রূপান্তর

আজ থেকে প্রায় আট মাস আগে বিয়ের দিন মৃন্ময়ীদেবীর সঙ্গে ঐশীর প্রথম দেখা। মৃন্ময়ীদেবী শতদ্রুর পিসিমা। থাকেন মেদিনীপুরে। বিয়ের শতব্যস্ততায় তখন ওনার সঙ্গে ঠিকমতো পরিচয় ঘটেনি ঐশীর। আজ আট মাস পর ওনার পদধূলি পড়তে চলেছে এ-বাড়িতে। থাকবেনও প্রায় মাসখানেক। খবরটা পাওয়া মাত্রই বাড়িতে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল।

ওনার দাপুটে স্বভাব সম্পর্কে কমবেশি শ্বশুর, শাশুড়ি, বরের কাছে গল্প শুনেছে সে। যদিও কিয়দংশ তারও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিয়ের সময়তেই পুরোহিতের ভুল মন্ত্রোচ্চারণে একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়েছিলেন, পুরোহিতকে এই মারতে যান তো সেই মারতে যান… তারপর ঐশীর বাবা আর মৃন্ময়ীদেবীর ছোটোভাই রমাকান্তবাবুর মধ্যস্থতায় তিনি খানিক শান্ত হয়েছিলেন।

সেই কোন ছোটোবয়সে তিনি বিধবা হয়ে বাবার ভিটেতে গিয়ে উঠেছিলেন। এখনও ওই ভিটেই যক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। বাবা সংস্কৃতের টোল চালাতেন, ফলে মেয়েও তাতে বেশ চৌকশ। বাবা গত হয়েছেন, ছোটোভাই তো পড়াশোনা চলাকালীন-ই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তারপর আর ওমুখো হননি। কালেভদ্রে বেড়াতে বা প্রয়োজনে গেছেন কখনও সখনও। গ্রামের ওই প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দা বলতে বড়োভাই, ভাই বউ, আর তিনি। ভাইয়ের এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়িতে। আর এক ছেলে ছিল বটে, তবে সে আর বেঁচে নেই। বছর সাতেক আগে বিনা নোটিশে দু-দিনের জ্বরে সব শেষ। সেই থেকেই বড়োভাই শয্যাশায়ী। বিঘের পর বিঘে জমিজমা, চাষবাস সবই এখন মৃন্ময়ীদেবীর রক্ষণাবেক্ষণে।

ছুটির দিন। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে ঐশী। রোজই তো সেই ১০টা – ৬টার ডিউটি। সকালে উঠে কাকচান সেরে কোনওরকমে নাকেমুখে গুঁজে ছোটা। একদিন এর অন্যথা হলে বেশ ভালোই লাগে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আজ সোয়া নটা বেজে গেছে তার। তারপর বাড়তি মেদ ঝরাতে ট্রেড মিলে মিনিট কুড়ি হাঁটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনেই একটু স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ে আর কী! হাঁটতে হাঁটতেই কানে এল এক প্রৌঢ়ার গলা। এ গলা সে আগেও কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায়?… উৎসাহবশত বসার ঘরে আসতেই দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, শতদ্রু সবাই মিলে সেই পিসিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দীপ্তিময়ের সেই টানা চোখ। বয়সের কারণে ত্বকে খানিক শিথিল ভাব এলেও, এককালে যে অপরূপা সুন্দরী ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমনি লম্বা দীর্ঘকায়া তেমনি রংও যেন ফেটে পড়ছে। হাঁ করে তাকিয়েছিল ঐশী। হুঁশ ফিরল তাঁর রাশভারী গলার আওয়াজে। ভারী গলায় তিনি কাদের যেন দুষছেন। ‘বেআদব সব ছেলেপুলে। একটু শিক্ষেদীক্ষে নেই গো, বড়োদের সম্মান পর্যন্ত করতে জানেনে সব। সক্বাল না হতে হতে বেহায়াদের মতো হাত ধরাধরি করে… ছি ছি ছি…।’

পিসিশাশুড়ির কথায় হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। দু-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন পিসিমা?’

এই নাকি তাঁর নাতবউ! পরনে ট্রাউজার আর ঢলা গেঞ্জি। ঘেমে নেয়ে একাকার। দেখেই মৃন্ময়ীদেবীর চক্ষু চড়কগাছ।

‘থাক থাক। আর প্রণাম করতে হবে না।’ বলেই কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলি বেলা তো কম হল না, এখনও নাওয়া-খাওয়া হয়নি বুঝি?’

‘না আসলে একটু ব্যায়াম করছিলাম। আপনার আওয়াজ শুনে চলে এলাম। এবার…’

‘তা বেশ করেছ, এবার নেয়ে এসো দিকি।’

‘যাচ্ছি পিসিমা। তার আগে আপনার পছন্দের এককাপ চা বানিয়ে আনি। মার কাছ থেকে শিখেছি দেড় চামচ চিনি আর কড়া লিকার, তাইতো?’ বলেই হাসল ঐশী।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই চা বসা, আমি আসছি।’ সুমিত্রাদেবী বউমাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হন না। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই গলা ভারী করে ভাজের দিকে তাকিয়ে, ‘ও তুমিও বুঝি এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে শহুরে আদবকায়দা রপ্ত করেছ। ম্লেচ্ছদের মতো নাওয়া-ধোওয়া না করেই রান্নাঘরে ঢুকছ?’

‘না-না দিদি একদমই তা নয়। আমিই চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’ বলেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।

‘আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার আছে পিসিমা, আমি চটপট স্নান সেরে আসছি’, বলেই পিসিমাকে একবার জড়িয়ে ধরে ঐশী ছুটে পালাল স্নানঘরের দিকে।

‘কী মেয়েরে বাপু! বাপের বাড়ি থেকে কি কোনও রীতিনীতিই শিখে আসেনি? তা রমা তোরাও তো দেখছি আশকারা দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছিস। সংসারের আচার-ব্যবহার কিছু শেখা, নয়তো পরে তোদেরই ভুগতে হবে এই বলে দিচ্ছি।’ চা-আসা পর্যন্ত রমাকান্তবাবু আর শতদ্রুর এইভাবেই ক্লাস নিতে থাকলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবীর বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা দুজনের কারওরই ছিল না। দিদির কথার প্রেক্ষিতে রমাকান্তবাবু শুধু এটুকুই বললেন, ‘তুমি যখন এসেই গেছ, তুমিই ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিও। আচ্ছা দিদি তুমি বোসো, আমি একবার বাজারটা ঘুরে আসছি’, বলে উঠতে যাবেন এমন সময় সুমিত্রাকে দেখে, ‘ওই তো সুমিত্রা এসে গেছে। তুমি চা খাও, আমি এক্ষুনি আসছি’, বলেই রমাকান্তবাবু বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শতদ্রুও পিসিমার ব্যাগ-পত্র গেস্টরুমে রাখার বাহানায় ঘর থেকে সরে পড়ল। অগত্যা সুমিত্রাদেবী-ই বসে রইলেন ননদের উপদেশাবলি শোনার জন্য।

সন্ধেবেলা সকলে একসঙ্গে বসে চা-জলখাবার খেতে খেতে নানান আলোচনা চলছে। গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। গ্রামের নগেনখুড়ো থেকে শীতের নলেন গুড়– কোনওকিছুই বাদ নেই। খাওয়াদাওয়ার কথা উঠতেই ঐশী হঠাৎই হাহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবা মনে আছে চিন্নাস্বামী আর তার পরিবারের কথা, সেই দিল্লি যাওয়ার সময় ট্রেনে?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না! চিন্নাস্বামীর হাতির মতো চেহারার ছেলেটিকে বলে কিনা দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। একদম নাকি খায় না। অথচ ট্রেন ছাড়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত মুখ থেমে থাকেনি তার। বোধহয় দশজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।’ বলেই শ্বশুর, বউ মিলে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকল।

হাসিতে রাশ টানলেন পিসিমা। ‘আহ্ ঐশী একটু আস্তে। ভুলে যেও না এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে কেউ তোমার বন্ধু নয়।’

কেউ কিছু বলার আগেই ঐশী অকপটভাবে বলে বসল, ‘মা-বাবার থেকে বড়ো বন্ধু আবার কেউ হয় নাকি পিসিমা? বাপি ছিল আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু আর এখানে বাবা-মা। কী বলো বাবা?’

উত্তর দেওয়া দূরস্থান, ঐশীর কথাতেই বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে শ্বাস ফুলে উঠল রমাকান্তবাবুর। এই বুঝি দিদি ঝাঁপিয়ে পড়ল বেচারির উপর। হলও তাই।

‘বড়োদের মুখে মুখে কথা বলাটা মোটেই শোভনীয় নয় ঐশী। তাদের সম্মান করতে না পারো, অন্তত অনাদর কোরো না।’ বেচারিকে এমন ধমক দিলেন যে বাড়ির সকলের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

ঐশী জিভ কাটল, ‘ছি ছি পিসিমা, এমন বলবেন না। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, আসলে দোষটা আমার বাপির। আপনার সঙ্গে যখন আমার বাপির দেখা হবে, আপনি খুব করে শাসন করে দেবেন তো। ওনার অপত্যস্নেহেই আমি বিগড়ে গেছি। ছোটো থেকে উনি-ই আমাকে শিখিয়েছেন, সবকিছু বন্ধুর মতো ওনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে। সেই অভ্যাসটাই থেকে গেছে। এখানেও তাই বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভুলেই যাই যে উনি আমার শ্বশুরমশাই। ওনার সামনে বেশি কথা বলা সাজে না আমার।’ কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। ঐশীর মাথা নীচু করার ভঙ্গি দেখে শ্বশুর, শাশুড়ি, শতদ্রু – সকলেই হেসে ফেলল।

‘এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে তোমাদেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।’ সকলকে হাসতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবী আসার পর থেকে এ-বাড়িতে বেশ একটা অদ্ভুতরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ওনার কাজই যেন ঐশীর দোষত্রুটি খুঁজে বার করা। তারপর তাকে ভৎসনা করা। বাড়ির অন্য সদস্যরা তাঁর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালেই মুখ ব্যাজার করে সেই একই সাবধানবাণীর পুনরাবৃত্তি, ‘প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে মেয়েটাকে।’

দিন দশেক এইভাবেই কেটে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মায়াপুর থেকে খবর এল সুমিত্রাদেবীর ছোটোকাকা মারা গেছেন। দাহ হওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখতে হলে এখুনি রওনা দিতে হবে। তখুনি শতদ্রু বাবা-মাকে নিয়ে গাড়িতে রওনা দিল মায়াপুরের উদ্দেশে। ফিরতে ফিরতে কাল সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়িতে এখন ঐশী আর পিসিমা।

ভাই-ভাজ-ভাইপো রওনা দেওয়ার ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ ওনার মনে হল সময়টা ভালো যাচ্ছে না, তাই একবার মন্দিরে ঘুরে আসা দরকার। ফিরে আর কিছু খেলেনও না। ঐশী বারবার অনুরোধ করাতে জানালেন, ভোগ খেয়ে ফিরেছেন।

বিকেল থেকেই পিসি বারবার বাথরুম যাওয়া-আসা করছেন। সন্ধ্যার পর সেই আনাগোনার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে যোগ হল বমি। ঠিক করে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই ওনার। সন্ধে গড়িয়ে রাত হতে চলল। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়াবাড়ি হলে ঐশীর একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে এনে পিসিমাকে নিয়ে সোজা চলে গেল ডাক্তারখানায়।

চেম্বারে বেশ ভিড়। সকলেই অপেক্ষা করছেন তাদের পালা কখন আসবে। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করলে পিসির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না ভেবে, সোজা পিসিমাকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেল ঐশী। পাশ থেকে অপেক্ষারত অন্যান্য পেশেন্টদের বাড়ির লোকের দু-এক কথা কানে গেল বটে, ‘এভাবে হয় না, সিরিয়াল অনুযায়ী দেখাতে হয়। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। আমরাও তো রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছি।’

তাদের দিকে না তাকিয়েই ঐশী জবাব দিল, ‘নিয়ম-ই সিরিয়াস পেশেন্টদের আগে চেক-আপ করা।’ বলে পিসিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সে। ডাক্তারবাবু পেশেন্ট-এর অবস্থা দেখে আর দ্বিমত করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে চেক-আপ করে প্রয়োজনানুযায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধপত্র লিখে দিলেন।

বাড়িতে ফেরার পর প্রেসক্রিপশন মাফিক তিনটে ট্যাবলেট খাওয়ানোর পরে খানিক স্বস্তি পেলেন মৃন্ময়ীদেবী। ওআরএস জলে গুলে বারেবারে একটু একটু করে পিসিমাকে খাওয়াতে থাকল ঐশী। ঘন্টা দুয়েক পর অবস্থার খানিক উন্নতি হলে মৃন্ময়ীদেবী ঐশীর দিকে তাকালেন, ‘যদি রাতবিরেতে আবার বাড়াবাড়ি হয় তাহলে…’ মৃন্ময়ীদেবীর চোখেমুখে তখন চিন্তার ভাঁজ।

‘আমি তো আছি। আপনি চিন্তা করছেন কেন? কিছু হবে না। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন’, বলে পিসিমার মাথায় হাত বোলাতে থাকল ঐশী। বউমার আত্মবিশ্বাসে মৃন্ময়ীদেবীর সমস্ত টেনশন দূর হয়ে গেল। শিশুর মতো ঐশীর কোলের কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি।

মায়াপুর থেকে ফোন এলে তাদেরও সকলকে ভরসা দিল ঐশী, ‘চিন্তার কিছু নেই, এদিকটা আমি সামলে নেব।’

রাত্রে মৃন্ময়ীদেবী যতবারই চোখ খুলেছেন, বিছানার পাশে ঐশীকে পেয়েছেন। সারারাত জেগে মেয়েটা সেবা করেছে পিসিশাশুড়ির। মাঝে মাঝে চামচে করে নুন-চিনির জল দিয়েছে, খেতে না চাইলে ধমক দিয়েও খাইয়েছে। রাত দেড়টা নাগাদ ওনার শরীরটা বোধকরি আবার গুলিয়ে উঠেছিল, সামলাতে না পেরে বিছানাতেই কাপড়েচোপড়ে বমি করে ফেলেছিলেন তিনি। অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন তিনি। পিসিমাকে ইতস্তত বোধ করতে দেখে ঐশী সামান্য হাসে, ‘কেন এত সংকোচ করছেন। ঠিক আছে হয়ে গেছে। বরং উঠে গিয়ে ভালোই হয়েছে, এইবার একটু হালকা বোধ করবেন।’

এক এক করে ওনার কাপড় ছাড়ানো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা পরিষ্কার করা, ফ্রেশ কাপড় পরানো, বিছানার চাদর বদলানো সব হাসিমুখে সেরে ফেলল ঐশী। তারপর ওনার মাথায় এমন ভাবে হাত বুলিয়ে দিল যে মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল সাতটায় মৃন্ময়ীদেবী ঘুম ভাঙতে দেখলেন ঐশী তার মাথার পাশে বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা কাত হয়ে গেছে। স্নেহের হাত মাথায় রাখতেই চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে উঠল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো পিসিমা? শরীর কেমন? আর বমি হয়নি তো?’ যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে এক বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে, সেই অস্বস্তিতে একসঙ্গে প্রশ্ন করে ফেলল ঐশী।

‘ওরে থাম থাম, আমি একদম ঠিক আছি। শেষবার বমি হওয়াতে শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। এখন আর কোনও কষ্ট নেই। দ্যাখ একদম ফিট। আমার কথা ছাড়, তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল, এবার আরাম করগে যা তো। একটু ঘুমিয়ে নে। সারারাত ঠায় মাথার সামনে বসে ছিলি। আমি সব দেখেছি।’

‘আগে স্নান সেরে তোমার জন্য কিছু খাবার বানাই, তারপর না হয়…’

‘না না তোকে কিছু করতে হবে না। আমি সব করে নেব। তুই ঘুমুতে যা দিখি।’

‘কিন্তু’,

ঐশীকে থামিয়ে দিয়ে মৃন্ময়ীদেবী আদেশ দেবার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিন্তু-টিন্তু কিছু নয়, তোকে বলছি না তুই শুতে যা।’

এই এক রাতেই ঐশী আর মৃন্ময়ীদেবীর সম্পর্ক এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্নেহপরবশ হয়ে ঐশী যে কখন তার পিসিমার কাছে তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে, তা বোধকরি তিনিও টের পাননি। সত্যিই সময়ই পারে সবকিছু বদলাতে।

আদেশ অমান্য না করে পিসিমার খাটেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল ঐশী। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বউমাকে ওভাবে শুতে দেখে একখানা চাদর চাপিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

ঐশীর উঠতে উঠতে মৃন্ময়ীদেবীর ভাত-ডাল-আলু-পোস্ত সমস্ত কিছু কমপ্লিট। দুপুরে দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে দেদার গল্পে মেতেছে।

‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে কি? যদি দাও তা হলে বলি। আসলে তুমি আসার পর থেকেই প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।’

‘ভণিতা না করে কী বলবি বল দিকি?’

‘না দ্যাখো, আমরা প্রতিমাসে পার্লার ঘুরে আসছি, কত কত টাকা গচ্ছা দিয়ে আসছি, তবুও ত্বকে কোনও উজ্জ্বলতা নেই। আর তোমার এই বয়সেও এত গ্ল্যামার, রহস্যটা কী বলোতো?’ হাসতে হাসতে বলল ঐশী।

ঐশীর কানটা ধরে বলেন, ‘পিসিশাশুড়ির পিছনে লাগা হচ্ছে অ্যাঁ? ওরে মুখপুড়ি আমাদের সময় ওসব পার্লার ফার্লার ছিল না বটে, কিন্তু মা ঘষে ঘষে সর-বেসন মাখাতেন, বুঝলি।’

‘সত্যি বলছি তোমাকে দেখলে কেউ বলবেই না যে, তুমি বাবার থেকেও বড়ো। কী সুন্দর দেখতে তোমায়।’ মুগ্ধ চোখে তাকায় ঐশী।

‘নে আর আমড়াগাছি করতে হবে না।’ বলে মৃন্ময়ীদেবীও তার কৃত্রিম গাম্ভীর্য ভেঙে হেসে ফেললেন।

মায়াপুর থেকে ফেরার পর দুজনকে পাশাপাশি বসে এভাবে হাসিঠাট্টা করতে দেখে সকলেই হতবাক। পরিবেশ হালকা বুঝে রমাকান্তবাবু তো বলেই বসলেন, ‘একি রে বাবা, কোনও ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়লাম না তো? নয়তো এমন মিরাকেল – ভাবাই যায় না!’

পাশে বসে থাকা বউমার গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘দ্যাখ রমা তুই আর তাচ্ছিল্য করিসনি বাপু। এমনিই আমি মরমে মরে আছি। আমার সত্যিই চিনতে ভুল হয়েছিল রে – এ যে একেবারে খাঁটি হিরে।’ বলেই চিবুকে একটু হাত বুলিয়ে বলেন, ‘জানিস কাল সারারাত ঠায় মেয়েটা মাথার কাছে বসে সেবা করেছে আমার। খাব না বলেছি বলে ধমক পর্যন্ত দিয়েছে। ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার জন্য ডাক্তারখানায় কম রাগারাগি করেনি, ডাক্তারও বাধ্য হয়েছে আমাকে দেখতে। খুব বুঝেছি তোরা কেন এই পাগলিটাকে এত ভালোবাসিস।’ বলতে বলতে চোখের কোণায় জল ভরে আসে মৃন্ময়ীদেবীর। ‘মেয়েটাকে তো অকথা-কুকথা কম বলিনি, হাসিমুখে সব সয়েছে। আজকালকার দিনে এমন বউ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের রে। সত্যিই ভাগ্যের!’ আবেগবিহ্বল হয়ে চোখ মুছলেন পিসিমা। মৃন্ময়ীর এই রূপান্তরে সকলেই বেশ হতবাক। পাষাণের ভেতরেও যে এত টলটলে জলের এক হ্রদ ছিল তা কে জানত!

 

ক্যানভাস

দুচোখের পাতা অর্ধেক খুলতে না খুলতেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল সাত সকালের সোনালি রোদের ছটা। বিছানার পাশের জানলার ভারী পর্দাগুলো সরানো। এ নিশ্চয়ই অয়নের কাজ। এত বারণ করি তবুও শুনবে না। আমাকে বিরক্ত করে যে ও কী আনন্দ পায় কে জানে! এত রাগারাগি, চ্যাঁচামেচি কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না। সবসময় ওই এক ভালোমানুষের ভাবমূর্তি, অসহ্য!

ওকে যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। কী ধাতুতে গড়া! কম তো অত্যাচার করি না। বিয়ের আগেই জানিয়েছিলাম আমার আর রূপমের খোলামেলা সম্পর্কের কথা। যাতে ও এই বিয়েতে রাজি না হয়। কিন্তু কোথায় কী! আমার কোনও কথারই কোনও ফল হয়নি। তিন মাস হয়ে গেল বিয়ে, এখনও ওকে ছুঁতে পর্যন্ত দিইনি আমার শরীর। তবুও সে একই রকম নিরুত্তাপ! আমার মেজাজ, অহেতুক ঝগড়াঝাঁটি, জিনিসপত্র ভাঙা সব সহ্য করছে নিঃশব্দে।

বাবা যেদিন আমার বিয়ের ভাবনার কথা প্রথম বলেছিল পিকলুদাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব করেছিল তার শান্তশিষ্ট সহকর্মী অয়নের নাম। সব দেখে শুনে বাবা-মা একবারে রাজি হয়ে যায়। আমার আপত্তির পরোয়া কেউ করেনি। রূপমও তখন ছিল না আমার কাছে। দিন কাটাচ্ছিল কলকাতার কোনও এক রিহ্যাবে।

সন্ধে নামলেই অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে থাকি আজকাল। আকাশের অগুনতি তারাদের ভিড়ে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। আজও বেতের হেলানো চেয়ারটায় বসে একমনে ভাবছিলাম রূপমের কথা। আজ প্রায় ছমাস হতে চলল, দেখা হয়নি আমাদের। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানি না আমি।

কী করছিস এখানে? তারা গুনছিস? পেছন থেকে চুপি চুপি বলল ঝুম্পাদি, আমার পিসতুতো দিদি।

আরে, তুমি কখন এলে? পিকলুদা আসেনি?

এসেছে। ওই তো ড্রযিংরুমে আছে অয়নের সঙ্গে। কিন্তু গুনগুন একি চেহারা হয়েছে তোর? ফ্যাকাশে চোখমুখ, এলোমেলো চুল!

ধুস! ছাড়ো তো। সাজগোজটা কোনও কালেই আমার দ্বারা ঠিক হয় না।

সে আমি জানি। তাই বলে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো হয়ে থাকবি। অয়ন কী ভাবে বলতো? আহত স্বরে বললাম, অয়ন কী ভাবে! আচ্ছা, আমার ভাবনার পরোয়া কেউ কখনও করেছে ঝুম্পাদি? তোমরা তো জানতে যে রূপমকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তবুও জোর করে, রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে বাড়ির সকলে মিলে আমাকে ঝুলিয়ে দিলে অয়ন পুরকায়স্থ নামক এক নিপাট ভদ্রলোকের গলায়!

তুই একটা আস্ত পাগল রে গুনগুন! এখনও ওই বদমেজাজি, নেশাখোর ছেলেটার কথা ভাবছিস? নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, আর অয়নকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

তোমরা জানো না, রিহ্যাবে যাবার আগে রূপমকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ওর জন্যে অপেক্ষা করব। কথা না রাখতে পারার জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছি আমি প্রতিটা দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে। আমার জীবনে আর কোনও রং অবশিষ্ট নেই গো ঝুম্পাদি। স্রেফ পড়ে আছি একটা ফাঁকা ক্যানভাসের মতো।

আমার সামনে এসে দাঁড়াল ঝুম্পাদি। বলল, এখন কথা খেলাপির জন্যে কষ্ট পাচ্ছিস আর রূপমকে বিয়ে করলে অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতিই রে বোকা মেয়ে।

 

( ২ )

ড্রাইভিং সিটে বসে আছে পিকলুদা। পাশে অয়ন। পেছনে আমি আর ঝুম্পাদি।

জায়গার নামটা যেন কী?

ওই তো শামুকতলা থেকে কিছুটা দূরে। গ্রামের নাম একটা বলেছিল বটে রঞ্জন কিন্তু সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের পৈতৃক বাড়ি ওখানে। ঝুম্পাদির প্রশ্নের উত্তরে বলল পিকলুদা।

দেখেছিস এই একজন মানুষ! কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি ঠিক মতো না জেনেই রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি। বলি জায়গাটার নামটা তো শুনবে খেয়াল করে। তাহলে গুগল ম্যাপে একটু সার্চ করে দেখতাম। গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বলে উঠল ঝুম্পাদি।

পিকলুদাও দমবার পাত্র নয়। আরে রাখো তো তোমার গুগল ম্যাপ-ট্যাপ। বিরাট টেক স্যাভি হয়েছে আজকাল! শামুকতলা বাজারে পৌঁছে ফোন করতে বলেছে রঞ্জন। ওখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ও। তারপর নিয়ে যাবে গন্তব্যে। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কলকাতায় রেখে অনেকদিন বাদে দেশের বাড়িতে এসেছে রঞ্জন, আমার ইউনিভার্সিটির রুমমেট। সেদিন ফোনে আমন্ত্রণ জানাল ওদের গ্রামের বাড়িতে দু-একটা দিন সপরিবারে কাটিয়ে যাবার। এই উইক-এন্ডে তিনদিন পরপর ছুটি আছে। তাই লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কম খরচে ছোটোখাটো একটা আউটিং হয়ে যাবে। ঠিক কিনা বল, গুনগুন?

জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে পিকলুদার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। ঝুম্পাদিরা নিঃসন্তান। তাই ঘোরাফেরা, হইচই করেই চেষ্টা করে নিজেদের জীবনের শূন্যতাটাকে ভরিয়ে রাখতে। আজকাল ওদের সঙ্গী হয়েছি আমি আর অয়ন। আমাদের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা অন্ধকার নদীটাকে আলোয় ভরাতে চায় ওরা।

 

( ৩ )

একটু দূরেই ভুটান পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নাম না জানা পাহাড়ি ঝোরা। ধারে কাছে ঘরবাড়ি বিশেষ নেই। নৈঃশব্দের ভিড়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটা। চারপাশে কত রকমের ফুলের গাছ। নিকোনো উঠোন। গ্রামের বাড়ি হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রুচির ছাপ স্পষ্ট।

সন্ধের মুখে দোতলার ঘরে চলছিল গল্পগুজব। রঞ্জনদা দামি স্কচের বোতল খুলে বসেছেন। ওঁকে সঙ্গ দিচ্ছে পিকলুদা আর অয়ন। রাঁধুনি সোমরাজ প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে কুচো চিংড়ির পকোড়া আর ফ্রায়েড কাজু। কফির কাপ হাতে আমি আর ঝুম্পাদি নির্বাক দর্শক। কথায় কথায় রঞ্জনদা বলছিলেন অকৃতদার বিরাজকাকু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওনার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন, তাই বহুদিন ওনারা গ্রামছাড়া। পনেরো বছর আগে হঠাৎ বিরাজকাকু ফিরে আসে এখানে। বাবা গত হয়েছেন। মা অথর্ব। অকূল সমুদ্রে খাবি খাচ্ছি একলা আমি। বিরাজকাকুকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। সব দাযিত্ব ওঁর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেলাম কলকাতা, রুজিরুটির টানে। বিরাজকাকু না থাকলে সব সাত ভূতে খেত এতদিনে। শিল্পী মানুষ তো, তাই খুব শৌখিন। যত্ন করে আগলে রেখেছে আমার পৈত্রিক ভিটেমাটি, জমিজিরেত।

রঞ্জনদার একটু টিপসি লাগতে শুরু করেছে সবে। মাঝে মাঝেই বাঁক বদলাচ্ছে কথার স্রোত। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একমাথা কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক।

আরে বিরাজকাকু আসুন আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তাঁকে দেখে বলে উঠল পিকলুদা।

অয়ন-এর সঙ্গে তো পরিচয় হয়েছে। এই আমার মিসেস ঝুম্পা আর ওটি আমার শ্যালিকা গুনগুন।

আমার দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক কেমন যেন চমকে উঠলেন। অবাক চোখে দেখছিলেন আমাকে। সেই দৃষ্টিতে যে কী ছিল বলে বোঝানো যাবে না। রাগ? দুঃখ? ভয়? আনন্দ? নাকি অন্য কিছু? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার! ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অয়নকে বললাম আচ্ছা বিরাজকাকু ওভাবে কেন দেখছিলেন আমাকে?

কী জানি! রঞ্জনদা বলছিলেন উনি একটু আপনভোলা গোছের মানুষ।

আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ওঁর চোখ দুটো মনে পড়লেই কাঁটা দিচ্ছে গায়ে কে জানে আবার মাথাটাথা খারাপ কী না? এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় একা থাকেন। বেশ সন্দেহ হচ্ছে।

একটা অভয় দেবার হাসি হেসে অয়ন বলল অত ভেবো না। আমি, মানে আমরা সকলে আছি তো। কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। মোটা চাদরটা আমার গায়ে টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল অয়ন।

 

( ৪ )

ঘুমের ওষুধ ছাড়া আজকাল ঘুম আসে না সহজে। কিন্তু কাল রাতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ওষুধ খাবার কথাটা। তবুও অনেকদিন পর নিখাদ শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি আমি। হয়তো এই শান্ত পরিবেশে এসে অস্থির মনটাও বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা অয়নের দিকে। শিশুর মতো সারল্য ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।

ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। হালকা মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সূর্য। সকাল সকাল বৃষ্টিস্নান সেরে আরও বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে গাছগাছালি। কখনও কখনও মেঘছেঁড়া রোদ এসে পড়ছে তাদের গায়ে। ভেজা শরীরে রোদের আদর মেখে ঝিকমিক করে উঠছে বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলো। পরক্ষণেই কোথা থেকে এক টুকরো মেঘ এসে বিষাদের পর্দা টেনে দিচ্ছে সেই সোহাগি আলোর প্রবাহপথে।

রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে একটা ঘরের কাছে এসে থেমে গেল পা দুটো। দরজাটা হাট করে খোলা। জানলা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে একটা ক্যানভাসের ওপর। দেখি হাতে রঙের প্যালেট আর পয়েন্টেড তুলি নিয়ে বিরাজকাকু একমনে তাকিয়ে আছেন ফাঁকা ক্যানভাসটার দিকে। শুনেছিলাম সব শিল্পীর কাছেই তাঁর সৃষ্টি নিছক কাজ নয়, সাধনা। হয়তো বিরাজকাকু সে রকমই কোনও সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন। মনে মনে সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন কিছু। একটু পরেই যা তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠবে এই শূন্য ক্যানভাসের ওপর। পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন বিরাজকাকু। সেই একই রকম দুর্বোধ্য চাহনি।

 

আলিপুরদুয়ার জেলার এই অঞ্চলে অনেক জনজাতির মানুষের বাস। এদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন একটা সময়। তাই গ্রামের মাঝে তৈরি হয়েছে একটা বড়োসড়ো প্রটেস্টান্ট গির্জা। দুপুর দুপুর চার্চ, সিমেট্রি ঘুরে আমরা সবে ফিরেছি। এমন সময় সোমরাজ এসে বলল কাকাবাবু সেই সকাল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া কিছুই করেননি। আপনারা একবার ডাকবেন? শরীরটরির ঠিক আছে কিনা দেখবেন একটু?

সেকি! বিরাজকাকু তো কখনও এমন করেন না। শঙ্কিত গালায় বললেন রঞ্জনদা।

বিস্তর হাঁকডাকের পর অবশেষে খুলল দরজা। এদিক ওদিক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে দেখে বিরাজকাকুর চোখ স্থির হল আমার চোখের দিকে। একটা অস্বস্তি ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে। একটু একটু করে আমার কাছে এগিয়ে আসছিলেন বিরাজকাকু। বাড়তে থাকা হৃদকম্পটা টের পাচ্ছিলাম ভালো ভাবে। নিজের অজান্তেই কখন যেন শক্ত করে ধরে ফেলেছি আমার পাশে দাঁড়ানো অয়নের হাতটা।

কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? সেই যে আমাকে ম্যারেজ রেজিস্ট্যারের অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে বলেছিলে, মনে পড়ে? তুমি আর এলে না তো! কত খুঁজেছি তোমায়। বন্ধু, পড়শিরা বলল, তোমার বাড়ির লোকেরা নাকি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে বিয়ে হবে তোমার। সত্যিই হয়েছিল? জানো, সব ছেড়ে এসেছি আমি। সেই শহর, পুরোনো রাস্তা, গলি, চৌমাথা যা কিছু তোমার কথা মনে করাত, স…ব।

খড়খড়ে গলায় বলা কথাগুলো শুনে আমার সারা শরীরটা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমার সামনে বিরাজকাকু নয় রূপম দাঁড়িয়ে আছে। আজ যদি সে ফিরে আসে তবে এভাবেই অভিযোগের তিরে বিদ্ধ করবে আমাকে। কাঁপুনিটা যত বাড়ছিল, তত শক্ত করে ধরছিলাম অয়নের হাতটা। সকলেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিহ্বল ভাবে কথা বলছেন শুধু বিরাজকাকু, তুমি প্রায়ই অভিযোগ করতে আমি কত কিছু আঁকি কিন্তু কখনও তোমার ছবি আঁকি না। বিশ্বাস করো, তুমি চলে যাবার পর আমি আর অন্য কিছু আঁকতে পারিনি। রং তুলির আঁচড়ে শুধু ধরে রাখতে চেয়েছি তোমাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার। দিনের পর দিন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে। এতদিন ধরে যে-ব্যর্থতার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তার থেকে আজ হয়তো মুক্তি পাব আমি। সেই চোখ, সেই মায়াভরা দৃষ্টি… সব অতীত আমার সম্মুখে। আমি পারব এবার। দেখে নিও ঠিক পারব তোমার ছবি আঁকতে। এসো আরফিন, বসো এখানে।

রঞ্জনদা অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, ও আরফিন নয়, গুনগুন। অয়নের স্ত্রী।

বিরাজকাকু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তুই জানিস না রঞ্জন, ডিব্রুগড়ে আমাদের বাড়ির পাশে থাকত ওরা। আরফিন, আমার আরফিন।

আবার আরফিন! বললাম না ওর নাম…

জানি না হঠাৎ অয়নের কী হল। রঞ্জনদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ছেড়ে দিন রঞ্জনদা, এসব বুঝবেন না বিরাজকাকু। দেখছেন না একটা ঘোরের মধ্যে আছেন উনি, বন্দি হয়ে আছেন ভালোবাসার মায়াজালে। আরফিন এখনও ভীষণ ভাবে জীবন্ত ওনার অনুভবে। তাকে ফিরে পাবার ইচ্ছে এতটাই প্রবল যে বাদামি চোখ আর বড়ো বড়ো আঁখিপল্লবের গুনগুন ওনার কাছে ধরা দিচ্ছে আরফিন হিসেবে। সেদিনের আরফিন আর আজকের গুনগুনের মধ্যে যে পনেরোটা বছরের ফারাক, সে খেয়াল ওনার নেই। একটা ইলিউশনকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন উনি। আসুন না আমরা বাঁচতে দিই ওনাকে।

বিরাজকাকুর দিকে মুখ ফিরিয়ে অয়ন বলল, হ্যাঁ আরফিন, ও আপনারই আরফিন। আঁকুন বিরাজকাকু। ঘুমিয়ে থাকা শিল্পীমনকে জাগিয়ে তুলুন আবার। শূন্য ক্যানভাস ভরে উঠুক রঙে রঙে।

বিরাজকাকু মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছেন আমাকে। আর আমি, অয়নকে। কোথা থেকে একটা হালকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল আমাদের। ভেতরের কাঁপুনিটা থেমে গিয়েছে কখন যেন। অয়নের বাম হাতটা কিন্তু এখনও রয়েছে আমার ডান হাতের ভেতর, নির্বিকারে উষ্ণতা বিনিময় করছে তারা একে অপরের সঙ্গে।

 

রজনি বৃত্তান্ত

কথা হচ্ছিল ঘুঘুডাঙার দিঘির পাড়ে প্রাচীন বটগাছের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে বসে গুটি পাঁচেক মাতব্বরের মধ্যে। ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে সনাতন হাজরা হ’ল গিয়ে লায়েক। গলা খাঁকারি দিয়ে সে-ই কথাটা পেড়েছিল। ওহে মেয়েমানুষ তো লয় চামার। দজ্জাল মেয়েছেলে। ধম্মকম্ম বলে কিস্যু নাই। গলা তুলে গাল পাড়া মন্দ কথা বলা, এর বাইরে…। বাকি কথাটা লুফে নিল ভজন সামন্ত, কিস্যু নাই কিস্যু নাই। দিনকাল বদল হইচে গো, নইলে এমন মেয়েছেলেকে গাঁয়ে রাখাও কাজের কথা নয়। অমনি বাকি তিনজন তালে তাল মেলাল। হরিহর সামন্ত, শুধু এক কদম এগিয়ে বলল, বাপটা আর সোয়ামিটা কী অমনি অমনি ধেনো খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সনাতন ঘুরে বলল, ওই ঘরজামাইটার কথা বলতিছ? ও তো ক্লীব, শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে বউ-এর লাথিঝ্যাঁটা খায়। আর ওকে তাল দেয় বিষ্ণু হাজরা মানে শ্বশুরটা। হরিহর অমনি গলা তুলে বলল, সে গুড়ে বালি। ওই খান্ডারনি বউয়ের হাত থেকে সম্পত্তি গ’লে ওর হাতে যেতে যেতে মাধব মানে মেধো এমনিই অক্বা পেয়ে যাবে।

শীতের দুপুরে রোদ্দুর যেন পালাব পালাব করে। দিঘির ও’পারে তালবনে সুয্যি ঠাকুর জাল গুটোচ্ছে। সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে সনাতন বলল, চল হে একটু পরেই হিম পড়বে। এই বুড়োবেলায় সব সইতে পারি হিম সইতে পারব না।

যাকে নিয়ে এত কথা সেই রজনি তখন সাঁঝের আকাশের দিকে চেয়ে গাল পাড়ছে, একবার ঘর এসো, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। হাটে যাবার নাম করে সেই সকালে দুটিতে বেইরেছে, এতখানি বেলা পার হয়ে সুয্যি পাটে বসল, ফেরার নাম নেই। হেঁসেলের উনুনে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব। গঙ্গাজলে ভাইস্যে দেব ওই বুড়োটাকে আর পোড়ামুখো জামাইটাকে। খিড়কির চৌকাঠে একটা ছায়া চুপিসারে ঢুকতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। রজনি আকাশমুখো, ভাগ্যিস। কে জানি রজনিকে বলেছিল, আকাশমুখো সব কথা বহু দূর তক্ শোনা যায়। ছায়া আরও এক পা রাখতেই খড়ের গাদার ওপর রাখা কাটারিটা টিউবওয়েলের বাঁধানো শানে পড়ে ঠনঝন শব্দ করে উঠল। সেদিক পানে চেয়ে রজনি তিরিক্ষি চেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো ওই কাটারিতে তোমাদের টুকরো টুকরো করব।

ছায়া এবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দাঁড়াল। বিষ্ণু হাজরা। একটু টাল খেয়েছিল। ধেনোটা বুকের ভেতর থেকে তখনও পেট অবধি নামেনি। এইসময় মেয়েটা এমন তেড়ে উঠল যে চমকে আবার পিছু হঠতে গিয়ে প্রায় কাটারিতে পা দিয়ে ফেলেছিল। সামলাতে গিয়ে টিউবওয়েল-এর হাতলটা ধরে ফেলল। রজনি খানিক থমকে গিয়ে আবার সুর তুলল, বলি ল্যাজটা কোথায়?

বিষ্ণু হাজরা অমনি যেন খানিক ফুরসত পেয়ে একরকম নীচু গলায় বলল, মেধো সেই কোন দুপুরে আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে কোথায় যে গেল, বলল তো হাটে যাচ্ছি…।

কোথায় গড়াগড়ি দিচ্ছে? তুলে আনতে পাল্লে না? এবার তুমি এসো, তোমায় দেখি খানিক। মেয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে নেশা ছুটে গেছে বিষ্ণু হাজরার। মনে খানিকটা বল সঞ্চয় করে বলল, একটু ঠান্ডা হ মা। হাট তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ঠিক ফিরে আসবে। তুই বরং উনুনে আঁচ দে। বিষ্ণু হাজরা মনে মনে আওড়াল, আঁচ দেবে কী, মেয়েটা তো নিজেই আঁচ হয়ে আছে।

তারপরেই মনে হ’ল, তাই তো ছোঁড়়াটা গেল কোথা! সে কী সত্যি-ই হাটে গেছে! ধেনোর ঠেকেও তো যায়নি। তাহ’লে!

মেধো তখন অনেক দূরে। আশমান গাঁ আর চাঁপাডাঙা ছাড়িয়ে ফুলটুসি গাঁয়ের মখমল বাজারের থেকে পোয়া মাইল দূরে এক সাধু আসন গেড়েছে। তাতেই লোক হামলে পড়েছে। সাধুর নাকি মোক্ষম দিব্যদৃষ্টি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ– সব গড়গড়িয়ে বলতে পারে। এত ভিড়ের মধ্যে সাধুর নাগাল পাওয়া কঠিন। বেশ খানিক পিছনে দুটো থান ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মেধো ঠাওর করতে চাইছে। এই সাধুর খবর সে পেয়েছিল তার ছেলেবেলার বন্ধু পঙ্কার কাছ থেকে। পঙ্কা বলেছিল, একবার গেলেই টের পাবি। স্বয়ং বিশ্বনাথের চ্যালা।

তোর যা দুঃখ, যা গিয়ে বল। কিছু একটা তো হবেই। ধেনো খেয়ে তো আর সাধুর কাছে আসা যায় না, তাই ধেনোর ঠেকে যাবার আগেই বাবা শ্বশুরকে বলেছে, হাটে যাচ্ছে। তবে ভেবেছিল সাধুর সঙ্গে দেখা করে বাজার থেকে আনাজপত্র কিনে ফিরবে। কিন্তু এত ভিড় ভাবনার বাইরে ছিল। ইতিউতি দাঁড়িয়ে কোনওভাবেই যেন তার দর্শন মেলে না। তেমন একটা গাছও নেই যার ওপর চড়ে সাধুর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকে দূর দূর থেকে এসেছে। কারও মানত ফলেনি, কারও ব্যাবসা মন্দগতিক– হাজারও সমস্যা। পঙ্কা বলেছিল, সব তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে সাধুবাবা। অগত্যা বেশ খানিক দূরে মোটা গুঁড়ির একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে বসে থাকে ঠায়। তাছাড়া সব কথা তো সবার মাঝে বলাও যায় না। কথাগুলো পেরাইভেট কিনা।

সন্ধের পর একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ইয়াব্বড়ো একটা চাঁদ ফুলকো লুচির মতো আকাশে ফুটে উঠল। শাল্লা মশার ভনভন, পোকামাকড়, সাপও থাকতে পারে। তারমধ্যেই একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখদুটো রাবারের মতো চিপসে যাচ্ছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই হঠাৎ কেউ কোথাও নেই। সাধু একলা বসে। বুক পর্যন্ত সাদা কাশফুলের মতো দাড়ি, কাঁধ থেকে বুক পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে সাদা জটা। সাধু মহারাজ একটা কল্কেতে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুজে আছে। ধুনির আলো আর চাঁদের আলোতে সাধুর পদ্মাসন থেকে পা দুটো খুলে ছড়িয়ে বসে থাকার কায়দাটা খুব চেনা ঠেকল। আরে ভুতোদা না! এই বসার ধরনটা এই গাঁ ছাড়িয়ে আরও দশ গাঁয়ের পর মেধোর জন্মভিটে হরিশপুরে কে না চেনে! আর ওই দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখটাও তো…! এইরকম আয়েশ করে বসতে আর কাউকেই জানে না মেধো। শুধু সে নয়, গাঁয়ের সব্বাই…।

হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোতেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতোদা-ই তো। ভুতোদা বলে ফসকা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। শুধু শুধু বেমক্বা সব কেঁচিয়ে দিলে হয় না। এখনও বাজারের লোক হয়তো সব ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু ফসকে যাওয়া ওইটুকুতেই ভুতোদা এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে চাপা গলায় বলল, কে কে বটে?

বুনো গাছগাছালির ওপর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু দুটোর নুনছাল উঠে গিয়েছিল। জ্বালা করছে। তবু শেষবার চেষ্টার মতো করে শরীরটা একরকম ছুড়ে দিল মেধো।

আমি গো আমি। চিনতে পাচ্ছো ভুতোদা? আমি হলেম গে হরিশপুরের মাধব হুই। বাপের নাম কেষ্টচরণ হুই। মায়ের নাম…।

বলতে হবে না। তো এ তল্লাটে কি কচ্ছিস?

আমি হলেম গ্যে ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে বিষ্ণু হাজরার ঘরজামাই গো।

ছ্যাঃ ঘরজামাই। পুরুষ মানুষের কলঙ্ক।

মেধো এবার গুছিয়ে বসে ঘনিষ্ট গলায় শুধাল, তুমি সাধু হলে কবে থেকে? বে থা করনি এ’কথা জানি। কিন্তু তাই বলে সাধু!

কল্কেতে টান দিয়ে খানিক ধোঁয়া উগরে দিয়ে ভুতো বলল, আমি হলেম ভূতানন্দ স্বামী। গৃহীর নাম সাধুর হয় না। তো বল তোর সমিস্যি কী।

সমিস্যি তো একটাই। বউটা বড়ো দজ্জাল। উঠতে বসতে গাল পাড়ে। আগে অমনটি ছেল না। ছেলেপুলে হ’লনি তো। তাতেই এমন তিরিক্ষি হয়ে গেল।

শুধু তোরেই গাল দেয়?

না গো ওর বাপটারেও দেয়। দোষের মধ্যি আমরা পুরুষ মানুষ তো বটে, একটু আধটু…।

কথা শেষ হবার আগেই ভুতো বলে, মেয়েছেলের দোষ আছে? মানে খারাপ বাড়িতে যাস নাকি? তা হ’লে তো…।

ছিঃ কী যে বলো। তুমি না সাধু। এই যেমন ধরো গিয়ে তুমি কল্কেতে টান দাও আর আমরা সারাদিন পরে একটু ধেনো খাই। সেটা কি খুউব দোষের?

দোষ? দোষ গুণের বিচার করার আমি কে রে। সবই ওই ওনার– বলে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে দেখাল ভুতো। তোর ছেলেপুলে?

হয়নি। আর তার জন্যই তো এত গোল। হাকিম বদ্যিও কম হয়নি। তো ওই যে বললে না সবই তেনার ইচ্ছে। এবার গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, দাও না।

কী? ছেলেপুলে?

না গো। ওতেও শান্তি হবে না। তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কথাটা বলে ভুতোর ছড়ানো পা দুটো ধরতে যাবে অমনি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ভুতো বলল, অত সোজা। সাধু হব বললেই সাধু হওয়া যায় নাকি? মেধো দ্বিতীয়বার শরীরটা ছুড়ে দিয়ে ভুতোর দুটো পা-ই ধরে ফেলল।

আঃ ছাড় ছাড়, সাধু হলে শ্বশুরের ভিটে জমি পুকুর এ’সব যে হাতছাড়া হয়ে যাবে রে।

হাতছাড়া হয়েই আছে ধরে রাখো। অমন দজ্জাল বউ না-মরা ইস্তক কিচ্ছুটি পাবার যো নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। তারপর আর একটু এগিয়ে ভুতোর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি দলাই মলাই করতে করতে মেধো কেমন যেন আবেশ বিভোর গলায় বলল, তোমার সেবা করব। আমারে দীক্ষে দাও।

সেবা করবি? তা হ’লে কর। কল্কেটা একটু সাজিয়ে দে। বাবা বিশ্বেশ্বর কী বলেন দেখি। মেধো অমনি হাত বাড়িয়ে কল্কেটা নিল।

দু’টান মারতেই ভুতোর কেমন ফুরফুরে উদার হয়ে গেল মনটা। তোকে আমার চ্যালা করে দিলাম যাঃ। ক’দিন এ’ধার ও’ধার আমার সঙ্গে ঘুরে দেখ, তারপর না হয় দেখা যাবে। সংসারের এঁটেল মাটি গা থেকে আগে খসুক, দীক্ষা হবে।

মেধো গদগদ গলায় বলল, হবে বইলছ। তাইলে এট্টু পেসাদ…। ভুতো কল্কেটা বাড়িয়ে দিল। মেধো চোখ বুজে এক দমে খানিক টেনে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। ব্যাস হয়ে গেল, পাপ তাপ সব ছাড়িয়ে ভেতরটা কেমন যেন উদাস বাউল পারা। কোথায় পড়ে রইল রজনি, জমি জমা ভিটে– সব কেমন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শুধু ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর যেটুকু দেখা যায়, ভূতানন্দ স্বামী।

দুই

রাতে ঘুম হয় না বিষ্ণু হাজরার। ঘোলাটে চোখ দুটো পেঁয়াজের পাতলা খোসার মতো যেন ভাসছে। ছেলেটা যে কর্পূরের মতো উবে গেল। আকাশপটে বাসি কদমফুলের মতো তখন শুকতারাটা ফুটেছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বিষ্ণু হাজরা, তোমায় বইলছি তো সব তোমার নামে নেকাপড়া করি দিব, তা বুঝি বিশ্বাস হ’লনি। তোমার হলি তো মেয়েটারও হ’ল নাকি! তারপরেই মনে হ’ল বেবাক কোথাও নেশার ঘোরে পড়ে নেই তো! তবে নেশার ঠেকগুলো তো এ’কদিন ঘুরে দেখে নিয়েছে। তো সে কোথায়! তাহ’লে কী…! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

পাশের ঘরে শুয়ে অমনি এ’পাশ ও’পাশ করে জেগে আছে রজনি। মানুষটা গেল কোথা! যা গাঁয়ের ছিরি ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল না তো! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে কপাট খুলে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। রাগে জ্বলে ওঠে রজনি, রঙ্গ হচ্ছে! তামাশা! তারপরেই কেমন যেন ভেঙে পড়ল, কোথায় খুঁজবে মানুষটাকে। বাপটা কি ঘুমে নিঃসাড়, না তারই মতো…! ভেতরের কপাট আবজানই ছিল।

পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? ভাবো কি আমি তোমায় ছাড়ি দিব? মানুষটাকে কোথায় রাখি এয়েচ? দিনরাত মদ গিলেও শান্তি হয়নি? শেষে বেচি দিলে মানুষটারে! বিষ্ণু হাজরা হাতের মুদ্রায় জানান দেয়, সে জানে না। এমন কাণ্ড কোনও বাপে করতি পারে!

তারপরেও সব যেমন চলছিল তেমনি সব ঠিকঠাক। সকালের প্রথম রোদ্দুর উঠোনে চুঁয়ে পড়েছে। রজনি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে অন্য মূর্তি। পারলে রাঙা রোদ্দুর ঝাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলে। বিষ্ণু হাজরা এক পা দু’পা করে খানিকটা এগোতেই রজনি রণং দেহী ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল, ভেবেছ কী? ওই আবাগির ব্যাটার সঙ্গে খালাস হই যাতি পাল্লে না। হাড় জুড়োত।

আঃ, আমি কী তার জানি! আমায় কি বলেকয়ে গেছে?

এমনি এমনি হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল? কেমন করে ভূত ছাড়াতি হয় তোমাদের আমার জানা আছে।

তারে খুঁজতি গেলেও তো যাতি হয়।

তো যাও। সঙের মতো দাঁইড়ে না থেকে খুঁজি আনো। মানুষটারে না নিয়ে ফিরলি তোমার একদিন কি আমার একদিন।

চিন্তায় বিষ্ণু হাজরার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, বাগদিপাড়া, দুলেপাড়া, মালাপাড়া কোনওটাতেই তো বাদ দেয়নি। তাহ’লে! মাথা নাড়তে নাড়তে বিষ্ণু হাজরা বেরিয়ে যেতেই ভজন সামন্তের ছোটো ছেলে পটলা হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির। সববনাশ হই গ্যাছে। গাঁয়ের কে যেন দেখেছে, মানুষটা এক সাধুবাবার সঙ্গে বাঁকা নদী পার হয়ে কোথায় যেন…!

তা কেউ বারণ করলে না?

বারণ করবে কিগো। সাধুবাবা যে তখন বাণ মারিছে। সব বেবাক দাঁইড়্যে…!

রজনির মুখ থেকে কথা সরে না। কোথা গেল মানুষটা! কতদূর!

বিষ্ণু হাজরা ফিরল বেশ খানিক রাতে। সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে। একে তাকে জিগ্যেস করেছে। ফুলটুসি গাঁয়ের কয়েকজন অবশ্য সাধুর কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কি হদিস মেলে! দু’একজন হেসে তামাশা করে বলেছে, তা তোমরা বাপ-বেটি মিলি মানুষটারে খেদানোর ভালো কল ঠাউরেছ তো! এখন হাপিত্যেস করার যাত্রা নাই বা করলে। বিষ্ণু হাজরা কোনও উত্তর দেয়নি। কী-ই বা উত্তর দেবে!

ঘরে ফিরতেই রজনির সামনাসামনি। পাল্লে না সাধুটারে পুঁতি রাখতি? ভণ্ড আমার সংসারটারে তুক করিছে, আর তুমি বেবাক ঘরে ফিরলে? যাও না কেনে বাঁকা নদী পার হই তারে খুঁজে আনতি।

বিষ্ণু হাজরা চুপচাপ দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত শোক কি ও সইতে পারে! বাইরের কপাট ধরে তখনও রজনি দাঁড়িয়ে।

পরের দিন পুলিশ চৌকিতে হাজির বাপ-বেটি। সব শুনে বড়োবাবু হাসল, তো আমি কী করব। জামাই পালিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেয় সংসার ত্যাগ করেছে, তো আমি কী করব? এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, হঠাৎ জ্বলে উঠল রজনি, তাই তো পুলিশ তো হাবাগোবা, শুধু ঘুষ নিবে, সাধুকে জেলে পুরবে আর চোরকে ছেড়ে দিবে। বড়োবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার মুখ সামলে।

চোপ, বিষ নেই তো কুলোপানা চক্বর। ঝাঁটা মারি অমন আবাগির ব্যাটাকে।

হনহন করে বেরিয়ে এল রজনি, বাপটা পেছু পেছু একরকম ছুটতে ছুটতে পাঞ্চেত বিডিও আপিস ঘুরেও কোথাও কোনও হদিস পেল না।

ঘরে ফিরে রজনি কেমন যেন থিতিয়ে গেল। চুপ করে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসে রইল।

তিন

এতসব কাণ্ড যখন তখন হর-কী পাউরির ঘাটে বসে কল্ কল্ জল দেখছে মেধো। পাশে বসে গুরু ভূতানন্দ স্বামী। দীক্ষান্তে মেধো এখন তার চ্যালা।

কেমন লাগছে তোর?

ভালোই, তবে…।

কী তবে?

নিরামিষ এত ভাল্লাগে না।

এ তো দেবস্থান। এ’সব কথা বলাও পাপ। এরপর তো তোর গেরুয়া বসন হবে।

ও যখন হবে, হবে। তাই বলে…।

চুপ করে থাকে ভূতানন্দ। চোখ বুজে মনে মনে বলে, সংসারের গন্ধ গা থেকে খসতে তো সময় লাগবেই। মুখে বলল, তাঁর ভজনা কর। তিনিই পথ দেখাবেন।

শাল্লা ঠিক সেইসময়-ই দজ্জাল বউটার কথা মনে হ’ল। বউটার জন্য কেমন যেন দুঃখ হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এমনটা কি সবার হয়! সংসার কি এমনিই পেছন থেকে টানে! কথাগুলো শুধোতে গিয়েও শুধোল না। শুধোলে তো সেই ওপরের ওনাকেই দেখিয়ে দেবে ভুতোদা, থুরি ভূতানন্দ।

তারপর কংখল। মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ভজন, গীত, স্তোত্র, খাওয়া বলতে মালসায় খিচুড়ি ভোগ। বাকি সময়টা মাধুকরী– ভিক্ষে চেয়ে পেট ভরা। শাল্লা পেট চটকে ঠাকুর ঠাকুর। নিকুচি করেছে ঠাকুরের। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যায় গাঁয়ে। অমনি মনে হ’ল রজনির কথা। যা খান্ডারনি হাত-পা ভেঙে নুলো করে দেবে। শাল্লা জলে কুমির তো ডাঙায় বাঘ। মাঝেমধ্যে কোনও গাঁয়ে গিয়ে আসন পাতলেও তো হয়। কলাটা মুলোটা ফলটা কম তো হয় না।

চাঁদ দেখছিল ভূতানন্দ। মেধো শুধিয়েই ফেলল, কবে যাবে?

কোথায়?

এই কোনও গাঁয়ে।

বোশেখের আগে নয়। তার আগে এলাহাবাদ। মাঘী স্নান।

মাঘী স্নান!

সারা মাঘ মাস স্নান চলবে আর ঠাকুরের নাম সংকীর্তন সঙ্গে মাধুকরী।

এই হয়েছে এক গেরো। দুটো কথা সহ্য করে গাঁয়ে থাকলে ভালো হতো। ভূতানন্দ ওর দিকে ফিরে চাইল। তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠল, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…। ঝুলি থেকে একটা কল্কে বের করে বলল, নে সাজ তো।

দুটো টান দিতেই গুরু খুশ্ তো চ্যালা খুশ্।

চার

সময় যেন ডাকহরকরা। নিদানের চিঠি তার হাতে ধরা। কখনও বা সে গাঁয়ের চপলা শ্যামলাবরণ মেয়ে। ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর।

শূন্য ঘরে রজনি একা। তার শরীরেও সময় কখন গুটিগুটি প্রবেশ করেছে। গত বিশ বছরের জোয়াল এখন তার কাঁধে। বিষ্ণু হাজরা দেহ রেখেছে তা-ও দশ বছর পার। আনমনা বসে থাকতে থাকতে শোনে কোথায় যেন কোনও বৈরাগী গান ধরেছে, এ জীবন নদীর পারা যতই ভাবো যায় না ধরা। হবে হয় তো। শূন্য ঝাঁপি শূন্যই থেকে যায়, কেউ তো এক আনিও দিল না।

রাত্রে মোহন এল। মোহন রজনির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। বলল, পিসি হয় না।

কী হয় না?

খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা যায়? যায় না। সব ধম্মস্থানই তো খুঁজলে, পেলে?

রজনি মোহনের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, হয় কী না হয় সে আমি বুঝব। তোকে যেতে হবে না।

আমি কি তা-ই বলেছি?

গেলে যাবি না গেলে যাবি না। কারও জন্য কিছু…। এই যে একটা গোটা মানুষ হারিয়ে গেল তার জন্য…! রজনি থেমে গেল।

তারপর শুধু চলা আর চলা। কখনও হূষিকেশ কখনও এলাহাবাদ আবার কখনও মথুরা। কোথাও নেই। রুদ্রপ্রয়াগ। মন্দিরে গান হচ্ছে, হ্যায় জীবন কি নৈয়া তুমহারে হাওয়ালে, জিধার চাহো হম কো উধর লে চলো তুম। গানের সুর, নদীর আবিরগোলা জল– সব একাকার।

মোহন পিছন থেকে ডাকল, পিসি। রজনি সাড়া দিল না। ও তখন অনেক দূরে। মানুষ হারিয়ে যাবার সুলুক সন্ধান যেন এখন ও জানে। মোহন বলল, যাবে পিসি?

কোথায়?

সাধুভান্ডারা। ভক্তের ভোগ দান সাধু বিলিয়ে দেবে সবার মধ্যে। যাবে? রজনি অস্ফুটে বলল, যাব।

সার বেধে ভক্তের দল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য তখন পুব আকাশে। পিসি-ভাইপো সেই সারে দাঁড়িয়ে। একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে রজনি এগিয়ে এসেছে। এক ব্রহ্মচারী। শ্বেত শুভ্র বসনের সঙ্গে পক্ব কেশ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলী একাকার। চোখদুটো যেন দূর পারের কান্ডারি। তন্ময় হয়ে দেখছে রজনি। চেনা মুখটা কত যেন অচেনা। মনে মনেই বলল, কে তুমি?

একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল রজনি। করজোড়ে আঁচলের কাপড় গলায় জড়িয়ে প্রণতভঙ্গিতে রজনি মাথা নীচু করল। ব্রহ্মচারী কেঁপে উঠল। অস্থির এক ভাব। হাত তুলতে গিয়েও যেন থমকে গেল।

দেব দর্শন। রজনি মনে মনেই বলল, তোমায় মুক্তি দিলাম ঠাকুর। মোহন কিছুই টের পায়নি।

বিহান তখনও ফুটেছে কী ফোটেনি। ব্রহ্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দির লাগোয়া ধরমশালার দোরগোড়ায়। কেয়ারটেকার বাবুটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সব শুনে বলল, উ লোগ তো চলা গিয়া।

অস্পষ্ট অন্ধকারে ব্রহ্মচারী দাঁড়ালেন নদীর সঙ্গমস্থলে। পুব পাড়ে তখন সূর্য ওঠার প্রস্ততিপর্ব। দু’হাত বুকের ওপর প্রণামের ভঙ্গিতে রেখে তিনি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বললেন, এবার গেরুয়া বসনের অধিকার দাও হে প্রভু।

অন্তরালে স্বামী ভূতানন্দ হয়তো হাসলেন।

বিকল্প

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুলল হরিয়ালি। কোলে দু বছরের ছেলে-সহ মেয়ে জামাই। জামাইয়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট, মেয়ের মাথায় এক গলা ঘোমটা যদিও এটা তার বাপের বাড়ি। যদি সব ঠিকঠাক থাকত, তাহলে ঘোমটার বহর থাকত না।

চল টুসু জলকে যাব, রানিগঞ্জের বড়তলা ঘুইরবার বেলা দেঁখায় আইনব কয়লা খাদের জলতুলা।

এখন পৌষ মাস। মাসভর সন্ধ্যা বেলায় টুসু গান শোনা যায় এই পাড়ায়। ভদ্রলোকের ভাষায় এটা বাউরি পাড়া। তবে এখানে বেশ কয়েক ঘর শুঁড়ি, গোয়ালা থেকে দু ঘর বিহারি, আর এক রাজপুত পরিবারেরও বসত। দয়াল সিং-এর পূর্বসূরিরা নিজেদের ঠাকুর পরিচয় দিয়ে থাকলেও অর্থনীতির কারণে এই অন্তজ সমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিম বর্ধমানের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই অঞ্চলে মানভুঁইয়া বাংলার সাথে হিন্দি-বিহারি মিশেল দিয়ে কথা বলে অবাঙালি পরিবারগুলো যারা দীর্ঘ দিন বাঙালিদের মাঝে থেকে বাংলাটাই স্কুলে মাতৃভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছে। অবশ্য যাদের পয়সা আছে তারা ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে যায়, তাদের কারও কারও দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। টুসু যদিও অঘ্রাণের শেষে আমন ধান তোলার পর এক ধরনের শস্যোৎসব, টুসু পাতাও হয় একটি সরায় চালের গুঁড়ি মাখিয়ে, তার ওপর তুষ ও ধান বিছিয়ে, দূর্বা ঘাস ও আলো চাল লাগানো গোবরের ঢেলা রেখে। কিন্তু পুরুলিয়া ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই ডিশেরগড় সাঁকতোড়িয়া অঞ্চলে ইদানীং নিম্ন বর্ণের যে পরিবারগুলি টুসু বা ভাদু পরবের ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে তারা আর কেউই বলতে গেলে কৃষিজীবী নয়। দু চারটি পরিবারের আবাদি জমি আছে, চাষও করে। তবে তাদের ছেলেপুলেরা আর হাল ধরতে চায় না। দেখেছে কয়লার কারবারে অনেক বেশি লাভ। জমিতে হাল দিলে অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য ধরার পরেও প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা। সেখানে আরও খানিকটা গভীরে খুঁড়ে যদি নিশ্চিত আমদানি হয় তো মানুষ সেদিকেই তো ঝুঁকবে। চোরা খাদানের জেরে ধস নামলে ইসিএল-কে দোষারোপ করে ক্ষতিপূরণ চায় স্থানীয় বাসিন্দারা, অন্য দিকে বৈধ বা অবৈধ খনি থেকে কয়লা চুরি বহু লোকের স্বীকৃত পেশায় দাঁড়িয়ে গেছে।

এবার টুসু পাতা হয়েছে মাখন বাউরির ঘরে। তার মেয়ে ময়না আসরের মধ্যমণি। কন্যাকে ঘিরে পাড়া প্রতিবেশীর বেশ একটা সমীহ ভাব। সে নাকি একবার বাজারের মাঝে হাটবারে চারটে ছেলেকে কোমর থেকে বেল্ট খুলে পেঁদিয়েছিল। ছেলেগুলো তাকে জিন্স, টি-শার্ট পরা দেখে শিস দিয়েছিল। ময়না তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দাখিল হয়েছে। হতে পারে কোটায় সুযোগ, তবু বাউরি ঘরের মেয়ে বাবুঘরে বাসন না মেজে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছে দেখে, ওই অঞ্চলের অনেকেই সমীহ মিশ্রিত কৌতূহলের চোখে দেখেছিল সেইসময়। দুহাজার সালের পর যেমন ঘরে ঘরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উৎপাদন হচ্ছে, তেমন হতো না নব্বইয়ের গোড়াতেও। ময়নাকে নিয়ে মেয়েদের মুখে মুখে টুসু গানও রচিত হয়েছে।

ময়নারানি বাপ-সোহাগি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে গো

তার সাথে লাইগতে গিয়ে চুয়াড় ব্যাটা মরে গো।

আসরে ছিল লাখো। লাখো বাউরি নয়, সিং। জশাইডি গ্রামের একমাত্র রাজপুত পরিবারের মেয়ে। নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিলেও ভদ্রলোকের ভাষায় বাউরি পাড়ার লোক হিসাবে দেগে গেছে। তাছাড়া তপশিলি জাতিভুক্ত হতে পারলে সুযোগসুবিধা আছে বলে তার দুই ভাই রাজু আর কিসান মিথ্যেটা ভাঙাতে খুব একটা উৎসাহী নয়। তারা বরং স্থানীয় কাউন্সিলরকে ধরে তপশিলি জাতির শংসাপত্র যোগাড় করে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছে। তবে দুজনেই অলস ছাত্রজীবন না কাটিয়ে যথাক্রমে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পরেই পড়াশুনোর ইতি টেনে স্বনির্ভরতার তাগিদে ঝালবাগান মোড়ে পান সিগারেটের গুমটি দিয়েছে। লাখো গ্রামের বাউরি আর গোয়ালা মেয়েদের চেয়ে নিজেকে আলাদা ভাবে না। বাংলাতেই কথা বলে আর দুর্দান্ত ভাদু, টুসু এমনকী মনসামঙ্গল গাওয়ার দৌলতে এই জাতীয় আসরে তার জায়গা বাঁধা।

ময়নার বীরত্বের কাহিনি আর তাকে নিয়ে বাঁধা গান শুনতে শুনতে লাখো ভেতরে ভেতরে বেশ উদ্দীপিত বোধ করছিল। তাকে স্কুল, দোকান, কাজের বাড়ি ইত্যাদি যাওয়া-আসার পথে কয়েকটা ছোকরা প্রায় রোজ উত্যক্ত করে। আজেবাজে ইঙ্গিত করে, সাহেব মেমদের কুৎসিত কাণ্ডকারখানার ছবি দেখাতে চায় জোর করে। শ্যামল নামের ছেলেটা একবার প্রেমপত্র দিয়েছিল। কিন্তু সে একা আসে না, তার সাথে তার তিনজন বন্ধুও থাকে যারা খ্যা খ্যা করে হাসে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রস্তাব দেয়। ওদের চোপা করেছে, সবাই মিলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ঘিরে ধরলে হাতে পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করেছে, ওদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে বলে সতর্ক করতে চেয়েছে, কিন্তু কোনওদিন একটা চড় মারার সাহস হয়নি।

কী করে হবে? ওরা চারজন লাখো একা। ওরা বড়ো ঘরের ছেলে, লাখোর মতো স্কুল করার পর লোকের বাড়ি কামিন খাটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় একথা ওদের বাড়ির লোক অবিশ্বাস না করলেও স্বীকার করতে চাইবে না। অন্তত শ্যামল, অমিতাভরা তাই দাবি করে লাখোর দরবার করার হুমকি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। ময়নার কথা শুনতে শুনতে লাখো কল্পনা করতে লাগল, হারামিগুলো আবার লাগতে এসেছে, আর ও পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিচ্ছে। তার কোমরে বেল্ট নেই তো কী, গাছের ডাল কি রাস্তার থান ইট তো আছে। আহা যদি জিন্স পরতে পেত কস্তুরী, বর্ণালিদের মতো!

গানে গলা মেলাতে গিয়েও লাখো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেগুলোর সাহস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। খারাপ মন্তব্য থেকে এবার হাত ধরে টানাটানি, জোর করে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা এইসব শুরু করেছে। যা সব ছবি দেখায় অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার সাথে সাথে ভয়ে হাত-পা পেটে সিঁধোয়। আবার শুনতে পায় ছোটো বোন গৌরীকে নাকি তাদের সাথে হাহাহিহি করতে দেখা গেছে। বোনকে সাবধান করতে গেলে সে উলটে দিদিকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দেয়।

‘কী রে লাখো কী ভাবছিস? চুপচাপ ক্যানে?’

‘বড়ো জাড়াচ্ছে। যা ঠান্ডা।’

আজ চাউড়ির দিন, গোবরমাটি দিয়ে ঘর নিকোনোর কথা। মাখন বাউরির যেহেতু পাকা ঘর তাই ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। যে তোলা উনোনটায় বাঁউড়ির দিন পিঠে হবে তাতে গোবর-মাটি লেপা হয়েছে। সেটাই জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে বারান্দার মধ্যিখানে আর তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আঁচ পোয়াতে পোয়াতে মেয়ে বউরা আসরে মেতেছে। আগামীকাল টুসুর জাগরণ অর্থাৎ নিশিপালন। টুসুর ভোগ হিসাবে বাড়িতে বাড়িতে হলুদ মুড়ি, ছোলা-মটর ভাজা, জিলিপি ও নানা ধরনের মিষ্টি আয়োজন হলেও জাগরণের জন্য বাঁউড়ির মূল আসর হয় মাখন বাউরি আর গণেশ মণ্ডলের বাড়ি। এদের বাড়িতে গ্রামের সবচেয়ে বড়োলোক আর বনেদি পরিবারের মহিলাদেরও নেমন্তন্ন থাকে। তারা ছোটো জাতের বাড়িতে চালের তৈরি পিঠে না খেলেও, শুকনো ছোলা, মটর, মিষ্টি দাঁতে কেটে ধন্য করে দেয়। লায়েক গিন্নির সাথে ঠিক ছোঁক ছোঁক করে তার অকালকুষ্মাণ্ড মেজো ছেলেটাও এসে হাজির হয়। সে নাকি গাড়ি করে মাকে পৌঁছোতে আসে। ওদের চারজন ড্রাইভার, সবাই কি একসাথে ছুটিতে থাকে নাকি এদিন? আসলে কিংশুক আসে মেয়েদের আসরে চোখ দুটো একটু সেঁকে নিতে। শীতের মধ্যে সবার শরীর সোয়েটার চাদরে ঢাকা থাকলেও, কে পেংলি আর কে ডবকা ঠাওর করা যায়। ছেলেকে নিয়ে লায়েক গিন্নি, তার জা ও ভাসুরঝি ভেতরে ঢুকতে সবাই একটু সচকিত হয়ে উঠল। তাদের বসার জন্য দালানে চেয়ার পেতে দেওয়া হল।

‘এই লাখো, তুই একটো গান ধর ক্যানে, তুর পছন্দের গান।’ বলল স্বয়ং ময়না।

কিংশুকের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে যা একখানা হাড়হিম করা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিল যে কল্পিত, সাহসিকতা ভুলে আগামীদিনের সম্ভাব্য বাস্তবতা মনে করে লাখোর ভেতরটা গুড়গুড় করতে লাগল। সে সকলের তাড়ায় ধরল–

‘আদারে-বাঁদাড়ে ঝিঙা ও ঝিঙা তুই বাড়িস না।

আমার ভাদু শিশু ছিলা ঝিঙা রাঁইধতে জানে না।’

‘ইটো তো ভাদু গান বটে। তুর কী হঁইছে বলত? আইসে অব্দি আনমনা।’

‘আরে, ভাদুর জায়গায় টুসু বসায়েন দিলেই উটো টুসু গান হঁইয়ে যায়। তা উয়ার কারও সাথে কুছু চক্বর-টক্বর চইলছে বুঝি?’ ওপাশ থেকে ফোড়ন কাটল কিংশুক।

অতসী কিংশুকদাদাবাবুর রসিকতায় হেসে গান ধরল– ‘আমার টুসু মান কইরেছে

মানে গেল সারা রাইত।

খুল টুসু মানে কপাট আইসছে তুমার প্রাণনাথ।।’

সমবেত গানে গলা মেলালেও লাখোর ভেতরে স্বস্তি নেই।

কিংশুকের জ্বলন্ত চোখের সাথে চোখাচোখি হলেই ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জ্বালায় সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছিল। কিংশুক দেখতে পেয়ে খুব আন্তরিকতাপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কী হল? শরীর খারাপ নাকি? ইস্কুলে দিদিমণি কুছু বইলছে, মেইরেছে?’

লাখো মাথা নাড়ে। প্রথমটায় জানাতে না চাইলেও সহানুভূতির স্পর্শ পেয়ে সব উগরে দিয়েছিল। কিংশুক লাখোকে ঝালবাগান মোড়ের গরাইদের বাঁধা চায়ের দোকানে বসিয়ে একরকম জোর করে তেলেভাজা, জিলিপি আর চা খাওয়ায়। বাড়িতে এইসময় স্কুল থেকে ফিরে ভাতই খায় লাখো। খেয়ে অসিত চৌধুরীর বাড়িতে কাজে যায় বিকেলের বাসন মাজতে।

কাজটা সে নিজের মর্জিমাফিক করে। খেয়াল খুশি মতো কামাই, বেলা পার করে চৌধুরী কর্তাগিন্নির মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে যখন খুশি হাজিরা দিলেই হল। তবে বিকেলে ওবাড়ি কাজ করতে যাওয়ার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে। চৌধুরীদের বড়ো মেয়ে ওই একই স্কুলে পড়ে। বয়সে লাখোর চেয়ে ছোটো হলেও দু ক্লাস উঁচুতে। সেও তৈরি থাকে খেয়েদেয়ে মার্বেল নিয়ে গুলি খেলার জন্য। দায়সারা কাজ চুকিয়েই লাখো মেতে ওঠে মনিবকন্যার সঙ্গে গুলি খেলায়। মৈত্রেয়ী হারলে আবার ঝালবাগান মোড়ের বুড়োর দোকান থেকে মার্বেল কিনে আনে মায়ের কাছে চেয়েচিন্তে পয়সা জোগাড় করে। কিন্তু লাখো হারলে নতুন গুলি কেনার পয়সা লাগে না। সে জানে মিতু অর্থাৎ মৈত্রেয়ী কোথায় নিজের মার্বেলের বাক্স লুকিয়ে রাখে। লাখোর চুরির ঠেলায় মিতু কতবার যে নিজের গোপন প্রকোষ্ঠ লুকিয়েছে তার লেখাজোকা নেই। যখনই গুলি বার করতে যায় দেখে গুনতিতে খান পাঁচ ছয় কি আরও বেশি কম পড়ছে। লাখোর ওপর চোটপাট করলে মিতুর মা মিতুকেই বকে। কাজের মেয়ে ছাড়া তার চলে না। আর কাকাবাবু গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করার বদলে বউয়ের ওপর চোটপাট করে বেশি। তাই কাকিমা ঝিয়ের হাতেপায়ে ধরে খোশামোদি করে। লাখোও সেই সুযোগে এনতার বেয়াড়াপনা করে নেয়।

কয়েক দান গুলি খেলার পর মিতুর বন্ধুরা ডাকতে আসে খেলার জন্য। বুড়ি-চু, ডাংগুলি, কবাডি, এক্বাদোক্বা, লুকোচুরি, নামডাকাডাকি, স্কিপিং– কতরকম। খেলার ভেন্যু নির্ভর করে কী খেলা হচ্ছে তার ওপর। কবাডি, বুড়ি-চু, কিতকিত কিংবা এক্বাদোক্বা হলে সাধারণত ডিপিএস-এর স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবের শান বাঁধানো ব্যাডমিন্টন কোর্টে চলে যায়। অন্যান্য খেলা কারও বাড়িতেও হতে পারে।

এমনিতে মিতুর বন্ধুরা কামিনের সঙ্গে গল্পগাছা না করলেও, খেলায় নিজেদের দল ভারী করার জন্য লাখোকে নিয়ে টানাটানি করে। মিতু তো মাছ মাংস দুধ ফল খেয়েও পেংলি, ক্ষীণজীবী। ওদিকে লাখো মাড় খেয়েও চারটে মিতুকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে। বুড়ি-চু, ডাংগুলি আর কবাডিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্র পাড়ার কোনও কোনও ছেলে পারে তাকে মাত দিতে। এই তো আজ বিকেলেও কবাডিতে কস্তুরীদের দলের খেলোয়াড়দের বলে বলে আউট করেছে। গাছে চড়াতেও তার জুড়ি নেই। পরের গাছের ফল-পাকুড়কে নিজের ভাবতে হলে এটুকু দক্ষতা তো রাখতেই হবে। আগে মারামারি লাগলে মেয়েরা গায়ের জোরেও কেউ তার সঙ্গে পেরে উঠত না। এখন বড়ো হয়ে গেছে বলে হাতাহাতি লাগে না। না হলে গুলি চুরির জন্য রোজই খণ্ডযুদ্ধ বাধার কথা। এখন মিতুদের বন্ধুরা প্রায় দিনই ছুটোছুটি খেলার বদলে রাস্তায় পা়য়চারি করতে করতে গালগল্প করে। ভদ্রলোকের মেয়েদের সঙ্গে ঝিগিরি করা মেয়ের তেমন প্রাণের কথোপকথন থাকে না। তাই ইদানীং খেলার পরিকল্পনা বাতিল হলে লাখোকে বিকেলটা নিজের সমতুল্য সামাজিক পদমর্যাদার সঙ্গী জুটিয়ে আড্ডা মারতে হয়। নাহলে গাছের মগডাল হোক কি কিতকিতের কোর্ট– লাখোকে যশাইডি আর ঝালবাগানের মেয়েরা সমঝেই চলে। এমন ডাকাবুকো মেয়ে কিনা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।

সেদিন কিংশুক লাখোকে বলেছিল, ‘পা থেইক্যে জুতাটো খুলে মুখে মাইরতে লারলি বানচোদগুলার? আমি থাইকলে দেখাইন দিথম মজা। আমার গাঁয়ের বিটির গায়ে হাত দেয় শূয়ারের বাচ্চাগুলান? আমায় আগে বলিস নাই ক্যেনে? বিচি কেইটে হাতে ধরায়েন দিথম। কিংশুক লায়েককে সবাই চিনে। তুঁই ভাবিস না। উয়াদের আমি খবর লিছি।’ দোকানে কিংশুকের জনা সাতেক বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা কিংশুকের দাদা কুন্তলের অ্যাকাউন্ট-এ ধারে চা, সিঙাড়া, মিষ্টি খাওয়ার বিনিময়ে লায়েক ভ্রাতাদ্বয়ের উচ্চারিত কথার দোয়ারকি দেয়।

আশ্বাস পেয়ে লাখো খেয়ে নিল। কিংশুক তার পিঠে কাঁধে মাঝেমাঝে হাত বোলাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে বলল, ‘চল তুখে ঘর পৌঁছায়েন দি।’ লাখো তার ষোলো বছরের জীবনে এমন আজব কথা কোনওদিন শোনেনি যে তাকে কেউ ঘরে পৌঁছোতে চাইছে। ভেতরটা একরকম পুলকে উছলে উঠলেও কুণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘একা যেইতে পাইরব। তুমি আপনার বন্ধুদের কাছে থাক।’

কিংশুক দায়িত্ববান বড়ো দাদার মতো গ্রামতুতো বোনের রক্ষক হয়ে কিছুদূর গিয়েই দুধনাথের গোয়ালটার আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে আচমকা লাখোকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। লাখো ছাড়ানোর চেষ্টা করলে তার ডান হাতখানা সজোরে পেছন দিকে মুচড়ে ধরল।

‘আঃ! আমার লাইগছে। ছেইড়ে দাও।’

‘তুকে আমি বদমাস ছিলাগুলার হাত থেইকে বাঁচাব, বদলে আমারও তো কুছু চাই।’

‘আমায় ছাড়ো বলইছি। না তো খুব খারাপ হবেক। আমি কাকিমাকে বইলে দুবো।’

‘আমি শ্যামলার পারা কেরানির ব্যাটা লই। লায়েক বাড়ির ছিলা, আদিত্য লায়েকের ব্যাটা, কুন্তল লায়েকের ভাই। তুর মতো বিটিছিলাকে আমি পায়ের জুতা বানায়েঁ রাইখতে পারি। বেহায়া মাগি ইস্কুল গিয়ে পড়াশুনার বদলে রাস্তার ছিলাদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করিস? দাঁড়া আমি তুর বাপকে জানাছি। মদনার কাছে আট গাড়ি গোবর চেঁইছিল দাদা, চার গাড়ি দিয়ে পাত্তা নেই। মদ গিলে পইড়ে থাকে, আমরা ডাইকলে আসে না।’

‘তুমরা টাকা বাকি রাখো যে।’

‘কী বইললি, খুব বাড় হঁইনছে লয়? যত বড়ো মুখ লয় তত বড়ো কথা? বাপ আর বিটি দুজনাকেই শায়েস্তা কইরতে হবেক।’

তারপর থেকে মা কালীকে ডাকতে ডাকতে একদিকে শ্যামলবাহিনী আর একদিকে কিংশুক লায়েককে চুক্বি দিতে হচ্ছে। শ্যামলরা সাঁকতোড়িয়া কলোনিতে থাকে, কিন্তু কিংশুক তো একই গ্রামের ছেলে। পৌষ পরব, পিঠেপুলি, টুসু গান– সব আনন্দ ভয়ের মেঘে ঢেকে গেছে। ও অন্যমনস্ক হবে না তো কী? মাখন বাউরির মেয়ের বীরত্বের কথা স্মরণ করেও মনে বল পাচ্ছে না।

নদী ঘাটে ভিড় দেখলে বোঝা যায় পুণ্যপিপাসার কাছে শরীরের কষ্টবোধ তুচ্ছ। এইসময় সকালের তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়, চার-পাঁচ প্রস্থ গরম জামা পরেও পাঁজরের কনকনানি কাটতে চায় না। দামোদরের হিমেল জলে এরই মধ্যে নানা বয়সি মেয়ে-পুরুষের সমাবেশে যেন মেলা লেগেছে। বয়স্ক মহিলা ও বাচ্চা দু-একটি মেয়েদের কেউ কেউ স্নানের পর শুকনো কাপড় পরলেও বেশিরভাগ মেয়ে ভেজা কাপড় ছাড়ার আড়াল না পেয়ে সেই পরেই বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে। লাখোও কাঁপতে কাঁপতে ভেজা সালোয়ার কামিজ গায়ে বাড়ির পথ ধরল। পায়ের আঙুলগুলো ঠান্ডায় জ্বলছে, হাতের পাতায় সাড় নেই, দাঁতে দাঁতে খটখটানি থামতেই চায় না। ঘাট থেকে যশাইডি গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পথ। হাসপাতাল ও ঝালবাগান মোড় পর্যন্ত অটো কি বাসে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে খরচ বেশি, পুণ্য কম। তার বাড়ি থেকে একমাত্র সেই আসে সকলের হয়ে পুণ্যার্জন করতে। মিতুদের বাড়ি আজ কাজে যাবে না, কেবল বিকেলে গিয়ে পিঠে নিয়ে আসবে। তারপর মাখন বাউরির ঘরে মোচ্ছব, রাতভর। হাঁটতে হাঁটতে একটা ডাক শুনে মুখ তুলে তাকাল লাখো।

‘কী রে, তখন থেইকে ডাকছি, শুনতে পাস না?’ শ্যামল, অমিতাভ, শিশির আর ছোটন। শ্যামল আর ছোটনের বাইকে ওরা চারজন।

লাখোর বুকের মধ্যে যে-স্রোতটা বয়ে গেল সেটার তাপমাত্রা কত কে জানে? ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে আবার পা বাড়াল।

শ্যামল বলল, ‘বড়ো জাড়াচ্ছে লয়, আয় তুকে মোটর সাইকিলে বাড়ি পৌঁছায়েন দিয়ে আসি।’

‘দরকার নাই, আমার পা আছে।’ বাজার ছাড়িয়ে তখন এমডি অফিসের কাছাকাছি। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে গেছে।

‘পায়ে হেঁইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বুকে সর্দি বইসে যাবে। আমার মোটর সাইকেলে উঠ।’ শ্যামলের ইশারায় অমিতাভ এসে লাখোর হাত ধরল। রাস্তায় লোকজন আছে, তাই ভয়টা কমে গেল। হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিতে অমিতাভ যেন একটু টলে গেল। টাল সামলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল অমিতাভ, ‘দেইখ্যে লুব তর কত ত্যাজ।’ লাখো চ্যাঁচালে হয়তো লোক জড়ো হতো, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে গেল।

সন্ধেবেলায় মিতুদের বাড়ি থেকে সবে পিঠে নিয়ে ঝালবাগান মোড় হয়ে গাঁয়ের গলিতে ঢুকছে হঠাৎ মুখে ঘাড়ে গলায় বরফ জলের কনকনে স্পর্শ, পর মুহূর্তে অবর্ণনীয় জ্বালা। ঠান্ডা নয়, প্রচণ্ড তপ্ত কিছু যেন চামড়া গলিয়ে মুখ থেকে গা বেয়ে নামছে। চিৎকার করতে করতে মাটিতে বসে পড়ল লাখো। দুটো মোটরবাইক গর্জন করে চলে যাওয়ার শব্দ হল। আশপাশের দোকানগুলো থেকে চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এল। যশাইডি গ্রামে ঢোকার দুটো পথ আছে, একটা ঝালবাগান মোড়ে, আর একটা হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তায় পড়ে।

কিংশুকের দাদা কুন্তলের গাড়ি করে অর্ধচেতন দেহটাকে ভর্তি করা হল সাঁকতোড়িয়া হাসপাতালে। হাসপাতালটা এমনিতে ইসিএল-এর হলেও স্থানীয় মানুষও কম খরচে চিকিৎসা পায়। ডাক্তাররা কেউ কেউ গরিবগুর্বোকে ওষুধ টষুধ দিয়ে দাক্ষিণ্যও করে থাকে।

মাসখানেক পর জীবিত ছাড়া পেল ঠিকই তবে মুখ আর গলা ঝলসে পুড়ে গেছে, মাথা তুলতে পারে না লাখো, খুব সামান্য ঘোরানো যায়। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশ শ্যামলদের ধরে নিয়ে গেলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কেউ বলে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, কেউ বলে জামিনে ছেড়েছে। তবে তারা আর লাখোর পথ আগলে দাঁড়ায় না, আর লাখো তো রাস্তায় বোরোয়ই না বলতে গেলে। ওদিকে কিংশুকও লাখোকে দেখলে ‘মুখপুড়ি’ বলে মাঝেমাঝে সম্বোধন ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর জ্বালায় না। বাজারে শ্যামলদের সঙ্গে তাকে গল্পও করতে দেখা গেছে। গাঁয়ের মেয়ের গায়ে হাত দিলে শাস্তি জানা আছে, কিন্তু তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারলে কী কর্তব্য জানা নেই সম্ভবত। গৌরীকে আর সাবধান করতে হয় না, সে দলবল ছাড়া স্কুলে যায় না।

গৌরীর বিয়ের জোর চেষ্টা চলছে। পাত্রপক্ষ ধানবাদ জেলার কুমারডুবিতে থাকে। তাদের হাজার বায়নাক্বা। কুমারডুবিতে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে একটা চালু গোলদারি দোকান আছে। দোকানটা একেবারে জিটি রোডের ওপরই বলা যায়। রোজগারপাতি ভালোই। তিন ননদ, কোনও দেওর-ভাসুর না থাকায় একমাত্র ছেলে বলা গেলেও সম্পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট বলা যায় না। মেজোমেয়েকে পার করতে হবে বলে লছমনের বাবা চাইছেন পণের টাকাটা তার ছেলের তরফের কুটুমের কাছ থেকে আদায় হোক। যে যেখানে মহাজন।

লাখোর মুখ পোড়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মা হরিয়ালি অসিত চৌধুরীদের বাড়ি কাজে আসে এবং সেইসূত্রে শাশ্বতী চৌধুরীর প্রিয় বান্ধবী। অবশ্য যে গাঁয়ের নিরানব্বই শতাংশ মানুষ কম বেশি চুরি করে, সেখানে লাখোর মা আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম। মেয়েরও হাতটান ছিল, কিন্তু মায়ের সামনে আলমারির চাবি ফেলে রাখলেও ভয় নেই। এমন মানুষ যতই কামাই করুক হাতছাড়া করা যায় না। বড়ো মেয়ে আইবুড়ো থাকতে ছোটো মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে বলে হরিয়ালি মন খারাপ করে। বছর খানেক পেরিয়ে গেছে, মেয়ের বিকৃত মুখে ছিরিছাঁদ ফেরেনি। লাখোর এখনও কথা বলতে, খাবার গিলতেও কষ্ট হয়। জলখাবার খেতে গিয়ে লাখোর মা প্রায় দিনই চোখের জল ফেলে।

গৌরীর বিয়েটা বোধহয় কেঁচিয়ে যাবে। পাত্রপক্ষ পণ নিয়ে বড়োই রগড়ারগড়ি করছে। রাজু কিসান পালা করে কুমারডুবিতে গিয়ে আলোচনা করেও কোনও রফাসূত্র বার করতে পারছে না। হরিয়ালি ছেলেদের দোকানে পাঠিয়ে ভাবছে আজ মিতুদের বাড়ি যাবে কিনা। এমন সময় উঠোনের দরজায় টোকা। এক কালো রোগা ছোকরা।

‘ইয়ে কা দয়াল সিংকা ঘর হ্যায়?’

‘হঁ বটে, কিন্তু উ তো অনেকদিন হইল মইরে গেছে। আমার স্বামী ছিলেক।’

‘মালুম হ্যায়। কেয়া ধানবাদমে গুরুচরণ বাঘেল কি ঘরমে আপ কি কিসি বেটি কি শাদি কি বাত চল রহি হ্যায়?’

‘হঁ হঁ। রাজু কিসানকে খবর কইরছি। উয়াদের সাথে কথা বলুন।’ হরিয়ালি একদম হিন্দি বলতে পারে না, খুব ভালো বুঝতেও পারে না। ছেলেরাও স্থানীয় ঝাড়খণ্ডি উপভাষার বাংলাতেই স্বচ্ছন্দ, কিন্তু বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদেরকেই এগিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া গৌরীর বিয়ের কথা চলছে যেখানে সেইখানে দুই ছেলেই যাওয়া আসা করেছে। সুতরাং সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারাই বেশি উপযুক্ত। হরিয়ালি মাথায় ঘোমটা টেনে বলল, ‘বসুন, আপ বইঠিয়ে। লাখো, যা তো রাজুকে ডেইকে লিয়ে আয়।’ বলেই বলল, ‘থাক তুকে আইসতে হবেক লাই। আমি ষষ্ঠীর ভাইকে বুইলছি।’ মুখ পোড়া মেয়ের কেচ্ছা আর এক মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির লোক জানতে পারুক চায় না। তাই লাখোর বৃত্তান্ত সেখানে জানানো হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি।

‘আপ পরেশান না হো, ম্যায় আপসে বাত করনা চাহতা হুঁ।’

‘হাম বাত মানে হিন্দিতে বাত কইরতে লারি। আমার ছিলাগুলাকে ডাক দিচ্ছি। উয়াদের সাথে কথা করুন। তাতখে মুখে টুকদু কুছু দ্যান।’

‘আমি বাঙালিই। আপনারা রাজপুত না? হিন্দি জানেন না?’

‘বইলতে লারি। ছুটু থেইকে বাংলাতেই কথা বইলছি লয়। অ্যাই ষষ্ঠী, অ্যাই মহেশ, রাজুদাকে টুকদু খবর কইরে আয় না। বল ঘরকে কুটুম আইসছে, জলদি আসে যেমন।’

ছেলেটার নাম প্রসূন মিশ্র। কুমারডুবিতে শঙ্কর টকিজ নামে তাদের একটা সিনেমা হল ছিল, এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাট হয়েছে, নীচে দুটো দোকান ঘর পেয়েছে প্রসূনরা। একটাতে নিজেদের আসবাবের দোকান করেছে আর একটা ভাড়া দেওয়া আছে এক মুদিখানার কারবারিকে। দোকানটা বাবা আর দাদারা দেখে, প্রসূন নিজে স্কুলে পড়ায়। কিন্তু এত কথা ও হরিয়ালিকে কেন বলছে? হরিয়ালি তো কিছু জানতে চায়নি।

ছেলেটা নিজের বাড়ির সম্পর্কে টুকটাক নানা কথা বলে গেল। যা বাবা! গৌরীর শ্বশুরবাড়ির কথা, লছমনের অর্থাৎ গৌরীর হবু বরের কথা তুলছেই না। প্রশ্ন করলে দায়সারা জবাব। তাহলে কি গুরুচরণজিরা পাঠায়নি একে? নাকি এ নিজেই? কথাটা হরিয়ালির মাথায় আসতেই খাতিরের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। উঠোনের দরজা দিয়ে রাজু ঢুকতেই বলল, ‘ইনার নাম পরসূন, পর্সূন কী যেন? ও মিশ্রা। পর্সূন মিশ্র। কুমারডুবি থেইকে আইসছে।’

একথা সেকথার পর প্রসূন গলা খাঁকারি দিয়ে খোলসা করল। সে হরিয়ালির মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। দেওয়া-থোওয়া ওদের সাধ্যমতো, কোনও দাবিদাওয়া নেই। হরিয়ালি তো হাতে স্বর্গ পেল, ‘আপনার, তুমার মা-বাবার সাথে কথা বুইলে..ছ? উনারা কী বলেন দেইখতে হবেক লয়?’

‘মা-বাবা রাজি নন। ওনারা মুখ পোড়া মেয়েকে বউ করতে চান না।’

‘মানে?’ এবার হরিয়ালির দশগুণ অবাক হওয়ার পালা। প্রসূন তাহলে গৌরীকে নয়, লক্ষ্মী অর্থাৎ লাখোকে বিয়ে করতে চায়? ইয়ার্কি করছে না হরিয়ালি স্বপ্ন দেখছে।

‘তুমি আমার ওই মেয়ের কুথা জাইনলে কেমন কইরে?’

‘গুরুচরণজির ছেলে লছ্মন আমাদের ওই দোকানঘর ভাড়া নিয়েগোলদারির দোকান দিয়েছে। কতগুলো শয়তানের জন্য ওর চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনটা তো নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।’

রাজু মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হরিয়ালি জল মিষ্টি পরিবেশন করে বলল, ‘আপনি… তুমি আজ দুপুরে আমার কাছকে ভাত খেয়ে যাবে। এ রাজু কিসনাকেও ডাক। কথা বইলতে হবেক।’

‘আর কাউকে ডাকার দরকার নাই। বিয়া আমি কইরব না। আমার মতো মুখপুড়িকে কেউ জেনেশুনে বিয়া করে?’ লাখো অন্ধকার ভেতর ঘর থেকে বাইরে এল। ও লোকজনের সামনে বড়ো একটা বেরোতে চায় না।

‘জেনেশুনেই তো কথা পাড়ছি।’ প্রসূন বলল।

‘কিন্তু আপনার বাপ-মার মত নাই। বিয়া হবে কী কইরে?’

‘বিয়েটা আমি করব। আমার মা-বাবা নয়। ওনারা রাজি হবেন না বলেই আমি নিজে কথা করতে এসেছি।’

‘আমার পারা মিয়াকে কেউ বিয়া করে? মা উয়াকে বুঝাও।’

‘হঁ বাবা। তুমার মা-বাবা রাজি লয়, ভগবানের শাপে আমার বিটিটোর এই অবস্থা। কুনো দিন উয়ার বিয়া হবার কথা লয়। ঘরে কামকাজ কইরে আপন মনে থাইকছে। তুমি জিদ কইরে বিয়া কইরলে তুমার বাড়িতে মেইনে লিবেক ক্যানে?’

রাজু এবার বলল, ‘মা ভাত বসাও। আমি কিন্তু জলদি বাইরব। কিসনা একা দোকান বন্ধ কইরতে লাইরবেক।’

‘সবসময় বিয়ে কি মা-বাবারা মেনে নিতে পারে? ওনারা স্কুল টিচার ছেলের জন্য মোটা টাকা দর হাঁকবেন। আমি পণ নেব না। শুধু একটা মেয়ের সঙ্গে যা অন্যায় হয়েছে তার কিছুটা পুষিয়ে দেব, মানে ওর তো কোনও দোষ নেই, ও কেন সারাজীবন বঞ্চিত থাকবে?’

হরিয়ালির নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তার দেখতে শুনতে ভালো ছোটো মেয়ের পাত্র ঠিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, আর বিকৃত মুখ বড়োটির জন্য যেচে এত ভালো পাত্র আসছে। আসছে কী, সাধছে, তাও আবার বিনা পণে। সে ছেলেকে ইশারা করল দিদিকে রাজি করাতে। নিজে উঠোনের এক কোণে তৈরি মাটির উনোনে ভাত ও তরিতরকারির জোগাড় করতে বসল। ইস্! কাল মিতুদের গাছ থেকে এঁচোড় নিয়ে এলে পারত। এখন অতিথিকে ভদ্রস্থ কী খাওয়ানো যায়? অল্প পোস্ত আছে। আলু পোস্ত করা যায়। সঙ্গে মাচায় যে কুমড়োর লতাটা উঠছে সেখান থেকে কয়েকটা কুমড়ো ফুল তুলে বেসনে ভেজে দেওয়া যায়। হরিয়ালি দোনোমনো করে সম্ভাব্য জামাইয়ের আদরের তোড়জোড় শুরু করল। কিন্তু এখন রাঁধতে বসলে খাবে কখন? শেষে কাজ চালানোর জন্য লাখোকে পাঠালো মিতুর মায়ের কাছ থেকে খানিক তরকারি ব্যাঞ্জন চেয়ে আনতে।

গৌরী স্কুল থেকে ফিরে দেখে এক ছোকরাকে নিয়ে বেশ খাতিরদারি চলছে। সে লছমন ভেবে বেশ একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে ঘরে ঢুকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। আলগোছে দু-একটা কথাও হল। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ওর আগমণের উদ্দেশ্য জেনে গৌরীর মূর্ছিত হওয়ার পালা। লছমনের ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রসূন তো প্রথম দর্শনেই চোখের সঙ্গে মনটাও আচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল। তার মুখপোড়া দিদির পাশে এই ছেলেটা? দিদির চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতেই পড়ে সে। দু বছর পর মাধ্যমিক পাসও করে যাবে। বড়ো ঘরের স্কুল টিচার ছেলে তবু তার বছর বছর ফেল মারা কামিন খাটা দিদিটাকে বিয়ে করতে চায়! আর তাদেরই দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মুদিখানা চালানো ছেলে গৌরীর মতো মেয়েকে নেওয়ার বিনিময়ে এত দর হাঁকছে?

লাখোকে প্রথমটায় রাজি করানো যাচ্ছিল না। বস্তুত হরিয়ালি আর তার দু ছেলেরও মনে হচ্ছে মুখপোড়া মেয়ে ঘরে কাজকর্ম করে মা-ভাইয়ের সংসার টেনে নিয়ে যেতে পারে। ও চলে গেলেই বরং অসুবিধা। বরং গৌরীটাকে প্রসূনের মতো পাত্রের সঙ্গে জুততে পারলে সব দিক থেকেই মানানসই হয়। কিঞ্চিদধিক পড়াশুনো শেখা ও অক্ষত থাকার সুবাদে গৌরী লোকের বাড়ি তো দূর ঘরেও কাজকর্ম করতে বিশেষ রাজি নয়। তাই হরিয়ালির ছেলেরা বড়দিকে রাজি করানোর চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে প্রসূনকে ছোড়দির দিকে ফেরাতে। তার মা-বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ করে দুটো বিকল্পের পথই খোলা রাখতে চাইছে। লাখো বেগতিক দেখে ঘাড় নেড়ে দিল। মেয়েরা যে শ্বশুরঘরে দাসত্ব করলেও গিন্নি আর বয়স পেরিয়ে বাপের ঘরে খেটে খেলেও আশ্রিতা, সেটা উপলব্ধি করার জন্য বেশি দূর পড়াশুনোর দরকার হয় না।

এরপর তিন বছর কেটে গেছে। প্রসূনের জেদ আর আন্তরিকতাই বজায় থেকেছে। গৌরীরও যেন কোনও অনিচ্ছুক পাত্রের পুরি ঘরওয়ালি হওয়ার বদলে একজনের আধি ঘরওয়ালি হওয়াতেই বেশি আগ্রহ। শালির বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে জামাইবাবু লড়ে যাচ্ছে। লছমনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে।

ভাই ও জামাইদাদার নতুন উদ্যোগে গৌরীরও বিয়ে হতে চলেছে কালীপাহাড়িতে। ছেলের নাকি কয়লা খনিতে মোটা মাইনের কাজ। অসিত চৌধুরী অর্থাৎ মিতুর বাবা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন খনি বলতে চোরা খাদান। এখানকার বহু লোকে জানেই না কোনটা বিধিসম্মত আর কোনটা বেআইনি খনি, বা জানলেও সেখানে কাজ করার মধ্যে অনৈতিক কিছু দেখে না। যেমন ইসিএল বা ডিপিএস-এর লাইন থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ নেওয়াকে বেশির ভাগ বাসিন্দা অনেকটা স্থানীয় মানুষের মৌলিক অধিকার বলে ধরে নিয়েছে, চুরি মনে করে না, আর করলেও ‘বেশ করেছি’ ভাব। খুব কম বাড়িতে কুয়ো বা পাম্প আছে। বড়ো বড়ো অট্টালিকাতেও ইসিএল-এর পাইপ লাইন থেকে শাখা প্রশাখা বার করে ট্যাঙ্ক ভরা হয়। একসময় কল্যাণেশ্বরীর জল ব্যবহূত হতো পানীয় জল হিসাবে, এখন সেটার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ইসিএল-ই ভরসা। হুকিং-এর তার ধরপাকড়ের সময় বাজেয়াপ্ত হলেও জলের লাইন কেটে দিলে আগুন জ্বলবে, কারণ অঞ্চলটার অধিকাংশ জায়গায় মাটির নীচটা ফাঁপা, কুয়ো খুঁড়লে জলের বদলে কয়লা নয়তো গহ্বর পাওয়া যাবে, আগুন আর ধোঁয়াও বেরিয়ে আসে জমির ফাটল বেয়ে। যশাইডি গাঁ, ঝালবাগান কলোনি আর বানডাঙার কয়েকটা বাড়িতে কুয়ো থাকলেও ‘কোম্পানিকা মাল দরিয়ামে ডাল’ দর্শনেরই জয়জয়াক্বার। কয়লা খাদানে জলও জমে, যে জল পাম্প করে আসানসোলের দু একটা অঞ্চলে, রানিগঞ্জ শহরের কিছু জায়গায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই ‘ধসা ওয়ার্ড’-এ মাটির নীচে কেবল কয়লা কিংবা আগুন। জনস্বার্থে কারচুপির জন্য প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ানদের নতুন নতুন উদ্ভাবন রীতিমতো পেটেন্টের দাবিদার হতে পারে।

গৌরীর দুই ভাই রাজু আর কিসান ছোটো বোনের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে বেশ গর্বের সঙ্গে অভিজ্ঞতা জানিয়েছিল অসিত চৌধুরীর বাড়িতে, বসার ঘরে চা খেতে খেতে তারা মাটির নীচ থেকে কয়লা কাটার ঠং ঠং শব্দ শুনতে পেয়েছে। অমন বিপজ্জনক বাড়িতে যে বোনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকতে পারে না তা বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে অসিতবাবু রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। জামাইয়ের করা সম্বন্ধ কি হেলাফেলা করা যায়। তাছাড়া ঘনঘন দিদির বাড়ি গিয়ে মাসের পর মাস থাকা নিয়ে লোকে ঠাট্টার ছলে একটু আধটু কথাও শোনাচ্ছে– দুই মেয়েকেই এক গাছতলে ফোকটে বেঁধে দিয়েছে লাখোর মা। সুতরাং অসিতবাবুর অকারণ আশঙ্কায় কান দেওয়ার মানে হয় না। বরং শাশ্বতী চৌধুরী মেয়ের বিয়েতে দেওয়া থোয়া নিয়ে কথা বলেন তার প্রিয় বান্ধবী লাখোর মায়ের সঙ্গে।

দ্বিরাগমণে ছোটো মেয়েদের আসতে দেরি দেখে লাখোর মা ঘরবার করছে। সে আজ বাবুঘরে যাবে না, সে যে লোকের বাড়ি কাজ করে তা জামাইরা জেনে ফেললেও গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। সকাল দশটা নাগাদ আসার কথা ছিল, বিকেল সাড়ে চারটে গড়াতে চলল। মিতুর মায়ের মতো মেয়েদের নিয়ে অত আতুপুতু করা লোকের বাড়ি খেটে খাওয়া মায়েদের থাকে না। কিন্তু এত দেরি? হরিয়ালি কেন, তাকে ঘণ্টাখানেক আগে দুশ্চিন্তার জন্য মুখ ঝামটা দেওয়া রাজুও উদ্বিগ্ন হয়ে টেলিফোন বুথে ছুটল।

প্রায় সাথে সাথেই দুই ভাই একত্রে ঘরে ঢুকল। কিসান হাঁপাতে হাঁপাতে খাটিয়ায় বসে পড়ল।

‘কী হইল রে? গৌরীর একটো খবর লিয়ে আসতে পাঠালম রাজুকে সিটো না কইরে ঘরকে চলে এলি যে? বুনটোর জইন্য কি টুকদু চিন্তা হয় না তুদের?’

‘মা!’ ডাকটা আর্তনাদের মতো শোনাল যেন। ‘গোরীদের বাড়িটো ধসে গেঁইনছে। দিলীপ খাদে ছিল। উঠে আইসতে পারে নাই। আর ছাদ চাপা পইড়ে গৌরী আর উয়ার শাশুড়িটোও গেঁইনছে। দোফোর থেইক্যে হাসপাতাল ডাক্টার এইসব চইলছে উয়াদের। বডি এইমাত্তর হাসপাতাল থেইক্যে ছাইড়লেক।’

লাখো উঠোনে বেড়া আর খড়ের ছাউনি দেওয়া হেঁসেলে চায়ের যোগাড় করছিল। বোন-ভগ্নীপতি আসবে বলে মাকে সাহায্য করতে কুমারডুবি থেকে দৌড়ে এসেছে। বাসনপত্র ফেলে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়ে জামাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অলীক সাব্যস্ত হওয়াতে হরিয়ালি ডুকরে উঠল, ‘হেই ভগমান, ভগমানের কেমুন বিচার গো! আমার মুখপুড়ি বিটিটোকে ছেইড়ে ভালোটাকে লিয়ে লিলেক…!’

(এই গল্পের সব চরিত্র ও নাম কাল্পনিক)

ঝিলমিল

ঝিলমিল তার বাবা, মা আর প্রতিবেশী কয়েজন বন্ধুবান্ধবের সাথে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছে। ঝিলমিল ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, তাই ধরাবাঁধা জীবনের থেকে কটা দিন মুক্তি। সবাই সহমত হয়ে জল-জঙ্গল দেখবার আকর্ষণে মেতে উঠেছে। লঞ্চের নামটাও কি সুন্দর, মালঞ্চ। টুরিস্টরা যখন ভয়ে ভয়ে পদক্ষেপ ফেলছে, ওঠানামায় সাহায্যের দরকার হচ্ছে, সেখানে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেগুলো এ-লঞ্চ ও-লঞ্চ অনায়াসেই টপকে যাচ্ছে। যেন জলেই ওদের জন্ম হয়েছে।

গদখালি থেকে যখন লঞ্চ ছাড়ল তখন চারদিক সোনা রোদে চিকচিক করছে। বিদ্যাধরীর পাড়ে পাড়ে সুন্দরী, বাইন, হেতাল আর গর্জনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে সবুজের হাতছানি। সবাই মনোনিবেশ করে আছে যদি দক্ষিণরায়কে দেখা যায় কিন্তু তাকে দেখা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। একটা বাজপাখি ছোঁ মেরে একটা মাছকে ওঠাতেই ঝিলমিল হাততালি দিয়ে বলে উঠল, আরে দ্যাখো দ্যাখো বাজপাখি এখন জেলে হয়ে গেছে।

উঁচু ক্লাসে পড়া রাহুল বিবেচকের মতো বলল, আরে ওটা ওদের খাদ্য খাদকের সম্পর্ক। মাছ খাদ্য আর বাজপাখি খাদক। ঝিলমিলের মা ঝলমলে হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ওই দ্যাখো কাকের কাণ্ড দ্যাখো। বাজপাখির নেওয়া মাছটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল! রাহুল বিজ্ঞের মতো বলল, প্রকৃতির বুকে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম চলছে।

এই সবকিছুর মাঝে টুর কোম্পানির রান্নার বউ কমলা ওদের জন্য গরম ভাতের সঙ্গে ঝুরি আলুভাজা, মুগডাল, চিকেন কষা আর টম্যাটোর চাটনি রেঁধে ফেলেছে। লঞ্চের ডেকের ওপর সুন্দর আযোজনে লাঞ্চ সারা হল। সবাইকে খাইয়ে সার্ভিস বয় মিঠুন সবার অনুরোধে নদী আর বনবিবিকে নিয়ে লোকসঙ্গীত গাইল। ওর অকৃত্রিম মেঠো সুর সবাই খুব উপভোগ করল।

পাখিরালয়ে পাখিরা হোটেলে সবার থাকার ব্যবস্থা। ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে নেমে গেল। পলিতে জল পড়ে জায়গায় জায়গায় পিচ্ছিল, ওরকম একটা রাস্তা পেরিয়ে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে ঝাঁ চকচকে একটা হোটেলে পৌঁছোনো গেল। সবার ছোটো দিব্য আর ঝিলমিল তো ঘুমিয়ে কাদা। হোটেল ম্যানেজারের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সবার মন ভরে গেল। তবে রান্নার দাযিত্ব সেই কমলা আর ওর স্বামী ফটিকের।

সন্ধেবেলায় সুন্দর সময় কাটানোর জন্য বসল বাউল-গানের আসর। চরম দারিদ্র‌্যের মধ্যে থেকেও গানের কলিতে ওরা আপ্রাণ ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে গেল। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর পূর্ণিমার আলোয় সে বাউল-গান, মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় সুরধ্বনি।

ছোট্ট দিব্য বেশ চাঙ্গা হয়ে বাউলদের নাচের দলে ভিড়ে গেল। দিব্যর বাবা ছেলের নাচের ভিডিও তুলছেন। কমলাও এসে দাঁড়িয়েছে, ওর কোলে তার আট মাসের সন্তান নয়ন। রুজির তাগিদে ওদের সপরিবারে জলে ভেসে থাকা।

রাতে কাঁকড়ার ঝোল মেখে ভাত খেতে খেতে রাহুল মস্করা করল, বুঝলে সবাই আমরা সর্বোচ্চ সারির খাদক তথা সর্বভুক। ডাল আলুভাজাও খেলাম, আবার কাঁকড়াও খাচ্ছি। সকলে এ বিষয়ে ওর সঙ্গে সহমত হল।

দিব্য আর ঝিলমিলকে তাদের মাযেরা ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে। বাইরে দরজার কাছে একটা নেড়ি আর তার বাচ্চা লেজ নেড়ে নেড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। দিব্যর বাবা কিছুটা মাখা ভাত নিয়ে নেড়িকে খাওয়াতে গেলে, দিব্য আর ঝিলমিলও খাওয়া ফেলে ছুটল। সব বাচ্চার মতো দিব্য আর ঝিলমিলও পশুপাখি ভালোবাসে।

নেড়ি ভাত খাচ্ছে, ঝিলমিলরা নেড়ির বাচ্চাকে আদর করছে। খাওয়া শেষ হতে যে যার রুমে ফিরল। শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কমলা, ফটিক, মিঠুন আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে আগুন পোহাচ্ছে। দিব্য আর ঝিলমিলের সে দৃশ্য দেখারও ইচ্ছে ছিল, মায়ের বকুনি খেয়ে ফিরতে হল।

পরদিন সকালে কুয়াশা কেটে গেলে ওদের গন্তব্য হবে সুধন্যখালি, যেখানে সাতটা নদী এসে মিশেছে। শরীরের ক্লান্তি আর পরদিন ভোর ভোর ওঠার তাড়ায় সবাই ঘুমোতে গেল।

ঝিলমিল মায়ের কোল ঘেঁষে বালিহাঁসের ডাকে চমকে চমকে উঠছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর বাবা পরেশ সেনের নাক ডাকা। মায়ের আদরের থাবড়ানিতে ঝিলমিল ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঝিলমিল জলের স্বপ্ন দেখল, সে যেন একা একটা নৌকায় কোথায় ভেসে যাচ্ছে।

 

পরদিন কুয়াশা না কাটতে মিঠুন এসে জানিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করতে হবে না, লঞ্চ সকাল দশটার আগে ছাড়বে না। অতএব সবাই বেরোল স্থানীয় বাজারে মধু কিনতে আর খেজুরের রস খেতে। সুন্দরী, বাইন আর গর্জনের ছোটো ছোটো চারাও পাওয়া যাচ্ছিল। দিব্যর খুব ইচ্ছে ওই চারাগুলো দিয়ে ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে একটা জঙ্গল বানায়। অনেক করে বোঝানোর পর একটা খেলনা বাঘ হস্তগত করে ওর বায়না থামল।

সুন্দরবনে মধুরই মাহাত্ম্য, তারল্য বেশি খাঁটি মধু। আর একে সংগ্রহ করতে গিয়ে ওদের পরিবারে কতই না বিষাদের ইতিহাস। কখনও সাপের কামড়ে, কখনও কুমীরের কবলে কখনও বা বাঘের পেটে চলে যাওয়া। অনায়াসে সবকিছু পাওয়ার জীবন ওদের নয়, বড়ো কষ্টের ওদের যাপন।

পরেশ সেনদের গোটা দলটাই ফেরিঘাটে লঞ্চে উঠল। সকালের জলখাবারে ছাতুর কচুরি আর কাবলি চানার ঘুগনি। ডেকের ওপর নদীর শোভা, লঞ্চ-জাহাজের যাতায়াত দেখতে দেখতে খাওয়া এক অনন্য অনুভূতি। দিব্য একটা কচুরি নিয়ে হাঁ করে বসে রইল। ঝিলমিলকে আজ বেশ চনমনে লাগছে, রাহুল যথারীতি প্রাজ্ঞ, অনুসন্ধিৎসু।

প্রায় দু-ঘন্টা নদীবক্ষে ভেসে থাকার পর এল দোবাঁকি। প্রত্যেকেরই আশা যদি হঠাৎ করে দক্ষিণরায়কে দেখা যায়। কারণ এখানে হোগলা আর হেতালের মাঝে একটা বড়ো পানীয় জলের জলাশয় আছে। আহা কি অপূর্ব, সেই জলাশয় ঘিরে চিতল হরিণ আর বালি হাঁস বিচরণ করছে। দিব্য হাততালি দিয়ে খুশিতে বলে উঠল, কত হরিণ, একটা বাড়ি নিয়ে যাব, পুষব!

দলের প্রধান খাদ্যরসিক মন্ডলদা বলে উঠলেন, হরিণের মাংস দারুণ স্বাদের, একসময় কত খেয়েছি। দিব্য আর ঝিলমিলের একটুও পছন্দ হল না মন্ডলকাকুর কথা। প্রাণভরে ছবি তুললেন ঝিলমিলের বাবা। অনেকগুলো লঞ্চ একসঙ্গে আসায় বেশ ভিড় জমে গেছে। শান্ত প্রকৃতি এই কোলাহলে বিরূপ হচ্ছে, তবুও সইতে হচ্ছে। একটা জিনিস ভালো লাগার মতো যে, কেউ এদিক ওদিক ময়লা ফেলছে না।

ঝিলমিল একবার জঙ্গল, একবার হরিণের দল আর নদীর দিগন্ত জোড়া বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে সবাই লঞ্চে ফিরে এল। এবারের গন্তব্য ঝড়খালি।

লঞ্চে পাঁঠার মাংস, ভাতের বিপুল আযোজন কমলার কল্যাণে। অসম্ভব সুন্দর স্বাদে সবাই পরিতৃপ্ত। দিব্য আর ঝিলমিল তাদের পছন্দের মাংসের মেটে পেয়ে গেছে, ওদের আর পায় কে!

ঝড়খালিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে বুড়ো অসুস্থ বাঘ দেখে ঝিলমিলের মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে গডের কাছে ওদের জন্য অনেক প্রে করল। কুমীর দেখে সবাই খুব খুশি হল, কারণ ওদের বেশ চনমনে লাগছিল। পাখিরালয়ে ওদের হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে গেল।

প্রতিদিনের মতো আজ ঝুমুর নাচের ব্যবস্থা। কী সুন্দর স্থানীয় মহিলারা নাচল সেই শ্রমসাধ্য নাচ! কাহিল হয়েও মুখের হাসিটুকু ধরে রাখল। দিব্য, ঝিলমিল, রাহুল, এমনকী দিব্য আর রাহুলের মা-ও নাচে অংশ নিল ওদের ডাকে। খুশি হয়ে যে যা দিল তাই নিয়ে ওরা হাসিমুখে চলে গেল।

ওরা বাড়ি ফিরবে কেউ পায়ে হেঁটে কেউ বা সাইকেলে। ঝিলমিল কমলার বাচ্চাকে কোলে তুলতে চেষ্টা করছে আর সে মায়ের কাছে থাকবে বলে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে। কমলার হাতের পারশের ঝাল খেয়ে হাত চাটতে চাটতে সব পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। সবার এই পরিতৃপ্তিটুকু কমলা উপভোগ করছে।

পরদিন সকাল নটা নাগাদ সবাই হোটেল ছাড়ল। ফিরতে হবে, তাই সবার মন খারাপ! ডেকের ওপর যে-যার মতো গল্প করছে। দূরে বকের সারি, জলের স্রোত, আকাশের ছড়ানো রোদ সবাই যেন বিদায় জানাচ্ছে। বাতাস কানে কানে বলে যাচ্ছে আবার এসো কিন্তু। বকশিশের টাকা হাতে করে কমলার চোখেও জল। দিব্য, ঝিলমিল মিঠুনের দুপাশে জমিয়ে বসে জল-জঙ্গল, রয্যাল বেঙ্গল টাইগার আর বনবিবির গল্প শুনছে।

গদখালি পৌঁছোতে প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে তাই লাঞ্চের ব্যবস্থা লঞ্চেই। কমলা ওর কচিটাকে নিয়ে ব্যস্ত রান্নায়। লঞ্চ চালাচ্ছে যে-ছেলেটা ওর চোখেমুখেও বাড়ি ফেরার ছটফটানি। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, জোয়ারের টানও ভালো আছে তাই লঞ্চ তরতরিয়ে চলেছে।

 

হঠাৎ একটা ঝুপ শব্দ। আরে ঝিলমিল পড়ে গেল যে জলে, সবার মিলিত আর্তনাদের মাঝে ‘মা মা গো আমি ডুবে যাচ্ছি’।

কমলা সেই ডাক শুনে এসে কোলের ছেলেটাকে নামিয়ে রেখে ঝাঁপ দিল জলে। সবাই আতঙ্কিত, কমলা জল তোলপাড় করে ফেলছে, হ্যাঁ হাতে একটা কিছু ঠেকল ওর, আরে এ তো ঝিলমিলের চুল। তাই ধরেই টেনে তুলল কমলা, নিজের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। হ্যাঁ কমলা পেরেছে ঝিলমিলকে জলে ডুবে যাওয়ার থেকে বাঁচাতে।

ডেকের ওপর ওঠানোর পর মিঠুন ঝিলমিলের গিলে ফেলা জল ওকে শুইয়ে চাপড় মেরে মেরে বার করল। একটু সুস্থ হতে ঝিলমিলকে গরম দুধ খাওয়ানো হল কিন্তু আতঙ্কে ও পুরোপুরি ট্রমাটাইজড। ঝিলমিলের মা এখনও কেঁদে চলেছে। ফেরার অভিজ্ঞতা সকলের জন্য ভীষণ খারাপ হল।

কমলা সকলের খাওয়ার বন্দোবস্ত করল, ও যে এত বড়ো একটা কাজ করল তা ওর মুখ দেখে এখন বোঝবার উপায় নেই। খাওয়াদাওয়া মিটলে ঝিলমিলের বাবা কমলাকে কিছু টাকা দিতে চাইলেন। কমলা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার ছেলে যদি জলে পড়ে যেত, আমি কি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না! সেরকমই তো, মাফ করবেন আমায়। এ টাকা আমি নিতে পারব না। কমলার ওপর কৃতজ্ঞতায় সবার অন্তর ভরে ওঠে।

তুমি আমার যে-উপকার করলে, তা সাত জন্মেও শোধ করতে পারব না, বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে ঝিলমিলের মা। কমলা শান্ত ভাবে বলে, এতে উপকারের কিছু নেই। আপনারা আবার এখানে বেড়াতে আসবেন আর আশীর্বাদ করুন আমার নয়নকে যেন ঠিকমতো মানুষ করতে পারি।

ঝিলমিল ওর কানে এখনও জলের গর্জন শুনছে আর কমলামাসিকে মিঠুনদার গল্পের বনবিবির মতো লাগছে, যে তাকে উদ্ধার করছে।

 

সুন্দরবনের ঘটনার পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরেশবাবু সপরিবারে অনেকবার এসেছেন সুন্দরবনে। মালঞ্চ লঞ্চটা খুঁজে পেলেও কমলাকে আর খুঁজে পাননি তাঁরা। বিশেষ করে মায়ের কাছে ওই দুর্ঘটনার বিবরণ বারবার শুনতে শুনতে কমলাকে দেবীর আসনে বসিয়ে রেখেছে ঝিলমিল। যার জন্য সে পঁচিশটা বসন্ত পার করতে পেরেছে, না হলে তো দুর্গাদোয়ানি নদীতে কবেই ওর সলিলসমাধি ঘটে যেত।

কমলামাসির মুখটা ঝিলমিলের হালকা মনে পড়ে, তার চেয়ে বেশি মনে পড়ে জলের মধ্যের সেই দমবন্ধ পরিবেশ, যা অনেক দিন ওকে তাড়া করেছিল।

ঝিলমিল এখন ডাক্তারির চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী। কত জলে ডোবা রোগী আসে। কাউকে বা আনা হয় মৃত অবস্থায়। তখন ঝিলমিল আঁতকে ওঠে! মনে মনে ভাবে তারও তো এই অবস্থা হতে পারত, হয়নি যে তা ঈশ্বরের নয় কমলামাসির দান।

ঝিলমিল ভাবে, এবারে যে করেই হোক কমলামাসিকে খুঁজে বের করতেই হবে। নিশ্চয়ই এখন বয়স হয়ে গেছে, একবার দেখা করতেই হবে। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, ঝিলমিলদি একবার আসুন ডাক্তার কনক বসু আপনাকে তাড়াতাড়ি ডাকছেন। বলেই সিস্টার বোস ছুট লাগালেন।

ঝিলমিল ডাক্তার কনক বসুকে খুঁজতে খুঁজতে এমার্জেন্সিতে হাজির হল। আরে এখানটা এত লোকে লোকারণ্য কেন? মানিকতলায় একটা মেলা চলছে, সেখানে গ্যাস বার্স্ট করে কয়েজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে তাদেরকে আনা হয়েছে ঝিলমিলের হাসপাতালে।

সেই ভিড় থেকে একজন বয়স্ক মানুষ ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে এল। তুমি ঝিলমিল দিদিমণি না, আমাকে চিনতে পারছ? আমি কমলার স্বামী ফটিক, সেই তুমি সুন্দরবন বেড়াতে এসে জলে ডুবে যাচ্ছিলে মনে আছে?

কমলামাসি কোথায়? ঝিলমিলের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল কথাটা। ফটিক ইশারায় মেঝের বিছানায় শুয়ে থাকা অর্ধদগ্ধ এক মহিলাকে দেখাল।

অগ্নিকাণ্ডে কমলা মারাত্মক জখম হয়েছে তাদের মেলায় দেওয়া চপের দোকানে। ঝিলমিল আর অপেক্ষা করেনি, চেষ্টা করে কেবিনে ভেন্টিলেশনে রেখে চিকিৎসা করছে কমলামাসির। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে ঝিলমিল, নয়নের মাকে যেন নয়নের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। যেমন করে একদিন কমলামাসি ফিরিয়ে দিয়েছিল ঝিলমিলকে তার মায়ের কোলে।

 

অগ্নিশুদ্ধি

জাতীয় স্তরে খুব বড়ো করেই এবার প্রতিযোগিতার আসর বসানো হয়েছে। গল্পের প্রতিযোগিতা। দেশের প্রায় সব রাজ্য থেকেই ছোটো-বড়ো বহু গল্প জমা পড়েছিল। তারই মধ্যে পঁচিশজন লেখককে সনাক্ত করা হয়েছে যাদের লেখা পুরস্কার পেতে চলেছে। বিশাল আয়োজন। স্টেজের উপর বেশ কিছু লেখক চেয়ারে বসে রয়েছেন। লেখকদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রঞ্জন কর্মকার। গল্পটি একটি বাচ্চাকে নিয়ে।

অনাথ একটি বাচ্চা জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে কীভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবে তাই নিয়ে গল্প। গল্পগুলি যারা সিলেক্ট করেছেন সেই বিচারকদের মধ্যেই মাধবীও একজন। তিন বছর আগে এই সংস্থাই মাধবী-কেও বেস্ট রাইটার-এর খেতাবে সম্মানিত করেছিল। মাধবী প্রথম যখন গল্পটি পড়ে, খুবই প্রভাবিত হয় কিন্তু লেখকের নাম দেখে তার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে। রঞ্জন কর্মকার… এ সে-ই লোক নয়তো! মনের মধ্যে ঝড় ওঠে মাধবীর।

স্টেজে উপস্থিত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে মাধবী জিজ্ঞেস করে, অরুণদা এই রঞ্জন কর্মকারকে আপনি চেনেন? তার কোনও ছবি দেখাতে পারবেন?

মাধবী, তুমি তো জানো প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাবার নিয়ম নেই। নয়তো সংস্থারই বদনাম হয়ে যাবে যে চেনা লোকেদেরই এরা পুরস্কার দেয়।

মাধবী লজ্জিত হল, সরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কী ব্যাপার, বলো তো?

না না, সেরকম কোনও ব্যাপার নয়, জাস্ট কৌতূহল হল বলে জিজ্ঞেস করলাম, কথোপকথন শেষ করতে মাধবী তৎপর হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরতে হবে। আজকে এখানকার সব কাজ বসে শেষ করে ফেলেছে মাধবী।

বাড়ি পৌঁছেও মনের উপর একটা ভার চেপে বসেছে অনুভব করল সে। ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারল না। অদিতি এসে জড়িয়ে ধরল মাধবীকে একটু আদর পাওয়ার আশায়। কিন্তু মাধবীর মন আজ স্মৃতির পাতা উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে বর্তমানের পটভূমিকা ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। শুধু একটা নাম, যা মনের মধ্যে সংগোপনে রাখা আগুনের ফুলকিকে উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মাধবী তো ভুলতে বসেছিল সবকিছু কিন্তু ওই একটা নাম আবার অতীতের ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে দগদগে করে দিতে চাইল। মাথা ভারী মনে হল মাধবীর, লুকোনো একটা ব্যথা বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হচ্ছিল এই তো সেদিনকার কথা, যেটা ভুলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল ও মনে মনে। না চাইতেও পুরোনো স্মৃতির পাতাগুলো একটার পর একটা খুলে যেতে লাগল চোখের সামনে।

 

দেয়াল ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠতেই মাধবী দৌড়ে জানলাটার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। লোকটা এত রাতে কোথায় কে জানে। এখন তো এটাই মাধবীর জীবনে রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত লোকটার অপেক্ষায় ঘড়িতে সময় দেখে কাটানো। অথচ লোকটার এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই।

মাধবী প্রথমে ঘড়ি দেখত, তারপর জানলা খুলে রাস্তা, যদি লোকটাকে দেখতে পায়। আজও রাস্তা ফাঁকা, বহুদূর পর্যন্ত একটা মানুষও ওর চোখে পড়ল না।

প্রায় দেড়টা বাজতে যায়, দরজায় ধাক্কা শুনে উঠে এল মাধবী। দরজা খুলতেই টলোমলো পায়ে লোকটা ভিতরে ঢুকে এল।

আজকে তুমি আবার এক গলা খেয়ে এসেছ? রাগে, দুঃখে মাধবীর চোখে জল চলে এল।

হ্যাঁ খেয়ে এসেছি। তোমার বাবার টাকায় তো খাইনি। অশ্লীল ভাষায় আরও দুটো গালমন্দ করে লোকটা থামল।

কেন এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছ?

নষ্ট করতে! পাগলের মতো হেসে উঠল বাহ্যজ্ঞানশূন্য লোকটা। জীবনটা স্বস্তি দিলই কখন? যবে থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছ, আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছে।

কেন কী এমন করেছি আমি? মাধবী জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কী চাই।

কিন্তু সেটার জন্য আমি কী করতে পারি? ক্লিনিকে গিয়ে তো নিজের চেক-আপ করিয়েছিলাম। মা হওয়ার জন্য আমি সব দিক থেকে সক্ষম। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে দুজনের চেক-আপ…

কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে, তুমি কি মনে করো আমি নপুংসক? সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার?

আমি একথা কখন বললাম? আমি খালি…

নিজেই নিজের ঝোল টানছ? বেয়াদপ মেয়েছেলে, আরও একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে।

তুমি যদি চাও আমি ঠিকমতো ব্যবহার করি তাহলে আমার যা চাহিদা সেটা পূরণ করো। পাঁচবছর আমাদের বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত বাচ্চার কান্না-হাসিতে বাড়িটার শূন্যতা ভরল না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে। আর আমি সহ্য করতে পারছি না।

তুমি চেক-আপও করাবে না আর আমাকে বাচ্চার জন্য জোরও দেবে! এটা কি আমার একার পক্ষে সম্ভব? মাধবী বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি শুধু রেজাল্ট চাই ব্যস, গলার আওয়াজ জোরালো হয়।

শোনো না, আমরা অনাথাশ্রম থেকেও তো বাচ্চা নিয়ে এসে মানুষ করতে পারি, সাহস জুটিয়ে বলে মাধবী।

কী বললে, আর একবার বলো, অনাথাশ্রমের বাচ্চা?

ক্ষতি কী?

মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। লাথি, চড়, ঘুঁসি এসে পড়ে মাধবীর উপর। এতেও লোকটার রাগ শান্ত হয় না। মাধবীর হাত ধরে টানতে টানতে দরজা খুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। পিঠে একটা লাথি মেরে মাধবীকে রাস্তায় ফেলে দেয়, আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ। যেখানে যেতে ইচ্ছে করে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। বাঁজা কোথাকার।

লোকটার মুখের এই অশ্লীল শব্দ, মাধবীর কানের মধ্যে যেন গরম তরল লোহা ঢেলে দিল। রাস্তাতেই পড়েছিল সে, হঠাৎই শরীরে উপলব্ধি করল এক দুর্জয় শক্তি। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বাঃ বাঃ খুব ভালো, ভালো লাগল নারীবাদী লেখকের মুখে এমন কথা শুনে। অথচ নিজের বাড়ির মেয়েদের প্রতি যার মনে এতটুকু সম্মান নেই। যাও যাও বাড়ির এই গল্পটাও লিখে ফেলো। তোমার দুঃখের কাহিনিটা-ও সকলকে জানাও, তবেই না তোমার জয়জয়কার হবে।

আমাদের মতো পুরুষপ্রধান দেশে মেয়েদের নিয়ে গল্পই খালি লেখা হয়। তোমার লেখাটাও আর একটা গল্প যোগ করবে। কিন্তু মনে রেখো রঞ্জন কর্মকার, সন্তানের মুখ তুমি কোনও দিনই দেখতে পাবে না। পারো তো একবার গিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নিও। হাজার বার বলব তুমি নপুংসক। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে বাড়ি থেকে কী বার করবে, আমি নিজেই এই নরকের পরিবেশ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, যেখানে তোমার মতো লোকের ছায়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।

রঞ্জন পাথরের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাধবীকে আটকাবার কোনও চেষ্টাই করে না। জনশূন্য রাস্তার নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে মাধবী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।

 

আজ চোদ্দো বছর পর ওই ফেলে আসা নামটা আবার মাধবীর চোখের সামনে অক্ষর হয়ে এসে দাঁড়াল। এতগুলো বছর মাধবীকে কম লড়াই করতে হয়নি। কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সব মনে আছে ওর, লোকের বাড়িতে কাজ করেছে পর্যন্ত। একটাই ভালো হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অরুণ বসুর আশীর্বাদধন্য হতে পেরেছে মাধবী। তাঁরই উৎসাহে এ কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা বই লিখে বেশ নাম করেছে মাধবী। অবশ্য লেখাগুলো সবই মধুমালতী ছদ্মনামে। অরুণ বসুই প্রকাশনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মাধবী যথেষ্ট জনপ্রিয় লেখিকা এখন। অর্থের কোনও অভাব আর নেই মাধবীর। নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে অনাথাশ্রম থেকে একটি শিশুকন্যাও দত্তক নিয়েছে সে। বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু রঞ্জন কর্মকারের নামটা ওর চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়ে সব কেমন এলোমেলো করে দিল। মন খালি বলছে, এটা হওয়া সম্ভব নয়। একই নামে বহু লোক আছে এই পৃথিবীতে। সুতরাং এ কিছুতেই অতীতের সেই রঞ্জন নয়।

ফোনটা বেজে উঠতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল মাধবীর। অরুণ বসুর নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ফোন তুলতেই অরুণবাবু জানালেন, লেখক সংগঠন থেকে ঠিক করা হয়েছে, রঞ্জন কর্মকারের হাতে প্রথম পুরস্কার তুলে দেওয়ার দাযিত্ব মাধবী তোমাকে নিতে হবে।

অবাক হল মাধবী, যেটাই এড়াতে চায় সেটাই আরও বেশি করে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ফোনেই মাধবী জানাল, সেদিন ওর পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু অরুণবাবু জোর দিলেন, ডাকযোগে লেখকদের জানানো হয়ে গেছে যে, মাধবী-ই সেদিন পুরস্কার দেওয়ার দাযিত্বে থাকবে।

কিন্তু এটা ঠিক করার আগে একবার আপনি কেন আমাকে জানালেন না? বিরক্তির স্বরে মাধবী জিজ্ঞেস করল।

এটা কী ধরনের কথা মাধবী! লোকে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, আর তুমি কিনা… কথার মাঝেই মাধবী বলে উঠল, সরি অরুণদা, সেদিন আমি কিছুতেই আসতে পারব না।

তার মানে আমার সম্মানটা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাও। এখন তো কার্ডগুলোও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ তখন আর আমি কী বলব?

অরুণদার গলাটা শুনে মাধবীর মনে হল, যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক সৈনিক। যুদ্ধ করার আগেই হেরে বসে আছেন। ঠিক আছে অরুণদা আমি যাব, নিশ্চিন্ত করে মাধবী।

অরুণ বসুকে মাধবী আদর্শ মনে করে চলে। বড়ো ভাইয়ের স্নেহই পেয়ে এসেছে মাধবী ওনার কাছে বরাবর। সুতরাং আজ সেই মানুষটার মনে আঘাত দেওয়ার মানসিকতা কিছুতেই হল না তার।

ঘড়িতে ঠিক সন্ধে সাতটা। লেখক ও বুদ্ধিজীবীর ভিড়ে হল গমগম করছে। আলো বন্ধ হতেই পিন পতন নিস্তব্ধতা গোটা প্রেক্ষাগৃহে। স্টেজের উপরে মাইকে অরুণ বসু ঘোষণা করলেন, প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে লেখক রঞ্জন কর্মকারকে। দয়া করে স্টেজে এসে আসন গ্রহণ করুন।

মাধবী তৈরিই ছিল। স্টেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা ব্যক্তিটিকে দেখে মাধবী পাথর হয়ে গেল। রঞ্জনও এক ঝলক মাধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। এত বছর ধরে যে-মুহূর্তটাকে মাধবী ভুলে যেতে চেয়েছে, এড়িয়ে এসেছে, আজ সেই মুহূর্তটাই এক বুক কষ্টর ঝাঁপি খুলে মাধবীর মনটাকে তাতে ডুবিয়ে দিল।

এতগুলো বছর ধরে রঞ্জনও ভেবে এসেছে, মাধবী ওর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। গুম হয়ে গেছে, যেখান থেকে সভ্য সমাজে ফিরে আসা আর কখনও সম্ভব নয়। অথচ, অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই মাধবী ওরফে মধুমালতী-র হাত থেকেই তাকে আজ পুরস্কার গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর থেকে নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?

মাধবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রঞ্জনের অহংকার, ভাঙা কাচের মতো গুঁড়ো হয়ে রঞ্জনকেই বিদ্ধ করল। মাধবী অরুণদার হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে রঞ্জনের হাতে ধরাল। রঞ্জনও কলের পুতুলের মতো পুরস্কার গ্রহণ করে, কোনও রকমে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে, স্টেজে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। দেখে যে-কেউই ভাবতে পারে রঞ্জন কর্মকারকে সম্মানিত করার বদলে জুতোপেটা করা হয়েছে।

এরপর ধীরে ধীরে অন্য লেখকদের পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ হতেই অরুণদাকে বলে হল ছেড়ে বেরিয়ে এল মাধবী। অন্য আরও অনুষ্ঠানগুলো দেখার মতো মানসিকতা ছিল না তার। গাড়ি বাইরেই রাখা ছিল। গাড়িতে উঠে বসল মাধবী।

 

বাড়িতে ঢুকতেই মাধবীর মনে হল একটু কাঁদতে পারলে হয়তো বুকের উপর চেপে বসে থাকা বোঝাটা হালকা হতো। কিন্তু একফোঁটা জলও চোখ দিয়ে বেরোল না। গলার কাছটায় শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে মাধবীর ঘোর কাটল।

কে? চোখের জল মুছে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল মাধবী কে এসেছে দেখতে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনকে দেখে ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে উঠল ওর।

তুমি কেন এসেছ এখানে? জানলা দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল মাধবী।

আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মাধবী।

মাধবী? কে মাধবী? চোদ্দো বছর আগে মাধবী মারা গেছে। আমার নাম মালতী, মধুমালতী। আমি তোমাকে চিনি না, চলে যাও এখান থেকে। শেষের দিকে মাধবীর গলার স্বর বেশ জোরালো শোনালো।

চলে যাব, শুধু একবার বলে দাও যে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রঞ্জন বন্ধ দরজার সামনে, গলায় কাকুতি।

বললাম তো আমি তোমাকে চিনি না। ভালোয় ভালোয় চলে যাও নয়তো চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, বলে জানলা বন্ধ করে দেয় মাধবী।

বহুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই, মাধবীর মনে হল রঞ্জন নিশ্চয়ই চলে গেছে। ভালোই হয়েছে। ওর সঙ্গে যখন কোনও সম্পর্কই নেই, তখন ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠছে কোথা থেকে। আমার জীবন নরক করে তুলে আজ আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে!

হঠাৎ-ই নিজের মনেই ধিক্কার অনুভব করল মাধবী। ভিতর থেকে নিজের বিবেকই প্রশ্ন তুলল, বাহ! মালতী এখন তুমি মাধবী থেকে মধুমালতী হয়েছ, নাম বদলে ফেলেছ জনপ্রিয়তা পেয়ে, কিন্তু স্ত্রীধর্ম? তুমি যদি ওকে চেনো না, তাহলে কার জন্য হাতে লোহা, মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ানো? হাতের লোহা খুলে ফেলে দাও, মাথার সিঁদুর মুছে ফেলো। রঞ্জন কর্মকারের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই বন্ধন আজও কেন বয়ে বেড়াচ্ছ? না মাধবী তুমি এসব কিছুই করতে পারবে না। উপরে উপরে যাই তুমি বলো না কেন, তোমার মন কি কখনও ওকে ভুলতে পেরেছে? না পারেনি। তোমার লেখায় এত দরদ কোথা থেকে আসে? জীবন দিয়ে তুমি উপলব্ধি করেছ বলেই না!

চুপ করো, আমি কিছু শুনতে চাই না, হঠাৎই নিজে নিজেই চেঁচিয়ে ওঠে মাধবী।

মাধবীর গলা শুনে অদিতি জেগে যায়। কোনও ভাবে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয় মেয়েকে কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারে না মাধবী। পুরোনো ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে চোখের সামনে আসতে থাকে।

রাত প্রায় একটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাধবী ঘুমোবার চেষ্টা করে। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ওর কেটে যায়। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না কিন্তু এক নাগাড়ে বাজতে থাকায় বাধ্য হয়ে উঠে আসে মাধবী।

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি অরুণ বলছি, শান্ত আওয়াজ ভেসে আসে ওপার থেকে।

এত রাতে অরুণদা… সব ঠিক আছে তো? চিন্তিত হয় মাধবী।

আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার সত্যি উত্তর দেবে? তুমি কি রঞ্জন… মানে রঞ্জন কর্মকারকে চেনো?

চমকে ওঠে মাধবী কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হঠাৎ এত রাতে ফোন করে এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আগে উত্তর দাও তুমি ওকে চেনো কি চেনো না?

হ্যাঁ, একসময় আমার স্বামী ছিলেন। ছিলেন শব্দটার উপর বিশেষ জোর দেয় মাধবী।

মাধবী, ছিলেন নয় আজও তিনি তোমার স্বামী কারণ তোমাদের ডিভোর্স হয়নি।

কিন্তু অরুণদা কী ব্যাপার বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মাধবী।

হয়তো রঞ্জন আর বাঁচবে না। কাল যখন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল, তুমি দরজা খুলে না দেওয়াতে ও অনেক্ষণ ওখানেই বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল তুমি দরজা খুলবে। বহুক্ষণ পরে সব আশা ত্যাগ করে ও যখন ওখান থেকে উঠে পড়ে রাস্তায় পা বাড়ায়, তখনও হয়তো মনে ক্ষীণ আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল যে দরজা খুলে তুমি নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। পিছন ফিরে সেটাই দেখতে গিয়ে একটা চলন্ত ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা মারে। হাসপাতালে ও এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ও একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কী করে? চোখের জল সামলাতে সামলাতে মাধবী প্রশ্ন করে।

প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর তুমি যখন হঠাৎ অনুষ্ঠান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে, রঞ্জনও তোমার পিছনে পিছনে দৌড়োল। আমার একটু সন্দেহ হয় কারণ যখনই এই নামটা তোমার সামনে আসে, তুমি কীরকম যেন অস্থির হয়ে ওঠো। আমিও বেরিয়ে আসি হল ছেড়ে আর তোমাদের পিছু নিই। তোমাদের বাড়ির কাছে এসেই রঞ্জন ট্যাক্সি ছেড়ে দেয় কিন্তু ততক্ষণে তুমি বাড়ি ঢুকে গেছ। আমিও একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকি। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ট্রাকটা ওকে ধাক্কা মারে। আমারও কিছু করার ছিল না। ওকে তুলে হাসপাতাল নিয়ে আসি। ডাক্তাররা আশা দিতে পারছেন না।

অরুণদা, আমি এখুনি আসছি, রিসিভার নামিয়ে রাখে মাধবী।

মাথার সিঁদুরের উপর চোখ যায় মাধবীর। মলিন সিঁদুরের রেখাটা খুব কষ্ট করে চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হয়ে গাড়িতে এসে বসে। হাসপাতালের দিকে গাড়ি ঘোরায় মাধবী।

মা এত রাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি? অদিতি জিজ্ঞেস করে।

তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

মিথ্যা কথা, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমিই তো এতদিন বলেছ, আমার বাবা কোথাও হারিয়ে গেছে, চেঁচিয়ে ওঠে অদিতি।

হ্যাঁ বলতাম কিন্তু আজই হঠাৎ ওনার খোঁজ পাওয়া গেছে।

তাহলে এখন থেকে বাবা কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

হয়তো।

তাহলে তো খুব মজা হবে, অদিতি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

অদিতি, এখন একটু চুপ করো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

হাসপাতালে পৌঁছতেই গাড়ি রেখে রিসেপশনেই অরুণদার দেখা পেল মাধবী। মাধবীদের নিয়ে রঞ্জনের বেড-এর সামনে দাঁড়াতেই চোখ খুলে চাইল ও। এসে গেছ। তোমারই আসার প্রতীক্ষা করছিলাম। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে রঞ্জনকে। মাধবীদের ঘরে রেখে অরুণ বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

রক্তাক্ত শরীরটাকে কোনও ভাবে টেনে তুলে রঞ্জন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাধবী জোর করে ওকে শুইয়ে দিল।

এ কী হাল করছে শরীরের? কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করে মাধবী।

সবই আমার কর্মদোষ! আমি তোমার উপর যে-অত্যাচার করেছি, আজ তারই ফল আমাকে ভুগতে হচ্ছে। আমার এই নিয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ নেই। আর তো কিছুক্ষণের অতিথি আমি। আমার শেষ ইচ্ছা, যেন তোমার সামনেই এই পাপে ভরা প্রাণটা ত্যাগ করতে পারি।

মাধবী রঞ্জনের হাত দুটো নিজের মুঠিতে তুলে নেয়, তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি তোমাকে বাঁচাব।

আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। হঠাৎ অদিতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই ইশারায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জন, এটি তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, দত্তক নিয়েছি।

ভালো করেছ মাধবী, নয়তো আমার চিতায় কে আগুন দিত? সারা জীবন এই একটাই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে যে, মৃত্যুর পর আমার কী হবে? কিন্তু এখন আর কোনও চিন্তা নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব, বলে রঞ্জন অদিতিকে স্নেহের স্পর্শে কাছে টেনে নেয়।

 

কী শান্তি! এই শান্তি আগে তো কোনও দিন অনুভব করেনি রঞ্জন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কে আপন কে পর তার হিসেব কে রাখে? আর তো কিছু মুহূর্ত…

যদি রঞ্জন সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে আজ আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আ.., মুখের কথা মুখেই থেকে যায় মাধবীর। গলা শুকিয়ে ওঠে। রুদ্ধ হয়ে আসে স্বর।

আমি তোমাকে কখনও হেয় করতে চাইনি মাধবী। কিন্তু কী যে পশু ভর করেছিল আমার মাথায়! সময়, কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিয়েছে আমার পাপের! এমন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বেরোবার শক্তি আমি জোটাতে পারিনি। তবুও বলব আজ আমি খুব খুশি। মৃত্যুর সময তো আমি তোমাকে কাছে পেলাম। আমার লেখায় আদর্শের ছড়াছড়ি কিন্তু বাস্তবে নিজের জীবনে আদর্শকে কোনও ঠাঁই দিইনি। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে যদি সুখী রাখতে পারতাম। আমি সত্যিই লজ্জিত মাধবী, ক্ষমা কোরো আমাকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মাধবী।

মাধবী কিছু বলার আগেই রঞ্জনের মাথা একপাশে হেলে পড়ল। মাধবী কাছে আসতেই বুঝতে পারল রঞ্জনের যাবতীয় কষ্টের অবসান ঘটেছে।

পরের দিন হাজারো সাহিত্যকারের ভিড়ে অদিতি, রঞ্জনের মুখাগ্নি করল। মাধবী অপলক দৃষ্টিতে চিতার আগুনের দিকে তাকাতেই মনে হল, আগুনের শিখার ভিতর থেকে রঞ্জনের হাসিমাথা মুখটা যেন মূর্ত হয়ে উঠছে। মাধবীকে বলছে, তুমি আমার শেষইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছ, যেটা এতগুলো বছর ধরে আমার গলায় ফাঁসের মতো আটকে ছিল, আমার অসম্পূর্ণ গল্প আজ সম্পূর্ণ হল মাধবী। এখন আমি নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছি।

মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুও জোর করে মুছে নিল। আর কান্না নয়, অদিতির জন্য বাকিটা জীবন তাকে হাসি মুখেই কাটাতে হবে।

 

নাম জানা হয়নি

একদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতা আর অন্যদিকে মাউন্ট ফুজির গগনচুম্বী বরফঢাকা শিখর। দু’পাশে প্রকৃতির সবুজ গালিচাকে সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে শিনকানসেন– জাপানি বুলেট ট্রেন। অসম্ভব গতির জন্য জানলার বাইরের সমস্ত দৃশ্যই যেন ঘষা ছবি। যেন একটা সদ্য জলরং করা ছবি অনবরত কেউ ঘেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইল না সার্থকের।

সংরক্ষিত আসনের বিলাসী ব্যাকরেস্ট পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, সে তার ক্লান্ত চোখদুটি বন্ধ করল। একটু-একটু তন্দ্রা মাঝেমধ্যে তাকে আচ্ছন্ন করে যাচ্ছে। খানিকটা তার অজান্তে আর খানিকটা সচেতনে তার মন বুলেটের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে অতীতে। মুহূর্তে আশেপাশের রঙিন প্রকৃতি চোখের সামনে থেকে উধাও। তার বদলে ফিরে এল অন্য সময়, অন্য পরিপ্রেক্ষিত।

বছরখানেক আগে সেই মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট দেখে এসে আর একমুহূর্তও খামোখা নষ্ট করতে চায়নি সার্থক। বাবা রাগারাগি করেছিলেন। মা কেঁদেকেটে একশা হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই টলানো যায়নি সার্থককে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলেছিল আগেই। সম্ভবত তার ছেলেবয়সেই। বাবা বলেছিলেন, ‘পড়াশোনা করতে না চাস তো সমবায় থেকে লোন নিয়ে ছোটোখাটো একটা দোকান করে দিচ্ছি। তিনটে তো পেট

সংসারে। ঠিক চলে যাবে–!’

সার্থক বাবাকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেনি। গররাজি মুখ করে চুপ করে গিয়েছিল। বাবা এই মফসসল শহরে বসে কী করেই বা বুঝবেন, তাঁর সীমাবদ্ধ ভাবনা আর সার্থকের লাগামবিহীন স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব কত যোজন! ছোটোবেলা থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে বিদেশে তাকে যেতেই হবে। উন্নতির একমাত্র ঠিকানাই বিদেশ।

অনেক আগে এ কথাটা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাদেরই পাড়ার ছেলে সুধন্য। বছরতিনেক আগে কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে সেও কেটে পড়ল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে ফোন করত। আইএসডি। সেই উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীকালে বজায় থাকেনি। কিন্তু সুধন্যর কথাগুলো মনে আছে সার্থকের। সুধন্য গল্প করেছিল, কীভাবে জাহাজের খালাসি হয়ে একজন পৌঁছে গিয়েছিল আমেরিকাতে। এখনও কত লোক প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়! তাদের বেশিরভাগের আবার ভিসা-পাসপোর্ট কিছুই নেই।

সেইদিন থেকে সার্থক একটাই লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বেসরকারি অফিসের অল্প মাইনের কেরানি তার বাবা। সামান্য মাইনেয় তিনজনের পরিবার টানতেই তাঁর প্রাণান্ত দশা হয়। সে তো চোখের সামনে দেখেছে, দিনের পর দিন কত কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে! একটা ছোটো সাইজের জামাকে অনেক বড়োসড়ো বপুতে গলানোর চেষ্টা করতে করতেই জীবন কেটে গেল বাবার। একই ভবিতব্য তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে, এ কথা ভাবতে গেলেই সে শিউরে ওঠে। বিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরেই সে যেন মরিয়া হয়ে উঠল।

সার্থককে বুঝিয়ে যখন হার মানলেন মা, খুব উদ্বিগ্ন আর হতাশ গলায় জানতে চাইলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে কী করবি?’

‘প্রথমে একটা চাকরির চেষ্টা করব।’

‘মেসে কষ্ট করে থাকতে পারবি তো বাবা?’ মা চোখের জল মোছেন আঁচলে।

‘নিশ্চয়ই পারব। কেন পারব না?’ সার্থক কঠিন গলায় বলে।

বৈশাখের কড়া রোদেলা শহর। সারাদিন ব্যস্ত মানুষ রাস্তা পারাপার করে। পথে কাটাকুটি খেলে অসংখ্য বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-রিকশা। সবাই যে কলকাতার, তা তো নয়। আশেপাশের জেলাশহর থেকেও প্রতিদিন কত মানুষ আসছে ক্ষুধার অন্ন জোটাতে।

একটা চলনসই গোছের চাকরি জুটে গেল অল্পদিনেই। এক ছোটোখাটো কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ। মাইনে সামান্য। কিন্তু ঘুরে বেড়িয়ে শহরটাকে আবিষ্কারের নেশাটা পেয়ে বসল তাকে অচিরেই।

এমনই একদিন সে বসে ছিল জাপান দূতাবাসের উলটো দিকে ফুটপাথের এক চায়ের দোকানে। দুপুর রোদে একটু ছায়া উপভোগ করছিল। গ্রীষ্মের দুপুর বলেই শহরটা একটু নিস্তরঙ্গ, নিস্তেজ। জাপান দূতাবাসের মূল দরজা পেরিয়ে ছোটোখাটো চেহারার এক জাপানি মহিলাকে সে অলস চোখে রাস্তা পেরোতে দেখল। জাপানি মেয়েদের গায়ের রং পার্ক স্ট্রিটে দেখা ফরাসি কিংবা বেলজিয়ান মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লালচে ফরসা এবং ত্বকও অনেক বেশি মসৃণ।

মেয়েটি রাস্তা পেরিয়ে এসে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াতে, সার্থক আন্দাজ করল মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে। হয়তো এই প্রথমবার কলকাতায় এসেছে। চোখমুখের উৎকণ্ঠিত ভাব সে কথাই বলছে। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে সে বোধকরি ফাঁকা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

মেয়েটি কি ইংরেজি বোঝে? সার্থক থেমে থেমে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কি বুঝবে মেয়েটির ভাষা? কিংবা মেয়েটি তার? অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে বিদেশবিভুঁইয়ে, অপরিচিত পরিবেশে সে যেন খানিকটা হতচকিত, থতোমতো!

তার চা খাওয়া হয়ে গেছিল। সঙ্গে প্রজাপতি বিস্কুট।

চা-ওয়ালাকে দাম মিটিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে সে থমকে তাকাল। মেয়েটি তেমনই বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ইতস্তত পায়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই হেলপ ইউ?… আপনি কি ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ?’

মেয়েটি স্মিত হেসে নাতিদীর্ঘ গ্রীবা হেলাল, অর্থাৎ, জানে।

সার্থক আশ্বস্ত হয়ে জানতে চাইল, ‘কোনও সাহায্য করতে পারি?’

‘আসলে, কাল রাতেই আমি কলকাতায় এসেছি। কাল সকালের ফ্লাইটে জয়পুর চলে যাব। ভাবছি যতটা সময় পাচ্ছি, তার মধ্যে শহরটাকে একটু দেখে নেব। শুনেছি, কলকাতা ইজ আ বিউটিফুল সিটি। অনেক কিছু দেখার আছে–!’

এ’কদিনের শহরবাসে কলকাতা শহরটাকে পায়ে হেঁটে ভালোই চিনে ফেলেছে সার্থক। তার পেশাটাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করেছে।

সে তাই বলল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, অ্যান্ড ফিল কমফর্টেব্ল, আমি কিন্তু শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি আপনাকে–!’

মুহূর্তের জন্য জাপানি তন্বী চুপ করে রইল। স্বাভাবিক, যে এ শহরটাকে চেনেই না, সংস্কৃতিটাকে জানেই না, সে কীভাবে তক্ষুনি এক অপরিচিত পুরুষের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেয়! তার পক্ষে সহজ নয় ব্যাপারটা।

মেয়েটির হ্যাঁ ও না-এর সম্ভাবনার দোলায় খানিকক্ষণ দুলল সার্থক নিজেও। অনেক সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসেছে সে, প্রত্যাখ্যানে মন ভেঙে যাবে তার। হঠাৎ-ই মেয়েটি বলল, ‘শিয়োর। কিন্তু আপনি সব জায়গা চেনেন তো?’

হ্যাঁ-বাচক ঘাড় নেড়ে একটা চলতি ট্যাক্সিকে থামাল সার্থক। শিভালরি দেখিয়ে পিছনের দরজা খুলে ধরল জাপানি মেয়েটির জন্য। নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে।

শহরের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লালদিঘি, যাদুঘর, সিটি সেন্টার…। জাপানি তরুণী অবাক চোখে দেখছিল। প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা উপভোগ করছিল। হুইলার স্টল থেকে একগোছা গোলাপি ক্যান্ডিফ্লস কিনে সেটি কী করে খেতে হয়, শিখিয়ে দিল সার্থককে। সার্থক অবশ্য জানত। ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ নামে এ জিনিসটাই ফেরিওয়ালার কাঁধে চেপে প্রায়ই আসত তাদের মফসসল শহরে। এখন সেই জিনিসটাই জাপানি মেয়ের মসৃণ, চকচকে গোলাপি ঠোঁটে মিশে যাচ্ছে।

জাপানি যুবতির সান্নিধ্য খুবই ভালো লাগছিল সার্থকের। কিন্তু দেখতে দেখতে দিনটা ফুরিয়ে এল। খিদে পেয়েছিল ওদের। জাপানি কন্যে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার খিদে পায়নি সার্থক?’

সার্থক সলজ্জে বলল, ‘হুঁ।’ কাউকে খিদের কথা জানাতে তার ভারি লজ্জা হয়। ছোটোবেলার অভ্যেস।

যুবতি বলল, ‘তাহলে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় চলো–!’

সার্থক ওর চেনা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল। এর আগে মাত্র একবারই এসেছে। সেই অর্থে চেনা নয়। তবে জানে, এটা তার পকেট এবং মধ্যবিত্ত ম্যানারের মাপেমাপে। আরও বড়ো রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাহস পেল না সার্থক।

জাপানি তরুণী যে-কোনও বিষয়েই তার উপর বড়ো নির্ভরশীল। সার্থকের সব কথাতেই তার হ্যাঁ। খাওয়াদাওয়ার পরে রাস্তায় এসে তার কী মনে হল, জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, সার্থক, তোমাদের শহরে কোনও নদী নেই?’

‘আছে তো। গঙ্গা। বিশাল নদী।’

‘নদীতে নৌকো চলে?’

‘চলে।’

‘আমায় নিয়ে যাবে?’

শহরের গঙ্গায় শেষ লঞ্চ অনেক আগেই চলে গেছে। যে-কটি আলো জ্বলছে বাতিস্তম্ভে, তাতে অন্ধকারটাই যেন আরও গাঢ় হয়েছে। কেবল কালো গঙ্গার বুক ভেসে যাচ্ছে হলুদ জ্যোৎস্নায়। ইতিউতি কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছায়ার মতো পরস্পরের লগ্ন হয়ে আছে। দূরে কয়েকটি নৌকো দেখা যায়। হ্যারিকেনের ম্লান আলো তাদের প্রায়-অনস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলছে।

সেদিকে আঙুল দেখিয়ে যুবতি বলল, ‘সার্থক, ওই নৌকোগুলোয় চড়া যায়?’

মুখের কাছে দু’হাতের তালু জড়ো করে সার্থক ডাক দিল, ‘মাঝিভাই, ও মাঝিভাই, নেবে নাকি?’

খানিক পরে নৌকো ঘাটে লাগলে, ওরা উঠে বসল ছইয়ের ভিতর। মাঝির হাতে দাঁড়ের প্রথম টানে দুলে উঠল নৌকো। আর, যুবতির শরীরও যেন টলে পড়ল সার্থকের গায়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল বিদেশিনি। সার্থকের একটি হাত নিজের হাতে বন্দি করে আনমনা গলায় বলে উঠল, ‘আমি অনেক দেশে ঘুরেছি সার্থক। দেশে দেশে কত বন্ধু হয়েছে। কিন্তু তারা একজনও তোমার মতো নয়। তোমার শহর থেকে অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি।’

বুক ভর্তি করে খোলা হাওয়া নিল তরুণী। সার্থকের হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলল, ‘জাপানে চলে আসছ না কেন? ওখানে অনেক সুযোগ। যদি আসতে চাও, আমায় জানিয়ো। কাল সকাল পৌনে নটায় আমার ফ্লাইট। সাতটা নাগাদ একবার হোটেলে এসো। আমার কার্ডটা তোমায় দিয়ে দেব।’

মিষ্টি হাওয়া বইছে। নৌকো কি এখন মাঝগঙ্গায়? ঘাট দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। মেয়েটি গুনগুন করে কোনও জাপানি সুর গাইছে। সুরটা অনেকটা ভাটিয়ালির মতোই। যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়। আশ্চর্য তৃপ্ত আর ভরাট লাগছে মেয়েটির মুখ। সে যেন সার্থকের ভালোবাসায় লীন হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটির মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সার্থক অস্ফুটে বলল, ‘মাঝিকে ঘাটে নৌকো ভেড়াতে বলি? অনেক রাত হল।’

মেয়েটিও যেন তন্দ্রা ভেঙে উঠে বসল। হোটেলে তাকে পৌঁছে দিল সার্থক। বিদায়ের মুহূর্তে হাত নেড়ে সে বলল, ‘কাল সকালে দেখা হচ্ছে।’

রাস্তায় নেমে সার্থকের মনে পড়ল, মেয়েটির নাম-ই জানা হয়নি। সে পিছন ফিরে ডাকবে তাকে, ভাবল। কিন্তু মেয়েটি চলে গেছে। তাকে আর দেখতে পেল না সার্থক।

অনেক রাতে সার্থক ফিরে এল মেসে। খাওয়াদাওয়ার পাট ছিল না। কেন-না রেস্তোরাঁয় খেয়ে তখনও পেট ভর্তি। সে সরাসরি বিছানায় শরীর ছুড়ে দিল। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, তবু তার ঘুম এল না। সন্ধের সুখস্মৃতি তাকে ঘুমোতে দিল না। রোমন্থনে জাগিয়ে রাখল। মনে হল, তার হাতটি যেন এখনও নিজের উষ্ণ করতলে ধরে রেখেছে সেই বিদেশিনি, যার নাম সে জানে না। ইস, কী ভুলটাই না সে করেছে! সার্থক ভাবে।

ঘুম না আসার অবশ্য আরও এক কারণ ছিল। সেটা তার উদ্বেগজনিত। ভোরবেলা উঠতে হবে। না উঠতে পারলে, হোটেলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যেতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্কতায় অনেকসময় ভুল হয়ে যায় বেশি।

কখন তার চোখদুটো লেগে এসেছে সার্থক জানে না। ধড়ফড় করে জেগে উঠে, বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটায় দেখল, আটটা বাজে। হোটেলে গিয়ে এখন জাপানি যুবতিকে দেখতে পাওয়া একরকম দুরাশাই। পৌনে নটায় তার ফ্লাইট, সার্থক জানে। তবু, বড়ো আশায় বুক বেঁধে সে হোটেলের দিকে রওনা দিল।

সকালে হোটেলে তেমন ব্যস্ততা নেই। হাতেগোনা কয়েকজন চেক আউট করা বোর্ডার, বাক্স-ব্যাগ নিয়ে বড়ো দরজার কাছে অপেক্ষা করছে ট্যাক্সির জন্য।

রিসেপশনের সদ্য ঘুমভাঙা ডাগর চোখমুখের মেয়েটি বলল, ‘কাল সন্ধেয় আপনি যাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে, তার কথা জানতে চাইছেন তো? উনি তো অনেকক্ষণ চেক আউট করে গেছেন। বোধহয় আপনার জন্যই লবিতে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। কেন-না, ওর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছিল, কাউকে খুঁজছেন। তারপর চলে গেলেন।’

সার্থকের বুকের মধ্যেটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল। সব হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থাকল তাকে। তার সব আশা যেন ভেঙে গেছে। সব ভাবনা যেন মিশে গেছে ধুলোয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকেই তার মধ্যে আর-এক ধরনের শক্তিপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে, টের পেল সার্থক। সেই শক্তি তাকে বেঁধে দিল এক কঠিন অঙ্গীকারের রজ্জুতে। একদিন নিশ্চয়ই সে তাকে খুঁজে বের করতে পারবে।

সামান্য হোঁচট খেয়ে শিনকানসেন থেমে যেতে, ভাবনার গতিপথেও বাধা পড়ল। ট্রেনের স্বচ্ছ কাচের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল সার্থক। নিরিবিলি স্টেশন। দু-চারজন মানুষ চলাফেরা করছে। একটা বোর্ড আছে বটে, কিন্তু জাপানি ভাষায় লেখা বলে, স্টেশনের নামটা পড়তে পারল না সার্থক। পাশের সিটের প্রৌঢ় সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে সার্থক জানতে পারল, স্টেশনের নাম হমামাতসুচো। একটা হাঁফ ছাড়ল সে। তার মানে, অর্ধেক পথ আসা গেছে এতক্ষণে। এবার সে স্টেশনটিকেই একটু ভালো করে ঠাহর করে দেখতে থাকল। ভারতের যে-কোনও স্টেশনের থেকে কত ফারাক! কোনও চ্যাঁচামেচি নেই, ব্যস্ততাও কত ব্যক্তিগত ও নীরব, প্ল্যাটফর্মটা এতই সাফসুতরো যে, জুতো পরে হাঁটতে সংকোচ হয়।

ট্রেন সামান্য সময়ের জন্য থেমেছিল। কিছু যাত্রী নেমে গেল, আবার অনেকে উঠল। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ধাক্বাধাক্বি নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আবার তীব্র গতিতে ছুট লাগাল। অমনি বাইরের যাবতীয় ছবি ঘেঁটে একশা। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সার্থক। এত গতি তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।

সার্থকের আবার মনে পড়তে থাকল, জাপানি যুবতির সেই পর্বটি মিটলে, সেলসম্যানের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সার্থক। পরিশ্রম আর উপার্জনে সামঞ্জস্য হচ্ছিল না কিছুতেই। এবার সে চাকরি নিল শহরের এক নামি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। মাইনে ভালোই, উপরন্তু দুপুরে ও রাতে খাওয়াটা ফ্রি। পেটের চিন্তা অনেকটা মিটল। কিন্তু তবু যেন কীসের অমোঘ টানে সে এখনও মাঝেমধ্যেই নিয়ম করে জাপানি দূতাবাসের উলটোদিকের ফুটপাথে, গাছতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ দোকানিটি মরে গেছে। এখন তার ছেলে চা বানায়। তাগড়া যুবক।

রেস্তোরাঁর কাজে ছুটিছাটা কম। সন্ধেগুলোতেই ভিড় বেশি। তার উপর সাধারণ ছুটির দিনেও খদ্দেরদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কেবল দুপুরটায় কাজের চাপ একটু কম থাকে। তখন রসুইঘরে খাবার তৈরির আগের পর্যায়ের কাজ চলে।

এই সময়টাতেই মাঝেমধ্যে ফুটপাথের সেই চায়ের দোকানে চলে আসে সার্থক। এক কাপ চা নিয়ে একঘণ্টা বসে থাকে। সঙ্গে দুটো প্রজাপতি বিস্কুট।

একদিন একটা কাণ্ড ঘটল।

দুপুরে রাস্তা এমনিতে ফাঁকাই থাকে। একটা অটোরিকশা তীব্র বেগে এগিয়ে এসে, ঠিক চায়ের দোকানের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক জাপানি যুবক নেমে জিন্সের পিছনের পকেট থেকে পার্স বের করে ভাড়া মেটালেন। তারপর পার্সটিকে আবার পিছনের পকেটে চালান করে দিয়ে, দূতাবাসের দিকে হাঁটা দিলেন। দেখে মনে হল যুবকের খুব তাড়া।

অলস চোখে তাকে লক্ষ করছিল সার্থক। এও তার চোখে পড়ল, তাড়াহুড়োয় পার্সটি যুবকের জিন্সের পকেটে না ঢুকে সশব্দে পড়ল রাস্তায়। ব্যস্ততায় যুবক তা খেয়াল করল না। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সার্থক যে তাকে ডেকে উঠল, সেটাও কানে গেল না তার। লম্বা পা ফেলে, সে দূতাবাসের অন্দরে সেঁধিয়ে গেল।

রাস্তা থেকে পার্সটা কুড়িয়ে আনল সার্থক। খুলে দেখল তাতে একগোছা দুই হাজার টাকার নোট। এত টাকা কোনওদিনও একসাথে দেখেনি সে। হাত কাঁপছে তার। কাউকে বলতেও পারছে না। পার্সটা বন্ধ করে, দুহাতের করতলে শক্ত করে ধরে রেখে সে ভাবতে থাকল, এখন কী করণীয়!

একঝলক দেখে সার্থকের মনে হয়েছে, অন্তত পঞ্চাশটা দু’হাজার টাকার নোট রয়েছে সেই গোছায়। মুহূর্তের জন্য চকচক করে উঠল তার চোখদুটো। এই টাকাগুলো বাবা পেলে, বাড়ির অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ করে ফেলত। রান্নাঘরটা মেরামত করত। ছাদের যে-জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়ে, সারাত সেগুলোও। মাকে কয়েকটা নতুন শাড়িও হয়তো কিনে দিত। আর স্যাকরার দোকানে মায়ের কানের যে দুলটা বাঁধা রেখে টাকা নিতে হয়েছিল সেবার মায়ের অসুস্থতার সময়, সেটাও হয়তো ছাড়িয়ে আনত।

পার্সটা একবার খুলল সার্থক। একগোছা কাগজের টুকরো। অথচ কী অসীম ক্ষমতা তাদের। পরমুহূর্তেই পার্স বন্ধ করে সে নিজের মনেই বলল, ছি। সে এসব কী ভাবছে?

তখনই উদ্ভ্রান্তের মতো সেই জাপানি যুবককেও রাস্তা পেরিয়ে এপাশে আসতে দেখা গেল। তার চেহারা ইতিমধ্যেই বেশ পালটেছে। চুল এলোমেলো। চোখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। কিছু খুঁজছে যেন।

সার্থক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যুবকের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আই হ্যাভ ইয়োর ওয়ালেট। ইউ ড্রপ্ড ইট হিয়ার।’

যুবকটি সার্থকের হাত থেকে খপ করে পার্সটি কেড়ে নিয়ে ভিতরটা আঁতিপাঁতি করে দেখল। তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঠায় সার্থকের দিকে।

সার্থক ম্লান হাসল। যুবক নিজের অভিভূত ভাবটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আই অ্যাম ভেরি মাচ ইমপ্রেসড। মে আই ডু সামথিং ফর ইউ?’

সার্থক যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষা করছিল এই প্রশ্নটার জন্য! উত্তরটা সাজানোই ছিল জিভের ডগায়, এমনভাবে সে বলে ফেলল, ‘আমি আপনার দেশে যেতে চাই। শুনেছি ওখানে কেরিয়ার তৈরির অনেক সুযোগ–!’

জাপানি যুবক হঠাৎ কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর সার্থকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁ আছে? আমার খুব খিদে পেয়েছে!’

কাছাকাছি সত্যিই একটা রেস্তোরাঁ আছে, জানে সার্থক। যুবকটি নিজেই অর্ডার করল। সার্থকের যদিও খিদে ছিল না, তবু অল্পস্বল্প কিছু নিতে হল। খেতে খেতে যুবকটি প্রশ্ন করে জেনে নিতে থাকে সার্থকের জীবনের নানা কথা। কেবল শোনেই না, নিজের কথাও বলে।

যুবকের নাম হারুকি। সম্প্রতি সে বিয়ে করেছে। পেশায় সে ব্যবসায়ী। এক বছর আগে হারুকির বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে হারুকি এখন তাঁর প্লাস্টিক কারখানাটির মালিক। ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজেই এবার সে ভারতে এসেছে। তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী অবশ্য এর আগে অনেকবারই এদেশে এসেছে। ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে সেসময় রিসার্চ করছিল সে।

গত বছর হারুকির কোম্পানি অপ্রত্যাশিত লাভ করেছে। জাপানি ভাষায় কোম্পানিকে বলে ‘খায়শা’। হারুকির খায়শা এখন রমরম করে চলায়, সে কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রীর হাতে দায়িত্ব সঁপে ভারতে এসেছে।

হারুকি বলল, ‘সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী কয়েক বছরে কোম্পানি আরও বড়ো হবে সার্থক! কারখানা করার জন্য জমিও কিনেছি। অনেক কর্মীরও দরকার হবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও, তাহলে আমার কোম্পানিতে একটা চাকরি তোমায় দিতে পারি। শর্ত দুটো। এক, পাকাপাকিভাবে জাপানেই থাকতে হবে। নাগরিকত্বের ব্যবস্থা আমি করে দেব। আর দুই, মন দিয়ে কাজ করতে হবে। জাপানে সকলকেই কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে হয়।’

খানিকটা সময় থেমে থেকে হারুকি আবার বলল, ‘তুমি রাজি থাকলে বলো–!’

সার্থক যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল। হারুকির প্রশ্নে চমকে উঠে বলল, ‘কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। আমি যাব।’

হারুকি উঠে পড়ে বলল, ‘আজ রাতের ফ্লাইটে আমি মুম্বই উড়ে যাচ্ছি। দু’দিন ওখানে থাকব। তারপর ফিরে যাব জাপানে। ওখান থেকে যাবতীয় জরুরি ডকুমেন্টস তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা কোরো।’

একটা ট্যাক্সি ডেকে হারুকিকে তুলে দিয়ে, বাস ধরে নিজের রেস্তোরাঁয় ফিরে এল সার্থক। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। মানুষের ভিড়ও বাড়ছিল। আজ ক্রেতারা তার কাছ থেকে পেল একটু বাড়তি হাসি। একটু বেশি সৌজন্য। তখন এক আশ্চর্য ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছে সার্থক। আর মাত্র কয়েক দিন, বন্ধু। ওগো চেনা মুখ, তোমাদের বড়ো মিস করব জাপানে।

হারুকি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়নি। সে জাপানে ফিরে যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায়, সার্থকদের রেস্তোরাঁর ঠিকানায় তার নামে একটা প্যাকেট এল। নিজের মেসে গিয়ে কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুলল সার্থক। ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় জরুরি কাগজপত্র, সেইসঙ্গে একটা ওপন ডেটেড এয়ার টিকিট। তার উপর সরু ক্লিপে আটকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে স্বহস্তে হারুকি লিখেছে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাপানে চলে আসার চেষ্টা করো!’

চোখে হঠাৎই জল চলে এল সার্থকের। সেই কোন ছোটোবেলার অধরা স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। পরের কয়েক দিন কেটে গেল দূতাবাসে ভিসা সংক্রান্ত কাজকর্মের ব্যস্ততায়। তার কয়েক দিন পরেই তার উড়ান নামল অশোকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। এয়ারপোর্টে ক্লিয়ারেন্সের যাবতীয় কাজ মিটে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। হারুকি যেভাবে বলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে অশোকা স্টেশন থেকে টোকিয়োগামী বুলেট ট্রেনে উঠে বসেছিল সার্থক।

শিনকানসেন এখন সাঁঝবেলার কুয়াশামাখা অন্ধকার ভেদ করে ছুটছে। দূরে দূরে ছোটো ছোটো জনপদ টের পাওয়া যায় মিটমিট করে জ্বলা আলো দেখে। পিছনে পড়ে রইল তার দেশ। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। দেশের বাড়ি, বাবা-মা…। চোখ জ্বালা করে উঠল সে কথা মনে পড়তে। প্রৌঢ় সহযাত্রীটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বললেন, ‘টোকিয়ো স্টেশন আসছে। আর দশ মিনিট।’

সত্যিই তাই! চোখেমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে বলে টয়লেটে ঢুকেছিল সার্থক। বেরিয়েই চমকে গেল। অন্ধকার উধাও। মিটমিট করে জ্বলা আলোরাও বিগত অতীত। তার বদলে মসৃণ এক শহর আলোয় আলোয় খিলখিল করে হাসছে। সিটে ফিরে আসতে বৃদ্ধ সহযাত্রী একগাল হেসে বললেন, ‘টোকিয়ো এসে গেছে।’

আগেই ফোনে কোথায় সার্থকের জন্য অপেক্ষা করবে বলে দিয়েছিল হারুকি। সেইমতো, পশ্চিমের দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে বের হয়ে, রিজার্ভেশন কাউন্টারের কাছে যেতেই সে হারুকিকে দেখতে পেল। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল হারুকি। বলল, ‘কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’

সার্থক মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল হারুকি। গাড়ি চলতে শুরু করল ফ্লাইওভার ধরে। এমন শহর সার্থক কেবল ছবিতে দেখেছে। আকাশে থেকে থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে রংবেরঙের ফুল হয়ে যাচ্ছে।

অবাক চোখে সেদিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুকি বলল, ‘খুব কাছে সুমিদা নদী। প্রত্যেক বছর এই দিনে নদীর পারে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছ। আমরা নদীর পার ধরেই যাব। দেখতে পাবে–!’

‘তোমার বাড়ি কি কাছেই?’

‘ফ্ল্যাট…। হ্যাঁ কাছেই।’

আধঘণ্টার মধ্যে গাড়িটা বাঁক নিয়ে একটা বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে খানিকটা গিয়ে থামল। সেখানে আরও অনেক গাড়ি রয়েছে। সার্থক বুঝতে পারল, এই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও ফ্ল্যাটেই থাকে হারুকি ও তার বউ। সাজানো ফ্ল্যাটে ঢুকে, ড্রয়িংরুমে বসার পর, হারুকি বলল, ‘তুমি কি টয়লেটে যেতে চাও?’

সত্যিই শরীর এখন চাইছে স্নান। দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে রাতপোশাকটা বের করে টয়লেটে ঢুকল সার্থক। আহা, স্নানের ঘর যে এমন হয়, সে কি জানে দেশে তার পরিচিত মানুষরা? কত বড়ো বাথটাব! দেয়ালে কতরকম কলের প্যাঁচ। কোনটার কী কাজ কে জানে! জেনেই বা কী দরকার! দেশে তো বাড়ির বাইরের টিপকল থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে ছাদখোলা টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে স্নান করত তারা।

বাথটাবের কল ছেড়ে দিয়ে, সার্থক আক্ষরিক অর্থে গা ভাসাল। টয়লেটের বাইরে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে পানীয় হাতে নিয়ে একাই বসে আছে হারুকি।

তাকে দেখে বলল, ‘একটু বোসো। আমার বউ এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। ওকে খবরটা দিয়ে আসি।’

সোফার নরম গদিতে প্রায় পুরোটাই ডুবে যায় সার্থক। সামলে নিয়ে সতর্ক হয়ে বসে। মাথাটা হেলিয়ে দিতেই বুজে আসে ক্লান্ত চোখদুটো। আর তখনই চোখের পর্দায় ভাসে সেই আশ্চর্য সুন্দর মুখটা। তার দেশের কেউ নয় সে, তার দেশের কারু মতো দেখতে নয় তাকে। তবু, সেদিন যখন সন্ধেবেলা গঙ্গার বুকে ভাসা নৌকোর ছইয়ের মধ্যে সে চেপে ধরেছিল সার্থকের হাতদুটি, তাকে দেখতে লাগছিল প্রতিমার মতো। সে মুখ ভোলার নয় কখনও। শুধু তাকে একটিবার দেখবে বলে, সে গিয়ে বসে থাকত দূতাবাসের উলটোদিকে চা-দোকানের ভাঙা চেয়ারে। শুধু জীবনধারণ নয়, তাকে খোঁজার জন্যও জাপানে আসা তার। তার নামও যে জানা হয়নি সেদিন।

হারুকির ডাকে ভাবনার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল সার্থকের। হারুকি ফিরে এসেছে ঘরে।

‘সার্থক, এই হচ্ছে আমার বউ, মিকা–!’ তার পাশ থেকে কেউ রিনরিনে গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো!

জবাবে ‘হ্যালো’ বলতে গিয়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল সার্থক। সেই মুখ। নরম দুটো চোখ। একবার সার্থকের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি যেন মেঝেয় গেঁথে ফেলেছে মেয়েটা। তার মানে, সার্থককে সে আগেই চিনেছে। ধরা দিতে চায় না। সার্থকের কাছেও না, তার স্বামীর কাছেও না।

মিকা বলল, ‘আমি যাই। খুব ক্লান্ত। কাল কথা হবে–।’

সে চলে যেতে, নিজের মনেই একচোট হাসল সার্থক। তারপর অকম্পিত গলায়, ‘সি ইউ’ বলে সোফার নরম ঔদার্যে ডুবিয়ে দিল শরীর।

তার এখন জব্বর ঘুম পাচ্ছে।

 

সারপ্রাইজ

অভিজিতের সঙ্গে পুনায় তার কর্মস্থলে চলে যাচ্ছে নন্দিনী। স্টেশনে তাদের দুজনকে সি-অফ করতে এসেছেন অভিজিতের বাবা-মা এবং বোন সীমা। মাত্র একমাস হল অভিজিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নন্দিনীর। বিয়ের পর এই কটা দিন যেন সুখের স্রোতে ভেসে কেটে গেছে। অভিজিতের পরিবারের সদস্যরা মাত্র একদিনেই ভালোবেসে ফেলেছেন মাতৃহারা মেয়েটিকে।

আজ ছেলে-বউমাকে বিদায় জানাতে এসে সে-কথাটি বিলক্ষণ বুঝছেন সুরমা। তার দুচোখ জলে ভরে এসেছে। নন্দিনীর চিবুক ধরে আদর করে বলে উঠলেন, ‘মন চাইছে না তোকে ছেড়ে দিতে নন্দিনী। কিন্তু কী করব বল! ছেলেটা বিদেশবিভুঁইয়ে একা থাকবে, এটাই বা মা হয়ে কী করে সহ্য করি বল! জানি, তোর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ করিস না মা। যখন ইচ্ছে করবে চলে আসবি। আর ফোন তো রইলই!’

সুরমার কথা শুনতে শুনতে মনটা ভিজে উঠল নন্দিনীরও। সুরমার কাঁধে মাথা রেখে সে ফুঁপিয়ে উঠল। নিজের মায়ের স্মৃতি, সময়ের ব্যবধানে আর খুব বেশি উজ্জ্বল নয় তার কাছে। সুরমার মধ্যে, তার দেওয়া স্নেহের মধ্যে, সে তার নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পেয়েছিল।

সীমা এগিয়ে এসে কানেকানে বলল, ‘বউদি, তুমি কী গো? আজকালকার মেয়েরা ভাবে, কতক্ষণে শ্বশুর-শাশুড়ির কড়া শাসনের বাইরে বের হবে। তোমার কাছে বিনা আয়াসে সেই সুযোগ যখন এসেইছে, তখন তুমি কাঁদছ? সত্যি তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না!’

সীমার কথা শুনে সুরমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে নন্দিনী ম্লান হাসি নিয়ে তাকাল।

পুনেতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে অভিজিৎ। তবে এখনও গৃহপ্রবেশ করেনি। একেবারে নন্দিনীকে নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে উঠবে, ঠিক করেছে। ফার্নিচারগুলো অবশ্য বিয়ে উপলক্ষ্যে কলকাতায় ছুটি নিয়ে আসার আগেই নতুন ফ্ল্যাটে রেখে দিয়ে এসেছে সে। আর, চাকুরেদের যে-মেসটায় থাকত এতদিন, বকেয়া মিটিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে সেটা।

ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসতে, ওরা নিজেদের কামরায় উঠে পড়ল। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন ভাড়া নিয়েছে অভিজিৎ। ভারী স্লাইডিং দরজাটা টেনে দিলে কেবিনটা একেবারে ব্যাক্তিগত হয়ে যায়। জানলার বাইরে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কাচের বাধা ভেদ করে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। রাত নটা নাগাদ ট্রেনের প্যান্ট্রি কার থেকে খাবার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে দশটা নাগাদ উপরের বাংকে শুতে চলে গেল অভিজিৎ।

নন্দিনীও হাতে একটা পেপারব্যাক নিয়ে আধশোয়া হল। কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে হঠাৎই তার নিজেকে খুব একা মনে হতে লাগল। আর মনে পড়ে যেতে থাকল পুরোনো স্মৃতিগুলো।

মনে পড়ল, অমরশংকর কত চিন্তিত ছিলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে! নন্দিনী সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা। বাধাটা সেদিক থেকে নয়। কিন্তু, পারিবারিক ইতিবৃত্তটি শোনার পর পাত্রপক্ষেরা পিছিয়ে যায়। আর, অমরশংকর তো সে কাহিনি না বলে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। একসময় পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে বসতে ক্লান্ত নন্দিনী তো বাবাকে বলেই ফেলেছিল, ‘তুমি আর চেষ্টা করো না। বিয়ে করাটাই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়! আমি পড়ব। আরও পড়ব। ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করব।’

অমরশংকরও হতাশ হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। এইসময়েই হঠাৎ দেবদূতের মতো হাজির হলেন সুরমা আর জয়ন্ত। সব শুনেও ওরা ওদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

অথচ সেই ইতিহাসের জন্য নন্দিনী কোনওভাবেই দায়ী ছিল না। নন্দিনীর মা বিনতা খুবই অর্ন্তমুখী স্বভাবের মহিলা ছিলেন। এমনকী কষ্টের কথাও তাকে কেউ কখনও মুখ ফুটে বলতে শোনেনি।

অমরশংকর সবে কলেজ পাশ করে চাকরি পেয়েছেন, এই সময়টায় বাড়িরঅমতে বিয়ে করেছিলেন বিনতাকে। বিয়ে করে আর দক্ষিণ কলকাতার সাবেকি বাড়িতে ওঠেননি ওরা। অন্যত্র বাসা নিয়েছিলেন। নন্দিনীরও জন্ম এখানেই। সমস্যার শুরু তার পরে।

নন্দিনীর খুব আবছা ভাবে মনে পড়ে শীতকালের এক দুপুরের কথা। স্কুল ছুটি ছিল। তাই বাড়িতেই ছিল সেদিন নন্দিনী। অমরশংকর যথারীতি অফিসে গেছিলেন। বাইরের বারান্দায় একা বসে, পুতুল এবং খেলনাবাটি নিয়ে সংসার পেতেছিল নন্দিনী। এইসময় সহসা বেজে উঠেছিল ফোনের ঘণ্টিটা। বিনতা ফোন ধরে কথা বলছিলেন। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতে কৗতূহলী হয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল নন্দিনী। তারপর ভিতরের দৃশ্য দেখে সে যেন পাথর হয়ে গেছিল।

ফোনের রিসিভারটা ঝুলছে। বিনতা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মেঝের উপর। চুলগুলো খোলা। হাওয়ায় উড়ছে। থরথর করে কাঁপছে বিনতার শরীরটা। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। উন্মত্তের মতো মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাচ্ছেন বিনতা।

নন্দিনীর বুকের মধ্যেটা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে কী করবে প্রথমে বুঝে পেল না। তারপর নিজেই দরজা খুলে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিল দীপা কাকিমাকে। দীপাও ঘাবড়ে গিয়ে অমরশংকরকে ফোন করেছিল তাঁর অফিসে। দ্রুত বাড়িতে চলে এসেছিলেন অমরশংকর।

খানিকক্ষণ পরে ডাক্তার এসেছিলেন। বিনতাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ক’দিনের মধ্যে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বিনতা। কিন্তু ডাক্তারবাবু সতর্কবাণী শুনিয়ে গেলেন। হিস্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে বিনতার মধ্যে।

বিনতা সেই সময়ের মতো সুস্থ হয়ে গেলেও ক”দিন পরে আবার তার মধ্যে ফের একইরকম বৈকল্য দেখা দিল। তারপর থেকে বারবারই এমন হতে থাকল। উন্মত্তের মত আচরণ করতে লাগলেন বিনতা। এমনকী এসময় বিনতার কাছাকাছি যেতে ভয় পেতেন অমরশংকর নিজেও। ভয়টা যতটা তার নিজের জন্য, তার ঢের বেশি বিনতার জন্য।

বিনতা যখন পাগলের মতো আচরণ করেন, তখন কেউ তার দিকে এগোলেই তিনি ভাবতে থাকেন তাকে বুঝি মারতে আসছে। তার এই রোগটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। কেবল প্রকোপের সময়টুকুতেই নয়, তার বাইরেও তিনি অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করলেন।

অমরশংকর যেন মনের দিকে থেকে ভেঙেচুরে গেলেন। তার কাছের বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিলেন, বাড়িতে না রেখে বিনতাকে কোনও মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখতে। তাদের আসলে ভয় ছিল নন্দিনীকে নিয়ে। ডাক্তারবাবুও বলেছিলেন, ‘বিনতা যেরকম ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ছে, তাতে করে আপনার নন্দিনীর কথাটা বোধহয় একটু ভাবা উচিত অমরবাবু। শুধু শারীরিক ক্ষতির ভয়ই নয়, বাচ্চা মেয়ে, তাই মনের উপরেও বিশ্রী চাপ পড়ার ভয় থেকেই যায়।’

অমরশংকর স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু ডাক্তারবাবুর পরামর্শ শোনার পর আর ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। সবচেয়ে নামি ও খরচবহুল একটি মেন্টাল অ্যাসাইলামে বিনতাকে রেখে এলেন তিনি। মাস-মাস মোটা টাকা ডোনেশন দিতে হতো সেখানে। বিনিময়ে বিনতা পেতেন সেরা যত্ন এবং দেখভাল।

নন্দিনীর মনে আছে, সপ্তাহে দুবার বিনতার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন অমরশংকর। ঘণ্টাখানেক বিনতার পাশে বসে কাটিয়ে আসতেন। বিনতা বেশি কথা তো বলতেন না। অমরশংকরও চুপ করে তার পাশে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে নন্দিনীর কথা আলোচনা করতেন।

এক সোমবার সকালে অ্যাসইলাম থেকে ফোন এল। বিনতা নেই। ফোনটা রেখে বাবা গুম মেরে বসে রইলেন। তারপর নন্দিনীকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের এক্ষুনি একবার মেন্টাল অ্যাসাইলামে যেতে হবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।’ কী ঘটেছে, তা টেলিফোনের কথোপকথন শুনেই বুঝতে পেরেছিলন নন্দিনী। আলদা করে বলতে হয়নি।

বিনতার ক্রিয়াকর্মে যোগ দিতে নন্দিনীর দাদু-ঠাকুমাও এলেন। নন্দিনী তখন দশ বছরের বালিকা। প্রতিমা– অমরশংকরের মাকে এই প্রথম সে দেখল। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে একটা অস্বাভাবিক কাঠিন্য আছে। কাজকর্ম মিটে যেতে প্রতিমা ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তো ও বাড়িতে ফিরবে না। সে প্রত্যাশাও আমি বা তোমার বাবা করি না। কিন্তু নন্দিনীর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তোমার উচিত ওকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করা।’

অমরশংকর শুনে, গলায় শ্লেষ ঢেলে বললেন, ‘বেঁচে থাকতে বিনতাকে কোনওদিন তোমরা মেনে নাওনি। এখন তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাও?’

প্রতিমার ঠোঁটের চারপাশ আর চোখের তলার চামড়াটা আশ্চর্য ভাবে কুঁচকে গেল। কর্কশ স্বরে বললেন, ‘বিনতা তোকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছিল অমর। ওকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না আমরা।’

‘বিনতা নয়, তোমরা। তেমারাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে।’ অমরশংকর রুখে উঠলেন, ‘সেখানেই শেষ নয়। আজ আমি ভালোই জানি, কার ফোন পেয়ে বিনতা অমন পাগলের মতো আচরণ করত।’

প্রতিমা চুপ করে গিয়েছিলেন। নন্দিনীর অতিসংবেদী শিশুমন তখনই স্পষ্ট করে বুঝে গিয়েছিল, সেদিন দুপুরে আসা ফোনটার অন্য প্রান্তে কে ছিল। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল তার মন। সে ঘৃণা আজও মোছেনি মন থেকে। কিন্তু এই কদর্য ছবিটার উলটো দিকে একটা সদর্থক ছবিও ছিল। যার জন্য অমরশংকরের জন্য নন্দিনীর মনে শ্রদ্ধার ভাবটা বেড়ে গিয়েছিল বহু শতগুণ। নিজের মনে একাকী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। রাতে তার চোখে ঘুম আসতে চাইত না। সবটাই লুকিয়ে দেখেছিল নন্দিনী। বাবার পাশে দাঁড়ানোর বয়স বা সাহস কোনটিই তার ছিল না। কেবল অমরশংকরের জন্য অদ্ভুত এক কষ্ট তাকে পীড়িত করত।

অথচ অন্য সময় অমরশংকর যেন অন্য মানুষ। নন্দিনীকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, দুপুরে সে বাড়ি ফেরার পর নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে ফোনে খবর নিচ্ছেন, আয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন, পার্টি এড়িয়ে চলছেন, কারণ তাঁকে সন্ধেয় দ্রুত বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে সঙ্গ দিতে হবে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। পলক ফেলতে না ফেলতে।

অমরশংকর এবার নন্দিনীর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। দ্রুত জবাব আসতে লাগল। পাত্রপক্ষের খুব পছন্দও হয় নন্দিনীকে। কিন্তু অমরশংকর যেই বিনতার কথা খুলে বলেন, তারা পিছিয়ে যায়। অমরশংকরের বন্ধুবান্ধবরা পরামর্শ দেন, ‘এত বিস্তারিত ভাবে পাত্রপক্ষকে সবকথা জানানোর কী আছে? ওরা কি মেয়েটাকে ঘরে নেবে, না তোমার বংশপরিচয়কে?’

অমরশংকর সব শুনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আর পাত্রপক্ষ শুকনো মুখে জানায়, ‘মেয়েকে তো আমাদের খুবই পছন্দ ছিল অমরবাবু। কিন্তু ভয় পাচ্ছি। মেয়ের মা পাগল। শেষে মেয়েও যদি কোনওদিন…!’

অমরশংকর ম্লান হাসেন।

নন্দিনীও ক্লান্ত হয়ে গেছিল প্রায় সন্ধ্যাতেই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে হাজিরা দিতে দিতে। শেষে একদিন  মরিয়া হয়ে মুখ ফুটে বলে উঠেছিল, ‘বাবা তুমি কি মনে করো বিয়েই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য? এখন মেয়েরা নিজেদের কেরিয়ারটাই আগে গড়তে চায়। আমিও কি সেরকম হতে পারি না?’

অমরশংকর বলেছিলেন, ‘অবশ্যই পারিস। কিন্তু কেরিয়ারের সঙ্গে বিয়ের তো বিরোধ নেই কোনও।’

এই সময়েই অকস্মাৎ একটা যোগাযোগ হয়ে গেল। অমরশংকরের সঙ্গে তার বন্ধু সুবিমলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছিল নন্দিনী। সেখানেই সুরমা তাকে প্রথম দেখেন। আর তারপরই খোঁজখবর নিয়ে ছেলে অভিজিতের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে মোটা মাইনের চাকরি করে অভিজিৎ। পারিবারিক কৗলিন্যও রয়েছে। অমরশংকরের ‘না’ বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এবং কী আশ্চর্য, অমরশংকর পুরোনো সব কথা বলার পরেও সুরমা এবং জয়ন্তকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেল না।

জয়ন্ত বললেন, ‘মায়ের একটা মানসিক অসুস্থতা ছিল বলে ওরও থাকবে, এটা এ ক্ষেত্রে তেমন যুক্তিযুক্ত বোধহয় নয়।’

সুরমা বললেন, ‘আমাদের ভাগ্যে যদি সেটা থাকেই, তাহলে ঘটবে–!’

অমরশংকর ভারি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল অভিজিৎ আর নন্দিনীর। কিন্তু বাস্তবের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী সেভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বিয়ের কয়েকদিন পরেই কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে চোখের জল ফেলে অভিজিতের কাছে সে জানতে চেয়েছিল, ‘আমিও যদি কোনওদিন মায়ের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ি?’

জানলা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকে এসে চোখের পাতায় বসতেই ঘুম ভেঙে গেল নন্দিনীর। সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যায় অভিজিৎ। কাজেই তার অফিসে বেরোনোর আগে অবধি, রান্নার তেমন ব্যস্ততা থাকে না। সেটা শুরু হয় পরে। অভিজিৎ বেরিয়ে যাওয়ার পর।

অভিজিতের অফিস তাদের ফ্ল্যাটের খুব কাছে হওয়ার জন্য, লাঞ্চের অবসরে অভিজিৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য বাড়িতে আসে। তখন ওরা দুজনে একসঙ্গে খেতে বসে।

বিছানা থেকে নেমে নন্দিনী ঠিক করল, রেসিপির বইটা দেখে আজ কিছু আনকোরা রান্না তৈরি করবে। ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলেই নন্দিনী বুঝল, ফোনের অন্য প্রান্তে রয়েছেন অমরশংকর।

প্রথমেই বললেন, ‘শুভ জন্মদিন নন্দিনী! কেমন আছিস মা?’

‘ভালো আছি বাবা। তোমার শরীর ঠিক আছে?’

‘শরীর ঠিক আছে। তবে সত্যি বলতে কি, তুই শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো ফাঁকা লাগে।’

নন্দিনীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।

অমরশংকর বলেন, ‘তোর জন্য একটা উপহার কিনে গতকালই কুরিয়র কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছি। আজই পেয়ে যাবি। পছন্দ হয়েছে কিনা জানাস–!’

অমরশংকর ফোনটা ছেড়ে দিলেন। অভিজিৎ বাথরুমে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন করেছিল নন্দিনী?’

‘বাবা!’

অভিজিৎ নিজের মনেই বলল, ‘ও!’

কিচেনের দিকে যেতে গিয়ে আবার থমকে যেতে হল নন্দিনীকে। আবার ফোনের ঘণ্টি বাজছে। এবার সীমা।

ফোন তুলতেই কলকল করে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন বউদি। তা, দাদা আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেলিব্রেট করতে?’

‘সেলিব্রেশন? তোমার দাদা?’ বলতে বলতে নন্দিনীর বুকে একটা অভিমান দলা পাকিয়ে ওঠে, ‘এখনও অবধি উইশ করেনি জানো? বোধহয় ভুলেই গেছে।’

‘ভুলে গেছে?’ সীমা স্পষ্টতই অবাক হয়, কিন্তু প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘আচ্ছা, আমি এখন কলেজে যাচ্ছি, কেমন বউদি? বাবা-মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আমি রাতে ফোন করব আবার। হিহি!’

সুরমা ও জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলে ফোনটা রেখে পিছন ফিরতেই নন্দিনী দেখল, অভিজিতের স্নান হয়ে গেছে। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে সে বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে নিজের মনে গুনগুন করছে।

নন্দিনীকে দেখে উদাসীন গলায় বলল, ‘বাব্বা! আজ দেখছি একের পর এক ফোন আসছে তোমার। ব্যাপারখানা কী?’

ক্লিষ্ট হেসে সরে যেতে যেতে নন্দিনী বলল, ‘হয় এক-একদিন এরকম!’

কিন্তু মনটা তার ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে। অভিজিৎ কী করে বউয়ের জন্মদিনের কথাটা ভুলে যেতে পারে? কিন্তু আচরণ দেখে মনে হচ্ছে বিষয়টা মাথাতেই নেই ওর।

টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে সে অভিজিৎকে ডাকল। কোনও কথা না বলে ওরা খাচ্ছে। নীরবতা ভেঙে অভিজিৎ সহজ গলায় জানতে চাইল, ‘তোমার কি মন খারাপ নন্দিনী?’

‘না তো! কেন?’– নন্দিনীর চোখদুটো জ্বালা করে উঠল।

‘না, তোমাকে অন্যমনস্ক দেখে ভাবলাম, হয়তো বাবার জন্য মন কেমন করছে। সেক্ষেত্রে কয়েকদিন তোমার বাবার ওখান থেকে আমরা ঘুরেও আসতে পারি।’

নন্দিনীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়া শেষ হয়ে গেছে অভিজিতের। গলার টাইটা বেঁধে নিতে নিতে বলল, ‘ও। শোনো, একটা কথা তো তোমায় বলাই হয়নি। আমার একবন্ধুর জন্মদিন আজ। হোটেলে পার্টি থ্রো করেছে। যেতেই হবে। তুমি সন্ধেয় সেজেগুজে তৈরি থেকো।’

অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর বন্ধ দরজাটায় পিঠ ঠেকিয়ে নন্দিনী ভাবতে থাকল, বন্ধুর জন্মদিন মনে রাখতে পারে অভিজিৎ। কেবল তার বেলাতেই ফাঁকি। এমন নয় যে, অভিজিৎ জানে না আজ তার জন্মদিন। কিন্তু কত সহজে সে সে-কথা ভুলে গেছে! প্রচণ্ড অভিমানে নন্দিনীও ঠিক করল, অভিজিৎকে কক্ষনও সে তার জন্মদিনের কথাটা মনে করিয়ে দেবে না। এমনকী সীমা বা সুরমার কাছ থেকে জানতে পেরে সে যদি কোনও উপহার কিনেও আনে, সে নেবে না। ফিরিয়ে দেবে।

মনের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা সত্ত্বেও সে অনেকক্ষণ ধরে সাজল। ভোটশিপের সময়, অভিজিতের পছন্দ করে কিনে আনা শাড়িটা পরে, সে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখল আয়নায়।

অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে দেখে চমকে গেল অভিজিৎ। মুগ্ধ চোখ ফেরাতে পারল না। যদিও তেমন উৎসাহ দেখাল না নন্দিনী। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। সুরমা হয়তো এরকম কোনও দিনের আগাম কল্পনা করেই, চলে আসবার দিন নন্দিনীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘কখনও কখনও খুব ছোটো ছোটো ঘটনাও বড়োসড়ো ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারগুলোকে সামলালে দেখবি, সব ঠিক হয়ে গেছে। কোনও কথা যদি খারাপ লাগে, তাহলে তক্ষুনি জবাব না দিয়ে ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।…’

নিজেও দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে অভিজিৎ ব্যস্ততার সঙ্গে বলল, ‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আবার একটা ছোটোখাটো প্রেজেন্টেশনও কিনে নিতে হবে।’

সন্ধে নেমে এসেছে। চর্তুপাশ ঝলমল করছে আলোয়। গাড়ির ঢল নেমেছে। একটা বড়ো গয়নার দোকান দেখে তার সামনে গাড়ি থামাল অভিজিৎ। বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি নন্দিনী। আমার এই বন্ধুটি একজন ভদ্রমহিলা। অল্প দিন হয়েছে, তার সঙ্গে আমার আলাপ।’

দোকানের সুবেশ ছেলেটিকে হিরের আংটি দেখাতে বলল অভিজিৎ। নানা ডিজাইনের আংটি চলে এল। বেশ কয়েকটা পছন্দসই মনে হল অভিজিতের। সবকটাই একে একে নন্দিনীর আঙুলে পরিয়ে শেষপর্যন্ত একটিকে চূড়ান্ত বাছাই করল সে। আংটিটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে। নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করতে সেও মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

আংটির দাম পঁচিশ হাজার টাকা। সব দেখে নন্দিনী যেন মনে মনে আরও বেশি করে নিভে যাচ্ছিল। বন্ধুর জন্য এত দামের উপহার, আর নিজের স্ত্রীর জন্য কিছুই না! কী অসম্ভব পরিহাস লুকিয়ে আছে গোটা ঘটনাটার মধ্যে।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। অনেকটা পথ পেরিয়ে এবার এসে থামল এক বিরাট পাঁচতারা হোটেলের নীচে। গাড়িটা পার্ক করে, চোখের ইশারায় তাকে অনুসরণ করার কথাই বলল অভিজিৎ। সে হাঁটতে লাগল হোটেলের রেস্তোরাঁটির দিকে। চারপাশে তাকাতে তাকাতে। যদি নিমন্ত্রিত বন্ধুবান্ধবদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!

রেস্তোরাঁর মধ্যেটা নরম আলোর ঠান্ডা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। খুব হালকা ভল্যুমে কোনও চেনা সুর বাজছে। টেবিলে টেবিলে ছায়ার মতো নারী-পুরুষ। সেদিক না মাড়িয়ে অভিজিৎ একটু নিরালা থাকা দামি কেবিনগুলোর একটার দিকে এগেল।

কেবিনের ভারী পর্দাটা সরিয়ে অভিজিৎ বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাম!’

নন্দিনী একটু অবাক হয়। বলে, ‘কই গো, তোমার হোস্ট কই? আমরাই কি প্রথম এলাম নাকি?’

আবছায়ায় অভিজিৎ একটু হাসল। কখন আরও দুটি ছায়ামূর্তি কেবিনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরনে হোটেলের কর্মীদের ইউনিফর্ম। হাতে ফুলের বোকে। দুজনে দুপাশ থেকে নন্দিনীর হাতে বোকে-দুটো তুলে দিতেই কেবিন মধ্যে হঠাৎ লাল-নীল নানা রঙের আলো জ্বলে উঠল। সেইসঙ্গে আলোয় লেখা ফুটে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন, নন্দিনী’।

নন্দিনীর মনে হচ্ছিল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। বিহ্বল মুখটা ফেরাতেই, সে আর লাল জামা পরা লোক দুজনকে দেখতে পেল না। বদলে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অভিজিৎ। নন্দিনীর ডানহাতের অনামিকা তুলে ধরে সযত্নে হিরের আংটিটি পরিয়ে দিল অভিজিৎ।

নন্দিনী জানতে চায়, ‘এসব কী অভিজিৎ? তোমার বান্ধবী কই?’

‘বান্ধবী! তোমার চেয়েও ভালো ও কাছের বান্ধবী আর কেউ আছে নাকি আমার?’

নন্দিনীর গালদুটি নিজের বাড়িয়ে ধরা করতলে নিয়ে অভিজিৎ বলে ওঠে।

এত সুখ নন্দিনীকে যেন মাতাল করে দিচ্ছে। অভিজিৎ হাতে তালি দিতেই দুটি লোক হাতে খাবারদাবার নিয়ে এসে, টেবিলভর্তি করে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

অভিজিৎ নিজেই, তার আর নন্দিনীর প্লেটে খাবার তুলে দেয় চামচ দিয়ে। আর নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘আমি কী ভাবছিলাম জানো নন্দিনী? সকাল থেকে তোমায় উইশ করিনি একবারও। তার উপর বান্ধবীর নাম করে দামি হিরের আংটি কিনেছি, তোমায় দিইনি– এতকিছুর পরে তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর বেজায় খেপে যাবে। অভিমান করবে। কথা বলবে না। কিন্তু ঘটনা হল, কাছের মানুষজনকে সারপ্রাইজ দিতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনও জিনিস স্বাভাবিক ভাবে হাতে এলে যত আনন্দ, আকস্মিক ভাবে এলে মজাটা তার বেশ কয়েকগুন হয়ে যায়। তাই নয় কি?’

অনেকক্ষণ পরে তার মনে হল, সে একাই বকবক করে যাচ্ছে, অথচ নন্দিনী কিছু বলছে না। তাই সে চোখ তুলে ডাকতে গেল, ‘নন্দিনী!’ কিন্তু তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হল না। সে দেখতে পেল চেয়ারে অদ্ভূত ভাবে এলিয়ে পড়ে আছে নন্দিনী। চুলটা খোলা। এলোমেলো। শাড়িটাও বিস্রস্ত। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে নন্দিনীর উপর দিয়ে।

উদ্বিগ্ন অভিজিৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে নন্দিনীর কাছে গিয়ে তার কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকিয়ে ডেকে উঠল, ‘নন্দিনী, নন্দিনী, কী হয়েছে তোমার?’ পাছে আওয়াজটা বাইরে গিয়ে লোকের মনে কৗতূহল সৃষ্টি করে, তাই যথেষ্ট চাপা গলায় সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

নন্দিনী চোখদুটো খুলল হঠাৎ। ভয় পেয়ে গেল অভিজিৎ। কেবিনের আলো-আঁধারিতে তার চোখদুটো অসম্ভব ঘোলাটে দেখাচ্ছে। দৃষ্টিটা যেন এ পৃথিবীর নয়। রঙিন ঠোঁট ভীষণ ছড়িয়ে হাসল নন্দিনী। এ তো স্বাভাবিক হাসি নয়। বুকে কাঁপন ধরানো এমন হাসি সে আগে কখনও দেখেনি।

দু-পা পিছিয়ে এল অভিজিৎ। তার মনে পড়ে, নন্দিনীই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, ‘আমার মায়ের মানসিক অসুস্থতা ছিল। আমার আবার সেরকম কিছু হবে না তো?’

সময় নষ্ট না করে, সে নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ‘ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে হবে–!’

বলে, ঘুরে দাঁড়াতেই কেউ যেন তার জামা ধরে টানল। ফিরে তাকিয়ে চমকে গেল অভিজিৎ। নন্দিনী হাসছে। সহজ, স্বাভাবিক, সরল, মজা-পাওয়া হাসি।

উদভ্রান্ত অভিজিৎ তার মুখটা নিজের করতলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছো নন্দিনী?’

‘আমার কিছু হয়ইনি।’

‘তাহলে?’

নন্দিনী হাসতে হাসতেই জবাব দিল, ‘সারপ্রাইজ!’

ফিরে এসো মলি

ভাইয়ের জ্বর কমছে না কিছুতেই। ওই ১০৪ ডিগ্রিতে আটকে রয়েছে। মলয়ের কপালে হাত রেখে থার্মোমিটার-টায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল হিমানী। তারপর আবার কাপড় ভিজিয়ে মলয়ের কপালে রাখল।

নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে থাকল হিমানী, কেন যে জ্বর নামছে না কে জানে? কতবার ভাইকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম, কিন্তু সেই এক জেদ… ঠিক হয়ে যাবে।

দিদি চিন্তা করিস না, ডাক্তার দেখিয়ে বা কী হতো ক্ষীণ স্বরে মলয় হিমানীকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি আর তোর এই অবস্থা দেখতে পারছি না। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েে মনে হচ্ছে! এত দুর্বল শরীর। আমি জানি মলির চলে যাওয়াটাকে তুই কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিস না। তুই নিজেই তো কাণ্ডটা বাঁধিয়েিস। কাউকে কিছু না বলে ডিভোর্স নিয়ে নিলি? সাতবছর একসঙ্গে সংসার করলি। সন্তান হয়নি তো কী হয়েে? আমি জানি মলির দুবার মিসক্যারেজ হয়েে কিন্তু বাচ্চা দত্তক নিতেই বা কী অসুবিধা ছিল? মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন বলার কেউ ছিল, এখন তো তোদের স্বাধীন জীবন।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না মলি কী করে এতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল? তুই চিরকালই কম কথা বলিস। বেচারা মলি নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য স্কুলে পড়াবার চাকরি-টা নিল আর বাড়িতে টিউশন করা আরম্ভ করেছিল। ওর দুটো কাজই তুই মেনে নিতে পারলি না। তোর মনে হল টাকার জন্য ও কাজ করছে। তোর অহংকারে লাগল। ভাই, আমি ভালো করেই জানি, তুই আজও পুরোনো বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে ধরে চলার চেষ্টা করিস। তুই শুধু যে মা-বাবাকে হারিয়েিস তা তো নয়, মলিও দ্বিতীয়বার মা-বাবার স্নেহের আঁচল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জানিস-ই তো কী প্রচণ্ড ভালোবাসত ও মা-বাবাকে।

মলয় চুপ করে থাকে। হিমানী কথাগুলো না বলেও থাকতে পারে না। ও জানে দোষ মলয়ের তাই দোষটা চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দ্যাখানো দরকার। হিমানী আবার বলে, তোর রাগ তো আমি জানি ভাই। নিশ্চয়ই চ্যাঁচামেচি করতিস মেযোর উপরে। একটা ভালো পড়াশোনা জানা মেয়ে একা সে করবেটাই বা কী? কারও সঙ্গে ওকে মিশতে দিবি না, বাড়িতেও কেউ আসা-যাওয়া করবে না। এখন ও চলে গেছে তাতেও তোর শান্তি নেই।

ও-বেচারারই বা কী অবস্থা কে জানে!

দিদি, প্লিজ চুপ কর, যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। তুই যা ভাবছিস তা মোটেই নয়। আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না! যার সঙ্গে খুশি ও থাকতে পারে, আমার কী? আমাকে বলেছে, আমি মরলেও জিজ্ঞেস করার কেউ থাকবে না আমার কাছে। ও এটাই চায়। তুই কী করে মলিকে সাপোর্ট করছিস? বেশি আর কী হবে মরেই যাব, এই তো?

তোর একটু শরীর খারাপ হলেই কান্নাকাটি করে একশা করত। তোর আঘাত লাগলে মুখ চুন করে ঘুরত। মায়ে অপারেশনের সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল। ও যা মায়ে সেবা করেছে, আমিও হয়তো করতে পারতাম না। সেই মেয়ে সব ছেড়েছুড়ে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে চলে গেল বিশ্বাস হয় না!

ওকে কনট্যাক্ট করার কোনও তো নম্বর হবে, আমাকে প্লিজ দে ভাই। একবার কথা বলতে চাই। ওর বান্ধবী শুভ্রার নম্বর তোর কাছে আছে? হিমানী নিজেই মলয়ের মোবাইলটা খাটের পাশ থেকে তুলে নিয়ে নম্বর খুঁজতে থাকে।

এখন আর কিছুই করার নেই দিদি। মলি নিজে বলেছে ও শশাঙ্ক-কে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মলয়।

হিমানী মলয়ের থেকে চার বছরের বড়ো। হিমানীর বিয়ে পাঁচ বছর বাদে মলয়ের বিয়ে হয়। স্বভাবে মলয় আর মলি একেবারে বিপরীত দুটো মানুষ। মলয় অন্তর্মুখী আর মলি উচ্ছল ঝরনাধারার মতো। বিয়ে হয়ে এসেই মলয়ের মা-বাবাকে আপন করে নিয়েছিল মলি নিজের ব্যবহারে। হঠাত্-ই মলয়ের মা মারা যান স্ট্রোক-এ। বাবাও আর বেশিদিন বাঁচেননি। সুগারের রুগি ছিলেন।

মা-বাবার মৃত্যু মলয় মানতে পারেনি। ডিপ্রেসড থাকতে শুরু করে। মলিও কিছুতেই ওকে এই অবসাদ থেকে টেনে বের করতে পারে না। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়া শুরু হয়।

অথচ মলি নিজের শ্বশুর-শাশুড়ির যত্নের কোনও অবহেলা কোনওদিন করেনি। বাড়ির সব কাজ সেরে মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরে আসত মলি। বাইরের কাজ থাকলে সেটা করে পাড়া-প্রতিবেশীদের খবরাখবর নিত। তাদের বাড়ি যেত, তাদের বাড়িতে ডাকত। সকলের সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়িরও আদরের ছিল সে। সকলেই তাকে ভালোবাসত। কিন্তু তাঁরা মারা যাওয়ার পর থেকেই, লোকজনের বাড়িতে আসা-যাওয়াটা মলয়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। অল্পেতেই মলয বিরক্ত হতো। কখনও মায়ে মতো রান্নায় স্বাদ হয়নি বলে, মলিকে বকাবকি করত। আবার কখনও ওর এত বাইরে যাওয়া নিয়ে অশান্তি আরম্ভ করে দিত।

শশাঙ্ক মলির ছোটোবেলার বন্ধু। ক্লাস টুয়েভ অবধি একসঙ্গে পড়েছে। সবসময় হাসিমুখ, অন্যের প্রযোজনে পাশে দাঁড়ানো, লোকের বিপদে আগু-পিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়া এই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সবার কাছেই খুব পপুলার ছিল শশাঙ্ক। স্কুল শেষ হওয়ার পর আর যোগাযোগ ছিল না, হঠাত্ই রাস্তায় একদিন মুখোমুখি দেখা। সেই একই রকম চেহারা রয়েে। মুখে দুষ্টু-মিষ্টি হাসিটা লেগে রয়েে। চোখদুটো যেন কথা বলছে। শুধু তফাত, আগের থেকে চেহারা খানিকটা ভারিক্কি হয়েে আর মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা।

আরে, শশাঙ্ক তুই, এখানে! চিনতে পারছিস? মলি খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে।

হ্ঁযা। তুই মলি? বিশ্বাস হচ্ছে না। মলি মানেই সেই স্কার্ট-ব্লাউজ পরা, দুটো বিনুনি ঝোলানো, রুমাল দিয়ে নাক মুছতে থাকা মেযোকেই মনে পড়ে। শাড়ি পরে মাথায় সিঁদুর, না রে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না! হা হা করে রাস্তার মাঝেই হাসতে আরম্ভ করে শশাঙ্ক।

আর তুই এখনও বিয়ে করিসনি? হেসেই জিজ্ঞেস করে মলি।

ঝটপট উত্তরও পেয়ে যায়, পাগল! এখনও আমি স্বাধীন। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি, ভালো একটা চাকরিও জোগাড় করেছি। এত সহজে হাড়িকাঠে মাথা দেব ভেবেছিস? একটু তো প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিই। মলির মনে হয় শশাঙ্ককেই মানায় এই প্রাণখোলা হাসিটায়।

কী করছিস? কিছু কেনাকাটা করার আছে নাকি? নয়তো চল বাইক সঙ্গে আছে, কোথাও বসে একটু আড্ডা মারি, শশাঙ্ক বলে।

না রে, সারাদিন বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠলে সন্ধেবেলায় একটু ঘুরে আসি। প্রযোজনে টুকিটাকি জিনিসও মাঝেমধ্যে কিনে নিই। সেটাই কিনতে যাচ্ছি এখন, হাসে মলি।

কেন রে, তোর পতিদেব বাইরের হাওয়া খেতে ভালোবাসে না! নাকি বউয়ে হাত ধরে বেরোনো তার পছন্দ নয়? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে শশাঙ্ক। লক্ষ্য করে না ওর এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে, মলির মুখে একটা ছায়া পড়ে, আবার মিলিয়ে যায়।

ঠিক আছে, চল না, জিনিসগুলো কিনে নে। তারপর কোথাও একটু চা খেয়ে তোকে না হয় আমি বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসব।

খানিক্ষণের মধ্যে বাইকের পিছনে বসে যেতে যেতে মলি শশাঙ্কের বলে যাওয়া জোক্সগুলো একটার পর একটা শুনতে শুনতে, অনেকটা হালকা বোধ করল। মনের উপর থেকে একটা ভারী পাথর যেন সরে গেছে। শশাঙ্কটা কিছুতেই গম্ভীর হয়ে থাকতে দেয় না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মলি এবার। বহুদিন বাদে এভাবে মনখুলে মলি হাসতে পারল। শশাঙ্কর দ্বারা বোধহয় কিছুই অসম্ভব নয়। শশাঙ্ক এবার প্লিজ থামবি। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করছে, কপট রাগ প্রকাশ করল মলি। মলির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা হচ্ছিল।

উফ্, মলি তুই কি বোরিং হয়ে গেছিস। কোথায় বরের সঙ্গে ঘুরবি, মুভি দেখতে যাবি, রেস্টুরেন্টে খাবি তা না করে

দোকান-বাজার করছিস। বিয়ে কেন করেছিস? চল তোর বরের জন্য সিঙাড়া কিনে দিই। কী করে না খায় দেখব। বাড়ি ঢুকে আগে গরম গরম চা কর। আশ্চর‌্য মলিকে বাড়িতে ছাড়তে অথবা বাড়িতে এসে মলির বরের সঙ্গে আলাপ করতে, এতটুকুও সঙ্কোচ বোধ ছিল না শশাঙ্কর। বরং মলি একটু বিব্রত বোধ করছিল। শশাঙ্কর উপস্থিতি মলয় কীভাবে নেবে, সেটা মলি বুঝে উঠতে পারছিল না।

দ্বিধা নিয়ে মলি শশাঙ্ককে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। মলয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে শশাঙ্ককে বসিয়ে মলি চা করতে চলে গেল। চা-সিঙাড়া ট্রে-তে সাজিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল মলয় চুপচাপ বসে, শশাঙ্ক একাই কথা বলে যাচ্ছে। শশাঙ্কর অনেকবার অনুরোধ করায় সিঙাড়ার একটা কোণ ভেঙে একটু মুখে দিয়ে প্লেট সরিয়ে রাখল। শশাঙ্কর মজার মজার কথাতেও মলয়ের মুখের কোনও পরিবর্তন হল না। মলয়ের মতে একটা বয়সের পর মানুষকে গম্ভীর হয়ে যেতে হয়। বাচ্চাদের মতন আচরণ তখন মানায় না। এর জন্য় কত বকা যে শুনতে হয় মলিকে, তার গুনতি করাই অসম্ভব।

ওদের কথার মাঝেই মলয় উঠতে চাইলে শশাঙ্ক উঠে দাঁড়ায়, আপনি বসুন, আমি এখন উঠব। অনেক বোর করলাম কিন্তু শিগগির আবার আসব। তৈরি থাকবেন।

গেট পর‌্যন্ত এসে মলির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে শশাঙ্ক বলল, এই লোকটাকে মানুষ বানিয়ে তবে ছাড়ব। আমি সহজে হার মানছি না। একে কী করে তুই বিয়ে করেছিস মলি! কাল সন্ধেবেলায় দেখা হচ্ছে। বাই, দিয়ে স্পিডে বেরিয়ে গেল।

পরের দিন সন্ধে ছটার সময় শশাঙ্ক মলির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। মলি দরজা খুলতেই পকেট থেকে তিনটে গোলাপি রঙের সিনেমার টিকিট চোখের সামনে নাচিয়ে শশাঙ্ক বলল, তাড়াতাড়ি তৈরি হ। তোর ব্যাজারমুখো বরটা কোথায়? ওটাকেও তৈরি হতে বল। আটটার শো। একটা ভালো কমেডি ছবি এসেছে।

তোকে তো বলেছিলাম মলয় সিনেমা দেখা পছন্দ করে না। বিশেষ করে কমেডি তো একেবারেই নয়। আরে ডাক না তোর বরকে। ওর পছন্দের ব্ল্যাক কফি খাওয়াব। রাতের ডিনারটাও না হয় আমার তরফ থেকেই। দ্যাখ এদিকটায় নতুন নতুন এসেছি কাউকে এখনও সেরকম চিনি না। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে দেখা হয়েিল! নে নে তাড়াতাড়ি কর। কুড়ি মিনিট পর ক্যাব পেঁছে যাবে, শশাঙ্ক অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

মলয় না করা সত্ত্বেও জোর করে ধরে নিয়ে যায় শশাঙ্ক সিনেমা দেখাতে। সারাটা সন্ধে আর বিশেষ কথা বলে না মলয়। চুপচাপ ডিনার খাওয়া শেষ করে শশাঙ্ক ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বাড়ি এসেই মলির উপর রাগ উগরে দেয় মলয়।

মলি, তোমার বন্ধু খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছে। ওকে আমার পছন্দ-অপছন্দগুলো বলে দিও। এরপর যদি করে, আমি কিন্তু যা-তা বলতে বাধ্য হব। ওর ফালতু রসিকতা তোমার মতো বেকারের পছন্দ, আমার নয়। মলিকে সাবধান করে দেয় মলয়।

শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যেতে স্নেহভরা পরিবেশ মলিও হারিয়েিল। কুড়ি বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েিল সে। চারপাশটা কেমন শূন্য মনে হয় মলির। চরম বিষাদেও নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেয়নি মলি। ভাঙা মন জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে বাড়ির পরিবেশটাকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু মলয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি হেরে গেছে মলি। দুবছর কেটে গেছে, মা-বাবার মৃতু্যর শোক আজও ভুলতে পারেনি মলয়। অবসাদের পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে, কাছেই একটা স্কুলে চাকরি নিয়েিল মলি। সেখানে সারাদিন বাচ্চা পড়িয়ে মনটা ভালো থাকত। এরপর বাড়িতেও বাচ্চাদের পড়াতে আরম্ভ করে সে। কিন্তু শনিবারগুলো মলয় বাড়ি থাকত। এছাড়া যেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরত, সেদিন বাড়িতে চার-পাঁচটা বাচ্চার হাসি, কথাবার্তা, সবেতেই বিরক্ত হয়ে উঠত মলয়। তাই, মলয়কে খুশি করতে সপ্তাহান্তে বাচ্চা পড়ানো বন্ধ করে দিয়েিল মলি।

মলির ব্যস্ততার কারণে আর মলয়ের অপছন্দ করার ফলে, শশাঙ্কও মলির বাড়ি আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েিল। মাঝেমধ্যে শনিবার এলেও, মলির সঙ্গে গল্প করেই চলে যেত। মলয় একদিনও ওদের সঙ্গে বসে আড্ডায় যোগ দিত না। শশাঙ্কর মজা করার অভ্যাস কিছুটা প্রাণ ফিরিয়ে আনত মলির।

একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতেই, মলয় দেখল বাড়িতে হইহই হচ্ছে। বাড়িতে কেক কাটা চলছে। মলির কোনও ছাত্রের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল মলয়।

বাড়ি খালি হতেই মলয় একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল মলির উপর, তোমাকে বলেছি না, বাড়ি ফিরে আমার একটু শান্তি চাই। এইসব ড্রামা আমার একদম পছন্দ নয়। কাল থেকে কোনও বাচ্চা যেন আমার বাড়িতে পড়তে না আসে। পড়াবার ইচ্ছে থাকলে কোথাও ঘর ভাড়া করে পড়াও। আমার খুশি তো তুমি কখনওই দ্যাখো না, যা ইচ্ছে তাই করো। আমি এটা বরদাস্ত করব না, বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ধৈর‌্যের শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে গেল মলির। মলয়ের কথাগুলো ছুরির আঘাত ওর কোমল হৃদয়টাকে রক্তাক্ত করে তুলল। মলয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে জোর করে দরজা খুলিয়ে প্রথমবার মলয়ের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল।

তুমি কী বলছিলে? তোমার বাড়ি? তোমার খুশি? আমি তো বিয়ে পর এটাকেই নিজের বাড়ি বলে ভেবে এসেছি। তোমার হুকুম শোনার জন্য আমি বিয়ে করিনি। আমি তোমার চাকর নই। তুমি শুধু নিজের খুশির চিন্তা করো, বউয়ে খুশি নিয়ে একদিনও ভেবেছ?

আমিও আদরে মানুষ হয়েি। একটা বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেযো সেটাকেই নিজের বাড়ি ভেবে নেয়, ওই বাড়ির নিয়মে নিজেকে আবার নতুন করে ঢেলে সাজায়। আর তুমি এক নিমেষে আমাকে বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দিলে? তোমার যদি এরকমই মেয়ে পছন্দ ছিল তাহলে অনাথ, গরিব, অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে। হাত জোড় করে তোমার আজ্ঞা পালন করত। কিন্তু তা তো হবার নয়। বিয়ে করতে হবে শিক্ষিত, সুন্দরী, ভালো ঘরের মেয়েে। যাতে সবার কাছে সম্মানটা বজায় থাকে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক নিশ্বাসে মলি কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে। মলয় বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে মলির দিকে, মুহূর্তে কোনও উত্তর জোগায় না মুখে।

পুরুষ মানুষ, বউয়ে কাছে হেরে যাওয়া লজ্জার কথা। সুতরাং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মলয় বলে উঠল, এতই যদি দম্ভ, বড়োলোক দেখে বিয়ে করলে না কেন? শশাঙ্কই তো ছিল। ওর সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য তোমার মন কাঁদে সব সময়। কেন, আগে ও ভালো চাকরি করত না বলে বিয়ে করনি?

খবরদার মলয়, একটা বাজে কথা মুখ থেকে আর বার করবে না। তোমার নোংরা মনের পরিচয় আমি আগেই পেয়েি। আমি শশাঙ্কর কাছেই চলে যাচ্ছি। একটাই শান্তি, ও তোমার মতো নীচ মনের মানুষ নয়। ওর সঙ্গে আমি অনেক ভালো থাকব, বলে রাগের মাথায় শশাঙ্ককে ফোন করল মলি।

অফিস ফেরত শশাঙ্ক সোজা মলিদের বাড়ি এল। মলিকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করল। মলয়ও অনেক অনুনয়-বিনয় করল কিন্তু মলি মন ঠিক করে নিয়েিল। কেউই কিছু বোঝাতে পারল না মলিকে। অগত্যা শশাঙ্ক বলল, ঠিক আছে, তুই আমাকে মাসিমার নম্বরটা দে। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। এলাহাবাদে গিয়ে কয়ে দিন কাটিয়ে আয়। আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি।

না রে, মা শুধু শুধু চিন্তায় পড়ে যাবে। সত্যিটা জানতে পারলে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না, জলে ভেসে যেতে থাকে মলির দুচোখ।

সত্যিটা বলবি কেন? বলবি এমনি ঘুরতে এসেছিস। ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। দুজনেরই রাগ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঠিক আছে কালই আমি টিকিট কিনে নিচ্ছি।

মলিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শশাঙ্ক সবে বড়ো রাস্তায় পড়েছে। হঠাৎ-ই রং সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারল শশাঙ্কর বাইককে। ছিটকে পড়ল শশাঙ্ক। হেলমেট থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারল মাথায় চোট লেগেছে, পা-টাও নাড়াতে পারছে না। মলির মুখটা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল সে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। পুলিশ এসে অ্যাম্বুল্যান্স করে হাসপাতালে পেঁছোল শশাঙ্ককে। ততক্ষণে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। শশাঙ্ক তখন কোমায়। মোবাইলটাও ভেঙে রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল।

তিনদিনের পরও যখন শশাঙ্ক এল না বা ওর ফোনও পাওয়া গেল না, মলয় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মলিকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ল না, তোমার ভালোবাসার মানুষ ভয় পেয়ে পালিয়েে।

সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। অন্যের সঙ্গে চলে যাব সেই ভয়ে কি ডিভোর্স দিচ্ছ না? বিরক্ত হয়ে মলি জিজ্ঞেস করে।

ভয় কাকে করব? শশাঙ্ককে? একটা উজবুক। কালই চলো ভালো কোনও উকিলের সঙ্গে কথা বলব।

ঠিক আছে, আবার অবস্থান বদলে ফেল  না, রাগের মাথাতেই নিশ্চিত হতে চাইল মলি।

সত্যি বলতে কী, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াল। শেষমেশ ডিভোর্সের পর সাহস করে মলি এলাহাবাদে মায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে, মলিনাদেবী শোকে পাথর হয়ে গেলেন। মলি ধীরে ধীরে তাঁকে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলেও, নিজে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারল না। শরীর ভাঙতে আরম্ভ করল। মলয়েরও মন আত্মগ্লানিতে ভরে উঠল। নিজের

অংহবোধ-এর জন্য মলির সঙ্গে ডিভোর্স নিয়েিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত ওদের সংসারের জন্য, ওর বুড়ো মা-বাবার জন্য মলি কতটা আত্মত্যাগ করেছে। মলি মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী সকলের মন জয় করে নিয়েিল। সকলেই জিজ্ঞেস করত মলি কেন চলে গেল? কিন্তু এর কোনও উত্তর ছিল না মলয়ের কাছে।

এ বাড়িতে আর কেউই আসত না। খালি বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসত মলয়কে। আগে সামান্য চ্ঁযাচামেচি হলে রেগে উঠত, আর এখন খালি মনে হতো বাড়িতে কেউ তো আসুক। প্রায়শ্চিত্তের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে শয্যাশাযী হয়ে গিয়েিল মলয়। জল এগিয়ে দেওয়ারও কেউ ছিল না। ভাগ্যিস, হিমানীকে কেউ খবর দিয়েিল। দিদি না এলে এতদিনে প্রাণটুকুও হয়তো হারাতে হতো।

শুভ্রাকে ফোন করে হিমানী জানতে পারল, শুভ্রা ইদানীং আর এলাহাবাদে থাকে না। দিল্লি চলে গেছে। ও সোজাসুজি হিমানীকে বলল, এখন আর কী হবে দিদি। ডিভোর্স হয়ে গেছে। মলয় ওর জীবন নরক করে তুলেছিল। ওর দুঃখ সহ্য করতে না পেরে মাসিমাও মারা গেলেন। এখন মলি শশাঙ্ককে বিয়ে করে কানাডায় সেটেলড। ওরা ভালো আছে। আপনারা আর ওর চিন্তা করবেন না।

এটা কিছুতেই হতে পারে না শুভ্রা।

মলয়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে মলির, শশাঙ্ককে বিয়ে করায় অসুবিধা কোথায়…, জোরের সঙ্গে বলল শুভ্রা। সেটাই তো। আমি জানি ওই বাড়ির সঙ্গে ও কতটা ক্লোজ ছিল। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গেও। ভাইয়ে বউ ছিল ও, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বও কিছু কম ছিল না। মলি ডিভোর্স করে বিয়ে করে নিল, মন কিছুতেই মানতে চাইছে না। শুভ্রা ঠিক করে বলো। একবার বলো তুমি যা বলছ সব মিথ্যা। মাত্র দেড় বছর হল আমরা নিউজিল্যান্ডে শিফ্ট করেছি, আর এর মধ্যে এত কাণ্ড! প্লিজ শুভ্রা ওর কনট্যাক্ট নম্বরটা একবার দাও। আমি ওর মুখ থেকে নিজের কানে শুনতে চাই, হিমানী করুণ স্বরে রিকোযে্ট করে শুভ্রাকে।

দিদি, ও নম্বর দিতে বারণ করেছে। আর কী করবেই বা তুমি? হাড় কটা রয়ে গেছে শরীরে। ওর অবস্থা চোখে দেখতে পারবে না। কেউ ওর কথা জিজ্ঞেস করলে এগুলোই সবাইকে বলতে বলেছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শুভ্রা। হিমানীর অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারে না, হেরে গিয়ে মলির নতুন নম্বরটা হিমানীকে দিয়ে দেয় শুভ্রা।

শুভ্রা, এটা তো ইন্ডিয়ারই নম্বর, আশ্চর‌্য হয় হিমানী।

দিদি মলি শশাঙ্ককেও বিয়ে করেনি, কানাডাও যায়নি। শশাঙ্ক আমার পিসির ছেলে। কলকাতায় গিয়ে সাংঘাতিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। চারমাস কোমাতে পড়ে ছিল। তারপর জ্ঞান ফিরলেও নানা সমস্যা হচ্ছিল। পিসিরা ওকে দিল্লিতে নিয়ে এসে চিকিত্সা করায়। এখন ভালো হয়ে ওরা সবাই এলাহাবাদ ফিরে গেছে। শশাঙ্কই আমাকে মলির খবরাখবর দিতে থাকে। শুভ্রা বিস্তারিত খুলে বলে হিমানীকে।

 

হিমানী, শুভ্রার ফোন ছেড়েই মলির নম্বর ডায়াল করে।

হ্যালো… সেই মিষ্টি গলা কিন্তু আজ তাতে আর যেন প্রাণ নেই।

মলি, আমি তোর হিমানীদি। এতটা পর করে দিলি আমাদের! কাউকে কিছু জানালি না। কী করলি তোরা? তোরা কি পাগল!

ওদিকে কোনও উত্তর নেই দীর্ঘশ্বাসের মৃদু আওয়াজ ছাড়া।

তোদের দুজনকে ভালোমতন জানি। তোর যা অবস্থা, মলয়েরও তাই। মলয়ও বিছানায় পড়ে রয়েে। এত ভালোবাসা কিন্তু এত ইগো কেন? মলয় প্রচুর ভুল করেছে। প্রিয়জনদের হারিয়ে ওর মাথায় ভত চেপেছিল যার জন্য তোকে ও হারিয়েে। আজ নিজের আচরণের জন্য ও লজ্জিত। প্রতি মুহূর্তে তোকে মিস করছে। মলি, মলয় আজও তোকেই ভালোবাসে।

মলি নিশ্চুপ।

এই ভাবে চললে দুজনের কেউই বাঁচবি না। অনেক তো লুকোবার চেষ্টা করলি। শুভ্রা আমাকে সব সত্যিটা বলেছে। ফিরে আয় মলি। আমি আসছি তোর কাছে, ভাইটাকেও কান ধরে নিয়ে আসব। আগে তো ক্ষমা চাইবে তোর কাছে। এরপর কখনও যদি তোকে দুঃখ দেয়, তোকে কাঁদায় তাহলে ও আমায় জীবিত পাবে না, এই আমি ওকেও জানিয়ে রাখলাম।

হিমানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মলয় বিছানা থেকে উঠে বসে দিদির মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরল, দিদি আর কোনও দিন এই কথাটা বলবি না।

তাহলে দুজনেই কান ধরে ক্ষমা চা আমার কাছে, মৃদু হেসে হিমানী বলল, যেটা মলয় ছাড়াও ফোনের ওপাশে মলির কানে গিয়ে পেঁছোল। মলি এমন একটা মেয়ে যে পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছিল, সবাইকে আপন করে নিয়েিল তার সঙ্গে তুই অ্যাডজাস্ট করতে পারলি না ভাই, কেন? মানছি তোর কিছু পছন্দ, অভ্যাস, সংস্কার আছে, সেরকম মলিরও তো কিছু চাহিদা আছে… তাই না কি? অ্যাডজাস্ট খালি ওই করে যাবে? আমি কি প্রথম থেকে এরকম ছিলাম? রানার জন্য অনেক নিজেকে বদলেছি। রানাও নিজেকে কম বদলায়নি। তাই আজ আমরা সুখী দম্পতি। তোকেও ভাই বদলাতে হবে, কিছু ত্যাগ করতে হবে মলির জন্য। পারবি না মলির জন্য নিজেকে বদলাতে? আশা নিয়ে মলয়কে জিজ্ঞেস করে হিমানী।

হ্ঁযা দিদি, তুই যা বলছিস আমি শুনব, আশ্বাস দেয় মলয়।

তাহলে কথা বল ওর সাথে। নম্বর-টা ডায়াল করে হিমানী ভাইয়ে হাতে ফোনটা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

মলি, কোন মুখ নিয়ে আমি কথা বলব তোমার সাথে। আমি অপরাধী, আমাকে পারো তো ক্ষমা করে দাও। বিয়ে পর থেকে বাড়ির সব দাযিত্ব তুমি পালন করেছ। হনিমুন কেন কখনও কোথাও তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাইনি। নিজের ইচ্ছে শুধু তোমার উপর চাপিয়ে গিয়েি। তোমার সঙ্গে পা মিলিয়ে দুপা হাঁটতেও কখনও চেষ্টা করিনি আমি। বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়ে, আমি মত দিইনি। বাড়িতে টিউশন আরম্ভ করেছিলে, সেখানেও আমি তোমাকে অপমান করেছি। তোমার বন্ধু সম্পর্কে যা নয় তাই বলেছি। তোমাকে পাঁকে নামাতেও আমি দ্বিধা করিনি। এতটা নীচে নামতে পেরেছি আমি। মলি এতদিন আমি যা করে এসেছি সব ভুল করেছি! তুমি কেন কেউই সহ্য করতে পারত না। প্লিজ কিছু বলো মলি। আমাকে থাপ্পড় মারো, গালাগালি দাও, বাজে কথা বলো কিন্তু প্লিজ কথা বলো, কথা না বললে আমি ওখানে চলে আসব।, মলয় অনুনয় বিনয় করতে থাকে।

ফোনের ওপাশ থেকে মলির কান্না মলয়ের বুকের গভীরে ক্ষত আরও বাড়িয়ে তোলে।

আমি আসছি মলি তখন মন ভরে আমাকে  মেরে নিও কিন্তু তুমি আমার প্রাণ। আমাকে আমার প্রাণ ফিরিয়ে দাও। দিদিকে দিচ্ছি আমি বলে হিমানীকে ফোন ধরায় মলয়।

আর কাঁদিস না মলি, অনেক কেঁদেছিস তোরা দুজন। তুই আসার জন্য তৈরি থাকিস। মলয় ফিট হলেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি, হিমানী বলে। ওপাশে কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েিল, কিছু বলবি না মলি! হেসে জিজ্ঞেস করে হিমানী। না দিদি তোমরা এসো, ক্ষীণ স্বরে মলি উত্তর দেয়।

তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নে, আমরা আসছি। বিয়ে দিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলব। দুর্গাপুজো এবার কলকাতায় একসঙ্গে কাটাব ঠিক করেই রেখেছি। রানা তোদের নিয়ে অসম্ভব চিন্তায় রয়েে। ওকেও আনন্দের খবরটা জানাতে হবে। দিদির উপর বিশ্বাস রাখ মলি। তোর সংসার তোর প্রতীক্ষায় রয়েে। ব্যস শুধু নিজের বাড়ি ফিরে আয় মলি।

ঠিক আছে দিদি। তোমরা যা চাও তাই হবে, মলির স্বরে প্রাণ ফিরে এসেছে হিমানী ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

নে ভাই, এবার তুইও সুস্থ হয়ে নে, তাড়াতাড়ি আমরা সবাই একসঙ্গে এলাহাবাদ যাব, হিমানী মলয়ের কপালের জলপট্টিটা বদলাতে বদলাতে মৃদু হেসে বলে।

মলয়কে ওষুধ খাইয়ে হিমানী উঠে গিয়ে স্বামীকে ফোন করল, মলি আর মলয়ের সুসংবাদটা দেবে বলে।

সিদ্ধান্ত

অফিসে পৌঁছে টেবিলে ফাইলগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে দীপান্বিতা কাজে বসে পড়ল। এমাসে দুটো ফুল-ডে আর একটা হাফ-ডে লিভ এরমধ্যেই নেওয়া হয়ে গেছে। তার উপর মার্চ মাস পড়তে মাত্র নয় দিন বাকি। এর মধ্যে জমা কাজগুলো শেষ করে ফেলতে হবে। ঘড়ি দেখল দীপান্বিতা। আজকে লাঞ্চের আগে অনেকটা কাজ সেরে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল ও।

টেবিলে নামিয়ে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ-ই বেজে উঠল। বিরক্ত হল দীপান্বিতা। স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখল রঞ্জনের নাম। নামটা দেখেই ও শঙ্কিত হয়ে উঠল। রোজই কোনও না কোনও বাহানায় দীপু-কে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়াটা রঞ্জনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নামেই রঞ্জন ওকে ডাকে। দুমাস হল ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছে, শুধু রঞ্জনের একটা প্রেমোশনের আপেক্ষা। তারপরেই ও বিয়েটা সারতে চায়। অথচ প্রায়দিনই রঞ্জনের কোনও না কোনও আত্মীয় দীপান্বিতার সঙ্গে দেখা করতে চায়, এই অজুহাতে রঞ্জন দীপু-কে জোর দেয় ওর বাড়ি আসতে। এটা দীপান্বিতার একেবারেই পছন্দ নয়। অথচ মা-বাবা দেখেই এই বিয়ে ঠিক করেছেন তাই রঞ্জনের সঙ্গে দেখা না করলে

মা-বাবা মনে কষ্ট পাবে এই ভেবে দীপান্বিতাও হবু বরের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে থাকে।

‘হ্যালো’, ফোনটা কানের কাছে নিয়ে আসে দীপান্বিতা।

‘দীপু, আমি বলছি। আজ প্লিজ হাফ ডে নিয়ে নাও অফিসে। মাসি হঠাৎ-ই গতকাল রাতে আমাদের বাড়ি এসেছে। মাত্র দু’দিন থাকবে। তোমাকে খুব দেখতে চাইছে। আগে শুধু একদিন তোমাকে দেখেছিল। আমি ঠিক দুটোর সময় তোমাকে অফিস থেকে তুলে নেব। আর হ্যাঁ, বাড়ি গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে শাড়ি পরে নিও। আমি অপেক্ষা করব। মাসি আবার একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। তোমাকে অন্য পোশাকে দেখলে কিছু একটা মন্তব্য করে বসতে পারে।’

‘শোনো রঞ্জন, আজ আমি কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না, আর হাফ-ডে মাসে একটাই নিতে পারি। সেটাও তো নেওয়া হয়ে গেছে।’

‘দীপু, আমি মা-কে কথা দিয়ে এসেছি যে তোমাকে নিয়েই আসব। সুতরাং ছুটি তুমি কীভাবে ম্যানেজ করবে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আসতে তো তোমাকে হবেই। এছাড়াও তুমি এলে রান্নাঘরেও মা-কে একটু সাহায্য করে দিতে পারবে।’

‘আমাকে কিছু না জানিয়েই তুমি কীভাবে কথা দিয়ে দিলে রঞ্জন?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল দীপান্বিতা।

‘তোমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? সব কাজ কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে করতে হবে নাকি?’

‘হ্যাঁ রঞ্জন, আমার সঙ্গে যে-কাজটার সম্পর্ক থাকবে সেটা অবশ্যই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে বই কি… একে তো মাঝেমাঝেই তুমি কারও না কারও সঙ্গে দেখা করাতে আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাও আর নিজে কোথায় উধাও হয়ে যাও। তোমার আত্মীয়স্বজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেই পারেন। কিন্তু রঞ্জন, বারবার তোমাদের বাড়ি যাওয়াটা কি দেখতে আদৗ ভালো লাগে?’

‘দীপু, এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি এর মধ্যেই তুমি আমাদের বাড়ি যেতে চাইছ না? নাকি আমার বাড়ির লোকেদের তোমার আর পছন্দ হচ্ছে না?’ বেশ রেগেই প্রশ্নটা করে রঞ্জন।

‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছ রঞ্জন। আমি মোটেই একথা বলিনি। বরং আমি তোমার সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে চাই। তোমাকে আরও জানতে চাই যাতে আমরা একে অপরকে আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারি, পছন্দ-অপছন্দগুলো জানতে পারি’, বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে দীপান্বিতা।

‘কোনও দরকার নেই অত বোঝবার। বোঝা-শোনার জন্য সারাটা জীবন পড়ে আছে। আমার বাড়ির লোকেরা তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে চায় আর তোমার উচিত ওদের মনের ইচ্ছা পূরণ করা। আমি ঠিক দুটোয় তোমাকে নিতে আসব, গেটে দাঁড়িও’, বলে ফোন কেটে দেয় রঞ্জন।

রঞ্জনের অফিস দীপান্বিতার ঠিক পাশের বিল্ডিং-এই। প্রথম প্রথম আসতে যেতে দুজনের প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। আগে আলাপ, তারপর বন্ধুত্ব। রঞ্জনের বাড়ি থেকেই দীপান্বিতার মা-বাবার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রোপোজালটা আসে। যেহেতু রঞ্জন মেয়ের ভালো বন্ধু, তাই ওনারাও সম্মতি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। দেড় মাসের মধ্যে বিয়ের কথা হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেই কারও না কারও সঙ্গে দেখা করাতে দীপান্বিতাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে জোর দেওয়া শুরু করে রঞ্জন। প্রথম প্রথম দীপান্বিতার ভালোই লাগত যে শ্বশুরবাড়ির সকলেই ওকে দেখতে চায় কিন্তু পরে সেটাই ওর গলার কাঁটা হয়ে উঠল।

দীপান্বিতা চাইত রঞ্জনের সঙ্গে সময় কাটাতে যেটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল। সব জিনিস নিয়েই রঞ্জন নিজের মতামত পোষণ করত। এমনকী দীপান্বিতা কী পোশাক পরবে, বাড়িতে কী রান্না হবে, এমনকী টিভির চ্যানেল কী থাকবে সবটাই রঞ্জনই নিয়ন্ত্রণ করত।

একদিন বাড়িতে ছুটির দিনে দীপান্বিতা খাবার টেবিলে সবেমাত্র বসেছে মা-বাবার সঙ্গে একসাথে মধ্যাহ্নভোজ সারবে বলে, হঠাৎই রঞ্জন বাড়িতে এসে হাজির।

ওকে দেখে দীপান্বিতার মা শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে চেয়ার এগিয়ে দিলেন রঞ্জনের দিকে, ‘এসো বাবা, তুমিও আমাদের সঙ্গে বসে পড়ো।’

‘না-না মাসিমা, আজ আর খাওয়া হবে না। এখুনি আমাকে বেরোতে হবে। তাছাড়া দেখছি মাছ রান্না করেছেন। ওটা আমি আবার একদম খেতে পারি না’, বিরক্তির ভঙ্গিতে উত্তর দেয় রঞ্জন।

এবার দীপান্বিতার বাবা পাশ থেকে বলে ওঠেন, ‘আমার মেয়ের আবার মাছ দারুণ পছন্দের।’

‘তাতে কী হয়েছে?’ রঞ্জন জবাব দেয়, ‘এখন পছন্দ যত খুশি খেয়ে নিক, বিয়ের পর তো আর খাওয়া হবে না, আমার পছন্দ মতোই ওকে খেতে হবে।’

‘তার মানে?’ চমকে ওঠেন দীপান্বিতার বাবা।

রঞ্জনের ভুরু সামান্য কুঁচকে উঠল, ‘মানে আবার কি মেশোমশায়ই, স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ের পর দীপুকে আমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী তো চলতে হবে… আমার কথা শুনে চলবে আমার বউ এটাই তো আমাদের সমাজের রীতি।’

‘উঁহু রঞ্জন’ কথার মাঝেই দীপান্বিতা বলে উঠল, ‘সবকিছু আমি তোমার ইচ্ছেমতোই বা করব কেন? আমার জীবন আমি আমার মতন করে কাটাতে চাই। তোমার ইশারায় আমি নাচব না’, দীপান্বিতার দুই চোখে কৗতুকের ঝলক।

‘দীপু, একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো। আজও সমাজে পুরুষের মর্যাদা নারীর থেকে অনেক বেশি। সুতরাং বিয়ের পর তোমার নয়, আমার কথাই…’

‘আরে আরে রঞ্জন রাগারাগি বন্ধ করো’, মা, রঞ্জনকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেন… ‘তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বসো, দীপু খেয়ে উঠেই যাচ্ছে।’ রঞ্জন বাইরে চলে গেলে মা বললেন, ‘দেখ দীপু, প্রথম প্রথম রঞ্জন হয়তো তোর উপর একটু অধিকারবোধ দেখাতে চাইছে। পরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। সংসার মানেই দুটো মানুষের মধ্যে অ্যাডজাস্টমেন্ট। চিন্তা করিস না। খাওয়া সেরে দুজনে বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে আয়, ভালো লাগবে।’

দীপুকে বুঝিয়ে বললেও মায়ের চোখে চিন্তার গাঢ় ছায়া ঘনিয়ে এল।

রঞ্জনের প্রোমোশন হতেই ওদের বিয়ের দিন স্থির করা হয়ে গেল। দুই বাড়ির ইচ্ছেতে শীতকালটাই বাছা হল বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। এর মধ্যে দীপান্বিতা আর রঞ্জন কিছুটা করে সময় নিজেদের জন্য বার করে নিত, দেখা করত অফিসের বাইরে সুবিধামতো। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে এমবিএ করেছিল দীপান্বিতা। ওর নিজস্ব কিছু ভাবনা, কিছু স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ সময় রঞ্জনের কথাই ওকে শুনে চলতে হতো। কেমন জানি স্বার্থপর হয়ে উঠত রঞ্জন। বাধ্য হতো রঞ্জনের কথামতো চলতে।

একদিন রঞ্জন জানাল, অফিসের পর ওর কিছু বন্ধুবান্ধব দীপান্বিতার সঙ্গে দেখা করতে চায়। দীপান্বিতাও রাজি হল আসতে যেহেতু অফিসের পরই পুরো ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করা হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে ঠিক সেদিনই অফিস ছুটির কিছু আগে কোম্পানির এমডি কয়েকজনকে নিয়ে মিটিং কল করলেন যার মধ্যে দীপান্বিতারও নাম ছিল। ও সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনকে ফোন করে খবরটা জানাল। তা-সত্ত্বেও রঞ্জন জোর করতে লাগল আসার জন্য যেটা একেবারেই সম্ভব ছিল না। মোবাইল সাইলেন্ট মোড-এ রেখে দীপান্বিতা মিটিং-এ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে সন্ধে গড়িয়ে গেল। রঞ্জন বন্ধুদের সঙ্গে অপেক্ষাই করতে থাকল। অভ্যাসবশত বারবার মোবাইলে ফোন করতে থাকল রঞ্জন। মোবাইল সি্্ক্রনে রঞ্জনের নাম ফুটে উঠতে দেখেও দীপান্বিতা মিটিং-এর মাঝে ফোন তুলতে পারল না।

এদিকে বারবার ফোন করলেও দীপান্বিতা ফোন না ধরায় রঞ্জনের রাগ বাড়তে লাগল। মিটিং শেষ হতে আটটা বেজে গেল। কাজের থেকে ফ্রি হয়েই মোবাইলে চোখ রাখল দীপান্বিতা। রঞ্জনের বাইশটা মিস্ড কল দেখে ঘাবড়ে গেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল রঞ্জনকে।

ফোন বাজতেই নিজের রাগ সামলাতে পারল না রঞ্জন, ফোনেই দীপান্বিতার উপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি নিজেকে কী ভাবো? আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আর তুমি আসবার দরকারই মনে করলে না। বন্ধুদের সামনে আমাকে অপমান না করলেই চলছিল না? আমি কতবার তোমাকে ফোন করেছি… একবারও তুলতে পারলে না… এতই ব্যস্ততা তোমার?

রঞ্জনের চ্যাঁচামেচিতে ঘাবড়ে গিয়ে দীপান্বিতা প্রথমে কোনও উত্তরই মুখে আনতে পারল না। তারপর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘রঞ্জন, আমি তো মিটিং আছে জানতে পেরেই তোমাকে ফোন করেছিলাম। জানিয়েছিলেম যে আজ কিছুতেই আসা সম্ভব হবে না। এমডি-র সঙ্গে মিটিং… তুমি তো ভালো করেই জানো এই ধরনের মিটিং-এ ফোন সাইলেন্ট-এ রাখতে হয়।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সব জানি। আমাকে শেখাবার কোনও দরকার নেই। তোমাকে আমি যখন আসতে বলেছি তখন আসতে হবে… আমার কাছে তোমার কাজটা সেকেন্ডারি’ রাগের মাথায় রঞ্জনের মুখে যা এল তাই দীপান্বিতাকে বলে গেল।

রঞ্জনের ফোনটা আসার পর থেকেই দীপান্বিতা মনে মনে একেবারে ভেঙে পড়ল। আজকেই সকালে নিজের প্রোমোশনের খবরটা পেয়েছিল দীপান্বিতা। উদগ্রীব হয়ে ছিল কতক্ষণে রঞ্জনকে খবরটা জানাবে কিন্তু সে সুযোগটুকুও ওর কপালে জুটল না। বিয়ের দিন যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই দীপান্বিতার মনে হতে লাগল একটা বোঝা যেন ওর মাথার উপর চেপে বসছে যেটার ভার সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। আজও ওর মনে হল, ও মস্ত কোনও ভুল করে ফেলছে না-তো রঞ্জনকে বিয়ে করবে স্থির করে।

বাড়ি যখন ফিরল ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। মানসিক ভাবে নিজেকে বড়ো বিপর্যস্ত মনে হল ওর। বাড়িতে ফিরে দেখল মা কোথাও বাইরে বেরিয়েছেন, বাবা একাই বাড়িতে। দীপান্বিতাকে দেখে বাবা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেলেন মেয়ের জন্য চা তৈরি করতে। দীপান্বিতা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল চা অলরেডি টেবিলে হাজির।

‘বাবা, তুমি কেন চা তৈরি করতে গেলে? আমি তো আসছিলামই’, চেয়ার টানতে টানতে বাবাকে বলে দীপান্বিতা।

‘মা, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অফিসে খুব বেশি চাপ ছিল? মিটিং কেমন হল? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? আজও রঞ্জনের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিস?’ বাবার একের পর এক প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতে হল দীপান্বিতাকে।

‘বাবা, তোমার কি মনে হয় আমিই সবসময় ঝগড়া করি? আজকে তো রঞ্জনের সঙ্গে ফাটাফাটি ঝগড়া হয়ে গেছে। আজকে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল কিন্তু এমডি-র সঙ্গে মিটিং ফিক্স হওয়ার পর আমি ওকে আগাম জানিয়ে দিই যে, আমি কোনওভাবেই আজ যেতে পারব না। তা-সত্ত্বেও ও কতগুলো যে কল করে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। মিটিং শেষ হতেই আমি ওকে ফোন করেছি কিন্তু ভালো ভাবে কথা বলা তো দূরের কথা, এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করল যে, আমার কথা বলারই কোনও সুযোগ হয়নি। এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি… কোন অধিকারে ও আমার উপর এভাবে চ্যাঁচাবার সাহস পায়? ও নিজেও চাকরি করে সুতরাং আমার অসুবিধে ও কেন বোঝার চেষ্টা করবে না? স্বামী বলেই ও আমার উপর বসিং করবে আর আমার দোষ না থাকলেও স্ত্রী বলে সব শুনে যাব? এভাবে তো চলতে পারে না’, দ্বীপান্বিতার কথায় ওর মনের ভাব পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

বাবা কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যে-মেয়েকে তিনি সবসময় আগলে এসেছেন, তাকে আজ এতটা অসহায় দেখে কী বলবেন, ভেবে পেলেন না।

দু’জনে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই দ্বীপান্বিতার মা-ও চলে এলেন। দুজনকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে মিটিং থেকে কখন ফিরলি?’

‘আধ ঘন্টার উপর হয়ে গেছে মা।’

‘সকালে প্রোমোশনের কথা বলছিলিস, কিছু জানতে পারলি কি?’

‘হ্যাঁ মা, আমার প্রোমোশন হয়েছে। স্যার আজকে জানালেন।

দু-দিনের মধ্যে কাগজ হাতে পেয়ে যাব।’

‘বাঃ, এ তো খুবই খুশির খবর। কিন্তু তুই এরকম মনমরা হয়ে রয়েছিস কেন? রঞ্জনকে ফোন করে আসতে বললে পারতিস তো, বাড়ির জামাই বলে কথা। এতে আমাদের খুশি আরও দ্বিগুন হতো’, মা উঠতে উঠতে বললেন।

দীপান্বিতা ‘না’ করা সত্ত্বেও মা জোর দিতে লাগলেন রঞ্জনকে খেতে ডাকার জন্য। বাধ্য হয়ে বাবা উঠে রঞ্জনকে ফোন করলেন কিন্তু রাত্রি হয়ে যাওয়াতে রঞ্জন জানাল ও পরের দিন আসবে। রাত্রে ওদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করতে রাজি হয়ে গেল ও।

পরের দিন দীপান্বিতা অফিসের কাজ নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকল। ইচ্ছে হল না রঞ্জনকে একটা ফোন করে কথা বলে। সারাদিনই মনটা বিষণ্ণ রইল। সন্ধেবেলায় মা-কে রান্নাঘরে একটু সাহায্য করে দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল।

ওর বাড়ি ফেরার প্রায় এক ঘন্টা পর রঞ্জন এসে পৌঁছোল। এসে জানতে পারল নিমন্ত্রণের কারণটা। দীপান্বিতার প্রোমোশনের খবরটা পেয়ে খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। বরং আরও গম্ভীর হয়ে উঠল ওর চোখমুখ। বাড়িতে কারওরই নজর এড়াল না। দীপান্বিতার মা জিজ্ঞেস করেই বসলেন, ‘কী হল রঞ্জন, তুমি খুশি হওনি?’

‘একটা প্রোমোশনে এত খুশি হওয়ার কী আছে? বাড়িতে তো ওকে কোনও কাজ করতে হয় না… সব কাজ আপনিই করেন। সুতরাং কোম্পানির কাজ ও মন দিয়ে করতে পারে। মন দিয়ে কাজ না করলেও প্রোমোশন যখন হবার তখন হবেই’, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেয় রঞ্জন। দীপান্বিতার মুখের দিকে চোখ পড়তেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘দীপু এখানে যা করছ করে নাও, আমার বাড়িতে এসব চলবে না। বাড়ির সব কাজ তখন তোমাকে করতে হবে। বউ এলে মা আরাম করবে… ওখানে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। বাড়ির বউ, বউয়ের মতোই থাকবে, মেয়ে হয়ে ওঠার চেষ্টা কোরো না…’। আরও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিল রঞ্জন আর বাকি তিনজন অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, ‘একী রঞ্জন, এসব তুমি কী বলে যাচ্ছ? আজকালকার ছেলে তুমি, এরকম সংকীর্ণ মানসিকতা কী করে হয় তোমার? আমি অবাক হচ্ছি… দীপু তোমার বউ হতে চলেছে… ওকে অপমান অন্তত কোরো না।’

‘প্লিজ মেশোমশাই, আপনি আমাদের দুজনের মধ্যে পড়বেন না। দীপুকে আগে থেকে আমি সব বলে দিতে চাই যাতে পরে গিয়ে ও আমাকে দোষারোপ না করতে পারে।’

ঘটনাক্রম কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে চুপ করে খাবার খেয়ে নিল। আনন্দের পরিবেশ বিষাদে পরিণত হল। খাবার খেয়েই রঞ্জন বেরিয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল অনেকগুলো প্রশ্ন।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। মাত্র আর এক মাস বাকি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনের স্বভাবের সত্যিটাও সকলের দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। জেদ, স্বার্থপরতা, হীন মনষ্কতা মানুষকে কতটা নীচে নামাতে পারে তার উদাহরণ প্রতিনিয়ত সকলের সামনে ফুটে উঠতে লাগল। ও কারও কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, অথচ সকলকে ওর ইচ্ছা অনুসারে চলতে হবে।

রঞ্জনের মা ভালোমানুষ, বহুবার দীপান্বিতাকে বলেছেন, রঞ্জন যেমন ব্যবহার করে দীপান্বিতাও যেন ওর সঙ্গে ওই একই রকম ব্যবহার করে। একমাত্র ওই উপায়তেই রঞ্জনকে বোঝানো যাবে ও যা করছে ভুল করছে।

কিন্তু দীপান্বিতার মন সায় দেয়নি। একটা মানুষকে সঠিক রাস্তায় আনতে এটা কখনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। রঞ্জনের মতো ব্যবহার করতে থাকলে জীবনযুদ্ধে যে ও জয়ী হবেই তার নিশ্চয়তা কী?

অশান্ত মন-কে শান্ত করার কোনও উপায় ছিল না দীপান্বিতার কাছে। কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, প্রতিনিয়ত তার সন্ধান করতে থাকত ও। অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। দীপান্বিতা তাকিয়ে দেখল রঞ্জনের ফোন। তুলতে ইচ্ছা হল না… রিং বাজতেই থাকল, তারপর একসময় কেটে গেল। দ্বিতীয়বার ফোনটা বাজতেই মা এসে ফোনটা ধরে দীপান্বিতার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাধ্য হয়ে ওকে কথা বলতেই হল।

‘হ্যালো, কী করছিলে? ফোন তুলছিলে না কেন? আচ্ছা শোনো আজকে একবার দেখা করতে চাই। পুরো ছুটি নিতে পারলে ভালো নয়তো হাফে বেরিও। কী করবে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিও। আর হ্যাঁ, অ্যাভয়েড করার চেষ্টা কোরো না, নয়তো আমি তোমার অফিসে পৌঁছে যাব।’

রঞ্জনের শাসানি শুনে দীপান্বিতা ভয় পেল। বুঝতে পারল ছুটি না নিলে রঞ্জন সত্যি ওর অফিস পৌঁছে যাবে। বাধ্য হয়ে অফিস পৌঁছে হাফ-ডে-র জন্য দরখাস্ত করল। ছুটি মঞ্জর হতেই রঞ্জনকে ফোনে জানিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি করে দেড়টার মধ্যে অফিসের সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে রঞ্জনের অপেক্ষায় বসে রইল।

ঠিক দুটোর সময় রঞ্জন নিজের গাড়িতে ওকে তুলে নিয়ে পরিচিত একটি রেস্তোরাঁয় এসে বসল।

‘কী ব্যাপার, হঠাৎ ছুটি নিতে বললে কেন?’ দীপান্বিতা জিজ্ঞেস না করে পারল না।

‘আসলে তোমাকে কিছু জরুরি কথা বলার ছিল’, একটু ভেবে উত্তর দিল রঞ্জন, ‘দীপু, আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের বিয়ে। তারপর তুমি আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে যাবে। যদিও এখনও তোমার ওখানে আসা-যাওয়া রয়েছে তবুও কয়েকটা জিনিস আমি পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই। আমার বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি নয় সুতরাং বউয়ের মতন তোমাকে থাকতে হবে। বাপের বাড়ির মতো স্বাধীনতা ওখানে থাকবে না, বাড়ির সব কাজও তোমাকেই করতে হবে। আমি এত কথা তোমাকে বলছি কারণ আমার মনে হয় বাড়ি আর অফিস দুটো একসঙ্গে সামলানো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি বরং চাকরি-টা ছেড়ে দাও।’

চমকে উঠল দ্বীপান্বিতা, ‘কী বলছ রঞ্জন তুমি? চাকরি কেন ছাড়ব? বাড়ি আর চাকরি দুটোই আমি একসঙ্গে ভালো ভাবে সামলাতে পারব, এই বিশ্বাসটুকু আমার নিজের উপরে আছে। তোমাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না, শুধু আমার উপর বিশ্বাস রাখো’, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে দীপান্তিতা বলে। যদিও রঞ্জনের যা স্বভাব, তাতে ও যে এই কথাগুলো মেনে নেবে না সেটা দীপান্বিতা খুব ভালো ভাবেই জানত, তবুও ও শেষ চেষ্টা একবার করে দেখতে চাইল।

‘দীপু, আমি তোমার মতামত নিতে বা তোমার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য এখানে আসিনি। আমি কি চাই, সেটা তোমাকে পরিষ্কার করে বলব বলে এখানে ডেকেছি। চাকরি তোমাকে ছাড়তে হবে আর জেনে রাখো আমার বাড়ির নিয়ম হচ্ছে সব সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নেবে… নিজের কাজের দক্ষতা দেখাতে চাও বাড়িতে বসে দেখাও। আমার উপর ছড়ি ঘোরাবার চেষ্টা কোরো না। আমার বাড়িতে আমি যা বলব তাই মানতে হবে, এটা তুমি যত তাড়াতাড়ি মেনে নেবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল। আজ এখন উঠব, একটা কাজ আছে’, বলে রঞ্জন উঠে দাঁড়াল এবং দীপান্বিতা-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

পেছন থেকে দুবার ডাক দিতেও যখন রঞ্জন ফিরে তাকাল না, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দীপান্বিতা উঠে দাঁড়াল। রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। বাড়ি ফিরতেই বাবা মেয়েকে দেখে বুঝে গেলেন বড়োসড়ো কোনও ঝড় বয়ে গেছে মেয়ের উপর। মেয়েকে বসিয়ে ভিতর থেকে ওর জন্য খাবার জল এনে সামনে রাখতেই দীপানিবতা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। বাবার বুকে মাথা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

‘কী হয়েছে দীপু, কাঁদছিস কেন মা?’

‘বাবা, আজ রঞ্জন দেখা করতে এসেছিল’, চোখ মুছে দীপান্বিতা পুরো ঘটনা বাবাকে খুলে বলল। সব শুনে উনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, এখনই বিয়ের আগে যদি রঞ্জনের এরকম ব্যবহার হয় তাহলে বিয়ের পর কী হবে?

‘বাবা, বিয়ের পর আমি কিছুতেই রঞ্জনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব না… আমার মন কিছুতেই এই বিয়েতে সায় দিচ্ছে না, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না’, কান্নাভেজা গলায় বাবাকে জানায় দীপান্বিতা।

‘এত উতলা হোস না মা। তোর মা বাড়িতে ফিরুক, আলোচনা করে দেখি। তুই গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’

হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে বসতেই মা ফিরে এলেন। দীপান্বিতা উঠে গেল তিনজনের জন্য চা বানিয়ে আনার জন্য। চা করে এনে বসে পড়ল সোফায়। বাবাই রঞ্জনের কথাটা তুললেন চা খেতে খেতে, ‘শুনছ, আজ রঞ্জন এসেছিল দীপুর সঙ্গে দেখা করতে। দীপুকে চাকরি ছাড়তে বলেছে। দীপু রঞ্জনকে বিয়ে করতে চাইছে না… কী করা যায়? বাবা জানতে চাইলেন।

মা তাকাল মেয়ের দিকে, বলল, ‘দীপু, প্রথম থেকেই রঞ্জনের স্বভাব, ওর ব্যবহার আমার অদ্ভুত মনে হয় কিন্তু তাও আমার মনে হতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোরা দুজন দুজনকে চিনবি, বুঝতে পারবি। কিন্তু আজ তুই অন্য কথা বলছিস। বিয়ের আর এক মাসও বাকি নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে বলা হয়ে গেছে… সবকিছু গোছানো শেষ… এই সময় সম্বন্ধ ভেঙে গেলে সবাই মেয়ের দোষই ধরবে।’ বেশ চিন্তিত মনে হল মায়ের কণ্ঠস্বর!

মায়ের কথায় লজিক ছিল এটা অস্বীকার করতে পারল না দীপান্বিতা। ভারাক্রান্ত মনে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে দিল ক্লান্ত শরীরটাকে। চেষ্টা করেও বিয়ের জন্য মনটাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারল না ও। রঞ্জনের প্রতি মনজুড়ে বিতৃষ্ণা ভরে গেছে ওর, এই অবস্থায় কী করে ও রঞ্জনকে স্বামী বলে মেনে নেবে ভেবে পেল না।

সকালে উঠে প্রতিদিনের মতো টেবিল থেকে চা আনতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হল দীপান্বিতা। ইশারায় টেবিলে বসতে বললেন ওকে তারপর উঠে এসে মেয়ের পাশে বসে ওর হাত দুটো তুলে নিলেন নিজের হাতে। আশ্বাসের সুরে বললেন, ‘অনেক ভেবে দেখলাম বুঝলি মা, রঞ্জনকে ফোন করে বলে দে যে তুই ওকে বিয়ে করবি না… তারপর যা হবে আমি আর তোর মা বুঝে নেব।’

‘বাবা তুমি এটা কি বলছ? সত্যিই আমি রঞ্জনকে বলে দেব যে ওকে আমি বিয়ে করব না?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে দীপান্বিতা।

‘হ্যাঁ মা, কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর তোর মা এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। মেয়ে সুখে থাকুক, মনের মতো স্বামী পাক এটাই সব মা-বাবার ইচ্ছা থাকে। যে-সম্পর্কটাকে বিয়ের আগেই বোঝা মনে হচ্ছে আমার মেয়ের, বিয়ের পর সেই সম্পর্কটাই হয়তো মেয়ের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এর থেকে ভালো সম্পর্কটা ছেড়ে বেরিয়ে আসা। যা মা যা, তুই আর দেরি করিস না। এখনই ফোনটা কর।’

দীপান্বিতার হঠাৎ-ই মনে হল মাথাটা খুব হালকা লাগছে। মাথার উপর চেপে থাকা ভারী বোঝাটা নেমে গিয়ে বেশ ফুরফুরে মনে হল নিজেকে। মা-বাবার আশীর্বাদ রয়েছে যে ওর উপর।

মোবাইলটা হাতে তুলতেই ওটা বেজে উঠল। রঞ্জন ফোন করছে। একটু শ্বাস নিয়ে দীপান্বিতা এপাশ থেকে উত্তর দিল, ‘হ্যালো…’ রঞ্জনের অধীর কণ্ঠ ভেসে এল, ‘দীপু, কী ঠিক করলে তাহলে? আজ রেজিগনেশনটা দিচ্ছ না, দিচ্ছ না?’

‘না রঞ্জন, রেজিগনেশন আমি দেব না। এই মুহূর্তে আমি তোমার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাকে আমি বিয়ে করব না।’

রঞ্জন ‘হ্যালো… হ্যালো…’ করতে করতেই দীপান্বিতা ফোনটা কেটে দিল। একটা সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল অথচ দীপান্বিতার মনে তার বিন্দুমাত্র রেখাপাত ঘটল না।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব