এমএনসি-র প্রেম (তৃতীয় পর্ব)

এর পরে বহু চেষ্টা করেও যখন রোহনকে রাজি করাতে পারলাম না, তখন ফিরে গেলাম আবার ওই আগের প্রেমিকের কাছে অর্থাৎ অভিজিৎ-এর কাছে। অভিজিৎ সব কথা শুনে বলল, তুমি কি ভেবেছ যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? রোহন তোমাকে প্রত্যাখ্যান করাতে তুমি আমার কাছে এসেছ। তাই তোমার জন্য আমার রাস্তাও এখন বন্ধ। বুঝলাম আমি আমার নিজের পায়েই কুড়ুল মেরেছি।

আপনিই বলুন স্যার, এ ভুলের কি প্রায়শ্চিত্ত হয়? এখন আমার জীবনটা মনে হয় রুক্ষ আর শুষ্ক। তাই মাথা উঁচু করে বাঁচার রাস্তাগুলোও আর খুঁজে পাচ্ছি না। কার জন্য, কীসের জন্য বাঁচব বলুন তো? আমার বাবা, মা, ভাই, বোনেরা ঝাঁসিতে থাকে। ওদের কাছেও আজ আমি বড়ো ছোটো হয়ে গেছি জানেন। ওরাও হয়তো আর আমাকে বিশ্বাস করে না।

—আমি তোমার সব ঘটনাটাই শুনলাম। কিন্তু এতে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো তাহলে আমি তোমাকে আবার পথের সন্ধান দিতে পারি। নিজের কাকার মতো ভেবে যদি আমার কথা শোনো, আমাকে সাহায্য করো, তাহলে হয়তো আমি তোমাকে আবার মূলস্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব। তবে তোমার সহযোগিতা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। আমার মনে পড়ে ছাত্র জীবনে আমরা বন্ধুরা মিলে কিছু ওয়াগন ব্রেকার-কে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলাম। সে কথা অন্যদিন তোমাকে শোনাব। আচ্ছা, তুমি বলো তো, এই অফিসে এমন কোনও ছেলে আছে যে-তোমার প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছে কোনওদিন?

—আছে, কিন্তু আমি তাকে কখনও পাত্তা দিইনি।

—ছেলেটি কি সবদিক থেকে ভালো নয়?

—না, ঠিক তা নয়। আসলে আমি তখন অন্যের সঙ্গে এনগেইজড তাই।

—কী নাম বল তো? এত কষ্টের মধ্যেও স্নেহার মুখে যেন একটু মুচকি হাসির ঝলক দেখা গেল।

স্নেহা উত্তর দিল— রঘু।

—ও, তোমাদের ডিপার্টমেন্টের রঘু! ও তো খুব ভালো ছেলে শুনেছি। পড়াশোনায় যেমন ভালো, ব্যবহারের দিকেও তেমন ভালো। ও আবার কখনও প্রপোজ করতে পারে এমনটা কেউ দেখে বলতে পারবে না। আচ্ছা স্নেহা, সত্যি কথা বলো তো— রঘুকে তোমার অপছন্দ নয় তো? যদি রঘু তোমায় বিয়ে করতে চায়, তবে তুমি রাজি কিনা শুধু এটুকু বললেই চলবে।

স্নেহা কোনও উত্তর দিল না। অবনীবাবু বুঝলেন স্নেহার মত আছে। নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন— তুমি আজ যাও। খুব শীঘ্রই হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে। আর ভেঙে পোড়ো না বুঝলে! অবনী কখনও হারতে শেখেনি জানো। তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে আমি নিশ্চিত।

স্নেহা বেরিয়ে গেলে অবনীবাবু হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত হয়ে গেছে। তাই অফিসে থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন। পরের দিন অফিসে পৌঁছেই মি. তেওয়ারির কাছে গিয়ে তেওয়ারির লুকোনো ক্যামেরায় তোলা মি. সন্দীপ চাড্ডার আপত্তিজনক ছবিগুলো দেখে ফিরে এলেন নিজের কেবিনে। ডেকে পাঠালেন বিনয় রাজদান-কে। তাঁকে বললেন— মি. চাড্ডাকে টারমিনেট করার চিঠিটা বানিয়ে চেয়ারম্যানের থেকে সই করিয়ে ওকে আজই হিসেবপত্র দিয়ে বের করে দিন।

চেয়ারম্যান-কে বলা হয়ে গেছে। সিকিউরিটিকে বলবেন যেন ওকে চিঠি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেন গেটের বাইরে ছেড়ে আসে আর ভেতরে যেন ঢুকতে না দেয়।

রাজদান— স্যার, মনে হয় টারমিনেটের দরকার হবে না। ব্যপারটা জেনে গেলে ও নিজেই সম্ভবত ‘রেজিগনেশন’ দিয়ে চলে যাবে।

অবনীবাবু— আপনি যাবার পথে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র রঘুকে একটু পাঠিয়ে দেবেন তো?

‘ওকে স্যার’ বলেই মি. রাজদান বেরিয়ে যান কেবিন থেকে।

এমএনসি-র প্রেম (দ্বিতীয় পর্ব)

জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, অবনীবাবু এইচআর হেড, মিস্টার বিনয় রাজদান-কে ডেকে পাঠান। মিস্টার রাজদান অবনীবাবুর কেবিনে এসে প্রবেশ করলে, অবনীবাবু বলা শুরু করেন— আচ্ছা, মিস্টার রাজদান, যদি কোনও কর্মচারীকে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়, তবে কত তাড়াতাড়ি আপনি তাঁকে বের করতে পারবেন আমাকে বলতে পারেন?

রাজদান— স্যার, দু’-তিন ঘণ্টা লাগবে সব ফর্মালিটি পুরো করতে। তবে তেমন আপৎকালীন অবস্থায় পাঁচ মিনিটেও বের করা যেতে পারে।

অবনীবাবু— আগামীকাল প্রয়োজন হতে পারে। তবে এ খবরটা যেন কেউ জানতে না পারে আগে থেকে।

রাজদান— ওকে, তাই হবে স্যার।

অবনীবাবু— আচ্ছা, স্নেহা গুপ্তা-কে আপনি চেনেন? মেয়েটি কাজেকর্মে কেমন?

রাজদান— স্যার, ভালোই কাজ করছিল, তবে কিছুদিন ধরে ওর প্রোজেক্ট ম্যানেজার বলছে যে, মেয়েটা যেন কেমন উদাস হয়ে গেছে।

অবনীবাবু— কোনও প্রেমে-ট্রেমে পড়েনি তো? ওর কোনও প্রেমিক থাকলে তার থেকেই জেনে নিন না ব্যাপারটা কী? কারণ মেয়েটা আগে কাজের জন্য অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। এমন একজন কর্মচারীর কাউন্সেলিং তো খুবই প্রয়োজন, তাই না? আপনি গিয়ে ওকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিন দেখি, আমাকে কিছু বলে কিনা। চেষ্টা করেই দেখি।

রাজদান বেরিয়ে গেলে অবনীবাবু ভাবতে থাকেন, কীভাবে কথা শুরু করবেন স্নেহার সঙ্গে। কারণ ওর মেজাজ ও হাবভাব দেখে খুবই হতাশ লাগছে আজকাল। নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে যা ও আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। দেখা যাক কী করা যায়।

স্নেহা গুপ্তা এসে অবনীবাবুর কেবিনে ঢোকে। অবনীবাবু স্নেহাকে বসতে বলে, ফোনে দু’টো চায়ের অর্ডার দেন। অবনীবাবুই প্রথম শুরু করেন—

—আচ্ছা, স্নেহা কেমন আছো বলো?

—ঠিক আছি স্যার।

—না, মোটেই তুমি ঠিক নেই। কয়েকদিন ধরেই দেখছি তুমি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো। কোনও সমস্যা হলে আমাকে অনায়াসেই বলতে পারো। এর আগেও তুমি দেখেছ অনেকের ক্ষেত্রেই আমি সমস্যার সমাধানে সাহায্য করেছি।

–না স্যার, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।

—বলেই দ্যাখো না, পারি কিনা? আরে বাবা, আমার চুলগুলো তো এমনি পাকেনি? তুমি আমাকে বলতে পারো। সমস্যার সমাধান আমার কাছে না থাকলে আমি তোমাকে সোজাসুজি বলে দেব।

—স্যার, এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। তবুও আপনি যখন জানতে চাইছেন বলছি, যেহেতু আমি আপনাকে অন্য চোখে দেখি। তবে কারও সঙ্গে এই কথাগুলো শেয়ার করবেন না প্লিজ।

—ঠিক আছে, বলো।

—স্যার, আমি সংক্ষেপে আপনাকে বলছি। আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসতাম কলেজ জীবনে। ওর সঙ্গে ঘর বাঁধব বলে ঠিকও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি এই শহরে চলে আসার পর ওর সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ কমতে থাকে। এর পর ও আমেরিকাতে অন সাইটে চলে যায়। সেখান থেকে মাঝে মাঝে কথাবার্তা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে তা কমে আসতে থাকে। যাকে ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ বলে আর কী। এই কোম্পানিতে এসে রোহন বলে একটি ছেলের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব বেড়ে যায়। একদিন সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকি। দু’জনে বিয়ে করব বলে ঠিক করি। কিন্তু আমাদের ভাগ্য মনে হয় সেটা মেনে নিল না। রোহনের বদলি হয়ে গেল বেঙ্গালুরু। এই ক্ষেত্রেও প্রায় তাই হচ্ছিল, দেখা শোনা কম হওয়ায় দূরত্বটা একটু বাড়ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরাই ঠিক করলাম আর দেরি নয়। বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলব। আমাদের দু’বাড়ির মধ্যে কথাও প্রায় পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। পাকাদেখার কয়েকদিন আগে আমি ভেবে দেখলাম আমার আগের প্রেমিকের সম্পর্কে রোহনকে সব খুলে বলা উচিত এবং সব কথা ওকে বললাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, ও সে সব কথা শুনে পিছিয়ে গেল! বলল – তোমার মনে হয় আগের জনকেই বিয়ে করা ঠিক হবে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! এটাকে আমার সরলতা বলব না বোকামি বুঝতে পারলাম না। এর পরে বহু চেষ্টা করেও যখন রোহনকে রাজি করাতে পারলাম না, তখন ফিরে গেলাম আবার ওই আগের প্রেমিকের কাছে অর্থাৎ অভিজিৎ-এর কাছে।

নরদেহ শেষ পর্ব

চুপচাপ নিঃসঙ্গ ভাবে ক’টাদিন ঘরের মধ্যেই কাটালেন সিদ্ধার্থ। কোভিডের ভয়ে কেউ দেখা করতেও এল না। ভয় আর আতঙ্কে দিশেহারা মানুষ ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হচ্ছে। উল্লাস নেই, আনন্দ নেই, উৎসব নেই— এ যেন এক অন্য পৃথিবী। অচেনা অজানা৷

কয়েক দিন পর এক রাতে সিদ্ধার্থ ফোন করলেন নিবারণকে। নিবারণ সেনগুপ্ত। লিগাল অ্যাডভাইজার। অনেক জুনিয়র, সদাহাস্যময় অমায়িক মানুষ। কাজের সূত্রে আলাপ হলেও সম্পর্কটা ধীরে ধীরে পারিবারিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। যথেষ্ট স্নেহ করেন সিদ্ধার্থ।

‘সবই তো শুনেছ, ভাই আর নেই নিবারণ। আমি ভাবছি আমার যা কিছু আছে তার একটা উইল করে রাখব। তোমার সহায়তা চাই। একটা ভিডিও করে আমি ডিটেলসটা ব্যাখ্যা করেছি। তোমাকে পাঠাচ্ছি। তুমি সেই মতো কাগজপত্র তৈরি করবে। এই সিচুয়েশনে একটু অসুবিধা হবে, তবুও করবে। আমার অনুরোধ। পারিশ্রমিক নিয়ে ভেব না। আসলে এই অতিমারিতে কে ক’দিন বাঁচব কোনও গ্যারান্টি নেই। বারো ভূতে খাওয়ার চেয়ে… বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই! বয়সও তো কম হল না।’

ভাই মারা যাওয়ার ঠিক দশ দিনের মাথায় নিজের ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেন সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরী। রামের মায়ের চিৎকারে সবাই জানল কিন্তু কেউ ছুটে এল না, ব্যালকনি, জানালা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল। পুলিশ এসে লাশ নামাল। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে পরবর্তী সমস্ত প্রোসিডিওর ওরা নিজেদের দায়িত্বেই পালন করল। রিপোর্টে লিখল, একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর পর চরম অবসাদে ভুগছিলেন, তাতেই এই সিদ্ধান্ত৷ এই ঘটনার কয়েকদিন পর। হরিশ মুখার্জির ছোটো ছেলেকে একদিন ফোন করলেন অ্যাডভোকেট নিবারণ সেনগুপ্ত, তপনবাবু কাল সকালে একবার আমার বাড়িতে আসুন। জরুরি কিছু কথা আছে।

নিবারণ তপনের মুখ চেনা৷ একই পাড়াতে থাকে, তবে দু’জনে দুমাথায়। নিবারণের কী কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে? ধন্দে পড়ল তপন। ‘সে না হয় যাব’খন। কিন্তু কারণটা কী?”

‘একটু গোপন৷ ফোনে বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া একটু সময়ও লাগবে। তাই সামনাসামনি বলাই বোধহয় ভালো৷”

এভাবে কেউ টেনশন বাড়ায়? মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেলেও কিছু বলতে পারল না। বুঝতে পারল, গলার মধ্যে কাঁটাটা নিয়েই রাতে ঘুমোতে হবে। রীতা পাশেই ছিল। কথাবার্তা শুনে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। তপন পুরোটাই খুলে বলল। শুনে রীতা হেসে বলল, “এতে টেনশনের কী আছে? উকিল ফোন করলেই কি ভয়ের ব্যাপার থাকে নাকি? তাছাড়া নতুন করে আর কী বিপত্তি হবে আমাদের?’

পরের দিন সকালে যথাসময়ে হাজির হল তপন। স্যানিটাইজ করে, সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনে ঘরে বসালেন নিবারণ, এই মুহূর্তে কেউ কারও বাড়ি যেতে সংকোচ বোধ করে। ডাকাটাও ঠিক নয়। আসলে ব্যাপারটা এমন, না ডেকে উপায় ছিল না। কৌতূহল না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। সিদ্ধার্থ জেঠু মরার আগে একটা উইল করে গেছেন, বিষয়টি সেটা নিয়েই।

আমি আপনার বাড়ি যেতে পারতাম কিন্তু সিদ্ধার্থ জেঠু বারবার বলেছেন ব্যাপারটা যেন পাঁচ কান না হয়, তাই আর সাহস পাইনি। সিদ্ধার্থ জেঠু তাঁর সম্পত্তির একটা অংশ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে দান করে গেছেন। ওঁর বিশ্বস্ত কাজের মাসি রামের মায়ের জন্য একটা বড়ো অ্যামাউন্ট সেভিংস করে রেখে গেছেন যাতে তার সুদে ওঁর চলে যায়। আর বসত বাড়িটা লিখে দিয়েছেন আপনার নামে।

‘কী! আকাশ থেকে পড়ল তপন৷’

নিবারণ বললেন, “আরও আছে, পুরোটা শুনুন। তাঁর নির্দেশ, বসতবাড়ির দখল না নিয়ে আপনি টাকাও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাকি বন্দোবস্তের দায়িত্ব আমার। তার জন্য আমার পারিশ্রমিকও ঠিক করে দিয়ে গেছেন। এই হল ব্যাপার, এবার বলুন আপনি কী করবেন?’ তপনের চোখে বোবা বিস্ময়। এসব কী শুনছে সে! শেষ বেলায় কি ভীমরতি ধরেছিল লোকটার?

নিবারণ হেসে বলল, “বুঝতে পারছি আপনার ভিতরে কী চলছে। জেঠুও বুঝেছিলেন বোধহয়। আপনার জন্য একটি চিঠি রেখে গেছেন। কাগজপত্রের মধ্যে ছিল। পরে খুঁজতে গিয়ে পাই। উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি।’

তপনের হাতে খাম গুঁজে দিয়ে নিবারণ বললেন, “আপনি পড়ুন ধীরে সুস্থে। আমি জরুরি একটা ফোন করে আসছি। মনে হয় আপনার কৌতূহলের উত্তর পেয়ে যাবেন।’ নিবারণ ভেতরে চলে গেলেন। তপন খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করল। সাদা কাগজে নীল কালি দিয়ে লেখা। একটু জড়ানো, তবে পড়তে অসুবিধা হয় না।

স্নেহের তপন,

জানি না এই চিঠি তুই কবে পড়বি, যখনই পড়বি আমার আত্মা তোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। কারণ আগে যে-লেখাগুলো পড়বি সেগুলো নিছক কোনও কথার কথা নয়, একটা মানুষের আত্মার আকুতি। আমি জানি তোর বাবা তোকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করেছে। কোনও সন্দেহ থেকে সে ক্ষোভের জন্ম। কিন্তু তোর মা তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে সে ক্ষোভ মেটানোর চেষ্টা করেছেন। জানি না তুই সেটা বুঝিস কিনা। মা আমাদের উৎস, মা আমাদের অস্তিত্বের আধার। যে আমাদের অস্তিত্বকে আশ্রয় দিয়েছে তার তুলনা একমাত্র ঈশ্বরের সঙ্গেই করা যায়। মাতৃরূপী ঈশ্বরকে আশ্রয়হীন করে দেওয়ার অর্থ স্বেচ্ছায় ঈশ্বরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। তোর মা আমাকে কেঁদে বলেছিলেন, যে-তপনকে আমি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি সেও আমাকে তাড়িয়ে দিতে চায়। কতটা কষ্টের কথা! আমি সব খবর জানি, তোর ব্যাবসার অবস্থা খুবই খারাপ। একে লকডাউন তার উপর অনেক ধারদেনা, নাভিশ্বাস চলছে তোর। তোর পরিস্থিতি এতটা খারাপ জেনেও তোর দাদারা এতটুকু সাহায্য করেনি। উলটে বাবার চিকিৎসার টাকা জোর করে আদায় করেছে। তবুও বলছি, সে রাগ মায়ের উপর কেন? আমি ঠিক করেছি স্বেচ্ছায় পৃথিবী ত্যাগ করব। পৃথিবীতে আমার আর কোনও পিছুটান নেই। আমার অস্তিত্ব আলগা হয়ে গেছে। এ গাছ মরবেই! শিকড়ে মাটি নেই। আমার যা কিছু ছিল তার একটা অংশ দিয়েছি যারা অসহায়ের সহায় হয় তাদেরকে। বাড়িটা তোর নামে দিলাম। যদি বাড়ি নিতে লজ্জা করে তবে টাকা নিস, নিবারণ সব ব্যবস্থা করে দেবে, কেউ জানবে না। আশা করি এই টাকায় ব্যাবসাটা আবার দাঁড়িয়ে যাবে। তোর মনে হয়তো প্রশ্ন উঠছে, আমি তোকে দিলাম কেন বাড়িটা? এর উত্তর সহজ। পৃথিবীতে আমার গণ্ডিটা ছিল ছোট্ট। ক’টা মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তাপস, নিলুদের অনেক আছে তবুও ওরা মনে ভিখিরি। ওই অভাব মেটার নয়। সর্বোপরি তোর মা। অনেক ভেবে দেখেছি, কিছু ব্যাপার থাকে জীবনে করা যায় না, জীবন দিয়ে করতে হয়। দর্শনের পরিভাষায় এই জগৎটা হল মায়া, মানুষ, মানুষের সম্পর্ক, এই বেঁচে থাকা, সবই একটা ইল্যুউশন। যে যেমন দেখে! হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? না রে সেটাই সত্যি, একদিন ঠিক বুঝতে পারবি। এবার তোর পালা। মায়ের একটু সেবা যত্ন করিস। ভালো থাকিস সবাই। আমার আশীর্বাদ সব সময় তোর মাথার উপর থাকবে।

ইতি-

সিদ্ধার্থ কাকু

কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলেন নিবারণ। বললেন, ‘পড়া হল? স্পেশাল কিছু লিখেছেন নাকি আমাকে যা যা বলেছেন সে সবই?”

‘সেরকম কিছু না। আপনি বুঝবেন না। আপনি বাড়িটা বিক্রির ব্যবস্থা করুন।”

তপনের পালটে যাওয়া থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে নিবারণ বললেন, “বেশ, আপনার যেমন ইচ্ছা।’

বাড়ির পথে যেতে যেতে তপনের মনে হল, সিদ্ধার্থ কাকুর বাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা, চিঠি লিখে যাওয়া, তাঁর সুইসাইড, সবকিছুর সঙ্গে যেন একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য রহস্য খুঁজে বের করার মতো বিরাট বুদ্ধি কি তপনের আছে? বাড়িটা না নিলেও টাকা তপনকে নিতেই হবে। আর টাকা নিলে মায়ের দায়িত্বও নিতে হবে, নিজের মৃত্যু দিয়ে চক্রব্যূহ রচনা করেছিল লোকটা। কিন্তু কীসের জন্য? হঠাৎ আপন মনেই স্বগতোক্তি করে তপন, জগৎটা আসলেই মায়া!

 

নরদেহ পর্ব-৪

সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সেরকম না হলেও সমস্যা হল মায়ের প্রশ্নেই। সিদ্ধার্থ একটা ছোটো চাল খাটানোর চেষ্টা করলেন, “ইচ্ছাপুরের হরিশের পৈতৃক বাড়ি থাকবে কুসুমের নামে। যে তাঁর দেখভাল করবে ওটা সেই পাবে, সেই সঙ্গে কুসুমের নামে রাখা টাকাও।”

নিলু তির্যক হেসে বলল, ‘বড়দা বোধহয় ও-ঘর থেকে আপনাকে শিখিয়ে এনেছে। আমার অত লোভ নেই কাকু। আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট। মায়ের নামের জিনিস আমি কেন নিতে যাব?’ সেয়ানা আর কাকে বলে! ইঙ্গিতটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল। সিদ্ধার্থ তাকালেন তপনের দিকে।

তপন বলল, ‘আমার ওসব কিছু লাগবে না। পরিস্থিতি একটু ঠিকঠাক হলে আমি এমনিতেই মাকে নিয়ে যাব। আমার একটু সময় চাই। বড়দা তো মুখের কথায় বিশ্বাস করছে না। ভাবছে কেটে পড়ব।’

নীপা বলল, ‘আমি দায়িত্ব নিতে পারি। কিন্তু দাদারা থাকতে মা আমার কাছে গিয়ে থাকলে সেটা কি ভালো দেখাবে? তাছাড়া আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এখনও জীবিত। মা কি ওভাবে থাকতে পারবে?”

সিদ্ধার্থ বললেন, ‘সেটা হয় না। তবে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থাই কর। তোদের মা শক্ত সমর্থ মানুষ। এখনও চলাফেরা করতে সক্ষম। এমন একটা মানুষকে নিয়েই যদি টানাহেঁচড়া হয়, তাহলে অশক্ত হলে কী অবস্থা হবে সহজেই অনুমেয়। বৃদ্ধাশ্রমই ওঁর জন্য ভালো জায়গা। অচেনা মানুষ অবহেলা করলে তবু মেনে নিতে পারবেন।’

চাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এরা যেমন লোভী তেমনি সেয়ানা। জানে সবাই, এই সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলে ঘুরেফিরে ওদের কাছেই ফিরে আসবে আবার। বহুকাল আগে পড়া একটা গল্প মনে পড়ে গেল, নোনাজল। মনে মনে হাসলেন সিদ্ধার্থ। কিছু কিছু জিনিস হাজার চেষ্টা করেও আটকানো যায় না৷ এরা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েই ছাড়বে। সেটাই বোধহয় কুসুমের নিয়তি। এদের কাছে সম্পর্কের কোনও মূল্য নেই। আর মূল্যহীন সম্পর্ক অচল পয়সার মতন, থাকা না থাকা সমান।

শেষ হুমকিটা দিলেন সিদ্ধার্থ, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি তোদের মাকে আমার কাছে নিয়ে রাখতেই পারি। কিন্তু সেটা কি ভালো দেখাবে? লোকে তোদের বদনাম করবে। আমারও। কিন্তু আমি পরোয়া করি না। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। বৃদ্ধাশ্রমে কেউ মন থেকে যায় না, পাঠানো হয়। একটা বড়ো গাছকে শিকড় টেনে তুলে অন্য জায়গায় পুঁতলে সেটা হয়তো মরে না কিন্তু সে কেমন বাঁচে সহজেই অনুমান করা যায়। আর কিছু বলার নেই আমার। এবার কী করবি তোরা বোঝ। তবুও তোদের মায়ের সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলব, শুনব তিনি কী বলেন।”

এবার আক্রান্ত হল সিদ্ধার্থের আধপাগল ভাই মতি৷ ছোঁয়াচে রোগ, পাগল বলে তো আর কাউকে ক্ষমা করবে না। রাস্তা ঘাটে নিয়মনীতি না মেনেই বেরিয়ে পড়ত। কতক্ষণ আর পাহারা দেওয়া যায়? ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠিক বেরিয়ে যেত। ধরে নিল মারণ ভাইরাস। পজিটিভ রিপোর্ট আসার পরেই হসপিটালে শিফট করে দিলেন সিদ্ধার্থ। কোভিড হসপিটালে বেডের সমস্যা থাকলেও অনিমেষের সহায়তায় একটা বেড জোগাড় হয়ে গেল৷ প্রাক্তন ছাত্র অনিমেষ সরকারি আমলা, ওর অনেক হাত। নিয়ম অনুযায়ী সিদ্ধার্থ ও রামের মায়েরও টেস্ট করাতে হয়েছে। দুজনেরই নেগেটিভ।

চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না সিদ্ধার্থ। তবুও বাঁচাতে পারলেন না ভাইকে। এই পৃথিবীতে রক্তের যোগসূত্রে একমাত্র এই ভাই-ই ছিল। ভাইয়ের দেখাশোনা, নিজের চাকরি, পড়াশোনা— এসব করতে গিয়ে বিয়েটাই আর করা হয়ে ওঠেনি। ভাই মারা যাওয়ার পর তাঁর জগৎটা হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল। নিজেকে মনে হল শূন্যে ভাসমান এক নরদেহ মাত্র, যে-নরদেহের অস্তিত্বের আভাসটুকুও আর থাকবে না, দেহ বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে।

 

নরদেহ পর্ব-৩

তাপসকে কড়া ভাষায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সিদ্ধার্থ, হঠাৎ তখনই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠল। আচ্ছা, হরিশ কি তাপসের নাম দিয়ে নিজের কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইল তাঁর কাছে? পর্যবেক্ষণ করে দেখল সিদ্ধার্থের প্রতিক্রিয়া? কী মারাত্মক! সেজন্যই কি বারবার বলত ফিরে এলে এটা করবে, সেটা করবে। সেসব কি এই সম্পর্কিত অনুসন্ধান? মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে অনুসন্ধান করার সময় না থাকাতে তাপসকে সামনে রেখে প্রশ্নটা করে বসেছিল? কাপুরুষ! এতই যখন সন্দেহ তখন নিজে সরাসরি প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারতিস। এই ভনিতার কী দরকার ছিল?

শ্রাদ্ধ হয়ে গেল হরিশের। কঠোর নিয়মে বাঁধা লকডাউন-শ্রাদ্ধ৷ গোনা গুনতি লোক নিয়ে কোনওরকমে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করা, আড়ম্বরহীন, আতিশয্যহীন। সিদ্ধার্থের মনে হল, এটাই যথার্থ। আত্মার মুক্তি কামনায় করণীয় বিধি এমনই তো হওয়া উচিত। সবকিছুতেই আড়ম্বর যুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া বড়ো অদ্ভুত। কিছু কিছু জিনিস অন্তরের অন্তঃস্থলে বসে সমাধা করতে হয়, প্রকৃতির সংযোগে হয় না। মুশকিল হল, অন্তরের ঘরটাকে দেখেই বা ক’জন, চেনেই বা ক’জন! চর্মচক্ষু যা দেখে তার বাইরে যেন আর কিছুই নেই।

হরিশ আর নেই। ওঁর অনুরোধ রক্ষা করার দায়ও আর নেই। এখন ওঁর নির্দেশ পালন করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। সিদ্ধার্থ মনে মনে ঠিক করলেন, এবার বন্ধ করবেন আসা যাওয়ার অভ্যাস। কী কারণে আর যাবেন? এমনও তো হতে পারে, হরিশের কথাই ঠিক। তাপস মনে মনে সত্যি সত্যি এমন একটা নোংরা ধারণা পোষণ করে। এতদিন বলেনি সামনাসামনি কিন্তু এবার বলবে। কারণ হরিশের ঢাল আর নেই।

চারদিনের মাথায় ডাক পড়ল সিদ্ধার্থের। অপমান করার নিমন্ত্রণ? না গিয়েও উপায় নেই। ডাকার পর না গেলে অন্যভাবে নিতে পারে। হরিশ ওদের মনে এমন ভাবে গেঁথে দিয়ে গিয়েছে তাঁকে, এখন সিদ্ধার্থের মাঝে হরিশকে দেখবে ওরা। অন্তত যাদের মনে নোংরা কিছু নেই।

তাপস আলাদা করে ডেকে বলল, ‘আপনি তো আমাদের পরিবারের সবই জানেন। আসল কথাটা একবারেই বলি। তপন, নীপা ওরা সবাই বলছে, বাবা যখন নেই তখন সম্পত্তির একটা বন্দোবস্ত করে ফেলাই ভালো। আমি বড়ো ভাই হিসাবে ভেবে দেখলাম, সেটাই ভালো, ওদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলে আমারও শাস্তি। তাই ডেকেছি আপনাকে।”

“আমি কেন? আমি কে? না না তোদের পৈতৃক সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করবি, সেখানে আমার থাকাটা শোভন দেখায় না। তোরা ঠিক করে নে। তাছাড়া তোর মা তো এখনও বেঁচে আছেন।’

“ওখানেই তো সমস্যা। আমি একচোট আলোচনা করেছি ওদের সঙ্গে। সম্পত্তির ভাগ নেবে সবাই অথচ মায়ের কী হবে, সে বিষয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমরা সবাই মিলে রোটেশন করে মাকে রাখব। চার মাস বা এক মাস করে করে। কিন্তু তাতেও রাজি নয়। এ বলে ব্যাবসার সমস্যা, ও বলে কাজের লোকের সমস্যা নানা অজুহাত। আমি তো ওদের চিনি, একবার ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেলে আর টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না ওদের।’

খানিক চুপ করে থেকে সিদ্ধার্থ বললেন, ‘মায়ের একটা সঠিক বন্দোবস্ত না করে ভাগ বাটোয়ারা করার প্রশ্ন আসে না। তাঁর মতামত নিয়েছিস কিছু, নাকি তিনি সরল মানুষ বলে নিজেরাই সব ডিসিশন নিচ্ছিস? তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাও তো জানা দরকার। তোরা এমন করছিস যেন সে অনাথ শিশু, তাঁকে নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়।”

“মায়ের কোনও মতামত নেই। তাঁর বক্তব্য, তোরা যেটা ভালো বুঝিস তাই করবি। ওরা আমার ওপর দায় চাপাতে চায় কাকু। সেটা কি সম্ভব, নাকি নায্য, আপনিই বলুন? অপর্ণা বলছিল আপনিই পারেন এর সমাধান করতে। আমিও জানি মায়ের প্রতি আপনার একটা দায়িত্ব বোধ আছে, যেটা আপনি কোনওদিনই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।’

হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেললেন সিদ্ধার্থ। তবে কি হরিশের কথাই ঠিক? সেই সত্যেরই ইঙ্গিত দিল তাপস?

ইচ্ছে না থাকলেও বসতে হল সিদ্ধার্থকে। হরিশের সবচেয়ে বড়ো গুণ ভীষণ গোছানো টাইপের মানুষ ছিলেন। জীবনে রোজগারও করেছেন অনেক। কে কী পাবে না পাবে তার একটা ইঙ্গিতও দিয়ে গিয়েছেন। সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সেরকম না হলেও সমস্যা হল মায়ের প্রশ্নেই।

নরদেহ পর্ব-২

সিদ্ধার্থ জানেন হরিশের ছেলেরা ওঁকে খুব একটা ভালোবাসে না। বিশেষ করে ছোটো ছেলে তপনের সঙ্গে একদমই বনিবনা হতো না। বড়ো দুজনেরও যেটুকু আছে সেটা অন্তরের নয়, কেজো আর লোক দেখানি ভালোবাসা। মাঝে মাঝেই বাবা-মাকে নিয়ে টাগ অফ ওয়ার চলে। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর মতো কথাও ওরা বলে, সিদ্ধার্থের কানে এসেছে। হরিশও সব জানত।

বৈঠক বসেছে সামনের ঘরে। হরিশের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনার জন্য।

হরিশের বড়ো ছেলে তাপস বলল, ‘বাবা গলদা চিংড়ি খুব ভালোবাসতেন। আমার ইচ্ছে ছিল মৎসমুখীতে গলদা চিংড়ি হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে তাতে খাওয়ানো তো দূরের কথা, অনুষ্ঠান করা যাবে কিনা সেটাই সন্দেহ। পুলিশ পঁচিশ-ত্রিশের বেশি লোকের পারমিশন দেবে না।”

সিদ্ধার্থ বললেন, “কী দরকার? নিষ্ঠা নিয়ে শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম কর, তাহলেই তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে। গলদা চিংড়ি খাওয়ালেই আত্মা শান্তি পাবে, কে বলেছে তোদের? গুরুদশা পার হল, এবার বাকি কাজগুলো কীভাবে করা যায় সেটা ভাব৷’

মেজ নীলু বলল, ‘তবুও লোকে ঠিক বলবে ছেলেগুলো কিপটে…।’

“কেন বলবে? লোকে পরিস্থিতি জানে না? ওটা তোর মনের ভুল ধারণা। বরং উলটোটা হবে, ডাকলেও কেউ আসবে না। আর যদি এতই খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকে তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে না হয় খাইয়ে দিস।’

ছোটো ছেলে তপন বলল, ‘আমাদের কপালটাই খারাপ। কী ট্রিটমেন্ট হল কে জানে, গুচ্ছের টাকা খেয়ে লোকটাকেও মেরে ফেলল। শালা হারামির…।’

তপনের বউ রীতা কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, ‘হচ্ছেটা কী? সবাই রয়েছে এখানে। মুখের ভাষা কি তোমার কোনওদিনই ভালো হবে না?”

হরিশের মেয়ে নীপা বলে, ‘ছোড়দার মুখের ভাষা হয়তো খারাপ কিন্তু অন্যায্য তো কিছু বলেনি। ব্যাবসা করার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছে মানুষের জীবন নিয়ে। তাও যদি বেঁচে ফিরত।’

সিদ্ধার্থ বিরক্ত গলায় বললেন, “তোরা কি আবার ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাস? তবে একটা কমপেনসেশন কেস ঠুকে দে৷ জিতে গেলে অনেক টাকা ফেরত পাবি ৷ ‘

“সেটাই তো উচিত ছিল।’ রাগে গজগজ করতে করতে বলল তপন।

মনে মনে হাসলেন সিদ্ধার্থ। এসব কি বাবার প্রতি ভালোবাসা, নাকি পাহাড় প্রমাণ বিলের জন্য হতাশা? যতদূর জানেন সিদ্ধার্থ, হরিশ নিজের চিকিৎসার জন্য একটা বড়ো অ্যামাউন্ট সব সময় রেডি রাখত। হয়তো তার বাইরে কিছু দিতে হয়েছে তাই রাগ সামলাতে পারছে না এরা। কিন্তু একদিক থেকে এদের আনন্দিত হওয়ারই কথা। কারণ বৃদ্ধ বাবাকে আমৃত্যু টানার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে হরিশ। কতটা পেলে মানুষ সন্তুষ্ট হয় এখনও বুঝে উঠতে পারেন না সিদ্ধার্থ। মানুষের মনোভূমিতে চাহিদার বিষবৃক্ষ কতটা বেড়ে উঠলে সম্পর্কগুলোকে নস্যাৎ করে শুধু চাহিদার কথাই ভাবতে থাকে— তার পরিমাপ আজও শিখলেন না। হরিশের মৃত্যুশোক ধীরে ধীরে টাকার শোকে পরিণত হচ্ছে। এই তো মানুষের অস্তিত্ব!

‘এসব কথা মায়ের সামনে বারবার তুললে তাঁর মনে কতটা আঘাত লাগে তোরা বুঝতে পারিস? বাবা গেল, মাকেও খুঁচিয়ে মারতে চাস? এমন করলে আমাকে আর ডাকিস না। সত্যি কথা বলতে এ বাড়িতে আমার আসার আর কোনও কারণ রইল না।”

তাপস কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না কাকু। আপনি এরকম বললে আমরা খুব কষ্ট পাব। বাবা নেই, এখন আপনিই আমাদের গার্জিয়ান।’

হাসতে গিয়েও কোনওরকমে নিজেকে সামলালেন সিদ্ধার্থ। এই মুহূর্তে হাসলে বড্ড বেমানান দেখাত। বেড়ে মিথ্যে কথাটা বলেছে ছোকরা! মরার ক’দিন আগেই হরিশ ফোনে চরম এক স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘জানি না আমি আর ফিরতে পারব কিনা, তোকে একটা গোপন কথা বলতে চাই।’ তারপরে সংকোচ ভরে বলেছিলেন, “জানি না বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তবুও বলছি কারণ একজন মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে যুক্তিতর্কের চেয়ে সত্যটা স্বীকার করার মধ্যে প্রাণের আরাম বেশি মনে হয়। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে। শোন সিদ্ধার্থ, আমার মৃত্যু হলে তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না। একদিন এক ঝগড়ার সূত্রে তাপস কি বলেছিল জানিস? বলেছিল, তোমরা যাকে এত প্রশ্রয় দাও সে তো আসলে লম্পট, চরিত্রহীন। ছোটো থাকতে ও নাকি দেখেছে, তুই নাকি ওর মার সঙ্গে একই বিছানায়… আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানি ওটা ওর বানানো গল্প। ও সব পারে। আমি বেঁচে থাকতে যেটা পারেনি সেটা আমার অবর্তমানে ঠিক করে দেখাবে।”

শোনার পর কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি সিদ্ধার্থ। সুতীব্র গ্লানিতে ভরে গিয়েছিল মন। এটা শুনতেও বাকি ছিল তাঁর! দু’দিন এতটাই তোলপাড় ছিল মন, হরিশের বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত মাড়াননি। পরে হরিশের অনুরোধেই আবার গিয়েছিলেন। হরিশ আকুতি মিশিয়ে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আসিস।”

 

 

 

মুখোশ (দ্বিতীয় পর্ব)

কয়েক ঘন্টা পর সমর এসে ওকে বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছোবার পর সন্ধেবেলায় সমর সঞ্চিতাকে শুধু এটুকুই বলল যে, ও এখন বাচ্চার দায়িত্ব নিতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। ওর এখন অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ও যদি সঞ্চিতাকে গর্ভপাত করাবার কথা বলত, তাহলে হয়তো ও রাজি হতো না। তাই বাধ্য হয়ে সমরকে এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

সবকিছু শোনার পর নিজের মনে গুমরে মরা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ওর কাছে খোলা নেই— সেটা খুব ভালো করেই বুঝে নিয়েছিল সঞ্চিতা। সমরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। এতদিন সমরের প্রতি যে-সম্মান, ভালোবাসা সঞ্চিতার হৃদয়কে ঘিরে রেখেছিল— সেখানে জায়গা হল ঘৃণা, তিরস্কারের। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকে সমরের বিরুদ্ধতা করা উচিত মনে করল না সঞ্চিতা। কারণ এখানে ও কাউকেই চেনে না, যে ওর পক্ষ নেবে। এখানে না কোনও বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা চেনা-পরিচিত— কার সঙ্গে ও মনের দুঃখ শেয়ার করবে?

একদিন দুপুরে বনানী পিসির ফোন এল সঞ্চিতার কাছে। পিসির কাছ থেকেই সঞ্চিতা জানতে পারল— গত পনেরো দিনে সমর বনানী পিসিকে তিনবার ফোন করেছে। প্রতিবারই নাকি পঁচিশ লক্ষ টাকা বনানীকে পাঠাতে বলেছে সমর ওর আমেরিকার অ্যাকাউন্টে। ও পিসিকে বলেছে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে এবং এই টাকা দিয়ে নিজের ব্যাবসা শুরু করবে। তাই টাকাটা ওর খুব প্রয়োজন।

সমরের হাবভাবে বনানীর সন্দেহ হওয়াতে সঞ্চিতাকে ফোন করে তিনি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সঞ্চিতা কিছু জানতই না বরং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সঞ্চিতার গর্ভপাত ঘটানোর কথা সঞ্চিতা পিসিকে জানালে— বনানী সমরের ব্যবহারে মানসিক ভাবে খুবই মুষড়ে পড়লেন।

সঞ্চিতা সমরকে ভয় পেতে আরম্ভ করল। সমর সম্পর্কে সমস্ত সত্যটা ধীরে ধীরে সঞ্চিতার সামনে আসতে আরম্ভ করল। বিদেশে সমরের শত্রুতা করার সাহস ছিল না সঞ্চিতার— আর দেশে মা-বাবাকে জানিয়ে তাদের চিন্তিত করে তুলতে কিছুতেই মন চাইছিল না তার।

বাড়িতেও আর সময় কাটছিল না সঞ্চিতার। ভাগ্যের কাছে পরাজিত সঞ্চিতা একদিন বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল। পত্রিকাটি আমেরিকার হলেও আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্যই মূলতঃ পত্রিকাটি বার হতো। একটা খবরের দিকে দৃষ্টি পড়তে সঞ্চিতার চোখ সেখানে আটকে গেল।

প্রণতি নামের একজন ক্রাইম রিপোর্টার কীভাবে নিজের সাহস এবং বুদ্ধির জোরে একটি বড়ো সেক্স র‌্যাকেটের পর্দা ফাঁস করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কিছু প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, প্রমাণ-সহ আইনের চোখে তাদের সে দোষী সাব্যস্ত করে ছেড়েছে— তার সম্পূর্ণ বিস্তারিত খবর ‘দ্য ট্রুথ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

খবরটা তিন-চারবার পড়ল সঞ্চিতা। আশার একটা আলো দেখতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটির দফতরে ফোন করে প্রণতির ঠিকানা এবং ফোন নম্বর সংগ্রহ করল সে। প্রণতিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল সঞ্চিতা। কথায় কথায় জানতে পারল প্রণতি ওর স্কুলেরই মেয়ে ওর থেকে দুবছরের সিনিয়র ছিল। তার বাবা চাকরি নিয়ে আমেরিকা চলে আসাতে ওদের পরিবার আমেরিকায় পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে।

প্রণতি নিজের বাড়িতেই আসতে বলল সঞ্চিতাকে। আমেরিকাতেও সঞ্চিতার নিজের বলতে কেউ আছে, এটা ভেবেই সঞ্চিতার মন অনেকটা হালকা বোধ হল। প্রণতির সঙ্গে দেখা করে ওর সঙ্গে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল। এমনকী পিসির কাছে পঁচিশ লক্ষ টাকা সমর চেয়েছে, এটা জানাতেও ভুলল না।

প্রণতিও মন দিয়ে সব শুনল। প্রায় দুঘন্টা ধরে ওদের কথাবার্তা চলল। প্রণতি কথা দিল, ও সমর সম্পর্কে সবকিছু অনুসন্ধান করে সঞ্চিতার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। নিশ্চিন্ত মনে সঞ্চিতা বাড়ি ফিরে এল।

সেদিন সারারাত সমর বাড়ি ফিরল না। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে, সঞ্চিতার কখন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ও নিজেই বুঝতে পারেনি। বহুবার ফোন করার পরেও কোনও রিপ্লাই না আসাতে, সঞ্চিতাও খোঁজ করা বৃথা চেষ্টা, ভেবে হাল ছেড়ে দিল। পরের দিন দুপুরে সমর বাড়ি ফিরল। ও কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল না। এক সপ্তাহর বেশি সময় পেরিয়ে গেল। রাতে বাড়ি না ফেরাটা প্রায়শই হতে লাগল সমরের। ফেরার কোনও ঠিক থাকত না। একবার টানা দুই রাত বাড়ি ফিরল না। জিজ্ঞেস করাও ছেড়ে দিল সঞ্চিতা।

পরের সপ্তাহের শেষের দিকে প্রণতির ফোন এল দেখা করার জন্য। তার আগের রাতেও সমর বাড়ি ফিরল না। সকালে উঠে চা খেয়ে সঞ্চিতা তৈরি হয়ে নিল। ওর অনুপস্থিতিতে সমর বাড়ি ফিরতে পারে, এই ভেবে একটা কাগজে মার্কেট যাচ্ছে লিখে খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল।

প্রণতির বাড়ি পৌঁছোতেই প্রণতি ওকে বসার ঘরে আসার জন্য বলল। সঞ্চিতা সোফায় এসে বসলে প্রণতি বলতে শুরু করল, সঞ্চিতা তুমি আমাকে সমরের অফিস এবং ওর সম্পর্কে যা যা প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়েছিলে, সেই মতন আমি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। ও একটা খুনের কেসে জড়িয়ে গেছে। গতকাল পুলিশ ওর ডেরায় পৌঁছে ওকে অ্যারেস্ট করেছে। এই কয়েকদিন ও পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তাই রাতে বাড়ি ফিরত না। ও এখন পুলিশের লক-আপে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত ও চাকরি ছাড়েনি বরং কোম্পানি ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। ও অফিসে ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা তছরুপ করেছে। বনানী পিসিকেও মিথ্যা বলেছিল। উনি সমরের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতেই ওই টাকা তুলে ও কোম্পানিকে দিয়ে আইনি সাজা পাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।

 

মুখোশ (প্রথম পর্ব)

বিয়ের পর ভারতীয় মেয়েদের দুরাবস্থার খবর আমাদের আশেপাশে, খবরের কাগজে প্রায়শই চোখে পড়ে, বিশেষ করে পাত্র যদি বিদেশে বসবাসকারী হয়। এর কারণ হচ্ছে মেয়ের পরিবারের লোকজন পাত্রের ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান।

নির্মলা পুণাতে থাকে। ওর মা আর ওখানকার মহিলা সমিতির মেম্বার বনানী খুব ভালো বন্ধু, সেই সূত্রে নির্মলার সঙ্গেও বনানী আন্টির ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন কথায় কথায় নির্মলা নিজের মেয়ে সঞ্চিতার বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছে জানাতে, বনানী আন্টি নিজের ভাইপো সমরের কথা বললেন। পাত্র বর্তমানে আমেরিকায় থাকে এবং ওখানে খুব ভালো চাকরি করে। বনানীর কথায় নির্মলা জানতে পারল— সমরের জন্যও পাত্রী সন্ধান করা হচ্ছে।

বাড়িতে স্বামী এবং মেয়েকে সমরের কথা জানাতে, নির্মলার স্বামী একটু ইতস্তত করলেও, সঞ্চিতা কিন্তু বিদেশে থাকা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। ওদিকে বনানীও সমরকে ফোনে সঞ্চিতার ছবি-সহ ওর সম্পর্কে, সবকিছু জানাতে সমরও কথা দিল পাত্রীর সঙ্গে কথা বলে পিসিকে জানিয়ে দেবে। বনানী পাত্র-পাত্রী উভয়কে ভিডিও চ্যাটে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বেশ কিছুদনি ওরা ফোনে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে সবকিছু ঠিক মনে হতে, নিজের নিজের পরিবারকে জানিয়ে দিল উভয়ে বিয়েতে রাজি আছে।

বিয়ের দিন স্থির হতে সমর এক মাসের ছুটি নিয়ে পুণা এসে পৌঁছোল। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করাই ছিল। সমর ও সঞ্চিতার বিয়ে হয়ে গেল। সমরের কোনওরকম খোঁজখবর না নিয়ে সঞ্চিতার মা-বাবা বনানীর উপর ভরসা করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।

ভরসা করার অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল, শৈশবে এক দুর্ঘটনায় মা-বাবাকে হারিয়ে সমর তার বনানী পিসির কাছেই মানুষ হয়েছিল। অবশ্য টাকা-পয়সার জন্য বনানীকে চিন্তা করতে হয়নি। মা-বাবার অকালে মৃত্যু হওয়াতে ওই শিশু বয়সেই সমর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র মালিক হয়ে উঠেছিল। বিধবা নিঃসন্তান বনানী, সমরকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করাতে সমরের বাবার তৈরি ট্রাস্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাতা হিসেবে বনানীকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অর্থের লোভে বনানী সমরকে দত্তক নিলেও ওকে মানুষ করতে কোনও কার্পণ্য করেননি। ভালো স্কুল থেকে পড়াশোনা করিয়ে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন সমরকে। একুশ বছর বয়সে সম্পত্তির অধিকার সমরের হাতে চলে আসায়, ধীরে ধীরে সমরের স্বভাব পালটাতে থাকে। সে ঠিক করে আমেরিকায় গিয়ে পাকাপাকি বসবাস করবে।

সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে চাকরি নিয়ে সমর আমেরিকায় পাড়ি জমায় এবং ওখানেই থেকে যাওয়া মনস্থির করে। এত বছর বাদে বিয়ের জন্য দেশে ফিরেও বিয়ে মিটতে না মিটতেই সঞ্চিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসে ও।

কী করে দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়, নতুন বিয়ের আনন্দে সঞ্চিতা বুঝতেই পারে না। রোজই মনে হতো সমরকে বিয়ে করে সারা বিশ্বের সুখ ওর মনের কোণায় জমা হয়েছে। একদিন হঠাৎ-ই সঞ্চিতা বুঝতে পারে যে, সে মা হতে চলেছে। এর পরেই ঠিক করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে তবে সমরকে জানাবে। ডাক্তার সব রিপোর্ট পজিটিভ জানালে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে সঞ্চিতা। অধীর আগ্রহে সমরের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকে সবকিছু সমরকে বলার জন্য।

সন্ধেবেলায় সমর বাড়ি ফিরলে সবথেকে আগে সঞ্চিতা এই আনন্দ সংবাদ সমরকে জানায়। কিন্তু ওর মুখে আনন্দের বদলে অন্যকিছু চোখে পড়াতে সঞ্চিতা ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। সমরের মুখের এই ভাবান্তর আগে কখনও সঞ্চিতা দেখেনি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সমর নিজেকে সামলে নিল। সঞ্চিতাকে দুই হাতে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, আমি তো বিশ্বাস করতেই পারছি না যে আমি বাবা হতে চলেছি। খবরটা শুনে কিছু মুহূর্ত আমার ব্রেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তুমি এখন থেকে খুব সাবধানে থাকবে। আমার পরিচিত একজন ভালো গাইনিকোলজিস্ট আছেন, কাল আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব সম্পূর্ণ চেক-আপের জন্য।

পরের দিন সঞ্চিতার যখন চোখ খুলল, দেখল অপরিচিত একটা বিছানায় ও শুয়ে আছে। কোমরের নীচের থেকে একটু ভারী ভারী মনে হচ্ছিল, পেটেও একটা সামান্য ব্যথা ছিল। চারপাশে চোখ বোলাতে মনে হল কোনও হাসপাতালের ঘরে ও শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করেও শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারল না। সেই মুহূর্তে একজন নার্স দৌড়ে এসে বলল, আপনি আরও খানিক্ষণ বিশ্রাম করুন। তিন ঘন্টা পর আপনি উঠতে পারেন।

হাসপাতালের বিছানায় ও কীভাবে এল জানতে, কাউকে না পেয়ে নার্সকেই জিজ্ঞেস করাতে নার্স একটু অবাক হল। নার্স সঞ্চিতার দিকে একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, আপনি জানেন না আপনার কী হয়েছে? আপনার অ্যাবর্শন হয়েছে।

শুনেই সঞ্চিতার মাথা ঘুরে গেল। ওর মনে পড়ল সমরের সঙ্গে ও হাসপাতালে গাইনিকোলজিস্ট-এর কাছে এসেছিল চেক-আপ করাতে। ওখানে ওকে জল খেতে দেওয়া হয়েছিল তারপরেই ওর খুব ঘুম পাচ্ছিল। ব্যস আর কিছু ওর মনে নেই। এখন পুরো ঘটনাটাই সঞ্চিতার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

 

পিরামিড (শেষপর্ব)

মাস তিন আরও পেরিয়ে গেল। রূপার মায়ের গর্ভের সেই অপত্যস্নেহের প্রাণ এই তিনমাসে আরও তিনমাস বড়ো হয়ে গেছে। রূপার মাকে এখন দেখলে বোঝা যায়। সেদিনের ঘটনার পর রূপার ব্যবহার জটিল থেকে যৌগিক হয়ে উঠল।

রূপার বাবা-মা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওয়াশের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। রূপার কথাও বলেছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবু সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, আপনাদের এইরকম পরিকল্পনা থাকলে আরও আগে ভাবতে হতো। এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। এমনকী ম্যাডামের কিছু ভালো-মন্দ হয়ে যেতে পারে। তার থেকে মেয়ের সঙ্গে আবার কথা বলুন, বোঝান।

বাড়ি ফিরে রূপাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বরং দিন দিন রূপা তার নিজস্ব পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে আরও বেশি করে পেঁচিয়ে রাখতে আরম্ভ করে। প্রযোজন ছাড়া বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লাঞ্চ তো একা খেতই, ডিনার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে আরম্ভ করল। বাবা-মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিত না। স্কুল বা টিউশন থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে আরম্ভ করল। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বেশির ভাগ সময়ে এড়িয়ে চলে যেত, অথবা চিল্লিয়ে বলত, তোমাদের কী?

একটা ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরির কথাও কানে এল। কিন্তু রূপাকে কিছু বলতে সাহস হয় না। একদিন রাত্রি নটার সময় বাবা বাড়ির সামনে একটা ছেলের বাইক থেকে রূপাকে নামতে দেখে। বাড়ি ফিরলে ছেলেটার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে খুব বাজে ভাবে উত্তর দেয়, ইজ ইট ইযোর বিজনেস?

মা শুয়ে শুয়ে চেল্লাতে আরম্ভ করে, এর মানে! আমরা জিজ্ঞেস করব না তো কে করবে?

বাবা শান্ত করে বলে, ডাক্তার তোমায় উত্তেজিত হতে বারণ করেছে, শান্ত থাকো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি। তারপর খুব শান্ত ভাবেই ছেলেটার কথা আবার জিজ্ঞেস করতে রূপা জবাব দেয়, ও চাঙ্কি, আমার টাইম পার্টনার, এনি প্রবলেম?

তবে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শূন্যের দিকে গেলে বাবার কাছে এসে গম্ভীর গলায় বলে, বাবা আমাকে কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে তো।

বাড়িতে টুকটাক কাজ করবার জন্যে আলপনা মাসি ছাড়াও রান্নার জন্যে আরকজন এসেছে। খিদে পেলে তাদের কাউকে বলে টিফিন থেকে আরম্ভ করে বাকি সব নিয়ে নেয়।

মা কিন্তু এখন এক্কেবারে শয্যাশাযী। ডাক্তার বলেছেন, বেশি বয়সের তো, বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেগন্যান্সি। রেস্ট না নিলে রিস্ক হতে পারে।

রূপা কিন্তু কোনওদিন মায়ের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছো? সাধের দিন পিসি আর দূর সম্পর্কের মাসি মামিরা এলেও রূপা স্কুল চলে যায়। এমনকী আগের রাতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে বলে, তাহলে কাল টিউশন থেকে ফেরার সময় পার্টি হবে।

আরও মাস দেড় পরে একরাতে দরজাতে বাবার জোরে জোরে ধাক্কা মারবার আওয়াজে রূপার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পায়, মাম্পি তোর মায়ের শরীর খারাপ, তুই দরজা খোল।

একবার দুবার তিনবার। রূপা কিন্তু দরজা খোলে না। শুধু ভিতর থেকেই জোরে বলে ওঠে, শরীর খারাপ তো আমি কী করব? তোমাদের ব্যাপার, তোমরা বোঝো।

মিনিট পনেরো পরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘরের ভিতরে আরও কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিও বোঝা যায়। আস্তে, একটু নামাও। এইসব কয়েকটা কথাও কানে আসে। আরও কিছু সময় পরে আবার বাবার গলা পায়।

—মাম্পি, তোর মাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি। আলপনা থাকল, পারলে সকালে আসবি।

রূপা কিন্তু তার পরের দিন হাসপাতালে যায়নি। সকালে উঠেই টিউশন চলে গেল। বাড়ি ফিরে তাকে আরও গুম হয়ে থাকতে হল। ঘরভর্তি লোকজন। ঢুকতেই প্রশ্ন, তোর মা কেমন আছে জানিস? সে কী রে?

তারপরেও হাজারটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা। রূপা কোনওরকমে সবাইকে এড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুসময় পরে দরজাতে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুললে, পিসি ঘরের ভিতরে এসেই বলে উঠল, পড়তে গেছিলি?

—হ্যাঁ।

—তোদের রান্নার মেয়েটা বলল সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসবে। তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

—কেন?

—তোর মাকে দেখতে যাবি না?

—তোমরা যাচ্ছ তো।

—তোর মায়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

—ও।

—ও মানে! ডাক্তার বলেছে ক্রিটিক্যাল স্টেজ।

কিছু সময় চুপ থেকে রূপার কাঁধে হাত রেখে বলল, কাল ওটিতে ঢোকানোর সময়ে ওই ব্যথার মধ্যেও তোর নাম ধরে ডাকছিল। দাদাকে বলে, তুমি বাড়ি যাও, মাম্পি একা আছে। কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাবার সময় দরজাতে হাত রেখে বলে উঠল, তোর বোনটাও বাঁচেনি।

নিজের ঘরে এই প্রথম রূপা নিজে খুব একা হয়ে উঠল। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া ঢুকলেও তার গরম লাগছিল। ব্যাগটা কিছুসময় আগেই বিছানাতে রেখেছিল। এবার নিজের শরীরটাকেও বিছানাতে জড় পদার্থের মতো ফেলে রাখল। মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়…

মোবাইলে হিন্দি গান বেজে উঠল। একবার, দুইবার তিনবারের বার মোবাইলে চোখ রাখল। স্ক্রিনে চাঙ্কির ছবি দেখা যাচ্ছে।

—বল।

—বাড়িতে কেউ নেই তো, স্কুলে আসবি?

—কেন?

—আমারও বাড়ি ফাঁকা।

—একটু ব্যস্ত, পরে কল করব।

ফোনটা কেটে বিছানাতে মুখ নীচু করে কিছুসময় শুয়ে থাকল রূপা। পিসির কথাগুলো কানে বাজছে। কিছুসময় পরেই বিছানাতে উঠে বসল। বাইরে একটা আওয়াজ আসছে। সবাই বেরোচ্ছে। রূপা ফোনটা সাইলেন্ট করে জোরে বলে উঠল, পিসি… তোমরা কখন যাবে? আমি রেডি।

 

 

পিরামিড (প্রথম পর্ব)

অঘটন বিভিন্ন রকমের হয়। সবই যে শরীর ধ্বংস করে বা হাত পা মাথা কাটে এমন নয়, মাঝে মাঝে এই অঘটন একটা অদ্ভুত আনন্দও দেয়। আনন্দের ধারণাটাও আপেক্ষিক, তাই একই ঘটনা এক পরিবারের একজনকে আনন্দিত করলেও অন্য আরেকজনকে দুঃখিত করে। সমস্যা হল এই দুঃখ আবার প্রকাশ করা যায় না, ঠিক যেমন রূপার হল।

ক্লাস টুয়েলভে পড়বার সময় একদিন রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বাবার গুজুরফুসুর কানে এল। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনওদিন এইভাবে বাবা-মা আড়ালে ফিসফাস করেছে বলে কোনও কিছু চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কী করে— তিনজনের সংসারে ঝামেলা বলতে শুধুমাত্র স্কুল আর অফিসের ভাত দেওয়া নিয়ে। তাও তো অর্ধেক দিন বাবাকে আগের দিনের রান্নাই গরম করে দেয়। বাবা অম্লান মুখে খেয়ে নেয়। মায়ের টুকটাক ঠুসঠাস যা হয়, তা রূপার সঙ্গে।

সরাসরি মা বা বাবাকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, তোমরা কী সব চুপিচুপি আলোচনা করছিলে? বাবা চুপ থাকলেও মা হয়তো রেগে যাবে। তাই জানার ইচ্ছে থাকলেও চুপ করেই থাকতে হল। কয়েকদিন পরেই অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

স্কুল থেকে ফেরবার সময় কমার্স সেকশনের অমৃতা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, কী রে খবরটা দিসনি তো?

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল রূপা। চয়ন মানে চাঙ্কির সঙ্গে ঘোরাঘুরি নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করে। রূপা উত্তরও দেয় আবার দেয়ও না। তবে অমৃতাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে, কোন খবরটা রে?

—সে কী রে, তোর নাকি ভাই বা বোন হবে? বেশ ভালো, তবে এজ গ্যাপটা একটু বেশি হয়ে যাবে।

রূপা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, কী বাজে বকছিস?

—বাজে নয় কাজের কথাই বলছি, তুই খবর না দিলেই বা কী! আমি ঠিক খবর পেয়ে গেছি। কবে ট্রিট দিবি বল?

আকাশ থেকে পড়ল রূপা, চারপাশটা দেখে গম্ভীর ভাবেই বলে উঠল, তোকে কে বলল?

—মা-বাবা আলোচনা করছিল, আমি শুনেছি। তোর মা আমার মাকে বলেছে।

সব শুনেও রূপা কিছু সময় কোনও কথা বলতে পারল না। রাস্তার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তাহলে গুজুরফুসুর মানে এইসব। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবা অফিস কামাই করে মা-কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিল, তার মানে ভিতরে ভিতরে এতদূর সবকিছু হয়ে গেল, আর কিছুই জানা গেল না। নিজের ওপরেই রাগ হল রূপার। অমৃতাকে বলল, আমার একটু তাড়া আছে। তারপরেই তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।

বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকতেই চোখ ফেটে জল এল। কারওর সঙ্গে কোনও কথা না বলে দরজা বন্ধ করে সন্ধে পর্যন্ত বসে রইল। মাঝে মা কয়েকবার এসে, কী হয়েছে? কেন এমন করছিস? এসব জিজ্ঞেস করল। স্কুলে বা টিউশনে কোনও কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল। রূপম নামের সেই ছেলেটা আর বিরক্ত করছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল।

সব প্রশ্নেরই এক উত্তর, না, কিছু হয়নি। কেউ কিছু করেনি। তুমি যাও। সন্ধের পর বাবা এসেও জিজ্ঞেস করল কিন্তু এবারেও উত্তর পেল না।

সমস্যা আরও বাড়ল। খেতে বসবার সময়। রূপা প্রথমে তো আসতেই রাজি হচ্ছিল না। পরে বাবার কথা শুনে খাবার টেবিলে এলেও খাবার নিয়ে বসে রইল। বাবা-মা দুজনে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, রূপার দুচোখ দিয়ে জল নেমে এল।

কিছুসময় পর রূপা কাঁদতে কঁদতেই বলে উঠল, আমার নাকি ভাই-বোন কিছু একটা হবে?

—কে বলল তোকে? কথাটা মা কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর বলল।

—কে বলল জানতে হবে না। সত্যি না মিথ্যা সেটা বলো।

বাবা এবার লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ, চারমাস চলছে।

—আর ইউ ম্যাড, অর স্যাভেজ ইললিটারেট?

মা কোনও উত্তর না দিয়ে গালে এক চড় কষিয়ে দিল। আচমকা আসা এই আঘাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কিছুসময় পরেই গালে হাত বোলাতে বোলাতে রূপা বলে উঠল, আমাকে চড় মারলে কিন্তু পাড়ার সবাই, ফ্ল্যাটের সবাই? ছিঃ ছিঃ করছে তোমাদের। কজনকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করবে।

সেই রাতে আর কারওরই খাওয়া হল না। পরেরদিন সকালে উঠেই বাবা রূপাকে চায়ের টেবিলে ডেকে বলল, দেখ তুই বড়ো হয়ে গেছিস। আজকের যুগের মেয়ে তুই, আসলে ঘটনাটা খুবই সাডেন। এমনকী তোর মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি।

—বোকা বোকা কথা বোলো না বাবা। তুমি বুঝতে পারোনি দ্যাটস ওকে, বাট মা!

—তোর মায়ের একটা প্রবলেম আছে সেটা তো জানিস। তোর সঙ্গে ডাক্তারও দেখাতে গেছিল।

—আমি বুঝতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা তোকে বলব না। তোর আমি ইয়ার দোস্ত না। আমরা মা-কাকিমাদের কখনও এইসব কথা বলবার সাহস পেতাম না। কথাগুলো একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল মা।

—তোমাদের কথা আলাদা মা।

—আলাদা মানে কি? মা-বাবার সঙ্গে এইসব কথা বলা?

—তোমরা কি এইসব কথা বলবার জন্য আমাকে ডাকলে, তাহলে আমি আসছি, কাজ আছে।

—কাজ মানে তো ফোনে ফটর ফটর করা।

—আমার এটাই বয়স। যে-বয়সে যেটা মানায়, সেটাই করতে হয়।

বাবা কিছুসময় চুপ থেকে মা-মেয়ের কথা শুনছিল। রূপার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল, ঠিক আছে, এবার বল তোর মতামত কী?

—হোয়াই শুড আই বাবা? ইউ হ্যাভ নট আস্কড মি বিফোর ডুইং দ্যাট।

—তা না, আমরা তো, মানে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

—দুর্ঘটনা! হাউ ফানি বাবা, দুর্ঘটনা মেড মাই মাদার প্রেগন্যান্ট।

—শোন ব্যাপারটা ঠিক ওইরকম নয়। আসলে আর বছর তিন পরে তোকে বিয়ে দিতে হবে, তার পরে তো আমরা একা।

—ইজ ইট এনি এক্সকিউজ? আমার বিয়ের পরে তোমার জামাই আসবে। কোথাও তো লেখা নেই বিয়ের পর মেয়েরা বাবা-মা-কে দেখবে না। তাছাড়া আমি বিয়ে করব কিনা সেটাও ঠিক নেই। তোমরা এত কিছু ভেবে এই বয়সে এরকম করে ফেললে?

—শোনো, মেয়ের কথা শোনো, তোমার প্রশ্রয়ে আজ এইরকম অবস্থা। আমার না হয় ভাই বোন নেই কিন্তু তোমার তো আছে। বুগি তোমার থেকে কত ছোটো?

—মা, ননসেন্সের মতো কথা বলো না। বুগি বাবার থেকে এগারো বছরের ছোটো, না জ্যাঠা বাবার থেকে বারো বছরের বড়ো, এটা নিয়ে কোনও কমপ্যারিজন হয় কি?

—ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে বলে কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবার বহর শোনো।

—মা, আমার শিক্ষা আমাকে তোমাদের সামনে এইভাবে কথা বলতে শিখিয়েছে। আর পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই সন্তান হলে বাবা-মায়ের ভুল বলা যাবে না।

শেষের কথাগুলো বলেই ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রূপা। বাবা একভাবে দরজার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার একটা জোরালো শ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়ে গেল বলো তো?

—তুমি বলো। তখন বারবার বারণ করেছিলাম, এখন সামলাও।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব