পাথর-প্রতিমা (পর্ব – ১)

হঠাৎ নাকে একটা অদ্ভুত সবুজ গন্ধ এসে লাগল। যদ্দুর মনে হয়, পাহাড়ের গায়ের ভিজে শ্যাওলার গন্ধ। মুখের ওপর ভারি টর্চের আলো। চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। আলোর পিছনে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আলো আর আমার চোখের মাঝখানে একটা কুয়াশার টুকরো ঝুলে আছে। হঠাৎ দপ করে আলোটা নিভে গেল। আলকাতরার মতো একটা অন্ধকার কে যেন ঢেলে দিল আমার চোখে। তারপরই একটা হিমশীতল ধাতুর স্পর্শ লাগল আমার পিঠে। পরক্ষণেই গুরুগম্ভীর একটা প্রশ্ন কালো রাত ফুঁড়ে আমার দিকে ধেয়ে এল, ‘আপনি কে? কোত্থেকে আসছেন?”

আমার গলা তখন ভয়ে আর মহুয়ার নেশায় পুরো জড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগটাই হাতের ইশারায় আর বাকিটা অস্ফুট শব্দে বলে উঠলাম, ‘বাড়ি রাজগাঙপুর। জঙ্গলে পথ হারিয়ে গেছি।’ আমার দুটো হাত দু’জনে ধরল। তারপর মাটিতে হেঁচড়েই ওরা পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠতে লাগল। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।

এবার আমার কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। আমার বেড়ে ওঠা উড়িষ্যার রাজগাঙপুরে। রাউরকেল্লা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। চারপাশে পাহাড়ের পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল আমাদের এলাকা। পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা শালের জঙ্গল, আবার কোথাও রুক্ষ। তবে সেই শুষ্ক পাথরের বুক ফেটেই নেমে এসেছে একটা রুপোলি ফিতের মতো নদী। নামটি ভারি মিষ্টি, কোয়েল। সেই নদীর গা ঘেঁষেই আমাদের কোয়ার্টার। মাঝেমধ্যে চাঁদের আলোয় দেখতাম সেই পাহাড়ের গা বেয়ে ভাল্লুক নেমে আসতে।

খুব গরমের সময় ভুট্টা খেতে পাহাড়ি জঙ্গল থেকে হাতির পালও নেমে আসতে দেখেছি। ভুট্টা খেয়ে নদীতে দাপিয়ে চান করত তারা। তবে ওই অরণ্যে চিতাবাঘ আছে শুনলেও কোনও দিন দেখিনি। কিন্তু আছে এটা বিশ্বাস করতাম, কারণ মাঝেমধ্যে দু’একটা গরু ছাগল উধাও হয়ে যেত। তবে এখন সবচেয়ে ভয় মানুষের। কেন? সে কথায় একটু পরে আসছি।

গ্রামে মূলত দু’ধরনের মানুষের বাস। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হল আদিবাসী সম্প্রদায়ের। অনেকেই অভাবের তাড়নায় খ্রিস্টান। ব্রিটিশ সাহেবরা খাবার আর পোশাকের লোভ দেখিয়ে এদের খ্রিস্টান করেছিল। আর কিছু আশেপাশের কারখানায় কর্মজীবী শহুরে মানুষ। যেমন আমরা। আমার বাবা কাজ করতেন কাছেই উড়িষ্যা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। আমি পড়তাম ওখানকার ‘রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়’ স্কুলে। গ্রামের আদিবাসীরাও ওই স্কুলেই পড়ে।

বাবার কারখানার পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার। তার পাশেই বিরাট হাতিশালা। হাতিশালায় দশ বারোটা হাতি ছিল। গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরেই ডলোমাইট খনি। কারখানায় লাইমস্টোন আসত মালগাড়িতে। ইঞ্জিন মালগাড়ি রেখে দিয়ে চলে যেত। হাতি সেসব কামরা ঠেলে আনত। আমরা ছোটোবেলায় খুব মজা করে সেই সব দৃশ্য দেখতাম।

সবার ঘরেই হাঁস মুরগি ছিল। বিকেলে মাঠ থেকে খেলে ফিরে, বাড়ির হাঁস মুরগি চই চই করে ঘরে ঢোকানোর দায়িত্ব ছিল আমার। বিনিময়ে আমি ডিমের বেশি ভাগ পেতাম। সকালবেলা দুধ আনতে গেলে ঝগড়ু ভালোবেসে খেতে দিত পূর্ণ গর্ভবতী গরু মোষের সাঁজো দুধ। ধোঁয়া ওঠা গাঢ় হলুদ রঙের দুধ। ওটা বেচার নয়। এসব খেয়ে আদিবাসীদের মতোই বেশ তাগড়াই হয়েছিল চেহারাটা। তবে গায়ের রংটা শুধু ফরসা ছিল, এই যা! পাহাড়ি গ্রামের ছবি আঁকার ফাঁকে একটু স্কুলবেলার কথা বলে নিই।

আমার সাথে স্কুলে পড়ত যেমন আমাদের কোয়ার্টার-এর চাকুরিজীবীদের ছেলেরা, তেমনি আসত অ্যালেক্স ওঁরাও, জুয়েল মূর্খ, বিরজু মুণ্ডা, শিবু হেমব্রম, এইসব আদিবাসী ছেলেরা। ওদের গ্রাম ছিল পাহাড়ের কোলে মহুয়া গাছ দিয়ে ঘেরা। শীতকালে আদিবাসীরা এই মহুয়া জ্বাল দিয়ে ‘মাহুল’ বানাত। মহুয়ার গন্ধে সারা এলাকা ম-ম করত। সেই গন্ধে অনেক সময়েই পাহাড় থেকে ভাল্লুক নেমে আসত। তারপর দু’হাত দিয়ে মানুষের মতো মহুয়ার হাঁড়ি তুলে ‘মাহুল’ খেত। খাওয়ার পর সে কী হাঁটা! টলতে টলতে মাতাল পায়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যেত।

এছাড়াও ওরা ভাত পচিয়ে হাঁড়িয়া বানাত। নেশা বেশি হওয়ার জন্য তাতে ‘বাখর’ বলে একরকম গাছের ফল মিশিয়ে দিত। তবে হাঁড়িয়া ফুটিয়ে ঠান্ডা হওয়ার সময়, হাঁড়ির গায়ে যে-বাষ্প জমা হতো, তার নাম ‘রাশি’। এর নেশা মারাত্মক। আদিবাসীরা খেত। আমি কোনও দিন খাইনি। পাকা নেশাড়ু ছাড়া অন্য কেউ সহ্য করতে পারবে না। বুধিয়া বারলা বলে আমার এক বন্ধু ছিল। পাখি মারায় ওস্তাদ। গুলতি দিয়ে কত নানা জাতের পাখি মেরে যে, তার মাংস আমায় খাইয়েছে, এখন ভাবলে প্রায়শ্চিত্ত করতে ইচ্ছে হয়।

আর একটা সাংঘাতিক কথা না বললে গল্প সম্পূর্ণ হবে না। ওরা ঠিক সন্ধে হওয়ার আগে ঘুড়ির সুতোয় বঁড়শি দিয়ে বাদুড় ধরত। বাদুড়ের ডানার চামড়ায় বঁড়শি গেঁথে যেত। তাই বলে আমি কোনও দিন বাদুড়ের মাংস খেয়ে দেখিনি। তবে বাদুড়ের হাড় ফোটানো তেল বাড়ি নিয়ে আসতাম। ব্যথায় বেশ কাজ দেয়। এই সবের ফাঁকেই কখন স্কুল পেরিয়ে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না। এবার একটু অন্য কথায় যাব।

আমরা যখন মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলতাম, তখন দূরে কবাডি খেলত মুনিয়া, নাচনী, বিজলি। এরা সব আদিবাসী গ্রামেরই মেয়ে। এই বিজলি আবার বিরজুর বোন। ওদের বাবা বীরসা মুণ্ডা হল আদিবাসীদের সর্দার। বিজলির শরীর ছিল কালো পাথরের মতো। যত বড়ো হতে লাগল, মনে হল যেন কোনও ভাস্কর ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ওকে কেটে কেটে নির্মাণ করছে। কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো। গোধূলির আবির মাখা আকাশে যখন সূর্যটা কপালের লাল টিপের মতো হয়ে যেত, পাহাড়ের কালো ছায়া এগিয়ে আসত ওদের গ্রামে। কিন্তু ভুট্টা খেতটা তখনও সোনালি বাগিচা। ঠিক যেন কানে মাকড়ি, নাকে নোলক আর হলুদ ফ্রক পরা বিজলি।

আমি এখনও যেন বিজলিকে দেখতে পাই বউবাজারের সোনার দোকানে। কাচের শো-কেসের ভেতর। কালো পাথরের গয়না পরা আবক্ষ মূর্তি, ঠিক যেন বিজলি! এখনও মনে হয় সেই দোলের দিনের আবির মাখানোর আবদার কাচ ভেঙে পূরণ করে দিই। সে এক আমার জীবনের উথালপাথাল ঘটনা। আজও মনে পড়ে সেই দোলের দিনের কথা। মানে ওরা যাকে বলত ‘ফাগুয়া’।

ক্রমশ…

 

মণিদা আমি এলাম (পর্ব ১)

মণি ঘোষাল। ইন্টেলেকচুয়াল। ছুঁচলো তার দাড়ি, অনেকটা আব্দুল মাঝির মতন। চোখে রিমলেস। ষাটোর্দ্ধ। টানটান আপাদমস্তক। ঠোঁট সতত একটা আলগা হাসির ক্লান্তিতে ঝুলন্ত। লম্বা চুলের মাথা সাহিত্যে খচাখচ। পায়ে কোলাপুরি। কাঁধে পত্রিকা ঠাঁসা শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ। নীল জিনস-এর সাথে সাদা পাঞ্জাবি। সেই কোন বছর চল্লিশ আগে পথ চলা শুরু।

মণি তখন বছর কুড়ির উঠতি কবি সাহিত্যিক। দু’চারজন ঘনিষ্ঠকে সাথে নিয়ে প্রকাশ করল— ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। তখন তো তার বিশ্বজয়ের আনন্দ। দু’টো ছোটোগল্প আর খান চল্লিশেক কবিতার প্রশ্রয়কে সঙ্গী করে তার সদর্প আবির্ভাব আসানসোলের সাহিত্যজগৎকে আলোকময় করে তুলল।

তারপর তো দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দশক কেটে গেছে। মণি ঘোষালের সোসিও—ইকনমিক ফান্ডাও নাকি বাড়তে বাড়তে এখন দারুণ শক্তিশালী! কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেছিল পত্রিকা প্রকাশের সাথে সাথে বই প্রকাশনাটাও একান্ত জরুরি। পত্রিকা কুনকি হাতির কাজ করবে— যাতে করে বই প্রকাশনাটাও নিয়মিত থাকে৷ এইভাবেই মণি মূলত অর্থকরী দিকটা সামাল দেয়।

পত্রিকা নতুন নতুন কাব্য প্রতিভার সন্ধানের একটা ইন্সট্রুমেন্ট আর তারপর কিছু সময় অপেক্ষা এবং একদিন ঝপাং করে বই প্রকাশনার যাঁতাকলে পড়ে ছটপটাবে বেচারা কবি সাহিত্যিক কমপক্ষে হাজার পনেরোর ধাক্কায়! আর পায় কে? মণি তার মলাট উন্মোচনের জন্য পকেট কাটবে, তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পকেট কাটবে। পুশসেলের সব পয়সাই যে মণির পকেটস্থ হবে সেটা বলাই বাহুল্য। নামডাকে মণি কিন্তু বেশ তুখোড় পরিচিতির নিরিখে। নিন্দুকেরা সময় সময় তার সম্পর্কে মন্দভালো কিছু না কিছু বলেই থাকে। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। সে নাকি আদ্যোপান্ত নিবেদিত সুমহান এক সাহিত্য প্রাণ। অক্ষরকর্মী শব্দকর্মী এরকম নানা বিশেষণেই নাকি তার ঝুলি বিভূষিত।

লোকে পিছনে তাকে ‘মাল ঘোষাল’ বললে কী হবে, সামনে তো গদগদ ভাব দেখিয়ে দাঁত কেলিয়ে হে হে… করতে থাকে! মণি এটাও জানে লোকে ঈর্ষা থেকেই এইসব অপপ্রচার করে থাকে। যাইহোক, নেগেটিভ হলেও প্রচার তো একটা বটেই। লাদেনের নাম কে না জানে— সে যে- জন্যই হোক! জানে কি না? একশোবার হাজারবার অস্বীকার করে সাধ্যি কার? মণি তার প্রবল অস্তিত্বটার গোড়ায় নিয়মিত জল সার দিতে ভুল করে না কখনও। মাসে দু’তিনটে গল্প আলোচনা কবিতা পাঠের আসর জমাবেই জমাবে। দশ পনেরো জন তো এমনি এমনিই জুটে যায়। অবশ্য তাদের অধিকাংশই একদা চাকুরিজীবী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সময় কাটাতে কবি সাহিত্যিক হতে গিয়ে মণির খপ্পরে।

কিংবা হয়তো একদা গৃহকর্মে নিপুণা এখন প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কবি কিংবা গল্পকার হয়ে ওঠার বাসনায় মণির ভেল্কিবাজি ধরতে না পেরে গল্পপাঠের আসরে দিস্তাখানেক কাগজ নিয়ে হাজির। মাঝবয়সিরা থাকে না এমন নয় তবে সংখ্যারলঘু পর্যায়ের। আর অবশ্যই অকর্মণ্য কিছু গ্র্যাজুয়েট, বাপের হোটেলে খেয়ে সাহিত্যের খোলনলচে পালটে তাকে উত্তর আধুনিকের পথ দেখানোর প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিছু দামড়া ছেলে। লিটল ম্যাগের মাহাত্ম্যে তার বিপ্লবী ইমেজ সম্পর্কে মাইক হাতে টানটান বক্তিমের জোরে হল ফাটানো হাততালি। ওরে বাপরে! শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শুধু নয়, সেই কাঁটা আবার ফুটেও যায়। সাথে মণির উস্কানির উত্তেজনা কামাল করে দেয় তাদের।

আঃ ভাবা যায়— ছোটোগল্পের কী দুর্দান্ত আলোচনাটাই না করলি রে অমরেশ। আর বোঝাতে গিয়ে তোর নিজের লেখা যে গল্পটা পড়ে শোনালি— তার জন্য কোনও তারিফই যথেষ্ট নয় রে! আয় আয় আমার বুকে আয়। একটা হামি দিইরে তোকে। আমার চাঁদের ছেলে আমার সোনার ছেলে। তারপরই গলাটা একপর্দা খাদে নামিয়ে বলে— বিমল করের মতো লেখকও তোর মতন এমন একটা লিখতে পারলে ধন্য হয়ে যেত রে। অমরেশ বিনয়ে মাটিতে মিশে যেতে বসেছে আর ভিতরে ভিতরে ফুলে ফেঁপে ঢোল— যে-কোনও সময় বিস্ফোরণের দিকে চলে যেতে পারে আপ খেতে খেতে। অমরেশ কিন্তু ফাটল না, যেহেতু আনকোরা নতুন নয়। তবে ফুলেফেঁপে থাকবেই এখন দিনকয়েক।

এবারের শারদসংখ্যায় তনু নাগরাজের গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করেছে মণি। তনু নাগরাজ বাড়িতে প্রায় সারাদিন একা। ছেলে বাইরে। বর একটা কোম্পানির ম্যানেজার। রান্নার লোক কাজের লোক বাগানের মালি ঠাকুর চাকর— কী নেই তার। নিজহাতে তাকে কুটোটি কেটে দু’টো করতে হয় না। বয়কাট চুল, তাও আবার আঁচড়ে দেওয়ার জন্য একটি মেয়ে আসে, তার পার্লারে যাওয়ার আগে ম্যামকে সাইজ করে দিয়ে যায়। তারপর সে তার লেডিস পার্লারের দোকান খোলে। আর সাহিত্যসভাতে গেলে তার তো আবার বিশেষ প্রস্তুতি থাকে, সেদিন সে মেয়ে তনু ম্যাডামকে একেবারে চিকনাই করে ছেড়ে দেয় ঘণ্টা দুয়েকের পরিচর্যায়।

মণির আদরের তনু কবিতাগুচ্ছ পাঠ করে শোনাল। মুগ্ধ হলঘর করতালি মুখরিত। মণি এবার তনুর একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভাবছে। পাঁচ ফর্মার করার প্ল্যান আছে। সত্তর বাহাত্তরটা কবিতা হলেই হবে। তা তনুর সংগ্রহে এখন ষাটটার মতন আছে। বলেছে সপ্তাহ দু’য়েক সময় পেলেই নাকি নামিয়ে ফেলবে। মণির আদেশ লেখা শেষ হলেই যেন তনু তাকে ফোন করে। কোনও কালক্ষেপ না, সাথে সাথেই ডিটিপি-র জন্য চলে যাবে যথাস্থানে।

মণি খরচখরচা বাবদ দু’টো ইনস্টলমেন্টে পঁচিশ পঁচিশ করে মোট পঞ্চাশ দিতে বলেছে। বাকিটা নাকি মণি বুঝে নেবে। নীচে কোথাও কোনও ফুটনোট নেই, কোনও শর্তাবলী নেই, এমনকী নেই কোনও হিডেন কস্ট-ও। ফার্স্ট অ্যান্ড ফাইনাল যাকে বলে। হাতি কা দাঁত মরদ কা বাত। এই হচ্ছে মণি ঘোষাল।

ক্রমশ…

বলিদান (শেষ পর্ব)

সার্থক আর অনন্যার সম্পর্কের কথা অফিসে কারওরই অজানা ছিল না এবং সকলেই চাইত ওরা দু’জনে বিয়ে করে নিক। ওদের দু’জনেরই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রমাণ করত দু’জনের মধ্যের ভালোবাসাটা কতটা গভীর।

—সার্থক, কবে বিয়ে করছ অনন্যাকে? অফিসের সহকর্মী আশিস অফিস ফাঁকা দেখে সার্থককে জিজ্ঞাসা করল। সার্থক আর আশিসের বন্ধুত্ব প্রায় নয়-দশ বছর গড়াতে চলল। অফিসেরই এক কলিগের মেয়ের বিয়েতে গেছে অফিসের বেশির ভাগ লোকজন। অফিস মোটামুটি ফাঁকা দেখেই আশিস প্রশ্নটা করেছিল।

অনন্যা বেরোবার সময় নিজের পার্সটা নিতে ভুলে গিয়েছিল, সেটাই নিতে অফিসে ফিরে এসেছিল। না চাইতেও আশিস আর সার্থকের কথোপকথন ওর কানে গেল। আশিসের মুখে নিজের নাম শুনে কৌতূহলবশত অনন্যা দাঁড়িয়ে গেল।

—অনন্যাকে আমি পছন্দ করি আশিস, ও খুব ভালো মেয়ে। কুশলও ওকে ভালোবাসে। কিন্তু অনন্যা এখন কুশলকে পছন্দ করলেও যখন ওর নিজের সন্তান হবে তখন কুশলকে ওর ভালো না-ও লাগতে পারে। আমি আমার ছেলের জন্য জীবনে কোনওরকম রিস্ক নিতে রাজি নই। আশিসের প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেয় সার্থক৷

এই কথা শোনার পর অনন্যার আর দাঁড়িয়ে কিছু শোনার ক্ষমতা ছিল না। পার্সটা নিয়ে অফিস থেকে ও বেরিয়ে গেল।

তিন-চারদিন অনন্যা অফিস এল না। মোবাইলও বন্ধ ছিল ওর। সার্থক কোনওরকম খবর না পেয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল। দুই বছরে এই প্রথমবার অনন্যার অনুপস্থিতি ওকে ভিতরে ভিতরে চিন্তায় পাগল করে তুলল। ও বুঝতে পারছিল না কী করে অনন্যাকে ছাড়া ওর জীবন চলবে? অফিসের প্রত্যেকে, সার্থকের এই মানসিক অস্থিরতা উপলব্ধি করতে পারছিল এবং বুঝতেও পারছিল ওর ব্যবহারে এই অসংলগ্নতার কারণ।

পাঁচদিন কেটে যাওয়ার পর সন্ধের দিকে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল সার্থকের বাড়ির সামনে। ট্যাক্সি থেকে নেমে অনন্যা সার্থকের দরজায় কলিংবেল বাজাল। দরজা খুলে অনন্যাকে সামনে দেখে সার্থক হতবাক হয়ে গেল।

অনন্যাকে খুব দুর্বল লাগছিল দেখতে। দেখে মনে হচ্ছিল কোনও শক্ত অসুখ থেকে সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তা চেপে রেখেই সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার অনন্যা, পাঁচদিন কোথায় ছিলে তুমি?’

ততক্ষণে কুশলও এসে দাঁড়িয়েছে অনন্যার কোল ঘেঁসে। ব্যাগের থেকে দুটো চকোলেট বার করে কুশলের হাতে দিল অনন্যা। সস্নেহে ওর নরম গালে হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিয়ে ওর চুলের মধ্যে ঠোঁট ঠেকাল অনন্যা।

প্রতিবারের মতোই ‘থ্যাংক ইউ’ বলে কুশল অনন্যার কোলে মুখ লুকাল।

—কী হল অনন্যা, বললে না তো তোমার কী হয়েছে। পাঁচদিন কোথায় ছিলে? অনন্যার উত্তরের অপেক্ষায় অধীর হয়ে উঠছিল সার্থক।

অনন্যা একটা গভীর নিশ্বাস নিল। হাতের ফাইলটা থেকে একটা কাগজ এগিয়ে দিল সার্থকের হাতে।

—এটা কী? সার্থক চোখ রাখল কাগজটিতে। বিস্ময়ে এবং হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল কাগজটির দিকে। অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরোল সার্থকের মুখ দিয়ে, ‘অনন্যা এটা তুমি কী করেছ?”

অনন্যাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সার্থক বলে উঠল, “তুমি নিজেকে এভাবে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করলে? কেন তুমি নিজের অপারেশন করালে?’ হাতের মেডিকেল সার্টিফিকেটটা নিয়ে সার্থক পাথরের মতো বসে রইল। এবার অনন্যা মুখ খুলল।

—সার্থক তুমি আমাকে বিয়ে করতে এই জন্যই রাজি ছিলে না বা ভয় পাচ্ছিলে যে, আমাদের সন্তান হলে আমি কুশলকে আর ভালোবাসব না। ওর খেয়াল রাখা বন্ধ করে দেব। এই ভাবনাই তোমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি চেয়েছি যে, কুশলই আমার একমাত্র সন্তান হয়ে থাকুক। তাই ভবিষ্যতে যাতে কোনওদিন নিজে মা হতে না পারি সেজন্য সকলের আশঙ্কাই শেষ করে দিতে আমি নিজের অপারেশন করালাম। সার্থক আমি তোমাকে কোনওভাবে হারাতে চাই না। অনন্যার কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

—অনন্যা, আমাদের সকলের জন্য তুমি এই নিয়ে তিন তিনবার চরম স্যাক্রিফাইস করলে। তোমার হৃদয়ের এই বিশালতার কাছে আমার কিছু বলা অতি তুচ্ছ! আমি তোমাকে দেখে কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি, বলে সার্থক অনন্যাকে নিজের বুকে টেনে নিল। অনন্যা অবাক হয়ে দেখল সার্থকের দু’গাল বেয়ে নামছে অশ্রুধারা!

বলিদান (পর্ব ২)

অনেকদিন পর অনন্যা যখন সার্থকের এরকম আচরণের কারণটা জানতে পারল, ও মনে মনে খুব দুঃখিত বোধ করল। সার্থকের জন্য মনের কোণায় সহানুভূতি জন্ম নিল। দু’বছর আগে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগে সার্থক স্ত্রীকে হারিয়েছে। পাঁচ বছরের ওদের একটি সন্তান আছে। দ্বিতীয়বার সার্থক আর বিয়ে করেনি কারণ সৎমা সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা সার্থকের নেই। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েই সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকে সার্থক।

এতটা শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা থাকতেও সার্থক যে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎকে অগ্রাধিকার দেয়, এটা ভেবেও ভালো লাগল অনন্যার।

একদিন লাঞ্চ টাইমে অনন্যাকে ক্যান্টিনে বসে খেতে দেখে সার্থক মনের মধ্যে ওঠা একটা প্রশ্ন না করে পারল না, “আচ্ছা অনন্যা, নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পুণার মতো একেবারে অচেনা একটা শহরে বদলি নিলে কেন?”

—কারণ, ওটা শুধু চারটে দেয়ালযুক্ত একটা বাড়িই, আর হ্যাঁ মাথায় একটা ছাদ আছে এইপর্যন্ত! আনমনা হয়ে উত্তর দিল অনন্যা।

—মানে? সার্থক অনন্যার উত্তরের মানেটা ঠিক বোধগম্য করতে পারল না।

—বাড়িতে ভাই বোনেদের মধ্যে আমি সবথেকে বড়ো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর বাড়িতে রোজগার করার মতো কেউ ছিল না। ভাই বোনেরা পড়াশোনা করছিল। বাবার জায়গায় আমাকে কোম্পানি বহাল করে কারণ বাবার বস বাবাকে খুব শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসতেন। সংসারে অবশ্য আর্থিক অনটন কিছু ছিল না।

আমার মাইনেতে ভালো ভাবেই সংসারটা চলছিল। ভাই বোনের পড়াশুনোও বন্ধ হয়নি। কিন্তু বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। বিয়ে করে নিলে বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেত আর ভাই বোনের কেরিয়ারটাও নষ্ট হয়ে যেত। উলটে অন্য আর একটা বিপদের সম্মুখীন হতে হতো।

একবার একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছিল। পাত্রপক্ষকে খুব সাহস করে একটা শর্ত দিয়েছিলাম — বিয়ের পর আমার মাসমাইনের অর্ধেক আমি নিজের বাড়িতে দেব। ব্যস, ওদের আগ্রহ ওখানেই শেষ। এরপর আর ওই শর্ত কারও সামনে রাখার সাহস হয়নি। আমার কাছে আমার ভাই বোন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমিই ওদের আশা-ভরসা ছিলাম। নিজের জীবন নিয়ে আমি খুব খুশি ছিলাম। ওদের পড়াশোনা শেষ হলে, নিজেদের কেরিয়ারে ওরা প্রতিষ্ঠিত হলে যতটা সম্ভব ধূমধাম করে ওদের বিয়ে দিই। মা-ও বোধহয় ওটার জন্যই বেঁচে ছিলেন। এরপর মা-ও মারা যান।

ভাইয়ের বিয়ের পরেই সমস্যা শুরু হয়। ভাইয়ের বউয়ের আমার মোটা মাইনের অঙ্কটা খুব পছন্দ ছিল কিন্তু আমি ওই একই বাড়িতে থাকি ওটা ওর পছন্দ ছিল না। আমাকে নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গেও কথা কাটাকাটি করত। ফলে ভাই-ভাইয়ের বউয়ের মধ্যে যেমন দূরত্ব বাড়ছিল, আমার আর ভাইয়ের মধ্যেও একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল উঠতে আরম্ভ করল। বেশ বুঝতে পারছিলাম ওদের জীবনে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার সম্মানের সঙ্গে সরে আসাটাই সবার জন্য মঙ্গল। অফিসেও বদলির জন্য দরখাস্ত করি এবং কারণটাও ওদের খুলে বলি। প্রথম বদলি হয় হায়দরাবাদে। এখন কোন শহরে আমার বদলি হল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সব শহরই আমার কাছে সমান।

এখানে পুণাতে এসে আমি মানসিক শান্তিতে রয়েছি। তারপর তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে এখন তো আরও ভালো লাগছে। সার্থক, আমি যেন আবার সেই কলেজের দিনগুলোতে ফিরে গেছি।

—অনন্যা, তোমার আত্মত্যাগের কোনও তুলনা হয় না। নিজের পরিবারের ভালোর জন্য এভাবে নিজের সুখ স্যাক্রিফাইস করা খুব সহজ কাজ নয়। তাও প্রথমবার নয়। পরিবারের জন্য নিজে বিয়ে করলে না আবার দ্বিতীয়বার সকলের ভালো চেয়ে নিজের বাড়ি ছেড়েই চলে এলে, যেটা কিনা মেয়েদের কাছে সবথেকে প্রিয় জায়গা। বলতে বলতে সার্থকের গলা অবরুদ্ধ হয়ে এল।

সার্থক অনন্যার জন্য গর্ববোধ করল। ওর মনের মধ্যে অনন্যার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অনেকটাই বেড়ে গেল।

—তুমি কখনও কাউকে ভালোবেসেছ? ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল সার্থক।

—জানি না, আমার কাছে দায়িত্ববোধ-টাই এত প্রবল ছিল, ভালোবাসাটা কোনওদিন উপলব্ধিই করতে পারিনি। অনন্যার উত্তর শুনে সার্থকের মনে হল আজও অনন্যা সত্যিকারের ভালোবাসার অপেক্ষায় রয়েছে।

—এখন আর তো কোনও দায়িত্ব নেই, তাহলে কেন বিয়ে করছ না? আপন মনে করেই সার্থক অনন্যাকে প্রশ্নটা করল।

—সত্যি বলব, এক তো বয়স হয়ে গেছে আর দ্বিতীয়ত খোঁজার মতোও তো কাউকে দরকার। হতাশা ভরা ফ্যাকাশে হাসি হাসল অনন্যা!

—৩৪-৩৫ বছর এখনকার দিনে কোনও বয়স নয়।

—দেখি, আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। অনন্যা এই আলোচনা বন্ধ করতে চাইছিল।

—তুমিও তো আমার থেকে মাত্র দু’বছরের সিনিয়র ছিলে, তাহলে তুমিই বা বিয়ে করছ না কেন? অনন্যা পালটা প্রশ্ন করল।

—শুধু ছেলের জন্য। মায়ের ভালোবাসা থেকে ও বঞ্চিত হয়েছে বলে বাবা হয়ে আমি ওকে ভালোবাসা দেব না? বাড়িতে ওর সৎমা নিয়ে এলে সে কেমন মা হবে কে জানে? তার উপর তার নিজের সন্তান হলে, আমার ছেলের খেয়াল সে কি রাখবে? এই প্রশ্নগুলোই আমার মনে ভয়ের উদ্রেক করে, স্পষ্ট উত্তর সার্থকের।

—ছেলে যেদিন কলেজ যাবে তখন না হয় দ্বিতীয় বিয়েটা করা যাবে, বলে সার্থক হেসে ফেলল। দেখাদেখি অনন্যাও হেসে ফেলল।

দেখতে দেখতে অনন্যা দু’টো বছর পুণায় কাটিয়ে ফেলল। সার্থক আর ও এখন খুব ভালো বন্ধু। একসঙ্গে দু’জনে বাইরে ঘুরতে যায় এমনকী সার্থকের সাত বছরের ছেলে কুশলও বেশিরভাগ সময় ওদের সঙ্গে থাকে। অনন্যাকে কুশলও খুব পছন্দ করে। ওকে অ্যান্টি সম্বোধন করে কুশল।

ক্রমশঃ

বলিদান (পর্ব ১)

চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল অনন্যা। এতগুলো বছর পার করে ফেলল। কমদিন হল না ওর চাকরির। বাবার অবর্তমানে ছোটো ভাই বোনের দায়িত্ব ওর উপরেই এসে পড়েছিল, এক অজানা নিয়তির হাত ধরে। ভাই বোনকে উচ্চশিক্ষা দিতে গিয়ে নিজের দিকে আর তাকাবার সময় পায়নি ও। এই করেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। অথচ শান্তি জোটেনি ওর কপালে।

ভাইয়ের বউয়ের গঞ্জনায় মাথার উপরের ছাদটুকুও ওকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। অবিবাহিত ননদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা ভাইয়ের বউয়ের পছন্দ হয়নি। সেখানের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে দেখে অনন্যা নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। ভরসা তার চাকরিটুকুই। একটি বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো পদে সে কর্মরত।

দু’বছর হল হায়দরাবাদ থেকে পুণায় বদলি হয়েছে। পুণায় এসে জানতে পেরেছে তার কলেজের সিনিয়র সার্থকও এই একই কোম্পানিতে রয়েছে গত দশ বছর। কলেজে থাকতে কলেজের যে-কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্বে অনন্যা এবং সার্থক দু’জনেই থাকত আরও অনেকের সঙ্গে। এই ভাবেই বন্ধুত্ব দু’জনের। অবশ্য সম্পর্কটা বন্ধুত্বেই থেকে গিয়েছিল, গভীরতা পায়নি।

পুণায় এসে অফিস জয়েন করার প্রায় তিন-চারদিন পর লাঞ্চ টাইমে হঠাৎ সার্থককে দেখতে পেয়ে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল অনন্যা।

অনন্যা, “আরে সার্থক না? তুমি এখানে?”

—হ্যাঁ, আমি এই অফিসেই কাজ করি কিন্তু আপনাকে ঠিক…’, সার্থক আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকাল অনন্যার দিকে! কারণ এখানে “তুমি’ সম্বোধন করার মতো এমন আপনজন কে হতে পারে। অবশ্য সার্থককেও দোষ দেওয়া যায় না। অনন্যার সৌন্দর্য এতটুকু কমে না গেলেও ছিপছিপে চেহারা আগের থেকে ভারী হয়েছে। চুল ছেঁটে কাঁধ অবধি এসেছে।

অফিসের তিন-চারজন কর্মচারীও অবাক হয়ে ওদের লক্ষ্য করছিল। ওরা নিশ্চিত ছিল অনন্যাই কোনওরকম ভুল করছে।

—সার্থক, আমি অনন্যা। জয়পুরে আমরা একই কলেজে পড়তাম। অনন্যা একটু আশ্চর্য হল, সার্থক ওকে চিনতে পারেনি দেখে! ও একটু লজ্জিত হল কারণ আশেপাশে সকলেই ওর দিকে এমন করে তাকাচ্ছিল যে ওদের চাহনি বলছিল অনন্যাই মস্ত ভুল করে বসেছে।

—সরি অনন্যা, আমি সত্যি তোমাকে চিনতে পারিনি। কলেজ ছেড়েছি প্রায় বারো-তেরো বছর হতে চলল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও কমছে। যদিও পঁয়ত্রিশ বছর এখনকার দিনে কোনও বয়সই নয় তবুও সার্থক কথোপকথন চালাবার চেষ্টা করল।

অনন্যার দিকে ভালো করে তাকাল সার্থক। মনে পড়ল কলেজে থাকতে লম্বা বিনুনি করে আসত। এখন কাঁধ পর্যন্ত চুল খোলা রয়েছে। চোখেও পাওয়ারের চশমা উঠেছে। কিন্তু এত কথা সাৰ্থক সকলের সামনে বলাটা সমীচীন মনে করল না।

—তুমি কবে জয়েন করলে অফিস? আসলে আমিও পাঁচদিন ছুটিতে ছিলাম। আমার বাচ্চাটা অসুস্থ ছিল, সার্থক বলল।

—আমি চারদিন হল, অফিস জয়েন করেছি। অনন্যা সার্থকের ব্যবহারে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে সার্থক ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নয় তো ওর সঙ্গে কথা বলার সার্থকের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। যদিও কলেজেও বন্ধুত্ব কোনওদিন খুব গভীর ছিল না দু’জনের মধ্যে। কাজ নিয়েই যা দু’জনের কথাবার্তা হতো। কিন্তু একে অপরের অপরিচিত তো ছিল না।

এতবছর বাদে একটা অচেনা শহরে এসে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াতে অনন্যা খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছিল, সার্থকের ব্যবহার অনন্যার সেই উৎসাহে একেবারে জল ঢেলে দিল। সার্থকের চেহারায় যে, কোনও পরিবর্তন হয়নি এমন তো নয়। আগের থেকে ওর শরীরেও মেদ জমেছে, গোঁফ রেখেছে। তাও ওকে চিনতে বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি অনন্যার। অফিসের সহকর্মীরাও ধরেই নিয়েছিল, ওদের দু’জনের সম্পর্কটা নিশ্চয়ই পুরোনো কলেজ প্রেমের বর্তমান রূপরেখা।

পরের দিন অনন্যার মুড খারাপ দেখে সার্থকের বুঝতে অসুবিধা হল না, ওর কথা বলার স্টাইলেই অনন্যা মনে মনে আহত হয়েছে। নিজেকে খুব দোষী মনে হল সার্থকের। লাঞ্চের সময় নিজেই এগিয়ে এসে অনন্যা-কে বলল, “খুব সরি অনন্যা, আমি তোমাকে একেবারেই চিনতে পারিনি।’ হাত দিয়ে কান ধরে কলেজের দিনের মতো বন্ধুত্বের ভাষা সার্থকের মুখে শুনে অনন্যা না হেসে পারল না।

—সার্থক আমার ছোটো চুল দেখে অনেকেই আমাকে চট করে চিনতে পারে না। তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি।

—হ্যাঁ, কলেজে তুমি লম্বা বিনুনির জন্যই খ্যাত ছিলে আর সেই কারণেই ‘মিস কলেজ’-এর খেতাবও তোমার ঝুলিতে জুটেছিল। সার্থকের চোখের সামনে ভেসে উঠল অনন্যার চুলের সৌন্দর্যে কেমন ছেলেরা ওর জন্য পাগল ছিল।

—কী করি? অফিস জয়েন করার পর সকালের দৌড়াদৌড়িতে বিনুনি করার সময় কোথায়? তাই জন্য চুল কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। অনন্যার কথায় আফশোশ স্পষ্ট ফুটে উঠছিল কারণ ভারতীয় নারীর কাছে নিজের চুলের সৌন্দর্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

অনেক সময় যখন আমরা একই শহরে বা একই কলেজে পড়ি এবং সেখানে রোজই প্রায় দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে তখন সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও ঘনিষ্ঠতা বাড়বেই এমনটা হলফ করে বলা যায় না। অথচ অন্য শহরে গিয়ে হঠাৎ যদি সেই দু’জনের দেখা হয়ে যায়, তাহলে মনে হয় দু’জন খুব কাছের মানুষ বহু বছর বিচ্ছেদ কাটিয়ে আবার একত্রিত হয়েছে। সার্থক এবং অনন্যার মনের অবস্থাটাও ঠিক এমনই ছিল।

কিছুদিন কাজ করতে করতেই অনন্যা লক্ষ্য করল অফিসের মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে সার্থকের কাজ ছাড়া কোনও কথা হয় না তাও বেশিরভাগই হ্যাঁ কিংবা হুঁ— শুধু এটুকুই। অথচ পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে সার্থক খুব সহজ ভাবে মেশে এবং সবসময় তাদের সাহায্য করতে এগিয়েও আসে। এছাড়াও ঠিক ছ’টায় অফিস ছুটির সঙ্গে সঙ্গে সার্থক এক মুহূর্ত কারও অপেক্ষা না করেই একাই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়।

ক্রমশঃ

অচেনা নারী (৩-পর্ব)

অতনুর কথা

আজ মঙ্গলবার। মনটা বড্ড খারাপ। মনে পড়ে ছোটোবেলায় মায়ের হাত ধরে কালীঘাটের কালীমন্দিরে যেতাম শনি বা মঙ্গলবারে। বড়ো হয়ে ভাবতাম ওসব কুসংস্কার, মন্দির, পুজো থেকে শত হাত দূরে থাকতাম। কিন্তু আজ ভীষণ ইচ্ছা করছে মা কালীর ওই শান্ত শীতল মূর্তির সামনে গিয়ে বসে থাকি। বলি আমার সবকিছু নিয়ে শুধু শান্তি দাও।

সকালে অফিসে প্রবাল আর অভ্র এসেছিল। প্রায় জোর করেই আমাকে নিয়ে গেল রীতেশের চেম্বারে। রীতেশ আমাদের থেকে বেশ ছোটো। কিন্তু এই বয়সেই সাইকায়াট্রিস্ট বলে নাম করেছে। সকালে ওর এক ঘন্টা খালি ছিল। ওরা কুহকিনীর সব ই-মেইলগুলোর প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছিল। রীতেশ সব শুনে বলল, এটা এক ধরনের স্ক্রিৎজফ্রেনিয়া। যারা মানসিক ভাবে দুর্বল, তাদের মনের ক্ষোভ অনেক সময় আক্রোশে পরিণত হয়।

অতনুদা, ছোটোবেলায় দেশে দেখেননি, রাস্তাঘাটে পাগল বা পাগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে— আর যাকে দেখছে গালাগালি দিচ্ছে। এটাও তাই। শুধু এক্ষেত্রে, গালাগালি দিচ্ছে ই-মেইলে। সবাইকে খারাপ কল্পনা করতে করতে একদিন কল্পনাটাই সত্যি বলে মনে হয়। তবে চিন্তা করবেন না। সবকিছুরই চিকিৎসা আছে। ফ্রাইডে ইভিনিং-এ সুচরিতাদিকে নিয়ে আসুন। কতগুলো টেস্ট করব। তবে হ্যাঁ, সময় সময় এরা কিন্তু ডেনজারাস হতে পারে। বিশেষ করে ট্রিটমেন্ট শুরু হলে। তখন এক বাড়িতে থাকা ঠিক নয়। রাত্রে যখন ঘুমোবেন তখন আপনারও ক্ষতি করে দিতে পারে। তাই মানসিক হাসপাতালে রাখতে হবে কিছুদিন। একদম ভাববেন না। এখানকার মানসিক হাসপাতাল খুব ভালো। ক’দিন পরেই দেখবেন ভালো হয়ে গেছেন।

সু মানসিক হাসপাতালে? না, অসম্ভব। প্রবালরা বোঝাল, দ্যাখ, রূপম আর সুমিত খুব রেগে আছে। ওরা চাইছিল ই-মেইলগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে। আইপি অ্যাড্রেস থেকে ওরা লোকেট করে দেবে কোন কম্পিউটার থেকে মেইলগুলো এসেছে। তারপর তোর বাড়ির সার্চ ওয়ারেন্ট বার করতে পারলে তোদের দু’জনের হাতেই হাতকড়া পড়ত। আমরা জানি তোর কোনও দোষ নেই। তুই শুধু একটু বেশি ভালোমানুষ। বউকে সময়মতো কন্ট্রোল করতে পারিসনি। তাই আইনি ঝামেলার থেকে এটা ভালো না? আমরাও চাই সুচরিতা আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাক। ক’দিনের তো ব্যাপার। কিন্তু সু রাজি হবে রীতেশের কাছে যেতে?

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে ওকে বললাম, ‘তোমার শরীরটা বোধহয় ভালো যাচ্ছে না, একটুতেই আজকাল মাথা গরম করো। এই শুক্রবার একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেব।”

সু খুব শান্ত ভাবে আমার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কোন ডাক্তার?’

একটু ভয়ে ভয়ে রীতেশের নাম বললাম। অবাক হয়ে দেখলাম সু রেগে গেল না। শুধু বলল ‘আচ্ছা।’

আজ বুধবার। রোজকার মতো খুব ভোরে অফিস যাব বলে তৈরি হয়ে বেরিয়েছি, দেখি গাড়িটা ড্রাইভওয়েতে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমি তো বরাবর গ্যারাজের দিকে মুখ করে রাখি। কাল কি রিভার্স করে রেখেছিলাম? মনে তো হচ্ছে না। কী জানি সু-র সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটাও বোধহয় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় স্কুল যাওয়ার সময় মা বলতেন, ‘সাবধানে যাস।’ মা তো কবেই উপরে চলে গেছেন। অথচ আশ্চর্য, ঠিক যেন ফিশফিশ করে মা-র গলা শুনলাম, ‘খোকা, সাবধানে যাস।’

অনেকদিন আগে মিহিরদার গলায় শোনা হেমন্তর একটা গান মনে পড়ল— আসব না ফিরে আর / আসব না। ফিরে কোনওদিন। মিহিরদা কী অপূর্ব গান করেন। ইশ বেচারার এখনও বোধহয় চাকরি নেই। দেশে থাকলে নামকরা গায়ক হতে পারতেন।

গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি সু এসে দাঁড়িয়েছে। ও তো এত ভোরে ওঠে না। চোখাচোখি হতে সু ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল। মুখে মৃদু হাসি। আমিও অনেকদিন আগের মতো ডান হাত বাড়িয়ে লুফে নিলাম। এই মেয়েকে আমি কী করে পাগলা গারদে পাঠাব? না না, কিছুতেই পারব না।

গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। সেই গানটা মাথার মধ্যে এখনও ঘুরছে। একেক দিন এরকম হয়। ‘যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়/ ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙে যায়। চোখের আলো নিভল যখন মনের আলো জ্বেলে/একলা এসেছি আমি, একলা যাব চলে।’

সু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ও কি বুঝতে পেরেছে আমরা কী প্ল্যান করছি? উঃ ভগবান! এই দোটানা থেকে আমায় মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।

 

অচেনা নারী (২-পর্ব)

সুচরিতার কথা

আজ অনেকক্ষণ দত্ত মাসিমার সঙ্গে ফোনে কথা হল। ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন শিকাগোর এক বাঙালি মেয়ের সঙ্গে। বারবার বলছিলেন বিয়ের বরযাত্রী যাবার কথা শিকাগোতে। যা হাসি পাচ্ছিল। মাসিমা তো জানেন না ওনার মেয়ে বনানী আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। যখন শুনবে ওর মা ওর ভাইয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছে আমাদের, একেবারে তুলকালাম লাগিয়ে দেবে৷ ইশ, দৃশ্যটা যদি দেখতে পেতাম! এইসব বাঙালি মেয়েগুলোকে দেখলে আজকাল আমার পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যায়। সবকটা হিংসুটে, অহংকারী, স্বার্থপর। ভাবতে অবাক লাগে, এত বছর ওদের সঙ্গে মিশতাম কী ভাবে।

এই যে বনানী! মেয়ে রিমলি হাইস্কুলে গেল কি না গেল, ওর গান শুরু হয়ে গেল। আমার মেয়ে তো বলে দিয়েছে স্টানফোর্ড, ইয়েল, হার্ভার্ড, এমআইটি — কোথাও যাবে না। এ মেয়েকে নিয়ে কী যে করব!

আরে কোথায় চান্স পায় আগে দ্যাখ। তাও তো চার বছর দেরি। আর যা সব পাকা মেয়ে, এই বয়স থেকেই বয়ফ্রেন্ড। হয়তো দেখব হাইস্কুল ছাড়ার আগেই কারও গলায় ঝুলে পড়েছে। যা একখান ই-মেইল ঝেড়েছি, খেপে আগুন।

আজকাল যে-মেয়েগুলো বিয়ে করছে, সেগুলো তো আরও অসহ্য। বেশিরভাগ বিয়ের আগেই এদেশে এসেছে পড়তে বা চাকরি নিয়ে। আমাদের এমন ভাবে দেখবে যেন আমরা বরের ঘাড়ে চেপে এদেশে এসেছি। নিজেদের যোগ্যতায় ভারতবর্ষের সীমানা পার হতে পারতাম না। তেমনি ন্যাকা ন্যাকা কথা। ওই এক আছেন মিহিরদা। নিজেকে ভাবেন হেমন্ত। কোথাও গান বাজনা হলেই প্রথমে অনেক বাহানা করেন — আবার আমাকে কেন, আমি তো সব জায়গাতেই গাই। আর মেয়েগুলো শুরু করবে — একদম না বলবেন না মিহিরদা। গান না গেয়ে এখান থেকে যান দেখি। তখন যেন উপায় না দেখে মিহিরদা গান ধরবেন। আর আমাকে দেখলে ওই গানটা গাইবেনই — ‘কী গান শোনাব বলো, ওগো সুচরিতা’।

আগে বোকা ছিলাম, ওনার কথায় হাসতাম, এখন বুঝি সবক’টা পারভার্ট। অরুণিমা তো আরেক। তার গর্ব কী না, তার বর কোনও ক্যাসিনো থেকে কখনও খালি হাতে ফেরে না। বলতে ইচ্ছা করে তোর শ্বশুর বোধহয় মহাভারতের শকুনির বংশধর। জাত জুয়াড়ি। শকুনি নয়, বলা উচিত শকুন। এই বয়সেও রূপমদার চোখ ঘোরে হাঁটুর বয়সি মেয়েদের উপর।

অজন্তার তো বর আবার স্টক মার্কেটে পয়সা করেছে বলে এত গর্ব, যেন নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। সব থেকে ভালো দিয়েছি রাধাকে। বাবা ও শাশুড়ি গা ঘ্যাঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়ে নায়াগ্রা ফলসের সামনে ছবি তুলেছেন উদ্ভাসিত মুখে। আবার সেই ফোটো পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। এমন ই-মেইল দিয়েছি যে, পরের দিনই ফেসবুক থেকে ফটো ডিলিট। একটাই আফশোস। ই-মেইল পড়ার সময় ওদের চোখ মুখের ভাব কী হল দেখতে পাই না।

অতনুটাও আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছে। বোকাটে ধরনের। এতদিন আমেরিকায় থেকেও সেই ভেতো বাঙালি হয়ে রয়ে গেল। এখন মনে হয় অল্পবয়সে ওকে ছেড়ে কোনও সাদা ছেলেকে ধরা উচিত ছিল। এখন টু লেট। যাই এবার ল্যাপটপে বসে কুহকিনীকে ঘুম থেকে তুলি।

 

অচেনা নারী (১-পর্ব)

অতনুর কথা

সকালবেলা ম্যানহাটনের অফিসে পৌঁছে ল্যাপটপ ডকিং স্টেশন-এ লাগিয়েছি— অমনি মোবাইল বেজে উঠল। সতেরো তলা থেকে দেখা যায় দূরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। কিন্তু সে সব দেখে অভিভূত হওয়ার দিন আর নেই। এখন ফোন এলেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। কোনও বাঙালির ফোন নয় তো? ঠিক তাই। রূপম। ইচ্ছা না হলেও ফোনটা ধরলাম।

—অতনু?

—বলছি।

—কী ব্যাপার বল তো? তোরা কি আর আমাদের শান্তিতে থাকতে দিবি না?

—না মানে… কী হয়েছে?

—কী হয়েছে? অরুণিমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। দেশ থেকে ফোন পেয়ে ও তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তিনদিনের মাথায় ই-মেইল এল ‘কী রে খুব তো গর্ব করছিলি মেয়ে এমআইটি-তে চান্স পেয়েছে বলে, এখন কেমন লাগছে? মায়ের জন্য দেশে যাবি, না মেয়ের জন্য পার্টি দিবি?”

—ই-মেইল… মানে।

—থাক আর ন্যাকামি করতে হবে না। দেখ ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম’ তোর না তোর বউয়ের ই-মেইল আইডি, তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে ওটা যে তোদের বাড়ি থেকেই আসছে তা এখানকার সব বাঙালিরা জানে। তবে আমরাও ছাড়ব না। এর একটা বিহিত করবই। ফোনটা কেটে দিল রূপম।

“তোর বউ’। ওরা আজকাল সুচরিতার নাম উচ্চারণ করতে ঘৃণা বোধ করে। অথচ এই রূপম – অরুণিমা, মিলন-অজন্তা, প্রবাল-মিতা, সুমিত-রাধা, অভ্র-বনানী, মিহিরদা-অঞ্জনাদি – এদের সঙ্গে এত বছর কত আড্ডা, শনিবারের ডিনার, রবিবার লাঞ্চ, ছেলেমেয়েদের জন্মদিনের পার্টি, পিকনিক, বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, দুর্গাপুজো— কী না করেছে এত দিন। আজ মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

এসবের শুরু বছর দুয়েক আগে। আমাদের একমাত্র মেয়ে রাকা যখন হাইস্কুল পাস করে কোনও ভালো কলেজে চান্স পেল না, তখন থেকেই দেখি সুচরিতার মুখ গম্ভীর। বন্ধুদের ফোন করা বন্ধ, কাউকে বাড়িতে ডাকে না, কেউ আসতে বললে এড়িয়ে যায়। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল তোমার? মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছ নাকি?’

সু উত্তর দিল— আজকাল ওদের সঙ্গে মিশতে গেলে মাথা গরম হয়ে যায়। আমিও আর কথা বাড়াইনি।

এর ক’দিন পরে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় মিলনরা ফোন করে বলল, ‘আসছি, জরুরি কথা আছে।’ মিলন আর অজন্তা এলে সু চা করে নিয়ে এল। ওরা দেখছিলাম বেশ গম্ভীর। হঠাৎ অজন্তা সু-কে জিজ্ঞেস করল, ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম কী তোর ই-মেইল আইডি।’

সু বলল, “না তো৷’ কিন্তু ওর মুখচোখ দেখে মনে হল, অবাক হওয়ার বদলে খুশির আভা।

—দ্যাখ বাজে কথা বলবি না। ইংলিশ অক্ষরে বাংলা কথা— দেশ থেকে পনেরো হাজার টাকা দামের শাড়ি কিনে দেখি খুব ডাঁট! নিজের চেহারা কি ভুলে গেছিস? দ্যাখ আবার ওই শাড়ি পরে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করিস না! দেশের লোকেরা বলবে, তোদের ওখানে আজকাল কাজের লোক পাওয়া যায় বুঝি?

—আমি যে পাঠিয়েছি তোকে কে বলল? সুচরিতার গলায় রীতিমতো খুশির ঝলক।

—দ্যাখ শাড়ির দামটা খালি তোকেই বলেছিলাম। ছেড়ে দেবার পাত্রী নয় অজন্তা।

—সে তো কলকাতার দোকানদারও দামটা জানে। এবার সত্যিই হেসে গড়িয়ে পড়ল সুচরিতা।

ওরা আর বসল না। চা না খেয়েই চলে গেল। আমি স্তম্ভিত। সু-কে বললাম ‘তুমি সত্যিই ওই ই-মেইলটা পাঠিয়েছিলে?’

সু চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ করেছি।’ উঠে শোওয়ার ঘরে চলে গেল সু। সেদিন আর এ নিয়ে কোনও কথা হয়নি।

এর প্রায় এক মাস বাদে, একদিন সকালে অভ্র-র ফোন অফিসে। ‘জরুরি কথা আছে, লাঞ্চের সময় তোকে অফিস থেকে তুলে নেব।”

অভ্র গাড়ি নিয়ে এসেছিল। কাছাকাছি চাইনিজ বাফেতে গিয়ে দেখি চাঁদের হাট — রূপম, মিলন, প্রবাল, সুমিত, মিহিরদা, অরুণিমা, অজন্তা, মিতা, রাধা, বনানী, অঞ্জনাদি সবাই হাজির। আগেকার মতো চেঁচিয়ে উঠলাম ‘একি! সারপ্রাইজ পার্টি নাকি?’ ওরা কেউ হাসল না। শুধু বনানী বলল, ‘চলো অতনুদা, খাবার নিয়ে নাও, তারপর কথা বলা যাবে।’

দশ ডলারে অল ইউ ক্যান ইট। খিদেও পেয়েছিল। সবাই যে যার ভর্তি প্লেট নিয়ে এসে বসলাম। তখনও জানি না আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে।

প্রথমে মিতা শুরু করল। অতনুদা, তুমি কতটা জানো আমরা জানি না, গত কয়েক দিন আমরা সবাই ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম’ থেকে ভীষণ বাজে বাজে ই-মেইল পাচ্ছি। আমরা জানি এগুলো সবই সুচরিতার লেখা। আমার বাবা কলকাতায় থাকেন, বয়স আশির উপর। জীবনে কখনও মদ ছোঁননি। একদিন রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে গিয়ে গর্তে পড়ে পা ভেঙেছেন। মেইল এল ‘আর এখান থেকে বাবার জন্য স্কচ নিয়ে যাস না, রাস্তায় বেরিয়ে মাতলামি করে লোকের মার খেয়ে একটা পা ভেঙেছে, এরপর আরেকটাও যাবে।’

—কিন্তু তোমাদের সঙ্গে অনেকদিন তো সুচরিতার যোগাযোগ নেই। ও এত সব জানবে কী করে? আমার গলা নিজের কাছেই অন্যরকম লাগল! আমি কি সুচরিতার হয়ে ওকালতি করছি?

—সে কথা আমরাও ভেবেছি। আসলে আমাদের ছেলেমেয়েদের নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। মিতা বলে চলল

—তোমার মেয়ে রাকাকে একদিন ফোন করেছিলাম। ও বলল রোজ ওর মা ওকে ফোন করে সব মাসিদের কথা জিজ্ঞেস করে। ও বন্ধুদের কাছে যা শোনে তা-ই মাকে বলে। রাকাকে অবশ্য আমি আর কিছু বলিনি।

—আমি বয়সে বড়ো বলে বোধহয় তুই তোকারি করেনি। কিন্তু যা লিখেছে তা তোমাদের সামনে বলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে, অঞ্জনাদি বলে উঠলেন। তবে চুপ করে থাকতে তো পারব না, তাহলে এটা চলতেই থাকবে। জানো বোধহয় তোমাদের মিহিরদার চাকরি নেই। ও তো আবার গান বাজনা ভালোবাসে৷

মেইল এল ‘এবার মুখে রং মেখে রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে লাইন দাও, সংসার চালাবে কী করে? বরকে বলো তুমি যখন খদ্দের সামলাচ্ছ, তখন টুপি খুলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতে— কিছু বাড়তি রোজগার হবে।”

—আমার বাবা ও শাশুড়িকে এক সঙ্গে গত সামারে দেশ থেকে এনেছি, রাধা বলল। মেইল এল, ‘তোদের তো একটাই গেস্টরুম, বাবা ও শাশুড়ি কি একই ঘরে? এবার ইস্কনের মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করিয়ে নে। ওটাই বা বাকি থাকে কেন?’

—ছেলেদেরও বাদ দেয়নি, মিলন বলে উঠল৷ আমাকে আজকাল প্রায়ই টুরে যেতে হয়। তোর কুহকিনী লিখেছে ‘বউ তো মাত্র একশো ডলারে ঘরে লোক নিচ্ছে, রেটটা একটু বাড়াতে বলো। প্রসাদেরও তো স্টেটাস থাকে।’

—আমার ননদের ছেলে টুবাই এমএস করতে এখানে এসেছে দেশ থেকে, অরুণিমা বলল। ক’দিন আগে আমার মেয়ে পৃথার সঙ্গে শপিং মলে গিয়ে সুচরিতার সঙ্গে দেখা। পৃথা তো কিছুই জানে না। ‘মাসি মাসি’ করে অনেক গল্প করেছে। বাড়ি এসে আমায় বলতেই আমি ভয়ে কাঁটা। ঠিক যা ভেবেছি। রাত্রেই মেইল এল, “তুই কি তেলুগু হয়ে গেছিস? মেয়েকে পিসতুতো দাদার সঙ্গে ডেট করতে পাঠাচ্ছিস?’

—এ তো তবু ভালো৷ বনানী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার বলে উঠল— রিমলিকে তো তোমরা জন্ম থেকে দেখছ অতনুদা। এখন গ্রেড নাইন। সেদিন স্কুলে হঠাৎ পেটে ব্যথা। ওরাই নাইন ওয়ান ওয়ান ডেকে হসপিটালে পাঠিয়েছে। ডাক্তার বলল অ্যাপেনডিসাইটিস। অপারেশনের পর দু’দিন হসপিটালে থেকে বাড়ি এসেছে। পরের সপ্তাহে কুহকিনীর মেইল, ‘অ্যাবরশন হয়ে গেল? বাচ্চাটার বাবা কে? চিনা না কাল্লু?’

ওরা আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। আমার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। সুচরিতা এত নীচ? এত কদর্য? ওদের ঠোঁটগুলো নড়ছে দেখতে পাচ্ছিলাম। শব্দগুলো বেরিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল। আমার কানে কিছুই আসছিল না।

 

উদয়ের অস্তাচল (পর্ব ১)

দিন-রাতের শেষ ট্রেনটা যখন চন্দনপুর স্টেশন ছেড়ে চলে গেল তখন একটা হাঁফ ছেড়ে বৈদ্যনাথবাবু দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালেন— রাত ন’টা বেজে পাঁচ মিনিট। বহুদিন পরে ট্রেনটা প্রায় ঠিক সময়ে স্টেশন ছেড়ে গেল। বৃষ্টিটা কমেছে এখন। সারাদিন ধরে আজ ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল।

পয়েন্টস ম্যান হারান মণ্ডল কেরোসিনের সিগনাল ল্যাম্প-টা হাতে নিয়ে ঢুকল। ‘বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মাস্টারবাবু; চলুন এবার বন্ধ করুন দোকানপাট।’

—হ্যাঁ, চল, বলে খাতাপত্র বন্ধ করলেন বৈদ্যনাথবাবু। ম্লান হেসে চশমার কাচ পরিষ্কার করলেন শার্টের আস্তিনে। আজ মেল- টা লেট করেনি অনেকদিন পরে।

ঘাড় নেড়ে সামান্য হেসে হারান মণ্ডল বলল, ‘হ্যাঁ আজ ঠিক সময়ে চাট্টি গরম ভাত ভাগ্যে জুটবে।’

হারান ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করল। পিছনের দরজা দিয়ে কোয়ার্টারে চলে যাবে। মাস্টারবাবুর কোয়ার্টারেরই একটা ঘরে থাকে হারান। বৈদ্যনাথবাবু লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘বাইরের লাইটটা জ্বলছে তো?”

ঘাড় নাড়ল হারান মণ্ডল৷

—চল, বলে এগিয়ে গেলেন বৈদ্যনাথবাবু। এমন সময় প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজায় মৃদু টোকা পড়ল।

বিরক্ত হল হারান। এই অসময়ে আবার কে এল? অবাক হয়ে বাইরের দিকে তাকালেন বৈদ্যনাথবাবু।

হারান মণ্ডল দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই বাইরে থেকে ভরাট গলায় আওয়াজ এল, ‘দয়া করে দরজাটা খুলুন।’ বৈদ্যনাথবাবু ইশারা করলেন।

দরজা খুলতেই দেখা গেল আগম্ভক মাঝবয়সি, প্রায় ছ’ফুট লম্বা সম্ভ্রান্ত সুপুরুষ। হালকা ফ্রেমের অন্তরালে উজ্জ্বল একজোড়া চোখে সাগরের গভীরতা।

—ভিতরে আসতে পারি? দরজায় ভারী গলার আওয়াজ।

বৈদ্যনাথবাবু দু’পা এগিয়ে এসে আমন্ত্রণ জানালেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন।’

আগন্তুক কোনও ভণিতা না করে ভিতরে ঢুকে বললেন, ‘আপনাদের অসুবিধায় ফেলার জন্য ভীষণ দুঃখিত! ঠিক জানা ছিল না, গাড়িতে এক ভদ্রলোক বললেন এখানে নামলে বলরামপুর কাছে পড়বে আর বাস বা অন্য গাড়ি পেয়ে যাব। কিন্তু এখন দেখছি এখানে কোনও গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যাবে না।’ বৈদ্যনাথবাবু আগন্তুককে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

—এখান থেকে বলরামপুর কাছে বটে কিন্তু আগের জংশন স্টেশনে নামলে ওখান থেকে রাতের বাসটা বা হয়তো শেয়ারের ট্যাক্সিও পেয়ে যেতেন।

পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে, প্যাকেটটা বৈদ্যনাথবাবুর সামনে এগিয়ে ধরলেন। বৈদ্যনাথবাবু হাতজোড় করে স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন, ‘আমার চলে না।’

আগন্তুক সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে হাত জোড় করলেন, ‘আমি অমিয়নাথ গাঙ্গুলি, যাব বলরামপুর। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তা নাহলে রাতটা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতেই কাটিয়ে দেওয়া যেত।’

বৈদ্যনাথবাবু লজ্জা পেয়ে জিভ বের করে বলে উঠলেন, “আরে না না, তাতে কী হয়েছে, পেছনেই আমার ডেরা। চলুন ওখানেই কষ্ট করে রাতটা না হয়…!’

—খুব খারাপ লাগছে। আপনাদের অযথা কষ্ট দিলাম। আন্তরিক বিনয়ের সঙ্গে বলে অমিয়নাথ কাঁধের ছোটো ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

—ছি ছি এমন করে বললে সত্যি সত্যিই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হবে! বৈদ্যনাথবাবু জিভ কাটলেন।

গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে কয়েক পা হেঁটেই স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারে চলে এলেন, ‘আসুন স্যার’ বলে একটা নড়বড়ে হাতভাঙা চেয়ার এগিয়ে দিলেন বৈদ্যনাথবাবু। পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি বৈদ্যনাথ দে৷ এই পাণ্ডববর্জিত স্টেশনের চাকুরে, পরিবারের অন্যান্যরা কলকাতায় থাকে, তাই ওই হারান মণ্ডলই আমার সেবক, পাচক, মালি আবার স্টেশনের পয়েন্টসম্যান। তাই ও যেমন ‘অল ইন ওয়ান’ আমিও তেমনি ‘ওয়ান ইন অল।” নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন বৈদ্যনাথ দে।

ছোটো কোয়ার্টারের ততোধিক ছোটো রান্নাঘর থেকে কেরোসিন স্টোভের সোঁ সোঁ আওয়াজ আসছিল। হারান রান্না চাপিয়েছে।

—পঁচিশ বছরে বিশেষ পরিবর্তন দেখছি না এখানের। জানালার বাইরে তাকিয়ে মন্তব্য করল অমিয়।

বৃষ্টিটা ততক্ষণে বেশ জোরে পড়তে আরম্ভ করেছিল, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা বাইরে ছুড়তেই ছ্যাঁত করে আওয়াজ তুলল।

জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে খুব আলতো করে বলল অমিয়, ‘বলরামপুরের গাঙ্গুলিদের নাম শুনেছেন?

—না, মানে আমার তো এখানে বেশিদিন হয়নি। আমতা আমতা করতে লাগলেন বৈদ্যনাথবাবু।

হঠাৎ হারান রান্নাঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলে উঠল, ‘অপরাধ মাফ করবেন! কত্তা কি জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে? যিনি …’ ইতস্তত করতে লাগল হারান।

ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমিয়নাথ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমিই জমিদার শঙ্করনাথ গাঙ্গুলির বড়ো ছেলে অমিয়নাথ। বাবার সঙ্গে মতের অমিল হওয়াতে বাড়ি আর দেশ দুটোই ছেড়েছিলাম।’

এমএনসি-র প্রেম (শেষ পর্ব)

একটু বাদেই রঘু এসে ঢোকে অবনীবাবুর কেবিনে। স্যার, আপনি আমাকে ডেকেছেন? হ্যাঁ, আচ্ছা তুমি শুনলাম এখানে একাই থাকো। তা খাওয়াদাওয়া কোথায় করো? কোনওদিন অফিসের ক্যান্টিনে, কোনওদিন বাইরের হোটেলে। এভাবেই চলে যাচ্ছে।

–তা, বিয়ের কথা ভাবছ না কেন? বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছ নাকি?

—না স্যার, ঠিক তা নয়। এখনও তেমন ভাবে ভাবিনি।

—আমি আমাদের অফিসের একটি মেয়েকে জানি। তুমি যদি রাজি থাকো তবে আমি তাকে বলে দেখতে পারি। তোমাদের জন্য না হয় ঘটকালির অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে। বলা তো যায় না রিটায়ারমেন্টের পর কাজে লাগতে পারে, কী বলো? বলেই হা হা করে হাসতে লাগলেন।

বললেন— এক কাজ করো আজ ছুটির পর তৈরি থেকো। বাড়ি ফেরার পথে আজ শিপ্রা হোটেলে আমরা তিন কাপ কফি খেয়ে বাড়ি যাব।

—স্যার, দু’কাপ কফি তো বুঝলাম। কিন্তু তিনকাপের রহস্যটা ঠিক বুঝলাম না।

—ওটাই তো সাসপেন্স। সময় হলেই বুঝতে পারবে। সন্ধে সাড়ে ছ’টায় অফিস থেকে বেরিয়ে যেও। শিপ্রা হোটেলের কফিশপেই বাকি কথাটা হবে।

রঘু কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই, অবনীবাবু স্নেহাকে ইন্টারকমে ফোন করে বললেন— স্নেহা, তোমার সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে। সন্ধে সাড়ে ছ’টায় আমার কেবিনে চলে এসো। আমরা একসঙ্গে বেরিয়ে যাব। পথে একটু কফি খেয়ে যাওয়া যাবে।

বলে ফোনটা রেখেই বাড়িতে ফোন করে স্ত্রীকে বললেন— আজ আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। একটু বিশেষ কাজে আটকে গেছি। অন্যপ্রান্ত থেকে আওয়াজ ভেসে এল — বাড়ি না এলেই তো পারো। বাড়ি তো শুধু খাওয়া আর শোয়ার জন্য মনে হয়। মাল্টিন্যাশানাল আর কর্পোরেট এই কথাগুলো শুনে শুনে একেবারে ঘেন্না ধরে গেছে, বলেই ফোনটা সজোরে রেখে দিল ও প্রান্ত।

সন্ধে হতেই অবনীবাবু স্নেহাকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে হাজির হলেন শিপ্রা হোটেলে। বললেন— চলো, ক্যাফেতে বসা যাক। ইতিমধ্যেই রঘুর ফোন এল, ‘স্যার, আমি রিসেপশন-এ পৌঁছে গেছি। আপনি কোথায়?”

অবনীবাবু বললেন— আমি ক্যাফেতে আছি। চলে এসো এখানে।

রঘু এসে হাজির হলে, স্নেহা ও রঘু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। অবনীবাবু ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য ওয়েটারকে ডেকে তিন কাপ কফির অর্ডার দিলেন।

অবনীবাবু— স্নেহা ও রঘু, আমি তোমাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যা জেনেছি তাতে মনে হল, তোমরা একে অন্যকে ভালোবাসো কিন্তু তোমাদের ব্যাপারটা আর এগোয়নি। তাই আমাকেই সে কাজটা করতে হল। আমার মনে হয় তোমাদের মধ্যে সম্পর্কটা গড়ে উঠলে তোমরা দু’জনেই সুখী হবে। আজ সকাল থেকে বহু সমস্যা মেটাতে মেটাতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই কফিটা খেয়েই আমাকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে, আগামীকাল অফিসে দেখা হবে। অফিসিয়াল রিপোর্ট চাই কিন্তু, বলেই হাসতে হাসতে কফির দাম মিটিয়ে বেরিয়ে গেলেন হোটেল থেকে।

বাড়ি ফিরে দেখলেন সেখানকার পরিবেশটা বেশ থমথমে। তাই কথা না বাড়িয়ে জামা-কাপড় ছেড়ে ইজি চেয়ারে বসে স্নেহা আর রঘুর কথা ভাবছিলেন।

এমন সময় তাঁর স্ত্রী এসে বললেন— আমি আর তোমার সঙ্গে ঘর করতে পারছি না জানো। আজকাল তুমি আমার কোনও খোঁজ খবরই রাখো না। আজ আমার জন্মদিন সেটাও তুমি ভুলে গেছ। আমি ড্রাইভার গোপালকে ফোন করে যখন জানলাম যে তুমি একটি মেয়েকে নিয়ে হোটেলে গেছ, তখনই ঠিক করে ফেললাম। তোমার সঙ্গে আর থাকা যাবে না। এনাফ ইজ এনাফ। আমি ডিভোর্স চাই। কালই চলো উকিলের কাছে যাব।

অবনীবাবু কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে ভাবলেন, আজ অন্যের ঘর বাঁধার তোড়জোর করে এলাম, আর আমার নিজের ঘরই টালমাটাল হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবনীবাবু মুখ খুললেন। বললেন— উমা, আমি কাল অফিস যাব না। তোমার সঙ্গে সারাদিন কাটাব। ডিভোর্সের কথাটা না হয় কালই ভাবা যাবে!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব