অমিতের হাত দুটো শক্ত করে ধরল রত্না। ওর চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। এখন কী হবে অমিত?
কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো। তুমি চিন্তা কোরো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমার পায়ে চোট সেরে যাবে। তুমি হাঁটতে পারবে। বলেই রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অমিত। কিন্তু অমিতের আশ্বাসেও ভয় কাটল না রত্নার। পরিস্থিতি বুঝে রত্নার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল অমিত। তারপর রত্নাকে পায়ে ব্যথা নিরাময়ে ওষুধ খাওয়াল।
ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল রত্না। আর তার পাশে আধশোওয়া থেকে আনমনা হয়ে পড়ল অমিত। তার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল সপ্তাহখানেক আগের ঘটনাটা অফিসের কাজে যাচ্ছি এই অজুহাতে কলকাতা থেকে বোলপুর পেঁছেছিল অমিত এবং রত্না। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে চেনাজানা একটি হোটেলে উঠেছিল দুজনে। দুদিনের জন্য বুকিং করে, বরাদ্দ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করেছিল ওরা। যেন এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল দুজনে। তাই, আলিঙ্গন, চুম্বনের পর চড়ান্ত শরীরী উষ্ণতা উপভোগ করতে অমিত এবং রত্না কেউই সময় নষ্ট করেনি। তবে এ ব্যাপারে রত্না একটু বেশি সক্রিয় ছিল। যেন ক্ষুধার্ত বাঘিনির মতো। দীর্ঘদিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকার পর যেন সে ক্ষুধা নিবারণ করল। তাই, অমিত তাকে বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব দিলেও, প্রথমে সে রাজি হয়নি। কারণ, বন্ধ ঘরে আরও কিছুটা সময় সে অমিতকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েিল। কিন্তু একঘেয়েি কাটানোর জন্য অমিত-ই প্রায় জোরাজুরি করে বাইরে বের করেছিল রত্নাকে। আর তারপরই ঘটেছিল বিপত্তি। সোনাঝুরির জঙ্গলে অমিতের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গর্তে একটা পা পড়ে গিয়েিল, তা বুঝতে পারেনি রত্না।
হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করানোর পর চিকিত্সক জানিয়েিলেন, রত্নার ডান পায়ে হাড়ে হালকা চিড় ধরেছে, ক্রেপ ব্যান্ডেজের পর অন্তত পনেরো দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।
পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ নিয়ে হোটলের বিছানায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেছে রত্না। দুদিনের হোটেল বুকিং বাড়িয়ে কুড়ি দিন করেছে অমিত। এখনও অনেক দিন থাকার পর বাড়ি ফিরতে পারবে দুজনে। অফিসের কাজ বেড়েছে বলে দুজনেই বাড়িতে বার্তা পাঠিয়েে। কিন্তু অমিতের স্ত্রী সেই বার্তা বিশ্বাস করে নিলেও, রত্নার হ্যাজব্যান্ড সুনীল যে সন্দেহের বাইরে রাখেনি, কথা বলে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না। যাইহোক, রত্নার পাশে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের ঘোর কাটল ওর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায়।
অমিত দেখল ওর বউ নীলিমার ফোন। ফোন কাটল অমিত। তারপর, বিজি অ্যাট প্রেজেন্ট, আই উইল কল ব্যাক লেটার লিখে পাঠিয়ে দিল। ওকে রিপ্লাই পাওয়ার পর শান্তিতে চোখ বন্ধ করল অমিত।
ঘুম ভাঙার পর রত্না দেখল অমিত ঘুমোচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে অমিতকে আর বিরক্ত করল না রত্না। বরং, চুপচাপ শুয়ে থেকে ভাবতে লাগল, অমিতের সঙ্গে পুনর্মিলনের সেই মুহূর্তটির কথা।
বছরখানেক আগের এক বিকেল। রত্না যে-এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট-এর ফ্যাকাল্টি, সেই ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্টস ওয়ার্কশপ ছিল ধর্মতলায় অবস্থিত একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর রত্না হল থেকে বেরিয়ে হাঁটছে লিফ্ট-এর দিকে। হঠাত্ একজনকে দেখে খুব চেনা মনে হল।
লিফট-এর একটু দূরে ঘুরে ফিরে কথা বলছিল অমিত। তাই, অমিত কিনা তা নিশ্চিত হতে রত্না দাঁড়িয়ে পড়ল।
এরই মধ্যে রত্নার মনে পড়ে গেল, বছর পাঁচেক আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনগুলির কথা। অমিত ওর মনের মানুষ ছিল। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত রত্না। কিন্তু ইউনির্ভাসিটির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, অমিত হঠাত্ কেন যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দর্শাতে পারেনি। অনেক অপেক্ষার পর তাই মা-বাবার পছন্দের পাত্র সুনীলকে বিয়ে করে রত্না। শুধু তাই নয়, বিয়ে পর রত্না সুনীলের সন্তানের মা-ও হয়েে নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু, সুনীলের বদমেজাজ আর অমিতের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসার কারণে, রত্না ভালো স্ত্রী হতে পারেনি। যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের মুখোমুখি হল রত্না। অমিত একবারেই রত্নাকে চিনতে পারল। ফোন ছেড়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে রত্নাকে জিজ্ঞেস করল
আরে রত্না, তুমি এখানে!
আমার ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্ট ওয়ার্কশপ ছিল। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?
আমার কোম্পানির প্রোডাক্ট লঞ্চ ছিল এখানে। বাই দ্য ওয়ে কেমন আছো রত্না?
আছি একপ্রকার, মণিহারা ফণির মতো।
কথাটা বলেই হাসতে হাসতে অমিতের চোখের দিকে তাকাল রত্না। যেন সে অমিতের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। এর ঠিক কয়ে সেকেন্ড পরে রত্না অমিতকে বলল, তুমি কেমন আছো?
ওই চলছে একপ্রকার।
ব্যস্ত মানুষ। তা এখন হাতে একটু সময় আছে? খুব বেশি সময় নষ্ট করব না। এতদিন বাদে দেখা, তাই একসঙ্গে বসে একটু কফি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
সেদিন রত্নার কফি খাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করে, নিজেও খুশি হয়েিল অমিত। আড্ডা জমেছিল অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনের বিবাহিত জীবন কেমন চলছে, একে অপরকে না পেয়ে কতটা দুখি, সবই সেদিন শেয়ার করেছিল পরস্পরকে। আর সেদিনের জন্য যখন একে অপরের থেকে বিদায় নিয়েিল, তখন দুটো শরীর যেন চুম্বক আর লোহার রূপ নিয়েিল। রাত বাড়ছে, বাড়ি ফিরতে হবে, ভেবেই হয়তো বাহুমুক্ত হতে বাধ্য হয়েিল তারা।
এরপর প্রতি মুহূর্তে দুজনে দুজনকে চোখে হারিয়েে। সময় পেলেই ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, কিংবা ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ সময় ধরে মনের ঝাঁপি খুলে ধরেছে।
রত্না এবং অমিত অফিস আওয়ার্স-এ বেশি কথা বলত। কারণ দুজনে যেহেতু অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে খুব কম কথা বলত তারা। তবে সংসার এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য ওই দিনের পর আর দেখা করতে না পারলেও, মনের টান বাড়তে লাগল উভয়ে। এ ব্যাপারে বেশি কাছে আসতে চাইত রত্না। একবার দূরভাষে রত্না অমিতকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না-পাওয়ার জন্য এতটাই আক্ষেপ করতে শুরু করেছিল যে, অমিত জিজ্ঞেস করল বিয়ে করে তুমি কি খুশি নও?
অমিতের কথার উত্তরে রত্না সেদিন বলেছিল, আজ নয়, সময় এলে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি অন্য ভাবে দিতে চাই।
একটু থেমে রত্না আবার অমিতকে আবেগভরা গলায় বলল, আমরা যে পরস্পরকে আজও ভালোবাসি, এটা তো সত্যি।
ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু এর বেশি আর কীই-বা করতে পারি আমরা? আমরা তো এক বিছানা শেয়ার করতে পারব না। কেউ কি সমর্থন করবে আমাদের এই সম্পর্ককে? কেউ কি বুঝবে যে, আমরা বিয়ে করেছি একজনকে আর ভালোবাসি অন্য কাউকে?
অমিতের আবেগ দ্বিগুন হল। আবারও সে বলতে শুরু করল, তুমি-ই বলো রত্না, কী করা উচিত আমাদের?
উত্তরে রত্না সেদিন জানিয়েিল, বিয়ে এবং ভালোবাসা দুটি ভিন্ন বিষয় আমার কাছে। যাদের আমরা বিয়ে করেছি, তাদের জায়গায় রেখেও তো আমরা আমাদের দুজনের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, নতুন করে আমাদের যা মন চায় তাই করতে পারি।
মানলাম আমরা দুজনে যা মন চাই তাই করলাম, কিন্তু আমাদের বাড়তি চাওয়ার ফলে তো সংসার থেকে মনও উঠে যাবে। আমাদের জীবনসঙ্গীরা তো কোনও অন্যায় করেনি, আমাদের সন্তানরা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে তারা অকারণে কেন শাস্তি পাবে?
অমিতের কথা কেড়ে নিয়ে রত্না বলেছিল, আমি কাউকে শাস্তি দিতে বলছি না, শুধু আমাদের চাহিদা পূরণের কথা বলছি। তাছাড়া আমরা তো ওদেরকে খুশি রেখেছি এতদিন। আজ যদি ভালোবাসার মানুষকে আমরা নতুন করে পেতে চাই, তাহলে অন্যায়টা কোথায় অমিত?
সেদিন আর কথা বাড়ায়নি অমিত। কিন্তু দূরভাষে এভাবেই মাঝেমধ্যে কাছে আসার জন্য উতলা করে তুলত রত্না। অমিতও রত্নাকে কাছে পাওয়ার একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত। কিন্তু বউ-বাচ্চার কথা ভেবে আবার পিছিয়ে যেত। এভাবেই রত্নাকে এবং নিজের মনকে বহুবার সামাল দিয়ে এসেছিল অমিত। কিন্তু ওদের পুনর্মিলনের এক বছর যখন পূর্ণ হতে চলেছিল, তখন রত্না জানাল, অমিত, আমি আর পারছি না, অন্তত দুটো দিন তোমার সঙ্গে একান্তে কাটাতে চাই। আগামী মাসের চার তারিখ আমাদের দেখা হওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে। ওই দিন আমরা বোলপুরে গিয়ে দুদিন কাটাব। ব্যস, এটুকুই আমার চাওয়া। ওই দুদিনের স্মৃতি নিয়ে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ।
রত্নার অনুরোধে দুদিন পর ভেবেচিন্তে বোলপুরে আসার সম্মতি জানিয়েিল অমিত। কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না। হোটেলের বিছানায় অমিতের পাশে শুয়ে রত্না তাই ভাবছিল, কী যে হয়ে গেল! বেশ ছিলাম হোটেলে, কেন যে মরতে বাইরে বেরোলাম, আরও এক সপ্তাহ পর কীভাবে যে সুনীলের মুখোমুখি হব বাড়ি গিয়ে এভাবেই ভাবনা আর অনুভবে পাশাপাশি থাকতে থাকতে অমিত ও রত্না কাটিয়ে দিয়েে আরও এক সপ্তাহ। এখন অমিতের কাঁধে ভর করে কিছুটা হাঁটতেও পারছে রত্না। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েেন ডক্টর। এবার ওদের বাড়ি ফেরার পালা।
হোটেল ছাড়ার আগে রত্না অমিতকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রয়েে। মিনিটখানেক ওভাবে থাকার পর রত্না অমিতের চোখে চোখ রেখে জানাল, আমার মনের দরজা সারা জীবন শুধু তোমার জন্য খোলা থাকবে। তুমি যখন খুশি আসতে পারো, আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পন করে আনন্দ পাব।
রত্না এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিল না। তা দেখে অমিত কিছুতেই রত্নাকে একা বাড়ি ফিরতে দিল না। আরও কিছুটা সময় যাওয়ার পথে অমিতকে কাছে পাবে, তাই রত্নাও আর বাধা দেয়নি।
ফেরার পথে ওরা আর ট্রেন ধরল না। বোলপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল কলকাতার বালিগঞ্জের উদ্দেশে। ওখানেই রত্নার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু অমিত থাকে উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে। তাই, রত্নাকে অমিত জানিয়েিল, ওর শ্বশুরবাড়ির কিছুটা আগে ওকে রিকশোতে তুলে দেবে। কিন্তু রত্না জানাল, না, তুমি আমাকে বাড়িতে পেঁছে দিয়ে আসবে। আমি সুনীলকে ম্যানেজ করব, আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।
বাড়ি পেঁছোনোর আগে সুনীলকে ফোন করে তাকে রিসিভ করার কথা জানিয়েিল রত্না। সেইমতো রাস্তায় এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েিল সুনীল।
গাড়ি থেকে নেমেই রত্না প্রথমে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কারণ, বিগত পনেরো দিন সে শুধু দূরভাষে ছেলের খবর নিয়েিল, টুকটাক কথা বলেছিল। ছেলের জন্য রত্নার বেশি চিন্তা ছিল না, কারণ রত্না জানত, ওর শাশুড়ি নাতিকে খুব ভালোবাসেন, তাই সামলে নেবেন।
সোনা বাবা, তুমি কেমন আছো? ঠাকুমা তোমায় আদর করেছিল তো? ছেলের গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলতে থাকে রত্না।
ঠাকুমা আমায় অনেক গল্প শুনিয়েে। সদ্য কথা বলতে শেখা ছেলেটি তার মাকে জানায়।
রত্নাকে নামিয়ে অমিত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েিল, তখনই রত্না গাড়ির ড্রাইভারকে থামতে বলে এবং অমিতকে নামতে বলে ইশারায়।
সুনীল, এদিকে এসো, আলাপ করিয়ে দিই আমার বন্ধু অমিতের সঙ্গে। মনে কোনও দ্বিধা-সংশয় না রেখে, খুব স্বাভাবিক ভাবে অমিতের সঙ্গে সুনীলের আলাপ করিয়ে দেয় রত্না।
অমিতের সঙ্গে আলাপ পর্বে সুনীল কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি ঠিকই, কিন্তু হতবাক হয়েিল হঠাত্ এমন একটি অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তাই অমিত চলে যাওয়ার পর, একাধিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কিন্তু রত্নাকে নিরুত্তাপ দেখে, সামযিক ভাবে ঘাবড়ে গিয়েিল সুনীল।
সময় এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। কাজের ব্যস্ততায় সুনীলের মাথা থেকেও বেরিয়ে যায় অমিতের বিষয়টা। পায়ে ব্যথা সেরে গিয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারার পর রত্নাও আবার কাজে যোগ দেয়। সময় পেলেই অমিতকে ফোনও করতে থাকে নিয়মিত। এভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু দিনের পর দিন বিছানায় রত্নাকে আর আগের মতো না পেয়ে নতুন করে আষাঢ়ের মেঘ ঘনীভত হতে শুরু করে সুনীলের মনে।
রাত দশটা। ডিনার সেরে নিয়েে রত্না। ছেলেকে খাইয়ে ওর ঠাকুমার ঘরে দিয়ে এসেছে। ঠাকুমার সঙ্গেই এখন ঘুমোনোর অভ্যাস ছেলের। রত্না তাই এখন একা। সুনীলের ফিরতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। তাই এই ফাঁকা সময়ে অমিতের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল রত্নার।
অমিত সেই রাতে অফিসের কাজে উত্তরবঙ্গে ছিল। কাজ সেরে হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। রত্নার ফোন রিসিভ করে টিভি বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ নিশ্চিন্তে কথোপকথন চালাতে থাকে অমিত এবং রত্না।
আবেগে চোখ বন্ধ রেখে কথা বলছিল রত্না। তাই, সুনীল কখন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে ওর প্রেমালাপ শুনছিল, বুঝতেই পারেনি। হঠাত্ ঘরে কারওর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খোলে রত্না। আচমকা সুনীলকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয় সে।
ফোনের ওপারে কে ছিল? ওই লোকটা যে তোমাকে পেঁছোতে এসেছিল? কর্কশ ভাবে প্রশ্নগুলো রত্নার দিকে ছুড়ে দেয় সুনীল।
হ্যাঁ, আমিতই ছিল, তো কী হয়েে?
প্রেম তো বেশ জমে উঠেছে দেখছি। এইজন্যই ভাবছিলাম, রাতে এখন শরীরে তোমার প্রাণ থাকে না কেন?
বাজে কথা রাখো। রাত হয়েে, আমার ঘুম পাচ্ছে, ফালতু বকবক করতে পারব না।
তা পারবে কেন! সব এনার্জি তো ওই লোকটার সঙ্গে বকবক করে শেষ করে ফেলেছ। লজ্জা করে না। বাচ্চার মা তুমি। আমি কী অভাব রেখেছি তোমার?
তুমি আমার শরীরের খবর রেখেছ, মনের খবর রেখেছ কি?
বাহ্, ভালো বলেছ। এখন অনেক কথাই তুমি বলবে। ওই ইতরটার সান্নিধ্য পেয়ে না। এখন তো আমার সবই তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হবে। যাইহোক, একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি, আর যদি ওই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখো, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ফাটাফাটি হবে বলে দিলাম। আমার সম্মান নষ্ট করলে আমি ছাড়ব না।
তোমার যা করার আছে তুমি করে নাও। অমিত আমার বন্ধু, আমি যোগাযোগ রাখবই।
ওহঃ তাই? দেখাচ্ছি মজা…
বলেই রত্নার হাত থেকে ওর মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে সুনীল। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ফোনের যন্ত্রাংশ। ভাঙা ফোনটা থেকে সিম কার্ডটা খুলে নিয়ে সুনীলের গালে সপাটে একটা চড় মেরে, অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয় রত্না। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সুনীলকে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেয় এবং বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা হাতিবাগানে মায়ে বাড়িতে ওঠে।
অমিত সেদিন ওর মাকে ফোন করে দরজা খুলিয়ে উদ্ধার হয়েিল ঘর থেকে। রাগের মাথায় সুনীল সেদিন রত্নার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে চেয়েিল কিন্তু ওর মা নিতে দেননি।
ওই ঘটনার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রত্নার কোনও খবর নেই। ছেলের খোঁজটুকুও নেয়নি। এদিকে ছোট্ট ছেলেটিকে ঠাকুমা আগলে রাখলেও, মাঝেমধ্যে মা-র জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে সুনীল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। মনকে বুঝিয়ে রত্নার খোঁজ শুরু করে। রত্নার অফিস থেকে কোনও খবর পায় না। এক আত্মীয়ে মাধ্যমে জানতে পারে রত্না ওর মায়ে বাড়িতে আছে।
ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর পরিবারের সামাজিক সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রত্নার মুখোমুখি হয় সুনীল। শাশুড়িকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আর রত্নার হাত ধরে অনেক অনুনয়, বিনয়ে পর, রত্নাকে বাড়ি ফেরাতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু সুনীলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, অমিত-রত্নার সম্পর্কের ব্যাপারে আর কখনও সে নাক গলাবে না।