্যস তোমার মতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আরে বাবা সমস্যার শুরু তো তখন হবে যখন রুমা তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।’

অন্ধকার ঘরে দীপ্তর মগজের টিউবলাইট তখন জ্বলে উঠল। তাই তো গত বারো তেরো বছর ধরে রুমা মায়ের কাছে আছে। যখন এসেছিল তখন ওর বয়স বোধহয় বছর তিরিশ হবে। বিয়ের পরে বাচ্চা না হবার জন্য শ্বশুরবাড়িতে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছিল। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। দাদা-বৌদির সংসারে হয়তো ঠাঁই হতো কিন্তু সেটা খুব একটা সম্মানের হতো না। তাই মায়ের এক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছে খবর পেয়ে মায়ের কাছে কাজের খোঁজে আসে।

মা তার দুবছর আগে শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সেই সময় দীপ অনেক কষ্ট করে তার স্বপ্নের দেশ আমেরিকা-তে এসে পৌঁছেছে। বড়দি আর কৃষ্ণনদা তখন তিথিকে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে, ছোড়দি আর সমীরদা উত্তরবঙ্গের কোনও এক শহরে। মা শ্রীরামপুরে তার নিজের বাড়িতেই থাকবার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। এ রকম অবস্থায় রুমা যখন মায়ের কাছে আশ্রয় চাইল মা তাকে না বলেননি। মনে একটু কিন্তু কিন্তু থাকলেও তারা তিন

ভাই-বোন ব্যাপারটা মেনে নেয় এই ভেবে যে, মায়ের জন্য একটা চবিবশ ঘন্টার কাজের লোক পাওয়া গেল।

রুমা থাকাতে মায়ের যে কত সুবিধা হয়েছে তা দু-বছর পরে দেশের বাড়িতে গিয়ে বুঝল দীপ্ত। দেখল মা সংসারটা রুমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। রুমা সকাল থেকে সন্ধে অবধি ছুটে বেড়াচ্ছে। সকালে দীপ্তর জন্য ডালপুরি আলুর দম বানাচ্ছে তো দুপুরে মিতার পছন্দের পটলের দোলমা। তারই মধ্যে মায়ের জন্য একাদশীর ফলাহার। দীপ্তর মেয়ে দিঘি যেবার দেশের বাড়িতে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল রুমাই তখন রাত বারোটার সময় ওষুধের দোকান খুলিয়ে ওষুধ নিয়ে আসে। রুমা যে কবে কাজের লোক থেকে বাড়ির লোক হয়ে গেল বোঝাই গেল না।

শুধু যে মায়ের সংসারে সে অপরিহার্য হয়ে গেল তা নয়,পাড়া-প্রতিবেশীদের ছোটো খাটো প্রয়োজনেও রুমারই ডাক পড়ে আগে। সামনের বাড়ির মাসিমার টিউবলাইট-টা কাজ করছে না! রুমা দেখে যা তো বাবা, পাশের বাড়ির বউদির বাড়িতে হঠাৎ করে বাপের বাড়ির লোকজন এসেছে– ‘রুমা চট করে মোড়ের দোকান থেকে এগ রোল নিয়ে আয় তো সোনা।’

এ হেন রুমা-কে নিয়ে সুতপা সেনের সংসার ভালোই চলছিল।শুরু শুরু-তে যে ভয় ছিল কোথাও কোনও গন্ডগোল না বাঁধিয়ে বসে রুমা! সেটাও ধীরে ধীরে চলে গেল। এখন হঠাৎ করে চল্লিশোর্ধ রুমা বিয়ে করে চলে গেলে অসুবিধা তো হবেই। মা কার কাছে থাকবে? দিদিরা নিশ্চয়ই দীপ্তকে বলবে না মা-কে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখতে। তাও দু-তিন মাস কোনওমতে হয়তো ম্যানেজ করা যাবে কিন্তু তার বেশি তো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।

হঠাৎ দীপ্তর মাথায় একটা সম্ভাবনা এল। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে রুমা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি না গিয়ে ওর স্বামীকে নিয়ে মায়ের কাছে থেকে গেল। তাহলে ওরা দুজনে মিলে মায়ের দেখভাল করতে পারবে। সময়ে অসময়ে একজন পুরুষমানুষ বাড়িতে থাকলে সুবিধাই হয়! প্রয়োজন হলে দীপ না হয় আরেকটু বেশি টাকা পাঠাবে। সমস্যার এমন ভালো সমাধান পেয়ে দীপ শান্তমনে আবার ঘুমের চেষ্টায় চোখ বুজল।

দুই

সুচিত্রা বেশ খুশি মনে তার চেম্বারে ঢুকল। যদিও বেশ টায়ার্ড লাগছে কিন্তু মনটা তার প্রসন্ন। সবাই বলেছিল ওই পঁয়ত্রিশ বছরের রুগ্ন তিন বাচ্চার মা পেশেন্টের সিজারিয়ান সেকশন করতে, কারণ সে একদম পুশ করতে পারছিল না আর বাচ্চাটাও বেশ বড়ো ছিল। সুচিত্রা কিছুটা জেদ করেই ফরসেপস ডেলিভারি করিয়েছে। সি-সেকশনের পরে যেরকম যত্ন নেওয়া উচিত তা এই চার সন্তানের মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে চাইছিল যথা সম্ভব অপারেশনটা না করতে। যাক এখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। বাচ্চাটা তো প্রায় সাড়ে তিন কিলো ওজনের।

সুচিত্রা অবাক হয়ে ভাবে এত রুগ্ন মায়ের পেটে এত হেল্দি বেবি কী করে হয়? আর তার মতো গাইনিকোলজিস্টকে ইনফারটাইল তকমা নিয়ে থাকতে হয়। যাকগে এই সব আজে বাজে কথা ভেবে সুচিত্রা আজকের এত ভালো দিনটা নষ্ট করবে না। সে তো এখন মা হয়েছে। অ্যাডপ্ট করা হলেও কী হবে, তিথি তো ওকে মা হবার সুযোগ দিয়েছে। নিজের ভালো হওয়া মনটাকে খারাপ হবার সুযোগ না দিয়ে চট করে ঘড়ি দেখে নিয়ে কৃষ্ণনকে মোবাইলে ফোন করল, ‘খাওয়া হয়ে গেছে?’

‘না তোর?’

‘না এক্ষুনি ওটি থেকে বেরোলাম। যে-পেশেন্টটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম ওর ফরসেপস ডেলিভারি করিয়েছি।। মাদার অ্যান্ড বেবি বোথ ওকে, ফিলিং স্যাটিসফায়েড।’

‘তাহলে চলে আয় আমার চেম্বারে, সেলিব্রেট করব।’ হই হই করে কৃষ্ণন বলল।

‘কী করে?’ সুচিত্রা জিজ্ঞেস না করে পারল না।

‘লুচি আর বোঁদে দিয়ে।’

কৃষ্ণনকে নিয়ে এই এক মুশকিল। ও খেতে খুব ভালোবাসে।

যে-কোনও সময় যা খুশি খেতে পারে, তা সে বিরিয়ানি দিয়ে ব্রেকফাস্ট হোক বা লস্যি দিয়ে লাঞ্চ।

চট করে ওটির জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কৃষ্ণনের চেম্বারে যেতে যেতে সুচিত্রা ঠিক করে ফেলল খাবার পরেই সুপ্রিয়াকে একবার ফোন করে নেবে। কাল রাতে ফোনে মায়ের কাছ থেকে রুমার বিয়ের কথাটা জেনেছিল। সকালে সুপ্রিয়াকে মেসেজ করেছিল। সরাসরি ফোন করেনি কারণ সুপ্রিয়া অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যায়। তাই ভেবেছিল মেসেজ পড়ে কিছুটা ধাতস্থ হবার পরে ফোন করবে। কিন্তু সুপ্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে এত প্রশ্ন করছিল আর তার সঙ্গে নিজের মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল যে সুচিত্রা তার রোগীর অজুহাত দেখিয়ে ওকে কোনওমতে থামাতে বাধ্য হয়। সঙ্গে এটাও প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল যে, ও কোনওমতেই মা বা রুমাকে ফোন করে এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা করবে না।

কৃষ্ণনের চেম্বারের দরজায় দুবারটোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল গাল ভরা হাসি নিয়ে কৃষ্ণন টেবিলে পুরি আর বোঁদে সাজিয়ে তারই অপেক্ষায় বসে আছে।

‘তোকে কে বলেছে এগুলো লুচি? এগুলো তো পুরি!’ সুচিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলল।

‘লুচি আর পুরি একই হয়। বাংলার জামাই হয়ে লুচিকে আমি পুরি বলব?’

লুচি আর পুরির তর্কে না গিয়ে সুচিত্রা খেতে বসে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করল ‘বোঁদে কোত্থেকে পেলি?’

অর্ধ নিমিলিত চোখে লুচি আর বোঁদে চিবোতে চিবোতে কৃষ্ণনের উত্তর, ‘আমার এক পেশেন্ট দিয়ে গেছে। হারনিয়া রিপেয়ার করেছিলাম। কলকাতার পেশেন্ট!’

‘কলকাতা থেকে হারনিয়া অপারেশন করাতে বেঙ্গালুরুতে এল। স্ট্রেঞ্জ, ওখানেই তো করাতে পারত।’ পুরির টুকরো ভেঙে মুখে দিতে দিতে সুচিত্রা বলল, ‘এখানে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, অহেতুক পয়সা খরচ করে কী যে স্যাটিসফ্যাকশন পায় কে জানে?’

কৃষ্ণনের তখন খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই সত্যি করে বল তো তুই আমার বউ নাকি শত্রু? কলকাতা থেকে পেশেন্ট আসছে, আমি দুটো পয়সা কামাচ্ছি, তা বুঝি তোর সহ্য হচ্ছে না।’ তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে আমার মনে হয় এটা হিউম্যান সাইকোলজি। যেটা হাতের কাছে পাই তার ভ্যালু আমরা বুঝি না। ওরা হয়তো ভাবে সাউথ ইন্ডিয়ান ডাক্তাররা ভালো, আর সেই ডাক্তার যদি বিশাল লম্বা সাউথ ইন্ডিয়ান নাম নিয়ে রোগীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলে তাহলে তো আর কথাই নেই।’

কৃষ্ণন হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই ফোন এল– ‘অপারেশন থিয়েটার রেডি’।

চট করে উঠে চেম্বার থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘চলি রে, দুটো অপারেশন বাকি আছে। তোর তো বিকেলে চেম্বার নেই আজকে, দ্যাখ যদি সাতটার মধ্যে বাড়ি আসতে পারিস তাহলে দুজনে মিলে একটা সিনেমা দেখা যেতে পারে। আর শোন ভাবছি উইক এন্ডে তিথিকে একবার সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে আসব। তুই প্ল্যান কর, আমি চলি।’

কৃষ্ণনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা ভাবল– ও সত্যি কত ভালো আছে। বিয়ের আগে সবাই কত ভয় দেখিয়েছিল। অবাঙালি ছেলে, মাছ মাংস খায় না, তার মধ্যে মায়ের একমাত্র ছেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেখছে কৃষ্ণনের মতো স্বামী পাওয়া, নিজের গর্ভে জন্ম না দিলেও তিথির মতো মেয়ে পাওয়া, সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু তাদের এই লাইফ স্টাইলের সাথে মা কি একটা দিনও মানাতে পারবে? নাকি মা এলে ওরা মা-কে বাড়িতে একা রেখে বাইরে এভাবে সময় কাটাতে পারবে? সকালে প্রিয়া ফোন করে এজাতীয় একটা প্রস্তাব রেখেছিল যেটা সুচিত্রার কাছে সম্পূর্ণ অবাস্তব মনে হয়েছিল।

সুচিত্রার চিন্তার জাল ছিঁড়ে মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখল সুপ্রিয়ার কল… ‘হ্যাঁ প্রিয়া বল। না না শোন তুই মাথা গরম করিস না, আমি পরের সপ্তাহে শনিবার কলকাতা যাব। তুইও চলে আয়। তখন বসে কথা হবে। তুই প্লিজ মা বা রুমার সঙ্গে রাগারাগি করিস না। তুই ভাবিস না। আমি দীপ্তর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। আমি বুঝি রে তুই কত ব্যস্ত। তাহলে এখন রাখি? ভালো থাকিস।’

তিন

সুপ্রিয়ার কাজের অন্ত নেই। সকাল আটটার মধ্যে দশ বছরের যমজ দুই ছেলেকে তৈরি করে স্কুল পাঠাও। তার মধ্যে বেড টি নিয়ে ছেলেদের বাবাকে ঘুম থেকে তোলো। তারপর নিজে তৈরি হয়ে কোনওমতে নাকে মুখে খাবার গুঁজে সময়মতো কলেজ পৌঁছাও। ভাগ্য ভালো তার রান্নার মাসিটা খুব ভালো পেয়েছে। সে বেশ সকাল সকাল চলে আসে বলে সুপ্রিয়া রক্ষা পেয়েছে। কামাইও করে না। তবে সুপ্রিয়াও মাসিকে যথেষ্ট তোয়াজ করে রাখে। শনিবার আধা বেলা আর রবিবার তো ওর পুরো ছুটি!

শাশুড়ি মায়ের সকালের চা থেকে শুরু করে খাবার-দাবার সব তো মাসিই করে দেয়। উনি তো আমিষের ছোঁয়া খাবেন না, তাই মাসি আগে নিরামিষ রান্না করে তার পর আমিষ রান্নাগুলো করে। এর জন্য সুপ্রিয়াকে দুটো গ্যাস আভেন রাখতে হয়েছে। তারই মধ্যে ছেলে দুটো কখনও কখনও রান্না ঘরে ঢুকে কী রান্না হয়েছে দেখতে গিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি করে ফেলল তো আর দেখতে হবে না। বাড়িতে তুলকালাম কান্ড বেধে যাবে, আর সব দোষ সুপ্রিয়ার উপর পড়বে। কী যে জ্বালা! আর এখন এই ডামাডোলের মধ্যে মা-কে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।

রুমা এখন বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়সে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বিয়ে করতে চলল। রুমা না থাকলে মায়ের পুরো দায়িত্ব সুপ্রিয়ার ঘাড়ে এসে পড়বে। হাতের কাছে তো সেই আছে। মাকে যে এখানে এনে রাখবে তারও উপায় নেই। শাশুড়িমা তার নিয়মের বেড়াজালে সংসারটাকে এমন করে বেঁধে রেখেছেন যে সুপ্রিয়ারই দমবন্ধ লাগে।

মঙ্গল আর শুক্রবারে কোনও পোড়া খেতে নেই তো বৃহস্পতি ও শনিবারে আমিষ খেতে নেই। এইমাসে লাউ খেতে নেই তো ওই মাসে কুমড়ো খেতে নেই।। আজকে সবার মাথায় তেল লাগাও তো কালকে গায়ে হলুদ লাগাও। শুরু শুরুতে তো পাগল পাগল লাগত। এখন সময়ের সাথে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে!

শাশুড়িমায়ের নিয়ম আছে তো সুপ্রিয়ার কাছে তার সহজ উপায় আছে। যেমন তেল বা হলুদ গোলা জল বাথরুমে রাখাই থাকে। প্রয়োজনে কপালে এক ফোঁটা ঘষে নিলেই হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে খটাখটি লাগে। শাশুড়িমায়ের বদ্ধমূল ধারণা, মায়ের প্ররোচনায় দিদি আর কৃষ্ণনদা তাদের ব্যাচমেট সমীরের ঘাড়ে সুপ্রিয়াকে চাপিয়ে দিয়েছে। যদিও সমীর প্রায় দুবছর রীতিমতো সুপ্রিয়ার সঙ্গে কোর্টশিপ করার পর তার মায়ের অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে?

সমীরকে বলে লাভ নেই। সে তার চাকরি নিয়ে সব সময় এত টেনশনে থাকে যে সুপ্রিয়া ওকে আর সংসারের অসুবিধার কথা বলে ব্যতিব্যস্ত করতে চায় না। দুবছর আগে পাওয়া কলেজের এই লেকচারারের চাকরিটা সুপ্রিয়া-কে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে কলেজটা একটু দূরে বলে যাতায়াতের সময়টা বেশি লাগে কিন্তু সেই সময়টাই ওর একান্ত নিজস্ব। ওই সময়টায় ও নিজের মনের সঙ্গে অনেক কথা বলে। কল্পনায় কখনও একা কখনও বা সমীরের আর ছেলেদের সঙ্গে দুরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়। এমন কোনও জায়গা যেখানে কোনও সমস্যা নেই কোনও অভিযোগ অনুযোগ নেই। যেখানে মন খুলে হাসা যায়, গান গাওয়া যায়। সুপ্রিয়া জানে না, সেদিন সত্যি তার জীবনে আসবে কিনা।

চার

আজ সকাল থেকে বাড়িতে বেশ হইচই লেগেছে। সুতপা গত এক সপ্তাহ থেকে অপেক্ষায় ছিল এই দিনটার জন্য। গত সপ্তাহে তার তিন ছেলেমেয়ে জানাল– ওরা আসবে সব একসাথে। চিত্রা আর প্রিয়া-রা দুদিন থেকে চলে যাবে, তবে দীপ্ত, বৗমা আর নাতনিকে নিয়ে এক সপ্তাহ থাকবে। তারপর ওরা মুম্বই-এ দিঘির মামার বাড়িতে কয়েকদিন থেকে আমেরিকা ফেরত যাবে।

সুতপা ভালো করেই বুঝতে পারছে ওরা কেন আসছে! তাহলেও খুব ভালো লাগছে সবাইকে একসাথে দেখতে পাবে বলে। দীপ্তরা কাল রাতেই এসে পৌঁছেছে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ভালো করে কথা হয়নি। তবে দী৫ আজ কাকভোরে উঠেই চলে এসেছে মায়ের ঘরে। মায়ের খাটে মশারির মধ্যে ঢুকে বাবু হয়ে বসে কত যে বকবক করল তার ঠিক নেই। এরই মধ্যে তাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে রুমা চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। দীপ্তর জোরাজুারিতে সুতপাকে দাঁত না মেজেই চা খেতে হল খাটে বসে। এতে নাকি চায়ের আসল স্বাদ পাওয়া যায়।

আসলে সুতপার মনে হল বাকি সবাই এসে যাবার আগেই দী৫ সুতপার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছিল। সুতপার সেই ছোটোবেলার দীপ্তকে মনে পড়ে যায়। সবসময় মায়ের সঙ্গে লেগে লেগে থাকত। বড়ো হবার পর সেটা কমলেও সব সময় ও সুতপার দিকে নজর রাখত। ওদের বাবা মারা যাবার পর তো আরও বেশি করে। মা সময়মতো খাচ্ছে কিনা, শরীরের খেয়াল রাখছে কিনা। চোখ দেখিয়ে চশমার পাওয়ার চেঞ্জ করা হয়েছে কিনা! এমনকী পুজোতে মায়ের কটা নতুন শাড়ি হল তাও খেয়াল রাখত।

সুতপার জীবনগাছের দী৫ ছিল এক বলিষ্ঠ ডাল। তারপর সেই ডাল আমেরিকায় গিয়ে নিজে গাছ হয়ে গেছে। শুধু কি দী৫ নাকি, চিত্রা, প্রিয়া সবাই এক একটা গাছ হয়ে নিজেদের সংসারের মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি সুতপার ভাবতে খুব ভালো লাগে যে, তার তিন ছেলে মেয়ে সবাই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠ। অজান্তে তার দৃষ্টি চলে গেল দেয়ালে বড়ো ফ্রেমে টাঙানো গৗতমের ছবির দিকে।

ব্যাংকে সামান্য চাকরি করা গৌতমের এক মাত্র লক্ষ্য ছিল তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করা। সংসারের একটু স্বাচ্ছল্য বাড়াবার জন্য সুতপা স্কুলে চাকরি নিয়েছিল। সুতপার মনে আছে সিনেমাপাগল গৗতম তার সন্তানদের নাম সিনেমার তারকাদের নামে রাখতে চেয়েছিল। দুই মেয়ের পরে ছেলের নামের সময় সুতপা বেঁকে বসেছিল শুভেন্দু নয় সুদীপ্ত রাখতে হবে।

হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে হা হা করে হাসির শব্দ সুতপার ভাবনাটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। তার মুখেও একটা ছোট্ট হাসি খেলে গেল। সকালে বিছানায় বসে দীপ্তর সঙ্গে গল্প করার মধ্যেই প্রিয়া আর সমীর দুই ছেলে-সহ চলে এসেছিল। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বোধহয় চিত্রারাও চলে আসবে। আবার জোর হাসির আওয়াজ এল, সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ার গলা ‘মা, মা তুমি এখানে এসো তো, এরা সবাই আমাকে যা তা বলছে তখন থেকে।’

ড্রয়িংরুমে যাবার বদলে সুতপা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রিয়া চলনে বলনে অনেকটা ওদের বাবার মতো ছিল। গান গাইত ভালো, সিনেমার পোকা ছিল, ছবি-টবিও অাঁকত। চিত্রা আর প্রিয়া প্রায় পিঠোপিঠি বোন হলেও চিত্রা অনেক বেশি যত্ন পেয়েছে। চিত্রা ছিল চুপচাপ শান্ত গোছের, প্রিয়া ছিল তার উলটো। সংসার নিয়ে প্রিয়া এত ব্যস্ত থাকে যে সুতপা জানে না– ও গান গাইবার বা সিনেমা দেখার সুযোগ পায় কিনা।

‘ও ঠাম্মা তুমি এখানে কী করছ? চলো না সবাই তোমাকে ও ঘরে ডাকছে’ দিঘি সুতপার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করল।

দিঘির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সুতপা বললেন, ‘একটু কাজ আছে, তুমি যাও আমি আসছি।’

‘না তোমাকে এখনই যেতে হবে।’ দুপাশ থেকে দুই নাতি বাবুন আর টাবুন একরকম টানতে টানতে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এল।

‘দেখলে তো কেমন পেয়াদা পাঠিয়ে তোমাকে ধরে আনলাম’ প্রিয়া বলল।

‘না রে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাই রান্নাঘরে গিয়েছিলাম’ সুতপা জবাবদিহি করতে গেলেন।

‘ব্রেকফাস্ট তো সিঙারা জিলিপি দিয়ে হবে। দিদি আর কৃষ্ণনদা এই এল বলে ওগুলো নিয়ে। এয়ারপোর্টে নেমেই কৃষ্ণনদা জানতে চাইলেন, আমরা এরকম ব্রেকফাস্টে রাজি আছি কিনা, অ্যান্ড উই অল এগ্রিড।’

‘তা হলে বাচ্চাগুলো?’ সুতপা মিতার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।

‘ওরাও তাই খাবে’ মিতা জবাব দেবার আগেই সুপ্রিয়া তড়বড়িয়ে বলে উঠল।

‘আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি ইউএস থেকে ওট্‌স আর কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট নিয়ে এসেছি, দিঘির সঙ্গে বাবুন টাবুনরাও খেতে পারে’ সেটা মিতা মিষ্টি করে জানিয়ে দিল তারপর সুপ্রিয়ার ভুরু কুঁচকানো গম্ভীর মুখের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, ‘আসলে দিঘির পেটে তো সব কিছু সহ্য হয় না, তাই আমাকে ব্যবস্থা রাখতেই হয়।

ড্রয়িংরুমের আবহাওয়াটা একটু যেন থমথমে হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তেই গেটের বাইরে থেকে কৃষ্ণনের আওয়াজ এল ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’ পাশ থেকে চিত্রার ধমক– ‘চ্যাঁচাস না, পুরো পাড়া দরজা খুলে তোকে তাড়া করবে।’

পাঁচ

দুপুরে খাওয়ার সময় আরেক চোট জমাটিয়া আড্ডা হল। তারপর সুপ্রিয়া ঘোষণা করল ‘অনেক গল্প হয়েছে এবার কাজের কথায় আসা যাক। তোমরা ভুলে যেও না যে তোমরা কলেজ রি-ইউনিয়নে আসোনি বরং একটা পারিবারিক সমস্যার সমাধানের খোঁজে এসেছ। সুতরাং বাচ্চারা বাদে সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসো, আমি বাবুন টাবুনকে ওদের হোমওয়ার্ক করতে বসিয়ে আসছি। রুমা তুই তোর কোনও কাজ থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে নে। আমরা তোর সঙ্গেও কথা বলতে চাই।’

দুই ছেলেকে সুপ্রিয়া সুতপার ঘরে পড়তে বসিয়ে দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখল সবাই আবার গল্পে মেতেছে। মা শুধু সকালের খবরের কাগজটা চোখের সামনে ধরে পড়বার চেষ্টা করছেন। ওরা সবাই জানে মায়ের চোখের অসুখের কথা। দুবার অপারেশন করিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ভালো করে দেখতে পায় না আর সেই জন্যেই তো সুপ্রিয়ার অত চিন্তা হয় মাকে নিয়ে।

সুপ্রিয়াকে দেখে সবাই নড়ে চড়ে বসল। এর মধ্যে রুমাও শাড়ির অাঁচলে হাত মুছতে মুছতে মায়ের পাশে মাথা নিচু করে বসল। কেউ কিছু বলছে না দেখে সুপ্রিয়াই শুরু করল– রুমা আমরা শুনলাম তুই নাকি বিয়ে করবি। এটা কি সত্যি?

রুমা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতেও আবার জিজ্ঞেস করল– ছেলেটা কে? কী করে? তোরা কবে এসব ঠিকা করলি?

রুমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সুতপাদেবী মুখ খুললেন, ‘ছেলেটাকে আমি দেখেছি। ভালো ছেলে। আগে অটোরিক্সা চালাত এখন টোটো চালায়। রুমাকে ভালোই রাখবে।’

সুপ্রিয়া প্রায় অাঁতকে উঠল– রিক্সাওয়ালা? মানে ভাড়াতে চালায়? কী করে চিনলি ওকে? আই মিন বিয়ের ব্যাপার তো তাই জিজ্ঞেস করছি। এসব সিদ্ধান্ত ভালো করে ভেবে চিন্তে নেওয়া উচিত।

এবারেও সুতপা রুমার হয়ে উত্তর দিলেন– রিক্সা নয় অটোরিক্সা চালাত, এখন টোটো চালায়। কাছেই থাকে। ওর মা এক সময় এ বাড়িতে কাজও করেছে। তোরা হয়তো কখনও দেখেও থাকতে পারিস।

‘তার মানে রুমার উড বি মাদার ইন ল ইজ এ ঠিকে ঝি, অ্যান্ড সি ইউজড টু ওয়ার্ক ইন দিস হাউস। আই হোপ দিস ইজ নট এ প্ল্যান টু গেট সাম ফিন্যান্সশিয়াল বেনিফিট’ মিতা ইচ্ছে করে ইংরেজিতে কথাগুলো বলল যাতে রুমা বুঝতে না পারে। তারপর রুমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘রুমা আমরা সবাই তোমার ভালো চাই, তাই বার বার বলছি তুমি সবদিক দেখে শুনে ভালো ভাবে চিন্তা ভাবনা করে ডিসিশন নিও, বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো কোরো না।’

দ্যাখো তুমি এখানে যেভাবে আছো একজন অটোরিক্সাওয়ালাকে বিয়ে করে তার বাড়িতে কি তুমি সেভাবে থাকতে পারবে? হয়তো কোনও কারণে তোমার তাকে এখন ভালো লাগছে কিন্তু যখন দেখবে সংসারে অভাব অনটন আসছে তখন এই ভালোবাসা মনের জানলা দিয়ে উড়ে যাবে, পড়ে থাকবে শুধু শরীরটা। তুমি একবার কষ্ট পেয়েছ জীবনে, তাই আমরা চাই না আবার সেরকম কিছু স্লকটা হোক।’

নিজের বক্তব্য শেষ করে মিতা দেখল সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে তারিফের দৃষ্টিতে! ব্যতিক্রম একমাত্র মা আর রুমা। মিতার কথার পিঠে কথা বসিয়ে সুচিত্রাও রুমাকে বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘মিতার কথা আমিও মানছি। আমি এত পেশেন্ট দেখি তো, সব জায়গায় একই ব্যাপার। ছেলেরা বউ-এর কাছ থেকে শরীর, সন্তান আর সেবা এটাই আশা করে। বিনিময়ে মেয়েরা কি সেভাবে আদৗ কিছু পায় স্বামীর কাছ থেকে? রুমা ভালো করে ভেবে নিয়ে বিয়ে করিস বাবা।’

‘যা বাবা হঠাৎ করে আমাদের পেছনে পড়লি কেন চিত্রা? এবার তো আমার বউ আমার উদাহরণ দিয়ে সমস্ত পুরুষজাতিকে তুলোধনা করবে’ সমীর সুচিত্রাকে কথার খোঁচা দিল। তোমার বউ পাগল নয় যে কাজের কথা থেকে সরে গিয়ে অন্য কথা বলে সময় নষ্ট করবে! সুপ্রিয়া সমীরের পাশ থেকে উঠে এসে রুমার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘রুমা তুই প্রাক্টিক্যালি ভাবার চেষ্টা কর –একজন অটোরিক্সাওয়ালা এত বছর বিয়ে না করে এখন একজন তেতাল্লিশ বছর বয়সি মহিলাকে বিয়ে করতে চাইছে কেন? শুনলাম তোর

দাদা-বউদিরও নাকি মত নেই এ বিয়েতে। তাহলে তুই বিয়েটা করছিস কেন?’

রুমা সবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদেরকে একবার বোঝাবার শেষ চেষ্টা করল, ‘যতিন টোটো আর ভাড়াতে চালায় না। গত মাসে ওটা ও কিনে নিয়েছে। আর বাড়িতে খালি ওর মা আছে। আমার কাজ করা নিয়েও যতিনের কোনও আপত্তি নেই। দাদা-বউদির থেকে মাসিমাই আমাকে ভালো বোঝেন, তাই বলছিলাম’ রুমার কথা শেষ করতে না দিয়েই সুচিত্রা বলে উঠল, ‘তাহলে তুই মায়ের কাজ ছাড়বি না তো? বাবা বাঁচালি।’

দেখা গেল যারা এতক্ষণ রুমার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত ছিল তাদের চিন্তার বিষয় হঠাৎ করে বদলে গেল। কৃষ্ণন সুচিত্রাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাট সি হ্যাজ নট সেইড দ্যাট। ডিড সি সে দ্যাট সি উইল ওয়ার্ক হিয়ার?’ তারপর রুমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘বিয়ের পরেও কি তুমি তোমার মাসিমার কাছে থেকে তার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখতে পারবে রুমা?’

‘দ্যাট ইজ পসিবল ওনলি ইফ সি লিভস্ ইন দিস হাউস অ্যান্ড দ্যাট অলসো উইথ হার হ্যাজবেন্ড’ দীপ তার মনের কথাটা বলে দিল।

‘আর যতিনের মা? তিনি কি তার ছেলেকে ছেড়ে দেবেন। তিনিও সবার সঙ্গে চলে আসবেন। রিক্সাওয়ালা হোক বা ডাক্তার,বাঙালি মায়েরা ছেলেদের তাদের মুঠো ছাড়া করেন না। তারপর যিনি ছিলেন বাড়ির ঝি তিনিই হয়ে যাবেন মালকিন, আর আমার মা হয়তো তখন বাড়ির ঠিকে ঝির কাজটা করবে।’ সুপ্রিয়া রাগের বশে কথাগুলো বলে ফেলে বুঝতে পারল কাজটা ঠিক করেনি কারণ ততক্ষণে জলভরা চোখ নিয়ে রুমা দৗড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে!

কোনওমতে পিরস্থিতি সামাল দিতে সমীর বলল, ‘আচ্ছা আমরা তো যতিনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি। এমনও তো হতে পারে সকালে এসে সারাদিন এখানে থেকে রুমা রাতে যতিনের বাড়ি চলে গেল। মায়ের কাছে রাতে থাকার জন্য আমরা কোনও আয়ার ব্যাবস্থা করে দেব। অথবা রুমার বদলে অন্য কোনও চবিবশ ঘন্টার কাজের লোকও খোঁজা যেতে পারে।’

কিন্তু আমরা যদি রুমার সঙ্গে যতিনকেও এখানে রাখতে পারতাম তাহলে কিন্তু আমাদেরই সুবিধা হতো। রাত-বিরেতে বাড়িতে একজন পুরুষমানুষ থাকলে সুবিধাই হয়।’ দী৫ আরেকবার নিজের মতটা সবার ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করল।

‘দী৫ ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা কর। যতিন একটা রিক্সাওয়ালা সরি টোটো-রিক্সাওয়ালা। তাকে বাড়িতে রাখাটা মোটেই প্রেস্টিজিয়াস নয়। ও এখানে থাকলে দুদিন পরে ওর লেভেলের বন্ধু-বান্ধবরাও এখানে আসা যাওয়া করবে। তুই কি মনে করিস আমাদের এই সফিস্টিকেটেড পাড়াতে লোকে সেটা অ্যালাউ করবে? যেখানে সবার বাড়ির সামনে দামি-দামি গাড়ি থাকে সেখানে আমাদের বাড়ির সামনে টোটো দাঁড়িয়ে থাকবে। ‘উফ্ আমি আর ভাবতে পারছি না।’ সুপ্রিয়ার গলায় হতাশার ছোঁয়া যেন। সে কোনও মতেই রুমার বিয়ে মানতে পারছে না।’

সুতপার শরীরটা কেমন যেন করছিল। কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার তো দুপরে খাবার পর একটু শোবার অভ্যাস, তোরা কথা-বার্তা বল, আমি ও-ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই।’ নিজের ঘরে গিয়ে দেখলেন তছনছ অবস্থা। নাতিদের বইপত্র, বিছানার বালিশ, চাদর সব মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তোশকটা খাট থেকে অর্ধেক ঝুলে আছে আর খাটের ওপর বাবুন টাবুন মারামারি করছে। দরজা বন্ধ করে কোনওমতে গেস্টরুমে এসে দিঘির পাশেই শুয়ে পড়লেন। চোখ বুজে শুয়ে পড়লেও ঘুমাতে পারলেন না কারণ তখন ড্রয়িংরুমে জোর চ্যাঁচামেচি চলছে।

সুপ্রিয়া বলছে, ‘দ্যাখ দিদি, বাবা মারা যাবার পর মায়ের যখন দরকার ছিল কাউকে নিজের পাশে পাবার, তখন তুই বা দী৫ কেউ মায়ের কথা ভাবিসনি। তোরা কি পারতিস না এখানে সেটল করতে? তা না তোরা রওনা দিলি দক্ষিণ ভারতে, ফর ব্রাইটার ফিউচার। নার্সিংহোম তো এখানেও করতে পারতিস কিন্তু করিসনি জাস্ট টু অ্যাভয়েড রেসপন্সিবিলিটিজ।’

সুচিত্রার উত্তর যেন তৈরি ছিল, বলল, ‘সেকি কিছুক্ষণ আগে তুই বললি না যে বাঙালি মায়েরা ছেলেদের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখে। ছেলেদের সংসারের মালকিন হয়ে থাকে, তাহলে মায়ের রেসপন্সিবিলিটি তো দীপ্তর নেওয়া উচিত। দীপ এখানে থাকতে পারত অথবা মা ইউএস চলে যেতে পারত ছেলেকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে।’ দী৫ চুপ করে বসে রইল, তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, কলকাতা ছেড়ে আমরা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তিথির জন্য। ওকে অ্যাডপ্ট করার পাঁচ বছর পরেও কোথাও দেখা হলেই চেনা পরিচিত লোকজনেরা বলত, এই বুঝি আপনাদের দত্তক নেওয়া মেয়ে। বেশ ভালো রেখেছেন তো। কোথা থেকে নিয়েছিলেন যেন। মা বাবার কোনও খোঁজ পেয়েছেন কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তিথি তখন বুঝতে শিখেছিল, দুঃখ পেত। আমাদের মনে হয়েছিল দূরে কোথাও চলে যাওয়াটাই ভালো।’

‘ঠিক আছে তখন প্রবলেম ছিল চলে গেছিস এখন তো তিথি দিল্লিতে হস্টেলে আছে। কৃষ্ণনদার মাও বেঁচে নেই, যে ওনার অজুহাত দেখাবি। তোরা তাহলে এখন ওখানকার পাঠ চুকিয়ে কলকাতা চলে আয়। যেখানে পড়াশোনা করলি সেখানকার লোকেদেরও কিছু সেবা যত্ন কর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের খেয়ালও রাখতে পারবি!’ সুপ্রিয়া স্লকপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল সুচিত্রা আর কৃষ্ণনের দিকে।

‘যেটা হয় না তা নিয়ে তর্ক করিস না ছোড়দি।’ দীপ সুপ্রিয়াকে থামাবার চেষ্টা করে।

‘তুই তো দিদির পক্ষ নিয়ে কথা বলবিই ভাই। দিদি যদি সাউথ ইন্ডিয়ায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে তাহলে তুই তো আরেক কাঠি ওপরে– আমেরিকায় মহানন্দে বিরাজমান এনআরআই। তোরা সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে যে যার মতো নিজেদের লাইফ এনজয় করছিস।’

সুচিত্রা এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠে ধমক দিল সুপ্রিয়াকে, ‘তুই চুপ করবি প্রিয়া? তখন থেকে খালি ঝগড়া করছিস। তুই এমন কী করেছিস যে তখন থেকে আমাদের দোষারোপ করে যাচ্ছিস।

‘করিনি আমি? মায়ের চোখ অপারেশন গত দুবছরে দুবার হল। কে এসে থাকল মায়ের কাছে? এ বছর যখন ভাইরাল ইনফেকশন থেকে মায়ের মারাত্মক জ্বর হল, কাকে দৗড়ে আসতে হল? আমেরিকার সাহেব টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললেন– ভালো নার্সিংহোমে ভর্তি কর আর বেঙ্গালুরুর ম্যাডাম দিনে দুবার ফোন করে জ্ঞান বিতরণ করলেন। সুপ্রিয়া কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। তোরা সব বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে নিজেদের ফিউচার ভালো থেকে আরও ভালো করার জন্য দৗড়োচ্ছিস আর আমি সকাল থেকে রাত অবধি দৗড়ে মরছি তোদের খুশি করার জন্য। আমি আর পারছি না।

হঠাৎ করে পুরো বাড়িটা যেন ভীষণ ভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণন বলল, ‘একটু চা খেলে বোধহয় ভালো হতো, কি বলিস সমীর?

সুচিত্রা উঠতে যাচ্ছিল চায়ের বন্দোবস্ত করতে, কিন্তু মিতা বলল, ‘তুমি বসো বড়দিভাই। আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি।’

তারপর ঘর থেকে বেরোবার আগে থমকে দাঁড়িয়ে সবার দিকে ঘুরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘জাস্ট ইট কেম টু মাই মাইন্ড।’ এ বছরের শুরুতে রুমা একদিনের জন্য কোনও হসপিটালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিল না? একটু চিন্তা করে সুচিত্রা বলল, ‘হ্যাঁ ভাইরাল গ্যাসট্রোএনটেরাইটিস হয়ে ডিহাইড্রেশন হয়েছিল। স্যালাইন নিতে হয়েছিল। কিন্তু কেন জানতে চাইছিস এসব এখন?’

‘সত্যি কি তাই হয়েছিল, নাকি প্রেগনেন্সি টারমিনেশন? ইউ নেভার নো।’

হংসীনির মতো গ্রিবা উঁচু করে মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সবার মনে এক সন্দেহের কাটা গুঁজে দিয়ে।

ছয়

তিন মাস পরে দীপ একটা ইমেইল পেল সুতপার কাছ থেকে। চোখের অসুবিধাটা বাড়াবাড়ি হবার আগে মা নিয়মিত কম্পিউটার ব্যবহার করতেন। ইদানীংকালে সেভাবে না হলেও মাঝেমধ্যে মায়ের ইমেইল পায় সে আর তাছাড়াও মাসে দুবার করে ভিডিও চ্যাটও করে। তাই ইমেইলটা পেয়ে সে মোটেই অবাক হয়নি। কিন্তু সকালে কাজের তাড়া থাকায় সেটা পড়ে উঠতে পারেনি। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ইমেইল খুলে দেখল মায়ের হাতে লেখা একটা চিঠি অ্যাটাচড করে পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে মা লিখেছেন–

আমার প্রিয়জনেরা,

আশাকরি তোমরা সবাই ভালো আছো। আমি ইমেইলটা দীপ্তকে পাঠাচ্ছি আর আশা করব এটা পড়বার পর দীপ চিত্রা ও প্রিয়াকে পাঠিয়ে দেবে। তোমরা হয়তো ভাববে মা ফোন না করে কেন চিঠি লিখছে। কারণ আমি সেকেলে মানুষ। মনের দ্বিধা সরিয়ে সব কথা চিঠিতে যেভাবে লেখা যায় তা বোধহয় ভিডিও চ্যাট বা ফোনে হয় না।

আসলে একটা খবর দেবার জন্য তোমাদের বিরক্ত করছি। আমি আর আধ ঘন্টার মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভয় পেও না, নিরুদ্দেশে যাত্রা করছি না। বরং রুমা আর যতিনের সঙ্গে ওদের বাড়িতে থাকতে যাচ্ছি। যতিনের মায়ের কোনও আপত্তি নেই ছেলের বউ-এর সঙ্গে তার মাসিমাকেও বাড়িতে আশ্রয় দিতে। আমি রুমাকে বলেছিলাম– ওদের দেড় খানা ঘরের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলে অসুবিধা হবে, কিন্তু ওরা শুনল না।

যতিন বারাসতের দিকে একটা জমি দেখেছে। পাকা বাড়ি বানাবার জন্য। আমি বলেছিলাম কিনে দিই, কিন্তু ও কিছুতেই আমাকে কিনতে দিল না। ছেলেটার আত্মসম্মান বোধটা প্রবল, তাই আমি জোর করিনি। যতিনের এ বাড়িতে ইন্টারনেট নেই তাই আর ইমেইল করতে পারব না যদি না দোকানে গিয়ে করি। সেইজন্য ভাবলাম কাজের কথা এখনই সেরে নিই।

একটা উইল এর কপি পাঠালাম। বাড়িটা তোমাদের তিনজনের নামে করে দিয়েছি। পাড়ার অনেকেই কিনতে ইচ্ছুক। বিক্রি করে তোমরা টাকাটা ভাগ করে নিও অথবা কোনও আশ্রমে দান করে দিও। আমার মোবাইলটা সঙ্গে আছে, যখন খুশি কথা বলতে পারো আমার সঙ্গে।

তোমাদের মা তোমাদেরই আছে খালি আমার নতুন ঠিকানাটা তোমাদের জানালাম না। তোমরা এখানে এলে ওরা অস্বস্তিতে পড়বে আর তোমাদেরও হয়তো ভালো লাগবে না। কিন্তু আমি জানি, আমি সত্যি ভালো থাকব ওদের সাথে!

ওহো তোমাদের আসল কথাটা জানাতে তো ভুলেই গেলাম। গত রবিবার যতিন আর রুমার বিয়ে দিয়েছি আমরা। তোমাদের কাছ থেকে নব বরবধুর জন্য আশীর্বাদ কামনা করি।

ইতি

তোমাদের মা–

ইমেইলটা পড়ে দীপ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।

নীলমাধবের চাঁদ

হাতে স্বর্গ পেল নীলমাধব। আজ তার সরকারের দেওয়া ৩৫ বছরের জীবনের শেষ দিন। একটু আগেভাগেই অফিস যাবে। প্রতিদিনের মতো শুধু নিজের চেয়ার টেবিল মুছে, টেবিলের কাচের নীচে রাখা কালি ঠাকুরকে পেন্নাম ঠুকে, এক গেলাস জল ঢক ঢক করে গলায় ঢালা শুধু নয়, আজ তার অফিসের চেয়ারের চারটে পায়ে প্রণাম করবে। টেবিলে খানিকটা মাথা ঠুকবে। ভেবে রেখেছে একটু কাঁদবেও। চোখের জল দিলে দেবতা খুশি হন।

ওই চেয়ার-টেবিল তো তার ভগবান। অফিসের লোকজন আসার আগেই সেসব আচার করে ফেলতে হবে। লোকজনের সামনে করলে হাসাহাসি হবে। এ জীবনে তার জন্য তো আর কোনও চেয়ার অপেক্ষা করে থাকবে না। কত মায়া ছিল ওই কাঠের চেয়ারটার। ডেলি-রেটেড মজদুর হিসেবে ঢুকে নিজের অধ্যবসায় আর মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করে আজ ক্লার্ক হয়ে রিটায়ার করছে।

হ্যাঁ, সকাল সকাল অফিস যাবে বলে একটু আগেই চানঘরে ঢুকে গেছে নীলমাধব। সঙ্গে অভ্যাসমতো খবরের কাগজ। কমোডের উপরে বসে খবরের কাগজ পড়া তার অন্যতম বিলাসিতা। ভাঁজ খুলতেই হলুদ কাগজের একটা ছোটো প্যামফ্লেট সড়সড় করে নেমে মেঝেয় পড়ে গেল। না ভেজেনি। নীলমাধব ঝুঁকে কাগজের টুকরাটো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কয়েকদিন ধরে মনের ভেতর ঢুকে আসতে থাকা অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে যেন। নগ্ন, নির্মেদ প্রায় ছয় ফিটের শ্যামবর্ণ শরীর নিজের অক্ষের উপর চরকি মারল। তার চোখে পড়েছে। প্যামফ্লেটের একেবারে নীচের দুটি লাইন– একটিমাত্র ফোন আপনার জীবনের পরিবর্তন আনতে পারে। রত্না ঘোষ, ফোন- ৯৭৬৮৫৫৪২৭২।

বউ ঘোষণা করে দিয়েছিল অনেক আগেই, ‘সারাদিন বাড়িতে বসে ট্যাঙস ট্যাঙস করে কথার ফোড়ন কাটবে, সেটি হবেনি। হাত-পা মজবুত আছে, কাজ-কাম করোগে যাও।’

নীলমাধব জানে, ওই ঘোষণা মানে আদেশ। সত্যি সত্যি সারাটা দিন তাকে সইতে পারবে না বউ। এ-কথার পিঠে সে-কথা, তারপর তো বাড়ি মাথায় করে কুরুক্ষেত্র। আর সেসব এড়াতে রাস্তায় রাস্তায় উদ্দ্যেশ্যহীন কতদিন আর ঘুরে বেড়াতে পারবে! সে এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্যামফ্লেট পড়তে থাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ আলো।

লেখা আছে, ‘ইউ এস মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি কলকাতায় তাদের ব্যাবসা বাড়াবার জন্য চাকরির অফার দিচ্ছে।’

নীলমাধব আতিপাতি করে খুঁজল কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলেছে কিনা। সেখানে সে আটকে যেতে পারে। সে তো মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস। আর এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার জন্য সোনার টুকরো সব ছেলেমেয়েরা বসে আছে। অফিসের বড়োবাবুর ছেলে তো বেঙ্গালুরু থেকে পাশ করেই ইনফোসিস না কি কোম্পানিতে চাকরি করতে চলে গেল, সে-ও মাল্টিন্যাশনাল।

পেট ও মনের যুগপত আরাম হয়ে এসময় নীলমাধবের চোখে পড়ল প্যামফ্লেট-এর দুই নম্বর খোপটিতে লেখা আছে গৃহবধূ, রিটায়ার্ড ব্যক্তি, ভিআরএস।

তার যোগ্যতা রিটায়ার্ড ব্যাক্তি। মানে কাল থেকে সে এই কোম্পানিতে কাজ করার যোগ্য। তবে কালকের জন্য নীলমাধব অপেক্ষা করবে না। আজকেই ফোন করে জেনে রাখবে সব। যাতে কালই বউয়ের কথা মেনে অফিসের সময়েই ঘরের বাইরে পা দেয়া যায়।

অফিসটা কেমন হবে! শুনেছে সে, এসব অফিস খুব সাজানো গোছানো হয়। সরকারি অফিসের মতো নোংরা আর অন্ধকার যেখানে সেখানে জমে থাকে না। ঝাঁ চকচকে, সেন্ট্রালি এসি। আর সেখানে কাঠের চেয়ার টেবিলের বালাই নেই, খোপে খোপে ডেস্ক আর গদি দেওয়া রিভল্ভিং স্টিলের চেয়ার।

একটা লম্বা করে শ্বাস নেয় নীলমাধব। কমোডে বসে থেকেই তার মনে হল এসব অফিসের ড্রেস কোডের কথা। অসীম-দার বউ কাজ করে ‘বোম্বাই প্রেস অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইসমেন্ট -এর কলকাতা অফিস ১১১ পার্ক স্ট্রিটে। একদিন কী একটা কাজ নিয়ে অসীমদার সাথে সেই অফিসে গিয়েছিল। ওয়েটিং-এ তাদের জন্য যে মেয়েটি দামি ট্রেতে করে কফির কাপ, জলের গেলাস এনে দিল, তার দিকে চেয়ে তো বুকে কাঁপন ধরে গেছিল। সাদা ধবধবে পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত যেন মাখন দিয়ে গড়া। লাল স্কার্ট, লাল হাই হিল আর টকটকে লাল ঠোঁট-ই যথেষ্ট, মাথা ঘুরিয়ে দিতে। তার উপর জামার উপরের একটা বোতাম খোলা আর কফির কাপ নামিয়ে রাখার সময় ঝুঁকে পড়তেই দুটি সোনার ফসলের অনেকটা চোখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন। মেয়েটা চলে যেতেই অসীমদা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘কী রে একেবারে ফিদা হয়ে গেছিস?’

নীলমাধব ধরা পড়ে যাবার বিড়ম্বনায়, তো তো করে অজুহাত খুঁজতে যেতেই অসীমদা চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ‘ঝানু ঝানু পার্টিকে এভাবেই আতিথেয়তার প্রথম মুহূর্ত থেকেই বধ করে ফেলে। মতামতকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে যাবার জন্য এটা একটা প্রাচীনতম হিপনোটাইজিং ফ্যাক্টর।’

অসীমদাকে সিনিয়র হিসেবে শুধু নয়, তার নানা বিষয়ে জানাশোনার জন্য নীলমাধব মনে মনে শ্রদ্ধা করে। অসীমদা বেশ ইন্টেলেকচুয়াল। শুনেছে কফি হাউসে নাকি আড্ডা আছে তার। চাকরি ছাড়াও সংবর্ত নামে নাটকের দলে নাটক করে।

অসীমদা আবার কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফিসফিস করে, ‘ওই যে মেয়েটার চলকে ওঠা বুকের উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলি না…।’

‘না না কী যে বলো তুমি…।’ নীলমাধব নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।

অসীমদা বলে, ‘শোনই না, এদের অধিকাংশেরই নিজের বুক না, লিফট করা বুক। আর এরা মুখের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিম, রং বুকেও মাখে। দেখলি না কেমন গলা মোমের মতো লাবণ্য ঝরছিল সেখানে!’

‘যাঃ, তুমি না বাজে কথার জাদুকর।’

‘আরে আমি না জেনে বলছি নাকি! আমার বউ এলে দেখবি, তার-ও বুক ফেটে পড়ছে মনে হবে। কিন্তু দুটো দামড়া দামড়া ছেলের মা অমন ঢাউস বুক পাবে কোথায়! সবই নিউ মার্কেটের প্যাডেড ব্রা-র কেরামতি। আমি তো জানি, এই এতটুকু।’বলে অসীমদা হাতের আঙুল পাঁচটি দিয়ে একটা কমলালেবুর আকৃতি করল।

নীলমাধব ভাবনার ভালোলাগায় তলিয়ে ছিল। সে একটু নিজত্বে এসে ভাবল, তাহলে নিজেকেও তো সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে। অনেকদিন থেকেই নন্দিনী বলছে ভালো এক সেট জামা কাপড় কিনতে। এই ক্যাবলাকান্তপনা জামা কাপড়ে চলছে না। দামি কোনও শোরুমে নিয়ে গিয়ে সে-ই কিনে দেবে সব। কিন্তু নীলমাধব তানা নানা করে ঠেকিয়ে রেখেছে।

নন্দিনী নীলমাধবের ফুসফুস। সংসারে খরখরে গ্রীষ্মযাপনের মধ্যে নন্দিনী তার মরুদ্যান। না না বাড়িয়ে বলা নয়। আহিরিটোলা ঘাটের কাঠের জেটিতে কম দামের বুট ঠুকে সন্ধ্যার অল্প আলোয় কচুরিপানার স্রোতকে ভাটার টানে ছুটে যেতে দিয়ে নন্দিনীর গায়ে গা ঘেঁষে থেকে সে মাঝে মধ্যেই বলে, ‘বেঁচে থাকার সুখটুকু তোমার জন্যই পাচ্ছি, বিশ্বাস করো আর না-ই করো।’

অফিসে-বাড়িতে ইঁদুরের মতো থাকতে অভ্যস্ত নীলমাধব এই একটুকু সময় নদীর উদারতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। গঙ্গার হাওয়া নন্দিনীর শরীরের গন্ধ নিয়ে তার বুকের ভেতর ঢোকে। আবার তাকে একটা দিন বাঁচার প্রেরণা দেয়। হেরে যাওয়া জীবনে এই একজনই তাকে সমর্থন করে। শুধু তো সমর্থন নয়, এই একজনই যে নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করে বসে আছে।

দুই

বউ বলেছে দাদাকে ফোন করে দিচ্ছে, দাদা ঠিক একটা জুটিয়ে দেবে। বলেছে, বাসন্তীতে ১৫০ দিনের কাজে তার দাদা যে কত লোককে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মাটি-কাটার কাজ আছে। চিংড়ির মীন ধরে আড়তে দেবার লোক – একটা না একটা জুটে যাবে। তবে কাজের আগে পাত্তিটাত্তি ছাড়তে হতে পারে। তার দাদা, বোনের বর বলে ছেড়ে দেবে না।

নীলমাধব থ মেরে যায় বউয়ের কথায়। এখন সে মাটি-কাটার কাজ করতে পারবে! ওদের গাঁয়ের মেয়েবউদের সাথে লুঙ্গি পরে জলে নেমে মীন ধরবে! সারাজীবন অফিসে চেয়ার-টেবিলে কাজ করার পর এই এত বয়সে লেবারের কাজ করতে যাবে! মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে বউয়ের। কিন্তু বউয়ের যা গোঁ, কিছু একটা না করলে যদি ধরে-বেঁধে বাসন্তীতে পাঠিয়ে দেয়!

নীলমাধব চান শুরু করার আগে প্যামফ্লেটের শেষ অংশটুকুও পড়ে নিল, ‘বাড়ি থেকে অথবা অফিসে বসে কাজ।’

হ্যাঁ হ্যাঁ অফিসে বসেই কাজ করতে চায়। বাড়িতে বসে কাজ করতে বললে সে করবে না। মনে মনে ঠিক করে, পার্ট টাইম বা ফুল টাইম-এর মধ্যে, সে ফুল টাইমই নেবে।

একজন জহরকোট গায়ে দেওয়া ভদ্রলোক, মুখে ও হাতে শ্বেতির দাগ, প্রোজেক্টরের আলো এড়িয়ে এসে দাঁড়ালেন। কল টাইম ছিল বেলা তিনটে। ছোটো হল ঘরটা ভর্তি হয়ে গেছে। নীলমাধব থার্ড রো-তে মাঝামাঝি বসেছে। মাঝামাঝি থাকার নানা সুবিধে সে জানে। তার বাঁদিকে বসা পৃথুলা মেয়েটি অযথা কনুই দিয়ে চাপছে।

‘আমার নাম পি আচারিয়া।’ জহরকোট বলে উঠল। জহরকোট আরও বলল, ‘আসুন আমরা একসাথে তাল দি, প্রজেক্টরে একটা বিট বাজছিল।

নীলমাধব দেখল উপস্থিত সবাই ওই ভদ্রলোককে অনুসরণ করে হাততালি দিচ্ছে। এবং সে নিজেও।

‘এই কোম্পানির নাম হার্বলাইফ।’

পাওয়ার-পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন পড়ছে পর্দায় আর মিঃ আচারিয়া নামে ওই জহরকোট বলে চলেছে, ‘এই কোম্পানির বয়স ৩৪ বছর। মানে যুবক এখন। এখন তার এক্সপ্যানশনের সময়। বিশ্বের ৯৬টা দেশে এই কোম্পানি কাজ করছে। সাড়ে দশ কোটি লোক এই কোম্পানির প্রোডাক্ট ইউজ করে।’

একমাথা লম্বা চুল যেন তাকে বিব্রত করছে, এরকম ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে সে হাত দিয়ে মাথার চুল সরিয়ে দিলেও আবার সেসব চোখে মুখের উপর নেমে আসছে। নীলমাধবের মনে হল, পি আচারিয়া নামে ওই লোকটা তার চুলের অবিন্যস্ত অবস্থানটি নিশ্চই উপভোগ করে।

‘আমাদের প্রোডাক্ট উপভোক্তাদের কথা বলছিলাম, পর্দায় দেখুন, রোনাল্ডো, ওই যে ঢকঢক করে খেয়ে খেলায় নেমে গেল। গোল করল। বিরাট কোহলির জামায় দেখুন, লেখা রয়েছে হার্বলাইফ। ওই যে দেখুন, সাইক্লিস্টরা হার্বলাইফ-এর ড্রিংক খেয়ে নেমে পড়ছে রেসে।’

মাঝে মাঝে তিনি নেক্সট বলছেন, আর পাওয়ার-পয়েন্টে ছবি পালটে যাচ্ছে। একটা ছবিতে দেখানো হল একজন মোটা মেয়ে এই হেলথড্রিংক নিয়ে কীভাবে রোগা হয়েছে। ছবি থেকে দর্শক ও শ্রোতাদের দৃষ্টি সরিয়ে দিয়ে কমেন্ট্রেটর ভদ্রলোক একজন গৃহবধূকে সামনে ডেকে নিয়ে তার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিলেন। সেই বধূটি স্কিন টাইট পোশাকে স্ফিত বক্ষদেশের নীচে নিজের ক্ষীণ কোমরে হাত দেখিয়ে এবং বুক দুলিয়ে বললেন, এই ড্রিংক খেয়েই তিনি এরকম সিনেমার নায়িকার মতো শরীর তৈরি করতে পেরেছেন আর তিনি নাকি এই কোম্পানির একজন মার্কেটিং ম্যানেজার হয়ে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেন এবং দেশে-বিদেশে কোম্পানির হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন।

নীলমাধব মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। পাশের মেয়েটি নোট নেবার সময়, হাততালির সময় যেন ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে দিচ্ছিল। খুব ছোটো ছোটো চেয়ার। ডানদিকের হাতলে রাইটিং স্পেস। মেয়েটা একসময় তার শরীরের উপরের অংশ এতটা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে যে, নীলমাধবের বাহুতে তার বুকের ভারী অংশ ঘষা লাগছে।

কী চায় মেয়েটি! নীলমাধব জানে চেহারায় তাকে চল্লিশোর্ধ মনে হয়। এই মেয়েটা ফাঁসাবে নাকি! ও কি জেনে গেছে রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের অনেক টাকা তার হাতে আসতে চলেছে! নীলমাধব আরও কুণ্ডলী পাকায়। নিজের ছোট্ট চেয়ারে। আর যুবতির শরীরের নরম  অংশের ছোঁয়ায় উত্তেজিত বোধ করলে ভাবনাকে অন্য দিকে গড়িয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়।

অন্য কি বা তার আছে নন্দিনী ছাড়া! নন্দিনী পই পই করে বলেছে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ভুলভাল জায়গায় যেন না যায়।

গত বছর একটা ভুল জায়গায় সে চলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা নন্দিনীর সাথেই। নন্দিনীর সাথে চলতে তার কোনও ভাবনা হয় না। সব ভাবনা নন্দিনীর। নন্দিনী সঙ্গে থাকলে সে ফুরফুর করে ওড়ে। মেপে কথা বলা, মেপে চলা, কিচ্ছুটি করতে হয় না। কিন্তু অন্য সময় নীলমাধব শংকিত, সঙ্কুচিত থাকে, এই বুঝি কেউ তাকে ঠকাল, এই বুঝি কেউ তাকে অপমান করতে আসছে।

গত বছর নন্দিনী-ই নিয়ে গেল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। তাকে কিচ্ছুটি করতে হয়নি। শুধু কথামতো অফিস কেটে পৌনে দশটায় হাওড়া স্টেশনে বড়ো ঘড়ির নীচে নন্দিনী টিকিট কেটে দাঁড়িয়েছিল। দশটার কাটোয়া লোকাল।

‘আমার না খুব থ্রিল হচ্ছে জানো, এই প্রথম কলকাতার বাইরে কোথাও যাচ্ছি, তোমার সাথে। তোমার ভালো লাগছে তো! না কি আমি জোর করেছি বলে তুমি এলে?’

নন্দিনী জানালার পাশে বসেছে, হাওয়ায় তার কথা ভেসে যেতে পারে ভেবে সে অনেকখানি নীলমাধবের গায়ের ভেতর ঢুকে এসে কথা বলছে। তার ৩১ বছরের মাখন শরীর নীলমাধবের ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল যেন। নীলমাধবের স্বপ্নে জড়ানো দুটি চোখের উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না। কামরার দু-একজন তো নন্দিনীর সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না।

নীলমাধব নন্দিনীর কথার উত্তরে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘স্বপ্ন যে সত্যি হয়, তা আমি বুঝতে পারছি আজ। কতদিন মনে মনে ভেবেছি, তোমার সাথে দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে বেশ হয়। দূরের ট্রেনে পাশাপাশি যাওয়ার যে কি আনন্দ তা এই লোকাল ট্রেনেই টের পাচ্ছি।’

সোমড়াবাজার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাঝদুপুরে নেমেছে মাত্র পাঁচ-সাতজন। নীলমাধব প্ল্যাটফর্মে নেমে ডাবের কাঁদি দেখে লোভে পড়ে কিনে ফেলল দুটি। বেশ মিষ্টি জল। ডাব খেতে খেতেই জেনে নিয়েছে নন্দিনী সবুজদ্বীপের টোটো কোথায় মিলবে, কত ভাড়া।

সুবল হালদারের ডিঙিনৌকায় উঠে নন্দিনী প্রায় কিশোরীর মতো আচরণ শুরু করে। জলের ভেতর হাত দিয়ে জলে শব্দ তোলে। নীলমাধবের কোলে শুয়ে ভর দুপুরে নিজের প্রিয় গানটা গুনগুন করে, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’ কবে যেন একবার নীলমাধব নন্দিনীর রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে বাঁকা চাঁদ বলেছিল তাকে। সেই থেকে সুযোগ পেলেই নন্দিনী গীতা দত্তকে নকল করে দু’কলি শুনিয়ে দেয়।

বেহুলা নদীর বয়স্ক মাঝি এসব দেখতে অভ্যস্ত। সে গা করে না। শহরের মানুষজনের আদেখলাপনা সে জানে। বদলে সে গল্প করে এমন ভাবে যেন নীলমাধবদের ওই শারীরিক খুনসুটি কিছুই নয়। মাঝি জানে বাবু খুশি হলে ফেরার সময় ভাড়া ১০০-র জায়গায় ১৫০ করতে ভাববে না।

বেহুলা নদীর বাঁক ঘুরতেই চওড়া জলরাশির গঙ্গা। মাঝি জানায় উলটোদিকে নবদ্বীপ। নীলমাধবের চোখে পড়ে খানিকটা দূরে জলের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বনরাজি। এই তবে দ্বীপ। সবুজদ্বীপ।

অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নদী দেখছিল নীলমাধব। নন্দিনী হঠাৎ পিঠ জাপটে ধরে ইশারা করল। শুকনো ঘাসের ঝোপের পাশে খসখস শব্দ। একটু ভয় পায় নীলমাধব। তবে কি সাপ! নন্দিনীর চোখ অনুসরণ করে নীলমাধব দেখল এক জোড়া ছেলে-মেয়ে শরীরী প্রেম করছে। ছেলেটা মেয়েটার ব্লাউজ খুলে ফেলেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটার ধবধবে বুক। নীলমাধব নন্দিনীর বাহু ধরে টেনে নিয়ে আসে। এখানে থাকা ঠিক হবে না। নন্দিনী ওই দৃশ্যে উত্তেজিত। সে একটু সরে এসে নীলমাধবের ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল। সে চাইছিল ওই ছেলে-মেয়েটির মতো বন্যতা।

‘এই যে মশাই, মেয়ে নিয়ে এসে বেশ ফুর্তি-ফার্তা করছেন। কিছু মালকড়ি ছাড়ুন তো, আমরাও একটু মস্তি করি।’যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল তিন-চারটে ছেলে। নীলমাধব ভয় পেয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কথা সরছে না। সে ভাবছে এইসব মাস্তানেরা মেরে ধরে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে, তারপর হয়তো আরও ঘন বনের মধ্যে নন্দিনীকে টেনে নিয়ে গিয়ে গ্যাং রেপ করে দেবে।

নন্দিনী হঠাৎ কোমরে শাড়ি জড়িয়ে রানি লক্ষ্মীবাই হয়ে যায়। সে গলা সপ্তমে তুলে একেবারে বস্তির মেয়ের মতো অভিনয় করে দেয়। ‘আমি ওকে চুমু খেয়েছি, তোর বাপের কীরে? তুই যখন ওইদিকে ঝোপের আড়ালে একটা মেয়েকে ন্যাংটো করে মাটিতে ফেলে ঠাসছিলি, তখন আমি বলতে গেছি?’

চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে সে খপ করে ছেলেটির হাতের কবজি ধরে খানিকটা টেনে নিয়ে যায়। ‘চল, গার্ডের কাছে। গিয়ে বল, ওই মেয়েটা তোর বউ কিনা! আর যদি বউ হয়, দিনে-দুপুরে লোকজনের মাঝে চিত করেছিলি কেন!’

ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অন্য ছেলেগুলোও কেমন অবাক চোখ করে তাদের পান্ডাকে রেখেই গুটিগুটি কেটে পড়ে। নন্দিনী ছেলেটার কবজি কিছুতেই ছাড়ে না।

‘না না, তেমন কিছু করিনি।’ ছেলেটা তোতলাতে থাকে।

নীলমাধবই ছাড়াতে চায়, ‘দাও ছেড়ে দাও।’

‘অমনি অমনি ছাড়ব, পুলিশের হাতে দেব না! বেড়ানোর জায়গা কি দুষ্কৃতীদের স্বর্গ হবে, শুধোতে হবে না গেটের পুলিশ ভাইকে?’

ছেলেটা এবার পরিত্রাহি মুখ খোলে, ‘না না, এবার ছেড়ে দিন, আর কোনওদিন হবে না এরকম।’

তিন

কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না। নীলমাধবের পাশের সেই পৃথুলা মেয়েটির স্বর কাঁদো কাঁদো। সে বলছে, ‘না, নেই তো, আমার কাছে কোনও টাকা নেই।’

‘টাকা না নিয়ে এসেছ কেন? সামান্য ১০০০ টাকা থাকে না ব্যাগে!’ কোম্পানির সুন্দরী মেয়েটির ডাকাতে মুর্তি। তার কলেই অনেকে এসেছে এখানে। চাকরি পাবার শর্ত হিসেবে একটা পরীক্ষায় বসতে হবে। ফিজ ১০০০ টাকা। নিজের নিজের কনসালটেন্সির সময় এই টাকা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’

সেই সুন্দরী আবার দাঁত-মুখ খিঁচোয়, ‘ব্যাগে এটিএম কার্ড নেই? যাও আমাদের লোক দিচ্ছি সঙ্গে, টাকা তুলে নিয়ে এসো।’

ভিড়ের চাপে নীলমাধব দরজার কাছেই এসে পড়েছিল। সে কাউন্সিলিং-এর ডাক আসার আগেই কাউকে না বলে সটকে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ব্রড স্ট্রিটে পা রেখে হাঁফ ছাড়ে। চাকরি না-পাবার বিষণ্ণতায় গ্রাস হতে দেয় না ওই ১০০০ টাকা বাঁচিয়ে ফেলার আনন্দ। সন্ধেবেলায় গড়িয়াহাটে চায়ের দোকানে বসার আগে ভেবে নিল, নতুন কাজ জুটিয়ে ফেলার আগে শ্যালকের কাছে না হয় ঢুঁ মেরে আসবে খন। তাতে বউকেও খুশি করা যাবে আর যদি হিল্লে একটা হয়েই যায়। তবে হ্যাঁ, হাজার টাকার উপরে সে উঠবে না। শ্যালককে হাজার টাকাই দেবে।

হাজারেই হল। কিন্তু অত সকালে যেতে হবে! পারবে কি নীলমাধব! নীলমাধব নিজের মনে ভাবে কী এমন কাজ! সকালে পুরসভার গাড়ি নিয়ে অনেকেই বাঁশি বাজিয়ে ময়লা নিয়ে চলে যায়। ওই নোংরা কাজ করতে হবে না তো!

স্বস্তি পেয়েছে নীলমাধব। না নোংরা ফেলার কাজ নয়। মাছের সার ছড়ানোর কাজ। জায়গা পালটে পালটে যেতে হয়। বাসন্তীর কাজ শেষ করে, হেড়োভাঙায় করেছে, সাতজালিয়ায় করেছে। এমাসের দশ দিন গোসাবায় কাজ।

একটা জলঢোঁড়া খপ করে একটা মোটা চিংড়িকে বাগে নিয়ে নিল। অন্ধকার আর আবছা আলোর মিশেলে চোখে পড়েছে ঠিক। নীলমাধব দু-পা পিছিয়ে আসে। পঞ্চনাগ মনসাকে স্মরণ করে। আকাশের কোণটা লাল লাল লাগছে। ব্যাগের ভেতর এখনও অনেকটা মাছের খাবার। এত বড়ো বড়ো পুকুর যে এক পাক খেতেই ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়। ঘুঘু চেপে, মানে ডিঙিনৌকোয় করে জলের মাঝখানে খানিক ছড়াতে হয়। কিন্তু জলে শব্দ তোলা বারণ, তাই বেশিটাই পাড় ধরে। সুশান্তদা পইপই করে বলেছে, জলের কোনও কোণ যেন ফাঁকা না থাকে। ছেলেবেলায় স্কুল-স্পোর্টসে যেমন চুনের দাগ টানতে হতো সমান করে, তেমনি। নীলমাধব হাত আর পা দুটোতেই গতি আনতে চায়।

হু হু করে টাকা আসছে। কিন্তু কাঁচা টাকা পেয়ে নীলমাধবের মাথা ঘুরে যায়নি। কাজ করতে করতে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে। সে প্রশ্ন সুশান্তদাকে করবে, সে সাহস নেই তার। তবে ছক্বাকে অনেকবার শুধিয়েছে, ‘হ্যারা ভাইডি, এই যে আমরা মাছের চাষে সাহায্য করি, মানে জলায় জলায় মাছের সার দিই ভূতির মতো রাত থাকতি, তা দিনির বেলা দিলি কী ক্ষেতি?’ কলকাতায় থাকতে থাকতে দক্ষিণের ভাষা চলে গিয়েছিল। এই মাস তিনেক এদের সঙ্গে থেকে তা আবার ফিরে এসেছে। খুবই মিষ্টি, আর প্রাণের ভাষা।

ছক্বা বাইকের ধোঁয়া সুর্যের লাল-পানা মুখটার উপর ছড়িয়ে যেতে দিয়ে বলল, ‘তা অতো কতা আমি জানি! তবে শুনিছি সারারাত ঘুমনোর পর পোভাত কালে মাছের দেবতাদের খুব খিদে পায়, ত্যাকোন খাতি পালি তারা ধাই ধাই করে লম্বা হতি পারে।’

বাইকের পেছনে বসে বিড়ি ধরিয়ে ছক্বার মুখে গুঁজে দিতে দিতে নীলমাধব ভাবে, হ্যাঁ সে-ও তো শুনেছে বাগদা মাছের মীনগুলো অ্যান্টিবাওটিক পেলে ধা করে বড়ো হয়ে যায়। বালিগঞ্জের স্টেশন বাজারে দেখেছে বেশ বড়ো বড়ো চিংড়ি। দাম-ও তেমন নয়, ৩০০/৩৫০। সাধ্যের মধ্যে।

এপ্রিল মাস। মাঠ-ঘাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে রোজ। সুশান্তদা, ইসমাইল ভাই গত সপ্তাহে বাজারের ক্লাব ঘরে ডেকেছিল নীলমাধবকে। শ্যালক-ও ছিল সেখানে। সে-ই ডেকে নিয়ে গেছে। বলেছে, দাদা নাকি নীলমাধবের কাজে খুব খুশি। এবার টাকা-পয়সা বাড়ায়ে দেবানে।

‘আর কত বাড়াবে!’ মুখ থেকে বেরিয়ে গেছল কথা। নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে নীলমাধব কথার বদলে জব্বর করে একটা হাই তোলে। শ্যালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, যে কথা পেড়েছে সে-ই পুরোটা কবে আনে, না ক’লি তার শান্তি নাই।।

বড়ো শ্যালক বলল, ‘নীলু, এতদিন মাছের কাজ করিছ, এবার চাষের কাজ। প্রাণ-মন দিয়ে করতি হবে। আর আরও একটু রাত থাকতি টেমি জ্বালায়ে কাজ শেষ করতি হবে। ভেড়ির বাঁধ কাটেকুটে চাষের মাঠে জল ঢোকাতি হবে রাতারাতি, যাতে দিনেরবেলায় ট্রাক্টর চালায়ে ভেজা মাটি উল্টি দেয়া যায়।’

খাটনি একটু বেশি হচ্ছে বটে, কিন্তু নীলমাধব প্রতিদিনই তিনটি হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছে সকাল ১০টার মধ্যে। তারপর দুপুরে খেয়ে দেয়ে জম্পেস করে ঘুম। রাতের শেষ ট্রেনে ক্যানিং। সেখানে খানিকটা সময় ক্লাব ঘরে চা আর বিড়ি-টিড়ি খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়া ছক্বার বাইকে। কোন কোন বাঁধ কাটতে হবে তার লিস্ট থাকে ছক্বার কাছে।

আজ বেশি কষ্ট হয়নি। এই বাঁধের উপর দিয়ে লোক চলাফেরা করে না বলে মাটি নরম। তাড়াতাড়ি কেটে দেয়া গেছে। জল হুড়মুড় করে ঢুকছে জমিতে। নীলমাধব সেই জলের তোড়ে কোদালে লাগা মাটি ধুয়ে নেয়। নিজের হাত-পা ধুয়ে নেয়। এসময় ভেড়ির উলটো দিকে কয়েকটা আলোর ফুটকির নড়া-চড়া দেখে অবাক হয়। ছক্বা ছুটে এসে বলে, ‘নীলুদা, এক মুহূর্ত দেরি কোরো না। ওই দ্যাখো আলোগুলো ছুটি আসতিছে এদিকপানে।’

এক হ্যাঁচকা টান দেয় ছক্বা। ‘ওঠো, ওঠোদিনি, বাইকের পেছনে ওঠো।’

ছুটন্ত আলোগুলোর সাথে এবার পায়ের শব্দও কাছাকাছি। ছক্বা বাইকে ঝড় তুলে দেয়। সে ক্যানিং স্টেশনে যায় না। গলি-ঘুজি রাস্তা দিয়ে একেবারে বাইপাসে। হাফ-প্যান্ট, গেঞ্জি পরে আর কোদাল-সাবল হাতে নীলমাধবের মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। বাইকের আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ছক্বা বলে, কুদাল আর সাফল ফেলি দাও ওই ডোবার ভেতরে নীলুদা। সামনে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াতিছি, সেখানে চা-খেতি খেতি তুমি ব্যাগ থেকে জামাপ্যান্ট বের করি পরি নাও। না হলে যমের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে, যমের অরুচির হাতে, মানে পুলিশের হাতে গিয়ে পড়বানে।’

নীলমাধব কিচ্ছুটি বুঝে ওঠেনি। ঘটনার ল্যাজা-মুড়ো সে কিচ্ছুটি জানে না। নীলমাধবের চোখ জোড়া প্রশ্ন অনেক আগেই পড়তে পেরেছে ছক্বা। সে চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। এই বয়স্ক মানুষটাকে কেন যেন বিপদের ভেতর ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। নিজের বিপদটা আজ চোখের উপরে নেমে আসতে দেখেছে। দু’জন মেয়েছেলেকে বাঁধের উপরে অত ভোরে ঘোরাঘুরি করতে দেখে সন্দেহ আগেই হয়েছিল। তবে প্রথমে ভেবেছিল অন্ধকারে মেয়েছেলেরা মাঠকাজ সারতে এসেছে। কিন্তু খানিক বাদেই ওদের শঙ্খ বাজানো আর দূরে আলোর ফুটকিগুলোর নড়াচড়া ছক্বাকে বিপদের গন্ধ টের পাইয়ে দিয়েছে। প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি! আর ধরা পড়লে এতক্ষণে গণপিটুনিতে কী যে হতো, ভাবলেও শিউরে উঠছে। গতবছরে মেহতাব-এর তালগোল পাকানো লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল বাসন্তী বাজারে। মেহতাব-এর নামে পুলিশও কাঁপত, তার লাশ।

‘ভাইডি, কোনও পব্লেম আছে?’

নীলমাধব ছক্বার পাশে বসে তার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে শুধোয়। ভোরের মিঠে হাওয়ায় বিড়ির তীব্র গন্ধ প্রকট হয়ে উঠেছে।

‘নীলুদা, তোমার মতো গেঁয়োলোক আমি দেকিনি। তুমি ক্যানো বুজতি চাওনা বহুৎ বেইমানির কাজ এডা।’

‘কেন কেন! এই যে সুশান্ত-দা কলো, এডা হলো গে সমাজসেবার কাজ। সুন্দরবনের ডেভলপমেন্ট নিয়ে এই এনজিও কাজ করতিছে। দেশ-বিদেশ থেকে নাকি ট্যাকা আসে!’

‘মিছে কতা। সাধারণ মানষির পেটে লাথি মারি সুশান্তদার মতো কয়ডা মানষির উন্নতি হতিছে এহানে।’

‘কিন্তু, এই যে আমারে এত ট্যাকা দিতিছে, তা পাতিছে কোত্থেকে!’ নীলমাধব কিছুতেই অবিশ্বেস করতে চায় না।

‘তোমারে দিতিছে, আমারে দিতিছে, আরো কয়েকজনকে। যেখানে যেখানে প্রণামি দিলি নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে সবকিছু হতি পারে, সেখানে দিতিছে। সব দিয়ে থুয়েও ওদের হাতে বিস্তর ট্যাকা। এত ট্যাকা যে একটা নতুন দ্বীপ কিনতি পারবে, সেখানে শহর গড়তি পারবে।’

নীলমাধবের শরীরে কাঁপুনি এসেছে, সে ছক্বার হাতটা ধরে কাঁপুনি থামাতে চায়। মনের ভেতরের অপাপভূমি থেকে সমর্থনের ইশারা পেতে চায়। ‘কিন্তু ছ্যামড়া, আমি তো কোনও অন্যায় কাজ করি নাই, আমি গায়ে খেটে ট্যাকা নিছি, হারামের কিছুডি নিই নাই। নিজের গতর নিংড়ে মাছের গতর গড়ছি।’

মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসল ছক্বা। লোকজনের নজরে পড়তে চায় না। সে ফিসফিস করে, ‘ছাই! তোমার ওষুধে মাছ বাড়ত না, মরত।’

তা কেন, আমি তো আমাদের রেলবাজারে গিয়ে শুনছি, মাছের ফলন বাড়িছে, তা-ই দাম কম মাছের। আমার তো বেশ ভালো লাগত। সাধারণ মানুষ এই যে কম দামে মাছ পাতিছে, সিকেনে আমার ভূমিকা আছে।’

‘আছেই তো।’ছক্বার গলার স্বর কেমন ধাতব। সে হিসহিসায়, ‘বাসন্তীতে এত বেকার পোলাপান থাকতি তোমারে ক্যান কাজে নিল, তা কি একবারও ভাবিছ!’

নীলমাধব কাঁচুমাচু মুখে কথা ফেলে, ‘হাদুই শোন দিন, তা তো কই ভাবি নাই। ভাবছি শউড়ের পো কয়েছে তাই শান্তনুদা কাজটা দেছে।’

হ্যাঁ, শান্তনুদা তোমার মতো একটা সাদাসিদে লোক খুঁজতিছিল, যে বেশি খপর রাহে না। এলাকার বাইরের লোক হলি সুবিধা। পাঁচকান হবার ভয় নাই।’

‘ক্যান, কীসের ভয়?’ নীলমাধবের অবাক গলা।

ছক্বা নীলমাধবের কাছে আরো ঝুঁকে আসে। হ্যাঁ, সবটা জানিয়ে দেওয়া ঠিক হবে। মাস খানেক ধরেই তার মনে হচ্ছিল, বড়ো বিপদ আসতে চলেছে। আসলাম সানিকে অত লোকের মাঝে অপমান করেছিল শান্তনুদা। সেটা ঠিক হয়নি। গত সাত-আট বছর একসাথে রাজনীতি করে শান্তনুদার ঘাঁত-ঘোঁত সব জানে আসলাম। বাসন্তী, গোসাবা, কুলতলির প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম। সন্দেশখালির দিকে এক একটা গাঁ তো পুরোটাই। আসলাম এই সব জায়গার ভোট জড়ো করত নানা কৌশলে। সে কি সহজে হজম করবে! গত সপ্তাহে শান্তনুদার এক স্যাঙাত উদয় মণ্ডলকে সোনারপুরে কুপিয়েছে আসলামের ছেলেরা। মাটি-কাটা নিয়ে বিবাদ। ছক্বা এতদিন এদের সাথে থেকে দেখেছে, পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে শত্রু নিকেশ করত শান্তনু-আসলাম জুটি। এখন আসলাম বুড়ো আঙুল চুষবে!

ছক্বা বলল, ‘নীলুদা, তুমি জালায় মাছের সার দিতে না, বিষ দিতে।’

‘অ্যাঁ কী কতিছিস ছ্যমড়া! আমি তো নিজের চোখে দেখিছি, মাছেরা ডাঙার কাছে এসে মুখ চিবোয়।’

‘ঠিক দেখিছ নীলুদা। তবে মাছে যে খাচ্ছে, তা ঠিক না। তোমার ছড়ানো সারে এমন অল্প করে বিষ থাকত, যে মাছ জলের ভেতর থাকতি না পেরে ছটফট করতি করতি ডাঙার কাছ ঘেঁষে সব মুখ বাড়ায়, আঁকুপাঁকু করে নিশ্বাস নেয়। মরে না। ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ। কুইন্টল কুইন্টল মাছ। একসঙ্গে এত মাছ কিনবে কে! ভেড়ির মালিক জলের দরে তুলে দেয় নন্দীবাবু, দাসবাবু, ইমতিয়াজদের হাতে। এরা সবাই উঁচু উঁচু মান্যি জনের লোক। কাঁটায় যে দাম এরা হাঁকে, সেই দামেই ছাড়ি দিতি হয়। লাভের ট্যাকার মোটা অংশ শান্তনুদার ঘরে ঢোকে।’

নীলমাধব কথা হারিয়ে ফেলেছে। সে ছক্বার কবজি শক্ত করে ধরে আছে। সে তোতলায়, ‘কি কিন্তু আজ তো মাছে বিষ দিতি যাই নাই, সিকেনে আজ অত মানষি তাড়া করল, ক্যান?’

‘আজ কী করছিলে বলো?’

‘কেন, আজ তো কোনও দোষ করি নাই, মাঠে চাষের জন্য জল দিতিছিলাম।’

ছক্বার গলায় শ্লেষ, ‘কেন, তুমি কি সেচ দফতরের কর্মী নাকি, যে শ্যালো চালায়ে জল তুলে দেবা চাষিদের!’

ছক্বা থামে না, সে বলে চলে, ‘মাঠে কী জল ছাড়ছিলে?’

‘মীনের ভেড়ির জল।’

‘চিংড়ির মীন কোন জলে চাষ হয়? মিঠা জলে না নোনা জলে?’

‘নোনা জলে।’

‘ধান, পটল চাষের জন্যি কী জল লাগে?’

নীলমাধব মুখ চুন করে বলে ‘কেন, মিঠা জল।’

‘তালে বলো নীলুদা, তুমি ভেড়ির নোনা জল চাষের মাঠে ঢুকিয়ে চাষির কোন উপকারটা করলে!’

‘ভাইডি, আমারে যে কলো, রুখা জমি চাষের জন্যি বানাতি হবে। ভোর ভোর জল ঢুকালে চাষের সুবিধা। জমি নরম হবেনে। রোদ ওঠার আগে চাষ দিতি পারবে চাষি।’

‘তুমি বড্ড কাঁচা লোক গো নীলুদা। কিচ্ছু খপর রাখো না। এখন শহরের লাগোয়া আর জমিন নাই যে ঘরবাড়ি আর ফ্ল্যাট বানান যায়। সক্বলেই তাই জলা জমি, চাষের জমির দিকে হাত বাড়ায়ে আচে।’

নীলমাধবের গলা শুকিয়ে এসেছে। তাহলে সে এতদিন একটাও ভালো কাজ করেনি! নীলমাধবের পায়ের তলা থেকে ঝুরঝুর করে মাটি সরে সমুদ্রের নোনা জলের দিকে চলে যাচ্ছে। তার বুকে এখন হাউ হাউ করছে কান্না। কান্না চেপে সে অস্ফুট আওয়াজ বের করল, ‘কিন্তু চাষের জমিনে ভেড়ির নোনা জল ঢুকায়ে প্রামোটারের কী লাভ?’

‘আছে নীলুদা। সব সময় লাভ চোখের উপর দেখতি পাবা না। একটু তলায় থেকে সময় হলেই সে ভুস করে মাথা তোলে।’ চায়ের গেলাসে শেষ লম্বা চুমুক দিয়ে আবার বিড়িতে টান দেয় ছক্বা। তারপর বিড়ির টুকরোর উপর সব রাগ ঝেড়ে মাটিতে আছাড় মেরে থক করে একগাদা থুতু ফেলে।

‘ফ্ল্যাট বাড়ি বানানো দেহিছ নীলুদা? ফাঁকা জমিতে মাটি কেটে  ইট-বালি-সিমেন্ট সব মাটির ভেতর সেঁধোয়। পেত্থমে মনে হয় রাশি রাশি ট্যাকা মাটির বুকি ঢুকি যাতিছে। কিন্তু খানিক বাদে দেখবানে লকলক করি ধানের চারার মতো মাথা তুলি দাঁড়াতিছে এক একটা ফ্লোর, মানে লাখে লাখে ট্যাকা। তেম্বায়, ঠিক তেম্বায় শান্তনুদা চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকোয়ে চাষিরে বাধ্য করে ভেড়ি বানাতে। জমিতে নোনা লেগে গেলে আর যে ফসল হবে না গো।’

ছক্বা কথা থামায়। সে দেখে নীলমাধব ঝরঝর করে কাঁদছে। ‘কী হল, কাঁদতিছ ক্যান?’

‘ভাইডি, তালে তো আমি কত লোকের ক্ষেতি করে দিলাম, না! কত চাষির কপাল খালাম, হায় হায় রে।’

ছক্বা ধমকাল, ‘কী ন্যাকামিটা করতিছ! এখানে লোকজন জড়ো করি সব জানায়ে দেবা বুঝি! হাড়গোড় একখানাও আস্ত থাকবেআনে ভাবিছ? চুপটি করে বাইকের পেছনে ওঠোদিন। তোমারে আজ বাড়িতে ছেড়ে দে আসতিছি। কেলো ফোনে খপর দেছে শ’দুয়েক লোক শান্তনুদার বাড়ি ঘিরে ফেলিছে। কী হয় কে জানে! আমারে তো কলো, ডুব মারতি।’

খুবই বিধবস্ত দেখাচ্ছে বাসন্তীর রুস্তম ছক্বাকে। সে সুশান্তদার নানা কারবারে জড়িত। নিজে কিছুই করে না, কিন্তু বাইকবাহনে চেপে নজরদারি করে। ভালো চেহারা। চোখে কালো চশমা, কানে দুল। গ্রামের গরিব মানুষেরা সমীহ করে। একটু থাকা, একটু কড়া চোখে তাকানো, তাতেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। সুশান্তদা বদলে মাস গেলে ৩০ হাজার দেয়।

এখন ছক্বার মনে হচ্ছে, দাদার গোলামিটা না করে, মানে জমি দখল করা, অন্যদলের মানুষের ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া, বাজার থেকে তোলা আদায় করা, মাটি বিক্রি করা –মানে হাজার একটা সুশান্তদার বেআইনি কাজে নিজেকে না জড়িয়ে, যদি এরকম একটা চায়ের দোকানও করত, শান্তিতে দু-মুঠো ভাত খেতে পারত। এতক্ষণে হয়তো গণ ধোলাইতে সুশান্তদা-র নাড়িভুড়ি বেরিয়ে গেছে। এখন পুলিশে গুঁতোলেও গুঁতোবে, নয়তো ওই আসলামের লোকজন মেরে পেট চিরে মাতলায় ভাসিয়ে দেবে। মরণ তার বাঁধা।

ভাবতে ভাবতে বাইকে স্টার্ট দেয় ছক্বা। বাইকের পেছনে বসা এক নিতান্ত ভালোমানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা তার এ জীবনের একমাত্র ভালো কাজ। রুবির মোড়ে এসে ছক্বার হঠাৎ মনে হল, নীলমাধবদার বাড়িতে তো কিছুদিন সে লুকিয়ে থাকতে পারে। সেসময় ছক্বার মুখের উপর ভোরের সূর্য এসে বসেছে। তক্ষুনি বাইকের পেছনে বসা ভেঙে-চুরে যাওয়া নীলমাধবের চোখে পড়ল বড়োই ফ্যাকাশে এক বাঁকা চাঁদ পশ্চিমের আকাশে শুয়ে আছে। আর ছুটন্ত বাইকের পেছনে সোঁ সোঁ হাওয়ার ভেতর তার কানে এসে যেন বাজল নন্দিনীর গলা, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’

 

 

সারপ্রাইজ

অভিজিতের সঙ্গে পুনায় তার কর্মস্থলে চলে যাচ্ছে নন্দিনী। স্টেশনে তাদের দুজনকে সি-অফ করতে এসেছেন অভিজিতের বাবা-মা এবং বোন সীমা। মাত্র একমাস হল অভিজিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নন্দিনীর। বিয়ের পর এই কটা দিন যেন সুখের স্রোতে ভেসে কেটে গেছে। অভিজিতের পরিবারের সদস্যরা মাত্র একদিনেই ভালোবেসে ফেলেছেন মাতৃহারা মেয়েটিকে।

আজ ছেলে-বউমাকে বিদায় জানাতে এসে সে-কথাটি বিলক্ষণ বুঝছেন সুরমা। তার দুচোখ জলে ভরে এসেছে। নন্দিনীর চিবুক ধরে আদর করে বলে উঠলেন, ‘মন চাইছে না তোকে ছেড়ে দিতে নন্দিনী। কিন্তু কী করব বল! ছেলেটা বিদেশবিভুঁইয়ে একা থাকবে, এটাই বা মা হয়ে কী করে সহ্য করি বল! জানি, তোর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ করিস না মা। যখন ইচ্ছে করবে চলে আসবি। আর ফোন তো রইলই!’

সুরমার কথা শুনতে শুনতে মনটা ভিজে উঠল নন্দিনীরও। সুরমার কাঁধে মাথা রেখে সে ফুঁপিয়ে উঠল। নিজের মায়ের স্মৃতি, সময়ের ব্যবধানে আর খুব বেশি উজ্জ্বল নয় তার কাছে। সুরমার মধ্যে, তার দেওয়া স্নেহের মধ্যে, সে তার নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পেয়েছিল।

সীমা এগিয়ে এসে কানেকানে বলল, ‘বউদি, তুমি কী গো? আজকালকার মেয়েরা ভাবে, কতক্ষণে শ্বশুর-শাশুড়ির কড়া শাসনের বাইরে বের হবে। তোমার কাছে বিনা আয়াসে সেই সুযোগ যখন এসেইছে, তখন তুমি কাঁদছ? সত্যি তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না!’

সীমার কথা শুনে সুরমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে নন্দিনী ম্লান হাসি নিয়ে তাকাল।

পুনেতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে অভিজিৎ। তবে এখনও গৃহপ্রবেশ করেনি। একেবারে নন্দিনীকে নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে উঠবে, ঠিক করেছে। ফার্নিচারগুলো অবশ্য বিয়ে উপলক্ষ্যে কলকাতায় ছুটি নিয়ে আসার আগেই নতুন ফ্ল্যাটে রেখে দিয়ে এসেছে সে। আর, চাকুরেদের যে-মেসটায় থাকত এতদিন, বকেয়া মিটিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে সেটা।

ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসতে, ওরা নিজেদের কামরায় উঠে পড়ল। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন ভাড়া নিয়েছে অভিজিৎ। ভারী স্লাইডিং দরজাটা টেনে দিলে কেবিনটা একেবারে ব্যাক্তিগত হয়ে যায়। জানলার বাইরে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কাচের বাধা ভেদ করে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। রাত নটা নাগাদ ট্রেনের প্যান্ট্রি কার থেকে খাবার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে দশটা নাগাদ উপরের বাংকে শুতে চলে গেল অভিজিৎ।

নন্দিনীও হাতে একটা পেপারব্যাক নিয়ে আধশোয়া হল। কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে হঠাৎই তার নিজেকে খুব একা মনে হতে লাগল। আর মনে পড়ে যেতে থাকল পুরোনো স্মৃতিগুলো।

মনে পড়ল, অমরশংকর কত চিন্তিত ছিলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে! নন্দিনী সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা। বাধাটা সেদিক থেকে নয়। কিন্তু, পারিবারিক ইতিবৃত্তটি শোনার পর পাত্রপক্ষেরা পিছিয়ে যায়। আর, অমরশংকর তো সে কাহিনি না বলে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। একসময় পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে বসতে ক্লান্ত নন্দিনী তো বাবাকে বলেই ফেলেছিল, ‘তুমি আর চেষ্টা করো না। বিয়ে করাটাই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়! আমি পড়ব। আরও পড়ব। ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করব।’

অমরশংকরও হতাশ হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। এইসময়েই হঠাৎ দেবদূতের মতো হাজির হলেন সুরমা আর জয়ন্ত। সব শুনেও ওরা ওদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

অথচ সেই ইতিহাসের জন্য নন্দিনী কোনওভাবেই দায়ী ছিল না। নন্দিনীর মা বিনতা খুবই অর্ন্তমুখী স্বভাবের মহিলা ছিলেন। এমনকী কষ্টের কথাও তাকে কেউ কখনও মুখ ফুটে বলতে শোনেনি।

অমরশংকর সবে কলেজ পাশ করে চাকরি পেয়েছেন, এই সময়টায় বাড়িরঅমতে বিয়ে করেছিলেন বিনতাকে। বিয়ে করে আর দক্ষিণ কলকাতার সাবেকি বাড়িতে ওঠেননি ওরা। অন্যত্র বাসা নিয়েছিলেন। নন্দিনীরও জন্ম এখানেই। সমস্যার শুরু তার পরে।

নন্দিনীর খুব আবছা ভাবে মনে পড়ে শীতকালের এক দুপুরের কথা। স্কুল ছুটি ছিল। তাই বাড়িতেই ছিল সেদিন নন্দিনী। অমরশংকর যথারীতি অফিসে গেছিলেন। বাইরের বারান্দায় একা বসে, পুতুল এবং খেলনাবাটি নিয়ে সংসার পেতেছিল নন্দিনী। এইসময় সহসা বেজে উঠেছিল ফোনের ঘণ্টিটা। বিনতা ফোন ধরে কথা বলছিলেন। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতে কৗতূহলী হয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল নন্দিনী। তারপর ভিতরের দৃশ্য দেখে সে যেন পাথর হয়ে গেছিল।

ফোনের রিসিভারটা ঝুলছে। বিনতা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মেঝের উপর। চুলগুলো খোলা। হাওয়ায় উড়ছে। থরথর করে কাঁপছে বিনতার শরীরটা। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। উন্মত্তের মতো মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাচ্ছেন বিনতা।

নন্দিনীর বুকের মধ্যেটা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে কী করবে প্রথমে বুঝে পেল না। তারপর নিজেই দরজা খুলে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিল দীপা কাকিমাকে। দীপাও ঘাবড়ে গিয়ে অমরশংকরকে ফোন করেছিল তাঁর অফিসে। দ্রুত বাড়িতে চলে এসেছিলেন অমরশংকর।

খানিকক্ষণ পরে ডাক্তার এসেছিলেন। বিনতাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ক’দিনের মধ্যে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বিনতা। কিন্তু ডাক্তারবাবু সতর্কবাণী শুনিয়ে গেলেন। হিস্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে বিনতার মধ্যে।

বিনতা সেই সময়ের মতো সুস্থ হয়ে গেলেও ক”দিন পরে আবার তার মধ্যে ফের একইরকম বৈকল্য দেখা দিল। তারপর থেকে বারবারই এমন হতে থাকল। উন্মত্তের মত আচরণ করতে লাগলেন বিনতা। এমনকী এসময় বিনতার কাছাকাছি যেতে ভয় পেতেন অমরশংকর নিজেও। ভয়টা যতটা তার নিজের জন্য, তার ঢের বেশি বিনতার জন্য।

বিনতা যখন পাগলের মতো আচরণ করেন, তখন কেউ তার দিকে এগোলেই তিনি ভাবতে থাকেন তাকে বুঝি মারতে আসছে। তার এই রোগটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। কেবল প্রকোপের সময়টুকুতেই নয়, তার বাইরেও তিনি অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করলেন।

অমরশংকর যেন মনের দিকে থেকে ভেঙেচুরে গেলেন। তার কাছের বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিলেন, বাড়িতে না রেখে বিনতাকে কোনও মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখতে। তাদের আসলে ভয় ছিল নন্দিনীকে নিয়ে। ডাক্তারবাবুও বলেছিলেন, ‘বিনতা যেরকম ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ছে, তাতে করে আপনার নন্দিনীর কথাটা বোধহয় একটু ভাবা উচিত অমরবাবু। শুধু শারীরিক ক্ষতির ভয়ই নয়, বাচ্চা মেয়ে, তাই মনের উপরেও বিশ্রী চাপ পড়ার ভয় থেকেই যায়।’

অমরশংকর স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু ডাক্তারবাবুর পরামর্শ শোনার পর আর ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। সবচেয়ে নামি ও খরচবহুল একটি মেন্টাল অ্যাসাইলামে বিনতাকে রেখে এলেন তিনি। মাস-মাস মোটা টাকা ডোনেশন দিতে হতো সেখানে। বিনিময়ে বিনতা পেতেন সেরা যত্ন এবং দেখভাল।

নন্দিনীর মনে আছে, সপ্তাহে দুবার বিনতার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন অমরশংকর। ঘণ্টাখানেক বিনতার পাশে বসে কাটিয়ে আসতেন। বিনতা বেশি কথা তো বলতেন না। অমরশংকরও চুপ করে তার পাশে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে নন্দিনীর কথা আলোচনা করতেন।

এক সোমবার সকালে অ্যাসইলাম থেকে ফোন এল। বিনতা নেই। ফোনটা রেখে বাবা গুম মেরে বসে রইলেন। তারপর নন্দিনীকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের এক্ষুনি একবার মেন্টাল অ্যাসাইলামে যেতে হবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।’ কী ঘটেছে, তা টেলিফোনের কথোপকথন শুনেই বুঝতে পেরেছিলন নন্দিনী। আলদা করে বলতে হয়নি।

বিনতার ক্রিয়াকর্মে যোগ দিতে নন্দিনীর দাদু-ঠাকুমাও এলেন। নন্দিনী তখন দশ বছরের বালিকা। প্রতিমা– অমরশংকরের মাকে এই প্রথম সে দেখল। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে একটা অস্বাভাবিক কাঠিন্য আছে। কাজকর্ম মিটে যেতে প্রতিমা ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তো ও বাড়িতে ফিরবে না। সে প্রত্যাশাও আমি বা তোমার বাবা করি না। কিন্তু নন্দিনীর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তোমার উচিত ওকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করা।’

অমরশংকর শুনে, গলায় শ্লেষ ঢেলে বললেন, ‘বেঁচে থাকতে বিনতাকে কোনওদিন তোমরা মেনে নাওনি। এখন তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাও?’

প্রতিমার ঠোঁটের চারপাশ আর চোখের তলার চামড়াটা আশ্চর্য ভাবে কুঁচকে গেল। কর্কশ স্বরে বললেন, ‘বিনতা তোকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছিল অমর। ওকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না আমরা।’

‘বিনতা নয়, তোমরা। তেমারাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে।’ অমরশংকর রুখে উঠলেন, ‘সেখানেই শেষ নয়। আজ আমি ভালোই জানি, কার ফোন পেয়ে বিনতা অমন পাগলের মতো আচরণ করত।’

প্রতিমা চুপ করে গিয়েছিলেন। নন্দিনীর অতিসংবেদী শিশুমন তখনই স্পষ্ট করে বুঝে গিয়েছিল, সেদিন দুপুরে আসা ফোনটার অন্য প্রান্তে কে ছিল। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল তার মন। সে ঘৃণা আজও মোছেনি মন থেকে। কিন্তু এই কদর্য ছবিটার উলটো দিকে একটা সদর্থক ছবিও ছিল। যার জন্য অমরশংকরের জন্য নন্দিনীর মনে শ্রদ্ধার ভাবটা বেড়ে গিয়েছিল বহু শতগুণ। নিজের মনে একাকী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। রাতে তার চোখে ঘুম আসতে চাইত না। সবটাই লুকিয়ে দেখেছিল নন্দিনী। বাবার পাশে দাঁড়ানোর বয়স বা সাহস কোনটিই তার ছিল না। কেবল অমরশংকরের জন্য অদ্ভুত এক কষ্ট তাকে পীড়িত করত।

অথচ অন্য সময় অমরশংকর যেন অন্য মানুষ। নন্দিনীকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, দুপুরে সে বাড়ি ফেরার পর নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে ফোনে খবর নিচ্ছেন, আয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন, পার্টি এড়িয়ে চলছেন, কারণ তাঁকে সন্ধেয় দ্রুত বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে সঙ্গ দিতে হবে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। পলক ফেলতে না ফেলতে।

অমরশংকর এবার নন্দিনীর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। দ্রুত জবাব আসতে লাগল। পাত্রপক্ষের খুব পছন্দও হয় নন্দিনীকে। কিন্তু অমরশংকর যেই বিনতার কথা খুলে বলেন, তারা পিছিয়ে যায়। অমরশংকরের বন্ধুবান্ধবরা পরামর্শ দেন, ‘এত বিস্তারিত ভাবে পাত্রপক্ষকে সবকথা জানানোর কী আছে? ওরা কি মেয়েটাকে ঘরে নেবে, না তোমার বংশপরিচয়কে?’

অমরশংকর সব শুনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আর পাত্রপক্ষ শুকনো মুখে জানায়, ‘মেয়েকে তো আমাদের খুবই পছন্দ ছিল অমরবাবু। কিন্তু ভয় পাচ্ছি। মেয়ের মা পাগল। শেষে মেয়েও যদি কোনওদিন…!’

অমরশংকর ম্লান হাসেন।

নন্দিনীও ক্লান্ত হয়ে গেছিল প্রায় সন্ধ্যাতেই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে হাজিরা দিতে দিতে। শেষে একদিন  মরিয়া হয়ে মুখ ফুটে বলে উঠেছিল, ‘বাবা তুমি কি মনে করো বিয়েই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য? এখন মেয়েরা নিজেদের কেরিয়ারটাই আগে গড়তে চায়। আমিও কি সেরকম হতে পারি না?’

অমরশংকর বলেছিলেন, ‘অবশ্যই পারিস। কিন্তু কেরিয়ারের সঙ্গে বিয়ের তো বিরোধ নেই কোনও।’

এই সময়েই অকস্মাৎ একটা যোগাযোগ হয়ে গেল। অমরশংকরের সঙ্গে তার বন্ধু সুবিমলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছিল নন্দিনী। সেখানেই সুরমা তাকে প্রথম দেখেন। আর তারপরই খোঁজখবর নিয়ে ছেলে অভিজিতের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে মোটা মাইনের চাকরি করে অভিজিৎ। পারিবারিক কৗলিন্যও রয়েছে। অমরশংকরের ‘না’ বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এবং কী আশ্চর্য, অমরশংকর পুরোনো সব কথা বলার পরেও সুরমা এবং জয়ন্তকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেল না।

জয়ন্ত বললেন, ‘মায়ের একটা মানসিক অসুস্থতা ছিল বলে ওরও থাকবে, এটা এ ক্ষেত্রে তেমন যুক্তিযুক্ত বোধহয় নয়।’

সুরমা বললেন, ‘আমাদের ভাগ্যে যদি সেটা থাকেই, তাহলে ঘটবে–!’

অমরশংকর ভারি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল অভিজিৎ আর নন্দিনীর। কিন্তু বাস্তবের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী সেভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বিয়ের কয়েকদিন পরেই কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে চোখের জল ফেলে অভিজিতের কাছে সে জানতে চেয়েছিল, ‘আমিও যদি কোনওদিন মায়ের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ি?’

জানলা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকে এসে চোখের পাতায় বসতেই ঘুম ভেঙে গেল নন্দিনীর। সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যায় অভিজিৎ। কাজেই তার অফিসে বেরোনোর আগে অবধি, রান্নার তেমন ব্যস্ততা থাকে না। সেটা শুরু হয় পরে। অভিজিৎ বেরিয়ে যাওয়ার পর।

অভিজিতের অফিস তাদের ফ্ল্যাটের খুব কাছে হওয়ার জন্য, লাঞ্চের অবসরে অভিজিৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য বাড়িতে আসে। তখন ওরা দুজনে একসঙ্গে খেতে বসে।

বিছানা থেকে নেমে নন্দিনী ঠিক করল, রেসিপির বইটা দেখে আজ কিছু আনকোরা রান্না তৈরি করবে। ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলেই নন্দিনী বুঝল, ফোনের অন্য প্রান্তে রয়েছেন অমরশংকর।

প্রথমেই বললেন, ‘শুভ জন্মদিন নন্দিনী! কেমন আছিস মা?’

‘ভালো আছি বাবা। তোমার শরীর ঠিক আছে?’

‘শরীর ঠিক আছে। তবে সত্যি বলতে কি, তুই শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো ফাঁকা লাগে।’

নন্দিনীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।

অমরশংকর বলেন, ‘তোর জন্য একটা উপহার কিনে গতকালই কুরিয়র কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছি। আজই পেয়ে যাবি। পছন্দ হয়েছে কিনা জানাস–!’

অমরশংকর ফোনটা ছেড়ে দিলেন। অভিজিৎ বাথরুমে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন করেছিল নন্দিনী?’

‘বাবা!’

অভিজিৎ নিজের মনেই বলল, ‘ও!’

কিচেনের দিকে যেতে গিয়ে আবার থমকে যেতে হল নন্দিনীকে। আবার ফোনের ঘণ্টি বাজছে। এবার সীমা।

ফোন তুলতেই কলকল করে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন বউদি। তা, দাদা আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেলিব্রেট করতে?’

‘সেলিব্রেশন? তোমার দাদা?’ বলতে বলতে নন্দিনীর বুকে একটা অভিমান দলা পাকিয়ে ওঠে, ‘এখনও অবধি উইশ করেনি জানো? বোধহয় ভুলেই গেছে।’

‘ভুলে গেছে?’ সীমা স্পষ্টতই অবাক হয়, কিন্তু প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘আচ্ছা, আমি এখন কলেজে যাচ্ছি, কেমন বউদি? বাবা-মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আমি রাতে ফোন করব আবার। হিহি!’

সুরমা ও জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলে ফোনটা রেখে পিছন ফিরতেই নন্দিনী দেখল, অভিজিতের স্নান হয়ে গেছে। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে সে বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে নিজের মনে গুনগুন করছে।

নন্দিনীকে দেখে উদাসীন গলায় বলল, ‘বাব্বা! আজ দেখছি একের পর এক ফোন আসছে তোমার। ব্যাপারখানা কী?’

ক্লিষ্ট হেসে সরে যেতে যেতে নন্দিনী বলল, ‘হয় এক-একদিন এরকম!’

কিন্তু মনটা তার ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে। অভিজিৎ কী করে বউয়ের জন্মদিনের কথাটা ভুলে যেতে পারে? কিন্তু আচরণ দেখে মনে হচ্ছে বিষয়টা মাথাতেই নেই ওর।

টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে সে অভিজিৎকে ডাকল। কোনও কথা না বলে ওরা খাচ্ছে। নীরবতা ভেঙে অভিজিৎ সহজ গলায় জানতে চাইল, ‘তোমার কি মন খারাপ নন্দিনী?’

‘না তো! কেন?’– নন্দিনীর চোখদুটো জ্বালা করে উঠল।

‘না, তোমাকে অন্যমনস্ক দেখে ভাবলাম, হয়তো বাবার জন্য মন কেমন করছে। সেক্ষেত্রে কয়েকদিন তোমার বাবার ওখান থেকে আমরা ঘুরেও আসতে পারি।’

নন্দিনীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়া শেষ হয়ে গেছে অভিজিতের। গলার টাইটা বেঁধে নিতে নিতে বলল, ‘ও। শোনো, একটা কথা তো তোমায় বলাই হয়নি। আমার একবন্ধুর জন্মদিন আজ। হোটেলে পার্টি থ্রো করেছে। যেতেই হবে। তুমি সন্ধেয় সেজেগুজে তৈরি থেকো।’

অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর বন্ধ দরজাটায় পিঠ ঠেকিয়ে নন্দিনী ভাবতে থাকল, বন্ধুর জন্মদিন মনে রাখতে পারে অভিজিৎ। কেবল তার বেলাতেই ফাঁকি। এমন নয় যে, অভিজিৎ জানে না আজ তার জন্মদিন। কিন্তু কত সহজে সে সে-কথা ভুলে গেছে! প্রচণ্ড অভিমানে নন্দিনীও ঠিক করল, অভিজিৎকে কক্ষনও সে তার জন্মদিনের কথাটা মনে করিয়ে দেবে না। এমনকী সীমা বা সুরমার কাছ থেকে জানতে পেরে সে যদি কোনও উপহার কিনেও আনে, সে নেবে না। ফিরিয়ে দেবে।

মনের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা সত্ত্বেও সে অনেকক্ষণ ধরে সাজল। ভোটশিপের সময়, অভিজিতের পছন্দ করে কিনে আনা শাড়িটা পরে, সে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখল আয়নায়।

অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে দেখে চমকে গেল অভিজিৎ। মুগ্ধ চোখ ফেরাতে পারল না। যদিও তেমন উৎসাহ দেখাল না নন্দিনী। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। সুরমা হয়তো এরকম কোনও দিনের আগাম কল্পনা করেই, চলে আসবার দিন নন্দিনীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘কখনও কখনও খুব ছোটো ছোটো ঘটনাও বড়োসড়ো ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারগুলোকে সামলালে দেখবি, সব ঠিক হয়ে গেছে। কোনও কথা যদি খারাপ লাগে, তাহলে তক্ষুনি জবাব না দিয়ে ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।…’

নিজেও দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে অভিজিৎ ব্যস্ততার সঙ্গে বলল, ‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আবার একটা ছোটোখাটো প্রেজেন্টেশনও কিনে নিতে হবে।’

সন্ধে নেমে এসেছে। চর্তুপাশ ঝলমল করছে আলোয়। গাড়ির ঢল নেমেছে। একটা বড়ো গয়নার দোকান দেখে তার সামনে গাড়ি থামাল অভিজিৎ। বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি নন্দিনী। আমার এই বন্ধুটি একজন ভদ্রমহিলা। অল্প দিন হয়েছে, তার সঙ্গে আমার আলাপ।’

দোকানের সুবেশ ছেলেটিকে হিরের আংটি দেখাতে বলল অভিজিৎ। নানা ডিজাইনের আংটি চলে এল। বেশ কয়েকটা পছন্দসই মনে হল অভিজিতের। সবকটাই একে একে নন্দিনীর আঙুলে পরিয়ে শেষপর্যন্ত একটিকে চূড়ান্ত বাছাই করল সে। আংটিটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে। নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করতে সেও মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

আংটির দাম পঁচিশ হাজার টাকা। সব দেখে নন্দিনী যেন মনে মনে আরও বেশি করে নিভে যাচ্ছিল। বন্ধুর জন্য এত দামের উপহার, আর নিজের স্ত্রীর জন্য কিছুই না! কী অসম্ভব পরিহাস লুকিয়ে আছে গোটা ঘটনাটার মধ্যে।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। অনেকটা পথ পেরিয়ে এবার এসে থামল এক বিরাট পাঁচতারা হোটেলের নীচে। গাড়িটা পার্ক করে, চোখের ইশারায় তাকে অনুসরণ করার কথাই বলল অভিজিৎ। সে হাঁটতে লাগল হোটেলের রেস্তোরাঁটির দিকে। চারপাশে তাকাতে তাকাতে। যদি নিমন্ত্রিত বন্ধুবান্ধবদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!

রেস্তোরাঁর মধ্যেটা নরম আলোর ঠান্ডা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। খুব হালকা ভল্যুমে কোনও চেনা সুর বাজছে। টেবিলে টেবিলে ছায়ার মতো নারী-পুরুষ। সেদিক না মাড়িয়ে অভিজিৎ একটু নিরালা থাকা দামি কেবিনগুলোর একটার দিকে এগেল।

কেবিনের ভারী পর্দাটা সরিয়ে অভিজিৎ বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাম!’

নন্দিনী একটু অবাক হয়। বলে, ‘কই গো, তোমার হোস্ট কই? আমরাই কি প্রথম এলাম নাকি?’

আবছায়ায় অভিজিৎ একটু হাসল। কখন আরও দুটি ছায়ামূর্তি কেবিনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরনে হোটেলের কর্মীদের ইউনিফর্ম। হাতে ফুলের বোকে। দুজনে দুপাশ থেকে নন্দিনীর হাতে বোকে-দুটো তুলে দিতেই কেবিন মধ্যে হঠাৎ লাল-নীল নানা রঙের আলো জ্বলে উঠল। সেইসঙ্গে আলোয় লেখা ফুটে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন, নন্দিনী’।

নন্দিনীর মনে হচ্ছিল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। বিহ্বল মুখটা ফেরাতেই, সে আর লাল জামা পরা লোক দুজনকে দেখতে পেল না। বদলে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অভিজিৎ। নন্দিনীর ডানহাতের অনামিকা তুলে ধরে সযত্নে হিরের আংটিটি পরিয়ে দিল অভিজিৎ।

নন্দিনী জানতে চায়, ‘এসব কী অভিজিৎ? তোমার বান্ধবী কই?’

‘বান্ধবী! তোমার চেয়েও ভালো ও কাছের বান্ধবী আর কেউ আছে নাকি আমার?’

নন্দিনীর গালদুটি নিজের বাড়িয়ে ধরা করতলে নিয়ে অভিজিৎ বলে ওঠে।

এত সুখ নন্দিনীকে যেন মাতাল করে দিচ্ছে। অভিজিৎ হাতে তালি দিতেই দুটি লোক হাতে খাবারদাবার নিয়ে এসে, টেবিলভর্তি করে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

অভিজিৎ নিজেই, তার আর নন্দিনীর প্লেটে খাবার তুলে দেয় চামচ দিয়ে। আর নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘আমি কী ভাবছিলাম জানো নন্দিনী? সকাল থেকে তোমায় উইশ করিনি একবারও। তার উপর বান্ধবীর নাম করে দামি হিরের আংটি কিনেছি, তোমায় দিইনি– এতকিছুর পরে তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর বেজায় খেপে যাবে। অভিমান করবে। কথা বলবে না। কিন্তু ঘটনা হল, কাছের মানুষজনকে সারপ্রাইজ দিতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনও জিনিস স্বাভাবিক ভাবে হাতে এলে যত আনন্দ, আকস্মিক ভাবে এলে মজাটা তার বেশ কয়েকগুন হয়ে যায়। তাই নয় কি?’

অনেকক্ষণ পরে তার মনে হল, সে একাই বকবক করে যাচ্ছে, অথচ নন্দিনী কিছু বলছে না। তাই সে চোখ তুলে ডাকতে গেল, ‘নন্দিনী!’ কিন্তু তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হল না। সে দেখতে পেল চেয়ারে অদ্ভূত ভাবে এলিয়ে পড়ে আছে নন্দিনী। চুলটা খোলা। এলোমেলো। শাড়িটাও বিস্রস্ত। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে নন্দিনীর উপর দিয়ে।

উদ্বিগ্ন অভিজিৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে নন্দিনীর কাছে গিয়ে তার কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকিয়ে ডেকে উঠল, ‘নন্দিনী, নন্দিনী, কী হয়েছে তোমার?’ পাছে আওয়াজটা বাইরে গিয়ে লোকের মনে কৗতূহল সৃষ্টি করে, তাই যথেষ্ট চাপা গলায় সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

নন্দিনী চোখদুটো খুলল হঠাৎ। ভয় পেয়ে গেল অভিজিৎ। কেবিনের আলো-আঁধারিতে তার চোখদুটো অসম্ভব ঘোলাটে দেখাচ্ছে। দৃষ্টিটা যেন এ পৃথিবীর নয়। রঙিন ঠোঁট ভীষণ ছড়িয়ে হাসল নন্দিনী। এ তো স্বাভাবিক হাসি নয়। বুকে কাঁপন ধরানো এমন হাসি সে আগে কখনও দেখেনি।

দু-পা পিছিয়ে এল অভিজিৎ। তার মনে পড়ে, নন্দিনীই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, ‘আমার মায়ের মানসিক অসুস্থতা ছিল। আমার আবার সেরকম কিছু হবে না তো?’

সময় নষ্ট না করে, সে নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ‘ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে হবে–!’

বলে, ঘুরে দাঁড়াতেই কেউ যেন তার জামা ধরে টানল। ফিরে তাকিয়ে চমকে গেল অভিজিৎ। নন্দিনী হাসছে। সহজ, স্বাভাবিক, সরল, মজা-পাওয়া হাসি।

উদভ্রান্ত অভিজিৎ তার মুখটা নিজের করতলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছো নন্দিনী?’

‘আমার কিছু হয়ইনি।’

‘তাহলে?’

নন্দিনী হাসতে হাসতেই জবাব দিল, ‘সারপ্রাইজ!’

পরকীয়া

 

অমিতের হাত দুটো শক্ত করে ধরল রত্না। ওর চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। এখন কী হবে অমিত?

কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো। তুমি চিন্তা কোরো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমার পায়ে চোট সেরে যাবে। তুমি হাঁটতে পারবে। বলেই রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অমিত। কিন্তু অমিতের আশ্বাসেও ভয় কাটল না রত্নার। পরিস্থিতি বুঝে রত্নার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল অমিত। তারপর রত্নাকে পায়ে ব্যথা নিরাময়ে ওষুধ খাওয়াল।

ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল রত্না। আর তার পাশে আধশোওয়া থেকে আনমনা হয়ে পড়ল অমিত। তার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল সপ্তাহখানেক আগের ঘটনাটা অফিসের কাজে যাচ্ছি এই অজুহাতে কলকাতা থেকে বোলপুর পেঁছেছিল অমিত এবং রত্না। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে চেনাজানা একটি হোটেলে উঠেছিল দুজনে। দুদিনের জন্য বুকিং করে, বরাদ্দ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করেছিল ওরা। যেন এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল দুজনে। তাই, আলিঙ্গন, চুম্বনের পর চড়ান্ত শরীরী উষ্ণতা উপভোগ করতে অমিত এবং রত্না কেউই সময় নষ্ট করেনি। তবে এ ব্যাপারে রত্না একটু বেশি সক্রিয় ছিল। যেন ক্ষুধার্ত বাঘিনির মতো। দীর্ঘদিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকার পর যেন সে ক্ষুধা নিবারণ করল। তাই, অমিত তাকে বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব দিলেও, প্রথমে সে রাজি হয়নি। কারণ, বন্ধ ঘরে আরও কিছুটা সময় সে অমিতকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েিল। কিন্তু একঘেয়েি কাটানোর জন্য অমিত-ই প্রায় জোরাজুরি করে বাইরে বের করেছিল রত্নাকে। আর তারপরই ঘটেছিল বিপত্তি। সোনাঝুরির জঙ্গলে অমিতের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গর্তে একটা পা পড়ে গিয়েিল, তা বুঝতে পারেনি রত্না।

হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করানোর পর চিকিত্সক জানিয়েিলেন, রত্নার ডান পায়ে হাড়ে হালকা চিড় ধরেছে, ক্রেপ ব্যান্ডেজের পর অন্তত পনেরো দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।

পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ নিয়ে হোটলের বিছানায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেছে রত্না। দুদিনের হোটেল বুকিং বাড়িয়ে কুড়ি দিন করেছে অমিত। এখনও অনেক দিন থাকার পর বাড়ি ফিরতে পারবে দুজনে। অফিসের কাজ বেড়েছে বলে দুজনেই বাড়িতে বার্তা পাঠিয়েে। কিন্তু অমিতের স্ত্রী সেই বার্তা বিশ্বাস করে নিলেও, রত্নার হ্যাজব্যান্ড সুনীল যে সন্দেহের বাইরে রাখেনি, কথা বলে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না। যাইহোক, রত্নার পাশে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের ঘোর কাটল ওর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায়।

অমিত দেখল ওর বউ নীলিমার ফোন। ফোন কাটল অমিত। তারপর, বিজি অ্যাট প্রেজেন্ট, আই উইল কল ব্যাক লেটার লিখে পাঠিয়ে দিল। ওকে রিপ্লাই পাওয়ার পর শান্তিতে চোখ বন্ধ করল অমিত।

ঘুম ভাঙার পর রত্না দেখল অমিত ঘুমোচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে অমিতকে আর বিরক্ত করল না রত্না। বরং, চুপচাপ শুয়ে থেকে ভাবতে লাগল, অমিতের সঙ্গে পুনর্মিলনের সেই মুহূর্তটির কথা।

বছরখানেক আগের এক বিকেল। রত্না যে-এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট-এর ফ্যাকাল্টি, সেই ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্টস ওয়ার্কশপ ছিল ধর্মতলায় অবস্থিত একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর রত্না হল থেকে বেরিয়ে হাঁটছে লিফ্ট-এর দিকে। হঠাত্ একজনকে দেখে খুব চেনা মনে হল।

লিফট-এর একটু দূরে ঘুরে ফিরে কথা বলছিল অমিত। তাই, অমিত কিনা তা নিশ্চিত হতে রত্না দাঁড়িয়ে পড়ল।

এরই মধ্যে রত্নার মনে পড়ে গেল, বছর পাঁচেক আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনগুলির কথা। অমিত ওর মনের মানুষ ছিল। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত রত্না। কিন্তু ইউনির্ভাসিটির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, অমিত হঠাত্ কেন যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দর্শাতে পারেনি। অনেক অপেক্ষার পর তাই মা-বাবার পছন্দের পাত্র সুনীলকে বিয়ে করে রত্না। শুধু তাই নয়, বিয়ে পর রত্না সুনীলের সন্তানের মা-ও হয়েে নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু, সুনীলের বদমেজাজ আর অমিতের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসার কারণে, রত্না ভালো স্ত্রী হতে পারেনি। যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের মুখোমুখি হল রত্না। অমিত একবারেই রত্নাকে চিনতে পারল। ফোন ছেড়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে রত্নাকে জিজ্ঞেস করল

আরে রত্না, তুমি এখানে!

আমার ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্ট ওয়ার্কশপ ছিল। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?

আমার কোম্পানির প্রোডাক্ট লঞ্চ ছিল এখানে। বাই দ্য ওয়ে কেমন আছো রত্না?

আছি একপ্রকার, মণিহারা ফণির মতো।

কথাটা বলেই হাসতে হাসতে অমিতের চোখের দিকে তাকাল রত্না। যেন সে অমিতের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। এর ঠিক কয়ে সেকেন্ড পরে রত্না অমিতকে বলল, তুমি কেমন আছো?

ওই চলছে একপ্রকার।

ব্যস্ত মানুষ। তা এখন হাতে একটু সময় আছে? খুব বেশি সময় নষ্ট করব না। এতদিন বাদে দেখা, তাই একসঙ্গে বসে একটু কফি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

সেদিন রত্নার কফি খাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করে, নিজেও খুশি হয়েিল অমিত। আড্ডা জমেছিল অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনের বিবাহিত জীবন কেমন চলছে, একে অপরকে না পেয়ে কতটা দুখি, সবই সেদিন শেয়ার করেছিল পরস্পরকে। আর সেদিনের জন্য যখন একে অপরের থেকে বিদায় নিয়েিল, তখন দুটো শরীর যেন চুম্বক আর লোহার রূপ নিয়েিল। রাত বাড়ছে, বাড়ি ফিরতে হবে, ভেবেই হয়তো বাহুমুক্ত হতে বাধ্য হয়েিল তারা।

এরপর প্রতি মুহূর্তে দুজনে দুজনকে চোখে হারিয়েে। সময় পেলেই ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, কিংবা ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ সময় ধরে মনের ঝাঁপি খুলে ধরেছে।

রত্না এবং অমিত অফিস আওয়ার্স-এ বেশি কথা বলত। কারণ দুজনে যেহেতু অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে খুব কম কথা বলত তারা। তবে সংসার এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য ওই দিনের পর আর দেখা করতে না পারলেও, মনের টান বাড়তে লাগল উভয়ে। এ ব্যাপারে বেশি কাছে আসতে চাইত রত্না। একবার দূরভাষে রত্না অমিতকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না-পাওয়ার জন্য এতটাই আক্ষেপ করতে শুরু করেছিল যে, অমিত জিজ্ঞেস করল বিয়ে করে তুমি কি খুশি নও?

অমিতের কথার উত্তরে রত্না সেদিন বলেছিল, আজ নয়, সময় এলে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি অন্য ভাবে দিতে চাই।

একটু থেমে রত্না আবার অমিতকে আবেগভরা গলায় বলল, আমরা যে পরস্পরকে আজও ভালোবাসি, এটা তো সত্যি।

ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু এর বেশি আর কীই-বা করতে পারি আমরা? আমরা তো এক বিছানা শেয়ার করতে পারব না। কেউ কি সমর্থন করবে আমাদের এই সম্পর্ককে? কেউ কি বুঝবে যে, আমরা বিয়ে করেছি একজনকে আর ভালোবাসি অন্য কাউকে?

অমিতের আবেগ দ্বিগুন হল। আবারও সে বলতে শুরু করল, তুমি-ই বলো রত্না, কী করা উচিত আমাদের?

উত্তরে রত্না সেদিন জানিয়েিল, বিয়ে এবং ভালোবাসা দুটি ভিন্ন বিষয় আমার কাছে। যাদের আমরা বিয়ে করেছি, তাদের জায়গায় রেখেও তো আমরা আমাদের দুজনের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, নতুন করে আমাদের যা মন চায় তাই করতে পারি।

মানলাম আমরা দুজনে যা মন চাই তাই করলাম, কিন্তু আমাদের বাড়তি চাওয়ার ফলে তো সংসার থেকে মনও উঠে যাবে। আমাদের জীবনসঙ্গীরা তো কোনও অন্যায় করেনি, আমাদের সন্তানরা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে তারা অকারণে কেন শাস্তি পাবে?

অমিতের কথা কেড়ে নিয়ে রত্না বলেছিল, আমি কাউকে শাস্তি দিতে বলছি না, শুধু আমাদের চাহিদা পূরণের কথা বলছি। তাছাড়া আমরা তো ওদেরকে খুশি রেখেছি এতদিন। আজ যদি ভালোবাসার মানুষকে আমরা নতুন করে পেতে চাই, তাহলে অন্যায়টা কোথায় অমিত?

সেদিন আর কথা বাড়ায়নি অমিত। কিন্তু দূরভাষে এভাবেই মাঝেমধ্যে কাছে আসার জন্য উতলা করে তুলত রত্না। অমিতও রত্নাকে কাছে পাওয়ার একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত। কিন্তু বউ-বাচ্চার কথা ভেবে আবার পিছিয়ে যেত। এভাবেই রত্নাকে এবং নিজের মনকে বহুবার সামাল দিয়ে এসেছিল অমিত। কিন্তু ওদের পুনর্মিলনের এক বছর যখন পূর্ণ হতে চলেছিল, তখন রত্না জানাল, অমিত, আমি আর পারছি না, অন্তত দুটো দিন তোমার সঙ্গে একান্তে কাটাতে চাই। আগামী মাসের চার তারিখ আমাদের দেখা হওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে। ওই দিন আমরা বোলপুরে গিয়ে দুদিন কাটাব। ব্যস, এটুকুই আমার চাওয়া। ওই দুদিনের স্মৃতি নিয়ে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ।

রত্নার অনুরোধে দুদিন পর ভেবেচিন্তে বোলপুরে আসার সম্মতি জানিয়েিল অমিত। কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না। হোটেলের বিছানায় অমিতের পাশে শুয়ে রত্না তাই ভাবছিল, কী যে হয়ে গেল! বেশ ছিলাম হোটেলে, কেন যে মরতে বাইরে বেরোলাম, আরও এক সপ্তাহ পর কীভাবে যে সুনীলের মুখোমুখি হব বাড়ি গিয়ে এভাবেই ভাবনা আর অনুভবে পাশাপাশি থাকতে থাকতে অমিত ও রত্না কাটিয়ে দিয়েে আরও এক সপ্তাহ। এখন অমিতের কাঁধে ভর করে কিছুটা হাঁটতেও পারছে রত্না। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েেন ডক্টর। এবার ওদের বাড়ি ফেরার পালা।

হোটেল ছাড়ার আগে রত্না অমিতকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রয়েে। মিনিটখানেক ওভাবে থাকার পর রত্না অমিতের চোখে চোখ রেখে জানাল, আমার মনের দরজা সারা জীবন শুধু তোমার জন্য খোলা থাকবে। তুমি যখন খুশি আসতে পারো, আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পন করে আনন্দ পাব।

রত্না এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিল না। তা দেখে অমিত কিছুতেই রত্নাকে একা বাড়ি ফিরতে দিল না। আরও কিছুটা সময় যাওয়ার পথে অমিতকে কাছে পাবে, তাই রত্নাও আর বাধা দেয়নি।

ফেরার পথে ওরা আর ট্রেন ধরল না। বোলপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল কলকাতার বালিগঞ্জের উদ্দেশে। ওখানেই রত্নার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু অমিত থাকে উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে। তাই, রত্নাকে অমিত জানিয়েিল, ওর শ্বশুরবাড়ির কিছুটা আগে ওকে রিকশোতে তুলে দেবে। কিন্তু রত্না জানাল, না, তুমি আমাকে বাড়িতে পেঁছে দিয়ে আসবে। আমি সুনীলকে ম্যানেজ করব, আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।

বাড়ি পেঁছোনোর আগে সুনীলকে ফোন করে তাকে রিসিভ করার কথা জানিয়েিল রত্না। সেইমতো রাস্তায় এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েিল সুনীল।

গাড়ি থেকে নেমেই রত্না প্রথমে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কারণ, বিগত পনেরো দিন সে শুধু দূরভাষে ছেলের খবর নিয়েিল, টুকটাক কথা বলেছিল। ছেলের জন্য রত্নার বেশি চিন্তা ছিল না, কারণ রত্না জানত, ওর শাশুড়ি নাতিকে খুব ভালোবাসেন, তাই সামলে নেবেন।

সোনা বাবা, তুমি কেমন আছো? ঠাকুমা তোমায় আদর করেছিল তো? ছেলের গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলতে থাকে রত্না।

ঠাকুমা আমায় অনেক গল্প শুনিয়েে। সদ্য কথা বলতে শেখা ছেলেটি তার মাকে জানায়।

রত্নাকে নামিয়ে অমিত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েিল, তখনই রত্না গাড়ির ড্রাইভারকে থামতে বলে এবং অমিতকে নামতে বলে ইশারায়।

সুনীল, এদিকে এসো, আলাপ করিয়ে দিই আমার বন্ধু অমিতের সঙ্গে। মনে কোনও দ্বিধা-সংশয় না রেখে, খুব স্বাভাবিক ভাবে অমিতের সঙ্গে সুনীলের আলাপ করিয়ে দেয় রত্না।

অমিতের সঙ্গে আলাপ পর্বে সুনীল কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি ঠিকই, কিন্তু হতবাক হয়েিল হঠাত্ এমন একটি অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তাই অমিত চলে যাওয়ার পর, একাধিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কিন্তু রত্নাকে নিরুত্তাপ দেখে, সামযিক ভাবে ঘাবড়ে গিয়েিল সুনীল।

সময় এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। কাজের ব্যস্ততায় সুনীলের মাথা থেকেও বেরিয়ে যায় অমিতের বিষয়টা। পায়ে ব্যথা সেরে গিয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারার পর রত্নাও আবার কাজে যোগ দেয়। সময় পেলেই অমিতকে ফোনও করতে থাকে নিয়মিত। এভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু দিনের পর দিন বিছানায় রত্নাকে আর আগের মতো না পেয়ে নতুন করে আষাঢ়ের মেঘ ঘনীভত হতে শুরু করে সুনীলের মনে।

রাত দশটা। ডিনার সেরে নিয়েে রত্না। ছেলেকে খাইয়ে ওর ঠাকুমার ঘরে দিয়ে এসেছে। ঠাকুমার সঙ্গেই এখন ঘুমোনোর অভ্যাস ছেলের। রত্না তাই এখন একা। সুনীলের ফিরতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। তাই এই ফাঁকা সময়ে অমিতের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল রত্নার।

অমিত সেই রাতে অফিসের কাজে উত্তরবঙ্গে ছিল। কাজ সেরে হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। রত্নার ফোন রিসিভ করে টিভি বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ নিশ্চিন্তে কথোপকথন চালাতে থাকে অমিত এবং রত্না।

আবেগে চোখ বন্ধ রেখে কথা বলছিল রত্না। তাই, সুনীল কখন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে ওর প্রেমালাপ শুনছিল, বুঝতেই পারেনি। হঠাত্ ঘরে কারওর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খোলে রত্না। আচমকা সুনীলকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয় সে।

ফোনের ওপারে কে ছিল? ওই লোকটা যে তোমাকে পেঁছোতে এসেছিল? কর্কশ ভাবে প্রশ্নগুলো রত্নার দিকে ছুড়ে দেয় সুনীল।

হ্যাঁ, আমিতই ছিল, তো কী হয়েে?

প্রেম তো বেশ জমে উঠেছে দেখছি। এইজন্যই ভাবছিলাম, রাতে এখন শরীরে তোমার প্রাণ থাকে না কেন?

বাজে কথা রাখো। রাত হয়েে, আমার ঘুম পাচ্ছে, ফালতু বকবক করতে পারব না।

তা পারবে কেন! সব এনার্জি তো ওই লোকটার সঙ্গে বকবক করে শেষ করে ফেলেছ। লজ্জা করে না। বাচ্চার মা তুমি। আমি কী অভাব রেখেছি তোমার?

তুমি আমার শরীরের খবর রেখেছ, মনের খবর রেখেছ কি?

বাহ্, ভালো বলেছ। এখন অনেক কথাই তুমি বলবে। ওই ইতরটার সান্নিধ্য পেয়ে না। এখন তো আমার সবই তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হবে। যাইহোক, একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি, আর যদি ওই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখো, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ফাটাফাটি হবে বলে দিলাম। আমার সম্মান নষ্ট করলে আমি ছাড়ব না।

তোমার যা করার আছে তুমি করে নাও। অমিত আমার বন্ধু, আমি যোগাযোগ রাখবই।

ওহঃ তাই? দেখাচ্ছি মজা…

বলেই রত্নার হাত থেকে ওর মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে সুনীল। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ফোনের যন্ত্রাংশ। ভাঙা ফোনটা থেকে সিম কার্ডটা খুলে নিয়ে সুনীলের গালে সপাটে একটা চড় মেরে, অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয় রত্না। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সুনীলকে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেয় এবং বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা হাতিবাগানে মায়ে বাড়িতে ওঠে।

অমিত সেদিন ওর মাকে ফোন করে দরজা খুলিয়ে উদ্ধার হয়েিল ঘর থেকে। রাগের মাথায় সুনীল সেদিন রত্নার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে চেয়েিল কিন্তু ওর মা নিতে দেননি।

ওই ঘটনার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রত্নার কোনও খবর নেই। ছেলের খোঁজটুকুও নেয়নি। এদিকে ছোট্ট ছেলেটিকে ঠাকুমা আগলে রাখলেও, মাঝেমধ্যে মা-র জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে সুনীল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। মনকে বুঝিয়ে রত্নার খোঁজ শুরু করে। রত্নার অফিস থেকে কোনও খবর পায় না। এক আত্মীয়ে মাধ্যমে জানতে পারে রত্না ওর মায়ে বাড়িতে আছে।

ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর পরিবারের সামাজিক সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রত্নার মুখোমুখি হয় সুনীল। শাশুড়িকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আর রত্নার হাত ধরে অনেক অনুনয়, বিনয়ে পর, রত্নাকে বাড়ি ফেরাতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু সুনীলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, অমিত-রত্নার সম্পর্কের ব্যাপারে আর কখনও সে নাক গলাবে না।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব