হনন (পর্ব ২)

২য় পর্ব

—এ কি! তুমি এত সাজগোজ করে জামা-কাপড় পরে বসে আছ কেন? কোনও অনুষ্ঠানে যাবে বুঝি?

কথার উত্তর না দিয়ে শ্রী বিতানকে জাপটে ধরে খাটে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘কেন আমাকে দেখতে যথেষ্ট সুন্দর লাগছে না বুঝি? দ্যাখো… দ্যাখো… দ্যাখো ভালো করে। তোমার জন্যই তো সাজলাম। এগুলো কেরালার গয়না, জানো? বাবা কেরালার কান্নুরে পোস্টেড ছিলেন। তখন কিনে দিয়েছিলেন এগুলো।’ বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় বিতান।

—আঃ শ্রী! কী যে ছেলেমানুষি করো না! তোমাকে তো রোজই দেখছি। আমার জন্য এত সাজগোজ করবার তো কিছু নেই! বিতানের আরও কাছে এগিয়ে এসে তার বুকে মুখ গুঁজে শ্রী বলে ওঠে, ‘উঁহু, অনেকক্ষণ দ্যাখোনি তো আমায়। সারাটা দিন। মানে ঠিক আট ঘন্টা, ত্রিশ মিনিট, দশ সেকেন্ড।’ শ্রীর আলিঙ্গনে বিরক্তি যেন জাপটে ধরে বিতানকে।

—আঃ ছাড়ো এখন! সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরেছি। এখন বড্ড ক্লান্ত, শ্রী। কোথায় চা, জলখাবার দেবে তা নয়… কী যে করো না এসব!

ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে চলে যায় বিতান। পিছনে শ্রীদর্শিনীর মাথায় যে নীরবে ভিসুভিয়াস ফুটছে, তা বেশ বুঝতে পারে সে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের ঘরে ঢোকে বিতান। দেখে মা শরৎকাহিনিতে মগ্ন। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। এতক্ষণ মনে যে-ক্ষোভ, বিরক্তি জমেছিল পুরোটা উগরে দিল মায়ের উপর।

—বেশ ভালোই আছো তোমরা। একজন সাজগোজে বিভোর, আর একজন কাব্য-কাহিনি পড়তে ব্যস্ত। বাহ্! আমি যে সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এসেছি সে দিকে কারও নজর নেই। বিতান দেখল ছায়া ঘনিয়ে এল মায়ের মুখে। লজ্জিত মুখে মা বলল,

—এইমাত্র সব সেরে এসে একটু বসলুম রে, বাবা। ওবেলার রান্নাটাও সেরে নিলুম। রাতে শুধু গরম গরম ভাত নামিয়ে খেতে দেব তোদের। তা এখন জলখাবারে কী দেব, বল?

গজগজ করতে করতে বিতান বলে, ‘কেন? একা সব কাজ করো কেন? তোমার আদরের বউমাটিকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেও তো পারো! শেখালে কি সে শিখবে না?’ মায়ের মুখটা যেন আরও কালো হয়ে যায়। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আসলে সে তো এ সংসারের নতুন মানুষ। এখন একটু সাজগোজ-আমোদ-আহ্লাদ করুক না মেয়েটা। ক’দিন পরে তো সংসারের জোয়ার  কাঁধে নিতেই হবে। যাক গে, তোকে একটু মুড়ি মেখে দিই, শসা-পেঁয়াজ দিয়ে?’

—নাঃ, শুধু চা আর বিস্কুট দাও। বলেই গট গট করে ড্রয়িংরুমের দিকে হেঁটে যায় বিতান। যেতে গিয়ে আড় চোখে শোবার ঘরের দিকে তাকায়। সেখানে যেন কঠিন নীরবতা বিরাজ করছে! আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাষ! টিভিটা চালিয়ে অস্থির ভাবে চ্যানেল ঘোরাতে থাকে বিতান।

মা কিছু না বললেও বিতান জানে সারাদিন রূপচর্চায় মত্ত থাকতে চায় শ্রীদর্শিনী। নানারকম রূপটান বা ফেসপ্যাক, হেয়ার প্যাক তৈরির উপকরণ বিতানই তো কিনে আনে শ্রীর ফরমায়েশ অনুসারে।

সকালে উঠে এক কাপ ঈষদুষ্ণ জলে একটা পাতিলেবু আর এক চামচ মধু মিশিয়ে খায় শ্রী। তারপর মুসুরডাল বাটা আর হলুদ দিয়ে একটা প্যাক তৈরি করে মুখে লাগায়। শেষে ঈষদুষ্ণ নারকেল তেলে এক চামচ লবঙ্গ তেল মিশিয়ে ভালো করে স্ক্যাল্পে মাসাজ করে। প্রায় দিনই বিতান দেখে বাড়িতে লবঙ্গ তেল তৈরি করে শ্রী।

লবঙ্গ, মিক্সার গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে নারকেল তেলে মিশিয়ে একটা কাচের বোতলে ঢেলে খাটের নীচের অন্ধকারে রেখে দেয় এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ পর মসলিন কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে সেই তেল মাথায় লাগায়। বিতান লক্ষ্য করে শ্রীর এইসব রূপচর্চা ও তার উপকরণ তৈরি করা শেষ হতে হতে মায়ের একটা ভাজা, মাছের ঝোল, ডাল নেমে যায়। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু ও বিরক্তিকর লাগলেও নতুন বউকে কড়া ভাবে কিছু বলতে পারে না সে।

কিছুক্ষণ পরে শোবার ঘরে ঢুকে মনটা ভারী হয়ে ওঠে বিতানের। দেখে ঘরের সারা মেঝে জুড়ে গয়নাগাটি, মেক-আপের জিনিস ছড়ানো। লিপস্টিক, আইলাইনারগুলো ভেঙে কুটিকুটি করে ফেলেছে। আর বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শ্রী। কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখে বিতান। শ্রীর কান্নার তোড় আরও বাড়তে থাকে। মনে মনে অনুশোচনা হতে থাকে বিতানের। এতটা আঘাত না দিলেও হতো মেয়েটাকে। না হয় একটু সেজে তাকে দেখাতেই এসেছিল। একটু অবুঝ মা মরা মেয়েটা, বাবার আদরের। বুঝিয়েসুজিয়ে বললে নিশ্চয়ই একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। আদর করে শ্রীকে কাছে টেনে নেয় বিতান। শ্রীকে যে সত্যিই সে ভীষণ ভালোবাসে।

কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। নিজের রূপচর্চা-সাজগোজ আর বিতানকে ঘিরে শ্রীর ভয়ংকর অবসেশন দিনের পর দিন বাড়তেই লাগল। সবসময় শ্রীর এক অমূলক ভয় যে, সে দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর বিতান অন্য মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে…

—পুজোর দিনগুলোতে নিজের সাজপোশাকে সেরাটা দেওয়া মাস্ট। ভিড়ের মাঝে, বিশেষ করে তোমার অফিসের বিশ্বকর্মা পুজোর দিনের ওই গেট টুগেদারে নজর কাড়তে গেলে পোশাকের কালার, কাট, ফ্যাব্রিক সব হতে হবে একদম এক্সক্লুসিভ। জানো? কীভাবে সাজতে হবে ও ঘরোয়া রূপচর্চার নানা গাইড লাইন দিচ্ছে বহু প্রিন্টেড ও অন-লাইন ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো। নেইলপলিশ পরতে পরতে এক নাগাড়ে বলে চলে শ্রী।

—সেবার তুমি অফিসের কম্পিউটার সেকশানের মৃদুলার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছিলে। সেবন্তীর সঙ্গে তোমার সে কী হাহা হিহি! এবার আমি আর কোনও রিস্ক নেব না বাবা। এবার আমার ড্রেস হবে এক্কেবারে হটকে! আর জানো তো আজকাল পুরো মুখের সাজে একই রঙের আধিক্য। এই মনোক্রোম মেক-আপ এখন রীতিমতো ভাইরাল।

শ্রীর স্বরে যেন একেবারে কোনও ক্লান্তি নেই! শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায় বিভানের।

—জীবনটা শুধু সাজগোজ আর গয়নাগাটি নয়, শ্রী। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো লক্ষ্মীটি! এ তো মানসিক অসুখ! চলো তোমাকে নিয়ে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই। তিনি হয়তো তোমাকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারবেন।

—কী বললে? আমি পাগল? আমি পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব? হাউ ডেয়ার ইউ! রাগে হাতের কাছে যা থাকে বিতানের দিকে ছুড়তে থাকে শ্রী!

 

 

হনন (পর্ব ১)

বিতানদের বাড়িটা সাবেকি আমলের। বাবার তৈরি বাংলো প্যাটার্নের কাঠের বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট্ট একখানি বাগানের বুক চিরে হাঁটাচলা করার সরু একটা মোরামের পথ। বাবা চলে যাবার পর একবার ভেবেছিল বাড়িটাকে রি-মডেলিং করবে। কিন্তু মা একদম রাজি হয়নি। আর ছোটোবেলার গন্ধমাখা এই বাড়িটা বিতানেরও খুব প্রিয়।

আজ অফিস থেকে ফিরে সামনের গেট দিয়ে ঢুকে বাগান পেরোতে পেরোতে নানান ফুলের একটা ককটেল সুবাস যেমন বিতানের নাকে এসে লাগে, সেই সঙ্গে কান ছুঁয়ে দেয় শ্রীদর্শিনীর গান— সাজনা হ্যায় মুঝে সজনা কে লিয়ে…। ভারি সুরেলা গলা তার।

শ্রীদর্শিনী বিতানের স্ত্রী। মাত্র তিনমাস আগে এক মাঘীপূর্ণিমার সন্ধেতে শ্রীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। বিতান আর শ্রীদর্শিনীর পরিচয় হয়েছিল এক বছর আগে একটি সোশ্যাল ম্যাট্রিমোনি সাইটে। তিন মাস তারা একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর, মেলামেশা করবার পর দু’জনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর চলেছিল ছ’মাসের কোর্টশিপ।

শ্রীদর্শিনী তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বিতানের চেয়ে অনেক বেশি বৈভবে মানুষ সে। শ্রীর বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। এছাড়াও তাদের পারিবারিক ব্যাবসা আছে। ভারতের নানা প্রান্তের সংস্কৃতি, সাজগোজ সম্পর্কে শ্রী বেশ ওয়াকিবহাল। এছাড়া গণিতে স্নাতকোত্তর শ্রীদর্শিনী পড়াশোনাতেও বেশ মেধাবী। অন্যদিকে, বিতান নিতান্তই সাধারণ। অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক সংস্থায় কোয়ালিটি কনট্রোল ইঞ্জিনিয়র সে।

বাবা ছিলেন ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের ক্লার্ক। ছোটোবেলা থেকে তেমন কোনও বিলাসবহুল জীবনযাপন তাদের ছিল না। জীবনটা ছিল আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের মতো অত্যন্ত সাদামাটা। তাই মাঝে মাঝে বিতানের বেশ আশ্চর্য লাগে এটা ভেবে যে, তার মতো একজন সাধারণ ছেলেকে কীভাবে মনে ধরল অত উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে শ্রীদর্শিনীর!

বাগান পেরিয়ে এসে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকতেই ভীষণ চমকে উঠল বিতান। দেখল গা ভর্তি নানারকম সোনার গয়না পরে সেজেগুজে বসে আছে শ্রী। পরনে দামি শাড়ি, গলায় সীতাহার, কানে বড়ো ঝোলাদুল, হাতে মোটা সোনার চুড়ি, খোঁপায় বেলকুঁড়ির মালা। সামনে খোলা মেক-আপ বক্স, লিপস্টিক, আইলাইনার, আই-শ্যাডো — আয়নার সামনে বসে গভীর ভাবে নিজেকে দেখতে দেখতে মিটি মিটি হাসছে শ্রী। দেখেই চলেছে নিজেকে। যেন নিজের প্রেমে নিজেই বিভোর। চারপাশের কোনওকিছু সম্পর্কে তার যেন কোনও চেতনাই নেই।

বিয়ের আগে থেকেই বিতান জানত ভীষণ সাজতে ভালোবাসে শ্রীদর্শিনী। শ্রী সুন্দরী কিন্তু তার সাজগোজের জন্য অপরূপা হয়ে ওঠে সে। বিতানের সঙ্গে যখন দেখা করতে আসত তখন বরাবরই তার রুচিসম্মত সাজগোজ তাকে মুগ্ধ করত। শ্রীর দৌলতেই বিতান জেনেছে মেক-আপের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্টের কার্যকারিতা, ঘরোয়া রূপটানের উপকারিতা ইত্যাদি নানা বিষয়। তখন থেকেই বিতান লক্ষ্য করত তাদের কথোপকথনের বেশ অনেকটা অংশ জুড়েই যেন থাকছে সাজগোজ, রূপচর্চা বিষয়ক আলোচনা।

বিতান ছোটোখাটো সোনার গয়না বা জাংক জুয়েলারি, কিংবা লিপস্টিক, নেলপলিশ এসব উপহার দিলে ভীষণই খুশি হতো শ্রী। তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে বিতানের কাছ থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট পেলে শিশুর মতো আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠত। এমন কি পথ চলতি কোনও সুন্দরী মেয়ের দিকে বিতানের চোখ গেলে, ভারি অভিমানী গলায় শ্রী জিজ্ঞেস করত, ‘ওকে কি আমার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে দেখতে, বিতান? আমি কি তেমন সুন্দরী নই?’

বিতান খুব আনন্দিত হতো। মেতে উঠত খুনশুটিতে। ভাবত শ্রী তাকে এত ভালোবাসে যে সবসময় তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায়। ভাবলেই বুক ভরে উঠত তার। কিন্তু কথায় আছে একজনের সঙ্গে এক ছাদের নীচে চাল-ডাল-তেল- হলুদের আটপৌরে জীবন শুরু না হলে তাকে সম্পূর্ণ চেনাই যায় না। বিতানের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছিল।

 

অচেনা নারী (শেষ পর্ব)

সুচরিতার কথা

অতনু গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। ওকে শেষবারের মতো ফ্লাইং কিস দিলাম। এখন আমার অনেক কাজ। ঘরে গিয়ে ল্যাপটপে দেখতে হবে কত কম খরচে ফিউনারাল করা যায়। কোথায় দেখেছিলাম — এমনি খরচ ২,৫০০ ডলার, ভিউইং যোগ করলে ৪,০০০ ডলার। তাড়াতাড়ি দেখতে হবে। এরপর লোকজন আসতে শুরু করলে তো শোকে পাথর হয়ে যাবার অভিনয় করতে হবে।

সত্যি গুগুল-এর জবাব নেই। কাল মাত্র দশ মিনিটে বার করে ফেললাম একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে কী করে গাড়ির ফ্রন্ট ব্রেক নষ্ট করে দেওয়া যায়। আবার ওরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেন রিভার্স না করতে হয়। তাই তো কাল আগে গাড়ি রাস্তার দিকে মুখ করে রেখেছিলাম। সকালে উঠে গিয়েছিলাম, ও কিছু সন্দেহ করে কিনা দেখতে। অতনু কিছু বোঝেইনি। আমাকে খুব বোকা ভেবেছে। ভুলে গেছে যে, রীতেশের জুনিয়র যে সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়েটা কাজ করে, লতা, ও ছোটোবেলায় আমার বোনের ক্লাসমেট ছিল দিল্লিতে। তাই তো আমাকে কাল দুপুরে ফোন করে জানাল, ‘সুচরিতাদি, সামথিং ইজ ফিশি। ইওর হাজব্যান্ড কেম টু রীতেশ উইথ টু বেঙ্গলি ফ্রেন্ডস। দে ওয়ার টকিং ইন বেঙ্গলি বাট ইট সিম্স লাইক এ কন্সপিরেসি টু সেন্ড ইউ টু অ্যান অ্যাসাইলাম সুন। বি কেয়ারফুল।”

অতনু আমাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে তারপর কী ডিভোর্স নিত? নিয়ে কাকে বিয়ে করত? ওই মুটকি বনানীকে? যার বাড়ি গেলে দহিবড়া নিয়ে এসে ‘অতনুদা, আরেকটা নাও, আরেকটা নাও’ করে অতনুর গায়ে ঢলে পড়ে?

এই রাস্তাটা আমার বাড়ির সামনে থেকে সোজা গিয়ে একটা টি জংশনে পড়েছে। সেখানে স্টপ সাইন। ক্রস স্ট্রিট দিয়ে এ সময় প্রচুর গাড়ি যায়। স্টপ সাইনে ব্রেক কষবে, গাড়ি সোজা রাস্তার মধ্যে গিয়ে পড়বে ট্রাফিকের মাঝে। শুক্রবার রীতেশের কাছে আমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে না? সরি, তার বদলে রীতেশই আসবে তোমায় দেখতে, কাসকেটে শোয়া অবস্থায়।

অতনু, তুমি কেন আমার কিসটা লুফতে গেলে সেই অনেকদিন আগের মতো? তখন রাকা বোধহয় বছর দুই। সামারে গাড়ি নিয়ে চলে যেতাম কোনও পাহাড়ে। রাকার পিছনে দাঁড়িয়ে আমি ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিতাম। তুমি ডান হাত বাড়িয়ে লুফে নিতে। রাকা বুঝতে না পেরে তোমায় জিজ্ঞেস করত, ‘বাবা কী লুফলে?” তুমি হেসে বলতে ‘একটা প্রজাপতি’। তারপর মুঠো খুলে বলতে, ‘যা, উড়ে গেল।’

রাকার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে। রাকা খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলত, ‘বাবা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না।’ আমি হেসে গাছটা দেখিয়ে দিতাম। এখন কী হবে?

আজ যখন রাকা এসে কাঁদতে কাঁদতে বলবে ‘বাবা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না’ আমি কী উত্তর দেব? এটা আমি কী করলাম! এটা আমি কী করলাম! এটা আমি কী করলাম…! আমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি? ওই যে ফোন বাজছে! ওদিকে কি অতনু?

‘সু, আজ ভীষণ জোর বেঁচে গিয়েছি। ব্রেক কাজ করছিল না, স্টপ সাইনে না থেমে গাড়ি সোজা রাস্তার ওপারে ফুটপাথে। ভাগ্যিস কোনও গাড়ি ছিল না।’

নাকি পুলিশ? “ইস দিস অটনু রে’স রেসিডেন্স? সরি ম্যাম, অটনু ইজ নো মোর, স্পট ডেড ইন আ কার অ্যাক্সিডেন্ট।’ ফোনটা বেজেই চলেছে। আমি কেন উঠতে পারছি না সোফা থেকে? মনে হচ্ছে পা দুটো যেন কার্পেটের সঙ্গে পেরেক দিয়ে জুড়ে দিয়েছে কেউ। অতনু না পুলিশ। পুলিশ না অতনু? ভগবান যেন অতনু হয়, অতনু, অতনু, অতনু।

* এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক।

 

এমএনসি-র প্রেম (তৃতীয় পর্ব)

এর পরে বহু চেষ্টা করেও যখন রোহনকে রাজি করাতে পারলাম না, তখন ফিরে গেলাম আবার ওই আগের প্রেমিকের কাছে অর্থাৎ অভিজিৎ-এর কাছে। অভিজিৎ সব কথা শুনে বলল, তুমি কি ভেবেছ যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? রোহন তোমাকে প্রত্যাখ্যান করাতে তুমি আমার কাছে এসেছ। তাই তোমার জন্য আমার রাস্তাও এখন বন্ধ। বুঝলাম আমি আমার নিজের পায়েই কুড়ুল মেরেছি।

আপনিই বলুন স্যার, এ ভুলের কি প্রায়শ্চিত্ত হয়? এখন আমার জীবনটা মনে হয় রুক্ষ আর শুষ্ক। তাই মাথা উঁচু করে বাঁচার রাস্তাগুলোও আর খুঁজে পাচ্ছি না। কার জন্য, কীসের জন্য বাঁচব বলুন তো? আমার বাবা, মা, ভাই, বোনেরা ঝাঁসিতে থাকে। ওদের কাছেও আজ আমি বড়ো ছোটো হয়ে গেছি জানেন। ওরাও হয়তো আর আমাকে বিশ্বাস করে না।

—আমি তোমার সব ঘটনাটাই শুনলাম। কিন্তু এতে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো তাহলে আমি তোমাকে আবার পথের সন্ধান দিতে পারি। নিজের কাকার মতো ভেবে যদি আমার কথা শোনো, আমাকে সাহায্য করো, তাহলে হয়তো আমি তোমাকে আবার মূলস্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব। তবে তোমার সহযোগিতা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। আমার মনে পড়ে ছাত্র জীবনে আমরা বন্ধুরা মিলে কিছু ওয়াগন ব্রেকার-কে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলাম। সে কথা অন্যদিন তোমাকে শোনাব। আচ্ছা, তুমি বলো তো, এই অফিসে এমন কোনও ছেলে আছে যে-তোমার প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছে কোনওদিন?

—আছে, কিন্তু আমি তাকে কখনও পাত্তা দিইনি।

—ছেলেটি কি সবদিক থেকে ভালো নয়?

—না, ঠিক তা নয়। আসলে আমি তখন অন্যের সঙ্গে এনগেইজড তাই।

—কী নাম বল তো? এত কষ্টের মধ্যেও স্নেহার মুখে যেন একটু মুচকি হাসির ঝলক দেখা গেল।

স্নেহা উত্তর দিল— রঘু।

—ও, তোমাদের ডিপার্টমেন্টের রঘু! ও তো খুব ভালো ছেলে শুনেছি। পড়াশোনায় যেমন ভালো, ব্যবহারের দিকেও তেমন ভালো। ও আবার কখনও প্রপোজ করতে পারে এমনটা কেউ দেখে বলতে পারবে না। আচ্ছা স্নেহা, সত্যি কথা বলো তো— রঘুকে তোমার অপছন্দ নয় তো? যদি রঘু তোমায় বিয়ে করতে চায়, তবে তুমি রাজি কিনা শুধু এটুকু বললেই চলবে।

স্নেহা কোনও উত্তর দিল না। অবনীবাবু বুঝলেন স্নেহার মত আছে। নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন— তুমি আজ যাও। খুব শীঘ্রই হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে। আর ভেঙে পোড়ো না বুঝলে! অবনী কখনও হারতে শেখেনি জানো। তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে আমি নিশ্চিত।

স্নেহা বেরিয়ে গেলে অবনীবাবু হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত হয়ে গেছে। তাই অফিসে থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন। পরের দিন অফিসে পৌঁছেই মি. তেওয়ারির কাছে গিয়ে তেওয়ারির লুকোনো ক্যামেরায় তোলা মি. সন্দীপ চাড্ডার আপত্তিজনক ছবিগুলো দেখে ফিরে এলেন নিজের কেবিনে। ডেকে পাঠালেন বিনয় রাজদান-কে। তাঁকে বললেন— মি. চাড্ডাকে টারমিনেট করার চিঠিটা বানিয়ে চেয়ারম্যানের থেকে সই করিয়ে ওকে আজই হিসেবপত্র দিয়ে বের করে দিন।

চেয়ারম্যান-কে বলা হয়ে গেছে। সিকিউরিটিকে বলবেন যেন ওকে চিঠি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেন গেটের বাইরে ছেড়ে আসে আর ভেতরে যেন ঢুকতে না দেয়।

রাজদান— স্যার, মনে হয় টারমিনেটের দরকার হবে না। ব্যপারটা জেনে গেলে ও নিজেই সম্ভবত ‘রেজিগনেশন’ দিয়ে চলে যাবে।

অবনীবাবু— আপনি যাবার পথে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র রঘুকে একটু পাঠিয়ে দেবেন তো?

‘ওকে স্যার’ বলেই মি. রাজদান বেরিয়ে যান কেবিন থেকে।

এমএনসি-র প্রেম (প্রথম পর্ব)

অবনীবাবু অফিস থেকে ফিরে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চায়ের কাপটা মুখে তুলতে তুলতে অফিসের বিভিন্ন সমস্যার কথা ভাবছিলেন। তিনি যেহেতু কোম্পানির উচ্চপদে আছেন তাই সকলের সুবিধে অসুবিধের কথা তাঁকেই ভাবতে হয়। তাঁর কাজটাই এরকম। তাঁর ওপর কর্পোরেট অফিস বলে কথা।

মনে মনে ভাবেন এই কর্পোরেট গাল ভরা কথাটা শুনতে যেমন ভালো লাগে, আসলে তেমন নয়। আজকাল মাল্টিন্যাশানাল, কর্পোরেট এসব কথাগুলো শুনতে মন্দ লাগে না। এমনকী খবরের কাগজে ‘পাত্র-পাত্রী’ কলমেও এর ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনদাতারা নিজের কুলীন গোত্রের নিদর্শন তুলে ধরতে চান।

অবনীবাবু বহুদিন ধরেই একটি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি করছেন। নানান সমস্যার সমাধান করতে করতে এখন আর সমস্যাগুলোকে সমস্যা বলেই মনে হয় না। তবে দু’-একটি সমস্যা যে তাঁকে ভাবিয়ে তোলে না এমন নয়! গতকাল স্নেহা গুপ্তা-কে কাউন্সেলিং করতে গিয়েই বেশ মুশকিলে পড়েছিলেন। কীভাবে সমস্যাটার সমাধান করবেন ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না, কারণ এই সমস্যার সমাধান তাঁর হাতে নেই। আর সে বয়সও তাঁর নেই।

স্নেহা-কে ক’দিন খুব ম্রিয়মাণ দেখে তাঁর প্রজেক্ট ম্যানেজার, মনদীপ জ্বলি, অবনীবাবুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন— স্নেহার কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন আছে। যে-মেয়েটা ক’দিন আগেও হাসি-খুশিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখত, হঠাৎই কী এমন হল যে, সে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

অবনীবাবু এর আগেও বহু কর্মচারীরই কাউন্সেলিং করেছেন কিন্তু স্নেহা-র কথা শুনে উনিও আজকাল বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। চিন্তা শুধু এজন্য— এর সমাধান তাঁর হাতে নেই। কারণ এই সমস্যাটি একান্তই প্রেমঘটিত এবং ব্যক্তিগত। যদিও এর আগে এই কর্পোরেট সেক্টরে উনি বহু প্রেমেরই সাক্ষী হয়ে আছেন।

একবার মনে আছে গভীর রাতে অফিসে শিফট চলাকালীন ইলেকট্রিকের ফোরম্যান পরেশবাবু এসে বললেন— স্যার চলুন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই। বেশ কিছুদিন ধরে আমি এটা লক্ষ্য করছি। কোনওদিন কোনও বিপদ হয়ে গেলে আপনি আমাকেই চাকরি থেকে বের করে দেবেন।

অবনীবাবু— কী এমন হল যে আমাকে ডেকে দেখাতে হবে?

পরেশ বাবু— চলুনই না স্যার। দেখলেই বুঝতে পারবেন।

এর পরের ঘটনা অবনীবাবুকে সত্যিই খুব অবাক করেছিল। তখন তিনি নতুন ছিলেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে তাই অদ্ভুত লেগেছিল। আজকাল অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সেদিন ইলেকট্রিক সুইচরুমের ভেতর থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে আপত্তিজনক অবস্থায় উদ্ধার করেছিলেন।

অন্য এক ঘটনা— অবনীবাবু খবর পেয়েছিলেন যে এক ম্যানেজার নাকি তাঁর অধস্তন মহিলা কর্মচারীদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করছেন। কিন্তু এর কারণ তিনি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে এক মহিলা-র সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলেন, সেই ম্যানেজার প্রথমে কাজের চাপ ও ভয় দেখিয়ে তাঁকে বশবর্তী করেন এবং পরে তাঁর সঙ্গে অশ্লীলতা করেন।

অবনীবাবুর আর বুঝতে বাকি রইল না, কীভাবে এর অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। অবনীবাবু প্রথমেই ডেকে পাঠালেন সিকিউরিটি সুপারভাইজার মিস্টার তিওয়ারি-কে। বললেন— মি. তিওয়ারি, আমি মি. সন্দীপ চাড্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত সব খবর জানতে চাই। কখন সকালে আসেন, কখন কোথায় যান এবং ক’টা অবধি রাতে থাকেন?

মি. তিওয়ারি— স্যার, উনি তো বড়ো পোস্টে আছেন তাই ওনার সব খবরাখবরই আমরা লিখে রাখি। আপনি কী জানতে চান বলুন, আমি জানিয়ে দিচ্ছি।

—উনি রাত ক’টা অবধি অফিসে থাকেন?

—স্যার, কোনও ঠিক নেই। মাঝে মাঝে রাতে থেকেও যান কাজের জন্য, আবার কখনও কখনও রাত বারোটায় বেরিয়ে যান।

-ওঁর সঙ্গে কি অন্য কেউ থাকে?

–হ্যাঁ স্যার, থাকেন। মিস ডলি থাকেন।

—আপনি কি ওদের দু’জনের পরিবারের সম্পর্কে কিছু জানেন?

—স্যার, মি. চাড্ডার স্ত্রী একটি নামি কাগজের রিপোর্টার এবং তাঁর ডিউটি রাতেই থাকে, সেই কারণেই হয়তো মি. চাড্ডা রাতে অনেকদিনই বাড়ি যান না। মিস ডলি এই শহরে একাই থাকেন কারণ তাঁর মা-বাবা অন্য শহরে থাকেন।

—এদের সম্পর্কে কি আপনার কোনও কিছু বলার আছে?

—স্যার, আমাদের সিকিউরিটি গার্ডরা এদের নিয়ে নানারকম অশ্লীল কথাবার্তা বলে থাকে। রাতে নাকি এরা একই বন্ধ কেবিনে বসে কাজ করেন। আমাদের অফিসের একজন নাকি একদিন দু’জনকে রাতে পাশের শিপ্রা হোটেলে একসঙ্গে বসে বিয়ার খেতেও দেখেছেন।

—ঠিক আছে আপনি যান। ইলেক্ট্রিশিয়ান জন-কে একটু পাঠিয়ে দিন তো।

একটু পরেই জন এসে কেবিনের দরজায় টোকা দিয়ে প্রবেশ করে।

জন— স্যার আপনি আমাকে ডেকেছেন?

অবনীবাবু— হ্যাঁ। আচ্ছা আমাদের ক্লোজসার্কিট ক্যামেরাগুলো সব ঠিকমতো চলছে তো? আগামীকাল আমি কিন্তু সবগুলো চেক করতে চাই। শোনো, মি. চাড্ডা-র কেবিনে আমার ঘরের সামনের ক্যামেরাটা খুলে নিয়ে গিয়ে লাগাবে, তবে এখন নয়। সকলে অফিস থেকে চলে যাবার পর। আর এটা তুমি আর আমি ছাড়া কিন্তু কেউ জানবে না। জানলে তোমার চাকরি যাবে। ওটা লাগানো হয়ে গেলে তুমি রাতে আমাকে ফোনে কনফার্ম করবে।

জন— ঠিক আছে স্যার।

 

আরও একটু বৃষ্টি নামুক (পর্ব ২)

বিকালে কিছু জিনিসপত্র কিনতে দোয়েল বাইরে বেরোল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেটি গান ধরেছে। সে কিছু বলবে ভেবেও বলতে পারে না ছেলেটাকে। ছেলেটার নাম-ধাম কিছুই সে জানে না। দোয়েলের ফ্ল্যাটের মুখোমুখি ফ্ল্যাটে অনামি ছেলেটির বাস। ছেলেটির বয়স বত্রিশের বেশি নয়। শ্যামবর্ণ লম্বা সুঠাম চেহারা। মুখভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় ঢেউখেলানো লালচে চুল। মুখটা বোকা বোকা। দোয়েলকে দেখার পর থেকেই ছেলেটির গান গাওয়া শুরু হয়। অফিসের বাস ধরার জন্য দোয়েল বাস স্টপেজে এলে ছেলেটিও প্রতিদিন তার পা অনুসরণ করে বাস স্টপেজে আসে। দোয়েল বাসে না ওঠা অবধি ছেলেটি সেখান থেকে নড়ে না। বেশ কয়েকদিন দোয়েল এসব লক্ষ্য করছে। রাস্তাঘাটে লোকজন থাকার ফলে ছেলেটাকে দোয়েল কিছু বলতে পারে না।

আজও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। দোয়েলের পিছনে অনামি ছেলেটিও চলল। একটু তফাতে থেকেই ছেলেটি দোয়েলের পা অনুসরণ করল। দোয়েল ফেরার পর দেখল ছেলেটিকেও নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে।

সকালবেলা। স্নিগ্ধ আলোর দেখা নেই। আকাশের আজ মুখ ভার। অঝোরে বৃষ্টি নামতে পারে। কলকাতায় অবশ্য বৃষ্টিটা একটু বিলাসিতা করেই হয়। রমাও তাড়াহুড়ো করে কাজ সেরে চলে গেছে। বৃষ্টি নামার আগে দোয়েল অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। শ্রাবণের আকাশ যখন তখন জল ঢালবে এ আর নতুন কি!

দোয়েল ডার্ক ব্লু জিন্স, হোয়াইট টপ পরে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। পাশের ফ্ল্যাটের সেই অনামি ছেলেটিও দোয়েলের পা অনুসরণ করে চলল। আকাশে মেঘের কারণে রাস্তায় লোকজন একটু কম। দোয়েল কিছুটা রাস্তা গিয়ে থেমে গেল। ছেলেটিও সঙ্গে সঙ্গে থেমে গিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। দোয়েল চলা শুরু করায়, সেও আবার চলতে শুরু করল। দোয়েল মনে মনে ঠিক করল আজ ছেলেটাকে মজা দেখাবে। বাস স্টপেজের কিছু আগে দোয়েল আবার কী মনে করে চারপাশটা দেখে ছেলেটির দিকে কয়েক পা পিছিয়ে এল।

দোয়েল ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলল— ‘পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আপনাকে ভদ্র বাড়ির ছেলে মনে হয়। সবসময় আমাকে ফলো করেন কেন! মেয়ে দেখলেই বেসুরো গলায় সুর বেরোয় তাই না! ছেলেটির মুখটা আমচুরের মতো শুকিয়ে গেল।’

সে আমতা আমতা গলায় বলল— ‘দেখুন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আপনি যতটা আমাকে অভদ্র ভাবছেন ততটা অভদ্র আমি নই। আপনাকে দেখতে আমার কেন জানি না খুব ভালো লাগে। আপনাকে দেখতে তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটে চলি।’

দোয়েল বিরক্তির সুরে বলল— ‘যাক মানছেন যে আপনি আমাকে প্রতিদিন ফলো করেন। আপনাকে যদি দেখি ফারদার আমাকে ফলো করতে তাহলে অন্য স্টেপ নিতে আমি বাধ্য হব।’ হঠাৎ দোয়েল তার অফিসের সুদর্শন, সুপুরুষ অনিন্দ্য রায়ের কথা ভেবে ছেলেটিকে বলল— ‘একটা কথা আপনার জানা দরকার। আমি এনগেজড।’

ছেলেটি কেমন অবাক দৃষ্টিতে দোয়েলের দিকে তাকাল। সে মুখ নামিয়ে বলল— ‘সরি। ভুল হয়েছে।’ সে বাড়ির পথে পা বাড়াল। টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। দোয়েল হন্তদন্ত হয়ে বাসে উঠে পড়ল।

সারাদিন অফিসের কাজকর্মে দম ফেলার ফুরসত পায়নি দোয়েল। রবিবার অফিস বন্ধ থাকায় সোমবার কাজের চাপ একটু বেশিই হয়। ফাইলপত্র জমা দিয়ে দোয়েল অফিস থেকে বেরোবে এমন সময় অনিন্দ্য বলল— ‘দোয়েল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে। ওয়েট ফর জাস্ট ফাইভ মিনিটস।’

দোয়েল মনে মনে বলল— ‘হয়তো অনিন্দ্যদা আজ তার কাছে ধরা দেবে। মুখ ফুটে বলবে ভালোবাসার কথা। লুকোচুরি শেষ হবে। এসব ভেবে ভোরের সূর‌্যের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল তার মুখ।’

অনিন্দ্য এসে দোয়েলকে বলল— ‘চলো আমরা একটা কফি শপে যাই।’

আরও একটু বৃষ্টি নামুক (পর্ব ১ )

সকাল সাড়ে ছটা। বদ্ধ ঘরের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে মর্নিং অ্যালার্ম এবং কলিং বেল দুই-ই তারস্বরে বেজে উঠল। যৌথ শব্দে দোয়েলের ঘুমের বারোটা বেজে গেল। রাতের পোশাক পরিবর্তন না করেই মুখে একরাশ বিরক্তি এনে বলল— ‘রবিবার ছুটির দিনেও একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না রমা। ভালো লাগে না আর।’

রমা দোয়েলের ফ্ল্যাটের কাজের লোক। বছর পাঁচ হল সে দোয়েলের ফ্ল্যাটে কাজ করছে। দরজা খুলে দিয়ে দোয়েল বলল— ‘আসুন ম্যাডাম। আচ্ছা, তুই কি রাত্রে ঘুমোস না! আকাশে মেঘ মেঘ করেছে দেখে আমি ভাবলাম দেরিতে আসবি।’

দেরি করে এলে হবে নাকি! আরও দুবাড়ির কাজ আছে।

রমার কথায় দোয়েল আর কোনও প্রতিবাদ করল না। আজকাল খুব কাজের লোকের সমস্যা। রবিবার বলে দোয়েলের কোনও ব্যস্ততা নেই। অন্যদিন তো দশটার মধ্যে তাকে অফিস বেরোতে হয়।

রমা হাতের ব্যাগটা নামিয়ে দোয়েলকে বলল— ‘তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও না। আমি ঘরের কাজ সেরে তোমাকে ডাকব।’

তোর জন্য ঘুম হবে না। আগে আমায় চা করে দে।

চা দিচ্ছি গো। তোমাকে দেখতে কিন্তু হেবি লাগছে পোশাকটাতে।

দোয়েল স্মিত হেসে টাওয়েল কাঁধে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।

রমারও চোখ আছে। দোয়েল সত্যিই সুন্দরী। শর্ট নাইট ড্রেসে তাকে বেশ দেখাচ্ছিল। দুধের মতো সাদা গায়ের রং। মুখশ্রী পানপাতার মতো। বয়স সাতাশ বছর। মেদহীন ছিপছিপে শরীর। বটগাছের ঝুরির মতো পিঠে নেমে এসেছে ঘন স্টেপ কাট চুল। টানা টানা জলভরা দুটি চোখ। নাইট ড্রেসের বাইরে অনাবৃত লোমহীন দুটি পা দেখলে যে-কারওর চোখ আটকাতে বাধ্য।

রমা কিছুক্ষণ পর চা করে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল— ‘দিদিমণি, চা তৈরি।’

দোয়েল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল— ‘আমার চা রেখে দে। তুই চা খেয়েছিস?’

রমা বলল— ‘খেয়েছি।’

স্নান সেরে নীল সালোয়ার কামিজে দোয়েলের সর্বাঙ্গে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছিল। দোয়েল একটু ধমক দিয়ে বলল— ‘পাকামি করিস না তো।’

দোয়েল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপে ফেসবুকে চোখ বুলিয়ে নিল। হোয়াটস অ্যাপে, অনিন্দ্য রায়ের মেসেজ চোখে পড়ল। অনিন্দ্য রায় দোয়েলের অফিসের বস। ভদ্রলোকটি চ্যাট করতে ওস্তাদ। অফিসে প্রায়ই দোয়েলকে শোনান, তিনি কাছের মানুষদের ছাড়া কাউকে ফোন অথবা এসএমএস করেন না। দোয়েলকে তিনি কাছের ভাবেন বলেই খোঁজখবর নেন।

অনিন্দ্যর অনেক আচরণই দোয়েল তিন বছর প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। দোয়েল কোনওদিনই অনিন্দ্যর মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। প্রথমত, দোয়েলের অফিসের বস অনিন্দ্য রায়। দ্বিতীয়ত, দোয়েলের প্রতি অনিন্দ্য রায়ের আচরণ অন্য সকল অফিস স্টাফদের থেকে আলাদা। এই আলাদা হওয়ার কারণেই অনিন্দ্যর প্রতি দোয়েলের মনে একটা সুপ্ত দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। দোয়েলের দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, অনিন্দ্য রায় তাকে ভালোবাসে।

দোয়েল এই যুগের মেয়ে হলেও মেয়ে তো। এখনও মুখ ফুটে সে অনিন্দ্যকে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে বলতে পারেনি তার মনের কথা। তাই দোয়েল অনিন্দ্যকে সম্বোধনের সময় অনিন্দ্যদা-এর দা-টা এখনও ছেঁটে ফেলতে পারেনি।

অনিন্দ্য কাল রাত্রে দোয়েলকে ফোনে বলেছে বলো তো দোয়েল রবিবার আমাদের জীবনে কেন আসে! আই মিস ইউ। এই মিস করার কারণ দোয়েল অনুসন্ধান করতে পারে না।

কিছুক্ষণ আগে রমা কাজ করে চলে গেছে। ব্রেকফাস্ট করে নিজের অগোছালো বেডরুম গোছাতে গিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি যেতেই দোয়েলের মেজাজ হঠাৎ পালটে গেল। সে বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলজানলা খুললেই ফাটা রেকর্ডের মতো চার বছর হয়ে গেল এক লাইন মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে এক চাঁদ কা টুকরা রহতে হ্যায় শুনে যাচ্ছি। জাস্ট অসহ্য। ছেলেটিকে নেওয়া যাচ্ছে না। সে জানলা বন্ধ করে দিয়ে ল্যাপটপে অফিসের কাজ সারছিল। কাল অনিন্দ্যদাকে সব ফাইল ক্লিয়ার করে তার জমা দেওয়ার কথা। দোয়েল বলেই অনিন্দ্য বেশি সময় দিয়েছে।

নরদেহ শেষ পর্ব

চুপচাপ নিঃসঙ্গ ভাবে ক’টাদিন ঘরের মধ্যেই কাটালেন সিদ্ধার্থ। কোভিডের ভয়ে কেউ দেখা করতেও এল না। ভয় আর আতঙ্কে দিশেহারা মানুষ ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হচ্ছে। উল্লাস নেই, আনন্দ নেই, উৎসব নেই— এ যেন এক অন্য পৃথিবী। অচেনা অজানা৷

কয়েক দিন পর এক রাতে সিদ্ধার্থ ফোন করলেন নিবারণকে। নিবারণ সেনগুপ্ত। লিগাল অ্যাডভাইজার। অনেক জুনিয়র, সদাহাস্যময় অমায়িক মানুষ। কাজের সূত্রে আলাপ হলেও সম্পর্কটা ধীরে ধীরে পারিবারিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। যথেষ্ট স্নেহ করেন সিদ্ধার্থ।

‘সবই তো শুনেছ, ভাই আর নেই নিবারণ। আমি ভাবছি আমার যা কিছু আছে তার একটা উইল করে রাখব। তোমার সহায়তা চাই। একটা ভিডিও করে আমি ডিটেলসটা ব্যাখ্যা করেছি। তোমাকে পাঠাচ্ছি। তুমি সেই মতো কাগজপত্র তৈরি করবে। এই সিচুয়েশনে একটু অসুবিধা হবে, তবুও করবে। আমার অনুরোধ। পারিশ্রমিক নিয়ে ভেব না। আসলে এই অতিমারিতে কে ক’দিন বাঁচব কোনও গ্যারান্টি নেই। বারো ভূতে খাওয়ার চেয়ে… বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই! বয়সও তো কম হল না।’

ভাই মারা যাওয়ার ঠিক দশ দিনের মাথায় নিজের ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেন সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরী। রামের মায়ের চিৎকারে সবাই জানল কিন্তু কেউ ছুটে এল না, ব্যালকনি, জানালা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল। পুলিশ এসে লাশ নামাল। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে পরবর্তী সমস্ত প্রোসিডিওর ওরা নিজেদের দায়িত্বেই পালন করল। রিপোর্টে লিখল, একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর পর চরম অবসাদে ভুগছিলেন, তাতেই এই সিদ্ধান্ত৷ এই ঘটনার কয়েকদিন পর। হরিশ মুখার্জির ছোটো ছেলেকে একদিন ফোন করলেন অ্যাডভোকেট নিবারণ সেনগুপ্ত, তপনবাবু কাল সকালে একবার আমার বাড়িতে আসুন। জরুরি কিছু কথা আছে।

নিবারণ তপনের মুখ চেনা৷ একই পাড়াতে থাকে, তবে দু’জনে দুমাথায়। নিবারণের কী কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে? ধন্দে পড়ল তপন। ‘সে না হয় যাব’খন। কিন্তু কারণটা কী?”

‘একটু গোপন৷ ফোনে বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া একটু সময়ও লাগবে। তাই সামনাসামনি বলাই বোধহয় ভালো৷”

এভাবে কেউ টেনশন বাড়ায়? মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেলেও কিছু বলতে পারল না। বুঝতে পারল, গলার মধ্যে কাঁটাটা নিয়েই রাতে ঘুমোতে হবে। রীতা পাশেই ছিল। কথাবার্তা শুনে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। তপন পুরোটাই খুলে বলল। শুনে রীতা হেসে বলল, “এতে টেনশনের কী আছে? উকিল ফোন করলেই কি ভয়ের ব্যাপার থাকে নাকি? তাছাড়া নতুন করে আর কী বিপত্তি হবে আমাদের?’

পরের দিন সকালে যথাসময়ে হাজির হল তপন। স্যানিটাইজ করে, সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনে ঘরে বসালেন নিবারণ, এই মুহূর্তে কেউ কারও বাড়ি যেতে সংকোচ বোধ করে। ডাকাটাও ঠিক নয়। আসলে ব্যাপারটা এমন, না ডেকে উপায় ছিল না। কৌতূহল না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। সিদ্ধার্থ জেঠু মরার আগে একটা উইল করে গেছেন, বিষয়টি সেটা নিয়েই।

আমি আপনার বাড়ি যেতে পারতাম কিন্তু সিদ্ধার্থ জেঠু বারবার বলেছেন ব্যাপারটা যেন পাঁচ কান না হয়, তাই আর সাহস পাইনি। সিদ্ধার্থ জেঠু তাঁর সম্পত্তির একটা অংশ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে দান করে গেছেন। ওঁর বিশ্বস্ত কাজের মাসি রামের মায়ের জন্য একটা বড়ো অ্যামাউন্ট সেভিংস করে রেখে গেছেন যাতে তার সুদে ওঁর চলে যায়। আর বসত বাড়িটা লিখে দিয়েছেন আপনার নামে।

‘কী! আকাশ থেকে পড়ল তপন৷’

নিবারণ বললেন, “আরও আছে, পুরোটা শুনুন। তাঁর নির্দেশ, বসতবাড়ির দখল না নিয়ে আপনি টাকাও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাকি বন্দোবস্তের দায়িত্ব আমার। তার জন্য আমার পারিশ্রমিকও ঠিক করে দিয়ে গেছেন। এই হল ব্যাপার, এবার বলুন আপনি কী করবেন?’ তপনের চোখে বোবা বিস্ময়। এসব কী শুনছে সে! শেষ বেলায় কি ভীমরতি ধরেছিল লোকটার?

নিবারণ হেসে বলল, “বুঝতে পারছি আপনার ভিতরে কী চলছে। জেঠুও বুঝেছিলেন বোধহয়। আপনার জন্য একটি চিঠি রেখে গেছেন। কাগজপত্রের মধ্যে ছিল। পরে খুঁজতে গিয়ে পাই। উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি।’

তপনের হাতে খাম গুঁজে দিয়ে নিবারণ বললেন, “আপনি পড়ুন ধীরে সুস্থে। আমি জরুরি একটা ফোন করে আসছি। মনে হয় আপনার কৌতূহলের উত্তর পেয়ে যাবেন।’ নিবারণ ভেতরে চলে গেলেন। তপন খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করল। সাদা কাগজে নীল কালি দিয়ে লেখা। একটু জড়ানো, তবে পড়তে অসুবিধা হয় না।

স্নেহের তপন,

জানি না এই চিঠি তুই কবে পড়বি, যখনই পড়বি আমার আত্মা তোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। কারণ আগে যে-লেখাগুলো পড়বি সেগুলো নিছক কোনও কথার কথা নয়, একটা মানুষের আত্মার আকুতি। আমি জানি তোর বাবা তোকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করেছে। কোনও সন্দেহ থেকে সে ক্ষোভের জন্ম। কিন্তু তোর মা তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে সে ক্ষোভ মেটানোর চেষ্টা করেছেন। জানি না তুই সেটা বুঝিস কিনা। মা আমাদের উৎস, মা আমাদের অস্তিত্বের আধার। যে আমাদের অস্তিত্বকে আশ্রয় দিয়েছে তার তুলনা একমাত্র ঈশ্বরের সঙ্গেই করা যায়। মাতৃরূপী ঈশ্বরকে আশ্রয়হীন করে দেওয়ার অর্থ স্বেচ্ছায় ঈশ্বরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। তোর মা আমাকে কেঁদে বলেছিলেন, যে-তপনকে আমি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি সেও আমাকে তাড়িয়ে দিতে চায়। কতটা কষ্টের কথা! আমি সব খবর জানি, তোর ব্যাবসার অবস্থা খুবই খারাপ। একে লকডাউন তার উপর অনেক ধারদেনা, নাভিশ্বাস চলছে তোর। তোর পরিস্থিতি এতটা খারাপ জেনেও তোর দাদারা এতটুকু সাহায্য করেনি। উলটে বাবার চিকিৎসার টাকা জোর করে আদায় করেছে। তবুও বলছি, সে রাগ মায়ের উপর কেন? আমি ঠিক করেছি স্বেচ্ছায় পৃথিবী ত্যাগ করব। পৃথিবীতে আমার আর কোনও পিছুটান নেই। আমার অস্তিত্ব আলগা হয়ে গেছে। এ গাছ মরবেই! শিকড়ে মাটি নেই। আমার যা কিছু ছিল তার একটা অংশ দিয়েছি যারা অসহায়ের সহায় হয় তাদেরকে। বাড়িটা তোর নামে দিলাম। যদি বাড়ি নিতে লজ্জা করে তবে টাকা নিস, নিবারণ সব ব্যবস্থা করে দেবে, কেউ জানবে না। আশা করি এই টাকায় ব্যাবসাটা আবার দাঁড়িয়ে যাবে। তোর মনে হয়তো প্রশ্ন উঠছে, আমি তোকে দিলাম কেন বাড়িটা? এর উত্তর সহজ। পৃথিবীতে আমার গণ্ডিটা ছিল ছোট্ট। ক’টা মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তাপস, নিলুদের অনেক আছে তবুও ওরা মনে ভিখিরি। ওই অভাব মেটার নয়। সর্বোপরি তোর মা। অনেক ভেবে দেখেছি, কিছু ব্যাপার থাকে জীবনে করা যায় না, জীবন দিয়ে করতে হয়। দর্শনের পরিভাষায় এই জগৎটা হল মায়া, মানুষ, মানুষের সম্পর্ক, এই বেঁচে থাকা, সবই একটা ইল্যুউশন। যে যেমন দেখে! হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? না রে সেটাই সত্যি, একদিন ঠিক বুঝতে পারবি। এবার তোর পালা। মায়ের একটু সেবা যত্ন করিস। ভালো থাকিস সবাই। আমার আশীর্বাদ সব সময় তোর মাথার উপর থাকবে।

ইতি-

সিদ্ধার্থ কাকু

কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলেন নিবারণ। বললেন, ‘পড়া হল? স্পেশাল কিছু লিখেছেন নাকি আমাকে যা যা বলেছেন সে সবই?”

‘সেরকম কিছু না। আপনি বুঝবেন না। আপনি বাড়িটা বিক্রির ব্যবস্থা করুন।”

তপনের পালটে যাওয়া থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে নিবারণ বললেন, “বেশ, আপনার যেমন ইচ্ছা।’

বাড়ির পথে যেতে যেতে তপনের মনে হল, সিদ্ধার্থ কাকুর বাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা, চিঠি লিখে যাওয়া, তাঁর সুইসাইড, সবকিছুর সঙ্গে যেন একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য রহস্য খুঁজে বের করার মতো বিরাট বুদ্ধি কি তপনের আছে? বাড়িটা না নিলেও টাকা তপনকে নিতেই হবে। আর টাকা নিলে মায়ের দায়িত্বও নিতে হবে, নিজের মৃত্যু দিয়ে চক্রব্যূহ রচনা করেছিল লোকটা। কিন্তু কীসের জন্য? হঠাৎ আপন মনেই স্বগতোক্তি করে তপন, জগৎটা আসলেই মায়া!

 

নরদেহ পর্ব-৪

সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সেরকম না হলেও সমস্যা হল মায়ের প্রশ্নেই। সিদ্ধার্থ একটা ছোটো চাল খাটানোর চেষ্টা করলেন, “ইচ্ছাপুরের হরিশের পৈতৃক বাড়ি থাকবে কুসুমের নামে। যে তাঁর দেখভাল করবে ওটা সেই পাবে, সেই সঙ্গে কুসুমের নামে রাখা টাকাও।”

নিলু তির্যক হেসে বলল, ‘বড়দা বোধহয় ও-ঘর থেকে আপনাকে শিখিয়ে এনেছে। আমার অত লোভ নেই কাকু। আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট। মায়ের নামের জিনিস আমি কেন নিতে যাব?’ সেয়ানা আর কাকে বলে! ইঙ্গিতটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল। সিদ্ধার্থ তাকালেন তপনের দিকে।

তপন বলল, ‘আমার ওসব কিছু লাগবে না। পরিস্থিতি একটু ঠিকঠাক হলে আমি এমনিতেই মাকে নিয়ে যাব। আমার একটু সময় চাই। বড়দা তো মুখের কথায় বিশ্বাস করছে না। ভাবছে কেটে পড়ব।’

নীপা বলল, ‘আমি দায়িত্ব নিতে পারি। কিন্তু দাদারা থাকতে মা আমার কাছে গিয়ে থাকলে সেটা কি ভালো দেখাবে? তাছাড়া আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এখনও জীবিত। মা কি ওভাবে থাকতে পারবে?”

সিদ্ধার্থ বললেন, ‘সেটা হয় না। তবে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থাই কর। তোদের মা শক্ত সমর্থ মানুষ। এখনও চলাফেরা করতে সক্ষম। এমন একটা মানুষকে নিয়েই যদি টানাহেঁচড়া হয়, তাহলে অশক্ত হলে কী অবস্থা হবে সহজেই অনুমেয়। বৃদ্ধাশ্রমই ওঁর জন্য ভালো জায়গা। অচেনা মানুষ অবহেলা করলে তবু মেনে নিতে পারবেন।’

চাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এরা যেমন লোভী তেমনি সেয়ানা। জানে সবাই, এই সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলে ঘুরেফিরে ওদের কাছেই ফিরে আসবে আবার। বহুকাল আগে পড়া একটা গল্প মনে পড়ে গেল, নোনাজল। মনে মনে হাসলেন সিদ্ধার্থ। কিছু কিছু জিনিস হাজার চেষ্টা করেও আটকানো যায় না৷ এরা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েই ছাড়বে। সেটাই বোধহয় কুসুমের নিয়তি। এদের কাছে সম্পর্কের কোনও মূল্য নেই। আর মূল্যহীন সম্পর্ক অচল পয়সার মতন, থাকা না থাকা সমান।

শেষ হুমকিটা দিলেন সিদ্ধার্থ, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি তোদের মাকে আমার কাছে নিয়ে রাখতেই পারি। কিন্তু সেটা কি ভালো দেখাবে? লোকে তোদের বদনাম করবে। আমারও। কিন্তু আমি পরোয়া করি না। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। বৃদ্ধাশ্রমে কেউ মন থেকে যায় না, পাঠানো হয়। একটা বড়ো গাছকে শিকড় টেনে তুলে অন্য জায়গায় পুঁতলে সেটা হয়তো মরে না কিন্তু সে কেমন বাঁচে সহজেই অনুমান করা যায়। আর কিছু বলার নেই আমার। এবার কী করবি তোরা বোঝ। তবুও তোদের মায়ের সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলব, শুনব তিনি কী বলেন।”

এবার আক্রান্ত হল সিদ্ধার্থের আধপাগল ভাই মতি৷ ছোঁয়াচে রোগ, পাগল বলে তো আর কাউকে ক্ষমা করবে না। রাস্তা ঘাটে নিয়মনীতি না মেনেই বেরিয়ে পড়ত। কতক্ষণ আর পাহারা দেওয়া যায়? ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠিক বেরিয়ে যেত। ধরে নিল মারণ ভাইরাস। পজিটিভ রিপোর্ট আসার পরেই হসপিটালে শিফট করে দিলেন সিদ্ধার্থ। কোভিড হসপিটালে বেডের সমস্যা থাকলেও অনিমেষের সহায়তায় একটা বেড জোগাড় হয়ে গেল৷ প্রাক্তন ছাত্র অনিমেষ সরকারি আমলা, ওর অনেক হাত। নিয়ম অনুযায়ী সিদ্ধার্থ ও রামের মায়েরও টেস্ট করাতে হয়েছে। দুজনেরই নেগেটিভ।

চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না সিদ্ধার্থ। তবুও বাঁচাতে পারলেন না ভাইকে। এই পৃথিবীতে রক্তের যোগসূত্রে একমাত্র এই ভাই-ই ছিল। ভাইয়ের দেখাশোনা, নিজের চাকরি, পড়াশোনা— এসব করতে গিয়ে বিয়েটাই আর করা হয়ে ওঠেনি। ভাই মারা যাওয়ার পর তাঁর জগৎটা হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল। নিজেকে মনে হল শূন্যে ভাসমান এক নরদেহ মাত্র, যে-নরদেহের অস্তিত্বের আভাসটুকুও আর থাকবে না, দেহ বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে।

 

নরদেহ পর্ব-৩

তাপসকে কড়া ভাষায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সিদ্ধার্থ, হঠাৎ তখনই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠল। আচ্ছা, হরিশ কি তাপসের নাম দিয়ে নিজের কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইল তাঁর কাছে? পর্যবেক্ষণ করে দেখল সিদ্ধার্থের প্রতিক্রিয়া? কী মারাত্মক! সেজন্যই কি বারবার বলত ফিরে এলে এটা করবে, সেটা করবে। সেসব কি এই সম্পর্কিত অনুসন্ধান? মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে অনুসন্ধান করার সময় না থাকাতে তাপসকে সামনে রেখে প্রশ্নটা করে বসেছিল? কাপুরুষ! এতই যখন সন্দেহ তখন নিজে সরাসরি প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারতিস। এই ভনিতার কী দরকার ছিল?

শ্রাদ্ধ হয়ে গেল হরিশের। কঠোর নিয়মে বাঁধা লকডাউন-শ্রাদ্ধ৷ গোনা গুনতি লোক নিয়ে কোনওরকমে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করা, আড়ম্বরহীন, আতিশয্যহীন। সিদ্ধার্থের মনে হল, এটাই যথার্থ। আত্মার মুক্তি কামনায় করণীয় বিধি এমনই তো হওয়া উচিত। সবকিছুতেই আড়ম্বর যুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া বড়ো অদ্ভুত। কিছু কিছু জিনিস অন্তরের অন্তঃস্থলে বসে সমাধা করতে হয়, প্রকৃতির সংযোগে হয় না। মুশকিল হল, অন্তরের ঘরটাকে দেখেই বা ক’জন, চেনেই বা ক’জন! চর্মচক্ষু যা দেখে তার বাইরে যেন আর কিছুই নেই।

হরিশ আর নেই। ওঁর অনুরোধ রক্ষা করার দায়ও আর নেই। এখন ওঁর নির্দেশ পালন করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। সিদ্ধার্থ মনে মনে ঠিক করলেন, এবার বন্ধ করবেন আসা যাওয়ার অভ্যাস। কী কারণে আর যাবেন? এমনও তো হতে পারে, হরিশের কথাই ঠিক। তাপস মনে মনে সত্যি সত্যি এমন একটা নোংরা ধারণা পোষণ করে। এতদিন বলেনি সামনাসামনি কিন্তু এবার বলবে। কারণ হরিশের ঢাল আর নেই।

চারদিনের মাথায় ডাক পড়ল সিদ্ধার্থের। অপমান করার নিমন্ত্রণ? না গিয়েও উপায় নেই। ডাকার পর না গেলে অন্যভাবে নিতে পারে। হরিশ ওদের মনে এমন ভাবে গেঁথে দিয়ে গিয়েছে তাঁকে, এখন সিদ্ধার্থের মাঝে হরিশকে দেখবে ওরা। অন্তত যাদের মনে নোংরা কিছু নেই।

তাপস আলাদা করে ডেকে বলল, ‘আপনি তো আমাদের পরিবারের সবই জানেন। আসল কথাটা একবারেই বলি। তপন, নীপা ওরা সবাই বলছে, বাবা যখন নেই তখন সম্পত্তির একটা বন্দোবস্ত করে ফেলাই ভালো। আমি বড়ো ভাই হিসাবে ভেবে দেখলাম, সেটাই ভালো, ওদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলে আমারও শাস্তি। তাই ডেকেছি আপনাকে।”

“আমি কেন? আমি কে? না না তোদের পৈতৃক সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করবি, সেখানে আমার থাকাটা শোভন দেখায় না। তোরা ঠিক করে নে। তাছাড়া তোর মা তো এখনও বেঁচে আছেন।’

“ওখানেই তো সমস্যা। আমি একচোট আলোচনা করেছি ওদের সঙ্গে। সম্পত্তির ভাগ নেবে সবাই অথচ মায়ের কী হবে, সে বিষয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমরা সবাই মিলে রোটেশন করে মাকে রাখব। চার মাস বা এক মাস করে করে। কিন্তু তাতেও রাজি নয়। এ বলে ব্যাবসার সমস্যা, ও বলে কাজের লোকের সমস্যা নানা অজুহাত। আমি তো ওদের চিনি, একবার ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেলে আর টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না ওদের।’

খানিক চুপ করে থেকে সিদ্ধার্থ বললেন, ‘মায়ের একটা সঠিক বন্দোবস্ত না করে ভাগ বাটোয়ারা করার প্রশ্ন আসে না। তাঁর মতামত নিয়েছিস কিছু, নাকি তিনি সরল মানুষ বলে নিজেরাই সব ডিসিশন নিচ্ছিস? তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাও তো জানা দরকার। তোরা এমন করছিস যেন সে অনাথ শিশু, তাঁকে নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়।”

“মায়ের কোনও মতামত নেই। তাঁর বক্তব্য, তোরা যেটা ভালো বুঝিস তাই করবি। ওরা আমার ওপর দায় চাপাতে চায় কাকু। সেটা কি সম্ভব, নাকি নায্য, আপনিই বলুন? অপর্ণা বলছিল আপনিই পারেন এর সমাধান করতে। আমিও জানি মায়ের প্রতি আপনার একটা দায়িত্ব বোধ আছে, যেটা আপনি কোনওদিনই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।’

হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেললেন সিদ্ধার্থ। তবে কি হরিশের কথাই ঠিক? সেই সত্যেরই ইঙ্গিত দিল তাপস?

ইচ্ছে না থাকলেও বসতে হল সিদ্ধার্থকে। হরিশের সবচেয়ে বড়ো গুণ ভীষণ গোছানো টাইপের মানুষ ছিলেন। জীবনে রোজগারও করেছেন অনেক। কে কী পাবে না পাবে তার একটা ইঙ্গিতও দিয়ে গিয়েছেন। সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সেরকম না হলেও সমস্যা হল মায়ের প্রশ্নেই।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব