আজকাল শহরে মহিলা-পার্টির বেশ একটা চল হয়েছে। পার্টির নামে এর বাড়ি-তার বাড়িতে দশ-বারোজন একত্রিত হও, আর জমিয়ে পিএনপিসি চালিয়ে যাও। এতে শরীর স্বাস্থ্য দুই-ই নাকি ভালো থাকে। এরকমই এক সান্ধ্যপার্টিতে যাওয়ার জন্য এস্টেট-এর মহিলামণ্ডলী সবেমাত্র বড়ো গেটের সামনে জড়ো হয়েছে। সেখান থেকেই তারা একত্রিত হয়ে পার্টির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। এমন সময় পিউ আর তার মাকে পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে, মহিলামণ্ডলীর-ই এক সদস্যা রীতা বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠল, ‘আরে দ্যাখ দ্যাখ, সুন্দরীকে দ্যাখ! রোজ নিত্যনতুন পোশাক পরে পাড়ায় প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।’
মহিলামণ্ডলীর আর এক সদস্যা শ্বেতা একপ্রকার কথা কেড়ে নিয়ে উঠে বলে, ‘আরে ধুর শুধু মেয়ে কেন? মাকে দ্যাখো না। আপাদমস্তক পরিবর্তনের ঝড়। বছর চারেক আগেও যে পাড়ার লোকের জামাকাপড় সেলাই করে কোনওমতে একবেলার অন্নের সংস্থান করত, আজ তার পরনে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক। ভাবা যায়! ভগবান জানে কোথা থেকে এত টাকাপয়সা এল এদের হাতে !’
‘আরে বাবা, যা একখানা মালদার পার্টি ধরেছে না! বাপ-কাকার বয়সি বিবাহিত পুরুষ হলে কী হবে, অঢেল টাকার মালিক তো বটে। অবশ্য এর জন্য কুমারজিকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। সবসময় কোনও মেয়ে যদি ঢলে ঢলে গায়ে পড়ে তাহলে সে-ই বা কী করে। আখেরে সেও তো পুরুষই।’ প্রত্যুত্তরে রীমা বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথাগুলি বলছিল।
কথাগুলি শুনতে শুনতে আর-এক সদস্যা বেশ আশ্চর্য হয়েই রীমাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই কি আমাদের কুমারজির কথা বলছিস? মেইন রোডের ওধারেই যার বাড়ি? যার দুই ছেলে? এক ছেলের নাম সোহম?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওনার কথাই বলছি। জয়পুরে যাদের প্রচুর সম্পত্তি আছে৷ ভদ্রলোকের স্ত্রী ভীষণ শান্ত স্বভাবের। তার সরলতার সুযোগ নিয়েই এই মেয়েটি যথেচ্ছাচার করছে। এমন অঙ্গভঙ্গি করে যে হিরোইনরাও মাত হয়ে যাবে তার কাছে। বাপরে বাপ, বাপের জন্মে এইরকম মেয়ে দেখিনি।’ সুর টেনে টেনে বলতে থাকে রীমা।
রীতা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ থাকা বোধহয় তার কোষ্ঠীতে লেখা নেই, তাও আবার এরকম একটা মুখরোচক চটপটা প্রসঙ্গে। হঠাৎই নীরবতা ভেঙে বলে উঠল, ‘সত্যিই তো, মউমাছির মতো কেউ যদি সারাক্ষণ চারপাশে ভনভনিয়ে উড়তে থাকে, তাহলে কুমারজিই বা কী করে বল তো! আমি তো দেখেছি কখনও পড়ার নামে, কখনও কখনও শ্রুতিকে বাড়ির কাজে সাহায্যের নামে আবার কখনও কুমারজির সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্কের টানে ওদের বাড়িতে পড়ে থাকে।’
‘রীতাদি তুমি কি আজকাল গোয়েন্দাগিরি করছ নাকি? তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল অদিতি।
‘আরে নারে গোয়েন্দাগিরি করব কেন কিন্তু যদি চোখের সামনে কিছু দেখতে পাই, সেটাও তো না দেখে থাকা যায় না বল। কুমারজির বড়ো ছেলে সোহম আর আমার ছেলে একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ে। ওদের অঙ্কের টিচার হরিশবাবু ওনাদের বাড়িতে দুজনকে একসঙ্গেই পড়ান। ছেলেকে পৌঁছে দিতে আর নিতে যাওয়ার সূত্রেই ওনাদের বাড়িতে যাতায়াত। এই আর কী!’ সাফাই দিতেই এই সমস্ত কথাগুলো অদিতির উদ্দেশ্যে বলে রীতা।
এমন সময় আর-এক সদস্যা একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, ‘ছাড়ো না বাবা, তোমরাও সব কী টপিক নিয়ে পড়লে। শুধু শুধু কাদা ঘেঁটে লাভ আছে? বরং তাড়াতাড়ি পার্টিতে চলো জমিয়ে মজা করি।’
আজকাল পিউ আর এই সমস্ত কথাবার্তা গায়ে মাখে না। বিগত চার বছর ধরে পাড়াপড়শির এই ধরনের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভালোবাসায় পেশাদার মনোভাব চলে এলেও, প্রথম প্রথম সেটা কিন্তু আন্তরিকই ছিল।
বছর চারেক আগেকার কথা। পিউ তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বাবা নেই, মা সারাদিন সেলাই-ফোঁড়াই করে সংসারটা কোনওমতে টানার চেষ্টা করছে। তাতে কী আর সংসার চলে। তার উপর আবার তার পড়াশোনা। বাড়ির আর্থিক সংকট কিছুটা হলেও লাঘব করার জন্য একদিন পিউ ছুটে গিয়েছিল কুমারজির কাছে। যদি ওনার কিউরিও শপ-এ সেলস্গার্ল-এর চাকরি পাওয়া যায়।
সেদিন তার ছুটে যাওয়া বিফলে যায়নি। মিষ্টভাষিনী মেয়েটিকে ফেরাতে পারেননি কুমারজি। তার ইচ্ছেমতোই দোকানে সেলস্গার্ল-এর কাজে নিয়োগ করেছিলেন তাকে। কলেজের পরে বাকি সময়ের বেশিরভাগটাই দোকানে মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করত পিউ। কুমারজিও দোকানেই উপস্থিত থাকতেন। কাজের প্রতি পিউ-এর একাগ্রতা কুমারজির বেশ ভালোই লাগত। এমনিতেই কুমারজি একটু নরম মনের মানুষ, তার উপর কেয়ারিংও বটে। পিউয়ের চোখেমুখে কোনওরকম চিন্তার ভাঁজ দেখলেই তার কাছে ছুটে গিয়ে তার কারণ জেনে সেই সমস্যার সমাধান করাই যেন তাঁর অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকী পড়তে পড়তে কিছু না বুঝতে পারলে, সেটা বোঝানোর দায়িত্বও তাঁর উপরই বর্তাত। জ্ঞানে-অজ্ঞানে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা না-বলা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
দেখতে দেখতে এইভাবে মাস ছয়েক কেটে গেল। সবই আগের মতোই ঠিকঠাক চলছিল। এরই মাঝে পিউয়ের চার-পাঁচ দিন দোকানে না আসার ব্যাপারটাই যেন তাদের সহজ-সরল সম্পর্কটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। পিউয়ের না আসার ব্যাপারটা কুমারজি কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিলেন না। মনের কোণে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধছিল। অবশেষে চতুর্থ দিন আর থাকতে না পেরে কুমারজি সোজা চলে গিয়েছিলেন পিউদের বাড়িতে। পিউয়ের মা বেশ অবাকই হয়েছিল সেদিন– মালিক এসে পৌঁছেছে এক অতি নগণ্য তুচ্ছ কর্মচারীর বাড়িতে তার খোঁজ নিতে! সত্যি বলতে কী পিউও একটু অবাকই হয়েছিল কুমারজির এহেন আচরণে। হয়তো পিউও বুঝতে পারছিল সবার অনবধানে সে কুমারজির জীবনের একটা অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।
কুমারজির প্রশ্নের সহানুভূতিপূর্ণ স্পর্শে চোখ জলে ভরে গিয়েছিল পিউয়ের। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘বাবা অসুস্থ, খাবার পয়সা নেই, তার উপর আমার পড়াশোনাটাও বন্ধ হয়ে যাবে। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। কী করব বুঝতে পারছি না। তাই…’
সেইদিন বাবার মতোই হোক বা অন্য কোনও সম্পর্কের সূত্রে, পিউয়ের মাথায় হাত রেখে কুমারজি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘তুই চিন্তা করছিস কেন? আমি তো আছি! পড়া চালিয়ে যা, তোর পড়ার খরচ আমি দেব।’
সেখান থেকেই পিউ আর কুমারজির সম্পর্কটা একটা গভীরতা পেতে শুরু করে। যে-মানুষটার জন্য তার চাকরি পাওয়া, পড়াশোনা করা, বাড়ির সকলের পেটের জোগান, সেই মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতা জন্মানোটাই বোধহয় স্বাভাবিক। আর সেই কৃতজ্ঞতার স্বাভাবিক বোধটাই ধীরে ধীরে পিউয়ের মনে ভালোবাসার আকার নেয়। পিউয়ের কাছে কুমারজি তখন ভগবানতুল্য, সুযোগ পেলে তাঁর পায়ে নিজেকে সমর্পণ করতেও বোধহয় সেদিন সে দ্বিধাবোধ করত না। শয়নে-স্বপনে কুমারজি আর কুমারজি। সবসময় কুমারজির চোখের সামনে ঘুরঘুর করা, নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা, কুমারজির পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরা, এই ছিল যেন তার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
একদিন কুমারজিরই এক বান্ধবী হঠাৎই কিছু কেনাকাটার জন্য দোকানে এসে হাজির। বান্ধবীটি প্রকৃত অর্থেই সুন্দরী, একেবারে ডানাকাটা পরি। যাইহোক, বহুদিন পরে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা আর তারপর অনেকদিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হলে যা হয় আর কী। দুজনে পাশাপাশি বসে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন চলল বেশ কিছুক্ষণ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সমস্ত কিছুই লক্ষ্য করছিল পিউ। এভাবে হেসে হেসে কুমারজির অন্য কারওর সঙ্গে কথা বলাটা একেবারেই মন থেকে মানতে পারছিল না। মনে মনে জ্বলে উঠছিল সে।
বান্ধবীটি চলে যাওয়া মাত্রই পিউ হন্তদন্ত হয়ে কুমারজির একেবারে কাছে গিয়ে বলল, ‘এটা একদম ঠিক নয়।’
হঠাৎই পিউয়ের এহেন আচরণে কুমারজি হতভম্ব হয়ে উঠে বলেন, ‘কী ঠিক নয়?’
‘আমি ছাড়া তুমি অন্য কারও সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারো না।’ পিউ বেশ অধিকারের সঙ্গেই কথাগুলি বলে ওঠে।
‘কী বলছিসটা কী?’ কথাটা বলতে বলতেই কুমারজি লক্ষ্য করছিলেন, পিউয়ের চোখে শধু অভিযোগই নয়, কোথাও যেন একটা ভালোবাসার আবেদন রয়েছে।এক মুহূর্ত চুপ থেকে খুব আস্তে আস্তে কুমারজি বলেন, ‘কেন, তোর খারাপ লেগেছে?’
‘হ্যাঁ, খুব বাজে লেগেছে। তুমি আর কারও সঙ্গে কথা বলবে না। তুমি শুধু আমার।’ চোখভরা জলে কথাগুলো বলতে বলতেই সেদিন পিউ একেবারে জাপটে ধরেছিল কুমারজিকে।
এহেন পরিস্থিতির জন্য কুমারজি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু পিউয়ের নিখাদ ভালোবাসাকেও সেদিন ফেরাতে পারেননি কুমারজি। পিউয়ের হাতের বন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ থেকে শুধু এটুকুই বলেছিলেন, ‘একেবারে পাগলি। তুই তো জানিস আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আর আমি আমার বউকে ভীষণ ভালোবাসি, এসব জেনেও…।’
‘জানি তুমি বিবাহিত। তুমি তোমার বউকে খুব ভালোবাসো। আমি তো তোমাকে বলিনি যে, তুমি তোমার বউকে ছেড়ে আমার কাছে চলে এসো। আমি শুধু তোমাকে এইটুকু বলেছি যে, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। ব্যস এটাই সত্যি।’
‘ঠিক আছে বাবা আর এরকম কাজ করব না। হয়েছে?’ বলেই পিউকে সমস্ত আবেগ দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন কুমারজি।
প্রেমের এই প্রথম স্পর্শে দুজনের শরীর-মনে যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে শুরু হওয়া সেই সম্পর্ক সময়ের স্রোতে এগিয়ে গেছে। দূরে থাকলে সবসময় একে-অপরকে এসএমএস পাঠানো আর কাছে থাকলে সারাক্ষণ চোখে চোখে দুজনের কথা বিনিময়। সময়ে-অসময়ে এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গঙ্গার ধারে কাটানো, পিউয়ের পছন্দের জিনিসপত্র কিনতে নিউমার্কেটে যাওয়া।
না চাইতেই সমস্ত কিছু পেয়ে পেয়ে পিউয়ের চাহিদার প্রত্যাশা দিনের পর দিন বেড়েই চলল। আর পিউকে সেই প্রত্যাশার দিকে ঠেলে দেওয়ার ব্যাপারে পিউয়ের মায়ের অবদানও কম নয়। পিউকে মাধ্যম করে কুমারজির থেকে টাকা আত্মসাৎ করাটাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। যার জন্য কুমারজির দিকে মেয়েকে এগিয়ে দিতে তিনি একবারও ভাবেননি। মেয়েটিও ভালোবাসার সারল্যে, কিছু চাওয়ার হলেই কুমারজির উপর জোর খাটায়। আজ সোনার চেন তো কাল কানের দুল– বায়নার শেষ নেই। এই করে করে কুমারজির আয়ের বেশ কিছু অংশ পিউয়ের আবদার মেটাতেই চলে যেত। খরচে কুমারজির বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধও ছিল না। কারণ তিনি সত্যই পিউকে মন থেকে ভালোবাসতেন। সেই কারণেই হয়তো ভাবতেন পিউয়ের সখসাধ মেটানো তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
প্রথমে বেশ কিছুদিন সম্পর্কটা বেশ মিষ্টি-মধুর আবেগপূর্ণ ছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলেছে। পিউ তার পড়াশোনা কমপ্লিট করেছে। সঙ্গে বদলেছে তার চিন্তাভাবনা, মানসিকতা। আগে যা কিছু করত হয় আবেগে, নয় তো ভালোবাসার টানে। এখন সমস্ত কিছুই মাথা খাটিয়ে চিন্তাভাবনা করে পা ফেলা। এখন তার এতটুকুও বোধগম্য হতে বাকি নেই যে, কুমারজিকে সে কোনওদিনই নিজের করে পাবে না।কারণ তাঁর স্ত্রী-সন্তান আছে এবং তিনি তাদের যথেষ্ট ভালোওবাসেন। তাদের ছেড়ে তিনি কোনওদিন বেরিয়ে আসবেন না তার হাত ধরার জন্য।
সুতরাং তাদের সম্পর্ক রাখতে হলে সারাজীবনই এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে তা লালন করে যেতে হবে তাকে। কোনওদিনই বাড়ির বউয়ের মর্যাদা পাবে না। শুধু তাই কেন, পিউ এটাও ভালোভাবেই জানত যে, তার আর কুমারজির মধ্যে বয়সের ব্যবধানও যথেষ্ট। বিয়ে করলেও তাদের বিবাহিতজীবন বেশিদিন সুখের হওয়ার নয়। অতএব যতদিন না মনের মতো একজন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়, ততদিনই এই সম্পর্কের আয়ু। ততদিন কুমারজি তার মানসিক আর আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর একটি মাধ্যম মাত্র। আগে বেশ কয়েকবার কুমারজির আবদার মেটাতে বা ভালোবাসার টানে তারা সঙ্গমেও লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু এখন সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া মানেই পিউয়ের বড়ো দাঁও মারার সুযোগ। সেই মুহূর্তে কুমারজির থেকে যা কিছু চেয়ে নিত পিউ। কুমারজিও কোনওদিন না বলতেন না।
কথাতেই আছে পাপ কখনও লুকিয়ে রাখা যায় না। ভাই-বোনের অজুহাত দিয়ে আর কতদিনই বা সবকিছু লুকিয়ে রাখা যায়। একদিন না একদিন ধরা পড়তে বাধ্য। এমনিতেই তাদের দুজনের এই ঘনিষ্ঠতা ঘরে-বাইরে সকলের চোখে ধরা পড়ছিল। তাই সংসারে বড়োসড়ো কিছু না হলেও, ছোটোখাটো মনোমালিন্যের সৃষ্টি হচ্ছিলই।
ওদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই পিউয়ের আচার-ব্যবহার কুমারজিকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। কোনও কিছু চাই তো জোর-জবরদস্তি তক্ষুনি কুমারজিকে দিয়ে তা করিয়ে নেওয়া। এই ব্যাপারগুলো কুমারজি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। একদিন তো সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে পিউ, তার এবং কুমারজির চূড়ান্ত মুহূর্তের ছবি মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করল, কুমারজির বারবার মানা করা সত্ত্বেও পিউ ছবিগুলি ক্যাপচার করেই রেখে দিল।
তার কয়েকদিন পরেই একদিন সন্ধেয় পিউ একপ্রকার ছুটতে ছুটতে কুমারজির কিউরিও শপ-এ গিয়ে বলল, ‘জানো, মা আমার বিয়ের ঠিক করেছে। টাকাপয়সা নেই বলে এমন একজন লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে, মাতাল বলে যার দুর্নাম আছে।’ বলেই কাঁদতে শুরু করে পিউ।
কথাগুলো শুনে কুমারজি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। কোনওরকমে পিউয়ের কান্না থামিয়ে বলেন, ‘তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলব। আমি জানি উনি ঠিক বুঝবেন। তাছাড়া তুমিও তো অন্য কারও সঙ্গে সুখী হতে পারবে না।’
‘আমি অন্য কারও সঙ্গে সুখী হব না এমন কথা আবার কবে বললাম? সারাজীবন তো আর এভাবে চলতে পারে না। বিয়ে তো আমাকে একদিন না একদিন করতেই হবে, তবে হ্যাঁ সেই পাত্রকেও যোগ্য হতে হবে। ধীরে ধীরে তার প্রতিও ভালোবাসা এসে যাবে।’ খুব সহজ সরল ভাবেই কথাগুলি বলল পিউ।
‘জ্বালাচ্ছ আমাকে? আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে?’ কুমারজি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
‘কেন? তুমি কি তোমার বউ থাকা সত্ত্বেও আমাকে ভালোবাসোনি?’ সোজাসুজি প্রশ্ন করল পিউ।
কুমারজি বেশ হতবাক হয়েই বললেন, ‘তার মানে তুমি বিয়ে করতে চাও?’
প্রত্যুত্তরে পিউ বলে ওঠে, ‘প্রত্যেক মেয়েরই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। আমারও আছে। আমি তো তাদের বাইরে নই। আমিও চাই আমার একটা ঘর-সংসার হোক।’
‘ভেবে বলছ? আমার কথা মনে পড়বে না তোমার? পারবে আমাকে ছেড়ে থাকতে?’ পিউকে দ্বিতীয়বার যাচাই করার জন্য প্রশ্ন করেন কুমারজি।
হাসতে হাসতে পিউ জবাব দেয়, ‘কষ্ট হয়তো হবে, তবে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা আমার আছে। তাছাড়া কথাতেই তো আছে, আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড।’
‘ঠিক আছে যদি সেটাই সত্যি হয়, তাহলে তোমার বিয়ে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেব।’ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন কুমারজি।
কুমারজির কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে পিউ বলে, ‘সেটাই তো আমি চাই, তোমার মতো একজন ভালো মানুষ খুঁজে দাও না আমাকে। নাহলে তুমি তো জানোই আমি কী করতে পারি।’
কর্কশভাবে কুমারজি বলে ওঠেন, ‘কী, কী করতে পারো তুমি?’
‘তুমি তো জানো তোমার জিয়নকাঠি-মরণকাঠি সবই আমার ক্যামেরায় বন্দি। চাইলেই তার একঝলক তোমার বউকে দেখাতেই পারি। কিন্তু সেটা কি তোমার জন্য ভালো হবে? মনে হয় না! চাইলে পাড়াপড়শিদেরও…।’
কুমারজি উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন, ‘তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ! লজ্জা করছে না তোমার? কী করিনি তোমার জন্য আমি!’
প্রত্যুত্তরে ইনিয়েবিনিয়ে পিউ জবাব দেয়, ‘অবশ্যই করেছ। তাই বলছি এতকাল যখন আমার জন্য এতকিছু করে এলে, আর-একটু করলেই না হয়।’
কুমারজি প্রশ্ন করে, ‘একটুটা কী শুনি।’
উত্তরে পিউ বলে, ‘কী আবার, দ্যাখো বিয়ে দিতে টাকা লাগে। তুমি তো জানো আমার মায়ের সেই সামর্থ্য নেই। তাই বলছি যদি লাখ দশেক টাকা…’
পিউয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই কুমারজি একপ্রকার আঁতকে উঠে পিউকে কোল থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘লাখ দশেক টাকা! মাথার ঠিক আছে তো তোমার? অত টাকা আমি কোথায় পাব? আমার এই ভেবে নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে পিউ, যে আমি তোমার মতো একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। তোমার জন্য আমি আমার স্ত্রী-সন্তান সকলকে ঠকিয়েছি। আমার মতো লোকের বোধহয় এটাই হওয়ার ছিল। নয়তো জীবনে আমি এই ফাঁদ থেকে বেরোতে পারতাম না। এটাই আমার যথাযোগ্য শাস্তি, কথাগুলি বলতে বলতে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন কুমারজি।
‘ওসব ঘৃণা শাস্তি-টাস্তি বুঝি না, টাকাটা কবে দিচ্ছ বলো? আমি জানি ওটা তোমার হাতের ময়লা।’
পিউয়ের কথার উত্তরে কুমারজি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, ‘কাল এসে চেকটা নিয়ে যেও।’
পিউ চলে যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ কুমারজি গুম হয়ে বসে রইলেন। ব্যাগ থেকে চেকবইটা বের করে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার একটি চেক লিখলেন পিউয়ের নামে। তারপর সচরাচর যা করেন না, তা-ই করলেন। দোকানের শাটার অর্ধেক নামিয়ে ভিতরে বসেই হুইসকির বোতলটা খুললেন। কুমারজি নিজের বাড়িতে ছাড়া কোথাও বড়ো একটা মদ্যপান করেন না। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছেন না। বেশ খানিকটা মদ, জল না মিশিয়েই গলায় ঢাললেন। তারপর কতক্ষণ ওভাবে বসে মদ খেয়েছেন খেয়াল নেই। একসময় দোকানের শাটার নামিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন।হাত কাঁপছে, তবু স্টিয়ারিং-এ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করলেন কুমারজি। বাড়ির পথ ধরতে ইচ্ছে করল না তাঁর। পালাতে চাইছেন–নিজের ছায়াটার কাছ থেকেও। দ্বিতীয় সেতু পেরিয়ে গাড়ি, বম্বে রোড ধরল।হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে, চোখ ক্রমশ ঝাপসা। ভারী ভারী ট্রাকগুলো এলোমেলোভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে তাঁকে। হঠাৎই একটা জোরালো হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কোনও রিফ্লেক্স আর কাজ করছে না। ব্রেক-এ পা দেওয়ার কথা খেয়াল হল না কুমারজির।