ভুলের মাশুল (১-পর্ব)

এখন সকাল। রোদ্দুরের তেজটা সেরকম বোধ হচ্ছে না। প্রিন্সেপ ঘাটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছেন অমিত সেন। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজ করার সুবাদে আগে এখানে কতবার এসেছেন। এখন আর সেরকম ভাবে আসা হয় না। ঘাটের চারপাশজুড়ে আকাশ কমলা হওয়ার দৃশ্যটা কতদিন দেখেননি তিনি! চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে প্রায় সবাইকে নিজের কাজে বেরুতে হবে। সে তাড়া অমিত সেনের নেই। আজ তাঁর একটু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার দরকার ছিল। তাই সটান চক্র রেলে চেপে এখানে এসেছেন।

আজ আবার ঘটনাটা ঘটল। এই নিয়ে কতবার যে হল আর মনে করতে পারছেন না অমিত সেন। কিছুদিন আগে বাসে উঠে মনে পড়ল দরজাটা লক করা হয়নি। মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাড়ির সামনে এসে দেখেন তার ধারণা ভুল। দরজা বন্ধ। ব্যাংক-এ পাশবই আপ ডেট করতে গিয়ে দেখেন পাশবইটা সঙ্গে আনা হয়নি। এসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেরটা একেবারে সাংঘাতিক ভুল। কথায় বলে ভুলের মাশুল। কড়ায় গণ্ডায় একেবারে বারো হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। এরপর চলবে জলকষ্ট। তাঁদের চার-পাঁচটা বাড়ির পরে থাকেন মোহিত দাস। তিনি কিছুদিন করোনা রোগের শিকার হয়েছিলেন। যমে-মানুষে টানাটানি করে বাড়ি এলেন কিন্তু ব্রেন-এর অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উলটোপালটা বকেন। মোহিতবাবু-র একমাত্র মেয়ে বিদেশে। আয়া-নির্ভর জীবন। আয়ার চড়-চাপট খেয়ে জীবন কাটে। সেই মোহিত দাসের বাড়িতে কিছুদিন আগে পুলিশ এল। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় থাকার সুবাদে মোহিত দাসের সঙ্গে অমিত সেনের ভালোই সখ্যতা আছে। আজকাল অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। অভিযোগ মারাত্মক। মহিলার শ্লীলতাহানি।

আশেপাশের বাড়ি থেকে গুঞ্জন উঠল, তাহলে কি আয়ার সঙ্গে! এই বয়েসে! ছিঃ ছিঃ ইত্যাদি। পরের ঘরের কুৎসা পেয়ে যে যত পারে বেলুন ফোলাতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এইসব ঘটনাকে মোহিতবাবুর সাময়িক যৌন উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আখ্যায়িত করল। অমিতবাবুর এইসব ন্যাস্টি কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগল না। তিনি নিজে মোহিতবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ব্যাপারটা অন্য। এক্কেবারে রোমান্টিক।

অয়ন দাস তাঁর স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে মোহিতবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে চুরি করতে চোরেদের এখানে খুব মজা। এখন অবশ্য এসব ঘটনা শোনা যায় না। তবে উঁকি ঝুঁকি মারলে প্রতিবেশীর বেডরুমে চোখ পৌঁছে যায়। সেই চোখই হয়েছে ভিলেন।

মোহিতবাবু নাকি প্রায়শই অয়নবাবুর বাড়িতে উকিঝুঁকি মারেন। মনিকাকে নাম ধরে ডাকেন। বয়সে বড়ো, তাছাড়া ভুলো মনের মানুষ এইসব ভেবে অয়ন বা মনিকা খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু শেষ কয়দিন মোহিবাবুর মাথার ব্যামো একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রায়ই কলতলায় যাওয়ার সময় জানলার ফাঁক দিয়ে ‘মনিকা, মনিকা’ বলে হাঁক পেড়ে চলে যান। এতেও ঠিক ছিল। তিন দিন আগে দু’তিনবার, ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’ সুর ভেঁজেছেন। ব্যস আর যায় কোথায়! রাহুল দেব বর্মনের এই কীর্তিকে একেবারে খাটো করে দেখতে রাজি নন তারা। একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বেন। তাই সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অয়ন-রা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। পুলিশ যদি বুড়োকে একটু আচ্ছা করে কড়কে দেয়।

পাঁচতলা থানার ওসি রামদাস মণ্ডল একজন রসিক এবং সমপরিমাণ বদমেজাজি ব্যক্তি। নিজে মাঝেমধ্যে পাড়ার গজিয়ে ওঠা শখের থিয়েটারে ছোটোখাটো পার্ট করে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন। খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করেন বলে পুলিশমহলে বেশ ওজনদার। রামদাস ওসি যখন মোহিত বাবুর কাঁটাপুকুরের বাড়িতে এলেন, তখন অমিতবাবু একটু অবাকই হলেন। সিনেমার শুটিং-এর মতো ক্যামেরার পরিবর্তে হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে চোখের সামনে এনে বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে মোহিত বাবুকে মাপতে লাগলেন। হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। তার কথা শুনে মোহিতবাবু দেঁতো হাসি হাসলেন। অমিতবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ক্রমশ…

 

 

জোড়া শালিক (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

একবার সুশীলা এবং সুনীল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছে। সুনীলের বাইকের পিছনে সুশীলা বসল। হঠাৎ করে ব্যাংকের দরজার বাইরে পেয়ারা গাছেতে জোড়া শালিকের একটি ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য শালিকটাও কাঁই কাঁই করে উঠল। সুনীল তখন সবে বাইক স্টার্ট দিয়েছে। গাছটা ওদের ঠিক ডান পাশে। ভালো করে দেখার জন্য সুশীলা ‘রুকিয়ে জি’ বলে লাফিয়ে নেমে পড়ল বাইক থেকে। কান হেলমেটে ঢাকা থাকাতে সুনীল কিছুই শুনতে পায়নি। বাইক ব্যাংকের পরিসর থেকে বেরিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল।

জোড়া শালিকে মাথা ঠোকা শেষ হলে সুশীলা সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখল সুনীল ও বাইক দুটোই ধারে কাছে নেই। এদিকে অনেকটা যাওয়ার পর সুনীল অনুভব করল পিছনটা বেশ হালকা লাগছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে বউ নেই। দুশ্চিন্তায় বাইক ঘোরাল ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকে পৌঁছে অবাক, সুশীলা সেখানে নেই! সুনীলের সঙ্গে আসবে বলে সুশীলা ফোনটাও আনেনি। কী করবে ভাবছে, এমন সময়, গেটের বাইরে বসে থাকা মুচিটা বলল, ‘সাব কিসিকো ঢুঁঢ রহা হ্যায় ক্যায়া?’

সুনীল বলল, ‘মেরি পত্নি কুছ দের পহলে এহি থি, কহা চল দি পতা নহি, ফোন ভি নহি হ্যায় উনকি পাস।’

—এক মেডামজি থোড়া পরিশান দিখ রহি থি। ও তো পয়দল চল দিয়ে।

সুনীল আর্তস্বরে বলল, “কিধার চল দিয়ে, দেখা আপনে?’

—জি সাহাব বাঁয়ে তরফ গয়ি, জবাব দিল মুচি।

এবার প্রমাদ গুনল সুনীল, উলটো দিকে হাঁটা দিয়েছে সুশীলা। বাইক ঘোরাল ডান দিকে। কিছুটা এগোতেই দেখা পেল সুশীলার। ও হেঁটেই বাড়ি যাবে, কিছুতেই সুনীলের বাইকে চড়বে না। অনেকবার সরি বলার পরেও মানতে নারাজ। অগত্যা সুনীল বলল, ‘মগর হামারা ঘর দুসরা তরফ হ্যায়, রাস্তাপে খো যাওগি।’ এবার ভয় পেয়ে গেল সুশীলা, ফিরে এসে বাইকে বসল।

এহেন সুশীলাদেবীর ঝোলা বারান্দার সামনে কবিতাদেবীর বারান্দা। কবিতাদেবী এবং ওনার স্বামী দুবেজি ধার্মিক প্রকৃতির। দুবেজি সকালবেলায় স্নান করে সূর্য প্রণাম করেন। এরকম একদিন, দুবেজি যখন সূর্য প্রণাম সারছেন, সেই সময় এক জোড়া শালিক কচর কচর করতে করতে দুবেজির বারান্দার মাথার উপর কার্নিশে এসে বসল। জোড়া শালিকের কচকচানি শুনে সুশীলা দৌড়ে এসে দরজা খুলে জোড়া শালিক সকাল সকাল দেখে আনন্দে আত্মহারা। ভাবাবেগে পরের পর ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল।

ভগবান বন্দনায় মত্ত দুবেজি পরপর চুমু ছুড়ে দেওয়ার আওয়াজ শুনে চোখ খুলে দেখেন, সুশীলা দেবী চোখ বুজে ক্রমাগত চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন তার দিকে। বয়সে অনেকটা ছোটো সুশীলা ওনার থেকে। দুবেজির স্ত্রী রীতিমতো দাপুটে। ভগবানবন্দনা অসম্পূর্ণ রেখে বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে ভিতরে চলে গেলেন দুবেজি! সংবিৎ ফিরে এল সুশীলার, এবার খেয়াল হল তির ভুল জায়গায় বিঁধেছে!

চুমুর আওতায় শালিক ছাড়া দুবেজিও ছিলেন। শালিক-চুম্মা দুবেজি-চুম্মাতে পরিণত হয়েছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম। দুবেজিও চাচা নিজের প্রাণ বাঁচা, ঝুল বারান্দায় আসাই বন্ধ করে দিলেন। সুশীলা অনুশোচনায় দগ্ধ। এ কি কাণ্ড হল! ছেলে বড়ো হয়ে গেছে, পাঁচকান হলে আর রক্ষে নেই। বাধ্য হয়ে স্বামী সুনীলকে বলল কিছু একটা করতে।

সুনীল সাফ জানাল, ‘হামসে কুঁছো না হতোই। ই তোহার লাফরা, হম না পরবু।’

এমত অবস্থায় একদিন নীচে মন্দিরে যেতে গিয়ে সামনে পেলেন দুবেজি পত্নি কবিতাজিকে। হিম্মত করে বলেই ফেললেন সমস্ত ঘটনা। সব শুনে কবিতাজি বললেন, ‘ছোড়িয়ে আপ ময়না কো দিয়ে, ক্যায়া দুবেজি কো দিয়ে — ম্যায় ক্যায়া জানু। ঔরতকো সমাহালকে রহনা চাহিয়ে। হমলোগ হ্যায় সজ্জন ব্রাহ্মণ।’ বলে গটগট করে চলে গেলেন কবিতা।

সুশীলার মাথায় হাত— এবার বোধহয় পাড়ায় ঢিঢি পড়তে আর খুব বেশি দেরি হবে না!

 

জোড়া শালিক (পর্ব-২)

পর্ব ২

সুশীলা দেখতে সুন্দরী, তার উপর মাঞ্জা দিয়ে গেছিল। বাড়ি ফিরে সুনীল, শালাকে ফোন করে বলল, ‘অব সে ডগডর কে পাস অপনি পাগলেট দিদিকো তুমহি লেকে জানা, আজ বহুৎ বেইজ্জত হুয়া মেরা।’

বলা বাহুল্য ডাক্তারের ওষুধ বেশিদিন চলল না এবং চরিত্রের পরিবর্তনও এল না। এই অসুবিধার জন্য সুনীল কোনও লম্বা দূরত্বের ট্রেনজার্নি সুশীলাকে নিয়ে করে না। কারণ সুশীলা ট্রেনের টয়লেটে কিছুতেই যাবে না। একবার ভাগ্নির বিয়েতে গুয়াহাটি নিয়ে গেছিল। গুয়াহাটি পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। সমস্যা দেখে, সুনীল ফিরতি পথে ফ্লাইটে এল।

সুশীলার এই আচরণে সবচেয়ে দুঃখী সুশীলার শ্বাশুড়ি মা। ভদ্রমহিলা যৌথ পরিবারে সংসার করেছেন, ভাসুর, দেওর ও জায়েদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন। ওনারা এখন বাড়ির কাছাকাছি সবাই থাকেন। এছাড়া সুশীলার তিন ননদ। তারাও কাছাকাছি থাকেন। এরা সবাই সুশীলার ছোঁয়াছুঁয়ির ও সেই নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে সহজে এই বাড়িতে পা রাখেন না। এই নিয়ে বাড়িতে কম অশান্তি হয়নি। কিন্তু সুশীলা নিজেকে একটুও বদলায়নি।

নিজের এই চারিত্রিক অবস্থা নিয়ে সুশীলা কখনও মনে মনে নিজেই বিব্রত বোধ করে। বুঝে পায় না কী করবে! একেক সময় মনে করে কিছুতেই এসব নিয়ে ভাববে না। কিন্তু সেরকম কিছু দেখলে মনের মধ্যে খচখচ হতেই থাকে। নিজের এই বিব্রত বোধ কাউকে বললে একমাত্র রেখা ছাড়া সবাই বিস্তর জ্ঞান দেয়।

কাজের মেয়ে রেখা সুশীলাকে খুব তেলিয়ে চলে। রেখাই একমাত্র সুশীলাকে বোঝে, এরকমটাই সুশীলা মনে করে। তার জন্য মাঝে মাঝে দুশো চারশো টাকা রেখাকে ধারও দেয়। সেগুলো পরে ধার থেকে দান-এ পরিবর্তিত হয়ে যায়। টাকা ফেরত কখনওই বেচারি রেখা দিতে পারে না। তবুও টাকা নেওয়ার সময় ধার বলেই সুশীলার থেকে নেয়।

একদিন সুশীলা যখন ওর মনের দুঃখের কথা রেখাকে বলে, রেখা ওকে আশ্বস্ত করে, বলে ও এক গুনিনকে জানে যার অব্যর্থ ঝাড়ফুঁকে এসব নিমেষে ঠিক হয়ে যায়। সেইমতো বাড়ির লোককে লুকিয়ে সুশীলা রেখার সঙ্গে গুনিনের ডেরায় পৌঁছোয়। গুনিন গঙ্গার পাড়ে এক পোড়ো বাড়িতে ভেড়া বানিয়েছে। বাড়ির ভিতর ঢুকেই সুশীলার গা ছমছম করতে থাকে। নিজেকেই নিজে দোষ দেয় এই ভেবে যে, এরকম জায়গায় কাজের লোকের কথায় এই ভাবে আসাটা ঠিক হয়নি।

সুশীলার অবস্থা দেখে রেখা ওকে অভয় দেয়। সুশীলাকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। গুনিন তখন এরকমই আরেক রোগীর রোগ সারাতে ব্যস্ত। সমানে একটা ময়ূরপঙ্খি ঝাড়ু দিয়ে সপাং সপাং করে পিঠে মারছে, আর চলছে উটপটাং মন্ত্র উচ্চারণ। মার খাওয়া রোগী ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে গোঙিয়ে চলেছে। সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর ভয়াবহ পরিবেশ।

সুশীলা এক ঝটকায় রেখার হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরে দৌড় লাগাল। থামল এসে গলি থেকে বেরিয়ে মেন রোডে। পিছনে পিছনে ‘এ ভাবি, এ ভাবি’ বলে চীৎকার করতে করতে রেখাও দৌড়োতে দৌড়োতে এসে পৌঁছেছে। একটা খালি অটো থামিয়ে তাতে চেপে বসল সুশীলা। রেখা তখনও পিছনে ডেকে চলেছে। অ্যাপার্টমেন্টের ভিতরে ঢুকে শান্তি পেল সুশীলা। এরপর রেখার চাকরিটা ওই বাড়িতে আর একদিনের জন্যও টেকেনি।

জোড়া শালিকে খুব আস্থা সুশীলার। জোড়া শালিক দেখলে দিন ওর খুব ভালো যায়। এক শালিক দেখলে নাকি খুব খারাপ যায়। নিদেনপক্ষে শাশুড়ির বকা তো খেতেই হয়। এর একটা নিদানও বের করেছে সে। যেদিন এক শালিক দেখে আর জোড়া শালিক দেখা হয় না, সেদিন কপালে তর্জনি দিয়ে ‘জ’ আঁকে। তাতে নাকি কিছুটা রেহাই হয়। তবে সকাল সকাল ভুল করে একটা শালিক দেখলে ছাদে গিয়ে দ্বিতীয়টার দর্শন না করে খান্ত হয় না সে।

ক্রমশ…

 

জোড়া শালিক (পর্ব-১)

আমাদের পাটনার আবাসনের ফ্ল্যাটগুলোর বেশ কিছু ব্যালকনির অবস্থান এরকম, একটা ব্যালকনিতে দাঁড়ালে অন্য ব্লকের ব্যালকনির ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়। এর সুফল অনেক, যেমন আমার স্ত্রী-কে এঘর ওঘর ঘুরে না পেলে আমি সোজা ব্যালকনিতে পৌঁছে যাই। দেখি সামনের ফ্ল্যাটের পল্লবীর মায়ের সঙ্গে গল্পে মশগুল। পল্লবীর বাবা চাকরিসূত্রে পাটনার বাইরে কর্মরত। সামনাসামনি ব্যালকনি হওয়ার কুফলও আছে! আজকের গল্প সেই কুফল কে নিয়ে।

আমার পাশের ফ্ল্যাটের গৃহিণী হলেন সুশীলা শর্মা। তিনি ভালোরকম খুঁতখুঁতে ও বাতিকগ্রস্ত ভদ্রমহিলা। বিড়াল রাস্তা কেটে বেরিয়ে গেলে, বরকে ধমকে বাইক থামিয়ে দেন। বেরনোর সময় হাঁচি পড়লে, তখনকার মতো যাত্রা বন্ধ। সৌন্দর্য নিয়ে প্রশংসা করলে বলেন – নজর মত লাগাইয়ে জি। রাস্তায় ভুলবশত স্বামীর বাইক কোনও বিষ্ঠার ওপর দিয়ে গেলে বাইক, স্বামী ও নিজেকে স্নান না করিয়ে ছাড়েন না।

একবার ব্যালকনিতে গিয়ে দেখেন পিঁপড়ের সারি রেলিং-এ শুকোতে দেওয়া বালিশের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, আর তারা আসছে পাশের একটা নির্দিষ্ট পাইপ বেয়ে। ব্যালকনির পাশেই বাথরুম, পাইপগুলো বাথরুম থেকেই বেরিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বালিশগুলো পত্রপাঠ বিদায়। ওনার এই অদ্ভুত আচরণে স্বামী সুনীল বেচারা বিরক্ত এবং পরিশ্রান্ত। কোনও ভাবে সুনীলকে কোনও পাইপের তলা দিয়ে আসতে দেখলে ধুন্দুমার লেগে যায় শর্মা পরিবারে। বেচারিকে বাড়িতে ঢুকে সোজা বাথরুমে স্নান করতে হয়। শাস্তির বহর এখানেই শেষ নয়, এর থেকেও বড়ো শাস্তি পেতে হয়।

শীতের দিনে মাঝ রাত্তিরে আদিম খেলার ইচ্ছা জাগলে, সম্ভোগের পর বেচারা সুনীলকে ৫ ডিগ্রি টেম্পেরেচারেও পুরোদস্তুর স্নান করতে হতো। এহেন অত্যাচারের ফলে প্রায় বারো মাসই পাশের ফ্ল্যাটে সুনীলের ‘হ্যাঁচ্চো” “হ্যাঁচ্চো’ লেগেই থাকত। সেই হাঁচিও আবার আমার জন্য বিশেষ বিশেষ সময়েতেই বরাদ্দ থাকত। আমি বাড়ির থেকে বেরোতে গেলে, ঘুম থেকে উঠে মাটিতে পা দেওয়ার আগে, ভাতের থালায় প্রথম গ্রাসটা মুখে দেওয়ার প্রাক্ মুহূর্তে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সুশীলার এই পাইপ নিয়ে শুচিবাই অনেকেই জেনে গেছেন। কেউ কেউ ভালোবেসে নাম দিয়েছেন পাইপওয়ালি ভৌজাই। এক অদ্ভুত যুক্তিতে বলির পাঁঠা হয়েছিল বাড়ির দ্বিতীয় বাথরুমের ওয়েস্টার্ন স্টাইলের কমোডটা। সেটিকে সমূলে উৎপাটিত করে সিমেন্ট বালি দিয়ে একটা স্মৃতি সৌধ করে রাখা হয়েছে। যুক্তিটা ছিল কমোড মানে ছোঁয়াছুঁয়িতে পুরো শরীর অশুচি। বাড়ির অন্য লোকরাও তিতিবিরক্ত হয়ে ওটাকে সাবেকি দেশি প্যানেতে বদলাননি। সুনীল তো বিরক্ত হয়ে যৌবনেই আলাদা বিছানায় শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিল।

ছেলে ঈশান মায়ের এই ব্যবহারে ভীষণ ক্ষিপ্ত। কোনও বন্ধুকে বাড়িতে আনে না। আসলেই প্রশ্ন— “ঈশানওয়া তোরা দোস্তলোগ নীচলকা পাইপ নহি না ছুল হ্যায়?’ কী অপমান! কী অপমান! আমরাও কোনও দরকারে দরজায় দাঁড়িয়েই কথা সেরে নিতাম, নিতান্তই নিরুপায় না হলে ঘরে ঢুকতাম না।

একবার হোলিতে ধুন্দুমার। ফ্ল্যাটের ছাদে বিকেলবেলায় সবাই সবাইকে আবির লাগাচ্ছে। আমরা সবাই সুশীলা ভাবিকে এড়িয়েই যাই। সেবার নতুন ভাড়াটে এসেছেন মনোজজি। সুশীলা ভাবি দেখতে মন্দ ছিলেন না। বেচারা মনোজজি একমুঠো আবির নিয়ে সুশীলা ভাবির গায়ে দিয়ে বললেন— ‘মেরি ইতনি সুন্দর ভাবিকো কোই ধ্যান হি নহি দে রহা হ্যায়।’

আবির লাগানোর পর সুশীলা ভাবির মনোজজির স্ত্রীকে সোজা সাপটা প্রশ্ন— ‘বহনজি, মনোজজি উধার ওয়ালা পাইপ নহি না ছুঁয়া।’ লেগে গেল ধুন্দুমার। ছোঁয়াছুঁয়ির রোগ সুশীলার কিছুতেই যায় না। রোজ বাড়িতে অশান্তি, ভাইয়েরা এসে বোঝায়, মা এসে বকা দিলেন— কোনও পরিবর্তন নেই। অগত্যা সবাই মিলে অনেক কষ্টে রাজি করাল মনোবৈজ্ঞানিক ডাক্তার দেখানোর, নিয়ে যাবে সুনীল। বউয়ের নির্যাতনে দিশাহারা সুনীল বেচারা সাদামাটা থাকে। বউ, সংসার এবং অফিস সামলাতে গিয়ে অনেক সময় দাড়ি কাটার সময় পায় না।

কর্তা-গিন্নি পৌঁছোলেন ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারের পসার ভালো, লাইনে অপেক্ষা করতে হল। পেশেন্টদের নম্বর দেওয়া হয়েছে। সময় আসলে নম্বর ধরে ডাকা হচ্ছে। ওদের নম্বর আসতেই ওরা ডাক্তারের ঘরে ঢুকতেই সুশীলাকে আটকে দিয়ে সুনীলের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল— ‘রুকিয়ে মেডাম, পেশেন্টকো পহলে জানে দিজিয়ে।’

ক্রমশ…

দুর্গা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

গিরিডি স্টেশন আসতেই শুভায়ুর মন থেকে দুর্গার কথা কর্পূরের মতোই উবে গেছিল। তার কারণ পাটনার মতো অজানা অচেনা জায়গায় গিয়ে কোথায় উঠবে, কোথায় থাকবে সেটাই ছিল তখন চিন্তার বিষয়। কথায় বলে জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। তা না হলে সেদিন ট্রেনের কামরায় গেরুয়াবসন পরা এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাদের দেখা হবে কেন? কেন সেই সন্ন্যাসী দুই বন্ধুর ভাবগতিক দেখে সন্দেহের বশে বলে উঠলেন, ‘তোমরা কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে?’

শোভন বলেছিল, ‘হ্যাঁ। আপনি ঠিকই ধরেছেন।’

—কিন্তু কেন? সন্ন্যাসী আবার তাকে প্রশ্ন করেছিলেন।

শোভনের মুখ থেকে সব শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের রাঁচিতে একটা আশ্রম আছে। সেখানে মিশনের সেবামূলক কাজ যদি করতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। ওখানে তোমাদের থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। আর যদি সেখানে ভালো না লাগে, তাহলে আমি তোমাদের আটকাব না।’

এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে কে? আশ্রমে তিনমাস অজ্ঞাতবাসে থাকার পর শোভনের আর মন টিকল না। কলকাতার ছাত্র রাজনীতির হাতছানি তাকে অস্থির করে তুলল। শুভায়ুরও বাড়িতে ফেরার জন্য মন টানছিল। শেষে দুই বন্ধু রাঁচির পাট তুলে চলে এল গ্রামের বাড়িতে।

শুভায়ু ফিরে এসে ভর্তি হল কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে, আর শোভন মেতে রইল রাজনীতির আখড়ায়। রাঁচি থেকে ফিরে আসার পর শুভায়ু দুর্গার সঙ্গে আর দেখা করেনি। কারণ শোভন যাকে ভালোবাসে, সেখানে ভাগ বসাতে তার মন ওঠেনি। তার কাছে তখন প্রেমের চেয়েও বড়ো ছিল শোভনের বন্ধুত্ব। যদিও দুর্গার সঙ্গে নিভৃতে একটু কথা বলার জন্য, তার গায়ের সুগন্ধটুকু পাওয়ার জন্য শুভায়ুর মনপ্রাণ উতলা হয়ে উঠত। কিন্তু শোভনের কথা ভেবে সে নিজেকে দুর্গার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। দুর্গা পথে ঘাটে যতবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, সে এড়িয়ে গেছে। একবার জয়নগরের চড়কের মেলায় হঠাৎ তার সঙ্গে দুর্গার দেখা হয়ে গিয়েছিল।

দুর্গা তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে কান্নার স্বরে বেজে উঠেছিল, ‘তুমি এ ভাবে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? আমি কী দোষ করেছি?”

শুভায়ু তার অশ্রুসজল চোখের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বলেছিল, “দোষ তুমি করোনি। তোমাকে ভালোবাসাটাই আমার অন্যায় হয়েছে।’

—কিন্তু কেন? দুর্গার অশ্রুভেজা চাপা স্বর শোনা গিয়েছিল।

দুর্গাকে সে আঘাত দিতে চায়নি। তবু সেদিন শুভায়ু তার ক্ষোভ উজাড় করে দিয়ে দুর্গার উদ্দেশে বলেছিল, “দু’-নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। শোভনকে তুমি ভালোবাসো, এ কথা জানলে আমি কিছুতেই তোমাকে মন দিতাম না!”

সে কথা শুনে দুর্গা অশ্রুসজল চোখে বলেছিল, ‘তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমি শোভনদাকে দাদার মতো সম্মান করি!” দুর্গা তখন হাত নেড়ে আরও কী যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু শুভায়ু তাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়িয়েছিল।

এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ার জন্য শুভায়ু বারড্রোন গ্রাম থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে শিয়ালদার একটি মেসবাড়িতে এসে উঠেছিল। লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকার জন্য দুর্গার কথা তার মনেই ছিল না। তার তখন একটাই চিন্তা, লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

একদিন রাতে মেসবাড়িতে বসে শুভায়ু এক মনে পার্ট টু পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে— হঠাৎ শোভন ঝড়ের গতিতে এসে বলল, ‘দুর্গার বিয়ে হয়ে গেছে জানিস?’

সে কথা শুনে শুভায়ু হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘সে কি কার সঙ্গে!’

—বাসুলডাঙা গ্রামের বাড়ুজ্যেবাড়ির ছোটো ছেলের সঙ্গে।

—কিন্তু আমি যে জানতাম দুর্গা তোকে ভালোবাসে।

—ভুল শুনেছিস, ও আমাকে দাদার মতো ভালোবাসে। আসলে দুর্গা তোকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত।

—তুই জানলি কী করে?

—বিয়ের পর ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। দুর্গা আমাকে সব কথা বলেছে। তুই যদি আমাকে একবার বলতিস তা হলে বউদিকে বলে তোর সঙ্গেই দুর্গার বিয়ে দিতাম।

আজ মাকে পুড়িয়ে আসার পর দাওয়ায় বসে দুর্গার দিকে তাকিয়ে শুভায়ুর মনে হল জীবনে একটা মস্ত বড়ো ভুল হয়ে গেছে। মাকে দাহ করে শ্মশান থেকে ফিরে শুভায়ুর মনে যে শোকের আগুনটা ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছিল, বহুদিন বাদে দুর্গাকে দেখার পর তা যেন ভালোবাসার আগুন হয়ে শতগুন বেড়ে গেল।

সমাপ্ত

 

দুর্গা (পর্ব-৩)

পর্ব – ৩

আজও বেশ মনে আছে দুর্গার লালকালিতে লেখা প্রথম প্রেমপত্রটি দলমঘাটা বাস রাস্তায় এসে লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে শুভায়ু প্রায় তিরিশবার পড়েছিল। ইচ্ছে করেছিল, তার সেই পবিত্র নিষ্পাপ ভালোবাসার কথা পৃথিবীর সবাইকে জানাতে। সে কারণে সে সন্ধেবেলা প্রেমপত্রটি দেখাতে শোভনের বাড়ি ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দুর্গার লেখা প্রেমপত্র শোভনকে সে দেখাতে পারেনি। একটা অপরাধবোধ তার মনকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

সে এক পা এগিয়ে আবার দু’পা পিছিয়ে এসেছিল। তার কারণ হল দুর্গা শোভনের দাদার শালি। শোভনের দৌলতেই শুভায়ু দুর্গাদের বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। শোভনকে চিঠিটা দেখালে যদি সে রাগ করে, যদি তাকে ঘেন্না করে, তা হলে তো শুভায়ুর সব আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই সে দিন শোভনকে চিঠিটার কথা বলতে পারেনি।

ইতিমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। দুর্গার সঙ্গে শুভায়ুর প্রেম যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, শুভায়ু ভালো ভাবেই পাস করেছে। কিন্তু শোভন কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে। শোভনের কম্পার্টমেন্টাল পাওয়ার কারণ হল লেখাপড়ায় তার যতটা না মন ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল ছাত্র রাজনীতিতে। রাজনীতি করতে গিয়েই তার লেখাপড়ার এই হাল হয়েছিল।

যাই হোক, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে শোভন যখন মনে প্রাণে ক্ষতবিক্ষত, তখনই সে ঠিক করল যে-দিকে দু’- চোখ যায় চলে যাবে। এ পোড়া মুখ নিয়ে বারড্রোন গ্রামে সে আর থাকতে রাজি নয়। একটা কিছু কাজ জোগাড় করে তবেই সে গ্রামে ফিরবে, নচেৎ নয়। শোভনের মনের কথা জানতে পেরে শুভায়ু তখন তাকে বলেছিল, ‘আমিও তোর সঙ্গে যাব।’

সে কথা শুনে শোভন বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘তুই ভালো ভাবে পাস করেছিস। তুই আমার সঙ্গে জাহান্নামের পথে কেন যাবি? তা ছাড়া তোকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। তোর এখানে থাকা দরকার।’

শুভায়ু বলেছিল, ‘তোকে জাহান্নামের পথে একা ঠেলে দিতে পারব না। তা ছাড়া তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমি তোর সঙ্গে যাবই।’

শুভায়ু জেদ ধরে থাকায় শোভন আর বারণ করতে পারেনি। তার পর একদিন কাউকে কিছু না বলে হাওড়া স্টেশনে এসে পাটনার টিকিট কেটে গয়া প্যাসেঞ্জারে দু’জনে উঠে বসল। ট্রেনটা যখন ধানবাদ স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তখন শুভায়ুর বাড়ির জন্য মন কেমন করে উঠেছিল।

শুভায়ু বলেছিল, ‘বাড়ির লোকেরা যদি তোর খোঁজ না পেয়ে পুলিশে খবর দেয়, তাহলে কী হবে?’

—যা হওয়ার তাই হবে। তবে আমি শুধু পাটনায় যাওয়ার খবর দুর্গাকে জানিয়ে এসেছি। বলে শোভন একটা সিগারেট ধরিয়েছিল।

শুভায়ু আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘ও কিছু বলেনি।’

—তখন সে কিছু বলেনি। তবে চলে আসার আগে দুর্গা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে। এই নে পড়ে দেখ। বলে শোভন ট্রাউজারের পকেট থেকে দুর্গার লেখা চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

শোভনের হাত থেকে চিঠিটা নিতে গিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর ক্যানেস্তারা পেটানোর মতো দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছিল। তার জন্য তখন হয়তো কোনও অশুভ সংকেত অপেক্ষা করছিল। দুর্গার হাতে লালকালিতে লেখা চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখা গেল তাতে লেখা রয়েছে- -দোহাই শোভনদা, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে না এলে বুঝব আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না।

—ইতি দুর্গা

চিঠিটা শোভনকে ফিরিয়ে দিয়ে শুভায়ু ট্রেনের জানলার ধারে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। অব্যক্ত যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল তার দেহ-মন। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল নারী কী বিষম বস্তু। নারী যেমন ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ মানুষকে রাজা বানাতে পারে, তেমনি আবার চূড়ান্ত ছলনা করে পথেও বসাতে পারে। দুর্গা শোভনকে ভালোবাসে বলে তার একটুও দুঃখ হয়নি। দুঃখ হয়েছে শোভনকে ভালোবাসার কথা দুর্গা কেন গোপন করল। নারী যে ছলনাময়ী, এ কথা দুর্গা সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

ক্রমশ…

 

দুর্গা (পর্ব- ২)

পর্ব – ২

আসলে শোভনের জন্যই শুভায়ুর, দুর্গার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তা না হলে তার জানাই হতো না জয়নগর গ্রামে এরকম একটি সুন্দরী রমণী রত্ন আছে। পাওয়া হতো না প্রেমের রূপ-রস-গন্ধ। তার বেশ মনে আছে, অভাবের জন্য যখন তাদের সংসার অচল হয়ে পড়েছিল, তখন শোভন জয়নগরে তার দাদার শ্বশুরবাড়িতে পাঁচশো টাকার একটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিল। সে সময় অভাবের সংসারে টিউশনি করে পাওয়া পাঁচশো টাকার মূল্য ছিল অনেক।

শুভায়ু যখন দুর্গার ছোটো ভাই রাজুকে পড়াতে যেত, তখন সে দেখত ছলছুতো করে দুর্গা পড়ার ঘরে হঠাৎ ঢুকে তার উপস্থিতি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিত। কখনও ছাত্র পড়ানোয় ব্যস্ত শুভায়ুর কানের কাছে আলতো স্বরে বেজে উঠত রঙিন কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আবার কখনও কোনও মুহূর্তে ভেসে আসত শাড়ির খসখস শব্দ। যদি কখনও পড়ার ঘরে স্নো পাউডারের গন্ধ ঘ্রাণে ভেসে আসত, শুভায়ু বুঝতে পারত দুর্গা এসে ঘরে ঢুকেছে। সে এক অপূর্ব অনুভূতি ঘিরে থাকত শুভায়ুকে সারাক্ষণ।

সে সময় শুভায়ুকে যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল। পড়াতে এসে যদি কোনও দিন দুর্গার উপস্থিতি টের না পেত, মনটা তখন ভীষণ খারাপ লাগত। অথচ তখনও তার ছাত্রের দিদির মুখটা দেখা হয়নি। সে যেমন মাথা নীচু করে শোভনের দাদার শ্বশুড়বাড়ি পড়াতে আসত, তেমনি পড়ানো শেষ হলে মাথা নীচু করেই চলে যেত। শুধু একদিন সে যখন তাকে চা দিতে এসেছিল, সেদিন শুভায়ু সাহস করে চশমার ফাঁক দিয়ে তার পদ্মফুলের মতো আলতা পরা ফরসা পা দু’খানা দেখেছিল। তাইতেই সে মজে গিয়েছিল। তারপর থেকে দুর্গার মুখটা দেখার জন্য সে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।

একদিন দুর্গা সে সুযোগ করে দিল। সে দিন কী কারণে যেন ঘরে ঢুকেছিল। ‘উরি বাবারে বলে হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠতেই শুভায়ু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “কী হয়েছে?”

—দেখুন না, আরশোলা। বলে দুর্গা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়েছিল।

শুভায়ু দেখল তার সামনে যেন কুমোরটুলির রাখাল পালের দুর্গা প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে দিন কি তিথি ছিল তা মনে নেই। শুধু মনে আছে দুর্গার পরনে ছিল জরিপাড় বসানো লাল ছাপা তাঁতের শাড়ি, কানের লতিতে ছিল সোনার রিং, গলায় ছিল কালো পুঁতি দিয়ে গড়া মঙ্গলসূত্র হার, আর নাকে ছিল ডালিমের দানার মতো লালপাথর সেট করা নাকছাবি। যতদূর মনে পড়ে, কপালের মাঝখানে কুমকুমের একটা ছোটো টিপও ছিল।

আজও মনে আছে, দুর্গার সেই অপরূপ মোহিনী রূপ দেখে শুভায়ু ফস করে বলে ফেলেছিল, ‘দুর্গা নামটা তোমার সার্থক!’

সে কথা শুনে দুর্গার মেক-আপ করা মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল। শুভায়ুর স্পষ্ট মনে আছে, দুর্গা তাকে জিভ ভেংচে ছুটে পালাতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল।

শুভায়ু পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে কোনও দ্বিধা না করে তার হাত ধরে তুলে বলেছিল, ‘খুব লেগেছে বুঝি?’ দুর্গার সুন্দর মুখটা তখন ঘামতেলের মতো চকচক করছিল। সে যখন মাথা নেড়ে তার ভ্রমরকালো চঞ্চল চোখের দৃষ্টি দিয়ে শুভায়ুকে মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন করে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল, তখন শুভায়ুর বুকে হাজার খুশির ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছোটোবেলা থেকে যত দুঃখ যন্ত্রণা তার মনে জমা হয়েছিল, তা যেন দুর্গার এক পলকের সম্মোহনী দৃষ্টিতে সেই মুহূর্তে গলে জল হয়ে গিয়েছিল।

তার পর পরম লগ্ন এল সেই দিন, যে-দিন পড়াতে গিয়ে দুর্গা তার প্রেমপত্রে কোনও ভনিতা না করেই জানিয়ে দিয়েছিল তার মনের গোপন কথা… ‘তোমাকে ভালোবাসি। এর চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে আর কিছু নেই। ভালোবাসা যদি কোনও পাপ না হয়, যদি অন্যায় না হয়, তাহলে অন্তত একটা চিঠি লিখে আমাকে জানিও। তোমার চরণে শত কোটি প্রণাম জানিয়ে চিঠি এখানেই শেষ করছি।’

— ইতি দুর্গা।

ক্রমশ…

দুর্গা (পর্ব – ১)

দুর্গার কথা মতো শুভায়ু নিমপাতা দাঁতে কেটে চিনি মুখে দিয়ে বারান্দার এককোণে গিয়ে কুশাসন পেতে বসল। শুভায়ু একটু আগে ভাবছিল শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরার পর শ্মশানযাত্রীদের মুখে কে একটু চিনি জল দেবে। কে তাদের যত্ন করে দাওয়ায় বসাবে। দিদিটাও যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তার কোনও চিন্তা ছিল না।

বাসুলডাঙ্গা গ্রামে দিদির যখন বিয়ে হয়, তখন সে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ছাত্র। বাবা বেশ ধুমধাম করেই দিদির বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কপাল পুড়ল। ছেলেপুলে না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে লাগল। শুধু তার খাওয়া বন্ধ নয়, বাঁজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ বলে শাশুড়ির অকথ্য গঞ্জনাও চলতে লাগল।

শ্বশুরবাড়ির অনাচার আর অবহেলা পেয়ে দিদি যখন মনের দুঃখে বাপের বাড়ি ফিরে এল, তখন শুভায়ু দেখল দিদি নয়, যেন তার কঙ্কালসার দেহটা ফিরে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বছর খানেক বেঁচেছিল। তারপর একদিন দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সব দুঃখ আঁচলে বেঁধে পরপারে পাড়ি দিয়েছিল।

শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির নিন্দেমন্দ করলেও বাসুলডাঙা গ্রামের লোকজন দিদিকে দেবীর আসনে বসিয়েছিল। তারা এখনও বলে সতীলক্ষ্মী এরকম মেয়ে আর হয় না। গ্রামের কারও বিপদ-আপদ হলে দিদি যেন তখন দশভুজা হয়ে তাদের সেবা করত। সাধে কি আর বাসুলডাঙা গ্রামের লোকেরা তাকে দেবী বলে। আজ মায়ের শব দাহ করে এসে শুভায়ুর দিদির কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে।

—এই চা-টুকু খেয়ে নাও। শরীরের ধকলটা একটু কমবে, বলে দুর্গা চায়ের প্লেটটা শুভায়ুর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে উঠোনে নেমে গেল।

দুর্গা যে কখন স্টোভ ধরিয়ে চা করেছে, কখন শ্মশানযাত্রীদের হাতে মিষ্টি তুলে দিয়েছে— শুভায়ু জানতেই পারেনি। জানতে পারল তখন, যখন সে দেখল শ্মশানবন্ধুরা একে একে যে-যার বাড়ি চলে গেছে। শুধু বারান্দার একধারে শোভন হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চায়ের কাপে সে চুমুক দেয়নি। তার বিষণ্ণ চোখের দৃষ্টি এখন উঠোনে উড়ে এসে বসা শালিখ পাখির দিকে, না কাপ-ডিশ ধোয়ায় ব্যস্ত দুর্গার পদতলে, বোঝা মুশকিল।

একটু পর দুর্গা হাতের কাজ সেরে এসে বলল, ‘কী হল শোভনদা চা যে জুড়িয়ে গেল।’

শোভন তাড়াতাড়ি এক চুমুকে চা-টুকু খেয়ে দুর্গার উদ্দেশে বলল, “তুমি শুভায়ুর জন্য হবিষ্যির ব্যবস্থা করো। আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি।’

দুর্গা বলল, “দিদিকে বোলো সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। আমি একটু পরেই যাচ্ছি।

—আসি রে, বলে শোভন, শুভায়ুর উদ্দেশে হাত নেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

—চা-টা খেয়ে নাও। চা খেলে মাসিমার আত্মা মোটেও কষ্ট পাবে না। বলে দরজার কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল দুর্গা। শুভায়ু চোখ তুলে দেখল, দুর্গার কথা বলার ধরন, তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, এমনকী কাজলকালো টানা চোখের দৃষ্টিটাও ঠিক সাত বছর আগেকার মতো। যা কিছু পরিবর্তন ওর হয়েছে, তা হল কপালের সিঁদুর আর তার পলা বাঁধানো শাঁখা – যাকে বলে এয়োস্ত্রীর চিহ্ন। শোকের দিনেও দুর্গার চিবুকের তিলটার দিকে তাকিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর পুষে রাখা পুরোনো ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। পৃথিবীর কোনও ওষুধেই এ ক্ষত সারবে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে ঠিক পেসমেকারের মতো।

—কী হল, চা খেলে না? দুর্গার সেই পিয়ানোর সুর বেজে ওঠা কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল। যে-কণ্ঠস্বর শুনলে এখনও একরাশ কান্না গুমরে গুমরে ওঠে শুভায়ুর পোড়খাওয়া বুকের মধ্যে। এর জন্য দায়ী তার বন্ধু শোভন।

ক্রমশ…

 

সমর্পিতা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

দিন দশেক ভালোই কাটল অন্বেষা আর শুভর। পুরীতে জগন্নাথ দর্শন, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, চিল্কা সঙ্গে সমুদ্রস্নান। চিন্তা, টেনশন থেকে একেবারে দূরে। পুরী থেকে ঘুরে আসার পরে ওদের একদিন নিমন্ত্রণ করলাম বাড়িতে। মা বিভিন্ন পদ রেঁধেছে ওদের জন্য। ওদের বিয়ের পর থেকে খেতেও বলা হয়নি একদিনও। তাই ওদের পছন্দমতো মাছ-মাংস নিয়ে এসেছিলাম। কেন জানি না, ওরা ভালো আছে দেখে আমার মনটাও ভীষণ ভালো হয়ে গেছে। হয়তো আমি একটা অপরাধবোধে ভুগছিলাম। হাজার হোক আমার হাত ধরেই তো ওদের আলাপ। কথা ছিল অন্বেষা আগে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে, আর শুভ অফিস ফেরত।

সেইমতো অন্বেষা আসার মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল শুভ। তখন মা আমি আর অন্বেষা জমিয়ে গল্প করছি। শুভ আসতেই মা ওর জন্য চা বানাতে চলে গেল। মা ভিতর ঘরে চলে যাওয়ার পরেই একগাল হেসে বলল, ‘শোন শোন দারুণ খবর আছে। আজ অফিসে রেজিগনেশন জমা দিলাম!’

আঁৎকে ওঠে অন্বেষা, কী বলছ কী? পাগল-টাগল হলে নাকি। এটাকে তুমি দারুণ খবর বলছ?’

‘আরে আগে পুরো কথাটা তো শোনো,’ বলে শুভ।

আমিও বলে উঠলাম, ‘শুনবে আবার কী? কী শুনবে? আজকের বার্তা-র মতো হাউস তুই ছেড়ে দিলি! পাবি আর এরকম চাকরি?’

‘পাব আবার কী, পেয়ে বসে আছি বুঝেছিস।’ জোর গলায় বলে উঠল শুভজিৎ।

অন্বেষা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুভর দিকে। বলে, ‘মানে?’

‘মানে একটা নতুন ডেইলি থেকে দারুণ অফার পেয়েছি। আজকের বার্তায় যা পাচ্ছি তার ডাবল দিতে রাজি হয়েছেন পত্রিকার মালিক। তবে কাজের সূত্রে মাঝেমাঝে বাইরে যেতে হতে পারে। আর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট-ই মুম্বইয়ের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। প্রায় মাস খানেকের ধাক্কা।

‘মাস খানেক!’ অজানা আশঙ্কায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে অন্বেষার কপালে। বিস্মিত হয়ে আমিও বলে বসলাম, ‘এতদিন? অন্বেষার কী হবে?’

হাসতে হাসতে শুভ জবাব দেয়, ‘আরে কটা তো দিন, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। না হয় কিছুদিন বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে আসবে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কভার করার সুযোগ তো সবসময় আসে না, তাই হাতছাড়া করতে চাইছি না।’

মুম্বই যাওয়ার পর প্রায় সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। এর মধ্যে হাতেগুনে চার-পাঁচবারই কথা হয়েছে ওদের। ফোন করলেই কাজের চাপ আর ব্যস্ততা, নানান কারণ দেখিয়ে ফোন কেটে দেয় শুভ। এই ভাবেই কেটে যায় বাকি কটা দিন। কাজ সেরে ফিরে আসে শুভজিৎ।

একদিন অফিস যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখা শুভজিতের সঙ্গে। উদভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করছে। গালভরা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল। চাউনিটাও যেন কেমন ছন্নছাড়া। জিজ্ঞাসা করলাম, “কীরে, ফিরে তো কোনও খবরই দিলি না। কাটল কেমন, আজ অফিস নেই?’

উত্তর না দিয়েই হাঁটা দিল শুভজিৎ। পরে জানলাম, চাকরিটা আর নেই। মদ তো ছিলই, মুম্বইতে এ-কদিন থেকেই জুয়ার নেশাটাও চেপে বসেছে। প্রচুর ধারদেনা করে ফেলেছে। অফিসের দেওয়া লাখ-খানেক টাকার ক্যামেরা বিক্রি করে সেই দেনা মেটায়। যার কারণে চাকরিটাও খুইয়ে বসেছে। সম্পাদক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ক্যামেরার দাম না মেটালে থানায় অভিযোগ করবেন। এমনকী অন্য সংবাদপত্রে যাতে শুভজিৎ কাজ না পায়, সে বন্দোবস্তও করবেন তিনি।

সঞ্চয় বলে কিছুই ছিল না শুভজিতের। বরাবরই দেখনদারির ব্যাপার ছির ওর মধ্যে। হাই-প্রোফাইল স্ট্যাটাস মেনটেন করতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই বেশি হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত অন্বেষা নিজের গয়না বিক্রি করে ও বন্ধুদের থেকে ধার করে শুভজিৎকে বাঁচায়। অথচ এ নিয়ে প্রচুর কটাক্ষ শুনতে হয়েছে অন্বেষাকে। টাকা কোথা থেকে এল, সে নিয়েও নোংরা ইঙ্গিত করেছে শুভজিৎ বহুবার।

অন্বেষার হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও বদলায়নি শুভজিৎ। কোনও কাজকর্ম করত না। সারাদিন মদের ঠেক আর জুয়ার আড্ডাতেই কাটাত। পয়সার টান পড়লেই মারমুখী হয়ে উঠত। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় গুমরে মরত অন্বেষা। হাসিখুশি মেয়েটাকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে খারাপ লাগত। ক্যানটিনে খেতে খেতে একদিন ওই-ই বলল, ‘ভানুদা আর পারছি না। এরচেয়ে মৃত্যুই ভালো। মারধর তো রয়েইছে, এখন কথায় কথায় চরিত্র নিয়েও টানাটানি করে। একজন মেয়ের কাছে স্বামীই সব। সে-ই যদি চরিত্র নিয়ে বাজে ইঙ্গিত করে, অপমান করে, এইভাবে বাঁচা যায় না!’

সান্ত্বনার ভাষা আমার জানা ছিল না। শুধু বললাম, ‘মনকে শক্ত কর। শুভকে বরং কোনও রি-হ্যাব সেন্টারে নিয়ে যা। কিছুদিন থাকুক, দ্যাখ না কী হয়। এখন তো অনেকেই ওভাবে নেশার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে।’

একপ্রকার জোর করেই আমরা রি-হ্যাব সেন্টারে ভর্তি করলাম শুভজিৎকে। মাস চারেক থাকার পর অনেকটা সুস্থ হতে বাড়ি আনা হল। দিন দশেক বিশ্রাম নিয়ে স্টুডিয়োর বিজনেস আবার শুরু করল। টুকটাক কাজও পাচ্ছিল। তারপর পূর্ব পরিচিত এক বন্ধুর হাত ধরে মেগাস্টার সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়ের ফোটোগ্রাফির অর্ডার। হারানো রাজ্যপাট ফিরে পেয়ে আবার আগের মেজাজ ফিরে এসেছে শুভজিতের।

এর মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্ট। বেশ কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি। প্রাণে বাঁচলেও চিরকালের মতো হারাতে হল দুটো হাতই। চালকের পাশেই বসেছিল শুভ। পিছন থেকে লরি ধাক্কা মারতেই কীভাবে যেন শুভর হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইলে ঢুকে যায়। তারপর দু-তিন বার পাল্টি খেয়েছে গাড়িটা। হাতের একটা হাড়ও আর আস্ত ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাত দুটো কেটে বাদ দেয় ডাক্তাররা।

কষ্ট পেতে পেতে মেয়েটা বোধহয় পাথর হয়ে গেছে। আজ আর কিছুই ওর মনকে ছোঁয় না। এই ঘটনা ওকে আরও শক্ত করেছে। খুব ইচ্ছে হল বলি, অন্বেষা তুই ডিভোর্স নিয়ে নতুন করে জীবনটা শুরু কর। কিন্তু ওর হাতদুটো ধরে কিছু বলার আগেই ও-ই বলে, “চিন্তা কোরো না ভানুদা। আজ থেকে তোমার বন্ধুর সব দায়িত্ব আমার। আমার বাকি জীবনটা তোমার বন্ধুকেই সমর্পণ করলাম।’

অজান্তে কখন যে দু-চোখ দিয়ে জল নেমে এসেছে বুঝতেই পারিনি।

 

সমর্পিতা (পর্ব-২)

পর্ব-২

এরপর দুজনের মেলামেশা, ঘোরাফেরা। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত। অন্বেষার বাবার, এই বিয়েতে একদমই মত ছিল না। দুজনের পীড়াপীড়িতে যখন মেশোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম ওনার বাড়িতে, উনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ‘দ্যাখো ভানু, তোমার বন্ধুকে তোমার ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার মতো অতটাও ম্যাচিওর হয়নি অনু। তাছাড়া খবর নিয়ে দেখলাম, তোমার বন্ধুটির তো নিয়মিতই বার-এ বসার অভ্যেস। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তো আর মেয়েটাকে জলে ফেলে দিতে পারি না।’

প্রত্যুত্তরে বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘দেখুন দু-এক পেগ মদ্যপান করলে কেউ খারাপ হয়ে যায় না। আজকাল কাজের ক্ষেত্রে এসব একটু-আধটু খেতেই হয়। তাছাড়া ওরা দুজন-দুজনকে জানে ও ভালোবাসে। আপনি মত দিলেও ওরা বিয়ে করবে, না দিলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ…। কাজেই এবার আপনি বুঝুন কী করবেন। মেয়ে আপনার কাছে চিরদিন ছোটোই থাকবে, আফটার অল আইনের চোখে ওরা তো অ্যাডাল্ট এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে নিজেরা ডিসিশন নেওয়ার অধিকারী।’

অগত্যা… অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ের ভালোবাসার কাছে হার মানতেই হল। সম্মতিক্রমে বিয়েটাও হয়ে গেল।

বিয়ের কয়েকদিন পরেই শুভজিতের আসল চেহারাটা ধরা পড়ে অন্বেষার কাছে। একদিন নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছি, অন্বেষা ঢুকল। কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে কখন এলি? বাঁদরটা কোথায়?’

“তার কথা আর বোলো না। যা কাণ্ডটা বাধাল কাল। শুধু মামা অসুস্থ, না এলেই নয় তাই বাধ্য…।’

রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন রে কী হয়েছে?’

‘কাল রাত ১টা নাগাদ খবরের কাগজের সম্পাদক বিকাশবাবুর ফোন। জানাল রিজিওনাল বিজনেস পার্ক উদ্‌ঘাটন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তোলার জন্য পাঠিয়েছিল শুভকে। কিন্তু রাত ১টা নাগাদও অফিসে কোনও ছবি পাঠায়নি শুভ। তাঁর হাউসের তো একটা রেপুটেশন আছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ খবর যদি ছাপা না হয়, তো কম্পিটিশনের বাজারে তাঁর টিকে থাকাই দায় হবে।’

উত্তরে শুধু তখন ওর বাড়িতে না ফেরার কথাটা বলতে পেরেছিলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে কাগজের রেপুটেশন-এর প্রশ্ন, সেখানে শুভর চাকরি নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি হতে পারে। চিন্তায় সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’

‘তারপর। তারপর কী হল?’ বলে উঠলাম।

‘ফোনের পর ফোন করে গেছি ভানুদা। সমানে নট রিচেবল আসছিল।। ভাবছিলাম অন্য কিছু।’

বললাম, ‘আমাকে ফোন করলি না কেন?’

‘তোমাকে ফোন করার জন্যই ফোনটা সবে হাতে নিয়েছি, ঠিক তখনই ডোরবেলটা বেজে উঠল। রাত তখন আড়াইটে হবে। বাবু ফিরলেন। বেহেড অবস্থা।’

অফিসে ছবি না পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে বলল, অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেখানেই ক্যামেরা পড়ে গিয়ে সিস্টেমে গণ্ডগোল। আসল সত্যিটা হল, ও অনুষ্ঠানে যায়ইনি। ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সারারাত নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল কোথাও।’ বলার পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ কানে এল। চোখদুটোও ছলছল করছে অন্বেষার ।

পরের প্রশ্নটা কী হতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম আমি। যা ভাবা ঠিক তাই, খানিক থামার পর প্রশ্ন করল, ‘ও কি আগাগোড়াই এমনই ছিল ভানুদা?’

বোবার মতো চেয়ে থাকলাম ওর দিকে। কে যেন বাকরুদ্ধ করে রেখেছে আমাকে।

এমন নয় যে, এই প্রথমবার শুনলাম শুভ নেশার জন্য কোনও কাজ করেনি। একবার আমার এক বন্ধুর বাবার বার্ষিকীর কাজে ছবি দরকার। সেইজন্য দায়িত্ব নিয়ে ছয় বাই ছয় সাইজের ল্যামিনেটেড ছবি বানাতে দিয়েছিলাম শুভকে। কথা ছিল পরের দিনই ডেলিভারি দেবে।

রাত্তিরে যখন ওর বাড়িতে গেলাম, দরজায় তখন তালা ঝোলানো। দু-দিন পরে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, রীতিমতো রাগারাগি। ‘তুই যখন সময় মতো দিতেই পারবি না, পরিষ্কার বলে দিতিস। তোর জন্য কতটা লজ্জিত হতে হল আমাকে।’

শুভ তখন কেমন সহজভাবে বলে ফেলল, “ইয়ার ছবির কথা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রেস ফোটোগ্রাফারদের একটা পার্টি ছিল। ওখানেই একটু বেশি চড়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আর কাজ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। বরং একটা সরি জানিয়ে দিস।’

কোনও সদুত্তর না পেয়ে অন্বেষা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল ভানুদা, কই কিছু বললে না তো!

‘অ্যাঁ, অ্যা কী যেন বলছিলিস?’

‘ওই-ই শুভর নেশা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ দ্যাখ, ওর যে আগেও দু-এক পেগ চলত এটা তো তুইও জানতিস। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে চলে গেছে, সেটা আমারও অজানা।’

‘বাবা জানলে কী যে হবে কে জানে!’

ওর টেনশন দেখে বললাম, ‘দ্যাখ অন্বেষা এখন ওসব ছাড়। আমার মনে হয়, যা হয়েছে ভুলে যা। তুইও ওকে একটু সময় দে। কদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুজন মিলে কোথাও ঘুরে আয়। ওকে বোঝা। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

ক্রমশ…

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব