সেদিনের সেই দিনগুলি

অনবরত চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল স্নেহার। বারবার ফিরে যাচ্ছিল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়। আনন্দের মুহূর্তগুলো বারবার স্নেহার স্মৃতিকোঠায় ফিরে আসছিল। আর কিছুক্ষণ পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে সে তাই বোধহয় এত স্মৃতি ভিড় করে আসছে মনে।

কলেজের সেই প্রথম দিনটা। কেমিস্ট্রি-র ক্লাস চলছিল। প্রফেসর নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কেমিস্ট্রির জ্ঞান পরখ করার চেষ্টা করছিলেন। একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। স্নেহার আজও মনে পড়ে, ঋদ্ধ একাই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। ঋদ্ধর বিষয়ের প্রতি এতটা গভীর জ্ঞান দেখে সেদিনই স্নেহা ঋদ্ধর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।

কলেজে ওদের ক্লাসে সকলেই নতুন, তাই ছাত্র-ছাত্রীদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় হতে বেশ কয়েকটা দিন কাটল। একদিন স্নেহা কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখল ঋদ্ধ কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। স্নেহা-কে দেখে ঋদ্ধ এগিয়ে এল, ‘এত তাড়াতাড়ি কলেজে কী ব্যাপার। ক্লাস তো প্রায় একঘন্টা পর।’

‘বাবার, এদিকে একটা কাজ ছিল তাই আমিও বাবার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। একটু না হয় লাইব্রেরিতে বসে সময় কাটাব’, হেসে জবাব দিল স্নেহা।

‘তাহলে চল, একটু ক্যান্টিনে বসা যাক’, ঋদ্ধকে না বলতে পারল না স্নেহা। প্রথম দিন থেকেই ঋদ্ধ-র প্রতি একটু বেশি দুর্বলতা বোধ করছিল স্নেহা।

ক্যান্টিনে বসে দু’জনে কফি খেতে খেতে গল্প করছিল। মাঝেমধ্যেই স্নেহা অনুভব করছিল ঋদ্ধর দৃষ্টি ওর মুখের উপর এসে কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করছে। ক্লাসের সময় এগিয়ে আসাতে দু’জনে ক্যান্টিন ছেড়ে ক্লাসরুমে এসে পাশাপাশি বসে পড়ে।

বিকেলে ক্লাস শেষ হবার পর ঋদ্ধ স্নেহা-কে বলে, ‘একটু দাঁড়া। স্যারকে বইটা দিয়ে এক্ষুনি আসছি। একসঙ্গে বেরোব।’

গেট অবধি পৌঁছোতেই ঋদ্ধ চলে আসে। দু’জনে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যায়। স্নেহা বলে, ‘ঋদ্ধ তুই এবার যা, বাস এলে আমি উঠে পড়ব। কিন্তু তুই তো এখান থেকে বাস পাবি না। তোকে তো একটু হাঁটতে হবে।’

‘হ্যাঁ যাচ্ছি। স্নেহা তোকে একটা কথা বলার ছিল। তোকে আমার খুব ভালো লাগে, সবসময় তোকে দেখার জন্য, কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। এটাই বোধহয় ভালোবাসা। আমি নিশ্চিত যে আমি তোকে ভালোবাসি।’

স্নেহা ঘটনার আকস্মিকতায় থ হয়ে যায়। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ওর মুখ। নিজের হূৎস্পন্দন যেন নিজের কানকেই আঘাত হানছে মনে হয় ওর। বাসটা এসে পড়ায় মুহূর্তের লজ্জার হাত থেকে নিজেকে কিছুটা বাঁচাতে পারে স্নেহা। সিটে বসে জানলা দিয়ে খেয়াল করে, ঋদ্ধ তখনও দাঁড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডে।

বাড়ি ফিরে এক মুহূর্তের জন্যও ঋদ্ধর চিন্তা মন থেকে দূর করতে পারল না স্নেহা। ওর চোখের গভীর চাহনির আকর্ষণ যেন প্রতিক্ষণেই স্নেহাকে মনে মনে চঞ্চল করে তুলতে লাগল। প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে স্নেহা ঠিকমতো মনে করতে পারল না। ঘুম ভাঙল একেবারে সকালবেলায়। অভ্যাসমতো মোবাইল-টা ঘাঁটতেই চোখে পড়ল ঋদ্ধর পাঠানো ছোট্ট মেসেজটায়, ‘সুপ্রভাত। দেখা হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।’

রোমাঞ্চ অনুভব করল স্নেহা। ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি বুঝি এমনটাই হয়, স্নেহার মনে হল। অনেক ভেবেও উত্তরে কী লিখবে বুঝতে পারল না। চিন্তা করার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। ‘সুপ্রভাত’ লিখে পাঠিয়ে দিল স্নেহা।

শুরু হল স্নেহার জীবনের নতুন অধ্যায়। ঋদ্ধর সঙ্গে আলাপ হওয়া, রোজ কলেজে একসঙ্গে বসে ক্লাস করা, ভালোবাসার উড়ানে গা ভাসিয়ে দেওয়া এই সবকিছুই স্নেহার ভালো লাগতে আরম্ভ করল। উভয়ের দেখা না হওয়া পর্যন্ত মন অস্থির হয়ে উঠত। ক্লাস অফ থাকলেই পার্কে, কখনও গঙ্গার ধারে কখনও আবার কোনও মল-এ ওদের দুজনের একসঙ্গে দেখা পাওয়া যেত। কলেজেও দুজনকে নিয়ে ভালোই চর্চা শুরু হয়েছিল।

স্নেহা জানত, ঋদ্ধর মা-বাবা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান এবং কাকা-কাকিমার কাছে ও মানুষ হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে থাকেন

কাকা-কাকিমা। শহরে একটা ঘর ভাড়া করে ঋদ্ধ থাকে। টিউশন করে কলেজের মাইনে দেয় ঋদ্ধ। পড়াশোনায় ভালো বলে প্রফেসররা নোট এবং বই দিয়ে ঋদ্ধকে সাহায্য করতেন একথাও অজানা ছিল না স্নেহার।

সেদিন কলেজে গিয়ে স্নেহা ঋদ্ধকে কোথাও দেখতে পেল না। একটা ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর রীতিমতো চিন্তায় পড়ল স্নেহা। এতদিন হয়ে গেল ঋদ্ধ এরকম কখনও করেনি। ফোনেও কোনও মেসেজ করেনি। স্নেহা ঋদ্ধ-র নম্বরে ফোন করল। ফোন সমানে বেজে চলেছে ওপাশ থেকে কোনও উত্তর নেই। ভয় পেয়ে গিয়ে মরিয়া হয়ে আবার ফোন করল স্নেহা। এবার উত্তর এল। অস্ফুট কণ্ঠে উত্তর এল, ‘স্নেহা আজ আমি কলেজ যেতে পারব না। প্রচণ্ড জ্বর, উঠতে পারছি না। চিন্তা করিস না। জ্বরটা কমলেই কলেজ যাব।’

পরের দিনও ঋদ্ধ কলেজ আসতে পারল না। ক্লাসে কিছুতেই মন লাগল না স্নেহার। খালি মনে হচ্ছিল একবার ঋদ্ধ-কে দেখতে যাওয়া খুব দরকার। এত জ্বরে একা একা সবকিছু কী করে সামলাচ্ছে ঋদ্ধ।

ঠিকানা জানাই ছিল। বাড়ি খুঁজে পেতে তবুও বেশ কষ্ট হল। অনেকবার দরজায় ধাক্বা দেওয়ার পর ঋদ্ধ এসে দরজা খুলল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। ঋদ্ধকে দেখে কষ্ট হওয়ার বদলে রাগই হল স্নেহার। ‘এতটা জ্বর আর তুই কিছুই জানাসনি? ওষুধ খেয়েছিস? বাড়ির কাউকে জানিয়েছিস?’

চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছিল না ঋদ্ধ। সেই অবস্থাতেই শিথিল স্বরে জবাব দিল, ‘কাকা-কাকিমাকে জানিয়ে কী হবে? শুধু শুধু অত দূরে ওনারা চিন্তা করবেন। আর ডাক্তারে কাছে যাওয়ার অবস্থা আমার ছিল না।’

দুদিনেই ঋদ্ধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। চোখের নীচে কেউ যেন কালি ঢেলে দিয়েছে মনে হচ্ছিল। ঋদ্ধর অবস্থা দেখে স্নেহার কান্না পাচ্ছিল। হয়তো দুদিন কিছুই খাওয়া হয়নি ঋদ্ধর কারণ ও নিজেই রান্না করে খেত। এতক্ষণে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল স্নেহা। জিনিসপত্র এধার-ওধার ছিটিয়ে পড়ে আছে। ছোটো একটা কাঠের টেবিলের উপর কাচের গেলাসে অর্ধেকটা জল পড়ে রয়েছে আর একটা বিস্কুটের খোলা প্যাকেট রাখা আছে।

স্নেহা প্রথমে একটা বাটিতে জল ভরে, রুমালের সাহায্যে ঋদ্ধর কপালে জলপট্টি দিতে লাগল যাতে জ্বরটা একটু কম হয়। কপালটা একটু ঠান্ডা হয়েছে বলে মনে হলে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে, জায়গার জিনিস জায়গায় গুছিয়ে রাখল। বাইরে বেরিয়ে সামনের দোকান থেকে ব্রেড আর দুধ নিয়ে ফিরে এল। দুধ ফুটিয়ে, ব্রেড সেঁকে ঋদ্ধকে জোর করে খাওয়াল তাও একটাই ব্রেড খেতে পারল ঋদ্ধ।

নিজেদের পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন করে স্নেহা ঋদ্ধর অবস্থা জানাল। ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধের নাম জেনে দোকান থেকে ওষুধ কিনে এনে ঋদ্ধকে খাওয়াল। সন্ধে অবধি ঠায় বসে রইল ঋদ্ধর পাশে। ঋদ্ধর কৃতজ্ঞতা ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখাল স্নেহা। ‘আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব সেটুকুই করলাম। তোকে আর কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে না।’

‘জানিস স্নেহা, ছোটো বেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার জীবন থেকে খুশি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কাকু-কাকিমা আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ওদের জন্য আমি বোঝা। তুই আমার জীবনে আসাতে আবার আমি নতুন করে ভালোবাসা পেয়েছি। তুই আমার যা সেবা করলি হয়তো আমার মা বেঁচে থাকলে এতটাই করত। তাই কৃতজ্ঞতা নয়, এটা আমার অনেস্ট কনফেশন।

অবশ্য কাকু-কাকিমার বিরুদ্ধে আমার কোনও নালিশ নেই। আমি তো তাদের নিজের সন্তান নই। তাঁরা যে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট’, ঋদ্ধর চোখ জলে ভরে আসে।

‘তুই চুপ করবি ঋদ্ধ। এইসব কথা বলার সময় নয় এটা। শরীরটা আগে। নিজেকে একলা ভাবিস না, আমি সব সময় তোর পাশে আছি।’ পাশে রাখা ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঋদ্ধর মুখটা ভালো করে মুছে দিয়ে স্নেহা উঠে দাঁড়াল। ঋদ্ধর জ্বরটা একটু কমেছে বোধ হল। এদিকে সন্ধেও হয়ে এসেছে। দেরি হলে বাড়িতে সকলে চিন্তা করবে। নিজের কলেজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল স্নেহা, ‘ঋদ্ধ আজ আসি। দুধ আর ব্রেড রাখা রইল। পাত্রে দুধটা একটু গরম করে খেয়ে নিস। ওষুধটাও খাবি। রাত্রে কোনওরকম অসুবিধা হলে ফোন করিস। আমি একা মেয়ে রাত্রে কী করব এই ভেবে আবার সমস্যা নিয়ে বসে থাকিস না। আমি তোর জন্য সব কিছু করতে পারি।’

বাড়িতে এসেও ঋদ্ধর চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারল না স্নেহা। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঋদ্ধকে ফোন করল। ঋদ্ধ অনেকটাই সুস্থ বোধ করছে জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হল স্নেহা। বিছানায় গা এলাতেই ঘুমের জগতে পৌঁছে গেল।

চারদিনের দিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল ঋদ্ধ। এই দুদিন স্নেহা সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বাড়ি থেকে ঋদ্ধর জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে ওকে খাইয়ে আসত। ঘন্টার পর ঘন্টা ঋদ্ধ-র কাছে বসে ওর সঙ্গে গল্প করত। পঞ্চম দিন থেকে ঋদ্ধ কলেজ আসতে আরম্ভ করল। এই ক’দিনে ওরা দুজন আরও বেশি করে পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়েছিল এবং দুজনেই বুঝতে পারল একে অপরজনকে ছাড়া আলাদা থাকা তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

দেখতে দেখতে কলেজে তিনটে বছর কেটে গেল। এই তিনটে বছর স্নেহার জীবনে সবথেকে সুখের যার স্মৃতি আজও স্নেহার মনে উজ্জ্বল। কলেজ শেষ হতেই ঋদ্ধ হায়ার এডুকেশনের জন্য অন্য একটি কলেজে অ্যাডমিশন নিল। স্নেহার বাবা মেয়েকে আর পড়াশোনা করাতে রাজি হলেন না। সুতরাং ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা করাটা সমস্যা হয়ে উঠল স্নেহার কাছে। ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা না হলেই মন খারাপ হয়ে যেত স্নেহার। ফোনে কথা বলে আশ মিটত না ওর।

স্নেহার মা-বাবাও মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করে দিল। মেয়ের দায়িত্ব কতদিন আর বয়ে বেড়ানো যায়! বাড়ি থেকে বেরোতে হলে হাজার কৈফিয়ত। দিনের বেলা ঋদ্ধ-র কলেজ সুতরাং দেখা করতে হলে সেই সন্ধেবেলা। সেটাও স্নেহার বাবার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধেবেলায় বাড়ির মেয়ের রাস্তায় কী কাজ? রোজ মিথ্যা বলা সম্ভব নয়। একপ্রকার বন্দি জীবন হয়ে উঠল স্নেহার। সুযোগ পেলেই ঋদ্ধকে ফোন করে কিছু একটা উপায় বার করার জন্য অনুরোধ জানাত স্নেহা যাতে দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারে। কিন্তু চাকরি ছাড়া কীভাবে বিয়ে করা সম্ভব সেটা ঋদ্ধ কিছুতেই ভেবে পেত না।

ছেলের বাড়ি থেকে কেউ দেখতে এলেই স্নেহার চোখে জল চলে আসত। ঋদ্ধকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ও ভাবতেই পরত না। এদিকে

মা-বাবাকে ঋদ্ধ-র সম্পর্কে জানাতেও কিছুতেই সাহসে কুলোতে পারছিল না স্নেহা। বাবা পুলিশে ছিলেন সুতরাং শক্ত ডিসিপ্লিনের মধ্যে মানুষ হতে হয়েছিল স্নেহাকে। যদিও একটিমাত্র কন্যা হওয়ার কারণে মা-বাবার আদরের সন্তান ছিল স্নেহা। স্নেহা মনে করতে পারে না, ওর সঙ্গে বাবা কোনওদিন উঁচু গলায় কথা বলেছেন বলে।

একদিন স্নেহার মা ওকে জানালেন পাত্রপক্ষ ওকে সন্ধেবেলায় দেখতে আসবে। পাত্র ডাক্তার। মন অশান্ত হয়ে উঠল। ঋদ্ধকে ফোনে সব কিছু জানিয়ে দেখা করার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে নিল। বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার মিথ্যা অছিলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা করল স্নেহা। ঋদ্ধকে দেখে চোখের জল বাধ মানল না।

‘ঋদ্ধ, প্লিজ তুই কিছু একটা কর। বাবার কাছ থেকে আমাকে চেয়ে নে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।’

স্নেহার মানসিক অবস্থা দেখে ঋদ্ধও কিছুক্ষণ কোনও উত্তর দিতে পারল না। স্নেহা একটু শান্ত হলে ঋদ্ধ বলল, ‘স্নেহা, আজ আমার নিজেরই দাঁড়াবার মতো সামর্থ্য নেই, আমি কোন মুখে তোর বাবার কাছে তোর হাত চাইব? উনি যদি মানা করে দেন তাহলে আমাদের দুজনেরই আশা ভেঙে যাবে। যতক্ষণ না আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি ততক্ষণ তোকে ধৈর্য রাখতেই হবে। যোগ্য হয়ে উঠতে দে, ততদিন কিছু বলে মা-বাবাকে বুঝিয়ে রাখ। খুব শিগগির তোর বাবার কাছে যাব।’

‘যদি সত্যি সত্যি এরকম করতে পারতাম। শেষ নিঃশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত তোর জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম! জানি না কেন বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে? তুই একটু তাড়াতাড়ি কর, আমি সারা জীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’ একটু দম নেয় স্নেহা, ‘ঋদ্ধ আমি আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তোকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করব।’

ঋদ্ধ ঘাবড়ে গেল, ‘এই ভুল খবরদার করিস না। তোকে ছেড়ে থাকার কথা আমিও ভাবতে পারি না। কিন্তু আপাতত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’

ঋদ্ধ-র কাছে আশ্বাস পেয়ে এক বুক আশা নিয়ে স্নেহা বাড়িতে ফিরে এল। ঋদ্ধ প্রমিস করেছে, আর কয়েকটা দিন। তারপরেই ওরা দুটিতে একসঙ্গে সংসার পাতবে। সন্ধেবেলায় পাত্রপক্ষ এসে স্নেহাকে দেখে গেল। কলের পুতুলের মতো ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল স্নেহা। আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।

কয়েক দিন পরেই স্নেহার স্বপ্নের সংসার গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে গেল। স্নেহার মা এসে জানালেন পাত্রপক্ষ স্নেহাকে পছন্দ করেছে। ছেলে এবার নিজে আসবে স্নেহাকে দেখতে। ঘাবড়ে গিয়ে স্নেহা ঋদ্ধকে ফোন করল। কিন্তু একি? রিং হয়ে যাচ্ছে অথচ ওধার থেকে কেউই কল রিসিভ করছে না। ঋদ্ধ-র হল কী? ফোন ধরছে না কেন? উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল স্নেহার।

মনে হল হয়তো কোনও কাজে ব্যস্ত রয়েছে। ফোন রেখে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল স্নেহা। আবার ফোন করল কিন্তু ঋদ্ধ ফোন ওঠাল না। এরকম তো ঋদ্ধ কখনও করে না। সেই মুহূর্তে ধরতে না পারলেও পরে পরেই ফোন করে নেয়। ঘড়ি দেখল স্নেহা। মধ্যরাত, এত রাতে বাইরে থাকারও কথা নয় ঋদ্ধর। চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম এল না। চেষ্টা করতেই লাগল। শেষমেশ উলটো দিকে ফোন সুইচ অফ হয়ে গেল। কোনও উপায় না দেখে বালিশ অাঁকড়ে স্নেহা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

পরের দিন সকালে বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে মিথ্যা বাহানা করে স্নেহা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা ঋদ্ধ যে বাড়িতে ভাড়া থাকে সেখানে গেল। দরজায় তালা দেখে আশেপাশে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারল, ঘর খালি করে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ঋদ্ধ কোথাও চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে কেউ-ই বলতে পারল না। কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই ভেবে পেল না স্নেহা। কাউকে কিছু না বলে ঋদ্ধ কোথায় যেতে পারে? ও যে এরকম করতে পারে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না স্নেহার।

সন্ধে হয়ে আসতে মায়ের জোরাজুরিতে স্নেহাকে সেজেগুজে তৈরি হতে হল। ডাক্তার ছেলেটির দেখতে আসার কথা। স্নেহার খালি মনে হচ্ছিল ছেলেটির যদি ওকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় তাহলে ও নিজের মনকে কী করে এই বিয়েতে রাজি করাবে? ঋদ্ধ ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করাটা ওর পক্ষে কখনওই সম্ভব হবে না।

মনকে কিছুতেই মানাতে পারছিল না, ঋদ্ধ-র হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়ার ঘটনাটা। তাহলে কি শুধু ফূর্তি করার জন্যই স্নেহার সঙ্গে ভালোবাসার নাটক করল ও, না, না, এটাও কী সম্ভব! ঋদ্ধ-র চোখে ওর জন্য ভালোবাসা স্পষ্ট দেখেছে স্নেহা, সুতরাং নিজের চোখকে কী করে অবিশ্বাস করে স্নেহা? তাহলে কোনও কিছু না জানিয়ে হঠাৎ-ই ঋদ্ধ-র অন্তর্ধান হওয়ার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে?

ছেলে এসে স্নেহাকে পছন্দ করে গেল। স্নেহার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারিদিকে খুশির পরিবেশ। স্নেহার মা, আত্মীয়স্বজন সকলকেই মেয়ের বিয়ের ঠিক হওয়ার খবরটা জানিয়ে রাখলেন। বাবাও ধুমধাম করে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আয়োজন শুরু করে দিলেন। এই হইচই-এর পরিবেশ থেকে স্নেহা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল কারণ রোজ একটাই প্রার্থনা করত স্নেহা, যাতে এই বিয়েটা কোনওভাবে ভেঙে যায়।

এই ভাবেই প্রায় এক মাস পার হতে চলল। ঋদ্ধ-র কোনও খবর পেল না স্নেহা। তবে একটা এমন ঘটনা ঘটল যাতে স্নেহার সমস্যা কিছুটা হলেও মিটল। হঠাৎই পাত্রপক্ষ স্নেহার সঙ্গে বিয়েটা নিয়ে কিন্তু কিন্তু শুরু করে দিল। স্নেহার বাবা ভিতর থেকে খবর আনলেন যে টাকার লোভে ছেলের অভিভাবকেরা অন্য জায়গায় ছেলের সম্বন্ধ ঠিক করেছে। খবরটা পেয়ে স্নেহা সবথেকে আনন্দ পেল। বহুদিন পর ওর মুখে হাসি ফুটল।

ঘুরতে ফিরতে ঋদ্ধকে ফোন করাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল স্নেহার। কিন্তু এত কিছুর পরেও সেই ‘সুইচ অফ’ ছাড়া ওপার থেকে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। মেসেঞ্জার-এও মেসেজ পাঠাল স্নেহা কিন্তু উত্তর এল না। কয়েকদিন পর স্নেহা খেয়াল করল ঋদ্ধ ওকে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে। খুব রাগ হল ওর, যাকে কাছে পাওয়ার জন্য ও মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই-ই ওকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না তাহলে প্রথমে বলে দিলেই হতো, এভাবে ভীতুর মতো কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কী অর্থ ছিল?

ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিল স্নেহা। মোবাইলে ঋদ্ধ-র ফোন নম্বরটা টাইপ করতেও আর আঙুল চলত না স্নেহার। রোজই মনে হতো ঋদ্ধ-র ফোন আসবে। কিন্তু না একটা ফোন কল আর না যে নিজে একবারের জন্যেও স্নেহার সামনে এল। দু মাস ধরে লাগাতার চেষ্টা করে করে স্নেহা অবশেষে হার মানল। মোবাইলে ঋদ্ধর নম্বর ডায়াল করাই বন্ধ করে দিল। একদিন ঋদ্ধ-র নম্বরটাই মুছে দিল নিজের মোবাইল থেকে।

সময়ের স্রোত নিজের গতিতে বইতে লাগল। ইতিমধ্যে স্নেহার বাবারও বদলির খবর এল। শিলিগুড়িতে নতুন বদলি। সুতরাং পুরো পরিবার নিয়ে স্নেহার বাবা শিলিগুড়ি চলে এলেন।

ঋদ্ধকে পাওয়ার আশা স্নেহা পুরোপুরি ত্যাগ করে দিল। শিলিগুড়িতে এসে স্নেহার মনে হল এবার অতীতকে ভোলা অনেক সহজ হবে। বাড়িতে যখনই ওর বিয়ের কথা উঠত স্নেহা নিজের ভিতরে নিজেই গুটিয়ে যেত। বিয়ে এবং ভালোবাসা এই দুটো শব্দের সঙ্গে ওর শত্রুতা তৈরি হয়েছিল। স্নেহা বাড়িতে বিয়ে নিয়ে কোনওরকম আলোচনা করতে মা-কে বারণ করে দিল।

দু’বছরের উপর স্নেহা-রা শিলিগুড়িতে কাটিয়ে ফেলল। মাঝেমধ্যেই স্নেহার মনে হতো, আদৗ কি ঋদ্ধ কখনও ওর কথা মনে করে? পুরোটাই ওর যদি ছলনা ছিল তাহলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কেন দিল? একবার যদি ও নিজের মনের কথা জানাত তাহলে মনে হাজার দুঃখ পেলেও ও ঋদ্ধকে ক্ষমা করে দিতে পারত। সত্যিকারের ভালোবাসা যে আজও আছে, এই ভুলটা অন্তত ওর ভাঙত।

শিলিগুড়ি আসার পর থেকে বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোত না স্নেহা। ওর কিছু ভালো লাগত না। একদিন ওর মা জোর করে ওকে প্রতিবেশী কাকিমার বাড়ি নিয়ে গেল। একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান ছিল। কাকিমার মেয়ে রূপা-কে পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা ছিল।

মায়ের মন, তাই মনে হল বিয়ের পরিবেশ দেখে মেয়ের মনে যদি কোনও পরিবর্তন আসে। সন্ধ্যাকে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে আনার দায়িত্ব এসে পড়ল স্নেহার উপর। নিজে সাজতে ভুলেই গিয়েছিল স্নেহা। রূপাকে সামনে পেয়ে অতীত এসে আবার স্নেহার সামনে দাঁড়াল। এমনই সেজেগুজে ঋদ্ধ-র কাছে যেত স্নেহা। নিশ্চয়ই ওরই মধ্যে কোনও কিছুর অভাব ছিল যার কারণে ঋদ্ধ ওর জীবন থেকে সরে গেল।

ছেলের বাড়ির সকলেই এসে গিয়েছিল। ইচ্ছে না থাকলেও কাকিমার ইচ্ছেমতো রূপার শৃঙ্গার শেষ করে ওর হাত ধরে স্নেহা বসার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

সামনে সোফায় বসা ছেলেটির দিকে তাকাতেই স্নেহার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল। প্রতিটা ক্ষণ যার অপেক্ষা করে থেকেছে, যার জন্য এত চোখের জল ফেলেছে, নিজের সুখ-শান্তি সব ছেড়েছে আর যে কিনা ভীরুর মতো চুপিচুপি ওর জীবন থেকে পালিয়ে গেছে, সেই বিশ্বাসঘাতক ঋদ্ধ ওর সামনে বসে আছে। আজ সে আর একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবে বলে এসেছে।

‘স্নেহা… স্নেহা…’ চোখ খুলতেই সেই পরিচিত মধুর আওয়াজ স্নেহার কানে এসে প্রবেশ করে। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কেউ ওর মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। বহু পরিচিত একটা স্পর্শ অনুভব করতে পারছে স্নেহা। পরিচিত বাহুর বেষ্টনী ওকে ঘিরে রয়েছে।

‘চোখ খোল স্নেহা…’ আবার সেই মধুর আওয়াজ কানে আসে।

‘ঋদ্ধ না?’ না চাইতেও মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে নামটা।

‘হ্যাঁ, আমি ঋদ্ধ।’

অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে স্নেহার চোখ বেয়ে। মনের ভিতর জমে থাকা অভিমান কথার মধ্যে বেরিয়ে আসে, ‘তুই কেন এভাবে আমাকে ঠকালি ঋদ্ধ? কেন আমাকে না জানিয়ে তুই পালিয়ে গেলি? আজও তোকে আমি খুঁজে যাচ্ছি। তোর জন্য অনেক কেঁদেছি, অনেক কষ্ট পেয়েছি। যদি আমাকে ছেড়ে চলেই যাবি ভেবেছিলি তাহলে আমাকে মুখের উপর বলে দিতে পারতিস। আমিই বোধহয় পাগল ছিলাম যে তোকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।’

‘স্নেহা, তোকে ছেড়ে এসে আমিও প্রচুর কেঁদেছি’, ঋদ্ধ বলে, ‘যেদিন তুই শেষবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি সেই দিনটার কথা তোর মনে আছে?’

‘হ্যাঁ… কেন?’

‘সেদিন তুই চলে যাওয়ার পর, তোর বাবা চার-পাঁচজন লোক নিয়ে আমার ওখানে আসেন। সবারই গায়ে পুলিশের পোশাক ছিল।’

‘সে কী…’, বিস্ফারিত চোখে ঋদ্ধর দিকে তাকায় স্নেহা।

‘হ্যাঁ, তোর বাবা এসে আমাকে শাসান, আমি যেন তোর সঙ্গে কোনওদিন আর দেখা না করি। তোর কাছ থেকে আমি যেন অনেক দূরে চলে যাই। নয়তো ফল ভালো হবে না। ওনার কোনও সহকর্মী আমাদের দুজনকে পার্কে বসে থাকতে দেখেছিল এবং তোর বাবাকে বলে দেয়। তোর বাবা চেয়েছিলেন আমাকে দূরে পাঠিয়ে তোর তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবেন। আমার এখানে কিছুই করার ছিল না। পুলিশের সঙ্গে কী করে লড়ব বিশেষকরে যেখানে তোর বাবা উপস্থিত। তোর জীবনে যাতে ঝড় না আসে তাই আমি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।

নিজের সিম কার্ড ভেঙে ফেলে দিয়ে দিল্লি চলে যাই। ওখানে বন্ধুর বাবার মাধ্যমে একটা চাকরি জোগাড় করি আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকি। একবছর বাদে পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংক-এ অফিসার পদে নির্বাচিত হই। কিন্তু সবকিছু হলেও তুই আমার জীবনে ছিলি না তাই স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সুখ ছিল না। এই ভেবে মনকে শান্ত রাখতাম যে, এতদিনে নিশ্চয়ই তোর বিয়ে হয়ে গেছে আর তুই নতুন জীবনে সুখে আছিস। আবার কখনও এও মনে হতো, তুই আমার ছাড়া অন্য কারও কিছুতেই হতে পারিস না।

একবার তো সাহস করে কলকাতায় যাই এই ভেবে যে, হয়তো তুই আজও আমার অপেক্ষায় রয়েছিস। কিন্তু গিয়ে দেখি সপরিবারে তোরা অন্য কোথাও চলে গিয়েছিস। অনেক চেষ্টা করার পরেও তোদের খোঁজ না পেয়ে কাকু-কাকিমার জেদ আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিই। এখানে কাকিমার এই আত্মীয়ার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল তাই আমার এখানে আসা। কিন্তু তোকে যখন একবার খুঁজে পেয়েছি, আর আমি তোকে হারাতে চাই না।’

স্নেহার পুরোটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আজ ওর বিশ্বাস হল, সত্যিকারের ভালোবাসা অটুট হয়। ঋদ্ধকে নিয়ে গর্ববোধ করল যে, এত বছরেও ঋদ্ধ ওকে ঠকায়নি।

ফাঁদ

হাতকাটা গোপাল ঘরে বসে ভোজালিটা একটু ধার দিয়ে নিচ্ছিল। গোপাল জীবনে এমন কোনও বাজে কাজ করতে বাদ রাখেনি। এক সময়ে টাকার জন্য ওয়াগন ব্রেকারদের সাথে রাতের পর রাত কাজ করেছে। তারপর একটা রাজনৈতিক দলে ঢুকে সত্তর-একাত্তর সালে অনেক বোমাবাজি করেছে। তাদের হয়ে বোমা বেঁধেছে। কয়েক বছর আগে বোমা বাঁধতে গিয়ে ওর একটা হাত উড়ে যাওয়ায় সবাই ওকে হাতকাটা গোপাল হিসেবেই চেনে।

কিছুদিন বর্ষাতিয়ার দলেও কাজ করেছে। এখন নিজের দল

বানিয়ে কাজকর্ম চালায় তাই বর্ষাতিয়ার সাথে প্রায়ই গণ্ডগোল লেগেই থাকে। আজকাল অপরাধ জগতে বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। তবে গর্ব করে বলে যে গোপাল বা তার দল কোনও মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আর ওর এই গুণটার জন্য পাড়ার লোকেরাও ওকে নিয়ে মাথা ঘামাত না।

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হতেই ঘরের এককোণে ভোজালিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ ওর দলের সকলকে বলা আছে, কেউ দরজায় আওয়াজ না দিয়ে ঘরে ঢুকবে না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ‘জাসসি’ ঘরে ঢুকছে। মুখে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। জাসসি এখন অপরাধ জগতের ‘বিউটি কুইন’ নামেই পরিচিত। গোপাল জাসসি-র দিকে তাকিয়ে ভাবছে– মেয়েটা সুন্দরী এতে কোনও সন্দেহ নেই। শ্যাম্পু করা কালো রেশমের মতো চুল ঘরের আলোয় চকচক করছে। ওকে দেখে আর যাই হোক কুখ্যাত একটা চোরের দলের সদস্য বলে মনে হয় না।

–কিরে তুই এই অসময়ে? আমি-তো অন্য কেউ ভাবছিলাম।

–এসেছি একটা কাজে। বলেই হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে গোপালকে কাত করার চেষ্টা করল। এই হাসিটাই ওর একটা বড়ো সম্পদ। বলল– গোপাল, আমার ধারণা আমরা একজন আর একজনকে ভালোমতো বুঝতে পারি। সেটা বুঝতে পেরেছি বর্ষাতিয়ার দলে একসাথে কাজ করতে গিয়ে। আর এখন এটাও জেনে গেছি যে বর্ষাতিয়ার সাথে তোর

সাপে-নেউলের সম্পর্ক।

–তা তোর আসার উদ্দেশ্যটা কী বল। কী খাবি? ঠান্ডা না গরম?

–না থাক। আজ হাতে সময় নেই। তাছাড়া কেউ জানতে পারলে এতক্ষণে খবর পৗঁছে যাবে বর্ষাতিয়ার কাছে।

–তুই তো আজকাল বর্ষাতিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিস। এমনকী শুনেছি তুই নাকি বর্ষাতিয়ার লাইফ পার্টনার হতে চলেছিস?

–সব বাজে কথা। আজকাল বর্ষাতিয়া রুমি-র সাথে খুব ঢলাঢলি করছে। অযোগ্য মেয়েটার প্রেমে মজে ওর পরামর্শে আমাকে দল থেকে বের করে দিয়েছে। এত খারাপ লাগছে তোকে কি বলব। আমার মাথায় এখন অপমানের আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আর সে জন্যই তোর কাছে এসেছি।

–বলে ফ্যাল। তুই কি আমার দলে যোগ দিতে এসেছিস? তা যদি ভেবে থাকিস তাহলে সরি, আমি তোকে নিতে পারব না। আমার দলে আমি জেনেশুনেই কোনও মেয়েকে রাখি না। শালা, মেয়ে এলেই লাফরা শুরু হয়ে যাবে। আর তুই তো এমনিতেই মক্ষীরানি। তাই ঝগড়াটা বেশ ভালোই হবে। তুই তো সবাইকে খেলিয়ে বেড়াবি সিনেমার নায়িকাদের মতো।

মৃদু হেসে জাসসি জবাব দিল– বোকার মতো কথা বলিস না গোপাল। কোটি টাকা দিলেও আমি তোর দলে কাজ করব না। ধূর্ত শিয়ালকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু তোকে যায় না। যাক সে কথা। আমি এসেছি তোকে সাবধান করে দিতে।

মৃদ শিস দিতে দিতে গোপাল বলল– বল, কী বলতে এসেছিস।

–ভাবিস না হঠাৎ তোর প্রেমে পড়ে গিয়ে তোকে সব বলতে এসেছি। আমি এসেছি বর্ষাতিয়ার অবিচারের বদলা নিতে। তুই তো জানিস, দিল্লি থেকে অ্যান্টিক জিনিসের ব্যবসায়ী রামলাল আগরওয়াল এসেছে শহরে নিলামে একটা অ্যান্টিক দামি হরিণ বিক্রি করার জন্য, যেটার দাম এর মধ্যেই পঞ্চাশ লাখের ওপর উঠে গেছে। বড়ো অঙ্কের বিমা পলিসিও করিয়েছে জিনিসটার জন্য…।

–জানি, অ্যান্টিক হরিণটা সোনার তৈরি আর ওটার গায়ে নানা রকম দামি দামি রত্ন বসানো। সম্রাট আকবরের আমলের জিনিস ওটা। আগের আমলে মুখশুদ্ধি বা মশলা-দানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ওই হরিণটা। শুধু তাই নয়, ওই হরিণটার পেটের জায়গাটাতে যেখানে মশলা রাখা হতো সেখানে একটা দামি হিরাও রাখা আছে।

ধানাই-পানাই ছেড়ে তুই আমাকে কেন এসব শোনাচ্ছিস সেটা বল।

–বর্ষাতিয়া জেনে গেছে যে তুইও হরিণটার পেছনে লেগে আছিস।

–জেনেছে তো কি হয়েছে? বয়েই গেলো। তুই কি আমাকে সাবধান করতে এসেছিস? এটা হল বিজনেস। আমি শালা বর্ষাতিয়ার বাবার পয়সায় খাই না বুঝলি। গিয়ে বলে দিস তোর বসকে। আসল কথাটা বল।

–শোন তাহলে,  রামলাল আগরওয়াল যে-বাড়ির ফ্ল্যাটে উঠেছে, সেই বাড়ির ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটে তুই তোর দলের আববাসকে ভাড়াতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিস কারণ তুই আগেই ওই রেনডিয়ারটা হাতাতে চাস। বর্ষাতিয়ার ধারণা যে ওই রামলাল আগরওয়ালকে চোখে চোখে রাখার জন্যই তুই এটা করেছিস। তোকে সে সুযোগ দিতে চায় না বর্ষাতিয়া। আগামীকাল রাতেই বর্ষাতিয়া ওটা চুরি করতে চায়। এখন তোর উচিত, তার আগেই কাজটা সেরে ফেলা। বর্ষাতিয়া, আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি বানিয়ে ফেলেছে। ওর আয়রন সেফ খোলার পিন নম্বরও জোগাড় করে ফেলেছে। আমি সেগুলো চুরি করে নিয়ে এসেছি।

আমি জানি আমাকে ধরে ফেললে বর্ষাতিয়া আমাকে মেরে ফেলবে তাই আগামীকাল শহর ছেড়ে দেব ঠিক করেছি। তবে ভাবিস না আমি বিনা স্বার্থে এটা করছি। আমার বদলা নেওয়াও হবে আর আমার অর্ধেক ভাগ চাই আগামীকাল সকালে। তোকে আজ রাতের মধ্যেই কাজটা করতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই। রামলাল আগরওয়াল এখন গ্র্যান্ড হোটেলে গেছে। সেখানে মদ খেয়ে নাচানাচি করছে। ফিরতেও অনেক রাত হবে। তাই আজই সবচেয়ে ভালো সুযোগ। দেরি করিস না। কাজটা চুপচাপ করে ফেল। আর আমি জানি একমাত্র তুই-ই পারবি এটা করতে। তুই যদি ওটা বিক্রির টাকা আমাকে না-ও দিস আমার দুঃখ নেই। আমি বর্ষাতিয়ার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারলেই খুশি।

–আমাকে একটু ভাবতে দে জাসসি।

গোপাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নীরবে ভোজালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মনটা অন্য কোথাও পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় কি একটা চিন্তা করছে। এমন সময় বাইরে থেকে হরবোলা মন্টুর আওয়াজ শোনা গেল। মন্টুকে এলাকার সবাই চেনে। মুখ দিয়ে নানা রকম আওয়াজ করে কিছু উপার্জন করে আর বাচ্চাদের আনন্দ দেয়। উঠে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল গোপাল। দেখল মন্টু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গোপাল বুঝল, ওকে কোনও জরুরি খবর দিতে এসেছে। মাঝে মাঝেই দেয়। কারণ, মন্টু হরবোলা ওর চর।

জাসসি কে উদ্দেশ্য করে বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল– দেখলি তো কি রকম আওয়াজ শুরু করেছে। টাকা না দিলে যাবে না, এরকম ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। যাই, দুটো টাকা দিয়ে আসি।

ঘরের বাইরে সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্য পাড়ে তাকিয়ে দেখল বেশকিছু বাচ্চার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মন্টু হরবোলা। ইশারায় কাছে ডাকল। পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে মন্টুর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল– কি গো মন্টুদা, কোনও খবর আছে নাকি?

পাঞ্জাবির ছেঁড়া পকেট থেকে ডান হাতটা বেরিয়ে এল মন্টুর। গোপালের হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় একটুকরো কাগজ গুঁজে দিল গোপালের হাতে।

–সাবধানে থাকবেন, গোপালদা, এই কাগজে সব লিখে দিয়েছি, পড়লেই বুঝতে পারবেন। তারপর গোপালের দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।

গোপাল আবার বাড়ির দরজার কাছে ফিরে এল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাগজটা ভালো করে পড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বড়ো হাইড্রেনে ফেলে দিল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল জাসসি টিভিটা খুলেছে। গোপাল ঘরে ঢুকতেই জাসসি জিজ্ঞাসা করল– গোপাল, কী ঠিক করলি? হাতে কিন্তু তোর বেশি সময় নেই। আজ রাতের মধ্যেই কাজটা সারতে হবে।

গোপাল মাথাটা ঝাঁকাল। বলল– কাজটা হয়ে যাবে জাসসি। কাল সকালে খবর পেয়ে যাবি।

জাসসি একটু মুচকি হাসল, বলল– আমি জানতাম একমাত্র

তুই-ই পারবি, তাই তো তোর কাছেই এলাম। বলে ব্যাগ থেকে একটা চাবি আর এক টুকরো কাগজ বের করে টেবিলে রাখল। বলল– চাবিটা আগরওয়াল-এর ফ্ল্যাটের আর কাগজে লেখা আছে ঘরের ভেতরে যে সেফটা আছে, তার কোড নম্বর। আমি চলি রে। আমাকে এগিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কেউ দেখে ফেলতে পারে। সাবধানে থাকিস। বলেই বেরিয়ে গেল জাসসি। যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।

( দুই )

অনেকক্ষণ চুপচাপ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল গোপাল। কী যেন চিন্তা করছে। পরিস্থিতিটা বেশ মজার। মোবাইল থেকে  আববাসকে ফোন করল। অনেক কথা হল, কথার শেষে বলল– আববাস, আমি তোর ফ্ল্যাট-এ আসছি। দুজনের কথা হল ফোনে। তারপর চাবিটা আর কাগজে লেখা পিন কোডটা সঙ্গে নিল। রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করল অলোকনন্দা অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে। বাড়িটা খুব দূরে নয়। হেঁটে যেতে অল্প কয়েক মিনিট লাগল। বাড়ির গেটে পৌঁছে দেখল গার্ড গুমটির ভেতরে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। নিঃশব্দে মূল গেটের কোনায় লাগানো ছোটো দরজার পাল্লাটা খুলে ঢুকে পড়ল গোপাল। খুব দ্রুত গতিতে আববাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছোল। আববাস সেখানে অপেক্ষা করছিল গোপালের।

গোপাল– আববাস, আমি আগরওয়ালের ফ্ল্যাট-এ যাচ্ছি। তুই ওপরের জানালা থেকে নজর রাখ। কেউ এলে সিগন্যাল দিবি। সিঁড়ি দিয়ে নীচের ফ্ল্যাট-এ নেমে এসে দরজায় কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল যে কেউ আছে কিনা। যখন বুঝল ভেতরে কেউ নেই তখন জাসসির চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

কুড়ি মিনিট পর ঘর থেকে বেরিয়ে, নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে, মৃদু শিস দিয়ে আববাসকে ডাকল। সিঁড়িতেই নেমে এল আববাস। তারপর ঘুমন্ত গার্ডের পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল দুজনে। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বলল– আববাস, শরবতের সাথে মনে হয় তোর ঘুমের ওষুধটা একটু বেশিই দিয়ে দিয়েছিস। তোর আর ওখানে থাকা চলবে না। বলেই নিজের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হল।

–ঘটনাটা কী গুরু? তুমি যখন আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে ঢুকলে, তখন আমি দু-জন লোককে রাস্তার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে এই ফ্ল্যাটের দিকে নজর রাখতে দেখেছি। মনে হল সাদা পোশাকে পুলিশের লোক। তুমি পিছনে লক্ষ্য করো, ওরা আমাদের ফলো করছে। হাসল গোপাল, কোনও উত্তর দিল না।

দশ মিনিট পর আববাসকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকল গোপাল। বেরোনোর সময় ঘরের লাইট, ফ্যান ও টিভিটা অন করে গিয়েছিল। গোপাল বলল– আববাস, আজ বর্ষাতিয়ার প্রেমিকা জাসসি এসেছিল। আমাকে বেশ ভালো একটা গল্প শোনাল। বর্ষাতিয়া নাকি অন্য একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর তাই জাসসিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জাসসি প্রতিশোধ নিতে চায়, তাই আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি আর আয়রন সেফের কোড নম্বর লেখা কাগজ চুরি করে এনেছে বর্ষাতিয়ার থেকে। সেগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছে আজই যেন ওই দামি হরিণটা চুরি করে সরিয়ে ফেলি। তাহলে বর্ষাতিয়া আর সেটা পাবে না আর জাসসি-র-ও প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

 

জানিস, আমার গল্পটা শুনে খুব কাঁচা মনে হয়েছে। ওটা চুরি করতে হলে আমাকে দিয়ে কেন? জাসসি তো নিজেই চুরি করতে পারত। আপন মনে যখন এসব কথা ভাবছিলাম, তখন হরবোলা মন্টুদা আমাকে সংকেত দিল। আর তখন জাসসি আমার ঘরে বসেছিল। মন্টুদাকে ভিক্ষে দেওয়ার নাম করে নীচে নেমে গেলাম। মন্টুদা কাগজে লেখা একটা মেসেজ দিল। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য। দুদিন আগে মন্টুদা বর্ষাতিয়া, আগরওয়াল আর জাসসি-কে মিটিং করতে দেখেছে। জানলার পাশের টেবিলে বসে কথা বলছিল ওরা। সন্দেহ হওয়ায় মন্টুদা কান পেতে ওদের কথা শুনেছে।

 

আমাকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করছিল ওখানে বসে। জাসসি যখন বলেছিল ও টাকা চায় না, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। ও তো টাকার জন্য সব কিছু করতে পারে, তবে টাকার কথা বলাতে আমার সন্দেহটা বেড়ে গিয়েছিল। আর মন্টুদার খবরটা পেয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওরা জানত, আগরওয়ালের হরিণটার ওপর আমার নজর আছে। ওরা ঠিক করেছিল আমাকে চুরি করার সুযোগ করে দেবে আর পুলিশ ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত-কেও জানিয়ে রাখবে। পুলিশ আমার ওপর নজর রাখবে। এভাবে পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছে বর্ষাতিয়া। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আর কি!

–গুরু, আজকাল তুমি তো বেশ পোড় খাওয়া লোকের মতো কথা বলছ। তোমার দিমাকটাও আজকাল বেশ চলছে।

–তুই আর তেল লাগাস না তো! ওরা বুঝতে পারেনি যে আমি ওদের ফন্দিটা বুঝতে পেরেছি। ওরা হয়তো ভাবছে আমি ওদের ফাঁদে পা দিয়েছি। দেখবি একটু বাদেই হয়তো পুলিশ আসবে আমার কাছে। শুনলাম ওই দামি হরিণটা নাকি ইন্স্যুরেন্স করিয়ে রেখেছে মোটা টাকার। যাতে চুরি গেলে আগরওয়ালের কোনও ক্ষতি না হয়, বেশি টাকা পায়। এককথায় বলতে পারিস, ওরা চেয়েছিল যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। ওরা এখনও হাতকাটা গোপালকে চেনেনি। ওরা চলে ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। তুই খালি মজাটা দেখে যা। আমি যা যা বলব তাই করে যা।

আববাস জিজ্ঞাসা করল– হরিণটা কি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?

–পাগল হয়েছিস? এসব জেনেও সঙ্গে আনব? জায়গা মতো সেট করে এসেছি। তোকে বলব তবে এখন নয় পুলিশের চলে যাওয়ার পর।

আববাস একটু থেমে বলল– আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না এতে রামলাল আগরওয়ালের কী স্বার্থ আছে?

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল– দরজা খোল। দরজা খোল, নয়তো দরজা ভেঙে ফেলব।

আববাস-এর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে গোপাল এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দেখল দরজার সামনে সাদা পোশাকে আরও তিনজন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত। বদ্যিনাথ দত্তকে চেনে না এই শহরে খুব কম লোকই আছে। বিশেষ করে বদ্যিনাথ দত্ত অপরাধ জগতের সবার কাছে এক বিভীষিকা। দরজাটা খুলে দিতেই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে বলল– মালটা বের করে দে।

–কোন মালটা স্যার?

–ভেবেছিস আমি কোনও খবর রাখি না? রামলাল আগরওয়ালের চুরি যাওয়া দামি হরিণটা। আমি ওটা চাই। তোকে ওখান থেকে বেরোতে দেখেছি।

–স্যার, আমি তো আববাসের কাছে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমাকে। আপনি যখন এতই শিওর তাহলে খুঁজে দেখুন।

চারজন মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল ঘরগুলো। জিনিসপত্রগুলো তছনছ করল, ওলট-পালট করে ফেলল। কিন্তু কোথাও সেই দামি হরিণটা খুঁজে পেল না। একঘন্ট৆া ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঘর্মাক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল চারজনে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত হতাশার ভঙ্গিতে সহকারীদের দিকে তাকালেন।

গোপাল হাসিমুখে বলল– স্যার আমি তো আগেই বলেছিলাম যে আমি জিনিসটা নিইনি। প্রথমেই যদি আমার কথা বিশ্বাস করতেন তবে অকারণে আপনাদের এই কষ্টটা করতে হতো না। বরং যদি আমাকে সব ঘটনাটা খুলে বলতেন তাহলে হয়তো অনুমান করতে পারতাম যে ওটা কারা উড়িয়েছে।

ইন্সপেক্টর রেগে গিয়ে বললেন– চুপ কর শালা, আমি কি মজা করছি এতক্ষণ? তোর হিম্মত দেখে অবাক হচ্ছি। আমি চাইলে তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টার করে দিতাম কিন্তু ওই জিনিসটা না পাওয়া অবধি তোকে মারতে পারব না। দেখ, পালাতে যাস না। পালাতে চেষ্টা করলে কিন্তু কুত্তার মতো মারব।

আমি যে সোর্স থেকে শুনেছি তাতে শিওর ছিলাম যে ওটা এখানেই পেয়ে যাব। আমার ইনফরমেশন ভুল হতে পারে না। দু’ঘণ্টা আগে তুই রামলাল আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলি আর হরিণটা তুইই চুরি করেছিস।

গোপাল– স্যার, আমার মনে হয় আপনাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে বা ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে। মনে হয় রামলাল আগরওয়াল থানায় রিপোর্ট করেছে আর বর্ষাতিয়া বলেছে যে আমিই ওটা লোপাট করেছি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি পালাব না। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়ে ঘুমোন। আগামীকাল আমি বারোটা নাগাদ আপনার সাথে দেখা করব। হরিণটা কোথায়, কার কাছে আছে আপনি জেনে যাবেন।

কঠোর দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টর গোপালের দিকে তাকালেন। রুক্ষকন্ঠে বললেন– চুপ কর শালা, তুই একটা মহা ধড়িবাজ, শয়তান। তুই ভাবছিস তোকে আমি চিনি না। আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল যে তুই তো এত বোকা নয় যে হরিণটা নিজের কাছে রাখবি। আমি শহরের চারিদিকে পাহারা বসিয়ে দিচ্ছি যাতে তুই পালাতে না পারিস। যাই হোক, আমি আজ যাচ্ছি। কাল থানায় ১চ্টায় তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই তো জানিসই ওটা না পেলে বদ্যিনাথ দত্ত কী করতে পারে। তোর ছাল ছাড়িয়ে নেব, হতভাগা। মনে থাকে যেন।

–জানি স্যার, এনকাউন্টার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন কাল আপনি ওটা পেয়ে যাবেন।

ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাওয়ার পর গোপাল আববাসকে বলল– দেখে নে তো আপদগুলো চলে গেছে কিনা?

–তুমি ঠিকই করেছ গুরু। আজ মালটা হাতছাড়া হয়ে যেত আর তুমিও ফেঁসে যেতে। বেফালতু শালা আমাকেও দুটো ডান্ডা মেরে গেল। তোমার ওটা পেলে যে কি ক্যালাত তা বুঝতে পারছ?

–তাই তো মালটা নিয়ে আসিনি। যা আজ গিয়ে শুয়ে পড়। কাল একটু কাজ আছে।

( তিন )

পরের দিন সকাল দশটায় গোপাল পৌঁছে গেল স্থানীয় ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির অফিসে। অফিসে ঢুকেই বলল– ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। পাঁচ মিনিট পর ডেকে পাঠালেন। ম্যানেজার বললেন– বলুন, আপনার কী বলার আছে?

গোপাল– আজ সকালে বিশাল একটা অঙ্কের চুরির ক্লেইম হয়তো আপনি পেয়েছেন। রামলাল আগরওয়ালের কাছ থেকে। কারণ কাল রাতেই আগরওয়াল-এর দামি হরিণটা চুরি হয়ে গেছে আর তাই গতকাল রাতেই আগরওয়াল থানায় ডায়ারি লিখিয়ে এসেছে। গলাটা একটু নীচু করে ফিস ফিস করে গোপাল বলল– জিনিসটা কোথায় আছে আমি জানি।

ম্যানেজার বিস্ময়ের চোখে তাকালেন, বললেন– আপনি জানেন? তাহলে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতেন। বসুন, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি।

–ওসব এখনই করতে যাবেন না। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। আজই জেনে যাবেন।

–মশাই, যে করে হোক ওটা আমার চাই, নয়তো আমার কোম্পানির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আজই আমি একটা প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছি তাতে লিখেছি ওই দামি হরিণটার সন্ধান যে দিতে পারবে, তাকে সাত লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। বলেই ফাইল থেকে একটা কপি বের করে দেখালেন। বললেন – আপনি ওটা পাইয়ে দিলে আপনিও টাকাটা পেতে পারেন। তবে আগে নয়।

–ঠিক আছে, আপনি আমাকে চেক দিয়ে ব্যাংকে বলে দিন যাতে আপনার অনুমতির আগে যেন ওটা রিলিজ না করে। কারণ আপনি তো জানেনই আমরা কখন, কোথায় থাকি তার ঠিক নেই। তাছাড়া আমরা অ্যাডভান্স না নিয়ে কাজ করি না।

–ঠিক আছে, তাহলে এই নিন চেক। এতটা ভরসা তো আপনাকে করতেই হবে। তবে মনে রাখবেন চালাকি করতে গেলে কিন্তু একটা পয়সাও পাবেন না বরং জেল যেতে হবে।  বলেই একটা সাত লাখ টাকার চেক লিখে খামে ভরে দিয়ে দিলেন।

গোপাল যেতে যেতে দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বলল– আর হ্যাঁ, বেশি চালাকি করবেন না, যদি জিনিসটা পাওয়ার পরও চেকটা ক্যাশ না হয় তবে আমরা কিন্তু কোর্টে কেস করি না। আমাদের হিসেবটা একটু অন্যরকম হয়। এই পৃথিবী থেকেই তাকে সরিয়ে দিই। বিশ্বাস না হয়, এই শহরে যে কাউকে হাত-কাটা গোপালের সম্পর্কে জেনে নেবেন। বলেই দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল।

গোপাল বেরিয়ে যেতেই ভদ্রলোক ব্যাংকে ফোন করে বলে দিলেন যে ওনার সাথে কথা না বলে যেন, চেকটার পেমেন্ট না করা হয়।

গোপাল একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফিরে এল নিজের বাড়িতে। দেখল বারোটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই, তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ফোন করে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির ম্যানেজারকে-কেও কিছু বলল। এরপর ফোন করল কয়েকজনকে।

ঠিক পৗনে বারোটার সময় জাসসি যে হোটেলে থাকে, সে লিফট দিয়ে উঠতে দেখা গেল ওই হোটেলের দারোয়ানকে। হাতে

রং-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো একটা সুন্দর ফুলের তোড়া। জাসসির ফ্লোরে নেমে ঘরের সামনে গিয়েই কলিং বেলটা বাজাল দারোয়ান। জাসসি দরজা খুলে দিলে তোড়াটা তার হাতে দিল। বলল– কয়েক মিনিট আগে এক ভদ্রলোক তোড়াটা আপনাকে দিতে বলেছেন। না, তাঁর নাম, ঠিকানা কিংবা পরিচয় কিছুই জানাননি ভদ্রলোক। দারোয়ানকে দশটাকার একটা নোট বকশিশ দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল জাসসি। আর ঠিক সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দৗড়ে গেল মোবাইলটা ধরতে। নম্বরটা অজানা। তাড়াহুড়োতে দরজাটা লক করতেই ভুলে গেল। ফোনটা তুলে নিতেই অন্য দিক থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল– হ্যালো, জাসসি, আশাকরি ফুলের তোড়াটা তোর ভালো লেগেছে। পরের বার আমাকে ঠকাতে আসার আগে ভেবেচিন্তে আসিস। গুড লাক।

–গোপাল তুই কি বলছিস? এটুকু কথা বলার সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল।

রাগে লাল হয়ে গেল ওর মুখটা। তোড়াটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। মেঝেতে পড়েই তোড়াটার বাঁধন গেল খুলে। ফুলগুলো সব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর মেঝেতে একটা ধাতব জিনিস পড়ার আওয়াজ হতেই চমকে উঠল জাসসি। সেটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ছড়ানো ফুলগুলোর মধ্যে চকচক করছে মনিরত্ন খচিত একটা হরিণ। ওটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল জিনিসটা।

ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। সাদা পোশাকপরা পাঁচজন অফিসারকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্ত।

ইন্সপেক্টর বললেন– মিস জাসসি, আপনি যে রামলাল আগরওয়ালের দামি হরিণটা চুরি করেছেন তা হাতকাটা গোপাল আমাদের আগেই বলে দিয়েছে। আপনি আর বর্ষাতিয়া মিলে ওকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন।

–মিথ্যে কথা। এটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এইমাত্র গোপালের পাঠানো ফুলের তোড়ার মধ্যে পেলাম। নিশ্চয়ই আমাকে ফাঁসানোর জন্য গোপালই একাজ করেছে।

–চোরাই মাল আপনার কাছে পাওয়া গেছে তাই আপনাকেই আমাদের অ্যারেস্ট করতে হবে। কে কী করেছে, সেটা তদন্ত করলেই বেরিয়ে যাবে। আপাতত আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। একটু থেমে ইন্সপেক্টর বললেন– আর একটা কথা, শুধু গোপাল নয়,  আপনার বস বর্ষাতিয়াও বলেছে, ওই হরিণটা আপনিই চুরি করেছেন।

( চার )

এই সুযোগে গোপাল পৌঁছে গেল ব্যাংকে। প্রায় এক ঘণ্টা বাদে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এল গোপাল। মুখে প্রশান্তির হাসি। হরিণটার সন্ধান দিতে পারার জন্য পুরস্কার হিসেবে চেকটা এনক্যাশ করার অনুমতি দিয়েছে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

নিজের বাড়ির কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেল ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্তর সাথে। কঠিন হাসি হেসে ইন্সপেক্টর বললেন– টাকাটা যত তাড়াতাড়ি পারিস খরচ করে ফেল গোপাল। তোকে খুব বেশিদিন আর বাইরে থাকতে দেব না। জেলে আমি তোকে ঢোকাবই। যত চালাকিই তুই করিস না কেন! আমি জানি যে ওই হরিণটা তুই-ই চুরি করেছিলিস। এখন শুধু সেটা প্রমাণ করা বাকি।

এটুকু বলেই রাগ দেখিয়ে ইন্সপেক্টর গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন।

বিপরীত স্রোত

রান্নাঘরে অঞ্জনের টিফিন বানাতে বানাতে নমিতা টিভির পর্দায় মাঝে মাঝেই চোখ রাখছিল। কয়েকদিন ধরেই মিডিয়াগুলো ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে পড়েছে। রোজই নতুন নতুন খবর উঠে আসছে। খবরটা নমিতা নিয়ম করেই দেখে। কোথায় কী হচ্ছে নয়তো জানবে কীভাবে?

অঞ্জন এসে শেল্ফ-এর সামনে দাঁড়াল। নমিতার ফ্ল্যাটে ওপেন কিচেনের ব্যবস্থা সুতরাং রান্না করতে করতে টিভি দেখাটাও নমিতার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বামীকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘সকাল সকাল এদের আবার শুরু হয়ে গেছে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, চাষি আত্মহত্যা করছে, দেশের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। আর এই মহিলাদের দ্যাখো, এদের আর কোনও কাজ নেই, মি টু-তে সমস্বরে গলা মেলাচ্ছে। আমার শুধু এদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, যখন ঘটনাটা ঘটেছিল তখন কেন প্রতিবাদ করেনি, ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছিল? এখন চেঁচিয়ে কী লাভ? আসলে এরা চায় প্রচারের আলোয় থাকতে। এ হচ্ছে পুরুষদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। বন্ধ করো টিভি, খবরে আজকাল আর কিছুই দেখাবার নেই’, বিরক্ত বদনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দেয় অঞ্জন।

টিফিন কৗটোর ঢাকনা বন্ধ করতে করতে নমিতা উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা এইসব মহিলারা মিথ্যা বানিয়ে বলছে আর তোমরা পুরুষরা সব ধোয়া তুলসীপাতা? আমাদের সমাজটা এইভাবেই মহিলাদের চুপ করিয়ে তাদের শালীনতায় মুড়ে রাখতে চায়। গলা তুলতে গেলেই, সেটা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সমাজ উঠেপড়ে লেগে যায়।’

‘আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি। কিন্তু ৩০ বছরের পুরোনো কাদা ঘেঁটে লাভটা কী হবে বলতে পারো? সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট বা হ্যারাসমেন্ট যখন ফেস করেছিল তখনই দরকার ছিল প্রতিবাদ করার’, অফিসের শার্ট-টা পরতে পরতে জবাব দেয় অঞ্জন।

অঞ্জনের মনোভাব বুঝতে পেরে রেগে যায় নমিতা, ‘তোমার এটা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি মনে হচ্ছে কারণ তুমি সত্যিটা দেখতে চাইছ না। আসলে এটা শুধু পুরুষদের দোষ নয়, সমাজের বানানো নিয়মে অত্যাচার করার পরেও ওই মেয়েগুলোকেই আবার চুপ করে থাকার জন্য ভয় দেখানো হয়।

অফিসে গিয়ে দ্যাখো মেয়েরা যৗন শোষণের বিরুদ্ধে সরব হলেই তাদের চাকরি চলে যাচ্ছে আর যারা বাড়িতে রয়েছে তাদের এত সাহস কোথায়? ছোটো থেকে মেয়েদের শেখানো হয় লজ্জাই মেয়েদের ভূষণ অথচ ছেলেদের স্বাধীনতা ছুট দিয়ে রেখেছে সমাজ।

আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে এই দেখে যে ভারতবর্ষের মতো দেশে এই প্রথম পুরুষরা কিছুটা ভয় পেয়েছে। আগে হয়তো এমন কোনও অপরাধ সে করে এসেছে, যেটা এই আন্দোলনের ফলে সবার সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে মনে মনে ভীত হয়ে পড়ছে। সীতাকে আর অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে না, এবার রামের পালা’, গর্বের সঙ্গে বলে নমিতা।

‘আচ্ছা এবার বক্তৃতা দেওয়া বন্ধ করো… খেতে দেবে তো দাও নয়তো টিফিন নিয়ে আমি অফিস বেরিয়ে যাচ্ছি’, বিরক্ত মুখে বলে অঞ্জন।

ভাতের থালাটা অঞ্জনের সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল নমিতা, ‘কী ব্যাপার বলো তো, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? তুমিও কি কারও সঙ্গে… ভয় পাচ্ছ নাকী যে তোমারও পুরোনো পাপ ধরা পড়ে যাবে?’

নমিতার কথা শুনে ভাত আটকে যায় অঞ্জনের গলায়। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বলে, ‘কী… পাগলের মতো বলছ? বিনা কারণে আমাকে এসবের মধ্যে টেনে আনছ কেন? দোষ কেউ করেছে আর সন্দেহ আমার উপর। সকলেই জানে আমি কীরকম, সুতরাং নিজের সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না।’

‘হুঁ, এটা ভুলো না যাদের চরিত্রের সত্যিটা আজ সকলের সামনে খুলে গেছে তাদের সম্পর্কেও কিন্তু মানুষের আগে অন্যরকম ধারণা ছিল… হঠাৎ করেই হয়তো জানতে পারলাম তুমিও কোনও মেয়ের সঙ্গে… আর আমি এটা তো শুধু উদাহরণ দিচ্ছি’, টিফিন বক্সটা অঞ্জনের হাতে দিতে দিতে নমিতা বলল।

অঞ্জন জ্বলে উঠল নমিতার কথা শুনে। ইচ্ছে করছিল টিফিনটা ছুড়ে মারে নমিতার মুখের উপর। আবিশ্বের পুরুষরা সব খারাপ আর মহিলারা সব সতীসাধবী! নিজেকে সংযত করল অঞ্জন। নমিতার সামনে প্রতিবাদ করা মানে নিজেকেই সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। বরং সুর নরম করল অঞ্জন, ‘এখন নিজের স্বামীকেও ভরসা করছ না? আমাকে তোমার এতটাই নীচ চরিত্রের মনে হয় যে, তুমি আমাকে এসব কথা বলতে পারছ?’

নমিতার মনে হল একটু বেশি-ই বলা হয়ে গেছে অঞ্জনকে। ও যাতে মনে দুঃখ না পায় তাই গলায় যথা সম্ভব মাধুর্য নিয়ে এসে বলল, ‘আমি তো এমনি-ই তোমাকে এইসব বলছিলাম, আমি কি তোমাকে চিনি না? আচ্ছা এবার অফিসে বেরোও, নয়তো পরে বলবে আমার জন্য তোমার অফিস যেতে দেরি হয়ে গেল।’

‘হুঁ, আজ আবার একটা মিটিং আছে অফিসে’, বলে বেরিয়ে আসে অঞ্জন। অফিস যেতে যেতে মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকে ওর। ভয় বাসা বেঁধেছে ওর মনে। মি টু নিয়ে যা আরম্ভ হয়েছে তাতে ওর নিজের কেলেঙ্কারি ফাঁশ হবার আশঙ্কা কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছে না। শিউরে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কিছুতেই ওর অন্যায় বরদাস্ত করবে না, শাস্তি পাওয়ার সব ব্যবস্থা করে তবে ছাড়বে। বাচ্চাদের চোখেও ওর সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। এতদিনের চেষ্টায় সমাজে যে মান-সম্মান অর্জন করেছে, তাও আর বজায় রাখা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

মিটিং-এও ঠিকমতো মন দিতে পারল না অঞ্জন। রোজকার মতো সবাইকে বকে ধমকে কাজ করিয়ে নেওয়ার এনার্জি কিছুতেই জোগাতে পারল না। অফিসে কিছুই ভালো লাগছিল না। সন্দীপ এসে কেবিনে উঁকি মারল।

‘কী হল, আজ এত চুপচাপ যে? ঢুকলি যখন আমার ‘গুডমর্নিং’-এ সাড়া দিলি না, আবার এখন এভাবে বসে থাকা, কারও ওপর চ্যাঁচামেচি করছিস না… কী হল কী তোর? কোনও মহিলা তোকে আবার ফাঁসিয়ে দেয়নি তো?’ সন্দীপ এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল, কেবিনের বাইরে যারা বসে তাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল।

কেবিনের বাইরে থেকে কারও গলা ভেসে এল, ‘ছাড় না সন্দীপ, বউয়ের সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। ওকে ওর মতো থাকতে দে না।’ সন্দীপ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

অফিসে দিনটা কোনওমতে কাটিয়ে অঞ্জন বাড়িতে ফিরে আসে। হাত-মুখ ধুয়ে বসতে বসতে খেয়াল করে নমিতা ফোনে ব্যস্ত রয়েছে। নমিতার কথাগুলো কানে ভেসে আসে, ‘দেখিস লোকটা যেন কোনওমতেই ছাড়া না পায়, নিজেকে কী ভাবে বলতো? খুব তো ভদ্র সেজে ঘুরত। নাতি, নাতনি সব রয়েছে অথচ দেখ নিজের মেয়ের বয়সি একটা মেয়েকে… আচ্ছা এখন আমি রাখছি, অঞ্জন অফিস থেকে ফিরেছে’, বলে নমিতা ফোন নামিয়ে রাখে।

‘কী হয়েছে?’ অঞ্জন জানতে চায়। ‘আমি তোমাকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম। জানো, পাড়ার সুজিতদার উপর কোনও মেয়ে নাকি হ্যারাসমেন্টের কেস দিয়েছে, অথচ সুজিতদাকে দেখে ভদ্র বলেই মনে হতো। ভদ্রলোকের বউয়ের বক্তব্য, মেয়েটি মিথ্যা আরোপ দিচ্ছে, সুজিতদাকে নাকি বদনাম করতে চাইছে। বউদি সবাইকে বলেছে মেয়েটি সুজিতদার কাছে চাকরি করত। কোনও কারণে মেয়েটিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করায় সুজিতদার উপর রেগে যায় মেয়েটি এবং মিথ্যা বদনাম দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার তো বউদির উপর রাগ হচ্ছে যে একজন অপরাধীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন উনি। কিন্তু যতই চেষ্টা করুন না কেন সুজিতদাকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবেন না। ওনার বউকেও জেলে পুরে দেওয়া উচিত’, রাগে নমিতার মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে।

‘হতে তো পারে যে সুজিতদাই সত্যি কথা বলছেন আর মেয়েটি মিথ্যা…’

‘মিথ্যা…?’ অঞ্জনের কথার মাঝখানেই নমিতা ওকে থামিয়ে দেয়। ‘কেন কোনও মেয়ে শুধু শুধু নিজেকে বদনাম করবে? নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কিছু ঘটেছে বলেই না ও গলা তুলেছে। সাধারণত মেয়েরা প্রতিবাদ করে না বলেই পুরুষরা বেঁচে যায়। আর বউগুলোকে দ্যাখো, স্বামী দোষী জেনেও তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে থাকে। সত্যি বলছি অঞ্জন, আমার স্বামী যদি এরকম করত, আমি ছাড়তাম না, জেলে পাঠিয়ে তবে বিশ্রাম নিতাম।’ নমিতার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল অঞ্জন।

‘একবার ভেবে দ্যাখো, আমাদেরও মেয়ে রয়েছে। কেউ যদি ওর সঙ্গে এরকম করত তাহলে? ছিঃ মেয়েরা জড়পদার্থ নাকি যে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যার যেরকম ভাবে ইচ্ছে তাকে ব্যবহার করবে? এটা সমাজের পক্ষে লজ্জাকর, অঞ্জন’, নমিতা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।

কথা শেষ করে নমিতার দৃষ্টি পড়ে অঞ্জনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটার উপর। ‘একী, তোমার কী হল, মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? আমি জানি তোমারও ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লাগছে,

যে-কোনও ভদ্রলোকেরই ঘটনাটা জেনে ঠিক এরকমই মনোভাব হবে। আসলে কারও চরিত্র সম্পর্কে হলফ করে কিছু বলা আজ আর সম্ভব নয়’, বলে নমিতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে অঞ্জনের। আজ সুজিতদা পাড়ায় আলোচনার বস্তু হয়ে উঠেছেন, যে-কোনও দিন অঞ্জনের নামও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। নিজের সন্তানদের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? ঘেমে ওঠে অঞ্জন, চুপচাপ এসে শোবার ঘরে শুয়ে পড়ে।

রাতের খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে নমিতা আর বাচ্চারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও, হাজার চেষ্টা করেও অঞ্জন দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। নানা চিন্তা এসে ওকে ঘিরে ধরছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল সকলে এমনকী বাড়ির প্রতিটা আসবাবপত্র পর্যন্ত ওকে উপহাস করছে, বলছে, ‘দেখছ তো অঞ্জন, এতদিন স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে এসেছ আজ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কীরকম বোধ করছ? বাঁচতে তো তুমিও পারবে না। হ্যাঁ দেরি হয়েছে বটে কিন্তু সকলেই নিজের নিজের কর্মের ফল একদিন পাবেই, তুমিও বাদ যাবে না।’ ঘেমে নেয়ে বিছানাতেই উঠে বসে অঞ্জন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। ভয় যেন সম্পূর্ণ গ্রাস করে ওকে কিন্তু কাকে বলবে এইসব কথা এবং কী-ই বা বলবে? ওর করা অপরাধের কথা যদি সবাই জানতে পেরে যায়, তাহলে এতদিনের সংসারটা ওর তছনছ হয়ে যাবে।

নিজের মনেই হাজারো প্রশ্ন উঠতে থাকে অঞ্জনের। আবার নিজেই নিজেকে স্ত্বান্না দেয়। মন বলে এরকম কিছুই ঘটবে না, বেকার কেন ও এত চিন্তা করছে? শ্রেয়া কখনওই নিজের মুখ খুলবে না, আর যদি খোলে ওকে মিথ্যা প্রমাণ করতে কতটুকুই বা পরিশ্রম হবে? ও প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু কার সাহস হবে অঞ্জনের বিরুদ্ধে কিছু বলতে? ও বরং নিজেই শ্রেয়াকে দোষী প্রমাণিত করে দেবে। অঞ্জনের চোখের সামনে ৭-৮ বছর আগেকার ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে। শ্রেয়ার উপর করা এক-একটা অত্যাচারের পাতা পরপর খুলে যেতে থাকে অঞ্জনের চোখের সামনে।

সাত-আট বছর আগে যে কোম্পানিতে ছিল অঞ্জন, সেখানেই শ্রেয়া অঞ্জনের অধীনে কাজ করত। তন্বী চেহারার মেয়েটির এক মাথা ঘন কালো চুল, ডাগর দুটো চোখ এবং ত্বকের গোলাপি আভা অঞ্জনের দুর্নিবার আকর্ষণের কারণ ছিল। শ্রেয়াকে দেখলেই ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করত অঞ্জন যা শ্রেয়ার কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ওর সামনে এলে শ্রেয়া কিছুতেই সহজ হতে পারত না, জামাকাপড় ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠত যেন।

শ্রেয়া বুঝতে পারত, অঞ্জনের ওর প্রতি দুর্বলতার কারণ ওর শরীরটা ছাড়া আর কিছু নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করত সময়ের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে ছুটি হলেই অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু রোজ সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। অন্য কোনও কাজের অছিলায় অঞ্জন মাঝেমধ্যেই ওকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠাত। ছুটির পরেও ওকে আটকে রাখত। কাজ করতে করতেও শ্রেয়া বেশ বুঝতে পারত ওকে ঠিক কী নজরে দেখছেন অঞ্জন স্যার। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে যেত স্যারের চোখে কিন্তু তাতেও অঞ্জন বিন্দুমাত্র বিচলিত হতো না বরং বাধ্য হয়ে লজ্জায় শ্রেয়াকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হতো।

ধীরে ধীরে সাহস বাড়তে আরম্ভ করে অঞ্জনের। ছলছুতো করে শ্রেয়ার গায়ে হাত দিতেও শুরু করে দেয়। কখনও পিঠে, ঘাড়ে, বুকে অনাবশ্যক হাত দিয়ে ফেলে আবার অমায়িক একটা ‘সরি’ ছুড়ে দিতেও কসুর করত না।

শ্রেয়ার রক্তাক্ত মনে অশ্রু ঝরত শুধু, প্রতিবাদ করে উঠতে পারত না। মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ বলে মনে হতো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর মা আর ভাইয়ের দায়িত্ব না নেওয়া ছাড়া উপায় কিছু ছিল না আর অঞ্জন স্যার ওর বাড়ির অবস্থা পুরোটাই জানতেন এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি।

সেদিনও এমনি এমনি মিথ্যা কাজের বাহানায় অঞ্জন শ্রেয়াকে নিজের কেবিনে বসিয়ে রেখেছিল। অফিস অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছিল। অঞ্জন ওকে বাড়ি ছেড়ে দেবে এই অজুহাতে শ্রেয়াকে আটকে রেখেছিল। শ্রেয়া তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ-ই অঞ্জন পিছন থেকে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে জোর করে টেনে নেয়। শ্রেয়ার সারা শরীরে, মুখে ত৫ চুম্বনের রেখা স্লঁকে দিতে থাকে।

শ্রেয়া নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কোনওমতে মুখ সরিয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, ‘স্যার, এটা কী করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।’

‘শ্রেয়া, এই দিনটার জন্য কতদিন আমি অপেক্ষা করেছি। আজ কী করে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব বলো’, শ্রেয়ার চুলে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে অঞ্জন।

হঠাৎ-ই কেবিনের দরজায় টোকা। অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় শ্রেয়াকে। ‘কাম ইন’, বলাতে অফিসের পিওন এসে ঢোকে যাকে আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল অঞ্জন।

‘কী ব্যাপার, তুমি ফিরে এলে যে?’

‘না স্যার, আমার টিফিনের কৗটোটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটাই নিতে এসেছি’, কাঁচুমাচু ভাবে জবাব দেয় পিওন।

‘ঠিক আছে, নিয়ে নাও’, বিরক্তি সহকারে জবাব দেয় অঞ্জন।

শ্রেয়া কিন্তু মনে মনে ধন্যবাদ জানায় পিন্টুকে। হোক না অফিসের পিওন কিন্তু সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলে শ্রেয়া ওর সঙ্গে। ওর কেন জানি না মনে হয় কিছু একটা অঘটনের অাঁচ পেয়েই পিন্টুদা অফিসে ফিরে এসেছে। টিফিন কৗটোটা একটা বাহানা মাত্র। পিন্ঢু৆দার জন্য আজ ও বেঁচে গেল এই জঘন্য লোকটার হাত থেকে।

অঞ্জন কিন্তু মোটেই খুশি হল না। ওর এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করল পিন্টুকেই এবং সুযোগ বুঝে শ্রেয়াও অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এল। অঞ্জন এখানেই থেমে থাকল না, সুযোগ খুঁজতে লগল শ্রেয়াকে নিজের জালে ফাঁসাবার।

সুযোগ এল খুব শিগগির। শহরের বাইরে কাজ পড়ল অঞ্জনের। তৎক্ষণাৎ ফোন করল শ্রেয়াকে, ‘শ্রেয়া কাল তৈরি হয়ে অফিসে এসো। দুদিনের জন্য আমার সঙ্গে তোমাকে অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হবে।’

‘কিন্তু স্যার, আমার পক্ষে যাওয়া…’, শ্রেয়ার না-যাওয়ার বাহানা না শুনেই ওকে থামিয়ে দেয় অঞ্জন, ‘শ্রেয়া তোমার ইচ্ছে, অনিচ্ছে জানতে চাইনি আমি। ইট্‌স মাই অর্ডার। বসের সঙ্গে তোমার যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে নয়তো তোমার মতো মেয়েদের সকলে জুতোর তলায় রাখে।’

শ্রেয়া ভালো করেই জানত ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওর শরীরটাকে ভোগ করা। অঞ্জনের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই। অফিসে থাকতে গেলে অঞ্জন স্যারের কথামতো চলতে হবে আর নয়তো চাকরি হারাতে হবে। এই সত্য বুঝতে পেরে গিয়েছিল শ্রেয়া। মুহূর্তে নিজের মনকে তৈরি করে নিল ও। পদত্যাগপত্র লিখে জমা করে বেরিয়ে এল অফিস ছেড়ে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। অনেকদিন ধরেই অন্য চাকরির সন্ধান করছিল কারণ অঞ্জনের সঙ্গে এক অফিসে চাকরি করতে পারবে না বেশ বুঝতে পারছিল শ্রেয়া। জানে কটা দিন একটু কষ্ট করতে হবে কিন্তু পার্থ আছে ওর পাশে। কটা দিন পরেই পার্থর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। একদিক দিয়ে ভালোই হল বলে শ্রেয়ার মনে হল। এই অফিসের কেলেঙ্কারির কথা যদি বিয়ের পর পার্থ-র মা-বাবা জানতে পারতেন তাহলে কতটা লজ্জার সম্মুখীন হতে হতো সেটা ভেবে শ্রেয়া শিউরে ওঠে।

কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেল শ্রেয়া। নতুন চাকরিতে জয়েন করার তিনমাস পরেই পার্থর সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর নিজের ফোনের নম্বর বদলে ফেলল ও, যাতে অঞ্জন কোনও ভাবেই ওকে কনট্যাক্ট করতে না পারে। অতীতের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে নতুন জীবনের সুখে নিজেকে ভাসিয়ে দিল শ্রেয়া। অঞ্জনের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হল ও।

শ্রেয়া জানতে পারল না, একদিন যেখানে ও অঞ্জনের মুখোমুখি যাতে না হতে হয় তার জন্য পালিয়ে বেড়াত, সেখানে আজ অঞ্জন শ্রেয়ার ভয়ে ভীত হয়ে রয়েছে। সবসময় অঞ্জনের মনে হতো এই বুঝি শ্রেয়া এসে সকলের সামনে অঞ্জনের আসল চেহারার উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেবে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতেও পারত না। অজানা, অচেনা কেউ বাড়িতে এলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত অঞ্জন। কলিংবেল বাজলে বুক কেঁপে উঠত ওর, ভাবত ওই বুঝি শ্রেয়া ওর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে।

একদিন অফিস থেকে ফিরতেই নমিতা জানাল একটি লোক অঞ্জনের নামে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে গিয়েছে।

‘কোথায় রেখেছ খামটা। কী থাকতে পারে ওতে?’ শঙ্কিত হয়ে অঞ্জন নমিতার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

‘জানি না, হয়তো ফোটো বা ওই ধরনের কিছু হবে। দেখি খামটা খুলে’, বলে খামটা হাতে নিতেই অঞ্জন ছোঁ মেরে নমিতার হাত থেকে খামটা ছিনিয়ে নিল।

‘আমার চিঠি তুমি খুলছ কেন?’ নমিতা অঞ্জনের কান্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেল। তোমার কী হয়েছে বলো তো। আগে তোমার সব চিঠি আমি-ই তো খুলতাম, আজ হঠাৎ হল কী? তুমি তো এমন ভয় পাচ্ছ যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে তোমার গোপন কোনও তথ্য লুকোনো রয়েছে?’

নমিতার কথা শুনে চমকে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কি ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে? কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। খামটাতে অন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে যেটা ওরই বন্ধু পাঠিয়েছে।

অঞ্জনের ব্যবহারে নমিতা প্রায়শই আশ্চর্য হয়ে পড়ত। মাঝেমধ্যেই মনে হতো অঞ্জনের মাথার কোনও গোলমাল হল না তো? সত্যিটা নমিতা জানবেই বা কী করে? অতীতে করে আসা পাপের দংশনই যে অঞ্জনকে ভীত, ত্রস্ত করে তুলছে। অঞ্জনের সব সময় মনে হতো একবার শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ও ক্ষমা চেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারত। অথবা পুরোনো দিনগুলো যদি ফেরত আনা যেত তাহলে নিজের চরিত্রটা শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু অতীত-কে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব?

অঞ্জন সিদ্ধান্ত নেয়, যেভাবেই হোক শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ওকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নয়তো সারাজীবন এই অশান্তিতে ওকে কাটাতে হবে যে, কবে ও ধরা পড়ে যাবে। চেষ্টা করে শ্রেয়ার ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলে। যাবে যাবে করতে করতে একদিন হঠাৎই শ্রেয়াকে ও দেখে একটা থানায় ঢুকতে। দেখেই মনের মধ্যে পুরোনো ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওর মনে হয় শ্রেয়া নিশ্চয়ই ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাতেই থানার দ্বারস্থ হয়েছে নয়তো শ্রেয়ার মতো মেয়ের থানায় কী কাজ থাকতে পারে?

থানার বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অঞ্জন, শ্রেয়ার বাইরে বেরোবার জন্য কিন্তু কোনও লাভ হয় না। বাধ্য হয়ে ও ওখান থেকে চলে আসে। খালি মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে যে শ্রেয়া থানায় কেন গিয়েছিল?

এই ভাবেই কেটে যায় দু-তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে অঞ্জন জানতে পারে শ্রেয়ার থানায় আসার কারণ। ওর ভাইয়ের বউ, শ্রেয়ার মা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে থানায় রিপোর্ট লিখিয়েছে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রেয়ার থানায় আসা।

একটু যেন স্বস্তি পায় অঞ্জন। শ্রেয়া পুলিশে জানালে এতদিনে নিশ্চয়ই পুলিশ বসে থাকত না, আইনি পদক্ষেপ অবশ্যই নিত। কিন্তু বলা যায় না। নমিতার কাছেই শুনছিল পাড়ার সুজিতদা আপাতত বাড়িতে ফিরেছে ঠিকই কিন্তু কোর্ট-কাছারি করতে হচ্ছে। নমিতা তো বেশ জোর গলায় বলল, যে-পাপ লোকটি করেছে তার সাজা অবশ্যই একদিন লোকটাকে পেতেই হবে। এটাই ওর ভরাডুবির কারণ হবে।

আজ অঞ্জন মনে করছে ও শ্রেয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু ভয়, আশঙ্কার খাঁড়াটা সারা জীবন ওর ঘাড়ের উপর ঝুলতে থাকবে। যে-কোনও মুহূর্তে ওটা লক্ষ্যে নেমে আসতে পারে। স্রোতের বিপরীতে থাকতে পারার জন্য মুহূর্তের আনন্দ বিষাদে বদলে যেতে পারে যদি শ্রেয়া ‘মি টু’ আন্দোলনে নিজেকে শামিল করে নেয়। এই সবই অঞ্জন ভালো করেই বুঝতে পারছিল এবং এই সত্যটাও ওর অজানা ছিল না যে, এখন থেকে সারাটা জীবন ওকে ভয়ে ভয়েই কাটাতে হবে। ভবিষ্যতে ওর ভাগ্যে কী আপেক্ষা করছে সেটা জানার আজ আর কোনও উপায় নেই।                                           ঞ্জ

সিদ্ধান্ত

অফিসে পৌঁছে টেবিলে ফাইলগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে দীপান্বিতা কাজে বসে পড়ল। এমাসে দুটো ফুল-ডে আর একটা হাফ-ডে লিভ এরমধ্যেই নেওয়া হয়ে গেছে। তার উপর মার্চ মাস পড়তে মাত্র নয় দিন বাকি। এর মধ্যে জমা কাজগুলো শেষ করে ফেলতে হবে। ঘড়ি দেখল দীপান্বিতা। আজকে লাঞ্চের আগে অনেকটা কাজ সেরে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল ও।

টেবিলে নামিয়ে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ-ই বেজে উঠল। বিরক্ত হল দীপান্বিতা। স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখল রঞ্জনের নাম। নামটা দেখেই ও শঙ্কিত হয়ে উঠল। রোজই কোনও না কোনও বাহানায় দীপু-কে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়াটা রঞ্জনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নামেই রঞ্জন ওকে ডাকে। দুমাস হল ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছে, শুধু রঞ্জনের একটা প্রেমোশনের আপেক্ষা। তারপরেই ও বিয়েটা সারতে চায়। অথচ প্রায়দিনই রঞ্জনের কোনও না কোনও আত্মীয় দীপান্বিতার সঙ্গে দেখা করতে চায়, এই অজুহাতে রঞ্জন দীপু-কে জোর দেয় ওর বাড়ি আসতে। এটা দীপান্বিতার একেবারেই পছন্দ নয়। অথচ মা-বাবা দেখেই এই বিয়ে ঠিক করেছেন তাই রঞ্জনের সঙ্গে দেখা না করলে

মা-বাবা মনে কষ্ট পাবে এই ভেবে দীপান্বিতাও হবু বরের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে থাকে।

‘হ্যালো’, ফোনটা কানের কাছে নিয়ে আসে দীপান্বিতা।

‘দীপু, আমি বলছি। আজ প্লিজ হাফ ডে নিয়ে নাও অফিসে। মাসি হঠাৎ-ই গতকাল রাতে আমাদের বাড়ি এসেছে। মাত্র দু’দিন থাকবে। তোমাকে খুব দেখতে চাইছে। আগে শুধু একদিন তোমাকে দেখেছিল। আমি ঠিক দুটোর সময় তোমাকে অফিস থেকে তুলে নেব। আর হ্যাঁ, বাড়ি গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে শাড়ি পরে নিও। আমি অপেক্ষা করব। মাসি আবার একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। তোমাকে অন্য পোশাকে দেখলে কিছু একটা মন্তব্য করে বসতে পারে।’

‘শোনো রঞ্জন, আজ আমি কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না, আর হাফ-ডে মাসে একটাই নিতে পারি। সেটাও তো নেওয়া হয়ে গেছে।’

‘দীপু, আমি মা-কে কথা দিয়ে এসেছি যে তোমাকে নিয়েই আসব। সুতরাং ছুটি তুমি কীভাবে ম্যানেজ করবে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আসতে তো তোমাকে হবেই। এছাড়াও তুমি এলে রান্নাঘরেও মা-কে একটু সাহায্য করে দিতে পারবে।’

‘আমাকে কিছু না জানিয়েই তুমি কীভাবে কথা দিয়ে দিলে রঞ্জন?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল দীপান্বিতা।

‘তোমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? সব কাজ কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে করতে হবে নাকি?’

‘হ্যাঁ রঞ্জন, আমার সঙ্গে যে-কাজটার সম্পর্ক থাকবে সেটা অবশ্যই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে বই কি… একে তো মাঝেমাঝেই তুমি কারও না কারও সঙ্গে দেখা করাতে আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাও আর নিজে কোথায় উধাও হয়ে যাও। তোমার আত্মীয়স্বজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেই পারেন। কিন্তু রঞ্জন, বারবার তোমাদের বাড়ি যাওয়াটা কি দেখতে আদৗ ভালো লাগে?’

‘দীপু, এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি এর মধ্যেই তুমি আমাদের বাড়ি যেতে চাইছ না? নাকি আমার বাড়ির লোকেদের তোমার আর পছন্দ হচ্ছে না?’ বেশ রেগেই প্রশ্নটা করে রঞ্জন।

‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছ রঞ্জন। আমি মোটেই একথা বলিনি। বরং আমি তোমার সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে চাই। তোমাকে আরও জানতে চাই যাতে আমরা একে অপরকে আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারি, পছন্দ-অপছন্দগুলো জানতে পারি’, বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে দীপান্বিতা।

‘কোনও দরকার নেই অত বোঝবার। বোঝা-শোনার জন্য সারাটা জীবন পড়ে আছে। আমার বাড়ির লোকেরা তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে চায় আর তোমার উচিত ওদের মনের ইচ্ছা পূরণ করা। আমি ঠিক দুটোয় তোমাকে নিতে আসব, গেটে দাঁড়িও’, বলে ফোন কেটে দেয় রঞ্জন।

রঞ্জনের অফিস দীপান্বিতার ঠিক পাশের বিল্ডিং-এই। প্রথম প্রথম আসতে যেতে দুজনের প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। আগে আলাপ, তারপর বন্ধুত্ব। রঞ্জনের বাড়ি থেকেই দীপান্বিতার মা-বাবার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রোপোজালটা আসে। যেহেতু রঞ্জন মেয়ের ভালো বন্ধু, তাই ওনারাও সম্মতি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। দেড় মাসের মধ্যে বিয়ের কথা হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেই কারও না কারও সঙ্গে দেখা করাতে দীপান্বিতাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে জোর দেওয়া শুরু করে রঞ্জন। প্রথম প্রথম দীপান্বিতার ভালোই লাগত যে শ্বশুরবাড়ির সকলেই ওকে দেখতে চায় কিন্তু পরে সেটাই ওর গলার কাঁটা হয়ে উঠল।

দীপান্বিতা চাইত রঞ্জনের সঙ্গে সময় কাটাতে যেটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল। সব জিনিস নিয়েই রঞ্জন নিজের মতামত পোষণ করত। এমনকী দীপান্বিতা কী পোশাক পরবে, বাড়িতে কী রান্না হবে, এমনকী টিভির চ্যানেল কী থাকবে সবটাই রঞ্জনই নিয়ন্ত্রণ করত।

একদিন বাড়িতে ছুটির দিনে দীপান্বিতা খাবার টেবিলে সবেমাত্র বসেছে মা-বাবার সঙ্গে একসাথে মধ্যাহ্নভোজ সারবে বলে, হঠাৎই রঞ্জন বাড়িতে এসে হাজির।

ওকে দেখে দীপান্বিতার মা শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে চেয়ার এগিয়ে দিলেন রঞ্জনের দিকে, ‘এসো বাবা, তুমিও আমাদের সঙ্গে বসে পড়ো।’

‘না-না মাসিমা, আজ আর খাওয়া হবে না। এখুনি আমাকে বেরোতে হবে। তাছাড়া দেখছি মাছ রান্না করেছেন। ওটা আমি আবার একদম খেতে পারি না’, বিরক্তির ভঙ্গিতে উত্তর দেয় রঞ্জন।

এবার দীপান্বিতার বাবা পাশ থেকে বলে ওঠেন, ‘আমার মেয়ের আবার মাছ দারুণ পছন্দের।’

‘তাতে কী হয়েছে?’ রঞ্জন জবাব দেয়, ‘এখন পছন্দ যত খুশি খেয়ে নিক, বিয়ের পর তো আর খাওয়া হবে না, আমার পছন্দ মতোই ওকে খেতে হবে।’

‘তার মানে?’ চমকে ওঠেন দীপান্বিতার বাবা।

রঞ্জনের ভুরু সামান্য কুঁচকে উঠল, ‘মানে আবার কি মেশোমশায়ই, স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ের পর দীপুকে আমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী তো চলতে হবে… আমার কথা শুনে চলবে আমার বউ এটাই তো আমাদের সমাজের রীতি।’

‘উঁহু রঞ্জন’ কথার মাঝেই দীপান্বিতা বলে উঠল, ‘সবকিছু আমি তোমার ইচ্ছেমতোই বা করব কেন? আমার জীবন আমি আমার মতন করে কাটাতে চাই। তোমার ইশারায় আমি নাচব না’, দীপান্বিতার দুই চোখে কৗতুকের ঝলক।

‘দীপু, একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো। আজও সমাজে পুরুষের মর্যাদা নারীর থেকে অনেক বেশি। সুতরাং বিয়ের পর তোমার নয়, আমার কথাই…’

‘আরে আরে রঞ্জন রাগারাগি বন্ধ করো’, মা, রঞ্জনকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেন… ‘তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বসো, দীপু খেয়ে উঠেই যাচ্ছে।’ রঞ্জন বাইরে চলে গেলে মা বললেন, ‘দেখ দীপু, প্রথম প্রথম রঞ্জন হয়তো তোর উপর একটু অধিকারবোধ দেখাতে চাইছে। পরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। সংসার মানেই দুটো মানুষের মধ্যে অ্যাডজাস্টমেন্ট। চিন্তা করিস না। খাওয়া সেরে দুজনে বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে আয়, ভালো লাগবে।’

দীপুকে বুঝিয়ে বললেও মায়ের চোখে চিন্তার গাঢ় ছায়া ঘনিয়ে এল।

রঞ্জনের প্রোমোশন হতেই ওদের বিয়ের দিন স্থির করা হয়ে গেল। দুই বাড়ির ইচ্ছেতে শীতকালটাই বাছা হল বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। এর মধ্যে দীপান্বিতা আর রঞ্জন কিছুটা করে সময় নিজেদের জন্য বার করে নিত, দেখা করত অফিসের বাইরে সুবিধামতো। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে এমবিএ করেছিল দীপান্বিতা। ওর নিজস্ব কিছু ভাবনা, কিছু স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ সময় রঞ্জনের কথাই ওকে শুনে চলতে হতো। কেমন জানি স্বার্থপর হয়ে উঠত রঞ্জন। বাধ্য হতো রঞ্জনের কথামতো চলতে।

একদিন রঞ্জন জানাল, অফিসের পর ওর কিছু বন্ধুবান্ধব দীপান্বিতার সঙ্গে দেখা করতে চায়। দীপান্বিতাও রাজি হল আসতে যেহেতু অফিসের পরই পুরো ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করা হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে ঠিক সেদিনই অফিস ছুটির কিছু আগে কোম্পানির এমডি কয়েকজনকে নিয়ে মিটিং কল করলেন যার মধ্যে দীপান্বিতারও নাম ছিল। ও সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনকে ফোন করে খবরটা জানাল। তা-সত্ত্বেও রঞ্জন জোর করতে লাগল আসার জন্য যেটা একেবারেই সম্ভব ছিল না। মোবাইল সাইলেন্ট মোড-এ রেখে দীপান্বিতা মিটিং-এ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে সন্ধে গড়িয়ে গেল। রঞ্জন বন্ধুদের সঙ্গে অপেক্ষাই করতে থাকল। অভ্যাসবশত বারবার মোবাইলে ফোন করতে থাকল রঞ্জন। মোবাইল সি্্ক্রনে রঞ্জনের নাম ফুটে উঠতে দেখেও দীপান্বিতা মিটিং-এর মাঝে ফোন তুলতে পারল না।

এদিকে বারবার ফোন করলেও দীপান্বিতা ফোন না ধরায় রঞ্জনের রাগ বাড়তে লাগল। মিটিং শেষ হতে আটটা বেজে গেল। কাজের থেকে ফ্রি হয়েই মোবাইলে চোখ রাখল দীপান্বিতা। রঞ্জনের বাইশটা মিস্ড কল দেখে ঘাবড়ে গেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল রঞ্জনকে।

ফোন বাজতেই নিজের রাগ সামলাতে পারল না রঞ্জন, ফোনেই দীপান্বিতার উপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি নিজেকে কী ভাবো? আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আর তুমি আসবার দরকারই মনে করলে না। বন্ধুদের সামনে আমাকে অপমান না করলেই চলছিল না? আমি কতবার তোমাকে ফোন করেছি… একবারও তুলতে পারলে না… এতই ব্যস্ততা তোমার?

রঞ্জনের চ্যাঁচামেচিতে ঘাবড়ে গিয়ে দীপান্বিতা প্রথমে কোনও উত্তরই মুখে আনতে পারল না। তারপর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘রঞ্জন, আমি তো মিটিং আছে জানতে পেরেই তোমাকে ফোন করেছিলাম। জানিয়েছিলেম যে আজ কিছুতেই আসা সম্ভব হবে না। এমডি-র সঙ্গে মিটিং… তুমি তো ভালো করেই জানো এই ধরনের মিটিং-এ ফোন সাইলেন্ট-এ রাখতে হয়।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সব জানি। আমাকে শেখাবার কোনও দরকার নেই। তোমাকে আমি যখন আসতে বলেছি তখন আসতে হবে… আমার কাছে তোমার কাজটা সেকেন্ডারি’ রাগের মাথায় রঞ্জনের মুখে যা এল তাই দীপান্বিতাকে বলে গেল।

রঞ্জনের ফোনটা আসার পর থেকেই দীপান্বিতা মনে মনে একেবারে ভেঙে পড়ল। আজকেই সকালে নিজের প্রোমোশনের খবরটা পেয়েছিল দীপান্বিতা। উদগ্রীব হয়ে ছিল কতক্ষণে রঞ্জনকে খবরটা জানাবে কিন্তু সে সুযোগটুকুও ওর কপালে জুটল না। বিয়ের দিন যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই দীপান্বিতার মনে হতে লাগল একটা বোঝা যেন ওর মাথার উপর চেপে বসছে যেটার ভার সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। আজও ওর মনে হল, ও মস্ত কোনও ভুল করে ফেলছে না-তো রঞ্জনকে বিয়ে করবে স্থির করে।

বাড়ি যখন ফিরল ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। মানসিক ভাবে নিজেকে বড়ো বিপর্যস্ত মনে হল ওর। বাড়িতে ফিরে দেখল মা কোথাও বাইরে বেরিয়েছেন, বাবা একাই বাড়িতে। দীপান্বিতাকে দেখে বাবা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেলেন মেয়ের জন্য চা তৈরি করতে। দীপান্বিতা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল চা অলরেডি টেবিলে হাজির।

‘বাবা, তুমি কেন চা তৈরি করতে গেলে? আমি তো আসছিলামই’, চেয়ার টানতে টানতে বাবাকে বলে দীপান্বিতা।

‘মা, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অফিসে খুব বেশি চাপ ছিল? মিটিং কেমন হল? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? আজও রঞ্জনের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিস?’ বাবার একের পর এক প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতে হল দীপান্বিতাকে।

‘বাবা, তোমার কি মনে হয় আমিই সবসময় ঝগড়া করি? আজকে তো রঞ্জনের সঙ্গে ফাটাফাটি ঝগড়া হয়ে গেছে। আজকে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল কিন্তু এমডি-র সঙ্গে মিটিং ফিক্স হওয়ার পর আমি ওকে আগাম জানিয়ে দিই যে, আমি কোনওভাবেই আজ যেতে পারব না। তা-সত্ত্বেও ও কতগুলো যে কল করে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। মিটিং শেষ হতেই আমি ওকে ফোন করেছি কিন্তু ভালো ভাবে কথা বলা তো দূরের কথা, এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করল যে, আমার কথা বলারই কোনও সুযোগ হয়নি। এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি… কোন অধিকারে ও আমার উপর এভাবে চ্যাঁচাবার সাহস পায়? ও নিজেও চাকরি করে সুতরাং আমার অসুবিধে ও কেন বোঝার চেষ্টা করবে না? স্বামী বলেই ও আমার উপর বসিং করবে আর আমার দোষ না থাকলেও স্ত্রী বলে সব শুনে যাব? এভাবে তো চলতে পারে না’, দ্বীপান্বিতার কথায় ওর মনের ভাব পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

বাবা কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যে-মেয়েকে তিনি সবসময় আগলে এসেছেন, তাকে আজ এতটা অসহায় দেখে কী বলবেন, ভেবে পেলেন না।

দু’জনে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই দ্বীপান্বিতার মা-ও চলে এলেন। দুজনকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে মিটিং থেকে কখন ফিরলি?’

‘আধ ঘন্টার উপর হয়ে গেছে মা।’

‘সকালে প্রোমোশনের কথা বলছিলিস, কিছু জানতে পারলি কি?’

‘হ্যাঁ মা, আমার প্রোমোশন হয়েছে। স্যার আজকে জানালেন।

দু-দিনের মধ্যে কাগজ হাতে পেয়ে যাব।’

‘বাঃ, এ তো খুবই খুশির খবর। কিন্তু তুই এরকম মনমরা হয়ে রয়েছিস কেন? রঞ্জনকে ফোন করে আসতে বললে পারতিস তো, বাড়ির জামাই বলে কথা। এতে আমাদের খুশি আরও দ্বিগুন হতো’, মা উঠতে উঠতে বললেন।

দীপান্বিতা ‘না’ করা সত্ত্বেও মা জোর দিতে লাগলেন রঞ্জনকে খেতে ডাকার জন্য। বাধ্য হয়ে বাবা উঠে রঞ্জনকে ফোন করলেন কিন্তু রাত্রি হয়ে যাওয়াতে রঞ্জন জানাল ও পরের দিন আসবে। রাত্রে ওদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করতে রাজি হয়ে গেল ও।

পরের দিন দীপান্বিতা অফিসের কাজ নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকল। ইচ্ছে হল না রঞ্জনকে একটা ফোন করে কথা বলে। সারাদিনই মনটা বিষণ্ণ রইল। সন্ধেবেলায় মা-কে রান্নাঘরে একটু সাহায্য করে দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল।

ওর বাড়ি ফেরার প্রায় এক ঘন্টা পর রঞ্জন এসে পৌঁছোল। এসে জানতে পারল নিমন্ত্রণের কারণটা। দীপান্বিতার প্রোমোশনের খবরটা পেয়ে খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। বরং আরও গম্ভীর হয়ে উঠল ওর চোখমুখ। বাড়িতে কারওরই নজর এড়াল না। দীপান্বিতার মা জিজ্ঞেস করেই বসলেন, ‘কী হল রঞ্জন, তুমি খুশি হওনি?’

‘একটা প্রোমোশনে এত খুশি হওয়ার কী আছে? বাড়িতে তো ওকে কোনও কাজ করতে হয় না… সব কাজ আপনিই করেন। সুতরাং কোম্পানির কাজ ও মন দিয়ে করতে পারে। মন দিয়ে কাজ না করলেও প্রোমোশন যখন হবার তখন হবেই’, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেয় রঞ্জন। দীপান্বিতার মুখের দিকে চোখ পড়তেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘দীপু এখানে যা করছ করে নাও, আমার বাড়িতে এসব চলবে না। বাড়ির সব কাজ তখন তোমাকে করতে হবে। বউ এলে মা আরাম করবে… ওখানে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। বাড়ির বউ, বউয়ের মতোই থাকবে, মেয়ে হয়ে ওঠার চেষ্টা কোরো না…’। আরও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিল রঞ্জন আর বাকি তিনজন অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, ‘একী রঞ্জন, এসব তুমি কী বলে যাচ্ছ? আজকালকার ছেলে তুমি, এরকম সংকীর্ণ মানসিকতা কী করে হয় তোমার? আমি অবাক হচ্ছি… দীপু তোমার বউ হতে চলেছে… ওকে অপমান অন্তত কোরো না।’

‘প্লিজ মেশোমশাই, আপনি আমাদের দুজনের মধ্যে পড়বেন না। দীপুকে আগে থেকে আমি সব বলে দিতে চাই যাতে পরে গিয়ে ও আমাকে দোষারোপ না করতে পারে।’

ঘটনাক্রম কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে চুপ করে খাবার খেয়ে নিল। আনন্দের পরিবেশ বিষাদে পরিণত হল। খাবার খেয়েই রঞ্জন বেরিয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল অনেকগুলো প্রশ্ন।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। মাত্র আর এক মাস বাকি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনের স্বভাবের সত্যিটাও সকলের দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। জেদ, স্বার্থপরতা, হীন মনষ্কতা মানুষকে কতটা নীচে নামাতে পারে তার উদাহরণ প্রতিনিয়ত সকলের সামনে ফুটে উঠতে লাগল। ও কারও কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, অথচ সকলকে ওর ইচ্ছা অনুসারে চলতে হবে।

রঞ্জনের মা ভালোমানুষ, বহুবার দীপান্বিতাকে বলেছেন, রঞ্জন যেমন ব্যবহার করে দীপান্বিতাও যেন ওর সঙ্গে ওই একই রকম ব্যবহার করে। একমাত্র ওই উপায়তেই রঞ্জনকে বোঝানো যাবে ও যা করছে ভুল করছে।

কিন্তু দীপান্বিতার মন সায় দেয়নি। একটা মানুষকে সঠিক রাস্তায় আনতে এটা কখনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। রঞ্জনের মতো ব্যবহার করতে থাকলে জীবনযুদ্ধে যে ও জয়ী হবেই তার নিশ্চয়তা কী?

অশান্ত মন-কে শান্ত করার কোনও উপায় ছিল না দীপান্বিতার কাছে। কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, প্রতিনিয়ত তার সন্ধান করতে থাকত ও। অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। দীপান্বিতা তাকিয়ে দেখল রঞ্জনের ফোন। তুলতে ইচ্ছা হল না… রিং বাজতেই থাকল, তারপর একসময় কেটে গেল। দ্বিতীয়বার ফোনটা বাজতেই মা এসে ফোনটা ধরে দীপান্বিতার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাধ্য হয়ে ওকে কথা বলতেই হল।

‘হ্যালো, কী করছিলে? ফোন তুলছিলে না কেন? আচ্ছা শোনো আজকে একবার দেখা করতে চাই। পুরো ছুটি নিতে পারলে ভালো নয়তো হাফে বেরিও। কী করবে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিও। আর হ্যাঁ, অ্যাভয়েড করার চেষ্টা কোরো না, নয়তো আমি তোমার অফিসে পৌঁছে যাব।’

রঞ্জনের শাসানি শুনে দীপান্বিতা ভয় পেল। বুঝতে পারল ছুটি না নিলে রঞ্জন সত্যি ওর অফিস পৌঁছে যাবে। বাধ্য হয়ে অফিস পৌঁছে হাফ-ডে-র জন্য দরখাস্ত করল। ছুটি মঞ্জর হতেই রঞ্জনকে ফোনে জানিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি করে দেড়টার মধ্যে অফিসের সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে রঞ্জনের অপেক্ষায় বসে রইল।

ঠিক দুটোর সময় রঞ্জন নিজের গাড়িতে ওকে তুলে নিয়ে পরিচিত একটি রেস্তোরাঁয় এসে বসল।

‘কী ব্যাপার, হঠাৎ ছুটি নিতে বললে কেন?’ দীপান্বিতা জিজ্ঞেস না করে পারল না।

‘আসলে তোমাকে কিছু জরুরি কথা বলার ছিল’, একটু ভেবে উত্তর দিল রঞ্জন, ‘দীপু, আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের বিয়ে। তারপর তুমি আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে যাবে। যদিও এখনও তোমার ওখানে আসা-যাওয়া রয়েছে তবুও কয়েকটা জিনিস আমি পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই। আমার বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি নয় সুতরাং বউয়ের মতন তোমাকে থাকতে হবে। বাপের বাড়ির মতো স্বাধীনতা ওখানে থাকবে না, বাড়ির সব কাজও তোমাকেই করতে হবে। আমি এত কথা তোমাকে বলছি কারণ আমার মনে হয় বাড়ি আর অফিস দুটো একসঙ্গে সামলানো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি বরং চাকরি-টা ছেড়ে দাও।’

চমকে উঠল দ্বীপান্বিতা, ‘কী বলছ রঞ্জন তুমি? চাকরি কেন ছাড়ব? বাড়ি আর চাকরি দুটোই আমি একসঙ্গে ভালো ভাবে সামলাতে পারব, এই বিশ্বাসটুকু আমার নিজের উপরে আছে। তোমাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না, শুধু আমার উপর বিশ্বাস রাখো’, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে দীপান্তিতা বলে। যদিও রঞ্জনের যা স্বভাব, তাতে ও যে এই কথাগুলো মেনে নেবে না সেটা দীপান্বিতা খুব ভালো ভাবেই জানত, তবুও ও শেষ চেষ্টা একবার করে দেখতে চাইল।

‘দীপু, আমি তোমার মতামত নিতে বা তোমার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য এখানে আসিনি। আমি কি চাই, সেটা তোমাকে পরিষ্কার করে বলব বলে এখানে ডেকেছি। চাকরি তোমাকে ছাড়তে হবে আর জেনে রাখো আমার বাড়ির নিয়ম হচ্ছে সব সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নেবে… নিজের কাজের দক্ষতা দেখাতে চাও বাড়িতে বসে দেখাও। আমার উপর ছড়ি ঘোরাবার চেষ্টা কোরো না। আমার বাড়িতে আমি যা বলব তাই মানতে হবে, এটা তুমি যত তাড়াতাড়ি মেনে নেবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল। আজ এখন উঠব, একটা কাজ আছে’, বলে রঞ্জন উঠে দাঁড়াল এবং দীপান্বিতা-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

পেছন থেকে দুবার ডাক দিতেও যখন রঞ্জন ফিরে তাকাল না, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দীপান্বিতা উঠে দাঁড়াল। রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। বাড়ি ফিরতেই বাবা মেয়েকে দেখে বুঝে গেলেন বড়োসড়ো কোনও ঝড় বয়ে গেছে মেয়ের উপর। মেয়েকে বসিয়ে ভিতর থেকে ওর জন্য খাবার জল এনে সামনে রাখতেই দীপানিবতা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। বাবার বুকে মাথা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

‘কী হয়েছে দীপু, কাঁদছিস কেন মা?’

‘বাবা, আজ রঞ্জন দেখা করতে এসেছিল’, চোখ মুছে দীপান্বিতা পুরো ঘটনা বাবাকে খুলে বলল। সব শুনে উনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, এখনই বিয়ের আগে যদি রঞ্জনের এরকম ব্যবহার হয় তাহলে বিয়ের পর কী হবে?

‘বাবা, বিয়ের পর আমি কিছুতেই রঞ্জনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব না… আমার মন কিছুতেই এই বিয়েতে সায় দিচ্ছে না, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না’, কান্নাভেজা গলায় বাবাকে জানায় দীপান্বিতা।

‘এত উতলা হোস না মা। তোর মা বাড়িতে ফিরুক, আলোচনা করে দেখি। তুই গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’

হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে বসতেই মা ফিরে এলেন। দীপান্বিতা উঠে গেল তিনজনের জন্য চা বানিয়ে আনার জন্য। চা করে এনে বসে পড়ল সোফায়। বাবাই রঞ্জনের কথাটা তুললেন চা খেতে খেতে, ‘শুনছ, আজ রঞ্জন এসেছিল দীপুর সঙ্গে দেখা করতে। দীপুকে চাকরি ছাড়তে বলেছে। দীপু রঞ্জনকে বিয়ে করতে চাইছে না… কী করা যায়? বাবা জানতে চাইলেন।

মা তাকাল মেয়ের দিকে, বলল, ‘দীপু, প্রথম থেকেই রঞ্জনের স্বভাব, ওর ব্যবহার আমার অদ্ভুত মনে হয় কিন্তু তাও আমার মনে হতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোরা দুজন দুজনকে চিনবি, বুঝতে পারবি। কিন্তু আজ তুই অন্য কথা বলছিস। বিয়ের আর এক মাসও বাকি নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে বলা হয়ে গেছে… সবকিছু গোছানো শেষ… এই সময় সম্বন্ধ ভেঙে গেলে সবাই মেয়ের দোষই ধরবে।’ বেশ চিন্তিত মনে হল মায়ের কণ্ঠস্বর!

মায়ের কথায় লজিক ছিল এটা অস্বীকার করতে পারল না দীপান্বিতা। ভারাক্রান্ত মনে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে দিল ক্লান্ত শরীরটাকে। চেষ্টা করেও বিয়ের জন্য মনটাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারল না ও। রঞ্জনের প্রতি মনজুড়ে বিতৃষ্ণা ভরে গেছে ওর, এই অবস্থায় কী করে ও রঞ্জনকে স্বামী বলে মেনে নেবে ভেবে পেল না।

সকালে উঠে প্রতিদিনের মতো টেবিল থেকে চা আনতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হল দীপান্বিতা। ইশারায় টেবিলে বসতে বললেন ওকে তারপর উঠে এসে মেয়ের পাশে বসে ওর হাত দুটো তুলে নিলেন নিজের হাতে। আশ্বাসের সুরে বললেন, ‘অনেক ভেবে দেখলাম বুঝলি মা, রঞ্জনকে ফোন করে বলে দে যে তুই ওকে বিয়ে করবি না… তারপর যা হবে আমি আর তোর মা বুঝে নেব।’

‘বাবা তুমি এটা কি বলছ? সত্যিই আমি রঞ্জনকে বলে দেব যে ওকে আমি বিয়ে করব না?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে দীপান্বিতা।

‘হ্যাঁ মা, কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর তোর মা এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। মেয়ে সুখে থাকুক, মনের মতো স্বামী পাক এটাই সব মা-বাবার ইচ্ছা থাকে। যে-সম্পর্কটাকে বিয়ের আগেই বোঝা মনে হচ্ছে আমার মেয়ের, বিয়ের পর সেই সম্পর্কটাই হয়তো মেয়ের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এর থেকে ভালো সম্পর্কটা ছেড়ে বেরিয়ে আসা। যা মা যা, তুই আর দেরি করিস না। এখনই ফোনটা কর।’

দীপান্বিতার হঠাৎ-ই মনে হল মাথাটা খুব হালকা লাগছে। মাথার উপর চেপে থাকা ভারী বোঝাটা নেমে গিয়ে বেশ ফুরফুরে মনে হল নিজেকে। মা-বাবার আশীর্বাদ রয়েছে যে ওর উপর।

মোবাইলটা হাতে তুলতেই ওটা বেজে উঠল। রঞ্জন ফোন করছে। একটু শ্বাস নিয়ে দীপান্বিতা এপাশ থেকে উত্তর দিল, ‘হ্যালো…’ রঞ্জনের অধীর কণ্ঠ ভেসে এল, ‘দীপু, কী ঠিক করলে তাহলে? আজ রেজিগনেশনটা দিচ্ছ না, দিচ্ছ না?’

‘না রঞ্জন, রেজিগনেশন আমি দেব না। এই মুহূর্তে আমি তোমার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাকে আমি বিয়ে করব না।’

রঞ্জন ‘হ্যালো… হ্যালো…’ করতে করতেই দীপান্বিতা ফোনটা কেটে দিল। একটা সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল অথচ দীপান্বিতার মনে তার বিন্দুমাত্র রেখাপাত ঘটল না।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব