পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে

সকালবেলা পাঁচকড়িবাবু রেগে একদম অগ্নিশর্মা। তার ছেলে বিটকেলকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছেন তিনি। আশেপাশের বাড়ির একগাদা কুঁচোকাঁচার সাথে দু-একজন মাঝবয়সি মানুষও সেখানে উপস্থিত। মাঝেমাঝেই হাসির রোল উঠছে। আর পাঁচকড়িবাবুর রাগ এবং বিরক্তির পরিমাণও চড়ছে। ছেলেকে তিনি খালি বলছেন, হাঁ কর, হাঁ কর হতভাগা।

বছর ছয়েকের অত্যন্ত বিদঘুটে মার্কা ছেলে বিটকেল হাঁ করছে। পাঁচকড়িবাবু মগে করে ওর মুখে খানিকটা জল ঢালছেন, আর বলছেন, হ্যাঁ, বন্ধ কর মুখ। এবার গেল! কিরে গেল? গেছে এবার? এবারও যায়নি? প্রচণ্ড বিরক্ত হন তিনি, বলেন, হতচ্ছাড়া ছেলে, এক মগ জল গিলে ফেললি আর একটা ক্যাপসুল গলা দিয়ে নামল না? নে, হাঁ কর আবার, হাঁ কর। আবারও জল ঢালেন তিনি।

পাঁচকড়িবাবু কেলেপানা রোগা পাতলা মানুষ। পড়াশোনা কোনওমতে গ্র্যাজুয়েশন অবধি করেছিলেন বাঁকুড়ায়, তারপর কলকাতা চলে আসেন ভাগ্যান্বেষণে। চেনাজানা বলতে পাড়ার নন্টেদা, বাগবাজারে তার কাছেই এসে উঠলেন। হাজার হোক নিজের গ্রামের ছেলে! নন্টেদা থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন নিজের মেসেই। দুটো টিউশনও জুটিয়ে দিলেন একে ওকে ধরে। কিন্তু বহু চেষ্টা চরিত্র করেও তেমন কিছু হল না। শেষে এক পাবলিশারের কাছে কাজ জুটল, প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে, বাইন্ডিং, ছাপাখানার তদারকি, বইপত্র পার্টির বাড়ি পৌঁছে দেওয়া সবই করতে হয় তাঁকে।

এসব করতে করতে মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে। শেষে একটু বেশি বয়সে বাড়ির লোকের পীড়াপীড়িতে বিয়ে ঘটনাচক্রে স্ত্রীর বয়স খুবই কম। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার‌্যা। পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী-অন্ত প্রাণ। বিয়ের আগে তাঁর একটু বদনাম ছিল খিটকেল মেজাজের মানুষ বলে। সামান্য ঘটনাতেই যখন তখন রেগে যেতেন তিনি। এর তার ওপর চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতেন। সেই পাঁচকড়িবাবু বিয়ের পর বদলে গেলেন পুরোপুরি! মুখে তার অমায়িক হাসি মোটে বাসি হয় না। বিয়ের বছর খানেক আগে এসে এ বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি।

ভাড়া বাড়ি, প্রায় পনেরো-ষোলো ঘর ভাড়াটে। বর্গাকারে সাজানো ভাড়ার ঘরগুলি। মাঝখানে বিরাট ফাঁকা স্পেস, সেখানে দু-দুটো পাতকুয়ো, দুটো টিউবওয়ে, তাছাড়া আছে কর্পোরেশনের জলের লাইন। যে-বাড়িতে পাঁচকড়িবাবু ভাড়া থাকেন, তাতে একটাই ঘর, সামনে সামান্য বারান্দা, এক পাশে রান্নাঘর। বছর সাত-আট হল এ বাড়িতে আছেন তিনি।

বিয়ের পর পর পাঁচকড়িবাবুর মেজাজের হঠাৎ পরিবর্তন হলেও তা বেশি দিন টেকেনি। ছেলে হবার পর পরই আবার তা পালটে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে স্ত্রীর সঙ্গে মধুর ব্যবহার থাকলেও বাইরের লোকেদের সাথে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া বাঁধত তাঁর। অনেকে পিছনে তাঁকে খিটকেলে পাঁচকড়ি নামেও ডাকত।

যাইহোক, পাঁচকড়িবাবুর ছেলে বিটকেল প্রচণ্ড রোগা, যাকে বলে, একদম প্যাঁকাটির মতন। কিন্তু তার দৌরাত্ম্যে লোকে সর্বদাই তটস্থ। আশেপাশের ভাড়াটেদের ছেলে-মেয়েদের মেরেধরে গণ্ডগোল বাধায় প্রতিদিন। স্কুল থেকে নালিশ আসে। বছরে তিন-চারবার বই কিনে দিতে হয়, কারণ সে হয় বই হারাচ্ছে, না হয় ছিঁড়ে ফেলছে। ঘরে যতক্ষণ থাকে এটা ভাঙছে, ওটা ভাঙছে, কখনও হাত ভাঙছে, কখনও মাথা ফাটাচ্ছে দুদিন ছাড়া ছাড়া। ছেলেকে নিয়ে একদম নাজেহাল পাঁচকড়িবাবু।

ছেলে এত রোগা বলে ক’দিন ধরেই পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী গুঁতুনি দিচ্ছিলেন, চলো না একটু ডাক্তারের কাছে, চলো না। অগত্যা পাঁচকড়িবাবু উপয়ান্তর না দেখে ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে যান ডাক্তার সরখেলের কাছে। ওষুধটষুধ খেয়ে যদি চেহারাটা একটু সারে।

ডাক্তার সরখেল সব শুনে এবং বিটকেলকে ভালো করে চেকআপ করার পর বললেন, দেখুন পাঁচকড়িবাবু, ছেলে আপনার সুস্থ বলেই মনে হচ্ছে। চেকআপ করে খারাপ কিছু তো দেখলাম না।

—না, না, ডাক্তারবাবু, একদম খেতে চায় না ও। জোর করে, মেরেধরে কোনওমতে দুটো গেলানো হয়। যাতে নিজের থেকে খায় এমন কোনও ওষুধ দিন আপনি! চেহারাটা কিছুতেই সারছে না ওর, বলেন পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, চেহারা যাতে হয় এমন কিছু দিন, গোঁ ধরেন পাঁচকড়িবাবুও।

বাধ্য হয়ে ডাক্তার সরখেল কিছু মাল্টি ভিটামিন ক্যাপসুল লিখে দেন ছেলেটির জন্য। তারপর বলেন, রোজ সকালবেলা ব্রেকফাস্টের পর নিয়মিত একটা করে ক্যাপসুল পনেরো দিন খাওয়াবেন। তারপর ছেলে কেমন থাকে এসে জানাবেন আমায়।

অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে পাঁচকড়িবাবু স্পেশালিস্ট ডাক্তারের হাতে কড়কড়ে একশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে প্রেসক্রিপশন বুক পকেটে ফেলে, ছেলের হাত ধরে গটমট করে বেরিয়ে আসেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে। পিছন পিছন তাঁর স্ত্রী। সোজা এক ওষুধের দোকানে ঢুকে পনেরো দিনের জন্য পনেরোটা ক্যাপসুল কিনে তারপর বাড়ি। যেন এক বিরাট সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ঘরে ঢুকেই বললেন, কি গো গিন্নি, এক কাপ চা পাওয়া যাবে তো?

—দাঁড়াও না, এই তো এলে, আগে হাত মুখ ধোও, গিন্নির মেজাজও ভালোই মনে হল। কিন্তু সমস্যা শুরু হল ঠিক তার পরের দিন থেকে। পাঁচকড়িবাবুর ছেলে বিটকেল কিছুতেই ক্যাপসুল গিলতে পারে না। হাঁ করে মুখে ক্যাপসুল নেয় ঠিকই, পাঁচকড়িবাবু জল ঢালেন ওর মুখে, মাথা পিছনে হেলিয়ে চিবুক উঁচু করে ঢোঁক গেলে সে। জল পেটে চলে যায়, কিন্তু মুখের ক্যাপসুল মুখেই থেকে যায়!

চার-পাঁচ দিন ধরে একই ঘটনা ঘটছে। সকালবেলা বারান্দায় বসে এ কদিন ক্যাপসুল গেলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন তিনি। গরমের ছুটি চলছে। সব ঘরেই বাচ্চারা এখন রয়েছে। বিটকেলের ক্যাপসুল খাওয়ার ঘটনায় মজা হয় জেনে সবাই জড়ো হচ্ছে কদিন এইসময়। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি তার।

পাশের বাড়ির ভটচায্যিবাবু দাঁত মাজতে মাজতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট ধরে চলছে ক্যাপসুল গেলানো পর্ব। ব্যাপার-স্যাপার দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। বললেন সক্কাল সক্কাল ভালো কেলো শুরু করলে হে পাঁচকড়ি।

—আর বলবেন না দাদা, হতচ্ছাড়া জ্বালিয়ে মারল। একটা ক্যাপসুল গিলতে পারে না অথচ ইয়া বড়ো বড়ো রসগোল্লা টপাটপ গিলে ফেলে।

—এক কাজ করো না পাঁচকড়ি। ব্যাটাচ্ছেলেকে ক্যাপসুলটা জলে গুলে খাইয়ে দাও না, প্রস্তাব দেন ভটচায্যিবাবু।

সে চেষ্টা আর করিনি ভাবছেন! এই তো গত পরশু সে রকমই করলাম। তা সেটা গিলেই ছেলের চিল চিত্কার, তেতো, তেতো, মরে গেলাম, বাবা-রে, মা-রে করে বাড়ি মাথায় তুলল একদম। শেষমেশ গোটা বারো রসগোল্লা খাইয়ে নিস্তার পেলাম। বলুন তো দাদা, দু টাকার ক্যাপসুলের জন্য যদি রোজ ষাট টাকার রসগোল্লা খাওয়াতে হয় তো আমি যাই কোথায়?

—ঠিক, ঠিক, সমস্যাই বটে, হাসতে হাসতে বলেন ভটচায্যিবাবু। তারপর হঠাৎ বিটকেলের পিঠে একটা থাপ্পড় মারেন তিনি, বলেন, কী রে ছেলে, একটা ক্যাপসুল গিলতে পারিস না?

—কী করব, যাচ্ছে না তো, ব্যাজার মুখে বলে বিটকেল।

—যাচ্ছে না তো, রাগের চোটে ভেঙিয়ে ওঠেন পাঁচকড়িবাবু, যাবে কী করে? বলি যাওয়ালে তো যাবে।

হো হো করে হেসে ওঠে আশেপাশের সকলে, হাসেন ভটচায্যিবাবুও।

এমন বাঁদর ছেলে মশাই, কী বলব আপনাকে। আবার বলতে থাকেন তিনি, কাল রাতে একেই তো সারারাত কারেন্ট ছিল না, হতচ্ছাড়া এমন হাত-পা ছোড়ে ঘুমাবার সময় যে বলার কথা নয়। এক গাদা মশা ঢুকিয়েছে কাল মশারিতে। বাইরে সেজের আলোয় তেমন দেখা যায় না। কোনও মতে হাঁটু মুড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মশা মারছি আমি। হতচ্ছাড়া ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বলে কিনা, বাবা, কী হয়েছে তোমার? এত রাতে তাই তাই দিচ্ছ কেন?

আবার হাসির রোল ওঠে, ভটচায্যিবাবু জানতে চান, তারপর?

—তারপর আর কী? হতভাগাকে দিলাম এক উড়নচাঁটি। বিটকেলকে বলেন, হাঁ কর হতচ্ছাড়া, হাঁ কর আবার। ওর মুখে জল ঢালেন যথারীতি, বলেন, নে গেল। গিলে উদ্ধার কর আমায়।

বিটকেল চোখ বন্ধ করে, এবার মাথা নীচু করে চেষ্টা করে গেলার। টুক করে ক্যাপসুল চালান হয়ে যায় পেটে। সে বলে, বাবা, নেই।

—নেই? মানে গিলে ফেলেছিস? বিস্মিত পাঁচকড়িবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন। তারপর কনফার্ম হতে বলেন, হাঁ কর দেখি। বিটকেল হাঁ করে, বিশ্বরূপ দর্শন করেন পাঁচকড়িবাবু, তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন, ওঃ বাঁচা গেল, এতক্ষণে গিললি?

সকলে হইহই করে উঠল, গিলেছে, গিলেছে। দল বেঁধে দৌড়ে চলে গেল বিটকেল আর সঙ্গীসাথিরা।

ভটচায্যিবাবু বলেন, তোমার ছেলের নামটা খুব ভেবেচিন্তেই রেখেছিলে কিন্তু।

—ওর নাম তো তিনকড়ি। কে যে ওর নাম দিল বিটকেল কে জানে! হঠাৎ শুনি সবাই বিটকেল, বিটকেল বলে ডাকছে।

—যে-ই দিক নামটা একদম সঠিক দিয়েছে কিন্তু, হাসতে হাসতে বলেন ভটচায্যিমশাই।

—আমারও মাঝে মাঝে তাই মনে হয় দাদা, বলেন পাঁচকড়িবাবু। ব্যাটাচ্ছেলেকে স্কুলে নিয়ে গেছিলাম, ভেবেছিলাম ক্লাস টুতে ভর্তি করাব। হেডমাস্টারমশাই বললেন, তোমার বাবার নাম লেখো, একটা চক এগিয়ে দিলেন ওর হাতে।

মনে মনে ভাবলাম, যাক হেডস্যার ভালো প্রশ্নই দিয়েছেন, কারণ ওকে বহুবার শেখানো হয়েছে বাবার নাম। নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি। ও বাবা, ছেলে আমার লিখে বসল, আমার বাবার নাম পাঁচকড়ি হালদার দাঁড়ি!

আমি অবাক, হেডমাস্টারমশাইও অবাক। দুজনে দুজনার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। হেডস্যার বললেন, কী ব্যাপার খোকা, মুখে একটু আগে বললে বাবার নাম পাঁচকড়ি হালদার, লিখলে পাঁচকড়ি হালদার দাঁড়ি?

ছেলে নির্বিকার ভাবে বলল, কোনও কিছু লিখলে শেষে দাঁড়ি দিতে হয়।

—কিন্তু সে তো লম্বা দাগ টেনে, এই রকম, বলে চক নিয়ে মাস্টারমশাই নিজে বোর্ডে লিখে দেখালেন।

ছেলে বলল, ওরকম দিলেও হয় এরকম দিলেও হয়। এমন বেঁড়ে ওস্তাদকে কে নেবে স্কুলে। হেডমাস্টারমশাই রেগে গিয়ে বললেন, আপনার ছেলের কোথাও গণ্ডগোল আছে মশাই। ওকে নিয়ে যান, আমার স্কুলে অমন ছেলে ভর্তি নিই না।

শেষে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে হাতে-পায়ে ধরে হতভাগাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করি।

হাঃ হাঃ হাঃ, করে হাসিতে ফেটে পড়েন ভটচায্যিমশাই।

ঠিক সে সময় পাঁচকড়িবাবুর চোখ যায় ভাড়াটে বাড়ির প্রধান ফটকের দিকে।

যে-ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, সে পাঁচকড়িবাবুর এক ভাই জগন্নাথ। সে এ বাড়িতে আগে কখনও আসেনি। পাঁচকড়িবাবু মুহূর্তে বুঝে যান জগন্নাথ কী জিজ্ঞাসা করছে। তিনি গলা চড়িয়ে বলেন, জগা, এদিকে, এদিকে।

দ্রুত এগিয়ে আসে জগন্নাথ তার দাদার দিকে, তার মুখ চোখ থমথমে। সশঙ্কচিত্তে পাঁচকড়িবাবু ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে বলেন, কী ব্যাপার জগা, কী হয়েছে রে?

—দাদা, বাবা আর নেই গো দাদা। বলেই কেঁদে দুহাতে মুখ ঢাকে জগন্নাথ।

ঘটনার আকস্মিকতায় খানিক হতবাক হয়ে যান পাঁচকড়িবাবু, পাশে দাঁড়ানো ভটচায্যিবাবুও কোনও কথা বলতে পারেন না। বহুদিন বাড়িছাড়া, তাই ওদিকের টান কম ছিল পাঁচকড়িবাবুর। বিয়ের পর শেষ বাড়ি গেছেন দু’বছর আগে। তখনও বাবা চুয়াত্তর বছর বয়সে গ্রাম্য জলহাওয়ায় বেশ ফুরফুরে ছিলেন। মনে হয়নি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন! বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে ওঠে পাঁচকড়িবাবুর, চোখের কোল ভিজে ওঠে অজান্তে।

কিছু সময়ে মধ্যেই তিনি স্ত্রী-পুত্রসহ জগন্নাথের সঙ্গে রওনা হন দেশের বাড়ি। প্রাথমিক কান্নাকাটি সারা হলে শুরু হল শবদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার তোড়জোড। একে একে সব ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনেরা জড়ো হলে কাঁধে ওঠে শবদেহ। ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল, বলো হরি।

শ্মশানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা। গ্রাম দেশ, নদী পারে শ্মশান। মাথায় পূর্ণিমার  জ্যোত্স্নায় ম ম করছে চারপাশ। প্রয়োজনীয় মন্ত্রতন্ত্র পাঠের পর পাঁচকড়িবাবুর পিতৃদেবকে তোলা হল চিতায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। উপস্থিত মেয়েরা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কেউ কেউ। অপেক্ষাকৃত বড়োরা শোকাহত, বিমূঢ়!

হঠাৎ পাঁচকড়িবাবুর ছেলে চিত্কার করে নাচ জুড়ে দিল, আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের…

আবছা অন্ধকারে পাঁচকড়িবাবুর মুখের অভিব্যক্তিটা বোঝা গেল না।

মনসাসুন্দরী

ওই যে ধন্যিমেয়ে বইতে উত্তমকুমার দাঁত মুখ খিঁচোয়ে ওর অমন সুন্দর ভাইডারে বলতিছিল গো, এই বগলা গোল দে, এই বগলা গোল দে, ত্যাকোন থে মুঁই বগলার প্রেমে। আহা, কচি কলাপাতার মোতন ডগমগে রূপ ঝ্যামোন, আর নামডাও তেমনি ডাংগুলির গুলি ঝ্যানো। বনবন করি হাওয়ায় ঘুরতি ঘুরতি বুকের ভেতর সেঁইধে যায়।

বেশি লোকজন নেই। কাজের সুবিধেই হয়েছে। স্টেশনের দুচারজন দোকানদার কলকাতার বাবুদের দেখে পায়ে পায়ে এসেছে। তা আসুক। এটুকু ঝক্কি সামলেই ওরা কাজ করে।

তা যা বলেন বাবুরা, ত্যাকোন থে মোর মাথাটা লড়বড়ে হুয়েছে। ওই যে গেরামের মাঠে তাঁবু খাটায়ে বই পড়ল। মুঁই ধন্যিমেয়ে দ্যাকলাম। ব্যাশ, মোর প্রেম পালো। মনে মনে ঠিক করি নিলাম, না আর মুঁই মাঠে গোবর কুড়ব নে। মোর একখান বগলা চাই-ই চাই। আর সারা দিনমান ঘরে, বাইরে, পুকুরঘাটে— ঝিদিক পানে যাই না ক্যান, সিকেনেই গানখানা গুনগুন করি। জয়া ভাদুড়ি গেয়েছিল গো। বইয়ে তার নাম মনসা ছেল। আর মোর নামও মনসা। হি হি হি!

তা দিদি, ওই গানটি একটিবার শোনাও আমাদের! মদন, ভাই দোকানদারকে বল না, টিনের গেলাসে দু-কাপ চা আর কয়েকটা ভালো বিস্কুট কাগজে মুড়ে দিতে।

সামনে থেকে টিনের গেলাস তুলে নিয়ে মদন নামে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মের স্টলে চা আনতে গেলে বেশ উৎসাহ লাগিয়ে মনসা বলে ওঠে, চা খাওয়ার আগে গাতি হবে, না কি পরে গাবানে?

দিদি, তোমার মন চাইলে এখনই গাইতে পারো।

মনসা মাথাটা চুলকে নেয়। উকুনগুলো সড়সড় করে চলে ফিরে কিছু বলছে। ও কান পেতে ওদের কথা ধরার চেষ্টা করে। এক কানে হাত চাপা দিয়ে অন্য কানের দিকে চোখ আর মন যত্ন করে লাগায়।

তার একমাথা চুল কাকের বাসার মতো নয় ঠিক, তবে বেশ এলোমেলো। মাঝে মাঝে চুলকোয়। তবে উকুন মারে না সে। উকুনরা যে তার আশ্রয়ে আছে। গুটি কয়েক প্রাণকে সে তার এই বিরাট মাথার ভেতর আশ্রয় দিয়েছে, তা কী এমন বেশি! তাছাড়া সন্ধের পর এই নির্জন প্ল্যাটফর্মে কার সাথে কথা কয়ে সময় কাটাবে! ওরা না থাকলি অমন থেবড়ে বসা রাতখানা কাটায় কী করে সে! ঘুম তো আসতি চায় না। ওদের সাথেই তো সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে ভোরের ট্রেনের খবর নেয় কানে। প্যাসেঞ্জারের পায়ে শব্দে মনে আরাম হয়।

সুধাময়, প্রাণেশ, টিঙ্কু-রা নানা কোণ থেকে ছবি তুলছে, তবে গোপনে। স্টেশন চত্বরের চার-পাঁচজনের ভিড়টা লক্ষ করেনি যে ছবি উঠছে খেপির। তারা দেখছে একজন নীল জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা সুন্দর মতো লোক মাটিতে পা মুড়ে বসে খেপির সাথে কথা বলতে লেগেছে।

কদবেলের দোকানদার উবু হয়ে বসে সবটা বুঝতে চাইছিল। সে বলল, গা তো খেপি ওই গানটা। কদবেল মাখা দেব দুপুরবেলায়। গা।

প্যাসেঞ্জাররা তাড়াহুড়োয় দেখে না সবটা। কদবেলওলা বেল ফাটিয়ে চিনি, লংকা, নুন, ধনেপাতা আর কাসুন্দি দিয়ে মেখে তুলে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে। কিন্তু গেলাসের নীচে খানিকটা যে ফেলে রাখে দোকানদার তা নজরে পড়ে না খদ্দেরদের। আর পরেরটা বানানোর আগে দোকানদার চামচ দিয়ে টেনে তুলে তা একটা বাটির ভেতর রেখে দেয়। দুপুর পর্যন্ত যা জমে তা খেপিকে এক ফাঁকে দিয়ে আসে।

মনসা উকুনদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুঙ্গি পরা, বুক খোলা পেট উঁচু ওই কদবেল দেওয়া লোকটার দিকে। তার চোখের তারায় মেঘ ঢোকে। ছায়া লাগে মুখে, বুকের ভেতর জয়া ভাদুড়ির সেই আদুরে আর অভিমানী মুখের ঢল নামে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, গলা খুসখুস করে। কথা হয়, কিন্তু কেউ শোনে না। শুধু মনসা ঠোঁট নাড়ে জয়া ভাদুড়ির মতো। উকুনেরা দিব্যি শুনতে পায় তা যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

ভিডিও রেকর্ডিং করছিল যে মোবাইলগুলো, তারা একটু একটু এগিয়ে আসে। প্ল্যাটফর্মের একটা গোটা দিক, রেল লাইন, সিগন্যাল, স্টেশনের নাম লেখা কংক্রিটের বোর্ড, একটা খেঁকুরে কুকুরের হেঁটে যাওয়া কিছুই বাদ যায় না। তারা মোবাইল ফোনের লেন্স মনসার দিকে যতটা পারে জুম করে। সামনে বসে গল্প করতে থাকা ওদের এডি শুভঙ্করের ছবিও একই ফ্রেমের ভেতর রাখতে হবে যে।

মনে হয় এবার গান শুরু হবে। গান আর মুখের প্রথম অভিব্যক্তি ধরা চাই। তারপর কলকাতায় ফিরে, এডিটিং করে, মনসা পুজোয় মনসার গান ক্যাপশন দিয়ে ইউ টিউব-এ ছাড়বে কাল। কাল যে শ্রাবণ মাসের শেষ, মনসা পুজো।

টিউবে ওদের চ্যানেলের নাম দ্য নেচার। কৃত্রিমতাহীন সবকিছুই ওদের সাবজেক্ট। বাজারে খাসি কাটার দৃশ্য, তার ব্যা ডাক, আর অল্প পা-দাপানো যেমন থাকে, তেমনি ঘুঘু পাখি, পায়রা বা ফড়িং-এর সোহাগদৃশ্য হাঁ করে দেখছে তিন-চার বছরের বাচ্চারা, তাও দেখায়।

ওরা চায় প্রাকৃতিক কিন্তু অড সাবজেক্ট। এই আগস্ট মাসের শুরুতেই একটা ভিডিযো গোটা ইউ টিউবে হইচই ফেলেছে। সেটা ছিল, হাত-পা হীন এক কিশোরীর সমারসেট ভল্ট। সে গ্রামের দিকে হাটে বাজারে খেলা দেখায়। সুন্দরী মেয়েটি একেবারে পেঙগুইনের মতো কোমরের নীচে একটুকু ছড়ানো থাই দিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই সে মাটি থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে আবার দাঁড়ায়। এরপর সে মাদারি খেলার মতো দুটো বাঁশের আগায় বাঁধা দড়িতে উঠে যায়। তার তো হাত নেই। সে ব্যালান্সের লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে দড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাবার ডুগডুগির বাজনা কানে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফেরে। ফিরে আসে দড়ির মাঝখানে। সেখান থেকে সে মুখের সরু বাঁশটি ফেলে দেয়। ডুগডুগিতে দ্রিমি দ্রিমি দ্রুতলয়ে বাজে। সে ওখান থেকে ঝাঁপ মারে মাটিতে। শূন্যে দুটো-তিনটে ভল্ট দিয়ে সে অনায়াসে মাটিতে দাঁড়ায় থপ করে। তার ঘন করে লাল করা ঠোঁট খুলে যায়, এক ঝলক সাদা দাঁত হাসির বিদ্যুৎ ছড়ায়।

মনসাদি গাও।

এটা কলকাতার বাবু, সামনে যে বসে আছে, তার গলা। যে এসেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। তার কথা মান্যি করবে না তো মদনার কথা শোনবে! তারপর বাবু একেবার মনসার সঙ্গে মাটিতে বসেছে। কেমন লেপটে বসেছে। হি হি হি স্টেশনের ধুলো-ময়লার কোনও জ্ঞান-গম্যি নাই বাবুর। তারে কেমন নিজের নিজের লাগে মনসার। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেলল, গাইব! কোনটা গাতি হবে বল ত?

মদন চায়ের গেলাস আর পাউরুটির ঠোঙায় জড়ানো বিস্কুট নিয়ে সিনের ভেতর এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে। এখানে তো কাট, ক্লাপস্টিক-এর ব্যাপার নেই। মনসা চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই একটা মোবাইলে ধরা পড়ে তার মুখে কী সরল হাসির ঝিলিক খেলে গেল। মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মুখ বার করার মতো। তারপর সে কাগজে মোড়া হাতের বিস্কুট থেকে একটা লম্বা বিস্কুট নিয়ে চায়ের গেলাসে ডুবিয়ে কামড় দিল।

আহ! কি দারুণ দাঁত! একেবারে সুচিত্রা সেন না!

প্রাণেশ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল টিঙ্কু। এই যে গান হবে হবে করে হচ্ছে না, তাতে ওর বিরক্তি লেগে গেছে। আর অফিসের বস ইচ্ছে করে ওকে পাঠিয়েছে এত দূরে। শয়তানি আর কী! না হলে কলকাতার মেয়েকে এতটা দূরে সমুদ্রগড়ে পাঠানো কেন!

প্রাণেশ টিঙ্কুর দিকে ফিরে বলল, যা বলেছিস। একে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখে কাজল আর চুলের কলি কানের উপর টেনে বের করে একখানা সাদা কালো হাসির সাইড ভিউ তুলে নিলে দর্শকরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবে। কে কত উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখেছে, আর তাঁদের সিনেমা দেখে প্রেম করতে শিখেছে কেমন ভাবে দিব্য ঘোরের ভেতর ঢুকে যাবে। সাবস্ক্রাইব করে ফেলবে এক দিনেই কয়েক হাজার।

খেপি, তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ কর। গানটা গা।

ওই লুঙ্গি পরা লোকটা আবার এন্ট্রি নেয়। কী করবে, খানিকটা মস্করাটস্করা করে সময় কাটাতে চায় কদবেল, আমড়া, কল-ওঠা ছোলার দোকানদার। ট্রেনের ঘন্টা হয়নি। ট্রেন না এলে তার খদ্দের নেই। পরের আপ ট্রেন ঢুকতে এখনও ঘন্টাখানেক।

চায়ের ভেতর বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে মনসা ডুব দিয়েছে ভাবনায়। এই যে সামনে উবু হয়ে বসে আছে বুক খোলা দোকানদার, সে যে কদবেল আর ছোলা খাইয়ে কতবার তাকে খেয়েছে সন্ধাবেলায় নদীর চরে নিয়ে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেহুলা নদীর পাশে সরু কাশ বনের ভেতর অনেকখানি জায়গা বেশ পরিষ্কার। কাশ আর হোগলা শুকিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা বিছানার মতো করে রাখা। সেসব খুব মনে পড়ছে এখন মাথা নীচু করে থাকা মনসার। এই কদবেলের কারবারি ছাড়াও লাইনের ওপারে ভাতের হোটেলের থালাবাসন ধোওয়ার লোকটাও তাকে নিয়ে গেছে কয়েকবার সেখানে। বদলে সে প্রায় সন্ধেতে দুটো আলাদা আলাদা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখা সারাদিনের হোটেলের খদ্দেরদের ফেলে দেওয়া ভাত তরকারি এনে দেয়। মনসা আরাম করে খায়।

তার এখন মনে এল, এই লোকটার বাচ্চা তো সে পেটে ধরেছিল। সেটা ছেলেই হবে। আর ওই হোটেলের লোকটার মেয়ে তারা সব কোথায় গেল! ওরা সব কোথায় গেল! হারিয়ে গেল! মনে পড়ল তার, চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

হেমন্তের গান। বগলার সাথে ভাব হবার পর বগলা রেডিও কিনে দিয়েছিল। লাল টুকটুকে রেডিও। সেখান থেকে শুনে শুনে কত গান যে শিখেছে সে।

মনসা জানে এই যে সে বিড়বিড় করে কথা কইছে, গান গাইছে, উকুনেরা সেসব শুনছে কান পেতে। তখন ওরা চুপ করে থাকে। মাথায় নড়াচড়া করে না। মনসার মাথা চুলকোতে হয় না। এই কথা বলা বা গান গাওয়ার তালে মনসা ওদের জব্দ করে রাখে। ওরা ভালো ছেলেমেয়ের মতো মনোযোগী হয়। মনসার গান, গল্পে মজে যায়।

মনসা চুপি চুপি মুখে মৃদু হাসি টেনে এখন মাথা নিচু করে ওদেরই শোনাচ্ছে সব। উকুনদের শোনাচ্ছে মনসার পুরোনো জীবন। অনেকগুলো বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ ওদের তিনজনকেই নবদ্বীপ স্টেশনে ভিক্ষা করতে রেখে এসেছিল এই কদবেল ব্যাপারী-ই। তখন বয়স অনেক কম, শরীরে যৌবন থইথই করছে।

শ্রীচৈতন্য ভক্তরা স্টেশনে নেমে গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখত একখানা রাধা যেন বসে আছে। দিতও হাত খুলে। মেলা মানুষ, মেলা পয়সা। কিন্তু ভিড় যে-ভালো লাগে না মনসার। একদিন ট্রেনে চেপে নিজে নিজে ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়। বাচ্চা দুটোর কথা ভুলেই মেরে দেয়। তা সে দুটো গেল কোথায়! এতদিনে তো ডাগর হওয়ার কথা!

মদনাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছে সকলে। ওর কোনওদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। কোন সময় কী করা উচিত, তা নিজে নিজে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। একদম কলের পুতুল। তা না-হয়ে ওর উপায় কী! অভ্যাস অভ্যাস! ও যে-মাছের দোকানে কাজ করত আগে, সেখানে তো ছিল ভিড় আর ভিড়। সকালবেলায় দম ফেলার ফুরসত নেই। মাছ মাপার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ছাড়াতে হতো। তারপর দোকানদার মাছ কাটতেই ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকা। সেই মাছের ডাক্তার রুইমাছের মাথার ভেতর সন্না ঢুকিয়ে একটা গোলমতো সাদা কড়াইয়ের দানা টেনে বের করে নিজের বাঁ হাতের তালুতে লাগিয়ে নিয়ে চলে যেত। তখন মদনের কাজ মাছের মাথার কানকো ফেলে দেওয়া। তারপর সাদা পলিথিনের প্যাকেটে মাছ ভরা আর গুছিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া। এই রুটিনের বাইরে তার তো ভাবার কোনও অধিকার নেই। দুপুরের দিকে দোকান গুটোনোর কাজ, মাঝেমধ্যে খইনি বানানো সেসব এক্সট্রা। অন্যমনস্ক হলেই চোদ্দো-গুষ্ঠির আকাশ থেকে নেমে আসার মতো গালাগালির বৃষ্টি। একদিন তো সেই মাছের ব্যাপারী লাথি মেরেই বসল ভরা বাজারে, অত লোকের সামনে। সেই দিনই মদন কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে প্ল্যাটফর্মে সে জুতো পরিষ্কার করে। তাতে কম টাকা হলে হোক, কারও কথা তো শুনতে হয় না।

মদনও দেখল মনসাদি চায়ের গেলাসে বিস্কুট ডুবিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আর গেলাসের ভেতর দেখছে। সে বুঝতে পারল বিস্কুট ভিজে গিয়ে হাত ছুটে গেলাসের নীচে পড়ে গিয়েছে। সে এক দৌড়ে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে একটা চামচ এনে দিতেই মনসাদির হাসি মুখ থেকে সারা গালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন চাঁদ ঝাঁপিয়ে পড়ে কোজাগরীতে। সে চামচ দিয়ে গোলা বিস্কুট তুলে তুলে খেতে লাগল।

কী চার্মিং না! কী সরল না! প্রাণেশ একেবারে বিগলিত। সে টিঙ্কুর চোখে চোখ রাখে।

জানিস, আমার ছোটোবেলায় এরকম হতো। দুধের ভেতর ঢুকে যেত বিস্কুট। আঙুল দিয়ে তুলতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগত। তখন বাধ্য হয়ে সব দুধটা চোঁ চোঁ মেরে দিতাম ওই বিস্কুট খাবার লোভে। অনেককাল পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল মায়ের কারসাজি। মা বিস্কুট চুবিয়ে খেতে বলত। কারণ আমি একদম দুধ পছন্দ করতাম না।

ঢং ঢং করে বড়ো একখানা ঝোলানো রেলের পাতের গায়ে ছোটো লোহা পেটানোর শব্দ হল। জুতোকালি করা ছেলে মদন, শুভঙ্করের কাছে উবু হয়ে বসেছিল। সে বলল, আপ ট্রেনের খবর হল। তবে আসতে আসতে এখনও মিনিট চল্লিশ। এই ফাঁকে গানটা না হলে আবার লোকজন যে-জমে যাবে দা! মনসাদির গানের মুড আনতে তখন আবার সময় লাগবে। তখন সে ভিক্ষে করবে। বলবে দাও, দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।

শুভঙ্কর যে কথাটা ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতায় জানে, জোরাজুরি করে এদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি বের করা যায় না। এদের মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারলে, তবে নদী কি ঝরনার দেখা মেলে।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল গো?

মনসা মুখ তুলে বাবুটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে। তা আমি কতি পারব নাকি! আমার কি তা মনে আছে!

তোমার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে না? শুভঙ্কর ইচ্ছে করে বরের কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী জানি সেখানে কোনও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিরাগ থাকতে পারে। এরকম পথের ভিখিরি মেয়েরা একশোটার মধ্যে প্রায় একশোটাই স্বামী খ্যাদানো হয়।

মনসা শুভঙ্করের মুখের উপর তার আয়ত চোখ ফেলে রেখে মাথা নাড়ল। না মনে পড়ে না।

মুখে খানিকটা মেঘ উড়ে এসে বসেছে। মনসা চেষ্টা করছে মায়ের কথা মনে করতে। চেষ্টা করছে বাবার মুখটা কেমন ছিল স্মৃতির ভেতর দেখে উঠতে। কিন্তু শীতের দিনের ভোরবেলায় যেমন ধু ধু মাঠ থাকে, গাছপালা, বাড়িঘর কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না, সেরকমই ওই সাদা জলছাপের ভেতর থেকে দুখানি মানুষের চেহারা বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মনসার চোখের উপর ভাসছে কালো কালো দুটি ছবি, ছটফট করছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

শুভঙ্করের চোখে পড়েছে মনসার মুখের উপর থেকে ঝকমকে ভাবখানা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে মনসাকে এই আটকে পড়া অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। মনসাদি, তোমার যে-একটা ছাগলাছানা ছিল, বলো, তার কী হল!

একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছুঁয়ে দিয়েছে শুভঙ্কর। এই ছুটে বেড়ানোর কাজ করেও সে কবিতা লেখাটা ফেলে দিতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই লেখে। আর সে তা লেখে মানুষের নরম মনের কাছে পৌঁছোতে। বছরে পাঁচ-ছটা লিখলেও সই। সে জোরাজুরি করে কবিতা লেখে না। কবিতা তার কাছে ধরা দিলে সে লেখে।

মনসা ছটফট করে উঠল। সে তার গায়ে কাপড় টেনেটুনে নিয়ে বাবুটির আরও একটু কাছে ঘষটে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, মোর তো ছাগলছানা ছেল না। মোর ছেল এক সাদা ধবধবে বাছুর। ওরে নে মুঁই মাঠে যাতাম ঘাস খাওয়াতি। আমাগে ছেল ধুধু করা মাঠ, আর তার ভেতর দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া নদী। আমাগে ধানের খেত ছেল, পাটের খেত ছেল। আর পুকুরভর্তি হাঁস। ঝুপঝুপ করে ওদের সাথে সাঁতার কাটতাম। সারাদিন মাঠেঘাটে চই চই। লাল লাল চুকোই ফল তুলতাম কোঁচড়ে। তারপর নুন মাখিয়ে পা ছড়িয়ে খাতাম। ওরা সব কোথায় গেল? হারিয়ে গেল। চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

আহা কী মিঠে সুর! ফিসফিস করল প্রাণেশ। টিঙ্কুর চোখটা যেন একটু ভিজে। কিন্তু দারুণ, দারুণ। পুরোটা তুলেছে। দুজনে দুরকম অ্যাঙ্গেলে। ওরা জানে, সুধাময়ও তুলছে অন্যদিক থেকে। বড়ো মুভি ক্যামেরায়। লোকজনের ভেতর থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে ওর ফোকাস। ছেলেটা ছমাসের সিনে কোর্স করেছিল। স্পেশাল পেপার নিয়েছিল ক্যামেরা। ওর অনেক সাধ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে। কিন্তু শিকে ছিঁড়তে পারেনি।

শুভঙ্কর উল্লসিত। মনসা মন মেলছে। শুভঙ্কর যে-মনে মনে নিজেকে মনের ডাক্তার ভাবে। সে মানুষের মনের উপর যে-কালো মেঘ এসে জমে, তাকে ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চায়। তাইতো এরকম অ্যাসাইনমেন্ট পেলে সে লুফে নেয়।

কী ওলট পালট গাইছিস রে খেপি! তোর গান গা। ওই যে চোখ গেল, বয়ে গেল! সেই গান।

আরে মশাই, সেই তখন থেকে আপনি ওস্তাদি করছেন। কে আপনাকে বলতে বলেছে! এখানে বসলে, চুপ করে বসুন। সমস্ত মাটি করে দিলেন! আপনার গান আমরা রেকর্ড করতে আসিনি কলকাতা থেকে। মনসাদেবীর গান শুনতে আর রেকর্ড করতে এসেছি।

কদবেলওলা বমকে গেছে ওই তাড়া খেয়ে সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, তার ঠিক পাশেই এক বাবু মোবাইল ক্যামেরায় ফটো তুলে যাচ্ছে। সে খানিকটা শঙ্কিত হয়। সত্যিই তো। তার কথা বলা উচিত হয়নি। সামনের বাবুটি খুব রেগে গেছে।

শুভঙ্করের রাগ শুধু রেকর্ডিং-এর সমস্যার জন্য নয়। এই যে মনসা নিজে নিজে চেষ্টা করছিল তার মনের কালো অংশ সরিয়ে যেটুকু ভালো, তা সামনে আনতে, সেটাতে হোঁচট খেল তো! পারবে সে, আবার পারবে! শুভঙ্করকে দোলাচল ঘেরে।

মনসা শুভঙ্করকে আশ্বস্ত করে। সে তার মনের দরজা বন্ধ করেনি। বলে, তালে, ওই গানখান গাই বাবু! ওই গানখান গালি আমার যে খুব প্রাণের আরাম হয়। আমার বগলা সামনে আসি দাঁড়ায়। আমার গানখান শুনে সে ঝরঝর করি কাঁদে, আর বলে, তোরে নিয়া পালায় যাবানে রে মনসা। আর একানে থাকবনি। পালায় গিয়া বিয়া করবানে।

বলতে বলতে মনসা গান ধরে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

খুব নরম হয়ে গেছে শুভঙ্করের মন। ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে। সে জানে যত বেশি সম্ভব রেকর্ডিং হবে, তত ভালো। ৫০ মিনিট তুললে তবে কেটে ছেঁটে সাচ্চা ৩০ মিনিট বানাতে পারবে। ইউ টিউব চ্যানেল ৩০ মিনিটের জন্য ভিডিযো দিলে এবং সাবক্রিপশন ৪০ হাজার ছাড়ালে ভালো টাকা দেয়।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তা তোমার বগলার সাথে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে?

মনসা একটু লজ্জা পেয়েছে যেন এমন একটা ভাব করে শাড়ির আঁচল মাথায় নিয়ে আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাঁ পালায় গেলাম তো। বগলা একদিন ভোর রাতে মোর হাত ধরে পলান দিল। তারপর কত টেরেন চাপল, বাস চাপল, ঝালমুড়ি খাওয়াল। কত গেরাম ছাড়ায়ে কোন দেশের দিকে যাতি লাগল যে, জানি না। এক চড়ক মেলায় বগলার সাথে আলাপ হয়ে ছেল, আবার পালাতি পালাতি অমন এক মেলার মাঠে গিয়ে বগলারে হারায় ফেললাম। আর পালাম না বগলারে।

শুভঙ্কর বুঝে ফেলেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর খপ্পরে পড়েছিল মনসাদি। তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেকথা এখানে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু এই যে মনসা অনেকটা নিজের কথা বলতে পারল, অতীত বলতে পারল, তা অনেক। শুভঙ্কর জানে এই মনসার মুক্তি গানে। কিন্তু গান করার সুযোগ কোথায় পাবে সে! আর শুভঙ্করেরও এমন কিছু ক্যাচ নেই যে মনসার জন্য কিছু করতে পারে। দ্য নেচারের এপিসোডটুকু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সে সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টর কলকাতার বাইরে যেতে চায় না বলে শুভঙ্কর বাইরে এসে এই স্বাধীনতাটুকু এনজয় করে। নিজের মতো করে বিষয়টা সাজায়, শুট করে। মোবাইলে ভিডিও তোলে। আর তার নিজের সোশাল সাইটে একটা প্রিলিউড-এর মতো করে পোস্ট দেয়। তাতেই আনন্দ।

ফিরে যাবার আগে টিঙ্কু বলল, শুভঙ্করদা, মনসাদির লুকের ভেতর একটা সুচিত্রা সুচিত্রা ভাব আছে না! তুমি আমার মোবাইলে দ্যাখো। এই যে ওর দাঁত মেলে হাসি। শাড়ি পরিয়ে সুধাময়দার ক্যামেরায় একটা দুটো লুক শুট করলে হয় না!

স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সামান্য তিনশ টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে আনা হল। মনসাদি যথেষ্ট ফরসা। তোলা কাপড় পেয়ে সেও ডগমগ। আর এবার সুধাময়ের এক্তিয়ার। সে নানা পোজে ছবি তুলল মনসার। সুধাময় তার শেখার সবটা দিয়ে প্রায় নিখুঁত সুচিত্রা লুক দাঁড় করিয়ে দিল।

দুই

এই দাদা, তুই কনে রে! তখন থেকে কল করতিছি, কিছুতেই লাগতিছে না।

মুঁই গাড়ি চালাইতেছি রে, একটু বাদে তোরে ফোন দি?

পাঁচ মিনিট হয়নি আবার সে ফোন করে। সে যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। তাছাড়া দিদিভাই, মানে যে-বাড়িতে সে কাজ করে, সে গেছে গড়িয়াহাটে। দাদাবাবু অফিসে যাবার পর ফোন করে কয়েকটা জিনিস আনতে বলেছে। তার টুর আছে কালই। চম্পা ফাঁকা বাড়িতে বসে মোবাইল দেখছে আর ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। এক একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেকক্ষণ। সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মা যদি চিনতে পারে তো আর দাসীগিরি করতে হয় না। মা তো এখন খুবই জনপ্রিয় মানুষ। টাইম লাইন ভরে যাচ্ছে মায়ের ফটোতে। শেয়ার হয়েছে কত কত। মায়ের চেহারার কী খোলতাই হয়েছে। খুব গর্ব হচ্ছে চম্পার। একেবারে সিরিয়ালের দিদিমণিদের মতো দেখতে লাগছে।

ডাবলু হালতু বাজারে সওয়ারিকে নামিয়ে ভাড়া নিতে না নিতেই আবার ফোন। সে পোস্ট অফিসের দিকে রিকশা সাইড করে ফোন ধরল। তার স্বরেও উত্তেজনা। ডাবলু বলল, আমার মোবাইলে তো ছবি দেখা যায় না। তুই কি তোর বউদির মোবাইলে পাঠাতে পারবি? আমি বাড়ি গিয়ে দেখে নিতাম। তবে শুধু ছবি পাঠাবি। অন্য কিছু লেখার দরকার নেই। তার যা কুচুটে বুদ্ধি, কোথা থেকে আবার কী বাগড়া না দিয়ে বসে।

হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল আটটার নবদ্বীপ লোকাল ধরেছে ওরা। সমুদ্রগড় যেতে ঘন্টা আড়াই। কিন্তু দুই ভাই-বোন উত্তেজনায় ছটফট করছে। চম্পা বলল, এই দাদা, মায়ের বাড়িতে থাকি যাই কটাদিন, কী বলিস? আর মোটে পারা যাচ্চে না। আর ইচ্ছা করে না এই ঝি-গিরি করতে। তুই অন্য আর একজনকে জোগাড় করে দিদিমণিকে দিস আনে। নাইলে তার কষ্ট হবে।

ডাবলু বলল, সে তুই চিন্তা করিসনে। তুই মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি, থাক। তার জন্যি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া কততি হবেনে। তারে কইলকাতায় নে যাবানে। সবাই মিলে একসাথে থাকবানে। মায়ের কাছ থে কিছু ট্যাকা পেলি একখান ব্যাটারির রিকশাক কিনুম আনে, ভাবছি। তাতে একটু আয়-টায় বেশিই হবে।

চম্পা বলল, অ্যারা, কিন্তুক মা সমুদ্রগড়ে কুথায় থাহে তাই তো জানি নারে দাদা! ফেসবুকে সবাই তো কইছে সমুদ্রগড়ের মনের মানুষ মনসাসুন্দরী। তো সিকেনে সবাই ঝ্যাকোন চেনে, ত্যাকোন লিশ্চই কয়েক দেবেনে, তাই নারে দাদা?

হ্যাঁ, তাই তো মনে কয়।

একটু লেট করে ট্রেন সমুদ্রগড়ে এগারোটা নাগাদ এল। বেশি লোক নামে না। জনা পঞ্চাশেক হবে। ওরা ভাই-বোন দুজন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এমনি এমনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়টা কমে গেলে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোবে। একজন সাইকেলের রডে দু-কাঁদি ডাব ঝুলিয়ে বাঁশের স্ট্যান্ড লাগিয়ে বিক্রি করছিল। চম্পার খুব লোভ হল। এখন তো তারা বড়োলোক। মায়ের পয়সা মানে তার ছেলে-মেয়েদের পয়সা। সে দাদাকে বলল, দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর ডাব। কইলকাতায় এমুন তাজা ডাব পাওয়াই যায় না। খাবা?

ডাবলু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। ট্রেনের টিকিট কেটেছে। হাওড়ায় আসার বাসের টিকিট কেটেছে। তারপর আজ তো কাজ হল না। মানে রোজগার নেই। ঘরে ফিরে টাকা ধরাতে না পারলে তো বউ-এর মুখ ঝামটা শুনতে হবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ঘরে না দিলে তো বিপদ। সে তো তো করে।

চম্পা বোঝে। সে বলে, দাদা তুমি তো অনেক খরচ করিছ, আমি ডাবের দাম দেবানে। তাছাড়া দিদিভাই আজ সকালেই মাইনে দেছে।

ডাব খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে কী মনে করে চম্পা ডাবঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কতি পারেন মনসাসুন্দরী এখানে কই থাহেন!

ডাবওয়ালা পরের খদ্দেরের জন্য ডাব কাটতে কাটতে পেছন দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভাই-বোন চটপট সে দিকেই পা চালায়। মনে মনে চম্পা ভাবল, ডাবঅলাও বলে দিতে পারল মানে মায়ের খুবই জনপ্রিয়তা হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষে লেভেলক্রসিং-এ রেললাইনের উপরেই গোটা দুয়ে্ক টোটো দাঁড়িয়ে হাঁকছে। দুজন আসছে দেখে তারা উৎসাহী হয়েছে। ডাবলু আর চম্পার চোখও টোটোঅলাদের দিকে। ওদের যে-কোনও একটাতে উঠে বসে মনসাসুন্দরীর বাড়ির কাছে নামাতে বলবে।

প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষে এসে পড়েছে। চম্পা একটা স্বর শুনে পিছন ফিরল। গলাটা চেনা যেন! একজন মহিলা গাছতলায় বসে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পার পা আটকে গেছে। সে দাদার হাত খামছে ধরেছে। যেন ভূত দেখছে। চম্পার পা কোনও দিকে যাচ্ছে না। না সামনে না পেছনে। সামনের ভিখারিনি তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনের থেকে নামা আর তেমন কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। এদের কাছ থেকে যদি পাওয়া যায়। ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পা তার কাজের বাড়ির একটা বাতিল লেডিজ ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে দশটা টাকা খুঁজে হাতে নেয়। হাত মুঠো করে। টাকাটা দলা পাকায়। তারপর এক পা এগিয়ে সেই দলাকরা টাকা ছুড়ে দেয় ভিখারিনির থালার দিকে। থালার একটু আগেই পড়ে টাকা। চম্পা মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে দাদার হাত ধরে টান দেয়। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে ডাউন ট্রেনের জন্য। কলকাতায় ফিরবে।

ভিখারিনি টাকা কুড়িয়ে সেটা সোজা করতে করতে মনের খুশি ওর মাথার উকুনদের জানাতে চেয়ে খানিকটা জোরেই গেয়ে ফেলে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা…।

 

টাইম মেশিন

সম্প্রতি আমাদের দেশের বিজ্ঞানী ড. পলাশ সেনের নাম প্রতিদিনই খবরের কাগজে বেরোচ্ছে। জানা গেছে তাঁর একটি আবিষ্কার, যেটি এখনও গোপন আছে, সেটির ঘোষণা তিনি করতে চলেছেন খুব শীঘ্রই। তবে সেটি সারা বিশ্বের কাছে এক অভতপূর্ব আবিষ্কার হবে বলে সকলের ধারণা।

তাজা খবর কাগজের সম্পাদক, সৌমিত্রবাবু এ সুযোগ আর ছাড়তে চাইলেন না। তিনি ফোন করলেন বিজ্ঞানী ড. পলাশ সেন-কে এবং অনেক অনুরোধ করে বললেন, দেখুন আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। মাত্র আধঘণ্টা সময় আপনার থেকে চাই।

অনেক ভেবে-চিন্তে সেনবাবু বললেন, ঠিক আছে আজ সন্ধে সাতটায় আসুন। তবে ব্যাপারটা যেন খুব গোপন থাকে। না হলে মিডিয়ার লোকেরাও আমাকে ছেঁকে ধরবে।

কথামতো সৌমিত্র ভট্টাচার্য অফিসের সব কাজ সহ-সম্পাদক-কে বুঝিয়ে দিয়ে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলেন। এরকম একজন বিজ্ঞানীর সাথে দেখা হবে ভেবেই খুব খুশি হচ্ছিলেন। যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলেন বিজ্ঞানী ড. সেনের গবেষণাগারে। ড. সেনের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সৌমিত্রবাবুকে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা এবার বলুন আপনি আমার থেকে কী জানতে চান?

—আচ্ছা, একটা উড়ো খবর শুনছি, আপনি নাকি টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছেন এবং সেটির ঘোষণা আগামীকাল সাংবাদিক সম্মেলনে করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবেন! কথাটা কি ঠিক?

—ঠিকই শুনেছেন। আচ্ছা, আপনি কি টাইম মেশিনের কথায় বিশ্বাস করেন?

—স্যার, আজকাল অনেক শুনছি, তবে ব্যাপারটা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কীভাবে এটা সম্ভব! এ নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব রয়েছে মনের মধ্যে।

—চলুন পাশের ঘরটায় যাওয়া যাক। ওটাই আমার স্পেস শিপ।

একথা বলেই দুজনে গিয়ে পাশের ঘরটায় বসলেন। দেখলেন নানা রকমের লাল, নীল আলো জ্বলছে। কোনওটা থেকে বিপ বিপ আওয়াজ আসছে। বিজ্ঞানী বললেন, ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই। আপনি হলেন ভারতবর্ষের প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি এটা দেখাতে চলেছি। আগামীকাল সারা বিশ্ব এটা জানবে। কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। তাঁর চোখ মাথার ওপর সিলিংয়ে দিকে। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি।

সৌমিত্রবাবু ভাবছেন, অফিসে অনেক কাজ জমে আছে। এখানে বেশি দেরি হয়ে গেলে খুব মুশকিল হতে পারে অফিস পৌঁছোতে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বুদ্ধিকে একটু কাজে লাগালেন। হঠাৎ হাত থেকে পেনটা মেঝেতে ফেলে দিলেন। পেনটা মেঝেতে পড়ে যেতেই তত্ক্ষণাৎ একটা জোরে বিপ সাউন্ড হল। আর ড. সেন  সংবিৎ ফিরে পেলেন।

ড. সেন বললেন, আচ্ছা, আপনার সাথে এমন কখনও হয়েছে যে, আপনি অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন আর নিমেষেই অফিসে পৌঁছে গেলেন, অর্থাৎ গন্তব্যস্থানে! কীভাবে পৌঁছোলেন, কোন রাস্তা ধরে গেলেন তার কোনও কিছুই আর হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না।

আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সৌমিত্রবাবু বললেন, না, স্যার আমার তেমন কখনও হয়নি। এরকমও কি হয়! আপনি তাহলে বলুন, আমি শুনছি।

আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন, বললেন, গত সপ্তাহের সকালে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে আমি আমার ড্রইং রুম-এ সকাল ৮টায় টিভি খুলে একটা ভালো সাক্ষাত্কার দেখছিলাম। দেখতে দেখতে একটা কাজে এই ঘরটাতে এসে কাজটা শেষ করতে থাকি এবং এই ঘরের টিভিটা চালাই। হঠাৎ দেখি টিভিতে ওই চ্যানেলে তখন খবর পড়া চলছে। ভালো করে দেখে বুঝলাম তারিখটা ৩ জানুয়ারি সকাল ৮টা দেখাচ্ছে। ভাবলাম নিজের মাথাটা হয়তো ঠিক কাজ করছে না। কিন্তু বাইরে গিয়ে ওই টিভি-তে দেখলাম আগের সাক্ষাত্কারটাই চলছে। তখন একটু নড়েচড়ে বসলাম। বুঝলাম আমার গবেষণা সার্থক রূপ নিতে চলেছে। ৩ জানুয়ারি বাইরের ঘর থেকে ওই সময়ে ওই চ্যানেল খুলে দেখলাম আমার এই ঘর থেকে দেখা খবর পড়া অনুষ্ঠানটাই দেখানো হচ্ছে। সাধারণত এমন হওয়ার কথা নয়। তখন বুঝলাম আমার স্পেস শিপ-টা কাজ করছে।

এসব শুনতে শুনতে সৌমিত্রবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তা কী করে সম্ভব, যদি না…

ড. সেন বললেন, ঠিক ধরেছেন। যদি না আমি কোনও স্পেস শিপে গতিশীল থাকি। তাই না? আমার এই ঘরটা কোনও স্পেস শিপ নয়। তবে স্পেস শিপের মতোই। আমাদের ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরা পারে না কি বলতে পারেন? আমরা যে-সব রকেট পাঠাচ্ছি তা অনেক কম খরচে। চাঁদে যে-রকেট পাঠানো হয়েছিল তার জন্য যে অনেক কম খরচ হয়েছিল, তা তো আপনারা সবাই এখন জেনে গেছেন।

শুধু তাই নয়, ২৭ মে বাইরের ঘরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে পেনটা নিতে এই ঘরে ঢুকেছিলাম। পেনটা নিয়ে যখন বাইরের ঘরে ফিরে গেলাম, দেখলাম রামু আমার টেবিলে ২৮ ও ২৯ মে-র খবরের কাগজটা রেখে গেছে। এই ২৮ তারিখটা আমার জীবন থেকে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝলাম না। আমার ড্রাইভার, চাকরবাকর, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে আমার সহকর্মীদের কেউই ২৮ মে আমাকে দেখতে পায়নি।

সৌমিত্রবাবুর গলাটা তখন যেন কেমন শুকিয়ে কাঠ হওয়ার জোগাড়। ভাবতে লাগলেন, এ তো দেখা যাচ্ছে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের থিযোরি অফ রিলেটিভিটিকেও ডাইভার্ট করছে এই ঘটনা। এমন ঘটনা, যার কোনও ব্যাখ্যা নেই!

—আপনার তো ভুল হতে পারে। আপনি হয়তো আসলে ২৯ মে-তেই এ ঘরে এসেছিলেন। বেশ শুকনো গলায় সৌমিত্রবাবু কথাগুলো বললেন।

আবার উদাস হয়ে গেলেন ড. পলাশ সেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আপনি কটায় আমার বাড়িতে এসেছিলেন সৌমিত্রবাবু?

—ঠিক সাতটায়। সৌমিত্রবাবুর ঠিক মনে আছে কারণ কলিংবেলটা টেপার সময় মোবাইল-এ সময়টা দেখেছিলেন। হ্যাঁ, সাতটাই বেজেছিল তখন।

—এর মধ্যে কতক্ষণ হল আপনার সাথে আমি কথা বলছি? প্রায় আধঘণ্টা তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তাহলে তো এখন সাড়ে সাতটা বাজার কথা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কিন্তু ঘড়িটা দেখুন তো।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন সৌমিত্রবাবু। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! ঘড়িতে সাড়ে দশটা দেখাচ্ছে। সৌমিত্রবাবু ভাবলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এ ঘড়িটা হয় খারাপ, নয়তো ইলিউশন। তিনি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলেন, তাতেও সাড়ে দশটা দেখাচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব! ভাবতে থাকেন অবাক হয়ে।

—ভাবছেন আমি বিজ্ঞানের কোনও এক্সপেরিমেন্ট করছি? হেসে জিজ্ঞেস করলেন বিজ্ঞানী সেন। বলতে বলতে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন বিজ্ঞানী।

—আমি তাহলে এবার চলি। অনেক রাত হল, বলেই সৌমিত্রবাবু বেরিয়ে গেলেন। ফেরার জন্য গাড়িতে চড়ে আবার মোবাইলটা দেখলেন। তখনও দেখাচ্ছে রাত ১০টা ৪০ মিনিট। ভাবলেন কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ আর অফিসে ফিরবেন না, সোজা বাড়ি ফিরে যাবেন। অফিসে ফোন করে বলে দিলেন খবরটা সহ-সম্পাদককে দিয়ে দিতে।

সৌমিত্রবাবু গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলেন, একটু আগে ঘড়িতে এবং মোবাইল-এ যখন সাড়ে দশটা দেখলেন সেটা কোনও ভ্রম বা ম্যাজিক নয়তো? ড. সেনের ঘরটা কোনও ম্যাজিক ঘর নয়তো? বিজ্ঞানীর সমস্যার সমাধান হয়তো করা যাবে, একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। এরকম নানা উদ্ভট কল্পনা করতে করতে বাড়ি এসে পৌঁছোলেন। বাড়িতে ফোন করবেন ভাবলেন কিন্তু ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এরকম তো হয় না সাধারণত। আজ সকালেই পুরো চার্জ দেওয়া হয়েছিল। নতুন মোবাইল, তাই প্রায় দুদিন অনায়াসেই চলে যায়। কিন্তু এরকম হল কেন! আজ সবই যেন কেমন ওলটপালট লাগছে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে বাড়িতে এসে পৌঁছোলেন সৌমিত্রবাবু।

বাড়িতে ঢুকতেই তাঁর ছোটো মেয়ে রিঙ্কি ছুটে এলো। চেঁচিয়ে বলতে লাগল মা, দাদা, দেখে যাও বাবা এসেছে!

অমনি সবাই হুড়মুড় করে ড্রইংরুমে এসে ঢুকল।

—কী হয়েছে? তোমরা এত হইচই করছ কেন? বিরক্তির সুরে জানতে চাইলেন তিনি।

স্ত্রী সুমনাদেবী বলে উঠলেন, হইচই মানে!  শুনলাম কাল বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে। তারপর থেকে তোমার আর কোনও খোঁজ নেই। আর তুমি বলছ আমরা হইচই করছি। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সুমনা। আমাদেরকে মানুষ বলেই মনে হয় না তোমার না!

তার কান্না সৌমিত্রকে আচ্ছন্ন করল বটে কিন্তু তাঁর জীবন থেকে যে একটা দিন হারিয়ে গেল সেই অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারলেন না!

ফাগুন বাসর

ওরে হিমু, কোথায় গেলি রে? পুকুরপাড়ে একগাদা এঁটো বাসন পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি একটু মেজে নিয়ে আয় না, মা। সবাই সক্কাল সক্কাল বেরোবে। রান্না চাপাতে হবে যে।

হিমু তখন মুগ্ধ চোখে দেখছে মাঠের পুব-ধারে একটু একটু করে ঘোমটা খুলছে উষারানি। কপালে যেন গোল থালার মতো এক মায়াময় সিঁদুরের টিপ। অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ফিকে হলুদ আলো। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দিয়ে ধবলী আর করালীকে জাবনা দিতে যায় হিমু। জাবনা দিতে দিতে দেখে উষারানির টিপটা কেমন ঘেঁটে গিয়ে চারদিকে ফিকে লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে। কী অপূর্ব! মনটা যেন জুড়িয়ে যায়!…ওই মা ডাকছে… চমক ভাঙে হিমুর,

ধবলী আর করালীকে মাঠে বেঁধে দিয়ে এখুনি বাসনগুলো মেজে নিয়ে আসছি, মা।

ধবলী আর করালীকে মাঠের বেশ ঘন ও বড়ো বড়ো ঘাসওয়ালা জায়গায় বেঁধে দিয়ে পরম মমতায় করালীর কালো কুচকুচে শরীরটাতে হাত বোলায় হিমু। বাড়ির সবাই, পাড়া-পড়শীরা আসতে যেতে ধবলীর লালচে সাদা শরীরে আদুরে হাত বোলায় কিন্তু করালীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দেখে বড়ো কষ্ট হয় হিমুর। অথচ করালীটা যখন গামলা গামলা দুধ দেয়, তখন তো সবাই বেশ আয়েশ করে গেলাস গেলাস দুধ সাবাড় করে! চোখটা ছলছল করে ওঠে। কোথাও যেন করালী আর নিজেকে এক সারিতে দেখতে পায় হিমু।

অ্যাই হিমু, হিমু… শিগগির এদিকে আয় তো। আমার জামাপ্যান্টগুলো কেচে ইস্তিরি করে রাখিসনি কেন? এখন আমি কি পরে যাব? একখানাও ইস্তিরি করা নেই! হিমু…উ…উ…উ…

হিমুর তখন চোখের পলক পড়ছে না। নিস্তব্ধ দুপুরে দূরের বাঁশঝোপের আড়াল থেকে পাঁজর ফাটিয়ে ডাকছে কোকিলটা! পুকুরের বুকে নুয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়, সবুজ ছায়া তিরতির কাঁপছে টলটলে জলে। লাল-হলুদ-সবুজ ফড়িং আর রংবেরঙের প্রজাপতির দল উড়ে উড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। উতল দুপুর ঘাই মারছে হিমুর বুকে! কী যে অসহ্য রূপ এই দুপুরের… ইশ!

অ্যাই হিমু, কানে কানে জল ঢোকেনি বুঝি, না রে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। বিধুদা এল বলে। কনে-দেখা আজ, আলো থাকতে থাকতে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। হিমু, এই হিমু।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় হিমুর। দাদা ডাকছে।

যাই গো দাদা।

আজ পাড়ার বিধু ঘটকের সঙ্গে পাশের গাঁয়ে মেয়ে দেখতে যাবে হিমুর দাদা। হুগলির রিষড়ায় সে এক গেঞ্জি কারখানায় প্যাকেজিং ডেসপ্যাচিংয়ের কাজ করে। হিমুর বিয়ে না দিয়ে তার দাদা বিয়ে করতে চাইছিল না। কিন্তু বিয়ের বাজারে হিমুর মতো নিকষ কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করে না। বিধু ঘটক হিমুর জন্য পাত্রের সন্ধান এনে এনে একেবারে হাঁপিয়ে গেছে। তাই দাদা আর কদ্দিন অপেক্ষা করবে? তারও তো বিয়ের বয়স গড়িয়ে যেতে বসেছে। পুরুষ মানুষ কদ্দিন আর মেসে থেকে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাবে! তারও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে, নাকি! অগত্যা পাশের গাঁয়ে প্রদীপ স্যাকরার মেয়ে অপালার সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে বিধুদা। একমাত্র মেয়ে, দেবে থুবেও ভালো।

অ্যাই হিমু, পুকুরধারে কী করছিস রে? তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?

এক বুক পাথর ভার নিয়ে দাদার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হিমু।

হিমু, হিমু…উ…উ… অ হিমু, হিমু রে, আমার লাইগ্যা একটু আকন্দফুলের পাতা আইন্যা দে না রে, মা। পূন্নিমা আইতাছে। বাতের ব্যাতাটা আবার বড়ো বাড়ছে রে! উঃ! সব্বার মরণ হয়, আমার ক্যান হয় না? আরে অ হিমু…

হিমু তখন পুকুর ঘাটে। হাঁ করে গিলছে পলাশ গাছটার বুক জ্বালানো রূপ! বসন্ত বাণে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে হিমুর যুবতি-শরীর, মন। আমবাগানে ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ফিকে কমলারঙা গোল থালার মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মাঠের পশ্চিম দিকে। দিনের তেজ কমে আসছে, গোলাপি আভা ধরেছে আকাশে। কোথা থেকে এক ঝলক ফিসফিসে বাতাস এসে চোখে মুখে ঠান্ডা স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে হিমুর,.আহা! ওই ঠাম্মা বুঝি ডাকছে…

আসছি…ই…ই…ই…

ঠাম্মা বহুদিন থেকেই বাতের রোগী। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হরেন বৈদ্যের কালচে সবুজ এক কবিরাজি তেল ঠাম্মার কোমরে, পায়ে মালিশ করে দেয় হিমু। তেলের গন্ধটা ভারি বিশ্রী! বমি চলে আসে। কিন্তু কি আর করা, মায়ের সারাদিন সংসারের নানা কাজ থাকে। উদয়াস্ত পরিশ্রম তাঁর। দিদিরা তো সবাই যে-যার শ্বশুরবাড়িতে। তাই হিমু ছাড়া আর কে-ই বা আছে হাতনুরকুৎ? এছাড়া অমাবস্যা, পূর্ণিমায় ব্যথাটা খুব বেড়ে যায় ঠাম্মার। তখন জ্বলন্ত হ্যারিকেনের মাথার ওপর আকন্দপাতা গরম করে সেঁক দিয়ে দেয় হিমু। পুকুরের পুব-ধারে আকন্দগাছের ঝাড়, সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে সে।

তার বাড়ির সকলেরই একখানাই তো ভাঙাকুলো হিমু। অঘ্রাণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাম্মা বড়ো শখ করে নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী। হেমন্তে জন্ম হলেও হেমন্ত প্রকৃতি তার সোনারঙা ফসলের ভরপুর সৌন্দর্য দিয়ে সাজায়নি হৈমন্তীকে। হৈমন্তী সেই কবেই হিমু হয়ে গেছে সকলের মুখে মুখে। ঠাম্মার কাছে শুনেছে জন্মের পর তার কালো কুৎসিত ছোট্ট শরীরটা দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাবা। আর কোনওদিনই বাবা নাকি কোলে তোলেননি তাকে। এ সবই মুখরোচক গল্পচ্ছলে বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকে শোনা হিমুর। নীরবে হৈমন্তিক শিশির ঝরেছে টুপটাপ। বড়ো হেলাফেলায় সবার ফাইফরমাশ খেটে, সবার মন জুগিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে হিমু। শুধু নিজের মনটাই আলো-হাওয়া না পেয়ে পেয়ে কবে যেন পাথর চাপা পড়ে গেছে!

তবু জীবন তো থেমে থাকেনি। হিমুর দাঁত উঁচু, নাক বোঁচা, শনের মতো চুলওয়ালা, থ্যাবড়ামুখো কালো কুৎসিত শরীরেও একদিন দাপিয়ে যৌবন এসেছে নিঃশব্দে। কালো মেয়ে বলে মা-ঠাকুমার বিলাপ, পাড়া-পড়শির করুণার মধ্যেই বড়ো হয়েছে সে। তার মুখ কেউই দেখতে চায় না। পাড়ার কেউ কোনও শুভ কাজে রওনা হলে হিমু তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। তার অপয়া মুখ দেখলে নাকি হওয়া কাজও পণ্ড হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনায়ও তেমন এগোতে পারেনি হিমু। বছর বছর গণিতে, বিজ্ঞানে ফেল করে করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোনোর আগেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়াশোনায় ইতি ঘটে যায় তার। মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়েও তার মতো কালো কুৎসিত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। বেশ কয়েকবার পাত্রপক্ষ এসে মিষ্টি ধ্বংস করার পর বলতে বলতে গেছেন, আমরা তো কয়লার বস্তা ঘরে নিয়ে যেতে আসিনি! যত্তসব!!

নিজের কানে এইসব কথা শুনে টুপটাপ ঝরে পড়ে হৈমন্তিক শিশির। ভেসে যায় বুক। স্তব্ধ হয়ে যায় হিমুর ভিতর ঘর।

হিমুর দুই দিদি জয়তী আর রেবতী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মোটামুটি দিয়েথুয়ে বিয়ে হয়ে গেল তাদের। লাজুক মুখে এক মাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল তারা। যাবার সময় দুজনেই হিমুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে কেটে বলল,

তোর জন্য দেখছি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা। চিন্তা করিস না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসারের বেড়াজালে হিমুর কথা তাদের আর মনেই রইল না।

এই অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে হিমু। এখনও অনুঢ়া সে। শরীরে তার ভরা যৌবন! মনে সুনামির জলোচ্ছ্বাস! ফুলেভরা শিমূলের ডালে, হলুদ অমলতাসের ঝাড়ে, ফুলের ভারে নুয়েপড়া কাঞ্চনগাছে প্রকৃতি যেন উড়িয়ে দিয়েছে রংবেরঙের ফাগ। দেখে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে হিমুর। কান্নায় গলা বুজে আসে! আকাশ কী সুন্দর নীল! প্রকৃতির কত অপরূপ রং-রূপ-রস। সেও তো এই প্রকৃতিরই অংশ, তবে কেন সে এত কুৎসিত? এ পৃথিবীতে কোথাও কি তার জন্য এতটুকু ভালোবাসা থাকতে নেই?

কাল দোলপূর্ণিমা। হিমুর ছোড়দি রেবতী এসেছে বর আর বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হই হই ব্যাপার। হিমুর খরা বুকেও যেন বাজছে টুংটাং বাসন্তী সুর। ছোড়দির ছেলেটা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে, আধো বুলি ফুটেছে মুখে। মনটা বড়ো ভিজে ওঠে হিমুর। তবে দিদিরা আসায় তার খাটুনি অনেকখানিই বেড়েছে। রান্নার সব দাযিত্বই যে-তার। মা অবশ্য সাহায্য করছেন। এই একটি বিষয়ে হিমুর খুব নাম। তার রান্না স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। সব্বাই চেটেপুটে খায়। রান্না করতে করতে আনমনা হয়ে পড়ে সে!

রজতদা ছোড়দিকে কী ভালোবাসে! চোখে হারায় একদম! সকালে দেখছিল জলখাবার খাওয়ার সময় রজতদা ছোড়দির মুখে লুচি তুলে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। ভালোবাসার রঙে রাঙা হয়ে উঠছিল ছোড়দির মুখটা! বুকটা ভারী হয়ে ওঠে হিমুর। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! তাকে এভাবে আদর-আহ্লাদ করার কেউ নেই এই পৃথিবীতে!

সন্ধে নামতেই গোল থালার মতো ভরা-যৌবনা চাঁদটা রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে নিল মাঠ-ঘাট, পুকুর, সজনেগাছের সারি, আমবাগান, শিমূলবন। এমন গভীর চাঁদরাত গায়ে মেখে, আমের মুকুলের গন্ধ বুকে ভরে নিয়ে আমবাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে হিমু। রাতের আবডালে তার কুৎসিত মুখখানাও কিছুটা ঢাকা পড়ে যায়। বুক ভরিয়ে দিয়ে কী যেন এক নাম না-জানা গন্ধ ছুঁয়ে দিচ্ছে হিমুর গভীরে কোথাও। সে গন্ধ যেন এক তীব্র কষ্ট হয়ে হৃদপিণ্ডটাকে খামচে ধরছে। যে-গন্ধের কোনও কারণ জানে না হিমু। হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। পাশের ঘরে শুয়েছে রজতদা আর ছোড়দি। একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আকর্ষণে জালনার ফুটোতে চোখ রাখে হিমু। দেখতে পায় আধো অন্ধকার ঘরে দুই ছায়ামূর্তি রজতদা আর ছোড়দি! রজতদা যেন একেবারে মিশে যেতে চাইছে ছোড়দির নগ্ন শরীরে!

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে হিমুর। কেমন একটা নেশা নেশা লাগে। সেই অনামি গন্ধটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে! মাঝরাতে জ্যোৎস্নার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে গোটা গ্রাম। শুধু ঘুম আসে না হিমুর। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে টলটলে জল-আয়নায় ভাসছে রুপোলি চাঁদ। সজনে গাছগুলোর তলা সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে! চারদিক একেবারে শুনশান! দূর থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হিমু। সহসা কিছু বোঝার আগেই একটা বলিষ্ঠ লোমশ হাত পেছন থেকে জাপটে ধরে হিমুকে শুইয়ে দেয় সজনেফুলের সাদা বিছানায়। ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে থাকে তার পোশাক। ঘোরলাগা চোখে লোকটাকে চিনতে পারে না সে। লোকটার মুখে হাড়িয়ার গন্ধ। পরম আশ্লেষে লোকটাকে জাপটে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে হিমু ফিসফিসিয়ে বলে,

আমি কুৎসিত নই, ততটা কুৎসিত নই। একবার ভালোবেসে এসো ভেতরে আমার, হাড়-মাস-চামড়া ছাড়িয়ে একেবারে ভেতরে, অনেক ভেতরে…

লোকটার মুখের হাড়িয়ার গন্ধ ভেদ করে সেই বিশেষ গন্ধটা যেন খুব ধীরে ধীরে হিমুর আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকে, যে-গন্ধের কাছাকাছি এলে ভালোবেসে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় তার। বহুদিনের জমাটবাঁধা একটা বরফখণ্ড যেন গলে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে হিমুর যুবতি শরীর থেকে।

 

সহমরণ

আট বছরের মেয়ে সানাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ‘নিরালা’-য় অবসর যাপন করতে চলে আসে সন্তু আর নীতা।

বাঁশবন, পেয়ারা বাগান, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, কদম, বট, অশ্বত্থ, বাবলা,শিরীষ,বকুল,কামিনি,শিউলি, সুপুরি,সবজি খেত আর পুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে আছে গোবিন্দপুরের এই ‘নিরালা’ আবাসন। বহুতল আবাসনের এই ছাদ থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় দারুণ ভাবে। রাতের আকাশের চাঁদের আলো যেমন ভালোবাসার আবেশে জড়ায়, ঠিক তেমনই কৃষ্ণপক্ষের সূচিভেদ্য অন্ধকার শিহরণ জাগায় শরীরে। লকডাউন-এর অবসরে, কলকাতার কোলাহল ছেড়ে এমনই প্রকৃতিকে সঙ্গী করে, ‘নিরালা’-য় এসে আশ্রয় নিয়েছিল সন্তু আর নীতা। কিন্তু তখন কে জানত যে, অমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝেই ঘটে যাবে ভয়ংকর বিপদ !

গোধুলির ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আবাসনের গেট-এর কাছে,মুখে মাস্ক পরে ঘাসজমিতে বসে গল্প করছে নীতা আর সন্তু। একই ভাবে মুখে মাস্ক পরে ওদের মেয়ে সানা দুলছিল পা‌শে ঝোলানো একটি দোলনায়।

হঠাৎ হইহুল্লোড় কানে আসতেই গেট-এর দিকে এগিয়ে গেল সন্তু, নীতা এবং সানা। ওরা দেখতে পেল, ছোটোবড়ো একদল স্থানীয় ছেলে একটা বড়ো সাপ মেরে, লাঠিতে ঝুলিয়ে এনে, গেট-এর কাছে কদম গাছটার নীচে ফেলে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে সাপটাকে ওখান থেকে সরাতে বললেও, ছেলেগুলোর কানে পৌঁছোলো না দারোয়ানের কথা। পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে, তাই সাপটাকে ওখান থেকে সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করল সন্তু। অগত্যা, কথা রাখার প্রতিশ্রুতি দিল দারোয়ান।

এরই মধ্যে সন্ধে নেমেছে। বৈদ্যুতিক আলোগুলি জ্বলে উঠছে আবাসন চত্বরে। নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিল সন্তু আর নীতা। তাই, মেয়ে সানা যে কখন নজরের বাইরে চলে গেছে, তা আর ওদের খেয়াল ছিল না।

হঠাৎ নজর কাড়ল দারোয়ান। ওর কোলে তখন অঝোরে কেঁদে চলেছে সানা।

‘কী হয়েছে ? সানা কাঁদছে কেন ? পড়ে গেছে ? ‘ —–উদ্বেগ ভরা গলায় সন্তু এবং নীতা প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করে চলেছে দারোয়ানকে।

‘বড়ো বিপদ ঘটে গেছে স্যার। আমি বাথরুম-এ গিয়েছিলাম,এরই মধ্যে ছোটো গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল আপনাদের মেয়ে।’

‘তা বিপদটা কী ঘটেছে ?’ —–দ্বিগুণ উদ্বেগে প্রশ্ন করল সন্তু।

‘শুকনো কাঠি দিয়ে ওই পড়ে থাকা সাপটার মুখে খোঁচাতে গিয়ে, কামড় খেয়েছে। সাপটা বেঁচে ছিল। একেবারে মরণ কামড় দিয়েছে। ব্যাঙ ধরার মতো করে ধরে ছিল ওর হাতের চেটোটা। বিষাক্ত সাপ। পুরো বিষ ঢেলে দিয়েছে সম্ভবত। আমি ওর হাত বেঁধে দিয়েছি,বিষ আর ওপরে যাতে না ওঠে। শিগগির গাড়ি বের করুন স্যার। হাসপাতালে নিয়ে চলুন। আমি সাপটাকে কৌটোতে ভরে নিচ্ছি। ‘—–এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, সানাকে ওর মায়ের কোলে দিল দারোয়ান।

সানার হাত থেকে রক্ত ঝরছে। নীতা মেয়েকে কোলে নিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

লকডাউন-এর হ্যাপা কাটিয়ে সন্তু আর নীতা যখন সানাকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছোলো, ততক্ষণে কেটে গেছে অনেকটা সময়। চিকিৎসা শুরু হল ঠিকই, কিন্তু সানার শরীরকে বিষমুক্ত করার সুযোগ পেলেন না চিকিৎসক। মাল্টি অরগান ফেলিওর হতে শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, কৌটোয় রাখা ওই মরা সাপটার মতই নিথর হয়ে আছে সানার শরীরটা।

তিনে নেত্র

আগের মতো বাবু হয়ে বসলে মা, রানুমাসি দুজনেই আজকাল খুব বকে। অগত্যা বদলে গেল আমার বসার ঢং। কিন্তু সেবারই প্রথম দোলে, চুলের সিঁথির ফাঁকে ইচ্ছে করেই রেখে দিলাম একটু আবির রং। কেন জানি না!

আগে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হতো গরমের ছুটির আগে। সারা দুপুর আমাদের খুব লুডো খেলা হতো। আমার দাদার বন্ধু মৈনাকদা আসত আমাদের বাড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। এলোমেলো দাড়ি। সাজ-পোশাক পরিপাটি নয়, তবু চোখে একটা গভীরতা ছিল। আর কথায় ছিল জাদু। আমি তখন এর বেশি কিছু বুঝি না।

সেবছর ফাল্গুনে, টুটুমাসির বিয়েতে বর দেখে যেরকম ভালো লেগেছিল, সেরকম ভালো লাগে। আর ভালো লাগে আমার পাকা ঘুঁটি, দান পড়লেও মৈনাকদা কাটে না। আমার দাদা রেগে যায়, মৈনাকদা থামিয়ে দেয়। ঝগড়াও হতো মাঝেমধ্যে। সেটা ভুলে গেছি। সুযোগ পেয়ে জোড়া পাকা ঘুঁটি না খাওয়াটা আজও ভুলিনি।

চুল ঝাঁকিয়ে বেশ তবলা বাজাত মৈনাকদা। আমার সাথে সন্ধেবেলা অনেকদিন বাজিয়েছে। সেদিন আমার গান ভালো হতো না। শুদ্ধ স্বরগুলো নড়ে গিয়ে কড়ি-কোমলে লাগত। দাদা আমার থেকে দুবছরের বড়ো, তবুও আমি বড়ো হয়ে গেলাম আগে। কারণ মেয়েবেলায় ছেলেবেলাটা খুব ছোটো।

মাধ্যমিকের আগে দাদাকে বললাম, লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলো একটু বুঝিয়ে দিবি?

দাদার সামনে উচ্চমাধ্যমিক। দাদা বলল, কমার্স পড়তে পড়তে ওসব ভুলে গুলে খেয়ে দিয়েছি। মৈনাককে বলে দেব, ও দেখিয়ে দেবে।

পরদিন দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে শুরু হল আমার লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা। পরের বছর সরস্বতী পুজোয় নৃত্যনাট্যে স্টেজের পিছনে অন্ধকারে খুব অল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলাম আমরা। তবলা নিয়ে মৈনাকদা আর তার ঠিক পাশেই আমি লাফিয়ে গিয়ে বসেছিলাম। ভালো লাগত বসতে। পাঞ্জাবি পরেছিল ও। গায়ে গন্ধটা চোখ বুঝলে আজও পাই। একটা জিতে যাওয়া মানুষের গায়ের গন্ধ। ওটাই শেষ পাশে বসা। মায়ের সজাগ চোখ তারপর আর কোনওদিন, আমাদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি। বারান্দা থেকে ওর কলেজ যাওয়া দেখাটা, আমার আরও বেড়ে গেল। তবে স্বপ্নে অনেক কিছু দেখেছি, সেটা আমার একান্ত নিজস্ব। কাউকে বলা যাবে না।

আমার বাবা- মা দুজনেই চাকরি করে। রানুমাসি আমাদের সবসময়ে কাজের লোক, দেখাশোনা করে। মায়ের নির্দেশে, বেশি বেশি নজরে রাখে আমাকে। কারণ মৈনাক ভালো ছেলে হলেও, অর্থাভাবে ওদের টানাটানির সংসার। ওই বয়সে আমার কাছে সেটা অর্থহীন।

বিজয় দশমীর দিন ও প্রতিবছর আসত আমাদের বাড়ি। বাবা মাকে প্রণাম করত। দাদার সাথে কোলাকুলি করত। আর আমার সাথে চোখে চোখে যেটা হতো, শুধু সেটা নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। মা থালা সাজিয়ে মিষ্টি দিত। আমার, মামারবাড়িতে জামাই-ষষ্ঠীর কথা মনে হতো। মা বলত, দ্যাখ, মৈনাক কত ভালো ছেলে, যেমন পড়াশোনায়, তেমনি কি সুন্দর তবলা বাজায়।

আমার এই কথাগুলো ভালো লাগত না। এগুলো লোক ঠকানো। মৈনাকও বুঝত ভালো বিশেষণ পাওয়া সহজ। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার অনেক মাপকাঠি আছে। তবুও অবুঝের মতো হতাশ চোখে দেখত। আজকের মতো তখন এত মেলামেশার সুযোগ ছিল না। তখন ভালোবাসা বেশি ছিল, সাহস কম ছিল। এখন ঠিক উলটো। সাহসটা বেশি কিন্তু ভালোবাসাটা কম। আসলে বাধা-বিপত্তি না থাকলে কোনও কাজেই আনন্দ নেই।

ফল্গুর মতো একটা প্রেম বয়ে চলতে লাগল। পাড়ায় একটা চর্চা ছিল। কিন্তু কারও হাতেই কোনও প্রমাণ ছিল না। আসলে মৈনাক খুব ভীতু প্রেমিক। মৃদুমন্দ বসন্তবাতাসের মতো সারাদিন মন ভালো করে দেবে, অথচ প্রয়োজনে কালবৈশাখী হয়ে উঠতে পারবে না। না হলে এমএসসি পাশ করা একটা ছেলে তখনও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারছে না। নব্বইয়ের দশকে একটা মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগ নিতে পারে না।

আমার তখন গ্র‌্যাজুয়েশন হয়ে গেছে। আজকের যুগে হলে এটা জলের মতো সহজ। তবে সেটা হলে এ লেখাটাও হতো না, আর ভালোবাসার হয়তো মরণ হতো দু-ছক্কা দুই-এর সংসারের চাপে।

অনেক সাহস করে মৈনাক একদিন দেখা করেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। প্রেম বলতে ওই একদিন আমরা করেছিলাম। গল্পের শেষে আমি যখন বলেছিলাম, বাবা-মা কিন্তু কোনওদিনই তোমার সাথে বিয়ে দেবে না।

ও কোনও উত্তর করল না। শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে রইল। ও যদি সেদিন আমায় এই বিশ্বসংসারের সব ছেড়ে ঝাঁপ দেবার ডাক দিত, আমি সেদিন ওর বুকে মাথা রাখতাম। ঠিক-ভুল, সময় বিচার করত। সাগর ডাক না দিলে, শুধু নদীর পক্ষে এগিয়ে গিয়ে মেলা কঠিন। মনে মনে সেদিন-ই বুঝে গেলাম, এ প্রেম আমায় সারা জীবন বিরহ যন্ত্রণা দেবে। ওঠার আগে আমার হাত চেপে ধরল মৈনাক।

একটা কান্না আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল। আসলে প্রেম তো শুধু ভালোবাসা চায় না, সে রাগারাগি চায়, ঝগড়া চায়, দোকানের ফর্দ চায়, বাজারের ভুল চায়, মুখ-ঝামটা দিয়ে ভাত বাড়তে চায়, মায়ের মতো রাগ করে আলাদা শুতে চায়, মাঝরাতে আবার মশারির ভেতরে এসে সোহাগ পেতে চায়। এসবে প্রেমের মৃত্যু হয়, না সাফল্য আমি জানি না। এখন নিজে মা হয়ে বুঝি, প্রেমের সংসার আর সংসারের প্রেমে কত তফাত।

তারপর যা হবার তাই হল। আমার কিশোরীবেলার অবুঝ প্রেম সাপলুডোর সিঁড়ি পেল না, সাপের মুখে পড়ল। বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কত কলকাকলি, তার মধ্যে বিবাহ-সংগীত, গায়ে লাল বেনারসী, রজনীগন্ধা, আগের সব গন্ধ ঢেকে দিল। কত উপহারের নীচে চাপা পড়ে গেল মৈনাকের দেওয়া গীতবিতান। অচেনা এক পুরুষকে বন্ধু করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মৈনাকের জলছবির ওপর ধুলো জমতে থাকল।

বুঝতেই পারলাম না, কখন আমার ভেতরের দুদিকে দোল খাওয়া দু-বিনুনির ছটফটে মেয়েটা, মরে গিয়ে খোঁপায় পরিপাটি এক শান্ত বউ-এর জন্ম হল। এতদিনের গান-বাজনা, পড়াশোনা, সব টানটান বিছানা, রং মেলানো পর্দা, আর দুপুরের রঙিন কাপড় দিয়ে সেলাই করা বালাপোষের নীচে চাপা পড়ে গেল। কোলে এল মেহুল। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। সন্তান।

নব্বইয়ে দশকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে সন্তানের জন্য জীবন দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। স্কুল, কোচিং ক্লাস, নোট নেওয়া এসবই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। নিজের সব না-পারা ছেলেমেয়ের মধ্যে উসুল করে নেওয়া। জীবনের আয়নায় নিজের থেকে প্রতিবিম্বকে সুন্দর করে তোলা। মেহুলের নীচে চাপা পড়ে গেল আমার সব ঝাপসা অতীত।

আমার স্বামী মানুষটা খারাপ নয়। চাকরি ভালোই করে। মদ বা সিগারেট যেটুকু খায়, তাতে তাকে নেশাগ্রস্ত বলা যায় না। কর্তব্যে ফাঁকি নেই, তবে অমনোযোগিতা আছে। সুখ চারপাশে অনেক ছড়িয়ে আছে, একঘেয়েমির বিরক্তিও আছে। তবে সুপ্রিয় আমাকে খুব বিশ্বাস করে। শিকড় সমেত গাছ তুলে এনে অন্য মাটিতে বসালে যে অসুবিধাগুলো হয়, সেটা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম।

ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করে দ্বিতীয় পদবির বয়সও কুড়ি বছর হয়ে গেল। মেহুল এখন কলেজে পড়ে। আজকাল মেয়েরা, মেয়ে হওয়ার কষ্ট কমই বোঝে। একটা করে সন্তান, চারহাতে ঢাকা প্রদীপের শিখার মতো। আপন খেয়ালে বেড়ে উঠতে পারে। মেয়ে বলে কোনও আলাদা ভয় সমাজ এদের মনে ঢেলে দেয়নি। ফলে আমাদের থেকে খোলস ভাঙার ক্ষমতা এদের বেশি।

মেহুল একদিন কলেজ থেকে ফিরে বলল, মা জানো, আজকে একটা দারুণ ঘটনা হয়েছে। আমাদের কেমিস্ট্রি স্যার, এমডি আজকে হঠাৎ ক্লাসে আমাকে মার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তোমার নাম বললাম, আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করল। মা তুমি চেনো?

মুহূর্তে মনের ফুটো দিয়ে সব স্মৃতি ফিনকি দিয়ে উঠল। নিজেকে সংবরণ করলাম। শান্ত ভাবে বললাম, ওনার পুরো নাম কি?

মেয়ে বলল, মৈনাক দত্ত, দারুণ পড়ায়।

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, তোমার মামার বন্ধু। বলেই অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে নিলাম। আমাদের প্রজন্মের, এ ভয়, না মরলে যাবে না। নিজের গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহকে মানুষ চিনতে যাচ্ছে, অথচ একজন পুরুষকে আমি চিনতাম, সে কথা স্বীকার করার সৎসাহস আজও অর্জন করতে পারলাম না।

মেহুল রোজ এসে মৈনাকের গল্প বলত। ও বিশ্বাসই করতে চাইত না যে, মৈনাক ওর মামার বন্ধু! আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, মামার থেকে এত ছোটো দেখতে লাগে কেন?

আমি ওকে কী করে বোঝাব আমার মৈনাকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। এখন শুধু একটাই আপশোশ করি, মেহুলকে একটু সুপ্রিয়র মতো দেখতে হল না কেন। যত বড়ো হচ্ছে একদম অবিকল আমি। শুধু হাঁটাটা আলাদা। দুদশক আগে আমাদের হাঁটায় শাড়ি পরে যে-সলজ্জ ভাবটা ছিল, সেটা এখন জিন্সে অনেক আধুনিক আর সাহসী।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সুপ্রিয় তখনও ফেরেনি, মেহুল ওর নিজের ঘরে, আমি বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ মেহুল এসে বলে, মা স্যার ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।

আমি ইশারায় বললাম, বল মা টয়লেটে, পরে কথা বলবে।

আমার খুব রাগ হল, ও এরকম বোকার মতো করছে কেন? আসল সময়ে সাহসের খোঁজ নেই। এখন এসব করার কোনও মানে আছে। এখনকার মেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান। কিছু যদি আন্দাজ করতে পারে কী বাজে হবে ব্যাপারটা!

স্যারের সাথে মেহুলের সম্পর্ক আরও কাছাকাছি আসতে লাগল। মেহুলকে কলেজের পর অনেক জায়গায় খাওয়াতে নিয়ে যায়। লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ দুজনে সময় কাটায়। কেমিস্ট্রির অনেক বই, নোটস দিয়েছে মেহুলকে। কিন্তু আমার যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। না পারছি, সুপ্রিয়কে সব খুলে বলতে… না বারণ করতে পারছি, মেহুলকে। তবে ফোনে আর কোনওদিন আমার সাথে কথা বলতে চায়নি। হয়তো বুঝে গেছে, আমি পছন্দ করছি না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেহুলের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে মেহুলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বারণ করে দিই। এতে মেহুল জানতে পারলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। এই নিয়ে অশান্তি আমার বাড়তেই থাকল।

সেদিন পঁচিশে বৈশাখ। আমি টিভিতে গান শুনছি। মেহুল সকালে উঠে বলল, মা, তোমার লালপাড় হলুদ শাড়িটা পরে আজকে কলেজ যাব। রবীন্দ্র-জয়ন্তী আছে।

আলমারি থেকে বার করে দিলাম। লাল ব্লাউজটা হালকা সেলাই করে দিলাম। শাড়ি পরে মেহুল এসে যখন সামনে দাঁড়াল, তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। এতদিনে মা হয়ে বুঝিনি, মেহুল হঠাৎ মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে মেয়েকে কলেজ পাঠালাম। সুপ্রিয় তখনও ওঠেনি। এক ঠ্যালা দিয়ে বললাম, তুমি এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো।

ও ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, কার?

আমি রেগে বললাম, তোমার।

এবার ও ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে বলবে তো?

ওকে বুঝিয়ে বললাম, এবার মেয়ের বিয়ের খোঁজখবর শুরু করতে হবে, কথা বললেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। সময় ঠিক কেটে যাবে। ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে দিয়ে দেব। তারপর পড়তে চাইলে, বিয়ের পর পড়বে।

ও ধামাচাপা দেওয়ার মতো বলল, ঠিক আছে।

সন্ধেবেলা মেহুল ফিরে এল। হই হই করতে করতে ঘরে ঢুকল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা স্যারকে পাঞ্জাবি পরে কী লাগছিল! মনেই হয় না স্যারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। কী দারুণ তবলা বাজাল! আমার নাচের ভিডিওটা দ্যাখো। এই বলে আমাকে অনুষ্ঠানের সব ছবিগুলো দেখাতে লাগল। হঠাৎ একটা ছবিতে মৈনাককে দেখলাম। একইরকম আছে। শুধু চোখে একটা পুরু কাঁচের মোটা ফ্রেমের চশমা।

মেহুলকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের স্যারের চোখে খুব পাওয়ার?

মেহুল বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠল, হ্যাঁ স্যারের তো গ্লুকোমা আছে, আর তো বছর দুয়েক হয়তো দেখতে পাবে, ডাক্তার বলে দিয়েছে। স্যার আমায় সব গল্প করে, স্যার তো কলেজে পড়ার সময়ে জানত। কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে একবারে অন্ধ হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো স্যার বিয়ে করেনি।

সেদিন গভীর রাত। সবাই শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। আমি মেহুলের ঘরে ঢুকে মৈনাকের নাম্বারটা নিলাম। ফোন করলাম মৈনাককে। গভীর রাতে সবার গলাই খাদে নেমে যায়। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় ভেসে এল,

হ্যালো…।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। আস্তে করে বললাম, মালবিকা।

কেমন আছো? একবার শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।

তোমার চোখের কথা শুনলাম।

ও কিছু না। আমি তো ওটা পঁচিশ বছর আগেই জানি। শুধু চিরকালের মতো আলো নিভে যাওয়ার আগে, একবার তোমাকে দেখতে চাই। ওটা আমার অন্ধকারের ভেতরটা আলো করে রাখবে।

আমি যাব, রাখলাম।

সারারাত আমার ঘুম এল না। দেখলাম, একটা গোটা রাত কত গভীর, কত অন্ধকার। বারবার মনে পড়ছিল, মৈনাকের লেখা কবিতার চারটে লাইন,

আমি আজ দুঃখ দিয়ে নেশা করব,

আমার কান্নায় আফিমের কারবার;

তবু…, তুমি জ্যোত্স্না মাখলে না, মহাকাশে

রটিয়ে দিয়েছি স্পর্শহীন প্রেমের ইস্তেহার।

পরদিন সকালে উঠে চা করে ওদের ডাকলাম। সুপ্রিয়র সুগার আছে, ও চিনি দিতে বললে, আমি রাগারাগি করি। আজ আমি ভুল করে ওর কাপেই দুচামচ চিনি দিয়ে দিলাম। শরীর ভারী লাগছে। কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করছে না।

মেহুলকে বললাম, তোর কলেজে একদিন যাব।

মেহুল জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মিষ্টি মা।

মালবিকা ভাবতে লাগল… চোখ কী শুধু দেখার, না কাঁদার!

অস্বাভাবিক

মাথার উপর বনবন করে ঘুরছে পাখাটা। চলছে টিভিটাও। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে চলেছে অনবরত। হঠাৎ ঘুমের ঘোর কাটলো সায়কের।

আধখোলা জানলা দিয়ে সকালের মিঠেকড়া রোদের এক ঝলক এসে পড়েছে সায়কের ঠিক চোখের উপর। তাই চোখ খুলতে সময় লাগলো তার।

রিমোটটা খুঁজে নিয়ে বন্ধ করলো টিভিটা। ততক্ষণে  মোবাইল ফোনটা বাজা বন্ধ হয়ে গেছে।

বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হাতে-পায়ে ঠেকল উলটানো গেলাস, চিপস-এর প্যাকেট, জলের বোতল ইত্যাদি। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, আটটা বেজে দশ মিনিট।

আবার বাজছে মোবাইল ফোনটা। সায়ক দেখলো, অরুণিমা-র কল।

—হ্যাঁ বলো…

—-আগে দু’বার কল করেছি, ধরোনি। ঘুমোচ্ছিলে নাকি ? কত বেলা হল। গতকাল সেই সন্ধে সাতটায় লাস্ট কথা হয়েছিল, মিটিং আছে বলে,সেই যে কথা বলা বন্ধ করলে…. ‘

এক নিঃশ্বাসে বলা অরুণিমার কথাগুলো শোনার পর সায়ক বললো, ‘না মানে রাতের দিকে আমার শরীরটা একটু খারাপ ছিল। ‘

—–বেশি গিলে ফেলেছিলে নাকি ? ক’পেগ ? মেয়েকে নিয়ে আমি বাবার বাড়িতে চলে এলে যা ইচ্ছে তাই করছো!

‘ না, ঠিক তা নয়। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না  কী করবো! ‘

——কী হয়েছে ?

‘তোমাকে তো বলেছিলাম, আমার আগের ছবিটা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ দেখে,এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা শর্ট ফিল্ম প্রযোজনা করবেন বলেছিলেন। কিন্তু তিনি হরর ফিল্ম পছন্দ করেন।’

‘তা এর মধ্যে অদ্ভুত ঘটনাটা এল কোত্থেকে ?’—- প্রশ্ন অরুণিমার।

‘না মানে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে যিনি সন্ধে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলেন,তিনি কি করে দিঘার কাছে সন্ধে সাতটায় পথ দুর্ঘটনায় পড়লেন!’

‘কী বলছো আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!’ …রাগত সুরে জানায় অরুণিমা।

‘আরে, সুরজিৎ বসু নামের ওই প্রযোজক ভদ্রলোকই তো গতকাল আমার সঙ্গে মিটিং করতে এসেছিলেন। জাতীয় সড়কের ধারে পেট্রোল পাম্প আছে তাঁর। গতকাল সন্ধে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলেন আমার সঙ্গে। এক কাপ চা-ও খেলেন। গল্প রেডি নেই জেনেও, ভরসা করে পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করে গেলেন! ‘

‘তারপর ?’——অরুণিমার আগ্রহ দ্বিগুণ হল এবার।

‘রাত আটটার সময় উনি চলে গেলেন। তারপর আমি একটু ‘রঙিন জল’ নিয়ে বসলাম গল্পটার প্লট ভাবব বলে। পান করতে-করতে টিভিতে খবর দেখছিলাম। হঠাৎ একটা খবর শুনে চমকে গেলাম! সন্ধে সাতটা নাগাদ দিঘার কাছে এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় নাকি প্রাণ হারিয়েছেন ব্যবসায়ী সুরজিৎ বসু। খবরে এও বলা হয়, পুলিস জানিয়েছে, মৃত ব্যক্তি এক পেট্রোল পাম্পের মালিক।’

সায়ক বলে চলে, ‘নেশার ঘোরে ছিলাম, তাই খবরটা শুনেই আমি পাগলের মতো ফোন করতে থাকি সুরজিৎ বাবুর মোবাইল ফোনে কিন্তু কোনও ভাবে কানেক্ট করতে পারিনি। আর তারপরেই আমি সম্ভবত সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম বিছানাতেই।’

‘এখনও তোমার নেশা কাটেনি, তাই ভুল বকছো। এমন আবার হয় নাকি! যাও বাথরুম-এ গিয়ে মাথায় জল ঢালো।’ —–অরুণিমা রেগে ফায়ার।

অরুণিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়ক বলে, আচ্ছা দাঁড়াও, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো, অ্যাডভান্স-এর চেকটা ড্রয়ার-এ রাখা আছে, ছবি তুলে পাঠাচ্ছি।’

চেকটা হাতে নিয়ে ছবি তুলে অরুণিমাকে পাঠাতে যাবে, ততক্ষণে ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে অরুণিমা।

সায়কের ফোনটা আবার বাজছে। স্ক্রিন-এ ভেসে উঠল প্রোডিউসার সুরজিৎ বসু-র নাম।

সায়ক চমকে উঠল! কাঁপা গলায় বললো, ‘হ্যালো…’

ওপ্রান্ত থেকে সুরজিৎ বাবুর গলা….’আমার মারা যাওয়ার খবরটা আপনিও শুনেছেন নিশ্চয়ই ? কিন্তু আমি মরি, বাঁচি যাই করি না কেন, ছবিটা বানাবেন অবশ্যই। বাকি টাকা ঠিক সময় মতো পেয়ে যাবেন আপনি।’—–বলেই একটু থামলেন, তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন ফোনের ওপ্রান্তে থাকা মানুষটা। আর সায়ক ঘেমে স্নান করার অবস্থা। হতবাক !

‘আরে ভাই কী হলো,বিশ্বাস না হয় খবরের চ্যানেল চালিয়ে দেখুন।’—-এই  পরামর্শ এলো ফোনের ওপ্রান্ত থেকে।

একপ্রকার ঘোরের মধ্যে টিভি খুলে খবরের চ্যানেল চালু করল সায়ক। খবরপাঠক বলে চলেছে……

‘গতকাল দিঘার কাছে গাড়ি দুর্ঘটনার পর দীর্ঘ সময় ধরে চলল মৃত্যু বিভ্রাট! একই নাম, একই পেশা। তফাৎ শুধু বয়স আর ঠিকানায়। যিনি মারা গেছেন, তিনি মাঝবয়সি, আর যাঁকে নিয়ে মৃত্যুর বিভ্রান্তি ছড়াল, সেই সুরজিৎ বসু বয়সে প্রবীণ। রসিকতার সুরে তিনি জানিয়েছেন, পুনর্জন্ম হয়েছে তাঁর, বেড়ে গেছে আয়ু।’

খবর শোনার পর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সায়কের। টিভিটা বন্ধ করল। ওর কানে তখনও মোবাইল ফোনটা ধরা রয়েছে।বললো, ‘হ্যালো ….’

ওপ্রান্ত থেকে হাসতে হাসতে ….. ‘ কী সায়কবাবু, কী শুনলেন ?’

‘কী কাণ্ড বলুন তো!’ ….সায়কের মুখে হাসির ঝলক।

‘পুরো ভৌতিক কাণ্ড !’ বললেন সুরজিৎ।

‘বাঃ ! ফ্যান্টাস্টিক। আমাদের শর্ট ফিল্ম-এর নাম রাখব—- ভৌতিক।’

——–আর, স্টোরি ?

——–স্টোরিলাইনও তো পেয়ে গেলাম এই সুবাদে।…. বলেই হাসতে থাকল সায়ক।

——–তাহলে আর অপেক্ষা কিসের ? প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। বেস্ট অফ লাক। হাঃ হাঃ…..

‘ধন্যবাদ।’ ……বলেই ফোনটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ‘ ইউরেকা ‘ বলে সায়ক ডুব দিল ভাবনার গভীরে।

অভিনয়

সন্ধে ছুঁই-ছুঁই। রাস্তার ধারে বাতিস্তম্ভের আলোগুলি জ্বলে উঠছে ক্রমশ। ঘোলাটে আলো  ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। যানবাহন আর লোকজনের কোলাহলকে সঙ্গী করে ঋক হেঁটে চলেছে ফুটপাত ধরে। বৈঠকখানা বাজার অঞ্চলের ভিড় ঠেলে বেশ জোরে-জোরে হাঁটার চেষ্টা করছে ঋক।

‘নবদিগন্ত নাট্যসংস্থা’-র অফিসঘরের দরজার সামনে ঋক যখন পৌঁছোলো,এক অদ্ভূত উদ্বেগে ততক্ষণে ঘেমে গেছে সে।

কলিংবেল টিপল ঋক। দরজা খুললেন বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ও নির্দেশক প্রাণেশ  মুখোপাধ্যায়। ঋককে দেখে কিছুটা চমকে গেলেন তিনি।  ‘কী ব্যাপার, রিহর্সাল রুম-এ না গিয়ে তুমি হঠাৎ এই অফিসঘরে? ‘

‘স্যার, খুব বিপদে পড়ে এলাম এখানে । ট্রেন-এর মান্থলি টিকিটটা হারিয়ে ফেলছে আমার বন্ধু। টিটি ধরেছে। ১২০০ টাকা ফাইন করেছে তর্ক-বিতর্ক হওয়ার কারণে। এখনই না দিলে অ্যারেস্ট করে কোর্টে চালান করে দেবে বলেছে। আমাকে ফোন করে সাহায্য চাইল। কিন্তু, গাড়ি ভাড়া বাদ দিলে, আমার কাছে মাত্র ২০০ টাকা আছে। স্যার,প্লিজ আমাকে ১০০০ টাকা দিন, কাল এসে ফেরৎ দিয়ে যাব।’—-কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে ব্যক্ত করল ঋক।

‘আরে শান্ত হও। তুমি তো ঘেমে গেছো পুরো! দাঁড়াও, দিচ্ছি টাকা।’

মানিব্যাগ বের করে প্রাণেশ এবং সুমিতাভ মুখোপাধ্যায় দু’জনে ৫০০ করে মোট ১০০০ টাকা  ঋকের হাতে তুলে দিলেন। প্রাণেশ বললেন, ‘ফাইনটা দিয়ে তুমি রিহার্সাল রুম-এ চলে এসো।’

আধা ঘন্টা পরে ছকু খানসামা লেন-এর মহড়াকক্ষে ঋক গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মহড়ায় যোগ দেয়নি। অন্য এক শিক্ষার্থীর হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, ‘শোনো সায়ন, আজ রিহার্সাল করতে পারছি না, এই চিঠিটা দুই স্যার-এর মধ্যে কোনও একজনের হাতে দিয়ে দিও প্লিজ।’

সায়ন আশ্বস্ত করার পর, মহড়াকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে  হস্টেল-এর উদ্দেশে রওনা দেয় ঋক।

শিয়ালদহ থেকে বাসে নেতাজি নগর পৌঁছোতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগল ঋকের। বাসে থাকাকালীন একটা বিষয় ভেবে,বারবার হাসি পাচ্ছিল তার কিন্তু একা-একা হাসলে লোকে পাগল ভাবতে পারে, অতএব, মুখে হাত ঢাকা দিয়ে খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছিল সে। তাই, হস্টেল-এ নিজের ঘরে ঢুকে, জুতো, জামাপ্যান্ট না ছেড়ে, বিছানায় শরীরটাকে অর্ধেক এলিয়ে দিয়ে হেসেই চলেছে ঋক।

হাসিটা আসলে অভিনয় সাফল্যের। কোনও মঞ্চে কিংবা রুপোলি পর্দায় ভালো অভিনয় করে প্রশংসা কিংবা পুরস্কার পেয়ে নয়। কিন্তু ঋক আজ এমন এক অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছে, যার সাফল্যে সে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ায় মতো আনন্দ উপভোগ করছে।

এরই মাঝে ঋকের মোবাইলটা বেজে উঠল।

সায়নের ফোন।

হাসি চেপে রেখে ঋক বলল, হ্যাঁ, সায়ন বলো—-কী ব্যাপার—–

…….গুরু, চিঠিতে কী লিখেছো ! প্রাণেশ স্যার পড়ার পর,সুমিতাভ স্যারকে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাক্কা শয়তান ছেলে।’

হাসতে হাসতে ঋক জিগ্যেস করল সায়নকে, ‘আর সুমিতাভ স্যার চিঠি পড়ে কী বললেন?’

‘কিছু বললেন না, সিগারেট আর দেশলাইটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।’

সায়নের ফোনটা ছাড়ার পর ঋকের হাসি দ্বিগুণ হল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজের হাতে লেখা সেই চিঠির বয়ান…….

মহাশয়দ্বয়,

মহড়ার খরচবাবদ প্রথম মাসে ৫০০ টাকা আমার থেকে নিয়েছিলেন আপনারা। চলতি মাসেও ৫০০ টাকা চেয়েছিলেন। টিউশন-এর টাকা পেলে দিতামও হয়তো। কিন্তু, প্রায় দেড় মাস ধরে দেখলাম, খবরের কাগজে প্রতি সপ্তাহে ‘অভিনেতা চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে শুধু টাকা কামাচ্ছেন,নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্য যে নেই, এটা বেশ বুঝতে পারলাম। কিন্তু এ তো এক রকম প্রতারণা ! তাই, এ মাসে আর ৫০০ টাকা খোয়াতে চাইলাম না। পরিবর্তে, যা দিয়েছিলাম আর  আমার যাতায়াতের খরচ বাবদ আরও ৫০০ টাকা, অর্থাৎ মোট ১০০০ টাকা আজ আদায় করে নিয়ে এলাম।

আসলে কী জানেন স্যার, অন্যায় যে একেবারেই সহ্য করতে পারি না, তা আজ শৈল্পিক দক্ষতায় প্রমাণ করে এলাম।

আশাকরি, মনে রাখবেন আমাকে।

——–

অন্ধের দিনরাত্রি

এস্থার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে হয়তো অ্যালার্ম-টা বাজছে। এত তাড়াতাড়ি সকালে ওঠার অভ্যাস আগে একেবারেই ছিল না। সকাল আটটার আগে ওর ঘুমই ভাঙত না। কিন্তু এখানে এটা শোভনীয় নয়! এটা শ্বশুরবাড়ি। মাত্র দুদিন হল তার বউভাত হয়েছে। একেবারে নতুন বউ। কিন্তু এ-বাড়ির প্রতিটা সদস্য যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, এস্থারেরও মনে হচ্ছে, পরিবর্তে ওদের জন্যও তার কিছু হলেও করা উচিত।

প্রসূনের মুখেই শুনেছিল, প্রসূনের মা সুনন্দা খুব সকালে উঠে পড়েন সংসারের কাজ সামলাতে। সুনন্দার নাকি ওটাই বরাবরের অভ্যাস। এস্থার দেখল ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, তার মানে শাশুড়ি এতক্ষণে উঠে পড়েছেন। বাড়ির সকলের সকাল সকাল চা পানের অভ্যাস। সেও তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক বদলে চোখমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

এস্থার কল্পনাও করেনি প্রসূনের মা-বাবা এত সহজে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন। কারণ সব সময় প্রসূনের মুখে শুনেছে, এদের পরিবার খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ আর সেখানে এস্থার খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে কিন্তু বউভাতের দিনই তার মনের এই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি, ও অন্য ধর্মের এবং ভিন্ন জাতের।

জাতি, ধর্ম কখনওই স্নেহ, ভালোবাসার মধ্যে দেয়াল হয়ে উঠতে পারে না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রসূনের পরিবার। এই সবই ভাবতে ভাবতে এস্থার রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, হুঁশ ফিরল প্রসূনের একমাত্র পিসির চিৎকারে, আরে আরে… বউমা এ কী অনর্থ করতে যাচ্ছো…।

প্রসূনের বিধবা পিসি সুমিত্রা বেশিরভাগ সময়ে নিজের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের সংসারেই পড়ে থাকেন। সকাল সকাল উঠে পড়েন এবং হাতে জপের মালা নিয়ে একটা ধুনুচি জ্বালিয়ে আসন পেতে হলঘরটায় বসে থাকেন। ভান করেন জপ করছেন কিন্তু আসলে নজর রাখেন বাড়ির কে কী করছে। হলঘরটা থেকে সব ঘরগুলো পরিষ্কার দেখা যায়।

সুমিত্রার চিৎকারে, ভাইয়ের বউ সুনন্দা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। এস্থারও হঠাৎ পিসিমার চিৎকারে স্থানুবৎ রান্নাঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।

সুনন্দা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই পিসিমা এস্থারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই বাড়িতে পা দিয়ে তুমি আমার ভাইয়ের নাক কাটিয়েছ সমাজে। জাত-কুল সব নষ্ট হয়েছে। এখন আবার স্নান না করেই রান্নাঘরে ঢুকে আমাদের ধর্মও নষ্ট করার ইচ্ছে রয়েছে? ধর্ম নিয়ম বলে কিছু আছে তো নাকি? অবশ্য তোমরা মোমবাতি জ্বালানো ছাড়া আর কী-ই বা জানো? কিন্তু সুনন্দা, তুমি… তোমার তো এই পরিবারে এতগুলো বছর কেটে গেল, এখনও কি তুমি নিয়মগুলো শিখতে পারলে না?

সুনন্দা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। পিসিমা আবার বলেন, বউমাকে বুঝিয়ে দাও এ সংসারের কিছু রীতি নিয়ম আছে। এখানে কী কী করা যাবে আর কী না, সেটা ওকে পরিষ্কার করে বলে দাও। ছেলের মোহ-তে এতটাও অন্ধ হয়ে যেও না যে বাড়ির পুরোনো নিয়ম বদলে ফেলতে হবে।

এস্থার ভয়ে রান্নাঘরের দরজাতেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম দুদিন সুনন্দা ওকে কোনও কাজ করতে দেয়নি। আজ এস্থার নিজে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল শাশুড়িকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কাল অবধি যে-পিসিমা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, আজ এমন কী দোষ করে ফেলল যে তার উপর পিসিমা এতটা রেগে উঠলেন?

সুনন্দা ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিলেন, ও তো একেবারে নতুন দিদি, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে হাতে করে সব শিখিয়ে দেব। এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।

হ্যাঁ শিখতে তো হবেই। তোমার ছেলে শুধু বেজাতের বউ-ই নয় অন্য ধর্মেরও মেয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সব শুনে সুনন্দা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে যেতে এস্থারকেও ইশারা করলেন সঙ্গে আসার জন্য।

ননদের চোখের আড়াল হতেই সুনন্দা, এস্থারকে কাছে টেনে নিয়ে স্নেহবশত ওর মাথায় হাত রাখলেন, দিদির কথায় কষ্ট পেও না। একটু কড়া কড়া কথা বলেন ঠিকই কিন্তু মনের দিক থেকে খুবই ভালো মানুষ। তুমি বরং স্নানটা সেরে নাও, ততক্ষণ আমি পুজোটা করে নিচ্ছি। তারপর দুজনে মিলে চা-জলখাবার করব, বলে সুনন্দা পুজোর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এত সকালবেলায় স্নানের কথা এস্থার ভাবতেও পারে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জিততে গেলে সকালেই তাকে স্নান করতে হবে। প্রসূন আগেই বলে দিয়েছে, এস্থারকে নিয়ে কোনও অভিযোগ পরিবারের মুখ থেকে শুনতে সে রাজি নয়। কারণ এই ব্যাপারে ও স্ত্রীকে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না।

 

সকালের ঘটনায় এস্থার কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে কোথাও যেন বাড়ির সদস্যদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার মনোভাব উঁকি মারার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এস্থার জোর করে মন থেকে নেতিবাচক মনোভাব সরিয়ে রেখে স্নানে চলে গেল। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখল সকলে খাবার টেবিলে এসে বসেছে।

শাশুড়িমা চা-জলখাবার বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে দিয়েছেন। সকলেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে। একা সুনন্দা সকলকে পরিবেশন করছেন। কেউ লুচি চাইছে তো কেউ তরকারি। কেউ আর এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ করছে। এমনকী সুনন্দার একমাত্র মেয়ে শিল্পীও মা-কে দুপুরে কী খাবে তার ফরমায়েশ জানাচ্ছে। বেচারি সুনন্দা একা হিমশিম খাচ্ছেন!

এসব দেখে এস্থার ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও মুখে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সকলের ওর উপর চোখ পড়লেও, কেউই মুখে কিছু বলল না। এমনকী প্রসূনও না! সুনন্দা রান্নাঘরে ছিলেন। সকলের ব্যবহারে এস্থার এতটাই মনে আঘাত পাচ্ছিল যে, ওর চোখে জল এসে গেল। সুনন্দা এস্থারকে দেখতে পেয়ে বললেন, এস্থার তুমিও চা খেয়ে নাও।

সুনন্দার কথা শেষ হতেই টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রসূনের ঠাকুমা বলে ওঠেন, বউমা, এখন তুমি বাড়ির বউ শুধু নও, শাশুড়ি হয়ে গেছ। সুতরাং তোমার দাযিত্ব এখন যে, ভুল করেও এমন কিছু কোরো না যেটা নিয়ে পরে তোমাকে পস্তাতে হতে পারে। এটা তোমার বাপের বাড়ি নয়, যেখানে সবকিছু সবাই মেনে নেবে।

ঠিক আছে মা, মাথা নীচু করে সুনন্দা উত্তর করলেন।

প্রসূনের ঠাকুমা আবার বললেন, আর একটা কথা বউমা, কাল আমার গুরুদেবকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছি। যা যা ব্যবস্থা করার সব করে রেখো। পুজোর সমস্ত সামগ্রী গুরুদেব নিজেই নিয়ে আসবেন। পুরো বাড়ি শুদ্ধ করে দেবেন এবং একই সঙ্গে এই ছুঁড়িটার নাম বদলে ওকেও শুদ্ধ করে দেবেন।

মায়ের কথা শুনেই সুমিত্রা জপের মালা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশ্বরের আরাধনায় সামান্য বিরাম টেনে জিজ্ঞেস করলেন, নাম বদলে… কিন্তু কেন?

তোরও কি জ্ঞানগম্যি সব লোপ পেল সুমি? ছুঁড়িটার নাম মুখে এলেও জিভ মনে হয় অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গুরুদেবও বলেছেন, নাম বদলালেই প্রসূনের বিবাহিত জীবন সুখময় হতে পারবে, ভবিষ্যতে নয়তো বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়াও ছুঁড়িটার কারণে পরলোকে আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর যে-কলঙ্ক লেগেছে, সেটাও গুরুদেব যজ্ঞ করে দূর করে দেবেন। ওনাদের ওখানে তাহলে আর নরকবাস করতে হবে না। একই সঙ্গে শিল্পীর বিয়ের জন্যও গ্রহশান্তির ব্যবস্থা করাবার কথা বলছিলেন গুরুদেব। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে যান সুনন্দার শাশুড়ি গায়ত্রীদেবী।

একটু দম নিয়ে এবার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রদীপ, ব্যাংক খুললেই সকাল সকাল গিয়ে এক লক্ষ টাকা তুলে আনিস। পুজোর জন্য লাগবে।

টাকার অঙ্ক শুনেই প্রসূনের বাবা আঁতকে উঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, মা এক লক্ষ টাকা, তাও শুধু পুজোর জন্য! একটু বেশি নয় কি?

ভাইয়ের কথা শুনে সুমিত্রা বলে উঠলেন, বেশি কোথায় রে ভাই। এটা খুবই কম! আমাদের পরিবারের উপর গুরুদেবের আশীর্বাদ রয়েছে। এছাড়া মা গুরুদেবের পরমভক্ত, তাই এতটা কমে এই পুজোপাঠ করতে রাজি হয়েছেন তিনি। তুই আর সুনন্দা তো ছেলের প্রতি অন্ধ হয়ে একটা বিধর্মী মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিস। তোদের জন্য আমাদের পরলোকগত পূর্বপুরুষদের সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে।

প্রসূন এতক্ষণ চুপ করে থেকে বাবার মুখে চিন্তার আনাগোনা লক্ষ করছিল। ও বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে বলল, বাবা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনব।

এস্থার অবাক হয়ে যায় প্রসূনের ব্যবহারে। এতদিন ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা করছে, প্রসূনের এরকম অন্ধবিশ্বাস আগে কখনও সে দেখেনি। সেই সঙ্গে প্রসূনের পুরো পরিবার এতটা শিক্ষিত এবং আধুনিক হয়ে কীভাবে এই অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার গারদে স্বেচ্ছায় বন্দি থেকে গেছে, সেটা এস্থারের কিছুতেই বোধগম্য হল না। তার খালি মনে হচ্ছিল, এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো কী করে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়েছিল।

 

আসলে এস্থারের এটা অজানাই ছিল যে, এই গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার তাকে বউ হিসেবে এইজন্যই মেনে নিয়েছিল, যাতে তাদের একমাত্র রোজগেরে ছেলে বিয়ের পরে আলাদা না থাকতে শুরু করে দেয়। তাছাড়া এস্থারও খুব বড়ো চাকরি করে। ফলে ছেলে, বউমা দুজনকেই প্রযোজনে কাজে লাগবে। এছাড়াও বাড়ির একমাত্র মেয়েরও বিয়ে দিতে হবে সুতরাং সেখানেও টাকার দরকার পড়বে।

এইসব নানা কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ এস্থারের খেয়াল হল যখন গুরুদেব আর গ্রহশান্তির কথা হচ্ছিল, তখন সে কথা শুনে শাশুড়িমা-র মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল আর শিল্পীর মধ্যেও একটা অস্থিরতা এস্থার টের পেয়েছিল।

যে-মেয়ে হেসে হেসে এতক্ষণ সকলের সঙ্গে গল্প করছিল, গ্রহশান্তির কথা শুনেই তার মুখের এই ভাবান্তর, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং শিল্পীর পিছনে সুনন্দারও চলে যাওয়াটা এস্থারকে ভাবিয়ে তুলছিল। এস্থারও একটু বসে নিজের ঘরে যেতে গিয়ে শিল্পীর ঘরের সামনে পৌঁছোতেই, সুনন্দা আর শিল্পীর কথোপকথন তার কানে এল।

শিল্পী বলছে, মা আমি গ্রহশান্তির জন্য কিছুতেই পুজোয় বসব না, তাতে আমার বিয়ে হোক আর নাই হোক।

সুনন্দা মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে বলছেন, শিল্পী, ঠাকুমা আগে থেকেই তোমার গ্রহশান্তির জন্য গুরুদেবকে বলে রেখেছেন, সুতরাং তোমাকে তো পুজোতে বসতেই হবে। এই পুজোর ফলে তোমার ভালো বাড়িতে বিয়ে হবে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সব ভালো হবে।

এস্থার আর অপেক্ষা করতে পারল না, দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে এল। শাশুড়িকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, মা কী হয়েছে, গ্রহশান্তির কথা শুনে শিল্পী এত কাঁদছে কেন? সুনন্দা উত্তর করলেন না। একই ভাবে মেয়েকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

হঠাৎই শিল্পী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সুনন্দার উপর চেঁচিয়ে উঠল, মা তুমি কেন বুঝতে পারছ না, পুজোর পর প্রতিবার আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সারা গায়েহাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে। মা, আমার ভীষণ ভয় লাগে। প্লিজ মা আমি পুজোতে বসব না।

শিল্পীর কথার থেকে বেশি ওর চোখে, মনের ভয়টা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। শিল্পীর অবস্থা দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠেই এস্থার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল, মা, শিল্পীর পুজোতে বসা কি খুব দরকার?

এস্থার, তোমার এ বাড়িতে মাত্র তিন-চারদিনই হয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন করা ছেড়ে কালকে গুরুদেবের সেবায় এবং খাওয়াদাওয়ার আযোজনে আমাকে সাহায্য কোরো। আর প্রসূনকে বোলো এক লক্ষের একটু বেশি টাকা তুলতে। কারণ পুজোর খরচ ছাড়াও গুরুদেবকে দক্ষিণাও দিতে হবে, যাতে শিল্পীর জন্য ভালো সম্বন্ধ আসে।

শাশুড়ির কথা শুনে এস্থার বুঝে গিয়েছিল, সময় থাকতে তাকেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো তার সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব সবই ধুলোয় চাপা পড়ে যাবে।

এই পরিবারের লোকেদের চোখে অন্ধবিশ্বাসের এমন ঠুলি পরানো আছে, যা বার করে ফেলাটা খুব সহজ নয়। এস্থার এও জানে সে চেষ্টা করলেই সফল হবে এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। তাই শুদ্ধিকরণ, নামকরণ, বিয়ের জন্য গ্রহশান্তির পুজো এসব যে কতটা বুজরুকি তা জেনেও, পরের দিন সকালে উঠে এস্থার, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

 

যথাসময়ে গুরুদেব পাঁচ শিষ্যকে সঙ্গে করে এস্থারের শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। এস্থার বাদে সকলে গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিল। সবার হয়ে গেলে গায়ত্রীদেবী এস্থারকে ইশারা করলেন, গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে।

আশীর্বাদ দেওয়ার নামে গুরুদেব যেভাবে এস্থারকে স্পর্শ করলেন, তাতে এস্থারের সারা শরীর শিউরে উঠল। গুরুদেবের শিষ্যদের দৃষ্টিও ক্ষুধার্ত পশুর মতো মনে হল এস্থারের। সেই মুহূর্তে গায়ত্রীদেবী পুজো শুরু করে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতেই এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল গুরুদেবের মুখে। এস্থারকে দেখিয়ে বললেন, আমি প্রথমে এই মেয়েটিকে শুদ্ধ করে তবে পুজোয় বসব। পুজোর ঘরে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না, বলে গুরুদেব সকলকে বাইরে যেতে বলে পুজোর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

প্রায় দুঘন্টা পর গুরুদেব ও এস্থার ঘর থেকে বেরোতেই তৎক্ষণাৎ শিষ্যদের নিয়ে গুরুদেব পুজোয় বসে পড়লেন। পুজো করতে করতে বারবার এস্থারের সঙ্গে কাটানো সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত গুরুদেবের মনে পড়তে লাগল। এরকম অবস্থার সম্মুখীন আগে কখনও তাঁকে হতে হয়নি।

এস্থার চালাকি করে আগে থেকেই মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা অন করে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে ঘরের মধ্যে যা-যা ঘটবে সব মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড হতে থাকবে। গুরুদেব কীভাবে পুজোর সামগ্রীর সঙ্গে আনা মাদক পুরিয়া এস্থারকে খেতে দিয়েছেন, এস্থার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ভেবে তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে উদ্যত হয়েছেন, এস্থার কীভাবে ওঁর মুখ থেকে সব সত্য বার করে আনতে ওঁকে বাধ্য করেছে সব মোবাইলে রেকর্ড হয়েছে। গুরুদেব ভালো করেই জানেন, এই সত্যি প্রকাশ পেলে জেলের ঘানি টানা থেকে তাঁকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

তাড়াতাড়ি পুজো সেরে ওই বাড়ি থেকে কখন বেরোবেন ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন গুরুদেব। কারণ এস্থারের দেওয়া হুমকি তখনও কানে বাজছিল গুরুদেবের। সকলের অগোচরে বদ্ধ ঘরের আড়ালে এস্থার তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে পুজো সেরে এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো পুলিশ ডেকে ভিডিও সমেত আপনাকে ধরিয়ে দেব। ভিডিও সামনে এলেই সকলে বুঝতে পারবে আপনার পুরোটাই সাজানো একটা চক্র যার প্রধান পাণ্ডা আপনি। পুজো, ধর্ম, গ্রহশান্তির নাম করে বাড়ির মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা, তাদেরকে নিজের শিকার বানাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারকে আর্থিক ভাবে লুঠে নেওয়া ইত্যাদি কারসাজি আমি সবার সামনে নিয়ে আসব যাতে জেলে যাওয়া থেকে আপনাকে কেউ আটকাতে না পারে।

পুজো শেষ করেই গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরোবার জন্য হুড়োহুড়ি করতে গায়ত্রীদেবী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াহুড়ো কেন করছেন গুরুদেব? এখনও তো এই ছুঁড়ির নামকরণ এবং আমার নাতনির গ্রহশান্তির পুজো করেননি।

গুরুদেব এস্থারের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলেন, নামকরণের কোনও দরকার নেই। খুবই শুভলগ্নে ওদের বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এই বাড়িতে ওর পা পড়তেই বাড়ির সব বাধাবিঘ্ন দূর হয়ে গেছে। সমস্ত গ্রহও সুস্থানে বিচরণ করছে। সুতরাং গ্রহশান্তি করাবারও আর কোনও দরকার নেই। আর এই পুজোর জন্য আমি কোনও দক্ষিণাও গ্রহণ করব না। এই বলে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

মুহূর্তে এস্থার অনুভব করল বাড়ির সকলের দৃষ্টি তার উপরে। সকলেরই চোখের ভাষা একদম বদলে গেছে। হঠাৎ করেই ভালোবাসার ফল্গুধারা সকলের চোখ থেকে প্রবাহিত হতে দেখে মনে মনে হাসল এস্থার। নিজের মনেই বলল, এদের অন্ধবিশ্বাস এখনও কাটেনি ঠিকই কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে না-তো শিল্পীর বিয়ে আটকাবে আর না-তো এই মেয়ের উপর গুরুদেবের দৈহিক অত্যাচার চলতে থাকবে, যা এতদিন ধরে এ বাড়িতে চলে এসেছে।

 

রোবোট?

হাউ ফ্যানটাস্টিক,  উদীয়মান সূর্য‌্যের দিকে তাকিয়ে বলল জয়িতা।

মি. দাস বিরক্ত হয়ে দেশলাই বাক্সটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। একটাও কাঠি জ্বলছে না। কুয়াশার জন্য? কি বিচ্ছিরি কুয়াশা বটে। একটু আগেও ছিল না, এখন আবার হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে। সূর্য‌্যটাও ঢাকা পড়ে গেল। যাকগে। একটা সিগারেট কি খাওয়া যাবে না?

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, খাবেন নাকি একটা? ডু ইউ স্মোক?

ওঃ, অফ্ কোর্স।

দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টান দিল। সুমন বলল, আমাদের ভাগ্য কিন্তু ভালো, তাই না?

হোয়াই?

দেখলেন না কেমন কুয়াশা নেমে এল। আর একটু আগে নামলেই তো এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখা হতো না। কী বলেন?

কোন অসাধারণ দৃশ্যের কথা বলছ?

সানরাইজ মশাই!

হুঁ। তেমন অসাধারণ কিছু নয়। ম্যাল থেকেও এটা দেখা যায়।

দুটো কি এক হল?

প্রায় এক। সে যাই হোক। এটা দেখার জন্য এত ভোর ভোর উঠে এত দূরে ছুটে আসার কোনও মানেই হয় না।

তাহলে এলেন কেন?

মিসেস বলল,

খুব শোনেন বুঝি মিসেসের কথা।

একটু তো শুনতেই হয়।

আচ্ছা দেখি, আমার মিসেস আবার কোথায় গেল?

সুমন সরে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ততক্ষণে মলি এগিয়ে এসেছে। মলি ওর নতুন বিয়ে করা বউ। দুজনে মিলে হনিমুনে এসেছে। সে এসেই সুমনের হাত ধরে বলল, তোমরা এখানে? ওঃ সিগারেট খাওয়া হচ্ছে। ফেলো ওটা। ওদিকটায় দ্যাখো খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। দেখেছ, কেমন পাগলের মতো ছবি তুলছে সবাই। তারপরেই মি. দাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, আপনি কটা ছবি তুললেন?

একটাও না।

কেন?

কারণ আমি পাগল নই। তাছাড়া সূর্য‌্যদেবকে ক্যামেরাবন্দি করার ইচ্ছেও নেই।

হাসল মলি। কথাটা খারাপ বলেননি তো!

সুমনও হাসল। বলল, উনি বলছিলেন এই একটা সূর্যদয় দেখার জন্য এত দূর ছুটে আসার কোনও মানে হয় না।

মলি ভুরু কোঁচকাল। তারপরেই বলল, খুব ভুল বলেননি কিন্তু। হাতের কাছেই কত ভালো জিনিস আমরা দেখি না। ওই যে রবিঠাকুরও বলেছিলেন না, কত দেশ ঘুরে কত ক্রোশ দূরে তার পরের লাইনটা বলো না।

মনে নেই, আমার কিন্তু এখন অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বেশ উঁচু গলায় আবৃত্তি করল সুমন,

আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর কবিতাটা পড়েছেন নিশ্চয়ই মি. দাস?

আমি কবিতা পড়ি না।

যাঃ, কিন্তু এই কবিতাটা তো সব বাঙালির-ই জানা।

তোমার সঙ্গে বুঝি সব বাঙালির পরিচয় আছে?

মলি হাসল। ওর সঙ্গে তুমি ক়থায় পারবে না।

হঠাৎই কী মনে হতে সুমন মলির হাত ধরে টানে, আচ্ছা মি. দাস। আমি একটু ওকে নিয়ে ওদিকটায় ঘুরে আসি। আপনি থাকুন বরং। ডোন্ট মাইন্ড।

মাইন্ড করব কেন? তুমি তোমার বউকে ঘোরাতে নিয়ে এসেছো। আমাকে তো নয়?

দুজনে এগিয়ে গেল।

জয়িতা ওখানে কী করছে?

মি. দাস এগিয়ে গেলেন।

জয়িতা, সরে এসো, খাদের পাশে দাঁড়িয়ো না।

সরে দাঁড়াল জয়িতা।

কী করছিলে ওখানে?

কুয়াশা দেখছিলাম। কত নীচ থেকে উঠে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে, সুন্দর না?

কুয়াশা হামাগুড়ি দেয় না আর দাঁড়াবে না খাদের পাশে।

জয়িতা ঘাড় নাড়ায়, আচ্ছা।

গাড়ি নামছে টাইগার হিল থেকে। হঠাৎ করেই ব্রেক কষে। পাশেই একটা ভিড় জমেছে। অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা শোনা গেল।

সুমন ও মি. দাসরা একই গাড়িতে ফিরছিল। গাড়ির ড্রাইভার নেমে দেখতে গেল ব্যাপারটা। পেছন পেছন সুমনও নামল।

একটু পরেই ফিরে এসে সে বলল, হরিবল্ ব্যাপার বুঝলেন? মুখোমুখি দুটো গাড়ির ধাক্কা। ড্রাইভারটা স্পট ডেড। মাথা ছাতু হয়ে গেছে। আর একজন গুরুতর ভাবে জখম। একটা পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

মলি শুনেই দেখতে ছুটল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল বিবর্ণ মুখে।

ইস্, লোকটার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে না দেখলেই ভালো করতাম।

দেখতেই তো গেছিলেন বিরস মুখে বললেন মি. দাস।

জয়িতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ বলল, আচ্ছা, লোকটাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিলে হয় তো।

তার মানে! চোয়াল ঝুলে গেছে সুমনের।

আপনি বললেন না জখম হয়েছে? ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে।

সেটা হয় নাকি একটু অস্বস্তি নিয়ে যেন মাথা নাড়ে সুমন, এটা পুলিশের কেস্। আর স্থানীয় লোকেরা তো আছেই। দরকার পড়লে ওরাই নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

মি. দাস আপন মনেই বিড়বিড় করলেন, বাইস্ট্যান্ডারস এফেক্ট।

কী বললেন?

কিছু না ড্রাইভার, গাড়ি স্টার্ট করো।

যেতে যেতে মলি বলল, জয়িতাদি কিন্তু ঠিকই বলেছিল। হাসপাতালে এক্ষুণি নিয়ে গেলে হয়তো…

মি. দাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, সুমন বলছিল লোকটার পা চলে গেছে। এভাবে না বাঁচাই ভালো।

অদ্ভুত মানুষ আপনি, মলি ভুরু কোঁচকায়।

পথে তেনজিং পযে্ট দেখে একটা বড়ো গুম্ফার সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের গাড়ি। ওরা নামে।

গুম্ফাটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। সুন্দর জায়গাটা। গুম্ফার পাঁচিল থেকে অনেক দূর পর্য়ন্ত দেখা যায়। জয়িতা আরেকবার বলে ফেলল, ফ্যানটাস্টিক।

এর পরেই অবশ্য হতাশ হতে হল ওদের। মূল প্রার্থনা ঘরটা বন্ধ। বোধিসত্ত্বের মূর্তিটা দেখা যাবে না। দশটার আগে দরজা খোলে না। এখন সবে সাতটা বাজে।

পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে সুমনরা কয়েকটা ছবি তুলল। মি. দাসকে বলল, ওদের দুজনের ছবি তুলে দিতে।

প্রার্থনা-মন্দিরটার পাশেই একটা ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে কয়েকটা বাচ্চা লাল আলখাল্লা পরে ঘুরছে। একজন একটা ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুরের সঙ্গে খেলা করছে।

জয়িতা জিজ্ঞেস করল, ওরা কারা?

দে আর লিটল্ লামা বুদ্ধিস্ট মংকস্।

সুমন হেসে বলল, ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন নাকি? অবশ্য, আমাদের ভাষা ওরা বোধহয় বুঝবে না।

সো কিউট্ দে আর। ভুরু কোঁচকায় জয়িতা, এত ছোটো বয়সে সন্ন্যাসী হয়?

দেখছেনই তো হয়েছে। এটা কিন্তু ঠিক নয় বলুন?

কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় জয়িতা। তার ভুরু দুটো আবার কুঁচকে গেছে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে একটা বাচ্চার দিকে। এই বাচ্চাটাই একটু আগে কুকুরের সঙ্গে খেলছিল।

কী দেখছেন এত মন দিয়ে সুমনের গলায় কৌতূহল।

দেখুন না, ওর হাতে একটা পোকা বসে আছে, কামড়াচ্ছে মনে হয়। ও কিন্তু ওটা ফেলে দিচ্ছে না। চুপ করে দেখছে পোকাটাকে। অদ্ভুত না!

সুমনও ব্যপারটা দেখল। ততক্ষণে আর একটা বাচ্চা, এ একটু বড়ো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটার। পোকাটাকে খুব সাবধানে, যেন সযত্নে তুলে সে পাশেই একটা উঁচু জায়গায় রেখে দিল।

ওঃ… এরা তো বৌদ্ধ, তাই বোধহয় সুমন বলল।

এখানে কী করছ? মি. দাস এসে দাঁড়িয়েছেন।

সুমন পুরো ঘটনাটা শুনিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনার মিসেস কিন্তু বেশ ইনকুইজিটিভ। ছোটো ছোটো ব্যপারও ওঁনার চোখ এড়ায় না।

মেযোনুষ যে, ঘাড় ঝাঁকালেন মি. দাস। চলো এবার কিছু দেখার নেই এখানে।

বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বোধহয় কথা বলার ইচ্ছে ছিল জয়িতার। কিন্তু আর কিছু না বলে ফেরার পথ ধরল।

হোটেলে ফিরে সুমন ও মলি রেস্ট নিচ্ছে। টিভি চালিয়েছে। হঠাৎ করেই মলি বলল, মি. দাস লোকটা যেন কেমন, তাই না?

হ্যাঁ, একটু অদ্ভুত বটে।

অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভাবো। কোনও রিঅ্যাক্ট করলেন না!

সে তো সানরাইজটাই উনি ভালো করে দেখলেন না। অথচ লোকে ওটা দেখতেই… আমি সিগারেট খাওয়ালাম দুতিনবার কিন্তু উনি একবারও আমাকে অফার করলেন না। ভাবো!

আমরা এতক্ষণ একসঙ্গে ঘুরলাম, উনি নিজে থেকে একটা কথাও বলেননি। এটা খেয়াল করেছ? আমারাই শুধু যেচে আলাপ করেছি।

হ্যাঁ, ভদ্রলোক সামাজিকতার ধার ধারেন না। কাঠ কাঠ আচরণ।

হ্যাঁ, কেমন যেন রোবট রোবট।

হয়তো সত্যিই উনি একটা রোবট! হাসতে হাসতে বলে সুমন।

শোনো না স্বামীর পাশে ঘন হয়ে আসে মলি। আমারও কিন্তু তা-ই মনে হচ্ছে।

কী মনে হচ্ছে?

হাসি নয়। সেদিন খবরের কাগজে পড়লাম না রোবোট কোম্পানিগুলো এখন অবিকল মানুষের মতো দেখতে যান্ত্রিক এসকর্ট তৈরি করছে। কোনও সঙ্গীহীন লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে। যাচ্ছেও অনেকে। এই লোকটা নিশ্চয়ই সেরকম কিছু।

তোমার মাথায় আসেও বটে! রোবট কি সিগারেট খায়?

সিগারেট ধরাচ্ছিল কিন্তু ইন করছিল না আমি লক্ষ্য করেছি।

বাঃ, বেশ খুঁটিয়ে দেখেছ দেখি ওকে। মনে ধরেছে বুঝি?

ঠাট্টা কোরো না, ভদ্রমহিলার আই মিন জয়িতাদির দেখেছ মাথায় সিঁদুর নেই। স্বামী মারা গেছেন হয়তো।

আর তাই একটা রোবট ভাড়া করে দার্জিলিং ভ্রমণে এসেছেন, তুমি গল্প লেখা শুরু করে দাও বুঝলে। ভালো কল্পনাশক্তি আছে।

তুমি তো আমার কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছ! হতে পারে না বুঝি এরকম?

পারে, পারে সব হতে পারে মলিকে কাছে টানে সুমন। তার রাগ রাগ মুখে একটা চকাস করে চুমু খেয়ে বলে,নতুন বউ চাইলে এই হোটেলটাও তাজমহল হতে পারে, আর আমি হতে পারি সম্রাট শাজাহান… ঠোঁটটা দাও না।

আঃ, আমার মুড নেই এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মলি। জয়িতাদির কথা ভেবে খারাপ লাগছে।

কেন? একটু ক্ষুণ্ণ সুরেই বলে সুমন, ভালোই তো আছেন মহিলা। সারাক্ষণ হাসছেন।

ওটা জোর করা হাসি। তোমরা ছেলেরা বুঝবে না। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মলি। বলে এত প্রাণবন্ত মহিলা, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু সঙ্গীহীন রোবট কি আর মানুষের একাকিত্ব ঘোচাতে পারে। তার ওপর ওরকম গম্ভীর একটা রোবট!

যাঃ, তুমি সত্যিই ভাবছ নাকি উনি একটা রোবট!

রোবট যদি না হয়, তাহলে তো লোকটাকে আরও-ই সহ্য করা যাবে না। রবিঠাকুরের কবিতাও লোকটা জীবনে পড়েনি। ভাবা যায়!

 

রাত দশটা। খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় এসে শুয়েছেন মি. দাস। জয়িতা ঘরে ঢুকল। একটা গোলাপি রঙের হাত কাটা নাইটি পরেছে। স্বচ্ছ পোশাকটার ভেতরে তার পরিপূর্ণ শরীর কুয়াশা ঢাকা চাঁদের মতো সুন্দর লাগছে।

মি. দাসের পাশে এসে জয়িতা বসল। মি. দাসের গায়ে হাত রেখে বলল, চলো ঘুমোই।

আর একটু পরে, মি. দাস বললেন।

জয়িতা একটু ঝুঁকে মি. দাসের ঠোঁটে একটা আলতো করে চুমু খেল। তারপর তার একটা হাত ধরে নিজের বুকের ওপর রাখল।

হাত ছাড়ো জয়িতা, আমার ভাল্লাগছে না।

জয়িতা হাতটা ছেড়ে দিল। মনোযোগ দিয়ে একটা একটা করে মি. দাসের জামার বোতাম খুলতে লাগল।

আঃ, কী করছ? এক ঝটকায় জয়িতার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন মি. দাস।

জয়িতা তাকিয়ে আছে। তার ভুরুটা একটু কুঁচকেছে। যেন কিছু একটা জিনিস তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। একটু চুপ থেকে সে আবার হাত বাড়াল। মি. দাস একটা পাজামা-প্যান্ট পরেছিলেন, সেটা ধরে টেনে নামিয়ে দিল জয়িতা।

ইউ ডার্টি গার্ল, প্যান্ট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালেন মি. দাস। রাগ রাগ মুখে জয়িতার গলার পেছনে একটা বিশেষ অংশে দুই আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিছানার ওপর ঢলে পড়ল জয়িতা। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃসাড় শুয়ে আছে।

যেমন নিঃসাড় আমার এই পা টা, নিজের মনেই বললেন মি. দাস। পাজামার ওপর দিয়ে নিজের কৃত্রিম ডান পা-টার ওপর সস্নেহে ধীরে ধীরে হাত বোলালেন। জয়িতার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। বেচারি। ওর তো কোনও দোষ নেই। রাত হলেই ক্লায়েন্ট কে ও সেক্সুয়াল সার্ভিস দেবে। এভাবেই ওকে প্রোগ্রাম করা আছে।

নিজের মনেই একটু হাসলেন মি. দাস। সানরাইজ দেখে, কুয়াশা দেখে কেমন সুন্দর মুগ্ধ হবার ভান করে মেয়েটি। যেমন তিনি ভান করছেন একটি স্বাভাবিক সুস্থ, মানুষের মতো বাঁচার…

নীচু হয়ে জয়িতার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিলেন মি. দাস। তারপর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব