ইঁদুরের গর্ত

আমি করব। মা বাবার কনসেন্ট জোগাড় করাটা আমার ব্যাপার।

র-এর চাকরির সাক্ষাৎকারে বলেছিল কস্তুরী, যদিও ব্যাপারটা ওর হাতে ছিল না, পারিবারিক বিষয় হয়ে গিয়েছিল। র-এর প্রাথমিক মনোনয়নপত্র বা অফার লেটার আসতেই বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কারণ ভিন দেশে গুপ্ত মিশনে মারা গেলে শরীরটা ভারত সরকার ফেরত নেওয়া তো দূর, নিজের নাগরিক হিসাবে স্বীকার নাও করতে পারে। এই জাতীয় শর্ত দেখার পর মা তো নাওয়া-খাওয়া ও সেইসঙ্গে রান্না করা ছাড়লেন।

ট্রেকিং-এর স্বপ্ন কোন ছোটোবেলায় দুচোখে ও মস্তিষ্কে আঁকা হয়ে গেছে পাকাপাকি। কিন্তু শখ থাকলেই সাধ্য থাকতে হবে, এই আপ্তবাক্য বা প্রবাদ সবার জীবনে মেলে না। কস্তুরীরও জেদ, কিছুতেই আর-পাঁচজন বিজ্ঞানের ছাত্রীর মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হবে না। সে বিশেষ কিছু করবে, মানে ভেতো বাঙালি মার্কা নয়, রোমাঞ্চকর কিছু।

তবে রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে তেমন কিছু একটা চাকরি লাগিয়ে ফেলা যায়। সবাই যখন আইএএস দেয়, কিছু ছেলেমেয়ে শুধু একটা লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে বস হবে বলে আইপিএস পেতে চায়। অন্যরা যখন ব্যাংক প্রবেশনারি অফিসার হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়াশোনা করে, তখন খুশিমনে কস্তুরী দাশগুপ্ত সিবিআই, র, ফরেনসিক বা নিদেনপক্ষে কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ় তথা আইবি-র পরীক্ষা দিয়ে গেছে।

বাড়ির সবার চাপে জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে মন নেই। ভর্তি হয়েছে মায়ের মন রাখতে। যদি ফরেন্সিকে যেতে পারে, তো এই লাইনে থাকবে, নয়তো শুধু শুধু মরা-পচা কাটার কোনও বাসনা নেই। যে-কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সেই গতানুগতিকতার মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছা করে না।

এই সময় কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ-এর ইন্টারভিউ কল পেল। চাকরিটা যে তিন বছর করে কাস্টমস আর তিন বছর করে সেন্ট্রাল এক্সাইজ় পোস্টিং আগে জানা ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে দুরূহ অবস্থার মোকাবিলা, আত্মগোপন করা, ছদ্মবেশ ধারণ করার শিক্ষানবিশি সব নিতে হবে। শুনেই কস্তুরীর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল রোমাঞ্চে, আর মা-বাবার কাঁটা দিচ্ছিল উদ্বেগে। উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, পাগলির কথা শোনো। ডাক্তারির সুযোগ ছেড়ে কেউ চোর ডাকাত স্মাগলারদের পিছু ঘোরে?

মনে মনে মরিয়া হয়ে সাক্ষাৎকার দিল এবং পেয়ে গেল কস্তুরী। প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম পোস্টিং মেঘালয়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অসম সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই, মা-বাবা তাতেও খুঁতখুঁত করছিলেন। ওখানে বাঙালিরা মোটেই নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ থেকে যেহেতু অবাধে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পরিয়াযী মানুষ অসম ও মেঘালয়ে প্রাণ বাঁচাতে বা জীবিকার সন্ধানে আসে, তাই সাত প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী বাঙালির প্রতিও যেন শরণার্থী জবরদখলকারীর মনোভাব স্থানীয়দের। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হ্যাংলার মতো শিলং, বড়া পানি, চেরাপুঞ্জি, মৌসিনরাম দেখতে ছোটা চাই। স্বজাতির কী হল না হল সেসব ভেবে নিজেদের সীমিত পরিসরের আনন্দ মাটি করতে চায় না কেউ। কিন্তু এখন যে, নিজের কন্যার প্রশ্ন। মাথা ঘামাতেই হচ্ছে।

কিন্তু আজকের দিনে সরকারি চাকরি বলে কথা, কোটার পাত্রী নয়, কটাকে হেলাফেলা করবে? ডাক্তারি পড়তে লাগবে কম পক্ষে পাঁচ বছর। তারপর হাউস স্টাফ থাকতে হবে। স্বাধীন রোজগেরে হতে গেলে অন্তত ছয় সাত বছরের ধাক্কা। আর এটা শুরুতেই মোটা মাইনে, দুবছর পর পাকা চাকরি। সবরকম সরকারি সুযোগসুবিধা-সহ নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, মহার্ঘ্য ভাতা, এলটিসি সব। অগত্যা মা কালী মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে শেষে লোকনাথ বাবার কাছে নিরাপত্তার জিম্মা দিয়ে মেয়েকে এয়ারপোর্টে এসে মেঘালয়ের উদ্দেশে রওনা করতেই হল।

বিমানে ওঠার আগে খুশির হাসি হেসে খুশিমনে কস্তুরী বলল, মা দুই বাংলার বাইরে লোকনাথ বাবাকে কেউ চেনে না, যদিও বলা হয় উনি সুমেরু পর্যন্ত নাকি ঘুরে এসেছেন, তবে নর্থ-ইস্টে যাননি। উনি না মানচিত্র গোলমাল করে ফেলেন। ঠাকুরের আসনে সেভেন সিস্টার সমেত ভারতের ম্যাপটাও রেখে দিও।

উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনার বিশেষ অধিকার, তার অপব্যবহার, ক্রমাগত অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নবাদী কার্যকলাপ সব মিলিয়ে জটিল গোলকধাঁধা। তার মধ্যে কস্তুরীর কাজ পড়েছে কয়লা চোরাচালান আটকানোর বিভাগে। যদিও প্রশিক্ষণ পর্যায়, তবু এমন বিপজ্জনক কাজের ট্রেনিং-ও বিপন্মুক্ত হওয়া সহজ নয়।

ওদিকে দক্ষিণ মিজ়োরামে ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার, কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আযোজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম সবকিছু নিয়ে ঝামেলা। কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর সঙ্গে মেলে না।

ষাটের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। নিজেদের জুমিয়া জাতি বলে বাংলাদেশ তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চেনে ও কড়া হাতে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর গোড়ায় সত্যিই চাকমা সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী বা চাকমা আর্মড ফোর্স তৈরি করে নাম দেওয়া হয় শান্তি বাহিনী। তাই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। আবার উচ্ছেদ, আবার ভারতের অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়া। কেউ কেউ পরিব্রাজন করে লাগোয়া অসম মেঘালয়ে চলে আসে। তাদের পুনরায় আগমণ নিয়ে মিজ়োরাম তো বটেই, মেঘালয়ে এই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার ওপর বসতভিটে ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের উৎপাত তো আছেই।

নাক ও চোখের গড়নের সাদৃশ্যের খাতিরে স্থানীয়দের চোখে চাকমারা যদিও ওদের মধ্যে কিছুটা আত্মগোপন করতে পারে, কিন্তু বাঙালি মানেই বাংলাদেশী আর বাঙালি দেখলেই সবার দ্যাখো মার ভঙ্গি। মেয়ও তবু একটু দয়া দাক্ষিণ্য করে, কিন্তু মেঘালয়ে গারো খাসি জয়ন্তিয়া জনজাতিরা এবং মিজ়ো ছেলেরা বাঙালি পুরুষ নারী বাচ্চা কাউকেই রেহাই দিতে চায় না।

বাঙালি ও চাকমা খেদানো নিয়ে সেখানে প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কট পর্যন্ত হয়ে গেছে। জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পুনর্বাসন ও অভিবাসন হবে না কথা দিয়ে শান্তি নেই। বাঙালি মানেই মেরে ফ্যাল শালা, রিফিউজির জাত। নামেই মাতৃপ্রধান সমাজ। কোনও মহিলাকে মুখ্যমন্ত্রী তো দূর, কোনও বড়ো পদে দেখাও বিরল ব্যাপার। অথচ ঘর-সংসার থেকে ব্যাবসাপত্র, সম্পত্তি সবকিছুর দেখভাল মেয়েরাই করে।

আরেক পক্ষের দাবি, অভিবাসন দিলে সবাইকে দিতে হবে। জাতি ধর্মের বিভেদ করলে চলবে না। যারা আসছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতে আসছে, সুতরাং কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে সেই ভেদাভেদ করা চলবে না। রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিক পরিস্থিতি সব সময় উত্তপ্ত, যে-আগুনে পুড়তে হয় মূলত সব হারানো বাঙালি পরিবারগুলোকেই।

নাগরিকত্ব নিয়ে কেন্দ্র সরকার একটু আংশিক উদারতা দেখাতেই মেঘালয়ে বাঙালি খেদানোর ও মারার নতুন হিড়িক পড়ে যায়। রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়, বাঙালি মেঘালয় পাহাড় না ছাড়লে রক্তের স্রোত বইবে। ভারতের দেশজ হোক বা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী বাঙালির জন্য ক্রমশ আরেক বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে মিজ়োরাম ও মেঘালয়। বাঙালিরা যেখানেই যায়, নিজেদের বুদ্ধির জোরে বড়ো বড়ো চাকরি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি সম্মানজনক পেশাগুলো হাতিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের থিতু হয়ে বসতে না দিলে জীবনরক্ষায় দিনানিপাতেই কেটে যাবে কাল।

আরও একটা ভয়, এই পুরো অঞ্চল জুড়ে নানা খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। সেগুলোর মালিকানা স্থানীয় জনজাতি ছাড়া আর কারও হাতে যাওয়া পছন্দ নয় মিজো, খাসি, গারোদের। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি ও অনেক বেআইনি কোলিয়ারি আছে। বেশ কয়েকটির মালিক মাড়োয়ারিরা। স্থানীয়দের ভাষায় ইন্ডিয়ান। তাদের বেসরকারি কোলিয়ারি আইনানুগ নথিভুক্ত। কিন্তু তাতেও বেআইনি কাজ করতে বাধা নেই। চুক্তিমতো ন্যুনতম পারিশ্রমিক না দেওয়া, দৈনিক রোজ বাকি রাখা, বিমা ছাড়া কন্দরে প্রবেশ করানো কত আর বলা যায়?

কোথাও কোথাও খনির মুখ এত সরু, যে বড়ো মানুষ ঢুকতে পারে না। তাই বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও বেআইনি ভাবে নামানো হয় সেই সব গভীর ইঁদুর গর্তে। বাস্তবিকই ওগুলোর নামকরণ সার্থক র‌্যাট হোল মাইন। সেখানে অস্ত্র হাতে গুঁড়ি মেরে কয়লা কেটে আনতে হয়। দুর্ঘটনা নিত্যসঙ্গী। সেই ভ্যান গখের জীবনীতে পড়েছিল কস্তুরী এই অবিশ্বাস্য শোষণের কাহিনি। এ যেন তাকেও ছাপিয়ে যায়। এখানে তো গরিব মানুষের নগণ্য পারিশ্রমিকও বাকি রেখে তা পুরোটা চোকানোর টোপ দিয়ে তাদের আবার নামতে বাধ্য করা হয় ওই মরণ গহ্বরে। এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সব হারানো বাঙালির বাচ্চারাই। দুটো খেতে পাওয়ার জন্য মানুষ কী না পারে? বাংলাদেশ থেকে খেদানি খেয়ে এখন অসম থেকেও খাচ্ছে, আর কোলিয়ারি মালিকদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে।

মা আমি নাই যাব ঐহানে। ডর লাগে। হাত পা ছিলা যায়। বাবা গো! আমারে পাঠায়ও না।

আজ কাম করে নে, টাকাটা পেলে পরদিন আর যাবি না উহেনে।

কিন্তু সেই পরদিন আর আসে না। পেট চালাতে মহাজনের কাছে দেনা। শুধতে গেলে আবার কাজ, আর কাজ মানে ইঁদুরের গর্তের অতলে তলিয়ে কয়লা তুলে আনা। পারিশ্রমিক যা পায়, গালাগাল পায় তার বেশি। তবু এই চক্র থেকে রেহাই নেই। ২০১৮-র ডিসেম্বরে একসাথে পনেরো জন শ্রমিক আটকে পড়ায় খবর হয়েছিল। তাদের উদ্ধারে বাযুসেনা পর্যন্ত নেমেছিল, নেমেছিল ডুবুরি বাহিনী। তবু শেষটায় ছয় জনকে বাঁচানো যায়নি। আরও কত খুচরো সংখ্যক প্রাণ যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে চলে যায়, তার গোনা-গুনতি নেই!

আবার শোনা যাচ্ছে লিটন নদীর জল ইঁদুর গর্তে ঢুকে পঞ্চাশজন শ্রমিক আবদ্ধ। ৩৬০ ফুট গভীরে তাদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে খবরটা ধামাচাপা দেওয়া যায়, তাতে সচেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজের উদ্ধার বাহিনী নামিয়েছেন। কিন্তু সেনা ডাকা মানে সর্বভারতীয় খবর হওয়া। একই ব্যক্তির রাজত্বে দু-দুবার এমন দুর্ঘটনা ভালো প্রশাসনের পরিচয় নয়। গতবারেই কোল ইন্ডিয়া স্বীকার করেছিল, এই তল্লাটে প্রচুর চোরা খাদান আছে। পাহাড় গাত্র ফুঁড়ে চলা এই র‌্যাট হোল, শুধু শ্রমিক কেন, সাধারণ মেঘালয়বাসীর পক্ষেও ধস নেমে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা মেনেছিল আইন অমান্য করে খনিতে নাবালক নাবালিকাদের নামানো হচ্ছে। কিছুদিন কাগজে হইচই হল, দু-একজন গ্রেফতার হয়ে জামিনে খালাস। তারপর আবার যেই কে সেই। এবারেও মনে হচ্ছে আধা সেনা ও সেনা ডাকতে হবে, নতুবা পরে জানাজানি হলে আরও হাঙ্গামা, যদিও মন্ত্রীদের পদ তাতে টলে না।

র‌্যাট হোল খনি শুনলেই গা ছমছম করে কস্তুরীর মতো ডাকাবুকো মেয়েও। তার মধ্যে স্থানীয়রা সবাই এটাকে সবচেয়ে ভয় করে। ওখানে মানুষ ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। যাদের জীবন নরকের চেয়ে দুর্বিষহ, তাদেরও বাঁচার এত সাধ, আর অজানা অন্ধকারকে এত ভয়?

কস্তুরী সীমান্তে চোরাচালান ধরার দাযিত্বে। যদিও তার ট্রেনিং চলছে, কিন্তু নির্ভীক স্বভাবের জন্য ওকে মাঝে মাঝে ভয়াল জায়গাতেও ঠেলে দেওয়া হয়। এবার রেস্কিউ টিমে ওকেও রাখা হয়েছে। খনি মালিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ ও চার্জশিট গঠনে সহায়তা করলেই তার দায় মেটে। আটকা পড়া মানুষগুলোকে জীবন্ত উদ্ধার করা গেলে একরকম, আর মারা গেলে আরও কড়া প্রকৃতির। তাদের বাঁচানোর দায় মোটেই তার নয়। তবু বাঁচাতে পারলে নাকি চোর ধরতে কাজে লাগবে।

এটা কাস্টমস্-এর কাজ নয়। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে ধান ভাঙে। আসলে কাজটা কস্তুরীর ছেলেমানুষি আবেগে নিজের শখের ডুবুরি ট্রেনিং নেওয়ার কথা ফাঁস করে দেওয়ার ফলশ্রুতি। নাও এখন মরণ গহ্বরে ডুবে মানুষ উদ্ধার করো। এক সময় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে চায়নি কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরের গর্তের মুখোমুখি।

ঘটনাচক্রে শ্রমিক ছেলেমেয়ে ও বয়স্করাও জলের শব্দ পেয়ে ১৬০ ফুট গভীরে একটা চাতালে উঠে এসেছে। ওখানকার ছাত বা সিলিং-এ একটা সিসি টিভি ক্যামেরা আছে। ভাগ্যক্রমে তার লাইনে এখনও গোলযোগ হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে। বস্তুত এর গভীরে নামা নিয়মও নয়। একজন মাত্র নিখোঁজ। ওই একজন কে, ওপরে কেউ জানে না, নীচ থেকেও স্পষ্ট খবর আসছে না। সম্ভবত কোনও মহিলা। কিন্তু মানুষজনের হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চাশের মধ্যে একটি প্রাণ যেন কিছুই না।

চাতালের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু পর্বতগাত্রের সঙ্গে ত্যারছাভাবে একটা সুড়ঙ্গ সাবধানে খোঁড়া হচ্ছে সমান্তরাল উদ্ধারকার‌্যের জন্য, ঠিক যেমন রানিগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে করা হয়েছিল। সেবারেও ছয় সাতজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাটির গভীরে অন্ধকারে জলের তলায় তারা জলে ইঁদুর চোবা হয়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে ওইসব অঞ্চলে ওপেন কাস্ট খনির সংখ্যা বাড়ানো হলেও চোরা খাদানকে আটকানো যায়নি। আটকানো যাচ্ছে না ধস, অগ্নুৎপাতকেও।

বৃষ্টি শুরু হল। সর্বনাশ! বৃষ্টি পড়লেই বিপত্তি। তখন আর কোনও আশা থাকবে বা। বড়ো বড়ো ত্রিপলে খনিমুখ ঢাকার ব্যবস্থা হল। আধা সেনাবাহিনীর ট্রুপ এখনও এসে পৌঁছোয়নি। তবে শোনা মাত্র স্থানীয় মানুষরা কয়েকটা ত্রিপল ও প্লাস্টিক জোগাড় করেছে। কারণ তাদেরই আপনজনেরা কেউ কেউ যে নীচে আটকে আছে।

প্রথমেই জলে ডুবতে হয়নি, কৃত্রিম সুড়ঙ্গ পথে উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে ত্রিশজন চেন বাঁধা ডুলিতে চেপে উঠে এসেছে। এবার শ্রমিকদের আশ্রয় নেওয়া শুকনো চাতাল পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। শুকনো বললেও ভেতরটা অসম্ভব গুমোট ও ভ্যাপসা। ওই একজন তরুণী ছাড়া মনে হচ্ছে সবাইকে তোলা যাবে।

একজনের পা ফেঁসে গেছে পাথরের বা কয়লার খাঁজে। জল উঠে এসেছে তার বুক পর্যন্ত। নিজের পা-টা ছাড়ানোর জন্য যত টানাটানি করে তত যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যায়, কিন্তু পা যে আরও ফেঁসে যায়।

কস্তুরী বলল, ওর পা কেটে বার করে আনা হোক। পা যাবে কিন্তু প্রাণটা বাঁচবে।

মাথা খারাপ? জলের মধ্যে পা কাটলে ব্লিডিং বন্ধ করা যাবে? ও দমবন্ধ হয়ে না মরলেও রক্তপাতেই শেষ হয়ে যাবে…

ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ার পড়তে পড়তে ছেড়ে এসেছি। স্কুলে এনসিসি করেছি। সবরকম স্মল আর্মস চালাতে পারি। এ ছাড়া উপায় নেই। কোনও সার্জেন থাকলে প্লিজ় দেখুন। তেমন কেউ দাযিত্ব নিলে আমি নামব না।

বাধা ব্যাগড়া দেওয়ার জন্য যত লোক তৎপর হয়, আসল কাজে তার এক শতাংশকেও দেখা যায় না। কেউ রাজি নয় দেখে কস্তুরী নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নাকে নল গুঁজে বলল, আমি যাব। যদি ওর পা কাটতে হয়, আইনত কোলিয়ারি তার দাযিত্ব নেবে। কিন্তু যদি মারা যায়, আমি সব দায় মাথায় করে নেব। শাস্তি ভোগ করতে রাজি। দেখুন জল ওর গলা, টাচ করেছে। আর সময় নেই। আর এক ফুট জল উঠলেই সিসি টিভি অকেজো হয়ে যাবে। এখনও হয়নি সেটাই পরম বিস্ময়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করা যাবে না।…

কাউকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে মাথায় টর্চ হেডলাইট নিয়ে আর হাতে ধারালো চপার নিয়ে কস্তুরী নেমে পড়ল গহ্বরে। সবাই হতবাক। তারপর মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই তুমুল হইহল্লা শুরু হল। যদিও উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে নাকি মেয়েদের সম্মান আছে। পরিবার প্রধান হয়, পদবি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদেই প্রায় পুরুষ। আর বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে মন্তব্য ভেসে এল মেয়ে মানুষের বেশি বাড়। ট্রেনিং পিরিয়ডে এত সাহস পায় কী করে? কাস্টমস অফিসাররা কি হাতে চুড়ি পরে আছে? আর্মি তো আসছেই। আটচল্লিশজনকে উদ্ধার করা গেছে, একজন নিখোঁজ, আরেকজন মরলে কী ক্ষতি ছিল?… ইত্যাদি।

আধ ঘণ্টা পরে মাইন শ্যাফট এলিভেটরে টান পড়ায় টেনে তোলা হল। ডুবুরির সরঞ্জাম না থাকলে কস্তুরীকে চেনা যেত না। সারা গায়ে কয়লা ও কাদার আস্তরণ। ও ডুলিতে চেপে ধরে আছে এক তরুণকে। তার গায়ে জল কাদা কালি। তার মধ্যেও রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কাটা পায়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে। সেখানে তার নিজের শার্টখানাই বাঁধা রক্তক্ষরণ যতটুকু কম করা যায়।

তবে আরও আশ্চর্য, কস্তুরীর দু পায়ের মাঝখানে কিছু একটা কাদাকালি মাখা জিনিস ধরা। সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে ও চ্যাঁচাল, সেই কাটা পাটা নিয়ে এসেছি। শিগগির হাসপাতালে ভর্তি করলে ছেলেটাকে আর তার পা, দুটোই বাঁচানো যাবে। কুইক।

দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সিংগ্রাম নামের ছেলেটার প্রাণ বাঁচলেও তার থ্যাঁতলানো এলোমেলো করে কাটা পাখানা জোড়া লাগানো যায়নি। তবু কস্তুরী তার ও তার পরিবারের কাছে সাক্ষাৎ দেবী।

হাসপাতালে শুয়ে কস্তুরী খবর পেল, খনি মালিককে পুলিশ ধরেছে। তিনি আপাতত পুলিশ হেফাজতে হাজতে। সেটাও ওদের কাস্টমস দলের দলবদ্ধ সাফল্য। মনটা হালকা হয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে একজনের মোবাইল চেয়ে বাড়িতে ফোন করল কস্তুরী, মা, খুশি বলছি। কেমন আছো?

আর কেমন আছো? যেখানে গেছিস সব সময় চিন্তায় থাকি। তুই কেমন আছিস?

ভালো। ইয়ে মা… একটু খোঁজ নিতে পারবে, মেডিকেলটা আবার শুরু করা যায় কিনা? জানি জেনারেল ক্যান্ডিডেটের সিট ফাঁকা থাকে না, তবু যদি আমার স্কোর কনসিডার করে…। ডিপার্টমেন্ট যদি পারমিশন দেয়, তাহলে ভাবছি মা, এমবিবিএস-টা কমপ্লিট করে সার্জারিতে মাস্টার্স করব। দেখলাম চোর ডাকাত ধরার চাইতেও কারও প্রাণ বাঁচাতে পারাটা আরও বেশি স্যাটিসফ্যাকশন দেয়।

 

 

পরিতোষের সিদ্ধান্ত শেষ পর্ব

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা করো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বললো, ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে একজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দুচোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

দার্জিলিং

দুপুর একটা পঞ্চান্নর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চেপে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে দার্জিলিং। এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ট্রেনটা ওরা মিস করল।

তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুবিমল। ঘুম ভেঙেছিল মোবাইলের রিংটোনে। ফোন ধরতেই মায়ার গলা, কোথায় আছেন? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি, ফোন ধরছেন না কেন?

এই আসছি, ট্রেন তো এখনি ঢুকবে!

ব্যাগ গোছানোই ছিল। তাড়াহুড়ো করে দরজায় তালা দিয়ে বেরোয় সুবিমল। টোটো ধরে স্টেশন। মায়া তার মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কোনওমতে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ওরা দেখে ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। একা থাকলে লাফিয়ে উঠে পড়ত সুবিমল। কিন্তু মায়া আর দিয়াকে নিয়ে তো সেটা সম্ভব নয়।

এবার কী হবে? মায়ার গলা কাঁদো কাঁদো শোনায়।

এনকোয়ারিতে গিয়ে ওরা জানল চারটের আগে আর শিলিগুড়ির দিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই। তার মানে আরও দুঘন্টা স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সুবিমল বলল, চলো ফিরেই যাই। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। বলে, আমায় নিয়ে আপনি দার্জিলিং যেতে চান না তাই তো?

এরকম ভাবছ কেন? আসলে ট্রেন পেতে দেরি হলে শিলিগুড়ি যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আর তখন হোটেল-টোটেল পাব কিনা…

হোটেল না পেলে স্টেশনে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেব। কিন্তু বেরিয়েছি যখন যাবই! সুবিমলকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল মায়া, দার্জিলিং নিয়ে কত কথা বললেন। কম্পিউটারে ছবি দেখালেন। আর এখন যেতে চাইছেন না?

দার্জিলিং-এর কথাটা বলতেই মায়ার মুখটা কেমন নরম হয়ে গেল আর চোখদুটো চকচক করে ওঠে, একটা কষ্ট অনুভব করল সুবিমল। বেচারি! কখনও দূরে কোথাও যায়নি। কিছু দেখেনি। পাহাড়, সমুদ্র কিছু না। কেউ নিয়ে যাবার নেই!

আচ্ছা মা, দার্জিলিং-এ তো এখন খুব ঠান্ডা তাই না? পাশ থেকে দিয়া বলে।

সেটা তোর কাকুকেই জিজ্ঞেস কর না।

আঃ তুমিই বলো না। ওখানে কি এখন বরফ পড়ছে? কী মজা!

মেলা বকিস না তো। এখন যাওয়া হবে কিনা তারই ঠিক নেই, আর ইনি চোখে বরফ দেখছেন।

বকুনি খেয়ে একটু চুপ করে যায় মেয়েটা। একটু পরেই আবার বলে, আমি কিন্তু দার্জিলিং গিয়ে টয়ট্রেনে চড়ব।

হ্যাঁ, তুমি টয়ট্রেন চাপবে! কত টাকা টিকিট লাগবে জানিস? তুই দিবি?

টয়ট্রেনের ছবি দেখিয়েছিল সুবিমল কিন্তু তার টিকিট-ফেয়ার নিয়ে কিছু বলেনি। সে নিজেও ঠিক জানে না। তবে মায়া হয়তো ধরেই নিয়েছে, এত সুন্দর দেখতে একটা ট্রেনে উঠতে অনেক টাকা লেগে যাবে। এসব কথা হতে হতেই একটা ট্রেন চলে এল।

পুরি-কামাখ্যা এক্সপ্রেস।

মায়া তড়িঘড়ি বলল, দেখুন না, এই ট্রেনটা শিলিগুড়ি যাচ্ছে কিনা?

এখন তো ওদিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই, শুনলে না?

আঃ দেখুনই না একবার।

কী মনে করে সুবিমল সিট ছেড়ে এগোয়। ট্রেনের জানলার ধারে বসে থাকা একজন প্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করে। লোকটা হিন্দিতে জবাব দেয়, শিলিগুড়ি যায়েগে কেয়া নহি জানতে, পর ইয়ে এনজিপি যায়েগা।

এনজেপি মানে নিউ জলপাইগুড়ি। শিলিগুড়ির আগের স্টেশন। ওখান থেকেও তো দার্জিলিং যাওয়া যায়! মায়া ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুবিমল ব্যস্ত হয়ে বলে, চলো চলো এটা যাবে। মালপত্র নিয়ে ছুটতে ছুটতে ওরা সামনের কামরাটাতে উঠে পড়তেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

এনকোয়ারির লোকটা এই ট্রেনটার কথা বললই না। ভাবো এরা কি জন্যে যে চাকরি করে, সুবিমল সিটে বসতে বসতেই বলে।

দেখলেন তো, আমার কথা শুনলেন বলেই… মায়ার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটেছে। জানলার পাশে দিয়াকে বসিয়ে সে নিজেও বসেছে। কামরা একদম ফাঁকা। রিজার্ভেশন হয়নি বলে আসতে চাইছিলেন না। এখন দেখুন শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে। আমার বেড়াবার ভাগ্য কী ভালো।

সুবিমল ঘর থেকে তিনটে বড়ো বড়ো ক্ষীরসাপাতি আম আর লিচু নিয়ে এসেছে। বার করল সেগুলো। ট্রেনে উঠলেই তার খিদে পায়, কেন কে জানে!

নাও আমগুলো কাটো। লিচু খাও।

আম কেটে, টিফিনবাটির ঢাকনায় তুলে প্রথমেই সুবিমলের দিকে এগিয়ে দেয় মায়া। তারপর মেয়েকে দিয়ে নিজেও নেয়। সিটের ওপর পা তুলে গুছিয়ে বসে, আম খায়।

আঃ পাটা নামিয়ে বসো না, সুবিমল বলে।

কেন, কী হয়েছে?

সুবিমল আর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। কেন যে আসতে গেল এদের সাথে। নোংরা পা দুটো একেবারে সিটের ওপর তুলে বসল। যেন ঘরের বিছানা! কম শিক্ষিত হলে যা হয়। এই যে, আবার পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলা হচ্ছে জানলা দিয়ে। এত থুতু আসে কী করে মুখে ও বুঝে পায় না!  দিয়ার ওপর চোখ পড়তেই মাথা আবার গরম হয় সুবিমলের। কালো মুখে রং মেখেছে!

দার্জিলিং-এর ছবিগুলো আবার দেখান না, আবদারের সুরে বলে মায়া।

সুবিমল বিরস মুখে ব্যাগ খুলে তার ল্যাপটপটা বার করে, সুউচ অন করে। মোডেম লাগায়। ইউ টিউব চালায়।

ওই তো টয়ট্রেন, লাফিয়ে ওঠে দিয়া।

চিৎকার করছিস কেন? মেয়ের দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া। দিয়ার মুখ শুকনো হয়ে যায়।

টয়ট্রেন ততক্ষণে ঘুম স্টেশনে এসে থেমেছে। কুয়াশায় আবছা দেখা যাচ্ছে। এবার দার্জিলিং-এর বাজার দেখাচ্ছে নেপালি মেয়েটা, রংবেরং-এর উলের পোশাক বিক্রি করছে। দোকানে দোকানে কত জিনিস সাজানো, নীল সবুজ পাথরের মূর্তি। বাজার ছেড়ে পথ ওপরে উঠছে। এবার ম্যালে এসে থামল।

কী চমৎকার জায়গাটা। এটাই তো বলেছিলেন মল। তাই না?

মল নয়, ম্যাল সুবিমল হাসে।

ওঃ ম্যাল। লজ্জা পেয়ে মাথা ঝাঁকায় মায়া। তারপর বলে, আপনি বলেছিলেন না, ম্যালে গেলে কোনও না কোনও পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়ে যাবেই।

হ্যাঁ, লোকে তো সেরকমই বলে, একটু অন্যমনস্ক হয় সুবিমল। আমি যখন খুব ছোটোবেলায় মা বাবার সাথে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, ম্যালে গিয়ে মনে আছে একজন দূর সম্পর্কের রিলেটিভ মানে আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেছিল। পরে আর কখনও ওনাকে দেখিনি। এখনও মনে আছে, উনি আমাকে গাল টিপে আদর করেছিলেন, ঘোড়ায় চড়িয়েছিলেন।

আমিও ম্যালে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ব।

সুবিমলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। বিরক্ত হয়ে সে দিয়ার দিকে তাকায়।

আঃ কতবার তোকে বলেছি, কথার মাঝখানে কথা বলবি না। দেব কানপাট্টিতে এক থাপ্পড়। তারপর বলুন না কী হয়েছিল?

সুবিমলের মনে তখন অন্য একটা চিন্তা জন্ম নিয়েছে। ম্যালে গিয়ে যদি… ম্যালে তো যেতেই হবে। গিয়ে যদি আবার কোনও আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় অথবা তারই স্কুলের কোনও কলিগের সাথে! তখন সে কী করবে। কী পরিচয় দেবে মায়ার আর মায়ার মেয়ে। কী বলবে সে?

কী হল, কী ভাবছেন?

কিছু না লিচুর খোসা ছাড়ায় সুবিমল।

এসব কথা বলতে বলতে ওরা যখন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছোল তখন রাত আটটা বাজে।

ট্রেন থেকে নেমেই দিয়া বলল, মা দেখেছ, কত্ত বড়ো স্টেশন! সঙ্গে বেশি টাকা আনেনি সুবিমল। স্টেশনের পাশে একটা ছোটো দেখে হোটেলেই ওঠে।

হোটেল মালিক টাকা নিয়ে খাতা খুলে সুবিমলকে সই করাল। তারপর বলল, আপনাদের আধার কার্ডটা দেখাবেন। মায়ার কার্ডটা দেখে বলল, আপনার পদবি তো দেখছি দাস আর ওনার ভট্টাচার্জি।

সুবিমল বুঝতে পারল না লোকটা কি বলতে চাইছে। কিন্তু মায়া একবার সুবিমলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, এটা বাবার নামে করেছিলাম তো। বিয়ে পর আর পালটানো হয়নি।

আপনারা সত্যিই ম্যারেড তো?

কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?

সুবিমল বলল, রেজিস্ট্রি পেপার দেখাতে হবে?

না, না, ঠিক আছে। আচ্ছা আপনারা ঘরে যান।

ঘরে গিয়ে ওরা আর বসল না। মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল যত সকাল সকাল বেরোনো যায় ততই ভালো।

ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছেই অনেকগুলো খাবার হোটেল। তারই একটায় ঢুকে ওরা বসে। সুবিমল মাছ ভাত বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়া বলল ডিম ভাত নিতে। খরচ যেটুকু বাঁচানো যায়।

রাতে বিছানায় শুয়ে ওদের চোখে ঘুম আসে না। মায়া আর সুবিমলের মাঝে দিয়া শুয়েছে। সে বলে, মা ঘুম পাচ্ছে না। একটা গল্প বলো না। ওই দুষ্টু শেয়ালের গল্পটা।

হ্যাঁ, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তোকে এখন গল্প বলব। চুপ করে ঘুমো। ভোর ভোর উঠতে হবে।

না, বলো না একটা।

মায়া কী ভেবে বলে, তোর কাকুকে বল। কাকু অনেক ভালো ভালো গল্প জানে।

অন্ধকারের মধ্যেই সুবিমলকে উদ্দ্যেশ্যে করে সে বলে, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে? নাহলে ওকে একটা গল্প বলুন না। আমিও শুনব।

সুবিমল ভাবছিল, দিয়া এখন সঙ্গে না থাকলে কত ভালো হতো। মায়াকে এখন সে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারত। বদমাইস মেয়েটা একেবারে তাদের মাঝখানে এসে শুয়েছে। মায়া বলেছিল একপাশে শুতে। কিন্তু শুনলে তো! তবে এটাও মনে হয়েছে ওর, দিয়া সঙ্গে না থাকলে হয়তো হোটেলে ঘর পেতে অসুবিধে হতো। ও আছে বলেই সবাই ওদের একটা পরিবার বলে ধরে নিচ্ছে। স্বামী, স্ত্রী ও তাদের মেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। মনটা হঠাৎই জ্বালা করে ওঠে সুবিমলের। পরিবার! সত্যিই কি কোনও দিন তার নিজস্ব পরিবার হবে? তার নিজের সন্তান, তার নিজের বউ। চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল। আর কবে সে বিয়ে করবে?

বলবেন একটা গল্প, বলুন না। মায়ার গলায় আবদারের সুর।

মায়ার সাথে প্রথম পরিচয়টা একটু অদ্ভুত ভাবেই হয়েছিল। বাউল মেলা দেখতে গিয়েছিল সুবিমল। দিয়াকে একটা এগরোলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দ্যাখে। ভিড়ের মধ্যে ওর হাত ছুটে নাকি ওর মা হারিয়ে গেছে। সুবিমলই শেষপর্যন্ত দিয়ার হাত ধরে মায়াকে খুঁজে বার করে। সেদিন মনে আছে একটা চুমকি বসানো জংলা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিল মায়া। বেশ লাগছিল। বিশেষ করে ওর ফিগারটা। এক মেয়ের মা বলে ওকে বোঝাই যায় না! মেলাতেই ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। তারপর কীভাবে যে ওরা দুজন কাছে চলে এল। স্বামী নেই বলে মায়ার দিক থেকেও নিশ্চয়ই একটা শারীরিক চাহিদা ছিল!

ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

হঠাৎ করেই মায়ার কথা ভেবে মনটা কেমন নরম হয়ে যায় সুবিমলের। বেচারি। বিয়ে হতে না হতেই বর মারা গেছে। শুধু একটা ছোটো দোকান রেখে গেছে, পান-বিড়ি-সিগারেটের, আর এই মেয়েটা। ওকে বোনের বাড়ি রেখে বেড়াতে আসবার কথা মায়া বলেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত পারেনি। মায়ের মন। বলল, আমি ঘুরব আর ও পাহাড় দেখবে না?

সুবিমল পাশ ফিরে বলে, আচ্ছা শোনো। এই দিয়া শোন, একটা গল্প বলছি। হ্যাপি প্রিন্স ও সোয়ালো পাখির গল্প। এক দেশে এক রাজার ছেলে ছিল। দুঃখ কাকে বলে সে জানত না, তারপর একদিন সে মারা গেল।

এত তাড়াতাড়ি মারা গেল?

কথা বলছিস কেন? ধমকে ওঠে মায়া চুপ করে শোন।

সুবিমল বলতে থাকে, দিয়া চুপ করে শুনছে। কতটা বুঝছে বলা মুশকিল কিন্তু সুবিমল যখন যখন বলল সোয়ালো, সোয়ালো, ও লিটল সোয়ালো। দিয়াও সুর করে বলল, সোয়ালো সোয়ালো ও লিটল সোয়ালো…

গল্প শেষ হলে মায়া বলল, ওরা দুজন দুজনকে কত ভালোবেসেছিল। সত্যিই কি কেউ কাউকে এত ভালোবাসতে পারে? তারপর তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ার ডাকাডাকিতেই ঘুম ভাঙল সুবিমলের।

আর কত ঘুমোবেন?

উঠে বসে সুবিমল। এঃ, পৌনে ছটা বাজে। রোদ উঠে গেলে তো পাহাড়ে ওঠার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি বাথরুমে যায় সুবিমল। হাত মুখ ধুয়ে বেরোয়। দিয়াও এইমাত্র উঠল। ঘুমচোখে বিছানার ওপর বসে আছে। মায়া ওকে টেনে হিঁচড়ে নামায়।

শিলিগুড়ি সদর মোড়ে এসে ওরা ট্রেকার থেকে নামে। একটু দূরেই দুটো বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। একটা গাড়ির চালক হাঁক দিচ্ছে দার্জিলিং দার্জিলিং। মায়া সুবিমলের হাত চেপে ধরে, একটু তাড়াতাড়ি চলুন, গাড়িটা বোধহয় ছেড়ে দেবে এক্ষুনি কিন্তু সুবিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কী হল চলুন,

সুবিমল এবার এগোয়। গাড়ির চালককে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। কালিম্পং যাবার কোনও গাড়ি নেই?

এই তো পাশের গাড়িটাই যাবে, যান উঠে পড়ুন। মায়া অবাক হয়ে সুবিমলের দিকে তাকায়।

কী হল? আমরা তো দার্জিলিং যাব।

না মায়া। একটু ইতস্তত করে সুবিমল বলে, সাত হাজার টাকায় দার্জিলিং ঘোরা যাবে না। ওখানে হোটেল ভাড়াই অনেক হবে।

কেন, আমার কাছেও তো কিছু টাকা আছে, এতে হবে না?

না, তোমার টাকায় আমি হাত দেব না। কালিম্পং কাছে। খরচ কম পড়বে। চলো ওখানেই ঘুরে আসি। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

দার্জিলিং যাব বলে এলাম আর এখন বলছেন…

না মায়া, দার্জিলিং-এ খুব ঠান্ডা পড়ে। তুমি তো জানো আমার বেশি ঠান্ডা সহ্য হয় না।

কেন, গরম কাপড় তো সঙ্গে এনেছেন। এতে হবে না?

না।

ঠোঁট কামড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। ওর জন্য কষ্ট হয় সুবিমলের। বেচারি কত আশা করে এসেছিল!

গাড়ি সমতল ছেড়ে সেবকের কাছে এসে পাহাড়ে ওঠার পথ ধরতেই মায়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দিয়া জানলার পাশে বসেছে। বাইরে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, মা দ্যাখো নদী কত নীচে। মায়া জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। সুবিমলকে ডেকে বলে, দেখুন পাহাড়ি নদী।

কী নাম নদীটার? জলটা কেমন সবুজ। দেখবে কী করে সুবিমল। সে বসেছে মাঝখানে।

বাঃ, বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে সে, আর সে-ই কিছু দেখতে পাবে না! একটু রাগ রাগ মুখ করেই বসে থাকে সুবিমল। থাক, ওরাই দেখুক। একটু পরে অবশ্য সে নিজেও সরে এসে মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকায়। আর কী আনন্দই যে হয়। দিয়ার মতো বয়সে সে এই পথ দিয়ে গিয়েছিল। এই সুবিস্তীর্ণ পাহাড়, পাহাড়ের খাদ থেকে উঠে আসা এই লম্বা লম্বা গাছ, আর গাছের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা ওই রূপসি রঙ্গীত এরা কি তাকে চিনতে পারছে! দার্জিলিং যাওয়া হল না!

কাকু তোমার কাছে স্মার্ট ফোন নেই? তাহলে ছবি তুলব, দিয়া বলে।

মাথা নেড়ে না বলে সুবিমল। অন্য যাত্রীরা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও করছে। দিয়া মায়ের কাছ থেকে ছোট্ট কমদামি মোবাইলটা নিয়ে তাতেই ছবি তুলতে থাকে। দেড় ঘন্টা বাদেই ওরা মেঘের রাজ্যে পৌঁছে যায়। পাহাড়ের বুকে শুয়ে থাকা মেঘগুলো সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে।

কী সুন্দর! মায়া অস্ফুটে বলে, এরকম জিনিস দেখতে পাব কখনও ভাবিইনি।

মেঘ দেখা ভুলে গিয়ে সুবিমল চেয়ে থাকে মায়ার ঝলমলে খুশিভরা মুখের দিকে।

 

কালিম্পং গাড়ি স্ট্যান্ডে এসে নামার পর মায়া অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। পাহাড়ের এত ওপরে এত বড়ো সুন্দর শহর! ওরা প্রথমেই একটা দোকানে ঢুকে লুচি মিষ্টি খেয়ে নেয়। তারপর হোটেল খুঁজতে বার হয়। বেশি খুঁজতে হয় না। স্ট্যান্ডের পাশেই প্রচুর হোটেল। শেষপর্যন্ত হোটেল প্যারাডাইস বলে একটা দোতলা ঝকঝকে সুন্দর হোটেলে ওরা সাহস করে ঢোকে। আর এমনই ভাগ্য, মাত্র হাজার টাকায় একটা বড়ো ঘর পেয়ে যায়। ঘরে দুটো সিংগল বেড, টিভি সেট আছে, বড়ো আয়না আছে, জানলায় শৌখিন পর্দা ঝুলছে, টাইলস বসানো বাথরুমের সাইজটাই শিলিগুড়ির হোটেল ঘরটার থেকে বড়ো।

ওরা আরও অবাক হল যখন হোটেল ম্যানেজার ওদের কাছে আধার কার্ড দেখতে চাইল না, এমনকী আগাম ভাড়াও চাইল না। শুধু খাতায় নাম তুলে নিল। তারপর বলল, যান, মালপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে নিন। সাইট সিযিং করবেন তো? আমার চেনা ভালো ড্রাইভার আছে। বারোশো টাকা নেবে, সেভেন পয়েন্টস ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।

সেভেন পয়েন্টসটা কী? প্রশ্ন করে সুবিমল।

কালিম্পং-এ মেইন দেখার জায়গা সাতটা। নতুন আসছেন বুঝি?

হ্যাঁ।

মায়া বলল, আমরা স্নান খাওয়া সেরেই বেরোব। আপনি ড্রাইভারকে বলে দিন।

ঠিক বারোটা বাজতেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হোটেলের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা তখন সবে ভাত খেয়ে হোটেলে ঢুকছে। তড়িঘড়ি ওপরে উঠে ওরা ড্রেস চেঞ্জ করে। মায়া বলে, দেখুন না কোন শাড়িটা পরব?

শাড়ি কেন, যে-সবুজ সালোয়ারটা এনেছ ওটা পরো।

ওটা পরব? একটু ছোটো হয় আমার। গায়ে চেপে বসে।

পরোই না।

সালোয়ার গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মায়া। পেছন থেকে সুবিমল বলে, তোমায় দেখতে সেই হট লাগছে।

যাঃ, মায়ার মুখে লজ্জা। তারপরেই জিভ কেটে বলে, ওড়নাটাই আনতে ভুলে গেছি। ওড়না না পরে বেরোব?

ভালোই হল, সুবিমল হাসে। বলে আরও বেশি সেক্সি লাগবে।

মা, সেক্সি মানে কি? দিয়া বলে।

গাড়ির ড্রাইভারের চেহারা একেবারে সিনেমার হিরোর মতো। লম্বা, ফরসা, ধারালো চোখ মুখ। ওরা আসতেই গাড়ির দরজা খুলে দেয়।

ডেলো আর দুরপিন, এই দুটো উঁচু পাহাড়ের মাঝে কালিম্পং। ড্রাইভারটা প্রথম ওদের ডেলো পিকে নিয়ে যায়। পিকের ওপরে একটা খুব বড়ো হনুমানজির মূর্তি। পাশে ফুলের বাগান। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে দিয়া, হনুমানজির পায়ে কাছে রেলিং ঘেরা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। চেঁচিয়ে বলে, মা দ্যাখো মেঘ। সত্যিই, একেবারে হাতের কাছ দিয়ে শরীরের ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে।

সুবিমল মায়াকে বলে, দ্যাখো এই মেঘগুলো যেন আমাদের স্বপ্নের মতো তাই না? মনে হচ্ছে ধরা যায় কিন্তু হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

মায়া হেসে বলে, আপনার আবার কী স্বপ্ন আছে? দার্জিলিং, মনে মনে বলে সুবিমল। একদিন আমি দার্জিলিং যাব।

সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামছে, পাশেই দুহাত উঁচুতে পাথরের খাঁজে খাঁজে অদ্ভুত সুন্দর এক ধরনের জংলি ফুল ফুটে আছে দেখতে পায় সুবিমল। জুতো খুলে রেখে, ওপরে ওঠবার চেষ্টা করে। একবার পা পিছলে পড়ে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ফুলগুলোর কাছে হাত পৌঁছোয়। কয়েটা তুলে এনে দিয়াকে দেয় আর একটা মায়ার চুলে গুঁজে দেয়। মায়া সলজ্জ মুখে হাসে, কী যে ছেলেমানুষি করেন, পায়ে লাগল তো?

ডেলো পার্কটাও চমৎকার জায়গা। সেখানে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ার বায়না ধরে দিয়া। কিন্তু দশ মিনিট ঘোরাতে দুশো টাকা নেবে শুনেই না করে দেয় মায়া। এরপর মর্গান হাউস, নেচার মিউজিয়াম ইত্যাদি আরও কয়েটা ভালো ভালো জায়গা দেখে সন্ধের সময় ওরা হোটেলে ফেরে।

বিছানায় বসে মায়া বলে, ড্রাইভারটা কী ভালো বলুন। আমরা যেখান থেকেই ঘুরে বেরোচ্ছি, একেবারে সামনে গাড়ি নিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াচ্ছে, একটুও হাঁটতে হয়নি। অন্যদের গাড়িগুলো কিন্তু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। কত সামান্য জিনিসও মেয়েদের চোখে পড়ে, ভাবে সুবিমল।

একটু তাড়াতাড়িই বাইরে বেরিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা। ফেরার পথে ওপরে তাকায় সুবিমল। এই আকাশ সমতলে দেখা যাবে না। তারাগুলো কী ঝকঝক করছে, যেন কাছে নেমে এসেছে। তারপরেই দূরের পাহাড়ে চোখ পড়তে চমকে ওঠে সুবিমল। মায়ারাও দেখেছে। প্রথমটা বুঝতে পারেনি ওরা। যেন হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলছে! তারপর ভালো করে দেখে বুঝল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সারি সারি বসতবাড়ি। তার আলো।

দুটো সিংগল বেড পাশাপাশি এনে ওরা শুতে যায়। দিয়া সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়াও। সুবিমল জেগে থাকে। আর একটু রাত হলে মায়া এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কখন ঘুম ভাঙল ওর!

মায়া ফিসফিসিয়ে বলে, চলুন, আপনার খাটটা ওই পাশে সরিয়ে নিই।

এর আগেও তো কতবার ওরা মিলিত হয়েছে। কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা। মাটি থেকে চার হাজার ফিটের ওপরে, মেঘের রাজ্যে। অনেকটা সময় পার করতে করতে এই ঠান্ডা রাতেও তারা ঘেমে গেল। তারপর, সেই ভিজে ভিজে সুখ মেখেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল। একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙে ওদের।

দিয়া উঠেই বলে, কাকুর খাটটা ওখানে কেন? সুবিমল মায়ার দিকে তাকায়।

মায়া মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, রাতে তোর কাকুর একা শুতে ইচ্ছে হল, তাই খাটটা সরিয়ে নিল।

সত্যি কাকু? দিয়া সুবিমলকে দ্যাখে।

মুখ-টুখ ধোওয়া হলে সুবিমল বলে, বেল টিপে ম্যানেজারকে ডাকব? চা দিতে বলি আর সঙ্গে কিছু খাবার।

ডাকবেন? ঘরে এসে দিলে হয়তো বেশি দাম চাইবে।

তা হোক।

চা, লুচি-তরকারি এল। সবাইকে ভাগ করে দিয়ে খেতে খেতে মায়া বলল, এটা আমার মনে থাকবে। একেবারে হাতের কাছে এসে দিয়ে গেল, হোটেলের বিছানায় বসে খাচ্ছি।

কালিম্পং দেখা শেষ। এবার ফেরার পালা। নীচে এসে হোটেলের খাতায় সই করার সময় ম্যানেজার বলল, ফিরে যাচ্ছেন? এখানে এলেন যখন লাভা ঘুরে যান। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। খুব শান্ত। একটা গুম্ফা আছে, ভালো লাগবে আপনাদের। লাভার নাম আগে শুনেছে সুবিমল। কিন্তু জায়গাটা ঠিক কীরকম সে জানত না।

বাইরে বেরোতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। ভিজতে ভিজতেই ওরা গাড়ি স্ট্যান্ডে এল। ওযেদার খারাপ, শিলিগুড়ি ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষে লাভায় যাবার গাড়িই ধরল সুবিমল। মায়া আর দিয়া খুব খুশি। গাড়ি যখন ছাড়ল তখনও বৃষ্টি পড়ছে। ড্রাইভার যদিও বলল, পাহাড়ের এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। আর হলও তাই। মিনিট কুড়ি পরেই আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ।

যেতে যেতে কম্পিউটার বার করল সুবিমল। লাভা সম্বন্ধে একটু জেনে নিলে ভালো হয়। আর যা জানল তাতে সে অবাকই হল। লাভার উচ্চতা সাত হাজার ফিটের বেশি। দার্জিলিং-এর চেয়ে কয়েকশো ফিট ওপরে। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিমল, মায়া, আমরা দার্জিলিং-এর চেয়ে বেশি উঁচুতে উঠছি।

আধঘন্টা পর থেকেই ওদের ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। আর এই প্রথম ওদের ব্যাগ থেকে গরম পোশাক বার করতে হল। সোয়েটার পরেও সুবিমল কাঁপছে। মায়া ওর হাতে নিজের শালটা দিয়ে বলল, কানে জড়িয়ে নিন। আপনার তো আবার ঠান্ডা সহ্য হয় না।

একদম সরু পথ দিয়ে গাড়ি ওপরে উঠছে। ভাঙাচোরা রাস্তা। বেশি টুরিস্ট বোধহয় এদিকে আসে না। ডানপাশে খাদের তলা থেকে অতিকায় লম্বা লম্বা গাছ আকাশে উঠে গেছে। কুয়াশায় ভিজে ভিজে তাদের গুঁড়ির রং কালো। তাদের গা থেকে মোটা মোটা দড়ির মতো সবুজ শ্যাওলা ঝুলছে। কি সুবিপুল গাম্ভীর্যে পূর্ণ চারিদিক। একটা অদ্ভুত অনুভতি হল সুবিমলের। এই অমর্তলোকে ওরা যেন অনধিকার প্রবেশকারী!

লাভা পৌঁছোতে দুঘন্টার বেশি লাগল। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই একটা সরু পথ নীচে নেমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানল, গুম্ফা দেখতে এই রাস্তাটা ধরেই যেতে হবে। খাড়াই পথটা ধরে ভারি ব্যাগ হাতে নিয়ে তরতরিয়ে নামতে থাকে মায়া। সুবিমল পিছিয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে, একটু আস্তে হাঁটো না। মায়ার হাসি শোনা যায়, আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন।

বহুদূর থেকেই গুম্ফাটা দেখা যায়। রাস্তার দুপাশে ছোটো বড়ো দোকান। সবজির বাজার। লোকজন কম। গাড়ি চলছে না। দুএকজন সাইকেল চেপে যাচ্ছে। পথ ঘেঁষে রঙিন কাঠের বাড়ি। বড়ো বড়ো কিছু হোটেলও অবশ্য দেখা যাচ্ছে।

দূর থেকে যা মনে হয়েছিল গুম্ফাটা তার থেকেও অনেক বড়ো। কালিম্পং-এও গুম্ফা দেখেছে ওরা। কিন্তু সেগুলো আয়তনে এর অর্ধেকও হবে না। পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে প্রায় আধ কিলোমিটার লম্বা পাঁচিল চলে গেছে। তার ওপরে সারি সারি রঙিন নিশান উড়ছে। ভেতরে ঢুকে ওরা একটুক্ষণ পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ায়। নীচেই কুয়াশা ঢাকা গভীর খাদ। দিয়া হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে যায়। আশপাশে কেউ নেই।

সুবিমল বলে, এখান থেকে লাফ দিতে পারবে মায়া? মায়া ভুরু কুঁচকে তাকায়।

যত অদ্ভুত কথা আপনার।

না বলছি, ওই কুয়াশার মধ্যে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না?

বাজে কথা রাখুন, চলুন দিয়া কোথায় গেল দেখি।

একটা বাঙালি পরিবারের সাথে দেখা হয়। স্বামি-স্ত্রী আর তাদের মেয়ে। বউটি ফরসা ও সুন্দরী। মেয়ে কিন্তু দিয়ার মতোই কালো তবে খুব স্মার্ট। কনভেন্ট স্কুলে পড়ে। ওরাও কালিম্পং ঘুরে এসেছে শুনে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করেন, ডেলো পার্ক তো গিয়েছিলেন, ওখানে প্যারাগ্লাইডিং করেছিলেন?

প্যারাগ্লাইডিং, কাঁধে নকল ডানা বেঁধে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া, ডেলোতে ছিল বটে। না ওটা হয়নি।

করেননি! সাচ্ আ প্লেজন্ট এক্সপেরিযে্নস। একেবারে কুয়াশার ভেতর দিয়ে উড়তে উড়তে এসে নীচে নামলাম। কিন্তু রেটটা একটু হাই। তিনজনের সাতহাজার টাকা পড়ে গেল।

সাত হাজার! একটা লাফের জন্য! তিনহাজার টাকায় ওদের কালিম্পং ঘোরা হয়ে গেল।

মহিলা ও তার মেয়ে সাথে গল্প করতে করতেই সুবিমল এগোয়। মায়ারা পিছিয়ে যায়। একবার মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে সুবিমল, বউটির হাজব্যান্ড মায়ার পাশে পাশে আসছে। এক ঘন্টার বেশি লাগল পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে। একটা জপযন্ত্র দেখল, দুমানুষ সমান উঁচু। তার চাকা ঘুরিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। ওরাও একটু ঘোরাল।

লাল জোব্বা পরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এদিক ওদিক ঘুরছে। নিজেদের ভাষায় কিসব কথা বলছে। প্রত্যেকেই খুব হাসিখুশি। এই বিশাল সুন্দর প্রকৃতির কোলে, ভগবান বুদ্ধের অর্চনায় এরা যেন সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। একজন সন্ন্যাসীকে দেখল, মেঝেতেই বসে বসে খাচ্ছে। সাধারণ ডাল ভাত একটা তরকারি তাতেই মুখে ওনার কি অপরূপ আনন্দের ছাপ।

কী পিসফুল জায়গাটা বলুন। ভদ্রমহিলা বল্লেন, মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে এখানেই থেকে যাই।

ভালোই হয় তাহলে! সুবিমল ভাবে। সেও এর সাথে থেকে যেতে রাজি আছে।

প্রার্থনা ঘরটা বিশাল। দেয়ালে কী সুন্দর রঙিন কারুকাজ। উঁচু আসনের ওপর নিমীলিতচোখ বোধিসত্ত্বের মূর্তির সামনে এসে একটু দাঁড়ায় সুবিমল। হাজার বছর বা তারও আগে, রাজার প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল যেই রাজার কুমার, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে বলে। সেই বিশাল-হৃদয় পুরুষের জন্য হঠাৎ করেই এক অপরিমেয় শ্রদ্ধায় সুবিমলের মন অভিভত হল, কেন যেন হ্যাপি প্রিন্সের গল্পটা মনে পড়ে গেল। চোখ বুজে মনে মনে উচ্চারণ করল সে, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি হে অমিতাভ, হে তথাগত বুদ্ধ আমার প্রণাম নাও।

প্রার্থনা ঘর থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আসুন আপনাদের নিয়ে একটা ছবি তুলি। তাঁর হাতে বড়ো লেন্সওয়ালা দামি ক্যামেরা। বললেন, আপনার কি কম্পিউটার আছে? তাহলে মেইল করে ছবি পাঠিয়ে দেব। মায়া খুব খুশি। লাভার একটা তো স্মৃতি থাকল। চলে যাবার সময়ে বউটা দিয়ার গাল টিপে একটা ক্যাডবেরি দিয়ে যায়।

ওরা যেতেই মায়া হাসতে হাসতে বলে, ভদ্রলোক আমার ফোন নম্বর চাইছিলেন।

দিলে?

না। দিলে বুঝি খুশি হতেন?

হতাম, সুবিমল হাসে।

ভদ্রলোক কিন্তু বুঝতে পেরেছেন আমরা বিবাহিত নই।

কী করে বুঝলেন?

ছবি তোলবার সময় আপনি আমার থেকে দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছিলেন।

ওঃ!

আপনি তো ওই বউটা আর তার মেয়ে সাথেই সারাক্ষণ গল্প করে গেলেন। একটু থেমে মৃদু গলায় বলে মায়া, মা-মেয়ে দুজনেই কী সুন্দর ইংরেজি বলছিল। আপনার তো ভালো লাগবেই।

দিয়ার দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া, আর এই ভ্যাবলা মেয়েটা সারাক্ষণ চুপ করেই থাকল। আন্টি যখন চকোলেট দিলেন একটা থ্যাংক ইউ বলতে পারলি না?

আঃ ছাড়ো। ছোটোদের অত থ্যাংক্স বলতে হয় না।

গুম্ফা থেকে বেরিয়ে ওরা সেই রাস্তাটা ধরে উঠছে। মায়া আর দিয়া একটু এগিয়ে ছিল। হঠাৎ করেই ওরা হারিয়ে গেল! একঝাঁক মেঘ এসে ওদের ঢেকে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ওদের দেখতে পেল না সুবিমল। তারপরেই মেঘ সরে গেল। ওই তো মায়া। আবার নতুন একদল মেঘ এসে তাদের আড়াল করে দাঁড়াল। মায়া নেমে এসে সুবিমলের হাত ধরল। বলল, কী দারুণ না? সুবিমল মায়ার হাতটা চেপে ধরে। মেঘের ভেতর সাঁতার কাটতে কাটতেই ওরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়।

মায়া বলে, চলুন এটায় ঢুকি। দিয়ার খিদে পেয়েছে। রেস্টুরেন্টটা পুরোই ফাঁকা। দরজার কাছের টেবিলটায় এসে ওরা বসে। এখান থেকে রাস্তায় উড়ে যাওয়া মেঘ দেখা যাচ্ছে।

মায়া আর দিয়ার জন্য দু-প্লেট চিকেন চাউমিন আর নিজের জন্য থুপ্পা চাইল সুবিমল। থুপ্পা সেই মনে আছে দার্জিলিং-এ খেয়েছিল। কিন্তু এটায় সেই স্বাদ পেল না। মায়া নিজের প্লেট থেকে চাউমিন তুলে সুবিমলের প্লেটে দিল। খেয়ে দেখুন কি চমত্কার করেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে ওরা জানল, শিলিগুড়ি যাবার শেষ গাড়ি বেরিয়ে গেছে। তার মানে আজ রাতটা হোটেলেই থাকতে হবে।

সবজিবাজারের গলির ভেতর একটা ছোটো কিন্তু সুদৃশ্য হোটেল। চয়েস লজিং অ্যান্ড ফুডিং। সেটাতেই ঢুকল ওরা। ম্যানেজার অল্পবয়সি একটা ছেলে।

সুবিমল প্রশ্ন করল, ইঁহা কেয়া রুম মিলেগা?

ছেলেটি একটু হেসে বলল, দোতলায় একটা ঘরই খালি আছে, চাইলে দেখতে পারেন?

তুমি বাংলা বলতে পারো!

আমি শ্যামনগরের ছেলে, নাম রাজা। আপনারাও তো বাঙালি, দেখেই বুঝেছি।

বাঃ, তাহলে তো খুব ভালোই হল সুবিমল খুশি হয়ে ওঠে।

আসুন আপনাদের ঘরটা দেখিয়ে দিই।

সিঁড়ি দিয়ে ওদের ওপরে নিয়ে আসে রাজা। এটা বোধহয় হোটেলের পেছন দিক। একটা সরু করিডর দিয়ে হেঁটে ওরা একটা ছোটো বারান্দায় এসে দাঁড়াল আর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেল। পুরো বারান্দাটাই ঝুলছে পাহাড়ের খাদের ওপর। একদিকে পাহাড়ের দেয়াল। সামনে মেঘে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়া। হু হু করে কুয়াশা উঠে আসছে নীচ থেকে। বারান্দার লাগোয়া ঘরটাই ওদের দেখায়। সুন্দর সাজানো ঘর। পাশেই অ্যাটাচড বাথরুম।

ওদের অবাক করে দিয়ে মাত্র আটশো টাকা ঘর ভাড়া চায় রাজা। মায়া তবু বলে, ছশো টাকায় হবে না?

কম পড়ে যাবে দিদি।

না ওটাই রাখো।

আর কিছু না বলেই খাতায় ওদের নাম লিখে ঘরের চাবি তুলে দেয় রাজা।

ঘরের বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মায়া বলে, কখনও কল্পনাই করিনি এরকম ঘরে থাকব। ঘর থেকেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

একটু রেস্ট নিয়ে ওরা বাইরে বার হয়। অন্ধকার নেমে এসেছে এখনই। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একটা বড়ো রাস্তা সোজা চলে গেছে। তার দুপাশে গভীর জঙ্গল। পুরো নির্জন পথ। কোনও শব্দ নেই, একটাও আলো নেই। শুধু উজ্জল তারার আলোয় নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকে ওরা।

মায়া বলে, দিয়া এখন যদি বাঘ বেরোয় তো কী করবি?

দিয়া একটু ভেবে বলে, বাঘ এলে যেন আমাকেই খায়।

কেন?

বাঃ, তোমাদের বাঘে খেলে আমি কার সাথে বাড়ি ফিরব? সুবিমল হেসে ওঠে। মায়াও। ফেরার পথেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা।

হোটেলে ফিরে দিয়া টিভি চালায়। চ্যানেল পালটায় সুবিমল। জি সিনেমায় এসে দ্যাখে অনুসন্ধান সিনেমাটা চলছে। দ্যাখা ছবি, তবু আবার দেখতে বসে ওরা।

জানো তো, এই ছবিটার শুটিং পুরোটাই দার্জিলিং-এ হয়েছিল।

তাই?

ভোর হচ্ছে। ছবির মতো সাজানো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে বেতের ঝুড়ি পিঠে ঘুরে ঘুরে নামছে পাহাড়ি মেয়েটা।

সত্যি কি সুন্দর! মায়া বলে।

অন্ধ নায়িকা গান করছে, ওঠো ওঠো সূর‌্যাইরে, ঝিকিমিকি দিয়া, কালকে তুমি আঁধার রাতে, কোথায় ছিলে গিয়া।

ইস, ওর কী কষ্ট তাই না?

কেন?

ও তো কোনওদিন সূর্যটা দেখতেই পাবে না।

সিনেমা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে দিয়া। ওরা জেগে থাকে। সিনেমা শেষ হচ্ছে, অমিতাভ বচ্চন রাখির কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে।

সুবিমল বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। সিগারেট ধরায় একটা। ভেতরে গান চলছে, আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ।

মায়াও কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, বইটা সত্যিই খুব ভালো তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু অবাস্তব!

এমন কেন বলছেন?

অমিতাভের মতো একজন হ্যান্ডসাম পুলিশ অফিসার একটা অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করছে। অবাস্তব নয়?

কেন, এরকম কি হতে পারে না?

জানি না। একটু চুপ করে থেকে সুবিমল বলে, এই যে তুমি আর আমি একসাথে ঘুরছি, রাতে শুচ্ছি। কিন্তু আমি কি তোমায় বিয়ে করতে পারব কোনও দিন?

না। আপনি করবেন না, আমি জানি।

তাহলে?

চুপ করে যায় মায়া। কিছুক্ষণ কেউই কথা বলে না। মুখ না ফিরিয়ে সুবিমল কেমন করে বুঝতে পারে, মায়া কাঁদছে। কোনও শব্দ না করেই।

আচ্ছা মায়া, এই যে আমি তোমাকে কোনও সম্মান দিতে পারি না। সবার কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কটা লুকোতে চাই। এতে তোমার খারাপ লাগে না?

খারাপ লাগলেই বা কী করতে পারি।

মায়া বলে, আমি জানি তো আমি আপনার যোগ্য নই। আমি গরিব, পড়াশোনা জানি না। আবার একটা মেয়ের মা। আপনাকে বিয়ে করার কথা আমি নিজেই ভাবতে পারি না।

তুমি তো জোর করতে পারো।

কেন করব। জোর করে কি সব কিছু পাওয়া যায়?

কিছুক্ষণ আবার চুপ থাকে দুজনে।

আমি জানি কেন আপনি দার্জিলিং যাননি…

কেন?

আসলে বিয়ের পর বউকে নিয়ে দার্জিলিং যাবেন ভেবেছিলেন, তাই না?

কেন এরকম মনে হল তোমার?

এমনিই। আগে ভাবিনি, এক্ষুনি মনে হল। বলুন, ঠিক বলেছি কিনা।

জানি না।

হঠাৎ করেই সুবিমলের পাশে সরে এসে তার বুকে চুমু দেয় মায়া, আর তাকে জড়িয়ে ধরে। সুবিমল বুঝতে পারে তার বুকের কাছটা মায়ার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে।

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সুবিমল বলে, কাঁদে না মায়া। বেড়াতে এসে এমন করে না।

আমি আপনাকে ছাড়তে পারব না।

কে ছাড়তে বলেছে তোমাকে। কেঁদো না।

আমায় ছ়েড়ে চলে যাবেন না তো?

যাবো না।

ঠিক?

ঠিক।

বাইরে লাভার নক্ষত্রভরা আকাশ ভগবান বুদ্ধের করুণাঘন দ্যুতিরময় চোখের মতো তাদের দুজনের দিকে চেয়ে থাকে।

 

আমি ও কোকিলা শেষ পর্ব

একটানা কথাগুলো বলে কোকিলা থামল। আমি ওর দিকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম। একটু চুপ করে বসে জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘ক্রমশ নেমে এল আমার জীবনে চরম অন্ধকার। জানতে পারলাম রাজীবের কোনও হাই-ফাই ব্যবসা নেই। বড়ো ব্যাবসাদারকে খুশি করে অর্ডার পাওয়াই তার কাজ। অল্প কিছু দিনের মধ্যে তার এই ব্যাবসাদার বন্ধুরা বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল। রাজীব বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসত। হুইস্কি-সোডা-রাম, আরও কী যে আমি অত নামও জানি না। এসব নিয়ে আমায় যেতে হতো রাজীবের তথাকথিত বন্ধুদের সামনে। আমায় সময় দিতে হতো, হাস্যময়ী-লাস্যময়ী হয়ে সময় কাটাতে হতো গভীর রাত পর্যন্ত। রাজীব আরও এগিয়ে দিত আমাকে। অর্ডারটা যে পেতেই হবে। পরে আপত্তি জানালে রাজীবের হাতে উত্তম-মধ্যমই জুটত। কাকে জানাব? প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, কেন গুরুজনদের কথা শুনিনি? মা-বাবার বারণ, বিশেষত মায়ের চোখের জল জীবনের চলার পথ কখনওই মসৃণ রাখে না। মা-তো। সন্তানের মঙ্গল কামনা কোন মা না চায়। আমি রাজীবের মা-বাবার সাথে আবার কথা বললাম। কিন্তু ওনাদের উদাসীনতা আমায় অবাক করল। নিজের বাবা-মাকে কী বলব! কুনাল, যে আমার সাথে রাজীবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সে-ও হেসে উড়িয়ে দিল, রাজীব নাকি এমন হতেই পারে না। আমিই সবকিছু মানিয়ে নিতে পারছি না। ভেবেছিলাম রাজীবকে ছেড়ে চলে যাব কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। কী খাব, কোথায় রাত কাটাব, আবার যদি অন্য রাজীবের খপ্পরে পড়ি! ভয়ে আমি রাজীবের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করলাম। এই রাজীবের জন্যই আমায় দু-দু’বার গর্ভপাত করাতে হয়েছে। আমি চাইনি কিন্তু ওর ভয়, আমার ফিগার খারাপ হয়ে যাবে তাই বাধ্য হয়েই আমি রাজি হই। কী কষ্ট যে হয়েছিল। কোন মেয়ে না মা হতে চায়! মনে হয়েছিল একটি শিশু বোধহয় দু’পক্ষের মা-বাবাকে হাসিখুশিতে ভরিয়ে তুলবে। আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শুধু একটা শিশু– আমার স্বপ্ন, আমার জীবন। কিন্তু সবই বৃথা, রাজীবের নির্দয় আচরণ, তার সিদ্ধান্ত, আমায় কোন অন্ধকারে ঠেলে দিল! আর রাজীবের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। আমি রাজীবের তুরুপের তাস। তাই তো আমার সাজসজ্জার দিকে ওর এত নজর। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

আবার কোকিলা চুপচাপ। ফোঁপানির শব্দ। নিশ্চুপ আমি শুধু নির্বাক হয়ে শুনে গেলাম। আমার কিছু করার নেই। কোকিলার এ অবস্থার জন্য অনেকাংশে ও নিজেই দায়ী। আমি কিছুই করতে পারি না। কোকিলা হঠাৎ ঘুরে চলে গেল। আমি কোকিলাকে কোনওদিন কোনও পরামর্শও দিইনি। এ ঘটনার মাস চারেক পরেই আমি বদলি হলাম।

চাকরি সূত্রে বদলি হয়ে চলে এলাম আরব সাগরের তীরে, মুম্বাইতে। আসার সময় রাজীব-কোকিলা দুজনকে একসাথে গুডবাই জানিয়ে এসেছিলাম। বিশেষ করে রাজীবকে, নানা অসুবিধা সত্ত্বেও থাকতে দেওয়ার জন্য। কোকিলা একটা কথাও বলেনি আমার সাথে কিন্তু ওর চোখ বলে দিচ্ছিল অনেক অনেক কথা। হাসির আভাসমাত্র দিয়ে কোকিলা আমায় বিদায় জানিয়েছিল।

মুম্বাই এসে নিজেকে গুছিয়ে নিতে মাস দেড়েক কেটে গেল কোথা দিয়ে বুঝতেই পারিনি। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু যেন বেশি সময় লেগে গেল। তবে মাঝেমধ্যেই কোকিলার বিবর্ণ মুখটা কেমন যেন আমায় উদাস করে দিত। সব জেনেও আমি নিরুপায়, হাত-পা বাঁধা, কিছুই করার নেই। দু’একবার কোকিলাকে ফোন করেছি, ওপ্রান্তে রাজীবের গলা। সাদামাটা কথার পর ফোন নামিয়ে রেখেছি। কোকিলার সাথে কথা বলতে চাইলে রাজীব যে ভাবেই হোক এড়িয়ে গেছে। কোকিলা যেন হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। দিন তার নিজের ছন্দে চলে। অবসরে কখনও আরব সাগরের ধারে বসে দেখি অনন্তের রূপ। সমুদ্রেরও এক নিজস্ব ছন্দ আছে, ওঠানামা, ভাসানো, ফিরে যাওয়া। একা-একা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যাই মাঝেমধ্যে, আবার ঝাড়া দিয়ে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসি নিজেকে। একদিন অফিস গিয়ে নিজের নামে চিঠি দেখে বেশ চমকে গেলাম। এই মোবাইলের যুগে কেউ আর ব্যক্তিগত চিঠি লেখে না। খুলে দেখি চিঠির তলায় লেখা কোকিলা।

বিনা সম্বোধনেই সে লিখেছে – ‘জানি এতদিন বাদে আমার চিঠি পেয়ে তুমি চমকে যাবে। আমার কথা মনে আছে তো? নাকি সব ভুলে গেছ? মাত্র অল্প কয়েক মাস তুমি ছিলে আমাদের কাছে, তবু তোমায় আমি আমার ব্যক্তিগত অনেককিছু উজাড় করে দিয়েছিলাম। তুমি জানতে চাওনি তবুও। তোমার নীরবতাই আমায় টেনেছিল তোমার দিকে। সে যাইহোক, কুণালকে মনে আছে নিশ্চয়ই। আমার কলেজের বন্ধু যে রাজীবের সাথে আলাপ করিয়েছিল। আমি জানতাম কুণাল আমায় ভালোবাসে, তবু ওই বয়সে রাজীবের অত টাকাপয়সা, ব্যবসা, সব আমায় গুলিয়ে দিয়েছিল। আমি কুণালের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে রাজীবের হাত ধরেছিলাম। কুণাল বেশ ভেঙে পড়লেও আমায় কিছু বলেনি। জানি ও এখনও বিয়ে করেনি। এও জানি এখন ও চেম্বুরে কোনও এক ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের অফিসার। প্লিজ ওর সাথে যোগাযোগ কোরো, বলো বিয়ে করতে। কেন বলছি জানি না, তবু একদিন আমি ওকে ভালোবাসতাম, ও হয়তো আজও বাসে। আমায় ভুলে যেতে বোলো। প্লিজ শুধুমাত্র একসময়ে বন্ধুত্বের দাবিতে তোমায় হয়তো বিরক্ত করলাম। ভালো থেকো। আমি কেমন আছি জানতে চেও না।’

অফিসে কাজ করা মাথায় উঠল। হাফ-ডে করে বেরিয়ে পড়লাম কুণালের খোঁজে। অফিস টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটেই কুণালের খোঁজ পাওয়া গেল। কিন্তু দুজনে মুখোমুখি হতে আরও চার-পাঁচদিন কেটে গেল। ফোনে আমি কোকিলার কথা সেভাবে কিছুই জানাইনি। শুধু বলেছিলাম, ওকে চিনি। কুণালকে কোকিলার চিঠির কথা বলতে কুণাল চুপচাপ শুনল, যখন চিঠিটা ওর হাতে দিতে গেলাম নিল না। অদ্ভুত স্থির হয়ে বলল ‘চিঠিটার কোনও মূল্য আর নেই বোধহয়, গতকাল রাতে কোকিলা সবকিছুর ঊর্দ্ধে চলে গেছে। আমি চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম ‘কি! তুমি কি করে জানলে? কে খবর দিল? কি হয়েছিল?’ কুণাল ধীর গলায় বলল, ‘বিজয় চেম্বুরে এসেছে, ওর মাসির বাড়ি এখানেই। কাকতালীয়ভাবে আমিও সেই বাড়িতে পেয়িংগেস্ট থাকি।’

কোনও কথা না বলে আমি ফিরে এলাম নিজের ঘরে। এক অদ্ভুত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম না খেয়েই। পরের দিন যথারীতি অফিস। পৌঁছোতেই আবার এক চমক। চিঠি। হাতের লেখা দেখেই বুঝলাম, কোকিলা। যে-মানুষটার চিঠি আমার হাতে, সে যে পৃথিবীতে নেই, ভাবতেই কেমন যেন এক বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। চিঠিটা হাতে নিয়ে নিজের টেবিলে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে বসে রইলাম, সামনে কোকিলার চিঠি। চিঠিটা খুললাম, এক সুন্দর গন্ধের ছোঁওয়া চিঠির পাতায়। একইরকম ভাবে সম্বোধনহীন চিঠি।

‘কী হল, কুণালের সাথে দেখা হল? তোমার চিঠির অপেক্ষায়।’

—- কোকিলা

পুনশ্চঃ  তোমায় বলা হয়নি, আমি আর ভালো নেই। হাসপাতালে রয়েছি। এইচআইভি পজিটিভ। তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কোরো। মনে হয় তুমি দেরি করে এলে, তোমারও মনে হবে বড়ো দেরি হয়ে গেলো।

আমি ও কোকিলা পর্ব ০১

কুনালের পক্ষে সম্ভবই নয় প্রভূত পরিমাণে টাকা কিংবা গাড়ির স্বপ্ন দেখা। আর রাজীব, দিল্লিতে নিজের বাড়ি-ব্যাবসা— সব মিলিয়ে সফল পুরুষ। এক মুহূর্ত সময় নেয়নি কোকিলা এতদিনের ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে রাজীবের হাত ধরতে।

কোকিলার মৃত্যুসংবাদ আমায় বিচলিত করেনি। আমি জানতাম এমনটাই হবে— ধীরে ধীরে। জীবন যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খাবে, এক পা এক পা করে ও এগোবেই মৃত্যুর দিকে। আমি হতবাক হয়ে ভাবছিলাম ওর সাথে পরিচয়, সুখস্মৃতির কথা।

কোকিলা আমার কেউ নয়, এমনকী বন্ধুও নয়। ওকে চিনেছি অন্যভাবে সৌজন্যবশতঃ। কাজের সূত্রে অল্প কিছুদিনের জন্য দিল্লি থাকতে হয়েছিল। সেখানেই আলাপ রাজীবের সাথে। রাজীব ধূত। পেশায় ব্যবসায়ী। ঘরের খোঁজ তার কাছেই পাই। তারই বাড়ির চিলেকোঠায়। এককামরা হলেও আমার অসুবিধা নেই। আমার অফিস এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। আর জায়গাটাও বেশ ভাল। বেশ ছিমছাম। রাজীব একা থাকে, স্ত্রী থাকলেও এক সপ্তাহেও তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি।

সুযোগ এল, তা অন্যভাবে। একদিন অফিস থেকে বেরতে গিয়ে শুনি, ‘বন্ধ’। আরে হলটা কি? এই তো দুপুরে নীচে এসেছিলাম। গেটের সিকিউরিটি খবর দিল, ‘সাব দো আদমি মর গয়ে। দুকান সব বন্ধ হো গিয়া তিন বজে।’ বেশ দুশ্চিন্তা হল। বুঝলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হঠাৎ সব দোকানপাট বন্ধ। আমার তো মাথায় হাত। রোজ ভুজবল (ওড়িয়া ছেলে) আমার দিনের রাতের-খাবার দিয়ে যায়। শুনশান রাস্তা দিয়ে বেশ সন্ত্রস্তভাবে হেঁটে বাড়ি এলাম। একটু ঘুরে ভুজবলের দরজায় টোকা মারলে খানিকবাদে চিৎকার করে উত্তর এল, ‘খাবার পাওয়া যাবে না। দুপুর থেকে সব বন্ধ।’ আমি দরজা খোলার কথা বললেও কেউ খুলল না। অগত্যা বাড়ি এসে বিস্কুট-মুড়ি-চানাচুর, দারুণ ডিনার। ঢকঢক করে জল খেয়ে সটান বিছানায়। অন্যান্য দিন একটু টিভি দেখি আজ ভুজবলের উপর রাগে আমার সব গোলমাল হয়ে গেল।

ঘুম ভাঙল বেশ ভোরবেলায়। এত সকালে আমি উঠি না। গ্যাসে চা বানিয়ে লনে একটু বসেছি হঠাৎ রাজীব। ও যে প্রাতর্ভ্রমণ করে আমি জানতাম না। সুপ্রভাত জানিয়ে পাশে বসে পড়ল। ও বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল ‘এত সকাল সকাল কি ব্যাপার! আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও বলতে বাধ্য হলাম, ‘কার্ফিউয়ের জন্য ভুজবল ডুব মেরেছে।’ রাজীব মনে হল একটু লজ্জিত হল। একথা-সেকথার পর একটু ব্যায়াম করে চলে গেল। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে সিঁড়ির মুখে গিয়ে বলল, ‘আমাদের সাথে সকালের নাস্তাটা করে যেও।’ রাজীব মাঝেমধ্যে বাংলা বলার চেষ্টা করে। আজ ও পুরো বাংলায় কথা বলল।

আমি দ্বিরুক্তি না করে, রেডি হয়ে সকাল ন’টায় হাজির হলাম নীচে। রাজীবই দরজা খুলে দিল। খাবার টেবিলে আলাপ হল রাজীবের স্ত্রী কোকিলার সাথে। প্রথম দেখায় কেমন যেন ম্লান মনে হল, হাসলও ফ্যাকাসে ভাবে। দু’দিন আমায় ওদের সাথে জলখাবার খেতে হয়েছিল। কোকিলা খাবার টেবিলে বড়োই চুপচাপ। আমি আর রাজীবই যা কথা বলি। তবে রাজীব ঝড়ের মতো, খেয়েই বেরিয়ে যায় নতুবা বেশি সময় মোবাইলে কথা বলে। আমি মাঝেমধ্যে কোকিলার দিকে তাকাই। নীরব চোখে। মনে কত জিজ্ঞাসা কিন্তু রাজীব নিজের স্ত্রী-র ব্যাপারে উদাসীন না সতর্ক, তা বুঝতে পারিনি। কথা বলতেই দেয় না। ঠিক এড়িয়ে চলে, যাতে কোকিলা নাস্তার টেবিলে কথোপকথনে যোগ না দিতে পারে। তিনদিনের দিন থেকে দিল্লির রাস্তাঘাট স্বাভাবিক, ভুজবলও স্বাভাবিক।

দিন কাটছে নিজের ছন্দে। রাজীব বা কোকিলার কারুর সাথেই দেখা হয় না। একদিন বেশ সকালে দরজায় খুটখুট। ভাবলাম রাজীব। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই চমকে ঘুম পালাল, কোকিলা। পাশ কাটিয়ে কোকিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানায় বসেই বলে উঠল, ‘কানপুর থেকে আমার ভাই আসবে কাল সকালে, ও আপনার সাথেই থাকবে।’ একটু থেমে একটু নরম স্বরে আবার বলল, ‘আশা রাখি আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু কেন? আপনাদের নীচে তো ঘরের অভাব নেই। আমার একটা মাত্র ঘর সেখানে দু’জন!’

‘আপনার সঙ্গ আমার ভাইয়ের ভালো লাগবে।’

‘কিন্তু রাজীব যদি কিছু বলে বা মনে করে?’

‘রাজীবের কিছুই আসে যায় না আমার ভাইয়ের ব্যাপারে” অদ্ভুত ঠান্ডা নিরাশ স্বর ভেসে এল কোকিলার গলা থেকে।

একেবারে টিনএজার কোকিলার ভাই। মাত্র তিনদিনের সফরে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছে। অফিসের কাজ ম্যানেজ করে কোকিলার অনুরোধে ভাই বিজয়কে নিয়ে বের হতে হল দিল্লি ঘোরাতে। অবশ্য এজন্য কোকিলা রোজ পাঠিয়েছে ভালো-মন্দ খাবার। বেশ অবাক লেগেছিল যখন বিজয়ের খাবারও আমার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল কোকিলা। প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও আমি নীরব। রাজীবকে একদিনও আমার ঘরে আসতে দেখলাম না শালাবাবুর জন্য। বিজয় চলে যেতে বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আবার ভুজবলের লম্বা কৌটোর খাবার, ঠিক যেন মুখে লাগছিল না। এ ব্যাপারে কোকিলার মুখটা বার বার ভেসে উঠছিল। দু’তিন দিন বাদে সব যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল, রাজীব একদিন আমায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল বিজয়ের জন্য। আমি এতটা সময় দিয়েছি বলে। আমি কেমন যেন বিস্মিত হলাম। হেসে চুপচাপ রইলাম। তবু মনের মধ্যে খচখচানি গেল না। বড়ো বাড়ি, এত ঘর তবু বিজয়কে থাকতে হল আমারই সাথে। এটা কোনওভাবে মেনে নিলেও, দিদির সাথে ভাইয়ের না খাওয়া আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার দিদির বাড়ি গেলে দিদির আদর। ভাগ্না-ভাগ্নিরাও দিদির সাথে তাল মেলায়, আর জামাইবাবু তো পারলে সেদিন ওকালতি করতে যান না।

আমার সব প্রশ্নের সমাধান হল সেদিনই রাত্রে। সিঁড়ির সামনে কোকিলার মুখোমুখি হলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠল, ‘অনেক প্রশ্ন আপনার মনে, অনেক কৌতূহল, আমি জানি। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করছি না। আমি চাইনি আমার ভাই দু’দিনের জন্য আমার কাছে বেড়াতে এসে দিদি-জামাইবাবুর রোজনামচা জেনে যাক। আজ সকালে ও দিল্লির বাইরে গেছে, ব্যাবসার জন্য। প্রতিমাসেই ওর যাওয়া থাকে। ওপরে আপনার ঘরে চলুন অনেক কথা আছে।’ তাকিয়ে দেখি কোকিলার চোখে জলঃ আমি নির্বাক। বুঝলাম মেয়েটি আরও কিছু বলতে চায়। সে নিজের মনেই বলে চলল, ‘আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। বাবা-মা কেউ চায়নি আমি রাজীবকে বিয়ে করি। আমারই এক কলেজ-বন্ধু রাজীবের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। রাজীব নাকি ব্যাবসা করে দিল্লিতে এবং রাজীবও আগ্রহী আমার প্রতি। ওকে দেখে আমি প্রায় পাগল। মা-বাবার অমতে, পড়াশোনা শেষ না করেই ওকে বিয়ে করি। কুনাল, আমার কলেজ-বন্ধু। সে ছিল রাজীবের সম্পর্কতুতো ভাই। সেও বলেছিল, ‘গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট কর।’ আমি সবার বিপরীতে গিয়ে রাজীবকে বিয়ে করি। কেন জানি না আমার ছোটো থেকে স্বপ্ন ছিল, ধনী ঘরে আমার বিয়ে হবে। ছা-পোষা কেরানিকে বিয়ে করা আমার পোষাবে না। রাজীবের মা-বাবাকে জানানো হয়েছিল, ওনারা আসতে চাননি। আমার মা বাবা তখনই আপত্তি করেছিল কিন্তু আমার অন্ধ প্রেম সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। রাজীবের অদ্ভুত তাকানো, কথা বলা, স্বপ্ন রচনা, ভালোবাসার খুঁটিনাটি সব… সব আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক স্বর্গরাজ্যে। ও বলেছিল হনিমুনে যাবে সিঙ্গাপুরে। কিন্তু বিয়ের পর কাজের চাপের জন্য সব ক্যানসেল। মেনে নিয়েছিলাম স্বাভাবিক কারণেই। ব্যবসাদার মানুষজনদের কাজের ধারাটাই এরকম। সে যাইহোক, এও বলেছিল বিয়ের পর দিল্লিতে একটা গ্রান্ড পার্টি দেবে। কোথায় কি? রাজীবের বাড়ির লোকজন আমায় ভালো করে অভ্যর্থনাটুকুও জানায়নি। তিন চারদিন ওর মা-বাবার সাথে থাকার পরই চলে গেলাম ভাড়ার বাড়িতে।’

সন্দেহ

(১ )

এই শনিবার পঞ্চানন পুজো। রাঘবের মনে ছিল না। যথারীতি সকালে উঠে লাল চা আর বিস্কুট, তারপর গরুর দেখভাল। দুটো গাই গরু আছে। এবেলা ওবেলা ভালোই দুধ দেয়। কিন্তু রাঘবের আফশোস বাড়ির কেউ দুধ খায় না, আর রাঘব নিজে দুধ বিক্রির বিরুদ্ধে। রাঘব রাতে দুধভাত আর দিনে দইভাত পছন্দ করে।

বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং সংসারে সাকুল্যে তিনজন। ছোটো মেয়ে বউ আর সে। শুক্রবার রাত্রে ছোটো মেয়ে জন্মদিন ছিল। লুচি করেছিল কৃষ্ণা। পাশাপাশি খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত। রাঘবের অফিসে আবার সেদিন ছিল ইয়ার এন্ডিং। দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে রাতে আর লুচি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লুচি রেখে দিয়েছে তার গিন্নি কৃষ্ণা।

ছোটো মেয়ে ইতু হঠাৎ বলে উঠল বাবা তুমি বাসি লুচি খাচ্ছ! আজ তো শনিবার। বটতলায় শিবের থানে যাবে না? দেড়খানা লুচি খেয়েছিল রাঘব, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল ওরে বাবা কি পাপ করলাম…রে! অর্ধভুক্ত লুচি আর হাফ কাপ চা পড়ে রইল। আর সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটল।

পুজো ছিল কদমগাছি রায়নাপুরে। বরাবর সে এটা করে। সবই নির্বিঘ্নে হল। কেবল ধ্যান করার সময় বাসি লুচির ঢেকুর। কেমন অম্বল অম্বল! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল রাঘবের। শুক্রবার মাংস, শনিবার বাসি লুচি। বটতলা থেকে রাঘব ফিরছিল, গায়ে নামাবলি।

দু-পাশে গাছ। পঞ্চায়ে লাগিয়েছে। পিচ ঢালা রাস্তা। মোরাম বদলে পিচ। সোনাঝুরি গাছের ছায়া। মনোরম লাগে রাঘবের। ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এই অঞ্চলে। আগে একটু নেশা করত রাঘব। এখন সেই সব বালাই নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে। পুজোআচ্চা বেড়েছে। রাঘব নিজে এখন অভয়গিরি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ। আজকাল মাঝে মাঝেই আকস্মিক বেগ চলে আসছে।

সোনাঝুরির গাছের পাশে চওড়া ড্রেন। সাইকেল থামিয়ে রাঘব বসে পড়ল। কানে পইতে। কিন্তু দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হওয়ার পরেই রাঘবের মাথা ঘুরে গেল। সটান ড্রেনে একেবারে মুখ গুঁজে পড়ল। কতক্ষণ যে সে ড্রেনে ছিল, তার নিজের খেয়াল নেই। অজ্ঞান রাঘব। যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে। ডাক্তার বললেন সব গ্যাস থেকে হয়েছে। হাতে কোনও চোট নেই, মাথায় আঘাত নেই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে কোমরে লাগছে।

চিত্তরঞ্জন থেকে বড়দা এসে উপস্থিত। বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ছড়িয়ে বড়ো বাড়ি, বেশিরভাগ ঘর তালা বন্ধ। একমাত্র দোল উত্সবে সবাই একসঙ্গে। তখন সাতদিন ধরে বাড়ি থাকে জমজমাট। রাধাকৃষ্ণের অষ্টমঙ্গলা পর্ব সমাপ্ত করে আবার সবাই কর্মস্থলে ফিরে যায়। অঢেল ভোগের এলাহি বন্দোবস্ত। লুচি ছোলার ডাল, তিন-চাররকম সবজি দিয়ে তরকারি, পায়ে। পাত পেতে সবাই মিলে ঘরে একসঙ্গে। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাবার পর রাঘব কদিন ঝিম হয়ে বসে থাকে। নীলাচল, রাঘবের বড়দা এসে এবারে খুব হম্বিতম্বি করল। তার ধারণা রাঘব নেশা করে, রাঘব যত বলে সে নেশা থেকে শত হস্ত দূরে, নীলাচলের বিশ্বাস হয় না। বাড়ির পেছনেই তাল গাছ।

—তুই নিশ্চয়ই তালের রস খাস! নীলাচল বলল।

—বিশ্বাস করো দাদা রাঘব গলায় মিনতির সুর।

—তাহলে তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি কেন? দড়ির মই কেন?

পরদিনই হাঁড়ি নামানো হল। দড়ির মই কেটে ফেলা হল। নীলাচলও নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। ইচ্ছে করে রাঘবের মাঝে মাঝে তালের রস খেতে। কিন্তু গোপালপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার কেউ নেশাভাং করে না।

কোমরের ব্যথা রাঘবের কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে কোমরে বেল্ট, প্রতিদিন ব্যায়াম। রাঘবের বড়ো মেয়ে রানীগঞ্জে থাকে। জামাই গৌতম থানার সেকেন্ড অফিসার। বাড়ি বৈদ্যবাটি। চতুর ছেলে। নিজেই রাঘবকে বলে, বাবা মাইনেতে হাত দিতে হয় না। পকেট ভর্তি টাকা গৌতমের। গৌতমই সন্ধান নিয়ে এল, নিয়ামত্পুরের অদূরে একজন সাধিকা আছেন, তিনি ওষুধ দেন।

রাঘবের এক বছর চাকরি আছে। ছোটো মেয়ে ইতু এবার মাধ্যমিকে বসেছে। মনে উদ্বেগ সবসময় কাজ করে রাঘবের। যদি তার কিছু হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে! ড্রেনের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় নাকে এসেছিল প্রস্রাবের গন্ধ। সেই গন্ধটা আর দূর হচ্ছে না। আর ওই গন্ধটা নাকে এলেই উদ্বেগ। বউ কৃষ্ণাকে বলেছে রাঘব। কৃষ্ণা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে ও তোমার মনের ভুল। এর জন্য রাঘবকে নিয়ামত্পুরের সাধিকার কাছে জোর করে নিয়ে এল জামাই গৌতম।

বাংলা বিহার সীমান্ত ঘেঁষা এক শ্মশানে সাধিকার আশ্রম দেখে রাঘবের চোখ ছানাবড়া। অত্যন্ত রূপসী। মাথায় জটা, একটি মধ্যত্রিশের মেয়ে গৌতমের সঙ্গে কী সব ইশারায় কথা হল। রাঘবের মোটেও পছন্দ হল না। গৌতম ও সাধিকা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। লোকজন বিশেষ নেই। বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। অদূরে একটা মরা পুড়ছে। পাশে একটি সরু খাল। সামান্য জল। সেই জলে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে। সন্ধে হয়ে আসছে। চারধারটা নির্জন।

জামাই গৌতমের স্কুটারে চেপে রাঘব এসেছে। তার আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বড়ো মেয়ে জোর করে পাঠিয়েছে। বড়ো মেয়ে বিশ্বাস এই সাধিকার ওষুধ খেলে তার বাবা ভালো হয়ে যাবে। স্কুটারে ফেরার পথে রাঘব গৌতমের শরীর থেকে মদের গন্ধ পেল। রাঘবের কোমরে ব্যথাটা আজ যেন একটু বেশি। মাঝে মাঝে ভেতরে ভেতরে কেঁপে যাচ্ছিল রাঘব। ওষুধ খেতে হবে। রাঘবের মনে হচ্ছে স্রেফ বুজরুকি। সাধিকা ও গৌতমের নিভু আঁচে পারস্পরিক ইশারা ইঙ্গিত! ভাবতেই রাঘবের ব্যথা উঠে এল ঠিক শিরদাঁড়ার নীচে। কোমরের ডান দিকে।

রিতু, রাঘবের বড়ো মেয়ে বলল, বাবা কেমন বুঝলে? খুব ভালো সাধিকা তাই না!

রাঘব বিহ্বল। কেমন যেন ঘোর!

—ওষুধ দিয়েছে বাবা? নিয়ম করে কিন্তু খেতে হবে তোমাকে।

রাঘবের তখন বলতে ইচ্ছে হল রিতুকে, যেন গৌতম ওখানে আর না যায়! কিন্তু সবেমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে রিতুর। আগের বাচ্চাটা নষ্ট প্রসব। এই সময়ে এসব কথা বলা কি ঠিক!

রাঘবের চোখ বন্ধ। নাকে আসছে আশ্রমের ধূপের গন্ধ। রাঘবের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। রাঘবের ফাটিকা গ্রাম। দেবখালের পাশে। দেবখাল বেশ বড়ো। খালের দুপাশে বাঁশের ঝাড়। খসেপড়া বাঁশের বাকল। হলদে ছায়া। নিরিবিলি। দুপুরের তাপ কেমন শান্ত! বাঁশ তলিতে গভীর ঘুঘু পাখির ডাক। নুয়ে পড়া বেতের লতা। একটা দুটো ফিঙ্গে পাখি। দেবখালের চারপাশে কৃষিজমি। বর্ষায় জল উপচে পড়ে। পচিয়ে দেয় জমির ধান। খালের জলের নীচে দলঘাসা শৈবাল। নলখাগড়া। দেবখালের সঙ্গে বিষহরি খাল মিশেছে।

( ২ )

বছর ঘুরে আবার পঞ্চানন পুজো। রাঘব নিবিষ্ট! কতক্ষণ বসে আছে রাঘব, কোনও খেয়াল নেই, চারদিকে প্রচুর মানুষ। রাঘবের স্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ। রাঘবের কোমরের ব্যথা শিরশির করছে। ব্যথার অনুভতি মেরুদন্ড বেয়ে ক্রমশ উঠছে।

শেষদিকে রাঘবের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া একটা আচ্ছন্ন ভাব। কিন্তু অর্চনা তো শেষ করতে হবে! এটা চার-পাঁচটা গ্রামের খুব ধুমধাম উত্সব। চোখ বন্ধ রাঘবের। কোথায় যেন পড়েছিল শ্রীপঞ্চানন (শিব) পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি পছন্দ করে না। রাঘবের তো নেই। তবে হঠাৎ এ কথা কেন মনে হল!

বাড়ি ফিরছিল রাঘব। গত বছর যেখানে তার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে রাঘব সাইকেল দাঁড় করল। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের রোদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ কী যে মনে হল রাঘবের, একটা গাছের আড়ালে বসে নিজের পোঁটলা খুলে ফেলল। কৌতূহল, খিদে, একই সঙ্গে তার এখন। পোঁটলার মধ্যে কতরকম জিনিস। দেখে তো রাঘবের চোখ ছানাবড়া।

এক কুইন্টাল চাল, পাঁঠার মুড়ি, পাঁঠার পেছনের ঠ্যাং, তিন হাজার টাকা (পাঁচশো টাকার ছখানা কড়কড়ে নোট) তিন হাজার টাকার কয়ে। ওরে ব্বাস অস্ফুট কণ্ঠস্বর রাঘবের। সত্যি তো এত সব দিয়েছে তাকে! গত বছরে দেয়নি, তার আগের বছরও…! কিছু মনে নেই রাঘবের। কালে কালে কত হল। এতসব জিনিসপত্র নিয়ে সে কী করবে? তার বউ কৃষ্ণা, মেয়ে ইতু মাছ মাংস ছোঁয় না। রাঘবের ইচ্ছে করে খেতে।

পোঁটলার ভেতরে পোঁটলা। মাখা সন্দেশ, শসা, কলা, আপেল, আর নাড়ু। গুড়ের নাড়ু। পটপট কয়েটা নাড়ু খেয়ে নিল রাঘব। সঙ্গে বোতলের জল। পাশে পড়ে আছে ছাতা, দক্ষিণায় পাওয়া নতুন ধুতি। ক্রমশ অন্ধকার করে আসছে। তুমুল হাওয়া ও টিপটিপে বৃষ্টি। সকালের দিকেও মেঘ ঘন ছিল। মেঘের রং এত কালো যে বোঝাই যাচ্ছে না সময় কত! বাড়ি ফিরতেই তুমুল বৃষ্টি এল। আর তখনই তরল ছায়ার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণা পাশে এসে দাঁড়াল।

—রিতুকে কেমন দেখলে? কৃষ্ণার প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল ভালো।

—আর গৌতম কেমন আছে? কৃষ্ণার পরের প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল এসব প্রশ্ন করছ কেন হঠাৎ!

—কৃষ্ণা কেঁদে উঠল। বৃষ্টির শব্দ ও কান্নার হেঁচকি মিলেমিশে একাকার।

—কাঁদছ কেন? রাঘবের স্বরে বিস্ময়।

—ওরা গৌতমের মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে। কান্নাভেজা গলায় কৃষ্ণা জানাল।

—কারা? রাঘব জিজ্ঞেস করল।

—মুখটা ঝলসে গেছে গৌতমের। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।

—কে মেরেছে অ্যাসিড রাঘব প্রশ্ন করল?

—আমাকে ফোন করেছিল হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণা বলল।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাঘবের মুখ। কৃষ্ণাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে ছুড়েছে অ্যাসিড?

ভোরবেলায় রওনা হল রাঘব। আসানসোল। বড়ো হাসপাতাল। বেডের কাছে কেউ নেই। চোখে মুখে ব্যান্ডেজ। বাইরে দাঁড়িয়ে গৌতমের বন্ধুরা। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাঘবের। পলাশ গাছের নীচে রাঘবকে দেখে সবাই কেমন চুপ। রাঘব খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কে ছুড়েছে অ্যাসিড ওর মুখে? রাঘবের চোয়াল তখন শক্ত। কেউ বলতে চাইছে না। সবাই নিশ্চুপ।

বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু রাঘবকে ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে বলল, মেসোমশাই আমরা সামলে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গৌতম প্রাণে বেঁচে যাবে। শুধু মুখটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ সব ঘরের সমস্যা… সন্দেহ। চা খাবেন মেসোমশাই?

চায়ে দোকানে পাতা বেঞ্চিতে থপ করে বসে পড়ল রাঘব। কোমরের ব্যথাটা একেবারে মাথার পেছন বরাবর উঠে এসেছে। এভাবেও হয়! রিতু সন্দেহের বশে এই কাজটা করতে পারল? সন্দেহ তো তারও প্রথম থেকে হয়েছিল। তা বলে… বলে…!

সই চম্পাবতী

এক

গুপ্তিপাড়ার এক কবিরাজের কাছে গোপনে গোপনে ওষুধ খাচ্ছিল চম্পা মণ্ডল। যৌনতা-বর্ধক ওষুধ। না, কবিরাজকে সে চেনে না। জানেও না এর জন্য কত দাম নেয় সে। ওষুধের গুণ টের পাওয়া যাবে তিনমাস পর থেকেই। পুরো ফল পেতে হলে আরও তিনমাস মোট ছমাস খেতে হবে।

তাকে নিয়মিত এই ওষুধ এনে দেয় তার স্বামীর বন্ধু সুনীল। এমন উপকারী লোক, অথচ দ্যাখো পয়সা দিতে গেলে নেবে না। জোর করলে বলবে, এই কোবরেজের খুব নাম। অনেকেই তার ওষুধ খায়, শুনি কাজও হয়। যদি কাজ হয়, তখন তুমি আমাকে পয়সা দেবে, কেমন?

বিয়ের পর প্রথম প্রথম কিছু বলেনি হারান। দিন কয়েক যাবার পর সে মুখ খুলতে থাকে। মিলন শেষে নিরুত্তাপ গলায় বলত, তুমি বড়ো ঠান্ডা! কিছুতেই গা-গরম হয় না তোমার! অথচ তুমি যা গায়েগতরে। দেখলেই মনে হয় ঝাঁপ দিই ওই উত্তুঙ্গ যৌবনের ভিতর। প্রাণের জ্বালা জুড়াই। কিন্তু আসলে তুমি একটি ঠান্ডা সাপ ছাড়া আর কিছু নও। ঝাঁপ দিয়ে আগুন মেলে না, বরফের জলে গা ভিজে ওঠে।

কথাটা গায়ে মাখেনি চম্পা। যৌনতা তার ভালো লাগে না। ওই সময় সে কেন যে আড়ষ্ট হয়ে থাকত, তা সে নিজেই জানে না। পরের দিকে হারান নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সে চম্পাকে মারধর করত। রাগে গরগর করতে করতে মাঝরাতেই ঘরের বাইরে চলে যেত।

একাকী বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদত চম্পা। তার গায়ের রং কালো। কিন্তু সুডৌল স্তন, ভরাট কোমর, চওড়া কাঁধ ও তার কালোর উপর সুন্দর মুখশ্রীতে এমন কিছু ছিল যে, একবার দেখতে গিয়ে হারানের তাকে ভালো লেগে যায়।

হারানের এক প্রাণের বন্ধু হল সুনীল রাজবংশী। সুনীল নৌকো বানায়। ঘর ছেড়ে নৌকো বানানোর জন্য কোথায় না কোথায় পাড়ি দেয় সে। এক মাস দিঘা তো কোনও মাস মেদিনীপুরের অচেনা কোনও এক নদীর ধারে, আবার কখনও তার ডাক আসত শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ থেকে। কখনও বা ঘরের পাশে কুন্তীঘাটে যেত নৌকো বানাতে।

নৌকোর কারিগর হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু তার নিজের কোনও নৌকো নাই। সে যখন হারানের সন্ধানে আসত, তাকে ঠেস মেরে চম্পা বলত, এবার এট্টা নৌকো বানাও মাঝি, গাঙ্গ-এ ভেসে পড়ি।

সুনীল তখন রসিক নাগরের মতো হাসত। বলত, তোমায় নিয়ে কোথা যাব, বউ? সুনীল তাকে গোপনে বউ বলে ডাকত। মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারত সুনীল। চম্পার মাঝে মাঝে মনে হতো, তার যদি সুনীলের সঙ্গে বিয়ে হতো, তবে সে সুখী হতে পারত।

হারান ছিল রাজমিস্ত্রি। বড়ো রাজমিস্ত্রি নয়, সে ছিল সহকারী। কাজের টানে তাকেও বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন সে সুনীলকে বলে যেত, বউটা রইল, দেখিস। সুনীল সেইসব দিনে আসত কিন্তু ঘরে ঢুকত না।

চম্পা ডাকত ঘরে বসার জন্য কিন্তু সে বলত, দিনকাল তো ভালো নয় বউ, কে কখন কী বদনাম দেয় তার ঠিক কী! তার চেয়ে এই ভালো। তোমার খবর করা হল, দেখা হল, কথা হল, সবদিক বজায় থাকল, আর কী চাই? এমনটাই থাক না।

চম্পা রেগে বলত, বদনাম আবার কী মাঝি? কে করবে বদনাম? তুমি কি আমার পর? তুমি আসবে, রোজ আসবে এই আমি কয়েক দি। শুনে মিটিমিটি হাসে সুনীল।

—আর বদনাম হলে? মুখটি ফিরিয়ে নেয় চম্পা।

—সে তো আমার ভাগ্য গো! এমন বদনামে যে মরেও সুখ!

বুক ভরে ওঠে সুনীলের। মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, বলো কী, বউ! তারপর?

—তারপর আর কী, একখান নাও নিয়ে ভেসে পড়ব দুজনাতে।

সুনীল তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তা ভেসে ভেসে যাবে কদ্দূর?

—যাব না। নাও-তেই থেকে যাব। সারারাত, সারাজীবন।

—সংসার তোমার ভালো লাগে না, না বউ?

নীচু মুখে, বাঁ হাতের আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে চম্পা বলে, পালাইনি তো তোমার সঙ্গে। পালালে, একটা সংসার পেতুম।

—তবে ভেসে পড়বার কথা বারবার কও কেন, বল দিকি?

—সে আমার ইচ্ছে!

—কেবলি ইচ্ছে? আর কিছু নয়?

উদাস গলায় চম্পা বলে, আমি কোনওদিন নদী দেখি নাই! অনেক অনেক জল দেখি নাই! পাড় থেকে দেখা কি আর দেখা হল মাঝি? নদীকে দেখতে হলে নদীর বুকে থাকতে হবে। কেন, তোমার কি আমাকে নিয়ে ভেসে পড়তে আপত্তি আছে?

সুনীল বলে, তা নয় বউ। তুমিই আমার সব। আমার জীবনমরণ। আমার নাও, আমার নদী, আমার নৌকো। পর তো নও তুমি আমার। কিন্তু জানো কী, যেখন তুমি নাও ভাসাবার কথা কও, তোমাকে কেমন যেন উদাস লাগে।

—আর কেমন লাগে?

—বেউলা লাগে তোমায়। বেউলা- সুন্দরী। এক কলার মান্দাসে চলেছ তুমি।

—সেই মান্দাস তুমি, মাঝি বোঝ না?

—বুঝি বউ, বুঝি।

—তবে আমাকে নিয়ে ভেসে পড়ো না, কেন?

—পারি না যে!

—কেন পারো না মাঝি? আমার এ জীবন কি জীবন? পারো না আমায় একটা নতুন জীবন দিতে?

—ও এমনি করে তোমার গায়ে হাত তুলবে আমি কল্পনাও করতে পারি নাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চম্পা বলে, দেহ ছাড়া সুখ হয় না মাঝি। দেহ ছাড়া দেহসুখ যে সোনার পাথরবাটি, মাঝি! দেহ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হয় না, সংসার হয় না, প্রেম-পিরিতি হয় না। দেহ ছাড়া এই পৃথিবী শূন্য মাঝি! এ-পৃথিবী দেহের বশ। আর সেই দেহ আমার নেই!

তার দীর্ঘশ্বাস নিজ গায়ে মেখে নিতে নিতে সুনীল বলে, এ-যে তোমার মনের কথা নয়, সখি চম্পাবতী। তুমি যেমনি করে আমাকে বোঝো, তেমনি আর কে বোঝে বলো দিকি। হারানের কথা বলছ? ও কিন্তু সহজ সরল ছেলে। ছোটো থেকেই তো দেখছি তাকে।

—সেটাই তো বিপদ মাঝি। সহজ-সরলেরা যে মনের গভীর কথা পড়তে পারে না! ওদেরকে সব যে বলে বলে দিতে হয়, বুঝিয়ে দিতে হয়!

মাথা নেড়ে সুনীল বলে, কেন যে হারান এমনি করে! ওকে এখন আমি বুঝতে পারি না। মাথা নীচু করে চম্পা।

—ওর শরীর যে আমি সুখে সুখে ভরাতে পারি না, মাঝি। ওকে খুশি করতে পারি না! এবার আমাকে নিয়ে একখানা নাও বানাও মাঝি। সে নাওয়ের নাম দিয়ো সই চম্পাবতী। আমি মরে যাই যদি, তোমার সেই নাও-এর মাঝেই আমি বেঁচে থাকব। আমার এই দুই চোখ এঁকে দিও নাও-এর গায়।

—তুমি নাও হবে, বউ? সুনীল চোখ বড়ো বড়ো করে। বলে, তুমি যে গহিন গাং বউ, নাও হতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? গহিন গাং, তার এপার, ওপার দেখা যায় না। মনের গভীর-গোপনে কোন ধন খেলা করে, তাকে কে বোঝে, কে ছোঁবে বউ? গহিন গাং তাই চিরকাল মানুষের কাছে অধরাই থেকে যায়।

—আমি যদি গহিন গাং হই, তুমি তার বুকে এক নাও।

—না বউ। আমি তা নয়।

—তবে? গহিন গাং যদি তোমার কোনও কাজেই না-লাগে, তবে লাভ কী আমার গাং হয়ে

—তোমায় ডুবে মরে যে সুখ, সখি!

এর পর আর নিজেকে সামলাতে পারেনি চম্পা। দুবাহু এগিয়ে দিয়ে সে জাপটে ধরে সুনীলকে।

সুনীল থরথর করে কেঁপে ওঠে। চম্পার উষ্ণ নিঃশ্বাসের কাছে সে পুড়ে যেতে থাকে। নতজানু হয় তার শরীরী-সুবাসে। ক্রমে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে তার। আর চম্পা তাকে দিয়ে নিজেকে চেনে। সে বোঝে, গহিন গাং-এ জোয়ার এসেছে। সেটা কবিরাজি ওষুধের কাজ নাকি সুনীলের সোহাগভরা ব্যবহার— তা সে নিজেই জানে না। মোটেই একটি ঠান্ডা সাপ নয়। সেও পারে। সেও জানে, কীভাবে প্রবল জোয়ারের ধাক্কায় ডুবাতে হয়, কীভাবে ভাসাতে হয়, একটি নাও-কে। কীভাবে সেই নাও-কে নিজের গোপন খাঁড়ির দিকে গভীরে নিতে হয়।

দুই

এক পথ-দুর্ঘটনায় হারান মণ্ডল মারা গেল। লরি-বাস নয়, তাকে ধাক্কা মেরেছিল একটা বাইক। সকালে যেমন কাজে বের হয়, সেদিনও তেমনি বেরিয়েছিল। সমুদ্রগড় স্টেশনে নেমে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। রাস্তা পেরোনোর সময় একটি দ্রুতগতির বাইক তাকে সজোরে ধাক্কা মারে, হারান রাস্তার ধরে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। লোকজন জমা হয়। একটা ভুটভুটি ভ্যানে করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেখানে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল তিনদিন।

লোকমুখে খবর পেয়ে সুনীলকে নিয়ে সেখানে যায় চম্পা। মৃত হারানকে দেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তাকে একদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখনই জানা যায়, সে তিনমাসের পোয়াতি!

হারানের মৃত্যুর পর বাপের ভিটেতে ফিরে গেল না চম্পা। সে রয়ে গেল শ্বশুরের ভিটেতেই। কিন্তু সে এখন পড়েছে অথৈ জলে। তাকে দেখার কেউ নেই, শোনার কেউ নেই। তার সংসার চলে না। হারান বেঁচে থাকাকালীন সে বিড়ি বাঁধার কাজ করত। হাজারটা বিড়ি বাঁধলে আশি টাকা মিলত। কিন্তু এখন তাকে আর কেউ কাজ দেয় না।

সকলে বলে, হারানকে সে-ই চক্রান্ত করে মেরেছে। নইলে বাইকের ধাক্কায় কেউ মরে? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল সুনীলের নাম। ফলে সুনীল আর আসে না তার বাড়িতে। নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে না সুনীল। কাজের অছিলায় সে নানাস্থানে চলে যায়, ফেরে না। আগে যেমন সে ফিরলেই চলে আসত চম্পাকে দেখতে, তার নাভি-পদ্মের দর্শনে, তার শরীরী সৌরভে মাতোয়ারা হতে— এখন এসবের ধারেকাছে নেই সুনীল।

সে শুনেছে, এই অবসরে সুনীলের দাদারা তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের কিছু জমিজমা আছে। তা থেকেও বেদখল করা হতে পারে সুনীলকে। এই নিয়ে বাড়ি থেকে সুনীলের বুড়ি মাকে নানারকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। মাঠের ধারে, জলাজঙ্গলের মধ্যে, একটেরে এই মাটির বাড়িতে একাকী এক বিপন্ন যুবতি বিধবা কীভাবে বাস করে, এই নিয়ে সমাজের কিন্তু কোনও মাথাব্যথা নেই!

হারান মারা যাবার পর যে-মানুষটি সর্বদা তার পাশে ছিল, সে সুনীল। সেইসময় একদম ভেঙে পড়েছে চম্পা, ঘরে দুদিনের মতো খাবারও মজুত নেই, তখন সেই সুনীলই তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই বা কতদিন দেবে। বিয়ের সময় একজোড়া দুল দিয়েছিল তাকে, বাপেরবাড়ি থেকে। সেটা বেচে দিল সে সুনীলেরই হাত দিয়ে কারণ, সে বুঝতে পারছিল, এইভাবে সুনীল আর বেশিদিন সাহায্য করতে পারবে না। তাকে কাজে বেরোতে হবে। আর সে কাজে গেলে মহাসমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে চম্পা। তাই হাতে বেশ কিছু অর্থ থাকা দরকার। কারণ সে আর একা নয়। তার পেটের মধ্যে একটা প্রাণ বাড়ছে, তার কথা চম্পাকে আগে ভাবতে হবে।

দুলজোড়া হাতে নিয়ে সুনীল বলেছিল, সোনা বেচে দিচ্ছ বউ? একবার ঘর থেকে গেলে আর গড়াতে পারবে?

ম্লান গলায় চম্পা বলে, ও-জিনিস কী হবে আমার? ঘরে রেখে কী করব, বল দিকি! বিপদের দিনে সোনা যদি কাজে না-আসে মানুষের, তবে ঘরে সোনাদানা রাখা কেন?

—তা বটে!

—তিন-চার হাজার টাকা মিলবে না এ-থেকে?

—তা হয়তো মিলবে। কিন্তু এই দুলজোড়ায় যে-তোমাকে স্বপ্নের মতো লাগে, বউ!

—এ দুটি বেচে ঝুটো একজোড়া দুল এনো না হয়!

মুষড়ে পড়ে সুনীল বলে, আমার টাকা নিতে মানে লাগছে বুঝি?

—আমার মান বলো, মন বলো— সবই তুমি। তোমার এই ঋণ ফিরত দিব কী প্রকারে?

—না-হয় নাই দিলে, কে চাইছে তোমার থেকে?

—তুমি চাইবে না জানি, মাঝি। তুমি নাও বানাও, দূরে দূরে যাও টাকার দরকার কত লাগে তোমার। তাছাড়া তুমি দাদাদের সংসারে থাকো। সেখানেও টাকা দিতে হয়।

—আমার সংসার তো তুমি।

চম্পা কেঁপে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার কালো গায়ে সেই রোশনাই আর নেই। মুখ মলিন। সেই এক ঢাল কালো চুল রুক্ষ হয়ে উঠেছে। সব সময় সে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সব সময় চিন্তিত। সে যে পোয়াতি! একজন সহায় সম্বলহীন বিধবা কী করে একাকী একটি বাচ্চার জন্ম দেয়? তার প্রতিবেশী বা গ্রামের লোকদের আপত্তি এখানেই।

ওদের সকলেরই বক্তব্য, এই বাচ্চা আদৌ হারানের নয়। হারান জানতই না তার বউ পোয়াতি। তাদের ধারণা, এই বাচ্চা আসলে সুনীলের। এই নিয়ে নাকি তার আর হারানের মধ্যে রোজকার অশান্তি হতো। তাই তাকে ষড় করে সরিয়ে ফেলেছে সুনীল। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছে চম্পা।

তিন

একদিন রাতেরবেলা, ঘুম আসছিল না চম্পার। বিছানায় শুয়ে খালি এ-পাশ ও পাশ করছে। রাত গড়াচ্ছে কিন্তু সে ঘুমুতে পারছে না। নিজের কী যে হচ্ছে, কিছু বুঝছে না সে। এইসময় তার দরজায় তিনটি টোকা পড়ল পরপর। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসল সে। সাড়া দিল না। কোনও শব্দ করল না। কে হতে পারে দরজার ওপারে? সুনীল? কিন্তু সুনীল এইরকম করে না। রাতে কোনওদিন তার ঘরে আসে না সে। যতবার সে মিলিত হয়েছে সুনীলের সঙ্গে, সেটা দুপুর। উদ্দাম দুপুর, মিলনও তেমনি দুরন্ত। আর সেটা এতটাই চুপিসাড়ে যে, কারও টের পাবার উপায় নেই।

এই যে, লোকজন তার নামে এত অকথা-কুকথা বলে, সেটা হারান মারা গেছে বলেই। সুনীলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল চম্পা। আর বুঝেছিল, সব নারীর মধ্যেই যৌনতা থাকে। সেটাকে বের করে আনা, উপলব্ধি করার দাযিত্ব হল পুরুষের। পুরুষ যদি না পারে, সেখানে নারীর কিছুই করার থাকে না। সুনীল তাকে আবিষ্কার করেছিল। তারও কামনা আছে। তার স্পর্শেই একজন সত্যিকারের নারী হয়ে ফুটে উঠেছিল সে।

কিন্তু দরজার ওপারে কে? যে আছে, সে কোনও সাড়া করছে না। আর এমনি করে টোকা মারছে, নিশাচরের মতো, যেন কাক-পক্ষীতেও টের না পায়। মনের শঙ্কা এবার ভয়ে পরিণত হল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে…?

ওপাশ থেকে আওয়াজ এল— আমি, দরজা খোলো!

মেয়েমানুষের গলা! এবার নামল সে বিছানা থেকে। আলো জ্বালল। আস্তে আস্তে দরজার খিল সরাল। তবে পাল্লা দুটি হাট করে খুলে দিল না। একটা বন্ধ রেখে অপরটি একটু ফাঁক করল। ওপারের মানুষটির ছোটোখাটো চেহারার অল্প একটু দেখা গেল।

—খোলো হারানের বউ, ভয় পেয়ো না। আমি সুনীলের মা।

সুনীলের মা! সে তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিল। এত রাতে সুনীলের মা তার কাছে কেন! সুনীলের কোনও বিপদ হল?

ঘরে ঢুকে বুড়ি বলল, নাও, এবার দরজা আটকে দাও। খিল তুলে দিল চম্পা।

—কিছু হয়েছে মাসিমা? আপনি এমন হাঁপাচ্ছেন কেন? কী হল?

—আমার বড়ো বিপদ!

—বিপদ! আপনি বসুন। জল খান। বলে বুড়িকে সে বসাল। এক গেলাস জল দিল।

বুড়ি ধাতস্থ হয়ে বলল, আমি তোমার কাছে থাকতে এলাম। আমাকে থাকতে দেবে আজকের রাতটা? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।

—সেকি! কেন?

—ওই যে, আমি বলেছি, সুনীলকে জায়গা-জমির ভাগ দেব, তাই।

—সুনীল কোথায়?

—সে আছে নদীয়ায়।

—কবে ফিরবে?

—ফিরবে না। যদি মেরে দেয়, ওই ভয়ে ওখানে গেছে একমাস হতে চলল। যাবার আগে বলে গেছে, এবার ওখানেই থেকে যাব মা। আমি ঘর দেখছি। তার মধ্যেই এইসব ব্যাপার।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল চম্পার। বহুদিন হয়ে গেল, সুনীল তার কাছে আসে না। তাকে ভালোবাসে না। কতদিন সে দেখে না সুনীলকে। তার জন্য মন কেমন করে চম্পার। কিন্তু বাইরের কাউকে কিছুই বলার উপায় নেই। এমনিতেই ঢিঢি পড়ে আছে চারিদিকে। এবার তার মনকেমনের কথা একবার চাউর হলে, সে এখানে আর বাস করতে পারবে না।

সুনীলের মা গর্জে ওঠে, আমিও ছাড়ব বলে ভেবেছ? রাজবংশী পরিবারের বউ আমি। আমার এক ছেলেকে বঞ্চিত করে বাকিরা সুখ ভোগ করবে, এ আমি হতে দেব না। আমি উইল বদলাব। সমান ভাগ আর থাকবে না। তুমি একবার সুনীলকে ফোন করো।

—এত রাতে?

—হ্যাঁ, এখুনি করবে। আমি কথা বলব। তিনবার রিং হবার পর সুনীল ফোন ধরে হ্যালো বলল।

আহা! কতদিন পর সে সুনীলের কণ্ঠস্বর শুনছে। সে ফোনটা সুনীলের মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল।

সুনীলের মা বললে, শোন সুনীল, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কাল ভোরের ট্রেনেই আমি আর চম্পা তোর ওখানে চলে যাচ্ছি। ঘর ঠিক করেছিস তো… আচ্ছা আচ্ছা ও… রাখ।

ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সুনীলের মা বললে, আমাদের কাল ভোরের ট্রেনটা ধরতে হবে, ওদের কোনও বিশ্বাস নেই। আর ওখানে গিয়ে তোমার এই চম্পা নামটি থাকবে না। তুমি হবে চম্পাবতী রাজবংশী। নাও বউমা, কাপড়-জামা গুছিয়ে নাও। তুমি পোয়াতি, খুব সাবধানে যেতে হবে আমাদের। ভোরের ট্রেনে ভিড় কম হয়। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।

কিছু বুঝতে পারছিল না চম্পা। কেবল আমতা আমতা করে বলল, আমি, মানে…!

—বুঝতে পারছ না? ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমি সুনীলের বিয়ে দেব। তোমাদের সব অপবাদ ঘুচিয়ে দেব। ওখানে তোমরা নিজের মতো করে সংসার পাতবে।

ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল চম্পা। মনে পড়ল, সুনীলকে একদিন বলেছিল সে, কদ্দিন আর পরের পোয়াতি বিধবার পিছনে ঘুরঘুর করবে। তোমায় এবার নিজের সংসার পাততে হবে, নিজেরটা দেখতে হবে। তোমার এখানে আর না-আসাই ভালো।

সুনীল বলেছিল, তুমি আবার পরের কোনখানটায়? পুরোটাই তো আপন।

চম্পাবতী হু-হু করে কাঁদছিল। চোখের জল বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিল তার। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুনীলের মা। তবু এক কষ্ট জাগে বুকের ভেতর। এত আনন্দের মাঝেও বুকের ভেতর এই এক দমচাপা কষ্ট চম্পার, কে জানে কার জন্যে!

 

 

অটোর সেই লোকটা

বিডন স্ট্রিট পার হয়নি তখনও। ব্যাকসিটে হেলান দিয়ে সবে চোখ দু’টো একটু বুজেছে নীলোৎপল। শেষ কবে অটোয় উঠে এত আরামে বসেছিল মনে পড়ে না। বাঙালি গতরে বাড়ছে নাকি কলকাতার অটোগুলো বহরে ছোটো হচ্ছে ইদানীং কে জানে। দু’টোর পর তিনটে লোক যেই উঠল অমনি শুরু হল চাপাচাপি। অগত্যা সেই আগুপিছু করে বসা।

আজ প্রথমটায় একটু অবাকই লেগেছিল তাই। এই অটোটার পিছনের সিটে বসতে গিয়ে। আগে থাকতেই বসেছিল দু’টো লোক। তাকে উঠতে দেখে খুব একটা যে নড়েচড়ে বসল মনে হল না। কিন্তু সিটে পিঠ রেখেই টের পেল নীলোৎপল– বেঁকেচুরে বসার দরকার নেই কোনও। দিব্যি আরামে কাঁধ ছড়িয়ে বসা যাবে।

লোকগুলোর দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল সে। সিড়িঙ্গে টাইপের চেহারা। গায়ে বেরঙা টি-শার্ট। একেবারে কর্নারের লোকটা কপালে হাত দিয়ে মাথা নামিয়ে বসেছিল। মুখখানা ভালো করে দেখতে পায়নি সে। যাকগে। কপাল করে অটোটা পেয়েছে। শোভাবাজার থেকে উলটোডাঙা কম রাস্তা নয়। আয়েশ করে যাওয়া যাবে। একসঙ্গে দু’ দু’টো এমনি রোগা রোগা লোক চট করে পাওয়া যায় না আজকাল। আর একজন এসে পড়লেই হয় এবারে। মোবাইল বের করে ফোন করে দিল সায়ন্তনকে, ‘শোভাবাজারে। এই অটোয় উঠলাম। আর-একজন হলেই ছাড়বে…’

‘শালা এতক্ষণে মোটে শোভাবাজার! সোনাগাছিতে ঢুকেছিলি নাকি?’

‘ক্যালানে। টাইম লাগে না নাকি বাসে আসতে। গ্লোবারের সামনেটায় দাঁড়া। সবাই এসে গেছিস?’

‘জয়ন্ত আর নির্মাল্যটা কোথায় কে জানে। বাকিরা এসে গেছি। তুই কুইক আয়…’

এরমধ্যেই গগলস্ চোখে সাতাশ আঠাশের একটা ছেলে ব্যাগ হাতে এসে বসে পড়ল ড্রাইভারের পাশের সিটে।

‘গৌরীবাড়ি…’

‘বসুন।’

অটো ছেড়ে দিল।

ফেব্রুয়ারির ফুরফুরে হাওয়ায় চোখ যেন লেগে আসছিল নীলোৎপলের। একেবারে ভর দুপুরে বেরিয়েছে। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে একঘুম হয়ে যেত। বিডন স্ট্রিট আসতে আসতে আপনা থেকেই বুজে এসেছিল চোখ দু’টো। আর ঠিক তখনই জিন্সের বাঁ পকেটে বেজে উঠল মোবাইলখানা। বিরক্তিতে এবার মুখচোখ রীতিমতো কুঁচকে উঠল তার। হারামজাদাগুলোর কি তর সইছে না একটুও! সেই গ্রে স্ট্রিট থেকে সমানে জ্বালিয়ে যাচ্ছে পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর। বিডন স্ট্রিট থেকে উলটোডাঙা অবধি কি সে উড়ে যাবে এখন। একবার ভাবল দরকার নেই ধরার। বেজে যায় যাক। কিন্তু ফোন আসতেই থাকবে সমানে। যতক্ষণ না ধরছে জ্বালিয়ে মারবে। বাধ্য হয়েই কলটা রিসিভ করতে হল। জয়ন্ত ফোন করছে। তারমানে সেও বোধহয় পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।

ওপাশ থেকে সম্মিলিত গলায় ভেসে আসছে চার-পাঁচটা করে অক্ষর। আর কোনও কথা নেই। মনের সুখে গালি দিচ্ছে শালারা। নেহাত কাকার বয়সি লোকজন রয়েছে অটোয়। নইলে বাছা বাছা কয়েকখানা এখনই শুনিয়ে দেওয়া যেত বাছাধনদেরও। বিরক্ত গলায় শুধু বলে নীলোৎপল, ‘এই তো খান্নায় এখন। উড়ে যাব নাকি? অত তাড়া থাকলে চলে যা। বাপের বিয়ে লাগেনি আমার…’

কথা শেষ করে সুইচড অফ করে দিল নীলোৎপল। নে শালারা, এবারে যত পারিস ট্রাই করে যা। পৌঁছোনোর পর অবশ্য খিস্তি খেতে হবে কনফার্ম। তবে সেও ছেড়ে কথা বলবে না। অনেক তো দেখা আছে। এমন নয় যে পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে সেই প্রথম জব নামাল ক্যাম্পাসিংয়ে। জয়ন্ত, দেবরূপ, সায়ন্তন– সক্বলে আরও আগেই সব মোটা মোটা প্যাকেজের জব নামিয়ে বসে আছে। ট্রিট তো কে কেমন দিয়েছে দেখাই গেছে। সে তো তাও রাজি হয়েছে হাসিমুখে। নাকি তার চাকরিটা পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা ভাবছে সবাই! অন্যরা ক্যালকাটা বেল্টের এক একখানা নামি কলেজ থেকে বি টেক করছে। ভাল চাকরি তো পাবেই। আর সে যেহেতু জেলার একটা এলেবেলে কলেজ থেকে পড়ছে, কোনও গতি হতো না হয়তো। নেহাত ফাইনাল ইয়ারে অনেক হাঙ্গাম হুজ্জোত করে কলেজকে ক্যাম্পাসিং করাতে বাধ্য করে চাকরি জুটিয়েছে, তাই ট্রিট দেওয়াটা তার নৈতিক দায়!

কথাবার্তায় তো বোঝা যায়। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে চাকরি পেয়েছিল অনুরাগ। ক্যাম্পাসিংয়ের আগের রাতে তাই তাকেই ফোন করেছিল নীলোৎপল, ‘কী টাইপের কোশ্চেন আসতে পারে বল তো। আমার তো কোনও এক্সপিরিয়েন্স নেই এসবের…’

‘তোদের টিচাররা কিছু বলছে না?’

‘ফার্স্ট টাইম ক্যাম্পাসিং হচ্ছে ভাই কলেজ হিস্ট্রিতে…’

‘আই সি। তা নামটা কি বললি যেন কোম্পানির?’

‘জিটিবি সল্যুশনস।’

‘কীসের কোম্পানি এটা? কথার সুরেই মনে হচ্ছিল নীলোৎপলের ফোনের ওপারে ভুরু কুঁচকোচ্ছে অনুরাগ।’

‘সফ্টওয়্যার।’

দায়টা তার নিজের। তাছাড়া সেই প্রথম ক্যাম্পাসিংয়ের পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে সে। অত গায়ে মাখাতে গেলে চলবে না তখন।

‘জন্মে নাম শুনিনি’, ফোনের ওপাশে বোধহয় ঠোঁট উলটাল অনুরাগ, মনে হল নীলোৎপলের। একটা গুঞ্জন ভেসে আসছিল অনেকক্ষণ থেকেই। দোকান বাজারে কোথাও রয়েছে নিশ্চয় অনুরাগ। তখনই নির্মাল্যর গলাও শুনতে পেল সে, ‘আর-একটা সোডা হবে দাদা এই টেবিলে..’

আরও কে কে আছে ওখানে সে কথা ভাবার সময় তখন নয়। তবুও মনে হয়েছিল এমন অসময়ে ক্যাম্পাসিংয়ের কোশ্চেন টাইপ নিয়ে ফোন এলে হয়তো বিরক্ত হতো সেও।

কিন্তু আশ্চর্য। বিরক্ত হয়েছে বলে মনেই হচ্ছিল না অনুরাগের গলা শুনে। অল্প কথায় কাজ মিটিয়ে ফেলার মতো কথাও বলছিল না সে। বরং নীলোৎপলের সঙ্গে যেন অনেক কথাই বলতে চাইছিল সে। হস্টেলের রুমের ভেতর থেকে টাওয়ার পাওয়া যায় না সবসময়। কথা বলতে বলতে আচমকা কেটে যায় ফোন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা লাগছিল নীলোৎপলের। শার্টের ওপরে স্রেফ একখানা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। কতক্ষণই বা কথা হবে– মনে হয়েছিল তখন, আবার উইন্ডচিটার পরবে! ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোপালপুরে কলেজ। সামনে দিয়ে স্টেট হাইওয়ে গেলেও সন্ধের পর মাইলের পর মাইল স্রেফ শুনশান। টাউন থেকে দূরত্ব প্রায় মাইল ছয়েক। বয়েজ হস্টেল ততোধিক নিশুতির রাজ্যে। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আরও এক কিলোমিটার উত্তরে। চায়ের দোকানটা বন্ধ হয়ে যায় সন্ধে নামার আগেই। জানুয়ারির মাঝামাঝি কেমন ঠান্ডা পড়তে পারে এমন তেপান্তরের দেশে, কলকাতায় বসে কল্পনাও করতে পারবে না কেউ। ক্যাম্পাসিংয়ের আগের সন্ধেটায় হুইস্কি নিয়ে বসারও প্রশ্ন নেই অনুরাগদের মতো। চাদরটা গায়ে বেশ করে জড়িয়ে নিচ্ছিল নীলোৎপল।

তখনই শুনতে পেল কলকাতার দিক থেকে অণুতরঙ্গে ভেসে আসা অনুরাগের কথাগুলো, ‘পুনে সাইডের কোম্পানি বললি না? রেপুটেড কিছু নয়। আসলে কি জানিস, তেমন অ্যাক্লেমড কোনও কোম্পানি হলে টাইপটা বলা যেত। কে কেমন টাইপ ফলো করে না করে। আসলে তোরা ঝামেলা করেছিস। ইমিডিয়েটলি কাউকে নিয়ে আসতে হবে। যা হয় আর কি। হুট করে তো রেপুটেড কারুর সঙ্গে কিছু ফিক্স করে ফেলা যায় না। তখন এই টাইপের ছোটোখাটো কাউকে ধরে আনে। যাদের কেমন কোশ্চেন প্যাটার্ন হবে কেউ বলতে পারে না।’

রাগারাগির কিছু নেই। একেবারে সত্যি কথাই বলছিল অনুরাগ। বরং এই অবস্থায় এতটা সময় হয়তো নীলোৎপল নিজেও দিত না কাউকে। গুঞ্জনের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে কলকাতায়। আর সেই তেপান্তরের অন্ধকার রাজ্যে একটুখানি আলেয়ার মতো জ্বলে থাকা বয়েজ হস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ততক্ষণে বেশ ভালোই শিরশিরানি টের পাচ্ছে সে।

অনুরাগ বলে যাচ্ছিল, ‘একটা কাজ করতে পারিস। ওদের সাইটে ঢুকে দেখ তেমন কিছু পাস কিনা। সাইটে ঢুকলে ভুলভাল কিনা বুঝতেও পারবি। এরকম ধরে আনে তো অনেক এই টাইপের কলেজগুলো। এইরকম ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে। তোর কথা শুনে মনেও হচ্ছে তেমন যুতের কেউ নয় যারা আসছে। নইলে ভেবে দেখ না ক্যালকাটা থেকেই কেউ যেতে চায় না বীরভূমে ক্যাম্পাসিং করতে, আর পুনে থেকে এককথায় চলে আসছে…’

‘বীরভূম নয় এটা বর্ধমান ডিস্ট্রিক্ট,’ অনেকক্ষণ পরে একটা কথা বলেছিল নীলোৎপল।

তোরা শহিদ ধরে ফিরিস বলেছিলি না। শহিদ তো বীরভূম সাইডেই যায়…

বর্ধমান পেরিয়ে তবে তো বীরভূমে ঢোকে। অজয়ের ওপারে বীরভূম। তবে আমাদের কলেজ বীরভূম লাগোয়াই একরকম। গুসকরাতে নেমে…

‘আচ্ছা। আর সাইটে ঢুকে প্যাকেজটাও দেখে নিবি। আর-একটা কথা, বন্ডের ব্যাপারে কনশাস থাকবি। এসব আননোন কোম্পানির বন্ড তো! অরিজিনাল টেস্টিমোনিয়ালস জমা নিয়ে নেয় জয়েনিংয়ের সময় অনেকে। তারপর বন্ড পিরিয়ড যতদিন না শেষ হচ্ছে ওদের তাঁবে থাকে। আর পুনেতে মাসে কুড়ি হাজারে স্রেফ জলমুড়ি খেয়ে থাকতে হবে…’

‘ঠিক আছে। থ্যাংক্স ফর অ্যাডভাইস।’

আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয়নি। ঠান্ডা তো লাগছিলই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে একটা গরমও টের পেতে শুরু করেছিল। সেই হপ্তাখানেক আগে যেদিন বিকেলে কলেজের গেটে তালা মেরে ডিরেক্টর, রেজিস্ট্রার, ডিনদের মতো হোমরাচোমরাদের আটকেছিল গোটা ফোর্থ ইয়ার মিলে, সেদিনের মতো গরম।

হস্টেলের রুমে ঢুকে বেশ কয়েক মিনিট বসে খালি ভেবেছিল মদ খেয়ে একটুও কিন্তু নেশাড়ুর মতো কথা বলেনি অনুরাগ। কত সহজ স্বাভাবিক গলায় উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিল।

জিটিবির সাইটে অবশ্য ঢোকেনি আর সেই রাতে। চার বছরের সিলেবাসে তো কম সাবজেক্ট নেই। সাইট ঘেঁটে স্যালারি প্যাকেজের হিসেবনিকেশ করে ক্যাম্পাসিংয়ের আগের সন্ধেটা নষ্ট করার কোনও যুক্তি ছিল না। যা থাকে কপালে ভেবে যা যা দরকারি মনে হয়েছিল সবেতেই চোখ বোলাতে বোলাতেই বেজে গিয়েছিল রাত সাড়ে তিনটে।

ঠিক দু’ দিন বাদে সেই অনুরাগই যখন শুনল স্টার্টিংয়ে অ্যারাউন্ড ফর্টি প্লাস ও অ্যাকোমোডেশনের কথা, বলেছিল, ‘একদিন ট্রিট দিতে হবে কিন্তু বস। ম্যূলা রুঁজ। আর স্কচ। কোনও কথা শুনছি না। একেবারে ছক্বা মেরে দিয়েছিস। আমাদেরই শালা এই ছাতাপড়া ক্যালকাটায় ঘষতে হবে বসে বসে…’

এক বছরের পারফরম্যান্স দেখবে জিটিবি। ভালো করতে পারলে নেদারল্যান্ডস, ইটালি বা ব্রিটেনে পাঠিয়ে দিতেও পারে তারপর।

নীলোৎপল ভাবছিল দু’দিনের ভেতরেই দর কোথা থেকে কোথায় চলে যায় একলাফে। সত্যি সেই রাতে যা খেটেছিল সেমিস্টারের আগের রাতেও অত খাটেনি চার বছরে কোনও দিন। অবশ্য খাটতে হয়ও না সেমিস্টারে। ওই তো কলেজ। আর তার ওই তো সব ফ্যাকাল্টি। সিলেবাস শেষ করাতে কালঘাম বেরিয়ে যায় তেনাদের। চোতা সঙ্গে না থাকলে বোর্ডে একটা সার্কিট ঠিক করে অাঁকতে পারে না এমন লোকও আছে। তা স্যার ম্যাডামরা ক্লাসে চোতা নিয়ে আসবে আর তারা মাইক্রো জেরক্স নিয়ে হলে ঢুকলেই যত দোষ! অবশ্য ওইটুকু চক্ষুলজ্জা ফ্যাকাল্টিদেরও আছে। দু’একজন ঝামেলা করে না এমন নয়। প্রথম দেড়ঘন্টায় নিজে লিখতে হবে। পিছন ঘোরা যাবে না। তবে মোটের উপর নির্বিঘ্নেই কেটে যায় সেমের দিনগুলো।

একটু হেসে বলেছিল নীলোৎপল, ‘ঠিক আছে। আগে ফিরি। কলেজের এদেরও খাওয়াতে হবে। ফেব্রুয়ারি আঠের’র আগে নো চান্স।’

‘আচ্ছা’, অনুযোগের গলায় বলেছিল অনুরাগ, ‘এখন আমরা স্কুলের বন্ধুরা সব পুরোনো হয়ে গেলাম।’

‘তোরা তো পুরোনো বন্ধুই।’

ঠান্ডাটা অনেকটাই কমে এসেছিল মাঝের দু’দিনে। আর সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টাও যদি কথা বলতে চাইত অনুরাগ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে কোনওই আপত্তি ছিল না নীলোৎপলের।

সেই পুরোনো বন্ধুদের জন্যই ছুটির দিনের ভাতঘুমটা মাথায় তুলে আজ বেরোতে হয়েছে। আবার দশ মিনিট দেরি হচ্ছে বলে খিস্তিও খেতে হবে! কোথাকার লাটের বাঁট রে তোরা। পড়তিস তো কবে একসাথে মিত্র ইন্সটিটিউশনে। সেই খাতিরে গলাখানা ভালো করেই কাটার প্ল্যান করেছিলি সবকটায় মিলে। পার্ক স্ট্রিটের বাইরে তো বেরোতেই চাইছিলি না। অনেক দরাদরি করে উলটোডাঙার গ্লোবার অবধি নামা গেছে। শিয়ালদার টাওয়ারে নিয়ে গিয়ে শালা ট্রিট দেওয়া উচিত ছিল তোদের।

মনে আছে চার বছর আগে যখন ভর্তি হয়েছিল বিআইইএমে, কলেজের নামটা নিয়েও কি হাসাহাসি সক্বলের।

‘আর কলেজ পেলি না? বোর্দুরিয়া ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট! তার চাইতে প্রেসিডেন্সি বা জেভিয়ার্সে অনার্স করতে পারতিস ইংলিশেও…’

‘যাক, পরের উইকে ফিরবি যখন টিনটিনের অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে ভুলিস না কিন্তু।’

‘দেখিস আবার কলেজটার অ্যাফিলিয়েশন আছে তো রিয়েলি? চার বছর বাদে যেন কলেজটাই না ইমাজিনারি হয়ে যায়।’

‘হ্যাঁ রে, এত কিছু থাকতে হঠাৎ বোর্দুরিয়া কেন নামের ডগায়?’

দেবরূপ, সায়ন্তন, জয়ন্তদের চাট খেতে খেতে বলতে হয়েছিল, ‘যতদূর শুনেছি ম্যানেজিং ট্রাস্টির মেয়ে টিনটিনের কমিক্স খুব ভালোবাসে। আর মেয়ে নাকি খুব লাকি লোকটার। মেয়ের জন্মের পরেই বিজনেস ফুুলে-ফেঁপে উঠেছিল ম্যানেজিং ট্রাস্টির। তাই যখন লোকটা এডুকেশন সেক্টরে এল…’

‘বোর্দুরিয়া নাম দিয়ে দিল! রগড় কিন্তু হেভি…’

সেই বোর্দুরিয়া ইন্সটিটিউট চাকরি দিয়েছে বলেই শালারা আজ ফোকটে গলা অবধি মদ খাবি। ভাবতে ভাবতে নীলোৎপলের মনে হয়, ট্রিট যদি অনেস্টলি দিতেই হয় বরং দেওয়া উচিত ছিল বিআইইএমের মেকানিক্সের টিচার তমাল রায়চৌধুরিকে। শুধু তার একার নয় সব স্ট্রিম মিলিয়ে গোটা ফোর্থ ইয়ারের যে-আটান্ন জন চাকরি পেয়েছে তাদের সক্বলের চাঁদা তুলে ট্রিট দেওয়া উচিত ছিল টিআরসি স্যারকে।

নইলে প্লেসমেন্ট সেল তো ওই ঠুঁটো জগন্নাথ। ষোলো তারিখ বিকেলে যখন তালা পড়ল কলেজের গেটে, কোন ফাঁকে যে প্লেসমেন্ট অফিসার পাঁচিল টপকে ভেগেছিল সবার আগে কেউ জানতেও পারেনি ঘুণাক্ষরে। কেমন করে যে সময় থাকতেই খবর পেয়ে গিয়েছিল লোকটা– সেও এক রহস্য। যাহোক, তারপর আর এক সপ্তাহ টিকিটাও দেখা যায়নি প্লেসমেন্ট অফিসারের। এক হপ্তা ধরে নিয়ম করে গোটা ফোর্থ ইযার সকালে এসে তালা মেরে দিয়েছে কলেজের গেটে গেটে। ফ্যাকাল্টিরা সেই তেপান্তরের মাঠে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকেছে। হস্টেল থেকে ব্যানার বানিয়ে এনে ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্টরা মাঝেমধ্যে হল্লা তুলেছে। অন্যান্য ইয়ারের ক্লাসও শিকেয় উঠেছে। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের হেলদোল নেই। ডিরেক্টর স্যার অবশ্য ফোন করে চলেছেন কলকাতার হেড অফিসে। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি উঁচুতলা থেকে। একটা সপ্তাহ কাটার পর স্টুডেন্টদের নিজেদের মধ্যেই জল্পনা– এভাবে আর কতদিন? শেষ অবধি ভবিষ্যৎ কী?

এই সময় আচমকা একদিন খবর পাওয়া গেল প্লেসমেন্ট অফিসারের অবর্তমানে কোম্পানির সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল টিআরসি স্যারকে। তা নিজের ব্যক্তিগত চেনা পরিচিতির লিংক থেকে টিআরসি নাকি যোগাযোগ করেছেন পুনের জিটিবি সল্যুশনসের সঙ্গে। ঊনত্রিশ তারিখ নাকি কলেজে আসছে জিটিবি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের একটা মিশ্র বাতাবরণ তৈরি হল স্টুডেন্টদের ভেতর।

ভর্তির সময় ব্রোশিওরেও লেখা ছিল না সেভেন্টি পারসেন্ট ক্যাম্পাসিং ফেসিলিটি, এসি ক্লাসরুমের গল্প…

হস্টেল মে সেপারেট রুম ভি লিখা হুয়া থা। কাঁহা গয়া ভাই উয়ো সব? এক রুম কে অন্দর ইধার তো চার চার লোগোকো শেয়ার করনা পড়তা হ্যায়।

ইতনা ঘাটিয়া খানা ভি জিন্দেগি মে নেহি মিলি

লেকিন আভি ইসি ওয়াক্ত অ্যায়সা ঝুট ক্যাহেগা ইয়ে লোগ?

সেটাই। এই কন্ডিশনে পাগল না হলে কেউ এরকম গুজব রটাবে না…

পরের দিনই নোটিস পড়ে গেল মেন গেটের সামনে। ঊনত্রিশ তারিখ জিটিবির ক্যাম্পাসিংয়ের খবর দিয়ে। হইহই করে তালা খুলে দিল ফোর্থ ইয়ার। কলেজের নোটিস বোর্ডে এতদিন খালি সেমিস্টারের আগে অ্যাটেডেন্স কমের অজুহাতে ফাইনের নোটিসই বেরিয়েছে। চার বছরে এই প্রথম

ক্যাম্পাসিংয়ের নোটিস ঝুলল সেখানে। স্ট্রাইক তুলে সবাই ছুটল হস্টেলে। ধুলো ঝাড়তে হবে বইপত্রের।

দু’একজন বলাবলি করে সন্ধের পরে, ‘বেশ ছিল কিন্তু ভাই। দিনে স্ট্রাইক আর রাতে মাল। পড়তে পড়তে এখন কেলিয়ে যাচ্ছি।’

আঠাশ তারিখ সকাল থেকে ঝাঁট পড়তে লাগল গোটা কলেজ বিল্ডিংয়ে। লনের ঘাস ছাঁটা হল। গাছের পাতা সরিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলা হল ক্যাম্পাস। চার বছরে কেউ কখনও যা দেখেনি সেটাই ঘটল ঊনত্রিশ তারিখ সকালে। আটটার মধ্যে ডিরেক্টর, রেজিস্ট্রার, ডিনের মতো হোমরাচোমরারা সক্বলে স্যুট, টাই পরে হাজির। কলকাতা থেকে হেড অফিসের লোক চলে এসেছিল আঠাশ তারিখ রাতেই। মেন টাউনে লজ ভাড়া করে ছিল রাতে। তারাও গাড়ি নিয়ে হাজির সাড়ে ন’টার ভেতর। বিল্ডিংয়ের প্রত্যেক ফ্লোরে বারান্দায় বারান্দায় টবে করে ফুলগাছ এনে বসানো হয়েছে। সুগন্ধে ম ম করছে সব ক’টা ফ্লোর়, মায় টয়লেট অবধি। সাড়ে দশটার পর স্যুট বুট পরে হাজির জিটিবির এইচআর পার্সোনেলদের টিম। কলেজের মাথাদের সঙ্গে সঙ্গে টিআরসি স্যারও এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করল জিটিবির লোকজনের সঙ্গে।

‘খুচরো দেবেন দাদা,’ অটোওলার কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফেরে নীলোৎপলের। গৌরীবাড়ি এসে গেছে। সামনের সিটের সেই গগল্স পরা ছেলেটা পার্স থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করেছিল। অটোওলার কথায় নোটটা আবার পার্সে ঢুকিয়ে কয়েন বের করতে থাকে।

তার কাছে আছে তো খুচরো পয়সা? এই এক হয়েছে ঝামেলা। বাসে ট্রামে দোকানে বাজারে যেখানেই যাও, আজকাল খুচরো নিয়ে ঝঞ্ঝাট। তিরিশ টাকার মিষ্টি কিনে একশো টাকার নোট ধরালেও বিনা বাক্যব্যয়ে সত্তর টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছে ময়রা। কিন্তু তিন চার টাকার খুচরো নিয়ে কথা কাটাকাটি বেধে যাচ্ছে। সব খুচরো কয়েন শালা নাকি ব্লেড বানাতে চলে যাচ্ছে। তার কাছে আছে তো খুচরো কিছু? বাসভাড়া দেওয়ার সময় বেরিয়েছে একবার। দেখে নেওয়া ভালো এখনই। বাঁদিকে একটু আড় হয়ে নীলোৎপল ডান পকেট থেকে পার্সটা বের করতে যায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অটোর ব্যাকসিটের আরোহী একেবারে ডান কর্নারের লোকটার মুখের উপর নজর পড়ে যায় তার। কপাল থেকে হাত সরিয়ে সিড়িঙ্গে লোকটা গৌরীবাড়ির গলির দিকে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে।

আরে, এই লোকটাই তো জিটিবির এইচআর টিমের হয়ে বিআইইএমে গিয়েছিল। নীলোৎপলের ফাইনাল রাউন্ড ইন্টারভিউ এই লোকই নিয়েছিল। বেশ মনে আছে। দু’একটা কথা ইংলিশে হওয়ার পর লোকটা সটান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আর ইউ কমফর্টেবল ইন হিন্দি? আই থিঙ্ক সাচ। সো মাচ নন বেঙ্গলিজ ইন ইওর ক্যাম্পাস। মাস্ট ইউ নো হিন্দি।’

একটু অবাক হলেও তখন মনে হয়েছিল ভালোই হল। শালা মনে মনে ট্রান্সলেট করে করে ইংলিশ বলার থেকে তো হিন্দিটা বলতে পারবে তুরন্ত। জন আব্রাহামের এত সিনেমা নইলে কেন বেকার বেকার দেখল এতদিন! তাছাড়া কলেজেও বেশির ভাগ স্টুডেন্ট হয় বিহারি নয়তো ইউপির বলে স্যার ম্যাডামদের দু’একজন বাদে বাকিরা হিন্দিতেই পড়ান। ইংলিশে পড়ান দু’একজন টেঁটিয়া টাইপের স্যার। শালা অত দেমাক যখন বিআইইএমে পড়ে আছিস কেন? সেখানে পুনের কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার কেমন সুন্দর সেধে হিন্দি বলতে চাইছে।

সেই লোকটির সঙ্গে এক অটোতে যাচ্ছে নীলোৎপল! স্বপ্নের মতো মনে হয় তার। বাবা মার কাছে শুনেছে, যে-লোক সত্যিকারের গুণী বাইরে সে অতি সাধারণ হয়। সেদিন ভদ্রলোকের পরনে ছিল ঝকঝকে স্যুট টাই। অফিসিয়াল কাজে ভিজিট। দামি পোশাক তো থাকবেই। অথচ আজ কেমন সাধারণ টি-শার্ট আর একটা স্যান্ডেল পায়ে অটোতে উঠে পড়েছেন। একটা রিস্ট ওয়াচ অবধি নেই কবজিতে। অটো তখন সবে স্টার্ট দিয়েছে আবার গৌরীবাড়ি থেকে। ভদ্রলোককে দেখে নীলোৎপলের মনে হল কোনও মেকি গাম্ভীর্য থাকা সম্ভবই নয় এই লোকের। নইলে সেদিন তাকে ভেবে ভেবে ইংরেজি বলতে দেখে ওইভাবে সরাসরি হিন্দি বলতে সাহস জোগাতেন না। আচ্ছা, আলাপ করলে হয় না ভদ্রলোকের সঙ্গে! নাকি ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হবে! না, তা কেন। একটা কথা জিজ্ঞেস করে তো কথা পাড়াই যায়।

ভদ্রলোক রাস্তার বাঁদিকেই তাকিয়েছিলেন তখনও। একবার গলা খাঁকারি দিয়ে নীলোৎপল বলে ওঠে, ‘এক্সিউজ মি স্যার, আপলোগ ভিজিট কিয়ে থে না হামারে বিআইইএম কলেজ মে। পিছলে মাহিনে…’

ভদ্রলোক বোধহয় অন্যমনস্ক ছিলেন। হঠাৎ করে খেয়াল করতে পারেন না নীলোৎপলের কথা। একটা জিজ্ঞাসু চাহনিতে তাকালেন তার মুখের দিকে।

নীলোৎপল আবার বলে, ‘স্যার মুঝে পহেচানা? বিআইইএম কলেজ মে পড়তে হ্যায়। মুঝকো সিলেক্ট কিয়া স্যার আপনে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কব ভেজেঙ্গে স্যার? জুলাই মে হি?’

ভদ্রলোক হঠাৎ এমন চমকে উঠলেন জীবনে কাউকে এতখানি চমকাতে দেখেনি নীলোৎপল। সে আশ্চর্য হয়ে যায়। ভদ্রলোকের মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আচমকাই।

‘অ্যাই, রোকিয়ে। অটো ইধার হি রোকিয়ে। তুরন্ত রোকিয়ে ভাই…’

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষার আওয়াজ। অটোওলা বিরক্ত হয়েছে স্বভাবতই। বলতে থাকে, ‘আরে ঠিকঠাক বাতাইয়ে কাঁহা ইতরেগা। উধার বোলা উলটোডাঙা…’

নীলোৎপলকে প্রায় টপকে নেমে যান জিটিবির এইচআর ম্যানেজার ভদ্রলোক। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দিয়েই আর তিলমাত্র অপেক্ষা করেন না ফিরতির। অটোওলাও অবাক হয়ে গেছে। মুখে বলে, ‘পাগলা নাকি রে ভাই। ফেরত পয়সাটা নিয়ে যাবি তো নাকি। এরকম লোক রোজ যেন ওঠে কয়েকটা করে…’

কী হয়ে গেল আচমকা বুঝতে পারে না নীলোৎপল। ভদ্রলোক এমন চমকে উঠলেন কেন তাকে দেখে? তবে এরই মধ্যে খেয়াল করেছে সে কোনও পার্স ছিল না ভদ্রলোকের সস্তার ট্রাউজার্সের পকেটে। পকেট থেকেই নোটটা বের করে দিয়েই প্রায় দৌড়ে উলটোমুখে যেন পালিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

অটো আবার চলতে শুরু করে। বোকা বনে যাওয়ার মতো মুখ করে বসে থাকে সে। এই মুহুর্তে অটোয় আরোহী মাত্র দু’জন। রোগাভোগা চেহারার অন্য লোকটা একবার তাকায় তার মুখের দিকে। তার চোখেও জিজ্ঞাসু চাহনি।

অরবিন্দ সরণির মাথায় উঠে যানজটশূন্য পথ। তিরের গতিতে ছুটতে থাকে অটো। সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ বোকা বোকা ভাবটা কেটে যায় নীলোৎপলের। বিচারবুদ্ধি কাজ করতে থাকে আবার। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক কথাই পরিষ্কার হতে থাকে ক্রমশ। পুনের কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার ক্যাম্পাসিং শেষ হয়ে যাওয়ার হপ্তাখানেক পরেও কেন কলকাতায় বসে আছে। যদি ছুটিতেও লোকটা থেকে যায় বাড়িতে তবে কেন প্রাইভেট গাড়ি নিদেনপক্ষে ট্যাক্সিতেও চাপেনি এই দরের একজন মানুষ। আর যদি স্রেফ তর্কের খাতিরেই অটোতেও চাপল তবে কেন গৌরীবাড়িতেই নেমে গেল সে। উলটোডাঙায় যাবে বলে উঠেছিল যেখানে অটোয়। তাকে দেখে ভূত দেখার মতো লোকটার চমকে ওঠার কারণটুকুও বুঝতে আর বাকি থাকে না।

উলটোডাঙার স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে অটো। ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে আসে নীলোৎপল।

সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় অনুরাগের কথাগুলো– ‘হুট করে তো রেপুটেড কারুর সঙ্গে কিছু ফিক্স করে ফেলা যায় না।’

অনুরাগরা নিশ্চয় এতক্ষণে অনেকবার ফোনে ট্রাই করে ফেলেছে তাকে। দঙ্গল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গ্লোবারের সামনেটায়। দেখতে পেলেই চরম খিস্তিতে ভূত করে দেবে বলে।

কিন্তু অনুরাগদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো মুখ আর নেই তার। যদি অটোর সেই লোকটা ঊনত্রিশে জানুয়ারি না যেত তাদের কলেজে, তাহলেও বরং আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত ওদের সামনে।

অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার মাঝখানটায় এসে দাঁড়ায় নীলোৎপল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শোভাবাজারের দিক থেকে দৈত্যের গতিতে তার শরীরের দিকে এগিয়ে আসা একটা বাসের দিকে।

কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট

গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।

এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।

অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।

বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।

গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।

গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।

পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।

তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।

এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।

গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।

নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।

মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।

হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।

তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।

গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।

এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।

আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।

গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।

গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।

পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।

—বর্ধনদা কেমন আছেন?

গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।

—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।

গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।

মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!

গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।

—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?

—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।

গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।

—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!

এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।

—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।

সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।

গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।

গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?

সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!

—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।

গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।

—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।

—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।

সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।

—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।

—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?

—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।

গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।

ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।

সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।

গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।

দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।

গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।

লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।

রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।

পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।

আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –

মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।

মিতা একটা দামি ব্র‌্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।

শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।

সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।

গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!

ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।

গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।

কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!

তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব