মুনিয়া

ঘটনার সূত্রপাত মাস দশেক আগে। সেদিন বৈশাখ মাসের সতেরো তারিখ। দিনটা এখনও মনে আছে পালকের। বোধহয় সারাজীবন-ই মনে থেকে যাবে। মারাত্মক গরম পড়েছিল সেদিন। এর আগে এপ্রিল মাসে এত গরম পালক দেখেনি কখনও। সেদিন-ই সে মোক্ষম জবাব দিয়েছিল কেয়াকে।

প্রায় বছর দুয়ে হল এই ফ্ল্যাটে এসেছে পালক। কেয়া অবশ্য তার-ও আগে থেকেই এখানে থাকে। এই ফ্ল্যাটটার পজিশন সবচাইতে ভালো বলে দামটাও তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি-ই ছিল। দামে-দরে ঠিকঠাক পোষাচ্ছিল না বলে প্রোমোটার ফ্ল্যাটটা নিজের হাতেই রেখেছিল। নীচের তলায় ডানপাশে ফ্ল্যাট। পালকের ফ্ল্যাটটা পছন্দ হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে তার ফ্ল্যাটের সামনে পুর্বমুখী এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। এই অঞ্চলে এরকম ফ্ল্যাট আর একটাও তার চোখে পড়েনি। তাই এক দেখাতেই পালকের পছন্দ হয়ে যায় ফ্ল্যাটটা।

পালকের হাজব্যান্ড সায়ন্তন ভোলাভালা গোবেচারা টাইপের মানুষ। বউ-এর পছন্দের ওপর ভরসা রেখে চলা পুরুষদের মধ্যে একজন। তাই ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে কোনও দ্বিমত বা দ্বিরুক্তি করার মতো কেউ না থাকায়, পালক ফ্ল্যাটটা খুব সহজেই কিনে নিতে পেরেছিল। যদিও ওদের একমাত্র সন্তান জুলির স্কুলটা এই ফ্ল্যাট থেকে একটু বেশি দূর হয়ে গেল। তা হোক সামনের এত সুন্দর জায়গাটাতে বেশ কয়েকটা টব বসানো যাবে।

ফুলে ফলে ভরে যাবে তার ঘরের সামনের জমি। একি কম আনন্দের কথা! আর তাছাড়া পালক তো হাউস ওয়াইফ। জুলিকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া সে-ই তো করে। বাড়ি থেকে একটু আগে বেরোতে হবে এই যা। দামটা একটু বেশি দিতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পছন্দসই জিনিসের জন্য দাম নিয়ে ভাবলে চলে না। তাই মানে মানে নিয়ে ফেলেছিল ফ্ল্যাটটা।

পালকের পাশের ফ্ল্যাটে প্রায় পালকের-ই বয়সের আর একটি বউ থাকে। সে-ই হল কেয়া। প্রথম থেকেই পালক কেয়াদের এড়িয়ে চলে। যদিও কেয়া ভীষণই মিশুকে এবং হেল্পফুল। এই তো ফ্ল্যাটে ঢোকার পরপর-ই পালকদের পুরোনো ওয়াটার পিউরিফায়ারটা কাজ করছিল না ঠিকঠাক। সেই সময় কেয়াই ওদের ঘর থেকে ফিলটার্ড জল বোতলে করে দিয়ে সমস্যা মিটিয়েছিল। তারপর যখন ফ্ল্যাটে কাজ চলছিল তখন মইটা দাও তো, এটা দাও তো সেটা দাও তো এসব তো লেগেই ছিল। কেয়া কিন্তু সবকিছুই হাসিমুখে করেছে। কখনও মনে হয়নি যে, সে বিরক্ত।

তবুও পালক ওদের এড়িয়ে চলত। কারণ, নিঃসন্তান কেয়ার ঘরে ওর পোষ্য মুনিয়া থাকত। মুনিয়া ফটফটে সাদা রঙের একটা বজ্জাত বেড়াল। কেয়াদের ঘরের দরজা খোলা পেলেই সে বেরিয়ে আসে। আর ঢুকবি তো ঢোক ঢুকে পড়ে পালকদের ঘরে। পালকের জাস্ট গা ঘিনঘিন করে বেড়াল দেখে। কুকুর ওর যদি-বা একটু সহ্য হয়, বিড়াল জাতটাকে সে মোটেই সহ্য করতে পারে না।

ফ্ল্যাট কেনার আগে পালক দুবার এসেছিল ফ্ল্যাটটা দেখতে। কিন্তু সেই সময় কেয়ার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় ওরা সপরিবারে মেদিনীপুর ছিল। ফ্ল্যাট কেনার আগের :  পর্যন্ত পালক জানতেই পারেনি যে, তার পাশের ফ্ল্যাটেই অমন একটা ইরিটেটিং অ্যানিম্যাল থাকবে আর যখন তখন তার ঘরে ঢুকে দুধ, মাছে মুখ লাগাবে।

এর আগে কেয়াকে বেশ কয়েকবার বলেওছে পালক, তোমার মুনিয়াকে গলায় চেন দিয়ে বেঁধে রাখো কেয়া। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না জাস্ট।

কিন্তু কেয়া একই কথা বলেছে প্রত্যেকবারেই, পালক, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড প্লিজ। ওরা জাতে বিড়াল হলেও আসলে মানুষের-ই মতো। তোমার গলায় যদি সারাক্ষণ দড়ি বেঁধে রাখা হয়, ভালো লাগবে তোমার?

কী কথার কী উত্তর! একটা বিড়ালের সঙ্গে মানুষের তুলনা! জাস্ট ডিসগাস্টিং। সেই বাদানুবাদের ঠিক দশ দিনের মাথায় দুই কেজি মাছ সবে ধুয়ে রেখেছে পালক। সায়ন্তন রোজ বাজারে যেতে পারে না বলে যেদিন-ই মাছ আনে বেশি করেই আনে। যেন দু-তিনদিন ফ্রিজে রেখে চালিয়ে নেওয়া যায়।

পালক ফ্রিজের পাশে মাছের গামলা রেখে কিচেনে ঢুকেছে, তিনটে বাটিতে তিন দিনের জন্য মাছ আলাদা আলাদা করে ফ্রিজে ঢোকাবে বলে। সে সময় কেন জানি না জুলি কি একটা কারণে দরজাটা খুলে রেখেছিল। ঠিক সেই সময় কেয়াদের বিড়াল মুনিয়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পালকের রান্নাঘরে ঢুকেই বসে পড়ল মাছ খেতে। যেন মাছগুলো ওর জন্যেই গামলায় যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে পালক। ব্যস। পালক দেখেই জোরে চিত্কার করে উঠল। পুরো দু-কেজি মাছ ফেলে দিতে হয় সেই দিন।

জুলির পছন্দের পাবদা আর ভেটকি মাছ ফেলে দিতে পালকের বুক ফেটে যাচ্ছিল। বারো-তেরোশো টাকার মাছ জুলিকে না খাইয়ে নিজেরা না খেয়ে এভাবে ফেলে দিতে মন চায় কারও! সায়ন্তন তবু মিনমিন করে বলেছিল বটে, যেদিক থেকে মুনিয়া খেয়েছে সেদিক থেকে ফেলে দিয়ে বাদবাকিটা নেওয়া যায় না পালক! কিন্তু না। বিড়ালের মুখের জিনিস খেয়ে অন্য কোনও বড়ো অসুখ বাধাবে! পালক কি পাগল হয়েছে নাকি!

তারপর থেকেই ভেতরে ভেতরে ফুটছে পালক। মুনিয়ার একটা চরম এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কীভাবে করবে তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপরেই তনয়াকে ফোন করে বেশ কিছুক্ষণ জরুরি আলোচনা সেরে নেয় সে।

তনয়া হচ্ছে পালকের সেই ছোটোবেলার স্কুল ফ্রেন্ড। মনের গঠনগত দিক থেকে দুজনেই প্রায় একই রকম। দুজনেই ভীষণ ভাবে ঘেন্না করে এই বিড়াল জাতটাকে। দুজনেই ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। দুজনের-ই প্রিয় রং ম্যাজেন্টা। দুজনেই বাগান করতে ভালোবাসে। এরকম আরও কত কী! তনয়ার মাথা থেকেই আইডিয়াটা বের হয়। ব্যস। তারপর আর কি! দেখেশুনে একটা দিন ঠিক করল পালক।

পরের সপ্তাহে মঙ্গলবার সায়ন্তন অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে জুলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে জিনিসটা কিনে নিয়ে ফিরল পালক। তারপর একটা বাটিতে মাছ আর একটা বাটিতে দুধ রেখে তার মধ্যে বিষটা বেশ যত্ন করে মাখিয়ে দিল সে। শত হলেও শেষ খাওয়া খাবে মুনিয়া। একটু ভালো করে দেওয়াই ভালো। এরপর সে গ্রিলটা টেনে দিয়ে দরজাটা খুলে রেখে ফ্রিজের পাশে বাটি দুটো সাজিয়ে রেখে আরাম করে স্নান করতে লাগল।

ওয়াশরুমের দরজা ফাঁক করে একবার দেখে নিল পালক। হ্যাঁ। প্ল্যান মতোই সবকিছু এগোচ্ছে। মুনিয়া আরাম করে দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পর পালক বেরিয়ে দেখল দুটো বাটিই সাফ করে মুনিয়া পালিয়ে গেছে। যাক বাবা! এতদিন পর একটা কাজের কাজ করেছে পালক। এরকম একটা কিছুর ভীষণ-ই দরকার ছিল। সবকিছুর-ই একটা সীমা থাকা উচিত। একেই তো বিড়ালের পশমকে দারুণ ভয় পায় পালক, তার ওপর আবার যখন তখন ঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দিয়ে দেওয়া। উফ! অসহ্য!

দুপুর পর্যন্ত মুনিয়ার আর কোনও সাড়াশব্দ পায়নি পালক। একবার উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেরকম কিছুই বুঝতে পারেনি সে। জুলিকে আনতে যেতে হবে। হাতে এই মুহূর্তে প্রচুর কাজ পালকের। রান্না করতে করতে একরকম ভুলেই গেছিল মুনিয়ার কথা, ঠিক সেই সময় কলিং বেলটা সশব্দে বেজে উঠল। কে এল! কেয়া নাকি! ও কিছু সন্দেহ করছে না তো!

দু-বার ঢোঁক গিলে পালক দরজা খুলল। সাথে সাথেই কেয়া চিত্কার করে বলল, কী করে এরকম একটা নোংরা কাজ করতে পারলে পালক! আমার মুনিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল। এই অবস্থায় নিজে একজন মা হয়ে আরেকটা মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে একটুও হাত কাঁপল না তোমার! ছিঃ।

—বিষ! এসব তুমি কী বলছ কেয়া! না বোঝার ভান করল পালক।

—ন্যাকামো না করে তোমার বাগানে গিয়ে দেখে আসো মুনিয়ার কী অবস্থা!

বাগানের নাম শুনেই এক লাফে সিঁড়ির প্যাসেজ পার হয়ে মেন গেটের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল পালক। বেরিয়ে ডান হাতে তার বাগান। বাগানের বেশিরভাগ-ই সব ছোটো ছোটো টব। তাতে কোনটা তুলসী, কোনটাতে ধনেপাতা, আবার কোনওটাতে গোলাপ। একটাই শুধু বড়ো গামলার মতো টব। গামলায় একটা বনসাই আম গাছ। গাছটা বেশ সুন্দর ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গরমে মাঝে মাঝেই মুনিয়া আম গাছটার তলায় এসে বসে থাকে। এখনও যেমন শুয়ে আছে। তবে এই শোয়ার সঙ্গে আগের শোয়ার বেশ পার্থক্য রয়েছে, সেটা ভালো মতোই বুঝতে পারল পালক। মুখে সেসব কিছুই প্রকাশ না করে পালক বলল, ও মা! মুনিয়া এভাবে শুয়ে আছে কেন!

—এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে করতে চাই পালক। মুনিয়া একটা ছোট্ট প্রাণী তার ওপর সে মা হতে চলেছিল। তাকে এভাবে খুন করলে কেন পালক?

তার মধ্যেই পালক দেখে নিয়েছে মুনিয়ার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে জিভ বের করে সে ঠিক আমগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে।

—উফ! দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এখানে এসেই মরতে হল! মরেও শান্তি দেবে না দেখছি মুনিয়া!

মুনিয়াকে বুকের মধ্যে নিয়ে কেয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই গর্ভবতী মাকে মারার শাস্তি ভগবান তোমায় দেবে না ভেবেছ! এর শাস্তি তুমি পাবেই পালক। আমার মুনিয়া এত বড়ো অন্যায় কিছুতেই সহ্য করবে না। তুমি মিলিয়ে নিও।

পালক এরকম অভিশাপ শুনে একটু থমকে গেছিল প্রথমে। কেয়ার কান্না দেখেও বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে পালকের। কেয়া মুনিয়াকেই যে তার নিজের সন্তান ভাবত তা সে মরমে মরমে বুঝতে পারছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পালক দেখল আম গাছটাও গর্ভবতী। ডালে ডালে মুকুল এসেছে। কদিন বাদেই ফল ধরবে। কিন্তু না। ফল ধরার আগেই বিনা নোটিশে গাছটা মরে গেল। কিছুদিন ধরেই গাছের গোড়ায় জল দিলেও জল শুষে নিচ্ছিল না আমগাছটা। তার দিন কয়েক পরে মুকুলগুলোও হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

পালকের মনে কু ডাকতে লাগল। তাহলে মুনিয়ার আত্মা-ই কি গাছটাকে মেরে ফেলল! ভগবান কি এভাবেই শাস্তি দিল পালককে! এরপর আম গাছের জায়গায় খুব ভালো জাতের একটা বনসাই বাতাবি লেবুর গাছ লাগাল পালক। রোজ পালকের হাতের পরিচর‌্যা পেয়ে গাছটা বাড়তে লাগল দ্রুত। কিছুদিন পরে ফুল ধরল তাতে। ততদিনে পালকও বুঝতে পেরে গেছে ওসব আত্মা-টাত্মা পুরো ফালতু ব্যাপার।

তনয়াও এই ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে পালককে। নিজের হাতে লাগানো গাছের বাতাবি লেবু জুলি খাবে। এটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে পালকের। কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না। বরং ঘটল ঠিক তার উলটোটা। ফুল আসার কদিন পর থেকেই গাছটা শুকোতে আরম্ভ করল। এবার সত্যি সত্যি ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকম ভয় পেতে শুরু করেছে পালক।

আম গাছটা না হয় এমনিই মরে গেছিল। কিন্তু বাতাবি লেবুগাছ! সেটা কোন কারণে মারা গেল! গাছগুলোর যদি মরার-ই ইচ্ছে হয় তাহলে আগে বা পরে নয় কেন! ঠিক মুকুল এলেই গাছগুলো মরে যায় কেন! এবারে আর কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিকেও মানতে নারাজ পালক। তনয়ার নানারকম যুক্তি শুনতে ইচ্ছে করে না তার। তার মনের মধ্যে ভয়, দুশ্চিন্তা ক্রমশই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আজ অনেক দিন যাবত ঘুমাতে পারছে না পালক। কখনও যদি বা একটু ঘুমিয়ে পড়ে তাহলেই স্বপ্নের মধ্যে মুনিয়াকে দেখতে পায় সে।

মুনিয়া যেন মিহি সুরে বলছে, আমার বাচ্চাদের মেরেছিস কেন পালক! আমাকেই বা মারলি কেন পালক!

যখন তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে পালক। দুই চোখের তলায় জমাটবাঁধা কালি। পেলব মসৃণ ত্বক জৌলুস হারিয়ে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শরীর ভেঙে আধখানা হয়ে গেছে। সায়ন্তন কোনও কিছুই বুঝতে না পেরে পাড়ার নার্সারি থেকে আবার একটা বনসাই আম গাছ এনে ফাঁকা টবে লাগিয়ে দিয়েছে।

পালক আর কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সায়ন্তনকে না। জুলিকে না। কাউকে না। বহু রাত সে ঘুমোতে পারছে না ঠিকমতো। ঘুম এলেও একটু পরেই ভেঙে যায়। বারেবারে মুনিয়ার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কেয়ার দেওয়া অভিশাপ সবসময়-ই যেন শুনতে পায় সে। তবে কি পালক পাগল হয়ে যাচ্ছে!

সকালে উঠতেই সায়ন্তন পালকের হাতটা ধরে বলল, পালক, আমগাছে মুকুল এসেছে। এবার আর কিছুই হবে না। এবারে তোমার গাছে আম ধরবে দেখো!

মুকুল ধরেছে! আবার মুকুল ধরেছে! উফ! আবারও আসবে মুনিয়া। এই গাছটাকেও বাঁচতে দেবে না ও। কিছুতেই বাঁচতে দেবে না মুনিয়া।

পাশের কোনও একটা ফ্ল্যাট থেকে রাত দুটোর ঘন্টা বাজল। ঘুম আসছে না পালকের। এভাবে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বরং ওয়াশরুমে গিয়ে একটু মুখে জল দিয়ে আসি। ভাবতে ভাবতেই খুব আস্তে করে শোবার ঘরের দরজা খুলল পালক। নাহ! জুলিদের ঘুম ভাঙেনি। ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে বারান্দার দিকে চোখ পড়ে গেল হঠাত্। আমগাছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমগাছের পাশে ওটা কে দাঁড়িয়েছিল মনে হল! বসে পড়ল নাকি! আর দেখা যাচ্ছে না তো! পা টিপে টিপে বারান্দার কাছে এসে দেখল, কেকা একটা মগে একটা নুনের প্যাকেট থেকে নুন ঢেলে জলে গুলছে আর আম গাছের গোড়ায় ঢেলে দিচ্ছে।

ওহ মাই গড! গাছে মুকুল এলেই গাছগুলো তাহলে এভাবেই মরে যায়! হায় রে কেয়া! পালক প্রেগন্যান্ট মুনিয়াকে মেরেছে বলে তুমি আমার ফলবতী গাছগুলোকে এভাবে মেরে ফেলছ! মুনিয়ার মতো যে গাছগুলিও নিষ্পাপ গো কেয়া! আমি তো মহাপাপ করেছিলাম কেয়া। সেটা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। কত বড়ো ভুল আর অন্যায় যে সেদিন করেছিলাম এক গর্ভবতী মাকে খুন করে, সেটা ভেবে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি। সেই একই ভুল তুমিও করলে কেয়া! ভুল দিয়ে ভুলকে কি উপড়ে ফেলা যায় কেয়া!

আজ বহু দিন পর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে পালকের। আজ থেকে আবার ঘুমোবে সে।

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল, কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডার্লিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ সবই বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না, ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়নও নিজের রাগ সামলাতে না পেরে রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের মন অশান্ত হয়ে উঠল।

 

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল রোমার। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেয়েটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যের সাগরে তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

গুড সামারিটান

প্রকাশ ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে চলে যাবার পর প্রায় দুমিনিট মোহাচ্ছন্নের মতো দরজা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল বাসবী।

দুপুর দেড়টা নাগাদ খিচুড়ি খেতে বসেছিল বাসবী আর ঠিক সে সময়ই প্রকাশ এসে হাজির হল। পাঁচদিন আগে লক্ষীনগরের মোড়ের কাছে রাস্তা পার হবার সময় অটোর ধাক্কায় ছিটকে রাস্তায় পড়ে গিয়ে বাসবী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। চারপাশে জমে যাওয়া ভিড়ের মধ্য থেকে যখন কেউ এগিয়ে আসছিল না ওকে সাহায্য করতে তখন প্রকাশই বাসবীকে রাস্তা থেকে তুলে ওলা ডেকে, নিয়ে গিয়েছিল আকাশ নার্সিংহোমে।

ডান পায়ে পাতায় হেয়ার-লাইন ফ্র‌্যাকচার জুড়তে প্লাস্টার আর ফেটে যাওয়া মাথায় পাঁচটা স্টিচিং লাগিয়ে প্রকাশ ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সন্ধের দিকে। যাবার সময় ও বলেছিল দেখা করতে আসবে কোনও একদিন। কিন্তু এভাবে দুপুরের দিকে আগে না জানিয়ে ও এসে হঠাৎ হাজির হবে ভাবতে পারেনি বাসবী।

—চমকে গেছেন আমাকে দেখে, তাই না? প্রকাশ বলেছিল হেসে। অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম।

বাসবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, না না, বিরক্ত হব কেন? আসুন ভেতরে।

—আপনি ওয়াকার ইউজ করছেন না কেন? ভাঙা পা তাড়াতাড়ি সারাতে হলে আপনাকে ওয়াকারের সাহায্য নিতে হবে।

—আমার মেয়ে রিয়াও আমাকে ওয়াকার নিতে বলেছে, বাসবী দরজা বন্ধ করতে করতে বলেছিল।

—আপাতত আমার হাতে ভর দিয়ে ভেতরে চলুন আপনি, প্রকাশ বলল হাত বাড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘকায়, সুদর্শন যুবকটি বয়সে অন্তত দশ বছরের ছোটো হবে ওর থেকে কাজেই বাসবী বিনা দ্বিধায়, অসংকোচে প্রকাশের হাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে এসে বসল সোফায়।

—সেদিন আপনি খুব বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন আমাকে মিস্টার প্রকাশ।

—যখন বয়সে আপনার থেকে ছোটোই, তখন আমাকে নাম ধরে তুমি বলে সম্বোধন করলে খুশি হব।

বাসবী হেসে বলল, আচ্ছা তাই করব আমি। সেদিন তুমি এসে আমাকে রাস্তা থেকে না তুললে পেছন থেকে কোনও গাড়ি বা ভ্যান এসে যদি…

—আরে না না, অতটা ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। লোকজন তো জমেই গিয়েছিল আপনার চারপাশে, কেউ না কেউ ঠিক এগিয়ে আসত আপনাকে তুলে নিতে।

বাসবী ভ্রূ কুঁচকে বলল, বুঝতে পাচ্ছি তুমি দিল্লির ছেলে নও। এখানকার লোকজন কারও আপদ-বিপদে সহজে এগোতে চায় না। পকেটমার, ছিনতাইবাজ কাজ করে চলে যায় কিন্তু চ্যাঁচামেচি করলেও সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসে না। তা কোথাকার ছেলে তুমি বলো তো?

—আমার বাড়ি বেনারস। পড়াশোনা করেছি এলাহাবাদ আর বেঙ্গালুরুতে। চাকরি নিয়ে গুরুগ্রামে এসেছি ছমাস হল।

—খুব ভালো। বসো প্রকাশ, তোমার জন্য চা করে আনছি আমি।

—মাফ করবেন, এই ভরদুপুরে চা খাব না। আপনার দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে?

বাসবী ভাবল হ্যাঁ বলবে, কিন্তু তারপর ওর মনে হল যে-লোকটা ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে তাকে মিথ্যে বলবে না। আমার ঝি উমা খিচুড়ি রেঁধে রেখে গেছে আমার জন্য। তোমার যদি আপত্তি না থাকে একটু খিচুড়ি খেয়ে নাও আমার সঙ্গে।

প্রকাশ প্রথমে না না করলেও শেষ পর্যন্ত বাসবীর অনুরোধে খিচুড়ি খেতে বসে গেল ওর সঙ্গে।

—আগে থেকে জানিয়ে এলে তোমাকে এর থেকে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারতাম, বাসবী বলল খেতে খেতে। রাজমা-চাওল কিংবা পুরি-সবজি। তা এদিকে কোথায় এসেছিলে তুমি?

প্রকাশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কেন আপনাকে দেখতে আসতে পারি না আমি? আজ তো শনিবার, আমার অফিস ছুটি।

—কী কাজ করো তুমি, প্রকাশ?

—আমি ইঞ্জিনিয়র, একটা আইটি কোম্পানিতে কাজ করি।

—খুব ভালো। আমার মেয়ে রিয়ার সঙ্গে তোমার কখনও আলাপ করিয়ে দেব। ও দুসপ্তাহ আগে পুণেতে গেছে কম্পিউটার সাযে্সে বিটেক কোর্স করতে। আমার মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভালো। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় সাতানব্বুই পারসেন্ট পেয়েছে সাযে্সে। জযে্ট এন্ট্রান্সেও ভালো রেজাল্ট করেছে। বাসবী সস্নেহে তাকাল দেয়ালে টাঙানো, ফ্রেমে বাঁধানো, মা-মেয়ে যুগল ছবির দিকে। গালে গাল লাগিয়ে ওরা যেভাবে হাসছে তাতে ওদের মা মেয়ে নয়, দুই বোন বা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

—আপনার সঙ্গে আপনার মেয়ে বয়সের তফাত খুব কম মনে হচ্ছে এই ছবিতে, প্রকাশ বলল ছবির দিকে চোখ রেখেই।

—ঠিকই বলেছ তুমি, ও আমার থেকে ঠিক সতেরো বছরের ছোটো। আমরা এখন বন্ধুর মতোই হয়ে গেছি।

খাওয়া হয়ে গেলে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ওরা এসে বসল সোফায়। একটু পরে প্রকাশ বলল, এখন আপনি বিশ্রাম করুন, আমি উঠি। সামনের বার এসে আপনাকে যেন ওয়াকার নিয়ে হাঁটছেন দেখতে পাই।

—নিশ্চয়ই দেখবে, কিন্তু তোমার সামনের বার কতদিন পরে আসবে সেটা তো বললে না?

প্রকাশ হেসে বলল, শনি-রোববার ছাড়া তো আমার আসা হবে না।

—এবার দয়া করে একটা ফোন করে এসো, যাতে তোমাকে আবার খিচুড়ি খেতে না হয়। আমার ফোন নাম্বারটা সেভ করে নাও তোমার মোবাইলে।

একটু পরে প্রকাশের হাতে ভর দিয়ে বাসবী দরজায় পৌঁছেছিল ওকে বিদায় জানাতে। কিন্তু দরজার ছিটকিনি না খুলে বাসবীর মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে ওকে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রকাশ চুমু খেল! বাসবী প্রথম ভেবেছিল প্রকাশ ওর সঙ্গে বেয়াড়া ঠাট্টা করছে, কিন্তু প্রকাশের উত্তপ্ত ঠোঁট ওর ঠোঁটের উপর চেপে রইল পুরো এক মিনিট কিংবা তারও বেশি সময়। তারপর মুখ তুলে বাসবীর দুই গালে চুমু খেয়ে নরম গলায় ও বলেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাসবী।

দরজা খুলে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ও নীচে চলে গেল আর হতভম্ব বাসবী পাথরের মূর্তির মতো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

দুই

দুর্ঘটনার পর কীভাবে প্রকাশ ওকে রাস্তা থেকে তুলে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিত্সা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ রিয়াকে পরের দিনই জানিয়েছিল বাসবী। সেদিন সন্ধ্যার দিকে মায়ের শরীর কেমন আছে ফোনে জানতে চাইলে বাসবী মেয়েকে জানাল, প্রকাশ আজ ওকে দেখতে এসেছিল। খুব ভালো ছেলেটা, বলল বাসবী হালকা ভাবেই।

—হি ইজ আ গুড সামারিটান, মম। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি খুব আনন্দে রয়ে আজ, রিয়া বলল। প্রকাশ কি খুব হ্যান্ডসাম মম?

—তা বলতে পারিস। বেনারসের ছেলে, একটু বাউন্ডুলে টাইপের নইলে এভাবে না জানিয়ে ভরদুপুরে এসে হাজির হয়? আমি ভাবলাম খেয়েটেয়ে এসেছে, তাই চা অফার করলাম। চা না খেয়ে ছেলেটা শেষে আমার সঙ্গে বসে খিচুড়ি খেল।

—ভালোই তো, হ্যান্ডসাম গুড সামারিটানের সঙ্গে বসে খিচুড়ি খাওয়ার ভাগ্য কজনার হয় বলো?

—ধ্যাৎ, কী যে বলিস তুই। পাগলাটে টাইপের ছেলে ও, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। প্রকাশ যে ওকে চুমু খেয়েছে সে খবরটা মেয়েকে জানাবার সাহস হল না বাসবীর। প্রকাশ যদি সত্যিই খেয়ালের বশে ওকে চুমু খেয়ে থাকে আর দুএকবার ওর খবরাখবর নিয়ে এখানে আসা বন্ধ করে দেয়? রিয়া জানতে পারলে মাকে ত্রিশোর্ধ মহিলাদের নতুন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, সে ব্যাপারে জ্ঞান দিতে শুরু করবে।

—পা কেমন আছে তোমার? রিয়া জিজ্ঞেস করল।

—ব্যথাটা চলে গেছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো ক্যালসিয়াম খেয়ে যাচ্ছি। ওয়াকার নিয়ে চলাফেরা করছি না বলে প্রকাশ খুব বকাবকি করে গেল।

—ঠিকই করেছে, আমি তো প্রথম দিনই বলেছিলাম তোমাকে। তা আমার কথা শুনলে তো! ওয়াকার না ইউজ করলে পায়ে পাতার উপর জোর পড়বে, হাড় জোড়া লাগতে সময় লাগবে।

—ঠিক আছে, ওয়াকার কিনে নেব আমি। কাল পাশের বাড়ির সুনীতাকে নিয়ে নার্সিংহোমে যাব কপালের স্টিচ কাটতে। এবার তোর খবর বল। কলেজ, হস্টেল সব ঠিক আছে তো?

রিয়া জানাল, ওর কলেজের ফ্যাকাল্টি খুব ভালো, প্রশ্ন করলে বিরক্ত হয় না। হস্টেলে ওর রুমমেট অঙ্কিতা খুব শান্ত, পড়ুয়া মেয়ে একটু ধার্মিক টাইপের, সকালে উঠে হনুমান চল্লিশা পড়ে, বৃহস্পতিবার সাঁইবাবার মন্দিরে যায়। ওর বাড়ি লখ্নউ-এ। হস্টেলের খাবারদাবার এ ক্লাস না হলেও মোটামুটি ভালো, টলারেব্ল বলা চলে। গতকাল ফ্রেশারদের জন্য যে-পার্টি দিয়েছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ, তাতে রিয়া রং দে বাসন্তী গেয়ে খুব তালি পেয়েছে। পুণেতে গিয়ে রিয়া ওর কলেজ লাইফ ভালোভাবে উপভোগ করছে শুনে বাসবী নিশ্চিন্ত হল।

মেয়ে সঙ্গে কথা শেষ করে বাসবী এসে ওর শোবার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ছত্রিশ বছর বয়সে বাসবী এখনও সুন্দরী, এমনকী রিয়ার ভাষায় ওকে সেক্সিও বলা চলে। গায়ে রং একটু চাপা আর মাঝারি উচ্চতার হলেও ওর বড়ো বড়ো প্রতিমার মতো টানা চোখ, ডিম্বাকৃতি মুখের গড়ন, পুরু ঠোঁট (রিয়ার ভাষায় বি স্টাংগ লিপ্স) আর লম্বা, ঘন, কালো চুল এখনও আকৃষ্ট করতে পারে প্রকাশের মতো অনেক কম বয়সি ছেলেকে। রসগোল্লা খেয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনে দিল্লির বাঙালি কলোনি চিত্তরঞ্জন পার্কে বড়ো হওয়া বাসবী এখন দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব দিল্লির পাণ্ডব নগরের বাসিন্দা।

মুখের উপর এসে পড়া চুল সরিয়ে দিয়ে আয়নায় হাসল বাসবী। কী দেখল প্রকাশ ওর মধ্যে যে দ্বিতীয়বার দেখা হতেই ওর এই অসুস্থ অবস্থায় চুমু খেয়ে বসল ওকে? পুরুষ মানুষকে সব সময় চেনা যায় না, বোঝা যায় না। লম্বা একটা শ্বাস নিল বাসবী। প্রকাশ এক আচেনা, আগন্তুক, আমাকে সাবধানে থাকতে হবে, বাসবী নিজেকে বোঝাল। কে জানে বেনারসের এই সুদর্শন ছেলেটি ওর সঙ্গে ভাব করে হয়তো শুধু উপভোগ করতে চায় তার শরীর, ওর সেবার বিনিময়ে যদি সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায় তবে ওকে স্পষ্ট ভাবে না করে দিতে হবে।

মনস্থির করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসবী চলে গেল রান্নাঘরে এক কাপ চা করতে। না, কাল সুনীতার সঙ্গে বেরিয়ে নার্সিংহোম থেকে ফেরার পথে একটা ওয়াকার কিনতে হবে। না হলে হুট করে প্রকাশ যদি আবার এসে পড়ে কোনওদিন তাহলে, গালমন্দ শুনতে হবে তাকে।

তিন

পরের শনিবার সন্ধের দিকে প্রকাশ আবার এসে হাজির হল ফোন না করেই। বাসবী ওয়াকার ব্যবহার করছে দেখে ও খুশি হল, আরও খুশি হল ওর মাথার স্টিচ খুলে ফেলা হয়েছে দেখে।

—আজ তোমার কপাল ভালো প্রকাশ, বাসবী বলল সোফায় বসে। আমার ঝি ঊমা বিকেলে এসে সুজির হালুয়া করে দিয়ে গেছে, চায়ের সঙ্গে ওটাই দেব তোমাকে।

—কিন্তু ভাঙা পায়ে ভর দিয়ে তোমাকে আমার জন্য চা করতে হবে না, প্রকাশ বলল। প্রকাশ যে ওকে তুমি সম্বোধন করেছে তাতে আর আশ্চর্য হল না বাসবী।

—চা করতে কোনও অসুবিধা হবে না আমার, বলল বাসবী। ওয়াকার নিয়ে এখন আমি দিব্বি চলাফেরা করতে পারি।

—চলো রান্নাঘরে গিয়ে তোমায় সাহায্য করি আমি।

প্রস্তাবটা সরাসরি নাকচ করে দিতে চাইল না বাসবী। তাই বলল, সবতো হাতের কাছেই আছে, কী দরকার তোমার?

কিন্তু প্রকাশ ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছে, কাজেই ও যখন কেটলিতে জল ভরে, উপরের তাক থেকে চায়ের কাপ, ছাঁকনি ইত্যাদি এগিয়ে দিল, বাসবী কোনও বাধা দিল না। চায়ের জল যখন ফুটতে আরম্ভ করেছে ঠিক তখনই প্রকাশ ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেল আর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল সেই যাদু মাখানো, হৃদয় দ্রবিভত করা তিনটে শব্দ— আমি তোমাকে ভালোবাসি।

প্রকাশ যখন ওর সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকল বাসবী তো তখনই জানত, প্রকাশ ওকে চুমু খাবে! তবু ওর হাত কাঁপল, নিশ্বাস ঘন হয়ে এল। আমাকে চা-টা করতে দাও প্রকাশ, ও কাঁপা গলায় বলল।

উত্তরে নব ঘুরিয়ে গ্যাসের উনুন বন্ধ করে দিয়ে প্রকাশ বলল, চা পরে খাওয়া যাবে।

ওরা দুজন যখন গভীর আবেগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল ঠিক তখনই বেল বাজল দরজায়। পাশের বাড়ির সুনীতা এসেছে, আঁচল দিয়ে ঠোঁট মুছে ফিসফিস করে বলল বাসবী। তুমি আমার মেয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো যতক্ষণ না ও চলে যায়।

কিন্তু সে রাতে সুনীতা গল্পগাছা সেরে যখন উঠল তখন রাত সোয়া আটটা। ততক্ষণে রিয়ার বিছানায় শুয়ে প্রকাশ ম্যাগাজিনের পুরোনো একটা সংখ্যা নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসবী এসে যখন ওকে জাগিয়ে তুলে সুনীতার দেওয়া পুরির সঙ্গে হালুয়া খেতে দিল তখন নতুন করে প্রেমপর্ব শুরু করার উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছে ওরা দুজনেই।

সে রাতে বিছানায় শুয়ে বাসবীর মনে হল, প্রকাশকে ওর পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল নতুন করে প্রেমে পড়ার বয়স ও পেরিয়ে এসেছে। শরীরের একটা নিজস্ব দাবি আছে যেটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই বাসবীর কিন্তু সেটা মেটাতে গিয়ে নতুন ভাবে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চায় না ও। নতুন সম্পর্ক মানেই নতুন আবেগ আর আবেগ মানুষকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার কোনও ঠিকানা নেই। নাহলে মাত্র ষোলো বছর বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ওর বাবার অফিসের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক, পাঞ্জাবি ছেলে রোহিত খন্নার সঙ্গে কালকাজি মন্দিরে গিয়ে মালা বদল করতে পারত না বাসবী।

বিয়েটা ওদের টিকেছিল ঠিক দেড় বছর কারণ ওই সময়ে মধ্যেই মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছেলে রোহিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভালো সরকারি চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। পরিবারের গুঁতোয় আর পাঁচ কোটি টাকা পণের লোভে রোহিত লুধিয়ানার এক ধনী পরিবারের মেয়ে নেহাকে বিয়ে করে ফেলল। আর আঠারো বছর বয়সে ছমাসের মেয়ে কোলে নিয়ে পাণ্ডব নগরের দুকামরার ভাড়া বাড়িতে এসে উঠতে হয়েছিল বাসবীকে।

বাসবীর বাবা রণেন বোস কোর্টে কেস ঠুকে দিলে রোহন শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব নগরের এই পাঁচশ পঞ্চাশ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট, দুকামরার ফ্ল্যাট আর মেয়ে ভরণপোষণ এবং শিক্ষার জন্য কুড়ি লাখ টাকা বাসবীর অ্যাকাউন্টে জমা করে ডিভোর্সের পেপারে সই করায় ওকে দিয়ে।

মেয়ে দশ বছরে পড়লে বাসবী ওকে সব কথা জানিয়ে দিয়েছিল কেন না একটু বড়ো হবার পর থেকেই রিয়া ওকে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল। সব শুনে ওই বয়সেই বুদ্ধিমতী রিয়া মাকে বলেছিল, তোমার বয়স কম, দেখতেও তুমি খারাপ নও। তুমি আবার বিয়ে করো, মম।

বাসবী হেসে বলেছিল, না রে, আমি বিয়ে টিয়ে করব না। আমি তোকে নিয়ে খুব ভালো আছি।

কয়েক বছর পর আরেকটু বড়ো হলে বাসবী মেয়েকে বলেছিল, সাবধান রিয়া, আমার মতো অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে জীবনটা নষ্ট করবি না তুই। নিজের পায়ে ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ে কথা ভাববি।

তা রিয়া তো মার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। উনিশ বছরের মেয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও ছেলেকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কিন্তু মা হয়ে বাসবী কি সেই ভুলটাই করতে বসল দ্বিতীয় বার?

পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ রিয়া ফোন করলে বাসবী বলল, তোকে একটা কথা বলার ছিল রিয়া।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোবাইলের স্পিকার অন করে রিয়া বলল, ভালো না খারাপ কথা সেটা আগে বলে দাও মম।

—সেটা নির্ভর করছে তুই কীভাবে নিবি আমার কথাটা তার উপর। আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেমে পড়ে গেছি।

রিয়া চট করে ওর প্রতিক্রিয়া জানাল না। সম্ভবত খবরটা ভালো ভাবে হজম করতে একটু সময় নিল ও, তারপর বলল, তুমি ঠাট্টা করছ না তো মম? তা কার প্রেমে পড়লে তুমি? প্রকাশ?

—হ্যাঁ। বয়সে আমার থেকে বছর দশেকের ছোটো হবে ও।

—সেটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু ও যে তোমাকে সত্যি ভালোবাসে সেটা তোমার জানা দরকার।

—বার বার বাড়ি আসছে আর…

—তোমাকে চুমু খেয়েছে, তাই না?

—কী করব বল? রান্নাঘরে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরে…

—ঘুরে দাঁড়িয়ে কষে একটা থাপ্পড় মারলে না কেন?

—কী করে থাপ্পড় মারব ওকে? ও যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নার্সিংহোমে চিকিত্সা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে।

—সত্যিকার গুড সামারিটানরা কিন্তু সাহায্যপ্রার্থীকে প্রেম নিবেদন করে না, মম। ওর যে আর কোনও প্রেমিকা নেই বা ও যে বিবাহিত নয় সেটা জানার প্রযোজন বোধ করলে না তুমি? কী আশ্চর্য! ও যে তোমার সঙ্গে দুদিন ফুর্তি করে কেটে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী?

—ওকে এসব কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। এখন কী করব তুই বল আমাকে।

—ও তোমাকে বিছানায় নিয়ে যায়নি তো?

—না, আর চাইলেও আমি রাজি হব না।

—গুড। সিচুযেন এখনও তোমার কন্ট্রোলেই আছে। ও আবার এসে চুমু খেতে চাইলে বা প্রেম নিবেদন করলে ওকে স্পষ্ট বলে দিও তুমি ওর আন্টির বয়সি, কাজেই তোমাকে ও যেন আন্টি বলেই ডাকে আর আন্টির সন্মান দেয়। ওকে সোজাসুজি বলবে ও যেন ওর নিজের বয়সি কোনও মেয়ে খুঁজে নেয় প্রেম ভালোবাসার জন্য।

—ঠিক আছে, তুই যেরকম বললি সে রকমটাই করব আমি।

—গুড গার্ল। যা বললাম তাই করবে। কলেজের সময় হয়ে গেছে, আমাকে এখন ছুটতে হবে। বাই মম।

চার

সাতদিন পর রোববার সকালে প্রকাশ এসে বলল, আমাকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে, বাসবী।

রিয়ার উপদেশ মনে ছিল বাসবীর, তবু কেন ওর বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল ও বুঝতে পারল না।

—কোথায় যাচ্ছ তুমি?

—সিয়াটেল, ইউএসএ। ছমাসের ট্রেনিং হবে ওখানে।

—খুব ভালো। মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করল বাসবী। নতুন দেশ দেখবে, চাকরিতে আরও উন্নতি হবে।

—কিন্তু তোমাকে তো ওখানে দেখতে পাব না।

—আমি তো তোমার আন্টির বয়সি প্রকাশ। আমার বয়স কত জান তুমি? চল্লিশে পা রেখেছি আমি। নিজের বয়সটা চার বছর বাড়িয়ে প্রকাশকে ওর থেকে দূরে সরে যাবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল বাসবী। তারপর বলল, আমাকে তুমি আন্টি বলে ডাকলেই খুশি হব আমি।

—নেভার! আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাসবী।

—কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না, বলতে গিয়ে বলতে পারল না বাসবী। নিজের বয়সি কোনও মেয়েকে তুমি খুঁজে নাও প্রকাশ, বাসবী বলল রিয়ার উপদেশ মনে রেখে।

আর ঠিক তখনই প্রকাশ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল প্রবল আবেগে, বাসবীর শ্বাস রোধ করে। দুমিনিট পর ওর ঠোঁট থেকে মুখ তুলে নিয়ে প্রকাশ বলল, আমার ভালোবাসার কী প্রমাণ চাও তুমি আমার কাছ থেকে, বলো?

—ছ’মাস পর আমেরিকা থেকে ফিরে এলে এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলব আমি, বাসবী বলল ওর চোখে চোখ রেখে। বাসবী জানে ছ মাসের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে দুজনের জীবনে। বিদেশে গিয়ে প্রকাশ কোনও অল্প বয়সি, সুন্দরী মেয়ে সংস্পর্শে এসে ওকে ভুলে যেতে পারে।

—ঠিক আছে, তাই হবে। কিন্তু ছমাস পর ফিরে এলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না তুমি। তুমি হয়তো জানো না তোমাকে রাস্তা থেকে কোলে তুলে নেবার সময়-ই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ।

বাসবী মুখ ফিরিয়ে নিল কেন না ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল। ভাগ্যের এ কী বিড়াম্বনা? প্রকাশ যদি দশ বছর আগে আসত ওর জীবনে তাহলে ওকে বিয়ে করতে কোনওই অসুবিধা ছিল না বাসবীর। এমনকী রিয়াও কোনও বাধা দিত না ওদের বিয়েতে।

বাসবীর অনুরোধ সত্ত্বেও প্রকাশ চা খেতে রাজি হল না সেদিন। ও বলল বাইরে যাবার জন্য ওকে কিছু কেনাকাটি করতে হবে আর দেখা করতে হবে কয়েকজন কলিগের সঙ্গে। যাবার আগে শুধু এটুকুই জানিয়ে গেল প্রকাশ যে আমেরিকায় গিয়ে বাসবীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখবে ও।

সন্ধ্যার দিকে রিয়া ফোন করলে বাসবী জানাল প্রকাশ অধ্যায়ে যবনিকা টেনে দিয়েছে ও কোনওরকম ঝগড়াঝাঁটি না করেই। প্রকাশ যে ট্রেনিং নিতে আমেরিকার সিয়াটেলে চলে যাচ্ছে তাও জানাল রিয়াকে।

—ভেরি গুড মম। ইউ হ্যাভ ডান দ্য রাইট থিং। ছমাসের মধ্যে ও ওর পার্টনার ঠিক পেয়ে যাবে, হয়তো সুযোগ পেলে আমেরিকায় ও সেটল করে যাবে। ওখানের কোনও মেয়েকে বিয়ে করলে গ্রিন কার্ড পেতেও সুবিধা হবে ওর।

—ওখানে গিয়ে ও আমাকে ফোন করবে বলে বলেছে। ভাবছি ওর ফোন এলে আমি তুলব না, কী বলিস তুই?

—নো মম, ডোন্ট বি সিলি। আফটার অল হি ইজ আ গুড সামারিটান। ফোন করলে কথা বলবে জাস্ট অ্যাজ আ ওয়ে উইশিং আন্টি।

—কিন্তু আন্টি বললে ও যে খুব রেগে যায়।

—ওকে, ওকে, দেন ট্রিট হিম অ্যাজ আ ফ্রেন্ড, অ্যাজ আ গুড সামারিটান। গুড সামারিটানদের ডিসকারেজ করতে নেই কারণ ওদের সংখ্যা কমে আসছে পৃথিবীতে।

রিয়ার সঙ্গে কথা বলে মন হালকা হয়ে গেল বাসবীর। ঈশ্বরের ইচ্ছায়-ই প্রকাশ দূরে সরে যাচ্ছে যাতে ওর সঙ্গে সম্পর্কটা দানা বাঁধতে না পারে, ভাবল বাসবী স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে

পাঁচ

প্রথম সপ্তাহটা ভয়ে ভয়ে কাটল বাসবীর প্রকাশের ফোন আসবে ভেবে। রিয়া যতই বলুক একটা জোয়ান, শক্ত-সমর্থ ছেলে যে ওকে কোলে তুলেছে, ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে বেশ কয়েকবার, তাকে প্রেমিকের সিংহাসন থেকে নামিয়ে বন্ধুত্বের নড়বড়ে চেয়ারে বসানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনমাস পরেও প্রকাশের ফোন না আসায় বাসবীর সেই সমস্যাটা মিটে গেল।

রিয়া শুনে বলল, মম, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম ও ওর পার্টনার জোগাড় করে নেবে। সিয়াটেল তো আইটি হাব, বেশ কয়েক হাজার ইন্ডিয়ান থাকে ওখানে। আচ্ছা শোনো, ক্রিসমাস ভ্যাকেশনে আসছি আমি পাঁচদিনের জন্য। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।

—আমারও তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কথা বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল বাসবীর। প্রায় ছমাস মেয়েকে দেখেনি ও।

ক্রিসমাসের ছুটিতে রিয়া এলে পাঁচটা দিন মা আর মেয়ে খুব আনন্দে কাটাল। ওরা দুজন তো বন্ধুর মতোই ছিল আগে থেকে। এখন ছমাস দূরে থাকার পর সেই বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে। একসঙ্গে মলে যাওয়া, সিনেমা দেখা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া… দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কীভাবে উড়ে চলে গেল টেরও পেল না ওরা।

বাসবী বাঙালি রান্নাবান্না শেখবার তেমন সুযোগ পায়নি, তবু বাংলা চ্যানেলে রান্নার রেসিপি দেখে নিয়ে রিয়ার পুণে ফিরে যাবার আগের দিন শুক্তোনি আর মোচার ঘন্ট করে খাওয়াল মেয়েকে।

রিয়া চলে যাবার দুসপ্তাহ পর বাসবী যখন ধীরে ধীরে ওর একক জীবনে আবার অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তখনই ফোন এল প্রকাশের। সকাল দশটার দিকে এল ফোনটা, আমেরিকায় তখন প্রায় রাত বারোটা। ফোন ধরে হ্যালো বললে ওপাশ থেকে প্রকাশ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন আপনি আন্টি?

প্রকাশের মুখে এই প্রথম আন্টি ডাক শুনে বাসবী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। ঢোক গিলে কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছো প্রকাশ?

—আমিও খুব ভালো আছি আন্টি। অনেকদিন আপনাকে ফোন করব ভেবেছি, কিন্তু ঠিক সাহস করে উঠতে পারিনি। তা আপনার পা ঠিক আছে এখন?

—হ্যাঁ, চলতে ফিরতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

—খুব ভালো। আপনার মেয়ে রিয়া কেমন আছে?

রিয়ার নাম শুনে খুশি হয়ে বাসবী বলল, ক্রিসমাসের ছুটিতে ও এখানে এসেছিল। দুজনে মিলে খুব ঘোরাঘুরি করেছি, সিনেমা দেখেছি, রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। ও তো এখন আমার বন্ধুই!

—তা তো বুঝতেই পারছি। আমার দুঃখটা কী জানেন আন্টি, বয়সে অনেক ছোটো মেয়েকে বন্ধু করতে আপনার কোনও বাধা নেই কিন্তু কম বয়সি কাউকে নিজের প্রেমিক হিসেবে মেনে নিতে আপনার ঘোর আপত্তি আছে। এই ডাব্ল স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে জীবন কাটাতে আপনার যে-কোনও অসুবিধা হচ্ছে না সেটাই খুব আশ্চর্য লাগছে আমার!

বাসবী বুঝল প্রকাশ ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বসেছে। অপ্রস্তুত হয়ে ও বলল, এসব কথা এখন থাক না প্রকাশ। তোমার ওখানে কেমন সময় কাটছে বলো।

—দিনটা কীভাবে কেটে যায় টের পাই না কারণ ট্রেনিং-এ বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। রাত কাটানোই একটু কষ্টকর।

—ওখানে কোনও বন্ধুবান্ধব নেই তোমার?

—আছে বইকি তবে বন্ধু তো বন্ধুর-ই কাজ করতে পারে। কিন্তু তার বাইরেও তো একটা জীবন আছে।

প্রকাশের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বাসবী বলল, তা বান্ধবী জুটিয়ে নাও না কেন? রিয়া বলল তোমার ওখানে হাজার হাজার ভারতীয় আছে।

—তা আছে কিন্তু আমার তো বান্ধবীর প্রযোজন নেই, আমার আপনার মতো একজন সুন্দরী আন্টির প্রযোজন। নিজের অজান্তেই বাসবী খিল খিল করে হেসে উঠল।

—তুমি তো গুড সামারিটান, পরোপকারী। বাইরে বেরোলে রাস্তাঘাটের দিকে নজর রেখো। কখনও কোন সুন্দরী ভারতীয় বা আমেরিকান আন্টি দুর্ঘটনাগ্রস্ত দেখলে এগিয়ে যাবে।

—কিন্তু এখানে তো অটো নেই আন্টি আর যে স্পিডে গাড়ি চলে এখানে, তাতে অ্যাক্সিডেন্ট হলে গুড সামারিটানরা অ্যামবুলেন্স ডেকে আন্টিকে সোজা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। যাক জেনে খুশি হলাম আন্টি আপনি বহাল তবিয়তেই আছেন আর আপনার মেয়েকাম-বন্ধু…

বাসবী আর সহ্য করতে পারল না। বার বার আন্টি ডাকটা একটা বিশ্রী ঠাট্টার মতো কানে বিঁধছিল ওর। প্লিজ প্রকাশ আমাকে আর আন্টি ডাকতে হবে না তোমাকে।

—তাহলে কী ডাকব আপনাকে, ম্যাডাম?

—আগে যা ডাকতে তাই ডেকো।

—বাসবী ডার্লিং!

—প্রথমটাই যথেষ্ট নয় কি?

—অলরাইট। থ্যাংক ইউ সো-ও-ও মাচ, বেবি।

বাসবী আরেকবার খিল খিল করে হাসল। সত্যিই তো, সতেরো বছরের ছোটো মেয়ে যদি বন্ধু হতে পারে, তবে দশ বছরের ছোটো প্রকাশ প্রেমিক হতে বাধা কোথায়?

রিয়ার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক করবে বাসবী আর ও জানে এবার ওর স্মার্ট, বিদুষী মেয়ে ওর কাছে হেরে যাবে।

ইঁদুরের গর্ত

আমি করব। মা বাবার কনসেন্ট জোগাড় করাটা আমার ব্যাপার।

র-এর চাকরির সাক্ষাৎকারে বলেছিল কস্তুরী, যদিও ব্যাপারটা ওর হাতে ছিল না, পারিবারিক বিষয় হয়ে গিয়েছিল। র-এর প্রাথমিক মনোনয়নপত্র বা অফার লেটার আসতেই বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কারণ ভিন দেশে গুপ্ত মিশনে মারা গেলে শরীরটা ভারত সরকার ফেরত নেওয়া তো দূর, নিজের নাগরিক হিসাবে স্বীকার নাও করতে পারে। এই জাতীয় শর্ত দেখার পর মা তো নাওয়া-খাওয়া ও সেইসঙ্গে রান্না করা ছাড়লেন।

ট্রেকিং-এর স্বপ্ন কোন ছোটোবেলায় দুচোখে ও মস্তিষ্কে আঁকা হয়ে গেছে পাকাপাকি। কিন্তু শখ থাকলেই সাধ্য থাকতে হবে, এই আপ্তবাক্য বা প্রবাদ সবার জীবনে মেলে না। কস্তুরীরও জেদ, কিছুতেই আর-পাঁচজন বিজ্ঞানের ছাত্রীর মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হবে না। সে বিশেষ কিছু করবে, মানে ভেতো বাঙালি মার্কা নয়, রোমাঞ্চকর কিছু।

তবে রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে তেমন কিছু একটা চাকরি লাগিয়ে ফেলা যায়। সবাই যখন আইএএস দেয়, কিছু ছেলেমেয়ে শুধু একটা লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে বস হবে বলে আইপিএস পেতে চায়। অন্যরা যখন ব্যাংক প্রবেশনারি অফিসার হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়াশোনা করে, তখন খুশিমনে কস্তুরী দাশগুপ্ত সিবিআই, র, ফরেনসিক বা নিদেনপক্ষে কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ় তথা আইবি-র পরীক্ষা দিয়ে গেছে।

বাড়ির সবার চাপে জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে মন নেই। ভর্তি হয়েছে মায়ের মন রাখতে। যদি ফরেন্সিকে যেতে পারে, তো এই লাইনে থাকবে, নয়তো শুধু শুধু মরা-পচা কাটার কোনও বাসনা নেই। যে-কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সেই গতানুগতিকতার মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছা করে না।

এই সময় কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ-এর ইন্টারভিউ কল পেল। চাকরিটা যে তিন বছর করে কাস্টমস আর তিন বছর করে সেন্ট্রাল এক্সাইজ় পোস্টিং আগে জানা ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে দুরূহ অবস্থার মোকাবিলা, আত্মগোপন করা, ছদ্মবেশ ধারণ করার শিক্ষানবিশি সব নিতে হবে। শুনেই কস্তুরীর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল রোমাঞ্চে, আর মা-বাবার কাঁটা দিচ্ছিল উদ্বেগে। উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, পাগলির কথা শোনো। ডাক্তারির সুযোগ ছেড়ে কেউ চোর ডাকাত স্মাগলারদের পিছু ঘোরে?

মনে মনে মরিয়া হয়ে সাক্ষাৎকার দিল এবং পেয়ে গেল কস্তুরী। প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম পোস্টিং মেঘালয়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অসম সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই, মা-বাবা তাতেও খুঁতখুঁত করছিলেন। ওখানে বাঙালিরা মোটেই নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ থেকে যেহেতু অবাধে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পরিয়াযী মানুষ অসম ও মেঘালয়ে প্রাণ বাঁচাতে বা জীবিকার সন্ধানে আসে, তাই সাত প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী বাঙালির প্রতিও যেন শরণার্থী জবরদখলকারীর মনোভাব স্থানীয়দের। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হ্যাংলার মতো শিলং, বড়া পানি, চেরাপুঞ্জি, মৌসিনরাম দেখতে ছোটা চাই। স্বজাতির কী হল না হল সেসব ভেবে নিজেদের সীমিত পরিসরের আনন্দ মাটি করতে চায় না কেউ। কিন্তু এখন যে, নিজের কন্যার প্রশ্ন। মাথা ঘামাতেই হচ্ছে।

কিন্তু আজকের দিনে সরকারি চাকরি বলে কথা, কোটার পাত্রী নয়, কটাকে হেলাফেলা করবে? ডাক্তারি পড়তে লাগবে কম পক্ষে পাঁচ বছর। তারপর হাউস স্টাফ থাকতে হবে। স্বাধীন রোজগেরে হতে গেলে অন্তত ছয় সাত বছরের ধাক্কা। আর এটা শুরুতেই মোটা মাইনে, দুবছর পর পাকা চাকরি। সবরকম সরকারি সুযোগসুবিধা-সহ নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, মহার্ঘ্য ভাতা, এলটিসি সব। অগত্যা মা কালী মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে শেষে লোকনাথ বাবার কাছে নিরাপত্তার জিম্মা দিয়ে মেয়েকে এয়ারপোর্টে এসে মেঘালয়ের উদ্দেশে রওনা করতেই হল।

বিমানে ওঠার আগে খুশির হাসি হেসে খুশিমনে কস্তুরী বলল, মা দুই বাংলার বাইরে লোকনাথ বাবাকে কেউ চেনে না, যদিও বলা হয় উনি সুমেরু পর্যন্ত নাকি ঘুরে এসেছেন, তবে নর্থ-ইস্টে যাননি। উনি না মানচিত্র গোলমাল করে ফেলেন। ঠাকুরের আসনে সেভেন সিস্টার সমেত ভারতের ম্যাপটাও রেখে দিও।

উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনার বিশেষ অধিকার, তার অপব্যবহার, ক্রমাগত অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নবাদী কার্যকলাপ সব মিলিয়ে জটিল গোলকধাঁধা। তার মধ্যে কস্তুরীর কাজ পড়েছে কয়লা চোরাচালান আটকানোর বিভাগে। যদিও প্রশিক্ষণ পর্যায়, তবু এমন বিপজ্জনক কাজের ট্রেনিং-ও বিপন্মুক্ত হওয়া সহজ নয়।

ওদিকে দক্ষিণ মিজ়োরামে ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার, কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আযোজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম সবকিছু নিয়ে ঝামেলা। কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর সঙ্গে মেলে না।

ষাটের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। নিজেদের জুমিয়া জাতি বলে বাংলাদেশ তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চেনে ও কড়া হাতে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর গোড়ায় সত্যিই চাকমা সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী বা চাকমা আর্মড ফোর্স তৈরি করে নাম দেওয়া হয় শান্তি বাহিনী। তাই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। আবার উচ্ছেদ, আবার ভারতের অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়া। কেউ কেউ পরিব্রাজন করে লাগোয়া অসম মেঘালয়ে চলে আসে। তাদের পুনরায় আগমণ নিয়ে মিজ়োরাম তো বটেই, মেঘালয়ে এই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার ওপর বসতভিটে ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের উৎপাত তো আছেই।

নাক ও চোখের গড়নের সাদৃশ্যের খাতিরে স্থানীয়দের চোখে চাকমারা যদিও ওদের মধ্যে কিছুটা আত্মগোপন করতে পারে, কিন্তু বাঙালি মানেই বাংলাদেশী আর বাঙালি দেখলেই সবার দ্যাখো মার ভঙ্গি। মেয়ও তবু একটু দয়া দাক্ষিণ্য করে, কিন্তু মেঘালয়ে গারো খাসি জয়ন্তিয়া জনজাতিরা এবং মিজ়ো ছেলেরা বাঙালি পুরুষ নারী বাচ্চা কাউকেই রেহাই দিতে চায় না।

বাঙালি ও চাকমা খেদানো নিয়ে সেখানে প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কট পর্যন্ত হয়ে গেছে। জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পুনর্বাসন ও অভিবাসন হবে না কথা দিয়ে শান্তি নেই। বাঙালি মানেই মেরে ফ্যাল শালা, রিফিউজির জাত। নামেই মাতৃপ্রধান সমাজ। কোনও মহিলাকে মুখ্যমন্ত্রী তো দূর, কোনও বড়ো পদে দেখাও বিরল ব্যাপার। অথচ ঘর-সংসার থেকে ব্যাবসাপত্র, সম্পত্তি সবকিছুর দেখভাল মেয়েরাই করে।

আরেক পক্ষের দাবি, অভিবাসন দিলে সবাইকে দিতে হবে। জাতি ধর্মের বিভেদ করলে চলবে না। যারা আসছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতে আসছে, সুতরাং কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে সেই ভেদাভেদ করা চলবে না। রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিক পরিস্থিতি সব সময় উত্তপ্ত, যে-আগুনে পুড়তে হয় মূলত সব হারানো বাঙালি পরিবারগুলোকেই।

নাগরিকত্ব নিয়ে কেন্দ্র সরকার একটু আংশিক উদারতা দেখাতেই মেঘালয়ে বাঙালি খেদানোর ও মারার নতুন হিড়িক পড়ে যায়। রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়, বাঙালি মেঘালয় পাহাড় না ছাড়লে রক্তের স্রোত বইবে। ভারতের দেশজ হোক বা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী বাঙালির জন্য ক্রমশ আরেক বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে মিজ়োরাম ও মেঘালয়। বাঙালিরা যেখানেই যায়, নিজেদের বুদ্ধির জোরে বড়ো বড়ো চাকরি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি সম্মানজনক পেশাগুলো হাতিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের থিতু হয়ে বসতে না দিলে জীবনরক্ষায় দিনানিপাতেই কেটে যাবে কাল।

আরও একটা ভয়, এই পুরো অঞ্চল জুড়ে নানা খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। সেগুলোর মালিকানা স্থানীয় জনজাতি ছাড়া আর কারও হাতে যাওয়া পছন্দ নয় মিজো, খাসি, গারোদের। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি ও অনেক বেআইনি কোলিয়ারি আছে। বেশ কয়েকটির মালিক মাড়োয়ারিরা। স্থানীয়দের ভাষায় ইন্ডিয়ান। তাদের বেসরকারি কোলিয়ারি আইনানুগ নথিভুক্ত। কিন্তু তাতেও বেআইনি কাজ করতে বাধা নেই। চুক্তিমতো ন্যুনতম পারিশ্রমিক না দেওয়া, দৈনিক রোজ বাকি রাখা, বিমা ছাড়া কন্দরে প্রবেশ করানো কত আর বলা যায়?

কোথাও কোথাও খনির মুখ এত সরু, যে বড়ো মানুষ ঢুকতে পারে না। তাই বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও বেআইনি ভাবে নামানো হয় সেই সব গভীর ইঁদুর গর্তে। বাস্তবিকই ওগুলোর নামকরণ সার্থক র‌্যাট হোল মাইন। সেখানে অস্ত্র হাতে গুঁড়ি মেরে কয়লা কেটে আনতে হয়। দুর্ঘটনা নিত্যসঙ্গী। সেই ভ্যান গখের জীবনীতে পড়েছিল কস্তুরী এই অবিশ্বাস্য শোষণের কাহিনি। এ যেন তাকেও ছাপিয়ে যায়। এখানে তো গরিব মানুষের নগণ্য পারিশ্রমিকও বাকি রেখে তা পুরোটা চোকানোর টোপ দিয়ে তাদের আবার নামতে বাধ্য করা হয় ওই মরণ গহ্বরে। এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সব হারানো বাঙালির বাচ্চারাই। দুটো খেতে পাওয়ার জন্য মানুষ কী না পারে? বাংলাদেশ থেকে খেদানি খেয়ে এখন অসম থেকেও খাচ্ছে, আর কোলিয়ারি মালিকদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে।

মা আমি নাই যাব ঐহানে। ডর লাগে। হাত পা ছিলা যায়। বাবা গো! আমারে পাঠায়ও না।

আজ কাম করে নে, টাকাটা পেলে পরদিন আর যাবি না উহেনে।

কিন্তু সেই পরদিন আর আসে না। পেট চালাতে মহাজনের কাছে দেনা। শুধতে গেলে আবার কাজ, আর কাজ মানে ইঁদুরের গর্তের অতলে তলিয়ে কয়লা তুলে আনা। পারিশ্রমিক যা পায়, গালাগাল পায় তার বেশি। তবু এই চক্র থেকে রেহাই নেই। ২০১৮-র ডিসেম্বরে একসাথে পনেরো জন শ্রমিক আটকে পড়ায় খবর হয়েছিল। তাদের উদ্ধারে বাযুসেনা পর্যন্ত নেমেছিল, নেমেছিল ডুবুরি বাহিনী। তবু শেষটায় ছয় জনকে বাঁচানো যায়নি। আরও কত খুচরো সংখ্যক প্রাণ যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে চলে যায়, তার গোনা-গুনতি নেই!

আবার শোনা যাচ্ছে লিটন নদীর জল ইঁদুর গর্তে ঢুকে পঞ্চাশজন শ্রমিক আবদ্ধ। ৩৬০ ফুট গভীরে তাদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে খবরটা ধামাচাপা দেওয়া যায়, তাতে সচেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজের উদ্ধার বাহিনী নামিয়েছেন। কিন্তু সেনা ডাকা মানে সর্বভারতীয় খবর হওয়া। একই ব্যক্তির রাজত্বে দু-দুবার এমন দুর্ঘটনা ভালো প্রশাসনের পরিচয় নয়। গতবারেই কোল ইন্ডিয়া স্বীকার করেছিল, এই তল্লাটে প্রচুর চোরা খাদান আছে। পাহাড় গাত্র ফুঁড়ে চলা এই র‌্যাট হোল, শুধু শ্রমিক কেন, সাধারণ মেঘালয়বাসীর পক্ষেও ধস নেমে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা মেনেছিল আইন অমান্য করে খনিতে নাবালক নাবালিকাদের নামানো হচ্ছে। কিছুদিন কাগজে হইচই হল, দু-একজন গ্রেফতার হয়ে জামিনে খালাস। তারপর আবার যেই কে সেই। এবারেও মনে হচ্ছে আধা সেনা ও সেনা ডাকতে হবে, নতুবা পরে জানাজানি হলে আরও হাঙ্গামা, যদিও মন্ত্রীদের পদ তাতে টলে না।

র‌্যাট হোল খনি শুনলেই গা ছমছম করে কস্তুরীর মতো ডাকাবুকো মেয়েও। তার মধ্যে স্থানীয়রা সবাই এটাকে সবচেয়ে ভয় করে। ওখানে মানুষ ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। যাদের জীবন নরকের চেয়ে দুর্বিষহ, তাদেরও বাঁচার এত সাধ, আর অজানা অন্ধকারকে এত ভয়?

কস্তুরী সীমান্তে চোরাচালান ধরার দাযিত্বে। যদিও তার ট্রেনিং চলছে, কিন্তু নির্ভীক স্বভাবের জন্য ওকে মাঝে মাঝে ভয়াল জায়গাতেও ঠেলে দেওয়া হয়। এবার রেস্কিউ টিমে ওকেও রাখা হয়েছে। খনি মালিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ ও চার্জশিট গঠনে সহায়তা করলেই তার দায় মেটে। আটকা পড়া মানুষগুলোকে জীবন্ত উদ্ধার করা গেলে একরকম, আর মারা গেলে আরও কড়া প্রকৃতির। তাদের বাঁচানোর দায় মোটেই তার নয়। তবু বাঁচাতে পারলে নাকি চোর ধরতে কাজে লাগবে।

এটা কাস্টমস্-এর কাজ নয়। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে ধান ভাঙে। আসলে কাজটা কস্তুরীর ছেলেমানুষি আবেগে নিজের শখের ডুবুরি ট্রেনিং নেওয়ার কথা ফাঁস করে দেওয়ার ফলশ্রুতি। নাও এখন মরণ গহ্বরে ডুবে মানুষ উদ্ধার করো। এক সময় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে চায়নি কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরের গর্তের মুখোমুখি।

ঘটনাচক্রে শ্রমিক ছেলেমেয়ে ও বয়স্করাও জলের শব্দ পেয়ে ১৬০ ফুট গভীরে একটা চাতালে উঠে এসেছে। ওখানকার ছাত বা সিলিং-এ একটা সিসি টিভি ক্যামেরা আছে। ভাগ্যক্রমে তার লাইনে এখনও গোলযোগ হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে। বস্তুত এর গভীরে নামা নিয়মও নয়। একজন মাত্র নিখোঁজ। ওই একজন কে, ওপরে কেউ জানে না, নীচ থেকেও স্পষ্ট খবর আসছে না। সম্ভবত কোনও মহিলা। কিন্তু মানুষজনের হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চাশের মধ্যে একটি প্রাণ যেন কিছুই না।

চাতালের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু পর্বতগাত্রের সঙ্গে ত্যারছাভাবে একটা সুড়ঙ্গ সাবধানে খোঁড়া হচ্ছে সমান্তরাল উদ্ধারকার‌্যের জন্য, ঠিক যেমন রানিগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে করা হয়েছিল। সেবারেও ছয় সাতজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাটির গভীরে অন্ধকারে জলের তলায় তারা জলে ইঁদুর চোবা হয়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে ওইসব অঞ্চলে ওপেন কাস্ট খনির সংখ্যা বাড়ানো হলেও চোরা খাদানকে আটকানো যায়নি। আটকানো যাচ্ছে না ধস, অগ্নুৎপাতকেও।

বৃষ্টি শুরু হল। সর্বনাশ! বৃষ্টি পড়লেই বিপত্তি। তখন আর কোনও আশা থাকবে বা। বড়ো বড়ো ত্রিপলে খনিমুখ ঢাকার ব্যবস্থা হল। আধা সেনাবাহিনীর ট্রুপ এখনও এসে পৌঁছোয়নি। তবে শোনা মাত্র স্থানীয় মানুষরা কয়েকটা ত্রিপল ও প্লাস্টিক জোগাড় করেছে। কারণ তাদেরই আপনজনেরা কেউ কেউ যে নীচে আটকে আছে।

প্রথমেই জলে ডুবতে হয়নি, কৃত্রিম সুড়ঙ্গ পথে উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে ত্রিশজন চেন বাঁধা ডুলিতে চেপে উঠে এসেছে। এবার শ্রমিকদের আশ্রয় নেওয়া শুকনো চাতাল পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। শুকনো বললেও ভেতরটা অসম্ভব গুমোট ও ভ্যাপসা। ওই একজন তরুণী ছাড়া মনে হচ্ছে সবাইকে তোলা যাবে।

একজনের পা ফেঁসে গেছে পাথরের বা কয়লার খাঁজে। জল উঠে এসেছে তার বুক পর্যন্ত। নিজের পা-টা ছাড়ানোর জন্য যত টানাটানি করে তত যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যায়, কিন্তু পা যে আরও ফেঁসে যায়।

কস্তুরী বলল, ওর পা কেটে বার করে আনা হোক। পা যাবে কিন্তু প্রাণটা বাঁচবে।

মাথা খারাপ? জলের মধ্যে পা কাটলে ব্লিডিং বন্ধ করা যাবে? ও দমবন্ধ হয়ে না মরলেও রক্তপাতেই শেষ হয়ে যাবে…

ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ার পড়তে পড়তে ছেড়ে এসেছি। স্কুলে এনসিসি করেছি। সবরকম স্মল আর্মস চালাতে পারি। এ ছাড়া উপায় নেই। কোনও সার্জেন থাকলে প্লিজ় দেখুন। তেমন কেউ দাযিত্ব নিলে আমি নামব না।

বাধা ব্যাগড়া দেওয়ার জন্য যত লোক তৎপর হয়, আসল কাজে তার এক শতাংশকেও দেখা যায় না। কেউ রাজি নয় দেখে কস্তুরী নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নাকে নল গুঁজে বলল, আমি যাব। যদি ওর পা কাটতে হয়, আইনত কোলিয়ারি তার দাযিত্ব নেবে। কিন্তু যদি মারা যায়, আমি সব দায় মাথায় করে নেব। শাস্তি ভোগ করতে রাজি। দেখুন জল ওর গলা, টাচ করেছে। আর সময় নেই। আর এক ফুট জল উঠলেই সিসি টিভি অকেজো হয়ে যাবে। এখনও হয়নি সেটাই পরম বিস্ময়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করা যাবে না।…

কাউকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে মাথায় টর্চ হেডলাইট নিয়ে আর হাতে ধারালো চপার নিয়ে কস্তুরী নেমে পড়ল গহ্বরে। সবাই হতবাক। তারপর মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই তুমুল হইহল্লা শুরু হল। যদিও উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে নাকি মেয়েদের সম্মান আছে। পরিবার প্রধান হয়, পদবি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদেই প্রায় পুরুষ। আর বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে মন্তব্য ভেসে এল মেয়ে মানুষের বেশি বাড়। ট্রেনিং পিরিয়ডে এত সাহস পায় কী করে? কাস্টমস অফিসাররা কি হাতে চুড়ি পরে আছে? আর্মি তো আসছেই। আটচল্লিশজনকে উদ্ধার করা গেছে, একজন নিখোঁজ, আরেকজন মরলে কী ক্ষতি ছিল?… ইত্যাদি।

আধ ঘণ্টা পরে মাইন শ্যাফট এলিভেটরে টান পড়ায় টেনে তোলা হল। ডুবুরির সরঞ্জাম না থাকলে কস্তুরীকে চেনা যেত না। সারা গায়ে কয়লা ও কাদার আস্তরণ। ও ডুলিতে চেপে ধরে আছে এক তরুণকে। তার গায়ে জল কাদা কালি। তার মধ্যেও রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কাটা পায়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে। সেখানে তার নিজের শার্টখানাই বাঁধা রক্তক্ষরণ যতটুকু কম করা যায়।

তবে আরও আশ্চর্য, কস্তুরীর দু পায়ের মাঝখানে কিছু একটা কাদাকালি মাখা জিনিস ধরা। সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে ও চ্যাঁচাল, সেই কাটা পাটা নিয়ে এসেছি। শিগগির হাসপাতালে ভর্তি করলে ছেলেটাকে আর তার পা, দুটোই বাঁচানো যাবে। কুইক।

দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সিংগ্রাম নামের ছেলেটার প্রাণ বাঁচলেও তার থ্যাঁতলানো এলোমেলো করে কাটা পাখানা জোড়া লাগানো যায়নি। তবু কস্তুরী তার ও তার পরিবারের কাছে সাক্ষাৎ দেবী।

হাসপাতালে শুয়ে কস্তুরী খবর পেল, খনি মালিককে পুলিশ ধরেছে। তিনি আপাতত পুলিশ হেফাজতে হাজতে। সেটাও ওদের কাস্টমস দলের দলবদ্ধ সাফল্য। মনটা হালকা হয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে একজনের মোবাইল চেয়ে বাড়িতে ফোন করল কস্তুরী, মা, খুশি বলছি। কেমন আছো?

আর কেমন আছো? যেখানে গেছিস সব সময় চিন্তায় থাকি। তুই কেমন আছিস?

ভালো। ইয়ে মা… একটু খোঁজ নিতে পারবে, মেডিকেলটা আবার শুরু করা যায় কিনা? জানি জেনারেল ক্যান্ডিডেটের সিট ফাঁকা থাকে না, তবু যদি আমার স্কোর কনসিডার করে…। ডিপার্টমেন্ট যদি পারমিশন দেয়, তাহলে ভাবছি মা, এমবিবিএস-টা কমপ্লিট করে সার্জারিতে মাস্টার্স করব। দেখলাম চোর ডাকাত ধরার চাইতেও কারও প্রাণ বাঁচাতে পারাটা আরও বেশি স্যাটিসফ্যাকশন দেয়।

 

 

পরিতোষের সিদ্ধান্ত শেষ পর্ব

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা করো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বললো, ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে একজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দুচোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

দার্জিলিং

দুপুর একটা পঞ্চান্নর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চেপে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে দার্জিলিং। এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ট্রেনটা ওরা মিস করল।

তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুবিমল। ঘুম ভেঙেছিল মোবাইলের রিংটোনে। ফোন ধরতেই মায়ার গলা, কোথায় আছেন? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি, ফোন ধরছেন না কেন?

এই আসছি, ট্রেন তো এখনি ঢুকবে!

ব্যাগ গোছানোই ছিল। তাড়াহুড়ো করে দরজায় তালা দিয়ে বেরোয় সুবিমল। টোটো ধরে স্টেশন। মায়া তার মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কোনওমতে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ওরা দেখে ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। একা থাকলে লাফিয়ে উঠে পড়ত সুবিমল। কিন্তু মায়া আর দিয়াকে নিয়ে তো সেটা সম্ভব নয়।

এবার কী হবে? মায়ার গলা কাঁদো কাঁদো শোনায়।

এনকোয়ারিতে গিয়ে ওরা জানল চারটের আগে আর শিলিগুড়ির দিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই। তার মানে আরও দুঘন্টা স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সুবিমল বলল, চলো ফিরেই যাই। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। বলে, আমায় নিয়ে আপনি দার্জিলিং যেতে চান না তাই তো?

এরকম ভাবছ কেন? আসলে ট্রেন পেতে দেরি হলে শিলিগুড়ি যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আর তখন হোটেল-টোটেল পাব কিনা…

হোটেল না পেলে স্টেশনে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেব। কিন্তু বেরিয়েছি যখন যাবই! সুবিমলকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল মায়া, দার্জিলিং নিয়ে কত কথা বললেন। কম্পিউটারে ছবি দেখালেন। আর এখন যেতে চাইছেন না?

দার্জিলিং-এর কথাটা বলতেই মায়ার মুখটা কেমন নরম হয়ে গেল আর চোখদুটো চকচক করে ওঠে, একটা কষ্ট অনুভব করল সুবিমল। বেচারি! কখনও দূরে কোথাও যায়নি। কিছু দেখেনি। পাহাড়, সমুদ্র কিছু না। কেউ নিয়ে যাবার নেই!

আচ্ছা মা, দার্জিলিং-এ তো এখন খুব ঠান্ডা তাই না? পাশ থেকে দিয়া বলে।

সেটা তোর কাকুকেই জিজ্ঞেস কর না।

আঃ তুমিই বলো না। ওখানে কি এখন বরফ পড়ছে? কী মজা!

মেলা বকিস না তো। এখন যাওয়া হবে কিনা তারই ঠিক নেই, আর ইনি চোখে বরফ দেখছেন।

বকুনি খেয়ে একটু চুপ করে যায় মেয়েটা। একটু পরেই আবার বলে, আমি কিন্তু দার্জিলিং গিয়ে টয়ট্রেনে চড়ব।

হ্যাঁ, তুমি টয়ট্রেন চাপবে! কত টাকা টিকিট লাগবে জানিস? তুই দিবি?

টয়ট্রেনের ছবি দেখিয়েছিল সুবিমল কিন্তু তার টিকিট-ফেয়ার নিয়ে কিছু বলেনি। সে নিজেও ঠিক জানে না। তবে মায়া হয়তো ধরেই নিয়েছে, এত সুন্দর দেখতে একটা ট্রেনে উঠতে অনেক টাকা লেগে যাবে। এসব কথা হতে হতেই একটা ট্রেন চলে এল।

পুরি-কামাখ্যা এক্সপ্রেস।

মায়া তড়িঘড়ি বলল, দেখুন না, এই ট্রেনটা শিলিগুড়ি যাচ্ছে কিনা?

এখন তো ওদিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই, শুনলে না?

আঃ দেখুনই না একবার।

কী মনে করে সুবিমল সিট ছেড়ে এগোয়। ট্রেনের জানলার ধারে বসে থাকা একজন প্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করে। লোকটা হিন্দিতে জবাব দেয়, শিলিগুড়ি যায়েগে কেয়া নহি জানতে, পর ইয়ে এনজিপি যায়েগা।

এনজেপি মানে নিউ জলপাইগুড়ি। শিলিগুড়ির আগের স্টেশন। ওখান থেকেও তো দার্জিলিং যাওয়া যায়! মায়া ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুবিমল ব্যস্ত হয়ে বলে, চলো চলো এটা যাবে। মালপত্র নিয়ে ছুটতে ছুটতে ওরা সামনের কামরাটাতে উঠে পড়তেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

এনকোয়ারির লোকটা এই ট্রেনটার কথা বললই না। ভাবো এরা কি জন্যে যে চাকরি করে, সুবিমল সিটে বসতে বসতেই বলে।

দেখলেন তো, আমার কথা শুনলেন বলেই… মায়ার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটেছে। জানলার পাশে দিয়াকে বসিয়ে সে নিজেও বসেছে। কামরা একদম ফাঁকা। রিজার্ভেশন হয়নি বলে আসতে চাইছিলেন না। এখন দেখুন শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে। আমার বেড়াবার ভাগ্য কী ভালো।

সুবিমল ঘর থেকে তিনটে বড়ো বড়ো ক্ষীরসাপাতি আম আর লিচু নিয়ে এসেছে। বার করল সেগুলো। ট্রেনে উঠলেই তার খিদে পায়, কেন কে জানে!

নাও আমগুলো কাটো। লিচু খাও।

আম কেটে, টিফিনবাটির ঢাকনায় তুলে প্রথমেই সুবিমলের দিকে এগিয়ে দেয় মায়া। তারপর মেয়েকে দিয়ে নিজেও নেয়। সিটের ওপর পা তুলে গুছিয়ে বসে, আম খায়।

আঃ পাটা নামিয়ে বসো না, সুবিমল বলে।

কেন, কী হয়েছে?

সুবিমল আর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। কেন যে আসতে গেল এদের সাথে। নোংরা পা দুটো একেবারে সিটের ওপর তুলে বসল। যেন ঘরের বিছানা! কম শিক্ষিত হলে যা হয়। এই যে, আবার পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলা হচ্ছে জানলা দিয়ে। এত থুতু আসে কী করে মুখে ও বুঝে পায় না!  দিয়ার ওপর চোখ পড়তেই মাথা আবার গরম হয় সুবিমলের। কালো মুখে রং মেখেছে!

দার্জিলিং-এর ছবিগুলো আবার দেখান না, আবদারের সুরে বলে মায়া।

সুবিমল বিরস মুখে ব্যাগ খুলে তার ল্যাপটপটা বার করে, সুউচ অন করে। মোডেম লাগায়। ইউ টিউব চালায়।

ওই তো টয়ট্রেন, লাফিয়ে ওঠে দিয়া।

চিৎকার করছিস কেন? মেয়ের দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া। দিয়ার মুখ শুকনো হয়ে যায়।

টয়ট্রেন ততক্ষণে ঘুম স্টেশনে এসে থেমেছে। কুয়াশায় আবছা দেখা যাচ্ছে। এবার দার্জিলিং-এর বাজার দেখাচ্ছে নেপালি মেয়েটা, রংবেরং-এর উলের পোশাক বিক্রি করছে। দোকানে দোকানে কত জিনিস সাজানো, নীল সবুজ পাথরের মূর্তি। বাজার ছেড়ে পথ ওপরে উঠছে। এবার ম্যালে এসে থামল।

কী চমৎকার জায়গাটা। এটাই তো বলেছিলেন মল। তাই না?

মল নয়, ম্যাল সুবিমল হাসে।

ওঃ ম্যাল। লজ্জা পেয়ে মাথা ঝাঁকায় মায়া। তারপর বলে, আপনি বলেছিলেন না, ম্যালে গেলে কোনও না কোনও পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়ে যাবেই।

হ্যাঁ, লোকে তো সেরকমই বলে, একটু অন্যমনস্ক হয় সুবিমল। আমি যখন খুব ছোটোবেলায় মা বাবার সাথে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, ম্যালে গিয়ে মনে আছে একজন দূর সম্পর্কের রিলেটিভ মানে আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেছিল। পরে আর কখনও ওনাকে দেখিনি। এখনও মনে আছে, উনি আমাকে গাল টিপে আদর করেছিলেন, ঘোড়ায় চড়িয়েছিলেন।

আমিও ম্যালে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ব।

সুবিমলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। বিরক্ত হয়ে সে দিয়ার দিকে তাকায়।

আঃ কতবার তোকে বলেছি, কথার মাঝখানে কথা বলবি না। দেব কানপাট্টিতে এক থাপ্পড়। তারপর বলুন না কী হয়েছিল?

সুবিমলের মনে তখন অন্য একটা চিন্তা জন্ম নিয়েছে। ম্যালে গিয়ে যদি… ম্যালে তো যেতেই হবে। গিয়ে যদি আবার কোনও আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় অথবা তারই স্কুলের কোনও কলিগের সাথে! তখন সে কী করবে। কী পরিচয় দেবে মায়ার আর মায়ার মেয়ে। কী বলবে সে?

কী হল, কী ভাবছেন?

কিছু না লিচুর খোসা ছাড়ায় সুবিমল।

এসব কথা বলতে বলতে ওরা যখন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছোল তখন রাত আটটা বাজে।

ট্রেন থেকে নেমেই দিয়া বলল, মা দেখেছ, কত্ত বড়ো স্টেশন! সঙ্গে বেশি টাকা আনেনি সুবিমল। স্টেশনের পাশে একটা ছোটো দেখে হোটেলেই ওঠে।

হোটেল মালিক টাকা নিয়ে খাতা খুলে সুবিমলকে সই করাল। তারপর বলল, আপনাদের আধার কার্ডটা দেখাবেন। মায়ার কার্ডটা দেখে বলল, আপনার পদবি তো দেখছি দাস আর ওনার ভট্টাচার্জি।

সুবিমল বুঝতে পারল না লোকটা কি বলতে চাইছে। কিন্তু মায়া একবার সুবিমলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, এটা বাবার নামে করেছিলাম তো। বিয়ে পর আর পালটানো হয়নি।

আপনারা সত্যিই ম্যারেড তো?

কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?

সুবিমল বলল, রেজিস্ট্রি পেপার দেখাতে হবে?

না, না, ঠিক আছে। আচ্ছা আপনারা ঘরে যান।

ঘরে গিয়ে ওরা আর বসল না। মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল যত সকাল সকাল বেরোনো যায় ততই ভালো।

ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছেই অনেকগুলো খাবার হোটেল। তারই একটায় ঢুকে ওরা বসে। সুবিমল মাছ ভাত বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়া বলল ডিম ভাত নিতে। খরচ যেটুকু বাঁচানো যায়।

রাতে বিছানায় শুয়ে ওদের চোখে ঘুম আসে না। মায়া আর সুবিমলের মাঝে দিয়া শুয়েছে। সে বলে, মা ঘুম পাচ্ছে না। একটা গল্প বলো না। ওই দুষ্টু শেয়ালের গল্পটা।

হ্যাঁ, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তোকে এখন গল্প বলব। চুপ করে ঘুমো। ভোর ভোর উঠতে হবে।

না, বলো না একটা।

মায়া কী ভেবে বলে, তোর কাকুকে বল। কাকু অনেক ভালো ভালো গল্প জানে।

অন্ধকারের মধ্যেই সুবিমলকে উদ্দ্যেশ্যে করে সে বলে, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে? নাহলে ওকে একটা গল্প বলুন না। আমিও শুনব।

সুবিমল ভাবছিল, দিয়া এখন সঙ্গে না থাকলে কত ভালো হতো। মায়াকে এখন সে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারত। বদমাইস মেয়েটা একেবারে তাদের মাঝখানে এসে শুয়েছে। মায়া বলেছিল একপাশে শুতে। কিন্তু শুনলে তো! তবে এটাও মনে হয়েছে ওর, দিয়া সঙ্গে না থাকলে হয়তো হোটেলে ঘর পেতে অসুবিধে হতো। ও আছে বলেই সবাই ওদের একটা পরিবার বলে ধরে নিচ্ছে। স্বামী, স্ত্রী ও তাদের মেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। মনটা হঠাৎই জ্বালা করে ওঠে সুবিমলের। পরিবার! সত্যিই কি কোনও দিন তার নিজস্ব পরিবার হবে? তার নিজের সন্তান, তার নিজের বউ। চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল। আর কবে সে বিয়ে করবে?

বলবেন একটা গল্প, বলুন না। মায়ার গলায় আবদারের সুর।

মায়ার সাথে প্রথম পরিচয়টা একটু অদ্ভুত ভাবেই হয়েছিল। বাউল মেলা দেখতে গিয়েছিল সুবিমল। দিয়াকে একটা এগরোলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দ্যাখে। ভিড়ের মধ্যে ওর হাত ছুটে নাকি ওর মা হারিয়ে গেছে। সুবিমলই শেষপর্যন্ত দিয়ার হাত ধরে মায়াকে খুঁজে বার করে। সেদিন মনে আছে একটা চুমকি বসানো জংলা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিল মায়া। বেশ লাগছিল। বিশেষ করে ওর ফিগারটা। এক মেয়ের মা বলে ওকে বোঝাই যায় না! মেলাতেই ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। তারপর কীভাবে যে ওরা দুজন কাছে চলে এল। স্বামী নেই বলে মায়ার দিক থেকেও নিশ্চয়ই একটা শারীরিক চাহিদা ছিল!

ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

হঠাৎ করেই মায়ার কথা ভেবে মনটা কেমন নরম হয়ে যায় সুবিমলের। বেচারি। বিয়ে হতে না হতেই বর মারা গেছে। শুধু একটা ছোটো দোকান রেখে গেছে, পান-বিড়ি-সিগারেটের, আর এই মেয়েটা। ওকে বোনের বাড়ি রেখে বেড়াতে আসবার কথা মায়া বলেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত পারেনি। মায়ের মন। বলল, আমি ঘুরব আর ও পাহাড় দেখবে না?

সুবিমল পাশ ফিরে বলে, আচ্ছা শোনো। এই দিয়া শোন, একটা গল্প বলছি। হ্যাপি প্রিন্স ও সোয়ালো পাখির গল্প। এক দেশে এক রাজার ছেলে ছিল। দুঃখ কাকে বলে সে জানত না, তারপর একদিন সে মারা গেল।

এত তাড়াতাড়ি মারা গেল?

কথা বলছিস কেন? ধমকে ওঠে মায়া চুপ করে শোন।

সুবিমল বলতে থাকে, দিয়া চুপ করে শুনছে। কতটা বুঝছে বলা মুশকিল কিন্তু সুবিমল যখন যখন বলল সোয়ালো, সোয়ালো, ও লিটল সোয়ালো। দিয়াও সুর করে বলল, সোয়ালো সোয়ালো ও লিটল সোয়ালো…

গল্প শেষ হলে মায়া বলল, ওরা দুজন দুজনকে কত ভালোবেসেছিল। সত্যিই কি কেউ কাউকে এত ভালোবাসতে পারে? তারপর তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ার ডাকাডাকিতেই ঘুম ভাঙল সুবিমলের।

আর কত ঘুমোবেন?

উঠে বসে সুবিমল। এঃ, পৌনে ছটা বাজে। রোদ উঠে গেলে তো পাহাড়ে ওঠার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি বাথরুমে যায় সুবিমল। হাত মুখ ধুয়ে বেরোয়। দিয়াও এইমাত্র উঠল। ঘুমচোখে বিছানার ওপর বসে আছে। মায়া ওকে টেনে হিঁচড়ে নামায়।

শিলিগুড়ি সদর মোড়ে এসে ওরা ট্রেকার থেকে নামে। একটু দূরেই দুটো বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। একটা গাড়ির চালক হাঁক দিচ্ছে দার্জিলিং দার্জিলিং। মায়া সুবিমলের হাত চেপে ধরে, একটু তাড়াতাড়ি চলুন, গাড়িটা বোধহয় ছেড়ে দেবে এক্ষুনি কিন্তু সুবিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কী হল চলুন,

সুবিমল এবার এগোয়। গাড়ির চালককে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। কালিম্পং যাবার কোনও গাড়ি নেই?

এই তো পাশের গাড়িটাই যাবে, যান উঠে পড়ুন। মায়া অবাক হয়ে সুবিমলের দিকে তাকায়।

কী হল? আমরা তো দার্জিলিং যাব।

না মায়া। একটু ইতস্তত করে সুবিমল বলে, সাত হাজার টাকায় দার্জিলিং ঘোরা যাবে না। ওখানে হোটেল ভাড়াই অনেক হবে।

কেন, আমার কাছেও তো কিছু টাকা আছে, এতে হবে না?

না, তোমার টাকায় আমি হাত দেব না। কালিম্পং কাছে। খরচ কম পড়বে। চলো ওখানেই ঘুরে আসি। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

দার্জিলিং যাব বলে এলাম আর এখন বলছেন…

না মায়া, দার্জিলিং-এ খুব ঠান্ডা পড়ে। তুমি তো জানো আমার বেশি ঠান্ডা সহ্য হয় না।

কেন, গরম কাপড় তো সঙ্গে এনেছেন। এতে হবে না?

না।

ঠোঁট কামড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। ওর জন্য কষ্ট হয় সুবিমলের। বেচারি কত আশা করে এসেছিল!

গাড়ি সমতল ছেড়ে সেবকের কাছে এসে পাহাড়ে ওঠার পথ ধরতেই মায়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দিয়া জানলার পাশে বসেছে। বাইরে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, মা দ্যাখো নদী কত নীচে। মায়া জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। সুবিমলকে ডেকে বলে, দেখুন পাহাড়ি নদী।

কী নাম নদীটার? জলটা কেমন সবুজ। দেখবে কী করে সুবিমল। সে বসেছে মাঝখানে।

বাঃ, বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে সে, আর সে-ই কিছু দেখতে পাবে না! একটু রাগ রাগ মুখ করেই বসে থাকে সুবিমল। থাক, ওরাই দেখুক। একটু পরে অবশ্য সে নিজেও সরে এসে মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকায়। আর কী আনন্দই যে হয়। দিয়ার মতো বয়সে সে এই পথ দিয়ে গিয়েছিল। এই সুবিস্তীর্ণ পাহাড়, পাহাড়ের খাদ থেকে উঠে আসা এই লম্বা লম্বা গাছ, আর গাছের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা ওই রূপসি রঙ্গীত এরা কি তাকে চিনতে পারছে! দার্জিলিং যাওয়া হল না!

কাকু তোমার কাছে স্মার্ট ফোন নেই? তাহলে ছবি তুলব, দিয়া বলে।

মাথা নেড়ে না বলে সুবিমল। অন্য যাত্রীরা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও করছে। দিয়া মায়ের কাছ থেকে ছোট্ট কমদামি মোবাইলটা নিয়ে তাতেই ছবি তুলতে থাকে। দেড় ঘন্টা বাদেই ওরা মেঘের রাজ্যে পৌঁছে যায়। পাহাড়ের বুকে শুয়ে থাকা মেঘগুলো সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে।

কী সুন্দর! মায়া অস্ফুটে বলে, এরকম জিনিস দেখতে পাব কখনও ভাবিইনি।

মেঘ দেখা ভুলে গিয়ে সুবিমল চেয়ে থাকে মায়ার ঝলমলে খুশিভরা মুখের দিকে।

 

কালিম্পং গাড়ি স্ট্যান্ডে এসে নামার পর মায়া অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। পাহাড়ের এত ওপরে এত বড়ো সুন্দর শহর! ওরা প্রথমেই একটা দোকানে ঢুকে লুচি মিষ্টি খেয়ে নেয়। তারপর হোটেল খুঁজতে বার হয়। বেশি খুঁজতে হয় না। স্ট্যান্ডের পাশেই প্রচুর হোটেল। শেষপর্যন্ত হোটেল প্যারাডাইস বলে একটা দোতলা ঝকঝকে সুন্দর হোটেলে ওরা সাহস করে ঢোকে। আর এমনই ভাগ্য, মাত্র হাজার টাকায় একটা বড়ো ঘর পেয়ে যায়। ঘরে দুটো সিংগল বেড, টিভি সেট আছে, বড়ো আয়না আছে, জানলায় শৌখিন পর্দা ঝুলছে, টাইলস বসানো বাথরুমের সাইজটাই শিলিগুড়ির হোটেল ঘরটার থেকে বড়ো।

ওরা আরও অবাক হল যখন হোটেল ম্যানেজার ওদের কাছে আধার কার্ড দেখতে চাইল না, এমনকী আগাম ভাড়াও চাইল না। শুধু খাতায় নাম তুলে নিল। তারপর বলল, যান, মালপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে নিন। সাইট সিযিং করবেন তো? আমার চেনা ভালো ড্রাইভার আছে। বারোশো টাকা নেবে, সেভেন পয়েন্টস ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।

সেভেন পয়েন্টসটা কী? প্রশ্ন করে সুবিমল।

কালিম্পং-এ মেইন দেখার জায়গা সাতটা। নতুন আসছেন বুঝি?

হ্যাঁ।

মায়া বলল, আমরা স্নান খাওয়া সেরেই বেরোব। আপনি ড্রাইভারকে বলে দিন।

ঠিক বারোটা বাজতেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হোটেলের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা তখন সবে ভাত খেয়ে হোটেলে ঢুকছে। তড়িঘড়ি ওপরে উঠে ওরা ড্রেস চেঞ্জ করে। মায়া বলে, দেখুন না কোন শাড়িটা পরব?

শাড়ি কেন, যে-সবুজ সালোয়ারটা এনেছ ওটা পরো।

ওটা পরব? একটু ছোটো হয় আমার। গায়ে চেপে বসে।

পরোই না।

সালোয়ার গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মায়া। পেছন থেকে সুবিমল বলে, তোমায় দেখতে সেই হট লাগছে।

যাঃ, মায়ার মুখে লজ্জা। তারপরেই জিভ কেটে বলে, ওড়নাটাই আনতে ভুলে গেছি। ওড়না না পরে বেরোব?

ভালোই হল, সুবিমল হাসে। বলে আরও বেশি সেক্সি লাগবে।

মা, সেক্সি মানে কি? দিয়া বলে।

গাড়ির ড্রাইভারের চেহারা একেবারে সিনেমার হিরোর মতো। লম্বা, ফরসা, ধারালো চোখ মুখ। ওরা আসতেই গাড়ির দরজা খুলে দেয়।

ডেলো আর দুরপিন, এই দুটো উঁচু পাহাড়ের মাঝে কালিম্পং। ড্রাইভারটা প্রথম ওদের ডেলো পিকে নিয়ে যায়। পিকের ওপরে একটা খুব বড়ো হনুমানজির মূর্তি। পাশে ফুলের বাগান। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে দিয়া, হনুমানজির পায়ে কাছে রেলিং ঘেরা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। চেঁচিয়ে বলে, মা দ্যাখো মেঘ। সত্যিই, একেবারে হাতের কাছ দিয়ে শরীরের ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে।

সুবিমল মায়াকে বলে, দ্যাখো এই মেঘগুলো যেন আমাদের স্বপ্নের মতো তাই না? মনে হচ্ছে ধরা যায় কিন্তু হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

মায়া হেসে বলে, আপনার আবার কী স্বপ্ন আছে? দার্জিলিং, মনে মনে বলে সুবিমল। একদিন আমি দার্জিলিং যাব।

সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামছে, পাশেই দুহাত উঁচুতে পাথরের খাঁজে খাঁজে অদ্ভুত সুন্দর এক ধরনের জংলি ফুল ফুটে আছে দেখতে পায় সুবিমল। জুতো খুলে রেখে, ওপরে ওঠবার চেষ্টা করে। একবার পা পিছলে পড়ে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ফুলগুলোর কাছে হাত পৌঁছোয়। কয়েটা তুলে এনে দিয়াকে দেয় আর একটা মায়ার চুলে গুঁজে দেয়। মায়া সলজ্জ মুখে হাসে, কী যে ছেলেমানুষি করেন, পায়ে লাগল তো?

ডেলো পার্কটাও চমৎকার জায়গা। সেখানে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ার বায়না ধরে দিয়া। কিন্তু দশ মিনিট ঘোরাতে দুশো টাকা নেবে শুনেই না করে দেয় মায়া। এরপর মর্গান হাউস, নেচার মিউজিয়াম ইত্যাদি আরও কয়েটা ভালো ভালো জায়গা দেখে সন্ধের সময় ওরা হোটেলে ফেরে।

বিছানায় বসে মায়া বলে, ড্রাইভারটা কী ভালো বলুন। আমরা যেখান থেকেই ঘুরে বেরোচ্ছি, একেবারে সামনে গাড়ি নিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াচ্ছে, একটুও হাঁটতে হয়নি। অন্যদের গাড়িগুলো কিন্তু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। কত সামান্য জিনিসও মেয়েদের চোখে পড়ে, ভাবে সুবিমল।

একটু তাড়াতাড়িই বাইরে বেরিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা। ফেরার পথে ওপরে তাকায় সুবিমল। এই আকাশ সমতলে দেখা যাবে না। তারাগুলো কী ঝকঝক করছে, যেন কাছে নেমে এসেছে। তারপরেই দূরের পাহাড়ে চোখ পড়তে চমকে ওঠে সুবিমল। মায়ারাও দেখেছে। প্রথমটা বুঝতে পারেনি ওরা। যেন হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলছে! তারপর ভালো করে দেখে বুঝল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সারি সারি বসতবাড়ি। তার আলো।

দুটো সিংগল বেড পাশাপাশি এনে ওরা শুতে যায়। দিয়া সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়াও। সুবিমল জেগে থাকে। আর একটু রাত হলে মায়া এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কখন ঘুম ভাঙল ওর!

মায়া ফিসফিসিয়ে বলে, চলুন, আপনার খাটটা ওই পাশে সরিয়ে নিই।

এর আগেও তো কতবার ওরা মিলিত হয়েছে। কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা। মাটি থেকে চার হাজার ফিটের ওপরে, মেঘের রাজ্যে। অনেকটা সময় পার করতে করতে এই ঠান্ডা রাতেও তারা ঘেমে গেল। তারপর, সেই ভিজে ভিজে সুখ মেখেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল। একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙে ওদের।

দিয়া উঠেই বলে, কাকুর খাটটা ওখানে কেন? সুবিমল মায়ার দিকে তাকায়।

মায়া মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, রাতে তোর কাকুর একা শুতে ইচ্ছে হল, তাই খাটটা সরিয়ে নিল।

সত্যি কাকু? দিয়া সুবিমলকে দ্যাখে।

মুখ-টুখ ধোওয়া হলে সুবিমল বলে, বেল টিপে ম্যানেজারকে ডাকব? চা দিতে বলি আর সঙ্গে কিছু খাবার।

ডাকবেন? ঘরে এসে দিলে হয়তো বেশি দাম চাইবে।

তা হোক।

চা, লুচি-তরকারি এল। সবাইকে ভাগ করে দিয়ে খেতে খেতে মায়া বলল, এটা আমার মনে থাকবে। একেবারে হাতের কাছে এসে দিয়ে গেল, হোটেলের বিছানায় বসে খাচ্ছি।

কালিম্পং দেখা শেষ। এবার ফেরার পালা। নীচে এসে হোটেলের খাতায় সই করার সময় ম্যানেজার বলল, ফিরে যাচ্ছেন? এখানে এলেন যখন লাভা ঘুরে যান। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। খুব শান্ত। একটা গুম্ফা আছে, ভালো লাগবে আপনাদের। লাভার নাম আগে শুনেছে সুবিমল। কিন্তু জায়গাটা ঠিক কীরকম সে জানত না।

বাইরে বেরোতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। ভিজতে ভিজতেই ওরা গাড়ি স্ট্যান্ডে এল। ওযেদার খারাপ, শিলিগুড়ি ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষে লাভায় যাবার গাড়িই ধরল সুবিমল। মায়া আর দিয়া খুব খুশি। গাড়ি যখন ছাড়ল তখনও বৃষ্টি পড়ছে। ড্রাইভার যদিও বলল, পাহাড়ের এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। আর হলও তাই। মিনিট কুড়ি পরেই আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ।

যেতে যেতে কম্পিউটার বার করল সুবিমল। লাভা সম্বন্ধে একটু জেনে নিলে ভালো হয়। আর যা জানল তাতে সে অবাকই হল। লাভার উচ্চতা সাত হাজার ফিটের বেশি। দার্জিলিং-এর চেয়ে কয়েকশো ফিট ওপরে। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিমল, মায়া, আমরা দার্জিলিং-এর চেয়ে বেশি উঁচুতে উঠছি।

আধঘন্টা পর থেকেই ওদের ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। আর এই প্রথম ওদের ব্যাগ থেকে গরম পোশাক বার করতে হল। সোয়েটার পরেও সুবিমল কাঁপছে। মায়া ওর হাতে নিজের শালটা দিয়ে বলল, কানে জড়িয়ে নিন। আপনার তো আবার ঠান্ডা সহ্য হয় না।

একদম সরু পথ দিয়ে গাড়ি ওপরে উঠছে। ভাঙাচোরা রাস্তা। বেশি টুরিস্ট বোধহয় এদিকে আসে না। ডানপাশে খাদের তলা থেকে অতিকায় লম্বা লম্বা গাছ আকাশে উঠে গেছে। কুয়াশায় ভিজে ভিজে তাদের গুঁড়ির রং কালো। তাদের গা থেকে মোটা মোটা দড়ির মতো সবুজ শ্যাওলা ঝুলছে। কি সুবিপুল গাম্ভীর্যে পূর্ণ চারিদিক। একটা অদ্ভুত অনুভতি হল সুবিমলের। এই অমর্তলোকে ওরা যেন অনধিকার প্রবেশকারী!

লাভা পৌঁছোতে দুঘন্টার বেশি লাগল। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই একটা সরু পথ নীচে নেমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানল, গুম্ফা দেখতে এই রাস্তাটা ধরেই যেতে হবে। খাড়াই পথটা ধরে ভারি ব্যাগ হাতে নিয়ে তরতরিয়ে নামতে থাকে মায়া। সুবিমল পিছিয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে, একটু আস্তে হাঁটো না। মায়ার হাসি শোনা যায়, আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন।

বহুদূর থেকেই গুম্ফাটা দেখা যায়। রাস্তার দুপাশে ছোটো বড়ো দোকান। সবজির বাজার। লোকজন কম। গাড়ি চলছে না। দুএকজন সাইকেল চেপে যাচ্ছে। পথ ঘেঁষে রঙিন কাঠের বাড়ি। বড়ো বড়ো কিছু হোটেলও অবশ্য দেখা যাচ্ছে।

দূর থেকে যা মনে হয়েছিল গুম্ফাটা তার থেকেও অনেক বড়ো। কালিম্পং-এও গুম্ফা দেখেছে ওরা। কিন্তু সেগুলো আয়তনে এর অর্ধেকও হবে না। পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে প্রায় আধ কিলোমিটার লম্বা পাঁচিল চলে গেছে। তার ওপরে সারি সারি রঙিন নিশান উড়ছে। ভেতরে ঢুকে ওরা একটুক্ষণ পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ায়। নীচেই কুয়াশা ঢাকা গভীর খাদ। দিয়া হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে যায়। আশপাশে কেউ নেই।

সুবিমল বলে, এখান থেকে লাফ দিতে পারবে মায়া? মায়া ভুরু কুঁচকে তাকায়।

যত অদ্ভুত কথা আপনার।

না বলছি, ওই কুয়াশার মধ্যে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না?

বাজে কথা রাখুন, চলুন দিয়া কোথায় গেল দেখি।

একটা বাঙালি পরিবারের সাথে দেখা হয়। স্বামি-স্ত্রী আর তাদের মেয়ে। বউটি ফরসা ও সুন্দরী। মেয়ে কিন্তু দিয়ার মতোই কালো তবে খুব স্মার্ট। কনভেন্ট স্কুলে পড়ে। ওরাও কালিম্পং ঘুরে এসেছে শুনে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করেন, ডেলো পার্ক তো গিয়েছিলেন, ওখানে প্যারাগ্লাইডিং করেছিলেন?

প্যারাগ্লাইডিং, কাঁধে নকল ডানা বেঁধে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া, ডেলোতে ছিল বটে। না ওটা হয়নি।

করেননি! সাচ্ আ প্লেজন্ট এক্সপেরিযে্নস। একেবারে কুয়াশার ভেতর দিয়ে উড়তে উড়তে এসে নীচে নামলাম। কিন্তু রেটটা একটু হাই। তিনজনের সাতহাজার টাকা পড়ে গেল।

সাত হাজার! একটা লাফের জন্য! তিনহাজার টাকায় ওদের কালিম্পং ঘোরা হয়ে গেল।

মহিলা ও তার মেয়ে সাথে গল্প করতে করতেই সুবিমল এগোয়। মায়ারা পিছিয়ে যায়। একবার মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে সুবিমল, বউটির হাজব্যান্ড মায়ার পাশে পাশে আসছে। এক ঘন্টার বেশি লাগল পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে। একটা জপযন্ত্র দেখল, দুমানুষ সমান উঁচু। তার চাকা ঘুরিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। ওরাও একটু ঘোরাল।

লাল জোব্বা পরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এদিক ওদিক ঘুরছে। নিজেদের ভাষায় কিসব কথা বলছে। প্রত্যেকেই খুব হাসিখুশি। এই বিশাল সুন্দর প্রকৃতির কোলে, ভগবান বুদ্ধের অর্চনায় এরা যেন সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। একজন সন্ন্যাসীকে দেখল, মেঝেতেই বসে বসে খাচ্ছে। সাধারণ ডাল ভাত একটা তরকারি তাতেই মুখে ওনার কি অপরূপ আনন্দের ছাপ।

কী পিসফুল জায়গাটা বলুন। ভদ্রমহিলা বল্লেন, মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে এখানেই থেকে যাই।

ভালোই হয় তাহলে! সুবিমল ভাবে। সেও এর সাথে থেকে যেতে রাজি আছে।

প্রার্থনা ঘরটা বিশাল। দেয়ালে কী সুন্দর রঙিন কারুকাজ। উঁচু আসনের ওপর নিমীলিতচোখ বোধিসত্ত্বের মূর্তির সামনে এসে একটু দাঁড়ায় সুবিমল। হাজার বছর বা তারও আগে, রাজার প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল যেই রাজার কুমার, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে বলে। সেই বিশাল-হৃদয় পুরুষের জন্য হঠাৎ করেই এক অপরিমেয় শ্রদ্ধায় সুবিমলের মন অভিভত হল, কেন যেন হ্যাপি প্রিন্সের গল্পটা মনে পড়ে গেল। চোখ বুজে মনে মনে উচ্চারণ করল সে, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি হে অমিতাভ, হে তথাগত বুদ্ধ আমার প্রণাম নাও।

প্রার্থনা ঘর থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আসুন আপনাদের নিয়ে একটা ছবি তুলি। তাঁর হাতে বড়ো লেন্সওয়ালা দামি ক্যামেরা। বললেন, আপনার কি কম্পিউটার আছে? তাহলে মেইল করে ছবি পাঠিয়ে দেব। মায়া খুব খুশি। লাভার একটা তো স্মৃতি থাকল। চলে যাবার সময়ে বউটা দিয়ার গাল টিপে একটা ক্যাডবেরি দিয়ে যায়।

ওরা যেতেই মায়া হাসতে হাসতে বলে, ভদ্রলোক আমার ফোন নম্বর চাইছিলেন।

দিলে?

না। দিলে বুঝি খুশি হতেন?

হতাম, সুবিমল হাসে।

ভদ্রলোক কিন্তু বুঝতে পেরেছেন আমরা বিবাহিত নই।

কী করে বুঝলেন?

ছবি তোলবার সময় আপনি আমার থেকে দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছিলেন।

ওঃ!

আপনি তো ওই বউটা আর তার মেয়ে সাথেই সারাক্ষণ গল্প করে গেলেন। একটু থেমে মৃদু গলায় বলে মায়া, মা-মেয়ে দুজনেই কী সুন্দর ইংরেজি বলছিল। আপনার তো ভালো লাগবেই।

দিয়ার দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া, আর এই ভ্যাবলা মেয়েটা সারাক্ষণ চুপ করেই থাকল। আন্টি যখন চকোলেট দিলেন একটা থ্যাংক ইউ বলতে পারলি না?

আঃ ছাড়ো। ছোটোদের অত থ্যাংক্স বলতে হয় না।

গুম্ফা থেকে বেরিয়ে ওরা সেই রাস্তাটা ধরে উঠছে। মায়া আর দিয়া একটু এগিয়ে ছিল। হঠাৎ করেই ওরা হারিয়ে গেল! একঝাঁক মেঘ এসে ওদের ঢেকে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ওদের দেখতে পেল না সুবিমল। তারপরেই মেঘ সরে গেল। ওই তো মায়া। আবার নতুন একদল মেঘ এসে তাদের আড়াল করে দাঁড়াল। মায়া নেমে এসে সুবিমলের হাত ধরল। বলল, কী দারুণ না? সুবিমল মায়ার হাতটা চেপে ধরে। মেঘের ভেতর সাঁতার কাটতে কাটতেই ওরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়।

মায়া বলে, চলুন এটায় ঢুকি। দিয়ার খিদে পেয়েছে। রেস্টুরেন্টটা পুরোই ফাঁকা। দরজার কাছের টেবিলটায় এসে ওরা বসে। এখান থেকে রাস্তায় উড়ে যাওয়া মেঘ দেখা যাচ্ছে।

মায়া আর দিয়ার জন্য দু-প্লেট চিকেন চাউমিন আর নিজের জন্য থুপ্পা চাইল সুবিমল। থুপ্পা সেই মনে আছে দার্জিলিং-এ খেয়েছিল। কিন্তু এটায় সেই স্বাদ পেল না। মায়া নিজের প্লেট থেকে চাউমিন তুলে সুবিমলের প্লেটে দিল। খেয়ে দেখুন কি চমত্কার করেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে ওরা জানল, শিলিগুড়ি যাবার শেষ গাড়ি বেরিয়ে গেছে। তার মানে আজ রাতটা হোটেলেই থাকতে হবে।

সবজিবাজারের গলির ভেতর একটা ছোটো কিন্তু সুদৃশ্য হোটেল। চয়েস লজিং অ্যান্ড ফুডিং। সেটাতেই ঢুকল ওরা। ম্যানেজার অল্পবয়সি একটা ছেলে।

সুবিমল প্রশ্ন করল, ইঁহা কেয়া রুম মিলেগা?

ছেলেটি একটু হেসে বলল, দোতলায় একটা ঘরই খালি আছে, চাইলে দেখতে পারেন?

তুমি বাংলা বলতে পারো!

আমি শ্যামনগরের ছেলে, নাম রাজা। আপনারাও তো বাঙালি, দেখেই বুঝেছি।

বাঃ, তাহলে তো খুব ভালোই হল সুবিমল খুশি হয়ে ওঠে।

আসুন আপনাদের ঘরটা দেখিয়ে দিই।

সিঁড়ি দিয়ে ওদের ওপরে নিয়ে আসে রাজা। এটা বোধহয় হোটেলের পেছন দিক। একটা সরু করিডর দিয়ে হেঁটে ওরা একটা ছোটো বারান্দায় এসে দাঁড়াল আর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেল। পুরো বারান্দাটাই ঝুলছে পাহাড়ের খাদের ওপর। একদিকে পাহাড়ের দেয়াল। সামনে মেঘে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়া। হু হু করে কুয়াশা উঠে আসছে নীচ থেকে। বারান্দার লাগোয়া ঘরটাই ওদের দেখায়। সুন্দর সাজানো ঘর। পাশেই অ্যাটাচড বাথরুম।

ওদের অবাক করে দিয়ে মাত্র আটশো টাকা ঘর ভাড়া চায় রাজা। মায়া তবু বলে, ছশো টাকায় হবে না?

কম পড়ে যাবে দিদি।

না ওটাই রাখো।

আর কিছু না বলেই খাতায় ওদের নাম লিখে ঘরের চাবি তুলে দেয় রাজা।

ঘরের বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মায়া বলে, কখনও কল্পনাই করিনি এরকম ঘরে থাকব। ঘর থেকেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

একটু রেস্ট নিয়ে ওরা বাইরে বার হয়। অন্ধকার নেমে এসেছে এখনই। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একটা বড়ো রাস্তা সোজা চলে গেছে। তার দুপাশে গভীর জঙ্গল। পুরো নির্জন পথ। কোনও শব্দ নেই, একটাও আলো নেই। শুধু উজ্জল তারার আলোয় নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকে ওরা।

মায়া বলে, দিয়া এখন যদি বাঘ বেরোয় তো কী করবি?

দিয়া একটু ভেবে বলে, বাঘ এলে যেন আমাকেই খায়।

কেন?

বাঃ, তোমাদের বাঘে খেলে আমি কার সাথে বাড়ি ফিরব? সুবিমল হেসে ওঠে। মায়াও। ফেরার পথেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা।

হোটেলে ফিরে দিয়া টিভি চালায়। চ্যানেল পালটায় সুবিমল। জি সিনেমায় এসে দ্যাখে অনুসন্ধান সিনেমাটা চলছে। দ্যাখা ছবি, তবু আবার দেখতে বসে ওরা।

জানো তো, এই ছবিটার শুটিং পুরোটাই দার্জিলিং-এ হয়েছিল।

তাই?

ভোর হচ্ছে। ছবির মতো সাজানো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে বেতের ঝুড়ি পিঠে ঘুরে ঘুরে নামছে পাহাড়ি মেয়েটা।

সত্যি কি সুন্দর! মায়া বলে।

অন্ধ নায়িকা গান করছে, ওঠো ওঠো সূর‌্যাইরে, ঝিকিমিকি দিয়া, কালকে তুমি আঁধার রাতে, কোথায় ছিলে গিয়া।

ইস, ওর কী কষ্ট তাই না?

কেন?

ও তো কোনওদিন সূর্যটা দেখতেই পাবে না।

সিনেমা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে দিয়া। ওরা জেগে থাকে। সিনেমা শেষ হচ্ছে, অমিতাভ বচ্চন রাখির কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে।

সুবিমল বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। সিগারেট ধরায় একটা। ভেতরে গান চলছে, আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ।

মায়াও কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, বইটা সত্যিই খুব ভালো তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু অবাস্তব!

এমন কেন বলছেন?

অমিতাভের মতো একজন হ্যান্ডসাম পুলিশ অফিসার একটা অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করছে। অবাস্তব নয়?

কেন, এরকম কি হতে পারে না?

জানি না। একটু চুপ করে থেকে সুবিমল বলে, এই যে তুমি আর আমি একসাথে ঘুরছি, রাতে শুচ্ছি। কিন্তু আমি কি তোমায় বিয়ে করতে পারব কোনও দিন?

না। আপনি করবেন না, আমি জানি।

তাহলে?

চুপ করে যায় মায়া। কিছুক্ষণ কেউই কথা বলে না। মুখ না ফিরিয়ে সুবিমল কেমন করে বুঝতে পারে, মায়া কাঁদছে। কোনও শব্দ না করেই।

আচ্ছা মায়া, এই যে আমি তোমাকে কোনও সম্মান দিতে পারি না। সবার কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কটা লুকোতে চাই। এতে তোমার খারাপ লাগে না?

খারাপ লাগলেই বা কী করতে পারি।

মায়া বলে, আমি জানি তো আমি আপনার যোগ্য নই। আমি গরিব, পড়াশোনা জানি না। আবার একটা মেয়ের মা। আপনাকে বিয়ে করার কথা আমি নিজেই ভাবতে পারি না।

তুমি তো জোর করতে পারো।

কেন করব। জোর করে কি সব কিছু পাওয়া যায়?

কিছুক্ষণ আবার চুপ থাকে দুজনে।

আমি জানি কেন আপনি দার্জিলিং যাননি…

কেন?

আসলে বিয়ের পর বউকে নিয়ে দার্জিলিং যাবেন ভেবেছিলেন, তাই না?

কেন এরকম মনে হল তোমার?

এমনিই। আগে ভাবিনি, এক্ষুনি মনে হল। বলুন, ঠিক বলেছি কিনা।

জানি না।

হঠাৎ করেই সুবিমলের পাশে সরে এসে তার বুকে চুমু দেয় মায়া, আর তাকে জড়িয়ে ধরে। সুবিমল বুঝতে পারে তার বুকের কাছটা মায়ার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে।

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সুবিমল বলে, কাঁদে না মায়া। বেড়াতে এসে এমন করে না।

আমি আপনাকে ছাড়তে পারব না।

কে ছাড়তে বলেছে তোমাকে। কেঁদো না।

আমায় ছ়েড়ে চলে যাবেন না তো?

যাবো না।

ঠিক?

ঠিক।

বাইরে লাভার নক্ষত্রভরা আকাশ ভগবান বুদ্ধের করুণাঘন দ্যুতিরময় চোখের মতো তাদের দুজনের দিকে চেয়ে থাকে।

 

আমি ও কোকিলা শেষ পর্ব

একটানা কথাগুলো বলে কোকিলা থামল। আমি ওর দিকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম। একটু চুপ করে বসে জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘ক্রমশ নেমে এল আমার জীবনে চরম অন্ধকার। জানতে পারলাম রাজীবের কোনও হাই-ফাই ব্যবসা নেই। বড়ো ব্যাবসাদারকে খুশি করে অর্ডার পাওয়াই তার কাজ। অল্প কিছু দিনের মধ্যে তার এই ব্যাবসাদার বন্ধুরা বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল। রাজীব বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসত। হুইস্কি-সোডা-রাম, আরও কী যে আমি অত নামও জানি না। এসব নিয়ে আমায় যেতে হতো রাজীবের তথাকথিত বন্ধুদের সামনে। আমায় সময় দিতে হতো, হাস্যময়ী-লাস্যময়ী হয়ে সময় কাটাতে হতো গভীর রাত পর্যন্ত। রাজীব আরও এগিয়ে দিত আমাকে। অর্ডারটা যে পেতেই হবে। পরে আপত্তি জানালে রাজীবের হাতে উত্তম-মধ্যমই জুটত। কাকে জানাব? প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, কেন গুরুজনদের কথা শুনিনি? মা-বাবার বারণ, বিশেষত মায়ের চোখের জল জীবনের চলার পথ কখনওই মসৃণ রাখে না। মা-তো। সন্তানের মঙ্গল কামনা কোন মা না চায়। আমি রাজীবের মা-বাবার সাথে আবার কথা বললাম। কিন্তু ওনাদের উদাসীনতা আমায় অবাক করল। নিজের বাবা-মাকে কী বলব! কুনাল, যে আমার সাথে রাজীবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সে-ও হেসে উড়িয়ে দিল, রাজীব নাকি এমন হতেই পারে না। আমিই সবকিছু মানিয়ে নিতে পারছি না। ভেবেছিলাম রাজীবকে ছেড়ে চলে যাব কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। কী খাব, কোথায় রাত কাটাব, আবার যদি অন্য রাজীবের খপ্পরে পড়ি! ভয়ে আমি রাজীবের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করলাম। এই রাজীবের জন্যই আমায় দু-দু’বার গর্ভপাত করাতে হয়েছে। আমি চাইনি কিন্তু ওর ভয়, আমার ফিগার খারাপ হয়ে যাবে তাই বাধ্য হয়েই আমি রাজি হই। কী কষ্ট যে হয়েছিল। কোন মেয়ে না মা হতে চায়! মনে হয়েছিল একটি শিশু বোধহয় দু’পক্ষের মা-বাবাকে হাসিখুশিতে ভরিয়ে তুলবে। আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শুধু একটা শিশু– আমার স্বপ্ন, আমার জীবন। কিন্তু সবই বৃথা, রাজীবের নির্দয় আচরণ, তার সিদ্ধান্ত, আমায় কোন অন্ধকারে ঠেলে দিল! আর রাজীবের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। আমি রাজীবের তুরুপের তাস। তাই তো আমার সাজসজ্জার দিকে ওর এত নজর। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

আবার কোকিলা চুপচাপ। ফোঁপানির শব্দ। নিশ্চুপ আমি শুধু নির্বাক হয়ে শুনে গেলাম। আমার কিছু করার নেই। কোকিলার এ অবস্থার জন্য অনেকাংশে ও নিজেই দায়ী। আমি কিছুই করতে পারি না। কোকিলা হঠাৎ ঘুরে চলে গেল। আমি কোকিলাকে কোনওদিন কোনও পরামর্শও দিইনি। এ ঘটনার মাস চারেক পরেই আমি বদলি হলাম।

চাকরি সূত্রে বদলি হয়ে চলে এলাম আরব সাগরের তীরে, মুম্বাইতে। আসার সময় রাজীব-কোকিলা দুজনকে একসাথে গুডবাই জানিয়ে এসেছিলাম। বিশেষ করে রাজীবকে, নানা অসুবিধা সত্ত্বেও থাকতে দেওয়ার জন্য। কোকিলা একটা কথাও বলেনি আমার সাথে কিন্তু ওর চোখ বলে দিচ্ছিল অনেক অনেক কথা। হাসির আভাসমাত্র দিয়ে কোকিলা আমায় বিদায় জানিয়েছিল।

মুম্বাই এসে নিজেকে গুছিয়ে নিতে মাস দেড়েক কেটে গেল কোথা দিয়ে বুঝতেই পারিনি। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু যেন বেশি সময় লেগে গেল। তবে মাঝেমধ্যেই কোকিলার বিবর্ণ মুখটা কেমন যেন আমায় উদাস করে দিত। সব জেনেও আমি নিরুপায়, হাত-পা বাঁধা, কিছুই করার নেই। দু’একবার কোকিলাকে ফোন করেছি, ওপ্রান্তে রাজীবের গলা। সাদামাটা কথার পর ফোন নামিয়ে রেখেছি। কোকিলার সাথে কথা বলতে চাইলে রাজীব যে ভাবেই হোক এড়িয়ে গেছে। কোকিলা যেন হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। দিন তার নিজের ছন্দে চলে। অবসরে কখনও আরব সাগরের ধারে বসে দেখি অনন্তের রূপ। সমুদ্রেরও এক নিজস্ব ছন্দ আছে, ওঠানামা, ভাসানো, ফিরে যাওয়া। একা-একা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যাই মাঝেমধ্যে, আবার ঝাড়া দিয়ে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসি নিজেকে। একদিন অফিস গিয়ে নিজের নামে চিঠি দেখে বেশ চমকে গেলাম। এই মোবাইলের যুগে কেউ আর ব্যক্তিগত চিঠি লেখে না। খুলে দেখি চিঠির তলায় লেখা কোকিলা।

বিনা সম্বোধনেই সে লিখেছে – ‘জানি এতদিন বাদে আমার চিঠি পেয়ে তুমি চমকে যাবে। আমার কথা মনে আছে তো? নাকি সব ভুলে গেছ? মাত্র অল্প কয়েক মাস তুমি ছিলে আমাদের কাছে, তবু তোমায় আমি আমার ব্যক্তিগত অনেককিছু উজাড় করে দিয়েছিলাম। তুমি জানতে চাওনি তবুও। তোমার নীরবতাই আমায় টেনেছিল তোমার দিকে। সে যাইহোক, কুণালকে মনে আছে নিশ্চয়ই। আমার কলেজের বন্ধু যে রাজীবের সাথে আলাপ করিয়েছিল। আমি জানতাম কুণাল আমায় ভালোবাসে, তবু ওই বয়সে রাজীবের অত টাকাপয়সা, ব্যবসা, সব আমায় গুলিয়ে দিয়েছিল। আমি কুণালের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে রাজীবের হাত ধরেছিলাম। কুণাল বেশ ভেঙে পড়লেও আমায় কিছু বলেনি। জানি ও এখনও বিয়ে করেনি। এও জানি এখন ও চেম্বুরে কোনও এক ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের অফিসার। প্লিজ ওর সাথে যোগাযোগ কোরো, বলো বিয়ে করতে। কেন বলছি জানি না, তবু একদিন আমি ওকে ভালোবাসতাম, ও হয়তো আজও বাসে। আমায় ভুলে যেতে বোলো। প্লিজ শুধুমাত্র একসময়ে বন্ধুত্বের দাবিতে তোমায় হয়তো বিরক্ত করলাম। ভালো থেকো। আমি কেমন আছি জানতে চেও না।’

অফিসে কাজ করা মাথায় উঠল। হাফ-ডে করে বেরিয়ে পড়লাম কুণালের খোঁজে। অফিস টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটেই কুণালের খোঁজ পাওয়া গেল। কিন্তু দুজনে মুখোমুখি হতে আরও চার-পাঁচদিন কেটে গেল। ফোনে আমি কোকিলার কথা সেভাবে কিছুই জানাইনি। শুধু বলেছিলাম, ওকে চিনি। কুণালকে কোকিলার চিঠির কথা বলতে কুণাল চুপচাপ শুনল, যখন চিঠিটা ওর হাতে দিতে গেলাম নিল না। অদ্ভুত স্থির হয়ে বলল ‘চিঠিটার কোনও মূল্য আর নেই বোধহয়, গতকাল রাতে কোকিলা সবকিছুর ঊর্দ্ধে চলে গেছে। আমি চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম ‘কি! তুমি কি করে জানলে? কে খবর দিল? কি হয়েছিল?’ কুণাল ধীর গলায় বলল, ‘বিজয় চেম্বুরে এসেছে, ওর মাসির বাড়ি এখানেই। কাকতালীয়ভাবে আমিও সেই বাড়িতে পেয়িংগেস্ট থাকি।’

কোনও কথা না বলে আমি ফিরে এলাম নিজের ঘরে। এক অদ্ভুত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম না খেয়েই। পরের দিন যথারীতি অফিস। পৌঁছোতেই আবার এক চমক। চিঠি। হাতের লেখা দেখেই বুঝলাম, কোকিলা। যে-মানুষটার চিঠি আমার হাতে, সে যে পৃথিবীতে নেই, ভাবতেই কেমন যেন এক বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। চিঠিটা হাতে নিয়ে নিজের টেবিলে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে বসে রইলাম, সামনে কোকিলার চিঠি। চিঠিটা খুললাম, এক সুন্দর গন্ধের ছোঁওয়া চিঠির পাতায়। একইরকম ভাবে সম্বোধনহীন চিঠি।

‘কী হল, কুণালের সাথে দেখা হল? তোমার চিঠির অপেক্ষায়।’

—- কোকিলা

পুনশ্চঃ  তোমায় বলা হয়নি, আমি আর ভালো নেই। হাসপাতালে রয়েছি। এইচআইভি পজিটিভ। তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কোরো। মনে হয় তুমি দেরি করে এলে, তোমারও মনে হবে বড়ো দেরি হয়ে গেলো।

আমি ও কোকিলা পর্ব ০১

কুনালের পক্ষে সম্ভবই নয় প্রভূত পরিমাণে টাকা কিংবা গাড়ির স্বপ্ন দেখা। আর রাজীব, দিল্লিতে নিজের বাড়ি-ব্যাবসা— সব মিলিয়ে সফল পুরুষ। এক মুহূর্ত সময় নেয়নি কোকিলা এতদিনের ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে রাজীবের হাত ধরতে।

কোকিলার মৃত্যুসংবাদ আমায় বিচলিত করেনি। আমি জানতাম এমনটাই হবে— ধীরে ধীরে। জীবন যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খাবে, এক পা এক পা করে ও এগোবেই মৃত্যুর দিকে। আমি হতবাক হয়ে ভাবছিলাম ওর সাথে পরিচয়, সুখস্মৃতির কথা।

কোকিলা আমার কেউ নয়, এমনকী বন্ধুও নয়। ওকে চিনেছি অন্যভাবে সৌজন্যবশতঃ। কাজের সূত্রে অল্প কিছুদিনের জন্য দিল্লি থাকতে হয়েছিল। সেখানেই আলাপ রাজীবের সাথে। রাজীব ধূত। পেশায় ব্যবসায়ী। ঘরের খোঁজ তার কাছেই পাই। তারই বাড়ির চিলেকোঠায়। এককামরা হলেও আমার অসুবিধা নেই। আমার অফিস এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। আর জায়গাটাও বেশ ভাল। বেশ ছিমছাম। রাজীব একা থাকে, স্ত্রী থাকলেও এক সপ্তাহেও তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি।

সুযোগ এল, তা অন্যভাবে। একদিন অফিস থেকে বেরতে গিয়ে শুনি, ‘বন্ধ’। আরে হলটা কি? এই তো দুপুরে নীচে এসেছিলাম। গেটের সিকিউরিটি খবর দিল, ‘সাব দো আদমি মর গয়ে। দুকান সব বন্ধ হো গিয়া তিন বজে।’ বেশ দুশ্চিন্তা হল। বুঝলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হঠাৎ সব দোকানপাট বন্ধ। আমার তো মাথায় হাত। রোজ ভুজবল (ওড়িয়া ছেলে) আমার দিনের রাতের-খাবার দিয়ে যায়। শুনশান রাস্তা দিয়ে বেশ সন্ত্রস্তভাবে হেঁটে বাড়ি এলাম। একটু ঘুরে ভুজবলের দরজায় টোকা মারলে খানিকবাদে চিৎকার করে উত্তর এল, ‘খাবার পাওয়া যাবে না। দুপুর থেকে সব বন্ধ।’ আমি দরজা খোলার কথা বললেও কেউ খুলল না। অগত্যা বাড়ি এসে বিস্কুট-মুড়ি-চানাচুর, দারুণ ডিনার। ঢকঢক করে জল খেয়ে সটান বিছানায়। অন্যান্য দিন একটু টিভি দেখি আজ ভুজবলের উপর রাগে আমার সব গোলমাল হয়ে গেল।

ঘুম ভাঙল বেশ ভোরবেলায়। এত সকালে আমি উঠি না। গ্যাসে চা বানিয়ে লনে একটু বসেছি হঠাৎ রাজীব। ও যে প্রাতর্ভ্রমণ করে আমি জানতাম না। সুপ্রভাত জানিয়ে পাশে বসে পড়ল। ও বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল ‘এত সকাল সকাল কি ব্যাপার! আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও বলতে বাধ্য হলাম, ‘কার্ফিউয়ের জন্য ভুজবল ডুব মেরেছে।’ রাজীব মনে হল একটু লজ্জিত হল। একথা-সেকথার পর একটু ব্যায়াম করে চলে গেল। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে সিঁড়ির মুখে গিয়ে বলল, ‘আমাদের সাথে সকালের নাস্তাটা করে যেও।’ রাজীব মাঝেমধ্যে বাংলা বলার চেষ্টা করে। আজ ও পুরো বাংলায় কথা বলল।

আমি দ্বিরুক্তি না করে, রেডি হয়ে সকাল ন’টায় হাজির হলাম নীচে। রাজীবই দরজা খুলে দিল। খাবার টেবিলে আলাপ হল রাজীবের স্ত্রী কোকিলার সাথে। প্রথম দেখায় কেমন যেন ম্লান মনে হল, হাসলও ফ্যাকাসে ভাবে। দু’দিন আমায় ওদের সাথে জলখাবার খেতে হয়েছিল। কোকিলা খাবার টেবিলে বড়োই চুপচাপ। আমি আর রাজীবই যা কথা বলি। তবে রাজীব ঝড়ের মতো, খেয়েই বেরিয়ে যায় নতুবা বেশি সময় মোবাইলে কথা বলে। আমি মাঝেমধ্যে কোকিলার দিকে তাকাই। নীরব চোখে। মনে কত জিজ্ঞাসা কিন্তু রাজীব নিজের স্ত্রী-র ব্যাপারে উদাসীন না সতর্ক, তা বুঝতে পারিনি। কথা বলতেই দেয় না। ঠিক এড়িয়ে চলে, যাতে কোকিলা নাস্তার টেবিলে কথোপকথনে যোগ না দিতে পারে। তিনদিনের দিন থেকে দিল্লির রাস্তাঘাট স্বাভাবিক, ভুজবলও স্বাভাবিক।

দিন কাটছে নিজের ছন্দে। রাজীব বা কোকিলার কারুর সাথেই দেখা হয় না। একদিন বেশ সকালে দরজায় খুটখুট। ভাবলাম রাজীব। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই চমকে ঘুম পালাল, কোকিলা। পাশ কাটিয়ে কোকিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানায় বসেই বলে উঠল, ‘কানপুর থেকে আমার ভাই আসবে কাল সকালে, ও আপনার সাথেই থাকবে।’ একটু থেমে একটু নরম স্বরে আবার বলল, ‘আশা রাখি আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু কেন? আপনাদের নীচে তো ঘরের অভাব নেই। আমার একটা মাত্র ঘর সেখানে দু’জন!’

‘আপনার সঙ্গ আমার ভাইয়ের ভালো লাগবে।’

‘কিন্তু রাজীব যদি কিছু বলে বা মনে করে?’

‘রাজীবের কিছুই আসে যায় না আমার ভাইয়ের ব্যাপারে” অদ্ভুত ঠান্ডা নিরাশ স্বর ভেসে এল কোকিলার গলা থেকে।

একেবারে টিনএজার কোকিলার ভাই। মাত্র তিনদিনের সফরে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছে। অফিসের কাজ ম্যানেজ করে কোকিলার অনুরোধে ভাই বিজয়কে নিয়ে বের হতে হল দিল্লি ঘোরাতে। অবশ্য এজন্য কোকিলা রোজ পাঠিয়েছে ভালো-মন্দ খাবার। বেশ অবাক লেগেছিল যখন বিজয়ের খাবারও আমার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল কোকিলা। প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও আমি নীরব। রাজীবকে একদিনও আমার ঘরে আসতে দেখলাম না শালাবাবুর জন্য। বিজয় চলে যেতে বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আবার ভুজবলের লম্বা কৌটোর খাবার, ঠিক যেন মুখে লাগছিল না। এ ব্যাপারে কোকিলার মুখটা বার বার ভেসে উঠছিল। দু’তিন দিন বাদে সব যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল, রাজীব একদিন আমায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল বিজয়ের জন্য। আমি এতটা সময় দিয়েছি বলে। আমি কেমন যেন বিস্মিত হলাম। হেসে চুপচাপ রইলাম। তবু মনের মধ্যে খচখচানি গেল না। বড়ো বাড়ি, এত ঘর তবু বিজয়কে থাকতে হল আমারই সাথে। এটা কোনওভাবে মেনে নিলেও, দিদির সাথে ভাইয়ের না খাওয়া আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার দিদির বাড়ি গেলে দিদির আদর। ভাগ্না-ভাগ্নিরাও দিদির সাথে তাল মেলায়, আর জামাইবাবু তো পারলে সেদিন ওকালতি করতে যান না।

আমার সব প্রশ্নের সমাধান হল সেদিনই রাত্রে। সিঁড়ির সামনে কোকিলার মুখোমুখি হলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠল, ‘অনেক প্রশ্ন আপনার মনে, অনেক কৌতূহল, আমি জানি। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করছি না। আমি চাইনি আমার ভাই দু’দিনের জন্য আমার কাছে বেড়াতে এসে দিদি-জামাইবাবুর রোজনামচা জেনে যাক। আজ সকালে ও দিল্লির বাইরে গেছে, ব্যাবসার জন্য। প্রতিমাসেই ওর যাওয়া থাকে। ওপরে আপনার ঘরে চলুন অনেক কথা আছে।’ তাকিয়ে দেখি কোকিলার চোখে জলঃ আমি নির্বাক। বুঝলাম মেয়েটি আরও কিছু বলতে চায়। সে নিজের মনেই বলে চলল, ‘আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। বাবা-মা কেউ চায়নি আমি রাজীবকে বিয়ে করি। আমারই এক কলেজ-বন্ধু রাজীবের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। রাজীব নাকি ব্যাবসা করে দিল্লিতে এবং রাজীবও আগ্রহী আমার প্রতি। ওকে দেখে আমি প্রায় পাগল। মা-বাবার অমতে, পড়াশোনা শেষ না করেই ওকে বিয়ে করি। কুনাল, আমার কলেজ-বন্ধু। সে ছিল রাজীবের সম্পর্কতুতো ভাই। সেও বলেছিল, ‘গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট কর।’ আমি সবার বিপরীতে গিয়ে রাজীবকে বিয়ে করি। কেন জানি না আমার ছোটো থেকে স্বপ্ন ছিল, ধনী ঘরে আমার বিয়ে হবে। ছা-পোষা কেরানিকে বিয়ে করা আমার পোষাবে না। রাজীবের মা-বাবাকে জানানো হয়েছিল, ওনারা আসতে চাননি। আমার মা বাবা তখনই আপত্তি করেছিল কিন্তু আমার অন্ধ প্রেম সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। রাজীবের অদ্ভুত তাকানো, কথা বলা, স্বপ্ন রচনা, ভালোবাসার খুঁটিনাটি সব… সব আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক স্বর্গরাজ্যে। ও বলেছিল হনিমুনে যাবে সিঙ্গাপুরে। কিন্তু বিয়ের পর কাজের চাপের জন্য সব ক্যানসেল। মেনে নিয়েছিলাম স্বাভাবিক কারণেই। ব্যবসাদার মানুষজনদের কাজের ধারাটাই এরকম। সে যাইহোক, এও বলেছিল বিয়ের পর দিল্লিতে একটা গ্রান্ড পার্টি দেবে। কোথায় কি? রাজীবের বাড়ির লোকজন আমায় ভালো করে অভ্যর্থনাটুকুও জানায়নি। তিন চারদিন ওর মা-বাবার সাথে থাকার পরই চলে গেলাম ভাড়ার বাড়িতে।’

সন্দেহ

(১ )

এই শনিবার পঞ্চানন পুজো। রাঘবের মনে ছিল না। যথারীতি সকালে উঠে লাল চা আর বিস্কুট, তারপর গরুর দেখভাল। দুটো গাই গরু আছে। এবেলা ওবেলা ভালোই দুধ দেয়। কিন্তু রাঘবের আফশোস বাড়ির কেউ দুধ খায় না, আর রাঘব নিজে দুধ বিক্রির বিরুদ্ধে। রাঘব রাতে দুধভাত আর দিনে দইভাত পছন্দ করে।

বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং সংসারে সাকুল্যে তিনজন। ছোটো মেয়ে বউ আর সে। শুক্রবার রাত্রে ছোটো মেয়ে জন্মদিন ছিল। লুচি করেছিল কৃষ্ণা। পাশাপাশি খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত। রাঘবের অফিসে আবার সেদিন ছিল ইয়ার এন্ডিং। দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে রাতে আর লুচি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লুচি রেখে দিয়েছে তার গিন্নি কৃষ্ণা।

ছোটো মেয়ে ইতু হঠাৎ বলে উঠল বাবা তুমি বাসি লুচি খাচ্ছ! আজ তো শনিবার। বটতলায় শিবের থানে যাবে না? দেড়খানা লুচি খেয়েছিল রাঘব, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল ওরে বাবা কি পাপ করলাম…রে! অর্ধভুক্ত লুচি আর হাফ কাপ চা পড়ে রইল। আর সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটল।

পুজো ছিল কদমগাছি রায়নাপুরে। বরাবর সে এটা করে। সবই নির্বিঘ্নে হল। কেবল ধ্যান করার সময় বাসি লুচির ঢেকুর। কেমন অম্বল অম্বল! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল রাঘবের। শুক্রবার মাংস, শনিবার বাসি লুচি। বটতলা থেকে রাঘব ফিরছিল, গায়ে নামাবলি।

দু-পাশে গাছ। পঞ্চায়ে লাগিয়েছে। পিচ ঢালা রাস্তা। মোরাম বদলে পিচ। সোনাঝুরি গাছের ছায়া। মনোরম লাগে রাঘবের। ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এই অঞ্চলে। আগে একটু নেশা করত রাঘব। এখন সেই সব বালাই নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে। পুজোআচ্চা বেড়েছে। রাঘব নিজে এখন অভয়গিরি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ। আজকাল মাঝে মাঝেই আকস্মিক বেগ চলে আসছে।

সোনাঝুরির গাছের পাশে চওড়া ড্রেন। সাইকেল থামিয়ে রাঘব বসে পড়ল। কানে পইতে। কিন্তু দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হওয়ার পরেই রাঘবের মাথা ঘুরে গেল। সটান ড্রেনে একেবারে মুখ গুঁজে পড়ল। কতক্ষণ যে সে ড্রেনে ছিল, তার নিজের খেয়াল নেই। অজ্ঞান রাঘব। যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে। ডাক্তার বললেন সব গ্যাস থেকে হয়েছে। হাতে কোনও চোট নেই, মাথায় আঘাত নেই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে কোমরে লাগছে।

চিত্তরঞ্জন থেকে বড়দা এসে উপস্থিত। বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ছড়িয়ে বড়ো বাড়ি, বেশিরভাগ ঘর তালা বন্ধ। একমাত্র দোল উত্সবে সবাই একসঙ্গে। তখন সাতদিন ধরে বাড়ি থাকে জমজমাট। রাধাকৃষ্ণের অষ্টমঙ্গলা পর্ব সমাপ্ত করে আবার সবাই কর্মস্থলে ফিরে যায়। অঢেল ভোগের এলাহি বন্দোবস্ত। লুচি ছোলার ডাল, তিন-চাররকম সবজি দিয়ে তরকারি, পায়ে। পাত পেতে সবাই মিলে ঘরে একসঙ্গে। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাবার পর রাঘব কদিন ঝিম হয়ে বসে থাকে। নীলাচল, রাঘবের বড়দা এসে এবারে খুব হম্বিতম্বি করল। তার ধারণা রাঘব নেশা করে, রাঘব যত বলে সে নেশা থেকে শত হস্ত দূরে, নীলাচলের বিশ্বাস হয় না। বাড়ির পেছনেই তাল গাছ।

—তুই নিশ্চয়ই তালের রস খাস! নীলাচল বলল।

—বিশ্বাস করো দাদা রাঘব গলায় মিনতির সুর।

—তাহলে তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি কেন? দড়ির মই কেন?

পরদিনই হাঁড়ি নামানো হল। দড়ির মই কেটে ফেলা হল। নীলাচলও নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। ইচ্ছে করে রাঘবের মাঝে মাঝে তালের রস খেতে। কিন্তু গোপালপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার কেউ নেশাভাং করে না।

কোমরের ব্যথা রাঘবের কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে কোমরে বেল্ট, প্রতিদিন ব্যায়াম। রাঘবের বড়ো মেয়ে রানীগঞ্জে থাকে। জামাই গৌতম থানার সেকেন্ড অফিসার। বাড়ি বৈদ্যবাটি। চতুর ছেলে। নিজেই রাঘবকে বলে, বাবা মাইনেতে হাত দিতে হয় না। পকেট ভর্তি টাকা গৌতমের। গৌতমই সন্ধান নিয়ে এল, নিয়ামত্পুরের অদূরে একজন সাধিকা আছেন, তিনি ওষুধ দেন।

রাঘবের এক বছর চাকরি আছে। ছোটো মেয়ে ইতু এবার মাধ্যমিকে বসেছে। মনে উদ্বেগ সবসময় কাজ করে রাঘবের। যদি তার কিছু হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে! ড্রেনের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় নাকে এসেছিল প্রস্রাবের গন্ধ। সেই গন্ধটা আর দূর হচ্ছে না। আর ওই গন্ধটা নাকে এলেই উদ্বেগ। বউ কৃষ্ণাকে বলেছে রাঘব। কৃষ্ণা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে ও তোমার মনের ভুল। এর জন্য রাঘবকে নিয়ামত্পুরের সাধিকার কাছে জোর করে নিয়ে এল জামাই গৌতম।

বাংলা বিহার সীমান্ত ঘেঁষা এক শ্মশানে সাধিকার আশ্রম দেখে রাঘবের চোখ ছানাবড়া। অত্যন্ত রূপসী। মাথায় জটা, একটি মধ্যত্রিশের মেয়ে গৌতমের সঙ্গে কী সব ইশারায় কথা হল। রাঘবের মোটেও পছন্দ হল না। গৌতম ও সাধিকা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। লোকজন বিশেষ নেই। বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। অদূরে একটা মরা পুড়ছে। পাশে একটি সরু খাল। সামান্য জল। সেই জলে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে। সন্ধে হয়ে আসছে। চারধারটা নির্জন।

জামাই গৌতমের স্কুটারে চেপে রাঘব এসেছে। তার আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বড়ো মেয়ে জোর করে পাঠিয়েছে। বড়ো মেয়ে বিশ্বাস এই সাধিকার ওষুধ খেলে তার বাবা ভালো হয়ে যাবে। স্কুটারে ফেরার পথে রাঘব গৌতমের শরীর থেকে মদের গন্ধ পেল। রাঘবের কোমরে ব্যথাটা আজ যেন একটু বেশি। মাঝে মাঝে ভেতরে ভেতরে কেঁপে যাচ্ছিল রাঘব। ওষুধ খেতে হবে। রাঘবের মনে হচ্ছে স্রেফ বুজরুকি। সাধিকা ও গৌতমের নিভু আঁচে পারস্পরিক ইশারা ইঙ্গিত! ভাবতেই রাঘবের ব্যথা উঠে এল ঠিক শিরদাঁড়ার নীচে। কোমরের ডান দিকে।

রিতু, রাঘবের বড়ো মেয়ে বলল, বাবা কেমন বুঝলে? খুব ভালো সাধিকা তাই না!

রাঘব বিহ্বল। কেমন যেন ঘোর!

—ওষুধ দিয়েছে বাবা? নিয়ম করে কিন্তু খেতে হবে তোমাকে।

রাঘবের তখন বলতে ইচ্ছে হল রিতুকে, যেন গৌতম ওখানে আর না যায়! কিন্তু সবেমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে রিতুর। আগের বাচ্চাটা নষ্ট প্রসব। এই সময়ে এসব কথা বলা কি ঠিক!

রাঘবের চোখ বন্ধ। নাকে আসছে আশ্রমের ধূপের গন্ধ। রাঘবের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। রাঘবের ফাটিকা গ্রাম। দেবখালের পাশে। দেবখাল বেশ বড়ো। খালের দুপাশে বাঁশের ঝাড়। খসেপড়া বাঁশের বাকল। হলদে ছায়া। নিরিবিলি। দুপুরের তাপ কেমন শান্ত! বাঁশ তলিতে গভীর ঘুঘু পাখির ডাক। নুয়ে পড়া বেতের লতা। একটা দুটো ফিঙ্গে পাখি। দেবখালের চারপাশে কৃষিজমি। বর্ষায় জল উপচে পড়ে। পচিয়ে দেয় জমির ধান। খালের জলের নীচে দলঘাসা শৈবাল। নলখাগড়া। দেবখালের সঙ্গে বিষহরি খাল মিশেছে।

( ২ )

বছর ঘুরে আবার পঞ্চানন পুজো। রাঘব নিবিষ্ট! কতক্ষণ বসে আছে রাঘব, কোনও খেয়াল নেই, চারদিকে প্রচুর মানুষ। রাঘবের স্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ। রাঘবের কোমরের ব্যথা শিরশির করছে। ব্যথার অনুভতি মেরুদন্ড বেয়ে ক্রমশ উঠছে।

শেষদিকে রাঘবের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া একটা আচ্ছন্ন ভাব। কিন্তু অর্চনা তো শেষ করতে হবে! এটা চার-পাঁচটা গ্রামের খুব ধুমধাম উত্সব। চোখ বন্ধ রাঘবের। কোথায় যেন পড়েছিল শ্রীপঞ্চানন (শিব) পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি পছন্দ করে না। রাঘবের তো নেই। তবে হঠাৎ এ কথা কেন মনে হল!

বাড়ি ফিরছিল রাঘব। গত বছর যেখানে তার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে রাঘব সাইকেল দাঁড় করল। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের রোদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ কী যে মনে হল রাঘবের, একটা গাছের আড়ালে বসে নিজের পোঁটলা খুলে ফেলল। কৌতূহল, খিদে, একই সঙ্গে তার এখন। পোঁটলার মধ্যে কতরকম জিনিস। দেখে তো রাঘবের চোখ ছানাবড়া।

এক কুইন্টাল চাল, পাঁঠার মুড়ি, পাঁঠার পেছনের ঠ্যাং, তিন হাজার টাকা (পাঁচশো টাকার ছখানা কড়কড়ে নোট) তিন হাজার টাকার কয়ে। ওরে ব্বাস অস্ফুট কণ্ঠস্বর রাঘবের। সত্যি তো এত সব দিয়েছে তাকে! গত বছরে দেয়নি, তার আগের বছরও…! কিছু মনে নেই রাঘবের। কালে কালে কত হল। এতসব জিনিসপত্র নিয়ে সে কী করবে? তার বউ কৃষ্ণা, মেয়ে ইতু মাছ মাংস ছোঁয় না। রাঘবের ইচ্ছে করে খেতে।

পোঁটলার ভেতরে পোঁটলা। মাখা সন্দেশ, শসা, কলা, আপেল, আর নাড়ু। গুড়ের নাড়ু। পটপট কয়েটা নাড়ু খেয়ে নিল রাঘব। সঙ্গে বোতলের জল। পাশে পড়ে আছে ছাতা, দক্ষিণায় পাওয়া নতুন ধুতি। ক্রমশ অন্ধকার করে আসছে। তুমুল হাওয়া ও টিপটিপে বৃষ্টি। সকালের দিকেও মেঘ ঘন ছিল। মেঘের রং এত কালো যে বোঝাই যাচ্ছে না সময় কত! বাড়ি ফিরতেই তুমুল বৃষ্টি এল। আর তখনই তরল ছায়ার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণা পাশে এসে দাঁড়াল।

—রিতুকে কেমন দেখলে? কৃষ্ণার প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল ভালো।

—আর গৌতম কেমন আছে? কৃষ্ণার পরের প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল এসব প্রশ্ন করছ কেন হঠাৎ!

—কৃষ্ণা কেঁদে উঠল। বৃষ্টির শব্দ ও কান্নার হেঁচকি মিলেমিশে একাকার।

—কাঁদছ কেন? রাঘবের স্বরে বিস্ময়।

—ওরা গৌতমের মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে। কান্নাভেজা গলায় কৃষ্ণা জানাল।

—কারা? রাঘব জিজ্ঞেস করল।

—মুখটা ঝলসে গেছে গৌতমের। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।

—কে মেরেছে অ্যাসিড রাঘব প্রশ্ন করল?

—আমাকে ফোন করেছিল হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণা বলল।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাঘবের মুখ। কৃষ্ণাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে ছুড়েছে অ্যাসিড?

ভোরবেলায় রওনা হল রাঘব। আসানসোল। বড়ো হাসপাতাল। বেডের কাছে কেউ নেই। চোখে মুখে ব্যান্ডেজ। বাইরে দাঁড়িয়ে গৌতমের বন্ধুরা। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাঘবের। পলাশ গাছের নীচে রাঘবকে দেখে সবাই কেমন চুপ। রাঘব খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কে ছুড়েছে অ্যাসিড ওর মুখে? রাঘবের চোয়াল তখন শক্ত। কেউ বলতে চাইছে না। সবাই নিশ্চুপ।

বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু রাঘবকে ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে বলল, মেসোমশাই আমরা সামলে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গৌতম প্রাণে বেঁচে যাবে। শুধু মুখটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ সব ঘরের সমস্যা… সন্দেহ। চা খাবেন মেসোমশাই?

চায়ে দোকানে পাতা বেঞ্চিতে থপ করে বসে পড়ল রাঘব। কোমরের ব্যথাটা একেবারে মাথার পেছন বরাবর উঠে এসেছে। এভাবেও হয়! রিতু সন্দেহের বশে এই কাজটা করতে পারল? সন্দেহ তো তারও প্রথম থেকে হয়েছিল। তা বলে… বলে…!

সই চম্পাবতী

এক

গুপ্তিপাড়ার এক কবিরাজের কাছে গোপনে গোপনে ওষুধ খাচ্ছিল চম্পা মণ্ডল। যৌনতা-বর্ধক ওষুধ। না, কবিরাজকে সে চেনে না। জানেও না এর জন্য কত দাম নেয় সে। ওষুধের গুণ টের পাওয়া যাবে তিনমাস পর থেকেই। পুরো ফল পেতে হলে আরও তিনমাস মোট ছমাস খেতে হবে।

তাকে নিয়মিত এই ওষুধ এনে দেয় তার স্বামীর বন্ধু সুনীল। এমন উপকারী লোক, অথচ দ্যাখো পয়সা দিতে গেলে নেবে না। জোর করলে বলবে, এই কোবরেজের খুব নাম। অনেকেই তার ওষুধ খায়, শুনি কাজও হয়। যদি কাজ হয়, তখন তুমি আমাকে পয়সা দেবে, কেমন?

বিয়ের পর প্রথম প্রথম কিছু বলেনি হারান। দিন কয়েক যাবার পর সে মুখ খুলতে থাকে। মিলন শেষে নিরুত্তাপ গলায় বলত, তুমি বড়ো ঠান্ডা! কিছুতেই গা-গরম হয় না তোমার! অথচ তুমি যা গায়েগতরে। দেখলেই মনে হয় ঝাঁপ দিই ওই উত্তুঙ্গ যৌবনের ভিতর। প্রাণের জ্বালা জুড়াই। কিন্তু আসলে তুমি একটি ঠান্ডা সাপ ছাড়া আর কিছু নও। ঝাঁপ দিয়ে আগুন মেলে না, বরফের জলে গা ভিজে ওঠে।

কথাটা গায়ে মাখেনি চম্পা। যৌনতা তার ভালো লাগে না। ওই সময় সে কেন যে আড়ষ্ট হয়ে থাকত, তা সে নিজেই জানে না। পরের দিকে হারান নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সে চম্পাকে মারধর করত। রাগে গরগর করতে করতে মাঝরাতেই ঘরের বাইরে চলে যেত।

একাকী বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদত চম্পা। তার গায়ের রং কালো। কিন্তু সুডৌল স্তন, ভরাট কোমর, চওড়া কাঁধ ও তার কালোর উপর সুন্দর মুখশ্রীতে এমন কিছু ছিল যে, একবার দেখতে গিয়ে হারানের তাকে ভালো লেগে যায়।

হারানের এক প্রাণের বন্ধু হল সুনীল রাজবংশী। সুনীল নৌকো বানায়। ঘর ছেড়ে নৌকো বানানোর জন্য কোথায় না কোথায় পাড়ি দেয় সে। এক মাস দিঘা তো কোনও মাস মেদিনীপুরের অচেনা কোনও এক নদীর ধারে, আবার কখনও তার ডাক আসত শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ থেকে। কখনও বা ঘরের পাশে কুন্তীঘাটে যেত নৌকো বানাতে।

নৌকোর কারিগর হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু তার নিজের কোনও নৌকো নাই। সে যখন হারানের সন্ধানে আসত, তাকে ঠেস মেরে চম্পা বলত, এবার এট্টা নৌকো বানাও মাঝি, গাঙ্গ-এ ভেসে পড়ি।

সুনীল তখন রসিক নাগরের মতো হাসত। বলত, তোমায় নিয়ে কোথা যাব, বউ? সুনীল তাকে গোপনে বউ বলে ডাকত। মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারত সুনীল। চম্পার মাঝে মাঝে মনে হতো, তার যদি সুনীলের সঙ্গে বিয়ে হতো, তবে সে সুখী হতে পারত।

হারান ছিল রাজমিস্ত্রি। বড়ো রাজমিস্ত্রি নয়, সে ছিল সহকারী। কাজের টানে তাকেও বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন সে সুনীলকে বলে যেত, বউটা রইল, দেখিস। সুনীল সেইসব দিনে আসত কিন্তু ঘরে ঢুকত না।

চম্পা ডাকত ঘরে বসার জন্য কিন্তু সে বলত, দিনকাল তো ভালো নয় বউ, কে কখন কী বদনাম দেয় তার ঠিক কী! তার চেয়ে এই ভালো। তোমার খবর করা হল, দেখা হল, কথা হল, সবদিক বজায় থাকল, আর কী চাই? এমনটাই থাক না।

চম্পা রেগে বলত, বদনাম আবার কী মাঝি? কে করবে বদনাম? তুমি কি আমার পর? তুমি আসবে, রোজ আসবে এই আমি কয়েক দি। শুনে মিটিমিটি হাসে সুনীল।

—আর বদনাম হলে? মুখটি ফিরিয়ে নেয় চম্পা।

—সে তো আমার ভাগ্য গো! এমন বদনামে যে মরেও সুখ!

বুক ভরে ওঠে সুনীলের। মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, বলো কী, বউ! তারপর?

—তারপর আর কী, একখান নাও নিয়ে ভেসে পড়ব দুজনাতে।

সুনীল তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তা ভেসে ভেসে যাবে কদ্দূর?

—যাব না। নাও-তেই থেকে যাব। সারারাত, সারাজীবন।

—সংসার তোমার ভালো লাগে না, না বউ?

নীচু মুখে, বাঁ হাতের আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে চম্পা বলে, পালাইনি তো তোমার সঙ্গে। পালালে, একটা সংসার পেতুম।

—তবে ভেসে পড়বার কথা বারবার কও কেন, বল দিকি?

—সে আমার ইচ্ছে!

—কেবলি ইচ্ছে? আর কিছু নয়?

উদাস গলায় চম্পা বলে, আমি কোনওদিন নদী দেখি নাই! অনেক অনেক জল দেখি নাই! পাড় থেকে দেখা কি আর দেখা হল মাঝি? নদীকে দেখতে হলে নদীর বুকে থাকতে হবে। কেন, তোমার কি আমাকে নিয়ে ভেসে পড়তে আপত্তি আছে?

সুনীল বলে, তা নয় বউ। তুমিই আমার সব। আমার জীবনমরণ। আমার নাও, আমার নদী, আমার নৌকো। পর তো নও তুমি আমার। কিন্তু জানো কী, যেখন তুমি নাও ভাসাবার কথা কও, তোমাকে কেমন যেন উদাস লাগে।

—আর কেমন লাগে?

—বেউলা লাগে তোমায়। বেউলা- সুন্দরী। এক কলার মান্দাসে চলেছ তুমি।

—সেই মান্দাস তুমি, মাঝি বোঝ না?

—বুঝি বউ, বুঝি।

—তবে আমাকে নিয়ে ভেসে পড়ো না, কেন?

—পারি না যে!

—কেন পারো না মাঝি? আমার এ জীবন কি জীবন? পারো না আমায় একটা নতুন জীবন দিতে?

—ও এমনি করে তোমার গায়ে হাত তুলবে আমি কল্পনাও করতে পারি নাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চম্পা বলে, দেহ ছাড়া সুখ হয় না মাঝি। দেহ ছাড়া দেহসুখ যে সোনার পাথরবাটি, মাঝি! দেহ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হয় না, সংসার হয় না, প্রেম-পিরিতি হয় না। দেহ ছাড়া এই পৃথিবী শূন্য মাঝি! এ-পৃথিবী দেহের বশ। আর সেই দেহ আমার নেই!

তার দীর্ঘশ্বাস নিজ গায়ে মেখে নিতে নিতে সুনীল বলে, এ-যে তোমার মনের কথা নয়, সখি চম্পাবতী। তুমি যেমনি করে আমাকে বোঝো, তেমনি আর কে বোঝে বলো দিকি। হারানের কথা বলছ? ও কিন্তু সহজ সরল ছেলে। ছোটো থেকেই তো দেখছি তাকে।

—সেটাই তো বিপদ মাঝি। সহজ-সরলেরা যে মনের গভীর কথা পড়তে পারে না! ওদেরকে সব যে বলে বলে দিতে হয়, বুঝিয়ে দিতে হয়!

মাথা নেড়ে সুনীল বলে, কেন যে হারান এমনি করে! ওকে এখন আমি বুঝতে পারি না। মাথা নীচু করে চম্পা।

—ওর শরীর যে আমি সুখে সুখে ভরাতে পারি না, মাঝি। ওকে খুশি করতে পারি না! এবার আমাকে নিয়ে একখানা নাও বানাও মাঝি। সে নাওয়ের নাম দিয়ো সই চম্পাবতী। আমি মরে যাই যদি, তোমার সেই নাও-এর মাঝেই আমি বেঁচে থাকব। আমার এই দুই চোখ এঁকে দিও নাও-এর গায়।

—তুমি নাও হবে, বউ? সুনীল চোখ বড়ো বড়ো করে। বলে, তুমি যে গহিন গাং বউ, নাও হতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? গহিন গাং, তার এপার, ওপার দেখা যায় না। মনের গভীর-গোপনে কোন ধন খেলা করে, তাকে কে বোঝে, কে ছোঁবে বউ? গহিন গাং তাই চিরকাল মানুষের কাছে অধরাই থেকে যায়।

—আমি যদি গহিন গাং হই, তুমি তার বুকে এক নাও।

—না বউ। আমি তা নয়।

—তবে? গহিন গাং যদি তোমার কোনও কাজেই না-লাগে, তবে লাভ কী আমার গাং হয়ে

—তোমায় ডুবে মরে যে সুখ, সখি!

এর পর আর নিজেকে সামলাতে পারেনি চম্পা। দুবাহু এগিয়ে দিয়ে সে জাপটে ধরে সুনীলকে।

সুনীল থরথর করে কেঁপে ওঠে। চম্পার উষ্ণ নিঃশ্বাসের কাছে সে পুড়ে যেতে থাকে। নতজানু হয় তার শরীরী-সুবাসে। ক্রমে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে তার। আর চম্পা তাকে দিয়ে নিজেকে চেনে। সে বোঝে, গহিন গাং-এ জোয়ার এসেছে। সেটা কবিরাজি ওষুধের কাজ নাকি সুনীলের সোহাগভরা ব্যবহার— তা সে নিজেই জানে না। মোটেই একটি ঠান্ডা সাপ নয়। সেও পারে। সেও জানে, কীভাবে প্রবল জোয়ারের ধাক্কায় ডুবাতে হয়, কীভাবে ভাসাতে হয়, একটি নাও-কে। কীভাবে সেই নাও-কে নিজের গোপন খাঁড়ির দিকে গভীরে নিতে হয়।

দুই

এক পথ-দুর্ঘটনায় হারান মণ্ডল মারা গেল। লরি-বাস নয়, তাকে ধাক্কা মেরেছিল একটা বাইক। সকালে যেমন কাজে বের হয়, সেদিনও তেমনি বেরিয়েছিল। সমুদ্রগড় স্টেশনে নেমে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। রাস্তা পেরোনোর সময় একটি দ্রুতগতির বাইক তাকে সজোরে ধাক্কা মারে, হারান রাস্তার ধরে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। লোকজন জমা হয়। একটা ভুটভুটি ভ্যানে করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেখানে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল তিনদিন।

লোকমুখে খবর পেয়ে সুনীলকে নিয়ে সেখানে যায় চম্পা। মৃত হারানকে দেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তাকে একদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখনই জানা যায়, সে তিনমাসের পোয়াতি!

হারানের মৃত্যুর পর বাপের ভিটেতে ফিরে গেল না চম্পা। সে রয়ে গেল শ্বশুরের ভিটেতেই। কিন্তু সে এখন পড়েছে অথৈ জলে। তাকে দেখার কেউ নেই, শোনার কেউ নেই। তার সংসার চলে না। হারান বেঁচে থাকাকালীন সে বিড়ি বাঁধার কাজ করত। হাজারটা বিড়ি বাঁধলে আশি টাকা মিলত। কিন্তু এখন তাকে আর কেউ কাজ দেয় না।

সকলে বলে, হারানকে সে-ই চক্রান্ত করে মেরেছে। নইলে বাইকের ধাক্কায় কেউ মরে? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল সুনীলের নাম। ফলে সুনীল আর আসে না তার বাড়িতে। নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে না সুনীল। কাজের অছিলায় সে নানাস্থানে চলে যায়, ফেরে না। আগে যেমন সে ফিরলেই চলে আসত চম্পাকে দেখতে, তার নাভি-পদ্মের দর্শনে, তার শরীরী সৌরভে মাতোয়ারা হতে— এখন এসবের ধারেকাছে নেই সুনীল।

সে শুনেছে, এই অবসরে সুনীলের দাদারা তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের কিছু জমিজমা আছে। তা থেকেও বেদখল করা হতে পারে সুনীলকে। এই নিয়ে বাড়ি থেকে সুনীলের বুড়ি মাকে নানারকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। মাঠের ধারে, জলাজঙ্গলের মধ্যে, একটেরে এই মাটির বাড়িতে একাকী এক বিপন্ন যুবতি বিধবা কীভাবে বাস করে, এই নিয়ে সমাজের কিন্তু কোনও মাথাব্যথা নেই!

হারান মারা যাবার পর যে-মানুষটি সর্বদা তার পাশে ছিল, সে সুনীল। সেইসময় একদম ভেঙে পড়েছে চম্পা, ঘরে দুদিনের মতো খাবারও মজুত নেই, তখন সেই সুনীলই তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই বা কতদিন দেবে। বিয়ের সময় একজোড়া দুল দিয়েছিল তাকে, বাপেরবাড়ি থেকে। সেটা বেচে দিল সে সুনীলেরই হাত দিয়ে কারণ, সে বুঝতে পারছিল, এইভাবে সুনীল আর বেশিদিন সাহায্য করতে পারবে না। তাকে কাজে বেরোতে হবে। আর সে কাজে গেলে মহাসমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে চম্পা। তাই হাতে বেশ কিছু অর্থ থাকা দরকার। কারণ সে আর একা নয়। তার পেটের মধ্যে একটা প্রাণ বাড়ছে, তার কথা চম্পাকে আগে ভাবতে হবে।

দুলজোড়া হাতে নিয়ে সুনীল বলেছিল, সোনা বেচে দিচ্ছ বউ? একবার ঘর থেকে গেলে আর গড়াতে পারবে?

ম্লান গলায় চম্পা বলে, ও-জিনিস কী হবে আমার? ঘরে রেখে কী করব, বল দিকি! বিপদের দিনে সোনা যদি কাজে না-আসে মানুষের, তবে ঘরে সোনাদানা রাখা কেন?

—তা বটে!

—তিন-চার হাজার টাকা মিলবে না এ-থেকে?

—তা হয়তো মিলবে। কিন্তু এই দুলজোড়ায় যে-তোমাকে স্বপ্নের মতো লাগে, বউ!

—এ দুটি বেচে ঝুটো একজোড়া দুল এনো না হয়!

মুষড়ে পড়ে সুনীল বলে, আমার টাকা নিতে মানে লাগছে বুঝি?

—আমার মান বলো, মন বলো— সবই তুমি। তোমার এই ঋণ ফিরত দিব কী প্রকারে?

—না-হয় নাই দিলে, কে চাইছে তোমার থেকে?

—তুমি চাইবে না জানি, মাঝি। তুমি নাও বানাও, দূরে দূরে যাও টাকার দরকার কত লাগে তোমার। তাছাড়া তুমি দাদাদের সংসারে থাকো। সেখানেও টাকা দিতে হয়।

—আমার সংসার তো তুমি।

চম্পা কেঁপে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার কালো গায়ে সেই রোশনাই আর নেই। মুখ মলিন। সেই এক ঢাল কালো চুল রুক্ষ হয়ে উঠেছে। সব সময় সে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সব সময় চিন্তিত। সে যে পোয়াতি! একজন সহায় সম্বলহীন বিধবা কী করে একাকী একটি বাচ্চার জন্ম দেয়? তার প্রতিবেশী বা গ্রামের লোকদের আপত্তি এখানেই।

ওদের সকলেরই বক্তব্য, এই বাচ্চা আদৌ হারানের নয়। হারান জানতই না তার বউ পোয়াতি। তাদের ধারণা, এই বাচ্চা আসলে সুনীলের। এই নিয়ে নাকি তার আর হারানের মধ্যে রোজকার অশান্তি হতো। তাই তাকে ষড় করে সরিয়ে ফেলেছে সুনীল। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছে চম্পা।

তিন

একদিন রাতেরবেলা, ঘুম আসছিল না চম্পার। বিছানায় শুয়ে খালি এ-পাশ ও পাশ করছে। রাত গড়াচ্ছে কিন্তু সে ঘুমুতে পারছে না। নিজের কী যে হচ্ছে, কিছু বুঝছে না সে। এইসময় তার দরজায় তিনটি টোকা পড়ল পরপর। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসল সে। সাড়া দিল না। কোনও শব্দ করল না। কে হতে পারে দরজার ওপারে? সুনীল? কিন্তু সুনীল এইরকম করে না। রাতে কোনওদিন তার ঘরে আসে না সে। যতবার সে মিলিত হয়েছে সুনীলের সঙ্গে, সেটা দুপুর। উদ্দাম দুপুর, মিলনও তেমনি দুরন্ত। আর সেটা এতটাই চুপিসাড়ে যে, কারও টের পাবার উপায় নেই।

এই যে, লোকজন তার নামে এত অকথা-কুকথা বলে, সেটা হারান মারা গেছে বলেই। সুনীলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল চম্পা। আর বুঝেছিল, সব নারীর মধ্যেই যৌনতা থাকে। সেটাকে বের করে আনা, উপলব্ধি করার দাযিত্ব হল পুরুষের। পুরুষ যদি না পারে, সেখানে নারীর কিছুই করার থাকে না। সুনীল তাকে আবিষ্কার করেছিল। তারও কামনা আছে। তার স্পর্শেই একজন সত্যিকারের নারী হয়ে ফুটে উঠেছিল সে।

কিন্তু দরজার ওপারে কে? যে আছে, সে কোনও সাড়া করছে না। আর এমনি করে টোকা মারছে, নিশাচরের মতো, যেন কাক-পক্ষীতেও টের না পায়। মনের শঙ্কা এবার ভয়ে পরিণত হল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে…?

ওপাশ থেকে আওয়াজ এল— আমি, দরজা খোলো!

মেয়েমানুষের গলা! এবার নামল সে বিছানা থেকে। আলো জ্বালল। আস্তে আস্তে দরজার খিল সরাল। তবে পাল্লা দুটি হাট করে খুলে দিল না। একটা বন্ধ রেখে অপরটি একটু ফাঁক করল। ওপারের মানুষটির ছোটোখাটো চেহারার অল্প একটু দেখা গেল।

—খোলো হারানের বউ, ভয় পেয়ো না। আমি সুনীলের মা।

সুনীলের মা! সে তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিল। এত রাতে সুনীলের মা তার কাছে কেন! সুনীলের কোনও বিপদ হল?

ঘরে ঢুকে বুড়ি বলল, নাও, এবার দরজা আটকে দাও। খিল তুলে দিল চম্পা।

—কিছু হয়েছে মাসিমা? আপনি এমন হাঁপাচ্ছেন কেন? কী হল?

—আমার বড়ো বিপদ!

—বিপদ! আপনি বসুন। জল খান। বলে বুড়িকে সে বসাল। এক গেলাস জল দিল।

বুড়ি ধাতস্থ হয়ে বলল, আমি তোমার কাছে থাকতে এলাম। আমাকে থাকতে দেবে আজকের রাতটা? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।

—সেকি! কেন?

—ওই যে, আমি বলেছি, সুনীলকে জায়গা-জমির ভাগ দেব, তাই।

—সুনীল কোথায়?

—সে আছে নদীয়ায়।

—কবে ফিরবে?

—ফিরবে না। যদি মেরে দেয়, ওই ভয়ে ওখানে গেছে একমাস হতে চলল। যাবার আগে বলে গেছে, এবার ওখানেই থেকে যাব মা। আমি ঘর দেখছি। তার মধ্যেই এইসব ব্যাপার।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল চম্পার। বহুদিন হয়ে গেল, সুনীল তার কাছে আসে না। তাকে ভালোবাসে না। কতদিন সে দেখে না সুনীলকে। তার জন্য মন কেমন করে চম্পার। কিন্তু বাইরের কাউকে কিছুই বলার উপায় নেই। এমনিতেই ঢিঢি পড়ে আছে চারিদিকে। এবার তার মনকেমনের কথা একবার চাউর হলে, সে এখানে আর বাস করতে পারবে না।

সুনীলের মা গর্জে ওঠে, আমিও ছাড়ব বলে ভেবেছ? রাজবংশী পরিবারের বউ আমি। আমার এক ছেলেকে বঞ্চিত করে বাকিরা সুখ ভোগ করবে, এ আমি হতে দেব না। আমি উইল বদলাব। সমান ভাগ আর থাকবে না। তুমি একবার সুনীলকে ফোন করো।

—এত রাতে?

—হ্যাঁ, এখুনি করবে। আমি কথা বলব। তিনবার রিং হবার পর সুনীল ফোন ধরে হ্যালো বলল।

আহা! কতদিন পর সে সুনীলের কণ্ঠস্বর শুনছে। সে ফোনটা সুনীলের মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল।

সুনীলের মা বললে, শোন সুনীল, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কাল ভোরের ট্রেনেই আমি আর চম্পা তোর ওখানে চলে যাচ্ছি। ঘর ঠিক করেছিস তো… আচ্ছা আচ্ছা ও… রাখ।

ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সুনীলের মা বললে, আমাদের কাল ভোরের ট্রেনটা ধরতে হবে, ওদের কোনও বিশ্বাস নেই। আর ওখানে গিয়ে তোমার এই চম্পা নামটি থাকবে না। তুমি হবে চম্পাবতী রাজবংশী। নাও বউমা, কাপড়-জামা গুছিয়ে নাও। তুমি পোয়াতি, খুব সাবধানে যেতে হবে আমাদের। ভোরের ট্রেনে ভিড় কম হয়। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।

কিছু বুঝতে পারছিল না চম্পা। কেবল আমতা আমতা করে বলল, আমি, মানে…!

—বুঝতে পারছ না? ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমি সুনীলের বিয়ে দেব। তোমাদের সব অপবাদ ঘুচিয়ে দেব। ওখানে তোমরা নিজের মতো করে সংসার পাতবে।

ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল চম্পা। মনে পড়ল, সুনীলকে একদিন বলেছিল সে, কদ্দিন আর পরের পোয়াতি বিধবার পিছনে ঘুরঘুর করবে। তোমায় এবার নিজের সংসার পাততে হবে, নিজেরটা দেখতে হবে। তোমার এখানে আর না-আসাই ভালো।

সুনীল বলেছিল, তুমি আবার পরের কোনখানটায়? পুরোটাই তো আপন।

চম্পাবতী হু-হু করে কাঁদছিল। চোখের জল বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিল তার। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুনীলের মা। তবু এক কষ্ট জাগে বুকের ভেতর। এত আনন্দের মাঝেও বুকের ভেতর এই এক দমচাপা কষ্ট চম্পার, কে জানে কার জন্যে!

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব