পিঙ্গলার প্রেম

বুনো বিড়ালটা এক মোক্ষম শিকার ধরেছে। ঠিক ধরেনি। হদিশ পেয়েছে। পাহাড়ের গর্তে মুখ ঢোকাচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। দু’পা এগোচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। শিকার যে একটা জবরদস্ত পেয়েছে সেটা বোঝা যায়, লেজ নাড়ানোর বহর দেখে। তিড়িক তিড়িক করে লেজ নাড়িয়েই চলেছে। এটা তার শিকার ধরার আক্রমনাত্বক শানিত অস্ত্র। শিকার রেঞ্জে এলে তবেই সিওর শট। শিকার পিঙ্গলাও পেয়েছে। তিনটে ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো বসিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। একটা ভাঙা কড়াইয়ের ভিতরে উই পোকার ডিম ফ্রাই হচ্ছে। পিঙ্গলার দৃষ্টি এড়ায়নি। ঘরের থেকে বর্শাটা এনে উনুনে লাল করতে থাকে। ঘর বলতে পাহাড়ের গুহা। গুহাটা বেশি বড়ো নয়। একটু বড়ো সাইজের ফোকর। তারই মধ্যে জঙ্গলের কাঠ দিয়ে তক্তপোশ বানানো। বুড়া বাপটার জন্য। বুড়া বাপটা একটানা কেশেই চলেছে। সূর্যের উদয় অস্ত আছে। বুড়ার কাশিতে উদয় আছে, অস্তটা নেই। থেকে থেকে চ্যাঁচায়– এ বিটিয়া ভুখ লাইগছে রে।

গর্তের মধ্যে মুরগিটা ঘাপটি মেরে বসেছিল। বেচারা মুরগি! পালাবার বিকল্প পথও নেই। দেহটা মুরগির মতো। মুখটা মুরগির মতো নয়। মুখটা থ্যাবড়ানো। প্যাঁচার মতো। বনবিড়ালটা তাক করেছে মুরগিটাকে। পিঙ্গলা ভাবছে, আর বিড়ালটার গতিবিধি নজর করছে। পাহাড়টা সবার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। যত উন্নাসিকতা মানুষ নামক জীবগুলোর খাদ্যের বেলায়। বিড়ালটা এক কিম্ভূত কিমাকার আওয়াজ করে লেজটা সটান বীর বিক্রমে খাড়া করে মুরগির মাথাটা কামড়ে ধরে। হতভাগা মুরগি। মরণ যন্ত্রণার আর্তনাদটুকু করার পর্যন্ত সময়ও পেল না। ততক্ষণে পুরো মাথাটাই বিড়ালের মুখের ভিতর। পিঙ্গলার মনে এক অদ্ভুত রকমের জিঘাংসার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন ছিটকে বেরোতে চায়। দু’দুটো দিন অনাহারে থাকতে থাকতে তারই সামনে বনবিড়ালটা খাবারটা চিবোচ্চে। পিঙ্গলা ঠিক থাকতে পারে না। আগুনের ভেতর থেকে তপ্ত বর্ষাটা বার করে হিংস্র বাঘিনীর মতো বিড়ালটার পুচ্ছদেশে সেদিয়ে দেয়। হত্যার উন্মত্ত আনন্দে পিঙ্গলার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে।

দেবার মেজাজ আজ বেশ রিলাক্সড মুডে। গতকাল ত্রিদেবের মেয়ের বিয়ের ভূরিভোজনে শরীর মন দু’টোই বেশ চাঙ্গা। ভুরিভোজনের চাইতেও বড়ো, খাবারের পুঁটুলি লাঠির ডগায় নিয়ে পরমানন্দে পাহাড়ের বেষ্টনী ডিঙিয়ে চলেছে কুঠুরির দিকে। উদরস্থ খাদ্যবস্তুর পঁচাত্তর শতাংশ পথেই খরচ করেছে। বাকিটা এখনও পেটে গজগজ করছে। এসব অনায়াসে হয়নি। আমদানি করা খাসি কেটে মাংস থেকে জ্বালানি জোগাড় করা ছাড়াও নানা রকম ফাইফরমাসের বিনিময়ে হয়েছে।

পিঙ্গলা বসেছে বর্শার ফলা দিয়ে মৃত বিড়ালটার চামড়া ছাড়াতে। থেকে থেকে গুহার ভিতর থেকে বুড়ার সেই ফাটা কাশির আওয়াজ– পিংলা, ভুক্ষ লাইগছে রে। পিঙ্গলা সাড়া দেয় না। আপন মনে কাজ করে আর গজগজ করে। বুড়ার অভিভাবক পিঙ্গলা। অভিভাবকের ক্ষুদা তৃষ্ণা থাকতে নেই। পেছন দিক থেকে দেবা লম্বা লাঠির মাথায় পুটুলি নিয়ে পিঙ্গলার পিছনে দাঁড়ায়।

– এ পিংলা, এ-তু কি করছিস বটেক? পিঙ্গলা ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর দেখে নিয়ে বলে– কেনে, দিখতে লাইরছিস? জ্বলন, পেডের জ্বলন। ঘরকে দ্যাখ, বুড়ার মরণ ভুক্ষ লাইগছে। আবার সেই আওয়াজ– কুছ খেতে দে নারে। দেবা এক পলক দেখে নিয়ে বলে– তুয়ার ভুক্ষ লাগে নাই?

– হুঃ, মুয়ের ভুক্ষ লাইগতে নাই রে, দেবা। দেবা লাঠির মাথায় বাঁধা পুটুলিটা খুলে নিয়ে বলে– পিংলা, এ কামডা মু করছি। তু ঘরকে যা। এ খাবারডা তু খা, আর বুড়াকে দে।

– তু খাবেক নাই কেনে? মু তো খাইছি বটেক।

তিলাবনী পাহাড়। ছোটো নাগপুরের মালভূমি অঞ্চলের এক মিনি সদস্য। দৈত্যাকার নয়। শান্তস্নিগ্ধ। শীতের কুয়াশায় অলসতায় আকাশের বুকে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভৌগোলিক অক্ষরেখায় নামটা আছে। বাহ্যিক দাম্ভিকতা নেই। অন্তরে আছে। কোলে কোলে অজস্র গ্রাম। শ্রাবণের ধারা কৃষি জমিকে উর্বর করে। তিলাবনী বুক চিরে লোকালয়ের সঙ্গে রাস্তা তৈরি করেছে। জীবনযাত্রা বর্ণময় না হলেও দুর্বিষহ নয়। তারই অপর প্রান্তে বেজম্মার মতো জন্ম নিয়েছে জিয়ারা গ্রাম। বঞ্চিত। অবহেলিত। পদদলিত। শ্রাবণের রক্তরস নিংড়ে ছিবড়ে করে সমৃদ্ধ করেছে পাশেই পিচুলা গ্রাম। কোল দিয়ে অবারিত জলধারা সমতলে নদীর চেহারা নিয়েছে। পোশাকি নাম দ্বারকেশ্বর। জিয়ারা তার অবাঞ্ছিত বেয়ারা জারজ সন্তান। জিয়ারা অপভ্রংশ নাম।

রুক্ষ শুষ্ক। বছরের পর বছর ধরণে (খরা) বাঁজা মরুভূমিতে পরিণত। আর্তনাদ নেই। কলরব নেই। শক্তি নেই বলে। তিলাবনীর রুক্ষ পাথরের দেয়ালে সেঁদিয়ে থাকা মৃতদেহের দুর্গন্ধ চিল-শকুনের নাকে বিরিয়ানির স্বাদ এনে দিচ্ছে। নীল আকাশ কবে দেখা গেছিল কে জানে। গোটা আকাশ চিল-শকুন দখল করে নিয়েছে। ভাবলেশহীন তিলাবনী নীরব দর্শক। নীরব দর্শক সরকারি ত্রাণ দফতরও। ত্রাণ নিয়ে এ গ্রামে কেউ পা মাড়ায় না। ভোটও নেই। রাস্তাও নেই। বেজম্মা গ্রামে কারও মমত্ববোধ কাজ করে না।

শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। গ্রীষ্মে সূর্যের অগ্নিবৃষ্টি। এসবে তিলাবনী ভাগ বসায়নি। কেড়ে নিয়েছে শুধু শ্রাবণের ধারা। দেবা বসেছে উনুনের পাশে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া দেহটাকে সেঁকে নিতে। ঠিক সেঁকে নিতে নয়। বিড়ালের ঠ্যাংটাকে আগুনে ঝলসে নিতে। আলকাতরার পোঁচ লাগানো মুখে কোটরগত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অনাহারে শীর্ণ হয়ে যাওয়া হাত দুটো দিয়ে বিরানির মাংস খেতে খেতে পিঙ্গলা বলে– বেসাম খাবারডা ভালাই আনছিস বটেক। ইতে হরদিন কুছু খিতে লাইরবেক। দেবা, ই খাবার তু কুথা থেকে আনছিস? কেনে, পিচলার তিদেব বাবুয়ার মিয়ার বিয়া লাইগছে যে।

– ওহঃ, তা তু চোরি করিছ নাই ত?

– কেনে? বাবুয়ার ডেড়াতে কাম করলাম যে। উস লাইগা খাবারডা দিল ত। দেবা আগুনে লাকড়িটা খানিক ঠেলে দিয়ে বলে– বুড়া খাবারডা খাইছে? পিঙ্গলা ক্ষিপ্রতা নয়, অনুযোগের সুরে বলে– মুর বাপকে বুড়া বলবিক নাই। দেবা অনুযোগের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারপর রান্নার রসদ যুগিয়ে বলে– গুস্সা করছিস কেনে পিংলা। তুয়ার বাপ ত মুয়ার বাপ আইনছে বটেক।

পেটে মা লক্ষ্মী গিয়ে পিঙ্গলার খিটখিটে মেজাজ এখন শান্ত। বুড়া বাপটা ফাটা কাশি বন্ধ করে শীতের আড়ষ্টতায় দুই হাঁটু মাথা এক করে তিন মাথার বুড়া। মন বুঝে দেবা সুপ্ত ইচ্ছাটা বলেই বসে।

– পিংলা মিলায় যাবি কেনে?

– মিলা! কোন মিলা?

– শবর মিলা

– কুথা সে?

– রাজনা গাড়ে।

– আরে বা প! সে তো বহত দূর আছে বটেক। টঙ্কা লাগবেক তো।

– মুয়ের আছে। চলনা কেনে?

– ডাকাইতি করলি না-কি রে?

– কেনে কাম জুটাইছি যে। উ বাবুয়ার ডেড়ায়। হপ্তায় শ-টংকা দিবে। একশো টাকার একটা নোট বের করে বলে– ই দেখ না কেনে।

ত্রিশংকর হালদার এখানকার আদিবাসী নয়। বহুদিন আগে পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল ছেলেটা জীবিকার সন্ধানে ভাসতে ভাসতে তিলাবনীর পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পেশায় কোয়াক ডাক্তার। কুমিরের সাথে সখ্যতা না করলে জলে বাস করা যায় না। শ্রম দিয়ে চিকিৎসায়, সেবায়, ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ শবর জাতিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। হয়ে ওঠে শবর জাতির দেবতা। কতকটা বেঁচে থাকার তাগিদ কতকটা মানবিকতা, মূল্যবোধের তাগিদে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাবার মরিয়া চেষ্টা। ত্রিশংকর এখন দেবতা ত্রিদেব। তিলাবনীর কোলে মাথা গুঁজেই ত্রিশংকর জীবনের ধারাটা বদলে ফেলেছে। এরা বড়ো অসহায়। অশিক্ষা অজ্ঞতা যাদের একমাত্র অবলম্বন, হিংস্রতা ছাড়া বেঁচে থাকার পথ থাকে না। কাজটা যে সহজ, অনায়াসলভ্য তাও নয়। অনেক অত্যাচার, লাঞ্ছনা সহ্য করেও একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে জীবনের মধ্যগগনে বসে ভাবছে– সভ্যতার বিকাশ, উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া স্পর্শ করাতে পারলাম কই? অশিক্ষা, নির্বুদ্ধিতাকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ লুঠেরা অতি বিপ্লবীর দল বারে বারে কাজে লাগাচ্ছে। একদম বিফলে গেছে ঠিক তাও নয়। একজনকে অন্তত পেরেছে। দেবা। কাক কাকের মাংস খাওয়ার অনাবিল আনন্দে নয়। ধবংস নয়। দেবা আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত।

দীর্ঘ অনাহারে গুরু ভোজনের গুরু ভার বুড়া বহন করতে পারেনি। চিল শকুনের দল পজিসন নিচ্ছে। একটু একটু করে রাতের আঁধার নেমে আসছে। চিল-শকুনদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। গুটি গুটি পায়ে সরে যাচ্ছে। জায়গা নিল তিলাবনীর ফোকরে। হিমেল হাওয়ায় উনুনের পাশে বসে পিঙ্গলা আর দেবা উষ্ণতার নির্যাস নিচ্ছে। দেবা বলছে

– ভোর রাইতে এক স্বপন দিখলাম বটেক। পিঙ্গলার তর সয় না।

– কি স্বপন দিখলি? দিখলাম, জিয়ারা থিকা রাস্তা বানায়ছি পিচলাতক। কোতো গাড়ি আইছে। কোতো গাড়ি যাইছে। তিলাবনীর বুক ফাটায়ে জলের তোড় আনছি। মাঠ ডোবা জলে টইটম্বুর হইছে। মাঠ সবুজ। সগগলে কাম লইছে। পিঙ্গলা উদাস মনে দেবার স্বপ্নের বাসনা গিলছিল। এ বাসনা পিঙ্গলারও ছিল। সুপ্ত রেখেছে। প্রতিদিন যাদের মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়, এ স্বপ্ন পাহাড়ের চূড়ায় বসে ভৈরবী রেওয়াজের মতো। বাস্তবে ফিরেছে পিঙ্গলা।

– তিলাবনীর বুক ফাটায়ে রাস্তা বানায়ছিস?

– হ।

– জল আনছিস?

– হ।

– কোতো দিন সিনান করিস না বল না কেনে? তুয়ার মাথাডা গরম হইছে।

– কেনে?

– তু পাগল হইছিস বটেক।

– পাগল হই নাইরে পিংলা। উ রাস্তা হামি বানাবই। দিখে লিবি। উ চিল-শকুনের দল মু তাড়াবই। সগ্গলে জমিনে কাম করবেক। বাবুয়া কইছে– তু-ই পারবিক দেবা। আরও কইছে– হামাদের ভদ্দর হইতে হবেক। ভদ্দর সমাজ তৈয়ার কইরতে হবেক।

– তু থাম দেবা। উ বাবুয়া তোর মাথাডা খাইছে। উয়ারা ভদ্দরলোক বাবুয়া আছে। পেটে দানা পানি আইনছে। তাই উসব কতা কইছে। মু-দের পেটে দানা পানি নাই।

– উ সব কুথা মুদের মানাইছে না।

– চুপ যা পিংলা। উ বাবুয়া দেব্তা আইনছে রে। পাশে রাখা পুঁটুলিটার ভিতর থেকে একটা নাইটি বার করে বলে– ই দেখ্ না কেনে। ইটাকে মিয়াদের ডেরেস বলে।

– পর। পর না কেনে। দাঁড়া মু পড়ায় দিছি। দেখ্, দেখ্ মুকেও দিছে। প্রথম। এই প্রথম পিংলাকে নতুন রূপে, নতুন ভাবে দেখল। চোখ ফেরায় না। শরীরে, মনে এক অদ্ভুত শিহরণ। কি অপরূপ শোভা! গুছিয়ে ভাবতে পারে না। সদ্য উত্থিত যৌবনের চিহ্নগুলো শুকিয়ে ফলন্ত লাউগাছ। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। ভাবছে মিয়াটা পেট পুরে দুটো খিতে পাইরত! উঠে দাঁড়ায়– নাঃ ঘরকে যাই।

ত্রিশংকর হালদারের বাজার আজ বড়ো খারাপ। সকাল থেকে টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করে চুপচাপ বসে। কোনও পেশেন্ট নেই। মেয়েটার বিয়ের পর ঘরটা একেবারে শুন্সান। বউ মরেছে মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়েই। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সে স্মৃতি আজ ঝাপসা হয়ে আসছে। পেশেন্ট যে একেবারে হয়নি ঠিক তাও নয়। বউনি খদ্দের। একটি কচি মেয়ে গণশাকে ধরতে ধরতে চেম্বারের বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। কচি বউটা রাগে গরগর করতে করতে বলে– দ্যাখ্ কেনে বাবুয়া, ডেড়ায় চাউল নাই। বাচ্চা দুটো খিতে লাইরছে। আর উ কাম করবেক নাই। শুধু হাড়িয়া গিলবে। হর রাইত ঘরকে যায় নাই। সক্বালবেলা দিখি জমিনে শুইয়া ঘ্যোৎ ঘ্যোৎ কইরছে। সারা শরীল থিকে খুন ঝইরছে। উ মুয়ার শরীলে জ্বলন ধরায় দিল। ত্রিশংকর ডেটল জল দিয়ে ধুয়ে, বেটাডিন তুলায় লাগাতেই গণশার আর্ত চিৎকার।

জ্বলন ধইরচে রে ডাক্তার বাবুয়া। ত্রিশংকর ওর চিৎকারে কান দেয় না। ব্যান্ডেজটা ভালো করে বেঁধে দেয়। তারপর টক্সাইড ইঞ্জেকশান প্রস্তুত করতেই আবার চিৎকার– বাবুয়া জ্বলন ধইরছে। তু আবার সূঁচ লাগাইছিস? মরে যাবেক বাবুয়া। উটা তু দিস না বাবুয়া। ত্রিশংকর ডাক্তার মিচকি মিচকি হাসছে। ডাক্তার আদিবাসীদের ভাষা বোঝে। বলতে পারে না। এরাও ডাক্তারের ভাষা বোঝে। ভাব বিনিময়ের বোঝাপড়াটা এরকমই। ডাক্তার বলছে– জ্বলন ধরছে? মরে যাবি? জখমটা তো বেশি হয়নি। তা সারারাত জমিনে পড়েছিলি যখন জ্বলনটা কোথায় ছিল? ছাইপাঁশ গিলবার সময় জ্বলনের কথাটা মাথায় ছিল না? এভাবে বেঘোরে প্রাণটা দিচ্ছ কেন বাপু? এসব ছাড়। বেঘোরে মরবি। মন দিয়ে কাজ কর।

সংসারে অভাব থাকবে। কষ্ট থাকবে। বউ বাচ্চা নিয়ে দুঃখ কষ্টে সংসারটা চালা। এর মধ্যেই শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাবি। বুঝলি তো। বাধ্য ছাত্রের মতো গণশা ঘাড় নাড়ে। পকেট থেকে ত্রিশংকর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে বউটাকে দিয়ে বলে– নাও, আজকের মতো বাচ্চাগুলোকে কিছু খাওয়াও। বউটা কোঁচড়ে টাকাটা গুঁজে নিয়ে পা দুটো ধরে প্রণাম করে বলে– বাবুয়া, তু দেবতা আছিস বটেক। গণশা কিছু বলল না।

বউ-এর ঘাড়ে হাত রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে এক ঝলক দেখে নিল। মনের অভিব্যক্তি। হে মহামানব, তুমি আছ বলেই শবর জাতি আছে। অবহেলিত, ঘৃণিত মানুষগুলো এখনও অতল তিমিরে চলে যায়নি। সকালবেলা বউনি দক্ষিণাটা এভাবেই হ’ল ত্রিশংকর হালদারের।

নিকম্মা দিন। কাজ না থাকলে ত্রিশংকর ভাবে। টেবিলের উপর বাঁ কনুইটা রেখে গালে হাত রেখে অনাবিল ভাবনার নদীতে ডুব দেয়। কতটুকু সামর্থ্য আমার। ভাবে জিয়ারা গ্রামের কথা। সেখানে শবর আদিবাসীদের কথা। বছরের পর বছর খরা। পাহাড়ের ঝরনা ধারা নামে না। অনাহার অপুষ্টিতে ক্রমশ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ। শিক্ষিত সমাজ গায়ে অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠীর লেবেল সেঁটে দেয়। কালেভদ্রে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতে যা ফসল হয়, সেখানেও সম্পদ লুঠেরা অতি বিপ্লবীর মুখোশ পরে চালায় নিরীহ মানুষের উপর তাণ্ডব। কাজে লাগায় এই অশিক্ষিত অজ্ঞ বুভুক্ষু শবর জাতিদের। ভাবনার শ্বাস সীমিত। সেই ভাবনার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসলে আর এগোতে পারে না।

দেবার ঘরটা বেশ মজবুত। এখানটা তিলাবনীর ঢালটা নেমে এসে লম্বা একটা ছাদের আকার নিয়েছে। দেবা বেশ খানিকটা জায়গা বুনো জঙ্গলের ডালপালা দিয়ে বেড়া দিয়ে নিয়েছে। ঝড় বৃষ্টি রোদের তাপ নেই। বেশ নিরাপদ। দেবা বসেছে ছেনি ঘষে ঘষে ধার দিতে। মনে দিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন। তিলাবনী যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে পিচুলা আর জিয়ারা গ্রামকে বিভক্ত করে রেখেছে। পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা তৈরি করবে। দুটি গ্রাম থাকবে একই মায়ের সহোদরের মতো। দেবা অশিক্ষিত। তথাকথিত মূর্খ। প্রযুক্তিটা জানে। মনে মনে রাস্তার ব্লু প্রিন্ট ছকে নিয়েছে। তিলাবনী দেবার কাছে মায়ের মতো। শুধু দেবা কেন সমস্ত শবর, কুর্মী আদিবাসীদের কাছেই মাতৃতুল্য। তবু কেন জানি কোন এক অজ্ঞাত কারণে জিয়ারা গ্রামের উপর তার এই বৈমাত্রেয় আচরণ। অভিমানে, ক্ষোভে চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। তবু মা-তো! ধরিত্রীর উপর সুবিস্তৃত এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভারসাম্য বজায় রাখার দায়ভার তো সন্তানকেই নিতে হয়। দেবা মনে মনে ভাবছে কীভাবে রাস্তাটা সেপ্টিপিনের মতো ঘুরে ঘুরে পিচুলা গ্রামে মিশবে। দু’টো গ্রাম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। পরিকল্পিত সৃষ্টির আনন্দে আরও একবার চোখ দুটো চিক্ চিক্ করে ওঠে।

কার্তিকে চলেছে দুর্ভেদ্য পাহাড় ডিঙিয়ে এঁকেবেঁকে এবড়োখেবড়ো পাথরের খাঁজে খাঁজে পা চালিয়ে। কাঁধে দু’হাত দিয়ে ধরা একটা ছাগল। দেবা দেখেছে। ছেনিতে শান দিতে দিতে হাঁক পাড়ে– এ কার্তিকে, এ কার্তিকে। সাড়া দেয় না, আরও তরতর করে পা চালায়। ছেনিটা রেখে পিছু নেয় দেবা। কার্তিকে দাঁড়ায় না। আরও তাড়াতাড়ি পা চালায়। দেবা এবার দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে দাঁড়ায়।

– ছাগলটা তু কুথা থিকা আনছিস বটেক? কার্তিকে নিরুত্তর। তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে গল্পটা তৈরি করতে পারেনি। সত্যিটা বলতেও মনের সাহস জোগায় না। দেবার কাছে গোটা গ্রাম ঋণী। বিপদে আপদে সবসময় পাশে দাঁড়ায়। শরীরের রক্তরস নিঃশেষিত করে অপরাধপ্রবণ লেবেলটা মোছার চেষ্টা করছে। ভদ্র সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এ শিক্ষাটা পেয়েছে ত্রিদেব বাবুয়ার কাছ থেকে।

– তু চোরি করলি বটেক?

ছাগলটা ছেড়ে দিয়ে মাথা নীচু করে থাকে। তারপর বলে

– ছিনায়ে আনছি বটেক।

– ছিনায়ে আনছিস? ভদ্দর হবিক নাই? ভদ্দর সমাজ মুদের ঘৃণা কইরছে। উ দাগ মুছতে দিবিক নাই?

– হ হ ভদ্দর সমাজ! পেডের জ্বলন ভদ্দর সমাজ মুছে নাই রে, দেবা। বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।

– তুয়ার খাওন হয় নাই তো মুকে জানালি না কেনে? চল্, চাড়ে চাড়ে চল।

– কুথা?

– কেনে মুয়ার ঘরকে। মুয়ার খাবারডা যা আছে ভাগ করে লিবেক। যেতে যেতে দেবা বলে– মুয়ের স্বপনডা মুই একা পূরণ কইরতে লারবেক। এ গিরামের সগ্গলে কাম কইরতে হবেক। স্মরণে রাইখবি, তুয়ের খতরা তো মুয়ের খত্রা। সগ্গলের খত্রা।

বুদ্ধিটা ত্রিশংকরই দিয়েছিল। বলেছিল

– শোন দেবা, রাস্তাটা প্রথমে বেশি চওড়া করবি না। একজন যাতায়াত করার মতো। মনে রাখবি তিলাবনী তোদের মা-বাপ। পাহাড়ের আড় দেখে দেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তাটা হবে? জনপ্রতি দু’টাকা করে নিবি। তারপর বড়ো রাস্তা। পেটে লক্ষ্মী-নারায়ণ ঢুকে গেলে কার্তিকের ভোঁতা বুদ্ধির খোলসটা থেকে খানিকটা সতেজ হয়েছে। তা ইখন পেড চালাইছি কি করে? ঘরে ইকটা বাচ্চা। বউ-ডার আবার পেড হইছে। হব হব কইরছে। চইলতে লাইরছে।

– তু এক কাম কর। মুয়ের লগে বাবুয়ার ডেড়াই যাবেক। উ দেবতা একটা কাম জুটাই দিবেক। ই নে, পিরানডা পর। ছাগল ডা লিয়ে যা, কাল মালকিনকে ফিরায়ে দিবেক। একটা পুঁটুলিতে কিছু চাল দিয়ে বলে– ইটা লিয়ে যা। বউ-ডা, বাচ্চা খাবেক কি? মনের ক্ষিপ্ততার, ঝাঁঝ কেটে গিয়ে এখন লাউডগা সাপ। শুধু মনে মনে ভাবে। বয়সে দেবা আমারই মতো। অথচ আমাদের মতো এই জংলা মানুষটার মধ্যে মহামানবের মহা-প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল কে? শান্ত, অবনত মস্তকে বলে– ইকটা কুথা বলবেক দেবা? বল্ না কেনে? কার্তিকে ছাগলটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে– ইটা তুয়ার কাছে রাইখ রাইতডা। কাল দু’য়ে দু’য়ে ফিরায়ে দিবে।

মহাপ্রাণটা প্রতিষ্ঠা করেছিল ত্রিশংকর। প্রতিষ্ঠা করেনি। দেবার মধ্যে উন্নত সভ্যতার চেতনা জাগিয়েছিল। দিয়েছিল বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মন্ত্রণা। সেই মন্ত্রণার বীজ দেবা একটু একটু করে শবরদের মধ্যে রোপন করেছে। সবটা পারেনি। কিছুটা পেরেছে। সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে কার্তিকে, পিঙ্গলার মধ্যে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে। ত্রিশংকর শবরদের দিয়েছে অনেক কিছুই। ত্রিশংকর পরামর্শ দিয়েছে। হেমন্ত চলে গিয়ে শীত আসব আসব করছে।

– দেখ দেবা, ধানপাকার সময় হয়েছে। পিচুলার গ্রামে এখন অনেক কাজ। প্রতিষ্ঠিত পরিবারে পুরোনো লেপ কম্বল কিছুটা মজুরির বিনিময়ে চেয়ে নে। আর একটা কথা মনে রাখবি। যেখানেই সম্পদ, সেখানেই লুঠেরা। যত সম্পদ। তত লুঠেরা। সেই সম্পদ লুঠ করার চেষ্টা চলে অবিরত। স্বনামে। বেনামে। কখনও অতি বিপ্লবী মুখোশ পরে তাণ্ডব চালায়। ভণ্ড সাধুর দল আড়াল থেকে সাহায্য করে। হিংস্র পশু গেরস্থের সংসারে এসে পোষ মেনেছে। সব কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। এটুকু বুঝতে পেরেছে, মনের ভিতর ঘুমন্ত সৈনিকটা জাগিয়ে তুলতে হবে। আসন্ন শীতে রাতের আকাশটা মেঘমুক্ত। খোলামেলা জায়গায় তারাগুলো কিত কিত খেলছে। দেবা সেই আকাশে চোখ রেখে একান্তে ভেবে চলেছে। দেবা ডেরায় বসে জংলি কাঠ বিছানো শুকনো জঙ্গলে একসময় শ্রান্ত দেহটাকে নিদ্রার কোলে ছেড়ে দেয়।

মানবিক মূল্যবোধ, চেতনা কম দামে পাওয়া যায় না। মূল্য দিতে হয়। অনেক মূল্য। হয়তো বা জীবন দিয়েও। মনের দিক থেকে ত্রিশংকর প্রস্তুতই ছিল। জীবনের সুখ, দুঃখ, বাঁচা মরা সব কিছুই ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে যারা নির্লিপ্ত থাকে, ত্রিশংকর সে ধাতুতে গড়া নয়। রাতের আকাশ। এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। ওই এক মুঠো আকাশটার ভাগীদার তো সবাই। অথচ তারাগুলো অনাবিল আনন্দে যখন খেলে বেড়াচ্ছে, পিছন থেকে লম্পট মার্কা মেঘগুলো চুপিচুপি গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। মেঘ না মেছো চিল! জীবনটা আসলে সবলের জন্য। কৌশলবাজদের জন্য। সবলেরা গিলতে চায় দুর্বলকে। কৌশলবাজ ক্যারাটে প্যাঁচ মারে সরল নির্ভেজাল মানুষগুলোকে। এটা আদি অকৃত্রিম।

ত্রিশংকর এখন অনেক বস্তুনিষ্ঠ। জীবনদর্শনটা খুব কাছ থেকে দেখেছে। ত্রিশংকর ঘরে ঢুকে দরজার খিলটা এঁটে দেয়। শুয়ে শুয়ে ভাবছে। সময় বেশি নেই। আক্রমণটা আসবে। প্রথম আঘাতটা তার উপরই। অনেক ঘুরপথে অস্ত্রটা দেবার হাতে তুলে দিলাম। আগ্নেয়াস্ত্রের ভারটা বইতে পারবে তো? এলোমেলো ভাবনা। সেই ভাবনাগুলি মনে ক্লান্তি এনে দেয়। সেই ক্লান্তিতেই ত্রিশংকর ঘুমিয়ে পড়ে। পাতলা ঘুম। হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়। একঝাঁক বুটের আওয়াজ। এগিয়ে আসছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলির ভুষ্টিনাশ করে বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলছে। পালাবার পথ নেই। দরজায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে গোটাকতক হায়েনা। চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। সারা মাথা মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। শুধু হায়েনার দাঁতগুলো চিক্ চিক্ করছে। মত্ত উল্লাসে বলছে। ই বাবুয়া, তু ডাইকলি না। মুয়েরা আইছি। তুয়ার ব্যামো সারাইতে। পাশ থেকে আর এক হায়েনা বলছে– তু কে সূঁচ ফুটাইছিল না? তুয়ার ব্যামো সারাইবার লিগা। তু এক কাম কর। উয়ার ব্যামো সারাই দে বটেক। সূঁচ ফুটাই দে না কেনে? উয়ার ব্যামো সারবেক। অনেকক্ষণ থেকে গলার আওয়াজটা পরিচিত মনে হচ্ছিল। ‘ব্যামো’র কথাতে ত্রিশংকরের চিনতে অসুবিধা হয় না।

– তুই গণশা না? তু-ই আমাকে মারতে এসেছিস? গণশা মুখে কথা নেই। শুধু মনে মনে বলে

– তুমি দেবতা। যদি পারো ক্ষমা করে দাও প্রভু। তুমিই তো পারো অধমকে ক্ষমা করতে। যে জালে আমি জড়িয়েছি। এছাড়া আমার যে আর পথ খোলা ছিল না। হায়েনার দল সাংকেতিক নামে কথা বলছে। ‘র’ ‘গ’ ‘শ’ নামে। পাশ থেকে বলছে

– ‘গ’ মশিনডা চলা কেনে?

‘গ’ বলছে,

– মশিনডা কাম কইরতে লাইরছে। সময় নষ্ট করে না। দুম দুম করে দুটো আওয়াজ। বার্ধক্যে শক্তি বেশি ধরে না। ত্রিশংকরও মৃত্যু যন্ত্রণায় বেশি সময় নষ্ট করেনি। অল্প ক্ষণেই ঘরের কড়িকাঠে চোখ দুটো স্থির করে শান্ত হয়ে যায়। প্রস্তাবটা গণশাই দিল। বলে – ইকটা কাম করি। ডেড়ায় আগ লাগাই দি কেনে?

– লগই দে। গণশা সাইকেলের টায়ারগুলি সারা ঘরে ছড়িয়ে দেয়। সদর থেকে বাতিল টায়ার কাঁধে করে নিয়ে আসে। আগুন লাগাতে এগুলি উপাদেয় পদার্থ। আগুন লাগায়। মনে মনে বলে– দেওতার সৎকারডা ত হউক বুটেক।

অমাবস্যার রাত। বাইরে মিশকালো ঘন অন্ধকার তিলাবনীকে গ্রাস করেছে। আবার দুম দুম করে আওয়াজ। ‘র’ ‘শ’ ইত্যাদি পিছন ফিরে তাকায়। টর্চ মারে। গণশা পড়ে আছে। তখনও ঠোঁটটা থর থর করে কাঁপছে। কিছু বলতে চাইছে। নব আগন্তুকেরা সে ভাষা বোঝে না। তিলাবনী বুঝেছে। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। দেব্তা তুয়ার মরণ হয় নাই। মরণ হইছে মুয়ের। মরণ হইছে শবরদের। সেই অন্ধকারে হিংস্র দানবের দল মিলিয়ে গেল।

বসন্ত আসতে ঢের দেরি। হোলি খেলাও শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে রক্তের হোলি খেলা। ত্রিশংকরের রক্ত দিয়ে। গল্পটা এখানেই শেষ হলে হয়তো ভালো হতো। সব গল্প তো শেষ হয়েও হয় না। কারণ ত্রিশংকরের রক্তের বীজ দিয়ে জন্ম নিয়েছে আগামীদিনের লড়াইয়ের বুনিয়াদ। শবরদের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই।

শীতকাল না এলেও শীত এসে পড়েছে। গ্রীষ্মেও অনাহুতে দল আগে ভাগে ঢুকে পড়ে। তিলাবনী শত সহস্র হাত প্রসারিত করে চারিদিক বেষ্টন করে রেখেছে। তিলাবনীর অবাঞ্ছিত জিয়ারা গ্রামের জলবায়ুর বন্দোবস্তটা এরকমই। দেবার কাঁধে লম্বা লাঠির মাথায় এক পুঁটুলি। পুঁটুলি ঠিক নয়। একটা বস্তা। গা দিয়ে তখনও গলগল করে ঘাম ঝরছে। বস্তাটা পিঙ্গলার ডেরার সামনে ধপাস্ করে ফেলে। একটা বিরাট কম্বল বার করে ললিত মোহনের বুকে চাপিয়ে দেয়। মনের ভিতর এক আনন্দের ঝিলিক মারে।

– ই বাপ, শরীলডা গরম হইছে না বটেক? জারে বহুত কষ্ট পাইছিস বটেক। আর কইরতে লাইরবেক। আর একটা কম্বল পিঙ্গলার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে– পিঙ্গলা কিমন লাইগছে বটেক।

ভিন্ গাঁয়ে ভিন্ মজুরিতে দেবার পকেট ভারী। আচমকাই পিঙ্গলার পিঠে হাত পড়ে যায়। মুহূর্তে পিঙ্গলার সমস্ত শরীরটা চনমন করে ওঠে। চোখে চোখ রেখে দুটি হৃদয় ভালোবাসাময় হয়ে ওঠে। পিঙ্গলা মনে মনে বলে– মু ত তুয়ার পরানে হারায়ে গিছি বুটেক। যৌবনের বুকে ফুটে ওঠে নব পত্রিকার জৌলুস। দেবার বুকে তখন দহনীয় বৈশাখ। মনের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে রং মশালের আলো। দু’টি হূদয় ভালোবাসার গাঙে হারিয়ে, সময়কে বয়ে যেতে দেয়। বাধা দেয় না। ডেরার বাইরে আগাছার মতো বেড়ে ওঠে পাহাড়ি ফুলের ঝাড়। দেবা এক গোছা ফুল নিয়ে বলে– চুলডা জড়ায়ে নে না কেনে? বসন্ত আসতে ঢের দেরি। এলেও এ গাঁয়ে উঁকি মারে না। না এলেও পিঙ্গলার মনে এসেছে। সেই বসন্ত পিঙ্গলাকে করেছে লজ্জাবতী ফুল। লাজুক চোখে তাকিয়ে বলে– কেনে?

– জড়াই দেনা কেনে। পিঙ্গলা অবাধ্য হয় না। জড়িয়ে দেয়। দেবা সেই চুলে পাহাড়ি ফুল গুঁজে দিয়ে বলে,

– বড়ো বাহারি লাইগছে বুটেক। শীতের হিমেল বাতাস চুপিসারে বলছে দেখেছি, দেখেছি। সব দেখেছি। সাক্ষী আছে হিমেল বাতাস। সাক্ষী আছে তিলাবনী। সমাজে ফিরেছে দেবা। বলছে– পিংলা, একটা কথা বইলবার মন চাইছে বুটেক। পিঙ্গলার কালো গাল দুটো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে। লাজুক গলায় বলে

– বল্ না কেনে।

শরম লাইগছে বুটেক। দু’টো চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের জাল বোনে। দেবার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। সময়ের দণ্ড পলের তর সয় না। অবশেষে অমৃত স্বাদের গন্ধ ঝরে পড়ে।

গুসসা করবিক নাইন ত বুটেক? মু তুকে বিহ করবারে মন চাইছে। দুয়ে দুয়ে ঘর করবেক। বাপটা থাইকবে মুদের মালিক। তু নারাজ নাইন ত বটেক?

সরম পিঙ্গলারও লাগছে। এক ছুটে ডেড়ার বাইরে গিয়ে মাথা নীচু করে নখ খুটতে থাকে। কিছু ত বল্ না বুটেক? পিঙ্গলা ফিস্ফিস করে বলে– পিরিতডা ত করি বুটেক।

– তা হইলে শুন্ না কেনে।

– ই অগ্রানে টুসু পরবে ঠাকুর মশাইকে স্মরণ দিবে। উ ঠাকুর মুদের বিহডা করাই দিবেক।

– উ কানুনডা মুদের ত নাইন বটে।

– নাইন থাক। ছাড়ান দে জংলি কানুন। ভদ্দর সমাজের কানুডাই বিহ করবেক।

ভালোবাসার রংমশালের আলোটা আচমকাই দপ করে নিভে গেল। ললিত মোহনের বুক থেকে অদ্ভুত একটা ঘড়ঘড়ানি শব্দ। দেবা এক লাফে বুড়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। এক ভয়ংকর শ্বাস টান উঠছে। দেবা উদ্ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত। চিৎকার করে বলে– পিংলা, চাড়ে চাড়ে আয় কেনে। দ্যাখ বাপ কিমন কইরছে বটে। তবু অশক্ত কম্পিত হাতটা দিয়ে দেবার হাতটা খপ্ করে ধরে। দেবা মরিয়া চেষ্টা করে। বলে– পিংলা, বাপকে মু লিয়ে যাব।

– কুথা?

– সদরে।

– আর সময় লাইরে দেবা। বাপটাকে থিরে যাইত দে। শেষবারের মতো পিংগলার হাতটা টেনে নিয়ে দেবার হাতে মেলাবার চেষ্টা করে। পারে না। শুধু অপূর্ণ স্বপ্নের বার্তাটা থরথর করে কেঁপে ঠোঁটটা স্তব্ধ হয়ে যায়।

চঞ্চলতা, অস্থিরতা, ব্যস্ততা কাঠবেড়ালির আছে। সে ব্যস্ততার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। উদভ্রান্ত, অস্থিরতা ব্যস্ততার কারণ কার্তিকের আছে। কার্তিকে ছুটছে। পাগলের মতো। হোঁচট খাচ্ছে। পড়ছে। আবার ছুটছে। তিলাবনীর পাঁজরে আঘাত লেগে সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্ত ঝরছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। মুখে শুধু আকাশ ফাটা আর্তনাদ। এই মুহূর্তে দেবাই সর্বনাশের আসান। পিঙ্গলার মনটা বিষাদগ্রস্ত। অসহায়ের মতো গালে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাপটা চলে গেল। এইমাত্র দাহ করে ফিরেছে। মাথার উপর থেকে অশক্ত ছাদটুকু চলে গেল। সমস্ত অভিভাবকত্ব, অনুশাসন, শাসনের অবসান ঘটিয়ে ঘরে ফিরেছে। দেবা স্ত্বান্না দেয় না। ভাষা নেই যে। বসে আছে হাঁটু মুড়ে মাথা নীচু করে। পিঙ্গলার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে কার্তিকে। বয়ে আনছে আরও এক ভয়ংকর বিপর্যয়ের ঝোড়ো হাওয়া। মনটা আরও উতলা হয়ে ওঠে।

– দেবা, উ আইছে কার্তিকে না? দেখ্ না কেনে উ আঙ্গাস ফাটা চেচাইছে। মাথা নীচু করে দেবা চলে গেছে ভিন জগতে। পিঙ্গলার উত্তেজনায় সম্বিত ফিরেছে।

– হ, লাইগছে বটে। কার্তিকে আরও কিছুটা সামনে এলে দেবা উঠে দাঁড়ায়।

– কার্তিকে, চেঁচাইছিস কেনে? কী হইছে বল্ না বটে? তিলাবনীর পাজরে আরও একবার আছাড় খেয়ে দেবার সামনে ছিটকে পড়ে। উত্তেজিত দেবা সস্নেহে বসিয়ে বলে

– চাড়ে চাড়ে বল্। কি হইছে বটেক?

– দেব্তা নাইরে দেবা। উ শয়তানরা দেব্তাকে মারি দিলা। উয়ার ঘর জ্বালাইন দিছে। গণশাও ছিল বটেক। আকস্মিক বজ্রপাতে দেবা দিশেহারা। উন্মাদ। শুধু আর্তনাদে একটা কথাই শোনা গেল। দেব্তা মু আইছি বটেক। সব শয়তান মু নিধন করবেক। পিতৃহীন, অভিভাবকবিহীন পিঙ্গলা এখন বড়ো অসহায়। পাশে আছে দেবা। বলিষ্ঠ অবলম্বন। ভালোবাসার রঙিন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুটে চলেছে ভয়ংকর দুর্যোগের অকুস্থলে। অসহায় পিঙ্গলা স্বপ্নকে ধরে রাখতে ছুটতে থাকে। মুখে শুধু আকুল আর্তি – দেবা, মুয়ার ডর লাগিছে বটেক। ইখন তু নাইন যাইছ। দুপহর গড়াইছে। রাইত নাইমছে। পথের বিপদ আইনছে। তু নাইন যাইছ। পিঙ্গলার সেই আকুল আর্তি তিলাবনীর পাঁজরে প্রতিধবনিত হতে থাকে। দেবার কানে সেই আর্তি পৌঁছোল কি না, কে জানে! দূর থেকে একটাই প্রতিশ্রুতি ভেসে আসল।

– ডরাইস না পিংলা। মু আসবেই। মু চাড়ে চাড়ে যাব আর আসব। পাথরের চড়াই উৎরাই পার করে মুহূর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর দেখা গেল না।

ত্রিদেবের চিতা নিভে গেছে অনেক আগেই। শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে তিলাবনীর চূড়া ছুঁয়ে উঁচুতে। আরও উঁচুতে। ত্রিদেবের চিতার পাশে বসে দেবা নিস্পলক দৃষ্টিতে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে চেয়ে আছে। দেবা শুধু ভাবছে। পিঙ্গলাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন, রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা, সুস্থ সামাজিক মানুষ গড়ার কারিগর সব কিছুই দলা পাকিয়ে তিলাবনীর চূড়া ছাড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে নীল নীলিমায়। ঘোর দুঃস্বপ্নের মধ্যেই ভেসে আসে অমোঘ বার্তা। ভয় পাস না দেবা। আমার দেহটা নেই। আছি তোদের মাথার উপর। লড়াইটা চালিয়ে যা। ভয় কি? তোর সঙ্গে আছে পিঙ্গলা, কার্তিকে। জিয়ারা গ্রামের সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যা। দেবা উঠে দাঁড়ায়। জীবন যুদ্ধের নির্ভীক সৈনিক। জিয়ারাকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে হবে। জিয়ারা হবে সভ্য সমাজের মডেল গ্রাম। সে যুদ্ধ হবে পিঙ্গলাকে সঙ্গে নিয়েই।

তিলাবনী রাস্তা দেয়নি। দেয়নি জল। কিন্তু সব কেড়ে নেয়নি। দিয়েছে অসংখ্য গাছ। সেই গাছের অসংখ্য প্রসারিত ডালের ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে। ত্রিশংকরের আশীর্বাদপুষ্ট দেবার বুক ভরা আর্তনাদ। আর একদিকে আন্দোলিত হচ্ছে অপরাজিত সংকল্প। এগিয়ে চলেছে দেবা। সামনে বিশাল রাক্ষুসে খাদ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিলাবনীর বুক চিরে বিশাল জলধারা দড়ির মতো পাক দিয়ে। এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অসংখ্য গাছের ডাল। অগণিত ঝুরি নেমে গেছে খাদের দিকে। দেবার মনোবল এখন অনেক মজবুত। মজবুত মনের শক্তি যুগিয়ে গেছে ত্রিশংকর। সেই মনোবলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গাছের ঝুরি ধরে। একটার পর একটা। রাতের জমাট বাঁধা অন্ধকার।

তিলাবনীর বুকে রাতের আঁধার বড়ো তাড়াতাড়ি নামে। পায়ের নীচে মরণখাদ। শ্রান্তিহীন, ক্লান্তি বিহীন অকুতোভয় ছেলেটা এখন মৃত্যুঞ্জয়ী। হাত ফসকালেই চলে যেতে হবে মৃত্যুর কোলে। প্রান্তিক ঝুরি। তারপরই সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর। জিয়ারা আর পিচুলা গ্রামকে বিভাজন করে রেখেছে। আচমকাই দুর্ঘটনা। চড়চড় করে একটা শব্দ। নিভে গেল দেবার মনের সব আলো। গড়িয়ে চলে গেল দেবার নিথর দেহটা গহিন খাদে। সেই ঘন অন্ধকারে আর দেখা গেল না। জিয়ারার স্বপ্ন, পিঙ্গলার চোখে রংমশালের আলো, রাস্তা তৈরির কারিগর, সব কিছুই চলে গেল অনন্ত তিমির লোকে।

দেবার চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সমস্ত গ্রাম আজ শোকের হাট। সুখ চায়নি। বাঁচতে চেয়েছিল। সভ্য সমাজে মাথা উঁচু করে। তিলাবনী কেড়ে নিয়েছে তাদের ন্যূনতম স্বপ্ন। দেবা যে তাদের লড়াইয়ের সেনাপতি। সামনে দেবার চিতা। পিঙ্গলার চোখে মুখে আগুনের ঝলকানি। চোখ দুটো হিংস্র বাঘের মতো জ্বলছে। রোদের ঝাঁঝ কমে আসছে। তবু সেই আলোয় পরিষ্কার বোঝা যায়, তিলাবনী ভয় পেয়েছে। কোনও দাম্ভিকতা নেই। নেই কোনও বিদ্বেষ। ঈশান কোণে জমে ওঠা জমাট বাঁধা মেঘটা ঘনীভূত হচ্ছে। ধেয়ে আসছে এক প্রবল ঝড়। সে ঝড়ে তিলাবনী তার অস্তিত্ব কতটুকু ধরে রাখতে পারবে? কে জানে।

এই বিয়োগান্তক গল্পের পরিসমাপ্তিটা এখানেই হলে হয়তো ভালো হতো। আসলে লড়াইয়ের পাটিগণিত কোনও সূত্র ধরে চলে না। আসলে লড়াইটা যে এখান থেকেই শুরু। পিঙ্গলা এক দৌড়ে দেবার আস্তানা থেকে ছেনি হাতুড়িটা নিয়ে আসে। ঘৃণা, ক্ষোভে সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। চিতার লেলিহান অগ্নিশিখা পিঙ্গলার মনেও আগুন ধরিয়েছে। এক বজ্র হুংকারে তিলাবনীর পাথরে প্রতিধবনিত হতে থাকে।

– এ তিলাবনী, তুয়ার বহুত দিমাক হইছে না রে? মুয়াদের রাস্তা নাইন দিলি। কোল গড়ায়ে জল দিছিস নাই। কষ্ট করছি। কুছু বলি নাইন। মুয়াদের ভুক্ষা মারবি? ইখন মুয়ার ভাবী মরদকে ছিনায় নিলি? তুয়ার ইত জ্বলন কেনে রে? ত দেখ কেনে, মু কি কইরতে লাইরছি? কোনও ভূমিকা নেই। কোনও গৌরচন্দ্রিকা নেই। ছেনির উপর হাতুড়ির এক একটা আঘাত আগুনের ফুলকি হয়ে ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ ঘটতে থাকে। রাস্তার নক্সাটা পেয়েছিল দেবার কাছ থেকেই। অবিরত ছেনির উপর হাতুড়ির আঘাত। ঠন্ ঠন্ ঠন্।

সতেরোটা বছর ধরে

– ছেনি হাতুড়ির আঘাতে পাথরের এক একটা চাঙ্গড় ধসে পড়ছে। অনিদ্রা অনাহারে শরীরটা ক্লান্ত। মনের জোরটা অটুট। সেই জোরেই সেফটিপিনের মতো রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎই কানে আসে একটা অজানা সোঁ সোঁ শব্দ। বুঝতে পারে না। উৎসে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। পাথরের গায়ে মাথা ঠেকায়। একটা বিশাল জলের গর্জন। পিঙ্গলা সময় নষ্ট করে না। শুরু হয় ছেনি হাতুড়ির আঘাত। আঘাতের পর আঘাত। তারপরই কুল কুল শব্দে জলের ধারা। আসন্ন বিপদ বুঝতে দেরি হয় না। পিঙ্গলা ছুটে বেরিয়ে আসে। মুহূর্তে বিশাল আওয়াজ। বিরাট পাথরের চাঙড় খসে পড়ে। তারপরই ভয়ংকর গর্জনে আছড়ে পড়ে জলের ধারা জিয়ারা গ্রামে। অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণ মাঠ, পুকুর, ডোবা হয়ে ওঠে কল্লোলিনী গর্ভবতী। শরীরের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে মনের অনাবিল আনন্দে পিঙ্গলা নাচতে থাকে। আত্মহারা জিয়ারা শবরবাসী।

রাস্তা ফিনিশিং-এর কাজ চলছে। কাশিটা ধরেছে অনেকদিন ধরেই। পালা করে জ্বরও আসছে প্রতিদিন। তবু তিলাবনীর পাঁজরে সেই আওয়াজ। ঠন্ ঠন্ ঠন্। কার্তিকে বুঝতে পারছে, পিঙ্গলার শরীরের অবস্থা ভালো না। বলছে– পিংলা, রাইত হইছে বুটেক। ঘরকে চল। তুয়ার শরীলডা অর দিছে নাই। ছলকে যাবি বুটেক। কাশির সঙ্গে গলগল করে খানিক রক্ত। হাঁপাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাত দিয়ে রক্ত মুছে পিঙ্গলা বলে

– তু ঘরকে যা। তুয়ার গরে বহু, বাল-বাচ্ছা আইনছে। তুয়ার অনেক দায় আইনছে। ই রাস্তাডা মুয়ার পরান। ইটাই মুয়ার দেবা আইনছে রে, কার্তিকে। তু ঘরকে যা।

সদর থেকে মাল বোঝাই ট্রাকগুলো ধুলো উড়িয়ে পিচুলা ছুঁয়ে জিয়ারা দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিয়ারাবাসী আজ অপরাধপ্রবণ অসভ্য লেবেলটা মুছে ফেলেছে। সে শিক্ষাটা দিয়ে গেছে দেবা পিঙ্গলা। কালের নিয়মে, সময়ের মলিনতায় নব প্রজন্মের স্মৃতির অতলে তারা তলিয়ে গেছে। সাক্ষী আছে তিলাবনী। জিয়ারা পিচুলা যে একই মায়ের গর্ভজাত। তবু তিলাবনীর পাঁজরে কান পাতলে আজও শোনা যায় পিঙ্গলার ছেনি-হাতুড়ির শব্দ। ঠন্ ঠন্ ঠন্।

বিকৃতি

আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বারবার রজত ওই অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজের চ্যাট বক্সটা খুলছে, ডিপিটা দেখছে, আবার রেখে দিচ্ছে।

ভদ্রমহিলার মুখটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল ঘাড় বেয়ে কোমর অবধি নেমে এসেছে। সুঠাম দেহের গঠন, চুলের পাশ থেকে প্রসারিত হয়েছে ফরসা দুটো হাত যেন কোনও চিত্রকরের অঙ্কিত দুটি বঙ্কিমরেখা। বয়স বড়োজোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। প্রথম মেসেজটা ওপার থেকেই এসেছিল, ছোট্ট একটা, হাই!

রজত প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো কোনও উড়ো মেসেজ। তাই অফিসিয়ালি রিপ্লাই দিয়েছিল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

একসাথে অনেকগুলো স্মাইলি এসেছিল। রজত একটু অবাক হয়। এত রাতে সচরাচর এরকম রিপ্লাই কে দেবে?

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল,

কে আপনি?

ধরুন, আপনার কোনও বান্ধবী।

মানে?

কেন আপত্তি আছে? ছবি না দেখে বুঝি বন্ধুত্ব করা যায় না?

রজতের আকর্ষণটা বেড়ে গেছিল। এরকম প্রত্যুত্তর সে অনেক দিন পায়নি।

আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?

এই মহাবিশ্বের কোনও একটি ক্ষুদ্র শহরের বাসিন্দা।

হেঁয়ালি করছেন?

সরকারি আধিকারিকের সাথে হেঁয়ালি? না, অত সাহস নেই।

ভদ্রমহিলার চমকপ্রদ জবাবগুলো রজতের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন প্রায় সারাদিনই ও ফোন কাছে কাছে রাখে। কিন্তু সেই রহস্যময়ী সারাদিনে একবারও অনলাইন আসে না। শুধুমাত্র একবার। রাত বারোটার পর।

অতএব, রজতও সেই সময়টাই বেছে নিয়েছে। মনে মনে একবার কল্পনা করে অবয়বটাকে। আজ সে ঠিক করেছে, ভদ্রমহিলার নাম জানতে চাইবে।

তাই প্রথমেই বলে, এতদিন কথা বলছি, আপনার নামটা জানতে পারি কি?

লোকে মধুরিমা বলে!

বেশ, আমিও ওই নামেই ডাকব।

যা ইচ্ছা!

একবার দেখা করা যায় কি?

এই প্রশ্নের পর টানা কুড়ি মিনিট কোনও রিপ্লাই আসেনি। ইতিবাচক কোনও কিছুর আশা নিয়ে রজত ফোনের দিকে তাকিয়েছিল। চার্জটা ক্রমশ কমে আসছে। প্লাগে চার্জারটা কানেক্ট করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিল। অবশেষে রিপ্লাই এল, সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকেই

অবশ্যই, আগে চিনি, জানি..

রজত নিরাশ হয়নি। বরং আশার একটা ক্ষীণ আলেয়া জ্বলে উঠেছিল। ওর পুরো মনটা আলোকিত করে তুলেছিল। মুখভঙ্গি না দেখেও শুধু কয়েটা রিপ্লাই যে, কোনও মানুষকে এতটা সম্মোহিত করতে পারে সেটা জানা ছিল না রজতের।

আজকাল আর তার কাজে মন নেই। সে এখন শুধু বারবার ওই নম্বরটাতে কল করে।

সুইচ অফ! ট্রু কলারে দেখেও কোনও লাভ হয়নি।

তাই শুধু রাতের গহিন অপেক্ষা। এখন রাত হলেই কেমন নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সে। অমোঘ জালে জড়িয়ে পড়েছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বলেই ফেলে, মধুরিমা, মধুরিমা, আমি তোমায় ভালো…

কী?

ভালোবেসে ফেলেছি!

তাই বুঝি! এত তাড়াতাড়ি?

দেরির কী আছে শুনি? তোমার কি আমাকে পছন্দ না?

তুমি যে বিবাহিত!

হ্যাঁ, রজত তো বিবাহিত। দীর্ঘ সংসারজীবন অতিক্রম করে এসেছে। এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথক ভাবে। একই বাড়িতে থাকলেও রজতের স্ত্রী মল্লিকা থাকে নীচের তলায়, রজত উপরতলায়। এখনও মল্লিকা সিঁদুর পরে, শাঁখায় সিঁদুর ছোঁয়ায়।

 

রজতের আজকের চাকরির পদটা একদা মল্লিকার বাবারই দেওয়া। বিয়ে পর বেকার জামাইকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া শ্বশুরের দাযিত্ব! সেই দাযিত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিলেন মল্লিকার বাবা পরিমলবাবু। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে জামাইকে সরকারি অফিসে পার্মানেন্ট পদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের বুকে জমি কিনে ঝাঁ চকচকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বদলে চেয়েছিলেন, মেয়ে কাছে বাকি জীবনটা কাটাতে। সেটাই কাল হয়েছিল। মরতে হয়েছিল জামাইয়ে হাতে। তাও সুখ। মরেও সুখ। মেয়ে তো ভালো আছে। কিন্তু সত্যিই কি ভালো ছিল মল্লিকা?

রজতের এনে দেওয়া ওষুধগুলো খেতে খেতে দিন দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছিল মল্লিকা। শুধু ঘুম পেত, অনিচ্ছাকৃত কোনও ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত না। ক্রমে নীরবে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করাই ওর ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। রজত বলত, ওগুলো নাকি বাতের ব্য়থার ওষুধ, খেলে বার্ধক্য আসবে না কোনও দিন।

মল্লিকাও সরল বিশ্বাসে দিনের পর দিন নিঃশব্দে জলের তোড়ে গিলত সেগুলো। কখনও কোনও প্রশ্ন করত না। আসলে বাঙালি মেযো কখনওই স্বামীর সামনে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে পারে না। দৃঢ় গলায় কোনও কিছুর সদর্থক কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে না। এই চিরকালীন ব্যর্থতাই হয়তো কালের নিষ্ঠুর নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে।

এই অনাড়ম্বর জীবন থেকে নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই রজতের। তাই সে আবারও প্রেমে পড়েছে। এবারের প্রেক্ষাপটটা অন্যবারের থেকে একটু অন্যরকম। কথা বলতে বলতে সেই সুতোর জটে সে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, তার থেকে বেরোনোর উপায় পাচ্ছে না। সে বেরোতে চায়ও না। বরং আরও প্রবল ভাবে নিজেকে সেই জটের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চায়। সংসার সুতোয় গিঁট দিতে চায়। অতঃপর, মধুরিমার সম্মতি চাই। তাই আবারও মুষ্টিভিক্ষা করে, তুমি কি আমার হবে মধুরিমা?

সম্ভব?

জীবনটা বড়ো বিষাদ হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই। ব্যস।

বেশ, তবে দেখা কোরো।

বলো। কোথায় আসতে হবে?

কাল, পার্ক হোটেলে। বাকি ডিটেলস কাল সকালে আমি তোমাকে সেন্ড করে দেব।

ওকে!

মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সবকিছুই যেন নিমেষে রঙিন হয়ে গেছে রজতের কাছে। পাথুরে মাটিতে আবার জলীয় স্পর্শে ঘাস গজিয়েছে। কাল সে অনেকগুলো গোলাপ নিয়ে যাবে মধুরিমার জন্য। ভালো করে দেখতে পাবে ওর মুখটা। না জানি, সে কতই না সুন্দর হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসে রজতের।

পরদিন সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে, প্রায় দশটা বাজতে যায়। চটপট করে ব্রেকফাস্ট সেরে মোবাইল খুলে দেখে, মধুরিমা অ্যাড্রেস সেন্ড করেছে। দেরি না করে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।

আজ রজত অনেকটা পারফিউম দিয়েছে। তার এক বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। কোনও দিনও খুলে দেখা হয়নি। কিন্তু আজ প্রয়োজন পড়ল।

এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল পার্ক হোটেলে। তারপর রিসেপশনে ফরম্যালিটিস কমপ্লিট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। দুশো বাহাত্তর নম্বর রুম। সেখানেই অপেক্ষা করছে তার বহু কাঙ্ক্ষিত সুন্দরী।

ঘরের সামনে এসে আলতো করে নক করে রজত। আপাদমস্তক কালো ওড়নাতে ঢাকা একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। সম্মোহিতের মতো কোনও অজানা স্নায়বিক নির্দেশনায় ঘরে ঢুকে আসে রজত। বসে পড়ে সোফার উপর। প্রশ্ন করে, তুমিই মধুরিমা?

ইঙ্গিতে উত্তর আসে, হ্যাঁ!

এখনও কি নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখবে?

ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে একটা মদের গেলাস বাড়িয়ে দেয় রজতের দিকে। বশীভূতের মতো সেটা হাতে নিয়ে একচুমুকে শেষ করে ফেলে সে। এভাবে পরপর তিনবার। রজতের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সোফার উপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পায়, কালো ওড়নাটা সরিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মল্লিকা। বিস্ফারিত দৃষ্টি, যেন আগুন ঝরছে সমস্ত দেহটা থেকে!

চিত্কার করে বলে ওঠে, কেন এরকম করলে তুমি বলো? আমাকে ঠকিয়ে দিনের পর দিন একের পর এক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে গেলে? একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না? কত সম্মান করেছিলাম তোমাকে। আমার ভগবান ভাবতাম।

সেদিন যখন তুমি ফোনটা ভুল করে আমার ঘরে রেখে চলে গেছিলে, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তুমি আমায় এতদিন যে-ওষুধগুলো খাইয়ে, ওগুলো কোনও সুস্থ মানুষের সেবনযোগ্য নয়। ওই ড্রাগসগুলো নিলে যে-কোনও সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যেতে পারে।

অ্যাকচুয়ালি, তুমি আমাকে বদ্ধ পাগল বানিয়ে রাখতেই চেয়েছিলে! যাতে বাইরের দুনিয়ার সামনে কখনও আমাকে না নিয়ে যেতে হয়, আর তুমি নিজের মতো করে স্বেচ্ছাধীন জীবনযাপন করতে পারো, ইচ্ছামতো নারীসঙ্গে বুঁদ হতে পারো! কিন্তু আমি আর তা হতে দেব না মি. রজত সান্যাল! কারণ আসল মনের অসুখ তো তোমার, অসুস্থ তুমি! উন্মাদ তুমি, নাহলে এভাবে একের পর এক নারীসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারো না। বিকৃত মানসিকতাও একপ্রকার ভয়ংকর অসুখ, যার একমাত্র ওষুধ মৃত্যু!

রজত মল্লিকার হাত দুটো আটকাতে যায়। কিন্তু পারে না। শরীর ইতিমধ্যেই অবশ হয়ে গেছে। মল্লিকা হিংস্র বাঘিনীর মতো ছুরিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। সেই শেষের মুহূর্তটা আসতে আর কিছুক্ষণ মাত্র বাকি!

দীনানাথের শেষ উইল

কাকভোরে রাজপালের ঘুমটা ভেঙে গেল। কী কারণে সেটা প্রথমে ঠাউর করতে করতে কিছুটা সময় গেল। তারপরেই খেয়াল হল তাকের উপর সযত্নে তুলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙেছে। মালিকের ফোন। মালিক হচ্ছেন বড়ো হাভেলির দেওয়ান সাহেব। আজ তো শনিবার ওর ছুটির দিন। তাহলে সকাল সকাল ফোন, কী ব্যাপার!

চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাজপালের কপালে। আজকের দিনে ওকে দেওয়ান সাহেবের জঙ্গলের দেখাশোনা করতে যেতে হয়। জঙ্গলের পুরো দাযিত্বই রাজপালের ওপর ছেড়ে রেখেছেন মালিক। অত বড়ো হাভেলিতে দেওয়ান সাহেব একাই থাকেন। দু’-দু’বার বিয়ে করেছেন। কোনওটাই স্থায়ী হয়নি।

প্রথম স্ত্রী ছেলের সঙ্গে বিদেশে থাকেন। মালিকের এক ছেলে এক মেয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীও আলাদাই থাকেন, তবে যাওয়ার আগে দেওয়ানজির অনেক টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মালিকের বিরাট ব্যাবসা।

হ্যালো, রাজপাল ফোনটা হাতে নিল। দেওয়ানজির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রাজপাল, কাল ঠিক এগারোটার সময় হাভেলি আসতে হবে।

মনে মনে আশ্চর্য হল রাজপাল। মালিক ভালো করেই জানেন, শনি আর রবিবারটা জঙ্গলে কাটিয়ে সোমবার রাজপাল ফেরে। কী আর করা? মালিকের আদেশ অমান্য করা চলবে না। হয়তো মালিকের শরীরটা একটু বেশি খারাপ হয়েছে। বেশ কয়েদিন ধরে ওনার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। একা একা থাকা। শুধুমাত্র একজন গুজ্জর মহিলা নুরা মালিকের দেখাশোনা করে।

প্রথম প্রথম নুরা হাভেলির দোতলাটার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দাযিত্বে ছিল। কিন্তু ওর কাজ দেখে খুশি হয়ে দীনানাথ পুরো বাড়ির দায়িত্ব ওকে সঁপে দিয়েছিলেন। অত বড়ো হাভেলির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে বাবলু, নুরাকে সাহায্য করত আর রাত্রে দীনানাথের কাছে শুত।

দীনানাথের মেয়ে মুম্বইয়ে থাকত। তার দুটি সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে স্বামীর জুতোর ব্যাবসা ছিল যার অবস্থা তখন প্রায় পড়ন্ত। অবশ্য মেয়ে উপাসনার স্বামীর সঙ্গে তখন বনিবনাও ছিল না। উপাসনার মদ্যপানে আসক্তির অভ্যাস স্বামী আনন্দকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র স্ত্রীকে বরদাস্ত করত এই আশায় যে, শ্বশুরের মৃত্যুর পর অর্ধেক সম্পত্তির মালকিন হবে উপাসনা। যেনতেন প্রকারেণ ওই সম্পত্তি স্ত্রীকে ঠকিয়ে কী করে নিজের করা যায়, তারই নানা ফন্দিফিকির মাথায় আনাগোনা করত সবসময়। উপাসনার সঙ্গে ভালোবাসার বিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু সম্পর্কটা তিক্ততার দিকে মোড় নিয়েছিল। আনন্দ দেনায় আকণ্ঠ ডুবে ছিল।

দীনানাথের ছেলে অতুল একেবারে নিষ্কর্মা বলতে যা বোঝায় তাই। আজ পর্যন্ত কোনও কাজই ঠিক ভাবে করে উঠতে পারেনি। অতুলেরও এক ছেলে। সবাই বিদেশেই থাকত। অতুলের যত ফুটানি সবই মায়ের টাকায়। কিন্তু মায়ের প্রতি কোনও দায়িত্বই ও পালন করত না। এই নিয়ে নিত্যদিন বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকত।

দুই ছেলে-মেয়ের সঙ্গেই দীনানাথের বনিবনা একেবারেই হতো না। মাঝেমধ্যে কখনও কখনও দেখাসাক্ষাৎ হতো। মা-কে ডিভোর্স করার জন্য উপাসনা বাবাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারেনি। যদিও সে জানত তার মা খুবই ঝগড়ুটে, স্বার্থপর একজন মহিলা। দুই-তিন বছরে একবার ভাইবোন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তাও কিছু টাকা আদায় করার ধান্দায়।

নাতি-নাতনিদেরও কোনও খবর দীনানাথের কাছেও ছিল না। উনি কোনও দিন তাদের চোখেই দেখেননি। এই হল দীনানাথের পুরো পরিবারের চিত্র যা আজকের পটভূমিকাতেও অদ্ভুত বলেই সকলে গণ্য করবে।

ঠিক এগারোটায় হাভেলি পৌঁছোতেই রাজপাল দেখল সদরে বহু মানুষ ভিড় করেছে। ঘাবড়ে গেল সে। গাড়ি রাস্তাতেই দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। দেখল পুলিশের কিছু লোক রয়েছে। একটা চৌকির উপর দীনানাথের নিষ্প্রাণ শরীরটা শোয়ানো আছে। অদূরেই দাঁড়িয়ে নুরা, মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে। বোঝা যাচ্ছে কান্নাকাটি করেই এমন অবস্থা হয়েছে।

রাজপালকে দেখেই ইন্সপেক্টর রমন এগিয়ে এলেন ওর দিকে, আপনি কি দেওয়ানজি মারা যাওয়ার খবরটা আগেই পেয়েছিলেন?

রাজপাল সংযত হয়ে উত্তর দিল না, ইন্সপেক্টর। আমার জন্য এটা একটা বিরাট শক্। আমাকে তো স্যার নিজেই ফোন করে বলেছিলেন, আজ ঠিক এগারোটায় হাভেলি পেঁছে যেতে।

নুরা আর রাজপালকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ইন্সপেক্টর রমন মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে, এটা আত্মহত্যার কেস। শুধুমাত্র এই দুজনই জানত মালিক ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। দুই ছেলে-মেয়ে সম্প্রতি জানতে পেরেছিল, বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবে তারা নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, বাবার কাছে আসার কারওরই সময় হয়নি।

ইন্সপেক্টর রমন পকেট থেকে একটা বাদামি রঙের খাম বার করে রাজপালকে জিজ্ঞেস করলেন, এই খামটা অ্যাডভোকেট লোকেশ বক্সির নামে। আপনি একে চেনেন নাকি?

হ্যাঁ, উনি, দেওয়ানজির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই হাভেলির চার-পাঁচটা বাড়ি পরেই উনি থাকেন।

আপনি কি দেওয়ান সাহেবের ছেলেমেয়ে আর আত্মীয়স্বজনদের খবর পাঠিয়েছেন? রমন রাজপালকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করলেন।

দুজনের কথার মাঝেই হঠাৎই অ্যাডভোকেট বক্সি উদভ্রান্তের মতো ভিতরে প্রবেশ করলেন। একনজর দেখেই ওনার তীক্ষ্ম দৃষ্টি বুঝে ফেলেছিল, বন্ধু আর নেই। ওনার হাতেও একটা বাদামি রঙের খোলা খাম ধরা। ইন্সপেক্টর, মিস্টার বক্সিকে আগে থেকেই চিনতেন। নানা কেসের সুবাদে আদালতে দেখাসাক্ষাৎ হতেই থাকত। দীনানাথ, বক্সি আর রমন তিনজনেই জম্মুর পুরোনো বাসিন্দা।

চিঠি আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, বক্সি সাহেব খামটা ইন্সপেক্টরের হাতে ধরাল। দুটো খামেই চিঠির বর্ণনা হুবহু একই। রমন লক্ষ্য করলেন একই ব্যক্তির লেখা। পরিষ্কার তাতে লেখা আছে, আমি দীনানাথ, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে নিজের জীবন শেষ করছি। আজ চার-পাঁচ বছর হল ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য অসুখে ভুগছি। হয়তো আর বেশীদিন বাঁচব না। এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। আমার কাছে যারা কাজ করে তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত। সুতরাং তাদেরও আমি আর কষ্ট দিতে চাই না। অনেক ভেবেচিন্তে আমি এই সিদ্ধান্তে পেঁছেছি।

আমার মৃত্যুর পর আমার গোটা সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ অর্থাৎ এই বাড়ি, আমার গ্রামের আমবাগান আর নগদ ধনরাশিরও অর্ধেক ভাগ নুরা পাবে। রাজপাল যে-কিনা কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে, সে আমার কুদ-এর জমি বাড়ি সব পাবে। এছাড়া আমার নগদ অর্থের কুড়ি শতাংশ ওকে যেন দেওয়া হয়।

বাকি যা অর্থ পরে থাকবে তা আমি আমার বাড়ির পাশের মন্দিরের ট্রাস্ট-কে দিয়ে যাচ্ছি। বাকি যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাকে খালি ব্যবহার করে গেছে, তাদের জন্য আমার কাছে দেওয়ার কিছুই নেই। বেঁচে থাকতে আমি যা কষ্ট পেয়েছি, আমি চাই ওরাও এই কষ্ট ভোগ করুক। যদি এর থেকে ওরা কোনও শিক্ষা নিতে পারে।

আমার কাজ ধুমধাম করে করার কোনও দরকার নেই। যে-মন্দিরে আমি প্রতি মঙ্গল আর রবিবার যেতাম সেখানেই যেন আমার শ্রাদ্ধশান্তি সম্পন্ন করা হয়। আর লোকেশ, তোমার দাযিত্ব হচ্ছে আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করা। আর নুরা আর রাজপাল যেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটা দেখা। নয়তো মৃত্যুর পরেও আমি শান্তি পাব না।

রমনের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠতেই বক্সি বললেন, হাতে লেখা উইল কোনও কোর্ট অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু সবথেকে আশ্চর‌্যের বিষয় হল দীনানাথ নিজের সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে গেলেন না।

ইন্সপেক্টর রমন বললেন, বাচ্চারা তো এই উইল-টাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে।

হ্যাঁ পারে, কিন্তু সেটা খুবই দীর্ঘ প্রসেস। কত বছর যে লাগবে কিছুই বলা যায় না, তার উপর আলাদা করে খরচও আছে।

আপনি তো দীনানাথের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি নিশ্চই সব জানেন? প্রশ্ন করেন রমন।

হ্যাঁ, জানি তো সব। রোজ সন্ধেবেলায় দেখা করতে যেতাম। রবিবারও বাদ যেত না। তবে দুই বছরের বেশি হল, ওর শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ে। খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমাকেও মনের কথা বলা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল, উত্তর দেন বক্সি।

আপনি নুরা সম্পর্কে কী জানেন?

বক্সি আর রমন কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে এসেছিলেন। বাড়িতে লোকজন আসতে আরম্ভ করছিল। সন্ধের মধ্যে

দাহ-সংস্কার করার কথা ঠিক করা হয়েছিল কারণ ছেলে-মেয়ে দূর থেকে আসতে সময় লাগবে।

নুরা প্রায় দশ বছর ধরে দীনানাথের কাছে কাজ করছে। নুরার বাবা ও তার গোটা পরিবারকে দীনানাথ চিনতেন। প্রথম প্রথম নুরা ঘরদোর পরিষ্কার করে বাড়ি চলে যেত। কিন্তু যখন থেকে দীনানাথ অসুস্থ হলেন, নুরা সারা বাড়ির দাযিত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। শেষ দুবছর তো ও-ই প্রায় সব কাজ করত। ওদের বাড়ির অবস্থা বেশ খারাপ। মদ খেয়ে খেয়ে স্বামীটা মরে গেছে, ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তবে মেযো ভালো। মেযো নার্সিং পড়া সবে শেষ করেছে, বক্সিবাবু জানালেন রমনকে।

নুরার মেয়ে এখন কোথায়? রমন আগ্রহ প্রকাশ করল।

লুধিয়ানায় চাকরি করছে। নুরার বুড়ি মা নাতনির সঙ্গে থাকে।

দাহ-সংস্কার হয়ে যাওয়ার পর উইলের দুটো কপি বানানো হল। একটা রমন নিজে রাখল, অন্য অরিজিনাল কপিটা বক্সির কাছে থাকল। ঠিক করা হল, দীনানাথের সন্তানরা এলে ওনার পারিবারিক উকিল হিসেবে বক্সিবাবু ছেলে-মেয়েে উইল-এর বিষয়ে জানাবে।

মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা ও তার স্বামী আনন্দ রাতেই পেঁছে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল দাদা অতুলের পৌঁছোনোর। সে-ও দুদিন বাদেই বিদেশ থেকে এসে পৌঁছোল।

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা অনুশোচনার আগুনে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছিল। সারা জীবন মায়ের কথা শুনে এসেছে। বাবার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ শুনতে শুনতে বাবার প্রতি ঘৃণার মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল উপসনার। কিন্তু আজ বাবা না থাকাতে মনের মধ্যে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে।

আনন্দর এই পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছিল। ওর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, টাকা আত্মসাৎ করার। ওল্ড ম্যান-এর মৃত্যুতে ওর কোনওরকম আপশোশ ছিল না।

বাবার মৃত্যুতে অতুলের মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। বারবার শেষবারের আসার কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রথমবার দীনানাথ ওর সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বাবা-ছেলের মধ্যে মতের মিল ছিল কোথায়, যে দুজনে কোনও বিষয় নিয়ে বসে আলোচনা করবে এবং একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে!

অত দূর কানাডা থেকে এসে মাত্র পাঁচদিন থেকেই অতুল ফিরে গিয়েছিল। বাবার মৃতু্য়র পর বারবার এটাই মনে হচ্ছিল, চলো একটা অধ্যায় তো শেষ হল। এখন বাবা তার জন্য যে-সম্পত্তি, টাকাপয়সা রেখে গেছেন তাই দিয়ে সে নতুন করে নিজের ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে।

নুরা অতিথিদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। হাভেলির প্রত্যেকটা ঘর পরিষ্কার করে সকলের থাকার ভালো ভাবে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।

দীনানাথের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হলে অতুল আর উপাসনা মিলে ঠিক করল, এবার নুরা আর রাজপালকে ওদের দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়ার সময় হয়েছে। এদের বদলে নতুন লোক রাখা হবে বাড়ির কাজের আর রান্নাবান্না করার জন্য। রাজপালের জায়গায় একজন স্মার্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখা দরকার, যে-কিনা ব্যাবসা থেকে শুরু করে জঙ্গলের সব কাজকর্ম একাই সামলাতে পারবে। অতুল জানাল, এখন থেকে সে মাঝেমাঝেই দেশে আসবে সবকিছু দেখাশোনা করার জন্য।

ভাইবোনের আলোচনার মাঝেই ইন্সপেক্টর রমন এবং বক্সি সাহেব হাভেলি এসে পৌঁছোলেন। ওনাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল অতুল আর উপাসনা। কারণ তারা জানত আজ বাবার উইল পড়া হবে। নুরাকে অতিথিদের জন্য চা আনতে বলে দুজনে এসে বসল।

অতুল, অ্যাডভোকেট বক্সিকে লক্ষ্য করে বলল, আংকেল, আমি ভাবছি এবার বাড়ির হাল নিজের হাতে ধরব। বাবার পর আমারই দাযিত্ব সবকিছু দেখাশোনা করার। আমরা ঠিক করেছি নুরা আর রাজপালকে আর রাখব না। এমনিতেও ওদের দু’জনকে আমরা কেউ পছন্দ করি না। নুরাকে দেখলে তো মনে হয়, ওই এ বাড়ির মালকিন।

রমন আর বক্সির চোখাচোখি হল, যেন ওরা বলতে চাইছে, এরা বেচারারা কী করে জানবে, যে কী হতে চলেছে ওদের সঙ্গে।

আংকেল আপনি কিছু বলবেন না এই ব্যাপারে? উপাসনা জিজ্ঞেস করল।

উত্তর দিল রমন, তোমাদের যা বলা হচ্ছে মন দিয়ে শোনো। তোমার বাবার লেখা চিঠি যেটা ওনার কাছ থেকে পাওয়া গেছে, সেটা পড়ে তোমাদের শোনানো হচ্ছে এখন।

বাবার এত বড়ো সম্পত্তি পেতে চলেছে এই ভেবে উপাসনা আর অতুল মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেও, চোখেমুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে রেখে দু’জনেই সাগ্রহে রমনের দিকে তাকাল।

রমন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দীনানাথের পত্রটা পড়ে দুই ভাইবোনের দিকে তাকাল।

কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না। ওদের দুজনের মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ওরা রীতিমতো শকড। এমনটা কেউ আশা করেনি।

এ কী করে সম্ভব? উপাসনাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

আমরা দুজন ওনার সন্তান। নুরা, রাজপাল ওনার কে? কোথা থেকে ওরা এসেছে কেউ জানে না। আমার তো প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল কোথাও একটা রহস্য আছে…। নুরাটা এক নম্বরের চরিত্রহীন, বাবাকে ফাঁসিয়ে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।

সেই মুহূর্তে উপাসনার স্বামী আনন্দ ঘরে ঢুকে ওদের কথাবার্তায় যোগ দিল। উপসনার কথা শেষ হতেই বলে উঠল, আমার তো প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল, বাড়িতে যেভাবে গৃহকত্রী হয়ে ঘুরে বেড়াত, তাতে যে কেউই ভাবতে পারে বাড়িটা ওরই।

অতুল কোনও কথাই বলতে পারল না। রাগে ওর মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। দীনানাথ কোনও দিন বাবা হিসেবে কোনও কর্তব্য পালন করেননি। শুধু খরচ দিয়ে গেছেন। কখনও ওর স্কুলে যাননি। স্পোর্টস-এ এত ভালো ছিল অতুল কিন্তু বাবার কাছ থেকে কোনও দিন একটা বাহবাও ওর কপালে জোটেনি। মায়ে সঙ্গেও দীনানাথ মানিয়ে নিতে পারেননি এবং বহু অর্থ নিয়ে তবেই দীনানাথের থেকে আলাদা হয়েছিলেন মা ঠিকই কিন্তু তাতে অতুলের দোষটা কোথায় ছিল! অতুল তো দীনানাথের নিজের সন্তান। তাহলে বাবা হয়ে সন্তানের এত বড়ো সর্বনাশ কী করে করতে পারলেন, অতুল কিছুতেই সেটা ভেবে পেল না।

নুরা নুরা উপাসনা গলার জোর বাড়াল।

জি বিবিজি, নুরা মুহূর্তে সামনে এসে হাজির হল।

নুরা, এসব কী শুনছি! তুই জানতিস বাবা এত সম্পত্তি তোর নামে করে গেছেন? জানতিস তো নিশ্চয়ই নয়তো কোনও সম্পর্ক ছাড়াই দিনরাত কেন এখানে পড়ে থাকতিস? তিক্ততা ফুটে ওঠে উপাসনার গলায়।

না বিবিজি, আমি কিছুই জানতাম না, চোখে জল ভরে যায় নুরার।

আপনি এসব কী বলছেন? আমি তো এখনই আপনার মুখ থেকে শুনছি। আমি তো স্বপ্নেও এসব ভাবতে পারি না।

নুরা, তুমি যাও নিজের কাজ করো, অ্যাডভোকেট বক্সি এতক্ষণে মুখ খুললেন।

এটা কী করে সম্ভব আংকেল। আমি তো রাজপাল আর নুরাকে ছাড়ব না। এটা এদের বাপের সম্পত্তি নয় যে, এগুলো নিয়ে নেবে। প্রযোজনে আদালতে যাব, ওখানেই মীমাংসা হবে। রাগের মাথায় বলে ওঠে আনন্দ। শুনে সকলের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

বক্সি উত্তরে বলেন, হাতে লেখা উইলকে চ্যালেঞ্জ করাটা খুবই ঝুঁকির কাজ। বছর গড়িয়ে যাবে। খুব বেশি হলে আর কী হবে হয়তো কোনও জজ সাহেব হাতের লেখার পরীক্ষা করাতে পাঠাবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত দুটো চিঠিই দীনানাথ নিজের হাতেই লিখেছেন।

কিন্তু এদের কেন? আমরা কেন নই? এতক্ষণে অতুল কথা বলে।

ইন্সপেক্টর রমন এবার বলেন, এটা তো নিজের নিজের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। ওনার একাকিত্বটা একটু ভাবার চেষ্টা করো যেটার মধ্যে দিয়ে ওনাকে একাই যেতে হয়েছে। তার উপর ক্যান্সারের মতো রোগ, তোমরা তো কেউ খোঁজও রাখোনি। এই দুজনই তোমাদের বাবার সেবা করেছে।

শেষের এক দেড় বছর তো অসম্ভব মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। কখনও খুশি তো কখনও ডিপ্রেশনের শিকার হত। আমি ওর এই মুড সুইং দেখেছি আর এও দেখেছি নুরার কি অসীম ধৈর‌্য আর সহনশীলতা। নিজের কাজ নিয়ে থাকত ও। অত্যন্ত প্রভুভক্ত এবং বিশ্বাসী। শেষের বেশ কিছুদিন দীনানাথ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে কাপড়চোপড় বদলানো, পায়ে জুতো পরিয়ে দেওয়া সব নুরাই সামলাত। অ্যাডভোকেট বক্সি বললেন।

ইন্সপেক্টর রমনের আর কিছু করার ছিল না। উনি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। মনে মনে জানতেনই নতুন কিছু ঘটলে, সেটা বক্সি সাহেবের কাছেই জানতে পেরে যাবেন।

রমন চলে যেতেই বক্সি বললেন, তোমরা জানতে চাও, এরকম কেন করেছে দীনানাথ। আমি জানি এটার সম্পর্ক তোমাদের পরিবারের সঙ্গে। সেজন্য রমনের সামনে আমি কিছু বলতে চাইছিলাম না।

শ্লেষ মিশ্রিত হাসির রেখা ফুটে উঠল আনন্দের ঠোঁটে, কী এমন কথা আছে যে বাড়ির লোকেরা কিছু জানে না অথচ আপনি জানেন? আবার নুরার সাপোর্টে নতুন গল্প নয় তো?

ভদ্র ভাবে কথা বলো। তুমি এ বাড়ির জামাই। তাই তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার মাথার সাদা চুলের সম্মানটুকু করো। বক্সি রাগত স্বরে আনন্দকে বললেন।

অতুল বলে উঠল, আংকেল আপনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

বক্সি বলতে আরম্ভ করলেন, তোমরা সকলেই আশ্চর‌্য হয়ে গেছ, দীনানাথ কেন এরকম করল এই ভেবে! ১৯৪৬-৪৭ সালের কথা হবে। তোমাদের ঠাকুরদা নতুন নতুন ব্যাবসা আরম্ভ করেছেন। ব্যাবসা বাড়াবার জন্য তিনি কুদ-এ বেশ কিছু জমি নিয়ে রেখেছিলেন। ওখানে ওনার ছোটো একটা বাড়ি ছিল। সেখানে পাশেই এক গুজ্জর পরিবার থাকত। ওদের অনেক জমিজমা ছিল।

অশিক্ষিত গুজ্জরের কাছে অত জমি দেখে তোমাদের ঠাকুরদার মনে লোভ জন্ম নেয়। উনি সেগুলো হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। যখন কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারেন না, তখন একদিন রাতের অন্ধকারে ওদেরকে মেরে ফেলা হয়, সেটা তোমাদের বাবা দেখে ফেলে। ওর বয়স তখন মাত্র সাত। গুজ্জরের বউ একমাত্র মেয়ে নুরাকে নিয়ে কোনওমতে পালিয়ে জম্মু চলে আসে। নুরা তখন খুব ছোটো।

কিন্তু বাবা ওদেরকে কী করে খুঁজে পেল? উপাসনা জানতে চাইল।

আমি এটুকুই জানি, দীনানাথ ওদেরকে অনেক খুঁজেছিল, হয়তো পরিচিত কাউকে একাজে বহাল করেছিল। নুরা যখন এই বাড়িতে কাজে লেগেছে তখন হয়তো দীনানাথ ওদের ঠিকানাও খুঁজে বার করে ফেলেছে। হ্যাঁ, তবে নুরাকে ও কখনও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ সবসময় কাজ করত ওর। হয়তো সেই থেকেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীনানাথ।

তোমাদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা

না-হওয়া, দীনানাথের দুরারোগ্য ব্যাধি এই সবই হয়তো ওকে নতুন করে চিন্তা করতে প্ররোচিত করেছে। রক্তের সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভালোবাসা দিয়ে যখন দীনানাথ ভয়ানক যন্ত্রণায় ছটফট করত, তখন নুরাই ওর দেখাশোনা করত, ওষুধ এগিয়ে দিত।

আনন্দ বলে ওঠে, তবুও নিজের সন্তানের জায়গা কেউ নিতে পারে না। সে কাছেই থাকুক বা দূরেই থাকুক।

উপাসনা আর অতুল একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরা এর বিরুদ্ধে কোর্টে অ্যাপিল করব।

বক্সি সাহেব মৃদু হেসে বললেন, অতুল তোমাকে কানাডা থেকে বারবার আসা-যাওয়া করতে হবে। উপাসনা তুমিও ভেবে দেখ এটা কিন্তু সহজ নয়. বেশ কিছু বছর হয়তো লেগে যেতে পারে। কিন্তু হাতে লেখা উইল কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

বাবা

কী যেন নাম বললে তোমার বাবার? ইন্দ্রনাথ মুখার্জী? স্মিত হেসে মাথা নাড়াল পত্রালি।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাবা মুখোপাধ্যায় লিখতেন।

ভদ্রলোক দ্রুত হাতে স্টেপল করা কাগজগুলো উলটে যাচ্ছেন। প্রায় না দেখেই খসখস খসখস করে সই করছেন প্রত্যেকটায়। দুটো ভুরুর মধ্যিখানে গভীর ভাঁজ। মনক্ষুণ্ণ হচ্ছিল পত্রালির। তার মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কশিট, অত অত নম্বর একবারও চোখ পেতে দেখছেন না এই জ্ঞানী ব্যক্তি! জীবনের প্রথম দুটো বড়ো পরীক্ষায় এলাকা এবং স্কুলের নাম খবরের কাগজে তুলেছিল পত্রালি। একটি স্থানীয় চ্যানেল তাকে নিয়ে খবরও করেছিল। লাজুক মুখে বাইট দিয়েছিলেন পত্রালির মা। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া জড়িয়ে হাসি মুখে তার বাবা বলেছিলেন, আমার মেয়ে সত্যিই আমার গর্ব! আমি নিজে শিক্ষক কিন্তু ওকে আর কতটুকু সময় পড়িয়েছি আমি?

যাক, এখন অবশ্য সবই অতীত। এইসব রেজাল্ট দেখে যদি কেউ সত্যি সত্যিই একটা চাকরি দিত পত্রালিকে! প্রতিবার চাকরির পরীক্ষায় বসার আগে এই এক ফর্মালিটি! গেজেটেড অফিসারের সই চাই। আগে দুতিনবার সুকুমারকাকুই করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো তিনি না ফেরার দেশে। অগত্যা স্টেশন রোডের এই আদিত্য সাহার অ্যাপযে্টমেন্ট নিতে হয়েছে পত্রালিকে। পত্রালি এনাকে চিনত না। ভাগ্যিস তৃপ্তি যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল!

সই শেষ করে আদিত্যবাবু কাগজের বান্ডিলটা টেবিলের উলটো প্রান্তে ঠেলে দিলেন। নাও, তোমার কাজ শেষ। এইবার আমি অফিসের জন্য তৈরি হই।

হাতজোড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পত্রালি বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। সকাল সকাল আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। মাফ করবেন।

আদিত্য সাহার বাড়িটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রঙ্গন, জবা, নয়নতারা আরও কিছু নাম না-জানা ফুলের গাছ রয়েছে। মূল দরজা থেকে বেরিয়ে বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে গেটের সামনে উপস্থিত হয়ে একটা ফুটফুটে ছোট্ট ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল পত্রালি।

আহা রে! দেখি দেখি, তোমার লাগেনি তো বাবু?

ছেলেটা খিলখিল করে হেসে ঘরের দিকে দৌড় দিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে আদিত্যবাবুর ডাক শুনতে পেল পত্রালি। এই যে শুনছ, একটু দাঁড়াও তো।

বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। চোখদুটো ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মানে প্রভাতসখা হাইস্কুলের শিক্ষক, সাড়ে তিন বছর আগে যাঁর নামে মিটু অভিযোগ উঠেছিল?

মুহূর্তেই পত্রালির মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। মনে হল তার পায়ে নীচের মাটি দুলছে। চোখের সামনে দৃশ্যমান পৃথিবী এখন আবছা। দুটো কান তরল লাভার মতো তেতে উঠেছে। যে-কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পেটের ভেতর কী যেন পাক খাচ্ছে সরীসৃপের মতো। জ্ঞান হারাতে হারাতেও মায়ে মুখটা মনে করে, আদিত্যবাবুর বাড়ির কারুকাজ করা লোহার গেটটা ধরে নিজেকে সামলে নিল পত্রালি। শান্ত আর নির্লিপ্ত সুরে বলল, হ্যাঁ, একটা সাজানো অভিযোগ।

বিশ্বাস করো কাকিমা, আমি এক বর্ণ মিথ্যে বলছি না। তুমি যখন মামকে নিয়ে পরীক্ষা দেওয়াতে যেতে, স্যার আমাকে…! একদিন নয়, দুদিন নয়, চার-পাঁচবার এই ভাবে অত্যাচারিত হয়েছি আমি। তাও স্যারের সম্মানার্থে আমি মুখ খুলিনি।

ইন্দ্রনাথবাবু কোনও কথার প্রতিবাদ করেননি। একবারও কনফ্রন্ট করার চেষ্টা করেননি। পাথরের মতো শীতল আর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খোলা জানলার সামনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। পত্রালির মা তখন ঘেমে নেয়ে কেঁদেকেটে একশা। মহিলা সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে হাই-প্রেশারের রোগী। থাইরয়ে, কোলেস্টেরলে আধমরা। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই ছোটাছুটি করছিলেন। বেসিনের সামনে গিয়ে ওয়াক তুলছিলেন। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের ড্রাম টেনে আনতে যাচ্ছিলেন। চেঁচামেচি আর উত্তপ্ত আবহ দেখে পত্রালিদের পাশের বাড়ির লোকেরা উঁকি মারছিল। মিঠু কিন্তু এসব দেখেও দেখেনি। সে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছিল এক সুরে। পত্রালিদের দীর্ঘ দিনের পরিচিত বিকাশকাকুর মেয়ে মিঠু। মা নেই। বাবা মদ্যপ। মুদি দোকান চালাতে গিয়ে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে প্রতি মাসে ক্লাবের ছেলেদের হাতে মারধোর খায়।

হাই স্কুল পেরিয়ে মিঠু, ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর পায়ে এসে পড়েছিল। আমাকে আপনি পড়াবেন স্যার? বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে আমার। কিন্তু আমি পড়তে চাই।

পত্রালি অবাক হয়ে মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এই কি সেই মেয়ে যে, দিনের পর দিন ওদের বাড়িতে এসে না খেয়ে থাকার অজুহাত দিয়ে গোগ্রাসে লুচি, তরকারি, পরোটা, আলু কষা গিলেছে। ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর টাকায় কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর‌্যন্ত পৌঁছেছে? বাজারে বেরোলেই যার জন্য একটা চুড়িদার, একটা শাড়ি শখ করে কিনে এনে পত্রালির মা এতদিন ধরে বলে এসেছেন, থাক না। মা নেই। বাবাটা অসভ্য। ও তো আমাদের মেয়ে মতোই!

এসব যখন হচ্ছে, পত্রালি তখন কলেজের শেষ বর্ষে। তার কাছে সবটা জলের মতো পরিষ্কার। তাই মুখ লুকোনোর জায়গাটুকুও পায়নি সে। অবোধ সেজে না বোঝার ভান করতেও পারেনি। তার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েের বড়ো একটা মেয়ে বাড়ি বয়ে এসে তার বাবাকে ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত করে দিচ্ছে! তাদের সাজানো-গোছানো সংসারটা চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর পত্রালির কানে তখন ভাসছে পাড়া-বেপাড়া, দুবেলা যাতায়াতের পথে ট্রেনের চার-পাঁচ নম্বর বগিতে কলেজের ছাত্রদের মুখে শোনা, মিঠুর দুষ্কর্মের কাহিনি। নোংরা মেয়েছেলে শব্দবন্ধ না জুড়ে সাধারণত ওই মেযোর নাম নেয় না কেউই।

মিঠুর শরীরের ভাষা লক্ষ লক্ষ কথা বুঝিয়ে দিচ্ছিল পত্রালিকে। মিথ্যে বলতে গিয়ে অতি দক্ষ মানুষও কিন্তু ভাবার জন্য, বানানোর জন্য একবার থমকায়। পত্রালি একবারও বাবার সামনে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়ায়নি। তার মনের কোণে কোথাও সেই ইচ্ছেটাই আসেনি। কারণ সে জানত, ওই জঘন্য কাজ ইন্দ্রনাথবাবু কিছুতেই করেননি। তার বাবা কোনও দিন কোনও ছাত্রছাত্রীকে তার থেকে আলাদা চোখে দেখেননি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পত্রালি দেখেছে, ইন্দ্রনাথবাবু সন্তানজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের আগলাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ মুখার্জী একজন আদর্শ শিক্ষক। আজও পত্রালি সে কথা মানে।

রিটায়ারমেন্টের তিনদিন আগের ওই প্রবল ধাক্কাটা ইন্দ্রনাথবাবু সামলাতে পারেননি। অসৎ হয়তো চাপে পড়ে আত্মহত্যা করে, কিন্তু সৎ তো মহাকালের কাছ থেকে করুণার বদলে মৃতু্য চেয়ে নিতে পারে। মিঠু চলে যেতে তিনি পড়ার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিয়েছিলেন। পত্রালির মায়ে তখন পাগলপারা অবস্থা। বুকের বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়েছে। বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন পত্রালির মাকে। মহিলার মানসিক দিকটা সেই থেকেই ক্ষতবিক্ষত। পত্রালির মা এখন একটা কচি শিশুর মতো হয়ে গিয়েছেন। খাইয়ে না দিলে খাবেন না। চান করবেন না। সারাদিন গুম মেরে বসে থাকবেন। মাঝে মাঝে কাঁদবেন। পত্রালি যখন আদর করে দুহাত বাড়িয়ে ডাকবে, তখন এমন করে স্থূল শরীর নিয়ে থপথপিয়ে ছুটে আসবেন, যেন প্রাইমারি স্কুলের কোনও ছোট্ট বাচ্চা!

মিঠুর ওই কাণ্ডের পরদিন সকালেও ইন্দ্রনাথবাবু নিজে থেকে বাইরে বেরোননি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হব হব। সন্দেহ তখন শীর্ষে। ঘরের দরজায় একের পর ধাক্কা মেরে হুমড়ি খেয়ে মেঝের ওপর আছড়ে পড়েছিল পত্রালি। একদিকে অসুস্থ মা। আর একদিকে চিরদিনের মতো স্থির হয়ে যাওয়া একটা শরীর, ভালোবাসার ভালো লাগার ছোঁওয়া, শখানেক ডাকনাম, হাত ধরে ধরে হাঁটতে শেখানো লম্বাটে আঙুল আর অসীম স্নেহধারার অধিকারী তার বাবা। মামা, মামি, দূর সম্পর্কের দাদারা বুড়ি ছোঁওয়ার মতো ছুঁয়ে গিয়েছিল পত্রালিকে। অবশ্য মামার আবেগ বরাবরই একটু বেশি। তাই হয়তো দাদুর উইল অনুযাযী কিছু চাষ জমির ভাগ পেয়েছেন পত্রালির মা।

ইন্দ্রনাথবাবুর কর্মস্থল খালি করে ছুটে এসেছিলেন সহকর্মীরা। স্কুলের খোলা ময়দানে বাবার মরদেহ আগলে মাথা নীচু করে বসতে হয়েছিল পত্রালিকে। কারণ বেলা বাড়তে মিটু ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল যত্রতত্র, মফস্সলের আনাচে-কানাচে। তবে ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ে ইমেজ নষ্ট হয়নি। মাস ছয়ে যেতে না যেতেই আবার এক মাঝবয়সি লোককে ফাঁসাতে গিয়ে মিঠু নিজেই একটা ঘূর্ণির ভেতর তলিয়ে যায়।

আপনার সঙ্গে কথা বলে আমরা সত্যিই ইমপ্রেসড। আপনার রিটেন পরীক্ষার মার্কসও তো বেশ ভালো।

বেশ প্রশংসা নিয়ে পত্রালির মুখের দিকে তাকালেন ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখ্য প্রশ্নকর্তা। ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিহিত চারজন জাঁদরেল অফিসার সামনেই বসে রয়েছেন। পত্রালি নম্র ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাল, অনেক ধন্যবাদ স্যার, থ্যাংক ইউ।

তবে একটা শেষ জিজ্ঞাস্য আছে আমাদের। আপনার বয়স তো খুবই কম। অভিজ্ঞতাও অল্প। প্রশাসনিক পদের চারপাশে লোভ কীভাবে ধূর্ত শ্বাপদের মতো ওঁত পেতে থাকে জানেন তো? যদি কোনও দিন পা পিছলে যায়, ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন, কী করবেন?

একে অন্যের সঙ্গে চোখ চাওয়াচায়ি করছেন অফিসাররা। স্মিত হাসল পত্রালি। তারপর সরাসরি প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক অথচ সৌম্য গলায় জবাব দিল, আদর্শ আর প্রলোভনের মধ্যে থেকে আমি আদর্শকেই বেছে নেব স্যার। কারণ আমার আদর্শ হলেন আমার বাবা। কোনও মূল্যে আমি তাঁকে হারতে দিতে পারব না।

স্বীকারোক্তি

ডা. চ্যাটার্জি বললেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার সবসময় হয় না?

টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও, অর্পণের চোখ মোটেও ডা. চ্যাটার্জির উপর ছিল না। বরং তার দৃষ্টি ছিল ঘরের দেয়াল ঘড়ি, মানুষের ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি, একটা ক্যালেন্ডার বা ওর রিভলভিং-এর একটু উপরে একটা এসির উপর। জায়গাটা চেম্বার আর কর্পোরেট অফিসের এক মিশ্রণ মনে হচ্ছিল।

মুখ ফিরিয়ে এবার বলল, একেবারেই না। হয়তো মনের কোথাও থাকে অনুভূতিটা। কিন্তু তীব্র ভাবে জেগে ওঠে, যখন ও আমার কাছাকাছি থাকে। যেমন ধরুন, খাবার টেবিলে। আমার কাছাকাছি বসে খাচ্ছে বা আমার বাইকে। বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

আর কোথাও? টেবিলের উপর দুটো কনুই তুলে, হাতের উপর কায়দা করে নিজের চিবুক রাখলেন ডা. চ্যাটার্জি। ফরসা মুখ আর হালফ্যাশনের চশমায় মুখে আগ্রহের রেখা।

না, সবচেয়ে বেশি হয়, গলা এক স্কেল নামিয়ে বলল অর্পণ, যখন আমরা বিছানা শেয়ার করি।

তখন কোনও সমস্যা? মানে, প্রসেসটা চলার সময় আপনার কোনও অনুভূতি?

ঘরে কেউ নেই। তাও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ডা. চ্যাটার্জির চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভাসা সুরে বলল, প্রবলেম মানে, ব্যাপারটার মধ্যে যেন একশো শতাংশ থাকতে পারি না। একটা নতুন বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আর সে জন্যেই তো আপনার কাছে…

আসলে, কাউন্সেলিং-এর পরিভাষায় এটাও এক ধরনের ডবল পার্সোনালিটি। এই স্টেজটাকে আমরা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির মধ্যে রাখলেও, আমরা বুঝি নর্মাল আর অ্যাবনর্মাল-এর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব, ডা. চ্যাটার্জির কাউন্সেলিং সত্তা জেগে উঠেছে।

অর্পণের মনে হচ্ছিল, উনি একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন এগোনোর। মন বলছিল, আরও প্রশ্ন ভেসে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তর তো দিতেই হবে। না হলে সমাধান মিলবে কেমন করে।

আসলে, সত্যিটা এটাই। আবার বলতে শুরু করেছেন উনি, আমরা যতই বলি, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার তা কিন্তু নয়। কিছু স্মৃতি অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি থাকলেও, ভীষণ সতেজ থাকে। মানে, আমরা ভিতর থেকে, অবচেতন মনে তার থেকে ডিট্যাচড্ হতে চাই না।

চেম্বারের ভেতরের নিস্তব্ধ হিম পরশে আর ডা. চ্যাটার্জির নরম সাহচর্যে ইতিমধ্যেই অশান্ত ভাবটা কমতে শুরু করেছিল। স্বস্তি নেমে আসছিল। অর্ণব অফিস কলিগ হলেও ইনটিমেট ফ্রেন্ড। ডা. সৌম্যশেখর চ্যাটার্জির নাম সাজেস্ট করে বলেছিল, ওনাকে সব বলতে পারবি। ওনার সমাধান একেবারেই অফবিট। পেশাদারিত্বর সঙ্গে গোপনীয়তাও দারুণ বজায় রাখেন। জাস্ট চেক করে দেখতে এসেছিল। নির্ভরতাটা তৈরি হচ্ছে। শ্রদ্ধা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সমাধান আছে নিশ্চই?

অবশ্যই আছে। আই গ্যারান্টি। বন্ধুর মতো, নিজের মতো করে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে এই টেকনিকটাকে আমরা বলি, ফ্রি অ্যাসোসিয়েন অবাধ অনুষঙ্গ। এতে আপনি অনেকটা হালকা বোধ করবেন। আর সমাধানটা অনেক মাইনর ব্যাপার। জাস্ট একটা উপসংহার টানার মতো।

থমকাল অর্পণ। এখনও পর্যন্ত ডা. চ্যাটার্জির সঙ্গে এই অ্যাপযে্টমেন্টের বেশ কয়েটা ধাপে প্রথমে থেমে, তারপর এগোতে হয়েছে। সুতো ছাড়ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে। সমস্যা নিয়ে একজন কাউন্সেলর-এর পরামর্শ নিতে আসা। লাজুক ভাব আর হাসির মোটামুটি ব্যালেন্স যেমন অফিসে করে, সেরকম ভাবে বলল, আসলে, এ রকম অ্যাফেয়ার তো আজকের যুগে সবারই একটা-দুটো থাকে। পাসিং অ্যাফেয়ারের মতো। তা পেরিয়ে সবাই চলেও যায়। বিবাহিত জীবন শুরুও হয়ে যায় জমাটি ভাবে। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগেরই কাহিনি অনেকটা এ রকমই।

একদম ঠিক বলেছেন। তবে ঘটনার রেখাপাত সবার মনে একরকম ভাবে হয় না। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মনের আলাদা আলাদা স্তর।

অর্পণকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র আর শিক্ষিত মনে হয় বলেই কি শুরু থেকেই ডা. চ্যাটার্জি এতটা টেকনিক্যাল স্বর বজায় রাখছেন? হতেও পারে। বেশ কিছুটা বাতাস বুকে ভরে নিয়ে অর্পণ বলল, যে-সমাধান আপনি দেবেন, তাতে কি মনের ভারি ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে কি আর রেজাল্ট পাবেন, মি. মিত্র? কিন্তু রেজাল্ট আসে। আর সে চেঞ্জ আপনি বুঝতে পারবেন আপনা থেকেই।

ফিল-গুড ভাবটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতেও পারছে অর্পণ। প্রথমে ভেবেছিল, কোনও জ্যোতিষের কাছে যাবে। টিভি খুললেই তিন মিনিটে কালসর্পদোষ, ব্যাংদোষ, টিকটিকিদোষ কাটানো হয়। স্ক্রিনের নীচের ফোন নাম্বারে ফোন করলেই এদের চেম্বারে। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য এদের হাতের মুঠোয়। জ্যোতিষির ডিগ্রিতে সব এক একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আর ত্রিকালজ্ঞ। অর্ণবকে বলতেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, কাউকে বলিস না, অ্যাড এজেন্সিতে এই পদে চাকরি করিস। বিজ্ঞাপন এখন তোকেই টুপি পরাচ্ছে! ভাবতে পারি না।

তখন আর কথা এগোয়নি। এখন মনে হচ্ছে অর্ণবের কথা শুনে একদম ঠিক করেছে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বলল, ওকে। কিন্তু সলিউশনটা কী?

কিছু না। ছোট্ট একটা কনফেশন।

কনফেশন! কার কাছে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে অর্পণের।

হেসে ফেলেছেন ডা. চ্যাটার্জি। নট সো ফাস্ট। কারও-র কাছে না। নিজের কাছে। কেউ থাকবেও না।

মানে?

খুব সহজ মি. মিত্র। নিজের ভেতরে যদি কোনও পাপবোধ থেকেও থাকে, তা খুঁড়ে, তুলে ফেলে দিন স্ট্রেট…

সেটাই তো বলছি। মানে…

দেখুন, আপনি নিশ্চয় চার্চে কনফেশন বক্স দেখেছেন।

হুঁ….

উলটো প্রান্তে একজন পাদরি বসে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাজ হল শুধু শুনে যাওয়া। অনেকেই বলে, তা করে তারা রিলিফ পেয়েছে।

তাহলে কি চার্চে, বিভ্রান্ত লাগছে অর্পণের।

না, না। আসলে নিজের ভেতরের কথাগুলো আপনি কোনও দিন কাউকে পুরোটা বলেননি। সেটাই নিজে এবার একটা কাগজে পুরো লিখে ফেলুন।

এক মিনিট। আপনাকে তো…

সরি, মি. মিত্র, আমাকেও আপনি পুরোটা বলেননি। ইনফ্যাক্ট বলতে পারছেন না। তাই বলছি, লিখে ফেলুন পুরোটা।

হ্যাঁ, তারপর?

সিম্পল। কোনও ভরা পূর্ণিমার রাতে, যখন কেউ দেখছে না সেটাকেই কুচিয়ে টুকরো করে চোখের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। এ টুকুই। দেখবেন, অনেকটা রিলিভড হয়ে যাবেন।

সত্যি কি এটা হতে পারে? এর কোনও সাযে্নটিফিক জাস্টিফিকেশনই তো নেই।

সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের সব সলিউশন, বিজ্ঞান মেনে হয় না মি. মিত্র। একবার ট্রাই করুন শুধু। ডা. চ্যাটার্জি হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়েছেন। টলে যাওয়া বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অর্পণ, কিন্তু মুন লাইটই কেন?

মুন ইজ আ লাভ সিম্বল। চাঁদের আলোর একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার আছে।

ওকে, কবে করতে বলছেন এটা? কাল বাদ পরশুই কিন্তু পূর্ণিমা আছে। মোবাইল খুলে বং ক্যালেন্ডার-এ ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে অর্পণ।

দুচোখ বুজে কী যেন ভাবলেন ডা. চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, পরে করতে গেলে আবার বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা। কামিং ডেটটাই কাজে লাগান।

একটা কথা, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল অর্পণ, বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা বেশ সিক্রেট। এটা নিশ্চয়ই ডিসক্লোজ হবে না কোনও ভাবেই?

শুনুন মি. মিত্র, কোনও কাউন্সেলরই এক জন পেশেন্ট-এর কেস হিস্ট্রি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

থ্যাংক ইউ। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনে অর্পণ।

 

তোফা দুপুরের ঘুমের পরও আলিস্যি ভাবটা ছেড়ে যাচ্ছিল না। রোববার মানেই শেষ তিন মাসে পাতলা খাসির মাংসের ঝোল আর ভাত। শেষ পাতে একটু টক দই। ঘুম ঘুম ভাবটা খাবার টেবিলেই ফিল করে অর্পণ। নতুন ফ্ল্যাট-এর ইএমআই-এর সময় যত এগিয়ে গেছে, তত বেশি করে এই অলস ভাবটা ঘিরে ধরেছে। উত্তরপাড়ায় জিটি রোড গঙ্গার কোল ঘেঁসে এই ফ্ল্যাট। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল। সে সময় ওর বয়স আঠাশ। কোম্পানি চেঞ্জ করে বহুজাতিকে যোগদান করে, ডিজাইনার হিসেবে তখনই ঈর্ষণীয় পে-স্কেলে চলে গিয়েছিল। আর এখন তো উন্নতির চরমসীমায়।

অ্যাড-এর ফিল্ডে অর্পণ মিত্রকে সমস্ত ক্লাযে্নট এক ডাকে চেনে। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন না করে স্পেশালাইজড কোর্স করতে গোঘাট থেকে সোজা কলকাতায়। একেবারে রেসিডেন্সিয়াল। দুবছর পর ক্যাম্পাস থেকেই একটা মোটামুটি কোম্পানিতে। দেশের বাড়িতে আর ফিরলই না। বছর তিনেক গড়িয়াতে দুজনের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকা। গোঘাটে দাদার সংসারে বাবা-মা থাকলেও, বেশ কয়েবার কাটিয়ে গেছে এখানে।

ঘরে ঢুকে বক্স খাটের পাশের ড্রয়ারের উপরে বিকেলের চা রাখল ঐশিকি। এই তিনমাসে দুপুরে অন্তত ছুটির দিনে তাকে ঘুমোতে দেখেনি অর্পণ। প্রচণ্ড হেলথ কনশাস বলেই কি ঘুমোয় না! তিন মাসের নব বিবাহিত জীবনে, এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। চায়ের গন্ধের সঙ্গে ঐশিকির লম্বা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও মিশে যাচ্ছে। একটা ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলেও এখনই কাছে টানাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

সদ্য ঘুমিয়ে উঠেছে। বাসি গন্ধ, মাথা চাড়া দিল যেন। উঠে বসে চা বিছানায় নিল। খোলা ব্যালকনিতে চলে গেছে ঐশিকি। এ সময়টায় ওর বাড়ি থেকে মা বা বাবা কেউ একজন ফোন করে। চোখ সরিয়ে রাখল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পুরুষ্ট গোঁফে আর একটু বেড়ে ওঠা ভুঁড়িতে, সুখের ঝলক নাকি স্বামী হয়ে ওঠার আদল প্রকাশ পাচ্ছে!

চা খেয়ে আলিস্যি ভাবটা যাচ্ছে না। আজ রাতে কী করবে ভাবতেই বুকে শান্তির হাওয়া। একটা বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া।

চা শেষ করে চিত হয়ে শুল অর্পণ। স্যান্ডো গেঞ্জিটা উঠে গেছিল। নামিয়ে নিল পাজামার উপর ঠিক ঠাক। সুখের উড়ানকে সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছে। এমনকী সুদেষ্ণার সঙ্গে কাটানো সময়ে তো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল বা কলেজে কারও-র সঙ্গে ক্রাশ হয়নি। প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটে যখন এসে বলেছিল, রীতিমতো মুখ টিপে হাসাহাসি হয়েছিল। হোস্টেলে অলক বলেছিল, তোরা মফস্সল বা একটু ভিতর দিকের ছেলেরা কেমন যেন একটু বাড়তি চাপা প্রকৃতির হোস। গ্রাম শব্দটা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া।

ভ্রূ কুঁচকে অর্পণ বলেছিল, আর তোরা সিটির লোকেরা সত্যি কথা বলে যে ডিক্সনারিতে কিছু হয়, তা বোধহয় বিশ্বাসই করিস না।

অলক চোখ গোল্লা করে বলেছিল, তুই কিন্তু অন্যরকম। আগ লাগা দেগা তু।

তো আগুনই লেগেছিল। সে আগুন যে কী কী পোড়ায়, বুঝতে সময় লাগেনি। ইনফরমাল কমিউনিকেশনের চতুর্থ ক্লাসেই চোখ গেছিল অর্পণের। হ্যাঁ, তবে উপরের ঠোঁটের এক সেমি উপরের তিলটায়। পাশের ডেস্কে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছিল বলে অলক এক সময়ে ফিসফিসিয়ে বলেও ছিল, পুরো ম্যাডোনা তো রে। ঠোঁটে হাসি চলে এসেছিল।

ক্লাস শেষ করেই সিনেমাটোগ্রাফিক বিস্ফোরণ। তবে ম্যাডোনা না, সুচিত্রা সেন টাইপ। এগিয়ে এসে একেবারে মিসাইল, সোজাসুজি কারও-র সম্পর্কে কিছু বলতে না পারাটা হিপোক্রেসি। বুঝতে পারছিস?

ঠোঁটে হাসিটা রেখে বলে উঠেছিল অর্পণ, ফ্যাকাল্টির সামনে তোর তিল নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগত?

বাঃ! স্মার্টনেসের তো অভাব নেই।

অভাব কেন হবে। আশির দশকের কেবলু বাংলা সিনেমার নায়ক আর কোথায় পাবি এখন!

সুদেষ্ণা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলেও, অলক পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিল, তেরা হোগা গুরু।

সত্যিই হয়েছিল এবং এগিয়ে গিয়েছিল একটু দ্রুত গতিতে। প্রথম প্রেম আর তার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে লেকের ধার সুদেষ্ণার সঙ্গে সে সম্পর্ক এগিয়েছিল চোখের পলকে। সিনেমার হলে একই ফাউন্টেনে চুমুক, লাইব্রেরিতে স্টাডিনোট লোড করা বা গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটা হু হু করে কেটে গেছিল দিনগুলো। একই গতিতে শেষ হয়েছিল কোর্সের বছর দুটোও।

অর্পণের মনে হয়েছিল ছেদ পড়তে এবার বাধ্য, কারণ সুদেষ্ণা বর্ধমানে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা বলছিল। ঠিক সেই সময় অর্পণের হঠাৎ চাকরি। আর সুদেষ্ণার আবার একটা স্পেশাল কোর্সে ভর্তি হওয়া।

 

চব্বিশে চাকরি কি অর্পণকে বেপরোয়া করে দিয়েছিল? ছুটির দিনে নতুন কেনা বাইকে বোম্বে হাই রোড ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া বা বাইকে রাতের কলকাতা আবিষ্কার ওর আর সুদেষ্ণার। এ ছাড়াও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ভাড়ার ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

অফিসিয়ালি দাঁড়ি টানলাম, এই জাতীয় কথা কোনও দিন ওরা পরস্পরকে বলে, সম্পর্ক থেকে বেরোয়নি। কেউ কোনও দিন কাউকে পরে ফোন করে বা দেখা করে কৈফিয়তও চায়নি। সেটা সম্পর্কের চোরাটানের মৃত্যু হতে পারে বা, দুজনের ইগো ফ্যাক্টর হতে পারে। এমনকী নিজের তরফে ঠিক কী, সেটাও নিশ্চিত করে অর্পণ বলতে পারে না। মনের গভীরে স্মৃতি থেকে যাওয়াতেই কি কোথাও পাপবোধ! প্রথম কয়েক মাস ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকেও মনে হতো, একবার যোগাযোগ করলে কেমন হয়। তারপর একদিন সেখানেও ধাক্কা।

ছোটোখাটো মনোমালিন্য ওদের মধ্যে হলেও তা দীর্ঘস্থাযী হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজ করে নিত সুদেষ্ণাই। তাই কোনও দিন সেভাবে ওর মুখ গম্ভীর দেখেনি। স্পেশাল কোর্স শেষের ঠিক একমাস পর এলগিন রোডের এক ক্যাফেতে রবিবারের দুপুরে হাজির হয়ে দেখতে পেয়েছিল গম্ভীর মুখ। বাইরেও আকাশের মুখ ভার। অসাধারণ সুন্দর মিউজিকের সঙ্গতেও দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ হয়েছিল নিঃশব্দে।

এই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউটা ক্র‌্যাক করতে পারলাম না। অথচ পোস্টিং কলকাতাতে ছিল, আর প্যাকেজও ছিল অ্যাট্রাকটিভ। সুদেষ্ণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নীচের ঠোঁট।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল অর্পণ, তো?

তো কিছুই নয়। দিল্লিতে একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা ইন্টারেস্টেড। এক সেকেন্ড থেমে সুদেষ্ণা যোগ করেছিল, আমিও।

সোজা হয়ে বসেছিল অর্পণ, ভালো খবর। কিন্তু কলকাতাতে আরও দুএকটা ট্রাই করলে হতো না?

ইনস্টিটিউটে শর্মা স্যার বলছিলেন, দিল্লির অফারটা নিয়ে নেওয়া উচিত। ওদের নাকি প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনিং স্টাইলটা গোটা ইন্ডিয়ায় খুব খাচ্ছে। আর আহমেদাবাদ আইআইএম-এর দুজন প্রাক্তন মিলে অফিসটা খোলায়, শেখার স্কোপটা বেশি হবে।

অন্যমনস্ক হয়ে খালি কফি কাপটা একবার নাড়াচাড়া করে অর্পণ বলেছিল, ও, তাহলে তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস।

এভাবে ভাবছিস কেন, যে-কোনও অবস্থাতেই কলকাতা ফিরে আসতে পারি। আরও অনেক বেটার এক্সপেরিযে্ন্স নিয়ে। অফিসের দুদুটো অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে চলতে থাকায় রাতের ফোন ছাড়া সে সপ্তাহে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বর্ধমানে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সুদেষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে ওর বাবা-মা ছাড়তে এসেছিল। আগে থেকে কোনও পরিচয় না থাকায় সামনে যেতে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।

দিল্লিতে সেটলড হয়ে ফোনে বেশ কয়েবার কথা হয়েছিল। সে ফোনও কমে আসছিল তিন-চার মাস পর। তারপর দুদুটো নম্বর অস্তিত্বহীন।

শোক করেনি অর্পণ। নিজের প্রেমের নির্লিপ্তিতে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভাবার এত সময় ছিল না। নিজের কেরিয়ার গ্রাফ রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। কোম্পানি চেঞ্জ করে সাধারণ বেসরকারি অফিসে চাকরি থেকে অনেকগুনে বেশি রোজগার মোটেও মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। দুবছরের মাথায় ফ্ল্যাট নিয়ে পরের ছবছর শুধু তার ইএমআই গুনে গেছে নিঃশব্দে।

১৮ লাখের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে উঠে এসে প্রথম প্রথম উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারির যুদ্ধটা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ভালো লাগত। রাতে ফ্ল্যাটে একা থাকার পীড়া যে-একেবারেই দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু ক্লান্তি খুব দ্রুত ঘুমের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলত।

এ রকম অবস্থাতে ছটা বছর কেটেছিল অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। নতুন করে কারও-র সঙ্গে জড়ানোর সময় ছিল না। ছুটির দিনে বাজার, গোছগাছ, রান্নার লোককে বুঝিয়ে দেওয়া আর বাকি সময়টা ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ডিজাইন। গোঘাট থেকে বউদি আর মায়ের অনবরত ফোন ভেসে আসছিল।

বিয়ের প্রস্তাবে খুব বেশি চমকায়নি। হিসেব কষে দেখেছিল ফ্ল্যাটের ঋণশোধে বাকি আর সাত বছর। ইনক্রিমেন্ট স্টেডি রেটে বাড়ছে। জিডিপির লোয়ার গ্রোথের দাঁত ওদের ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শরীর-মন একযোগে বলে উঠেছিল বিয়ের এটাই সঠিক সময়। আর তা ছাড়া এতগুলো বছর অন্য কারও-রও তো মনে পড়েনি। সুতরাং দায়ের প্রশ্ন আসছে না বোধহয়। আর নিশ্চিত সমাধান তো এবার হাতের কাছেই।

চন্দননগরে ঐশিকিদের বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখা। মোটামুটি খবর নেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারফেক্ট চয়েস। বাংলায় অনার্স গ্র‌্যাজুয়েট। তবুও বাইরে দুতিনবার মিট করে নিয়েছিল। লম্বা চুল, হাইট, রং-এ জোরদার লাগলেও, সুদেষ্ণার সঙ্গে তুলনায় যায়নি। চন্দননগর ষ্ট্র‌্যান্ডেই রবিবারের এক সন্ধেতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঐশিকীকে, ওর অতীত জীবনের কথা। কোনও পাস্ট অ্যাফেয়ার, এ বিয়েতে রাজি কিনা, ছোটো ছোটো প্রশ্নে জানার চেষ্টা করেছিল।

ঐশিকির সোজা-সাপটা সরল উত্তরে কিছুতেই নিজের অতীতকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পারেনি। বিয়ের পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও নিষ্কলঙ্ক ঐশিকীর আচরণে, নিজের অতীতকে বার বার গিলতে হয়েছে। একটা অ্যাফেয়ার কী করে অপরাধবোধে পরিণত হয়, ভেবে বের করতে পারেনি। অগত্যা ছুটে যাওয়া ডা. চ্যাটার্জির কাছে।

 

ঘুমানোর ভান করেই শুয়েছিল। একটা হালকা উত্তেজনা তো বটেই, দুপুরে ভালো রকম ঘুমের জন্যও ঘুম আসতে চাইছিল না। কাল খুব সকালে উঠে প্রোজেক্টের একটা কাজ ছকে নিতে হবে বলেছিল। তাই ঐশিকি আজ আর কোনও উষ্ণতা চায়নি। ভীষণ কম্প্রোমাইজিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মেয়ে। সম্পর্কের সতেজতা আর স্নিগ্ধতা দুটোই সমান ভাবে মেনটেইন করতে পারে। এভাবেই তিন মাস অর্পণকে যেন অদৃশ্য হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

মধ্য কুড়িতে সম্পর্ক উন্মাদনা খোঁজে হয়তো, মধ্য তিরিশে স্থিতাবস্থা। সংসারের বৃত্তে এ ভাবেই বোধহয় ঢুকে পড়তে হয়। আজকের রাতের পর নিশ্চই পুরোপুরি ঢুকে পড়বে। সন্ধেবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঐশিকির চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। বিশেষত ছুটির দিনে। মনে হয়েছিল রাতই সঠিক সময়।

রোজের মতো আজও ঐশিকি টয়লেটে উঠল। এসি অফ করল। মিনিট চারেক সময় ব্যয় করে টয়লেটে ও। এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এক মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়ল অর্পণ। ভাগ্যিস অ্যাটাচড্ বাথ নয়। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল। টয়লেটের আলো জ্বলছে, জলও পড়ছে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিজের ল্যাপটপে কম্পোজ করেছিল প্রায় তিন পাতার কনফেশন। প্রিন্ট আউটও বের করে রেখেছিল। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলল। সামনে চাঁদের আলোয় ভরা গঙ্গা। দ্রুত হাওয়ায় বড়ো মায়াবী এ চরাচর। টুকরোগুলো হাত থেকে ছোড়ার আগের মুহূর্তেই, স্থির হতে হয়।

পাশের ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে আসে প্রায় একই রকম কাগজের টুকরো। অসংখ্য। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের জানালা থেকে সরে যায় ঐশিকির মুখ। হাতের ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোকে এবার ছেড়ে দেয় অর্পণ। দুটো স্বীকারোক্তি প্রায় একইরকম হয়ে মিলেমিশে প্রবল হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মিশে যায়। যেমন করে বসন্তের হাওয়া আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছিল…

 

বেহায়া

অফিসের জন্য তৈরি হয়ে অনন্যা বাইরের ঘরে এসে দেখল, শাশুড়ি-মা বসে শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করছেন। অনন্যা এসেই সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরে অফিস যাওয়ার অনুমতি চেয়ে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বাই বলে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল। অজয়ের বাবা অনিরুদ্ধবাবু খুবই ভালোবাসেন অনন্যাকে।

সুগন্ধা বললেন, অনন্যা, আজ কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। অজয়ের পিসিমা আসবেন সন্ধেবেলা।

মা, তাড়াতাড়ি আসা তো মুশকিল। অফিস থেকে পাঁচটায় বেরোলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা তো বাজবেই। এসে দেখা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। বলে নিজেই জোর করে হাসি টেনে আনে মুখে। আর তাছাড়া পিসিমা তো আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন না। নিজের গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।

খানিক আগেই স্বামী অজয় ঘরে ঢুকেছে, অনন্যা খেয়াল করেনি। অজয়ে গলার আওয়াজে ওর দিকে দৃষ্টি পড়ল অনন্যার। ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে হাসতেই অজয় বলল, বাজে কথা বোলো না অনন্যা। ঠিক সময় চলে এসো।

হাসতে হাসতেই অনন্যা বেরিয়ে গেল।

মায়ে গম্ভীর মুখ দেখে অজয় সুগন্ধাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? মুড খারাপ?

না, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে অজয় বাবার দিকে তাকাল। অনিরুদ্ধবাবু ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। ইশারায় কথা বলে বাবা ছেলে দুজনের মুখেই চাপা হাসি ফুটে উঠল।

অজয় অফিস চলে গেলে অনিরুদ্ধবাবু নিজের স্ত্রীকে বললেন, আমি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চেষ্টা করব, দিদি আসার আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু তুমি এত কেন চুপচাপ?

স্বামী প্রশ্ন করতেই রাগে ফেটে পড়লেন সুগন্ধা। চুপ করে থাকব না তো আর কী করব? আর কত অ্যাডজাস্ট করব? সকাল থেকে ওইরকম বেহায়া ছেলের বউকে দেখে এমনিতেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

বেহায়া? অনন্যা? একথা কেন বলছ?

হাবভাব দেখছ তো, একে দেখে এ বাড়ির বউ বলে মনে হয়? সবসময় ঠাট্টা, ইয়ার্কি, সাজগোজ তারপর এই প্রাইভেট চাকরি! আর কথাবার্তার তো কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কত ভেবেছিলাম বাড়ির বউ নম্র, ভদ্র হবে, মা-বাবার দেওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থাকবে। কিন্তু না, যাই বলি না কেন এমন উত্তর দেবে যে, তারপর আর কিছু বলা চলে না। সব কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অথচ আমাদের মেয়ে অপর্ণাকে দেখো, শ্বশুরবাড়ির সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শাশুড়ি যা বলছেন তাই মাথা নীচু করে মেনে নিচ্ছে। আর আমাদের অজয় এমন একটা বেহায়া মেয়েে এনে আমাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে তার কাঁধে হাত রাখলেন, এখনই এত অধৈর্য্য হয়ে পড়ছ কেন? মাত্র চারমাস হয়েছে অনন্যা এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি ওর কোনও রকম ছবি মনের মধ্যে এঁকে ফেলো না। তুমিও তো পড়াশোনা করেছ, তুমিও যথেষ্ট মডার্ন। এই কদিন অনন্যাকে দেখেই তুমি ওর নামকরণ করে ফেলেছ বেহায়া! এটা ঠিক নয় সুগন্ধা। অজয় যথেষ্ট দাযিত্ববান ছেলে। ও অনন্যাকে যখন নিজের বউ হিসেবে স্বীকার করেছে, তখন নিশ্চই সে অনন্যার গুণ দেখেই ঘরে এনেছে।

হ্যাঁ, গুণ তো আছে বটেই। সেই জন্যই তো অজয়কে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। অনন্যা যা বলে তাতেই সায় দেয় অজয়। ও সাজগোজ আর বউয়ে রূপ দেখে এমন মজেছে যে, অনন্যা যাই করুন না কেন তাতে তার সাত খুন মাপ হয়ে যায়। আমিই শুধু ওর কোনও গুণ দেখতে পাই না কেন কে জানে!

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীয়ের রাগ দেখে হেসে ফেলেন। একটু রসিকতা করার ইচ্ছা সামলাতে পারেন না। সুগন্ধা কখনও কোনও শাশুড়িকে দেখেছ ছেলের বউয়ে গুণ এত সহজে মেনে নিতে? তোমার তো কত গুণ ছিল কিন্তু তোমার শাশুড়ি কোনও দিন সেটা স্বীকার করেছেন?

এত রাগের মধ্যেও স্বামীর কথা শুনে সুগন্ধা হেসে ফেলেন।

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, ঠিক আছে, আমি এখন বেরোচ্ছি। রাগ কোরো না, বিশ্রাম নাও। দিদি এলে তুমিও ব্যস্ত হয়ে পড়বে, এই বলে অনিরুদ্ধবাবু বেরিয়ে যান।

সুগন্ধা বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের লোককে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে দুপুরে একটু ফ্রি হয়ে সবে শুতে যাবেন, ফোনটা বেজে উঠল। বড়ো ননদের ফোন যিনি সন্ধেবেলায় ওঁদের বাড়ি আসছেন থাকতে।

সুগন্ধা, আমি ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ তোমাদের বাড়ি পৌঁছে যাব। ততক্ষণে আমাদের বউমাও নিশ্চয় বাড়ি এসে যাবে? বিয়ের সময়ে ওর সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারিনি।

হ্যাঁ দিদি, অনন্যা বলেছে ও চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ফিরতে, বলে ফোন নামিয়ে রাখেন সুগন্ধা। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সুগন্ধা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। সন্ধেবেলায় অনেক কাজ আছে। কিন্তু শুয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। নানা চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করে। তিন বছর আলাপের পর মাত্র চারমাস আগে অজয় আর অনন্যার বিয়ে হয়েছে। অনন্যার মা-বাবা দুজনেই প্রফেসর। বেঙ্গালুরুতে অনন্যা বড়ো হয়েছে। সুন্দরী, মডার্ন, সুশিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে

অজয় অনন্যাকে পছন্দ করে, এটাই সুগন্ধার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সন্তনের খুশিতে, সংসারের আনন্দেই সুগন্ধা পরিপূর্ণ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অনন্যার সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার পরেই একটাই শব্দ দিনরাত ওনার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করল, বেহায়া।

সুগন্ধা ভালোমতোই জানেন, অনন্যা অজয়কে চোখে হারায়। অনন্যার অফিস বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। যার ফলে অজয়ে আগে ওকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় আর ফেরেও অজয় ফেরার অনেকটা পরে।

কলকাতায় অফিস যাতায়াত করাটা একটা সমস্যা কিন্তু অনন্যা বাড়ি এসেই চটপট জামাকাপড় বদলে, ফ্রেশ হয়ে সকলের সঙ্গে বসে গল্প করতে শুরু করে দেয়। কোথাও ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও থাকে না ওর চেহারায়। সুগন্ধা অবাক হয়ে যান যত ওকে দেখেন। বাড়িতে এমন ভাবে থাকে, দেখে যে কেউ ভাববে ও বাড়ির মেয়ে নতুন বিয়ে হয়ে আসা বউ নয়।

রান্নাবান্নার কোনও শখ নেই অনন্যার। একদিন সুগন্ধা খুব আদর করেই অনন্যাকে বলেছিলেন, অনন্যা, ছুটির দিনগুলোতে একটু একটু করে রান্নাটা শিখে নাও।

কেন মা? ঝট করে অনন্যা বলে ফেলে।

রান্নার জন্য লোক আছে ঠিকই কিন্তু একটু আধটু রান্না তো সকলেরই শিখে নেওয়া উচিত।

সে কাজ চালাবার মতো রান্না আমি করে নিতে পারব। ওটাতেই এখন কাজ চলবে। পরে কখনও শিখে নেব, বলেই অনন্যা শাশুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে।

মা রান্নাঘরে ঢুকতে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি একবার হ্ঁযা বলো, এখুনি একজন ফুল টাইম রান্নার লোকের ব্যবস্থা করছি। তোমারও একটু বিশ্রাম হবে। আমি তো বলি তুমি সবসময়ে জন্য একটা লোক রেখেই নাও।

বাড়ির ভিতর সবসময় কাজের লোক ঘোরাফেরা করবে ভেবেই সুগন্ধা মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তখনকার মতো অনন্যাকে চুপ করানোর জন্য বলেন, ঠিক আছে, যখন ইচ্ছে হবে শিখে নিও। এখন লোকের আমার কোনও প্রযোজন নেই। প্রমিলা সব কাজই তো করে দিচ্ছে।

অনন্যা আর সুগন্ধার কথোপকথন যখন হচ্ছিল তখন অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবা আর ছেলে, দুজনের কথা শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিলেন।

আজ সুগন্ধা অনিরুদ্ধবাবুকে একা পেয়ে অনন্যার বিরুদ্ধে জমে থাকা রাগ উগরে দিলেন, নিজের চোখেই দেখছ বাড়ির কোনও কাজ করতে চায় না। যখনই কিছু শেখার কথা বলি অমনি গলা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে যে, রাগও করতে পারি না।

স্ত্রীয়ে নালিশ শুনে হেসে ফেলেন অনিরুদ্ধবাবু, তুমি কতটা শাশুড়ি হিসেবে রাগ দেখাতে পারো আমার খুব জানা আছে।

সন্ধেবেলায় উমাদিদি আসার আগেই অনিরুদ্ধবাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, যাতে সুগন্ধার মনে ক্ষোভ না তৈরি হয়।

চা-জলখাবার খেতে খেতে উমা অনন্যা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। কেমন বউ হয়েছে? শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে কিনা? অফিসে এতটা সময় কাটায়, তাহলে বাড়ির কাজ করে কখন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

উত্তরটা অনিরুদ্ধবাবুই দিলেন, আমাদের সেবার কীসের দরকার! আমরা কি কেউ অসুস্থ? অনন্যা খুব ভালো মেয়ে দিদি। দাযিত্ব নিয়ে সব কাজ করে।

অনন্যার কথা ওঠাতে সুগন্ধার মুখের উপর কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। উমার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সবই নজর করল। মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন উমা। অনিরুদ্ধর থেকে বেশ অনেকটাই বড়ো উমা। মা-বাবার মৃতু্যর পর ভাই-বোনের সম্পর্ক আরও অনেক বেশি মজবুত হয়েছে। সম্পর্কের মান দুজনেই রক্ষা করে চলেছেন।

বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন উমা। এখন বয়ে হওয়ায় আরও বেশি পূজাপাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সেকেলে

আচার-বিচার মেনে চলেন। কোনও এক মহারাজ-এর কাছে দীক্ষিত। কাশীধামে থাকেন মহারাজ। দেশের যেখানেই মহারাজের প্রবচন থাকে, উমা ঠিক কিছু একটা করে

চার-পাঁচদিনের জন্য সেখানে পৌঁছে যান।

কলকাতার রাজারহাটে এবার মহারাজের শিবির অনুষ্ঠিত হয়। সেটার জন্যই উমার রাঁচি থেকে কলকাতায় আসা। ওঁরা বসে গল্প করতে করতেই অজয় আর অনন্যাও অফিস থেকে চলে এল। পিসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অনন্যা নিজের ঘরে চলে এল ফ্রেশ হবে বলে। ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে ডিনার করতে করতে সকলে আড্ডায় মেতে উঠল। অন্যান্য সময়ে মতো অনন্যাও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। অনন্যার এই ব্যবহার উমার চোখে অতিরিক্ত স্পর্ধার বলেই মনে হতে লাগল।

এরপর শুরু হল নাগরিকতা বিল নিয়ে আলোচনা। অনন্যা তো সোজাসুজি জানিয়ে দিল এই বিল সে সমর্থন করে না। অথচ উমা নিজের বাড়িতে স্বামীকে এই বিলের সমর্থনে সবসময় কথা বলে আসতে শুনেছেন। অনন্যার কথাবার্তায় উমার খালি মনে হতে লাগল, অনন্যা একপ্রকার তার স্বামীকেই অপমান করছে। প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল উমার। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান স্বল্প হওয়াতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

অনন্যা অনিরুদ্ধবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে চলছিল, বাবা আমাদের অফিসে আমার কিছু সহকর্মী এই বিলের বিরোধিতা করে একটা মিছিল বার করার প্ল্যান করছে। আমার এতে পুরো সমর্থন রয়েছে।

উমা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ইচ্ছে করে অনন্যাকে থামাবার জন্য বলে উঠলেন, আমি ভাবছিলাম এবার মহারাজের শিবিরে যাওয়ার সময় সুগন্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ওখানে দুটো দিন থেকেও নেবে আর মহারাজের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। কী বউমা, তোমার শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে ওই দুটো দিন সংসার সামলে নিতে পারবে তো?

কিন্তু পিসিমা, মা তো শিবিরে যাবেন না।

সুগন্ধা হতচকিত হয়ে পড়েন। এই বেহায়া মেয়েটা বলে কী? আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাব না, সেটা ও ঠিক করবে? উমাও অনন্যার কথা শুনে যেন শক খেলেন। দুদিন হল বাড়িতে এসেছে, এর মধ্যেই ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস পাচ্ছে মেযো? একটু গম্ভীর হয়ে উমা বললেন, মহারাজের কাছে দু’দণ্ড বসে ওনার কথা যে-শোনে, তার জীবনে কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকে না।

পিসিমার কথায় রসিকতা করার ইচ্ছেটাকে কিছুতেই দমাতে পারল না অনন্যা। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, সে কী পিসিমা, তাহলে আপনার মহারাজের জন্য দেখছি, ডাক্তারদের ক্লিনিকগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে! সাবধান হতে বলবেন মহারাজকে, নাসা থেকে ওনাকে তুলে নিয়ে না চলে যায়, হা হা হা বলে হাসিতে ফেটে পড়ে অনন্যা।

খুব গম্ভীর দেখায় উমাকে। বলেন, বউমা, আমার মনে হয় আধ্যাত্মিক বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সেজেগুজে অফিসে যাওয়া এক ব্যাপার আর আধ্যাত্মিক চেতনা অন্য জিনিস।

পিসিমার কঠোর স্বর শুনে অনন্যা ভিতরে ভিতরে একটু মুষড়ে পড়লেও, স্বভাবসুলভ কৌতুকের বশেই বলে ফেলল, পিসিমা সত্যিই আধ্যাত্মিক আলাপ-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

অনন্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার উমা সুগন্ধাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তাহলে তুমি যাবে তো সুগন্ধা?

সুগন্ধার কাছে বাড়ির শান্তি সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু ননদের মুখের উপর কিছু বলার সাহস কোনও দিনই তাঁর হয়নি। আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, আমি মনে হয় যেতে পারব না দিদি। বেশিক্ষণ বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় আজকাল। পায়ে ব্যথাটা খুব বেড়েছে।

উমার মুখের উপর অসন্তোষের ছায়া এসে মিলিয়ে গেল। অজয়ও বলে উঠল, হ্যাঁ মা, তোমার তো ওখানে একেবারেই যাওয়া উচিত নয়। পিসি, তুমি বরং একাই ঘুরে এসো।

রাতে সবাই ঘরে শুতে চলে গেলে উমা, সুগন্ধার সঙ্গে সোফায় এসে বসলেন, সুগন্ধা তোমার ছেলের বউ তো দেখছি খুব স্মার্ট। ফটফট করে মুখের উপর কথা বলে।

সুগন্ধা কী বলবেন ভেবে পান না। চুপ করে থাকেন।

তোমাকে সাবধান করছি সুগন্ধা, ওকে এত বেশি বাড়তে দিও না। লাগাম নিজের হাতে রাখো।

হেসে ফেলেন সুগন্ধা। দিদি ও বাড়ির বউ। ঘোড়া হলে না হয় লাগাম কষে ধরতাম। সুগন্ধা বরাবরই শান্তিপ্রিয়। অশান্তি কোনও দিনই ওনার পছন্দ নয়।

সুগন্ধাকে চুপ থাকতে দেখে উমাই আবার মুখ খুললেন, এ যেরকম মেয়ে দেখলাম বাড়ির কাউকে ও পরোযা করে না বলেই মনে হয়। সবসময় সেজেগুজে, মেক-আপ করে রয়েছে। বড়োদের সামনে মুখ বন্ধ করে থাকার সভ্যতাটুকুও ওর জানা নেই। এইসব মেযো স্বামীকে ভালো মতন আঁচলে বেঁধে রাখতে জানে। দেখো তোমার সংসারে ভাঙন না ধরায়।

ছেলের বউকে কীভাবে রাখা উচিত, এ বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার সুগন্ধার কাছে উজাড় করে দিয়ে উমা পরের দিন সকালে মহারাজের শিবিরে চলে গেলেন। ওখান থেকেই উমা নিজের বাড়ি চলে যাবেন এটাই প্রথম থেকে স্থির ছিল।

পিসিমা চলে যেতে অজয় অনন্যাকে বলল, তুমি তো পিসির সামনে প্রচুর কথা বলছিলে দেখলাম। এত কথা মা কোনও দিন বলতে সাহস করেননি।

মা যত ভালোমানুষ না অজয়, সেরকম ভালোমানুষ হয়ে আজকের দুনিয়ায় কোনও কাজ করা যায় না। মাঝেমধ্যে বলতেও হয়। শান্ত এবং গম্ভীর স্বরে কথাগুলো অনন্যা বলতেই, সুগন্ধা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দেখলেন অনন্যাকে। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি অনন্যা। ওর চেহারায় সবসময় একটা তরতাজা ভাব, মুখে প্রশান্তি এবং যথেষ্ট সুন্দরী সে।

অপর্ণা, অজয়ে থেকে চার বছরের বড়ো। শ্বশুরবাড়ি বরোদায়। বছরে একবার আসে

মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছেলেকে আনে।

স্বামী সুজয় সবসময় আসতে পারে না। ভাই অজয়ে বিয়ে সময় মাত্র পাঁচদিনের জন্য আসতে পেরেছিল। তাই ছেলের স্কুলের ছুটি পড়তেই, এবার কুড়ি দিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে অপর্ণা হাজির হল বাপের বাড়িতে। বাড়তি আগ্রহ, অনন্যার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করার। সুজয় আসতে পারেনি অফিসে জরুরি কাজ থাকার জন্য। এমনিতে অপর্ণা খুবই স্বামীর অনুগামী। কিন্তু একলা বাপের বাড়ি আসায় বেশ একটা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।

অনন্যার সঙ্গে জমেও গেল খুব অপর্ণার। সুগন্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলেন অপর্ণার সঙ্গে বেশি করে, সময় কাটাবার জন্য অনন্যা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল।

দুদিন যেতে না যেতেই অনন্যা একদিন অপর্ণাকে বলল, এ কী দিদি, আজকাল ম্যাচিং গয়না পরে সাজগোজ করে থাকার যুগ। আর তোমার গলায়, হাতে লাল-কালো সুতোয় খালি মাদুলি পরা! এসব কোথা থেকে জোগাড় করেছ?

অপর্ণা আমতা আমতা করে উত্তর দিল, আমার শাশুড়ি-মা সারাদিন মন্দির, দেবতা, বাবাজি, পুরোহিতদের নিয়ে থাকেন। বাড়িতে কিছু একটা হলেই, একটা মাদুলি নিয়ে পরের দিনই উপস্থিত হন। আমাকে এরকম দেখছ, তাহলে সুজয়কে দেখে কী বলবে? সারা শরীরে এই মাদুলি। এভাবেই ওকে অফিস করতে হয়। ওর অফিসে নিশ্চই ওকে নিয়ে ওর কলিগরা হাসাহাসি করে।

অনন্যা এবার জোরে হেসে উঠল, দিদি, সুজয়দার অফিসে যদি আমার মতো মেয়ে থাকে, তাহলে তো নিশ্চই সুজয়দাকে নিয়ে হাসবেই।

অনন্যার কথা বলার ভঙ্গিতে অপর্ণাও হেসে উঠল। অনন্যা এটা কিন্তু খুব খারাপ। নন্দাইকে নিয়ে এরকম রসিকতা তাও আবার ননদেরই সামনে!

সন্ধেবেলা শপিং-এ যাওয়ার কথা ছিল। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, দিদি তুমি শাড়ি আর সু্য়ট ছাড়া আর কিছু পরো না? যেমন ধরো ওযে্টার্ন ড্রেস?

না, অনন্যা। আমার শাশুড়ির শাড়িই পছন্দ।

তুমি তো তোমার পছন্দের কথাও ওনাকে জানাতে পারো। এখন তো সবাই সবরকমের পোশাক পরছে।

অপর্ণাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে অনন্যা।

বাইরের ঘরে বসে অপর্ণা এবং অনন্যার সব কথাই সুগন্ধা শুনতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল বেহায়া মেযোর এতদূর স্পর্ধা যে, নিজের নন্দাইকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে একটুও আটকায় না। আবার ভিতরে ভিতরে খুশিও হচ্ছিলেন নিজের মেয়ে অপর্ণার প্রতি অনন্যার ভালোবাসা দেখে। মেয়ে আগেও যতবার এসেছে এতটা আনন্দে ওকে কখনও থাকতে দেখেননি সুগন্ধা।

অপর্ণা আসার চার-পাঁচদিন পরেই হঠাৎ সুগন্ধার ভাই ফোন করে জানাল, ওনার ছেলে রাতুল তার ফ্যামিলির সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে আসছে। ফোন আসার পর থেকে সুগন্ধা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় যখন খবরটা শুনলেন তখন ওদের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক মনে হলেও অনন্যা, শাশুড়ি এবং ননদের মুখের উপর লক্ষ্য করে কালো মেঘের ঘনঘটা।

সারাদিনই অপর্ণা কারও সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা না বলে নিজের ঘরেই বন্ধ থাকল। হাসিখুশি মেযো হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। অপর্ণার ছেলে খুবই শান্ত, ও নিজের মতো অাঁকা, বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাকে বিরক্ত করার কথা ওর মনেও হয় না।

পরের দিন অনিরুদ্ধবাবু আর অজয় অফিস চলে গেলে, অনন্যা খেয়াল করল সুগন্ধার ঘরে অপর্ণা। নীচু স্বরে দুজনে কিছু কথা বলছে। অপর্ণার ছেলে বসে টিভি দেখছে। অনন্যা, শাশুড়ির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এতদিনে এই বাড়িটা, বাড়ির লোকজনগুলো বড়ো আপন হয়ে উঠেছে তার। ও জানতে চাইছিল, কেন ওদের দুজনের মুখে অমাবস্যার ছায়া পড়েছে, মামার ছেলে রাতুলের নাম শুনে।

অপর্ণার গলা শুনতে পেল, মা, আমি কালই বরোদায় ফিরে যাচ্ছি। টিকিটের ব্যবস্থা এখুনি অজয়কে বললেই করে দেবে।

না অপু, এত কষ্ট করে এই তো এলি, এরই মধ্যে…

মা আমি রাতুলের মুখও দেখতে চাই না।

কিন্তু রাতুল তো ফ্যামিলির সঙ্গে আসছে, তুই চিন্তা করিস না। ইগনোর করিস।

মা, তুমি সবসময় এই একই কথা বলো, ইগনোর কর। আমি কিছুতেই ওর মুখ দেখতে পারব না।

বাইরে দাঁড়িয়ে অনন্যা বুঝে ফেলে, কিছু একটা রহস্য আছে। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে। অপর্ণাকে বলে, দিদি তুমি কেন এখান থেকে যাবে? এটা তোমার বাপের বাড়ি, মানে তোমারও নিজের বাড়ি। তোমরা আমার আপন। তোমার কষ্ট মানে আমারও কষ্ট। আমাকে আপন ভেবে নিজের কষ্টের কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না?

অপর্ণা জড়িয়ে ধরে অনন্যাকে, নিশ্চই শেয়ার করব। এতদিনে তুইও আমার বড়ো আপন হয়ে উঠেছিস। রাতুল আমার মামার ছেলে। অত্যন্ত অভদ্র, রুঢ় এবং চরিত্রহীন। আমার বিয়ে কিছুদিন আগে এখানে এসেছিল এবং আমাকে একদিন একা পেয়ে আমার শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে। আমি চ্ঁযাচাতে এবং থাপ্পড় মারাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। অথচ ওকে কিছু বলার বদলে মা আমাকেই চুপ থাকতে বলে, ইগনোর করতে বলে। আমার বিয়েে আসেনি। এতদিন পর যখন আসছে, আমি ওর মুখও দেখতে চাই না।

অনন্যা ননদের হাত চেপে ধরে, তোমাকে ওর মুখ দেখতে হবে না দিদি।

কিন্তু ও তো আসছে!

সুগন্ধা চুপ করে ছিলেন। অনন্যা বলে, মা তুমি শুধু নও, অনেক মা-ই এমন করেন। মেয়েেই চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু বাড়ির সাপোর্ট না পেলে এই ক্ষত আরও গভীর হয়ে ওঠে মেয়েের মনে। সেদিন দিদির কাছে শোনার পর, রাতুলের গালে চারটে থাপ্পড় মেরে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তাহলে দিদিকে আজ চলে যাওয়ার কথা বলতে হতো না। যাই হোক, যা হওয়ার ছিল হয়েছে। দিদি তুমি একদম চিন্তা কোরো না। এছাড়াও দেখছি, যে যখন খুশি কলকাতায় মানে এখানে চলে আসছে। ফলে মা-কে একগাদা কাজ করতে হয়। মা মুখে কিছু বলেন না কিন্তু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমিও অফিসে থাকি। ইচ্ছে করলেও কোনও সাহায্য করতে পারি না। দিদিকে তো আমি কোনও ভাবেই কষ্টে থাকতে দেব না। বলেই অনন্যা তত্ক্ষণাৎ অজয়কে ফোন করল।

অজয়, প্লিজ একটা কাজ করতে হবে। মামাকে ফোন করে বলো, যে-হঠাৎই আমরা বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি। মা কিছু জানত না। তুমি সারপ্রাইজ দেবে বলে আগে থেকে টিকিট কেটে, কাউকে জানাওনি।

অজয়ে উত্তর কেউ শুনতে না পেলেও অনন্যার মুখ হাসিতে ভরে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, এখুনি ফোনটা করো। বলে ফোন কেটে দিল।

অপর্ণার মুখের উপর থেকে চিন্তার ছায়া কেটে গিয়ে হাসিতে মুখ ঝলমল করে উঠল। সুগন্ধার মুখে হাসি ফুটতেই অনন্যা সুগন্ধার কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, মা, এইসব করতে হয়। ভালোমানুষ হয়ে কাজ চলবে না। আমার মতো স্পষ্টবক্তা এখনকার দিনে দরকার। অজয় তোমার ভালোমানুষির অনেক গল্প শুনিয়েছে। কিন্তু আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি এসে গেছি।

এমন ভাবে কথাগুলো বলল অনন্যা, সুগন্ধা আর অপর্ণা জোরে হেসে উঠলেন।

সুগন্ধা অনন্যার চুলে বিলি কাটতেই ঝট করে অনন্যা উঠে বসল, আমার চুলে এখন হাত দেওয়া যাবে না মা, সবে স্ট্রেটনিং করিয়েছি।

সুগন্ধা হেসে হাত সরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধার ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলেন উমার ফোন। ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

উমা মহারাজের সম্পর্কে দু-চার কথা বলেই অনন্যার প্রসঙ্গে চলে এলেন, কী সুগন্ধা তোমার বেহায়া বউটার কী খবর?

দিদি, ওই বেহায়া বউটাই আমার মনের পুরো জায়গাটা জুড়ে বসে গেছে। আরও অন্য কিছু কথা বলে সুগন্ধা ফোন রেখে আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর কথায় উমাদি যথেষ্ট আশ্চর‌্য হয়েছেন।

ঘরে আসতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করল, পিসি কী বললেন?

কিছু না। ওই আমরা সবাই কেমন আছি।

কেন মা, জিজ্ঞেস করলেন না, বেহায়া মেযো নতুন কী খেল দেখাচ্ছে?

সুগন্ধা শক খেলেন, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ একথা বলছ কেন?

হেসে গড়িয়ে পড়ল অনন্যা। মা চিন্তা কোরো না। আমার খুব ভালো লেগেছে এই নামটা। আজকে দিদি আর তোমার কথা যেমন কানে এসেছিল, সেরকমই ওইদিনও পিসিমা আর তোমার কথাগুলো কানে গিয়েছিল। তোমাকে বললাম না, ভালোমানুষির যুগ শেষ। এখন চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়। কিন্তু এটা সত্যি আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। বলে সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরল অনন্যা।

অপর্ণা লক্ষ্য করছিল। হেসে বলল, মা, এটা কী হচ্ছে?

সরি সরি রে বাবা, বলে সুগন্ধা নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের কান ধরতেই তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠল। অনন্যা মিছিমিছি কলার তোলার ভান করে বলল, দেখলে তো, এই বেহায়া মেযে শাশুড়িকেও কান ধরিয়ে ছাড়ল।

তিনজনেরই মিষ্টি হাসিতে ঘরের ভিতরটা আনন্দে ভরে উঠল।

সংঘাত

সুখে থাকতে গেলে একজন মানুষের কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়? মানুষের উপর বিশ্বাসের? সম্পর্কের উপর আস্থার? সহানুভূতির? নাকি, অনেক অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে সুখ, যেরকম বলে থাকেন অনেকে। জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার রসদ, গলা ফাটিয়ে নিজের অধিকার ঘোষণা করার অধিকার– সুখে থাকার জন্য এইরকম কত বিষয়েরই না দরকার পড়ে!

কিন্তু সবসময় কি এই সবকিছু খুব সহজে মেলে? সহজে পাওয়ার রাস্তায় কত না বাধা। মানুষের রিপু বড়ো পরশ্রীকাতর। সে বড়ো হিংসুক। বড়ো লালসা তার! চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রতারণা, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, ছল– ইত্যাকার হাজাররকম প্রকাশ সেই লালসার। এই কি তবে মানুষের নসিব? মানুষ একটু সুখে থাকবে, তাতে আর একজন মানুষের খুব কি কিছু আসে-যায়, যদি না সেই সুখ অন্য কারও বঞ্চনার মাধ্যমে এসে না থাকে? যুক্তি বলে, যায় না। বুদ্ধি বলে, অবশ্যই যায়।

তাড়াহুড়ো করে স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে এই সব কথাই মনে মনে ভাবছিল সুজাতা। রোজ সকালে ঠিক এভাবেই অত্যন্ত ব্যস্ত পা ফেলে তাকে স্টেশনে আসতে হয়। অফিসযাত্রীদের ভিড়টা এসময়েই সবচেয়ে বেশি থাকে। পা মাড়িয়ে, কনুই দিয়ে সহযাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে মানুষের চলমান শরীরগুলো উন্মত্তের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কারওর অন্য কোনও দিকে হুঁশ নেই। মানুষ কি ধীরে ধীরে উন্মাদ বা পাশবিক হয়ে যাচ্ছে? কে জানে!

পিছন থেকে এসে একটা লোক সুজাতার পা মাড়িয়ে চলে যেতেই সে চাপা গুঙিয়ে উঠল। লোকটি বোধহয় একটু ভদ্রগোছের। সুজাতার গোঙানি শুনে অন্তত পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে গেল, ‘দুঃখিত’! হায়, দুঃখ প্রকাশে যদি শরীরের ব্যথা কিছুমাত্রাতেও কমত! যদিও ব্যথার দিকে পিছু ফিরে তাকানোর সময় সুজাতারও নেই। ভোরে বাড়িতে একটা ব্যাচ পড়তে আসে। তাদের পড়িয়ে উঠতে বেলা চড়ে যায়। অন্যান্য দিন যদিও সে কিছুটা সমবেদনামূলক ছাড় পায়, কিন্তু সেটি হওয়ার জো নেই আজ। স্কুলপরিদর্শনে সরকারের অফিসারেরা আসছেন। ছাত্রছাত্রীদের কালকেই সে পইপই করে বলে দিয়েছিল যাতে আজ কেউ কামাই না করে। সরকারি বাবুরা যদি দেখেন স্কুলে পড়াশুনা ভালো হচ্ছে, ছেলেমেয়েদর মধ্যে পড়ার এবং বাবা-মায়েদের মধ্যে তাদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা রয়েছে, তাহলে স্কুলের জন্য বাড়তি কিছু অনুদান চাইবার মুখটা থাকে।

কিন্তু এত সহজে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কিছুতেই। শেষমুহূর্তে ছেলেমেয়েগুলো যেন না ডোবায়।

মালতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভূগোলের দিদিমণি সুজাতা। মালতীপুর জায়গাটা খুব বড়ো হয়তো নয়, তবে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এ অঞ্চলে ধান খুব ভালো হয়। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান রিকশায় চেপে সুজাতা যখন স্কুলের দিকে যায়, রাস্তার দুধারে হলুদ হয়ে যাওয়া ধানগাছগুলি হাওয়ায় মাথা দোলাতে থাকে। মাটিতে বীজ পোঁতা থেকে, কচি সবুজ ধানগাছগুলির বেড়ে ওঠা, তারপরে সেগুলির সোনালি হতে থাকার প্রতিটি দৃশ্য এখন তার চেনা। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এত বর্ধিষ্ণু গ্রামেও বিকাশের লক্ষণগুলি তেমন স্পষ্ট নয়। টিউবওয়েলে ঠিকমতো জল ওঠে না, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা নামমাত্র। কে বলবে, এখানেও বছর-বছর ভোটের হাওয়া বয়। নেতাদের গরম বক্তৃতায় তেতে ওঠে সমাজজীবন। ভোট হয়ে যায়। উন্নয়নও ঝিমিয়ে পড়ে। জীবন চলতে থাকে সেই একইরকম শম্বুকগতিতে। তাই এখানে চাকরি করতে আসার ইচ্ছে থাকে না সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও। সুজাতাই কি পোস্টিংটা পেয়ে খুব খুশি হতে পেরেছিল?

তার অবশ্য অন্য সমস্যাও কিছু ছিল। তবে সবকিছুর উপরে, এখানে বদলি হয়ে আসতেও তার মন চায়নি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, কোনওরকম সামাজিক সুযোগসুবিধাহীন জায়গায় পঙ্গু হয়ে থাকার চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে?

তার উপর রাতুল এখনও যথেষ্ট ছোটো। শ্বশুর-শাশুড়িও বৃদ্ধ হয়েছেন। তবু যদি মনোময় কলকাতায় চাকরি করত, একটা কথা ছিল। তাকেও তো বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দিয়েছে।

সুজাতা তাই বাস্তবিক খুবই আতান্তরে পড়ছিল। অনুরোধে যদি কিছু হয়, সেই ভেবে সত্যপ্রিয় মজুমদারের কাছে পৗঁছেও গিয়েছিল একদিন। টাকমাথা, মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। সারাদিন পান চিবোচ্ছেন। দেখলেই মনে হয় ধুরন্ধর, ভোগী মানুষ। সব শুনে বাঁকা হেসে বললেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনি কি মনে করেন অসুবিধা আপনার একার? কিন্তু তাই বলে, লোকে শহর ছেড়ে নড়বে না, এরকম হলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষার হালটা কী দাঁড়াবে ভাবতে পারছেন?’

সুজাতা এরপরও তার নাচার অবস্থাটা আর একটু বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেছিল। সত্যপ্রিয়বাবু থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কত্তা তো ভালো পোস্টেই আছেন, তাই তো? তা আপনার আর টাকাপয়সার কী দরকার? অসুবিধা হলে ছেড়ে দিন না। আমরাও তো সেটাই চাই। আপনার পুরোনো লোকেরা সব বাস্তুঘুঘু হয়ে গেছেন। চাকরির বাজারের যা অবস্থা তাতে নতুন টিচার অনেক কম মাইনেয় পাওয়া যাবে।’

জিভটা মুহূর্তে তেতো হয়ে গিয়েছিল লোকটার চাঁচাছোলা বক্তব্য শুনে। কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সত্যপ্রিয়র চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল সুজাতা। সত্যিই তো, প্যানেলে এখনও শতসহস্র যুবক-যুবতি অপেক্ষা করছে চাকরি পাওয়ার জন্য। একটা জায়গা খালি হওয়ার খবর পেলেই তদ্বিরের ধুম পড়ে যায় বলে শোনা যায়। যার যেখানে যত প্রভাবশালী খুঁটি আছে, তাদের ব্যবহার করার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। কপালের শিকে তো এক-আধজনেরই ছেঁড়ে। আর সত্যপ্রিয় মজুমদারের মতো লোকেরা দিব্যি মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে যান।

তাকে ম্লানমুখে চেম্বারের বাইরে বের হতে দেখে রামকুমার দাঁড়িয়ে পড়ে। বগলে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে সে কোথাও যাচ্ছিল। সুজাতাকে দেখে গলায় খানিকটা শ্লেষ এনে কথা শুরু করে।

‘কী? হল না বুঝি?’– মুখে একফালি হাসি ঝুলিয়ে রাখল রামকুমার, যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে।

ম্লান হাসল সুজাতা, যার মানে, না।

রামকুমার বলল, ‘আপনাদের কিছু হবেও না। কেন হবে? এত বছর ধরে চাকরি করছেন, এখনও সরকারি কর্তারা কীসে তুষ্ট সেটা ধরতে পারলেন না?’

রামকুমার খুব অর্থবহ দৃষ্টিতে সুজাতার দিকে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ে গেল সহকর্মী তপতীর কথা। সাধারণ গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে তপতী। কিন্তু মেয়েটির বাস্তববোধ দেখার মতো। সুজাতাদের বয়সি হলেও তপতী তাদের থেকে বেশ খানিকটা পরিণত। বছরকয়েক শহরের জল পেটে পড়তেই, তপতী গ্রাম ছেড়ে এসে এখানেই একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট কিনে জমিয়ে বসল। বিয়ে-থা করেনি। গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এল।

সেই তপতীর আবার গ্রামে পোস্টিং হতে সে বেঁকে বসল। সুজাতাদের কাছে বলল, ‘এই অর্ডার আমি পালটে তবে ছাড়ব।’ বাস্তবে ঘটলও তাই। তপতীর বদলে অন্য কোন শিক্ষকের ঘাড়ে বদলির কোপটা পড়ল, তা অবশ্য সুজাতা জনে না। তপতী হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জানতে হবে, কোন পুরুষের কী চাহিদা! লোকটা বোকা ছিল বুঝলি! খুব বেশি আপস করতে হল না। বাঁ হাতের মুঠোয় আদর করে কিছু ছাপানো কাগজ গুঁজে দিতেই গলে গেল!’

আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তপতী বলল, ‘তুই চাইলে লোকটার সঙ্গে আমি একবার কথা বলে দেখতে পারি। খুব বেশি কম্প্রোমাইজ না করে যদি হয়ে যায় ক্ষতি কী? আর একটু-আধটু কম্প্রোমাইজ করলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় বল তো? পৃথিবীর প্রত্যেককে আপস করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে. কেউ কম করছে, কেউ বেশি। এত সতীপনা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে আজীবন!’

তপতীর চাপা গলায় বলা কথাগুলো কানে যেন গরম সিসের মতেই ঢুকল সুজাতার। সে মরে গেলেও পারবে না তপতীর মতো করে ভাবতে। কঠিন গলায় বলল, ‘না, তার দরকার হবে না!’ তক্ষুনি তার চোখের সামনে মনোময়ের সহজ ঋজু চাহনিটা ভেসে উঠেছিল।

আজকাল পনেরো দিনে একবার বাড়িতে আসার সুযোগ পায় মনোময়। আর তাই নিয়ে তার খেদের অন্ত নেই। যে দু-একদিন বাড়িতে থাকে মনোময়, সুজাতার ইচ্ছে করে না তাকে ছেড়ে দূরে যেতে। এটা শুধু প্রেমের জন্য নয়। নির্ভরতার জন্য, বলা যেতে পারে। মনোময় একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে। সকাল-সন্ধে কাজের মাসি এসে তার জন্য রান্না করে চাপাঢাকা দিয়ে রেখে চলে যায়। অধিকাংশ দিন সেই ঠান্ডা খাবারই গিলতে হয় তাকে। সুজাতার বুকটা ভেঙে যায় এসব কথা শুনে। মনোময় বোঝে। তাই আজকাল ক্লিষ্ট হাসি ঠোঁটে টেনে এনে বলে, সে ভালো আছে।

সুজাতা এখন দিব্যি বোঝে, সেই ভালো থাকার মানে কী! সকালের ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে ঘণ্টাদেড়েক যাত্রার পর, কম করে দু-কিলোমিটার হাঁটা। তবে পৌঁছোনো যায় স্কুলে। সেদিন অংকের বিনোদবাবু বলছিলেন, ‘আপনি একটা সাইকেল কিনে নিন মিসেস মিত্র। এখানে একটু খোঁজখবর নিলে পুরোনোও পেয়ে যেতে পারেন। স্টেশন থেকে স্কুলে আসবেন, আবার ফেরার সময় স্টেশনে রেখে বাড়ি চলে যাবেন।’

সুজাতাও দেখেছে, গ্রামের রাস্তায় মেয়েরা এখানে সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন্তু সুজাতার বড়ো সংকোচ হয়।

ইংরেজির বিনতা মিস বলেছিলেন, ‘একটা কথা তোকে বলে রাখি সুজাতা। আমাদের গ্রামটা আর আগের মতো নেই বুঝলি? পাশের গ্রামে পলিটিক্যাল মারামারি নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই খুনজখম হয় বলে শুনি। তার ছোঁয়াচ এ গ্রামেও লাগছে। কাজেই সাবধানে রাস্তা চলবি । তুই নতুন লোক। কখনও রাত করে ফিরবি না।’

বিনোদবাবু বললেন, ‘শুধু পলিটিক্যাল বলছেন কেন? আমাদের স্কুলের কতগুলো মেয়ে গত দু-তিন বছরে উধাও হয়ে গেছে কেউ খোঁজ রেখেছে? সব নারীপাচারের ব্যাপার, বুঝলেন মিসেস মিত্র! কেউ দেখার নেই!’

বিনোদবাবু খেদের সঙ্গে জিভে শব্দ করলেন। ভয়ে শিউরে উঠছিল সুজাতা। সব শুনে মনোময়ও কম উদ্বিগ্ন হল না। বলল, ‘তোমার ছুটিছাটা জমা নেই? কোনওমতে ওসব নিয়ে এ বছরটা কাটিয়ে দাও সুজাতা। সামনের বছর দেখি, কাউকে ধরেকরে কিছু করা যায় কিনা!’

বিছানায় শুয়ে থাকা মনোময়ের শরীরের উপর নিজেকে হিঁচড়ে তুলে এনে সুজাতা বলল, ‘আর ততদিনে আমার যদি একটা কিছু হয়ে যায়? তুমি এত দূরে থাকো, তুমি তো খবরও পাবে না! আমার খুব ভয় করে।’

মনোময় বলল, ‘ভয়ের কী? তুমি একা অত দূরে চাকরি করতে যাও? আরও অনেকে ওই স্টেশনে বা কাছাকাছি স্টেশনে নামে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে। তোমরা দল বেঁধে যাওয়া-আসা কোরো। দেখবে কোনও বিপদ থাকবে না।’

মুখে এ কথা বলে সুজাতার মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করলেও মনোময়ের গলায় যেন জোর নেই। সুজাতাও হয়তো সেটা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছুই করার নেই, মনে করে চুপ করে রইল দুজনেই।

দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেতকে সাক্ষী রেখে ট্রেনটা ছুটছে। সুজাতাদের স্কুলের হেডমাস্টার অভ্রনীল দত্ত, বিপ্লবী মানুষ। একসময় নাকি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু রাজনীতির ক্লেদটা নিজের চোখের সামনে দেখার পরেই এক মুহূর্ত আর থাকেননি তার মধ্যে। ইদানীং বেশ হালছাড়া হতাশ গলাতেই কথাবার্তা বলে থাকেন। একদিন স্টাফরুমে সুজাতাকে ঝুঁকির কথা বলতে শুনে, নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘খুব বেশি ভেবো না এসব নিয়ে সুজাতা। পৃথিবীটা এরকম-ই। এভাবেই চলবে। তুমি আর আমি কিছু ভাবলেই যে সেটা হয়ে যাবে, এমন নয়। আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি, আমার কিংবা তোমার মতে কিছুই হওয়ার নয়।’

তারপর থেকে প্রবীণ এই শিক্ষকের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেল সুজাতার।

মানুষের সত্ত্বা সবসময়ই দ্বৈত। যে-অভ্রনীল অন্য সময় সুজাতাকে স্ত্বান্না দেন, সেই তিনিই কোনও কোনওদিন চরম বিরক্তিতে বলে ওঠেন, ‘ভেবে দ্যাখো একবার, সরকারি যোজনাগুলিকে গ্রামীণ জনতার কাছে পৗঁছে দেবে কে? না আমরা। পোলিয়ো ড্রপস খাওয়ানোর প্রচার কে করবে? আমরাই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের বোঝাবে, গ্রামীণ মানুষের মনে গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ ঘটাবে, সাক্ষরতা অভিযান চালাবে, বিনে পয়সার বই বন্টন করবে, বাচ্চারা স্কুলে না এলে বাড়ি থেকে টেনে আনবে, সরকারি কর্তারা এলে জলপানির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, আমরা!’

হেডমাস্টারমশাইয়ের কথাটা যে কত দূর সত্যি, তা আজ হাড়ে-হাড়ে টের পেল সুজাতা। দশটা বাজতে না বাজতে স্কুলের সামনে এসে হাজির হয়েছে ধুলোমাখা দুটো গাড়ি। ঝটপট দরজা খুলে চার-পাঁচজন মানুষ নেমে এলেন। ততক্ষণে তাদের দেখতে গ্রামের কৗতূহলী মানুষজন ভিড় করেছে। আজ স্কুলে অ্যাটেনডেন্স একশো শতাংশ। এর পুরো কৃতিত্বটাই অবশ্য স্কুলের অশিক্ষক কর্মীদের। অভ্রনীলের একটা বড়ো চিন্তা তাতে দূর হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সুজাতারাও।

সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতার নাম জয়ন্ত গুহ। ক্লাসগুলো খুব কম সময়ে পরিদর্শন করে ফিরে এলেন স্টাফরুমে। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসলেন সরকারি প্রতিনিধিরা। তাদের ফেরার তাড়া আছে। ফলে একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে তারা রাজি নন।

জয়ন্ত গুহ গম্ভীর চোখে হেডমাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের কথাও শুনি–!’

খুকখুক করে একটু কেশে নিলেন অভ্রনীল। তারপর বললেন, ‘আমাদের স্কুলবাড়িটার অবস্থাটা তো নিজের চোখেই দেখলেন স্যার। আমাদের এ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে অনেকবার বলেছি। কাজ হয়নি। আরও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, স্কুলে যে-টিউবওয়েলটা আছে, তাতে জল ওঠে না ঠিকমতো। বাচ্চারা জল খেতে পারছে না। স্কুলের মূল দরজাটা চুরি হয়ে গেছে। সকালবেলা এসে আমরা দেখতে পাই অবলা জীবের বিষ্ঠায় ভরে আছে ক্লাসঘর। পরিষ্কার না করলে ভদ্রভাবে বসা পর্যন্ত যাবে না। কে পরিষ্কার করবে? এখানে তো  কোনও সাফাইকর্মীও নেই!’

অভ্রনীল হাঁফিয়ে উঠলেন সমস্যার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে। জয়ন্ত গুহরা নিশ্চয়ই সব জায়গাতে গিয়েই এমন ফিরিস্তি শুনতে অভ্যস্ত। তাই, তার মুখেচোখে কোনও ভাবান্তর ধরা পড়ল না। কেবল বললেন, ‘সমস্যা কোথায় নেই অভ্রনীলবাবু? এই তো, আমরা শহর থেকে আসছিলাম। আসার পথে গাড়ির টায়ার গেল ফেটে। এটা সমস্যা নয়?’

জয়ন্ত গুহের রসিকতায় তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা হেসে উঠলেন।

জয়ন্ত তাদের থামিয়ে বললেন, ‘যাক সে কথা। ঘটনা হচ্ছে, অভ্রনীলবাবু, আমি আপনাদের কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে আসিনি। স্কুলের ডেভেলপমেন্টের জন্য পঞ্চায়েতের কাছে সরকারি টাকাপয়সা আছে। এত দূর থেকে আমরা তো আর সবটা দেখে উঠতে পারি না! আপনাকেই প্রধানের সঙ্গে বসে সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিতে হবে। তবে একটা কথা, মিড-ডে মিলের ব্যাপারে সরকার কিন্তু এখন খুবই কড়া। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাজেই ওই প্রকল্পটা যাতে ঠিকভাবে চলে সেটা দেখবেন।

‘মিড-ডে-মিল?’ অভ্রনীল আঁতকে ওঠেন, ‘সত্যি বলতে কী জয়ন্তবাবু, সপ্তাহে তিনদিনের বেশি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না হয় না। বাসনপত্র নেই। জ্বালানি কেনার টাকা পাওয়া যায় না। আপনারা কেবল আমাদেরই দোষ দেখেন!’

অভ্রনীল রেগে উঠতে গিয়েও উলটোদিকে বসে থাকা সুজাতার ভয়ার্ত মুখচোখ দেখে চুপ করে যান। সরকারি লোকেদের কাছে কোন বিষয়গুলি তুলে ধরা হবে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মিটিংয়ে মিড-ডে মিলের বিষয়ে প্রবলভাবে সরব হয়েছিলেন অভ্রনীল। তার বক্তব্য ছিল, একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক এইবার। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাচ্চারা মিড-ডে মিলের মতো সরকারি প্রকল্প থেক বঞ্চিত হবে, আর সব দোষটা এসে পড়বে শিক্ষকদের উপর– এটা চলতে পারে না।

তখনই অজানা আতঙ্কে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিল সুজাতার। মরিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘এমন চরম মনোভাব নেওয়া ঠিক হবে না স্যার। আপনি মোটরসাইকেলে গ্রামের মধ্য দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করেন। কেউ যদি আপনাকে একা পেয়ে অপহরণ করে, তাহলে? আপনি আছেন বলেই আমরা জোর পাই।’

‘তা বলে কি চুপ করে থাকব দিনের পর দিন?’ অভ্রনীল রেগে গিয়েছিলেন সেদিনও। তারপর নিজেকে সামলে, শান্ত গলায় বললেন, ‘মনে রেখো, এটা আমার গ্রাম। আমার মাতৃভূমি। আমার কিছু অধিকার আছে। পাঁচটা মানুষ আমায় সম্মান করে। সবকিছু এত সহজ হবে না।’

ভূগোলের দিদিমণি চিত্রা সমর্থন করেছিল সুজাতাকে। বলল, ‘আমার মনে হয় সুজাতা ঠিক কথাই বলেছে স্যার। আপনি না হয় এখানকার ভূমিপুত্র। আমরা তো তা নই। সকালবেলা সংসার গুছিয়ে রেখে শহর থেকে এখানে আসি চাকরি করতে। কাজেই, আমার মনে হয় কৗশল নিয়ে চলাই সমীচীন হবে।’

অভ্রনীল খানিকটা থমকে গেলেন শিক্ষিকাদের প্রত্যুত্তরে। শেষে নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘কৗশল কাকে বলে, আপনারাই বলে দিন আমায়। প্রধানের কাছে মিড-ডে মিলের টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী আসে। সেগুলো ঠিকমতো দেওয়া হয় না। আংশিক দেওয়া হয়। হেডমাস্টারের আলাদা ঘর আছে। কিন্তু প্রথমত সেটি জরাজীর্ণ, বসার অযোগ্য, উপরন্তু পঞ্চায়েত মেম্বারের বাড়ির পশুখাদ্য সব ওখানেই থাকে, আপনারা জানেন। স্কুলবাড়িটা ভেঙে পড়ছে, কারওর নজর আছে সেদিকে? সরকারি লোকজন তো দেখেশুনে আমাদেরই দোষ দেবেন। বলবেন, আপনারাই ঠিকভাবে যত্ন নেননি। শাস্তিও দিতে পারেন তারা। তখন কোন কৌশলটা কাজে লাগবে বলুন তো!’

সুজাতা আর কোনও কথা বলেনি। চিত্রাও চুপ করেই ছিল। কারণ ওরা সকলেই জানত, অভ্রনীল যতই গলা ফাটান, সে কেবল অরণ্যেরোদন ছাড়া অন্য কিছু হবে না। এই গ্রামে প্রধানের প্রতিপত্তি সীমাহীন। সামনে অবশ্যই একটা ভদ্রতার আড়াল আছে। কিন্তু বাস্তবে যে তার ভয়ংকর লোকলস্করের সঙ্গে ওঠাবসা, এ কথাও গ্রামে সকলে জানে। তাই কেউ মুখ খোলে না। কে জানে, কোন কথায় আবার কোন সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে!

অভ্রনীলের অভিযোগ লোকটি নতমস্তকে শুনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যাবে– এটাই তো ঘটেছে বারবার।

সরকারি প্রতিনিধিরা আসার আগেরদিন অভ্রনীল নিজেই স্কুল বসার আগে একজন মজুরকে ডেকে এনে গোটা স্কুল সাফ করালেন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। সুজাতা অবশ্য বলছিল, সে-ও অর্ধেক খরচ দেবে। স্কুল সাফ করা কি একা হেডমাস্টারের দায়িত্ব?

অভ্রনীল রাজি হননি। গলা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘গতকাল রাতে নিজেকে অনেক বোঝালাম সুজাতা। কিন্তু মন সায় দিল না আপসে। বাস্তব পরিস্থিতি যা, তাকেই সামনে না এনে উপায় নেই সুজাতা। কাউকে আড়াল করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।’

সুজাতা চুপ করে রইল। এক অদ্ভুত মানসিক দোলাচল তাকে ক্রমাগত পীড়িত করছে।

অভ্রনীল ফের বললেন, ‘ভয় পাচ্ছ?’

সুজাতা ক্লিষ্ট হেসে জবাব দিল, ‘একটু।’

অভ্রনীল বললেন, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না, দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই, মরব না’– শুনেছ তো এই রবীন্দ্রসংগীতটা? তাহলে? সমস্যার প্রতিকার তো একদিন কাউকে না কাউকে করতেই হবে। তাহলে আমরাই বা নই কেন? এখনই বা নয় কেন?’

জয়ন্ত গুহ পোড়খাওয়া আমলা। ফুঁসে উঠলেন, ‘দোষের ভাগি তো আপনাকেও হতে হবে অভ্রনীলবাবু। এই স্কুল দেখাশোনার দায়িত্ব সরকার আপনার উপর সঁপেছে। ইস, কী অবস্থা করেছেন স্কুলটার! চোখে দেখা যায় না!’

অভ্রনীল ম্লান হেসে বললেন, ‘কেন কিছু হয়নি, সবই আপনাকে বলেছি স্যার। তারপরও…!’

জয়ন্ত গুহর পাশে বসে থাকা অন্য অফিসারটি এবার মুখ খুললেন, ‘ঞ্জসব বাহানা না হয় না-ই শোনালেন! আমরা সবকিছুই জানি। গ্রামের বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসা শিক্ষক স্কুলেই আসেন না। কেবল মাইনে নেন। আমরা এও জানি, সেই মাইনে থেকে সামান্য টাকা গ্রামেরই কোনও বেকার যুবককে দিয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষকতার কাজটা করিয়ে নেন।’

জয়ন্ত গুহ হাসেন, ‘যা হোক, এটুকু দায়িত্ববোধ তো তাদের আছে, কী বলো সরকার! এটুকু অন্তত বোঝে যে, স্কুলটা খুলতে হবে।’

সরকার বলে যেতে থাকেন, ‘আমরা জানি, এ স্কুলেও সেই ঘটনা ঘটে। প্রধানসাহেব আমাদের সবই জানিয়েছেন। লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ হবে না অভ্রনীলবাবু।’

অভ্রনীল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে। বলতে গেলেন, তার স্কুলে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তিনি গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এইসময় বিনোদবাবু এসে তার কানে কিছু যেন বললেন। মিটিং ছেড়ে বাইরে এলেন অভ্রনীল। গ্রামের প্রধান অরূপ মাইতি এসেছেন। মুখে বিগলিত হাসি। দেখেই মনটা বিষিয়ে উঠল অভ্রনীলের। ভ্রূদুটো কুঁচকে গেল।

প্রধান বললেন, ‘মাস্টারমশাই, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’

অভ্রনীল প্রমাদ গুনলেন।

প্রধান বললেন, ‘শহর থেকে বাবুদের যে-দলটা এসেছে, তারা আজ এখানেই থাকবেন। কাল এখান থেকেই অন্য জায়গায় স্কুল পরিদর্শনে যাবেন। ওদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়।’

অভ্রনীল বললেন, ‘পঞ্চায়েত করুক। আমায় বলছেন কেন?’

প্রধান বললেন, ‘সে তো করবই। কিন্তু, আপনার স্কুলের দুই দিদিমণিরও বাড়ি যাওয়া চলবে না। বাবুদের একটু যত্নআত্যি…!’

প্রধানের কথা শেষ করতে দিলেন না অভ্রনীল। বলে উঠলেন, ‘ওরা অনেক দূর থেকে আসেন। সংসার, ছোটো বাচ্চা আছে। ওদেরকে তো ছাড়তেই হবে ভাই!’

‘ছাড়তেই হবে, মানে?’ প্রধানের গলা চড়ে যায়, ‘ঞ্জই স্কুলে চাকরি করতে হলে ওদের যে এটুকু করতেই হবে মাস্টারমশাই!’

অভ্রনীলের যে কী হয়ে গেল, হঠাৎই হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন প্রধানের গালে। অরূপ মাইতির টকটকে গায়ের রং ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। তাকে কিছু বলতেও হল না। তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভ্রনীলের উপর।

তার পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য অবশ্য প্রস্তত ছিল না সুজাতা। সমস্ত ক্লাসঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছেলেমেয়েদের দল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুষ্কৃতীদের উপর। আর অভ্রনীল দূর থেকে চ্যাচাঁচ্ছেন, ‘ওরে ছেড়ে দে। মারের পালটা মার নয়।…’ কিন্তু তার দুচোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।

বডিগার্ড

উন কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে টাটানগর থেকে হাওড়া ফিরছিল প্রকাশ। তার এমআর-এর চাকরি। আগের দু-দিনে সব ডক্টর্স চেম্বার ভিজিট করা হয়নি। শনি-রবিতে প্রায় সব চেম্বারে রোগীর এত লাইন থাকে যে,পাঁচ মিনিট ডেমনস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য এক দেড় ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই আজ সকালেও তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ঘন্টা চারেক টাটানগরে টো টো করে ঘুরতে হল। অভ্যাস অনুযায়ী সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ারও সময় মেলেনি। ট্রেনে চেপে ব্যাগটা কোনও মতে বাংকে তুলে প্রকাশ দৈনিকটা খুলে বসেছে। তারপর দু’ঘন্টা ধরে আর তার হুঁশ ছিল না। কাগজের ষোলো-সতেরো পাতা যখন প্রায় মুড়ো ল্যাজা করে পুরোপুরি পড়া হল, তখন ট্রেন ঝাড়গ্রামে ঢোকার আগে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে।

ঘড়ি দেখে বিরক্ত হল প্রকাশ, কুরলা এক্সপ্রেস টানা দুঘন্টা টাটায় লেট ছিল, আর এখন তিন ছুঁই ছুঁই। কত রাত করে যে হাওড়া ঢুকবে, ভগবানেরও অজানা। ওঠার পরে এতটা সময় পার করে দিয়ে, এই প্রথম কামরার অভ্যন্তরে চোখ বুলোবার ফুরসত পায় প্রকাশ। লম্বা সিটে তাকে নিয়ে চার চার আটজন, ওপাশে জানালার ধারে সিঙ্গল সিটে আরও দু’জন। সকলেই দেহাতি, মলিন পোশাক। এদের কেউ খড়গপুরের এপারে যাবে বলে মনে হয় না। তাতে অবশ্য প্রকাশের কিছুই হেলদোল নেই। যেন আগুনের পরশমণি প্রাণে জাগিয়ে বসে আছে।

প্রায় দু’বছর ধরে মাসে দু’তিনবার ট্রেনে জার্নি করা খাওয়া-শোয়ার মতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কথা বলার মতো সঙ্গীর দরকার হয় না। অনেকে বলে খালি ট্রেনে চোর-ডাকাতের উৎপাত হয়, প্রকাশ আমল দেয় না। সেই কবিতার লাইনটা মনে পড়ে, ‘হঠাৎ আলো দেখবে যখন, ভাববে কী বিষম এই কান্ডখানা।’ হঠাৎ আলো মানে আরপিএফ জওয়ানদের লাঠির গুঁতো আর গুলির খোঁচা। তবে কুরলা নিয়ম করে লেট করে ঠিকই, কিন্তু ভিড় কমে গেলে কামরায় চুরি ছিনতাই হয়, এই গাড়ির বেলায় এমন বদনাম শোনেনি। নিজেও তো এল গেল এবার নিয়ে সাত-আটবার।

ফালতু কথা আর না ভেবে প্রকাশ ঝাড়গ্রাম প্ল্যাটফর্মে চোখ বোলাতে থাকে। সকালে ইস্পাত এক্সপ্রেসে আসার সময় দেখেছে, স্টেশন লোকের ভিড়ে জমজমাট আছে। এখন শুনশান। ঝাঁকড়া গাছগুলোয় কিচিরমিচির করে পাখিরা আসর জমিয়ে রেখেছে। তিন নম্বর, মানে লুপ লাইনে গাড়ি থেমেছে। হয়তো, এখানেও খানিক লেট করানো হবে। বিরক্ত মুখ কামরার ভেতরে ফেরাতে গিয়েই চোখ পড়ল ভদ্রমহিলার দিকে। এখান থেকেই উঠলেন। হাতে ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগ, জলের বোতল। উলটোদিকের সিটে বসতে চাইতেই দুই দেহাতি বুড়ো নিজেদের মধ্যে ছ’ইঞ্চি জায়গা খালি করে দিল। ভদ্রমহিলা বেশ দ্বিধায় পড়েছেন, প্রকাশ দেখেই বুঝতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনি বরং এই জানলার ধারে এসে বসুন, আমি ওপাশে চলে যাচ্ছি।

– থাক না, একটু বাদে খড়গপুরে অনেকে নেমে যাবে মনে হয়। তখন ভালো করে বসব।

– আরে বসুন। আমি টাটা থেকে জানালার ধারে এলাম।

ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ালেন না। বসতে গিয়ে প্রকাশকে একটা অনুরোধ করলেন– আমার এই ব্যাগটা যদি বাঙ্কের একটু ভিতর দিকে তুলে দেন। বেঁটে চেহারার মানুষকে এই সাহায্যটা প্রতিবারই কারও না কারও কাছে চাইতে হয়।

প্রকাশ হেসে ফেলল। ‘বেঁটে’ শুনে ভদ্রমহিলাকে প্রথম ভালো করে দেখল। তখনই মনে হল, আগে কোথাও দেখেছে।

এইমাত্র জানালা ছেড়েছে, এইবার গায়ে পড়ে ‘মনে হচ্ছে আগে কোথাও যেন দেখেছি আপনাকে’ বলাটা নাটকের মতো হয়ে যাবে। মহিলা সুন্দরী হলেও বিবাহিতা, বয়সে ওর সমান কিংবা খানিক বড়োও হতে পারেন। বাড়তি মনোযোগ দেবার তেমন কোনও কারণ নেই। তাই প্রশ্নটা ঢোঁক গিলে মনোযোগ দিয়ে বাঙ্কে ব্যাগ ওঠাল প্রকাশ। দুই বুড়োর মাঝখানে আলগোছে বসতেই ট্রেন নড়ে উঠল।

বাঁশতলা এবং সারদিয়া স্টেশন পার হয়ে খেমাশুলিতে গাড়ি আবার ঘটাং করে থেমে গেল। তখনই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পিলপিল করে উঠতে থাকে আদিবাসী মহিলারা। মিনিট দুই তিনেকের মধ্যে লোকাল ট্রেনের চেহারা নিল কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাস। দুই সিটের মধ্যে এত লোক ঢুকেছে যে, নড়াচড়া করাই দায় হল। কুরলা এক্সপ্রেসে এতবার ফিরেছে প্রকাশ, এরকম ঘটনা আগে কখনও চোখে পড়েনি। মনে করে দেখল, স্টপেজই নেই লো-লেভেল স্টেশন খেমাশুলিতে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল চমকে মোড়া বিস্ময়– এত লোক এই জঙ্গল দেশে কোথা থেকে এল?

– কপালে সিঁদুর লেপা দেখে বুঝতে পারছেন না, এরা গুপ্তমণির পুজো দিতে গিয়েছিল। আজ হয়তো কোনও বিশেষ উৎসব আছে। হাইওয়েতে বাস বন্ধও হতে পারে। জানলার ধারে ভদ্রমহিলা বললেন।

অনেকক্ষণ পরে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল প্রকাশ। ভিড়ের মধ্যে মুখটুকুই শুধু দেখতে পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল, সবার কপালে টিপ তো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু গুপ্তমণি আবার কে?

– তিনি আমাদের দুর্গা বা কালীর মতো এই এলাকার আদিবাসীদের প্রিয় এক দেবী। সবাই বলে খুব জাগ্রত। হাইওয়ে দিয়ে বাসে গেলে দেখতেন, যাত্রী থেকে ড্রাইভার কন্ডাক্টর, সকলে মন্দির পার হওয়ার সময় নমস্কার করে পয়সা ছুড়ে দেয়। সেই পয়সা কুড়োতে মন্দিরের পনেরো কুড়ি জন লোক সবসময় ছুটে বেড়ায়।

প্রকাশ এমন বিচিত্র দেবীস্থানের মাহাত্ম্যের কথা শুনে মজা পায়। উপরন্তু অবাক ভাব চাপতে না পেরে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করে– আপনি এখানকার অনেক কিছুই জানেন দেখছি!

– এটা জানার মতো কোনও বিষয় নয়। ঝাড়গ্রামে আমার প্রায় আঠারো উনিশ মাস মানে দেড় বছরেরও বেশি চাকরি হয়ে গেল। উইকেন্ডে ফিরে যাই। এই ট্রেন প্রায় দিনই লেট করে। তখন বাস ধরে খড়গপুর বা গিরি ময়দান যেতে হয় লোকাল ট্রেন ধরার জন্য। সেই বাসেই দেখেছি গুপ্তমণির মন্দির।

প্রকাশ কথা ঘোরায়– আপনার চাকরি ঝাড়গ্রামে, রাজ কলেজে নাকি?

– বাঃ, আপনিও তো দেখছি অনেক কিছু জানেন। রাজ কলেজের নাম বলে দিলেন। তবে, আমি স্কুলে পড়াই, রানি বিনোদ মঞ্জরী।

– এ নামটাও শুনেছি মনে হচ্ছে। মেয়েদের স্কুল। বোধহয় সরকারি।

– ঝাড়গ্রাম তো দেখছি, আপনার নখদর্পনে। অথচ গুপ্তমণির নাম শোনেননি?

– আসলে, আমার এক মেসোমশাই বেশ কয়েক বছর আগে রাজ কলেজে পড়াতেন। সরকারি কলেজ তো, হুগলি মহসিন থেকে দু-বছরের জন্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছি। বলে রাখি, আমার সেই মেসোমশাইয়ের নাম জগৎ লাহা।

– তাই বলুন।

– এখনও রাজবাড়ি, জঙ্গলমহল, চিলকিগড় আর ডুলুং নদীর কথা ভালোই মনে আছে। মেসোমশাই যে জায়গাটায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন সেখানকার নাম রঘুনাথপুর না রঘুনাথগঞ্জ কী যেন।

এবার ভদ্রমহিলার অবাক হওয়ার পালা। বললেন– আপনার স্মৃতি দেখছি একেবারে টাটকা রয়েছে। আমিও রঘুনাথপুরে থাকি, স্টেশনের কাছেই।

ভিড়ের চাপে, বাচ্চাদের তারস্বরে কান্না আর বায়নায় একসময় কথা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে শেষ বিকেলের সোনা হলুদ আলো মেখে খড়গপুর স্টেশনে ঢুকল ডাউন কুরলা এক্সপ্রেস।

কামরা খালি করে প্রায় সবাই নেমে গেল। প্রকাশদের খোপে সে এবং ভদ্রমহিলা ছাড়া উলটোদিকের জানালার ধারের লোকদুটো শুধু বসে রইল। ভদ্রমহিলার মুখোমুখি জানালায় সরে গেল প্রকাশ। দেখতে চেষ্টা করল, প্ল্যাটফর্মে কোনও কফিওয়ালা দেখা যাচ্ছে কি না। তখনই এদের খোপে ফাঁকা সিটের দখল নিল জনা পাঁচেক লোক। হাবভাব দেখে ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে মনে হচ্ছে। ধুপধাপ বসেই কোনও কথা না বলে সিগারেট ধরাল। মুহূর্তে ধোঁয়ায় খোপটা নরক গুলজার করে তুলল। প্রকাশ দেখল, উলটোদিকে ভদ্রমহিলা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করছেন। বিরক্ত মুখে ও লোকগুলোর দিকে ফিরল। বলল– কম্পার্টমেন্টের ভিতরে এভাবে স্মোক করছেন কেন? জানেন না, এটা নিষিদ্ধ? দরজায় দাঁড়িয়ে শেষ করে আসুন।

লোকগুলো উঠে যাওয়ার কোনও গরজ দেখায় না। যেন কথা শুনতেই পায়নি। প্রকাশ আবার তাই গলার জোর আরেকটু বাড়িয়ে বলে– আপনাদের বলছি, সিগারেটগুলো দরজায় গিয়ে ফিনিশ করে আসুন। আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে।

এইবার দলের একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল– বেশি বকবেন না তো। রোজই আমরা এই ট্রেনে যাই।

এইবার প্রকাশের রাগ বেড়ে যায়। উঁচু গলায় বলে কী বলতে চান আপনারা, রোজ এক ট্রেনে গেলে কি আইন ভাঙার অধিকার জন্মায়?

– আইন আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখাবেন। জানালায় বসেছেন, খানিকক্ষণ এখন নাকে রুমাল চাপা দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখুন। সিগারেট একসময় নিজেই ফুরিয়ে যাবে।

রাগে লাল হয়ে উঠল প্রকাশ। কোনওরকম সিভিক সেন্স নেই এদের। একবার ভাবে, টিটিই-র কাছে কমপ্লেন করা যেতে পারে। কিন্তু এটা ভেস্টিবিউল কম্পার্টমেন্ট নয়, টিটিই-কে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, তার ঠিক নেই। কমপ্লেন করেও কোনও ফল হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে প্রকাশের। যাতায়াতের পথে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকজন তো কম দেখল না। তাই প্রকাশ একবার ভাবল, তর্ক চালিয়ে যাবে। তাতে পরের রাউন্ডে সিগারেট ধরানোর আগে লোকগুলো অন্তত দ্বিতীয়বার ভাববে। শেষ পর্যন্ত উলটোদিকে বসা সদ্য পরিচিতার অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ভদ্রমহিলাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার আবার মনে হল, খুব চেনা। স্মৃতি হাতড়ে বিরক্তি আর সময় কাটাতে থাকল প্রকাশ। সংবিৎ ফিরল মেচেদা পৌঁছে, জানালার কাছে ‘গরম চপ-সিঙাড়া’ ওয়ালার বাজ পড়ার মতো হাঁক শুনে। কামরার ভেতরে তখন টিমটিমে আলো জ্বলে উঠেছে। পাশের লোকগুলো যথারীতি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাঁটুতে হাঁটুতে তোয়ালে পেতে তাস খেলার আসরে মেতে উঠেছে। অকারণে তর্ক জুড়ে কামরা ফাটাচ্ছে। সামনে ভদ্রমহিলা যথারীতি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে রয়েছেন, দৃষ্টি প্রকাশের দিকে। এক পলকে দেখল ও, তার চোখেও কেমন অবাক করা ভাব। এ চোখের ভুল, ভেবে প্রকাশ দৃষ্টি ফেরাল মেচেদার ভিড়ের দিকে।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই বাইরের ঝুপসি অন্ধকার ধেয়ে এল। ভিতরে পরিবেশ এতই বিরক্তিকর যে, বাইরের সে অন্ধকার রাজ্যে চোখ সওয়াবার চেষ্টা করতে থাকে প্রকাশ। গাড়ি এবারে বেশ গতি নিয়েছে। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের সেতু পার হওয়ার পর ও আবার ভাবতে শুরু করে, সামনে বসা ভদ্রমহিলাকে ও কোথায় দেখতে পেয়েছে আগে। এমন সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। হয়তো টয়লেটে যাবেন। তাসখেলা লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন– তোয়ালেটা একটু সরিয়ে নিন, আমি বাইরে যাব। খেলা থেকে চোখ না সরিয়ে একজন কড়া গলায় জবাব দেয়– এখন গোটানো যাবে না। সিটে গিয়ে বসুন। সাঁতরাগাছি ঢুকলে খেলা শেষ হবে।

– তা কেন? আমাকে যেতে দিন।

তাসুড়ের গলা এবার আরও চড়ল– বাইরে যাওয়ার এত তাড়া থাকলে জানালার ধারে বসেন কেন? নিজের বাড়ির সব সুবিধা তো ট্রেনে মেলে না।

একে ভদ্রমহিলা, তায় তার ওপর মানসিক জবরদস্তি। মনে হচ্ছিল প্রকাশের, ভদ্রমহিলার বাথরুমে যাওয়ার কথা শুনে তাঁর মন এবং শরীরকে মানসিক ভাবে ভিসুয়ালাইজ করছিল তারা।

আরেকজন চোখ নাচিয়ে বলল– আমি ঘোড়াঘাটা যাচ্ছি। এই তো ঘোড়াঘাটা চলে এল বলে। আর বড়োজোর ঘন্টা খানেকের মামলা। মেয়েরা তো ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুম চেপে রাখতে পারে।

সংকোচে বাক্রুদ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলা বসে পড়লেন। এতক্ষণ প্রকাশ চুপচাপই ছিল। মন বসাতে চেষ্টা করছিল বাইরের অন্ধকারে। এবারে তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। উঠে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে বলল– খেলা বন্ধ করুন এবার।

লোকগুলো কথা শোনার পাত্র নয়। ওর চেয়েও এক কাঠি বেশি রাগ দেখিয়ে একজন বলল– আপনি তখন থেকে ফালতু বকে চলেছেন কেন বলুন তো। সব প্রসঙ্গের মধ্যে ঢুকছেন! যার বাথরুম যাওয়ার দরকার ছিল তিনি তো চুপচাপ বসে রয়েছেন।

– নোংরা কথা বলবেন না। মহিলাদের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলতে জানেন না আপনারা?

– আমরা জানি না, আর আপনি দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলেন। এই তো শোধবোধ হয়ে গেল। এবারে তবে থামুন।

নিজেকে প্রকাশ আর সামলে রাখতে পারল না। কলার চেপে ধরল সবচেয়ে উঁচু গলার লোকটার। তখন বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকাশের উপর– ছাড় শালা। রাজার চালে যাবি তো এসিতে চাপতে পারতিস। মেয়েরা সেখানে সারাদিন বার্থ আর বাথরুম করে কাটালেও কেউ কিছু বলবে না।

সিঙ্গল সিটে বসা লোকদুটোর দিকে ফিরে মরিয়া ভাবে প্রকাশ বলে– শুনুন আপনারা। আবার নোংরা কথা বলছে। এরা মহিলাদের সম্মান করে না। আপনারা চুপ করে থাকবেন?

প্রকাশের আশা বৃথা। গ্রাম্য লোকদুটো এদিকেই তাকিয়ে বসেছিল, কথা শুনে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে জানালার দিকে ঘুরে বসল। পাশের খুপরি থেকে কয়েকটা উৎসুক মুখ উঁকি দিল। তাদের একজন তাসপার্টির নেতাকে জিজ্ঞাসা করে– কীসের ঝামেলা, মজুমদারবাবু? হাত লাগাতে হবে নাকি?

– আরে না দাদা, একজন অসভ্য লোক সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ভাট বকেই যাচ্ছে। আমরা চেপে বসিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে মহিলা থাকলে সবাই তো একটু বীরত্ব দেখাতে চায়। প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয়ে গেল নিজের অসহায়তা অনুভব করে। নোংরা লোকগুলো দলে ভারী। এদেশে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক ক্রমেই কমে আসছে। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিজের সিটে বসে পড়ল প্রকাশ। ও এবং সামনের মহিলা, দু’জনের দৃষ্টি মাটির দিকে। তাসুড়েরা কিন্তু নির্বিকার, তাসের চাল নিয়ে আবার তুমুল তর্কে ফিরে গেল। একটু বাদে খুপরির ভিতরের অস্বাভাবিক গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করে প্রকাশ– আপনি যাবেন কোথায়?

– চন্দননগর।

– আজ অনেক রাত্রি হয়ে যাবে হাওড়া ঢুকতে। ন’টা আটান্নোর মেন লাইন বর্ধমানটা পাওয়া যাবে কি না কে জানে।

– আপনি কি ওদিকেই?

– হ্যাঁ, কিন্তু আপনার অনেক আগে নামব, কোন্নগর।

মৌড়িগ্রামে কুরলা ঢুকছে। আউটার সিগনাল লাল হয়ে থাকায় থেমে গিয়ে ঘন ঘন হুটার বাজাচ্ছে। এইবার তাসপার্টির আসর গোটানোর তাড়া লাগল। তোয়ালে ভাঁজ করতে করতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল– আমি ভাবলাম লোকটা নিজের লোকের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, এখন দেখছি অচেনা।

আরেকজন হেসে গড়িয়ে গিয়ে বলল– মজুমদার, মেয়েদের মতো ন্যাকামি কোরো না। তুমিও বয়সকালে পরিচিত মহিলার কাছে এমনই হিরো সাজতে চাইতে।

– তা হতে পারে, কিন্তু মালটাকে কোন্নগরে আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

– ফি হপ্তায় আটটা দশটা করে ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠছে আর কত উটকো লোক রোজ থাকতে আসছে। কোন্নগরের বনেদি লোক বলে কি সবাই তোমার চেনা হবে?

– তা একরকম ঠিকই বলছ। আমরাই এখন কোন্নগরে কোণঠাসা।

ওরা ভাব এমন করছিল যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু প্রকাশ ও ভদ্রমহিলা দুজনের কানেই যাতে পৌঁছোয়, ততটাই জোরে বলছিল।

মহিলা আবার সংকুচিত হলেন। তাসের আসর গোটানো হতেই টয়লেটের দিকে চলে গেলেন। প্রকাশ একটুক্ষণ আগে যে লোকটার জামার কলার চেপে ধরেছিল, সে এই সুযোগে ওর দিকে ফিরল। গলায় দারুণ ঘৃণা ঝরিয়ে বলল– ঝামেলা পাকানো ধাতে নেই বলে আজ ছাড় পেয়ে গেলে। অন্য কারও গায়ে হাত দিলে মেরে শুইয়ে দিত। আমিও কোন্নগরে থাকি, তিনপুরুষের বাস। মুখটা ভালো করে চিনে রাখো।

বিরক্ত প্রকাশ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা যে-দিকে গিয়েছেন তার উলটোদিকের টয়লেটের পথে পা বাড়াল।

শেষবার প্রতিদিনের নিয়মমতো ট্রেনটা মার খেল টিকিয়াপাড়া ইয়ার্ডে। হাওড়া ঢুকল দশটা বাজার পর। তাসপার্টি শেষবার প্রকাশের দিকে আগুনের মতো দৃষ্টি হেনে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। বাংক থেকে নিজের ও ভদ্রমহিলার ব্যাগ নামাতে নামাতে বলল প্রকাশ– চলুন, একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে দশটা সতেরোর ব্যান্ডেল লোকালটা মনে হয় পেয়ে যাব। কোন্নগর পর্যন্ত একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। তারপরেও ট্রেনে ভালো ভিড় থাকে। ভয় পাবেন না।

ভাগ্যক্রমে ব্যান্ডেল লোকালে পাশাপাশি দুটো সিট পাওয়া গেল। ট্রেন ছাড়ল। মাত্রই কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে কোন্নগর। প্রকাশ ‘এবার আসি’ বলে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল ভিড় ঠেলে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে বলে। কোন্নগরে ট্রেন ঢোকার মুখে ভদ্রমহিলা গলা তুলে জানতে চাইলেন– এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, আপনার নাম কী ভাই?

পিছনে প্রবল ঠেলা খেতে খেতে প্রকাশ কোনওমতে জবাব দিল– প্রকাশ সেনগুপ্ত, আপনার?

উত্তর শোনার আগেই এক ধাক্বায় প্লাটফর্মে। প্রকাশ ট্রেনের জানালায় হাত নাড়তে যেতেই ভদ্রমহিলা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এলেন জানালার সামনে। বললেন– প্রকাশ আমি তোমার পারমিতা দিদি। ঝাড়গ্রাম থেকে মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি। এইমাত্র চিনতে পারলাম। আর কোনও কথা হওয়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ব্যান্ডেল লোকাল। প্লাটফর্মে হতবাক প্রকাশ। সেও এইমাত্র চিনতে পেরেছে পারমিতা দিদিকে। চেনার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হারিয়ে যাওয়া।

দুঃখিত প্রকাশ মনে মনে ফিরে গেল চব্বিশ পচিঁশ বছর আগে। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে। তখন ওরা ভাড়াবাড়িতে ঢাকুরিয়ায়। স্কুল বাসে গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে স্কুলে যাতায়াত করত ও। বড়ো ছেলেরা বাসের জানালা আর প্যাসেজের দিকের সিট সবসময় আগলে রাখত, ওকে কিছুতেই মাঝখানে ছাড়া বসতে দিত না। দুজনের মাঝখানে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে স্কুলে যাওয়া যেন অলিখিত নিত্যনৈমিত্তিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওঠা নামার সময় তাড়াহুড়ো করলেও দাদারা টেনে ধরে আটকে, অকারণে চড়চাপড় লাগাত। বাসের কাকুদের কাছে দু-একবার কাঁদো কাঁদো হয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। বাসযাত্রার ভয়ে ‘কাল স্কুলে যাব না’ একসময় নিত্যনৈমিত্তিক বোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকাশের। রোজ শুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ আর সকালে ঘুম থেকে চোখ ছাড়ানোর পর একপ্রস্থ।

সমস্যাটা কী, তা জানতে বাবা-মা বারদুয়েক স্কুলের আন্টির সঙ্গে দেখাও করে এলেন। স্কুল থেকে কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ না পেয়ে তারাও দিশাহারা হয়ে পড়লেন। ঠিক সেই সময় একদিন স্কুলবাসে যেতে পাদানিতে উঠতে আরম্ভ করে ডাকাবুকো পারমিতা দিদি। প্রকাশ যখন ক্লাস ওয়ান, পারমিতা তখন সিক্স। ওদের স্টপ থেকে দুটো কালো সাপের মতো লম্বা বিনুনি ঝুলিয়ে উঠত। ছোট্ট প্রকাশের ওপর বড়োদের অত্যাচারের কথা শুনে দু-তিনদিন পরেই কাছে ডেকে নিল। জানালার সিট ছেড়ে সেখানে বসতে দিল। বড়ো ছেলেদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে দিল– আজ থেকে রোজ তুই আমার পাশের সিটেই বসবি। কেউ মেরে তুলে দিতে এলে আমাকে বলবি, তাকে উচিত সাজা দেব। এরপর থেকে অনেকদিন ধরে প্রকাশকে আগলে আগলে রাখত পারমিতা দিদি। এর জন্য দাদাদের সঙ্গে ঝগড়াও করত। একসময় তাই বাসের সকলে পারমিতা দিদিকে ‘প্রকাশের বডিগার্ড’ বলে ডাকতে শুরু করে।

অভিভাবক মহলেও নামটা ছড়িয়েছিল। প্রকাশের বাবা-মা ছেলের বডিগার্ডকে খুব ভালোবাসতেন। প্রকাশ স্কুল বদল করার আগে পর্যন্ত তার প্রত্যেক জন্মদিনে বডিগার্ড-এর নিমন্ত্রণ বাঁধা ছিল। প্রকাশরা কোন্নগরে নিজেদের বাড়িতে উঠে আসতে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আজকের ঘটনার কথা ভেবে অসহায় প্রকাশের নিজের প্রতি চরম বিরক্তি জাগল, অসভ্য লোকগুলো দিদিকে অপমান করে গেল আর উচিত জবাবটুকুও একজন পুরুষ হয়ে সে দিতে পারল না। নিজের দু’গালে চড় কষালেও বোধহয় খারাপ লাগা দূর হবে না।

কোন্নগরে তখন রাত প্রায় এগারোটা। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রকাশ। কুরলা এক্সপ্রেসের সেই তাসুড়েদের মধ্যে কোন্নগরের বাসিন্দা দু’জন প্লাটফর্ম থেকে নামার পথে আবিষ্কার করল তাকে। শুনিয়ে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে বলল– দ্যাখ, ভ্যাবলাটা দাঁড়িয়ে আছে। বউদির বডিগার্ড।

জোড়া-বকুল

বকুলগাছটার ভেতরে কী ছিল কে জানে! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলেই গাছটা কেমন যেন মোহময়ী রহস্যের ঘোমটা পরে নিত। তখন তার পাতায় পাতায় হিল্লোল। ডালপালায় দু’হাত বাড়ানো আর্তি। ইমন এসব ছোটোবেলায় বুঝত না। ধীরে ধীরে পরত খোলার মতো জেনেছে নিজের অনুভূতি দিয়ে। পুরো বর্ষাকাল এখন তাকিয়ে থাকে বকুলগাছটার পাতার দিকে। গাঢ় সবুজ পাতার প্রান্তে সামান্য কোঁকড়ানো ভাব, স্থূল চোখে দেখা যায় না। মন দিয়ে দেখলে, যেমন সব মেয়ের লম্বা চুলেই ঢেউ খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের বকুলগাছের সব পাতাতেই তেমন প্রান্ততরঙ্গ দেখা যাবে, ইমন লক্ষ্য করেছে।

– এই ইমন, ইস্কুল যাবি না?

ইমনের মা প্রতিভা মেয়ের কাছে জানতে চায়। ইমনের আজ স্কুলে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নেই। আজ ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। স্কুলে পড়াশোনা বিশেষ হবে না। নাম কা ওয়াস্তে স্কুল। তাই যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা নেই। আবার সিএল-ও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। কিছুটা সময় নিয়ে ইমন নিজেকে রাজি করায় স্কুলে যাওয়ার পক্ষে।

– হ্যাঁ মা, যাব। তুমি ওয়াড্রোব থেকে কমলা ঘিয়ে পিত্তর সিল্কটা বের করে রাখো। আর কালো ব্লাউজটা। আমি বাথরুমে গেলাম।

– কোনটা বলতে কোনটা বের করব! তুই এসেই বের করিস।

প্রতিভা ঈষৎ বিরক্ত হয় মনে মনে। কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেয় না। শাড়ি ব্লাউজ বার করে দিতে তার অসুবিধা নেই কিন্তু ঠিক ঠিক কোনও দিনই বার করতে পারে না।

বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে ইমন মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করে, তবে তোমার পছন্দের শাড়ি একটা বেছে দাও। যেটা পরলে তোমার মেয়েকে যে-কোনও পাত্রের একবারেই পছন্দ হয়ে যায়।

– সে ভাগ্য কি আমার হবে! তোর বাবা থাকলে এত চিন্তা করতাম না!

ইমন মায়ের সঙ্গে কথা বাড়ায় না। হড়াৎ করে বাথরুমে ঢুকে যায়। তার দেরিও হয়ে গেছে। ন’টা কুড়ির শিয়ালদা লোকালটা ধরতে হবে। হাতে আর মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ মিনিট। এই ট্রেনটা মিস করলে পরেরটা ন’টা পঞ্চাশে। বলরামপুর স্টেশন থেকে বারুইপুর এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। স্কুল অবশ্য স্টেশনের কাছেই। রিকশায় পাঁচ মিনিট আর হাঁটলে মিনিট দশেক। আজকাল লোকের যা চাপ গাড়ি ঘোড়া চালানোই যায় না। ইমন অবশ্য রোজ রিকশাতেই যায়। লোকের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি তার ঠিক পছন্দ হয় না। গা চিড়বিড় করে যেন। অবশ্য ট্রেনের কথাটা আলাদা। উপায় নেই। তবুও সে চেষ্টা করে লেডিজ কম্পার্টমেন্ট ধরতে।

হাতে সময় না থাকলে মানুষ বাথরুমে ঢুকেই জামাকাপড় খুলে ফেলে। তারপর ঝপাৎ ঝপাৎ জল ঢালে শরীরে। নগ্নতার গা মোছে। কিন্তু ইমন সেটা পারল না। বাথরুমের জানলা দিয়ে বকুলগাছটা দেখা যায়! আজ ইমনের চোখে পড়ল বকুলগাছটা কেমন চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। অন্যদিনের থেকে বেশ অন্যরকম তাকানো। ইমন কিছুতেই সালোয়ার খুলতে পারে না। কোনওদিনই পারে না। ইমন আজ বাথরুমের ছোটো জানলাটা বন্ধ করে। খুব লজ্জা পাচ্ছে আজ তার। জানলাটা বন্ধ করার পরেও সে জামাকাপড় পরেই স্নানটা সারে। বাথরুম থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে যেন বাঁচে। বকুলের চোখের আড়াল না হলে লজ্জা যেন যাবার নয়।

অনেকটা জায়গা নিয়ে ইমনদের বাড়ি। বাড়ির পরেই পরিখা। আসলে লম্বা খালের মতো চারদিকে চারটে পুকুর। বাবা খুব গর্ব করে পুকুরগুলোকে পরিখা বলত। তাই ইমনও পরিখা বলে। সেই পুকুরগুলোর চওড়া উঁচু পাড়। সেই উঁচু পাড়ে নানান বৃক্ষের সমাবেশ। শিরীষ, সেগুন, সোনাঝুরি, অর্জুন, কদম প্রভৃতি দামি কাঠের গাছগুলো পুকুরের বাইরে সার সার দাঁড়িয়ে আছে যেন প্রহরী। তাদেরই মধ্যে পশ্চিম দিকে ইমনের প্রিয় বকুল গাছ ঝাঁকড়া হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। বকুলগাছটা ইমনের বাবারও প্রিয় ছিল। আলাদা ভাবে যত্ন করত বকুলগাছটার, ইমনের মনে আছে। আর মনে আছে একটা কথা। গাছটা বসানোর দিনেই বাবা কাউকে ফোনে বলছিল, গাছটা যতদিন বাঁচবে তোমাকে পাব!

পরিখার ভেতরে যত ফলের গাছ। নানান আমগাছ। এমনকী একটা আলফানসো আমেরও গাছ বসিয়েছিল ইমনের বাবা। কোথা থেকে কিনে এনেছিল ইমন জানে না। ইমন তখন খুব ছোট্ট। ক্লাস থ্রি। জাম, লিচু, জামরুল, সবেদা, চালতা, ডেয়াঁ ফল। এমন ফল নেই তাদের বাগানে, যা এ অঞ্চলে ফলে না। ইমনের সামনেই গাছগুলো বড়ো হল, এখন ফল দিচ্ছে। সব ঠিকঠাক। যেমন যেমন বাবা বলেছিল, দেখিস আম ফলবে আগে, তারপর লিচু, হয়তো সে বছরই জাম ধরবে। চালতার একটু দেরি হবে। সবেদা অল্প অল্প দু’বছর পর থেকেই ফলবে। সব বাবার কথামতোই ফল দিচ্ছে। শুধু বাবাই হঠাৎ করে চলে গেল। দুদিনের ধুম জ্বর। ডাক্তার, হসপিটাল করার আগেই সব শেষ।

ইমনের তখন ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ি ভর্তি লোকজন। চেনে না জানে না এমন সব লোক বাবার বসানো গাছগুলোর গায়ে উঠে পড়ছে যেন। গাছগুলো তখনও বেশ ছোটো। ধাক্বা মারলে ভেঙে যাবে। ইমনের খুব রাগ ধরছিল লোকগুলোর উপর। তার থেকেও বিস্ময়। এত লোক কেন! দৗড়ে ঘরে ঢুকে দেখে বাবা বিছানায় নিস্পলক শুয়ে। সেই প্রথম মৃত্যু-ছুঁয়ে দেখে ইমন। তবু তার মনে যে-প্রশ্নটা প্রথম জাগে, সেটা বকুলগাছটা নিয়ে। বাবার থেকে জানা হল না, বকুলগাছটা কার নামে বসানো!

বাবা মারা যাওয়ার পর বকুলগাছটার যত্ন নিতে শুরু করে ইমন। কিন্তু বৃক্ষের যত্ন কিবা! যত্ন নেবার কিছুই নেই। ইমন লোক দিয়ে বকুলগাছটার গোড়ার মাটি কুপাতো। মা হাঁ হাঁ করে উঠত! কাঠের গাছের অত যত্ন নিতে হবে না!

তবু ইমন লুকিয়ে সার কিনে আনত। বোনডাস্ট। ছড়িয়ে দিত বকুলতলায়। কিন্তু বকুলের শিকড় তো অনেক গভীরে! তার জল হলেই চলবে। তবে গভীর শিকড়ে বকুলটা আস্তে আস্তে জড়িয়ে নিচ্ছিল ইমনকেও। ইমন প্রথম দিকে গাছটার প্রতি বাবার ভালোবাসার কথা ভেবে যত্ন করত। বাবার কোনও গোপন মানুষের কথা ভেবে হয়তো বসানো।

সে মাকে এ নিয়ে কিছু বলেনি। তার মা বকুলগাছটা সম্বন্ধে কিছুই জানত না। তাছাড়া মা তখন সদ্য বিধবা হয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম। ঢেউ-এর মাথায় পানসি নৗকার মতো চলছে কোনওক্রমে তাদের সংসার। ইমনের বাবার দোকান বিক্রির টাকায় আর বাগানের ফলমূল বেচে কত আর চলে সংসার। সোনায় হাত পড়ে বছর বছর। প্রতিভার বকুল নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় কোথায়! ইমন হয়েছে বাবার মতো! ইমনের বাবার মোড়ের মাথায় স্টেশনারি দোকান ছিল। লাভ ছিল ভালোই। কিন্তু লাভের থেকে বাবার খরচ ছিল বেশি। তাছাড়া দোকানের টাকা জমিয়েই তো বাবা সখের এই বাড়ি বাগান করেছিল।

একটু বড়ো হতে, ক্লাস টেন ইলেভেনে উঠতে বকুলগাছটার ফুল ফোটে, ফল হয়। পাকা ফল বকুলগাছের গোড়ায় বিছিয়ে পড়ে থাকে। বিস্কুট রঙের ফল অনেকটা খেজুরের মতো। বকুলফুলের কী সুবাস। প্রাণ ভরে যায় যেন। তখন থেকে বকুলগাছটা তার কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। বাবার প্রিয় মানুষ, কিংবা তার নিজস্ব বন্ধু। বকুলগাছটা যেন তখন থেকেই কথা বলে ইমনের সঙ্গে। ইমন তখন থেকে একটু একটু বুঝতে শেখে বকুলের ভাষা।

– এই ইমন, দিনরাত বকুলতলায় কী করিস তুই?

ছোটোবেলায় ইমন সঙ্গীর অভাবে খেলতে পেত না। কিন্তু তার খেলার সঙ্গীর অভাব হয়নি। বাগানের সবকটা গাছ ছিল তার বন্ধু। বিশেষকরে বকুলের সঙ্গে তার ভাব ছিল খুব। বকুলটাকে নিয়েই সে পুতুল খেলত। তখন খুব মোটা হয়নি। ফুট খানেক বেড় আর সবে সবে বাড়ির দোতলা ছুঁয়েছে তখন। গাছের গোড়ায় কাপড়ের বেড় দিয়ে শাড়ি পরাত। কখনও ইমন বকুলকে মেয়ে করে বিয়ে দিত বাগানের সেগুন গাছের সঙ্গে। আবার কখনও বকুলকে নিয়ে নিজেই বর-বউ খেলত। কখনও সে বউ, কখনও বকুল। তার সময় কেটে যেত কোনও বন্ধু ছাড়াই।

– আসছি মা!

আসছি বলেও ইমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত বকুলগাছটার সঙ্গে।

ইমনের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা অন্য একটা কারণেও নেই। সুমনবাবু স্কুলের নতুন ম্যাথের টিচার। মাস ছয়েক জয়েন করেছে। ইমনের থেকে টিচার হিসাবে জুনিয়র। কী নাকি বিসিএস দেবে বলে টিচারি নেয়নি। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে স্কুলে ঢুকে বিসিএস-এর জন্যও পড়ছে। ক’মাসেই স্কুলে খুব জনপ্রিয়। ছাত্ররা তো সুমনবাবু বলতে অজ্ঞান।

যদিও কো-এড স্কুলে ছাত্রীরা সবথেকে পছন্দ করে তাদের সুন্দরী কেমিস্ট্রি টিচার ইমনকে। কিন্তু ছাত্রীরা তো আর ছেলেদের মতো হই হই করে জানান দিতে জানে না। তারা ইমনকে ভালোবাসে গোপনে, মনে মনে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রাখে। ছাত্ররা সেই মাথায় করে রাখা সুমনবাবুর সঙ্গে ইমনদির তুলনা করে। কে বেশি ভালো তাই নিয়ে। আর প্রতিবার নিজেরাই জিতিয়ে দেয় সুমনবাবুকে। এইসব ইমনের একদম ভালো লাগত না প্রথম প্রথম। তখন ভাবত জেনারেল ট্রান্সফার নিয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে! এই স্কুলে আর না।

তারপর ঘটনা বদলে গেল অন্যদিকে। ছাত্রদের প্রিয় সুমনবাবু কয়েক মাসেই ইমনদির সঙ্গে এক রিক্সায় স্টেশন থেকে স্কুলে যেতেই ইমনের স্কুলটা আবার ভালো লাগতে শুরু করে। কিন্তু ছেলেটার বড্ড তাড়া। সব যেন একদিনেই চায়। গ্রীষ্মের শুরুতে স্কুলে জয়েন করল। বর্ষা পড়তে না পড়তেই ইমনকে প্রপোজ করে বসে। আর সারাটা বর্ষা জ্বালাচ্ছে, কী হল ইমন আমাকে চুমু দেওয়ার?

আরে বাবা বললেই কি সবাই এত দ্রুত সব কিছু পারে? ইমন ছোটোবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের। সুমনের সব কথায় চুপ থাকা মানে কি যে ইমন তার সব কথা মেনে নিয়েছে! যদিও ইমনের সুমনকে খুব ভালো লাগে। ইমনের বাবার মতোই দিলদার হাসি। দেখতেও সুন্দর। ম্যাথে মাস্টার্স করা। যে-কোনওদিন বিসিএস লাগিয়ে দেবে। পাত্র হিসাবে সত্যিই ভালো সুমন। কিন্তু ইমন যেই সুমনের কথা ভাবে, বিশেষকরে বাড়িতে থাকলে, বকুলগাছটার পাতায় পাতায় মন খারাপের পলক পড়ে। ইমন বুঝতে পারে।

ইমন এক পা বাড়ায় সুমনের দিকে আর বাড়ি ফিরেই দু’পা পিছিয়ে যায় বকুলগাছটার কথা ভেবে। সে বকুলগাছটাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। পুরো বর্ষাটা সে ভাবছে উচ্ছল সুমনকে কী বলবে! হ্যাঁ বলাটাই স্বাভাবিক। তবু বকুলগাছটা পিছনে টানছে খুব। আজ আবার সুমনের নানান পরিকল্পনা ইমনকে নিয়ে। শিক্ষকদিবসের তাড়াতাড়ি ছুটিতে ওকে নাকি মুখ ফুটে জানাতেই হবে, ভালোবাসি।

ইমন মাকে কিছুই বলে না। প্রতিভা একটুতেই উৎকণ্ঠিত হয়। না হলে আজকের দিনে মাত্র সাতাশ বছরের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেউ মাথায় ভাদ্রের তালপড়া ব্যথা নিয়ে চিন্তা করে না। ইমন সুমনের কথা ভেবেই আজ স্কুলে যেতে চাইছিল না। অথচ তার কথা ভেবেই স্কুলের দিকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়।

স্টেশন থেকে স্কুল পর্যন্ত রিকশায় আসতে আসতেই সুমন ইমনকে জানিয়ে দিয়েছে, আজ তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সেই থেকে ইমন রেগে আছে সুমনের উপর। সুমন যেন ধরেই নিয়েছে ইমন ওকে ভালোবাসে বা ভালোবাসতে বাধ্য। অবশ্য একা সুমন কেন, সারা স্কুল যেন ধরেই নিয়েছে দুই সুন্দরের মিলন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অথচ ইমন নিজেই জানে না সে সুমনের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী। বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে।

অবশ্য আজকে এই মুহূর্তে ইমন সুমনের উপর রেগে আছে অন্য কারণে। ইমন আজ স্কুলের ধকলের কথা ভেবে পিওর সিল্ক শাড়ি পরেছে। কিন্তু তার চেহারা রোগার দিকে। আগে থেকে যদি বলত, তাহলে সে তাঁতের শাড়ি পরে আসত। তাঁতের শাড়িতে তাকে মানায় ভালো।

স্কুলের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান বড়ো করে কিছু হয় না। প্রার্থনার সময়েই বড়দি শিক্ষকদিবস সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার পর জানিয়ে দিয়েছেন, উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা জুনিয়রদের ক্লাস নেবে। বড়োদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা আর ছোটোদের মধ্যে গুনগুন গুঞ্জন। টিফিনের আগেই সব স্যার ম্যাডামরা যে যে-ক্লাসের ক্লাসটিচার সেখান থেকে ছোটোখাটো উপহার পেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে। ইমনও ক্লাস নাইন ‘বি’-এর ছেলেমেয়েদের থেকে একটা দামি পেন পেয়েছে। প্রতি বছর সে এদিন তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের লজেন্স দেয়। আজ সে ভুলে গেছে একদম। খুব রাগ হয় সুমনের উপর। তার ছন্দে বাঁধা জীবন, যেখানে বকুলফুলের মৃদু সুবাস নিয়ে সে বেঁচে থাকে, সেখানে সুমন তার সমস্ত আকর্ষণ দিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। বাবার তৈরি বাড়ি ছেড়ে সে যাওয়ার কথা ভাবেনি এখনও। বিয়ের কথা তো সুমনের নাছোড় আবেগের আগে কখনও ভাবেইনি! ইমন মনে মনে ঠিক করে, আজই সুমনকে না বলে দেবে। সুমনের মায়ের সামনেই ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে। জানিয়ে দেবে, তার পক্ষে বকুলগাছটাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়।

ট্রেনে একটাও কথা বলেনি ইমন। সুমনের পাশে শক্ত হয়ে বসে আছে। মনে মনে শক্ত হয়ে উঠতে শরীরের কাঠ কাঠ ভাবটা খুব কাজে দেয় ইমন জানে। কিন্তু সুমন সেসব খেয়ালই করছে না। সে আগের মতোই কানের কাছে বকবক করে চলেছে আলতু ফালতু অথবা দামি সব আবেগের কথা। ইমন সেসব আবেগ নিতে পারছে না। সে হয়তো তার সব আবেগ জমা রেখে এসেছে বকুলগাছের পাতায় পাতায়।

বারুইপুর থেকে সোনারপুর হয়ে চম্পাহাটি এমন কিছু দূর না। জায়গাটা এখনও গ্রাম গ্রাম। অনেকটা তাদের বলরামপুরের মতোই। চম্পাহাটি থেকে রিকশা নিতে হয় সুমনের বাড়ি পর্যন্ত। বেশ পুরোনো পাড়া। ছাড়াছাড়া বাড়ি। সুমনদের বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দুজনে একছাতার নীচেতেই সুমনের বাড়ি ঢোকে। সুমনের মা-ই দরজা খোলে। সুমনের মাকে দেখেই ইমনের মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ইমন বুঝতে পারে, ভদ্রমহিলা ভাদ্রের বৃষ্টিভেজা বিকালে ছেলে কোনও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবু আপ্যায়নে আন্তরিকতার অভাব রাখে না, সম্ভবত ছেলের সততার উপর বিশ্বাস রেখে।

– মা, এ ইমন। আমাদের স্কুলের জনপ্রিয় কেমিস্ট্রির টিচার। আমার থেকে টিচার হিসাবে সিনিয়র তবে এমনিতে জুনিয়র। ভালো গান গাইতে পারে। আবৃত্তিও শিখেছে ব্রততীর কাছে…

সুমনের মা হেসে ফেলেন। ছেলেকে ভালোই চেনেন। বলেন, তুই সব বলবি না ওকেও কিছু বলতে দিবি!

তারপর ইমনকে হাত ধরে নিয়ে যান নিজের ঘরে। ফ্যান চালিয়ে বসান বিছানায়। আর নিজে পাশের রান্না ঘরে চলে যান, জল, শরবত আনতে। সেখান থেকে কাচের গ্লাসে স্টিলের চামচ দিয়ে টুং টাং করে শরবত বানাতে বানাতে ইমনের সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। সুমন এইসময় ছাতা মাথায় সাইকেল নিয়ে বের হয়। সম্ভবত ইমনের জন্য মিষ্টি কিনতে। ইমন ভাবে আসার সময়ই তো কিনে নিতে পারত সুমন। আচ্ছা বোকা সুমনটা। বকবক করা ছাড়া কিচ্ছু জানে না।

– কী নাম মা তোমার? পাগলটা হুড়মুড় করে কী বলল বুঝতে পারিনি। খুব জ্বালায় না, তোমায়!

– আমি ইমন বিশ্বাস।

– কোথায় বাড়ি তোমার? বাড়িতে কে কে আছে?

– জয়নগর লাইনের বলরামপুরে বাড়ি আমার। বাবা নেই। মা আর আমি থাকি। শরবত করা বন্ধ রেখে সুমনের মা ঘরে ঢুকে আসে। ইমনের খুব কাছে এসে বলেন, কোথায় বাড়ি বললে?

– বলরামপুর।

– তোমার বাবার নাম কী?

ইমন তার বাবার নাম বলে।

সুমনের মা এবার খাটে বসা ইমনের মুখটা তুলে ধরে বলেন, তোমাদের বাড়িতে একটা বকুলগাছ আছে না? বাড়ির পশ্চিমদিকে?

কথাটা শেষ করতে করতে সুমনের মা জানলার কাছে চলে যান। ইমন হঠাৎ যেন কোনও পরিচিতকে দেখতে পেয়েছে পূর্বজন্ম থেকে, জানলার কাছে গিয়ে সুমনের মায়ের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে, আপনি কী করে জানলেন? আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকে বকুলগাছ আছে!

সুমনের মা জানলা দিয়ে যেন বহুদূরে তাকিয়ে। দিগন্ত থেকে বলে, আমার বাপের বাড়িও তো বলরামপুরের পাশের গ্রাম সুজনপুর।

তারপর ইমনকে জানলার কাছে টেনে যুবতির উচ্ছ্বাসে প্রৌঢ়া  বলেন, দেখো দেখো ইমন, আমাদের পশ্চিমেও একটা বকুলগাছ। বলরামপুরের বকুলগাছটার সমবয়সিই হবে জানো!

উপলব্ধি

মঞ্জরির আজকাল কিছুতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, অথচ আগে ও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। সেই কবে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে শিশিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে সেই থেকে সংসারটা যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সংসার ছাড়া অন্য কিছুতে মন দেওয়ার কোনও আগ্রহই বোধ করেনি কোনওদিন।

ছেলে-মেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। শিশিরও ব্যাবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে থাকে। ছেলে অতনু এমএস করতে আমেরিকা গিয়েছিল এখন ওখানেই ও ওয়েল সেটেলড। মঞ্জরি ভালো মতোই জানে ও কোনওদিন দেশে ফিরবে না। এষা আর মঞ্জরির সম্পর্কটা ঠিক মা-মেয়ের মতো নয়। দুটিকে দেখে মনে হয় অসমবয়সি বান্ধবী। সর্বদা একসঙ্গে, দেখে মনে হয় না ওদের জীবনে অন্য কারও প্রয়োজন আছে।

অথচ এই বন্ধুত্বের মায়াও মঞ্জরিকে ত্যাগ করতে হল। আগের সপ্তাহেই এষাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এসে মঞ্জরি চোখের জল কিছুতেই আটকাতে পারল না। মনে হচ্ছিল শরীরের একটা অংশ যেন কেটে নেওয়া হচ্ছে। অথচ মিলানে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার কথাটা যখন এষা জানিয়েছিল তখন সবথেকে বেশি খুশি বোধহয় মঞ্জরি-ই হয়েছিল।

শিশির অবশ্য ওকে বলেছিল মহিলাদের কোনও সংস্থার হয়ে সোশ্যাল ওয়ার্ক করার জন্য কিন্তু মঞ্জরি রাজি হয়নি। ওর মনে হয় সোশ্যাল ওয়ার্কের নামে সমাজসেবা করাটা সংস্থার উদ্দেশ্য নয় বরং অর্থবান স্বামীদের অর্ধাঙ্গিনিরা নিজেদের টাইম পাস করার জন্য এই সব সংস্থায় জয়েন করে। অন্যদের মতো কার চারিত্রিক দুর্বলতা কোনটা, কে কোন গয়না কিনল বা কত টাকা গয়না কিনতে খরচ করল অথবা বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে দামি আসবাবপত্র বা নতুন ক্রকারি দেখাবার মতো মানসিকতা মঞ্জরির ছিল না। আগেও ও দুবার সংস্থার হয়ে কাজ করেছে কিন্তু পুরোটাই ছিল দুঃস্থ পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ। বাচ্চাদের নিয়ে সারাদিন কাটাতে ওর খুব ভালো লাগত। ও যেন নিজের শৈশবে ফিরে যেতে পারত, ভুলে যেত পঞ্চাশের কোঠা ও পার করে ফেলেছে। কিন্তু সংসারের প্রয়োজনে সংস্থা যখন ওকে ছাড়তে হয়েছিল তখনকার স্মৃতি ওর কাছে মোটেই মধুর ছিল না। সংস্থার অন্যান্য সদস্যরা ওর এই হঠাৎ ছেড়ে দেওয়াটা ভালো চোখে দেখেননি এবং এই বিষয়ে কিছু কটূক্তি শুনতেও মঞ্জরি বাধ্য হয়েছিল।

এষা চলে যাওয়ার পর সময় কাটাতে মঞ্জরি প্রায়শই বাড়ির কাছের পার্ক-টায় গিয়ে বিকেলে বসত। বাচ্চাদের খেলাধূলো দেখতে দেখতে বেশ সময়টা কেটে যেত। একদিন পার্কে বসে মোবাইলে এষার পাঠানো ছবিগুলোতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল মঞ্জরি, হঠাৎই ধ্যানভঙ্গ হল একটি কণ্ঠস্বরে, ‘এক্সকিউজ মি’।

চমকে তাকাতেই দেখল সামনে ২৯ বছর বয়সি একজন যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটি বেশ লম্বা এবং হ্যান্ডসাম। বেঞ্চে পাশে রাখা মঞ্জরির পার্স-টা সরাতে অনুরোধ করছে। পার্সটা সরাতেই যুবকটি মঞ্জরির পাশে এসে বসল।

মিনিট পাঁচেক এইভাবেই কাটল দু’জনের। কেউ কাউকে চেনে না। যুবকটি মাঝেমধ্যেই অধীর আগ্রহ নিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে কারও যেন অপেক্ষা করছে। মঞ্জরি কোতূহল দমন করতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, ‘কারও অপেক্ষা করছেন?’

মঞ্জরি প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক যুবক সুতরাং তাকে প্রশ্ন করার অধিকার ওর নেই। নিশ্চই যুবকটি বিরক্ত হয়েছে ওর আচরণে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, যুবকটি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে মঞ্জরি-কে বলল, ‘হ্যাঁ… হ্যাঁ… আমি একজনের আসার অপেক্ষা করছি… কিন্তু আপনি একলা নাকি?’

‘হ্যাঁ… বাড়িতে ভালো না লাগলে এখানে এসে একটু বসি। আমার বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত মানুষ শুধু আমি ছাড়া। হয়তো আপনজনের সঙ্গ পাওয়ার আশায় এখানে এসে বসে থাকি’, মঞ্জরির কথায় হতাশা ফুটে উঠলেও একটু মজার ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলল।

‘হয়তো… হয়তো এটাই ঠিক। আমিও আমার গার্লফ্রেন্ডের অপেক্ষা করছি। অবশ্য গার্লফ্রেন্ড না বলে হাফ গার্লফ্রেন্ড বলাটাই ভালো। ও বাচ্চাদের হোস্টেলে অফিসার ইনচার্জ। ওর প্রচুর কাজ থাকে সুতরাং টাইমে কোনও দিনই আসতে পারে না’, পাশে বসা মঞ্জরিকে মনের কথা খুলে বলে যুবকটি। মঞ্জরির ব্যবহারে এমন একটা আন্তরিকতা অনুভব করে ও যে, নিজের কথা বলতে দ্বিধা করে না। নিজের পরিচয় দিয়ে নামটা বলে মঞ্জরিকে, ‘আমার নাম সম্রাট, আর আপনার?’

‘মঞ্জরি’, একটু ইতস্তত করে মঞ্জরি নিজের পরিচয় দেয়।

‘আপনার গার্লফ্রেন্ডের নামটা কি আর কেনোই বা ও এখনও আপনার হাফ গার্লফ্রেন্ড?’

‘ওর নাম রিয়া… মুম্বইতে আমরা ক্লাস সেভেন অবধি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। তারপর ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় কলকাতায়। হঠাৎ-ই তিনমাস আগে ওর সঙ্গে আবার দেখা হয়। প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও একে অপরের পরিচয় দিতেই বুঝতে পারি যে ও আমার পুরোনো পরিচিত। ব্যস, তারপর থেকেই মেলামেশা শুরু হয়। আমরা দুজনেই একে অপরকে পছন্দ করি কিন্তু এখনও কেউ কাউকে ওই তিনটে ম্যাজিক শব্দ বলে উঠতে পারিনি।’ মঞ্জরিকে এত কথা বলতে গিয়ে সম্রাট কিছুটা লজ্জা বোধ করে।

‘তাহলে তো তুমিও রিয়ার হাফ বয়ফ্রেন্ড, তাই না?’ মঞ্জরি বুঝতে পারে ছেলেটির সঙ্গে গল্প করতে ওর বেশ ভালো লাগছে।

‘না… না একদমই না কারণ রিয়া আমার মনের কথা খুব ভালো করেই জানে। আমি অত রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না কিন্তু ম্যাডাম… বাপরে, পুরোনো দিনের সাইলেন্ট মুভির হিরোইন। আগেও যেমনি নায়িকারা নায়কদের নিজেদের পিছনে ছুটিয়ে মারত এখনকার মেয়েরাও ছেলেগুলোকে বাধ্য করে পিছনে পিছনে দৌড়োবার জন্য।’ সম্রাটের এই শিশুর মতো স্বীকারোক্তি মঞ্জরির হৃদয়ে স্নেহের  উদ্রেক করে। ওর প্রতি কেমন যেন একটা মায়া অনুভব করে মঞ্জরি।

‘সম্রাট, তুমি যা বললে সেটা পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের উপর। আমি কোনওদিন কাউকে আমার পিছনে দৗড় করাইনি। যেদিনই বুঝেছিলাম শিশিরকে ভালোবাসি, সেদিনই সময় নষ্ট না করে ওর কাছে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। শিশির কেন, আমি কারও কাছেই মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। আমার সন্তানই হোক বা বন্ধু, সকলের কাছেই আমার ফিলিংস পরিষ্কার হয়ে যায়।’ মঞ্জরি কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে পড়ে।

‘ঠিকই বলেছেন, আমিও চুপ থাকতে পারিনি। রিয়াকে পরিষ্কারই নিজের মনের কথা বলে দিয়েছি। এখন ওর মুখ থেকে শুনতে চাই আমার প্রতি ওর কী ফিলিংস’, উত্তেজিত হয়ে পড়ে সম্রাট।

‘সম্রাট, আমি সহজে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এটার জন্য লোকে আমার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলবে। কিন্তু এটার জন্য জীবনে অনেক কিছু শিখেওছি। রিয়ার মনের কথা কীভাবে বার করবে আমি তোমাকে বলে দেব… ঠিক আছে?’

‘ডিল?’

‘ডিল!’

দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। একে অপরের ফোন নম্বর নিয়ে মঞ্জরি বেরিয়ে আসে পার্ক থেকে।

সেক্টর ফাইভে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সম্রাট ভালো পদে কাজ করে। ও একাই কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকে। মা-বাবা দুজনেই মুম্বই থাকেন। সম্রাটের স্বভাব মিশুকে হলেও খুব কমজনই ওর হূদয় অবধি পৌঁছোতে পারত। বন্ধু বাছার ব্যাপারে ও খুব চুজি ছিল। মঞ্জরির স্নেহশীল ব্যবহারে সম্রাট ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়। দুজনের মধ্যে প্রায়শই দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে, ফোনেও দুজনের কথাবার্তা চলতে থাকে।

মঞ্জরির সঙ্গে দেখা হলেই, সম্রাট হাজারো মনের মধ্যে জমে থাকা সমস্যা মঞ্জরির সামনে উজাড় করে দিত সমাধান পাওয়ার আশায়। মঞ্জরিও ধীর ভাবে সম্রাটের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করত। রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন যখনই সম্রাটের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠত, মঞ্জরি তৎক্ষণাৎ গভীর ব্যাখ্যার মাধ্যমে রিয়া সম্পর্কে সম্রাটের মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর করে দিত।

সম্রাট বুঝে গিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ মঞ্জরির কাছে আজও প্রেম শব্দটার একটা গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য রয়েছে। বয়সের সাথে সাথে মঞ্জরির জীবন থেকে প্রেম দূরে সরে যেতে পারেনি। তাই সম্পর্কের মাধুর্য আজও মঞ্জরিকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রেমকে অবহেলা করলে মঞ্জরি সেটা সহ্য করতে পারে না। তবে মঞ্জরির মূল্যবোধগুলো জীবনের প্রান্তে এসে অনেক বেশি পরিপক্ব যার প্রশংসা সম্রাটকে মনে মনে করতেই হয়। মঞ্জরির স্নেহধন্য হয়ে সম্রাট মনের মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি লাভ করে। মঞ্জরিও সম্রাটের উৎসাহে প্রভাবিত হয়ে মনের মধ্যে এক উদ্দাম শক্তির প্রকাশকে অনুভব করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দুজনে এক অজানা সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে লাগল।

প্রায় একমাস বাইরে বাইরে থাকার পর শিশির বাড়ি ফিরে নতুন এক মঞ্জরিকে আবিষ্কার করল। এই মঞ্জরি অনেক বেশি হাসিখুশি। লাল কেপ্রির উপর লম্বা ক্রিম কালারের কুর্তা পরে, পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে যে মেয়েটি শিশিরকে স্বাগত জানাল সে যেন তিরিশ বছর আগের ফেলে আসা মঞ্জরি।

সুটকেশ হাতে করে নিজের ঘরে ঢুকতেই শিশির দেখল খাটের পাশে রাখা সোফাটায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে একজন অচেনা যুবক। শিশির কিছু বলার আগেই মঞ্জরি কফির ট্রে সাজিয়ে ঘরে ঢুকল। শিশিরের সঙ্গে সম্রাটের পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার বন্ধু সম্রাট।’

শিশিরকে অবাক হতে দেখে এবার সম্রাটই কথা বলল, ‘জানি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন কারণ আমাদের বয়সের অনেকটা তফাত। তবু আমিও এই সম্পর্কটাকে বন্ধুত্বই বলব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো? আমি ওনাকে আমার বন্ধু বলতে পারি?’ সম্রাটের সরলতা মুহূর্তে শিশিরের মন জয় করে নিল।

‘শুধু বন্ধু বললেই হবে, মন থেকেও তো ওকে বন্ধু বলে মেনেও নিতে হবে। মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে ও এমন একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে যাতে আমাদের ম্যাডাম দুনিয়াদারি সব ভুলে গিয়েছে। যাক একটা ভালো হয়েছে, এবার থেকে কলকাতার বাইরে গেলে মঞ্জরিকে নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।’ শিশির সম্রাটের পিঠ চাপড়ায়। কফি খেতে খেতে তিনজন গল্পে বুঁদ হয়ে যায়। সময়ের খেয়াল থাকে না কারওরই।

রিয়াকে নিয়ে সম্রাটের চিন্তা দেখে মঞ্জরি মাঝে মাঝে না হেসে পারত না। রিয়ার মনের কথা জানার জন্য সম্রাট ব্যস্ত হয়ে পড়ত। নিজেদের সম্পর্কটাকে একটা নাম দেওয়ার অধীর অপেক্ষায় থাকত। মঞ্জরি সম্রাট-কে রিয়ার সামনে একটু রিজার্ভ থাকার পরামর্শ দিল যাতে রিয়া নিজে থেকে সম্রাটের প্রতি ইন্টারেস্ট নেয়। মঞ্জরির কথা মেনে সম্রাট রিয়াকে বারবার ফোন আর মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। কাজের প্রেশারের দোহাই দিয়ে হোয়াট্‌সঅ্যাপ থেকেও নিজের নাম তুলে নিল। এতে ভিতরে ভিতরে সম্রাট কিছুটা আন-ইজি ফিল করলেও শেষমেশ ও যা চাইছিল তাই হল।

কফি শপে মুখোমুখি বসে দুজন। সম্রাট চাইছিল রিয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে। মঞ্জরির কথা মনে পড়ল। নিজেকে রিয়ার চোখে কাচের মতো পরিষ্কার করে তুলে ধরার দিন শেষ। নিজের আঙুলগুলো নিয়েই খেলা করতে লাগল সম্রাট। রিয়া একটু অবাকই হল। ওর সামনে সম্রাটকে এতটা চুপচাপ হয়ে থাকতে কোনওদিন দেখেনি। ওর অনর্গল কথার স্রোতের মাঝে লাগাম লাগাবার কাজটা রিয়াকেই করতে হতো। সম্রাটই মুখ খুলল তবে নিজের কথা দিয়ে নয়। অফিসের নানা সমস্যা, তাই নিয়ে কথা। চুপচাপ খানিক্ষণ শোনার পর রিয়া বোর হতে শুরু করল, ‘প্লিজ সম্রাট… অফিসের কথা ছাড়ো না। বরং তোমার ছোটোবেলা, কলেজের কথা বলো। স্কুলে তোমাকে দেখেছি, তখন তুমি খুব চুপচাপ থাকতে।’

‘উফ! আবার আমার লাইফের বোরিং অধ্যায়গুলো’, কপট বিরক্তি প্রকাশ করল সম্রাট।

‘আমার তো খুব ভালো লাগে তোমার সম্পর্কে জানতে।’

‘রিয়েলি… কিন্তু আমার কথা ভালো লাগার নিশ্চয়ই একটা কারণ তো হবে?’ আশা জাগে সম্রাটের মনে।

‘সব কিছুর কি কারণ থাকতেই হবে… তোমার চিন্তাধারাই অন্যরকম।’

‘আমার উপর রাগ করে কি লাভ? আমাকে তুমি ভালোবাসো, এই কথাটা তুমিই বলতে পারছ না উলটে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ।’

‘সব কথা মুখে বলার দরকার পড়ে না। আমি কি কখনও তোমাকে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে চাপ সৃষ্টি করেছি? তোমার কথায়, মেসেজে সব পরিষ্কার এমনিতেই হয়ে গেছে’, রিয়া হাসি চাপতে পারে না।

সম্রাট এবার সত্যি রেগে যায়, ‘হ্যাঁ, আমি মানুষটাই এরকম। মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। অথচ এতদিন হয়ে গেল তুমি সেই

মা-বাবার লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই রয়ে গেলে।’

‘আরে বাবা… এত রাগ। ঠিক আছে, আজ থেকে আমি তোমার ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। কি… আশ্রয় দেবে তো?’

আনন্দে সম্রাট রিয়ার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। মনে মনে মঞ্জরিকে ধন্যবাদ জানায়। সাফল্যের এই রাস্তা তো ওই সম্রাটকে চিনিয়ে দিয়েছে।

বাড়ি পৌঁছেই সম্রাট মঞ্জরিকে ফোন করল। কিন্তু ফোনে মঞ্জরিকে না পেয়ে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে ও শুয়ে পড়ল। সকালেও কোনও উত্তর না দেখে আবার ফোন করতে লাগল কিন্তু কোনও সাড়া নেই। এবার চিন্তা হতে শুরু করল সম্রাটের। শিশির শহরের বাইরে সুতরাং দূরে কোথাও যাবে না মঞ্জরি। তাহলে ফোন ধরছে না কেন? ঠিক করল অফিস যাওয়ার আগে একবার মঞ্জরির বাড়ি হয়ে যাবে। গাড়ি বার করতে যাবে এমন সময় মঞ্জরির ফোন এল। মঞ্জরি জানাল গতকাল থেকে ওর প্রচণ্ড জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না।

‘আমি এক্ষুনি আসছি’, বলে সম্রাট গাড়ি বার করল। রিয়াকে ফোন করে জানাল যে, একজন বন্ধু অসুস্থ হওয়াতে ও তার বাড়ি যাচ্ছে। ওখান থেকেই অফিস চলে যাবে আর বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না পারলে ও যেন রাগ বা চিন্তা না করে।

মঞ্জরির বাড়ি গিয়েই প্রথমে ওর কাছ থেকে ডাক্তারের ফোন নম্বর নিয়ে ডাক্তারকে কল করল। মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করে সম্রাট অফিস গেল। বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করল। সম্রাটের সঙ্গে দেখা হতেই রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বন্ধু কেমন আছে?’

‘মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে এসেছিলাম। এবেলা অনেকটা ভালো।’

‘তুমি তো বলেছিলে তোমার বন্ধুর শরীর খারাপ।’

‘হ্যাঁ, মঞ্জরি তো আমার বন্ধু।’

‘মানে?’ রিয়ার গলায় অবিশ্বাস ঝরে পড়ে।

‘মানে, তোমারও কি মনে হয় যে একজন পুরুষ কখনও কোনও মেয়ের বন্ধু হতে পারে না?’ খুব সিরিয়াস শোনায় সম্রাটের কণ্ঠস্বর।

‘সম্রাট, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন আধুনিকা। নিশ্চই বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু ৫০ বছর বয়সি কাকিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব? এটা একটু বাড়াবাড়ি হল না… আই কান্ট বিলিভ ইট…’ বলে রিয়া উঠে দাঁড়াল।

মঞ্জরির বাড়ি হয়ে সম্রাট তাড়াতাড়িই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। খুব ক্লান্ত বোধ করছিল সম্রাট। সারাদিনের ছোটাছুটি, স্ট্রেস তার উপর রিয়ার অবুঝের মতো ব্যবহার। রাগে সম্রাটের মাথাটা দপদপ করছিল। ও একটা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল সকাল মঞ্জরি ফোন করল ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। অনেক সুস্থ শোনাচ্ছিল ওর গলা। কিন্তু সম্রাটের গলা শুনে ভালো লাগল না মঞ্জরির, ‘কী হল সম্রাট? মন ভালো নেই নাকি? রিয়া ভালো আছে?’ মঞ্জরির গলা চিন্তিত শোনাল।

‘মঞ্জরি, রিয়া বড্ড ছেলেমানুষ। ও কি সত্যিই কোনওদিন অ্যাডজাস্ট করতে পারবে আমার সঙ্গে?’

‘কেন নতুন করে কী হল আবার?’ মঞ্জরি এটা জিজ্ঞেস করতেই সম্রাট গতকালের পুরো ঘটনা খুলে বলল ওকে।

‘সম্রাট এতে রিয়ার কি দোষ? আমরা এমন সংস্কার নিয়ে বড়ো হই যে নিজেদের স্বাধীন ভাবে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই পারি না। সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতার কিছু লোক এমন কিছু নিয়ম শৃঙ্খলে আমাদের মনটাকে বেঁধে রেখেছে যে, আমরা সেটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে ভয় পাই। সারা জীবনই সেটা অাঁকড়ে বেঁচে থাকতেই ভালোবাসি। রিয়াকেও একটু শুধু বোঝাতে হবে। তুমি চিন্তা কোরো না প্লিজ… দেখছি এখন কী করা যায়’, মঞ্জরির কথায় সম্রাট আশ্বস্ত হয়। ফোন রেখে দেয় মঞ্জরি।

দুদিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে মঞ্জরি। সুস্থ হতেই দোকানে গিয়ে প্রচুর চকোলেট কিনে সম্রাটের থেকে ঠিকানা জোগাড় করে, রিয়া

যে-বাচ্চাদের হোস্টেলের ইনচার্জ, সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়। ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে চকোলেট বণ্টনের ইচ্ছা প্রকাশ করতেই ওর আশা মতো ওকে হোস্টেলের ইনচার্জ রিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফরসা, তন্বী চেহারার যে-মেয়েটির কাছে মঞ্জরিকে নিয়ে যাওয়া হল সেই মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। সম্রাটের কাছে কোনওদিন ছবিও দেখেনি মেয়েটির কারণ সম্রাটের ইচ্ছা ছিল রিয়ার সঙ্গে ওকে মুখোমুখি আলাপ করিয়ে দেবে। মনে মনে রিয়ার সৗন্দর্যের প্রশংসা করল মঞ্জরি। মঞ্জরি নিজের নাম বলল না। ও জানত রিয়া ওকে সামনাসামনি কখনও দেখেনি। সুতরাং ওকে দেখেও রিয়া কিছুতেই চিনতে পারবে না।

রিয়া মঞ্জরিকে হোস্টেলের খেলার মাঠটায় নিয়ে গেল। ওখানেই হোস্টেলের সব বাচ্চদের একত্রিত করা হল। বেশিরভাগই পাঁচ থেকে দশ বছর বয়স। ওখানে যেসব বাচ্চারা থাকে তাদের

থাকা-খাওয়া-জামাকপড় আর পড়াশোনা করাবার সুব্যবস্থা একটি এনজিওর উপর। রিয়া মঞ্জরিকে বলল, ‘জানেন ম্যাডাম, এদের সঙ্গে আমার সময় খুব ভালো কাটে। ওদের থেকেই আমি শক্তি ও সাহস পাই। জীবনের একটা নতুন দিশার সন্ধান ওদের মাধ্যমেই আমি খুঁজে পেয়েছি।’

বাচ্চাদের প্রতি রিয়ার ভালোবাসা মঞ্জরিকে মুগ্ধ করল। রিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটি বাচ্চা এগিয়ে এসে রিয়ার দিকে একটি চকোলেট বাড়িয়ে দিল, ‘ম্যাম এটা আপনি খান।’ রিয়া সামান্য একটু ভেঙে নিয়ে বাকিটা ওর হাতে ধরিয়ে বাচ্চাটিকে আদর করল আর ওকে খেলতে পাঠিয়ে দিল।

‘ওর নাম শ্রেষ্ঠ। একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওর মা-বাবা মারা যায় আর ওর চোখও নষ্ট হয়ে যায়। কেন জানি না, ও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও ওর দুঃখ দেখতে পারি না, বাচ্চাটার প্রতি অসম্ভব একটা টান অনুভব করি। আমারও কোনও কষ্ট হলে আমাকে ছুঁয়ে ও বলে দেয় যে আমার মন খারাপ। আমাকে খুশি করার সবরকম চেষ্টা করতে থাকে।’

‘সত্যিই… খুব দুঃখের। তবে একটাই ভালো হয়েছে সে তোমার মতো একজন বন্ধু পেয়েছে।’

‘আমি জানি না ম্যাডাম এটা আপনি কতটা বুঝবেন… শ্রেষ্ঠ আর আমি একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এত ভালো বন্ধু আমার আর নেই’, মঞ্জরির কাছে রিয়ার নিজেকে তুলে ধরতে কোনও অসুবিধা হল না। মঞ্জরির মিষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য।

‘তাহলে আজ থেকে ২০-২৫ বছর পরেও তুমি কি চাইবে না যে, তোমাদের বন্ধুত্বটা এরকমই অটুট থাকুক? পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেই কি তোমার জীবন থেকে বন্ধুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? একটা বয়সের পর মনের চাহিদা কি সত্যিই দাবিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়? ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ যদি আজকের মতোই তোমাকে ভালোবাসে, একাত্মতা অনুভব করে, তাহলেও কি বয়সের এতটা তফাতের কথা মনে রেখে তোমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা কমিয়ে ফেলতে হবে? সম্পর্কটা তখন বদলে বন্ধুত্ব থেকে অন্য কিছু হয়ে যাবে? কী নাম দেবে সেই সম্পর্কটার? হয়তো কোনও-ই নাম নেই সম্পর্কটার, সেই ক্ষেত্রে তুমি কী করবে রিয়া?’ রিয়ার দিকে তাকিয়ে মঞ্জরি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে।

‘ভালোবাসাটা তো একইরকম থাকবে, আমার দিক থেকেও আবার শ্রেষ্ঠর দিক থেকেও। আর নাম… সম্পর্কটার নাম তো বন্ধুত্বই থাকবে। এখনও তাই। পরেও ব্যাপারটা একই…’, রিয়াকে চিন্তিত লাগে।

‘যদি শ্রেষ্ঠ আর তোমার সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব বলা যায় তাহলে সম্রাট আর মঞ্জরির সম্পর্কটাকে নয় কেন…?’ বলতে বলতে মঞ্জরির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চেপে রাখা অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে ওর দু’চোখ বেয়ে।

সময় গড়িয়ে চলে। দু’জনেই বসে থাকে চুপচাপ। মঞ্জরি-ই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, ‘আমি আজ উঠি রিয়া। কাল আমার বাড়িতে এসো। সম্রাটকে ওখানেই ডেকে নেব। প্রচুর গল্প করার আছে তোমাদের সঙ্গে।’ রিয়া সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে মঞ্জরিকে বিদায় জানায়।

রিয়ার মনে হল আজ ওর সামনে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হল। অপরকে ভালোবাসা, তার জন্য চিন্তা করা, ত্যাগ, আকর্ষণ ইত্যাদি মানুষের সুকোমল বৃত্তিগুলিরই অন্য নাম। এগুলির একত্রে সমাবেশই গড়ে তোলে বন্ধুত্ব সুতরাং এটা সম্পূর্ণই মনের সম্পদ। একজন মানুষের মন একটাই হয়… বন্ধুত্ব কেন তাহলে মনের না হয়ে বয়সের উপর নির্ভর করবে?

সঙ্গে সঙ্গে রিয়া সম্রাটকে মেসেজ করল, সম্রাট…

সম্পর্কের গভীরত্ব এতদিন আমি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনি। কোনও সম্পর্কই ফুরিয়ে যাওয়া উচিত নয় জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত। আমার ইচ্ছে তোমার এবং মঞ্জরির বন্ধুত্ব সারাজীবন সুরভিত হয়ে থাকুক। আজ বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর সেরা উপরহাটা হল ‘বন্ধুত্ব’।

ইতি তোমার রিয়া।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব