নরদেহ পর্ব-১

“এখন সবাই একটু কিছু মুখে দাও।’’ গম্ভীর মুখে কথাটা বললেন সিদ্ধার্থ।

ঘরের সবাই অবাক চোখে তাকাল তাঁর দিকে। বলে কী লোকটা! মাথার ঠিক আছে তো? বাবার মৃত্যুর পর তিন ঘন্টাও কাটেনি। কোভিডে মৃত্যু, তাই ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ পায়নি কেউ। শুধু ওখানে উপস্থিত তাপস আর নিলু দূর থেকে প্ল্যাস্টিকের মোড়কে আটকানো বাবার মুখটা দেখতে পেয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল ওদের লোকেরাই। কাঁদতেও পারেনি ওখানে। বাড়িতে ফিরে আসার পর একচোট কান্নার রোল উঠেছিল। সময় কান্নার জল শুষে নেয়। অন্তর গুমরে উঠলেও জল সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একসময়। মাঝে মাঝে একটু নাক মোছা চলছিল, ঠিক তখনই সিদ্ধার্থ কাকুর এই কথা!

কান্না পর্ব শেষ। এখন চলছে শোক স্তব্ধতার পর্ব। পর্বের সমাহারই জীবন। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলেনি। মনে মনে হয়তো সিদ্ধার্থকে তুলোধনা করছিল। এইসময় এরকম একটা কথা বলা যায়? লোকটা মানুষ না জানোয়ার? অথচ যিনি মারা গিয়েছেন তিনি তো তাঁরই বাল্যবন্ধু। একটা মানুষ মরে গেল আর ওর কাছে খাওয়াটাই বড়ো হল? তিনি বিচক্ষণ, তিনি আবার একজন অধ্যাপক!

সময় আর কিছুক্ষণ সময় নিল, তারপরেই নিজের খেল দেখিয়ে দিল। সিদ্ধার্থ মনে মনে কষ্ট পেলেও জানতেন এটাই হবে। শোক আসলে একটা ঝোড়ো হাওয়া, সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না।

তাপসদের মিনু মাসি খবর পেয়েই চলে এসেছেন লকডাউন উপেক্ষা করে। খুব বেশি দূরে থাকেন না বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বললেন, “যে গেল সে তো আর ফিরে আসবে না। ভাবলেই বুক ফেটে কান্না আসছে। কী ভালোমানুষ ছিলেন জামাইবাবু। সবই নিয়তি। তোরা চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি করিসনি। কিন্তু দাদার কথাটাও মানতে হবে। সবশুদ্ধু খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলে কেমন করে চলবে? সামনে কত কাজ। আমি বরং ফ্রিজ থেকে কিছু ফল বের করে রাখি, একটু গরম হবে।’

সময় আর শোকের খেলা জমে উঠছে। এতক্ষণ শোক একচেটিয়া মাঠ দখল করে খেলছিল, এবার শিথিল হচ্ছে তার আধিপত্য, খেলা ধরছে সময়।

তাপসের বউ অপর্ণা বলল, ‘ফলগুলো ভালো করে স্যানিটাইজ করতে হবে। আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে, চলুন।

শোকের চেয়ে বড়ো কর্তব্য। জীবন থাকলে কর্তব্য থাকবে। যে মরে যায় তার সঙ্গে সবাই তো একসঙ্গে মরতে পারে না। জীবন-মৃত্যুর টানাটানিতে যে যেদিকে থাকবে, তাকে সেখানেই লড়াই করতে হবে।

সিদ্ধার্থ সে অর্থে এ বাড়ির কেউ নন। আবার অন্যদিক থেকে অনেক কিছু। মৃত হরিশ মুখার্জির বাল্যবন্ধু তিনি। অকৃতদার। নিজের পরিবার বলতে এক আধপাগল ভাই, একটা পোষা কুকুর, আর রান্নার কাজের লোক রামের মা। রামের মায়ের আসল একটা নাম আছে বটে কিন্তু সেটা ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড আর আধার কার্ডের বাইরে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করার সুযোগই পায় না। মজার ব্যাপার, তিনি নিজেও সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যান।

সিদ্ধার্থ ফিলোজফির অধ্যাপক ছিলেন। বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। বন্ধু হরিশের পরিবারকে নিজের পরিবারের মতো ভালোবাসেন। তার কারণও আছে একটা। সিদ্ধার্থের মা মারা গিয়েছিলেন শৈশবেই। সেই সময় থেকে হরিশের মা তাকে মাতৃস্নেহ দিয়েছিলেন। সখির ছেলে বলে কথা! সবাইকে বলতেন, ওরা দুজন আমার দুই সন্তান। ওদের বলতেন— আমি যখন থাকব না, তোরা দুজনে দুজনকে দেখে রাখবি।

হরিশের ডায়াবেটিস ছিল। কিছুদিন আগে হার্টের কিছু মাইনর সমস্যাও ধরা পড়েছিল। ইদানীং একটুতেই হাঁপিয়ে যেতেন। তবুও থেমে থাকেননি। বয়সের সিম্পটম বলে দিব্যি ইগনোর করে যাচ্ছিলেন। তবে করোনার আবির্ভাবে সবার মতো হরিশও ভয় পেয়েছিলেন। যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করে চলার চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার, ঘরবন্দি হয়ে থাকা, নিয়ম করে গার্গেল করা, প্রোটিন, ভিটামিন সি, কোনও কিছুই বাদ দেননি। তবুও তিনি করোনা আক্রান্ত হলেন। প্রথমে সর্দি, কাশি, গা-হাত-পা ব্যথা, তারপরে এল জ্বর। হাউজ ফিজিশিয়ান ডাক্তার মিত্র বললেন, ‘টেস্টটা করিয়ে নিন।’

টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ। হালকা শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। পুরো এলাকা তখন কনটেইনমেন্ট জোন। কেউ কোথাও যেতে পারে না, কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না, সে এক মহা বিড়ম্বনা। এক একটা বাড়ি যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সন্ধ্যা হতেই কোলাহলের শহরে মৃত্যুপুরীর নির্জনতা নামে। টিভি আর মোবাইল বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

দশ দিন লড়াই করার পর হেরে গেলেন হরিশ। হেরে গেলেন জীবনের কাছে। মাঝখানে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তখন দু’বেলা ফোন করতেন সিদ্ধার্থকে। বাড়ির খবরাখবর নিতেন। আর বলতেন, এবার ফিরলে এটা করব সেটা করব, কত প্ল্যান! আসলে আইসোলেশন পর্বে হরিশ পিছনের জীবনটাকে দেখার, মূল্যায়ন করার অখণ্ড অবকাশ পেয়েছিলেন ওখানে। দূরে গেলে কাছটাকে দেখা যায়, একদম খাঁটি সত্য। কাছ থেকে কাছটাকে দেখাই হয়ে ওঠে না! হঠাৎ করে একটা লোক আবার অতটা সিরিয়াস হয়ে গেল কী করে কে জানে, চলে গেলেন হরিশ। হরিশের ছেলেরা হসপিটালের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু এই ডামাডোলে ধোপে টেকেনি।

 

মুখোশ (শেষ পর্ব)

গত সপ্তাহে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সমর, মদের নেশায় চুর হয়ে একটা ওর চেনা-পরিচিত ক্যাসিনোতে যায়। ওখানে ও প্রায়ই যেত তাই ক্যাসিনোর মালিক ওকে খেলার জন্য দুই লক্ষ টাকা ধারও দেয়। কিন্তু সমর একঘন্টার মধ্যেই পুরো টাকা হেরে যায় এবং তার পরেও আবার টাকা ধার দেওয়ার জন্য ক্যাসিনোর মালিককে জোরাজুরি করতে থাকে। কিন্তু ওখানকার মালিক আর টাকা ধার না দিয়ে সমরকে চব্বিশ ঘন্টা সময় দেন আগের দুই লক্ষ টাকার ধার মেটাবার জন্য। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে বচসা হয় এবং পরিস্থিতি মারমারি পর্য‌ন্ত পৌঁছোয়। মারামারির মধ্যে সমরের হাতে ক্যাসিনোর মালিক খুন হয়ে যায়। ফলে খুনের চার্জ গিয়ে পড়ে সমরের উপর। ও কোনওমতে ওখান থেকে পালাতে পারলেও উপস্থিত সকলেই ওকে খুন করতে দেখেছিল। ফলে পুলিশের কাছেও ওর বিরুদ্ধে যথেষ্ট ছিল।

প্রণতি এবার একটু গম্ভীর হল। প্রণতির চোখে কিছুটা অনুকম্পা প্রকাশ পেল কিনা ঠিক বুঝতে পারল না সঞ্চিতা। আরও কিছু শোনার অপেক্ষায় নিঃশ্বাস প্রায় আটকে উঠছিল সঞ্চিতার। প্রণতি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। আবার বলতে আরম্ভ করল, এবার নিজেকে একটু শক্ত করো সঞ্চিতা, কারণ এখন আমি যেটা বলতে যাচ্ছি সেটা তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্নেও কোনওদিন ভাবোনি। তোমাকে বিয়ে করার ছয়মাস আগে সমর একটি জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু মেয়েটি দুতিন মাস পরেই স্বামীর চালচলন ঠিক নয় বুঝে ওকে ছেড়ে চলে যায়। এখনও পর্য‌্যন্ত আইনত ওদের ডিভোর্স হয়নি। সেজন্য তোমার বিয়ে কতটা আইনসিদ্ধ সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সম্ভবত সেই কারণেই তোমার গর্ভপাত করানো হয়েছে, যাতে তোমার আর বাচ্চার জন্য ও সমস্যায় না পড়ে।

সমর ছেলেটি একেবারে ধোঁকাবাজ একটা ছেলে। ওকে দয়া করার কোনও মানেই হয় না। তুমি যেমন করে পারো এই বিয়েটা থেকে বেরিয়ে এসো। আমার পরিচিত উকিলের সঙ্গে আমি কথা বলছি, দেখি তিনি কী পরামর্শ দেন। কাল দুপুরে সমরকে কোর্টে তোলা হবে। আমি আমার উকিলের সঙ্গে ওখানে যাব। তুমি এখন বাড়ি যাও। তোমার যত জিনিস, গয়না, টাকা-পয়সা— সব নিয়ে আমার বাড়ি চলে এসো। এখানে তোমার একটা জিনিসেও কেউ হাত দেবে না। কেস মেটা না পর্য‌্যন্ত তুমি আমার বন্ধু, বোন হিসেবে এই বাড়িতেই থাকবে আমার কাছে।

চোখের জল মুছে সঞ্চিতা মাথা নেড়ে প্রণতিকে নিজের সম্মতি জানাল এবং ধন্যবাদ জানিয়ে প্রণতির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

নিজের বাড়িতে এসে সঞ্চিতা শাড়ি, জামাকাপড়, গয়না যা যা ছিল সব দুটো সুটকেসে ভরে নিল। গয়নাগুলো সব ঠিক আছে দেখে একটু আশ্চর্যও হল। ওর কাছে যা টাকা ছিল, জরুরি কাগজপত্র, পাসপোর্ট-ভিসা সব ব্যাগে ভরে নিয়ে সারা বাড়িটা একবার চোখ বুলিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে প্রণতির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

 

পরের দিন সমরকে কোর্টে হাজির করা হল। সঞ্চিতা, প্রণতি উকিলের সঙ্গে ওখানেই উপস্থিত ছিল। সঞ্চিতা এবার সমরের মুখোমুখি হল, জিজ্ঞেস করল কেন একটা মেয়েকে ও এভাবে ধোঁকা দিল? সমরের কাছে কোনও উত্তর ছিল না। শুনানি হয়ে যেতে পুলিশ ওকে নিয়ে চলে গেল।

প্রণতির সাহায্যে সঞ্চিতা জার্মান মেয়েটির সঙ্গেও দেখা করল। সমরের সব ঘটনা শুনে মেয়েটিও অবাক হয়ে গেল। সমরের হাত থেকে রেহাই পেতে মেয়েটি কথা দিল সঞ্চিতাকে সবরকম ভাবে ও সাহায্য করবে।

সবার আশ্বাস পেয়ে সঞ্চিতা অনেকটাই চিন্তামুক্ত হতে পারল। ওর মনে হল সমরের হাত থেকে সহজেই ও মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সমরের কেস-টার নিষ্পত্তি হতে দেড় বছর গড়িয়ে গেল। ওর দশ বছরের সাজা হল। সঞ্চিতা এবার ডিভোর্স পেপার সাইন করাতে সমরের সঙ্গে দেখা করল। সমর শেষপর্য‌্যন্ত বিনা বাক্যব্যয়ে সমস্ত কাগজে সাইন করে দিল। অবশেষে সঞ্চিতা স্বাধীনতার স্বাদ পেল। এর জন্য প্রণতিকে ও বার বার ধন্যবাদ জানাল।

এতদিনে সমরের কুকীর্তির কথা বনানী পিসি আর নিজের মা-বাবাকে জানিয়েছে সঞ্চিতা। সকলেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেলেন। বনানীও সঞ্চিতার মা-বাবার থেকে ক্ষমা চাইলেন সঞ্চিতার এখানে বিয়ে ঠিক করার জন্য। যদিও এটাতে তাঁর কোনও দোষই ছিল না। তিনি নিজেও সমরের এই চারিত্রিক অবনতির কথা জানতেন না। কারণ সমর তাঁকেও অন্ধকারে রেখেছিল। সঞ্চিতার মা-বাবাও ওনাকে ক্ষমা করে দিলেন। একে অপরকে দোষারোপ করে আর লাভ কী?

দিনকয়েক পরে সঞ্চিতা মুম্বই এয়ারপোর্টে নামলে ওকে স্বাগত জানাবর জন্য ওর মা-বাবার সঙ্গে বনানী পিসিও হাজির হলেন। প্রণতির সাহায্য নিয়ে সঞ্চিতা পেরেছিল সমরের ভালোমানুষি চেহারাটা থেকে মিথ্যার মুখোশটা টেনে খুলে দিতে। সকলের সামনে ওর আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দিতে। মুখোশধারি এরকম হাজার হাজার সমর সর্বত্র রয়েছে। সাহসের সঙ্গে সেই মুখোশ টেনে সরিয়ে দিতে মেয়েদেরই আজ এগিয়ে আসার দরকার।

পিছুটান

দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল এখানে। চুপচাপ নিস্তরঙ্গ এই ছোট্ট জনপদটা বেশ লাগছে আমার। সবুজে ঘেরা চারপাশ। আকাশ এখানে দিনে নীল, রাতে ঘন কালো। আর যখন সেই ঘন কালো আকাশ জুড়ে সলমাজরির ফুলকারি কাজের মতো ঝিকিমিকি তারা দেখি, আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলায় ছোটোকাকু মাঝেমাঝে আমায় এমন রাতে ছাদে নিয়ে যেত তারা চেনাতে। সপ্তর্ষিমণ্ডল, শুকতারা, ধ্রুবতারা…

এখানে এসে আবার আমার তারাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে। আকাশ, গাছ, পাখি, কাঠবিড়ালি— সবার সঙ্গে চেনাজানা বাড়ছে। শহরে তো শুধু ইট-কাঠ-কংক্রিট আর ব্যস্ত দৌড়ে বেড়ানো মানুষের ভিড়।

আমি খুবই সাধারণ মধ্যমেধার একজন মানুষ। কী পড়শোনা, কী অন্যকিছু, কোনও কিছুতেই তেমন ছাপ ফেলার মতো কিছু করতে পারিনি আজ অবধি। আমি যাকে বলে একটা এলেবেলে, ভিড়ে মিশে থাকা মনিষ্যি. যার ওই একটা নামই আছে শুধু।

বাবা-মা গত হয়েছেন, বোন তার সংসার নিয়ে নাজেহাল। চারপাশে সবাই কমবেশি ব্যস্ত, শুধু আমারই অখণ্ড অবসর। পৈত্রিক বাড়ির একটা অংশের ভাড়া আর বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকায় আমার চলেই যেত ঠিকঠাক। আসলে কোনও কাজই খুব বেশিদিন আমার ভালো লাগত না, একঘেয়ে লাগত। তাই কখনও কাজ আমায় ছাড়ত কখনও আমি কাজকে।

বন্ধুবান্ধব সবাই যে যার মতো নিজের জীবনে শিকড় গেড়ে বসেছে। তাদের কত গল্প! বউয়ে টকঝাল খুনসুটি, সন্তানের স্কুল, পরীক্ষা, ভবিষ্যৎ। নিজেদের পরকীয়া, অবদমিত যৌনতা, সুগার, প্রেশার, আমাশা, ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ির মাইলেজ, বসের শয়তানি, বকেয়া ডিএ। ওদের কত্ত বিষয় আলোচনার, যেগুলো আমার কিচ্ছু নেই। তাই ধীরে ধীরে একসময় ওদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। ওরা ওদের মতো আর আমি আমার মতো, একা।

তবে কি, একা থাকতে থাকতে একটা সময় বেশ ক্লান্ত লাগত। মাঝেমাঝেই মনে হতো একটা সংসার থাকলে বেশ হতো। একটা মিষ্টি মতো বউ। যার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর, দু-একটা ছেলেপিলে, কিছু দায়িত্ব, একটু ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান আর এসব জড়ানো অনেকটা ভালোবাসা মাখানো রাশি রাশি স্বপ্ন। তারপরই হাসি পেত। আমার মতো লোকের নাকি আবার বউ, ছেলে-মেয়ে সংসার… ঠিক এমন সময়ে এই চাকরির সুযোগটা এসেছিল।

আমার ভাড়াটে ছেলেটি বেশ চৌকশ। কোথায় একটা চাকরি করে, শখের ফটোগ্রাফার আর কী সব এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। ছটফটে মজারু ছেলে। ও একদিন হঠাৎ বলল, দাদা আজকাল কী করছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ভারি মুশকিল। যদি বলি কাজ করছি, তো কী কাজ? কোথায় অফিস? কত দেয়? হাজার প্রশ্ন! আর যদি বলি কিছু করছি না, তবে কেন করছেন না? না করলে চলছে কী করে? আরও একঝুড়ি কথা। আমার বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না। তাই হুঁ হা করে এড়িয়ে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু সে ছেলে ছাড়লে তো?

—একটা কাজ আছে, করবেন? আপনার ভালো লাগবে।

—এই রে, আমার মতো লোকের জন্যও কাজ?

—কেন? মানে আমাকেই বলছ কেন? কাজের লোকের তো অভাব নেই।

—না মানে, ওরা একজন পিছুটানহীন লোক চাইছেন, তাই…

সত্যিই তো। এভাবে তো ভাবিনি। আমার এই জীবনটা নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি। আমার পথ চেয়ে কেউ বসে থাকার নেই। আমারও কারও কাছে কোনও দায় নেই। আমার না আছে শিকড় না নিজস্ব পরিসর। আমি সত্যিই পিছুটানহীন। তা এহেন আত্মপোলব্ধিতে অন্যের কী হতো জানি না, আমার বেশ মজাই লেগেছিল।

রাজি হবার সময় সত্যি ভাবতে পারিনি এরকম একটা জায়গায় থেকে কাজ করতে হবে আমায়। শহর থেকে অনেক দূরে, শাল মহুলে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদে একটা আবাসিক স্কুলের কেরানি এখন আমি। ছাত্ররা সবাই স্থানীয় গ্রামের। বেশির ভাগই বোর্ডিং-এ থাকে। আমার কাজ বোর্ডিং-এর খাতাপত্র লেখা, ছেলেপুলেগুলোর ওপর নজর রাখা, খাবারদাবার এর তদারকি করা এইসব। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বোর্ডিং-এই।

আমার জন্য বরাদ্দ ছাদের ঘরটা চমৎকার। জানলা খুললেই স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সবুজ মাঠ পেরিয়ে দূরের গহিন জঙ্গলটা দেখা যায়, যার একটু ভিতরে একটা আদিগন্ত বিস্তৃত জলাশয় আছে। রাতে ছেলের দল খেয়েদেয়ে যখন শুয়ে পড়ে, আমি ঘর ছেড়ে ছাদে চলে আসি। দূর জঙ্গলটা থেকে তখন কতরকম শব্দ মিঠে হাওয়ায় ভেসে আসে। শনশনে হাওয়ায় ডালপালার আড়মোড়া ভাঙা, রাতচরা পাখির তীক্ষ্ন ডাক, অজানা জন্তুর গরগরানি আর সেসব ছাপিয়ে অদ্ভুত একটা ছলছলে জলের আওয়াজ ভেসে আসে। প্রশান্ত, গম্ভীর, বাঙ্ময়। যেন একটা গভীর ডাক, একটা আকুল আহ্বান। আমি একদিন যাব। আমায় যেতেই হবে ওইখানে।

আজ অকারণেই আমার মনটা খারাপ। দুপুর শেষ হতেই কিছুই যেন ভালো লাগছিল না। কাজে মন বসছিল না। কাউকে কিছু না জানিয়ে স্কুল চৌহদ্দির পিছন দিকটার ঢালু জমিটায় এসে বসেছি। এখান থেকে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে সেই জলাটা আবছা দেখা যায়।

আমার ভিতরে আজ কদিন একটা ইচ্ছে পাক খাচ্ছে। যাই চলে এই ঘাস জমি পেরিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ওই জলাশয়ে কাছে। দুদণ্ড বসি ওর পাড়ে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা পই পই করে বারণ করেছেন জঙ্গলে যেতে। সাপ-খোপ, বুনো জন্তু কী না আছে ওখানে! বোর্ডিং-এর রান্নার মাসি একদিন বলছিল, ওই জলার নাকি মায়াটান আছে। মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চায়। যতসব গ্রাম্য রটনা।

এখন দুপুর গড়িয়ে পড়ছে বিকেলের কোলে। কয়েজন গ্রাম্য নারীপুরুষ গরু ছাগলের খুঁট ধরে বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে। কারও মাথায় ঝরা শালপাতার বোঝা, কারও হাতে কাঠকুটো, ডালপালা। আপন মনে কলকল করতে করতে ওরা চলে যাচ্ছে দূর গাঁয়ে দিকে। ওদের কথা, হাসি, ছাগলগুলোর গলার ঘন্টার টুংটাং আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মানুষ আর গরু ছাগলের পায়ে অভিঘাতে মেঠো পথে ধুলোর ঘুর্ণি উঠছে। ওদিকের বিশাল প্রাচীন গাছগুলোর মাথায় সূর‌্য আগুনরাঙা থালার মতো ধীরে নেমে আসছে। আর সেসবের মধ্যে দিয়ে আমার কানে আসছে পাড়ে মৃদু মৃদু ধাক্কা খাওয়া জলের শব্দ। ছলাৎ… ছলাৎ…। আমায় বিবশ করে ফেলছে সেই শব্দ।

হঠাৎ যেন ঘোর ভেঙে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে, এই দশ কি বারো বছর বয়ে হবে, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, হাতে একটা মাছ ধরার ছিপ নিয়ে হনহন করে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি তো অবাক। এই সময়ে একা একটা বাচ্চা ছেলে ওদিকে যাচ্ছে কেন?

—এই ছেলে, তুই কোথায় যাচ্ছিস রে?

ভয়ানক চমকে ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি উঠে ওর কাছে গেলাম। ছেলেটা আমাকে দেখছে আমিও ওকে। একমাথা রুখুশুখু চুল, শ্যামলা মুখটায় টানা টানা দুটো চোখ। কী ভীষণ মায়া জড়ানো তাতে।

—তুমি কে?

—আমি? আমি ওই স্কুলে থাকি। শহরের লোক।

—ও, তা তুমিও জলা দেখতে যাচ্ছ?

ভারি আশ্চর্য তো! আমার জলা দেখার ইচ্ছের কথা ও জানল কী করে?

—বললি না তো তোর নাম কী?

—ছোটু।

—আরে বাঃ ভারি সুন্দর নাম তো। তা তোর প্যান্টুটা কি কোমরে ঢলঢল করছে? হাত দিয়ে ধরে আছিস যে?

—হঁ।

—আচ্ছা দাঁড়া।

আমি ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলাম। তারপর প্যান্টুটা ধরে ওর কোমরের ঘুনসির মধ্যে দিয়ে গলিয়ে ওপর দিকে তুলে আবার একটু নামিয়ে দিলাম। প্যান্টটা টাইট করে আটকে রইল ওর ঘুনসিতে। একগাল হাসি উপহার দিল ছোটু।

—চলো তোমায় জলা দেখিয়ে নিয়ে আসি। আমি দুটো মাছ ধরব ওখান থেকে। মা আর আমি খাব।

—ও তা বেশ। চল…

ছেলেটা ভারি সরল আর মিশুকে তো। আমি ভাবছিলাম আমাদের শহরের বাচ্চারা অচেনা লোকের সাথে এত কথা বলত না।

—ঘরে তোরা কে কে থাকিস রে?

—আমি আর মা।

—তোর বাবা?

—বাবা নেই। চলে গেছে। আর আসে না।

আমার বুকটা হু হু করে উঠল। আহা রে, এতটুকু ছেলের বাবা নেই। কেন জানি না কীরকম একটা জ্বালা করে উঠল চোখ দুটো। ছোটু মহা উৎসাহে হাত পা নেড়ে আপনমনে বকবকম করতে করতে তরতরিয়ে হাঁটছে। আমি ওর সাথে তাল রাখতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছি।

—তা মাছ যে ধরবি তোর চার কোথায়?

—এই তো।

বলে পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজে মোড়া একদলা মোটা লালচে ভাত বার করল ও।

—ও আচ্ছা।

আমরা এখন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। খুব চুপচাপ চারদিক। দূরে অস্পষ্ট পাখির ডাক আর বড়ো গাছগুলোর নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে আমাদের চলার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

শুধু একটা গন্ধ। ভেজা, গহন, গভীর, প্রাচীন একটা গন্ধ ধীরে ধীরে আমার ইন্দ্রিয়কে বশ করে আনছে। কী মাদকতা এই গন্ধে। আমি অস্থির হয়ে উঠছিলাম। আরও কাছে যেতে হবে এ গন্ধের

—উই দ্যাখো গো জলা। আমরা এসে গেছি গো।

হঠাৎ যেন উঁচু গাছগুলোর মাথা থেকে ঝুপ করে দলা দলা নরম অন্ধকার নেমে এল নীচে। কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল আমাদের ঘিরে। আমরা এখন জলের একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছি।

দ্রুত সন্ধে নেমে আসছে। ছোটু দেখলাম পাড়ের কাদা মাড়িয়ে পায়ে পাতা ডুবিয়ে ভাত বেঁধানো বড়শিটা জলে ছুড়ে দিল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর জলে একটা আলোড়ন উঠল। আমি ছোটুর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম তোলপাড় হচ্ছে জল। ছোটুর ছিপে টান পড়েছে। ও প্রাণপণে ছিপটা টেনে ধরে পাড়ের দিকে আনতে গেল কিন্তু উলটে নিজেই জলের মধ্যে নেমে যেতে লাগল।

আমি খুব উৎসাহ পেয়ে গেলাম। বড়ো কোনও রাঘব বোয়াল গেঁথেছে নির্ঘাত। ছোটুর হাতের পাশ দিয়ে চেপে ধরলাম বঁড়শিটাকে। টানতে লাগলাম পাড়ের দিকে।

পারছি না। পারছি না দুজনে। উলটে নেমে যাচ্ছি জলের গভীরে। ওটা আমাদের টেনে নিচ্ছে ভিতর পানে। আঁধার আরও গভীর হচ্ছে চারপাশে। আমার পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শ্যাওলা। ছোটুর হাতটা ছেড়ে গেল বোধহয়। আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ছিপটায় টান দিলাম আর তখনই এক অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম।

আমার মাথার ওপরে, চারপাশে চরাচর জোড়া মিশকালো আকাশ। সারা আকাশ জুড়ে সলমাজরির ফুলকারি কাজের মতো তারাদের ঝিকিমিকি। আমি কোমর অবধি ডুবে আছি সেই তরল কালো আকাশে! আমার চারপাশে সেই আকাশ ছাওয়া অমোঘ মায়া আমায় পিছু টানছে। চারপাশে কী যেন ভেসে বেড়াচ্ছে মাছের মতো। সরে যাচ্ছে দূরে, আবার কাছে আসছে।

আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ফিশফিশ করে বলছে আয় আয়। ডুব দে আরও গভীরে। পাড়ে কেউ নেই তোর জন্য অপেক্ষায়। আর ফিরে যাওয়ার কী দরকার? এখানে আয়। এখানে নির্জন অন্ধকার বড়ো গভীর আর শীতল। সব তাপ তোর জুড়িয়ে যাবে। আয়… আয়…

আমি অনুভব করলাম এই অমোঘ ডাক— এই টান, অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি বিবশ। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পাড়ে যাব না।

সেই গন্ধটায় চারপাশ ম’ ম’ করছে। আমি ডুবে যাচ্ছি সেই আদিম গন্ধে। হঠাৎ মনে হল ছোটুর কথা। ও কোথায়? আমি থমকে গেলাম, জোর করে নিজের মনকে সংযত করার চেষ্টা করলাম।

—ছোটু, ছোটু, কোথায় তুই?

—এই তো আমি, মাছ পেয়েছি গো।

আমি পিছু ফিরলাম। ছোটু পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর হাতে একটা রুপোলি মাছ ছটপট করছে। ছোটুর মুখে হাসি। এমন হাসি, এত মধুর, অমলিন, স্বর্গীয় যে, আমার বুকটা হু হু করে উঠল।

আমি দেখতে পেলাম তকতকে নিকানো মাটির উনুনে, কাঠকুটো আর শুকনো ডালপালার আগুনে লোহার কড়াইয়ে মাছ ভাজা হচ্ছে। টাটকা মাছের গন্ধে ম’ ম’ করছে চারপাশ। ছোটু বসে আছে ধোঁয়া ওঠা মোটা লালচে ভাত রাখা থালার সামনে। একগোছা রেশমি চুড়ি পরা হাতে ভাজা মাছের দুটো টুকরো তুলে দিচ্ছে ওর পাতে, মাথায় ঘোমটা টানা কেউ একজন। তারপর সে আমার দিকে ফিরল।

—আসুন, এবার আপনিও বসুন।

আমি দেখলাম তার মুখে সলজ্জ হাসি। গর্জন তেল মাখানো প্রতিমার মুখের মতো চকচকে মুখ তার, কপালে সিঁদুর। সেই সিঁদুরের কমলা গুঁড়ো তার নাকের ওপর পড়েছে। তার হাতে ধরা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা। আমার জন্য।

আর কিছু ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, গলার কাছে দলা পাকানো কী একটা ঠেকছে।

আমি আর কিচ্ছু না ভেবে শরীরের সব শক্তি দিয়ে পিছু ফিরলাম। আমায় ফিরতে হবে। পাড়ে যেতে হবে। এক উলটো টান আমায় পাড়ের দিকে টানছে। সে টান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার।

এখন আমার হাতে ধরা ছোটুর হাত। ওর গা মাথা আমি মুছিয়ে দিয়েছি আমার জামা দিয়ে।

ছোটু বকবক করছে। ওর গাঁয়ের গল্প, বন্ধুদের কথা, মায়ের কথা বলছে।

আমার মনে এখন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। অথই জল ছেড়ে শুকনো ডাঙায় ওঠার নিশ্চিন্তি। ছোটুর হাতের উত্তাপ আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ভিতরে ভিতরে ছটফট করছি। দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা নিয়ে যার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

আকাশের নিকষ কালো অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ফুটফুটে একফালি চাঁদ। আমার শরীর মন জুড়ে এখন ভীষণ খিদে।

মাঙ্কি ক্যাপ (১ম পর্ব)

শীত এলেই সবার নজরে পড়ে মাঙ্কি ক্যাপটির উপর। প্রথমে ইমনের দাদু এক্স বিপ্লবী স্বদেশ হালদারের। একসময় চুটিয়ে স্বদেশি করেছেন। সার্থক তাঁর নাম আর কাম। মাথায় গান্ধি ক্যাপ। মনে হতো তিনিই মহাত্মা। স্বাধীনতার পরও টুপি মাথায়। গান্ধি যেন তাঁর তেলা নি-কেশ মাথায় চেপে বসেছে। পাড়ার উঠতি ছেলেছোকরার কাছে তিনি টুপিদাদু। কিন্তু দাদুরও বয়স বাড়ছে। সঙ্গে জাঁকিয়ে পড়ছে শীত। গান্ধি টাক মাথা সামলালেও কান আর নাকের ফুটোয় গোঁজ মারা তার কম্মো নয়। ফলত হিমেল হাওয়ার দাপটে ইমনের টুপি দাদু একেবারে কুপোকাত। গলায় ঘর্ঘর, নাকে সরসর আর কানের ভিতর কড়কড় অনবরত বেজেই চলেছে। তবু দাদু টুপি খুলবেন না। ডাক্তার সনাতন হাজরা ইমনের মাকে উপদেশ দিলেন— এমনটা কখনওই বরদাস্ত করা যাবে না। আরে বাবা বয়স তো হচ্ছে নাকি? কত চলছে?

ইমনের মা আঙুলের কড় গুনে বলেন— আশি ছুঁই ছুঁই।

ডাক্তার হাজরা চমকে উঠে বলেন— এই ভয়ংকর শীতে এখনও হাফ নেকেড ফকির হয়ে থাকতে চান। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—বাবা তো সচিনের মতো সেঞ্চুরির পাহাড় গড়বেন বলে শপথ করেছেন।

—বলবেন, ওসব গান্ধিগিরি চলবে না। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভিমরতি। নিউমোনিয়ায় একেবারে টেসে যাবে।

—তাহলে উপায় ডাক্তারবাবু?

—হনুমান ডট কমের যুগ। ছবিতে দেখেছেন বিশুর ছেলেটা মাথায় কী পরে আছে? ইমনের মা মাথা নাড়ে।

ডাক্তার হাজরা বিজ্ঞের মতো বলেন— আইসল্যান্ডে ওসব গান্ধি-টান্ধি এক্কেবারে অচল। হনুমানই পারে ওরকম রাবণের মতো ভয়ংকর প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে।

—তার মানে, আপনি বলছেন মাঙ্কি ক্যাপ।

—গান্ধির বদলে হনুমান। ঠিক ধরেছেন।

—কিন্তু হনুমান টুপি যদি মাথায় না পরতে চান? আমার শ্বশুরমশাইয়ের যা জেদ।

ডাক্তার হাজরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে কিসব চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতহাস্যে বললেন— কুছ পরোয়া নেই। যে রোগের যেমন ওষুধ।

ইমনের মা বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন— সেটা আবার কী?

—কথা না শুনলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।

—আপনি কী করবেন?

—ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে গান্ধি খুলিয়ে হনুমান পরিয়ে দেব।

—কতক্ষণ লাগবে?

—মাত্র সাড়ে সতেরো মিনিট।

—বলেন কী টুপি পরানো এত সোজা? এত তাড়াতাড়ি?

—আমার নাম…।

ইমনের মা সামান্য রসিকতা করে বলে— মুন্না ভাই এমবিবিএস। তাই না?

—ধ্যাৎ, কী যে বলেন। আমার নাম সনাতন হাজরা। রোগীদের টুপি পরানোই আমার কাজ। বিফলে মূল্য ফেরত।

ইমনের মা বিড়বিড় করে বলে— মুন্নার বদলে সনাতন। গান্ধির বদলে হনুমান। দুয়ে দুয়ে চার।   ভালোই মিলেছে।

ডাক্তার হাজরার চেম্বার পর্যটন করে ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপের স্বাদ টের পেয়েছেন এখন হাড়ে হাড়ে। তাঁর মুখে দিনরাত হনুমান চালিশা। হনুমান ভক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। টুপির এত গুণ, আগে জানা ছিল না। শীত এলেই তিনি বাহুবলী হয়ে যান। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে যখন সবাই লেপের ভিতর জবুথবু, ঘুম আর ভাঙতেই চায় না, তখন ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে স্বপ্নবীথি পার্কের ভিতর তিন রাউন্ড মর্নিং-ওয়াক সেরে অবলীলায় বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর সোজা ইমনের বাবার ঘরে ঢুকে এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলেন— যা আর দেরি করিস না। পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। ইমনের বাবার মুখে বিরক্তির সুর— আঃ আমাকে আবার টুপি পরাতে এলে কেন? দাদু নাছোড়বান্দা। টুপি পরানোয় তিনি জেনারেশন ধরে অভ্যস্ত করাবেনই। সবশেষে যে ইমনের পালা, তা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সে জানে লেপের তলায় ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকলেও রেহাই নেই। দাদু ইমনের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন – শোন মহিম, মাঙ্কি ক্যাপ পরে শীতের সকালে মর্নিং ওয়াকের মজাই আলাদা। ইমনের বাবা যেন তার দাদুর কথা শুনতেই পায় না। লেপের ভিতর শামুক হয়ে থাকতে চায়। দাদু তবু ছাড়ে না ইমনের বাবাকে। বলেন— কিরে উঠবি নাকি বউমাকে বলব গায়ে জল ঢেলে দিতে। ইমনের বাবা মুখ বিকৃত করে বলে— আঃ কি জ্বালাতন! শান্তিমতো ঘুমোতেও দেবে না নাকি?

—ব্যাটা কুম্ভকৰ্ণ। এত ঘুম আসে কী করে? রাতে ঘুমোসনি? হঠাৎ দাদু বাজখাই গলায় ইমনের মাকে চিৎকার করে ডেকে বলেন— বউমা, মহিম কি রাতে ঘুমায় না? তোমরা করো কী? মা আমতা আমতা করে বলে— আপনার গুণধর ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমি পই পই করে বলি, যা ঠান্ডা পড়েছে তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর…। দাদু মাকে সমর্থন করে বলেন— ইউ আর রাইট বউমা। বাট মহিম…।

—সাত তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর ঢুকলে ওর নাকি জ্বর আসে।

—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জ্বর?

—মানে গরম হয়ে গেলে আর ঘুম আসে না। —কই আমি তো এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না।

—আপনি গুরুজন। আপনাকে কি সব খুলে বলা যায়?

—তুমি কাছে থাকো না?

—আমি থাকলে জ্বর আরও বাড়ে।

—সে কি কথা! কেমন ব্যাধি?

—আপনার ছেলেই ভালো বলতে পারবে।

—ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

—আপনার ছেলে না যেতে চাইলে আমি কি আর করতে পারি?

—আঃ বউমা হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার হাতেই ওর কলকব্জা।

—শীত এলেই ও এরকম বিগড়ে যায়। মেশিন ঠিক থাকে না।

—না না এতো ভালো কথা নয়। এর একটা আশু বিহিত প্রয়োজন।

—দেখুন চেষ্টা করে। আপনার মধ্যস্থতায় যদি কাজ হয়। আমি তো অলরেডি ফেড-আপ।

এইবার দাদু ইমনের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন— কী’রে বউমা যা বলছে সত্যি?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— হুম।

—রাতে ঘুমোস না?

—হুম।

—বউমার কথা শুনিস না?

—হুম।

—কী তখন থেকে হুম হুম করছিস?

—আঃ বিরক্ত কোরো না তো। লেট মি হ্যাভ এ সাউন্ড স্লিপ।

—রাতে না ঘুমিয়ে সকালে কেন ঘুমোচ্ছিস মহিম?

—ক’দিন ধরে অফিসের কিছু জরুরি ফাইল রাতে দেখতে হচ্ছে। তাই শুতে দেরি হচ্ছে। আর কোনও গল্প নেই।

ইমনের মার দিকে তাকিয়ে দাদু বলেন— ও তাই বল। আমরা তো অন্য কিছু সন্দেহ করছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন -ওরে বাবা সাতটা বেজে গেল। নে আর দেরি না করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপটা চাপিয়ে পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। দেখবি মন-মেজাজ একেবারে ঝরঝরে হয়ে যাবে।

ইমনের বাবার সেই এক বিরক্তিকর জবাব— আজ টুপি না পরলেই নয়?

— টুপি না পরলে ইউ মাস্ট ক্যাচ কাফ্ অ্যান্ড কোল্ড। আজকের টেম্পারেচার কত জানিস? অলমোস্ট এইট ডিগ্রি। ‘জয় হনুমান’ বলে বেরিয়ে পড়।

—আজ আমি টুপি পরব না।

—ছেলেমানুষি করিস না মহিম। টুপি তোকে পরতেই হবে।

—কিছুতেই না।

—অবাধ্য হোস না। তুই ভালো করেই জানিস। আমি এক সময় স্বদেশি করেছি। কতজন গোরাকে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলেছি। গান্ধি ছেড়ে এখন আমি হনু হয়েছি। আমার এখন মহাবলী শক্তি।

হঠাৎ ‘জয় বজরংবলী’ বলে একলাফে ইমনের টুপিদাদু তার বাবাকে চ্যাংদোলা করে তুলে বাইরে এনে ফেলে। তারপর মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ পরিয়ে বলেন— মহিম তুই এখনও আমার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু রে।

(২)

সেদিনটাও ছিল এমনই এক ভয়ংকর শীতের সকাল। হনুমান টুপি মাথায় ইমনের বাবা বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে তখন পড়ত বাবা। সঙ্গে চাকরির পরীক্ষা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বডি ফিট। বাইসেপস, ট্রাইসেপস, সিক্স প্যাকস সবই তার স্বাস্থ্যবান শরীরে সুসজ্জিত ও সুশোভিত। কিন্তু শীতকাল এলেই কেমন জবুথবু হয়ে যায় ইমনের বাবা। সামান্য ঠান্ডা যেন সহ্য হয় না। হাঁচি একবার শুরু হলে তিন কুড়িতে গিয়ে থামত। নাকের ট্যাপ কলে প্যাঁচ বিকল। অনবরত জল পড়েই চলেছে। ইমনের ঠাম্মা বুকে গরম তেল মালিশ করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলত— যা মর্নিং ওয়াকটা সেরে আয়। তোর বাবা আগেই বেরিয়েছে। আমি গরম জল চাপাচ্ছি। চা খেয়ে বাজারে যাবি। ইমনের বাবা ঠাম্মার কথা শিরোধার্য করে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

আড়াই রাউন্ড মারার পর হঠাৎ ইমনের বাবার বোধোদয় হয় কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। একেই ভয়ংকর ঠান্ডা। তার উপর পার্ক প্রায় জনমানবশূন্য। যে দু-চারজন সিনিয়র সিটিজেন হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করছিল তারাও একবার কোনওক্রমে রাউন্ড মেরেই সটকেছে। কেবল ইমনের নির্ভীক স্বাস্থ্যবান বাবা একা শীতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

পিছনে না তাকিয়েই জোরে পা চালায় তার বাবা। ভাবে, নির্ঘাৎ কোনও চোর-ডাকাত। তার পকেটে বাজারের টাকা। আঙুলে জন্মদিনের সোনার আংটি। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। সব কেড়ে নিলে, খুলে নিলে তার যাবতীয় বীরত্ব ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। ওর হাতে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে।

এরকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পিছু-নেওয়া আগন্তুকের সঙ্গে ছোটাছুটি লুকোচুরি খেলার পর অকস্মাৎ এক মেয়েলি কন্ঠস্বরে ইমনের বাবার সম্বিৎ ফেরে। তার বাবা শুনতে পায়— প্লিজ হেল্প মি…. আর পারছি না… ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি… আমাকে বাঁচান।

মেয়েলি কেসে তার বাবা কোনওদিনই পাশ করতে পারেনি। বরাবরই শূন্য পেয়েছে মেয়ে পটানোর পরীক্ষায়। অথচ কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুরা ক্যান্টিনে বাথরুমে-সিঁড়িতে- ব্যালকনিতে— যত্রতত্র নির্ভয়ে টুকলি করে পাশ করে যাচ্ছে। ইমনের বাবার কানে ফের সেই করুণ আর্ত কন্ঠস্বর — আমাকে বাঁচান… আমি জমে যাচ্ছি… মরে যাচ্ছি। ইমনের বাবা মনে মনে ভাবে— কেসটা জন্ডিস নয় তো? বাঁচাতে গিয়ে যদি ফেঁসে যায়? মেয়েরা সব পারে। ইমনের বাবা তবু সাহস সঞ্চয় করে ‘জয় বজরং বলী’ বলে একলাফে মেয়েটির সম্মুখীন হয়— আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান বলুন তো? মেয়েটি তার কথার জবাব না দিয়ে ইমনের বাবার মুখের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বাবা থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে বলে— কী মেয়েরে বাবা, কথা নেই বার্তা নেই। প্রথম সাক্ষাতেই মুখ দেখাচ্ছে। এরপর না জানি কী করতে বলবে। এদিকে মেয়েটি প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রায় বাকরুদ্ধ। আঙুল দেখিয়ে কোনওক্রমে বলে — টুপি। ইমনের বাবা চমকে উঠে বলে— টুপি কেন?

—বাইটিং কোল্ড। বুঝিনি বাইরে এতটা ঠান্ডা। টুপি না জড়ালে কানের যন্ত্রণায়…।

—কিন্তু আমার টুপি আপনাকে জড়ালে আমার হাঁচি, কাশি, নাকের জল…।

—আপনি কি চান না একটা অসহায় মেয়েকে এই নিষ্ঠুর আবহাওয়া থেকে বাঁচাতে, উদ্ধার করতে। আপনি সু-পুরুষ স্বাস্থ্যবান। আপনি নিশ্চয়ই চান না চোখের সামনে অসহায় মেয়েটি শীতের প্রচন্ড কামড়ে ফালাফালা হোক। ইমনের বাবার মনে হল, কে যেন তার জামা-প্যান্ট-মাফলার-সোয়েটার-হনুমান টুপি সব খুলে নিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেহে এক বালতি জল ঢেলে দিল।

মাথার মাঙ্কি ক্যাপটা একটানে খুলে ইমনের বাবা মেয়েটির মাথায় পরিয়ে দিল। উষ্ণতা পেয়ে মেয়েটি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। কিন্তু টুপি খসিয়ে হাড়-কামড়ানো কনকনে শীতে ইমনের বাবা টানা এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছিল। মেয়েটি এর মধ্যে বার কয়েক এসে তার বাবাকে উষ্ণ করে দিয়ে গেছে। এরপর তার বাবার চাকরি, তার বাবার বিয়ে সবই সম্ভব হয়েছে মেয়েটির চিরস্থায়ী সঙ্গলাভ এবং ভালোবাসার হাতের-গরম স্পর্শে। মাঙ্কি ক্যাপের আড়ালে সুজাতা সরকার নামের সেই মেয়েটি এইভাবেই ইমনের বাবার অর্ধাঙ্গিনি এবং ইমনের গর্ভধারিণীরূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

রঘু

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি। একদম দুয়ে নিয়ে ছাড়ে। রোজ রোজ অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয় খুব। তাই ‘স্লিপ ডেট’ কাটাতে রবিবারই ভরসা। সেখানেও জ্বালা। ন’টা বাজলেই গামলা মুখে বউয়ের গর্জন। চলো বাজার, বাজার চলো! এপাশ ওপাশ করে যে আরও আধঘন্টা ল্যাদ খাবো তার উপায় নেই। আজ যেমন গরম চায়ের কাপে আমার আঙ্গুল দিল ডুবিয়ে। ড্যাশের নাম খগেন। একলাফে বাথরুম গজগজ করতে করতে।

রবিবার বাজার সেরে আমাদের বন্ধুদের একটা আড্ডা হয় কাকার চায়ের দোকানে। জনা পনেরো থাকি। বাজার ফেলেই দে দৌড়। প্রথমে মাছ মাংস কিনে তারপর সবজি বাজার সারি। ক’দিন ধরেই চিংড়ি চিংড়ি করছে ছেলেটা। একটু বড়ো সাইজের কয়েকটা নিলাম। বাটা মাছ বাবার জন্য। কাতলা কিছুটা নিলাম বাড়ির বাকিদের জন্য। চিকেন নিয়ে সবজি বাজারে ঢুকতেই দেখি পল্টুর ফলের দোকানের সামনে খুব ভিড়। পল্টু জুতো খুলে কাউকে মারছে আর “চোর চোর” বলে চিৎকার করছে। উৎসাহী কয়েকজন বেশ সোচ্চার। তাদের হুলোর মতো মুখগুলো, যেন এখনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকিয়ে দেখলাম সব মুখগুলোয় অপরের রাগ অন্যকে ঝাড়ার চেষ্টা।

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম পল্টু জুতো নিয়ে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাকে মারছে। ছেলেটার জামা ছিঁড়ে গেছে। সারা মুখ লাল মারের চোটে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খুব মায়া হলো। এইটুকু বাচ্চাকে কেউ ওভাবে মারে! ছুটে গিয়ে পল্টুর হাতটা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম, “মেরে ফেলবি নাকি বাচ্চাটাকে”। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে লাগল। নাটকের যবনিকা এতো তাড়াতাড়ি হবে ওরা ভাবতে পারেনি। এর মধ্যে তাপসদা হাজির।

তাপসদা অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার। বিশাল চেহারা ও মোটা পাকানো গোঁফ ভয় ধরায়। তাপসদা পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। পল্টুর হাতে একটা আপেল। মারার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “ছেলেটা আপেল চুরি করে ছুটে পালাচ্ছিল”। এর মধ্যে বাচ্চা ছেলেটা উঠে বসেছে। সারা শরীরে লাল লাল মারের দাগ।

হঠাৎ তাপসদা গম্ভীর গলায় বাচ্চাটাকে জিঞ্জাসা করল, “কি করেছিলিস সত্যি করে বল।”

তাপসদার চেহারা দেখেই ছেলেটা ভয় পেয়েছে খুব বোঝা গেল। একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘একটা আপেল কিনতে চেয়েছিলাম। পাঁচ টাকা আমার কাছে ছিল। দোকানদার বলল, দশটাকা দাম। আমি একটা ছোট আপেল দেখিয়ে বলি, এটা পাঁচ টাকায় দাও না। ও তখন আমাকে গালাগাল করে। বলে অতো কম দামে আপেল হয় না। তারপরও একটা নোংরা কথা বলে।’

‘আমি বলি ‘ওরকম খারাপ কথা কেন বলছো?’ বলতেই ও চিৎকার করতে থাকে আর বলে চোর চোর। আমি ভয় পেয়ে ছুটতেই ও ধরে মারতে শুরু করে। আরও কয়েকজন মারতে থাকে। আমি আপেল চুরি করিনি। আপেলে হাতই দিইনি।’ রিক্সা চালায় হারু সব দেখেছে। সে বলল, ‘বাচ্চাটা ঠিকই বলছে।’ পল্টু এমনি এমনি মারছে বাচ্চাটাকে। ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল যেন।

তাপসদা পল্টুকে শূন্যে তুলে ধরে ছুড়ে ফেলল দূরে রাস্তার ওপর। তারপর আগুন চোখে মিলিটারি মার শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলে দেখছে। যারা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে পল্টুর সঙ্গ দিচ্ছিল তারা পগারপার। তাপসদাকে থামানো যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর নিজের পায়ের জুতো খুলে বাচ্চাটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তুই মার এবার ওর মুখে তোকে যেমন মারছিল।’

সকলকে অবাক করে বাচ্চাটা বলে উঠল, ‘মা বলে, বড়োদের অসম্মান করতে নেই। গায়ে হাত দিতে নেই’। স্তম্ভিত সকলে। বাচ্চার কথাটা সকলের হৃদয় ছুঁয়ে গেল যেন। পল্টুকে ছেড়ে হাসিমুখে তাপসদা বাচ্চাটাকে কাকার চায়ের দোকানে নিয়ে গেল।

বাচ্চাটার নাম রঘু। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। ওর মা এক বাড়িতে কাজ করে। তারা সকালে চা আর বাসি রুটি দেয়। ওর মা ওই রুটি নিয়ে এলে ওরা সকলে খাবে। বাড়িতে ওরা তিনজন। মা, বোন আর ও। বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। চা আর বিস্কুট হাতে চুপ করে বসে রইল রঘু। খেতে বলতেই কেঁদে ফেলল। বলল, ওর বোনের ক’দিন ধরে জ্বর। ও না খেয়ে আছে। এক বাবুর গাড়ি ধুয়ে পাঁচ টাকা পেয়েছিল কাল। ওই টাকা নিয়ে বোনের জন্য আপেল কিনতে এসেছিল। ক’দিন ধরেই রঘুর কাছে আপেল খাবার বায়না করছিল বোন। বোন না খেয়ে আছে, তাই ও চা বিস্কুট খেতে পারবে না!

তাপসদা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রঘুর দিকে। বোনের জন্য ওর ভালোবাসায় মুগ্ধ সকলে। তাপসদা হঠাৎ চিৎকার করে পল্টুকে ডাক দিল। মাথা নিচু করে পল্টু হাজির। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে তাপসদার দিকে। তাপসদা হাসতে হাসতে পল্টুকে কাছে ডাকল। বলল, এক কেজি আপেল আর এক ছড়া কলা নিয়ে আয়। দৌড়ে গেল পল্টু দোকানে। আপেল আর কলা আনতেই একটা পাঁচশো টাকার নোট রঘুকে দিয়ে বলল, টাকাটা দে কাকুর হাতে। তুই তোর বোনের জন্য আপেল আর কলা কিনলি।

রঘু কিছুতেই নেবে না। ওর মা বলেছে, ‘এভাবে কেউ দয়া করলে নিবি না’। হো হো করে হেসে উঠল তাপসদা।

পল্টুকে বলল, ‘দেখলি এই ছেলেটাকে তুই চোর বলে মারলি। তোর ছেলেকে কখনও তুই এই শিক্ষা দিয়েছিস? এ ছেলে অনেক দূর যাবে, দেখে নিস।’ তাপসদা জোর করতেই রঘু বলে উঠল, তাহলে আমি বড়ো হয়ে চাকরি করলে তখন ফেরত নিতে হবে কিন্তু। উপস্থিত সকলে রঘুর কথায় হেসে উঠল। কয়েকটা কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট আমি দিয়ে দিলাম ফলের ব্যাগে।

আনন্দে রঘু দে দৌড়। আমিও রঘুর মতো দৌড় লাগালাম সবজি বাজারের দিকে। দেরিতে বাজার নিয়ে ঢুকলেই বৌয়ের গামলা মুখের অগ্নিবান কল্পনা করতে করতে।

 

সন্ধে আলোর মুখোমুখি

এই নিয়ে চতুর্থবার সন্ধে আলোর মুখোমুখি রেস্তোরাঁয় শিমুল ও শিরিন। খুব একটা ভিড় থাকে না। নিরিবিলিতে কথা বলা যায়। ওয়েটার আগেই জল দিয়ে গেছিল। এবার কোল্ড কফি সার্ভ করে গেল। শিরিন অফিস-ফেরতা আর শিমুল আপাতত এখানে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ যাবে নিজের চেম্বারে। তারপর গোটা দশেক রোগী দেখে খুব বেশি হলে ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ ফ্ল্যাটে ফিরে শিরিনের কথা ভাববে!

আর মাসখানেক বাকি তবুও যেন তর সইছে না। দোষ কী, বিয়ে পাগলা হলে যা হয়! সবে মাস চারেক সে বিবাহ বিচ্ছিন্ন। আর শিরিন বছরখানেক আগের বিয়ে থেকে বিচ্ছিন্না। তফাত বলতে এইটুকুই যা!

শিরিন কফিতে একটা হালকা সিপ দিয়ে বলল, দ্যাখো মাসখানেকের যোগাযোগ এমন তো আর খুব বেশি না অথচ মনে হচ্ছে তুমি যেন আমার কতদিনের! কী গো হার্ট স্পেশালিস্ট, তাই না? গতকালই আমার খুব মনে হচ্ছিল আর ঠিক আজ সকালেই তুমি দেখা করতে চাইলে। আমার কী সুবিধাটাই না হল তুমি হৃদয় বিশারদ হওয়াতে। আমি যে চাইছিলাম সেটা ঠিক বুঝে ফেলেছ কি বলো! শিমুল গদগদ কৃতার্থের একটা হাসি ছড়াল। বলল, আমিও না খুব ছটপট করছিলাম কাল সারারাত্তির।

—কেন গো কী জন্য? অপর্ণার জন্য মন খারাপ করছিল বুঝি?

—আরে, বাদ দাও তো ওর কথা। ও এখন অতীত।

—তবে কার কথা ভাবছিলে?

—কার আবার, তোমার।

—ও তাই। তা আমার কীসের?

এবার শিমুল ক্লিন বোল্ড। কথা আটকে গেছে।

—আরে বলো বলো… এতে লজ্জার কী আছে। শুনলে হয়তো আমারও ভালো লাগবে।

—যাঃ, তোমাকে শুনতে হবে না।

—আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যখন বলবে না-ই ভেবেছ তখন আমিই বলে দিই।

—আরে আরে করছটা কী? কিচ্ছু বলার দরকার নেই।

—কেন?

—বলার নয় বলে। কারণ…

—কারণটা শুনি

—ওসব হাতে কলমে করার

শিরিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ওরে মিচকে পাজি শয়তান কোথাকার। আমার সাথে ফাজলামি! ঠিক আছে আমিও দেখে নেব কার কত দম।

তারপর দু’জনেই খিলখিল করে হেসে উঠেই আবার চেপে গেছে কারণ ততক্ষণে দু’একজন খদ্দের ওদের দিকে দৃষ্টিপাত করার মতো অপরাধ করে ফেলেছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। কে জানে ওরা প্রত্যেকেই হয়তো ছেলে মেয়েদের কথা ভাবছিল এমনও হতে পারে, কারণ আগের পক্ষের সুবাদে দু’জনেই বাবা-মা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা এদের কারওরই কাছে থাকে না, তাই ঝাড়া হাত-পা ।

না ওদের দু’জনের কেউই সম্ভবত সন্তানদের কথা ভাবছিল না। দু’জনেই স্রেফ নিজের নিজের ভালোমন্দের হিসেব নিকেশ নিয়ে মজে ছিল। শিমুলের মনে হচ্ছিল অপর্ণার মতো শিরিনও যদি সব লুটে নিয়ে যায় তাকে চূড়ান্ত ঠকিয়ে! কে জানে কপালে কী যে আছে! আর শিরিন ভাবছিল আমি তো এইরকম একজন গৌরী সেন-এর খোঁজেই ছিলাম এতদিন। আমার অপেক্ষা এখন প্রায় সফলের দিকে, ভেবেই মনটা খুশিতে ডগমগ করে উঠল। মানুষ এমন নির্বোধও হয়? কিন্তু তার তো কিছু করার নাই। বোকাকে তো ঠকতেই হয়! আর এখানে শিরিন নিমিত্তমাত্র।

শিরিনের নিজস্ব ফ্ল্যাট গাড়ি বেসরকারি চাকরি চোখটানা আকর্ষণের চিকন চেহারা৷ হলই বা পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব, কী নেই! তুলনায় শিমুল খুব খুবই গরিব। শুধু টাকা আর টাকা, টাকা ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। তা বলে দু’একখানা গাড়ি বাড়ি থাকবে না, তা কি কখনও হয়? আসলে পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব শিমুলের চেহারা জৌলুসের দিক থেকে একেবারেই সাদামাটারও অধিক। সে যাই হোক, ম্যারেজ ওয়েবসাইট এই মুহূর্তে ওদের দু’জনকে দু’জনের করে দিয়েছে এমন ভীষণ ভাবে, যেন ওরা জীবনে এই প্রথমবার প্রেম এবং বিয়েতে আবদ্ধ হতে চলেছে!

শিরিন অবশ্য অনেক পরিণত, তুলনায় শিমুলের আচার আচরণে একটু বেশি পরিমাণেই আদেখলেপনা ঝরে পড়ে। শিরিনের ভালোই লাগে। এই হ্যাংলাপনাটা ও ওর প্রাক্তন, অমিতের কাছে অনেক আশা করেও পায়নি। আর মূলত এই না পাওয়াটাকেই শিরিনের মনে হয়েছিল অমিত ওকে তেমন ভালোবাসে না কিংবা পাত্তা দেয় না, যতটা ওর পাওয়া উচিত। ফলস্বরূপ বিয়ে পরবর্তী বছর দশেকের মাথায় সরকারি ভাবে ছাড়াছাড়ি। যদিও ওদের বিয়েটা আদৌ দেখাশোনা করে নয় বরং কলেজজীবনের প্রেম পরিণতিরই ছিল।

আর শিমুল? তার সাদা চামড়ার স্মার্ট প্রাক্তনী, ম্যাদামারা শিমুলকে কতই বা সহ্য করে। একটা ইযং হ্যান্ডসাম জুটিয়ে শিমুলেরই অ্যাকাউন্ট ভেঙে খাচ্ছিল হাড়ে মজ্জায়, শিমুলের উপস্থিতি অনুপস্থিতি ব্যতিরেকে যখন তখন, তাও আবার শিমুলেরই ফ্ল্যাটে। শিমুল ওসব অ্যাডভেঞ্চার বন্ধ করে ভদ্রস্থ হয়ে থাকার কথা বললেও, মহিলা তখন ডিভোর্স পেতে মরিয়া। শিমুল তবুও বুঝিয়েছে৷ কিন্তু না, অগত্যা দেনাপাওনা বুঝে নিয়ে ডিভোর্স।

শুনেছি শিমুল নাকি ঘুমের ঘোরে প্রাক্তনীর নাম ধরে অপর্ণা অপর্ণা করে প্রায়ই চেঁচিয়ে উঠত। তবে এখন আর ওঠে না। ঠাকুরের নাম জপের মতন সাঁঝ-সকাল একশো আটবার করে শিরিনের নাম ভজে। জয় রাধে।

একটা ছোটো বেসরকারি ফার্মের চাকুরে শিরিন আর কতই-বা মাইনে পায়৷ মেরেকেটে ৩০-৪০ হাজার টাকা, তার বেশি না। তবু তার ঠাটবাট চোখ টাটানোর মতো। গাড়ি, বাড়ি, গয়না, পোশাকআশাক, ঝাঁ চকচকে জীবনযাপন— তার মাইনের সাথে সামঞ্জস্যহীন। তবে তার স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নামক একটি একস্ট্রা কাজ, বিশেষত কোম্পানির সম্মানিত অতিথি সেবার জন্য– হিসাব বহির্ভূত আয়ের সংস্থান এতটাই স্ফীত যে, মূল মাইনে তার কাছে নাকি নেহাত নস্য।

কোম্পানি তাকে ব্যবহার করে বড়ো বড়ো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অর্ডারগুলো হাতায় আর শিরিন নিজেকে ব্যবহার করে উপার্জনকে একলাফে হাজার থেকে লক্ষে নিয়ে যায়! দু’পক্ষই লক্ষ্যে স্থির। কোনও ছুত্মার্গ নেই। শিরিন জানে জল এমনই পবিত্র যে ধুয়ে দিলে সব মুছে সাফ। যেন এক ফিনিক্স পাখি! কোম্পানির চোখে শিরিন তাই বিশেষ অ্যাসেটরূপে আদৃত। মালিকের নেক নজরে সতত জাজ্বল্যমান। যার জন্য শিরিনের যে-কোনও আবদার, তা সে যৌক্তিক অযৌক্তিক যাই হোক না কেন, পূরণ হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ।

অপর্ণার বিদায়ে বিমর্ষ ক’টা সপ্তাহ শিমুলের যে কীভাবে কেটেছে, থ্রি বেডরুমের অত বড়ো একটা ফ্ল্যাটে একা একদম তার ভেতরের মতোই শূন্যতা ঠাসা ছিল। তবে শিরিনের আগমন সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতেই এখন আবার ভরে উঠছে ক্রমাগত।

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়ামের একটা বড়োসড়ো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ওদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার হাসান রায়ের দেখভালের দায়িত্ব এখন শিরিনের উপর বর্তেছে। এতে সফল হলে শিরিনের মালিক এক লক্ষ টাকা দেবে বলেছে তাকে।

শিরিন সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্ল্যাটের ইএমআই পরিশোধের কথা চিন্তা করে দেখল এবারের এই টাকাটা জমা দিলেই ফ্ল্যাটটা ঋণমুক্ত হয়ে এক্কেবারে তার নিজস্ব হয়ে যাবে। মাত্র এক বছর সময়ের মধ্যেই শিরিন পঞ্চাশ লাখের ফ্ল্যাটটা কিনে ফেলল স্রেফ এই স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্টের দৌলতে।

হাসানের বদান্যতায় শিরিনের কোম্পানি পৌনে এক কোটির অর্ডারটা খুব সহজেই পেয়ে গেল। শিরিনের নিজেরও কদর বেড়েছে যত দিন গেছে হাসানের সহায়তায়। পরবর্তীতে শিরিন অন্যান্য অনেক তেল কোম্পানি ছাড়াও স্টিল, ইলেকট্রিক্যাল-সহ মাইনিং ও আইটি সেক্টটরের অনেককেই পরিষেবা দিয়েছে। তাই শিরিন এখন হাসানের খুবই আস্থাভাজন এবং হাসানও।

ব্রেক আপের সময় শিরিন খুব ভেঙে পড়েছিল। হাসান সেই সময়গুলো ওকে মানসিক ভাবে অনেক সাপোর্ট করেছিল। তার জন্যে শিরিন যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। হাসানের যে-কোনও ডাকে শিরিনের কখনও না নেই। এই তো সেদিন হাসান ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কলেজ রি-ইউনিয়নে শিরিনকে নিয়ে গেল। অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবরা তো ভেবেছিল শিরিন বুঝি হাসানের স্ত্রী। কিন্তু যখন শুনল যে স্ত্রী না, তখন কেউ চোখ কোঁচকাল কেউ বা শিরিনের গ্ল্যামার দেখে হাসানের ভাগ্যকে বাহবা না দিয়ে পারল না।

ওদের দু’জনের জন্য হাসানের ইচ্ছা অনুযায়ী ফাইভ স্টার হোটেলে আলাদা করে রুম বুক করা হয়েছিল। একজন বন্ধু আবদার জুড়েছিল শিরিনের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য, হাসান না করেনি। আর হাসানের ইচ্ছাই শিরিনের ইচ্ছা। শিরিন ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতেও হালকা সাদা গাউনের মোহ ছড়িয়ে কী নাচটাই না নেচেছিল, সেবার মূল ফাংশনের মঞ্চ ফাটিয়ে– জাস্ট ভাবা যায় না!

শিরিন ওর পরিচিতদের-কে বলেছিল ও-নাকি ওদের কোম্পানির তরফে আইআইটি-তে গেছিল রিক্রুটমেন্টের জন্য ইন্টারভিউ নিতে। তা শুনে অনেকেই দুই আর দুইয়ে চার করতে পারেনি। কারণ একটা ছোটো কোম্পানি আর শিরিনের মতন একজন নন-টেকনিক্যাল মানুষ আইআইটি-তে ইন্টারভিউ! অসম্ভব। তাছাড়াও ক্যাম্পাসিংয়ে আইআইটি-র মতো প্রতিষ্ঠান ওইরকম ঘেঁচুমেচু-দেরকে গ্রাহেকর মধ্যেই নেয় না। তাতে অবশ্য শিরিনের কিছু যায় আসে না। তার মানে এই নয় যে, শিরিন আগে কখনও রিক্রুটমেন্টের জন্য একেবারেই যায়নি। অনেকবারই গেছে তবে ছোটোখাটো ইঞ্জিনিয়রিং কলেজগুলোতে।

একবার তো শিমুলকেও নিয়ে গেছিল তার আধিপত্য জাহিরের বহর দেখানোর জন্য। অবশ্য ইন্টারভিউটাকে শিমুলের একটা প্রহসন বলেই মনে হয়েছিল। তবে শিরিন তার মিশনে সফল ছিল কারণ শিমুল শিরিনের স্ট্যাটাসটা বিশ্বাস করেছিল। ফেরার সময় শিমুল জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা কী রকম ইন্টারভিউ? শুধু নাম ধাম জানতে চাওয়া, আর কোনও প্রশ্ন নেই!

শিরিন ভ্রু নাচিয়ে বলেছিল, আছে আছে আঙ্কেল এসব তুমি বুঝবে না। শিমুল নাছোড়, শুনবেই। শিরিন বলেছিল তবে শোনো এটা একটা আই ওয়াশ মাত্র।

—তার মানে?

—মানে কিছু না। আমার কাজ শুধু যে-কোনও দু’জনকে খুশি মতন তুলে নেওয়া। ব্যস। খতম।

—সে আবার কী?

—আরে বাবা ওই কলেজ আমাদের কোম্পানিতে দু’জন ছাত্রকে ছয় মাসের জন্য চাকরিতে বহাল রাখার মূল্য বাবদ ষাট হাজার টাকা দিয়ে রেখেছে। আমরা মাসিক তিন হাজার করে দিয়ে ছয় মাস পরে ভাগিয়ে দেব।

—তাতে লাভ?

—প্রথমত আমাদের চব্বিশ হাজার টাকা ক্যাশ আর ফ্রি-তে ছয় মাস কাজ করিয়ে নেব আমাদের খুশি মতন। মানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। আর কলেজ, ছাত্রদের পড়া শেষে হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্লেসমেন্ট দেখাবে। আমাদের মতন এইরকম প্রচুর কোম্পানির সাথে এই সমস্ত কলেজের এইভাবেই চুক্তি হয়। বেচারা ছাত্রদের কাছ থেকে কলেজ টাকা নেয় আর আমরা নিই কলেজের থেকে। মাছের তেলেই মাছভাজা যাকে বলে আর কী।

শুনে তো শিমুলের চক্ষু চড়ক গাছ! কিছু বলেনি। বোধহয় বলার মতো অবস্থায় ছিল না বলেই।

যাইহোক, হাসানের বন্ধুদের অনেকেই এখন শিরিনের উষ্ণতায় ধন্য। শিরিন তো এটাই চায়। হাসানের পরিচিতির বিস্তারটাকে শিরিন কাজে লাগিয়েছে খুব সফল ভাবে। শিরিনের এখন বিভিন্ন রকমের ছোটো বড়ো মাঝারি মাপের অনেক মই রয়েছে, যখন যেমন দরকার সেটা ব্যবহার করে।

সারা বছর এত ব্যস্ত থাকতে হয় শ্বাস ফেলার সময় নেই। নিজের অফিস গেলেও হয়, না গেলেও ক্ষতি নেই। শুধু দরকারের সময় কোম্পানির ডাকে সাড়া দিলেই হল। মালিক তাতেই খুশি। তবে শিরিনের মনের কোণের কোথাও যেন আলাদা করে একটা পার্মানেন্ট মইয়ের চাহিদা তৈরি হচ্ছিল। কেন কে জানে, সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিল না।

যাইহোক, শিরিন ম্যারেজ সাইট-এর শিমুলের অ্যাডটা নিয়ে হাসানের পরামর্শ চাইল। ডা. শিমুলের বায়োডাটা দেখে হাসান সায় দিল। আহ্ কি আনন্দ! এবার আরও মুক্ত হয়ে গেলাম। আর কোনও চিন্তা রইল না। বলা যায় ভবিষ্যতটাও বেশ সুরক্ষিত হয়ে গেল পাকাপোক্ত ভাবে ডাক্তারবাবুর সমর্থ ছাদের নীচে।

সবাই খুব খুশি। জমিয়ে বিয়ে হয়ে গেল। ডাক্তারবাবুর মনে এখন ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে..। কিন্তু কপালে না থাকলে ঘি ঠকঠকালে হবে কী! মধুচন্দ্রিমা মাস ছয়েক যেতে না যেতেই খতম।

শিরিন অন্য একটা চাকরি নিয়ে শ্রীরামপুর থেকে দিল্লি। হাসান কলকাতা থেকে ফরিদাবাদ যা দিল্লির হাত বাড়ালেই দূরত্বের!

শিমুলও আবার যে কে সেই। ফ্ল্যাট ভরতি একাকিত্বের ভিতর থেকে ঘুমের ঘোরে প্রায়ই অস্পষ্ট চিৎকারে গুঙিয়ে ওঠার সেই ডাক অপর্ণা অপর্ণা… ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিনিয়ত।

তবে ওই পরিযায়ী পাখির মতন শিরিনের মাঝে মধ্যে আসা-যাওয়া আর দেশ-বিদেশের ভ্রমণ সঙ্গী হওয়া কখনও সখনও তার বেশি না। শিমুলের নিজেকে কেমন যেন অতিথি অতিথি বলে মনে হয় শিরিনের কাছে। তাই যতটা বা যেটুকু পাওয়া হয় সেটাই অনেক ভেবে নেওয়া ছাড়া আর শিমুলের করারই বা কী আছে! শিরিন অবশ্য শিমুলকে নিজের উদ্বৃত্তটুকু দিয়ে শান্ত করে রাখে। শিমুলের সেটা জানার কথা নয়, কাজেই জানতেও পারে না। আর পারবেও না কোনওদিন।

শিরিন তার নিজের মাইনের সমস্ত টাকা গচ্ছিত রেখে মাস খরচের পুরো টাকাটাই শিমুলের থেকে নেয়। তাছাড়া রূপচর্চা ও হেলথ ম্যানেজমেন্টের জন্য আলাদা তো নেয়-ই। এই তো কিছুদিন আগে স্লিম অ্যান্ড ট্রিম হওয়ার জন্য লাখ দু’য়েক টাকা খরচ করে লাইপোসাকশন পদ্ধতিতে তলপেটের চর্বি নামিয়ে এল শিমুলের গাঁটের কড়ি খসিয়ে৷

তারপরের কোনও একদিন হাসান, শিরিনকে দেখে বলেছিল, ব্রাভো মিসেস…। হাসানের কথা শেষ হওয়ার আগেই শিরিন বলেছিল, হাসান রায়।…ঠিক তখনই, যখন কলকাতার চেম্বারে ডা. শিমুল একটা রোগীর হার্টের নির্ভরতাজনিত কোনও বিশ্বাসযোগ্যতার অন্বেষণে বারংবার গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছিল।

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল, কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডার্লিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ সবই বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না, ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়নও নিজের রাগ সামলাতে না পেরে রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের মন অশান্ত হয়ে উঠল।

 

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল রোমার। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেয়েটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যের সাগরে তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

হ্যালুসিনেশন

নাইলনের সুতোর শেষ প্রান্তে বঁড়শি গিলে আটকে আছে মাছটা। ধড়ে এখনও প্রাণও আছে অবশিষ্ট। মাঝেমধ্যে ঝটপট করে উঠে সেকথা জানানও দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন প্রজাতির মাছ অতুল কাঞ্জিলাল আগে কখনও দেখেননি, শুনেছেন বলেও তিনি মনে করতে পারলেন না। বিশ্বাসদের এই পুকুরে তিনি মাছ ধরছেন তা প্রায় সাত বছর হল।

বর্ষার ঋতুতে অন্তত দিন দশেক তাঁর মাছ ধরা বরাদ্দ। আজ সেই বাৎসরিক নিয়মেরই তৃতীয় দিন। এর আগে তাঁর ছিপে উঠেছে তেলাপিয়া, কই, চারাপোনার মতো সাধারণ মাছ। একবার একটা কেজি দুয়েকের রুইও উঠেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এগুলি ছাড়া অন্য কোনও মাছ এই পুকুরে যে আদতেই থাকতে পারে, তা অন্তত অতুলবাবুর জানা ছিল না। আজ যে-মাছটা ধরা পড়েছে, তা অতুলবাবুর সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

বঁড়শি থেকে মাছটা সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ যত্ন করে উলটে পালটে দেখতে লাগলেন অতুলবাবু। মাছটার দৈর্ঘ্য আন্দাজ পাঁচ ইঞ্চি এবং ওজন একশো গ্রাম হলেও আশ্চর্যের কিছু নয়। রুপোলি শরীরের উপর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের উলম্ব রেখা মাছটাকে এক ঈর্ষণীয় সৌন্দর‌্যের অধিকারী করেছে। চোখ দুটি উজ্জ্বল হলুদ। প্রায় চল্লিশ মিনিট ছিপ ফেলে অপেক্ষা করার পর এই মাছটা উঠে এসেছে। এক কথায় যাকে বলে প্রাইজড পজেশন।

মাছ ধরা ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণরূপে ধৈর্য এবং সংযমের উপর নির্ভরশীল তা অতুলবাবু বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু এখন তাঁর মধ্যে এই দুটোর অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে এবং তার কারণ যে ওই অদ্ভুত দর্শন মাছটা, সেটি বুঝতে অতুলবাবুর বাকি রইল না। অগত্যা তিনি উঠে পড়লেন। উদ্দেশ্য একটাই, মাছটাকে জীবিতবস্থায় বাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে।

একটি ইটপাতা গলি পথে তিনটি বাঁক পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছোতে অতুলবাবুর সময় লাগে ঠিক সাত মিনিট। আজ কিন্তু সময় লাগল আরও এক মিনিট কম। সদর দরজায় কলিং বেল চাপতেই পরিচারক পরিমল এসে দরজা খুলে দিয়ে অবাক সুরে প্রশ্ন করল, ‘বাবু, আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে? বড়ো কোনও মাছ পেয়েছেন বুঝি?’

অতুলবাবু উত্তর দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে প্রকাশ না করে ছিপটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা জায়গামতন রাখ গিয়ে আর চটপট আমার জন্য এক কাপ চা করে আন তো।

পরিমল যেভাবে হতবাক ভঙ্গিতে ছিপটি নিয়ে অন্দরমহলে বিদায় নিল তাতে বোঝা গেল, সে মালিকের এই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত নয়।

সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে বেশ কিছুটা খোলামেলা জায়গায় একটি টি-টেবিলকে ঘিরে চারটি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করা আছে। উত্তর দিকের দেয়ালে একটি পুরোনো আমলের ঘড়ি এবং দুটি বাঁধানো অয়েল পেন্টিং ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে এই ঘরে যে-জিনিসটি সবচেয়ে নজর কাড়ার মতো এবং যার সামনে এখন অতুলবাবু দণ্ডায়মান, তা হল একটি বড়ো মাপের অ্যাকোয়ারিয়াম।

অ্যাকোয়ারিয়ামটা বেশ পুরোনো। অন্তত বছর পনেরোর কম তো নয়ই। অ্যাকোয়ারিয়ামটি বিভিন্ন আকারের গোল্ড ফিশ, রেড হেড এবং পলির মতো শান্তিপূর্ণ সহবাসকারী বারোটি মাছের বিচরণক্ষেত্র। মাছ পোষা যে অতুলবাবুর শখ এইটুকু বললে বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি মাছের চরিত্র, জীবনধারণ পদ্ধতি ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্টাডি করতেন। এটাও এক প্রকারের গবেষণা বলা যায়।

একসময় এই অ্যাকোয়ারিয়ামে দুটো পিরানহা, ক্রাউনটেল বিটা, পাফার ফিশ-এর মতো মাংসাশী মাছও তিনি মজুত করেছিলেন। তবে তাদের একটিও মাস খানেকের বেশি টেকেনি। এর জন্য অর্থ এবং পরিশ্রম দুই-ই বিস্তর খরচ করেছেন অতুলবাবু। তবে এ সবই পুরোনো কথা।

এখন তাঁর শরীর বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে। বলাইবাহুল্য শখটাও খানিকটা থিতিয়ে পড়েছে। গত জানুয়ারিতে তিনি আটষট্টিতে পা দিয়েছেন। অবিবাহিত জীবনে সরকারি দফতরের দায়িত্ব ছাড়া আর কোনও ঝক্কি তাঁকে সামলাতে হয়নি। অবসরের পর প্রথমদিকে কিছুটা একাকিত্বের ভ্রূকুটি সামলাতে হয়েছিল অবশ্য। কিন্তু এখন টুকটাক শখ আহ্লাদ মিটিয়ে দিন চলে যাচ্ছে বেশ। এই শখেরই একটি অন্যতম হল ভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ।

বেশ কয়েক বছর বিরতির পর অতুলবাবু যেন সেই পুরোনো রোমাঞ্চ আজ আর একবার অনুভব করছেন। অদ্ভুত দর্শন মাছটাকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে। স্বভাবতই নতুন পরিবেশ এবং প্রতিবেশীদের মাঝে সে কিছুটা নিস্তেজ এবং ভীত। একগোছা কৃত্রিম আগাছার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে মাছটা।

পরিমল চা দিয়ে গেছে প্রায় মিনিট পনেরো, কিন্তু অতুলবাবু তাতে একবারও চুমুক দেওয়ার সময় পাননি। কারণ তাঁর দৃষ্টি ল্যাপটপের আয়তাকার স্ক্রিনের উপর স্থির। শুধু স্থির নয় বরং উত্তেজনায় উজ্জ্বল। সদ্য ধরে আনা মাছটার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে করতে একটি খবরের উপর নজর পড়তেই অতুলবাবু থমকে দাঁড়িয়েছেন।

মাছটার নাম সারপা সালপা। একটি রঙিন ছবিও জুড়ে দেওয়া আছে খবরটির সঙ্গে, যা দেখে অতুলবাবু একশো শতাংশ নিশ্চিত যে, ল্যাপটপের ছবিটি এবং তাঁর ধরে আনা মাছটা একই বংশদ্ভুত। এই প্রজাতির মাছ মূলত পাওয়া যায় আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরে। ভারতবর্ষের কোনও অঞ্চলে এর অস্তিত্ব কোনও কালেই আবিষ্কৃত হয়নি।

এই ধরনের মাছকে বিশেষজ্ঞরা একটি বিশেষ নামে ভূষিত করেছেন, হ্যালুসিনোজেনিক। অর্থাৎ যে-মাছ মানুষের মধ্যে হ্যালুসিনেশন বা কল্পিত দৃশ্যের জন্ম দিতে সক্ষম। এইসব তথ্য অতুলবাবু ইন্টারনেট থেকে জোগাড় করে একটি ডায়ারিতে লিখে নিচ্ছেন। প্রতিটি তথ্য তাঁকে বারেবারে যেমন চমকিত করে তুলছে, তেমনি অতিক্রম করে যাচ্ছে তাঁর বিশ্বাসের গণ্ডি।

সারপা সালপা যে প্রকৃত অর্থেই একটি নিষিদ্ধ মাছ এবং এটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যে রীতিমতো বিপজ্জনক তা বোঝাতে গবেষকরা বেশ কয়েকটি ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। যেমন এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ এই মাছ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি প্রাণে মারা না পড়লেও দুদিন যাবৎ অদ্ভুত এবং ভযংকর দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠতে থাকে। এক কথায় হ্যালুসিনেশন।

এমনই আর একটি ঘটনা ঘটে বছর চারেক পর। এইক্ষেত্রে রোগীর পরিস্থিতি আরও গুরুতর এবং দীর্ঘায়িত হয়। অতুলবাবু আর পড়তে পারলেন না। তাঁর দুই ভ্রূর মাঝে এক গভীর ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন এখন একটাই যে, এমন একটি দুর্লভ মাছ বিশ্বাসদের এই পুকুরে কী ভাবে এল?

এই প্রশ্নের উত্তর যে পুকুরের মালিক, প্রাণতোষ বিশ্বাসের থেকে পাওয়া যাবে না তা অতুলবাবু খুব ভালো করেই জানেন। ফলে মনের উদ্বেলিত আগ্রহকে সেই মুহূর্তের জন্য দমন করা ছাড়া আর উপায় রইল না।

রাত এগারোটা। খাওয়া দাওয়া সেরে অতুলবাবু বিছানায় উঠেছেন তা প্রায় আধঘন্টা। এটা তাঁর অভ্যাস। কিন্তু নিয়মের বাইরে আজ যা ঘটেছে তা হল, অতুলবাবুর দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। চিন্তাটা ঠিক এইসময় অতুলবাবুর মনে উঁকি দিল। শুধু চিন্তা নয়, এক ভযংকর চিন্তা। বলা যেতে পারে এও একপ্রকার গবেষণার রসদ। গবেষণার ক্ষেত্রে গিনিপিগের ব্যবহার সর্বজনবিদিত।

অতুলবাবু এইমাত্র যে-পরিকল্পনার খসড়া মনে মনে এঁকেছেন তা হল, সারপা সালপা মাছটা কোনও এক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার প্রভাব তিনি নথিভুক্ত করবেন এবং এই গবেষণার গিনিপিগ হবে তাঁর পুরোনো ও বিশ্বস্ত পরিচারক, পরিমল। তবে এ কাজে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে এবং সে কথা পরিমল জানতে পারলে এমন আত্মবলিদানে সে কিছুতেই রাজি হবে না। তবে এই গবেষণায় তিনি সফল হলে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানমহলে যে একটা সাড়া পড়ে যাবে, সেকথা ভেবেই অতুলবাবু রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন এবং সেই সঙ্গেই তার মনের দৃঢ়তা কয়েকগুন বেড়ে উঠল।

ভোরের আলো ফুটতেই অতুলবাবু ছুটে গেলেন অ্যাকোয়ারিয়ামটির কাছে। সুদর্শন মাছটা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পেয়েছে। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচের দেয়াল ঘেঁষে সে নির্দ্বিধায় সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখে অতুলবাবু নিশ্চিন্ত হলেন।

অ্যাকোয়ারিয়ামে নতুন অতিথিটিকে লক্ষ্য করেছিল পরিমল। কিন্তু তখনও সে জানে না এই আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মাছটার মধ্যে কী ভয়ানক ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে।

পরিমল, তুমি এমন মাছ আগে কখনও দেখেছ? অতুলবাবু অনিবার্য উত্তরটি জানা সত্ত্বেও প্রশ্নটি করলেন।

না, বাবু। আমি গাঁ-গঞ্জের মানুষ। ছোটোবেলা থেকে খালবিল চষে বেড়িয়েছি। দুহাতে কত মাছ ধরেছি। কিন্তু এমন মাছ সত্যিই কখনও দেখিনি। এর কী নাম, বাবু?

এর নাম, সারপা সালপা।

কী, কী বললেন? সাপলা… সার পলা

পরিমলের কাণ্ড দেখে অতুলবাবু হাসিতে ফেটে পড়লেন। প্রায় মিনিট খানেক পর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, তুমি বরং এক কাজ করো পরিমল। মাছটাকে বার করে বেশ করে ভাজা করো দেখি।

এই মাছ আপনি খাবেন! কী সব নাম বলছেন বাপের জন্মেও শুনিনি। এটা কি খাওয়া ঠিক হবে? পরিমলের গলায় বিভ্রান্তি স্পষ্ট।

আলবাত খাব। এই মাছ এত সহজে মেলে না। দারুণ স্বাদ বুঝলে? নাও আর সময় নষ্ট না করে যা বললাম তাই করো। পরিমল বিনা বাক্যব্যয়ে মালিকের নির্দেশ পালন করল।

দুপুরে খাবার টেবিলে বসে অতুলবাবুকে একটা ছোটোখাটো অভিনয় করতে হল। খাবার পরিবেশিত হতেই অতুলবাবু বলে উঠলেন, আজ শরীরটা মোটেই ভালো ঠেকছে না। ভাত আর এবেলা খাব না। আমাকে বরং একটু ছাতু-মুড়ি দাও তো।

অতুলবাবুর কথা শুনে পরিমল ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল, সেকি বাবু! সকালেও তো ভালোই ছিলেন। এইটুকু সময়ে মধ্যে আবার কী হল?

পেটটা বোধহয় ঠিক নেই।

তবে এক কাজ করি, মাছ ভাতটা বরং ফ্রিজে তুলে রাখি। রাতে না হয় গরম করে…

কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে অতুলবাবু বললেন, না না, ওসবের দরকার নেই। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। মাছের কথাটা ওনাকে বলেছিলাম। উনি শ্রেফ মানা করে দিয়েছেন। আজ আর মাছটা আমার খাওয়া হবে না। তুমি মাছটা এবেলাই খেয়ে নাও।

পরিমল বেশ কিছুটা প্রতিবাদ করলেও তাতে ফল কিছুই হল না।

দুপুরের পর থেকেই অতুলবাবু তাঁর পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন। ডায়ারিতে এখনও পর্যন্ত দুটো এন্ট্রি তুলেছেন অতুলবাবু।

প্রথমটা, দুপুর একটা সাতাশ মিনিটে। বয়ান এইরূপ পরিমল দাস আমার পনেরো বছরের পুরোনো বিশ্বস্ত পরিচারক। বয়স আটচল্লিশ। উচ্চতা, আনুমানিক পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, শীর্ণকায় এবং সামান্য হাঁপানির লক্ষণ আছে। পরিমল সারপা সালপা মাছটার আদ্যপান্ত আত্মসাৎ করেছে। কাঁটাগুলোকেও সে চিবোতে ছাড়েনি। জানিয়েছে, স্বাদ মোটের উপর ভালো লেগেছে।

দ্বিতীয় এন্ট্রিটি দুপুর আড়াইটের পরিমলের মধ্যে এখনও কোনও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।

এখন সন্ধে ছটা বেজে দশ মিনিট। প্রতিটি মিনিটের হিসেব রাখছেন অতুলবাবু। পরিমল রান্নাঘরে চা বানাতে ব্যস্ত। অতুলবাবু একটি চেয়ারে বসে। সামনের টেবিলের উপর রাখা তাঁর ডায়ারি ও একটি কলম। অতুলবাবুর দৃষ্টি যদিও হাতে ধরে রাখা খবরের কাগজের উপর স্থির, তথাপি তাঁর কানজোড়া সতর্ক।

হঠাৎ রান্নাঘর থেকে এক তীব্র চিত্কার। পরিমলের আর্তনাদ। অতুলবাবু ইতিমধ্যেই চমকে উঠেছেন। তিনি তড়িঘড়ি ছুটে গেলেন রান্নাঘরে উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, পরিমল বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে পশ্চিম দেয়ালের খোলা জানলাটার দিকে।

কী হয়েছে, পরিমল? অমন করে চ্যাঁচামেচি করছ কেন?

পরিমল ধীরে ধীরে তার কম্পমান আঙুল তুলে জানলাটার দিকে দেখিয়ে বলল, বাবু, ওই প্যাঁএএএচাটা কেমন আমার দিকে চেএএএয়ে আছে!

পরিমলের উত্থিত আঙুল অনুসরণ করে অতুলবাবু জানলার দিকে চোখ ফেরালেন। নাহ, সেখানে কিচ্ছু নেই। ব্যাপারটা বুঝতেই এক প্রসন্নতার প্রচ্ছন্ন হাসি অতুলবাবুর ঠোঁটে খেলে গেল।

পরিমল, তুমি ভুল দেখেছ। জানলায় তো কিছুই নেই, অতুলবাবু বললেন।

ইতিমধ্যেই পরিমল কয়েক পা পিছনে সরে এসে অতুলবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী বলছেন বাবু, ওই তো জানলায় বসে প্যাঁচাটা,আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? কী কুত্সিত দেখতে! এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমার চোখ দুটো খুবলে নেবে!

পরিমলকে চা করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এল অতুলবাবু। মাছটার প্রথম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সময় এবং ধরনটা ডায়ারিতে যত্ন করে তুলে রাখলেন অতুলবাবু। সেই দিন রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ঘটল না। পরের দিন রাত দশটা পর‌্য়ন্তও পরিমলের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে না পেরে অতুলবাবু একপ্রকার নিরাশ হয়ে পড়লেন।

ঘটনাটা ঘটল রাত বারোটা নাগাদ। অতুলবাবু বিছানায় শুয়ে মনের ভিতর ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী চিন্তা কাটাকুটি খেলে চলেছে। হঠাৎ এক ক্ষীণ পায়ে শব্দে অতুলবাবুর চিন্তায় চিড় ধরল। তিনি সতর্ক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। পায়ে আওয়াজটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খুব মনোযোগ দিয়ে অতুলবাবু বুঝলেন, পায়ে শব্দটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে।

চোর! কথাটা মনে হতেই একটা চাপা ভয়ে উদ্রেক হল অতুলবাবুর মধ্যে। তবে এই ভীতি অমূলক কিনা তা পরীক্ষা করতে বিছানা থেকে নামতে যাবেন এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল পরিমল। দুবছর আগে একটা মেজর হার্ট অ্যাটাকের পর দরজায় হুড়কো দেওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অতুলবাবু। পরামর্শটা অবশ্য ডাক্তারবাবুরই ছিল। অতুলবাবু সে কথার যথার্থতা বুঝতে পেরে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে চলেছেন মাত্র।

পরিমলকে ঘরের মধ্যে আবিষ্কার করে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন অতুলবাবু। বেড সুইচে চাপ দিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে অতুলবাবু যা দেখলেন, তাতে তাঁর শরীরের রক্ত হিমশীতল হয়ে উঠল। তিনি দেখলেন, পরিমল তার বজ্র মুঠিতে ধরে আছে একটি বড়ো মাপের ছুরি। ছুরিটির ধারলো অংশে রক্তের ছাপ। এবার অতুলবাবুর দৃষ্টি পড়ল তার পরিচারকের পোশাকের উপর। পরিমলের জামার বিভিন্ন অংশে ছুরি চালানোর দাগ স্পষ্ট এবং সেই ছেঁড়া অংশ থেকে শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের ধারা। আঁতকে উঠলেন অতুলবাবু।

অতুলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় দেখলেন, পরিমল তার হাতে ধরে থাকা ছুরিটা হাওয়ায় বেপরোয়া ভাবে চালাতে শুরু করেছে। ঠিক যেন কোনও এক অদৃশ্য আততায়ীর থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।

যা… যা, চলে যা বলছি। কাছে আসবি না। পরিমল হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলি বলল। ঘরে অতুলবাবুর উপস্থিতি যেন তার নজরেই পড়েনি। এক পা এক পা করে পিছোতে পিছোতে তার পিঠ এসে ঠেকল দেয়ালের গায়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিমলের এক তীব্র আর্তনাদে ঘরের শান্ত বাতাস আলোড়িত হয়ে উঠল।

না, আমার কাছে এলেই কিন্তু এই ছুরি দিয়ে.. বলেই পরিমল তার অস্ত্রটি নিজের শরীরের উপরেই চালাতে লাগল।

এমন একটি রক্তাক্ত দৃশ্য চোখের সামনে দেখে অতুলবাবু কিছু সময়ে জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। প্রাথমিক বিহ্বলতার ভাবটা কাটিয়ে উঠে তিনি বললেন, পরিমল, কী হয়েছে? কে তোমার কাছে আসছে? এখানে তো কেউ নেই!

ওই যে, একটা কুকুর। ওটা মনে হয় পাগল। আমাকে কতবার কামড়েছে। আর একটা সাপও ছিল। ওই প্যাঁচাটাও আবার এসেছে। ওই যে জানলায় বসে, ওই তো ওইখানে। ওরা আমায় মেরে ফেলবে। না, কাছে আসবিইইই না বলছি… কথাগুলি বলতে বলতে পরিমল নিজের বুকের উপর ছুরিটা আড়াআড়ি এমন ভাবে চালিয়ে দিল, যেন শরীরে জোঁকের মতো আঁকড়ে থাকা অদৃশ্য প্রাণীগুলিকে সে ছাড়িয়ে ফেলছে। এতে ফল হচ্ছে বিপরীত, তার শরীরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ক্ষত।

ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে তা কল্পনাও করতে পারেননি অতুলবাবু। শুধু যে গড়িয়েছে তা নয়, বরং অনেক অংশেই হাতের বাইরে চলে গেছে। অতুলবাবু যে-মারাত্মক খেলায় মেতে উঠেছিলেন, তার পরিণাম হিসেবে এখন পরিমলের প্রাণ সংশয় উপস্থিত।

অতুলবাবু দুহাত তুলে পরিমলকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পরিমল তখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অতুলবাবুকে এগিয়ে আসতে দেখে পরিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল, শেয়াল শেয়াল! খবরদার, আমি…আমি।

পরিমলের চোখে ফুটে উঠেছে মারাত্মক হিংস্রতা। তার হাতের ছুরিটা বুকের কাছে ঢালের মতো স্থির। অতুলবাবু আর এক পা এগোতেই, তুই আমাকে শেষ করার আগে আমি তোকে শেষ করব বলেই পরিমল ঝাঁপিয়ে পড়ল অতুলবাবুর বৃদ্ধ শরীরের উপর। কয়েক মূহুর্তের লড়াইয়ে পর পরিমলের হাতের ছুরিটি অতুলবাবুর বুকের বাঁ দিকের নরম চামড়া ভেদ করে অন্তত চার ইঞ্চি ভেতরে প্রবেশ করল। তত্ক্ষণাৎ ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল লাল তরল।

অতুলবাবুর চোখ যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তাঁর মুখমণ্ডল যন্ত্রণায় বিকৃত, আর্তনাদ গলায় এসে পথ হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু একটি চাপা গোঙানি চলল মিনিট খানেক, তারপর সব কিছু স্তব্ধ। পরিমলের বিজয়ের অট্টহাসি ঘরের চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন অনুরণিত হতে লাগল।

আমি ও কোকিলা পর্ব ০১

কুনালের পক্ষে সম্ভবই নয় প্রভূত পরিমাণে টাকা কিংবা গাড়ির স্বপ্ন দেখা। আর রাজীব, দিল্লিতে নিজের বাড়ি-ব্যাবসা— সব মিলিয়ে সফল পুরুষ। এক মুহূর্ত সময় নেয়নি কোকিলা এতদিনের ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে রাজীবের হাত ধরতে।

কোকিলার মৃত্যুসংবাদ আমায় বিচলিত করেনি। আমি জানতাম এমনটাই হবে— ধীরে ধীরে। জীবন যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খাবে, এক পা এক পা করে ও এগোবেই মৃত্যুর দিকে। আমি হতবাক হয়ে ভাবছিলাম ওর সাথে পরিচয়, সুখস্মৃতির কথা।

কোকিলা আমার কেউ নয়, এমনকী বন্ধুও নয়। ওকে চিনেছি অন্যভাবে সৌজন্যবশতঃ। কাজের সূত্রে অল্প কিছুদিনের জন্য দিল্লি থাকতে হয়েছিল। সেখানেই আলাপ রাজীবের সাথে। রাজীব ধূত। পেশায় ব্যবসায়ী। ঘরের খোঁজ তার কাছেই পাই। তারই বাড়ির চিলেকোঠায়। এককামরা হলেও আমার অসুবিধা নেই। আমার অফিস এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। আর জায়গাটাও বেশ ভাল। বেশ ছিমছাম। রাজীব একা থাকে, স্ত্রী থাকলেও এক সপ্তাহেও তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি।

সুযোগ এল, তা অন্যভাবে। একদিন অফিস থেকে বেরতে গিয়ে শুনি, ‘বন্ধ’। আরে হলটা কি? এই তো দুপুরে নীচে এসেছিলাম। গেটের সিকিউরিটি খবর দিল, ‘সাব দো আদমি মর গয়ে। দুকান সব বন্ধ হো গিয়া তিন বজে।’ বেশ দুশ্চিন্তা হল। বুঝলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হঠাৎ সব দোকানপাট বন্ধ। আমার তো মাথায় হাত। রোজ ভুজবল (ওড়িয়া ছেলে) আমার দিনের রাতের-খাবার দিয়ে যায়। শুনশান রাস্তা দিয়ে বেশ সন্ত্রস্তভাবে হেঁটে বাড়ি এলাম। একটু ঘুরে ভুজবলের দরজায় টোকা মারলে খানিকবাদে চিৎকার করে উত্তর এল, ‘খাবার পাওয়া যাবে না। দুপুর থেকে সব বন্ধ।’ আমি দরজা খোলার কথা বললেও কেউ খুলল না। অগত্যা বাড়ি এসে বিস্কুট-মুড়ি-চানাচুর, দারুণ ডিনার। ঢকঢক করে জল খেয়ে সটান বিছানায়। অন্যান্য দিন একটু টিভি দেখি আজ ভুজবলের উপর রাগে আমার সব গোলমাল হয়ে গেল।

ঘুম ভাঙল বেশ ভোরবেলায়। এত সকালে আমি উঠি না। গ্যাসে চা বানিয়ে লনে একটু বসেছি হঠাৎ রাজীব। ও যে প্রাতর্ভ্রমণ করে আমি জানতাম না। সুপ্রভাত জানিয়ে পাশে বসে পড়ল। ও বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল ‘এত সকাল সকাল কি ব্যাপার! আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও বলতে বাধ্য হলাম, ‘কার্ফিউয়ের জন্য ভুজবল ডুব মেরেছে।’ রাজীব মনে হল একটু লজ্জিত হল। একথা-সেকথার পর একটু ব্যায়াম করে চলে গেল। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে সিঁড়ির মুখে গিয়ে বলল, ‘আমাদের সাথে সকালের নাস্তাটা করে যেও।’ রাজীব মাঝেমধ্যে বাংলা বলার চেষ্টা করে। আজ ও পুরো বাংলায় কথা বলল।

আমি দ্বিরুক্তি না করে, রেডি হয়ে সকাল ন’টায় হাজির হলাম নীচে। রাজীবই দরজা খুলে দিল। খাবার টেবিলে আলাপ হল রাজীবের স্ত্রী কোকিলার সাথে। প্রথম দেখায় কেমন যেন ম্লান মনে হল, হাসলও ফ্যাকাসে ভাবে। দু’দিন আমায় ওদের সাথে জলখাবার খেতে হয়েছিল। কোকিলা খাবার টেবিলে বড়োই চুপচাপ। আমি আর রাজীবই যা কথা বলি। তবে রাজীব ঝড়ের মতো, খেয়েই বেরিয়ে যায় নতুবা বেশি সময় মোবাইলে কথা বলে। আমি মাঝেমধ্যে কোকিলার দিকে তাকাই। নীরব চোখে। মনে কত জিজ্ঞাসা কিন্তু রাজীব নিজের স্ত্রী-র ব্যাপারে উদাসীন না সতর্ক, তা বুঝতে পারিনি। কথা বলতেই দেয় না। ঠিক এড়িয়ে চলে, যাতে কোকিলা নাস্তার টেবিলে কথোপকথনে যোগ না দিতে পারে। তিনদিনের দিন থেকে দিল্লির রাস্তাঘাট স্বাভাবিক, ভুজবলও স্বাভাবিক।

দিন কাটছে নিজের ছন্দে। রাজীব বা কোকিলার কারুর সাথেই দেখা হয় না। একদিন বেশ সকালে দরজায় খুটখুট। ভাবলাম রাজীব। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই চমকে ঘুম পালাল, কোকিলা। পাশ কাটিয়ে কোকিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানায় বসেই বলে উঠল, ‘কানপুর থেকে আমার ভাই আসবে কাল সকালে, ও আপনার সাথেই থাকবে।’ একটু থেমে একটু নরম স্বরে আবার বলল, ‘আশা রাখি আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু কেন? আপনাদের নীচে তো ঘরের অভাব নেই। আমার একটা মাত্র ঘর সেখানে দু’জন!’

‘আপনার সঙ্গ আমার ভাইয়ের ভালো লাগবে।’

‘কিন্তু রাজীব যদি কিছু বলে বা মনে করে?’

‘রাজীবের কিছুই আসে যায় না আমার ভাইয়ের ব্যাপারে” অদ্ভুত ঠান্ডা নিরাশ স্বর ভেসে এল কোকিলার গলা থেকে।

একেবারে টিনএজার কোকিলার ভাই। মাত্র তিনদিনের সফরে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছে। অফিসের কাজ ম্যানেজ করে কোকিলার অনুরোধে ভাই বিজয়কে নিয়ে বের হতে হল দিল্লি ঘোরাতে। অবশ্য এজন্য কোকিলা রোজ পাঠিয়েছে ভালো-মন্দ খাবার। বেশ অবাক লেগেছিল যখন বিজয়ের খাবারও আমার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল কোকিলা। প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও আমি নীরব। রাজীবকে একদিনও আমার ঘরে আসতে দেখলাম না শালাবাবুর জন্য। বিজয় চলে যেতে বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আবার ভুজবলের লম্বা কৌটোর খাবার, ঠিক যেন মুখে লাগছিল না। এ ব্যাপারে কোকিলার মুখটা বার বার ভেসে উঠছিল। দু’তিন দিন বাদে সব যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল, রাজীব একদিন আমায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল বিজয়ের জন্য। আমি এতটা সময় দিয়েছি বলে। আমি কেমন যেন বিস্মিত হলাম। হেসে চুপচাপ রইলাম। তবু মনের মধ্যে খচখচানি গেল না। বড়ো বাড়ি, এত ঘর তবু বিজয়কে থাকতে হল আমারই সাথে। এটা কোনওভাবে মেনে নিলেও, দিদির সাথে ভাইয়ের না খাওয়া আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার দিদির বাড়ি গেলে দিদির আদর। ভাগ্না-ভাগ্নিরাও দিদির সাথে তাল মেলায়, আর জামাইবাবু তো পারলে সেদিন ওকালতি করতে যান না।

আমার সব প্রশ্নের সমাধান হল সেদিনই রাত্রে। সিঁড়ির সামনে কোকিলার মুখোমুখি হলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠল, ‘অনেক প্রশ্ন আপনার মনে, অনেক কৌতূহল, আমি জানি। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করছি না। আমি চাইনি আমার ভাই দু’দিনের জন্য আমার কাছে বেড়াতে এসে দিদি-জামাইবাবুর রোজনামচা জেনে যাক। আজ সকালে ও দিল্লির বাইরে গেছে, ব্যাবসার জন্য। প্রতিমাসেই ওর যাওয়া থাকে। ওপরে আপনার ঘরে চলুন অনেক কথা আছে।’ তাকিয়ে দেখি কোকিলার চোখে জলঃ আমি নির্বাক। বুঝলাম মেয়েটি আরও কিছু বলতে চায়। সে নিজের মনেই বলে চলল, ‘আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। বাবা-মা কেউ চায়নি আমি রাজীবকে বিয়ে করি। আমারই এক কলেজ-বন্ধু রাজীবের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। রাজীব নাকি ব্যাবসা করে দিল্লিতে এবং রাজীবও আগ্রহী আমার প্রতি। ওকে দেখে আমি প্রায় পাগল। মা-বাবার অমতে, পড়াশোনা শেষ না করেই ওকে বিয়ে করি। কুনাল, আমার কলেজ-বন্ধু। সে ছিল রাজীবের সম্পর্কতুতো ভাই। সেও বলেছিল, ‘গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট কর।’ আমি সবার বিপরীতে গিয়ে রাজীবকে বিয়ে করি। কেন জানি না আমার ছোটো থেকে স্বপ্ন ছিল, ধনী ঘরে আমার বিয়ে হবে। ছা-পোষা কেরানিকে বিয়ে করা আমার পোষাবে না। রাজীবের মা-বাবাকে জানানো হয়েছিল, ওনারা আসতে চাননি। আমার মা বাবা তখনই আপত্তি করেছিল কিন্তু আমার অন্ধ প্রেম সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। রাজীবের অদ্ভুত তাকানো, কথা বলা, স্বপ্ন রচনা, ভালোবাসার খুঁটিনাটি সব… সব আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক স্বর্গরাজ্যে। ও বলেছিল হনিমুনে যাবে সিঙ্গাপুরে। কিন্তু বিয়ের পর কাজের চাপের জন্য সব ক্যানসেল। মেনে নিয়েছিলাম স্বাভাবিক কারণেই। ব্যবসাদার মানুষজনদের কাজের ধারাটাই এরকম। সে যাইহোক, এও বলেছিল বিয়ের পর দিল্লিতে একটা গ্রান্ড পার্টি দেবে। কোথায় কি? রাজীবের বাড়ির লোকজন আমায় ভালো করে অভ্যর্থনাটুকুও জানায়নি। তিন চারদিন ওর মা-বাবার সাথে থাকার পরই চলে গেলাম ভাড়ার বাড়িতে।’

নতুন বৃত্ত

‘শুনছ? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

শাড়িগুলো ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ-ই প্রশ্ন করল অদিতি। প্রশ্নটা কানে ঠিকই গেছে সুব্রতর। কিন্তু সে কোনও উচ্চবাচ্য করল না।

আসলে সে খুব ক্লান্ত। অফিস থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আজ অসম্ভব ভিড় ছিল। বসার জায়গা পায়নি। অবিরত কনুইয়ের ধাক্বা খেতে খেতে একঘণ্টার রাস্তাটা আসতে হয়েছে। স্টেশনে নেমেও কি শান্তি আছে? স্টেশন থেকে বাড়ি বাসে নেয় দশ মিনিট। কিন্তু বাসটা সাধারণত এড়িয়েই চলে সুব্রত। সেই তো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে হবে। তার চেয়ে ফুটপাথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া অনেক আরামের। শরীরের ব্যায়ামও হয়, আবার পয়সাও বাঁচে।

কিন্তু সব মিলিয়ে এই ধকলটা তাকে খুব নাকাল করে দেয়। বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মনটা হাঁকুপাঁকু করে। কোনওমতে ঘামে ভেজা জামাটা ছেড়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। তাদের এই নতুন বাসাবাড়িতে ট্যাংকের জল পাওয়া যায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ে। অদিতি সেই জল বালতিতে জমিয়ে রাখে। সন্ধেয় সেই বালতির জলই হুড়মুড় করে মাথায় ঢেলে, ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে। তারপর সটান বিছানায় গিয়ে চিতপাত হয়। টেলিভিশনটা খোলাই থাকে। তবে, ছবি দেখে না সুব্রত। কেবল কানে শোনে। খবর শোনে। স্টুডিয়োয় নেতা-নেত্রীদের বিতর্ক শোনে। অদিতি সাধারণভাবে এ সময়টা তাকে বিরক্ত করে না। চা করে এনে রেখে যায়। কিন্তু আজ অন্যরকম হল।

সুব্রতর কোনও সাড়া না পেয়ে অদিতি আবার ডাকল তাকে, ‘কী গো? ডাকছি যে, শুনতে পাচ্ছ না?’

সুব্রত এবার অসহিষ্ণু গলায় উত্তর দেয়, ‘কী?’

‘এদিকে ফেরো না! কেমন মানুষ গো তুমি?’

সুব্রত এপাশ ফিরে বলে, ‘ফিরেছি। বলো–!’

‘আজ এপাড়ায় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে, জানো?’ অদিতির কণ্ঠে উদ্বেগ।

সুব্রত চোখ বুজে রেখেই বলল, ‘কী হল আবার? এ পাড়াতেও কি তোমার মন বসছে না?’

হাতের শাড়িটাকে এলোমেলোভাবেই আলনার উপর ফেলে রেখে অদিতি, সুব্রতর পাশে খাটের উপর এসে বসল। সুব্রতর ডানপাশে জানলাটা খোলা আছে। তাই অদিতি গলা নামিয়ে বলল, ‘আজ এ পাড়ায় খুব মারপিট হয়েছে। ছুরি মেরেছে।’

‘কী?’ সুব্রত উত্তেজনায় আধশোয়া হয়, ‘কখন? কোথায়?’

‘এই তো আমাদের দরজার প্রায় সামনে। দুপুরবেলা। বাইরে হঠাৎ হইচই। দরজা খুলে দেখতে গেলাম, কে যেন কড়া গলায় বলল, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিন বউদি।’ আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছি। অনেকক্ষণ হইচইটা চলল। তারপর সেটা একটু থেমে যেতেই কান্নাকাটির রোল, আর-এক রকম হইচই শুরু হয়ে গেল।’

সুব্রতর চোখে পড়ল জানলাটা খোলা। সে ত্রস্ত হাতে সেটা বন্ধ করে দিয়ে ঘন হয়ে বসল।

‘কে কাকে ছুরি মেরেছে?’

‘পল্টুকে চেনো তো? ওই যে গো, টাইম-কলের সামনের বাড়িটায় থাকে! ওর বাড়িতে নাকি একটা লোক প্রায়ই যাওয়া-আসা করে। ওর বন্ধু। আজ বোধহয় সেই লোকটা মদ খেয়ে এসেছিল। পল্টু বাড়িতে ছিল না। সুযোগ পেয়ে পল্টুর বউয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করতে যায়। ইতিমধ্যে পল্টু ফিরে এসে ঘটনাটা দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে একটা ছুরি এনে সোজাসুজি বসিয়ে দিয়েছে বন্ধুর পেটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ওহ্…!’

বলতে বলতে অদিতির চোখমুখের ভাব পালটে গেছে। এতক্ষণ পরেও ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল এই শীতের সন্ধেতেও।

সুব্রত নিজেও কম উদ্বিগ্ন হল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী,’ অদিতি বিরস গলায় বলল, ‘কেউ বোধহয় থানায় খবর দিয়েছিল। পুলিশ এল। লোকটা তখনও মরেনি। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেল দেখলাম। কে জানে লোকটা বাঁচল না মরল!

‘আর, পল্টু?

‘নাহ্, পল্টুকে ধরতে পারেনি। সে ঘটনা ঘটিয়েই পালিয়েছে। পুলিশ সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না সে কোথায় গেছে। নাকি জেনেও বলল না, কে জানে!’

‘তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল নাকি, পুলিশ?’

‘করেছিল। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। সাফ বলে দিয়েছি, সেসময় দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিলাম, তাই কিছুই কানে আসেনি।’

‘ওরা বিশ্বাস করল?’

‘বিশ্বাস করল কিনা জানি না। তবে, মাথা নেড়ে চলে গেল। আর কিছু জানতে চায়নি!’

‘খুব ভালো করেছ!’

‘মাথা খারাপ? কেউ এইসব ঝামেলায় পড়ে?

অদিতির মুখ সাদা হয়ে গেছে। খুব দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে উত্তেজনায়। চোখের সামনে আহত লোকটির চেহারাটা যেই ভেসে উঠছে, অমনি শিউরে উঠছে অদিতি। মুহূর্তের মধ্যে মুখটা ঘামে তেলতেল করছে। শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে ভীত চোখে সে সুব্রতর দিকে তাকাল।

তারপর বলল, ‘এদিকে পাড়ার লোকেরা সবাই দেখলাম পল্টুরই পক্ষ নিয়েছে। বলছে, পল্টু যা করেছে ঠিক করেছে। দুর্বৃত্ত বন্ধুটির এমন কঠোর শাস্তিই পাওনা ছিল। মাতাল অবস্থায় লোকটি নাকি প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে মেয়ে-বউদের সঙ্গে অভব্যতা করত, রাস্তায়-ঘাটে তাদের উত্ত্যক্ত করে মারত। পল্টু ছিল ওর দোস্ত। বন্ধুর বউকেও শেষে লোকটা ছাড়েনি…!

সুব্রত আনমনাভাবে বলল, ‘কিন্তু তা বলেই তো আর নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে আর-একটা বড়ো অপরাধ করে বসা যায় না!’

এ কথার কোনও জবাব দিল না অদিতি। আধ-ভাঁজ করা শাড়িটাকে নিয়ে সে গোড়া থেকে ভাঁজ করতে থাকে। সুব্রতর ভয়টা অন্য জায়গায়। সারাদিন সেও বাড়িতে থাকে না। অদিতি একা থাকে। পল্টুর বন্ধুর মতো আরও কত লোক এ অঞ্চলে আছে কে জানে! কোনওদিন তারা তো এ বাড়িতেও ঢুকে পড়তে পারে সুব্রতর অবর্তমানে। সেই ভাবনাটা মনে আসতেই শিউরে উঠল সুব্রত।

এবং যে-সমাধানটাকে সে আর ভাবতে চায় না, সেটাই খুব সহজে বলে উঠল অদিতি।

‘আমরা অন্য কোনও জায়গায় বাসা ভাড়া করে চলে যেতে পারি না?’

অদিতিকে এর আগে অনেকবার সে বুঝিয়েছে, নিজের জায়গা থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। পালাতে পালাতে একদিন দেখা যাবে, পালানোর জায়গাটাই আর নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে সুব্রতর সেই যুক্তিটাকেও নেহাত জোলো বলে মনে হওয়ায়, সে মনে মনে অসহায় বোধ করতে থাকে।

অদিতি থেমে থেমে বলে চলেছে, ‘তুমি সকালবেলা চাকরিতে বের হয়ে যাও। সারাদিন এ বাড়িতে আমি একলা থাকি। ভীষণ ভয় করে, জানো! তাও তো কত ঘটনার কথা বলি না তোমায়! প্রত্যেকদিনই এ পাড়ায় কোথাও না কোথাও ঝগড়া, মারামারি! কখনও ছুরি-চাকু চলছে, কখনও লাথি-ঘুসি। যখন-তখন পুলিশ এসে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। ধরা পড়ছে মদের ড্রাম, আফিম কিংবা চুরির মাল। কখনও দিনের বেলা প্রকাশ্যে রাস্তায় পাড়ার কোনও মস্তান কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি করছে। আবার কখনও কাছেপিঠের কোনও বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে অল্পবয়সি মেয়েদের। তারা নাকি মধুচক্র বসিয়েছিল। আর কতদিন এই বিশ্রী অবস্থাটা দেখে যেতে হবে বলো তো? মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ ভয় করে।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অদিতি। সুব্রত তাকে কোনও সান্ত্বনার কথা বলে না। তার সংকোচ হয়। অদিতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে তার দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ করল। অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে সিলিংয়ের সাদা রঙের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভাবনারা গতি পায়।

অদিতি তার সামনে যে-প্রশ্নটা রেখেছে, তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় তার নেই। আবার এই প্রশ্নটার সামনে সে অসহায়ও। চাইলেও অদিতির আপাতসরল প্রশ্নের জবাব দিতে সে অপারগ। সে যদি বলতে পারত, ঠিক আছে, আমরা কালই অন্য কোনও পাড়ায় উঠে যাব, নতুন কোনও বাসায়, সে যেন বেঁচে যেত। কিন্তু সুব্রত জানে, এই শহরে নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কত কষ্ট করে এখনকার বাসাটা পাওয়া গেছিল, সে কথা সুব্রত ভোলেনি। ভালো টাকা সেলামি দিতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে রাজি হতে হয়েছিল উচ্চহারে ভাড়ার শর্তে।

সে কথা অবশ্য অদিতিরও অজানা নয়। অঞ্চলটা ভালো, কিন্তু সেখানে থাকার জন্য গুণাগারও দিতে হচ্ছে উচ্চ হারে, এ কথা সুব্রতর মুখ থেকে শোনার পর প্রথম বেঁকে বসেছিল সে নিজে।

‘এত টাকা ভাড়া?’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁগো, বাড়িভাড়াতেই তো আমাদের সংসারের সব টাকা বেরিয়ে যাবে, আমরা খাব কী?’

‘কী আর করা? ভদ্রলোকের পাড়ায় থাকতে হলে এটুকু খেসারত তো দিতেই হবে–!’

তারপর আর আপত্তি করেনি অদিতি। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে সেদিন নিজের আপত্তিকে আরও জোরালো করে তুলতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। নিত্যদিনের এই উদ্বেগ আর হ্যাপা সইতে হতো না!

সারাসন্ধে, তারপর সারারাত পাড়াটা অদ্ভুত রকম নীরব আর শান্ত হয়ে রইল। সেই নীরবতা, যা সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর। যে নীরবতা ভয়ের বার্তাবহ। ভোর হওয়ার পরও থমথমে ভাবটা গেল না। গোটা পাড়াটা যেন দমবন্ধ করে অপ্রিয় কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে। সকালে অফিসে বেরোনোর সময়ই সেটা টের পেল সুব্রত।

বাসস্টপে পৌঁছে খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। স্বপ্নেন্দুর একটা ছোটোখাটো ইলেকট্রিক জিনিসপত্রের দোকান আছে। প্রয়োজনে কখনও-সখনও স্বপ্নেন্দুর দোকানে যেতে হয়েছে সুব্রতকে। সেই থেকেই মুখ চেনা।

তাকে দেখতে পেয়েই স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞেস করল, ‘কাল আপনাদের পাড়ায় একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে শুনলাম! কী কাণ্ড বলুন তো!’

সুব্রত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘ভাবছি এ পাড়া থেকে চলে যাব। আপনি তো জানেন ভাই, আপনার বউদি সারাদিন একা বাড়িতে থাকেন! কাল যা ঘটেছে শুনলাম, তাতে এখানে পরিবার নিয়ে থাকাটাই তো দেখছি বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে!’

‘কোথায় যাবেন?’ স্বপ্নেন্দু জানতে চায়।

‘ঠিক নেই। এখনও তো কাউকে কিছু বলিনি। তা ছাড়া এ সময়ে সুবিধেজনক ভালো জায়গায় বাড়ি পাওয়াও তো সহজ ব্যাপার নয়!’

স্বপ্নেন্দু শুনে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার নিজের একটা বাসা আছে, দাদা! দশ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে নিয়েছিলাম। ভাড়া দিই মাসে দু-হাজার। ভেবেছিলাম পরিবার নিয়ে ওখানেই থাকব আর বাড়ির বাইরে একটা দোকান দেব। কিন্তু সেটা শেষপর্যন্ত হয়নি।’

সুব্রত ভাবে, সকাল-সকাল স্বপ্নেন্দু তাকে পাকড়াও করে তার নিজের ইতিহাস শোনাতে বসল কেন!

স্বপ্নেন্দু অবিচলিত মুখেই বলে যেতে থাকে, ‘শেষপর্যন্ত পুরোনো বাড়িতেই রয়ে গেলাম, জানেন! ওই বাড়িটা তালা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। এখন ভাবছি, ভালো ভাড়াটে পেলে তাকে ছেড়ে দেব!’

সুব্রত হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল।

‘ছেড়ে দেবে? টাকাপয়সা কী দিতে হবে?’

স্বপ্নেন্দু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য কীসের টাকাপয়সা, কীসের কী দাদা? আপনি ওই দশ হাজার টাকাই সেলামি দেবেন। ভাড়া দু’হাজার। তাড়া নেই। রাজি থাকলে দশ-বারো দিনের মধ্যে একটু জানিয়ে দেবেন আমায়!’

স্বপ্নেন্দু তার মোটরবাইকের মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

চিন্তায় পড়ল সুব্রত। দশ হাজার টাকা সেলামিতে ভালো জায়গায় বাসা পাওয়া এই সময়ে সহজ কথা নয়। তার উপর ভাড়াটাও মোটামুটি সামর্থ্যের মধ্যেই বলছে। এখন দেখার, পাড়াটা কেমন। সুব্রত ভাবল, আজ একবার অফিস থেকে ফেরার সময় স্বপ্নেন্দুর দোকানে যাবে। স্বপ্নেন্দু সেসময় যদি ফাঁকা থাকে, তাহলে ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটাও দেখে আসবে একবার।

রাতে বাড়ি ফিরতে অদিতি অন্য নানা-প্রসঙ্গের পরে জানতে চাইল, ‘কাউকে বলেছিলে নতুন একটা বাসা দেখার কথা?’

সুব্রত তখন দু-আঙুলে রুটি ছিঁড়ে আলু-পটলের তরকারিতে ডুবিয়ে মুখে দিয়েছে। চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আজই একটা দেখে এলাম অদিতি। পাড়াটা বেশ ভালো। বাড়িটাও। কিন্তু নিতে হলে দশ-বারো দিনের মধ্যে দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। এত অল্প সময়ে এত টাকা কোথায় পাই, বলো তো!’

অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘শোনো বিয়ের সময় বাবা কিছু গয়না দিয়েছিলেন। এমনিতেও সেগুলো খুব পুরোনো ডিজাইনের। আমি তো পরিই না–!’

আঁতকে উঠল সুব্রত, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ? তোমার গয়না বেচে টাকা জোটাব? আমার দ্বারা হবে না।… আর তা ছাড়া পরে কখনও তোমার বাবা জানতে চাইলে কী জবাব দেবে?

‘জবাবের ভারটা আমার উপরই ছেড়ে দাও। সংসারের প্রয়োজনেই যদি কাজে না লাগল তো ওই গয়না দিয়ে আমার হবে কী?’

‘তবু, আমার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না অদিতি,’ সুব্রত কিন্তু-কিন্তু করে।

‘তাহলে কি এভাবেই আমাদের জীবন কেটে যাক, এটাই বলতে চাইছ? প্রত্যেক মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরতে হবে? তোমার আর কী? তুমি তো সারাদিন অফিসেই কাটিয়ে দাও! ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি আমি’– অদিতির চোখের কোলে জল টলটল করে।

অদিতিকে কিছু বলতে পারল না সুব্রত। সত্যিই তো, ত্রুটি তার দিক থেকেই হয়েছে। সুব্রতর বাবা-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছিলেন। তিনকূলে কেউ ছিল না সুব্রতর, এক দিদি ছাড়া। দিদি নয়নার বিয়ে হয়েছিল মফসসলের দিকে। উপরন্তু বিয়ের পর ওরা পাকাপাকিভাবে মুম্বাইয়ের বাসিন্দা হয়ে যায়। কারণ, তার স্বামী অখিলের অফিস তাকে মুম্বাইয়ে বদলি করে। মুম্বাইয়ে যাওয়ার পরেই সুব্রতর উপরে বিয়ের জন্য চাপসৃষ্টি করা শুরু করে দেয় নয়না। স্বাভাবিক, দিদি হিসাবে তার গভীরতর চিন্তা ভাইকে নিয়ে। ভাইকে জীবনে সেটলড দেখলে  খুশি ও আশ্বস্ত হয়। কিন্তু সুব্রতরও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যও তার দরকার ছিল কয়েকটা বছর। সে অনেকবারই এ কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছে একাদিক্রমে নয়না ও অখিলকে। ওরাও অনড় ছিল। অখিল তো এমনও বলেছিল, ‘তোমার তো বাড়তি চিন্তা করার কিছু নেই সুব্রত! আমরা তো রইলাম!’

সুব্রত বলতে চেয়েছিল, ‘বউকে এনে তুলব কোথায়? এই ভাঙাচোরা ভাড়াবাড়িতে?’

‘ভাঙাচোরা বাড়ি সারিয়ে নিলেই সুশ্রী হয়ে যাবে,’ অখিল সহজ সমাধান করে দিল।

‘কিন্তু, তা সত্ত্বেও কিছু হওয়ার নয় অখিলদা। একখানা মাত্র ঘর। তাও এইটুকু–!’

‘তাহলে অন্য একটা বাড়ি দ্যাখ! যত তাড়াতড়ি পারিস! আমি পাত্রী দেখা শুরু করি,’ কঠোর সিদ্ধান্তের মতো জানিয়ে দিয়েছিল নয়না।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সুব্রতর কান্না পেয়েছিল। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়া মলিন ঘরের অবিন্যস্ত চেহারা দেখে সে ভেবে পাচ্ছিল না কোন স্পর্ধায় কোনও তরুণীকে এ বাড়িতে থাকতে সে বাধ্য করতে পারে! নতুন বাসা যে দেখবে, সেও অনেক টাকার ব্যাপার। সেলামি দিতে হবে। পুরোনো বাড়ির মতো পুরোনো ভাড়ায় থাকা যাবে না।

আলমারির লকার থেকে ব্যাংকের পাশবই বের করে সে নানারকম হিসেবনিকেশ করে দেখল। সঞ্চয় সামান্যই। তবু, সেটাকেই সম্বল করে সে একটি ভদ্রস্থ বাসাবাড়ির সন্ধান চালাতে থাকে। অখিল অবশ্য বলেছিল, ‘আজকাল কলকাতায় এঁদো গলিতেও কত ফ্ল্যাট উঠছে!’ সুব্রত এড়িয়ে গেছে। ফ্ল্যাট কিনতে হলে তাকে লোন নিতে হবে। কিন্তু এখনই ঋণের জালে জড়াতে রাজি নয় সে।

নতুন বাসাবাড়ি ঠিক করে অখিল আর নয়নার সঙ্গে অদিতিকে দেখতে গেছিল সুব্রত। অফিসের কাজ উপলক্ষ্যে কলকাতায় এসেছিল অখিল। সঙ্গে নয়নাকেও নিয়ে এসেছিল। এক সন্ধ্যায় তারা গেছিল অদিতিদের বাড়িতে। শীতকাল। বড়ো রাস্তার হ্যালোজেনের নীচে মৌচাকের মতো কুয়াশা জমে আছে।

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার অদিতিদের। আড়ম্বর বিশেষ নেই। প্রথম দর্শনেই ধীর-স্থির, শান্ত, ভীরু চোখের মেয়েটিকে দেখে তার প্রতি এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করেছিল সুব্রত। অখিলের ফিরে যাওয়ার তাড়া ছিল। সুব্রতর সম্মতি আছে দেখে, এখানেই সম্বন্ধ পাকা করে এসেছিল নয়না। বলেছিল, ‘তাহলে, আসছে ফাগুনেই চার হাত এক হয়ে যাক–!’

অদিতি এ বাড়িতে আসার পর, দৈনন্দিন জীবনের চেনা ছকটাই পালটে গেল সুব্রতর। সংসারের প্রতি, বাড়ির প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ, প্রতিদিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরিয়ে আনত বাড়িতে। জীবন একটা নতুন ছন্দে বয়ে যেতে থাকল স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর মতো।

কিন্তু সেটা অন্তরের উন্মাদনা। তাদের নতুন পাড়ায় আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তাদের চোখের আড়ালে, যা সেই উন্মাদনার প্রাবল্যে কিছুদিন ঢাকা পড়ে রইল। উন্মাদনা কিঞ্চিৎ স্থিমিত হয়ে এল যেদিন, সেদিন থেকে চোখে পড়তে থাকল বাহিরের আসল চিত্রটা। তখনই চারপাশের পরিবেশটা যেন দীর্ঘ এক অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরতে থাকল তাদেরকে, এমনকী তাদের সম্পর্কের সারল্য, নিরাপত্তা আর নৈকট্যকেও।

একদিন অফিসে যাওয়ার সময় তাদের বাসার ঠিক সামনে কয়েকজন নারী-পুরুষের অশালীন ঝগড়া শুনল সুব্রত। আর-একদিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরতে অদিতি জানাল, পাড়ায় বোমা পড়েছে। একদিন গভীর রাতে তারা শ্বাস চেপে রেখে শুনল, পুলিশের জিপ আসার আওয়াজ। তার কিছুক্ষণ পরেই দ্রুত কিছু পায়ের দৌড়ে যাওয়া, চাপা গলায় চিৎকার। পরদিন সকালে শোনা গেল, কয়েক গ্যালন দেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে। নিত্যদিন এমনই চলতে থাকল। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে অদিতির কাছে পাড়া সম্পর্কে এক-একটি নতুন কাহিনি শুনতে থাকল সুব্রত। শেষে একদিন অত্যন্ত অসহিষ্ণু গলায় অদিতি প্রশ্ন করল, ‘আমি তোমার স্ত্রী তো, নাকি?’

‘হঠাৎ এমন অদ্ভুত প্রশ্ন?’

‘বলো, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও–!’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!’

‘এবার বলো, কোন স্বামী তার স্ত্রীকে এরকম একটা অসুরক্ষিত জায়গায় সারাদিনের জন্য একা রেখে চলে যায়?’ অদিতির চোখের কোলে অভিমানে টলমল করে জল।

সুব্রত খুব অসহায় হয়ে যায়। সহজে কোনও উত্তর দিতে পারে না। কতবার সে অধৈর্য হয়ে ভেবেছে অদিতিকে বলবে, ‘তুমি তাহলে আপাতত সেই মফসসল শহরে তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকো। এখানে একটা ভালো বাড়ি পেলে, তোমাকে নিয়ে আসব।’

কিন্তু বাক্যগুলো শেষপর্যন্ত জিভ থেকে ঠোঁটের গোড়ায় আসেনি। কেন-না, এই সাময়িক বিরহের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তাকে তার সহকর্মীরাও বলেছে, কলকাতা শহরে এ ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া মুখের কথা নয়। এই অবস্থায় কোন মুখে অদিতিকে সে বাপেরবাড়িতে গিয়ে থাকতে বলে?

এইসব চিন্তাভাবনা তাকে তিষ্ঠোতে দেয় না। অফিসের কাজেও মন বসে না তার। অনেকেই তার মধ্যে এই উন্মনা ভাবটা লক্ষ করেছে। সেদিন তার সহকর্মী অয়ন তাকে রীতিমতো চেপে ধরল, ‘কী হয়েছে তোর?’

‘কই, কিছু না তো!’

‘কিছু তো হয়েছেই। তোকে এত আনমনা আগে কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই কিছ লুকোচ্ছিস!’

সুব্রত খানিকটা বাধ্য হয়েই সব কথা খুলে বলে। অয়ন সব শুনে গম্ভীর হল। খানিকক্ষণ থেমে থেকে বলল, ‘এটা তো ঠিক-ই কলকাতা শহরে ভাড়াবাড়ি পাওয়া এখন বেশ দুষ্কর। চতুর্দিকে সব ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। রেস্ত থাকলে কিনে নাও। না হলে একটা ভালো পাড়ায় কোনও ভদ্র গৃহস্থের বাড়ির একচিলতে ঘরের জন্য মাথা কুটে মরো!’

এসবই সুব্রত জানে। তবু অয়নের কথা শুনে যায়। শেষে অয়ন আসল কথাটা জিজ্ঞেস করল।

‘ঠিক কলকাতা শহরের মধ্যে না, একটু দূরে যাবি? এই ধর, বাসে করে অফিস পৌঁছোতে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট লাগবে!’

‘সে তো অনেক দূর!

‘দূর হলেই বা, শান্তি আছে। ওখানে আমার মামার বাড়ি। শরিকি বাড়ি। দিদিমা যে-অংশটায় থাকত, দিদিমা মারা যাওয়ার পরে সে অংশটা ফাঁকাই। দুটো বড়ো ঘর। রান্নাঘর। বাথরুম। রাজি থাকলে বল, কথা বলি!

সুব্রত মাথা চুলকে বলল, ‘একটু গ্রামের দিক হয়ে গেল না?’

‘গ্রাম?’ অয়ন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘গ্রাম কী রে? আগে ছিল মফসসল। এখন রীতিমতো শহর। কলকাতা শহরটা ক্রমশ ওদিকে বাড়ছে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে গোল গোল তরঙ্গ হতে দেখেছিস? ঠিক ওরকম করে বৃত্ত বড়ো হচ্ছে। মূল শহরে তারাই থাকবে, যাদের ট্যাঁকের জোর আছে, বুঝলি? আর, আমাদের মতো হাভাতেরা সেই তরঙ্গের ঘাড়ে চেপে ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃত্তের বাইরে নতুন বৃত্ত তৈরি করে। ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট, বস্!’

অদিতিকে বলতে সে লাফিয়ে উঠল। সে মফসসলেরই মেয়ে। তার তো খুশি হওয়ারই কথা। তার দুটো গয়না বাঁধা দিতেই হল। নইলে সেলামির টাকাটা জোটানো যাচ্ছিল ন।

ওরা উঠে এল নতুন বাসায়। পুরোনো বাড়ি। কিন্তু অনেকটা জায়গা নিয়ে। পিছনের দিকে বেশকিছু গাছগাছালিও আছে। সুব্রত বলল, ‘নাও, এবার খুশি তো? এখানে আর দিনদুপুরে খুনখারাবির প্রশ্ন নেই। কত ভদ্র পাড়া!’

অদিতি আকর্ণ হেসে বলল, ‘সত্যি!’

তবে সুব্রতকে ইদানীং একটু তাড়াতাড়িই অফিসে বের হতে হয়। অনেকটা রাস্তা। আগে থেকে বোঝা যায় না, কখন যানজট হবে! ফিরতেও আগের তুলনায় রাত হয়। সেসবই হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সুব্রত।

দেখতে দেখতে নতুন বাসায় দু-মাস কেটে গেল তাদের। ভরা বর্ষায় তাদের ভাগের কিচেন গার্ডেনে লকলকিয়ে উঠল লাউগাছ। সুব্রত এক রবিবার বাঁশের কঞ্চি কেটে মাচা বানিয়ে দিল।

মরশুমের শেষ বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। ছাতা মাথায় আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে সদর দরজার কড়া নাড়তেই হাট করে খুলে গেল দরজাটা। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজায় খিল এঁটে দিল অদিতি। লোডশেডিং হওয়ায় তার অবয়বটা শুধু আন্দাজ করতে পারছিল সুব্রত। তাতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

অদিতি বলল, ‘ওগো, আমরা আবার একটা খারাপ জায়গায় চলে এসেছি।’

‘মানে?’

‘আজ এ বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’

‘কেন?’

‘পাশের বাড়িতে অনেকদিন ধরে নাকি মধুচক্র চলে। কলকাতার বেশ কিছু রাঘব বোয়ালের এখানে যাতায়াত। আজ পুলিশ এসে সবকটাকে হাতেনাতে ধরেছে। সব বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে, মা গো। কী নোংরা, কী নোংরা…!’

বলতে বলতে আন্ধকারের বুক চিরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল অদিতি। আকাশটা ভেঙেচুরে গিয়ে উথালপাতাল বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সুব্রত। অনুভূতিহীন। বৃষ্টির ধারাল ফোঁটাগুলি চৌবাচ্চার জলে লাফিয়ে পড়ছে। জমা জলে হুটোপুটি করছে। জলের তরঙ্গে বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। একটার পরে আর-একটা।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব