জলার হাওয়া

পুলিশ দুই প্রকার, ভালো পুলিশ আর খারাপ পুলিশ। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সাধারণ মানুষ কখনওই পুলিশকে সুনজরে দেখে না। পুলিশ মানেই যেন খারাপ চরিত্রের। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার আগেই শুভ্রজ্যোতি জানতেন এটা। যুবক বয়সে নিজেও থানাপুলিশ এড়িয়ে চলেছেন। চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সময় বাছাবাছিতে যাননি। কারণ, তখনই চাকরির বাজার বেশ খারাপ। এমনই কপাল, শিকে ছিঁড়ল পুলিশের চাকরিতেই। গুরুজন এবং চেনাজানারা সকলেই বলল, যতই হোক সরকারি চাকরি। এইবেলা ঢুকে পড়।পরে এই চাকরিও দুর্লভ হয়ে যাবে।

জয়েন করে গেলেন শুভ্রজ্যোতি। ট্রেনিং পিরিয়ডে, বিশেষকরে থিয়োরির ক্লাসগুলোতে মনে হতো আমি ভালো পুলিশ হয়ে উঠব। পুলিশের চাকরি যথেষ্ট মর্যাদাকর। কতিপয় খারাপ মানুষ এই চাকরিতে ঢুকে পুলিশের বদনাম তৈরি করে। প্রথম পোস্টিং হল ডক এরিয়ার থানায়। অপরাধপ্রবণ এলাকা। সেই থানাতে একটাও ভালো পুলিশ ছিল না। দু’জন সৎ পুলিশ ছিল। তারা পয়সা খেত না, কোনও কাজও করত না। একেবারে নিস্ক্রিয়। শুভ্রজ্যোতি বসে বসে মাইনে নিতে পারবেন না। অলসতা তাঁর স্বভাবে নেই। কাজ করতে গেলেন, ধরে রাখতে পারলেন না সততা। প্রলোভন এবং পরিস্থিতির চাপের কাছে হার মানলেন। অনেক পুলিশ আছে, যারা হার মানে না। শুভ্রজ্যোতির কাছে তারা প্রণম্য।

সেইসব নমস্য পুলিশদেরও বিশ্বাস করে না সাধারণ পাবলিক। বলাবলি করে, পুলিশ ঘুষ খায় না, তা আবার হয় নাকি! বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনওদিন হয়তো বিড়াল মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবে। পুলিশ ঘুষ খাওয়া ছাড়বে না। এরকম একটা ধারণা শুভ্রজ্যোতির প্রতি

আত্মীয়-পরিজনেরও ছিল। ঠাকুরদার দেওয়া অমন সুন্দর নাম ওই বদনামকে আড়াল করতে পারেনি। এমনকী ফুলশয্যার রাতে চন্দ্রিমা দু’চার কথার পরই জানতে চেয়েছিল, স্যালারি কত পাও সে তো বাবার থেকে শুনেছি, উপরি কীরকম হয়?

বেশি নয়। নিতে হয় বলে নিই। নয়তো চাকরি টেকাতে পারব না। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

চন্দ্রিমা বলে, বেশি নিয়ে কাজ নেই বাবা। স্বভাব নষ্ট হয়ে যাবে।

নববধূর ইমেজ রাখতেই কথাটা বলেছিল চন্দ্রিমা। পরবর্তীকালে বিলাসব্যসনের এই যে এত আয়োজন, জানতে চায়নি কোথা থেকে, কীভাবে আসছে? স্বভাব সত্যিই নষ্ট হল কিনা, কখনও খোঁজ করেনি।

চরিত্র ধীরে ধীরে অধঃপাতেই গেছে শুভ্রজ্যোতির। এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি হয়েছেন। বেড়েছে পদমর্যাদা। শুকনো থানায়, মানে যেখানে দুনম্বরি পয়সার আমদানি কম, সে সব জায়গায় পোস্টিং-এর খবর কানে এলেই দৌড়েছেন ওপর মহলে। নানান কৌশলে আটকেছেন বদলির চিঠি। তার জন্য প্রশাসনের হয়ে অন্যায় কাজ করে দিয়েছেন অনেক। যতদিন গেছে শাসকদল এবং প্রশাসনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তবে এটাও ঠিক গোটা দেশ কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির ওপর ভর করে চলে না। এখনও সততা, ন্যায়নিষ্ঠার জোর অপরিসীম। এমনই এক সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ বড়োকর্তা শুভ্রজ্যোতির ডানা ছাঁটতে দেবনগরের আইসি করে পঠিয়ে দিলেন। বহু তদ্বির করেও বদলি ঠেকাতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। দেবনগর একেবারেই বন্ধ্যা জায়গা। কলকারখানা নেই, পুরোনো হাইওয়ে যেটা আছে, মাল পাচারকারীদের কাছে সেটা পরিত্যক্ত। বড়ো মার্কেট নেই। ক্রাইম প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখানে ভাই-ভাই। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন হয় রাখি উৎসবের মেজাজে।

দেবনগরে এসে প্রথমদিকে খুবই ডিপ্রেশনে ভুগতেন শুভ্রজ্যোতি। বউ-ছেলে থাকে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। ওদের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং বাড়িয়ে ফেলেছেন শুভ্রজ্যোতি। কীভাবে খরচ জোগাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। থানার অন্যান্য সহকর্মীদের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। দেবনগরের সামাজিক আবহাওয়ায় মানিয়ে নিয়েছে। আলস্যে দিন কাটায়। শুভ্রজ্যোতি খুঁটেখুঁটে ক্রাইম বার করে দু’চার পয়সা কামাতে লাগলেন। এই যেমন, হেলমেটহীন বাইক আরোহীকে থানায় ধরে নিয়ে আসতে বলা। অন্ধকার মাঠে মাতাল, প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরপাকড় করা। যা টাকা পাওয়া যায়, তাই নিয়ে ছেড়ে দেওয়া। এরকম বিবিধভাবে তোলা তুলতে লেগেছিলেন শুভ্রজ্যোতি। নিজের ওপরে ধিক্বার এসে যাচ্ছিল। আগে যে থানাগুলোতে ঘুরে এসেছেন, বাঁয়া-ডাঁয়া দু’পা গেলেই পাঁচ-দশ হাজার আপনা থেকেই হাতে এসে যেত। কিন্তু ওই যে, কী যেন বলে না, ‘যেখানেই যাও কপাল যায় সঙ্গে সঙ্গে’, শুভ্রজ্যোতির হচ্ছে ঘুষের কপাল। দেবনগরের মতো শুখা থানাতেই বিরাট একটা দাঁও মারার চান্স এসে গেছে। যাকে বলে বিগ শট। এতটাই বিগ, কাজটা সাকসেসফুলি উতরে গেলে যে-টাকাটা পাবেন, বাকি জীবন চাকরি না করলেও আরামে চলবে। ছেলের জীবনও কেটে যাবে ওই টাকাতেই।

লটারি লাগার মতো এরকম একটা সুযোগ যে আসবে, এই দেবনগরে বসে, কল্পনাও করতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। রেলের লাইনের ওপারে নসিবপুর, দেবনগর থানার আন্ডারে। ওখানে একটা স্টিল ফ্যাক্টরি আছে। অনেকদিন ধরেই টিমটিম করে চলছে। কারখানার গায়ে প্রায় বিশ একর জুড়ে জলাভূমি। লোকে বলে হাতিডোবার বিল। বিশ একরের দশ একর কারখানার সম্পত্তি, বাকিটা খাস। বিলের মাঝে বড়ো একটা চরা আছে। সেখানে প্রায় তিরিশ ঘরের বসবাস। সকলেই উদ্বাস্তু। র্যাশন কার্ড নেই। জায়গাটার নাম মেছোডাঙা। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা একমাত্র নৌকো। কারখানা সমেত গোটা এলাকা জুড়ে আধুনিক শহর তৈরি হবে। ডেভলপমেন্ট হওয়ার কথা দেশি-বিদেশি সংস্থার কোলাবোরেশনে। কারখানার মালিক নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি। খাসজমি অধিগ্রহণের সময় সরকার চোখ বুজে থাকবে। কারণ, সরকার উন্নয়ন চায়। বাধ সেধেছে একটা গোষ্ঠী। যারা নিজেদের পরিবেশকর্মী বলছে। জলাজমি বুজিয়ে ফেললে জনবসতির ড্রেনেজ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যাবে চতুর্দিক। বিলে প্রত্যেক বছর পরিযায়ী পাখি আসে, তারা আর আসবে না। প্রচুর মাছ চাষ হয় বিলে। মেছোডাঙার বাসিন্দাদের ওটাই জীবিকা। এছাড়াও আছে ক্ষতির নানান ফিরিস্তি। সব ছাই মনেও থাকে না শুভ্রজ্যোতির। পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই যোগ দিয়েছে মেছোডাঙার পরিবারগুলো। সাকুল্যে দু থেকে আড়াইশো জন এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। স্টিল ফ্যাক্টরি সবে নিজের জমি ভরাট করতে শুরু করেছে, হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে তারা। ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার থানার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রথম যেদিন কারখানার গেটের সামনে বিক্ষোভ হল। আড়াইশোজনের অ্যাজিটেশন লাঠি উঁচিয়ে ফাঁকা করে দেওয়া পুলিশের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। ঘটেওছিল তাই। তারপরই ম্যানেজার শুভ্রজ্যোতিকে ডেকে পাঠান নিজের চেম্বারে। গোটা পরিকল্পনাটা ভেঙে বলেন, বিশ একরে আধুনিক শহরের প্ল্যান। বলেছিলেন, অত কম বিক্ষোভকারী দেখেঞ্জভাববেন না ওদের শক্তি কম। আইনের জোর আছে ওদের পিছনে। কারখানা বাড়ানোর নাম করে আমরা নিজেদের জলাজমি ভরাট করছি, এখনকার আইন বলছে তা আমরা করতে পারি না। পরিবেশ দফতরের পারমিশন লাগবে। ‘জলাজমি’ ব্যাপারটা এখন এত সেনসেটিভ, অনুমতি পাওয়া যাবে না। আন্দোলনকারীরা কোর্টে যাওয়ার আগেই কারখানার দশ একর ভরাট করে ফেলতে হবে আমাদের। কয়েকটা রাতের মধ্যে চুপিচুপি সেরে ফেলতে হবে কাজ। আপনি আমাদের প্রোটেকশন দেবেন। কোর্টের রায় যদি এসেও যায় আপনার হাতে, আপনি অ্যাকশন নিতে গড়িমসি করবেন। একবার ভরাট হয়ে গেলে বাকিটা সামলে নিতে পারব আমরা। আমি ইতিমধ্যে মেছোডাঙার বাসিন্দাদের অফার দিয়েছি, কারখানা বড়ো করে চাকরি দেব তোমাদের। আমরা যে কারখানা বিক্রি করে সরে পড়ার তাল করছি, এটা ওদের বুঝিয়েছে আন্দোলনে থাকা শিক্ষিত মানুষ। মেছোডাঙার লোকেরা আমাদের বিশ্বাস করছে না। আপনি যদি পুরো অবস্থাটা আমাদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারেন, প্রচুর টাকা দেব।

টাকার অঙ্ক শুনে চোখ কপালে উঠেছিল শুভ্রজ্যোতির। তখনও জানতেন না আরও দু’টো পার্টির থেকে এরকমই আকর্ষণীয় অফার আসবে। সরকারের এক প্রভাবশালী ফোন করে বললেন, কাজটা করে দিন। ভালো জায়গায় বদলি এবং প্রোমোশন দেব। পার্টির ছেলেদের দিয়ে কাজটা অনায়সে করানো যেত। আড়াইশোজনের প্রতিবাদ ধোপে টিকত না। কিন্তু এইসব সেনসেটিভ ইস্যুতে ইন্টারফিয়ারেন্স নিলে পার্টির বদনাম হবে। বিরোধী পার্টির সঙ্গেও আপসরফা হয়ে গেছে। আপনি শুধু ওই আড়াইশোজনকে সামলান।

এরপর ফোন এসেছিল ডেভলপারের কাছ থেকে। কাজটা করে দেওয়ার জন্য তারা যে-টাকার অফার দিয়েছে, স্বপ্নেও তা কল্পনার অতীত।

এত সব উজ্জ্বল প্রস্তাব পেয়ে নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের মতো হয়ে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। তিনটে পার্টির কাছেই তিনি সময় চেয়ে নেন। বলেন, আমাকে প্ল্যান সাজাতে দিন। আমি না-বলা পর্যন্ত আপনারা কোনও স্টেপ নেবেন না।

কাজ অনেকটাই মেরে এনেছেন শুভ্রজ্যোতি। মাথা ঠান্ডা রেখে ঝড়ঝাপটা সামলাতে হয়েছে ভালোই। এখন লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল অপারেশনটা বাকি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন। টেনশন বাড়ছে, নাগালের মধ্যে এসে গেছে বিপুল টাকা, চাকরির উন্নতি! স্টেপিং-এর সামান্য ভুলে সমস্ত কিছু চলে যেতে পারে হাতের বাইরে। উৎকণ্ঠায় কাহিল হয়ে শুভ্রজ্যোতি, জীবনে প্রথমবার কোনও প্রফেশনাল জ্যোতিষীর কাছে চলেছেন। সন্তানের কোষ্ঠীবিচার বাবা হয়তো কখনও করিয়েছিলেন, ফলাফল জানা নেই শুভ্রজ্যোতির। আত্মীয়বন্ধু মহলে দু’চারজনের কাছে হাত দেখিয়েছেন। সেসব ভবিষ্যদ্বাণী কিছুই মেলেনি। ভাগ্যবিচারকে বুজরুকি, দুর্বল মনের আশ্রয় বলেই গণ্য করতেন শুভ্রজ্যোতি। টেনশনের চোটে এখন মনে হচ্ছে সামনেটা যদি একটু জানা যেত, মনটা বশে থাকত অ্যাটলিস্ট।

জ্যোতিষীর কাছে যাচ্ছেন, একজন ছাড়া কেউ জানে না। সেই ব্যক্তিই দিয়েছিল জ্যোতিষীটির হদিস। জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হওয়াটা গোপন রাখতে চান শুভ্রজ্যোতি। চন্দ্রিমাকে বলার প্রয়োজন নেই। দূরে থাকে বলে জানতেও পারে না, শুভ্রজ্যোতি কোথায় যান না যান। থানার সহকর্মীদেরও কিছু বলেননি। চেনা একজনের গাড়ি নিয়ে সিভিল ড্রেসে চলেছেন চণ্ডীতলা। সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি, একতলায় চেম্বার।

দেবনগরের পর দু’টো থানা-এরিয়া পেরিয়ে গঙ্গার খালের ব্রিজের ওপারে চণ্ডীতলা। জ্যোতিষীর বাড়ি নাকি খালের গায়েই। সঙ্গে কোনও সহকর্মী এবং থানার গাড়ি নিয়ে আসতেই পারতেন শুভ্রজ্যোতি। আনেননি দুটো ভিন্ন কারণে। এক, জ্যোতিষীর কাছে পুলিশ পরিচয় লুকোতেই পরনে সিভিল ড্রেস এবং ‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়ি নেননি। সামান্য ক্লু পেলেই জ্যোতিষীরা অ্যানালিসিস করে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় কথা বলে দেয়। ফালতু সময় নষ্ট। শুভ্রজ্যোতি সামান্য হলেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পেতে চান। আর সহকর্মী কারওকে আনেননি নিজের ইমেজের কথা ভেবে। থানার সকলেই জানে তিনি রাফ অ্যান্ড টাফ। এইসব মানুষের জ্যোতিষীর শরনাপন্ন হওয়া মানায় না।

সাবঅর্ডিনেটরা সমীহ করবে না। ওদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে না পারলে জলাভূমি দখল করা মুশকিল। এখন অবধি ওরা যে কো-অপারেশনটা করছে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়, সমীহ থেকে। এই তো যেদিন মেছোডাঙার চার মাথাকে ফল্স কেস-এ চালান করলেন কোর্টে, কাজ মিটিয়ে ফিরে আসছেন থানায়, গাড়িতে পাশের সিটে বসেছিল সিনিয়র স্টাফ বাসুদেব গড়াই। বলেছিল, হাতিডোবার বিলটা না বোজালেই নয় স্যার? ওদিক থেকে দারুণ একটা হাওয়া দেয় বলেই দেবনগর এলাকাটা এত শান্ত। তারপর ধরুন সস্তায় টাটকা মাছ পাওয়া যায়। শীতকালে কাছে পিঠে এত সুন্দর পিকনিক স্পট! সেই সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসে…

উত্তরে শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, আপনি এক কাজ করুন, চাকরিতে রিজাইন দিয়ে পছন্দসই গ্রামে বসবাস করতে চলে যান। রিটায়ারমেন্টের সময় তো হয়েই এল, লস খুব একটা হবে না।

বাসুদেব গড়াই আর কথা বাড়ায়নি। কাজ শেষের মুখে গড়াইয়ের ন্যাকামি শুনে গা জ্বলে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। কত সতর্ক হয়ে মিশনটাতে এগিয়েছেন। অফারগুলো আসার পর প্রথমে মিটিং করলেন পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে। জলাজমি বুজিয়ে কী হতে চলেছে বললেন পুরোটাই। যদিও ওরা সবই জানত। শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, জায়গাটার উন্নয়ন হচ্ছে, আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন?

ওদের বক্তব্য, কারখানা বন্ধ করে বড়োলোকদের বাসস্থান কী ধরনের উন্নয়ন। গরিব সাধারণ মানুষের কী উপকার হবে এতে? পরিবেশ নষ্ট হয়ে বরং ক্ষতিই হবে মানুষের।

এর পরের মিটিং শুভ্রজ্যোতি করলেন মেছোডাঙার বাসিন্দাদের সঙ্গে। মেছোডাঙায় গিয়ে ওদের বোঝালেন, তোমরা প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। জীবনের মান উন্নত হবে তোমাদের। চরা ছেড়ে চলে যাও।

ওরা বুঝল না। বলল, আমরা ছিটেবেড়ার ঘরে ভালোই আছি। খেয়েপরে দিন চলে যাচ্ছে। কোনও উন্নতির দরকার নেই আমাদের।

কিন্তু সকলেই তো আর নির্লোভ নয়। শুভ্রজ্যোতি ছোট্ট একটা দান চেলে রেখে এসেছিলেন মেছোডাঙায়। বলেছিলেন, ঠিক আছে, তোমরা ভালো করে ভেবে দ্যাখো। আমি জোর করব না। যদি মত পরিবর্তন হয় থানায় এসে আমাকে জানিও। তোমাদের জন্য দরজা সব সময় খোলা।

ওদের মধ্যে মাত্র দু’জন এসেছিল চুপিচুপি। তারা জীবনে উন্নতি চায়। তাদের ইনফর্মার হিসেবে নিয়োগ করলেন শুভ্রজ্যোতি। তিনি জানতেন মেছোডাঙায় মাঝে মাঝে বাইরের থেকে দুষ্কৃতিরা এসে গা ঢাকা দেয়। মেছোডাঙার বাসিন্দারা ভয় পেয়ে আশ্রয় দেয় তাদের। দুই ইনফর্মার এক দাগি অপরাধীর গাঞ্জঢাকা দেওয়ার খবর দিল। ফোর্স নিয়ে তাকে ধরতে গেলেনঞ্জশুভ্রজ্যোতি। নৌকো করেই যেতে হয়েছিল। তাছাড়া অন্য উপায় তো নেই। অপরাধী পালাল। শুভ্রজ্যোতি জানতেন নৌকোর মতো ধীর গতির যান নিয়ে অপরাধীকে ধরা যাবে না। দুষ্কৃতিরা সেটা বুঝেই ওখানে গা ঢাকা দেয়। শুভ্রজ্যোতির আসল উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হল। দাগি দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে মেছোডাঙার চার মাথাকে অ্যারেস্ট করলেন।

এতেই আন্দোলনকারীদের মনোবল অনেকটা ভেঙে গেছে।

যে-কেসে অ্যারেস্ট করেছেন, থানায় এসে বিক্ষোভ জানাতে পারছে না তারা। তবে ওরা খুব শীঘ্রই বিক্ষোভ জানাবে কারখানার গেটে। শুভ্রজ্যোতির নির্দেশে কারখানার ম্যানেজার ভরাট করতে যাবেন জলা। এটা আসলে টোপ। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে সামিল হলেই, শুভ্রজ্যোতি তার দুই ইনফর্মার এবং দু’চারটে ভাড়াটে গুন্ডা ঢুকিয়ে দেবে ভিড়ে। তারা ভাঙচুর করবে কারখানায়। পুলিশ এলে ইট ছুড়বে। শুভ্রজ্যোতি বেছেবেছে আন্দোলনকারীদের মাথাগুলোকে অ্যারেস্ট করবেন। এবার তারা বেল পেয়ে জেল থেকে বেরোতে বেরোতে ঠিকাদাররা ভরাট করে ফেলবে হাতিডোবার বিল। বাধা দেওয়ার মতো লোকবল, পাকামাথা ওদের দলে থাকবে না। কারণ, হাতিডোবার বিল নিয়ে দেবনগর এবং আশপাশের শহর মফস্সলের বাসিন্দাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। জলার হাওয়ায় তারা শান্তি পায়। দেখতে যায় না হাওয়াটা আসছে কোথা থেকে? হাওয়া যে দেখা যায় না। এমনই স্বার্থপর হয়ে উঠেছে মানুষ। অথচ যত দোষ শুধু পুলিশের!

এই ফুলপ্রুফ প্ল্যানে একটাই কাঁকর, গোপার ছেলে সৌম্য। সে আন্দোলনকারীদের একজন। গোপার সঙ্গে শুভ্রজ্যোতির ফস্টিনস্টির সম্পর্ক। শুভ্রজ্যোতি যখন যে থানায় গেছেন, সেই এরিয়ায় নিশ্চিত করে একটা নষ্টামির রিলেশন তৈরি হয়েছে, যার অাঁচ কিছুতেই পেৌঁছোতে দেন না বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। পার্টনারের সঙ্গে সেরকমই অ্যাডজাস্টমেন্ট করা থাকে। গোপা হাজব্যান্ড সলিলকে নিয়ে থানায় এসেছিল বাড়িওলার নামে অভিযোগ জানাতে। দোষ যদিও গোপাদের। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া দেয় না। স্বাভাবিক কারণেই বাড়িওলা ওদের উঠে যেতে বলছে। হুমকি দিয়েছে অল্পবিস্তর। জলের লাইন কেটে দিয়েছে। গোপাকে পছন্দ হয়ে গেল শুভ্রজ্যোতির। ওদের বাড়িতে চা খেতে আসার নেমতন্ন পেলেন গোপার থেকে, সঙ্গে গোপার ভ্রূ ভঙ্গিতে আরও গোপন কিছু পাইয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত। শুরু করলেন ওদের বাড়িতে যাওয়া। বাড়িওলা জলের লাইন জোড়া লাগিয়ে দিল। ভাড়াও চায় না। সলিলটা ভেডুয়া টাইপের, শুভ্রজ্যোতি ওদের বাড়ি গেলেই কোনও একটা অছিলায় বেরিয়ে যায়। সমস্যা সৌম্যকে নিয়ে। কলেজে পড়া ছেলে। বাড়ির বাইরেই থাকে বেশিরভাগ। তবু কখনও যদি বাড়ি এসে শুভ্রজ্যোতিকে দেখে, এমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়, সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে শুভ্রজ্যোতির পক্ষে।

পরিবেশকর্মী বা আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেবনগর, নসিবপুরের লোক হাতেগোনা। বেশিরভাগ বাইরের। হাতেগোনা ক’জনের মধ্যে কেন যে সৌম্য কাঁকরের মতো রয়ে গেল… বিক্ষোভে কিংবা মিটিংয়ে যতবারই আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, সৌম্যর মতো ঘৃণার দৃষ্টিতে কেউ তার দিকে তাকায়নি। ও রাগ তো জলাভূমি নিয়ে নয়।

শুভ্রজ্যোতি গোপাকে বলেছেন, ছেলেকে ওসব আন্দোলনে থাকতে বারণ করো। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।

গোপা বলেছে, ও যেমন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে এবাড়িতে আসতে বারণ করে না, আমিও ওর ইচ্ছেতে বাধ সাধব না।

শুভ্রজ্যোতি একটা ব্যাপারে ভীষণ আশঙ্কিত হচ্ছেন, প্ল্যান মাফিক যে- গন্ডগোলটা কারখানার গেটে পাকাবেন ঠিক করেছেন, কোনও ভাবে যদি সৌম্য উন্ডেড হয়, একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। ফোর্সকে তিনি যতই একজনকে বাঁচিয়ে অ্যাকশন করতে বলুন, ওই পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশ পালন করা বেশ কঠিন।

সৌম্য পুলিশের মারে জখম হলে গোপা ছেড়ে দেবে না শুভ্রজ্যোতিকে। প্রতিশোধস্পৃহায় ফুঁসে উঠবে মায়ের মন। গোপা হয়তো চলে যাবে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে শুভ্রজ্যোতির সংসারে। এই সব সম্ভাবনার কথা ভেবে শুভ্রজ্যোতির মনে উৎকন্ঠার পারদ ক্রমশ চড়ছে। ভবিষ্যতের আভাস পাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে সেই কারণেই।

চণ্ডীতলার জ্যোতিষীর সন্ধান দিন দশেক হল পেয়েছেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করে জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে ফিরছিলেন। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দেবাংশুর এখন ফার্স্ট ইয়ার। মেধাবী স্টুডেন্ড, জয়েন্টে র্যাংক করে চান্স পেয়েছে। বাবার ঘুষের টাকায় প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হতে হয়নি।

সে যাই হোক, এই ট্রিপে চন্দ্রিমা সঙ্গে ছিল না। শুভ্রজ্যোতির অপোজিট বার্থে বছর তিরিশের এক কো-প্যাসেঞ্জার বারবার পাথর লাগানো আংটিতে চুমু খেয়ে আংটির হাতটা কপালে ঠেকাচ্ছিল। চোখের সামনে ক্রমাগত একই ঘটনা ঘটতে থাকায় বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলেটিকে একসময় বলেই ফেললেন, আপনি তো বেশ ভক্ত লোক মশাই। আপনার বয়সে এত ভক্তি সহজে দেখা যায় না।

খোঁচাটা খেয়ে ছেলেটি রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে ছিল। মুখে কিছু বলেনি। ঘটনাটা কিন্তু ঘটিয়েই যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সহযাত্রীর কাণ্ডকারখানা থেকে মনটাকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

ট্রেন শিয়ালদা পৌঁছোনোর পর যে কাণ্ডটা ঘটল, জানা গেল সহযাত্রীর ওই আচরণের কারণ। প্ল্যাটফর্মে নেমে ছেলেটি একটু বুঝি ত্রস্ত পায়ে হাঁটছিল শুভ্রজ্যোতির সামনে। ওর ধরনধারণ দেখে একটু ছিটিয়াল টাইপের বলেই মনে হচ্ছিল। আচমকা কোথা থেকে দুটো ছেলে ছুটে এসে ধাক্বা মারল ওই সহযাত্রীকে। মুহূর্তের মধ্যে ওর কাঁধের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে দু’জনেই ধাঁ।

পুলিশ হয়েও শুভ্রজ্যোতি ঘটনাটায় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। দুষ্কৃতিদের চেজ করা হয়ে ওঠেনি। সহযাত্রী ছেলেটি ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে বসে পড়ে মাথা চাপড়াচ্ছে। বলছে, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। সব গেল আমার… ও মা, এবার আমি কী করব…

শুভ্রজ্যোতি সহযাত্রীটির পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসেছিলেন। পিঠে হাত রেখে সহমর্মীর গলায় বলেন, মনে হচ্ছে ওদের কাছে খবর ছিল দামি কিছু ক্যারি করছেন আপনি। কী ছিল ব্যাগে?

হা-হুতাশ থামিয়ে ছেলেটি রাগের চোখে তাকিয়ে ছিল শুভ্রজ্যোতির দিকে। মুখ ঝামড়ে বলেছিল, প্রচুর টাকা ছিল। আমার বিজনেসের টাকা। ট্রেনে আপনি বলছিলেন না, আমার ভক্তি বেশি। ভক্তি এই কারণে। বলে ছেলেটি হাতের আংটিটা দেখিয়ে মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিল। আংটিতে পান্না বসানো। যে-জ্যোতিষী দিয়েছিলেন, বলে দেন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই রত্নের রং গাঢ় হতে শুরু করবে। তখনই যেন সতর্ক হয়ে যায় ছেলেটি। ট্রেন জার্নি-তে পান্নার রং আরও সবুজ হতে দেখে ছেলেটি চিন্তায় পড়ে যায়। সামনের স্টেশনে নেমে পড়বে, নাকি পুরোটাই যাবে? বিপদ দু-জায়গাতেই ওত পেতে থাকতে পারে। তাই সে আংটিতে চুমু খেয়ে আংটি কপালে ঠেকিয়ে ভগবানের কাছে বারবার প্রার্থনা করছিল, এ যাত্রায় সে যেন বেঁচে যায়।

শেষ রক্ষা হয়নি। শুভ্রজ্যোতি কিন্তু তাঁর এই টেনশনের সময়কালে পাওয়ারফুল জ্যোতিষীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ছেলেটিকে বলেছিলেন, ব্যাপারটা আপনি আগে বলবেন তো আমাকে! আমি পুলিশ। আর্মস আছে সঙ্গে। অ্যালার্ট থাকতে পারতাম।

আপনি পুলিশ, আমি জানব কী করে! বলেছিল ছেলেটি। ভুল কিছু বলেনি। ছেলেটিকে শুভ্রজ্যোতি নিয়ে যান জিআরপি-তে। নিজের পরিচয় দিয়ে ডায়ারি লেখান। ততক্ষণে জ্যোতিষী চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যর ঠিকানা নিয়েছেন ছেলেটির থেকে। জ্যোতিষী সপ্তাহে তিনদিন দুপুর দু’টো থেকে সন্ধে ছ’টা অবধি চেম্বারে বসেন। প্রবল ভিড় হয়। নাম লেখাতে হয় আগে থেকে। সোমবার ভিড় একটু কম।

আজ সোমবার। গত শনিবার ফোন করেছিল পল্লব, ট্রেনের সেই সহযাত্রী। সুখবর শোনাল। বলল, আপনার সঙ্গে গিয়েছিলাম বলেই জিআরপি উঠে পড়ে লেগে আমার অনেকটা টাকাই উদ্ধার করে ফেলেছে। আপনি পুলিশ অফিসার বলেই কেসটা সিরিয়াসলি নিয়েছিল ওরা। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব আপনাকে… যাই হোক চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন নাকি ইতিমধ্যে?

না, যাইনি। দু’একদিনের মধ্যেই যাব। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

পল্লব বলল, সোমবার চলে আসুন। আমি যাচ্ছি। নাম লিখিয়ে রাখব। ক’টা নাগাদ আসবেন বলুন।

বিকেল চারটের আশেপাশে যাবেন বলে রেখেছেন শুভ্রজ্যোতি। আধঘন্টা মতো দেরি হয়ে গেল। পল্লব নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।

খালের ব্রিজে গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছেন শুভ্রজ্যোতি। খালে টলটলে জল। ব্রিজ থেকে নেমে যে-রাস্তাটা খাল বরাবর চলে গেছে, সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি।

রাস্তাটা অপ্রশস্ত এবং শুনসান। ডানপাশে খাল, বাঁ দিকে পরপর চালাঘর, পাকা ছাদের বাড়ি চোখেই পড়ছে না। গাড়ির স্পিড আস্তে করে নিয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে জ্যোতিষীর বাড়ি কোনটা?

ছেলেটি এসে পড়ল। শুভ্রজ্যোতি গাড়ি থামালেন। ছেলেটিকে বললেন, চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়িটা কোথায়?

– সোজা চলে যান। লাল রকওলা দোতলা বাড়ি। বলার পর ছেলেটি জানতে চাইল, আপনি কি হাত দেখাতে এসেছেন?

হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না শুভ্রজ্যোতি। শুধু ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলেন, এটা পুলিশি অভ্যেস। ছেলেটা নিজের থেকেই প্রশ্নের কারণটা বলবে। এবং বলল, উনি হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন মাস খানেক হল। গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

কেন ছেড়ে দিয়েছেন জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলেন না শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। পল্লব কি তাহলে জানে না হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন? ও যে বলল নাম লিখিয়ে রাখবে? নাম না লেখাতে পেরে একটা ফোন করতে পারত। পল্লবকে এখন কি একবার ফোন করবেন শুভ্রজ্যোতি? না, থাক। জ্যোতিষীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক না ব্যাপারটা। এতটা যখন এসেই পড়েছেন।

নীচের তলার ঘরে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য গোমড়া মুখে বসে রয়েছেন তক্তপোশের ওপর। সামনে কাঠের চেয়ারে শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল আরোহী সঠিক খবরই দিয়েছে, ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পর পর ছ’জনের হাতে আসন্ন মৃত্যুযোগ দেখার পর তাঁর মনে হয়েছে, ঈশ্বর চান না তিনি আর ভাগ্যবিচার করুন। তাই সেই সব মানুষকেই হাত দেখাতে পাঠাচ্ছেন, যাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। যে ছ’জনের গণনা তিনি করেছিলেন, চারজনের মৃত্যুর খবর কানে এসে পৌঁছেছে, দু’জনের কী হয়েছে জানেন না। মৃত্যুযোগ প্রতিকারের ক্ষমতাও নেই চিত্তরঞ্জন জ্যোতিষীর। মিছিমিছি ভাগ্যগণনা করে কী লাভ! ঈশ্বর তাঁকে যতটুকু সম্পদ দিয়েছেন, বাকি জীবনটা ওতেই চলে যাবে।

শুভ্রজ্যোতি অনেক অনুনয়-বিনয় করে নিজের হাতটা দেখানোর চেষ্টা করলেন। পল্লবের রেফারেন্স দিলেন। বললেন ওঁরই দেওয়া সেই আশ্চর্য পান্নার কথা, বিপদ কাছে এলে যার রং গাঢ় হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন পল্লবকে মনে করতে পারলেন না। পরপর খারাপ হাত দেখে জ্যোতিষ ব্যাপারটা থেকে মন উঠে গেছে তাঁর। বাধ্য হয়ে শুভ্রজ্যোতি হুমকি দিলেন, হাত আপনাকে আমি দেখিয়েই ছাড়ব। এতেই ঠিক হয়ে যাবে কার মরণ আসন্ন, আপনার না আমার।

এরপর থেকেই গুম মেরে গেছেন চিত্তরঞ্জন। এবার মুখ তুললেন। বললেন, আপনি পুলিশ বলেই এভাবে জোর খাটাচ্ছেন। ভাগ্যবিচার আমি করে দিচ্ছি। দেখে যেটা বুঝব, সেটাই বলব। ধাক্বাটা সহ্য করতে পারবেন তো?

আমি পুলিশ, কী করে জানলেন? নিশ্চয়ই পল্লব বলেছে। অথচ বলছেন পল্লবকে মনে করতে পারছেন না।

আপনার কথা কেউ আমাকে বলেনি। চুলের ছাঁট, কোমরে বেল্ট, জামা গুঁজে পরা, ঠায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসা, এক দু’বার ঝোঁকার চেষ্টা করেও পারলেন না। বগলের তলায় বেল্টের সঙ্গে বাঁধা আছে পিস্তল। সর্বপরি আপনার শীতল চাহনি, দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি না করলে এমনটা হয় না। পিস্তল আর চাহনির চাপে পড়েই আপনার ভাগ্য গণনায় রাজি হলাম আমি। একটু বসুন, ওপর থেকে খাতাপত্তর নিয়ে আসি।

তক্তপোশ থেকে নেমে ঢিমেতালে বাড়ির ভিতরে গেলেন চিত্তরঞ্জন। শুভ্রজ্যোতির একটু ভয় ভয় করছে, লোকটা যা বলছেন, সত্যি হবে না তো? মৃত্যুযোগ কি আমার হাতেও আছে? ভগবানের পাঠানো সাত নম্বর ব্যক্তি কি আমি? …চিন্তাটা কাক তাড়ানোর মতো মাথা থেকে তাড়ান শুভ্রজ্যোতি। আগের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তাছাড়া ছ’জনের মধ্যে দু’জন হয়তো বেঁচে আছে, যাদের খবর পাননি চিত্তরঞ্জন। পল্লবের ব্যাপারটা নিয়ে শুধু ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। বলল, আজ আসবে। নাম লিখিয়ে রাখবে…

চিত্তরঞ্জন ফিরে এলেন। হাতে হালখাতার মতো লাল পুরোনো খাতা আর ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। তক্তপোশে উঠে বসে চিত্তরঞ্জন বললেন, বলুন, আপনার জন্মের সময় আর তারিখ।

বললেন শুভ্রজ্যোতি। খাতা খুলে ছক কাটতে লাগলেন চিত্তরঞ্জন। নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। আঁক কাটা শেষ হতে বললেন, দিন, এবার ডানহাতটা দিন।

হাত বাড়ালেন শুভ্রজ্যোতি। হাতটা ধরে ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে দেখছেন চিত্তরঞ্জন। মোটা কাচের চশমা তো আছেই, আতসকাচও ব্যবহার করছেন।

এবার বাঁ-হাতটাও চেয়ে নিলেন। শুভ্রজ্যোতি নিবিষ্ট হয়ে জ্যোতিষীর এক্সপ্রেশন পড়ার চেষ্টা করছেন। চিত্তরঞ্জনের কপালের ভাঁজ এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্তি দেখা দিচ্ছে চেহারায়। এবার মুখ তুলে একগাল হেসে বললেন, নাঃ, নেই মৃত্যুযোগ। এখনও বহুদিন বাঁচবেন। উন্নতি করবেন জীবনে। প্রচুর অর্থ উপার্জনও হবে। সুখে কাটবে বাকি জীবনটা।

শুভ্রজ্যোতির মুখে হাসি ফিরে এসেছে। হাত দু’টো ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, দেখলেন, কেমন একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। আমি জোর না করলে ভুলটা আপনার ভাঙত না, থেকেই যেত।

আসলে একের পর এক মৃত্যুর গ্রহণ লাগা হাত দেখতে কার ভাল লাগে বলুন! বিষণ্ণ গলায় বললেন চিত্তরঞ্জন।

শুভ্রজ্যোতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। পার্স বার করে একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন চিত্তরঞ্জনের দিকে। বললেন, এতে হয়ে যাবে তো?

টাকা দিচ্ছেন কেন! আমি তো ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছি। আপনি জোর করলেন বলেই…

শুভ্রজ্যোতি জ্যোতিষীর ডানহাতটা তুলে ধরে নোটটা রাখলেন। বললেন, প্রফেশন ছেড়ে দেবেন কেন? এই তো আজ একটা ভালো হাত পেলেন। এবার থেকে দেখতে থাকুন। মিছিমিছি নিজের ক্ষমতাকে অপচয় করবেন না।

শুভ্রজ্যোতি রিল্যাক্সড্ ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নোটটা ফতুয়ার পকেটে ঢোকাতে অস্বস্তি হচ্ছে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের। আবার অবসাদ ঘিরে ধরেছে তাকে। এই লোকটাও বাঁচবে না। মানুষটাকে মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কালসর্প যোগ আছে লোকটার। মানে অপঘাতে মৃত্যু। ফণা উঁচিয়ে আছে নিয়তি। আর ঘন্টা খানেকও বাঁচবে কিনা সন্দেহ। এরকম দাপুটে মানুষটা নিয়তির কাছে বড়ো অসহায়! লোকটার প্রতি মায়া হয় চিত্তরঞ্জনের। মানুষটাকে শেষবার দেখার জন্য বাড়ির রকে এসে দাঁড়ালেন। আঁতকে উঠলেন সামনের দৃশ্য দেখে! মৃত্যু যে বাইরেই ওত পেতে ছিল, ভাবতেই পারেননি। চার, নাকি পাঁচজন যুবক পুলিশ লোকটার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ির বনেটে শুইয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিলেন চিত্তরঞ্জন। এক্ষুনি গুলি চালানোর শব্দ আসবে কানে।

আসছে না দেখে চোখ খুললেন। এখন অন্য দৃশ্য, কপালে বন্দুক ঠেকানোই আছে পুলিশের। লোকটাকে দিয়ে একটা কাগজে কী সব লেখাচ্ছে ছেলেগুলো। বেশি লিখতে হল না। সই করাল সম্ভবত। লোকটাকে ছেড়ে দিল ওরা। পুলিশটা দৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। দু’টো বাইকে পাঁচজন যুবক চেপে চলে গেল জুটমিল বস্তির দিকে। নিয়তি তার মানে ছেলেগুলির ইচ্ছে অনুযায়ী ফণা নামিয়ে নিল। বেঁচে গেল লোকটা। ওই যুবকরা কি তা হলে নিয়তির চেয়েও শক্তিমান।

ছেলেগুলো খুন করেছে। শুভ্রজ্যোতিকে নয়, ওঁর ভিতরে থাকা খারাপ পুলিশটাকে। ব্রিজের ওপর উঠে এসে শুভ্রজ্যোতি আর গাড়ি চালানোর রিস্ক নেননি। হাত কাঁপছে, ধড়াস ধড়াস করছে বুক। গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। খারাপ পুলিশটার নগ্ন দেহ যেন খালের জলে ভেসে আসতে দেখছেন। এরকম হুমকিই দিয়েছিল ছেলেগুলো। আচমকা মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছিল পাঁচজন। শুভ্রজ্যোতি নিজের আর্মস বার করার সুযোগই পাননি। কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলল, কোনও সেয়ানাগিরি নয়। যা বলছি শোন। নয়তো দানা ভরে জামাকাপড় খুলে লাশ ফেলে দেব খালে। ভাটার টাইম, ভাসতে ভাসতে অন্য জেলায় চলে যাবি।

শুভ্রজ্যোতিকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে আসাটা ছিল ট্র্যাপ। শুনশান এলাকা। খালটা জেলার সীমানায়। এখানে বডি ফেলে দিলে নিখোঁজ শুভ্রজ্যোতিকে জেলার পুলিশ খোঁজার পর সারা রাজ্যজুড়ে তল্লাশি চলত। ততক্ষণে বডিটা হয়তো পৌঁছে যেত সাগরে। খুনের কোনও প্রমাণ থাকত না।

পাঁচজনের দলে পল্লব তো ছিলই আর ছিল গোপার ছেলে সৌম্য, সঙ্গে আরও দু’জন আন্দোলনকারী। বাকি দু’টো ছেলেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। ওরা যে-কাগজে সই করাল, তাতে শুভ্রজ্যোতি পুলিশ জীবনে যা যা অপরাধ করেছেন, সমস্ত লেখা আছে। ছেলেগুলো এতসব জোগাড় করল কী ভাবে, কে জানে! কাগজটা ছিল স্বীকারোক্তির বয়ান। শুভ্রজ্যোতিকে সাইন করিয়ে ওরা বলল, হাতিডোবার বিলে হাত বাড়াবি না। পুলিশ হওয়ার অ্যাডভান্টেজ নিবি না আর কখনও। যদি নিস, এই ডিক্লেয়ারেশনের এক কপি যাবে সিআইডি  ডিপার্টমেন্টে, আর একটা কপি মিডিয়ায়। প্রাণে বেঁচেছিস, এটাই জানবি তোর চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি।

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা! এখন অনেকটা ধাতস্থ লাগছে। খারাপ পুলিশটা ব্রিজের তলা দিয়ে আবর্জনার মতো ভেসে গেছে সাগরের দিকে। পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস বয়ে আসছে। সম্ভবত হাতিডোবা বিলের হাওয়া। শুভ্রজ্যোতি এবার চন্দ্রিমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দেবনগরে নিয়ে আসবেন। বলবেন, ছেলে যখন বাইরে, কলকাতায় একা থেকে কী করবে! দেবনগরে একসঙ্গে থাকি চলো। জায়গাটা বেশ ভালো। হইচই নেই। নিরিবিলি। পশ্চিমি হাতিডোবার বিল থেকে উঠে আসা হাওয়ার প্রভাবেই এলাকাটা এত শান্ত! যে-কথা বলবেন না, তা হল, কিছু অশান্ত, দামাল যুবক অহর্নিশ হাওয়াটাকে পাহারা দেয়।

মা

ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং…

শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরে প্রিয়া।

‘হ্যালো।’

হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে ওঠে প্রিয়ার ছোটোপিসি সুশীলার গলা।

‘পিসি! এত রাতে ফোন করছ, কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হয়েছে তো বটেই। কিন্তু তোকে যে কীভাবে বলি। শুনলেই তুই তো আবার রাগারাগি করবি। আমার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বি। ব্যাপারটা কীভাবে নিবি কে জানে?’

‘দ্যাখো পিসি হেঁয়ালি ছাড়ো, পরিষ্কার করে বলো তো কী হয়েছে?’

বেশ ত্রস্তকণ্ঠেই সুশীলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া, একটু আগেই বড়দি ফোন করে বলল, দাদা নাকি আবার

বিয়ে করেছে।’

‘কী যা তা বলছ… মাথার ঠিক আছে তো তোমার?’

‘যা তা বলছি না রে। দিদিই নাকি কোনও এক ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে দাদার বিয়েটা দিয়েছে।’

এত রাতে ফোনের আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল প্রিয়ার। ভয় পেয়েছিল কোনও খারাপ সংবাদ নয়তো! তার ভাবনাটাই সত্যি হল, কোনও মৃত্যুসংবাদ না পেলেও এই বয়সে তার বাবার বিয়েটা তার কাছে মৃত্যুসংবাদের থেকে কম শকিং নয়। পিসির কাছ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই হকচকিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছিল প্রিয়া। এ তার কাছে এক বিশাল লজ্জার ঘটনা। শাশুড়ি, বড়ো-জা, ননদ এমনকী স্বামী নীলাদ্রিকেই বা কী করে মুখ দেখাবে। তাদের সকলের কাছে তো হাসির পাত্রী হয়ে দাঁড়াবে সে। একী করল বাবা। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না প্রিয়া, অঝোর নয়নে কেঁদে চলেছিল।

প্রিয়ার বিয়ের সময়তেও তার বড়োপিসির এহেন কথার জন্য বেশ গোল বেধে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রিয়া রেগেমেগে পিসিকে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছিল। আজ এতদিন পরে প্রিয়া হাড়েহাড়়ে টের পাচ্ছে ওই মহিলা সেদিন সেই মুহূর্তের জন্য চুপ করলেও মনে মনে বদ্ধপরিকর ছিল তার একাকী, নিঃসঙ্গ দাদার আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে পিসিকে দুষতে থাকে প্রিয়া। ‘পিসিকে না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কিন্তু বাবা…! বাবা একবারও তার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এই ঘটনা তার বিবাহিত মেয়ের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? সবাই বলত বাবা নাকি মেয়ে অন্ত প্রাণ। তাহলে বাবা এমন অবিবেচক হল কেন? ভারি অভিমান হল প্রিয়ার।

সংসার বলতে তো ছিল চারটে প্রাণী। প্রিয়া, প্রিয়ার বাবা নরেনবাবু, মা মোহিনীদেবী এবং অন্ধ, বিকলাঙ্গ ভাই হেমেন। বাড়ির একমাত্র ছেলে এমন হওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিল ঠিকই, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মোহিনীদেবীর ভালোবাসা সংসারে যেন এক আশ্চর্য সুখশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু সেই সুখের সংসারে হঠাৎই একদিন বাধ সেধে বসে এক মারণ ব্যাধি। ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন মোহিনীদেবী। ব্যস, দু’বছরের মধ্যেই সব শেষ। তখন প্রিয়া তেরো আর হেমেন বছর নয়েকের। তারপর কেটে গেছে দশটা বছর। সময় তার নিয়মেই বয়ে গেছে। এরই মধ্যে বাবা-মেয়ে মিলে সংসারের সব দায়িত্ব সামলেছে। পাশাপাশি প্রিয়া স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। বছর তিনেক হল একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়েও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলালেও বদলায়নি মোহিনীদেবীর প্রতি সকলের ভালোবাসা।

তার নিজের বিয়ের পরেও কেটে গেছে তিন-তিনটে বছর। মাস আষ্টেকের একটি মেয়েও আছে। সবই তো ঠিক চলছিল। ভাইকেও বাড়ির পুরোনো কাজের লোক মিনতিদি বেশ যত্ন নিয়েই দেখাশোনা করছিল। তাহলে আজ কী এমন ঘটে গেল যে, এই বয়সে বাবাকে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হল? এই কথাগুলি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল প্রিয়াকে।

অনেকক্ষণ প্রিয়া আসছে না দেখে ঘর থেকে নীলাদ্রি ডাকতে থাকে প্রিয়াকে। নীলাদ্রির ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পায় প্রিয়া। কোনওরকমে চোখমুখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে সাড়া দেয়, ‘হ্যাঁ আসছি। এক্ষুনি আসছি।’

প্রিয়াকে দেখেই চমকে ওঠে নীলাদ্রি। ‘কী হল এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন তোমায়, চোখ দুটো এত লাল লাগছে কেন? কেঁদেছ নাকি? কার ফোন এসেছিল?

নীলাদ্রির প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারে না নীলাদ্রি। খানিকবাদে প্রিয়া নিজেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘জানো, বাবা আবার বিয়ে করেছে!’

অবিন্যস্ত, অগোছালো, বেদনাতুর প্রিয়াকে দেখেই নীলাদ্রি বুঝে গিয়েছিল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, সুতরাং বৃষ্টি তো নামারই ছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় কিছুটা আশ্চর্য হলেও পরিস্থিতি সামলাতে ইয়ার্কির ছলে নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘সেকি বাবা বিয়ে করেছেন? এই বয়েসে? তা আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন না কেন?’

রেগেমেগে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘সবটাতে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। ভেবে দেখেছ এরপর লোকের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে?’

পরিস্থিতি হালকা করতে হাসতে হাসতে নীলাদ্রি বলে, ‘না দ্যাখো, সাদা চুলে টোপর পরে বাবাকে কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখার ইচ্ছে জাগাটা কি অন্যায় বলো? নাকি বাবা, বিয়ের আগে ডাই করেছিলেন কে জানে। কিছুই তো জানতে পারলাম না, জানলে না হয় একটু ফেসিয়াল, টেসিয়াল…’

নীলাদ্রির কথা শোনামাত্রই আরও জোরে কেঁদে ওঠে প্রিয়া।

‘আচ্ছা, আচ্ছা, সরি, বাবা আর ইয়ার্কি করব না, কিন্তু দ্যাখো ব্যাপারটা যখন ঘটেই গেছে তখন মেনে নেওয়াটাই কি…’

নীলাদ্রির কথার ইঙ্গিত বুঝেই একপ্রকার গর্জে ওঠে প্রিয়া। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’ এই বলে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।

ভাবগতিক খারাপ দেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে প্রিয়ার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায় নীলাদ্রি। নিজেও তার পাশে বসে তার হাত দুটি ধরে বলে, ‘আচ্ছা বলো তুমি এখন কী চাইছ?’

নীলাদ্রির এই স্নেহস্নিগ্ধ আচরণে প্রিয়ার চোখ জলে ভরে যায়। একটু শান্ত হয়ে বলে, ‘তুমি বলো বাবা এটা কী করল? একবারও আমার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এসব জানলে শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে আমি কতটা হাস্যকর হয়ে উঠব। শুধু তাই নয় বাবা যে দেখাত মার মৃত্যুর পরেও বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে, বাবার পৃথিবী নাকি মায়ের স্মৃতি জুড়েই, তাহলে সবই লোক দেখানো, মিথ্যে!’

প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকে, ‘তুমি তো জানো আমি ওদের কতটা ভালোবাসি। আমার বিয়ের পর আমি কতটা চিন্তায় থাকতাম। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সব বাবাকে একা হাতে সামলাতে হতো। প্রথমে বাবাকে হেল্প করার মতো কেউ ছিল না। ভাইয়ের পক্ষে তো নিজেরটাই নিজের সামলানো সম্ভব নয়। কাজেই সবসময় ওদের জন্য চিন্তা হতো। তারপর পাশের বাড়ির রমামাসি ওদের গ্রাম থেকে মিনতিদিকে এনেছিল আমাদের বাড়িতে। ব্যস তারপর থেকে তো বাবাকে আর সংসারের দিকে তাকাতে হয়নি। তাহলে, আজ কেন এই ডিসিশন?’

কথার মধ্যেই নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘প্লিজ আর কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে। একটু জল খাবে?’

একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করে প্রিয়া। ‘রোজকার মতো কালকেও দু’তিনবার ফোন করেছি বাবাকে। অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, বাবা এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে চলেছে। শুধু বলেছিল পিসির সঙ্গে নাকি কী দরকার আছে তাই পিসির বাড়ি যাবে। বাবার মনে এই ছিল!’

কথা বলতে বলতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যায় নীলাদ্রির। রাত আড়াইটে বেজে গেছে দেখে নীলাদ্রি বলে, ‘প্রিয়া অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালে মিষ্টুর ভ্যাকসিনের ডেট আছে। শুয়ে পড়ো প্লিজ। একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল না হয় যা হোক একটা…।’

মেয়ের কথা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রিয়া একটু স্থির হয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না। আমি জানব মার সঙ্গে সঙ্গে বাবাও এ পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’

কথাগুলি শুনে নীলাদ্রি বলে, ‘ছিঃ প্রিয়া, উনি না তোমার বাবা। আজ না হয় একটা তোমার অপছন্দের কাজ করেছেন, কিন্তু এতদিন তো তাঁর কর্তব্য তিনি যথাযথ ভাবে পালন করে এসেছেন। সম্পর্ক রাখবে না মনে হলে রেখো না, কিন্তু এরকম বাজে কথা বোলো না। অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’

নীলাদ্রি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত প্রিয়া দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে এল। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির সকলে যে-যার কাজে ব্যস্ত। শ্বশুর, ভাসুর অফিস যাবার জন্য আর শাশুড়ি, বড়ো-জা তাদের টিফিন, খেয়ে যাওয়ার রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অন্যান্য দিন প্রিয়াও তাদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগায়, কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার জন্য আজ তার হেঁশেল থেকে ছুটি। তাই সকালে প্রিয়াকে কারওরই মুখোমুখি হতে হল না।

তবে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও শ্বাশুড়ি স্নিগ্ধাদেবীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না প্রিয়া। ক্ষণিকের দেখাতেই তিনি প্রিয়ার চোখ-মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণবন্ত, ফুটফুটে ছোটোবউমাটির কিছু একটা হয়েছে। সাধারণত শ্বাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও প্রিয়া আর তার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক ব্যতিক্রমীই বলা যেতে পারে। স্নিগ্ধাদেবীর কোনও মেয়ে না থাকার কারণে তিনি তাঁর দুই বউকেই মেয়ের মতো ভালোবাসেন, তবে ছোটোবউমা প্রিয়াকে একটু বেশিই স্নেহ করেন। ছটফটে, মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটির, শাশুড়ির মন জয় করতে একটুও সময় লাগেনি। আর এই কারণেই বড়ো-জা সহেলির প্রচ্ছন্ন রাগও আছে। তবে সেটা মনে মনে। এমনিতে প্রিয়া আর বড়ো-জায়ের মধ্যে বেশ মিল, তবে মাঝেমধ্যে সংসারের নিয়মে যেমন ঘটি-বাটি ঠোকাঠুকি হয়, তেমনি আর কী। কিন্তু সেটা কোনওদিন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছোয় না।

ডাক্তারখানা থেকে ফেরার পর থেকেই প্রিয়াকে চুপচাপ দেখে বড়ো-জা সহেলি তাকে ডেকে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে রে তোর? এত চুপচাপ আছিস যে!’

একটু চুপ থেকে প্রিয়া উত্তর দিল, ‘কই কিছু হয়নি তো, মাথাটা একটু ধরেছে এই যা।’

দুপুরবেলাতেও খাবার টেবিলে একই জিনিস, যে প্রিয়া একমুহূর্ত বকবক না করে থাকতে পারে না, সেই প্রিয়া এত শান্ত, অথচ আজ আবার নীলাদ্রিও বাড়িতে। অফিস যায়নি। বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি চলতেই থাকে, খানিক বাদে বাদেই শাশুড়ির কাছে ছুটে যায় স্বামীর বিরূদ্ধে নালিশ করতে। আজ হঠাৎ করে তার স্বভাবে এতটা পরিবর্তন সত্যিই বাড়ির লোকের কাছে বিস্ময়কর বই-কি।

খাওয়া শেষ হতেই স্নিগ্ধাদেবী ছোটোছেলে আর বউমাকে ডেকে বললেন, ‘সত্যি করে বল তো তোদের কী হয়েছে রে? দ্যাখ সহেলির মতো আমাকে বোঝাতে যাস না। তোকে পেটে ধরেছি, আর ওকে পেটে না ধরলেও ওর শিরা-উপশিরা সব চিনি। কী হয়েছে বলে ফেল।’

ছলছলে চোখে মাথা হেঁট করে বসে থাকে প্রিয়া।

খানিক চুপ থেকে নীলাদ্রি বলে, ‘মা, ওর বাবা কাল হঠাৎ বিয়ে করে বসেছেন। তাই…।’

স্নিগ্ধাদেবী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মহিলা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বউমা, তোমার রাগ হওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু একবার বাবার জায়গায় নিজেকে রেখে দ্যাখো তো, বাড়িতে বিকলাঙ্গ ছেলে, যে নিজেরটুকু নিজে করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, তার উপর অফিস, এই বয়সে একটা মানুষের পক্ষে কি সবদিক সামলানো সম্ভব? এতদিন তুমি ছিলে, দুজনে মিলে কোনওরকমে পরিস্থিতি সামলেছ, কিন্তু এখন তুমি নেই…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই জল ভর্তি চোখে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘কিন্তু মিনতিদি তো আছে!’

‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু সে তো আদপে একজন কাজের লোক ছাড়া কিছু নয়। তার উপর তুমিই তো বলতে, ইদানীং মিনতি মাঝেমাঝেই ছুটি নেয়। তাহলে সেই অবস্থাতে তিনি অফিস সামালাবেন না ঘর সামলাবেন। বাড়িতে কথা বলার কেউ নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর মুখের সামনে যে কেউ একগ্লাস জল ধরবে, সেরকমও কেউ নেই। তিনিও তো একটা মানুষ। চোখের সামনে অমন সমর্থ ছেলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই… এমন অবস্থায় তারও তো মনের দুটো কথা বলার লোক চাই। আমার তো মনে হয় এই সিদ্ধান্ত ওনার অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত, যে তোমার বাবা-ভাইকে দেখাশোনা করার মতো একজন লোক এসেছে।’

শাশুড়ির কথায় খানিকটা হলেও মন হালকা হয় প্রিয়ার। গত দেড় দিনের ধকলে সে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়া।

এরপর দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। বহুবার চেষ্টা করেও বাবাকে ফোন করে উঠতে পারেনি প্রিয়া, নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে।

হঠাৎ একদিন বিকালে বড়োপিসির আগমন। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই বড়োপিসিকে দেখে বেশ অবাকই হল প্রিয়া। হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট আর ব্যাগ।

‘কিরে ভিতরে আসতে বলবি না?’

মনে মনে রাগ থাকলেও বলে, ‘হ্যাঁ এসো।’

ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে পড়ে বলে, ‘নে এগুলো, তোর জন্যই এনেছি।’

‘আমার জন্য? কী এগুলো।’ প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায় পিসির দিকে। মনে মনে ভাবে আর যাই হোক বড়োপিসি তার জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবে না। ছোটোপিসি হলেও না হয়…। পিসির হঠাৎ এই দরদের কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই, পিসি যেই ব্যাগটা থেকে নারকেলনাড়ু বার করেছিল সেই ব্যাগটার উপর নজর যায় প্রিয়ার। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ সে ঠিকই ধরেছে। এই ব্যাগটাতেই তো তার বাবা দোকান-বাজার করে। এটা থেকে প্রিয়া যেন তার বাবার গায়ের গন্ধ পেল। উৎসুক হয়ে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা তো বাবার ব্যাগ পিসি, তাহলে কি বাবাও এসেছে?’

‘হ্যাঁ এসেছে তো। কিন্তু তোর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে। এই সমস্ত জিনিস তো তোর নতুন মা-ই পাঠিয়েছে তোর জন্য। তোর বাবা তো তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছে রে।’

মা-বাবা দুজনেই বাইরে অপেক্ষা করছিল।

পিসির কথা শুনে সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে দরজার দিকে ছুটে যায় প্রিয়া।

মেয়েকে দেখামাত্রই মেয়ের দিকে অপরাধীর মতো এগিয়ে এসে নরেনবাবু বলেন, ‘আমায় ক্ষমা করে দিস মা, আমি তোর অপরাধী।’

এ ক’দিনে আরও যেন শীর্ণ হয়ে গেছে বাবার চেহারাটা। প্রিয়ার মনে হয় বাবাও যেন এক দুর্নিবার মানসিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাগ নয়, এই মুহূর্তে ভারি মায়া হল প্রিয়ার। যে-অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা, তাতে যে-কোনও সময় কোনও ভারি অসুখে পড়তে পারে। কে দেখবে তখন বাবাকে। ভাবতে গিয়ে মনটা কেমন ভিজে যায়। বাবার হাত দুটো ধরে ধরা গলায় প্রিয়া বলে, ‘না, বাবা এমন করে বোলো না। আমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছি, একবারও তোমাদের কথা ভাবিনি। ভাবিনি যে তোমরা কতটা কষ্টে ছিলে।’

হঠাৎই প্রিয়া অনুভব করে পিঠে কারও একটা নরম হাতের স্পর্শ। ভারি মায়াময় সেই হাত। ঘুরে তাকাতেই এক বছর পঞ্চাশের স্নিগ্ধ চেহারার মহিলাকে দেখতে পায় প্রিয়া। অপ্রস্তুত অবস্থা কাটিয়ে মহিলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া আমি সোমলতা। আমি জানি, তোমার মায়ের জায়গাটা আমি কখনও নিতে পারব না, ভরে দিতে পারব না তোমার মনে তাঁর অভাববোধ। কিন্তু দুটো অচেনা মানুষ, মেরুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে বন্ধুও কী হতে পারে না? হবে আমার বন্ধু?’

প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে যায়। কোনও কথা সরছে না মুখে। কিন্তু সোমলতার আন্তরিকতা তাকে কোথাও যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সমাজ আর সংস্কারে বাঁধা পড়া মনটা যেন শিকল ভেঙে বেরোতে চায়। বাবা ছোটো থেকেই তার আদর্শ ছিল, মানুষটা ব্যতিক্রমী বলে। আজ সেই বাবাকেই যেন আবার ফিরে পায় প্রিয়া।

কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট

গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।

এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।

অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।

বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।

গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।

গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।

পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।

তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।

এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।

গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।

নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।

মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।

হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।

তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।

গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।

এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।

আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।

গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।

গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।

পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।

—বর্ধনদা কেমন আছেন?

গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।

—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।

গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।

মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!

গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।

—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?

—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।

গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।

—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!

এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।

—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।

সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।

গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।

গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?

সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!

—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।

গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।

—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।

—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।

সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।

—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।

—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?

—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।

গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।

ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।

সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।

গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।

দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।

গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।

লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।

রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।

পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।

আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –

মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।

মিতা একটা দামি ব্র‌্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।

শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।

সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।

গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!

ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।

গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।

কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!

তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।

 

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে

সকালবেলা পাঁচকড়িবাবু রেগে একদম অগ্নিশর্মা। তার ছেলে বিটকেলকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছেন তিনি। আশেপাশের বাড়ির একগাদা কুঁচোকাঁচার সাথে দু-একজন মাঝবয়সি মানুষও সেখানে উপস্থিত। মাঝেমাঝেই হাসির রোল উঠছে। আর পাঁচকড়িবাবুর রাগ এবং বিরক্তির পরিমাণও চড়ছে। ছেলেকে তিনি খালি বলছেন, হাঁ কর, হাঁ কর হতভাগা।

বছর ছয়েকের অত্যন্ত বিদঘুটে মার্কা ছেলে বিটকেল হাঁ করছে। পাঁচকড়িবাবু মগে করে ওর মুখে খানিকটা জল ঢালছেন, আর বলছেন, হ্যাঁ, বন্ধ কর মুখ। এবার গেল! কিরে গেল? গেছে এবার? এবারও যায়নি? প্রচণ্ড বিরক্ত হন তিনি, বলেন, হতচ্ছাড়া ছেলে, এক মগ জল গিলে ফেললি আর একটা ক্যাপসুল গলা দিয়ে নামল না? নে, হাঁ কর আবার, হাঁ কর। আবারও জল ঢালেন তিনি।

পাঁচকড়িবাবু কেলেপানা রোগা পাতলা মানুষ। পড়াশোনা কোনওমতে গ্র্যাজুয়েশন অবধি করেছিলেন বাঁকুড়ায়, তারপর কলকাতা চলে আসেন ভাগ্যান্বেষণে। চেনাজানা বলতে পাড়ার নন্টেদা, বাগবাজারে তার কাছেই এসে উঠলেন। হাজার হোক নিজের গ্রামের ছেলে! নন্টেদা থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন নিজের মেসেই। দুটো টিউশনও জুটিয়ে দিলেন একে ওকে ধরে। কিন্তু বহু চেষ্টা চরিত্র করেও তেমন কিছু হল না। শেষে এক পাবলিশারের কাছে কাজ জুটল, প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে, বাইন্ডিং, ছাপাখানার তদারকি, বইপত্র পার্টির বাড়ি পৌঁছে দেওয়া সবই করতে হয় তাঁকে।

এসব করতে করতে মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে। শেষে একটু বেশি বয়সে বাড়ির লোকের পীড়াপীড়িতে বিয়ে ঘটনাচক্রে স্ত্রীর বয়স খুবই কম। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার‌্যা। পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী-অন্ত প্রাণ। বিয়ের আগে তাঁর একটু বদনাম ছিল খিটকেল মেজাজের মানুষ বলে। সামান্য ঘটনাতেই যখন তখন রেগে যেতেন তিনি। এর তার ওপর চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতেন। সেই পাঁচকড়িবাবু বিয়ের পর বদলে গেলেন পুরোপুরি! মুখে তার অমায়িক হাসি মোটে বাসি হয় না। বিয়ের বছর খানেক আগে এসে এ বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি।

ভাড়া বাড়ি, প্রায় পনেরো-ষোলো ঘর ভাড়াটে। বর্গাকারে সাজানো ভাড়ার ঘরগুলি। মাঝখানে বিরাট ফাঁকা স্পেস, সেখানে দু-দুটো পাতকুয়ো, দুটো টিউবওয়ে, তাছাড়া আছে কর্পোরেশনের জলের লাইন। যে-বাড়িতে পাঁচকড়িবাবু ভাড়া থাকেন, তাতে একটাই ঘর, সামনে সামান্য বারান্দা, এক পাশে রান্নাঘর। বছর সাত-আট হল এ বাড়িতে আছেন তিনি।

বিয়ের পর পর পাঁচকড়িবাবুর মেজাজের হঠাৎ পরিবর্তন হলেও তা বেশি দিন টেকেনি। ছেলে হবার পর পরই আবার তা পালটে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে স্ত্রীর সঙ্গে মধুর ব্যবহার থাকলেও বাইরের লোকেদের সাথে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া বাঁধত তাঁর। অনেকে পিছনে তাঁকে খিটকেলে পাঁচকড়ি নামেও ডাকত।

যাইহোক, পাঁচকড়িবাবুর ছেলে বিটকেল প্রচণ্ড রোগা, যাকে বলে, একদম প্যাঁকাটির মতন। কিন্তু তার দৌরাত্ম্যে লোকে সর্বদাই তটস্থ। আশেপাশের ভাড়াটেদের ছেলে-মেয়েদের মেরেধরে গণ্ডগোল বাধায় প্রতিদিন। স্কুল থেকে নালিশ আসে। বছরে তিন-চারবার বই কিনে দিতে হয়, কারণ সে হয় বই হারাচ্ছে, না হয় ছিঁড়ে ফেলছে। ঘরে যতক্ষণ থাকে এটা ভাঙছে, ওটা ভাঙছে, কখনও হাত ভাঙছে, কখনও মাথা ফাটাচ্ছে দুদিন ছাড়া ছাড়া। ছেলেকে নিয়ে একদম নাজেহাল পাঁচকড়িবাবু।

ছেলে এত রোগা বলে ক’দিন ধরেই পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী গুঁতুনি দিচ্ছিলেন, চলো না একটু ডাক্তারের কাছে, চলো না। অগত্যা পাঁচকড়িবাবু উপয়ান্তর না দেখে ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে যান ডাক্তার সরখেলের কাছে। ওষুধটষুধ খেয়ে যদি চেহারাটা একটু সারে।

ডাক্তার সরখেল সব শুনে এবং বিটকেলকে ভালো করে চেকআপ করার পর বললেন, দেখুন পাঁচকড়িবাবু, ছেলে আপনার সুস্থ বলেই মনে হচ্ছে। চেকআপ করে খারাপ কিছু তো দেখলাম না।

—না, না, ডাক্তারবাবু, একদম খেতে চায় না ও। জোর করে, মেরেধরে কোনওমতে দুটো গেলানো হয়। যাতে নিজের থেকে খায় এমন কোনও ওষুধ দিন আপনি! চেহারাটা কিছুতেই সারছে না ওর, বলেন পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, চেহারা যাতে হয় এমন কিছু দিন, গোঁ ধরেন পাঁচকড়িবাবুও।

বাধ্য হয়ে ডাক্তার সরখেল কিছু মাল্টি ভিটামিন ক্যাপসুল লিখে দেন ছেলেটির জন্য। তারপর বলেন, রোজ সকালবেলা ব্রেকফাস্টের পর নিয়মিত একটা করে ক্যাপসুল পনেরো দিন খাওয়াবেন। তারপর ছেলে কেমন থাকে এসে জানাবেন আমায়।

অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে পাঁচকড়িবাবু স্পেশালিস্ট ডাক্তারের হাতে কড়কড়ে একশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে প্রেসক্রিপশন বুক পকেটে ফেলে, ছেলের হাত ধরে গটমট করে বেরিয়ে আসেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে। পিছন পিছন তাঁর স্ত্রী। সোজা এক ওষুধের দোকানে ঢুকে পনেরো দিনের জন্য পনেরোটা ক্যাপসুল কিনে তারপর বাড়ি। যেন এক বিরাট সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ঘরে ঢুকেই বললেন, কি গো গিন্নি, এক কাপ চা পাওয়া যাবে তো?

—দাঁড়াও না, এই তো এলে, আগে হাত মুখ ধোও, গিন্নির মেজাজও ভালোই মনে হল। কিন্তু সমস্যা শুরু হল ঠিক তার পরের দিন থেকে। পাঁচকড়িবাবুর ছেলে বিটকেল কিছুতেই ক্যাপসুল গিলতে পারে না। হাঁ করে মুখে ক্যাপসুল নেয় ঠিকই, পাঁচকড়িবাবু জল ঢালেন ওর মুখে, মাথা পিছনে হেলিয়ে চিবুক উঁচু করে ঢোঁক গেলে সে। জল পেটে চলে যায়, কিন্তু মুখের ক্যাপসুল মুখেই থেকে যায়!

চার-পাঁচ দিন ধরে একই ঘটনা ঘটছে। সকালবেলা বারান্দায় বসে এ কদিন ক্যাপসুল গেলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন তিনি। গরমের ছুটি চলছে। সব ঘরেই বাচ্চারা এখন রয়েছে। বিটকেলের ক্যাপসুল খাওয়ার ঘটনায় মজা হয় জেনে সবাই জড়ো হচ্ছে কদিন এইসময়। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি তার।

পাশের বাড়ির ভটচায্যিবাবু দাঁত মাজতে মাজতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট ধরে চলছে ক্যাপসুল গেলানো পর্ব। ব্যাপার-স্যাপার দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। বললেন সক্কাল সক্কাল ভালো কেলো শুরু করলে হে পাঁচকড়ি।

—আর বলবেন না দাদা, হতচ্ছাড়া জ্বালিয়ে মারল। একটা ক্যাপসুল গিলতে পারে না অথচ ইয়া বড়ো বড়ো রসগোল্লা টপাটপ গিলে ফেলে।

—এক কাজ করো না পাঁচকড়ি। ব্যাটাচ্ছেলেকে ক্যাপসুলটা জলে গুলে খাইয়ে দাও না, প্রস্তাব দেন ভটচায্যিবাবু।

সে চেষ্টা আর করিনি ভাবছেন! এই তো গত পরশু সে রকমই করলাম। তা সেটা গিলেই ছেলের চিল চিত্কার, তেতো, তেতো, মরে গেলাম, বাবা-রে, মা-রে করে বাড়ি মাথায় তুলল একদম। শেষমেশ গোটা বারো রসগোল্লা খাইয়ে নিস্তার পেলাম। বলুন তো দাদা, দু টাকার ক্যাপসুলের জন্য যদি রোজ ষাট টাকার রসগোল্লা খাওয়াতে হয় তো আমি যাই কোথায়?

—ঠিক, ঠিক, সমস্যাই বটে, হাসতে হাসতে বলেন ভটচায্যিবাবু। তারপর হঠাৎ বিটকেলের পিঠে একটা থাপ্পড় মারেন তিনি, বলেন, কী রে ছেলে, একটা ক্যাপসুল গিলতে পারিস না?

—কী করব, যাচ্ছে না তো, ব্যাজার মুখে বলে বিটকেল।

—যাচ্ছে না তো, রাগের চোটে ভেঙিয়ে ওঠেন পাঁচকড়িবাবু, যাবে কী করে? বলি যাওয়ালে তো যাবে।

হো হো করে হেসে ওঠে আশেপাশের সকলে, হাসেন ভটচায্যিবাবুও।

এমন বাঁদর ছেলে মশাই, কী বলব আপনাকে। আবার বলতে থাকেন তিনি, কাল রাতে একেই তো সারারাত কারেন্ট ছিল না, হতচ্ছাড়া এমন হাত-পা ছোড়ে ঘুমাবার সময় যে বলার কথা নয়। এক গাদা মশা ঢুকিয়েছে কাল মশারিতে। বাইরে সেজের আলোয় তেমন দেখা যায় না। কোনও মতে হাঁটু মুড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মশা মারছি আমি। হতচ্ছাড়া ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বলে কিনা, বাবা, কী হয়েছে তোমার? এত রাতে তাই তাই দিচ্ছ কেন?

আবার হাসির রোল ওঠে, ভটচায্যিবাবু জানতে চান, তারপর?

—তারপর আর কী? হতভাগাকে দিলাম এক উড়নচাঁটি। বিটকেলকে বলেন, হাঁ কর হতচ্ছাড়া, হাঁ কর আবার। ওর মুখে জল ঢালেন যথারীতি, বলেন, নে গেল। গিলে উদ্ধার কর আমায়।

বিটকেল চোখ বন্ধ করে, এবার মাথা নীচু করে চেষ্টা করে গেলার। টুক করে ক্যাপসুল চালান হয়ে যায় পেটে। সে বলে, বাবা, নেই।

—নেই? মানে গিলে ফেলেছিস? বিস্মিত পাঁচকড়িবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন। তারপর কনফার্ম হতে বলেন, হাঁ কর দেখি। বিটকেল হাঁ করে, বিশ্বরূপ দর্শন করেন পাঁচকড়িবাবু, তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন, ওঃ বাঁচা গেল, এতক্ষণে গিললি?

সকলে হইহই করে উঠল, গিলেছে, গিলেছে। দল বেঁধে দৌড়ে চলে গেল বিটকেল আর সঙ্গীসাথিরা।

ভটচায্যিবাবু বলেন, তোমার ছেলের নামটা খুব ভেবেচিন্তেই রেখেছিলে কিন্তু।

—ওর নাম তো তিনকড়ি। কে যে ওর নাম দিল বিটকেল কে জানে! হঠাৎ শুনি সবাই বিটকেল, বিটকেল বলে ডাকছে।

—যে-ই দিক নামটা একদম সঠিক দিয়েছে কিন্তু, হাসতে হাসতে বলেন ভটচায্যিমশাই।

—আমারও মাঝে মাঝে তাই মনে হয় দাদা, বলেন পাঁচকড়িবাবু। ব্যাটাচ্ছেলেকে স্কুলে নিয়ে গেছিলাম, ভেবেছিলাম ক্লাস টুতে ভর্তি করাব। হেডমাস্টারমশাই বললেন, তোমার বাবার নাম লেখো, একটা চক এগিয়ে দিলেন ওর হাতে।

মনে মনে ভাবলাম, যাক হেডস্যার ভালো প্রশ্নই দিয়েছেন, কারণ ওকে বহুবার শেখানো হয়েছে বাবার নাম। নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি। ও বাবা, ছেলে আমার লিখে বসল, আমার বাবার নাম পাঁচকড়ি হালদার দাঁড়ি!

আমি অবাক, হেডমাস্টারমশাইও অবাক। দুজনে দুজনার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। হেডস্যার বললেন, কী ব্যাপার খোকা, মুখে একটু আগে বললে বাবার নাম পাঁচকড়ি হালদার, লিখলে পাঁচকড়ি হালদার দাঁড়ি?

ছেলে নির্বিকার ভাবে বলল, কোনও কিছু লিখলে শেষে দাঁড়ি দিতে হয়।

—কিন্তু সে তো লম্বা দাগ টেনে, এই রকম, বলে চক নিয়ে মাস্টারমশাই নিজে বোর্ডে লিখে দেখালেন।

ছেলে বলল, ওরকম দিলেও হয় এরকম দিলেও হয়। এমন বেঁড়ে ওস্তাদকে কে নেবে স্কুলে। হেডমাস্টারমশাই রেগে গিয়ে বললেন, আপনার ছেলের কোথাও গণ্ডগোল আছে মশাই। ওকে নিয়ে যান, আমার স্কুলে অমন ছেলে ভর্তি নিই না।

শেষে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে হাতে-পায়ে ধরে হতভাগাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করি।

হাঃ হাঃ হাঃ, করে হাসিতে ফেটে পড়েন ভটচায্যিমশাই।

ঠিক সে সময় পাঁচকড়িবাবুর চোখ যায় ভাড়াটে বাড়ির প্রধান ফটকের দিকে।

যে-ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, সে পাঁচকড়িবাবুর এক ভাই জগন্নাথ। সে এ বাড়িতে আগে কখনও আসেনি। পাঁচকড়িবাবু মুহূর্তে বুঝে যান জগন্নাথ কী জিজ্ঞাসা করছে। তিনি গলা চড়িয়ে বলেন, জগা, এদিকে, এদিকে।

দ্রুত এগিয়ে আসে জগন্নাথ তার দাদার দিকে, তার মুখ চোখ থমথমে। সশঙ্কচিত্তে পাঁচকড়িবাবু ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে বলেন, কী ব্যাপার জগা, কী হয়েছে রে?

—দাদা, বাবা আর নেই গো দাদা। বলেই কেঁদে দুহাতে মুখ ঢাকে জগন্নাথ।

ঘটনার আকস্মিকতায় খানিক হতবাক হয়ে যান পাঁচকড়িবাবু, পাশে দাঁড়ানো ভটচায্যিবাবুও কোনও কথা বলতে পারেন না। বহুদিন বাড়িছাড়া, তাই ওদিকের টান কম ছিল পাঁচকড়িবাবুর। বিয়ের পর শেষ বাড়ি গেছেন দু’বছর আগে। তখনও বাবা চুয়াত্তর বছর বয়সে গ্রাম্য জলহাওয়ায় বেশ ফুরফুরে ছিলেন। মনে হয়নি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন! বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে ওঠে পাঁচকড়িবাবুর, চোখের কোল ভিজে ওঠে অজান্তে।

কিছু সময়ে মধ্যেই তিনি স্ত্রী-পুত্রসহ জগন্নাথের সঙ্গে রওনা হন দেশের বাড়ি। প্রাথমিক কান্নাকাটি সারা হলে শুরু হল শবদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার তোড়জোড। একে একে সব ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনেরা জড়ো হলে কাঁধে ওঠে শবদেহ। ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল, বলো হরি।

শ্মশানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা। গ্রাম দেশ, নদী পারে শ্মশান। মাথায় পূর্ণিমার  জ্যোত্স্নায় ম ম করছে চারপাশ। প্রয়োজনীয় মন্ত্রতন্ত্র পাঠের পর পাঁচকড়িবাবুর পিতৃদেবকে তোলা হল চিতায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। উপস্থিত মেয়েরা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কেউ কেউ। অপেক্ষাকৃত বড়োরা শোকাহত, বিমূঢ়!

হঠাৎ পাঁচকড়িবাবুর ছেলে চিত্কার করে নাচ জুড়ে দিল, আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের…

আবছা অন্ধকারে পাঁচকড়িবাবুর মুখের অভিব্যক্তিটা বোঝা গেল না।

মনসাসুন্দরী

ওই যে ধন্যিমেয়ে বইতে উত্তমকুমার দাঁত মুখ খিঁচোয়ে ওর অমন সুন্দর ভাইডারে বলতিছিল গো, এই বগলা গোল দে, এই বগলা গোল দে, ত্যাকোন থে মুঁই বগলার প্রেমে। আহা, কচি কলাপাতার মোতন ডগমগে রূপ ঝ্যামোন, আর নামডাও তেমনি ডাংগুলির গুলি ঝ্যানো। বনবন করি হাওয়ায় ঘুরতি ঘুরতি বুকের ভেতর সেঁইধে যায়।

বেশি লোকজন নেই। কাজের সুবিধেই হয়েছে। স্টেশনের দুচারজন দোকানদার কলকাতার বাবুদের দেখে পায়ে পায়ে এসেছে। তা আসুক। এটুকু ঝক্কি সামলেই ওরা কাজ করে।

তা যা বলেন বাবুরা, ত্যাকোন থে মোর মাথাটা লড়বড়ে হুয়েছে। ওই যে গেরামের মাঠে তাঁবু খাটায়ে বই পড়ল। মুঁই ধন্যিমেয়ে দ্যাকলাম। ব্যাশ, মোর প্রেম পালো। মনে মনে ঠিক করি নিলাম, না আর মুঁই মাঠে গোবর কুড়ব নে। মোর একখান বগলা চাই-ই চাই। আর সারা দিনমান ঘরে, বাইরে, পুকুরঘাটে— ঝিদিক পানে যাই না ক্যান, সিকেনেই গানখানা গুনগুন করি। জয়া ভাদুড়ি গেয়েছিল গো। বইয়ে তার নাম মনসা ছেল। আর মোর নামও মনসা। হি হি হি!

তা দিদি, ওই গানটি একটিবার শোনাও আমাদের! মদন, ভাই দোকানদারকে বল না, টিনের গেলাসে দু-কাপ চা আর কয়েকটা ভালো বিস্কুট কাগজে মুড়ে দিতে।

সামনে থেকে টিনের গেলাস তুলে নিয়ে মদন নামে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মের স্টলে চা আনতে গেলে বেশ উৎসাহ লাগিয়ে মনসা বলে ওঠে, চা খাওয়ার আগে গাতি হবে, না কি পরে গাবানে?

দিদি, তোমার মন চাইলে এখনই গাইতে পারো।

মনসা মাথাটা চুলকে নেয়। উকুনগুলো সড়সড় করে চলে ফিরে কিছু বলছে। ও কান পেতে ওদের কথা ধরার চেষ্টা করে। এক কানে হাত চাপা দিয়ে অন্য কানের দিকে চোখ আর মন যত্ন করে লাগায়।

তার একমাথা চুল কাকের বাসার মতো নয় ঠিক, তবে বেশ এলোমেলো। মাঝে মাঝে চুলকোয়। তবে উকুন মারে না সে। উকুনরা যে তার আশ্রয়ে আছে। গুটি কয়েক প্রাণকে সে তার এই বিরাট মাথার ভেতর আশ্রয় দিয়েছে, তা কী এমন বেশি! তাছাড়া সন্ধের পর এই নির্জন প্ল্যাটফর্মে কার সাথে কথা কয়ে সময় কাটাবে! ওরা না থাকলি অমন থেবড়ে বসা রাতখানা কাটায় কী করে সে! ঘুম তো আসতি চায় না। ওদের সাথেই তো সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে ভোরের ট্রেনের খবর নেয় কানে। প্যাসেঞ্জারের পায়ে শব্দে মনে আরাম হয়।

সুধাময়, প্রাণেশ, টিঙ্কু-রা নানা কোণ থেকে ছবি তুলছে, তবে গোপনে। স্টেশন চত্বরের চার-পাঁচজনের ভিড়টা লক্ষ করেনি যে ছবি উঠছে খেপির। তারা দেখছে একজন নীল জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা সুন্দর মতো লোক মাটিতে পা মুড়ে বসে খেপির সাথে কথা বলতে লেগেছে।

কদবেলের দোকানদার উবু হয়ে বসে সবটা বুঝতে চাইছিল। সে বলল, গা তো খেপি ওই গানটা। কদবেল মাখা দেব দুপুরবেলায়। গা।

প্যাসেঞ্জাররা তাড়াহুড়োয় দেখে না সবটা। কদবেলওলা বেল ফাটিয়ে চিনি, লংকা, নুন, ধনেপাতা আর কাসুন্দি দিয়ে মেখে তুলে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে। কিন্তু গেলাসের নীচে খানিকটা যে ফেলে রাখে দোকানদার তা নজরে পড়ে না খদ্দেরদের। আর পরেরটা বানানোর আগে দোকানদার চামচ দিয়ে টেনে তুলে তা একটা বাটির ভেতর রেখে দেয়। দুপুর পর্যন্ত যা জমে তা খেপিকে এক ফাঁকে দিয়ে আসে।

মনসা উকুনদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুঙ্গি পরা, বুক খোলা পেট উঁচু ওই কদবেল দেওয়া লোকটার দিকে। তার চোখের তারায় মেঘ ঢোকে। ছায়া লাগে মুখে, বুকের ভেতর জয়া ভাদুড়ির সেই আদুরে আর অভিমানী মুখের ঢল নামে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, গলা খুসখুস করে। কথা হয়, কিন্তু কেউ শোনে না। শুধু মনসা ঠোঁট নাড়ে জয়া ভাদুড়ির মতো। উকুনেরা দিব্যি শুনতে পায় তা যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

ভিডিও রেকর্ডিং করছিল যে মোবাইলগুলো, তারা একটু একটু এগিয়ে আসে। প্ল্যাটফর্মের একটা গোটা দিক, রেল লাইন, সিগন্যাল, স্টেশনের নাম লেখা কংক্রিটের বোর্ড, একটা খেঁকুরে কুকুরের হেঁটে যাওয়া কিছুই বাদ যায় না। তারা মোবাইল ফোনের লেন্স মনসার দিকে যতটা পারে জুম করে। সামনে বসে গল্প করতে থাকা ওদের এডি শুভঙ্করের ছবিও একই ফ্রেমের ভেতর রাখতে হবে যে।

মনে হয় এবার গান শুরু হবে। গান আর মুখের প্রথম অভিব্যক্তি ধরা চাই। তারপর কলকাতায় ফিরে, এডিটিং করে, মনসা পুজোয় মনসার গান ক্যাপশন দিয়ে ইউ টিউব-এ ছাড়বে কাল। কাল যে শ্রাবণ মাসের শেষ, মনসা পুজো।

টিউবে ওদের চ্যানেলের নাম দ্য নেচার। কৃত্রিমতাহীন সবকিছুই ওদের সাবজেক্ট। বাজারে খাসি কাটার দৃশ্য, তার ব্যা ডাক, আর অল্প পা-দাপানো যেমন থাকে, তেমনি ঘুঘু পাখি, পায়রা বা ফড়িং-এর সোহাগদৃশ্য হাঁ করে দেখছে তিন-চার বছরের বাচ্চারা, তাও দেখায়।

ওরা চায় প্রাকৃতিক কিন্তু অড সাবজেক্ট। এই আগস্ট মাসের শুরুতেই একটা ভিডিযো গোটা ইউ টিউবে হইচই ফেলেছে। সেটা ছিল, হাত-পা হীন এক কিশোরীর সমারসেট ভল্ট। সে গ্রামের দিকে হাটে বাজারে খেলা দেখায়। সুন্দরী মেয়েটি একেবারে পেঙগুইনের মতো কোমরের নীচে একটুকু ছড়ানো থাই দিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই সে মাটি থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে আবার দাঁড়ায়। এরপর সে মাদারি খেলার মতো দুটো বাঁশের আগায় বাঁধা দড়িতে উঠে যায়। তার তো হাত নেই। সে ব্যালান্সের লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে দড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাবার ডুগডুগির বাজনা কানে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফেরে। ফিরে আসে দড়ির মাঝখানে। সেখান থেকে সে মুখের সরু বাঁশটি ফেলে দেয়। ডুগডুগিতে দ্রিমি দ্রিমি দ্রুতলয়ে বাজে। সে ওখান থেকে ঝাঁপ মারে মাটিতে। শূন্যে দুটো-তিনটে ভল্ট দিয়ে সে অনায়াসে মাটিতে দাঁড়ায় থপ করে। তার ঘন করে লাল করা ঠোঁট খুলে যায়, এক ঝলক সাদা দাঁত হাসির বিদ্যুৎ ছড়ায়।

মনসাদি গাও।

এটা কলকাতার বাবু, সামনে যে বসে আছে, তার গলা। যে এসেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। তার কথা মান্যি করবে না তো মদনার কথা শোনবে! তারপর বাবু একেবার মনসার সঙ্গে মাটিতে বসেছে। কেমন লেপটে বসেছে। হি হি হি স্টেশনের ধুলো-ময়লার কোনও জ্ঞান-গম্যি নাই বাবুর। তারে কেমন নিজের নিজের লাগে মনসার। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেলল, গাইব! কোনটা গাতি হবে বল ত?

মদন চায়ের গেলাস আর পাউরুটির ঠোঙায় জড়ানো বিস্কুট নিয়ে সিনের ভেতর এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে। এখানে তো কাট, ক্লাপস্টিক-এর ব্যাপার নেই। মনসা চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই একটা মোবাইলে ধরা পড়ে তার মুখে কী সরল হাসির ঝিলিক খেলে গেল। মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মুখ বার করার মতো। তারপর সে কাগজে মোড়া হাতের বিস্কুট থেকে একটা লম্বা বিস্কুট নিয়ে চায়ের গেলাসে ডুবিয়ে কামড় দিল।

আহ! কি দারুণ দাঁত! একেবারে সুচিত্রা সেন না!

প্রাণেশ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল টিঙ্কু। এই যে গান হবে হবে করে হচ্ছে না, তাতে ওর বিরক্তি লেগে গেছে। আর অফিসের বস ইচ্ছে করে ওকে পাঠিয়েছে এত দূরে। শয়তানি আর কী! না হলে কলকাতার মেয়েকে এতটা দূরে সমুদ্রগড়ে পাঠানো কেন!

প্রাণেশ টিঙ্কুর দিকে ফিরে বলল, যা বলেছিস। একে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখে কাজল আর চুলের কলি কানের উপর টেনে বের করে একখানা সাদা কালো হাসির সাইড ভিউ তুলে নিলে দর্শকরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবে। কে কত উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখেছে, আর তাঁদের সিনেমা দেখে প্রেম করতে শিখেছে কেমন ভাবে দিব্য ঘোরের ভেতর ঢুকে যাবে। সাবস্ক্রাইব করে ফেলবে এক দিনেই কয়েক হাজার।

খেপি, তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ কর। গানটা গা।

ওই লুঙ্গি পরা লোকটা আবার এন্ট্রি নেয়। কী করবে, খানিকটা মস্করাটস্করা করে সময় কাটাতে চায় কদবেল, আমড়া, কল-ওঠা ছোলার দোকানদার। ট্রেনের ঘন্টা হয়নি। ট্রেন না এলে তার খদ্দের নেই। পরের আপ ট্রেন ঢুকতে এখনও ঘন্টাখানেক।

চায়ের ভেতর বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে মনসা ডুব দিয়েছে ভাবনায়। এই যে সামনে উবু হয়ে বসে আছে বুক খোলা দোকানদার, সে যে কদবেল আর ছোলা খাইয়ে কতবার তাকে খেয়েছে সন্ধাবেলায় নদীর চরে নিয়ে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেহুলা নদীর পাশে সরু কাশ বনের ভেতর অনেকখানি জায়গা বেশ পরিষ্কার। কাশ আর হোগলা শুকিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা বিছানার মতো করে রাখা। সেসব খুব মনে পড়ছে এখন মাথা নীচু করে থাকা মনসার। এই কদবেলের কারবারি ছাড়াও লাইনের ওপারে ভাতের হোটেলের থালাবাসন ধোওয়ার লোকটাও তাকে নিয়ে গেছে কয়েকবার সেখানে। বদলে সে প্রায় সন্ধেতে দুটো আলাদা আলাদা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখা সারাদিনের হোটেলের খদ্দেরদের ফেলে দেওয়া ভাত তরকারি এনে দেয়। মনসা আরাম করে খায়।

তার এখন মনে এল, এই লোকটার বাচ্চা তো সে পেটে ধরেছিল। সেটা ছেলেই হবে। আর ওই হোটেলের লোকটার মেয়ে তারা সব কোথায় গেল! ওরা সব কোথায় গেল! হারিয়ে গেল! মনে পড়ল তার, চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

হেমন্তের গান। বগলার সাথে ভাব হবার পর বগলা রেডিও কিনে দিয়েছিল। লাল টুকটুকে রেডিও। সেখান থেকে শুনে শুনে কত গান যে শিখেছে সে।

মনসা জানে এই যে সে বিড়বিড় করে কথা কইছে, গান গাইছে, উকুনেরা সেসব শুনছে কান পেতে। তখন ওরা চুপ করে থাকে। মাথায় নড়াচড়া করে না। মনসার মাথা চুলকোতে হয় না। এই কথা বলা বা গান গাওয়ার তালে মনসা ওদের জব্দ করে রাখে। ওরা ভালো ছেলেমেয়ের মতো মনোযোগী হয়। মনসার গান, গল্পে মজে যায়।

মনসা চুপি চুপি মুখে মৃদু হাসি টেনে এখন মাথা নিচু করে ওদেরই শোনাচ্ছে সব। উকুনদের শোনাচ্ছে মনসার পুরোনো জীবন। অনেকগুলো বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ ওদের তিনজনকেই নবদ্বীপ স্টেশনে ভিক্ষা করতে রেখে এসেছিল এই কদবেল ব্যাপারী-ই। তখন বয়স অনেক কম, শরীরে যৌবন থইথই করছে।

শ্রীচৈতন্য ভক্তরা স্টেশনে নেমে গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখত একখানা রাধা যেন বসে আছে। দিতও হাত খুলে। মেলা মানুষ, মেলা পয়সা। কিন্তু ভিড় যে-ভালো লাগে না মনসার। একদিন ট্রেনে চেপে নিজে নিজে ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়। বাচ্চা দুটোর কথা ভুলেই মেরে দেয়। তা সে দুটো গেল কোথায়! এতদিনে তো ডাগর হওয়ার কথা!

মদনাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছে সকলে। ওর কোনওদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। কোন সময় কী করা উচিত, তা নিজে নিজে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। একদম কলের পুতুল। তা না-হয়ে ওর উপায় কী! অভ্যাস অভ্যাস! ও যে-মাছের দোকানে কাজ করত আগে, সেখানে তো ছিল ভিড় আর ভিড়। সকালবেলায় দম ফেলার ফুরসত নেই। মাছ মাপার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ছাড়াতে হতো। তারপর দোকানদার মাছ কাটতেই ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকা। সেই মাছের ডাক্তার রুইমাছের মাথার ভেতর সন্না ঢুকিয়ে একটা গোলমতো সাদা কড়াইয়ের দানা টেনে বের করে নিজের বাঁ হাতের তালুতে লাগিয়ে নিয়ে চলে যেত। তখন মদনের কাজ মাছের মাথার কানকো ফেলে দেওয়া। তারপর সাদা পলিথিনের প্যাকেটে মাছ ভরা আর গুছিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া। এই রুটিনের বাইরে তার তো ভাবার কোনও অধিকার নেই। দুপুরের দিকে দোকান গুটোনোর কাজ, মাঝেমধ্যে খইনি বানানো সেসব এক্সট্রা। অন্যমনস্ক হলেই চোদ্দো-গুষ্ঠির আকাশ থেকে নেমে আসার মতো গালাগালির বৃষ্টি। একদিন তো সেই মাছের ব্যাপারী লাথি মেরেই বসল ভরা বাজারে, অত লোকের সামনে। সেই দিনই মদন কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে প্ল্যাটফর্মে সে জুতো পরিষ্কার করে। তাতে কম টাকা হলে হোক, কারও কথা তো শুনতে হয় না।

মদনও দেখল মনসাদি চায়ের গেলাসে বিস্কুট ডুবিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আর গেলাসের ভেতর দেখছে। সে বুঝতে পারল বিস্কুট ভিজে গিয়ে হাত ছুটে গেলাসের নীচে পড়ে গিয়েছে। সে এক দৌড়ে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে একটা চামচ এনে দিতেই মনসাদির হাসি মুখ থেকে সারা গালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন চাঁদ ঝাঁপিয়ে পড়ে কোজাগরীতে। সে চামচ দিয়ে গোলা বিস্কুট তুলে তুলে খেতে লাগল।

কী চার্মিং না! কী সরল না! প্রাণেশ একেবারে বিগলিত। সে টিঙ্কুর চোখে চোখ রাখে।

জানিস, আমার ছোটোবেলায় এরকম হতো। দুধের ভেতর ঢুকে যেত বিস্কুট। আঙুল দিয়ে তুলতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগত। তখন বাধ্য হয়ে সব দুধটা চোঁ চোঁ মেরে দিতাম ওই বিস্কুট খাবার লোভে। অনেককাল পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল মায়ের কারসাজি। মা বিস্কুট চুবিয়ে খেতে বলত। কারণ আমি একদম দুধ পছন্দ করতাম না।

ঢং ঢং করে বড়ো একখানা ঝোলানো রেলের পাতের গায়ে ছোটো লোহা পেটানোর শব্দ হল। জুতোকালি করা ছেলে মদন, শুভঙ্করের কাছে উবু হয়ে বসেছিল। সে বলল, আপ ট্রেনের খবর হল। তবে আসতে আসতে এখনও মিনিট চল্লিশ। এই ফাঁকে গানটা না হলে আবার লোকজন যে-জমে যাবে দা! মনসাদির গানের মুড আনতে তখন আবার সময় লাগবে। তখন সে ভিক্ষে করবে। বলবে দাও, দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।

শুভঙ্কর যে কথাটা ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতায় জানে, জোরাজুরি করে এদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি বের করা যায় না। এদের মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারলে, তবে নদী কি ঝরনার দেখা মেলে।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল গো?

মনসা মুখ তুলে বাবুটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে। তা আমি কতি পারব নাকি! আমার কি তা মনে আছে!

তোমার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে না? শুভঙ্কর ইচ্ছে করে বরের কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী জানি সেখানে কোনও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিরাগ থাকতে পারে। এরকম পথের ভিখিরি মেয়েরা একশোটার মধ্যে প্রায় একশোটাই স্বামী খ্যাদানো হয়।

মনসা শুভঙ্করের মুখের উপর তার আয়ত চোখ ফেলে রেখে মাথা নাড়ল। না মনে পড়ে না।

মুখে খানিকটা মেঘ উড়ে এসে বসেছে। মনসা চেষ্টা করছে মায়ের কথা মনে করতে। চেষ্টা করছে বাবার মুখটা কেমন ছিল স্মৃতির ভেতর দেখে উঠতে। কিন্তু শীতের দিনের ভোরবেলায় যেমন ধু ধু মাঠ থাকে, গাছপালা, বাড়িঘর কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না, সেরকমই ওই সাদা জলছাপের ভেতর থেকে দুখানি মানুষের চেহারা বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মনসার চোখের উপর ভাসছে কালো কালো দুটি ছবি, ছটফট করছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

শুভঙ্করের চোখে পড়েছে মনসার মুখের উপর থেকে ঝকমকে ভাবখানা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে মনসাকে এই আটকে পড়া অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। মনসাদি, তোমার যে-একটা ছাগলাছানা ছিল, বলো, তার কী হল!

একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছুঁয়ে দিয়েছে শুভঙ্কর। এই ছুটে বেড়ানোর কাজ করেও সে কবিতা লেখাটা ফেলে দিতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই লেখে। আর সে তা লেখে মানুষের নরম মনের কাছে পৌঁছোতে। বছরে পাঁচ-ছটা লিখলেও সই। সে জোরাজুরি করে কবিতা লেখে না। কবিতা তার কাছে ধরা দিলে সে লেখে।

মনসা ছটফট করে উঠল। সে তার গায়ে কাপড় টেনেটুনে নিয়ে বাবুটির আরও একটু কাছে ঘষটে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, মোর তো ছাগলছানা ছেল না। মোর ছেল এক সাদা ধবধবে বাছুর। ওরে নে মুঁই মাঠে যাতাম ঘাস খাওয়াতি। আমাগে ছেল ধুধু করা মাঠ, আর তার ভেতর দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া নদী। আমাগে ধানের খেত ছেল, পাটের খেত ছেল। আর পুকুরভর্তি হাঁস। ঝুপঝুপ করে ওদের সাথে সাঁতার কাটতাম। সারাদিন মাঠেঘাটে চই চই। লাল লাল চুকোই ফল তুলতাম কোঁচড়ে। তারপর নুন মাখিয়ে পা ছড়িয়ে খাতাম। ওরা সব কোথায় গেল? হারিয়ে গেল। চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

আহা কী মিঠে সুর! ফিসফিস করল প্রাণেশ। টিঙ্কুর চোখটা যেন একটু ভিজে। কিন্তু দারুণ, দারুণ। পুরোটা তুলেছে। দুজনে দুরকম অ্যাঙ্গেলে। ওরা জানে, সুধাময়ও তুলছে অন্যদিক থেকে। বড়ো মুভি ক্যামেরায়। লোকজনের ভেতর থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে ওর ফোকাস। ছেলেটা ছমাসের সিনে কোর্স করেছিল। স্পেশাল পেপার নিয়েছিল ক্যামেরা। ওর অনেক সাধ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে। কিন্তু শিকে ছিঁড়তে পারেনি।

শুভঙ্কর উল্লসিত। মনসা মন মেলছে। শুভঙ্কর যে-মনে মনে নিজেকে মনের ডাক্তার ভাবে। সে মানুষের মনের উপর যে-কালো মেঘ এসে জমে, তাকে ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চায়। তাইতো এরকম অ্যাসাইনমেন্ট পেলে সে লুফে নেয়।

কী ওলট পালট গাইছিস রে খেপি! তোর গান গা। ওই যে চোখ গেল, বয়ে গেল! সেই গান।

আরে মশাই, সেই তখন থেকে আপনি ওস্তাদি করছেন। কে আপনাকে বলতে বলেছে! এখানে বসলে, চুপ করে বসুন। সমস্ত মাটি করে দিলেন! আপনার গান আমরা রেকর্ড করতে আসিনি কলকাতা থেকে। মনসাদেবীর গান শুনতে আর রেকর্ড করতে এসেছি।

কদবেলওলা বমকে গেছে ওই তাড়া খেয়ে সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, তার ঠিক পাশেই এক বাবু মোবাইল ক্যামেরায় ফটো তুলে যাচ্ছে। সে খানিকটা শঙ্কিত হয়। সত্যিই তো। তার কথা বলা উচিত হয়নি। সামনের বাবুটি খুব রেগে গেছে।

শুভঙ্করের রাগ শুধু রেকর্ডিং-এর সমস্যার জন্য নয়। এই যে মনসা নিজে নিজে চেষ্টা করছিল তার মনের কালো অংশ সরিয়ে যেটুকু ভালো, তা সামনে আনতে, সেটাতে হোঁচট খেল তো! পারবে সে, আবার পারবে! শুভঙ্করকে দোলাচল ঘেরে।

মনসা শুভঙ্করকে আশ্বস্ত করে। সে তার মনের দরজা বন্ধ করেনি। বলে, তালে, ওই গানখান গাই বাবু! ওই গানখান গালি আমার যে খুব প্রাণের আরাম হয়। আমার বগলা সামনে আসি দাঁড়ায়। আমার গানখান শুনে সে ঝরঝর করি কাঁদে, আর বলে, তোরে নিয়া পালায় যাবানে রে মনসা। আর একানে থাকবনি। পালায় গিয়া বিয়া করবানে।

বলতে বলতে মনসা গান ধরে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

খুব নরম হয়ে গেছে শুভঙ্করের মন। ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে। সে জানে যত বেশি সম্ভব রেকর্ডিং হবে, তত ভালো। ৫০ মিনিট তুললে তবে কেটে ছেঁটে সাচ্চা ৩০ মিনিট বানাতে পারবে। ইউ টিউব চ্যানেল ৩০ মিনিটের জন্য ভিডিযো দিলে এবং সাবক্রিপশন ৪০ হাজার ছাড়ালে ভালো টাকা দেয়।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তা তোমার বগলার সাথে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে?

মনসা একটু লজ্জা পেয়েছে যেন এমন একটা ভাব করে শাড়ির আঁচল মাথায় নিয়ে আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাঁ পালায় গেলাম তো। বগলা একদিন ভোর রাতে মোর হাত ধরে পলান দিল। তারপর কত টেরেন চাপল, বাস চাপল, ঝালমুড়ি খাওয়াল। কত গেরাম ছাড়ায়ে কোন দেশের দিকে যাতি লাগল যে, জানি না। এক চড়ক মেলায় বগলার সাথে আলাপ হয়ে ছেল, আবার পালাতি পালাতি অমন এক মেলার মাঠে গিয়ে বগলারে হারায় ফেললাম। আর পালাম না বগলারে।

শুভঙ্কর বুঝে ফেলেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর খপ্পরে পড়েছিল মনসাদি। তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেকথা এখানে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু এই যে মনসা অনেকটা নিজের কথা বলতে পারল, অতীত বলতে পারল, তা অনেক। শুভঙ্কর জানে এই মনসার মুক্তি গানে। কিন্তু গান করার সুযোগ কোথায় পাবে সে! আর শুভঙ্করেরও এমন কিছু ক্যাচ নেই যে মনসার জন্য কিছু করতে পারে। দ্য নেচারের এপিসোডটুকু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সে সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টর কলকাতার বাইরে যেতে চায় না বলে শুভঙ্কর বাইরে এসে এই স্বাধীনতাটুকু এনজয় করে। নিজের মতো করে বিষয়টা সাজায়, শুট করে। মোবাইলে ভিডিও তোলে। আর তার নিজের সোশাল সাইটে একটা প্রিলিউড-এর মতো করে পোস্ট দেয়। তাতেই আনন্দ।

ফিরে যাবার আগে টিঙ্কু বলল, শুভঙ্করদা, মনসাদির লুকের ভেতর একটা সুচিত্রা সুচিত্রা ভাব আছে না! তুমি আমার মোবাইলে দ্যাখো। এই যে ওর দাঁত মেলে হাসি। শাড়ি পরিয়ে সুধাময়দার ক্যামেরায় একটা দুটো লুক শুট করলে হয় না!

স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সামান্য তিনশ টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে আনা হল। মনসাদি যথেষ্ট ফরসা। তোলা কাপড় পেয়ে সেও ডগমগ। আর এবার সুধাময়ের এক্তিয়ার। সে নানা পোজে ছবি তুলল মনসার। সুধাময় তার শেখার সবটা দিয়ে প্রায় নিখুঁত সুচিত্রা লুক দাঁড় করিয়ে দিল।

দুই

এই দাদা, তুই কনে রে! তখন থেকে কল করতিছি, কিছুতেই লাগতিছে না।

মুঁই গাড়ি চালাইতেছি রে, একটু বাদে তোরে ফোন দি?

পাঁচ মিনিট হয়নি আবার সে ফোন করে। সে যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। তাছাড়া দিদিভাই, মানে যে-বাড়িতে সে কাজ করে, সে গেছে গড়িয়াহাটে। দাদাবাবু অফিসে যাবার পর ফোন করে কয়েকটা জিনিস আনতে বলেছে। তার টুর আছে কালই। চম্পা ফাঁকা বাড়িতে বসে মোবাইল দেখছে আর ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। এক একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেকক্ষণ। সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মা যদি চিনতে পারে তো আর দাসীগিরি করতে হয় না। মা তো এখন খুবই জনপ্রিয় মানুষ। টাইম লাইন ভরে যাচ্ছে মায়ের ফটোতে। শেয়ার হয়েছে কত কত। মায়ের চেহারার কী খোলতাই হয়েছে। খুব গর্ব হচ্ছে চম্পার। একেবারে সিরিয়ালের দিদিমণিদের মতো দেখতে লাগছে।

ডাবলু হালতু বাজারে সওয়ারিকে নামিয়ে ভাড়া নিতে না নিতেই আবার ফোন। সে পোস্ট অফিসের দিকে রিকশা সাইড করে ফোন ধরল। তার স্বরেও উত্তেজনা। ডাবলু বলল, আমার মোবাইলে তো ছবি দেখা যায় না। তুই কি তোর বউদির মোবাইলে পাঠাতে পারবি? আমি বাড়ি গিয়ে দেখে নিতাম। তবে শুধু ছবি পাঠাবি। অন্য কিছু লেখার দরকার নেই। তার যা কুচুটে বুদ্ধি, কোথা থেকে আবার কী বাগড়া না দিয়ে বসে।

হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল আটটার নবদ্বীপ লোকাল ধরেছে ওরা। সমুদ্রগড় যেতে ঘন্টা আড়াই। কিন্তু দুই ভাই-বোন উত্তেজনায় ছটফট করছে। চম্পা বলল, এই দাদা, মায়ের বাড়িতে থাকি যাই কটাদিন, কী বলিস? আর মোটে পারা যাচ্চে না। আর ইচ্ছা করে না এই ঝি-গিরি করতে। তুই অন্য আর একজনকে জোগাড় করে দিদিমণিকে দিস আনে। নাইলে তার কষ্ট হবে।

ডাবলু বলল, সে তুই চিন্তা করিসনে। তুই মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি, থাক। তার জন্যি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া কততি হবেনে। তারে কইলকাতায় নে যাবানে। সবাই মিলে একসাথে থাকবানে। মায়ের কাছ থে কিছু ট্যাকা পেলি একখান ব্যাটারির রিকশাক কিনুম আনে, ভাবছি। তাতে একটু আয়-টায় বেশিই হবে।

চম্পা বলল, অ্যারা, কিন্তুক মা সমুদ্রগড়ে কুথায় থাহে তাই তো জানি নারে দাদা! ফেসবুকে সবাই তো কইছে সমুদ্রগড়ের মনের মানুষ মনসাসুন্দরী। তো সিকেনে সবাই ঝ্যাকোন চেনে, ত্যাকোন লিশ্চই কয়েক দেবেনে, তাই নারে দাদা?

হ্যাঁ, তাই তো মনে কয়।

একটু লেট করে ট্রেন সমুদ্রগড়ে এগারোটা নাগাদ এল। বেশি লোক নামে না। জনা পঞ্চাশেক হবে। ওরা ভাই-বোন দুজন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এমনি এমনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়টা কমে গেলে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোবে। একজন সাইকেলের রডে দু-কাঁদি ডাব ঝুলিয়ে বাঁশের স্ট্যান্ড লাগিয়ে বিক্রি করছিল। চম্পার খুব লোভ হল। এখন তো তারা বড়োলোক। মায়ের পয়সা মানে তার ছেলে-মেয়েদের পয়সা। সে দাদাকে বলল, দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর ডাব। কইলকাতায় এমুন তাজা ডাব পাওয়াই যায় না। খাবা?

ডাবলু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। ট্রেনের টিকিট কেটেছে। হাওড়ায় আসার বাসের টিকিট কেটেছে। তারপর আজ তো কাজ হল না। মানে রোজগার নেই। ঘরে ফিরে টাকা ধরাতে না পারলে তো বউ-এর মুখ ঝামটা শুনতে হবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ঘরে না দিলে তো বিপদ। সে তো তো করে।

চম্পা বোঝে। সে বলে, দাদা তুমি তো অনেক খরচ করিছ, আমি ডাবের দাম দেবানে। তাছাড়া দিদিভাই আজ সকালেই মাইনে দেছে।

ডাব খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে কী মনে করে চম্পা ডাবঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কতি পারেন মনসাসুন্দরী এখানে কই থাহেন!

ডাবওয়ালা পরের খদ্দেরের জন্য ডাব কাটতে কাটতে পেছন দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভাই-বোন চটপট সে দিকেই পা চালায়। মনে মনে চম্পা ভাবল, ডাবঅলাও বলে দিতে পারল মানে মায়ের খুবই জনপ্রিয়তা হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষে লেভেলক্রসিং-এ রেললাইনের উপরেই গোটা দুয়ে্ক টোটো দাঁড়িয়ে হাঁকছে। দুজন আসছে দেখে তারা উৎসাহী হয়েছে। ডাবলু আর চম্পার চোখও টোটোঅলাদের দিকে। ওদের যে-কোনও একটাতে উঠে বসে মনসাসুন্দরীর বাড়ির কাছে নামাতে বলবে।

প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষে এসে পড়েছে। চম্পা একটা স্বর শুনে পিছন ফিরল। গলাটা চেনা যেন! একজন মহিলা গাছতলায় বসে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পার পা আটকে গেছে। সে দাদার হাত খামছে ধরেছে। যেন ভূত দেখছে। চম্পার পা কোনও দিকে যাচ্ছে না। না সামনে না পেছনে। সামনের ভিখারিনি তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনের থেকে নামা আর তেমন কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। এদের কাছ থেকে যদি পাওয়া যায়। ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পা তার কাজের বাড়ির একটা বাতিল লেডিজ ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে দশটা টাকা খুঁজে হাতে নেয়। হাত মুঠো করে। টাকাটা দলা পাকায়। তারপর এক পা এগিয়ে সেই দলাকরা টাকা ছুড়ে দেয় ভিখারিনির থালার দিকে। থালার একটু আগেই পড়ে টাকা। চম্পা মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে দাদার হাত ধরে টান দেয়। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে ডাউন ট্রেনের জন্য। কলকাতায় ফিরবে।

ভিখারিনি টাকা কুড়িয়ে সেটা সোজা করতে করতে মনের খুশি ওর মাথার উকুনদের জানাতে চেয়ে খানিকটা জোরেই গেয়ে ফেলে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা…।

 

ফাগুন বাসর

ওরে হিমু, কোথায় গেলি রে? পুকুরপাড়ে একগাদা এঁটো বাসন পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি একটু মেজে নিয়ে আয় না, মা। সবাই সক্কাল সক্কাল বেরোবে। রান্না চাপাতে হবে যে।

হিমু তখন মুগ্ধ চোখে দেখছে মাঠের পুব-ধারে একটু একটু করে ঘোমটা খুলছে উষারানি। কপালে যেন গোল থালার মতো এক মায়াময় সিঁদুরের টিপ। অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ফিকে হলুদ আলো। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দিয়ে ধবলী আর করালীকে জাবনা দিতে যায় হিমু। জাবনা দিতে দিতে দেখে উষারানির টিপটা কেমন ঘেঁটে গিয়ে চারদিকে ফিকে লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে। কী অপূর্ব! মনটা যেন জুড়িয়ে যায়!…ওই মা ডাকছে… চমক ভাঙে হিমুর,

ধবলী আর করালীকে মাঠে বেঁধে দিয়ে এখুনি বাসনগুলো মেজে নিয়ে আসছি, মা।

ধবলী আর করালীকে মাঠের বেশ ঘন ও বড়ো বড়ো ঘাসওয়ালা জায়গায় বেঁধে দিয়ে পরম মমতায় করালীর কালো কুচকুচে শরীরটাতে হাত বোলায় হিমু। বাড়ির সবাই, পাড়া-পড়শীরা আসতে যেতে ধবলীর লালচে সাদা শরীরে আদুরে হাত বোলায় কিন্তু করালীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দেখে বড়ো কষ্ট হয় হিমুর। অথচ করালীটা যখন গামলা গামলা দুধ দেয়, তখন তো সবাই বেশ আয়েশ করে গেলাস গেলাস দুধ সাবাড় করে! চোখটা ছলছল করে ওঠে। কোথাও যেন করালী আর নিজেকে এক সারিতে দেখতে পায় হিমু।

অ্যাই হিমু, হিমু… শিগগির এদিকে আয় তো। আমার জামাপ্যান্টগুলো কেচে ইস্তিরি করে রাখিসনি কেন? এখন আমি কি পরে যাব? একখানাও ইস্তিরি করা নেই! হিমু…উ…উ…উ…

হিমুর তখন চোখের পলক পড়ছে না। নিস্তব্ধ দুপুরে দূরের বাঁশঝোপের আড়াল থেকে পাঁজর ফাটিয়ে ডাকছে কোকিলটা! পুকুরের বুকে নুয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়, সবুজ ছায়া তিরতির কাঁপছে টলটলে জলে। লাল-হলুদ-সবুজ ফড়িং আর রংবেরঙের প্রজাপতির দল উড়ে উড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। উতল দুপুর ঘাই মারছে হিমুর বুকে! কী যে অসহ্য রূপ এই দুপুরের… ইশ!

অ্যাই হিমু, কানে কানে জল ঢোকেনি বুঝি, না রে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। বিধুদা এল বলে। কনে-দেখা আজ, আলো থাকতে থাকতে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। হিমু, এই হিমু।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় হিমুর। দাদা ডাকছে।

যাই গো দাদা।

আজ পাড়ার বিধু ঘটকের সঙ্গে পাশের গাঁয়ে মেয়ে দেখতে যাবে হিমুর দাদা। হুগলির রিষড়ায় সে এক গেঞ্জি কারখানায় প্যাকেজিং ডেসপ্যাচিংয়ের কাজ করে। হিমুর বিয়ে না দিয়ে তার দাদা বিয়ে করতে চাইছিল না। কিন্তু বিয়ের বাজারে হিমুর মতো নিকষ কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করে না। বিধু ঘটক হিমুর জন্য পাত্রের সন্ধান এনে এনে একেবারে হাঁপিয়ে গেছে। তাই দাদা আর কদ্দিন অপেক্ষা করবে? তারও তো বিয়ের বয়স গড়িয়ে যেতে বসেছে। পুরুষ মানুষ কদ্দিন আর মেসে থেকে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাবে! তারও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে, নাকি! অগত্যা পাশের গাঁয়ে প্রদীপ স্যাকরার মেয়ে অপালার সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে বিধুদা। একমাত্র মেয়ে, দেবে থুবেও ভালো।

অ্যাই হিমু, পুকুরধারে কী করছিস রে? তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?

এক বুক পাথর ভার নিয়ে দাদার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হিমু।

হিমু, হিমু…উ…উ… অ হিমু, হিমু রে, আমার লাইগ্যা একটু আকন্দফুলের পাতা আইন্যা দে না রে, মা। পূন্নিমা আইতাছে। বাতের ব্যাতাটা আবার বড়ো বাড়ছে রে! উঃ! সব্বার মরণ হয়, আমার ক্যান হয় না? আরে অ হিমু…

হিমু তখন পুকুর ঘাটে। হাঁ করে গিলছে পলাশ গাছটার বুক জ্বালানো রূপ! বসন্ত বাণে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে হিমুর যুবতি-শরীর, মন। আমবাগানে ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ফিকে কমলারঙা গোল থালার মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মাঠের পশ্চিম দিকে। দিনের তেজ কমে আসছে, গোলাপি আভা ধরেছে আকাশে। কোথা থেকে এক ঝলক ফিসফিসে বাতাস এসে চোখে মুখে ঠান্ডা স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে হিমুর,.আহা! ওই ঠাম্মা বুঝি ডাকছে…

আসছি…ই…ই…ই…

ঠাম্মা বহুদিন থেকেই বাতের রোগী। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হরেন বৈদ্যের কালচে সবুজ এক কবিরাজি তেল ঠাম্মার কোমরে, পায়ে মালিশ করে দেয় হিমু। তেলের গন্ধটা ভারি বিশ্রী! বমি চলে আসে। কিন্তু কি আর করা, মায়ের সারাদিন সংসারের নানা কাজ থাকে। উদয়াস্ত পরিশ্রম তাঁর। দিদিরা তো সবাই যে-যার শ্বশুরবাড়িতে। তাই হিমু ছাড়া আর কে-ই বা আছে হাতনুরকুৎ? এছাড়া অমাবস্যা, পূর্ণিমায় ব্যথাটা খুব বেড়ে যায় ঠাম্মার। তখন জ্বলন্ত হ্যারিকেনের মাথার ওপর আকন্দপাতা গরম করে সেঁক দিয়ে দেয় হিমু। পুকুরের পুব-ধারে আকন্দগাছের ঝাড়, সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে সে।

তার বাড়ির সকলেরই একখানাই তো ভাঙাকুলো হিমু। অঘ্রাণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাম্মা বড়ো শখ করে নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী। হেমন্তে জন্ম হলেও হেমন্ত প্রকৃতি তার সোনারঙা ফসলের ভরপুর সৌন্দর্য দিয়ে সাজায়নি হৈমন্তীকে। হৈমন্তী সেই কবেই হিমু হয়ে গেছে সকলের মুখে মুখে। ঠাম্মার কাছে শুনেছে জন্মের পর তার কালো কুৎসিত ছোট্ট শরীরটা দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাবা। আর কোনওদিনই বাবা নাকি কোলে তোলেননি তাকে। এ সবই মুখরোচক গল্পচ্ছলে বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকে শোনা হিমুর। নীরবে হৈমন্তিক শিশির ঝরেছে টুপটাপ। বড়ো হেলাফেলায় সবার ফাইফরমাশ খেটে, সবার মন জুগিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে হিমু। শুধু নিজের মনটাই আলো-হাওয়া না পেয়ে পেয়ে কবে যেন পাথর চাপা পড়ে গেছে!

তবু জীবন তো থেমে থাকেনি। হিমুর দাঁত উঁচু, নাক বোঁচা, শনের মতো চুলওয়ালা, থ্যাবড়ামুখো কালো কুৎসিত শরীরেও একদিন দাপিয়ে যৌবন এসেছে নিঃশব্দে। কালো মেয়ে বলে মা-ঠাকুমার বিলাপ, পাড়া-পড়শির করুণার মধ্যেই বড়ো হয়েছে সে। তার মুখ কেউই দেখতে চায় না। পাড়ার কেউ কোনও শুভ কাজে রওনা হলে হিমু তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। তার অপয়া মুখ দেখলে নাকি হওয়া কাজও পণ্ড হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনায়ও তেমন এগোতে পারেনি হিমু। বছর বছর গণিতে, বিজ্ঞানে ফেল করে করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোনোর আগেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়াশোনায় ইতি ঘটে যায় তার। মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়েও তার মতো কালো কুৎসিত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। বেশ কয়েকবার পাত্রপক্ষ এসে মিষ্টি ধ্বংস করার পর বলতে বলতে গেছেন, আমরা তো কয়লার বস্তা ঘরে নিয়ে যেতে আসিনি! যত্তসব!!

নিজের কানে এইসব কথা শুনে টুপটাপ ঝরে পড়ে হৈমন্তিক শিশির। ভেসে যায় বুক। স্তব্ধ হয়ে যায় হিমুর ভিতর ঘর।

হিমুর দুই দিদি জয়তী আর রেবতী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মোটামুটি দিয়েথুয়ে বিয়ে হয়ে গেল তাদের। লাজুক মুখে এক মাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল তারা। যাবার সময় দুজনেই হিমুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে কেটে বলল,

তোর জন্য দেখছি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা। চিন্তা করিস না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসারের বেড়াজালে হিমুর কথা তাদের আর মনেই রইল না।

এই অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে হিমু। এখনও অনুঢ়া সে। শরীরে তার ভরা যৌবন! মনে সুনামির জলোচ্ছ্বাস! ফুলেভরা শিমূলের ডালে, হলুদ অমলতাসের ঝাড়ে, ফুলের ভারে নুয়েপড়া কাঞ্চনগাছে প্রকৃতি যেন উড়িয়ে দিয়েছে রংবেরঙের ফাগ। দেখে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে হিমুর। কান্নায় গলা বুজে আসে! আকাশ কী সুন্দর নীল! প্রকৃতির কত অপরূপ রং-রূপ-রস। সেও তো এই প্রকৃতিরই অংশ, তবে কেন সে এত কুৎসিত? এ পৃথিবীতে কোথাও কি তার জন্য এতটুকু ভালোবাসা থাকতে নেই?

কাল দোলপূর্ণিমা। হিমুর ছোড়দি রেবতী এসেছে বর আর বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হই হই ব্যাপার। হিমুর খরা বুকেও যেন বাজছে টুংটাং বাসন্তী সুর। ছোড়দির ছেলেটা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে, আধো বুলি ফুটেছে মুখে। মনটা বড়ো ভিজে ওঠে হিমুর। তবে দিদিরা আসায় তার খাটুনি অনেকখানিই বেড়েছে। রান্নার সব দাযিত্বই যে-তার। মা অবশ্য সাহায্য করছেন। এই একটি বিষয়ে হিমুর খুব নাম। তার রান্না স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। সব্বাই চেটেপুটে খায়। রান্না করতে করতে আনমনা হয়ে পড়ে সে!

রজতদা ছোড়দিকে কী ভালোবাসে! চোখে হারায় একদম! সকালে দেখছিল জলখাবার খাওয়ার সময় রজতদা ছোড়দির মুখে লুচি তুলে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। ভালোবাসার রঙে রাঙা হয়ে উঠছিল ছোড়দির মুখটা! বুকটা ভারী হয়ে ওঠে হিমুর। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! তাকে এভাবে আদর-আহ্লাদ করার কেউ নেই এই পৃথিবীতে!

সন্ধে নামতেই গোল থালার মতো ভরা-যৌবনা চাঁদটা রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে নিল মাঠ-ঘাট, পুকুর, সজনেগাছের সারি, আমবাগান, শিমূলবন। এমন গভীর চাঁদরাত গায়ে মেখে, আমের মুকুলের গন্ধ বুকে ভরে নিয়ে আমবাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে হিমু। রাতের আবডালে তার কুৎসিত মুখখানাও কিছুটা ঢাকা পড়ে যায়। বুক ভরিয়ে দিয়ে কী যেন এক নাম না-জানা গন্ধ ছুঁয়ে দিচ্ছে হিমুর গভীরে কোথাও। সে গন্ধ যেন এক তীব্র কষ্ট হয়ে হৃদপিণ্ডটাকে খামচে ধরছে। যে-গন্ধের কোনও কারণ জানে না হিমু। হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। পাশের ঘরে শুয়েছে রজতদা আর ছোড়দি। একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আকর্ষণে জালনার ফুটোতে চোখ রাখে হিমু। দেখতে পায় আধো অন্ধকার ঘরে দুই ছায়ামূর্তি রজতদা আর ছোড়দি! রজতদা যেন একেবারে মিশে যেতে চাইছে ছোড়দির নগ্ন শরীরে!

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে হিমুর। কেমন একটা নেশা নেশা লাগে। সেই অনামি গন্ধটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে! মাঝরাতে জ্যোৎস্নার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে গোটা গ্রাম। শুধু ঘুম আসে না হিমুর। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে টলটলে জল-আয়নায় ভাসছে রুপোলি চাঁদ। সজনে গাছগুলোর তলা সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে! চারদিক একেবারে শুনশান! দূর থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হিমু। সহসা কিছু বোঝার আগেই একটা বলিষ্ঠ লোমশ হাত পেছন থেকে জাপটে ধরে হিমুকে শুইয়ে দেয় সজনেফুলের সাদা বিছানায়। ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে থাকে তার পোশাক। ঘোরলাগা চোখে লোকটাকে চিনতে পারে না সে। লোকটার মুখে হাড়িয়ার গন্ধ। পরম আশ্লেষে লোকটাকে জাপটে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে হিমু ফিসফিসিয়ে বলে,

আমি কুৎসিত নই, ততটা কুৎসিত নই। একবার ভালোবেসে এসো ভেতরে আমার, হাড়-মাস-চামড়া ছাড়িয়ে একেবারে ভেতরে, অনেক ভেতরে…

লোকটার মুখের হাড়িয়ার গন্ধ ভেদ করে সেই বিশেষ গন্ধটা যেন খুব ধীরে ধীরে হিমুর আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকে, যে-গন্ধের কাছাকাছি এলে ভালোবেসে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় তার। বহুদিনের জমাটবাঁধা একটা বরফখণ্ড যেন গলে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে হিমুর যুবতি শরীর থেকে।

 

সহমরণ

আট বছরের মেয়ে সানাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ‘নিরালা’-য় অবসর যাপন করতে চলে আসে সন্তু আর নীতা।

বাঁশবন, পেয়ারা বাগান, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, কদম, বট, অশ্বত্থ, বাবলা,শিরীষ,বকুল,কামিনি,শিউলি, সুপুরি,সবজি খেত আর পুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে আছে গোবিন্দপুরের এই ‘নিরালা’ আবাসন। বহুতল আবাসনের এই ছাদ থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় দারুণ ভাবে। রাতের আকাশের চাঁদের আলো যেমন ভালোবাসার আবেশে জড়ায়, ঠিক তেমনই কৃষ্ণপক্ষের সূচিভেদ্য অন্ধকার শিহরণ জাগায় শরীরে। লকডাউন-এর অবসরে, কলকাতার কোলাহল ছেড়ে এমনই প্রকৃতিকে সঙ্গী করে, ‘নিরালা’-য় এসে আশ্রয় নিয়েছিল সন্তু আর নীতা। কিন্তু তখন কে জানত যে, অমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝেই ঘটে যাবে ভয়ংকর বিপদ !

গোধুলির ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আবাসনের গেট-এর কাছে,মুখে মাস্ক পরে ঘাসজমিতে বসে গল্প করছে নীতা আর সন্তু। একই ভাবে মুখে মাস্ক পরে ওদের মেয়ে সানা দুলছিল পা‌শে ঝোলানো একটি দোলনায়।

হঠাৎ হইহুল্লোড় কানে আসতেই গেট-এর দিকে এগিয়ে গেল সন্তু, নীতা এবং সানা। ওরা দেখতে পেল, ছোটোবড়ো একদল স্থানীয় ছেলে একটা বড়ো সাপ মেরে, লাঠিতে ঝুলিয়ে এনে, গেট-এর কাছে কদম গাছটার নীচে ফেলে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে সাপটাকে ওখান থেকে সরাতে বললেও, ছেলেগুলোর কানে পৌঁছোলো না দারোয়ানের কথা। পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে, তাই সাপটাকে ওখান থেকে সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করল সন্তু। অগত্যা, কথা রাখার প্রতিশ্রুতি দিল দারোয়ান।

এরই মধ্যে সন্ধে নেমেছে। বৈদ্যুতিক আলোগুলি জ্বলে উঠছে আবাসন চত্বরে। নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিল সন্তু আর নীতা। তাই, মেয়ে সানা যে কখন নজরের বাইরে চলে গেছে, তা আর ওদের খেয়াল ছিল না।

হঠাৎ নজর কাড়ল দারোয়ান। ওর কোলে তখন অঝোরে কেঁদে চলেছে সানা।

‘কী হয়েছে ? সানা কাঁদছে কেন ? পড়ে গেছে ? ‘ —–উদ্বেগ ভরা গলায় সন্তু এবং নীতা প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করে চলেছে দারোয়ানকে।

‘বড়ো বিপদ ঘটে গেছে স্যার। আমি বাথরুম-এ গিয়েছিলাম,এরই মধ্যে ছোটো গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল আপনাদের মেয়ে।’

‘তা বিপদটা কী ঘটেছে ?’ —–দ্বিগুণ উদ্বেগে প্রশ্ন করল সন্তু।

‘শুকনো কাঠি দিয়ে ওই পড়ে থাকা সাপটার মুখে খোঁচাতে গিয়ে, কামড় খেয়েছে। সাপটা বেঁচে ছিল। একেবারে মরণ কামড় দিয়েছে। ব্যাঙ ধরার মতো করে ধরে ছিল ওর হাতের চেটোটা। বিষাক্ত সাপ। পুরো বিষ ঢেলে দিয়েছে সম্ভবত। আমি ওর হাত বেঁধে দিয়েছি,বিষ আর ওপরে যাতে না ওঠে। শিগগির গাড়ি বের করুন স্যার। হাসপাতালে নিয়ে চলুন। আমি সাপটাকে কৌটোতে ভরে নিচ্ছি। ‘—–এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, সানাকে ওর মায়ের কোলে দিল দারোয়ান।

সানার হাত থেকে রক্ত ঝরছে। নীতা মেয়েকে কোলে নিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

লকডাউন-এর হ্যাপা কাটিয়ে সন্তু আর নীতা যখন সানাকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছোলো, ততক্ষণে কেটে গেছে অনেকটা সময়। চিকিৎসা শুরু হল ঠিকই, কিন্তু সানার শরীরকে বিষমুক্ত করার সুযোগ পেলেন না চিকিৎসক। মাল্টি অরগান ফেলিওর হতে শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, কৌটোয় রাখা ওই মরা সাপটার মতই নিথর হয়ে আছে সানার শরীরটা।

শর্ত

ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে শ্বেতার চোখটা আটকে গেল নাম আর পরিচিত ছবিটা দেখে। ষোলো বছর পর দেখছে। মুখের অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর নামটা দেখলেই বোঝা যাবে শ্বেতা চিনতে ভুল করেনি। হ্যাঁ, ওই তো পরিষ্কার লেখা নীলাঞ্জনা সাহা।

কলেজের দিনগুলোয় ফিরে গেল শ্বেতা। অভিন্নহৃদয় দুই বন্ধু অথচ সামাজিক স্থিতি অনুযায়ী সকলের কাছেই বড়ো বেমানান ওদের বন্ধুত্ব। নীলাঞ্জনা ধনী পরিবারের মেয়ে বনেদি ব্যাবসাদার ওদের চোদ্দোপুরুষ। আলিপুরের মতো জায়গায় ওদের বিরাট জমিশুদ্ধ চারতলা অট্টালিকা। সেখানে শ্বেতার বাড়িটা হচ্ছে কসবার ছোট্ট একটা গলিতে। ঘর বলতে মাত্র দুটি যেখানে মা-বাবা এবং আরও দুজন ভাইবোনের সংসার। বাড়ি মেরামতিতে কতদিন হাত পড়েনি শ্বেতা ঠিকমতো মনেও করতে পারে না।

কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতি দুই বন্ধুর মধ্যে কখনও দেয়াল হয়ে উঠতে পারেনি। বাধাহীন নদীর স্রোতের মতোই ওরা দুজনে বয়ে গেছে বন্ধুত্বের স্রোতে। শ্যামলা রঙের নীলাঞ্জনার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কোনও অভাব ছিল না। শ্বেতা এক কথায় সুন্দরী। টানা বড়ো বড়ো চোখ, নিজেকে নিয়ে ওর যত চিন্তা ভাবনা।

শ্বেতা মনে মনে নিজেকে সবসময় নীলাঞ্জনার সঙ্গে তুলনা করত আর নিজেকে ওর আরও হতদরিদ্র মনে হতো। একমাত্র নিজের সৌন্দর্যের প্রতি মনের মধ্যে একটা গর্ব ছিল। শ্বেতা বিশ্বাস করত, সৌন্দর্যের জন্যই ও একদিন ধনীবাড়ির বউ হতে পারবে। শ্বেতা সবসময় নীলাঞ্জনাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করত। ওর মতো ব্যবহার, আদবকায়দা, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু।

সেদিন নীলাঞ্জনার জন্মদিন ছিল। একটি পাঁচতারা হোটেলে সব বন্ধুদেরই নিমন্ত্রণ করেছিল নীলাঞ্জনা। সেখানেই ঋষির সঙ্গে নীলাঞ্জনা সকলের পরিচয় করাল। ঋষি নীলাঞ্জনার বাবার বন্ধুর ছেলে, যে-কিনা মুম্বই আইআইটি-র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ছুটিতে কলকাতায় উপস্থিত ছিল ঋষি। নীলাঞ্জনার বন্ধু হিসেবে জন্মদিনের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে এসেছিল। লম্বা-চওড়া সুন্দর চেহারার ঋষিকে দেখলে যে-কোনও পুরুষেরই হিংসা হওয়ার কথা।

সাধারণত যা হয়ে থাকে, এতগুলো মেয়ের একজায়গায় হয়ে হাসাহাসি, চ্যাঁচামেচিতে পুরো হলঘর জমজমাট হয়ে উঠেছিল। একমাত্র শ্বেতা চুপচাপ একটা কোণায় চেয়ারে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। ঋষির শ্বেতার উপর দৃষ্টি পড়তে নীলাঞ্জনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি চুপচাপ একা কেন বসে আছে? ওকেও ডাক না!

সঙ্গে সঙ্গে, নীলাঞ্জনা শ্বেতার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে তুলে এনে ঋষির সামনে দাঁড় করাল, আমার সব থেকে ভালো আর পুরোনো বান্ধবী শ্বেতা।

এরপর খাবার অর্ডার করা শুরু হল। অর্ধেকের বেশি খাবারের নাম শ্বেতা কোনওদিন শোনেইনি। ঋষি এসে শ্বেতার পাশে চেয়ার টেনে বসল। মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বেতার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, যেটা, আমি অর্ডার করছি আপনিও সেটাই করবেন।

ঋষির কথা শুনে শ্বেতা একটু আশ্বস্ত হল। শ্বেতার মতো মেয়ের সঙ্গে আলাপ ঋষির জীবনে প্রথম। ওর নিজের মা-বোন কত আলাদা। কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া, মুখ রাঙা হয়ে ওঠা, শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলা করা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে বসেও কপালে ঘাড়ে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠা, প্রসাধন ছাড়া নিখুঁত মুখমণ্ডল এ সব কিছুই ঋষির প্রথম দেখা।

রাত হচ্ছে দেখে নীলাঞ্জনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোর খোঁজে শ্বেতা হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এল। পেছনে ঋষিও এসে দাঁড়াল। একটু ইতস্তত করে ঋষি বলল, চলুন, আমার কাছে গাড়ি আছে, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এইসময় অটো করে যাওয়াটা খুব একটা সেফ নয়।

শ্বেতার কোনও জবাব না পেয়ে ঋষি বলল, ভয় নেই, আপনার বাড়ির দরজায় নামিয়ে চলে আসব। চায়ের জন্য আপনি বসতে বললেও বসব না।

অগত্যা শ্বেতা রাজি হয়ে গেল। গাড়িতে সারাটা রাস্তা চুপচাপই বসে রইল শ্বেতা। অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করতে পারছিল ও। বাড়ির দরজায় শ্বেতাকে নামিয়ে দিয়ে ঋষি চলে গেল। বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। প্রাণ খুলে আগে কেউ কখনও শ্বেতার সঙ্গে কথা বলেনি ঋষির মতো। ঋষির মুখটা আর কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্বেতার। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা স্বপ্নটা যেন এতদিনে সত্যি হতে চলেছে, বারবার এটাই মনে হতে লাগল শ্বেতার।

ধীরে ধীরে শ্বেতা নিজের সাজসজ্জার উপর বেশি নজর দিতে আরম্ভ করল। কলেজ ছাড়া বেশিরভাগ সময়টা পড়াশোনার বাহানা করে নীলাঞ্জনার বাড়িতেই কাটাতে আরম্ভ করল ও। নীলাঞ্জনা বুঝতে পারত ঋষিকে দেখতেই তাদের বাড়িতে শ্বেতার এতটা সময় পড়ে থাকা, যদি একটিবার ঋষি এখানে আসে। ঋষিকে খুব ভালো করেই চিনত নীলাঞ্জনা। ওর স্বভাব নীলাঞ্জনার অজানা ছিল না। শ্বেতার জন্য ও কষ্টবোধ করত!

একদিন থাকতে না পেরে নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে স্পষ্টই বলল, শ্বেতা, তুই ঋষির পিছনে ছুটিস না, ও হচ্ছে মায়ামৃগ। সবার সঙ্গেই ও আপনজনের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু বাস্তবে ওকে প্লেবয় বলাটাই বোধহয় সঠিক পরিচয় দেওয়া হবে।

কিন্তু শ্বেতার চোখে তখন ঋষি নামের ঘোর, যেটা সরতেই চায় না। নীলাঞ্জনার সাবধানবাণীও শ্বেতার মনে হল ঈর্ষাবশত। এইভাবেই নরমে গরমে ওদের তিনজনের বন্ধুত্ব এগিয়ে চলছিল। দুবছর এভাবেই কাটল অথচ এই দুই বছরে ঋষি একবারও শ্বেতার প্রতি বিশেষ ভালোবাসার কোনও দাবি জানাল না। কিন্তু শ্বেতা মনের মধ্যে নিজেকে উজাড় করে দিল ঋষির কাছে। ঋষি ছাড়া নিজের জীবনের কোনও অর্থই থাকল না শ্বেতার কাছে।

ওদিকে শ্বেতার চুপ করে সব মেনে নেওয়া, কথায় কথায় ঘাবড়ে যাওয়া ঋষিকে যেমন আকর্ষণ করত, তেমনি নীলাঞ্জনার আত্মবিশ্বাস, সহজে কোনও কথা মেনে না নিয়ে তর্ক করার অভ্যাসও সমান ভাবে ঋষিকে প্রভাবিত করত।

শ্বেতার কাছে ঋষি কোনও কমিটমেন্টে না গেলেও, শ্বেতার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, ঋষি একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওর কাছে অবশ্যই আসবে। দেখতে দেখতে কলেজ পার করে নীলাঞ্জনা ওর বাবার ব্যাবসায় ঢুকে পড়ল। আর শ্বেতা ঋষির প্রস্তাবের অপেক্ষায় দিন গুনতে আরম্ভ করল।

ফোনে দুজনের সবসময় কথা হতো। এরই মধ্যে ঋষি চাকরিও পেয়ে গেল। কিন্তু চাকরিটা নিয়ে ও খুব একটা খুশি হল না। আরও ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর মধ্যে। ঋষি ফোন করলেই প্রতিবারই শ্বেতা ওকে বলত, ওর বিয়ের প্রচুর সম্বন্ধ আসছে। ঋষি বুঝতে পারত না শ্বেতা কেন এইসব কথা ওকে বলে!

একদিন বিরক্ত হয়ে ঋষি শ্বেতার মুখের উপরেই বলে বসল, তুই কীরকম বন্ধু রে? আমি এদিকে ভালো একটা চাকরি খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুই তোর বিয়ে নিয়ে পড়ে আছিস! জানি তুই খুব সুন্দরী, তোর বরের অভাব হবে না। কে তোকে আটকাচ্ছে, কর না বিয়ে বলে ফোনটা কেটে দিল ঋষি।

শ্বেতার মনে হল, ঋষি নিজেকে অসুরক্ষিত ভাবছে এই ভেবে যে, শ্বেতার বিয়ে অন্য কোথাও না হয়ে যায়। খুশি হল শ্বেতা, যাক এবার তাহলে ঋষি দৌড়ে ওর কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাবটা দেবে।

একদিন হঠাৎ নীলাঞ্জনার ফোন এল ওর কাছে, আর্জেন্ট তলব। বাগানে ফুলের পরিচর্যা করছিল নীলাঞ্জনা, শ্বেতাকে দেখেই দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। শ্বেতা লক্ষ্য করল নীলাঞ্জনার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। শ্বেতাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে বলল, শ্বেতা, কাল আমার আশীর্বাদ। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলি না তো কার সঙ্গে?

শ্বেতার মুখ-চোখ মুহূর্তে কালো হয়ে গেল, কোনওমতে বলল, কেন ইয়ার্কি মারছিস। ঋষি তো বিয়ে নিয়ে এখুনি কিছু ভাবতে চায় না। ও নিজের মুখে আমাকে বলেছে।

শ্বেতার কথা শুনে নীলাঞ্জনা হেসে ফেলল। শ্বেতার চিবুকটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল, তুই বড্ড সরল রে শ্বেতা। ঋষি ওর নিজের ব্যাবসা আরম্ভ করেছে। আমার বাবারও তাতে পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিজনেস প্ল্যানটা আমিই ঠিক করে দিয়েছি। এটা বাবারই মাথায় প্রথম আসে, যখন আমাকে আর ঋষিকে একসঙ্গেই কাজ করতে হবে তখন একসঙ্গে জীবন কাটাতেই বা আপত্তি কোথায়।

শ্বেতা নিজেকে আর আটকাতে পারে না, চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তাহলে বল, তোরা টাকা দিয়ে ঋষিকে কিনে নিয়েছিস।

শ্বেতার কথাগুলো নীলাঞ্জাকে দুঃখ দিলেও নিজেকে ও সামলে নিয়ে সংযত স্বরে বলে, শ্বেতা, এটা ঋষির সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত। আমার বাবা ওকে কোনও জোর দেননি। এমনিই টাকা দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ঋষির কাছে সৌন্দর্যের থেকে নিজের কেরিয়ারের উন্নতি করাটা অনেক বেশি গুরুত্বের। তুই নিঃসন্দেহে সুন্দরী কিন্তু জীবনে এগোতে গেলে ক্ষমতা এবং স্মার্টনেসের দরকার যেটা সম্ভবত ঋষি আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে।

এটা হতে পারে না নীলাঞ্জনা। ঋষি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারে না! আর আমি, তোর থেকে সব বিষয়ে অনেক ভালো।

নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে ভালো করে লক্ষ্য করে। ওর মুখে ফুটে ওঠা হতাশা দেখে বলে, সব ঠিক হয়ে গেছে শ্বেতা। সৌন্দর্য সবার ফাস্ট প্রেফারেন্স না-ও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যারা সৌন্দর্যের থেকেও বুদ্ধি, আত্মবিশ্বাস এগুলিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আমার জন্যই ঋষি এই প্রোজেক্টটা শুরু করতে পেরেছে।

নীলাঞ্জনার কথাগুলো সহ্য করতে পারে না শ্বেতা। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় ও। বলে, নীলাঞ্জনা, তোর বাবা ধনী বলে তোর খুব অহংকার, তাই না? আর এই টাকার জোরেই তুই ঋষিকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিলি। কিন্তু তুইও আমার একটা কথা শুনে নে, আমার এই সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, বৈভব-কেও একদিন আমার দাস হতে হবে এবং এটা আমি তোকে করে দেখাব এই আমার প্রতিজ্ঞা তোর কাছে।

নীলাঞ্জনার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল, বলল, শ্বেতা তোর এই চিন্তাভাবনা অত্যন্ত অন্যায়। তবুও সেই দিনটার প্রতীক্ষা আমিও করব যেদিন তোর প্রতিজ্ঞা রেখে আবার তুই আমার সামনে এসে দাঁড়াবি।

সেই দিনের পর শ্বেতা, নীলাঞ্জনা এবং ঋষির অধ্যায়কে নিজের জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলল। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা ও ভুলল না। জীবনে একটাই লক্ষ্যকে ও স্থির করে নিল, যেমন করেই হোক ওকে ধনী হতে হবে। তার জন্য মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা সব সম্বন্ধ ও নাকচ করতে শুরু করল। যেটা শ্বেতার পছন্দ হতো সেখানে টাকার চাহিদা দেখে শ্বেতার মা-বাবা পিছিয়ে আসতেন। শ্বেতার মর্জিমাফিক ব্যবহারে ওর পরিবারের সকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল।

এই করতে করতে শ্বেতার বয়স তিরিশে পড়ল। হঠাৎ-ই কোনও এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে শ্বেতা, রাজেশ্বরী দেবীর চোখে পড়ে গেল। উনি নিজের ছেলের দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন। একমাত্র ছেলে বিকাশের প্রথম স্ত্রী, দুটি সন্তান রেখে মারা যায়। শ্বেতাকে দেখেই রাজেশ্বরী দেবীর পছন্দ হয়ে যায়। বনেদি ধনী পরিবার। অর্থের অভাব নেই, প্রযোজন শুধু একজন মায়ের যে ওই বাচ্চাদুটিকে সন্তানতুল্য মানুষ করতে পারবে।

শ্বেতার মা-বাবার কাছে অবশ্য রাজেশ্বরী দেবীর প্রস্তাব একেবারেই মনঃপূত হল না। নিজের সন্তানকে দোজবরে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁদের একেবারেই ছিল না। তার উপর পাত্রের বয়স প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই, যতই তারা ধনী হোক না কেন! তাছাড়া দুটি সন্তানের বাবা। কিন্তু শ্বেতাই আগ্রহ দেখিয়ে এই সম্বন্ধ স্বীকার করতে মা-বাবাকে বাধ্য করাল। বহুদিন পর এমন একটা সম্বন্ধ শ্বেতার মনের মতো হল। কারণ পাত্র কিংবা তার সন্তানের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ওর একমাত্র নজর ছিল বিকাশের অর্থ, বৈভবের প্রতি এবং ওর সামাজিক পদমর্যাদার প্রতি।

বিয়ের পর দশটা বছর কেটে গেছে। যে টাকার জন্য শ্বেতা বিয়ে করেছিল, সেই অর্থের কোনও অভাব ছিল না ওর। বিকাশের সন্তানরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। বিকাশকে শ্বেতা নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করত। শ্বেতার কথায় বিকাশ উঠত-বসত। তবুও শ্বেতার মনের মধ্যে একটা পুরোনো ব্যথা মাঝেমধ্যেই ওকে বিষণ্ণ করে তুলত।

বিকাশ সবসময় শ্বেতাকে হাতের চেটোয় রাখার চেষ্টা করত, তবুও ওদের সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর মতো নয় বরং ভৃত্য এবং মালিকের মতো ছিল। শ্বেতার মতো অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করত বিকাশ। স্ত্রীয়ের সৌন্দর্যের পূজারি হয়ে উঠেছিল ও, স্বামী হওয়ার কখনও চেষ্টা করেনি। বিকাশের সন্তানদের সঙ্গে শ্বেতা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখত। ওর নিজের কোনও সন্তান হয়নি এবং এই নিয়ে ওর মনে কোনও দুঃখও ছিল না। সন্তান না হওয়াতে পনেরো বছর আগেকার ছিপছিপে ধনুকের মতো শরীর শ্বেতার বজায় ছিল। আয়নায় যখনই নিজেকে দেখত শ্বেতা, একটা অহংকার বোধ জেগে উঠত ওর মনের ভিতরে।

আজ অনেকদিন পর নীলাঞ্জনার পরিচিত মুখটা ফেসবুকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সেটা ঈর্ষা না আনন্দ বুঝতে পারল না। নীলাঞ্জনা যেন দেখতে আগের থেকে আরও সাধারণ হয়ে গেছে কিন্তু ঋষি এখনও তেমনই হ্যান্ডসাম। হঠাৎ করেই আবার সেই পুরোনো অধ্যায় শ্বেতাকে নিয়ে চলল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়।

নিয়তি হয়তো একেই বলে। নয়তো নীলাঞ্জনা আর ঋষি কীভাবে আবার শ্বেতার জীবনে ফিরে এল। ঋষির ব্যাবসা সংক্রান্ত একটি জরুরি ফাইল বার করার ছিল যা কিনা একমাত্র বিকাশের সাহায্যেই করা সম্ভব ছিল।

অফিসে বিকাশ যখন জানতে পারল নীলাঞ্জনা এবং ঋষি ওর স্ত্রীয়ের কলেজের সময়কার বন্ধু, ও ঋষিদের নিজের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাল। শ্বেতা এতে মনে মনে খুশি হলেও বাইরে কিছুই প্রকাশ করল না। নিজের ঐশ্বর্য ওদের দেখাবার এমন সুযোগ কেই বা হাতছাড়া করতে চায়! তাছাড়া ঋষিকেও তো বোঝাতে হবে, শ্বেতাকে বিয়ে না করে ও কী হারিয়েছে আর কাচের টুকরোকে হিরে ভেবে তুলে নিয়ে গেছে। নিজের যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাসের উপর নীলাঞ্জনার অহংকারের সাক্ষী শ্বেতা নিজে। সুতরাং নীলাঞ্জনাকেও বোঝাতে হবে, জীবনের দাঁড়িপাল্লায় আজ শ্বেতার বৈভব, সৌন্দর্যের ওজন নীলাঞ্জনার তুলনায় অনেক বেশি।

সময়ের আগেই নীলাঞ্জনা আর ঋষি বিকাশদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ওরা দুজন পুরোনো স্মৃতিতে মাঝেমধ্যে তলিয়ে যেতে থাকলেও, শ্বেতার ব্যবহারে এটাই বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল যে, পুরোনো কথা আর কিছুই ওর মনে নেই।

কথার মাঝেই নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই শ্বেতা বলে উঠল, তুই কি চেহারা করেছিস! আগের থেকে কত মোটা হয়ে গেছিস। জিম-টিমে যাস না? নিজের ছিপছিপে শরীর প্রদর্শন করতে শ্বেতা শাড়ির আঁচল সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে আবার সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, উদ্দেশ্য একটাই কোনও ভাবে ঋষির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল শ্বেতার। ঋষির চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল নীলাঞ্জনার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং সম্মান।

নীলাঞ্জনা শ্বেতার কথায় মৃদু হেসে উত্তর দিল, শ্বেতা মা হওয়ার পর মেয়েদের ওজন এমনিতে বেড়েই যায়। তোর যখন নিজের সন্তান হবে তখন বুঝতে পারবি।

শ্বেতার মনে হল একটা থাপ্পড় মেরে কেউ ওর মুখ বন্ধ করে দিল। ওর মুখের গোলাপি আভা নীলাঞ্জনার কথায় ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। বিকাশের সঙ্গে ঋষি আর নীলাঞ্জনাও নিজেদের সন্তানের সম্পর্কে আলোচনায় মশগুল হয়ে গেল।

এই প্রথম শ্বেতা অনুভব করল, ও বিকাশের সন্তানদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। বিকাশকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু ওর সন্তানদের মা হয়ে উঠতে পারেনি।

খাওয়ার টেবিলে সকলে এসে বসলে শ্বেতা মনে মনে বলল, আমার রান্নার স্বাদকে ওরা উপেক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু এখানেও ও নিরাশ হল! রান্নায় এত তেল-ঝাল মশলার ব্যবহার দেখে নীলাঞ্জনা বলেই ফেলল, এত তেল-মশলা ব্যবহার কেন করিস শ্বেতা? বিকাশদার বয়স হচ্ছে তাছাড়া আমাদের সকলেরই এখন উচিত কম তেলের খাবার খাওয়া। সম্ভবত বিকাশের শরীরে মেদের প্রাচুর্য দেখেই নীলাঞ্জনার ওই উক্তি।

শ্বেতা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ওর রূপ, ঐশ্বর্য কেন ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারছে না। ওর প্রতি ওদের দৃষ্টিই নেই। ঋষি আর নীলাঞ্জনার সম্পর্কের রসায়ন যে-কোনও দম্পতির মনেই ঈর্ষার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে শ্বেতার মতো মহিলার মনে তো বটেই যেখানে শ্বেতার বিয়ে কেবল অর্থের জন্য হয়েছে। এছাড়া বিকাশের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

খাওয়া শেষ হলে ঋষি আর বিকাশ কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলতে বাগানে গিয়ে বসল। শ্বেতা নীলাঞ্জনাকে নিজের বিশাল ড্রয়িংরুমে বসিয়ে কফি আনতে ভিতরে চলে গেল।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে নীলাঞ্জনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শ্বেতার মনে হল এবার বোধহয় নীলাঞ্জনা ওর আতিথেয়তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। হঠাৎই বেশ জোরেই হেসে উঠল নীলাঞ্জনা। বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, শ্বেতা, এখনও কি তুই তোর প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে দিয়েছিস? মনে হচ্ছে তুই-ই জিতে গেছিস।

শ্বেতা উত্তর দিল না। কিন্তু ও বুঝে গিয়েছিল ও নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি। নীলাঞ্জনাদের কাছে ও হেরে গেছে। ওর সৌন্দর্য, বৈভব কিছুই ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দিতেই ও বিকাশকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আজ শ্বেতা বুঝতে পারছে, নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দেওয়া ওর পক্ষে কোনওদিনই সম্ভবপর হবে না। কারণ একজন স্ত্রীয়ের সাফল্য তার সৌন্দর্যে নয় বরং তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আর দৃঢ়তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেটা শ্বেতার বৈবাহিক জীবনে কোনও মান্যতা পায়নি।

কফি শেষ করে নীলাঞ্জনা, বিকাশ আর ঋষি যেখানে বসে, সেদিকে পা বাড়াল। শ্বেতার মনে হতে লাগল ওর অর্থহীন প্রতিজ্ঞা আজ ওকে এমন একটা মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে হয়তো সঠিক ঠিকানার দিশা ও কোনও দিনই খুঁজে পাবে না।

তিনে নেত্র

আগের মতো বাবু হয়ে বসলে মা, রানুমাসি দুজনেই আজকাল খুব বকে। অগত্যা বদলে গেল আমার বসার ঢং। কিন্তু সেবারই প্রথম দোলে, চুলের সিঁথির ফাঁকে ইচ্ছে করেই রেখে দিলাম একটু আবির রং। কেন জানি না!

আগে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হতো গরমের ছুটির আগে। সারা দুপুর আমাদের খুব লুডো খেলা হতো। আমার দাদার বন্ধু মৈনাকদা আসত আমাদের বাড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। এলোমেলো দাড়ি। সাজ-পোশাক পরিপাটি নয়, তবু চোখে একটা গভীরতা ছিল। আর কথায় ছিল জাদু। আমি তখন এর বেশি কিছু বুঝি না।

সেবছর ফাল্গুনে, টুটুমাসির বিয়েতে বর দেখে যেরকম ভালো লেগেছিল, সেরকম ভালো লাগে। আর ভালো লাগে আমার পাকা ঘুঁটি, দান পড়লেও মৈনাকদা কাটে না। আমার দাদা রেগে যায়, মৈনাকদা থামিয়ে দেয়। ঝগড়াও হতো মাঝেমধ্যে। সেটা ভুলে গেছি। সুযোগ পেয়ে জোড়া পাকা ঘুঁটি না খাওয়াটা আজও ভুলিনি।

চুল ঝাঁকিয়ে বেশ তবলা বাজাত মৈনাকদা। আমার সাথে সন্ধেবেলা অনেকদিন বাজিয়েছে। সেদিন আমার গান ভালো হতো না। শুদ্ধ স্বরগুলো নড়ে গিয়ে কড়ি-কোমলে লাগত। দাদা আমার থেকে দুবছরের বড়ো, তবুও আমি বড়ো হয়ে গেলাম আগে। কারণ মেয়েবেলায় ছেলেবেলাটা খুব ছোটো।

মাধ্যমিকের আগে দাদাকে বললাম, লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলো একটু বুঝিয়ে দিবি?

দাদার সামনে উচ্চমাধ্যমিক। দাদা বলল, কমার্স পড়তে পড়তে ওসব ভুলে গুলে খেয়ে দিয়েছি। মৈনাককে বলে দেব, ও দেখিয়ে দেবে।

পরদিন দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে শুরু হল আমার লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা। পরের বছর সরস্বতী পুজোয় নৃত্যনাট্যে স্টেজের পিছনে অন্ধকারে খুব অল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলাম আমরা। তবলা নিয়ে মৈনাকদা আর তার ঠিক পাশেই আমি লাফিয়ে গিয়ে বসেছিলাম। ভালো লাগত বসতে। পাঞ্জাবি পরেছিল ও। গায়ে গন্ধটা চোখ বুঝলে আজও পাই। একটা জিতে যাওয়া মানুষের গায়ের গন্ধ। ওটাই শেষ পাশে বসা। মায়ের সজাগ চোখ তারপর আর কোনওদিন, আমাদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি। বারান্দা থেকে ওর কলেজ যাওয়া দেখাটা, আমার আরও বেড়ে গেল। তবে স্বপ্নে অনেক কিছু দেখেছি, সেটা আমার একান্ত নিজস্ব। কাউকে বলা যাবে না।

আমার বাবা- মা দুজনেই চাকরি করে। রানুমাসি আমাদের সবসময়ে কাজের লোক, দেখাশোনা করে। মায়ের নির্দেশে, বেশি বেশি নজরে রাখে আমাকে। কারণ মৈনাক ভালো ছেলে হলেও, অর্থাভাবে ওদের টানাটানির সংসার। ওই বয়সে আমার কাছে সেটা অর্থহীন।

বিজয় দশমীর দিন ও প্রতিবছর আসত আমাদের বাড়ি। বাবা মাকে প্রণাম করত। দাদার সাথে কোলাকুলি করত। আর আমার সাথে চোখে চোখে যেটা হতো, শুধু সেটা নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। মা থালা সাজিয়ে মিষ্টি দিত। আমার, মামারবাড়িতে জামাই-ষষ্ঠীর কথা মনে হতো। মা বলত, দ্যাখ, মৈনাক কত ভালো ছেলে, যেমন পড়াশোনায়, তেমনি কি সুন্দর তবলা বাজায়।

আমার এই কথাগুলো ভালো লাগত না। এগুলো লোক ঠকানো। মৈনাকও বুঝত ভালো বিশেষণ পাওয়া সহজ। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার অনেক মাপকাঠি আছে। তবুও অবুঝের মতো হতাশ চোখে দেখত। আজকের মতো তখন এত মেলামেশার সুযোগ ছিল না। তখন ভালোবাসা বেশি ছিল, সাহস কম ছিল। এখন ঠিক উলটো। সাহসটা বেশি কিন্তু ভালোবাসাটা কম। আসলে বাধা-বিপত্তি না থাকলে কোনও কাজেই আনন্দ নেই।

ফল্গুর মতো একটা প্রেম বয়ে চলতে লাগল। পাড়ায় একটা চর্চা ছিল। কিন্তু কারও হাতেই কোনও প্রমাণ ছিল না। আসলে মৈনাক খুব ভীতু প্রেমিক। মৃদুমন্দ বসন্তবাতাসের মতো সারাদিন মন ভালো করে দেবে, অথচ প্রয়োজনে কালবৈশাখী হয়ে উঠতে পারবে না। না হলে এমএসসি পাশ করা একটা ছেলে তখনও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারছে না। নব্বইয়ের দশকে একটা মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগ নিতে পারে না।

আমার তখন গ্র‌্যাজুয়েশন হয়ে গেছে। আজকের যুগে হলে এটা জলের মতো সহজ। তবে সেটা হলে এ লেখাটাও হতো না, আর ভালোবাসার হয়তো মরণ হতো দু-ছক্কা দুই-এর সংসারের চাপে।

অনেক সাহস করে মৈনাক একদিন দেখা করেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। প্রেম বলতে ওই একদিন আমরা করেছিলাম। গল্পের শেষে আমি যখন বলেছিলাম, বাবা-মা কিন্তু কোনওদিনই তোমার সাথে বিয়ে দেবে না।

ও কোনও উত্তর করল না। শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে রইল। ও যদি সেদিন আমায় এই বিশ্বসংসারের সব ছেড়ে ঝাঁপ দেবার ডাক দিত, আমি সেদিন ওর বুকে মাথা রাখতাম। ঠিক-ভুল, সময় বিচার করত। সাগর ডাক না দিলে, শুধু নদীর পক্ষে এগিয়ে গিয়ে মেলা কঠিন। মনে মনে সেদিন-ই বুঝে গেলাম, এ প্রেম আমায় সারা জীবন বিরহ যন্ত্রণা দেবে। ওঠার আগে আমার হাত চেপে ধরল মৈনাক।

একটা কান্না আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল। আসলে প্রেম তো শুধু ভালোবাসা চায় না, সে রাগারাগি চায়, ঝগড়া চায়, দোকানের ফর্দ চায়, বাজারের ভুল চায়, মুখ-ঝামটা দিয়ে ভাত বাড়তে চায়, মায়ের মতো রাগ করে আলাদা শুতে চায়, মাঝরাতে আবার মশারির ভেতরে এসে সোহাগ পেতে চায়। এসবে প্রেমের মৃত্যু হয়, না সাফল্য আমি জানি না। এখন নিজে মা হয়ে বুঝি, প্রেমের সংসার আর সংসারের প্রেমে কত তফাত।

তারপর যা হবার তাই হল। আমার কিশোরীবেলার অবুঝ প্রেম সাপলুডোর সিঁড়ি পেল না, সাপের মুখে পড়ল। বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কত কলকাকলি, তার মধ্যে বিবাহ-সংগীত, গায়ে লাল বেনারসী, রজনীগন্ধা, আগের সব গন্ধ ঢেকে দিল। কত উপহারের নীচে চাপা পড়ে গেল মৈনাকের দেওয়া গীতবিতান। অচেনা এক পুরুষকে বন্ধু করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মৈনাকের জলছবির ওপর ধুলো জমতে থাকল।

বুঝতেই পারলাম না, কখন আমার ভেতরের দুদিকে দোল খাওয়া দু-বিনুনির ছটফটে মেয়েটা, মরে গিয়ে খোঁপায় পরিপাটি এক শান্ত বউ-এর জন্ম হল। এতদিনের গান-বাজনা, পড়াশোনা, সব টানটান বিছানা, রং মেলানো পর্দা, আর দুপুরের রঙিন কাপড় দিয়ে সেলাই করা বালাপোষের নীচে চাপা পড়ে গেল। কোলে এল মেহুল। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। সন্তান।

নব্বইয়ে দশকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে সন্তানের জন্য জীবন দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। স্কুল, কোচিং ক্লাস, নোট নেওয়া এসবই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। নিজের সব না-পারা ছেলেমেয়ের মধ্যে উসুল করে নেওয়া। জীবনের আয়নায় নিজের থেকে প্রতিবিম্বকে সুন্দর করে তোলা। মেহুলের নীচে চাপা পড়ে গেল আমার সব ঝাপসা অতীত।

আমার স্বামী মানুষটা খারাপ নয়। চাকরি ভালোই করে। মদ বা সিগারেট যেটুকু খায়, তাতে তাকে নেশাগ্রস্ত বলা যায় না। কর্তব্যে ফাঁকি নেই, তবে অমনোযোগিতা আছে। সুখ চারপাশে অনেক ছড়িয়ে আছে, একঘেয়েমির বিরক্তিও আছে। তবে সুপ্রিয় আমাকে খুব বিশ্বাস করে। শিকড় সমেত গাছ তুলে এনে অন্য মাটিতে বসালে যে অসুবিধাগুলো হয়, সেটা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম।

ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করে দ্বিতীয় পদবির বয়সও কুড়ি বছর হয়ে গেল। মেহুল এখন কলেজে পড়ে। আজকাল মেয়েরা, মেয়ে হওয়ার কষ্ট কমই বোঝে। একটা করে সন্তান, চারহাতে ঢাকা প্রদীপের শিখার মতো। আপন খেয়ালে বেড়ে উঠতে পারে। মেয়ে বলে কোনও আলাদা ভয় সমাজ এদের মনে ঢেলে দেয়নি। ফলে আমাদের থেকে খোলস ভাঙার ক্ষমতা এদের বেশি।

মেহুল একদিন কলেজ থেকে ফিরে বলল, মা জানো, আজকে একটা দারুণ ঘটনা হয়েছে। আমাদের কেমিস্ট্রি স্যার, এমডি আজকে হঠাৎ ক্লাসে আমাকে মার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তোমার নাম বললাম, আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করল। মা তুমি চেনো?

মুহূর্তে মনের ফুটো দিয়ে সব স্মৃতি ফিনকি দিয়ে উঠল। নিজেকে সংবরণ করলাম। শান্ত ভাবে বললাম, ওনার পুরো নাম কি?

মেয়ে বলল, মৈনাক দত্ত, দারুণ পড়ায়।

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, তোমার মামার বন্ধু। বলেই অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে নিলাম। আমাদের প্রজন্মের, এ ভয়, না মরলে যাবে না। নিজের গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহকে মানুষ চিনতে যাচ্ছে, অথচ একজন পুরুষকে আমি চিনতাম, সে কথা স্বীকার করার সৎসাহস আজও অর্জন করতে পারলাম না।

মেহুল রোজ এসে মৈনাকের গল্প বলত। ও বিশ্বাসই করতে চাইত না যে, মৈনাক ওর মামার বন্ধু! আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, মামার থেকে এত ছোটো দেখতে লাগে কেন?

আমি ওকে কী করে বোঝাব আমার মৈনাকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। এখন শুধু একটাই আপশোশ করি, মেহুলকে একটু সুপ্রিয়র মতো দেখতে হল না কেন। যত বড়ো হচ্ছে একদম অবিকল আমি। শুধু হাঁটাটা আলাদা। দুদশক আগে আমাদের হাঁটায় শাড়ি পরে যে-সলজ্জ ভাবটা ছিল, সেটা এখন জিন্সে অনেক আধুনিক আর সাহসী।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সুপ্রিয় তখনও ফেরেনি, মেহুল ওর নিজের ঘরে, আমি বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ মেহুল এসে বলে, মা স্যার ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।

আমি ইশারায় বললাম, বল মা টয়লেটে, পরে কথা বলবে।

আমার খুব রাগ হল, ও এরকম বোকার মতো করছে কেন? আসল সময়ে সাহসের খোঁজ নেই। এখন এসব করার কোনও মানে আছে। এখনকার মেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান। কিছু যদি আন্দাজ করতে পারে কী বাজে হবে ব্যাপারটা!

স্যারের সাথে মেহুলের সম্পর্ক আরও কাছাকাছি আসতে লাগল। মেহুলকে কলেজের পর অনেক জায়গায় খাওয়াতে নিয়ে যায়। লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ দুজনে সময় কাটায়। কেমিস্ট্রির অনেক বই, নোটস দিয়েছে মেহুলকে। কিন্তু আমার যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। না পারছি, সুপ্রিয়কে সব খুলে বলতে… না বারণ করতে পারছি, মেহুলকে। তবে ফোনে আর কোনওদিন আমার সাথে কথা বলতে চায়নি। হয়তো বুঝে গেছে, আমি পছন্দ করছি না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেহুলের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে মেহুলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বারণ করে দিই। এতে মেহুল জানতে পারলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। এই নিয়ে অশান্তি আমার বাড়তেই থাকল।

সেদিন পঁচিশে বৈশাখ। আমি টিভিতে গান শুনছি। মেহুল সকালে উঠে বলল, মা, তোমার লালপাড় হলুদ শাড়িটা পরে আজকে কলেজ যাব। রবীন্দ্র-জয়ন্তী আছে।

আলমারি থেকে বার করে দিলাম। লাল ব্লাউজটা হালকা সেলাই করে দিলাম। শাড়ি পরে মেহুল এসে যখন সামনে দাঁড়াল, তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। এতদিনে মা হয়ে বুঝিনি, মেহুল হঠাৎ মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে মেয়েকে কলেজ পাঠালাম। সুপ্রিয় তখনও ওঠেনি। এক ঠ্যালা দিয়ে বললাম, তুমি এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো।

ও ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, কার?

আমি রেগে বললাম, তোমার।

এবার ও ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে বলবে তো?

ওকে বুঝিয়ে বললাম, এবার মেয়ের বিয়ের খোঁজখবর শুরু করতে হবে, কথা বললেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। সময় ঠিক কেটে যাবে। ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে দিয়ে দেব। তারপর পড়তে চাইলে, বিয়ের পর পড়বে।

ও ধামাচাপা দেওয়ার মতো বলল, ঠিক আছে।

সন্ধেবেলা মেহুল ফিরে এল। হই হই করতে করতে ঘরে ঢুকল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা স্যারকে পাঞ্জাবি পরে কী লাগছিল! মনেই হয় না স্যারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। কী দারুণ তবলা বাজাল! আমার নাচের ভিডিওটা দ্যাখো। এই বলে আমাকে অনুষ্ঠানের সব ছবিগুলো দেখাতে লাগল। হঠাৎ একটা ছবিতে মৈনাককে দেখলাম। একইরকম আছে। শুধু চোখে একটা পুরু কাঁচের মোটা ফ্রেমের চশমা।

মেহুলকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের স্যারের চোখে খুব পাওয়ার?

মেহুল বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠল, হ্যাঁ স্যারের তো গ্লুকোমা আছে, আর তো বছর দুয়েক হয়তো দেখতে পাবে, ডাক্তার বলে দিয়েছে। স্যার আমায় সব গল্প করে, স্যার তো কলেজে পড়ার সময়ে জানত। কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে একবারে অন্ধ হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো স্যার বিয়ে করেনি।

সেদিন গভীর রাত। সবাই শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। আমি মেহুলের ঘরে ঢুকে মৈনাকের নাম্বারটা নিলাম। ফোন করলাম মৈনাককে। গভীর রাতে সবার গলাই খাদে নেমে যায়। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় ভেসে এল,

হ্যালো…।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। আস্তে করে বললাম, মালবিকা।

কেমন আছো? একবার শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।

তোমার চোখের কথা শুনলাম।

ও কিছু না। আমি তো ওটা পঁচিশ বছর আগেই জানি। শুধু চিরকালের মতো আলো নিভে যাওয়ার আগে, একবার তোমাকে দেখতে চাই। ওটা আমার অন্ধকারের ভেতরটা আলো করে রাখবে।

আমি যাব, রাখলাম।

সারারাত আমার ঘুম এল না। দেখলাম, একটা গোটা রাত কত গভীর, কত অন্ধকার। বারবার মনে পড়ছিল, মৈনাকের লেখা কবিতার চারটে লাইন,

আমি আজ দুঃখ দিয়ে নেশা করব,

আমার কান্নায় আফিমের কারবার;

তবু…, তুমি জ্যোত্স্না মাখলে না, মহাকাশে

রটিয়ে দিয়েছি স্পর্শহীন প্রেমের ইস্তেহার।

পরদিন সকালে উঠে চা করে ওদের ডাকলাম। সুপ্রিয়র সুগার আছে, ও চিনি দিতে বললে, আমি রাগারাগি করি। আজ আমি ভুল করে ওর কাপেই দুচামচ চিনি দিয়ে দিলাম। শরীর ভারী লাগছে। কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করছে না।

মেহুলকে বললাম, তোর কলেজে একদিন যাব।

মেহুল জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মিষ্টি মা।

মালবিকা ভাবতে লাগল… চোখ কী শুধু দেখার, না কাঁদার!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব