শর্ত

ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে শ্বেতার চোখটা আটকে গেল নাম আর পরিচিত ছবিটা দেখে। ষোলো বছর পর দেখছে। মুখের অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর নামটা দেখলেই বোঝা যাবে শ্বেতা চিনতে ভুল করেনি। হ্যাঁ, ওই তো পরিষ্কার লেখা নীলাঞ্জনা সাহা।

কলেজের দিনগুলোয় ফিরে গেল শ্বেতা। অভিন্নহৃদয় দুই বন্ধু অথচ সামাজিক স্থিতি অনুযায়ী সকলের কাছেই বড়ো বেমানান ওদের বন্ধুত্ব। নীলাঞ্জনা ধনী পরিবারের মেয়ে বনেদি ব্যাবসাদার ওদের চোদ্দোপুরুষ। আলিপুরের মতো জায়গায় ওদের বিরাট জমিশুদ্ধ চারতলা অট্টালিকা। সেখানে শ্বেতার বাড়িটা হচ্ছে কসবার ছোট্ট একটা গলিতে। ঘর বলতে মাত্র দুটি যেখানে মা-বাবা এবং আরও দুজন ভাইবোনের সংসার। বাড়ি মেরামতিতে কতদিন হাত পড়েনি শ্বেতা ঠিকমতো মনেও করতে পারে না।

কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতি দুই বন্ধুর মধ্যে কখনও দেয়াল হয়ে উঠতে পারেনি। বাধাহীন নদীর স্রোতের মতোই ওরা দুজনে বয়ে গেছে বন্ধুত্বের স্রোতে। শ্যামলা রঙের নীলাঞ্জনার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কোনও অভাব ছিল না। শ্বেতা এক কথায় সুন্দরী। টানা বড়ো বড়ো চোখ, নিজেকে নিয়ে ওর যত চিন্তা ভাবনা।

শ্বেতা মনে মনে নিজেকে সবসময় নীলাঞ্জনার সঙ্গে তুলনা করত আর নিজেকে ওর আরও হতদরিদ্র মনে হতো। একমাত্র নিজের সৌন্দর্যের প্রতি মনের মধ্যে একটা গর্ব ছিল। শ্বেতা বিশ্বাস করত, সৌন্দর্যের জন্যই ও একদিন ধনীবাড়ির বউ হতে পারবে। শ্বেতা সবসময় নীলাঞ্জনাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করত। ওর মতো ব্যবহার, আদবকায়দা, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু।

সেদিন নীলাঞ্জনার জন্মদিন ছিল। একটি পাঁচতারা হোটেলে সব বন্ধুদেরই নিমন্ত্রণ করেছিল নীলাঞ্জনা। সেখানেই ঋষির সঙ্গে নীলাঞ্জনা সকলের পরিচয় করাল। ঋষি নীলাঞ্জনার বাবার বন্ধুর ছেলে, যে-কিনা মুম্বই আইআইটি-র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ছুটিতে কলকাতায় উপস্থিত ছিল ঋষি। নীলাঞ্জনার বন্ধু হিসেবে জন্মদিনের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে এসেছিল। লম্বা-চওড়া সুন্দর চেহারার ঋষিকে দেখলে যে-কোনও পুরুষেরই হিংসা হওয়ার কথা।

সাধারণত যা হয়ে থাকে, এতগুলো মেয়ের একজায়গায় হয়ে হাসাহাসি, চ্যাঁচামেচিতে পুরো হলঘর জমজমাট হয়ে উঠেছিল। একমাত্র শ্বেতা চুপচাপ একটা কোণায় চেয়ারে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। ঋষির শ্বেতার উপর দৃষ্টি পড়তে নীলাঞ্জনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি চুপচাপ একা কেন বসে আছে? ওকেও ডাক না!

সঙ্গে সঙ্গে, নীলাঞ্জনা শ্বেতার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে তুলে এনে ঋষির সামনে দাঁড় করাল, আমার সব থেকে ভালো আর পুরোনো বান্ধবী শ্বেতা।

এরপর খাবার অর্ডার করা শুরু হল। অর্ধেকের বেশি খাবারের নাম শ্বেতা কোনওদিন শোনেইনি। ঋষি এসে শ্বেতার পাশে চেয়ার টেনে বসল। মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বেতার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, যেটা, আমি অর্ডার করছি আপনিও সেটাই করবেন।

ঋষির কথা শুনে শ্বেতা একটু আশ্বস্ত হল। শ্বেতার মতো মেয়ের সঙ্গে আলাপ ঋষির জীবনে প্রথম। ওর নিজের মা-বোন কত আলাদা। কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া, মুখ রাঙা হয়ে ওঠা, শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলা করা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে বসেও কপালে ঘাড়ে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠা, প্রসাধন ছাড়া নিখুঁত মুখমণ্ডল এ সব কিছুই ঋষির প্রথম দেখা।

রাত হচ্ছে দেখে নীলাঞ্জনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোর খোঁজে শ্বেতা হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এল। পেছনে ঋষিও এসে দাঁড়াল। একটু ইতস্তত করে ঋষি বলল, চলুন, আমার কাছে গাড়ি আছে, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এইসময় অটো করে যাওয়াটা খুব একটা সেফ নয়।

শ্বেতার কোনও জবাব না পেয়ে ঋষি বলল, ভয় নেই, আপনার বাড়ির দরজায় নামিয়ে চলে আসব। চায়ের জন্য আপনি বসতে বললেও বসব না।

অগত্যা শ্বেতা রাজি হয়ে গেল। গাড়িতে সারাটা রাস্তা চুপচাপই বসে রইল শ্বেতা। অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করতে পারছিল ও। বাড়ির দরজায় শ্বেতাকে নামিয়ে দিয়ে ঋষি চলে গেল। বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। প্রাণ খুলে আগে কেউ কখনও শ্বেতার সঙ্গে কথা বলেনি ঋষির মতো। ঋষির মুখটা আর কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্বেতার। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা স্বপ্নটা যেন এতদিনে সত্যি হতে চলেছে, বারবার এটাই মনে হতে লাগল শ্বেতার।

ধীরে ধীরে শ্বেতা নিজের সাজসজ্জার উপর বেশি নজর দিতে আরম্ভ করল। কলেজ ছাড়া বেশিরভাগ সময়টা পড়াশোনার বাহানা করে নীলাঞ্জনার বাড়িতেই কাটাতে আরম্ভ করল ও। নীলাঞ্জনা বুঝতে পারত ঋষিকে দেখতেই তাদের বাড়িতে শ্বেতার এতটা সময় পড়ে থাকা, যদি একটিবার ঋষি এখানে আসে। ঋষিকে খুব ভালো করেই চিনত নীলাঞ্জনা। ওর স্বভাব নীলাঞ্জনার অজানা ছিল না। শ্বেতার জন্য ও কষ্টবোধ করত!

একদিন থাকতে না পেরে নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে স্পষ্টই বলল, শ্বেতা, তুই ঋষির পিছনে ছুটিস না, ও হচ্ছে মায়ামৃগ। সবার সঙ্গেই ও আপনজনের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু বাস্তবে ওকে প্লেবয় বলাটাই বোধহয় সঠিক পরিচয় দেওয়া হবে।

কিন্তু শ্বেতার চোখে তখন ঋষি নামের ঘোর, যেটা সরতেই চায় না। নীলাঞ্জনার সাবধানবাণীও শ্বেতার মনে হল ঈর্ষাবশত। এইভাবেই নরমে গরমে ওদের তিনজনের বন্ধুত্ব এগিয়ে চলছিল। দুবছর এভাবেই কাটল অথচ এই দুই বছরে ঋষি একবারও শ্বেতার প্রতি বিশেষ ভালোবাসার কোনও দাবি জানাল না। কিন্তু শ্বেতা মনের মধ্যে নিজেকে উজাড় করে দিল ঋষির কাছে। ঋষি ছাড়া নিজের জীবনের কোনও অর্থই থাকল না শ্বেতার কাছে।

ওদিকে শ্বেতার চুপ করে সব মেনে নেওয়া, কথায় কথায় ঘাবড়ে যাওয়া ঋষিকে যেমন আকর্ষণ করত, তেমনি নীলাঞ্জনার আত্মবিশ্বাস, সহজে কোনও কথা মেনে না নিয়ে তর্ক করার অভ্যাসও সমান ভাবে ঋষিকে প্রভাবিত করত।

শ্বেতার কাছে ঋষি কোনও কমিটমেন্টে না গেলেও, শ্বেতার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, ঋষি একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওর কাছে অবশ্যই আসবে। দেখতে দেখতে কলেজ পার করে নীলাঞ্জনা ওর বাবার ব্যাবসায় ঢুকে পড়ল। আর শ্বেতা ঋষির প্রস্তাবের অপেক্ষায় দিন গুনতে আরম্ভ করল।

ফোনে দুজনের সবসময় কথা হতো। এরই মধ্যে ঋষি চাকরিও পেয়ে গেল। কিন্তু চাকরিটা নিয়ে ও খুব একটা খুশি হল না। আরও ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর মধ্যে। ঋষি ফোন করলেই প্রতিবারই শ্বেতা ওকে বলত, ওর বিয়ের প্রচুর সম্বন্ধ আসছে। ঋষি বুঝতে পারত না শ্বেতা কেন এইসব কথা ওকে বলে!

একদিন বিরক্ত হয়ে ঋষি শ্বেতার মুখের উপরেই বলে বসল, তুই কীরকম বন্ধু রে? আমি এদিকে ভালো একটা চাকরি খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুই তোর বিয়ে নিয়ে পড়ে আছিস! জানি তুই খুব সুন্দরী, তোর বরের অভাব হবে না। কে তোকে আটকাচ্ছে, কর না বিয়ে বলে ফোনটা কেটে দিল ঋষি।

শ্বেতার মনে হল, ঋষি নিজেকে অসুরক্ষিত ভাবছে এই ভেবে যে, শ্বেতার বিয়ে অন্য কোথাও না হয়ে যায়। খুশি হল শ্বেতা, যাক এবার তাহলে ঋষি দৌড়ে ওর কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাবটা দেবে।

একদিন হঠাৎ নীলাঞ্জনার ফোন এল ওর কাছে, আর্জেন্ট তলব। বাগানে ফুলের পরিচর্যা করছিল নীলাঞ্জনা, শ্বেতাকে দেখেই দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। শ্বেতা লক্ষ্য করল নীলাঞ্জনার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। শ্বেতাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে বলল, শ্বেতা, কাল আমার আশীর্বাদ। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলি না তো কার সঙ্গে?

শ্বেতার মুখ-চোখ মুহূর্তে কালো হয়ে গেল, কোনওমতে বলল, কেন ইয়ার্কি মারছিস। ঋষি তো বিয়ে নিয়ে এখুনি কিছু ভাবতে চায় না। ও নিজের মুখে আমাকে বলেছে।

শ্বেতার কথা শুনে নীলাঞ্জনা হেসে ফেলল। শ্বেতার চিবুকটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল, তুই বড্ড সরল রে শ্বেতা। ঋষি ওর নিজের ব্যাবসা আরম্ভ করেছে। আমার বাবারও তাতে পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিজনেস প্ল্যানটা আমিই ঠিক করে দিয়েছি। এটা বাবারই মাথায় প্রথম আসে, যখন আমাকে আর ঋষিকে একসঙ্গেই কাজ করতে হবে তখন একসঙ্গে জীবন কাটাতেই বা আপত্তি কোথায়।

শ্বেতা নিজেকে আর আটকাতে পারে না, চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তাহলে বল, তোরা টাকা দিয়ে ঋষিকে কিনে নিয়েছিস।

শ্বেতার কথাগুলো নীলাঞ্জাকে দুঃখ দিলেও নিজেকে ও সামলে নিয়ে সংযত স্বরে বলে, শ্বেতা, এটা ঋষির সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত। আমার বাবা ওকে কোনও জোর দেননি। এমনিই টাকা দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ঋষির কাছে সৌন্দর্যের থেকে নিজের কেরিয়ারের উন্নতি করাটা অনেক বেশি গুরুত্বের। তুই নিঃসন্দেহে সুন্দরী কিন্তু জীবনে এগোতে গেলে ক্ষমতা এবং স্মার্টনেসের দরকার যেটা সম্ভবত ঋষি আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে।

এটা হতে পারে না নীলাঞ্জনা। ঋষি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারে না! আর আমি, তোর থেকে সব বিষয়ে অনেক ভালো।

নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে ভালো করে লক্ষ্য করে। ওর মুখে ফুটে ওঠা হতাশা দেখে বলে, সব ঠিক হয়ে গেছে শ্বেতা। সৌন্দর্য সবার ফাস্ট প্রেফারেন্স না-ও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যারা সৌন্দর্যের থেকেও বুদ্ধি, আত্মবিশ্বাস এগুলিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আমার জন্যই ঋষি এই প্রোজেক্টটা শুরু করতে পেরেছে।

নীলাঞ্জনার কথাগুলো সহ্য করতে পারে না শ্বেতা। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় ও। বলে, নীলাঞ্জনা, তোর বাবা ধনী বলে তোর খুব অহংকার, তাই না? আর এই টাকার জোরেই তুই ঋষিকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিলি। কিন্তু তুইও আমার একটা কথা শুনে নে, আমার এই সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, বৈভব-কেও একদিন আমার দাস হতে হবে এবং এটা আমি তোকে করে দেখাব এই আমার প্রতিজ্ঞা তোর কাছে।

নীলাঞ্জনার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল, বলল, শ্বেতা তোর এই চিন্তাভাবনা অত্যন্ত অন্যায়। তবুও সেই দিনটার প্রতীক্ষা আমিও করব যেদিন তোর প্রতিজ্ঞা রেখে আবার তুই আমার সামনে এসে দাঁড়াবি।

সেই দিনের পর শ্বেতা, নীলাঞ্জনা এবং ঋষির অধ্যায়কে নিজের জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলল। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা ও ভুলল না। জীবনে একটাই লক্ষ্যকে ও স্থির করে নিল, যেমন করেই হোক ওকে ধনী হতে হবে। তার জন্য মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা সব সম্বন্ধ ও নাকচ করতে শুরু করল। যেটা শ্বেতার পছন্দ হতো সেখানে টাকার চাহিদা দেখে শ্বেতার মা-বাবা পিছিয়ে আসতেন। শ্বেতার মর্জিমাফিক ব্যবহারে ওর পরিবারের সকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল।

এই করতে করতে শ্বেতার বয়স তিরিশে পড়ল। হঠাৎ-ই কোনও এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে শ্বেতা, রাজেশ্বরী দেবীর চোখে পড়ে গেল। উনি নিজের ছেলের দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন। একমাত্র ছেলে বিকাশের প্রথম স্ত্রী, দুটি সন্তান রেখে মারা যায়। শ্বেতাকে দেখেই রাজেশ্বরী দেবীর পছন্দ হয়ে যায়। বনেদি ধনী পরিবার। অর্থের অভাব নেই, প্রযোজন শুধু একজন মায়ের যে ওই বাচ্চাদুটিকে সন্তানতুল্য মানুষ করতে পারবে।

শ্বেতার মা-বাবার কাছে অবশ্য রাজেশ্বরী দেবীর প্রস্তাব একেবারেই মনঃপূত হল না। নিজের সন্তানকে দোজবরে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁদের একেবারেই ছিল না। তার উপর পাত্রের বয়স প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই, যতই তারা ধনী হোক না কেন! তাছাড়া দুটি সন্তানের বাবা। কিন্তু শ্বেতাই আগ্রহ দেখিয়ে এই সম্বন্ধ স্বীকার করতে মা-বাবাকে বাধ্য করাল। বহুদিন পর এমন একটা সম্বন্ধ শ্বেতার মনের মতো হল। কারণ পাত্র কিংবা তার সন্তানের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ওর একমাত্র নজর ছিল বিকাশের অর্থ, বৈভবের প্রতি এবং ওর সামাজিক পদমর্যাদার প্রতি।

বিয়ের পর দশটা বছর কেটে গেছে। যে টাকার জন্য শ্বেতা বিয়ে করেছিল, সেই অর্থের কোনও অভাব ছিল না ওর। বিকাশের সন্তানরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। বিকাশকে শ্বেতা নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করত। শ্বেতার কথায় বিকাশ উঠত-বসত। তবুও শ্বেতার মনের মধ্যে একটা পুরোনো ব্যথা মাঝেমধ্যেই ওকে বিষণ্ণ করে তুলত।

বিকাশ সবসময় শ্বেতাকে হাতের চেটোয় রাখার চেষ্টা করত, তবুও ওদের সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর মতো নয় বরং ভৃত্য এবং মালিকের মতো ছিল। শ্বেতার মতো অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করত বিকাশ। স্ত্রীয়ের সৌন্দর্যের পূজারি হয়ে উঠেছিল ও, স্বামী হওয়ার কখনও চেষ্টা করেনি। বিকাশের সন্তানদের সঙ্গে শ্বেতা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখত। ওর নিজের কোনও সন্তান হয়নি এবং এই নিয়ে ওর মনে কোনও দুঃখও ছিল না। সন্তান না হওয়াতে পনেরো বছর আগেকার ছিপছিপে ধনুকের মতো শরীর শ্বেতার বজায় ছিল। আয়নায় যখনই নিজেকে দেখত শ্বেতা, একটা অহংকার বোধ জেগে উঠত ওর মনের ভিতরে।

আজ অনেকদিন পর নীলাঞ্জনার পরিচিত মুখটা ফেসবুকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সেটা ঈর্ষা না আনন্দ বুঝতে পারল না। নীলাঞ্জনা যেন দেখতে আগের থেকে আরও সাধারণ হয়ে গেছে কিন্তু ঋষি এখনও তেমনই হ্যান্ডসাম। হঠাৎ করেই আবার সেই পুরোনো অধ্যায় শ্বেতাকে নিয়ে চলল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়।

নিয়তি হয়তো একেই বলে। নয়তো নীলাঞ্জনা আর ঋষি কীভাবে আবার শ্বেতার জীবনে ফিরে এল। ঋষির ব্যাবসা সংক্রান্ত একটি জরুরি ফাইল বার করার ছিল যা কিনা একমাত্র বিকাশের সাহায্যেই করা সম্ভব ছিল।

অফিসে বিকাশ যখন জানতে পারল নীলাঞ্জনা এবং ঋষি ওর স্ত্রীয়ের কলেজের সময়কার বন্ধু, ও ঋষিদের নিজের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাল। শ্বেতা এতে মনে মনে খুশি হলেও বাইরে কিছুই প্রকাশ করল না। নিজের ঐশ্বর্য ওদের দেখাবার এমন সুযোগ কেই বা হাতছাড়া করতে চায়! তাছাড়া ঋষিকেও তো বোঝাতে হবে, শ্বেতাকে বিয়ে না করে ও কী হারিয়েছে আর কাচের টুকরোকে হিরে ভেবে তুলে নিয়ে গেছে। নিজের যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাসের উপর নীলাঞ্জনার অহংকারের সাক্ষী শ্বেতা নিজে। সুতরাং নীলাঞ্জনাকেও বোঝাতে হবে, জীবনের দাঁড়িপাল্লায় আজ শ্বেতার বৈভব, সৌন্দর্যের ওজন নীলাঞ্জনার তুলনায় অনেক বেশি।

সময়ের আগেই নীলাঞ্জনা আর ঋষি বিকাশদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ওরা দুজন পুরোনো স্মৃতিতে মাঝেমধ্যে তলিয়ে যেতে থাকলেও, শ্বেতার ব্যবহারে এটাই বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল যে, পুরোনো কথা আর কিছুই ওর মনে নেই।

কথার মাঝেই নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই শ্বেতা বলে উঠল, তুই কি চেহারা করেছিস! আগের থেকে কত মোটা হয়ে গেছিস। জিম-টিমে যাস না? নিজের ছিপছিপে শরীর প্রদর্শন করতে শ্বেতা শাড়ির আঁচল সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে আবার সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, উদ্দেশ্য একটাই কোনও ভাবে ঋষির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল শ্বেতার। ঋষির চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল নীলাঞ্জনার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং সম্মান।

নীলাঞ্জনা শ্বেতার কথায় মৃদু হেসে উত্তর দিল, শ্বেতা মা হওয়ার পর মেয়েদের ওজন এমনিতে বেড়েই যায়। তোর যখন নিজের সন্তান হবে তখন বুঝতে পারবি।

শ্বেতার মনে হল একটা থাপ্পড় মেরে কেউ ওর মুখ বন্ধ করে দিল। ওর মুখের গোলাপি আভা নীলাঞ্জনার কথায় ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। বিকাশের সঙ্গে ঋষি আর নীলাঞ্জনাও নিজেদের সন্তানের সম্পর্কে আলোচনায় মশগুল হয়ে গেল।

এই প্রথম শ্বেতা অনুভব করল, ও বিকাশের সন্তানদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। বিকাশকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু ওর সন্তানদের মা হয়ে উঠতে পারেনি।

খাওয়ার টেবিলে সকলে এসে বসলে শ্বেতা মনে মনে বলল, আমার রান্নার স্বাদকে ওরা উপেক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু এখানেও ও নিরাশ হল! রান্নায় এত তেল-ঝাল মশলার ব্যবহার দেখে নীলাঞ্জনা বলেই ফেলল, এত তেল-মশলা ব্যবহার কেন করিস শ্বেতা? বিকাশদার বয়স হচ্ছে তাছাড়া আমাদের সকলেরই এখন উচিত কম তেলের খাবার খাওয়া। সম্ভবত বিকাশের শরীরে মেদের প্রাচুর্য দেখেই নীলাঞ্জনার ওই উক্তি।

শ্বেতা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ওর রূপ, ঐশ্বর্য কেন ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারছে না। ওর প্রতি ওদের দৃষ্টিই নেই। ঋষি আর নীলাঞ্জনার সম্পর্কের রসায়ন যে-কোনও দম্পতির মনেই ঈর্ষার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে শ্বেতার মতো মহিলার মনে তো বটেই যেখানে শ্বেতার বিয়ে কেবল অর্থের জন্য হয়েছে। এছাড়া বিকাশের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

খাওয়া শেষ হলে ঋষি আর বিকাশ কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলতে বাগানে গিয়ে বসল। শ্বেতা নীলাঞ্জনাকে নিজের বিশাল ড্রয়িংরুমে বসিয়ে কফি আনতে ভিতরে চলে গেল।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে নীলাঞ্জনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শ্বেতার মনে হল এবার বোধহয় নীলাঞ্জনা ওর আতিথেয়তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। হঠাৎই বেশ জোরেই হেসে উঠল নীলাঞ্জনা। বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, শ্বেতা, এখনও কি তুই তোর প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে দিয়েছিস? মনে হচ্ছে তুই-ই জিতে গেছিস।

শ্বেতা উত্তর দিল না। কিন্তু ও বুঝে গিয়েছিল ও নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি। নীলাঞ্জনাদের কাছে ও হেরে গেছে। ওর সৌন্দর্য, বৈভব কিছুই ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দিতেই ও বিকাশকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আজ শ্বেতা বুঝতে পারছে, নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দেওয়া ওর পক্ষে কোনওদিনই সম্ভবপর হবে না। কারণ একজন স্ত্রীয়ের সাফল্য তার সৌন্দর্যে নয় বরং তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আর দৃঢ়তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেটা শ্বেতার বৈবাহিক জীবনে কোনও মান্যতা পায়নি।

কফি শেষ করে নীলাঞ্জনা, বিকাশ আর ঋষি যেখানে বসে, সেদিকে পা বাড়াল। শ্বেতার মনে হতে লাগল ওর অর্থহীন প্রতিজ্ঞা আজ ওকে এমন একটা মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে হয়তো সঠিক ঠিকানার দিশা ও কোনও দিনই খুঁজে পাবে না।

তিনে নেত্র

আগের মতো বাবু হয়ে বসলে মা, রানুমাসি দুজনেই আজকাল খুব বকে। অগত্যা বদলে গেল আমার বসার ঢং। কিন্তু সেবারই প্রথম দোলে, চুলের সিঁথির ফাঁকে ইচ্ছে করেই রেখে দিলাম একটু আবির রং। কেন জানি না!

আগে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হতো গরমের ছুটির আগে। সারা দুপুর আমাদের খুব লুডো খেলা হতো। আমার দাদার বন্ধু মৈনাকদা আসত আমাদের বাড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। এলোমেলো দাড়ি। সাজ-পোশাক পরিপাটি নয়, তবু চোখে একটা গভীরতা ছিল। আর কথায় ছিল জাদু। আমি তখন এর বেশি কিছু বুঝি না।

সেবছর ফাল্গুনে, টুটুমাসির বিয়েতে বর দেখে যেরকম ভালো লেগেছিল, সেরকম ভালো লাগে। আর ভালো লাগে আমার পাকা ঘুঁটি, দান পড়লেও মৈনাকদা কাটে না। আমার দাদা রেগে যায়, মৈনাকদা থামিয়ে দেয়। ঝগড়াও হতো মাঝেমধ্যে। সেটা ভুলে গেছি। সুযোগ পেয়ে জোড়া পাকা ঘুঁটি না খাওয়াটা আজও ভুলিনি।

চুল ঝাঁকিয়ে বেশ তবলা বাজাত মৈনাকদা। আমার সাথে সন্ধেবেলা অনেকদিন বাজিয়েছে। সেদিন আমার গান ভালো হতো না। শুদ্ধ স্বরগুলো নড়ে গিয়ে কড়ি-কোমলে লাগত। দাদা আমার থেকে দুবছরের বড়ো, তবুও আমি বড়ো হয়ে গেলাম আগে। কারণ মেয়েবেলায় ছেলেবেলাটা খুব ছোটো।

মাধ্যমিকের আগে দাদাকে বললাম, লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলো একটু বুঝিয়ে দিবি?

দাদার সামনে উচ্চমাধ্যমিক। দাদা বলল, কমার্স পড়তে পড়তে ওসব ভুলে গুলে খেয়ে দিয়েছি। মৈনাককে বলে দেব, ও দেখিয়ে দেবে।

পরদিন দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে শুরু হল আমার লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা। পরের বছর সরস্বতী পুজোয় নৃত্যনাট্যে স্টেজের পিছনে অন্ধকারে খুব অল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলাম আমরা। তবলা নিয়ে মৈনাকদা আর তার ঠিক পাশেই আমি লাফিয়ে গিয়ে বসেছিলাম। ভালো লাগত বসতে। পাঞ্জাবি পরেছিল ও। গায়ে গন্ধটা চোখ বুঝলে আজও পাই। একটা জিতে যাওয়া মানুষের গায়ের গন্ধ। ওটাই শেষ পাশে বসা। মায়ের সজাগ চোখ তারপর আর কোনওদিন, আমাদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি। বারান্দা থেকে ওর কলেজ যাওয়া দেখাটা, আমার আরও বেড়ে গেল। তবে স্বপ্নে অনেক কিছু দেখেছি, সেটা আমার একান্ত নিজস্ব। কাউকে বলা যাবে না।

আমার বাবা- মা দুজনেই চাকরি করে। রানুমাসি আমাদের সবসময়ে কাজের লোক, দেখাশোনা করে। মায়ের নির্দেশে, বেশি বেশি নজরে রাখে আমাকে। কারণ মৈনাক ভালো ছেলে হলেও, অর্থাভাবে ওদের টানাটানির সংসার। ওই বয়সে আমার কাছে সেটা অর্থহীন।

বিজয় দশমীর দিন ও প্রতিবছর আসত আমাদের বাড়ি। বাবা মাকে প্রণাম করত। দাদার সাথে কোলাকুলি করত। আর আমার সাথে চোখে চোখে যেটা হতো, শুধু সেটা নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। মা থালা সাজিয়ে মিষ্টি দিত। আমার, মামারবাড়িতে জামাই-ষষ্ঠীর কথা মনে হতো। মা বলত, দ্যাখ, মৈনাক কত ভালো ছেলে, যেমন পড়াশোনায়, তেমনি কি সুন্দর তবলা বাজায়।

আমার এই কথাগুলো ভালো লাগত না। এগুলো লোক ঠকানো। মৈনাকও বুঝত ভালো বিশেষণ পাওয়া সহজ। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার অনেক মাপকাঠি আছে। তবুও অবুঝের মতো হতাশ চোখে দেখত। আজকের মতো তখন এত মেলামেশার সুযোগ ছিল না। তখন ভালোবাসা বেশি ছিল, সাহস কম ছিল। এখন ঠিক উলটো। সাহসটা বেশি কিন্তু ভালোবাসাটা কম। আসলে বাধা-বিপত্তি না থাকলে কোনও কাজেই আনন্দ নেই।

ফল্গুর মতো একটা প্রেম বয়ে চলতে লাগল। পাড়ায় একটা চর্চা ছিল। কিন্তু কারও হাতেই কোনও প্রমাণ ছিল না। আসলে মৈনাক খুব ভীতু প্রেমিক। মৃদুমন্দ বসন্তবাতাসের মতো সারাদিন মন ভালো করে দেবে, অথচ প্রয়োজনে কালবৈশাখী হয়ে উঠতে পারবে না। না হলে এমএসসি পাশ করা একটা ছেলে তখনও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারছে না। নব্বইয়ের দশকে একটা মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগ নিতে পারে না।

আমার তখন গ্র‌্যাজুয়েশন হয়ে গেছে। আজকের যুগে হলে এটা জলের মতো সহজ। তবে সেটা হলে এ লেখাটাও হতো না, আর ভালোবাসার হয়তো মরণ হতো দু-ছক্কা দুই-এর সংসারের চাপে।

অনেক সাহস করে মৈনাক একদিন দেখা করেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। প্রেম বলতে ওই একদিন আমরা করেছিলাম। গল্পের শেষে আমি যখন বলেছিলাম, বাবা-মা কিন্তু কোনওদিনই তোমার সাথে বিয়ে দেবে না।

ও কোনও উত্তর করল না। শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে রইল। ও যদি সেদিন আমায় এই বিশ্বসংসারের সব ছেড়ে ঝাঁপ দেবার ডাক দিত, আমি সেদিন ওর বুকে মাথা রাখতাম। ঠিক-ভুল, সময় বিচার করত। সাগর ডাক না দিলে, শুধু নদীর পক্ষে এগিয়ে গিয়ে মেলা কঠিন। মনে মনে সেদিন-ই বুঝে গেলাম, এ প্রেম আমায় সারা জীবন বিরহ যন্ত্রণা দেবে। ওঠার আগে আমার হাত চেপে ধরল মৈনাক।

একটা কান্না আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল। আসলে প্রেম তো শুধু ভালোবাসা চায় না, সে রাগারাগি চায়, ঝগড়া চায়, দোকানের ফর্দ চায়, বাজারের ভুল চায়, মুখ-ঝামটা দিয়ে ভাত বাড়তে চায়, মায়ের মতো রাগ করে আলাদা শুতে চায়, মাঝরাতে আবার মশারির ভেতরে এসে সোহাগ পেতে চায়। এসবে প্রেমের মৃত্যু হয়, না সাফল্য আমি জানি না। এখন নিজে মা হয়ে বুঝি, প্রেমের সংসার আর সংসারের প্রেমে কত তফাত।

তারপর যা হবার তাই হল। আমার কিশোরীবেলার অবুঝ প্রেম সাপলুডোর সিঁড়ি পেল না, সাপের মুখে পড়ল। বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কত কলকাকলি, তার মধ্যে বিবাহ-সংগীত, গায়ে লাল বেনারসী, রজনীগন্ধা, আগের সব গন্ধ ঢেকে দিল। কত উপহারের নীচে চাপা পড়ে গেল মৈনাকের দেওয়া গীতবিতান। অচেনা এক পুরুষকে বন্ধু করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মৈনাকের জলছবির ওপর ধুলো জমতে থাকল।

বুঝতেই পারলাম না, কখন আমার ভেতরের দুদিকে দোল খাওয়া দু-বিনুনির ছটফটে মেয়েটা, মরে গিয়ে খোঁপায় পরিপাটি এক শান্ত বউ-এর জন্ম হল। এতদিনের গান-বাজনা, পড়াশোনা, সব টানটান বিছানা, রং মেলানো পর্দা, আর দুপুরের রঙিন কাপড় দিয়ে সেলাই করা বালাপোষের নীচে চাপা পড়ে গেল। কোলে এল মেহুল। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। সন্তান।

নব্বইয়ে দশকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে সন্তানের জন্য জীবন দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। স্কুল, কোচিং ক্লাস, নোট নেওয়া এসবই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। নিজের সব না-পারা ছেলেমেয়ের মধ্যে উসুল করে নেওয়া। জীবনের আয়নায় নিজের থেকে প্রতিবিম্বকে সুন্দর করে তোলা। মেহুলের নীচে চাপা পড়ে গেল আমার সব ঝাপসা অতীত।

আমার স্বামী মানুষটা খারাপ নয়। চাকরি ভালোই করে। মদ বা সিগারেট যেটুকু খায়, তাতে তাকে নেশাগ্রস্ত বলা যায় না। কর্তব্যে ফাঁকি নেই, তবে অমনোযোগিতা আছে। সুখ চারপাশে অনেক ছড়িয়ে আছে, একঘেয়েমির বিরক্তিও আছে। তবে সুপ্রিয় আমাকে খুব বিশ্বাস করে। শিকড় সমেত গাছ তুলে এনে অন্য মাটিতে বসালে যে অসুবিধাগুলো হয়, সেটা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম।

ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করে দ্বিতীয় পদবির বয়সও কুড়ি বছর হয়ে গেল। মেহুল এখন কলেজে পড়ে। আজকাল মেয়েরা, মেয়ে হওয়ার কষ্ট কমই বোঝে। একটা করে সন্তান, চারহাতে ঢাকা প্রদীপের শিখার মতো। আপন খেয়ালে বেড়ে উঠতে পারে। মেয়ে বলে কোনও আলাদা ভয় সমাজ এদের মনে ঢেলে দেয়নি। ফলে আমাদের থেকে খোলস ভাঙার ক্ষমতা এদের বেশি।

মেহুল একদিন কলেজ থেকে ফিরে বলল, মা জানো, আজকে একটা দারুণ ঘটনা হয়েছে। আমাদের কেমিস্ট্রি স্যার, এমডি আজকে হঠাৎ ক্লাসে আমাকে মার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তোমার নাম বললাম, আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করল। মা তুমি চেনো?

মুহূর্তে মনের ফুটো দিয়ে সব স্মৃতি ফিনকি দিয়ে উঠল। নিজেকে সংবরণ করলাম। শান্ত ভাবে বললাম, ওনার পুরো নাম কি?

মেয়ে বলল, মৈনাক দত্ত, দারুণ পড়ায়।

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, তোমার মামার বন্ধু। বলেই অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে নিলাম। আমাদের প্রজন্মের, এ ভয়, না মরলে যাবে না। নিজের গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহকে মানুষ চিনতে যাচ্ছে, অথচ একজন পুরুষকে আমি চিনতাম, সে কথা স্বীকার করার সৎসাহস আজও অর্জন করতে পারলাম না।

মেহুল রোজ এসে মৈনাকের গল্প বলত। ও বিশ্বাসই করতে চাইত না যে, মৈনাক ওর মামার বন্ধু! আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, মামার থেকে এত ছোটো দেখতে লাগে কেন?

আমি ওকে কী করে বোঝাব আমার মৈনাকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। এখন শুধু একটাই আপশোশ করি, মেহুলকে একটু সুপ্রিয়র মতো দেখতে হল না কেন। যত বড়ো হচ্ছে একদম অবিকল আমি। শুধু হাঁটাটা আলাদা। দুদশক আগে আমাদের হাঁটায় শাড়ি পরে যে-সলজ্জ ভাবটা ছিল, সেটা এখন জিন্সে অনেক আধুনিক আর সাহসী।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সুপ্রিয় তখনও ফেরেনি, মেহুল ওর নিজের ঘরে, আমি বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ মেহুল এসে বলে, মা স্যার ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।

আমি ইশারায় বললাম, বল মা টয়লেটে, পরে কথা বলবে।

আমার খুব রাগ হল, ও এরকম বোকার মতো করছে কেন? আসল সময়ে সাহসের খোঁজ নেই। এখন এসব করার কোনও মানে আছে। এখনকার মেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান। কিছু যদি আন্দাজ করতে পারে কী বাজে হবে ব্যাপারটা!

স্যারের সাথে মেহুলের সম্পর্ক আরও কাছাকাছি আসতে লাগল। মেহুলকে কলেজের পর অনেক জায়গায় খাওয়াতে নিয়ে যায়। লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ দুজনে সময় কাটায়। কেমিস্ট্রির অনেক বই, নোটস দিয়েছে মেহুলকে। কিন্তু আমার যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। না পারছি, সুপ্রিয়কে সব খুলে বলতে… না বারণ করতে পারছি, মেহুলকে। তবে ফোনে আর কোনওদিন আমার সাথে কথা বলতে চায়নি। হয়তো বুঝে গেছে, আমি পছন্দ করছি না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেহুলের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে মেহুলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বারণ করে দিই। এতে মেহুল জানতে পারলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। এই নিয়ে অশান্তি আমার বাড়তেই থাকল।

সেদিন পঁচিশে বৈশাখ। আমি টিভিতে গান শুনছি। মেহুল সকালে উঠে বলল, মা, তোমার লালপাড় হলুদ শাড়িটা পরে আজকে কলেজ যাব। রবীন্দ্র-জয়ন্তী আছে।

আলমারি থেকে বার করে দিলাম। লাল ব্লাউজটা হালকা সেলাই করে দিলাম। শাড়ি পরে মেহুল এসে যখন সামনে দাঁড়াল, তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। এতদিনে মা হয়ে বুঝিনি, মেহুল হঠাৎ মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে মেয়েকে কলেজ পাঠালাম। সুপ্রিয় তখনও ওঠেনি। এক ঠ্যালা দিয়ে বললাম, তুমি এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো।

ও ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, কার?

আমি রেগে বললাম, তোমার।

এবার ও ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে বলবে তো?

ওকে বুঝিয়ে বললাম, এবার মেয়ের বিয়ের খোঁজখবর শুরু করতে হবে, কথা বললেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। সময় ঠিক কেটে যাবে। ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে দিয়ে দেব। তারপর পড়তে চাইলে, বিয়ের পর পড়বে।

ও ধামাচাপা দেওয়ার মতো বলল, ঠিক আছে।

সন্ধেবেলা মেহুল ফিরে এল। হই হই করতে করতে ঘরে ঢুকল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা স্যারকে পাঞ্জাবি পরে কী লাগছিল! মনেই হয় না স্যারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। কী দারুণ তবলা বাজাল! আমার নাচের ভিডিওটা দ্যাখো। এই বলে আমাকে অনুষ্ঠানের সব ছবিগুলো দেখাতে লাগল। হঠাৎ একটা ছবিতে মৈনাককে দেখলাম। একইরকম আছে। শুধু চোখে একটা পুরু কাঁচের মোটা ফ্রেমের চশমা।

মেহুলকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের স্যারের চোখে খুব পাওয়ার?

মেহুল বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠল, হ্যাঁ স্যারের তো গ্লুকোমা আছে, আর তো বছর দুয়েক হয়তো দেখতে পাবে, ডাক্তার বলে দিয়েছে। স্যার আমায় সব গল্প করে, স্যার তো কলেজে পড়ার সময়ে জানত। কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে একবারে অন্ধ হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো স্যার বিয়ে করেনি।

সেদিন গভীর রাত। সবাই শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। আমি মেহুলের ঘরে ঢুকে মৈনাকের নাম্বারটা নিলাম। ফোন করলাম মৈনাককে। গভীর রাতে সবার গলাই খাদে নেমে যায়। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় ভেসে এল,

হ্যালো…।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। আস্তে করে বললাম, মালবিকা।

কেমন আছো? একবার শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।

তোমার চোখের কথা শুনলাম।

ও কিছু না। আমি তো ওটা পঁচিশ বছর আগেই জানি। শুধু চিরকালের মতো আলো নিভে যাওয়ার আগে, একবার তোমাকে দেখতে চাই। ওটা আমার অন্ধকারের ভেতরটা আলো করে রাখবে।

আমি যাব, রাখলাম।

সারারাত আমার ঘুম এল না। দেখলাম, একটা গোটা রাত কত গভীর, কত অন্ধকার। বারবার মনে পড়ছিল, মৈনাকের লেখা কবিতার চারটে লাইন,

আমি আজ দুঃখ দিয়ে নেশা করব,

আমার কান্নায় আফিমের কারবার;

তবু…, তুমি জ্যোত্স্না মাখলে না, মহাকাশে

রটিয়ে দিয়েছি স্পর্শহীন প্রেমের ইস্তেহার।

পরদিন সকালে উঠে চা করে ওদের ডাকলাম। সুপ্রিয়র সুগার আছে, ও চিনি দিতে বললে, আমি রাগারাগি করি। আজ আমি ভুল করে ওর কাপেই দুচামচ চিনি দিয়ে দিলাম। শরীর ভারী লাগছে। কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করছে না।

মেহুলকে বললাম, তোর কলেজে একদিন যাব।

মেহুল জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মিষ্টি মা।

মালবিকা ভাবতে লাগল… চোখ কী শুধু দেখার, না কাঁদার!

অস্বাভাবিক

মাথার উপর বনবন করে ঘুরছে পাখাটা। চলছে টিভিটাও। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে চলেছে অনবরত। হঠাৎ ঘুমের ঘোর কাটলো সায়কের।

আধখোলা জানলা দিয়ে সকালের মিঠেকড়া রোদের এক ঝলক এসে পড়েছে সায়কের ঠিক চোখের উপর। তাই চোখ খুলতে সময় লাগলো তার।

রিমোটটা খুঁজে নিয়ে বন্ধ করলো টিভিটা। ততক্ষণে  মোবাইল ফোনটা বাজা বন্ধ হয়ে গেছে।

বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হাতে-পায়ে ঠেকল উলটানো গেলাস, চিপস-এর প্যাকেট, জলের বোতল ইত্যাদি। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, আটটা বেজে দশ মিনিট।

আবার বাজছে মোবাইল ফোনটা। সায়ক দেখলো, অরুণিমা-র কল।

—হ্যাঁ বলো…

—-আগে দু’বার কল করেছি, ধরোনি। ঘুমোচ্ছিলে নাকি ? কত বেলা হল। গতকাল সেই সন্ধে সাতটায় লাস্ট কথা হয়েছিল, মিটিং আছে বলে,সেই যে কথা বলা বন্ধ করলে…. ‘

এক নিঃশ্বাসে বলা অরুণিমার কথাগুলো শোনার পর সায়ক বললো, ‘না মানে রাতের দিকে আমার শরীরটা একটু খারাপ ছিল। ‘

—–বেশি গিলে ফেলেছিলে নাকি ? ক’পেগ ? মেয়েকে নিয়ে আমি বাবার বাড়িতে চলে এলে যা ইচ্ছে তাই করছো!

‘ না, ঠিক তা নয়। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না  কী করবো! ‘

——কী হয়েছে ?

‘তোমাকে তো বলেছিলাম, আমার আগের ছবিটা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ দেখে,এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা শর্ট ফিল্ম প্রযোজনা করবেন বলেছিলেন। কিন্তু তিনি হরর ফিল্ম পছন্দ করেন।’

‘তা এর মধ্যে অদ্ভুত ঘটনাটা এল কোত্থেকে ?’—- প্রশ্ন অরুণিমার।

‘না মানে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে যিনি সন্ধে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলেন,তিনি কি করে দিঘার কাছে সন্ধে সাতটায় পথ দুর্ঘটনায় পড়লেন!’

‘কী বলছো আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!’ …রাগত সুরে জানায় অরুণিমা।

‘আরে, সুরজিৎ বসু নামের ওই প্রযোজক ভদ্রলোকই তো গতকাল আমার সঙ্গে মিটিং করতে এসেছিলেন। জাতীয় সড়কের ধারে পেট্রোল পাম্প আছে তাঁর। গতকাল সন্ধে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলেন আমার সঙ্গে। এক কাপ চা-ও খেলেন। গল্প রেডি নেই জেনেও, ভরসা করে পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করে গেলেন! ‘

‘তারপর ?’——অরুণিমার আগ্রহ দ্বিগুণ হল এবার।

‘রাত আটটার সময় উনি চলে গেলেন। তারপর আমি একটু ‘রঙিন জল’ নিয়ে বসলাম গল্পটার প্লট ভাবব বলে। পান করতে-করতে টিভিতে খবর দেখছিলাম। হঠাৎ একটা খবর শুনে চমকে গেলাম! সন্ধে সাতটা নাগাদ দিঘার কাছে এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় নাকি প্রাণ হারিয়েছেন ব্যবসায়ী সুরজিৎ বসু। খবরে এও বলা হয়, পুলিস জানিয়েছে, মৃত ব্যক্তি এক পেট্রোল পাম্পের মালিক।’

সায়ক বলে চলে, ‘নেশার ঘোরে ছিলাম, তাই খবরটা শুনেই আমি পাগলের মতো ফোন করতে থাকি সুরজিৎ বাবুর মোবাইল ফোনে কিন্তু কোনও ভাবে কানেক্ট করতে পারিনি। আর তারপরেই আমি সম্ভবত সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম বিছানাতেই।’

‘এখনও তোমার নেশা কাটেনি, তাই ভুল বকছো। এমন আবার হয় নাকি! যাও বাথরুম-এ গিয়ে মাথায় জল ঢালো।’ —–অরুণিমা রেগে ফায়ার।

অরুণিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়ক বলে, আচ্ছা দাঁড়াও, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো, অ্যাডভান্স-এর চেকটা ড্রয়ার-এ রাখা আছে, ছবি তুলে পাঠাচ্ছি।’

চেকটা হাতে নিয়ে ছবি তুলে অরুণিমাকে পাঠাতে যাবে, ততক্ষণে ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে অরুণিমা।

সায়কের ফোনটা আবার বাজছে। স্ক্রিন-এ ভেসে উঠল প্রোডিউসার সুরজিৎ বসু-র নাম।

সায়ক চমকে উঠল! কাঁপা গলায় বললো, ‘হ্যালো…’

ওপ্রান্ত থেকে সুরজিৎ বাবুর গলা….’আমার মারা যাওয়ার খবরটা আপনিও শুনেছেন নিশ্চয়ই ? কিন্তু আমি মরি, বাঁচি যাই করি না কেন, ছবিটা বানাবেন অবশ্যই। বাকি টাকা ঠিক সময় মতো পেয়ে যাবেন আপনি।’—–বলেই একটু থামলেন, তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন ফোনের ওপ্রান্তে থাকা মানুষটা। আর সায়ক ঘেমে স্নান করার অবস্থা। হতবাক !

‘আরে ভাই কী হলো,বিশ্বাস না হয় খবরের চ্যানেল চালিয়ে দেখুন।’—-এই  পরামর্শ এলো ফোনের ওপ্রান্ত থেকে।

একপ্রকার ঘোরের মধ্যে টিভি খুলে খবরের চ্যানেল চালু করল সায়ক। খবরপাঠক বলে চলেছে……

‘গতকাল দিঘার কাছে গাড়ি দুর্ঘটনার পর দীর্ঘ সময় ধরে চলল মৃত্যু বিভ্রাট! একই নাম, একই পেশা। তফাৎ শুধু বয়স আর ঠিকানায়। যিনি মারা গেছেন, তিনি মাঝবয়সি, আর যাঁকে নিয়ে মৃত্যুর বিভ্রান্তি ছড়াল, সেই সুরজিৎ বসু বয়সে প্রবীণ। রসিকতার সুরে তিনি জানিয়েছেন, পুনর্জন্ম হয়েছে তাঁর, বেড়ে গেছে আয়ু।’

খবর শোনার পর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সায়কের। টিভিটা বন্ধ করল। ওর কানে তখনও মোবাইল ফোনটা ধরা রয়েছে।বললো, ‘হ্যালো ….’

ওপ্রান্ত থেকে হাসতে হাসতে ….. ‘ কী সায়কবাবু, কী শুনলেন ?’

‘কী কাণ্ড বলুন তো!’ ….সায়কের মুখে হাসির ঝলক।

‘পুরো ভৌতিক কাণ্ড !’ বললেন সুরজিৎ।

‘বাঃ ! ফ্যান্টাস্টিক। আমাদের শর্ট ফিল্ম-এর নাম রাখব—- ভৌতিক।’

——–আর, স্টোরি ?

——–স্টোরিলাইনও তো পেয়ে গেলাম এই সুবাদে।…. বলেই হাসতে থাকল সায়ক।

——–তাহলে আর অপেক্ষা কিসের ? প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। বেস্ট অফ লাক। হাঃ হাঃ…..

‘ধন্যবাদ।’ ……বলেই ফোনটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ‘ ইউরেকা ‘ বলে সায়ক ডুব দিল ভাবনার গভীরে।

অভিনয়

সন্ধে ছুঁই-ছুঁই। রাস্তার ধারে বাতিস্তম্ভের আলোগুলি জ্বলে উঠছে ক্রমশ। ঘোলাটে আলো  ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। যানবাহন আর লোকজনের কোলাহলকে সঙ্গী করে ঋক হেঁটে চলেছে ফুটপাত ধরে। বৈঠকখানা বাজার অঞ্চলের ভিড় ঠেলে বেশ জোরে-জোরে হাঁটার চেষ্টা করছে ঋক।

‘নবদিগন্ত নাট্যসংস্থা’-র অফিসঘরের দরজার সামনে ঋক যখন পৌঁছোলো,এক অদ্ভূত উদ্বেগে ততক্ষণে ঘেমে গেছে সে।

কলিংবেল টিপল ঋক। দরজা খুললেন বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ও নির্দেশক প্রাণেশ  মুখোপাধ্যায়। ঋককে দেখে কিছুটা চমকে গেলেন তিনি।  ‘কী ব্যাপার, রিহর্সাল রুম-এ না গিয়ে তুমি হঠাৎ এই অফিসঘরে? ‘

‘স্যার, খুব বিপদে পড়ে এলাম এখানে । ট্রেন-এর মান্থলি টিকিটটা হারিয়ে ফেলছে আমার বন্ধু। টিটি ধরেছে। ১২০০ টাকা ফাইন করেছে তর্ক-বিতর্ক হওয়ার কারণে। এখনই না দিলে অ্যারেস্ট করে কোর্টে চালান করে দেবে বলেছে। আমাকে ফোন করে সাহায্য চাইল। কিন্তু, গাড়ি ভাড়া বাদ দিলে, আমার কাছে মাত্র ২০০ টাকা আছে। স্যার,প্লিজ আমাকে ১০০০ টাকা দিন, কাল এসে ফেরৎ দিয়ে যাব।’—-কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে ব্যক্ত করল ঋক।

‘আরে শান্ত হও। তুমি তো ঘেমে গেছো পুরো! দাঁড়াও, দিচ্ছি টাকা।’

মানিব্যাগ বের করে প্রাণেশ এবং সুমিতাভ মুখোপাধ্যায় দু’জনে ৫০০ করে মোট ১০০০ টাকা  ঋকের হাতে তুলে দিলেন। প্রাণেশ বললেন, ‘ফাইনটা দিয়ে তুমি রিহার্সাল রুম-এ চলে এসো।’

আধা ঘন্টা পরে ছকু খানসামা লেন-এর মহড়াকক্ষে ঋক গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মহড়ায় যোগ দেয়নি। অন্য এক শিক্ষার্থীর হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, ‘শোনো সায়ন, আজ রিহার্সাল করতে পারছি না, এই চিঠিটা দুই স্যার-এর মধ্যে কোনও একজনের হাতে দিয়ে দিও প্লিজ।’

সায়ন আশ্বস্ত করার পর, মহড়াকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে  হস্টেল-এর উদ্দেশে রওনা দেয় ঋক।

শিয়ালদহ থেকে বাসে নেতাজি নগর পৌঁছোতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগল ঋকের। বাসে থাকাকালীন একটা বিষয় ভেবে,বারবার হাসি পাচ্ছিল তার কিন্তু একা-একা হাসলে লোকে পাগল ভাবতে পারে, অতএব, মুখে হাত ঢাকা দিয়ে খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছিল সে। তাই, হস্টেল-এ নিজের ঘরে ঢুকে, জুতো, জামাপ্যান্ট না ছেড়ে, বিছানায় শরীরটাকে অর্ধেক এলিয়ে দিয়ে হেসেই চলেছে ঋক।

হাসিটা আসলে অভিনয় সাফল্যের। কোনও মঞ্চে কিংবা রুপোলি পর্দায় ভালো অভিনয় করে প্রশংসা কিংবা পুরস্কার পেয়ে নয়। কিন্তু ঋক আজ এমন এক অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছে, যার সাফল্যে সে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ায় মতো আনন্দ উপভোগ করছে।

এরই মাঝে ঋকের মোবাইলটা বেজে উঠল।

সায়নের ফোন।

হাসি চেপে রেখে ঋক বলল, হ্যাঁ, সায়ন বলো—-কী ব্যাপার—–

…….গুরু, চিঠিতে কী লিখেছো ! প্রাণেশ স্যার পড়ার পর,সুমিতাভ স্যারকে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাক্কা শয়তান ছেলে।’

হাসতে হাসতে ঋক জিগ্যেস করল সায়নকে, ‘আর সুমিতাভ স্যার চিঠি পড়ে কী বললেন?’

‘কিছু বললেন না, সিগারেট আর দেশলাইটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।’

সায়নের ফোনটা ছাড়ার পর ঋকের হাসি দ্বিগুণ হল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজের হাতে লেখা সেই চিঠির বয়ান…….

মহাশয়দ্বয়,

মহড়ার খরচবাবদ প্রথম মাসে ৫০০ টাকা আমার থেকে নিয়েছিলেন আপনারা। চলতি মাসেও ৫০০ টাকা চেয়েছিলেন। টিউশন-এর টাকা পেলে দিতামও হয়তো। কিন্তু, প্রায় দেড় মাস ধরে দেখলাম, খবরের কাগজে প্রতি সপ্তাহে ‘অভিনেতা চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে শুধু টাকা কামাচ্ছেন,নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্য যে নেই, এটা বেশ বুঝতে পারলাম। কিন্তু এ তো এক রকম প্রতারণা ! তাই, এ মাসে আর ৫০০ টাকা খোয়াতে চাইলাম না। পরিবর্তে, যা দিয়েছিলাম আর  আমার যাতায়াতের খরচ বাবদ আরও ৫০০ টাকা, অর্থাৎ মোট ১০০০ টাকা আজ আদায় করে নিয়ে এলাম।

আসলে কী জানেন স্যার, অন্যায় যে একেবারেই সহ্য করতে পারি না, তা আজ শৈল্পিক দক্ষতায় প্রমাণ করে এলাম।

আশাকরি, মনে রাখবেন আমাকে।

——–

অন্ধের দিনরাত্রি

এস্থার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে হয়তো অ্যালার্ম-টা বাজছে। এত তাড়াতাড়ি সকালে ওঠার অভ্যাস আগে একেবারেই ছিল না। সকাল আটটার আগে ওর ঘুমই ভাঙত না। কিন্তু এখানে এটা শোভনীয় নয়! এটা শ্বশুরবাড়ি। মাত্র দুদিন হল তার বউভাত হয়েছে। একেবারে নতুন বউ। কিন্তু এ-বাড়ির প্রতিটা সদস্য যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, এস্থারেরও মনে হচ্ছে, পরিবর্তে ওদের জন্যও তার কিছু হলেও করা উচিত।

প্রসূনের মুখেই শুনেছিল, প্রসূনের মা সুনন্দা খুব সকালে উঠে পড়েন সংসারের কাজ সামলাতে। সুনন্দার নাকি ওটাই বরাবরের অভ্যাস। এস্থার দেখল ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, তার মানে শাশুড়ি এতক্ষণে উঠে পড়েছেন। বাড়ির সকলের সকাল সকাল চা পানের অভ্যাস। সেও তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক বদলে চোখমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

এস্থার কল্পনাও করেনি প্রসূনের মা-বাবা এত সহজে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন। কারণ সব সময় প্রসূনের মুখে শুনেছে, এদের পরিবার খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ আর সেখানে এস্থার খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে কিন্তু বউভাতের দিনই তার মনের এই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি, ও অন্য ধর্মের এবং ভিন্ন জাতের।

জাতি, ধর্ম কখনওই স্নেহ, ভালোবাসার মধ্যে দেয়াল হয়ে উঠতে পারে না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রসূনের পরিবার। এই সবই ভাবতে ভাবতে এস্থার রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, হুঁশ ফিরল প্রসূনের একমাত্র পিসির চিৎকারে, আরে আরে… বউমা এ কী অনর্থ করতে যাচ্ছো…।

প্রসূনের বিধবা পিসি সুমিত্রা বেশিরভাগ সময়ে নিজের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের সংসারেই পড়ে থাকেন। সকাল সকাল উঠে পড়েন এবং হাতে জপের মালা নিয়ে একটা ধুনুচি জ্বালিয়ে আসন পেতে হলঘরটায় বসে থাকেন। ভান করেন জপ করছেন কিন্তু আসলে নজর রাখেন বাড়ির কে কী করছে। হলঘরটা থেকে সব ঘরগুলো পরিষ্কার দেখা যায়।

সুমিত্রার চিৎকারে, ভাইয়ের বউ সুনন্দা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। এস্থারও হঠাৎ পিসিমার চিৎকারে স্থানুবৎ রান্নাঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।

সুনন্দা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই পিসিমা এস্থারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই বাড়িতে পা দিয়ে তুমি আমার ভাইয়ের নাক কাটিয়েছ সমাজে। জাত-কুল সব নষ্ট হয়েছে। এখন আবার স্নান না করেই রান্নাঘরে ঢুকে আমাদের ধর্মও নষ্ট করার ইচ্ছে রয়েছে? ধর্ম নিয়ম বলে কিছু আছে তো নাকি? অবশ্য তোমরা মোমবাতি জ্বালানো ছাড়া আর কী-ই বা জানো? কিন্তু সুনন্দা, তুমি… তোমার তো এই পরিবারে এতগুলো বছর কেটে গেল, এখনও কি তুমি নিয়মগুলো শিখতে পারলে না?

সুনন্দা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। পিসিমা আবার বলেন, বউমাকে বুঝিয়ে দাও এ সংসারের কিছু রীতি নিয়ম আছে। এখানে কী কী করা যাবে আর কী না, সেটা ওকে পরিষ্কার করে বলে দাও। ছেলের মোহ-তে এতটাও অন্ধ হয়ে যেও না যে বাড়ির পুরোনো নিয়ম বদলে ফেলতে হবে।

এস্থার ভয়ে রান্নাঘরের দরজাতেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম দুদিন সুনন্দা ওকে কোনও কাজ করতে দেয়নি। আজ এস্থার নিজে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল শাশুড়িকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কাল অবধি যে-পিসিমা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, আজ এমন কী দোষ করে ফেলল যে তার উপর পিসিমা এতটা রেগে উঠলেন?

সুনন্দা ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিলেন, ও তো একেবারে নতুন দিদি, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে হাতে করে সব শিখিয়ে দেব। এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।

হ্যাঁ শিখতে তো হবেই। তোমার ছেলে শুধু বেজাতের বউ-ই নয় অন্য ধর্মেরও মেয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সব শুনে সুনন্দা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে যেতে এস্থারকেও ইশারা করলেন সঙ্গে আসার জন্য।

ননদের চোখের আড়াল হতেই সুনন্দা, এস্থারকে কাছে টেনে নিয়ে স্নেহবশত ওর মাথায় হাত রাখলেন, দিদির কথায় কষ্ট পেও না। একটু কড়া কড়া কথা বলেন ঠিকই কিন্তু মনের দিক থেকে খুবই ভালো মানুষ। তুমি বরং স্নানটা সেরে নাও, ততক্ষণ আমি পুজোটা করে নিচ্ছি। তারপর দুজনে মিলে চা-জলখাবার করব, বলে সুনন্দা পুজোর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এত সকালবেলায় স্নানের কথা এস্থার ভাবতেও পারে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জিততে গেলে সকালেই তাকে স্নান করতে হবে। প্রসূন আগেই বলে দিয়েছে, এস্থারকে নিয়ে কোনও অভিযোগ পরিবারের মুখ থেকে শুনতে সে রাজি নয়। কারণ এই ব্যাপারে ও স্ত্রীকে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না।

 

সকালের ঘটনায় এস্থার কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে কোথাও যেন বাড়ির সদস্যদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার মনোভাব উঁকি মারার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এস্থার জোর করে মন থেকে নেতিবাচক মনোভাব সরিয়ে রেখে স্নানে চলে গেল। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখল সকলে খাবার টেবিলে এসে বসেছে।

শাশুড়িমা চা-জলখাবার বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে দিয়েছেন। সকলেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে। একা সুনন্দা সকলকে পরিবেশন করছেন। কেউ লুচি চাইছে তো কেউ তরকারি। কেউ আর এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ করছে। এমনকী সুনন্দার একমাত্র মেয়ে শিল্পীও মা-কে দুপুরে কী খাবে তার ফরমায়েশ জানাচ্ছে। বেচারি সুনন্দা একা হিমশিম খাচ্ছেন!

এসব দেখে এস্থার ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও মুখে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সকলের ওর উপর চোখ পড়লেও, কেউই মুখে কিছু বলল না। এমনকী প্রসূনও না! সুনন্দা রান্নাঘরে ছিলেন। সকলের ব্যবহারে এস্থার এতটাই মনে আঘাত পাচ্ছিল যে, ওর চোখে জল এসে গেল। সুনন্দা এস্থারকে দেখতে পেয়ে বললেন, এস্থার তুমিও চা খেয়ে নাও।

সুনন্দার কথা শেষ হতেই টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রসূনের ঠাকুমা বলে ওঠেন, বউমা, এখন তুমি বাড়ির বউ শুধু নও, শাশুড়ি হয়ে গেছ। সুতরাং তোমার দাযিত্ব এখন যে, ভুল করেও এমন কিছু কোরো না যেটা নিয়ে পরে তোমাকে পস্তাতে হতে পারে। এটা তোমার বাপের বাড়ি নয়, যেখানে সবকিছু সবাই মেনে নেবে।

ঠিক আছে মা, মাথা নীচু করে সুনন্দা উত্তর করলেন।

প্রসূনের ঠাকুমা আবার বললেন, আর একটা কথা বউমা, কাল আমার গুরুদেবকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছি। যা যা ব্যবস্থা করার সব করে রেখো। পুজোর সমস্ত সামগ্রী গুরুদেব নিজেই নিয়ে আসবেন। পুরো বাড়ি শুদ্ধ করে দেবেন এবং একই সঙ্গে এই ছুঁড়িটার নাম বদলে ওকেও শুদ্ধ করে দেবেন।

মায়ের কথা শুনেই সুমিত্রা জপের মালা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশ্বরের আরাধনায় সামান্য বিরাম টেনে জিজ্ঞেস করলেন, নাম বদলে… কিন্তু কেন?

তোরও কি জ্ঞানগম্যি সব লোপ পেল সুমি? ছুঁড়িটার নাম মুখে এলেও জিভ মনে হয় অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গুরুদেবও বলেছেন, নাম বদলালেই প্রসূনের বিবাহিত জীবন সুখময় হতে পারবে, ভবিষ্যতে নয়তো বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়াও ছুঁড়িটার কারণে পরলোকে আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর যে-কলঙ্ক লেগেছে, সেটাও গুরুদেব যজ্ঞ করে দূর করে দেবেন। ওনাদের ওখানে তাহলে আর নরকবাস করতে হবে না। একই সঙ্গে শিল্পীর বিয়ের জন্যও গ্রহশান্তির ব্যবস্থা করাবার কথা বলছিলেন গুরুদেব। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে যান সুনন্দার শাশুড়ি গায়ত্রীদেবী।

একটু দম নিয়ে এবার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রদীপ, ব্যাংক খুললেই সকাল সকাল গিয়ে এক লক্ষ টাকা তুলে আনিস। পুজোর জন্য লাগবে।

টাকার অঙ্ক শুনেই প্রসূনের বাবা আঁতকে উঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, মা এক লক্ষ টাকা, তাও শুধু পুজোর জন্য! একটু বেশি নয় কি?

ভাইয়ের কথা শুনে সুমিত্রা বলে উঠলেন, বেশি কোথায় রে ভাই। এটা খুবই কম! আমাদের পরিবারের উপর গুরুদেবের আশীর্বাদ রয়েছে। এছাড়া মা গুরুদেবের পরমভক্ত, তাই এতটা কমে এই পুজোপাঠ করতে রাজি হয়েছেন তিনি। তুই আর সুনন্দা তো ছেলের প্রতি অন্ধ হয়ে একটা বিধর্মী মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিস। তোদের জন্য আমাদের পরলোকগত পূর্বপুরুষদের সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে।

প্রসূন এতক্ষণ চুপ করে থেকে বাবার মুখে চিন্তার আনাগোনা লক্ষ করছিল। ও বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে বলল, বাবা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনব।

এস্থার অবাক হয়ে যায় প্রসূনের ব্যবহারে। এতদিন ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা করছে, প্রসূনের এরকম অন্ধবিশ্বাস আগে কখনও সে দেখেনি। সেই সঙ্গে প্রসূনের পুরো পরিবার এতটা শিক্ষিত এবং আধুনিক হয়ে কীভাবে এই অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার গারদে স্বেচ্ছায় বন্দি থেকে গেছে, সেটা এস্থারের কিছুতেই বোধগম্য হল না। তার খালি মনে হচ্ছিল, এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো কী করে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়েছিল।

 

আসলে এস্থারের এটা অজানাই ছিল যে, এই গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার তাকে বউ হিসেবে এইজন্যই মেনে নিয়েছিল, যাতে তাদের একমাত্র রোজগেরে ছেলে বিয়ের পরে আলাদা না থাকতে শুরু করে দেয়। তাছাড়া এস্থারও খুব বড়ো চাকরি করে। ফলে ছেলে, বউমা দুজনকেই প্রযোজনে কাজে লাগবে। এছাড়াও বাড়ির একমাত্র মেয়েরও বিয়ে দিতে হবে সুতরাং সেখানেও টাকার দরকার পড়বে।

এইসব নানা কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ এস্থারের খেয়াল হল যখন গুরুদেব আর গ্রহশান্তির কথা হচ্ছিল, তখন সে কথা শুনে শাশুড়িমা-র মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল আর শিল্পীর মধ্যেও একটা অস্থিরতা এস্থার টের পেয়েছিল।

যে-মেয়ে হেসে হেসে এতক্ষণ সকলের সঙ্গে গল্প করছিল, গ্রহশান্তির কথা শুনেই তার মুখের এই ভাবান্তর, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং শিল্পীর পিছনে সুনন্দারও চলে যাওয়াটা এস্থারকে ভাবিয়ে তুলছিল। এস্থারও একটু বসে নিজের ঘরে যেতে গিয়ে শিল্পীর ঘরের সামনে পৌঁছোতেই, সুনন্দা আর শিল্পীর কথোপকথন তার কানে এল।

শিল্পী বলছে, মা আমি গ্রহশান্তির জন্য কিছুতেই পুজোয় বসব না, তাতে আমার বিয়ে হোক আর নাই হোক।

সুনন্দা মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে বলছেন, শিল্পী, ঠাকুমা আগে থেকেই তোমার গ্রহশান্তির জন্য গুরুদেবকে বলে রেখেছেন, সুতরাং তোমাকে তো পুজোতে বসতেই হবে। এই পুজোর ফলে তোমার ভালো বাড়িতে বিয়ে হবে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সব ভালো হবে।

এস্থার আর অপেক্ষা করতে পারল না, দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে এল। শাশুড়িকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, মা কী হয়েছে, গ্রহশান্তির কথা শুনে শিল্পী এত কাঁদছে কেন? সুনন্দা উত্তর করলেন না। একই ভাবে মেয়েকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

হঠাৎই শিল্পী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সুনন্দার উপর চেঁচিয়ে উঠল, মা তুমি কেন বুঝতে পারছ না, পুজোর পর প্রতিবার আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সারা গায়েহাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে। মা, আমার ভীষণ ভয় লাগে। প্লিজ মা আমি পুজোতে বসব না।

শিল্পীর কথার থেকে বেশি ওর চোখে, মনের ভয়টা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। শিল্পীর অবস্থা দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠেই এস্থার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল, মা, শিল্পীর পুজোতে বসা কি খুব দরকার?

এস্থার, তোমার এ বাড়িতে মাত্র তিন-চারদিনই হয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন করা ছেড়ে কালকে গুরুদেবের সেবায় এবং খাওয়াদাওয়ার আযোজনে আমাকে সাহায্য কোরো। আর প্রসূনকে বোলো এক লক্ষের একটু বেশি টাকা তুলতে। কারণ পুজোর খরচ ছাড়াও গুরুদেবকে দক্ষিণাও দিতে হবে, যাতে শিল্পীর জন্য ভালো সম্বন্ধ আসে।

শাশুড়ির কথা শুনে এস্থার বুঝে গিয়েছিল, সময় থাকতে তাকেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো তার সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব সবই ধুলোয় চাপা পড়ে যাবে।

এই পরিবারের লোকেদের চোখে অন্ধবিশ্বাসের এমন ঠুলি পরানো আছে, যা বার করে ফেলাটা খুব সহজ নয়। এস্থার এও জানে সে চেষ্টা করলেই সফল হবে এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। তাই শুদ্ধিকরণ, নামকরণ, বিয়ের জন্য গ্রহশান্তির পুজো এসব যে কতটা বুজরুকি তা জেনেও, পরের দিন সকালে উঠে এস্থার, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

 

যথাসময়ে গুরুদেব পাঁচ শিষ্যকে সঙ্গে করে এস্থারের শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। এস্থার বাদে সকলে গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিল। সবার হয়ে গেলে গায়ত্রীদেবী এস্থারকে ইশারা করলেন, গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে।

আশীর্বাদ দেওয়ার নামে গুরুদেব যেভাবে এস্থারকে স্পর্শ করলেন, তাতে এস্থারের সারা শরীর শিউরে উঠল। গুরুদেবের শিষ্যদের দৃষ্টিও ক্ষুধার্ত পশুর মতো মনে হল এস্থারের। সেই মুহূর্তে গায়ত্রীদেবী পুজো শুরু করে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতেই এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল গুরুদেবের মুখে। এস্থারকে দেখিয়ে বললেন, আমি প্রথমে এই মেয়েটিকে শুদ্ধ করে তবে পুজোয় বসব। পুজোর ঘরে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না, বলে গুরুদেব সকলকে বাইরে যেতে বলে পুজোর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

প্রায় দুঘন্টা পর গুরুদেব ও এস্থার ঘর থেকে বেরোতেই তৎক্ষণাৎ শিষ্যদের নিয়ে গুরুদেব পুজোয় বসে পড়লেন। পুজো করতে করতে বারবার এস্থারের সঙ্গে কাটানো সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত গুরুদেবের মনে পড়তে লাগল। এরকম অবস্থার সম্মুখীন আগে কখনও তাঁকে হতে হয়নি।

এস্থার চালাকি করে আগে থেকেই মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা অন করে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে ঘরের মধ্যে যা-যা ঘটবে সব মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড হতে থাকবে। গুরুদেব কীভাবে পুজোর সামগ্রীর সঙ্গে আনা মাদক পুরিয়া এস্থারকে খেতে দিয়েছেন, এস্থার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ভেবে তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে উদ্যত হয়েছেন, এস্থার কীভাবে ওঁর মুখ থেকে সব সত্য বার করে আনতে ওঁকে বাধ্য করেছে সব মোবাইলে রেকর্ড হয়েছে। গুরুদেব ভালো করেই জানেন, এই সত্যি প্রকাশ পেলে জেলের ঘানি টানা থেকে তাঁকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

তাড়াতাড়ি পুজো সেরে ওই বাড়ি থেকে কখন বেরোবেন ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন গুরুদেব। কারণ এস্থারের দেওয়া হুমকি তখনও কানে বাজছিল গুরুদেবের। সকলের অগোচরে বদ্ধ ঘরের আড়ালে এস্থার তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে পুজো সেরে এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো পুলিশ ডেকে ভিডিও সমেত আপনাকে ধরিয়ে দেব। ভিডিও সামনে এলেই সকলে বুঝতে পারবে আপনার পুরোটাই সাজানো একটা চক্র যার প্রধান পাণ্ডা আপনি। পুজো, ধর্ম, গ্রহশান্তির নাম করে বাড়ির মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা, তাদেরকে নিজের শিকার বানাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারকে আর্থিক ভাবে লুঠে নেওয়া ইত্যাদি কারসাজি আমি সবার সামনে নিয়ে আসব যাতে জেলে যাওয়া থেকে আপনাকে কেউ আটকাতে না পারে।

পুজো শেষ করেই গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরোবার জন্য হুড়োহুড়ি করতে গায়ত্রীদেবী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াহুড়ো কেন করছেন গুরুদেব? এখনও তো এই ছুঁড়ির নামকরণ এবং আমার নাতনির গ্রহশান্তির পুজো করেননি।

গুরুদেব এস্থারের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলেন, নামকরণের কোনও দরকার নেই। খুবই শুভলগ্নে ওদের বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এই বাড়িতে ওর পা পড়তেই বাড়ির সব বাধাবিঘ্ন দূর হয়ে গেছে। সমস্ত গ্রহও সুস্থানে বিচরণ করছে। সুতরাং গ্রহশান্তি করাবারও আর কোনও দরকার নেই। আর এই পুজোর জন্য আমি কোনও দক্ষিণাও গ্রহণ করব না। এই বলে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

মুহূর্তে এস্থার অনুভব করল বাড়ির সকলের দৃষ্টি তার উপরে। সকলেরই চোখের ভাষা একদম বদলে গেছে। হঠাৎ করেই ভালোবাসার ফল্গুধারা সকলের চোখ থেকে প্রবাহিত হতে দেখে মনে মনে হাসল এস্থার। নিজের মনেই বলল, এদের অন্ধবিশ্বাস এখনও কাটেনি ঠিকই কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে না-তো শিল্পীর বিয়ে আটকাবে আর না-তো এই মেয়ের উপর গুরুদেবের দৈহিক অত্যাচার চলতে থাকবে, যা এতদিন ধরে এ বাড়িতে চলে এসেছে।

 

রোবোট?

হাউ ফ্যানটাস্টিক,  উদীয়মান সূর্য‌্যের দিকে তাকিয়ে বলল জয়িতা।

মি. দাস বিরক্ত হয়ে দেশলাই বাক্সটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। একটাও কাঠি জ্বলছে না। কুয়াশার জন্য? কি বিচ্ছিরি কুয়াশা বটে। একটু আগেও ছিল না, এখন আবার হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে। সূর্য‌্যটাও ঢাকা পড়ে গেল। যাকগে। একটা সিগারেট কি খাওয়া যাবে না?

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, খাবেন নাকি একটা? ডু ইউ স্মোক?

ওঃ, অফ্ কোর্স।

দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টান দিল। সুমন বলল, আমাদের ভাগ্য কিন্তু ভালো, তাই না?

হোয়াই?

দেখলেন না কেমন কুয়াশা নেমে এল। আর একটু আগে নামলেই তো এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখা হতো না। কী বলেন?

কোন অসাধারণ দৃশ্যের কথা বলছ?

সানরাইজ মশাই!

হুঁ। তেমন অসাধারণ কিছু নয়। ম্যাল থেকেও এটা দেখা যায়।

দুটো কি এক হল?

প্রায় এক। সে যাই হোক। এটা দেখার জন্য এত ভোর ভোর উঠে এত দূরে ছুটে আসার কোনও মানেই হয় না।

তাহলে এলেন কেন?

মিসেস বলল,

খুব শোনেন বুঝি মিসেসের কথা।

একটু তো শুনতেই হয়।

আচ্ছা দেখি, আমার মিসেস আবার কোথায় গেল?

সুমন সরে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ততক্ষণে মলি এগিয়ে এসেছে। মলি ওর নতুন বিয়ে করা বউ। দুজনে মিলে হনিমুনে এসেছে। সে এসেই সুমনের হাত ধরে বলল, তোমরা এখানে? ওঃ সিগারেট খাওয়া হচ্ছে। ফেলো ওটা। ওদিকটায় দ্যাখো খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। দেখেছ, কেমন পাগলের মতো ছবি তুলছে সবাই। তারপরেই মি. দাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, আপনি কটা ছবি তুললেন?

একটাও না।

কেন?

কারণ আমি পাগল নই। তাছাড়া সূর্য‌্যদেবকে ক্যামেরাবন্দি করার ইচ্ছেও নেই।

হাসল মলি। কথাটা খারাপ বলেননি তো!

সুমনও হাসল। বলল, উনি বলছিলেন এই একটা সূর্যদয় দেখার জন্য এত দূর ছুটে আসার কোনও মানে হয় না।

মলি ভুরু কোঁচকাল। তারপরেই বলল, খুব ভুল বলেননি কিন্তু। হাতের কাছেই কত ভালো জিনিস আমরা দেখি না। ওই যে রবিঠাকুরও বলেছিলেন না, কত দেশ ঘুরে কত ক্রোশ দূরে তার পরের লাইনটা বলো না।

মনে নেই, আমার কিন্তু এখন অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বেশ উঁচু গলায় আবৃত্তি করল সুমন,

আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর কবিতাটা পড়েছেন নিশ্চয়ই মি. দাস?

আমি কবিতা পড়ি না।

যাঃ, কিন্তু এই কবিতাটা তো সব বাঙালির-ই জানা।

তোমার সঙ্গে বুঝি সব বাঙালির পরিচয় আছে?

মলি হাসল। ওর সঙ্গে তুমি ক়থায় পারবে না।

হঠাৎই কী মনে হতে সুমন মলির হাত ধরে টানে, আচ্ছা মি. দাস। আমি একটু ওকে নিয়ে ওদিকটায় ঘুরে আসি। আপনি থাকুন বরং। ডোন্ট মাইন্ড।

মাইন্ড করব কেন? তুমি তোমার বউকে ঘোরাতে নিয়ে এসেছো। আমাকে তো নয়?

দুজনে এগিয়ে গেল।

জয়িতা ওখানে কী করছে?

মি. দাস এগিয়ে গেলেন।

জয়িতা, সরে এসো, খাদের পাশে দাঁড়িয়ো না।

সরে দাঁড়াল জয়িতা।

কী করছিলে ওখানে?

কুয়াশা দেখছিলাম। কত নীচ থেকে উঠে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে, সুন্দর না?

কুয়াশা হামাগুড়ি দেয় না আর দাঁড়াবে না খাদের পাশে।

জয়িতা ঘাড় নাড়ায়, আচ্ছা।

গাড়ি নামছে টাইগার হিল থেকে। হঠাৎ করেই ব্রেক কষে। পাশেই একটা ভিড় জমেছে। অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা শোনা গেল।

সুমন ও মি. দাসরা একই গাড়িতে ফিরছিল। গাড়ির ড্রাইভার নেমে দেখতে গেল ব্যাপারটা। পেছন পেছন সুমনও নামল।

একটু পরেই ফিরে এসে সে বলল, হরিবল্ ব্যাপার বুঝলেন? মুখোমুখি দুটো গাড়ির ধাক্কা। ড্রাইভারটা স্পট ডেড। মাথা ছাতু হয়ে গেছে। আর একজন গুরুতর ভাবে জখম। একটা পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

মলি শুনেই দেখতে ছুটল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল বিবর্ণ মুখে।

ইস্, লোকটার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে না দেখলেই ভালো করতাম।

দেখতেই তো গেছিলেন বিরস মুখে বললেন মি. দাস।

জয়িতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ বলল, আচ্ছা, লোকটাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিলে হয় তো।

তার মানে! চোয়াল ঝুলে গেছে সুমনের।

আপনি বললেন না জখম হয়েছে? ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে।

সেটা হয় নাকি একটু অস্বস্তি নিয়ে যেন মাথা নাড়ে সুমন, এটা পুলিশের কেস্। আর স্থানীয় লোকেরা তো আছেই। দরকার পড়লে ওরাই নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

মি. দাস আপন মনেই বিড়বিড় করলেন, বাইস্ট্যান্ডারস এফেক্ট।

কী বললেন?

কিছু না ড্রাইভার, গাড়ি স্টার্ট করো।

যেতে যেতে মলি বলল, জয়িতাদি কিন্তু ঠিকই বলেছিল। হাসপাতালে এক্ষুণি নিয়ে গেলে হয়তো…

মি. দাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, সুমন বলছিল লোকটার পা চলে গেছে। এভাবে না বাঁচাই ভালো।

অদ্ভুত মানুষ আপনি, মলি ভুরু কোঁচকায়।

পথে তেনজিং পযে্ট দেখে একটা বড়ো গুম্ফার সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের গাড়ি। ওরা নামে।

গুম্ফাটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। সুন্দর জায়গাটা। গুম্ফার পাঁচিল থেকে অনেক দূর পর্য়ন্ত দেখা যায়। জয়িতা আরেকবার বলে ফেলল, ফ্যানটাস্টিক।

এর পরেই অবশ্য হতাশ হতে হল ওদের। মূল প্রার্থনা ঘরটা বন্ধ। বোধিসত্ত্বের মূর্তিটা দেখা যাবে না। দশটার আগে দরজা খোলে না। এখন সবে সাতটা বাজে।

পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে সুমনরা কয়েকটা ছবি তুলল। মি. দাসকে বলল, ওদের দুজনের ছবি তুলে দিতে।

প্রার্থনা-মন্দিরটার পাশেই একটা ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে কয়েকটা বাচ্চা লাল আলখাল্লা পরে ঘুরছে। একজন একটা ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুরের সঙ্গে খেলা করছে।

জয়িতা জিজ্ঞেস করল, ওরা কারা?

দে আর লিটল্ লামা বুদ্ধিস্ট মংকস্।

সুমন হেসে বলল, ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন নাকি? অবশ্য, আমাদের ভাষা ওরা বোধহয় বুঝবে না।

সো কিউট্ দে আর। ভুরু কোঁচকায় জয়িতা, এত ছোটো বয়সে সন্ন্যাসী হয়?

দেখছেনই তো হয়েছে। এটা কিন্তু ঠিক নয় বলুন?

কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় জয়িতা। তার ভুরু দুটো আবার কুঁচকে গেছে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে একটা বাচ্চার দিকে। এই বাচ্চাটাই একটু আগে কুকুরের সঙ্গে খেলছিল।

কী দেখছেন এত মন দিয়ে সুমনের গলায় কৌতূহল।

দেখুন না, ওর হাতে একটা পোকা বসে আছে, কামড়াচ্ছে মনে হয়। ও কিন্তু ওটা ফেলে দিচ্ছে না। চুপ করে দেখছে পোকাটাকে। অদ্ভুত না!

সুমনও ব্যপারটা দেখল। ততক্ষণে আর একটা বাচ্চা, এ একটু বড়ো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটার। পোকাটাকে খুব সাবধানে, যেন সযত্নে তুলে সে পাশেই একটা উঁচু জায়গায় রেখে দিল।

ওঃ… এরা তো বৌদ্ধ, তাই বোধহয় সুমন বলল।

এখানে কী করছ? মি. দাস এসে দাঁড়িয়েছেন।

সুমন পুরো ঘটনাটা শুনিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনার মিসেস কিন্তু বেশ ইনকুইজিটিভ। ছোটো ছোটো ব্যপারও ওঁনার চোখ এড়ায় না।

মেযোনুষ যে, ঘাড় ঝাঁকালেন মি. দাস। চলো এবার কিছু দেখার নেই এখানে।

বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বোধহয় কথা বলার ইচ্ছে ছিল জয়িতার। কিন্তু আর কিছু না বলে ফেরার পথ ধরল।

হোটেলে ফিরে সুমন ও মলি রেস্ট নিচ্ছে। টিভি চালিয়েছে। হঠাৎ করেই মলি বলল, মি. দাস লোকটা যেন কেমন, তাই না?

হ্যাঁ, একটু অদ্ভুত বটে।

অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভাবো। কোনও রিঅ্যাক্ট করলেন না!

সে তো সানরাইজটাই উনি ভালো করে দেখলেন না। অথচ লোকে ওটা দেখতেই… আমি সিগারেট খাওয়ালাম দুতিনবার কিন্তু উনি একবারও আমাকে অফার করলেন না। ভাবো!

আমরা এতক্ষণ একসঙ্গে ঘুরলাম, উনি নিজে থেকে একটা কথাও বলেননি। এটা খেয়াল করেছ? আমারাই শুধু যেচে আলাপ করেছি।

হ্যাঁ, ভদ্রলোক সামাজিকতার ধার ধারেন না। কাঠ কাঠ আচরণ।

হ্যাঁ, কেমন যেন রোবট রোবট।

হয়তো সত্যিই উনি একটা রোবট! হাসতে হাসতে বলে সুমন।

শোনো না স্বামীর পাশে ঘন হয়ে আসে মলি। আমারও কিন্তু তা-ই মনে হচ্ছে।

কী মনে হচ্ছে?

হাসি নয়। সেদিন খবরের কাগজে পড়লাম না রোবোট কোম্পানিগুলো এখন অবিকল মানুষের মতো দেখতে যান্ত্রিক এসকর্ট তৈরি করছে। কোনও সঙ্গীহীন লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে। যাচ্ছেও অনেকে। এই লোকটা নিশ্চয়ই সেরকম কিছু।

তোমার মাথায় আসেও বটে! রোবট কি সিগারেট খায়?

সিগারেট ধরাচ্ছিল কিন্তু ইন করছিল না আমি লক্ষ্য করেছি।

বাঃ, বেশ খুঁটিয়ে দেখেছ দেখি ওকে। মনে ধরেছে বুঝি?

ঠাট্টা কোরো না, ভদ্রমহিলার আই মিন জয়িতাদির দেখেছ মাথায় সিঁদুর নেই। স্বামী মারা গেছেন হয়তো।

আর তাই একটা রোবট ভাড়া করে দার্জিলিং ভ্রমণে এসেছেন, তুমি গল্প লেখা শুরু করে দাও বুঝলে। ভালো কল্পনাশক্তি আছে।

তুমি তো আমার কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছ! হতে পারে না বুঝি এরকম?

পারে, পারে সব হতে পারে মলিকে কাছে টানে সুমন। তার রাগ রাগ মুখে একটা চকাস করে চুমু খেয়ে বলে,নতুন বউ চাইলে এই হোটেলটাও তাজমহল হতে পারে, আর আমি হতে পারি সম্রাট শাজাহান… ঠোঁটটা দাও না।

আঃ, আমার মুড নেই এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মলি। জয়িতাদির কথা ভেবে খারাপ লাগছে।

কেন? একটু ক্ষুণ্ণ সুরেই বলে সুমন, ভালোই তো আছেন মহিলা। সারাক্ষণ হাসছেন।

ওটা জোর করা হাসি। তোমরা ছেলেরা বুঝবে না। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মলি। বলে এত প্রাণবন্ত মহিলা, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু সঙ্গীহীন রোবট কি আর মানুষের একাকিত্ব ঘোচাতে পারে। তার ওপর ওরকম গম্ভীর একটা রোবট!

যাঃ, তুমি সত্যিই ভাবছ নাকি উনি একটা রোবট!

রোবট যদি না হয়, তাহলে তো লোকটাকে আরও-ই সহ্য করা যাবে না। রবিঠাকুরের কবিতাও লোকটা জীবনে পড়েনি। ভাবা যায়!

 

রাত দশটা। খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় এসে শুয়েছেন মি. দাস। জয়িতা ঘরে ঢুকল। একটা গোলাপি রঙের হাত কাটা নাইটি পরেছে। স্বচ্ছ পোশাকটার ভেতরে তার পরিপূর্ণ শরীর কুয়াশা ঢাকা চাঁদের মতো সুন্দর লাগছে।

মি. দাসের পাশে এসে জয়িতা বসল। মি. দাসের গায়ে হাত রেখে বলল, চলো ঘুমোই।

আর একটু পরে, মি. দাস বললেন।

জয়িতা একটু ঝুঁকে মি. দাসের ঠোঁটে একটা আলতো করে চুমু খেল। তারপর তার একটা হাত ধরে নিজের বুকের ওপর রাখল।

হাত ছাড়ো জয়িতা, আমার ভাল্লাগছে না।

জয়িতা হাতটা ছেড়ে দিল। মনোযোগ দিয়ে একটা একটা করে মি. দাসের জামার বোতাম খুলতে লাগল।

আঃ, কী করছ? এক ঝটকায় জয়িতার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন মি. দাস।

জয়িতা তাকিয়ে আছে। তার ভুরুটা একটু কুঁচকেছে। যেন কিছু একটা জিনিস তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। একটু চুপ থেকে সে আবার হাত বাড়াল। মি. দাস একটা পাজামা-প্যান্ট পরেছিলেন, সেটা ধরে টেনে নামিয়ে দিল জয়িতা।

ইউ ডার্টি গার্ল, প্যান্ট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালেন মি. দাস। রাগ রাগ মুখে জয়িতার গলার পেছনে একটা বিশেষ অংশে দুই আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিছানার ওপর ঢলে পড়ল জয়িতা। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃসাড় শুয়ে আছে।

যেমন নিঃসাড় আমার এই পা টা, নিজের মনেই বললেন মি. দাস। পাজামার ওপর দিয়ে নিজের কৃত্রিম ডান পা-টার ওপর সস্নেহে ধীরে ধীরে হাত বোলালেন। জয়িতার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। বেচারি। ওর তো কোনও দোষ নেই। রাত হলেই ক্লায়েন্ট কে ও সেক্সুয়াল সার্ভিস দেবে। এভাবেই ওকে প্রোগ্রাম করা আছে।

নিজের মনেই একটু হাসলেন মি. দাস। সানরাইজ দেখে, কুয়াশা দেখে কেমন সুন্দর মুগ্ধ হবার ভান করে মেয়েটি। যেমন তিনি ভান করছেন একটি স্বাভাবিক সুস্থ, মানুষের মতো বাঁচার…

নীচু হয়ে জয়িতার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিলেন মি. দাস। তারপর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন।

 

গল্পকার হয়ে ওঠার গল্প

এক গাদা সাংবাদিকের ভিড় মানেই কানের কাছে আজকাল মশা-মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পাই। প্রেস ক্লাবে পা রাখতেই ভনভনানিটা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল। বইয়ের প্রকাশ আর বিক্রির মধ্যিখানে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ সালতামামি। খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের লোকজন ছাড়াও প্রায় সবকটি বাংলা খবরের চ্যানেলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। অথচ লেখিকা অপর্ণা ঘোষের এটি প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। কিন্তু এতে সবটা বলা হল না।

লেখিকা অপর্ণা ঘোষ মৃত স্বনামধন্য লেখক পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রী। যার অন্তত তিনটি উপন্যাস আর দুটি গল্পগ্রন্থ দৈনিকের বেস্টসেলারের তালিকায় হামেশায়-ই দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে বছর দুয়েক আগে এই লেখকের মৃত্যুতে গোটা বাংলার সাহিত্যকুলকেই প্রায় গেল গেল রব তুলতে দেখেছিলাম। সামনের মাসেই পঙ্কজ ঘোষের জন্মদিন। যে-কাগজে কাজ করি, তার রবিবারের সাপ্লিতে পঙ্কজ ঘোষ সংখ্যা হবার কথা হয়ে আছে। ঠিক এই সময় পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রীর নিজের গল্পগ্রন্থ প্রকাশ সংবাদেরই বিষয় বটে।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এখনও শুরু হয়নি। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসরে প্রবেশ করবেন অপর্ণা ঘোষ। বেশ ব্যস্ত ভাবে এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি করছে সুদীপ্ত মজুমদার। দীর্ঘদিন ধরে পঙ্কজ ঘোষকে আপ্তসহায়তা করে এসেছে এই সুদীপ্ত মজুমদার। ঘোষ পরিবারের বিশেষ স্নেহধন্য ছিল জানতাম। লেখকের স্ত্রী আবার ওকে নিজের জন্য পুনর্বহাল করলেন কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কামানো মুখ আর পাট ভাঙা হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজের মধ্যে প্রাণপনে একটা লেখক লেখক ভাব আনার চেষ্টা করছে সুদীপ্ত।

জেট নিউজের কৌশিকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সামনের মুলোর মতো দাঁত দুটো বের করে মন ভুলিয়ে দেওয়া একটা এক্সপ্রেশন ঝাড়ল। যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রিত ভাবে হাসিটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সদ্য ইলেকট্রনিক্স-এ জয়েন করার পরে নিজের মধ্যে একটা হামবড়াই ভাব এনেছে কৌশিক। তবে ওর দেঁতো হাসির উপহার সবাই পায় না। সম্পাদকীয় বিভাগে থাকলে কেউ কেউ ওর এই হাসি উপহার পায়। যেমন আমি।

এতজন মানুষের উপস্থিতিতে কিনা জানি না এসি-র কনকনে ঠান্ডা ভাবটাও শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না, যে-শীতল অনুভূতিটা পেতে চাইছিলাম। অপর্ণা ঘোষের সাক্ষাৎকার পর্ব কয়েকটা পয়েন্ট-এর আকারে তুলে নিয়ে ছুটতে হবে আবার অফিসে। প্রতিবেদন আকারে সেটার পেজ সেটিং না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে কেমন করে যেন একঘেয়েমি ঢুকে পড়ছে।

একটু গুঞ্জন, তারপরই অপর্ণা ঘোষের প্রবেশ। সাদামাটা, হালকা ঘি রঙের তাঁতের শাড়িতে বিধবাভাবকে লুকোনোর কোনও চেষ্টা নেই। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কাটা মুখে চোখ দুটো আমার নজরে এল। দামি রিমলেস চশমার আড়ালে সে চোখ বেশ উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে। গরমের মধ্যে আসতে হয়েছে, তাই বোধহয় তৃষ্ণা দূর করতে টেবিলের উপর রাখা জলের গেলাসের অনেকটা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললেন।

আমি ছাড়াও, অনেকেই প্রস্তুত। মনেই হচ্ছিল সোজাসুজি কাজের কথায় যেতে বিশ্বাসী লেখিকা।

অনন্ত বার্তা দৈনিকের বিকাশ সেন-ই প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন। অপর্ণাদি, পঙ্কজবাবুর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। বেশ অবাক ঘটনা নয় কি?

বেশ সাবলীল ভাবেই উত্তর বেরিয়ে এল লেখিকার মুখ থেকে, আসলে সংসারের আকর্ষণটা তখন অনেক বেশি করে কাজ করছিল ভিতরে। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ায় বেশ কিছুটা দিশাহারা লেগেছিল। একসময় আবিষ্কার করলাম সংসারের সেই ভয়ানক আকর্ষণটা যেন পেনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বলতে পারেন পেন যেন সংসারকে প্রতিস্থাপন করল।

বিকাশদার পরবর্তী প্রশ্নের আগেই সান্ধ্য খবরের রমা ঘোষ ফায়ার করল, দিদি পঙ্কজবাবু বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর লেখা ছোটো গল্প এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সট বুকে স্থান পেয়েছে। তিনি বর্তমানে থাকলে আপনার এই বই প্রকাশ কতটা প্রাসঙ্গিক হতো?

অল্পক্ষণের জন্য লেখিকাকে স্মৃতিমেদুরতায় ডুবতে দেখলাম। কিছু বলবেন উনি। অপেক্ষা করছি আমরা। কার মোবাইল ফোন নিজের অস্তিত্ব জাহির করে বসল। পিছন ফিরে দু-একজন তাকাতে তড়িঘড়ি সেটি বন্ধ হয়। বাঁ হাতে রুমাল ধরে থাকা হাত নিজের মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন উনি, অনেকটাই। উনি যে-মানসিকতার মানুষ ছিলেন তাতে তো মনে হয় এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়াটাই ওনার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক।

আবার প্রশ্ন উড়ে এল, আচ্ছা ম্যাডাম এ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া গল্পগুলি কি কোনও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত?

না-সূচক ঘাড় নাড়লেন অপর্ণা। না, লেখা অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছিল। আসলে লেখাগুলোর কনস্ট্রাকশন সম্পর্কে একদম নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই বারবার এডিট করতে হচ্ছিল। বই যে করতে হবে সে ব্যাপারে চাপটা অবশ্য সুদীপ্তর তরফেই আসে, তৃপ্তি মেশানো এক মায়াময় হাসি ছুটে যায় সহকারীর দিকে।

নড়েচড়ে উঠি আমি। অস্বস্তিকর গরমটা কিছুতেই যেন ছেড়ে যাচ্ছিল না। লেখিকা অপর্ণার সঙ্গে বারবার লেখক পঙ্কজের নামটা জুড়ে যাচ্ছিল। আমরা এখানে যারা এই বই প্রকাশ কভারেজ করতে এসেছি, ঠিক কার কাছে এসেছি! লেখিকা অপর্ণার সত্তাটা স্বাধীন কিনা দেখে নেবার ইচ্ছা জাগছিল। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা এগিয়ে দিই, দিদি একটু অন্যরকম প্রসঙ্গ। লেখিকা অপর্ণা যদি পঙ্কজবাবুর স্ত্রী না হতেন তবে কি তাঁর বইপ্রকাশ ঘিরে সংবাদ মাধ্যমের এই উচ্ছ্বাস থাকত?

মুখে লেগে থাকা হাসিটা যেন ওনার একটু ম্লান হয়ে এল। ক্লান্তি মেশানো স্বরে বলে উঠলেন, কী মন্তব্য করি বলুন তো? সেটা আপনারাই ঠিক করুন না।

রাতে অফিস থেকে যখন বেরোলাম, তখনও ঘুরে ফিরে লেখিকা অপর্ণার মুখটা আমার মধ্যে ফিরে আসছিল।

দুই

একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। রোববারের পাতার জন্য ফিচার চেয়েছিলাম পরিচিত এক লেখকের কাছে। সাবধানি চোখ নিয়ে তার জমা দেওয়া লেখাটা পড়ছিলাম। লেখার বাঁধুনিটা ভীষণ ভালো। কিন্তু প্যারাগ্রাফের চেঞ্জগুলো একদম ঠিকঠাক করতে পারেননি। সেগুলিকেই সম্পাদকীয় দৃষ্টিতে যতটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

সামনে এসে দাঁড়াল অনিরূপা। বছর ২৭-এর মেয়েটি রবিবারের পাতার সম্পাদকীয় বিভাগে আছে প্রায় দেড় বছর। তারও আগের দু-বছর প্রথম শ্রেণির একটা দৈনিক ডেস্কে চাকরি করে এসেছে। বাংলা ভাষায় এত কম বয়সে এই জ্ঞান খুব কম মেয়ের মধ্যে দেখা যায় অথচ কোনওরকম আঁতলামো নেই, উলটে এক নম্বর ফক্কড়। সাহিত্যলোকের এ সপ্তাহতেই প্রকাশিত সংখ্যাটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে চোখ দুটো বড়ো করে বলল, সৌম্যদা, এবার না তুমি খবর হয়ে যাবে।

নিজের হাতঘড়িটা কনুইয়ে দিকে একটু ঠেলে তুলে দিয়ে বলি, কেন রে!

অপর্ণা ঘোষের স্টোরিটা তুমি করেছিলে না?

হ্যাঁ, তো!

ভালো করে পড়ে দেখো এটা। চলে যায় অনিরূপা।

সাহিত্যলোকের বইয়ে আলোচনার বিভাগটা খুলে রেখে গেছে ও। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। বাজারে এই মুহূর্তে সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা অনেকগুলো। সদ্য প্রকাশিত বইগুলির আলোচনাও থাকে সে সমস্ত সংখ্যায়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাহিত্যলোকের আলোচনা বিভাগটিকে অন্যরকম গুরুত্ব দিই। দীর্ঘদিন ধরে এই বিভাগটিতে লেখেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। লোকটার পড়াশোনা, বিশ্লেষণ এবং তথ্য পেশ করার ক্ষমতা চমকে দেবার মতো। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো সমালোচক কোনও লেখক বা বই সম্পর্কে যে মন্তব্য করবে, সেটা আমার মতো অনেকের কাছেই আপ্তবাক্য। সবচেয়ে বড়ো কথা লোকটা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, তার মতো ব্যক্তিত্ব যখন অপর্ণা ঘোষের লেখার সঙ্গে পঙ্কজ ঘোষের লেখার অত্যাশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছে, সেটা আর যাই হোক ধান ছড়িয়ে বুলবুলিতে খাওয়ার মতো ঘটনা নয়।

স্টোরিটা করার সময় অপর্ণা ঘোষের বইয়ের দুএকটি গল্প পড়ে আমি কিছু মন্তব্যও করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, কোনও লেখিকার প্রথম গল্প গ্রন্থেরই ভাষা এত সাবলীল অথচ গভীর হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। গোটা স্টোরিটাই তৈরি করেছিলাম একটু মুগ্ধ ভাব নিয়ে। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনার কোনও কোনও অংশ ব্যাঙ্গাত্মক তীর হয়ে যে আমার কাগজের রবিবারের স্টোরিটাকেও বিদ্ধ করেছে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর লেখার ধরনের মধ্যে মিল থাকা কি খুব অস্বাভাবিক! দীর্ঘদিন একজনের সাথে থাকতে থাকতে তার অনেক কিছুই তো অজান্তেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সাহিত্যলোকের আলোচনাটা যে অপর্ণা ঘোষের সদ্য শুরু হওয়া সাহিত্য জীবনকে অনেকটাই জটিল করে তুলবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

হাতের কাছে রাখা নিজের মোবাইল থেকে সান্ধ্য নিউজের রমাদি-কে ধরলাম। ভদ্রমহিলার লিটারেচার ফিল্ডের জ্ঞানটা যেমন গভীর তেমনি খবরও রাখেন নানারকম। প্রথমবার বেজে বেজে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার ফোন করার সাথে সাথেই গম্ভীর অথচ সুরেলা গলা নিয়ে আমার কানের কাছে উঠে এলেন রমাদি। আমি সোজাসুজি আসল দরকারে আঘাত হানার চেষ্টা করলাম, দিদি, সেদিন তো অপর্ণা ঘোষের বইয়ের লঞ্চিং-এ আপনিও ছিলেন। সাহিত্যলোকে এবারে যে-আলোচনাটা বেরিয়েছে চোখে পড়েছে নাকি?

হ্যাঁ পড়েছে, সংক্ষিপ্ত, উদাসীন প্রতিক্রিয়া মনে হল আমার।

কী মনে হচ্ছে আপনার?

কী আবার! গণেশবাবু যখন লিখেছেন তখন একটা কিছু ব্যাপার তো রয়েছেই।

আপনার কী মনে হচ্ছে? ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম।

কী বলি বলো তো! বেশ বিতর্কিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে পঙ্কজদার কিছু লেখা অপ্রকাশিত পড়েছিল। সেগুলোকেই এখন নিজের নামে চালানোর চেষ্টা চলছে। অপর্ণা চিরকালই সংসারিক মেয়ে কোনও সাহিত্যের অনুষ্ঠানেও স্বামীকে সঙ্গ দিতে দেখিনি, অথচ পঙ্কজদা বরাবর নারীবাদের স্বপক্ষে কথা বলে এসেছেন।

সেন্ট্রাল এসি-র মধ্যে বসেও নিজের চারপাশে একটা গরম আবহাওয়ার বেষ্টনী পেলাম। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা আর একটু খুঁড়ে দেখা দরকার। ও প্রান্তে রমাদি অবশ্য আমার উত্তেজনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন।

এটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কী হবে সৌম্য! বাংলা সাহিত্যে লেখালিখিতে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম। সুদীপ্তর ফোন নাম্বারটা যতদূর মনে হচ্ছে ফোন বুকে তোলা আছে। একটু খুঁজতে পেয়ে গেলাম। অনুরোধটা করতেই ওর মুখ থেকে যেন একরাশ বিরক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

কেন কথা বলতে হবে, কেন? অপর্ণাদি তার মতো লিখেছেন। আপনারা যেটা লিখবেন সেটাকেই কেন সবচেয়ে বড়ো সত্যি বলে মেনে নিতে হবে!

দেখুন সুদীপ্তবাবু, কথাটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু কথাটা বোধহয় আমার সম্পর্কে খাটে না। বইটা পড়েই অপর্ণাদি সম্পর্কে আমার একটু অন্যরকম ধারণা হয়েছিল। আমি একটু ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি প্লিজ একটা অ্যাপয়েনটমেন্ট…

কথা দিতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখছি।

সুদীপ্তর কন্ঠস্বরকে এতটুকু নরম মনে হল না!

তিন

মিনিট পনেরো হল চা-টা শেষ করেছি। দাঁত এবং মাড়ির আশেপাশে লেপটে থাকা বিস্কুটের স্তরটাকে জিভ চালিয়ে পরিষ্কার করে নেবার চেষ্টা করছিলাম। ফুল স্পিড-এ মাথার ওপরে পাখা ছাড়াও পাশে থাকা সুপার স্পিড-এর স্ট্যান্ডফ্যানটা মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে যাচ্ছিল।

অপর্ণা ঘোষ উলটো দিকের সোফায় এসে বসেছেন বেশ কিছুক্ষণ কিন্তু এখনও অবধি মুখ খোলেননি। একই সোফার কোণে বসে আছে সুদীপ্ত। প্রশ্নগুলো মোটামুটি নিজের মনে সাজিয়ে রেখেছি। রিডিং লাইটের আধা আলো আঁধারিতে লেখিকার মুখের ভাব ও মনের তরঙ্গের ঠিক হদিশ মিলছিল না। ঘোর লাগা গলায় একসময় সূচনাহীন এবড়োখেবড়ো প্রবন্ধ পড়ার ভঙ্গিমায় ওনার হঠাৎ করে বলতে শুরু করাটা আমাকে সচকিত করে দেয়। নিজের উরুর ওপরে প্যাডটা খুলে রাখাই ছিল। ডট পেনের পিছনটা আঙুল চালিয়ে টিপে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হই।

এত বছর পঙ্কজবাবুর সঙ্গে কাটানোর কারণেই কি তার অন্বয়রীতি, বাক্যবিস্তার, প্লট আপনার গল্পে গৃহীত হয়েছে? খুব ধীর গতিতে প্রশ্নটাকে ওনার সামনে রাখার চেষ্টা করলাম।

প্রশ্নটার সরাসরি জবাব দেবার কোনও তাগিদ লক্ষ করলাম না ওনার মধ্যে। স্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবে পুনরায় ভেসে উঠতে চাইলেন তিনি। সত্যেন বোস লেনের মেসটাতে ও যখন থাকতে এল, তখনই ও ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশোনায় কোনওদিনই সেভাবে মন ছিল না ওর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার অফিসে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করছিল বটে কিন্তু সেভাবে কলকে পাচ্ছিল না। বেশ হতাশ। এইরকম একটা সময়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ওর সঙ্গে আমার দেখা। ইংরাজি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। প্রথম দেখাতেই উদ্দাম প্রেম আর তার মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে। একটি খবরের কাগজে যৎসামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ও কলাম লিখত। একটু দম নেবার জন্য যেন থামতে চাইলেন অপর্ণা।

পরের প্রশ্নটা করব কিনা ভাবছি, এমন সময় পূর্ব প্রসঙ্গকে আরও টেনে বলতে শুরু করলেন অপর্ণা। তখন কাগজে ও যে-সব রিভিউগুলো লিখছে সেগুলোও সম্পাদকের ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছে না। বেশ হতাশ ও। সংসার চলতে চাইছে না। সংসার ক্রমশ আমার কাছে বিভীষিকা তখন। এরই মধ্যে মোটামুটি একটি নামি পত্রিকায় আমার একটি গল্প বেরোয়। লেখাটি মোটামুটি প্রশংসিত হয়েছিল। আপনি ভাবছেন এসব কথা আপনাকেই বা কেন বলছি! আসলে এই মুহূর্তে অনেকেই যখন অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে আমার বিরুদ্ধে কলম চালাচ্ছে, তখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি সত্যিকথার অনুসন্ধান করেন। আর এত বছরে আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে…।

সাদা সাংবাদিকতাকে কীভাবে হলুদ সাংবাদিকতা নিজের বশে এনে ফেলেছে তা এই কবছরে ভালোই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু অপর্ণা ঘোষের শেষ বাক্যটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ওনাকে বলি, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার কিন্তু কোথাও একটু গণ্ডগোল ঠেকছে। কোথাও একটা ফাঁক। একটা মস্ত বড়ো সত্যি যেন মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই ধোঁয়াশা আপনিই দূর করতে পারেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন অপর্ণা। মুখ তুলে এরপর উনি সুদীপ্তর দিকে তাকাতে মুখে অল্প হাসি এনে সুদীপ্ত যেন ওনাকে কিছুর সম্মতি দেয়।

উনি বলতে শুরু করলে ওনার গলাটা আগের থেকে দৃঢ় শোনাচ্ছিল, ক্রিয়েটিভ রাইটিংটা কোনওদিন আপনাদের পঙ্কজদার আসত না। খেতে পাচ্ছি না অথচ রোজই ওর মুখে গালভরা স্বপ্ন শুনতাম। আর কখনও-কখনও রাতে বাড়ি ফিরে গায়ে হাত তুলত। অনেক বড়ো বড়ো সভায় গিয়ে সমাজে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনেক বক্তৃতাই ও শুনিয়েছে। কিন্তু নিজের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে কী ব্যবহার করত আপনাদের সংবাদমাধ্যম কি তার খবর রেখেছে? আমার গল্পটা প্রশংসিত হবার পর আরও একটি গল্প লিখি এবং একটি নামি দৈনিকের রবিবারের পাতায় গল্পটি ওর নামে পাঠিয়ে দিই। আমার স্বামীকে এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এতদিন পঙ্কজ ঘোষের নামে যা যা বেস্টসেলার পাবলিক জেনে এসেছে তার প্রতিটি অক্ষর আসলে আমার সৃষ্টি। দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন অপর্ণা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিলাম। স্টোরিটা কীভাবে নিজের কাগজে প্লেস করব, এবার তার ভাবনা আমাকে ধাক্কা দেয়। খুব ধীর গলায় সুদীপ্ত বলে ওঠে, কিন্তু লেখার রীতিটা যে দিদির, সেটা বোধহয় প্রমাণ করা সম্ভব নয়, না?

মৃদু হেসে বলে উঠি, কেন নয়? পঙ্কজ ঘোষের প্রবন্ধের ভাষা ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা পরীক্ষা করে, আমার ধারণা একজন ভাষাবিদ অবশ্যই বলতে পারবেন। আর তা ছাড়া সত্যিটা প্রকাশিত হলে জনগণের সামনে একটা দুটো গল্প একজন জাত লেখিকা লিখে দিতে পারে। এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি না।

ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াই। এ বাড়িতে ঢোকার আগে সাক্ষাৎকার শিরোনাম কী দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শিরোনামটা হঠাৎই মাথায় এসে যায়। নিজের ব্যাগ থেকে প্যাডটা বের করে ভুলে যাবার আগেই তা দ্রুত হাতে লিখে নিতে থাকি আমি…

 

আবার আসিব ফিরে

একদৃষ্টে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল রাজীব। আরব সাগরের অশান্ত, উত্তাল ঢেউ সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ কেন জানি না রাজীবের উত্তাল অশান্ত হৃদয়ের চেহারাই বারবার প্রতিফলিত হচ্ছিল সাগরের অন্তহীন বুক জুড়ে।

সঞ্জনার চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল রাজীবের চোখের সামনে। কিছুই আর চিন্তা করতে পারছিল না সঞ্জনা ছাড়া। সারা পৃথিবীতে কী ঘটে চলেছে তার সঙ্গে রাজীবের কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল না। ও শুধু নিজের জগতেই নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিল।

সঞ্জনা রাজীবের বিবাহিতা স্ত্রী। মা, বাবার দেখে দেওয়া পাত্রীকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। তিন বছরের বিবাহিত জীবন ওদের। সঞ্জনা ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কল্পনাও করতে পারত না রাজীব। এক স্বর্গীয় ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে রাজীব তুলে ধরেছিল সঞ্জনার হাতে।

চাকরি এবং স্ত্রী সঞ্জনাকে নিয়ে রাজীব মুম্বই শহরে এসে পৌঁছেছিল। তিন বছর ওদের কোনও সন্তান হয়নি। এই নিয়ে কোনও দুঃখও ছিল না রাজীবের মনে। সঞ্জনাই ওর পুরোটা জুড়ে ছিল। সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি রাজীব। সঞ্জনা ছাড়া ও কিছুই প্রত্যাশা করত না। তবুও দুজনের সংসারে তৃতীয়জনের আসার সংবাদ ডাক্তারের মুখে শুনে খুশি হয়েছিল রাজীব। বেশি খুশি হয়েছিল সঞ্জনার জন্য।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস স্বীকার করা ছাড়া আর কী-বা করতে পারল রাজীব? সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চিরতরে রাজীবকে ত্যাগ করে সঞ্জনা কোথায় হারিয়ে গেল। রাজীব, কন্যাসন্তান, গোছানো সংসার সবই পড়ে থাকল শুধু গুছিয়ে রাখার মানুষটাই স্নেহ, মায়ার বন্ধন কাটিয়ে রাজীবের হৃদয়টাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।

বাড়িতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু সঞ্জনার স্মৃতি। সবথেকে বেশি সঞ্জনার কথা মনে হতো সঞ্জনার ফেলে যাওয়া একরত্তি ওই মেয়েকে দেখলে। রাজীব যেন মনে মনে সঞ্জনার মৃত্যুর জন্য মেয়েকেই দাযী করে বসল। ওর দিকে তাকালেই মনটা আরও বেশি হুহু করে উঠত।

বেঙ্গালুরু থেকে রাজীবের মা-বাবা মুম্বই এসেছিলেন পুত্রবধূ বাড়ি ফিরলে সংসার সামলাতে যাতে কষ্ট না হয় সঞ্জনার ছোটো বাচ্চা নিয়ে কিন্তু সেই সঞ্জনাই ফিরল না। ঠাকুমা-ঠাকুরদাই নাতনিকে আপন করে নিলেন। স্নেহ মমতা দিয়ে ওইটুকু প্রাণকে আগলে রাখার চেষ্টা করে চললেন। ছেলেকে ওনারা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু রাজীবের মন কিছুতেই ভিজল না। জীবন থেকে মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখল সে।

অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে রাজীবের মা-বাবা একমাত্র নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে গেলেন। রাজীব মুম্বইতে একাই রয়ে গেল। তার জীবনে ভালোবাসা রূপকথা হয়ে রয়ে গেল।

সঞ্জনার মৃত্যুর প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কেটে গেছে এই দীর্ঘ সময়টা। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুরই খেয়াল করেনি রাজীব। তাহলে আজ হঠাৎ আবার সাগরের একের পর এক ভেঙে পড়া ঢেউ দেখতে দেখতে, কেন তার হৃদয় এতটা উদ্বেলিত হচ্ছে রাজীব বুঝতে পারছে না! সঞ্জনাকে দেখে তো এমনটা হতো কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু তো জীবনে একবারই আসে। তাহলে আজ কীসের জন্য মন এতটা অশান্ত? তাহলে কারও প্রতি কি তার মন আকর্ষিত হচ্ছে? না না এ হতে পারে না। সঞ্জনার উপর কোনও অন্যায় অবিচার সে হতে দিতে পারে না। এ অন্যায়।

রাজীব স্বপ্নেও ভাবেনি এই মুহূর্তটুকু আবার তার জীবনে প্রবেশ করবে। মানসিক এই টানাপোড়েন অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল রাজীবের ভিতর। প্রতিবেশী মেয়েটির চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। একজন প্রতিবেশীর জন্য চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু সবকিছুকে রাজীব কিছুতেই একটা সরলরেখায় ফেলতে পারছিল না।

ছয় মাসের হয়তো একটু বেশিই হবে সামনের খালি ফ্ল্যাট-টায় ওই মেয়েটি এসেছে। মেয়ে না বলে মহিলা বললেই হয়তো ঠিক হবে কারণ রাজীবের মনে হয়েছিল মহিলার বয়স তিরিশের আশেপাশে। বারান্দায় দাঁড়ালে রাজীবের ঠিক উলটো দিকে সেই ফ্ল্যাট। দুটো ফ্ল্যাটের মুখোমুখি বারান্দা।

রাজীবের প্রথম চোখে পড়ে যখন মেয়েটিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখে। এছাড়া খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে চোখে পড়েছিল লোক দিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র সব গুছিয়ে তুলছিল ওই মহিলা। ব্যস অতটুকুই।

অফিসে যাওয়া-আসার পথে, লিফট-এ প্রায়শই দেখা হতো। অনেকেরই সাথে তো রোজ দেখা হয়, তাহলে বিশেষ করে ওই একজনের প্রতি কেন আকর্ষণ অনুভব করত রাজীব, নিজেই বুঝতে পারত না। হয়তো একাকিত্ব বোধ থেকে অথবা শরীরের অপ্রতিরোধ্য চাহিদা থেকে, এর মধ্যে কোনটা সেটা রাজীবের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন লিফ্ট থেকে বেরোতে গিয়ে তাড়াহুড়োতে কোনও ভাবে পা মুচকে গিয়ে মহিলা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, রাজীব কোনওরকমে ধরে ফেলে। হাত ধরে বাইরে রাখা একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে দেয় রাজীব।

দেখি কোথায় লাগল আপনার, বলে নীচু হয়ে রাজীব আঘাতের জায়গাটা দেখার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় মহিলা পা-টা সরিয়ে নিল।

না না, আমি ঠিক আছি। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, বলতে বলতে মহিলা চেয়ারে বসেই পা-টাকে একটু নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কোনও সাহায্য লাগলে বলুন…

না না ধন্যবাদ। ঠিক সামলে নেব…

কথা না বাড়িয়ে রাজীব অফিসের পথে পা বাড়াল। কিন্তু সারাটা দিন মুহূর্তের ওই স্পর্শটুকু কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারল না।

দুতিন দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখল মহিলাকে। এর মধ্যে দেখা হলে মৌখিক হাসি বিনিময় হতো আর মাঝেমধ্যে একটা দুটো করে কথা। মহিলা রাজীবের মনে চেপে বসে থাকা বরফের চাঁইটাকে একটু একটু করে গলাতে শুরু করল।

এর পর হঠাৎ করেই তিন-চারদিন আবার দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল রাজীব। বারান্দার দরজাও রাতদিন বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় রাজীবের মন কেঁপে উঠল।

মহিলার ফ্ল্যাটে যাওয়া উচিত হবে কিনা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না রাজীব। হঠাৎ দরজায় কলিংবেল-এর আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখল ওই মহিলার বাড়ির কাজের মাসি সামনে দাঁড়িয়ে

সাহাব, একবার ওই ফ্ল্যাটে চলো। মেমসাহেবের শরীর খুব খারাপ, কী করব আমি বুঝতে পারছি না। এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলে ওঠে মাসি।

রাজীব তত্ক্ষণাৎ মহিলার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় মাসির সঙ্গে। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মহিলা, দেখে হুঁশ আছে বলে মনে হল না।

কোনও ডাক্তার দেখেছে? চিন্তিত হয়ে মাসিকেই জিজ্ঞেস করে রাজীব।

মাথা নাড়ায় মাসি।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলে রাজীব। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধপত্র সব লিখে দিয়ে যান। ওষুধগুলো মাসিকে দিয়ে আনিয়ে নেয় রাজীব। পালা করে মাসির সঙ্গে মাথায় জলপট্টি করতে থাকে যাতে জ্বরের পারদ একটু নামে। ডাক্তারবাবুর ওষুধগুলো একটা একটা করে খাইয়ে দেয় মহিলাকে। ধীরে ধীরে জ্বর কিছুটা কম হলে রাজীব নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।

পরের দিন মহিলাকে একটু সুস্থ দেখে রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনার আত্মীয় কেউ আছেন যাকে খবর দিতে হবে? আপনি বললে আমি ফোন করে দিতে পারি। হালকা করে মাথা নেড়ে না বলে মহিলা। সুতরাং তার খাওয়াদাওয়া, সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়ানোর দাযিত্ব রাজীব নিজের উপরেই নিয়ে নেয়। রাজীব বুঝতে পারছিল এর ফলে মহিলা সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যার জন্য কিছু বলতে পারছে না।

চারদিন পর রাজীব মহিলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখল, এতদিন পর বিছানায় উঠে বসেছে মহিলা। অনেক সুস্থ লাগছে ওকে। রাজীব ঘরে ঢুকতেই মহিলা বলে উঠল, আপনাকে এতদিন ধরে অনেক কষ্ট দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।

ক্ষমা কীসের জন্য? প্রতিবেশীই তো প্রতিবেশীর কাজে আসে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।

হ্যাঁ, ভাবছি কালকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরশু থেকে অফিস জয়েন করব। কোনও কিছুর দরকার আছে কিনা জেনে নিয়ে রাজীব অফিস বেরিয়ে পড়ে।

এর পর মেলামেশা আরও একটু গাঢ় হয়। একসঙ্গে ডিনার সারা, একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করা ওদের দুজনের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।

জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল রাজীব। আকাশ এত নীল আগে কখনও খেয়াল করেনি। হয়তো কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার কথাই মনে হয়নি। হৃদয়ে যখন শূন্যতা জায়গা জুড়ে বসে তখন সবকিছুই কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কয়েক মাস হল আকাশে রঙের আনাগোনা লক্ষ্য করছে রাজীব।

আজ সন্ধেবেলা দুজনে ডিনারে যাওয়ার কথা আছে। এতদিন ধরে মেলামেশা করছে, রাজীবের মনে হল আজ পর্যন্ত সঙ্গিনীর নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য দুজনের কেউই আজ পর্যন্ত নিজেদের অতীত নিয়ে কখনও কথা তোলেনি।

ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা বলা শুরু করলে রাজীবই প্রসঙ্গ তুলল, এতদিন হয়ে গেল, আপনার নামটাই এখনও জানা হল না।

অনসূয়া, হাসিতে ভরে গেল মহিলার মুখ।

বাঃ, ভারী সুন্দর আপনার নাম। অত্রি মুনির স্ত্রী ছিলেন সতীসাধ্বী অনসূয়াদেবী। রামায়ণে আমরা তাঁর বর্ণনা পাই, আপনিও নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন?

মায়ের মুখে এই গল্প বহুবার শুনেছি। হেসে উত্তর দেয় অনসূয়া।

কথা বলতে বলতেই খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দেয় রাজীব।

আরও কিছু বলুন নিজের সম্পর্কে। আমরা কেউই একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবেই বলুন! সামান্য দ্বিধা নিয়ে কথাগুলো বলে রাজীব।

অনসূয়া চোখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে থাকে।

ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলতে হবে না, ব্যস্ত কণ্ঠে রাজীব বলে ওঠে।

না না, সেরকম কিছু নয়। এতদিনে এইটুকু বন্ধুত্ব তো হয়ে গেছে। আমি নিজের কথা আপনাকে খুলে বলতে পারি। চলুন, খাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে সব বলব। চোখ নীচে নামিয়ে অনসূয়া কিছুটা সময় চেয়ে নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে।

খাওয়ার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অনসূয়া তারপর ধীর স্বরে বলতে আরম্ভ করল, আমরা দুজনেই এমবিএ করছিলাম। ছেলেটিও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমরা লিভ ইন করতে শুরু করি। আমার মা-বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল এই সম্পর্ক থেকে সরে আসার জন্য। প্রচুর বকাবকিও করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। মা আমাকে বুঝিয়েছিল যে, বিয়ের পর আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি কিন্তু আমিই শুনিনি।

আমার মনে হয়েছিল, যখন দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তখন বিয়ের বন্ধনের দরকারটা কোথায়? এছাড়া তখন বিয়ে করা সম্ভবও ছিল না। মা-বাবা রাগ করে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর পর আমরাও চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু আলাদা আলাদা শহরে। চেষ্টা করছিলাম দুজনের চাকরি যাতে এক শহরে হয়।

আমার বয়ফ্রেন্ড কখনও ছুটি পেলে আমার কাছে চলে আসত, কখনও আমি ওর কাছে চলে যেতাম। এই ভাবে প্রায় একটা বছর কেটে যায়। তার পর হঠাৎই খেয়াল করি ও না আসতে পারার জন্য রোজ নতুন নতুন বাহানা দিচ্ছে। একটু জোর দিতেই ও স্বীকার করে নেয়, অন্য একটি মেয়েকে নাকি সে এখন ভালোবাসে। এটা কী করে সম্ভব? আমি তো জানতাম ভালোবাসার আনন্দ একবারই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। দ্বিতীয়বার কি আর কখনও সেভাবে ভালোবাসা যায়? আপনিই বলুন…। কথা বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢাকে অনসূয়া।

রাজীব অনসূয়ার হাত ধরে সামনে থাকা একটা বেঞ্চের উপর বসিয়ে দেয়।

না না আপনিই বলুন দ্বিতীয়বার কি আর ভালোবাসা আসে জীবনে? অশ্রুসজল নয়নে অনসূয়া প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় রাজীবকে।

উত্তর দেয় না রাজীব। দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে সে। অনসূয়া ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠে, তার মানে আপনি বলতে চান প্রথমটা ভালোবাসা ছিলই না। শুধুই শরীরী আকর্ষণ মাত্র!

না আমি সেরকম কিছু তো বলিনি, তবে ভালোবাসা…, চুপ করে যায় রাজীব।

হ্যাঁ, ভালোবাসা… কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন। অনসূয়ার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।

আমিও এতদিন এটাই বিশ্বাস করতাম, গভীর নিঃশ্বাস নেয় রাজীব। যে ভালোবাসা জীবনে একবারই আসে। আমিও প্রাণের থেকে স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মৃত্যু হয়। তখন মনে হয়েছিল এটাই আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা যতদিন না… বলতে বলতে রাজীব চুপ হয়ে যায়।

যতদিন না… একরাশ প্রশ্ন নিয়ে অনসূয়া রাজীবের দিকে তাকায়। রাজীব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

কী হল, বললেন না? তাহলে কি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসেন? অনসূয়ার দৃষ্টির গভীরতা রাজীবকে বিদ্ধ করে।

হঠাৎ রাজীব তাড়া দেয় অনসূয়াকে, চলুন রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফেরা যাক।

অনসূয়া রাজীবের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলে, আগে কথা শেষ করুন।

অনেক রাত হল, এবার ফেরা যাক।

না, আগে আমাকে বলুন, অধীর হয়ে ওঠে অনসূয়া।

কী বলব। হ্যাঁ ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি অনসূয়া। উত্তেজিত হয়ে রাজীব বলে ওঠে, চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

না, না এ কিছুতেই হতে পারে না! অনসূয়া ছেড়ে দেয় রাজীবের হাত।

অনসূয়া শোনো, তোমার প্রতি আমার এই অনুভতি যে তোমারও থাকবে এই দাবি কখনও-ই করি না। আমার এই অনুভতি যে আমাদের বন্ধুত্বের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না সেটা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

পরের দিন দুজনের দেখা হলেও কথা বলার খুব একটা সুযোগ হল না। রাজীবও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিন অনসূয়া জানাল, তাকে পাঁচদিনের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে মায়ের শরীর খারাপের খবর আসাতে রাজীব ছুটি নিয়ে বেঙ্গালুরু চলে এল। মেয়েকে এই প্রথম নিজে থেকে কোলে তুলে নিল রাজীব। আজ এই প্রথমবার তার মনে হল না এই মেয়ের জন্যই সে সঞ্জনাকে হারিয়েছে চিরজীবনের মতো। মনে আজ আর কোনও বিদ্বেষ নেই, রাজীব মনে শান্তি অনুভব করল। সঞ্জনার স্মৃতি আজ দুঃখ দিল না। বরং তার মনে হল, সঞ্জনা জীবনে পুরো ভালোবাসা পেয়ে যেতে পেরেছে। এই সন্তান সঞ্জনার অস্তিত্ব নয় বরং রাজীবের জীবনের একটা অংশ এবং এই অংশকে কোনওদিন অবহেলা করার নয়, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল রাজীব।

রাজীবের মা-ও ছেলের এই পরিবর্তন ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন। পুরোনো আগের সেই রাজীবকে ফিরে পেয়ে উনিও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এক সপ্তাহ সকলের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে রাজীব ফিরে এল মুম্বই।

সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে তাড়াতাড়ি স্নানে ঢুকেছিল রাজীব। তখনই টের পেল বারবার কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে বাথরোব পরে নিয়ে রাজীব বাইরে বেরিয়ে এল। যে-কেউই দরজায় থাক না কেন অপেক্ষা করতে রাজি নয় বেশ বুঝতে পারছিল।

দরজা খুলতেই দেখে অনসূয়া দাঁড়িয়ে, একপ্রকার রাজীবকে ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এল সে। রাজীব দরজা বন্ধ করতেই চেঁচিয়ে উঠল রাজীবের উপর।

কোথায় চলে গিয়েছিলেন? বলেও যাননি কিছু? ফোন নম্বরও দিয়ে যাননি। আপনার কোনও আইডিয়া আছে, আমার অবস্থা কী হতে পারে? চিন্তা করে কোনও কুল পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না তো? এমনিতে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন অথচ একবারও আমার চিন্তা আপনার মাথায় এল না? বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনসূয়া।

সামান্য হেসে এগিয়ে এসে রাজীব অনসূয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এতদিনে ভালোবাসাও অনসূয়ার হৃদয়ের আঙিনায় জানান দিয়ে গেছে, আবার আসিয়াছি ফিরে।

 

পৌনঃপুনিক

আত্মহত্যা করার জন্য দমদমে রেল-লাইনের ধারে এসে দাঁড়াল অম্বরীশ। রাত তখন দশটা বেজে গেছে। মাঘ মাসের রাত। বেশ ঠান্ডা। অম্বরীশের হাতে সিগারেট। একটা লম্বা টান দিতেই, আগুনটা জোরালো হল। সেই আগুনের হালকা আলোয় দেখতে পেল, তিনটে ইটের ওপর মাটির হাঁড়ি রেখে লাইনের ধারে ঝোপের পাশে একটা লোক ভাত রান্না করছে। পাশে একটা বাচ্চা খেলা করছে।

অম্বরীশের মায়ের কথা, বেশি করে, মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে। পরক্ষণেই শক্ত করে নিচ্ছে নিজেকে। না হলে সে পারবে না। সবাইকে নিজের কাছে খারাপ করে তুলতে হবে। মনকে বিষিয়ে নিতে হবে। অনুভূতিটাকে কেউ ভালোবাসে নার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। অম্বরীশ ভাবে, শুধু তো মালবিকার বাবা-মা নয়, আমার নিজের বাবা-মা-ও তো ষড়যন্ত্রী। তারাও তো একবারও ভাবেনি মালুকে না পেলে অম্বুর কতটা কষ্ট হবে!

আজকে এই বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে এখনও রাশি, গণ, গোত্র, কুষ্ঠির দোহাই দিয়ে একটা প্রেমকে ওরা হত্যা করল। অম্বরীশ শুধু একটা রহস্যই ভাবতে লাগল যে, কীভাবে ভবিষ্যতের অকল্যাণের ভয় দেখিয়ে ওরা মালবিকাকে রাজি করাল। দূরে সরিয়ে দিল আমার থেকে। এক কথায়, ওর বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। আমি হাতজোড় করে, বুক চিরে মনটা দেখাতে চেয়েছি, কেউ করুণা করেনি। আজকে সব শেষ করে বুঝিয়ে দেব, আমাদের কীসে কল্যাণ।

যে-মালবিকার ভোরবেলা ভৈরবী রাগের আরোহণ, অবরোহণের প্রতিটি স্বরনিক্ষেপ জানলা দিয়ে ভেসে এসে হৃদয় আন্দোলিত করে দিত। প্রথম বুঝেছিলাম কর্ণ একটা ইন্দ্রিয়। সামান্য হলুদ জামাটা বারান্দায় একবার চোখের দেখা দেখলে বুঝতাম ইন্দ্রিয়সুখ কাকে বলে। গত অষ্টমীতে, পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেবার সময় যে-গন্ধটা পেয়েছিলাম, সেটা আজও নাকে স্পষ্ট। গত বছর দোলে মালু বুঝিয়ে দিয়েছিল, জিহ্বা, ত্বক সবই ইন্দ্রিয়। সেই মালবিকাকে তোমরা কেড়ে নিলে! শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।

পাঁচ নম্বর রেল লাইনের দিকটা নির্জন কিন্তু অনেকক্ষণ কোনও ট্রেন আসছে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার; গত বছর সরস্বতী পুজোয় শাপমোচন নৃত্যনাট্যর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আলোকের এই ঝরনাধারায় গানের সাথে আলতার ফোঁটা দেওয়া নরম ফর্সা রক্তাভ ওই পেলব হাতের যে-নৃত্যভঙ্গিমা আজও আমার বুকে মোচড় দেয়, সেই হাত দুটো আজ মঙ্গলঘটে অন্য পুরুষের হাতের ওপর। এ অসম্ভব! এ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।

আমি মঞ্চের পিছনে অন্ধকারে ভাষ্যপাঠ করছি, গন্ধর্বকুমার, অরুনেশ্বরের কথা কমলিকাকে…। কিন্তু না! কেন এত ভালো হচ্ছে, আমি জানি। আসলে অম্বরীশ তো মালবিকাকেই বলছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাচের সাথে, মালবিকার যে-হাসিটা আমি প্রাণভরে দেখেছি, সেটার জন্য, শুধু সেটার জন্য, আমি এক পৃথিবী সুখ হেলায় ছেড়ে দিতে পারি। ওই তো! ট্রেন আসছে। অম্বরীশ প্রস্তুত। একবার আকাশের দিকে তাকাল, চাঁদের দিকে, নাকি তার জ্যোত্স্নার দিকে। বিদায় পৃথিবী। ঝাঁপ দিয়ে দিল অম্বরীশ।

চোখে একটা ঠান্ডা জলের ঝাপটা। তা-ও চোখ খুলতে পারছে না অম্বরীশ। মাথার পিছনে অসহ্য একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ধীরে ধীরে একটু ফাঁক করল চোখটা। আবার সেই একই চাঁদ-টা মুখের ওপর। তবে জ্যোত্স্না-টা এবার ভেজা। সেই পাগলাটে ধরনের লোকটা, মুখটা ওর মুখের কাছে নিয়ে এসে পরিষ্কার ঝকঝকে বাংলায় বলল, মরতে যাচ্ছিলেন কেন? পৃথিবীতে এমন কোনও কারণ হতে পারে না, যা থেকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। মৃত্যু কোনও সমাধান নয়, ওটা হেরে যাওয়া। বাঁচার রসদ সবসময় আছে, মানুষ খুঁজে পায় না। আপনার ইচ্ছে করলেও আপনি চিরকাল বাঁচতে পারবেন না। এত তাড়া কীসের? অম্বরীশ বোকার মতো তাকিয়ে আছে।

আমার গল্প শুনলে তাহলে আপনি কী করবেন?

অম্বরীশ ধীরে ধীরে উঠে বসল।

লোকটি শুরু করল, আমি মালদার বাসিন্দা। কলেজের পড়াশোনা শেষ করে, একটা ছোটো চাকরি নিলাম। মন বসছিল না সেই চাকরিতে। নিজের ব্যাবসা ছোটো করে শুরু করলাম। একটা ছোটো ঘর নিয়ে এসটিডি বুথ করলাম। ফ্যাক্সও বসালাম। বেশ ভালো চলছিল। বিয়ে করলাম। একটি ছোটো ফুটফুটে মেয়ে হল। মেয়ে আমার লক্ষ্মী। পেজার-এর ব্যাবসায় নামলাম। ব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। বাড়ি, দোকান, ব্যাংক-এ বন্ধক দিয়ে অনেক টাকা লোন নিয়ে ব্যাবসায় পুঁজি বাড়ালাম। পেজার তখন মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হতো। প্রচুর টাকার মাল, সস্তায় তুললাম। হঠাৎ বাজারে এল মোবাইল। ধীরে ধীরে তার দাম, কলচার্জ সব কমতে লাগল। মানুষ পেজার ছেড়ে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এসটিডি, ফ্যাক্স সব ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করল। যাদের পুঁজি অনেক বেশি, তারা লাইন চেঞ্জ করতে পারল।

প্রচুর ছোটো ব্যবসায়ী নিঃশব্দে নিঃস্ব হয়ে গেল। আমার বাড়ি দোকান সব চলে গেল। সংসারে শুরু হল চরম অশান্তি। স্ত্রী একদিন মেয়েকে নিয়ে বিষ খেল। সব শেষ। ছমাসের মধ্যে আমার সুন্দর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। ওখানে আর লজ্জায় থাকা সম্ভব নয়। অল্প

যে-টাকাপয়সা ছিল, সঙ্গে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে।

মাস ছয়েক হল এই দমদম স্টেশনে এসেছি। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেঁচে থাকার শক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলাম। একদিন মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সব যখন শেষ হয়ে গেছে,আর এভাবে জীবনকে টেনে লাভ নেই। সেই সময় ঈশ্বর বাঁচার রসদ জুগিয়ে দিলেন। ওই বাচ্চা মেয়েরা। কে যেন ফেলে দিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে ওকে নিয়ে আছি।

দু-তিনটে দোকানে ফাইফরমাস খাটি। ভালোই আছি। রান্না করি, দুজনে খাই। তবে এবার ওই সামনের বস্তিতে একটা ঘরভাড়া নেব।

অম্বরীশ মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে নিয়েছে। এবার যেন জীবনকে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল।

বিশ বছর কেটে গেছে। যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে কিছুদিন পর চাকরি নিয়েছিল অম্বরীশ। বাবা-মার অনুরোধে সংসারও পাতল। স্ত্রী অতসী। ভারী ভালো মেয়ে প্রেমিকার গুণ কম থাকলে, স্ত্রীগুণ বেশি থাকে মেয়েদের। সেটাই সংসার গড়তে বেশি কাজের। আর ছেলেদের কথা আমি লিখতে পারব না, কারণ কোনও ক্ষেত্রেই আমি সফল নয়। যে-সব পুরুষের কাছে সেই শংসাপত্র আছে, অন্তত পরিপূর্ণ প্রেমিক বা সফল স্বামী যে-কোনও একটা বা দুটোই তকমা আছে তারা বলতে পারবে। ওদের দুটো

ছেলে-মেয়ে আছে। বজ্র, আর বৃষ্টি। ছেলে বড়ো, মেয়ে ছোটো। এখন অম্বরীশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দক্ষিণ কলকাতায় থাকে।

ওদিকে মালবিকার বিয়ে হয়েছিল মযূখের সাথে। মযূখ ব্যাংক-এ চাকরি করে। যাদবপুরে নিজেদের বাড়ি। ওদের একটাই ছেলে। মৈনাক, ডাক্তারি পড়ে। মালবিকা বরাবরই নাচে গানে পারদর্শী। ছেলেকে তবলা শিখিয়েছে। ভালোই বাজায়।

ঘটনাটা ঘটল একদিন প্যান্ট কাচতে গিয়ে মালবিকার বরাবরের অভ্যাস সব পকেট হাতড়ে তারপর ওয়াশিংমেশিনে দেওয়া। মৈনাকের প্যান্টে মানিব্যাগটা থেকে গেছে। ব্যাগের ভেতরের খাপে একটি মেয়ে ফটো। মুখটা মালবিকার খুব চেনা। কিন্তু কোথায় দেখেছে, মনে করতে পারছে না।

মেয়ে বন্ধু এখন সব ছেলেরই অনেক থাকে। সবই এখন কো-এডু স্কুল। সেই আগের পাঁচিল এখন ভেঙে গেছে। আগে যেমন আইবুড়ো ছেলেমেয়ে কথা বললেই, বড়োরা ভাবত প্রেম করছে। আর এখন প্রেম করলেও কথা বলে না। সবটাই তরঙ্গবাহিত। ডিজিটাল প্রেম। তবে প্রেম করলে, সাজ বাড়বে, আর গলায় সুর না থাকলেও একটু গুন গুন করবেই। মালবিকারও ছেলের হাবভাব কিছুদিন হল ভালো ঠেকছিল না।

মৈনাক বাথরুমে ঢোকার পর ওর মোবাইলটা দেখল মালবিকা। একটা মেসেজ রয়েছে একটা নাম্বার থেকে, প্রোফাইলে কোনও ছবি নেই। একটা গোলাপ ফুলের ফটো। লেখা রয়েছে বৃষ্টি ঠিক সময়ে আসবে, তুমি দেরি করবে না।

বাথরুম থেকে বেরাবোর পর মালবিকা সরাসরি মৈনাক-কে জিজ্ঞেস করল, মানিব্যাগের ভেতর ছবিটা কি বৃষ্টির? এসব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার সেরা উপায় হল আক্রমণাত্মক হওয়া। স্বাভাবিক ভাবেই মৈনাক সেই রাস্তাই নিল। বলে উঠল, কে বৃষ্টি?

মালবিকা অনেক বুঝিয়ে বলল, এটা কোনও অপরাধ নয়। আসলে এখনকার অভিভাবকরা অনেক আধুনিক। সাহস পেয়ে মৈনাক স্বীকার করল। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। পুরো নাম বৃষ্টি সেনগুপ্ত।

এক নিঃশ্বাসে মালবিকা প্রশ্ন করল, বাবার নাম?

অম্বরীশ সেনগুপ্ত।

মুহূর্তে, তদন্ত করতে গিয়ে নিজের মুখটাই অপরাধীর মতো হয়ে গেল মালবিকার। মুখে আচ্ছা বলে নিজেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নিল। চোখ দুটো কিন্তু অম্বরীশের মতো টানা আর উজ্জ্বল। তবে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বৃষ্টির নাম্বারটা আগেই টুকে রেখেছে। মৈনাক বেরিয়ে যাবার পর, অনেক দোটানা কাটিয়ে মালবিকা বৃষ্টি-কে ফোন করল।

হ্যালো? আমি মৈনাকের মা বলছি।

হ্যাঁ আন্টি, বলো…।

মালবিকা ভাবল নতুন প্রজন্মের মেয়েরা কত চৌখস। জানা নেই, শোনা নেই, দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়া একটা মেয়ে প্রথমেই তুমি, আর কী আপন সম্মোধন!

তুমি মৈনাককে চেনো?

হ্যাঁ আন্টি, আমি তো ঢাকুরিয়া কলাকুঞ্জে নাচ শিখি। ওখানেই আলাপ।

মৈনাক কি তোমার বন্ধু?

হ্যাঁ, আমাদের নাচের ক্লাসে তবলা বাজায় তো।

জানি, তোমরা কি শুধুই বন্ধু?

হ্যাঁ আন্টি, মৈনাকদা খুব ভালো ছেলে।

মালবিকা মনে মনে ভাবল, অম্বরীশের মেয়েটা খুব পাকা হয়েছে তো! ওইটুকু মেয়ে দুমিনিটে ফোনেই মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। মেয়েটিকে ভালো লাগছে মালবিকার। দেখতেও বেশ চটক আছে। মালবিকা ওর বাবার ফোন নাম্বারটা চাইল।

এবার একটু ভয় পেয়েছে বৃষ্টি! জিজ্ঞেশ করল, কেন আন্টি? না মানে; আমি কিন্তু কোন ইয়ে..

তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার বাবা তোমায় একটা কথাও বলবে না। আমি কথা দিলাম।

বাবা বকবে না তো আন্টি?

না রে বাবা, তোর কোনও ভয় নেই। ফস্ করে মুখ থেকে তুই বেরিয়ে গেল মালবিকার। বৃষ্টি, ওর বাবার নাম্বার পাঠিয়ে দিল।

মালবিকা ভাবছে, এই মেয়ে তুলনায় ওর ছেলে তো ভীষণ বোকা। আসলে, ছেলেরা পুরুষ হয় বিয়ে পর। আর মেয়েরা বযঃসন্ধিতেই নারী হয়ে যায়। তবে মেয়েটি ভারি মিষ্টি। অম্বরীশকে কি ফোন করা উচিত হবে? মযূখ যদি জানতে পারে। মযূখ ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। পরক্ষণেই ভাবল, একজন অভিভাবক আর একজন অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করবে, এতে বিশ্বাসভঙ্গের কোনও ব্যাপার নেই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অম্বরীশকে ফোনটা করেই ফেলল মালবিকা।

হ্যালো… হ্যালো… হ্যালো…? কথা বলতে পারছে না মালবিকা।

অম্বরীশ গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করত। এখন গলা আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। মালবিকার গলা কেঁপে গেল।

আ…মি মালু।

ওপারেও নীরবতা। তারপর ভীষণ আস্তে। কেমন আছো?

সুখের সংসারে যেমন সবাই ভালো থাকে। তোমার খবর বলো।

ভালোই। আমার নাম্বার পেলে কোত্থেকে?

বৃষ্টি দিয়েছে।

তুমি বৃষ্টিকে চেনো?

হ্যাঁ, কলাকুঞ্জে আমার ছেলে তবলা বাজায়।

একদিন দেখা করবে?

বলো… কোথায়?

শনিবার বিকেল চারটে, গড়িয়াহাট আনন্দমেলা।

আসার আগে ফোন করে নিও। আমি এখন অন্যের বউ, তোমার প্রেমিকা নয়। বলে হাসল।

ফোন রেখে মালবিকা ভাবতে লাগল, সে আবার দুর্বল হয়ে পড়বে না তো! পরক্ষণেই ভাবল, জীবনের মধ্যাহ্বে যে-উত্তাপকে সে চেপে রাখতে পেরেছে, এখন এই গোধূলি বেলায় রং ছড়াতে পারে বড়োজোর, রঙিন করতে পারবে না।

কেন জানি না! আজ একটু অন্যরকম সাজল মালবিকা। আবির রঙের ফিনফিনে সিফনের শাড়ি, সঙ্গে ফিরোজা ব্লাউজ। পিঠে একরাশ খোলা চুল। কয়েক গোছা অবাধ্য কপালের ওপর। চল্লিশ পেরিয়ে শাঁখের মতো বক্ষ। কলকে ফুলের মতো নাভি। মনকে যতই অভিভাবক বলে সান্ত্বনা দিক, পুরোনো ব্যথা সারে না। আজকে আয়নায় একটু বেশিই দেখছে নিজেকে। হয়তো আর একবার একটু দুর্বল করতে চাইছে অম্বরীশকে। এমনিই…।

ঠিক বিকেলবেলা গড়িয়াহাট মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। দূর থেকে দেখল, অম্বরীশ আসছে। বরাবরই গম্ভীর প্রকৃতির। গাম্ভীর‌্যটা আরও বেড়েছে। দুজনে চোখাচোখি হল। পুরোনো হিন্দি সিনেমায়, মেলায় বা নৌকাডুবিতে হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাইকে খুঁজে পেলে যে-দৃষ্টি বিনিময় হতো, ঠিক সেই ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুজনে গিয়ে কফি ক্যাফে ডে-তে বসল। দু-একটা কথা বলার পরেই স্বাভাবিক নারীসুলভ প্রশ্নটাই করল মালবিকা, তোমার বউয়ের কথা বলো।

অম্বরীশ বলল, ভালো।

আমার থেকে সুন্দরী?

মোবাইলে অতসীর ছবিটা দেখাল, তারপর বলল, পাহাড়ও সুন্দর, আবার সমুদ্রও সুন্দর। এর তুলনা চলে না। এক জায়গায় ঢেউ বিশেষ মুহূর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, অপর জায়গায় অনন্তকাল ধরে তরঙ্গ গতিশীল।

বাব্বা! এখনও সেই গম্ভীর গলায় ভারী ভারী কথা।

যাকগে, তোমার কথা বলো।

মযূখ দারুণ মানুষ। ছেলেটাকেও ভালো মানুষ করেছি। ঠিকই আছে। আচ্ছা, আমাদের বিয়ে হলে কি আমরা বেশি সুখী হতাম?

প্রেমের শ্রেষ্ঠ পরিণতি বিরহ, বিবাহে তার মৃত্যু। সংসারে একটা সুখের অভ্যাস আছে, বিরহবেদনায় একটা বিলাস আছে। দৈনন্দিন জীবনের বিক্ষিপ্ত মনামোলিন্য, কখনও হতে পারে তিক্ত। কিন্তু সেটার অভাবে তুমি আরও বেশি রিক্ত।

তাহলে মশাই, আমদের ছেলে-মেয়েরা যে প্রেম করছে তার কী হবে?

মনে করো না একই হিমবাহ থেকে তৈরি দুটো ঝরনা। নদী হয়ে কিছুটা যাবার পর আবার সমুদ্রে মিশছে। ওদের-কে এখন ওদের মতো ভাসতে দাও।

মালবিকা অম্বরীশের হাতের ওপর হাত রাখল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। গোধূলির আকাশে শরীর না মিললেও, দিগন্তে রক্তের সাথে রক্ত মিশে যাচ্ছে।

হাত্থি ঠাকুরের গল্প

আলের উপর দিয়ে হেঁটে পিচের রাস্তার দিকে যাচ্ছিল জিয়ন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেঘ জমছে। যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সকালবেলায় খটঙ্গা গ্রাম থেকে ও যখন বেরিয়েছিল, তখন ঝকঝকে রোদ্দুর। সাইকেল চালিয়ে ওর খেত জমিতে আসার সময় দরদর করে ঘামছিল। জিয়ন তখন মনে মনে মারাংবুরুর কাছে প্রার্থনাও করেছিল, যেন দু’একদিনের মধ্যে বৃষ্টি নামে। অনেক কষ্টে সেচের জল এনে ধান রুয়েছে। সেই ধানগাছ এখন হাঁটুর সমান বেড়ে উঠেছে। জলের অভাবে যেন শুকিয়ে না যায়। কানালি জমি এমনিতে নীচু, ধানচাষ খুব শক্ত। কিন্তু, উপায় নেই। বাপ-ঠাকুদ্দার রেখে যাওয়া জমি জিয়ন শুখা ফেলে রাখবে কী করে?

পিয়াল গাছের নীচে সাইকেলটা রাখা আছে। বৃষ্টি নামার আগেই ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। বছর দুয়েক আগে পুবের দেশে জনমজুরি খাটতে গিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল জিয়ন। তখনই বর্ধমানে ঠিকাদারের এক সর্দারের কাছ থেকে ও পুরোনো সাইকেলটা কেনে। এখন খুব কাজে লাগছে। খেতের নজরদারির জন্য যখন-তখন ও চলে আসতে পারে। সাইকেল নিয়ে হুটহাট ঝালদা শহরে চলে যায়। চাষ দফতরের বাবুদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। আজকাল সরকার থেকে বিনে পয়সায় বীজধান পাওয়া যায়। প্রয়োজনমতো রাসায়নিক সার ইউরিয়া আর কীটনাশকও। ঠিক সময়ে পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত আপিসে গিয়ে মুরুব্বিদের তোয়াজ করতে হয়। এ বারই যেমন, এখনও ইউরিয়া পাওয়া যায়নি। জিয়ন ভেবে রেখেছিল, বাড়ি ফিরে কিছু মুখে দিয়ে একবার ঝালদা শহরে যাবে। কবে ইউরিয়া পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু, বৃষ্টি নামলে যে বাড়ি থেকে ওর আর বেরোতেই ইচ্ছে করবে না।

সাইকেল নিয়ে পিচের রাস্তায় উঠে আসার সময়ই জিয়ন দেখতে পেল, উলটো দিক থেকে সুবোধ খুটদার মোটর বাইকে করে আসছেন। মাঝবয়সি, পঞ্চায়েতের মেম্বার। থাকেন ওদের খটঙ্গাতেই। বদমাশ টাইপের লোক। মানুষটাকে দেখেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল। উনি এদিকে কোত্থেকে আসছেন? নিশ্চয় আনন্দপুর আশ্রমে গিয়েছিলেন। আবার কোনও অশান্তি ঘটাতে না কি? আশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সম্পর্ক খুব খারাপ। দোষটা খুটদার খুড়াদের মতো লোকেদেরই। সন্ন্যাসীরা গেরামের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করতে চান। রাস্তা-ঘাট, স্কুল, টিউবওয়েল বসানো। কিন্তু খুটদার খুড়ারা ওঁদের কিছুতেই করতে দেবেন না। আশ্রমের জিপগাড়ি নাকি অনেকদিন আগে একবার চাপা দিয়েছিল একটা বাচ্চাকে। তারপর থেকে মুরুব্বিরা আশ্রমের উপর খাপ্পা।

খুড়াকে আসতে দেখে জিয়নের মনে হল, যাক, ঝালদায় যাওয়ার ঝামেলা তা হলে আর পোয়াতে হবে না। উনি নিশ্চয়ই খবর দিতে পারবেন ইউরিয়া সম্পর্কে। জিয়ন দ্রুত রাস্তায় উঠে এল যাতে খুটদার খুড়া ওকে দেখতে পান। বাইক কাছে এসে দাঁড়াতেই খুড়ার গলায় মোটা সোনার চেনটা ওর চোখে পড়ল। এই বছর তিনেক আগেও বাজারে খুড়ার টেলরিং শপ ছিল। পঞ্চায়েতে ঢোকার পর উনি অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন। ও কিছু বলার আগেই বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে খুটদার খুড়া বললেন, ‘তু কুত্থায় থাকিস রে জিয়ন? পরশু মিছিলে এলি না ক্যানে? মুর্মুদা তুর নামে কাইল যা তা কইছিলঅ পঞ্চায়েত আপিসে।’

মিছিলের কথা মনেই ছিল না জিয়নের। পার্টির লোকজন বাড়ি বয়ে এসে বলে গিয়েছিল বটে। দিল্লির সরকার টাকা পাঠাচ্ছে না। একশো দিনের কাজের প্রোগ্রাম আটকে গিয়েছে। গাঁয়ের লোকেদের কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতিবাদ মিছিল খটঙ্গা, মারামু, বেরাদি… আশপাশের গ্রাম থেকে বেরিয়ে ঝালদার দিকে যাবে। ওই মিছিলে যাওয়াটা কত জরুরি, অনেকক্ষণ ধরে তা বুঝিয়েছিলেন স্কুলের মাস্টার দশরথ মুর্মু। বলেছিলেন, বেলা দশটার সময় স্কুলের মাঠে হাজির হতে। কিন্তু আগের রাতে বুধিরামের বাড়িতে পরব ছিল। একটু বেশি হাঁড়িয়া খাওয়া হয়ে গিয়েছিল জিয়নের। ঘুম থেকে উঠতেই সেদিন বেলা এগারোটা। সত্যি কথা বলতে কী, মিছিলের কথা মনে থাকলেও ও যেত কি না সন্দেহ। পঞ্চায়েতের সব শালা হারামখোর।

কথাটা বললে সুবোধ খুটদার চটে উঠতে পারেন। তাই ও বলল, ‘শরীলটা জুত ছিল না খুড়া।’

‘ই কথা কইলে চইলবে?’ খুটদার খুড়া বললেন, ‘মিটিন ত তুদের জন্যেই। তুরা যাতে কাজকম্ম পাস, তার জন্যঅ। তুদের মতো জুয়ান মরদরা যদি লা আসিস, মোদের খেইটে লাভ কী?’

খুড়ার গলায় বিরক্তির ঝাঁঝ। শুনে মুখ নীচু করে রইল জিয়ন। মুর্মু খুড়া ওর নামে কী বলেছেন, সেটা শোনার খুব কৌতূহল হল ওর। কিন্তু সে কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। মুর্মু খুড়া ইদানীং স্কুলে পড়ানোর থেকে অনেক বেশি সময় দেন পার্টির কাজে। আর সুযোগ পেলেই ওকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে খুটদার খুড়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘তু লা কি আইজগাল রুজ সন্তোষ হাঁসদার ঘরকে যাচ্ছিস? মুর্মুদা কইছেল। ই তো ভালো কতা লয় বাপ।’

প্রশ্নটা করেই খর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুবোধ খুটদার। যেন জরিপ করে নিচ্ছেন। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। ইদানীং মাঝে মাঝেই ওকে সন্তোষ খুড়ার বাড়িতে যেতে হচ্ছে। খুড়া এখন ঘরছাড়া। পার্টিগত বিবাদ। উনি আশ্রয় নিয়েছেন বলরামপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সন্তোষ খুড়ার মেয়ে রাইমণি বাড়িতে এখন একা। মিত্তিরবাবুদের বাড়িতে কাজ করে। সেইসঙ্গে শুয়ারের খোঁয়াড় করেছে। সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই কখনও সখনও রাইমণি ওকে ডেকে নিয়ে যায়। এই লোকগুলো কি তাহলে রাইমণির পিছনেও লেগেছে! গেরাম থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে না কি? যদি তা করে, তা হলে কিন্তু ও ছেড়ে দেবে না। রাইমণিকে ও প্রথম দেখে চাকলাদাঁড়ি পরবের সময়। অন্য মেয়াদের সঙ্গে ঝিকা নাচছিল। সেদিনই জিয়ন ঠিক করে ফেলেছিল, বিহা যদি করে, তো এই মেয়াকেই করবে। খুড়ার প্রশ্ন করার ধরনটা জিয়নের ভালো লাগল না। ও কার বাড়িতে যাবে, সেটা পঞ্চায়েতের লোকেরা ঠিক করে দেবে না কি?

কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে খুটদার খুড়া ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইল না ক্যানে?’

আকাশে মেঘ গুড়গুর করে উঠল। জিয়নের বুকের ভিতরে রাগটাও। মুখ কঠিন করে ও তাকাল। ওর মুখ দেখে খুটদার খুড়া কী বুঝলেন, কে জানে? আকাশের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, বাইকের ইঞ্জিন চালু করে, খানিকটা বোঝানোর ভঙ্গিতেই খুড়া বললেন, ‘সন্তোষের মেয়াছেনাটা ভালো লয় রে বাপ। রাইত-বিরেতে ল্যাংটা হইয়ে ঘুইরে বেরায়। জানগুরু বলছে, উ মেয়া ডাইন। উয়ার সঙ্গে তু পীড়িত কইরিস না।’

শুনে চমকে উঠল জিয়ন। সাঁওতাল সমাজে যে মেয়ার নামে ডাইন অপবাদ জোটে, তার কপালে অশেষ দুর্ভোগ অনিবার্য। ও জানে, রাইমণি কত দুঃখী মেয়া। কী দুর্দশার মধ্যে ও জীবন কাটাচ্ছে। একটার বেশি দুটো কাপড় ওর নেই। রাতে সেই কাপড় শুকোতে দিলে ওকে ল্যাংটা হয়েই থাকতে হয়। খুড়া শুধুশুধু বদনাম দিচ্ছেন। জিয়ন তা মানবে কেন? পালটা কিছু বলতে না চাইলেও ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ই তু কী কইছিস খুড়া? রাইমণি সে র’ম মেয়া লয়। তুর কথা মাইনতে পারলাম লাই।’

‘অ… না মাইনতে চাস, মানিস লাই।’ ভ্রু কুঁচকে খুড়া বললেন, ‘তুরে কিন্তুক সাবধান কইরে দিলাম। পরে মোকে দুষ দিবি নাই।’

হিমশীতল গলায় কথাটা বলেই খুটদার খুড়া আর অপেক্ষা করলেন না। ধুলো উড়িয়ে বাইক ছুটিয়ে দিলেন গেরামের দিকে। খুড়াকে আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হল না। ইউরিয়া কবে পাওয়া যাবে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিয়ন সাইকেলে উঠে বসল। মনে মনে বলল, ‘রাইমণির কুনও ক্ষেতি হলে তুদের ছাইড়বক না খুড়া।’ কথাটা বলেই ও একবার আকাশের দিকে তাকাল। ঘরে পৌঁছোতে ওর মিনিট দশেক লেগে যাবে। এর মধ্যে জোরে বৃষ্টি নেমে গেলে কোথাও গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কাঁচা রাস্তায় এত পাঁক হবে, নিশ্চিন্তে সাইকেল চালানো যাবে না। গেরামের ভিতর রাস্তা মেরামতির দিকে খুড়াদের কারও নজর নেই।

কাঁচা রাস্তার একপাশে জঙ্গল। ছোটোবেলায় মায়ের সঙ্গে জিয়ন এই জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসত। তখন আশেপাশে প্রচুর শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়াল, কুসুম, কেঁদ, আমলকী গাছ ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে ম ম করত পুরো অঞ্চল। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের কাঠ মাফিয়ারা রাতের অন্ধকারে এসে শাল, সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে। সবাই জানে, কারা তাদের মদত দিয়েছিল। রাস্তার এইদিকটা এখন আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস আর রাধাচূড়া গাছে ভর্তি। বাপের কাছে জিয়ন শুনেছে, রাস্তায় কোনও গাছই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকত না, আনন্দপুর আশ্রমের সন্ন্যাসীরা যদি না এসে এইসব গাছ তখন লাগিয়ে দিতেন। বাপ প্রায়ই ওই আশ্রমে গিয়ে পড়ে থাকত। ফাইফরমাশ খেটে রোজ দশ-বিশ টাকা রোজগার করে আনত। বাপের সুবাদে সন্ন্যাসীদের অনেকেই জিয়নকে চেনেন। রাস্তা-ঘাটে কোথাও দেখা হলে তাঁরা দু’দণ্ড কথা বলেন।

সাইকেল চালানোর ফাঁকেই জিয়ন পিছন থেকে গাড়ি আসার শব্দ শুনল। পিছন দিকে তাকিয়ে ও দেখল, আনন্দপুর আশ্রমের দিক থেকে একটা জিপগাড়ি আসছে। গাড়িটাকে জায়গা দেওয়ার জন্য ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে দেখে জিপগাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল। গেরুয়া রঙের পোশাক পরা দু’জন সন্ন্যাসী জিপে বসে আছেন। তাঁদের একজনকে জিয়ন চিনতে পারল। দয়ানন্দ মহারাজ। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে ও প্রণাম জানাল। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মহারাজ ওকে বললেন, ‘তুমি ঠাকুরদাস টুডুর ছেলে… জিয়ন না?’

শুনে ঘাড় নাড়ল জিয়ন। দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘একটা খারাপ খবর আছে জিয়ন। রাঁচির জঙ্গল থেকে একটা হাতির দল এসে বেলামু পাহাড়ের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। দু’একদিনের মধ্যেই দলটা গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়বে। সব্বাইকে সাবধান করে দিও।’

শুনে উত্তেজনায় সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল জিয়ন। এ বারও গণেশ ঠাকুরের দল খেতের ফসল নষ্ট করে দেবে? গত বছর গেরামের কয়েকটা বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল। ওদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল দুর্যোধন হাঁসদা বলে ওরই বয়সি একজন। সেই গণেশ ঠাকুর শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে তুলে দুর্যোধনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি। পরে পায়ে পিষে ওকে মেরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে এমন সময় হাত্থির দল এসে হাজির হয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনকে পর্যন্ত খবর দেওয়া যায় না। আশ্রমের সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে এবার অন্তত একটা আগাম খবর পাওয়া গেল। দয়ানন্দ মহারাজ সাবধান করে দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু গেরামের মানুষের করার কী আছে? গণেশ ঠাকুরের প্রতি লোকের এত ভক্তি, ওদের পালটা আঘাত করার কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

ও জিজ্ঞেস করল, ‘গণেশ ঠাকুরদেরকে বেলামুতেই আটকে দ্যান না ক্যানে মহারাজ?’

‘মনে হয়, সম্ভব না। আশ্রমের পাঁচিল ভেঙে ওরা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। আমরা শূন্যে ফায়ার করে ওদের ভয় দেখিয়েছি বলে। দলটা বেশ বড়ো। দশ-বারোজনের মতো। আমরা এও খবর পেয়েছি, ওদের মধ্যে একটা খুনিয়া হাতি আছে। দাঁতাল, সে-ই লিডার।’

খুনিয়া হাত্থি মানে যে হাত্থি ইতিমধ্যেই মানুষ খুন করেছে। গত বছরও এই রকম একটা হাত্থি এসেছিল দলের সঙ্গে। এবার কার কপালে মৃত্যু লেখা আছে, কে জানে? জিয়ন শূন্যচোখে তাকিয়ে রইল। হাত্থির দল এত ক্ষতি করে যাচ্ছে, তবুও ওদের শিক্ষা দেওয়ার কথা কেউ ভাবে না! গেরামের দু’চারজনের সঙ্গে জিয়ন কথা বলেছিল। ‘পাগলা হইয়েনছিস তু’ বলে তারা সরে গিয়েছিল। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘তোমাদের সুবোধ খুটদার একটু আগে আশ্রমে এসেছিলেন। তাঁকে সব জানিয়েছি। আমরা এখন ঝালদার দিকে যাচ্ছি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আপিসে খবর দিতে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, গাঁয়ের লোকদের জানাও।’

দয়ানন্দ মহারাজ চলে যাওয়ার পর জিয়ন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কী করা যায়, বল ক্যানে?’

গণেশ ঠাকুরদের অত্যাচার কী করে বন্ধ করা যায়, সে কথা গত তিন বছর ধরে জিয়ন ভাবছে। এই একটি ভাবনাই ওকে এখন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কীভাবে ওদের শায়েস্তা করা যায়? পরপর তিন বছর ওরা খেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। ওর জীবনের চূড়ান্ত সর্বনাশ করে দিয়েছে, এই হাত্থির একটা দল। সেই কথা যখনই জিয়ন ভাবে, অসহ্য রাগে ওর পেশিগুলো ফুলে ওঠে। বদলা নেওয়ার ইচ্ছেয় হাত নিসপিস করে। কিন্তু ঠাকুর-দ্যাবতার বিরুদ্ধে ও লড়বে কী করে? ওদের সাঁওতাল সমাজে হাত্থি যে ঠাকুর। গেরামের সবাই তাদের পুজো করে। অক্ষমতা ওর ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দেয়। তখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মারাত্মক এক বিষণ্ণতা ওকে গ্রাস করে। তখনই বাড়ির উঠোনে ও ধামসা মাদল বাজাতে শুরু করে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে, ততক্ষণ মাদল বাজিয়েই যায়।

গেরামে ঢোকার মুখে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করল। পরনের টি শার্ট আর পাজামা যাতে ভিজে না যায়, সেজন্য নকুল মণ্ডলের দোকানে চালার নীচে এসে দাঁড়াল জিয়ন। বাড়িতে ফিরে পোশাক বদলে ও লুঙ্গি পরে নেবে। খটঙ্গার স্কুলে ও আর নকুল একসঙ্গে আট ক্লাস অবধি পড়েছিল। ছোটোবেলার বন্ধু। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর বাপের মুদিখানা দোকানে বসে যায় নকুল। আর জিয়ন চাষের কাজে হাত লাগিয়েছিল বাপের সঙ্গে। নকুলের দোকানটা বাজারের ঠিক পাশে। বুদ্ধি করে ও একটা চায়ের ঠেক বানিয়েছে। পুরুলিয়া শহর থেকে একটা সাদা-কালো টিভি সেট কিনে এনে লাগিয়েছে লাগোয়া দোকানে। চা খাওয়ার ফাঁকে অনেকেই বসে খবর শোনে। এই মুহূর্তে অবশ্য দোকানে কোনও খদ্দের নেই। অন্য সময় নকুল কথা বলার সময় পায় না। আজ জিয়নকে দেখে একটা টুল এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘বোস না ক্যানে।’

গেরামে এই একটি লোকের সঙ্গেই জিয়ন মন খুলে কথা বলে। মাঝেমধ্যে এলে নকুলের কাছে গেরামের অনেক খবর পায়। রাইমণিকে ডাইন অপবাদ কারা দিল, কেন দিল, কথায় কথায় ও জিজ্ঞেস করবে, ভেবে নিয়ে টুলে বসে পড়ল জিয়ন। বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের মাঠটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছগুলো মাথা নাড়াচ্ছে বাতাসের দমকে। দৃষ্টি সরিয়ে এনে জিয়ন দেখল, দ্রুত হাতে চা বানাচ্ছে নকুল। দোকানে এলে এইটুকু আতিথ্য ও পায়। একটু পরেই চা ঢেলে মাটির ভাঁড় ওর দিকে এগিয়ে দিল নকুল। কাচের বয়াম খুলে বেকারির বিস্কুট বাড়িয়ে দিল। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দু’জনে কথা বলতে লাগল। চা খাওয়ার অভ্যাস আগে জিয়নের ছিল না। ভিন দেশে জনমজুরির কাজ করতে গিয়ে অভ্যাসটা করে ফেলেছে। কানালি জমিতে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। খেতির কাজকর্ম যখন থাকে না, তখনই ও বেরিয়ে পড়ে। বছরে পাঁচ-ছ’মাস গেরামেই থাকে না।

বাজারের হালচাল, পঞ্চায়েতের পক্ষপাতিত্ব, গেরামের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে লাগল নকুল। একটা সময় সন্তোষ খুড়া হয়ে ওদের আলোচনা চলে এল রাইমণিতে। খুটদার খুড়া হুমকি দিয়েছেন শুনে নকুল বলল, ‘উকে লষ্ট কইরে দিবেক শালা হড়ডপটরা। তুকে এগটা কথা কইব ভাবছিলাম জিয়ন। তু ত উকে ভালোবাসিস। রাইমণিকে তু বিহা কইরে ফ্যাল না ক্যানে?’

রাইমণিকে ঘরে আনার ইচ্ছেটা জিয়নের মাঝেমধ্যেই জাগে, যখন ও ভিন দেশে কাম করতে যায়। সেখানে মরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনমজুর খাটে মেয়ারা। প্রবাসে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে, প্রতিবারই জিয়ন ভাবে, গেরামে ফিরে রাইমণির সঙ্গে বিহাটা সেরে ফেলবে। দু’জনে মিলে পাকাপাকিভাবে রাঁচি অথবা হাজারিবাগ চলে যাবে। খটঙ্গার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই রাখবে না। কিন্তু গেরামে ফেরার পরই ওর আক্রোশ ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে। বদলা নেওয়ার আগুন জ্বলতে থাকে ওর বুকে। প্রতি রাতেই নির্জন ঘরে শুয়ে থাকার সময় সেই দুঃস্বপ্নের দৃশ্যগুলো ওর চোখের সামনে ভাসে। সেকথা মনে করে জিয়ন বলল, ‘তু কইলি, আর আমি ঝপ কইরে বিহা কইরে লুব! অ্যাখুন আমি বিহা কইরতে পারবক লাই ভাই। মোর এগটা কাম বাকি আছে। তু ত জানিস।’

‘হাত্থিদের ফাইন্দে ফ্যালার কাম বুঝি?’ নকুল বলল, ‘পাগলার মতন কথা বলিস না ভাই। গেরামের মানুষ তুর নামে কী কয়, তু জানিস? তুর মাতথায় ব্যামো হইনছে।’

‘বলুক গা। তাতে কিছু আইসে যায় না।’

‘শুন ভাই, অতীতে কী হইনছে, মুনের মধ্যে চেইপে রাখিস না। ভুইলে যা। হাত্থি ঠাকুরের সঙ্গে তুই লড়বি কী কইরে? উয়াদের সঙ্গে লড়া অততো সহজ কথা লয়। উয়াদের কাছে মানুষ ত লিইলিপুট। তু একা কী কইরবি, বল? হাত্থি ঠাকুরকে মেইরে ফেলবি? উ চেষ্টা করিস লা ভাই। কইরলে ফরেস্টবাবুরা তুকে ধরে লিয়ে যাবেক।’

নকুল আরও কী বলতে যাচ্ছিল, দু’তিনজন খদ্দের এসে যাওয়ায় চুপ করে গেল। বৃষ্টির তোড় কমে এসেছে। আনন্দপুর আশ্রমের দিকটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গেরাম আর আশ্রমের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার পাথুরে রুক্ষ জমি। অনেক ঘুরে ঘুরে, পায়ে হেঁটে আশ্রমে যেতে হয়। আশ্রমটা কীসের, সে সম্পর্কে জিয়নের কোনও ধারণা নেই। তবে ভিতরটা বিশাল, বলতে গেলে ছোটোখাটো একটা শহরের মতো। কী নেই তাতে? স্কুল, ব্যাংক, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস, বাজার… সব আছে। বাপের মুখে জিয়ন শুনেছে, ওখানে যারা থাকে, তারা বেশিরভাগই বিদেশি। ওখানে যাকে তাকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বিনা অনুমতিতে পুলিশও ওখানে ঢুকতে পারে না। বাপের সঙ্গে অবশ্য বেশ কয়েকবার জিয়ন আশ্রমের ভিতরে গিয়েছে। সে এক আশ্চর্য জগৎ।

‘শুইনেছিস, গণেশ ঠাকুরের দল লা কি আবার গেরামের দিকে আইসছে।’

নকুলের কথা শুনে জিয়ন এদিকে মুখ ফেরাল। খবরটা খদ্দেরদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয় ওকে দিয়ে গেল।

জিয়ন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘শুইনেছি। আজকাইলের মধ্যেই গেরামে ঢুইকবেক।’

‘গেরামের মানুষ রাইত জেইগে খেত সামাল দিবে বইলে তৈরি হইনছে। খুটদার খুড়া মিটিন ডেইকেছেন। তু একবার যা না ক্যানে পঞ্চায়েতে।’

কোনও উত্তর না দিয়ে জিয়ন মুখ গোঁজ করে বসে রইল। পঞ্চায়েতের অফিসে গিয়ে কী আর হবে? না, না, কিছুতেই ও খুটদার খুড়াদের কাছে যাবে না। বেলামু পাহাড়ের দিক থেকে হাত্থির দল যখন এ দিকে আসবে, তখন প্রথমেই পড়বে ওর খেত। হাত্থিদের দাপাদাপিতে ধানগাছের কী অবস্থা হবে, ভাবতেই রাগ হতে লাগল জিয়নের। গত দু’মাসের পরিশ্রম বৃথা যাবে। রাতে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, হই হট্টগোল করে হয়তো হাত্থি তাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। পাহারাদারদের লক্ষ্য থাকবে, নিজের খেত বাঁচিয়ে অন্যের খেতের দিকে হাত্থির পালকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাতে কোনও লাভ হবে না।

গণেশ ঠাকুরের দল আগে দলমা থেকে বেরিয়ে অযোধ্যা পাহাড় হয়ে নেমে আসত। কিন্তু, তিন বছর আগে সেই প্রথম রাঁচির দিক থেকে আচমকাই একটা দল বেলামু পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঢুকে পড়েছিল ওদের গেরামে। মানুষজন সচেতন হওয়ার আগেই গেরামে কান্নার রোল উঠেছিল। গভীর রাতে পোষা কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জিয়নের। ভয়ার্ত সেই ডাক। বিছানা ছেড়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়াতেই মূর্তিমান বিভীষিকা চোখে পড়েছিল ওর। একটা দাঁতাল হাত্থি উঠোনে দাঁড়িয়ে। প্রবল বেগে মাথা নাড়াচ্ছে। মুলো বাঁশের মতো তার দুটো দাঁত। বিরাট কান দুটো ফটরফটর করছে। কুকুরের ডাক শুনে বিরক্ত। প্রায় জমি ছোঁয়া ওর লম্বা শুঁড় থেকে ভোঁস ভোঁস শব্দ ভেসে আসছে। হাত্থিটা এক পা বাড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করায় ব্যস্ত। শুঁড়ে পেঁচিয়ে কুকুরটাকে শূন্যে তুলে নেবে।

মাটির বাড়ির ভিতরের ঘরে বাপ-মা আর বোন শুয়ে আছে। তাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে কি না, জিয়ন বুঝতে পারেনি। ওর কাছে এমন সময়ও ছিল না, ভিতরে ঢুকে সবাইকে ডেকে তোলে। বাড়ির উঠোনে প্রকাণ্ড জীবটাকে আগে কখনও দেখেনি। কুকুরের আস্ফালন তাই আরও বেড়ে গিয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও একটা গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল জিয়ন। তার মানে আশেপাশে আরও সঙ্গী নিয়েই দাঁতালটা ঢুকেছে। শুক্লপক্ষের রাত। হালকা জ্যোৎস্নায় কী চোখে পড়েছিল কে জানে? কুকুরটা হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। ভয় পেয়ে পিছু হটে, ঘরের ভিতর ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিল চৌকির নীচে। সেখান থেকেই কুঁইকুঁই আওয়াজ করছিল। ওকে তাড়া করে, এর পর ঘরে ঢোকার চেষ্টায় হাত্থিটা যখন মাটির দেয়ালে ঢুঁসো মারে, তখনই প্রাণভয়ে দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে জিয়ন খিড়কির দিকে ছুটে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ও টালির চাল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে দেখে। খিড়কি থেকেই ও বাপ-মায়ের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল। সেইসঙ্গে উন্মত্ত হাত্থির হুঙ্কার।

শেষ রাতে গণেশ ঠাকুরের দলটাকে পিচের রাস্তা ধরে চলে যেতে দেখেও জিয়ন জঙ্গল থেকে বেরোনোর সাহস পায়নি। আতঙ্কে থরথর করে কেঁপেছিল পিয়াল গাছের আড়ালে। আলো ফোটার পর ফিরে এসে দেখে বাড়ির কোনও চিহ্নই নেই। কুকুরকে খুঁজে পাওয়ার তাগিদে ভগ্নস্তুপের উপর দাপাদাপি করে গিয়েছে হাত্থির দল। মাটির কলসিতে রাখা হাঁড়িয়াও খেয়ে গিয়েছে। গেরামের লোক চৌকির নীচ থেকে টেনে বের করেছিল থেঁতলে যাওয়া তিনটে দেহ। ওর বাপ, মা আর বোনকে। কুকুরটার কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি। মনে আছে, জিয়নের সব মনে আছে। উঠোনে তিনটে মৃতদেহ পড়েছিল অনেক বেলা পর্যন্ত। পঞ্চায়েতের লোকজন বলেছিল, ফরেস্টবাবুরা না আসা পর্যন্ত সৎকার করা যাবে না। হাত্থির তাণ্ডবে কেউ মারা গেলে না কি ফরেস্টবাবুদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। সারাটা দুপুর জিয়ন শোকস্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। ওর বুকে তখন আগুন জ্বলছিল ধিকধিক করে। ফরেস্টবাবুরা বিকেলের দিকে এসে রিপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। না, পরে কোনও ক্ষতিপূরণ জিয়নের কপালে জোটেনি। বাবুরা বলেছিলেন, নিছক দুর্ঘটনা। টালির চালা ভেঙে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

নকুলের দোকানে চালার নীচে বসে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে জিয়নের ফের একবার কৈলাস স্যারের কথা মনে পড়ল। স্কুলের বাংলা টিচার ছিলেন কৈলাস স্যার। ক্লাসে পড়ানোর সময় স্যার একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা বল তো, সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী কে?’ ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর স্যার নিজে থেকেই বলেন, ‘পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বুদ্ধিমান হল মানুষ। বুদ্ধিতে মানুষের সঙ্গে অন্যরা পেরে উঠবে না।’ গত তিন বছরে জিয়ন অনেকবারই ভেবেছে, স্যারের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে এই গুন্ডা হাত্থিগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার মতো বুদ্ধি কেন মানুষ দেখাতে পারছে না? এমন উপায় কেন খুঁজে পাচ্ছে না, যাতে ওরা আর না আসে? তা হলে কি হাত্থিদের বুদ্ধি আরও বেশি? না হলে কয়েকশো মাইল দূর থেকে রাস্তা চিনে প্রতিবছর ফসলের সময়ই ওরা আসে কী করে।

‘জল থেইমে গেনছে। ঘরকে যাবিক নাই?’

নকুলের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল জিয়নের। সামনের দিকে তাকিয়ে ও দেখতে পেল বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। টুল ছেড়ে উঠে ও সাইকেলের কাছে নেমে এল। মনের মধ্যে যে-প্রশ্নটা এতক্ষণ পাক খাচ্ছিল, হঠাৎ সেটাই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তু বুল ত ভাই নকুল। হাত্থিদের বুদ্ধি কি মানুষের থেইকে বেশি?’

প্রশ্নটা শুনে নকুল হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

চাদর মুড়ি দিয়ে দাওয়ায় শুয়ে ছিল জিয়ন। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। তবুও, শুয়ে নিজের দুর্দশার কথা ভাবছিল। হঠাৎ রাইমণির গলা শুনতে পেল, ‘শুইয়ে আনছিস ক্যানে? শরীলডা খারাপ?’

দাওয়ায় উঠে এসে মাথার কাছে বসল রাইমণি। কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল গা গরম কি না? চোখ মেলে ওর সোন্দর মুখটা দেখে জিয়নের মন ভালো হয়ে গেল। রাইমণির হাতটা ধরে ও নিজের গালে ছোঁয়াল। গত তিন-চারটে দিন ওর অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে। হাত্থি ঠাকুরের দল ফের লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গিয়েছে ওর খেত। বুধিরাম এসে যখন খবরটা দেয়, তখন খেতে দৌড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটুকুও জিয়নের হয়নি। নিজেকে বাড়ির মধ্যেই ও আটকে রেখেছিল। পরে শুনেছে, ঝালদার দিকে যাওয়ার সময় হাত্থির দল গেরামের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। গাছপালা উপড়েছে। শুধু মাটির বাড়িই নয়, বুধিরামদের পাকা গাঁথনির দেওয়ালও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এই প্রথম বুধিরাম বলে গিয়েছে, এবার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কদ্দিন আর সহ্য করা হবে হাত্থি ঠাকুরের অত্যাচার?

মাঝে রাইমণি একদিন এসেছিল। ওকে স্ত্বান্না দিয়ে গিয়েছে। জানতে চেয়েছিল, এ বার ও কী করবে? তখনও জিয়ন কিছু ঠিক করেনি। গেরামে পড়ে থাকার কোনও মানে নেই। কিন্তু, যাবেই বা কোথায়? বর্ষার সময় ইমারতির কাজ বন্ধ থাকে। বাইরে জনমজুরির কাজ পাওয়াও শক্ত। একমাত্র বর্ধমানের দিকে গেলে হয়তো কাজ পাওয়া যেতে পারে। ওখানে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। জিয়ন মাঝেমধ্যেই ভাবছে, রাইমণিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে নতুন সংসার পাতবে। কথাটা ভাবা মাত্র, এই বিপর্যয়ের মধ্যেও, একটা সুখের কম্পন ও শরীরে অনুভব করছে। এই মুহূর্তে রাইমণির হাতের ছোঁয়া আরও নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য জিয়ন ওর কোলে মাথা রাখল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওর কোমর।

চুলে হাত বোলাচ্ছে রাইমণি। খানিকক্ষণ পর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ও বলল, ‘উঠ না ক্যানে। দয়া মহারাজ তুকে ডেইকেনছেন।’

দয়া মহারাজ মানে, আনন্দপুর আশ্রমের দয়ানন্দ মহারাজ। এই তো ক’দিন আগে রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হল। হঠাৎ ওকে ডেকেছেন কেন, জানার জন্য জিয়ন উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুর সঙ্গে উয়ার দেখা হইয়েনছিল লা কি?’

‘হ। মো আইশ্রমে কাম কইরতে গেইনছিলাম কাইল।’

‘কী কইলেন তুকে?’

‘মুর্মু খুড়া জানগুরু লিয়ে এইসেছেন রাঁঞ্চি থেইকে। মোকে ডাইন অপবাদ দিবার লেগ্যে।’

খবরটা খুটদার খুড়ার কাছ থেকে আগেই শোনা জিয়নের। এইবার ও বুঝতে পারল, ষড়যন্ত্রের মূলে তা হলে মুর্মু খুড়া। নিশ্চয় কোনও বদ মতলব আছে। সন্তোষ খুড়ার ঘরটাও হাতিয়ে নিতে চান। রাঁচি থেকে জানগুরু নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। হাজার খানিক টাকা তো তাঁকে দিতেই হবে। সেইসঙ্গে শুঁয়ার আর পাঁঠা। এত খরচ মুর্মু খুড়া এমনি এমনি করবেন না। জিয়ন কিন্তু অবাক হল এই ভেবে, খবরটা এত তাড়াতাড়ি দয়ানন্দ মহারাজের কানে পেৌঁছোল কী করে? পরক্ষণেই ওর মনে হল, গেরামে আশ্রমের কৃপাপ্রার্থী অনেকেই আছে। গেরামের ভালো-মন্দ অনেক খবরই তাই সন্ন্যাসীরা আগাম পেয়ে যান।

ওদের সাঁওতাল সমাজে নানারকম কুসংস্কার আছে। দয়ানন্দ মহারাজরা সেইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এর আগে একবার ডাইন অপবাদ থেকে ওঁরা বাঁচিয়েছিলেন বারুদি গেরামের একজনকে। সেই মেয়াকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে ঘরে আগুন লাগিয়ে। আগে খবর পেয়ে সন্ন্যাসীরা পুলিশ নিয়ে হাজির হন সেখানে। তা হলে কি রাইমণিকেও উয়ারা বাঁচাতে চান? সেই কারণেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন? কথাটা মনে হওয়া মাত্র জিয়ন উঠে পড়ল। বলল, ‘তু ইগট্টু বোস ক্যানে। আমি চট কইরে রেডি হইয়ে লিই। মোর সঙ্গে তু আইশ্রমে যাবিক।’

… ঘণ্টাখানেক পর পাথুরে রুক্ষ জমির উপর দিয়ে দু’জনে যখন সাইকেলে আনন্দপুর আশ্রমে পৌঁছোল, তখন মাঝ দুপুর। প্রকাণ্ড গেটটার খানিক আগে কালভার্টের উপর এসে ওরা দাঁড়াল। বেলামু পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোটো একটা নদী নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় হেঁটেই জিয়নরা শুখা নদীটা পেরিয়ে যেত। কিন্তু, গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে নদীর জল এখন টইটুম্বর। সাইকেলটা কালভার্টের নীচের ঢালে দাঁড় করানোর ফাঁকে ওরা দেখতে পেল, কাঁধে রাইফেল নিয়ে দু’জন গেট পাহারা দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ-ছ’বছর পর জিয়ন এই আশ্রমের দিকে এল। আগে কখনও আর্মড গার্ড ওর চোখে পড়েনি। দেখে, কেন জানে না, ওর মনে হল, পার্টির লোকেরা যাতে দলবল নিয়ে হঠাৎ চড়াও না হতে পারে, সেই কারণেই এত কড়াকড়ি।

অফিস ঘরে দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা হতেই উনি হাসিমুখে বললেন, ‘এসো জিয়ন। একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে জিয়ন বলল, ‘আপনি ডেইকেছিলেন মহারাজ?’

‘আগে বোসো। তোমার সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করার ছিল। হাতিরা কতটা ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তা দেখার জন্য কাল আমি তোমাদের গ্রামে গেছিলাম। তোমার খেতে তো ধানগাছের চিহ্ন আর নেই বললেই চলে। এখন কী করবে বলে তুমি ভাবছ?

গত তিন বছর ধরে যে-ইচ্ছেটা ও লালনপালন করছে, রাগের মাথায় সেটাই জিয়ন বলে বসল, ‘মুনে লয়, হাত্থিগুলানকে গুলি কইরে মারি।’

শুনে হাসি মিলিয়ে গেল মহারাজের মুখ থেকে। ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বললেন, ‘হাতিদের উপর তোমার এত রাগ কেন জিয়ন? কখনও কি ভেবে দেখেছ, জঙ্গল ছেড়ে প্রতি বছর ওরা লোকালয়ে আসে কেন? এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তো আমরা… মানুষরা। বসতি বাড়ানোর জন্য আমরা জঙ্গল কেটে নিয়েছি। জঙ্গলে ওদের খাবার ভাঁড়ারে টান পড়েছে। খাবারের খোঁজে তাই ওরা মানুষের ডেরায় ঢুকছে। হাতিদের কি দোষ দেওয়া যায়, বলো? ওদেরও কি বাঁচার অধিকার নেই? এই পৃথিবীর উপর ওদের দাবি তো অনেক বেশি। কেন-না, মানুষের অনেক আগে ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। যা বলছি, তুমি কি বুঝতে পারছ, জিয়ন?’

শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল জিয়ন। এক ঝটকায় ওর চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। দয়ানন্দ মহারাজ যা বলছেন, তার পিছনে যুক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের মতো হাত্থিরাও প্রাণী। ওদেরও খিদে আছে। বেঁচে থাকার আকুতি আছে। নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে আছে। তবুও, মনে মনে পালটা প্রশ্ন হাতড়াতে লাগল জিয়ন। জঙ্গল কেটে বাপ-ঠাকুর্দারা যদি ভুল করে গিয়ে থাকে, তা হলে তার খেসারত ওদের দিতে হবে কেন? ওদের মুখে অন্ন তা হলে কে জোটাবে?

দয়ানন্দ মহারাজ বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের বললেন, ‘হাতিদের নিয়ে সমস্যাটা শুধু তোমাদের খটঙ্গা গ্রামেরই নয়… সারা দেশের। ওদের অন্নসংস্থানের কথা যে আমাদেরই ভাবতে হবে জিয়ন। এক জঙ্গলে যদি ওদের খাবার শেষ হয়ে যায়, তা হলে ওরা যাতে কাছাকাছি অন্য জঙ্গলে গিয়ে খাবার পায়, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেইসঙ্গে দুটো জঙ্গলের মাঝে যাতায়াতের সময় ওদের জন্য নিরাপদ একটা করিডর। তাহলে গ্রামে ঢোকার কথা ওরা আর ভাববেই না।’

হাত্থি ঠাকুর সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলতে লাগলেন দয়ানন্দ মহারাজ। লেখাপড়া জানা মানুষ… কত কী জানেন! ভিন্ রাজ্যে নাকি হাতি আটকানোর জন্য গেরামের চারপাশে ইলেকট্রিকের বেড়া লাগানো হয়। একবার শক্ খেলে হাতি আর গেরামে ঢোকার সাহস পায় না। পথ বদলে অন্যদিকে সরে যায়। হাত্থি ঠাকুরের না কি অসীম বুদ্ধি। ওরা ঠিক বুঝতে পারে, কে ওদের ক্ষতি করতে চায়, কে নয়? কয়েকটা উদাহরণও দিলেন দয়ানন্দ মহারাজ। কথাগুলো শুনতে শুনতে জিয়ন দ্বিধায়। ওর বাপ, মা, বোন তো হাত্থি ঠাকুরের কোনও ক্ষতি করেনি? তাহলে ওদের মরতে হল কেন? একটা সময় হাতি প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে মহারাজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাষ করার ইচ্ছে কি আর তোমার আছে, জিয়ন?’

উত্তরটা ও ঠিক করে রেখেছে। জিয়ন বলল, ‘না।’

‘তোমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। খটঙ্গা থেকে আশ্রম পর্যন্ত একটা রাস্তা বানানোর কথা আমরা ভাবছি। তার জন্য মাটি দরকার। তোমার খেত থেকে যদি আমরা মাটি তুলে নিই, তাহলে কি তোমার আপত্তি আছে? মাটি কেনার টাকা তুমি পাবে। মাটি তোলা নিয়েও তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরাই লোকজন দিয়ে মাটি কাটার ব্যবস্থা করে নেব। তুমি কি তাতে রাজি?’

প্রস্তাবটা শুনে জিয়নের মন্দ লাগল না। কানালি জমি এমনিতেই নীচু। বছরে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। চাষ করেই বা আর লাভ কী? একে গেরাম থেকে ওর মন উঠে গিয়েছে। পঞ্চায়েতের লোকজনদের ওর সহ্য হচ্ছে না। খেতের ওই জমি আর রাইমণির টানেই ও অ্যাদ্দিন খটঙ্গায় পড়ে আছে। পাকাপাকিভাবে এবার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে ক্ষতি কী? রাইমণির দিকে তাকিয়ে জিয়ন বুঝতে পারল, ওর অসম্মতি নেই। তাই বলল, ‘মো রাজি।’

‘গুড। তা হলে টাকা পয়সার কথা তোমাকে পরে জানিয়ে দেব।’

একটু থেমে রাইমণির দিকে তাকিয়ে দয়ানন্দ মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘আর একটা কথা। রাইমণি সম্পর্কে কি তুমি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছ? যদি না নিয়ে থাকো, তাহলে আমি বলি কি, ও এখন আমাদের আশ্রমেই থাক। ও যে কী বিপদের মধ্যে আছে, নিশ্চয়ই তুমি তা জানো। ঘরে একা থাকা ওর পক্ষে ঠিক হবে না। আশ্রমের হেঁসেলে নানা রকম কাজ থাকে, রাইমণি আপাতত সেই কাজ করুক।’

দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে জিয়ন যখন আনন্দপুর থেকে বেরিয়ে এল, তখন মন খুশিতে ভরপুর। রাইমণিকে নিয়ে আর কোনও আশঙ্কা ওর নেই। তার থেকেও বড়ো কথা, একটা দিশা পাওয়া গিয়েছে। বুদ্ধির খেলায় এইবার হাত্থি ঠাকুরদের ও হারিয়ে দিতে পারবে। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় জিয়ন লম্বা একটা শ্বাস নিল।

গেরামে ওকে একঘেরিয়া করে দেওয়া হবে, এমন একটা কথা খুব রটেছে। পরিস্থিতিটা এমন, পারলে খুটদার খুড়ারা জিয়নকে ছিঁড়ে খান। ওর খেতের জমির কাছে যেদিন মাটি কাটার যন্তর এসে দাঁড়ায়, সেদিনই সবাই বলাবলি করেছিল, ঠাকুরদাসের ব্যাটার মাথার ঠিক নেই। ব্যামোটা আবার বেড়েছে। না হলে চাষের জমিতে কেউ খাদান করে? কী শুনেছিল, কে জানে? সেদিনই দুপুরে নকুল ওর কাছে এসে বিরক্ত গলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘তুর মতলবটা কী বুল ত? গেরামে থাকার ইচ্ছে তুর আছে?’

প্রশ্নটা কেন করছে জিয়ন তা জানে। তবুও বলেছিল, ‘ই কথা কইছিস ক্যানে?’

‘আইশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তুকে কে ইত ভাবভালোবাসা কইরতে বুলেছে? উয়াদের কানছে তু জমি বিককিরি কইরেছিস ক্যানে? তু জানিস না, পঞ্চায়েতের কেউ উয়াদের পছন্দ করে না?’

‘মুই ত জমি বিককিরি করি লাই। মোর জমি… মুই কী কইরব, পঞ্চায়েত বলার কে বটে?’

নকুলের সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ কথাকাটাকাটি হয়েছিল জিয়নের। ও ভয় দেখিয়েছিল, খুটদার খুড়ারা ভয়ানক চটে রয়েছেন। মুখিয়া যে-কোনওদিন মিটিন ডেকে শাস্তি দিতে পারেন। সাঁওতাল সমাজে সেই বিধান গেরামের সবাই মানবে। পরবের সময় কেউ ওকে ডাকবে না। হাটে-বাজারে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবে না। ও একঘরে হয়ে যাবে। এসব শুনেও জিয়ন একটুও পিছিয়ে আসেনি। নকুলকে কিছু বলা মানে, সবার কানে তা পেৌঁছে দেওয়া। জোর গলায় ও বলে দিয়েছিল, মাটি কাটা হয়ে গেলে আপাতত ও তাতে জল ভরে রাখবে। তারপর কী করবে, পরে ঠিক করবে।

নকুল মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে গিয়েছিল, জমিতে ধরে রাখা জল জিয়ন সেচের জন্য দেবে। জেলার নানা জায়গায় এই রকম জলাধার তৈরি করার জন্য গেরামের লোকেদের আজকাল উৎসাহ দিচ্ছে সেচবাবুরা। মুখে নকুলকে যা-ই বলুক না কেন, জিয়ন ঠিক করেই ফেলেছে, ও কী করবে। মাটি খননের কাজ চলছে প্রায় তিন হপ্তা ধরে। খেতের এক দিকটায় প্রায় পাঁচ-ছ’ফুট মাটি তোলা হয়ে গিয়েছে এক্সক্যাভেটর দিয়ে। এই যন্তরটা জিয়ন চেনে। জনমজুরি খাটতে গিয়ে দেখেছিল। রাঁচি থেকে দুটো এক্সক্যাভেটর নিয়ে এসেছেন দয়ানন্দ মহারাজরা। সেইসঙ্গে চার-পাঁচটা ডাম্প ট্রাকও। মাটি তোলার সঙ্গে সঙ্গে ডাম্প ট্রাকে করে তা ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন আশ্রমের দিকে।

রাতে রোজই একবার করে টর্চ নিয়ে খেতের দিকে যায় জিয়ন। আজও বেরিয়েছে, কত মাটি কাটা হয়েছে, তা দেখার জন্য। বিকেলের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘশূন্য আকাশে বাঁকা চাঁদ। পিছল আল ধরে এক চক্বর মারার সময় হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, একটা এক্সক্যাভেটর গাছের উপর কাত হয়ে রয়েছে। এত বড়ো যন্তরটার ওই অবস্থা হল কী করে, তা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতেই জিয়নের মনে হল, এ মানুষের কম্ম নয়। নিশ্চয়ই হাত্থি ঠাকুরদের কাজ। ঝালদা থেকে এই রাস্তা দিয়েই হয়তো ওরা আজই ফিরে গিয়েছে বেলামুর দিকে। ওদের আক্রোশ থেকে যন্তরও রেহাই পায়নি। আজব যন্তরটা কী, জানার জন্য নিশ্চয় ওরা ঢুঁসো মেরে গিয়েছে। জিয়ন ভেবে একটু অবাকই হল, হাত্থি ঠাকুরের দল খটঙ্গার পাশ দিয়ে চলে গেল, অথচ গেরামের লোক কেউ টের পেল না!

মেঠো রাস্তার দিকে এগোনোর সময  হঠাৎ ক্ষীণ স্বরে হাত্থির ডাক শুনতে পেল জিয়ন। ডাক না বলে, আর্তনাদ বলা ভালো। টর্চের আলো ফেলতেই ওর চোখে পড়ল, বাচ্চা একটা হাত্থি প্রাণপণ খাদ থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। বোধহয় দলছুট হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে বুঝতে পারেনি, তাই গড়িয়ে পড়ে গিয়েছে খাদে। দলের বড়োদেরও সেটা চোখে পড়েনি। কয়েক মিনিট ধরে বাচ্চাটার ভয়ার্ত ডাক শুনে জিয়ন আর স্থির খাকতে পারল না। খাদে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে, বাচ্চাটা একটা সময় জলে ডুবেও মারা যেতে পারে। ওর খেতে যদি তা হয়, তা হলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠল জিয়ন। গেরামের মানুষের ধারণা হবে, বদলা নিতে গিয়ে ও-ই মেরে ফেলেছে হাত্থি ঠাকুরকে। সবার রোষ এসে পড়বে ওর উপর। না, না, রাতের মধ্যে যে করেই হোক, বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে হবে। কথাটা ভাবতেই হাত্থি বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ও দৌড়োতে শুরু করল বুধিরামের বাড়ির দিকে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই গেরামের মানুষ এসে হাজির খেতের চারপাশে। জুয়ান মরদরা তো বটেই, এমনকী মেয়া-বউরাও। হাত্থি ঠাকুরকে বাঁচাতেই হবে। না হলে পুরো গেরাম মারাংবুরুর কোপে পড়বে। কারও হাতে রশি, বাঁশ। কারও হাতে মশাল, হ্যাজাক, টর্চ আর কাঠের পাটাতন। অতি উৎসাহে অনেকেই খাদে নেমে পড়ল। কিন্তু, এত মানুষজন আর আলো দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছে বাচ্চাটা। বারবার চেষ্টা করছে খাদের ঢাল দিয়ে উপরে ওঠার। কিন্তু নরম কাদায় পা পিছলে বারবারই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে, শেষে লুকোনোর জন্যই জলে গা ডুবিয়ে দিল বাচ্চা হাত্থিটা। কিছুতেই তাকে আর ডাঙ্গায় তোলা যায় না। গেরামের মাতব্বররা একেকজন এক এক রকম পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু, ওই হই হট্টগোলে, কে শোনে কার কথা?

ঘণ্টা পাঁচেক যুদ্ধ করে মরদরা গলদঘর্ম। কে যেন বুদ্ধি করে কলাগাছ কেটে এনেছিল। সেটা মুখের কাছে ধরতেই জল থেকে বাচ্চা হাতিটা উঠে এল। বোধহয় খিদে পেয়েছিল। নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে সে কলাগাছ চিবোতে শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে আলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো উৎফুল্ল, ‘হাত্থি ঠাকুর সেবা লিয়েছে গ।’ সেই সুযোগে নকুল ফিসফিস করে জিয়নকে বলল, ‘চল ভাই, পেইটে রশির ফাঁস দেই বটে। পরে টেইনে উপরে তুইলে লিব।’ জিয়ন তখন পরম মমতায় বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

বাচ্চাটাকে আলের উপর তোলা হয়েছে। চারদিকে গোল হয়ে তাকে সবাই ঘিরে রয়েছে। ভোরের আলোয় একটা অদ্ভুত দৃশ্য জিয়নদের চোখে পড়ল। পূব দিক থেকে মত্ত হাত্থির দল এদিকে আসছে। মাঝ রাস্তায় হয়তো ওদের খেয়াল হয়েছে, বাচ্চাটা সঙ্গে নেই। তাকে উদ্ধার করার জন্য রণহুংকার দিয়ে ফের ওরা ফিরে আসছে। ভয়ে গেরামের মানুষ পালিয়ে গেলেও নকুলের সঙ্গে জিয়ন কিন্তু আলের উপর দাঁড়িয়ে রইল। হাত্থি ঠাকুরদের আর ও ভয় পাচ্ছে না। ওদের উপর ওর আর কোনও রাগও নেই। দয়ানন্দ মহারাজের কথাই ঠিক। এই পৃথিবীটা শুধু মানুষদেরই নয়, সব প্রাণীর। মানুষ যেহেতু সবথেকে বুদ্ধিমান, তাদেরই সবথেকে বেশি মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। আলের উপর দাঁড়িয়ে জিয়ন দেখতে পেল, বাচ্চাটাকে পেয়ে হাত্থি ঠাকুরের দল প্রচণ্ড খুশি। শুঁড় দিয়ে সবাই ওকে আদর করছে। শুঁড় উঁচিয়ে ওরা ডাকছে। দেখে জিয়নের মনে হল, গেরামের মানুষদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। খানিক পরে থামের মতো পাগুলোর আড়াল দিয়ে ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে রওনা হল বেলামু পাহাড়ের দিকে।

জিয়নের সারা মন জুড়ে এখন আনন্দের অনুভূতি। মেঠো রাস্তা দিয়ে নকুলের সঙ্গে বাড়ির দিকে আসার সময় মনে মনে ও স্থির করে নিল, বেলায় ও একবার আনন্দপুর আশ্রমে যাবে। দয়ানন্দ মহারাজের আশীর্বাদ নিয়ে আসবে। মহারাজ ওকে একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মাটি কাটা হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টির জল ধরে রেখে তুমি মাছের চাষ শুরু করো জিয়ন। তোমার মাছ আমরাই কিনে নেব। এর পর থেকে হাতির দল গেরামে এলেও তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’ কথাটা ওর মনে ধরেছিল। হাত্থি ঠাকুরদের জব্দ করার এই সুযোগটা ছাড়তে চায়নি জিয়ন। মাঝে দয়ানন্দ মহারাজ কিছু টাকা ওকে দিয়েছেন। একদিন তাই পুরুলিয়া শহরে গিয়ে ও কথাও বলে এসেছে মৎস্য দফতরের বাবুদের সঙ্গে। ওঁরা বলেছেন, সবরকম সাহায্য করবেন।

এই মুহূর্তে আরও একটা কাজ বাকি রয়েছে জিয়নের। তার জন্য ওকে বলরামপুর যেতে হবে। গিয়ে সন্তোষ খুড়াকে বলতে হবে, ‘রাইমণিকে বিহা কইরতে চাই। কত্তো টাকা গন্নকাউডি (পণ) দিইতে হবেক, দয়া কইরে বলেন।’

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব