পত্রমিতালি

মাস ছয়েক হল সাতপাকে বাঁধা পড়েছে অরিত্রি। সবে সবে এমএ কমপ্লিট করেছে, তারপরেই সম্বন্ধ করে বিয়ে। বরানগরের সাহা বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্র ঋদ্ধির সঙ্গে। অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে গিয়েই ঋদ্ধির বাবা-মায়ের চোখে পড়ে যায় অরিত্রি। পড়বে না-ই বা কেন, ফরসা, টিকোলো নাক, টানাটানা চোখ, যাকে বলে একেবারে প্রকৃত সুন্দরী। ব্যস তারপরেই পাকাদেখা, আর চারহাত এক করা।

অরিত্রির নতুন পরিবার বলতে ঋদ্ধি, শ্বশুর-শাশুড়ি আর সমবয়সি এক দেওর। ভীষণ ফিচেল। হবি বলতে সময় পেলেই শার্লক হোমস্-এর বই নিয়ে বসে পড়া। কেমন যেন সন্দেহপ্রবণ। সবেতেই নাকি রহস্যের গন্ধ পায় সে। আর একজন বিবাহিত ননদ। সাংসারিক কিছু সমস্যার জন্য ইদানীং বাপের বাড়িতেই থাকছে। তবে ভীষণ মিষ্টি স্বভাবের। যাই হোক অরিত্রি এগুলো বেশ এনজয়ই করে। এযুগের মেয়ে হলেও নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি অরিত্রির একেবারেই পছন্দের নয়। বরং বরাবরই সংযুক্ত পরিবারের প্রতিই তার ঝোঁক বেশি। সে তার পছন্দ মতোই পরিবার পেয়েছে বটে। সারাদিন কাজ বলতে শাশুড়ির হাতেহাতে টুকটাক কিছু। আরও একটি ব্যাপারে অরিত্রি বেশ প্রাচীনপন্থী। এই ফেসবুক, টুইটারের যুগেও সে পত্রমিতালিতেই আস্থাশীল।

সেদিনও বেলা এগারোটা নাগাদ শাশুড়ি আর দেওরের সঙ্গে বসার ঘরে গল্প করছিল অরিত্রি। শ্বশুর ধৃতিমান আর স্বামী ঋদ্ধি তখন অফিসে। সেই সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। সোহম-ই দরজা খোলার জন্য উঠে গেল। খানিক পরে একটা গোলাপিরঙা খাম নাকে দিয়ে শুঁকতে শুঁকতে ঘরে ঢুকল। খামটা অরিত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও বউমণি তোমার চিঠি।’ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।

মুহুর্তেই অরিত্রির মুখচোখের রঙই বদলে গেল। একপ্রকার লাফিয়ে উঠেই সোহমের হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিল সে। নিজের ঘরের দিকে যাবার উপক্রম করতেই শাশুড়ি বিমলাদেবী প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কার চিঠি বউমা?’

‘আমার বন্ধুর’ কোনওমতে জবাব দিয়েই নিজের ঘরের দিকে চলে গেল অরিত্রি।

বউমণির হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গেল সোহম। এমনিতে তো অষ্টমঙ্গলার দিন-দুয়েক পর থেকেই চিঠি আসা শুরু হয়েছে। তবে সোহমের মারফত এই প্রথম। মনে মনে ভাবতে থাকল, এমন কার চিঠি যে হাতে পাওয়া মাত্রই বউমণির মুখে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে গেল? অমন ভাবে ছিনিয়েই বা নিল কেন? তার উপর খামের ওই সুগন্ধী! আরও যেন উসকে দিল সোহমের সন্দেহপ্রবণতাকে।

ভাবনায় বাধ সাধলেন বিমলাদেবী। চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁরে সোহম আজও দিদির কোনও ফোন বা চিঠিপত্তর কিছু এল না নারে?’

‘মা এব্যাপারে আমাদেরও তো কোনও তৎপরতা নেই বলো। আমরাও যেমন ভাবছি ওদিক থেকে কোনও সাড়া পেলে আমরা এগোব, তেমন ওরাও হয়তো সেটাই ভাবছে। তাছাড়া ওরা দিদিকে যেভাবে হেনস্থা করেছে, তাতে করে ওর আর ওবাড়িতে না যাওয়াই ভালো। ও এখানেই থাক।’ কথা বলতে বলতেই কানে ভেসে এল রবীন্দ্রসংগীত। সম্ভবত বউমণির ঘর থেকেই। ‘দ্যাখ সংসার থাকলে একটু-আধটু অশান্তি হয় বটে। পরে সব ঠিকও হয়ে যায়। তাছাড়া মা-বাবা যেমনই হোক জামাই তো আমাদের খুব ভালো। লজ্জায় হয়তো ফোন করতে পারছে না। চিঠি পাঠালেও তো পাঠাতে পারে। আচ্ছা বউমা তো মাঝেমধ্যেই পোস্ট অফিসে যায়, না? তা ওকে বললেই তো একটু খোঁজ নিতে পারে।’

‘তোমার বউমা তো তার বন্ধুকে চিঠি দিতে যায়। ননদের কথা ভাবার কি তার সময় আছে? এই দ্যাখো না পনেরো দিনের মাথায় দু-বার চিঠি এল বউমণির। সেদিন তো নিজেই নিল। আর আজ… সেই একই গোলাপি খামে সুগন্ধী দেওয়া চিঠি।’ সোহম বেশ গম্ভীর ভাবেই বলল।

‘বউমার এই চিঠির কথা ঋদ্ধি জানে? নিশ্চয়ই জানে।’ আশঙ্কা প্রকাশ করেও নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি। এমনিতে অরিত্রিকে নিয়ে অভিযোগের জায়গাই ছিল না বিমলাদেবীর। দেখতে যেমন, তেমনই মিষ্টি ব্যবহারও। সকলকে যত্ন করে খাওয়ানো, কেউ কষ্ট পেলে তা লাঘব করার চেষ্টা, একেবারে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল ওর। তবু মা তো। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এমনিই মেয়েকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় আছেন, তার উপর এখন আবার ছেলে। সোহমের কথাগুলো বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল বিমলাদেবীকে।

‘ঠিকানাটা দেখলি? কোথা থেকে এল চিঠিটা?’

সোহম কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল, ‘আমি কী করে জানব, বউমণির পেন ফ্রেন্ড। কাজেই ওটা বউমণিই জানবে।’

‘পেন ফ্রেন্ড’ আবার কী জিনিস রে?’ ভুরু কোঁচকালেন বিমলাদেবী।

‘মা তুমিও না! কী করে বোঝাই বলো তো? মানে পত্রমিত্র।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, এবার বুঝতে পেরেছি। ঋদ্ধি যখন ছোটো ছিল, তখন বাচ্চাদের পত্রিকা থেকে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ও তাদের চিঠি লিখে পাঠাত।’

‘মা, তুমি না খুব সহজ সরল। তোমাকে বোকা বানানো খুব সোজা। মানুষ বছরের পর বছর একসঙ্গে স্কুলে পড়ার পর সেইসব বন্ধুদের একটা সময় পর ভুলে যায়, আর এ তো কোন পত্রমিত্র। বউমণির মতো নিয়মিত পত্রমিত্র-র চিঠি আসতে কখনও দেখিনি।’

সোহমের কোথাও বেরোনোর ছিল বোধহয়। বন্ধু ডাকতে হনহন করে বেরিয়ে গেল। বিমলাদেবী খানিকক্ষণ সেখানেই বসে রইলেন। হয়তো কিছু ভাবছিলেন। তারপর গতানুগতিক ভাবে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ঋদ্ধি আবার খিদে সহ্য করতে পারে না। খিদের সময় খাবার না পেলে ওর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। তাই বিকাল বিকাল জলখাবার বানাতে শুরু করে দেন বিমলাদেবী। সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে, ‘ওহ্, অরিত্রি তোমার দাদা ফোন করেছিল। তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমাকে কল করেছিল। কাল রমামাসি নাকি কে যেন আসবে ওবাড়িতে। তাই আমাদের যাওয়ার জন্য বলছিল। আমার তো সময় হবে না, তুমি ঘুরে এসো।’

‘ঠিক আছে। তুমি গেলে ভালো হতো। কিন্তু সময় না পেলে আর কী করা যাবে। সময় করে আমিই একবার দেখা করে আসব।’

পরদিন ঋদ্ধি অফিস যাবার পর অরিত্রি পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রমামাসি অরিত্রির ছোটোমাসির বড়োজা। ছোটোমাসি মারা গেলেও ওনার জায়ের সঙ্গে অরিত্রির মায়ের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। একেবারে মায়ের পেটের বোনের মতো। অসুস্থ থাকায় অরিত্রির বিয়েতে আসতে পারেননি। তাই আসার সময় আদরের অরিত্রির জন্য একছড়া সোনার মালা আর কানের দুল এনেছেন। সেটা পেয়ে অরিত্রি একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।

রমামাসির সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় সকলে গল্পে মশগুল হয়ে গেল। গল্পের মাঝে হঠাৎই অরিত্রির মা বিভাদেবীর কিছু মনে পড়ে যাওয়াতে ‘একটু আসছি’ বলে ভিতর ঘরে গেলেন। খানিক পরে একটা খাম হাতে করে নিয়ে এসে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নে অরি, পরশুদিন এটা এসেছিল। বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি।’ সেই গোলাপিরঙা খাম দেখে একপ্রকার মায়ের হাত থেকে কেড়েই নিল অরিত্রি।

‘কার কার্ড রে?’ অরিত্রির নেওয়ার ভঙ্গিমা দেখে প্রশ্ন করে বসল বউদি অনিন্দিতা।

‘কেন তুমি আমার পত্রমিত্র-র কথা জানো না? নতুন নাকি?’

‘বাবা, তোরা যে কীভাবে না দেখেশুনে একজন অচেনা লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাস কে জানে। এইভাবে আবার…’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যায় অনিন্দিতা। মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় তার। কোনও এক অশনিসংকেতের আভাসে মুহূর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার।

‘হ্যাঁরে ওবাড়িতে এইরকম কোনও চিঠি যায় না তো?’ শঙ্কা প্রকাশ করে অনিন্দিতা।

‘কেন, না যাওয়ার কী আছে?’

‘তোর এই পত্রমিত্রের কথা ঋদ্ধি জানে?’

‘নাহ্। আর জানলেই বা কী হবে? আমি তো কোনও অন্যায় করছি না।’ সহজ ভাবে উত্তর দেয় অরিত্রি।

‘ভুলে যাস না অরি, তুই এখন বিবাহিত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভীষণ স্পর্শকাতর। সামান্য থেকে সামান্য জিনিসও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই এমন কিছু করিস না, যেটাতে ওর বা ওর বাড়ির লোকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। ছেলেমানুষি ছাড়, এসব চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া বন্ধ কর।’ অরিত্রিকে বোঝানোর চেষ্টা করে অনিন্দিতা।

‘বউদি তুমি ভালো করেই জানো আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া আর অন্য কোনও সম্পর্ক নেই। এই সামান্য একটা কারণে আমার আর ঋদ্ধির সম্পর্কে ফাটল ধরবে, ঋদ্ধি আমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। সরি বউদি, তোমার এই অ্যাডভাইস-টা মানতে পারলাম না।’

গল্প আর কথার মাঝে বিকাল গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে। বাড়িতে ফেরারও তাড়া ছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মাসির দেওয়া উপহারগুলো সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেল অরিত্রি।

দেখতে দেখতে আরও দুটো মাস কেটে গেল। শীত গড়িয়ে গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এইরকমই এক গ্রীষ্মের দুপুরে অরিত্রি স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখল ঋদ্ধি মুখটা ভার করে বসে রয়েছে। তার দিকে ফিরেও দেখছে না। অথচ অন্যান্য দিন ভিজে চুলে অরিত্রিকে দেখে ঋদ্ধির যে কী হয় কে জানে। নিজেকে একদম কন্ট্রোল করতে পারে না। অরিত্রি নানা অছিলায় তাকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করে। ইচ্ছে করেই বুক থেকে আঁচলটা খসিয়ে দেয় সে। কিন্তু কিছুতেই কোনও লাভ হচ্ছে না দেখে চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে, ‘আজ কী হয়েছে তোমার? এত নির্লিপ্ত কেন?’

অরিত্রির গলার আওয়াজ শুনে ঘাড়টা ফিরিয়ে ঋদ্ধি বউয়ের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল, ‘তোমার চিঠি’। ঋদ্ধির কপালে অসন্তোষের ভাঁজ স্পষ্ট।

‘আমার চিঠি!’ চিঠির দিকে চোখ যেতেই আনন্দে হাসতে হাসতে খামটা খুলতে খুলতে বলল, ‘আরে এটা তো সুরজের চিঠি।’ বলেই চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে দিতে প্রশ্ন করল, ‘সুরজ কে? এর কথা তো আগে কখনও বলোনি!’

‘আমার পত্রমিত্র। ভীষণ ভালো। ওর গুণের তুলনা হয় না।’ পড়তে পড়তেই জবাব দিল অরিত্রি। তারপর আবার চিঠির মধ্যে ডুবে গেল। পরে আয়নার সামনে বসে গুনগুন করে গাইতে থাকল। ঋদ্ধি আড়চোখে অরিত্রিকে পরখ করছিল। পরপুরুষের প্রতি স্ত্রীর প্রীতি কোন পুরুষই বা মেনে নিতে পারে? রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনওমতে নিজেকে সংযত করে বেশ দৃঢ় ভাবেই বলল, ‘আজ খাবারদাবার পাওয়া যাবে নাকি?’

‘খাবার তো রেডিই আছে,’ বলে রান্নাঘরে চলে গেল সে। স্ত্রীর এত খুশির কারণ কী? ওই চিঠিতে কী এমন লেখা রয়েছে? কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে অরিত্রি যাওয়া মাত্রই আলমারি থেকে চিঠিটা বার করে পড়তে শুরু করল ঋদ্ধি। হিমাচল প্রদেশের কোনও এক গ্রাম থেকে চিঠিটা এসেছে। প্রতিটি ভাষায় রয়েছে পর্বতীয় সংস্কৃতির ছাপ। অরিত্রিকে সপরিবারে ওখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে সুরজ। নতুন বছরে কার্ড পাঠাবার জন্য অরিত্রিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, সঙ্গে ওর কিছু প্রশ্নের উত্তরও। চিঠির ভাষা আর লেখনী সত্যিই তারিফযোগ্য।

অরিত্রি খাবার দেওয়ার পর একে একে সকলে এসে টেবিলে খেতে বসে গেছে। ঋদ্ধি খেতে বসলেও খাওয়ায় বিন্দুমাত্র মন নেই তার। কেমন যেন উদাস। সোহম শুরু থেকেই দাদাকে খেয়াল করছিল। কারণ এই খাম আসার সাক্ষী সে নিজেও, তাই হয়তো দাদার কষ্টটা ও ফিল করছিল। মনে মনে বউমণিকে দূষতে ছাড়েনি সে।

দাদার মন ঘোরাতে মটর পনিরের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাদা এটা তো খেলেই না। দারুণ টেস্ট, খেয়ে দ্যাখো।’

‘না না দিস না। পেটটা ভারভার লাগছে।’ বলে টেবিল থেকে উঠে চলে গেল ঋদ্ধি।

দাদার অবস্থা দেখে সোহম মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিল এবার কোনও চিঠি এলে সে তার বউমণিকে না দিয়ে দাদা ঋদ্ধির হাতেই তুলে দেবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই রহস্য ভেদ করতেই হবে।

সোহমের পরিকল্পনা অনুযায়ী দিন পনেরো পরে সেই শুভক্ষণ উপস্থিত হল। বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবে বলে বেরোচ্ছে, এমন সময় গেটের মুখে ডাকপিয়োন হরিদার সঙ্গে দেখা। দাদার অফিসের একটা চিঠির সাথে সাথে বউমণির সেই গোলাপিরঙা খাম পকেটস্থ করে বেরিয়ে গেল সোহম।

সিনেমা, খাওয়াদাওয়া সেরে সোহম যখন ফিরল তখন ঋদ্ধিও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গেছে। বউমণি রান্নাঘরে আর মা বারান্দায় বসে বসে রেডিয়োতে পুরোনো দিনের গান শুনতে ব্যস্ত। সেই সুযোগে সোজা দাদার কাছে গিয়ে, ‘দাদা, এগুলো নাও। এটা বোধহয় তোমার অফিসের, আর এটা বউমণির। দুপুরে বেরোনোর সময় রাস্তাতেই হরিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।’

‘ওহ্, ঠিক আছে। টেবিলে রেখে যা। আমি দেখে নেব।’ সোহম যাওয়ার পর অফিসের চিঠিটা নিজের কাছে রাখল। অরিত্রির-টা ওর বালিশের নীচে।

ডিনার সেরে অরিত্রি যখন শুতে এল তখন ঋদ্ধি তার চিঠির কথা তাকে জানাল, সঙ্গে এও জানাল সেটা তার বালিশের নীচে রয়েছে।’

‘আমার চিঠি এই সময়?’ অরিত্রি বেশ আশ্চর্য হয়েই কথাগুলি বলে বসল।

‘ওটা দুপুরেই এসেছে। ছোটোন নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন দিয়ে গেল।’ ঋদ্ধির মুখের দিকে তাকাল অরিত্রি। ‘সুরজ-এর চিঠি তাই তো?’ তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল সে।

‘হ্যাঁ, তুমি কেমন করে জানলে?’ হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করল অরি।

‘খাম দেখে। তা, যে আমার বউয়ের মনের এত কাছে, সেই মহাশয়ের সম্পর্কে আমারও তো জানার অধিকার রয়েছে নাকি?’ বিছানায় বসে পড়ল ঋদ্ধি।

‘অবশ্যই রয়েছে। সুরজের সম্পর্কে তোমাকে কী বলব, ঠিক ভাষা খুঁজে পাই না। আমারই সমবয়সি হবে। যেমন সুন্দর তেমনি ব্যক্তিত্ব, আকর্ষকও বটে। ভীষণ ভালো লেখে। মনে হয় পড়তেই থাকি। আর ওর চোখ দুটো…’ বলতে বলতে থেমে যায় অরি। বোধহয় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এমনটা মনে হয় ঋদ্ধির। সন্দেহ আর ঈর্ষায় জ্বলে যেতে থাকে সে। তারপর আর মুখ খোলেনি ঋদ্ধি। পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে সে। অরিত্রি একবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সাড়া দেয়নি ঋদ্ধি। সেও পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

এই কদিনে ঘর সংসারের কোনও পরিবর্তন না হলেও, ঋদ্ধির আচার-ব্যবহারে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে। দেরি করে বাড়ি ফেরে। অরিত্রি না খেয়ে বসে থাকলেও ‘বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি’ বলে হাত-পা ধুয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।

বিমলাদেবী আর সোহমও ঋদ্ধির এই আকস্মিক পরিবর্তনে চিন্তান্বিত হয়ে উঠেছিল। চোখের সামনে ছেলেটা সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে চলেছে। বাড়িতে কারওর সঙ্গে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলছে না। চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

একদিন সন্ধ্যাবেলা কোনও কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে ঋদ্ধি। ফেরা থেকেই ঘর থেকে এক পা বেরোয়নি। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সিগারেটে টান দিয়েই চলেছে। একটা শেষ হলে আরেকটা। সামনে টিভি চালিয়ে বসেছে, কিন্তু একবারের জন্যও সেদিকে তাকিয়ে দেখছে না। যেন অন্য কোনও জগতে রয়েছে।

চোখের সামনে এসব আর দেখতে পারছিল না অরিত্রি। রাগে হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল সে, ‘কী হয়েছে তোমার? আমাকে খোলসা করে বলোতো। আমাকে দেখলে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ কেন? বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি। আমি কি এতটাই অবহেলার পাত্রী? নাকি আমাকে আর পছন্দ হচ্ছে না তোমার?’

টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করল না ঋদ্ধি। তাই দেখে রাগে গা জ্বালা করে উঠল অরিত্রির। কিন্তু তাতেও স্বামীর কোনওরম তাপোত্তাপ নেই দেখে একটু নরম হয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘কী এত ভাবো তুমি? কারণটা আমাকে বলা যায় না? আগে তো এত সিগারেট খেতে না। কী এমন হল বলো না?’ চোখ ছলছল করে উঠল অরিত্রির।

‘তুমি আগেও যেমন সুন্দর ছিলে, এখনও তেমনি সুন্দর আছ। বরং আমিই তোমার যোগ্য নই। সুরজের মতো আমি সুন্দরও নই, অত সুন্দর কথাও বলতে পারি না, আর আকর্ষকও নই।’ কথাগুলো কানে গিয়ে লাগল অরিত্রির।

‘এসব কী বলছ তুমি?’

‘ঠিকই বলছি। তোমাকে আমি আর বেশিদিন ধরে রাখব না। যাতে খুব তাড়াতাড়ি পাকাপাকি ভাবে সুরজের কাছে যেতে পারো, সেই ব্যবস্থাই করছি।’ ঠান্ডা মেজাজে জবাব দিল ঋদ্ধি।

‘তুমি কী পাগল হলে? এসব কী আবোল-তাবোল বকছ তুমি?’ বলেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল অরিত্রি। সে ভালোমতোই বুঝে গিয়েছিল ঋদ্ধির মনে সন্দেহ বাসা বেঁধেছে। সহজে এটা যাওয়ারও নয়।

‘তুমি যেটা মুখ ফুটে বলতে পারোনি, আমি সেই সত্যিটা-ই বলছি। প্লিজ আমাকে ভালোবাসার নাটকটা এবার বন্ধ করো।’ কঠোরভাবেই ঋদ্ধি কথাগুলো বলে গেল।

‘এমন করে কেন বলছ। সুরজ শুধুই আমার পত্রমিত্র। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না। শুধু শুধু সন্দেহ করছ।’ দু-গাল দিয়ে জল বয়ে নেমে এল অরিত্রির।

‘তুমি যতই সাফাই দাও না কেন, আমি জানি তোমাদের সম্পর্কটা কী। স্ত্রীকে পরপুরুষে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছে, এটা কোন স্বামী মেনে নেবে।’ একই ভঙ্গিমায় বলে যাচ্ছিল ঋদ্ধি।

‘তুমি পড়ে দ্যাখো, এগুলো প্রেমপত্র নয়।’ দৌড়ে আলমারি থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিল অরিত্রি।

কিন্তু ঋদ্ধির সেই এক গোঁ। অরিত্রির কোনও কথাই সে শুনবে না। ‘ওগুলো নিজের ভবিষ্যতের জন্য রেখে দাও।’ বলেই চিঠিগুলো অরিত্রির মুখের উপর ছুড়ে মারল।

‘তুমি জানো না ঋদ্ধি, আমাদের সম্পর্ক এই কাগজের চিঠিপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমাকে কী করে বোঝাব।’

‘বোঝানোর আর আছেটা কী? কী বোঝাবে আমাকে? ধরা পড়ে গেছ অরি। এত বোকা ভেব না আমাকে।’ রাগে বিছানা থেকে বালিশটা নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ঋদ্ধি।

কাঁদতে কাঁদতে অরিত্রি আওড়ে যেতে থাকল, ‘তুমি ভুল বুঝছ। ফোটো ছাড়া আমি তাকে কোনওদিন দেখিনি পর্যন্ত, বন্ধুত্ব ছাড়া কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের। প্লিজ ট্রাস্ট মি।’ অরিত্রির পৌনঃপুনিক কাতর স্বীকারোক্তি ঋদ্ধির কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা কে জানে। অনেক রাত পর্যন্ত ওই ভাবেই বসে রইল অরিত্রি। ভোরের দিকে গা এলিয়ে দিল বিছানায়।

পরদিন সাততাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় ঋদ্ধির। অরিত্রি তখনও অবচেতন ভাবে ঘুমিয়ে রয়েছে। প্রায় সাতটা নাগাদ বাড়ির ল্যান্ড ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই কোনওরকমে হাত-পা মুখ ধুয়েই ছোটে রান্নাঘরের দিকে। ব্রেকফাস্ট রেডি করে আনতে আনতেই বেরিয়ে যায় ঋদ্ধি। প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অরিত্রি। ছেলেকে বেরিয়ে যেতে দেখে, ‘কী হল বউমা?’ প্রশ্ন করেন বিমলাদেবী।

‘কিছু না মা।’ লোকানোর চেষ্টা করে অরিত্রি।

‘বাবু না খেয়েই চলে গেল?’

‘তাড়া ছিল তাই…’

‘এত কীসের তাড়া, যে না খেয়ে চলে যেতে হল। বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি তোমাদের দুজনের কিছু একটা হয়েছে। যাই হোক ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ভেবে দেখো’ বলে অন্যত্র চলে গেলেন বিমলাদেবী।

সেইদিন ঋদ্ধি বাড়ি ফিরলও বেশ রাত করে। সকলে অপেক্ষা করছিল তার জন্য।

ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে এল, তখন বিমলাদেবী ছেলেকে পাশে বসিয়ে একপ্রকার চেপে ধরলেন, ‘হ্যাঁরে বাবু আগে তো অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি করতিস না। কদিন ধরে কী হচ্ছে, রোজই দেরি করছিস, ঠিক করে খাচ্ছিস না।’

‘মা, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। তাই দেরি হচ্ছে।’

‘কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে তুই ভালো নেই।’ ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিমলাদেবী।

‘না-না মা। সেরকম কিছু নয়।’ হাসার চেষ্টা করল ঋদ্ধি।

‘জানিস বাবু তুই তো তাড়াহুড়োতে না খেয়ে চলে গেলি। তারপর থেকে মেয়েটা সারাটা দিন কিচ্ছুটি মুখে দিল না।’

‘পতিব্রতা নারীদের মতো?’ কথার মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তীর্যক উক্তি করল সোহম। ছোটোছেলের রসিকতার জন্য বিমলাদেবী তাকে বকাও দিলেন। ওদিকে অরিত্রি লক্ষ্য করল শাশুড়ি বলার পর থেকেই ঋদ্ধি আড়চোখে তাকেই দেখে যাচ্ছে। ভালো করে খাচ্ছে না দেখে এবার শাশুড়িই ছেলেকে খাওয়াতে উদ্যোগী হলেন। হাতে খানিকটা ভাতের দলা তুলে ছেলের মুখে দিতে দিতে বললেন ‘তোর মনে আছে বাবু, ছোটোবেলায় তুই একটা গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতিস। বামুন আর পাঁঠার গল্প। সেই যে বলি দেবে বলে বামুন হাট থেকে একটা স্বাস্থ্যবান পাঁঠা কিনে ফিরছিল। ফেরার পথে একদল দুষ্টু লোক বামুনকে বোকা বানিয়ে পাঁঠা নিয়ে কেটে খাবে বলে তাকে বলল, ‘এমা পুরুতমশাই আপনি একটু কুকুর ঘাড়ে করে কোথায় চললেন?’ বামুন তো একপ্রকার তাদের গালমন্দ করে ভাগিয়ে দিলেন। ‘অন্ধ মুখপোড়ার দল কিছুই কি তোদের চোখে পড়ে না?’

ঋদ্ধি ছেলেমানুষের মতো গল্প শুনতে শুনতে ভাত মুখে পুরতে থাকে। বিমলাদেবী গল্পের জাল বুনতে থাকেন। তারপর আরেকদল ছেলে একই উদ্দেশ্যে বলে, ‘ও পুরুতমশাই এই গাধাটাকে ঘাড়ে নিয়ে কোথায় চললেন?’ এই শুনে পুরোহিত তাদের এই মারে তো সেই মারে। কিন্তু তৃতীয়বার একই উদ্দেশ্যে একদল চাষী যখন বলে ওঠে ‘ও ঠাকুরমশাই ব্রাহ্মণ হয়ে আপনি শেষে কিনা একটা মরা বাছুর ঘাড়ে নিয়ে চললেন’। এবার পুরুতমশাই তাদের কথায় বিশ্বাস করে ওখানেই পাঁঠাটাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। এই গল্পের নীতিবাক্যটা মনে আছে বাবু? সত্যতা যাচাই করে তবেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত। চল উঠে পড় খাওয়া শেষ তোর।’

ঋদ্ধি যেন ঘোর ভেঙে উঠে পড়ল। পরিবেশ হালকা করার জন্য এবার বিমলাদেবী বললেন, ‘তাহলে আজকে একটা সায়গলের গান হয়ে যাক, কী বলিস বাবু।’

অন্যমনস্ক থাকায় হঠাৎই মায়ের কথা শুনে চমকে উঠল ঋদ্ধি। কোনওমতে জবাব দিল, ‘ঠিক আছে।’

ডিনার সেরে ওঠার পর হালকা করে সায়গলের গান চালিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই ঋদ্ধির। হয়তো মানসিক অশান্তিও এর একটা কারণ। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই বিছানায় থাকা বিয়ের অ্যালবামগুলো নজরে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই হাত চলে গেল অ্যালবামগুলোর দিকে। বিছানায় বসে অ্যালবামগুলো হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে ওলটাতে পালটাতে থাকল সে। বিয়ের সেইসব সুখের মুহূর্তগুলো ভেসে উঠল চোখের সামনে। সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমেষে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল।

সমস্ত কাজ গুছিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা স্বামীর পাশে গিয়ে বসল অরিত্রি। ‘বিশ্বাস করো আমার মনে কোনও পাপ নেই। হ্যাঁ পত্রমিত্র-র ব্যাপারটা আমি আগাগোড়াই সহজভাবে নিয়ে এসেছি। এটা নিয়ে কোনওদিন গভীর ভাবে ভাবিইনি। এটাই আমার সব থেকে বড়ো ভুল। প্রতিটি ক্ষণে যার মাসুল গুনছি আমি।’

ঋদ্ধি অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। অরিত্রি বলে চলেছিল তার কথা। ‘আজ সারাদিন ভেবেছি, এই সামান্য একটা ভুলের জন্য আমার সংসারটা আজ ভাঙতে বসেছে। আমার ভালোবাসা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ঠিক করেছি এই কাগজের সম্পর্ক আমি আজই শেষ করব’ বলে সমস্ত চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল অরিত্রি। তারপর একটু এগিয়ে ঋদ্ধির গা ঘেঁষে বসে তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘আমি শুধু তোমার… শুধু তোমার। ভুল বুঝে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ। একটা মুহূর্ত তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি।’

বারবার মায়ের বলা গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। অরিত্রির কথা শুনে জমে থাকা সব অভিমান গলে জল হয়ে গেল ঋদ্ধির। চোখ ছলছল করছিল তার। অরিত্রির হাত দুটো নিজের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে, ‘তুমি জানো না অরি এই কয়েকদিনে তোমার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। প্রতিটি মুহূর্তে ছটফট করেছি। সুরজের প্রতি তোমার অ্যাটেনশন, কথায় কথায় ওর প্রশংসা, মেনে নিতে পারছিলাম না। সুরজের নাম শুনলেও কেমন একটা আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল আমাকে।’ খানিক চুপ করে যায় ঋদ্ধি। অরি-র হাতদুটো আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘জানো ছোটোন যখন তোমার চিঠিটা লুকিয়ে আমাকে দিতে এল, তখন লজ্জায় ওর চোখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারিনি। শুধু মনে হয়েছে ওরা তোমাকে কত ছোটো নজরে দেখছে। তোমার চরিত্র নিয়ে… বিশ্বাস করো তোমাকে কেউ ছোটো করুক সে আমি চাইনি।’ মাথা হেঁট করে নেয় ঋদ্ধি।

স্বামীকে কাছে টেনে নেয় অরিত্রি। ‘দুঃস্বপ্ন ভেবে সব ভুলে যাও। দেখো আমরা খুব সুখী হব।’ একে-অপরের খুব অন্তরঙ্গ হয়ে আসে ওরা। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। তখনও দুজনের চোখে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে সুদূর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছে।

 

রুনার আকাশ

এক

আমার ঠাকুরদার নাম হরিহর। হরিহর গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের বাড়িতে ঠাকুরদার কোনও ছবি নেই। কেন নেই কে জানে! সে আমলেও তো ভালো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি তোলা হতো।

এইসব প্রশ্ন রুনা আমাকে করে। রুনা মানে আমার মাস তিনেকের বিয়ে করা নতুন বউ। ঠাকুমার কাছে শুনেছি দেশের বাড়ি তৈরির সময় টাটা স্টিলের লোহার বিম, এক মাইল রাস্তা ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন গাঙ্গুলিমশাই। এসব কথা রুনা অবাক হয়ে শোনে। গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে,

– তুমি পারো?

– আমি? অবাক না হয়ে পারি না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সদ্য বিয়ে করা বউকে অবাক হয়ে দেখা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি!

সেই শুরু। এরপর থেকে গাঙ্গুলিমশাই থেকেই গেলেন। আমার আর রুনার মধ্যে ছোট্ট হাইফেনের মতো। আমাদের শয়নে, স্বপনে, আহারে, বিহারে এবং সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যেও।

একটা উদাহরণ দিলে সহজবোধ্য হবে ব্যাপারটা। নাইট শো’তে সিনেমায় গেছি আমরা দুজন। এলাকার প্রেস্টিজিয়াস এসি হল ‘মৌলি’তে। রুনার হাতে আমার হাত। আর স্বাধীনতা পেলে কী করতে পারে আমার হাত সে ভালোমতো জানা আছে। রুনাও সম্ভবত তেমনই কোনও প্রত্যাশায় কাঁপছে ভিতরে ভিতরে। স্ক্রিনে তখন ভালোই চলছে ‘মিস লাভলি’র নীরব অভিসার। আমাদেরও। হলের অন্ধকার ও নৈঃশব্দ্যে। হঠাৎ এক দৃশ্যে এক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ। ওই যেমন হয় আরকি, নায়ক কি নায়িকার দাদু বা অন্য কেউ। বুঝতে পারলাম ছটফটিয়ে উঠল রুনা।

হাতের মধ্যে ধরে থাকা ওর হাত না ছেড়েই জিজ্ঞেস করলাম,

– কী হল রুনা?

আর কিছু বলবার দরকার ছিল না। কানের পাশেই ফিসফিসিয়ে উঠল রুনা

– দাদু থাকলে খুব ভালো হতো, না গো!

বিশ্বসংসার তখন লুপ্ত আমার সামনে। স্ক্রিন ডাহা ফাঁকা। গান-গল্প বিষ লাগছে সব। নায়ক-নায়িকার চূড়ান্ত প্রেমও কেমন অভব্য লাগছে পর্দায়। অথচ ঠিক আমার পাশেই সেই মুখ, ঠোঁট আর পহলগাঁওয়ের পথের পাশের কাশ্মীরি আপেলের মতো টুকটুকে গাল। ওই গালে ঠোঁট ছোঁয়ানো যায় শুধু। হাত তোলা কক্ষনো নয়।

বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর ঘরে চার দেয়ালের নির্জনে রুনাকে একেবারে নিজের করে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– আচ্ছা রুন, দাদুর কথাটা এবার থেকে একটু কম বলা যায় না কি?

রাতে বিছানায় উঠে আসবার আগে কন্ঠার কাছটায়, চোখের তলায় ক্রিম ঘষে রুনা। ফরাসি ক্রিম। ওরিগন। দশ মিলি সাড়ে সাতশো টাকা। ওর মাসির বাড়ি থেকে দিয়েছে। মামুলি প্রাইভেট ফার্মের কর্মচারী, আমার এসব সাধ্যের বাইরে।

ঠিক এই একটি কারণে রুনার বাবা শুভ্রজ্যোতিবাবুর, মেয়ের পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও আমার নামের পাশে বিরাট এক ঢ্যারা মেরে দিতে প্রথমে একটুও দ্বিধা হয়নি। বড়ো চাটার্ড ফার্ম ‘মুখার্জি অ্যান্ড সরকার’-এর সিনিয়র পার্টনার মুখার্জি সাহেবের ছোটো মেয়ে রুনা। কীভাবে যে কলেজ সোশ্যালে আমার গলায় ‘রামধনু মন’ শুনে মজল, উঁহু শুধু মজল না গলা পর্যন্ত ডুবল, সেটাই এক রহস্য। আমার কাছে। মুখার্জি সাহেবের কাছে তো বটেই।

সেই রুনা এবং আশ্চর্য এক মায়াবী সুগন্ধ এখন উড়ে বেড়াচ্ছে আমার মুখের আশপাশে। ওর গলায় মুখার্জি দম্পতির দেওয়া পার্ল-এর হার লকেটসমেত। দোল খাচ্ছে আমার চোখের সামনে। আলতো করে জিভ দিয়ে সেই লকেট স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে ফেলি। তবুও সেই অবস্থায়ই জিজ্ঞেস করি,

– কী হল, কিছু বললে না যে?

আমার নাকে নিজের নাক দিয়ে ঘষতে ঘষতে রুনা হাসল। ঘরের আলোআঁধারিতে সেই সংক্রামক হাসি কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে কোনও পুরুষকে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। যুগ যুগ ধরে শুধু তথ্যই আহরিত হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে– আর কিছু নয়। বাস্তবে সেই অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারাই শুধু জানে।

– আচ্ছা, তুমি কেমন মানুষ গো! যে-মানুষটার কোনও ছবিই নেই বাড়িতে, তাকে তোমার এত হিংসে কেন? আমাকে নিজের শরীরের নীচে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে দখলদারিত্ব দেখিয়ে বলল রুনা।

এই সুমধুর সময়ে, যখন নাইটির পাতলা আড়াল ছাড়া রুনার পাখির মতো হালকা নরম শরীরটা সম্পূর্ণ আমারই অধিকারে এবং সেই শরীরের সর্বত্র চলে বেড়াচ্ছে আমার চঞ্চল হাত, তখন এসব কথা জিজ্ঞেস করে কোন মূর্খ? তবু একবার প্রায় জড়িয়ে আসা গলায় বলবার চেষ্টা করলাম,

– উঁ…উঁ… হিংসের কথা উঠছে কেন?

– ন্– না– এসব কথা থাক এখন। বুকের উপর অহংকারী মরালীর মতো শরীর ছেড়ে রাখা রুনা, ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিল। অগত্যা আমাকে চুপ করতেই হল।

দুই

রমেনের বাবা জীবনকাকু মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার। শুধু কমিশনার বললে ভুল হবে। রীতিমতো বাঘ আর গরুকেএকঘাটে জল খাওয়ানোর এলেমধারী বলতে যা বোঝায় জীবন রায় ঠিক তাই-ই।

ওঁকে বাদ দিয়ে মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান দিনে অন্ধকার দেখেন আর রাতে চোখে তারাবাজি। সেই জীবনকাকু আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির আঠাশ নম্বর ওয়ার্ডের। এই ওয়ার্ডেই আবার এলাকার সবচেয়ে বড়ো মার্কেটিং কমপ্লেক্স ‘উত্তরায়ণ’। কেন ‘উত্তরায়ণ’ কেন ‘দক্ষিণায়ন’ নয় এসব জটিল কথার জবাব কাকুকে জিজ্ঞেস করলে সুন্দর দাঁতের প্রদর্শনী দেখান। তারপর হাত একটু কাত করেন উপর দিকে। অর্থাৎ চেয়ারম্যান জানতে পারেন কিংবা আর একটু উপরের, সব চেয়ারম্যানের লর্ড স্বয়ং ভগবান।

এই মানুষটির ছেলে রমেন আমার বন্ধু। সেই পাঠশালার দিনগুলো থেকে। তারপর সেন্ট জন্স এইচ এস স্কুল হয়ে কলেজ পর্যন্ত। সেই রমেন। রমেন রায়। তার ফুলশয্যা। আটশো থেকে হাজার লোকের অ্যারেঞ্জমেন্ট। মিছিলের মতো একদল ঢুকছে ‘কুশন্ডিকা’ লজে আর একদল বেরিয়ে আসছে। বাজারের যত কসাই আর মাছওয়ালাদের দেখলাম। সবাই বেশ ওদের স্বাভাবিক ড্রেস লুঙ্গি, গেঞ্জি আর রক্তমাংস মাখা ফতুয়া ছাড়াই সেজেগুজে এসেছে। অনেকের চোখে আবার সুরমা টানাও দেখলাম।

রুনা আর আমিও এসেছি খুব সেজেগুজে। হালকা নীল ফুলস্লিভ ব্র্যান্ডেড শার্ট পরেছি। ‘আবু জানি’র এই শার্ট শীতের তত্ত্বে দিয়ে পাঠিয়েছেন আমার শাশুড়ি মা। এসব কি গরিব জামাইকে কিছু শেখানোর জন্য? কে জানে? পরবার জন্য শার্ট এসেছে পরেছি। তার সঙ্গে মানানসই ট্রাউজার। কোটের বাটনহোল-এ লালগোলাপ সামান্য মাথা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে আমার স্বাতন্ত্র্য।

আর রুনা যা সেজেছে আজ দেবতারাও মনে হচ্ছে স্বর্গের ব্যালকনিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে দেখছেন ওকে। বাঙ্গালোর সিল্ক-এর উপর বিয়েবাড়ির আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে যেন। রামধনু-রঙা চোলি, ঠিক ব্যাকলেস নয় আবার তা বলাও যায়। অদ্ভুত এক রঙিন কাটাকুটি খেলায় মেতেছে পিঠের দিকটা।

নিজের বউকে এইসব সময়েই অন্য কারওর বলে মনে হয়। গলা থেকে অনায়াসে ঝুলছে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া মুক্তোর হার। কানে ম্যাচিং দুল। যেন ইশারায় ডাক পাঠাচ্ছে, ‘আয় আয় ছুঁয়ে যা’। হাতে সুগন্ধি ডোকরা প্রিন্টেড রুমাল। দেখেশুনে কার ফুলশয্যা হচ্ছে আমার না রমেনের বোঝা দায়।

কাজের বাড়িতে জীবনকাকু কারওর কোনও অসুবিধার জায়গাই রাখেননি। আদর-আপ্যায়ন, কফি, পকোড়া এবং অবশ্যই মাটনের সঙ্গে বিবিধ মাছের প্রিপারেশন (ইলিশ, চিংড়ি আর ভেটকি)।  খাওয়াদাওয়া শেষ করে সকলে ধন্য ধন্য করতে করতে বেরিয়ে আসছে। ঘড়িতে রাত বারোটা। খাওয়াদাওয়ার পর সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে রমেন আর পর্ণাকে ঘরে ঢুকিয়ে তবে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আমাদেরও ছুটি।

এত রাতে আবার বাড়ি ফেরা কেন রমেনদের বাড়ির সকলেই সেকথা জিজ্ঞেস করছিল। রুনা হেসে সকলকে বিদায় জানাল। হাসলে যে ওকে এত সুন্দর লাগে একান্নতম বার সেই সত্যটা আবিষ্কার করলাম একেবারে ওর পাশে দাঁড়িয়ে।

রমেনের বাবা ঘাড় ফিরিয়ে কাকে যেন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে বললেন আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য। তারপর কাজের বাড়িতে যা হয়। আরও গুরুতর কোনও কাজের তাড়ায় আমাদেরটা অনায়াসে হারিয়ে গেল।

অগত্যা শুধু আমরা দুজনে রাস্তায় নেমে এলাম। পিছন ফিরে একবার আলোয় ঝলমলে লজটার দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা জাহাজের মতো মনে হল। টাইটানিক নাকি রে বাবা! মজা পেলাম খুব। বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম রমেনের উদ্দেশে আমাদের যৌথ শুভেচ্ছাবাণী– ভাস রমেন, ভেসে যা ওই অথৈ সমুদ্রে!

সামনের দিকে রাস্তা পড়ে আছে রাস্তারই মতো শুনসান। অনুষ্ঠান বাড়ির গাড়িগুলো তীরবেগে ছুটে চলে যাবার পরই রাস্তা আবারও শুনসান। একটু তফাতে তফাতে হ্যালোজেন ল্যাম্পের আলো অন্ধকারের পরিধি কমিয়েছে কেবল। আলো আর অন্ধকারের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলতে খেলতে কখন যে বেশ খানিকটা ফাঁকা রাস্তা ফেলে এগিয়ে এসেছি আমরা দুজনে একটুও বুঝতে পারিনি।

এমন ফাঁকা রাস্তায় আমার রুন-কে একলা পাবার আনন্দে মন গুনগুনিয়ে উঠল। চট করে ওর পাশে গিয়ে ডানহাত দিয়ে বেড় দিয়ে নিলাম ওর মোম আর মেদ দিয়ে তৈরি মসৃণ কোমরটাকে। নীচু হয়ে সেই কোমরে সবে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছি, এমন সময় যেন পায়ের আওয়াজ পেলাম পিছনে।

চমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। কেউ কোথাও নেই। রাস্তা যেই কে সেই। একেবারে ফাঁকা। কেবল দূরে দূরে একটি দুটি কুকুর। সন্দেহজনক চোখে দেখছে আমাদের। উপযুক্ত পরিচালকের হাতে পড়লে এই সিন মারকাটারি হয়ে উঠতে পারে। এই স্তব্ধতা, এই নির্জন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ধোঁয়া ধোঁয়া আচ্ছন্নতা। তার সঙ্গে বিমূঢ় নায়ক-নায়িকা। ফ্যানটাস্টিক!

মাথার মধ্যে কোনও প্রতিবর্তী সংকেত পাবার আগেই রুনার ভয়ার্ত গলা শুনতে পেলাম,

– একটা লোক!

স্বর্গ থেকে যেন পতন হল আমার,

– কই– কোথায়?

– পিছনে। বলতে বলতে আমার শরীরে সেঁধিয়ে এল রুনা। আহ্ রুন, আমার রুনি! ওকে শক্ত করে এক হাতে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে পিছনে তাকালাম। কোনও তারতম্য নেই। নির্জন রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টের আলো শুষে নিচ্ছে নিঃশব্দে।

– ধুস্ – ভুল দেখেছ। বিয়েবাড়িরই কেউ হবে হয়তো।

রুনাকে সাহস দিতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল আমার। এত রাতে বেমক্বা রাস্তায় নেমে পড়বার কী খেসারত দিতে হবে কে জানে। কোনও অটো কিংবা অন্য যানবাহনও তো নজরে পড়ছে না। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো!

যাই হোক, এই পরিস্থিতি থেকে তো বেরোনোর চেষ্টা করতেই হবে। সঙ্গে আবার রুনাও রয়েছে। আমার যা হবার হোক। কিন্তু রুন– আমার রুন যেন নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে। কপালে বিন্ বিন্ করে ঘাম ফুটছে টের পেলাম।

আমার এমন প্রায়-অপ্সরা বউয়ের স্পর্শও নিশ্চিন্ত করতে পারল না একটুও। একবার মনে হল পায়ের আওয়াজ পেলাম পাশেই। চমকে তাকালাম। কেউ না। কিছু না। অথচ নিশ্চিতভাবেই পায়ের শব্দ। নির্ঘাত বদ মতলবেই লুকিয়েচুরিয়ে কেউ আসছে পিছু পিছু।

চিন্তাটা মাথায় আসতেই কেঁপে উঠলাম। মনে মনে খুব ধমকাতে লাগলাম নিজেকে। কেন যে অনুষ্ঠান বাড়ির বাইরে ওদেরই বাড়ির দু’চারজন ছোকরা যারা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রাস্তার অগুনতি সুন্দরীদের ঝাড়ি করছিল ফ্রাঙ্কো নিরো কি চার্লস ব্রনসন স্টাইলে, তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এলাম না। আপশোশ হচ্ছিল খুব। রুনার সুগন্ধি কানের লতির পাশে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললাম,

– আর দেরি নয়। এবার দৌড় দিতে হবে।

রুনা হয়তো বলতও কিছু কিন্তু আমার হাতে বাঁধা পড়েছে ওর হাত। কুসুমকোমল যাকে বলে। সেই হাতে টান পড়ল। শুরু হল আমাদের সম্মিলিত দৌড়। রেডি-স্টেডি-গো।

পাশে পড়ে রইল ‘কমলা স্টোর্স’, ‘হিরন্ময় জুয়েলারি হাউস’। ঘাড় ফিরিয়ে আবার কাউকে দেখতে হবে, এখন আর এমন ভয় করি না। শক্ত করে রুনার হাত ধরে কাছে টানলাম ওকে। বললাম,

– এলাকায় এসে গেছি। আর কোনও ভয় নেই।

আস্তে আস্তে দুই পরাজিত সৈনিকের মতো বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। পিছনে আর কোনও পায়ের শব্দ নেই। ওই তো সামনে হলুদ গেটওয়ালা অনিরুদ্ধ সিনহার বাড়ি। সিনহাদা’র পরই আমাদের সাতাশ’এর দুই, চণ্ডীতলা রোড-এর আস্তানা। বারান্দার আলো এখান থেকেও নজরে পড়ে বেশ।

তিন

রাতের ব্যাপারটাকে মনে মনে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না। তা নইলে রুনাকে কি আর অমন করে কাছে পেতাম কোনওদিন। একেবারে সর্বস্ব নিয়ে কাছে আসা বোধহয় একেই বলে।

ভোর সত্যিই যে কত মনোরম হতে পারে এমন ঘোরতর কোনও রাত না কাটলে তা বোঝা যেত না। রাতে ঘরের তালা খুলে কখন ঢুকলাম, কখন অনুষ্ঠানবাড়ির পোশাক ছেড়ে আবার বিছানার পোশাকে ফিরলাম এসব এই ভোরে আর মনে করতে ইচ্ছা হল না।

শেষরাতে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙেছে এটুকুই শুধু মনে করতে পারলাম। রুনার মোবাইলে সুন্দর সুরেলা আওয়াজ। হাত বাড়াতে ইচ্ছা করছিল না বলে ধরিনি। তার থেকে ঘুমন্ত রুনার কবিতার মতো ঠোঁটদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশি ভালো লাগছিল।

বসে বসে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, আবার ক্রিং ক্রিং… এবার ল্যান্ডলাইনে।

হাত গেল। রুনারই পছন্দ করা প্রিয়দর্শিনী রিসিভার উঠে এল হাতে। কোনও কথা না বলে শুধু ‘শুনলাম’ বলাই ভালো।

– হ্যালো রুনা, আমি আকাশ।

কেবল ‘হুঁ’ দিয়ে গেলাম। কে আকাশ, কী বৃত্তান্ত সেসব কথা এই ভোরের রাজেন্দ্রাণী উঠে জানাবে আমায়।

অফিস বেরোবার সময় শুধু আমার রুনের স্বপ্নালু চোখ দুটিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম,

– আকাশের ফোন এসেছিল।

– ওমা, সত্যি! কখন গো?

এত উচ্ছ্বাস ঝ’রে পড়ল রুনার গলায় যে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না,

– কে আকাশ?

– সেকি তুমি আকাশকে চেনো না! রুনার চোখ গোল হয়ে গেল। যেন আকাশ রবিশংকরজি কিংবা রোনাল্ডো যে তাকে চিনতেই হবে। আরও হয়তো কথা বলতাম কিন্তু হাতের ঘড়ি এক মারাত্মক যন্ত্র। ঘাড় ধাক্বা দিয়ে অফিসে তাড়িয়ে নিয়ে গেল আমায়। বিয়ের পর এই কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবার দুপুরে আর বাড়িতে ফোন করলাম না।

সন্ধের একটু পরে অটো থেকে নেমে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতেই শুনতে পেলাম ড্রইংরুম থেকে ভেসে আসা রুনার হাসির শব্দ।

পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ালাম। সোফায় বসা রুনা তাকাল। অত্যন্ত রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে এলিয়ে বসে আছে সোফায়। শরীরের আঁচল নামক বস্তুটি অজান্তে কিংবা স্বজ্ঞানেই কখন প’ড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেয়। আর সেই শরীরের প্রখর তাপে দগ্ধ হয়ে চলেছে রুনার পায়ের কাছে ভক্তের মতো বসে থাকা এক ঝাঁকড়া চুলের ছোকরা। গায়ে অসংখ্য তারা আঁকা ‘গোয়া’ লেখা টি-শার্ট আর পরনে ডেনিম।

আমাকে দেখে হই হই করে উঠল রুনা,

– দ্যাখো কে এসেছে! আরে এ-ই তো আকাশ। আকাশ ঘোষদস্তিদার। ফেমাস আর্টিস্ট। আসলে, ঠাকুরদার একটা ছবি আঁকানোর ব্যাপারে –

ছোকরা কথার মধ্যেই তার মুগ্ধ চোখদুটি আমার দিকে ফেরাল। আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না। পর্দা ছেড়ে সিঁড়িতে বেশ কয়েকধাপ উঠে গেলাম তাড়াতাড়ি।

‘গাঙ্গুলিমশাই’-এর ছবি যে আঁকা হবেই, সেটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হল না আর।

 

ভালোবাসার মূল্য

আজকাল শহরে মহিলা-পার্টির বেশ একটা চল হয়েছে। পার্টির নামে এর বাড়ি-তার বাড়িতে দশ-বারোজন একত্রিত হও, আর জমিয়ে পিএনপিসি চালিয়ে যাও। এতে শরীর স্বাস্থ্য দুই-ই নাকি ভালো থাকে। এরকমই এক সান্ধ্যপার্টিতে যাওয়ার জন্য এস্টেট-এর মহিলামণ্ডলী সবেমাত্র বড়ো গেটের সামনে জড়ো হয়েছে। সেখান থেকেই তারা একত্রিত হয়ে পার্টির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। এমন সময় পিউ আর তার মাকে পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে, মহিলামণ্ডলীর-ই এক সদস্যা রীতা বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠল, ‘আরে দ্যাখ দ্যাখ, সুন্দরীকে দ্যাখ! রোজ নিত্যনতুন পোশাক পরে পাড়ায় প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।’

মহিলামণ্ডলীর আর এক সদস্যা শ্বেতা একপ্রকার কথা কেড়ে নিয়ে উঠে বলে, ‘আরে ধুর শুধু মেয়ে কেন? মাকে দ্যাখো না। আপাদমস্তক পরিবর্তনের ঝড়। বছর চারেক আগেও যে পাড়ার লোকের জামাকাপড় সেলাই করে কোনওমতে একবেলার অন্নের সংস্থান করত, আজ তার পরনে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক। ভাবা যায়! ভগবান জানে কোথা থেকে এত টাকাপয়সা এল এদের হাতে !’

‘আরে বাবা, যা একখানা মালদার পার্টি ধরেছে না! বাপ-কাকার বয়সি বিবাহিত পুরুষ হলে কী হবে, অঢেল টাকার মালিক তো বটে। অবশ্য এর জন্য কুমারজিকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। সবসময় কোনও মেয়ে যদি ঢলে ঢলে গায়ে পড়ে তাহলে সে-ই বা কী করে। আখেরে সেও তো পুরুষই।’ প্রত্যুত্তরে রীমা বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথাগুলি বলছিল।

কথাগুলি শুনতে শুনতে আর-এক সদস্যা বেশ আশ্চর্য হয়েই রীমাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই কি আমাদের কুমারজির কথা বলছিস? মেইন রোডের ওধারেই যার বাড়ি? যার দুই ছেলে? এক ছেলের নাম সোহম?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওনার কথাই বলছি। জয়পুরে যাদের প্রচুর সম্পত্তি আছে৷ ভদ্রলোকের স্ত্রী ভীষণ শান্ত স্বভাবের। তার সরলতার সুযোগ নিয়েই এই মেয়েটি যথেচ্ছাচার করছে। এমন অঙ্গভঙ্গি করে যে হিরোইনরাও মাত হয়ে যাবে তার কাছে। বাপরে বাপ, বাপের জন্মে এইরকম মেয়ে দেখিনি।’ সুর টেনে টেনে বলতে থাকে রীমা।

রীতা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ থাকা বোধহয় তার কোষ্ঠীতে লেখা নেই, তাও আবার এরকম একটা মুখরোচক চটপটা প্রসঙ্গে। হঠাৎই নীরবতা ভেঙে বলে উঠল, ‘সত্যিই তো, মউমাছির মতো কেউ যদি সারাক্ষণ চারপাশে ভনভনিয়ে উড়তে থাকে, তাহলে কুমারজিই বা কী করে বল তো! আমি তো দেখেছি কখনও পড়ার নামে, কখনও কখনও শ্রুতিকে বাড়ির কাজে সাহায্যের নামে আবার কখনও কুমারজির সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্কের টানে ওদের বাড়িতে পড়ে থাকে।’

‘রীতাদি তুমি কি আজকাল গোয়েন্দাগিরি করছ নাকি? তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল অদিতি।

‘আরে নারে গোয়েন্দাগিরি করব কেন কিন্তু যদি চোখের সামনে কিছু দেখতে পাই, সেটাও তো না দেখে থাকা যায় না বল। কুমারজির বড়ো ছেলে সোহম আর আমার ছেলে একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ে। ওদের অঙ্কের টিচার হরিশবাবু ওনাদের বাড়িতে দুজনকে একসঙ্গেই পড়ান। ছেলেকে  পৌঁছে দিতে আর নিতে যাওয়ার সূত্রেই ওনাদের বাড়িতে যাতায়াত। এই আর কী!’ সাফাই দিতেই এই সমস্ত কথাগুলো অদিতির উদ্দেশ্যে বলে রীতা।

এমন সময় আর-এক সদস্যা একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, ‘ছাড়ো না বাবা, তোমরাও সব কী টপিক নিয়ে পড়লে। শুধু শুধু কাদা ঘেঁটে লাভ আছে? বরং তাড়াতাড়ি পার্টিতে চলো জমিয়ে মজা করি।’

আজকাল পিউ আর এই সমস্ত কথাবার্তা গায়ে মাখে না। বিগত চার বছর ধরে পাড়াপড়শির এই ধরনের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভালোবাসায় পেশাদার মনোভাব চলে এলেও, প্রথম প্রথম সেটা কিন্তু আন্তরিকই ছিল।

বছর চারেক আগেকার কথা। পিউ তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বাবা নেই, মা সারাদিন সেলাই-ফোঁড়াই করে সংসারটা কোনওমতে টানার চেষ্টা করছে। তাতে কী আর সংসার চলে। তার উপর আবার তার পড়াশোনা। বাড়ির আর্থিক সংকট কিছুটা হলেও লাঘব করার জন্য একদিন পিউ ছুটে গিয়েছিল কুমারজির কাছে। যদি ওনার কিউরিও শপ-এ সেলস্গার্ল-এর চাকরি পাওয়া যায়।

সেদিন তার ছুটে যাওয়া বিফলে যায়নি। মিষ্টভাষিনী মেয়েটিকে ফেরাতে পারেননি কুমারজি। তার ইচ্ছেমতোই দোকানে সেলস্গার্ল-এর কাজে নিয়োগ করেছিলেন তাকে। কলেজের পরে বাকি সময়ের বেশিরভাগটাই দোকানে মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করত পিউ। কুমারজিও দোকানেই উপস্থিত থাকতেন। কাজের প্রতি পিউ-এর একাগ্রতা কুমারজির বেশ ভালোই লাগত। এমনিতেই কুমারজি একটু নরম মনের মানুষ, তার উপর কেয়ারিংও বটে। পিউয়ের চোখেমুখে কোনওরকম চিন্তার ভাঁজ দেখলেই তার কাছে ছুটে গিয়ে তার কারণ জেনে সেই সমস্যার সমাধান করাই যেন তাঁর অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকী পড়তে পড়তে কিছু না বুঝতে পারলে, সেটা বোঝানোর দায়িত্বও তাঁর উপরই বর্তাত। জ্ঞানে-অজ্ঞানে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা না-বলা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

দেখতে দেখতে এইভাবে মাস ছয়েক কেটে গেল। সবই আগের মতোই ঠিকঠাক চলছিল। এরই মাঝে পিউয়ের চার-পাঁচ দিন দোকানে না আসার ব্যাপারটাই যেন তাদের সহজ-সরল সম্পর্কটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। পিউয়ের না আসার ব্যাপারটা কুমারজি কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিলেন না। মনের কোণে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধছিল। অবশেষে চতুর্থ দিন আর থাকতে না পেরে কুমারজি সোজা চলে গিয়েছিলেন পিউদের বাড়িতে। পিউয়ের মা বেশ অবাকই হয়েছিল সেদিন– মালিক এসে পৌঁছেছে এক অতি নগণ্য তুচ্ছ কর্মচারীর বাড়িতে তার খোঁজ নিতে! সত্যি বলতে কী পিউও একটু অবাকই হয়েছিল কুমারজির এহেন আচরণে। হয়তো পিউও বুঝতে পারছিল সবার অনবধানে সে কুমারজির জীবনের একটা অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।

কুমারজির প্রশ্নের সহানুভূতিপূর্ণ স্পর্শে চোখ জলে ভরে গিয়েছিল পিউয়ের। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘বাবা অসুস্থ, খাবার পয়সা নেই, তার উপর আমার পড়াশোনাটাও বন্ধ হয়ে যাবে। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। কী করব বুঝতে পারছি না। তাই…’

সেইদিন বাবার মতোই হোক বা অন্য কোনও সম্পর্কের সূত্রে, পিউয়ের মাথায় হাত রেখে কুমারজি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘তুই চিন্তা করছিস কেন? আমি তো আছি! পড়া চালিয়ে যা, তোর পড়ার খরচ আমি দেব।’

সেখান থেকেই পিউ আর কুমারজির সম্পর্কটা একটা গভীরতা পেতে শুরু করে। যে-মানুষটার জন্য তার চাকরি পাওয়া, পড়াশোনা করা, বাড়ির সকলের পেটের জোগান, সেই মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতা জন্মানোটাই বোধহয় স্বাভাবিক। আর সেই কৃতজ্ঞতার স্বাভাবিক বোধটাই ধীরে ধীরে পিউয়ের মনে ভালোবাসার আকার নেয়। পিউয়ের কাছে কুমারজি তখন ভগবানতুল্য, সুযোগ পেলে তাঁর পায়ে নিজেকে সমর্পণ করতেও বোধহয় সেদিন সে দ্বিধাবোধ করত না। শয়নে-স্বপনে কুমারজি আর কুমারজি। সবসময় কুমারজির চোখের সামনে ঘুরঘুর করা, নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা, কুমারজির পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরা, এই ছিল যেন তার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

একদিন কুমারজিরই এক বান্ধবী হঠাৎই কিছু কেনাকাটার জন্য দোকানে এসে হাজির। বান্ধবীটি প্রকৃত অর্থেই সুন্দরী, একেবারে ডানাকাটা পরি। যাইহোক, বহুদিন পরে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা আর তারপর অনেকদিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হলে যা হয় আর কী। দুজনে পাশাপাশি বসে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন চলল বেশ কিছুক্ষণ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সমস্ত কিছুই লক্ষ্য করছিল পিউ। এভাবে হেসে হেসে কুমারজির অন্য কারওর সঙ্গে কথা বলাটা একেবারেই মন থেকে মানতে পারছিল না। মনে মনে জ্বলে উঠছিল সে।

বান্ধবীটি চলে যাওয়া মাত্রই পিউ হন্তদন্ত হয়ে কুমারজির একেবারে কাছে গিয়ে বলল, ‘এটা একদম ঠিক নয়।’

হঠাৎই পিউয়ের এহেন আচরণে কুমারজি হতভম্ব হয়ে উঠে বলেন, ‘কী ঠিক নয়?’

‘আমি ছাড়া তুমি অন্য কারও সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারো না।’ পিউ বেশ অধিকারের সঙ্গেই কথাগুলি বলে ওঠে।

‘কী বলছিসটা কী?’ কথাটা বলতে বলতেই কুমারজি লক্ষ্য করছিলেন, পিউয়ের চোখে শধু অভিযোগই নয়, কোথাও যেন একটা ভালোবাসার আবেদন রয়েছে।এক মুহূর্ত চুপ থেকে খুব আস্তে আস্তে কুমারজি বলেন, ‘কেন, তোর খারাপ লেগেছে?’

‘হ্যাঁ, খুব বাজে লেগেছে। তুমি আর কারও সঙ্গে কথা বলবে না। তুমি শুধু আমার।’ চোখভরা জলে কথাগুলো বলতে বলতেই সেদিন পিউ একেবারে জাপটে ধরেছিল কুমারজিকে।

এহেন পরিস্থিতির জন্য কুমারজি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু পিউয়ের নিখাদ ভালোবাসাকেও সেদিন ফেরাতে পারেননি কুমারজি। পিউয়ের হাতের বন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ থেকে শুধু এটুকুই বলেছিলেন, ‘একেবারে পাগলি। তুই তো জানিস আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আর আমি আমার বউকে ভীষণ ভালোবাসি, এসব জেনেও…।’

‘জানি তুমি বিবাহিত। তুমি তোমার বউকে খুব ভালোবাসো। আমি তো তোমাকে বলিনি যে, তুমি তোমার বউকে ছেড়ে আমার কাছে চলে এসো। আমি শুধু তোমাকে এইটুকু বলেছি যে, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। ব্যস এটাই সত্যি।’

‘ঠিক আছে বাবা আর এরকম কাজ করব না। হয়েছে?’ বলেই পিউকে সমস্ত আবেগ দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন কুমারজি।

প্রেমের এই প্রথম স্পর্শে দুজনের শরীর-মনে যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে শুরু হওয়া সেই সম্পর্ক সময়ের স্রোতে এগিয়ে গেছে। দূরে থাকলে সবসময় একে-অপরকে এসএমএস পাঠানো আর কাছে থাকলে সারাক্ষণ চোখে চোখে দুজনের কথা বিনিময়। সময়ে-অসময়ে এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গঙ্গার ধারে কাটানো, পিউয়ের পছন্দের জিনিসপত্র কিনতে নিউমার্কেটে যাওয়া।

না চাইতেই সমস্ত কিছু পেয়ে পেয়ে পিউয়ের চাহিদার প্রত্যাশা দিনের পর দিন বেড়েই চলল। আর পিউকে সেই প্রত্যাশার দিকে ঠেলে দেওয়ার ব্যাপারে পিউয়ের মায়ের অবদানও কম নয়। পিউকে মাধ্যম করে কুমারজির থেকে টাকা আত্মসাৎ করাটাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। যার জন্য কুমারজির দিকে মেয়েকে এগিয়ে দিতে তিনি একবারও ভাবেননি। মেয়েটিও ভালোবাসার সারল্যে, কিছু চাওয়ার হলেই কুমারজির উপর জোর খাটায়। আজ সোনার চেন তো কাল কানের দুল– বায়নার শেষ নেই। এই করে করে কুমারজির আয়ের বেশ কিছু অংশ পিউয়ের আবদার মেটাতেই চলে যেত। খরচে কুমারজির বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধও ছিল না। কারণ তিনি সত্যই পিউকে মন থেকে ভালোবাসতেন। সেই কারণেই হয়তো ভাবতেন পিউয়ের সখসাধ মেটানো তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

প্রথমে বেশ কিছুদিন সম্পর্কটা বেশ মিষ্টি-মধুর আবেগপূর্ণ ছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলেছে। পিউ তার পড়াশোনা কমপ্লিট করেছে। সঙ্গে বদলেছে তার চিন্তাভাবনা, মানসিকতা। আগে যা কিছু করত হয় আবেগে, নয় তো ভালোবাসার টানে। এখন সমস্ত কিছুই মাথা খাটিয়ে চিন্তাভাবনা করে পা ফেলা। এখন তার এতটুকুও বোধগম্য হতে বাকি নেই যে, কুমারজিকে সে কোনওদিনই নিজের করে পাবে না।কারণ তাঁর স্ত্রী-সন্তান আছে এবং তিনি তাদের যথেষ্ট ভালোওবাসেন। তাদের ছেড়ে তিনি কোনওদিন বেরিয়ে আসবেন না তার হাত ধরার জন্য।

সুতরাং তাদের সম্পর্ক রাখতে হলে সারাজীবনই এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে তা লালন করে যেতে হবে তাকে। কোনওদিনই বাড়ির বউয়ের মর্যাদা পাবে না। শুধু তাই কেন, পিউ এটাও ভালোভাবেই জানত যে, তার আর কুমারজির মধ্যে বয়সের ব্যবধানও যথেষ্ট। বিয়ে করলেও তাদের বিবাহিতজীবন বেশিদিন সুখের হওয়ার নয়। অতএব যতদিন না মনের মতো একজন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়, ততদিনই এই সম্পর্কের আয়ু। ততদিন কুমারজি তার মানসিক আর আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর একটি মাধ্যম মাত্র। আগে বেশ কয়েকবার কুমারজির আবদার মেটাতে বা ভালোবাসার টানে তারা সঙ্গমেও লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু এখন সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া মানেই পিউয়ের বড়ো দাঁও মারার সুযোগ। সেই মুহূর্তে কুমারজির থেকে যা কিছু চেয়ে নিত পিউ। কুমারজিও কোনওদিন না বলতেন না।

 

কথাতেই আছে পাপ কখনও লুকিয়ে রাখা যায় না। ভাই-বোনের অজুহাত দিয়ে আর কতদিনই বা সবকিছু লুকিয়ে রাখা যায়। একদিন না একদিন ধরা পড়তে বাধ্য। এমনিতেই তাদের দুজনের এই ঘনিষ্ঠতা ঘরে-বাইরে সকলের চোখে ধরা পড়ছিল। তাই সংসারে বড়োসড়ো কিছু না হলেও, ছোটোখাটো মনোমালিন্যের সৃষ্টি হচ্ছিলই।

ওদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই পিউয়ের আচার-ব্যবহার কুমারজিকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। কোনও কিছু চাই তো জোর-জবরদস্তি তক্ষুনি কুমারজিকে দিয়ে তা করিয়ে নেওয়া। এই ব্যাপারগুলো কুমারজি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। একদিন তো সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে পিউ, তার এবং কুমারজির চূড়ান্ত মুহূর্তের ছবি মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করল, কুমারজির বারবার মানা করা সত্ত্বেও পিউ ছবিগুলি ক্যাপচার করেই রেখে দিল।

তার কয়েকদিন পরেই একদিন সন্ধেয় পিউ একপ্রকার ছুটতে ছুটতে কুমারজির কিউরিও শপ-এ গিয়ে বলল, ‘জানো, মা আমার বিয়ের ঠিক করেছে। টাকাপয়সা নেই বলে এমন একজন লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে, মাতাল বলে যার দুর্নাম আছে।’ বলেই কাঁদতে শুরু করে পিউ।

কথাগুলো শুনে কুমারজি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। কোনওরকমে পিউয়ের কান্না থামিয়ে বলেন, ‘তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলব। আমি জানি উনি ঠিক বুঝবেন। তাছাড়া তুমিও তো অন্য কারও সঙ্গে সুখী হতে পারবে না।’

‘আমি অন্য কারও সঙ্গে সুখী হব না এমন কথা আবার কবে বললাম? সারাজীবন তো আর এভাবে চলতে পারে না। বিয়ে তো আমাকে একদিন না একদিন করতেই হবে, তবে হ্যাঁ সেই পাত্রকেও যোগ্য হতে হবে। ধীরে ধীরে তার প্রতিও ভালোবাসা এসে যাবে।’ খুব সহজ সরল ভাবেই কথাগুলি বলল পিউ।

‘জ্বালাচ্ছ আমাকে? আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে?’ কুমারজি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

‘কেন? তুমি কি তোমার বউ থাকা সত্ত্বেও আমাকে ভালোবাসোনি?’ সোজাসুজি প্রশ্ন করল পিউ।

কুমারজি বেশ হতবাক হয়েই বললেন, ‘তার মানে তুমি বিয়ে করতে চাও?’

প্রত্যুত্তরে পিউ বলে ওঠে, ‘প্রত্যেক মেয়েরই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। আমারও আছে। আমি তো তাদের বাইরে নই। আমিও চাই আমার একটা ঘর-সংসার হোক।’

‘ভেবে বলছ? আমার কথা মনে পড়বে না তোমার? পারবে আমাকে ছেড়ে থাকতে?’ পিউকে দ্বিতীয়বার যাচাই করার জন্য প্রশ্ন করেন কুমারজি।

হাসতে হাসতে পিউ জবাব দেয়, ‘কষ্ট হয়তো হবে, তবে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা আমার আছে। তাছাড়া কথাতেই তো আছে, আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড।’

‘ঠিক আছে যদি সেটাই সত্যি হয়, তাহলে তোমার বিয়ে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেব।’ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন কুমারজি।

কুমারজির কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে পিউ বলে, ‘সেটাই তো আমি চাই, তোমার মতো একজন ভালো মানুষ খুঁজে দাও না আমাকে। নাহলে তুমি তো জানোই আমি কী করতে পারি।’

কর্কশভাবে কুমারজি বলে ওঠেন, ‘কী, কী করতে পারো তুমি?’

‘তুমি তো জানো তোমার জিয়নকাঠি-মরণকাঠি সবই আমার ক্যামেরায় বন্দি। চাইলেই তার একঝলক তোমার বউকে দেখাতেই পারি। কিন্তু সেটা কি তোমার জন্য ভালো হবে? মনে হয় না! চাইলে পাড়াপড়শিদেরও…।’

কুমারজি উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন, ‘তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ! লজ্জা করছে না তোমার? কী করিনি তোমার জন্য আমি!’

প্রত্যুত্তরে ইনিয়েবিনিয়ে পিউ জবাব দেয়, ‘অবশ্যই করেছ। তাই বলছি এতকাল যখন আমার জন্য এতকিছু করে এলে, আর-একটু করলেই না হয়।’

কুমারজি প্রশ্ন করে, ‘একটুটা কী শুনি।’

উত্তরে পিউ বলে, ‘কী আবার, দ্যাখো বিয়ে দিতে টাকা লাগে। তুমি তো জানো আমার মায়ের সেই সামর্থ্য নেই। তাই বলছি যদি লাখ দশেক টাকা…’

পিউয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই কুমারজি একপ্রকার আঁতকে উঠে পিউকে কোল থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘লাখ দশেক টাকা! মাথার ঠিক আছে তো তোমার? অত টাকা আমি কোথায় পাব? আমার এই ভেবে নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে পিউ, যে আমি তোমার মতো একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। তোমার জন্য আমি আমার স্ত্রী-সন্তান সকলকে ঠকিয়েছি। আমার মতো লোকের বোধহয় এটাই হওয়ার ছিল। নয়তো জীবনে আমি এই ফাঁদ থেকে বেরোতে পারতাম না। এটাই আমার যথাযোগ্য শাস্তি, কথাগুলি বলতে বলতে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন কুমারজি।

‘ওসব ঘৃণা শাস্তি-টাস্তি বুঝি না, টাকাটা কবে দিচ্ছ বলো? আমি জানি ওটা তোমার হাতের ময়লা।’

পিউয়ের কথার উত্তরে কুমারজি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, ‘কাল এসে চেকটা নিয়ে যেও।’

পিউ চলে যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ কুমারজি  গুম হয়ে বসে রইলেন। ব্যাগ থেকে চেকবইটা বের করে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার একটি চেক লিখলেন পিউয়ের নামে। তারপর সচরাচর যা করেন না, তা-ই করলেন। দোকানের শাটার অর্ধেক নামিয়ে ভিতরে বসেই হুইসকির বোতলটা খুললেন। কুমারজি নিজের বাড়িতে ছাড়া কোথাও বড়ো একটা মদ্যপান করেন না। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছেন না। বেশ খানিকটা মদ, জল না মিশিয়েই গলায় ঢাললেন। তারপর কতক্ষণ ওভাবে বসে মদ খেয়েছেন খেয়াল নেই। একসময় দোকানের শাটার নামিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন।হাত কাঁপছে, তবু স্টিয়ারিং-এ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করলেন কুমারজি। বাড়ির পথ ধরতে ইচ্ছে করল না তাঁর। পালাতে চাইছেন–নিজের ছায়াটার কাছ থেকেও। দ্বিতীয় সেতু পেরিয়ে গাড়ি, বম্বে রোড ধরল।হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে, চোখ ক্রমশ ঝাপসা। ভারী ভারী ট্রাকগুলো এলোমেলোভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে তাঁকে। হঠাৎই একটা জোরালো হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কোনও রিফ্লেক্স আর কাজ করছে না। ব্রেক-এ পা দেওয়ার কথা খেয়াল হল না কুমারজির।

ছলনা

অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বারান্দায়। তারপর চা-সহযোগে একটু জলখাবার খাওয়ার পর, ফুরফুরে বাতাসে আরামকেদারায় গা এলিয়ে দেওয়া নিত্য অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে আকাশের। একফালি বারান্দা থেকে যে প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ দেখা সম্ভব, তা বোধকরি নতুন বাড়িতে শিফট না করলে বোধগম্য হতো না তাঁর। দখিনা বাতাস আর মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রকৃতি সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়েমুছে কখন যে তাঁর চোখে আচ্ছন্নের ভাব এনে দেয়, তিনি নিজেও বুঝতে পারতেন না। সেদিনও একটু তন্দ্রাভাব এসেছে কী আসেনি, পাশের বাড়ি থেকে এক নারীকন্ঠ ও জনৈক পুরুষের তুমুল চিৎকার-চ্যাঁচামেচি কানে এল। বেশ কিছুক্ষণ স্থির থাকার পরেও এই মহাভারতের অবসান নেই বুঝে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘রমা, দ্যাখো তো এত হাঙ্গামা কীসের!’

কাজের মেয়ে পারুলের পেছনে খিটখিট করা রমার স্বভাব। তাকে দিয়ে ঘর মোছাতে মোছাতে এটা সেটা গজগজ করছিল রমা। আকাশের দেওয়া এই বাড়তি কাজে সে তেমন উৎসাহ পেল বলে মনে হল না। দিল্লির দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল আকাশের। শ্বশুরবাড়ির জ্বালায়, একটু শান্তির খোঁজে দিল্লি থেকে তার কলকাতা চলে আসা। অনেক ছোটাছুটির পর তবেই এই ট্রান্সফার। দিল্লিতে তো সর্বদা রমার বাড়ির লোকের আনাগোনা। অফিস যাওয়ার আগে, ফেরার পরে কেবলই কথাবার্তা আর হুল্লোড়। নিরিবিলি বলে যেন কিছুই ছিল না সংসারে।

পঁয়ত্রিশ বর্ষীয় আকাশ বরাবরই একটু রিজার্ভ প্রকৃতির। তেমন হইহল্লা কোনওদিনই পছন্দ করেন না  বরং একান্তে থাকতেই ভালোবাসেন। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকের জ্বালায় জীবনটা তাঁর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। লোকে বোধহয় ঠিকই বলে– মনের শান্তি, বড়ো শান্তি।

ভাবনায় বাধা পড়ে রমার গলার আওয়াজে। কিছুক্ষণ পর কাজের ঝিকে বিদায় করে রমা এসে দাঁড়ায় আকাশের সামনে। তীর্যক হাসি হাসতে হাসতে বলে, ‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে পতিদেব। কয়েকদিন ধরে বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। শুনলে খুব খুশি হবে। পাশের বাড়িতে আমার পাতানো বোন মালারা ভাড়া এসেছে। দুবছর আগেই ওর বিয়ে হয়েছে।’

কথাটা শোনামাত্রই আকাশের মুখ একেবারে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। শুধু একটা অস্পষ্ট আওয়াজ রমার কানে এল, ‘এখানেও?’

রমা বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলল, ‘আরে শোনো শোনো, এইটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে? শালি বলে কথা। তাও আবার তোমার একমাত্র শাশুড়ির বান্ধবীর মেয়ে। তখন না হয় কাজের জন্য শালির বিয়েতে যেতে পারোনি, এখন তো বাড়িতে ডেকে আতিথেয়তা করতেই হবে।’

আর সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না আকাশের। বউয়ের কথার মাঝখানে কথা কেটে একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘ওহ্, তাহলে অমন নির্লজ্জের মতো ঝগড়াটা তারাই করছিল, তাই তো?’

বড়ো বড়ো চোখ করে স্বামীর দিকে তাকায় রমা, ‘সহানুভূতি না দেখাতে পারো, অন্তত তাদের নিয়ে পরিহাস কোরো না। কার যে কখন কেমন সময় আসে, কে বলতে পারে!’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমা। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করে, ‘দুজনেই ভালো চাকরি করত। মালার কল সেন্টারের চাকরিটা ছাড়তে হল নাইট শিফ্টের কারণে। আর তার কয়েকদিন পরেই সৌরভ যে-কোম্পানিতে চাকরি করত, সেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানিটাও বিনা নোটিশে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। তাও প্রায় দুমাস হয়ে গেল। সংসার খরচ, ঘরভাড়া– কী করে যে সংসারটা চলবে! তাই আপাতত হাজার কুড়ি টাকা দেব…।’

টাকার কথা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় আকাশের।

‘আমার থেকে অনুমতি না নিয়েই যাকে-তাকে…।’

‘যাকে-তাকে কাকে বলছ। আফটার অল আমার মাসির মেয়ে।’

মেজাজ চড়েই ছিল আকাশের। ‘মাসির মেয়ে, মাসি! তবু যদি জানতাম নিজের কেউ। বলা নেই কওয়া নেই, উনি একেবারে কথা দিয়ে চলে এলেন। আমাদের গাছ আছে নাড়া দেব, আর তুই টাকা নিয়ে চলে আসবি। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটলে তবে দুটো পয়সা পাওয়া যায় বুঝেছ।’ কথাগুলি বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যান আকাশ। দরজার সামনেই অত্যন্ত সুন্দর, আকর্ষক এক মহিলা এবং একজন পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মতো হাইটের সুপুরুষ। বোকার মতো মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন আকাশ। চিরকালই মহিলাদের উপর একটা আলাদা টান ছিল তাঁর। তাও আবার এমন আকর্ষণীয়া সুন্দরী।

ঠিক তখনই রমা বেশ উঁচু স্বরে বলে ওঠে, ‘আয়, আয় মালা। সৌরভ এসো। আরে দাঁড়িয়ে গেলি কেন তোরা।’

নিজের শান্ত জীবনে দুই আগন্তুকের অতর্কিত প্রবেশ সত্ত্বেও আর কিছু বলতে পারলেন না আকাশ। খানিক আলাপচারিতা আর চা-জলখাবার খাওয়ার পর দিদিকে আলাদা ঘরে নিয়ে যায় মালা, ‘দিদি টাকাটা!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ আনছি।’ বলেই কুড়ি হাজার টাকা আলমারি থেকে বার করে মালার হাতে ধরিয়ে দেয় রমা।

টাকা হাতে পাওয়া মাত্রই খুশি মনে কপোতকপোতী গেট থেকে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা চারেক আর দুজনের টিকিটি পাওয়া গেল না। রাতে ফিরে, ফের রমার বাড়িতে হাজির দুজনে। মালা ঘরে ঢুকেই সোফায় গা এলিয়ে বলে, ‘রমাদি ডিনারটা কিন্তু এখানেই সারব। আর রান্না করার মতো শক্তি নেই আমার। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে।’

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি তোরা দুজন?’ প্রশ্ন করে রমা।

‘বেশিরভাগ সময়টাই তো চলে গেল পার্লারে।’ চমকে ওঠে রমা। মালা কোনও দিকে না তাকিয়ে কলকলিয়ে ওঠে, ‘পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, ফেসিয়াল, হেয়ার কাটিং।’

‘তুই তো এমনিই সুন্দর। তাহলে এসবের কী দরকার ছিল বলতো? খামোকা এই সময়ে কতগুলো টাকা নষ্ট হল।’ বিমর্ষতার ভাব ঝরে পড়ছিল রমার স্বরে।

‘কতগুলো আর কোথায়, মোটে পনেরোশো টাকাই তো লেগেছে।’ নিজের এলো চুলগুলো নাড়তে নাড়তে মালা কেমন অকপটে বলে গেল, ‘মেনটেন না করলে কী আর সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় রমাদি। নিজের দিকেই দ্যাখো না, এমন চাঁদপানা মুখটার কী অবস্থা করে রেখেছ। ভাই, হয় পয়সা বাঁচাও, না-হয় রূপ… টাকা তো হাতের ময়লা, আজ আছে কাল নেই।’

আকাশের সহ্যশক্তির বাঁধ প্রায় ভাঙতেই বসেছিল। নিজেকে কিছুটা সংযত করে তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে ফেললেন, ‘সৌরভ কি তাহলে মেন্স স্যালন-এ গিয়েছিল নাকি?’

‘আরে না না। ওর এত সময় কোথায় যে ও পার্লারে যাবে। রাজ্যের বিল জমা দিতে দিতেই তো ওর সময় চলে গেল, ঘরের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল। না হলে হয়তো ও-ও…।’

শিউরে ওঠে রমা, ‘তাহলে তো অনেকটাই গেল!’

‘হ্যাঁ, বেশিরভাগটাই। এখনও দুধের বিল বাকি আছে। সঙ্গে নিত্যদিনের খরচাপাতি।’

মনে মনে আকাশ বলতে থাকেন, ‘পকেটে কড়ি নেই, অথচ ফুটানি দ্যাখো, যেন একেবারে জমিদারের ব্যাটা।’

স্বামীর চোখমুখ দেখামাত্রই ঘাবড়ে যায় রমা। ‘মালা তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তোরা বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

মালা আর সৌরভ যাওয়া মাত্রই আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়লেন আকাশ, ‘কোথাও যাবে না তুমি। লাটসাহেব সব একেবারে। দু-পয়সা উপায় করার মুরোদ নেই, অথচ ঠাটবাট দ্যাখো। ভগবান একটু সুখশান্তি আর আমার কপালে লেখেনি। সেই কথায় বলে না, তুমি যাবে বঙ্গে, তোমার কপাল যাবে সঙ্গে।’ গজগজ করতে থাকেন আকাশ।

খাটোগলায় রমা বলার চেষ্টা করে ‘না না ওটা ধার হিসাবে নিয়েছে…’ কিন্তু তাতে আরও রেগে ওঠে আকাশ।

প্রায় মাস-দুয়েক হতে চলল আকাশ আর রমা বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে এসেছে। আস্তে আস্তে পাড়াপড়শির সাথে পরিচিতি বেড়েছে। সেখান থেকেই খবর পাওয়া। মালা-সৌরভ আশেপাশের অনেক লোকের থেকেই টাকাপয়সা ধার করে বসে আছে। যখন তাদের হাতে টাকা থাকে তখন মনে হয় এরা একে অপরের জন্যই তৈরি। আর পকেট ফাঁকা হলেই দুজনের চ্যাঁচামেচির জ্বালায় পাড়ায় কাকপক্ষীও বসতে সাহস দেখায় না।

এমনভাবেই কেটে গেল আরও ছটা মাস। ততদিনে পাড়াপড়শিরাও এই জুটির স্বভাব সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তাই তারাও ধার দেওয়ার ঝাঁপি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। ওদিকে ছ’মাসের ভাড়াও বাকি পড়ে গেছে। বাড়িওয়ালা রোজই আসে আর খালি হাতে ফিরে যায়। ক্রোধের বশে একদিন বাড়িওয়ালা সৌরভকে না পেয়ে ঘরের সমস্ত মালপত্র তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। মালার সঙ্গে বাড়িওয়ালার তুমুল বচসা বেধে যায়। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না।

ঘটনাচক্রে সেদিন সৌরভ কোনও কাজে কলকাতার বাইরে ছিল। তার ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত। ওদিকে রমাও সেদিন পাড়ার এক মহিলার সঙ্গে পরিচিত কারওর বাড়িতে ঠাকুরের নামগান শুনতে গেছে। তারও বাড়ি ফিরতে রাত গড়াবে। এমতবস্থায় আস্তানা হিসাবে কেবলমাত্র তার রমাদির গেটকেই বেছে নেয় মালা।

রোজের অশান্তির কারণে কলকাতার প্রতিও মোহভঙ্গ হতে বসেছিল আকাশের। সেই জন্যই অন্যত্র বদলির জন্য কোম্পানিতে আবেদনপত্র জমাও দিয়েছিল। কিন্তু ওই ভাগ্য। অফিস থেকে ফিরে গেটের দরজাটা খুলতে যাবে কী, সামনে আলুথালু ভাবে বসে মালা। মালাকে দেখামাত্রই হকচকিয়ে ওঠেন আকাশ। খানিক পরে ধাতস্ত হয়ে মালাকে ঘরে বসার জন্য বলেন। ঘরে ঢোকামাত্রই জামাইবাবুকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মালা। সৌরভ আর মালার প্রতি তিতিবিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও মালাকে সরিয়ে দিতে পারেন না আকাশ। মালার শরীরের মদির স্পর্শে আকাশের শরীরে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে যায়। মালার গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর ঘন চুলের আবর্তে আরও আকর্ষিত হতে থাকেন আকাশ। হূৎস্পন্দন বাড়ার সাথে সাথে কেঁপে ওঠে শরীরও। কয়েক মুহূর্তের লাবণ্যে বশীভূত হয়ে যান তিনি। সেইসময় হঠাৎই বেজে ওঠে আকাশের ফোনটা। সম্বিত ফেরে আকাশের। এ-কী করতে বসেছিল সে! সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরিয়ে দেন মালাকে। পাশের সোফায় বসায় তাকে। ‘শান্ত হও। যাই হোক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

চোখ মুছতে মুছতে মালা জবাব দেয়, ‘ঠিক হওয়ার জন্য টাকাই তো আমাদের কাছে নেই। নাহলে কী আর বাড়িওয়ালা জোর করে এভাবে তুলে দেয়। কী করে সব ঠিক হবে?’

‘ঠিক আছে দেখছি কী করতে পারি। তুমি একটু বোসো, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমি আসছি।’ বলে পকেট থেকে এটিএম কার্ডটা বার করে গাড়ি নিয়ে চলে যান আকাশ।

মিনিট সাতেক পরে ফিরে ছয় মাসের বাড়ি ভাড়া বাবদ মালার হাতে হাজার তিরিশেক টাকা দিতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে মালা। কায়দা করে শাড়ির আঁচলটা খসিয়ে দিয়ে আকাশের একদম কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘থ্যাংক ইউ আকাশদা, থ্যাংক ইউ।’

জুতো খোলার জন্য সোফায় বসা আকাশের চোখ আটকে যায় যৌবনে ভরা মালার সুডৌল স্তন যুগলের উপর। মুখ থেকে কোনও কথা সরে না তার। কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

সেদিনের পর থেকে মালা-সৌরভের প্রতি আকাশের ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। এই পরিবর্তনটা যে রমার চোখে পড়েনি, তা নয়। অবাক যেমন হয়েছে, খুশিও হয়েছে তার দ্বিগুণ। মনে মনে ভেবেছে, যাক রোজকার ঝঞ্ঝাট থেকে তো অন্তত মুক্তি পাওয়া গেল। আকাশ রমাকে বলব বলব করে মালাকে টাকা দেওয়ার কথাটা শেষ পর্যন্ত আর বলে উঠতে পারেননি।

ওদিকে মালাও বুঝে গিয়েছিল আকাশ ক্রমশ তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাকে নিজের মোহজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করল সে।

সহজসরল রমা যখনই কোনও কাজে বাইরে যায়, এমনকী বাপের বাড়ি গেলেও সংসারের দায়িত্ব মালার উপরেই দিয়ে নিশ্চিত থাকে সে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় মালা। বিভিন্ন অছিলায় নিজের রূপযৌবনকে হাতিয়ার করে আকাশের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করা। আজ এটা চাই, কাল সেটা চাই– তৎপর আকাশও মোহের বশে উড়িয়ে যায় টাকা। বাদ যায়নি রমাও। তার কাছ থেকেও কুমিরের কান্না কেঁদে টাকা হাতাতে থাকে মালা।

সহজসরল স্বভাবের অনুরাগী স্বামীর, হঠাৎই তার প্রতি উদাসীন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিল না রমা। খটকা একটা লাগছিলই। কিন্তু কোথায় যে এর গোড়া, অনেক চিন্তাভাবনার পরেও সেটা কোনওভাবেই অনুসন্ধান করতে পারল না রমা।

কেবলমাত্র পয়সার জন্যই মালার যত ছলাকলা। আকাশের প্রতি বিন্দুমাত্রও দায়বদ্ধতা ছিল না তার। একদিন রমার অনুপস্থিতিতে সংযম হারিয়ে আকাশ মালাকে বিছানায় টেনে নেয়। সব বাধা পেরিয়ে মালার শরীরী সান্নিধ্য পেতে চায় একান্তভাবে। বাধ সাধে মালা। রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘ভেবেছেনটা কি টাকা দিচ্ছেন বলে কি নিজেকে উৎসর্গ করব আপনার কাছে? এতটা সহজলভ্য বস্তু বোধহয় আমি নই। আরে আপনার মতো বোকা লোকেরও তো অভাব নেই পৃথিবীতে, শরীরের একটু হালকা স্পর্শ পেলেন কী না পেলেন সবকিছু লোটাতে শুরু করলেন। যাক অনেক হয়েছে, হাজার কুড়ি ছাড়ুন তো।’

হতবাক আকাশ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। মালা বলতে থাকে, ‘ছাড়ুন, ছাড়ুন, নয়তো আপনার আসল চেহারাটা আর কারওর জানতে বাকি থাকবে না।’ বাঁচার জন্য মানুষ কী না করে, অগত্যা মালাকে দিতেই হয় সেই টাকা। এইভাবেই মালার লোভ আরও বেড়ে চলে।

কলশির জলও গড়াতে গড়াতে একদিন শেষ হয়ে যায়। রমা আর আকাশের সংসারেও অভাবের ছাপ পড়তে শুরু করে। তাই একদিন বাধ্য হয়েই মালাকে দেওয়া পাওনা টাকার কিছুটাও যদি মালার মায়ের থেকে পাওয়া যায়, সেই আশায় অনুভামাসিকে ফোন করে রমা। কিন্তু তিনি বলেন, ‘ছোটোবোনকে কটা টাকা দিয়েছিস বলে সেটাও চাইছিস। এত নীচ তোকে কখনও ভাবিনি।’

পরে রমা তার মাকে সব কথা জানালে, তিনিও ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মেয়ের উপরে, ‘মালা যে দিনের পর দিন তোর সরলতার সুযোগ নিয়ে এভাবে টাকা নিচ্ছে কই আগে বলিসনি তো? সবকিছু খুইয়ে দিয়ে এখন বলছিস। অনুভা আর ওর পরিবারের ওই দোষের জন্য আমরা ওদের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ছেদ করে দিয়েছি।’

এতদিনে বাপের বাড়ির লোকেদের থেকে মোহভঙ্গ হয়েছে রমার। ওদিকে মালার প্রতিও ঘেন্না জন্মে গিয়েছিল আকাশের মনে। তৎসত্ত্বেও তিনি না পারছিলেন রমাকে সত্যিটা বলতে, না পারছিলেন মালার দিনদিন বেড়ে যাওয়া চাহিদা মেটাতে। সংসারের চাপ আর মালার চাহিদায় আকাশ রীতিমতো নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন। রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল তাঁর। অন্যত্র বদলির জন্য আবেদন জমা দিয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি।

এরই মাঝে মালা আবার কলসেন্টারে জয়েন করেছে। সৌরভও একপ্রকার চাপে পড়েই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেছে। পাড়াপড়শির কাছে প্রচুর দেনা, তারাও তো আর ছেড়ে কথা বলছে না। সেই চাপেই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু উপায় তেমন বিশেষ নয়। বরং খরচা অনেক বেশি।

দিন পনেরো এভাবে চলার পর হঠাৎই একদিন মালা উধাও হয়ে গেল। অফিসে গিয়ে আর ফেরেনি। পুলিশ এদিক-সেদিক খুঁজলেও কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র এটুকুই খবর পাওয়া গিয়েছিল মালা সেইদিন কলসেন্টার যায়ইনি। সৌরভ পাগলের মতো খুঁজে বেড়াল তাকে। তারপর একদিন সেও নিরুদ্দেশ।

ঠিক তখনই মালার মা অনুভাদেবী, আকাশ আর রমার বিরূদ্ধে রিপোর্ট দায়ের করলেন। তাদের নিখোঁজের পিছনে নাকি রমা আর আকাশের-ই হাত রয়েছে। পাড়াপড়শির হস্তক্ষেপ এবং উপরমহলের কিছু বন্ধুর জন্য জেলে যেতে হয়নি তাদের। বড়ো বাঁচা বেঁচেছে তারা।

মাসদুয়েক পর হঠাৎই একদিন দেরাদুন থেকে ট্রান্সফার লেটার এসে উপস্থিত হল। এই পরিবেশে দুজনেই বেশ হাঁফিয়ে উঠেছিল তাই পাকাপাকি ভাবে দেরাদুনে সেটল করার আগে একবার সেখানে তদারকি করতে ও কয়েকদিন ছুটি কাটাতে রমাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল আকাশ।

প্রথমদিনটা অফিসেই কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন টুরিস্ট বাসে চড়ে পুরো শহর ঘোরার পালা। সেইমতো সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া। যেতে যেতে পথের মাঝে শুটিং হচ্ছে দেখে গাড়ি থামিয়ে সকলে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল। কোনও এক হিন্দি ছবির নাচের শুটিং চলছিল। নায়ক-নায়িকার পিছনে বেশ কয়েকজন রংবেরঙের পোশাক পরে তালে তালে নাচছে।

আচমকা রমা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ওটা মালা না?’

আকাশেরও বিন্দুমাত্র চিনতে অসুবিধা হল না। মালাকে দেখে রমা আকাশকে বলল, ‘এবার অনুভামাসির হাতে ওকে তুলে দিয়ে আমাদের বদনাম ঘোচাব। একবার যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ার প্রশ্নই নেই।’

রমার কথায় ঘোর আপত্তি তোলে আকাশ। বলে, ‘খবরদার, একবার যখন এই ধান্দাবাজগুলোর হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি তখন আর এসবের মধ্যে ঢুকতে যেও না। ফালতু ফালতু জল ঘোলা করে লাভ কী। চলো ফিরে যাই।’

কিন্তু রমাকে বোঝাবে কে? তার মাথায় জেদ চেপে বসেছে, এই কলঙ্ক থেকে তাদের মুক্তি পেতেই হবে। তাই স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে, শুটিং শেষ হওয়ার পরেই মালার পিছু পিছু একটা ট্যাক্সি নিয়ে পিছনে ধাওয়া করল। একটি নিম্নবিত্ত পাড়ায় একখানা অপরিসর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল মালা। অপ্রত্যাশিত ভাবে আকাশ আর রমাকে দেখে, মালা এমন ভান করল যেন তাদের কোনওদিন দেখেইনি। রীতিমতো চিনতে অস্বীকার করল তাদের। সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় রমার। রাগে চিৎকার করে ওঠে, ‘তুই এখানে আয়েশে আছিস, আর তোর মা তোর কারণে আমাদের দুজনকে জেলে পাঠাবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত প্রায় সেরেই ফেলেছিল। তোকে নাকি আমরা গায়েব করেছি। এখুনি আমাদের সাথে চল। তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাব তোকে।’

একটা কথাও বলল না মালা। কোনও সদুত্তর না পেয়ে রাগের বশে মালার গালে একটি সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে রমা বলে, ‘যে তার নিজের স্বামীর হতে পারেনি, সে অন্যের কী হবে! তুই এখানে আনন্দে বেলেল্লাপনা করছিস, আর তোর বর সৌরভ পাগলের মতো খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে তোকে। ভগবান জানে সে এখন কোথায়।’ হ্যাঁচকা টানে মালাকে ঘর থেকে বাইরে আনার উপক্রম করতেই, মালা রীতিমতো জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’

আওয়াজ শুনে আশপাশের বেশ কয়েকজন লোক জড়ো হতেই ঘাবড়ে গিয়ে রমা, মালার হাত ছেড়ে দিল। সেখানকার গতিক ভালো নয় বুঝে আকাশ একপ্রকার জোর করেই রমাকে টেনে নিয়ে ট্যাক্সিতে এনে বসালেন।

খানিক যাওয়ার পরেই আকাশ বলে উঠলেন, ‘আমাদের এখানে কোনও গন্ডগোল না পাকিয়ে ওদের ঠিকানাটা কলকাতার পাওনাদারদের দিয়ে দিলেই হতো, তারাই যা করার করত।’ আকাশের কথাতে সম্মতি জানাতে গিয়ে হঠাৎই রমার মনে পড়ে গেল, তাইতো ঠিকানাটাও তো ঠিক করে দেখা হল না। গাড়ি থামিয়ে রমা বলে, ‘তুমি গাড়িতেই থাকো। আমি লুকিয়ে জেনে আসছি।’

জায়গাটায় ফেরত আসতেই, রমা হকচকিয়ে গেল। গলায় জয়ের উল্লাস নিয়ে মালা বলছে, ‘কি মা, কেমন অ্যাক্টিংটা করলাম বলোতো? রমাদিকে একেবারে আউট করে দিলাম কেমন। দ্বিতীয়বার আর এখানে আসার ভুলটা করবে না।’

অনুভাদেবীও মেয়ের কাজে খুশি হয়ে শাবাশ শাবাশ করতে লাগলেন।

‘মানছি বাবা মানছি। তুই তো আচ্ছা আচ্ছা নায়িকাদেরও কাত করে দিবি রে! কী দারুণ অভিনয়টাই না করলি। তোর হিরোইন হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না দেখিস।’

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মালার বর সৌরভও মালার তারিফ না করে পারল না।

সবকিছু দেখে হতবাক রমা, বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। নতুন করে আর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না তার। গাড়িতে ফিরে স্বামীকে সমস্ত বৃত্তান্ত শোনাতে শোনাতে কেঁদে ফেলল সে, ‘আমরা ঠকে গেছি আকাশ, একেবারে ঠকে গেছি। সবাই প্লান মাফিকই টাকা হাতানোর এই ফাঁদটা পেতেছিল। আমাদের সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মালা-সৌরভ দিনের পর দিন ছলনা করে গেছে। ছলনা।’

 

প্রস্তাব

অফিসের মহিলা কলিগদের থেকে সৌহার্দ্য একটু ডিসটেন্স রেখেই চলে। অফিসিয়াল কথাবার্তা ছাড়া তেমনভাবে কারওর সাথে মেশে না। এর পিছনে যে কোনও কারণ রয়েছে, তেমনটা নয় বা তাকে দেখতে-শুনতে খারাপ তেমনও নয় বরং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সুন্দর, হ্যান্ডসাম, মিষ্টি স্বভাবের। হাইটও তেমনি, প্রায় ছ ফুট। গায়ের রং শ্যামলা– মেয়েরা ঠিক যেমনটা চায় আর কি। তাকে দেখলে যে-কোনও মহিলার হূদয়ে কম্পন অনুভূত হবে, এমনটা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু হয় না– অনেকেই নিজের মতো করে ভেবে নেয়, সৌহার্দ্যও অফিসের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনকে এক করতে চায় না। তাই ছুটির পর এক মুহূর্তও ওয়েস্ট না করে সোজা বাইক ছুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। তবে মাঝেমধ্যে কাজের জন্য আটকেও পড়তে হয়। এরকমই একদিন একটা প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য শ্রেয়া আর তাকে ছুটির পরেও থেকে যেতে হল। প্রেজেন্টেশন জমা করতে করতে রাত প্রায় সোয়া দশটা হয়ে গেল। যাবার সময় বসের ফরমায়েশ, ‘সৌহার্দ্য, শ্রেয়ার ফেরার ব্যাপারটা একটু দেখে নিও।’

‘ওকে স্যার। আপনি না বললেও এত রাতে ওনাকে…।’

‘আরে না না। আমাকে নিয়ে এত ভাববেন না। আমার সঙ্গে স্কুটি রয়েছে। আমি চলে যেতে পারব,’ কথার মাঝেই বলে বসে শ্রেয়া।

পার্কিং জোনে শ্রেয়ার স্কুটি স্টার্ট করার বিফল চেষ্টা দেখে, সৌহার্দ্য বলে– ‘স্টার্ট যখন নিচ্ছেই না, ওটা এখানে ছেড়ে যান। কাল মেকানিক ডেকে দেখিয়ে নেবেন। চেষ্টা করলে স্টার্ট হয়তো নিয়ে নেবে, কিন্তু মাঝপথে যদি আবার বিগড়োয় প্রবলেমে পড়বেন।’

‘ঠিক বলেছেন। বরং সৌরভকে বলি পিক করে নিতে।’ ব্যাগ থেকে ফোন বার করতে করতে কথাটা শেষ করে শ্রেয়া, ‘আশা করি মিনিট পনেরোর মধ্যে ও চলে আসবে।’

‘কিন্তু ততক্ষণ এখানে দাঁড়ানোটাও তো নিরাপদ নয়। তার চেয়ে বরং আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।’

‘কিন্তু আমার বাড়ি তো আপনার বাড়ির ঠিক উলটো পথে, শুধু শুধু আবার অতটা পথ…’ বলতে বলতে থেমে যায় শ্রেয়া।

‘আপনাকে বিপদের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়ার মতো পাত্র তো আমি নই, আশা করি এতক্ষণে সেটা বুঝে গেছেন। তাছাড়া বসের হুকুম বলে কথা। না মানলে কী আর চলে বলুন? তাই বলছি দেরি না করে গাড়িতে বসে পড়ুন।’ ঈষৎ মজা করেই বলে সৌহার্দ্য।

শ্রেয়া আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যায় তারা।

‘চলুন, ভিতরে চলুন।’ বলতে বলতে কলিংবেলটা বাজায় শ্রেয়া।

‘অন্য আর এক দিন, শ্রেয়া।’ বলে গাড়িটা ঘোরাতে যাবে এমন সময় শ্রেয়ার মা উমাদেবী আর যমজ ভাই সৌরভ বেরিয়ে আসে। ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়াতে হয় সৌহার্দ্যকে।

মা-ভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় শ্রেয়া।

‘তা বাবা কষ্ট করে এতদূর যখন মেয়েটাকে ছাড়তে এলেই… অন্তত একটু চা যদি…’

‘শুধু চা কেন আন্টি অন্য একদিন পাত পেড়ে খেয়ে যাব’খন। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাবা-মা না খেয়ে বসে থাকবেন।’

এমন সময় ভিতর থেকে কাঁপা গলায় শ্রেয়ার বাবা নীরেন্দ্রবাবুর আওয়াজ ভেসে আসে, ‘শ্রেয়া বাড়ি ফিরেছিস? সঙ্গে কে? ভিতরে আসতে বল।’

‘আসলে বাবার কাল থেকে আর্থ্রাইটিসের ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে-চলতেও পারছেন না। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা লোকজন খুব ভালোবাসেন। যদি একবার দেখা করে যেতেন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চলুন ওনার সাথে আলাপ করে আসি।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘরে ঢুকে যায়।

ঘরে ঢুকেই নীরেন্দ্রবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সৌহার্দ্য। ‘আরে বোসো বোসো। এখন আর এসব কেউ মানে নাকি। তা বুঝেছ বাবা কাল থেকে বাতের ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে। পা বাড়াতে গেলেই একেবারে বাবা-মা সকলকে টেনে আনতে হচ্ছে।’ বলে খানিক থেমে যান, তারপর আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেখেছ কাণ্ড, নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার নামটাও তো জিজ্ঞেস করা হয়নি! তোমার নাম যেন কী?’

‘সৌহার্দ্য।’

‘মানে অন্তরঙ্গ। বাহ্ বেশ মিষ্টি নাম তো।’ বলেই উমাদেবীকে ডাকতে শুরু করেন। ‘উমা, উমা। বলি ছেলেটাকে কিছু খেতে তো দেবে নাকি। সারাদিন খেটে মুখটা একেবারে আমসি হয়ে গেছে।’ ভাবটা এমন যেন কতদিনের পরিচিত। অবশ্য মানুষটাই এইরকম। নীরেন্দ্রবাবুর ডাকাডাকিতে উমাদেবী ইতস্ততবোধ করতে থাকেন।

‘না না আঙ্কল, আন্টি বলেছিলেন। আমিই না বলেছি। রাত হয়েছে তো।’

‘বলি বিয়ে করেছ?’

‘আজ্ঞে!’

‘বিয়ে করেছ কি?’

‘না-না।’

‘ব্যাচেলার। তাহলে আবার দেরি কিসের হে। না খেয়ে তোমার যাওয়া হবে না।’

‘আসলে বাবা চিন্তা করবেন তো তাই।’

‘বাবা খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

মুচকি হেসে সম্মতি জানায় সৌহার্দ্য।

‘জানিয়ে দাও। আজ তুমি খেয়েদেয়ে ফিরবে।’ বেগতিক দেখে বাড়িতে জানাতেই হয় সৌহার্দ্যকে।

খেতে বসে এদিক-ওদিকের নানারকম কথা চলতে থাকে। আড্ডা বেশ জমে ওঠে।

‘কাল ম্যাচটা দেখলেন?’ প্রশ্ন করে সৌরভ।

কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই নীরেন্দ্রবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘ওই তোর এক দোষ বাবু, শুধু খেলা আর খেলা। তার চেয়ে বরং খবরটা শোন কাজে দেবে।’

‘সত্যি বাবা পারো বটে। খেলার নাম শুনলেই তোমার যে কী হয়!’ শুরু হয়ে যায় বাপ-ছেলের কথা কাটাকাটি।

‘তোমাদেরও বলিহারি যাই, ছেলেটা একদিন এসেছে কোথায় ওর সাথে চারটে কথা বলবে তা নয়, বাপ-ছেলে মিলে শুরু করে দিলে। ছাড়ো ওদের কথা। তুমি তোমার কথা বলো, বাবা।’ উমাদেবী পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করেন।

‘আমার কথা। আলাদা করে কী বলব! পরিবার বলতে বাবা-মা আর আমি। বাবা-মা দুজনেই ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক ছিলেন। বেশ কয়েকদিন হল রিটায়ার করেছেন। এখন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং চালাচ্ছেন।’

‘তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভীষণ ভালো লাগল বাবা। সময় পেলেই চলে এসো।’

‘আরে আসবেই তো। কী হে, এই সেকেলে বুড়োটার সাথে মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসবে তো?’

‘অবশ্যই আঙ্কল। তবে আজ উঠতে হবে। অনেক রাত হল। ওহ্… আঙ্কল আপনার বাতের ব্যথার জন্য একটা ওষুধ পাঠিয়ে দেব, ব্যবহার করে দেখবেন।’

দিন পাঁচেক পরেই শ্রেয়ার হাত দিয়ে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছিল সৌহার্দ্য। সঙ্গে একটা কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে ব্যবহারবিধি লিখে পাঠিয়েছিল সে।

তারপর আরও দিন দশেক কেটে গেছে। শ্রেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তেমন না এগোলেও নীরেন্দ্রবাবু আর উমাদেবীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে সৌহার্দ্য। সময় পেলেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একে-অপরকে ফোন করে খবর নেওয়া। কিছু স্পেশাল রান্না করলেই উমাদেবী নয় তো নীরেন্দ্রবাবুর ফোন। শ্রেয়ার হাত দিয়ে খাবারও পাঠিয়েছে বার দুয়েক। ওনাদের এই আন্তরিকতা সৌহার্দ্য-র মনকেও ছুঁয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে বেশ এনজয়ই করে।

একদিন সৌহার্দ্য সবেমাত্র লাঞ্চবক্স নিয়ে বসেছে, ঠিক সেই সময়েই নীরেন্দ্রবাবুর ফোন, ‘বলি ব্যাপার কী হে! বুড়োটার খবর কী শুধু ফোন মার়ফত-ই নেবে নাকি দর্শনও দেবে?’

‘না না আঙ্কল, কী বলছেন, সময় পেলেই চলে যাব।’

‘না না ওসব সময়-টময় বুঝি না বাপু। তুমি বরং রবিবার দিনই চলে এসো। জমিয়ে আড্ডাও দেওয়া যাবে আর একসাথে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। তোমার মাসিমা কী সব হায়দরাবাদি বিরিয়ানি বানাবে। তোমার খুব ভালো লাগবে।’

‘বিরিয়ানি, ওয়াও। বাবা – আমি দুজনেই ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু রবিবার তো হবে না আঙ্কল। ওই একটা দিনই তো বাড়ির সকলে একসঙ্গে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়।’

‘তাহলে, বাবা-মাকেও সঙ্গে নিয়ে চলে এসো। ওনার ফোন নম্বর দাও। আমি নিজে ওনাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাব। ওই দ্যাখো তোমার মাসিমাও বলছে আসার জন্য।’

‘আরে না-না আঙ্কল, অত ফর্মালিটির প্রয়োজন নেই, বাবাকে আমি বললেই হবে। মা হয়তো আসতে পারবে না। ওই দিন মায়ের, মাসির বাড়ি যাবার কথা।’

‘ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইল।’

কথামতো রবিবার সন্ধেবেলা সৌহার্দ্য তার বাবা অসীমবাবুকে নিয়ে শ্রেয়াদের বাড়িতে উপস্থিত হল। বাবা-ছেলের হূদ্যতা সত্যিই প্রভাবিত করার মতো। হাসিঠাট্টা, আলাপচারিতার পর, খাওয়ার টেবিলে উমাদেবীর রান্নার তারিফ না করে পারলেন না অসীমবাবুও।

‘বাহ্ দিদিভাই। লাজবাব। বিশ্বাস করুন বহু বড়ো বড়ো রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। কিন্তু এই স্বাদ…জাস্ট অতুলনীয়! তবে হ্যাঁ আপনি যেমন বিরিয়ানিতে এক্সপার্ট, আমার গিন্নি তেমনি হিংয়ের কচুরি। না খেলে বুঝবেন না।’ তারিফের বহরে খানিক কুন্ঠাবোধ করেন উমাদেবী।

‘সামনের রবিবার আমাদের ওখানে চলে আসুন। গীতার সঙ্গে আলাপও হয়ে যাবে আর ছুটিটা উপভোগও করা যাবে। কী বলিস বাবা?’

‘আরে হ্যাঁ সে আর বলতে। চলে আসুন সামনের রবিবার। সৌরভ ওইদিন কোনও কাজ রাখিস না কিন্তু। শ্রেয়া, আঙ্কল-আন্টির সঙ্গে তুমিও আসছ কিন্তু।’ শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে সৌহার্দ্য।

ঠোটের কোণায় ঈষৎ হাসি খেলে যায় শ্রেয়ার। মুখের দু-পাশ রাঙা হয়ে ওঠে। মাথা নীচু করে সম্মতি প্রকাশ করে সে।

পরের রবিবার শ্রেয়া, সৌরভ বাবা-মায়ের সঙ্গে টাইম মতোই পৌঁছে যায় সৌহার্দ্য-দের বাড়িতে। গীতাদেবীও বাপ-ছেলের মতোই মিশুকে। সহজ সরল। কাজেই দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। গীতাদেবীর সঙ্গে উমাদেবীও কিচেনে ওনার হাতে হাতে খানিক সামলে নিলেন। খাওয়ার সময়তেও খাবার পরিবেশন করার ব্যাপারেও হেল্প করলেন। অসীমবাবুও খাতিরে কোনও ত্রুটি রাখেননি। যাবার সময় বরং সকলে মিলে বারবার অনুরোধ করেছে আবার আসার জন্য। ‘নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু তার আগে গীতাদিকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে।’ প্রত্যুত্তরে উমাদেবী বললেন।

‘আপনি না বললেও আমি আমার মিসেসকে নিয়ে আসতাম আপনাদের বাড়িতে। কি বলো গিন্নি?’ গীতাদেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন অসীমবাবু।

পরের দিন অফিসে শ্রেয়ার মোবাইলে একটা এসএমএস। প্রেরক সৌহার্দ্য। দু-চার কথায় লেখা রয়েছে– অফিসের পরে ওয়েট কোরো। কথা আছে।

শ্রেয়া বেশ অবাকই হয়েছিল। চোখের সামনেই তো রয়েছে মানুষটা, তাহলে কী এমন কথা যে এখানে বলা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল শ্রেয়াকে। তারপর থেকে কাজে মন বসাতে পারেনি একটুও।

অফিসের পরে গেটের সামনে এগোতেই সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে হাজির।

‘বোসো।’ সৌহার্দ্যের হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমি বলাতে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে শ্রেয়া। ভাবার শক্তি যেন কে ছিনিয়ে নিয়েছে। সম্বিত ফেরে সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বরে, ‘কী হল বোসো।’

‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ বসছি। কোথায় যাব? আ…আপনি যে বললেন কথা…’ মাঝখানেই থামিয়ে দেয় সৌহার্দ্য, ‘কেন বিশ্বাস নেই আমার উপর?’

‘এবাবা আমি এভাবে বলতে চাইনি’, হঠাৎ এই পরিবর্তনে হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া।

‘তাহলে?’ আর একটাও কথা বলে না শ্রেয়া। গাড়ি ছুটতে থাকে। মিনিট পনেরো পরে একটা রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করায় সৌহার্দ্য। ভিতরে টেবিল আগে থেকেই বুক করা ছিল। সেখানে গিয়ে খাবারের অর্ডার দেয় সে।

‘দ্যাখো আমি ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে পারি না। স্পষ্টই বলছি, বাবা-মা কাল তোমাদের বাড়িতে যাবেন আমাদের বিয়ের কথা বলতে।’ কথা সরে না শ্রেয়ার। কেবল শুনতে থাকে। এতটাও আশা করেনি শ্রেয়া। বলে যায় সৌহার্দ্য। ‘তুমিও খুব ভালো করে জানো যে তোমার বাবা-মা এই বিয়েতে অমত করবেন না। তবে তোমার হ্যাঁ বলার আগে, আমার মনে হয় তোমাকে কিছু কথা জানানো উচিত। অবশ্যই আমার পরিবারের কথা। আমার জীবনে আমার বাবার স্থান সবার উপরে। আমার জন্য ওনার অবদান ভোলার নয়। সত্যিই আমি ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনি আমার জন্মদাতা নন। আমার জন্মের কয়েকমাস পরেই আমার বাবা মারা যান।

মা যে-কলেজে পড়াতেন বাবাও সেই কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সঙ্গে মামার বন্ধুও। মামার সূত্রে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে আসতেন আর আমার সঙ্গে আমার মতো করেই মিশতেন, খেলা করতেন। সেই সময় বাড়িতে মায়ের আবার বিয়ে দেওয়ার কথা চলছে। উনি আমাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে শুনেই মামাকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘তাহলে সৌহার্দ্যর কী হবে? নতুন মানুষটি সৌহার্দ্যকে মেনে নেবে এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারে? এই সব সম্পর্কে সবসময়ই একটা রিস্ক থেকে যায়। সৌহার্দ্যর ব্যাপারে আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তোদের যদি অমত না থাকে আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবন ওকে বুঝতেই দেব না যে, আমার সঙ্গে ওর রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই।’ বলতে বলতে চোখে জল ভরে আসে সৌহার্দ্যর। বাবার প্রতি তার আবেগ একটু বেশিই।

সামলাতে সৌহার্দ্যের হাতটা চেপে ধরে শ্রেয়া। নিজেকে সামলে নেয় সৌহার্দ্য। অপলক দৃষ্টিতে শ্রেয়ার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার বলতে শুরু করে সে।

‘মামার বাড়ি থেকে মেনে নিলেও বাবার বাড়িতে মানে ঠাকুরদা ব্যাপারটা একেবারেই ভালো চোখে নেননি। শুধুমাত্র আমার জন্য সেদিন বাবা নিজের বাবা-মা, বিশাল সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছিল। এখানেই শেষ নয়, সেইসময় বাবা আইএএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরীক্ষার সময়তেই এমারজেন্সি পিরিয়ডে মায়ের ইউটেরাসের অপারেশন করাতে হল। মায়ের বেড রেস্ট। বাবা পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি, কেরিয়ার ভুলে আমার আর মায়ের দেখাশোনা করে গেছে।’

সৌহার্দ্য আবেগতাড়িত হয়ে বলে যাচ্ছিল। বাবার প্রতি তার অসীম ভালোবাসা প্রতিটা কথায় ঝরে পড়ছিল।

‘এটা বললেও বোধহয় ভুল হবে না যে বাবা নিজের সর্বস্ব আমার উপর সমর্পিত করে দিয়েছিল। এখন বাবাকে বাকি জীবনটা সুখে রাখাই হল আমার একমাত্র কর্তব্য। আমার বউকেও এটা মেনে চলতে হবে। দায়িত্বটা আমার বউয়ের উপরও বর্তাবে। জানি শ্রেয়া, শুধুই পরিবারের লোকজনই নয়, আমরাও একে-অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। হয়তো বা ভালোও বেসে ফেলেছি। তবুও হ্যাঁ বলার আগে ভালো করে ভেবে নাও। সারাজীবন তোমাকে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানে বাবা-মাকে নিয়েই থাকতে হবে।’ উত্তরের আশায় বসে থাকে সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্যর হাতটা আর একটু জোরে চেপে ধরে শ্রেয়া। বলে, ‘মেসোমশাই আর মাসিমার মতো সহূদয় মানুষের সঙ্গে থাকতে আমার কেন কারওরই কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হলেও কথা দিচ্ছি কোনওদিন কোনওরকম অভিযোগ করব না তোমাকে।’

শুনে খানিক আশ্বস্ত বোধ করে সৌহার্দ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর শ্রেয়ার হাতটা মুঠোর মধ্যে ভরে নেয়।

‘বিশ্বাস করো আমি জানতাম তুমি পারবে।’

মাস দেড়েক পরে চার-হাত এক হয়ে গেল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী এক অফিসে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করতে পারে না। সেই কারণে চাকরি ছাড়তে দ্বিধাবোধ করেনি শ্রেয়া। মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর শ্বশুর-শাশুড়ির কোচিং সেন্টারে যোগ দিয়েছিল সে। ধীরে ধীরে অসীমবাবুর বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রেয়া। কাজের সূত্রে দিনের বেশিরভাগ সময়টা একসঙ্গে কাটানোর জন্য শ্বশুর-বউমার সম্পর্কটা আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। অসীমবাবু স্নেহও করতেন তেমনভাবেই।

‘ভাগ্যিস অফিসের দায়িত্বটা নিয়েছিলে শ্রেয়া। সারাদিন কোচিং ক্লাস করানোর পর আর পেরে উঠছিলাম না।’ শ্রেয়া মমতা অনুভব করে শ্বশুরের প্রতি।

‘ঠিক আছে বাবা, নতুন অফিসে জয়েন করলেও তোমার এই অফিসের কাজগুলো ছুটির দিনে বসে আমিই করে দেব।’

‘খানিক স্বস্তি পেলাম। সত্যিই আর পারছি না, হাঁফিয়ে উঠছি। আর কতদিন পারব তাও জানি না। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ নিজের কাছেই নিজে হেরে যাচ্ছি।’ শ্বশুরের কথাগুলো কেমন আর্তনাদের মতো মনে হল শ্রেয়ার।

অবাক হয়ে শ্রেয়া বলে, ‘কী বলছ বাবা! মনের সাথে যুদ্ধ মানে!’

‘সৌহার্দ্য বা গীতাকে একথা বলা যায় না। তাছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে ওরা আমাকে বার করতে পারবে না।’

‘তাহলে কে পারবে?’

‘তুমি, কেবলমাত্র তুমি।’ অসীমবাবুর চোখেমুখে তখন বিমর্ষতার স্পষ্ট ছাপ।

‘আমি! আমি কীভাবে?’ প্রহেলিকার থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না শ্রেয়া।

‘আমার করুণ কাহিনি শুনবে?’

‘অবশ্যই। আমায় বলে যদি একটু হালকা হতে পারো, তা বলো না বাবা।’

‘এখানে নয়, চলো একটু খোলা হাওয়ায় বেরোই।’

দারোয়ানকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে একটা বিশাল জমিদারবাড়ির সামনে থামল গাড়িটা।

‘এই বাড়িটা দেখছ। এটা আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে। গীতা আর আমার বিয়েটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমাদের বিয়ের পর বাবা একটাই শর্ত রেখেছিলেন, এই বিশাল সম্পত্তির মালিক শুধুমাত্র তার রক্তের সম্পর্কের নাতি বা নাতনি অর্থাৎ আমার নিজের সন্তানই পাবে। সৌহার্দ্য নয়। সৌহার্দ্যের জন্যই তো গীতাকে বিয়ে করা, আর বাবা বলে কিনা সে-ই…। রক্ত চড়ে গেল মাথায়, ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। এমনিতেই গীতার গর্ভাশয়ে ফ্রাইব্রয়েডের সমস্যা ছিলই, হাতিয়ার করলাম সেটাকেই। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে গীতার জরায়ুটাই শরীর থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। তারপর আর কখনও এ-বাড়ির পথ মাড়াইনি।’ মিনিট খানেক স্থির হয়ে বসে রইলেন অসীমবাবু।

‘তারপর? তারপর কী হল?’

‘মাস আষ্টেক হল বাবা মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে উনি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, ওনার দাহ-সংস্কার যেন আমার হাতেই হয়। সেইমতো ডেকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সমস্ত সম্পত্তি আমার নামেই করে গেছেন, কারণ তিনি কখনও চাননি জায়গা-জমি-টাকাপয়সা বংশের বাইরে অন্য কারওর কাছে যাক। সঙ্গে রেখে গেছেন একটা চিঠিও। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই আত্মগ্লানিতে তিল তিল করে মরছি।’

‘কেন, কী এমন লেখা ছিল সেই চিঠিতে?’

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন অসীমবাবু। তারপর বলতে শুরু করেন ‘ওনার বংশ নিঃশেষ করার জন্য কেবলমাত্র আমিই দায়ী, এমন অভিযোগের পাশাপাশি একটা তীব্র আর্তি… ‘পারলে নিজের বংশজকে পৃথিবীতে নিয়ে এস। বংশরক্ষা কোরো নইলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না। বেঁচে থাকতে তো বাবার ইচ্ছের দাম দিলে না, অন্তত মারা যাওয়ার পর যদি বাবাকে একটু সম্মান দাও।’

অসীমবাবুর সারা মুখে একটা ভেঙে পড়া বিষণ্ণতার ছাপ।

‘তারপর থেকেই অনুশোচনায় ভুগছি। কোথাও একটা মনে হচ্ছে, বাবার কথাটা বোধহয় কিছুটা হলেও সত্যি। যদি আমার আর একটা সন্তান এই পৃথিবীতে আসত তাতে তো সৌহার্দ্য-র প্রতি ভালোবাসা কমে যেত না। ছেলে বা মেয়ে যাই হতো দুজনে একসাথে বড়ো হতো। এতে আমার বাবাও শান্তি পেতেন আর বংশরক্ষাও হতো। এখন ভাবি সেদিন অতটা কঠিন সিদ্ধান্ত না নিলেই পারতাম। অন্তত একটা বাচ্চার পরেও তো গীতার অপারেশনটা করাতে পারতাম।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অসীমবাবু।

‘আমি তোমার ফিলিংসটা বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু এখন সবই তো হাতের বাইরে।’

‘না, একটা রাস্তা এখনও আছে, তুমি, একমাত্র তুমি আমায় সাহায্য করলে এখনও সম্ভব শ্রেয়া। অবশ্যই যদি তুমি চাও।’

‘এক্ষেত্রে আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শ্রেয়া।

শ্রেয়ার হাতটা চেপে ধরে অসীমবাবু। ‘কেউ জানতে পারবে না শ্রেয়া। সবাই জানবে সৌহার্দ্য-র সন্তান। শুধু তুমি আর আমি…’ তড়িতাহত হয়ে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় শ্রেয়া। শ্বশুরের কথা শুনে আঁতকে ওঠে সে।

বউমার প্রতিক্রিয়া দেখে অসীমবাবু বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘না-না শ্রেয়া তুমি ভুল বুঝছ। আমি কোনওরকম অশ্লীল বা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বলছি না তোমাকে! স্পার্ম ট্রান্সপ্ল্যান্ট মানে আইভিএফ-এর কথা তো নিশ্চয়ই তুমি শুনে থাকবে। প্লিজ শ্রেয়া যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়াও, তাহলে আমিও শান্তি পাই, আর বাবার আত্মাও খানিক স্বস্তি পায়।’

পরমপূজ্য শ্বশুরের আত্মতুষ্টির কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে পড়ে শ্রেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে, এমন জঘন্য কথাটা বলল কীভাবে বাবা? একবারও বাধল না! ছিঃ ছিঃ ছেলের বউয়ের সম্পর্কে এমনটা ভাবতে পারে কোনও শ্বশুর? সৌহার্দ্য-র বিশ্বাস, ভালোবাসার এই দাম দিল মানুষটা! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সৌহার্দ্যর কাছে কখনও এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না আর বিশ্বাস করলেও এই আঘাত সহ্য করতে পারবে না। পায়ের নীচ থেকে যেন অযাচিত ভাবে খানিকটা মাটি সরে গেছে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে অভিশপ্ত সেই বাড়ি থেকে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে আসে শ্রেয়া। কোথায় যাবে সে, কাকে বলবে, তার এই লজ্জাকর পরিস্থিতির কথা। সৌহার্দ্যও কী করে করতে পারবে তার এই দুঃস্বপ্নের অবসান?

 

বিদায়

অনুভা কাগজ পড়তে পড়তে রিমার মুখের দিকে তাকালেন। একমাত্র মেয়ে। অরূপ এবং অনুভা বহু আদরে নিজেদের একমাত্র সন্তানকে বড়ো করে তুলেছেন। কোথাও কিছু ফাঁক রাখেননি। শহরের নামি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে এখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। রিমার এখন বয়স মাত্র উনিশ বছর। অথচ অনুভা আশ্চর্য হয়ে যান রিমার সাহস এবং কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বলেই ফেলেন, ‘এটা তুই কী বলছিস রিমা?’

‘হ্যাঁ মা, আমি অনেক ভেবেচিন্তেই ডিসিশন নিয়েছি। কলেজের ওই একঘেয়েমি ক্লাস আর পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না। ঠিক করেছি অভিনেত্রী হব।’

অনুভার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া এক্সপ্রেশন রিমার চোখ এড়ায় না, ‘এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? অনেকদিন ধরেই খোঁজখবর নিচ্ছিলাম শুধু তোমাদের আগে জানাইনি। অনন্যাকে চেনো তো? আমার সঙ্গে কলেজে পড়ে। নামটা লেখানো মাত্র, ক্লাস করে না। টিভির পর্দায় এখন ও বেশ পরিচিত মুখ। ওই আমাকে মুম্বইয়ের এক এজেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ফোনে কয়েকবার ওই এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাকে মুম্বই গিয়ে থাকতে হবে, তবেই অডিশনের সুযোগ ও করিয়ে দেবে। তার আগে অবশ্য খানিকটা গ্রুমিংয়েরও দরকার আছে।’

অনুভা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের মুখের দিকে। এই সেদিনের সেই ছোট্ট রিমা নিজের মধ্যে এত তেজ আনল কীভাবে, সেটা অনুভা ভেবে পেলেন না। তবুও মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে ছাড়লেন না, ‘এতদূর একা গিয়ে থাকবি কিন্তু ওখানে কাউকেও তো তুই চিনিস না। আর ওই এজেন্টকেও তো সামনাসামনি কখনও দেখিসনি। ওর উপর আমরা ভরসা করব কী করে? এছাড়া তোর বাবাকেও তো সব খুলে বলতে হবে। উনি মত দেবেন বলে মনে হয় না।’

‘আমি মুম্বই যাব ঠিক করে নিয়েছি’, রিমার কণ্ঠস্বর কঠোর শোনায়, ‘তোমরা আমাকে ভরসা করবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার। যেমন করেই হোক অভিনয়ের জগতে আমাকে খ্যাতি পেতেই হবে, তবেই তো আমি টাকা রোজগার করতে পারব। টাকা এবং খ্যাতি, এই দুটোই আমার স্বপ্ন।’

অরূপ বাড়িতে আসতে অনুভা মেয়ের ইচ্ছের কথা স্বামীর কাছে জানান। অরূপ সব শুনে বুঝতে পারেন মেয়ে যখন জেদ ধরেছে ওকে আটকাবার আর কোনও উপায় নেই। অনুভাকে শান্ত করতে বলেন, ‘আমার মত যদি শোনো অনুভা, তাহলে মেয়েকে আটকাবার চেষ্টা কোরো না। রিমা বড়ো হয়েছে। আইনের চোখে ও এখন অ্যাডাল্ট। সুতরাং আমরা আটকাবার চেষ্টা করলে ও যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। তার চেয়ে বরং ওর ইচ্ছেটাকে মেনে নিলে সম্পর্কটা টিকে থাকবে। আর ওর ভালোমন্দের দায়টা তো আমাদেরই। তবে একটা কথা, ওর কাছ থেকে এজেন্টের নম্বরটা নিয়ে রেখো, আমি একবার লোকটার সঙ্গে কথা বলে ওকে যাচাই করে নিতে চাই।’ অনুভা চুপ করে থেকেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন।

খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি হতে মেয়েকে সরাসরি অরূপ ধরলেন, ‘হ্যাঁরে, তোর মায়ের কাছে শুনলাম তুই নাকি মুম্বই যেতে চাস অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য। ভালো কথা। আশা করি এই পেশার ভালোমন্দ সবকিছু জানার পরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। এই পেশায় যেমন অর্থ, খ্যাতি আছে তেমনি একাকিত্ব, অবসাদও আছে। খ্যাতি ধরে রাখা কিন্তু কঠিন কাজ। তুই কি প্রস্তুত এই কঠিন পথে পা ফেলতে? ভেবে দ্যাখ কিন্তু।’

‘বাবা, আমি সবকিছু জেনেই অভিনেত্রী হতে যাচ্ছি। আমি জানি আমি সফল হবই।’

ট্রেন ছুটে চলেছে টিনসেল টাউনের দিকে। বাতানুকূল কামরার চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয় রিমা। মনে মনেই বলে, ‘চারপাশে শুধু মানুষের ভিড়। আজ আমি এই ভিড়েরই একটা

অংশমাত্র। এই লোকের ভিড়ে এদের সকলের মতো আজ আমি হারিয়ে গেছি, কেউ আমাকে চেনে না। আমার নামও কেউ জানে না। অথচ একটা এমন দিন আসবে যেদিন লোকের মুখে মুখে আমার নাম ঘুরবে। এক দেখায় লোকে আমাকে চিনে ফেলবে।’ চারপাশের ভিড় অগ্রাহ্য করেই রিমার মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।

রিমার চোখের সামনে মুম্বইয়া এজেন্টটার মুখ ভেসে ওঠে। আরব সাগরে খড়কুটোর মতো ওই এজেন্টটিই তো ভরসা। রিমার পোর্টফোলিও দেখে ও চার-পাঁচটা টিভি ধারাবাহিকের প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে কথা বলেছে। ওর জোরাজুরিতেই মুম্বইতে এসে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া, কারণ এজেন্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে শহরে এসে না থাকলে অডিশনের সুবিধা ও করিয়ে দিতে পারবে না। তবে অডিশন দিলে নাকি কোথাও না কোথাও রিমার চান্স হয়েই যাবে এই আশ্বাস এজেন্ট দিয়েছে।

মুম্বইতে পা দিয়েই প্রথমে রিমা এজেন্টকে ফোন করে। ওরই পাঠানো গাড়িতে বান্দ্রার অফিসে গিয়ে এজেন্টের সঙ্গে দেখা করে। এজেন্টই রিমাকে নিয়ে যায় অফিসের কাছাকাছি একটি লোকালিটিতে যেখানে সস্তায় পিজি থাকার ব্যবস্থা রিমার জন্য করা হয়েছে। একটা ঘরে চারজন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনটে অলরেডি দখল করেছে তিনটি অবাঙালি মেয়ে, চতুর্থজন হল রিমা।

ঘরের দশা দেখে রিমা খানিকটা দমে যায়। এজেন্টটা প্রবাসী বাঙালি তাই রিমার ধারণা ছিল বাঙালিদের সুবিধা অসুবিধাটা অন্তত লোকটা বুঝবে। এরকম একটা ঘর ঠিক করে রাখবে ও, রিমা ভাবতে পারেনি।

সংযত হয়ে রিমা প্রশ্ন করে, ‘আপনি তো অনেক বড়ো বড়ো কথা বলেছিলেন, এরকম একটা ঘর পছন্দ করলেন কীভাবে?’

‘ডোন্ট বি সিলি রিমা। এরকম ঘর না তো কি জুহুর বাংলোতে থাকবে! ভালো ঘর মানে ভালো টাকা। স্টার হতে পারলে তবেই তোমার হাতে টাকা আসবে আর এর জন্য তোমাকে প্রচুর পরিশ্রমও করতে হবে। এসব কথা এখন ছাড়ো। কাল তোমার জন্য একটা অডিশনের ব্যবস্থা করে রেখেছি। সকালে ঠিক দশটার সময় এই ঠিকানায় পৌঁছে যেও’, বলে রিমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিল এজেন্ট।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে রিমা সময়ের আগেই নির্দেশিত ঠিকানায় পৌঁছে গেল। নতুন জায়গা, অচেনা লোকজন রিমাকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলছিল। অডিশনের জন্য লম্বা লাইন। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অবশেষে ডাক এল। তখন প্রায় তিনটের ঘরে ঘড়ির কাঁটা। রিমার বেহাল অবস্থা। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্তিতে সারা শরীর ঝিম মেরে গেছে। তবুও নিজেকে কিছুটা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার উপযুক্ত করে নিয়ে ভিতরে পৌঁছল রিমা। যে-লাইনগুলো ক্যামেরার সামনে বলার জন্য দেওয়া হয়েছিল সেগুলো মনে মনে ঝালিয়ে নিল। ভিতরে ঢুকে সামান্য কথাবার্তার পর সোজা ক্যামেরার সামনে ওকে দাঁড়াতে বলা হল। মুহূর্তে সব কিছু যেন গুলিয়ে গেল রিমার। যে লাইনগুলো ওকে বলার জন্যে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সব গুলিয়ে তাল পাকিয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না। স্বাভাবিক ভাবেই অডিশন-এ পাশ করতে পারল না রিমা।

টানা তিনমাস একটাও অডিশন রিমা উতরোতে পারল না। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই কেমন জানি সব গোল পাকিয়ে যেত, চেহারায় এক্সপ্রেশন কিছুতেই ফোটাতে পারত না। সঙ্গের টাকাপয়সাও শেষ হবার জোগাড় হল। রিমার রুমমেটদেরও সেই একই অবস্থা। রুপোলি পর্দার মোহ সবাইকে এই মায়া নগরীতে টেনে এনেছিল ঠিকই কিন্তু বাস্তবে কাজ জোগাড় করা অতটাও সহজ ছিল না।

ক্যামেরার সামনে স্বাভাবিক না হতে পারাই যে তার ব্যর্থতার কারণ সেটা রিমা বুঝতে পারছিল। এজেন্টের অভিজ্ঞ চোখও সেটা বুঝতে পেরে রিমাকে প্রথমে মডেলিং-এ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।

এজেন্টের কথামতো রিমা ওয়াডালায় একটি মডেলিং এজেন্সিতে এসে উপস্থিত হল। সেখানেও মেয়েদের ভিড়। অপেক্ষা করতে করতে রিমা লক্ষ্য করছিল ওই এজেন্সিরই একটি ছেলে, মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাপ নিচ্ছে আর জোরে জোরে অন্য একটি ছেলেকে মেয়েদের নামের সঙ্গে সঙ্গে মাপগুলো বলছে। অন্যজন কাগজে সেগুলো লিখে নিচ্ছে। রিমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির মাপ নেওয়ার সময় ছেলেটি অশালীন ভাবে মেয়েটির নিতম্বে চাপ দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আসলি হ্যায়?’ রিমার এসমস্তই অত্যন্ত কুরুচিকর মনে হলেও মনে মনে ভাবল আগুনে পুড়েই খাঁটি সোনা হওয়া যায়।

ধীরে ধীরে এই ধরনের কালচারে রিমা অভ্যস্ত হয়ে উঠল। ক্যামেরার সামনে জড়ত্ব কাটাতে শুরু করল। ছোটোখাটো বিজ্ঞাপনের কাজ আসতে লাগল সেইসঙ্গে টাকা পয়সার অভাবও মিটে গেল। মুম্বইতে থাকাটাই যেখানে অসম্ভব মনে হচ্ছিল, সেটাই রিমার কাছে এখন সম্ভব মনে হল।

রিমার চোখে এমন একটা জেদ ছিল এবং রিমার চেহারার বৈশিষ্ট্য দেখে রিমার এজেন্ট বুঝে গিয়েছিল, মেয়েটি এই ইন্ডাস্ট্রিতে হারার জন্য আসেনি। ইতিমধ্যে টিভি ধারাবাহিকের আর-একটি অডিশনের জন্য সে রিমাকে পাঠাল। এবার আর রিমাকে অসফল হতে হল না। ধারাবাহিকে একটি পার্শ্বচরিত্রে রিমা নির্বাচিত হল। পার্শ্বচরিত্র হলেও গল্পে চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রথম রিমার মনে হতো, অফিসে কাজ করছে ও। পরিশ্রম, সময়ে পৌছনো সবই করতে হচ্ছে উলটে শনি-রবিবারেও কোনও ছুটি নেই। জ্বর, শরীর খারাপ হলেও ওষুধ খাও আর কাজে এসো। কিন্তু আস্তে আস্তে ধারাবাহিকের টিআরপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিমার করা চরিত্রটাও দর্শকদের কাছে পর্দার পরিচিতি মুখ হয়ে দাঁড়াল। রিমার বাড়িওলাও ওর সঙ্গে আগের থেকে অনেক মার্জিত ভাবে কথা বলা শুরু করল। বাড়িওলার টিনএজার ছেলেটিও মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের নিয়ে রিমার কাছে পৌঁছে যেত সেলফি তোলার অজুহাতে।

রিমাও ব্যাপারটা উপভোগ করতে আরম্ভ করল এবং ওর এজেন্টও ওকে সাবধান করল, ‘রিমা, এখন তুমি একজন সেলিব্রিটি। হুটহাট করে যে-কোনও পোশাকে দোকান-বাজার চলে যাওয়া তোমাকে এখন মানায় না। দরকার পড়লে অনলাইনে অর্ডার করো।’

ইতিমধ্যে অভিনয়ের ব্যস্ততা রিমাকে নিজের মা-বাবার থেকেও অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও কাজের প্রেশারে ফোনে কথাবার্তাও একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করলে অনুভা স্বামীর সঙ্গে মুম্বই কিছুদিনের জন্য ঘুরে যেতেন। তাতেও বিশেষ লাভ হতো না কারণ বাড়িতে রিমাকে কতটুকুই বা তাঁরা পেতেন! কিন্তু মেয়ে সম্পর্কে কানাঘুষো কলকাতায় বসেও তাঁদের কানে আসতে থাকত। এবারে তাই অনুভা ঠিক করেই এসেছিলেন মেয়ের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলবেন।

‘হ্যাঁরে রিমা, খবরের কাগজগুলোতে তোর সঙ্গে ওই ছেলেটার নাম জড়িয়ে রোজই কিছু না কিছু ছাপা হচ্ছে। কী ব্যাপার বল তো! তোর এখন বয়স অল্প। এই ধরনের খবর যদি বেরোতে থাকে কাগজে তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার। আমি জানি ওরা যা পারে কাগজে ছেপে দেয়। কারও বদনাম হলে ওদের কি?’

‘ওই নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না’, অল্প কথায় উত্তর সারলেও রিমা এই বিষয়টা নিয়ে খুবই সচেতন। অভিনয় জগতে প্রায় দুই বছর কাটাবার পর রিমা এখন অনেক বেশি পরিপক্ব। ওর সহঅভিনেতা সিদ্ধার্থকে রিমা প্রথম থেকেই খুব পছন্দ করে। কাজের খাতিরে দুজনকে প্রায়শই সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হতো। রিমার চোখের ভালোলাগা, সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায় এবং গসিপ ছড়িয়ে পড়ে। সিদ্ধার্থও জেনে ফেলে রিমার হূদয়ের দুর্বলতা।

পঁয়ত্রিশ বছর উত্তীর্ণ সিদ্ধার্থ সময় নষ্ট না করেই রিমাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। সিদ্ধার্থর সঙ্গে একা থাকার এই সুযোগ রিমারও ছেড়ে দিতে মন চায় না। তারপর থেকেই কখনও কফি শপে, ডিস্কোয় অথবা কারও পার্টিতে শুটিং-এর পর দুজনে একসাথে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দুজনের এই মেলামেশা চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মিডিয়ার কাছে।

সেদিনটা, প্রাণ থাকতে রিমা কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সিদ্ধার্থর সঙ্গে ডেটে বেরিয়েছিল রিমা। পাঁচতারা হোটেলে টেবিল বুক করে রেখেছিল সিদ্ধার্থ। ডিস্কোতে নাচতে নাচতে রিমা বুঝতে পারেনি কখন ভিড় থেকে সরে গিয়ে সামান্য আলোআঁধারইতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। সিদ্ধার্থর শক্ত বাহু তার কোমর বেষ্টন করে তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে এক করে নিয়েছে। কিছু বলা বা বোঝার আগেই সিদ্ধার্থের তপ্ত চুম্বন এসে পড়ে রিমার নরম ঠোঁটের উপর। একবার নয় বারবার। মিনিট, সেকেন্ড সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রিমা। ভালো খারাপ সব মুছে যায় মন থেকে। সেই রাতটা হোটেলেরই একটা রুমে এক শয্যায় কাটে রিমা আর সিদ্ধার্থর। নিজেকে উজাড় করে তুলে দেয় সিদ্ধার্থের চাহিদার আগুনে।

এরপর আর লুকোচুরি, রাখঢাক কিছুই রাখেনি রিমা। প্রকাশ্যে হাতে হাত দিয়ে দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছে, ভিড়ের মধ্যেই সিদ্ধার্থর গলা জড়িয়ে ধরে উষ্ণ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। মিডিয়াও চুপ করে থাকেনি। ছবির পাশাপাশি ফলাও করে রিমা, সিদ্ধার্থর সম্পর্কের রঙিন বর্ণনা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে কার্পণ্য দেখায়নি। ফলে দুজনের সম্পর্কের কথা সাধারণ লোকের মুখে মুখে ফিরেছে এমনকী অভিনয় জগতের সহশিল্পীরা ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেও ছাড়েনি।

আজ রিমা তাই মায়ের প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে গেল যদিও ওর মনে হল মায়ের চিন্তাটা অমূলক নয়।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে এজেন্টের ফোন দেখে রিমা একটু অবাকই হল। এত রাতে প্রয়োজন ছাড়া ও কথা বলে না তবুও ফোন তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘রিমা, টিভিতে সন্ধে সাতটার স্লটে যে ধারাবাহিকটা চলছে তার লিড অ্যাক্ট্রেস প্রেগনেন্ট। আর কয়েকদিনই ও কাজ করবে। তুমি ওর জায়গায় কাজ করতে রাজি থাকলে আমি ডাইরেক্টরের সঙ্গে কথা বলব তোমার জন্য।’

‘হ্যাঁ, কথা বলুন আমি কাজ করব’, পরপর কাজের অফার আসাতে রিমা খুশি হয়, মনে মনে অহংকারও বোধ করে।

সকালে শুটিং-এর কাজ না থাকাতে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে রিমা। ফোনটা বাজতেই আলস্য ভরে ফোনটা কানে নেয়। ‘আজকের খবরের কাগজটা পড়েছো রিমা?’ ঈশানীর গলার আওয়াজ শুনে একটু অবাক হয়ে যায়। দুটো ধারাবাহিকে একসঙ্গে কাজ করেছে ঠিকই কিন্তু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। সামনাসামনি দেখা হলে হাই…হ্যালো। ব্যস ওই পর্যন্তই দৌড়।

‘না, এখনও পড়া হয়নি। নতুন একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সঙ্গে সাতটার স্লটে যে ধারাবাহিকটা চলছে তার লিড অ্যাক্ট্রেস হওয়ার একটা অফার পেয়েছি।’

‘সে কী! ওটাতেই তো যে লিড রোলে এখন করছে সে আসলে সিদ্ধার্থের গার্লফ্রেন্ড। ওর সন্তানেরই মেয়েটি মা হতে চলেছে। আসছে সপ্তাহেই ওরা দুজন বিয়ে করছে। আমি ভাবলাম তুমি আর সিদ্ধার্থ এত ভালো বন্ধু, তুমি নিশ্চই এই আনন্দের খবর আগেই পেয়ে থাকবে।’

ঈশানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিমা ফোনটা নামিয়ে রাখে। সত্যিই কি সিদ্ধার্থ তার সঙ্গে এমনটা করতে পারে? ঈশানীরই বা কী স্বার্থ থাকতে পারে মিথ্যা কথা বলায়। এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক সিদ্ধার্থ, মেনে নিতে রিমার কষ্ট হয়। বসে থাকতে পারে না রিমা। হাত-পা মনে হয় যেন অবশ হয়ে আসছে। শুয়ে পড়ে বিছানায়। অনুভা, অরূপ কেউই পারেন না ওকে তুলে খাওয়াতে।

সন্ধের সময় রিমার এজেন্ট, রিমার খোঁজে বাড়িতে এসে পৌঁছোয়। অনুভা ওকে রিমার ঘরের দোরগোড়ায় ছেড়ে দিয়ে অন্য ঘরে চলে যান। কারণ উনি ভালো করেই জানেন বাড়ির লোকের সামনে কাজের কথাবার্তা রিমা একেবারেই পছন্দ করে না।

‘কী ব্যাপার রিমা? সকাল থেকে তোমার ফোন ট্রাই করছি, ধরছ না কেন?’ বলতে বলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এজেন্ট। রিমার বিশ্রস্ত অবস্থা দেখে মুহূর্তেই বুঝতে পারে সিদ্ধার্থর খবর আগেই এসে পৌঁছেছে রিমার কানে।

রিমাকে উঠিয়ে বসায়। রিমা সামলে নিতে একটু সময় নেয়। ওকে সহজ করার জন্য বলে, ‘এত আপসেট হওয়ার কী আছে? এই ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকে।’

‘রিয়েলি? সত্যিই আপনার মনে হয় আমার আপসেট হওয়া উচিত নয়?’

‘দ্যাখো রিমা, যা হয়ে গেছে ভুলে যাও। চামড়া মোটা না করলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকতে পারবে না। টিভির জগৎটাই আলাদা। রাতারাতি খ্যাতি, প্রতিপত্তি… কাল পর্যন্ত তুমি সকলের অজানা ছিলে আর আজ ঘরে ঘরে তোমায় নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। তোমার কাছে অর্থ আছে, খ্যাতি আছে, জনপ্রিয়তার স্বাদ সবেই পেতে শুরু করেছ। আর তোমার বয়সটাই বা কী? এখনও বহুদিন তোমাকে কাজ করতে হবে। সুতরাং এবার নিজের একটু যত্ন নাও। যত তোমার নামডাক হবে ততই তুমি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে এবং এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। আবেগে ভেসে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া তোমার অনুচিত। নিজেকে শক্ত করো। প্রেমে বিহ্বল হয়ে পড়ার মতো ফালতু সময় তোমার এখন নেই।’ এজেন্ট রিমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই একইরকম হয় না। রিমা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সিদ্ধার্থ তাকে এভাবে ধোঁকা দেবে। এজেন্টের হাজার বোঝানো সত্ত্বেও রিমা বুঝতে পারছিল কাজে ঠিকমতো মন বসাতে পারছে না। হাতের মুঠোয় আসা ধারাবাহিকের লিড রোলটাও এই করে রিমার হাতছাড়া হয়ে গেল। মেলামেশা করাও বন্ধ করে দিয়েছিল রিমা। যে-ধারাবাহিকটায় ও কাজ করছিল তার কাজও প্রায় শেষ হওয়ার মুখে ছিল। হাতে কাজ না থাকলেও টিভির অভিনেত্রী হিসেবে তাকে নিজের ঠাটবাট বজায় রেখেই চলতে হচ্ছিল। হাতের জমানো টাকাও প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় রিমা নিজের এজেন্টকে গিয়ে ধরে। মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিল রিমা, হাতে যা কাজ পাবে তাতেই রাজি হয়ে যাবে। এজেন্টের চেষ্টায় একটা রিয়ালিটি শো-তে কাজ করার সুযোগ হয়ে যায়। কাজটা পেয়ে রিমা খুশিও হয় কারণ সেটার পুরো শুট্-টাই বিদেশে হওয়ার কথা ছিল ফলে এই বাহানায় বিদেশ যাওয়ারও সুযোগ হয়ে যায় রিমার।

শো-তে গিয়ে রিমার আলাপ হয় রঞ্জনের সঙ্গে। রঞ্জন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিল মুম্বইতে মডেলিং করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু আশা সফল হয়নি। কাজের জন্য যখন হয়রান হয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তখনই হঠাৎ করে এই শো-টার কাজ হাতে পায় রঞ্জন। বিদেশে একা থাকার কষ্টটাও লাঘব হয়ে যায় রিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর।

রিমার অবস্থাটাও খানিকটা রঞ্জনের মতোই হয়। ভালোবাসায় একবার অসফল হওয়ার পর রঞ্জনকেই আঁকড়ে ধরে রিমা। কয়েক মাস বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে দেশে ফেরার পথে বিমানেই রঞ্জন রিমাকে প্রোপোজ করে, ‘রিমা তোমাকে আমি আমার পাশে পেতে চাই সারা জীবন। তোমাকে ভালোবাসি।’

রিমাকে মুখে ‘হ্যাঁ’ বলতে হয় না, ওর চোখে-মুখে উপচে পড়া আনন্দই রঞ্জনকে তার প্রত্যাশিত উত্তর দিয়ে দেয়।

দুজনে ঠিক করে মুম্বই ফিরে তারা একসঙ্গে থাকবে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। কথামতোই শোতে পাওয়া পুরো টাকা দুজনে একত্রিত করে এবং রঞ্জনের নামে লোন অ্যাপ্লাই করা হয় নতুন ফ্ল্যাট কেনা হবে বলে। রঞ্জন পরিষ্কার রিমাকে লোন নিয়ে মাথা ঘামাতে বারণ করে দিল, ‘তোমাকে টাকার লোন নিয়ে ভাবতে হবে না। প্রতি মাসে মাসে আমি ঠিক শোধ করতে থাকব টাকা। কিন্তু ফ্ল্যাটটা সাজাবার দায়িত্ব তোমার। ওই ব্যাপারে আমি কোনও কথা বলব না।’ রঞ্জনের দায়িত্ববোধ রিমার সব চিন্তা দূর করে দেয়। মনে শান্তি অনুভব করে রিমা।

মুম্বইতে এসেই রিমা নিজের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে রঞ্জনের কাজের জন্য। এজেন্টের সাহায্যে পরপর কাজও আসতে থাকে রঞ্জনের কাছে। নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওঠে দুজনে। কাজ থেকে কিছুদিনের বিরতি নিয়ে রিমা ব্যস্ত হয়ে যায় নতুন ফ্ল্যাট সাজাতে। আশেপাশের প্রতিবেশীদের কাছে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়েই ওরা লিভ ইন শুরু করে। দিনগুলো কাটতে থাকে স্বপ্নের মতো আর রাতের আঁধারে দুজনে ভাসতে থাকে উষ্ণ ভালোবাসায়। নরম বিছানা ছুঁয়ে পড়ে থাকা দুটো তপ্ত শরীর তৃপ্ত হওয়ার বাসনায় ভুলে যায় সমাজ, বাস্তব জগতটার কথা। বিয়ে শব্দটা অনাহূত অতিথির মতোই ওদের মনের গভীরে প্রবেশ করার পথ পায় না।

হুঁশ ফেরে যখন রিমা নিজের শরীরে নতুন একটি প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে। কী পরিচয়ে বড়ো করবে সন্তানকে? এতো তার ভালোবাসার সন্তান, তবুও রিমা চিন্তা করে, সমাজ কি রিমার মনের কথা বুঝবে?

রাতে রঞ্জন বাড়ি ফিরলে, বিছানায় শুয়ে রঞ্জনের হাতটা রিমা নিজের পেটের উপর টেনে আনে। মুহূর্তে রঞ্জন বুঝে যায় ইঙ্গিতটা। তার সন্তান রিমার গর্ভে। আনন্দে রিমার নরম শরীরটা নিজের শরীরের উপর টেনে নেয় রঞ্জন। চুম্বনে ভরিয়ে দেয় রিমাকে।

‘আমাদের বিয়েটা এবার করে নেওয়া উচিত রঞ্জন’, অতিকষ্টে রঞ্জনের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রিমা বলে।

‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমিও তাড়াতাড়ি সব অনুষ্ঠান করে নিতে চাই। সকালেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা করব। এই মাসের মধ্যেই শুভদিন দেখে…।’

দশ-বারো দিন স্বপ্নে ভেসে কাটার পর একদিন হঠাৎই বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বরটা বেজে ওঠে। সাধারণত প্রয়োজনে সকলেই মোবাইল ব্যবহার করায় এই ফোনটার উপস্থিতি রিমা প্রায় ভুলতেই বসেছিল। বাজতেই চমকে ওঠে রিমা। উঠে এসে ফোনটা তুলে নেয় হাতে, ‘হ্যালো!’ মন দিয়ে শোনে ওপাশের মহিলা কণ্ঠস্বর কী বলতে চায়, তারপর আবার বলে, ‘কিন্তু রঞ্জন তো এখন বাড়ি নেই। আপনি কে বলছেন বলুন, ও এলে আমি ওকে বলে দেব।’

কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আমি ওর পুরোনো বান্ধবী। ওর সঙ্গে দেখা করে সারপ্রাইজ দিতে চাই। যদি ঠিকানাটা দেন খুব ভালো হয়।’

রিমা ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা দিয়ে দেয় সামান্য ইতস্তত করে।

সন্ধের অন্ধকার ঘনাতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। রিমা দরজা খুলতেই অচেনা একটি মেয়ে ঘরে এসে ঢোকে রিমাকে একপ্রকার ঠেলে দিয়েই। রঞ্জনকে দেখেই মেয়েটি রঞ্জনের গালে সপাটে একটি চড় কষিয়ে দেয়, ‘তোমার সাহস কোথা থেকে হয় যে আমাকে বিট্রে করে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছ। ভুলো না তোমার বাবা আমার ড্যাডের আন্ডারে কাজ করে। ড্যাডের একটা কথায় যদি তোমার বাবার চাকরি যায় তাহলে তোমার অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারছ? একটা রাস্তার মেয়ের জন্য আমায় চিট করার স্বপ্ন যদি দেখে থাকো, তাহলে আমিও তোমার এবং তোমার এই গার্লফ্রেন্ডের কি দুর্দশা করব তুমি ভাবতেও পারবে না।’

এই ঘটনা রিমার জীবন থেকে সমস্ত আনন্দ ছিনিয়ে নিয়ে ওর জোড়া লাগা হূদয়টাকে আবার দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত করে তোলে। রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেও পরিষ্কার জবাব পায় না। দুজনে একসঙ্গে থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। রঞ্জনের ব্যবহারে স্পষ্ট হতে থাকে রিমার প্রতি তার উদাসীনতা। রাগের মাথায় গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না রঞ্জন।

গর্ভাবস্থায় এই মানসিক স্থিতি ধীরে ধীরে রিমাকে ডুবিয়ে দেয় অবসাদে। নিজেকে অসহায় মনে করা শুরু করে রিমা। তার মনে হতে থাকে, কী লাভ এই সৌন্দর্যের? সারা পৃথিবীতে কারও কাছ থেকেই তো এতটুকু ভালোবাসা সে পেল না। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পর আর কী ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব? অর্থ এবং খ্যাতির জন্য রিমা বাড়ি ছেড়েছিল, কিন্তু মানুষের চাহিদার কি কোনও শেষ আছে? এরপর জীবনে প্রেমকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল রিমা। সেটাও যখন পুরোপুরি পেয়ে গেছে মনে করতে শুরু করেছিল রিমা– রঞ্জনের সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল– স্বপ্ন দেখার অপরাধ করেছিল, তখনই সব শেষ হয়ে গেল।

খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে ছাপা খবরটা অনুভার দৃষ্টি এড়াল না, ‘টিভির পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী রিমার মৃতদেহ উদ্ধার তাঁর নিজের ফ্ল্যাট থেকে। সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বিস্তারিত খবর তিন-এর পাতায়।’

 

লিভ-ইন রিলেশন

ঘন্টা তিনেক পর কনফারেন্স রুম থেকে মিটিং শেষ করে বের হয় আদিত্য। মোবাইলটা হাতে নিয়েই ঘাবড়ে যায়। মায়ের মোবাইল থেকে এগারোটা মিসড্ কল। তড়িঘড়ি ফোন করে। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে পরমা-র কণ্ঠস্বর। পরমা আদিত্যর ছোটোপিসি। ‘আদিত্য, ছোটোপিসি বলছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। তোর মায়ের অবস্থা একেবারেই ভালো না।’ মায়ের ফোনে পিসির গলা শুনেই বুঝতে পেরেছিল আদিত্য, কিছু একটা হয়েছে। তার আশঙ্কাই ঠিক হল।

‘কী  বলছ পিসি! কী এমন হল? সব তো ঠিকই ছিল?’

‘সকালে সবে ঠাকুরঘরে ঢুকেছি, ঠিক সেই সময়তেই কাজলের ফোন.. পিসিমা তাড়াতাড়ি চলে আসুন, জেঠিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমরা পৌঁছোনোর আগেই ক্লাব থেকে কয়েকজন ছেলে মিলে গ্রিনল্যান্ড নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে।’

একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে পরমা। ‘দিনকয়েক সময় নিয়ে আসিস। কখন যে কী হয়।’ বলতে বলতে আবার থেমে যায় পরমা।

‘ঠিক আছে। জানি বলতে হবে না, তবু আমি না যাওয়া অবধি মায়ের একটু খেয়াল রেখো। আর টাকাপয়সার জন্য যেন কোনওরকম ভাবে চিকিৎসা না আটকে থাকে সেটা একটু দেখে নিও। আমি গিয়ে সমস্ত ক্লিয়ার করে দেব। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি।’ বলে ফোনটা কেটে দেয় আদিত্য। আর একটা ১০ ডিজিটের নাম্বার প্রেস করে ফোনটা কানে দেয় আদিত্য। ‘শ্রী, অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল আমার নামে একটা কলকাতার ফ্লাইটের টিকিট বুক করে আমাকে মেসেজ করে দাও। আমি ছুটির জন্য বসের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।’

‘আরে হঠাৎ কী হল সেটা তো বলবে।’ চিন্তিত শোনায় শ্রীয়ের স্বর।

‘মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার-রা প্রেডিক্ট করছেন, ইট্স অ্যা ব্রেন হেমারেজ।’ বলতে বলতেই চোখে জল চলে আসে আদিত্যর। কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয়। ‘শ্রী প্লিজ, পরে সব বলব। তুমি টিকিট-টা কেটে আমাকে একটা কল করে দিও।’ আদিত্যর কষ্টটা ফিল করতে পারে শ্রী। মনে মনে ভাবে এ-অবস্থায় আদিকে কিছুতেই একা ছাড়া যাবে না। তার মা যে তার মনের কতটা জায়গা জুড়ে রয়েছে সেটা শ্রী ভালোমতোই জানে। আদিত্যকে সে ভালোমতো জানে ও বোঝে। আর কারও কাছে নিজেকে ধরা না দিলেও শ্রী-কে ফাঁকি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রী-য়ের কাছে ধরা তাকে পড়তেই হবে। ভালোবাসার বন্ধনটা বোধকরি এমনই হয়। জেদ ধরে বসে, ‘আমিও সঙ্গে যাব।’ ফোনটা কেটে দিতেই যাচ্ছিল আদিত্য। শ্রীয়ের কথা শুনে থমকে গেল।

‘সব কিছু জেনেও তুমি একথা বলছ? ভুলে গেছ সবকিছু? তুমি জানো না, মা আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কতটা আপসেট? যদি তোমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সেটাও তো মায়ের শরীরের জন্য ঠিক নয়, না। তাছাড়া আমি চাই না তোমাকে কেউ ঘৃণার চোখে দেখুক।’

আদিত্যর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নেয় শ্রী। ‘কী যাতা বলছ বলো তো? উনি পছন্দ করেন না বলে কি এই বিপদের সময়তেও আমি ওনার কাছে থাকতে পারি না? তাছাড়া এখন এসব ভাববার সময় নয় আদি।’

‘ভেবে দ্যাখো কী করবে।’

‘ভাবার কিছু নেই। আমি যাচ্ছি এটা ফাইনাল।’

‘ঠিক আছে তাহলে তোমার যা নেওয়ার নিয়ে নিও। আমারও কয়েকটা জামাকাপড় প্যাক করে নিও। থ্যাংকস্ শ্রী, তুমি সাথে থাকলে একটু মনের জোর পাব।’

বসের সাথে কথা বলার পর সোজা এয়ারপোর্ট-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আদিত্য। পূর্বনির্ধারিত সময় মতো শ্রী-ও লাগেজ নিয়ে পৌঁছে যায় এয়ারপোর্টে। পথে যাবতীয় ফোনাফুনি সেরে নেয় আদিত্য। দিদি অন্বেষাকে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানো থেকে শুরু করে ঘন্টায় ঘন্টায় পিসির থেকে মায়ের শরীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া চলতে থাকে।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই শ্রী-কে দেখতে পায় আদিত্য। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা কোণে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শ্রী-কে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। লাগেজটা নিয়ে নেয় শ্রী-র থেকে। আদিত্যর চোখেমুখে তখন বিষণ্ণতার স্পষ্ট ছাপ। চোখটা টকটকে লাল। আদি কাঁদলেই ওর চোখ-মুখের অবস্থা ঠিক এমনটাই হয় সেটা জানে শ্রী।

সান্ত্বনা দিতে ওর হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘চিন্তা করছ কেন, আন্টি ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেঙে পোড়ো না।’

একটু মনোবল সঞ্চয় করতে শ্রীয়ের হাতটা চেপে ধরে আদিত্য। ‘চলো চলো ঘন্টা দেড়েক পরেই ফ্লাইট। চেক-ইন করতে হবে তো।’

শ্রীয়ের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে দুজনেই ঢুকে পড়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে। সমস্ত ফর্মালিটির পর পাশাপাশি সিটে বসে দুজনে। আদিত্য-র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে শ্রী। আদিত্য চোখ বুঝে ফেলে। মুহূর্তেই পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করে। মা অসুস্থ এটা যেন সে ভাবতেই পারে না। মা-কে তো কোনওদিন এভাবে দেখেনি সে। বরং মায়ের দৃঢ়চেতা স্বভাবই দেখে এসেছে সে। যেমন ভালোবাসা, মমত্ব উজাড় করে দিয়েছে, তেমনি প্রয়োজনে পিঠে বেত কষাতেও বাকি রাখেনি। চিরকাল মাকে এভাবেই দেখে এসেছে সে। শত বাধা-বিপত্তিতেও মায়ের চোখে জল দেখেনি। শুধু একবার বাবার মৃত্যুর সময় মাকে ভেঙে পড়তে দেখেছে সে। ব্যস সেই দিনকতক। তারপর আরও নানা স্মৃতি আনাগোনা করতে থাকে।

আদিত্য আর শ্রী লিভ-ইন করছে প্রায় বছর তিনেক। এর মাঝে বার-চারেক শ্রী-কে নিয়ে কলকাতাতে মায়ের কাছে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছে আদিত্য। বার বার উনি ছেলেকে বুঝিয়েছেন শ্রী-কে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য।

‘একসাথে যখন থাকছ। সংসার করছ, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধেটা কোথায়? কীসের ভয় তোমাদের? বাঁধা পড়ার?’ প্রত্যেক বার এই নিয়ে মায়ের সাথে বচসা বেধে যেত আদিত্যর। এবার সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। অশান্তি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, আদিত্য মুম্বই ফিরে যাবার সময় মাকে বলে যায়, এরকম করলে মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখা নাকি তার পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তার লাইফ, সে কীভাবে লিড করবে এটা একান্ত ভাবেই তার সিদ্ধান্ত। তারপর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এই ঘটনা ঘটে গেল। কোথাও গিয়ে তার মনে হয়েছে, মায়ের অসুস্থতার জন্য সে-ই দায়ী। অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। ঘন্টা তিনেকের পথ এভাবেই কেটে যায়। ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা পৌঁছে যায়

নার্সিংহোমে। রাত তখন এগারোটা। নার্সিংহোমে ঢুকেই চোখে পড়ে বেঞ্চের এককোণে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে ছোটো পিসি। আর পিসেমশাই পায়চারি করে চলেছে। তাদের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। সঙ্গে শ্রী-ও এগিয়ে আসে।

‘মা,  এখন কেমন আছেন পিসেমশাই?’

‘ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্রেন হেমারেজ হয়েছে। ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না। ডাক্তাররা তো এমনটাই বলছেন।’

আইসিইউ-তে ঢোকার পারমিশন না মেলায় দরজার কাচ দিয়েই মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আদিত্য। মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, হাতে কতগুলো চ্যানেল করা, একটা মেশিনে কী-সব আকিঁবুঁকি রেখা ছুটে চলেছে, অথচ সাদা বিছানায় মা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। সহ্য করতে পারে না সে। পরমাকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

‘ছোটোপিসি,  মা ঠিক হয়ে যাবে তো, বলো না?’

‘নিজেকে শক্ত কর আদি।’

পাশ থেকে পিসেমশাই বলে ওঠেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমাদের, যাও বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তোমাদের দেখেই মনে হচ্ছে তোমরা দুটিতে সারাদিন কিচ্ছুটি খাওনি। যাও যাও। আর দেরি কোরো না, সঙ্গে পিসিকেও নিয়ে যাও। সারাদিন ওইভাবেই বসে আছে, আর টেনশন করছে। ওকেও কিছু খাইয়ে দিও।’ বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখেন, ‘যাও মা যাও, তুমিও যাও।’

আদিত্যর পিসেমশাই বরাবরই একটু দাপুটে স্বভাবের। ওনার কাছে কোনওকিছুই ধোপে টেকে না। আদিত্য নার্সিংহোমে থাকার জন্য  জেদ ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু পিসেমশাইয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হল।

‘যা বলছি তাই শোনো। এমনিতেই আজ আর কাউকে বউদির কাছে যেতে দেবে না। যদি কিছু লাগেও তার জন্য তো আমি

রইলাম-ই। বরং কাল সকাল থেকে মায়ের কাছে থেকো। ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নিও।’

‘কিন্তু..’ নার্সিংহোমে থাকার জন্য পিসেমশাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে আদিত্য।

‘আর কোনও কিন্তু নেই। যাও, কাল সকাল সকালই চলে এসো।’

ইচ্ছে না থাকলেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বেরিয়ে যেতে হল তিনজনকে। নার্সিংহোম থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি হলে মিনিট দশেকের। ট্যাক্সিতে মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায় তারা। দরজা খুলেই সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে যায় আদিত্য। ঘরের আলমারি, বিছানা, আলনা, সব জায়গাতেই মায়ের পরশ অনুভব করে সে। একটু করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। হঠাৎই চোখ আটকে যায় দেয়ালে টাঙানো মায়ের ফোটোফ্রেমটার দিকে। যেটা সে একদিন নিজে হাতে রঙ-তুলির টানে সৃষ্টি করেছিল। আর ছেলের আঁকা বলে তার মা সেটা সযত্নে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটা আদ্যোপান্ত ধুলোয় ঢেকে গেছে। ঠিক করে মায়ের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সেটাকেই নামানের চেষ্টা করতে থাকে আদিত্য। দেয়ালে পেরেকের সঙ্গে ফ্রেমের পিছন দিকে আটকানো তারটা এমনভাবে জড়িয়ে বাঁধা রয়েছে যে, সহজে নামিয়ে আনতে পারে না সে। খুলে আনার জন্য টান দিতে থাকে।

খাবার জন্য ডাকতে আসা ছোটোপিসির চোখ এড়ায় না পুরো ঘটনাটা। আপনা-আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরমা।

‘ওটা  কী করছিস আদিত্য?’

‘এই যে মায়ের ছবিটা পিসি। একেবারে ধুলো পড়ে গেছে।’

একটা বাঁকা হাসি হাসে পরমা। ‘এরকমই বোধহয় হয় রে আদি, লোক দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। পড়ে গেলে তবেই বোঝে।’

পিসির খোঁচাটা বুঝতে পেরে বিরক্ত লাগে আদিত্যর।

‘কী যা-তা বলছ পিসি।’ মুহূর্তেই চোখ লাল হয়ে যায় তার।

‘খুব  কি কিছু ভুল বলছি? কী পেয়েছে বল তো মানুষটা? আজ তোদের জন্যই তো বৃন্দা বউদির এই হাল। এর জন্য তোরাই দায়ী।’ মাথা নীচু করে শুনতে থাকে আদিত্য।ঠোঁটে রা কাড়ে না সে।

পরমা তার মতো করে বলে চলে, ‘নিজের দাদা বলে বলছি না, তিনি তো সমস্ত দায়ভার তোমার মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। খুব যে কিছু রেখে গেছেন তাও তো বলতে পারব না। তৎসত্বেও তো তোমাদের কোনও অভাব রাখেনি তোমার মা। এক এক করে সব গয়না খুইয়েছে তোমাদের পড়াশোনার জন্য। এমনকী তোমার দিদিকে সিম্বায়োসিসে ল’ পড়ানোর জন্য বাড়িটা পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছে। বদলে তোমরা কী করেছ, শুধু মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়েছ। তোমার দিদি পড়াশোনা চলাকালীন তার থেকে বাইশ বছরের বড়ো একটা মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে বসল। আর এখন তুমি  লিভ ইন করে ওর মুখে কালি লেপছ।  একসাথে থাকবে অথচ বিয়ে করতেই যত ওজর-আপত্তি। আর কত সইবে সে। ওর কি মান-সম্মান বলে কিছু নেই? ঠিকই আছে, বউদির মরে যাওয়াই ভালো।’

কথাগুলো শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিত্য। পিসির হাত দুটো চেপে ধরে বলে ‘প্লিজ ছোটোপিসি, এভাবে বোলো না।’

‘কেন বলব না, বলতে  পারো। সমাজে মুখ দেখানোর বাকিটা কী রেখেছ তোমরা। লজ্জায় মানুষটা একেবারে একঘরে করে ফেলেছিল নিজেকে। সে-সব যাবে কোথায়? কাঁহাতক একটা মানুষ একলা থাকতে পারে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে? চোখ বুজলে যদি একটু শান্তি পায়।’

পিসির গলার আওয়াজ পেয়ে এক-পা এক-পা করে আদিত্যর মায়ের ঘরের সামনে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রী। পিসি-ভাইপোর মাঝে কথা বলার দুঃসাহস সে দেখায় না। সেই শিক্ষাও তার নেই। তাকে একঝলক আপাদমস্তক দেখে নেয় পরমা। তারপরে আবার বলতে শুরু করে ‘বৃন্দা তো তোদের খুশিতেই খুশি থাকতে চেয়েছিল। ও চেয়েছিল তোদের চারহাত এক করে দিতে। কিন্তু তোদের মাথায় কী ওই লিভ-ইনের ভূত চেপে বসে রয়েছে। শিক্ষিত হয়েছিস, ভালো চাকরি করছিস, এখন আর মায়ের কথা শুনবি কেন? এখন যেভাবে খুশি থাক, আর কেউ বলতে আসবে না। এটা মনে রাখিস আমাদের সমাজ এখনও এতটা উদার মানসিকতার হয়নি যে, এটাকে ভালো ভাবে নেবে। কর, যা মন চায় কর।’ আদিত্য তখন পিসির হাত দুটো ধরে একেবারে মাটিতে বসে পড়েছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে।

‘আমার ভুল হয়ে গেছে পিসি, মা যে এভাবে নেবে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু ভগবান আমার মাকে সুস্থ করে দিক, মা যা বলবে আমি তাই করব। শুধু একটা সুযোগ।’

আশ মিটিয়ে বলার পর খানিকটা নরম হয় পরমা। ভাইপোর হাতটা ধরে বলে, ‘আরে ওঠ ওঠ। চল রাগের মাথায় কত কী-ই না শোনালাম তোকে। আসলে কী জানিস তো, সেই তোর মায়ের বিয়ে হয়ে আসা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। সারাজীবন ওকে শুধু কষ্ট পেতেই দেখলাম। আমি চাই ও একটু ভালো থাকুক রে।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় পরমার। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নেয়। ‘আরে যা যা, অনেক রাত হল, তোরা দুটিতে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আয়। কিচ্ছু ভালো লাগছে না-রে, কী যে দেখব কাল…।’

চোখ মুছতে মুছতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। পরমা-ও ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে, ‘চল, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। মুখে কিছু দিয়ে নিবি চল।’

কারওর-ই গলা দিয়ে খাবার নামল না। শুধু প্রয়োজনের তাগিদে কোনওরকমে দু-এক গাল মুখে দিয়েই যে-যার ঘরে শুতে চলে গেল। সকলের একটাই চিন্তা, কীভাবে বৃন্দা ভালো হয়ে উঠবেন।

দিনের আলো ফোটার আগেই আদিত্য তৈরি হয়ে নিল। রুম থেকে বেরিয়ে দেখে, ছোটোপিসিও রেডি। পিসেমশাইকে নিয়েও খানিক চিন্তায় ছিলেন, ওনার যে আবার হাই-ব্লাডপ্রেশার। সারারাত জাগা। শ্রী-ও তাদের সাথে যাবার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। বাধ সাধে আদিত্য।

‘শ্রী, তুমি দুপুরে এসো। তোমাকে দেখে যদি আবার মা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘ঠিক আছে। তাহলে আন্টিকে কী খাবার দিতে হবে ডাক্তারের থেকে জেনে নিয়ে আমায় বোলো। সেইমতো বানিয়ে নেব।’

‘যা লাগে কাজলকে দিয়ে তাহলে আনিয়ে নিও।’

‘ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না। আমি সব সামলে নেব।’

‘ওকে’, বলে বেরিয়ে যায় তারা।

দিনতিনেক পর আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফ্ট করা হল বৃন্দাকে। এখন আউট অফ ডেঞ্জার, তবে শরীরের একটা দিক পড়ে গেছে। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে দেখে চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সেটা এতটাই ক্ষীণ আর অস্পষ্ট যে বোঝার উপায় নেই। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন বৃন্দা। তারপর ইশারায় শ্রীয়ের কথা জানতে চান। আদিত্য আঙুল দিয়ে দরজার বাইরের দিকে দেখিয়ে দেয়। বৃন্দার চোখ চলে যায় দরজার বাইরে থাকা শ্রীয়ের দিকে। জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখের ইশারায় ডেকে নেয় শ্রীকে। আদিত্য একটু ভয় পেয়েছিল বটে, তবে মায়ের আচরণ দেখে সে খানিকটা আশ্বস্তই হয়। বুঝতে পারে শ্রীয়ের উপস্থিতিতে মা খুশিই হয়েছে।

তবে মায়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল আদিত্যকে। মা-কে সবসময় কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে, সেই মায়ের এই অবস্থা মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে কষ্টদায়ক তো বটেই। এর আগে সে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। বুঝে উঠতে পারছিল না কী করলে তার মা আবার আগের মতো হেঁটেচলে বেড়াবে।

বৃন্দার সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রী। খাবার বানানো থেকে শুরু করে খাওয়ানো পর্যন্ত খুব যত্নের সঙ্গে সামলাচ্ছিল সে। কখন কী লাগে এই ভেবে সবসময় তাঁর পাশে পাশে থাকত শ্রী। বৃন্দাও আস্তে আস্তে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাকেই খুঁজে বেড়াত বৃন্দার চোখ। পিসি, পিসেমশাই মাঝে মাঝে এসে শ্রীয়ের যত্ন দেখে খুশিই হতেন।

বিপত্তির মাঝে আর এক বিপত্তি। অফিস থেকে পত্রাঘাত। কোম্পানি তাকে ইউএসএ পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটা আদিত্যর অনেক দিনের স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ গড়ার এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর সে কোনওদিনও পাবে না। এত আনন্দের খবরটাও তার কাছে আজ নিরানন্দের-ই সমান। কী করবে সে? এই অবস্থায় মাকে ফেলে যাওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বারবার দিদি অন্বেষাকে ফোন করছে আসার জন্য, কিন্তু তার ওই এক কথা, মা তাকে পছন্দ করে না। তাকে দেখলে মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তবু সে চেষ্টা করে দেখবে।

অবশেষে আরও দু-দিন পর পুনে থেকে আদিত্যর দিদি অন্বেষা উপস্থিত। তাকে দেখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিল আদিত্য। ‘তোকে দেখে খানিক স্বস্তি পেলাম রে দিদি। যদিও মা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো আছে, অ্যাটেনডেন্টও রয়েছে, তবুও দেখাশোনার জন্য নিজেদের লোকজন পাশে থাকাটাও জরুরি। এতে মা-ও খানিক ভরসা পায়। তা কয়েকদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস তো?’

‘না, না।  তুই তো জানিস আমার জব-টা কী? এখন আবার এক্সাম চলছে। হুট করে এভাবে বিনা নোটিশে ছুটি নেওয়া যায় নাকি? তবুও তো প্রিন্সিপাল-কে বলে কয়ে দিন দুয়েকের ছুটি পেয়েছি।’

বেশ হতাশ হয়ে যায় আদিত্য।

‘এবাবা আমি তো ভেবেছিলাম তুই থেকে একটু মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করবি।’

‘জানিস-ই তো, হাসপাতালের নাম শুনলে বরাবরই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। হাত-পা কাঁপতে থাকে আমার। এই গন্ধটা কিছুতেই নিতে পারি না।’

অন্বেষার কথা শুনে আদিত্য রীতিমতো শকড হয়ে যায়। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। কেমন অচেনা লাগে নিজের দিদিকে। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে যায় তার। এদিকে ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে। উনি বলেছেন, ‘এবারে আপনারা আপনার মা-কে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন নিয়মিত ফিজিয়োথেরাপি-টা মাস্ট। এখন ওনার সুস্থ হওয়াটা পুরোটাই ওনার সেরে ওঠার ইচ্ছাশক্তি আর আপনাদের সেবা শুশ্রুষা-র উপরই নির্ভর করবে।’

‘কিন্তু ডাক্তারবাবু ওনার কথাগুলোও তো এখনও জড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে এত তাড়াতাড়ি…’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘আপনাকে তো আগেই বললাম, আমাদের যা করার আমরা করে দিয়েছি। এখন যা ওষুধ চলবে তাতে ধীরে ধীরে কাজ হবে। জেনারেলি এসব কেসগুলোতে দীর্ঘকালীন ট্রিটমেন্ট চলে। পেশেন্টের মনোবল থাকলে অনেকে কিওর হয়ে যায় আবার অনেকের…। থাক ওসব কথা।’ বলে ডাক্তারবাবু রাউন্ডে চলে যান।

সেসব নিয়েই আদিত্যর মাথায় নানারকম দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই কারণেই অন্বেষাদিকে দেখে একটু চিন্তামুক্ত হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু উলটোটাই হল। দিদিকে আরও একবার কনভিন্স করার চেষ্টা করল আদিত্য।  ‘কোনওভাবেই কি কয়েকটা দিন ম্যানেজ করা যায় না? কয়েকটা দিন? এই মুহূর্তে আমার ইউএস যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। আমি ওখানে জয়েন করার পরে পরেই এসে মাকে নিয়ে চলে যাব। মা-কে নিয়ে যাব তার জন্য তো আমাকে কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। জাস্ট কয়েকটা দিন।’

‘না, কোনওভাবেই সম্ভব নয়। এক্সামের ডিউটি না থাকলে…। তাছাড়া কালই আমার ফ্লাইটের টিকিট।’ দিদির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিত্য। অন্বেষা কী একটা ভাবে। তারপর হুঠ করে কথা প্রসঙ্গে বলে বসে, ‘তুই তো একটা অ্যাটেনডেন্ট রাখলেই পারিস।

সে-ই তো মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।’ অন্বেষার ভাবটা এমন যেন সে ভাইয়ের কাঁধ থেকে দায়িত্ব অনেকটা কমিয়ে দিতে পেরেছে।

‘একজন অচেনা মানুষের দায়িত্বে পুরো বাড়িতে মা একা?’ ভাবতে পারে না আদিত্য।

‘কেন সঙ্গে কাজলদিকে থাকতে বল। ও-তো বিশস্ত। অনেকদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে।’

‘নিজের কেউ একজন পাশে থাকাটাও জরুরি দিদি। ওসব তুই বুঝবি না। স্পর্শ- চিকিৎসা বলেও একটা ব্যাপার আছে জানিস তো।’

‘ছাড় তো, যত সব ফালতু ব্যাপারস্যাপার। তোর যদি এতই সমস্যা তাহলে ভালো কোনও ওল্ড এজ হোমে রেখে যা। কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার।’

‘বাঃ দিদি বাহ্, এটা তোর পক্ষেই সম্ভব। একটু বাধল না, না রে? সব ভুলে গেছিস, মা সারাজীবন আমাদের দুই ভাইবোনের জন্য কী করেছে। আর এখন যখন তার আমাদেরকে প্রয়োজন, আমরা পিঠ বাঁচাচ্ছি।’

‘আমাকে  কর্তব্য শেখাতে আসিস না। যেটা বাস্তব সেটাই বলেছি। আর কী বলছিস মা এই করেছে, সেই করেছে। হোস্টেলে রেখেছে, ফিজ দিয়েছে এই তো। এগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে? প্রত্যেকটা বাবা-মা-ই তাই করে। আমার মা-ও তাই করেছে।’

দিদির কথাগুলো সহ্য করতে পারে না আদিত্য। ভাইবোনের মধ্যে রীতিমতো তর্কাতর্কি চলতে থাকে। রাগে ফুঁসতে থাকে আদিত্য। সে ভুলে যায় যে তার মায়ের ঘরে মায়ের চোখের সামনে এই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। কথার মাঝে শ্রী  মায়ের কেবিনে ঢুকে পড়ে। তখন আদিত্যর সম্বিৎ ফেরে। শ্রীয়ের দৃষ্টি মায়ের দিকে, কিন্তু বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে আছে শ্রী৷ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে আদিত্য । মা ওঠার চেষ্টা করছে। ডান হাতটা নাড়াচাড়া করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। দু-চোখ জলে ভেজা। মায়ের কাছে ছুটে যায় শ্রী। শান্ত করার চেষ্টা করে ওনাকে। আদিত্য বোকার মতো একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে কত বড়ো ভুল সে করেছে।

‘তোমাদের  মুখগুলো এরকম লাগছে কেন? আমি কি তোমাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম? মা-ই বা হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে উঠল কেন?’, জানতে চায় শ্রী৷ কোনও উত্তর দিতে পারে না আদিত্য। ফ্যালফ্যাল করে কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শ্রী, আদিত্য আর অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত যে আন্টি কাল বাড়ি ফিরছে। উলটে তোমাদের মুখগুলো কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।’

এইবার উত্তর দেয় আদিত্য। ‘ভাবছি মাকে কে দেখবে। ২২ তারিখে আমার ফ্লাইট। তার আগে দিল্লির অফিসের সমস্ত কাজ আমাকে মিটিয়ে নিতে হবে। সেইজন্য দুদিন আগে যাওয়াটা জরুরি। দিদিও থাকতে পারবে না বলছে।ওর ফ্লাইট কাল ।’

‘এই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কী আছে? আমি থেকে যাচ্ছি আন্টির কাছে। আমি দেখাশোনা করব ওনার। আমি তো একটু আগেই একজন ফিজিয়োথেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বললাম। একটা অ্যাটেনডেন্ট-এর ব্যবস্থা করে নেব, সে আমার হাতে হাতে সাহায্য করবে, তাহলেই হবে। তাছাড়া কাজলও রইল। ও-ও সাহায্য করবে।

‘আর  তোমার অফিস?’

‘আমার অসুস্থতা দেখিয়ে একটা মেল করে দিচ্ছি। মানলে ভালো, না মানলে আর কী করা যাবে। চাকরি চলে যাবার ভয়ে তো আর আন্টিকে একা ছাড়তে পারি না।’

আদিত্যর কপালে চিন্তার ভাঁজ মুহূর্তেই পরিস্কার হয়ে গেল। শ্রীয়ের এই সিদ্ধান্তে সে-যে খুব কিছু অবাক হয়েছে তা-ও নয়। কারণ সে শ্রী-কে চেনে। জানে, ও এইরকমই একটা পাগলি মেয়ে। কিন্তু অন্বেষার চোখে-মুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে।

পরদিন কাউন্টারে বিল মিটিয়ে ডিসচার্জ পেপার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল আদিত্য। সেই ফাঁকে শ্রী, বৃন্দার সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে নিল। বৃন্দার জামাকাপড় গোছানো থেকে শুরু করে তার চুল বেঁধে দেওয়া পর্যন্ত, সমস্ত নিজে হাতে মনের মতো করে সেরে নিল। সমস্ত ফর্মালিটি পূরণের পর ওয়ার্ডবয় আর নার্সের সাহায্যে মা-কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল তারা।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই অন্বেষাকে ভীষণ ভারাক্রান্ত লাগছিল। সবার থেকে দূরে ঘরের এক কোণে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসেছিল সে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে ঘরে ঢুকে, অন্বেষাকে ওই অবস্থায় দেখে প্রশ্ন করে বসে শ্রী– ‘দিদি তোমার কি মাথাব্যথা করছে নাকি? বাম দেব?’

মাথাটা তুলে জবাব দেয় অন্বেষা, ‘নারে, ঠিক আছি আমি।’ অন্বেষার চোখ দেখে ঘাবড়ে যায় শ্রী। রক্তজবার মতো লাল টকটক করছে চোখদুটো।

‘এমা  তুমি কাঁদছ? কিছু যদি মনে না করো, তোমার মনের কথা আমায় খুলে বলতে পারো। জল দেব, একটু জল খাবে?’

‘না রে, লাগবে না।’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় অন্বেষা।

‘জানিস আজ তোকে সব বলতে ইচ্ছে করছে। তুই ভেবে অবাক হচ্ছিস না, মেয়ে হয়ে আমি কীভাবে মায়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করছি। ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে কিছু করছি না রে। মাকে দেখলেই না আমার ছোটোবেলার খারাপ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে পড়ে।’

‘খারাপ স্মৃতি’! একটু অবাক হয় শ্রী।

অন্বেষা তার মতো করে বলে চলে ‘মায়ের সাথে আমার এমন দুর্ব্যবহারের কারণ হল, রমেশ কাকা আর মায়ের সম্পর্ক। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওনার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক। বাবার জায়গায় অন্য কেউ, এটা আমি কখনওই মানতে পারিনি। ভাবলেই এখনও গা-টা কেমন যেন রি-রি করে ওঠে। আদি তো ছোটো ছিল, সেই কারণে ও কিছু বুঝত না। আমি বুঝতাম বলে সবসময় আমাকে বকাঝকা করত। সেই কারণেই আমি পুনেতে হোস্টেলে চলে গিয়েছিলাম। থাকতে চাইনি এই পরিবেশে, বিশ্বাস কর।’

অন্বেষার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা  দেওয়ার চেষ্টা করে শ্রী। দু-চোখ দিয়ে অঝোরে জল নেমে আসে তার। কাঁদতে কাঁদতেই শ্রী-র হাতটা চেপে ধরে সে। ‘বিশ্বাস কর, শ্রী, আমি চেষ্টা করি মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে। যখন দুরে থাকি ভাবি মায়ের সাথে আর এরকম ব্যবহার করব না, কিন্তু সামনাসামনি দেখলেই সব ভাবনাচিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। তখন শত চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারি না।’

অন্বেষার কষ্টটা খানিকটা হলেও বুঝতে পারে শ্রী। তার দিকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘দিদি তোমার কষ্টটা আমি ফিল করতে পারছি। কিন্তু একটা জিনিস কখনও ভেবে দেখেছ কি? সারাজীবন কাঁহাতক একটা মানুষ একা থাকতে পারে? ওনারও তো একটা লাইফ আছে। উনি তো চাইলে আবার বিয়েও করতে পারতেন, কিন্তু তোমাদের কথা ভেবে সেটা তো করেননি। নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাদের মানুষ করেছেন। পরিবর্তে তিনি যদি কোনও কিছু নিয়ে একটু খুশি থাকেন তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? তোমায় শিক্ষা দিয়েছেন, ভালোভাবে মানুষ করেছেন, কোথাও কোনও খামতি রাখেননি। তাহলে তোমরা মায়ের খুশির জন্য এইটুকু কেন মানতে পারছ না। ভেবে দেখেছ কখনও? যদিও এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই। আমি যতদূর জানি বছর দুয়েক হল রমেশকাকা নিরুদ্দেশ।’ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে শ্রী।

শ্রী-র মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অন্বেষা। অবলীলায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘কী বলছিস? এসবের তো আমি কিছুই জানি না। অবশ্য কোনওদিন জানার চেষ্টাও করিনি। শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে এসেছি। মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি নিজেকে।’ বলে চুপ করে যায় অন্বেষা।

শ্রী আবার বোঝায়, ‘দিদি, আজ রাতেই তো তোমার ফ্লাইট। এই যে যাবে, আবার কবে আসবে জানি না। যাও না, একটু মায়ের পাশে গিয়ে বসো না। দেখবে তোমারও ভালো লাগবে আর মায়েরও ভালো লাগবে।’

এরপর বেরোনোর আগে পর্যন্ত অন্বেষা মায়ের সাথে সুখ-দুঃখের অনেক কথা বলেছে। যাওয়ার আগে খুব শিগ্গির আসার ইচ্ছাও প্রকাশ করে গেছে।

দিনদুয়েক পরে আদিত্যও মাকে শ্রীয়ের ভরসায় রেখে ইউএস রওনা দিল। এখন বাড়ির সদস্য বলতে বৃন্দা আর শ্রী। মানসিকভাবে দৃঢ় হলেও বৃন্দা আন্টিকে নিয়ে একটু চিন্তাতেই ছিল শ্রী। কীভাবে সুস্থ হবে? কতদিন লাগবে? আদিত্য থাকতে মনের একরকম জোর ছিল, কিন্তু ও চলে যাওয়াতে এখন একটু নার্ভাস বোধ করছে। নিজের বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পক্ষাঘাতে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। কী যে কষ্টের আর যন্ত্রণার তা সে চাক্ষুস করেছে। তাই সে যে ভাবেই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার আন্টিকে আবার আগের মতো হেঁটে-চলে বেড়াতে দেখতে চায়। তার জন্য যা করতে হয় তাই করতে সে রাজি।

নার্সের জন্যও অপেক্ষা করত না শ্রী। আদিত্যর মাকে পট বাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে গা স্পঞ্জ করে দেওয়া, কোনও কিছুতেই তার কোনও দ্বিধা নেই, ঘেন্না নেই। অবলীলায় হাসতে হাসতে সেইসব কাজ করে সে। টাইমে ওষুধ খাওয়ানো, মাসাজ করা, এক্সারসাইজ করানো সবকিছুর মধ্যেই ভীষণ আন্তরিক ভাব।

বৃন্দা আন্টিকে সারিয়ে তোলার জন্য শ্রীর আপ্রাণ চেষ্টা সত্যিই কাজে দিয়েছিল। মাত্র দিন কুড়ির মাথাতেই হঠাৎই আন্টির বাঁ-হাতের আঙুলগুলো নড়ছে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল শ্রী। আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিল আদিত্য এবং দিদির সঙ্গে। বাড়িতে রুটিন চেক-আপে এসে ডাক্তারও রীতিমতো আশ্চর্য হয়েছেন। ছোটোপিসি তো হাত উজাড় করে আশীর্বাদ করে গেছে তাকে।

এভাবেই কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন। এখন বৃন্দা ডান হাতে ভর দিয়ে নিজেই বসতে পারেন। শ্রী ধরে ধরে দু-এক পা হাঁটায়ও। মাঝে মাঝে একা থাকলে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে তাঁর। স্বামী মারা যাওয়ার পরে পরেই তাঁকে বিজনেস জয়েন করতে হয়েছিল। যদিও তখন ব্যাবসার সাতপাঁচ বুঝতেন না বৃন্দা। এক অর্থে প্রথম প্রথম পুরো বিজনেসটাই দেখাশোনা করতেন রমেশ।  প্রায় ভরাডুবি অবস্থা ছিল তখন ব্যাবসার৷ আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝে নিতে সময় লেগেছিল বৃন্দার। নির্ভরতার মাঝে  কখন যে রমেশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তিনিও বোধকরি নিজেও বুঝতে পারেননি। তবে বরাবরই ছেলেমেয়েদের প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন বৃন্দা। তাদের কখন কী লাগবে, কীসে ভালো থাকবে, চিরকাল এটাই তাঁর ভাবনা ছিল। এমনকী যখন ব্যাবসায় রীতিমতো টালমাটাল অবস্থা তখন যেমন জলের দরে কোম্পানি বেচে দিয়ে কর্মীদের পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনও কমপ্রোমাইজ করেননি। মেয়েকে পুনেতে সিম্বায়োসিস-এ ভর্তি করানোর জন্য বাড়িটাকে পর্যন্ত বন্ধক রেখেছেন। অথচ এই দুঃসময়ে ছেলে-মেয়ে কেউ নেই তার পাশে। জীবিকার প্রয়োজনে হলেও, আছে তো দূরেই।

মনে মনে হাজারো রকম প্রশ্ন ঘুরতে থাকে তাঁর। ভাবতে বাধ্য হন তাঁর রক্তের সম্পর্ক কার সাথে– আদিত্য, অন্বেষা নাকি শ্রী-য়ের সাথে। কত আন্তরিক ভাবে তাঁর সমস্ত কাজ করে দেয় শ্রী, একটুও বিরক্ত হয় না। শ্রীয়ের জন্যই তো আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অথচ এই মেয়েকেই একদিন সে কতই না অপমান করেছে।

ভাবনায় বাধ সাধে পরমা। প্রায় রোজই একবার করে ঘুরে যায় সে। একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে– ‘কী রে, শুনলাম দৌড়োচ্ছিস।’ কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় পরমা বরাবরই বৃন্দাকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করে।

‘হ্যাঁ, সবই শ্রী-র দৌলতে। আজও কয়েক পা হাঁটিয়েছে আমাকে।’ হেসে জবাব দেন বৃন্দা।

‘হাসপাতালে তোর অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে। ভেবেছিলাম তুই বোধহয় আর…’ চোখ জলে ভরে আসে পরমার।

পরমাকে দেখে বৃন্দারও চোখ ভিজে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না বুঝেছ। এখন ছেলের বিয়ে দেব। নাতি-নাতনির মুখ দেখব। তবেই আমার যাবার পালা।’ হেসে ফেলে পরমাও।

‘যাও তো, আলমারিটা খুলে মায়ের দেওয়া বালাগুলো এনে দাও।’

‘ওটা  তো তুই তোর বউয়ের জন্য রেখেছিলিস?’

‘আরে হ্যাঁ, আগে আনো তো।’ বলে চাবির গোছাটা পরমাদির দিকে বাড়িয়ে দেন বৃন্দা।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বালাজোড়াটা এনে বৃন্দার হাতে দেয় পরমা। ঠিক সেই সময়তেই শ্রী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকে।

‘এদিকে শোন তো। কাছে বস।’ আদর করে শ্রী-কে পাশে বসান বৃন্দা।

‘এখনও তোমার খাবার বানানো হয়নি। তারপর আবার অতগুলো ওষুধ।’ বকবক করে চলে শ্রী।

বকবকানি থামাতে ধমকে দেন বৃন্দা। ‘বস তো তুই। সারাদিন শুধু কাজ। হাতটা বাড়া।’

‘কেন?’

‘আবার প্রশ্ন করে। যা বলছি তাই শোন।’

কথা মতো হাতটা বাড়াতেই বৃন্দা শ্রীয়ের হাতে বালাজোড়া পরিয়ে দেন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রী। একটাও কথা বলতে পারে না।

শ্রী-র হাত দুটো তুলে ধরে বৃন্দা বলেন– ‘কী দিদি দারুণ মানিয়েছে না?’

‘খুব মানিয়েছে। আমাদের আদিত্যর জন্য ও-ই যথার্থ।’

শ্রীয়ের চোখ জলে ভিজে আসে। তাকে বুকে টেনে নেন বৃন্দা। আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ওরে এখনই কেঁদে ভাসাচ্ছিস, জানিস তো শাশুড়িরা বউদের খুব জ্বালায়। আমি ট্র্যাডিশনের বাইরে কী করে যাব বল! আমি তো একটু হলেও জ্বালাব, তখনকার জন্য একটু বাঁচিয়ে রাখ। সামনের সপ্তাহে বাবু এসে তো আমাদের নিয়ে চলে যাবে।

তখন থেকে তো একসাথেই থাকতে হবে বল।’ বলে একসঙ্গে হেসে ওঠে সকলে।

শয়তানের মুখোশ

‘বাবা এ বাবা দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

‘দেখছিস মাপ লিচ্ছি তবু কানের গড়াটায় সেই ঘ্যেনের ঘ্যেনের কচ্চিস। টুকু দাঁড়া ন, মাপটা লিয়েলি।’

‘বাবা এ বাবা…’ এবার ঘুমটা ভেঙে যায় দুলালের। এখন ঘরময় অন্ধকার, দাঁত বিছিয়ে খিলখিল করে হাসছে। বিছানা থেকে উঠে লাইটটা জ্বালায় দুলাল। অন্ধকারের দাঁতগুলো যে যার মতো ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঘামে শরীরটা ভিজে গেছে দুলালের। মাটির কলশি থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে ঢক-ঢক শব্দে জলটা গিলে নেয় দুলাল। বাতাসি আলুথালু শরীর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বাতাসির চুপসে যাওয়া বুকদুটো বেরিয়ে পড়েছে বাতাসের খোঁজে। বালিশের তলা থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাইটা নিয়ে একটা বিড়ি ধরায় দুলাল। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটা আরও গুমোট হয়। দুলালের কানে স্বপ্নে শোনা কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে…

১)

ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি থেকেই কাজের চাপ বাড়তে থাকে দুলালের। এই দুটো মাস নিঃশ্বাসটাও গুনে-গুনে নিতে হয় ওকে। বাতাসি কাজে তেমন পটু না হলেও দুলালকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মুখোশগুলোকে সময় মতো রোদে দেওয়া, পরিমাণমতো রোদ পাওয়ার পর সেগুলোকে তুলে ঘরে রাখা। দোকানে দোকানে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসা। সময় মতো অর্ডারের মাল দোকানে দিয়ে আসা। বাতাসি না থাকলে দুলালের একার পক্ষে সবদিক সামলানো সম্ভব হতো না।

পুরুলিয়ার মাহাত পাড়ায় গিয়ে দুলাল মাহাতোর নাম বললে যে কেউ ওর ঘরটা দেখিয়ে দিতে পারবে। রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে দুলাল। সেবছর দুর্গা পূজার সময় বাথানির মাঠে মরা মহিষ বানিয়ে শকুন নামিয়ে দিয়েছিল দুলাল। সেদিনের পর থেকে ছেলেবুড়ো সবাই ওকে এক নামে চেনে। তবে দুলাল মাটির কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ছৌনাচের মুখোশ বানাতেই ও বেশি ভালোবাসে। সারা বছর ধরেই মুখোশ বানাতে হয় ওকে। দুর্গা পূজার আগের কটা মাস খুব কাজের চাপ পড়ে যায়। নানান জায়গা থেকে অর্ডার আসে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও দুলাল সকাল সকাল নিজের কাজ নিয়ে বসেছিল। আপন মনে রং করছিল একটা মুখোশ। বাতাসি মুখোশের সাইজ অনুযায়ী পেপার কাটছিল দুলালের পাশে বসেই। ঠিক এমন সময় একটা লোক ঢুকল ঘরের ভেতর। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। কাঁচাপাকা চুল, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। পরনে আলখাল্লা ধরনের একটা পাঞ্জাবি। দুলাল কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল লোকটাকে, তারপর বলল, ‘পূজার আগে আর লতুন অডার লিব লাই।’ লোকটা কিছুই বলল না। হাসি মুখে তাকিয়ে রইল একটা মুখোশের দিকে। কথাটা বলার পর দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো কিছু বলবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুলাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের মুখশ চাই?’

এবার উত্তর দিল লোকটা, ‘আমি মুখোশ কিনতে আসিনি।’

‘তাহলে কী জন্যে আইচেন?’ জিজ্ঞেস করল দুলাল।

‘এমনি।’

লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না দুলাল। আর কথা না বাড়িয়ে বাতাসিকে চোখের ইশারায় ঘরের ভেতর ঢুকতে বলে, আবার নিজের কাজে মন দিল। বাতাসি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দুলালের দিকে। তারপর চুপচাপ ঘরের ভেতরে চলে গেল। হাতে ধরে থাকা মুখোশটায় রং দেওয়া হলে দুলাল তাকিয়ে দেখে লোকটা নেই। কখন বেরিয়ে গেছে। লোকটার মতিগতি বোধগম্য হল না দুলালের। এমন তো কত লোকেই আসে-যায় ওসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার সময় হয় না দুলালের। আজকের এই লোকটাকে দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগল ওর।

হাতের রং করা মুখোশটাকে উঠোনের রোদে নামাতে গিয়ে দুলাল খেয়াল করল সদর দরজার কোণায় একটা প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেটটা কুড়িয়ে থমকে গেল দুলাল। একবান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট রাখা আছে প্যাকেটটার ভেতর। বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল দুলালের। কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো লোকটা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল কয়েকবার। কোনও উত্তর পেল না। একবার ভাবল প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে লোকাল থানায় দিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত সাহস হল না দুলালের। পুলিশের চক্বরে পড়লে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রেখে দিল একটা মুখোশের ভেতর। যদি লোকটা আবার আসে তাহলে ওকে ফিরিয়ে দেবে…

২)

নানান কাজের চাপে টাকার প্যাকেটটার কথা মাথাতেই ছিল না দুলালের। মনে পড়ল মুখোশটা বিক্রি করতে গিয়ে। মুখোশটা হাতে নিয়েও টাঙিয়েই রেখে দিল দেয়ালে। বেশ কিছুদিন হল পূজা পেরিয়ে গেছে। এখন কাজের তেমন চাপ নেই বললে চলে। দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো আবার কিছু দিনের ভেতর কোনও কুপ্রস্তাব নিয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা সেই যে গেল আজও এল না। প্যাকেটটার কথা দুলাল বাতাসিকেও বলেনি। দুলাল জানে বাতাসি টাকার গন্ধ পেলে সেটা শেষ না করে শান্তিতে বসবে না।

দিন দিন কাজের পরিমাণ যতই কমছিল ততই বেশি মনে পড়ছিল টাকার প্যাকেটটার কথা। শেষ পর্যন্ত দুলাল যখন নিশ্চিত হল লোকটা আর আসবে না তখন হাত দিল টাকার প্যাকেটটায়। ওই টাকা খরচা করে ঘরের চাল-ডাল যেমন এল, ঠিক তেমন ভাবেই মুখোশের রং তুলিও এল। বিনা পরিশ্রমের টাকা খরচা করতে বিশেষ সময় লাগল না। মাস দুয়েকের ভেতরেই দুলাল শেষ করে ফেলল টাকাগুলো। টাকাটা শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আবার হাজির হল লোকটা। লোকটা যে আবার কোনও দিন আসতে পারে সেটা কল্পনা করেও দেখেনি দুলাল। লোকটাকে দেখামাত্রই দুলাল মনে মনে ঠিক করে নিল লোকটা টাকার কথা বললে টাকাটার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা টাকার কোনও কথাই বলল না। সেদিন যেমন নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই বেরিয়ে গেল আজকেও। তবে আজকে আর কোনও টাকা রেখে গেল না লোকটা।

এবার বেশ চিন্তায় পড়ল দুলাল। কে এই লোকটা? কেন আসে ওর কাছে? কী করাতে চায় ওকে দিয়ে? নিজেই নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে দুলাল। কিন্তু উত্তরগুলো কিছুতেই ধরা দিল না ওর হাতে। শেষ পর্যন্ত বাতাসিকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল দুলাল। ওর একার পক্ষে আর চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তবে বাতাসিকে বলেও বিশেষ কিছুই লাভ হল না দুলালের। বাতাসি এমন কোনও পথ বলতে পারল না যে পথে ভাবলে মানসিক শান্তি পায় দুলাল।

৩)

আজকে আর রাতজেগে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না দুলালের। বেশ কিছুদিন হল শরীরটাও সাথ দিচ্ছে না ওর। বাতাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা ভাঙল আবার সেই স্বপ্নটা দেখে। অনেক চেষ্টা করেও আর ঘুম এল না ওর। শেষ পর্যন্ত ঘরের কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল ওকে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বসল ঘরের বারান্দায়। আজকে আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা মুখোশগুলো। ঘরের পিছন দিকের বাঁশ বাগান থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। এমন রাত মানুষের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। দুলালের ভেতরটাও আপন খেয়ালে গুনগুন করে ওঠে,

‘আইজ চাঁদ চইল্যেছে আকাশ গায়ে জোছনা বিছ্যায়ে

আইজ বুকের ভেতর প্রেমের খেলা দুবুক লাচ্যাইয়ে।

তুই ঘর ভিতরে ঘুমাই আছিস আমি বেকার বাজাই বাঁশি

আর কবে বুঝবি লো তুই আমি কীসের লাইগ্যে আসি?’

দুলাল গানটা থামিয়ে দিতেই দরজার বাইরে থেকে গানের পরের লাইন দুটো ভেসে আসে,

‘ওলো সখী তুই উঠার আগেই ভোর হইয়্যে যায় পাছে

আয়-না-গো তুই বাতাস হইয়্যে আমার বুকের কাছে।’

গানের শেষ দুটো লাইন শুনে দুলাল অবাক হয়ে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কে এই গান গায়? এই গান তো দুলালের বানানো গান। এই গান অন্য কারুর জানার কথা নয়। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা খুলল দুলাল। দরজাটা খুলেই দেখল সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দুলাল পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটা হাসছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করল দুলাল, ‘এতো রাইত্যে কী জন্যে আইচেন?’

‘একটা মুখোশ চাই আমার।’

‘না আমি আপনারে কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসতে থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ভয়ংকর শোনায় সেই হাসির শব্দ। দুলাল নিজের কান দুটোকে প্রাণপণে চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আমি দিব লাই মুখশ। কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসি মুখেই বলে, ‘মুখোশটা বানিয়ে ফ্যাল্। ওই মুখোশটা তোকে বানাতেই হবে।’ কথাগুলো বলেই লোকটা স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুলাল কান দুটোকে চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে কপাট কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে আর দেখা যায় না। বাতাসি দুলালকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে কপাট বন্ধ করে দেয়।

৪)

পরের দিন সকাল সকাল বাতাসি কয়েকটা মুখোশ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ে। এই মুখোশগুলো রমেন গাঙ্গুলি অর্ডার দিয়েছিল। মুখোশগুলো কলকাতায় যাবে। আজকে বাজারে আরও একটা কাজ আছে বাতাসির। দুটো কাজ সেরেই ও ফিরবে। বাতাসি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ভাঙা আলমারিটা থেকে দুলাল একটা মুখোশ বের করে আনে। আজ অনেক বছর পর দুলাল আবার বের করেছে মুখোশটা। সেদিন সারারাত কাজ করেও মুখোশটা শেষ করতে পারেনি দুলাল। সেই রাতের পর আর হাত দেওয়া হয়নি মুখোশটায়। আজকে যে ভাবেই হোক মুখোশটার অসমাপ্ত কাজটা ওকে শেষ করতে হবে। গতকাল রাতেই দুলাল বুঝতে পেরেছিল লোকটা কোন মুখোশটা নিতে চায়। আজ থেকে সাত বছর আগে একজন লোক এসেছিল দুলালের কাছে। একটা শয়তানের মুখোশ বানাতে বলেছিল দুলালকে। কাজটা নিয়েছিল দুলাল। কিন্তু শেষ আর করতে পারেনি।

মুখোশটায় রং করতে করতে দুলাল শুনতে পায়, ‘বাবা এ দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

মাঝে মাঝে রং তুলি ফেলে কান দুটোকে চাপা দেয় দুলাল। কয়েক মিনিট পর কান ছেড়ে আবার কাজে মন দেয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এভাবে চলার পর মুখোশটার কাজ শেষ হয়। একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় দুলালের ভেতর। এর আগে কোনও মুখোশ বানিয়ে এতটা আনন্দ হয়নি ওর। যেমন বানাতে চেয়েছিল অবিকল তেমনই মুখোশ বানিয়েছে দুলাল।

মুখোশটা দুহাতে নিয়ে দুলাল ওটাই ভাবছিল কতক্ষণে লোকটা আসে। ও এলেই ওর হাতে মুখোশটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করবে ওকে। মুখোশটা কমপ্লিট হওয়ার পর সেই লোকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসি মুখে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, ‘হয়েছে?’

‘হইচ্যে। কিন্তু এই মুখশটা লিয়ে যাবার পর আর আসা চইলব্যেক লাই আমার বাড়ি।’ দুলাল বলে।

লোকটা কোনও কথা না বলে মুচকি হেসে দুলালের কাছে এগিয়ে আসে। দুলাল শক্ত করে ধরে রাখে মুখোশটা। কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে দূরের থেকেই মুখোশটা দেখায় লোকটাকে। লোকটার পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারে দুলাল।

লোকটা হাসি মুখে অস্ফুট সুরে বলে, ‘শয়তানের মুখোশ।’

যখন বাতাসি ঘরে ঢোকে তখনও দুলাল লোকটার সঙ্গে গল্প করছে। আজকে বাতাসির সঙ্গে আরও একজন এসেছে।

পুলিশ?

না পুলিশ নয়, মনের ডাক্তার। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুবিমল সরকার। ডাক্তারকে বাতাসি আঙুল বাড়িয়ে দেখায় দুলাল কেমন ভাবে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প করছে। শুধু তাই নয় দুলাল গল্প করছে সম্পূর্ণ দুরকম ভাবে। একটা ওর নিজের ভাষা। অন্যটা শহরের। বাতাসি দুলালের কাছে যেতে চাইলে সুবিমল বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ওকে মুখোশটা দিতে দাও।’

দুলালের কল্পনায় তৈরি লোকটা যখন কথা দেয় ও আর আসবে না, তখন দুলাল মুখোশটা শূন্যে তুলে ধরে। তারপর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বাতাসি আর সুবিমল সরকার মিলে দুলালকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে। সুবিমল বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই। আশা করি আজকের পর আর এই সমস্যা হবে না। তবে ওই মুখোশটা যেন ওর চোখে আর না পড়ে। পারলে ওটাকে পুড়িয়ে দিও।’

৫)

বাতাসি উঠোনে গিয়ে মুখোশটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। অবিকল নিজের মুখোশ বানিয়েছে দুলাল। কাঁচাপাকা চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। মুখোশ হাতে নিয়ে বাতাসি ডাক্তারের সামনে তুলে ধরে। মুখোশটাকে দেখার পর কয়েক মিনিট চিন্তা করে সুবিমল। কোনও একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সুবিমল বাতাসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা দুলাল নিজের মুখোশ বানাল কেন? তোমার কী মনে হয়?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতাসি বলে, ‘যেদিন রাইত্যে আমাদের ছেল্যাডারে সাপে কাইট্যে ছিল সেদিন একটা লোক আছিল একটা অডার লিয়ে। একটা শয়তানের মুখশের অডার। সেই অডারের কাইজটাই রাইত্যের বেলায় কচ্চিল দুলাল। আমি ঘুমোচ্চিলাম। তাতাই আমাকেও তুইল্যেছিল, উঠি লাই। উয়ার বাপও কাইজ ছ্যাইড়ে উঠে লাই। যখন জাইনত্যে পাইল্লম তাতাইকে সাপে কাইট্যাছে, তখন সব শেষ। সেদিন থ্যেইক্যেই তাতাই-এর বাপ ক্যেমন যেন হইয়ে গেছ্যে।’

‘আচ্ছা সেদিন তুমি টাকার বান্ডিলটা কোথায় রেখেছিলে?’

‘ওই কপাট কুনট্যায়।’ আঙুল বাড়িয়ে দেখায় বাতাসি।

‘দুলাল টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রেখেছিল বলতে পারবে?’

‘একটা মুখশের ভিতর‍্। দাঁড়ান লিয়ে আসচি।’

বাতাসি মুখোশটা নিয়ে এসে সুবিমলের হাতে দেয়। সুবিমল মুখোশটা বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর বলে, ‘আচ্ছা এই মুখোশটার ভেতর আরেকটা ছোট্ট মুখোশ কেন আছে?’

এবার চুপ করে যায় বাতাসি। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা পু্রোনো ব্যথাটা চোখের পাতা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাতাসিকে চুপ করে থাকতে দেখে সু্বিমল বলে, ‘আমাকে মুখোশ রাখার ঘরটায় একবার নিয়ে চলুন।’

না বলতে পারে না বাতাসি। মুখোশ ঘরে নিয়ে আসে সুবিমল ডাক্তারকে। ঘরটায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় ডাক্তার। সারা ঘরটা জুড়ে কয়েক’শ মুখোশ রাখা আছে। দেব-দেবীদের মুখোশ থেকে শুরু করে পশু-পাখি কিছুই বাদ নেই। কিন্তু একটা দেয়াল জুড়ে ঝুলছে অদ্ভুত কিছু মুখোশ। প্রতিটা মুখোশের ভেতর একটা করে ছোটো মুখোশ আছে। একটা মুখোশ হাতে নিয়ে ভেতরের ছোটো মুখোশটাকে বের করার চেষ্টা করে ডাক্তার। পারে না। বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটো মুখোশটাকে এমন ভাবেই ঢোকানো আছে যে, দুটোকে আলাদা করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সুবিমল অবাক চোখে বাতাসিকে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেন বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটোটাকে লুকিয়ে রেখেছে দুলাল?’

শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বাতাসি বলে, ‘তাতাইকে সাপে কামড়্যায় নায়, ডাক্তারবাবু।’

‘তাহলে?’

‘সাত বছর আগে সেদিন যে লোকটা আইছিল, সে বইল্যেছিল…’

‘শয়তানের মুখোশ বানাতে। তারপর?’

‘মুখশটা মাপে ঠিক হচ্যিল লাই। তাতাই-এর বাপ তাই তাতাইকে মুখশটা পরাই মাপটা ঠিক করত্যে গ্যেইছিল…’ কান্নায় বাতাসির কথাগুলো ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেতরের কান্নাটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে বাতাসি বলে, ‘তাতাই বারবার বইল্যেছিল, দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। উয়ার বাপ কথাগুল্যান কানেই নিল লাই। আর খুলত্যে পারে নাই মুখশটা। মাছের মতো ছটপট্যাই ছটপট্যাই মইরে ছিল তাতাই…’ নিজেকে আটকাতে পারে না বাতাসি। সাত বছর ধরে জমিয়ে রাখা চোখের জল আজ আর কোনও বাধা মানতে চাইছে না।

সুবিমল একটা মুখোশকে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। পারে না। প্রতিটা কাগজের মুখোশের ভেতর টিনের পাত দেওয়া আছে। সুবিমল খেয়াল করে দেখে সব মুখোশগুলোর গঠন এক নয়। অধিকাংশ মুখোশের পিছন দিকটায় কিছু নেই, ফাঁকা। গোটা কুড়ি-পঁচিশ মুখোশ আছে যেগুলোর পিছনটাও সুন্দর ভাবে বানানো। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই কুড়ি-পঁচিশটা মুখোশ শয়তানের মুখোশ।

সুবিমল সরকার আগে তো একজন মানুষ, পরে ডাক্তার। ওর বাড়িতেও বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে আছে। তাই ওর পক্ষে দুলাল কিংবা বাতাসির যন্ত্রণার জায়গাটা বোঝা কঠিন নয়। এতক্ষণে সুবিমল বুঝতে পারে, কেন দুলাল শয়তানের মুখোশে নিজের রূপ এঁকেছে। কেন শয়তানের মুখোশের ভেতর একটা করে ছোট্ট মুখোশ ঢোকানো রয়েছে।

দুলাল এখনও অচেতন ভাবে বিছানায় পড়ে আছে। সুবিমল দুলালের নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। না নিঃশ্বাস স্বাভাবিক। এখন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে না দুলাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুবিমল বাতাসিকে বলে, ‘চিন্তা কোরো না। দুলাল ওই বাজে স্বপ্নটা বা ওই লোকটাকে আর কখনওই দেখবে না। তবে হাঁ জ্ঞান ফেরার পর যদি কাঁদে তো ওকে মন খুলে কাঁদতে দিও।’ কথাটা বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েও আবার একবার ফিরে আসে সুবিমল, ‘আরেকটা কথা। শয়তানের ওই মুখোশটা, যেটা দুলালের নিজের মুখের আকৃতি, সেটা যেন আর দুলালের চোখে না পড়ে। ওটাকে দূরে কোথাও পুড়িয়ে দিও কিংবা মাটি চাপা দিয়ে দিও।’

সুবিমল চলে যাওয়ার পর বাতাসি দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে দুলালের মুখটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর মুখোশটা নিয়ে বাড়ির পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কোনওদিন দুলালের চোখে পড়বে না শয়তানের মুখোশটা।

 

বনপথে বনচরী

পরম হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পৌঁছে গিয়েছে। আরও কিছুটা গেলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। বনপথে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। রেলস্টেশনে নেমেছে ভোরের আলো ফোটার আগেই।

ট্রেন থেকে নেমেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। স্টেশনের পিছন থেকে একটা পথ বনের দিকে চলে গিয়েছে। মানুষের পায়ে পায়ে ক্ষয়ে কী দারুণ পথরেখা তৈরি হয়েছে। আর এই চেনা পথটা ধরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আপন ঘরে ফেরার অনাবিল আনন্দে চলতে থাকে সে। বহু বছর পর বাড়ি ফেরার একটা আনন্দ আছে বইকি!

শ্রাবণের ভরা বর্ষায় পথঘাট ভিজে। কচিসবুজ পাতা গাছের ডগায় ডগায়। পাখির কিচিরমিচির। বৃষ্টিভেজা পাখির ঝাঁক, ডানা ঝাপটাতে থাকে গাছের ডালে ডালে। সামনে একটা ভাঙা সাঁকো রয়েছে। কয়েকটা বাঁশ দিয়ে নদী পারাপার করা যায় এই পথে। সাঁকোটা পার হলেই একটা মেঠো পথ চলে গিয়েছে বনের দিকে।

ভোরের আলোয় এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। নিস্তব্ধতা চারিদিকে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টিতে পথ ধুয়ে গেছে। ধুলো মাটিতে বনের সর্বত্র পলির আস্তরণ পড়েছে। পরমের পায়ে ছাপ পড়ছে সেই নরম বনপথে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর হাঁপিয়ে গিয়েছে। তাই একটা আধশোয়া গাছের ডালে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। হয়তো গাছটা গত রাতের ঝড়ে নুইয়ে পড়েছে। আরও কয়েক কিলোমিটার পথ পার হলেই ছোটো নদী।

ভরা বর্ষায় জল থইথই নদী পার হওয়া খুব কঠিন। এই সময় স্রোতের প্রবল টান থাকে। আবার হড়পা বানে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। যখনই নদীর জলে পা রাখে পরম, স্রোতের টানে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। জলের গভীরতা খুব বেশি, আবার কোথাও হাঁটুজল। আবার কিছুটা পিছিয়ে নদী পার হতে যায়। কিন্তু পিছলে যায় বারবার। ভয় ভয় ভাব কাজ করছে। এবার কিছুটা হতাশ হয়ে বসে পড়ে। নদীর দিকে চেয়ে থাকে অপলক। আর ভাবতে থাকে অতীত দিনের কথা। বেলা গড়িয়ে এখন দুপুর। মধ্য-গগনে গনগন করছে সূর্য‌্য। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যেন আলোর রশ্মি চুঁইয়ে পড়ছে।

বনচরী রোজ নদীর তীরে আসে গরু চরাতে। বর্ষায় লকলকে ঘাস নদী অববাহিকায়। এখানেই গরুর বাথান। গরুর পাল আপন মনে চরতে থাকে। নদীর ওপারে তাদের বসতি। সাতসকালে যখন গরুর পাল নিয়ে এসেছিল তখন নদীতে স্রোত ছিল না। সহজেই পার হয়ে এপারে এসেছে। অতিবৃষ্টিতে বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠে নদী। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লেই হড়পা বানে নদীর জল বেড়ে যায়। আর দুই পাড়ের মানুষ নদীর দিকে চেয়ে থাকে। বৃষ্টি কিছুটা ধরলে আবার নদী পারাপার করে।

শীতের সময়ে নদীর কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। নুড়িপাথর আর বালি বোঝাই হয় নদীগর্ভ। বনচরী সকালেই নদী পার হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে বৃষ্টি ছিল না। পরিষ্কার আবহাওয়া, কখন যে দিন গড়িয়ে গেছে! রোজ কিছু খাবার নিয়ে আসে বনচরী। গ্রামের আরও কয়েকজন এই বনাঞ্চলের ঘাস জমিতে গরু ছাগল নিয়ে আসে। শীতের মরশুমে এই নদী চরে পিকনিক পার্টির মোচ্ছব বসে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আবার। প্রচণ্ড বৃষ্টির ছাঁট। ছিটছিট রঙের প্রজাপতির মতো ছাতাটা মেলে নিজেকে আড়াল করছে বনচরী। গরুর পাল আর তার সঙ্গীরা বেশ কিছুটা দূরে। বনচরী ঘরের গাই-বাছুর সঙ্গে নিয়ে আসে। ছোট্ট চঞ্চল বাছুরটা হঠাৎ দলছুট হয়ে গিয়েছিল। আর সেই বাছুরের পিছনে ছুটতে ছুটতে নদীর তীরে এসে পৌঁছোয় বনচরী।

একটা দমকা হাওয়া আর সঙ্গে এলোমেলো বৃষ্টি শুরু হল। বনচরীর ছাতাটা উড়ে এক্কেবারে পরমের কাছে। পরম তখন বৃষ্টির থেকে রক্ষা পেতে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময় রঙিন ছাতাটা তার পায়ে কাছে লাগে। সযত্নে তুলে নিয়ে বনচরীর হাতে দেয়। লাজুক মুখে ছাতাটা নিয়ে ঘুরছে সে অন্যপথে।

পরম সাহস করে জিজ্ঞাসা করে, তোমার গ্রাম কোথায়? নদীর ওপারের দিকে হাত তুলে দেখায় বনচরী। ছাতাটা মুঠোতে শক্ত করে ধরে বৃষ্টি আটকাতে থাকে। অচেনা দুজন একই ছাতার তলায়। এলোপাথাড়ি বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে বনচরীর শঙ্খশুভ্র হাতের কবজি। বৃষ্টি কিছুটা কমেছে এখন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে সূর্য‌্যের রশ্মি। রামধনু ওঠার সম্ভবনা প্রবল।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে পরমকে ইশারায় বনচরী তার সঙ্গে যেতে বলে। ফিক ফিক করে মুচকি হেসে রাস্তার দিক নির্দেশ করে সে। বনপথে আরও কিছুটা গভীর অরণ্যে একটা বনদেবীর মন্দির। আর মন্দিরের চাতালে গবাদী পশু নিয়ে যারা রোজ আসে, তারা ঝড়-ঝঞ্ঝায় আশ্রয় নেয়। সকলেই অপেক্ষায় নদীর জল কমলে ওপারের বনবস্তিতে ফিরে যাবে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখনও। একই ছাতার তলায় হাঁটছে দুজন, পরম ও বনচরী।

পশুপালকরা মন্দির চত্বর ছেড়ে ফিরছে। নদীর হাঁটুজল বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। মাঝপথে ওদের দুজনকে দেখে বেশ হতবাক বনচরীর সঙ্গী-সাথিরা। সকলেই নদী পার হতে থাকে পশুর দল সঙ্গে নিয়ে পরম বহুদিন এই ভাবে নদী পার হয়নি। পা পিছলে যায়। বনচরী কখনও আলগোছে পরমকে ধরতে যায়। আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নেয়। মধ্যনদীর গর্ভে দুটো হাত যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ধরে ফেলে।

নদীর জল ছুঁই ছুঁই গাছের ডালগুলো নুইয়ে পড়ছে। আঁধার নেমে আসছে রাতের গভীরে। হৃদয়ে উথলে ওঠে ভালোবাসার ফল্গুধারা। নদী পার করে এখন বনবস্তির পথ ধরেছে পরম। বাকিদের সঙ্গেও আলাপ হয়ে যায় পরমের। গোধূলির রং মেখে এখন সবার ঘরে ফেরার পালা। বেশ টুকটুকে দেখতে বনচরী। পথ চলতে চলতে যেন ইশরায় কত কথা হয়। ভালোবাসা হয়ে যায় চোখে চোখে। আর কিছুটা গেলেই বনচরীরা সামনের বনবস্তিতে ঢুকবে। তাদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় হাসি ঠাট্টা চলছে।

এই অঞ্চলের উপজাতি মেয়েরা খুব প্রাণ চঞ্চল হয়। কোনও ভনিতা পছন্দ করে না। সহজ সরল জীবনবোধ আর পরকে আপন করে নেবার সহজাত প্রবৃত্তি এদের। কিছুটা গেলেই বনপথটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পরম হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে।

চেনাপথ পরমের যেন খুব অচেনা লাগছে। বহুবছর পর ঘরে ফিরছে। পথের সবুজ বনের পথের বাঁকে মোচড় দিয়ে ওঠে মন এক অনাবিল আনন্দে। দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যায় বনচরীদের দল। বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় সে। আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের ডাক।

মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছরের পুরোনো কথা। তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। সে ছিল এক বৃষ্টি বাদলের দিন। মনিবের ঘরে হাল চাষ করত বাবা সত্যাপির। হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। সঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ। বিদ্যুতের ঝলসানো আলোয় সব কিছু নিমেষে শেষ হয়ে যায়। চরম দারিদ্র নেমে আসে তাদের সংসারে।

দিনমজুর বাবার মৃত্যুতে মনিবের ঘরে মায়ে একটা কাজ জুটলেও, সংসারে টানাটানি অবস্থা। কয়েক মাস পর শহরের এক ঠিকাদারের অধীনে পরম কাজ পায়। এই সূত্রে দক্ষিণ ভারতে যাওয়া। বহুবছর পর বর্ষার মরশুমে কিছুদিন ছুটি নিয়ে তার ঘরে ফেরা। বহুদিন পর শাঁখ, ঝিঁঝিঁর শব্দ শুনতে শুনতে আলো-আঁধারি পথে গ্রামে ঢুকছে পরম।

পথ হাঁটতে হাঁটতে এখন কালো পিচ ঢালা রাস্তাটা সামনে এসে পড়ল। এই পথে শহর থেকে বাস এসে ঢুকছে বনাঞ্চলের শেষ ঠিকানায়। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি পথে বাসের হেড লাইটে বনপথটা আঁধারের বুক চিরে চলে গেছে।

গ্রামে ঢোকার মুখেই তাদের ঘর। টিমটিম করে পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। ছোট্ট বোন খুশি, বই পড়ছে। দাদাকে দেখে জাপটে ধরে। রান্নাঘর থেকে পরমের আসার খবর পেয়ে ছুটে আসে মা। বেশ কয়েক বছর বাইরে থাকায় একটা আধুনিকতার ছাপ পরমের চোখে মুখে। তবুও পরমকে যেন আনমনা লাগছে খুব। হাত মুখ ধুয়ে ছুটে যায় মনসা মন্দিরের সান্ধ্য আড্ডায়। বাল্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কিছুক্ষণ গল্প করে ফের বাড়ি ফেরা।

বনচরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকদিন। প্রথম দেখার পর থেকেই পরম একটা ঘোরের মধ্যেই ছিল। সাতসকালে বনচরীকে দেখত গাঁয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে। গ্রামের শেষে সেচ বাঁধের পাড় ঘেঁসে বনচরীদের বস্তি। যেন দুটো যমজ গ্রাম। রেশন থেকে মুদির দোকান সবই পরমদের ঘরের সামনে। দুবেলা এই গ্রামেই আসতে হয় তাদের।

লাজুক স্বভাবের পরম। ইচ্ছে থাকলেও সময় সুযোগ করে আর সেরকম কথা হয়নি। বিভিন্ন ছলে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। কখনও বনচরী হাতের তালুতে মুখ ঢেকে চলে গিয়েছে। একমুখ প্রাণোচ্ছ্বল হাসি, পরমের মনের গহীনে ভালোবাসার প্লাবন বইয়েছে। কয়েকটা মাস যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি।

নুন আনতে পান্তা ফুরায় বনচরীদের সংসারে। কোনও দিন একশো দিনের কাজ জুটলে তাতেও পরিবারের সঙ্গে হাত লাগায় বনচরী। কিংবা সাপ্তাহিক গ্রামীণ হাটে, মুরগীর ডিম নিয়ে বিক্রি করতে যায়। আর প্রতিদিন গাঁয়ে গরু, ছাগল নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে যেতে হয় বনবাথানে। নিজ ঘরের গাই-বাছুরটিও তখন তার সঙ্গী হয়। পরমদের ঘরের পাশ দিয়ে একটা মেঠো পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে চলে

গরু-ছাগলের পাল। কিছুটা ঢালু জমি, পগার পেরোলেই ঘন অরণ্য।

চঞ্চল ছটফটে বাছুরটা দৌড়োতে দৌড়োতে চলছে। কখনও রকেটের গতিতে গভীর বনাঞ্চলে ঢুকে যায়। আবার ফিরে আসে। বনচরীর সাথিরা বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে যায়। সে থমকে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। জানে রোজকার মতো হারিয়ে যাওয়া বাছুরটা আবার ফিরে আসবে। এমনটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে। বনের পথের নির্জনতায় একাকী আকাশ কুসুম ভাবতে থাকে বনচরী।

কয়েকটা মাস গ্রামীণ শ্যামলিমায় কাটিয়ে এবার কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে পরমকে। ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে। হঠাৎ চেনা মানুষের মুখ দেখে হকচকিয়ে ওঠে বনচরী। মন ছুঁয়ে যাওয়া মানুষের মুখটা দেখেই যেন মন ভালো হয়ে যায়। নির্জন বনপথে আচমকা পরমকে দেখে অজানা উল্লাসে সারা মন ভরে ওঠে। কর্মস্থলে এই পথে আজ ফিরছে সে।

হাত নাড়তে নাড়তে খুব কাছে চলে এসেছে। লজ্জা ভেঙে গড়গড় করে না বলা অনেক কথা বলতে থাকে পরম। মাথা নুইয়ে মিহি মাটির বন্য উঠোনে একটা শুকনো কাঠি দিয়ে আঁকিবুঁকি আঁকতে থাকে বনচরী। লজ্জায় বনচরীর চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।

চোখ-মুখে একটা অব্যক্ত বেদনা। অনেক কিছুই তো বলতে চায় সে! বাছুরটা খুঁজতে খুঁজতে বনচরী তার চেনা বনপথে লাজুক হরিণীর মতো যেন হারিয়ে যায় সবুজ বনের বাঁকে।

পরমের বুঝতে মোটেই আর অসুবিধা হল না যে, কথা বলতে পারে না বনচরী। কয়েকটা মাসের বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, পরমের বুকে ভালোবাসার সিন্ধু তৈরি করেছে। কথা বলতে না পারা মেযো যে বহু কথা বলে দিয়েছে। মায়ার এক অদ্ভুত বাঁধনে বনচরী তাকে পিছন থেকে অহরহ টানে। বন্য সুবাসের মতো তার শরীরের গন্ধ বনাঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

তবু মনে রেখো…

পাবলিশারের দফতর থেকে এক কপি একটুকরো আকাশ সবেমাত্র হাতে পেল আঁচল। বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। কবি তোর্সা বসু নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিউ সার্কুলার রোডের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটটা যতই আপন হোক, সে আর সুতীর্থ বিয়ের পর প্রথম সংসার পেতেছিল মালিনী নিবাস-এই। ভাড়া বাড়ি হলেও আজও কেন জানি বড্ড নিজের!

মালিনী রায়চৌধুরী বছর ষাটের ডাকসাইটে সুন্দরী। স্বামী বেণুলাল রায়চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে তাঁর দিন কাটে। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাবার অভ্যাস কোনও কালেই নেই। সারাজীবনে, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, তার রক্ষনাবেক্ষণের দাযিত্ব স্ত্রী মালিনীদেবীর হাতে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্ত। এসব মাথায় রাখা মানেই তো উর্বর মস্তিষ্ককে কষ্ট দেওয়া। অতএব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতে হয় মালিনীদেবীকেই। নিন্দুকেরা বলে, মালিনীদেবীর শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে একটি পিঁপড়েরও প্রবেশাধিকার নেই মালিনী নিবাস-এ। যদি বা আচমকা প্রবেশ করে ফেলে, তত্ক্ষণাৎই মালিনীদেবীর সম্মার্জনী আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

বেশ মনে পড়ে আঁচলের, যারা মালিনী নিবাস-এ বাসন সাফাই আর কাপড় ধোয়ার দাযিত্বে বহাল হতো, তাদের মুখগুলো দিন কুড়ি পর পর বদলাতে থাকত। কারও তেল চিটচিটে বাসন ধোয়া তো কেউ কাপড় নিংড়ানোর কোনও ছিরি জানত না। মাঝে একবার মালিনীদেবীর তীব্র হাঁটু ব্যথার দরুন, একমাসের জন্য যে-কজন রন্ধনশিল্পী বহাল হয়েছিল তাদের কারওরই মালিনীদেবীর মাপ করা তেল-মশলায় রান্নার পারদর্শিতা ছিল না।

 

মালিনী নিবাস-এ দুটি প্রাণী। কর্তা ও গিন্নী। অনেক যত্ন নিয়ে বড়ো করেছেন একমাত্র ছেলে অবিনাশকে। সে-ও বদলি নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তার স্ত্রী তিতির সাফ জানিয়েছে, মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করার জন্য সে পৃথিবীতে জন্মায়নি। তার করার মতো অনেক কাজ রয়েছে।

মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় একবেলার জন্য অবিনাশ আসত। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র শ্বশুরালয়ে থাকায় অবিনাশের বিশেষ থাকা হতো না। এতে মালিনীদেবীর বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। বরং এ যেন একদিকে ভালোই। অন্যের আজেবাজে কাজ তার বরাবরই না-পসন্দ। খালি মাঝে মাঝে এক মাত্র নাতি তাতানের জন্য ভেতরটা হু হু করে এই যা! সাধ করে জিভেগজা, খুরমা, আচার বয়ম ধরে বানিয়ে রোদে দেন। সংরক্ষণ করেন, যদি কখনও তার দাদুভাই আসে! কিন্তু কালের নিয়মে একসময় তাতে ছাতা ধরে। তবু মালিনীদেবী প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারেন না।

মালিনী নিবাস-এর একমাত্র ভাড়াটে সুতীর্থ বসু আর তার ছোট্ট ছেলে বাবিনের প্রতি মালিনীদেবী বরাবরই স্নেহশীলা। কিন্তু সুতীর্থর বাউন্ডুলে লেখিকা বউ, আঁচলের উড়নচণ্ডী স্বভাব দেখে রেগে গজগজ করে বলতেন, মেযোনুষের অত সংসার ফেলে বাউন্ডুলেপনা ভালো লাগে না বাপু! বলি পাতাকে পাতা হিজিবিজি লিখলে সংসারের কোনও উপকার হয়? তার চেয়ে ঝুলগুলো তো একটু ঝাড়তে পারে? নেহাৎ পড়েছিল অমন ভালো ছেলেটার হাতে! আহা গো, বাচ্চাটা কেমন শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়!

প্রতিদিনের মতোই একদিন মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করতে করতে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের শিকার হয়ে শয্যাশাযী হলেন মালিনীদেবী। বাঁ দিকটা কোনও জোর নেই। ভাগ্যিস আঁচল এসে ধরেছিল, নইলে সে যাত্রা ফিরতেন না। সবই অদৃষ্ট নইলে কে ভেবেছিল, তার মতো দাপুটে মহিলাকেও কাজের মাসি আর আয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।

এদিকে পিঁপড়ে, আরশোলা, ছুঁচো মনের সুখে বাসা বেঁধেছে মালিনী নিবাস-এ। বেণুলাল খুব একটা এদিকে আসেন না। রোগীর ঘরে আসতে তাঁর গা ঘিনঘিন করে। পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, মাঝে মাঝে ভুলেই যান, ডান না বাঁ কোন দিকে অসাড় মালিনীদেবীর। না এসব করলেও বেণুবাবু যথেষ্ট কর্তব্যবান। কারণ চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় আর্থিক ভার তো তাঁরই। শুধু শুধু খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে বিপদ বাড়ানো বই-তো নয়!

বিশেষ কেউ আসে না মালিনীদেবীর ঘরে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক স্বস্তির। অবিনাশ একবেলার জন্য এসেছিল। চোখ ফেটে জল আসে মালিনীদেবীর। সামনে আলমারীর ওপরে তাঁদের বিয়ে ছবি। আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বেঢপ বেণুলালের সঙ্গে নিজের জুটিটাকে মানানসই করতে, নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন সেই কবেই! এই পুতুল খেলার নেশার মতো সংসারের নেশায় বুঁদ হয়ে সব কষ্ট ভুলেছেন। নয়তো এই স্বার্থপর, বাতিকগ্রস্ত, বদমেজাজি লোকটার সঙ্গে থাকতেন কীভাবে? মাঝে মাঝে বিভিন্ন মহিলা কলিগের সঙ্গে মাখোমাখো গল্প কানে এসেছে। শুনেও শোনেননি, বুঝেও বোঝেননি। সব কষ্ট থেকে পালানোর একটাই জায়গা ছিল। আজ আর সেটাও রইল না।

ও মাসি আমি কিন্তু ফল, হরলিক্স আনিনি, এই দ্যাখো বকুল ফুল। খুশি? বলেই হেসে ওঠে আঁচল। আঁচলের চুলের শ্যাম্পু আর পারফিউমের গন্ধে সতেজ লাগে মালিনীর। পর্দা সরাতেই ঘরে একরাশ রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।

এই দ্যাখো মাসি আমার মোবাইলে, একি! মাসি তুমি কাঁদছ?

চাঁপা কলির মতো আঙুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আঁচল স্বভাবসুলভ ভাবে বলে চলে, এটা ওয়ে ম্যাগাজিন। আমি এডিটর। সেদিন কাগজওয়ালার পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপে, তোমার কবিতার খাতাগুলো পাই। মেসো মনে হয় বোঝেননি। আমি কিন্তু আরও ছাপব মাসি! আসলে তুমি যতই খিটখিট করো, আলমারী ঠাসা রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পূর্ণ সেট আর ঝাড়ু দিতে দিতে রবিবাসরীয় পড়া দেখেই বুঝেছিলাম।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মালিনীদেবী। আঁচল বলে চলে, বারীন সেনের মতো লেখক তোমার বন্ধু? উনি পড়ে নিজে আমায় ফোন করেছেন। ভাবতেই পারছি না! কত বেস্টসেলার লিখেছেন উনি।

 

ঈষৎ বেঁকে যাওয়া, বলিরেখায় ভরা মুখটায় কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। লাজুক হেসে একটু জড়ানো স্বরে বলে চলেন, এক কালে বারীনদার সাথে কত চিঠি, কবিতা দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। মামার সংসারে মানুষ তো! বারীনদা তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তোর মেসোর ভালো চাকরি। (একটু থেমে) আচ্ছা আঁচল আমি কি আর আগের মতো জোর ফিরে পাব না রে? শুয়ে বসে খুব কষ্ট হয়। আমাকে একটু তোর মতো ফোন দিয়ে টাইপ শিখিয়ে দে না। নতুন করে লিখি।

খুব কষ্ট হয় আঁচলের। জোর করে হেসে বলে, একটু ভালো হও তারপর। এখনও তো অসুস্থ তুমি।

ধুর! আর ভালো হব নাকি! শোন না, আমার এই সোনার চুড়ি দুটো রাখ।

এ মা! কেন?

আরে সে লোক এখন টাকা পয়সা নিজের হাতে করে নিয়েছে। সময় থাকতে সরিয়ে রাখিনি আমিও যেমন! শোন না, কবিতাগুলোর একটা বই করে দিবি মা! এটা দিয়ে হবে তো? আর একটা কথা, কবির নাম দিবি তোর্সা বসু। আমার বাপের দেওয়া ডাকনাম। বাপের পদবী।

তুমি ওটা রাখো মাসি, আমি নিজে করে দেব। চাকরি করি তো না কি! একটু সময় দাও।

শোন না যাবার আগে বাবিন সোনার জন্য আমের আচার নিয়ে যাস কিন্তু।

চোখটা মুছে মোবাইলের গ্যালারি থেকে মালিনী মাসিমার ছবিটা বের করে আঁচল আপন মনেই বলে, আজ বইমেলার ৪ নম্বর স্টলে তোমার এক টুকরো আকাশ থাকবে। তোমার কথা ভুলিনি মাসি, একটু দেরি হয়ে গেল! গুছিয়ে নিতে সময় লেগে গেল।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব