দুর্গা (পর্ব- ২)

পর্ব – ২

আসলে শোভনের জন্যই শুভায়ুর, দুর্গার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তা না হলে তার জানাই হতো না জয়নগর গ্রামে এরকম একটি সুন্দরী রমণী রত্ন আছে। পাওয়া হতো না প্রেমের রূপ-রস-গন্ধ। তার বেশ মনে আছে, অভাবের জন্য যখন তাদের সংসার অচল হয়ে পড়েছিল, তখন শোভন জয়নগরে তার দাদার শ্বশুরবাড়িতে পাঁচশো টাকার একটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিল। সে সময় অভাবের সংসারে টিউশনি করে পাওয়া পাঁচশো টাকার মূল্য ছিল অনেক।

শুভায়ু যখন দুর্গার ছোটো ভাই রাজুকে পড়াতে যেত, তখন সে দেখত ছলছুতো করে দুর্গা পড়ার ঘরে হঠাৎ ঢুকে তার উপস্থিতি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিত। কখনও ছাত্র পড়ানোয় ব্যস্ত শুভায়ুর কানের কাছে আলতো স্বরে বেজে উঠত রঙিন কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আবার কখনও কোনও মুহূর্তে ভেসে আসত শাড়ির খসখস শব্দ। যদি কখনও পড়ার ঘরে স্নো পাউডারের গন্ধ ঘ্রাণে ভেসে আসত, শুভায়ু বুঝতে পারত দুর্গা এসে ঘরে ঢুকেছে। সে এক অপূর্ব অনুভূতি ঘিরে থাকত শুভায়ুকে সারাক্ষণ।

সে সময় শুভায়ুকে যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল। পড়াতে এসে যদি কোনও দিন দুর্গার উপস্থিতি টের না পেত, মনটা তখন ভীষণ খারাপ লাগত। অথচ তখনও তার ছাত্রের দিদির মুখটা দেখা হয়নি। সে যেমন মাথা নীচু করে শোভনের দাদার শ্বশুড়বাড়ি পড়াতে আসত, তেমনি পড়ানো শেষ হলে মাথা নীচু করেই চলে যেত। শুধু একদিন সে যখন তাকে চা দিতে এসেছিল, সেদিন শুভায়ু সাহস করে চশমার ফাঁক দিয়ে তার পদ্মফুলের মতো আলতা পরা ফরসা পা দু’খানা দেখেছিল। তাইতেই সে মজে গিয়েছিল। তারপর থেকে দুর্গার মুখটা দেখার জন্য সে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।

একদিন দুর্গা সে সুযোগ করে দিল। সে দিন কী কারণে যেন ঘরে ঢুকেছিল। ‘উরি বাবারে বলে হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠতেই শুভায়ু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “কী হয়েছে?”

—দেখুন না, আরশোলা। বলে দুর্গা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়েছিল।

শুভায়ু দেখল তার সামনে যেন কুমোরটুলির রাখাল পালের দুর্গা প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে দিন কি তিথি ছিল তা মনে নেই। শুধু মনে আছে দুর্গার পরনে ছিল জরিপাড় বসানো লাল ছাপা তাঁতের শাড়ি, কানের লতিতে ছিল সোনার রিং, গলায় ছিল কালো পুঁতি দিয়ে গড়া মঙ্গলসূত্র হার, আর নাকে ছিল ডালিমের দানার মতো লালপাথর সেট করা নাকছাবি। যতদূর মনে পড়ে, কপালের মাঝখানে কুমকুমের একটা ছোটো টিপও ছিল।

আজও মনে আছে, দুর্গার সেই অপরূপ মোহিনী রূপ দেখে শুভায়ু ফস করে বলে ফেলেছিল, ‘দুর্গা নামটা তোমার সার্থক!’

সে কথা শুনে দুর্গার মেক-আপ করা মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল। শুভায়ুর স্পষ্ট মনে আছে, দুর্গা তাকে জিভ ভেংচে ছুটে পালাতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল।

শুভায়ু পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে কোনও দ্বিধা না করে তার হাত ধরে তুলে বলেছিল, ‘খুব লেগেছে বুঝি?’ দুর্গার সুন্দর মুখটা তখন ঘামতেলের মতো চকচক করছিল। সে যখন মাথা নেড়ে তার ভ্রমরকালো চঞ্চল চোখের দৃষ্টি দিয়ে শুভায়ুকে মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন করে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল, তখন শুভায়ুর বুকে হাজার খুশির ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছোটোবেলা থেকে যত দুঃখ যন্ত্রণা তার মনে জমা হয়েছিল, তা যেন দুর্গার এক পলকের সম্মোহনী দৃষ্টিতে সেই মুহূর্তে গলে জল হয়ে গিয়েছিল।

তার পর পরম লগ্ন এল সেই দিন, যে-দিন পড়াতে গিয়ে দুর্গা তার প্রেমপত্রে কোনও ভনিতা না করেই জানিয়ে দিয়েছিল তার মনের গোপন কথা… ‘তোমাকে ভালোবাসি। এর চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে আর কিছু নেই। ভালোবাসা যদি কোনও পাপ না হয়, যদি অন্যায় না হয়, তাহলে অন্তত একটা চিঠি লিখে আমাকে জানিও। তোমার চরণে শত কোটি প্রণাম জানিয়ে চিঠি এখানেই শেষ করছি।’

— ইতি দুর্গা।

ক্রমশ…

দুর্গা (পর্ব – ১)

দুর্গার কথা মতো শুভায়ু নিমপাতা দাঁতে কেটে চিনি মুখে দিয়ে বারান্দার এককোণে গিয়ে কুশাসন পেতে বসল। শুভায়ু একটু আগে ভাবছিল শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরার পর শ্মশানযাত্রীদের মুখে কে একটু চিনি জল দেবে। কে তাদের যত্ন করে দাওয়ায় বসাবে। দিদিটাও যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তার কোনও চিন্তা ছিল না।

বাসুলডাঙ্গা গ্রামে দিদির যখন বিয়ে হয়, তখন সে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ছাত্র। বাবা বেশ ধুমধাম করেই দিদির বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কপাল পুড়ল। ছেলেপুলে না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে লাগল। শুধু তার খাওয়া বন্ধ নয়, বাঁজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ বলে শাশুড়ির অকথ্য গঞ্জনাও চলতে লাগল।

শ্বশুরবাড়ির অনাচার আর অবহেলা পেয়ে দিদি যখন মনের দুঃখে বাপের বাড়ি ফিরে এল, তখন শুভায়ু দেখল দিদি নয়, যেন তার কঙ্কালসার দেহটা ফিরে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বছর খানেক বেঁচেছিল। তারপর একদিন দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সব দুঃখ আঁচলে বেঁধে পরপারে পাড়ি দিয়েছিল।

শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিদির নিন্দেমন্দ করলেও বাসুলডাঙা গ্রামের লোকজন দিদিকে দেবীর আসনে বসিয়েছিল। তারা এখনও বলে সতীলক্ষ্মী এরকম মেয়ে আর হয় না। গ্রামের কারও বিপদ-আপদ হলে দিদি যেন তখন দশভুজা হয়ে তাদের সেবা করত। সাধে কি আর বাসুলডাঙা গ্রামের লোকেরা তাকে দেবী বলে। আজ মায়ের শব দাহ করে এসে শুভায়ুর দিদির কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে।

—এই চা-টুকু খেয়ে নাও। শরীরের ধকলটা একটু কমবে, বলে দুর্গা চায়ের প্লেটটা শুভায়ুর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে উঠোনে নেমে গেল।

দুর্গা যে কখন স্টোভ ধরিয়ে চা করেছে, কখন শ্মশানযাত্রীদের হাতে মিষ্টি তুলে দিয়েছে— শুভায়ু জানতেই পারেনি। জানতে পারল তখন, যখন সে দেখল শ্মশানবন্ধুরা একে একে যে-যার বাড়ি চলে গেছে। শুধু বারান্দার একধারে শোভন হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চায়ের কাপে সে চুমুক দেয়নি। তার বিষণ্ণ চোখের দৃষ্টি এখন উঠোনে উড়ে এসে বসা শালিখ পাখির দিকে, না কাপ-ডিশ ধোয়ায় ব্যস্ত দুর্গার পদতলে, বোঝা মুশকিল।

একটু পর দুর্গা হাতের কাজ সেরে এসে বলল, ‘কী হল শোভনদা চা যে জুড়িয়ে গেল।’

শোভন তাড়াতাড়ি এক চুমুকে চা-টুকু খেয়ে দুর্গার উদ্দেশে বলল, “তুমি শুভায়ুর জন্য হবিষ্যির ব্যবস্থা করো। আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি।’

দুর্গা বলল, “দিদিকে বোলো সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। আমি একটু পরেই যাচ্ছি।

—আসি রে, বলে শোভন, শুভায়ুর উদ্দেশে হাত নেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

—চা-টা খেয়ে নাও। চা খেলে মাসিমার আত্মা মোটেও কষ্ট পাবে না। বলে দরজার কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল দুর্গা। শুভায়ু চোখ তুলে দেখল, দুর্গার কথা বলার ধরন, তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, এমনকী কাজলকালো টানা চোখের দৃষ্টিটাও ঠিক সাত বছর আগেকার মতো। যা কিছু পরিবর্তন ওর হয়েছে, তা হল কপালের সিঁদুর আর তার পলা বাঁধানো শাঁখা – যাকে বলে এয়োস্ত্রীর চিহ্ন। শোকের দিনেও দুর্গার চিবুকের তিলটার দিকে তাকিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর পুষে রাখা পুরোনো ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। পৃথিবীর কোনও ওষুধেই এ ক্ষত সারবে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে ঠিক পেসমেকারের মতো।

—কী হল, চা খেলে না? দুর্গার সেই পিয়ানোর সুর বেজে ওঠা কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল। যে-কণ্ঠস্বর শুনলে এখনও একরাশ কান্না গুমরে গুমরে ওঠে শুভায়ুর পোড়খাওয়া বুকের মধ্যে। এর জন্য দায়ী তার বন্ধু শোভন।

ক্রমশ…

 

সমর্পিতা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

দিন দশেক ভালোই কাটল অন্বেষা আর শুভর। পুরীতে জগন্নাথ দর্শন, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, চিল্কা সঙ্গে সমুদ্রস্নান। চিন্তা, টেনশন থেকে একেবারে দূরে। পুরী থেকে ঘুরে আসার পরে ওদের একদিন নিমন্ত্রণ করলাম বাড়িতে। মা বিভিন্ন পদ রেঁধেছে ওদের জন্য। ওদের বিয়ের পর থেকে খেতেও বলা হয়নি একদিনও। তাই ওদের পছন্দমতো মাছ-মাংস নিয়ে এসেছিলাম। কেন জানি না, ওরা ভালো আছে দেখে আমার মনটাও ভীষণ ভালো হয়ে গেছে। হয়তো আমি একটা অপরাধবোধে ভুগছিলাম। হাজার হোক আমার হাত ধরেই তো ওদের আলাপ। কথা ছিল অন্বেষা আগে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে, আর শুভ অফিস ফেরত।

সেইমতো অন্বেষা আসার মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল শুভ। তখন মা আমি আর অন্বেষা জমিয়ে গল্প করছি। শুভ আসতেই মা ওর জন্য চা বানাতে চলে গেল। মা ভিতর ঘরে চলে যাওয়ার পরেই একগাল হেসে বলল, ‘শোন শোন দারুণ খবর আছে। আজ অফিসে রেজিগনেশন জমা দিলাম!’

আঁৎকে ওঠে অন্বেষা, কী বলছ কী? পাগল-টাগল হলে নাকি। এটাকে তুমি দারুণ খবর বলছ?’

‘আরে আগে পুরো কথাটা তো শোনো,’ বলে শুভ।

আমিও বলে উঠলাম, ‘শুনবে আবার কী? কী শুনবে? আজকের বার্তা-র মতো হাউস তুই ছেড়ে দিলি! পাবি আর এরকম চাকরি?’

‘পাব আবার কী, পেয়ে বসে আছি বুঝেছিস।’ জোর গলায় বলে উঠল শুভজিৎ।

অন্বেষা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুভর দিকে। বলে, ‘মানে?’

‘মানে একটা নতুন ডেইলি থেকে দারুণ অফার পেয়েছি। আজকের বার্তায় যা পাচ্ছি তার ডাবল দিতে রাজি হয়েছেন পত্রিকার মালিক। তবে কাজের সূত্রে মাঝেমাঝে বাইরে যেতে হতে পারে। আর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট-ই মুম্বইয়ের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। প্রায় মাস খানেকের ধাক্কা।

‘মাস খানেক!’ অজানা আশঙ্কায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে অন্বেষার কপালে। বিস্মিত হয়ে আমিও বলে বসলাম, ‘এতদিন? অন্বেষার কী হবে?’

হাসতে হাসতে শুভ জবাব দেয়, ‘আরে কটা তো দিন, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। না হয় কিছুদিন বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে আসবে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কভার করার সুযোগ তো সবসময় আসে না, তাই হাতছাড়া করতে চাইছি না।’

মুম্বই যাওয়ার পর প্রায় সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। এর মধ্যে হাতেগুনে চার-পাঁচবারই কথা হয়েছে ওদের। ফোন করলেই কাজের চাপ আর ব্যস্ততা, নানান কারণ দেখিয়ে ফোন কেটে দেয় শুভ। এই ভাবেই কেটে যায় বাকি কটা দিন। কাজ সেরে ফিরে আসে শুভজিৎ।

একদিন অফিস যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখা শুভজিতের সঙ্গে। উদভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করছে। গালভরা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল। চাউনিটাও যেন কেমন ছন্নছাড়া। জিজ্ঞাসা করলাম, “কীরে, ফিরে তো কোনও খবরই দিলি না। কাটল কেমন, আজ অফিস নেই?’

উত্তর না দিয়েই হাঁটা দিল শুভজিৎ। পরে জানলাম, চাকরিটা আর নেই। মদ তো ছিলই, মুম্বইতে এ-কদিন থেকেই জুয়ার নেশাটাও চেপে বসেছে। প্রচুর ধারদেনা করে ফেলেছে। অফিসের দেওয়া লাখ-খানেক টাকার ক্যামেরা বিক্রি করে সেই দেনা মেটায়। যার কারণে চাকরিটাও খুইয়ে বসেছে। সম্পাদক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ক্যামেরার দাম না মেটালে থানায় অভিযোগ করবেন। এমনকী অন্য সংবাদপত্রে যাতে শুভজিৎ কাজ না পায়, সে বন্দোবস্তও করবেন তিনি।

সঞ্চয় বলে কিছুই ছিল না শুভজিতের। বরাবরই দেখনদারির ব্যাপার ছির ওর মধ্যে। হাই-প্রোফাইল স্ট্যাটাস মেনটেন করতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই বেশি হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত অন্বেষা নিজের গয়না বিক্রি করে ও বন্ধুদের থেকে ধার করে শুভজিৎকে বাঁচায়। অথচ এ নিয়ে প্রচুর কটাক্ষ শুনতে হয়েছে অন্বেষাকে। টাকা কোথা থেকে এল, সে নিয়েও নোংরা ইঙ্গিত করেছে শুভজিৎ বহুবার।

অন্বেষার হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও বদলায়নি শুভজিৎ। কোনও কাজকর্ম করত না। সারাদিন মদের ঠেক আর জুয়ার আড্ডাতেই কাটাত। পয়সার টান পড়লেই মারমুখী হয়ে উঠত। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় গুমরে মরত অন্বেষা। হাসিখুশি মেয়েটাকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে খারাপ লাগত। ক্যানটিনে খেতে খেতে একদিন ওই-ই বলল, ‘ভানুদা আর পারছি না। এরচেয়ে মৃত্যুই ভালো। মারধর তো রয়েইছে, এখন কথায় কথায় চরিত্র নিয়েও টানাটানি করে। একজন মেয়ের কাছে স্বামীই সব। সে-ই যদি চরিত্র নিয়ে বাজে ইঙ্গিত করে, অপমান করে, এইভাবে বাঁচা যায় না!’

সান্ত্বনার ভাষা আমার জানা ছিল না। শুধু বললাম, ‘মনকে শক্ত কর। শুভকে বরং কোনও রি-হ্যাব সেন্টারে নিয়ে যা। কিছুদিন থাকুক, দ্যাখ না কী হয়। এখন তো অনেকেই ওভাবে নেশার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে।’

একপ্রকার জোর করেই আমরা রি-হ্যাব সেন্টারে ভর্তি করলাম শুভজিৎকে। মাস চারেক থাকার পর অনেকটা সুস্থ হতে বাড়ি আনা হল। দিন দশেক বিশ্রাম নিয়ে স্টুডিয়োর বিজনেস আবার শুরু করল। টুকটাক কাজও পাচ্ছিল। তারপর পূর্ব পরিচিত এক বন্ধুর হাত ধরে মেগাস্টার সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়ের ফোটোগ্রাফির অর্ডার। হারানো রাজ্যপাট ফিরে পেয়ে আবার আগের মেজাজ ফিরে এসেছে শুভজিতের।

এর মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্ট। বেশ কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি। প্রাণে বাঁচলেও চিরকালের মতো হারাতে হল দুটো হাতই। চালকের পাশেই বসেছিল শুভ। পিছন থেকে লরি ধাক্কা মারতেই কীভাবে যেন শুভর হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইলে ঢুকে যায়। তারপর দু-তিন বার পাল্টি খেয়েছে গাড়িটা। হাতের একটা হাড়ও আর আস্ত ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাত দুটো কেটে বাদ দেয় ডাক্তাররা।

কষ্ট পেতে পেতে মেয়েটা বোধহয় পাথর হয়ে গেছে। আজ আর কিছুই ওর মনকে ছোঁয় না। এই ঘটনা ওকে আরও শক্ত করেছে। খুব ইচ্ছে হল বলি, অন্বেষা তুই ডিভোর্স নিয়ে নতুন করে জীবনটা শুরু কর। কিন্তু ওর হাতদুটো ধরে কিছু বলার আগেই ও-ই বলে, “চিন্তা কোরো না ভানুদা। আজ থেকে তোমার বন্ধুর সব দায়িত্ব আমার। আমার বাকি জীবনটা তোমার বন্ধুকেই সমর্পণ করলাম।’

অজান্তে কখন যে দু-চোখ দিয়ে জল নেমে এসেছে বুঝতেই পারিনি।

 

সমর্পিতা (পর্ব-২)

পর্ব-২

এরপর দুজনের মেলামেশা, ঘোরাফেরা। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত। অন্বেষার বাবার, এই বিয়েতে একদমই মত ছিল না। দুজনের পীড়াপীড়িতে যখন মেশোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম ওনার বাড়িতে, উনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ‘দ্যাখো ভানু, তোমার বন্ধুকে তোমার ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার মতো অতটাও ম্যাচিওর হয়নি অনু। তাছাড়া খবর নিয়ে দেখলাম, তোমার বন্ধুটির তো নিয়মিতই বার-এ বসার অভ্যেস। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তো আর মেয়েটাকে জলে ফেলে দিতে পারি না।’

প্রত্যুত্তরে বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘দেখুন দু-এক পেগ মদ্যপান করলে কেউ খারাপ হয়ে যায় না। আজকাল কাজের ক্ষেত্রে এসব একটু-আধটু খেতেই হয়। তাছাড়া ওরা দুজন-দুজনকে জানে ও ভালোবাসে। আপনি মত দিলেও ওরা বিয়ে করবে, না দিলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ…। কাজেই এবার আপনি বুঝুন কী করবেন। মেয়ে আপনার কাছে চিরদিন ছোটোই থাকবে, আফটার অল আইনের চোখে ওরা তো অ্যাডাল্ট এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে নিজেরা ডিসিশন নেওয়ার অধিকারী।’

অগত্যা… অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ের ভালোবাসার কাছে হার মানতেই হল। সম্মতিক্রমে বিয়েটাও হয়ে গেল।

বিয়ের কয়েকদিন পরেই শুভজিতের আসল চেহারাটা ধরা পড়ে অন্বেষার কাছে। একদিন নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছি, অন্বেষা ঢুকল। কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে কখন এলি? বাঁদরটা কোথায়?’

“তার কথা আর বোলো না। যা কাণ্ডটা বাধাল কাল। শুধু মামা অসুস্থ, না এলেই নয় তাই বাধ্য…।’

রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন রে কী হয়েছে?’

‘কাল রাত ১টা নাগাদ খবরের কাগজের সম্পাদক বিকাশবাবুর ফোন। জানাল রিজিওনাল বিজনেস পার্ক উদ্‌ঘাটন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তোলার জন্য পাঠিয়েছিল শুভকে। কিন্তু রাত ১টা নাগাদও অফিসে কোনও ছবি পাঠায়নি শুভ। তাঁর হাউসের তো একটা রেপুটেশন আছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ খবর যদি ছাপা না হয়, তো কম্পিটিশনের বাজারে তাঁর টিকে থাকাই দায় হবে।’

উত্তরে শুধু তখন ওর বাড়িতে না ফেরার কথাটা বলতে পেরেছিলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে কাগজের রেপুটেশন-এর প্রশ্ন, সেখানে শুভর চাকরি নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি হতে পারে। চিন্তায় সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’

‘তারপর। তারপর কী হল?’ বলে উঠলাম।

‘ফোনের পর ফোন করে গেছি ভানুদা। সমানে নট রিচেবল আসছিল।। ভাবছিলাম অন্য কিছু।’

বললাম, ‘আমাকে ফোন করলি না কেন?’

‘তোমাকে ফোন করার জন্যই ফোনটা সবে হাতে নিয়েছি, ঠিক তখনই ডোরবেলটা বেজে উঠল। রাত তখন আড়াইটে হবে। বাবু ফিরলেন। বেহেড অবস্থা।’

অফিসে ছবি না পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে বলল, অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেখানেই ক্যামেরা পড়ে গিয়ে সিস্টেমে গণ্ডগোল। আসল সত্যিটা হল, ও অনুষ্ঠানে যায়ইনি। ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সারারাত নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল কোথাও।’ বলার পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ কানে এল। চোখদুটোও ছলছল করছে অন্বেষার ।

পরের প্রশ্নটা কী হতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম আমি। যা ভাবা ঠিক তাই, খানিক থামার পর প্রশ্ন করল, ‘ও কি আগাগোড়াই এমনই ছিল ভানুদা?’

বোবার মতো চেয়ে থাকলাম ওর দিকে। কে যেন বাকরুদ্ধ করে রেখেছে আমাকে।

এমন নয় যে, এই প্রথমবার শুনলাম শুভ নেশার জন্য কোনও কাজ করেনি। একবার আমার এক বন্ধুর বাবার বার্ষিকীর কাজে ছবি দরকার। সেইজন্য দায়িত্ব নিয়ে ছয় বাই ছয় সাইজের ল্যামিনেটেড ছবি বানাতে দিয়েছিলাম শুভকে। কথা ছিল পরের দিনই ডেলিভারি দেবে।

রাত্তিরে যখন ওর বাড়িতে গেলাম, দরজায় তখন তালা ঝোলানো। দু-দিন পরে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, রীতিমতো রাগারাগি। ‘তুই যখন সময় মতো দিতেই পারবি না, পরিষ্কার বলে দিতিস। তোর জন্য কতটা লজ্জিত হতে হল আমাকে।’

শুভ তখন কেমন সহজভাবে বলে ফেলল, “ইয়ার ছবির কথা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রেস ফোটোগ্রাফারদের একটা পার্টি ছিল। ওখানেই একটু বেশি চড়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আর কাজ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। বরং একটা সরি জানিয়ে দিস।’

কোনও সদুত্তর না পেয়ে অন্বেষা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল ভানুদা, কই কিছু বললে না তো!

‘অ্যাঁ, অ্যা কী যেন বলছিলিস?’

‘ওই-ই শুভর নেশা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ দ্যাখ, ওর যে আগেও দু-এক পেগ চলত এটা তো তুইও জানতিস। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে চলে গেছে, সেটা আমারও অজানা।’

‘বাবা জানলে কী যে হবে কে জানে!’

ওর টেনশন দেখে বললাম, ‘দ্যাখ অন্বেষা এখন ওসব ছাড়। আমার মনে হয়, যা হয়েছে ভুলে যা। তুইও ওকে একটু সময় দে। কদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুজন মিলে কোথাও ঘুরে আয়। ওকে বোঝা। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

ক্রমশ…

সমর্পিতা (পর্ব-১)

প্রথম সারির অভিনেতা সুবিমল রায়ের একমাত্র ছেলের বিয়েতে ফোটোগ্রাফির অর্ডার পাওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। অহংকারে মাটিতে পা পড়ছিল না শুভজিতের। বদলে মুচকি হেসে বলেছিলাম, ‘তা ভাই বেশ তো, আশপাশের মানুষগুলো যদি উন্নতির শিখরে পৌঁছোতে পারে এবং সেটা যদি আবার বন্ধুবান্ধব হয়, শুনে ভালোই লাগে।’

তারপর কেটে গেছে তিনটে দিন। কাল থেকে গা-টা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। সেদিন শুভজিৎদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম বটে। তাই বুঝি, হালকা টেম্পারেচার এসেছে। তার উপর ইয়ার এন্ডিং এর কারণে অমানুষিক কাজের চাপ। শরীর আর দিচ্ছিল না। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ-ই অন্বেষা, মানে শুভজিতের বউয়ের ফোন। উৎকণ্ঠিত গলায় খবর দিল শুভজিতের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়েতে, ফোটোগ্রাফির কাজ সেরে ফেরার সময়, যে-গাড়িতে ফিরছিল সেটা লরির ধাক্কায় উলটে গেছে। জরুরি অবস্থায়, স্থানীয় লোকেরা পাশেই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এখন আইসিসিইউ-তে।

এরকম একটা খবর শুনে কি থাকা যায়? শরীরের কথা ভুলে অগত্যা ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমাকে দেখা মাত্রই অন্বেষার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। খানিক আশ্বস্ত করার জন্য এগোব, ঠিক তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার জানালেন, পেশেন্টের অবস্থা যথেষ্ট সংকটজনক, ৭২ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা সম্ভব নয়।

অতএব অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই আমাদের। সবকিছু এখন উপরওয়ালার হাতে। অপেক্ষমান মূর্তির মতো আইসিসিইউ-এর সামনের বেঞ্চে বসে রইলাম আমরা দুজনে। অন্বেষাকে ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছিল।

একবার জিজ্ঞাসাও করলাম, ‘একটু চা খাবি? ভালো লাগবে।’ কোনওরকমে ঘাড় নাড়িয়ে না বলেই বেঞ্চে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ দুটো বুজল। সত্যিই মেয়েটাকে দেখলে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ের পর থেকে একটা দিনও সুখ পেল না।

মনে পড়ে অতীতে শুভজিৎ আর অন্বেষার প্রথম সাক্ষাতের কথা। অন্বেষা তখন বিকম পাশ করে চাকরি খুঁজছে। এ-অফিস সে-অফিসে দরখাস্ত জমা দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাকেও বলেছিল, ‘ভানুদা তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে, দেখো না কোথাও যদি কোনও সুযোগসুবিধা থাকে।’

ভানু আমার ডাকনাম। আমার ঠাকুমার দেওয়া বড়ো আদরের নাম। আমাদের বাড়ির পাশেই অন্বেষার মামারবাড়ি। ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ায় ও মামার বাড়িতে দিদার কাছেই বেশি থাকত। সেই থেকেই আমি ওর ভানুদা। আমার থেকে বছর সাতেকের ছোটো। কোনও অসুবিধা হলেই ভানুদা আছে।

সেই সময় আমাদের অফিসেই অ্যাকাউন্টস্ ডিপার্টমেন্টে একটা পদ খালি ছিল। মালিককে বলেকয়ে একটা চাকরির বন্দোবস্ত হয়েছিল। তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল অন্বেষা। ঘটনাক্রমে ওইদিন শুভজিৎও হাজির। সেই প্রথম দেখা দুজনের।

অন্বেষা খুব সুন্দরী না হলেও বেশ একটা আলগা চটক রয়েছে। কথাবার্তায়ও পারদর্শী। কথার মারপ্যাচেই বিশ্বজয় করতে পারে সে। তার উপর অল্পবয়সি অমন চটপটে মেয়েকে ভালো লাগাই স্বাভাবিক।

জয়েনিং ডেট অনুযায়ী ৩ অক্টোবর অফিস জয়েন করল অন্বেষা। দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে পরিচয় করানো ছাড়াও ওর কাজও বুঝিয়ে দিলাম আমি। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এক কর্মচারী রিপোর্ট দিয়ে গেল, ‘সাহেব, নতুন ম্যাডাম খুব ভালো। এত মিষ্টি কথা বলেন যে অন্যান্য সাহেবরাও খুব তারিফ করেন ওনার।’

শুভজিৎ মাঝেমধ্যে আমার অফিসেও আসত। খেয়াল করে দেখেছি, ও আমার সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ থাকত অন্বেষার দিকে। একদিন তো বলেই ফেলল, “আরে বস, এটা ওই মেয়েটা না, সেদিন যাকে তোদের বাড়িতে দেখেছিলাম?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস। আসলে সেদিন ও বাড়ি ফেরার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছিল, যে তোর সঙ্গে ওর পরিচয় করানোটাই সম্ভব হয়নি। তবে মনে হচ্ছে তোদের পরিচয়টা খুব শিগগিরি করাতে হবে।’

ঠিক সেই সময় দেখলাম অন্বেষা ফাইল হাতে অ্যাকাউন্টট্যান্ট রতনদার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রতনদা অন্য কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সামনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে অন্বেষা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমার দিকে তাকাতেই ইশারা করে ডাকলাম। দু’এক কথায় রতনদাকে মনে হয় কিছু বলল, হয়তো আপনি ফ্রি হলে আসছি’ এমন কিছু। তারপর সোজা আমার টেবিলে।

‘আরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বস।’

একটু হেসে অন্বেষা জবাব দিল, ‘না না ঠিক আছে। কিছু বলবে?’

‘বলছি বলছি আগে বস। খানিক বসলে তোর কাজের এমন কিছু ক্ষতি হবে না।’

বসতেই হল অন্বেষাকে। এদিক-ওদিক টুকটাক কিছু কথা হওয়ার পর, সপ্রতিভ ভাবে বললাম ‘দেখেছিস তোদের আলাপটাই করানো হয়নি। অন্বেষা এ হল শুভজিৎ।’ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি বিনিময় হল দুজনের। বললাম, ‘আমার কলেজের বন্ধু, ‘আজকের বার্ত’-র ফোটোগ্রাফার। পাশাপাশি অবশ্য একটা স্টুডিয়োও চালায়। আর এই হল অন্বেষা। আমার কলিগ কাম বোন, আবার বন্ধুও বলতে পারিস। ভারি মিষ্টি মেয়ে।’

লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে অন্বেষার মুখ। বলে, ‘সত্যি ভানুদা তুমিও না ।

ক্রমশ…

সিলেবাসের বাইরে (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অয়নের বাবা রিকশা চালাত। একদিন এক লরির ধাক্কায় কোমরের হাড় ভেঙে শয্যাশায়ী। অভীক বাড়িতে আর কাউকে দেখতে পেল না। পরিচয় দিতে অয়নের বাবা বসতে বললেন অভীককে পাশে রাখা মাদুরে। অয়নের বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নিয়ে এসেছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। কথা বলতে বলতেই অয়ন আর ওর মা বাড়িতে এল।

এদিকে অয়ন পাড়ায় খবর পেয়ে গেছে, স্যার এসেছেন বাড়িতে। খারাপ কিছু হতে পারে তাই মাকে কাজ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে। দু’জনের মুখের ঘাম বলে দিল দৌড়ে এসেছে ওরা। দু’জনের চোখেই একমুখ দুশ্চিন্তা। আশপাশের কিছু উৎসাহী মুখ উকি মারতে লাগল। অভীক ওদের স্বাভাবিক হতে বলে এক গেলাস জল চাইল অয়নের মায়ের কাছে।

অয়নের মা অয়নের মুখে আজকের স্কুলের ঘটনা শুনেছে। রাগে ঘেন্নায় আলোকদের বাড়ি আর কাজে যাবে না বলে এসেছে। অয়ন আগে কখনও জানায়নি আলোকের কোনও কথা ওর মাকে। কাজ চলে গেলে ওদের সংসার চলবে কী করে এই ভেবে!

অয়নের দিকে অভীক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে এখন ও নিজের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছে! অয়নকে কাছে ডেকে নিল। ওর মা বাবাও যেন একটু একটু করে শান্ত হতে থাকল। অভীক ওদের নিজের ছেলেবেলার গল্প বলতে লাগল। গরিব হলে এরকম ঘেন্না ও নোংরা আচরণ করাটা তথাকথিত পয়সাওয়ালারা যেন নিজেদের অধিকার ভেবে ফেলে। অভীকের কথা শুনতে শুনতে অয়নের পরিবারের সকলে যেন সমব্যথী হয়ে পড়ল। অভীক বুঝল, মাটি তৈরি হয়েছে। এবার বলা যায় ওর প্রস্তাবটা।

অভীক সরাসরি অয়নের মা বাবাকে বলল-কিছুদিন অয়নকে ওর কাছে রাখতে চায়। ওর পড়াশোনার সব দায়িত্ব সে নিতে চায়। সকলকে দেখিয়ে দিতে চায়, গরিবি কোনও অপরাধ নয়। বরং এটা জীবনে এগিয়ে চলার বড়ো একটা প্রেরণা হতে পারে। স্কুল থেকে অভীকের বাড়ি কুড়ি মিনিটের দূরত্বে। স্কুল ফেরত অয়ন প্রতিদিন অভীকের সাথে যাবে ওর বাড়ি। রাতে পড়াশোনা করে অভীকের বাড়িতে খেয়েদেয়ে ফিরবে ওর মা বাবার কাছে। দরকারে অভীক ওকে একটা সাইকেল কিনে দেবে। ওতে যাতায়াতের সুবিধা হবে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার অভীকের কাছে পড়তে যাবে অয়ন। ওখানে চান খাওয়া করে ওরা একসাথেই স্কুলে চলে আসবে। শনিবার, রবিবার ও ছুটির দিন অয়ন বাড়িতে থাকবে ওর নিজের মা বাবার কাছে। কারণ ওই দিনগুলোয় অভীক যায় গবেষণার কাজে।

প্রস্তাব শুনে অয়নের বাবা-মার চোখ ভরে জল এল। হঠাৎ অয়নের মা বলে উঠলেন, ঠিকই বলেন মন্দিরের ঠাকুর মশায়! মন থেকে ডাকলে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়। উনি সাহায্য করতে মানুষের রূপ ধরে মাটিতে নেমে আসেন। বেশ জোরেই কেঁদে উঠল অয়নের মা। ওর বাবার চোখেও জল। অয়ন কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে। ওর এইমাত্র শোনা স্যারের কথাগুলো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

অভীক আকাশে মুখ তুলে তাকিয়ে বাবাকে খুঁজতে লাগল। বাবা বলত, বড়ো হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালে তবেই জানবি তোর শিক্ষা সার্থক। ও দেখল, চাঁদের আলোয় ভাসছে অয়নদের সারা উঠোন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অভীক চলল মায়ের কাছে। সারা বুক জুড়ে একটা ভালোলাগার নদী বইছে, ছলাৎছল ছলাৎছল!

পরদিন থেকে শুরু হল অয়নের নতুন লড়াই। সহকর্মীরা অভীককে অনেক উৎসাহ দিল। মা অয়নকে যেন নিজের নাতি ভেবে বসে আছে। জোর করে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে। চম্পা মাসিও খুব খুশি। যেখানে বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করা ছেলে মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধ বয়সে, সেখানে অভীকের মতো মানুষরা অপরের ছেলেকে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

চম্পা মাসিও অয়নকে খুব ভালোবাসে। এক একদিন জোর করে অয়নের বাবা মার জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়। স্কুল ও স্কুলের বাইরে অভীকের এই কাজ যেন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে অহঙ্কারী মানুষগুলো ওর কাছে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে অয়নের ক্লাসে। আলোক আর ওকে ‘ছোটোলোক’ বলে না। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে। এখন অয়নের মনের মধ্যেও সে দুঃখ-কষ্ট আর নেই।

এদিকে অয়নের লেখাপড়ার উন্নতি, সত্যিই চোখে পড়ার মতো। অভীক মনপ্রাণ ঢেলে ওকে অর্জিত সব বিদ্যা যেন উজাড় করে দেয়। এটা অভীকেরও একটা লড়াই। অয়নের মাধ্যমে সমাজকে যেন ও একটা বার্তা দিতে চায়। একটু সহানুভূতি, একটু বাড়িয়ে দেওয়া হাত অসুবিধায় পড়া মানুষগুলোর জগৎ বদলে দিতে পারে।

সেদিন স্কুল জুড়ে সকলের চোখে মুখে আনন্দ! প্রধান শিক্ষক মহাশয় আনন্দে অভীককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সহকর্মীরা উচ্ছ্বসিত। অয়ন ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে! একটা লড়াইয়ের জয় হয়েছে। অভীক-অয়নের লড়াই ঘুণপোকায় আক্রান্ত নষ্ট হতে থাকা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে যেন এক নতুন দিশা! শিক্ষক ও ছাত্রদের পবিত্র সম্পর্ক যেন আলোয় আলোয় ভরে যায় আগামীতে। অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ- সকলের প্রার্থনা আজ এটাই।

এদিকে কামিনী ফুলের গাছটার নীচে অয়ন ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে। প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা চেয়ে চেয়ে দেখছে স্কুলে উপস্থিত ছাত্র, অভিভাবক সকলে। অভীক ওর ছেলেবেলার শিক্ষকদের স্মরণ করল। এ যেন এক গুরুদক্ষিণা ওর। হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালে আঁকা সেই দাড়িবুড়োর দিকে। মুচকি হেসে যেন বলছেন, কিছুই হারায় না। রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!

 

সিলেবাসের বাইরে (পর্ব- ১)

অভীকের একমাত্র আশ্রয় মা, কিডনির সমস্যায় এখন শয্যাশায়ী। গবেষণার কাজ প্রায় থেমে। স্যারের “বিগ পুশ”-এও কোনও কাজ হচ্ছে না। মায়ের ডায়ালিসিস চলছে মাসে দুটো করে। অনেক টাকার ধাক্কা। একটা চাকরির নিতান্ত প্রয়োজন। তাই স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অর্থনীতির সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান গ্রামেরই স্কুল আরামবাগ বিদ্যানিকেতনে। মেধা তালিকার ক্রমসংখ্যা একদম প্রথম দিকে থাকার ফল।

শনিবার বিকেল ও রবিবার গবেষণার কাজে বের হতে হয়। ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পালা বদলের যে-ইতিহাস তৈরি হতে শুরু করেছে তা সমাজ পরিবর্তনের হাওয়া মোরগ হয় কিনা তার ওপর চলছে ওর গবেষণা। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গ্রামের প্রত্যন্ত পরিবারে একটা উন্নয়নের দিশা দেখাচ্ছে। কিছু মহিলা দল তৈরি করে কাজ করছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে যৌথ ভাবে। তাতে দায়বদ্ধতা থাকছে সকলের। সেই ঋণের টাকা আয় উপার্জনকারী কোনও কাজে লাগিয়ে আয় করছে এবং ব্যাংকের ঋণ শোধ করছে। বাংলাদেশের অধ্যাপক মহম্মদ ইউনুসের দেখানো পথে চলছে এই ‘সেল্ফ হেল্প গ্রুপ’-এর কর্মধারা। উন্নয়নের একটা উদ্দীপনা সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে।

শিক্ষকতার কাজে অভীকের আগ্রহ নতুন নয়। সংসার চালাতে এর আগে ও প্রাইভেট টিউশনিও করেছে অনেক। বাবার মৃত্যুর পর জমানো টাকায় আর ক’দিন চলবে! ভালো ছাত্র হিসেবে নামডাক ওর টিউশনির পসার বাড়িয়ে ছিল খুব। চাকরিটা পেয়ে ও সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছে। ওর বন্ধু প্রবালকে দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু মা, স্কুল, গবেষণা নিয়েই চলছে।

মায়ের কাছে সবসময় থাকার জন্য চম্পা মাসিকে রেখেছে। অসহায় বিধবা চম্পা মাসি ওদের বাড়িতেই থাকে। মায়ের দেখাশোনার সাথে বাড়ির সব কাজই করে। শনিবার স্কুল ছুটির পর, রবিবার ও ছুটির দিনগুলোয় গবেষণার কাজ জোর কদমে করে অভীক।

স্কুলের পরিবেশ বেশ ভালোই। সহকর্মীরা খুব তাড়াতাড়ি ওকে নিজেদেরই একজন করে নিয়েছে। স্কুলের শৃঙ্খলা বেশ ভালো। লেখাপড়ায় ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মানও বেশ উঁচুতে। ভালোই চলছে ওর শিক্ষকতার দিনগুলো। বেশ মন দিয়ে কাজ করে ও। মা বলেন – যে অন্ন দেয় তাকে কখনও ঠকাবি না। অভীক স্কুলে ওর সেরাটা দেবার চেষ্টাই করে। সহকর্মীরা ও প্রধানশিক্ষকও খুশি ওর কাজে।

নীচু শ্রেণির ক্লাসে ও গ্রামারটা পড়ায়। ভিত শক্ত না হলে ইংরাজিটা শিখবে কী করে! সিক্স-এর ক্লাসে সেদিন ও সবে ক্রিয়ার কাল শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে পিছনের বেঞ্চে একটি ছেলে মুখ নীচু করে বসে। মাঝে মাঝে ওর সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে যেন! কৌতূহলী হয়ে বিষয়টা জানার চেষ্টা করতেই ওর পাশের ছেলে যা বলল তা শুনে খুব কষ্ট হল অভীকের।

যে-ছেলেটি কাঁদছে তার নাম অয়ন। ক্লাশের মনোযোগী ছাত্র। ক্লাসে মাঝেমাঝে অভীকের প্রশ্নের উত্তরও দেয়। অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে, অন্য বিষয়েও বেশ ভালো। ছেলেটির রোল পনেরো। পাশের ছেলে রমেন বলল, ওর কান্নার কারণটা।

অয়নরা খুব গরিব। ওর মা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়। ওর মা ক্লাসের চতুর্থ রোল নম্বর, আলোকদের বাড়িতে কাজ করে। আলোক ক্লাসের মনিটর। অয়নের মা লোকের বাড়ি কাজ করে বলে অয়নকে আলোক ‘ছোটোলোক’ বলে গালাগাল করে। ভীতু চেহারার অয়ন কিছু বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা অয়নের হয়ে বলতে গেলে আলোক মনিটর বলে উলটোপালটা নাম তুলে স্যারেদের কাছে বকুনি খাওয়ায়।

অয়ন আজ আগে এসে প্রথম বেঞ্চে বসেছিল। আলোক পরে এসে ওর ব্যাগ শেষ বেঞ্চে রেখে ওর জায়গায় বসে। শুধু তাই নয়, আলোক অয়নকে সকলের সামনে বলে – ছোটোলোকের ছেলে সামনের বেঞ্চে বসবি কী! তুই রোজ শেষ বেঞ্চে বসবি। নাহলে তোর নামে উলটোপালটা নালিশ করব স্যারেদের কাছে। রীতিমতো হুমকি! চমকে উঠল অভীক। এইটুকু ছোটো ছেলেটার বুকে এতো ঘৃণা! অয়নের জন্য একটা কান্না যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে অভীকের ছেলেবেলা অয়নের সাথে।

অভীকের বাবার মৃত্যুর পর আশপাশের পরিচিত আত্মীয়দের ব্যবহার, ও ভোলেনি। কথায় কথায় গরিব বলে একটা ঘেন্না ছুড়ে দিত ওদের দিকে। মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদত সেই সময়। আগুন চোখে মা শুধু বলত, সুদিন আসবেই। মুখ বুজে অভীক সেই সুদিনের প্রতীক্ষা করে গেছে। ঈশ্বরের দূতের মতো কিছু শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে তখন ও পাশে পেয়েছে। স্যারেরা অভীকের লেখাপড়ায় সব সমস্যা মিটিয়েছেন। তাঁদের, শুধু তাঁদেরই জন্যে অভীক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং আজ গবেষণায়। অয়নের কান্নাভেজা দু’চোখ ওর বুকে ঝড় তুলেছে আজ!

স্টাফরুমে ফিরে ও সহকর্মীদের বলল সব। প্রধানশিক্ষকও শুনলেন সব। পরের দিন আলোকের অভিভাবক-কে ডাকার ব্যবস্থা করলেন। অভীক বুঝল, অয়নের মাকে কালই অপমান করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে ওরা। তাই যা করার আজই করতে হবে। স্কুল ছুটির পর অভীক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে করে অয়নের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোল। দেখল মাটির বারান্দায় অয়নের বাবা শুয়ে।

ক্রমশ…

 

 

কালো রাস্তার মানুষ (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব  

বিয়ের পর বছর চার কেটে গেলেও হারু ও ফুলমণির কোনও সন্তান জন্মায় না। ফুলমণির মাসের রক্তপাত বন্ধ হয়, পেটে সন্তানের উপস্থিতি বুঝতে পারে। কয়েকমাসের মধ্যে একদিন হঠাৎ রক্তপাত হতে শুরু করে। পরনের কাপড় ছেড়ে রক্ত গড়িয়ে আসে পায়ের দিকেও। এই রক্তপাত বড়োবাবুদের কাছে এটা খুব ভালো খবর হলেও ফুলমণির জন্যে খুবই দুঃখের।

হারু ফুলমণিকেই দোষ দেয়। ঝগড়া করে, খাবার উলটে দেয়, মদ খাবার পরিমাণ বাড়ায়। এমন ভাবেই চার বছর কেটে যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই তিন মাস হল একটা মেয়ে জন্মালেও হারু কিন্তু তার আগের জায়গায় ফিরে আসেনি, বরং একটা গা’ছাড়া ভাব তাকে জাপটে ধরেছে। মুখে কিছু না বললেও ফুলমণি বেশ বুঝতে পারে।

পরের দিন খুব তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে যায়। ফুলমণি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তাঁবুতে হারু নেই। মেয়েটা রাতে বেশ কয়েকবার কেঁদে উঠেছিল, কেমন যেন দম বন্ধ করা কান্না, গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কাল সকালেও না কমলে বড়োবাবুর হাতে পায়ে ধরে একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে। এদিকে সারা রাত বৃষ্টিও পড়েছে। রাতভর সে নিজেও ঘুমোতে পারেনি। ভোরের দিকে চোখদুটো বুজে আসে। ফুলমণি বাইরে বেরিয়ে দেখে বাকি সবাই উঠে গেলেও কাজের কোনও তোড়জোড় নাই।

বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার, এইরকম থাকলে আজ আর কাজ হবে না। চোখে মুখে জল দিয়ে হাঁড়ি থেকে পান্তা বের করে নিজে নেয়, হারুর জন্যেও ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়। কিছু সময় পরেই দেখে দূরের চা-দোকানের ওই লোকটা তার দোকান ছেড়ে আরেকটু উপরের দিকে উঠে গেছে। জিনিসগুলো একটা একটা করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটার শরীরের কথা ভেবে ফুলমণি ছেলেদের তাঁবুর কাছে এসে বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আমার লোকটা কোথায় গো?’

—পকুরের পানে গেইচে, উ আর সুবলা।

—আজ কাজ হবেক?

—দেখি বাবু যা বলবেক, ম্যাঘ করিছে, জল পড়লে আর কী করে কাজ বাগাব? রাজুয়ার গলা।

ফুলমণি একপা একপা করে দোকানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি গো আজ রুটি দিবে না?’ দোকানি প্রথমে কোনও উত্তর দেয় না। ফুলমণি আবার জিজ্ঞেস করে। এবার দোকানি বিরক্ত হয়!

—দেখছ না, আজ কী অবস্থা, এক্ষুনি গাড়ি এসে সব ভেঙে দেবে, পিছিয়ে গেলাম। বৃষ্টি আরম্ভ হলে এই মানুষটাকে কোথায় রাখব কে’জানে?’

ফুলমণি তাকিয়ে দেখে দোকানির বউটা সেই একই ভাবে শুয়ে আছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি মাথা নীচু করে নিজের তাঁবুতে ফিরে মেয়েদের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ায়, ‘কাঁদেনি তো?”

—না, শুনি নাই। রুবি উত্তর দেয়।

—আজ তো কাজ হবেক নাই, চল চানট করে আসি গা। একটু ভালো করে রান্না চাপাইতে হবেক।

–তুই উদিকে কুথাকে গিছিলি?

—উই যে, আজ উয়াদের দুকানটা ভেঙি দিবেক বলিছে, সেই…।

টিপ টিপ বৃষ্টি আরম্ভ হয়, ফুলমণি নিজের তাঁবুর ভেতর আসে। মেয়েটা এখনও উঠে নাই। ‘ভালো হল!’

পাশের তাঁবুতে গিয়ে মেয়েটাকে দেখবার জন্যে বলে ফুলমণি আরও কয়েকজনের সাথে স্নান করতে যায়। ফেরবার সময় একটু দেরি হয়ে যায়। বৃষ্টির জন্যে বেশ কয়েকবার দাঁড়াতে হয়েছিল। মাথায় গামছা ঢাকা দিয়ে তাঁবুতে ফিরতেই ভয় পেয়ে যায়। তাঁবুর ভেতর এক পাশে হারু কেমন ভাবে বসে আছে, তার মুখে কোনও কথা নেই।

ফুলমণি তার দিকে তাকিয়ে একরকম আঁৎকে উঠেই জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’

হারু কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, ‘গা-ট ঠান্ডা হয়ে… ‘

ফুলমণি তাড়াতাড়ি মেয়েটার পাশে বসে তার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে, সেই তো এক্কেবারে বরফের মতো ঠান্ডা, নাকের নীচে হাত দেয়, না কোনও শ্বাস পড়ছে না।

ফুলমণি চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার শুনে পাশের দুটো তাঁবু থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। একজন ফুলমণিদের তাঁবুর ভেতর গিয়ে বাচ্চাটার শরীরে হাত দেয়।

—না আর প্রাণ নাই।

বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যায়। বাইরে তখন মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। নিজেদের তাঁবুতে ফুলমণি কোলে মরা বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে বৃষ্টি থামবার অপেক্ষা করে। কবর দেবে? কোথায় দেবে? বড়োবাবুকে একবার জানাবে?

ফুলমণির চোখ দুটো কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। পাশে ছেলেদের তাঁবু, ওখান থেকেও কোনও গান বা হাসি-মজার আওয়াজ নেই. ওখানেই হারু বসে আছে। হঠাৎ ফুলমণির দূরের ওই চায়ের দোকানটার দিকে চোখ যায়। পাঁচরকমে খেয়াল করেনি, দোকানটা এক্কেবারে ভেঙে দিয়ে গেছে। ফুলমণির চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়।

ভাঙা দোকানের পিছনে একটা খোলা ছাতা দেখতে পায়। ভিতরে দু’জন মানুষ খোলা আকাশের মাঝে একটা ছাতার নীচে বসে আছে। ফুলমণি এক ভাবে দেখে যায়, শুধু দেখে যায়। কোলে মরা মেয়ে, একটু দূরে একটা ছাতার নীচে বসে আছে সেই দোকানি আর তার অসুস্থ বউ। একদিকে তৈরি হওয়া রাস্তার উপর তখন শুধু মুষল ধারার বৃষ্টি পড়ছে।

 

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-২)

পর্ব ২

বড়োবাবু বুঝতে পারলেই চিৎকার করে, ‘দূর হ, এখন আর কাজ হবে না, হয় সব খসিয়ে আয়, না হলে ভাগ।’ ফুলমণিদের সবেই জ্বালা। এমনিতেই মাসে মাসে আরেকটা জ্বালা আসে, কয়েকটা দিন পেটে ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, সারাটা শরীরে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই ম্যাদা মেরে যায়। তখন কাজ করতে হাঁপ ধরে, মাঝে মাঝেই আড়াল খুঁজতে হয়।

কথাগুলো তাঁবুতে প্রথম দিকে টুনটুনির মা বলেছিল, সেই সঙ্গে বড়োবাবুর থেকে সাবধানে থাকতে বলে। ফুলমণি নিজেও বড়োবাবুর চোখে সব সময়ের খিদে দেখছে। ফুলমণিরা শাড়ি বা সালোয়ার যাই পরুক তার উপর একটা জামাও পরে। তাও কাজ করবার ফাঁকে জামা সরে যায়, পোশাকের বাঁধন আলগা হয়, বড়োবাবু তখনই শকুন হয়ে ওঠে।

ফুলমণি নিজেও দেখেছে, গোবরার বউ কয়েকদিন আগে তার কোলের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। বড়োবাবু মুখে একটা বিড়ি ভরে চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছিল মায়ের আদর, ভালোবাসা। গোবরার বউয়ের সেদিন কোনও উপায় ছিল না।

টুনটুনিও কাজ করত। কাজ করবার সময়েই বিয়ে হল, এখন কোনও নজর নাই। একবার টুনটুনি আর ফুলমণির একই সময়ে রক্তপাত আরম্ভ হল। টুনটুনি বয়সে অনেক ছোটো ছিল, তাও মেয়ে তো। কাজ করবার মাঝে বারবার আড়াল খুঁজতে গেলে বড়োবাবু ঝাঁঝি মেরে ওঠেন, ‘তুরা গেদে কামচোর, একটু ঝাঁট দিচ্ছিস আর পালাচ্ছিস।’

—উয়ারা এমনি পালাচ্ছে নাকি গো। তোমার ঘরে বিটিছিলা নাই! জানো না, কি বটে?

সেদিন অবশ্য বড়োবাবু সবার মাঝে হেসে উঠেছিল, ‘তুদের আবার লজ্জা?’

খেপে উঠেছিল টুনটুনির মা, ‘কেন গো বাবু, তুমার ঘরের মেয়েদের শরীর-ট শরীর, লাজলজ্জা সব তুমাদের, আমাদের নাই।’

—তুর কিন্তু খুব কথা হয়েছে। লাথ মেরে তাড়িয়ে দিলে বুঝবি।

আর কোনও কথা বলেনি টুনটুনির মা। সেদিনই রাতে রান্না করবার সময় ফুলমণিদের মাঝে বসে কথাগুলো বলে। ফুলমণি কোনও দিন তার মাকে কাঁদতে দেখেনি। চরম কষ্টের দিনেও শুকনো চোখে খেটে গেছে। গোবর কুড়িয়েছে, ঘুঁটে দিয়েছে, সেই ঘুঁটে মাথায় করে বিক্রি করেছে, রাতে বরের হাতে মার খেয়েছে, মারামারি করেছে, চিল্লিয়েছে। টুনটুনির মাকে কাঁদতে না দেখলেও চোখমুখে একটা চাপা ভয় দেখতে পেয়েছে।

ফুলমণি লম্ফের আলোটা একটু বাড়ায়। ভাতের মধ্যে কয়েকটা আলু আর দুটো ডিম ফেলে দেয়। আর বেশি কিছু করতে ভালো লাগছে না। লোকটার মুখে আবার খারাপ কিছু রোচে না, খিস্তি করে, মারতে যায়। আগে লোকটা এমন ছিল না। যে-রাতে বড়ো তাঁবুতে ফুলমণির পাশে মোটা বউয়ের বরটা ফুলমণির শরীর ছুঁয়ে নিজের আমিত্ব ফলাতে গেছিল তারপরের দিন সকালে উঠেই হারু লোকাটাকে খুব পেটায়। বড়োবাবুর কাছে খবর চলে যায়।

মোটাবউ ও তার বর দু’জনেই বড়োবাবুর পেয়ারের লোক ছিল। সবাই জানত নিজের শরীরের গন্ধ শুঁকিয়ে মোটা বউ বড়োবাবুর হকের মেয়েমানুষ হয়ে উঠেছে। সারাদিন কোনও কাজ না করে বসে থাকলেও তাকে কিছু বলে না, বরং ফুরসত পেলেই দু’জনে গল্প করে। বড়োবাবু একটা ক্লাব ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকে। মোটাবউ সকালে রাতে সেখানে রান্না করতে যায়।

—রান্না করে হাতি, ও যায় ধান্দা করতে। কথাগুলো হাবুলের বউ একদিন বলে।

ফুলমণি তখন এই কাজে নতুন এসেছে। কথা বললেও খুব বেশি মাখামাখি করে না। পরের দিনের ঝামেলার জন্যে দু’জনেরই কাজ চলে যেত, পোঁটলা গুটিয়ে চলে যেতে হতো। কিন্তু বড়োবাবুর হাত পা ধরে সে যাত্রায় কোনওরকমে কাজটা বাঁচলেও অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়, বড়োবাবুও সেখানে যাবে। হারু ও ফুলমণিকে আবার নিজেদের খরচে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নতুন জায়গায় যেতে হয়।

হারুর বাবাও রাস্তা তৈরি করবার কাজ করত। ছোটো বয়সে মা মারা যাবার পর হারুও বাবার সাথে ছোটো থেকেই এই রাস্তা তৈরি করবার কাজে ঢুকে যায়। দু’জনের রোজগারে ভালোই চলছিল। বাবা ফুলমণির সাথে বিয়ের দেখাশোনাটাও করে গেছিল, তারপর হারুর বিয়ের আগেই একদিন রাস্তা তৈরি করবার সময় রোলার গাড়ির নীচে পড়ে এক্কেবারে মাটির সাথে মিশে যায়। কয়েক বছর সব চুপচাপ থাকবার পরেই ফুলমণির বাড়ি থেকে আবার হারুর সাথে যোগাযোগ করে, তাদের বিয়ে হয়। কন্ট্রাকটর কিছু টাকা দিয়েছিল, সেই টাকাতেই বিয়ের খরচ মেটে।

বিয়ে হলেও সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। হারুর তো বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ। গ্রামে বাবার একটা ঘর থাকলেও সেখানে আর কেউ থাকে না। হারুর জীবনও এই তাঁবুর ভেতরেই কাটতে আরম্ভ হয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করা বউ তো আর সেভাবে থাকবে না। কথাগুলো তার তাঁবুর বাকি লোকদের সাথে আলোচনা করলে তারা বেশ মজা করেই বলে, “আরে বাবা, তুই বিয়ে করবি এটা তো ভালো কথা। এখানে অনেকেই বউ নিয়েই থাকে। তোরা যখন থাকবি আমরা না হয় চোখদুটো বন্ধ করে রাখব।”

হারু হেসে ওঠে। তাদের বিয়ে হয়, কন্ট্রাকটর কয়েকদিন ছুটিও দেয়, ফুলমণির বাড়িতেই তাদের ফুলশয্যা হয়। কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও বসে বসে কেউ আজীবন মুখে ভাত দেবে না। হারু ফুলমণি দু’জনই কাজে ঢুকে যায়। কাজ বলে কাজ— পিচ গরম, রাস্তা খোঁড়া, ধুলো বালি পরিষ্কার করা, পাথর বিছিয়ে সমান করা, দু’পায়ে চিকচিকি বেঁধে পিচ ফেলা, বালি দেওয়া, কাজের আর শেষ নাই।

ফুলমণির প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। বিয়ের কয়েকদিন পর হারু কোনও পিচের রাস্তার উপর দিয়ে যাবার সময় বলে উঠত, “এই দ্যাখ এই রাস্তাটা আমরা করেছি।’ তারপরেই রাস্তা তৈরি করবার গল্প করত। তখন ফুলমণি অবাক হয়ে শুনলেও কাজ করতে এসে বোঝে, সব গল্প গল্প হয় না!

ক্রমশ…

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-১)

তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে ফুলমণি আকাশের দিকে চোখ রেখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এই দিকটাতে আলো নেই, চারদিকের অন্ধকার মেঘের জন্যে আরও গুমোট, তাঁবুর ভিতরেও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পাশে মেয়েদের তাঁবুটাতেও রান্না চেপেছে, কারওর মোবাইলে গান বাজছে। ছেলেদের তাঁবুতে এই সময় এক-দু’জন বাদে কেউ থাকে না, ওরা রান্না করে না, মেয়েদের তাঁবুতেই রান্না করা হয় — সবাই তো বউ-বর বা মা-ছেলে।

মেয়েদের একটা তাঁবু, আর ছেলেদের আলাদা একটা। শুধু ফুলমণিরাই আলাদা থাকে। তাঁবুটা ওদের টাকাতেই তৈরি করা। ফুলমণি দেখে একটু দূরের চায়ের দোকানটা এখনও খোলা আছে। বেশ কয়েকবার ওই দোকানে পাউরুটি কিনতে গেছে। ঘরের মানুষটার মতিগতি সব সময় ভালো থাকে না। মাঝে মাঝে ফুলমণির মনে হয় সকাল আর রাতে দু’জন আলাদা লোকের সাথে ঘর করে! পেটে জল পড়লেই হয়ে গেল, কতদিন ভাতের হাঁড়ি উলটে দিয়েছে, তখনই দোকানে খাবার কিনতে যেতে হয়।

চায়ের দোকানটাতে গিয়ে অনেকবার কথাও বলেছে। দেখে খুব মায়া হয়! লোকটার বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়ে কেউ দ্যাখে না। বউটাও অসুস্থ। দোকানের পিছনেই একটা ছোটো জায়গায় ওরা দু’জন থাকে। বউটা ওখানেই শুয়ে থাকে। ফুলমণি একবার দোকানের লোকটাকে, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করেছিল।

লোকটা কেমন ভাবে বলে উঠেছিল, ‘আর কী হয়েছে! বেঁচে আছে এই…’

বউটা চোখ ঘুরিয়ে ফুলমণিকে দেখেছিল। তারপর থেকে ফুলমণি দোকানে গেলেই বউটাকে দেখে। বুঝতে পারে ভালো ঘরের মেয়ে, রোগে ভুগলেও গায়ের রং এখনও বেশ চকচকে। কয়েকদিন আগে দোকানিটা অন্য আরেকজন খদ্দেরকে বলছিল, “আর ক’দিন থাকতে দেবে কে জানে? শুনলাম সেন গুমটির কাছে সব দোকান ভেঙে দিয়েছে, আমাদের এদিকটাও ভাঙবে।” ফুলমণি কথাগুলো শুনে নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দোকান ভেঙে দেবে, কেন?’

লোকটা ফুলমণির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘এই যে তোমরা রাস্তা তৈরি করছ।’

মনটা খারাপ হয়ে যায়, কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না! হারুকে বললেই এক্ষুনি খেঁকিয়ে উঠবে। সে নিজে এই কয়েক বছরে অনেক জায়গায় রাস্তা তৈরি করতে গেছে। দেখেওছে কীভাবে রাস্তা তৈরি করবার আগে কত জায়গার দু’দিকের ঘরবাড়ি দোকানঘর ভেঙে দেয়। এখানেও প্রথম দিকে কয়েকটা দোকানঘর ভেঙেছিল।

ফুলমণির এসব দেখে কষ্ট হয়, একবার ঝড়ে ওদের নিজেদের গোয়ালঘর ভেঙে গেছিল। দু’টো গরু সারাটা রাত ভিজেছিল। এদিকেও রাস্তা একদিকে তৈরি হয়, আরেক দিকে গাড়ি চলে। রাস্তা হয়ে গেলে এখন আবার পাথর বসায়, একটা কী যেন নাম আছে। ফুলমণিদের অবশ্য তখন ডাকে না।

একটু আগেই ও পুকুরে স্নান করে এসেছে। পুকুরটা একটু দূরে, তাও সন্ধেবেলাতেও সবাই মিলে স্নান করতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হয় না। প্রতিদিন দু’বার করে স্নান করবার জন্যে প্রথম দিকে ঠান্ডা লাগত। এখন সবকিছু কেমন যেন সয়ে গেছে।

—কি রে ফুলু, আজ কী করবি, আটা খাবি, নাকি ভাত চাপাবি?

—আটা খেতে লারি, গলা দিয়ে নামতেই খুঁজে না, গেল হপ্তাতে কয়েকদিন আটা খেয়িছিলম, হাগা আর বাগাতে লারি, ক’টা ভাতই ভালো, তুমি কী করছ?

—আমার তো একার কথাতে কিছু হবেক নাই, সবাই রুটি সেঁকছে। ভাত কালকের লগে, পান্তা করবেক।

কথাগুলো বলে লোকটি এগিয়ে গেলেও পিছন থেকে ফুলমণি ডাকে, ‘ও, খুড়ো, বড়োবাবুর কী খবর, এখনও টাকা দিলেক নাই।’ খুড়ো একটা শ্বাস ছাড়ে। হাওয়ার শব্দ ফুলমণির কান দিয়ে মাথার ভেতরে পৌঁছে যায়।

—সেই তো, গেল হপ্তা থেকে পাঁয়তারা কষছে। হারু কই?

—সাঁঝের ব্যালা কুথাকে থাকে?

খুড়ো আর কথা না বলে একপা একপা করে নিজের তাঁবুর দিকে যায়। খুড়োর বয়স হয়েছে, এখন একটু বেশি কাজ করলেই হাঁপায়। কয়েকদিন আগেও মাটি কুপাত, মাথায় করে গরম পিচ মেশাত, পাথর ফেলত। এখন শুধু রোলার গাড়িটার সামনে ভিজে বস্তা ধরে আর বাকি টুকটাক কিছু কাজ করে।

ফুলমণি খুড়োর সাথে কথা শেষ করেই নিজের তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। এইবেলা ভাতটা করে নিলে অনেকটাই ফের কাটে। ফুলমণিরা আগে একটা তাঁবুতেই থাকত, তখন এই ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে ছিল না। মরদগুলো সারাটা দিন জানোয়ারের মতো খাটত। কাজ শেষ হলে কয়েকজন পিচ গলানোর কাজ করলেও বাকিরা চলে যেত। রাত বাড়লে টলতে টলতে তাঁবুতে ফিরত। যারা পিচ গলাত তারাও যে গিলত না সেটা নয়, তাও ওদের সব কিছু বাঁচিয়ে করতে হতো।

এই দলে কম বয়সি মেয়েছেলেগুলোও মদ মারে। না হলে ওদের শরীর কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে যায়, তারা কেউ বাইরে যায় না। ফুলমণি প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখত। টানা পাঁচদিন কাজের পর একদিন ছুটি থাকত, সেদিনের জন্যে তারা টাকা না পেলেও সবাই সন্ধেবেলা তাঁবুর ভেতরে বসে যেত, সামনের কোনও দোকানে ঝাল ঝাল করে চপ বা অন্যকিছু ভাজাত তারপর…

ফুলমণির লোকটার অবশ্য এইসব পোষাত না। দোকানে না গেলে তার নেশা জমত না। ফুলমণিরও খুব সাধ হতো, ছুটির বেলায় সবার সাথে বসে একটু মজা করবে। কিন্তু সেই সময় পেটে শত্রু চলে আসত। এটাই ফুলমণির সব থেকে অসুবিধার। শত্রু আসত, কয়েকটা মাস পেটেই বড়ো হতো, তারপর পেটের ভেতরেই মরে যেত। ফুলমণির সেই সময় খুব রক্তপাত হতো। কয়েকদিন তাঁবুর ভেতরেই শুয়ে থাকতে হতো। কাজ করতে পারত না। এটাই ঝামেলার, শত্রু এলে আর ভালো কাজ হয় না।

ক্রমশ…

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব