অটোর সেই লোকটা

বিডন স্ট্রিট পার হয়নি তখনও। ব্যাকসিটে হেলান দিয়ে সবে চোখ দু’টো একটু বুজেছে নীলোৎপল। শেষ কবে অটোয় উঠে এত আরামে বসেছিল মনে পড়ে না। বাঙালি গতরে বাড়ছে নাকি কলকাতার অটোগুলো বহরে ছোটো হচ্ছে ইদানীং কে জানে। দু’টোর পর তিনটে লোক যেই উঠল অমনি শুরু হল চাপাচাপি। অগত্যা সেই আগুপিছু করে বসা।

আজ প্রথমটায় একটু অবাকই লেগেছিল তাই। এই অটোটার পিছনের সিটে বসতে গিয়ে। আগে থাকতেই বসেছিল দু’টো লোক। তাকে উঠতে দেখে খুব একটা যে নড়েচড়ে বসল মনে হল না। কিন্তু সিটে পিঠ রেখেই টের পেল নীলোৎপল– বেঁকেচুরে বসার দরকার নেই কোনও। দিব্যি আরামে কাঁধ ছড়িয়ে বসা যাবে।

লোকগুলোর দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল সে। সিড়িঙ্গে টাইপের চেহারা। গায়ে বেরঙা টি-শার্ট। একেবারে কর্নারের লোকটা কপালে হাত দিয়ে মাথা নামিয়ে বসেছিল। মুখখানা ভালো করে দেখতে পায়নি সে। যাকগে। কপাল করে অটোটা পেয়েছে। শোভাবাজার থেকে উলটোডাঙা কম রাস্তা নয়। আয়েশ করে যাওয়া যাবে। একসঙ্গে দু’ দু’টো এমনি রোগা রোগা লোক চট করে পাওয়া যায় না আজকাল। আর একজন এসে পড়লেই হয় এবারে। মোবাইল বের করে ফোন করে দিল সায়ন্তনকে, ‘শোভাবাজারে। এই অটোয় উঠলাম। আর-একজন হলেই ছাড়বে…’

‘শালা এতক্ষণে মোটে শোভাবাজার! সোনাগাছিতে ঢুকেছিলি নাকি?’

‘ক্যালানে। টাইম লাগে না নাকি বাসে আসতে। গ্লোবারের সামনেটায় দাঁড়া। সবাই এসে গেছিস?’

‘জয়ন্ত আর নির্মাল্যটা কোথায় কে জানে। বাকিরা এসে গেছি। তুই কুইক আয়…’

এরমধ্যেই গগলস্ চোখে সাতাশ আঠাশের একটা ছেলে ব্যাগ হাতে এসে বসে পড়ল ড্রাইভারের পাশের সিটে।

‘গৌরীবাড়ি…’

‘বসুন।’

অটো ছেড়ে দিল।

ফেব্রুয়ারির ফুরফুরে হাওয়ায় চোখ যেন লেগে আসছিল নীলোৎপলের। একেবারে ভর দুপুরে বেরিয়েছে। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে একঘুম হয়ে যেত। বিডন স্ট্রিট আসতে আসতে আপনা থেকেই বুজে এসেছিল চোখ দু’টো। আর ঠিক তখনই জিন্সের বাঁ পকেটে বেজে উঠল মোবাইলখানা। বিরক্তিতে এবার মুখচোখ রীতিমতো কুঁচকে উঠল তার। হারামজাদাগুলোর কি তর সইছে না একটুও! সেই গ্রে স্ট্রিট থেকে সমানে জ্বালিয়ে যাচ্ছে পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর। বিডন স্ট্রিট থেকে উলটোডাঙা অবধি কি সে উড়ে যাবে এখন। একবার ভাবল দরকার নেই ধরার। বেজে যায় যাক। কিন্তু ফোন আসতেই থাকবে সমানে। যতক্ষণ না ধরছে জ্বালিয়ে মারবে। বাধ্য হয়েই কলটা রিসিভ করতে হল। জয়ন্ত ফোন করছে। তারমানে সেও বোধহয় পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।

ওপাশ থেকে সম্মিলিত গলায় ভেসে আসছে চার-পাঁচটা করে অক্ষর। আর কোনও কথা নেই। মনের সুখে গালি দিচ্ছে শালারা। নেহাত কাকার বয়সি লোকজন রয়েছে অটোয়। নইলে বাছা বাছা কয়েকখানা এখনই শুনিয়ে দেওয়া যেত বাছাধনদেরও। বিরক্ত গলায় শুধু বলে নীলোৎপল, ‘এই তো খান্নায় এখন। উড়ে যাব নাকি? অত তাড়া থাকলে চলে যা। বাপের বিয়ে লাগেনি আমার…’

কথা শেষ করে সুইচড অফ করে দিল নীলোৎপল। নে শালারা, এবারে যত পারিস ট্রাই করে যা। পৌঁছোনোর পর অবশ্য খিস্তি খেতে হবে কনফার্ম। তবে সেও ছেড়ে কথা বলবে না। অনেক তো দেখা আছে। এমন নয় যে পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে সেই প্রথম জব নামাল ক্যাম্পাসিংয়ে। জয়ন্ত, দেবরূপ, সায়ন্তন– সক্বলে আরও আগেই সব মোটা মোটা প্যাকেজের জব নামিয়ে বসে আছে। ট্রিট তো কে কেমন দিয়েছে দেখাই গেছে। সে তো তাও রাজি হয়েছে হাসিমুখে। নাকি তার চাকরিটা পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা ভাবছে সবাই! অন্যরা ক্যালকাটা বেল্টের এক একখানা নামি কলেজ থেকে বি টেক করছে। ভাল চাকরি তো পাবেই। আর সে যেহেতু জেলার একটা এলেবেলে কলেজ থেকে পড়ছে, কোনও গতি হতো না হয়তো। নেহাত ফাইনাল ইয়ারে অনেক হাঙ্গাম হুজ্জোত করে কলেজকে ক্যাম্পাসিং করাতে বাধ্য করে চাকরি জুটিয়েছে, তাই ট্রিট দেওয়াটা তার নৈতিক দায়!

কথাবার্তায় তো বোঝা যায়। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে চাকরি পেয়েছিল অনুরাগ। ক্যাম্পাসিংয়ের আগের রাতে তাই তাকেই ফোন করেছিল নীলোৎপল, ‘কী টাইপের কোশ্চেন আসতে পারে বল তো। আমার তো কোনও এক্সপিরিয়েন্স নেই এসবের…’

‘তোদের টিচাররা কিছু বলছে না?’

‘ফার্স্ট টাইম ক্যাম্পাসিং হচ্ছে ভাই কলেজ হিস্ট্রিতে…’

‘আই সি। তা নামটা কি বললি যেন কোম্পানির?’

‘জিটিবি সল্যুশনস।’

‘কীসের কোম্পানি এটা? কথার সুরেই মনে হচ্ছিল নীলোৎপলের ফোনের ওপারে ভুরু কুঁচকোচ্ছে অনুরাগ।’

‘সফ্টওয়্যার।’

দায়টা তার নিজের। তাছাড়া সেই প্রথম ক্যাম্পাসিংয়ের পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে সে। অত গায়ে মাখাতে গেলে চলবে না তখন।

‘জন্মে নাম শুনিনি’, ফোনের ওপাশে বোধহয় ঠোঁট উলটাল অনুরাগ, মনে হল নীলোৎপলের। একটা গুঞ্জন ভেসে আসছিল অনেকক্ষণ থেকেই। দোকান বাজারে কোথাও রয়েছে নিশ্চয় অনুরাগ। তখনই নির্মাল্যর গলাও শুনতে পেল সে, ‘আর-একটা সোডা হবে দাদা এই টেবিলে..’

আরও কে কে আছে ওখানে সে কথা ভাবার সময় তখন নয়। তবুও মনে হয়েছিল এমন অসময়ে ক্যাম্পাসিংয়ের কোশ্চেন টাইপ নিয়ে ফোন এলে হয়তো বিরক্ত হতো সেও।

কিন্তু আশ্চর্য। বিরক্ত হয়েছে বলে মনেই হচ্ছিল না অনুরাগের গলা শুনে। অল্প কথায় কাজ মিটিয়ে ফেলার মতো কথাও বলছিল না সে। বরং নীলোৎপলের সঙ্গে যেন অনেক কথাই বলতে চাইছিল সে। হস্টেলের রুমের ভেতর থেকে টাওয়ার পাওয়া যায় না সবসময়। কথা বলতে বলতে আচমকা কেটে যায় ফোন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা লাগছিল নীলোৎপলের। শার্টের ওপরে স্রেফ একখানা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। কতক্ষণই বা কথা হবে– মনে হয়েছিল তখন, আবার উইন্ডচিটার পরবে! ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোপালপুরে কলেজ। সামনে দিয়ে স্টেট হাইওয়ে গেলেও সন্ধের পর মাইলের পর মাইল স্রেফ শুনশান। টাউন থেকে দূরত্ব প্রায় মাইল ছয়েক। বয়েজ হস্টেল ততোধিক নিশুতির রাজ্যে। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আরও এক কিলোমিটার উত্তরে। চায়ের দোকানটা বন্ধ হয়ে যায় সন্ধে নামার আগেই। জানুয়ারির মাঝামাঝি কেমন ঠান্ডা পড়তে পারে এমন তেপান্তরের দেশে, কলকাতায় বসে কল্পনাও করতে পারবে না কেউ। ক্যাম্পাসিংয়ের আগের সন্ধেটায় হুইস্কি নিয়ে বসারও প্রশ্ন নেই অনুরাগদের মতো। চাদরটা গায়ে বেশ করে জড়িয়ে নিচ্ছিল নীলোৎপল।

তখনই শুনতে পেল কলকাতার দিক থেকে অণুতরঙ্গে ভেসে আসা অনুরাগের কথাগুলো, ‘পুনে সাইডের কোম্পানি বললি না? রেপুটেড কিছু নয়। আসলে কি জানিস, তেমন অ্যাক্লেমড কোনও কোম্পানি হলে টাইপটা বলা যেত। কে কেমন টাইপ ফলো করে না করে। আসলে তোরা ঝামেলা করেছিস। ইমিডিয়েটলি কাউকে নিয়ে আসতে হবে। যা হয় আর কি। হুট করে তো রেপুটেড কারুর সঙ্গে কিছু ফিক্স করে ফেলা যায় না। তখন এই টাইপের ছোটোখাটো কাউকে ধরে আনে। যাদের কেমন কোশ্চেন প্যাটার্ন হবে কেউ বলতে পারে না।’

রাগারাগির কিছু নেই। একেবারে সত্যি কথাই বলছিল অনুরাগ। বরং এই অবস্থায় এতটা সময় হয়তো নীলোৎপল নিজেও দিত না কাউকে। গুঞ্জনের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে কলকাতায়। আর সেই তেপান্তরের অন্ধকার রাজ্যে একটুখানি আলেয়ার মতো জ্বলে থাকা বয়েজ হস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ততক্ষণে বেশ ভালোই শিরশিরানি টের পাচ্ছে সে।

অনুরাগ বলে যাচ্ছিল, ‘একটা কাজ করতে পারিস। ওদের সাইটে ঢুকে দেখ তেমন কিছু পাস কিনা। সাইটে ঢুকলে ভুলভাল কিনা বুঝতেও পারবি। এরকম ধরে আনে তো অনেক এই টাইপের কলেজগুলো। এইরকম ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে। তোর কথা শুনে মনেও হচ্ছে তেমন যুতের কেউ নয় যারা আসছে। নইলে ভেবে দেখ না ক্যালকাটা থেকেই কেউ যেতে চায় না বীরভূমে ক্যাম্পাসিং করতে, আর পুনে থেকে এককথায় চলে আসছে…’

‘বীরভূম নয় এটা বর্ধমান ডিস্ট্রিক্ট,’ অনেকক্ষণ পরে একটা কথা বলেছিল নীলোৎপল।

তোরা শহিদ ধরে ফিরিস বলেছিলি না। শহিদ তো বীরভূম সাইডেই যায়…

বর্ধমান পেরিয়ে তবে তো বীরভূমে ঢোকে। অজয়ের ওপারে বীরভূম। তবে আমাদের কলেজ বীরভূম লাগোয়াই একরকম। গুসকরাতে নেমে…

‘আচ্ছা। আর সাইটে ঢুকে প্যাকেজটাও দেখে নিবি। আর-একটা কথা, বন্ডের ব্যাপারে কনশাস থাকবি। এসব আননোন কোম্পানির বন্ড তো! অরিজিনাল টেস্টিমোনিয়ালস জমা নিয়ে নেয় জয়েনিংয়ের সময় অনেকে। তারপর বন্ড পিরিয়ড যতদিন না শেষ হচ্ছে ওদের তাঁবে থাকে। আর পুনেতে মাসে কুড়ি হাজারে স্রেফ জলমুড়ি খেয়ে থাকতে হবে…’

‘ঠিক আছে। থ্যাংক্স ফর অ্যাডভাইস।’

আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয়নি। ঠান্ডা তো লাগছিলই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে একটা গরমও টের পেতে শুরু করেছিল। সেই হপ্তাখানেক আগে যেদিন বিকেলে কলেজের গেটে তালা মেরে ডিরেক্টর, রেজিস্ট্রার, ডিনদের মতো হোমরাচোমরাদের আটকেছিল গোটা ফোর্থ ইয়ার মিলে, সেদিনের মতো গরম।

হস্টেলের রুমে ঢুকে বেশ কয়েক মিনিট বসে খালি ভেবেছিল মদ খেয়ে একটুও কিন্তু নেশাড়ুর মতো কথা বলেনি অনুরাগ। কত সহজ স্বাভাবিক গলায় উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিল।

জিটিবির সাইটে অবশ্য ঢোকেনি আর সেই রাতে। চার বছরের সিলেবাসে তো কম সাবজেক্ট নেই। সাইট ঘেঁটে স্যালারি প্যাকেজের হিসেবনিকেশ করে ক্যাম্পাসিংয়ের আগের সন্ধেটা নষ্ট করার কোনও যুক্তি ছিল না। যা থাকে কপালে ভেবে যা যা দরকারি মনে হয়েছিল সবেতেই চোখ বোলাতে বোলাতেই বেজে গিয়েছিল রাত সাড়ে তিনটে।

ঠিক দু’ দিন বাদে সেই অনুরাগই যখন শুনল স্টার্টিংয়ে অ্যারাউন্ড ফর্টি প্লাস ও অ্যাকোমোডেশনের কথা, বলেছিল, ‘একদিন ট্রিট দিতে হবে কিন্তু বস। ম্যূলা রুঁজ। আর স্কচ। কোনও কথা শুনছি না। একেবারে ছক্বা মেরে দিয়েছিস। আমাদেরই শালা এই ছাতাপড়া ক্যালকাটায় ঘষতে হবে বসে বসে…’

এক বছরের পারফরম্যান্স দেখবে জিটিবি। ভালো করতে পারলে নেদারল্যান্ডস, ইটালি বা ব্রিটেনে পাঠিয়ে দিতেও পারে তারপর।

নীলোৎপল ভাবছিল দু’দিনের ভেতরেই দর কোথা থেকে কোথায় চলে যায় একলাফে। সত্যি সেই রাতে যা খেটেছিল সেমিস্টারের আগের রাতেও অত খাটেনি চার বছরে কোনও দিন। অবশ্য খাটতে হয়ও না সেমিস্টারে। ওই তো কলেজ। আর তার ওই তো সব ফ্যাকাল্টি। সিলেবাস শেষ করাতে কালঘাম বেরিয়ে যায় তেনাদের। চোতা সঙ্গে না থাকলে বোর্ডে একটা সার্কিট ঠিক করে অাঁকতে পারে না এমন লোকও আছে। তা স্যার ম্যাডামরা ক্লাসে চোতা নিয়ে আসবে আর তারা মাইক্রো জেরক্স নিয়ে হলে ঢুকলেই যত দোষ! অবশ্য ওইটুকু চক্ষুলজ্জা ফ্যাকাল্টিদেরও আছে। দু’একজন ঝামেলা করে না এমন নয়। প্রথম দেড়ঘন্টায় নিজে লিখতে হবে। পিছন ঘোরা যাবে না। তবে মোটের উপর নির্বিঘ্নেই কেটে যায় সেমের দিনগুলো।

একটু হেসে বলেছিল নীলোৎপল, ‘ঠিক আছে। আগে ফিরি। কলেজের এদেরও খাওয়াতে হবে। ফেব্রুয়ারি আঠের’র আগে নো চান্স।’

‘আচ্ছা’, অনুযোগের গলায় বলেছিল অনুরাগ, ‘এখন আমরা স্কুলের বন্ধুরা সব পুরোনো হয়ে গেলাম।’

‘তোরা তো পুরোনো বন্ধুই।’

ঠান্ডাটা অনেকটাই কমে এসেছিল মাঝের দু’দিনে। আর সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টাও যদি কথা বলতে চাইত অনুরাগ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে কোনওই আপত্তি ছিল না নীলোৎপলের।

সেই পুরোনো বন্ধুদের জন্যই ছুটির দিনের ভাতঘুমটা মাথায় তুলে আজ বেরোতে হয়েছে। আবার দশ মিনিট দেরি হচ্ছে বলে খিস্তিও খেতে হবে! কোথাকার লাটের বাঁট রে তোরা। পড়তিস তো কবে একসাথে মিত্র ইন্সটিটিউশনে। সেই খাতিরে গলাখানা ভালো করেই কাটার প্ল্যান করেছিলি সবকটায় মিলে। পার্ক স্ট্রিটের বাইরে তো বেরোতেই চাইছিলি না। অনেক দরাদরি করে উলটোডাঙার গ্লোবার অবধি নামা গেছে। শিয়ালদার টাওয়ারে নিয়ে গিয়ে শালা ট্রিট দেওয়া উচিত ছিল তোদের।

মনে আছে চার বছর আগে যখন ভর্তি হয়েছিল বিআইইএমে, কলেজের নামটা নিয়েও কি হাসাহাসি সক্বলের।

‘আর কলেজ পেলি না? বোর্দুরিয়া ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট! তার চাইতে প্রেসিডেন্সি বা জেভিয়ার্সে অনার্স করতে পারতিস ইংলিশেও…’

‘যাক, পরের উইকে ফিরবি যখন টিনটিনের অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে ভুলিস না কিন্তু।’

‘দেখিস আবার কলেজটার অ্যাফিলিয়েশন আছে তো রিয়েলি? চার বছর বাদে যেন কলেজটাই না ইমাজিনারি হয়ে যায়।’

‘হ্যাঁ রে, এত কিছু থাকতে হঠাৎ বোর্দুরিয়া কেন নামের ডগায়?’

দেবরূপ, সায়ন্তন, জয়ন্তদের চাট খেতে খেতে বলতে হয়েছিল, ‘যতদূর শুনেছি ম্যানেজিং ট্রাস্টির মেয়ে টিনটিনের কমিক্স খুব ভালোবাসে। আর মেয়ে নাকি খুব লাকি লোকটার। মেয়ের জন্মের পরেই বিজনেস ফুুলে-ফেঁপে উঠেছিল ম্যানেজিং ট্রাস্টির। তাই যখন লোকটা এডুকেশন সেক্টরে এল…’

‘বোর্দুরিয়া নাম দিয়ে দিল! রগড় কিন্তু হেভি…’

সেই বোর্দুরিয়া ইন্সটিটিউট চাকরি দিয়েছে বলেই শালারা আজ ফোকটে গলা অবধি মদ খাবি। ভাবতে ভাবতে নীলোৎপলের মনে হয়, ট্রিট যদি অনেস্টলি দিতেই হয় বরং দেওয়া উচিত ছিল বিআইইএমের মেকানিক্সের টিচার তমাল রায়চৌধুরিকে। শুধু তার একার নয় সব স্ট্রিম মিলিয়ে গোটা ফোর্থ ইয়ারের যে-আটান্ন জন চাকরি পেয়েছে তাদের সক্বলের চাঁদা তুলে ট্রিট দেওয়া উচিত ছিল টিআরসি স্যারকে।

নইলে প্লেসমেন্ট সেল তো ওই ঠুঁটো জগন্নাথ। ষোলো তারিখ বিকেলে যখন তালা পড়ল কলেজের গেটে, কোন ফাঁকে যে প্লেসমেন্ট অফিসার পাঁচিল টপকে ভেগেছিল সবার আগে কেউ জানতেও পারেনি ঘুণাক্ষরে। কেমন করে যে সময় থাকতেই খবর পেয়ে গিয়েছিল লোকটা– সেও এক রহস্য। যাহোক, তারপর আর এক সপ্তাহ টিকিটাও দেখা যায়নি প্লেসমেন্ট অফিসারের। এক হপ্তা ধরে নিয়ম করে গোটা ফোর্থ ইযার সকালে এসে তালা মেরে দিয়েছে কলেজের গেটে গেটে। ফ্যাকাল্টিরা সেই তেপান্তরের মাঠে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকেছে। হস্টেল থেকে ব্যানার বানিয়ে এনে ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্টরা মাঝেমধ্যে হল্লা তুলেছে। অন্যান্য ইয়ারের ক্লাসও শিকেয় উঠেছে। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের হেলদোল নেই। ডিরেক্টর স্যার অবশ্য ফোন করে চলেছেন কলকাতার হেড অফিসে। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি উঁচুতলা থেকে। একটা সপ্তাহ কাটার পর স্টুডেন্টদের নিজেদের মধ্যেই জল্পনা– এভাবে আর কতদিন? শেষ অবধি ভবিষ্যৎ কী?

এই সময় আচমকা একদিন খবর পাওয়া গেল প্লেসমেন্ট অফিসারের অবর্তমানে কোম্পানির সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল টিআরসি স্যারকে। তা নিজের ব্যক্তিগত চেনা পরিচিতির লিংক থেকে টিআরসি নাকি যোগাযোগ করেছেন পুনের জিটিবি সল্যুশনসের সঙ্গে। ঊনত্রিশ তারিখ নাকি কলেজে আসছে জিটিবি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের একটা মিশ্র বাতাবরণ তৈরি হল স্টুডেন্টদের ভেতর।

ভর্তির সময় ব্রোশিওরেও লেখা ছিল না সেভেন্টি পারসেন্ট ক্যাম্পাসিং ফেসিলিটি, এসি ক্লাসরুমের গল্প…

হস্টেল মে সেপারেট রুম ভি লিখা হুয়া থা। কাঁহা গয়া ভাই উয়ো সব? এক রুম কে অন্দর ইধার তো চার চার লোগোকো শেয়ার করনা পড়তা হ্যায়।

ইতনা ঘাটিয়া খানা ভি জিন্দেগি মে নেহি মিলি

লেকিন আভি ইসি ওয়াক্ত অ্যায়সা ঝুট ক্যাহেগা ইয়ে লোগ?

সেটাই। এই কন্ডিশনে পাগল না হলে কেউ এরকম গুজব রটাবে না…

পরের দিনই নোটিস পড়ে গেল মেন গেটের সামনে। ঊনত্রিশ তারিখ জিটিবির ক্যাম্পাসিংয়ের খবর দিয়ে। হইহই করে তালা খুলে দিল ফোর্থ ইয়ার। কলেজের নোটিস বোর্ডে এতদিন খালি সেমিস্টারের আগে অ্যাটেডেন্স কমের অজুহাতে ফাইনের নোটিসই বেরিয়েছে। চার বছরে এই প্রথম

ক্যাম্পাসিংয়ের নোটিস ঝুলল সেখানে। স্ট্রাইক তুলে সবাই ছুটল হস্টেলে। ধুলো ঝাড়তে হবে বইপত্রের।

দু’একজন বলাবলি করে সন্ধের পরে, ‘বেশ ছিল কিন্তু ভাই। দিনে স্ট্রাইক আর রাতে মাল। পড়তে পড়তে এখন কেলিয়ে যাচ্ছি।’

আঠাশ তারিখ সকাল থেকে ঝাঁট পড়তে লাগল গোটা কলেজ বিল্ডিংয়ে। লনের ঘাস ছাঁটা হল। গাছের পাতা সরিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলা হল ক্যাম্পাস। চার বছরে কেউ কখনও যা দেখেনি সেটাই ঘটল ঊনত্রিশ তারিখ সকালে। আটটার মধ্যে ডিরেক্টর, রেজিস্ট্রার, ডিনের মতো হোমরাচোমরারা সক্বলে স্যুট, টাই পরে হাজির। কলকাতা থেকে হেড অফিসের লোক চলে এসেছিল আঠাশ তারিখ রাতেই। মেন টাউনে লজ ভাড়া করে ছিল রাতে। তারাও গাড়ি নিয়ে হাজির সাড়ে ন’টার ভেতর। বিল্ডিংয়ের প্রত্যেক ফ্লোরে বারান্দায় বারান্দায় টবে করে ফুলগাছ এনে বসানো হয়েছে। সুগন্ধে ম ম করছে সব ক’টা ফ্লোর়, মায় টয়লেট অবধি। সাড়ে দশটার পর স্যুট বুট পরে হাজির জিটিবির এইচআর পার্সোনেলদের টিম। কলেজের মাথাদের সঙ্গে সঙ্গে টিআরসি স্যারও এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করল জিটিবির লোকজনের সঙ্গে।

‘খুচরো দেবেন দাদা,’ অটোওলার কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফেরে নীলোৎপলের। গৌরীবাড়ি এসে গেছে। সামনের সিটের সেই গগল্স পরা ছেলেটা পার্স থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করেছিল। অটোওলার কথায় নোটটা আবার পার্সে ঢুকিয়ে কয়েন বের করতে থাকে।

তার কাছে আছে তো খুচরো পয়সা? এই এক হয়েছে ঝামেলা। বাসে ট্রামে দোকানে বাজারে যেখানেই যাও, আজকাল খুচরো নিয়ে ঝঞ্ঝাট। তিরিশ টাকার মিষ্টি কিনে একশো টাকার নোট ধরালেও বিনা বাক্যব্যয়ে সত্তর টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছে ময়রা। কিন্তু তিন চার টাকার খুচরো নিয়ে কথা কাটাকাটি বেধে যাচ্ছে। সব খুচরো কয়েন শালা নাকি ব্লেড বানাতে চলে যাচ্ছে। তার কাছে আছে তো খুচরো কিছু? বাসভাড়া দেওয়ার সময় বেরিয়েছে একবার। দেখে নেওয়া ভালো এখনই। বাঁদিকে একটু আড় হয়ে নীলোৎপল ডান পকেট থেকে পার্সটা বের করতে যায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অটোর ব্যাকসিটের আরোহী একেবারে ডান কর্নারের লোকটার মুখের উপর নজর পড়ে যায় তার। কপাল থেকে হাত সরিয়ে সিড়িঙ্গে লোকটা গৌরীবাড়ির গলির দিকে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে।

আরে, এই লোকটাই তো জিটিবির এইচআর টিমের হয়ে বিআইইএমে গিয়েছিল। নীলোৎপলের ফাইনাল রাউন্ড ইন্টারভিউ এই লোকই নিয়েছিল। বেশ মনে আছে। দু’একটা কথা ইংলিশে হওয়ার পর লোকটা সটান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আর ইউ কমফর্টেবল ইন হিন্দি? আই থিঙ্ক সাচ। সো মাচ নন বেঙ্গলিজ ইন ইওর ক্যাম্পাস। মাস্ট ইউ নো হিন্দি।’

একটু অবাক হলেও তখন মনে হয়েছিল ভালোই হল। শালা মনে মনে ট্রান্সলেট করে করে ইংলিশ বলার থেকে তো হিন্দিটা বলতে পারবে তুরন্ত। জন আব্রাহামের এত সিনেমা নইলে কেন বেকার বেকার দেখল এতদিন! তাছাড়া কলেজেও বেশির ভাগ স্টুডেন্ট হয় বিহারি নয়তো ইউপির বলে স্যার ম্যাডামদের দু’একজন বাদে বাকিরা হিন্দিতেই পড়ান। ইংলিশে পড়ান দু’একজন টেঁটিয়া টাইপের স্যার। শালা অত দেমাক যখন বিআইইএমে পড়ে আছিস কেন? সেখানে পুনের কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার কেমন সুন্দর সেধে হিন্দি বলতে চাইছে।

সেই লোকটির সঙ্গে এক অটোতে যাচ্ছে নীলোৎপল! স্বপ্নের মতো মনে হয় তার। বাবা মার কাছে শুনেছে, যে-লোক সত্যিকারের গুণী বাইরে সে অতি সাধারণ হয়। সেদিন ভদ্রলোকের পরনে ছিল ঝকঝকে স্যুট টাই। অফিসিয়াল কাজে ভিজিট। দামি পোশাক তো থাকবেই। অথচ আজ কেমন সাধারণ টি-শার্ট আর একটা স্যান্ডেল পায়ে অটোতে উঠে পড়েছেন। একটা রিস্ট ওয়াচ অবধি নেই কবজিতে। অটো তখন সবে স্টার্ট দিয়েছে আবার গৌরীবাড়ি থেকে। ভদ্রলোককে দেখে নীলোৎপলের মনে হল কোনও মেকি গাম্ভীর্য থাকা সম্ভবই নয় এই লোকের। নইলে সেদিন তাকে ভেবে ভেবে ইংরেজি বলতে দেখে ওইভাবে সরাসরি হিন্দি বলতে সাহস জোগাতেন না। আচ্ছা, আলাপ করলে হয় না ভদ্রলোকের সঙ্গে! নাকি ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হবে! না, তা কেন। একটা কথা জিজ্ঞেস করে তো কথা পাড়াই যায়।

ভদ্রলোক রাস্তার বাঁদিকেই তাকিয়েছিলেন তখনও। একবার গলা খাঁকারি দিয়ে নীলোৎপল বলে ওঠে, ‘এক্সিউজ মি স্যার, আপলোগ ভিজিট কিয়ে থে না হামারে বিআইইএম কলেজ মে। পিছলে মাহিনে…’

ভদ্রলোক বোধহয় অন্যমনস্ক ছিলেন। হঠাৎ করে খেয়াল করতে পারেন না নীলোৎপলের কথা। একটা জিজ্ঞাসু চাহনিতে তাকালেন তার মুখের দিকে।

নীলোৎপল আবার বলে, ‘স্যার মুঝে পহেচানা? বিআইইএম কলেজ মে পড়তে হ্যায়। মুঝকো সিলেক্ট কিয়া স্যার আপনে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কব ভেজেঙ্গে স্যার? জুলাই মে হি?’

ভদ্রলোক হঠাৎ এমন চমকে উঠলেন জীবনে কাউকে এতখানি চমকাতে দেখেনি নীলোৎপল। সে আশ্চর্য হয়ে যায়। ভদ্রলোকের মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আচমকাই।

‘অ্যাই, রোকিয়ে। অটো ইধার হি রোকিয়ে। তুরন্ত রোকিয়ে ভাই…’

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষার আওয়াজ। অটোওলা বিরক্ত হয়েছে স্বভাবতই। বলতে থাকে, ‘আরে ঠিকঠাক বাতাইয়ে কাঁহা ইতরেগা। উধার বোলা উলটোডাঙা…’

নীলোৎপলকে প্রায় টপকে নেমে যান জিটিবির এইচআর ম্যানেজার ভদ্রলোক। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দিয়েই আর তিলমাত্র অপেক্ষা করেন না ফিরতির। অটোওলাও অবাক হয়ে গেছে। মুখে বলে, ‘পাগলা নাকি রে ভাই। ফেরত পয়সাটা নিয়ে যাবি তো নাকি। এরকম লোক রোজ যেন ওঠে কয়েকটা করে…’

কী হয়ে গেল আচমকা বুঝতে পারে না নীলোৎপল। ভদ্রলোক এমন চমকে উঠলেন কেন তাকে দেখে? তবে এরই মধ্যে খেয়াল করেছে সে কোনও পার্স ছিল না ভদ্রলোকের সস্তার ট্রাউজার্সের পকেটে। পকেট থেকেই নোটটা বের করে দিয়েই প্রায় দৌড়ে উলটোমুখে যেন পালিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

অটো আবার চলতে শুরু করে। বোকা বনে যাওয়ার মতো মুখ করে বসে থাকে সে। এই মুহুর্তে অটোয় আরোহী মাত্র দু’জন। রোগাভোগা চেহারার অন্য লোকটা একবার তাকায় তার মুখের দিকে। তার চোখেও জিজ্ঞাসু চাহনি।

অরবিন্দ সরণির মাথায় উঠে যানজটশূন্য পথ। তিরের গতিতে ছুটতে থাকে অটো। সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ বোকা বোকা ভাবটা কেটে যায় নীলোৎপলের। বিচারবুদ্ধি কাজ করতে থাকে আবার। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক কথাই পরিষ্কার হতে থাকে ক্রমশ। পুনের কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার ক্যাম্পাসিং শেষ হয়ে যাওয়ার হপ্তাখানেক পরেও কেন কলকাতায় বসে আছে। যদি ছুটিতেও লোকটা থেকে যায় বাড়িতে তবে কেন প্রাইভেট গাড়ি নিদেনপক্ষে ট্যাক্সিতেও চাপেনি এই দরের একজন মানুষ। আর যদি স্রেফ তর্কের খাতিরেই অটোতেও চাপল তবে কেন গৌরীবাড়িতেই নেমে গেল সে। উলটোডাঙায় যাবে বলে উঠেছিল যেখানে অটোয়। তাকে দেখে ভূত দেখার মতো লোকটার চমকে ওঠার কারণটুকুও বুঝতে আর বাকি থাকে না।

উলটোডাঙার স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে অটো। ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে আসে নীলোৎপল।

সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় অনুরাগের কথাগুলো– ‘হুট করে তো রেপুটেড কারুর সঙ্গে কিছু ফিক্স করে ফেলা যায় না।’

অনুরাগরা নিশ্চয় এতক্ষণে অনেকবার ফোনে ট্রাই করে ফেলেছে তাকে। দঙ্গল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গ্লোবারের সামনেটায়। দেখতে পেলেই চরম খিস্তিতে ভূত করে দেবে বলে।

কিন্তু অনুরাগদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো মুখ আর নেই তার। যদি অটোর সেই লোকটা ঊনত্রিশে জানুয়ারি না যেত তাদের কলেজে, তাহলেও বরং আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত ওদের সামনে।

অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার মাঝখানটায় এসে দাঁড়ায় নীলোৎপল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শোভাবাজারের দিক থেকে দৈত্যের গতিতে তার শরীরের দিকে এগিয়ে আসা একটা বাসের দিকে।

কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট

গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।

এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।

অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।

বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।

গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।

গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।

পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।

তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।

এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।

গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।

নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।

মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।

হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।

তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।

গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।

এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।

আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।

গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।

গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।

পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।

—বর্ধনদা কেমন আছেন?

গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।

—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।

গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।

মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!

গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।

—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?

—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।

গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।

—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!

এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।

—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।

সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।

গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।

গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?

সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!

—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।

গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।

—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।

—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।

সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।

—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।

—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?

—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।

গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।

ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।

সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।

গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।

দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।

গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।

লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।

রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।

পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।

আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –

মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।

মিতা একটা দামি ব্র‌্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।

শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।

সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।

গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!

ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।

গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।

কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!

তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।

 

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে

সকালবেলা পাঁচকড়িবাবু রেগে একদম অগ্নিশর্মা। তার ছেলে বিটকেলকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছেন তিনি। আশেপাশের বাড়ির একগাদা কুঁচোকাঁচার সাথে দু-একজন মাঝবয়সি মানুষও সেখানে উপস্থিত। মাঝেমাঝেই হাসির রোল উঠছে। আর পাঁচকড়িবাবুর রাগ এবং বিরক্তির পরিমাণও চড়ছে। ছেলেকে তিনি খালি বলছেন, হাঁ কর, হাঁ কর হতভাগা।

বছর ছয়েকের অত্যন্ত বিদঘুটে মার্কা ছেলে বিটকেল হাঁ করছে। পাঁচকড়িবাবু মগে করে ওর মুখে খানিকটা জল ঢালছেন, আর বলছেন, হ্যাঁ, বন্ধ কর মুখ। এবার গেল! কিরে গেল? গেছে এবার? এবারও যায়নি? প্রচণ্ড বিরক্ত হন তিনি, বলেন, হতচ্ছাড়া ছেলে, এক মগ জল গিলে ফেললি আর একটা ক্যাপসুল গলা দিয়ে নামল না? নে, হাঁ কর আবার, হাঁ কর। আবারও জল ঢালেন তিনি।

পাঁচকড়িবাবু কেলেপানা রোগা পাতলা মানুষ। পড়াশোনা কোনওমতে গ্র্যাজুয়েশন অবধি করেছিলেন বাঁকুড়ায়, তারপর কলকাতা চলে আসেন ভাগ্যান্বেষণে। চেনাজানা বলতে পাড়ার নন্টেদা, বাগবাজারে তার কাছেই এসে উঠলেন। হাজার হোক নিজের গ্রামের ছেলে! নন্টেদা থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন নিজের মেসেই। দুটো টিউশনও জুটিয়ে দিলেন একে ওকে ধরে। কিন্তু বহু চেষ্টা চরিত্র করেও তেমন কিছু হল না। শেষে এক পাবলিশারের কাছে কাজ জুটল, প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে, বাইন্ডিং, ছাপাখানার তদারকি, বইপত্র পার্টির বাড়ি পৌঁছে দেওয়া সবই করতে হয় তাঁকে।

এসব করতে করতে মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে। শেষে একটু বেশি বয়সে বাড়ির লোকের পীড়াপীড়িতে বিয়ে ঘটনাচক্রে স্ত্রীর বয়স খুবই কম। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার‌্যা। পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী-অন্ত প্রাণ। বিয়ের আগে তাঁর একটু বদনাম ছিল খিটকেল মেজাজের মানুষ বলে। সামান্য ঘটনাতেই যখন তখন রেগে যেতেন তিনি। এর তার ওপর চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতেন। সেই পাঁচকড়িবাবু বিয়ের পর বদলে গেলেন পুরোপুরি! মুখে তার অমায়িক হাসি মোটে বাসি হয় না। বিয়ের বছর খানেক আগে এসে এ বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি।

ভাড়া বাড়ি, প্রায় পনেরো-ষোলো ঘর ভাড়াটে। বর্গাকারে সাজানো ভাড়ার ঘরগুলি। মাঝখানে বিরাট ফাঁকা স্পেস, সেখানে দু-দুটো পাতকুয়ো, দুটো টিউবওয়ে, তাছাড়া আছে কর্পোরেশনের জলের লাইন। যে-বাড়িতে পাঁচকড়িবাবু ভাড়া থাকেন, তাতে একটাই ঘর, সামনে সামান্য বারান্দা, এক পাশে রান্নাঘর। বছর সাত-আট হল এ বাড়িতে আছেন তিনি।

বিয়ের পর পর পাঁচকড়িবাবুর মেজাজের হঠাৎ পরিবর্তন হলেও তা বেশি দিন টেকেনি। ছেলে হবার পর পরই আবার তা পালটে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে স্ত্রীর সঙ্গে মধুর ব্যবহার থাকলেও বাইরের লোকেদের সাথে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া বাঁধত তাঁর। অনেকে পিছনে তাঁকে খিটকেলে পাঁচকড়ি নামেও ডাকত।

যাইহোক, পাঁচকড়িবাবুর ছেলে বিটকেল প্রচণ্ড রোগা, যাকে বলে, একদম প্যাঁকাটির মতন। কিন্তু তার দৌরাত্ম্যে লোকে সর্বদাই তটস্থ। আশেপাশের ভাড়াটেদের ছেলে-মেয়েদের মেরেধরে গণ্ডগোল বাধায় প্রতিদিন। স্কুল থেকে নালিশ আসে। বছরে তিন-চারবার বই কিনে দিতে হয়, কারণ সে হয় বই হারাচ্ছে, না হয় ছিঁড়ে ফেলছে। ঘরে যতক্ষণ থাকে এটা ভাঙছে, ওটা ভাঙছে, কখনও হাত ভাঙছে, কখনও মাথা ফাটাচ্ছে দুদিন ছাড়া ছাড়া। ছেলেকে নিয়ে একদম নাজেহাল পাঁচকড়িবাবু।

ছেলে এত রোগা বলে ক’দিন ধরেই পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী গুঁতুনি দিচ্ছিলেন, চলো না একটু ডাক্তারের কাছে, চলো না। অগত্যা পাঁচকড়িবাবু উপয়ান্তর না দেখে ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে যান ডাক্তার সরখেলের কাছে। ওষুধটষুধ খেয়ে যদি চেহারাটা একটু সারে।

ডাক্তার সরখেল সব শুনে এবং বিটকেলকে ভালো করে চেকআপ করার পর বললেন, দেখুন পাঁচকড়িবাবু, ছেলে আপনার সুস্থ বলেই মনে হচ্ছে। চেকআপ করে খারাপ কিছু তো দেখলাম না।

—না, না, ডাক্তারবাবু, একদম খেতে চায় না ও। জোর করে, মেরেধরে কোনওমতে দুটো গেলানো হয়। যাতে নিজের থেকে খায় এমন কোনও ওষুধ দিন আপনি! চেহারাটা কিছুতেই সারছে না ওর, বলেন পাঁচকড়িবাবুর স্ত্রী।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, চেহারা যাতে হয় এমন কিছু দিন, গোঁ ধরেন পাঁচকড়িবাবুও।

বাধ্য হয়ে ডাক্তার সরখেল কিছু মাল্টি ভিটামিন ক্যাপসুল লিখে দেন ছেলেটির জন্য। তারপর বলেন, রোজ সকালবেলা ব্রেকফাস্টের পর নিয়মিত একটা করে ক্যাপসুল পনেরো দিন খাওয়াবেন। তারপর ছেলে কেমন থাকে এসে জানাবেন আমায়।

অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে পাঁচকড়িবাবু স্পেশালিস্ট ডাক্তারের হাতে কড়কড়ে একশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে প্রেসক্রিপশন বুক পকেটে ফেলে, ছেলের হাত ধরে গটমট করে বেরিয়ে আসেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে। পিছন পিছন তাঁর স্ত্রী। সোজা এক ওষুধের দোকানে ঢুকে পনেরো দিনের জন্য পনেরোটা ক্যাপসুল কিনে তারপর বাড়ি। যেন এক বিরাট সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ঘরে ঢুকেই বললেন, কি গো গিন্নি, এক কাপ চা পাওয়া যাবে তো?

—দাঁড়াও না, এই তো এলে, আগে হাত মুখ ধোও, গিন্নির মেজাজও ভালোই মনে হল। কিন্তু সমস্যা শুরু হল ঠিক তার পরের দিন থেকে। পাঁচকড়িবাবুর ছেলে বিটকেল কিছুতেই ক্যাপসুল গিলতে পারে না। হাঁ করে মুখে ক্যাপসুল নেয় ঠিকই, পাঁচকড়িবাবু জল ঢালেন ওর মুখে, মাথা পিছনে হেলিয়ে চিবুক উঁচু করে ঢোঁক গেলে সে। জল পেটে চলে যায়, কিন্তু মুখের ক্যাপসুল মুখেই থেকে যায়!

চার-পাঁচ দিন ধরে একই ঘটনা ঘটছে। সকালবেলা বারান্দায় বসে এ কদিন ক্যাপসুল গেলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন তিনি। গরমের ছুটি চলছে। সব ঘরেই বাচ্চারা এখন রয়েছে। বিটকেলের ক্যাপসুল খাওয়ার ঘটনায় মজা হয় জেনে সবাই জড়ো হচ্ছে কদিন এইসময়। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি তার।

পাশের বাড়ির ভটচায্যিবাবু দাঁত মাজতে মাজতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট ধরে চলছে ক্যাপসুল গেলানো পর্ব। ব্যাপার-স্যাপার দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। বললেন সক্কাল সক্কাল ভালো কেলো শুরু করলে হে পাঁচকড়ি।

—আর বলবেন না দাদা, হতচ্ছাড়া জ্বালিয়ে মারল। একটা ক্যাপসুল গিলতে পারে না অথচ ইয়া বড়ো বড়ো রসগোল্লা টপাটপ গিলে ফেলে।

—এক কাজ করো না পাঁচকড়ি। ব্যাটাচ্ছেলেকে ক্যাপসুলটা জলে গুলে খাইয়ে দাও না, প্রস্তাব দেন ভটচায্যিবাবু।

সে চেষ্টা আর করিনি ভাবছেন! এই তো গত পরশু সে রকমই করলাম। তা সেটা গিলেই ছেলের চিল চিত্কার, তেতো, তেতো, মরে গেলাম, বাবা-রে, মা-রে করে বাড়ি মাথায় তুলল একদম। শেষমেশ গোটা বারো রসগোল্লা খাইয়ে নিস্তার পেলাম। বলুন তো দাদা, দু টাকার ক্যাপসুলের জন্য যদি রোজ ষাট টাকার রসগোল্লা খাওয়াতে হয় তো আমি যাই কোথায়?

—ঠিক, ঠিক, সমস্যাই বটে, হাসতে হাসতে বলেন ভটচায্যিবাবু। তারপর হঠাৎ বিটকেলের পিঠে একটা থাপ্পড় মারেন তিনি, বলেন, কী রে ছেলে, একটা ক্যাপসুল গিলতে পারিস না?

—কী করব, যাচ্ছে না তো, ব্যাজার মুখে বলে বিটকেল।

—যাচ্ছে না তো, রাগের চোটে ভেঙিয়ে ওঠেন পাঁচকড়িবাবু, যাবে কী করে? বলি যাওয়ালে তো যাবে।

হো হো করে হেসে ওঠে আশেপাশের সকলে, হাসেন ভটচায্যিবাবুও।

এমন বাঁদর ছেলে মশাই, কী বলব আপনাকে। আবার বলতে থাকেন তিনি, কাল রাতে একেই তো সারারাত কারেন্ট ছিল না, হতচ্ছাড়া এমন হাত-পা ছোড়ে ঘুমাবার সময় যে বলার কথা নয়। এক গাদা মশা ঢুকিয়েছে কাল মশারিতে। বাইরে সেজের আলোয় তেমন দেখা যায় না। কোনও মতে হাঁটু মুড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মশা মারছি আমি। হতচ্ছাড়া ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বলে কিনা, বাবা, কী হয়েছে তোমার? এত রাতে তাই তাই দিচ্ছ কেন?

আবার হাসির রোল ওঠে, ভটচায্যিবাবু জানতে চান, তারপর?

—তারপর আর কী? হতভাগাকে দিলাম এক উড়নচাঁটি। বিটকেলকে বলেন, হাঁ কর হতচ্ছাড়া, হাঁ কর আবার। ওর মুখে জল ঢালেন যথারীতি, বলেন, নে গেল। গিলে উদ্ধার কর আমায়।

বিটকেল চোখ বন্ধ করে, এবার মাথা নীচু করে চেষ্টা করে গেলার। টুক করে ক্যাপসুল চালান হয়ে যায় পেটে। সে বলে, বাবা, নেই।

—নেই? মানে গিলে ফেলেছিস? বিস্মিত পাঁচকড়িবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন। তারপর কনফার্ম হতে বলেন, হাঁ কর দেখি। বিটকেল হাঁ করে, বিশ্বরূপ দর্শন করেন পাঁচকড়িবাবু, তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন, ওঃ বাঁচা গেল, এতক্ষণে গিললি?

সকলে হইহই করে উঠল, গিলেছে, গিলেছে। দল বেঁধে দৌড়ে চলে গেল বিটকেল আর সঙ্গীসাথিরা।

ভটচায্যিবাবু বলেন, তোমার ছেলের নামটা খুব ভেবেচিন্তেই রেখেছিলে কিন্তু।

—ওর নাম তো তিনকড়ি। কে যে ওর নাম দিল বিটকেল কে জানে! হঠাৎ শুনি সবাই বিটকেল, বিটকেল বলে ডাকছে।

—যে-ই দিক নামটা একদম সঠিক দিয়েছে কিন্তু, হাসতে হাসতে বলেন ভটচায্যিমশাই।

—আমারও মাঝে মাঝে তাই মনে হয় দাদা, বলেন পাঁচকড়িবাবু। ব্যাটাচ্ছেলেকে স্কুলে নিয়ে গেছিলাম, ভেবেছিলাম ক্লাস টুতে ভর্তি করাব। হেডমাস্টারমশাই বললেন, তোমার বাবার নাম লেখো, একটা চক এগিয়ে দিলেন ওর হাতে।

মনে মনে ভাবলাম, যাক হেডস্যার ভালো প্রশ্নই দিয়েছেন, কারণ ওকে বহুবার শেখানো হয়েছে বাবার নাম। নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি। ও বাবা, ছেলে আমার লিখে বসল, আমার বাবার নাম পাঁচকড়ি হালদার দাঁড়ি!

আমি অবাক, হেডমাস্টারমশাইও অবাক। দুজনে দুজনার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। হেডস্যার বললেন, কী ব্যাপার খোকা, মুখে একটু আগে বললে বাবার নাম পাঁচকড়ি হালদার, লিখলে পাঁচকড়ি হালদার দাঁড়ি?

ছেলে নির্বিকার ভাবে বলল, কোনও কিছু লিখলে শেষে দাঁড়ি দিতে হয়।

—কিন্তু সে তো লম্বা দাগ টেনে, এই রকম, বলে চক নিয়ে মাস্টারমশাই নিজে বোর্ডে লিখে দেখালেন।

ছেলে বলল, ওরকম দিলেও হয় এরকম দিলেও হয়। এমন বেঁড়ে ওস্তাদকে কে নেবে স্কুলে। হেডমাস্টারমশাই রেগে গিয়ে বললেন, আপনার ছেলের কোথাও গণ্ডগোল আছে মশাই। ওকে নিয়ে যান, আমার স্কুলে অমন ছেলে ভর্তি নিই না।

শেষে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে হাতে-পায়ে ধরে হতভাগাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করি।

হাঃ হাঃ হাঃ, করে হাসিতে ফেটে পড়েন ভটচায্যিমশাই।

ঠিক সে সময় পাঁচকড়িবাবুর চোখ যায় ভাড়াটে বাড়ির প্রধান ফটকের দিকে।

যে-ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, সে পাঁচকড়িবাবুর এক ভাই জগন্নাথ। সে এ বাড়িতে আগে কখনও আসেনি। পাঁচকড়িবাবু মুহূর্তে বুঝে যান জগন্নাথ কী জিজ্ঞাসা করছে। তিনি গলা চড়িয়ে বলেন, জগা, এদিকে, এদিকে।

দ্রুত এগিয়ে আসে জগন্নাথ তার দাদার দিকে, তার মুখ চোখ থমথমে। সশঙ্কচিত্তে পাঁচকড়িবাবু ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে বলেন, কী ব্যাপার জগা, কী হয়েছে রে?

—দাদা, বাবা আর নেই গো দাদা। বলেই কেঁদে দুহাতে মুখ ঢাকে জগন্নাথ।

ঘটনার আকস্মিকতায় খানিক হতবাক হয়ে যান পাঁচকড়িবাবু, পাশে দাঁড়ানো ভটচায্যিবাবুও কোনও কথা বলতে পারেন না। বহুদিন বাড়িছাড়া, তাই ওদিকের টান কম ছিল পাঁচকড়িবাবুর। বিয়ের পর শেষ বাড়ি গেছেন দু’বছর আগে। তখনও বাবা চুয়াত্তর বছর বয়সে গ্রাম্য জলহাওয়ায় বেশ ফুরফুরে ছিলেন। মনে হয়নি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন! বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে ওঠে পাঁচকড়িবাবুর, চোখের কোল ভিজে ওঠে অজান্তে।

কিছু সময়ে মধ্যেই তিনি স্ত্রী-পুত্রসহ জগন্নাথের সঙ্গে রওনা হন দেশের বাড়ি। প্রাথমিক কান্নাকাটি সারা হলে শুরু হল শবদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার তোড়জোড। একে একে সব ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনেরা জড়ো হলে কাঁধে ওঠে শবদেহ। ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল, বলো হরি।

শ্মশানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা। গ্রাম দেশ, নদী পারে শ্মশান। মাথায় পূর্ণিমার  জ্যোত্স্নায় ম ম করছে চারপাশ। প্রয়োজনীয় মন্ত্রতন্ত্র পাঠের পর পাঁচকড়িবাবুর পিতৃদেবকে তোলা হল চিতায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। উপস্থিত মেয়েরা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কেউ কেউ। অপেক্ষাকৃত বড়োরা শোকাহত, বিমূঢ়!

হঠাৎ পাঁচকড়িবাবুর ছেলে চিত্কার করে নাচ জুড়ে দিল, আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের…

আবছা অন্ধকারে পাঁচকড়িবাবুর মুখের অভিব্যক্তিটা বোঝা গেল না।

মনসাসুন্দরী

ওই যে ধন্যিমেয়ে বইতে উত্তমকুমার দাঁত মুখ খিঁচোয়ে ওর অমন সুন্দর ভাইডারে বলতিছিল গো, এই বগলা গোল দে, এই বগলা গোল দে, ত্যাকোন থে মুঁই বগলার প্রেমে। আহা, কচি কলাপাতার মোতন ডগমগে রূপ ঝ্যামোন, আর নামডাও তেমনি ডাংগুলির গুলি ঝ্যানো। বনবন করি হাওয়ায় ঘুরতি ঘুরতি বুকের ভেতর সেঁইধে যায়।

বেশি লোকজন নেই। কাজের সুবিধেই হয়েছে। স্টেশনের দুচারজন দোকানদার কলকাতার বাবুদের দেখে পায়ে পায়ে এসেছে। তা আসুক। এটুকু ঝক্কি সামলেই ওরা কাজ করে।

তা যা বলেন বাবুরা, ত্যাকোন থে মোর মাথাটা লড়বড়ে হুয়েছে। ওই যে গেরামের মাঠে তাঁবু খাটায়ে বই পড়ল। মুঁই ধন্যিমেয়ে দ্যাকলাম। ব্যাশ, মোর প্রেম পালো। মনে মনে ঠিক করি নিলাম, না আর মুঁই মাঠে গোবর কুড়ব নে। মোর একখান বগলা চাই-ই চাই। আর সারা দিনমান ঘরে, বাইরে, পুকুরঘাটে— ঝিদিক পানে যাই না ক্যান, সিকেনেই গানখানা গুনগুন করি। জয়া ভাদুড়ি গেয়েছিল গো। বইয়ে তার নাম মনসা ছেল। আর মোর নামও মনসা। হি হি হি!

তা দিদি, ওই গানটি একটিবার শোনাও আমাদের! মদন, ভাই দোকানদারকে বল না, টিনের গেলাসে দু-কাপ চা আর কয়েকটা ভালো বিস্কুট কাগজে মুড়ে দিতে।

সামনে থেকে টিনের গেলাস তুলে নিয়ে মদন নামে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মের স্টলে চা আনতে গেলে বেশ উৎসাহ লাগিয়ে মনসা বলে ওঠে, চা খাওয়ার আগে গাতি হবে, না কি পরে গাবানে?

দিদি, তোমার মন চাইলে এখনই গাইতে পারো।

মনসা মাথাটা চুলকে নেয়। উকুনগুলো সড়সড় করে চলে ফিরে কিছু বলছে। ও কান পেতে ওদের কথা ধরার চেষ্টা করে। এক কানে হাত চাপা দিয়ে অন্য কানের দিকে চোখ আর মন যত্ন করে লাগায়।

তার একমাথা চুল কাকের বাসার মতো নয় ঠিক, তবে বেশ এলোমেলো। মাঝে মাঝে চুলকোয়। তবে উকুন মারে না সে। উকুনরা যে তার আশ্রয়ে আছে। গুটি কয়েক প্রাণকে সে তার এই বিরাট মাথার ভেতর আশ্রয় দিয়েছে, তা কী এমন বেশি! তাছাড়া সন্ধের পর এই নির্জন প্ল্যাটফর্মে কার সাথে কথা কয়ে সময় কাটাবে! ওরা না থাকলি অমন থেবড়ে বসা রাতখানা কাটায় কী করে সে! ঘুম তো আসতি চায় না। ওদের সাথেই তো সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে ভোরের ট্রেনের খবর নেয় কানে। প্যাসেঞ্জারের পায়ে শব্দে মনে আরাম হয়।

সুধাময়, প্রাণেশ, টিঙ্কু-রা নানা কোণ থেকে ছবি তুলছে, তবে গোপনে। স্টেশন চত্বরের চার-পাঁচজনের ভিড়টা লক্ষ করেনি যে ছবি উঠছে খেপির। তারা দেখছে একজন নীল জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা সুন্দর মতো লোক মাটিতে পা মুড়ে বসে খেপির সাথে কথা বলতে লেগেছে।

কদবেলের দোকানদার উবু হয়ে বসে সবটা বুঝতে চাইছিল। সে বলল, গা তো খেপি ওই গানটা। কদবেল মাখা দেব দুপুরবেলায়। গা।

প্যাসেঞ্জাররা তাড়াহুড়োয় দেখে না সবটা। কদবেলওলা বেল ফাটিয়ে চিনি, লংকা, নুন, ধনেপাতা আর কাসুন্দি দিয়ে মেখে তুলে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে। কিন্তু গেলাসের নীচে খানিকটা যে ফেলে রাখে দোকানদার তা নজরে পড়ে না খদ্দেরদের। আর পরেরটা বানানোর আগে দোকানদার চামচ দিয়ে টেনে তুলে তা একটা বাটির ভেতর রেখে দেয়। দুপুর পর্যন্ত যা জমে তা খেপিকে এক ফাঁকে দিয়ে আসে।

মনসা উকুনদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুঙ্গি পরা, বুক খোলা পেট উঁচু ওই কদবেল দেওয়া লোকটার দিকে। তার চোখের তারায় মেঘ ঢোকে। ছায়া লাগে মুখে, বুকের ভেতর জয়া ভাদুড়ির সেই আদুরে আর অভিমানী মুখের ঢল নামে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, গলা খুসখুস করে। কথা হয়, কিন্তু কেউ শোনে না। শুধু মনসা ঠোঁট নাড়ে জয়া ভাদুড়ির মতো। উকুনেরা দিব্যি শুনতে পায় তা যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

ভিডিও রেকর্ডিং করছিল যে মোবাইলগুলো, তারা একটু একটু এগিয়ে আসে। প্ল্যাটফর্মের একটা গোটা দিক, রেল লাইন, সিগন্যাল, স্টেশনের নাম লেখা কংক্রিটের বোর্ড, একটা খেঁকুরে কুকুরের হেঁটে যাওয়া কিছুই বাদ যায় না। তারা মোবাইল ফোনের লেন্স মনসার দিকে যতটা পারে জুম করে। সামনে বসে গল্প করতে থাকা ওদের এডি শুভঙ্করের ছবিও একই ফ্রেমের ভেতর রাখতে হবে যে।

মনে হয় এবার গান শুরু হবে। গান আর মুখের প্রথম অভিব্যক্তি ধরা চাই। তারপর কলকাতায় ফিরে, এডিটিং করে, মনসা পুজোয় মনসার গান ক্যাপশন দিয়ে ইউ টিউব-এ ছাড়বে কাল। কাল যে শ্রাবণ মাসের শেষ, মনসা পুজো।

টিউবে ওদের চ্যানেলের নাম দ্য নেচার। কৃত্রিমতাহীন সবকিছুই ওদের সাবজেক্ট। বাজারে খাসি কাটার দৃশ্য, তার ব্যা ডাক, আর অল্প পা-দাপানো যেমন থাকে, তেমনি ঘুঘু পাখি, পায়রা বা ফড়িং-এর সোহাগদৃশ্য হাঁ করে দেখছে তিন-চার বছরের বাচ্চারা, তাও দেখায়।

ওরা চায় প্রাকৃতিক কিন্তু অড সাবজেক্ট। এই আগস্ট মাসের শুরুতেই একটা ভিডিযো গোটা ইউ টিউবে হইচই ফেলেছে। সেটা ছিল, হাত-পা হীন এক কিশোরীর সমারসেট ভল্ট। সে গ্রামের দিকে হাটে বাজারে খেলা দেখায়। সুন্দরী মেয়েটি একেবারে পেঙগুইনের মতো কোমরের নীচে একটুকু ছড়ানো থাই দিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই সে মাটি থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে আবার দাঁড়ায়। এরপর সে মাদারি খেলার মতো দুটো বাঁশের আগায় বাঁধা দড়িতে উঠে যায়। তার তো হাত নেই। সে ব্যালান্সের লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে দড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাবার ডুগডুগির বাজনা কানে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফেরে। ফিরে আসে দড়ির মাঝখানে। সেখান থেকে সে মুখের সরু বাঁশটি ফেলে দেয়। ডুগডুগিতে দ্রিমি দ্রিমি দ্রুতলয়ে বাজে। সে ওখান থেকে ঝাঁপ মারে মাটিতে। শূন্যে দুটো-তিনটে ভল্ট দিয়ে সে অনায়াসে মাটিতে দাঁড়ায় থপ করে। তার ঘন করে লাল করা ঠোঁট খুলে যায়, এক ঝলক সাদা দাঁত হাসির বিদ্যুৎ ছড়ায়।

মনসাদি গাও।

এটা কলকাতার বাবু, সামনে যে বসে আছে, তার গলা। যে এসেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। তার কথা মান্যি করবে না তো মদনার কথা শোনবে! তারপর বাবু একেবার মনসার সঙ্গে মাটিতে বসেছে। কেমন লেপটে বসেছে। হি হি হি স্টেশনের ধুলো-ময়লার কোনও জ্ঞান-গম্যি নাই বাবুর। তারে কেমন নিজের নিজের লাগে মনসার। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেলল, গাইব! কোনটা গাতি হবে বল ত?

মদন চায়ের গেলাস আর পাউরুটির ঠোঙায় জড়ানো বিস্কুট নিয়ে সিনের ভেতর এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে। এখানে তো কাট, ক্লাপস্টিক-এর ব্যাপার নেই। মনসা চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই একটা মোবাইলে ধরা পড়ে তার মুখে কী সরল হাসির ঝিলিক খেলে গেল। মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মুখ বার করার মতো। তারপর সে কাগজে মোড়া হাতের বিস্কুট থেকে একটা লম্বা বিস্কুট নিয়ে চায়ের গেলাসে ডুবিয়ে কামড় দিল।

আহ! কি দারুণ দাঁত! একেবারে সুচিত্রা সেন না!

প্রাণেশ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল টিঙ্কু। এই যে গান হবে হবে করে হচ্ছে না, তাতে ওর বিরক্তি লেগে গেছে। আর অফিসের বস ইচ্ছে করে ওকে পাঠিয়েছে এত দূরে। শয়তানি আর কী! না হলে কলকাতার মেয়েকে এতটা দূরে সমুদ্রগড়ে পাঠানো কেন!

প্রাণেশ টিঙ্কুর দিকে ফিরে বলল, যা বলেছিস। একে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখে কাজল আর চুলের কলি কানের উপর টেনে বের করে একখানা সাদা কালো হাসির সাইড ভিউ তুলে নিলে দর্শকরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবে। কে কত উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখেছে, আর তাঁদের সিনেমা দেখে প্রেম করতে শিখেছে কেমন ভাবে দিব্য ঘোরের ভেতর ঢুকে যাবে। সাবস্ক্রাইব করে ফেলবে এক দিনেই কয়েক হাজার।

খেপি, তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ কর। গানটা গা।

ওই লুঙ্গি পরা লোকটা আবার এন্ট্রি নেয়। কী করবে, খানিকটা মস্করাটস্করা করে সময় কাটাতে চায় কদবেল, আমড়া, কল-ওঠা ছোলার দোকানদার। ট্রেনের ঘন্টা হয়নি। ট্রেন না এলে তার খদ্দের নেই। পরের আপ ট্রেন ঢুকতে এখনও ঘন্টাখানেক।

চায়ের ভেতর বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে মনসা ডুব দিয়েছে ভাবনায়। এই যে সামনে উবু হয়ে বসে আছে বুক খোলা দোকানদার, সে যে কদবেল আর ছোলা খাইয়ে কতবার তাকে খেয়েছে সন্ধাবেলায় নদীর চরে নিয়ে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেহুলা নদীর পাশে সরু কাশ বনের ভেতর অনেকখানি জায়গা বেশ পরিষ্কার। কাশ আর হোগলা শুকিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা বিছানার মতো করে রাখা। সেসব খুব মনে পড়ছে এখন মাথা নীচু করে থাকা মনসার। এই কদবেলের কারবারি ছাড়াও লাইনের ওপারে ভাতের হোটেলের থালাবাসন ধোওয়ার লোকটাও তাকে নিয়ে গেছে কয়েকবার সেখানে। বদলে সে প্রায় সন্ধেতে দুটো আলাদা আলাদা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখা সারাদিনের হোটেলের খদ্দেরদের ফেলে দেওয়া ভাত তরকারি এনে দেয়। মনসা আরাম করে খায়।

তার এখন মনে এল, এই লোকটার বাচ্চা তো সে পেটে ধরেছিল। সেটা ছেলেই হবে। আর ওই হোটেলের লোকটার মেয়ে তারা সব কোথায় গেল! ওরা সব কোথায় গেল! হারিয়ে গেল! মনে পড়ল তার, চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

হেমন্তের গান। বগলার সাথে ভাব হবার পর বগলা রেডিও কিনে দিয়েছিল। লাল টুকটুকে রেডিও। সেখান থেকে শুনে শুনে কত গান যে শিখেছে সে।

মনসা জানে এই যে সে বিড়বিড় করে কথা কইছে, গান গাইছে, উকুনেরা সেসব শুনছে কান পেতে। তখন ওরা চুপ করে থাকে। মাথায় নড়াচড়া করে না। মনসার মাথা চুলকোতে হয় না। এই কথা বলা বা গান গাওয়ার তালে মনসা ওদের জব্দ করে রাখে। ওরা ভালো ছেলেমেয়ের মতো মনোযোগী হয়। মনসার গান, গল্পে মজে যায়।

মনসা চুপি চুপি মুখে মৃদু হাসি টেনে এখন মাথা নিচু করে ওদেরই শোনাচ্ছে সব। উকুনদের শোনাচ্ছে মনসার পুরোনো জীবন। অনেকগুলো বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ ওদের তিনজনকেই নবদ্বীপ স্টেশনে ভিক্ষা করতে রেখে এসেছিল এই কদবেল ব্যাপারী-ই। তখন বয়স অনেক কম, শরীরে যৌবন থইথই করছে।

শ্রীচৈতন্য ভক্তরা স্টেশনে নেমে গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখত একখানা রাধা যেন বসে আছে। দিতও হাত খুলে। মেলা মানুষ, মেলা পয়সা। কিন্তু ভিড় যে-ভালো লাগে না মনসার। একদিন ট্রেনে চেপে নিজে নিজে ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়। বাচ্চা দুটোর কথা ভুলেই মেরে দেয়। তা সে দুটো গেল কোথায়! এতদিনে তো ডাগর হওয়ার কথা!

মদনাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছে সকলে। ওর কোনওদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। কোন সময় কী করা উচিত, তা নিজে নিজে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। একদম কলের পুতুল। তা না-হয়ে ওর উপায় কী! অভ্যাস অভ্যাস! ও যে-মাছের দোকানে কাজ করত আগে, সেখানে তো ছিল ভিড় আর ভিড়। সকালবেলায় দম ফেলার ফুরসত নেই। মাছ মাপার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ছাড়াতে হতো। তারপর দোকানদার মাছ কাটতেই ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকা। সেই মাছের ডাক্তার রুইমাছের মাথার ভেতর সন্না ঢুকিয়ে একটা গোলমতো সাদা কড়াইয়ের দানা টেনে বের করে নিজের বাঁ হাতের তালুতে লাগিয়ে নিয়ে চলে যেত। তখন মদনের কাজ মাছের মাথার কানকো ফেলে দেওয়া। তারপর সাদা পলিথিনের প্যাকেটে মাছ ভরা আর গুছিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া। এই রুটিনের বাইরে তার তো ভাবার কোনও অধিকার নেই। দুপুরের দিকে দোকান গুটোনোর কাজ, মাঝেমধ্যে খইনি বানানো সেসব এক্সট্রা। অন্যমনস্ক হলেই চোদ্দো-গুষ্ঠির আকাশ থেকে নেমে আসার মতো গালাগালির বৃষ্টি। একদিন তো সেই মাছের ব্যাপারী লাথি মেরেই বসল ভরা বাজারে, অত লোকের সামনে। সেই দিনই মদন কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে প্ল্যাটফর্মে সে জুতো পরিষ্কার করে। তাতে কম টাকা হলে হোক, কারও কথা তো শুনতে হয় না।

মদনও দেখল মনসাদি চায়ের গেলাসে বিস্কুট ডুবিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আর গেলাসের ভেতর দেখছে। সে বুঝতে পারল বিস্কুট ভিজে গিয়ে হাত ছুটে গেলাসের নীচে পড়ে গিয়েছে। সে এক দৌড়ে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে একটা চামচ এনে দিতেই মনসাদির হাসি মুখ থেকে সারা গালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন চাঁদ ঝাঁপিয়ে পড়ে কোজাগরীতে। সে চামচ দিয়ে গোলা বিস্কুট তুলে তুলে খেতে লাগল।

কী চার্মিং না! কী সরল না! প্রাণেশ একেবারে বিগলিত। সে টিঙ্কুর চোখে চোখ রাখে।

জানিস, আমার ছোটোবেলায় এরকম হতো। দুধের ভেতর ঢুকে যেত বিস্কুট। আঙুল দিয়ে তুলতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগত। তখন বাধ্য হয়ে সব দুধটা চোঁ চোঁ মেরে দিতাম ওই বিস্কুট খাবার লোভে। অনেককাল পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল মায়ের কারসাজি। মা বিস্কুট চুবিয়ে খেতে বলত। কারণ আমি একদম দুধ পছন্দ করতাম না।

ঢং ঢং করে বড়ো একখানা ঝোলানো রেলের পাতের গায়ে ছোটো লোহা পেটানোর শব্দ হল। জুতোকালি করা ছেলে মদন, শুভঙ্করের কাছে উবু হয়ে বসেছিল। সে বলল, আপ ট্রেনের খবর হল। তবে আসতে আসতে এখনও মিনিট চল্লিশ। এই ফাঁকে গানটা না হলে আবার লোকজন যে-জমে যাবে দা! মনসাদির গানের মুড আনতে তখন আবার সময় লাগবে। তখন সে ভিক্ষে করবে। বলবে দাও, দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।

শুভঙ্কর যে কথাটা ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতায় জানে, জোরাজুরি করে এদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি বের করা যায় না। এদের মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারলে, তবে নদী কি ঝরনার দেখা মেলে।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল গো?

মনসা মুখ তুলে বাবুটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে। তা আমি কতি পারব নাকি! আমার কি তা মনে আছে!

তোমার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে না? শুভঙ্কর ইচ্ছে করে বরের কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী জানি সেখানে কোনও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিরাগ থাকতে পারে। এরকম পথের ভিখিরি মেয়েরা একশোটার মধ্যে প্রায় একশোটাই স্বামী খ্যাদানো হয়।

মনসা শুভঙ্করের মুখের উপর তার আয়ত চোখ ফেলে রেখে মাথা নাড়ল। না মনে পড়ে না।

মুখে খানিকটা মেঘ উড়ে এসে বসেছে। মনসা চেষ্টা করছে মায়ের কথা মনে করতে। চেষ্টা করছে বাবার মুখটা কেমন ছিল স্মৃতির ভেতর দেখে উঠতে। কিন্তু শীতের দিনের ভোরবেলায় যেমন ধু ধু মাঠ থাকে, গাছপালা, বাড়িঘর কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না, সেরকমই ওই সাদা জলছাপের ভেতর থেকে দুখানি মানুষের চেহারা বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মনসার চোখের উপর ভাসছে কালো কালো দুটি ছবি, ছটফট করছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

শুভঙ্করের চোখে পড়েছে মনসার মুখের উপর থেকে ঝকমকে ভাবখানা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে মনসাকে এই আটকে পড়া অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। মনসাদি, তোমার যে-একটা ছাগলাছানা ছিল, বলো, তার কী হল!

একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছুঁয়ে দিয়েছে শুভঙ্কর। এই ছুটে বেড়ানোর কাজ করেও সে কবিতা লেখাটা ফেলে দিতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই লেখে। আর সে তা লেখে মানুষের নরম মনের কাছে পৌঁছোতে। বছরে পাঁচ-ছটা লিখলেও সই। সে জোরাজুরি করে কবিতা লেখে না। কবিতা তার কাছে ধরা দিলে সে লেখে।

মনসা ছটফট করে উঠল। সে তার গায়ে কাপড় টেনেটুনে নিয়ে বাবুটির আরও একটু কাছে ঘষটে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, মোর তো ছাগলছানা ছেল না। মোর ছেল এক সাদা ধবধবে বাছুর। ওরে নে মুঁই মাঠে যাতাম ঘাস খাওয়াতি। আমাগে ছেল ধুধু করা মাঠ, আর তার ভেতর দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া নদী। আমাগে ধানের খেত ছেল, পাটের খেত ছেল। আর পুকুরভর্তি হাঁস। ঝুপঝুপ করে ওদের সাথে সাঁতার কাটতাম। সারাদিন মাঠেঘাটে চই চই। লাল লাল চুকোই ফল তুলতাম কোঁচড়ে। তারপর নুন মাখিয়ে পা ছড়িয়ে খাতাম। ওরা সব কোথায় গেল? হারিয়ে গেল। চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

আহা কী মিঠে সুর! ফিসফিস করল প্রাণেশ। টিঙ্কুর চোখটা যেন একটু ভিজে। কিন্তু দারুণ, দারুণ। পুরোটা তুলেছে। দুজনে দুরকম অ্যাঙ্গেলে। ওরা জানে, সুধাময়ও তুলছে অন্যদিক থেকে। বড়ো মুভি ক্যামেরায়। লোকজনের ভেতর থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে ওর ফোকাস। ছেলেটা ছমাসের সিনে কোর্স করেছিল। স্পেশাল পেপার নিয়েছিল ক্যামেরা। ওর অনেক সাধ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে। কিন্তু শিকে ছিঁড়তে পারেনি।

শুভঙ্কর উল্লসিত। মনসা মন মেলছে। শুভঙ্কর যে-মনে মনে নিজেকে মনের ডাক্তার ভাবে। সে মানুষের মনের উপর যে-কালো মেঘ এসে জমে, তাকে ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চায়। তাইতো এরকম অ্যাসাইনমেন্ট পেলে সে লুফে নেয়।

কী ওলট পালট গাইছিস রে খেপি! তোর গান গা। ওই যে চোখ গেল, বয়ে গেল! সেই গান।

আরে মশাই, সেই তখন থেকে আপনি ওস্তাদি করছেন। কে আপনাকে বলতে বলেছে! এখানে বসলে, চুপ করে বসুন। সমস্ত মাটি করে দিলেন! আপনার গান আমরা রেকর্ড করতে আসিনি কলকাতা থেকে। মনসাদেবীর গান শুনতে আর রেকর্ড করতে এসেছি।

কদবেলওলা বমকে গেছে ওই তাড়া খেয়ে সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, তার ঠিক পাশেই এক বাবু মোবাইল ক্যামেরায় ফটো তুলে যাচ্ছে। সে খানিকটা শঙ্কিত হয়। সত্যিই তো। তার কথা বলা উচিত হয়নি। সামনের বাবুটি খুব রেগে গেছে।

শুভঙ্করের রাগ শুধু রেকর্ডিং-এর সমস্যার জন্য নয়। এই যে মনসা নিজে নিজে চেষ্টা করছিল তার মনের কালো অংশ সরিয়ে যেটুকু ভালো, তা সামনে আনতে, সেটাতে হোঁচট খেল তো! পারবে সে, আবার পারবে! শুভঙ্করকে দোলাচল ঘেরে।

মনসা শুভঙ্করকে আশ্বস্ত করে। সে তার মনের দরজা বন্ধ করেনি। বলে, তালে, ওই গানখান গাই বাবু! ওই গানখান গালি আমার যে খুব প্রাণের আরাম হয়। আমার বগলা সামনে আসি দাঁড়ায়। আমার গানখান শুনে সে ঝরঝর করি কাঁদে, আর বলে, তোরে নিয়া পালায় যাবানে রে মনসা। আর একানে থাকবনি। পালায় গিয়া বিয়া করবানে।

বলতে বলতে মনসা গান ধরে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

খুব নরম হয়ে গেছে শুভঙ্করের মন। ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে। সে জানে যত বেশি সম্ভব রেকর্ডিং হবে, তত ভালো। ৫০ মিনিট তুললে তবে কেটে ছেঁটে সাচ্চা ৩০ মিনিট বানাতে পারবে। ইউ টিউব চ্যানেল ৩০ মিনিটের জন্য ভিডিযো দিলে এবং সাবক্রিপশন ৪০ হাজার ছাড়ালে ভালো টাকা দেয়।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তা তোমার বগলার সাথে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে?

মনসা একটু লজ্জা পেয়েছে যেন এমন একটা ভাব করে শাড়ির আঁচল মাথায় নিয়ে আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাঁ পালায় গেলাম তো। বগলা একদিন ভোর রাতে মোর হাত ধরে পলান দিল। তারপর কত টেরেন চাপল, বাস চাপল, ঝালমুড়ি খাওয়াল। কত গেরাম ছাড়ায়ে কোন দেশের দিকে যাতি লাগল যে, জানি না। এক চড়ক মেলায় বগলার সাথে আলাপ হয়ে ছেল, আবার পালাতি পালাতি অমন এক মেলার মাঠে গিয়ে বগলারে হারায় ফেললাম। আর পালাম না বগলারে।

শুভঙ্কর বুঝে ফেলেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর খপ্পরে পড়েছিল মনসাদি। তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেকথা এখানে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু এই যে মনসা অনেকটা নিজের কথা বলতে পারল, অতীত বলতে পারল, তা অনেক। শুভঙ্কর জানে এই মনসার মুক্তি গানে। কিন্তু গান করার সুযোগ কোথায় পাবে সে! আর শুভঙ্করেরও এমন কিছু ক্যাচ নেই যে মনসার জন্য কিছু করতে পারে। দ্য নেচারের এপিসোডটুকু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সে সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টর কলকাতার বাইরে যেতে চায় না বলে শুভঙ্কর বাইরে এসে এই স্বাধীনতাটুকু এনজয় করে। নিজের মতো করে বিষয়টা সাজায়, শুট করে। মোবাইলে ভিডিও তোলে। আর তার নিজের সোশাল সাইটে একটা প্রিলিউড-এর মতো করে পোস্ট দেয়। তাতেই আনন্দ।

ফিরে যাবার আগে টিঙ্কু বলল, শুভঙ্করদা, মনসাদির লুকের ভেতর একটা সুচিত্রা সুচিত্রা ভাব আছে না! তুমি আমার মোবাইলে দ্যাখো। এই যে ওর দাঁত মেলে হাসি। শাড়ি পরিয়ে সুধাময়দার ক্যামেরায় একটা দুটো লুক শুট করলে হয় না!

স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সামান্য তিনশ টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে আনা হল। মনসাদি যথেষ্ট ফরসা। তোলা কাপড় পেয়ে সেও ডগমগ। আর এবার সুধাময়ের এক্তিয়ার। সে নানা পোজে ছবি তুলল মনসার। সুধাময় তার শেখার সবটা দিয়ে প্রায় নিখুঁত সুচিত্রা লুক দাঁড় করিয়ে দিল।

দুই

এই দাদা, তুই কনে রে! তখন থেকে কল করতিছি, কিছুতেই লাগতিছে না।

মুঁই গাড়ি চালাইতেছি রে, একটু বাদে তোরে ফোন দি?

পাঁচ মিনিট হয়নি আবার সে ফোন করে। সে যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। তাছাড়া দিদিভাই, মানে যে-বাড়িতে সে কাজ করে, সে গেছে গড়িয়াহাটে। দাদাবাবু অফিসে যাবার পর ফোন করে কয়েকটা জিনিস আনতে বলেছে। তার টুর আছে কালই। চম্পা ফাঁকা বাড়িতে বসে মোবাইল দেখছে আর ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। এক একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেকক্ষণ। সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মা যদি চিনতে পারে তো আর দাসীগিরি করতে হয় না। মা তো এখন খুবই জনপ্রিয় মানুষ। টাইম লাইন ভরে যাচ্ছে মায়ের ফটোতে। শেয়ার হয়েছে কত কত। মায়ের চেহারার কী খোলতাই হয়েছে। খুব গর্ব হচ্ছে চম্পার। একেবারে সিরিয়ালের দিদিমণিদের মতো দেখতে লাগছে।

ডাবলু হালতু বাজারে সওয়ারিকে নামিয়ে ভাড়া নিতে না নিতেই আবার ফোন। সে পোস্ট অফিসের দিকে রিকশা সাইড করে ফোন ধরল। তার স্বরেও উত্তেজনা। ডাবলু বলল, আমার মোবাইলে তো ছবি দেখা যায় না। তুই কি তোর বউদির মোবাইলে পাঠাতে পারবি? আমি বাড়ি গিয়ে দেখে নিতাম। তবে শুধু ছবি পাঠাবি। অন্য কিছু লেখার দরকার নেই। তার যা কুচুটে বুদ্ধি, কোথা থেকে আবার কী বাগড়া না দিয়ে বসে।

হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল আটটার নবদ্বীপ লোকাল ধরেছে ওরা। সমুদ্রগড় যেতে ঘন্টা আড়াই। কিন্তু দুই ভাই-বোন উত্তেজনায় ছটফট করছে। চম্পা বলল, এই দাদা, মায়ের বাড়িতে থাকি যাই কটাদিন, কী বলিস? আর মোটে পারা যাচ্চে না। আর ইচ্ছা করে না এই ঝি-গিরি করতে। তুই অন্য আর একজনকে জোগাড় করে দিদিমণিকে দিস আনে। নাইলে তার কষ্ট হবে।

ডাবলু বলল, সে তুই চিন্তা করিসনে। তুই মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি, থাক। তার জন্যি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া কততি হবেনে। তারে কইলকাতায় নে যাবানে। সবাই মিলে একসাথে থাকবানে। মায়ের কাছ থে কিছু ট্যাকা পেলি একখান ব্যাটারির রিকশাক কিনুম আনে, ভাবছি। তাতে একটু আয়-টায় বেশিই হবে।

চম্পা বলল, অ্যারা, কিন্তুক মা সমুদ্রগড়ে কুথায় থাহে তাই তো জানি নারে দাদা! ফেসবুকে সবাই তো কইছে সমুদ্রগড়ের মনের মানুষ মনসাসুন্দরী। তো সিকেনে সবাই ঝ্যাকোন চেনে, ত্যাকোন লিশ্চই কয়েক দেবেনে, তাই নারে দাদা?

হ্যাঁ, তাই তো মনে কয়।

একটু লেট করে ট্রেন সমুদ্রগড়ে এগারোটা নাগাদ এল। বেশি লোক নামে না। জনা পঞ্চাশেক হবে। ওরা ভাই-বোন দুজন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এমনি এমনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়টা কমে গেলে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোবে। একজন সাইকেলের রডে দু-কাঁদি ডাব ঝুলিয়ে বাঁশের স্ট্যান্ড লাগিয়ে বিক্রি করছিল। চম্পার খুব লোভ হল। এখন তো তারা বড়োলোক। মায়ের পয়সা মানে তার ছেলে-মেয়েদের পয়সা। সে দাদাকে বলল, দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর ডাব। কইলকাতায় এমুন তাজা ডাব পাওয়াই যায় না। খাবা?

ডাবলু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। ট্রেনের টিকিট কেটেছে। হাওড়ায় আসার বাসের টিকিট কেটেছে। তারপর আজ তো কাজ হল না। মানে রোজগার নেই। ঘরে ফিরে টাকা ধরাতে না পারলে তো বউ-এর মুখ ঝামটা শুনতে হবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ঘরে না দিলে তো বিপদ। সে তো তো করে।

চম্পা বোঝে। সে বলে, দাদা তুমি তো অনেক খরচ করিছ, আমি ডাবের দাম দেবানে। তাছাড়া দিদিভাই আজ সকালেই মাইনে দেছে।

ডাব খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে কী মনে করে চম্পা ডাবঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কতি পারেন মনসাসুন্দরী এখানে কই থাহেন!

ডাবওয়ালা পরের খদ্দেরের জন্য ডাব কাটতে কাটতে পেছন দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভাই-বোন চটপট সে দিকেই পা চালায়। মনে মনে চম্পা ভাবল, ডাবঅলাও বলে দিতে পারল মানে মায়ের খুবই জনপ্রিয়তা হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষে লেভেলক্রসিং-এ রেললাইনের উপরেই গোটা দুয়ে্ক টোটো দাঁড়িয়ে হাঁকছে। দুজন আসছে দেখে তারা উৎসাহী হয়েছে। ডাবলু আর চম্পার চোখও টোটোঅলাদের দিকে। ওদের যে-কোনও একটাতে উঠে বসে মনসাসুন্দরীর বাড়ির কাছে নামাতে বলবে।

প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষে এসে পড়েছে। চম্পা একটা স্বর শুনে পিছন ফিরল। গলাটা চেনা যেন! একজন মহিলা গাছতলায় বসে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পার পা আটকে গেছে। সে দাদার হাত খামছে ধরেছে। যেন ভূত দেখছে। চম্পার পা কোনও দিকে যাচ্ছে না। না সামনে না পেছনে। সামনের ভিখারিনি তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনের থেকে নামা আর তেমন কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। এদের কাছ থেকে যদি পাওয়া যায়। ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পা তার কাজের বাড়ির একটা বাতিল লেডিজ ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে দশটা টাকা খুঁজে হাতে নেয়। হাত মুঠো করে। টাকাটা দলা পাকায়। তারপর এক পা এগিয়ে সেই দলাকরা টাকা ছুড়ে দেয় ভিখারিনির থালার দিকে। থালার একটু আগেই পড়ে টাকা। চম্পা মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে দাদার হাত ধরে টান দেয়। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে ডাউন ট্রেনের জন্য। কলকাতায় ফিরবে।

ভিখারিনি টাকা কুড়িয়ে সেটা সোজা করতে করতে মনের খুশি ওর মাথার উকুনদের জানাতে চেয়ে খানিকটা জোরেই গেয়ে ফেলে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা…।

 

টাইম মেশিন

সম্প্রতি আমাদের দেশের বিজ্ঞানী ড. পলাশ সেনের নাম প্রতিদিনই খবরের কাগজে বেরোচ্ছে। জানা গেছে তাঁর একটি আবিষ্কার, যেটি এখনও গোপন আছে, সেটির ঘোষণা তিনি করতে চলেছেন খুব শীঘ্রই। তবে সেটি সারা বিশ্বের কাছে এক অভতপূর্ব আবিষ্কার হবে বলে সকলের ধারণা।

তাজা খবর কাগজের সম্পাদক, সৌমিত্রবাবু এ সুযোগ আর ছাড়তে চাইলেন না। তিনি ফোন করলেন বিজ্ঞানী ড. পলাশ সেন-কে এবং অনেক অনুরোধ করে বললেন, দেখুন আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। মাত্র আধঘণ্টা সময় আপনার থেকে চাই।

অনেক ভেবে-চিন্তে সেনবাবু বললেন, ঠিক আছে আজ সন্ধে সাতটায় আসুন। তবে ব্যাপারটা যেন খুব গোপন থাকে। না হলে মিডিয়ার লোকেরাও আমাকে ছেঁকে ধরবে।

কথামতো সৌমিত্র ভট্টাচার্য অফিসের সব কাজ সহ-সম্পাদক-কে বুঝিয়ে দিয়ে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলেন। এরকম একজন বিজ্ঞানীর সাথে দেখা হবে ভেবেই খুব খুশি হচ্ছিলেন। যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলেন বিজ্ঞানী ড. সেনের গবেষণাগারে। ড. সেনের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সৌমিত্রবাবুকে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা এবার বলুন আপনি আমার থেকে কী জানতে চান?

—আচ্ছা, একটা উড়ো খবর শুনছি, আপনি নাকি টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছেন এবং সেটির ঘোষণা আগামীকাল সাংবাদিক সম্মেলনে করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবেন! কথাটা কি ঠিক?

—ঠিকই শুনেছেন। আচ্ছা, আপনি কি টাইম মেশিনের কথায় বিশ্বাস করেন?

—স্যার, আজকাল অনেক শুনছি, তবে ব্যাপারটা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কীভাবে এটা সম্ভব! এ নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব রয়েছে মনের মধ্যে।

—চলুন পাশের ঘরটায় যাওয়া যাক। ওটাই আমার স্পেস শিপ।

একথা বলেই দুজনে গিয়ে পাশের ঘরটায় বসলেন। দেখলেন নানা রকমের লাল, নীল আলো জ্বলছে। কোনওটা থেকে বিপ বিপ আওয়াজ আসছে। বিজ্ঞানী বললেন, ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই। আপনি হলেন ভারতবর্ষের প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি এটা দেখাতে চলেছি। আগামীকাল সারা বিশ্ব এটা জানবে। কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। তাঁর চোখ মাথার ওপর সিলিংয়ে দিকে। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি।

সৌমিত্রবাবু ভাবছেন, অফিসে অনেক কাজ জমে আছে। এখানে বেশি দেরি হয়ে গেলে খুব মুশকিল হতে পারে অফিস পৌঁছোতে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বুদ্ধিকে একটু কাজে লাগালেন। হঠাৎ হাত থেকে পেনটা মেঝেতে ফেলে দিলেন। পেনটা মেঝেতে পড়ে যেতেই তত্ক্ষণাৎ একটা জোরে বিপ সাউন্ড হল। আর ড. সেন  সংবিৎ ফিরে পেলেন।

ড. সেন বললেন, আচ্ছা, আপনার সাথে এমন কখনও হয়েছে যে, আপনি অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন আর নিমেষেই অফিসে পৌঁছে গেলেন, অর্থাৎ গন্তব্যস্থানে! কীভাবে পৌঁছোলেন, কোন রাস্তা ধরে গেলেন তার কোনও কিছুই আর হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না।

আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সৌমিত্রবাবু বললেন, না, স্যার আমার তেমন কখনও হয়নি। এরকমও কি হয়! আপনি তাহলে বলুন, আমি শুনছি।

আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন, বললেন, গত সপ্তাহের সকালে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে আমি আমার ড্রইং রুম-এ সকাল ৮টায় টিভি খুলে একটা ভালো সাক্ষাত্কার দেখছিলাম। দেখতে দেখতে একটা কাজে এই ঘরটাতে এসে কাজটা শেষ করতে থাকি এবং এই ঘরের টিভিটা চালাই। হঠাৎ দেখি টিভিতে ওই চ্যানেলে তখন খবর পড়া চলছে। ভালো করে দেখে বুঝলাম তারিখটা ৩ জানুয়ারি সকাল ৮টা দেখাচ্ছে। ভাবলাম নিজের মাথাটা হয়তো ঠিক কাজ করছে না। কিন্তু বাইরে গিয়ে ওই টিভি-তে দেখলাম আগের সাক্ষাত্কারটাই চলছে। তখন একটু নড়েচড়ে বসলাম। বুঝলাম আমার গবেষণা সার্থক রূপ নিতে চলেছে। ৩ জানুয়ারি বাইরের ঘর থেকে ওই সময়ে ওই চ্যানেল খুলে দেখলাম আমার এই ঘর থেকে দেখা খবর পড়া অনুষ্ঠানটাই দেখানো হচ্ছে। সাধারণত এমন হওয়ার কথা নয়। তখন বুঝলাম আমার স্পেস শিপ-টা কাজ করছে।

এসব শুনতে শুনতে সৌমিত্রবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তা কী করে সম্ভব, যদি না…

ড. সেন বললেন, ঠিক ধরেছেন। যদি না আমি কোনও স্পেস শিপে গতিশীল থাকি। তাই না? আমার এই ঘরটা কোনও স্পেস শিপ নয়। তবে স্পেস শিপের মতোই। আমাদের ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরা পারে না কি বলতে পারেন? আমরা যে-সব রকেট পাঠাচ্ছি তা অনেক কম খরচে। চাঁদে যে-রকেট পাঠানো হয়েছিল তার জন্য যে অনেক কম খরচ হয়েছিল, তা তো আপনারা সবাই এখন জেনে গেছেন।

শুধু তাই নয়, ২৭ মে বাইরের ঘরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে পেনটা নিতে এই ঘরে ঢুকেছিলাম। পেনটা নিয়ে যখন বাইরের ঘরে ফিরে গেলাম, দেখলাম রামু আমার টেবিলে ২৮ ও ২৯ মে-র খবরের কাগজটা রেখে গেছে। এই ২৮ তারিখটা আমার জীবন থেকে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝলাম না। আমার ড্রাইভার, চাকরবাকর, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে আমার সহকর্মীদের কেউই ২৮ মে আমাকে দেখতে পায়নি।

সৌমিত্রবাবুর গলাটা তখন যেন কেমন শুকিয়ে কাঠ হওয়ার জোগাড়। ভাবতে লাগলেন, এ তো দেখা যাচ্ছে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের থিযোরি অফ রিলেটিভিটিকেও ডাইভার্ট করছে এই ঘটনা। এমন ঘটনা, যার কোনও ব্যাখ্যা নেই!

—আপনার তো ভুল হতে পারে। আপনি হয়তো আসলে ২৯ মে-তেই এ ঘরে এসেছিলেন। বেশ শুকনো গলায় সৌমিত্রবাবু কথাগুলো বললেন।

আবার উদাস হয়ে গেলেন ড. পলাশ সেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আপনি কটায় আমার বাড়িতে এসেছিলেন সৌমিত্রবাবু?

—ঠিক সাতটায়। সৌমিত্রবাবুর ঠিক মনে আছে কারণ কলিংবেলটা টেপার সময় মোবাইল-এ সময়টা দেখেছিলেন। হ্যাঁ, সাতটাই বেজেছিল তখন।

—এর মধ্যে কতক্ষণ হল আপনার সাথে আমি কথা বলছি? প্রায় আধঘণ্টা তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তাহলে তো এখন সাড়ে সাতটা বাজার কথা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কিন্তু ঘড়িটা দেখুন তো।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন সৌমিত্রবাবু। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! ঘড়িতে সাড়ে দশটা দেখাচ্ছে। সৌমিত্রবাবু ভাবলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এ ঘড়িটা হয় খারাপ, নয়তো ইলিউশন। তিনি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলেন, তাতেও সাড়ে দশটা দেখাচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব! ভাবতে থাকেন অবাক হয়ে।

—ভাবছেন আমি বিজ্ঞানের কোনও এক্সপেরিমেন্ট করছি? হেসে জিজ্ঞেস করলেন বিজ্ঞানী সেন। বলতে বলতে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন বিজ্ঞানী।

—আমি তাহলে এবার চলি। অনেক রাত হল, বলেই সৌমিত্রবাবু বেরিয়ে গেলেন। ফেরার জন্য গাড়িতে চড়ে আবার মোবাইলটা দেখলেন। তখনও দেখাচ্ছে রাত ১০টা ৪০ মিনিট। ভাবলেন কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ আর অফিসে ফিরবেন না, সোজা বাড়ি ফিরে যাবেন। অফিসে ফোন করে বলে দিলেন খবরটা সহ-সম্পাদককে দিয়ে দিতে।

সৌমিত্রবাবু গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলেন, একটু আগে ঘড়িতে এবং মোবাইল-এ যখন সাড়ে দশটা দেখলেন সেটা কোনও ভ্রম বা ম্যাজিক নয়তো? ড. সেনের ঘরটা কোনও ম্যাজিক ঘর নয়তো? বিজ্ঞানীর সমস্যার সমাধান হয়তো করা যাবে, একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। এরকম নানা উদ্ভট কল্পনা করতে করতে বাড়ি এসে পৌঁছোলেন। বাড়িতে ফোন করবেন ভাবলেন কিন্তু ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এরকম তো হয় না সাধারণত। আজ সকালেই পুরো চার্জ দেওয়া হয়েছিল। নতুন মোবাইল, তাই প্রায় দুদিন অনায়াসেই চলে যায়। কিন্তু এরকম হল কেন! আজ সবই যেন কেমন ওলটপালট লাগছে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে বাড়িতে এসে পৌঁছোলেন সৌমিত্রবাবু।

বাড়িতে ঢুকতেই তাঁর ছোটো মেয়ে রিঙ্কি ছুটে এলো। চেঁচিয়ে বলতে লাগল মা, দাদা, দেখে যাও বাবা এসেছে!

অমনি সবাই হুড়মুড় করে ড্রইংরুমে এসে ঢুকল।

—কী হয়েছে? তোমরা এত হইচই করছ কেন? বিরক্তির সুরে জানতে চাইলেন তিনি।

স্ত্রী সুমনাদেবী বলে উঠলেন, হইচই মানে!  শুনলাম কাল বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে। তারপর থেকে তোমার আর কোনও খোঁজ নেই। আর তুমি বলছ আমরা হইচই করছি। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সুমনা। আমাদেরকে মানুষ বলেই মনে হয় না তোমার না!

তার কান্না সৌমিত্রকে আচ্ছন্ন করল বটে কিন্তু তাঁর জীবন থেকে যে একটা দিন হারিয়ে গেল সেই অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারলেন না!

ফাগুন বাসর

ওরে হিমু, কোথায় গেলি রে? পুকুরপাড়ে একগাদা এঁটো বাসন পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি একটু মেজে নিয়ে আয় না, মা। সবাই সক্কাল সক্কাল বেরোবে। রান্না চাপাতে হবে যে।

হিমু তখন মুগ্ধ চোখে দেখছে মাঠের পুব-ধারে একটু একটু করে ঘোমটা খুলছে উষারানি। কপালে যেন গোল থালার মতো এক মায়াময় সিঁদুরের টিপ। অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ফিকে হলুদ আলো। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দিয়ে ধবলী আর করালীকে জাবনা দিতে যায় হিমু। জাবনা দিতে দিতে দেখে উষারানির টিপটা কেমন ঘেঁটে গিয়ে চারদিকে ফিকে লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে। কী অপূর্ব! মনটা যেন জুড়িয়ে যায়!…ওই মা ডাকছে… চমক ভাঙে হিমুর,

ধবলী আর করালীকে মাঠে বেঁধে দিয়ে এখুনি বাসনগুলো মেজে নিয়ে আসছি, মা।

ধবলী আর করালীকে মাঠের বেশ ঘন ও বড়ো বড়ো ঘাসওয়ালা জায়গায় বেঁধে দিয়ে পরম মমতায় করালীর কালো কুচকুচে শরীরটাতে হাত বোলায় হিমু। বাড়ির সবাই, পাড়া-পড়শীরা আসতে যেতে ধবলীর লালচে সাদা শরীরে আদুরে হাত বোলায় কিন্তু করালীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দেখে বড়ো কষ্ট হয় হিমুর। অথচ করালীটা যখন গামলা গামলা দুধ দেয়, তখন তো সবাই বেশ আয়েশ করে গেলাস গেলাস দুধ সাবাড় করে! চোখটা ছলছল করে ওঠে। কোথাও যেন করালী আর নিজেকে এক সারিতে দেখতে পায় হিমু।

অ্যাই হিমু, হিমু… শিগগির এদিকে আয় তো। আমার জামাপ্যান্টগুলো কেচে ইস্তিরি করে রাখিসনি কেন? এখন আমি কি পরে যাব? একখানাও ইস্তিরি করা নেই! হিমু…উ…উ…উ…

হিমুর তখন চোখের পলক পড়ছে না। নিস্তব্ধ দুপুরে দূরের বাঁশঝোপের আড়াল থেকে পাঁজর ফাটিয়ে ডাকছে কোকিলটা! পুকুরের বুকে নুয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়, সবুজ ছায়া তিরতির কাঁপছে টলটলে জলে। লাল-হলুদ-সবুজ ফড়িং আর রংবেরঙের প্রজাপতির দল উড়ে উড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। উতল দুপুর ঘাই মারছে হিমুর বুকে! কী যে অসহ্য রূপ এই দুপুরের… ইশ!

অ্যাই হিমু, কানে কানে জল ঢোকেনি বুঝি, না রে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। বিধুদা এল বলে। কনে-দেখা আজ, আলো থাকতে থাকতে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। হিমু, এই হিমু।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় হিমুর। দাদা ডাকছে।

যাই গো দাদা।

আজ পাড়ার বিধু ঘটকের সঙ্গে পাশের গাঁয়ে মেয়ে দেখতে যাবে হিমুর দাদা। হুগলির রিষড়ায় সে এক গেঞ্জি কারখানায় প্যাকেজিং ডেসপ্যাচিংয়ের কাজ করে। হিমুর বিয়ে না দিয়ে তার দাদা বিয়ে করতে চাইছিল না। কিন্তু বিয়ের বাজারে হিমুর মতো নিকষ কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করে না। বিধু ঘটক হিমুর জন্য পাত্রের সন্ধান এনে এনে একেবারে হাঁপিয়ে গেছে। তাই দাদা আর কদ্দিন অপেক্ষা করবে? তারও তো বিয়ের বয়স গড়িয়ে যেতে বসেছে। পুরুষ মানুষ কদ্দিন আর মেসে থেকে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাবে! তারও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে, নাকি! অগত্যা পাশের গাঁয়ে প্রদীপ স্যাকরার মেয়ে অপালার সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে বিধুদা। একমাত্র মেয়ে, দেবে থুবেও ভালো।

অ্যাই হিমু, পুকুরধারে কী করছিস রে? তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?

এক বুক পাথর ভার নিয়ে দাদার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হিমু।

হিমু, হিমু…উ…উ… অ হিমু, হিমু রে, আমার লাইগ্যা একটু আকন্দফুলের পাতা আইন্যা দে না রে, মা। পূন্নিমা আইতাছে। বাতের ব্যাতাটা আবার বড়ো বাড়ছে রে! উঃ! সব্বার মরণ হয়, আমার ক্যান হয় না? আরে অ হিমু…

হিমু তখন পুকুর ঘাটে। হাঁ করে গিলছে পলাশ গাছটার বুক জ্বালানো রূপ! বসন্ত বাণে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে হিমুর যুবতি-শরীর, মন। আমবাগানে ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ফিকে কমলারঙা গোল থালার মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মাঠের পশ্চিম দিকে। দিনের তেজ কমে আসছে, গোলাপি আভা ধরেছে আকাশে। কোথা থেকে এক ঝলক ফিসফিসে বাতাস এসে চোখে মুখে ঠান্ডা স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে হিমুর,.আহা! ওই ঠাম্মা বুঝি ডাকছে…

আসছি…ই…ই…ই…

ঠাম্মা বহুদিন থেকেই বাতের রোগী। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হরেন বৈদ্যের কালচে সবুজ এক কবিরাজি তেল ঠাম্মার কোমরে, পায়ে মালিশ করে দেয় হিমু। তেলের গন্ধটা ভারি বিশ্রী! বমি চলে আসে। কিন্তু কি আর করা, মায়ের সারাদিন সংসারের নানা কাজ থাকে। উদয়াস্ত পরিশ্রম তাঁর। দিদিরা তো সবাই যে-যার শ্বশুরবাড়িতে। তাই হিমু ছাড়া আর কে-ই বা আছে হাতনুরকুৎ? এছাড়া অমাবস্যা, পূর্ণিমায় ব্যথাটা খুব বেড়ে যায় ঠাম্মার। তখন জ্বলন্ত হ্যারিকেনের মাথার ওপর আকন্দপাতা গরম করে সেঁক দিয়ে দেয় হিমু। পুকুরের পুব-ধারে আকন্দগাছের ঝাড়, সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে সে।

তার বাড়ির সকলেরই একখানাই তো ভাঙাকুলো হিমু। অঘ্রাণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাম্মা বড়ো শখ করে নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী। হেমন্তে জন্ম হলেও হেমন্ত প্রকৃতি তার সোনারঙা ফসলের ভরপুর সৌন্দর্য দিয়ে সাজায়নি হৈমন্তীকে। হৈমন্তী সেই কবেই হিমু হয়ে গেছে সকলের মুখে মুখে। ঠাম্মার কাছে শুনেছে জন্মের পর তার কালো কুৎসিত ছোট্ট শরীরটা দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাবা। আর কোনওদিনই বাবা নাকি কোলে তোলেননি তাকে। এ সবই মুখরোচক গল্পচ্ছলে বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকে শোনা হিমুর। নীরবে হৈমন্তিক শিশির ঝরেছে টুপটাপ। বড়ো হেলাফেলায় সবার ফাইফরমাশ খেটে, সবার মন জুগিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে হিমু। শুধু নিজের মনটাই আলো-হাওয়া না পেয়ে পেয়ে কবে যেন পাথর চাপা পড়ে গেছে!

তবু জীবন তো থেমে থাকেনি। হিমুর দাঁত উঁচু, নাক বোঁচা, শনের মতো চুলওয়ালা, থ্যাবড়ামুখো কালো কুৎসিত শরীরেও একদিন দাপিয়ে যৌবন এসেছে নিঃশব্দে। কালো মেয়ে বলে মা-ঠাকুমার বিলাপ, পাড়া-পড়শির করুণার মধ্যেই বড়ো হয়েছে সে। তার মুখ কেউই দেখতে চায় না। পাড়ার কেউ কোনও শুভ কাজে রওনা হলে হিমু তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। তার অপয়া মুখ দেখলে নাকি হওয়া কাজও পণ্ড হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনায়ও তেমন এগোতে পারেনি হিমু। বছর বছর গণিতে, বিজ্ঞানে ফেল করে করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোনোর আগেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়াশোনায় ইতি ঘটে যায় তার। মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়েও তার মতো কালো কুৎসিত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। বেশ কয়েকবার পাত্রপক্ষ এসে মিষ্টি ধ্বংস করার পর বলতে বলতে গেছেন, আমরা তো কয়লার বস্তা ঘরে নিয়ে যেতে আসিনি! যত্তসব!!

নিজের কানে এইসব কথা শুনে টুপটাপ ঝরে পড়ে হৈমন্তিক শিশির। ভেসে যায় বুক। স্তব্ধ হয়ে যায় হিমুর ভিতর ঘর।

হিমুর দুই দিদি জয়তী আর রেবতী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মোটামুটি দিয়েথুয়ে বিয়ে হয়ে গেল তাদের। লাজুক মুখে এক মাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল তারা। যাবার সময় দুজনেই হিমুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে কেটে বলল,

তোর জন্য দেখছি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা। চিন্তা করিস না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসারের বেড়াজালে হিমুর কথা তাদের আর মনেই রইল না।

এই অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে হিমু। এখনও অনুঢ়া সে। শরীরে তার ভরা যৌবন! মনে সুনামির জলোচ্ছ্বাস! ফুলেভরা শিমূলের ডালে, হলুদ অমলতাসের ঝাড়ে, ফুলের ভারে নুয়েপড়া কাঞ্চনগাছে প্রকৃতি যেন উড়িয়ে দিয়েছে রংবেরঙের ফাগ। দেখে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে হিমুর। কান্নায় গলা বুজে আসে! আকাশ কী সুন্দর নীল! প্রকৃতির কত অপরূপ রং-রূপ-রস। সেও তো এই প্রকৃতিরই অংশ, তবে কেন সে এত কুৎসিত? এ পৃথিবীতে কোথাও কি তার জন্য এতটুকু ভালোবাসা থাকতে নেই?

কাল দোলপূর্ণিমা। হিমুর ছোড়দি রেবতী এসেছে বর আর বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হই হই ব্যাপার। হিমুর খরা বুকেও যেন বাজছে টুংটাং বাসন্তী সুর। ছোড়দির ছেলেটা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে, আধো বুলি ফুটেছে মুখে। মনটা বড়ো ভিজে ওঠে হিমুর। তবে দিদিরা আসায় তার খাটুনি অনেকখানিই বেড়েছে। রান্নার সব দাযিত্বই যে-তার। মা অবশ্য সাহায্য করছেন। এই একটি বিষয়ে হিমুর খুব নাম। তার রান্না স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। সব্বাই চেটেপুটে খায়। রান্না করতে করতে আনমনা হয়ে পড়ে সে!

রজতদা ছোড়দিকে কী ভালোবাসে! চোখে হারায় একদম! সকালে দেখছিল জলখাবার খাওয়ার সময় রজতদা ছোড়দির মুখে লুচি তুলে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। ভালোবাসার রঙে রাঙা হয়ে উঠছিল ছোড়দির মুখটা! বুকটা ভারী হয়ে ওঠে হিমুর। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! তাকে এভাবে আদর-আহ্লাদ করার কেউ নেই এই পৃথিবীতে!

সন্ধে নামতেই গোল থালার মতো ভরা-যৌবনা চাঁদটা রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে নিল মাঠ-ঘাট, পুকুর, সজনেগাছের সারি, আমবাগান, শিমূলবন। এমন গভীর চাঁদরাত গায়ে মেখে, আমের মুকুলের গন্ধ বুকে ভরে নিয়ে আমবাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে হিমু। রাতের আবডালে তার কুৎসিত মুখখানাও কিছুটা ঢাকা পড়ে যায়। বুক ভরিয়ে দিয়ে কী যেন এক নাম না-জানা গন্ধ ছুঁয়ে দিচ্ছে হিমুর গভীরে কোথাও। সে গন্ধ যেন এক তীব্র কষ্ট হয়ে হৃদপিণ্ডটাকে খামচে ধরছে। যে-গন্ধের কোনও কারণ জানে না হিমু। হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। পাশের ঘরে শুয়েছে রজতদা আর ছোড়দি। একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আকর্ষণে জালনার ফুটোতে চোখ রাখে হিমু। দেখতে পায় আধো অন্ধকার ঘরে দুই ছায়ামূর্তি রজতদা আর ছোড়দি! রজতদা যেন একেবারে মিশে যেতে চাইছে ছোড়দির নগ্ন শরীরে!

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে হিমুর। কেমন একটা নেশা নেশা লাগে। সেই অনামি গন্ধটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে! মাঝরাতে জ্যোৎস্নার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে গোটা গ্রাম। শুধু ঘুম আসে না হিমুর। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে টলটলে জল-আয়নায় ভাসছে রুপোলি চাঁদ। সজনে গাছগুলোর তলা সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে! চারদিক একেবারে শুনশান! দূর থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হিমু। সহসা কিছু বোঝার আগেই একটা বলিষ্ঠ লোমশ হাত পেছন থেকে জাপটে ধরে হিমুকে শুইয়ে দেয় সজনেফুলের সাদা বিছানায়। ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে থাকে তার পোশাক। ঘোরলাগা চোখে লোকটাকে চিনতে পারে না সে। লোকটার মুখে হাড়িয়ার গন্ধ। পরম আশ্লেষে লোকটাকে জাপটে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে হিমু ফিসফিসিয়ে বলে,

আমি কুৎসিত নই, ততটা কুৎসিত নই। একবার ভালোবেসে এসো ভেতরে আমার, হাড়-মাস-চামড়া ছাড়িয়ে একেবারে ভেতরে, অনেক ভেতরে…

লোকটার মুখের হাড়িয়ার গন্ধ ভেদ করে সেই বিশেষ গন্ধটা যেন খুব ধীরে ধীরে হিমুর আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকে, যে-গন্ধের কাছাকাছি এলে ভালোবেসে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় তার। বহুদিনের জমাটবাঁধা একটা বরফখণ্ড যেন গলে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে হিমুর যুবতি শরীর থেকে।

 

সহমরণ

আট বছরের মেয়ে সানাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ‘নিরালা’-য় অবসর যাপন করতে চলে আসে সন্তু আর নীতা।

বাঁশবন, পেয়ারা বাগান, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, কদম, বট, অশ্বত্থ, বাবলা,শিরীষ,বকুল,কামিনি,শিউলি, সুপুরি,সবজি খেত আর পুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে আছে গোবিন্দপুরের এই ‘নিরালা’ আবাসন। বহুতল আবাসনের এই ছাদ থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় দারুণ ভাবে। রাতের আকাশের চাঁদের আলো যেমন ভালোবাসার আবেশে জড়ায়, ঠিক তেমনই কৃষ্ণপক্ষের সূচিভেদ্য অন্ধকার শিহরণ জাগায় শরীরে। লকডাউন-এর অবসরে, কলকাতার কোলাহল ছেড়ে এমনই প্রকৃতিকে সঙ্গী করে, ‘নিরালা’-য় এসে আশ্রয় নিয়েছিল সন্তু আর নীতা। কিন্তু তখন কে জানত যে, অমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝেই ঘটে যাবে ভয়ংকর বিপদ !

গোধুলির ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আবাসনের গেট-এর কাছে,মুখে মাস্ক পরে ঘাসজমিতে বসে গল্প করছে নীতা আর সন্তু। একই ভাবে মুখে মাস্ক পরে ওদের মেয়ে সানা দুলছিল পা‌শে ঝোলানো একটি দোলনায়।

হঠাৎ হইহুল্লোড় কানে আসতেই গেট-এর দিকে এগিয়ে গেল সন্তু, নীতা এবং সানা। ওরা দেখতে পেল, ছোটোবড়ো একদল স্থানীয় ছেলে একটা বড়ো সাপ মেরে, লাঠিতে ঝুলিয়ে এনে, গেট-এর কাছে কদম গাছটার নীচে ফেলে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে সাপটাকে ওখান থেকে সরাতে বললেও, ছেলেগুলোর কানে পৌঁছোলো না দারোয়ানের কথা। পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে, তাই সাপটাকে ওখান থেকে সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করল সন্তু। অগত্যা, কথা রাখার প্রতিশ্রুতি দিল দারোয়ান।

এরই মধ্যে সন্ধে নেমেছে। বৈদ্যুতিক আলোগুলি জ্বলে উঠছে আবাসন চত্বরে। নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিল সন্তু আর নীতা। তাই, মেয়ে সানা যে কখন নজরের বাইরে চলে গেছে, তা আর ওদের খেয়াল ছিল না।

হঠাৎ নজর কাড়ল দারোয়ান। ওর কোলে তখন অঝোরে কেঁদে চলেছে সানা।

‘কী হয়েছে ? সানা কাঁদছে কেন ? পড়ে গেছে ? ‘ —–উদ্বেগ ভরা গলায় সন্তু এবং নীতা প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করে চলেছে দারোয়ানকে।

‘বড়ো বিপদ ঘটে গেছে স্যার। আমি বাথরুম-এ গিয়েছিলাম,এরই মধ্যে ছোটো গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল আপনাদের মেয়ে।’

‘তা বিপদটা কী ঘটেছে ?’ —–দ্বিগুণ উদ্বেগে প্রশ্ন করল সন্তু।

‘শুকনো কাঠি দিয়ে ওই পড়ে থাকা সাপটার মুখে খোঁচাতে গিয়ে, কামড় খেয়েছে। সাপটা বেঁচে ছিল। একেবারে মরণ কামড় দিয়েছে। ব্যাঙ ধরার মতো করে ধরে ছিল ওর হাতের চেটোটা। বিষাক্ত সাপ। পুরো বিষ ঢেলে দিয়েছে সম্ভবত। আমি ওর হাত বেঁধে দিয়েছি,বিষ আর ওপরে যাতে না ওঠে। শিগগির গাড়ি বের করুন স্যার। হাসপাতালে নিয়ে চলুন। আমি সাপটাকে কৌটোতে ভরে নিচ্ছি। ‘—–এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, সানাকে ওর মায়ের কোলে দিল দারোয়ান।

সানার হাত থেকে রক্ত ঝরছে। নীতা মেয়েকে কোলে নিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

লকডাউন-এর হ্যাপা কাটিয়ে সন্তু আর নীতা যখন সানাকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছোলো, ততক্ষণে কেটে গেছে অনেকটা সময়। চিকিৎসা শুরু হল ঠিকই, কিন্তু সানার শরীরকে বিষমুক্ত করার সুযোগ পেলেন না চিকিৎসক। মাল্টি অরগান ফেলিওর হতে শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, কৌটোয় রাখা ওই মরা সাপটার মতই নিথর হয়ে আছে সানার শরীরটা।

তিনে নেত্র

আগের মতো বাবু হয়ে বসলে মা, রানুমাসি দুজনেই আজকাল খুব বকে। অগত্যা বদলে গেল আমার বসার ঢং। কিন্তু সেবারই প্রথম দোলে, চুলের সিঁথির ফাঁকে ইচ্ছে করেই রেখে দিলাম একটু আবির রং। কেন জানি না!

আগে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হতো গরমের ছুটির আগে। সারা দুপুর আমাদের খুব লুডো খেলা হতো। আমার দাদার বন্ধু মৈনাকদা আসত আমাদের বাড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। এলোমেলো দাড়ি। সাজ-পোশাক পরিপাটি নয়, তবু চোখে একটা গভীরতা ছিল। আর কথায় ছিল জাদু। আমি তখন এর বেশি কিছু বুঝি না।

সেবছর ফাল্গুনে, টুটুমাসির বিয়েতে বর দেখে যেরকম ভালো লেগেছিল, সেরকম ভালো লাগে। আর ভালো লাগে আমার পাকা ঘুঁটি, দান পড়লেও মৈনাকদা কাটে না। আমার দাদা রেগে যায়, মৈনাকদা থামিয়ে দেয়। ঝগড়াও হতো মাঝেমধ্যে। সেটা ভুলে গেছি। সুযোগ পেয়ে জোড়া পাকা ঘুঁটি না খাওয়াটা আজও ভুলিনি।

চুল ঝাঁকিয়ে বেশ তবলা বাজাত মৈনাকদা। আমার সাথে সন্ধেবেলা অনেকদিন বাজিয়েছে। সেদিন আমার গান ভালো হতো না। শুদ্ধ স্বরগুলো নড়ে গিয়ে কড়ি-কোমলে লাগত। দাদা আমার থেকে দুবছরের বড়ো, তবুও আমি বড়ো হয়ে গেলাম আগে। কারণ মেয়েবেলায় ছেলেবেলাটা খুব ছোটো।

মাধ্যমিকের আগে দাদাকে বললাম, লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলো একটু বুঝিয়ে দিবি?

দাদার সামনে উচ্চমাধ্যমিক। দাদা বলল, কমার্স পড়তে পড়তে ওসব ভুলে গুলে খেয়ে দিয়েছি। মৈনাককে বলে দেব, ও দেখিয়ে দেবে।

পরদিন দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে শুরু হল আমার লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা। পরের বছর সরস্বতী পুজোয় নৃত্যনাট্যে স্টেজের পিছনে অন্ধকারে খুব অল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলাম আমরা। তবলা নিয়ে মৈনাকদা আর তার ঠিক পাশেই আমি লাফিয়ে গিয়ে বসেছিলাম। ভালো লাগত বসতে। পাঞ্জাবি পরেছিল ও। গায়ে গন্ধটা চোখ বুঝলে আজও পাই। একটা জিতে যাওয়া মানুষের গায়ের গন্ধ। ওটাই শেষ পাশে বসা। মায়ের সজাগ চোখ তারপর আর কোনওদিন, আমাদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি। বারান্দা থেকে ওর কলেজ যাওয়া দেখাটা, আমার আরও বেড়ে গেল। তবে স্বপ্নে অনেক কিছু দেখেছি, সেটা আমার একান্ত নিজস্ব। কাউকে বলা যাবে না।

আমার বাবা- মা দুজনেই চাকরি করে। রানুমাসি আমাদের সবসময়ে কাজের লোক, দেখাশোনা করে। মায়ের নির্দেশে, বেশি বেশি নজরে রাখে আমাকে। কারণ মৈনাক ভালো ছেলে হলেও, অর্থাভাবে ওদের টানাটানির সংসার। ওই বয়সে আমার কাছে সেটা অর্থহীন।

বিজয় দশমীর দিন ও প্রতিবছর আসত আমাদের বাড়ি। বাবা মাকে প্রণাম করত। দাদার সাথে কোলাকুলি করত। আর আমার সাথে চোখে চোখে যেটা হতো, শুধু সেটা নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। মা থালা সাজিয়ে মিষ্টি দিত। আমার, মামারবাড়িতে জামাই-ষষ্ঠীর কথা মনে হতো। মা বলত, দ্যাখ, মৈনাক কত ভালো ছেলে, যেমন পড়াশোনায়, তেমনি কি সুন্দর তবলা বাজায়।

আমার এই কথাগুলো ভালো লাগত না। এগুলো লোক ঠকানো। মৈনাকও বুঝত ভালো বিশেষণ পাওয়া সহজ। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার অনেক মাপকাঠি আছে। তবুও অবুঝের মতো হতাশ চোখে দেখত। আজকের মতো তখন এত মেলামেশার সুযোগ ছিল না। তখন ভালোবাসা বেশি ছিল, সাহস কম ছিল। এখন ঠিক উলটো। সাহসটা বেশি কিন্তু ভালোবাসাটা কম। আসলে বাধা-বিপত্তি না থাকলে কোনও কাজেই আনন্দ নেই।

ফল্গুর মতো একটা প্রেম বয়ে চলতে লাগল। পাড়ায় একটা চর্চা ছিল। কিন্তু কারও হাতেই কোনও প্রমাণ ছিল না। আসলে মৈনাক খুব ভীতু প্রেমিক। মৃদুমন্দ বসন্তবাতাসের মতো সারাদিন মন ভালো করে দেবে, অথচ প্রয়োজনে কালবৈশাখী হয়ে উঠতে পারবে না। না হলে এমএসসি পাশ করা একটা ছেলে তখনও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারছে না। নব্বইয়ের দশকে একটা মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগ নিতে পারে না।

আমার তখন গ্র‌্যাজুয়েশন হয়ে গেছে। আজকের যুগে হলে এটা জলের মতো সহজ। তবে সেটা হলে এ লেখাটাও হতো না, আর ভালোবাসার হয়তো মরণ হতো দু-ছক্কা দুই-এর সংসারের চাপে।

অনেক সাহস করে মৈনাক একদিন দেখা করেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। প্রেম বলতে ওই একদিন আমরা করেছিলাম। গল্পের শেষে আমি যখন বলেছিলাম, বাবা-মা কিন্তু কোনওদিনই তোমার সাথে বিয়ে দেবে না।

ও কোনও উত্তর করল না। শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে রইল। ও যদি সেদিন আমায় এই বিশ্বসংসারের সব ছেড়ে ঝাঁপ দেবার ডাক দিত, আমি সেদিন ওর বুকে মাথা রাখতাম। ঠিক-ভুল, সময় বিচার করত। সাগর ডাক না দিলে, শুধু নদীর পক্ষে এগিয়ে গিয়ে মেলা কঠিন। মনে মনে সেদিন-ই বুঝে গেলাম, এ প্রেম আমায় সারা জীবন বিরহ যন্ত্রণা দেবে। ওঠার আগে আমার হাত চেপে ধরল মৈনাক।

একটা কান্না আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল। আসলে প্রেম তো শুধু ভালোবাসা চায় না, সে রাগারাগি চায়, ঝগড়া চায়, দোকানের ফর্দ চায়, বাজারের ভুল চায়, মুখ-ঝামটা দিয়ে ভাত বাড়তে চায়, মায়ের মতো রাগ করে আলাদা শুতে চায়, মাঝরাতে আবার মশারির ভেতরে এসে সোহাগ পেতে চায়। এসবে প্রেমের মৃত্যু হয়, না সাফল্য আমি জানি না। এখন নিজে মা হয়ে বুঝি, প্রেমের সংসার আর সংসারের প্রেমে কত তফাত।

তারপর যা হবার তাই হল। আমার কিশোরীবেলার অবুঝ প্রেম সাপলুডোর সিঁড়ি পেল না, সাপের মুখে পড়ল। বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কত কলকাকলি, তার মধ্যে বিবাহ-সংগীত, গায়ে লাল বেনারসী, রজনীগন্ধা, আগের সব গন্ধ ঢেকে দিল। কত উপহারের নীচে চাপা পড়ে গেল মৈনাকের দেওয়া গীতবিতান। অচেনা এক পুরুষকে বন্ধু করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মৈনাকের জলছবির ওপর ধুলো জমতে থাকল।

বুঝতেই পারলাম না, কখন আমার ভেতরের দুদিকে দোল খাওয়া দু-বিনুনির ছটফটে মেয়েটা, মরে গিয়ে খোঁপায় পরিপাটি এক শান্ত বউ-এর জন্ম হল। এতদিনের গান-বাজনা, পড়াশোনা, সব টানটান বিছানা, রং মেলানো পর্দা, আর দুপুরের রঙিন কাপড় দিয়ে সেলাই করা বালাপোষের নীচে চাপা পড়ে গেল। কোলে এল মেহুল। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। সন্তান।

নব্বইয়ে দশকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে সন্তানের জন্য জীবন দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। স্কুল, কোচিং ক্লাস, নোট নেওয়া এসবই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। নিজের সব না-পারা ছেলেমেয়ের মধ্যে উসুল করে নেওয়া। জীবনের আয়নায় নিজের থেকে প্রতিবিম্বকে সুন্দর করে তোলা। মেহুলের নীচে চাপা পড়ে গেল আমার সব ঝাপসা অতীত।

আমার স্বামী মানুষটা খারাপ নয়। চাকরি ভালোই করে। মদ বা সিগারেট যেটুকু খায়, তাতে তাকে নেশাগ্রস্ত বলা যায় না। কর্তব্যে ফাঁকি নেই, তবে অমনোযোগিতা আছে। সুখ চারপাশে অনেক ছড়িয়ে আছে, একঘেয়েমির বিরক্তিও আছে। তবে সুপ্রিয় আমাকে খুব বিশ্বাস করে। শিকড় সমেত গাছ তুলে এনে অন্য মাটিতে বসালে যে অসুবিধাগুলো হয়, সেটা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম।

ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করে দ্বিতীয় পদবির বয়সও কুড়ি বছর হয়ে গেল। মেহুল এখন কলেজে পড়ে। আজকাল মেয়েরা, মেয়ে হওয়ার কষ্ট কমই বোঝে। একটা করে সন্তান, চারহাতে ঢাকা প্রদীপের শিখার মতো। আপন খেয়ালে বেড়ে উঠতে পারে। মেয়ে বলে কোনও আলাদা ভয় সমাজ এদের মনে ঢেলে দেয়নি। ফলে আমাদের থেকে খোলস ভাঙার ক্ষমতা এদের বেশি।

মেহুল একদিন কলেজ থেকে ফিরে বলল, মা জানো, আজকে একটা দারুণ ঘটনা হয়েছে। আমাদের কেমিস্ট্রি স্যার, এমডি আজকে হঠাৎ ক্লাসে আমাকে মার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তোমার নাম বললাম, আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করল। মা তুমি চেনো?

মুহূর্তে মনের ফুটো দিয়ে সব স্মৃতি ফিনকি দিয়ে উঠল। নিজেকে সংবরণ করলাম। শান্ত ভাবে বললাম, ওনার পুরো নাম কি?

মেয়ে বলল, মৈনাক দত্ত, দারুণ পড়ায়।

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, তোমার মামার বন্ধু। বলেই অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে নিলাম। আমাদের প্রজন্মের, এ ভয়, না মরলে যাবে না। নিজের গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহকে মানুষ চিনতে যাচ্ছে, অথচ একজন পুরুষকে আমি চিনতাম, সে কথা স্বীকার করার সৎসাহস আজও অর্জন করতে পারলাম না।

মেহুল রোজ এসে মৈনাকের গল্প বলত। ও বিশ্বাসই করতে চাইত না যে, মৈনাক ওর মামার বন্ধু! আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, মামার থেকে এত ছোটো দেখতে লাগে কেন?

আমি ওকে কী করে বোঝাব আমার মৈনাকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। এখন শুধু একটাই আপশোশ করি, মেহুলকে একটু সুপ্রিয়র মতো দেখতে হল না কেন। যত বড়ো হচ্ছে একদম অবিকল আমি। শুধু হাঁটাটা আলাদা। দুদশক আগে আমাদের হাঁটায় শাড়ি পরে যে-সলজ্জ ভাবটা ছিল, সেটা এখন জিন্সে অনেক আধুনিক আর সাহসী।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সুপ্রিয় তখনও ফেরেনি, মেহুল ওর নিজের ঘরে, আমি বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ মেহুল এসে বলে, মা স্যার ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।

আমি ইশারায় বললাম, বল মা টয়লেটে, পরে কথা বলবে।

আমার খুব রাগ হল, ও এরকম বোকার মতো করছে কেন? আসল সময়ে সাহসের খোঁজ নেই। এখন এসব করার কোনও মানে আছে। এখনকার মেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান। কিছু যদি আন্দাজ করতে পারে কী বাজে হবে ব্যাপারটা!

স্যারের সাথে মেহুলের সম্পর্ক আরও কাছাকাছি আসতে লাগল। মেহুলকে কলেজের পর অনেক জায়গায় খাওয়াতে নিয়ে যায়। লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ দুজনে সময় কাটায়। কেমিস্ট্রির অনেক বই, নোটস দিয়েছে মেহুলকে। কিন্তু আমার যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। না পারছি, সুপ্রিয়কে সব খুলে বলতে… না বারণ করতে পারছি, মেহুলকে। তবে ফোনে আর কোনওদিন আমার সাথে কথা বলতে চায়নি। হয়তো বুঝে গেছে, আমি পছন্দ করছি না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেহুলের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে মেহুলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বারণ করে দিই। এতে মেহুল জানতে পারলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। এই নিয়ে অশান্তি আমার বাড়তেই থাকল।

সেদিন পঁচিশে বৈশাখ। আমি টিভিতে গান শুনছি। মেহুল সকালে উঠে বলল, মা, তোমার লালপাড় হলুদ শাড়িটা পরে আজকে কলেজ যাব। রবীন্দ্র-জয়ন্তী আছে।

আলমারি থেকে বার করে দিলাম। লাল ব্লাউজটা হালকা সেলাই করে দিলাম। শাড়ি পরে মেহুল এসে যখন সামনে দাঁড়াল, তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। এতদিনে মা হয়ে বুঝিনি, মেহুল হঠাৎ মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে মেয়েকে কলেজ পাঠালাম। সুপ্রিয় তখনও ওঠেনি। এক ঠ্যালা দিয়ে বললাম, তুমি এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো।

ও ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, কার?

আমি রেগে বললাম, তোমার।

এবার ও ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে বলবে তো?

ওকে বুঝিয়ে বললাম, এবার মেয়ের বিয়ের খোঁজখবর শুরু করতে হবে, কথা বললেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। সময় ঠিক কেটে যাবে। ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে দিয়ে দেব। তারপর পড়তে চাইলে, বিয়ের পর পড়বে।

ও ধামাচাপা দেওয়ার মতো বলল, ঠিক আছে।

সন্ধেবেলা মেহুল ফিরে এল। হই হই করতে করতে ঘরে ঢুকল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা স্যারকে পাঞ্জাবি পরে কী লাগছিল! মনেই হয় না স্যারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। কী দারুণ তবলা বাজাল! আমার নাচের ভিডিওটা দ্যাখো। এই বলে আমাকে অনুষ্ঠানের সব ছবিগুলো দেখাতে লাগল। হঠাৎ একটা ছবিতে মৈনাককে দেখলাম। একইরকম আছে। শুধু চোখে একটা পুরু কাঁচের মোটা ফ্রেমের চশমা।

মেহুলকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের স্যারের চোখে খুব পাওয়ার?

মেহুল বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠল, হ্যাঁ স্যারের তো গ্লুকোমা আছে, আর তো বছর দুয়েক হয়তো দেখতে পাবে, ডাক্তার বলে দিয়েছে। স্যার আমায় সব গল্প করে, স্যার তো কলেজে পড়ার সময়ে জানত। কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে একবারে অন্ধ হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো স্যার বিয়ে করেনি।

সেদিন গভীর রাত। সবাই শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। আমি মেহুলের ঘরে ঢুকে মৈনাকের নাম্বারটা নিলাম। ফোন করলাম মৈনাককে। গভীর রাতে সবার গলাই খাদে নেমে যায়। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় ভেসে এল,

হ্যালো…।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। আস্তে করে বললাম, মালবিকা।

কেমন আছো? একবার শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।

তোমার চোখের কথা শুনলাম।

ও কিছু না। আমি তো ওটা পঁচিশ বছর আগেই জানি। শুধু চিরকালের মতো আলো নিভে যাওয়ার আগে, একবার তোমাকে দেখতে চাই। ওটা আমার অন্ধকারের ভেতরটা আলো করে রাখবে।

আমি যাব, রাখলাম।

সারারাত আমার ঘুম এল না। দেখলাম, একটা গোটা রাত কত গভীর, কত অন্ধকার। বারবার মনে পড়ছিল, মৈনাকের লেখা কবিতার চারটে লাইন,

আমি আজ দুঃখ দিয়ে নেশা করব,

আমার কান্নায় আফিমের কারবার;

তবু…, তুমি জ্যোত্স্না মাখলে না, মহাকাশে

রটিয়ে দিয়েছি স্পর্শহীন প্রেমের ইস্তেহার।

পরদিন সকালে উঠে চা করে ওদের ডাকলাম। সুপ্রিয়র সুগার আছে, ও চিনি দিতে বললে, আমি রাগারাগি করি। আজ আমি ভুল করে ওর কাপেই দুচামচ চিনি দিয়ে দিলাম। শরীর ভারী লাগছে। কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করছে না।

মেহুলকে বললাম, তোর কলেজে একদিন যাব।

মেহুল জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মিষ্টি মা।

মালবিকা ভাবতে লাগল… চোখ কী শুধু দেখার, না কাঁদার!

অস্বাভাবিক

মাথার উপর বনবন করে ঘুরছে পাখাটা। চলছে টিভিটাও। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে চলেছে অনবরত। হঠাৎ ঘুমের ঘোর কাটলো সায়কের।

আধখোলা জানলা দিয়ে সকালের মিঠেকড়া রোদের এক ঝলক এসে পড়েছে সায়কের ঠিক চোখের উপর। তাই চোখ খুলতে সময় লাগলো তার।

রিমোটটা খুঁজে নিয়ে বন্ধ করলো টিভিটা। ততক্ষণে  মোবাইল ফোনটা বাজা বন্ধ হয়ে গেছে।

বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হাতে-পায়ে ঠেকল উলটানো গেলাস, চিপস-এর প্যাকেট, জলের বোতল ইত্যাদি। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, আটটা বেজে দশ মিনিট।

আবার বাজছে মোবাইল ফোনটা। সায়ক দেখলো, অরুণিমা-র কল।

—হ্যাঁ বলো…

—-আগে দু’বার কল করেছি, ধরোনি। ঘুমোচ্ছিলে নাকি ? কত বেলা হল। গতকাল সেই সন্ধে সাতটায় লাস্ট কথা হয়েছিল, মিটিং আছে বলে,সেই যে কথা বলা বন্ধ করলে…. ‘

এক নিঃশ্বাসে বলা অরুণিমার কথাগুলো শোনার পর সায়ক বললো, ‘না মানে রাতের দিকে আমার শরীরটা একটু খারাপ ছিল। ‘

—–বেশি গিলে ফেলেছিলে নাকি ? ক’পেগ ? মেয়েকে নিয়ে আমি বাবার বাড়িতে চলে এলে যা ইচ্ছে তাই করছো!

‘ না, ঠিক তা নয়। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না  কী করবো! ‘

——কী হয়েছে ?

‘তোমাকে তো বলেছিলাম, আমার আগের ছবিটা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ দেখে,এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা শর্ট ফিল্ম প্রযোজনা করবেন বলেছিলেন। কিন্তু তিনি হরর ফিল্ম পছন্দ করেন।’

‘তা এর মধ্যে অদ্ভুত ঘটনাটা এল কোত্থেকে ?’—- প্রশ্ন অরুণিমার।

‘না মানে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে যিনি সন্ধে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলেন,তিনি কি করে দিঘার কাছে সন্ধে সাতটায় পথ দুর্ঘটনায় পড়লেন!’

‘কী বলছো আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!’ …রাগত সুরে জানায় অরুণিমা।

‘আরে, সুরজিৎ বসু নামের ওই প্রযোজক ভদ্রলোকই তো গতকাল আমার সঙ্গে মিটিং করতে এসেছিলেন। জাতীয় সড়কের ধারে পেট্রোল পাম্প আছে তাঁর। গতকাল সন্ধে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলেন আমার সঙ্গে। এক কাপ চা-ও খেলেন। গল্প রেডি নেই জেনেও, ভরসা করে পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করে গেলেন! ‘

‘তারপর ?’——অরুণিমার আগ্রহ দ্বিগুণ হল এবার।

‘রাত আটটার সময় উনি চলে গেলেন। তারপর আমি একটু ‘রঙিন জল’ নিয়ে বসলাম গল্পটার প্লট ভাবব বলে। পান করতে-করতে টিভিতে খবর দেখছিলাম। হঠাৎ একটা খবর শুনে চমকে গেলাম! সন্ধে সাতটা নাগাদ দিঘার কাছে এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় নাকি প্রাণ হারিয়েছেন ব্যবসায়ী সুরজিৎ বসু। খবরে এও বলা হয়, পুলিস জানিয়েছে, মৃত ব্যক্তি এক পেট্রোল পাম্পের মালিক।’

সায়ক বলে চলে, ‘নেশার ঘোরে ছিলাম, তাই খবরটা শুনেই আমি পাগলের মতো ফোন করতে থাকি সুরজিৎ বাবুর মোবাইল ফোনে কিন্তু কোনও ভাবে কানেক্ট করতে পারিনি। আর তারপরেই আমি সম্ভবত সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম বিছানাতেই।’

‘এখনও তোমার নেশা কাটেনি, তাই ভুল বকছো। এমন আবার হয় নাকি! যাও বাথরুম-এ গিয়ে মাথায় জল ঢালো।’ —–অরুণিমা রেগে ফায়ার।

অরুণিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়ক বলে, আচ্ছা দাঁড়াও, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো, অ্যাডভান্স-এর চেকটা ড্রয়ার-এ রাখা আছে, ছবি তুলে পাঠাচ্ছি।’

চেকটা হাতে নিয়ে ছবি তুলে অরুণিমাকে পাঠাতে যাবে, ততক্ষণে ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে অরুণিমা।

সায়কের ফোনটা আবার বাজছে। স্ক্রিন-এ ভেসে উঠল প্রোডিউসার সুরজিৎ বসু-র নাম।

সায়ক চমকে উঠল! কাঁপা গলায় বললো, ‘হ্যালো…’

ওপ্রান্ত থেকে সুরজিৎ বাবুর গলা….’আমার মারা যাওয়ার খবরটা আপনিও শুনেছেন নিশ্চয়ই ? কিন্তু আমি মরি, বাঁচি যাই করি না কেন, ছবিটা বানাবেন অবশ্যই। বাকি টাকা ঠিক সময় মতো পেয়ে যাবেন আপনি।’—–বলেই একটু থামলেন, তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন ফোনের ওপ্রান্তে থাকা মানুষটা। আর সায়ক ঘেমে স্নান করার অবস্থা। হতবাক !

‘আরে ভাই কী হলো,বিশ্বাস না হয় খবরের চ্যানেল চালিয়ে দেখুন।’—-এই  পরামর্শ এলো ফোনের ওপ্রান্ত থেকে।

একপ্রকার ঘোরের মধ্যে টিভি খুলে খবরের চ্যানেল চালু করল সায়ক। খবরপাঠক বলে চলেছে……

‘গতকাল দিঘার কাছে গাড়ি দুর্ঘটনার পর দীর্ঘ সময় ধরে চলল মৃত্যু বিভ্রাট! একই নাম, একই পেশা। তফাৎ শুধু বয়স আর ঠিকানায়। যিনি মারা গেছেন, তিনি মাঝবয়সি, আর যাঁকে নিয়ে মৃত্যুর বিভ্রান্তি ছড়াল, সেই সুরজিৎ বসু বয়সে প্রবীণ। রসিকতার সুরে তিনি জানিয়েছেন, পুনর্জন্ম হয়েছে তাঁর, বেড়ে গেছে আয়ু।’

খবর শোনার পর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সায়কের। টিভিটা বন্ধ করল। ওর কানে তখনও মোবাইল ফোনটা ধরা রয়েছে।বললো, ‘হ্যালো ….’

ওপ্রান্ত থেকে হাসতে হাসতে ….. ‘ কী সায়কবাবু, কী শুনলেন ?’

‘কী কাণ্ড বলুন তো!’ ….সায়কের মুখে হাসির ঝলক।

‘পুরো ভৌতিক কাণ্ড !’ বললেন সুরজিৎ।

‘বাঃ ! ফ্যান্টাস্টিক। আমাদের শর্ট ফিল্ম-এর নাম রাখব—- ভৌতিক।’

——–আর, স্টোরি ?

——–স্টোরিলাইনও তো পেয়ে গেলাম এই সুবাদে।…. বলেই হাসতে থাকল সায়ক।

——–তাহলে আর অপেক্ষা কিসের ? প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। বেস্ট অফ লাক। হাঃ হাঃ…..

‘ধন্যবাদ।’ ……বলেই ফোনটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ‘ ইউরেকা ‘ বলে সায়ক ডুব দিল ভাবনার গভীরে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব