সমর্পিতা (পর্ব-২)

পর্ব-২

এরপর দুজনের মেলামেশা, ঘোরাফেরা। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত। অন্বেষার বাবার, এই বিয়েতে একদমই মত ছিল না। দুজনের পীড়াপীড়িতে যখন মেশোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম ওনার বাড়িতে, উনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ‘দ্যাখো ভানু, তোমার বন্ধুকে তোমার ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার মতো অতটাও ম্যাচিওর হয়নি অনু। তাছাড়া খবর নিয়ে দেখলাম, তোমার বন্ধুটির তো নিয়মিতই বার-এ বসার অভ্যেস। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তো আর মেয়েটাকে জলে ফেলে দিতে পারি না।’

প্রত্যুত্তরে বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘দেখুন দু-এক পেগ মদ্যপান করলে কেউ খারাপ হয়ে যায় না। আজকাল কাজের ক্ষেত্রে এসব একটু-আধটু খেতেই হয়। তাছাড়া ওরা দুজন-দুজনকে জানে ও ভালোবাসে। আপনি মত দিলেও ওরা বিয়ে করবে, না দিলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ…। কাজেই এবার আপনি বুঝুন কী করবেন। মেয়ে আপনার কাছে চিরদিন ছোটোই থাকবে, আফটার অল আইনের চোখে ওরা তো অ্যাডাল্ট এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে নিজেরা ডিসিশন নেওয়ার অধিকারী।’

অগত্যা… অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ের ভালোবাসার কাছে হার মানতেই হল। সম্মতিক্রমে বিয়েটাও হয়ে গেল।

বিয়ের কয়েকদিন পরেই শুভজিতের আসল চেহারাটা ধরা পড়ে অন্বেষার কাছে। একদিন নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছি, অন্বেষা ঢুকল। কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে কখন এলি? বাঁদরটা কোথায়?’

“তার কথা আর বোলো না। যা কাণ্ডটা বাধাল কাল। শুধু মামা অসুস্থ, না এলেই নয় তাই বাধ্য…।’

রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন রে কী হয়েছে?’

‘কাল রাত ১টা নাগাদ খবরের কাগজের সম্পাদক বিকাশবাবুর ফোন। জানাল রিজিওনাল বিজনেস পার্ক উদ্‌ঘাটন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তোলার জন্য পাঠিয়েছিল শুভকে। কিন্তু রাত ১টা নাগাদও অফিসে কোনও ছবি পাঠায়নি শুভ। তাঁর হাউসের তো একটা রেপুটেশন আছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ খবর যদি ছাপা না হয়, তো কম্পিটিশনের বাজারে তাঁর টিকে থাকাই দায় হবে।’

উত্তরে শুধু তখন ওর বাড়িতে না ফেরার কথাটা বলতে পেরেছিলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে কাগজের রেপুটেশন-এর প্রশ্ন, সেখানে শুভর চাকরি নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি হতে পারে। চিন্তায় সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’

‘তারপর। তারপর কী হল?’ বলে উঠলাম।

‘ফোনের পর ফোন করে গেছি ভানুদা। সমানে নট রিচেবল আসছিল।। ভাবছিলাম অন্য কিছু।’

বললাম, ‘আমাকে ফোন করলি না কেন?’

‘তোমাকে ফোন করার জন্যই ফোনটা সবে হাতে নিয়েছি, ঠিক তখনই ডোরবেলটা বেজে উঠল। রাত তখন আড়াইটে হবে। বাবু ফিরলেন। বেহেড অবস্থা।’

অফিসে ছবি না পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে বলল, অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেখানেই ক্যামেরা পড়ে গিয়ে সিস্টেমে গণ্ডগোল। আসল সত্যিটা হল, ও অনুষ্ঠানে যায়ইনি। ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সারারাত নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল কোথাও।’ বলার পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ কানে এল। চোখদুটোও ছলছল করছে অন্বেষার ।

পরের প্রশ্নটা কী হতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম আমি। যা ভাবা ঠিক তাই, খানিক থামার পর প্রশ্ন করল, ‘ও কি আগাগোড়াই এমনই ছিল ভানুদা?’

বোবার মতো চেয়ে থাকলাম ওর দিকে। কে যেন বাকরুদ্ধ করে রেখেছে আমাকে।

এমন নয় যে, এই প্রথমবার শুনলাম শুভ নেশার জন্য কোনও কাজ করেনি। একবার আমার এক বন্ধুর বাবার বার্ষিকীর কাজে ছবি দরকার। সেইজন্য দায়িত্ব নিয়ে ছয় বাই ছয় সাইজের ল্যামিনেটেড ছবি বানাতে দিয়েছিলাম শুভকে। কথা ছিল পরের দিনই ডেলিভারি দেবে।

রাত্তিরে যখন ওর বাড়িতে গেলাম, দরজায় তখন তালা ঝোলানো। দু-দিন পরে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, রীতিমতো রাগারাগি। ‘তুই যখন সময় মতো দিতেই পারবি না, পরিষ্কার বলে দিতিস। তোর জন্য কতটা লজ্জিত হতে হল আমাকে।’

শুভ তখন কেমন সহজভাবে বলে ফেলল, “ইয়ার ছবির কথা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রেস ফোটোগ্রাফারদের একটা পার্টি ছিল। ওখানেই একটু বেশি চড়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আর কাজ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। বরং একটা সরি জানিয়ে দিস।’

কোনও সদুত্তর না পেয়ে অন্বেষা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল ভানুদা, কই কিছু বললে না তো!

‘অ্যাঁ, অ্যা কী যেন বলছিলিস?’

‘ওই-ই শুভর নেশা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ দ্যাখ, ওর যে আগেও দু-এক পেগ চলত এটা তো তুইও জানতিস। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে চলে গেছে, সেটা আমারও অজানা।’

‘বাবা জানলে কী যে হবে কে জানে!’

ওর টেনশন দেখে বললাম, ‘দ্যাখ অন্বেষা এখন ওসব ছাড়। আমার মনে হয়, যা হয়েছে ভুলে যা। তুইও ওকে একটু সময় দে। কদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুজন মিলে কোথাও ঘুরে আয়। ওকে বোঝা। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

ক্রমশ…

সমর্পিতা (পর্ব-১)

প্রথম সারির অভিনেতা সুবিমল রায়ের একমাত্র ছেলের বিয়েতে ফোটোগ্রাফির অর্ডার পাওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। অহংকারে মাটিতে পা পড়ছিল না শুভজিতের। বদলে মুচকি হেসে বলেছিলাম, ‘তা ভাই বেশ তো, আশপাশের মানুষগুলো যদি উন্নতির শিখরে পৌঁছোতে পারে এবং সেটা যদি আবার বন্ধুবান্ধব হয়, শুনে ভালোই লাগে।’

তারপর কেটে গেছে তিনটে দিন। কাল থেকে গা-টা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। সেদিন শুভজিৎদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম বটে। তাই বুঝি, হালকা টেম্পারেচার এসেছে। তার উপর ইয়ার এন্ডিং এর কারণে অমানুষিক কাজের চাপ। শরীর আর দিচ্ছিল না। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ-ই অন্বেষা, মানে শুভজিতের বউয়ের ফোন। উৎকণ্ঠিত গলায় খবর দিল শুভজিতের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়েতে, ফোটোগ্রাফির কাজ সেরে ফেরার সময়, যে-গাড়িতে ফিরছিল সেটা লরির ধাক্কায় উলটে গেছে। জরুরি অবস্থায়, স্থানীয় লোকেরা পাশেই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এখন আইসিসিইউ-তে।

এরকম একটা খবর শুনে কি থাকা যায়? শরীরের কথা ভুলে অগত্যা ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমাকে দেখা মাত্রই অন্বেষার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। খানিক আশ্বস্ত করার জন্য এগোব, ঠিক তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার জানালেন, পেশেন্টের অবস্থা যথেষ্ট সংকটজনক, ৭২ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা সম্ভব নয়।

অতএব অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই আমাদের। সবকিছু এখন উপরওয়ালার হাতে। অপেক্ষমান মূর্তির মতো আইসিসিইউ-এর সামনের বেঞ্চে বসে রইলাম আমরা দুজনে। অন্বেষাকে ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছিল।

একবার জিজ্ঞাসাও করলাম, ‘একটু চা খাবি? ভালো লাগবে।’ কোনওরকমে ঘাড় নাড়িয়ে না বলেই বেঞ্চে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ দুটো বুজল। সত্যিই মেয়েটাকে দেখলে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ের পর থেকে একটা দিনও সুখ পেল না।

মনে পড়ে অতীতে শুভজিৎ আর অন্বেষার প্রথম সাক্ষাতের কথা। অন্বেষা তখন বিকম পাশ করে চাকরি খুঁজছে। এ-অফিস সে-অফিসে দরখাস্ত জমা দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাকেও বলেছিল, ‘ভানুদা তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে, দেখো না কোথাও যদি কোনও সুযোগসুবিধা থাকে।’

ভানু আমার ডাকনাম। আমার ঠাকুমার দেওয়া বড়ো আদরের নাম। আমাদের বাড়ির পাশেই অন্বেষার মামারবাড়ি। ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ায় ও মামার বাড়িতে দিদার কাছেই বেশি থাকত। সেই থেকেই আমি ওর ভানুদা। আমার থেকে বছর সাতেকের ছোটো। কোনও অসুবিধা হলেই ভানুদা আছে।

সেই সময় আমাদের অফিসেই অ্যাকাউন্টস্ ডিপার্টমেন্টে একটা পদ খালি ছিল। মালিককে বলেকয়ে একটা চাকরির বন্দোবস্ত হয়েছিল। তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল অন্বেষা। ঘটনাক্রমে ওইদিন শুভজিৎও হাজির। সেই প্রথম দেখা দুজনের।

অন্বেষা খুব সুন্দরী না হলেও বেশ একটা আলগা চটক রয়েছে। কথাবার্তায়ও পারদর্শী। কথার মারপ্যাচেই বিশ্বজয় করতে পারে সে। তার উপর অল্পবয়সি অমন চটপটে মেয়েকে ভালো লাগাই স্বাভাবিক।

জয়েনিং ডেট অনুযায়ী ৩ অক্টোবর অফিস জয়েন করল অন্বেষা। দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে পরিচয় করানো ছাড়াও ওর কাজও বুঝিয়ে দিলাম আমি। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এক কর্মচারী রিপোর্ট দিয়ে গেল, ‘সাহেব, নতুন ম্যাডাম খুব ভালো। এত মিষ্টি কথা বলেন যে অন্যান্য সাহেবরাও খুব তারিফ করেন ওনার।’

শুভজিৎ মাঝেমধ্যে আমার অফিসেও আসত। খেয়াল করে দেখেছি, ও আমার সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ থাকত অন্বেষার দিকে। একদিন তো বলেই ফেলল, “আরে বস, এটা ওই মেয়েটা না, সেদিন যাকে তোদের বাড়িতে দেখেছিলাম?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস। আসলে সেদিন ও বাড়ি ফেরার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছিল, যে তোর সঙ্গে ওর পরিচয় করানোটাই সম্ভব হয়নি। তবে মনে হচ্ছে তোদের পরিচয়টা খুব শিগগিরি করাতে হবে।’

ঠিক সেই সময় দেখলাম অন্বেষা ফাইল হাতে অ্যাকাউন্টট্যান্ট রতনদার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রতনদা অন্য কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সামনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে অন্বেষা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমার দিকে তাকাতেই ইশারা করে ডাকলাম। দু’এক কথায় রতনদাকে মনে হয় কিছু বলল, হয়তো আপনি ফ্রি হলে আসছি’ এমন কিছু। তারপর সোজা আমার টেবিলে।

‘আরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বস।’

একটু হেসে অন্বেষা জবাব দিল, ‘না না ঠিক আছে। কিছু বলবে?’

‘বলছি বলছি আগে বস। খানিক বসলে তোর কাজের এমন কিছু ক্ষতি হবে না।’

বসতেই হল অন্বেষাকে। এদিক-ওদিক টুকটাক কিছু কথা হওয়ার পর, সপ্রতিভ ভাবে বললাম ‘দেখেছিস তোদের আলাপটাই করানো হয়নি। অন্বেষা এ হল শুভজিৎ।’ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি বিনিময় হল দুজনের। বললাম, ‘আমার কলেজের বন্ধু, ‘আজকের বার্ত’-র ফোটোগ্রাফার। পাশাপাশি অবশ্য একটা স্টুডিয়োও চালায়। আর এই হল অন্বেষা। আমার কলিগ কাম বোন, আবার বন্ধুও বলতে পারিস। ভারি মিষ্টি মেয়ে।’

লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে অন্বেষার মুখ। বলে, ‘সত্যি ভানুদা তুমিও না ।

ক্রমশ…

সিলেবাসের বাইরে (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অয়নের বাবা রিকশা চালাত। একদিন এক লরির ধাক্কায় কোমরের হাড় ভেঙে শয্যাশায়ী। অভীক বাড়িতে আর কাউকে দেখতে পেল না। পরিচয় দিতে অয়নের বাবা বসতে বললেন অভীককে পাশে রাখা মাদুরে। অয়নের বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নিয়ে এসেছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। কথা বলতে বলতেই অয়ন আর ওর মা বাড়িতে এল।

এদিকে অয়ন পাড়ায় খবর পেয়ে গেছে, স্যার এসেছেন বাড়িতে। খারাপ কিছু হতে পারে তাই মাকে কাজ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে। দু’জনের মুখের ঘাম বলে দিল দৌড়ে এসেছে ওরা। দু’জনের চোখেই একমুখ দুশ্চিন্তা। আশপাশের কিছু উৎসাহী মুখ উকি মারতে লাগল। অভীক ওদের স্বাভাবিক হতে বলে এক গেলাস জল চাইল অয়নের মায়ের কাছে।

অয়নের মা অয়নের মুখে আজকের স্কুলের ঘটনা শুনেছে। রাগে ঘেন্নায় আলোকদের বাড়ি আর কাজে যাবে না বলে এসেছে। অয়ন আগে কখনও জানায়নি আলোকের কোনও কথা ওর মাকে। কাজ চলে গেলে ওদের সংসার চলবে কী করে এই ভেবে!

অয়নের দিকে অভীক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে এখন ও নিজের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছে! অয়নকে কাছে ডেকে নিল। ওর মা বাবাও যেন একটু একটু করে শান্ত হতে থাকল। অভীক ওদের নিজের ছেলেবেলার গল্প বলতে লাগল। গরিব হলে এরকম ঘেন্না ও নোংরা আচরণ করাটা তথাকথিত পয়সাওয়ালারা যেন নিজেদের অধিকার ভেবে ফেলে। অভীকের কথা শুনতে শুনতে অয়নের পরিবারের সকলে যেন সমব্যথী হয়ে পড়ল। অভীক বুঝল, মাটি তৈরি হয়েছে। এবার বলা যায় ওর প্রস্তাবটা।

অভীক সরাসরি অয়নের মা বাবাকে বলল-কিছুদিন অয়নকে ওর কাছে রাখতে চায়। ওর পড়াশোনার সব দায়িত্ব সে নিতে চায়। সকলকে দেখিয়ে দিতে চায়, গরিবি কোনও অপরাধ নয়। বরং এটা জীবনে এগিয়ে চলার বড়ো একটা প্রেরণা হতে পারে। স্কুল থেকে অভীকের বাড়ি কুড়ি মিনিটের দূরত্বে। স্কুল ফেরত অয়ন প্রতিদিন অভীকের সাথে যাবে ওর বাড়ি। রাতে পড়াশোনা করে অভীকের বাড়িতে খেয়েদেয়ে ফিরবে ওর মা বাবার কাছে। দরকারে অভীক ওকে একটা সাইকেল কিনে দেবে। ওতে যাতায়াতের সুবিধা হবে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার অভীকের কাছে পড়তে যাবে অয়ন। ওখানে চান খাওয়া করে ওরা একসাথেই স্কুলে চলে আসবে। শনিবার, রবিবার ও ছুটির দিন অয়ন বাড়িতে থাকবে ওর নিজের মা বাবার কাছে। কারণ ওই দিনগুলোয় অভীক যায় গবেষণার কাজে।

প্রস্তাব শুনে অয়নের বাবা-মার চোখ ভরে জল এল। হঠাৎ অয়নের মা বলে উঠলেন, ঠিকই বলেন মন্দিরের ঠাকুর মশায়! মন থেকে ডাকলে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়। উনি সাহায্য করতে মানুষের রূপ ধরে মাটিতে নেমে আসেন। বেশ জোরেই কেঁদে উঠল অয়নের মা। ওর বাবার চোখেও জল। অয়ন কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে। ওর এইমাত্র শোনা স্যারের কথাগুলো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

অভীক আকাশে মুখ তুলে তাকিয়ে বাবাকে খুঁজতে লাগল। বাবা বলত, বড়ো হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালে তবেই জানবি তোর শিক্ষা সার্থক। ও দেখল, চাঁদের আলোয় ভাসছে অয়নদের সারা উঠোন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অভীক চলল মায়ের কাছে। সারা বুক জুড়ে একটা ভালোলাগার নদী বইছে, ছলাৎছল ছলাৎছল!

পরদিন থেকে শুরু হল অয়নের নতুন লড়াই। সহকর্মীরা অভীককে অনেক উৎসাহ দিল। মা অয়নকে যেন নিজের নাতি ভেবে বসে আছে। জোর করে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে। চম্পা মাসিও খুব খুশি। যেখানে বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করা ছেলে মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধ বয়সে, সেখানে অভীকের মতো মানুষরা অপরের ছেলেকে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

চম্পা মাসিও অয়নকে খুব ভালোবাসে। এক একদিন জোর করে অয়নের বাবা মার জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়। স্কুল ও স্কুলের বাইরে অভীকের এই কাজ যেন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে অহঙ্কারী মানুষগুলো ওর কাছে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে অয়নের ক্লাসে। আলোক আর ওকে ‘ছোটোলোক’ বলে না। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে। এখন অয়নের মনের মধ্যেও সে দুঃখ-কষ্ট আর নেই।

এদিকে অয়নের লেখাপড়ার উন্নতি, সত্যিই চোখে পড়ার মতো। অভীক মনপ্রাণ ঢেলে ওকে অর্জিত সব বিদ্যা যেন উজাড় করে দেয়। এটা অভীকেরও একটা লড়াই। অয়নের মাধ্যমে সমাজকে যেন ও একটা বার্তা দিতে চায়। একটু সহানুভূতি, একটু বাড়িয়ে দেওয়া হাত অসুবিধায় পড়া মানুষগুলোর জগৎ বদলে দিতে পারে।

সেদিন স্কুল জুড়ে সকলের চোখে মুখে আনন্দ! প্রধান শিক্ষক মহাশয় আনন্দে অভীককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সহকর্মীরা উচ্ছ্বসিত। অয়ন ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে! একটা লড়াইয়ের জয় হয়েছে। অভীক-অয়নের লড়াই ঘুণপোকায় আক্রান্ত নষ্ট হতে থাকা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে যেন এক নতুন দিশা! শিক্ষক ও ছাত্রদের পবিত্র সম্পর্ক যেন আলোয় আলোয় ভরে যায় আগামীতে। অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ- সকলের প্রার্থনা আজ এটাই।

এদিকে কামিনী ফুলের গাছটার নীচে অয়ন ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে। প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা চেয়ে চেয়ে দেখছে স্কুলে উপস্থিত ছাত্র, অভিভাবক সকলে। অভীক ওর ছেলেবেলার শিক্ষকদের স্মরণ করল। এ যেন এক গুরুদক্ষিণা ওর। হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালে আঁকা সেই দাড়িবুড়োর দিকে। মুচকি হেসে যেন বলছেন, কিছুই হারায় না। রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!

 

চান (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

পুরোহিতের নির্দেশের অপেক্ষায় আছে আদিবাসী ভক্তরা। তাদের ধামসা, রামসিঙা বেজে উঠবে। দুই থানের মাঝখানে দুটো মোষ বাঁধা আছে। পুরোহিত মঞ্চ থেকে তাদের গায়ে ফুল ছুড়লেই চারদিক থেকে টাঙি, বর্শা ছুঁড়ে মারতে থাকবে ভক্তরা। যতক্ষণ না ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে না পড়ে। তারপর বিশাল খাঁড়া দিয়ে তাদের মাথা কেটে দেবীর পায়ে দেয়া হবে। কুড়ানি সেই সময়ের প্রতীক্ষায় আছে। মোষের রক্ত কপালে ছুঁয়ে প্রার্থনা জানাবে, হে মা, একটা সন্তান দাও। অথচ ঝমঝম পা ফেলে সে নেমে আসে এসময়। রাগে চৌচির হতে থাকে। এই প্রতিক্ষিত সময়ে ডাকাডাকি! সন্ধ্যাদি কানে কানে বলল, দু’পা পেরোলেই শিলদারদের আটচালা শিবমন্দির, পাশে সামন্তদের বাড়িতেই মজুমদার মশায়ের ডাক। দ্রুত পা কুড়ানির। উৎকর্ণ কান ধামসা, সিঙার শব্দের দিকে। পাছে সে বাদ পড়ে যায়। মজুমদার মশাইকে কখনও দেখেনি কুড়ানি, তাঁর নামডাক শুনেছে শুধু। এই হতদরিদ্র অঞ্চলে যে সামান্য শ্রী এসেছে তাঁর নেপথ্যে তিনি। স্থানীয় রাজনীতিতেও তাঁর প্রবল প্রতাপ। ফলে তাঁকে কেউ অমান্য করে না। কিন্তু এই সময়ে ডাক! অবোধ মেয়ে মানুষ। পাঁচিলের পাশে বুড়ো শিরীষ গাছে একটা পেঁচা উড়ে এসে বসে। কুড়ানির চোখ যায়। ‘আর ভাল্লাগেনি মোর। বলতো কোন পানে আছেন উনি?’

বাগাল ছেলেটা গোয়ালে গরু তুলতে তুলতে মুখ না ফিরিয়েই আঙুল দেখিয়ে দেয়। সূর্য নেমে গেছে কিছুক্ষণ হল। কুয়াশার মতো একপোঁচ অন্ধকার নেমে এসেছে। কুড়ানির উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তি তাতে রহস্য ছড়িয়েছে ঢের। একটা অস্থিরতা নিয়ে হুড়মুড় করে বনটগর গাছটার পাশে সামন্তদের বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে পড়ে কুড়ানি।

সামনে জমাট অন্ধকার দেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে আসছে। কুড়ানির শরীরেও তা পিছলে যেতে থাকে। খোলা দরজা দিয়ে কিছু দূরের ভৈরব থানের অস্পষ্ট আলো দেখা যায়। কিন্তু ভিতরে গুমোট অন্ধকার। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আর দেখা যাবে বা কাকে! আজ এ তল্লাটের সমস্ত মানুষের বউ-বাচ্চার ঝক্কি সামলাবে ওই রঙ্কিণী থান। চোখের নজর বাড়িয়েও কোথাও কাউকে দেখে না কুড়ানি ।

‘তবে মোর ভুল হইছে। কী শুনতি কী শুনছি!’

পিছনে ফেরে কুড়ানি, দরজার দিকে পা বাড়ায়। ‘ফিরতিছ ক্যান?’ একটা গলা ফ্যাসফ্যাস করে ওঠে আচমকা। কুড়ানি চমকায়। আবার চিঁচিঁ করে কথা বাজে, ‘তুমি আইছ, বসো, দুফরে খাওয়া হয় নাই?’

কুড়ানির মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। কার কথা! নন্দীদের জোয়ান ছেলেটা শিরীষ গাছের ডালে ঝোলার পর অনেকবার ওইপথে সাঁঝবেলায় এরকম রক্তহীন আমন্ত্রণ শুনেছে। পড়িমরি দৌড়ে দাওয়ায় এসে উঠেছে অনেকদিন। ঘরে বসেও সেই বুক ধরফরানি থামেনি।

‘মায়ের ফুল আনছ, ধকল গিছে। এটটু বসো, জিরায় লও।’

“আলো নাই ক্যানে?’

শশব্যস্ত একটা ক্ষীণ আলো তক্ষুনি জ্বলে ওঠে। ঘরের কোণে একটা বসার জায়গা পরিপাটি দেখা যায়। অন্য প্রান্ত থেকে ডাক আসে, ‘আসো, বসো!’

কুড়ানির পায়ে জড়তা। মাথার ভিতর কাঁসাইয়ের ভটভটি। জোয়ারের টানে ভটভটি এগিয়ে যায় একপার থেকে অন্যপার। তক্তপোশে বসতেই কুড়ানির নাকে একটা বোটকা গন্ধ ধাক্কা মারে। এরকম গন্ধ তার চেনা। মাঝে মাঝে অনেক রাতে দিবা যখন বাড়ি ফেরে, এই গন্ধে সে ভীষণ রেগে যায়, চ্যাঁচামেচি করে। ততক্ষণে অন্য গন্ধ সমস্ত ঘরজুড়ে কুণ্ডলী পাকাতে থাকে। একটা অমঙ্গলের ঘূর্ণি ঘুরপাক খায়। কুড়ানির বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। অন্ধকার সয়ে এসেছে কুড়ানির, দূরে অস্পষ্ট আলোয় দেখে আরাম চেয়ারে শুয়ে এক বিশাল পুরুষ। এই আলোতে মুখ দেখা না গেলেও বোঝে সেইটা মজুমদারমশাই। ভয় ছেনে কুড়ানি কিছু সাহস সঞ্চয় করে। কথা বাড়ায়।

‘তা কি কইতেছেন? মোর একন কি করার আছে বলো দিকিন?’

‘করার তো আছেই। তুমি বুঝনি?’

শরীর রক্তহীন লাগে। কেমন ধোঁয়াটে বাতাস ঘরময় ঘোরাফেরা করে। এই রহস্যের খোলসের ভেতর থেকে একসময় সেই আধশোয়া পুরুষ উঠে আসে, কপাট লাগায়। ধোঁয়াশার চাদর সরে যায়। কুড়ানির সারাদিনের উপোসি শরীর এই আতঙ্ক সহ্য করতে পারে না। তার প্রায় বুজে আসা চোখের সামনে দেখে ভয়ংকর করাল মূর্তি। রক্তলোভী, লোলুপ তার জিভ, লকলক করছে। বহুদিনের পিপাসা তৃষ্ণা মেটাতে চায়। ভৈরব থান থেকে মাইকে মন্ত্র ভেসে আসে

মুণ্ডমালা গলে রক্তাংগীং শববাহনাম
সদাপূজম ধ্যায়েৎ সদা রঙ্কিণীম

সঙ্গে সঙ্গে ধামসা মাদল রামসিঙা ঢোল উৎকট শব্দে বেজে ওঠে। এই উচ্চকিত শব্দে তার সংজ্ঞা ফিরে আসতে দেখে, সেই বিশালাকায় মূর্তি তাকে গ্রাস করছে। মনে হচ্ছে যেন শত শত আদিবাসীদের টাঙি, বর্শা তার গায়ে এসে পড়ছে। ভীষণদর্শন পুরোহিত খাঁড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে তার মুন্ডু কেটে নিতে। জ্ঞান হারায় কুড়ানি।

চেতন অচেতনে এই জল-জঙ্গল ধান-পানের দেশে এক ভটভটি জলের শান্ত শরীর দুমড়ে দিতে দিতে অন্য পারে চলে যায়। আর এক গাড্ডার ভিতর থেকে, হুজুগের ভিতর থেকে, পাগলামির ভিতর থেকে উঠে আসে কুড়ানি। বড়ো রাস্তায় উঠে চোখ যায় রঙ্কিণী থানের দিকে। মানতের কথা মনে হতেই পেটের ভিতর থেকে, বুকের ভেতর থেকে, গলার ভেতর থেকে ঘেন্নার থুতু তুলে আনে। থুক করে। থুথু হাওয়ায় ভেসে ছড়িয়ে পড়ে রঙ্কিণী থানে, দূরের বর্গভীমার মন্দিরে, বাবা পঞ্চানন্দের চোখে মুখে। তারপর আত্মবিশ্বাসে লৌকিক পায়ে হেঁটে যায় উলটো পথে, নেমে পড়ে পালদের পুকুরে। জমানো গ্লানি ধুয়ে ফেলে ঘরে ফিরতে হবে।

 

 

চান (পর্ব ৩)

ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। এই ধ্বনির মধ্যে কী যেন আবেশ জড়িয়ে আছে। জড়ানো মোহ আছে, মন অন্য হয়ে যায়। এবছরই গরমে দিবার সাথে গিয়েছিল বর্গভীমা মন্দিরে। সেখানে এই ঘণ্টাধ্বনি, ধূপ-দীপ, আশ্চর্য গন্ধ তাকে স্থানু করে রেখেছিল প্রায় একবেলা। আসতেই ইচ্ছে করছিল না। সেই ধ্বনি।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঝামা পাথরের পঞ্চরথ পাঢ়া দেওল। চৌকো চৌকো পাথর বসিয়ে গাঁথনি। বহু যুগের শ্যাওলা জমা। ডাইনটিকরির লোকেরা বলে সাত আটশো বছরের পুরোনো তো হবেই। মন্দির কাছাকাছি হতে একটা ভয়ও কুড়ানির ভেতর, যদি কোনও কারণে কোনও ত্রুটি হয়। দূর থেকে সিঁদুরলিপ্ত পাথরে গুড়িসুড়ি মেরে ঢুকে পড়ছিল। অষ্টভুজা মা-র কাছে যাবে, যদি একটা আবছা অবয়ব দেখে। ক্রমে তা গাঢ় হয়। ওড়িয়া ব্রাহ্মণের দুর্বোধ্য মন্ত্রপাঠ কানে যায়। বোঝে না। পূর্বমুখী মন্দির। দরজায় দাঁড়াতেই ভেতরে ছায়া পড়ে। পুরোহিত ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের থালি হাতে কুড়ানিকে দেখতে পান। ইশারায় বসতে বলেন।

স্থানীয় ভক্তদের মতো পূজারিও জানেন দেবী রঙ্কিণীর আসল বাসস্থান ছোটোনাগপুরের ঘাটশিলা। এই ভৈরবভূমিতে তিনি মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য আসেন। আসেন ওড়গন্ডায়। তবে পথে এই ডাইনটিকরির মন্দিরেও কিছুক্ষণের জন্য দেবী প্রতিষ্ঠিত হন। এই প্রতিষ্ঠাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যই যেন এই ফুল দেয়া নেয়া।

ফেরার পথটা প্রায় উড়ে পার হতে চায় কুড়ানি। চারদিকে অদ্ভুত একটা গন্ধ। দুরের বাঁশঝাড়, বেনাবুদা, লাটকে লাট ধানখেত— সব চেনা ছবিও নতুন লাগছে।

ধানওঠা রুখা জমিগুলো, মাঝেমাঝে কাঁকরভরা রুগড়ি পাথরের লাল পথ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। মকরসংক্রান্তির জন্য কাসাইয়ের তীরে মেলা বসেছিল। কুড়ানি এক বান্ডিল কাচের চুড়ি কিনেছে। চুড়িপরা হাত নাড়ালেই রিনরিন করে বাজছে। হাত তুলতেই নীল কাচের চুড়ি আলো ঠিকরোচ্ছে, খুশির।

একি আত্মপ্রকাশের আনন্দ? বুনো মকাই-এর খই-এর মতো ভেতরে ভেতরে ফুটছে। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে যায়। দুহাত জড়ো হয়ে মাথায় ওঠে। রঙ্কিণী মা-র জন্য নয়। মজুমদার মশাইয়ের প্রতি। তিনিই তো এইসব ব্যবস্থা করেছেন। সামান্য কুড়ানি এই একমেলা মানুষের মধ্যে আলাদা আসন পাবে এতো তারই দান। এই মানুষটিকে কুড়ানি কখনও দেখেনি। শুধু তার দানই পেয়ে এসেছে। শিলদায় মজুমদার মশাই-এর বড়ো দোকান। খড়গপুর শহরেও তার ব্যাবসা। বাস আছে। শুনেছে কলকাতায় তার ঘর আছে। তিনি পঞ্চায়েতেরও মাথা।

দূরপাল্লার এই বাসটা সেমি-ডিলাক্স। বাসে গান বাজছে। বচ্চনের। ‘মেরে অঙ্গনেমে তুমারা ক্যায়া কাম হ্যায়।’ অন্য সময় হলে মন দিয়ে শুনত। মাথা নেড়ে হিন্দি উচ্চারণ করার অক্ষম চেষ্টা করত৷ দ্রুতগামী বাস। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে যায় কুড়ানি। বাস স্টপের গায়েই ভৈরব থান। বাস থেকে নেমেই দিবাকে দেখতে পায়। ভৈরব থানের পাশে দাঁড়ানো। সাড়ে চার ফুট উঁচু মাকড়াপাথরের বেদী। বেদী সাজানো হয়েছে। আলপনা আঁকা। নানা মাটির মূর্তি বেদীতে। হাতি ঘোড়াই বেশি। উলটোদিকে ভৈরবের শক্তি রঙ্কিণী দেবীর থান। কালো পাথরে লাল কাপড় জড়ানো দেবীর অধিষ্ঠান। মাথায় সিঁদুর মাখানো। সামনে পুজোর ঘট। স্থানীয় মান্যজনেরা এসে গিয়েছেন। কুড়ানি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল ভীরু পায়ে। পুরোহিতের হাতে ফুলের থালি তুলে দিতেই মন্ত্র উচ্চারণ হল। ঢাকঢোল বেজে উঠল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, হরিতকী, বয়রা ঘেরা মাঠে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাঁওতাল খেরোয়াল আদিবাসী ভক্তরা সেজেগুজে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র আর বর্শা, টাঙি নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামনের দিকে নাচের জন্য মেয়েরা। বাঁশ নাচে পারদর্শী ছেলেরাও। বেদীর পাশেই উঁচু মঞ্চে বসবার আয়োজন হয়েছে বিভিন্ন মান্যজনের। কুড়ানিরও ঠাই হল সেখানে।

কুড়ানি শুনেছে এই দেবীর মূর্তি আছে ঘাটশিলায়। কখনও সে দেখেনি। তাঁর মাথায় জটাজুট, আটহাত। উপরের দুটো হাত দিয়ে একটা হাতি ধরে আছেন। অন্যহাতে অস্ত্রশস্ত্র। শববাহন, রক্তমুখী, রক্তবর্ণা এই দেবী পশুরক্তে সন্তুষ্ট নন। তিনি নররক্ত চান। একসময় নরবলির রেওয়াজ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে হেজ সাহেবের হস্তক্ষেপে সে বলি বন্ধ হয়ে যায়। নরবলি দেয়া বন্ধ হলেও কুড়ানির মা বলত দেবী নিজের হাতে নরহত্যা করে রক্তপিপাসা মেটাতেন। এখন মানুষের মূর্তি দেয়া হয় দেবীর কাছে।

ক্রমশ…

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (শেষ পর্ব)

সামন্তকের মুখের সবকটা বাতি নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। কোনও রকমে আমতা আমতা করে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি এসবের কিছুই জানতাম না।”

জানার কথাও নয়। আপনার কাকুর মতো ক্রিমিনালরা সকলকে অন্ধকারে রেখেই নিজেদের কাজ হাসিল করেন। রাগ-অভিমান এসবের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন এখন মাসিমণি। তাই সবকিছু জেনেও আপনার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানালেন না আর। শুধু এই টাকাটা দিলেন, রোগশয্যায় থাকা গুরুর প্রতি একজন শিষ্যার দক্ষিণা হিসেবে।

তন্দ্রার এগিয়ে দেওয়া খামটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়ে নিল স্যমন্তক। মুখে বলল, ‘আপনি না বললে এসব কথা হয়তো জানাই হতো না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমার।’

—মাসিমণি এই কথাগুলো কাউকে বলেন না। আপনাকেও হয়তো বলতেন না। কিন্তু আমি দিনের পর দিন একজন মানুষকে কষ্ট পেতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই না পেরে বলে দিলাম। দয়া করে স্নেহাংশু সরকারকে এই বাড়ির ঠিকানা জানাবেন না।

আর আমি? আমাকেও কি আসতে বারণ করছেন আপনি? তন্দ্রার চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল স্যমন্তক।

ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি লেগে আছে তার। গলার স্বরটাও কেমন যেন আবেগমাখা! নিরুত্তর তন্দ্রা তাকিয়ে আছে অপলক। দমকা হাওয়ায় মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে অজস্র হলুদ রঙের ফুল।

প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে লাস্ট বাসটা ধরল স্যমন্তক। ভাগ্যক্রমে একদম শেষের জানালার ধারের সিটটা পেয়ে গেল বসার জন্যে। ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল একটা। বাসটা চলতে শুরু করেছে। জানলা দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা জোলো বাতাস। পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে মুখটা সামান্য খুলল। একবার চোখ বুলিয়ে নিল কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোটগুলোর ওপর। হাজার দশেক আছে মনে হয়। আপাতত চলে যাবে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল স্নেহাংশু সরকারকে। পরলোকে যাবার আগে একটা মোক্ষম পয়সা কামানোর উপায় বাতলে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

স্যমন্তককে মধুরিমার কাছে যাবার কথা বলেই চোখ বুজেছিলেন স্নেহাংশু। কী একটা ভেবে স্যমন্তকও লুফে নিয়েছিল কাকুর অন্তিম ইচ্ছেটা। ভগ্যিস নিয়েছিল। ব্যাবসাপাতির এই মন্দার বাজারে এখন মাঝে মাঝেই তাঁর নাম করে বেশ কিছু মালকড়ি হাতানো যাবে ভালো মানুষ মধুরিমার কাছ থেকে।

স্যমন্তকের জীবনে মেঘ না চাইতেই জল হিসেবে এসেছেন মধুরিমা, একসময়ের নামজাদা গায়িকা। অনেক টাকার মালিক। বছর বছর রয়্যালটি হিসেবেই ব্যাংক-এ জমে গাদা গাদা টাকা। স্নেহাংশুর সঙ্গে মধুরিমার আইনত বিচ্ছেদ হয়নি। তাই হিসেব মতো স্যমন্তকই এখন তাঁর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধিকারি।

এতদিন মৃত মেয়েকে শিখণ্ডী বানিয়ে টাকা নিয়ে এসেছেন স্নেহাংশু। এবার পালা স্যমন্তকের। ফুসফুসের জটিল রোগে ধুঁকে ধুঁকে ইহলোক ত্যাগ করা কাকুর মিথ্যে অসুখের ফিরিস্তি দিয়ে যতদিন পারা যায় টানবে আর এর মধ্যে যদি পটিয়ে ফেলতে পারে মধুরিমার পালিত কন্যা তন্দ্রাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তন্দ্রার বিহ্বল চাহনি আশা জাগাচ্ছে স্যমন্তকের মনে। তার ফেলা টোপটা বোধহয় বৃথা যায়নি। আইসিইউতে চলে যাওয়া বাবার ব্যাবসাটাকে এবার একটু একটু করে সারিয়ে তুলবে সে। সাদা খামটায় আলতো করে চুমু খেয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল স্যমন্তক।

বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে। হু হু হাওয়া এসে ঝাপটা মারছে মুখে। প্রসন্ন চিত্তে সিটের ব্যাকরেস্টে শরীর এলিয়ে দিয়েছে স্যমন্তক। মধুরিমার বিক্রি হওয়া বাংলোর দাম, বর্তমান বাড়ির ভ্যালুয়েশন, বছর বছর জমতে থাকা গানের রয়্যালটি এসবের একটা আনুমানিক হিসেব মনে মনে কষে চলেছে সে।

আধো ঘুম আধো চেতনার ঘোরেই চোখের সামনে একবার ভেসে উঠছে অনেক অনেক টাকা আর একবার তন্দ্রার মুখ। হঠাৎ পথ চলতে চলতে কোনও দামি জিনিস কুড়িয়ে পেলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমনই একটা খুশি চলকে উঠছে স্যমন্তকের মনে।

জীবনের এবড়োখেবড়ো পথে চলতে চলতে সেও যেন আচমকাই একটা স্বপ্ন কুড়িয়ে পেয়েছে। জোর করে চোখ বুজে থাকে স্যমন্তক ফিরে ফিরে দেখতে চায় স্বপ্নটাকে…।

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ৪)

পুরোনো কথা শোনার আগ্রহ স্যমন্তকের তেমন ছিল না। অস্থিরতা বাড়ছিল। সাড়ে চারটের বাসটা না ধরতে পারলে কেস খেতে হবে। তাই ব্যস্ত হয়ে বলল, “এবার আমায় উঠতে হবে ছোটোমা। সাড়ে চারটেতে লাস্ট বাস।’

—হ্যাঁ, তাই তো। গল্পে গল্পে সময়ের খেয়াল ছিল না। তোমাকে এ্যদ্দিন বাদে দেখে সমস্ত পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। তুমি আর একটু বসো, কেমন। তন্দ্রা একবারটি ভেতরে আয় তো।

যাবার আগে স্যমন্তকের মাথায় হাত রেখে মধুরিমা আরও একবার উচ্চারণ করলেন ওম শান্তি। স্যমন্তকও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল তার ছোটোমাকে। তন্দ্রা মধুরিমাকে অনুসরণ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর আবার ফিরেও এল কয়েক মিনিটের মধ্যে। হাতে একটা সাদা খাম।

—চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।

কথাটা বলেই চলে গেল দরজার দিকে। পায়ে গলিয়ে নিল চামড়ার জুতো। তারপর স্যমন্তককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে। কয়েক মিনিট চুপচাপ হাঁটার পর স্যমন্তক বলল, ‘আপনি যে আমার সঙ্গে এসেছেন সে কথা ছোটোমা জানেন?”

—নাহ। উনি এখন মেডিটেশনে বসেছেন। কোনও দিকে মন দেবেন না। তাই চলে এলাম আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে। —যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন করব?

—করুন।

—কাকু না হয় অন্যায় করেছেন ছোটোমার সঙ্গে। কিন্তু মিতিন? সে তো তাঁর সন্তান। তাহলে মিতিনের প্রতি এতটা উদাসীন কীভাবে হয়ে গেলেন ছোটোমা? বিষয়টা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকল।

ধীর গতিতে হাঁটছিল ওরা। এবার থেমে গেল তন্দ্রা। পথে লোকজন বিশেষ নেই। সকালে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ এখনও মেঘলা। রাস্তার পাশের রাধাচূড়া গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে স্যমন্তকের দিকে তাকাল সে। বলল, “আপনি আপনার কাকু আর ছোটোমা সম্পর্কে কতটা জানেন স্যমন্তক?’

—না মানে তেমন কিছুই আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বললাম না আপনাকে কাকু সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাকু ফিরে আসায় একটু আধটু জেনেছি। ইতস্তত করে উত্তর দিল স্যমন্তক।

—একটু আধটু নয়, আপনি আসলে কিছুই জানেন না। আপনার কাকু মানে স্নেহাংশু সরকার আপনাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে থাকা শুরু করেছিলেন মিতিনকে নিয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি হানা দিতেন মাসিমণির বাসায় আর নানা বাহানায় টাকা নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় টাকা চাওয়ার কারণটা হতো মিতিন। মাসিমণি অনেক খোঁজখবর করে তার আস্তানার হদিশ বের করেছিল দু’একবার কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা পাওয়া যেত না কারওর। প্রত্যেকবার টাকা নিয়ে যাবার পর নিজের ঠিকানা বদলাতেন স্নেহাংশু। আত্মীয়স্বজনদের মুখে শুনেছি মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্যে পাগলের মতো করতেন মাসিমণি। কিন্তু আপনার কাকু কোনওদিনও সে সুযোগ দেননি মাসিমণিকে। শুধু দিনের পর দিন হাত পেতে টাকাই নিয়ে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন মাসিমণি। কমিয়ে দিয়েছিলেন গান গাওয়া।

—এসব কথা তো আমি…

—এখানেই শেষ নয় স্যমন্তক। গল্প আরও আছে। মাসিমণির সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম হাওড়ায় এক কনসার্টে। সেখানে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় পাপিয়ামাসির সঙ্গে। পাপিয়ামাসি মাসিমণির ছোটোবেলার সঙ্গী। একসঙ্গে গান শিখতেন স্নেহাংশু সরকারের কাছে। তিনি কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের নার্স। তাঁর মুখ থেকেই মাসিমণি শুনেছিলেন সেই চরম সত্যিটা যেটা দিনের পর দিন আপনার কাকু লুকিয়ে রেখেছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে।

—চরম সত্যি? সেটা কী ?

ভ্রূ কুঁচকে তন্দ্রার দিকে তাকাল স্যমন্তক। বুজে আসা গলায় তন্দ্রা যে-কথাটা বলল সেটা শোনার জন্যে একটুও প্রস্তুত ছিল না স্যমন্তক।

—মিতিন আর বেঁচে নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার পরপরই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় মিতিন। পাপিয়ামাসিদের হাসপাতালেই ভর্তি ছিল সে। আপনার কাকু বানিয়ে বানিয়ে মাসিমণির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রচুর গল্প বলেছিলেন পাপিয়ামাসিকে। তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটা। অথচ স্নেহাংশু সরকার দিনের পর দিন সেই মৃত মেয়ের নাম করে টাকা নিয়ে আসছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে। আজও আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই একই কারণে। মিতিনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই গান গাওয়া ছেড়ে দেন মাসিমণি। শান্তির খোঁজে পা বাড়ান আধ্যাত্মিকতার পথে। পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে আশ্রয় নেন এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায়। চলে যেতে চেয়েছিলেন। স্নেহাংশুর ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু টাকার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সেখানেও পৌঁছে গিয়েছে ওই ঠগবাজ লোকটা। নিজে আসতে না পারলেও পাঠিয়ে দিয়েছে আপনাকে।

(চলবে)

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ৩)

দিঘির জলের মতো স্থির, শান্ত চাহনিতে বাঁধা পড়েছে স্যমন্তক। বলার আছে অনেক কথাই কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে, ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বললেন মধুরিমাই, ‘আমার এ বাড়ির ঠিকানা তোমায় কে দিল বুম্বা?’

গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে স্যমন্তক বলল, “আমি আপনার কলকাতার বাড়িতে বার কয়েক গিয়েছি। কিন্তু জানতে পারলাম আপনি এখন আর সেখানে থাকেন না। বিক্রি করে দিয়েছেন বাড়িটা। তারাই আমাকে কয়েকটা সম্ভাব্য ঠিকানার কথা বলেছিল। সবগুলোতে খুঁজে খুঁজে শেষমেশ জানতে পারলাম আপনি এখানে আছেন।’

—তা এত বছর পর হঠাৎ ছোটোমাকে এমন খোঁজাখুঁজি ? কোনও বিশেষ কারণ আছে নিশ্চয়ই? ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মধুরিমা।

সামন্তকের গলায় এখনও মৃদু উত্তেজনা, কারণ একটা আছে অবশ্য। কিন্তু বুম্বার কি তার ছোটোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? “বিশ্বাস করুন ছোটোমা, আমি বহুবার আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাকু নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন সব রাস্তা। তাই ইচ্ছে থাকলেও পৌঁছোতে পারিনি আপনাদের ধারে কাছে। যতদিন গায়িকা মধুরিমা সরকার প্রচারের আলোয় ছিলেন ততদিন তবুও আপনার খবরাখবর পেতাম। কিন্তু তারপর… ঠাকুমা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপশোশ করে গিয়েছেন এই ছন্নছাড়া সংসারটার জন্যে। বাবা বরাবরই উদাসীন ছিল কাকুর প্রতি তাই ঠাকুমার হাজার বায়নাক্কার পরেও আগ বাড়িয়ে খোঁজ করতে যায়নি তাঁর। বারণ করে দিয়েছিল আমাকেও। কিন্তু সেদিন…..

—কেমন আছেন দাদামণি, দিদিভাই? স্যমন্তকের কথা মাঝ পথে থামিয়েই বলে উঠলেন মধুরিমা। —বাবা চলে গিয়েছে আজ দু’বছর হল। মা বাতের ব্যথায় কাবু। কোনওরকমে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

—আর তুমি? বিয়ে থা করেছ? কাজ কারবার?

—বিয়ে এখনও করিনি ছোটোমা। বাবার ওষুধের ব্যাবসাটারই হাল ধরার চেষ্টা করছি।

ভেতর ঘরে যাবার দরজাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আলতো হেসে উত্তর দিল স্যমন্তক। আর ঠিক তখনই নড়ে উঠল পর্দাটা। হাতে জলখাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল তন্দ্রা। টেবিলের ওপর রেখে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল মধুরিমার পাশে। বলল, “তুমি এখন চা খাবে মাসিমণি?”

—না রে বাবু, আজ আর চা খেতে মন চাইছে না। বুম্বা কে দে। তুইও খা।

—আমার জন্যে ব্যস্ত হবার দরকার নেই ছোটোমা। এতসব আয়োজন না করলেই হতো।

—সে কী? এতবছর পর তোমাকে দেখছি দু’চারটে মিষ্টি খাওয়াব না? আপত্তি কোরো না। এই গরমে এতটা পথ এসেছ, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

খিদে তার জব্বরই পেয়েছিল তাই আর বেশি ভণিতা না করে দ্রুত তুলে নিল প্লেটটা। গোটা তিনেক মিষ্টি শেষ করে হাতে নিল বড়োসড়ো একটা শিঙাড়া। প্রসন্ন মুখে তার খাওয়া দেখছিলেন মধুরিমা। তন্দ্রা আড় চোখে নজর রাখছিল স্যমন্তকের ওপর।

—আর দুটো মিষ্টি দেবে?

—না না ছোটোমা, এই ঢের।

জল খেয়ে একটা মৃদু ঢেকুর তুলে জবাব দিল স্যমন্তক। খাওয়া দাওয়া সারা। এবার যত তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আসা যায় ততই মঙ্গল। মধুরিমা বোধহয় পড়তে পেরেছিলেন স্যমন্তকের মনের কথাটা। তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “তোমার এখানে আসার পেছনে কী একটা কারণ আছে বলছিলে…।’

—হ্যাঁ ছোটো মা, আসলে যে কথাটা বলছিলাম। এতগুলো বছর আপনার, কাকুর, মিতিনের কোনও খবর না পেয়ে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম সবকিছু। কিন্তু হঠাৎই দিন দশেক আগে কাকুর লেখা একটা চিঠি আসে ডাকে। জানতে পারি তিনি অসুস্থ। আমাকে তাঁর ঠিকানায় যেতে লিখেছেন। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলে স্যমন্তক, একবার দেখে নেয় মধুরিমাকে। ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে আছেন সামন্তকের দিকে।

স্নেহাংশুর অসুস্থতার খবরে একটুও বিচলিত দেখাল না তাঁকে। রুমালটা পকেটে গুঁজে আবারও বলতে শুরু করে, অনেক খুঁজে পেতে অবশেষে উপস্থিত হই উত্তর কলকাতার এক ঘুপচি ঘরে। ওটাই কাকুর আস্তানা। হাঁপানির টানে দম নিতে পারছিলেন না তিনি। অনেক কষ্টে জানালেন আপনার কথা। বললেন, আপনাকে যেন খবরটা দিই আর বলেছেন মিতিনের হস্টেলের ফিজ বাকি পড়েছে অনেকদিন হল। উনি অসুস্থ তাই কোনও ভাবেই জোগাড় করতে পারছেন না টাকাটা। আমার হাতে আপনাকে টাকা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন কাকু।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করলেন মধুরিমা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুটে বললেন, ‘এখন কোথায় আছেন তিনি?”

—হাসপাতালে ভর্তি করেছি। কিছুটা ভালো আছেন। আমি আসতে চাইনি কিন্তু কাকু বারবার জোর করতে থাকায়…

—ভালোই করেছ। এত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা তো হল। চেহারা অনেকটা বদলে গিয়েছে তোমার। কপালের ওই কাটা দাগটা না দেখলে চিনতেই পারতাম না হয়তো। সেবার মামা-ভাগ্নে পাহাড় দেখতে গিয়ে মাথা ফেটে সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! মনে আছে?

মধুরিমার কথা শেষ হতেই পাশে দাঁড়ানো তন্দ্রা ঝটিতি তাকাল সামন্তকের দিকে। তন্দ্রার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কাটা দাগটায় হাত বোলাল স্যমন্তক। একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলল, ‘সে আর বলতে?”

স্নেহাংশুর অসুস্থতা, মিতিনের হস্টেলের প্রসঙ্গ কোনও কিছু নিয়েই তেমন কৌতূহল দেখাচ্ছিলেন না মধুরিমা। বিষয়টা কেমন অদ্ভুত ঠেকছিল সামন্তকের কাছে। আঠারো বছর আগে দেখা মানুষটা অনেকটাই বদলে গিয়েছেন। এমনকী তাঁর একমাত্র মেয়েকে নিয়েও একটা শব্দ খরচ করছেন না তিনি। তাঁর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, সামন্তকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা— এসব গল্পই তিনি শোনাচ্ছিলেন তন্দ্রা আর স্যমন্তককে।

(চলবে)

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ১)

রাস্তার পাশে জমে থাকা জলে চাকাটা পড়তেই ছপাৎ করে শব্দ হল একটা। মাঝবয়সি রিকশাচালক বলল, ‘ইয়ে লিজিয়ে ভাইয়াজি আগয়ি আপকি শান্তিকুঞ্জ।’

রিকশায় বসেই অবাক চোখে স্যমন্তক তাকাল বাড়িটার দিকে। ছোটোখাটো চেহারার একতলা বাড়ি। সামনে একফালি সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি। দু’চারটে ফুল আর গোটা কয়েক সুপুরি গাছ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ছোটো লোহার গেটটা খুলল স্যমন্তক। ক্যাঁচ করে শব্দ হল একটা। বাড়ির হাতা পেরিয়ে এসে দাঁড়াল সদর দরজার সামনে। পুরোনো আমলের ডোরবেলটা বাজাতেই ভেতর থেকে শোনা গেল নারী কণ্ঠ, ‘কে?’

—আমি স্যমন্তক, স্যমন্তক সরকার। ম্যাডামের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল।

খুট করে একটা শব্দ হল দরজায় আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ পাল্লা খুলে বেরিয়ে এল ফরসা, ছিপছিপে চেহারার একটা মেয়ে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। জিন্‌স, টি-শার্ট পরা, পিঠব্যাগ কাঁধে স্যমন্তককে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে সে বলল, ‘ও, আপনি? আপনার তো সকালের দিকে আসার কথা ছিল, তাই না?”

—হ্যাঁ কথা তো তেমনই ছিল। কিন্তু রাস্তায় একটু ফেঁসে গিয়েছিলাম। হাইওয়েতে সকালে একটা বড়োসড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তাই পথ অবরোধ ছিল অনেকক্ষণ। তার উপর জ্যাম, প্রায় ঘণ্টা তিনেক আটকে থাকতে হল ওখানে। ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলে থামল স্যমন্তক। তারপর জিজ্ঞেস করল, আজ কি তাহলে দেখা হবে না ম্যাডামের সঙ্গে? আসলে আমার দেখা করাটা খুব দরকার। অনেকটা দূর থেকে এসেছি।

ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কুর্তি পরা মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “আপনি ভেতরে এসে বসুন। আমি মাসিমণিকে খবর দিচ্ছি। যদি উনি দেখা করতে চান তবে নিশ্চয়ই দেখা হবে।’

স্যমন্তককে বৈঠকখানায় বসিয়ে সে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। ধবধবে সাদা দেয়াল। জানলা-দরজার পর্দা, সোফার কভার এমনকী ছোট্ট ডিভানের ঢাকাটা পর্যন্ত সাদা! একটা হালকা লাল আলো জ্বলছে ঘরে। চন্দনের সুবাসে ভরে আছে চারপাশ। ঘরটাতে ঢুকেই একটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল স্যমন্তকের মন। একটু ইতস্তত করে স্যমন্তক বসল দুধ সাদা সোফার ধার ঘেঁষে। চারদিকটা ভালো করে দেখছিল সে।

ঘরের মেঝে থেকে টি-টেবিলের ঢাকনা, সবেতেই যত্নের ছাপ স্পষ্ট। ডানদিকের বড়ো দেয়াল জুড়ে রয়েছে একজন শুভ্র কেশ প্রৌঢ়ের ছবি। নীচে বড়ো বড়ো করে ইংরেজি হরফে লেখা ওম শান্তি। ধুপকাঠি জ্বলছে দু’খানা। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। বোধহয় গুরুদেব-টেব হবেন। ছোটো একটা ট্রেতে এক গেলাস জল আর দুটো সন্দেশ নিয়ে ঘরে ঢুকল মেয়েটি। বলল, ‘মাসিমণি আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। একটু পরে আসছেন উনি।’

সে ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই স্যমন্তক পেছন থেকে আচমকা বলে উঠল, ‘ছোটোমা, মানে মধুরিমা ম্যাডাম কি আপনার আপন মাসি?’

প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকাল মেয়েটি। একটা সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, ‘না ঠিক আপন নয়। একটু দূর সম্পর্কের। খুব ছোটো বয়সে আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই মাসিমণি নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছেন আমাকে।’

—আমিও সেরকমই কিছু আন্দাজ করছিলাম, কারণ মিসেস মধুরিমা সরকারের কোনও ভাই বা বোন ছিল না বলেই জানতাম। কথাটা বলে ঠান্ডা জলের গেলাসে চুমুক দিল স্যমন্তক।

মেয়েটি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল স্যমন্তকের দিকে। ভর দুপুরে আসা এই আগন্তুকের প্রতি যে তার অসীম কৌতূহল সে বিষয়ে স্যমন্তক নিশ্চিত। মধুরিমাদেবী মেয়েটিকে স্যমন্তকের বিষয়ে একেবারে অন্ধকারে রেখেছেন, বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটিকে একটু খেলাতে ইচ্ছে করল।

এমনিতে তার সুপুরুষ চেহারা, তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা যে-কোনও নারীর মনকেই টেনে নেয় চুম্বকের মতো। রমণীমোহন হিসেবে তার ভালোরকম খ্যাতি আছে বন্ধুমহলে। বান্ধবীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

জলের গেলাসটা টেবিলে রেখে বলল, উফ, প্রাণটা জুড়োল। এই রোদে ভিড় বাসে ট্র্যাভেল করা যে কী হ্যাপা, সেটা যারা করে তারাই জানে। তার উপর এই বিরক্তিকর জ্যাম! একবার ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই। পরক্ষণেই মনে হল মধুরিমাদেবী হয়তো অপেক্ষা করে বসে থাকবেন। কথার খেলাপ করাটা ঠিক হবে না। তাই তেতে পুড়ে হলেও চলে এলাম। বড্ড তেষ্টা পেয়েছিল, জানেন? জলটা দিয়ে আপনি আমাকে বাঁচালেন মিস…?

—তন্দ্ৰা৷

—বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো আপনার!

—আপনি বিশ্রাম নিন, আমি দেখি ওদিকে মাসিমণির হল কিনা। লাজুক হেসে তন্দ্রা আবার চলে গেল ভেতরে।

 

(চলবে)

মা (শেষ পর্ব)

তুষারের ফ্ল্যাটে আসা থেকে অসীমা এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেননি। সন্ধে হলে রঞ্জনাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাত্তিরে তোর কী খেতে ইচ্ছে করছে বল, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’ রঞ্জনা শাশুড়ির হাত ধরে খাটে বসিয়ে কোলে মাথা রাখল, ‘তুমি যখন থেকে বাড়িতে এসেছ, এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নাওনি। রাত্তিরে তুমি কিচ্ছু করবে না, তুষার রেস্টুর‌্যান্ট থেকে খাবার নিয়ে আসবে।’

‘এই অবস্থায় হোটেলের খাবার? ওই খাবার খেলে তোকে হাসপাতাল যাওয়ার হাত থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের সকলের জন্যে চট করে কিছু একটা বানিয়ে নিচ্ছি যেটা খেলে তোর হজমের কোনও অসুবিধে হবে না। তার আগে তোর চুলে তেল লাগিয়ে চুলটা বেঁধে দিই চল। সন্ধে হয়ে গেছে চুল খোলা রাখতে নেই।’

তুষারও সঙ্গে সঙ্গে মায়ের সামনে উপস্থিত হল, ‘মা আমাকেও মাথায় একটু তেল মালিশ করে দাও। জানো রঞ্জনা, বাড়িতে এই তেল লাগানো নিয়ে আমাদের দুই ভাই আর বাবার মধ্যে লড়াই বেধে যেত, কে আগে মায়ের কাছে বসে মালিশ করাবে।’

তেল মালিশ করে চুল বেঁধে দিতেই রঞ্জনার ঘুমে চোখ ঢুলে আসে। কখন চোখ লেগে গিয়েছিল জানে না, চোখ খুলল যখন তখন দেখে তুষার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। অসীমার আঙুলগুলো খেলা করছে তুষারের চুলের মধ্যে। মা ছেলেকে বলছেন, “আমি বাড়ি ছেড়ে কতদিন আর তোদের কাছে থাকব? রঞ্জনা খুব ভালো মেয়ে। বাড়িতে কোনও জিনিস কিনিসনি তাও ও তো কোনওরকম অভিযোগ করেনি। ওর চাহিদা খুব কম। মেয়েটার মনে কোনও লোভ নেই। এই সামান্য জিনিসেই সংসার সামলাচ্ছে। আমাকেও বারবার থেকে যাওয়ার জন্যে জোর করছে। বউমা-কে নিয়ে বাড়ি ফিরে চল। ওখানে ওকে দেখাশোনা করার জন্যে আমরা থাকব। ওর যা শরীরের অবস্থা, খাওয়াদাওয়ার উপর বিশেষ যত্ন নেওয়া দরকার যেটা তোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তোরা এখানে থাকলে আমার আর তোর বাবারও চিন্তার শেষ থাকবে না। রঞ্জনাকে বাড়িতে পেলে তোর বাবাও খুব খুশি হবেন।’

তুষার মায়ের কোল থেকে উঠে বসে, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি, কিন্তু রঞ্জনাকে জিজ্ঞেস না করে…’

অসীমা উঠে যান রান্নাঘরের কাজ শেষ করতে। কাজ শেষ করে যখন ঘরে ঢোকেন রঞ্জনা উঠে বসেছে খাটের উপর। শাশুড়িকে ঘরে ঢুকতে দেখে রঞ্জনা বলে, ‘মা, তুমি তেল লাগিয়ে দেওয়াতে এত আরাম হয়েছে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। তুমি যদি রাগ না করো একটা কথা বলতে চাই।’

“হ্যা, বল না কী বলতে চাস।’

“মা, আমি আর তুষার তোমাদের কাছে গিয়ে থাকতে চাই। তোমাদের অসুবিধা হবে না তো? আমি জানি আমরা গেলে তোমার কাজ অনেক বেশি বেড়ে যাবে কিন্তু তোমাদের সঙ্গে থাকলে আমি জানি আমার খুব ভালো লাগবে। আমি আনন্দে থাকব আর তাছাড়াও আমি থাকলে বাবা খুশি হবেন তাই না?’

‘কী বলছিস কী তুই? ওটা তো তোরও বাড়ি। অসীমাদেবী গলার স্বরে খুশি চেপে রাখতে পারেন না। তুষারকে ডেকে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘যা, যা গোছাবার এক্ষুনি গুছিয়েনে। সকাল হলেই আমরা ওই বাড়িতে রওনা হবো। ওখানে গিয়েই জলখাবার খাওয়া হবে। বাবাকে একটা ফোন করে দে। রঞ্জনার জামাকাপড় যা দরকার এখন নিয়েনে, বাকি পরে এসে নিয়ে যাস। আর হ্যাঁ, রঞ্জনা, রঞ্জনার দিকে তাকান অসীমা, ‘মেয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে। শাড়ি পরার দরকার নেই। তোকে অফিস যেতে হবে মনে রাখিস। সুতরাং যে-পোশাক পরে তোর সুবিধা হবে, তাই সঙ্গে নিবি। আমার বা তোর বাবার কোনও আপত্তি নেই।’

পরের দিন ভোরে উঠে তুষার আর অসীমা সবকিছু গোছানো জিনিসপত্র দরজার সামনে এনে রাখলেন। রঞ্জনাও উঠে পড়েছিল। অসীমা ওকে জামাকাপড় বদলাতে সাহায্য করলেন। জিনিসপত্র নিয়ে তুষার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলে, রঞ্জনার হাত ধরে অসীমাদেবী ফ্ল্যাটের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। রঞ্জনা বাড়ির চাবি শাশুড়ির হাতে দিল তালা লাগাবার জন্য। তালা লাগিয়ে অসীমা চাবিটা বাড়িয়ে দেন রঞ্জনার দিকে, ‘এটা ব্যাগে রেখে দে।’

“মা, এটার আমার আর দরকার নেই। এটা এবার থেকে তোমার কাছেই থাকবে।’

অসীমা, রঞ্জনার হাত চেপে ধরে পা বাড়ান সিঁড়ির দিকে।

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব