আত্মজ

রবিদার চায়ের দোকানে বসে সিগারেট টানছিল। ভাবনায় সলিলদা। যাওয়াটা ঠিক হবে? কিছুদিন হল খবর পাঠাচ্ছে। রাস্তায় দেখা হয়েছিল, প্রসঙ্গ তুলতে বলল, বাড়ি আয়। সব কথা রাস্তায় হয় না।

কী কথা কে জানে! হতে পারে সেদিনের জের। বউদি হয়তো কানে তুলেছে। ভয় হচ্ছে। সংকোচও।

পাগলিটার চিৎকার কানে আসে। অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছে। তেড়ে যাচ্ছে কারও দিকে। হুটোপাটি পালানোর শব্দ। হা হা হো হো…

বিভাসের অস্বস্তি হয়। ভাবনায় চিড় খাচ্ছে। কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না সলিলদার বিষয়টা। ভদ্রলোকের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। তাকে স্নেহ করেন। তাঁর পরামর্শেই কন্ট্রাকটারি ব্যাবসায় নেমেছে। নিজে পিডব্লউডি-র অফিসার হওয়ায় কন্ট্রাক্ট পেতে সমস্তরকম সাহায্য করেন। বিনিময়ে এতটুকু সুবিধা নেননি কখনও। ভয় হচ্ছে, পাছে সম্পর্কে চিড় ধরে। কেন যে মরতে গৌরী বউদির সাথে সেদিন খারাপ ব্যবহার করল!

‘মর মর খান্কির বাচ্চারা…’

পাগলিটা গালাগাল দিচ্ছে। মাথার প্রতিটি কোশে আঘাত করে শব্দগুলো। রক্তক্ষরণ টের পায়। শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে আরও একটা ধরায়। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টায় পুরোনো ভাবনায় ফিরে আসতে চায়। দিন পনেরো আগের ঘটনা, ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে সলিলদার বাড়়ি যেতে হয়েছিল। সলিলদা তখন বাড়িতে ছিলেন না। গৌরী বউদি ভেতরে ডাকলেন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন বসতে হয়েছিল বিভাসকে। ভদ্রমহিলাকে সে পছন্দ করে না। কেবল গৌরী বউদি কেন, কোনও মহিলাকেই সে সহ্য করতে পারে না। ঘৃণা করে। আর গৌরী বউদিকে তো অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে। সেজেগুজে সারাদিন পটের বিবি, দিনভোর বিউটিপার্লার-ফেসিয়াল-ম্যানিকিয়োর কিংবা টিভি সিরিয়াল… শো-কেসের পুতুল যেন একটা। কেন জানে না, গৌরী বউদিকে দেখলে মনোকামিনীর কথা মনে পড়ে। ভদ্রমহিলাকে মা ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে। সজ্ঞানে ‘মা’ শব্দটা কখনও উচ্চারণ করেনি সে। ভবিষ্যতেও করবে না।

মাথার ভিতর ঘুণপোকার উপস্থিতি টের পায়। বিভাস তবু সামলে নিতে পারত। সামাজিক ভদ্রতা রক্ষা করতে বহু অভ্যাসে, নিজের সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে ইদানীং এ ক্ষমতা সে অর্জন করেছে। আচরণে কোনও প্রভাব পড়তে দেয় না। গৌরী বউদি বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই সব গোলমাল হয়ে গেল। জানে এ প্রসঙ্গে সে বিরক্ত হয়। একাধিকবার বলেছে, কোনও মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় সারাজীবন কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব। সেদিন এমন বাড়াবাড়ি করতে লাগল বউদি যে, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। বেশ দু’কথা শুনিয়ে, রাগ দেখিয়ে উঠে এসেছিল। পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়েছে।

গৌরী বউদি নিশ্চয় অপমানিত হয়েছিল। কথাটা হয়তো সলিলদার কানে তুলেছে। হতে পারে এই জরুরি তলব…

পাগলিটাকে ঘিরে ছেলেগুলোর অসভ্যতা বাড়ছে। বাড়ছে চিৎকার চ্যাঁচামেচি। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাগলির খিস্তি-খেউড়… সেই সাথে মাথার ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথার অনুভব। রবিদার চায়ের দোকানের সামনেই আইল্যান্ড, তিন রাস্তার সংযোগস্থল। মাঝখানে রবীন্দ্রমূর্তি। মূর্তির নীচে পাগলির বর্তমান ঠিকানা। কিছু কংক্রিটের বেঞ্চ আছে চারপাশে। সকাল-সন্ধে এখানেই আড্ডা মারে ছেলেগুলো। সকলে শিক্ষিত, ভালো পরিবারের। চাকরি জোটাতে না পেরে বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়ায়, বাকি সময়টা এখানেই। এদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ মেনে নিতে পারে না বিভাস।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে পার্কের গেটের মুখে এসে দাঁড়ায়। পাগলিটার একটা হাত স্ফীত পেটের উপর, অন্যহাতে একটা লাঠি– কখনও এর দিকে তেড়ে যাচ্ছে তো কখনও অন্যজনের দিকে। তাড়া খেয়ে প্রথমজন দৌড়ে পালাচ্ছে তো দ্বিতীয়জন এগিয়ে আসছে… পাগলির গর্ভস্থ সন্তান চুরি করার ভয় দেখাচ্ছে। আর তাতেই পাগলির আক্রোশ। পরনের কাপড় অর্ধেকের বেশি মাটিতে লুটোচ্ছে, উপরিভাগ সম্পূর্ণ অনাবৃত।

পাগলির ভারী তলপেটের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বিভাস। অসুস্থ শরীরে এমন দৌড়-ঝাঁপ… ভদ্দর ঘরের বউ হলে বিছানায় কেতরে থাকত। একটা রাস্তার পাগলিকেও, কারা যে এসব করে! আজব দেশ মাইরি!

–কী হচ্ছে এখানে? এত চিৎকার কীসের?

বিভাস প্রায় গর্জন করে ওঠে। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। ছেলেগুলোর সাথে সাথে পাগলিটাও থতমত খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সকলের চোখে ভয়।  এলাকায় একটা ‘দাদা’ ইমেজ আছে বিভাসের।

বিভাস তখনও পাগলিটার দিকে তাকিয়ে। এই প্রথম এত কাছ থেকে, সময় নিয়ে পাগলিটাকে দেখছে। এখানে নতুন এসেছে, শরীরে বয়ে এনেছে বীজ। বয়স তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। গায়ের রং একসময় ফর্সা ছিল। এখন রোদেপোড়া তামাটে। ছাই-ভস্ম মাখা চুলে জট পাকাতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আঙুল ডুবিয়ে চুলকোচ্ছে। এসবের মধ্যেও বেশ একটা ঢলঢলে ভাব আছে চেহারায়। সবচেয়ে মারাত্মক পাগলির চোখদুটো। কী এক মায়ায় যেন তার দিকে অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভরসা খুঁজছে।

চোখের এই আকুতি আগে কখনও দেখেনি বিভাস। নিজেকে সে নিষ্ঠুর, পাষাণ হূদয় হিসাবে ভাবতেই  অভ্যস্ত। তবু বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভূতি, শিরশির করে শরীর। পাগলিটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। অস্বস্তি হয়। চোখ ফিরিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকায়। ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলে, তোরা সব শিক্ষিত না?

– সরি বিভাসদা, ভুল হয়ে গেছে…

বিভাস কথা বাড়াল না। শব্দ করে থুতু ফেলল একদলা। পাগলিটার দিকে তাকাল। তখনও তার দিকে তাকিয়ে। চোখে করুণ আর্তি। বিভাস চোখ সরিয়ে নিল। সকলকে চমকে দিয়ে যেভাবে আচমকা ঢুকেছিল সেভাবেই আবার বেরিয়ে এল। রবিদার চায়ের দোকানে এসে ঢুকল।

–এরা কি ভদ্দরলোকের ছেলে!

দোকানে খদ্দের ছিল না, সমস্ত ঘটনা লক্ষ্য করেছে রবিদা। ভিতরে ক্ষোভ জমে ছিল, এতক্ষণে মুখ খুলল, কী বলব বলো! ব্যাবসা করে খাই, কিছু বলতেও পারিনে–

–একটা চা দিও।

মুড অফ হয়ে আছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না। রবিদার কথায় সরাসরি উত্তর দিল না।

–কি অমানবিক ব্যাপার বলো তো! চা দিতে দিতে রবিদা আবার আক্ষেপ করল।

যে-কোনও কারণেই হোক, বিভাস জানে, পাগলিটার উপর একটু সহানুভূতি আছে রবিদার। যখনই দোকানে এসে হাত পাতে, কেকটা রুটিটা… যা হোক কিছু একটা দেবে। ফেরায় না কখনও। বাড়ি থেকে বউদির বাদ দেওয়া একটা কাপড়ও এনে দিয়েছে।

চা খেতে খেতে মানুষটাকে খেয়াল করছিল বিভাস। তার দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে মুখ গোমড়া করে আছে। পরিবেশটা আরও গুমোট হয়ে ওঠে। বিভাসের ভালো লাগে না। উঠে পড়ে সে। সলিলদার বাড়ি থেকে বরং ঘুরে আসবে।

কাঁধ অবধি ঝাঁকড়া চুলে ঢেউ তুলে অভ্যর্থনা জানালেন গৌরী বউদি। বাব্বা, এতদিনে মনে পড়ল! আমি ভাবলাম রাগ করেছ, আর বুঝি আসবেই না। এসো ভেতরে এসো–

বিভাস অবাক হল। এমন প্রত্যাশা ছিল না। বরং উলটোটা আশঙ্কা করেছিল। ভয়ে ভয়ে ছিল। ফুরফুরে মেজাজে দেখে ভারটা নেমে গেল।

বিভাসকে বসার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, একটু বোসো। দাদা আসছে। বাথরুমে ঢুকেছে।

মিনিট দশেক পরে সলিলদা এলেন। স্নান সেরে ধোপদুরস্ত হয়ে এসেছেন। পেছনে গৌরী বউদি, তবে ভেতরে ঢুকলেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন পর্দা ধরে!

–সারাদিন কী এমন রাজকার্য থাকে, খবর দিয়েও পাওয়া যায় না!

–কিছুদিন আগেই তো এলাম। তাছাড়া আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে–

– সব কথা সব জায়গায় হয় না। কই গো, এবার বলো কী বলবে বলছিলে।

শেষ কথাগুলো বউদিকে উদ্দেশ্য করে। বউদি মুখ নামিয়ে নিলেন। মেঝেতে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের আঁচড় কাটতে কাটতে সংকোচ জড়ানো গলায় বললেন, তুমি বলো। চায়ের জল চাপিয়ে এসেছি–

কথা শেষ করে ধীর পায়ে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন তিনি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ তুললেন সলিলদা। সরাসরি বিভাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাজের কথায় আসি। মন দিয়ে শুনবে, বিষয়টা অনুভব করার চেষ্টা করবে।

বিভাস কিছু অনুমান করতে পারে না। বুঝতে পারে না সলিলদার মতো মানুষের কী এমন দরকার থাকতে পারে তার কাছে, যে জন্যে এত হেঁয়ালি। চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়।

–কিছুদিন হল তোমার বউদি খুব করে ধরেছে। চেষ্টা করলে তুমিই নাকি ওর সমস্যার সমাধান করতে পারো। আমিও ভেবে দেখলাম, খুব একটা ভুল বলেনি।

–সমস্যাটা কী? বিভাস কৌতূহল চাপতে পারে না।

–বলছি। তার আগে কথা দিতে হবে, সমস্ত রকম হেলপ পাব তোমার কাছে।

–সম্ভব হলে নিশ্চয় পাবেন।

সলিলদা গম্ভীর, তুমি তো জানো, প্রায় বারো বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। সন্তানাদি কিছু হল না। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। গৌরীকে দু-দুবার অপারেশন করিয়েছি। নিট লাভ জিরো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার অ্যাডপ্ট করব। সেই দু’বছর হতে চলল। বিভিন্ন জায়গায় নাম লিখিয়ে রেখেছি, এখনও কোনও জায়গা থেকে গ্রিন সিগনাল আসেনি। সব জায়গায় লম্বা লাইন। যতদিন যাচ্ছে ভরসা হারিয়ে ফেলছি।

বিভাস বোঝে না এসব অতি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তার সাথে কেন! জিজ্ঞাসাও করতে পারে না। অস্বস্তি হয় তার।

–কিছুদিন আগে একটা পাগলির কথা বলেছিলে না? অচমকা প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন, তোমাদের ওই রবীন্দ্রপার্কে থাকে…

–হ্যাঁ, কিন্তু…

–শুনেছি সে প্রেগন্যান্ট। তো, এর মধ্যে একদিন গিয়েছিলাম। দেখলাম তাকে। সাত-আট মাস তো হবেই, বেশিও হতে পারে। দেখে কষ্ট লাগে।

বিভাস ধন্দে পড়ে। এর মধ্যে আবার পাগলি এল কোত্থেকে! বিষয়টা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গালে রেখে কথা বলছে সলিলদা। অস্বস্তি হচ্ছে।

–তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, সলিলদা আবার মুখ খোলেন, কিছুদিন একটু চোখে চোখে রাখতে হবে পাগলিটাকে। তুমি তো বেশিরভাগ সময় ও দিকেই থাকো, প্রয়োজনে একজন লোক রাখবে দেখাশোনা করার জন্য।

–আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

–বলছি, সব খুলে বলছি। প্ল্যানটা আমার নয়, তোমার বউদির। তবে আমার সম্মতি আছে। আমরা ঠিক করেছি, পাগলির বাচ্চাটাকে আমরা অ্যাডপ্ট করব।

–এটা কী করে সম্ভব?

–তুমি হেলপ করলেই সম্ভব।

– তা বলে একটা রাস্তার পাগলির বাচ্চা!

–সন্তান সন্তানই। সে যার হোক, যেখানকার হোক।

–তা নয়, আমি ভাবছি…, ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত কথাটা বলে ফেলল, আমাদের দেশে একটা রাস্তার পাগলিও প্রেগন্যান্ট হয়, এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে! আর এ জন্যে যে বা যারা দায়ী, শিশুটার শরীরে সেইসব পশুর রক্ত রয়েছে।

–রক্তের পরিচয় কী সব! শিক্ষা, পরিবেশ… এসবের কোনও মূল্য নেই। তাছাড়া কোনও হোম থেকে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করলেও তার জন্ম পরিচয় আমরা জানতে পারব না। সেখানেও তো এ ধরনের পথ শিশুদেরই ঠাঁই হয়…

–আমি রক্তের পরিচয় নয়, রক্তের সম্পর্কের কথা বলছি। জিনকে তো অস্বীকার করা যায় না।

–আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে আমাদের মনের মতো করে মানুষ করে নেব। বিভাস বোঝে, সলিলদা এ বিষয়ে আর কোনও তর্ক চাইছে না। একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। মাথাটা আবার টিপটিপ করতে শুরু করে তার।

–তুমি শুধু পাগলিটাকে চোখে চোখে রাখবে। দেখবে কোনও অসুবিধা না হয়। আর নিয়মিত খবরগুলো দিতে থাকবে। পারবে না?

–চেষ্টা করব। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হল সে।

–চেষ্টা নয়, পারতেই হবে–

গৌরী বউদির গলা। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আবার। চোখ দুটো চিকচিক করছে। বিভাস অবাক হয়, ঠিক দেখছে তো! গৌরী বউদির চোখে জল! ভদ্রমহিলা তাহলে কাঁদতে জানে! তাও সন্তানের জন্য!

বিভাস উঠে দাঁড়ায়। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। বেরোতে হবে।

–বিষয়টা তাহলে তোমার উপরেই ছেড়ে দিলাম।

–আপনিও আর একবার ভাবুন।

কথা শেষ করে বেরিয়ে আসে বিভাস।

মাঝে মাঝে রবিদার দোকানে আসছে সলিলদা। দীর্ঘক্ষণ কাটাচ্ছে। ইতিমধ্যে রবিদার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। রবিদাকেও জানিয়েছে বিষয়টা। রবিদা খুশি এমন একটা সিদ্ধান্তে। অকুণ্ঠ সাধুবাদ সহ সমস্তরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।

দোকানে খদ্দের না থাকলে পাগলিটাকে দেখতে যায় রবিদা। পাগলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। সময় পেলে বিভাসও যায়। সলিলদার সিদ্ধান্ত হঠকারী মনে হলেও, তাকেও যেন কী এক নেশায় পেয়েছে। মাঝে মাঝে পার্কের ভিতরে ঢুকে যায়। খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে পাগলিটাকে। ছেলেগুলোর সাথেও ভাব হয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনার পর আর তারা পাগলিটাকে উত্যক্ত করেনি। বরং পাগলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে নজর রাখছে। তবুও একটা অঘটন ঘটে গেল।

পার্কের বাইরে রিকশা স্ট্যান্ড। চালকরা মাঝে মাঝে ভিতরে গিয়ে বসে কাজের চাপ না থাকলে। তাস খেলে, গল্প গুজব করে। সেদিন কেউ একজন পাগলিকে রাগানোর জন্যে বলেছিল, তোর বাচ্চাকে নিয়ে নেব। পাগলি ইট ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।

ঘটনাটা জানানোর জন্যে তখনই সলিলদার বাড়ি গিয়েছিল বিভাস। সবটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল সলিলদা। বউদির মুখেও দুশ্চিন্তার ছায়া।

–কাজটা কি সহজ হবে?

–দেখা যাক। সলিলদার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

আরও একটা সংশয় কিছুদিন হল বিভাসের মনে উঁকি মারছে। পাগলিটাকে নিয়ে হয়তো একটু বেশিই ভাবছে, যা আগে কখনও কারও ক্ষেত্রে হয়নি। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? এতদিন সলিলদাকে বলতে সাহস হয়নি। আজ হঠাৎ আবেগের বশে বলে ফেলল, আমরা বোধহয় অন্যায় করছি।

–কীসের? সলিলদার চোখে সংশয়।

–এভাবে কারও বাচ্চা…

কথা শেষ করতে পারে না, সলিলদার চোখে চোখ পড়তেই থেমে যায়। সলিলদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ খোলে, একটা বাচ্চা, আনওয়ানটেড বেবি, এভাবে ফুটপাথে বেড়ে উঠবে! যার ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সেটা অন্যায় নয়? তাকে ভদ্রসমাজে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দেওয়াটা অন্যায়?

গৌরী বউদি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার তিনিও মুখ খুললেন, নিজেকে দিয়ে ভাবো না, তোমার মাসি যদি দায়িত্ব না নিতেন, তোমার ভবিষ্যৎ কী হতো কল্পনা করেছ কখনও? তিনি কি অন্যায় করেছেন?

–এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম।

–কিচ্ছু অন্যরকম না। দুটি ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে একটা শিশুর ভবিষ্যৎ। বিনিময়ে সন্তানহীনা সন্তান পাচ্ছে। তিনি তো তোমাকে তোমার মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেননি। তার আত্মত্যাগ, ভালোবাসা… এসব অস্বীকার করতে পারবে?

স্বীকারও করেনি কোনওদিন। আসলে ভাবেইনি মনোময়ীকে নিয়ে। হতে পারে সে মনোকামিনীর বোন, গৌরী বউদির কথায় নাড়া খেল একটু। প্রসঙ্গটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল। মনোময়ী সত্যিই বিস্ময়কর।

বিভাসের বয়স তখন দু’বছর। মা মনোকামিনী বিনোদ বিশ্বাসের এক বন্ধুর সঙ্গে পালাল। আর ফেরেনি। নিঃসন্তান মনোময়ী ততদিনে বিধবা হয়েছেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাপের সংসারে। অন্যদিকে দু’বছরের শিশু সন্তান নিয়ে বিনোদ বিশ্বাসের মানসিক অবস্থাও তখন শোচনীয়। এমন সময় মনোময়ী এসে সংসারের হাল ধরেছিলেন। কোলে তুলে নিয়েছিলেন বিভাসকে। সেই থেকে এ বাড়িতে। এমন নয় যে অস্তিত্বের সংকটে তিনি একাজ করেছেন। মনোময়ীর বাবা অর্থাৎ বিভাসের দাদামশায়ের আর্থিক অবস্থাও ভালো। ইচ্ছা করলেই জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। তবু কোন স্বার্থে তিনি এখানে রয়ে গেলেন? বিভাসকে মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেননি। বিভাসের জন্যে তার উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তাও অস্বীকার করার মতো নয়। কীসের টানে এই ত্যাগ স্বীকার? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতরে পাক খায়। চিনচিন ব্যথাটা টের পায় আবার।

–তোমার মাসির কথা না হয় বাদ দিচ্ছি। এবার সলিলদা। দু’জনে যেন পরিকল্পনা করে তাকে আজ ধরেছে। বললেন, কিন্তু ওই পাগলি? পাগলিটার ক্ষেত্রে কী বলবে? যে-সন্তান এখনও পৃথিবীর আলোই দেখল না, তার জন্যে এখনই একজনের মাথা ফাটিয়ে ফেলল?

বিভাস চুপ করে রইল। কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না। ভাবাচ্ছে। ভাবাচ্ছে বলেই সলিলদার কাছে ছুটে এসেছে সংবাদটা জানানোর জন্যে। পাগলিটাও ভাবাচ্ছে। কী এক আকর্ষণে সময় পেলেই ছুটে যাচ্ছে পাগলিটাকে দেখতে। কীসের টানে? এই মুহূর্তে মনে হল, হঠাৎই মাথায় এল ভাবনাটা, পাগলির গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে কোথায় যেন তারও একটা যোগসূত্র আছে। নইলে এমন টান অনুভব করবে কেন? কিন্তু সূত্রটা ধরতে পারছে না…

পাগলির জন্যে আরও অনেক ব্যবস্থা নিয়েছেন সলিলদা। পাশের হোটেলে বলে রেখেছেন, কাজের ছেলেটা দু’বেলা শালপাতার থালায় ভাত দিয়ে যায়। এক ডাক্তার বন্ধুকে এনে দেখিয়েছে দুদিন মাঝরাতে। একদিন জোর করে দুটো ইনজেকশন দিয়েছেন তিনি। ডেলিভারির জন্যে নার্সিংহোমও ঠিক করে রেখেছেন, পেইন উঠলেই…

দিন যত এগোচ্ছে, পাগলিটার উপর তাদের সতর্ক দৃষ্টি তত তীক্ষ্ণ হচ্ছে। বিভাস যদিও মানসিক ভাবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

আরও একটা ঘটনা সেদিন খুব স্ট্রাইক করল। পার্কের এক কোণে বসে আনমনে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ পাগলিটার গলা কানে আসতে দেখল পাগলিটা তার স্ফীত তলপেটে হাত বোলাচ্ছে আর নাকি সুরে গাইছে–

খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল

বর্গি এল দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে…

হঠাৎ বর্গির প্রসঙ্গ কেন? কথাগুলো কি তাকে উদ্দেশ্য করে। তাদের অভিসন্ধি কিছু অনুমান করেছে? যেজন্যে এখন থেকেই গর্ভস্থ সন্তানকে সাবধান করছে। নিজেকে বর্গি বলে মনে হল বিভাসের। –অন্যায়! মনে মনে আবার বিড়বিড় করল, সলিলদা অন্যায় করছে। খবরটা তাকে জানানো দরকার।

বিভাস তখনই বাইক নিয়ে ছুটল।

আর মাত্র কয়েকটা দিন। খাওয়া-ঘুম ছুটেছে সলিলদার।

খাওয়া-ঘুম ছুটেছে বিভাসের। রবিদা এখন রাতে দোকানেই থাকছে। রাতবেরাতে কিছু একটা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে জানাবে। রবিদার মোবাইল ছিল না, সলিলদা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসবে। ড্রাইভারকেও সেইভাবে বলে রেখেছে।

সেদিন সন্ধ্যা থেকে আকাশের মুখ ভার। মাঝে মাঝে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে প্রবল। রাত দশটা পর্যন্ত রবিদার দোকানে কাটিয়ে গেল সলিলদা। লক্ষণ সুবিধার নয়। যাওয়ার আগে বারবার রবিদাকে সাবধান করে গেল। বিভাসকেও বলে গেল মোবাইল খোলা রাখতে।

বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না বিভাস। রবিদাকে পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। সন্ধ্যার পর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। বৃষ্টির কারণে আজ আবার বেশি টেনেছে।

এগারোটার পর মুষলধারে নামল। প্রবল বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। অস্থির পায়চারি করছিল ঘরের মধ্যে। দুর্যোগের মধ্যেই যদি কিছু একটা ঘটে যায়।

আধ ঘণ্টা হতে চলল, বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। বরং বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। উলটোপালটা হাওয়া। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। ইতিমধ্যে জল জমেছে বাড়ির সামনে। ব্যাং ডাকছে। সবমিলে অদ্ভুত একটা শব্দ। বিভাসের মনে হল, দূরে কোথাও অসংখ্য মানুষ চিৎকার করছে। কে জানে এদের মধ্যে পাগলিটাও আছে কিনা!

বিভাস আর থাকতে পারে না। দরজা খুলে বাইরে আসে। সোজা রাস্তায়। দ্রুত পা চালায় পার্কের দিকে। হাতে টর্চ। ভয় রবিদাকে নিয়ে, যদি ঘুমিয়ে পড়ে! রবিদা কী শুনতে পাবে পাগলির চিৎকার? সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দেয় যথাসম্ভব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে পৌঁছোতে হবে।

বাড়ি থেকে পার্কের দূরত্ব মাইলখানেক। হাঁটা পথে মিনিট পনেরো-কুড়ি। অথচ পথ যেন শেষ হচ্ছে না। অন্তহীন পথ হেঁটে চলেছে সে। কতদিন, কত মাস, বছর, যুগ ধরে… কিংবা তারও বেশি সময়… তবু গন্তব্যে পৌঁছোতে পারছে না।

বিভাস দৌড়োতে শুরু করে।

বৃষ্টিতে ঝাপসা সবকিছু। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বিদ্যুতের আস্ফালন। টর্চের আলো বৃষ্টি ভেদ করে বেশিদূর পৌঁছোয় না। মাঝে মাঝে হোঁচট খায় রাস্তার জল জমা খানাখন্দে। তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। পাগলের মতো সে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে যখন পার্কের কাছাকাছি, দূর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ কানে আসে। তবে কী…

সন্দেহ সত্যি। রবিদা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সলিলদা নেই। এদিকে রবীন্দ্রনাথের পায়ের গোড়ায় সদ্যজাতের কান্না। ভিতরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে গেল। রক্তে ভাসছে চারপাশ। একপাশে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে পাগলিটা, অন্যপাশে রক্তজলে মাখামাখি একতাল মাংস পিণ্ড। গলায় তীব্র চিৎকার। একটু দূরেই ওত পেতে বসে আছে দুটো রাস্তার কুকুর। চোখের তারায় লোভের ঝিলিক।

যে-কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমন বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। শিউরে উঠল সে। অস্ফূটে কাতরে উঠল, মাগো–

বহু বছর বাদে সে ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করল। নিজের অজ্ঞাতেই। তারপর টর্চ হাতে তেড়ে গেল কুকুর দুটোর দিকে। যে-কোনও মূল্যেই হোক এদের সে রক্ষা করবে। নইলে সে নিজের কাছেই মিথ্যে হয়ে যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে তার অস্তিত্ব।

 

অন্য নদীর গল্প

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে মা বলল, ‘শৌভিকের একটা চিঠি এসেছে, রেজিস্ট্রি পোস্টে। পিওনটা মহা পাজি, আমাকে কিছুতেই দিতে চাইছিল না। অনেক করে বলবার পর দিল।’ রেজিস্ট্রি পোস্টের ব্যাপারটা শুনেই আমার একটু খটকা লাগল। এই তো দিন সাতেক আগে ওর সাথে ফোনে কথা হল। শুধু বলল, ‘বাড়িতে একটা ছোটো অনুষ্ঠান হবে, ইনভাইট করব।’ কিন্তু সেদিনও তো চিঠির ব্যাপারে কিছু বলেনি।

শৌভিক আমার কলেজের বন্ধু। আমরা দুজন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত একসঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, পড়েছি। আমাদের দুজনের বাড়িও কাছাকাছি ছিল। আমি থাকতাম তেঘড়িয়া, আর ওরা কেষ্টপুরে। এখন অবশ্য ওরা এক নম্বর গেটের কাছে নতুন বাড়ি কিনেছে, আর আমাকে আসতে হয়েছে বীরভূম জেলার এক গ্রামে। শৌভিক চাকরির চেষ্টা করেনি। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পারিবারিক ব্যাবসার খুঁটি ধরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ওর দাদার আবার পারিবারিক ব্যাবসা ছাড়াও আরও কী সব ব্যাবসা রয়েছে। তাদের বউরাও পারিবারিক ব্যাবসাতে সাহায্য করে। ওর দাদার এক মেয়ে, পড়াশোনার সূত্রে বাইরে থাকে। শৌভিকের এখনও পর্যন্ত সন্তান হয়নি। বাড়িতে একা থাকে শৌভিকের মা। কাকু বছর তিন আগে মারা যান।

কলেজ বা ইউনির্ভাসিটিতে পড়বার সময় প্রায় দিনই সময়ে অসময়ে ওর বাড়ি চলে যেতাম, কতদিন ওদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি তার হিসেব নেই। এখন অবশ্য আর সেরকম ভাবে ওদের বাড়িতে থাকা হয় না, সেরকম ভাবে কেন বলব, একরকম হয়ই না। ইউনিভার্সিটির পাঠ শেষ হওয়ার পরের কয়েক বছর বেকারত্বের জ্বালা রগড়াতে রগড়াতে সরকারি চাকরি পেলাম। তবে খুব ভালো চাকরি নয়, পঞ্চায়েত অফিসের সহায়কের চাকরি। প্রথম সপ্তাহে বাড়ি থেকে যাতায়াত করলাম। কিন্তু সপ্তাহের শেষে মনে হল, এই তেঘড়িয়া থেকে বাসে বাদুড় ঝুলে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে বোলপুর স্টেশন, তারপর বাস থেকে নেমে সাইকেল, এত সবের পর অফিস করে বাড়ি ফিরতাম প্রায় জাম্বি হয়ে। কোনওদিন আটটা বাজত, কোনওদিন নটা। তারপর কারওর ভালো কথাও খারাপ লাগত।

আমার বাবার কোনও ব্যাবসা ছিল না। বাবাও আমার মতো সরকারি কর্মচারি ছিল, তবে কেন্দ্রীয়। চাকরি জীবনে সংসার খরচ, আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ বাদ দিয়ে যে-ক’টা টাকা বাবা জমাতে পেরেছিল, তা দিয়ে একতলার এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছু হয়নি। তাও আবার চাকরি শেষ হবার ছয়মাস আগে কাউকে কিছু না বলে, বাবা চলে গেল। আমি, দাদা পিতৃহারা হলাম। দাদার পড়াটা সেই সময় শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু দাদা স্থানীয় একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করবার সুবাদে দাদা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে একটি বড়ো কোম্পানির চেন্নাই অফিসে পোস্টিং নিয়ে দাদা চলে গেল। ফোন করত, চিঠি লিখত, কিন্তু মায়ের মন তো, চোখের আড়াল হলেই চোখের জল ফেলত। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও খুব বেশি বোঝাতে পারতাম না। এর মধ্যেই আমার বেকারত্বের জ্বালা আরম্ভ হল। একই বাড়িতে থেকেও কিছুটা অসামাজিক হয়ে পড়লাম। নিজের চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যে, কোথা দিয়ে যে সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। এই সময় মা আরও একা হয়ে গেলেও আমার কিছু করবার ছিল না। মাঝে মাঝে শৌভিকদের বাড়িতে কাকিমাকে দেখলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

শৌভিকদের বড়ো বাড়ি, তবে সবাই ব্যস্ত, ব্যতিক্রম শুধু কাকিমা। বয়সে কাকিমা মায়ের থেকে কয়েক বছরের বড়ো। ওদের বাড়িতে গেলেই কাকিমাকে দোতলার ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখতাম। ‘কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করলেই, এক বুক হতাশা নিয়ে বলত, ‘এই বাড়িটার মতো।’

তারপরেই কাকু মারা যাওয়ার পরে কীভাবে শূন্যতা, একাকিত্ব, কাকিমাকে গ্রাস করেছিল, তার বর্ণনা দিতে আরম্ভ করত। আমার তখনই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

বাড়ি ফিরে মায়ের পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করত, করতামও। সেই দিন থেকে পরের কয়েকটা দিন নিয়ম করে বসে গল্প করবার মাধ্যমে মায়ের সাথে সময় কাটাতাম।

কয়েক দিন পরেই অবশ্য মা বলে উঠত, ‘তুই তোর পড়াশোনা কর, আমি ঠিক আছি।’ আমি আবার বাধ্য ছেলের মতো পড়াশোনাতে মন দিতাম।

এমনি ভাবেই চলছিল। তারপরেই চাকরি পেলাম। অফিসের কাছে একটা বাসা দেখে মাকে বললাম, ‘কাজের খুব চাপ, এবার থেকে আমার বাড়ি ফিরতে রাত্রি বারোটা, একটা হতে পারে।’

ভীতু মনের মা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানে থাকবার কোনও ব্যবস্থা করতে পারবি না? না হলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।’

আমি একটা বাড়ি নেওয়ার কথা জানাতেই মা বলে উঠল, ‘তাহলে তো আর অসুবিধা নেই। তুই ওখানেই চলে যা। আগে তো তোর শরীর।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর তুমি? তোমারও তো বয়স বাড়ছে।’

তুই আমার কথা ভাবিস না। আমি ঠিক থাকব। তাছাড়া চুয়ান্ন বছর বয়সটা কোনও বয়স নয়, তোর কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে তো থাকব। বুকুর কাছেও চলে যাব।

তার থেকে তুমিও আমার সঙ্গে চলো। এই ঘরটা তালাবন্ধ থাক। শনি, রবি তো আমার ছুটি, চলে আসব। তাছাড়া আরও তো ছুটি আছে, ছুটি থাকলেই এখানে চলে আসব।

তা হয় না, এটা তোর বাবার তৈরি বাড়ি। এখানে আশেপাশের সবাই আমাকে চেনে। প্রয়োজনে বিপদে আপদে আমার পাশে দাঁড়াতে পারবে। তাছাড়া তোর বাড়িতে থাকলেও সারাটা দিন তো তুই অফিসে থাকবি। আমাকে ঘরের মধ্যে ভূতের মতো একাই থাকতে হবে। ওখানে একা থাকবার থেকে এখানে একা থাকাটাই ভালো।

এরপর আমি আর কোনও কথা না বলে, আমার নেওয়া বাড়িতে চলে গেলাম। প্রথম প্রথম একাই রান্না বা অন্য কাজকর্ম করতাম। মাস দেড় পরে একটা রান্না করবার ছেলে পেলাম। ছেলেটি প্রতিদিন সকাল সন্ধে রান্না করে দিয়ে যেত। আমি রবিবার রাত্রে বাড়ি থেকে অফিসের গ্রামে চলে এসে আবার শুক্রবার কোলকাতা ফিরে যেতাম। থাকল একা মা, আর বাবার তৈরি করা বাড়ি।

এমনিভাবেই পাঁচ মাস কাটল। এই পাঁচ মাসে চাকরির জায়গায় বেশ সুনাম অর্জন করলাম। প্রধান থেকে পার্টির স্থানীয় নেতাদের সাথে সখ্যতা বাড়ল। সেই সঙ্গে নতুন আরেক উপদ্রব আরম্ভ হল। অবশ্য এই উপদ্রবে শরীর মন, ভবিষ্যতের এক অলীক আনন্দের জন্য বেশ শিহরিত হয়ে উঠত। কিন্তু মা, দাদা জীবিত, তাই এই ব্যাপারে নিজেই কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে আমার মরালিটিতে বাধল। দাদা তখনও পর্যন্ত সংসার করেনি।

এই সব সাতপাঁচ ভেবেই মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আমার বাড়িতে কয়েকদিনের জন্যে মাকে নিয়ে এলাম। দুদিনের মাথায় শৌভিকের এই চিঠি।

হাত মুখ ধোয়ার আগেই খাম খুলে চিঠিটা বের করে পড়লাম। মা পাাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী লিখেছে?’

‘সামনের শনিবার ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। অবশ্যই যাওয়ার জন্য লিখেছে। তোমাকেও নিয়ে যেতে বলেছে।’

আমি জানি, মা শেষের কথাগুলো শোনেনি। এত তাড়াতাড়ি কলকাতাতে ফেরার কথা শুনে, মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেছে। বুঝলাম যে-কাজে মা এসেছিল সেটা এবারে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। সেই শনিবার আমি একাই সন্ধেবেলা শৌভিকদের বাড়ি পৌঁছলাম। আগেই জানতাম, বাড়িতে কিছু একটা উৎসব হচ্ছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ওরা প্রায় দিন বিভিন্ন কারণে উৎসব করে, তা সে নিজেদের বিবাহবার্ষিকী হোক, বা ছেলে মেয়েদের জন্মদিন, ওদের বাড়ি আলোতে সেজে ওঠে, সেই সঙ্গে এলাহি খাওয়াদাওয়া। শৌভিকদের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান মানেই, আমার নিমন্ত্রণ পাকা। মায়েরও থাকে, তবে মা, সব অনুষ্ঠানে যায় না।

শৌভিকদের বাড়ি পৌছনো মাত্রই বউদি এগিয়ে এসে আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। আমি বউদিকে বললাম, ‘আমাকে যে শৌভিক এমনি আসতে বলল। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে তো দেখছি বড়ো কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি কিন্তু কী অনুষ্ঠান কিছুই জানি না, কোনও কিছু উপহার আনতে পারিনি।’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই শৌভিকের বউদি বলে উঠল, ‘আমরা এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে কাউকে বলিনি। সবাইকে অবাক করে দেওয়ার জন্যেই শুধু চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ করলেও কী অনুষ্ঠান সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আর তুমি তো আমাদের ঘরের লোক, তুমি আবার উপহার কি আনবে?’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়াতে মন দিলাম।

নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। একশো দশ পনেরো হবে। আমার তো সবাইকে মনে হল আমারই মতো অবাক হওয়াদের দলে।

কিছু সময় পরে শৌভিকের সাথে দেখা হল। মা, না আসবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই শৌভিক বলল, ‘আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ব্রাদার উত্তর পেয়ে যাবে।’

অন্য সব অনুষ্ঠানের মতো এবারেও ওদের বাড়িতে খাবারের অঢেল আয়োজন। সেইসব খাবার টুকটাক খেতে খেতে অন্য সবার সাথে কথা বলছি, এমন সময় শৌভিকের দাদা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে অনুষ্ঠানে আসবার জন্য ধন্যবাদ জানাল।

আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ‘আরে, আমরা তো কেউই কোন অনুষ্ঠানে এসেছি, সে সব কিছুই জানি না, সেটা আগে বল।’

দাদা মুচকি হেসে আমাদের আরও কিছুসময় অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল।

অবশ্য আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না, কিন্তু তারপর যা দেখলাম, প্রথমে আমার নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরকম কিছু একটা দেখব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মতো যারা নিমন্ত্রত হয়ে এসেছিল, তারা প্রায় সকলেই কয়েকটা মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। একটা চাপা গুঞ্জনও আরম্ভ হল।

আমি কারওর সাথে কোনও কথা আলোচনা না করলেও সব কিছু দেখে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ বন্ধ করলেও ভেসে উঠল একটাই ছবি, কনের সাজে কাকিমা, পাশে ষাটোর্দ্ধ এক ভদ্রলোক, সঙ্গে শৌভিকদের বাকি সবাই।

মা একা থাকবে বলে, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। অল্প একটু খেয়ে, মায়ের জন্যে খাবার পার্সেল করে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিলাম। শৌভিকের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে সব হল?’

শৌভিক খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘তুই তো জানিস, আমরা সবাই ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। দাদার মেয়েটাও হস্টেলে। একা থাকতে থাকতে মা ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছিল। আর কয়েক দিন চললে অন্য রকম বিপদ হয়ে যেতে পারত। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার বললেন, কম্পানির প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মধ্যে সেরকম কে কম্পানি দেবে বলতো? একটা আয়া ঠিক করলাম। মায়ের সাথে সবসময় থাকত, তার সাথেই মর্নিংওয়াকে বের হতো। এই মর্নিংওয়াকের সময় কাকুর সাথে আলাপ পরিচয়। মায়ের সাথে বন্ধুত্ব হল। বাড়িতে কাকু আসতে লাগলেন। দেখলাম কাকু বাড়িতে আসাতে মা বেশ হাশিখুশি থাকত, সাজগোজ করত। একদিন কাকুই প্রস্তাবটা মাকে দিলেন। মা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কাকু তখন দাদার সাথে কথা বলেন। এরপর আমরা সবাই আলোচনা করতে বসি। আলোচনাতে অনেক কিছু কনফিউশন মিটিয়ে তারপর এই অনুষ্ঠান।’

শৌভিক সেদিন ব্যস্ত ছিল। আমাকে বলল, ‘পরে আরেকদিন আসবি, চুটিয়ে আড্ডা দেব।’ তারপরেই ওদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে, মোবাইলে কাকিমা আর নতুন কাকুর একটা ছবি তুলে, বাসস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াতেই, কানে এল নিমন্ত্রিতদের মধ্যে মাঝবয়সি এক মহিলা মোনোপজ সংক্রান্ত আলোচনা করতে করতে গাড়িতে উঠছে।

আমাদের হয়তো সব বয়সেই বিশেষ কারওর কম্পানির প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এই কম্পানি ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি দিয়ে পূরণ করা যায় না। আমরা এত কিছু বুঝি না, বুঝতে চাইও না। ইনফ্যাক্ট আমার নিজের মায়ের ব্যাপারেও এতসব ভাবার প্রয়াজন আছে বলে, মনে করিনি। এমনকী মায়ের কাছে গেলে এরপরেও অন্য কিছু ভাবব।

বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, শৌভিকদের বাড়িতে কী ছিল?’

আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ‘কাকিমার বিয়ে।’

‘কী বাজে বকছিস! বড়োদের নিয়ে কেউ এমনি কথা বলে?

মা রেগে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে সবকিছু ভালো ভাবে বলে, কিছুক্ষণ আগে মোবাইলে নেওয়া কাকিমাদের ছবিটা দেখালাম। মা সব কিছু দেখে কোনও কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি জামাকাপড় বদলে একটু ইতস্তত করে মায়ের ঘরে গিয়ে বললাম, ‘ঘুমোলে?’

মা শুয়ে শুয়েই উত্তর দিল, ‘না, কিছু বলবি?’

‘দাদাকে একটা ফোন করব?’

‘কেন?’

‘না, মানে তুমিও তো একা থাকো, তাই ভাবছিলাম…’

মা কিছু সময় চুপ করে শুয়ে থাকল। আমিও আর কোনও কথা না বলে আস্তে আস্তে মায়ের ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই মা বলল, ‘বুকু আজ ফোন করেছিল, পরের সপ্তাহে আসছে।’

 

চোরাবালি

গ্যাসে পাউরুটি সেঁকতে সেঁকতে স্ত্রী অনসূয়ার কথাই ভাবছিল দেবল। পনেরো দিন হল বাপের বাড়ি গিয়েছে অনু, আর এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কটা মাস কীভাবে কাটাবে জানা নেই দেবলের।

মা হতে চলেছে অনু। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে মাত্র তিনবারই যেতে পেরেছে সে। দেবলকে একা রেখে যেতে কিছুতেই মন চায় না অনুর। এবার দেবলই একপ্রকার জোর করে অনুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে। ওখানে থাকলে অনুর ঠিকমতো দেখাশোনা হবে। অফিস থেকে দেবলের ফেরার কোনও ঠিক থাকে না। এতক্ষণ এই অবস্থায় অনুকে বাড়িতে একা রাখতে দেবলের মন সায় দেয়নি। তাছাড়া ডাক্তারের কথামতো এইসময় একটু বিশেষ যত্নেরও প্রয়োজন  অনুর।

যথারীতি রোজকার মতো ডিম-পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই, দেবল অফিস পেঁছোল। লাঞ্চটা আজকাল বাইরেই সারে। অনু থাকতে টিফিন প্যাক করে ব্যাগে ভরে দিত। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়ি যখন ফিরল দেবল, নিজেকে অসম্ভব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। জিরিয়ে নিতে সোফায় এসে বসল। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল ফোনের একনাগাড়ে বেজে চলা ক্রিং ক্রিং শব্দে। অনুর ফোন। তাড়াতাড়ি উঠে বসল হ্যালো।

এত দেরি হল ফোন ধরতে? নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলে? এক কাজ করো বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নাও। বাড়িতে কিছু আর করতে হবে না, চিন্তিত লাগল অনুকে।

অনু ফোন ছেড়ে দিলে হাতমুখ ধুয়ে দেবল ফ্রেশ হয়ে নিল। সবে ফোনটা নিয়ে খাবারের অর্ডার দিতে যাবে, কলিংবেলটা বেজে উঠল। মনে মনে বিরক্ত হল, এই সময় কে আবার এল?

দরজা খুলতেই দেখল তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সি একটি তরুণী দরজায় দাঁড়িয়ে ফরসা, বেশ সুন্দরী। এক মুখ হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণায়।

আপনি?

আমি মিতা, আপনাদের ঠিক উপরের ফ্লোরেই থাকি।

কিন্তু আপনাকে তো আমি কোনও দিন…

দেবলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতা বলে উঠল, হ্যাঁ, আপনি আমাকে চেনেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। অনুর হাজব্যান্ড আপনি। অনু ডেলিভারির জন্য বাপের বাড়ি গেছে।

মিতার কথা শুনতে শুনতে একটা কথাই দেবলের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, ওদের সম্পর্কে মহিলা এত কথা কী করে জানলেন? এছাড়াও একই বিল্ডিং-এ থেকেও কী করে দেবল মহিলাকে চেনে না?

এত চিন্তা করতে হবে না। মাত্র একমাস আগেই এখানে শিফট হয়েছি আমি। কিছুই খবর রাখেন না দেখছি। আগে যারা থাকত তাদের জায়গায় এসেছি। অবশ্য আপনি সকালে অফিস বেরিয়ে যান, ফেরেন দেখি সেই সন্ধেবেলায়। আর আমাকে কী বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভিতরে আসতে বলবেন না?

ওহ! সরি, প্লিজ ভিতরে আসুন। দেবল মিতাকে বসার ঘরে সোফায় এনে বসায়।

সারাক্ষণ বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে না আপনার? বড়ো শহরের এই এক অসুবিধা। অন্যান্য সুবিধা তো প্রচুর আছে কিন্তু জায়গা অত্যন্ত সীমিত আর লোকগুলোও বড়ো স্বার্থপর। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অপরের জন্য কোনও সময় নেই।

মিতার কথা শুনে দেবল হেসে ফেলে।

আরে আমি আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। কথায় কথায় সেটা দিতেই ভুলে গেছি, বলে মিতা হাতে রাখা কাপড় ঢাকা থালাটা সোফার সামনেই টেবিলে নামিয়ে রাখল।

খাবার দেখে অস্বস্তি বোধ করছিল দেবল। কিন্তু কিছু বলার আগেই মিতা বলে উঠল, আমি জানি আপনি বলবেন এসবের কী দরকার ছিল? আরে আমি নিজের জন্য খাবার বানাচ্ছিলাম ভাবলাম, আপনারটাও বানিয়ে নিই।

মিতাকে হাসতে দেখে দেবলও মুখে হাসি টেনে আনে।

কথায় কথায় দেবল জানতে পারে, মিতা লখনউ-এর মেয়ে ওর স্বামী দুবাইতে ব্যাবসা করেন। এতদিন ওখানেই ছিল মিতা কিন্তু নিজে কিছু করবে ভেবে দেশে ফিরে আসে। এখানে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত সে।

ঠিক আছে আজ চলি। বাসনের চিন্তা করবেন না। সকালে এসে আমি নিয়ে যাব। মিতা চলে গেল। দেবল একদৃষ্টে মিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুব দিল।

সকালে বাসন নেওয়ার অছিলায় গরম গরম আলুর পরোটা আর এক বাটি দই জোর করে ধরিয়ে দিয়ে গেল দেবলের হাতে। দেবল প্রতিবাদ করলে, মিতা বলল, দেবলকে দেখে ওর মৃত দাদা অক্ষয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সুতরাং দেবল কিছুই আর বলে উঠতে পারে না।

 

এরপর থেকে রোজই কিছু না কিছু খাবার বানিয়ে দিয়ে যেতে আরম্ভ করে মিতা। অনু কিছু ভুল না ভেবে বসে, এই ভেবে বলব না বলব না করেও, শেষমেশ সবকিছু খুলে বলে দেবল।

সব শুনে অনু বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে, আমার এখানে চলে আসার আগেই ভদ্রমহিলা ওখানে শিফট করেন। অল্পবিস্তর আলাপ হয়েছিল। যাক বাড়ির তৈরি খাবার পাচ্ছ, আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু দেখো ওই খাওয়া অবধি, ওর থেকে বেশি কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না। নিজের রসিকতায় অনু নিজেই হেসে ওঠে।

কখনও পোলাও-মাংস তো কখনও লুচি-তরকারি আবার কখনও সাদামাটা ঘরোয়া খাবার রোজই কিছু না কিছু দেবলের কাছে আনা আরম্ভ করল মিতা। কিছু বললেই বলে, আপনার জন্য আমারও তো খাওয়া হচ্ছে।

এত কিছু খেয়ে ফিট থাকেন কী করে বলুন তো? জিজ্ঞেস করেই বসে দেবল।

কেন, রোজ হাঁটা এবং জিম দুটোই করি নিয়ম করে।

বাঃ, তাহলে চলুন কাল থেকে আমিও আপনাকে সঙ্গ দেব, দেবল বলে।

উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মিতা। এরপর রোজই সকালে দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে যেত আর সন্ধেবেলায় জিম যাওয়াটা ওদের রুটিন হয়ে দাঁড়াল।

ধীরে ধীরে মিতা আর দেবলের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল। বিশ্বাস থেকে মিতার উপর একটা নির্ভরতা গড়ে উঠল। কথায় কথায় একদিন আগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা শেয়ার করছিল দেবল, খেয়াল করল মিতা কিছুটা উদাস। কারণ জিজ্ঞেস করতে দেবল জানতে পারল, ডাক্তাররা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, মিতা কোনও দিনও মা হতে পারবে না। তবে ওদের স্বামী-স্ত্রীর ইচ্ছে কোনও অনাথ শিশুকে নিয়ে এসে মানুষ করা। এটা জানার পর মিতার প্রতি দেবলের মনে সম্মানের জায়গাটা আরও বেড়েছে।

সেদিন বিকেল থেকেই বৃষ্টি। আকাশ কালো করে শুধু মেঘের গর্জন। ছুটির দিন। অনুর কথা খুব মনে হচ্ছিল দেবলের। ও যদি বাড়িতে থাকত এই বৃষ্টির মরশুমে ছুটত গরম গরম পকোড়া ভাজতে। থালা ভরে দেবলের সামনে এনে রেখে দিত। নিজের হাত পুড়িয়ে পকোড়া ভাজতে মন চাইল না দেবলের। বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্যে  বুঁদ হয়ে রইল।

ফোনটা বাজতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল। মিতার ফোন, পকোড়া বানাচ্ছি। চলে আসুন আমার ফ্ল্যাটে।

যাক বাঁচা গেল। সত্যিই খুব পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি এখনই আসছি, বলে দেবল ফোন ছেড়ে দিল।

মিতার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতেই সঙ্গে সঙ্গে প্লেট ভর্তি করে পকোড়া হাজির। দেবলকে বসিয়ে মিতা পকোড়ার সঙ্গে গরম গরম চা বানিয়ে আনল। চা আর পকোড়ার সঙ্গে ওদের আড্ডাও বেশ জমে উঠল।

হঠাৎ-ই খেয়াল হল বাইরে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে।, আড্ডা মারতে মারতে খেয়ালই হয়নি। উঠব উঠব করেও কিছুতেই ওঠা হয়ে উঠছিল না। মাথাটাও কেমন জানি ঘুরছে বলেই মনে হল দেবলের। মিতা জোর করল, ডিনার খেয়ে যেতে হবে। বারণ করা সত্ত্বেও কথা কানে তুলল না মিতা। রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

হেঁটে একটু হাত-পাগুলো ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল দেবলের। সেই কখন থেকে এক ভাবে সোফায় বসে আছে। উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা জোরে ঘুরে গেল দেবলের। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল। জ্ঞান হারিয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়ল দেবল।

খানিক পরে মিতা এসে ঘরে ঢুকল। দেবলের ওই অবস্থা দেখে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। কোনও ভাবে টানতে টানতে দেবলের বেহুঁশ শরীরটাকে শোবার ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখল মিতা। যে-কোনও পুরুষমানুষের হুঁশ উড়ে যাওয়ার মতোই রূপ। ঘরের আলো নিভিয়ে দেবলের পাশে এসে শুয়ে পড়ল মিতা।

 

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই লক্ষ্য করল দেবল, মিতার নগ্ন শরীরটাকে ও বাহুবন্ধনে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। এ কী করে সম্ভব? চমকে উঠে বসল দেবল। ঘটনাস্রোত মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু সব অন্ধকার।

ততক্ষণে মিতাও উঠে বসেছে। চাদর দিয়ে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। দেবলের বিস্ফারিত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর দুই চোখ। দেবলের দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার? এর আগে কখনও এভাবে জবরদস্তি করোনি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কাল রাতে তোমার শরীরের জোরের সঙ্গে আমি পেরে উঠিনি।

লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারল না দেবল। নিজের প্রতি নিজেরই ঘেন্না হল। যে ওকে দাদার আসনে বসিয়েছিল, তাকেই ও নিজের বাসনার শিকার করল। এই ভুল ও কী করে করল? যে কিনা কোনও দিন অন্য মহিলাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। ভুল করে ফেলেছে, কী করেই বা সেটা শুধরানো যায়?

দেবলের ইচ্ছে হচ্ছিল ফোন করে মিতার কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু সাহসে কুলোল না। মিতা ফোন করা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। দেবলের ভয় করতে লাগল, মিতা যদি ওর উপর ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে অনু আর সমাজের সামনে কী করে সে মুখ দেখাবে? ফোনে অনুর সঙ্গে রোজই কথা হতো দেবলের কিন্তু এই ঘটনার কথা দেবল কিছুতেই অনুকে বলতে পারল না।

 

একদিন হঠাৎ নিজে থেকেই মিতা এসে হাজির হল দেবলের কাছে। দেবল ওকে দেখেই আমতা আমতা করে বলে উঠল, মিতা আমিই তোমার কাছে আসতাম ক্ষমা চাইতে।

কীসের ক্ষমা দেবল? সেদিনের ঘটনায় না তোমার দোষ ছিল আর না আমার। ঘটনাটা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে। দুর্ঘটনা ভুলে যেতে পারলেই ভালো। আমি মন থেকে ওটা মুছে ফেলেছি।

মিতার কথা শুনে দেবলের মধ্যে যেন প্রাণ এল। মনে হল, সত্যিই মিতার মতো মেয়ে হয় না!

দেবল, আমি একটা অন্য কাজে তোমার কাছে এসেছি। হঠাৎ আমার কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে এত টাকা আমার কাছে নেই। আমি তাড়াতাড়িই তোমাকে টাকাটা ফিরিয়ে দেব, বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মিতা দেবলের দিকে তাকাল।

কত টাকা?

পঞ্চাশ হাজার। টাকা এসে গেলেই আমি তোমার টাকা ফিরিয়ে দেব, দেবলের চোখে চোখ রাখে মিতা।

দোষী দোষ ঢাকতে কী না করে? যখন-তখন প্রযোজনের জন্য বাড়িতে চল্লিশ হাজার মতো রেখেই দেয় দেবল। সেই টাকাটাই বার করে এনে মিতার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমার কাছে চল্লিশ হাজারই আছে মিতা। টাকাটা দিয়ে দেবলের মনে হল, কিছুটা হলেও ওর অপরাধের বোঝা হালকা হয়েছে।

 

সেই শুরু। এরপর থেকে মাঝেমাঝেই মিতা কখনও দশ-বিশ হাজার টাকা দেবলের কাছে চাইতে শুরু করল। দিয়ে দিত দেবল, কিন্তু কত দিন? কুবেরের ধন নেই ওর কাছে! সুতরাং একদিন দেবলকে না বলতেই হল মিতার মুখের উপর। মিতাও চুপ করে থাকল না।

না শোনার অভ্যাস নেই মিতার। ফোঁস করে উঠল। তুমি কী ভেবেছ দেবল? ওই রাতের ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি? সেদিন তুমি যা কিছু করেছ তার সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। দেখতে চাও? বলে নিজের ফোনে রেকর্ড করা পুরো ভিডিও-টা তুলে ধরল দেবলের সামনে। ভিডিও-তে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে দেবল মিতার সঙ্গে জবরদস্তি করার চেষ্টা করছে আর মিতা ওর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সবকিছু দেখে ঘেমে উঠল দেবল।

কী বলো দেবল? ভিডিও-টা নিয়ে পুলিশের কাছে যাব, না সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল করে দেব? ভালোই হবে, অনুও দেখবে তোমার আসল রূপ, বাঁকা হাসি হেসে বলে মিতা।

শিউরে ওঠে দেবল। যে ওকে দাদা বলে মেনেছিল তার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার? ভাবতে পারেনি দেবল। সে মিতাকে কারণটা সরাসরি জিজ্ঞাসা করে। উত্তরও পায়।

একটা বড়ো বাড়ি দেখেছি। পঞ্চাশ লাখ দাম বলছে। তোমাকে দিতে হবে টাকাটা। একবারে নয়, কিছু কিছু করে দিলেই চলবে কিন্তু দিতে তো তোমাকে হবেই। নয়তো আমি কী করতে পারি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, শ্লেষের ভঙ্গিতে বলে মিতা।

খুব ভালো করেই বুঝেছে দেবল, ওর সঙ্গে আলাপ করাটা মিতার একটা কৌশল ছিল। অনুর কথাগুলো মনে পড়ল, কাউকে ভালো করে না জেনেশুনে ভরসা কোরো না। এটা যে কত বড়ো সত্যি আজ টের পাচ্ছে দেবল।

অনু ডেলিভেরির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে শুনেই দেবল কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কানপুর রওনা হল। অনুর বাপের বাড়ি ওখানেই। কিন্তু দেবল পৌঁছনোর আগেই অনু ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং হাসপাতালে পৌঁছে নিজের সন্তানকে দেখে গত কয়েক মাসের দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে স্ত্রী আর নবজাত সন্তানকে নিয়ে মেতে উঠল দেবল। এদিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসছিল। অনুর ইচ্ছে ছিল দেবলের সঙ্গেই ফিরে যায় কলকাতায়। কিন্তু ডাক্তারের কথামতো আরও একমাস কানপুরে মা-বাবার কাছে থেকে যেতে বাধ্য হল অনু। দেবল ফিরে এল একাই।

আবার সেই মিতার মুখোমুখি হওয়া। সেই টাকার জন্য চাপ। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয়। দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল দেবলের। পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও রাস্তা দেখতে পেল না সে।

এক মাস বাদেই অনু ফিরে এল সন্তানকে নিয়ে এসে অবাক হল দেবলের ব্যবহারে। যে-সন্তানকে নিয়ে এতদিন এত স্বপ্ন দেখেছে দেবল, সেই সন্তানকে কোলে নেওয়া তো দূরে থাক, তার একটু কান্নায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগল দেবল। নতুন খেলনা কিনে আনার কথা বললে রেগে উঠত বলত, বাজে খরচ করা বন্ধ করো অনু।

শুধু এটুকুই নয়, অনুর থেকেও দূরে দূরে থাকতে আরম্ভ করল দেবল। অনু কাছে আসার চেষ্টা করলে, অন্য ঘরে চলে যাওয়াটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল।

 

সেদিন দেবলের ছুটি। রোজকার থেকে একটু ধীরে ধীরেই বাড়ির কাজ সারছিল অনু। দেবের মোবাইলটা অনেক্ষণ থেকে বাজছে। এত সকালে কোথায় গেল দেব? এদিক ওদিক চাইল অনু। নাঃ আশেপাশে কোথাও নেই। বাধ্য হয়ে হাত মুছে মোবাইলটা ধরল। হ্যালো বলার আগেই ওধার থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল, দুদিন ধরে সমানে ফোন করছি, ফোন ধরছ না কেন? দ্যাখো আমাকে রাগিয়ে দিও না। তাহলে আমি বাধ্য হব ভিডিও-টা ভাইরাল করে দিতে। তখন তোমার অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছ একবার? আমার এখুনি পনেরো লাখ টাকা চাই। আর যখনই টাকার কথা বলব, এসে দিয়ে যেও। আর আজ রাত্রে একবার ফ্ল্যাটে এসো আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, হঠাৎই ফোনটা কেটে গেল।

অনুর পায়ে তলার মাটি সরে গেল। মহিলা কে? দেবলের কাছে কেন টাকা চাইছে? কোন ভিডিও ভাইরাল করার ভয় দেখাচ্ছে? রাত্রিতে কেন দেবলকে ফ্ল্যাটে ডাকল? এরকম নানা প্রশ্ন এসে অনুর মাথায় ভিড় করতে শুরু করল। ইচ্ছে হল সঙ্গে সঙ্গে দেবলের মুখোমুখি হতে কিন্তু আটকাল নিজেকে। আগে ব্যাপারটা বুঝতে হবে, ঘটনার শুরুটা জানতে হবে, তবেই কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব।

দেবল বাইরে থেকে ফিরলে, আজ অনেক দিন পর ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল অনু। সত্যি কত রোগা হয়ে গেছে। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। অনু নিজেকেই দোষারোপ করল, কেন লোকটার দিকে এতদিন ভালো করে তাকায়নি? কী এমন দুঃখ বুকে চেপে বসে আছে, যেটা ওকেও বলতে পারেনি দেবল?

দেব? অনেকটা সাহস বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে অনু তাকাল দেবলের দিকে। আমাকেও বলবে না, তোমার কী হয়েছে? আমরা তো কথা দিয়েছিলাম, কেউ কাউকে কোনও কথা লুকোব না। তাহলে এত বড়ো ঘটনা তুমি কী করে লুকিয়ে রাখলে?

ছ্যাঁত করে উঠল দেবলের বুকটা। অনু কি তাহলে সব জেনে গেল? সবকিছু অনুর কাছে খুলে বলার জন্য দেবলের মনটা উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোল না।

বলো না দেব, কে ওই মহিলা, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য তোমাকে বাড়ির বাইরে যেতে হয়? আজ তুমি না থাকাতে আমি ফোন ধরেছিলাম। যতক্ষণ তুমি না বলবে আমাকে, আমি কী করে জানব কেন তোমাকে মহিলা বিরক্ত করছেন? প্লিজ আমাকে খুলে বলো, হয়তো তাহলে তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারব।

অনুর কথায় দেবের চোখ জলে ভরে এল। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না দেবল। কী কী ঘটনা ওর সঙ্গে ঘটেছে সব খুলে বলল দেবল।

এত কিছু হয়ে গেছে, তুমি আমাকে জানাওনি? কীসের ভয় ছিল তোমার, যে আমি তোমাকে ভুল বুঝব? আমি তোমার স্ত্রী, এতদিনে তুমি আমাকে এটুকুই চিনেছ? তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমি, একটু তো ভরসা করতে পারতে আমাকে। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। আমি তোমাকে ঠিক এই চোরাবালি থেকে টেনে বার করবই।

সারাটা দিন ধরে ভাবল অনু। রাতে খেতে বসে মনে মনে ঠিক করে রাখা প্ল্যানটা জানাল দেবলকে।

সত্যিই অনু, তুমি যেটা করবে ভাবছ সেটা আদৌ কি হওয়া সম্ভব? তুমি জানো না ওই মহিলা কতখানি চালাক, শঙ্কিত চোখে প্রশ্নটা করে দেবল।

অবশ্যই হবে দেব তবে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেবলের হাতে হাত রেখে ওকে ভরসা দেয় অনু।

প্ল্যান অনুযায়ী অনু, মিতার সঙ্গে বেশি করে মিশতে আরম্ভ করল, যাতে বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়। যখন অনু বুঝল মিতা এখন ওকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে তখন ও শেষ চালটা দিল।

আজ ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। হয়তো দেরি হবে ফিরতে, দেবল ফিরলে তুমি বাড়ির চাবিটা দিয়ে দিও আর পারলে কিছু খাইয়ে দিও, নয়তো বেচারা খিদে পেটে নিয়ে বসে থাকবে। হাত জোড় করে বলে অনু। মিতার মনে হয় আকাশের চাঁদ আপনিই এসে ওর হাতে ধরা দিয়েছে।

আরে হাত জোড় কেন করছ অনু। চাবি দিয়ে দেব আর তোমার বরকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। চিন্তা কোরো না।

মিতাকে হাসতে দেখে গা জ্বলে উঠল অনুর। মনে মনে বলল অনু, হেসে নাও এখন যত খুশি। তুমি আমার দেবকে কাঁদিয়েছ মিতা, আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।

অফিস থেকে ফিরে নিজের বাড়িতে মিতাকে দেখে দেবল অবাক হবার ভান করল। মিতা তুমি আমার বাড়ির ভিতর, কী করছ?

তোমার অনু আমার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়ে গেছে দেবল। রহস্যময় হাসিতে মুখ ভরে উঠল মিতার। চাবির গোছাটাকে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে দেবলের খুব কাছে ঘেঁষে এল মিতা।

প্লিজ বন্ধ করো তোমার ফালতু নাটক। কেন করছ তুমি এরকম আমার সঙ্গে? তুমিই বলেছিলে আমার মধ্যে তুমি তোমার দাদাকে দেখতে পাও। তাহলে আমার সঙ্গে এসব করতে তোমার লজ্জা করে না?

ইচ্ছে করেই দেবল আবার ওই একই প্রসঙ্গ টেনে আনল। সেদিন তোমার ফ্ল্যাটে আমাকে প্ল্যান করেই ডেকেছিলে, তাই না? চা-পকোড়ার নাম করে নেশার ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলে চায়ের মধ্যে? ধর্ষণ আমি করিনি, তুমি করেছিলে আমাকে। বলো আমি মিথ্যা বলছি?

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছ। পুরোটাই আমার প্ল্যান ছিল। নেশার ওষুধ খাইয়ে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে তোমার জামাকাপড় নিজের হাতে খুলে তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ, আমিই তোমাকে ধর্ষণ করি। কিন্তু একথা তুমি কী করে প্রমাণ করবে দেবলবাবু? ভিডিও-তে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই সত্যি বলে সবাই ধরবে। যেদিন তোমাকে আমি বড়ো গাড়িটা করে যেতে দেখেছিলাম, সেদিনই ঠিক করে নিই, তোমাকে কোনও ভাবে ফাঁসাতে হবে। সত্যিই বলছি দেবল, এই দেশলাই বাক্সর মতো ফ্ল্যাটে দম আটকে আসছে। বড়ো বাড়ি, গাড়ি হবে। চাকরবাকর থাকবে আর পর্যাপ্ত শারীরিক সুখ, দেবে তো আমাকে দেবল?

আচ্ছা এইসব এইজন্যই তুমি করেছ যাতে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পার?

হ্যাঁ দেবল। পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাকে দিয়ে দাও, তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়। তুমি তো টাকা দিতে ঝামেলা করছ।

আর আমি যদি টাকা না দিই?

তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। চেঁচিয়ে ওঠে মিতা। অনু যে বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছে এবং ও পুলিশ নিয়ে এসেছে ভাবতেও পারেনি মিতা।

 

এবার তুই আমাদের হাত থেকে রেহাই পাবি না। অনেক ঘোল খাইয়েছিস। হঠাৎই মহিলা পুলিশ দেখে ঘাবড়ে যায় মিতা।

দেবল কিছু বলে ওঠার আগেই মিতা নকল অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বলে ওঠে, অফিসার এই লোকটা আমাকে ধর্ষণ করেছে আর এখন ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। বলছে ওর কথা না শুনলে ওর কাছে রেকর্ড করে রাখা ভিডিও ভাইরাল করে দেবে।

কোন ভিডিও-টা? যেটা উনি নন, তুই বানিয়েছিস? তোকে খুব ভালোমতন চিনি, বলে মহিলা পুলিশটি অনুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মহিলা এক নম্বরের ঠগ, জোচ্চোর। বহু লোককে এভাবে ঠকিয়েছে। অনেক দিন ধরেই পুলিশ একে খুঁজছিল। এর আসল নাম মিতা নয়, সোনম।

মিতার ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ লাখ লাখ টাকা আর অনেকগুলো ভিডিও উদ্ধার করল। মিতাকে এবং ভিডিওগুলো পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনুদের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় মিতার চাহনি একটাই কথা দেবলকে বলে গেল, তোমাকে আমি ছাড়ব না।

থ্যাংকস অনু। তুমি যদি শেষ চালটা না চালতে তাহলে যে আমার কী হতো জানা নেই। হয়তো চোরাবালি-ই গ্রাস করত আমাকে। দেব অনুকে নিজের কাছে টেনে নিল। অনুও সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে দেবের হাতে সঁপে দিল।

 

দাগ

সকাল সকাল ঘরটার অবস্থা দেখে সুচিত্রার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। ছেলে তো সেই সকাল সাতটার আগেই স্কুলের জন্য রওনা হয়ে গেছে। প্রতিদিনই স্কুলবাস আসে বাড়ির দরজায়। আর অরুণাভও তো অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল। কিন্তু বাড়ি খালি বলে, সুচিত্রার কিন্তু কোনও বিশ্রাম নেই। দু-কামরার ফ্ল্যাটটাকে বাপ-ব্যাটা মিলে আস্তাকুঁড় বানিয়ে রেখেছে যেন। চারিদিকে জামা কাপড় ছড়িয়ে রেখে গেছে। ছেলে রুমন পড়াশোনা যত না করেছে, তার থেকে বই-খাতা ছড়িয়েছে বেশি। সারা মেঝেতে দলাপাকানো কাগজ ছড়িয়েছে। এগুলো সব পরিষ্কার করে, ঘর-দোর গুছিয়ে তুলতে তুলতে সুচিত্রা জানে পাক্বা দু-তিন ঘন্টা লেগে যাবে। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না সুচিত্রা।

বাথরুমে ঢুকে ভেজা টাওয়েল এবং অরুণাভ-র ছাড়া শার্ট আর গেঞ্জিটা বার করে ওয়াশিং মেশিনে ফেলতেই যাচ্ছিল সুচিত্রা, খাটের পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। বিরক্ত হল ও। এই অসময়ে কার ফোন হতে পারে? সব রাগ গিয়ে পড়ল মোবাইল কোম্পানিগুলোর উপর। ওরা ছাড়া এই অসময়ে আর কে-বা হতে পারে! লেটেস্ট গানের কলার টিউন দিচ্ছে বলে ফোন করে করে জ্বালিয়ে যাবে। পুরো ব্যাপারটাই সুচিত্রার বুজরুকি কারবার ছাড়া কিছু মনে হয় না।

বিরক্ত হয়েই হাতটা নাইটিতে মুছে নিয়ে সুচিত্রা ফোনটা তুলে নিল। কলার আইডি দেখে সুচিত্রার রাগ মুহূর্তে জল হয়ে গেল। বিলাসপুর থেকে ননদের ফোন। একটু চিন্তিতও হল সুচিত্রা। দিদি সাধারণত দুপুরের দিকেই ফোন করে। আজ কী হল যে এত সকাল সকাল ফোন করছে?

‘হ্যালো দিদি, কেমন আছ? আজ এত সকাল সকাল ফোন করেছ সব ঠিক আছে তো?’

‘না সুচিত্রা, সব মনে হচ্ছে ঠিকঠাক নেই।’

‘কী হয়েছে’, খারাপ খবর শোনার আশঙ্কায় ঘাবড়ে গেল সুচিত্রা। যত খারাপ খবর সব কি এই সকালেই আসতে হয়?

‘তনুর শরীরটা মনে হয় ভালো নেই। সেদিন ফোন করেছিলাম ও ঘরে ছিল না। ওর রুমমেট বলল, সারারাত নাকি তনু ঘুমোয় না। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে।’

‘কবে থেকে এটা হচ্ছে?’

‘দুই-তিন মাস ধরে চলছে’ , কেঁদে ফেলে দিদি।

‘দিদি, শুধু শুধু কাঁদছ কেন? আমাকে আগেই তো বলতে পারতে, আমি একবার গিয়ে খোঁজ করে আসতাম। ঠিক আছে আমি আজই একবার চলে যাব।’ঘড়ির দিকে তাকায় সুচিত্রা, ‘দিদি এখন নটা বাজে, একটু পরেই ওর কলেজ শুরু হয়ে যাবে। বিকেল ছাড়া ওর সঙ্গে দেখা হবে না। ওর সঙ্গে দেখা করে আমি তোমাকে রাতে ফোন করে দেব।  চা-জলখাবার খেয়েছ?’

‘না…’

‘সে কী? যাও, নিশ্চিন্তে খাওয়াদাওয়া করো। আমি বাড়ির কাজ সেরে রুমন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বেরোব। তুমি এখন ফোন ছাড়ো। আমিও কাজ সেরে স্নান করে নিই।’ সুচিত্রা মোবাইল বন্ধ করে।

বাড়ির কাজ করতে করতে সুচিত্রার মাথায় ঘুরতে থাকে তনু মানে দিদির মেয়ে তানিয়ার কথা। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল তখন তনুর শরীর তো ঠিকই মনে হয়েছিল। বাড়ির এবং আত্মীয়স্বজনের সবকটি ছেলেমেয়ের মধ্যে তনুই সবথেকে ভালো পড়াশোনায়। এছাড়াও প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং খেলাধূলাতেও খুবই ভালো। রুমনকে সবসময় পরামর্শ দেয় সুচিত্রা, ওর দিদির থেকে কিছু শেখার জন্য কিন্তু রুমনের পড়াশোনাতে মন আছে বলেই মনে হয় না সুচিত্রার। প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ওর টিউশনের পিছনেই খরচ করে সুচিত্রা আর অরুণাভ।

তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ আর রান্নাবান্না সেরে স্নান সেরে নিল সুচিত্রা। রুমনের বিকেলের জলখাবারের জন্য কড়াইশুঁটির কচুরি তৈরি করে ক্যাসারোলে তুলে রেখে দিল সুচিত্রা, যাতে ছেলেটা বিকেলে ‘খিদে খিদে’করে পঞ্চাশবার ফোন না করে। কয়েকটা তনুর জন্যেও প্যাক করে গুছিয়ে নিল। মেয়েটা বড়ো ভালোবাসে এইসব খেতে। হস্টেলে পাবেই বা কোথায়? দিদির এই মেয়েটাকে বড়ো ভালোবাসে সুচিত্রা। আজকালকার দিনে এমন মেয়ে খুব একটা চোখে পড়ে না। সুচিত্রা চাইছিল তনুকে সারপ্রাইজ দিতে তাই ওকে ইচ্ছে করেই ফোন করল না। একটার মধ্যে রুমন স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকলে মা-ব্যাটায় দুপুরের খাবার খেয়ে রুমনকে সব বুঝিয়ে, সুচিত্রা তনুর হস্টেলে যাবার জন্য বেরোল। বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে অরুণাভকেও সবকিছু জানিয়ে রাখল সুচিত্রা।

তনুর হস্টেল, শহর থেকে একটু দূরে। দু’বার বাস বদলে যেতে হয়। ওর হস্টেলে যখন পৌঁছোলো সুচিত্রা, তখন চারটে বেজে গেছে। হস্টেল থেকে মেয়েরা বেরিয়ে কেউ কেউ টিউশন নিতে যাচ্ছে।

মুখেই দেখা হল তনুর রুমমেটের সঙ্গে। আগেই আলাপ হয়েছিল সুচিত্রার সঙ্গে, নাম সঞ্চিতা। সুচিত্রাকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এল, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

‘কেমন আছো?’ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সঞ্চিতার মাথায় হাত রাখল সুচিত্রা।

‘ভালো, মামিমা। আপনার আজকে আসার কথা ছিল? তনু জানে আপনি আসবেন?’

‘না, ওকে জানাইনি, সারপ্রাইজ দেব বলে। কিন্তু ও কোথায়?’ সুচিত্রা জিজ্ঞেস করে।

‘ও রুমে আছে,’ বলে সঞ্চিতা চলে গেল।

সুচিত্রা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওয়ার্ডেনের ঘরের দিকে পা বাড়াল। রেজিস্টারে সাইন করে তবেই তনুর ঘরে যাওয়ার পারমিশন পাবে।

সাইন করে তনুর রুমের সামনে গিয়ে অভ্যাসবশত দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজাটা সামনের দিকে কিছুটা খুলে গেল। ঘরটা অন্ধকার। তনু সিলিঙের দিকে দৃষ্টি মেলে চুপচাপ শুয়ে আছে। বাইরের নিভু নিভু আলোয় ঘরের ভিতরের অবয়ব অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে। সুচিত্রা পা টিপে রুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তনু কিছুই টের পেল না। ধীর পায়ে সুচিত্রা ওর মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তনুর চোখ চেপে ধরল।

‘কে… কে?’ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে তনু।

‘বল তো কে…’

‘ও… মামি, তুমি।’ গলার আওয়াজ চিনতে পেরে ওর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে যায়। বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বালায় তনু।

সুচিত্রা খাটের পাশে গিয়ে বসে। হাতটা ভিজে ভিজে ঠেকে, ‘কীরে কাঁদছিলি নাকি?’

‘না তো মামি’, তাড়াতাড়ি করে চোখের জল মোছবার চেষ্টা করে তনু।

ভালো করে তাকায় সুচিত্রা ওর দিকে। তনুর চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখটাও শুকনো, চোখের কোলে কালি পড়েছে। চুলগুলো অবিন্যস্ত, অগোছালো।

‘কী রে, কী হয়েছে তোর?’ চিন্তিত সুচিত্রা তনুর কাছে ঘেঁষে আসে। ‘সকালে তোর মা ফোন করেছিল, বলল, তুই নাকি খুব অসুস্থ। আমার কাছেও তো চলে আসতে পারতিস বা বাড়িতেও ক’দিন ঘুরে আসতে পারতিস। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছিস?’

‘আরে আরে দাঁড়াও মামি, একসঙ্গে কত প্রশ্ন করছ। আমি একদম ঠিক আছি, চিন্তা করার মতো কিচ্ছু হয়নি। তুমি বসো, আমি চা নিয়ে আসি , অগোছালো চুলটা হাতে পাকিয়ে খোপা করতে করতে তনু খাট থেকে নামার উপক্রম করে।

সুচিত্রা ওকে আটকে দেয়, ‘আমি চা খেয়েই এসেছি। তুই এখানে চুপচাপ বস, এখন কোথাও তোকে যেতে হবে না।’ হাতের ব্যাগটা থেকে বার করে টিফিন কৌটো-টা তনুর হাতে ধরিয়ে দেয় সুচিত্রা, ‘নে খেয়ে নে, কড়াইশুঁটির কচুরি আছে। আলুর দম আর মিষ্টি দিয়ে আজ খেয়ে নে। যেদিন প্ল্যান করে আসব তোর অর্ডারি রসোগোল্লার পায়েস নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।’

অন্যদিন হলে সুচিত্রার হাত থেকে প্রায় কেড়েই কৌটো খুলে বসত তনু কিন্তু আজ সুচিত্রা আশ্চর্য হল, তনু কৌটোটা সরিয়ে রাখল, ‘এখন ইচ্ছে করছে না মামি, পরে খেয়ে নেব। কৌটো-টা টুলের উপর রাখতে গিয়ে হাত লেগে তনুর একটা পড়ার বই মাটিতে পড়তেই, বইয়ের ভিতর থেকে একটা ওষুধের পাতা ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ল। সুচিত্রা চট্ করে ওষুধটা তুলে নিল। নামটা দেখে বুঝতে পারল ওটা ঘুমের ওষুধ। তনুর দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা বলল, ‘কী রে তোর ঘুম হয় না? ঘুমের ওষুধ খাস কেন?’

তনু, সুচিত্রার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ‘না-না সেরকম কোনও ব্যাপার নয়। তুমি বসো, আমি দৌড়ে চা নিয়ে আসি।’

‘তুই খাবি?’ সুচিত্র প্রশ্ন করে।

‘না, আমি খাব না।’

‘তবে আমার কাছে বস। আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতেও হবে। পড়াশোনা কেমন চলছে তোর?’

‘তেমন কিছু নয়।’

সুচিত্রা লক্ষ্য করল, তনু কিছুতেই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। অথচ আগে সুচিত্রা এলেই ওর গলা জড়িয়ে ধরে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিত তনু। বন্ধুরা কী করল, ক্লাসে কী হল, ওকে কে কী বলল, এ সব খুলে না বললে তনুর নাকি ঘুম আসত না। অথচ আজ এত চুপচাপ। প্রথম থেকেই সুচিত্রার সঙ্গে ওর বন্ধুর সম্পর্ক আর সুচিত্রারও মনে এই মেয়েটির প্রতি একটা ভালোবাসা সেই কবেই গড়ে উঠেছে।

কিন্তু আজ সুচিত্রার পরিবেশটা অন্যরকম মনে হল। যা প্রশ্ন করছে সেই উত্তরটুকুই খালি পাচ্ছে, আর বাকি সময়টা কিছু একটা চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে তনু। সুচিত্রা ভেবে পেল না কীভাবে তনুর মনে কী চলছে সেটা জানবে কিন্তু কিছু যে একটা গোপনে ঘটে চলেছে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল সুচিত্রা। এরই মধ্যে তনুর রুমমেট সঞ্চিতাও রুমে ফিরে এল।

‘মামিমা, আপনি তনুকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। সারা রাত ঘরের মধ্যে পায়চারি করে, জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না। ওকে আমিই ঘুমের ওষুধ খেতে বলেছি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করে না, পড়াশোনাও লাটে তুলে দিয়েছে। ওর রোগটা মনে হয় ‘প্রেমরোগ , বলে হাসতে থাকে সঞ্চিতা।

‘চুপ কর সঞ্চিতা। মামির সামনে মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছিস , রেগে যায় তনু।

‘আরে আমাকে নামটা বলিসনি ঠিক আছে কিন্তু মামিকে তো ছেলেটার নাম বলে দে। হতে পারে মামি তোকে এবারের মতো প্রেমসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। নে… নে, মেলা নাটক না করে মামিকে সব বলে দে। আমি বরং বাইরে চলে যাচ্ছি , বলে সঞ্চিতা দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

‘ইডিয়েট একটা , তনুর স্বগতোক্তি সুচিত্রারও কানে এসে পৌঁছোল।

সঞ্চিতার কথাগুলোই সুচিত্রার সত্যি মনে হল। ও তনুর দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘কোনও ছেলেকে পছন্দ করিস তো বল, আমি দিদির সঙ্গে কথা বলব।’

‘না কেউ নেই , হাতটা সরিয়ে নিল তনু।

সুচিত্রা ওর থুতনিটা হাত দিয়ে তুলে ধরল, ‘সত্যি করে বল কী হয়েছে, আমি তোর মামি। কিছু তো একটা তোর মনের উপর চেপে বসেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আর সেই জন্যই তুই ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিস। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, তোর কোনও কথা কেউ জানবে না। তুই আমাকে বন্ধু ভাবিস তো… তাহলে বল, তুই কোনও ভুল কাজ করেছিস কি? কারও কাছে খুলে বললে মন হালকা হবে আর তাছাড়া হয়তো আমিও তোকে কিছু সাহায্য করতে পারব। প্রেম ট্রেমের চক্বরে পড়েছিস নাকি হস্টেলের কোনও প্রবলেম…?’ দশ পনেরো মিনিট ধরে বারবার একই কথা সুচিত্রা বলতে লাগল যাতে তনু আসল সত্যিটা ওর কাছে খুলে বলে।

অনেক চেষ্টা করেও সুচিত্রা তনুর পেট থেকে কথা বার করতে সফল হল না। একটু রাগও হল ওর, ‘ঠিক আছে, তনু, তোর যখন আমার উপর এতটুকু বিশ্বাস নেই আর ঠিকই যখন করেছিস আমাকে কিছুই বলবি না, তাহলে শুধু শুধু এখানে বসে থেকে কী লাভ আমার? এখন আমি তাহলে চললাম, ভালো থাকিস , বলে সুচিত্রা উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করে।

‘মামি…’, তনু সুচিত্রার হাতটা আঁকড়ে ধরে। ওর চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে থাকে। সুচিত্রা তনুর চোখে জল দেখে ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে গেলেও কথা বার করার জন্য চিন্তাটা মুখের মধ্যে প্রকাশ হতে দেয় না, ‘কেন, আমি এখানে বসে আর কী করব , আমাকে বাড়িও তো ফিরতে হবে। নয়তো রুমনকে পড়ানোর সময় পেরিয়ে যাবে।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই তনু সুচিত্রাকে জড়িয়ে ধরল। ওর কাঁধে মাথা রেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল ও, ‘মামি, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।’

‘কী ভুল করেছিস?’ সস্নেহে সুচিত্রা প্রশ্নটা করে।

‘একজনের সঙ্গে আমি সম্পর্কে…’

আজকালকার মেয়ে প্রেমে পড়েছে হতেই পারে কিন্তু তনু, সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কথা বলাতে সুচিত্রার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। তনুর উপর প্রচন্ড রাগ হতে থাকে সুচিত্রার কিন্তু ও ভালো করেই জানে এখন বকাঝকা আরম্ভ করলে তনু সত্যি কিছুতেই ওর কাছে খুলে বলবে না।

তনুর হাত ধরে সুচিত্রা ওকে খাটে বসিয়ে নিজেও ওর সামনে এসে বসল। এই অবস্থায় রাগারাগি করলে সুচিত্রা জানে, এই মেয়ে কিছু একটা করে বসতে পারে, সুতরাং খুব সাবধানে সব কথা ওর পেট থেকে বার করতে হবে।

ধীরে ধীরে তনু শান্ত হলে সুচিত্রা ওকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে বলে। তনুর মুখ থেকে সব ঘটনা শুনে মোটামুটি একটা ছবি পরিষ্কার হয়ে যায় সুচিত্রার, যে তনু পরিস্থিতির শিকার।

তনুর হস্টেলের ঠিক পাশেই ‘চন্দন স্টেশনারি শপ’ যেখান থেকে তনু প্রয়োজনীয় খাতা, পেন কেনার সঙ্গে সঙ্গে নোট্‌স, সার্টিফিকেট ইত্যাদি ফোটোকপি করাত। হস্টেলের সব মেয়েরাই ওই দোকানটা থেকেই এসব কেনাকাটা করে। এছাড়াও ওখানে কুরিয়ার, ফোনবুথ এবং ছবি তোলার জন্য একটা স্টুডিও-ও একসঙ্গে ছিল।

দোকানের মালিক চন্দনের বাড়িতেই নীচের তলাটা জুড়ে দোকানটা রমরমিয়ে চলত। দোকান দেখার জন্য একটা লোকও ছিল কিন্তু চন্দনের বউ রীতাও সকাল থেকেই দোকানে এসে বসত।

রোজ প্রায় আসা-যাওয়াতে, হস্টেলের অন্য মেয়েদের মতোই তনুর বন্ধুত্ব হয়ে যায় রীতা এবং চন্দনের সঙ্গে। কখনও দোকান খালি থাকলে রীতা তনুকে বসিয়ে স্ন্যাক্স, চা খাইয়ে তবে ছাড়ত। রীতার চার আর সাত বছরের দুটি ছেলে। ওদের জন্য রীতা ভালো একজন টিউটারের সন্ধানে ছিল।

রীতা সঞ্চিতার কাছে টিউটারের জন্য বলে রেখেছিল। সঞ্চিতার নিজের কোনও সময় ছিল না কারণ ওর বন্ধুবান্ধব, পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে ও ঘুরে ঘুরে বেড়াত। ফলে ও তনুকে পড়াবার জন্য বলাতে তনু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটা এমনিতেই তনুর খুব পছন্দের ছিল তার উপর হস্টেলের পাশে বলে ওর আরও সুবিধা হল। রীতার বাচ্চাদের পড়াবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল।

দুই সন্তানের বাবা চন্দন, কিন্তু ওর চেহারা দেখে বয়স বোঝার কোনও উপায় ছিল না। সুপুরুষ চেহারা, দেখলে আঠাশ-তিরিশের বেশি বলে মনে হয় না। তনুর বয়সও কুড়ি-একুশের বেশি নয় এবং যথেষ্ট সুন্দরীও বলা চলে। বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতে মাঝেমধ্যেই তনু লক্ষ্য করত যেতে-আসতে আড়চোখে চন্দন ওকে লক্ষ্য করছে। তনুও যে, যৌবনের আকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে পারত এমন নয়। চন্দনের স্ত্রী এবং সন্তান আছে সব জেনেও ওর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করত ও।

হঠাৎই একদিন মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে রীতা ছোটো ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল তাড়াহুড়ো করে। এদিকে শহরে ধর্মীয় গন্ডগোলের কারণে দোকানপাট বন্ধ করিয়ে দিল মন্ত্রীর চ্যালাচামুণ্ডারা। অগত্যা দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হল চন্দন। বাড়ির কাজে মন দিল। রীতা কিছুই গুছিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি, চন্দন সেগুলো সবই গুছিয়ে তুলে রাখল।

এর দুদিন পর তনু নিয়মমতো পড়াতে গিয়ে দেখল চন্দনের দোকান বন্ধ রয়েছে। এতদিনে কখনও ও দোকান বন্ধ হতে দেখেনি, তাই অবাক হল। বাড়িতে ঢুকে চন্দনের কাছ থেকে রীতা আর দোকানের সব খবর শুনল তনু। ছোটো ভাই না থাকাতে চন্দনের বড়ো ছেলে কিছুতেই পড়তে রাজি হচ্ছিল না, তনু ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পড়তে বসাল। এরই মধ্যে চন্দন তনুকে চা আর চানাচুর দিতে এল। চন্দনকে বাড়ির পোশাকে প্রথম দেখল তনু।

‘রীতাদি কবে ফিরবে?’ কাপ হাতে নিতে গিয়ে চন্দনের আঙুলের সঙ্গে তনুর আঙুল ছুঁয়ে গেল। তনুর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

‘কাল বা পরশু ফিরবে রীতা , নিজের চা-টা নিয়ে চন্দন ওখানেই একটা চেয়ার টেনে বসল।

‘চা-টা খুব ভালো হয়েছে , তনু হেসে বলল।

‘বাঃ বাঃ, আপনার মতো ম্যাডামের আমার বানানো চা যে ভালো লেগেছে সেটা জেনে ভালো লাগছে , চন্দন হাসল।

তনুর ছাত্র যেই দেখল বাবা আর দিদি গল্পে ব্যস্ত, ও ওমনি চেয়ার ছেড়ে বাইরে খেলতে বেরিয়ে গেল।

‘আরে রাতুল… কোথায় পালাচ্ছিস…’। তনু কাপ রেখে তাড়াহুড়ো করে রাতুলের পিছনে দৌড়োতে গিয়ে চেয়ারের পায়ে পা জড়িয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হতেই চন্দন চট্ করে ওকে ধরে ফেলল। ‘কী হল ম্যাডাম, শেষে আমার বাড়িতে হাত-পা ভেঙে আমাকে কেস দেওয়ার চেষ্টায় আছেন নাকি?’ বলে তনুকে খাটে বসাল চন্দন।

তনু কিছুতেই চন্দনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ওর বুকের ভিতর যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছিল। চন্দনের শরীরের এতটা কাছাকাছি এসে ওর সারা শরীরে শিহরণ উঠছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল তনু, ও যদি চন্দনের চোখে চোখ রাখে তাহলে চন্দনকে নিজের করে পাওয়ার আকুতি স্পষ্টই ওর চোখে ফুটে উঠবে। বুড়ো আঙুলে সামান্য চোট পেয়েছিল তাই সামনে থেকে চোখ সরিয়ে আঙুলের উপর সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করল তনু।

‘আঙুলটা ব্যথা করছে?’ চন্দন জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ।’

‘দাও আমি ঠিক করে দিচ্ছি , চন্দন তনুর বুড়ো আঙুলটা ধরে এক ঝকটায় জোরে টানল। তনুর গলা দিয়ে সামান্য চিৎকার বার হল, ব্যস ব্যথা একদম গায়েব।

‘নাও, ঠিক হয়ে গেছে। তোমার মুখের থেকে পা আরও বেশি সুন্দর, তুলোর মতো নরম এবং ফরসা ’, তনুর পায়ে হাত রেখে চন্দন সরাসরি তাকাল তনুর চোখে।

তনুর শরীরে নতুন করে শিহরণ খেলে গেল। নিজের অস্বস্তি ঢাকতে তনুর মনে হল কিছু বলা দরকার, ‘আপনাকেও তো সকলে হ্যান্ডসাম বলে। বাড়ির পোশাকেও আপনি সুপুরুষ আর জানেনই তো লোমশ চেহারার পুরুষ সব মেয়েদেরই পছন্দ।’

কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই তনু বুঝতে পারে ভুল বলে ফেলেছে। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ও, ‘ও… ও… ভেরি সরি… আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি।’

চন্দনের কাছে তনুর মুখের এই প্রশংসাটুকু প্রেম নিবেদন বলেই মনে হল। হঠাৎ-ই চন্দন নীচু হয়ে তনুর ঠোঁট স্পর্শ করল। চন্দনের তপ্ত নিঃশ্বাসের উত্তাপে তনুর প্রতিরোধ বাষ্প হয়ে উবে গেল। দু’জনেই বুঝতে পারছিল যেটা ঘটতে চলেছে সেটা অন্যায় কিন্তু এটাকে আটকাবার মানসিকতা দুজনের মধ্যে কারওরই ছিল না।

শারীরিক ক্ষুদা তৃপ্ত হতেই সম্বিৎ ফেরে দুজনেরই। নিজের আচরণে তনু লজ্জায় চন্দনের সঙ্গে চোখ মেলাতেও ইতস্তত করে। কোনও রকমে অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক করে নিয়ে বেরিয়ে আসে তনু। রাতুলকে কোথাও দেখতে পায় না। হস্টেলে ফিরে এসে নিজের প্রতি ঘৃণা এবং সঙ্গে ভয় তনুকে ঘিরে ফেলে। নিজেকে শতবার দোষারোপ করতে থাকে যে পড়াশোনা শিখে এরকম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কীভাবে দিতে পারল ও।

বাচ্চাদের পড়ানো ছেড়ে দিল তনু। রীতা ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলে তনু বলে দিল ওর শরীর ভালো নয় তাই পড়ানোর ধকল নিতে পারছে না।

চন্দনের মনেও শান্তি ছিল না। তনুর ক্ষতি করার জন্য নিজেকেই অপরাধী ভেবে নিল। কীভাবে মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবে তার কোনও উপায় বার করতে পারল না চন্দন। তার উপর তনুর বাড়িতে আসা ছেড়ে দেওয়াতে এবং দোকানেও আসা যাওয়া বন্ধ করে দেওয়াতে তনুর সঙ্গে দেখাই হতো না ওর।

তনুর জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগল। যে ভুল একবার করে ফেলেছে তার পরিণাম যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সেটা ভেবেই সারারাত ঘুমোতে পারত না তনু। মা-বাবার বিশ্বাস ভাঙার গ্লানি কুরে কুরে খেতে লাগল তনুকে। একবার যদি সমাজে বদনাম হয়ে যায় তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর উপায়ই বা কী আছে, সেই চিন্তাতেই তনুর শরীর দিন দিন ভেঙে পড়তে লাগল।

‘মামি, প্লিজ, মা-বাবা যেন এই কথা জানতে না পারে , কাঁদতে কাঁদতে তনু সুচিত্রার দুহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

‘বিশ্বাস রাখ তনু, কেউ জানবে না। শুধু একটা কথা বল কোনওরকম শারীরিক অসুবিধা কিছু মনে হচ্ছে কি?’ সুচিত্রার গলার স্বরে আশঙ্কা প্রকাশ পায়।

‘না।’

‘এখন এই পুরো ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা কর। খুব বড়ো ভুল করেছিস সন্দেহ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতেও যদি নিজেকে ঠিক না করিস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। চট্ করে দু-তিনটে জামাকাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নে। আমার সঙ্গে আমার বাড়ি যাবি এখন।’

‘কিন্তু…’

‘কোনও কিন্তু নয়। আমি ওয়ার্ডেনের কাছ থেকে তোর এক সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে আসছি। কাল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব কারণ আজ অনেক রাত হয়ে গেছে , বলে সুচিত্রা ওয়ার্ডেনের ঘরের দিকে চলে গেল।

রাস্তায় যেতে যেতে সুচিত্রা বলল, ‘তনু এই পুরো ঘটনাটা কারও কাছে বলবি না এমনকী বন্ধুবান্ধবকে-ও না। আমি জানি, তোরা সব কথা শেয়ার করিস কিন্তু এটা কাউকে বলবি না।’

বাড়ি ঢুকতেই তনুকে দেখে রুমন খুশিতে লাফিয়ে উঠল। অরুণাভ তনুর চেহারা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে চেহারা এত খারাপ হয়েছে কেন? হস্টেলে কিছু খাস না?’

তনুর সঙ্গে সুচিত্রার চোখাচোখি হল, তনু উত্তর দিল, ‘না, না খাবার ঠিক মতোই খাই। পড়াশোনোর চাপ একটু বেশি।’

সুচিত্রাও তনুর কথায় সায় দিল, ‘তাই জন্যই তো ওকে এক সপ্তাহের ছুটি করিয়ে নিয়ে এসেছি। শরীরটা একটু সারিয়ে তারপর হস্টেলে পাঠাব।’

‘ভালোই করেছ , বলে অরুণাভ অন্য ঘরে চলে গেল।

স্বামীকে মিথ্যা বলতে সুচিত্রার খারাপই লাগল কিন্তু তনুর সম্মান আর মর্যাদা বাঁচাতে হলে হাজারো মিথ্যা বলার জন্য সুচিত্রা মনকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছে সুতরাং বাড়ি থেকে শুরু করতে অসুবিধা হল না ওর।

ফোন করে দিদিকে জানিয়ে দিল সুচিত্রা, তনুর শরীর পড়াশোনার চাপে সামান্য খারাপ হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি।

রাতের খাওয়া শেষ হতেই তনুকে রুমনের ঘরে শুইয়ে দিল সুচিত্রা আর ছেলেকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নিল। সারা রাত সুচিত্রা চোখের পাতা এক করতে পারল না। তনুর কথাই বারবার মনে হতে লাগল। আজকাল ইয়ং জেনারেশনের এতটা চেঞ্জ সুচিত্রা কিছুতেই সমর্থন করতে পারল না। কোনও বুদ্ধি-বিবেচনা করে এই প্রজন্ম কাজ করে না যেটা সত্যিই বিরক্তিকর।

সুচিত্রা খুব ভালো করেই জানে, চন্দনের সঙ্গে সঙ্গে তনুও এই ঘটনার জন্য সমান দোষী। তবুও এই ব্যাপারটা দিদিরই জানার কথা ছিল কিন্তু সুচিত্রা জানে, মায়েদেরও একটা বিশাল দোষ যে, তারা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আলোচনা করে না, অথচ সমস্যা কিছু একটা হলে শাসন করতে ছাড়ে না। ফলে সন্তানও মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না।

সকালবেলায় রুমন বায়না ধরল স্কুল যাবে না, তনুদিদির সঙ্গে সারাদিন কাটাবে। সুচিত্রা অনেক বুঝিয়ে ওকে স্কুল পাঠাল। সবাই কাজে চলে গেল। সুচিত্রা তনুকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তোকে নিয়ে একটু বেরোব, ডাক্তারের কাছে যাব।’

‘ডাক্তার… কেন মামি…?’ মনে হল তনু ওখানেই বসে পড়বে।

‘আমি তোকে কালকেই বলেছিলাম, তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব। তোর জীবনটা নিয়ে কোনওরম রিস্ক আমি নিতে চাই না , সুচিত্রা তনুর মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করল।

ডাক্তার তনুর সবরকম পরীক্ষা করলেন। উনি সুচিত্রাকে আলাদা ডেকে জানালেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। অনেক কারণেই ইয়ং বয়সে পিরিয়ডের সমস্যা হয়ে থাকে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, কয়েকদিন খেলেই আবার এনার্জি ফিরে পাবে। ও সামান্য দুর্বল সুতরাং ওর খাওয়া-দাওয়াটার একটু খেয়াল রাখা দরকার। এমনি আর কোনও ওর প্রবলেম নেই।’

আনন্দে সুচিত্রা ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। মন থেকে মেঘ সরে যেতেই সুচিত্রা আবার রোদ ঝলমলে দিনের অগ্রিম আভাস টের পেল।

রাস্তায় বেরিয়ে তনুর জন্য শপিং করল সুচিত্রা। রেস্তোরাঁয় বসে দুজনে তনুর পছন্দের খাবার আর আইসক্রিম খেয়ে বেরিয়ে এল। দুঃস্বপ্নের দিনগুলো থেকে তনুকে বাইরে বার করে আনার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখল না সুচিত্রা।

বাড়ি ফিরতেই তনু সুচিত্রার গলা জড়িয়ে ধরল, ‘থ্যাংক্স মামি। কালকে তোমার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তাতে আমার মন অনেক হালকা লাগছে। সত্যিই তুমি যদি আমাকে জোর না করতে আমি হয়তো তোমাকে খুলে বলতেই পারতাম না ঘটনাটা। মনের মধ্যেই পুরোটা থেকে যেত এবং কিছু হয়তো একটা করেও বসতাম। তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হ্যান্ডল করেছ আমি সত্যিই টেনশন ফ্রি হয়ে গেছি।

শুধু একটাই কথা খালি মনে হচ্ছে, ‘আমি কী করে এমন অবিবেচকের মতো কাজ করলাম? ঘটনাটায় আমার নিজের সবথেকে বেশি দোষ এটা স্বীকার না করা ছাড়া উপায় নেই , বলতে বলতে তনুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

‘অবশ্যই তুই এমন একটা ভুল করেছিস যার কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু এই যে তুই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস, প্রায়শ্চিত্ত করেছিস এটাই সবথেকে বড়ো কথা। সম্পর্ক সবসময় প্রথম মন থেকে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হোক অথবা প্রেমিকের সম্পর্কই হোক, প্রথম সম্পর্ক মনের গভীর থেকেই শুরু হয়। শরীর দিয়ে নয়।

চন্দনের সঙ্গে তোর মনের কোনও সম্পর্কই যেখানে ছিল না সেখানে ওকে নিয়ে এত চিন্তা করার দরকারটা কী? বরং ওকে মন থেকে সরিয়ে এবারে পড়াশোনায় মন দে আর আমার বিশ্বাস আর তুই এরকম ভুল করবি না’, বলে সুচিত্রা আলতো করে তনুর গালে সস্নেহে আদর করে। তনু যেন খানিকটা বিহ্বল হয়েই জড়িয়ে ধরে সুচিত্রাকে।

সেই মুহূর্তেই তনুর মোবাইল বেজে ওঠে, ‘মা আমি এখন একদম ভালো হয়ে গেছি। মামি আমার অসুখ সম্পূর্ণ সারিয়ে দিয়েছে…’ বলতে বলতে তনুর হাসির শব্দ সারা ঘরে প্রতিধবনিত হতে থাকে।

 

 

রোজদিনের রাস্তা

মানস বোস, কেউ বলে মানসা, কেউ বা আরও ভালোবেসে মা মনসা। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির রোগা চেহারার লোকটি জেলা অফিসের একটি দফতরের বড়োবাবু।

বছর ছাপ্পান্নর ভদ্রলোকটি ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস বাদ দিলে, বাকি সময় হাফশার্ট আর চটি পায়ে অফিসে আসেন। বাকি মাসে পাম শু, ফুল শার্ট আর হাফ সোয়েটার। মাথার বাঁ দিকে সিঁথে, চুল এক্কেবারে পেতে ছড়ানো।

আটটা একত্রিশের লোকাল ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরাতে উঠলেই, সবাই যে-যার খুশিমতো ডেকে ঠাট্টা ইযার্কি আরম্ভ করে। মানস বোস রাগেন না, বা রাগলেও প্রকাশ করেন না। বেশির ভাগ দিনেই ট্রেনে বসার জায়গাটা রাখা থাকে, না পেলে দাঁড়িয়ে চলে যান। কারও-র সাথে কোনও রকম বিরোধে সচরাচর যান না। কম কথা বলেন, হাসেন কম, আসা-যাওয়ার মাঝে এই টুকটাক যা কথাবার্তা এই নিয়ে চলে মানস বোসের নিত্যযাত্রা।

শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিন বাদে মানসবাবুর প্রতিদিনের কাজকর্মও এক্কেবারে নিয়মমাফিক। ঘুম থেকে ওঠেন সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে। নিজের হাতের তৈরি এক কাপ চা পান করে একটু হেঁটে যোগব্যায়াম করে বাড়ি ফেরা। তারপর ভাতের জল চাপিয়ে স্নান সেরে রান্নার কাজ আরম্ভ করেন।

মানসবাবু সকাল সাড়ে সাতটায় ভাত খেয়ে পৌনে আটটার বাস ধরেন। বাস থেকে নেমে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে বা কোনও দিন অফিসের গাড়িতে অফিস পৌঁছন।

সকালে বউয়ের সাথে কথা বলা মানে আলু পটলের নাম গোত্র অথবা একমাত্র মেয়ে কলেজ বা টিউশন বা হাত খরচের টাকা নেওয়া সম্পর্কিত। কোনও দিন বউয়ের মনটা বাগান বাগান থাকলে বা সকালে ভালো ভাবে পেট পরিষ্কার হয়ে গেলে, আরও দু-একটা কথা বলেন তার মধ্যে বেশির ভাগটাই নিজের বাপের বাড়ি নিয়ে।

মানসবাবুর মেয়ে কলেজে পড়ে, গড়ন রোগা হলেও মায়ের মতো গায়ে রং-টা ফরসা। এখনকার চালচলন সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন। নিয়মিত বিউটি পার্লার যায়, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিনেমা-টিনেমা তো আছেই। এখনও পর্যন্ত কোনও বিশেষ বন্ধু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে জানা না গেলেও, মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার গায়ে হুল ফোটাতে বেশ পটু হয়ে গেছে। মায়ের আশীর্বাদে এই দক্ষতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাধ্যমিক পাশ করেই মোবাইলের জন্য তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মানসবাবুকে হারিয়ে নিজেকে মায়ের যোগ্য কন্যা হিসাবে প্রমাণও করে দিয়েছে।

মানসবাবুও কোনও আঠারো ইঞ্চির কপাল নিয়ে জন্মাননি। তাঁর বউও পৃথিবীর সেই একমাত্র ব্যতিক্রমী ভদ্রমহিলা হবেন, যিনি সব কিছু ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে একমাত্র নিজের স্বামীর স্বার্থটাই দেখবেন। অন্তত মানসবাবু কোনও দিন স্বপ্নেও একথা ভাবেননি! বউএর পাশে দাঁড়ালে তাঁকে আরও নিরীহ অসহায় লাগে।

সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে মানসবাবু যখন বাড়ি ফেরেন, বউ তখন টিভির সাথে মধুর সহবাসে ব্যস্ত থাকেন। পেমেন্টের দিন বা অন্য কিছু বিশেষ দরকারের দিনে এক কাপ চায়ের সাথে কিছু খাবার মানসবাবুর মুখের সামনে পৌঁছে দেন। আর না হলে বলেন, চা করা আছে, গরম করে নাও, অথবা গিলে নাও।

এই বিশ বছরের বৈবাহিক জাঁতাযন্ত্রে বউএর রাগ, মন খারাপের রূপ, রং, গন্ধ, স্পর্শগুলো খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছেন। যেমন যেদিন নিজে দরজা খুলে হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা টেনে নেন, তার মানে আবহাওয়াটা বাগান বাগান। তা না হলে মেঘ জমেছে। সেদিন কোনও কথা না বলে চুপচাপ জামাকাপড় ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে নিজের চা গরম করে নেন। মুড়ির কৌটো থেকে মুড়ি বের করে চায়ে চুমুকের সাথে মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, রুটি হয়ে গেছে? উত্তরটাও সেদিনের আবহাওয়ার মতোই আসে।

সন্ধের থেকে রাতটা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। একটা শীতল জড়বস্তুর পাশে শুয়ে নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অন্তত মানসবাবুর নিজের সেই রকমই মনে হয়। তবুও কোনও কোনও দিন শরীর হালুম হালুম করে ওঠে। পাশে শুয়ে থাকা শীতল যন্ত্রটাকে নিজের দিকে টেনে নিতে গেলে স্পিকার বেজে ওঠে, সেই কয়েকটা বুলি, লজ্জা লাগে না, মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। বা মরণ! কখনও আদিখ্যেতা!

মানসবাবুর জেগে ওঠা রঙে আলকাতরা মিশে যায়। জেগে যাওয়া শরীর নুয়ে পড়ে, জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কোনও কোনও দিন শরীর বাগ মানে না। জেগে উঠে, বিছানা নড়ে। পাশের শীতল যন্ত্রের স্পিকারে শোনা যায, বাথরুমে যাও। তার পরেই ফুলস্টপ।

মানসবাবুর মেয়ে খুব ব্যস্ত। সকালে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ঘুম থেকে ওঠে। ফেরার সময় বেশির ভাগ দিনেই ব্যস্ত থাকে নিজের কাজে। কী কাজ, মানসবাবু জিজ্ঞেস করেন না। করলেও উত্তর আসে, তোমাকে বলে কী করব? কিছু বুঝবে কি? সেই তো সেকেলেই রয়ে গেলে। মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুল ফোটায়। মানসবাবুর ব্যথা লাগলেও কিছু বলা যায় না। বউ মেয়ে সাঁড়াশি আক্রমণে বেচারা বোসবাবুর যা অবস্থা, তা বর্ণনা করতে গেলে দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।

মানসবাবুর অফিসটাও খুব অদ্ভুত। সকাল থেকে দুপুর হয়ে বিকাল শুধু কিছু ফাইল আর লেখা। না হয় পেপার পড়া। ডিপার্টমেন্টের না আছে কোনও ঘুসের ব্যবস্থা, না আছে কোনও মহিলা কর্মচারী। আগে দুএকজন যা ছিল ফাঁক-তোল, ভাঁজ-খাঁজ দেখা যেত। কিন্তু কয়েক বছর আগে অন্য জায়গায় বদলির পরে শুধু ফাঁকা মরুভূমি।

তবে খুব ভালো লাগার জায়গা হল ট্রেনের কামরা। যদিও তিনি খুব একটা সক্রিয় যাত্রী নন। এমনকী তাঁকে নিয়ে ইয়ার্কিতে ফাজলামিও বেশি হয়। তাও অন্য কেউ কিছু বললে শোনেন, অন্যের ইয়ার্কিতে মন পুলকিত হয়ে ওঠে। তাঁদের নজনের নিত্যযাত্রীর দলে কোনও মহিলা সঙ্গী নেই। বোসবাবু ছাড়া বাকি সবাই কম-বেশি নেশা করেন, খিস্তিখাস্তাও চলে। মহিলা নিত্যযাত্রী থাকলে অসুবিধা হয়।

এমনি যাত্রীদের সেরকম পাত্তা দেওয়া না হলেও, মহিলা যাত্রীদের আড় চোখে দেখে নেওয়া হয়। বোসবাবুও এই রস নেওয়া থেকে বাদ যান না। বিশুদা এলে খুব ভালো লাগে, তিনদিন আসেন বিশুদা। ওষুধ সাপ্লাই করেন, জামার বাঁ দিকের পকেট থেকে প্যাড বের করে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, কপাতা? সঙ্গে একটা দামি মোবাইল থাকে। নিজের কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মোবাইলটা বেশির ভাগ দিনেই বোসবাবুকে দিয়ে দিলে, তিনি ওটাকে আড়ালে নিয়ে চলে যান। একমনে দেখেন, আর শরীরের ঘুম ভাঙান। অনেকেই এই ব্যাপারটা দেখে টিপ্পনি কাটে, তবে তাতে বোসবাবুর কোনও কিছু এসে যায় না, হেসে উড়িয়ে দেন।

নজনের নিত্যযাত্রীদের প্রায় সবাই বযস্কদের জায়গা ছেড়ে বসতে দেন। আর জায়গা ছাড়েন ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যাত্রীদের। শুধু কম বয়সী মহিলা, কলেজ পড়ুয়াদের বসতে জায়গা ছাড়েন না। তবে সেদিন এর ব্যতিক্রম ঘটল এবং ঘটালেন সেই মানস বোস।

লোকাল ট্রেনে সেদিন অস্বাভাবিক রকমের ভিড়। দেওঘরের কোনও এক আশ্রমের উৎসবের জন্য ট্রেনের সব কামরা তাদের দখলে। ট্রেনে ওঠার আগে এই খবরটা পেলেও কোনও এক্সপ্রেস ট্রেন না থাকার কারণে সবাইকে লোকালেই উঠতে হয়। উঠতেই পিছনের থেকে কেউ একজন বলে উঠল, কাকা, আজ মাছিও গলবে না। বোসবাবু তাকে কোনও উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে এগিয়ে যান।

অন্যদিনে যে-সিটে তিনজন বসে থাকে আজ সেখানেই পাঁচজন। বোসবাবু কোনও রকমে একটা জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেনাজানা কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে লাগলেন। মাথা নাড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানালেন। কেউ আবার তাঁকে দেখে বলে উঠল, বোসদা আমাদের এদিকে আসুন, গল্প করা যাবে।

না ভাই, আজ যে এখানে দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছি এটাই অনেক।

কেউ আবার বলে উঠল, কি রে মানসা, কোনও এক্সপ্রেস পেলি না? ভিড়ে মরতে এলি, না মারাতে?

বোসবাবু এবারেও হেসে উত্তর দেন, উৎসব চলছে তো তাই এত ভিড়।

নিত্যযাত্রীদের অনেকেই সেদিন পেপার বা পলিথিন পেতে দরজার সামনে বসেছিল। বোসবাবুর একবার এভাবে বসতে গিয়ে প্যান্ট ফেটে গেছিল! সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। সারাটা দিন ভগবানকে গালাগালের সাথে, জামা দিয়ে ফাটা জায়গা ঢাকতে হয়েছিল। তবে এইদিন মানসবাবুর ভাগ্যটা হয়তো একটু প্রসন্ন ছিল। পরের স্টেশনে একটা জায়গা পেয়ে গেলেন। গোটা সিট না হলেও এই বাজারে সেই সিটের যে কী মহিমা, তা আর বোঝাতে হবে না। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে শুনলেন, বোসদা আজ একটা লটারি কেটে নিন।

বোসবাবু কিছু না বলে হালকা হাসলেন। বুঝতে পারলেন নজর লেগে গেল, হলও তাই। এক স্টপেজ যেতে না যেতেই একটা মেয়ের গলা কানে এল, কাকু কাইন্ডলি আমাকে একটু বসতে দেবেন, পায়ে খুব ব্যথা করছে, আজ আমার পরীক্ষা আছে। বোসবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। তাঁর মেয়ের মতোই বয়স, একটু বড়োও হতে পারে। জিন্স-এর প্যান্ট আর কুর্তি পরে আছে। গায়ে রং-টা চাপা হলেও মুখটা বেশ ভালো। কোনও ছেলে হলে এতক্ষণ জবাব না দিয়ে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন। সেই জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বোসো, তবে জায়গাটা খুব কম। মেয়েটি বোসবাবুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে, থ্যাংক ইউ বলে বসেই হাতে থাকা একটা খাতাতে চোখ ডুবিয়ে দিল।

বোসবাবু আবার আগের জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আড়চোখে মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন। দুএকজন চেনা নিত্যযাত্রী দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি চোখের ইশারাতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটি বলে উঠল, কাকু তোমার ব্যাগটা দাও, আমি ধরছি। বোসবাবু, না, ঠিক আছে বললেও মেয়েটি মানসবাবুর হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় কেড়ে নিজের কোলে নিয়ে তার ওপর খাতা রেখে পড়তে আরম্ভ করল।

হাতের ভার কমলেও বোসবাবু আর মেয়েটির কুর্তির কোনও ভাঁজ দেখতে পেলেন না। তবে সারাদিন মনটা বেশ বাগান বাগান হয়ে থাকল। অলিগলি থেকে ট্রেনের মেয়েটার ভেসে ওঠা মুখটা শরীরটাকেও নাড়িয়ে দিচ্ছিল। কাজ করবার সময় গুনগুন গান আঙুলগুলোর মধ্যে একটা অনুঘটকের কাজ করছিল। এমনকী বাড়ি গিয়ে বউয়ের মুখ ঝামটা শুনেও সেরকম কোনও প্রতিক্রিযা হয়নি।

বাড়ি ফিরে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে অথবা হাওয়ার সাথে মিশিয়ে নিজের গাওয়া দু-এক কলি গান গাওয়ার মধ্যেও মেয়েটি চলে আসে। রাতে শুয়ে ঘুম আসেনি। বন্ধ চোখের সামনে সেই মুখ মনে শরীরে এক অদ্ভুত তৃপ্তি এনে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য বউয়ের ভয়ে বাথরুম চলে যেতে হল।

তার পরের দিনও সেই একই রকমের ভিড় ঠেলে কিছুটা ট্রেনের ভিতরে গিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই, আগের দিনের মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখে একটু রাগই হল। নিশ্চয়ই আবার কারওর পি… মেরে জায়গা করে নিয়েছে। কিছু না বলে একটু ইতস্তত করে আরও ভেতরের দিকে যাওয়ার পরেই পিছনের দিক থেকে শুনলেন, ও কাকু, আমি এখানে, দেখতে পাওনি?

বোসবাবু আর না এগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, না, মানে দেখতে পাইনি।

বুঝেছি, আর বলতে হবে না। না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলে।

মানসবাবুর মাথাতে আর কোনও জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা এল না। আমতা আমতা করে বললেন, তুমি পড়ছিলে তো তাই।

কই আজ তো আমি পড়িনি।

পরীক্ষা শেষ?

কাল একটা ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা ছিল।

তারপরে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাকু, আজ তুমি বোসো।

না না ঠিক আছে। আমরা তো প্রতিদিন জায়গা পাই না। দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে।

পাশে বসে থাকা আর একজন যাত্রী বললেন, আপনি বসুন, আমি পরেরটাতেই নেমে যাব।

মেয়েটির পাশে কুঁকড়ে বসতেই মেয়েটি বলে উঠল, ও কাকু, তুমি ওরকম জড়ভূতের মতো বসে আছো কেন? বি কমফর্টেবল।

না না, আমি ঠিক আছি।

দূর কিছু ঠিক নেই।

মানসবাবু মেয়েটির দিকে আরও একটু সরে বসলেন।

আজও আগের দিনের মতোই জিন্স আর টপ পরেই এসেছে। ডান কাঁধের সাথে বোসবাবুর বাঁ কাঁধ লেগে আছে, কনুইটা বুকের কাছাকাছি।

পিছন থেকে নিত্যযাত্রী ভোম্বল বলে উঠল, বোসদা লটারি কিনেছিলেন? আজ মিলিয়ে নেবেন, ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গেছেন। শুধু বউদিকে একটু সাইজে আনতে হবে।

ওষুধের বিশুদা বলে উঠল, নতুন ডাউনলোড করেছি দেখবেন নাকি? দেব ওখানে। বোসবাবু কিছু সময় মেয়েটির কাছে বসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, তুমি এখানে বোসো, আমি একটু বন্ধুদের কাছে যাই, ওরা আবার কী ভাববে।

ওরা তোমার লেগপুল করছে?

না না। আসলে প্রতিদিন একসাথে যাই তো, তাই একটু মজা করছে।

কথাগুলো শেষ করেই জায়গাটা ছেড়ে পিছনের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু নিত্যযাত্রীদের কাছে রীতিমতো টোন টিটকিরি সহ্য করতে হল। সেটা অবশ্য প্রতিদিনই হয়। তবে সেদিন এতটাই মাত্রা ছাড়াল যে, বোসবাবু তাদের থেকে পাশে সরে দরজার সামনে একাই দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাওয়া আসছিল, মনটাও ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন যেন অস্থির। সব সময় ইয়ার্কিও ভালো লাগে না।

কাকু বসবে না তুমি? কথাটা শুনে ঘাড়টা ঘোরাতেই দেখলেন আবার সেই মেয়েটি, এক্কেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বোসবাবু একটু কঠিন ভাবে বললেন, কী ব্যাপার তুমি উঠে এলে?

তুমি বসবে না?

তুমি বোসো।

মেয়েটি আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে নিজের জায়গাতে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর মানসবাবুর মনটা হু হু করে উঠল। মেয়েটিকে এরকম ভাবে না বললেই হতো। বেচারি শুধুমাত্র বসতে বলবার জন্য এসেছিল।

মেয়েটির কাছে গিয়ে ওকে সরিয়ে নিজের বসবার ব্যবস্থা করলেন। কিছু সময় পরে মেয়েটি, বোসবাবু কোথায় কাজ করতে যান থেকে আরম্ভ করে, বাড়িতে কে কে আছে, সব জেনে নিল।

মানসবাবুও জানলেন ওর নাম অনুশ্রী। এবার নিত্যযাত্রীরা কেউ কিছু বললেও, বোসবাবু কাউকে কোনও পাত্তা দিলেন না। সারাটা রাস্তা অনুশ্রীর সাথে গল্প করে যেতে লাগলেন।

ট্রেন থেকে নেমেই অনুশ্রী বলে, কাকু তোমার অফিস তো কাছেই, পরের ট্রেনে তো আসতে পারো। দশটার মধ্যে ঢুকে যাবে।

ট্রেনের কামরাতে থাকবার সময় অনুশ্রীর কথাটা সেরকম ভাবে না শুনলেও, অফিসের রাস্তায় হাঁটবার সময় কথাগুলো কানের কাছে গুন গুন করতে আরম্ভ করল। সত্যিই তো পরের ট্রেনটাতেও আসা যায়! বাড়িতে আরও আধ ঘন্টা বেশি সময় পাওয়া যাবে। আর একটু বেশি সময় ঘুমানো যাবে। ট্রেনেও শুধুমাত্র অনুশ্রী। তাছাড়া অফিসে তাড়াতাড়ি এসেই বা কী করবেন, সেই তো বসে বসে পেপার পড়া। না হয়, এর ওর সাথে গল্প করা। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।

অনুশ্রীর মোবাইলে ফোন করতেই সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে উত্তর আসে,

বলো কাকু…

ক্লাসে?

না, এই তো নামলাম।

শোনো কাল থেকে পরের ট্রেনেই আসব।

বেশ কাকু তাই হবে। পিছনের থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠবে, আমি জায়গা রাখব।

পরের দিন থেকেই মানসবাবু সব কিছু আধঘন্টা পরে করতে আরম্ভ করলেন। সেই ঘুম থেকে ওঠা থেকে আরম্ভ করে বাস ধরা পর্যন্ত সব কিছু আধ ঘন্টা পিছিয়ে গেল। বাকি সব কিছু একই ভাবে চললেও আরেকটা বড়ো পরিবর্তন বউয়ের চোখে পড়ল। অফিসে যাওয়ার সময় এই প্রথম জামা ইন করে পরতে আরম্ভ করলেন, সঙ্গে জুতো। এমনকী মেয়ের বডি স্প্রে-র গন্ধও জামার ঘামের গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। বউ সব কিছু দেখেও কিছু বললেন না। কিন্তু মাস দেড় পরে স্বামীর সাজ বেড়ে উঠতে দেখে, একদিন মানসবাবু বেরিয়ে গেলে, মেয়ের সাথে আলোচনা করলেন, হ্যাঁ রে তোর বাবার হল কী? এত চকচকে পোশাক, উড়ো উড়ো ভাব, বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়ল নাকি?

মেয়ে সব কিছু দেখে শুনে, মাকে চিন্তা করতে বারণ করলেও নিজের কাছে অস্বস্তি গোপন থাকল না। ট্রেনে কিন্তু বোসবাবুর যাতাযাতের মজা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। পরের ট্রেনটা তুলনামূলক ফাঁকা আসে। অনুশ্রীও প্রতিদিন বোসবাবুর জন্য জায়গা রেখে দেয়। সারাটা রাস্তা দুজনে গল্প করতে করতে চলে যান। শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিনে মন খারাপ লাগে। অনুশ্রীকে ফোন করেন।

বিশুদা কথা প্রসঙ্গে মোবাইলে আরও নতুন কিছু আনার খবর দেয়। মানসবাবু উত্তরে শুধু হাসেন। কিন্তু ট্রেন বা কার সঙ্গে কোন কামরাতে উঠলেন, সে সম্পর্কে কোনও কথাই বলেন না। রাতে ফিরে একা বসে প্রায়ই গুনগুন করে গান করেন। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি। বউ ঘুমিয়ে থাকা বোসবাবুকে দেখে বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু বুঝতে না পেরে পরের দিন বোসবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরে, আবার মেয়ের সাথে আলোচনা করতে বসেন।

 

সেদিন অফিস থেকে ফিরে মানসবাবু অবাক হয়ে যান। বেল বাজাতেই বউ তাড়াতাড়ি এসে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে চেযার টেনে বসতে দেন। হাত মুখ ধোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছে চা তৈরি করে দেন। মেয়ে ডিম পাঁউরুটি তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মানসবাবুর খাওয়ার আগে অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকেন।

বিবাহবার্ষিকী, দু-একটা পূজাপার্বণ আর মেয়ের জন্মদিন ছাড়া, অফিস থেকে ফিরে এরকম জলখাবার আর কোনও দিন হয় কিনা মনে করতে পারলেন না। তাই অত খাবার দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি কোনও অনুষ্ঠান আছে? কোনও পুজো-টুজো!

না না, অনুষ্ঠান কেন থাকবে? রোজ ওই এক মুড়ি। তাই মাম্পি বলল, ডিম পাঁউরুটি করবে। এই টিফিনটা শুধুমাত্র একদিনের জন্যেই নয়। এরপর অফিস থেকে ফিরলেই বিভিন্ন রকমের টিফিন নিয়ে মা, মেয়ে হাজির থাকত।

এখন রাতে শুয়ে বউ নিজের থেকে নিজের দিকে টেনে, বিয়ের প্রথম কয়েক বছরের সেই সব দিনের কথা আলোচনা করে। তারপর মাঝে মাঝেই জানলাতে মুখ রেখে মাম্পি ঘুমিয়ে গেছে কিনা দেখে নিয়ে নিজেদের ঘরের দরজার ছিটকিনিটা তুলে দেয়। বোসবাবুর এখন ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়। তবে অসুবিধা হয় না, হেঁটে এলেই হাতে রেডি চা পেয়ে যান।

এখন আর আনাজ কাটতে বসতে হয় না, ভাতের জলও চাপাতে হয় না। সব কাজ মা আর মেয়ে মিলেই সামলে দেয়। বোসবাবু ট্রেনে যাওয়ার সময় অনুশ্রীর সাথে সব কিছুর আলোচনা করেন, তবে পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারেন না। অনুশ্রীও কিছু বলে না।

একদিন প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজে উঠতে উঠতে পুরোনো নিত্যযাত্রীদের দলের তপন ফোন করে, কী ব্যাপার বোসদা, আমাদের ছেড়ে নতুন বান্ধবী পাতিয়েছেন শুনলাম! বউদি সব জানে তো? গা পিত্তি জ্বলে উঠল। কাছে থাকলে টেনে দুথাপ্পড় কষাতেন।

বেশ জোর গলাতেই উত্তর দিলেন, সে খবরে তোমার কী দরকার? বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।

ট্রেন আসতে মিনিট দশ দেরি হল। পিছনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠলেন। অনুশ্রী বাঁ দিকটাতে বসে। বোসবাবু বাঁ দিক দেখলেন, ডান দিক দেখলেন, কই নেই তো! সামনে উঠল নাকি? চলন্ত ট্রেনের ভিতর হেঁটে সেই কামরার সামনের দিকে এলেন। না নেই। ভালো লাগছে না। মোবাইলের কন্ট্যাক্ট-এ গিয়ে অনুশ্রীকে ডায়াল করলেন। কী আশ্চর্য! ফোন বন্ধ! তাহলে? একটা জায়গাতে বসলেন বোসবাবু, কিন্তু অনুশ্রী কই? আসেনি, নাকি সামনের দিকে উঠল? এরপর কি পুরো ট্রেনটা দেখতে হবে? শরীরে একটা অস্বস্তি আরম্ভ হল। না আর বসা যাবে না।

অফিসেও সেদিন কোনও কাজ করা তো দূর, ভালো করে বসে থাকতেই পারলেন না। একটা চাপা কষ্ট তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। বাড়িতে সেই এক অবস্থা। পরের দিন একটু আগে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগের ট্রেনে অনুশ্রীর কলেজে পৌঁছলেন। বহু কষ্ট করে ভিতরে গিয়ে ডিপার্টমেন্টও পৌঁছোলেন। কিন্তু নাম বলতে কেউই বুঝতে পারল না। একজন তো বলেই দিলেন, অনুশ্রী নামে এই ডিপার্টমেন্ট-এ কেউ নেই।

কলেজের রাস্তা ধরে অফিসের রাস্তায় আর যেতে ইচ্ছে করল না। কী রকম একটা লাগছে! তার মানে আগামীকাল থেকে সেই জীবন! সেই ট্রেন? সেই বউ মেয়ে?

কলেজের রাস্তার পাশে থাকা বেঞ্চে বসলেন। কত হাজার হাজার কমবয়সী ছেলে-মেয়ে কলেজে ঢুকছে। বোসবাবু তাদের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকলেন।

হঠাৎ দুকানে ও কাকু… ডাক শুনে একটু চমকে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে আরম্ভ করলেন। না মানুষটা ধারে কাছে নেই!

 

 

হার-জিত

রাত প্রায় বারোটা বাজে। রোজকার মতো প্রিয়া বইখাতা খুলে পড়াশোনায় ব্যস্ত। প্রিয়ার বাবা, সোমনাথ দরজায় এসে দাঁড়ালেন। ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলেন, এখনও পড়ছিস?

প্রিয়া না তাকিয়ে জবাব দিল, যা বলতে এসেছ বলে চলে যাও।

প্রিয়া জানত এত রাতে বাবা শুধু এখনও পড়ছিস, জিজ্ঞেস করতে ওর ঘরে আসেননি। অন্য কোনও কারণ আছে। কথা বলার আগে একটা ভূমিকা করা, প্রিয়ার একেবারে অপছন্দের। ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হল সে।

সোমনাথ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার ওকে ক্ষমা করে দে প্রিয়া…এমনিতেই ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

ক্ষমা, কখনও না, আমি ওকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না, অনেক কষ্টে প্রিয়া নিজের রাগ সংযত করে।

কিন্তু প্রিয়া ও তোর মা…

সোমনাথের কথাগুলো প্রিয়ার ভিতরে ঢুকে সজোরে ওকে ধাক্কা মারে, চেঁচিয়ে ওঠে সে। বাবা ওই মহিলা তোমার বউ হতে পারে কিন্তু আমার মা নয়। আর তাছাড়া মায়ের জায়গায় ওকে আমি কোনও দিনই বসাতে পারব না। কোনও শক্তিই আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিতে পারবে না।

কিন্তু প্রিয়া…

কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়া হাতের বইটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল, প্লিজ যাবে এখান থেকে? আমাকে একা ছেড়ে দাও।

মেয়ের রাগ দেখে সোমনাথ চলে গেলেন। প্রিয়া ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে লাগল। পনেরোয় পড়েছে প্রিয়া কিন্তু পরিস্থিতি ওকে বয়সের তুলনায় অনেকটাই বড়ো করে তুলেছে। রাগেতে চোখে জল চলে এল তার। হঠাৎই বাবার কথাগুলো তার মনে হল… ও আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুশিতে ভরে উঠল তার।

বাবার কথার সহজ মানেটা করে ফেলল প্রিয়া। তার মানে বাবার সঙ্গে ওই মহিলার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই কি বাবার এত মন খারাপ? বাবার থেকে মনটা সরিয়ে নিজের মনের মধ্যে ডুব দিল প্রিয়া। এতটা খুশি সে অনেকদিন বোধ করেনি।

পরের দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের ক্যান্টিনে নিয়ে গেল প্রিয়া। আজ ট্রিট আমার তরফ থেকে।

কেন রে, হঠাৎ এত খুশির কী হল? বন্ধুদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল।

ফাইনালি… ফাইনালি অ্যান্ড ফাইনালি আমার বাবার আর মণিকার ডিভোর্স হচ্ছে। মণিকা আমাদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে, উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল প্রিয়াকে।

সত্যি করেই মণিকাকে কখনও-ই প্রিয়া নিজের মায়ের আসনে বসাতে পারেনি। তাই মা বলা দূরে থাক বরাবরই নাম ধরেই ডেকে এসেছে। সোমনাথ মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাবার একটা কথাও কানে তোলেনি প্রিয়া।

চিন্তা ভঙ্গ হল রিয়ার ডাকে, এই কী ভাবছিস বল তো? আচ্ছা, তোর বাবা আর সৎমায়ের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়?

না তো!

বলতে বলতেই প্রিয়া আবার অতীতের দরজায় এসে দাঁড়াল। মনে পড়ে যখন ছোটো ছিল, মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া হতো। ওদের ঝগড়া দেখে প্রিয়া কাঁদতে থাকত। প্রিয়াকে কাঁদতে দেখে ঝগড়া ক্ষণকালের জন্য থেমে গেলেও, আবার শুরু হতো। ওদের ঝগড়ায বারবার প্রিয়ার নামটাও উঠে আসত। দুজনের একই অভিযোগ, অপরজনের জন্য নাকি প্রিয়ার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে। প্রিয়া চুপ করে থাকত কারণ মা-বাবার মধ্যে কাউকেই আলাদা করে বেছে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কখনও ঘুম ভেঙে গেলেও মৃতের মতো বিছানায় পড়ে থাকত। সে খুব ভালো ভাবে জানত, তাকে কাঁদতে দেখলে মা আর বাবা একে অপরকে দোষারোপ শুরু করবে। ক্রমশ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হতে আরম্ভ করল যে, মা-বাবা প্রিয়াকে আলাদা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

দুর্ভাগ্যের বিষয, সেখানেও প্রিয়া স্বস্তি পেত না। ওদের ঝগড়ার আওয়াজ প্রিয়ার ঘর পর্যন্ত চলে আসত। বালিশ দিয়ে কান চেপে ধরলেও লাভ হতো না। মনে মনে কামনা করত, সব যেন ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তার মনের আশা কখনও পূরণ হয়নি।

আজও ওই দিনটা প্রিয়া ভুলতে পারে না। ছয় বছর বয়স হবে তখন তার। মা তাকে একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরিয়ে খুব আদর করছিলেন। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল তাঁর চোখ-মুখ। কাঁদতে কাঁদতেই প্রিয়াকে কোলে বসিযে বললেন, প্রিয়া আমি কেস হেরে গেছি। তোমার বাবা তোমার কাস্টডি পেয়েছেন। আমাকে চলে যেতে হবে। বড়ো হও, আমি তখন যেমন করে হোক, আমার কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।

ব্যস, ওর মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিয়া বাবার সঙ্গে রয়ে গেল। প্রথম দুবছর বাবা মাসে একবার করে হলেও মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। মা, অবশ্য মাঝেমধ্যে প্রিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন আর কাঁদতেন। মায়ের কান্না প্রিয়ার কোমল মনটাকে ভেঙে চুরমার করে দিত। ফলে ইমোশনাল সাপোর্ট পেতে প্রিয়া নিজের বাবার উপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।

 

সেবার প্রিয়ার চতুর্থতম জন্মদিন পালিত হচ্ছিল। বাড়িতেই সোমনাথ সব ব্যবস্থা করেছিলেন ক্যাটেরার দিয়ে। অতিথিরা সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল। মণিকাকে প্রিয়া সেই প্রথম দ্যাখে। লক্ষ্য করে, বাবা একটু বেশিই হেসে হেসে কথা বলছেন মহিলাটির সঙ্গে। মহিলাটির সঙ্গে বাবাকে এতটা কথা বলতে দেখে, প্রথম দিনেই মণিকার প্রতি মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে যায় প্রিয়ার। অথচ মণিকার ছেলে অয়নের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার।

এর পর থেকে প্রায়দিনই মণিকা চলে আসত ওদের বাড়ি। যে সময়টা সোমনাথ মেয়ের সঙ্গে কাটাতেন, সেই সময়টার দখল নিল মণিকা। বাবাকে ওই মহিলার সঙ্গে দেখে প্রিয়ার মনের ভিতর আগুন জ্বলে উঠত। ওর খালি মনে হতো, বাবার পাশে বসার অধিকার শুধু তার আর মায়ের আছে। সেই অধিকার আর কেউ পেতে পারে না।

নানারকম ফন্দি আঁটত সে, কী করে মণিকাকে বাবার থেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু ওদের প্রেমের গভীরতা প্রিয়ার মতো ওইটুকু মেয়ে ফন্দিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত। কথাতেই আছে প্রেম অন্ধ। প্রিয়ার আজও মনে হয়, মণিকাকে বিয়ে করার সময় একবারের জন্যও বাবা তার কথা ভাবেননি।

বিয়ের পর মণিকার সঙ্গে ওর ছেলে অয়নও প্রিয়াদের বাড়িতেই থাকতে আরম্ভ করল। অয়নকে ছোটো ভাই হিসেবে স্বীকার করে নিলেও মণিকাকে সে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল না। আর না তো মা হিসেবে মেনে নিল।

প্রিয়ার মনে পড়ল বিয়ের পর মণিকা যখন প্রথমবার ওদের বাড়িতে পা রাখল, প্রিয়া ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, দুচোখে শুধু ঘৃণা নিয়ে ।মণিকা কিন্তু আদর করে ওকে কাছে টেনে নিয়েছিল। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল, প্রিয়া আমাদের জীবনটা একটা নদীর মতো। নদীর স্রোত কখনও পাথর ভেঙে নিজের রাস্তা তৈরি করে নেয় কখনও বা পাহাড় কেটে। আবার কখনও কাউকে আঘাত না করেই চুপচাপ নিজের গতিপথ বদলে নেয়। এর জন্য আমরা নদীকে দোষ দিতে পারি না। আমিও অনেকটা ওই নদীর মতোই। হঠাৎ তোমার জীবনে ঢুকে পড়েছি। আমি জানি তুমি আমাকে অপছন্দ করো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমরা এখন একটাই পরিবার। আমি চেষ্টা করব পরিবারটাকে যেন ভালো রাখতে পারি।

 

প্রিয়া, এই প্রিয়া কী অতশত ভাবছিস? রিয়ার ডাকে সংবিৎ ফিরল প্রিয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে আবার মেতে উঠল সে।

পরের চার-পাঁচদিন খুব আনন্দে কাটল প্রিয়ার। গান শোনা, আড্ডা মারা, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে দিল দিনগুলো। এই চার-পাঁচ দিনই মণিকা বা অয়ন কারওরই মুখোমুখি হতে হল না তাকে।

সপ্তাহ শেষে স্কুল ছুটি থাকায় বাড়িতে ছিল প্রিয়া। ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়েছিল  উঠে বাইরের ঘরে আসতেই দেখল অয়ন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। অয়নের কাছেই প্রিয়া জানতে পারল, মণিকা হাসপাতালে ভর্তি। জানার ইচ্ছা না থাকলেও সৌজন্য বজায় রাখতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মায়ের লাং ক্যান্সার। টার্মিনাল স্টেজ।

হোয়াট? চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়া। এখনই ধরা পড়ল আর এর মধ্যেই টার্মিনাল স্টেজ! কী করে সম্ভব?

প্রিয়ার চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। তাই দেখে অয়ন বলল, শুরুতে লাং-এই ক্যান্সার ধরা পড়েছিল কিন্তু এখন ব্রেনেও ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা শক খেল প্রিয়া। ঘটনার গতিপথ যে এরকম একটা মোড় নিতে পারে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। একটা ছোট্ট অপরাধবোধ গুঁড়ি মেরে যেন তার মনে জায়গা করে নিতে চাইছে। অয়নের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রিয়া বলল, অয়ন চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে নিজের ঘরে ফিরে এল প্রিয়া।

আজ বুঝতে পারছিল, কেন বাবা সেদিন বলেছিলেন মণিকার চলে যাওয়ার কথা। মণিকাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠল প্রিয়া। মনে পড়ল এক একদিন এমনও গেছে, মণিকা তার কাছে এসে কত অনুনয়বিনয় করেছে, ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রিয়াই পাষাণ হয়ে থেকেছে। অবশ্য তাতেও মণিকার দিক থেকে তার যত্নের কোনও কমতি কোনও দিনই হয়নি। মায়ের কর্তব্য মণিকা একনিষ্ঠ ভাবে পালন করে গেছে।

 

আজ মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে প্রিয়া বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আমি আজ তোমার সঙ্গে হাসপাতালে যাব মণিকাকে দেখতে। সন্ধেবেলায় হাসপাতালে গিয়ে মণিকার সঙ্গে দেখা হল না। মণিকাকে কাচের ঘরে রাখা হয়েছিল। সেখানে ভিজিটর যাওয়ার অনুমতি ছিল না।

মণিকাকে এভাবে কেন রাখা হয়েছে? প্রিয়া বাবাকে জিজ্ঞেস করল।

কেমো নেওয়ার পর মণিকার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায়, বুকে শুরুতেই সংক্রমণ হয়েছিল। তাই, ওকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারণ যাতে আর কোনও রকম সংক্রমণ না হয়।

কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে মণিকার শরীরের সঙ্গে লাগানো বিভিন্ন যন্ত্র ও নলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল প্রিয়া। মণিকা বাবার থেকে দূরে চলে যাবে এই স্বপ্নই দেখছিল এতদিন। কিন্তু এভাবে সেটা হোক, তা কখনওই চায়নি প্রিয়া। মণিকাকে মনে মনে সে ঘৃণা করত ঠিকই কিন্তু এতটাও ঘৃণা কখনও করেনি যে, মণিকাকে এই অবস্থায দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে।

আজ এইখানে মণিকার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রথমবার প্রিয়ার মনে হল একবার যদি সে মণিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পেত, তাহলে ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলত, মণিকা আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। প্রিয়ার চোখের জল বাঁধ মানে না।

বারবার প্রিয়ার মনে হতে থাকে, আজ এত বছর জিতে আসার পর মণিকার কাছে আজ সে সম্পূর্ণ হেরে গেছে। মণিকাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ডুবে যায় প্রিয়া। হঠাৎ করে বয়সের থেকে অনেকটাই বড়ো গেছে বলে মন হয় নিজেকে। উপলব্ধি করে, কোনও সম্পর্ক শেষ হওয়ার মূলে সবসময় যে অন্য কোনও নারীর হাত থাকে এই ধারণা ওর সম্পূর্ণ ভুল। ওর মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কটা ভাঙারই ছিল। তাহলে কেন ওর সবসময় মনে হয়েছে মণিকাই দোষী? প্রিয়ার নিজের কাছেও এর উত্তর অজানাই।

মণিকাও তো জানত সে প্রিয়ার নিজের মা নয়। তবুও সুখী পরিবার তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। সেই স্বপ্ন সত্যি করার লক্ষ্যে মণিকার দিক থেকে কোনও কমতি কোনও দিনও হয়নি। অথচ ওর সমস্ত চেষ্টা চালানোটাকে ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়েছে প্রিয়ার। আর সে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেওয়াকেই নিজের জয় বলে ধরে এসেছে প্রিয়া।

প্রতি বছরই একটু একটু করে বয়স বেড়েছে প্রিয়ার কিন্তু কেন জানি না এই সহজ সত্যটাকে দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে আর একটু সময় যদি ও হাতে পায়, তাহলে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। কিন্তু জীবন কী তাকে সেই সুযোগ দেবে? মনে মনে অস্থির হয় প্রিয়া।

এক সপ্তাহ কেমো আর রেডিয়েশন চলার জন্য মণিকাকে কাচের ঘরেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুধু প্রিয়া কেন, কারুরই ওর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল না।

এদিকে মণিকার অবস্থা শুধরোনোর বদলে আরও খারাপ হওয়া শুরু হল। ট্রিটমেন্ট কোনও কাজই করছিল না। রেডিয়েশনের জন্য সারা শরীরে জ্বলুনি অনুভব করছিল মণিকা। বাড়ির সকলে মণিকার জন্য উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিল। শুধু অপেক্ষা, কবে মণিকাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে। এছাড়া আর কোনও পথও খোলা ছিল না তাদের কাছে।

তাদের আশা অনুযায়ী মণিকাকে ওয়ার্ডে শিফ্ট করা হল না। অবস্থার অবণতি হওয়াতে এবং সোমনাথের বিশেষ চেনাশোনা থাকার কারণে হাসপাতালেই বিশেষ একটা কেবিনে আলাদা করে মণিকাকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার আর নার্সেরও ব্যবস্থা হল। সোমনাথ আর অয়ন হাসপাতালেই শিফট করে গেলেন যাতে পালা করে মণিকার দেখাশোনা করতে পারেন।

প্রিয়া কিছুতেই মণিকার সামনাসামনি হওয়ার সাহস জোটাতে পারল না। সে বাড়িতেই থেকে গেল। বাবার কাছ থেকে জানল, আর কিছু দিনের অতিথি মণিকা।

অনেক কষ্ট করে ভয় কাটিয়ে নিজের মনকে তৈরি করল প্রিয়া। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল মণিকার দুর্বল শরীরটা বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। চোখ জলে ভরে এল। তার দিকে মণিকার চোখ পড়তেই হাত তুলে কোনও রকমে ওকে কাছে ডাকল মণিকা। মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে সোমনাথ আর অয়ন কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মণিকা প্রিয়াকে ইশারা করল, তাকে খাটে বসিয়ে দিতে।

প্রিয়া ধীরে ধীরে বেডের হাতল ঘুরিয়ে বসানোর অবস্থায় নিয়ে এল। হাত দিয়ে ধরে থাকল মণিকাকে। মণিকা তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মনের ভিতর চলতে থাকা প্রতিটা সংঘর্ষ প্রিয়া চাইছিল মণিকার সঙ্গে শেযার করতে। কিন্তু হঠাৎ-ই ওর মনে হল মণিকা ওকে খুব জোরে ধরে রয়েছে। একটু চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ার খেযাল হল, মণিকা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মৃত্যু জিনিসটা যে কী, তা এর আগে কোনও দিন প্রিয়া দেখেনি। কিন্তু খারাপ কিছু আশঙ্কা করে প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ডক্টর… ডক্টর! ততক্ষণে মণিকা সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।

মণিকার মৃত্যুর পর সারা বাড়িটা যেন প্রিয়াকে গিলতে আসত। মা চলে যাওয়ার পরেও, এতটা একাকিত্ব কখনও বোধ করেনি প্রিয়া। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, শুধু বাড়িটাই নয়, ওর নিজের মনের অনেকটা জুড়েও মণিকা জায়গা দখল করে নিয়েছিল।

আত্মগ্লানিতে পুড়তে লাগল প্রিয়া। ইশ যদি সুযোগ পেত তাহলে মনের কথাটা মণিকাকে বলতে পারত! যেটা শোনার জন্য মণিকা এতটা অধীর হয়ে ছিল। আদৌ কি সে শুনতে পেত? মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে সত্যিই কি তার কথাটা কোনও গুরুত্ব পেত? প্রিয়া সবসময় শুনে এসেছে, সময় থেমে থাকে না। তাহলে কেন সে সময় থাকতে থাকতে নিজের মনের কথাটা খুলে বলতে পারল না?

নিজের উপরই ঘৃণা হল প্রিয়ার। অস্থির বোধ করল। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে মনে হল প্রিয়ার। ভিতর থেকে একটাই শব্দ ঠেলে বেরোতে চাইছে, মণিকা… মণিকা। চীৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে। স্বর বেরোচ্ছে না কিছুতেই প্রিয়ার গলা দিয়ে।আকাশে মেঘের ঘূর্ণায়মান গতিপথের দিকে চেয়ে সমস্ত শক্তি একত্র করে চ্যাঁচাল প্রিয়া, মণিকা প্লিজ… প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

কিন্তু খুব ভালো করেই জানে প্রিয়া, আজ মণিকা আর কোনও কথাই শুনবে না। আজ যে মণিকারই জয় হয়েছে।

ভাইরাল

বলছি আপনার প্রোফাইলটা একটু বলুন দিকি।

রায়বাবুর কথা শুনে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটা।

রায়বাবু তাড়া দিলেন, আচ্ছা লোক তো মশায় আপনি, প্রোফাইল বোঝেন না? মানে কী করেন? পলিটিকাল লিংক আছে কী না? মানে ধরুন মাঝামাঝি মানের নেতা হলেও চলবে। ভিআইপি-দের সাথে লিংক আছে? নিদেনপক্ষে ওনাদের সাথে কযেটা সেলফি, কিংবা কোনও এমএলএ বা মিনিস্টার রেকমেন্ডেশন?

লোকটা আবার চুপ।

রায়বাবু আর একটু ব্যাখ্যা করে বললেন, বলছি বিদেশ গেছেন কখনও? এনআরআই ছাপ আছে? বাড়ির কেউ বড়ো ডাক্তার বা নামকরা ইঞ্জিনিয়র আছেন? বা ধরুন কবি। মানে রিলেটিভে কি কোনও সেলিব্রিটি আছে?

লোকটা আবার চুপ। এবার রায়বাবু বিরক্ত।

আরে দূর মশাই আপনি কালা নাকি? আচ্ছা, ফেসবুক আইডি-টা বলুন, দেখি ভেরিফায়েড আইডি কিনা। লেখা শেযার করেন তো নাকি? তা ফ্যান ফলোয়ার কেমন আপনার? বলছি লাইক-টাইক পড়ে? শেযার হয় আপনার লেখা? কতগুলো পেজে লেখা বেরোয় আপনার? নিজের বন্ধু বান্ধবের ফলোয়ার আছে? কমেন্ট টমেন্ট পড়ে? ওই ম্যাগগুলোতে রেগুলার লেখেন তো না কী?

লোকটা আবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চুপ।

রায়বাবু বিরক্ত হয়ে হাঁক পাড়েন, কী রে কেষ্ট, যাকে তাকে অফিসে ঢোকাস কেন? যতসব সময় নষ্ট। দাদা আপনি আসুন, অনেক কাজ বাকি। আসুন তো মশাই।

লোকটা এবার আমতা আমতা করে বলল, মানে কোনও ভাবেই কী লেখা বের করা যাবে না?

রায়বাবু তাচ্ছিল্য করে বললেন, দূর মশাই আপনার তো কোনও প্রোফাইলই নেই। অচেনা লোকের লেখা লোক পড়বে কেন? চোখ ছোটো করে বললেন ৩০ হাজার দিতে পারবেন, ভাইরাল করে দেব আপনাকে।

লোকটা আবার চুপ।

 

লোকটা মানে আকাশ মুখার্জি। ১০ ফুট বাই ৯ ফুট-এর খুপরিতে ছেলে বউ নিয়ে অশান্তির সংসার। অশান্তিরই বললাম, এত অশান্তি আগে ছিল না, ভালোবাসার বিয়ে উদ্দাম আঠারোর আবেগের দিনে, আকাশের প্রায় সব কিছু ভালোলাগা নিয়ে ওর হাত ধরেছিল কুর্চি। কুর্চি নামটাও আকাশেরই দেওয়া। ছেলে বিতান আসার সময় পর্যন্ত সম্পর্কটা বেশ ছিল। তারপর অভাবের কালো হাঁ সব সম্পর্কগুলোকে কেমন যেন গিলে খেল। আকাশ গুণী ছিল কিনা সেটা কোনও দিন ভেবে দেখেনি কুর্চি। কিন্তু আকাশের সততা আর সারল্য কাছে টেনেছিল তাকে। আজ বিয়ের এত বছর পর কুর্চির মনে হয় কোথাও হয়তো একটা ভুল হয়ে গেছে। লোকটার সততা বা সারল্য-টা ভন্ডামি। আসলে লোকটা অলস আর ভীতু টাইপের। পরিবর্তনের নামে লোকটার গায়ে জ্বর আসে। সারাক্ষণ বইয়ে মুখে গুঁজে বসে থাকলে সংসার চলে না, এটা লোকটা বোঝে না। বিতানের মুখ চেযে চুপ থাকে। অন্য কেউ হলে কবে সংসার ছেড়ে চলে যেত। এখন কুর্চির একটাই স্বপ্ন বিতানটার কিছু একটা হোক।

অভাব যখন চাওয়া পাওয়ার থেকে কম হয়, তখন ভিখারীও রাজা হয় এই প্রবাদটা আকাশের জীবনের এক অমোঘ সত্যি। ছোটো থেকে অভাবের সংসার আকাশকে অতটা আঘাত দেয়নি যতটা আঘাত করত ওর না-পারা নিয়ে সমাজের পরিহাস। না, আকাশ কিচ্ছু পারত না। মানে যেগুলো পারলে সমাজ ওকে মনে রাখবে সেগুলোর প্রায় কিছুই আকাশ কোনও দিন পারেনি। আকাশ কোনও হোমড়াচোমড়া ক্লাবের মেম্বার ছিল না, না ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, না স্টেজ পারফর্মার। আর পড়াশোনা! টিউশন ছাড়া পাশ করে যেত কোনওরকমে। তবে আকাশ কবিতা লিখত, গল্প বুনত। যে-কবিতা কেউ পড়েনি, আকাশও কাউকে পড়ায়নি। সারাদিন ফ্যাক্টরির কালো ঘামে নিজেকে নিংড়ে যখন রাতের কালো হাতগুলো তাকে ভবিষ্যতের ভয় দেখাত, তখন আকাশ আর ওর লেখাগুলো, দিস্তাখাতায় জীবন্ত হয়ে জীবনের প্রতিটা বাস্তবকে কল্পনার চাদরে জড়িয়ে ওম দিত সুখের। কুর্চিকে নিয়ে লিখেছিল জীবনের প্রথম অনু কবিতা ইচ্ছে। ওর ব্যাগে চুপিচুপি ফেলেছিল চিরকুটটা,

ইচ্ছেটা ছিল সুযোগ হয়নি

এক থেকে মুহূর্তে একশো দেখার ইচ্ছে ছিল

এক থেকে দোকা হয়ে হারানোর ইচ্ছে ছিল

কাঁধে নির্ভরতা খোঁজার হাতকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল

মেঠো ধুলোয় নিজেকে ঝাপসা দেখার ইচ্ছে ছিল

পাহাড়ি রাস্তায় চুপিসারে বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে ছিল

পেট্রল পোড়া গন্ধে নিকোটিনের গন্ধ মেলানোর ইচ্ছে ছিল

ইচ্ছে কী জানে?

উত্তরটা কুর্চি দিয়েছিল। জীবনসঙ্গী হয়ে কী মধুরই না ছিল দিনগুলো। এখন সাধ্যগুলো সব একই আছে, ইচ্ছেটাই শুধু নেই। কুর্চিকেও দোষ দেয় না আকাশ, ব্যর্থ স্বামী নিয়ে সংসার করা সহজ নয়! আকাশেরও চাওয়া-পাওয়া কোনও দিন ছিল না, আজও নেই। শুধু দিস্তাখাতায় স্বপ্নগুলো বেড়েই চলত, পাতার পর পাতা, দিস্তার পর দিস্তা।

 

প্রিন্টিং প্রেসের মালিক যেদিন প্রুফ রিডার রায়বাবুকে কোরাল ড্র বা অ্যাডোব ফটোশপের কাজ শিখতে বলেছিল, সেদিনই মাথায় আকাশ ভেঙেছিল। সারা জীবন হাতে কালি লাগিয়ে কাজ করা আর বানান ভুল ধরা প্রিন্টিং-এর মানুষ রায়বাবু। দুম করে কম্পিউটার শেখা, তাও আবার যেগুলো কখনও নাম শোনেনি, সেগুলো শেখা অসম্ভব, রায়বাবু তা জানত। মারওয়াড়ি মালিক বলত, বেওসা চেঞ্জ হচ্ছে রায়বাবু। সোব কম্পুটারিজ হবে, না শিখলে আর আগে বাড়বে কী করে?

চাকরিটা হারাবে এটা জেনে আর পোযাতি বউটার ভবিষ্যৎ-এর চিন্তায় যখন বাজারে ফলিডলের খোঁজে রায়বাবু ব্যস্ত, তখন কেষ্টর সাথে আলাপ। কেষ্টর আসল নাম কী, কেউ জানে না। সবাই কেষ্ট দাস নামেই চেনে। লেখালিখি বলে একটা অনলাইন ফেক পাবলিকেশন চালায় বেনামে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতাল, প্রেমে ধোকা খাওয়া সাপ-ব্যাঙ-আগডুম-বাগডুম লেখাগুলোকে ফলস পাবলিসিটি দিয়ে লেখার রিচ বাড়ায়। তারপর শখের কবিদের লেখা বই করে ছাপাব বলে, হাজার হাজার টাকা ডোনেশন নেয়। ভালো ব্যাবসা। রায়বাবুকে পার্টনারশিপের কথা বলতেই, রায়বাবু রাজি। এখন দুজনের যৌথ ব্যাবসা। ইনভেস্টমেন্ট বলতে একটা অ্যান্ড্রোয়েড স্মার্ট ফোন, একটা কম্পিউটার, কয়েকশো ফেক সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট।

ফ্রাস্ট্রু খাওয়া হযবরল লেখাগুলোকে নিপুণ হাতে রায়বাবু বেছে নেন। কেষ্ট হাজারখানেক লাইক আর শেযার করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তারপর দম দেখে একদিন ফোন করে লেখক বা লেখিকাকে, সেটাও পোর্টফোলিও দেখে ডিমান্ড। ওনাদের টার্গেট ক্ষেত্র একটু অন্যরকম, বেশিরভাগই গৃহবধূ। যেমন বড়ো সরকারি নেতার বউ, ডাক্তারদের বউ, ইঞ্জিনিয়রদের বেকার বউ, সরকারি অফিসারদের বউ কিংবা এনআরআই-দের বউ।

শুধু গৃহবধূই নয়, আছে ফাস্ট্রেটেড যুবসমাজ, বাউন্ডুলে বড়োলোক আর তাদের সুপুত্ররা। প্রথমে ওনাদের প্রতিভার মেকি প্রশংসা তারপর ডিমান্ড। আর ডিমান্ড পেলেই একটা ভুলভাল প্রিন্টিং সেন্টার থেকে একটা বই। আর বই বেরোলেই হাজারটা ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েকশো শেয়ার। মালিক আর ক্লায়েনট দুজনেরই প্রফিট আর দুজনেই খুশ। মানে পুরো সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর লেখার মাফিয়া নেটওয়ার্ক, ফেলো কড়ি ছাপো লেখা, প্রতিভা কী আর দেখা যায়।

 

ডুবন্ত শিল্পরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ইউনিয়ন বাজিতে অনেকে ছাঁটাই হবার পরেও পুরোনো লোক হিসেবে আকাশকে রেখে দিয়েছিল কোম্পানি। শুধু ভালো কর্মীর জন্য নয়, এই ফ্যাক্টরির সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের লেখালেখির সব কাজ এতদিন আকাশই করে এসেছেন। সে ফ্যাক্টরির উদযাপন দিবস হোক বা শ্রমিকদের মে দিবস, লেবার ইউনিয়নের নেতা হোক বা কোম্পানির অবাঙালি ইঞ্জিনিয়র সবাই শুধু একবার বলে দিত আকাশদা কাল ভাষণ দিতে হবে, একটু লিখে দিও তো। ব্যস আকাশ নিজের ভঙ্গিতে সাবলীল ভাবে লিখে দিতেন। স্টেজে ওর লেখা অন্য কেউ পড়ে যখন হাততালিতে পুরো মঞ্চটা ভেসে যেত, তখন একবারও কেউ ওর নাম উচ্চারণ না করলেও আকাশ নিজের থেকেই খুশি হতো, এতদিন এটাই চলছিল।

এবারের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আকাশকে কেউ কিছু না বলায় খানিকটা অবাক হয়েছিল। অনুষ্ঠানের দিন শুনল ফ্যাক্টরির নতুন জয়েন করা এক ফিটার ওয়ার্কার, নাকি সব লেখালেখি করছে। প্রোডাকশনের জমাদারবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে জানল, নতুন ছেলেটা নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনসেশন। ইদানীং নাকি কী সব ব্যাপারে ভাইরাল হয়েছে। ফ্যান ফলোয়ারও নাকি অনেক। তাই এবার ম্যানেজারবাবু ওকে দাযিত্ব দিয়েছেন। এইসব অত্যাধুনিক ভাষাজ্ঞান বা উন্নত প্রযুক্তির কোনওটাই আকাশের কোনওদিন ছিল না। আর ইন্টারনেটটা এখনও গরিবের কাছে আলাদিনের প্রদীপ। আঘাতটা লেগেছিল। কুর্চিকে এগুলো বলেও লাভ নেই । বাড়ি ফিরে রাতের কালো অন্ধকারে চোখের জল লুকিয়ে বাঁধাই করা লেখাবোঝাই দিস্তাখাতাটা বুকে চেপেই শুয়ে পড়েছিল।

লেখালিখি পাবলিকেশন-এর খবরটা ফ্যাক্টরির নতুন ছেলেটাই আকাশকে দিয়েছিল। নিজে থেকেই এসে বলেছিল, কাকা তোমাদের ওই পুরোনো খাতা কলমে লেখা আর চলে না। আজকাল জো দিখতা হ্যায়, ওহি বিকতা হ্যায়। নতুন নতুন পেজে মিউজিক দিয়ে লেখা ইন্টারনেটে বেরোয় কাকা, পাবলিক ওটাই খায়। ঠিকানা নিয়ে বুকে সাহস করে কেষ্ট দাসের অফিসে এসে হাজির হয়েছিল আকাশ। যদি তার সারাজীবনের লেখাগুলো ইন্টারনেটে দেওয়া যায়। তারপর ওপরের ওই আলাপচারিতা। রায়বাবুর কাছ থেকে প্রশ্নগুলো শুনে বাড়ি ফেরার পথে কুর্চির জন্য প্রেশার-এর ওষুধটা একপাতা বেশি কিনল। সাথে একটা পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্প পেপার। ওদের যাতে উইল নিয়ে কোনও অসুবিধা না হয়।

 

আজ বিতান জয়েন করল। বাবা সুইসাইড করার পর মাকে নিয়ে দাঁত চেপে লড়ে আজ বিতান বড়ো সরকারি আধিকারিক। পুরোনো ঘর ভেঙে নতুন ঘর হয়েছে। বাবার দিস্তামার্কা খাতাটা এ পর্যন্ত কয়েক হাজারবার ওর পড়া। প্রায় সব লেখাগুলোই ওর মুখস্থ।

এই দিনটার জন্য বিতান অনেক দিন অপেক্ষা করেছে। এখন গভীর রাত। ফেসবুক প্রোফাইলে বিতান জব প্রোফাইলটা আপডেট দিল। সাথে দফতরের মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নেওয়া পোস্ট। তারপর দশ বছর ধরে অপেক্ষা করা দুটো ফ্রেন্ড রিকোয়েসট পাঠাল, একটা কেষ্ট দাস আর একটা রায়বাবুকে, সাথে লেখালিখি পেজে একটা মেসেজ,  অনেকগুলো লেখা ভাইরাল করতে চাই, যা লাগে দেব।

কেশকাঞ্চন

চুলের ব্যাবসা করবি?

প্রশ্ন শুনে বেটাকে আচ্ছা করে গাল পাড়ল তারাপদ। শ’কার, ব’কার, খ’কার, কিছুই বাদ গেল না।  হয়তো মেরেই দিত। চুলের আবার ব্যাবসা কী?  মশকরা করার জায়গা পায় না? আর পঙ্গু মানুষকে নিয়ে কেউ মশকরা করে? নেহাত পুরোনো বন্ধু তাই বেশি কিছু বলল না। বিড়ি ধরিয়ে রাস্তায় মন দিল।

বাসন্তী হাইওয়ে পিচঢালা, মসৃণ। পাশেই খাল। অবজ্ঞা, অবহেলা সয়েও একনিষ্ঠ। নিঃশব্দে বহন করে চলেছে কলকাতার নিকাশি। ওপারে ধাপা। আবর্জনার পাহাড়ে যেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। সায়েন্সসিটি ব্রিজের নীচে পুবমুখী রাস্তাটাই বাসন্তী হাইওয়ে। সোজা চলে গিয়েছে বাসন্তী। সেখান থেকে মাতলা পেরিয়ে গোসাবা হয়ে সুন্দরবন, অথবা রাজারহাট-বসিরহাট-বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশ। মাঝে বানতলা, বামনঘাটা, ভোজেরহাট, ঘটকপুকুর, ভাঙ্গড়, মালঞ্চ। রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে নিজগুণে। মারামারি, খুনোখুনি লেগেই আছে। অঞ্চলের বেশিরভাগটাই ভেড়ি। মিষ্টিতে যেমন পিঁপড়ে, মাছের ভেড়িতে তেমনি ক্রিমিনাল।

দুপুর সময়টা বড়োই গ্যাঁড়াকলের। নিষ্কর্মা মানুষকে উদোম করে দেয়। সকালটা কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রাতঃকৃত্য, চুল-দাড়ি কাটা, স্নান, চায়ের দোকান, এটা-সেটা করে। খবরের কাগজ তো ত্রাতা মধুসূদন। ‘অনেক কাজ পড়ে আছে’ বা ‘যেতে হবে বহু দূর’ও মানানসই। কে আর সত্যান্বেষণ করছে! আঁধার তো খুবই সুবিধের। দিব্যি লোকচক্ষুর আড়াল হওয়া যায়। যা হোক দুটি পেটে ফেলে শুয়ে পড়লেই হল। ঘুম আসুক না আসুক, সুখনিদ্রার ভানে অসুবিধে নেই। ঘুম অবশ্য দুপুরেও দেওয়া যায়। তবে লাভ নেই। কর্মব্যস্ত ধরণীতে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা একান্তই দৃষ্টিকটু। নিষ্কর্মার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তা ছাড়া অত ঘুমও কি মানুষের আসে? কাঁহাতক ভালো লাগে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে?

রোজ দুপুরে বানতলা বাজারে এসে বসতেই হয় তারাপদকে। গাছতলা, পুকুরপাড়, ভাঙা মন্দির, কোনওটাই তেমন জুতসই নয়। যেন আরও উদোম হওয়া। তার চেয়ে রাস্তার ধারই ভালো। গাড়িঘোড়া, মানুষজনের মাঝে দিব্যি মিশে থাকা যায়। চোখে লাগে না অতটা। ভরদুপুরে মানুষজন সামান্যই। গাড়িই ভরসা। গুনতি করে সময় মন্দ কাটে না। তবে মুশকিলও আছে। বেকার মানুষ পেলেই লোকের উপদেশ দেবার বাসনা উশখুশ করে। সেই কারণেই বটকেষ্টর, ‘চুলের ব্যাবসা করবি?’

কলকাতার এত কাছে, তবুও জীবন যেন এখানে থমকে আছে। হাইওয়ের উপর বিশাল চর্মনগরী, ছোটোখাটো কারখানা বা দু’একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকলেও, গ্রামের ভিতরে প্রায় উলটো চিত্র। বিদ্যুৎ থাকলেও সব রাস্তা পাকা নয়! সর্বসাধারণের স্কুল মাধ্যমিক পর্যন্ত। কাছের হাসপাতাল বলতে পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন। মানুষের রোজগার মূলত ভেড়ি থেকে। এখনও হাট বসে। রাস্তার দু’ধারে সার দেওয়া ‘কাঁটা, ওজন করার যন্ত্র। আশপাশের ভেড়ি থেকে মাছ এসে কাঁটায় ওঠে। শুরু হয় ‘অকশন। যার ডাক বেশি সেই দাবিদার। মিষ্টি জলের রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, পাড়ি দেয় গড়িয়াহাট, লেকমার্কেট, যদুবাবু বা মানিকতলা বাজারে। হইচই, হল্লাগুল্লায় হাট সরগরম। ঝগড়াঝাঁটি লাগলেও, বাজারে মাছ পৌঁছোনোর তাড়ায় আমল পায় না। মাছের সঙ্গে তরিতরকারিও থাকে। কলকাতার বাবুরা চলে আসে টাটকা মাছ-সবজির সন্ধানে। সস্তাও হয়! শপিং মল বা ফুডমার্টের চেয়ে তো বটেই। শুধু একটু চিনতে আর দরদাম করতে হয়। তাছাড়া গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে আসার অ্যাডভেঞ্চার তো আছেই। সাইট সিয়িং ফাউ।

সার দেওয়া কাঁটাগুলো বিশ্রামে! জেগে উঠবে সকালে। নির্ধারণ করবে লাভ-লোকশান। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারাপদ। আবার বিড়ি ধরাল। বিড়িও অন্যতম অবলম্বন। ‘কিছু একটা করছি’বা ,শেষ করেই যাব অন্যখানে। দু’টান মেরেই ফেলে দিল। মুখটা তিতকুটে। মনও। এই হাটেই একসময় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত টেরও পেত না। মানিকতলা বাজারের বিধু সাহার মাছ সওদা করত। অগাধ আস্থা ছিল বিধুর। মাছ চেনার ব্যাপারে তারাপদরও জুড়ি ছিল না। কোন কাঁটায় কারচুপি আছে সেও ছিল নখদর্পণে। ফলে সেরা দামের সঠিক ওজনের মাছ চালান যেত বিধুর আড়তে। বিধুও গুণীর কদর করত। মাস গেলে প্রাপ্য মেটাতে কসুর করত না।

বিধু কদর করলেও, ভেড়িওয়ালারা তারাপদর গুণপনায় অতিষ্ঠ। বিধুর মতো বড়ো খরিদ্দারের কাছে মাছ গছাতে পারলে একসঙ্গে অনেকটা মাছেরই হিল্লে হয়। কিন্তু তারাপদর জ্বালায় সে উপায় নেই। সেরা মাছ ছাড়া তুলবে না। ওজনেও একচুল এদিক-ওদিক করবার জো নেই। ভগবানও বোধহয় ব্যাপারীদের সহায়। একসময় দুটো পা’ই অসাড় হতে লাগল তারাপদর। ডাক্তারবাবুরাও ধরতে পারল না অসুখটা। হেকিমি, কবিরাজিতেও লাভ হল না। ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুস্পদ বনে গেল তারাপদ।

কোনও যুক্তি না পেলে সহজতম গ্রাম্য সমাধান, ‘কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে’ অথবা ‘বাণ মেরেছে’। এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। তবে কারওরই ‘কেউ’ বা ‘কিছু’ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। বাণ জিনিসটাও ভজকট। তন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকলেও, কেউই চাক্ষুষ করেনি কখনও। তাই পরিবার ভেড়িওয়ালাদের দিকে আঙুল তুললেও, প্রমাণ করতে পারল না কিছুই। বিধু অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছিল। সহকারী রেখে তারাপদ তদারকি করবে। করলও কিছুদিন। তারপরে আস্তে আস্তে ভাটা পড়ল। কাঁহাতক আর ভালো লাগে অন্যের বোঝা হতে? তা ছাড়া গুরুত্বও কমছিল। সবার চোখেই দয়া, করুণা, অনুকম্পা। একদিন যেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, সেখানে এই দুর্দশা মেনে নিতে পারল না। লাইনই ছেড়ে দিল। তারপর কাঠ বেকার।

‘একবার ভেবে দেখলে পারতিস। লাইনটা খারাপ কিছু নয়। বসেই তো থাকিস…’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তারাপদ। শব্দ করে একদলা থুতু ছেটাল।

‘আমি বসে থাকি তো তোর বাপের কী রে? তুই কি খাওয়াস না পরাস?’, মনে মনে গজরাল। চৈত্রের গনগনে রোদে তর্ক জুড়তে ইচ্ছে হল না।

‘প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। ইনকামও মন্দ নয়’, বটকেষ্ট নাছোড়বান্দা।

‘তা সে ইনকাম তুই কর না। আমার পেছনে পড়েছিস কেন?’, না বলে পারল না তারাপদ।

‘আমি তো চৌবাগা, ভিআইপি বাজার, পঞ্চান্নগ্রাম, এই এলাকাগুলো দেখছি। তুই এদিকটা দেখ না, বটকেষ্টর প্রস্তাব।

‘কেন রে শালা, আমি ছাড়া কি আর লোক নেই?’ পোঁদ ঘষটে আমাকেই গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে হবে?’, খিঁচিয়ে উঠল তারাপদ। হাঁটাচলা বলতে দু’হাতে ভর দিয়ে ঘষে ঘষে চলা। সব জেনেও বটা এইরকম প্রস্তাব দিচ্ছে? নাকি মজা করছে?

বটকেষ্ট পাকা ব্যাবসাদার। এ অঞ্চলে ব্যাবসা করা বিরাট ঝকমারি। লাইন দিয়ে টাকা নেবার লোক দাঁড়িয়ে। তোলা না দিয়ে এক পা-ও এগোনোর উপায় নেই। শালাগুলো কাজ-কম্ম কিছু করবে না, শুধু পরের ধনে পোদ্দারি মেরে মদ-মাংস খাবে। খাওয়া বেশি হলে পড়শির বউ-মেয়ের হাত ধরে টানবে। তবে তারাপদর কথা আলাদা। একে পঙ্গু তায় গ্রামের লোক। দয়া, করুণা, তাচ্ছিল্য যাই করুক না কেন, তোলা চাইবে না! ‘খোঁড়াটা আর কতই বা কামাবে’র যুক্তিতে ছাড়পত্র পাবে। এতসব না বলে হাসি মুখে বলল, ‘তুই আমার বন্ধু বলেই বলছি। তেমন হলে আমি নয় তোকে চাকা লাগানো গাড়ি বানিয়ে দিচ্ছি। ঠেলে ঠেলে ঘুরতে অসুবিধে হবে না।’

বিড়ি ধরাল তারাপদ। একটা হাতে চালানো সাইকেল গাড়ির জন্য কত তদবিরই না করেছে। নেতা থেকে এমএলএ পর্যন্ত। আশ্বাস ছাড়া জোটেনি কিছুই। অথচ ভোটটা কিন্তু ওই পার্টিকেই দিয়েছিল। কে জানে কেন, তালিকায় নাম আর উঠল না।।

তারাপদ চুপ করাতে বটকেষ্ট যেন ভরসা পেল। এদিককার গ্রামগুলো ছড়ানো-ছেটানো। দু’চারটে ঘুরতেই দিন কাবার। পড়তায় পোষায় না। লোক রেখেও সুবিধে হয় না। সকলেরই নজর ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে গৃহস্থের সঙ্গে বিউটি পার্লারও আছে। একলন্ধে চুল মেলে অনেকটা। তাই তারাপদ যদি রাজি হয়, তা হলে গাড়ি দিয়েও লাভ। পাশ ঘেঁসে বসে মোলায়েম স্বরে বলল, ‘নিজের কথা নয় নাই ভাবলি তোরা। সংসারের কথা তো একটু ভাবতে হয়। দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’

‘দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’ বটার এই কথাটাই টলিয়ে দিল তারাপদকে! সংসার বলতে বউ মালতী আর মেয়ে ঝুমুর। জমিজমা না থাকলেও বাড়িটা নিজের। একতলা। ইটের গাঁথনি, অ্যাসবেস্টসের চাল। প্লাস্টার বা রং করা হয়ে ওঠেনি। জমির প্রতি মোহ কোনওদিনই ছিল না তারাপদর। রক্ষণাবেক্ষণ ভয়ানক ঝামেলার। ব্যাংকে যাবারও প্রয়োজন বোধ করেনি কখনও। ঈশ্বর যখন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী করেছেন, তখন চিন্তা কী? এক বিধু গেলে অন্য বিধু আসতে সময় লাগবে না।

খাটা-খাটনিও তেমন কিছু নয় যে শরীর ভেঙে পড়বে। সকালে খানিক দৌড়ঝাঁপ, খিস্তি-খেউড়, হম্বিতম্বি, তারপরেই অখণ্ড বিশ্রাম। ম্যাটাডোরে মাল চাপিয়ে বোতল খুলে বসা। নিখরচায়। দায় ভেড়িওয়ালাদের। তোয়াজ, তোষামোদে গদগদ। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোক না হোক, শনি দেবতাকে তুষ্ট রাখতেই হয়। আমোদ-আাদে তোফা কাটছিল দিনগুলো। যেন রাজা-বাদশা!

গোল বাধল পায়ের অসুখটার পর। আচমকাই রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখি। টাকার জোগান থাকলে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। যেমন পড়েনি মালতীকে। দিব্যি হাসিখুশি গৃহকর্মনিপুণা! ভালো-মন্দ রান্না করা, ঘর-দোর গুছিয়ে রাখা, আত্মীয়-কুটুম্বিতা দরাজ হাতে। চারিদিকে ধন্য ধন্য, ‘বউ বটে তারাপদর!’ তারাপদও কোনও ফাঁক পায়নি। শরীর, মন দুইয়েরই চাহিদা মিটেছে অগাধ। বেসামাল অবস্থায় যত্ন-আত্তি তো দেখার মতো! জামা-জুতো খুলে, গা-হাত-পা মুছিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঘুম পাড়াত। পরম তৃপ্তিতে মনে হতো, ‘যাক, শেষ বয়সটায় কষ্ট পেতে হবে না!’

বোঝা যায়নি। হয়তো যায়ও না। সবুজে ভরা বনভূমি দেখে কি মরুভূমির আঁচ পাওয়া যায়? নাকি টলটলে নদীতে চরের পূর্বাভাস থাকে? সুউচ্চ মিনার আচমকা ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হবে, তা কী ভাবা যায়? না গেলেও, গেল একসময়। অভাব তাণ্ডব শুরু করতেই মালতী যেন ধূধূ মরুভূমি, রুক্ষ চর। প্রত্যাশার মিনার গুঁড়িয়ে চুরমার। শুরুতে মন দিয়েই চিকিৎসা করাচ্ছিল। আশা ছিল সুদিনের। যখন বুঝতে পারল দুর্দিন নিশ্চিত, তখনই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। প্রথমে ভাগ্যকে দোষারোপ, তারপর মানুষকে। তারাপদর মতো অবিবেচক মানুষ নাকি জীবনে দেখেনি। অথচ প্রতি রাত-সোহাগেই তারাপদর দিলদরিয়া স্বভাবের গুনগুনানি ছিল অনিবার্য। অনেক ভাগ্য করলে নাকি এমন স্বামী পাওয়া যায়।

বউয়ের তাগাদা, খ্যাচখ্যাচ, মুখঝামটায় ঠোঙা বানানোর কাজে হাত লাগাল তারাপদ। কিন্তু সারাদিন ঘরে বসে ঠোঙা বানানো পোষায়? কাজটাও ঘ্যানঘ্যানে, ম্যাদামারা টাইপের। মাছের কারবারের ছিটেফোঁটা উত্তেজনাও নেই। আর বানিয়েই বা লাভ কী? সব রোজগারই তো ঢুকবে সংসার ‘গভ্ভে’। এক ছিপি মালও বরাদ্দ হবে না নিজের জন্য। সবদিক বিবেচনা করে ঝিম মারল তারাপদ। হাজার মুখ ঝামটাতেও রা নেই। যেন বোবা, বধির।

ঠোঙা বানানো ছিল ফ্যামিলি বিজনেস। প্রথমে মেয়ে তারপর বাপ-মেয়েই ছিল প্রধান কারিগর। মালতী ঘরের কাজ সেরে হাত লাগাত। তারাপদ গুটিয়ে যাবার পর মসৃণ অ্যাসেম্বলি লাইনে ছেদ পড়ল। মা মেয়ের পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল। মেয়ে হোলটাইমার হলেও মাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ‘গুষ্টির গেলার জোগাড়ে’! আলুটা মুলোটা চেয়ে, গেঁড়ি-গুগলি জোগাড় করে তবে রান্না। মাঝেমধ্যে মরা মাছ জুটলেও, ভাতের বড়োই আকাল। উপায় না দেখে একসময় মালতী রান্নার কাজ নিল। আনন্দপুরের দিকটায় বড়ো-বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি। পয়সার কমতি নেই কারও! সেরকমই তিনটে বাড়িতে কাজ জোটাল। সাত সকালে বেরিয়ে মাঝ দুপুরে ফেরা। একবেলা খাওয়ার সঙ্গে হাজার পাঁচেক মাইনে। কোনওরকমে দিন গুজরান।

টাকার চেয়ে বড়ো জোর আর কিছুই নেই। এতএব ‘জোর যার মুলুক তার’ – এই যুক্তিতেই সংসারের রাশ মালতীর হাতে। তারাপদ যেন কীটাণুকীট, অপাংতেয়। নেহাত তাড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে সহ্য করা। তারাপদও মেনে নিল বউয়ের অহংকার, ঔদ্ধত্য। না মেনে উপায়ই বা কী? আত্মহত্যা? সম্ভব নয়! বড়ো ভয় জলে ডুবতে, গায়ে আগুন লাগাতে অথবা আচমকা গাড়ির সামনে পড়তে। দিনে দিনে আরও গুটিয়ে গেল। পারতপক্ষে রাতের আগে বাড়ি ফেরে না। ফিরেও চোরের মতো দুটো মুখে দিয়েই ঘুম। ঘুম মানে চোখ বুজে থাকা। মেয়েই খেতে দেয়। রাতে ঘুম না এলে পাশে এসে বসে কখনও-সখনও। মায়ের চোখে পড়লে মুখঝামটা, গালাগাল।

‘স্বামী তো নয়, শত্তুর।’

মেয়ে যেন আক্ষরিক অর্থেই গলার কাঁটা। রূপ না থাকলেও বেশিরভাগ মেয়েরই আলগা চটক বা লালিত্য থাকে। ঝুমুর যেন কুরুপার অধিক। চটক তো নেই-ই, লালিত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। আলকাতরার মতো রং, খরখরে চামড়া, মুখের দিকে না তাকালেই স্বস্তি! গুণ বলতে নম্র, গৃহকর্মনিপুণা, সরলমতি। একেবারে খাদহীন। কাদার তাল যেন! ওইসবের কদর বাপ-মায়ের কাছে থাকলেও, বাইরের লোকের দায় পড়েনি নজর করবার।

পায়ের গোলমাল শুরু হতেই মনে কু ডেকেছিল তারাপদর। মেয়ের বিয়েটা এইবেলা না দিলেই নয়। পাত্রী পছন্দ হবার প্রশ্ন নেই, তাই প্রথম থেকেই টাকার চার ফেলেছিল। মাছও এল! ছেলের বাড়ি জয়নগর। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে। দিল্লি, মুম্বাইতেও যায়। বাড়িতে বিধবা মা। জমিজমা না থাকলেও অভাব নেই। দেরি করল না তারাপদ। পঞ্চাশ হাজার টাকা বরপণে রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে মোটরবাইক। দয়াপরবশ হয়ে হাজার তিরিশেক টাকা দিল বিধু সাহা। বোধহয় লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট। বাকিটা মহাজনের কাছে ধার! মোটরবাইকও ধারে। পড়শি নগেন পালের কাছে বিনা সুদে। আয়োজন তেমন কিছু ছিল না। কালীঘাটে বিয়ে আর বাড়িতে জনা পঞ্চাশের নিমন্ত্রণ। কাজ উতরাল নির্বিঘ্নে। ট্রেনে চড়ে মেয়ে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। দ্বিরাগমনেও এল। বর ছ’মাসের জন্য দিল্লি যাচ্ছে। ফিরে এসে নিয়ে যাবে। সেই যে জামাই গেল, তিন বছর পার হতে চলল ফিরল না এখনও। জয়নগরে খোঁজ নিয়ে লাভ হয়নি। শাশুড়ির কাছেও হদিশ নেই। মোবাইল সুইচড-অফ। শুরু হল শবরীর প্রতীক্ষা।

শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে ঝুমুরও যেন পালটে গেল। যে-মেয়ে সাজগোজের ধারপাশ দিয়েও যেত না, সে নানারকম আবদার শুরু করল। ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য আর নেই। চিকিৎসা, বিয়েতে সর্বস্বান্ত। মালতীকে টানতে হচ্ছে মোটরবাইক, মহাজনের ধার। ঝুমুরেরও যেন তাড়া নেই শ্বশুরবাড়ি ফেরার। রহস্য উদ্ঘাটন হল ছ’মাস পার হবার পর। বর নানারকম দাওয়াই বাতলে দিয়েছে ফরসা হবার। টিভিতে চাক্ষুষ করিয়েছে সিনেমার হিরো হিরোইনদের রূপ রহস্য। আশ্বাস দিয়েছে ফরসা হলেই ফেরত নিয়ে যাবে। নইলে সমাজে মান রাখাই দায়। ঝুমুরও বিশ্বাস করেছে সরল মনে! উপায় বাতলালেও, সংস্থানের কোনও ব্যবস্থা করেনি পতিদেবতা। অগত্যা পাড়ার মেয়েদের থেকে চেয়ে-চিন্তে ক্রিম, সাবান জোগাড় করে ঝুমুর। মনে দুর্বার আকাঙক্ষা। হবে সাধের উত্তরণ।

চোখে জল এসেছিল তারাপদর। তীব্র অভিমান হয়েছিল ঈশ্বরের উপর। মনটার মতো মেয়েটার চেহারাটা একটু সাদা করতে পারল না? কালো মনের সাদা মানুষ তো আকছার! বেশ বুঝতে পারল টোপ গিললেও মাছ বঁড়শিতে গাঁথেনি! মেয়ে আজও কুমারী। হয়তো আজীবনই থাকবে। টাকা, বাইকের সংস্থান হতেই পালিয়েছে জামাই বাবাজি। সেই থেকেই ঝুমুর একনিষ্ঠ রূপ সাধনায় ব্রতী। পাড়ার লোকে হাসে, ব্যঙ্গ করে, আবার কৗতূহলে খয়রাতিও করে। অপেক্ষা করে চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সের। মিলনান্তক না বিয়োগান্তক? মিলনান্তক হলে, ‘আমিই তো…’, অন্যথায় মুখ বেঁকিয়ে ‘বোকার হদ্দ কোথাকার। সাধ্য নেই, সাধ আছে ষোলোআনা’। ঝুমুর অতশত বোঝে না। যে যা দেয় তাই নিয়েই খুশি। চালায় নিরলস প্রচেষ্টা। ডাক আসবে প্রিয়তমের।

নিরুত্তাপ, নিস্তরঙ্গ জীবনেও একসময় সিঁদুরে মেঘ দেখল তারাপদ। মালতীর শরীর ভেঙে পড়ছে। আজকাল প্রায়ই হাঁপ ধরে, বুক ধড়ফড় করে। অপুষ্টি, অধিক পরিশ্রমে শরীর কাহিল। মেজাজও তিরিক্ষি। স্বামীর উপর ক্ষোভ উগরেও শান্তি হয় না। মেয়েকেও জুড়ে নেয়। এমন বাপ-মেয়ের জন্যই নাকি জীবনটা দুর্বিষহ হল। বাপ-মেয়ে দুজনেই সর্বংসহা। এতএব মেজাজ আরও তিরিক্ষি! তবে ঠান্ডা হলে ঠোঙা বানানোয় হাত লাগায়। তারাপদ হাত উঠিয়ে নিলেও, মা-মেয়েতেই চালাচ্ছে ফ্যামিলি বিজনেস। মোটরবাইক, মহাজনের ধার এখনও চলছে। শুধু রান্নার কাজের মাইনেতে বাড়িতে রান্না চড়ানো মুশকিল। কিন্তু মালতী হঠাৎ অসুস্থ হলে? কেমন করে বাঁচাবে হাবাগোবা মেয়েটাকে?

‘ঘুম আসছে না বাবা?’

চমকে উঠল তারাপদ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করেনি কখন ঝুমুর শিয়রে এসে বসেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মালতীকে খুঁজল। চাপা স্বরে বলল, ‘এই ঘুমব… তুই এখন যা। মা দেখতে পেলে অযথা মুখঝামটা শুনবি!’

‘মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ঝুমুর হাসি মুখে জানায়।

নিশ্চিন্ত হল তারাপদ। মেয়ের হাতে হাত রেখে বলল, ‘বুঝলি মা, এবার একটা নতুন কারবারে হাত দিচ্ছি।’

‘কীসের কারবার?’

‘চুলের।’

চুল নিয়ে যে কারবার হয়, তারাপদর ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না। খদ্দের দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। বুঝল মহিলা মহলে এই ব্যাবসা খুবই জনপ্রিয়। নিজের মাথার ঝড়তি-পড়তি চুল বেচে যদি দুটো পয়সা মেলে, মন্দ কী? তাই ফেলে না দিয়ে কাচের শিশি বা প্লাস্টিকে জমায়। পরিমাণমতো হলে বেচে দেয়। দেড় থেকে তিন হাজার টাকা কিলো।

তারাপদকে পেয়ে মহিলা মহল যেন বর্তে গেল। খাপছাড়া গ্রামগুলোয় কোনও ক্রেতা না থাকায় বাড়ির পুরুষ মানুষদের শরণাপন্ন হতেই হতো। বিস্তর সাধাসাধি, তোষামোদ। তারপর নেহাতই দয়াপরবশ হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ! তাও সব সময় যে সঠিক পয়সা ঘরে আসবে এমনটা নয়। ব্যস্ত পুরুষকুল উপকারের বিনিময়ে মাঝেমধ্যেই এক বান্ডিল বিড়ি বরাদ্দ করে নেয়। ঝরা চুল কিলোখানেক হবার প্রশ্ন নেই। সাকুল্যে হয়তো কয়েকগ্রাম। সেটুকুতেও যদি নজর পড়ে, সহ্য হয়! বলতে গেলে পালটা রাগ, দায়িত্ব অস্বীকারের হুমকি। সেদিক দিয়ে তারাপদ শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। চোখের সামনে পুরো পয়সা মিলবে। তা ছাড়া চেনা লোক, ওজনে মারবে না ধরেই নেওয়া যায়। তবে কেউ কেউ নগদের বদলে বাসন প্রত্যাশী। কারও কারও নগদ নিয়েও অসন্তোষ। তারাপদ নাচার। ছোটো গাড়িতে বাসনের বোঝা বয়ে বেড়ানো দুঃসাধ্য। নগদ বাড়াবারও উপায় নেই। তা হলে নিজের বাড়া ভাতেই ছাই পড়ে। তা ছাড়া সবাইকে সমান নগদ দেওয়াও যায় না। দাম মেলে চুলের দৈর্ঘ্য অনুয়ায়ী। তবুও হাতের কাছে অন্য ক্রেতা না মেলায় তারাপদর কপালেই বরাত জোটে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

সময় মন্দ কাটে না তারাপদর। বটকেষ্টর দেওয়া গাড়িটা বেশ মজবুত। কাঠের তক্তার উপর চাকা লাগানো। হাত দিয়ে ঠেলে দিব্যি গড়গড়িয়ে যাওয়া যায়। অন্যদের মতো ডুগডুগিও দিতে চেয়েছিল। এক কথায় নাকচ করেছে তারাপদ। চেনা লোকজনের মাঝে ডুগডুগি বাজিয়ে ফেরি করবে। এ কি ব্যাবসা নাকি বাঁদর নাচ দেখানো? জোর করেনি বটকেষ্ট। এলাকায় পরিচিতি এবং অন্য ক্রেতা না থাকার সুবাদে তেমন অসুবিধে হবে না তারাপদর। ‘চুল দেবেন গো’ হাঁক পাড়ারও দরকার পড়বে না। মেয়ে-বউরা এমনিই উজিয়ে আসবে। তাই গাড়ির সঙ্গে শুধু ওজন করবার সূক্ষ্ম যন্ত্রটা দিয়েছে, যাতে কয়েক গ্রামও অনায়াসে ওজন করা যায়। আর দিয়েছে ধার হিসেবে দশটাকার বান্ডিল। বেশিরভাগের প্রাপ্যই পঞ্চাশ, একশো ছাড়ায় না। খুচরো রাখতেই হয়। তারাপদ ঠকায় না কাউকেই। সেই কারণেই হয়তো বাড়তি খাতির মেলে। চাইলে জল পাওয়া যায়। সঙ্গে বাতাসাও আসে কখনও।

‘তুই করিস কী চুলগুলো দিয়ে?’

‘বেচে দি।’

‘কাকে?’

‘সে খোঁজে তোর দরকার কী? তুই কামাচ্ছিস কামা না’, বটকেষ্টর সাফ জবাব। এই হল মানুষের দোষ। নিজেরটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না, অন্যের দিকে নজর । একেবারে নিশ্চিত, পরের প্রশ্ন দাম সম্বন্ধীয়।

‘তুই কী দাম পাস?’

হো-হো করে হেসে উঠল বটকেষ্ট! মানুষ ঘাঁটা সার্থক। তারাপদর পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘তোর তাতে দরকার কি রে শালা? তোকে একটা লাইন চেনালাম, গাড়ি বানিয়ে দিলাম, হাজার টাকা ধার দিলাম, এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক না। জাহাজের খবর জেনে তুই আদার ব্যাপারী কী করবি?’

চুপসে গেল তারাপদ। নেহাতই কৗতূহলী জিজ্ঞাসা। বটা যে কিছু মনে করবে ভাবেনি।

‘শোন, তোকে আর একটা রোজগারের উপায় বাতলাই’, পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল বটকেষ্ট। চুলের জট ছাড়িয়ে, সাবান দিয়ে ধুয়ে সাইজ অনুযায়ী আলাদা আলাদা বান্ডিল করবি। এ বাবদও কিছু পাবি। বিড়ি খরচটা উঠে যাবে।’

বিড়ির কথা উঠতেই হাত পাতল তারাপদ। দুটো আয়েশি টান মেরে বলল, ‘চুলগুলো কী কাজে লাগে বলবি?’

‘পরচুলা বানায়। বিদেশেও নাকি যায়। আমি সব জানিও না।’

চুলের জট ছাড়ানোর কাজটা বেশ পছন্দ হল তারাপদর। রোজগারও আছে, সময়ও কাটবে। পরে অনেকবারই বিড়ি বা ঠোঙা বানানোয় হাত লাগাবার কথা ভেবেছে। কিন্তু মালতীর রণংদেহি মেজাজের সামনে পড়তে মন চায়নি। তা ছাড়া, আবার যদি ভালো না লাগে? এবার আর রেয়াত করবে না মালতী। হয়তো ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বেরই করে দেবে। কী দরকার যেচে ঝামেলায় জড়ানোর! তার চেয়ে অনন্ত সময় ধরে জট ছাড়ানো ঢের ভালো। যেন মা-মেয়ের সঙ্গে অলিখিত প্রতিযোগিতা। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা। সামান্য হলেও কিছু টাকা তো দিচ্ছে সংসারে। তবে লাভ যৎসামান্যই। একবার কেনার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হয়। গ্রামগুলোও বেশি বড়ো নয়। গাড়ি ঠেলে দূরে যাওয়াও মুশকিল।

ইদানীং মালতীর আচরণ যেন অদ্ভুত! দূরছাইও করে আবার টাকাও নেয়। যেন ধার দিয়েছিল। টাকা অবশ্য মেয়ের হাতে দেয় তারাপদ! খামোখা সন্মুখ সমরে লাভ কী? তা হলেও, একটু সহানুভূতি পেতে মন চায়। শুনতে চায় সুবুদ্ধির প্রশংসা। আগেরই সেই মাখোমাখো ভাব না থাকলেও, প্রত্যাশা করে নরম সুর। মরুভূমি সবুজ না-ই হতে পারে, তা বলে কী মেঘের ছায়াটুকুও প্রাপ্য নয়? দু’ফোটা বৃষ্টিও কী বেশি চাওয়া হল? হাজার হলেও স্বামী তো! প্রত্যাশার ধারপাশও মাড়ায় না মালতী। মেজাজ রুক্ষতর। দিনগত পাপক্ষয়ে ক্লান্ত। তারাপদ হতাশ। নিজের কর্মকাণ্ডে অতিমনোযোগী। খেয়াল থাকে না, মরা নদীতে জোয়ার আসে না।

ঝুমুর যেন বৈশাখী বাতাস। খরা-মনে শান্তির প্রলেপ। মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি আসে। জট ছাড়াতে হাত লাগায়। ধুয়েও দেয়। তারাপদ বিশ্রাম নেয়। মেয়েলি হাতে কাজ এগোয় তরতরিয়ে। একদিন কাজ করতে করতেই বলল,

‘বাবা… আমাকে একটা জিনিস এনে দেবে?’

‘কী’? তারাপদর প্রশ্রয়। সারা জীবনে মেয়েকে দেওয়া হয়নি কিছুই। কাজ আর মদ খাওয়ার ব্যস্ততায় ফুরসতও মেলেনি! বিয়েটাও দিয়েছিল যত না মেয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি দায়মুক্ত হতে।

ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল ঝুমুর। তারাপদ দেখল পাতা জোড়া ক্রিমের বিজ্ঞাপন। সাত দিনেই বদলে যাবে ত্বকের রং! মেয়ে জুলজুল চোখে তাকিয়ে। মায়া হল তারাপদর। কত না স্বপ্ন মেয়েটার চোখে। ক্রিম লাগাবে, ফরসা হবে, বর নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। গড়ে উঠবে সংসার, আসবে সন্তান, সার্থক হবে নারী জনম!

ভাবনার মাঝেই মাথা নীচু করে ঝুমুর বলল, ‘অনেক দাম জিনিসটার। পাড়ায় কারও কাছে নেই। তুমি…’

‘তুই ভাবিস না মা! আমি নিশ্চয়ই কিনে দেব।’

‘দুশো টাকা!’

দাম শুনে আঁতকে উঠল তারাপদ। এ সপ্তাহে দুশো টাকাই জুটেছে। মালতী নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে। না পেলে কী কাণ্ড বাধাবে কে জানে! যা হয় হবে, মেয়ের শখপূরণ আজ করবেই। কত আশা করে রয়েছে মেয়েটা! জিনিসটা পেলেই হাসিতে ভরে উঠবে মুখ! মেয়ের হাসি মুখকে গুরুত্ব দিয়েই ক্রিমটা কিনে ফেলল তারাপদ। ঝড়-ঝাপটা যা আসে আসুক। ঠিক সামলে নেবে।

 

বাড়ির কাছাকাছি এসে কান্নার আওয়াজ পেল তারাপদ। তবে কি জামাই এল? মেয়ে চলে যাবে বলে মালতী কাঁদছে? নিশ্চয়ই তাই । ভগবান সবাইকেই একসময় সুখের মুখ দেখান। এবার নিশ্চয়ই মেয়ের কথা মনে পড়েছে! হয় জামাইয়ের মত বদল ঘটেছে অথবা মা অসুস্থ হবার কারণে বউয়ের প্রয়োজন পড়েছে। দুটোই মেয়ের পক্ষে মঙ্গল। শ্বশুরবাড়ি গেলে অনেকটাই নিশ্চিন্তি। একটা পেট কমলে মালতীর ভারও খানিকটা লাঘব হবে। অসুবিধে হবে তারাপদর। মেয়ের কল্যাণে যে দু’বেলা জুটত, সেটা হয়তো জুটবে না। চলতে হবে বউয়ের মর্জিমাফিক। সে হোক, মেয়ের সুখের জন্য এটুকু সওয়াই যায়। শুধু ক্রিমটার জন্য মন খচখচ করল। জামাই নিতে এসেছে মানে ওটার আর প্রয়োজন নেই। ফেরত না নিলে খামোখা গচ্চা।

বাড়ি পৌঁছে তারাপদ অবাক। সারা পাড়া ভেঙে পড়েছে উঠোনে। পড়শিদেরও নিশ্চয়ই মন খারাপ। দেখতে যেমনই হোক, সরল ব্যবহারে মেয়েটা সকলেরই মন টেনে নেয়। তাই চলে যাবার আগে সবাই দেখা করতে এসেছে। তারাপদরও দেখতে ইচ্ছে করল মেয়েকে। শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে নিশ্চয়ই লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা কান্না জুড়েছে মায়ের সঙ্গে। কান্না বড়োই সংক্রামক। কিছুতেই বাঁধ দেওয়া যায় না। তবে শুভক্ষণে কাম্য নয় একেবারেই। খামোখা অমঙ্গলের আহ্বান। মা-মেয়েকে সামলাতে এগিয়ে গেল তারাপদ।

‘ও কে ওখানে!’

দোরগোড়ায় বসে মালতী কাঁদছে। সামনে শুয়ে ঝুমুর।

‘ও ওরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন?’ মাথায় কিছুই ঢুকল না তারাপদর।

মালতীর কান্নার তোড় হঠাৎই বাড়ল।

সেই কান্নাই তারাপদকে জানিয়ে দিল, ঈশ্বরের বিধান সকলের জন্য সমান নয়। কাউকে কাউকে তিনি পৃথিবীতে পাঠান শুধুমাত্র দুঃখভোগের জন্যই। নইলে বাপ-মাকে সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়? আচমকাই তারাপদর পৃথিবী যেন থমকে গেল। বাতাস বইছে না, পাখি ডাকছে না, চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। হতভম্বের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। খানিক বাদে বুঝল, পৃথিবী চলছে আপন গতিতে, শুধু তার মেয়েটাই থেমে গিয়েছে।

‘আর সাতটা দিন, তারপরেই শাপমুক্তি।’

ঘুম থেকে উঠেই মাকে বলেছিল ঝুমুর! বাবা আনবে বিশল্যকরণী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল মালতী। সরল মেয়েটার জন্য বুক ফেটেছিল। গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোঁটা জল। সবাই শুধু বাইরেটাই দেখল, ভিতরটায় ভুলেও চোখ বোলাল না কেউ। দুঃখ চাপা দিতেই যে রাগ, বোঝাতেও পারল না কাউকে। সন্তানের ব্যর্থতার দায়ভার তো বাপ-মায়েরই। রাগ হয়, কষ্ট হয়, অনুশোচনায় জর্জরিত হয় মন। কিছু করার থাকলে সান্ত্বনা মেলে, নয়তো তীব্র আক্রোশ! একমাত্র মুক্তি আত্মপীড়নে। সেও বা কতক্ষণ? কাঁহাতক আর না খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে কষ্ট দেওয়া যায়? তাই রাগ গিয়ে পড়ে আপনজনদের উপর। অকারণেই রুঢ় ব্যবহার করে ফেলে মেয়েটার সঙ্গে। স্বামী যদি সহমর্মী হতো, তা হলে হয়তো মনের ভার কিছুটা কমত। কিন্তু সে মানুষটাও দুর্ভোগ, দুর্দশায় অনুভূতিহীন। দুর্বিপাকে কি মানুষ পড়ে না? পড়লে আবার কাটিয়েও তো ওঠে। কিন্তু মানুষটার কোনও চেষ্টাই নেই। সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ইদানীং চেষ্টা অবশ্য করছে। কতদিন স্থায়ী হয় কে জানে! আঁচলে ঠোঁট চেপে বিছানা ছেড়েছিল মালতী। তবে ভালো লেগেছিল মেয়ের প্রতি বাবার সামান্যতম দায়িত্ব পালন। কিছু তো করুক!

 

খবরটা দিয়েছিল বারুইবাড়ির ছোটো-বউ। বাপের বাড়ি জয়নগরে। নিজের চোখে দেখে এসেছে জামাইয়ের নতুন বউ। দিল্লি থেকে বিয়ে করে দিন সাতেক হল ফিরেছে। বিশ্বাস করেনি ঝুমুর। ছোটো বউ যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। অন্যের দুর্ভাগ্যে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করার সুযোগ ছাড়তে চায়নি। মোবাইলে ছবি তুলে এনেছিল। ঝুমুরের ছবিও তুলল। সতিন দেখার ফাস্ট রিয়েকশন। ছবি দেখে চুপ মারল ঝুমুর। তারপর দৌড়। মালতী, তারাপদ দুজনেই কাজে। ফাঁকা বাড়িতে গলায় দড়ি দিল।

মুখে কথা জোগাল না তারাপদর। হাতে তখনও বিশল্যকরণী। বুক ঠেলে কান্না উঠতে চাইলেও, কাঁদল না। কেনই বা কাঁদবে? তেমন করে আর মেয়েকে ভালোবাসল কই যে, হারাবার অনুতাপ করবে? ঝুমুরের মাথার কাছে ক্রিমের কৌটোটা রেখে দাওয়ায় বসল। পুলিশ এল খানিক বাদে। লাশ চলে গেল লাশকাটা ঘরে। প্রতিবেশিরা দু’একজন গেল সঙ্গে। বাকিরা নিজ নিজ কাজে। শূন্য উঠোনে সন্তানহারা বাপ-মা একাকী ।

ঝুমুর ফিরল পরদিন। খাটে শুয়ে, ফুলের মালা পরে। পাড়ার লোকেরাই ব্যবস্থা করেছে। শ্মশানে যাওয়ার ডাক পড়ল তারাপদর।

‘কোথায় যাচ্ছিস মুখপুড়ি? ধার শোধ না করে এক পা-ও নড়তে পারবি না তুই’ , হাউহাউ কান্নায় বলে উঠল মালতী। যদি আটকানো যায়!

রক্ত চলকে উঠল তারাপদর! ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরে ঢুকল। বেরিয়ে এল হাঁসুয়া নিয়ে! সবাই হতবাক। মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি বাপটা?

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারাপদ পৌঁছে গেল মেয়ের শিয়রে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হাসি পেল ঈশ্বরের লীলায়। মেয়েটাকে সামান্যতম রূপ না দিলেও, দিয়েছেন এক মাথা চুল। কোমর ছাড়িয়ে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। ক্ষিপ্র হাতে হাঁসুয়া চালাল তারাপদ। প্রায় গোড়া শুদ্ধ উঠে এল এক ঢাল চুল।

সেই চুলের গোছা হাতে চিৎকার করে উঠল তারাপদ,

‘ধার শোধ…’

 

 

ছবি

অনেক মানুষ জীবনে ভুল করে থাকে, তা হয়তো পরে তার অনুতাপের কারণ হয়। রহমান সামান্য ফুর্তি আর আনন্দ পাওয়ার জন্য যে ভুল করেছিল তা যেন কেউ কোনও দিন না  করে।

হাসানপুরের রহমান আর দীপক ছোটোবেলা থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু। একই বছরে গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স-সহ একজন বিএ অন্যজন বিএসসি পাশ করে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রহমান এমএ পাশ করে একটি গ্রামের স্কুলে মাস্টারি পায়, আর দীপক এমএসসি করে কলকাতার এক নামি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়।

দীপকের মা শান্তাদেবী রহমানকে রমেন বলেই ডাকেন। মায়ের কথামতো দীপকও তাই। শান্তাদেবী রমেনকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। জাতপাতের বিচার তাঁর নেই।

দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুতে বেশ কিছুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মোবাইল থাকলেও পত্র লেখাতেই এদের বেশি আনন্দ। রহমানের প্রতি পত্রেই থাকে ওর ওখানে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। দীপকেরও মাঝে মাঝে কলকাতার গণ্ডিবদ্ধ জীবনধারার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কাজের চাপে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

এবার রহমান লিখেছে, ‘কলকাতার বাবু, বড়োদিনের ছুটিতে না এলে আর পত্র লিখব না। মোবাইলও বন্ধ করে রাখব।’ আগত্যা দীপককে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।

স্টেশনে রহমান নিজে উপস্থিত ছিল। দু’বন্ধুতে দু’বছর পর দেখা। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে একই বিছানায় আশ্রয় নেয়। সারারাত গল্পের পর ভোরের দিকে দুজনেই গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়ে।

– বাবু আপনার প্রাইভেটের ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়েছে। সাতটা বাজে। চাকর রামু দরজায় ধাক্বা দিতে দিতে বলে।

রমেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে, দীপক তখনও অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।

প্রাইভেট পড়ানো প্রায় শেষ হওয়ার মুখে দীপক রমেনকে ডাক দেয়।

– বাবু পড়াতে বসেছে, আপনি মুখ হাত ধুয়ে নেন। চা-জলখাবার রেডি, বাবুরও ততক্ষণে পড়ানো শেষ হয়ে যাবে। রামু এসে জানায়।

– রমেন প্রাইভেট পড়ায় নাকি?

– হ্যাঁ, এখানের সব মাস্টারবাবুরাই তো পড়ায়।

এমন সময় রমেন এসে বলে, ‘দীপক উঠেছিস বুঝি? আমারও হয়ে এসেছে। চা খেয়ে তোকে আমাদের এখানকার বাজার দেখিয়ে আনব।’

রমেনের বাইরের ঘরে আঠারো-কুড়িটি ছেলেমেয়ে একমনে লেখাতে ব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়ে একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে যায় দীপক। পরনে দামি চুড়িদার, গায়ে রুচিসম্মত ওড়না জড়ানো, পিঠভর্তি কোঁকড়ানো চুলে দুটি বেনি, বেনি দুটিতে লাল ফিতে দিয়ে তৈরি দুটি গোলাপ ফুল আঁটা। কি অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা মুখশ্রী। এমন রূপসী মেয়ে দীপক জীবনে দেখেছে কি না সন্দেহ? এই বোধ হয় প্রথম।

আবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে দীপক। হঠাৎ রমেনের ডাকে তার চেতনা ফেরে।

– কিরে আয়, জলখাবার খেতে হবে না?

খেয়েদেয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে বাজারের দিকে। গ্রামটি যেন পটে আঁকা ছবির মতো। বেশির ভাগই ধনী। রমেনের স্কুলটিও বেশ সুন্দর জায়গায়, গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট্ট নদী, রূপসী। এর চারপাশের সৗন্দর্য সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করবে!

বাজার বেড়িয়ে ফেরার পথে হঠাৎ নারী কণ্ঠের ডাকে দুজনেই চমকে ওঠে। দীপক তাকিয়ে দেখে একটি বড়ো বাড়ির বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি। কতরকমের ফুলে ভরা বাগানটির বেশিরভাগই গোলাপ, তাও লালই বেশি।

– মাস্টারমশাই, আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাবা আছেন।

রমেন উত্তর দেয়, ‘আজ থাক্। পরে একদিন আসব।’

– বেশ প্রাইভেট টিউশন শুরু করেছিস রে ভাই, পথেঘাটে আমন্ত্রণ। শুধু পড়ানো, না আরও কিছু? হাসতে হাসতে টিপ্পনি কাটে দীপক।

–সে ভাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। মেয়েটি যদিও আমাদের স্বজাতি, কিন্তু মস্ত বনেদি বাড়ির মেয়ে। কত যে ধনী তা তো দেখেছিস-ই। ওর নাম ফিরোজা। ওর বাবা এখানকার একজন নামকরা ডাক্তার। দুই দাদা, বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, ছোটদাদা বিদেশে গবেষণা করছে। মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো। ভালো রেজাল্ট করে।

– আহা বড়ো বাড়ির মেয়ে তো কি হল? তোর ওকে ভালো লাগে না?

– না ভাই ও জিনিসে লোভ না করাই ভালো। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়ে কী লাভ বল? আমি হচ্ছি গরিব স্কুল মাস্টার। যেমন আছি ঠিক আছি। বুঝলি দীপক তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। মেয়েটির ব্যবহার খুব ভালো। কোনও অহংকার নেই।

দীপক বলে, ‘সত্যি রমেন এমন সুন্দরী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।’

– কিরে তুই দেখছি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস? বলে রমেন।

– তা পড়লে দোষ কি?

সারারাত গল্পের পর ভোরবেলায় দীপক ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোনোর ইচ্ছা তার মোটেও ছিল না। সকাল সাতটায় ফিরোজা আসবে। ওকে দেখার জন্য যে ওর প্রবল একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে আছে, তা তো আর রমেনকে বলতে পারে না। ভোরের ঘুমটা সব বারোটা বাজিয়ে দিল।

দীপকের ঘুম ভাঙল রমেনের ডাকে। সব ছাত্র-ছাত্রী তখন চলে গেছে যে যার নিজের বাড়িতে।

– কিরে ওঠ। ন’টা বাজে যে।

– ন’টা, আমাকে তুলিসনি কেন?

– তোমার সুন্দরী নূরজাহান আজ আসেনি বন্ধু। উঠলেও কিছু লাভ হতো না।

– বাঃ নামটা বেশ দিয়েছিস তো? ওই নামেই ওকে ডাকা উচিত। কি বলিস রমেন?

সেদিন ওরা ঘুরতে ঘুরতে ফিরোজাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। রমেন অবশ্য বারকতক গেছে এর আগে। কাছে যেতেই ফিরোজার মধুর আহ্বানে ফিরে তাকায় দুজনেই।

– একি, ফিরোজা তুমি! বলে রমেন।

পরনে জাফরানি রঙের চুড়িদার, নীল ওড়না, তার দুটি বেনিতে ওদেরই বাগানের দুটি রক্ত গোলাপ।

সত্যি এ মেয়ের তুলনা বুঝি কারও সাথেই চলে না। দীপক অবাক হয়ে ভাবতে থাকে।

এবার আর ফিরোজার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না ওরা। তবে দীপকের আর এক দফা অবাক হবার পালা। যেরকম সুরুচি সম্পন্ন আসবাবপত্র, সেরকম নিপুণ হাতে সাজানো সারা বাড়িটি! গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা জাগে তার।

ফিরোজার বাবার সাথে আলাপের পর ফিরোজাকে জিজ্ঞাসা করে রমেন, ‘আজ পড়তে যাওনি কেন?’

‘উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল স্যার।’ ছোট্ট উত্তর ফিরোজার।

এবার দীপকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে রমেন। কথায় কথায় প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে যায় ওদের। ফিরোজার মা আর বড়ো দাদার সাথেও পরিচয় হয় দীপকের। ফেরার সময় ফিরোজা ওদের মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আবার আসার আনুরোধ করে।

পথে নেমে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে দুটি নির্বাক মন। মৌনতা ভেঙ্গে রমেন প্রশ্ন করে, ‘কিরে দীপক বাকশক্তি হারিয়ে ফেললি নাকি?’

– তা হারালে দোষের কি ভাই!

– তুই কী ভাবছিস বল তো?

– ভাবছি, ভগবানের কি নিখুঁত তুলির কাজ।

– কিন্তু একটু ওলট-পালট হয়ে গেছে বন্ধু। তবে এ ব্যাপারে মন খারাপ কোরো না, ঘটকালিটা না হয় আমিই করব!

পরদিন অবশ্য ঘুম থেকে উঠতে দীপকের দেরি হয় না। তখন রমেন পড়াতে বসে গেছে। দীপক একটু ঘোরাফেরা করে সামনের রাস্তায়। দূর থেকে ফিরোজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখে ফিরোজা ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি মেয়েটিকে যেন সবসময় দেখতে ইচ্ছা করে। চোখ ফেরাতে মন চায় না। কেন যে এমন হয়?

ফিরোজা এসেছে আজ দেরি করে। আগের দিন আসতে পারেনি তাই আজ সবার ছুটির পরেও ফিরোজা একাই কিছুক্ষণ পড়ছে। রমেন ওকে পড়াচ্ছে। বাড়ির থেকে গাড়ি এসে ওকে নিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে দীপক আসে সেখানে। বলে,‘ রমেন এবেলা আর তোকে বাজারে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি।’

– আরে বাবা বোস না একটু এখানে, দুজনেই যাব। ফিরোজার গাড়ি এল বলে। হ্যাঁ ফিরোজা, তোমার বই রেখে যেও।

দীপক বলে, ‘আমি ভেতরে যাচ্ছি। তুই আয়, তারপর দুজনে বেরোব।’

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ফিরোজার বইটি দাগ দিতে দিতে বইয়ের ভিতরে একখানা ছবি দেখে রমেন দীপককে ডাকে।

– শোনো শোনো দীপকবাবু, তোমার স্বপ্নসুন্দরী নিজেই ধরা দিয়েছে। একবার এসে দেখে যাও।

ফিরোজার একখানা ছবি। শাড়ি পরা, চুল একই ভাবে সামনের দিকে বেনি বাঁধা আর তাতে গোঁজা ফুটন্ত লাল গোলাপ। মেয়েটা সত্যিই খুব ফুল ভালোবাসে।

দীপক ছবিটা রেখে দেয় নিজের কাছে গোপনে।

সেদিন রবিবার। দুপুরের দিকে রমেন পড়াশোনা করছে।। বিকেলে রমেনের টিউশনি আছে। আজ আর ফিরোজাদের নয়, অন্যদের। দীপক আস্তে আস্তে হেঁটে নদীর কাছাকাছি চলে যায়। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে চুপ করে বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে হয়, এখানকার সবই সুন্দর। রমেনটা বেশ আছে।

– আপনি এখানে যে সাহেব?

হঠাৎ ফিরোজার ডাকে তাকায় দীপক।

– এমনি বসে আছি। রমেনের ব্যাচ আছে তাই। তা তুমি এদিকে কোথায়?

– আমি আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে আসছি। চলুন না আমাদের বাড়ি। বলে ফিরোজা।

– না আজ থাক। তাছাড়া রমেনও সঙ্গে নেই। তুমি বুঝি মোটর সাইকেল চালাতে পারো?

– হ্যাঁ কিছুদিন হল শিখেছি। আপনি কলকাতায় থাকেন তাই না।

– হ্যাঁ ওখানে একটা কলেজে পড়াই।

– স্যার বলেছেন।

– তোমার নাম তো ফিরোজা?

– হ্যাঁ সাহেব।

দীপক বলে, ‘নূরজাহান তোমার উপযুক্ত নাম।’

– ধ্যাৎ কি যে বলেন। লজ্জায় মুখ নামায় ফিরোজা।

– আমি এখন যাই। যাবেন স্যারের সাথে আমাদের বাড়ি।

–আচ্ছা ফিরোজা তুমি আমাকে সাহেব বললে কেন?

– বাঃ রে আপনার গায়ের রং সাহেবকেও হার মানায়। সাহেব, এবার আমি আসি।

বলেই মুচকি হেসে ফিরোজা বাড়ির পথ ধরে।

ফিরোজার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীপক। সত্যি এই বুঝি ভালোবাসার নিয়ম। এদিকে কখন যে রমেন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি দীপক।

– কিরে তুই এখানে? আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অমন করে কী দেখছিলিরে ভাই?

– তুই তো সবই দেখেছিস। আবার জিজ্ঞাসা করছিস কেন?

– দীপক তুই ভুল করছিস। এ হবার নয়।

– কেন নয়? ভালোবাসা কি মানুষ ইচ্ছা করে করে? ভালোবাসা কি চেষ্টা করে করতে হয়? ভালোবাসা হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই হয়তো হয়ে যায়। যখন এমন ঘটে যায় তখন জাত-ধর্ম খড়কুটোর মতো উড়ে যায়।

– তা না হয় হল, কিন্তু ওর বাবাকে তুই চিনিস না। তাছাড়া তোর মা কি মেনে নেবেন? দ্যাখ ফিরোজাকে তুই ভুলে যা ভাই। বলিস তো সুন্দরী শিক্ষিতা তোর উপযুক্ত মেয়ে আমি দেখি।

দীপক নিরুত্তর থাকে।

দেখতে দেখতে দীপকের ছুটিও একদিন শেষ হয়ে যায়। বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় কলকাতায়। ছবিটা রয়ে যায় দীপকের কাছে আর মনটা পড়ে থাকে ফিরোজার কাছে।

বন্ধুর চিঠিতে ফিরোজার খবরাখবর দীপক মাঝে মাঝে পায়। ফিরোজাকে দেখতেও মন চায় কিন্তু লজ্জায় এত তাড়াতাড়ি বন্ধুর ওখানে যেতে পারে না।

কেটে যায় একটা বছর।

যৌবনে নারী-পুরুষ দুজনে দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এতে দোষের কিছু নেই। যদি জাত, ধর্ম, বয়স সব ক্ষেত্রে মিলে যায়, তাহলে তাদের প্রেম সঠিক পথে এগোয় আর যদি এগুলি না মেলে, তাদের প্রেমের পথে বাধা আসে প্রচুর। দীপকের বেলাতেও তাই হল। কোনও ব্যতিক্রম ঘটল না।

ছেলের বইয়ের আলমারি গোছাতে গিয়ে একটি সুন্দরী মেয়ের ছবি পান দীপকের মা শান্তা। ব্যস সেই শুরু! এ মেয়েকে তাঁরও খুব পছন্দ। কিন্তু যখন জানতে পারলেন এ মেয়ে ভিন্নধর্মের, আর এর সূত্রপাত রমেনের বাড়ি, তখন রমেনকে আসতে পত্র লিখলেন। সব জেনেও ছেলের বিয়ের জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করলেন। ছেলের বন্ধুকে নিজের ছেলের মতো দেখা, সে যতই বিধর্মী হোক, তা দোষের নয়! তবে একটি মুসলমানের মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনা সেটা বোধ হয় কোনও হিন্দু মা-ই পারে না। এতটা উদার মনের মানুষ দীপকের মা-ও নন এইক্ষেত্রে।

নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগল। কয়েকটি মেয়ে সত্যিই সুন্দরী। অবশেষে একটি মেয়েকে পছন্দ করে তাদের বাড়িতে ওর মা কথা দিয়ে এলেন। দীপক কিছুতেই রাজি হল না।

এদিকে ফিরোজার অবস্থাও সঙ্গিন। প্রথম কয়েকবার চিঠি  আদান-প্রদানে বাড়ির কেউ তেমন জানতে বা বুঝতে পারেনি। পরে সব জানাজানি হয়ে যায়। পাছে রহমানের মাধ্যমে সূক্ষ্ম যোগাযোগ থেকে যায় এবং কোনওদিন ওরা লুকিয়ে চলে যেতে পারে এই ভয়ে, ফিরোজার বাবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মেয়েকে সৌদি আরবে ওর কাকার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

বছর দুই পরে ওখানেই ফিরোজার কাকা বিয়ের ঠিক করেন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে! কোনও কিছুতেই কোনও শুভফল হল না! ছেলেটিকে সব কথা জানিয়ে দেয় ফিরোজা।

অবশেষে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে প্রায় জোর করে রহমানের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেন ফিরোজার বাবা ডাক্তারসাহেব। রহমানকে তিনি অনেকদিন ধরেই দেখছেন। পাত্র হিসাবে মোটেই খারাপ নয়। হয়তো ওদের মতো ধনী নয়, তবে ছেলেকে বাড়ি, গাড়ি, মূল্যবান জিনিসপত্র আর মেয়েকে সোনা দিয়ে মুড়ে দিলেন। সর্বতোভাবে মেয়েকে সুখী করার চেষ্টা করলেন!

এতেও ফল ভালো হল না। মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই তবে ফিরোজা বা রহমান কেউই সুখী হল না জীবনে। প্রথম প্রেমিককে ফিরোজা কিছুতেই ভুলতে পারল না। ফিরোজার মন আর ভালোবাসা কোনওদিনই পেল না রহমান। নিত্য অশান্তি আর অসুখের সংসার করতে করতে দুজনেই জেরবার। ফিরোজার মনে আজও একটা সংশয়, দুদিক দিয়ে কথা চালাচালি রহমানই করেছে তাকে পাওয়ার জন্য। হয়তো এই জন্যই ওর বাবা এ বিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে মায়ের চোখের জলের কাছে হার মেনে মায়ের কথা দেওয়া মেয়েটিকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয় দীপক। মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অপরূপা না হলেও বেশ সুন্দরী। তবে ফিরোজাকে শত চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারেনি আজও। এ নিয়ে ওদের সুখের সংসারে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তবুও অনেক যন্ত্রণা, অনেক কষ্টের পর একটি পুত্র সন্তান এসেছে ওদের সংসারে।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। ফিরোজার ছবিটি এখনও আছে দীপকের কাছে। সেই ছবিটি সে নিজের হাতে রং তুলি দিয়ে এঁকেছে। ছবিটি এতটাই জীবন্ত যেন এক্ষুনি কথা বলবে। সেটি সে রহমানকে পাঠিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে।

শান্তি-অশান্তি নিয়ে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকটা বছর। দেখতে দেখতে দীপকের ছোট্ট ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেল। সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বর্তমানে চেন্নাই-এ কর্মরত। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশ যাবে। দীপকের মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ফিরোজার আর বেশি খবর সে রাখে না। হয়তো রহমানের সাথে ভালোই আছে!

ঘটনার চোরাস্রোতে এক বর্ণমুখর সন্ধ্যায় রহমানের সঙ্গে হঠাৎ দীপকের দেখা হয়ে যায়। প্রথমে না চেনার ভান করে রহমান। পরে অবশ্য সবই বলে সে দীপককে। চেহারারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে রহমানের। ওর কাছেই জানতে পারে, ফিরোজা আর বেঁচে নেই। রমেন এখন ফিরোজাদের গ্রামে থাকেও না। তার একমাত্র মেয়েকে ওর মামা নিয়ে চলে গেছে, তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ। তারপর থেকে সে তাকে আজও দেখেনি! ওখানকার স্কুলের চাকরি অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে।

শত অনুরোধ সত্ত্বেও রহমান সেদিন দীপকের বাড়িতে যায়নি। কোথায় থাকে, কীভাবে চলছে তার সেসব কিছু সে বলেনি। যেমন এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

বাড়ি ফিরে দীপক একটি মজার কথা শোনে ওর স্ত্রীর কাছে। তার ছেলে রোহন নাকি তহমিনা বলে একটি প্রবাসী মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে সে বিয়ে করবে। এ বিয়ে যেন বাড়ি থেকে মেনে নেওয়া হয়।

মনে মনে হাসতে থাকে দীপক।

ফিরোজার বাবা ডাক্তার সাহেব বেঁচে আছেন। রহমান ফিরোজারা আজ না থাকলেও, ওদের বাড়িটি রং করানো চলছে, ঘরের সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে। তবে বাড়ির দেখভাল করার লোকটি একটি ছবি সরিয়ে ফেলে, কলকাতায় বিক্রি করলে এসব ছবির ভালো দাম পাওয়া যাবে ভেবে। বিয়ের পর ডাক্তার সাহেবের নাতনি নাতজামাই এই প্রথম আসবে। তাই এই সাজ সাজ রব। এত আয়োজন। অবশ্য মা মরা তহমিনার বিয়ে দিয়েছে ওর ছোটো মামা।

এদিকে রোহন তার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসেছে। ওদের মেনে নিতে হয়েছে সবকিছু। কিন্তু বউমাকে দেখে দীপক অবাক। একি! এ যে ফিরোজার প্রতিমূর্তি। ঠিক যেন যৌবনের ফিরোজা। এ কী করে সম্ভব?

রোহন যে-মেয়েটিকে বিয়ে করেছে তার বাবা মা কেউ নেই। ধনী মামারাই তাকে মানুষ করেছে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই সে প্যারিসে মানুষ। এখন চাকরি করে প্যারিসেই। রোহনকে তার কোম্পানি প্যারিসের একটি প্রোজেক্ট হ্যান্ডল করতে পাঠায়। সেখানেই তহমিনার সঙ্গে  তার আলাপ এবং প্রেম। মা-বাবা রাজি থাকায় রোহন আর দেরি করতে চায়নি। বিয়েটা সেরে ফেলে চটজলদি। এদিকে মা বাবা কাউকেই তহমিনার ভালো করে মনে নেই। ছোটোমামার কাছেই সে থাকত। তহমিনার মুখে তার মামার বাড়ির কথা শুনে স্তব্ধবাক্ হয়ে যায় দীপক। ডাক্তারসাহেবের সঙ্গে তার কি নতুন করে আত্মীয়তা তৈরি করা উচিত? নাকি পরিচয়টুকু গোপন-ই থাক– এই দোলাচলে মনটা বেশ অস্থির হয়ে ওঠে তার।

দীপক ভাবে তার মা যা পারেননি ওদের তা পারতে হল। রোহনদের এ বাড়িতে আসা বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। রোজই বিকালের দিকে ওরা কোথাও না কোথাও বেড়িয়ে আসে। এই কদিনে অনেক জায়গা ঘুরে, দেখে এসেছে। আর কদিন পরে ওরা যাবে তহমিনাদের বাড়িতে। ওখান থেকেই চলে যাবে নিজেদের কাজের জায়গায়।

সেদিন রোহন-তহমিনা রাত্রে ফিরে একটি মজার ঘটনা শোনায়। আজ একটি ছবির দোকানে ওরা একখানি বাঁধানো ছবি দেখে অবাক হয়ে গেছে। ছবিটি অপরূপা এক নারীর। ছবির নীচের কোণে ডি কে স্বাক্ষর করা। আশ্চর্যের ব্যাপার ছবিটি যেন হুবহু তহমিনাকে দেখে আঁকা।

সবই বুঝতে পারে দীপক। ফিরোজাকে উপহার দেওয়া তারই নিজের হাতে আঁকা ছবি।

আজ সকালে মাকে নিয়ে রোহনরা দক্ষিণেশ্বরে গেছে। বিকালে ওরা ছবিটি কিনে নিয়ে আসবে বলে ঠিক করেছে। ভেবে কূলকিনারা পায় না দীপক কী করবে সে এখন। আজ বাড়িতে কেউ নেই, যা করার তাকে এবেলাতেই করতে হবে। আজ সে কলেজে যাবে না।

এগারোটা নাগাদ সে ছবির দোকানে যায়। বহু অর্থের বিনিময়ে দীপক ছবিটি কিনে নেয়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে খবরের কাগজে মোড়া ছবিটি গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। সেই সঙ্গে ফিরোজার বই থেকে পাওয়া ছবিটিও।

যে অন্তরে আছে তাকে বাইরে রেখে লাভ কি? ডি কে নামের অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেষে সব জানাজানি হওয়ারই বা দরকার কি!

 

মেঘলা আকাশ

মেঘলা, আকাশ মেঘা বলে ডাকে। নামটা বেশ রোমান্টিক। সূর্য হাপুচুপু খায়। ভিজে যায় শরীর। আবার কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদে মন। আকাশ যখন মেঘা বলে ডাকে,মেঘার শরীরজুড়ে শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়। আকাশের চোখে মুখে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ লেপটে রয়েছে।

দীর্ঘ শীতাবকাশের পর আজ ছিল কলেজ খোলার দিন। কলেজ ফেরত আকাশ রোজকার মতো ফিরছে তার মেসে। কিন্তু মেঘার সঙ্গে দেখা হয়নি! এই পাহাড়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শীতের ছুটি পড়ে ডিসেম্বর মাস থেকে। মেঘা আসেনি কেন বুঝতে পারছে না আকাশ। অথচ, ওর তো আসার কথা ছিল। কিংবা একটা তো খবর দেবে। এমন তো করে না মেঘা!

কলেজের শেষ পিরিয়ডটা করে বেশ কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে দু’কাপ চায়ের ধূমায়িত পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে সেসব কথা। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে মেসে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। কিছুটা আলো থাকলেও সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই। এমন সময় আকাশের মুখ ভার। মেঘের গর্জন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি কিংবা বিদ্যুতের ঝিলিক। ঝোড়ো পরিবেশ। কারেন্ট নেই। বিদ্যুতের ঝলকানির আলোতে ঝাপসা পথটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বেশ কয়েকটা চড়াই-উতরাই পার করে আকাশের ছাত্রাবাস। সবুজ চা-বাগিচায় মোড়া সুখি উপত্যকার ঢালে মেস। স্থানীয় একজনের বাড়িতে প্রায় চার বছর ভাড়া রয়েছে। কাঠের সারি সারি ঘর, খুব পরিচ্ছন্ন আর লম্বা সরু এক ফালি বারান্দা। এই বারান্দা থেকে দূর পাহাড়ের বসতি ও উপত্যকায় চা-বাগিচার সবুজ যেন চুঁইয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য চোখের আরাম হয় বইকি।

এই পাহাড়ি শহরে অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার ডিগ্রি করছে আকাশ-মেঘলা। বিষয় ভূগোল। ফাইনাল ইয়ার। আর প্রথম যেদিন ভর্তি হতে আসে সেদিন মেঘলার সঙ্গে পরিচয়। মেঘলার মাস্টারমশাই মনোময়বাবু সজ্জন মানুষ। প্রথম দিনই আলাপ জমে যায় আকাশের সঙ্গে। মেঘলাকে ভর্তির পর ক্যান্টিনে মোমো খেতে খেতে সব কিছু মনের কথা উজাড় করে দিয়েছেন মনোময় স্যার। আকাশের সহযোগিতায় মেঘলার জন্য একটা ঘরে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করেন মনোময়বাবু। কিছুটা গার্জেনের ভূমিকা পালন করেন।

আজ দুর্যোগের দিন। মনখারাপ করা বিকালে হাঁটতে থাকে একাকী আকাশ। সাতপাঁচ ভাবতে থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। সবুজ কচিপাতায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি বিকালের রোদে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। পাহাড়ের সামনের ঢালে বৌদ্ধ মন্দিরে সান্ধ্য আরাধনার প্রস্তুতি চলছে। ঘন ধুপিগাছের সরলবর্গীয় কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি ঠিকরে পড়ছে চোখে মুখে। আরও কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা পার হলেই হেয়ার পিন বেন্ড পথ। তামাটে বিকালের রং চোখে মুখে।

দুর্যোগ কিছুটা কমল মনে হচ্ছে। বাঁকটার কাছে আসতেই কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল আকাশ। এই পথ যা স্মৃতির সরণি বেয়ে উঠে গিয়েছে শর্বরী পার্কে। বেশ কিছুটা ছায়া-সুনিবিড়, সমতল সবুজ ঘাসের মখমলে ঢাকা। দেখা যায় তুষারধবল কাঞ্চনজঙঘার মোহনীয় রূপ। কিছুটা পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া। রামধনু আকাশ ছুঁয়ে পাহাড়ের উপত্যকায় যেন জিরিয়ে নিচ্ছে। আকশের নীচে সবুজ উপত্যকা যেন সাতরঙের পেখম মেলেছে।

যেদিন শীতের ছুটি পড়ল সেদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিল আকাশ মেঘলা এইখানে। সেইসব স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। প্রায় দিন কলেজ শেষে এই পার্কে বসত। একটা ভিউ পয়েন্ট। পরিচ্ছন্ন আবহাওয়ায় মেঘেদের লুটোপুটি উপত্যকার বুকজুড়ে। দেখতে দেখতে কত সময় কেটে গেছে তাদের।

কখনও মেঘের দল এসে আকাশ-মেঘলাকে ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েও খুঁজে পেয়েছে। হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার একটা আনন্দ আছে বইকি! গভীর খাদটা যখন ভরে যেত মেঘে মেঘে তখন মনে হতো মেঘের সাগর। বিকালের ফুরফুরে হওয়ায় একটা ফুরফুরে মেজাজ। মেঘার এলোচুল কপালে চোখে মুখে উড়তে থাকত। আর ছোটো সাদা ধবধবে হাত দুটো দিয়ে নিমেষে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত মেঘলা। একটা দূরত্ব রেখে বসত দুজনেই।

লাল টুকটুকে ঠোঁটের ওঠানামায় আর চোখে কী দারুণ একটা মাদকতা ছিল মেঘলার। দূর থেকে দেখত কীভাবে মেঘেরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ। দেশলাই-বাক্সের মতো পাহাড়ি গাঁয়ের বসতি দেখা যায়। আর যে-পাথরটায় রোজ বসে গল্প করত সেই পাথরটাও খুব আপন হয়ে গিয়েছিল। দিনের শেষে বাগিচার শ্রমিকরা পিঠের ওপর দুধের শিশু নিয়ে ঘরে ফিরত। একটা সর্পিল পথ এই পাহাড়ের বাঁকটা ছুঁয়ে বেশ কিছুটা নীচে অন্য উপত্যকায় নেমে গিয়েছে। এই পথের নিয়মিত পথচারীরাও তাদের চিনে ফেলেছিল।

লেখাপড়ার গল্প আর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে বেশি আলোচনা চলত। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত না কেউই। ভাসা ভাসা কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকত নির্ভেজাল মনের গল্প। রাতের বিছানায় স্মৃতি রোমন্থনে দুটো মন সময়ের বয়সে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে।

খুব দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা মেঘলার। মনোময় স্যার না থাকলে এই নামি কলেজটায় আসতেই পারত না। আকাশ প্রথম দিন কিছু কথা শুনেছিল মনোময়বাবুর কাছে।

এই সেই পাহাড়ি বাঁক, যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে জীবনের প্রায় সব কথাই বলেছিল মেঘলা। আকশের মনে পড়ছে এখন সে সব কথাকাহিনি। মেঘলা সেদিন বলেছিল, ছোটো বোন চন্দ্রিমার কথা। বাবার কথা মনে করতে পারি না। মেঘলার মা সীমা জ্যোৎস্না রাতে ফুটফুটে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনিয়েছে হারিয়ে যাওয়া পিতার গল্প। সেসব কথাও বলেছে মেঘলা আকাশকে একটু একটু করে। মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা সইফুদ্দিন আকাশে তারা হয়ে জ্বলছে। পরে তারা দেখতে দেখতে যখন বড়ো হয়েছে সব বুঝেছে।

মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি নদী সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট লাগোয়া অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত কিছু খাসি জনজাতির বাস। আর পাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোটো গাঁয়ে বসবাস করত মেঘলাদের আদি খাসি পরিবার। সইফুদ্দিন সিলেটের বাসিন্দা। পুরুষানুক্রম থেকে চলে আসা ওদের মৎস্যশিকার আর জমিতে কৃষিকাজ-ই ছিল জীবিকা। পরিবহণ ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল সইফুদ্দিন।

নৌকা নিয়ে প্রায় দিন ডাউকি নদীর জল ভেঙে মাছ ধরত! কখনও পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে নৗকাবিহার করাত। কিছুটা পর্যটনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। ভালোই আয় হতো। আসা যাওয়ার পথে এই পাহাড়ি বসতির মানুষজন তার মুখচেনা হয়ে যায়। প্রথমে পরিচয়, মন দেওয়া নেওয়া তারপর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়! সীমা সফি বলে ডাকত। সফির বাবা মা পরিবার তা মেনে নেয়নি। ঘর থেকে পালিয়ে সীমার বন্ধনে আবদ্ধ হয় সফি।

খাসি পাহাড়ের পাদদেশে সুখের সংসার পেতেছিল সীমা-সফি। সইফুদ্দিন চোস্ত খাসি ভাষায় কথা বলতে পারত। বিয়ের পর দায়িত্ব বেড়ে যায় সফির। পরবর্তীতে পর্যটকদের সঙ্গী করে নৌকাবিহার পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হয়। তার নৗকাটাও বেশ সাজানো। নৌকার গায়ে আঁকা থাকত নদী, বিভিন্ন মাছের ছবি। ডাউকি বাজারলাগোয়া ডাউকি নদীর ঘাট পর্যটন মরশুমে পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা থাকত। নিশ্বাস ফেলার সময় হতো না সফির। নদীর স্বচ্ছ জলে নৌকা বিহার এখানে খুব জনপ্রিয়। আবার অফসিজনে কখনও মালবাহী ছোটো গাড়ি নিয়ে শিলং চেরাপুঞ্জি রওনা দিত। প্রায় দিন পাহাড়ি পথে সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরত।

সীমা ভুট্টা খেতে ভালোবাসত। সারাদিন স্টিয়ারিং ধরে ক্লান্ত অবসন্ন শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিত সীমার কোলে। সন্ধ্যায় ওরা দুজনে ডাউকির তীরে ভুট্টা খেতে খেতে গল্প করত। ডাউকি নদী যেন সীমা সফির কাছে ভালোবাসার পূণ্যতোয়া। রামধনু রঙে মাখামাখি জলে হরেক রকমের মাছের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে বাসায় ফিরে যেত। এ ছিল তাদের রোজকার রুটিন।

মেঘলার মা সীমা সেই স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রিয় সফিকে খুঁজে পেত। স্মৃতির চাতালে আজও দপদপ করে সেইসব দিনের কথা। মায়ের কাছে শুনেছে মেঘলা– তখনও সন্ধ্যা নামেনি, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে পাহাড়, যেন নৃত্য করছে। ডাউকির মাছরাঙা জল, উথলে উঠছে আকাশ ছোঁবে বলে। এমন একটা ধবংসলীলার চলচ্চিত্র সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিল মা।

বাবা গাড়ি নিয়ে চেরাপুঞ্জির রাস্তায় ছিল সেদিন। শুনেছি বহু মানুষ সেই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল। তারপর চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। কিছুটা সামলে আবার বলতে থাকে– সেই সন্ধ্যায় আর ফেরা হয়নি সফির। আসলে সেই সময়টায় কে কোন দিকে গিয়েছে জানা যায়নি। আত্মীয়স্বজন অনেকেই খবর নিয়েছে কিন্তু খোঁজ মেলেনি বাবার। মেঘলা বলে, মায়ের কাছে শুনেছে বীভৎস সেই রাতের কথা।

সবুজ শৈলশিরাটা যেখানে শিকলের মতো নদীর স্রোত ছুঁয়েছে সেই ঢালে বিক্ষিপ্ত জনবসতি সেখানেই দু-কামরার সীমা-সফির সাধের ছোটো সাংসার। কুটির বলাই ভালো। নদীর কাছে কিছুটা সমতল জায়গায় কয়েকজন মিলে তাড়াহুড়ো করে বার হয়ে আসে তাই বেঁচে যায়। বহু ছবির মতো পাহাড়ি বসতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণশিবিরে আশ্রয়।

তখন মা সন্তানসম্ভবা। একটি ত্রাণশিবিরে প্রথম প্রসব! সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। যদিও বৃষ্টি-মেঘের খেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সীমা যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। ত্রাণশিবিরের সকলে নাম রেখেছিল মেঘলা, চন্দ্রিমা।

এরপর ডাউকি নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। সীমান্তঘেঁষা উত্তর-পূর্বের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত ডাউকি নদীর সীমান্তঘেঁষে মেঘার পাহাড়ি গ্রাম। ঢিলছোড়া দূরত্বে বাংলাদেশের সিলেট শহর। খাসি ভাষা একটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা যা মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচলিত।

ত্রাণ শিবিরের পর কোনওরকম একটা তাঁবুর মতো ছেঁড়া প্লাস্টিকের ছাউনিতে ঠাঁই হয়। কিংবা বর্ষার দিন প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় ঠাঁই নিত। মেঘালয়ের ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির মতো বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল দরিদ্র পরিবার। খাসি রমণী সীমা পরিশ্রমী। দুই কন্যাসন্তানকে শিক্ষায় আচার-আচরণে উন্নত করেছে সে। মায়ের স্থানীয় হোটেলে রান্নার কাজ নেওয়া, কখনও-বা ডাউকি নদীর ঘাটের কাছে ছোটো দোকান দিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করা। এসব জীবনযন্ত্রণার কথা দিনের পর দিন বলেছে মেঘলা আকাশকে।

ডাউকি নদীর বর্ডার প্রসিদ্ধ প্রাকৃতিক পর্যটন। নদীর মনোলোভা সৗন্দর্য চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে পর্যটকদের। এরকম মনোরম পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেঘলার।

ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়ে যায় চন্দ্রিমার। ভীষণ জেদ ছিল মেঘলার। বড়ো হবার জেদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের খুব কাছ থেকে দেখেছে নদীতে নৗকা বিহার করতে। মায়ের সঙ্গে ডাউকি নদীর ধারে দোকানদারি করেছে সে। স্কুল পড়াশোনা, পাহাড়ের ঢালে জ্বালানি সংগ্রহ এই ছিল রোজকার রুটিন। শুকনো কাঠের জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কতবার কাঁটাঝোপে দুই বোনের আপেলের মতো গাল চিরে রক্ত ঝরেছে। সেই রক্ত রোদে জলে ধুয়ে গিয়েছে। খেয়ালই নেই মেঘলা, চন্দ্রিমার। ডাউকি নদীর আয়নার মতো জলে যখন সূর্যাস্ত হতো সিঁদুর মেঘের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত, তারপর ক্রমশ ঘন রাত আঁকড়ে ধরত ডাউকির এই পাহাড়ি গ্রামকে।

ডাউকির জনপথলাগোয়া ফুটপাথেই ছিল সীমা-মেঘলা-চন্দ্রিমার বাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। তারপর হাইস্কুল উচ্চমাধ্যমিক স্তর পার করেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকত মেঘলা। দূর পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতলে সিলেট শহরের রূপ দেখতে কখন সে আনমনা হয়ে পড়ত।

খাসি ভাষার কবি সো সো থামের কবিতা পড়তে ভালোবাসত মেঘলা। খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে এই প্রাচীনতম জনজাতির বাস। প্রকৃতি, প্রেম, কল্পনা, মননশীলতায় ভরপুর সো সো থামের খাসি কবিতার পুস্তকটি ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে মেঘলা। এমন সুন্দরী সবুজ উপত্যকায় বসে দেখেছে পাহাড়ি ঝরনা আর সূর্যমেঘের লুকোচুরি। পিতৃহারা মেঘলা-চন্দ্রিমা দেখেছে তাদের মায়ের কঠোর শ্রম।

কল্পনা, প্রকৃতি আর বাস্তবতা এসব নিয়ে তাদের ছোটো সংসার।নংক্রেম নৃত্যও অতি প্রসিদ্ধ খাসি উৎসব। লোক নাচে বেশ দক্ষ ছিল মেঘলা চন্দ্রিমা। পুরোনা অ্যালবাম ঘেঁটে কয়েকটা স্কুলজীবনের নাচগানের ছবিও দেখিয়েছে। চন্দ্রিমা ভালো গান গাইত। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের উপজাতীয়দের পার্বণ বেহদিয়েংখ্লাম পালিত হয় প্রতি বছর জুলাই মাসে। গারোরা পালন করেন ওয়াংগালা উৎসব যা আদতে সূর্যের উপাসনা। এসব কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা নেমেছে পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলত মেঘলা। দার্জিলিং পাহাড়ের সিঙ্গালিলা শৈলশিরায় বসে কলেজপড়ুয়া আকাশ জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মেঘলার কথা শুনেছে।

‘প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাধ্যামিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেশ কিছুদিন বাড়িতেই বসেছিলাম। কয়েকজন প্রতিবেশীর বাচ্চাদের টিউশন পড়াতাম।’ আকাশকে তাদের পরিবারের অনেক কথাই বলেছে মেঘলা। ‘জানো, স্যার আসত প্রায় খোঁজখবর নিতে। বোনের খুব ছোটোতে বিয়ে হয়ে যায়। পরির মতো টুকটুকে সুন্দরী বোন। ঘটকের পাল্লায় পড়ে আমারও বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল বহুবার। কিন্তু রাজি হইনি। বাড়ির কোণে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। পরে একদিন স্যার কে সব কথা বললাম। আমি শুধু পড়তে চাই।

স্যার আমাদের ক্লাসে বলতেন, ‘মেয়েদের পড়তে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।’ সে অনেক কথা– বলতে বলতে চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। মনোময় স্যার প্রবাসী বাঙালি। শিলং শহরে তাদের বাস। প্রাচীন বাঙালি পরিবার। অবিভক্ত দেশের এই পাহাড়ি স্কুলটা ডাউকি সীমান্তে অবস্থিত। মনোময় স্যার এই স্কুলের একজন শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগে মেঘলার এতটা পথ আসা। মেঘলা বলেছিল, সে পড়তে চায়! বড়ো হতে চায়। এদিকে মনোময় স্যার অবসর নেন যে-বছর, সেই বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মেঘলা।

মাধ্যমিক পাস করবার পর থেকে অভাবী ঘরের মেধাবী ছাত্রী সকলের নজর কাড়ে। মনোময় মেঘলাকে স্নেহ করতেন। তিনি দুঃস্থ অসহায় পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা করতেন। মনোময়বাবুর সহযোগিতা নিয়ে দার্জিলিঙে ভূগোল পড়তে আসা মেঘলার। সব কথাই আকাশকে বলেছিল মেঘলা দার্জিলিঙের শর্বরী পার্কের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে। কোনওদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গাঢ় অন্ধকার নামত পাহাড়ে।

ভোঁ ভোঁ শব্দে মেঘের চাদর ফুঁড়ে ফিরতি জিপগাড়িগুলো পাকদণ্ডি পথে হর্ন বাজিয়ে চলছে। সার্চলাইটের মতো গাড়ির হেডলাইট মেঘার কখনওবা আকাশের চোখে মুখে পড়ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে ফিরে যেত আপন আপন মেসে। একদিন তো ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসব থরেথরে সাজানো স্মৃতি কথাগুলো মনে করতে করতে আজ মেসে ফিরল একলা আকাশ। সঙ্গে মেঘলা নেই । কিন্তু মেঘলার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখনও পথে থমকে দাঁড়িয়েছে। আবার হাঁটা শুরু।

মূল সড়ক থেকে কিছুটা এবড়োখেবড়ো পথ নেমে গিয়েছে হ্যাপিভ্যালি চা বাগানের দিকে। এখন বৃষ্টি নেই। পরিচ্ছন্ন মেঘমুক্ত আকাশ। কয়েকটা ধাপ পা ফেলে ফেলে উঠলেই বারান্দা তার পর গভীর খাদ। ভেজানো দরজা খুলে লাইটের সুইচে হাত দিতেই আলোকিত হল ঘর। লাইট জ্বালিয়ে লেপটা বিছানায় বিছিয়ে দেয়। কারণ রাতের দিকে সব কিছু হিমশীতল হয়ে যায়।

সেই সকালে নীচের ঝরনা থেকে সংগৃহীত পানীয় জল বালতিতে কতটুকু রয়েছে দেখে নেয়। এর পর রান্নার তোড়জোড়। ডিম আলু ডাল একসঙ্গে সেদ্ধ করে নেওয়া। খিদে পেটে সব কিছুর স্বাদ অমৃত। রাত আটটার পর সব নিঝুম। তারার মতো দূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলজ্বল করে আলো। টগবগ করে ফুটছে ভাতের হাঁড়ির জল। কাঠের ছোটো ঘরের ফাঁকে খবরের কাগজ সাঁটানো।

শীতের রাতে গুনগুন করে গাইতে থাকে নেপালি গান, হিজো রাতি কিনো? কিনো? নিদ্রা লাগিনো, কসতো মায়া… কসতো মায়া… গানের কলি। ডেকচি উপচে ভাতের ফ্যানা পড়ছে।

ডালে-চালে আর আলু সেদ্ধ পেঁয়াজ লংকার তরিবতের খানা রেডি। কিছুক্ষণ সব ভুলে কলেজের পড়াসংক্রান্ত কাজ।

আকাশ রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে এখন ব্যালকনিতে। নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে পাহাড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে। এই সময়টা সে তার পড়া আর ভাবনাগুলোকে এক সূত্রে গাঁথে। আরও কয়েকটা মাস কাটাতে হবে পাহাড়ি শহরে। মনের মানুষের সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নদী বিষয়ে গবেষণার বড়ো ইচ্ছা আকাশের। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। এসব এলোমেলো ইচ্ছের কথাও বলে ছিল আকাশ মেঘলাকে। বলেছিল, ডুয়ার্সের ছবির মতো তার গ্রামের কথাও! কখন যে মেঘালায়ের ডাউকি আর আকাশের রায়ডাক মিলেমিশে একাকার হয়েছে মনের মোহনায়, হয়তো টের পায়নি কেউ। বন্ধুত্ব থেকে ভালোলাগা ভালোবসায় রূপান্তরিত হয়েছে সময়ে সময়ে। দিনের পর দিন ভালোবাসা ঘন হয়েছে।

আসলে এই তো সেদিন ডুয়ার্সের ভূটান সীমান্ত গাঁ থেকে আকাশ এই পাহাড়ি শহরে এসেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। পাহাড়ে খরচ বেশি। কিন্তু ভূগোল বিষয়ে সব কলেজে তখন পড়ার সুযোগ ছিল না। জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড়! মাসে মাসে আবার খরচ আছে। আকাশদের একান্নবর্তী পরিবার। বাবা বিমল রায় একজন কৃষিজীবী।

আকাশের বাবারা ছিল তিন ভাই। বাকিরা সকলেই ব্যাবসাবাণিজ্য সরকারি চাকরি নিয়ে থাকত। ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম ব্লকের খোঁয়াড়ডাঙা এলাকার নারারথলি গ্রামের এটাই সব চেয়ে বড়ো পরিবার। আকাশের বাবা খেতি কাজের পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর কাজও বেশ সফলতার সঙ্গে করেন।

স্থানীয় জঙ্গলের বিভিন্ন লতাগুল্ম দিয়ে হাড়গোড় জোড়া লাগাতেন আকাশের বাবা। ভোর থেকে লেগে থাকত ঘরময় রোগীর ভিড়। আকাশকে বড়ো মানুষ করে গড়ে তোলবার ইচ্ছা। সাত-পাঁচ করেই দার্জিলিং পাহাড়ের কলেজে ভর্তির বন্দোবস্ত করেছেন। আসলে, আকাশের দাদু হাড়ভাঙা ডাক্তার নামে এই সীমান্ত লাগায়ো আসাম-ভূটান স্ললাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন।

কলেজ ছুটির ফাঁকে পাহাড় থেকে নেমে পড়ত আকাশ। জীবনের গতি এখানে যেন ধীর। আলিপুরদুয়ার ছুঁয়ে জাতীয় সড়কটা অসমের দিকে গিয়েছে। আর তেলিপাড়া থেকেই বাঁ দিকে পিচ ঢালা এক ফালি রাস্তা ছুটছে খোঁয়াড়ডাঙা অভিমুখে! যা ভূটানের গা-ছমছম গভীর জঙ্গলে ঢুকেছে। রাস্তার দু-ধারে ছায়াসুনিবিড় গাছ গাছালি। চরম গ্রীষ্মে যখন হাঁসফাঁস করে মানুষ তখন রোদের তীব্রতাকে এই পথছায়া গোগ্রাসে গিলে খায়। আর শরীরে এক মনোরম শীতল অনুভূতি জেগে উঠে। এমন একটা রূপকথার গাঁয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে মনে মনে দানা বাঁধত মেঘলার।

আকাশের গ্রামের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ভূটান। জমজমাট গ্রামীণ বাজার। হাটের দিনগুলোতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। আকাশ যখন ছোটো ছিল বাবার সঙ্গে ঘরের মুরগি ও মরশুমের সবজি নিয়ে হাটে বসত। স্থানীয় নদ-নদীর তাজা নদীয়ালি মাছ যেমন পাওয়া যায় তেমনি ঘরের পোষা মুরগি হাঁস নিয়েও হাটুরেরা হাজির হয়। বিভিন্ন জনজাতীর মনপছন্দ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী রকমারি সব কিছু হাটে মিলবে।

এখানকার গ্রামীণ হাটগুলো মেলার রূপ নেয়। এলাকাটি যেন মিনি ভারতবর্ষ। বিভিন্ন জাতি উপজাতি ধর্মের আর সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র। সহজসরল জীবনযাপন আর অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর মানুষজন। ভাষা পোশাক ধর্ম আচার ভিন্ন হলেও কোথায় যেন একটা ঐক্যের সুর বাঁধা আছে। কৃষিপ্রধান এলাকা। রয়েছে বন বস্তি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘরবাড়ি পোশাকেও ছাপ পড়েছে। সব কথা মেঘলাকে শুনিয়েছে আকাশ। সকলকে আপন করে নেওয়ার কি অসাধারণ জাদু আছে আকাশের!

কলেজ জীবন শেষ করে এবার ঘরে ফেরা। তাঁর প্রিয় অধ্যাপকের পরামর্শ মতো নদী বিষয়ে গবেষণা শুরু করবে। ছোটো থেকেই নদীকে সঙ্গী করে জীবন। খুব কাছ থেকে দেখেছে কীভাবে ভূটান থেকে নেমে আসছে বিভিন্ন নদনদী! সংকোষ, রায়ডাকের মতো আন্তর্জাতিক নদী যেমন রয়েছে, তেমনি ঘোড়ামারা, জোড়াই, কুলকুলি প্রভৃতি নদী শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। অতি বর্ষণে বন্যা এই এলাকার স্থায়ী সঙ্গী। ভূটান পাহাড়ের অবৈজ্ঞানিকভাবে ডোলোমাইট উত্তোলন একটা কারণ। এই অঞ্চলের ঢাল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।

আকাশ দেখেছে নদীগুলোর পূর্ব দিকের পাড় ভাঙার প্রবণতা। হঠাৎ করে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসায় নদীর গতিবেগ কমে যায়। নদী পাথরনুড়িতে বোঝাই হয়ে থাকে। ফলত বন্যার কবলে পড়ে এলাকা। এখান থেকে যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নদীমাতৃক বাংলার রূপসী রুপ যেন এখানে উপচে পড়ছে। এলোকেশী-নারী যেন ভরা বর্ষায় ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভীষণ গর্জন করে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম। শীতের মরশুমে শুধু শোনা যায় নদীর কুলুকুলু শব্দ আর নিস্তব্ধতা ভাঙে কোকিলের কুহু কুহু ডাকে।

বনবস্তির চরে বেড়ানো গরু-ছাগলের গলায় ঝুলানো টিনের তৈরি ঘণ্টা জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। নদী যেন একা নীরবে শুয়ে থাকে। এমন এক অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা আকাশের। নদী পাহাড় তাকে আজও চুম্বকের মতো টানে।

শীতের ছুটির পর আর ফেরা হয়নি মেঘলার। ফিরবে কি করে! ফেরার দিন ঘটে গেল অঘটন। প্রতিদিন শিলং-গৗহাটি মেল নামে দুধসাদা বাসটা সাতসকালে হর্ন বাজিয়ে ডাউকি বাজার থেকে ছাড়ে। আর তখনই মেঘলাদের পুরোনো ঘড়িটা পেন্ডুলাম দোলাতে দোলাতে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ করে ঘড়ির কাঁটা মিলে যায় সাতের ঘরে।

সকাল সাতটা বাজে। এই সাত-পুরোনো ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে। মেঘলার বাবা সইফুদ্দিন বাংলাদেশ থেকে যখন চলে আসে তখন সীমাকে উপহার দিয়েছিল। সীমা দেওয়াল ঘড়িটা আগলে থাকে।

আজ মেঘলার দর্জিলিং ফেরার দিন। কিন্তু মা সীমার ঘুম ভাঙেনি। চলে গিয়েছে ঘুমের দেশে। হার্টের পেশেন্ট। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। শোকের ছায়া ঘরজুড়ে! মাস্টারমশায় মনোময়বাবুর কাছে খবর যায়। মেঘলার বুকে তখন একটা নোনা বঙ্গোপসাগর তৈরি হয়েছে। ঘড়িটার দিকে নিঃষ্পলক তাকিয়ে থাকে মেঘলা।

কিছুদিন মনোময়বাবুর ঘরে থাকে। পরে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হয়। আকাশকে সেসব কথা জানিয়ে চিঠিও লিখে রেখেছিল। কিন্তু চিঠিটা ফেলা হয়নি ডাকবক্সে! কচিকাঁচা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। প্রতিদিন সাতসকালে রাস্তায় পথ চলতি গাড়ি ধরে স্কুলে যায় মেঘলা। দুষ্টু-মিষ্টি শিক্ষার্থীরা তার বেঁচে থাকার রসদ। মনে মনে ভাবে জীবনটা যেন একটা অসম্পূর্ণ সনদ।

এদিকে দার্জিলিঙের পাট চুকিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘরে ফিরেছে আকাশ। ফিরেই সংবাদ পেল আকাশ গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। কৃষকের ছেলের এমন সাফল্যে গোটা গ্রামে উৎসবের মেজাজ। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারশিপ ও নদী বিষয়ে গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। গবেষণার কাজ শুরু করতে রওনা দিল আকাশ।

ডুয়ার্সের গা ঘেঁষেই অসম। গুয়াহাটি হয়ে সেদিন শিলং পৌঁছোল আকাশ। আবার একটা মেসের মতো কোয়ার্টারে থাকবার ব্যবস্থা। উত্তর-পূর্ব ভারতের নদনদী চরিত্র ও নদী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত টাটকা তথ্য সংগ্রহ করতে পাহাড়ি রাজ্য চষে ফেলেছে আকাশ। যখন কাজ শেষে রুমে ফেরে মেঘার কথা মনে পড়ে।

যাইহোক যদি পথে দেখা হয় কোনওদিন কি বলবে মেঘলাকে! কখনও রাগ অভিমানে গাল ফুলে যায়। আবার গবেষণার কাজে ডুবে যায় আকাশ। ভোলার চেষ্টা করে সব কথা। এবার ডাউকি নদী সীমান্তে যাবে। মেঘালয় মালভূমি থেকে আগত একটি পাহাড়ি নদী। ডাউকি চ্যুতির নাম অনুসারে নদীটির নাম ডাউকি। জল স্বচ্ছ কাচের মতো নান্দনিক সৗন্দর্যের যেন লীলাভূমি।

আকাশের গা ছমছম করে। সবে ডাউকি ব্রিজটা পার হয়ে গাড়িটা থামল। হকারের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে একটু কফি কাপে চুমুক। শিলং থেকে যখন গাড়িটা ছাড়ে তখনই বৃষ্টি শুরু। আজ সকাল থেকে খুব মেঘলা। ডাউকি ঢোকার মুখে ব্রিজ। মনে পড়ছে মেঘলার কথা। ডাউকি মেঘলা মেঘালয় যেন অজান্তেই তার নিজের হয়ে গিয়েছে। শরীরটা যেন হিমশীতল হয়ে আসে!

গাড়িটা স্টার্ট দিতে আবার ঝমঝম শিলা বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটায় নদীর জলে বুদবুদ উঠছে। হু হু করে পাহাড়ি ঝরনা মূল সড়কে ধুয়ে খাদে পড়ছে বীভৎস গর্জন করতে করতে। অগত্যা গাড়ি থামাল চালক! মেইন রোডের পাশে একটা বেসরকারি স্কুল। নাম রিভার পয়েন্ট নার্সারি। এখানে কিছুক্ষণ বিরতি। মেঘে ঢাকা আকাশ। দিনের বেলায় যেন অন্ধকার নেমে আসছে।

গাড়ির জানলার কাচটা খুলতেই আকাশ দেখে বেশ চমকে গেল, পরির মতো অপ্সরা একজন মহিলা মেঘেঢাকা পাহাড়ের সর্পিল পথ বেয়ে নেমে আসছে। লুকস লাইক আ ফাউন্টেন, হয়তো মূল সড়কে উঠবে! হাত নেড়ে গাড়িটাকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলছে। যদিও আকাশদের গাড়িটা এমনি অতিবৃষ্টির দরুন দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ কিছুটা হতোভম্ব হয়ে গাড়ির গেটটা খুলে দিল। সটান গেটে ছোটো হাতটা চেপে গাড়িতে উঠে পড়ল মহিলা।

খুব চেনা খুব জানা। কিন্তু দুজনেই নির্বাক। তখন আবার মেঘেঢাকা আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের রক্তিম আভায় টুকটুকে গাল দুটো স্মৃতির আলোর ঝরনাধারা। চোখের তারায় তারায় আনন্দ অশ্রুর প্লাবন।

জীবনের গাড়িটা হয়তো ছুটল পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথ পেরিয়ে আলোর ঠিকানায়।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব